বারান্দা কথন
জাহাঙ্গীরনগরে যখন পড়ি, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের এক বড় ভাই ছিলেন, নাম বারীণ ঘোষ। উনারে সব জুনিয়রেরা বারীণদা বইলা ডাকত। আমিও তাই ডাকি। কিন্তু প্রথমবারে এই ডাক শুইনা আমার একটু কানে লাগছিল।
ময়মনসিংহের ভাষায় আমরা বারান্দারে কইতাম বারিন্দা। খাস মমেনসিংগা ভাষায় অবশ্য বারান্দার ভাল একটা প্রতিশব্দ আছে, আমার দাদি-নানিরা সেইটা ব্যবহার করতেন, উনারা বারান্দারে ডাকতেন ‘উসুরা’ বইলা। আমরা যারা একটু মডারেটেড ভাষায় কথা কই তারা আবার এই সকল শব্দ জানি না, জানলেও কই না। ঝাটারে হাছুন, পাংখারে বিছুন, চিরুনিরে কাঁখই কয় জানলেও আমরা কোনোদিন কই নাই।
আগের দিনে বারিন্দা মানে ছিল ঘরের সামনে টানা একটা জাগা, যেখানে ছাদ আছে, দেওয়াল নাই। তখন ব্যালকনির ধারণার সঙ্গে আমরা পরিচিত ছিলাম না।
দিনে দিনে ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি হইতে হইতে টানা বারিন্দা বিলুপ্তপ্রায় হইয়া গেল। এখনের বাড়িগুলার বারিন্দা আবার এলিজাবেদান নাটকের ঝুল বারান্দাও না। বাংলাদেশের বাসাবাড়িগুলার বারিন্দা ইদানিং গ্রিল দেওয়া খাঁচার মতন একটা জাগা যেখানে কাপড়চোপড় শুকাইতে দেওয়া যায়, ঘরের মধ্যে এসি লাগাইন্না থাকলে সেইখানে দাঁড়াইয়া বিড়ি সিগারেট টানা যায়। অধিকাংশ বারিন্দায় বসার উপায় থাকে না। অন্তত শহুরে মধ্যবিত্তদের বাড়িতে তো থাকেই না।
কিন্তু যেটুক জাগা সেই চিপা খাঁচার মধ্যে থাকে সেটুকুতেই গাছপালা লাগাইয়া, সুন্দর কইরা রাখনের অনেক চেষ্টা রুচিবান মধ্যবিত্তগর মধ্যে দেখা যায়। আমাদের পাশের বাসার এক পরিবার ছিল তারা বারান্দায় এতই টব রাখছিলেন যে বাইরে থাইকা গাছ ছাড়া আর কিছু দেখতেই পাওয়া যাইত না। আমি তখন বলতাম, বারিন্দাডারে ত এরা সুন্দরবন বানাইয়া ফেলছে!
আমাদের বাসার বারিন্দাতে টবে গাছ ছিল না, ছাদেও না। তবে বারিন্দার বাইরে গাছপালা আছে, সেইগুলাও আমাদের গাছই,আমাদের বাড়ির সীমানার মধ্যেই যেহেতু। যাদের বাড়ি নিজের না তারা হয়ত বাইরের গাছ থাকাকে উপভোগ করতে পারেন না। গাছের মালিকানা দরকার হয় বইলা উনারা বারিন্দার গ্রিল দিয়া গাছপালা দেখতে পাইলেও খুশি না, নিজেদের টবে গাছ লাগাইতে হয় উনাদের।
আরেকটা কারণ হইতে পারে অর্নামেন্টাল উদ্ভিদের প্রতি আগ্রহ। নারিকেল গাছের পাতা বা আমের ডালে ধরা মুকুল হয়ত তাদের কাছে যথেষ্ট সুন্দর মনে হয় না। টবের পাতাবাহার, কিংবা নাইন ও ক্লক তাদের বেশি ভাল লাগে।
আমি কোনোদিন বারান্দার টবে গাছ লাগানের পিছনের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে যাই নাই। প্রথম টবে গাছ লাগাইছিলাম পুদিনা, বাজারে পুদিনা পাতা সবসময় কিনতে পাওয়া যায় না দেইক্খা ঈদের সময় কেনা পুদিনাপাতা থাইকা শিকড়সহ গাছ খুইজ্জা বাইর কইরা সেইটা টবে লাগাইছিলাম। বুরহানি বানাইতে পুদিনা লাগে দেইখা। পরে যখন ভাড়া বাসায় থাকতে গেছি, দইয়ের হাড়িতে মাটি ভইরা নাইন ও ক্লক লাগাইছিলাম, প্রতিদিন সকালে বারিন্দায় গিয়া গাঢ় ম্যাজেন্টা রঙের ফুলগুলা দেখতে খুবই ভাল লাগত।
মেদিনী হাই টাওয়ার নামে এক দশতলা বাড়ির চাইর তলায় আমরা ছয়মাস থাকছি, সেই ফ্ল্যাটে দুইটা বারিন্দা ছিল যার একটাতেও চেয়ার পাইতা বসার উপায় নাই। সেইখানে টবে আমি অপরাজিতা ফুটাইছিলাম। সাদা অপরাজিতা। এখন যেখানে থাকি সেই বাসায় আইসাও অপরাজিতা ফুটাইতে পারছি, এবারেরটা নীল রঙের। আগে যে আমি মানুষের টবে গাছ লাগানি নিয়া বিদ্রুপ করছি সেই আমিই এখন লোকের বাড়ি থাইকা চুরি কইরা আনা বিভিন্ন অর্নামেন্টাল উদ্ভিদ লাগাইয়া বারিন্দা ভইরা ফেলছি। মানুষ অনেক বদলায়, কখন বদলায় সে নিজেই টের পায় না।
তন্ময় আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটিতে আর্কিটেকচার নিয়া পড়ালেখা করত। বাংলাদেশের মানুষের বারিন্দায় কাপড় নাড়া দেইখা সে অত্যন্ত বিরক্ত হয়। তার কাছে মনে হয় ব্যালকনি হইল বাড়ির সৌন্দর্য, সেইখানে শায়া ব্লাউজ, জাঙ্গিয়া ব্রেসিয়ার শুকাইতে দেওয়া অরুচিকর। তাইলে কাপড় মানুষ নাড়বে কই?
ছোটকালে বড়খালামনির বাসায় গেছিলাম, লালমাটিয়াতে সেই বাসা। তখনকার বাসাগুলার বারান্দা যথেষ্ট বড় থাকত। মোড়া পাইতা বসা যাইত, অর্নামেন্টাল প্ল্যান্টস ছিল, কাপড় শুকানের দড়িও ছিল। কিন্তু সেইগুলা কাপড় শুধু দৃশ্যমান কাপড়, অন্তর্বাস সেই বারান্দায় নাড়া নিষেধ ছিল কারণ বারান্দাটা বাসার বাইরের দিকে। রাস্তা থাইকা দেখা যায়।
আমি জানি না অন্তর্বাসের ব্যাপারে সূক্ষরুচিসম্পন্ন মানুষেরা সেইগুলা কই নাড়েন। পেটিকোটও এক হিসাবে অন্তর্বাস, সেইটা রইদে কিংবা বাতাসে না শুকাইতে পারলে বিপদ। পেটিকোটের তলায় প্যান্টি আর ব্লাউজের তলায় ব্রেসিয়ার শুকান কি উনারা?
বারিন্দা নিয়া কলিকাতার অনেক গায়কের গান আছে, “বারান্দায় রোদ্দুর, আমি আরামকেদারায় বসে দুইপা নাচাই রে, গরম চায়ে চুমুক দিই…”—এমন একটা গান অনেক আগে শুনছিলাম। কার গান মনে নাই। নচিকেতার একটা গানে এমন লাইন ছিল—“খোলা বারান্দায়, এ নির্জনতায়, সিলিঙের বন্ধনে, মাটির ব্যবধানে, দুলছে স্খলিতবসনা, নীলাঞ্জনা।” এই গথিক ইমেজটারে আমার কাছে অবাস্তব মনে হইছে। গলায় দড়ি দিলে সাধারণত ফ্যানের লগে দেওয়া হয়, বারান্দায় ফ্যান খুব কম বাসায় থাকে। তাছাড়া বারান্দা খোলা জায়গা, সেইখানে সুইসাইড করতে গেলে কেউ না কেউ দেইখা ফেলতে পারে, গলায় দড়ি যারা দেন তারা সাধারণত কাজটা করেন দরজা বন্ধ কইরা।
আমার আব্বার বাসায় পাঁচটা ফ্ল্যাট, এক দিকে দুই তলা আরেক দিকে তিনতলা। তিনতলায় আমি থাকি, যে অংশে তিনতলা হয় নাই সেই অংশের ছাদটা আমার বাসার সামনে। সকাল থাইকা সেই ছাদে কাপড় নাড়া শুরু হয়। সকল প্রকারের কাপড় সেই ছাদে সারাদিন ঝুলে। একটা লাল রঙের ব্রেসিয়ার (জানি না কার) আর তন্ময়ের একটা নীল জিন্সের প্যান্টের ছবি তুইলা ইন্সটাগ্রামে এডিট করছিলাম। সেইটা ফেইসবুকেও দিছিলাম। আমার দুই এক সহকর্মীর শিক্ষকানুভূতিতে সেইটা খুব লাগছে।
অন্তর্বাসের ছবি দেওয়া নাকি ‘অশিক্ষক সুলভ’ আচরণ। উনারা কেন অন্তর্বাসরে অশ্লীল মনে করেন তা আমি জানি না। ব্রেসিয়ার দেখলেই হয়ত সেই জিনিসের মালিকের বক্ষ নিয়া কোনো ফ্যান্সি বা ফ্যান্টাসি তৈরি হইয়া যায় উনাদের।
আরো বেশি খারাপ লাগছিল জাহাঙ্গীরনগরের এক সিনিয়রের কমেন্ট দেইখা। সেই সিনিয়রের মতে গোপন জিনিস প্রকাশ্য করা রুচিহীন, অথচ ব্যক্তিজীবনে উনি নিজে অশালীন কথা বইলা অভ্যস্ত। আমার একটা মোবাইল ফোন ঝুলানের ব্যাগ ছিল, সেইটা গলায় ঝুলায় রাখতাম, ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে। উনি জিগাইলেন কেন মোবাইল গলায় রাখছি। আমি কইলাম, ক্লাসে মোবাইল বাজলে স্যার ম্যাডামেরা বিরক্ত হন আর ভাইব্রেশন দিয়া ব্যাগে রাখলে কল টের পাই না, সেইজন্যে।
উনি কইলেন, “ভাইব্রেশন দিয়া অন্য জাগায় রাখবি।” আশেপাশের অনেকেই হাইসা উঠছিল, আমি তখন উনার ইঙ্গিত বুঝতে পারি নাই। পরে বুঝছি। যৌন সুড়সুড়িমূলক কথা জনসমক্ষে বলার জন্যে উনার উপরে বিরক্ত হইবার অবকাশ পাই নাই, নিজের টিউব লাইট হওয়া নিয়াই আক্ষেপ করছিলাম। তা সেই বড় ভাই যখন আবার ব্রেসিয়ারের ছবি নিয়া আপত্তি করেন তখন ব্যাপারটা বিরক্তিকর। এই আচরণরে আম্মা বলেন, “নিজের গু বিসমিল্লাহ, পরের গু নাউজুবিল্লাহ।”
আমার বাসার এখনের বারান্দায়ও কয়েকটা গাছ আছে। প্রায়ই পানি দিতে ভুইলা যাই বইলা গাছগুলা কোনোমতে বাঁইচা আছে। দড়িতে কাপড় ঝুললে আসলেই বারান্দায় যাওয়া হয় না। বইসা চা খাওয়াও হয় না। বাসার ঠিক পাশেই ছাদ থাকাতে আমাদের চা খাওনের , বইসা গল্প করার জন্যে বারিন্দার দরকার কম। বিকালে সবার সব কাপড় নিয়া যাওয়া হইলে পরে আমাদের ছাদটাতে বসা যায়। হাঁটাহাঁটিও করা যায়।
আগে যে বাসাগুলাতে থাকতাম সেইখানেও আমরা সুযোগ পাইলেই ছাদে যাইতাম। কিন্তু এমন অনেক বাসা আছে যেখানে বাড়িওয়ালারা ছাদে যাইতে দেন না। আশেপাশের অনেক বাসায় দেখি এক চিলতা বারিন্দায় বাচ্চারা বইসা আছে বা খেলতেছে। আমরা যেমন ছোটকালে বড় উঠানে গোল্লাছুট বা কুতকুত খেলতাম, এখনকার বাচ্চাগর সেই সুযোগ নাই। ছেলে বাচ্চাদের কিছুটা থাকলেও মেয়ে বাচ্চারা একেবারেই বাসায় বন্দি।
বাঘমারার বাসা থাইকা আমি এইরকম একটা বাচ্চা মেয়েরে দেখতে পাইতাম, বারিন্দায় মোড়া পাইতা বইসা থাকত। আমার সেই বাচ্চা মেয়েটার জন্যে কষ্ট হইত। বাক্সবন্দি জীবনে একটু আকাশ দেখার জন্যে, একটু খোলা হাওয়ার জন্যে বাচ্চার আজকাল বারিন্দার উপরে নির্ভরশীল।
আগের দিনের উঠানওলা বাড়িগুলা সব ভাইঙ্গা বহুতলা বাড়ি বানানি হইতেছে। কিন্তু আমার দাদির বাসায় এখনো উঠান আছে, এল (L) শেপের সারি সারি ঘর আর এল শেপের বারিন্দাও আছে। আমার ছোট চাচা বিয়া করার পরে সেই এল শেপ বারিন্দার এক অংশে ঘেরা দিয়া পাকের ঘর বানানি হইছে। আমার চার চাচা এক বাড়ির কলতলা আর বাথরুম শেয়ার করলেও উনাদের পাকশাক আলাদা হয়, একান্নবর্তী আর নাই। সেই পাকের ঘর বানানের পরে সেই বাড়ির বারিন্দাটাও আগের আবেদন হারায়া ফেলছে।
কয়েক বছরের মধ্যে সম্ভবত বারিন্দা বলতে ব্যালকনি বা আমার ভাষায় যেইটা আসলে গ্রিল দেওয়া খাঁচা, সেইটাই বুঝাবে। ব্যালকনি নিয়া আমার সবচাইতে প্রিয় কবিতাটা শেয়ার কইরা লেখা শেষ করি। লিখছেন ইন্দ্রনীল চট্টোপাধ্যায়, আমার বোন মুমুর ভাসুর। কবিতাটা আমার মুখস্থ, স্মৃতি থাইকা লিখতেছি, লাইনের ব্রেক ভুল হইতে পারে (দেইখা নেওয়ার উপায় নাই, যে গানের অ্যালবামের কভারে লেখা ছিল সেইটা এই মুহূর্তে হাতের কাছে নাই) দাদাভাই নিশ্চয়ই তাতে মাইন্ড করবেন না—
“আমার মতো কিছু মানুষ সম্বিৎ ফিরে পেলে
গলির মোড়ে আর কখনো দুপুর রোদে একা
দাঁড়াবে না হুডতোলা রিকশা চলে গেলে
কাউকে তখন ব্যালকনিতে আর যাবে না দেখা
তুমি আকাশ ভাসাও জলে, মেঘ ওড়াও
পাতার মতন শুকিয়ে ফেলো হাওয়া
আর নির্বিকারে তাকিয়ে দ্যাখো
নিমপাতা ঝরে যাওয়া
তুমি চোখের কোলে, নিচে অবাক আঁধার
নিংড়ে নিয়ে আরো গহীন করো
তবু সত্যিকারের দু’হাত দিয়ে
আমায় জাপ্টে ধরো
তুমি সকাল ধরে ধরে রাত্রি নামো
নামতে থাকো, দৃষ্টিসীমার মাঝে
এসব কথা কেমন যেন
জটিল হয়ে আছে
আমার মতো কিছু মানুষ কাব্য ফিরে পেলে
কোথাও কোনো লেখা হয়তো আর যাবে না পড়া
আর যাবে না ব্যালকনিতে
শুকনো পাতা ধরা”
উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ...
0 comments:
Post a Comment