Saturday, July 1, 2017

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ : চেতনাপ্রবাহ রীতির প্রবর্তক



বা ংলা কথাসাহিত্যে একজন অন্যতম দিকপাল হচ্ছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্। মাত্র তিনটি উপন্যাস লিখে তিনি বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে অমরত্ব লাভ করেছেন। তার ছোটগল্প, নাটক প্রভৃতির ভেতরে তিনি অস্তিত্ববাদের বিষয়টি প্রকট করে দেখেছেন। ‘চেতনাপ্রবাহ রীতি’ ঝয়ড়পথশ সফ ঈসষঢ়ধমসৎঢ়ষপঢ়ঢ় তার হাতে প্রথম বাংলা সাহিত্যে পরিপূর্ণ সার্থকভাবে ফুটে ওঠে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র জীবনকাল ১৯২২ থেকে ১৯৭১। জীবনের বহু অভিজ্ঞতাকে তিনি সফলভাবে উপস্খাপন করেছেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ তার উপন্যাসে ইউরোপীয় অস্তিত্ববাদী দর্শন ও চেতনাপ্রবাহ রীতিকে বিশেষভাবে গ্রহণ করেছেন। মূলত অস্তিত্ববাদী দর্শনের বীজ রোপিত হয় জার্মান দার্শনিক সোরেন কিয়ের্কে গার্দ, হাইডেগার, নিট্শে প্রমুখের হাতে। যান্ত্রিক ও নিরপেক্ষ জীবন-জগতের মাঝে মানুষের মূল্য ও অবস্খান স্পষ্ট করে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। উনিশ শতকের সাহিত্যে অস্তিত্ববাদ বিভিন্নভাবে বিভিন্ন লেখকের হাতে সুবিন্যস্ত রূপ পায়। রুশ কথাসাহিত্যিক দস্তয়েভস্কি, চেক লেখক ফন্সানৎস কাফকার গল্প ও উপন্যাসে এ ধরনের বিষয়ের প্রয়োগ রয়েছে। অস্তিত্ববাদকে সাহিত্যের মাধ্যমে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য সচেষ্ট ছিলেন ফরাসি দার্শনিক-সাহিত্যিক জ্যাঁ পল সার্ত্র ও সিমন দ্য বোভোয়ার, আলবেয়ার কাম্যু, আঁদ্রে মারলো প্রমুখ কথাসাহিত্যিক। ‘চেতনাপ্রবাহ রীতির’ সাথে সিগমুন্ড ফন্সয়েডের ‘অবাধ অনুষঙ্গ’-এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কোনো ঘটনা ধারাবাহিকভাবে কার্যকারণ সূত্রে গ্রোথিত হয় না। কিছুটা অসংলগ্ন ও বিশৃঙ্খলভাবে ঘটনাগুলো বর্ণিত হয়। এই রীতি সার্থকভাবে ব্যবহার করেছেন ইংরেজ সাহিত্যিক জেমস জয়েস, ভার্জিনিয়া উল্ফ ফরাসি ঔপন্যাসিক মার্সেল প্রস্তু প্রমুখ। বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ই সর্বপ্রথম অস্তিত্ববাদ ও ‘চেতনাপ্রবাহ রীতিকে’ তার উপন্যাস, ছোটগল্প ও নাটকে সার্থকভাবে ব্যবহার করেছেন।
‘লালসালু’ (১৯৪৮) উপন্যাসে দুর্ভিক্ষ আক্রান্ত ভাগ্যান্বেষী মজিদ জীবিকার সংগ্রামে কিভাবে ভণ্ড ধর্ম ব্যবসায়ী হয়ে ওঠে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য, তা এখানে সুুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। অজ্ঞ গ্রামের মানুষের ভেতর কুসংস্কার, ভয়ভীতি, ধর্মীয় গোড়ামি ইত্যাদি ঢুকিয়ে সে লাভবান হতে থাকে। মজিদ এমনই এক গ্রামের মানুষ ‘যেখানে শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, ধর্মের চেয়ে আগাছা বেশি’। সেখানকার অধিকাংশ মানুষই ক্ষুধা-দারিদ্র্যের শিকার। কিন্তু মজিদ সুচতুর, ধুরìধর। সে নিজের অস্তিত্ব বিনাশ করতে চায় না। এজন্য সে নানা রকম কৌশল অবলম্বন করে। অস্তিত্বের জন্য মজিদ কোনো এক অজ্ঞাত কবরকে মোদাচ্ছের পীরের মাজার বলে ঘোষণা দেয়। ‘আপনারা বে-এলেম, আনপড়াহ মোদাচ্ছের পীরের মাজারকে আপনারা এমন করি ফেলি রাখছেন? উনি একদিন আমাকে স্বপ্নে ডাকি বললেন…’। এভাবে সে কৌশল কাজে লাগায়। পরে সে নারী লোভী হয়ে ওঠে। সুস্খ সবল স্ত্রী থাকতেও ছোট্ট এক মেয়ে জমিলাকে সে বিয়ে করে। পুরো গ্রামবাসীকে ধোঁকা দিয়ে সে তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা আকাáক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে থাকে। ‘লালসালু’ ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।



সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র পরবর্তী উপন্যাস ‘চাঁদের অমাবস্যা’ (১৯৬৪) চমৎকার একটি শিল্প সার্থক উপন্যাস। এখানে ‘চেতনাপ্রবাহ রীতি’ চমৎকার রূপ বিন্যাস পেয়েছে। আধুনিক মনস্তত্ববিদ ও দার্শনিকরা মনে করেন, মানুষের জীবনের তিন-চতুর্থাংশই অবচেতন। অর্থাৎ বেশির ভাগ সময়ই অবচেতন পর্যায়ে চলে। চেতনা স্রোতের কোনো হিসাব-নিকাশ নেই, কোনো সীমারেখা বা কূলকিনারাও নেই। চেতনা কোনো ছেঁড়া ছেঁড়া টুকরো ব্যাপারও নয়। নদীর পানির মতো তা এক অবিচ্ছিন্ন স্রোত।
‘চাঁদের অমাবস্যা’ উপন্যাসের সমগ্র অবয়বজুড়ে অস্তিত্ববাদী দর্শনের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এখানে কোনো সুসংবদ্ধ কাহিনী নেই, প্রতি মুহূর্তেই অনুভূতি ও আত্মোপলব্ধি একাকার হয়ে উঠেছে। মানব মনের জটিলতা বা আত্মদ্বন্দ্বকে প্রকাশ করার জন্য পরিবেশ উপযোগী শব্দ ব্যবহার করেছেন। বিশ্লেষণের রহস্যভরা আকর্ষণ প্রতীকের যথার্থ ব্যবহার তার উপন্যাসকে শিল্প সুষমামণ্ডিত করেছে। বিংশ শতাব্দীর মহাযুদ্ধ-উত্তর সমাজব্যবস্খায় যে নতুন শিল্পরীতির জন্ম হয়েছে, সেই চেতনাপ্রবাহ রীতিতেই ‘চাঁদের অমাবস্যা’র কাহিনী বিন্যস্ত হয়ে সার্থক হয়ে উঠেছে। আশ্রিত জীবনে অভ্যস্ত অস্তিত্বহীন স্কুলশিক্ষক আরেফ আলী কিভাবে অস্তিত্ববান হয়ে ওঠে, তার প্রতিফলন ঘটে ‘চাঁদের অমাবস্যায়’। এখানে মৌলিক সমস্যাকে লেখক বিশ্লেষণের সাহায্যে প্রকাশ করেছেন। আরেফ আলীর মানসিক ও অর্থনৈতিক যন্ত্রণা এখানে সুতীব্রভাবে প্রকাশ পেয়েছে এভাবে ‘আরেফ আলীর বয়স বাইশ-তেইশ, কিন্তু তার শীর্ণ মুখে, অনুজ্জ্বল চোয়ালে বয়োতীত ভার, যৌবনভার সে যেন বেশি দিন সহ্য করতে পারেনি। সে মুখে হয়তো যৌবন কন্টক জন্মেছিল, কখনো যৌবনসুলভ পুষ্পোদগম হয় নাই।’ এক রাতে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আরেফ আলী দেখে, জ্যোৎস্নালোকিত পরিবেশে বাঁশঝাড়ের ভেতর এক মৃত যুবতী পড়ে আছে। পাশে দণ্ডায়মান কাদের মিঞা, যে বাড়ি সে আশ্রিত, সে বাড়ির মালিক। এই সত্য কথাটি সে কাউকে বলবে কি বলবে না, সে দ্বিধাদ্বন্দ্বে তার অনেক সময় কেটে যায়। নদীতে মৃত যুবতীকে ফেলে দিয়ে সে আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়ে। অস্তিত্বহীনতার দোলায় দুলতে থাকে। কিন্তু না, অবশেষে সে ঘুরে দাঁড়ায়, সাহসী হয়ে ওঠে এবং সব সত্য কথা দাদা সাহেব ও আইন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রকাশ করে। আরেফ আলী হয়ে ওঠে অস্তিত্ববান। অস্তিত্ববাদের মতো চেতনা প্রবাহ রীতি তার এ উপন্যাসে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। ঘটনা বিন্যাস, চরিত্র চিত্রণ, অস্তিত্ববাদ ও চেতনাপ্রবাহ রীতি প্রয়োগে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র ‘চাঁদের অমাবস্যা’ একটি অন্যতম শিল্পসম্মত সফল উপন্যাস। ইউরোপীয় দর্শনের ছোঁয়া এ উপন্যাসে রয়েছে।
‘কাঁদো নদী কাঁদো’ (১৯৬৮) উপন্যাসের ঘটনার প্রারম্ভ আবর্তিত হয় স্টিমারের মধ্যে। কথক চরিত্রের মাধ্যমে তা পরিস্ফুটিত হয়। মুহম্মদ মুস্তফার সঙ্কটকবলিত অস্তিত্বই ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং যুদ্ধোত্তরকালে মানুষের অস্তিত্ব, ব্যক্তিসত্তা, স্বাধীনতা ও মর্যাদার অবহেলার প্রতিবাদস্বরূপ অস্তিত্ববাদের জন্ম। ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ উপন্যাসে তবারক ভূইঞার বক্তব্যের চেতনা প্রবাহের শব্দরূপ মুহম্মদ মুস্তফার মনস্তাপ ও আত্মবিলুপ্তির ইতিকথা। খোদেজার আত্মহত্যার জন্য কে দায়ী এমন মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব এখানে ফুটে উঠেছে। খোদেজার আত্মহত্যার কার্যকারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মুস্তফা ভয়বোধে আক্রান্ত হয়েছে এবং ক্রমশ এ বিশ্বাস জন্মেছে যে, ‘খোদেজা একটি প্রতিহিংসাপরায়ণ আত্মায় পরিণত হয়েছে, যে আত্মা সারা জীবন তাকে পদে পদে অনুসরণ করবে অদৃশ্যভাবে ছায়ার মধ্যে মিশে থেকে, হয়তো বা তাকে এক সময় ধ্বংসও করবে।
তেমনি ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ নিয়েও বিভিন্ন মন্তব্য প্রচলিত রয়েছে। তবে বিষয়টিকে গভীর দৃষ্টি দিয়ে লক্ষ করলে সার্বিক অবস্খানটি বোঝা যায়। এ উপন্যাস ফুটে উঠেছে কার্যকারণহীন উল্লেখধর্মী স্খান-কালবিচ্ছিন্ন ও স্বপ্ন ব্যাকরণময়। একটি উদ্ধৃতি এ রকম : ‘সুটকেসের দিকে তাকিয়ে রয়েছে এমন সময় সেটি অকস্মাৎ কাঁপতে শুরু করে, সুটকেসটি যেন একটি শুষ্ক রক্ত গাঢ় রঙের কলিজায় পরিণত হয়েছে। সে দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। হয়তো একবার দরজার নিকটে স্খাপিত লণ্ঠনের দিকে তাকায়। তবে কলিজাটি তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেখানে হাজির হয় এবং আকারে সহসা ছোট হয়ে লণ্ঠনের গায়ে পতঙ্গের মতো ডানা ঝাপটাতে শুরু করে। মুহম্মদ মস্তফা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে এই আশায় যে, পতঙ্গটি পুড়ে মারা যাবে, তার চঞ্চল ক্ষুধার্ত ডানা স্তব্ধ হবে। কিন্তু পতঙ্গ স্তব্ধ হয় না। এবার মেঝের দিকে তাকালে সেখানেও কলিজাটি দেখতে পায়। মেঝের উপর সেটি ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো ধড়পড় করছে যেন…।’ এ রকম যে বিচিত্র বর্ণনা তা অবশ্যই বিস্ময়কর এবং নতুনত্বের স্বাদ জাগায়।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ রচিত ছোট গল্পগুলোও অত্যন্ত চমৎকার ও রচনাশৈলীতেও উৎকৃষ্ট। ‘নয়ন তারা’ ও ‘দুই তীর’ তার গল্প গ্রন্থগুলোর মধ্যে চমকপ্রদ। তার রচিত ছোট গল্পগুলোতে ভিখিরি, চোর, সারেং মাঝি, দুর্ভিক্ষপীড়িত নিরন্ন মানুষ প্রভৃতি চরিত্র ফুটে উঠেছে, নস্টালজিয়া, স্মৃতিচারণ এবং গভীরতর ক্ষোভময় স্বপ্নের কথা তিনি বর্ণনা করেছেন এভাবে ‘ওধারে একটা দোকানে যে-ক-কাড়ি করা ঝুলছে, সেদিক পানে চেয়ে তবু চোখ জুড়ায়। ওগুলো কলা নয়তো যেন হলুদ রঙা স্বপ্ন ঝুলছে। ঝুলছে দেখে ভয় করে, নিচে কাদায় ছিঁড়ে পড়বে কি হঠাৎ।’ তার বিখ্যাত গল্পগুলোর ভেতর রয়েছে ‘মৃত্যুযাত্রা’, ‘খুনী’, ‘রক্ত’, ‘খণ্ড চাঁদের বক্রতা’, ‘একটি তুলসী গাছের কাহিনী’, ‘গ্রীষ্মের ছুটি’, ‘স্তন’, ‘হোমেরা’, ‘স্বাগত’, ‘স্বপ্নের অধ্যায়’, ‘মৃত্যু’ প্রভৃতি। গল্পগুলোর ভেতরে তিনি অস্বাভাবিক, অদ্ভুত প্রভৃতি বিষয়ের অবতারণা করেছেন। মনুষ্য জীবনের অতি বাস্তবতাকে তিনি দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তুলেছেন। তার নাটকগুলোর ভেতর ‘বহি:পীর’ (১৯৬০), ‘তরঙ্গ ভঙ্গ’ (১৯৬৪) উল্লেখযোগ্য।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ অত্যন্ত সার্থকভাবে বিষয়বস্তু সংগ্রহ, ঘটনা নির্বাচন ও জীবনাংশ আহরণের ক্ষেত্রে জাতিক, স্বাদেশিক কিন্তু জাগ্রতবোধ, প্রকাশ-প্রকরণের ক্ষেত্রে তিনি আন্তর্জাতিক বিশ্বমানসিকতাকে গ্রহণ ও উপযুক্তভাবে তার প্রকাশ করতে পেরেছেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ শিল্পী হিসেবে তার দক্ষতাকে প্রাণের শেকড়ে স্খাপিত করে শাখা-প্রশাখা, পত্রগুচ্ছ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পেরেছেন। তিনি সচেতনভাবে পরীক্ষাপ্রিয়, মেধাবী কথাসাহিত্যিক এবং অন্যতম লেখক। মানুষের অবচেতন মনের যে বিচিত্র ধারা, যা সহজে চোখে পড়ে না অথচ বাস্তবেরও অধিক বাস্তব, তা নিয়ে সুস্পষ্টভাবে নিপুণ শৈলীর মাধ্যমে তিনি সার্থকতা অর্জন করেছেন। বাংলা সাহিত্যে প্রথম তিনিই চৈতন্য প্রবাহ রীতিকে সুন্দরভাবে স্খাপন করেন, যা বাংলা সাহিত্যে অন্যতম শিল্পগুণ হিসেবে বিবেচিত।

0 comments:

Post a Comment