Saturday, July 1, 2017

আলোর ধাক্কায় মহাশূন্য ভ্রমণ


সূর্যের আলোকরশ্মির সাহায্যে চলে এমন নতুন এক ধরনের মহাকাশযানের নিরীক্ষা সম্প্রতি সফল হয়েছে।

বেশ কয়েকটি ত্রুটি পার হয়ে যানটি সফলভাবে উড়তে পেরেছে। সূর্যের আলোকরশ্মির সাহায্যে চলার প্রক্রিয়াটিকে বলা হচ্ছে ‘সোলার সেইল’। এই মহাকাশ যানের সামনে আগানোর পদ্ধতি রকেটের থেকে একদমই আলাদা। সোলার প্যানেলের মত সোলার অ্যানার্জি ব্যবহার করে না এটি, বরং এর চলার বা সামনে আগানোর প্রক্রিয়া অনেকটা পাল তোলা নৌকার মত। এর চলার প্রক্রিয়াকে সে কারণেই নাম দেওয়া হয়েছে ‘সোলার সেইল’।

এটি তৈরি করেছে ইউএস প্ল্যানেটারি সোসাইটি। এর ফান্ড এসেছে পাবলিক ডোনেশন থেকে। এটা কীভাবে চলবে, কী কী কাজে লাগবে এবং এর মেকানিজম কী হবে সে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। আগামি বছর সম্পূর্ণ সিস্টেম নিয়ে এটাকে আবার স্পেসে ছাড়া হবে। সোলার সেইলিং পদ্ধতির প্রথম মহাকাশযান এটি নয়, আগে ২০১০ সালে জাপানের ইকারুস প্রথম এই পদ্ধতি সফলভাবে ব্যবহার করেছে।

পাল তোলা নৌকার চলার সাথে এর মিলটা আসলে কোথায়?

বাতাসের পার্টিকেল বা কণা নৌকার পালে ধাক্কা দেয় বলেই নৌকা সামনে আগায়। সোলার সেইলিং এর ক্ষেত্রেও তাই, বাতাসের পরিবর্তে সূর্যের আলোক রশ্মির কণা বা ফোটন মহাকাশযানটিকে সামনে নিয়ে যায়।

স্পেস বা মহাশূন্য ভ্রমণের জন্য মহাকাশযানের ভবিষ্যৎ হবে এই সোলার সেইলিং সিস্টেম, এখন তাই মনে করা হচ্ছে।

আলোকরশ্মি ফোটন নামের এক ধরনের গতিশীল কণা দ্বারা গঠিত। এবং এই ফোটনগুলি মিরর বা আয়নায় প্রতিফলিত হয়। যখন এই প্রতিফলন ঘটে আয়নার পৃষ্ঠতলে একটা চাপ অনুভূত হয়, এই চাপকে বলা হয় সোলার র‍্যাডিয়েশন প্রেশার বা সৌর বিকিরণ চাপ।

এই সৌর বিকিরণ চাপ পরিমাণে খুবই সামান্য। পৃথিবীতে হাতে কোনো আয়না ধরে থাকলে এই বিকিরণ চাপ টের পাওয়া যায় না, কিন্তু স্পেসে বা মহাকাশে এই চাপের পরিমাণ যথেষ্ট। অন্তত আয়না লাগানো কোনো পাল নড়ানোর মত যথেষ্ট। এই সৌর বিকিরণ চাপকেই কাজে লাগিয়ে এই মহাকাশযান চলবে।

সোলার সেইলিং ব্যাপারটা পুরোপুরি বোঝার জন্য স্পেসের শূন্যতার ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ। যে কোনো যানবাহন যে মাধ্যমে চলে সেই মাধ্যমের সাথে ইন্টার‍্যাকশন করে একটা ফোর্স বা বল উৎপন্ন করে এবং তার মাধ্যমে সামনে আগায়। চাকাওয়ালা গাড়ি রাস্তার সাথে ইন্টার‍্যাকশনে এই বল তৈরি করে, নৌকা বা জাহাজ পানির সাথে ইন্টার‍্যাকশনে এই বল উৎপন্ন করে এবং সামনে আগায়।

কিন্তু স্পেসে বা মহাশূন্যে ইন্টার‍্যাকশনের বা বল উৎপন্ন করার কোনো মাধ্যম নাই। এই কারণে মহাকাশে রকেট পিছন দিকে লিকুইড অক্সিডাইজারের জ্বালানি নির্গমণ করে একটা বল উৎপন্ন করে এবং সেই বল রকেটকে বিপরীত দিকে ধাক্কা দেয়, অর্থাৎ রকেট সামনে আগায়। অতি পরিচিত নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্র অনুযায়ীই ব্যাপারটি ঘটে—একটি বস্তু অন্য আরেকটি বস্তুর উপর যে বল প্রয়োগ করে, সে তখন ওই বস্তু থেকে বিপরীত দিকে সমান পরিমাণের একটি বল অনুভব করে।

রকেটে বা সাধারণ মহাকাশযানে জ্বালানি থাকে সীমিত, এই জ্বালানি না থাকলে মহাকাশযান আর সামনে আগাতে পারে না। কিন্তু সোলার সেইলিং এর ক্ষেত্রে বল উৎপন্ন করার জন্য অক্সিডাইজারের জ্বালানির প্রয়োজন নেই। সোলার সেইলিং মানে মহাকাশযান অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য মহাকাশে চলতে পারবে।

সোলার সেইলিং সিস্টেম বাস্তবায়নে বেশ কয়েকটা ইন্জিনিয়ারিং চ্যালেন্জ আছে। এর মধ্যে প্রধান হল, সোলার র‍্যাডিয়েশন প্রেশার বা সৌর বিকিরণ চাপ খুবই অল্প। ফলে, মহাকাশযানকে সামনে নেওয়ার মত প্রেশার পাওয়ার জন্য এটার পাল অনেক বড় হতে হবে এবং সামনে যাতে আগাতে পারে সেজন্য ওজনে হাল্কা হতে হবে।

মহাকাশযান চালু করার সময় পাল ভাঁজ করা অবস্থায় থাকবে, যখন গ্র্যাভিটির বাইরে পৌঁছাবে, অর্থাৎ ওজনহীন অবস্থায় যাবে তখন পাল খুলে যাবে।

যে মহাকাশযানটি সফলভাবে স্পেসে যেতে সফল হয়েছে তার পালের ভাঁজ করা অবস্থায় প্রস্থ ছিল ৩০ সেন্টিমিটার, কিন্তু যখন পাল ভাঁজ খুলেছে তখন এর আয়তন হয়েছে ৩২ বর্গ মিটার।

তবে পাল আকারে বড় এবং ওজনে হাল্কা হলেও খুবই কম গতি পাওয়া যায়। দুটি টেনিস কোর্টের সমান বড় একটি পালে সৌর বিকিরণ চাপ দিয়ে যে বল পাওয়া যাবে সেটা পৃথিবীতে ১ গ্রাম ওজনের সমান। যদি সম্পূর্ণ মহাকাশযানটির ভর হয় ৩০ কেজি, তাহলে এর ত্বরণ হবে ০.০০০৩ মিটার পার স্কয়ার। অর্থাৎ  প্রতি সেকেন্ডে ০.০০০৩ করে বেগ বাড়বে। রকেটের তুলনায় এটা খুবই সামান্য।

সোলার সেইলিং সিস্টেমে মহাকাশযানটি সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে করে আস্তে আস্তে এর টার্গেটের দিকে এগিয়ে যাবে। এই মহাকাশযানটি যেহেতু সূর্যের আলোকরশ্মি দিয়েই চলবে, তাই এই সৌর জগতের ভিতরেই অন্য কোনো গ্রহে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহজেই সফল হতে পারবে এটা। তবে এখানে আরো একটা সমস্যা আছে, মহাশূন্যের র‍্যাডিয়েশন এবং আরো অন্যান্য কারণে এই মহাকাশযানের পালের আয়নার প্রতিফলন ক্ষমতা আস্তে আস্তে কমে যেতে পারে।

এই প্রজেক্টের নাম লাইটসেইল। এখন লাইটসেইল প্রজেক্ট আকারে ছোট হলেও এবং এর কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও ভবিষ্যতে স্পেস এক্সপ্লোরেশনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হবে এটা।

রকেটের অক্সিডাইজার জ্বালানির সীমাবদ্ধতার কথা চিন্তা করলে, হয়ত প্রযুক্তি লাইটসেইল-কে এমন জায়গায় নিয়ে যাবে যে সোলার সেইলিং-ই হবে ভবিষ্যতের মহাকাশযানগুলির সিস্টেম।

 

উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ..

0 comments:

Post a Comment