Monday, July 3, 2017

প্লুটো নিয়ে কয়েক ছত্র



দোজখের দেবতা
নাম-পরিচয় নিয়ে এমন শোরগোল বোধহয় আর কখনও পাকেনি, কারও বেলায়। তর্কাতর্কির এক চূড়ান্ত চিত্র। বিচিত্র এই মহাজাগতিক জাতকের জীবনে বিপর্যয় বুঝি লেখা ছিল তার জন্ম কুণ্ডলীতেই! আবিষ্কারের দিন থেকেই সবার চোখে ও চিহ্নিত হয়েছে বেয়াড়া হিসেবে। সহজাত সহোদরদের চেয়ে স্বভাব-চরিত্র যে তার একটু আলাদাই। আকিকার সময় তার নাম রাখা হয়েছিল প্লুটো। পদবিতে ছিল গ্রহ। কিন্তু যুক্তির যুদ্ধ শুরু জন্ম থেকেই। ৭৬ বছর পর, ২০০৬ সালে তার নাম গেল পাল্টে। বদলি নাম হল প্লুটোইড। পাল্টে গেল পদবিও। গ্রহ নয়, পরিচয় তার এখন বামন গ্রহ। প্লুটোর পতন নয়, এই প্রতিবেদনে থাকছে প্লুটো আবিষ্কারের পেছনের গল্প।
পৃথিবী থেকে খালি চোখে দেখা যায় সূর্যের পাঁচ সন্তানকে- বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি আর শনি। যন্ত্রের চোখে ধরা পড়া প্রথম গ্রহ হচ্ছে ইউরেনাস। আবিষ্কারকের নাম উইলিয়াম হার্শেল। এই আবিষ্কারে সাড়া পড়ে গেল চারদিকে। নেহাতই শখের এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী (যার আয়-রোজগার হয় কনসার্ট করে, অর্গান বাজিয়ে!) কি না খোঁজ দিলেন এক মহাজাগতিক বস্তুর। ইউরেনাসের আবিষ্কারে সৌরমণ্ডলের পরিধি বেড়ে গেল, হল দ্বিগুণ। গ্রিক পুরাণে স্যাটার্নের বাবা এবং আকাশের দেবতা ওউরানোস। এই দেবতার নামেই নতুন গ্রহের নাম রাখা হল ‘ইউরেনাস’।
এই গ্রহ আবিষ্কারের পর থেকেই বড় এক বিভ্রান্তি গ্রাস করেছে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের। সবচেয়ে নামিদামি লেন্সের দূরবীণে চোখ তাদের। তারা সূর্যকে ঘিরে ইউরেনাসের চলার পথপরিক্রমা যতই পর্যবেক্ষণ করছেন, ততই বাড়ছে সেই বিভ্রান্তি। একটি নক্ষত্রের চারপাশে গ্রহরা কীভাবে আবর্তিত হবে, তা বলে দিতে পারে আইজাক নিউটনের বিখ্যাত মহাকর্ষ সূত্র। সমীকরণের সাহায্যে আগেভাগেই বলে দেওয়া সম্ভব, আজ থেকে অনেকদিন পর বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি বা শনি-কে কোথায় থাকবে। বিপত্তি বাধল ইউরেনাসের বেলায়। দেখা গেল, ইউরেনাসের কক্ষপথ অনুমানে নিউটনের তত্ত্ব অসার! বহুকাল দূরের গল্প, এক বছর পরে কোথায় দেখা যাবে গ্রহটাকে, সেই গণনাও বাস্তবে মিলছে না। তবে কি নিউটনের তত্ত্ব ভুল? না, তা নয়।
গোলমালটা অন্যখানে-সন্দেহ জাগল দুই গবেষকের। না, তারা কেউ জ্যোতির্বিজ্ঞানী নন। দু’জনেই গণিতজ্ঞ। কখনও চোখ রাখেননি কোনো দূরবীণে। কিন্তু গ্রহের কক্ষপথ গণনা যেহেতু গণিতের ব্যাপার, তাই ইউরেনাস ঘিরে সমস্যা নিরসনে এগিয়ে এসেছিলেন তারা। এদের একজন ব্রিটিশ অধ্যাপক জন কাউচ অ্যাডামস এবং ফরাসি গণিত গবেষক আরবা জাঁ-জোসেফ লিভেরি। ইংলিশ চ্যানেলের দু’পারের দু’জনা। একে অন্যের গবেষণার খবর কিন্তু কেউ তারা জানতেন না। অথচ কী বিস্ময়, গণনার শেষে ১৮৪৫ সালে দু’জনেই এসে পৌঁছলেন একই সিদ্ধান্তে! ইউরেনাসের বেহিসাবি কক্ষপথের মূলে রয়েছে আরও দূরের এক গ্রহ। এত দিন দেখা যায়নি তো কী, দূরবীণে ঠিকমতো খুঁজলে ধরা পড়বেই। আকাশের কোথায় খুঁজতে হবে সেই লুকিয়ে থাকা গ্রহটিকে, তাও হিসাব করে বের করে ফেললেন তারা দু’জন। আর তারপর পেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের অনুরোধ করলেন রাতের আকাশে ওই এলাকাটা খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে। অবশেষে ১৮৪৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। বার্লিন অবজারভেটরির জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহান গটফ্রিড গল ও তার ছাত্র হেনরিখ লুডভিগ দূরবীণ ঘুরিয়ে সত্যিই খুঁজে পেলেন গ্রহটিকে।
এর কয়েকদিনের মধ্যে পাওয়া গেল আরেক খবর। ব্রিটেনের দু’জন জ্যোতির্বিজ্ঞানীও নাকি অ্যাডামসের পরামর্শ শুনে আকাশ খুঁজে পেয়েছেন একই গ্রহের খোঁজ! তা হলে কী নাম রাখা হবে এখন নতুন এই গ্রহটির? দূরবীণে ঈষৎ সবুজাভ দেখায় বলে সমুদ্রের দেবতার নাম অনুসারে গ্রহটির নাম দেওয়া হল ‘নেপচুন’। কিন্তু আবিষ্কর্তা? এবার কৃতিত্বের কাজিয়া শুরু হল ইংলিশ চ্যানেলের দু’পারের দুই দেশে। শেষমেশ অবশ্য রফা হল। লিভেরি এবং অ্যাডাম্স নেপচুনের যৌথ আবিষ্কর্তা।
কৃতিত্বের ভাগ নিয়ে ঝগড়ার কথা বাদ দিলে প্লুটোর আবিষ্কারের গল্পটাও ওই নেপচুন-কাহিনীর মতো। কী রকম? দেখা গেল, নেপচুনের উপস্থিতি ইউরেনাসের কক্ষপথের বিচ্যুতি অনেকটাই ব্যাখ্যা করছে বটে, তবে পুরোটা নয়। অতএব? হ্যাঁ, খুঁজলে মিলবে হারাধন সূর্যের আরও এক সন্তান! এই খোঁজে অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন পারসিভাল লোয়েল। ধনকুবের আমেরিকান। ১৮৯৪ সালে আরিজোনায় মরুভূমির বুকে গড়ে তুলেছেন তার নিজস্ব মানমন্দির। আর তার পর দূরবীণে চোখ রেখে মঙ্গল গ্রহের বুকে আবিষ্কার করেছিলেন ওখানকার ‘মানুষের তৈরি নদী-নালা’। এহেন খবরে হইচই পড়ে গিয়েছিল। এবং এতটাই যে, লেখক হারবার্ট জর্জ ওয়েলস কাহিনী (‘ওয়র অব দ্য ওয়ার্ল্ডস’) লিখে ফেলেন মঙ্গলের প্রাণীদের নিয়ে। শোরগোলের পর পেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বিদ্রূপের শিকার হন লোয়েল। মঙ্গলের বুকে খানাখন্দকে বড় তাড়াহুড়া করে প্রাণীর তৈরি বলে প্রচার করায়। বদনাম ঘোচাতেই অজানা গ্রহের খোঁজে মনপ্রাণ সঁপেন লোয়েল। ওটার একটা নামও আগাম দেন তিনি। ‘প্ল্যানেট-এক্স’।
১৯১৬ সালে লোয়েল মারা গেলেন তার সাধ অপূর্ণ রেখে। সে স্বপ্ন সফল করলেন ক্লাইভ টমবাও নামে এক তরুণ। বিদ্যার দৌড় যার স্রেফ স্কুল অবধি। নেহাতই আকাশ দেখার শখে লোয়েলের মানমন্দিরে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন যিনি।
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্ল্যানেট-এক্স খুঁজে পেলেন টমবাও। কিন্তু লোয়েলের বিধবা পত্নী কনস্টান্সের অনুরোধে গোপন রাখা হল আবিষ্কারের খবর। অবশেষে ঘোষণা হল ১৩ মার্চ, লোয়েলের ৭৫তম জন্মদিন আর ইউরেনাস আবিষ্কারের ১৪৯তম বর্ষপূর্তিতে। কনস্টান্স চাইলেন প্ল্যানেট-এক্স পরিচিত হোক ‘লোয়েল’ কিংবা ‘কনস্টান্স’ নামে। অবশ্য মানমন্দিরের কর্মীরা এর বদলে বেছে নিলেন ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড থেকে টেলিগ্রামে পাঠানো ১১ বছরের এক মেয়ের প্রস্তাব। সূর্যের দূরতম গ্রহ (না, এখন কিন্তু গ্রহ নয়, বামন গ্রহ)। আবার এমন জায়গায় বাস তার, আলো প্রায় পৌঁছয় না। তাই তার নাম রাখা হোক ‘প্লুটো’। গ্রিক পুরাণে প্লুটো হচ্ছে এক দেবতার নাম। দোজখের দেবতা! প্লুটো নাম রাখলে আরেকটা বাড়তি সুবিধা থাকছে। নামের প্রথম দুটো অক্ষর (পি এবং এল) বহন করে পারসিভাল লোয়েলের স্মৃতিও! তাই শেষ পর্যন্ত খুশিই হলেন লোয়েলের স্ত্রী কনস্টান্স।
আবিষ্কারের সময় থেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ধন্দে ফেলেছে প্লুটো। সূর্যকে ঘিরে বাকি আটখানা গ্রহের কক্ষপথ যেন এক সমতলে। কিন্তু প্লুটোর কক্ষপথ? শুধু অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি ডিম্বাকারই নয়, তা আবার ওই তল থেকে উঠে-নেমে রয়েছে। আরও নানা রকম অসঙ্গতি। এসব লক্ষ করে যুক্তরাষ্ট্রের জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেরার্ড কুইপার ১৯৫০-এর দশকে সন্দেহ প্রকাশ করলেন প্লুটোর ‘জাত’ নিয়ে। ওটা কি আসলেই কোনো গ্রহ? নাকি নেপচুনের চেয়েও বেশি দূরে বিশাল এলাকা জুড়ে বিচরণকারী নানান আকৃতির অনেক বস্তুর একটি মাত্র? ওই এলাকা এখন চিহ্নিত ‘কুইপার বেল্ট’ নামে। আর ওখানকার বস্তুগুলোকে বলা হয় কুইপার বেল্ট অবজেক্ট বা ‘কেবিও’। আজ পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে ছয়শ’রও বেশি কেবিও।
১৯৭৮ সালে আবিষ্কৃত হল প্লুটোর উপগ্রহ ‘ক্যারন’। আবিষ্কারের পরই গোল বাধল। ওটাকে ঠিক উপগ্রহ বলা যায় কি না তা নিয়ে। অন্য উপগ্রহরা যেখানে আকারে তাদের গ্রহদের ১০০ ভাগের ১ ভাগের মতো, ক্যারন সেখানে প্লুটোর প্রায় অর্ধেক। তার চেয়েও বড় কথা, চাঁদ যেভাবে পৃথিবীকে ঘিরে চক্কর দেয়, ক্যারন কিন্তু মোটেই সেভাবে প্লুটোর চারদিকে ঘোরে না। তা হলে? প্লুটো আর ক্যারন যেন ওদের মাঝখানে মহাশূন্যে একটা বিন্দুর চারদিকে ঘোরে। এ জন্য প্লুটো আর ক্যারনকে একসঙ্গে ‘ডাবল প্ল্যানেট’ নামেও ডাকা হতো। এদিকে সূর্যের চারদিকে প্লুটোর কক্ষপথ এতই চ্যাপ্টা ডিম্বাকার যে, চলতে চলতে একেক সময় সে ঢুকে পড়ে একেবারে নেপচুনের কক্ষপথের ভেতরে। এদিকে ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে জন্ম নিল আরেক প্রশ্ন। ক্যালটেকের জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাইকেল ব্রাউন। তিনি কুইপার বেল্টের মধ্যে প্লুটোর চেয়ে বড় একটা বস্তুর সন্ধান পেলেন। শুধু বড় নয়, প্লুটোর পাঁচ গুণ! নতুন এই বস্তুটার নাম রাখা হলো এরিস। সাংবাদিকদের লেখনীতে মূল নাম ছাপিয়ে এরিসের পরিচিতি ‘জেনা’ নামে। এই জেনা আবিষ্কারের পর থেকেই প্লুটোর স্ট্যাটাস নিয়ে ঘোর সংশয় দেখা দিল। প্লুটো যদি গ্রহ হতে পারে, তবে জেনাই বা তা নয় কেন? সুতরাং…? হ্যাঁ, প্লুটো এবং জেনা-দুটোই তবে ‘বামন গ্রহ’। সিদ্ধান্তটা চূড়ান্ত হয়েছিল ২০০৬ সালের ২৪ আগস্ট।



উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন  ..

0 comments:

Post a Comment