গুরুত্বপূর্ণ কিছু বই
জীবন পাল্টে দেওয়া ২০ টি বই
জীবন পাল্টে দেয়া বা দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দেয়া বইয়ের তালিকা করতে বললে এখন আমি যেটা করবো আগামী একছর বা দশবছর পর অনেকটাই পরিবর্তিত হয়ে যাবে, অনেক যোগ-বিয়োগ হবে। তেমনি আজ থেকে বছর দুয়েক আগে বললেও যে তালিকা হতো সেটা এখনকার সাথে পুরোপুরি মিলবে না। তবে কিছু কিছু বই সারাজীবন তালিকাতে থাকারই সম্ভাবনা বেশি।
আমার তালিকা করার ক্ষেত্রে ধর্মীয় মহাগ্রন্থগুলোর রাখিনি।তবে ভূমিকাতে তাদের নাম নিয়ে রাখলাম। পবিত্র কুরআন, পবিত্র বাইবেল, পবিত্র গীতা আমার পড়া তিনটি অসাধারণ গ্রন্থ। প্রত্যেকটিই বহুবার পড়া। শত শত বছর ধরে মানুষের জীবন পাল্টে দেওয়া থেকে শুরু করে জীবনের নতুন অর্থ নির্মাণের ক্ষেত্রে এগুলোর ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই।অন্যান্য ধর্মগ্রন্থগুলোও ঠিক এমন প্রভাবশালী হবে বলেই মনে করি। প্রত্যেকটি ধর্মের প্রধান গ্রন্থগুলো একে একে পড়ে শেষ করার আশা রাখি।
নিচে বিশটি বইয়ের তালিকা করার ক্ষেত্রে প্রধান ধর্মগ্রন্থগুলো নিয়ে আসা হয়নি।তবে অনেকেই লাও জু’র ‘তাও তে চিং’কে ধর্ম ও দর্শনের মাঝামাঝিই রাখে। আর মহাভারতেরই একটি অংশ যে গীতা। আগেভাগে একটু ফুটনোট দিয়ে রাখলাম!
সে যাই হউক এখন আমাকে কেউ প্রশ্ন করলে যে বিশটি বইয়ের নাম মাথায় আসবে সেগুলোর নাম নেওয়ার চেষ্টা করি:
১. এপলজি অব সক্রেতিস বা সক্রেতিসের জবানবন্দি-প্লাতো
সক্রেতিসের বাবা ভাস্কর আর মা ধাত্রী। সক্রেতিস পরবর্তী জীবনে মা-বাবার পেশাকে ধরে রেখেছেন বলে মনে করতেন। ধাত্রী যেমন কোন মানবশিশুকে পৃথিবীতে আসতে, জন্ম নিতে সহায়তা করতেন সক্রেতিসও তেমনি একজন জ্ঞানপিপাসুর জন্মের ক্ষেত্রে ধাত্রীর মতো ভূমিকা পালন করতেন। আবার একজন ভাস্কর যেমন কঠিন পাথরকে কেটেকুটে সুন্দর মূর্তির রূপ দেন তেমনি দার্শনিক ও মানবতার শিক্ষক সক্রেতিস ও একজন মানবশিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে নিপুণ ভাস্করের ভূমিকা পালন করেছেন। বৃক্ষ তোমার নাম কি? ফলে তার পরিচয়। এখন সক্রেতিস কেমন শিক্ষক ছিলেন তার প্রমাণ প্লাতো, অ্যারিস্তোতলদের মতো ওস্তাদদের পরম্পরা তৈরি করার মধ্যেই রয়েছে। তার প্রিয় এবং যোগ্যতম শিষ্য প্লাতোকে নিয়ে বলা হয়-‘পুরো পাশ্চাত্য দর্শন প্লাতোর ফুটনোট মাত্র’। প্লাতোর প্রত্যেকটি লেখাতে প্রধান চরিত্র হিসেবে থেকেছেন সক্রেতিস। মনে হচ্ছে যেন সক্রেতিস কথা বলছেন আর প্লাতো নোট লিখছেন। ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়। বয়স ত্রিশের দিকে গুরু সক্রেতিসের করুণ বিয়োগের ঘটনাটি এমনভাবেই তাড়িত করেছিল তরুণ প্লাতোকে যে সে তার পুরো জ্ঞানচর্চাকেই সক্রেতিসের পদতলে বিছিয়ে দিয়েছেন। ব্যাপারটা অনেক পরিষ্কার প্লাতো প্রথমদিকে হয়তো সক্রেতিসের দর্শনই সক্রেতিসের মুখ দিয়ে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু তার সেরা লেখাগুলোতে বা শেষদিকের লেখাগুলোতে নিজের দর্শন সক্রেতিসের মুখ দিয়ে বলিয়ে নিয়েছেন। সক্রেতিসের প্রতি তার একাত্ম আনুগত্য ও ভালোবাসার ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহের লেষমাত্র নেই।
সক্রেতিসকে খুব কাছ থেকে বুজতে হলে তার জবানবন্দি পড়তে পারেন। এর একাধিক বাংলা তর্জমা আছে। ইংরেজিতেও অনেকগুলো সংস্করণ আছে। যেকোন একটা পড়ে ফেলতে পারেন।
২. অন দ্য শর্টনেস অব লাইফ- সেনেকা
২. অন দ্য শর্টনেস অব লাইফ- সেনেকা
আমরা পৃথিবীতে এমনভাবে জীবনধারণ করি যেন আমরা অমর, মৃত্যু মনে হয় আসবেই না। অথচ যে মুহূর্তটা একবার চলে গেল সেটা আর ফিরিয়ে আনা কখনোই সম্ভব না। এবং মৃত্যু ও চলে যাওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ট্রাজিক সত্য। এটা ট্রাজিক সত্য কারণ এই সত্যটা সবাই জানলেও ভুলে থাকে বা ভুলে যায়।
সেনেকার মতে-‘তুমি এমনভাবে সময় অপচয় করো যেনো তোমার অফুরান যোগান আছে। কিন্তু ব্যাপারটা হলো কোনদিন কাউকে যে সময়টা দিলে বা যে জন্য দিলে সেটা হয়তো তোমার শেষ সময়। মরণশীল প্রাণীর সব ভয় তোমাদের মধ্যে কিন্তু তোমাদের আকাঙ্খা এত যেন তোমরা মরবে না।’
যারা বিভিন্ন আকামে ব্যস্ত থাকে অথচ ভবিষ্যতে কোন একসময় ভালো কাজ করবে বা ৫০/৬০ বছরের পর অবসরে গিয়ে সকল ভালো কাজ করার পরিকল্পনা করে রাখে তাদেরকে ব্যাপক সমালোচনা করেছেন। তিনি প্রশ্ন করেন কিভাবে তারা নিশ্চিত যে ৫০ বছর বা ৬০ বছর বেঁচে থাকবে? সেনেকার মতে এমন মানুষদের লজ্জা পাওয়া উচিত। যে তার জীবনের সেরা সময়টাতে ভালো কাজ করতে পারে নাই সে শেষ জীবনে গিয়ে করে ফেলবে এটা ভাবা অহেতুক কল্পনাবিলাস নয় কি? সেনেকার কথা হচ্ছে যা কিছু করার আজই শুরু করতে হবে। ভবিষ্যতের জন্য ফেলে রাখার দরকার নেই।
জীবনের অর্থ খুজে পাওয়া বা কিভাবে বাঁচতে হয় এটা শিখতে অনেক কষ্ট হয়, এমনকি জীবন ফুরিয়ে যাওয়ার আগে অনুধাবন হয় যে আসলে সেরকম বাঁচতেই পারলাম না। অনেকে বেশি মানুষের উপর ক্ষমতাবান হওয়াকে জীবনের সফলতা মনে করে। এর একটা বড় গোলকধাঁধা হচ্ছে এই যে অনেকের কাছে পরিচিত হলেও দেখা যায় সে নিজের কাছে সবচেয়ে অপরিচিত। এজন্য অনেক খ্যাতিমান লোক দিন শেষে দেখে তার নিজের জন্য সময় বরাদ্ধ কত কম!
অন্যকে সুখি করতে, অন্যের সামনে সুখি হিসেবে নিজেকে সবসময় তুলে ধরে রাখতে কত মানুষের জীবনের বড় অংশ চলে যায়। জীবনের যোগ বিয়োগ শেষে দেখা যায় আর সবাইকে সুখি করতে পারলেও যাকে সুখি করা হয়নি সেটা হলো নিজেকে! পাবলিক লাইফের প্যাড়া এমনই! এজন্যই আমরা কত রাজা-বাদশা, ধনরাজ, জ্ঞানী-মুনী-ঋষীকে দেখি অর্থ, সম্পদ, প্রাসাদ ছেড়ে জীবনের অর্থ খুঁজতে বের হয়ে পড়েন। তাদের মধ্য থেকেই বের হয়ে আসে গৌতম বুদ্ধ, মহাবীর, সক্রেতিস, রাহুল সাংকৃত্যায়ন, কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দেকার্ত বা লুডবিগ ভিৎগেনস্টেইন প্রমুখ মহামানব।
বেশিরভাগ মানুষের দিন কাটে অতীতের অনুশোচনা আর ভবিষ্যতের দুর্ভাবনা নিয়ে। কয়জন পারে আজকের দিনটাকেই শেষদিন মনে করে পূর্ণ করে বাঁচতে? আর অনেকের দিন কাটে ভবিষ্যতের ভালো সময়ের অপেক্ষা করে। সেনেকার প্রশ্ন ভবিষ্যতের কাছে দাবি-দাওয়া বা ভবিষ্যতের ভয় ছাড়া বর্তমানে বাঁচতে পারে কয়জন?
সময়ের অপচয় সেনেকা মেনে নিতে পারেন না। অন্য তুচ্ছ জিনিস নিয়ে বেশ সতর্ক হলেও এ ব্যাপারটাতে বেহিসাবী। সময়কে তুচ্ছ করে যারা অপচয় করে, অহেতুক কাজ করে বেড়ায় তারাই আবার যখন গভীর অসুস্থতায় পড়ে বা মৃত্যুমুখে পতিত হয় তারা ডাক্তার কবিরাজদের হাঁটুর নিচে পড়ে থাকে যেন আর কয়টা দিন বাঁচা যায়। বা কাউকে যখন মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় তখন উকিল-মোক্তারদের পেছনে ভাই-বন্ধু, আত্মীয়-স্বজনদের দৌড়ানো দেখলেই বুঝা যায় একটি দিন বেঁচে থাকা গুরুত্বপূর্ণ, একটি দিন কত বড়! আবার এ লোকটিই হয়তো দিনের পর দিন দিন ক্ষয় করে গেছে, অন্যের জীবন যাপন করে গেছে আর নিজের কাছে অচেনা থেকে কাটিয়েছে।
অনেক বছর বাঁচলেই কেবল বড় মানুষ হওয়া যায় না। সেনেকা বলেন- কারো ধূসর চুল আর কুচকে যাওয়া চামড়া দেখে ভেবো না সে অনেকদিন বেঁচেছে। সে আসলে অনেকদিন অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।
আমার কাছে একটি ভালো বই একটি ভালো সফটওয়ার। সফটওয়ার যেমন কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা স্মার্ট ফোনের কাজের প্রকৃতি পাল্টে দেয় তেমনি একটা ভালো বইও মানুষের দেখার দৃষ্টি, ভাবনার পদ্ধতি পাল্টে দেয়। তাই আমার মতে বই মানুষের জন্য সেরা সফটওয়ার। আর একেকটা সেরা বই পড়া হচ্ছে একেকটা সফটওয়ার ইন্সটল করা; তার মানে জগতকে একেকবার একেকটি দৃষ্টিতে দেখার সক্ষমতা অর্জন করা। সেনেকার ‘অন দ্য শর্টনেস অব লাইফ’ আমার কাছে তেমন একটি বই। যখন মনে হয় আমি অহেতুক সময় অপচয় করছি, যখন মনে হয় আমি আমার নিজের কাছে কমিটমেন্টের সাথে প্রতারণা করছি, আমার মনের গহীন কোণে হতাশার চাষবাস করছি তখনই এমন কিছু সফটওয়ারের সাহায্য নেই। এগুলো ইনস্টল করার মাধ্যমে আবার নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করি।
To buy "On The Shortness Of Life" click here or below the image
To buy "On The Shortness Of Life" click here or below the image
৩. দ্য আর্ট অব ওয়ার- সান জু
দ্য আর্ট অব ওয়ার শুধু একটি রণনীতির বই-ই নয় ব্যবসা-বাণিজ্য, খেলাধূলা থেকে শুরু করে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
এটা যেমন জেনারেলদের জন্য ম্যানুয়ালের মত কাজ করেছে তেমনি যেকোন সংকটময় পরিস্থিতিতে যে কেউ এর থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে পারে।
আর্ট অব ওয়ার আসলে কি?- যুদ্ধ না করেও যুদ্ধ জয় করা ( ‘winning without fighting’.)
যে কোন ব্যক্তি, যে কোন পেশা থেকেই এ বইটি পড়তে পারে। আসলে এটা বইয়ের চেয়েও বেশি কিছু, এটা ম্যানুয়াল বা গাইডলাইন। যারই জীবন পাল্টে দেয়ার উচ্চাকাঙ্খা রয়েছে সেই-ই এটা পড়তে পারে। আবার এ ম্যানুয়ালটি এমন নয় যে একেবারে প্রথম থেকে পড়া শুরু করে শেষ করতে হবে। জীবনের যেকোন সমস্যায় বইটির যেকোন পৃষ্ঠা খুললেই হয়তো প্রয়োজনীয় সমাধানের দিক নির্দেশনা মিলতে পারে।
আর্ট অব ওয়ার আসলে কি?- যুদ্ধ না করেও যুদ্ধ জয় করা ( ‘winning without fighting’.)
যে কোন ব্যক্তি, যে কোন পেশা থেকেই এ বইটি পড়তে পারে। আসলে এটা বইয়ের চেয়েও বেশি কিছু, এটা ম্যানুয়াল বা গাইডলাইন। যারই জীবন পাল্টে দেয়ার উচ্চাকাঙ্খা রয়েছে সেই-ই এটা পড়তে পারে। আবার এ ম্যানুয়ালটি এমন নয় যে একেবারে প্রথম থেকে পড়া শুরু করে শেষ করতে হবে। জীবনের যেকোন সমস্যায় বইটির যেকোন পৃষ্ঠা খুললেই হয়তো প্রয়োজনীয় সমাধানের দিক নির্দেশনা মিলতে পারে।
আধুনিক এই সময়ে আর্ট অব ওয়ারের গুরুত্ব কি কারণে?
আমরা একেকজন একেক যোদ্ধা, আমাদের জীবনের সংকট কম নয়। সেই ক্ষুদ্র ব্যক্তির জীবন ও সংকটকে মোকাবিলা করার জন্য এই বইয়ের নীতি অনেক সহায়ক হবে এ নিয়ে সন্দেহ নেই। নিজেকে যারা জীবন সংগ্রামের সৈনিক মনে করেন, যারা কিছু অর্জন করতে চান তাদেরকে অনেক রসদ দিবে সান জুর এই নীতিগ্রন্থটি।
To Buy "The Art Of War" click here or below the image
৪. আলকেমিস্ট- পাওলো কোয়েলহো
To Buy "The Art Of War" click here or below the image
৪. আলকেমিস্ট- পাওলো কোয়েলহো
আমাদের সময়ের ক্লাসিক। বিশ্বের প্রতিটি দেশে এখন এই বই পড়ুয়া কেউ না কেউ আছে। জীবন সংগ্রামে, নিজের মঞ্জিলে পৌছার সংগ্রামে থাকা ব্যক্তির জন্য এটা ম্যানুয়েল হিসেবে কাজে দেবে। স্বপ্নকে কিভাবে অনুসরণ করতে হয়, কিভাবে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা আমাদেরকে সমৃদ্ধ করে, কিভাবে মন থেকে কোন কিছু চাইলে পুরো বিশ্ব সেটা দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসে সেরকম অনুপ্রেরণার কথা পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়।
৫. দি প্রফেট-কাহলিল জিবরান
যে বইটা কয়েক ডজনবার পড়া হয়েছে। যার প্রতিটি লাইন মনে ও হৃদয়ে গেথে রাখার মতো। আমার কাছে কেউ প্রশ্ন করলে কোন বই পড়বো প্রথম দিকে যে অল্প কয়েকটি বইয়ের নাম নেই এটি অন্যতম। এখানে কাজ, কথা, সন্তান-সন্ততি, বিচার-আচার, ধর্ম ইত্যাদি বিভিন্ন মানবীয় বিষয় নিয়ে প্রফেটিক ও দার্শনিক উপদেশ বইটির পরতে পরতে।ইংরেজি অত্যন্ত সহজ ও মধুময় হওয়ার কারণে যে কেউ এটা পড়া শুরু করে দিতে পারেন।
৬. কর্মযোগ-স্বামী বিবেকানন্দ
আজ থেকে পাঁচ বছর আগে কর্মযোগ পড়ে ব্যাপক নাড়া খেয়েছিলাম। এখনো সেই প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারিনি। এজন্য মাঝে মাঝে স্বামী বিবেকানন্দের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে থাকি। কিভাবে একজন কর্মবীর হওয়া যায় আবার কাজের, পদের বা খ্যাতির মোহে আটকে পড়া থেকে দূরে থাকা যায়, কিভাবে পরমহংস হতে হয় তার পরামর্শ বইটিতে। গীতার শিক্ষা থেকে উৎসারিত বিবেকানন্দের কর্মযোগ আমার একটি প্রিয় বই।
৭. ভবঘুরে শাস্ত্র- রাহুল সাংকৃত্যায়ন
গত কয়েকবছরে এই ছোট্ট বইটি জীবনে বেশ বড় প্রভাব রাখছে। জীবনের প্রতি, পৃথিবীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হতে পারে তার পরামর্শ নিতে হলে ভবঘুরে শাস্ত্র একটি সহজ চয়েস হতে পারে। কিভাবে ভবঘুরেরাই পৃথিবীর মানচিত্র পাল্টে দিয়েছেন, ওলট-পালট করে দিয়েছেন তার উদাহরণ অহরহ মিলবে বইটিতে। একটি কর্মময় মহাজীবনের পথিক হতে হলে রাহুল সাংকৃত্যায়নের এই বইটি অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত।
৮. কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো- কার্ল মার্কস, ফ্রিডরিক এঙ্গেলস
নিয়মিত পড়া বইয়ের একটি। ১৮৪৮ সালে প্রকাশিত কার্ল মার্কস ও ফ্রিডরিক এঙ্গেলস রচিত এই বইটি বিশ্বজুড়ে বহুল পঠিত বইয়ের একটি। কার্ল মার্কসের দাস ক্যাপিটালে দাঁত বসাতে না পারলেও এ বইটি পড়ার মাধ্যমে কমিউনিজমের সাথে প্রাথমিক পরিচয় সম্পন্ন করা যাবে। বইটির আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে বইটি অত্যন্ত সুন্দর ও কাব্যিক ভাষায় লেখা এবং মনে রাখার মতো অসংখ্য লাইন চলে আসবে কিছুক্ষণ পরপর।
৯. তাও তে চিং- লাও জু
কিছু কিছু বই আছে যেগুলো শুধু একবার পড়ে নিস্তার নেই। বারবার পড়া উচিত। কিছু বই আছে একবার পড়লেই বুঝা হয়ে যায়। আবার কিছু বই আছে প্রত্যেক পাঠেই নতুন অর্থ নিয়ে হাজির হয়। প্রথম পাঠে অর্থ স্পষ্ট হয় না, বা যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয় তা অসম্পূর্ণ। এজন্য রিপিট করা আবশ্যক। আবার আপনার পছন্দের বই হিসেবে নিয়মিত হাতে চলে আসে সে বইটি।
লাও ৎস বা লাও জু’র ‘তাও তে চিং’এমন একটি বই। মাত্র ৫ হাজার চীনা শব্দের দ্বারা গঠিত এই নাতিদীর্ঘ বইটি দীর্ঘসময় ধরে চীন ও তার প্রতিবেশী দেশ থেকে শুরু করে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে প্রভাবশালী বই হিসেবে পঠিত হয়ে আসছে। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে রচিত এই কাব্যটি তাওবাদের একটি মৌলিক কেতাব! কনফুসিয়াসের চিন্তার সাথে লাও ৎস বা লাও জু’র তাওবাদ চীনের সবচেয়ে প্রভাববিস্তারী চিন্তা বা জীবণপ্রণালী! এটা একটি সহজিয়া পথের সন্ধান দেয়।
চীন-জাপানের জেন দর্শন নিয়ে হালকা জানাশুনা না থাকলে তাদের জন্য এটা বুঝতে একটু কষ্ট হতে পারে। আর চীনা গুরুজন সবসময়ই অ্যালূসিভ ভাষায় কথা বলেন। কনফুসিয়াস থেকে শুরু করে লাও জু, সান জু-সবার ভাষারই অনেকগুলো মিনিং থাকে।
ভাষার অর্থ বুঝতে হলে এর গভীরে প্রবেশ করা ছাড়া উপায় নাই। এবং সারফেস মিনিং এর উপর জোর দিলেই চলবেনা। ডিপ কি মিনিং দিচ্ছে সেটা বুঝার চেষ্টা করতে হবে।
১০. যদ্যপি আমার গুরু- আহমদ ছফা
বাংলাদেশের তরুনদের মধ্যে এখন সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখকদের একজন হচ্ছেন আহমদ ছফা। আমি নিজেও তার লেখা দ্বারা বেশ প্রভাবিত।‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’, ‘বাঙালি মুসলমানের মন’, ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা’ সহ অন্যান্য প্রবন্ধগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ বই হলেও ‘যদ্যপি আমার গুরু’ অত্যন্ত জনপ্রিয়। আহমদ ছফার লেখায় তার গুরু জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের চিত্রায়ন, সমকালীন বিভিন্ন প্রসঙ্গের উল্লেখ বইটিকে একটি অসাধারণ স্মৃতিচারণায় পরিণত করেছে। আবদুর রাজ্জাকের প্রজ্ঞার সাথে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এই বইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং রাজ্জাক স্যার মিথ সৃষ্টিতে বেশ ভূমিকা রেখেছে। নবীন পাঠকদের জন্য একটি সহজ টার্গেট হতে পারে এই বইটি।
১১. দি হানড্রেড- মাইকেল এইচ হার্ট
আমার শিক্ষক উইল ডুরান্টের কথায় বলতে হয় ‘আমি মহামানবদের লাজহীন স্তাবক’। বড় মানুষদের জীবন আমাবে বেশ টানে। এজন্য জীবনী, আত্মজীবনী, বড় মানুষদের কথা আমার সবচেয়ে প্রিয় পাঠ্য বিষয়। মাইকেল এইচ হার্টের এই বিশ্বখ্যাত বইটিতে একসাথে একশো জন মহামানবের উপস্থিতে বইটিকে আমার কাছে অনেক আকর্ষনীয় করে তুলেছে। এজন্য মাঝে মাঝে এই বইটা থেকে কয়েকজন মহামানবের জীবনের উপর দিয়ে একটু ভ্রমণ করে আসি। মহামানবদের জীবনের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে ভদ্রলোক অসাধারণ সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। তার সাথে দ্বিমত করার যথেষ্ঠ সুযোগ থাকলেও তার যুক্তির কাছে বশ মানা ছাড়া সুযোগ খুবই সীমিত।
১২. অন লিবার্টি- জন স্টুয়ার্ট
জন স্টুয়ার্ট মিলের ইউটিলিটারিয়ানিজম বা উপযোগবাদ বইটি সবচেয়ে বিখ্যাত হলেও ‘অন লিবার্টি’ আমার প্রিয় বইয়ের একটি। প্রথমবারের মতো দর্শনের যে বইটি পড়ে শেষ করেছিলাম এবং কয়েকমাস সাথে সাথে রাখতাম সেটি ছিল ‘অন লিবার্টি’। অনেকগুলো লাইন মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল এবং দর্শনের জগতে একেবারে টেনে হিচড়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এ বইটির ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই
১৩. মাই এক্সপেরিমেন্টস উইদ ট্রুথ- মহাত্মা গান্ধী
গান্ধীর বিভিন্ন পলিসির সাথে আমি একমত হতে পারি না, তার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে ভয়ানক মতবিরোধ হয়। কিন্তু আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলা ব্যক্তিত্বদের একজন হিসেবে গান্ধীর কথা বাদ দিতে পারি না। তার অন্তরঙ্গ পরিচয় পাওয়ার জন্যই এ বইটির দ্বারস্থ হয়েছি।কয়েকবার এ বইটি পড়ার মাধ্যমে গান্ধীর অন্দরমহলের সাথে পরিচিত হয়েছি।
১৪. নেপোলিয়ন ইমমোর্টাল-জেমস কেম্বেল, জন মারি
আমার প্রিয় নায়কদের একজন নেপোলিয়ন। নেপোলিয়নের জীবন ও কর্ম আমাকে ছোটবেলা থেকেই অনুপ্রাণিত করে আসছে। এজন্য নেপোলিয়ন নিয়ে যখনই কোন লেখা পাই পড়ে ফেলার চেষ্টা করি। নেপোলিয়নকে নিয়ে পড়া সেরা বইটি হচ্ছে ‘নেপোলিয়ন ইমমোর্টাল’ বইটি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিতে কয়েক সপ্তাহ লাগিয়ে এই বড় বইটি পড়ে শেষ করেছিলাম। লেখক দুজন এত সুন্দরভাবে নেপোলিয়নের ছবি একেছেন যেন মনে হবে পাঠক নেপোলিয়নের যুগে, নেপোলিয়নের পাশে দাড়িয়েই সব কিছু দেখছেন। থমাস কার্লাইল আর এমারসনের সাথে সাথে এই বইটি হতে পারে নেপোলিয়ন ভক্ত, শত্রু বা আগ্রহীদের জন্য অবশ্যপাঠ্য একটি বই।
১৫. ফ্রিডম এট মিডনাইট- ডমিনিক লেপিয়ার ও ল্যারি কলিন্স
ব্রিটিশদের কাছ থেকে ভারত-পাকিস্তানের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ইতিহাস নিয়ে সেরা বইয়ের একটি। ইতিহাস এত মধুর ও সুখপাঠ্য হতে পারে এ বইটি দেখিয়ে দেবে। ইতিহাসের চরিত্রগুলো যেন কোন উপন্যাস বা গল্পের চরিত্র হিসেবে বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় চলে আসবে। লেখকদ্বয়ের কলমের তুলি এতই শক্তিশালী যে একজন সাধারণ ভারতীয় নাগরিকের চরিত্রায়নও অনেক স্পষ্ট করে ফুটে উঠেছে। গান্ধী, নেহরু, জিন্নাহ, মাউন্টব্যাটেন সহ প্রত্যেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র অত্যন্ত সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। ব্রিটিশ ভারতের শেষ পঁঞ্চাশ বছর এবং সে সময়ের সবগুলো রাজনৈতিক উল্লম্ফন বর্ণিত আছে বইটিতে। একটি বই পড়ে যারা ওই পিরিয়ডটাতে দাঁত বসাতে চান তাদের জন্য এ বইটি বিনা দ্বিধায় হাতে নিতে পারেন। বইয়ের পাতায় ভ্রমনটা অসাধারণ উপভোগ্য হবে আমি শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারি।
১৬. মহাভারত
‘যাহা নেই (মহা)ভারতে তাহা নেই ভারতে।’ প্রায় দুইমাস লাগিয়ে রমেশ মেননের ইংরেজি অনুবাদে মহাভারত পড়ার পর এই বহুল প্রচলিত কথাটির সত্যতার উপলব্ধি হচ্ছিল। পাশ্চাত্যের সবগুলো প্রধান মহাকাব্যকে একসাথে করলেও মহাভারত বিষয় ব্যাপকতা, বিষয় বৈচিত্র্য, জৌলুশ দিয়ে সবগুলোকে হার মানাবে। বিশেষ করে গীতা পর্ব ও ভীষ্ম পর্ব আমার সবচেয়ে প্রিয়। এবং কর্ন ও ভীষ্ম আমার প্রিয় বীরদের দুজন। ভীষ্মের প্রজ্ঞা ও বীরত্ব এবং কর্নের বীরত্ব ও মহত্ব আমাকে টেনেছে। পাণ্ডবদের পক্ষে থাকা স্বাভাবিক হলেও মহাভারত শেষ করে উঠে কৌরব বীরদের প্রতি আমার মত সহানুভূতিশীল হয়ে উঠলে দোষ দেওয়ার কিছু নেই। কয়েক হাজার বছর ধরে ভারত তথা বিশ্বে প্রভাববিস্তারী এই বইটি পড়ে ফেলার জন্য সময় নিয়ে নেমে পড়তে পারেন।
১৭. ইলিয়াদ
গ্রিক বীর একিলিসের বীরত্ব এবং হেক্টরের দেশপ্রেম আমার আকর্ষনের বিষয়। এই মহাকাব্যটি গ্রেকো-রোমান সভ্যতা থেকে শুরু করে আধুনিক ইউরোপের সবচেয়ে প্রভাবশালী বইয়ের একটি। ইউরোপের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্যে এর প্রভাব অবিস্মরণীয়।ইলিয়াদের ভাষা, ভাবভঙ্গি, সমকালীন গ্রীক রাজনীতি ও সংকটের চিত্রায়ন তথা এর বিষয়-বৈচিত্র্য সববসময়ই পাঠকদের টানবে। হোমারের শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই যে তিনি অনেক বড় বড় ঘটনার সাথে সাথে অত্যন্ত ছোট্ট কোন ঘটনারও চিত্রায়ন করেছেন নিপুণ দক্ষতায়। ইলিয়াদ পড়া শুরু করলেই পাঠক চলে যাবে সুদূর গ্রিসে, দেখা হবে-কথা হবে-তর্ক হবে-যুদ্ধ হবে গ্রিকদের সাথে!
১৮. হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলসফি-বাট্রার্ন্ড রাসেল
দর্শনের জগতে ঘুরে আসার জন্য একটি অসাধারণ বই। ইংরেজি ভাষার একজন অসাধারণ গদ্যশিল্পী যে নিজেও একজন শক্তিশালী দার্শনিক তার কাছ থেকে তিন হাজার বছরের পাশ্চাত্য দর্শন ও দার্শনিকদের গল্প শুনার জন্য এই বইটি অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিত। রাসেলের গদ্য যেমন পাঠককে টানবে এবং প্রত্যেক দার্শনিককে নিয়ে করা তার মন্তব্য আমাদেরকে দিক নির্দেশনা দেবে।
১৯. দ্য গ্রেটেস্ট মাইন্ড এন্ড আইডিয়াজ অব অল টাইম-উইল ডুরান্ট
উইল ডুরান্টকে আমি আমার একজন শিক্ষক মনে করি। বিশেষ করে দর্শন ও ইতিহাসের তিনি এক অসাধারণ শিক্ষক।তিনি নিজেকে ‘আমি মহামানবদের লাজহীন স্তাবক’(শেইমলেস ওরশিপার অব গ্রেট মেন) হিসেবে উপাধি দেন। নিজের মধ্যেও এই গুণ ডুরান্টকে আমার শিক্ষক বানিয়ে দিয়েছে। আমিও মহামানবদের পথের ধূলি গুনতে যে ভালোবাসি! উইল ডুরান্টের কাছ থেকে বড় মানুষদের গল্প শুনা একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা। প্রায় দুইবছর আগে পড়া ‘দ্য গ্রেটেস্ট মাইন্ড এন্ড আইডিয়াজ অব অল টাইম’ বইটি এখনো মনের মণিকোঠায় জায়গা করে রেখেছে। এখন উইল ডুরান্টের ‘দ্য স্টোরি অব ফিলসফি’ পড়তে গিয়েও একইভাবে নাড়া খাই।’ সারা জীবন জ্ঞান সাধনার পেছনে বিলিয়ে দেওয়া মহান সাধকদের একজন হিসেবে উইল ডুরান্টের কাছ থেকে মহামানবদের গল্প শুনা সবসময়ই অনেক অনুপ্রেরণার।
২০. অসমাপ্ত আত্মজীবনী-শেখ মুজিবুর রহমান
বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে বড় চরিত্রটিকে নিয়ে একটি অসাধারণ বই। অবশ্য এক্ষেত্রে লেখক নিজেই নিজের বেড়ে উঠা, রাজনীতির জগতে প্রবেশের আলেখ্য এবং বিভিন্ন অভিজ্ঞতার গল্প তুলে এনেছেন। কিন্তু আফসোস থেকে যাবে এই কারণে যে মাত্র ৩৪ বছর অবধি (১৯৫৪ সাল) অভিজ্ঞতার কথা বর্ণিত হয়েছে। যদি আরও সময় পাওয়া যেতো হয়তো ১৯৭১ এ পৌছতে পারতেন। সেটা হলে একটি অসাধারণ কাজ হতো। কিন্তু আফসোস থাকলেও সন্তুষ্টি এই যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে লেখা কয়েক হাজার বইয়ের মধ্যে প্রথম সারিতে রাখার মতো বই পাওয়া গেল ।
*********************************************************************************
পড়তে পারেন দর্শনের যে ১০টি বই
দর্শন শুধু স্কুলে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ারই বিষয় নয় বা অল্প কতক পণ্ডিতের হাতের মোয়াই নয়। বরং এটা সমাজ ও সম্প্রদায়ের অভিজ্ঞতা ও যাপনের অংশ। প্রত্যেকটা সমাজ, দেশ বা সম্প্রদায়ের দর্শন রয়েছে সেটা নিজের হউক বা ধার করা হউক, শক্তিশালী হউক কিংবা দুর্বল হউক। কেউ দর্শন জানুক বা না জানুক দর্শন তাকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর সেটা যদি জানা যায় তাহলে ভালো নয় কি? কিভাবে পৃথিবী এখানটাতে এসেছে, কিভাবে এখন চলছে, ভবিষ্যতটা কেমন হতে পারে সেটা জানা বা জানার চেষ্টা মহান প্রচেষ্টা নয় কি?
দর্শন না জানলে আপনি নিজেকে শিক্ষিত লোক বলার লাইসেন্স হারান আসলে। দর্শন হলো সকল জ্ঞানকাণ্ডের মা বা সুতো। একে ঠিকমতো ধরতে পারলে জ্ঞানের অন্যান্য শাখায় দখল নেওয়া সহজ হয়ে যায়! এজন্য একজন পাঠককে সহজপাচ্য পড়াশুনা শেষ করে আরেকটু গভীরে যাওয়ার জন্য দর্শনের তরীতে সওয়ার হতে হবে। এখন কিভাবে সেই ভ্রমণটা শুরু করা যায় সেটা নবীন পাঠকের কাছে বিরাট প্রশ্ন আকারে হাজির হতে পারে।
বাংলাদেশ স্টাডি ফোরামের অনেক বন্ধু দর্শনের কোন কোন বইগুলো পড়ে যাত্রা শুরু করবে তার সাজেশন চেয়ে থাকে অহরহ। সর্বশেষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী ওয়ালি উল্লাহ বেশ জোর দাবি জানিয়ে আমাকে বললো যেন দর্শনের দশটা বইয়ের তালিকা করে দেই। সে দর্শন পড়া শুরু করতে চায়। দর্শনের ছাত্র হিসেবে এটা তো আমার জন্য অনেক আনন্দের বিষয় যে আরেকজন সহপাঠি পেয়ে যাচ্ছি। আমাদের সম্পর্ক তো এই ফিলসফি বা ‘জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা’র কারণেই! ওয়ালির মতো আরও কয়েকজনও দর্শনের বইয়ের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকার আবদার জানিয়েছিল বেশ কয়েকবার। সবার দাবির প্রতি সম্মান রেখে এখানে তাই সে ক্ষুদ্র প্রয়াসে হাত লাগাচ্ছি! লেখাটি পড়ার সময় এটা মনে রাখার অনুরোধ করবো কোন রূপ মুরব্বিয়ানার খায়েসে এটি লেখা হয়নি। দর্শনের জগতে আমার মতো নবীন পাঠকদের সহ-পথিক বা সহপাঠী হওয়ার আকাঙ্খাতে লেখা।
নিচে দশটি বইয়ের উল্লেখ রয়েছে যার মধ্যে কয়েকটা বইয়ের মাঝপথে এখনো আছি। কিন্তু যতটা এগিয়েছি বুঝতে পেরেছি আমার মতো অন্যান্য পাঠকের জন্যও বইগুলো কাজে দেবে।
১. সোফি’জ ওয়ার্ল্ড বা সোফির জগত- ইয়োস্তেন গার্ডার
পাশ্চাত্য দর্শনের জগতে প্রবেশের জন্য সবচেয়ে সহজ চয়েস হতে পারে এ বইটি। সারা বিশ্বে প্রায় বিশ মিলিয়ন কপি বিক্রি বলে দিচ্ছে বইটির জনপ্রিয়তার কথা।
১৪ থেকে ১৫ তে পা দিচ্ছে এমন মেয়ে সোফি স্কুল থেকে ফিরে দেখলো তার চিঠির বাক্সে তার জন্য দুটি চিঠি। প্রত্যেকটাতে একটি করে প্রশ্ন। একটাতে রয়েছে: ‘তুমি কে?’ আর অপরটাতে রয়েছে-‘পৃথিবী কোথা থেকে আসলো?’
এভাবে শুরু হলো একজন রহস্যময় দার্শনিকের সাথে পত্রবিনিময়। সেই রহস্যময় দার্শনিকের কাছ থেকে সে জানতে লাগলো সক্রেতিস থেকে একেবারে সার্ত্রে পর্যন্ত দর্শনের অভিযাত্রার কাহিনী।
বইটি মূলত একটি উপন্যাস। আছে থ্রিলার, সাসপেন্স ও রহস্যের সমাহার। মূলত শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা হলেও বড়রাই এর থেকে পুরো সুবিধা নিতে পারবে। দর্শনকে মানুষের কাছে সহজলভ্য ও সহজবোধ্য করার ক্ষেত্রে নরওয়ের লেখক ইয়োস্তেন গার্ডারের এই প্রয়াসকে সাধুবাদ জানানো উচিত সব পাঠকের! বইটির বাংলা অনুবাদ বাজারে পাওয়া যায়!
২. দ্য লিটল প্রিন্স-আন্তোন সেইন্ট দ্য এক্সিপেরি
গত শতকটি ছিল মানুষের আকাশে পাখা মেলার শতক। বিশ শতকের একেবারে প্রথমেই মানুষ প্রথমবারের মত মিলিয়ন বছরের আকাশে উড়ার স্বপ্ন সফল করে। বিমান আবিষ্কার মানবজাতির ইতিহাসে একটি অনন্য ঘটনা। যদিও দুটো বিশ্বযুদ্ধ এবং প্রতিনিয়ত চলতে থাকা বিভিন্ন যুদ্ধে বিভিন্ন মানুষের উপর হামলা চালানোর জন্য ব্যবহার হয়ে আসছে, দুটি পারমানবিক বিস্ফোরণের কাজে ব্যবহৃত হয়েছে কিন্তু বিমানের সাথে মানবজাতির মিলিয়ন বছরের আকাশে উড়ার স্বপ্ন বা স্মৃতি জড়িত রয়েছে। বিমানের মাধ্যমে আকাশে উড়ার প্রযুক্তি আসার সাথে সাথে তথ্য-প্রযুক্তি সেক্টর একটি বড় উল্লম্ফন দিয়েছে। খুব দ্রুতই এটা উন্নততর ও বৈচিত্র্যময় করার প্রচেষ্টা দেখা গেছে। এই বিমান চালু হওয়ার প্রথমদিকে যারা বিমান চালাতেন তারা ছিলেন সমকালের নায়ক। প্রথমদিকে বেশি বিমান দুর্ঘটনা হওয়ার কারণে বিমান চালনার পেশাতে যারা আসতেন তাদেরকে দু:সাহসী হিসেবেই দেখা হতো। এখনকার সময়ে মহাকাশে যারা কয়েকমাস বা বছরব্যাপী থাকেন তারা যেমন বড় তারকা হিসেবে স্বীকৃত হন তখন বিমানের পাইলটদের ব্যাপারটি এমন ছিল।
আন্তোন দে সেইন্ট এক্সিওপেরি হচ্ছেন প্রথমদিককার এমন একজন পাইলট। আর বিমান চালনা এবং আকাশযান বিষয়ক গল্প সমকালে বেশ জনপ্রিয় ছিল এখন যেমনটা সাইন্স ফিকশন এবং নভোজান বিষয়ক গল্প, সিনেমা জনপ্রিয়। দ্য লিটল প্রিন্স স্রেফ বিমান সম্পর্কিত গল্প হওয়ার কারণেই এত জনপ্রিয় নয়। এর সাথে রয়েছে দর্শন, কাব্য, রহস্য ও অভিযানের মসলা।
এই নভেলাটি ফরাসী ভাষায় সবচেয়ে বেশি পঠিত ও বেশি অনূদিত বই হিসেবে স্বীকৃত। এটা বিশ শতকে ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠ বই হিসেবেও নন্দিত। এটি একই সাথে নৈতিক অ্যালিগরি আবার আধ্যাত্মিক আত্মজীবনী। মোহনীয় বর্ণনায় আমরা দেখি কিভাবে একটি ছোট্ট ছেলে দূরের কোন গ্রহ থেকে পৃথিবীতে পতিত হয়। হিন্দি ‘পিকে’ মুভিটিতো দেখেছেন, তাই না? সেরকম আর কি। দূর কোন গ্রহ থেকে একজন এই পৃথিবীতে চলে এসেছে যে এই পৃথিবীর চালচলন কিছু বুঝে না। একজন বয়স্ক বৈমানিক তাকে বিভিন্ন রূপকে এই মানবসমাজের সাথে সেই ছোট্ট ছেলেটিকে পরিচিত করিয়ে দেয়। সেই ছোট্ট শিশুটি আমাদের ‘লিটল প্রিন্স’ যেন বড়দের দুনিয়া ও অভিজ্ঞতার জগতে অডেসিয়ান জার্নিটি দেন। মানবগোষ্ঠির জীবনে কি কি দার্শনিক অভিঘাত আসে এবং সেগুলোর দিকে কিভাবে দৃষ্টিপাত করতে হয় তার ইশারা আছে এই গ্রন্থে।
৩. এ ক্রিটিকাল হিস্ট্রি অব গ্রিক ফিলসফি- ডব্লিউ টি. স্টেইস
শুধু গ্রিক দর্শনের উপর দাঁত বসানোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বই এটি। স্টেইস ভিন্ন ভিন্ন ডিসিপ্লিন ও পেশার মানুষের সামনে গ্রিক দর্শনের উপর সিরিজ লেকচার দিয়েছিলেন। তারই ফল এ বইটি। এ কারণে বইটি পাঠকের কাছে সহজগম্য হবে। মোটামুটি ছোট সাইজের এ বইটি পড়ে পরিচিত হয়ে যেতে পারেন গ্রিক দর্শনের সাথে।
৪. হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলসফি-বাট্রার্ন্ড রাসেল
দর্শনের জগতে ঘুরে আসার জন্য একটি অসাধারণ বই। দর্শনের ইতিহাসের উপর আরও যে কয়েকটি বই ভালো লেগেছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো স্যামুয়েল ইনূচ স্টাম্ফের ‘সক্রেতিস টু সার্ত্রে: অ্যা হিস্ট্রি অব ফিলসফি’, ফ্রাঙ্ক থিলি’র ‘এ হিস্ট্রি অব ফিলসফি’ এবং উইল ডুরান্টের ‘দ্য স্টোরি অব ফিলসফি’। সময় ও সুযোগ থাকলে সবগুলোও পড়া যেতে পারে। তবে একটা দিয়ে যদি শুরু করতে চান তাহলে রাসেলকেই নিতে পারেন। ইংরেজি ভাষার একজন অসাধারণ গদ্যশিল্পী যে নিজেও একজন শক্তিশালী দার্শনিক তার কাছ থেকে তিন হাজার বছরের পাশ্চাত্য দর্শন ও দার্শনিকদের গল্প শুনা একটি সুখকর অভিজ্ঞতা হবে সেটা বলাই বাহুল্য। রাসেলের গদ্য যেমন পাঠককে টানবে এবং প্রত্যেক দার্শনিককে নিয়ে করা তার মন্তব্য আমাদেরকে দিক নির্দেশনা দেবে।
৫. এমিল অর অন এজুকেইশন -জ্যাঁ জ্যাক রুশো
শিক্ষা দর্শনের উপর রুশোর এ বইটি একটি অনন্য গ্রন্থ। রুশোর ভাষা ও ভাব প্রকাশভঙ্গি আলোচিত-সমালোচিত ও সমাদৃত কেন তার সাক্ষর পাওয়া যাবে এ বইটিতে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘দ্য সোসাল কনট্রাক্ট’ যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বই তেমনি পাশ্চাত্যে শিক্ষাদর্শনের আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ বই। তৎকালীন ফ্রান্সে একটি ফরাসী শিশু কি ভয়ানক উপায়ে শিক্ষাগ্রহণ করে, এবং তার উপর সেই ভুল ও দুর্বল শিক্ষা পদ্ধতির কি কি বাঁজে প্রভাব সারাজীবন তার সাথে থেকে যায় তার তীক্ষ্ণ বর্ণনা যেমন রয়েছে আবার কিভাবে একটি শিশুকে শিক্ষা দেওয়া উচিত তার সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা।
৬. এপলজি অব সক্রেতিস বা সক্রেতিসের জবানবন্দি-প্লাতো
সক্রেতিসের বাবা ছিলেন ভাস্কর আর মা ধাত্রী। সক্রেতিস পরবর্তী জীবনে মা-বাবার পেশাকে ধরে রেখেছেন বলে মনে করতেন। ধাত্রী যেমন কোন মানবশিশুকে পৃথিবীতে আসতে, জন্ম নিতে সহায়তা করতেন সক্রেতিসও তেমনি একজন জ্ঞানপিপাসুর জন্মের ক্ষেত্রে ধাত্রীর মতো ভূমিকা পালন করতেন। আবার একজন ভাস্কর যেমন কঠিন পাথরকে কেটেকুটে সুন্দর মূর্তির রূপ দেন তেমনি দার্শনিক ও মানবতার শিক্ষক সক্রেতিস ও একজন মানবশিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের ক্ষেত্রে নিপুণ ভাস্করের ভূমিকা পালন করেছেন। বৃক্ষ তোমার নাম কি? ফলে তার পরিচয়। এখন সক্রেতিস কেমন শিক্ষক ছিলেন তার প্রমাণ প্লাতো, অ্যারিস্তোতলদের মতো ওস্তাদদের পরম্পরা তৈরি করার মধ্যেই রয়েছে। তার প্রিয় এবং যোগ্যতম শিষ্য প্লাতোকে নিয়ে বলা হয়-‘পুরো পাশ্চাত্য দর্শন প্লাতোর ফুটনোট মাত্র’। প্লাতোর প্রত্যেকটি লেখাতে প্রধান চরিত্র হিসেবে থেকেছেন সক্রেতিস। মনে হচ্ছে যেন সক্রেতিস কথা বলছেন আর প্লাতো নোট লিখছেন। ব্যাপারটা কিন্তু এমন নয়। বয়স ত্রিশের দিকে গুরু সক্রেতিসের করুণ বিয়োগের ঘটনাটি এমনভাবেই তাড়িত করেছিল তরুণ প্লাতোকে যে সে তার পুরো জ্ঞানচর্চাকেই সক্রেতিসের পদতলে বিছিয়ে দিয়েছেন। ব্যাপারটা অনেক পরিষ্কার প্লাতো প্রথমদিকে হয়তো সক্রেতিসের দর্শনই সক্রেতিসের মুখ দিয়ে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু তার সেরা লেখাগুলোতে বা শেষদিকের লেখাগুলোতে নিজের দর্শন সক্রেতিসের মুখ দিয়ে বলিয়ে নিয়েছেন। সক্রেতিসের প্রতি তার একাত্ম আনুগত্য ও ভালোবাসার ব্যাপারে কোন প্রকার সন্দেহের লেষমাত্র নেই।
সক্রেতিসকে খুব কাছ থেকে বুঝতে হলে তার জবানবন্দি পড়তে পারেন। এর একাধিক বাংলা তর্জমা আছে। ইংরেজিতেও অনেকগুলো সংস্করণ আছে। যেকোন একটা পড়ে ফেলতে পারেন।
৭. অন দ্য শর্টনেস অব লাইফ- সেনেকা
আমরা পৃথিবীতে এমনভাবে জীবনধারণ করি যেন আমরা অমর, মৃত্যু মনে হয় আসবেই না। অথচ যে মুহূর্তটা একবার চলে গেল সেটা আর ফিরিয়ে আনা কখনোই সম্ভব না। এবং মৃত্যু ও চলে যাওয়া পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ট্রাজিক সত্য। এটা ট্রাজিক সত্য কারণ এই সত্যটা সবাই জানলেও ভুলে থাকে বা ভুলে যায়।
সেনেকার মতে-‘তুমি এমনভাবে সময় অপচয় করো যেনো তোমার অফুরান যোগান আছে। কিন্তু ব্যাপারটা হলো কোনদিন কাউকে যে সময়টা দিলে বা যে জন্য দিলে সেটা হয়তো তোমার শেষ সময়। মরণশীল প্রাণীর সব ভয় তোমাদের মধ্যে কিন্তু তোমাদের আকাঙ্খা এত যেন তোমরা মরবে না।’
যারা বিভিন্ন আকামে ব্যস্ত থাকে অথচ ভবিষ্যতে কোন একসময় ভালো কাজ করবে বা ৫০/৬০ বছরের পর অবসরে গিয়ে সকল ভালো কাজ করার পরিকল্পনা করে রাখে তাদেরকে ব্যাপক সমালোচনা করেছেন। তিনি প্রশ্ন করেন কিভাবে তারা নিশ্চিত যে ৫০ বছর বা ৬০ বছর বেঁচে থাকবে? সেনেকার মতে এমন মানুষদের লজ্জা পাওয়া উচিত। যে তার জীবনের সেরা সময়টাতে ভালো কাজ করতে পারে নাই সে শেষ জীবনে গিয়ে করে ফেলবে এটা ভাবা অহেতুক কল্পনাবিলাস নয় কি? সেনেকার কথা হচ্ছে যা কিছু করার আজই শুরু করতে হবে। ভবিষ্যতের জন্য ফেলে রাখার দরকার নেই।
জীবনের অর্থ খুজে পাওয়া বা কিভাবে বাঁচতে হয় এটা শিখতে অনেক কষ্ট হয়, এমনকি জীবন ফুরিয়ে যাওয়ার আগে অনুধাবন হয় যে আসলে সেরকম বাঁচতেই পারলাম না। অনেকে বেশি মানুষের উপর ক্ষমতাবান হওয়াকে জীবনের সফলতা মনে করে। এর একটা বড় গোলকধাঁধা হচ্ছে এই যে অনেকের কাছে পরিচিত হলেও দেখা যায় সে নিজের কাছে সবচেয়ে অপরিচিত। এজন্য অনেক খ্যাতিমান লোক দিন শেষে দেখে তার নিজের জন্য সময় বরাদ্ধ কত কম!
বেশিরভাগ মানুষের দিন কাটে অতীতের অনুশোচনা আর ভবিষ্যতের দুর্ভাবনা নিয়ে। কয়জন পারে আজকের দিনটাকেই শেষদিন মনে করে পূর্ণ করে বাঁচতে? আর অনেকের দিন কাটে ভবিষ্যতের ভালো সময়ের অপেক্ষা করে। সেনেকার প্রশ্ন ভবিষ্যতের কাছে দাবি-দাওয়া বা ভবিষ্যতের ভয় ছাড়া বর্তমানে বাঁচতে পারে কয়জন?
সময়ের অপচয় সেনেকা মেনে নিতে পারেন না। অন্য তুচ্ছ জিনিস নিয়ে বেশ সতর্ক হলেও এ ব্যাপারটাতে বেহিসাবী। সময়কে তুচ্ছ করে যারা অপচয় করে, অহেতুক কাজ করে বেড়ায় তারাই আবার যখন গভীর অসুস্থতায় পড়ে বা মৃত্যুমুখে পতিত হয় তারা ডাক্তার কবিরাজদের হাঁটুর নিচে পড়ে থাকে যেন আর কয়টা দিন বাঁচা যায়। বা কাউকে যখন মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয় তখন উকিল-মোক্তারদের পেছনে ভাই-বন্ধু, আত্মীয়-স্বজনদের দৌড়ানো দেখলেই বুঝা যায় একটি দিন বেঁচে থাকা গুরুত্বপূর্ণ, একটি দিন কত বড়! আবার এ লোকটিই হয়তো দিনের পর দিন দিন ক্ষয় করে গেছে, অন্যের জীবন যাপন করে গেছে আর নিজের কাছে অচেনা থেকে কাটিয়েছে।
অনেক বছর বাঁচলেই কেবল বড় মানুষ হওয়া যায় না। সেনেকা বলেন- ‘কারো ধূসর চুল আর কুচকে যাওয়া চামড়া দেখে ভেবো না সে অনেকদিন বেঁচেছে। সে আসলে অনেকদিন অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।’
৮. অন লিবার্টি- জন স্টুয়ার্ট
জন স্টুয়ার্ট মিলের ইউটিলিটারিয়ানিজম বা উপযোগবাদ বইটি সবচেয়ে বিখ্যাত হলেও ‘অন লিবার্টি’ আমার প্রিয় বইয়ের একটি। প্রথমবারের মতো দর্শনের যে বইটি পড়ে শেষ করেছিলাম এবং কয়েকমাস সাথে সাথে রাখতাম সেটি ছিল ‘অন লিবার্টি’। অনেকগুলো লাইন মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল এবং দর্শনের জগতে একেবারে টেনে হিচড়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এ বইটির ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। ১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইনের ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ এর প্রকাশের সালটিতেই প্রকাশিত হয়েছিল ‘অন লিবার্টি’। এবং সমকাল এবং উত্তরকালে প্রভাবের দিক থেকেও কম যায়নি ‘অন লিবার্টি’।
৯. চানক্যনীতি
আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশেই যে এক শক্তিশালী দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ছিলেন যার সাথে পরিচিত হওয়া এ অঞ্চলের প্রত্যেক শিক্ষার্থীরই অবশ্য কর্তব্য। পারিবারিক জীবন ব্যবস্থাপনা থেকে রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত মানুষের সম্ভাব্য যতগুলো দিক আছে তার প্রতিটির উপরই আলো ফেলেছেন এবং প্রাজ্ঞ পরামর্শ দিয়েছেন। চানক্যের সমরবিদ্যা চৈনিক সমরবিদ সান জুর তুলনায় কোন অংশে কম নয়। সান জুর মতো চানক্যের বেলাতেও বলা যায় ‘তুমি যদি চানক্যের পরামর্শ শুনো কোন ক্ষেত্রে পরাজিত হবে না আর যদি তার পরামর্শের অন্যথা করো তাহলে তোমার পরাজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না।’
১০. এ হিস্ট্রি অব ওয়েস্টার্ন ফিলসফি-রালফ ম্যাকলনার্নি
দর্শনের ইতিহাসের উপর নতুন হাতে আসা যে বইটি বেশ ভালো লাগছে সেটি হলো রাল্ফ ম্যাকলনার্নির এ বইটি। প্রায় সাড়ে আটশো পৃষ্ঠা প্রলম্বিত এই বইটির সবচেয়ে ভালো লাগার দিক হচ্ছে এর টসটসে ভাষা! ভাষা যেহেতু কোন বইয়ের জগতে প্রবেশের দরজা এ কারণে এ বইয়ে খুব সহজেই প্রবেশ করে ফেলতে পারবেন! সাইজ দেখে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। এক সপ্তাহ বা পনের দিন পড়ে যদিও এটা শেষ করতে পারা যায় তাহলে সেটা হবে একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা। বইটির বরাতে বেড়িয়ে আসতে পারবেন পাশ্চাত্য দর্শনের অন্দরমহলে এবং জেনে নিতে পারবেন এর হাড়ির খবর!
*********************************************************************************
মুজেস এন্ড মনোথিইজম-
সিগমুন্ড ফ্রয়েড
সিগমুন্ড ফ্রয়েডের এই ছোট্ট কেতাবটির প্রধান হাইপোথিসিস হচ্ছে মুসা ইহুদি ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন মিশরীয়। কোন সম্প্রদায়ের জীবনে যদি বড় কিছু ঘটতে যায় তাহলে ঐ সম্প্রদায় থেকেই নেতৃত্ব আসতে হয়। তাহলে প্রশ্ন জাগে ইহুদিদের জন্য একজন মিশরীয় লাগলো কেন? আবার কীভাবে সেই মিশরীয় ব্যক্তিটি সেই বিশৃঙ্খল জনতাকে জাতিতে রূপান্তর করেন?
মনে রাখতে হবে মুসা/মুজেস নামটি ভূৎপত্তিগতভাবে মিশরীয়। মুজেসের একেশ্বরবাদ নতুন ছিল না মিশরে। মুজেস যে নতুন ধর্ম নিয়ে আসলেন সেটা মুজেসের নতুন আবিষ্কার না। মিশরের অনেকগুলো ধর্মের মধ্যে সেটাও ছিল। যদিও সেটা মিশরের একমাত্র ধর্ম ছিলো না। অ্যামেনোফিস নামে মিশরীয় রাজা একেশ্বরবাদ প্রচলন করেছিলেন। কিন্তু ১৩৫৮ খ্রি.পূ. তার মৃত্যুর পর সেই ধর্মবিশ্বাস হারিয়ে যেতে থাকে। পরবর্তী ফারাওরা তার ইতিহাস মুছে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। তার সম্পর্কে জানা যায় সেই ফারাওয়ের বানানো একটি রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ, একটি সমাধিসৌধের মধ্যে লেখা কিছু কথা থেকে।
কোন ফারাও বা রাজার ইতিহাস রাজবংশ থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা মিশরীয় রাজ পরিবারে নতুন কিছু নয়। মিশরের প্রথম রাণী বা বিশ্বের প্রথম নারী রাষ্ট্রপ্রধান/ফারাও হাতেশপুৎ, রাণী নেফারতিতি থেকে শুরু করে ক্লিওপ্রেট্রার ইতিহাস মুছে দেওয়ার চেষ্টা চলেছে মিশরের রাজ পরিবারে।
একেশ্বরবাদী অ্যামেনোফিস বা আখনেটনের উত্তরসূরী মুজেস বা মুসা। সেই অ্যামেনোফিস বা আখনেটন কি ইউনূস বা জোনাহ সেটা ভাবনার বিষয়।
মুজেস তার অনুসারীদের জন্য খৎনা প্রথা চালু করেন নিজের অনুসারীদের জন্য। অবশ্য মিশরীয়রা অনেক আগে থেকেই নাকি এ প্রথা অনুসরণ করতো। অবশ্য খৎনা প্রথা চালু হয় আব্রাহামের সময় থেকে। ঈশ্বরের সাথে একটি চুক্তির ফলশ্রুতিতে আব্রাহাম এই প্রথার সূচনা করেছিলেন। মিশরীয়রা সেটা অনুসরণ করতো। হয়তো ইতিহাসের কোন এক পর্যায়ে আব্রাহামিক রীতি ও ধর্মাচার মিশরীয়দের মধ্যে প্রবেশ করেছিল। ইতিহাসের জনক হিসেবে পরিচিত হিরোডোটাস ৪৫০ খ্রি.পূ. মিশর ভ্রমণ করেছিলাম। মিশরীয়দের নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ লিখে যান। মিশরীয়দের ধর্মচর্চা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির আধিক্য নিয়ে কথা বলেন হিরোডোটাস। হিরোডোটাস ও মিশরীয়দের খৎনা প্রথা নিয়ে কথা বলেন। মিশরীয়রা নাকি ভারতীয়দের মতো গরুকে অনেক সম্মান করতো। গোহত্যা মিশরেও নিষিদ্ধ ছিলো কারণ এতে শিং ওয়ালী দেবী আইসিসের অপমান বলে ধরা হতো।
মুজেস এর উচ্চাকাঙ্খা নিয়ে লিজেন্ডে তার ছোটবেলার কথা বর্ণিত আছে। তখন তার বয়স তিন। ফারাওয়ের কোলে খেলছিলেন মুজেস। শিশুদেরকে শূন্যে নিক্ষেপ করার খেলা খেলছিলেন ফারাও। যখন উপরের দিকে নিক্ষেপ করা হয় মুজেস নাকি ফারাওয়ের মাথা থেকে মুকুট ছিনিয়ে নেয় এবং সেটা নিজের মাথায় পরে ফেলে! পরবর্তীতে ফারাও তার জ্যোতিষিদের কাছে বিষয়টির ব্যাখ্যা চান।
বিশ্বের বেশিরভাগ মহামানব, কোন সম্প্রদায় বা গোষ্ঠির নেতাদের কিছু ব্যক্তিগত দুর্বলতার উপস্থিতির মতো মুজেসেরও কিছু সমস্যা ছিল। তিনি তোতলা ছিলেন, কথা বলতে সমস্যা হতো তার কথা কুরআনেও বর্ণিত আছে। এ নিয়ে একটি দোয়া তো মুসলমান ছাত্রদের কাছে অনেক জনপ্রিয়। কথায় সমস্যার কারণে ফারাওয়ের সম্মুখে কথা বলার জন্য তাকে ভাই অ্যারন বা হারুনের সহায়তা নিতে হতো।
আরেকটি সমস্যা ছিল সেটা হলো তিনি ছিলেন খুবই বদরাগী। রাগের মাথায় ঘুষি দিয়ে একজনকে মেরে ফেলেছিলেন। আবার নিজ অনুসারীদের উপর রাগ করে নাকি ঐশী নির্দেশনা সম্বলিত পাথরখণ্ডগুলো ভেঙ্গে ফেলেছিলেন। এতে ঈশ্বর নাকি তাকে একটি কঠোর শাস্তি দিয়েছিলেন। অবশ্য ইহুদি লিটারেচারে এ নিয়ে বিস্তারিত লেখা নেই। কারণ একটি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতার নেতিবাচক খবর প্রকাশ করতে আগ্রহী না হওয়াই ওই সম্প্রদায়ের কাছে স্বাভাবিক হিসেবে গণ্য।
তাকে ঈর্ষাপরায়ন, কঠোর ও নির্মম হিসেবে দেখানো হয়েছে কিছু কিছু জায়গায়। বিশাল একটি বিশৃঙ্খল জনতাকে জাতিতে রূপান্তরিত করা, ক্ষমতায়িত করার জন্য কওমের নেতা হিসেবে তার মধ্যে এ গুণগুলোর উপস্থিতি থাকা অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়।
তথসূত্র:
মুজেস এন্ড মনোথিইজম
সিগমুন্ড ফ্রয়েড
*********************************************************************************
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর
‘রাফকাট’
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ভেতর ও বাহিরটা বুঝার জন্য ‘রাফকাট’ বইটি কাজে আসবে নিঃসন্দেহে। গতকাল শুরু করে আজ সকালে এসে শেষ হলো এই ঢাউস সাইজের বইটি। আমাদের সময়ের মিডিয়া ও ফিল্ম জগতের শ্রেষ্ঠ সন্তানটিকে জানা, তার সংগ্রাম এবং স্বপ্নের সাথে পরিচিত হওয়া বেশ উপভোগ্য ঘটনা। বইটিতে রয়েছে ফারুকীর একটি দীর্ঘ সাক্ষাতকার, কিছু কবিতা, একটি ছোট গল্প, কয়েকটি প্রবন্ধ এবং তার অনেকগুলো ছবি। সাক্ষাতকার নিয়েছেন সাংবাদিক সাজ্জাদ হুসাইন। বইটি ‘ঐতিহ্য’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে।সমকালের বড় শিল্পীদের অনেক সময়ই চিনতে ভুল করা হয়। এটা ঘটে সমকালকে ছাপিয়ে ব্যক্তির অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার কারণে। আবার প্রস্তুত সময় তার শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের বরমাল্য দিয়ে ভূষিত করতেও সমর্থ হয়। শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাসে আমরা দুটিই দেখি। কেউ কেউ তার সময়েই তার অবস্থান ঘোষণা করে যেতে পেরেছেন। আবার কারো কারো কাজ উপযুক্ত অডিয়েন্স পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে।
মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সাথে সাথে এটা আমাদেরও সৌভাগ্য তিনি তার সময়ে, আমাদের সময়ে তার অবস্থান শক্তভাবে জানাতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশের সিনেমা জগতকে দেশীয় পরিমণ্ডল ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে নিয়ে যাওয়ার পাইওনিয়ার হিসেবে তাকে শ্রদ্ধার আসনে রাখবে বর্তমান ও ভবিষ্যতের নির্মাতারা।
বলতে কেমন শুনায় আমি মাত্র গতবছর মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর প্রায় সবগুলো সিনেমা দেখে শেষ করেছি! টিভি নাটক সবগুলো না দেখলেও কয়েকটা দেখেছি। কিন্তু পুরো ছবি একটাও দেখার সৌভাগ্য হয়নি। গতবছর তার কিছু ইন্টারভ্যু পড়ে ছবিগুলোর দিকে বেশ আগ্রহী হলাম। প্রত্যেকটা ছবিই আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছে এবং একেকটা থেকে অন্যটাতে যাওয়ার মাঝখানে যে বাংলা সিনেমার উন্নতি সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। অনুশোচনা বলবো না কারণ জীবনে কোন অনুশোচনা রাখতে চাই না তবে একটু কষ্ট ছিল যে পত্রিকার সমালোচনা বা রিভিয়্যু পড়ে অপিনিয়ন তৈরি করে রাখা নিঃসন্দেহে বড় ভুল ছিল। এ ভুল কাটিয়ে উঠতে পেরেছি বলে মনে করছি। যা দেখবো নিজের চক্ষু-মন দিয়ে দেখবো, যা বলবো নিজের চিন্তা দিয়েই বলবো।
ফারুকীর একটা ছোট্ট কবিতা আমার বেশ ভালো লেগেছে। কবিতাটির নাম ‘প্রতিধ্বনি’। কথাগুলো হচ্ছে এমন-
আমি বলি
‘একটা প্রেম দাও।’
প্রতিধ্বনি ফিরে আসে
‘একটা ফ্রেম দাও।’
ফ্রেমের সাথে তার প্রেমের সাক্ষর যেন এই ছোট্ট কবিতাটি। তিনি তার এ সম্পর্কে অটল থাকুন আমাদের এই প্রত্যাশা।
তার একটি কবিতা ‘ভাত-কাক সম্পর্ক’ পাঠককে ভাবাবে। নারী-পুরুষের সম্পর্ককে ভাত-কাকের সম্পর্কের সাথে মেশানোর মেটাফরটা আকর্ষনীয় হয়েছে।
ফারুকীর চোখ-মুখ যীশু খ্রিস্টের মতো। কথা বলেছেনও যীশুর মতো অনেক উদাহরণ দিয়ে, প্যারাবল মিশিয়ে, সমাজের সচল ভাষায়-প্রমিত নামী কোন অচল ভাষায় নয়। ভাষা নিয়ে তার সরল কথা-‘ভাষা কোন স্মৃতিসৌধের বেদির মতো অটল এবং স্থির নয়। ভাষা বহতা নদীর মতো-’
বইয়ের ব্যাক কভারে লেখা- ‘এই বইয়ে তাঁর শৈশব, কর্ম, কর্ম প্রেরণা, প্রেম, দাম্পত্য জীবন, রাজনৈতিকতাবোধ, ধর্মদর্শন, ভাষাতাত্ত্বিক বিতর্কসহ ব্যক্তিচরিত্রের বিভিন্ন দিক প্রতিফলিত হয়েছে।’
পড়া শেষ করে যথার্থই মনে হলো।
উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন
*********************************************************************************
সমাজ বদলে দেয়া ৯টি বই
প্রত্যেকটা সমাজেই সংস্কারক এবং পন্ডিত ব্যাক্তিত্বের প্রবল প্রতাপ এবং প্রভাব আমরা দেখি মানুষের ইতিহাসের দিকে তাকালে । যুগে যুগে সকল সমাজেই বিপ্লবী পরিবর্তন সাধন করেছেন কয়েকজনমাত্র চিন্তাশীল মানুষ। সেসব বিপ্লবী চিন্তাশীলদের সমকালীন বিখ্যাত চিন্তাগুলো যেসব বইয়ে ধারন করেছিলেন সে বইগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করছি। আমাদের বর্তমান সমাজও ইচ্ছা করলে প্রয়োজনীয় চিন্তার খোরাক নিতে পারে আলোচ্য বইগুলো থেকে।
১. রিপাবলিক – প্লেটো
‘রিপাবলিক’ গ্রিক দার্শনিক প্লেটো রচিত এক অমর গ্রন্থ। রাষ্ট্রচিন্তার জগতের যে কজন ক্ষণজন্মা মনীষী অবদান রেখেছেন , তাদের মধ্যে মহামতি প্লেটো ছিলেন অন্যতম । এ গ্রন্থটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এর অনুপম রচনা সৌন্দর্য ভাষা মাধুর্য ।
এতে রাজনীতির সাথে দর্শনের সমন্বয় ঘটেছে । সমগ্র ‘দি রিপাবলিক’ রচনাটি দশটি ভাগে বিভক্ত। এর আলোচ্য বিষয় রাষ্ট্র গঠনের উপাদান , সমৃদ্ধ রাষ্ট্র , অভিভাবকদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য , শাসক বাছাই: তিন শ্রেণির পারস্পরিক সম্পর্ক। নারী ও পুরুষে সমতা , যৌথ পরিবার , গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্রী , চরিত্র ও বিবাহ , দার্শনিক শাসক: দার্শনিকের সংজ্ঞা, দার্শনিক-শাসকের শিক্ষা , জ্ঞানের চারটি স্তর , স্বৈরতন্ত্র এবং স্বৈরতান্ত্রিক চরিত্র ।
প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের রূপরেখা প্রণয়ন করেন এই বইয়ে এবং একজন আদর্শ শাসকের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন ।
প্রকৃতপক্ষে উত্তম জীবন উত্তম মানুষের নিয়েই দি রিপাবলিক মূল আলোচনা । এ যেন রাষ্ট্র পরিচালনার এক বিরাট পরিকল্পনা । প্লেটোর ‘দি রিপাবলিক’ মানুষের বাস্তব সমস্যা পর্যবেক্ষণ , অনুধাবন এবং চিহ্নিতকরনের প্রদ্ধতি অবলম্বন রচিত । এ দিক থেকে বিচার করলে অতি অল্প গ্রন্থ-ই ‘দি রিপাবলিকের’ সাথে তুলনীয় ।
প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্রের রূপরেখা প্রণয়ন করেন এই বইয়ে এবং একজন আদর্শ শাসকের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন ।
প্রকৃতপক্ষে উত্তম জীবন উত্তম মানুষের নিয়েই দি রিপাবলিক মূল আলোচনা । এ যেন রাষ্ট্র পরিচালনার এক বিরাট পরিকল্পনা । প্লেটোর ‘দি রিপাবলিক’ মানুষের বাস্তব সমস্যা পর্যবেক্ষণ , অনুধাবন এবং চিহ্নিতকরনের প্রদ্ধতি অবলম্বন রচিত । এ দিক থেকে বিচার করলে অতি অল্প গ্রন্থ-ই ‘দি রিপাবলিকের’ সাথে তুলনীয় ।
২. পলিটিক্স – এরিস্টটল
এরিস্টটলের বিখ্যাত একটি পুস্তক হলো ‘পলিটিক্স’ । এখানে তিনি সরকার , শাসক , শাসন পদ্ধতি , গণতন্ত্র , দাসপ্রথা , আদর্শ রাষ্ট্র , সংবিধান বিষয়ক আলোচনা করেছেন । যা পরবর্তীতে বহু বছর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের শাসকগন অনুসরণ করে এসেছেন ।এরিস্টটল জীবের জীবনের সঙ্গে রাজনৈতিক জীবনের গুণগত পার্থক্য এত পরিচ্ছন্নভাবে এঁকেছেন যে জীবের জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা আর রাজনৈতিক অচ্চিত্বের পার্থক্য হচ্ছে মানুষ জীবন নিয়ে জন্ম গ্রহণ করে কিন্তু অস্তিত্ব যাপন করে আসলে পরম ইষ্টে’। পরম ইষ্টে অচ্চিত্ব যাপনের পরম পরিণতি নগর-রাষ্ট্র। এটি এরিস্টটলের পলিটিক্স গ্রন্থের একটি প্রখ্যাত উক্তি।
একই গ্রন্থে তাঁর বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে, ‘মানুষ রাজনৈতিক জীব’। মানুষ জীব নয়, জীবের সঙ্গে তার পার্থক্যের জায়গা হচ্ছে জীব রাজনৈতিক নয়, কিন্তু মানুষ রাজনৈতিক। জীবের জীবন তার মনুষ্যত্বের সত্য নয়, তার সত্য রাজনৈতিকতায়। প্রজাতি হিসেবে জীবের সঙ্গে তার পার্থক্যের জায়গাও এখানে। মানুষের এই পার্থক্য নির্ণয়ের পরেই কেবল তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে মানুষের রাজনীতি গঠিত হয় রাজনৈতিকতার আরেকটি গুণ দিয়ে, সেটা হচ্ছে ভাষা। মানুষ ভাষাসম্পন্ন প্রাণী। অতএব জীবের মতো শুধু জীবের আরাম ও বেদনার মধ্যে মানুষের জীবন সংকীর্ণ নয় বরং ভাষার মধ্যে গড়ে ওঠে ‘ভালো’ ও মন্দ সংক্রান্ত ধারণা এবং অন্যায় ও ইনসাফ ইত্যাদির মধ্যে দিয়ে মানুষের রাজনৈতিক জগৎ বা রাজনৈতিক পরিমণ্ডল গড়ে ওঠে। জীবের জীবনের সঙ্গে মানুষের জীবনের পার্থক্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
৩. আল কানুন ফিত তিব – ইবনে সিনা
ইবনে সিনা ইসলামী সভ্যতার স্বর্ণযুগের চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন। চিকিৎসাবিদ্যায় তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে, ‘আল কানুন ফিত তিব’। এতো নির্ভরযোগ্য কোনো গ্রন্থ সে সময় অন্তত চিকিৎসাশাস্ত্রে ছিল না। এই বইটি অনূদিত হবার পর পশ্চিমারা ব্যাপকভাবে বইটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এবং তাদের চিকিৎসা সংক্রান্ত বিদ্যালয় মহাবিদ্যালয়গুলোতে বইটিকে পাঠ্য করে দেয়।
গ্রিক চিকিৎসাবিদ জালিনূসের বই যেসব ইউরোপীয় চিকিৎসকদের কাছে দুবোর্ধ্য ছিল তাঁরাও ইবনে সিনার কানুন গ্রন্থটির শরণাপন্ন হন। এর একটি কারণ ছিলো ইবনে সিনা তাঁর কানুন গ্রেথে জালিনূসের দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকেও বিশ্লেষণ করেছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে কানুন গ্রন্থটির বেশিরভাগ অনুবাদ হয়েছিল খৃষ্টীয় ষোল শতকে।
মুসলিম বিশ্বে তার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। মধ্যযুগীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের ভিত রচনায় তার অবদান অনস্বীকার্য। তার মূল অবদান ছিল চিকিৎসা শাস্ত্রে। তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রের বিশ্বকোষ ‘আল-কানুন ফিত-তীব’ রচনা করেন যা ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্তও প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল প্রতিষ্ঠানসমূহে পাঠ ছিল।
৪. মুকাদ্দিমাহ – ইবনে খালদুন
১৩৭৭ সালে তিউনিসিয়ান মুসলিম দার্শনিক ও ইতিহাসবেত্ত্বা ইবনে খালদুন তার প্রখ্যাত গ্রন্থ “মুকাদ্দিমাহ” রচনা শুরু করেন। মুকাদ্দিমাহকে সমাজ বিজ্ঞান, ইতিহাসের দর্শন আর সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ওপর লেখা প্রথম গ্রন্থ হিসাবে স্বীকৃতি দেন অনেকেই। ইবনে খালদুন মুকাদ্দিমাহ’তে উত্থাপন করে বসেন এক বৈপ্লবিক বক্তব্য। তিনি বলেন, রাজা রাজড়ার কীর্তিকলাপ বর্ণনা করাই নাকি ইতিহাসের মূল লক্ষ্য না, বরং মানবসভ্যতার বিকাশ আর পরিবর্তনের সঠিক চিত্র তুলে ধরাই ইতিহাস চর্চার আসল কাজ। খালদুনের সময়ে নতুন এবং বৈপ্লবিক এই বক্তব্য এখন এই আমাদের সময়ের স্বীকৃত সত্য। অবশ্য যেই দেশে পাঁচ বছর পর পর ঘটা করে ইতিহাস বদলের প্রতিযোগিতা হয় সেই দেশে এই সত্য অনুধাবন করা দূরুহ বটে। ইতিহাস চর্চা আমাদের দেশে রাজনীতির স্বার্থ সংশ্লিষ্ট, যার কাজ মানুষকে কেটে কুটে বিচ্ছিন্ন করা। কাল নিরপেক্ষ মানব জাতি দূরে থাক, এই কাটাছেড়ায় সমকালিন মানুষ হওয়াই বেজায় কঠিন।
৫. দ্য প্রিন্স – নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি
নিকোলো ম্যাকিয়াভেলির খ্যাতি মূলত ‘দ্য প্রিন্স (The Prince)’ বইটির জন্য। এটি অত্যন্ত সুলিখিত ও দার্শনিক রচনাবলির মধ্যে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে সহজপাঠ্য। ‘The Prince’ গ্রন্থকে একজন রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য একটি পাঠ্যবই হিসেবে বর্ণনা করা চলে। এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে, রাষ্ট্র পরিচালনায় সাফল্যের জন্য একজন প্রশাসককে নৈতিক মূল্যবোধ সম্পূর্ণ বিসর্জন দিতে হবে এবং নির্ভর করতে হবে শক্তি ও কৌশলের ওপর। ম্যাকিয়াভেলি সর্বাধিক গুরুত্ব দেন সামরিক প্রস্তুতির ওপর। তার মতে, রাষ্ট্রের নিজস্ব নাগরিকদের মধ্য থেকে সংগৃহীত সেনাবাহিনীই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য। ভাড়াটে সৈন্যদের ওপর নির্ভরশীল রাষ্ট্র দুর্বল ও বিপদাপন্ন।
ম্যাকিয়াভেলি শাসককে জনগণের সমর্থন লাভের পরামর্শ দেন। না হলে বিপদকালে তাঁর কোনো অবলম্বনই থাকবে না। তিনি অবশ্যই স্বীকার করেন, নতুন শাসককে ক্ষমতা সুদৃঢ় করার জন্য কোনো বিজেতার পক্ষে তাঁর নিষ্ঠুর কাজগুলো একভাবে করে ফেলাই ভালো। যেন সেগুলো বারবার করতে না হয়।
‘The Prince’ গ্রন্থকে প্রায়ই একনায়কদের নির্দেশিকা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু ম্যাকিয়াভেলির জীবনের ঘটনাবলি ও তাঁর অন্যান্য লেখা থেকে বোঝা যায় তিনি একনায়কত্ব থেকে প্রজাতন্ত্রকেই বেশি পছন্দ করতেন। তবে ইতালির রাজনৈতিক ও সামরিক দুর্বলতায় তিনি হতভম্ব হয়েছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন এমন একজন শক্তিশালী শাসক, যিনি বিদেশিদের শোষণ ও অত্যাচার থেকে মুক্ত করে জাতীয় ঐক্যকে সংহত করবেন। লক্ষ করার বিষয়, ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্রনায়ককে নীতিহীন ও নির্মম বাস্তববাদী হতে পরামর্শ দিয়েছেন, কিন্তু তিনি ছিলেন আদর্শবাদী ও দেশপ্রেমিক। যেসব কলাকৌশল তিনি অপরকে শিখিয়েছেন, নিজে কিন্তু সেগুলো তেমন আয়ত্ত করতে পারেননি। ম্যাকিয়াভেলির মতো খুব কম রাজনৈতিক দার্শনিকই এমন কঠোরভাবে নিন্দিত হয়েছেন। বহুকাল ধরে তিনি এমনভাবে চিত্রিত হয়েছেন যেন সাক্ষাৎ শয়তান। তাঁর নাম শঠতা ও কপটতার প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
রাজনৈতিক তত্ত্ব যে আজকাল যে অনেক বেশি বাস্তববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচিত হয়, তাঁর অনেকটা ম্যাকিয়াভেলির প্রভাবের কারণেই। যে কারণে তাঁকে
আধুনিক রাষ্ট্রের চিন্তাধারায় অন্যতম প্রধান প্রবর্তক বলে গণ্য করা হয়।
‘The Prince’ গ্রন্থকে প্রায়ই একনায়কদের নির্দেশিকা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু ম্যাকিয়াভেলির জীবনের ঘটনাবলি ও তাঁর অন্যান্য লেখা থেকে বোঝা যায় তিনি একনায়কত্ব থেকে প্রজাতন্ত্রকেই বেশি পছন্দ করতেন। তবে ইতালির রাজনৈতিক ও সামরিক দুর্বলতায় তিনি হতভম্ব হয়েছিলেন। তিনি চাচ্ছিলেন এমন একজন শক্তিশালী শাসক, যিনি বিদেশিদের শোষণ ও অত্যাচার থেকে মুক্ত করে জাতীয় ঐক্যকে সংহত করবেন। লক্ষ করার বিষয়, ম্যাকিয়াভেলি রাষ্ট্রনায়ককে নীতিহীন ও নির্মম বাস্তববাদী হতে পরামর্শ দিয়েছেন, কিন্তু তিনি ছিলেন আদর্শবাদী ও দেশপ্রেমিক। যেসব কলাকৌশল তিনি অপরকে শিখিয়েছেন, নিজে কিন্তু সেগুলো তেমন আয়ত্ত করতে পারেননি। ম্যাকিয়াভেলির মতো খুব কম রাজনৈতিক দার্শনিকই এমন কঠোরভাবে নিন্দিত হয়েছেন। বহুকাল ধরে তিনি এমনভাবে চিত্রিত হয়েছেন যেন সাক্ষাৎ শয়তান। তাঁর নাম শঠতা ও কপটতার প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
রাজনৈতিক তত্ত্ব যে আজকাল যে অনেক বেশি বাস্তববাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচিত হয়, তাঁর অনেকটা ম্যাকিয়াভেলির প্রভাবের কারণেই। যে কারণে তাঁকে
আধুনিক রাষ্ট্রের চিন্তাধারায় অন্যতম প্রধান প্রবর্তক বলে গণ্য করা হয়।
৬. সোস্যাল কন্ট্রাক্ট – রুঁসো
দার্শনিক রুঁসো (Rousseau, ১৭১২-১৭৭৮) রচনা করেছিলেন ‘সামাজিক চুক্তি (Social Contract)’। যেখানে তিনি বলেন- মানুষ জন্ম নেয় মুক্ত হয়ে, কিন্তু জন্মের পর দেখে চারিদিকে শুধু বাঁধার শেঁকল । এ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে বলেছেন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার কথা, যে আইন হবে সকল মানুষের নিজেদের তৈরী আইন- এক ধরণের সামাজিক চুক্তি। রুঁসো সমাজতন্ত্রের কথা সরাসরি না বললেও তাঁর লেখায় ছিল নিপীড়িত মানুষদের মুক্তির কথা। যে কারণে ফরাসী বিপ্লব যদিও রুঁসোর মৃত্যুর প্রায় দশ বছর পর সংঘঠিত হয়, তারপরও ফরাসী বিপ্লবে রুঁসোর দর্শনের অবদান ছিল বলে ধারণা করা হয়।
রুসোর মতবাদ প্রাকৃতিক সাম্য ধারনার উপর নির্ভরশীল, যেখানে মানুষ মাত্রই সমান, স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং তৃপ্ত। মানবিক জ্ঞানের উন্নতি এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবের ফলে শ্রমের শ্রেণীবিভক্তি সুচিত হয় এবং মানব জাতির প্রাকৃতিক সুখকর অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে ধনী-দরিদ্র বিভাজন সৃষ্টিকরে, পরিনতিতে রাষ্ট্রিয় সমাজ অত্যাবশ্যক হয়ে যায়।
রুশো বলেন,
রুসোর মতবাদ প্রাকৃতিক সাম্য ধারনার উপর নির্ভরশীল, যেখানে মানুষ মাত্রই সমান, স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং তৃপ্ত। মানবিক জ্ঞানের উন্নতি এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভবের ফলে শ্রমের শ্রেণীবিভক্তি সুচিত হয় এবং মানব জাতির প্রাকৃতিক সুখকর অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে ধনী-দরিদ্র বিভাজন সৃষ্টিকরে, পরিনতিতে রাষ্ট্রিয় সমাজ অত্যাবশ্যক হয়ে যায়।
রুশো বলেন,
“সমাজ গঠনের এমন একটা আদর্শ থাকতে হবে যাতে সমাজভুক্ত সকল ব্যক্তির জীবন ও সম্পদ সমাবেত শক্তির সাহায্যে নিরাপদ ও সুরক্ষিত থাকবে এবং প্রত্যেকে পরস্পরের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় আপন আদেশই পালন করবে ও আগের মতই স্বাধীন থাকবে”।
ফলত সামাজিক চুক্তি বিকশিত হয়। এ চুক্তি কেনো নিরঙ্কুশ শাসক তৈরি করে না। প্রত্যেক ব্যক্তি তার সমস্ত অধিকারকে সামাজিক চুক্তির দ্বারা সমষ্টির নিকট সমুদয় ভাবে সমর্পণ করে। আবার সকল নাগরিক একটা সার্বভৌম কাঠামোর সমান অধিকারী হিসাবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তার অধীনে তা পুনরায় লাভ করে। প্রত্যেকে নিজেদেরকে সমার্পন করবে অথচ ব্যক্তিগতভাবে কারো কাছে নত হবে না। ক্ষমতা এখানে ব্যক্তিবিশেষের নয়, পরস্পরের।
এই বইয়ের কিছু বিখ্যাত উক্তি
Man is born free, and everywhere he is in chains.
The Sovereign, having no force other than the legislative power, acts only by means of the laws; and the laws being solely the authentic acts of the general will, the Sovereign cannot act save when the people is assembled.
Every law the people have not ratified in person is null and void — is, in fact, not a law.
The legislative power belongs to the people, and can belong to it alone
৭. অন দ্যা অরিজিন অব স্পেসিস -চার্লস ডারউইন
ডারউইনের বিখ্যাত বই ‘অন দ্যা অরিজিন অব স্পেসিস (On the Origin of Species)’ বইটি ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হয় । বিবর্তনের সেই বিখ্যাত মতবাদের কারনে বহুল আলোচিত এই বইটি ।
৮. দাস ক্যাপিটাল – কার্ল মার্ক্স
জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্ক্স তাঁর মার্ক্সবাদী দর্শনের ভিত রচনা করেছিলেন এই বইটিতে । দুনিয়া তোলপার করা তাঁর দার্শনিক তত্ত্বে একাত্ব হয়ে কত তরুন হয়েছে বিপ্লবী , কত নগর হয়েছে পুঁজিবাদী থেকে সমাজতন্ত্রে রূপান্তর, তার ইয়াত্ত্বা নেই । ‘দাস ক্যাপিটাল’ (জার্মান Das Kapital; ইংরেজি Capital; বাংলায়- পুঁজি) কার্ল মার্ক্সের লেখা পুজিঁবাদের সমালোচনামূলক একটি বই। সমাজ প্রগতির সাথে অর্থনীতির জটিল সর্ম্পক মার্ক্সবাদের প্রধান অংশ। সামাজিক ইতিহাসের ব্যাখ্যায় মার্ক্স দেখিয়েছেন, যে কোনো ঐতিহাসিক যুগ সমকালীন পণ্য-উৎপাদন ব্যবস্থার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। উৎপাদন ব্যবস্থা বলতে মার্ক্স সাধারণভাবে উৎপাদন প্রসঙ্গ তোলেননি। মার্ক্স জোর দিয়েছেন উৎপাদন সর্ম্পকের উপর — যার অর্থ, ‘উৎপাদন ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে সামাজিক মানুষ পরস্পরের সংগে যে সর্ম্পক গড়ে তোলে’।
দাস ক্যাপিটালের প্রথম খণ্ডে মার্ক্স পুঁজিবাদী সমাজে উৎপাদন প্রণালীর বিশ্লেষণ করেছেন। ধনতান্ত্রিক সমাজে বাজারে বিক্রয়ার্থ পণ্যদ্রব্যের দুটি চেহারা দেখতে পাওয়া যায়। একটিতে তার ব্যবহারিক মূল্য প্রকাশ পায়, অপরটিতে বিনিময় মূল্য।
দাস ক্যাপিটালের ২য় খণ্ডের উপনাম ‘পুঁজির সঞ্চালন প্রক্রিয়া’। এখানে মার্ক্স ধনতান্ত্রিক অর্থনীতিতে পুঁজির গতিবিধি, আবর্তন, নিয়োজিত পুঁজির পণ্যে রূপান্তর ও পরিশেষে বাজার-পদ্ধতির মধ্যে বিনিময় ব্যবস্থায় বিভিন্ন পণ্যের উত্পাদন ও মূল্যমানের মধ্যে ভারসাম্য-অবস্থায় সরল পুনরুৎপাদন পদ্ধতির প্রচলন, ইত্যাদি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছেন।
এখানে মার্ক্স বিশেষ বিশেষ মূল্যমানের প্রশ্ন, পুঁজির মুনাফার হার ও উদ্বৃত্ত (surplus) মূল্যের বিভাজন থেকে প্রাপ্ত মুনাফার কথা বলেছেন। মার্ক্স দেখিয়েছেন, পণ্যোৎপাদনে পুঁজির মালিকের ব্যয়ের পরিমাণ ও পণ্যের যথার্থ উৎপাদন ব্যয় সমান নয়।
৯. ওয়েলথ্ অফ নেশনস – এডাম স্মিথ
আধুনিক অর্থনীতির জনক এডাম স্মিথ রচিত এ বইটির নাম ‘ওয়েলথ্ অফ নেশনস’। ১৭৭৬ সালে ক্ল্যাসিকাল অর্থনীতির উপর লিখিত এই বইটি ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লবের সহায়ক হিসেবে কাজ করে এরপর ধীরেধীরে ইউরোপের অর্থনৈতিক বিকাশে মূখ্যভূমিকা রাখে এই বইটি ।
তথ্যসূত্র :
১. পাশ্চাত্য দর্শন – ড আমিনুল ইসলাম
২. পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিবৃত্ত – ড আব্দুল হাই তালুকদার
৩. উইকিপিডিয়া
২. পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিবৃত্ত – ড আব্দুল হাই তালুকদার
৩. উইকিপিডিয়া
উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন
*********************************************************************************
ম্যাক্সিম গোর্কীর ‘মা’
সবাই যেদিন ব্যাস্ত থাকবে মানবতার সমাধিতে সেদিন ও একজন কে পাওয়া যাবে যার মাধ্যমে জয় হবে মানবতার, জাগ্রত হবে মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসার। তুলনা করছিলাম ম্যাক্সিম গোর্কীর “মা” এর সাথে আমার মা কে। উপন্যাসের প্রধান বিষয় পাভেল এবং তার মা পেলাগোয়া নিলভনার সম্পর্কটি। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য তৈরি হতে থাকা রাশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি বস্তুনিষ্ঠ ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এখানে। স্বামীর সংসারে অবহেলিত নির্যাতিত একজন মেয়ে মানুষ একসময় হয়ে উঠেন রাজনীতি সচেতন ব্যাক্তি।
একমাত্র পুত্র পাভেলের স্বপ্ন ছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ছেলের স্বপ্ন কে বাস্তবায়ন করতে “মা” ও হয়ে উঠেন সময়ের সৈনিক। মায়ের পাশাপাশি গোর্কী আরও কিছু উদ্যমী এবং সাহসী নারী চরিত্রের প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। নাতাসা, শাসা, লোডমিল্লা, সোফিয়া ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিপ্লবে নেমেছেন। আরামদায়ক জীবন ব্যবস্থায় থেকেও সংগ্রামী হয়েছেন সাধারন মানুষের জন্য।
১৯০২ সালের মে দিবসের প্রেক্ষাপটে সাজানো ” মা” উপন্যাসের প্রধান চরিত্র পেলগোয়া নিলভনার সংগ্রামী জীবন নারী পুরুষ তথা এই সমাজের কাছে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে কালে এবং কালোত্তরে। পাভেলের মত হাজারো যুবকের স্বপ্নের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে তাদের মায়েদের ত্যাগের বিনিময়ে।।
*********************************************************************************
সুখপাঠ্য ঐতিহাসিক উপন্যাস
“বাদশাহ নামদার”
মোঘল সাম্রাজ্য নিয়ে এর আগেও বিভিন্ন গ্রন্থ পড়েছি। বিভিন্ন সম্রাটের জীবনী পড়েছি। তবে, সম্রাট হুমায়ূনের জীবনী নিয়ে বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের “বাদশাহ নামদার” বই পড়ে মোঘল সাম্রাজ্য ও সমসাময়িক নানা ঘটনার পাশাপাশি ব্যক্তি হুমায়ূন মির্জার নানাবিধ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে পেরেছি।
বিংশ শতকের শেষভাগ ও একবিংশ শতকের প্রথমভাগে বাংলা কথাসাহিত্যে হুমায়ূন আহমেদ যে নিজস্ব ধারার প্রচলন করেছিলেন এবং অসম্ভব জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন, “বাদশাহ নামদার” উপন্যাসের সংলাপে আমরা সেই ধারাই দেখতে পাই। ঔপন্যাসিকের স্বাধীনতা কাজে লাগিয়ে উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মাধ্যমে নিজস্ব ভঙ্গিমায় সংলাপ বলিয়েছেন লেখক হুমায়ূন আহমেদ।
“বাদশাহ নামদার” আপাত দৃষ্টিতে একটি সামান্য উপন্যাস গ্রন্থ হলেও, আমার পঠিত সর্বশ্রেষ্ঠ বইগুলোর একটি মনে হয়েছে! এই উপন্যাসের শুরুতেই আমরা দেখতে পাই হিন্দুস্তানে মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর তাঁর পুত্র হুমায়ূন মির্জাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারণ, তাঁর এই ছেলেটি নিতান্তই অলস, ঘরকুঁনো স্বভাবের। তাঁর যুদ্ধ বিগ্রহ ভাল লাগে না। লোকের সংস্পর্শের চেয়ে একাকীত্বেই তাঁর শান্তি। হুমায়ূন মির্জা কবিতা লিখেন, ছবি আঁকেন, বই পড়েন। হিন্দুস্তানের ভাবী সম্রাটের তো আর এসবে চলবে না!
ঘটনা আরেকটু এগুলে দেখা যায়, ইতিহাসখ্যাত সেই ট্র্যাজেডি। হিন্দুস্তানের মহান সম্রাট বাবর নিজের প্রাণের বিনিময়ে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত পুত্র হুমায়ূনের জীবন রক্ষা করে পিতা-পুত্রের সম্পর্কের ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন।
বাবরের মৃত্যুর পর আমরা দেখব এক হেয়ালি সম্রাট হুমায়ূনকে। সাহিত্যানুরাগী, সংস্কৃতিমনা, বইপোকা, চিত্রশিল্পী, ক্ষমাশীল, ন্যায়পরায়ণ এক সম্রাটের নাম হুমায়ূন। ইতিহাস বলে সম্রাট হুমায়ূনের রাজত্বকাল সুখময় ছিল না। আপন ভাইদের উপর্যুপরি বিদ্রোহ, শের শাহের আক্রমণ ইত্যাদি কারণে জীবনের বেশীরভাগ সময় কাটিয়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। কিন্তু, এমন বিপদসঙ্কুল জীবনে আমরা দেখি অন্য এক হুমায়ূনকে। প্রধান সেনাপতি বৈরাম খানের হাতে দায়িত্ব দিয়ে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে বসে কবিতা রচনা করছেন, ছবি আঁকছেন, বই পড়ছেন! কী আশ্চর্য!
এই উপন্যাসে হুমায়ূনের সেনাপতি বৈরাম খাঁ একটি উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে। এছাড়া আফগান শাসক শের শাহ, হুমায়ূন ভ্রাতা কামরান মির্জা, হিন্দাল মির্জা, হুমায়ূন ভগ্নী গুলবদন বেগম, হুমায়ূন পত্নী হামিদা বানু (সম্রাট আকবরের মাতা) প্রমুখ চরিত্রগুলো প্রধান।
এই উপন্যাস পড়ে তৎকালীন ভারতবর্ষের অবস্থা সম্পর্কে ধারণা লাভের পাশাপাশি কূটনৈতিক রাজনৈতিক কৌশল সম্পর্কে আঁচ করা যায়।
সুতরাং, সার্বিকভাবে “বাদশাহ নামদার” বইখানা একটি সুখপাঠ্য হুমায়ূন সাহিত্যকর্ম হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার দাবি রাখে।
*********************************************************************************
“ঢাকার স্মৃতি।১২” – মুনতাসীর মামুন
অষ্টাদশ শতকের শুরুতে ঢাকা ছিল বিশ্বের দ্বাদশ বৃহত্তম নগরী। ঢাকার স্মৃতি বইটিতে ঢাকা সম্পর্কে সমৃদ্ধ তথ্য না থাকলেও খন্ড খন্ড কিছু ধারনা পাওয়া যায়। এখানে সংকলিত হয়েছে অলকানন্দা দাশগুপ্ত পটেল, রিজিয়া রহমান এবং রাবেয়া খাতুনের স্মৃতিকথা। অলকানন্দা দাশগুপ্ত ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিককার প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক অমিয় দাশগুপ্তের কন্যা। আর অমিয় দাশগুপ্ত অধ্যাপক াব্দুর রাজ্জাকের শিক্ষক। রিজিয়া রহমানের জন্ম কলকাতায়। ১৯৪৭ সালের পর তার পিতামাতা ঢাকায় চলে আসেন,, স্মৃতিকথায ঢাকায় প্রথম াসার বর্ননা করেছেন।
*********************************************************************************
“ঢাকার স্মৃতি।১২” – মুনতাসীর মামুন
অষ্টাদশ শতকের শুরুতে ঢাকা ছিল বিশ্বের দ্বাদশ বৃহত্তম নগরী। ঢাকার স্মৃতি বইটিতে ঢাকা সম্পর্কে সমৃদ্ধ তথ্য না থাকলেও খন্ড খন্ড কিছু ধারনা পাওয়া যায়। এখানে সংকলিত হয়েছে অলকানন্দা দাশগুপ্ত পটেল, রিজিয়া রহমান এবং রাবেয়া খাতুনের স্মৃতিকথা। অলকানন্দা দাশগুপ্ত ঢাকাবিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিককার প্রবাদপ্রতিম শিক্ষক অমিয় দাশগুপ্তের কন্যা। আর অমিয় দাশগুপ্ত অধ্যাপক াব্দুর রাজ্জাকের শিক্ষক। রিজিয়া রহমানের জন্ম কলকাতায়। ১৯৪৭ সালের পর তার পিতামাতা ঢাকায় চলে আসেন,, স্মৃতিকথায ঢাকায় প্রথম াসার বর্ননা করেছেন।
বাংলাদেশের অন্যতম কথাসাহিত্যক রাবেয়া খাতুন রক্ষনশীল সমাজে নিজ গুনে নিজস্ব অবস্থান তৈরি করেছিলেন। পুরনো ঢাকা েবং তখনকার গড়ে উঠতে থাকা ঢাকার এক সিনেম্যাটিক বিবরণ পাই তার কাছ থেকে।
১৯৪৬ সালের দিকে পুরানা পল্টন ছিল বেশ শান্ত খোলামেলা এক একটি পাড়া। বড় বড় দিঘী, ার দিঘীর পাশে বঁাধানো ঘাটে চলত খেলাধুলা, স্বাস্থ্যচর্চা, বৃদ্ধদের গল্চগুজব, অল্পবয়সীদেরর আলোচনা, রাজনীতি সহ সব আলোচনা।
বেশিরভাগ বাড়ি ছিল একতলা বেশ খানিকটা জমির উপরে, দোলনচাঁপা, মাধবীলতা, জঁুই, কাঞ্চন ছাড়াো অনেক বাড়িতে ছিল মৌসুমি ফুলের বাগান। পূজোর জন্য শিউলির মালা গঁাথা, বঁোটা শুকিয়ে বাসন্তী রঙে পুতুলের শাড়ি রাঙানো কাজে সবাই ব্যাস্ত ছিল। বাড়িগুলোতে উঠোনের আকর্ষন ছিল প্রচুর। কুয়ো থেকে জল তোলা, কয়লা ভাঙা, গুল দেওয়া, কাঠ কাটা সবই হতো উঠোনে।
মধ্যবিত্তরা পূজোতে সাধারন পোশাকই পরিধান করত। সুতির ফ্রক, কখনো একটি শাড়ি,, মেয়েদের পোশাক। ছেলেরা পরতেন ধুতি শার্ট অথবা ধুতি পাঞ্জাবি। তবে বয়স তিরিশের কাছাকাছি গেলেই বা দুই এক ছেলেমেয়ের মা হলেই মায়ের দলকে রঙিন শাড়ি ছেড়ে সাদা শাড়ি পরতেহতো।
তথনকার ঢাকাবাসীর খাবারেো ছিল ভিন্নতা। নিরামিষঘর আলাদা করে নাথাকলেও পেয়াজ রসুন ছাড়া সুস্বাদু পরিবেশনা থাকত। বকুল ফুল ভাজা, কুমরো ফুল ভাজা, লাউয়ের খোসা ভাজা, কঁাঠালের বিচি পোড়া, সব আলাদা স্বাদে আলাদা ুপপকরনে রান্না হত। ফুলের ভেতর ারেকটি ফুল ভরে কাকে ত্রিকোন করে বেসন বা চালের গঁোড়ো মাখিয়ে খাবার খেলে প্রান জুড়িয়ে যেত। অসুখ বিসুখ না হলে আপেল ানা হত না।
ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ভিতরের দৃশ্য সব বাহির থেকে দেখা যেত। ভেতরের মাঠে রাস্তায় বাগানে, কয়েদিদের কাজের ব্যাস্ততা সবই। সন্ধ্যায় কয়েদিদের ভেতরের দালানে ঢুকিয়ে তালা দেয়া হত, রাতে তারা দলবেধে মিলাদ পড়ত। কয়েদিরা তাদের মহিলা বাবুর্চিকে মামা বলে সম্বোধন করত। টিনের থালায় মোটা মোটা আটার রুটি, বুন্দিয়া ারর তরকারীর ঘ্যাট ছিল তাদের নাস্তা।
জাদুঘরটিরনঅবস্থান তখন ছিল নিমতলীতে। শুনশান অযত্নের মাঠের মধ্যে জনবিরল এক পুরনো বাড়ি।
সেইসময় থেকে এখন পর্যন্ত চলে গেছে অনেকগুলো বছর। সহস্র স্মৃতিবিজড়িত ঢাকা আজ অতীত হয়ে ই প্রানবন্ত আছে। চোখ বন্ধ করে শুধু রুপকথার রাজকন্যার মত নিরিবিলি গ্রামীণ আবহের ঢাকাকে কল্পনা ই করা যাবে কিন্তু কোন আঙ্কিক হিসাব আর মিলবে না।।
সেইসময় থেকে এখন পর্যন্ত চলে গেছে অনেকগুলো বছর। সহস্র স্মৃতিবিজড়িত ঢাকা আজ অতীত হয়ে ই প্রানবন্ত আছে। চোখ বন্ধ করে শুধু রুপকথার রাজকন্যার মত নিরিবিলি গ্রামীণ আবহের ঢাকাকে কল্পনা ই করা যাবে কিন্তু কোন আঙ্কিক হিসাব আর মিলবে না।।
উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন
********************************************************************************
আনা ফ্রাঙ্ক এর ডায়েরি :
ডায়েরির পাতায় শেষ আঁচর টেনেছিল পনেরো বছর দু মাস বয়সে। তার ঠিক সাত মাস পরে এই পৃথিবীর জল মাটি হাওয়ার সঙ্গেসম্পর্ক ছিন্ন হয়েছিল সেই কিশোরীর। তবে আমার ব্যক্তিক অভিমত পৃথিবী থেকে চলে গিয়ে আনার সম্পর্ক ছিন্ন হয় নি বরংবেড়েছে তা আরও বিস্তৃত পরিসরে।
ধর্মে ইহুদি জার্মানির বাসিন্দা আনা ফ্রাঙ্কের জন্ম ১৯২৯ সালে। ঠিক তখনই জার্মানির মাটিতে মাথা তুলেছে হিটলার। ইহুদিদেরবিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছে গেষ্টাপো বাহিনী। আলবার্ট আইনস্টাইন ও বাধ্য হয়েছেন জার্মানি ছাড়তে। সুভাষ মুখোপাধ্যায়েরঅনুবাদে প্রকাশিত “আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি” তে রয়েছে আনার বন্দী জীবনের স্পষ্ট উপস্থাপনা। কোথাও প্রস্ফুটিত হয়েছে বন্ধুদেরপ্রতি সহানুভূতি আর কোথাও বিকশিত হয়েছে মনের কোণে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত বাসনা।
বইটিতে আমি দেখেছি তেরো থেকে পনেরো বছরে আনার হেটে চলা। এক আশ্চর্য গভীর আনা অকপটে কথা বলে গেছেন দর্শন, মানব চরিত্র, প্রেম প্রকৃতি জীবনবোধ আর সমকালীন ইতিহাস নিয়ে। ফুটে উঠেছে ইহুদিদের লাঞ্চনা–যন্ত্রণা–সংগ্রাম এবং দ্বিতীয়বিশ্বযুদ্ধের ছবি। ইহুদীদের হলদে তারা পরতে হবে, সাইকেল চালানো যাবে না,রেলগাড়িতে চড়া ও ছিল নিষেধ।
গুপ্ত মহলে অবরুদ্ধ আনা এবং তার পরিবার সদা আতঙ্কে থাকত। কারন কোন প্রকার ভদ্রতা ছাড়া ই গেষ্টাপো বাহিনী ইহুদীদেরডজনে ডজনে তুলে নিয়ে যেত। এর মাঝেও আনা “লা বেলে নিফেরনাইসে” থেকে একটা করে অধ্যায় পড়ে ফেলত। নতুন শব্দ গুলোখাতায় টুকে রাখত।
লেখক হবার স্বপ্ন দেখত আনা, স্বপ্ন দেখত মৃত্যুর পরও বেচে থাকার। বেচে থাকলে আজ বয়স হতো সত্তোর। সে বেচে নেই। কুড়িতেই ঝড়ে গেছে। বেচে আছে শুধু দিনলিপি, আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি।।
*********************************************************
আনিসুল হকের “মা”
চোখটা এতো পোড়ায় কেন ও পোড়া চোখ সমুদ্রে যাও সমুদ্র কী তোমার ছেলে আদর দিয়ে চোখে মাখাও।। প্রয়াত সংগীত শিল্পী সঞ্জীব চৌধুরীর এই গানের কলিতে সীমাহীন দুঃখের সমুদ্রের বর্ণনা বিধৃত হয়েছে। দুঃখের সমুদ্রে আশা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, উদ্যমী হতে শেখায়। সমসাময়িক কালের জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক আনিসুল হকের “মা” উপন্যাস পড়ার পর আমরা এক আদর্শবান বাঙালী জেদি কিন্তু ধৈর্যশীলা মায়ের বর্ণনা পাই। আমরা এমন এক মায়ের বর্ণনা পাই যে মা হাসি মুখে দুঃখকে বরণ করে নিতে জানেন, যিনি সাত তলায় বাস করেও গাছতলায় বাস করার যোগ্যতাও রাখেন, যিনি দুঃখের সমুদ্রে ভেলা ভাসিয়ে তীরে পৌঁছানোর উদগ্র বাসনা ব্যক্ত করে তাঁর একমাত্র আদরের ধন আজাদকে নিয়ে ইউনুস চৌধুরীর বাড়ি ছাড়েন। তাঁর স্বামী ইউনুস চৌধুরী দুনিয়ার মোহতে পড়ে নিজের ব্যক্তিত্বকে অল্পদামে বিকিয়ে দিয়ে যখন দ্বিতীয় বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়লেন তখন সাফিয়া বেগম তাঁর ঘর ছাড়েন।
চৌধুরী বাবুর সম্পদ, মোহ, গাম্ভীর্য, শৌর্যবীর্য সবকিছু সাফিয়া বেগমের কাছে মূল্যহীন। দু পয়সা দামও দেন নি সুফিয়া বেগম। নিজের বিয়ের সময়ে বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া সোনার অলংকারগুলি নিয়ে তিনি তাঁর একমাত্র আদরের ধন আজাদকে সাথী নিয়ে চৌধুরী সাহেবের রাজপ্রাসাদ ছেড়ে চলে আসেন জীবন যুদ্ধের মাঠে। দুঃখ-বেদনায় ভরা জীবনের খেলাঘরে তিনি নিজেকে দাড় করানোর আপ্রাণ চেষ্টায় বিভোর হয়ে আজাদকে নিয়ে ইস্কাটনের রাজপ্রাসাদ ছেড়ে পাড়ি জমান ফরাশগঞ্জে। একেবারে আকাশের চাঁদ জমিনে পড়ার মত অবস্থা! জীবনযুদ্ধের হাল খুব শক্ত করে ধরলেন সাফিয়া বেগম। ধন-সম্পদের প্রতি মোহ তাঁর মনকে বিন্দুমাত্র হরণ করতে পারেনি বরং আদর্শের সোপানে ধাপে ধাপে উঠে যাওয়ার মনোবাসনা তাঁর ভিতরের জগৎটিকে নাড়া দিয়েছিল। তাইতো চৌধুরী সাহেবের চৌধুরীপনা তাঁর হৃদয়কে সাড়া জাগাতে ব্যর্থ হয়েছে।
চৌধুরী যখন তাদেরকে রাজী করিয়ে তাঁর রাজপ্রাসাদে আনতে ব্যর্থ হলেন তখন একমাত্র পুত্র আজাদকে করাচি পাঠিয়ে দিলেন মায়ের থেকে পৃথক করে দেওয়ার জন্য। একটি পাখিরছানাকে তার মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার পর মায়ের যে দশা হয় সাফিয়া বেগমের দশা তেমন হল। ছেলে তাঁর দেশের, দশের, সমাজের মুখ রাখবে এই মনোবাঞ্ছনা পূর্ণ করার জন্যই ছেলেকে তিনি করাচি পাঠাতে সম্মত হলেন। তাঁর বড় কষ্টের সংসার। মাতৃহীন আরও কয়েকটি সন্তানের মাও তিনি। নিজের মৃত বোনের সন্তানেরা যেন তাঁরই সন্তান। একজন মা কিভাবে তাঁর ছেলেকে আগলিয়ে রাখেন তার প্রমাণ মেলে সাফিয়া বেগমের মাতৃসুলভ আচরণে। তাঁর নীতি, আদর্শ, কর্মদক্ষতা, সততা, ব্যবহারের অমায়িকতা সব মিলিয়ে এক চলনসই চৌকশ পুত্রের প্রতিমূর্তি আজাদ। করাচির পড়াশুনা শেষ করে আজাদ দেশে ফিরে আসলে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। দেশ মাতৃকার সাহসী সন্তানেরা সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেদিন কোন শক্তি বাঙালিদেরকে থামিয়ে রাখতে সমর্থ হয়নি। আজাদকে যেন তাঁর মা সেদিন দেশের জন্য আজাদ করে দিয়েছিলেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন এদেশের দোসরদের সহযোগিতায় আজাদ ও তার বন্ধুদেরকে গ্রেফতার করেছিল সেদিন ও আজাদের মা ভেবেছিলেন বোধকরি তাঁর বুকের ধন ফিরে আসবে। কিন্তু আজাদরা আর কখনও ফিরে আসেনি।
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের পুত্র রুমীও সেদিন গ্রেফতার হয়েছিল স্বাধীন বাংলার জন্য স্লোগান দিয়েছিল তাই। আজাদ ও রুমী আর কখনও ফিরে আসেনি। জেলের গেটে আজাদের জন্য মা ঘণ্টার পর ঘণ্টা খাবার নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁর প্রিয় সন্তানকে দুমুঠো ভাত তুলে দিবেন বলে। আজাদের সাথে সাফিয়া বেগমের আর কখনও দেখা হয়নি। আজাদদেরকে গুম করে দিতে পারলেই এ দেশকে তাদের দখলে নিতে পারবে বলে কায়েমি স্বার্থবাদীরা ভেবেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকে তারা বাসা থেকে তুলে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।
আজাদ আর রুমীর মায়ের মত হাজার হাজার মায়েরা আদরের ধনকে দেশের জন্য আজাদ করে দিয়েছিলেন কিন্তু তারা কখনও অন্যায়ের কাছে তাদেরকে মাথা নত করতে শেখাননি। “এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়” এই নীতিতে বিশ্বাসী তাজা প্রাণের দুর্জয় অকুতোভয় সৈনিকেরা সেদিন নিজের প্রাণকে বিলিয়ে দিয়েছিল এই সোনার বাংলার জন্য। সোনার বাংলার সোনার মানুষ গড়ার যারা কারিগর তাদের পরিচয় কেন গোপন থাকবে?
আজ সময় এসেছে জাতিকে জানিয়ে দেওয়ার। আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে নাড়িয়ে দিতে একজন সাফিয়া বেগম প্রয়োজন, যিনি শত বাঁধা ডিঙ্গিয়ে একজন আদর্শ পুত্রের যোগ্য মায়ের ভূমিকায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। বাংলার ঘরে ঘরে একজন সাফিয়া বেগম যে আজ খুব দরকার! সাফিয়া বেগমদের মত মায়েরা সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের সন্তানকে জীবন যুদ্ধে লড়াই করার মন্ত্র শিক্ষা দেন। আদর্শ মানুষ গড়ার কারিগর আনিসুল হকের “মা” উপন্যাসের সেই আদর্শ মা সাফিয়া বেগমের কাছে জাতি চিরদিন ঋণী থাকবে।
******************************************************************************
এ হিস্ট্রি অব গড
জ্ঞানগম্যির আশির্বাদে অজস্র সমস্যার সমাধান মিলেছে। তারপরও একটা বিষয় বোধ হয় আজও ফয়সালা করা হয়নি। সময়ের স্রোত বেয়ে ধারণার বিবর্তন ঘটেছে মাত্র। বলা হচ্ছে ধর্মের কথাই। অথচ এই ধর্মই বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে ইতিহাসের পট পরিবর্তন করেছে। ত্যাগ আর মানবতার গল্প আছে, আবার অপব্যাখ্যা দিয়ে হিংস্রতার নজীরও কম নেই। এভাবে মানুষের ইতিহাসের মতোই গড়ে উঠেছে ঈশ্বরের ইতিহাস। ঠিক এমন একটি বিষয় নিয়ে লেখা বই- “এ হিস্ট্রি অব গড’। লেখিকা ক্যারেন আর্মস্ট্রং- এর দীর্ঘ গবেষণায় আব্রাহামিক ধর্মগুলোর বিচিত্র গল্প।
ধারণা করা হয়, আদিতে মানুষ একজন পরম উপাস্য (supreme deity)- এর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতো। কালক্রমে বিভিন্ন গুণে বিশেষায়িত দেবতাদের দ্বারা পরম ঈশ্বর (High God or sky God) প্রতিস্থাপিত হয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ প্যালিওলিথিক যুগে কৃষির বিকাশ ঘটার সময় High God কে ম্লান করে দিয়ে সামনে আসে Great mother। উর্বরতার প্রতীক হয়ে এক অন্তঃসত্ত্বা দেবীমূর্তি।
সময়ের পালাবদলে আবির্ভূত হন বা’আল, তিয়ামাত, ইয়া, আপসু, মারদুক দেবতাগণ। মানুষের মতোন এদেরও দখলদারিত্বের প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। কেউ থাকে, কেউ হারিয়ে যায়। খ্রিষ্টপূর্ব বিশ শতকের মাঝামাঝি আব্রাহাম কানানে বসতি গড়েছিলেন। তিঁনি ছিলেন “এল” গডের উপাসক।
খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ সালের দিকে আব্রাহামের বংশধর বলে দাবীদার গোত্রগুলো মিশর থেকে কানানে আসে। ইয়াহওয়েহ এর উপাসক মোজেস এদের দাসত্ব থেকে মুক্তি দেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৭৪২ সালে সলোমনও ছিলেন এই ইয়াহওয়েহ এর অনুগত। মূলত একেশ্বরবাদের সূচনালগ্ন এভাবেই।
খ্রিষ্টপূর্ব পয়লা শতকে ইহুদীবাদ ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করে। বিশেষ করে আলেকজান্দ্রিয়ায়। এসময় গ্রিক চিন্তাধারাতেও উকি মারেন ঈশ্বর। দার্শনিক প্লটিনাসের দ্যা ওয়ান এবং এরিস্টটলের Unmoved mover এর ধারণা ব্যাপকভাবে নাড়া দেয় চিন্তাশীলদের। এরপরেই আসে খ্রিষ্টধর্ম। জেসাসের জন্মরহস্য, আকস্মিক ক্রুশবিদ্ধ হওয়া এবং পুনরুত্থানের ধারণা মিলে জন্ম নেয় ট্রিনিটি। পিতা, পুত্র আর পবিত্র আত্মা।
৬১০ সালে ইসলামের নবী মুহাম্মদের আত্মপ্রকাশ। বিস্ময়কর দ্রুততার সাথে আরবরা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে বিজয় পতাকা উড়ায়। সাথে নিয়ে যায় এক আল্লাহ- এর ধারণা। খোলাফায়ে রাশেদিন পরবর্তী উমাইয়া এবং আব্বাসীয় শাসনকালে রাজনৈতিক ইসলাম ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। অন্যান্য ধর্মের মতো ইসলামকেও ব্যাখ্যা করা যায় নানা ভাবে। এজন্য খ্রিষ্টানদের ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট, মেথডিস্ট ও ব্যাপ্টিস্ট এর মতো মুসলিমরা সুন্নি ও শিয়া এর মতো বেশ কিছু সেক্ট এ বিভক্ত।
নবম শতকের পরে এসে দার্শনিকদের বেশ দোড়-ঝাপ চলে ঈশ্বর নিয়ে। ইবনে সিনা, ইমাম গাজ্জালি, আল-ফারাবী, ইবনে রুশদ ব্যাপক চিন্তা করেন। পরবর্তীতে যা মাইমোনাইডস, টমাস একুইনাস, আলবার্ট দ্যা গ্রেটকেও প্রভাবিত করে। প্লেটো কিংবা এরিস্টটল এর ধারণা আরবীয়দের স্পর্শে ঈশ্বর শুধু ঈশ্বর হয়ে থাকেনি। আত্মপ্রকাশ করেছেন সকল ধর্মের দর্শন হিশেবে।
এরপরেও থেমে থাকেনি চিন্তার চাকা। অতীন্দ্রিয়বাদীদের কাছে ধর্ম অন্যরকম ব্যাখ্যা লাভ করে। ইহুদী, খ্রিষ্টধর্ম এবং ইসলাম- তিনটি ধর্মেই মিস্টিসিজম দারুণরকম জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিশেষ করে ক্রুসেড পরবর্তী অস্থিরতায়। সুহরাওয়ার্দী, ইবনুল আরাবী, রুমি, শামস তাবরিজ কিংবা মানসুর হাল্লাজের মতো মুসলমানরা যেমন ছিলো, ছিলো মেইস্তার একহার্ত, জোহান্স টাওলার, হেনরি সুসো, রিচার্ড রোলে এবং ডেম জুলিয়ানের মতো বাঘা বাঘা পশ্চিমারাও। ঈশ্বর এখানে প্রেমিক হিশেবেই মুখ্য।
পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতক ঈশ্বরবাদীদের জন্য চরম সিদ্ধান্তমূলক। মুসলমান আর ইহুদীদের খেদিয়ে খ্রিস্টানজাত তখন ইউরোপের নায়ক। একদিকে আতঙ্ক আর হতাশা, অন্যদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর নতুন সমাজে ঈশ্বর তৃতীয় ব্যক্তিতে পরিণত হন। অথবা রেনেসাঁর জোয়ার সাঁতরে মানুষ যুক্তির মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে আলোকন চেয়েছে। এর ধারাবাহিতায় আসেন স্পিনোজা, দেকার্ত, হেগেলের মতো যুক্তিনিষ্ঠ দার্শনিক। সংস্কারকদের হাতে বেশ ভালোভাবেই নয়া রূপ নেন ঈশ্বর।
ঊনবিংশ শতকে প্রবেশ করে পুর্ববর্তী সবকিছু আরেকদফা সমালোচনায় আসেন। নাস্তিকতা একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়। অথচ কিছুদিন আগেও সেটা ছিলো খুব দুর্লভ। ম্যাটারিয়ালিজমের তোপে অনেকটা অসহায় হয়ে পড়ে ভাববাদ। ডারউইনের জীববিবর্তন, কার্ল মার্ক্স- এর সমাজ বিবর্তন এবং ফ্রয়েডের মনোবিবর্তন দারুণভাবে ঝাঁকি দেয় প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যকে। অন্যদিকে মৌলবাদের উত্থান প্রশ্নবিদ্ধ করে প্রচলিত বিশ্বাসকে। সে হিশেবে ঈশ্বর কি আরো একদফা সংস্কারের মুখোমুখি হবেন?
সন্দেহ নেই, “এ হিস্ট্রি অব গড” লেখিকার দীর্ঘসময়ের গবেষণার ফসল। এতেও সন্দেহ নেই, সভ্যতার সকাল থেকে আজ অবধি মানুষ আর ধর্মের সম্পর্ক অসাধারণ নিপুণতার সাথে তুলে ধরেছেন। তারপরও সমালোচনা করতে গেলে বলতে হবে, বইয়ের শুরুটা আরো সুন্দরভাবে করা যেতো। তাছাড়া জরাথ্রুস্টবাদ ও মিথরাসবাদের কথা একেবারেই বলা হয়নি বইটিতে। যদিও এরা একেশ্বরবাদী ধর্ম ছিলো এবং ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে পরবর্তী একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোকে। প্রাচ্যের হিন্দু এবং বৌদ্ধধর্ম নিয়ে তেমন আলোচনা করা হয় নি। দায়সারাভাবে দু’একবার নাম উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র। সে হিশেবে নাম “এ হিস্ট্রি অব গড” হলেও বইটা আচরণ করেছে “এ হিস্ট্রি অব আব্রাহামিক গড” এর মতো।
ধারণা করা হয়, আদিতে মানুষ একজন পরম উপাস্য (supreme deity)- এর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতো। কালক্রমে বিভিন্ন গুণে বিশেষায়িত দেবতাদের দ্বারা পরম ঈশ্বর (High God or sky God) প্রতিস্থাপিত হয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ প্যালিওলিথিক যুগে কৃষির বিকাশ ঘটার সময় High God কে ম্লান করে দিয়ে সামনে আসে Great mother। উর্বরতার প্রতীক হয়ে এক অন্তঃসত্ত্বা দেবীমূর্তি।
সময়ের পালাবদলে আবির্ভূত হন বা’আল, তিয়ামাত, ইয়া, আপসু, মারদুক দেবতাগণ। মানুষের মতোন এদেরও দখলদারিত্বের প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। কেউ থাকে, কেউ হারিয়ে যায়। খ্রিষ্টপূর্ব বিশ শতকের মাঝামাঝি আব্রাহাম কানানে বসতি গড়েছিলেন। তিঁনি ছিলেন “এল” গডের উপাসক।
খ্রিষ্টপূর্ব ১২০০ সালের দিকে আব্রাহামের বংশধর বলে দাবীদার গোত্রগুলো মিশর থেকে কানানে আসে। ইয়াহওয়েহ এর উপাসক মোজেস এদের দাসত্ব থেকে মুক্তি দেন। খ্রিষ্টপূর্ব ৭৪২ সালে সলোমনও ছিলেন এই ইয়াহওয়েহ এর অনুগত। মূলত একেশ্বরবাদের সূচনালগ্ন এভাবেই।
খ্রিষ্টপূর্ব পয়লা শতকে ইহুদীবাদ ব্যাপকভাবে বিস্তৃতি লাভ করে। বিশেষ করে আলেকজান্দ্রিয়ায়। এসময় গ্রিক চিন্তাধারাতেও উকি মারেন ঈশ্বর। দার্শনিক প্লটিনাসের দ্যা ওয়ান এবং এরিস্টটলের Unmoved mover এর ধারণা ব্যাপকভাবে নাড়া দেয় চিন্তাশীলদের। এরপরেই আসে খ্রিষ্টধর্ম। জেসাসের জন্মরহস্য, আকস্মিক ক্রুশবিদ্ধ হওয়া এবং পুনরুত্থানের ধারণা মিলে জন্ম নেয় ট্রিনিটি। পিতা, পুত্র আর পবিত্র আত্মা।
৬১০ সালে ইসলামের নবী মুহাম্মদের আত্মপ্রকাশ। বিস্ময়কর দ্রুততার সাথে আরবরা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে বিজয় পতাকা উড়ায়। সাথে নিয়ে যায় এক আল্লাহ- এর ধারণা। খোলাফায়ে রাশেদিন পরবর্তী উমাইয়া এবং আব্বাসীয় শাসনকালে রাজনৈতিক ইসলাম ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। অন্যান্য ধর্মের মতো ইসলামকেও ব্যাখ্যা করা যায় নানা ভাবে। এজন্য খ্রিষ্টানদের ক্যাথলিক, প্রোটেস্ট্যান্ট, মেথডিস্ট ও ব্যাপ্টিস্ট এর মতো মুসলিমরা সুন্নি ও শিয়া এর মতো বেশ কিছু সেক্ট এ বিভক্ত।
নবম শতকের পরে এসে দার্শনিকদের বেশ দোড়-ঝাপ চলে ঈশ্বর নিয়ে। ইবনে সিনা, ইমাম গাজ্জালি, আল-ফারাবী, ইবনে রুশদ ব্যাপক চিন্তা করেন। পরবর্তীতে যা মাইমোনাইডস, টমাস একুইনাস, আলবার্ট দ্যা গ্রেটকেও প্রভাবিত করে। প্লেটো কিংবা এরিস্টটল এর ধারণা আরবীয়দের স্পর্শে ঈশ্বর শুধু ঈশ্বর হয়ে থাকেনি। আত্মপ্রকাশ করেছেন সকল ধর্মের দর্শন হিশেবে।
এরপরেও থেমে থাকেনি চিন্তার চাকা। অতীন্দ্রিয়বাদীদের কাছে ধর্ম অন্যরকম ব্যাখ্যা লাভ করে। ইহুদী, খ্রিষ্টধর্ম এবং ইসলাম- তিনটি ধর্মেই মিস্টিসিজম দারুণরকম জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিশেষ করে ক্রুসেড পরবর্তী অস্থিরতায়। সুহরাওয়ার্দী, ইবনুল আরাবী, রুমি, শামস তাবরিজ কিংবা মানসুর হাল্লাজের মতো মুসলমানরা যেমন ছিলো, ছিলো মেইস্তার একহার্ত, জোহান্স টাওলার, হেনরি সুসো, রিচার্ড রোলে এবং ডেম জুলিয়ানের মতো বাঘা বাঘা পশ্চিমারাও। ঈশ্বর এখানে প্রেমিক হিশেবেই মুখ্য।
পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতক ঈশ্বরবাদীদের জন্য চরম সিদ্ধান্তমূলক। মুসলমান আর ইহুদীদের খেদিয়ে খ্রিস্টানজাত তখন ইউরোপের নায়ক। একদিকে আতঙ্ক আর হতাশা, অন্যদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর নতুন সমাজে ঈশ্বর তৃতীয় ব্যক্তিতে পরিণত হন। অথবা রেনেসাঁর জোয়ার সাঁতরে মানুষ যুক্তির মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে আলোকন চেয়েছে। এর ধারাবাহিতায় আসেন স্পিনোজা, দেকার্ত, হেগেলের মতো যুক্তিনিষ্ঠ দার্শনিক। সংস্কারকদের হাতে বেশ ভালোভাবেই নয়া রূপ নেন ঈশ্বর।
ঊনবিংশ শতকে প্রবেশ করে পুর্ববর্তী সবকিছু আরেকদফা সমালোচনায় আসেন। নাস্তিকতা একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়। অথচ কিছুদিন আগেও সেটা ছিলো খুব দুর্লভ। ম্যাটারিয়ালিজমের তোপে অনেকটা অসহায় হয়ে পড়ে ভাববাদ। ডারউইনের জীববিবর্তন, কার্ল মার্ক্স- এর সমাজ বিবর্তন এবং ফ্রয়েডের মনোবিবর্তন দারুণভাবে ঝাঁকি দেয় প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যকে। অন্যদিকে মৌলবাদের উত্থান প্রশ্নবিদ্ধ করে প্রচলিত বিশ্বাসকে। সে হিশেবে ঈশ্বর কি আরো একদফা সংস্কারের মুখোমুখি হবেন?
সন্দেহ নেই, “এ হিস্ট্রি অব গড” লেখিকার দীর্ঘসময়ের গবেষণার ফসল। এতেও সন্দেহ নেই, সভ্যতার সকাল থেকে আজ অবধি মানুষ আর ধর্মের সম্পর্ক অসাধারণ নিপুণতার সাথে তুলে ধরেছেন। তারপরও সমালোচনা করতে গেলে বলতে হবে, বইয়ের শুরুটা আরো সুন্দরভাবে করা যেতো। তাছাড়া জরাথ্রুস্টবাদ ও মিথরাসবাদের কথা একেবারেই বলা হয়নি বইটিতে। যদিও এরা একেশ্বরবাদী ধর্ম ছিলো এবং ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে পরবর্তী একেশ্বরবাদী ধর্মগুলোকে। প্রাচ্যের হিন্দু এবং বৌদ্ধধর্ম নিয়ে তেমন আলোচনা করা হয় নি। দায়সারাভাবে দু’একবার নাম উল্লেখ করা হয়েছে মাত্র। সে হিশেবে নাম “এ হিস্ট্রি অব গড” হলেও বইটা আচরণ করেছে “এ হিস্ট্রি অব আব্রাহামিক গড” এর মতো।
যাহোক, রুডলফ অটো-র “দ্যা আইডিয়া অব দ্যা হোলি” প্রকাশের প্রায় এক শতাব্দী পরে ক্যারেন আর্মস্ট্রং এর “এ হিস্ট্রি অব গড” শুধুমাত্র বিষয়বস্তুর জন্যই না, গবেষণার বস্তুনিষ্ঠতার জন্যও শ্রেষ্ঠত্বের দাবী রাখে। যেখানে সমাজের নব্বইভাগ মানুষ কোনো না কোনোভাবে ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত, সেখানে ঈশ্বর বিষয়টা নিয়ে নতুন করে আরো একবার ভেবে দেখা উচিৎ। অন্তত ইতিহাস থেকে পাঠ নেয়া দরকার। সে দিক থেকে বইটি অবশ্যই অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
ক্যারেন আর্মস্ট্রং বর্তমান বিশ্বে ধর্মতত্ত্ব গবেষণায় এক অনন্য নাম। “এ হিস্ট্রি অব গড” ছাড়াও তাঁর বেস্টসেলার বইগুলোর মধ্যে “এ শর্ট হিস্ট্রি অব মিথ”, মুহাম্মদ, বুদ্ধ, বাইবেল, ইসলাম প্রভৃতি প্রধান। বস্তুবাদী বিশ্বে নিহিলিজম যখন জীবনকে একঘেয়ে করে দিয়েছে, তখন ধর্মের রহস্য অনুসন্ধানীর কাছে একটি আদর্শ অবলম্বন হতে পারে “এ হিস্ট্র অব গড”।
*******************************************************************************
সাজিদ উল হক আবির এর ‘আয়াজ আলীর ডানা‘য় ভর করে
লেখকের বড় কৃতিত্ব হচ্ছে পাঠককে ভুলিয়ে বালিয়ে তার জগতে নিয়ে যাওয়া এবং তাদের মাথা-মগজ নিয়ন্ত্রণ করা। সাজেদ উল হক আবীরের ‘আয়াজ আলীর ডানা’ পড়ে পাঠক নিজেকে সে চরিত্রের সাথে মিলিয়ে ফেলে সুখবোধ করতে পারবে। আয়াজ আলীর ডানা একজন শিল্পীর শিল্পী জীবন এবং সংসার জীবনের মধ্যে ফারাক গোচানোর সংগ্রামের কাহিনী। সংসার, প্রেম, স্ত্রী-সন্তান এর নৌকা বাইতে বাইতে কিভাবে শিল্পী জীবনের সাথে কম্প্রোমাইজ করতে হয় তার করুণ বিবরণ পরতে পরতে। বেশিরভাগ তরুণ লেখক বা শিল্পী আয়াজ আলীর কাহিনীর সাথে মেলাতে পারবে। কারণ প্রত্যেকেরই মনে এমন আকাঙ্খা উকি মারে যখন পাখা মেলে উড়তে ইচ্ছে করে, স্বপ্নের জগতে বসবাস করতে ইচ্ছে করে। গ্রীক মিথের ইকারাসের মতো উড়ার দুরন্ত বাসনা যেমন তার মহাপতন নিয়ে এসেছে তেমনি তার মহাপতনও যে মহাসফল তার উদাহরণ হচ্ছে তার কয়েক হাজার বছর পরে সেই মানবপ্রজাতি চাঁদ জয় করে, ও সৌরজগত ভ্রমণ শেষে মহাবিশ্বে উড়ে বেড়াচ্ছে। মানুষ এখন ইকারাসের পাখা নিয়ে শুধু একাই ঘুরে বেড়াচ্ছে না, কয়েকশত লোককে একসাথে নিয়ে বিশাল ফড়িংয়ের পেটে আরামছে ভ্রমণ করছে হাজার হাজার মাইল। ইকারাসের এই মিথটি ইংরেজি সাহিত্যে সফল প্রয়োগ করেছেন সাহিত্যের জন্য শহীদ(!) জেমস জয়েস। তার ‘দ্য পোট্রেট অব দ্য আর্টিস্ট এজ অ্যান ইয়াং ম্যান’ এর স্টিফেন দেদালাস চরিত্রটি নির্মাণের মাধ্যমে। স্টিফেন দেদালাসকে আমরা তার ‘ইউলিসিস’ ও ‘ফিনেগেনস ওয়েক’ উপন্যাসেও পাই। স্টিফেন দেদালাস নামটির দুটি অংশ-‘স্টিফেন’ ও ‘দেদালাস’ । দেদারাস ছিলেন শিল্পী মানুষ, ইকারাসের বাবা। রাজার দ্বীপান্তর নির্বাসনের শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য আকাশপথই বাছাই করেছিলেন। কারণ জলপথ ও স্থলপথে রাজার সৈন্য সামন্ত প্রহরায় ছিল। মোমের তৈরি সেই পাখা মেলে উড়ার আগে ছেলে ইকারাসকে সতর্ক করেছিলেন বাবা দেদালাস যেন সে এত উপরে না উঠে যার কারণে সূর্যের কাছে চলে যায় আবার সাগরের কাছেও যেন চলে না যায় যার কারণে পাখায় পানি জমে পাখা ভারি হয়ে যায়। তাকে অনুসরণ করার আদেশ দিয়ে আকাশে উড়ছিলেন বাবা ছেলে। কিন্তু নতুন পাওয়া পাখা এবং উড়ার ক্ষমতা দিয়ে সে যেন উপরের দিকেই উড়তে ছিল। এটা এক অপূর্ব স্বাধীনতা! মানুষ দেখলো সে দেবতার মতো, ঈশ্বরের মতো, স্বর্গদূতের মতো আকাশে উড়ছে। ইকারাস যেন মানুষের দুর্দমনীয় জানার আকাঙ্খা, অর্জন, দেখা ও জয় করার আকাঙ্খার সার্থক প্রতিমূর্তি। সেই ইকারাস ঠিকই সেই আকাঙ্খার বলে একসময় সূর্যের কাছাকাছি চলে যায়। কিন্তু মোমের পাখা গলে যেতে থাকে ইকারাসের। একসময় দেখে সে শুধু হাত দিয়েই ঝাপটাচ্ছে কিন্তু আর উড়তে পারছেনা। শেষে আকাশ থেকে একটি সাগরে পরে সলিলসমাধি ঘটে। ইকারাসের এই মহাপতন কয়েক হাজার বছর ধরে মানুষের কল্পনাশক্তিকে মশলা সরবরাহ করেছে। ইকারাস এবং তার বাবা দেদালাস এর আকাশে উড়ার অদম্য আকাঙ্খা, এর একদিকে সফল ও অন্যদিকে ব্যর্থ প্রয়াস বিভিন্নভাবে শিল্প, সাহিত্য ও নাটকে উঠে এসেছে। ক্রিস্টোফার মার্লোর ডক্টর ফস্টাস একটি সার্থক উদাহরণ। বিশ শতকে জেমস জয়েস এই মিথটাকে সবচেয়ে সফলভাবে ব্যবহার করেছেন। শিল্প হচ্ছে শিল্পীর কাছে সেই ইকারাসের ডানা যার মাধ্যমে দূর আকাশে, দূর অতীতে বা দূর ভবিষ্যতে উড়ে বেড়ানো যায়। জেমস জয়েস ইংরেজি সাহিত্যের দেদালাস। ইকারাসের বাবার মতো শিল্পী তিনি, শিল্পের জন্য ত্যাগ করেছেন অনেক; দেশ, পরিবার এমনকি ধর্ম। সাহিত্য হয়ে উঠে তার কাছে আরাধ্য বিষয় এবং সেই মন্দিরেই সারা জীবনের সব পূজা জমা করেছেন। দেদালাস যেমন উড়ে গিয়ে মুক্ত হতে পেরেছেন কিন্তু সেই মুক্তির ফলও যে কম তেতো নয়! একজন বাবার সব সাফল্যই ম্লান হয়ে যায় ছেলের এমন করুণ মৃত্যুর কাছে। জয়েস তার ‘ইউলিসিস’ নিয়ে বলেছিলেন তিনি সেখানে এমন সব রসদ দিয়েছেন যা আগামী কয়েক শতকের সাহিত্য সমালোচকদের মাথা কুড়ে মরার জন্য যথেষ্ঠ। বিশ্বকে তিনটি কালজয়ী উপন্যাস, একগুচ্ছ ছোটগল্প, অনেকগুলো কবিতা উপহার দিয়ে গেলেও তার মৃত্যুর পর অন্তেষ্টেক্রিয়া পরিচালনার মতো যথেষ্ঠ টাকা ছিলো না তার পরিবারে। তার বইয়ের প্রকাশকের সহায়তায় সেটা সমাধা হয়েছিল। জয়েসের কথা বলার কারণ হলো শিল্পীদের দেদালাসের মতো এমন অর্জন বিসর্জনের এমন সহবাসের মধ্য দিয়েই যেতে হয়। কোন অর্জনই যেন সম্পূর্ণ অর্জন নয়, পেছনে অনেক বিসর্জনের কাহিনীও থাকে। আবীরের গল্পে গ্রীক মিথের দেদালাসের ছবিই পাই। একজন স্ট্রাগলিং লেখকের স্ট্রাগল শৈল্পিক রূপ নিয়েছে ইকারাসের ডানার মতো। গল্পে আয়াজ আলী ও তার মেয়ের যুগল উপস্থিতি ইকারাস-দেদালাসের যুগলবন্দিকে মনে করিয়ে দেবেই। গল্পটির সবচেয়ে শক্তিশালী উক্তি মনে হয়েছে- “দুনিয়ায় হকলডি মানুষ বাঁচে না, সবাই মরার মত কইরাই বাঁচে। তয় আপনে বাঁচছেন স্যার, বাঁচার মত কইরাই বাঁচছেন। আপনার জনম সার্থক” গল্পের শেষাংশে আয়াজ আলীর ডানাতে পুরো মানবজাতির ইতিহাস লিখিয়ে নিয়ে অসাধারণ শৈল্পিক ওস্তাদি ফলিয়েছেন লেখক। যেন আয়াজ আলী সমগ্র শিল্পী, সাহিত্যিক, কবির প্রতিমূর্তি আর তার ডানা সবার সৃষ্টিকর্মের সম্মিলনী। “সমগ্র মানবজাতির ইতিহাস লেখা সে ডানার একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে। পবিত্র সে সব আত্মা, যারা পৃথিবীর বুকে মানুষের দুখ দুর্দশা অন্তর দিয়ে অনুভব করেছে, ঘোষণা করেছে তার বিরুদ্ধে নীরব বিপ্লব তাদের গাঁথা সোনালী অক্ষরে খচিত সে ডানায়। নিজেকে আজীবন ব্যার্থ ভাবা নগণ্য গণমানুষের কবিকে এভাবেই মহাকাল স্নেহভরে কোলে তুলে নেয়।”
*******************************************************************************
*******************************************************************************
আহমদ ছফার “উপলক্ষের লেখা”
: এক ঈগল দৃষ্টি!
আহমদ ছফার “উপলক্ষের লেখা” বইটি মোট ৩৪ টি প্রবন্ধের আশ্রয়স্থল। ছফা ছিলেন অভিজ্ঞতায় পরিপক্ব, পঠনপাঠনে ও পর্যবেক্ষণে সিদ্ধহস্ত আর বিচক্ষণতায় তীক্ষ্ন। এ বইটি বিপুল তথ্যের এক দারুণ আধার। জীবনের শেষ দিনগুলির প্রবন্ধগুলি এখানে জায়গা করে নিয়েছে। অভিজ্ঞতার ঝাপি খুলে, ঈগলের দৃষ্টি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন সমাজের মানুষকে। তাঁর আতশকাঁচে তাই আমরা দেখি সমাজের চিরচেনা রূপ, তার মানুষ, তাদের জীবনের রেলগাড়ি, সুখ- দুঃখের নিত্য খেলা। এ বইটিতে অনেক বিশেষ চরিত্রকে আলোকিত করেছেন, পাঠককে জুগিয়েছেন তথ্যের খোরাক। জীবন সায়াহ্নে তাঁর অভিব্যক্তি, তাঁর আকুতি, তাঁর প্রার্থনা, তাঁর প্রাপ্তিস্বীকার, তাঁর ক্ষোভ প্রভৃতি বিধৃত হয়েছে অত্যন্ত সূচারুভাবে।
** প্রথমেই তিনি আলোকপাত করেছেন আচার্য আলাউদ্দীন খানের উপরে। কত সংগ্রাম করে অবশেষে ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ কিভাবে টিকেছিলেন তা এখানে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। সমাজের মানুষের বিচিত্র চিন্তা, ধ্যান-ধারণা, মতাদর্শ, দর্শন কিংবা সংস্কৃতি কিভাবে তাঁর চলার পথকে রুদ্ধ করেছিল তা ছফা এখানে তুলে এনেছেন। একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে খাঁ সাহেব ছিলেন শ্রেষ্ঠ ভাস্করের মত। ভাস্কর যেমন সুচারূভাবে মাটির পুতুল নির্মাণ করেন তেমনি তাঁর প্রবল ইচ্ছাশক্তিকে শিক্ষার্থীদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ইচ্ছাশক্তির এক সুচারূ কারিগর হিসেবে আমরা তাকে পাই। লালন ফকিরকে নিয়ে রহস্য, রহস্যের জাল উন্মোচন, তাঁর ধর্ম-দর্শনের এক ফিরিস্তি তিনি এখানে দিয়েছেন। ব্রাহ্মণ পরিবারে লালণের বেড়ে ওঠা, বসন্ত রোগে তাঁর আক্রান্ত হওয়া, তাঁর পরিবার কর্তৃক তাকে নদীর পাড়ে ফেলে যাওয়া, জোলার বাড়িতে লালন-পালন, অতঃপর গুরু সিরাজ শাঁইয়ের সাক্ষাৎ পাওয়া সবকিছু এখানে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ইতিহাসের দুই বিশেষ চরিত্রকে মানুষের সামনে উপস্থাপন করেছিলেন- একজন মহাত্মা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ও অপরজন লালন ফকির। লালনের যে প্রতিকৃতি আজ আমরা হরহামেশাই দেখি তা কিন্তু রবীঠাকুরের ভাই জ্যোতিরীন্দ্রনাথের আঁকা। ছফা লালনকে জাগ্রত প্রতিভা হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। তিনি মনে করেন যে, লালনের তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে বেশ দখল ছিল। ছফার মতে, “খুব সম্ভবত ধর্মতত্ত্ব সম্পর্কে লালন যে প্রগাঢ় জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তার পেছনের কারণ ছিল সুন্নী আলেমদের মারমুখী মনোভাবের বিরুদ্ধে আত্মপক্ষ সমর্থনে যুক্তি নির্মাণ করার তাগিদে।” আসলে লালনের পরিচয় ইতিহাসের পেন্ডুলামে দুলছে। যে যেভাবে পারছেন সুবিধামত লালনকে টেনে নিয়েছেন নিজেদের দিকে। তবে লালনের জাত-কূল যাইহোক না কেন সমাজের উঁচুবর্গের মানুষেরা নিজেদের সুবিধার্থে লালনকে নিজেদের দলে ভিড়িয়েছে।
** বিশিষ্ট লেখক বদরুদ্দীন উমরের বাবা আবুল হাশিম বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক প্রাত:স্মরণীয় রাজনীতিবিদ। তিনি মারফতি তরীকার মুসলমান ছিলেন। নামাজ, রোজার বিশেষ ধার ধারতেন না। তিনি খুব উচ্চমার্গের পন্ডিত ও বুদ্ধিজীবী ছিলেন। দেশকে নিয়ে অনেক বেশি ভাবতেন তিনি। ছফার ভাষায়, “তিনি দুঃখ করে বলতেন, এই জাতিকে আলোর দিকে, জ্ঞানের দিকে চালিত করার কোন ক্ষমতা তাদের থাকে না। এটাই হচ্ছে এই জাতির দুর্ভাগ্যের মূল কারণ।” আবুল হাশিমের গদ্যরীতি, যুক্তিরশক্তি, পঠন- পাঠনের ব্যাপ্তি ও মননশীলতা ছফার মনে দারুণভাবে রেখাপাত করেছিল। দুই বাংলাকে এক করে রাখার স্বপ্ন তিনি হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন। যুক্তবঙ্গের প্রস্তাব ব্যর্থ হলে খুব দুঃখ করে হাশিম সাহেব বলেছিলেন, ” বাঙালি হিন্দুর কী শোচনীয় পরিণতি। বাঙালি হিন্দুরা রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, সুভাষচন্দ্র বসু এই সমস্ত বিশ্ববিশ্রুত আকাশ-ছোঁয়া মনীষী পুরুষদের জন্ম দিয়েছেন। আজ দেখ তাদের কি অধঃপতন। অবাঙালি অর্থ এবং অবাঙালি চিন্তার কাছে তারা দাসখৎ লিখে দিয়েছে, মস্তক বেঁচে দিয়েছে।” এ আক্ষেপ শুধু হাশিমের নয় বরং আমাদের সবার। ছফা হাশিম সাহেবকে একজন উচ্চমার্গের পন্ডিত, রাজনীতিক ও বিজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আবুল হাশিম বেশ মজার মানুষ ছিলেন, ব্যঙ্গ করতেনও নিজস্ব ভঙ্গিমায়। ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ হাশিম সাহেবের একজন বড় শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। একদিন হাশিম সাহেবের বাড়িতে তিনি বেড়াতে আসলেন। তার পরের ঘটনা ছফার বর্ণনায়ঃ “তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, হাশিম সাহেব কী করছেন? হাশিম সাহেব বললেন, আরে ড. সাহেব আসেন, আসেন, বসেন। কী আর করব, ছোড়াকে দিয়ে প্রভাত মুখোপাধ্যায়েরর গল্প পড়াচ্ছি। আপনারা তো আর ভদ্রলোকের পড়ার উপযুক্ত কিছু লিখতে পারলেন না। এইবার শহীদুল্লাহ্ সাহেব সত্যি সত্যি ক্ষেপে গেলেন। হাশিম সাহেব, আপনি খবর রাখেন না আমি অনেক ছোটগল্প লিখেছি। হাশিম সাহেব কৌতুক করে বললেন, আপনি গল্প লিখেছেন? নাম বলুন দেখি, শহীদুল্লাহ্ সাহেব এক ঝোঁকে তাঁর লেখা তিন-চারটি গল্পের নাম বলে গেলেন। হাশিম সাহেব হুঁকোর নলটি মুখ থেকে সরিয়ে বাঁ- হাত দিয়ে একটা ভঙ্গি করে বললেন, ঠিক আছে ড. সাহেব থামেন, আর বলতে হবে না, এখন আমার কথা বলি। আপনি কী মনে করেন এসময়ের মধ্যে আমার রুচির এত অধঃপতন ঘটেছে যে আপনার লেখা গল্প আমাকে পড়তে হবে? অথচ তিনি ড. শহীদুল্লাহ্কে ভীষণ শ্রদ্ধা করতেন”।
** একজন ব্যক্তির লেখক হওয়ার পেছনে কিছু ব্যক্তি থাকেন যারা অনেক ক্ষেত্রে প্রচারবিমূখ থাকেন। যদি প্রতিষ্ঠিত লেখকের দয়া-দাক্ষিণ্যে তার পরিচয় মেলে তবে তা মন্দ হয় না। ঝড়ঝঞ্ঝার মধ্যে তরী ভাসানো লেখক ছফার জীবনে দুর্দিনের যাত্রীর মত এসেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান। সাহিত্যিক হিসেবে ছফার প্রতিষ্ঠার পেছনে অন্যতম চালক শক্তি হিসেবে ছিলেন হাসান হাফিজ, লেখক দ্বিধাহীন চিত্তে তা স্মরণ করে হাফিজের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে কৃতজ্ঞতার ঝুলিটাকে হালকা করেছেন। হাসান হাফিজের মত রণেশ দাশগুপ্তও ছফার দুর্দিনের ছায়া ছিলেন। নন্দনতত্ত্বে রণেশ দাশগুপ্তের আগ্রহ ছফাকে অন্যভাবে চিন্তা করতে সাহায্য করেছিল।
** মধ্যযুগীয় সাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী পন্ডিত ড. আহমদ শরীফের মৃত্যুতে ছফা একজন অভিভাবক ও গুরুকে হারিয়েছিলেন। আরজ আলী মাতুব্বরের মত আহমদ শরীফের শরীর সমর্পনের কথা অনেকের কাছে অজানা নয়। ছফা দুঃখ প্রকাশ করেছেন যে আহমদ শরীফের মত একজন অসাধারণ বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষক যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তনু-মন-প্রাণ ঢেলে ৩৫ বছর শিক্ষকতা করেছেন অথচ তাকে বিদায় বেলায় কোন সংবর্ধনার আয়োজন করেনি শিক্ষার্থীরা। ছফা আহমদ শরীফের সরাসরি শিক্ষার্থী ছিলেন, গুরুর থেকে শিখেছিলেন অনেক কিছু। ছফার ভাষায়,” তিনি আমাদের অন্যায়কে ঘৃণা করতে শিখিয়েছিলেন। চাপের কাছে নতি স্বীকার না করতে অনুপ্রাণিত করেছেন।” শওকত ওসমানকে লেখক একজন জীবনবাদী লেখক হিসেবে মূল্যায়ন করেছেন। তাঁর সুতীব্র জীবনবোধ ও প্রাণশক্তি ছফাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছিল। তাঁর “জননী” উপন্যাসকে ছফা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচনায় এনেছেন। শওকত ওসমানের সাথে লেখকের অনেকবারই মতামতের পার্থক্য ঘটেছে কিন্তু তাঁর থেকে লেখক স্নেহ বঞ্চিত হন নি কখনও। ছফা মনে করেন শওকত ওসমানের মধ্যে দু ধরনের মানসিকতা বুঁদ হয়েছিল। ছফার ভাষায়,” একটা হচ্ছে তিনি জীবনের প্রথম দিকে মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন। মাদ্রাসা শিক্ষার আচার সর্বস্বতা তাঁর মনে এমন একটি স্থায়ী অনপনেয় বিরূপ ছাপ ফেলেছিল, সেই জিনিসটি সারাজীবন তাঁকে তাড়িত করে নিয়ে গেছে। এটা এক ধরনের খন্ডিত মানসিকতা। শওকত ওসমান এই মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে পারেন— সেই কারণে বেহুদা মুসলিম সমাজের উপর আঘাত করার একটা অযৌক্তিক প্রবণতা তাঁকে পেয়ে বসেছিল। দ্বিতীয়ত, যে জিনিসটি তাঁকে সারাজীবন পীড়িত করেছে, সেটি হল তাঁর উদ্বাস্তু মানসিকতা। তিনি দেশ বিভাগের কারণে পাকিস্তানে চলে এসেছিলেন অথচ অন্তর থেকে পাকিস্তানকে মেনে নিতে পারেননি। জীবনের বিশ্বাস এবং বাস্তবতার মধ্যে যে পার্থক্য সেটুকু ভরাট করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি”।
** “রাজ্জাক সাহেবের স্মরণ-সভায়” প্রবন্ধে শিষ্য ছফা স্মরণ করেছেন গুরু প্রফেসর আবদুর রাজ্জাককে। ছফার জীবনে প্রফেসর রাজ্জাকের অবদানই সম্ভবত সবচেয়ে বেশি। ছফাকে নতুনভাবে ভাবতে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন, চিন্তার আঙিনায় উদ্ভাসিত হতে শিখিয়েছিলেন রাজ্জাক। ছফার ভাষায়” আমি নিতান্তই সামান্য মানুষ। প্রফেসর রাজ্জাকের সঙ্গে আমি ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম, সেটা একরকম দুর্ঘটনাই বলতে হবে। আমার করার কোন কাজ ছিল না এবং পেশায় ছিলাম সার্বক্ষণিক বেকার। আর রাজ্জাক সাহেবের ছিল অফুরন্ত সময়।” অকৃতদার রাজ্জাকের কাছে একেকটি গ্রন্থ ছিল বুকের পাঁজরের একেকটি হাড়ের মত। তবে একটি কথা স্মর্তব্য, রাজ্জাক কাউকে বই ধার দিতেন না। তবে এক্ষেত্রে ছফা সত্যিকার অর্থে একজন সৌভাগ্যবান ব্যক্তি যার বই ধার পাওয়ার সুযোগ মঞ্জুর হয়েছিল। রাজ্জাক স্যারকে নিয়ে তিনি অত্যন্ত উঁচু ধারণা পোষণ করতেন। রাজ্জাকও ছফাকে মূল্যায়ন করতেন বেশ এবং তাঁর মেজাজকে সম্মান দিতেন। ছফা রাজ্জাক স্যারকে মনে করতেন ‘চিরনতুনত্বের অফুরন্ত খনি’। তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক সৌন্দর্য ছিল অনেক উচ্চমার্গের। ছফার ভাষায়,” আমাদের দেশে মানুষ যত বুড়ো হয় তত বানর হয়। খুব কম মানুষই সুন্দরভাবে বুড়ো হতে জানে। রাজ্জাক স্যার আমার চোখে একমাত্র মানুষ যিনি সুন্দরভাবে বুড়ো হতে জেনেছিলেন”। লেখকের জীবনে সবচেয়ে বড় গর্বের বিষয় হল তিনি প্রফেসর রাজ্জাকের ছাত্র ছিলেন। তবে তিনি আক্ষেপ করতেন এই কথা বলে যে, ” আগামী প্রজন্মের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যদি প্রশ্ন করে এখানে নজরুলের কবর আছে, জয়নুল আবেদীনের কবর আছে, শহীদুল্লাহর কবর আছে,আবদুর রাজ্জাকের কবর নেই কেন? আমি জানি সে জবাব দেয়ার ক্ষমতা আপনাদের কারো নেই। আপনারা ক্ষমতার ছোটবড় নানারকম স্তম্ভ হিসেবে নিজেদের অবস্থানে থিতু হয়ে আছেন। আপাতত সেটিই ধরে থাকুন। আমার হা- হা- হা অট্টহাসি দেয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই”। আসলেই এ জিজ্ঞাসার উত্তর আমাদের থলেতেও নেই।
** সরদার ফজলুল করিমের একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন ছফা। সরদার ফজলুল করিম, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত ও আহমদ ছফা মিলে বের করেছিলেন ‘স্বদেশ’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা। প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক ছফার সামনে বাংলাদেশের যে দুই জন ব্যক্তিকে নিয়ে বেশি আলোচনা করতেন তাদের একজন আনিসুজ্জামান অপরজন সরদার। সরদারের “প্লেটোর সংলাপ” গ্রন্থটি লেখক ছফাকে দারুণভাবে উদ্বেলিত করেছিল। তিনি এই অনুবাদ গ্রন্থটির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। সরদারের সাথে সাক্ষাৎ হলে ছফাকে সরদার তিনটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতেন যা ছফা পাঠককে মনে করিয়ে দিলেন, ” শরীর কেমন, এখন কি পড়ছেন, তাঁর শেষ কথা— কি লিখছেন?” আসলে মোদ্দাকথা হল লেখকে লেখকে বইয়ের কথা চলবে, পড়াশুনার কথা চলবে: নিশ্চয়ই বাজারের মাছ-মাংসের গল্প চলবেনা এটাই স্বাভাবিক।
** ছফা সাহিত্যিক শাহেদ আলীকে স্মরণ করেছেন অত্যন্ত বিনয়ের সাথে। ছফার লেখক জীবনে যদি একজন ব্যক্তি দারুণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করে তাহলে তিনি শাহেদ আলী। পাঠককে জানিয়ে দেওয়ার তাগিদ অনুভব করছি যে ছফার প্রথম লেখা শাহেদ আলীর দ্বারা প্রকাশিত। একদিন শাহেদ আলীরা হয়তো হারিয়ে যাবেন, টিকে থাকবেন ছফারা। কিন্তু পাঠকেরা এটা জেনে খুশি হবেন যে ছফারা একদিনে হাওয়ায় ভেসে আসেন নি, তাদের জীবনে অনেক মানুষ ছিলেন ছায়ার মত। ছফা মনে করতেন অর্থনীতির সাথে নীতিশাস্ত্রের যে ঘনিষ্ঠ যোগ তা সবার আগে পরিষ্কারভাবে জানান দিয়েছিলেন অমর্ত্য সেন। অমর্ত্য সেনকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হলে তা ছফাকে দারুণভাবে পুলকিত করেছিল, যোগ্য পুরস্কার যোগ্যজনের হাতে গেছে এটা তাকে খুব বেশি প্রীত করেছিল।
** আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের “খোয়াবনামা” উপন্যাসকে ছফা বাংলাসাহিত্যের হাতে গোনা কয়েকটি সেরা সাহিত্যকর্মের একটি উল্লেখ করেছেন। মূলত আনন্দবাজার পত্রিকা ও এর চাটুকারদেরকে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য ইলিয়াস “খোয়াবনামা” লেখেন। এটি যে অসাধারণ সাহিত্যকর্ম এ ব্যাপারে সাহিত্য সমালোচকদের মধ্যে কোন দ্বন্দ্ব নেই। আমার দুঃখ লাগে এ কথা ভেবে যে, ইলিয়াস এই আনন্দগোষ্ঠী থেকেই বিখ্যাত ‘আনন্দ পুরস্কার’ গ্রহণ করেন, অবশ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত ইলিয়াসের তত দিনে একটি পা কাটা হয়েছে। মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকা ইলিয়াসের আনন্দ পুরস্কার গ্রহণ ছফাকে খুবই মর্মাহত করেছিল। আসলে এটা আমাদের প্রশাসনের ব্যর্থতা। আমি যতটুকু জেনেছি সরকারী তেমন কোন সাহায্য ইলিয়াসের ভাগ্যে জোটেনি। বাংলাদেশে বিখ্যাত ব্যক্তিরা পঁচে গিয়ে বেশি বিখ্যাত হন।
** ঝিনাইদহের কালিগঞ্জের সহস্রবর্ষী বটবৃক্ষ ছফাকে আকৃষ্ট করেছিল। এই গাছটিকে তিনি ইউনেস্কো ইন্টারন্যাশনাল হেরিটেজের আওতায় আনার চেষ্টা করেছিলেন অনেকবার। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছিলেন। ছফারা জীবিত ছিলেন অন্যদের সময়ে। ছফার বাবা মনে করতেন, “যে গ্রামে বটগাছ নেই সেই গ্রামের জীবন বিকশিত জীবন নয়। সেখানে প্রেম-প্রীতির বদলে হিংসাই প্রধান ভূমিকা পালন করে”। আমি এ কথা বলে শেষ করব যে, যে সমাজে জ্ঞানীকে চেনার মত চোখ নেই সে সমাজ অন্ধ, বন্ধ্যা। এ ধরনের সমাজে মানুষ কেবল দুমুঠো অন্নের প্রত্যাশা করতে পারে, উন্নত হওয়ার মানসিকতা জন্মানোর আগেই এদের বিবেক অন্ধ হয়ে যায়।
*********************************************************************************
উইংস অব ফায়ার
সেই হাতই সুন্দর, যে কাজ করে আন্তরিকভাবে, সৎভাবে, সাহস ভরে, মুহূর্ত থেকে মুহূর্তে, সারাদিন ধরে”- পড়ছিলাম শেখ সেলিমের অনুবাদে অরুন তিওয়ারীর সহযোগিতায় প্রকাশিত পদ্ম ভূষণ, পদ্মবিভূষণ এবং ভারত রত্ম উপাধি পাওয়া ইন্ডিয়ার ১১তম প্রেসিডেন্ট (২০০২-২০০৭)এ, পি, জে, আবদুল কালামের “উইংস অব ফায়ার” বইটি। মূলত এটি একটি আত্মজীবনী যেখানে স্থান পেয়েছে লেখকের বাল্যকাল, মিসাইল কর্মসূচি আর ইন্ডিয়ান মহাকাশ গবেষণা নিয়ে লেখকের একের পর এক ব্যর্থতা এবং সফলতা।
প্রারম্ভিক আলোচনায় ধর্মের প্রতি লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি, বাবা-মা এবং প্রতিবেশীদের মুসলিম ধর্মের প্রতি অগাধ বিশ্বাসী মনোভাব উঠে এসেছে। পরবর্তীতে উল্লেখ করা হয়েছে কৈশোরে স্বপ্ন বুপন করা আবদুল কালামের এরোনেটিকেল ডেবলাপমেন্ট ইস্টাবলিশমেন্ট এর কর্মঠ জীবন। যেখানে হোভারক্রাফ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে লেখক সুযোগ পেয়েছেন ইন্ডিয়ান মহাকাশ গবেষণা সেন্টার আর সেখান থেকে পেয়েছেন “নাসা” য় প্রশিক্ষন করার সুযোগ।
বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য নি:সন্দেহে অত্যন্ত আকর্ষণীয় এ বইটি। কারন বইটির সত্তোর শতাংশ ই হচ্ছে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত তথ্যরাশি। তবে ভবগুরে থেকে শুরু করে শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবনযাপনকারী প্রতিটি তরুন তরুণীর জন্য স্বপ্ন বাস্তবায়নে উৎসাহ মুলক একটি বই উইংস অব ফায়ার।
********************************************************************************
ডেল কার্নেগীর শ্রেষ্ঠ রচনাসমগ্র
অনেক মানিক রতনের সন্ধান পেয়েছি আজ। সত্যি ই তো ছোট্র জীবনপথ কে প্রতিদিন একটু একটু করে সাজাতে হবে। ভালবাসতে হবে নিজেকে আর আন্তরিকতা থাকতে হবে প্রতিটি কাজে। তবে ই শত কষ্টকর অবস্থা থেকে মুক্তি মিলবে। ছোট ছোট বাক্য আর জীবনের অভিজ্ঞতা গুলোর বাস্তব সংমিশ্রন ডেল কার্নেগীর ★শ্রেষ্ঠ রচনাসমগ্র ★। বইটির প্রতিটি অংশ মিলে যাবে যে কারও জীবনের সঙ্গে। শুরুটা দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তির আনন্দদায়ক উপায় আর শেষটা ব্যাক্তিত্বের বিকাশ এবং সাফল্য লাভের উপায়ের পরামর্শ।
দুশ্চিন্তা তো তখন ই আসে যখন কর্মপরিকল্পনায় থাকে অজানা বিষয়। সুতরাং দূরের কোন অস্পষ্টটা কে নিয়ে পড়ে না থাকে কাছের কোন স্পষ্ট জিনিস দেখতে হবে। তবে সেই অস্পষ্টতাকে বিভিন্ন ভাবে বিশ্লেষণেও সমাধান মিলবে। জীবনের প্রতিটি মুহুর্ত ই গুরুত্ববহ। মন্দ চিন্তায় মস্তিষ্ক ভরপুর করে স্নায়ুবিক দুর্বলতা বাড়ানোর প্রয়োজন নেই। ভাল চিন্তার সংমিশ্রন তৈরি যোগাবে অফুরন্ত মানসিক শক্তির। ডেল কার্নেগী দিগন্তপাড়ের মায়া গোলাপের স্বপ্নে আচ্ছন্ন হতে বাধা দিয়েছেন। মানুষের আশেপাশে ই ছড়িয়ে থাকা গোলাপ গুলো নিয়ে ই বাচতে হবে। একটু সচেতন দৃষ্টি রাখলেই পাওয়া যাবে জানালার পাশে ছড়িয়ে থাকা কোটি গোলাপ।
আমরা সবাই যোদ্ধা। জীবন নামের যুদ্ধের মাঠে একটি টাকার জন্যও সংগ্রাম বাধিয়ে দিই। অথচ দিনের বেশির ভাগ সময় অতিক্রম করি অপ্রয়োজনীয় আলাপন নয়তো কারও সমালোচনায়। জীবন যুদ্ধে এই সময়টাকে যদি যথাযথ ভাবে রক্ষনাবেক্ষন করতে পারি তবে আশেপাশের শত ঝড় ঝাপটা বা কঠিন কোন যন্ত্রণা ও আমাদের কাবু করতে পারবে না।
********************************************************************************
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের
‘চিলেকোঠার সেপাই’
‘চিলেকোঠার সেপাই’ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কালজয়ী সৃষ্টি। অত্যন্ত সাবলীলভাবে সহজ ভাষায় ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের ভূমিকা তুলে ধরেছেন। ছাত্র সংগঠনের পাশাপাশি জনসংগঠকদের ত্যাগের বিবরণ দিয়েছেন। মানুষের মুক্তির আকাক্সক্ষার পাশাপাশি একাকীত্বের করুণ পরিনতিও এ উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয়। ভাষাশৈলী ও অলঙ্করণ ভাব প্রকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। ঊনসত্তরের গনআন্দোলনে সর্বশ্রেণীর সাচ্ছন্দে অংশগ্রহণ, গ্রামীণসমাজে শোষণের হাতিয়ার হিসেবে কুসংস্কারের ব্যবহার, একাকীত্ব, প্রেম প্রভুতি এবং এগুলির নির্মাণে ভাষার সার্থক ব্যবহার এ উপন্যাসের অন্যতম মূল উপজীব্য বিষয়।
“চিলেকোঠার সেপাই – এ দেশের রাজনীতির পাকিস্তান পর্বের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আন্দোলন ঊনসত্তরের গনআন্দোলনকে ইলিয়াস যে ভাবে শিল্পসম্মতভাবে পুননির্মান করেন তা আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে বাস্তবিকই অভূতপূর্ব।” হাড্ডি খিজিরের মত অবহেলিত মানুষরা যেমন আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছে, আবার আন্দোলনের অজুহাতে সুবিধাভোগী কিছু মানুষ সম্পদ লুট করেছে। শহরে যেমন আন্দোলন গড়ে উঠেছে, গড়ে উঠেছে গ্রামেও। আলতাফ, আলাউদ্দীনের মত মানুষের হাত ধরে শহরে গড়ে ওঠে আন্দোলন। আবার গ্রামেও আলিবক্সের মত সংগঠকদের দেখা মেলে। আনোয়ার গ্রামে গিয়ে চাষাভুষা মানুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রুখে দাড়িয়েছে অত্যাচারের, শোষণের।
কুসংস্কারকে ব্যবহার করা হয়েছে শোষনের মাধ্যম হিসেবে। আফসার গাজী ও খয়বর গাজীর মত জোতদারেরা নিরীহ মানুষদের খুন করে চালিয়ে নেয় বিভিন্ন অজুহাতে। গোয়ালের গরু চুরি করে দেয় খোয়াড়ে। আবার সেই গরু আনতে গেলে টাকা নেয়ার জন্যে নানা ফন্দি করে। এমন কি পঁচার বাপ কে জীবন দিতে হয়। তাছাড়া, প্রাচীন অধিবাসী বটগাছের কান্ড বা ডাল কাটলে তার অমঙ্গল হয়। এ অজুহাতে প্রাণ যায় চেংটুর। যদিও স্পষ্ট করে উল্লেখ নেই, তবে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
আন্দোলন, একাকীত্বের মাঝেও প্রেম-ভালোবাসা ম্লান হয়ে যায়নি। আলাউদ্দীনের মামা রহমতউল্লাহর মত পাকিস্তানী দালালদের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালত হলেও তারই মেয়ে সেতারার সাথে আলাউদ্দীনের সম্পর্ক খোয়া যায়নি। প্রণয় থেকে পরিণয় লক্ষ করা যায় এ উপন্যাসেই। আবার, অভাব অভিযোগের মাঝেই টিকে থাকে খিজিরের সংসার। ওসমানও স্বপ্ন দেখে রেনুকে নিয়ে।
ভাষাশৈলী ও অলঙ্করণ উপন্যাসটিকে প্রাঞ্জল আর বাস্তবনির্ভর করেছে। খিজিরের মত মানুষের ভাষা দিয়েই তাকে রূপায়ন করা হয়েছে। তাদের ব্যবহার্য গলিগুলো হুবহু উঠে এসেছে। উদাহরণস্বরূপ, খিজির বলে, “আজাইড়া প্যাচাল পাড়িস না! আউজকা ভাড়া লইবো ক্যাঠায়?” আবার গ্রামকেও সেভাবেই তুলে ধরা হয়েছে। যেমন, চেংটুর লাশ পাওয়া গেলে নাদু পরামাণিক বিলাপ করতে করতে বলে, “চেংটু হারামজাদা তোর নাফপাড়া কোটে গেলো? বেন্ন্যামানষের ব্যাটা, চাষাভূষার ব্যাটা, তুই যাস বড়োনোকের সাথে তাল দিবার?” ভাষার ব্যবহার নি¤œশ্রেণীর লোকদের প্রত্যক্ষ উপস্থিতি নির্দেশ করে।
চিলেকোঠার সেপাই নামকরণের উদ্দেশ্য আমার জানা নেই। তবে যতটুকু মনে হয়েছে, এখানে চিলেকোঠার বাসিন্দা ওসমানকেই নির্দেশ করা হয়েছে। এই মানুষটি চিলেকোঠার নির্জন ঘরটিতে বাস করে। গনঅভ্যুত্থানে তার শুধু সমর্থনই নেই, বরং তার প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণও রয়েছে। উপন্যাসের মাঝামাঝি থেকে তার স্মৃতি বিভ্রাট দেখা দেয়। একেবাওে শেষ এপিসোডে দেখা যায়, সব বন্ধন ছিন্ন করে দরজা ভেঙ্গে এগিয়ে চলে মৃত খিজিরকে অনুসরণ করে। সেপাই শব্দটি ব্যবহারের সার্থকতা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আমার কাছে দু’টি বিষয় পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রথমত, ওসমান ছিলেন চিলেকোঠায় বসবাসরত ভাড়াটিয়া। তথাপি, তার সাথে রানুদের পরিবারের একাগ্রতা লক্ষ করা যায়। ওদের পরিবারের যে কোন সিদ্ধান্তে ওসমানের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। আবার রানুকে সে পড়ায়। এমনকি ভালোবাসেও। এক্ষেত্রে সে সেপাই বা রক্ষকের ভূমিকা পালন করে। দ্বিতীয়ত, সে গণআন্দোলনের একজন সেপাই। তিনি মিছিল পেলেই ছুটে যেতেন, যোগ দিতেন মিছিলে। সর্বশেষ খিজির তাকে মিছিলে ডাকে কিন্তু তিনি যেতে পারেন না। সেই মিছিলে মিলিটারির গুলিতে শহিদ হয় খেটে খাওয়া শ্রমিক হাড্ডি খিজির। এই ঘটনার পর থেকে সে কারণে অকারণে খিজিরের নামে প্রলাপ করতে থাকে। সুতরাং, গণআন্দোলনে ওসমানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ তাকে সেপাই বা রক্ষকের ভূমিকায় করেছে।
পরিশেষে, আন্দোলনে গণমানুষের অত্যাচার থেকে মুক্তির চিরন্তন আকাক্সক্ষা ফুটে উঠেছে সফলভাবে। কুসংস্কারের হেতু তলে ধরা হয়েছে অভিনব পদ্ধতিতে। কেন কুসংস্কার তৈরী হয় কিংবা কারা এর শিকার, সেটা উন্মোচন করে দিয়েছেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। প্রেম ভালোবাসাও জীবনের অনুসঙ্গ হিসেবে উঠে এসেছে সফলভাবে।
********************************************************************************
ক্রীতদাসের হাসি – শওকত ওসমান
পৃথিবী শুধু তার জন্য যার ক্ষমতা আছে। এখানে যে কেউ চাইলেই সুখে থাকতে পারে না, হাসতে পারে না, অধিকার নেই। হাসবে শুধু তারাই, যাদের ক্ষমতা আছে, বিত্ত-ভৈবব আছে। ইচ্ছামতো ভালো থাকার অধিকার, সুখে থাকার অধিকারও তাদের। শওকত ওসমানের ‘ক্রীতদাসের হাসি’ উপন্যাসটি আমার এই কথাগুলোর ভিত্তি প্রস্তর দাঁড় করিয়েছে। বোঝার সুবিধার্থে উপন্যাসের কিছু ঘটনা সংক্ষেপে তুলে ধরছি।
বাগদাদের অধিপতি হারুনর রশীদের মুখে আবেগ-চাঞ্চল্যের ছাপ। বড় একা লাগছে। সুসজ্জ্বিত মহল ‘কাওসুল আকদারে’ সবকিছুই আছে কিন্তু কেমন এক শূন্যতা ঘিরে আছে তার পুরো পৃথিবী জুড়ে। ভুলবশতঃ প্রিয় উজির আজম জাফর বামের্কীর কতল পরোয়ানা দিয়েছিলেন। নিজের করা ভুলে অনুশোচনায় ভুগছেন। মনের অশান্তি থেকে একটু পরিত্রান পেতে একান্ত সেনাপতি মশরুরের পরামর্শে বাগানে হাঁটতে বের হলেন। পুরানো স্মৃতি আওড়াতে লাগলেন বারবার। হঠাৎ তিনি লক্ষ্য করলেন তার মহলের অদূরেই সুখের হাসি হাসছে কেউ। অস্পষ্ট তবে মোহনীয়, যুগযুগান্তের উৎসবের বার্তাও বয়ে আসে সেই হাসির তরঙ্গে।
বাদশাহের অশান্ত মন আরো বেশী অশান্ত হয়ে উঠে। বাগদাদ অধীশ্বর হয়েও তিনি যে শান্তির গরীবানা হালে আছেন তা তো এই কথাগুলোতেই ফুটে উঠেছে- “মশরুর। শুনেছো এমন হাসি? এতরাতে কে হাসছে আমার মহলের দেওয়ালের ওদিকে? এ হাসি ঠোঁট থেকে উৎসারিত হয়না। এর উৎস সুখ-ডগমগ হৃদয়ের নিভৃত প্রদেশ। ঝর্ণা যেমন নির্জন পাহাড়ের উৎসঙ্গ-দেশ থেকে বেরিয়ে আসে উপলবিনুনী পাশে ঠেলে ঠেলে-বিজন পথ-ভ্রষ্ট তৃষ্ণার্ত পথিককে সঙ্গীতে আমন্ত্রণ দিতে-এই হাসি তেমনই বক্ষঝর্ণা-উৎসারিত। কিন্তু কে এই সুখীজন- আমার হিংসা হয়, মশরুর। আমি বাগদাদ অধীশ্বর সুখ ভিক্ষুক। সে তো আমার তুলনায় আরোও বড় ভিক্ষুক, তবু সুখের অধীশ্বর! কে, সে?
যখন জানা গেল এ হাসি তারই গোলামের তখন তিনি অবাক না হয়ে পারলেন না। গোলামেরা এমন হাসি হাসতে পারে তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। জোর যার মুল্লুক তার সূত্রে হারুনর রশীদের মুল্লুক আছে ঠিকই কিন্তু হাসি নেই। গোলামের মুল্লুক নেই তবে সুখের সমৃদ্ধি আছে, হৃদয়ের কোঠরে হাসি আছে। আর কি চাই?
হাবসী গোলাম তাতারীর সাথে বাদশাহের সহধর্মিণী জুবায়দার একান্ত বাঁদী আরমেনী তরুণী মেহেরজানের গোপন বিয়ে হয়েছিল। এই বিয়ের দায়িত্ব পালন করেন স্বয়ং বাদশাহের সহধর্মিণী। মেহেরজান খুবই রুপবতী, আকর্ষণীয়া যৌবনবতী এক নারী। বেগম জুবায়দা মেহেরজানকে খুব ভালোবাসতেন, হাসি-তামাশা করতেন তার সঙ্গে। বেগম জুবায়দার উৎসাহে প্রতিরাতেই তাতারীর সাথে গোপন অভিসারে যেত মেহেরজান, সুখে-শান্তিতে কাটতে থাকে এই দুই প্রেমিকযুগলের। তাদের সুখী জীবনের বার্তাই গভীর রাতের নিঃস্তব্ধতাকে ম্লাণ করে দিয়ে হাসি হয়ে ভেসে বেড়ায় দূর থেকে দূরে।
ঘটনাক্রমে গোলামের সুখের রহস্য জানতে পারলেন বাদশাহ। পরিকল্পনামতো একরাতে হাজির হলেন তাতারীর শয়নকক্ষে, একসাথে পেয়ে গেলেন মেহেরজানকেও। অতুলনীয় রুপবতী, যৌবনা মেহেরজানকে দেখলে যেকেউ ভালোবেসে ফেলবে। বাদশাহও মুগ্ধ হলেন এই অপরুপ লাবণ্যময়ীকে দেখে। ভীত-সন্ত্রস্ত তাতারী ও মেহেরজানকে বাদশাহ অভয় জানালেন এবং তাদেরকে তখনই আজাদ ঘোষণা করলেন। শাস্তির বদলে অভাবনীয় পুরস্কারে দু’জনই অবাক হলো। বাদশাহ জানালেন তাদের হাসিই তাদেরকে বাঁচিয়ে দিয়েছে এবং হাসিতে মুগ্ধ হয়েই এই এনাম তাদেরকে দেয়া হয়েছে। তাতারীকে একটি রাজ্যের রাজত্ব ঘোষণা করা হলো। রাতের দিপ্রহরে যে তাতারী ফকির ছিল ত্রিপ্রহরে এসে সে আমির হয়ে গেল। হাসির এত শক্তি, এত দাম! তাতারীকে তখনই তার জন্য মনোনীত রাজ্যে পাঠিয়ে দেয়া হলো, এবং বলে দেয়া হলো অতিশীঘ্রই তার হাসি শুনতে যাবেন বাদশাহ। মেহেরজানকে বেগম জুবায়দার কাছে ফিরে যেতে বলা হলো।
উপন্যাসের এই পর্যায়থেকে ঘটনা ভিন্নরুপ নিতে শুরু করে। তাতারী তার নতুন রাজ্যে বাস করা শুরু করলো কিন্তু তার সুখের পৃথিবীর দরজা ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। তাতারীর সুখের ঠিকানা ছিল মেহেরজান। সারাদিনের ক্লান্তির পরে মেহেরজানকে কাছে পেয়ে সব কষ্ট ভুলে যেতে পারতো, মন খুলে হাসতে পারতো। কিন্তু এখন!
গোলামী জীবনে মেহেরজান ছিল, সুখের একটা ঠিকানা ছিল সেথায়। হৃদয়জুড়ে দুঃচিন্তার কালো মেঘ জড়ো হতে থাকে তাতারীর। অনিশ্চয়তার কালো ছায়া তাকে আচ্ছন্ন করে ক্রমশঃ। হাসতে ভুলে যায় তাতারী। বাদশাহ তাতারীর মনে শান্তি এনে দিতে বাগদাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং সুন্দরী চিরযৌবনা তরুণীকে পাঠালেও তাতারী সেই রমণীকে ফিরিয়ে দেয়। তাতারীর নৈতিকতার জোর দেখে লজ্জায় পড়ে যায় সেই সুন্দরী এবং পড়ে সে অকল্পনীয়ভাবে আত্মহত্যা করে। রাজ্য-রাজত্ব, ভোগ-বিলাস কোন কিছুই চাইনা তাতারীর। কোনো কিছুতেই যে লোভ নেই চরিত্রবান হাবসী গোলাম তাতারীর। বাদশাহ অসন্তুষ্ট হয়ে যান এই যুবকের উপর। ঈর্ষান্বিত হন তাতারীর পবিত্র আত্মার জ্যোতি দেখে, তার প্রশংসা বিষিয়ে তোলে বাদশাহকে। নির্মম অত্যাচারের খরগ নেমে আসে তাতারীর ওপর।
বাদশাহের কারাগারে অত্যাচারে জর্জড়িত ক্ষত-বিক্ষত শরীর নিয়ে তাতারী বেঁচে থাকে দীর্ঘ ৩/৪ টি বছর কিন্তু তার মুখে কোনো কথা নেই। এই দীর্ঘ কারাবাসে একটি কথাও বাদশাহের সাথে বিনিময় করেনি সে। শেষদৃশ্যে মেহেরজানের উপস্থিতি ঘটে বাদশাহের বিবি পরিচয়ে। কথা ফোটে তাতারীর মুখে। অসহ্য যন্ত্রনা সয়েও এতটুকু ভালবাসা কমে যায়নি মেহেরজানের প্রতি বরং মেহেরজানই ভুলে গিয়েছিল সবকিছু। শেষপর্যায়ে হলেও মেহেরজান চিনতে পারে তার ভালোবাসার যথাযোগ্য পুরুষ তাতারীকে। কিন্তু নিরুপায় মেহেরজান এবং তাতারী। তারা কি জানতো যে হাসির বিনিময়ে তারা মুক্তি পেয়েছিলো সেটা আসলে মুক্তি ছিলনা বরং তার চেয়ে আরও কঠিন শেকল তাদের পায়ে বেঁধে দেয়া হয়েছিল। ইতিহাসে দেখা যায় অধিকাংশ শাসকরা নিজেকে ঈশ্বরের মর্যাদা দান করে বসেন, প্রজারা তাদের হুকুমের গোলাম হয়ে থাকে সারাজীবন। উপন্যাসের ভীতরকার প্রতিটি ঘটনা পাঠকহৃদয়কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে। উপন্যাসের বিভিন্ন চরিত্র পাঠকদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে সমাজের ক্ষমতাশালীদের আধিপত্যের নোংরা আচরণগুলো।
ক্রীতদাসের হাসি শওকত ওসমানের জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত একটি উপন্যাস প্রকাশিত হয় ১৯৬২ সালের দিকে। উপন্যাসটি রচনা সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য থেকে জানা যায় এটি আরব্য কাহিনী- ‘আলেফ লায়লা ওয়া লায়লানে’ (সহস্র দুই রাত্রি)’-র শেষ কাহিনীর বাংলা তরজমা (অনেকেই জানেন ‘আলেফ লায়লা লায়লান’ অর্থাৎ ‘সহস্র এক রাত্রি’ কিন্তু সেই তথ্যটি যে ভুল উপন্যাসটির ভূমিকা অংশে লেখক সে সম্পর্কে একটি আলোচনা তুলে ধরেছেন)। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের কবলে তৎকালীন পাকিস্তানে জনগনের সবধরনের বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়েছিল। সেই শাসন ব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করে এই উপন্যাস জনপ্রিয়তা পেয়েছিল বেশ।
গণতান্ত্রিক চেতনায় যখনই কেউ সোচ্চার হয়েছে তখনই স্বৈরশাসকরা তা কঠোর হাতে তা দমন করেছে। এবং এই প্রথা চলতে থাকে যুগ যুগ ধরে, প্রতিবাদ যে কেউ করে না, তা কিন্তু নয়। প্রতিবাদ করে, তবে তাতে লাভের লাভ হয়না কিছুই উল্টো প্রতিবাদকারীকে চরম মূল্য গুনতে হয় সবসময়ই। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রের তাতারী গণতান্ত্রিক চেতনাকে ধারণ করেছে। আর বাদশাহ হারুনুর রশীদ স্বৈরশাসকের ভূমিকা পালন করেছে যেন। এই ঘটনা রুপকের মধ্য দিয়েই বিস্তৃত হয়েছে শওকত ওসমানের ক্রীতদাসের হাসি।
উপন্যাসের রাজনৈতিক পটভূমি বিশ্লেষণ করতে যারা অনিচ্ছুক তাদের কাছেও গোলাম তাতারীর তীব্র শ্লেষমাখা চিৎকার বাঙালীর সংগ্রামের চেতনা পাঠকের কাছে সুস্পষ্টভাবে ধরা দিবে শেষ অংশের এই কথাগুলোই- ক্ষত-বিক্ষত তাতারীকে চাবুক মারা হচ্ছে, তাতারী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে এবং বলছে- “শোন হারুনুর রশীদ, দীরহাম দৌলত দিয়ে ক্রীতদাস গোলাম কেনা চলে, বান্দী কেনা সম্ভব! কিন্তু… কিন্তু ক্রীতদাসের হাসি? না! না! না! না!
********************************************************************************
হুমায়ন আজাদেরঃ
লাল নীল দীপাবলি
আপনজনদের রুপ এবং হৃদয়ের বদল দেখতে দেখতে ক্লান্ত পথিকদের জন্য এক পশলা খোরাক হতে পারে বাংলা সাহিত্যের সৌন্দর্যরূপের বদল দেখা। উপন্যাস, আত্মকাহিনী, গল্প,নাটক, সনেট, কাব্যগ্রন্থ, কাহিনীকাব্য, রম্যরচনা, শিশুতোষ গল্প, ছোট গল্প,প্রেম,বিরহ,পরিণতি -কী নেই বাংলা সাহিত্যে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক ড: হুমায়ুন আজাদ স্যার বাংলা সাহিত্যের নানা রঙের দীপ নিয়ে ছন্দের তালে তালে সৃষ্টি কররছেন “লাল নীল দীপাবলি “।
লেখকের লেখনীতে শুরুতেই একটু মতপার্থক্য রয়েছে। অর্থাৎ বাংলা সাহিত্যের ১৩৬৭ বছরের ইতিহাসের মাঝে প্রাচীন যুগ কে ধরা হয় ৬৫০ থেকে ১২০০ পর্যন্ত সময়কাল। কিন্তু বইটিতে উল্লেখ আছে প্রাচীন যুগটি ৯৫০ থেকে ১২০০ সাল পর্যন্ত যা ড: সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সাথে মিলে যায়।
লেখকের বর্ণনায় উঠে আসে “বাঙালা ” নামের উৎপত্তি। সম্রাট আকবরের সভার রত্ন আবুল ফজল বলেছেন বঙ্গ শব্দের সাথে “আল ” শব্দটি যোগ হবার পর আমরা পেয়েছি “বাঙাল” শব্দটি। বৃষ্টি বা বর্ষায় পর্যাপ্ত বাঁধ বা আল ছিল বলে ই এদেশের নাম হল বাঙালা বা বাঙলা।
১৮৮২ সালে রাজা রাজেন্দ্রলাল কর্তৃক প্রক্ষাপট সূচিত হয়ে ১৯০৭ সালে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্রী কর্তৃক আবিষ্কৃত চর্যাপদ ই ছিল প্রাচীন যুগের একমাত্র নিদর্শন। মধ্যযুগে বৈষ্ণবপদাবলি এ এবং আধুনিক যুগে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, প্যারীচঁাদ মিত্র, বঙ্কিমচন্দ্র, দীনবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ, বিহারীলাল,মশাররফ হোসেন, কায়কোবাদসহ অসংখ্য তীক্ষ্ণ প্রতিভার।
মঙ্গলকাব্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক যেন জানার তৃষ্ণা আরও বাড়িয়ে দিলেন। দুই পৃষ্ঠা উল্টোতেই জানা যাবে রাধা-কৃষ্ণ, বেহুলা-লক্ষীন্দরের কাহিনী।
লোকসাহিত্যের এক উপাদান “ছড়া” বইটির মাঝপথে ক্লান্তি দূর করে দিবে। আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে, ঝাঁঝর কাসর মৃদঙ্গ বাজে- এসব আবোলতাবোল ছন্দ মনের ভিতর এমনিতেই গুনগুনিয়ে দেহে নৃত্যের একটুখানি ঝংকার তুলে দিবে। উনিশশতকের পর্তুগিজ কবি অ্যান্টনি ফিরিঙ্গির বাংলার প্রতি আকাঙ্খা আমাদের বাঙালিদের মধ্যে বাংলা জানার আগ্রহকে দ্বিগুণ করে দিবে। যদিও লেখকের সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় অ্যান্টনির কথা বিস্তারিত তুলে ধরা সম্ভব হয় নি, তবুও “জাতিস্বর” মুভি থেকে সহজে ই এ পর্তুগিজ কবি সম্পর্কে সহজে হজম করা যাবে।
বর্তমান যুগে এসে বাংলা সাহিত্যের পুরোনো রত্নভান্ডার কে সঙ্গী করেই এগোতে হবে। পুরাতন মুক্তোদানা গুলো কে পাশে রেখে বাংলা সাহিত্যে নতুন নতুন সৃষ্টির দীপ জ্বেলে দিতে হবে। আর তবে ই সাহিত্য নামক মোমবাতির আলোয় আলোকিত হবে শিশু, কিশোর,যুবক,বৃদ্ধসহ সমগ্র মানবজাতি।
*******************************************************************************
একাত্তরের দিন গুলি-
জাহানারা ইমাম
বিভিন্ন সংগঠনের মধ্য দিয়ে ও নিজের অধীত জ্ঞান মানুষের মনোজগতে পৌছে দেয়া যায় -এমন সকল নির্যাস ই পাওয়া তাঁর কাছ থেকে। তিনি এক মুক্তিযোদ্ধার মা, সংগ্রামী দেশপ্রমিকের স্ত্রী এবং দৃড়চেতা বাঙালী নারী জাহানারা ইমাম। কোন বুকফাটা আর্তনাদ বা অস্থির হাহাকারে নয় বরং গোঁলাপকুড়ির মত মেলে ধরেছেন জীবনের দুঃখগুলোকে। খন্ড খন্ড অগণিত দুঃখের মিলনে যে মালা গেথেছেন তার হৃদয়চিত্র প্রস্ফুটিত হয়েছে “একাত্তরের দিনগুলি” তে। যেখানে স্থান পেয়েছে ১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ সোমবার থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর শুক্রবার পর্যন্ত প্রতি মুহূর্তের টান টান উত্তেজনার প্রত্যক্ষ বিবরণ।
লেখিকার পুত্রের সাথে ছিল তার বন্ধুসুলভ সম্পর্ক। সারাদিনের কর্মযজ্ঞ শেষ করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পর ক্লান্তিহীন ভাবে মাকে যেন সব বলতে হবে রুমির। কথায় কথায় ইংরেজী বাংলার উদ্ধৃতি ব্যবহার করা ছেলেটি ২ মার্চ বাড়ি এসে বরাবরের মতই মাকে সব বর্ণনা দিতে লাগলেন। লেখিকা নতুন পতাকার নাম শুনে তা কেমন দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করলে রুমি একখন্ড কাগজ আর কয়েকটা রঙিন পেন্সিল বের বের করে সেখানে সবুজের উপর লাল গোলাকার সূর্য তার মধ্যে হলুদ রঙে পূর্ব বাংলার ম্যাপ একে দেখাল।
তবে এ বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্কের মাঝেও ছেলের জন্য প্রাণটা সব সময় হাতে থাকত লেখিকার। কারন যেভাবে চেয়ারে স্বাধীকার স্বাধীনতা নিয়ে চেয়ারে চেয়ারে বাকবিতন্ডা চলছে কখন যেন কোনদিক থেকে আচমকা একটি গুলি এসে ছিন্ন করে দেয় রুমির হৃদয়টাকে। জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে একটি গুলির ব্যাবধান মাত্র।
ছেলের আলোচনার পরিধি নিয়ে সন্তুষ্টি কাজ করত লেখিকার মধ্যে। মাও সেতুং, এঙ্গেল্স, লেনিনদের নিয়ে এত স্বচ্ছ ধারণা তার আশেপাশে অনেকেই জানত না। ছোট ভাই শুধু চেগুয়েভেরার কথা আসলেই একটু আধটু লাফিয়ে উঠত।
মে মাসের দিকে ঘটে যাওয়া নৃশংস ঘটনার একটি হল রক্ত স্থানান্তর। সুস্থ মানুষ গুলোকে ধরে নিয়ে পাক আর্মিরা শরীরের শেষ রক্ত বিন্দু টুকুও নিয় নিত রাবারের সিরিঞ্জ ব্যবহার করে।
১৫জুন রুমি বাড়ি ছাড়ার ৪৮ দিন পর যখন বাড়ি আসে তখন যেন এক নতুন রুমিকে আবিষ্কার করেন জাহানারা ইমাম। সিগারেট খাওয়া, উসখোখুসকো চুল,ঠিক মত সেভ না করা এক অগোছালো রুমি। দীর্ঘদিন ট্রেইনিংয়ে থাকা ছেলের গল্প গুলো শুনে যেন অনেক ভাবনার জালে আবদ্ধ হন লেখিকা। সব সময় ফ্রিজে একগাদা খাবার রান্না করে রাখেন আর রুমির বন্ধুরা এলে তাদের যত্ন করে খাবারের ব্যবস্থা করেন।
নিজের বাড়ি থেকে রুমিসহ তার বন্ধুদের ধরে নিয়ে যাওয়া হলেও পরে সবার খোঁজ মিলে কিন্তু রুমি আর ফিরে আসে নি। জামির জন্মদিন, ঈদ, নিজেদের বিবাহবার্ষিকী, রুমির জন্মদিন সব কিছুতেই স্থবিরতা চলে আসে। আর একটু একটু করে রুমির বন্ধুরাই হয়ে পাশে থাকে লেখিকার। একজন রুমির মা হয়ে উঠেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম।
0 comments:
Post a Comment