Saturday, July 22, 2017

বিখ্যাতদের মজার ঘটনা





আইনস্টাইনের ‘থিউরি অফ রিলেটিভিটি’ অল্প কয়েকজন বিজ্ঞানীই শুধু বুঝতে পেরেছিলেন।কিন্তু তা সত্ত্বেও এই আবিষ্কারের ফলেই তাঁর জনপ্রিয়তা সর্বস্তরে পৌঁছে যায়।এক চুরুট কোম্পানি তো তাদের চুরুটের নামই রেখে ফেলে রিলেটিভিটি চুরুট।এ সময় আমেরিকা ভ্রমণের আমন্ত্রণ পেয়ে সস্ত্রীক রওনা হন তিনি।জাহাজ থেকে নামার মুহুর্তেই সাংবাদিকরা তাঁকে ঘিরে ধরেন।একজন একেক রকম প্রশ্ন করতে থাকেন।এক সাংবাদিক প্রশ্ন করে বসেন,আচ্ছা বলুন তো মেয়েরা আপনাকে এত পছন্দ করে কেন?আইনস্টাইন মৃদু হেসে উত্তর দেন,আপনি জানেন কি না জানি না,মেয়েরা সবসময় লেটেস্ট ফ্যাশন পছন্দ করে,আর এ বছরের ফ্যাশন হল ‘থিউরি অফ রিলেটিভিটি’,আমাকেও ওটার অংশ হতে হয়েছে কি না!

Friday, July 21, 2017

দ্বিতীয়-তৃতীয়-চতুর্থ মাত্রা নিয়ে সবচেয়ে সহজ ব্যাখ্যা - কার্ল সেগান



বৃহত্তর মাপকাঠিতে কসমসকে মাপতে গিয়ে জ্যোতির্বিদরা মাঝে মাঝে বলেন যে, স্থান নাকি বাঁকানো। কিংবা মহাবিশ্ব সসীম কিন্তু অনন্ত। তারা আসলে কী বলতে চাচ্ছে?

ধরে নিন, আমরা একেবারেই সমতল। মানে, পুরোপুরি চ্যাপ্টা। এবং আমরা থাকিও চ্যাপ্টাভূমিতে (Flatland)। এটার নকশা আর নামকরণ করেছিলেন এডুইন অ্যাবট। উনি শেকসপীয়ার বিশেষজ্ঞ, থাকতেন ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডে। চ্যাপ্টাভূমির সবাই, অবশ্যই একেবারেই চ্যাপ্টা। আমাদের বর্গ আছে, বৃত্ত বা ত্রিভুজ আছে। আমরা ঘোরাঘুরি করি, বাসায় যাই, সকল চ্যাপ্টা কাজকর্ম করি। এখানে প্রস্থ আছে, দৈর্ঘ্য আছে, কিন্তু কোনো উচ্চতা নেই। এই টুকরোগুলোর কিছু উচ্চতা আছে। কিন্তু আসুন, সেটা বাদ দেই। ধরে নিই, এগুলো সম্পূর্ণ চ্যাপ্টা। তো, এমন পরিস্থিতিতে আমরা, অর্থাৎ চ্যাপ্টাবাসীরা, ডান-বাম চিনি, আগে-পিছের কথা জানি, কিন্তু কখনো ওপর-নিচের কথা শুনিনি।



এবার ধরুন, সেই চ্যাপ্টাভূমির ওপরে, তিন মাত্রাবিশিষ্ট কিছু একটা হাজির হলো। ঘটনাচক্রে, এটা দেখতে অনেকটা আপেলের মত। ত্রিমাত্রিক এই জিনিসটি বেশ আকর্ষণীয় ও বন্ধুসুলভ বর্গ দেখলো। দেখল যে, সে তার ঘরে ঢুকছে। সে ঠিক করলো, দুটো ভিন্ন মাত্রার মধ্যে বন্ধুত্ব করার উদ্দেশ্যে “হ্যালো” বলবে।

“হ্যালো”, বললো আমাদের ত্রিমাত্রিক প্রাণীটি। “কী অবস্থা? আমি তৃতীয় মাত্রার একজন পর্যটক।” হুম, বেচারা বর্গ বদ্ধ ঘরের সবদিকে তাকালো। কাউকেই দেখলো না। উল্টো কে যেন সম্ভাষণ জানাচ্ছে তার শরীরের ভেতর থেকেই। যেন, অন্তরের কণ্ঠ! সে নিজের মানসিক সুস্থতা নিয়ে সন্দেহ শুরু করলো! ত্রিমাত্রিক প্রাণীটি বেশ নাখোশ হলো! তাকে মানসিক ত্রুটি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে!! তাই সে নেমে এলো, চ্যাপ্টাভূমিতে অবতরণের জন্য। এখন, ত্রিমাত্রিক প্রাণীটি চ্যাপ্টাভূমিতে আংশিকভাবে অস্তিত্বশীল। একটি তল বা একটি প্রস্থচ্ছেদ দেখা যাবে শুধু। যখন ত্রিমাত্রিক প্রাণীটি চ্যাপ্টা তলে প্রথম শরীর ছোঁয়ালো…শুধু স্পর্শ করা জায়গাগুলো দেখা যাবে। সেটা দেখাতে পারি, আপেলকে কালিতে চাপ দিয়ে আর সেটার ছাপ চ্যাপ্টাভূমিতে এঁকে দিয়ে। আপেলটা যতই নামবে, যতই চ্যাপ্টাভূমিকে ছেদ করতে থাকবে। আমরা ক্রমান্বয়ে আরো অনেক ফালি দেখতে পাবো। এটা দেখাতে পারি, আপেলটাকে কেটে। সেই বর্গ সাহেব দেখবে, একেক মুহূর্তে একেক বস্তু আবির্ভূত হচ্ছে কোনো ব্যাখ্যা ছাড়াই। তাও আবার বদ্ধ ঘরে! আর এদের আকৃতিও নাটকীয়ভাবে পাল্টাচ্ছে। সে সিদ্ধান্ত নিলো, তার মাথাটা গেছে। তো, আপেলটা এই সিদ্ধান্তে সামান্য বিরক্ত হলো। এবারের কাজটা দুটো ভিন্ন মাত্রার মধ্যে তেমন বন্ধুত্বপূর্ণ হলো না। সে বর্গকে নিচে থেকে ধরলো। আর আমাদের চ্যাপ্টা প্রাণীটাকে দুলিয়ে দিলো, উড়িয়ে নিলো চ্যাপ্টাভূমির ওপরে। শুরুতে বর্গ কিছুই বুঝতে পারলো না। সে এখন ভীষণ বিভ্রান্ত। এমন কিছুই তার অভিজ্ঞতায় নেই। কিন্তু একটু পরে, সে বুঝতে পারলো যে সে চ্যাপ্টাভূমির বদ্ধ ঘরগুলোর ভেতরটা দেখতে পাচ্ছে। সে তার চ্যাপ্টা বন্ধুদের ভেতরটা দেখতে পাচ্ছে। সে চ্যাপ্টাভূমিকে এমন এক দৃষ্টি দিয়ে দেখছে, যেভাবে ওর জানামতে, আর কেউ দেখেনি। অন্য মাত্রায় গিয়ে সে একটা আকস্মিক সুবিধা পেলো। যেন এক্স-রে দৃষ্টি পেলো। এবার সেই চ্যাপ্টাবাসী ধীরে ধীরে ভূমিতে নেমে এলো। বন্ধুরা ওকে দেখার জন্য ছুটে এলো। তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে, সে হঠাৎ করে আবির্ভূত হয়েছে। কোথাও থেকে হেঁটে আসেনি, অন্য কোনো স্থান থেকে এসেছে। তারা বললো, “কী আলামত! কী হয়েছিলো তোর?” আর বেচারা বর্গকে বলতে হলো – “হুম, আমি একটা আধ্যাত্মিক মাত্রায় ছিলাম…যাকে বলে ‘ওপর’।”

অন্যরা তাকে হাত বুলিয়ে স্বান্তনা দেবে অথবা জিজ্ঞেস করবে – “বেশ, দেখা আমাদেরকে, কই সেই তৃতীয় মাত্রা? কোনদিকে?” আর বেচারা বর্গ উত্তর দিতে ব্যর্থ হবে। কিন্তু হয়তো, আরো মজা হবে, যদি আমরা মাত্রার অন্য দিকটা দেখি। চতুর্থ মাত্রায় গেলে কী হবে? আসুন, সেটার জন্য একটা ঘনকের কাছে যাই।

ঘনকের ব্যাপারটা হচ্ছে এমন – একটা লাইনকে সমকোণের (৯০ ডিগ্রীর) দিকে টেনে আনুন। তাহলে বর্গ তৈরি হবে। বর্গটাকে তার সমকোণের দিকে তুললে, পেয়ে যাবেন ঘনক। তো এখন, আমরা জানি যে, ঘনকের ছায়া আছে। আর ঐ ছায়াতে আমরা দেখি, মানে, ক্লাস থ্রিতে দেখেছি অনেকবার – দুটো বর্গের শীর্ষগুলো সংযুক্ত হয়ে আছে। ত্রিমাত্রিক বস্তুর ছায়াকে দুই মাত্রাতে দেখলে, সব লাইনকে কিন্তু আর সমান মনে হয় না। সবগুলো কোণকে সমকোণ মনে হয় না। ত্রিমাত্রিক বস্তুটিকে দ্বিমাত্রিকে নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করা যায়নি। এটা হচ্ছে ছায়ার মধ্যে একটা মাত্রা কম থাকার জরিমানা।

এবার, এই ত্রিমাত্রিক ঘনকের কথা ধরুন। চলুন, এটাকে নিয়ে যাই বস্তুর চতুর্থ মাত্রায়। এদিকে না, ঐদিকে না, ওদিকেও না। কিন্তু তিনদিকেই সমকোণ করে। আমি ঐ মাত্রাটা দেখাতে পারবো না। কিন্তু ধরে নিন, একটা চতুর্থ মাত্রা আছে। তাহলে আমরা একটা চতুর্মাত্রিক অধি-ঘনক পাবো। যেটাকে বলে টেসার‍্যাক্ট। আমি টেসার‍্যাক্ট জিনিসটা দেখাতে পারবো না, কারণ আপনি-আমি…তিন মাত্রাতে বন্দী হয়ে আছি। কিন্তু যেটাতে দেখাতে পারবো, তা হলো, চতুর্মাত্রিক অধিঘনকের ত্রিমাত্রিক ছায়া।

এই যে, দেখা যাচ্ছে যে, পাশাপাশি দুটো ঘনক যাদের সবগুলো শীর্ষ সংযুক্ত করা আছে। তো, চার মাত্রার আসল টেসার‍্যাক্টে কিন্তু সব লাইন হবে সমান, সব কোণ হবে সমকোণ। এখানে কিন্তু তেমন নয়। কিন্তু এটাই ছায়াতে দেখার জরিমানা। দেখলেন তো, আমরা চার মাত্রার জগত কল্পনা করতে না পারলেও, চিন্তা করতে পারছি ঠিকমতই।

এবার একটা ব্রহ্মাণ্ডের কথা ভাবুন, ঠিক সেই চ্যাপ্টাভূমির মত করে, যা পুরোপুরি দ্বি-মাত্রিক, সবদিকে সম্পূর্ণ চ্যাপ্টা। কিন্তু একটা ব্যতিক্রম আছে – বাসিন্দারা জানে না যে, তাদের দ্বিমাত্রিক ব্রহ্মাণ্ডটা বাঁকানো। এর তৃতীয় একটা মাত্রা (উচ্চতা) আছে। হয়তো গোলকের মত! কিন্তু যাই হোক…এটা তাদের অভিজ্ঞতার পুরোপুরি বাইরে। স্থানীয়ভাবে, তাদের ব্রহ্মাণ্ড দেখতে চ্যাপ্টাই দেখায়। কিন্তু যদি ওদের কেউ, আমার চেয়ে অনেক ছোটো আর চ্যাপ্টা কেউ, আপাতদৃষ্টিতে সরলরেখায় লম্বা এক পদযাত্রায় বের হয় তাহলে, সে একটা বিশাল রহস্য উন্মোচন করবে। ধরুন, সে এখান থেকে যাত্রা শুরু করলো আর তার মহাবিশ্ব অন্বেষণ করতে বেরুলো। কোনো বাঁক নিলো না, কোনো শেষ সীমানায় পৌঁছালো না। সে জানে না যে, তার মনে হওয়া চ্যাপ্টা ব্রহ্মাণ্ড আসলে বাঁকানো একটা গোলক। সে বুঝছে না যে, সে গোলকের ওপর হাঁটছে।

এ স্থানটা গোল হলো কেন?

কারণ ব্রহ্মাণ্ডে বস্তুর পরিমাণ এতো বেশি যে, তা মহাকর্ষ দিয়ে স্থানকে মুচড়ে দেয়। বস্তুকে নিজের মধ্যে গুটিয়ে গিয়ে গোলক হতে বাধ্য করে। তবে আমাদের চ্যাপ্টা বাসিন্দারা তা জানে না। অনেক পরে সে আবিষ্কার করবে যে – সে ঘুরেফিরে শুরুর জায়গাতেই এসে পড়েছে। নিশ্চয়ই তৃতীয় কোনো মাত্রা আছে। আমাদের চ্যাপ্টাবাসী তৃতীয় মাত্রা কল্পনা করতে না পারলেও, বিষয়টি প্রমাণ করতে পারে। পুরো গল্পটাকে এক মাত্রা বাড়িয়ে দিলে যে পরিস্থিতি দাঁড়াবে, অনেক কসমোলজিস্টদের মতে, সেটা আমাদের জন্য প্রযোজ্য। আমরা ত্রিমাত্রিক প্রাণী, বাঁধা পড়ে আছি তিনটি মাত্রায়। আমরা আমাদের মহাবিশ্বকে তিনটি মাত্রায় সমতল ধরে নেই। কিন্তু হয়তো, এটা চতুর্থ কোনো মাত্রায় বেঁকে আছে। আমরা চতুর্থ মাত্রার কথা জানি, কিন্তু অভিজ্ঞতা নিতে পারি না। কেউ দেখাতে পারবে না, চতুর্থ মাত্রাটা কোনদিকে। ডান-বাম আছে, সামনে-পিছে আছে। ওপরে-নিচেও আছে। একই সাথে আরো কিছু দিক আছে, যেগুলো এই মাত্রাগুলোর সাথে সমকোণ করে আছে।

এখন ধরুন, মহাবিশ্ব সম্প্রসারিত হচ্ছে। আমরা যদি এটিকে চতুর্মাত্রিক বেলুনের মত ফোলাই, কী ঘটবে? নির্দিষ্ট ছায়াপথের কোনো জ্যোতির্বিদ মনে করেন যে, অন্য সব ছায়াপথ তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যে ছায়াপথ যত দূরে, সেটার গতি তত বেশি মনে হয়। এটাই দেখেছিলেন হামাসন আর হাবল। এই বাঁকানো মহাবিশ্বের পৃষ্ঠে কোনো সীমারেখা বা কেন্দ্র নেই। এই ব্রহ্মাণ্ড একইসাথে সসীম এবং সীমানাহীন হতে পারে। দূরের ছায়াপথগুলির লালমুখিতা দেখে হামাসনের যুগে অনেকের মনে হয়েছিলো যে আমরা এই প্রসারণশীল ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে আছি, আর আমাদের অবস্থান আশীর্বাদপুষ্ট।

কিন্তু ব্রহ্মাণ্ড যদি বাড়েই, তাহলে চতুর্থ মাত্রায় বাঁকুক আর নাই বাঁকুক, প্রতিটি ছায়াপথের দর্শক ঠিক একই জিনিস দেখবে – সব ছায়াপথই তাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যেন ছায়াপথগুলোর মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। যদি বস্তুর পরিমাণ এতো বেশি হয় যে ব্রহ্মাণ্ড মহাকর্ষের চাপে চুপসে যাবে, তাহলে নিশ্চয়ই এটা গোলকের মতই মুড়ে আছে। যদি কসমসকে গুটিয়ে আনার জন্য পর্যাপ্ত বস্তু না থাকে, তাহলে আমাদের ব্রহ্মাণ্ডের আকৃতি উন্মুক্ত, যা চিরকাল ধরে সব দিকে বেড়ে চলেছে।

এই স্যাডল (ঘোড়ায় বসার আসন) টা মাত্র একটা আকৃতি। এমন উন্মুক্ত আকৃতির সংখ্যা অগণিত হতে পারে। এরা গোলকাকৃতির মত বদ্ধ ব্রহ্মাণ্ড নয়। এই উন্মুক্ত ব্রহ্মাণ্ডগুলোতে অসীম পরিমাণ জায়গা থাকে। যদি আমাদের মহাবিশ্ব সত্যিই বদ্ধ হয়, তাহলে কিছুই বেরুতে পারবে না। বস্তুও না, আলোও না। অর্থাৎ, আমরা হয়তো একটা কৃষ্ণগহবরের ভেতরে বাস করছি। অবশ্য, বেরুনোর একটা রাস্তা থাকবে। একটা প্রস্তাবিত সুড়ঙ্গ বা ওয়ার্মহোল, যা বস্তুর উচ্চতর মাত্রা ব্যবহার করে…যা বস্তু ও আলো, দুটোই শুষে নেয়। আমরা কি পাবো এমন কোনো ওয়ার্মহোল? পারবো, এই যাত্রার ধকল নিতে? হয়তো আমরা আবির্ভূত হবো অন্য কোনো স্থান বা কালে, অন্য কোনো ব্রহ্মাণ্ডে। অথবা হয়তো আমাদেরই ব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোথাও।

যদি জানতে চান, কৃষ্ণগহবরের ভেতরটা কেমন, তাকান চারপাশে। কিন্তু আমরা এখনো জানি না, ব্রহ্মাণ্ডটি উন্মুক্ত নাকি বদ্ধ। তার ওপর, কিছু জ্যোতির্বিদ সন্দিহান যে, দূরের ছায়াপথগুলোর লালমুখিতা আসলেই ডপলার ইফেক্টের জন্যে কিনা। তারা সন্দিহান, ব্রহ্মাণ্ডের প্রসারণ এবং কৃষ্ণগহবর নিয়ে। হয়তো, পরবর্তী প্রজন্ম আমাদের অজ্ঞতাগুলোকে ততটুকু সহানুভূতি নিয়ে দেখবে, যেভাবে আমরা তাদেরকে দেখি, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে, এটা না জানার জন্য।

উৎস ঃ http://onubadokderadda.com/dimensions_explained_by_carl_sagan/

Thursday, July 20, 2017

শওকত আলীর সাক্ষাৎকার: সাঁওতালরা আমাদের জাতির একটা অংশ



আমাদের কথাসাহিত্যের অগ্রগণ্য লেখক শওকত আলী। তাঁর লেখায় বিচিত্র সৃষ্টি ও ভাবনার বিস্তার। পাঠক তার লেখায় মুগ্ধ হয়ে আছেন দীর্ঘকাল ধরে। সমালোচকদের দৃষ্টিতে প্রদোষে প্রাকৃতজন বাংলা সাহিত্যের এক অসামান্য সংযোজন। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি নিজের জন্য একটি স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন। এই গুণী কথাসাহিত্যিকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শ্যামল চন্দ্র নাথ



শ্যামল চন্দ্র নাথ :

আপনার জন্মের দু’বছর পর আপনার বোনের জন্ম হয়। এবং আপনার বাবা বাড়ির পাশে ইজারার কাছে কুচুবনে থাকতেন। আপনার দাদী আপনাকে বাঁচিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে যদি কিছু বলতেন।


প্রতিদিন ফেসবুক ব্যবহারকারী ১৩০ কোটি





ঢাকা: চলতি বছরে প্রথম তিন মাসের রিপোর্ট অনুযায়ী প্রতিদিন ফেসবুকের ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩০ কোটি। আর প্রতিমাসে ১৯৪ লাখ লোক এতে লগইন করেন। আর এ বছরের মাঝামাঝি সময় ২০০ কোটি পার হবে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা।

বিবিসি জানায়, বছরের প্রথম প্রান্তিকে ৩০০ কোটি ডলার আয় হয়েছে, যা বেড়ে ৭৬ শতাংশে পৌঁছেছে।

যদিও শঙ্কা ছিল এর আয় ও বিজ্ঞাপনের পরিমাণ আগের থেকে কমবে।

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন এ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট খুলছেন হাজারো মানুষ। এর মাধ্যমে বন্ধু, পরিবার ও নিজ পেশাগত বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে সৌজন্যতা রক্ষা করছেন তারা। ব্যবসা থেকে বিনোদন, ধর্ম থেকে স্বাস্থ্য। প্রায় সব ক্ষেত্রেই মানুষের জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে ফেসবুক।

এ নিয়ে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ জানিয়েছেন, এ বিশাল কমিউনিটি নিয়ে আরো অনেক কিছু করার আছে।

সম্প্রতি কয়েকটি সহিংস ঘটনার ওপর ভিত্তি করে ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আরো কঠোর হচ্ছে।

সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ৩ হাজারের বেশি লোক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে লাইভের মাধ্যমে সহিংসতা রোধ করার জন্য।

কর্তৃপক্ষ জানায়, বিশ্বজুড়ে ৪ হাজার ৫০০ জনের কমিউনিটি অপারেশন টিম আছে তাদের। শুধু তাই নয় একটি নতুন টুলস তৈরি করা হচ্ছে যার মাধ্যমে সহিংস ভিডিওগুলো এর ব্যবহারকারীরাই মুছে দিতে পারবে।

রোবটও পেল স্পর্শ অনূভুতি



প্রযুক্তির দিন দিন উন্নতি ঘটে চলেছে।আই.বি.এম তো ঘোষণা দিয়েছে পাঁচ বছরের মধ্যেই আমরা মোবাইল বা কম্পিউটার স্ক্রিন এর মাধ্যমে দূরের জিনিস ধরতে পারব।এই ভবিষ্যত বাণীটা ঠিক হওয়ার দিকে আমরা একধাপ কিন্তু এগিয়ে গেছি।বিজ্ঞানীরা যন্ত্রের মধ্যে বিভিন্ন বস্তুর স্পর্শ অনূভুতি জাগাতে সক্ষম হয়েছেন। এখানে যন্ত্রটি হল এক ধরনের মানুষের মত রোবট।ইউনিভার্সিটি অফ সাউর্দান ক্যালিফোর্নিয়া ভাইটারভি স্কুল অফ ইঞ্জিনিয়ারিং এর বিজ্ঞানীরা এমনই একটি রোবর্ট তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন এবং এ সম্বন্ধে একটি লেখা প্রকাশ করেছেন।তারা এই রোবটটির হাতে এক ধরনের বিশেষ সেন্সর ব্যবহার করেছেন।এই সেন্সর এর গঠন অনেকটা মানুষের আঙুলের মত।এর উপরে বিশেষ ভাবে গঠিত চামড়া থাকে এবং তাতে তরল পদার্থের একটি স্তর ও থাকে। চামড়াতে একধরনের বিশেষ খাঁজ কাটা অংশ থাকে,অনেকটা আঙুলের রেখার মত।রোবটিক আঙুলটি যখন কোন বস্তুর উপর দিয়ে নেয়া হয়,তখন চাপের তফাত,উঁচু নিচু ইত্যাদির কারনে সেন্সরটি ভায়ব্রেশন উৎপন্ন করে।এই ভায়ব্রেশন আঙুলের মাঝখানে থাকা হাড়ের মত হাইড্রোফোনের কাছে পাঠানো হয়।সেখান থেকে ভায়ব্রেশন নিয়ে,রোবটটির কম্পিউটার তা পূর্বে অভিজ্ঞতা থেকে সঞ্চিত রাখা ভায়ব্রেশন এর সাথে তুলনা করে বস্তুটি চিহ্নিত করে।এখন এ আবিস্কারটি করার জন্য বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বড় যে সমস্যাটি হয়েছে তা হল একটি নতুন এলগরিদম আবিস্কার করা।মানুষ কোন বস্তু স্পর্শের সাহায্যে চেনার জন্য কিছু বিশেষ উপায় অবলম্বন করে।এ উপায়গুলো মানুষ তার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে শিখে।এত দিন রোবটকে এসব উপায় শিখানোর কোন উপায় ছিলনা।তবে অবশেষে বিজ্ঞানীরা বিশেষ এলগরিদম আবিষ্কার করেছেন যার সাহায্যে রোবট এসব উপায় ব্যবহার করবে।বিজ্ঞানিরা তাদের উদ্ভাবিত রোবটকে মোট ১১৭টি বস্তু সম্বন্ধে জ্ঞান দিয়ে পরিক্ষা করেছেন।তাদের রোবটটি মোটামুটি ৯৫.৫% সময় ঠিকভাবে বস্তুগুলো আলাদা করতে পেরেছে,যখনই তাকে একসাথে কয়েকটি বস্তু দেয়া হয়েছিল।মজার বেপার হল রোবটটি এমন কিছু ক্ষেত্রে ধোঁকা খেয়েছে,যেগুলোও বস্তুগুলো খুবই কাছাকাছি।এত কাছাকাছি ধরনের বস্তু মানুষও সাধারনত স্পর্শের সাহায্যা আলাদা করতে পারেনা।অর্থাৎ এদের স্পর্শ অনূভুতি আমাদের চেয়েও ভাল।

উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ...

Wednesday, July 12, 2017

রবীন্দ্রনাথের দেড়শত তম জন্মদিন উপলক্ষে সমরেশ মজুমদার যখন ঢাকা এসেছিলেন


প্রিয় লেখা : আমার রবীন্দ্রনাথ


সমরেশ মজুমদার

গত সোমবার ঢাকায় এসেছি। নিজস্ব কাজকর্মের বাইরে জানতে আগ্রহ ছিল, রবীন্দ্রনাথের দেড়শো জন্মদিন উপলক্ষে বাংলাদেশের মানুষ কী ভাবছেন!

প্রতিবার আমি ঢাকা ক্লাবে উঠি। যে ছেলেটি চা দিতে এল সে বেশ স্মার্ট, সুন্দর দেখতে। তার বুকে আটকানো ফলকের নাম বলছে সে মুসলমান নয়। হেসে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘রবীন্দ্রনাথের নাম শুনেছ?’

‘কোন রবীন্দ্রনাথ? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর?’

Monday, July 10, 2017

বিরিয়ানির যত কথা – উৎপত্তি ও ইতিহাস



বিরিয়ানি পছন্দ করেনা এমন মানুষ ক’জন আছে বলুন? পুরনো ঢাকার কাচ্চি কিংবা তেহারীর নাম শুনেছেন অথচ জিভে জল চলে আসেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়। এই চিত্র যে শুধু আমাদের দেশে তা কিন্তু নয়। গোটা ভারতবর্ষের প্রতিটি আনাচে কানাচে সেই চারশ বছর আগের মুঘল আমল থেকে আজ অবধি এতটুকুও কমেনি বিরিয়ানির আবেদন। তাই বিখ্যাত রম্যসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় বলতে হয় “একি ভানুমতি! একি ইন্দ্রজাল”। হাজারো ভাষা, বর্ণ, গোত্র, জাতি ও ধর্মে বিভক্ত ভূ ভারতবাসীকে এক টেবিলে বসাতে পারে বোধ হয় দুটি জিনিস। তার মধ্যে একটি হল ক্রিকেট আর অন্যটি বোধহয় বিরিয়ানি। এই ঐন্দ্রজালিক বিরিয়ানির জানা অজানা নানা দিক নিয়ে সাজানো হয়েছে আমাদের আজকের এই প্রতিবেদনটি।

যেভাবে শুরুটা হয়েছিল বিরিয়ানির


ভারতবর্ষের ইতিহাসে মুঘল সম্রাজ্ঞী মুমতাজ মহল শুধু তাজমহলের কারণে অমর হয়ে আছেন এমন কিন্তু নয়। তাজমহল ছাড়াও ভারতবর্ষের মানুষ আরও একটি আশ্চর্য জিনিস লাভ করেছে তাঁরই সুবাদে। সেই জিনিসটি হল আমাদের সকলের প্রিয় খাবার বিরিয়ানি। জনশ্রুতি আছে একবার মুমতাজ মহল মুঘল সৈন্যদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে ব্যারাকে গেলেন। কিন্তু সম্রাজ্ঞী অত্যন্ত দুঃখের সাথে দেখলেন সৈনিকদের স্বাস্থ্যের অবস্থা অত্যন্ত করুণ। তাই মিলেটারি মেসের বাবুর্চিকে তিনি স্বয়ং নির্দেশ দিলেন চাল ও গোশত সমৃদ্ধ এমন একটা পুষ্টিকর খাবার তৈরি করতে যেটা সৈনিকদের ভগ্ন স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করে দিতে পারবে। সম্রাজ্ঞী মুমতাজ মহলের আদেশে বাবুর্চি যে খাবারটি তৈরি করলেন সেটাই আজকের দিনের বিরিয়ানি নামে পরিচিত। পরে ভোজন রসিক মুঘলদের খাবার টেবিলে জয়গা পেতে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি সুস্বাদু বিরিয়ানির। মুঘলরাই ভারতে যেখানে যেখানে গিয়েছেন সেখানেই জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন বিরিয়ানির স্বাদ। সেটা আবার স্থানীয়দের হাতে পেয়েছে এককটি নতুন মাত্রা। আর তাই তো পূর্বে ঢাকা থেকে পশ্চিমে পেশোয়ার অবধি বিরিয়ানির এত রকমফের! এত বৈচিত্র্য!

বিরিয়ানি শব্দের উৎপত্তি যেভাবে


বিরিয়ানি শব্দের উৎপত্তি ফারসি বিরিয়ান শব্দ থেকে। ফারসিতে বিরিয়ান শব্দের অর্থ রান্নার আগে ভেজে নেওয়া। বাস্তবেও বিরিয়ানি রান্নার আগে সুগন্ধি চাল ঘি দিয়ে ভেজে নেওয়া হয়। তাই এই নামকরণ। জেনে রাখা ভাল আমাদের দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে বৃহত্তর ময়মনসিং অঞ্চলে যে “বিরন করা” শব্দটি ব্যবহৃত হয় সেটা এই ফারসি শব্দেরই পরিবর্তিতরূপ।

কাচ্চি বিরিয়ানি


আমাদের দেশে বিশেষত পুরান ঢাকায় সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হল কাচ্চি বিরিয়ানি। কাচ্চি শব্দটা এসেছে উর্দু কাচ্চা শব্দটি থেকে যার বাংলা অর্থ কাঁচা। যেহেতু সুগন্ধি চালের সাথে গোশত সরাসরি রান্না করা হয় তাই এর নাম হয়েছে কাচ্চি। এটি হিন্দি এবং উর্দুতেও একই নামে পরিচিত। সেদ্ধ ছাড়া খাসির গোশত টকদই দিয়ে মাখিয়ে তার উপর আলু আর চালের আস্তরণ দিয়ে রান্না করা হয় কাচ্চি বিরিয়ানি। অন্যদিকে সেদ্ধ বা পাক করা গোশত চালের সাথে মিশিয়ে তৈরি করা হয় পাক্কি বিরিয়ানি।

হাঁটলেই তৈরি হবে বিদ্যুৎ!



মানুষের হাঁটা থেকেই বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদিত হবে। আর তা দিয়েই চালানো যাবে ট্রান্সমিটার; যা মানুষের অবস্থান নির্ণয় করতে পারবে। জুতা আকৃতির এমনই এক যন্ত্র আবিষ্কার করেছেন জার্মানির একদল গবেষক।  জার্মানির ভিল্লিজেন-শোয়েন্নিজেন নামক অঞ্চলে অবস্থিত একটি গবেষণাগারে এই বিশেষ জুতা তৈরি করা হয়েছে।


 ‘স্মার্ট ম্যাটেরিয়ালস অ্যান্ড স্ট্রাকচার্স’ নামক সাময়িকীতে এই গবেষণার বিস্তারিত প্রকাশিত হয়েছে।


প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশেষ প্রযুক্তির এই যন্ত্রটিতে রয়েছে একটি শক হারভেস্টার ও একটি সুইং হারভেস্টার। যখন জুতাটির হিল মাটি স্পর্শ করে তখন শক হারভেস্টার শক্তি উত্পাদন করে। আবার যখন হাঁটতে গিয়ে গোড়ালি বেঁকে যায়, তখন শক্তি উত্পাদন করে সুইং হারভেস্টার। এভাবে তৈরি শক্তি দিয়েই চলে জুতায় থাকা ট্রান্সমিটার ও সেন্সর। আর এই ট্রান্সমিটার থেকে পাঠানো সংকেত থেকেই জুতা পরিধানকারী ব্যক্তির অবস্থান নির্ণয় করা হয়।


গবেষক দলের সদস্য ক্লেভিস ইল্লি বলেন, ‘আমরা মূলত শক্তি উত্পাদনকারী একটি ছোট যন্ত্র তৈরি করতে চেয়েছিলাম। এ থেকে উত্পাদিত শক্তি দিয়ে একটি তারহীন ট্রান্সমিটার ও সেন্সর চালানোই ছিল আমাদের লক্ষ্য। এই যন্ত্রটির মাধ্যমে যে কেউ কোনদিকে কতটুকু হেঁটেছে তার হিসেব রাখতে পারবে।


তিনি আরও জানান, জুতাটি সর্বোচ্চ তিন থেকে চার মিলিওয়াট শক্তি তৈরি করতে পারবে


নিকোলা টেজলার শুভ জন্ম দিনে ...












১৮৭০ সাল। ক্রোয়েশিয়ার এক স্কুলে ম্যাথ ক্লাস চলছে-
আজকের টপিক ইন্টিগ্রেশন। বেশ কটা ক্লাসের পর আজকে কঠিন কঠিন ইন্টিগ্রেশন শুরু।
বোর্ডে কতগুলো অঙ্ক লিখে টিচার ফিরলেন সবাই অঙ্ক করছে কিনা দেখতে। সবাই মনোযোগ দিয়ে করছে। কিন্তু একজন বসেই আছে। স্যার তার দিকে এগিয়ে গেলেন। “তুমি কেন করছ না?” ১৪ বছরের সেই ছেলেটা বোর্ডের সবগুলো অংকের উত্তর বলে গেল।
স্যার ভাবলেন ছেলেটা উত্তর হয়ত মুখস্ত করে এসেছে। তিনি বানিয়ে কয়েকটা দিলেন। ছেলেটা এবারও সবগুলোর নির্ভুল উত্তর বলে দিল! একবারও খাতা কলম হাতে নিল না। টিচার বুঝতে পারলেন, এইছেলে ভয়ঙ্কর মেধাবী। কিন্তু এই ভয়ঙ্কর মেধাবীকে আমরা ছোটবেলা থেকে চিনে আসি না। যতটা না চিনি নিউটন আইন্সটাইন কিংবা টমাস আলভা এডিসনকে।

ছেলেটির নাম ছিল নিকোলা টেসলা।
এটাও আমরা জানি না, আজকের IEEE এর এক সময়ের ভাইস প্রেসিডেন্টও ছিলেন তিনি। ইতিহাসের পাতায় অবহেলিত এক EEE Engineer টেসলা। এ লিখাটা তার প্রতি একটা ট্রিবিউট।

১৮৫৬ সালের ১০ জুলাই টেসলার জন্ম। ক্রোয়েশিয়ার এক গ্রামে। বাবা ছিলেন একজন ধর্মযাজক। নানাও ছিলেন তাই। ৫ ভাই বোনের মধ্যে ছিলেন চতুর্থ। বড় ভাই মারা গিয়েছিলেন ঘোড়া থেকে পড়ে গিয়ে। তার বাবার ইচ্ছে ছিল নিকোলা-ও বড় হয়ে প্রিস্ট হবে তার মত। ছোট থেকেই তাকে সেটা নিয়ে চাপ দিতেন। কিন্তু নিকোলা সেটা চাইতেন না, একদমই না।

১৮৬১-তে প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন নিকোলা, শেখেন জার্মান ভাষা, গণিত আর ধর্মতত্ত্ব। ১৮৭০ সালে হাই স্কুলে পড়ছিলেন তিনি, যখন সেই ইন্টিগ্রেশনের ঘটনাটা ঘটে। তখনই তার আসল মেধাটা ধরা পড়ে। চার বছরের পড়া তিন বছরেই শেষ করে গ্র্যাজুয়েট করে ফেললেন তিনি ১৮৭৩ এ। সে বছরই ফিরে গেলেন নিজের গ্রামে। এসে কলেরার প্রকোপে পড়লেন। খুব ভয়ংকর অবস্থা। নয় মাস ছিলেন শয্যাশায়ী।কয়েকবার মৃত্যুর কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন।
নিকোলার বাবা অসহায় হয়ে তাকে কথা দিলেন, সুস্থ হলে তাকে সবচেয়ে ভাল ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে পড়তে পাঠাবেন। আর বলবেন না যাজক হতে। টেসলা সুস্থ হয়ে উঠলেন এক সময়।

১৮৭৪ সালে নিকোলা আর্মিতে ভর্তি হওয়া থেকে বাঁচতে পালিয়ে গেলেন। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরলেন। টেসলা পরে বলেছিলেন,প্রকৃতির সাথে এই নৈকট্যটা অনেক দরকার ছিল তার। বসে বসে মার্ক টোয়েন পড়তেন তিনি। ১৮৭৫ এ টেসলা ভর্তি হলেন অস্ট্রিয়ান পলিটেকনিকে। তাঁর স্বপ্ন। ফার্স্ট ইয়ারে তিনি একটা লেকচারও মিস করেন নি। সবগুলোতে ছিল হায়েস্ট গ্রেড। ডিনের থেকে লেটার পেয়েছিলেন তার বাবা, “আপনার ছেলে প্রথম শ্রেণির স্টার।”



প্রতিদিন রাত ৩টা থেকে রাত ১১টা (২০ ঘণ্টা) পর্যন্ত টানা খাটতেন তিনি। কোন ছুটির দিনও বিশ্রাম নিতেন না। ১৮৭৯ তে বাবা মারা যাবার পর বাবার পুরনো চিঠি ঘাটতে গিয়ে দেখলেন সেখানে তার প্রফেসরদের কাছ থেকে চিঠি আছে, “আপনার ছেলেকে এখুনি স্কুল থেকে সরিয়ে নিন। নাহলে খাটতে খাটতে মারাই যাবে।”

সেকেন্ড ইয়ারে “কমুটেটর দরকার কি দরকার না” সেটা নিয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়েন প্রফেসরের সাথে। সে বছরই জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েন নিকোলা আর স্কলারশিপ বাতিল হয়ে যায় তার। থার্ড ইয়ারে তিনি তার সব সম্পদ জুয়ায় উড়িয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। কিন্তু জুয়া খেলেই সব আবার earn back করেন। পরে তার বিলিয়ার্ড খেলার নেশা ধরল।

এক্সাম টাইম আসার পর, টেসলা আবিষ্কার করলেন তিনি কিছুই পড়েন নি। তিনি পিএল বাড়াতে চাইলেন। কিন্তু তার দাবি অগ্রাহ্য করা হল। তিনি গ্র্যাজুয়েট করতেই পারলেন না। লাস্ট সেমিস্টারের কোন গ্রেডই তার ভাগ্যে জুটল না। হয়ে গেলেন একজন ড্রপ-আউট।
১৮৭৮ এর ডিসেম্বরে টেসলা চলে গেলেন। নিজের পরিবারের সাথে সব রকম সম্পর্ক ছিন্ন করলেন, তারা যেন টের না পায় যে টেসলা এখন একজন ড্রপ আউট।

স্লোভেনিয়াতে চলে গেলেন তিনি, সেখানে মাসে ৬০ ফ্লোরিন এর বিনিময়ে ড্রাফটসম্যান এর কাজ করতেন, আর বাকি সময়টা কার্ড খেলে কাটাতেন রাস্তায় রাস্তায় মানুষের সাথে। ৭৯ সালের মার্চে তার বাবা তাকে সেখানে খুঁজে পেলেন, হাত জোড় করলেন বাড়ি ফিরতে, কিন্তু নিকোলা ফিরলেন না। এ সময়টা তিনি নার্ভাস ব্রেকডাউনে পড়েন।

৭৯ সালেই তিনি ফিরে আসেন আর বাবাও মারা যায় স্ট্রোক করে। সেখানে তার পুরনো স্কুলে পড়াতে লাগলেন টেসলা। ১৮৮০ সালে চাচাদের টাকায় প্রাগ-এ পড়তে যান টেসলা। কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছিল। ভার্সিটিতে রেজিস্ট্রেশন টাইম শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া, ভার্সিটির requirements ছিল যে গ্রিক আর চেক ভাষা জানতে হবে, তিনি এ দুটো তখনও পারতেন না।

৮১ সালে বুডাপেস্টে যান তিনি। সেখানে এক টেলিগ্রাফ কোম্পানিতে কাজ করতে লাগলেন। এখানেই টেসলা তার প্রথম সায়েন্টিফিক কাজ করেন, তিনি টেলিফোনের অ্যামপ্লিফায়ার পারফেক্ট করে তুলেন। কিন্তু কোনদিন সেটার পেটেন্ট নেন নি। ৮৪ সালে থমাস আল্ভা এডিসনের কোম্পানিতে কাজ করতে যান, স্বয়ং এডিসন তাকে হায়ার করেন। নিউ ইয়র্কে। প্রথম প্রথম তার কাজ ছিল সিম্পল ইলেক্ট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং আর এরপর ধীরে ধীরে কঠিন সব প্রব্লেম আসতে থাকে। তার কাজ দেয়া হল ডিসি জেনারেটর রিডিজাইন করা। ১৮৮৫ সালে টেসলা বললেন, “আমি এটা আরো ভাল করে বানাতে পারব।”
এডিসন বললেন, “পারলে তোমাকে ৫০ হাজার ডলার দেব।”

মাসের পর মাস কাজ করার পর টেসলা আসলেই কাজটা পারলেন। এডিসনকে তখন তিনি পেমেন্ট দিতে বললেন। হাসিমুখে এডিসনের উত্তর ছিল, “আরে টেসলা, তুমি দেখি আমেরিকান হিউমর বোঝোই না।” টেসলার বেতন কেবল ১৮ডলার/উইক থেকে ২৮ ডলার করে দিলেন এডিসন, এই ছিল তার পুরস্কার। কিন্তু টেসলা সেটানিতে অস্বীকার করলেন। তিনি কোম্পানি থেকে রিজাইন করলেন।

১৮৮৬তে তিনি নিজের “টেসলা ইলেক্ট্রিক লাইট অ্যান্ড ম্যানুফেকচারিং” কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করলেন। সেখানে তিনি ডায়নামো ইলেকট্রিক মেশিন কমুটেটর বানালেন, যেটা ছিল তার প্রথম পেটেন্ট। কিন্তু টেসলার নতুন নতুন জিনিসে ইনভেস্টররা আগ্রহ পেতেন না। টেসলা হয়ে পড়লেন কপর্দকহীন। এক পর্যায়ে তার পেটেন্টগুলোও হাতছাড়া হয়ে যায়। টাকার জন্য তিনি রিপেয়ার জব করে বেড়ালেন, এমনকিদিনে দুই ডলারের বিনিময়ে গর্ত খোঁড়ার কাজও করলেন। ১৮৮৬/৮৭ সালের সেই শীতকালে তিনি ভাবছিলেন, “কী লাভ হল আমার এত পড়াশুনা করে!?”

১৮৮৭ সালে টেসলা দুজন ব্যবসায়ীর সাথে মিলে একটা কোম্পানি করলেন। প্রথমবারের মত সেই ল্যাবে টেসলা এসি কারেন্ট দিয়ে চলা ইন্ডাকশন মোটর চালান, আজকের ইলেকট্রিক দুনিয়ার শুরু সেই ল্যাবেই, টেসলার হাতে। রোটেটিং ম্যাগনেটিকফিল্ডের ধারণাও টেসলা দেন প্রথম, ১৮৮২ সালে।
১৮৮৮ সালে এসি কারেন্ট প্রদর্শন করেন টেসলা। IEEE তে দেখালেন তিনি। সবাই ব্যাপারটা দেখে অবাক হল, ভালভাবেই নিল এই প্রথম। এমনকি ৬০০০০ ডলারের অফার পেলেন পর্যন্ত।

কিন্তু এতে এডিসনের মাথা গরম হয়ে গেল, টেসলার এসি কারেন্ট বাজার পেয়ে গেলে এডিসনের ডিসি কারেন্ট যে মার খেয়ে যাবে। এডিসন এসি কারেন্টকে নামদিয়েছিলন “ডেথ কারেন্ট”; এডিসন লোকাল ছেলেদের পার হেড ২৫ সেন্ট করে দিলেন জীবিত কুকুর আর বিড়াল এনে দেবার জন্য। সেই কুকুর বিড়াল আর একটা হাতি পর্যন্ত পাব্লিকলি এডিসন “টেসলার” এসি কারেন্ট দিয়ে ইলেক্ট্রোকিউট করে মারেন।সবাইকে বোঝানোর জন্য যে, এসি কারেন্ট বিপজ্জনক।

কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও পারলেন না। ১৮৯২ এর মধ্যে নিজের কোম্পানির হেড পদটাও হারিয়ে ফেললেন এডিসন। ১৮৯৪ সালে টেসলা কাজ শুরুকরলেন অদৃশ্য তরঙ্গ নিয়ে। কিন্তু সেটার পেটেন্ট বা কিছুই নেন নি। ১৮৯৫ সালে উইলিয়াম রঞ্জেন সে অদৃশ্য তরঙ্গের নাম দেন এক্স-রে। তখন টেসলা বলেন, তিনি এটা নিয়ে কাজ করছিলেন।



১৮৯৫ সালে, তার ল্যাবের সব কিছু (প্রায় ৫০ হাজার ডলারের জিনিস) আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যায়। তাই তার এক্স-রের কোন কাজ তিনি দেখাতে পারেন নি। আবার নতুন করে শুরু করেন। রঞ্জেন যখন এক্সরে নিয়ে কাজ করলেন, তখন মানুষ ভেবেছিল এক্সরে-র বুঝি হিলিং ক্ষমতা আছে। কিন্তু টেসলা বললেন, এই তরঙ্গ ডেঞ্জারাস। এটা যেন মেডিকালে ব্যবহার করা না হয় এখনও।
কিন্তু কে শোনে কার কথা। টেসলার এক্সরে নিয়ে ইন্টারেস্ট শুনে এডিসন লেগে গেলেন এক্সরে নিয়ে। একদম মেডিকাল কাজে। তার এক এমপ্লোয়ি ক্ল্যারেন্স ডালি এত বেশি এক্সরে-তে এক্সপোজড হন যে, তারহাত কেটে বাদ দিতে হয়েছিল। তাতেও লাভ হয়নি। ক্যান্সারে মারা যান তিনি। তাছাড়া নিজেও নিজের উপর এক্সরে নিয়ে কাজ করলেন, চোখে বারবার এক্সরে মারতে লাগলেন। প্রায় অন্ধই হয়ে গিয়েছিলেন।১৯০৩ সালে এক্সরে নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, “খবরদার আমার সাথে এক্সরে নিয়ে আলাপ করবে না। আমি ভয় পাই এক্সরে।”

আমরা জানি যে ইতালির মারকোনি রেডিও আবিষ্কার করেন। কিন্তু জানি না যে তার কাজগুলো ছিল টেসলার কাজের উপরভিত্তি করে!! মারকোনি প্রথম রেডিও মেসেজ পাঠানোর সংবাদ পাবার পর টেসলা বলেছিলেন,“মারকোনি লোকটা ভাল আছে। ওকে কাজ করতে দাও। ও আমার ১৭টা পেটেন্ট ব্যবহার করছে।”

আমরা জানি, ১৯৩৫ সালে রবার্ট ওয়াটসন ওয়াট আবিষ্কার করেন ‘রাডার’। অথচ, ১৯১৭ সালেই সেটার থিওরি দিয়ে যান টেসলা। প্রশ্ন জাগতেই পারে কেবল থিওরি দিয়েই শেষ কেন? করে দেখালেন না কেন? জি না। তিনি করতে গিয়েছিলেন। তখন প্রথম মহাযুদ্ধ চলছিল। ইউ এস নেভির জন্য এই টেকনোলোজি প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু… কিন্তু, ইউনেভির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এর প্রধান ছিলেন কে জানেন? এডিসন। তিনি টেসলা নাম দেখেই অফার রিজেক্ট করে দেন। মারা গেল এই টেকনোলোজি।

আপনি কি জানেন, হাইড্রো-ইলেক্ট্রিসিটির প্রথম ধারণা দেন টেসলা? তিনিই নায়াগ্রা ফলস থেকে প্র্যাক্টিকাল এনার্জি সোর্স বানানোর কথা বলেন। ক্রায়োজেনিক ইঞ্জিনিয়ারিং উদ্ভাবনের অর্ধ শতক আগেই সেটা নিয়ে কাজ করছিলেন নিকোলা টেসলা! ট্রানজিস্টর বানানোর উপকরণগুলোর পেটেন্ট কিন্তু টেসলারই ছিল। আজকের কম্পিউটার আসতই না এটা ছাড়া। বহির্বিশ্ব থেকে প্রথম রেডিও ওয়েভ ধরেন কে জানেন? টেসলা। কে পৃথিবীর রেজোন্যান্ট ফ্রিকুয়েন্সি আবিষ্কার করেন? টেসলা। [৫০ বছর পর বিজ্ঞানীরা সেটা বিশ্বাস করেন,আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে টেস্ট করে]

টেসলা একটা ভূমিকম্পযন্ত্র উদ্ভাবন করেন। সেটা চালু করার পর নিউ ইয়র্কের একটা নেইবরহুড প্রায় ধ্বংসই হয়ে যায়! বল লাইটনিং বলে একটা জিনিস আছে। মাটির কয়েক ফিট উপরে ভেসে থাকে। এটাও সেই ১৮৯০ এর দশকে টেসলা করে দেখিয়েছিলেন। রিমোট কনট্রোল কে আবিষ্কার করেন? টেসলা।
নিওন লাইট কে উদ্ভাবন করেন? টেসলা। আজকের ইলেকট্রিক মোটর? টেসলা। এমনকি আজকের তারহীন প্রযুক্তিও কিন্তু টেসলারই আবিষ্কার।
এটা নিয়ে একটা মজার ঘটনা মনে পড়েছে। ১৮৯৮ সালে wireless tech দিয়ে তিনি একটা নৌকা চালিয়ে দেখিয়েছিলেন দূর থেকে। ম্যাডিসন স্কয়ারের পাবলিক প্রদর্শনী। লোকজন তো সেটা দেখে আকাশ থেকে পড়ল। এমনকি “জাদু”,“টেলিপ্যাথি”, “ভিতরে কোন বানর চালাচ্ছে”- এগুলো বলতেও থামেনি। টেসলা রেডিও কনট্রোল টর্পেডো দিতে চেয়েছিলন ইউএস নেভিকে। তারা ইন্টারেস্ট দেখায়নি তখন।

টেসলা কথা বলতে পারতেন আটটা ভাষায়। সারবিয়ান, ইংলিশ্ জার্মান, চেক, ফ্রেঞ্চ, হাঙ্গেরিয়ান, ইতালিয়ান আর লাতিন। টেসলা কৃত্রিম বজ্রপাত produce করেছিলেন। সেটারশব্দ এত জোরে হয়েছিল যে ১৫ মাইল দূরে কলোরাডো থেকেও শোনা গিয়েছিল। ১৩৫ ফিট লম্বা মিলিওন ভোল্টের বজ্র। রাস্তায় হেঁটে যাওয়া মানুষ দেখল তাদের পায়ের আশপাশে স্ফুলিঙ্গ বয়ে যাচ্ছে। পানির লাইন থেকে লাইনে স্ফুলিঙ্গ খেলা করছে। ঘোড়া ছোটাছুটি করছে। প্রজাপতিরা ইলেক্ট্রিফাইড হয়ে যায়, তারা উড়ছে আর তাদের চারপাশে নীলাভ আলোজ্বলছে।
টেসলা দাবি করেছিলেন তিনি চাইলে পৃথিবীতে এমন ভূকম্পন সৃষ্টি করতে পারবেন যে পুরো মানবজাতি ধ্বংস হয়ে যাবে। এমনকি পুরো পৃথিবীকে দুইভাগে স্লাইস করে ফেলতে পারবেন। মারকোনি নোবেল প্রাইজ পেলেও টেসলা কোনদিন নোবেল পাননি। খুশির কথা, এডিসনও পাননি।
১৯২৮ সালে তিনি প্লেন বানান যেটা vertically উড্ডয়ন করতে পারত! এটাই ছিল তার লাস্ট পেটেন্ট।
নিকোলা টেসলার শেষ বয়সের শখ ছিল কবুতরকে খাওয়ানো। ১৯৩৭ সালের শরতে, মধ্যরাতে তিনি নিউ ইয়রকার হোটেল থেকে ক্যাথিড্রাল আর লাইব্রেরির আশপাশের কবুতরদের খাওয়ানোর জন্য বের হন। এমন সময় রাস্তায় এক ট্যাক্সিক্যাব তাকে ধাক্কা দেয়। তিনি পড়ে যান। তার মেরুদণ্ডে প্রচণ্ড আঘাত পড়ে। তিনটা পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে যায়। টেসলা সারাজীবন ডাক্তার দেখান নি, এটা তার একটা জেদ ছিল। এবারও তিনি ডাক্তার দেখাবেন না বলে জেদ করলেন। তাই তার আসলে কী কী ক্ষতি হয়েছিল আমরা জানি না। টেসলা জানতেও চাইলেন না কে তাকে ধাক্কা দিল, কেবল একটা ক্যাব ডেকে তাকে হোটেলে নিয়ে যেতে বললেন। কয়েক মাস শয্যাশায়ী। তার দুঃখ ছিল যে, তিনি কবুতর খাওয়াতে পারছেন না। ১৯৩৮ সালের বসন্তে টেসলা দাঁড়াতে পারলেন। আবার শুরু করলেন কবুতরদের খাওয়ানো।

এই হোটেলেরই ৩৩২৭ নাম্বার রুমে ১৯৪৩ সালের ৭ জানুয়ারি মারা যান এই “পাগল বিজ্ঞানী”।
দুই দিন আগে “DO NOT DISTURB” সাইন টানিয়ে দিয়েছিলেন দরজায়। সেই সাইন উপেক্ষা করে হোটেলের মেইড অ্যালিস ভিতরে ঢুকে পড়েন।ঢুকে লাশ আবিষ্কার করেন। করনারি থ্রম্বসিস ছিল তার মৃত্যুর কারণ।

মারা যাবার দুদিন পর এফবিআই তার সব সম্পদ জব্দ করে। এক এমআইটি প্রফেসরকে দিয়ে তার গবেষণার জিনিসপত্র চেক করিয়ে নেয়। প্রফেসর রিপোর্ট করেন যে, ডেঞ্জারাস কিছুই নেই।

টেসলার শেষ কাজটা ছিল কীজানেন? একটা টাওয়ার বানানো যেটা থেকে মানুষ ফ্রি ওয়্যারলেস এনার্জি পাবে। তার স্বপ্ন ছিল একদিন সারা বিশ্ব এভাবে ফ্রি এনার্জি পাবে। কিন্তু সেই টাওয়ার বানানো শেষ করার পর যখন নির্মাতা জানতে পারলেন এটাতে তার আর্থিক লাভ নাই, তখন তিনি টাওয়ার শাট ডাওন করে দিলেন। পুরো বাজেট লস।

টেসলা মারা যান দরিদ্র আর ঋণী অবস্থায়। দুধ আর নাবিস্কো বিস্কুট খেয়েই শেষ দিনগুলো পার করছিলেন সেই হোটেলে। শেষ বয়সে এক ইন্টার্ভিউতে তিনি বলেছিলেন, এক আহত কবুতর প্রতিদিন তার কাছে আসত। তিনি ২০০০ ডলার খরচ করে সেইকবুতরের জন্য একটা ডিভাইস বানিয়েছিলেন তাকে heal করার জন্য। ধীরে ধীরে সেই কবুতরের পাখা আর হাড় ঠিক হয়ে আসে।
সারা জীবন অবিবাহিত ছিলেন টেসলা। কোন নারীর সাথে ঘনিষ্টতাও দেখা যায় নি কোনদিন। তার ধারণা ছিল এটা তার কাজের ক্ষতি করবে। অথচ অনেক নারী তার জন্য পাগল ছিল, কী না করেছে তার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। কিন্তু টেসলার পাত্তা পায়নি। তিনি বলেছিলেন, “I do not think you can name many great inventions that have been made by married men.”

পৃথিবীতে খুব কম মানুষের ফটোগ্রাফিক মেমোরি আছে। টেসলা তার একজন। পুরো বই তিনি মুখস্ত বলতে পারতেন! হাজার হাজার ডিজাইন তিনি সম্পূর্ণ মনের মধ্যে করে ফেলতে পারতেন। কোনদিন হাতে লিখতেন না। আঁকতেন না। মেমোরি থেকেই সব করে ফেলতেন। কোন ডাইমেনশন কত হবে সব হিসেব নিকাশ মাথাতে করে ফেলতে পারতেন।

১৮৯২ থেকে ১৮৯৪ সাল পর্যন্ত নিকোলা টেসলা IEEE (তখন ছিল AIEEE) এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। মধ্য বয়সে তিনি লেখক মার্ক টোয়েনের বন্ধু হয়ে যান। অনেকটা সময় তারা একসাথে কাটিয়েছেন। মার্ক তার ইন্ডাকশন মোটর দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। ১৯৩১ সালে এডিসন মারা যাবার পর, নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় শত শত স্তুতিবাক্যের ভীড়ে এডিসনের নামে একমাত্র নিন্দাটা ছিল টেসলার। সারা জীবনের ক্ষোভ তিনি সেখানে মিটিয়ে নেন বটে।

টেসলা কোনদিন দু ঘণ্টার বেশি ঘুমাতেন না। তবে মাঝেমধ্যে “ঝিমাতেন”, তার মতে এটা নাকি তার “ব্যাটারি রিচারজ করে”; স্কুলে থাকতে ৪৮ ঘণ্টা টানা বিলিয়ার্ড খেলেছিলেন। একবার ল্যাবে ৮৪ ঘণ্টা একটানা কাজ করে বের হয়েছিলেন। কিছুই হয়নি তার।
তার সম্মানে ম্যাগনেটিক ফ্লাক্স ইন্টেন্সিটির এসআই একক রাখা হয় “টেসলা”।

জুলাই এর ১০ তারিখ নিকোলা টেসলা দিবস। এডিসন, আইনস্টাইনকে সকলে মনে রাখলেও টেসলাকে কজন স্মরণ করে? ভুল সময়ে জন্মানো এক কিংবদন্তী তিনি।


উৎস ঃ https://www.istishon.com/?q=node/22381



প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধে ব্রোকোলি



অনেকগুলি গবেষণায় দেখা গেছে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ব্রোকোলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও উপকারী সবজি। এই সবুজ সবজিটির স্বাস্থ্যগত উপকারীতা অনেক। নতুন তথ্য হল ব্রোকোলিতে যেসব পুষ্টি ও ঔষধি গুণাগুণ আছে তা প্রোস্টেট ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে পারে।

ব্রোকোলিতে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও পুষ্টি উপাদান আছে। তাই ব্রোকোলিকে ‘সুপার ভেগি’ বা ‘সুপার সবজি’ নামে ডাকা হয়।

আগের গবেষণাগুলিতে দেখা গেছে ব্রোকোলি ও কপি জাতীয় সবজিতে প্রাকৃতিকভাবেই সালফার সমৃদ্ধ একটি যৌগ থাকে। এর নাম সালফোরাফেন। এই যৌগটি ক্যান্সার প্রতিরোধ করে এবং ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধির গতি কমিয়ে দেয়। শরীরের কিছু নির্দিষ্ট এনজাইম ক্যান্সার তৈরি করার ক্ষমতা আছে এমন উপাদানগুলিকে প্রতিরোধ করে । এই ধরনের এনজাইম তৈরিতে সালফোরাফেন যৌগের ভূমিকা আছে।

প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি কমানোর জন্য ব্রোকোলি সহ কপি জাতীয় সবজি খাওয়া বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের অরেগন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা।

অরেগন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, সালফোরাফেন যৌগটি লং ননকোডিং আরএনএ’কে (lncRNA) নষ্ট করে দেয়। এর ফলে শরীরের আক্রান্ত কোষগুলি শরীরে আর বিস্তার ঘটাতে বা কলোনি তৈরি করতে পারে না।

অরেগন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউট্রিশন ও প্রেভেন্টিভ হেলথ বিভাগের এমিলি হো বলেছেন, এটা অবশ্যই আগ্রহের ব্যাপার যে এই যৌগটি ব্রোকোলিতে অনেক উচ্চ মাত্রায় পাওয়া গেছে, এই যৌগটি lncRNA-এর ক্ষতি করতে পারে। ক্যান্সার দমন করার জন্য অথবা চিকিৎসার মাধ্যমে ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে নতুন খাদ্যগ্রহণ পদ্ধতি, খাবার অথবা ওষুধের বিরাট সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে এটা।

LINC01116 নামের একটি lncRNA জিন প্রোস্টেট ক্যান্সারওয়ালা মানব কোষে সংখ্যায় বাড়তে থাকে। তবে সালফোরাফেন দিয়ে চিকিৎসার মাধ্যমে এই কোষবৃদ্ধি কমানো সম্ভব। এমিলি হো এবং তার সহকর্মী অন্যান্য গবেষকরা এটা নিশ্চিত করেছেন।

এই গবেষণার প্রধান লেখক, অরেগন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত লরা বীভার বলেছেন, দেখা গেছে সালফোরাফেনের মাধ্যমে চিকিৎসা করে lncRNA এর মাত্রা স্বাভাবিক করা যায়।

বীভার এবং অন্যান্য গবেষকরা জানিয়েছেন, তাদের গবেষণার এই ফলাফল শুধু ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্যই না, ক্যান্সার চিকিৎসার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।

বীভার বলেছেন, আমরা যদি ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধির গতি ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেওয়ার পদ্ধতি দাঁড়া করাতে পারি, এবং এর বিস্তার থামাতে পারি, তাহলে আমাদের কাজের অর্থ দাঁড়ায় যে কেমো-প্রতিরোধী গবেষণার জন্য একটি নতুন ক্ষেত্র এই lncRNA। এবং আমাদের কাজের মাধ্যমে আরেকটা জিনিস প্রমাণিত হয় যে খাদ্য উপাদান থেকে বের করা রাসায়নিক উপাদানগুলি বের করার পরেও কার্যকর থাকে ।

বীভার এবং তার সহকর্মী গবেষকরা তাদের এই গবেষণাটি সম্প্রতি দ্য জার্নাল অব নিউট্রিশন বায়োকেমিস্ট্রিতে প্রকাশ করেছেন।

Saturday, July 8, 2017

হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালাঃ সত্য না মিথ্যে?



বাংলাদেশের বাঁশি আর হ্যামিলনের বাঁশির সাথে পরিচয় নেই এমন মানুষ বাংলাদেশসহ পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। ছোটবেলায় হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার গল্প শোনেনি বা পড়েনি এমন কাউকে নিশ্চিতভাবেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে ইতিহাসে নামটা একেক জায়গায় ছিল একেক রকম, যেমন নামটা ছিল হ্যামিলন অথচ নামটা হবে হ্যামেলিন। সঙ্গীত ও হ্যামিলনের বাঁশির গল্পটা হঠাৎ আমাকে খুব উৎসাহিত করল। কারণ, এটা নিছক গল্প নয়, এর পেছনে রয়েছে কিছু কথা; আসলে কি ঘটনা সত্য? নাকি মানবসৃষ্ট কোনো গল্প? আসুন আমরা বিস্তারিত জেনে নিই।

আমরা ছোটবেলায় যে গল্পটা জেনেছিলাম, সেটি আরেকবার সংক্ষেপে বলব, তবে কাহিনির ভাঁজে যে নিঁখুত বর্ণনা আছে সেদিকে আমরা নজর দেবো।

জার্মানির লোয়ার স্যাক্সনির হ্যামেলিন শহর। সালটা ছিল ঠিক ১২৮৪। হ্যামেলিন শহর তখন ইঁদুরের প্রকোপে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। হঠাৎ একদিন কোথা থেকে যেন এসে  হাজির হলেন এক বাঁশিওয়ালা। তার গায়ে ছিল হরেক রঙের পোশাক। এই বাঁশিওয়ালা ইঁদুরের অত্যাচার দেখে শহরের প্রধান ব্যক্তি মেয়রকে একটি উপায় বাতলে দিলেন। মেয়র তার কথামতো রাজি হয়ে গেলেন। মেয়র mauldin বললেন ঠিক আছে, তুমি ইঁদুর তাড়াতে পারলে তোমাকে আমি ১ হাজার  সোনার মুদ্রা দেবো। বাঁশিওয়ালা রাজি হয়ে গেল। তার বাঁশি বাজল আর সুড় সুড় করে সব ইঁদুর পিছন পিছন এসে তলিয়ে গেল শহরের পাশের weser নদীর পানিতে। তবে কিভাবে যেন একটি ইঁদুর বেঁচে গেল।



বাঁশিওয়ালা ফিরে এসে মেয়রের কাছে তার প্রাপ্য সোনার মুদ্রা চাইলেন। কিন্তু মেয়র তাকে ১ হাজার সোনার মুদ্রা দিতে অস্বীকৃতি প্রকাশ করলেন। দিলেন মাত্র ৫০টি সোনার মুদ্রা। আর সাথে সাথে বলে বসলেন, তুমি নিজেই এই ইঁদুরগুলো এনেছিলে যেন তাড়িয়ে টাকা আয় করতে পারো। বাঁশিওয়ালা খুব দুঃখ পেলেন ও রাগ করে চলে গেলেন। যাবার আগে বাঁশিওয়ালা বলে গেলেন, তিনি এই অন্যায়ের  প্রতিশোধ নিয়ে ছাড়বেন।

১২৮৪ সালের জুন মাসের ২৬ তারিখ শহরে একটি অনুষ্ঠান চলছিল রোমের জন এবং পলের শহীদ হবার স্মরণে ‘সেন্ট জন পল দিবস’ পালন করা হয়। এই অনুষ্ঠানটি চলছিল, সেদিন সবাই ছিল চার্চে, যখন বাঁশিওয়ালা ফিরে এলো তবে এবার তার গায়ে ছিল না রঙ-বেরঙের পোশাক। তিনি পরে আসেন সবুজ রঙের পোশাক পরে। এই ঘটনার ফলে ‘সবুজ’ রঙকে তারা শিকারির রঙে আখ্যায়িত করে। তখন সকাল সাতটা। বাঁশিওয়ালা বাজাতে শুরু করল তার মায়াবী সুরে বাঁশি। সাথে সাথেই শহরের চার বছরের বড় সকল শিশু ঘর থেকে বেরিয়ে এলো আর গুনে গুনে ১৩০ জন শিশু বাঁশিওয়ালার বাঁশির সুরে সম্মোহিত হয়ে এক পাহাড়ের গুহায় ঢুকে গেল। আর বেরিয়ে এলো না। তাদের মধ্যে শহরের মেয়রের মেয়েও ছিল। তাদের নাকি নিয়ে যাওয়া হয় ট্রানসিলভানিয়াতে। এদের মধ্যে সৌভাগ্যক্রমে তিনজন শিশু বেঁচে যায়। তাদের একজন কানে শুনতে পেত না তাই সুর শোনেনি। আর একজন অন্ধ হয়ে জন্মাবার কারণে দেখতে পায়নি কোথায় যেতে হবে। আরেকজন জ্যাকেট নিয়ে আবার গিয়ে দেখে সবাই চলে গেছে বাঁশিওয়ালার সাথে সুরের মায়াজালে। এই তিন শিশুর মাধ্যমেই চার্চ ফেরত লোকজন জানতে পারল কী হয়েছে। আরেকটি বেবিসিটার মেয়ে কোলে শিশু নিয়ে পিছনে পিছনে দেখতে গিয়েছিল অনেকদূর, সে সবার আগে ফিরে এসে সবাইকে ঘটনাটি জানায়।

ঘটনার আরেক বর্ণনায় জানা যায়, শিশুদের নিয়ে বাঁশিওয়ালা চলে যায় কোপলবার্গ পাহাড়ের ওপারে। হয়তো ভাবছেন এটি নিছক এক গল্প। কিন্তু না, ১২৮৪ সালের ঘটনার পরেই চার্চে stained-glass জানালা লাগানো হয় ১৩০০ সালের দিকে। সেখানে এই করুণ ঘটনা লেখা ছিল। জানালাটা বানাবার উদ্দেশ্যই ছিল হারিয়ে যাওয়া শিশুদের স্মরণ করা। জানালাটা ধ্বংস হয়ে যায় ১৬৬০ সালে। পরে ইতিহাসবিদ হ্যাম্স ডবারটিন ঐতিহাসিক লেখা থেকে এই জানালা পুনঃনির্মাণ করেন। সেখানে দেখা যায় বাঁশিওয়ালা আর সাদা পোশাকে শিশুদের ছবি।



আমরা যে কারণে খ্রিস্টাব্দ বলি, যার মাধ্যমে খ্রিস্টের জন্ম স্মরণ করা হয়, তেমনই হ্যামেলিন শহরের  সরকারি ঐতিহাসিক রেকর্ড শুরুতেই হয় এই ঘটনার রেফারেন্সে।

প্রথম যে এন্ট্রি লিপিবদ্ধ আছে, সেটি হলো ১৩৮৪ সালের লেখা- “১০০ বছর হতে চলেছে আমাদের শিশুদের হারিয়েছি’’। ১৫৫৯ সালের বিস্তারিত বিবরণ থেকে ইঁদুরের ঘটনা পাওয়া যায়। তার আগ পর্যন্ত শিশুদের হারাবার করুণ কাহিনি প্রাধান্য পাওয়ায় আগে ইঁদুরের ঘটনা প্রাধান্য পেত না।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, যদিও এই ঐতিহাসিক লেখা সংরক্ষিত আছে, তার পরেও এই অদ্ভুত ঘটনার বাস্তবিক ব্যাখা দিতে না পারায় অনেকেই অস্বীকার করে বসেন যে আদৌ এ ঘটনা ঘটেছিল। এখন পর্যন্ত কেউই এই  ঘটনার সঠিক ব্যাখা দিতে পারেননি। কেউ বলেছেন, পাইড পাইপার আসলে এক শিশুকামী ছিল, তবে কিভাবে এতজন শিশুকে নিয়ে গেল তার ব্যাখা নেই। কারো মতে, ব্ল্যাক ডেথ মহামারিতে সব শিশু মারা যাওয়াতে গ্রামবাসী এই কাহিনি বানিয়েছে। কেউ বলেছে, এই শিশুদের ক্রুসেডে পাঠানো হয়েছিল, গ্রামবাসী যখন দেখল, শিশুরা আর ফিরে আসেনি, তখন এই ধাপ্পাবাজি গল্প ফেঁদে বসল নিজেদের সান্ত্বনা দিতে।

১৩৮৪ সালে হ্যামেলিনের ডেকান লুডের কাছে থাকা বইতে লাতিনে লেখা বাক্য তার দাদির ভাষ্যে নিজের চোখে দেখা হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার ঘটনা লিখিত ছিল। সতের শতকে এসে বইটি হারিয়ে যায়।

১৪৪০ সালের Luneburg পাণ্ডুলিপিতে জার্মান খোদাই করে লেখা এই অনুচ্ছেদ-

Anno 1284 AM Dage johnnis Et pauli Warder 26.Tunidorch Eienen piper Mit Allerley Farve Bekledet grewesen exxx kinder kerledet Binnen Hameln Getorento calvarie Bi Den Koppen keloren. অর্থ : ১২৮৪ সালের ২৬ জুন, সেন্টজন পাস দিবসে হ্যামেলিনের জন্ম নেয়া ১৩০ জন শিশু এক হরেক রঙ বংশীবাদকের সন্মেহনে পিছন পিছন হারিয়ে যায়। কোপেনের পিছনে কালভারিতে। কোপেন হলো হ্যামেলিনকে ঘিরে থাকা পাহাড়। ১৫৫৬ সালে বলা হয়, বংশীবাদক আসলে ছিল শয়তান। কালের বির্বতনে আধুনিক যুগে এসে কেউ কেউ বলেছেন- বাঁশিওয়ালা আসলে ছিল এক এলিয়েন, কোপেন পাহাড়ের ব্যাখ্যা- মহাকাশযান করে শিশুদের নিয়ে গিয়েছিল নিজেদের গ্রহে। কারণ সেখানে জনসংখ্যা বাড়ানোর দরকার ছিল। নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সির সুর বাজিয়ে কখনো ইঁদুর কখনো শিশু আর্কষণ করতে পারত তার যন্ত্র দিয়ে।

যদিও কখনো হ্যমেলিনের শহরে বেড়াতে যান, তবে দেখবেন- সেখানে বাঁশিওয়ালার মূর্তির সাথে ইঁদুর। ২০০৯ সালে তারা এক ‘টুরিস্ট ফেস্ট’-এর আয়োজন করে। শিশুদের প্রস্থানের কারণ ঘটনার ৭২৫তম বার্ষিকীতে যে বাড়িতে খোদাই করা ছিল ইতিহাসটি সেটিকে এখন ‘র‌্যাট ক্যাচার’-এর বাড়ি বলে। প্রতিবছর ২৬ জুন পালন করা হয় এই ‘র‌্যাট ক্যাচার দিবস’। আছে পাইড পাইপার থিম রেস্তোরা, আছে পাইড পাইপার মনোপলি। বর্তমানে আমরা যে যতখানি পাঠ্য বইতে পড়ি সেটা মূলত উপকথা শুনে গ্রিস ভাইদের পুনঃলিখন। শেষ যে রাস্তায় শিশুদের দেখা গিয়েছিল সে রাস্তার নাম ‘Bungelose nstrasse’ প্রেম ছাড়া  রাস্তা, সেখানে কোনো মিউজিক বাজানো নিষেধ।

টাউন হলে এ বাক্যগুলো লেখা ছিল :

In the year 1284 after the birth at christ From Hamelin were led away

One hundred thirty children. Born at this place

Led away by a piper into a mountain.

বানানো হয় মুদ্রাও। আর বহু পরে বানানো মেইন গেইটে খোদাই করা ছিল- ‘১৩০ শিশুকে জাদুকর নিয়ে যাবার ২৭২ বছর পর এই ফটক নির্মিত হয়’। হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালাকে নিয়ে লেখা হয়েছে অনেক কবিতা, গল্প আর উপন্যাস এমনকি ছায়াছবিও। অন্য দেশেও এর অনুকরণে রূপকথা চালু হয়ে যায়। কিন্তু হ্যামেলিনের বাঁশিওয়ালার রহস্য আজও অমীমাংসিত যে, আসলে কী হয়েছিল সেই ১৩০ শিশুর ভাগ্যে।



উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ..

Wednesday, July 5, 2017

যুগস্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আলবার্ট আইনস্টাইন এর ধর্মবিশ্বাস প্রসঙ্গ :



           যুগস্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আলবার্ট আইনস্টাইন  এর ধর্মবিশ্বাস প্রসঙ্গ :


                   ( লেখক ; বী রে ন্দ্র না থ অ ধি কা রী )

               রবীন্দ্রনাথ এবং আইনস্টাইনের সাক্ষাতকারগুলো বিভিন্ন সময়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস্, দ্য মডার্ন রিভিউ, দ্য আমেরিকান হিব্রু, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত এশিয়া সাময়িকী, কলকাতার বিচিত্রা ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তবে সেগুলো ছিল অসম্পূর্ণ এবং সেসবের বেশ কিছুতেই আইনস্টাইনের আপত্তি ছিল। সর্বশেষ ২০০১ খ্রিস্টাব্দে দ্য কী রিভিউ নামক একটি প্রকাশনা রবীন্দ্রনাথ এবং আইনস্টাইনের সাক্ষাতকারগুলোর বিস্তৃততর সমন্বিত ভাষ্য প্রকাশ করে। এটি মূলত বাংলা ভাষার অন্যতম বিখ্যাত কবি ও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব অমিয় চক্রবর্তী এবং জার্মানীর বিখ্যাত সাংবাদিক ও আইনস্টাইনের সৎ-কন্যা মার্গোর স্বামী দিমিত্রি মারিয়ানফ্-এর সমন্বিত নোট এবং শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্র ভবনে সংরক্ষিত      আর্কাইভসের উপর ভিত্তি করে গ্রন্থিত হয়। 

          প্রকাশিত এই গ্রন্থনায় ৩৩ বার রবীন্দ্রনাথের এবং ৩১ বার আইনস্টাইনের ভাষ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে। এসবে তাঁদের মধ্যে প্রশ্ন, পাল্টা প্রশ্ন ও বুদ্ধিদীপ্ত সুক্ষ্ম কৌতুকসহ যে-মতবিনিময় হয়, তা বিশ্বইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দ্বৈরথ জ্ঞানগর্ভ আলোচনা বলে বিবেচিত। সমন্বিত প্রকাশনার বাংলা তর্জমা নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হলো।

বিংশ শতাব্দীর যুগসন্ধিক্ষণের দুই যুগস্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আলবার্ট আইনস্টাইন। এই মহাপণ্ডিতদ্বয়ের লেখালেখি, গবেষণা, আবিস্কার এবং সৃষ্টিকর্ম বিশ্বকে যতটা আলোড়িত এবং আলোকিত করেছে, বা এখনো করে চলছে, অন্য কোনও কিছু কবে নাগাদ সেসবের অনুরণন ছাপিয়ে যাবে তা কেবল ভবিতব্যই বলে দিতে পারবে। তাই মহাপণ্ডিততো বটেই, তারও চেয়ে অধিক কোনও বিশেষণে আধুনিক এই যুগাবতারদ্বয়কে বিশেষায়িত করাও যথেষ্ট নয় বলে মনে হয়।

দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা হওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের মধ্যে একটা আত্মিক টান ছিল, যোগাযোগ বা সাক্ষাতের দুর্নিবার আক্ঙ্খা ছিল। সে কারণেই বয়সে অঠার বছরের ছোট-বড় দু’জনের মধ্যে গড়ে উঠেছিল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব, তাঁদের মধ্যে পত্র বিনিময় হয় বহুবার এবং সাক্ষাৎ ঘটে চারবার। রবীন্দ্রনাথকে জার্মান ভাষায় স্বহস্তে লেখা আইনস্টাইনের দু’টি চিঠি শান্তি-নিকেতনের রবীন্দ্রভবন সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত রয়েছে। অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথ ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমবার জার্মানীতে গেলেও সেবার আইনস্টাইনের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়নি। তবে কবিগুরুর দ্বিতীয়বার জার্মানী সফরের সময় ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের জনকের সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে। মূলত এদিন সকালে রবীন্দ্রনাথের সম্মানে জার্মান সাংস্কৃতিক মন্ত্রী বেকার এক চা-চক্রের আয়োজন করেন। আমন্ত্রিত অন্যান্য বিশিষ্টজনদের মধ্যে ছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন ছাড়াও জার্মানীর অনেক বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক। একই দিন বিকেলে ক্যাপুথে অবস্থিত নিজস্ব বাসভবন 'আইনস্টাইন ভিলায়' রবীন্দ্রনাথকে চা-চক্রে আপ্যায়িত করেন আইনস্টাইন। সেই সময়টাতে এই দুই মনীষী বিশ্বজোড়া খ্যাতির তুঙ্গে। কারণ, ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে বরীন্দ্রনাথ সাহিত্যে এবং ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে আইনস্টাইন পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। তাই এই দুই মহারথীর সাক্ষাত নিয়ে দেশ-বিদেশে জনকৌতুহল থাকা সত্ত্বেও প্রথমবার সাক্ষাতে তাঁদের মধ্যে যে-কথাবার্তা হয়, তার অংশবিশেষ চার বছর পর, অর্থাৎ ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই আগস্ট নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

রবীন্দ্রনাথ ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে ফের জার্মানী সফরে গেলে ঐ বছর ১৪ জুলাই আইনস্টাইনের বাসভবনে তাঁদের মধ্যে দ্বিতীয়বারের মতো সাক্ষাৎ ঘটে। আইনস্টাইন তখন বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং কাইজার ভিলহেলম ফিজিক্যাল ইনস্টিটিউটের পরিচালক। বিশ্বকবি এবং বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীর মধ্যে সেদিন দীর্ঘ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। তাঁদের মধ্যে তৎকালীন বিশ্বপরিস্থিতি, সমাজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি এবং ইহুদী ও ফিলিস্তিনী সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের মধ্যে তৃতীয়বার সাক্ষাৎ ঘটে ১৯৩০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। তাঁদের মধ্যে চতুর্থ এবং শেষবার দেখা হয় ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর আমেরিকার নিউ ইয়র্কে। সেবার রবীন্দ্রনাথ নিউ ইয়র্কে এক চিত্রশিল্পীর বাসায় আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন এবং আইনস্টাইন সেই বাসায় এসে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন।

রবীন্দ্রনাথ এবং আইনস্টাইনের সাক্ষাতকারগুলো বিভিন্ন সময়ে নিউ ইয়র্ক টাইমস্, দ্য মডার্ন রিভিউ, দ্য আমেরিকান হিব্রু, যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত এশিয়া সাময়িকী, কলকাতার বিচিত্রা ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তবে সেগুলো ছিল অসম্পূর্ণ এবং সেসবের বেশ কিছুতেই আইনস্টাইনের আপত্তি ছিল। সর্বশেষ ২০০১ খ্রিস্টাব্দে ‘দ্য কী রিভিউ’ নামক একটি প্রকাশনা রবীন্দ্রনাথ এবং আইনস্টাইনের সাক্ষাতকারগুলোর বিস্তৃততর সমন্বিত ভাষ্য প্রকাশ করে। এটি মূলত বাংলা ভাষার অন্যতম বিখ্যাত কবি ও রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব অমিয় চক্রবর্তী এবং জার্মানীর বিখ্যাত সাংবাদিক ও আইনস্টাইনের সৎ-কন্যা মার্গোর স্বামী দিমিত্রি মারিয়ানফ্-এর সমন্বিত নোট এবং শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্র ভবনে সংরক্ষিত আর্কাইভসের উপর ভিত্তি করে গ্রন্থিত হয়।

প্রকাশিত এই গ্রন্থনায় ৩৩ বার রবীন্দ্রনাথের এবং ৩১ বার আইনস্টাইনের ভাষ্য লিপিবদ্ধ রয়েছে। এসবে তাঁদের মধ্যে প্রশ্ন, পাল্টা প্রশ্ন ও বুদ্ধিদীপ্ত সুক্ষ্ম কৌতুকসহ যে-মতবিনিময় হয়, তা বিশ্বইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ দ্বৈরথ জ্ঞানগর্ভ আলোচনা বলে বিবেচিত। সমন্বিত প্রকাশনার বাংলা তর্জমা নিম্নে লিপিবদ্ধ করা হলো।
          রবীন্দ্রনাথ: আপনি অঙ্কশাস্ত্রের দুটো প্রাচীন সত্তা, স্থান এবং কাল-এর অনুসন্ধানে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন। আর আমি এদেশে পরমপুরুষের অনন্ত-শাশ্বত বিশ্ব-সত্যের জগৎ নিয়ে বক্তৃতা দিয়ে ঘুরছি।
          আইনস্টাইন: আপনি ঐশী শক্তিকে বাস্তব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হিসেবে বিশ্বাস করেন?
          রবীন্দ্রনাথ: বিচ্ছিন্ন করে নয়। মানুষের অনন্ত ব্যক্তিসত্তা বিশ্বপ্রকৃতিকে অনুধাবন করে। এমন কিছুই নেই যা মানবসত্তা বুঝতে অপারগ হয়, এবং এটাই প্রমাণ করে যে বিশ্বজগতের সত্য মানবসত্তার সত্য।
          আইনস্টাইন: মহাবিশ্বের প্রকৃতি সম্বন্ধে দুটো ধারণা রয়েছে− বিশ্বসত্তার ঐক্য মানবিকতার উপর নির্ভরশীল, এবং বিশ্বসত্তার বাস্তবতা মানবিক কার্যকারণের উপর স্বনির্ভর।
          রবীন্দ্রনাথ: যখন আমাদের বিশ্বজগৎ মানুষের সাথে সুসমন্বিত হয়, তখন সেটা হয় শাশ্বত, তখন তাকে আমরা সত্য বলে জানি, তাকে সুন্দর হিসেবে অনুভব করি।
         আইনস্টাইন: এটা বিশ্বজগতের সম্পর্কে পুরোপুরি মানবিক ধারণা।
           রবীন্দ্রনাথ: এই জগৎ হচ্ছে মানবিক জগৎ, বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষেরও জগৎ। অতএব আমাদের কাছ থেকে জগৎকে সরিয়ে রাখলে জগতের অস্তিত্ব থাকে না; এটা একটা আপেক্ষিক জগৎ এবং এর বাস্তবতা আমাদের চৈতন্যনির্ভর। কিছু আদর্শিক কারণ এবং আনন্দ আমাদের কাছে সত্যকে উপস্থাপিত করে। আদর্শ শাশ্বত মানুষ সেই, যার অভিজ্ঞতা সম্ভবপর হয়ে উঠে আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে।
         আইনস্টাইন: এটি মানবসত্তার উপলব্ধি।
          রবীন্দ্রনাথ: হ্যাঁ, এটি একটি অনন্তসত্তা। এটাকে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে আমাদের আবেগ এবং কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে। আমরা উপলব্ধি করি এমন পরমপুরুষকে, আমাদের সীমাবদ্ধতার বিচারে যার কোনো সীমাবদ্ধতা নাই। ব্যক্তির কাছে যা সীমাবদ্ধ নয়, বিজ্ঞান বিষয় সেটাই। এটি একটি নৈর্ব্যক্তিক সত্যের বিশ্বজগৎ। ধর্ম এসকল সত্যকে বাস্তবায়িত করে এবং আমাদের গভীরতর প্রয়োজনসমূহের সাথে সংযোগ ঘটায়। আমাদের ব্যক্তিগত সত্যের সজ্ঞানতা বিশ্বজনীন মূল্য লাভ করে। ধর্ম সত্যের মূল্যকে প্রয়োগ করে এবং আমরা এর সাথে নিজেদের মিলটাকে সুসমন্বিত করে সত্যকে মঙ্গলময় হিসেবে জানতে পারি।
          আইনস্টাইন: সত্য, তারপর, বা সৌন্দর্য, এগুলো কি স্বনির্ভর মানুষের জন্য নয়?
রবীন্দ্রনাথ: না, আমি তা বলছি না।
          আইনস্টাইন: যদি মানুষজাতির কেউ না থাকতো, তাহলে কি বেলভিডিয়ারের অ্যাপোলো সুন্দর বিবেচিত হতো না?
         রবীন্দ্রনাথ: না।
        আইনস্টাইন: সৌন্দর্যবোধের এই ধারণা সম্পর্কে আমি আপনার সাথে একমত, কিন্তু সত্য সম্পর্কে একমত নই।
          রবীন্দ্রনাথ: কেন নয়? সত্য তো মানুষের মধ্যে উপলব্ধির যোগ্য হয়ে উঠে।
           আইনস্টাইন: আমার ধারণা যে ঠিক, সে বিষয়ে আমি কোনো প্রমাণ দিতে পারব না। কিন্তু এটাই আমার ধর্মবিশ্বাস। আমরা তা ব্যক্তিগতভাবে উপস্থাপন করি− আমাদের ভ্রান্তি এবং অন্ধ অনুকরণসমূহের দ্বারা, সৃষ্ট অভিজ্ঞতার দ্বারা, আধ্যাত্মিক চেতনার দ্বারা।
          রবীন্দ্রনাথ: সৌন্দর্য হলো যথার্থ সমন্বয়ের আদর্শ, যা বিশ্বচরাচরে বিদ্যামান। সত্য হলো বিশ্বসত্তার মননশীলতার যথার্থ উপলব্ধি। এ ছাড়া আমরা কি ভাবে সত্যকে চিনতে পারবো?
          আইনস্টাইন: আমি প্রমাণ করতে পারবো না। কিন্তু আমি পিথাগোরাসের উপপাদ্যে বিশ্বাসী, যে সত্য মাননবসত্তার নির্ভরতামুক্ত। এটা অবিচ্ছন্ন যুক্তির সমস্যা।
           রবীন্দ্রনাথ: সত্য বিশ্বসত্তার সাথে সম্পৃক্ত, অবশ্যই মানুষের জন্য অত্যাবশ্যকীয় হবে। অন্যথা আমারা প্রত্যেকে সত্যকে অনুভব করবো। আমরা কোনো তাকে সত্য বলতে পারবো না। অন্তত সত্য বর্ণিত হবে বিজ্ঞানসম্মতভাবে, এবং শুধু যৌক্তিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তার কাছে পৌঁছাতে পারবো। অন্য কথায় তা হবে মানব তন্ত্রগত ভাবনা। ভারতীয় দর্শন অনুসারে ব্রহ্মই পরমসত্য। একে ব্যক্তিবিশেষের মনের বিচ্ছিন্ন কল্পনা হতে পারে না বা বাক্যের দ্বারা প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু এই সত্য উপলব্ধিতে আসতে পারে অনন্তসত্তার সাথে শুধু ব্যক্তিসত্তার মিলনেই। কিন্তু এই ধরনের সত্য বিজ্ঞানের জগতের নয়। আমরা যে প্রত্যক্ষতা নিয়ে আলোচনা করছি, তা হলো সত্যের প্রকৃতি; যাকে বলা যায়, মানুষের মনে যা সত্য হিসেবে প্রতিভাত হয়। যেহেতু এটা মানিবিক। এবং একে মায়া বা বিভ্রম বলা যেতে পারে।
           আইনস্টাইন: এটা ব্যক্তিবিশেষের বিভ্রম নয়, এটা মনুষ্য প্রজাতির বিভ্রম।
          রবীন্দ্রনাথ: এই প্রজাতির ঐক্য এবং মানবতাকে ধারণ করে। সেই জন্য সমগ্র মানব মননসত্তা সত্যকে উপলব্ধি করে, ভারতীয়-ইউরোপীয় মননসত্তা একই অনন্য উপলব্ধিতে মিলিত হয়।
          আইনস্টাইন: প্রজাতি শব্দটি জার্মান ভাষায় সকল মনুষ্যসত্তাকে বুঝায়; সত্যি কথা বলতে কি, বনমানুষ কিংবা ব্যাঙও এর ভিতরে পড়ে। সমস্যা হলো, সত্য সজ্ঞানতার স্বরনির্ভরতা কি না।
          রবীন্দ্রনাথ: যাকে আমরা সত্য বলে জানি, তা বাস্তবতার বিষয়ীকেন্দ্রিক এবং বাস্তবভিত্তিক যৌক্তিক সমন্বয়ের মধ্যস্তরে। উভয়ই পরমপুরুষ ধারণ করে।
          আইনস্টাইন: আমরা মনোজগতে যা ভাবি, এমনি কি প্রাত্যহিক জীবনে, এর জন্য আমরা দায়ী নই। এর উপর নির্ভর করে মন এর বাইরের বাস্তবতাসমূহ সম্পর্কে জ্ঞাত হয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, যখন বাড়ীতে কেউ নেই, তখনও টেবিলটা যেখানে ছিলো সেখানেই থাকে।
রবীন্দ্রনাথ: হ্যাঁ, এটা ব্যক্তি মনের বাইরে থাকে, কিন্তু সর্বজনীন মনের বাইরে থাকে না। টেবিল হলো কোনো সজ্ঞানতার দ্বারা প্রত্যক্ষ করার বিষয়। যা চেতনায় থাকে।
          আইনস্টাইন: কেউ যদি বাড়িতে নাও থাকে, তাহলেও টেবিলটির অস্তিত্ব কিন্তু থাকবে। কিন্তু ইতিমধ্যে তা আপনার দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে। এই কারণে টেবিলটা যে আছ ব্যাখ্যা বা প্রমাণ করতে পারবো না। বিষয়টা আমাদের দেখার উপর নির্ভর করে। মানবতানিরপেক্ষ সত্যের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের স্বাভাবিক বোধ ব্যাখ্যা কিংবা প্রমাণ করা যায় না। কিন্তু এই বিশ্বাস কেউ ত্যাগ করতে পারে না, এমন কি আদিবাসীরাও। সত্যকে আমরা পরমপুরুষ মূল্য দিই। অপরিহার্য এই বাস্তবতা যা আমাদের অস্তিত্ব, অভিজ্ঞতা এবং মানস থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। যদিও আমরা পরিষ্কার বলতে পারি না তার অর্থ কী।
          রবীন্দ্রনাথ: হ্যাঁ, যদি কোনো সত্য থেকে থাকে যার সঙ্গে মানবিকতার সাথে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন হয়, তবে আমাদের জন্য সেটা হবে সম্পূর্ণই অস্তিত্বহীনতা।
          আইনস্টাইন: তা হলে আপনার চেয়ে আমি বেশি ধার্মিক।
          রবীন্দ্রনাথ: আমার ধর্ম হচ্ছে পরমপুরুষের সাথে পুনর্মিলনে, সর্বজনীন পরমাত্মায়, আমার নিজস্ব ব্যক্তিসত্তায়।

আইনস্টাইনের সাথে রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয়বারের কথপোকথন প্রকাশিত হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া নামক সাময়িকীর মার্চ ১৯৩১ সংখ্যায়। নিচে এই কথপোকথনের অনুবাদ তুলে ধরা হলো।

          রবীন্দ্রনাথ: আমি আজ ডক্টর মেন্ডেলের সাথে গণিতের নব্য আবিষ্কার সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম, যা বলছে যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরমাণুরও কিছু করবার আছে; অস্তিত্বের নাটকীয়তা তার বৈশিষ্ট্যের দ্বারা পূর্বনির্ধারিত নয়।
          আইনস্টাইন: প্রকৃতপক্ষে এসব বিজ্ঞানকে এমনটি ভাবাচ্ছে, যা কার্যকারণবাদ ধারণাকে বাতিল করে না।
          রবীন্দ্রনাথ: তা হয়ত করে না, দেখা যাচ্ছে যে, কার্যকারণবাদ উপাদানের মধ্যে নিহিত নয়, কিন্তু অন্য কোনো শক্তি এর মাধ্যমে একটি সুসমন্বিত মহাবিশ্বের সৃষ্টি করে।
          আইনস্টাইন: যে কেউ এটা বুঝতে চেষ্টা করছে যে উচ্চতর স্তরে কীভাবে এ ক্রমধারা আছে। ক্রমধারাটি আছে; যেখানে বৃহৎ উপাদান একত্রিত করে এবং অস্তিত্বকে চালিত করে; কিন্তু সূক্ষ্মতর উপাদানে এ ক্রমধারা দৃশ্যমান নয়।
          রবীন্দ্রনাথ: এই দ্বৈততা অস্তিত্বের গভীরে বিদ্যমান, মুক্ত আকাঙ্ক্ষা এবং নির্দেশিত ইচ্ছার স্ববিরোধীতা, যা এর উপর কাজ করছে এবং একটি নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতির উপর আবর্তিত হচ্ছে।
          আইনস্টাইন: আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান স্বীকার করছে না যে তারা স্ববিরোধী। মেঘ দূর থেকে এক রকম দেখায়, কিন্তু খুব কাছ থেকে দেখলে বিক্ষিপ্ত জলকণিকা ছাড়া আর কিছুই দেখা যাবে না।
           রবীন্দ্রনাথ: আমি মানব-মনোবিদ্যায়ও প্রায় একই রকম দেখতে পাই। আমাদের আবেগ এবং আকাঙ্ক্ষাগুলো অনিয়ন্ত্রিত, কিন্তু আমাদের চরিত্র এগুলোকে পরিপূর্ণভাবে আয়ত্বে নিয়ে আসে। বস্তুজগতে কি এমনটি ঘটতে পারে? উপাদানগুলো স্বতন্ত্র আবেগ দ্বারা অসংযত, গতিশীল? এবং বস্তুজগতে এমন কি কোনো নীতি আছে যা তাদের নিয়ন্ত্রণ করে একটি ক্রমনির্দেশিত সংগঠন?
           আইনস্টাইন: এমনকি মৌলিক উপাদানগুলোও পরিসাংখ্যিক নিয়মমুক্ত নয়; যেমন রেডিয়মের অনুগুলোও সর্বদা একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলছে এবং চলবে; যেমন করে তারা সর্বদা চলে আসছে। তাহলে অবশ্যই বস্তু উপাদানও নিয়ন্ত্রিত।
           রবীন্দ্রনাথ: অন্যথায়, অস্তিত্বের ঘটনাপ্রবাহ উদ্দেশ্যহীন হয়ে যাবে। এটা হলো সুযোগ ও লক্ষ্য এ দুয়ের একটা ধ্রুব সমন্বয়, যা চির-নতুন এবং সজীব করে রাখে।
          আইনস্টাইন: আমি বিশ্বাস করি, যা আমরা করি কিংবা যা অস্তিত্বশীল তার সবকিছুরই কার্যকারণ রয়েছে; এটা ভাল, যদিও আমরা তার সবকিছু আগাগোড়া দেখতে পাই না।
           রবীন্দ্রনাথ: মানুষের ক্ষেত্রে নমনীয়তার একটা বিষয় আছে, যার ছোট্ট পরিসরে কিছুটা স্বাধীনতা আছে, যেখানে সে তার ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করতে পারে। এটা অনেকটা ভারতীয় সংগীতের মতো, যা পাশ্চাত্য সংগীতের মতো অতটা কঠিন নিয়মের শৃঙ্খলে আবদ্ধ নয়। আমাদের সুরকারগণ এর একটা সুনির্দিষ্ট রূপরেখা, সুরপদ্ধতি দিয়ে থাকেন এবং এর মধ্যে শিল্পী নিজেও কিছুটা স্বকীয়তার অনুপ্রবেশ ঘটাতে পারেন। তাঁকে অবশ্যই সেই সুনির্দিষ্ট সুরের মধ্যে থাকতে হবে এবং এর মধ্যে থেকেই সে গায়কী-আবেগের স্বতস্ফুর্ত প্রকাশ ঘটাতে পারে। আমরা সুর সৃষ্টিতে সুরকারের মননশীলতার প্রশংসা করি, কিন্তু একই সাথে আমরা শিল্পীর কাছে তার গায়কী এবং সংগীতালংকারে নিজস্ব দক্ষতা প্রত্যাশা করি। এই সৃষ্টিতে আমরা অস্তিত্বের কেন্দ্রীয় সূত্র মেনে চলি, কিন্তু আমরা যদি আমাদের এই দোদুল্যমনতা থেকে মুক্ত করতে না পারি - আমরা আমাদের ব্যক্তিত্বের মধ্যে থেকেও নিজের পরিপূর্ণ প্রকাশে পর্যাপ্ত স্বাধীনতা পাই।
          আইনস্টাইন: তা তখনই সম্ভব যখন সঙ্গীতের প্রবল নান্দনিক ঐতিহ্য মানুষের মনকে উজ্জ্বীবিত করে। ইউরোপে সঙ্গীত মানুষের জনপ্রিয় শৈলী এবং গণ-মানুষের আবেগ থেকে অনেক দূরে এসে গেছে এবং তা মূলত স্বীয় প্রথা ও ঐতিহ্য প্রকাশের নিগূঢ় শিল্প হিসেবে দেখা দিচ্ছে।
          রবীন্দ্রনাথ: আপনাকে অবশ্যই এ গূঢ় সঙ্গীতের কাছে অনুগত থাকতে হবে। ভারতবর্ষে নিজস্ব সৃজনশীল ব্যক্তিত্বই হলো একজন গায়কের স্বাধীনতার মাপকাঠি। সে একজন সুরকারের গান নিজস্ব ঢংএ গাইতে পারে যদি ঐ নির্দিষ্ট সঙ্গীতের জন্য তার নিজের গায়কীর মধ্যে নির্দিষ্ট সুরের সাধারণ নিয়মাবলী প্রকাশের সৃজনশীল সক্ষমতা থাকে।
          আইনস্টাইন: প্রকৃত সঙ্গীতের মাহাত্ম অনুধাবন করার জন্য অত্যন্ত উঁচু দরের শিল্পের প্রয়োজন, যাতে করে কেউ এ ধরনের পরিবর্তন করতে পারে। আমাদের দেশে এ ধরনের পরিবর্তনও সুনির্দিষ্ট।
          রবীন্দ্রনাথ: আমরা আমাদের আচরণে যদি মহত্মের সূত্রগুলো মেনে চলতে পারি তবেই আমরা আত্ম-প্রকাশের প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে পারব। আচরণের নীতিটা সেখানেই, কিন্তু এই চরিত্র যা একে সত্য এবং স্বতন্ত্র হিসেবে তৈরি করে তা আমাদেরই সৃষ্টি। আমাদের সঙ্গীতে স্বাধীনতা এবং সুনির্দিষ্টতার দ্বৈততা রয়েছে।
           আইনস্টাইন: সঙ্গীতের কথাগুলোও কি মুক্ত? আমি আসলে বোঝাতে চাইছি, সঙ্গীতের কথাগুলো, এবং যা সে গাইছে, তার সাথে একজন গায়ক কি সম্পূর্ণ একমত?
          রবীন্দ্রনাথ: হ্যাঁ। বাংলায় এক ধরণের সঙ্গীত রয়েছে, যাকে আমরা কীর্তন বলি, যেখানে গানের সাথে গায়ক তাঁর নিজস্ব ও পছন্দসই মতামত, কথা বা উক্তি জুড়ে দিতে পারেন। এগুলো আসলে প্রবল উৎসাহোদ্দীপক, গায়কের এ সকল সুন্দর স্বতস্ফুর্ত আবেগে শ্রোতারা মুগ্ধ হয়।
          আইনস্টাইন: এ ধরনের ছন্দোবদ্ধ গঠন কি খুবই কঠিন?
          রবীন্দ্রনাথ: হ্যাঁ, অবশ্যই। আপনি পদ্যরচনকৌশলের সীমাকে অতিক্রম করতে পারবেন না। একজন গায়ককে অবশ্যই তাঁর নির্দিষ্ট সুর ও সময়ের মধ্যে থেকেই পরিবর্তন করবেন। ইউরোপীয় সঙ্গীতে সময়ের সাথে গায়কের তুলনামূলক স্বাধীনতা রয়েছে কিন্তু সুরের সাথে নয়।
          আইনস্টাইন: বাণী ছাড়া কি ভারতীয় সঙ্গীত হতে পারে? কেউ কি বাণী ছাড়া সঙ্গীত বুঝতে পারে?
           রবীন্দ্রনাথ: হ্যাঁ, অর্থহীন শব্দ দিয়েও সঙ্গীত হতে পারে, এ শব্দগুলো কেবল কিছু সুনির্দিষ্ট সুরসঙ্কেত প্রকাশ করে। উত্তর ভারতে সঙ্গীত একটি স্বাধীন শিল্পকলা, বাংলার মতো শব্দ এবং ভাবের প্রকাশ নয়। এ সঙ্গীত অত্যন্ত দুর্বোধ্য এবং নিগূঢ়, এবং ইহা সম্পূর্ণরূপেই স্ব-ব্যাখ্যাত সুর।
আইনস্টাইন: ইহা কি বহু-স্বরিক নয়?
          রবীন্দ্রনাথ: যন্ত্রসমূহ ঐক্যতানের জন্য ব্যবহৃত হয় না, সময়ের সাশ্রয় এবং মাত্রা ও গভীরতা বৃদ্ধির জন্য। ইউরোপীয় সুর কি আরোপিত ঐক্যতান দ্বারা আক্রান্ত?
           আইনস্টাইন: কখনো খুব ভালোভাবেই আক্রান্ত। কখনো ঐক্যতান সম্পূর্ণ সুরকেই ছাপিয়ে ফেলে।
           রবীন্দ্রনাথ: সুর ও ঐক্যতান হলো অনেকটা ছবির রেখা এবং রংশিল্পের মতো। একটি রৈখিক ছবি পরিপূর্ণ সুন্দর হতে পারে; যাতে রংয়ের ছোঁয়া ছবিটিকেই অস্পষ্ট ও গুরুত্বহীন করে তুলতে পারে। তবে রং ও রেখার সমন্বয়ে ও একটি ভালো ছবির সৃষ্টি হতে পারে, এর মূল্য না ছাপিয়ে বা নষ্ট না করে।
          আইনস্টাইন: এটা একটা চমৎকার উদাহরণ, রেখা আসলে রংয়ের চেয়ে অনেক বেশি গভীর। মনে হয় আপনাদের সুরের কাঠামোয় আমাদের চেয়ে অনেক বেশি সমৃদ্ধ। জাপানী সঙ্গীতও আমার কাছে তেমনি মনে হয়।
          রবীন্দ্রনাথ: আমাদের মানসিকতা দিয়ে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সঙ্গীতের প্রভাব অনুধাবন করা খুবই কঠিন। পাশ্চাত্য সঙ্গীত আমাকে গভীরভাবে নাড়া দেয়; আমি মনে করি এটা মহান, এটা মহান এর গঠনে এবং এর সুরে। কিন্তু আমাদের সঙ্গীত এবং এর মৌলিক গীতিআবেদন আমাকে আরো বেশি স্পর্শ করে। ইউরোপীয় সঙ্গীত চরিত্রের দিক থেকে মহাকাব্যের মত; এর একটা বিশাল আবহ আছে এবং ইহা অনেকটা গথিক প্রকৃতির।
          আইনস্টাইন: আমরা আমাদের সঙ্গীতের সাথে এতটাই অভ্যস্ত যে এ প্রশ্নে উত্তর আমরা ইউরোপীয়রা জানি না। আমরা জানতে চাই আমাদের সঙ্গীত ঐতিহ্যের না মৌলিক মানবীয় আবেগের, এ ঐক্য এবং অনৈক্যের আবেগ যা স্বাভাবিক, অথবা কেবল ঐতিহ্যের দ্বারা যা আমরা অর্জন করি।
          রবীন্দ্রনাথ: যেকোনো উপায়ে পিয়ানো আমাকে বিস্মিত করে। বেহালা আমাকে অনেক বেশি আনন্দ দেয়।
আইনস্টাইন: এ গবেষণা খুবই আনন্দের হবে যে, একজন ভারতীয় যে যুবাকালে কখনোই ইউরোপীয় সঙ্গীত শোনে নি তার উপর এ সঙ্গীত কেমন প্রভাব ফেলে তা জানা।
          রবীন্দ্রনাথ: একদা আমি একজন ইংলিশ সুরকারকে আমার জন্য কিছু ক্লাসিক্যাল সঙ্গীত বিশ্লেষণ করতে বলেছিলাম, এবং এর সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করতে বলেছিলাম।
          আইনস্টাইন: সমস্যা হল, প্রকৃত ভালো সঙ্গীত, তা প্রচ্যেরই হোক কিংবা পাশ্চাত্যেরই হোক, বিশ্লেষণ করা যায় না।
          রবীন্দ্রনাথ: ঠিক, যা গভীরভাবে প্রভাবিত করে শ্রোতা আসলে তখন তার নিজের মধ্যে থাকে না।
         আইনস্টাইন: একই ধরনের অনিশ্চয়তা আমাদের অভিজ্ঞতার প্রায় সকল মৌলিক বিষয়েই রয়েছে, শিল্পকলা সম্পর্কে আমাদের প্রতিক্রিয়া, তা হোক ইউরোপে কিংবা এশিয়ায়। এমনকি আপনার টেবিলের এই লাল ফুল যা আমি দেখছি তাও আপনার কাছে এবং আমার কাছে একই নাও হতে পারে।
          রবীন্দ্রনাথ: অতএব, এ সবকিছুর মধ্যেই এক ধরণের মিলনক্রিয়া চলছে, ব্যক্তিবিশেষের রুচি সর্বদাই একটি সর্বজনীন আদর্শের অনুগত।

তর্জমাকৃত উপরোক্ত বর্ণনামতে গণিত শাস্ত্র ও বিজ্ঞানতত্ত্ব, মানবসত্তা, প্রকৃতি, অতীন্দ্রিয়বাদ, সঙ্গীতকলা, ধর্মবিশ্বাস ইত্যাদি গুরুসব বিষয়াদি নিয়ে দুই মহারথীকে আলোচনার যে-গভীরতায় নিবিষ্ট হতে দেখা যায় তার মর্মার্থ অনুধাবন এবং রসাস্বাদন করার বিষয়টি যে কারো জন্য হতে পারে পরম পাওয়া এবং বহুধা শিক্ষণীয় বিষয়াবলী। আরো বিশেষভাবে লক্ষণীয়, কবি এবং বিজ্ঞানী আলোচনার বিষয়বস্তুভেদে কখনো সহমত পোষণ, কখনোবা দ্বিতম পোষণ, আবার কখনোবা একে অপরের পরিপূরক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হচ্ছে- দুইজন দুই জগতের জ্ঞানতাপস হওয়া সত্ত্বেও একজন কর্তৃক উত্থাপিত বিষয়বস্তু অন্যজন খুব সহজেই রপ্ত করে অনায়াসে সমছন্দে যৌক্তিকভাবে মতামত ব্যক্ত করেছেন। অর্থাৎ, আলোচনার বিষয়বস্তু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে তাঁদের মতামত প্রদানে কখনোই ছন্দপতন হতে দেখা যায়নি, সমানতালে তাঁরা মতবিনিময় করে গেছেন। এ যেন আলোচনার মহাদ্বৈরথে ‘কেহ কারে নাহি জিনে সমানে সমান’!

কেমন বা কী ছিল দুই মহাজ্ঞানী রবীন্দ্রনাথ এবং আইনস্টাইনের ধর্মভাবনা, চিন্তা বা বিশ্বাস! পারিবারিক ও সামাজিক প্রভাবসহ এ ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে তাঁদের স্ব-স্ব যেসব মতামত প্রকাশিত হয়েছে সেসবের উপর কিয়দ আলোকপাত করলে বিষয়টি সম্পর্কে ধারণালাভ করা যেতে পারে।

বিখ্যাত হিন্দুধর্ম সংস্কারক রাজা রামমোহন রায় ব্রাহ্ম ধর্ম প্রবর্তন করেন। মূলত এই ধর্মাবলম্বীদের উপাস্য "পরম ব্রহ্ম", অন্য কথায় "নিরাকার ব্রহ্ম"। "পরম ব্রহ্ম" হচ্ছে এক কথায় উপনিষদের মূল উপজীব্য বা বিষয়বস্তু । জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার ছিল এই ব্রাহ্ম আদিধর্ম মতবাদের প্রবক্তা। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন ব্রাহ্ম ধর্মগুরু। সঙ্গত কারণে প্রথম জীবনে পারিবারিকভাবেই যে রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম ধর্ম সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানলাভে সক্ষম হন তা বলাই বাহুল্য। অধিকন্তু বোধগম্য, যুবক রবীন্দ্রনাথ উপনিষদ, বেদ, মনুসংহিতা এবং গীতাসহ হিন্দুধর্মের অন্যান্য প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ বা পৌরাণিক গ্রন্থসমূহ খুব ভালভাবেই রপ্ত করে ফেলেন। পর্যায়ক্রমে তিনি নিষ্কাম কর্ম, পুরুষোত্তম, বৈষ্ণববাদ, বৌদ্ধধমের্র অহিংস মতবাদ, খ্রিস্টীয় মতবাদ এবং ইসলামের মর্মবাণী সম্পর্কে সম্যক জ্ঞানলাভ করেন। এভাবে সর্বধর্ম জ্ঞানলাভকারী পরিপূর্ণ রবীন্দ্রনাথের ধর্মীয় ভাবনা কোনও একটি বিশেষ ধর্মে সীমবদ্ধ থাকেনি। তিনি কালক্রমে হয়ে উঠেন বিশ্বমানবতাবাদী এবং মানবধর্মের প্রধান প্রবক্তা। এ কারণেই ১৯৩০-এর দশকের প্রথমভাগে একদিকে দেশের অভ্যন্তরে একাধিক বক্তৃতা, গান ও কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় সমাজে ধর্মের দোহাইয়ে প্রচলিত বর্ণাশ্রম প্রথা ও অস্পৃশ্যতার তীব্র সমালোচনা করেন, অন্যদিকে তার এই মতবাদের উপর ভিত্তি করে ঐ বছরই তিনি ধারাবাহিকভাবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হিবার্ট লেকচারস’ শিরোনামে যে বক্তৃতামালা প্রদান করেন তা গোটা বিশ্বকে আলোড়িত করে। পরের বছর, ১৯৩১ সালে ‘হিবার্ট লেকচারস’-এর একত্রিত রূপ ‘দ্য রিলিজিয়ন অব ম্যান’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে তা বাংলা তর্জমায় ‘মানুষের ধর্ম’ শিরোনামে রবীন্দ্রনাথের প্রধান দর্শন হিসেবে তাঁর রচনাবলীর অবিচ্ছেদ্য অংশবিশেষ অন্তর্ভূক্ত হয়।

জীবনের শেষপ্রান্তে এসে রবীন্দ্রনাথ তাঁর মানবধর্ম মতবাদ সম্পর্কে মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েন।

ফলে কলকতায় অনুষ্ঠিত ১৯৩৭ সালের ৩ মার্চ বিশ্বধর্ম সম্মেলনের তৃতীয় দিনের অধিবেশনের সভাপতি হিসেবে জ্ঞানগর্ভ ভাষণে তিনি বলেন-

“সমগ্র মানবজাতির একটিমাত্র ধর্ম থাকবে, একই বিশ্বজনীন পদ্ধতিতে সকলে উপাসনা করবে এবং একই আদর্শে সকলের ধর্ম পিপাসা তৃপ্তি লাভ করবে, আমি এমন কথা বলি না।

যে রূঢ় সাম্প্রদায়িক মন বিনা কারণে নামমাত্র কারণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, সূক্ষ্ম বা স্থূলভাবে অত্যাচার করে, তাকে স্মরণ করিয়ে দিতে হবে যে, কবিতার ন্যায় ধর্মও কোনও আদর্শবাদ নয়,

উহা অভিব্যক্তি মাত্র।

সৃষ্টির বিচিত্রতার মধ্যেই ঈশ্বরের বহুমুখীন আত্মপ্রকাশ; অনন্ত সম্পর্কে আমাদের আদর্শও তদ্রুপ ব্যক্তিত্বের নিরবচ্ছিন্ন এবং অনমনীয় বিচিত্রতার মধ্যেই প্রকাশ করতে হবে।

কোনও ধর্ম যখন সমগ্র মানবজাতির উপর তার শিক্ষা চাপিয়ে দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে, তখন উহা আর ধর্ম থাকে না, তখন উহা হয়ে পড়ে স্বৈরাচার, ইহাও একপ্রকার সাম্রাজ্যবাদ। অধিকাংশ স্থানেই এ জন্যই দেখতে পাই, পৃথিবীর ধর্মজগতেও চলছে ফ্যাসিজমের তাণ্ডব, অনুভূতিবিহীন পদভারে উহা মানবাত্মাকে দলিত-মথিত করছে।”

কী ঔদার্য, কী সুদূরপ্রসারী বিশ্বজনীন ধর্মদর্শন বাণী!

তাঁর এই অমৃতবাণীর দীর্ঘ প্রায় ৮ দশক পর আজও পৃথিবীতে ধর্মভিত্তিক, সাম্প্রদায়িক ও গোষ্ঠীগত হানাহানি, যুদ্ধ, বিগ্রহ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটে চলছে। এ কারণেই চিন্তাচেতনা, মমনশীলতা, সৃষ্টিকর্ম, রচণাশৈলি ইত্যাদি সবকিছুর ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ প্রজন্মান্তর অন্য সকলের চেয়ে আধুনিকতার ধারক ও বাহক হিসেবে অগ্রগণ্য হয়ে থাকবেন।

রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক আরেক যুগস্রষ্টা আইনস্টাইনের ধর্মভাবনা নিয়ে বিভিন্নজনের ভিন্ন ভিন্ন মতামত রয়েছে। মূলত, একজন বিজ্ঞানী হিসেবে ধর্ম বিষয়ে আইনস্টাইনের চিন্তা-চেনতা বা ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের কোনও সম্পর্ক রয়েছে কিনা এসব নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজনের প্রশ্নের জবাবে তাঁর দেয়া উত্তরসমূহের প্রেক্ষিতে মতামতের এই ভিন্নতা সৃষ্টি করেছে। তবে স্রষ্টা ও ধর্ম সম্পর্কে তাঁর সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্বাস ছিল। ধর্মনিরপেক্ষ ইহুদি মা-বাবা কর্তৃক লালিত-পালিত হয়েছিলেন বলে ধর্মীয় ব্যাপারে আইনস্টাইন পারিবারিকভাবে ছোটবেলা থেকেই উদার দৃষ্টিভঙ্গির মানসিকতাসম্পন্ন হয়ে উঠেছিলেন। আর পরিণত বয়সে ধর্মীয় বিশ্বাসের ব্যাপারে তিনি বিভিন্ন সময়ে নিজেকে অজ্ঞেয়বাদী, ব্যক্তিধর্মে অবিশ্বাসী, সর্বেশ্বরবাদী এবং দার্শনিক বারুচ স্পিনোজা’র ঈশ্বরে বিশ্বাসী বলে অভিহিত করেছেন। ‘আমার দৃষ্টিতে জগৎ’ শীর্ষক প্রবন্ধে স্রষ্টা ও ধর্ম সম্পর্কে আইনস্টাইন সুনির্দিষ্টভাবে বেশ কিছু মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি লিখেছেন- “রহস্য সন্ধানের কৌতূহল-সমৃদ্ধ অভিজ্ঞতা থেকে আমরা মধুরতম অনুভূতি লাভ করতে পারি। প্রকৃত শিল্পকলা এবং প্রকৃত বিজ্ঞানের সূচনাবিন্দুতে রহস্য উদঘাটনের তীব্র আগ্রহ থাকে। এ আগ্রহ যার শেষ হয়ে যায়, সে আর বিস্মিত হয় না, কৌতূহলের আনন্দে কর্মচঞ্চল হয় না, সে মৃত, তার দৃষ্টিশক্তি নির্বাপিত হয়ে যায়। রহস্য সন্ধানের এ অভিজ্ঞতাই ধর্মের জন্ম দিয়েছে এবং সেক্ষেত্রে এ অভিজ্ঞতার মধ্যে ভয়ও যুক্ত থাকতে পারে। রহস্যময় অজানা কোনো কিছুর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানার আগ্রহ আর গভীরতম যুক্তিবোধ ও দীপ্তিময় সৌন্দর্যবোধভিত্তিক আমাদের ইন্দ্রিয়লব্ধ তীব্র অনুভূতির আদি ও অবিকৃত রূপের মধ্যে আমরা আমাদের সত্তায় অনুভব করতে পারি । এ আগ্রহ ও অনুভূতি দ্বারাই গঠিত হয় প্রকৃত ধর্মবোধ। এ অর্থে এবং কেবলমাত্র এ অর্থেই আমি গভীর ধর্মবোধসম্পন্ন মানুষ। আমি এমন কোনো ঈশ্বর কল্পনা করতে পারি না, যিনি তার সৃষ্ট জীবকে পুরস্কৃত করেন কিংবা শাস্তি দেন অথবা যিনি আমাদের ইচ্ছাশক্তির মতো কোনো প্রকার ইচ্ছাশক্তির অধিকারী। আমি কল্পনা করতে পারি না এবং কখনো কল্পনা করতে চাইও না যে, দৈহিক মৃত্যুর পরেও কোনো ব্যক্তির সত্তা বেঁচে থাকে। দুর্বল প্রকৃতির লোকেরা ভয় ও স্বার্থবোধ বশে এ ধরনের ধারণা পোষণ করতে পারে।”

স্ববিবৃত এই উক্তির চেয়ে আর কোনও বর্ণনাই ধর্মবিষয়ে আইস্টাইনের বিশ্বাস ও চিন্তা-ভাবনার যথার্থতা প্রমাণ করতে পারে না।

বিশ্বমানব কল্যাণে সকল মহামাবনই অভিন্ন চিন্তা-চেতনার ধারক- এই আপ্তবাক্যের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে উপরে বর্ণিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আলবার্ট আইনস্টাইনের আলাপচারিতা এবং ধর্মসম্পর্কিত তাঁদের চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণা।

রবীন্দ্রনাথ এবং আইনস্টানের জীবনের দু’টি বিশেষ ঘটনার কথা উল্লেখ করে আলোচনার পরিসমাপ্তি ঘটানো যেতে পারে। প্রথমত, রবীন্দ্রনাথ ‘মানুষের ধর্ম’ রচণাগুচ্ছের এক জায়গায় লিখেছেন- “মনে আছে, একবার ডালহৌসি পাহাড়ে পিতার সঙ্গে ছিলুম। সেখানে প্রচণ্ড শীত। সেই শীতে ভোরে আলো-হাতে এসে আমাকে শয্যা থেকে উঠিয়ে দিতেন। সেই ভোরে উঠে একদিন চৌরঙ্গির বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলুম। তখন ওখানে ফ্রি ইস্কুল বলে একটা ইস্কুল ছিল। রাস্তাটা পেরিয়েই ইস্কুলের হাতাটা দেখা যেত। সে দিকে চেয়ে দেখলুম, গাছের আড়ালে সূর্য উঠছে। যেমনি সূর্যের আবির্ভাব হল গাছের অন্তরালের থেকে, অমনি মনের পর্দা খুলে গেল। মনে হল, মানুষ আজন্ম একটা আবরণ নিয়ে থাকে। সেটাতেই তার স্বাতন্ত্র্য। স্বাতন্ত্র্যের বেড়া লুপ্ত হলে সাংসারিক প্রয়োজনের অনেক অসুবিধা। কিন্তু, সেদিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার আবরণ খসে পড়ল। মনে হল, সত্যকে মুক্ত দৃষ্টিতে দেখলুম। মানুষের অন্তরাত্মাকে দেখলুম। দুজন মুটে কাঁধে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে চলেছে। তাদের দেখে মনে হল, কী অনির্বচনীয় সুন্দর। মনে হল না, তারা মুটে। সেদিন তাদের অন্তরাত্মাকে দেখলুম, যেখানে আছে চিরকালের মানুষ”। অন্যদিকে, আইনস্টাইনের মেয়ের বিয়েতে সবাই চার্চে যাচ্ছিলেন তাঁরা। পথিমধ্যে তিনি মেয়েকে বললেন- ‘তুমি চার্চের দিকে যাও, আমি ল্যাবে আমার কলমটা রেখে আসছি’। মেয়ে অনেক বারণ করা সত্ত্বেও আইনস্টাইন গেলেন, ৩০ মিনিটের কথা বলে তিনি যখন ফিরে এলেন না, তখন সবাই মিলে উনার মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিলেন। সাতদিন পর উনার মেয়ে বাসায় এসে মাকে তার বাবা কোথায় তা জিজ্ঞাস করলে তার মা বললেন ওই যে গেলেন আরতো আসেননি। মেয়ে তখন আইনস্টাইনের খোঁজে ল্যাবে গেলেন। সেখানে গিয়ে দেখেন তার বাবা একটা কলম নিয়ে বোর্ডের সামনে গিয়ে কী যেন চিন্তা করছেন মেয়ে বাবা কে বলল- ‘বাবা কি কর’। তখন আইনস্টাইন বললেন- ‘মা, তুমি চার্চে যাও, আমি এই কাজটা ১০ মিনিটের মধ্যে শেষ করে আসছি’।

রবীন্দ্রনাথের ‘সত্যকে মুক্ত দৃষ্টিতে দেখা’ আর আইনস্টাইনের ‘কলম রেখে আসা’ যুগযুগান্তরেও শেষ হবার নয়। কারণ এঁরা কখনো কোনও অন্ধবিশ্বাসে বিশ্বাস করেন না।

বিজ্ঞানি আইনষ্টাইন ১৯৫৪ সালে এক চিঠিতে লিখেছেলেন ;
“ ঈশ্বর (GOD) শব্দটি আমার কাছে মানুষের দুর্বলতার বহির্প্রকাশ ও দুর্বলতা থেকে উৎপাদিত বস্ত্তর চেয়ে বেশি কিছু মনে হয় না । বাইবেল গ্রন্থটি খুবই ন্যায়পরায়ন, তবে আদিম কিংবদন্তির বেশি কেছু নয় । তার চেয়ে বড় কথা , খুবই শিশুসুলভ এগোলো ।
Details of the main letter ( from internate )

In January of 1954, just a year before his death, Albert Einstein wrote the following letter to philosopher Erik Gutkind after reading his book, "Choose Life: The Biblical Call to Revolt," and made known his views on religion. Apparently Einstein had only read the book due to repeated recommendation by their mutual friend Luitzen Egbertus Jan Brouwer. The letter was bought at auction in May 2008, for £170,000; unsurprisingly, one of the unsuccessful bidders was Richard Dawkins.
Translated transcript follows.

(Source: David Victor; Image: Albert Einstein, via.)

Translated Transcript
Princeton, 3. 1. 1954

Dear Mr Gutkind,

Inspired by Brouwer's repeated suggestion, I read a great deal in your book, and thank you very much for lending it to me. What struck me was this: with regard to the factual attitude to life and to the human community we have a great deal in common. Your personal ideal with its striving for freedom from ego-oriented desires, for making life beautiful and noble, with an emphasis on the purely human element. This unites us as having an "unAmerican attitude."

Still, without Brouwer's suggestion I would never have gotten myself to engage intensively with your book because it is written in a language inaccessible to me. The word God is for me nothing more than the expression and product of human weakness, the Bible a collection of honorable, but still purely primitive, legends which are nevertheless pretty childish. No interpretation, no matter how subtle, can change this for me. For me the Jewish religion like all other religions is an incarnation of the most childish superstition. And the Jewish people to whom I gladly belong, and whose thinking I have a deep affinity for, have no different quality for me than all other people. As far as my experience goes, they are also no better than other human groups, although they are protected from the worst cancers by a lack of power. Otherwise I cannot see anything "chosen" about them.

In general I find it painful that you claim a privileged position and try to defend it by two walls of pride, an external one as a man and an internal one as a Jew. As a man you claim, so to speak, a dispensation from causality otherwise accepted, as a Jew the privilege of monotheism. But a limited causality is no longer a causality at all, as our wonderful Spinoza recognized with all incision, probably as the first one. And the animistic interpretations of the religions of nature are in principle not annulled by monopolization. With such walls we can only attain a certain self-deception, but our moral efforts are not furthered by them. On the contrary.

Now that I have quite openly stated our differences in intellectual convictions it is still clear to me that we are quite close to each other in essential things, i.e; in our evaluations of human behavior. What separates us are only intellectual "props" and "rationalization" in Freud's language. Therefore I think that we would understand each other quite well if we talked about concrete things.

With friendly thanks and best wishes,

Yours,

A. Einstein

উতসঃ http://abdurrouf10.blogspot.com/2015/10/blog-post_8.html?m=1

Tuesday, July 4, 2017

সর্বকালের সেরা ১০ ধনী



চলমান শতাব্দীকে পৃথিবীর ইতিহাসে ধনীদের স্বর্ণযুগ বা স্বর্ণসময় বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। বিল গেটসকে তারা মনে করেন সর্বকালের সেরা। এ সব ধারণা আদতে ভুল। বাস্তবতা বলে বিশ্বের সমসাময়িক ধনী ব্যক্তিরা অতীত ইতিহাসের ধনীদের তুলনায় অনেকটাই ফ্যাকাশে এবং সর্বকালের ধনীর তালিকায় আজকের যুগের ধনাঢ্যরা অনেকটাই পিছিয়ে।

আজকের সময়ে বিশ্বের অধিকাংশ ব্যক্তিই তাদের অর্থের পাহাড় ব্যবসায়িক বিনিয়োগ ও দখলদারিত্বের মাধ্যমে গড়ে তুললেও ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় যে সম্পদশালী হওয়ার পথ আরো অনেক বেশি সাংঘর্ষিক ছিল।

সময়ের বিশাল ব্যবধান, অর্থনৈতিক পদ্ধতি ও মুদ্রামানের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান সত্ত্বেও বিশ্বের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা দশ ধনীর তালিকায় প্রাচীন আমলই বেশি আলোকিত।

১০. চেঙ্গিস খাঁ
chengis

সর্বকালের অন্যতম সফল একজন সামরিক শাসকের নাম চেঙ্গিস খাঁ। মঙ্গল সাম্রাজ্যের এ শাসকের নিয়ন্ত্রণ ছিল চীন থেকে শুরু করে সুদূর ইউরোপ অবধি। ইতিহাসে সবচেয়ে বিশালায়তন সাম্রাজ্যের অধিপতি ছিলেন তিনিই। তবে বিপুল প্রভাবশালী হওয়া সত্ত্বেও চেঙ্গিস খাঁ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলেন, তিনি কখনোই সম্পদ আহরণ বা মজুদ করতেন না। বিপরীত মত থেকে জানা যায়, চেঙ্গিস খাঁর প্রভাবের চাবিকাঠিই ছিল তার উদারতা।

তার সাফল্যের অন্যতম ভিত্তি ছিল লুণ্ঠনকৃত সম্পত্তি নিজের সৈনিক ও সেনাপতিদের সাথে ভাগাভাগি করে নেওয়া। অনেক প্রাক-আধুনিক সেনাবাহিনীর সাথে মঙ্গল সৈনিকদের পার্থক্য ছিল এই যে মঙ্গল সৈনিকরা ব্যক্তিগত পর্যায়ে লুটপাট করত না। কোনো অঞ্চল দখলে সফল হওয়ার পর সেখানকার প্রতিটি জিনিসের একটি তালিকা তৈরি করতেন সরকারি কর্মচারীরা এবং তারপর তালিকা অনুসারে সেগুলো সেনাবাহিনী ও তাদের পরিবারের মধ্যে বণ্টন করা হতো।

এরপর অবশিষ্ট যা কিছু চেঙ্গিস খাঁর ভাগে পড়তো, সেগুলো দিয়ে তার ধনী হওয়া খুব একটা সম্ভবপর নয়। তার নিজের কিংবা নিজ পরিবারের জন্য চেঙ্গিস খাঁ কোনো প্রাসাদ, কোনো মন্দির, কোনো দরবার, কোনো সমাধি, এমনকি কোনো বাড়িও নির্মাণ করেননি। যেভাবে জন্মেছিলেন, সেভাবেই একজন সাধারণের মতই পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি।

৯. বিল গেটস

rich-9
বিশ্বের সর্বকালের ধনীতম ব্যক্তিত্বের তালিকার একমাত্র জীবিত ব্যক্তিটির নাম বিল গেটস। জীবিত বলেই ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মধ্যে একমাত্র বিল গেটসের সম্পদেরই সঠিক পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব। ফোর্বসের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছর মাইক্রোসফট প্রতিষ্ঠাতার নিট আয় ৭৮.৯ বিলিয়ন ডলার। বর্তমান বিশ্বে জীবিত দ্বিতীয় ধনী ব্যক্তি জারা’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা অ্যামানিকো ওর্টেগার চাইতে আট বিলিয়ন ডলার বেশি মূল্যের সম্পদের মালিক গেটস।





৮. অ্যালান রুফুস

8-alan-rufus-321

সম্রাট উইলিয়ামের ভাতিজা রুফুস ইংল্যান্ড বিজয়ে নরম্যানদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন চাচার বাহিনীতে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে। মৃত্যুর সময় তিনি ছিলেন ১১ হাজার পাউন্ডের মালিক, ‘রিচেস্ট অব দ্য রিচ’ বইয়ের লেখক ফিলিপ বেরেসফোর্ড এবং বিল রুবিনস্টেইনের তথ্য অনুযায়ী- সে সময় এই ১১ হাজার পাউন্ড ছিল তৎকালীন ইংল্যান্ডের মোট জিডিপি’র সাত শতাংশ। তখনকার ১১ হাজার পাউন্ড ২০১৪ সালের বাজারমূল্যে ১৯৪ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ।





৭. জন ডি রকফেলার

7-John-d-Rokfelar-143
১৮৬৩ সালে তেল শিল্পে বিনিয়োগ করতে শুরু করেছিলেন রকফেলার এবং ১৮৮০ সাল নাগাদ তিনি প্রতিষ্ঠা করেন স্ট্যান্ডার্ড অয়েল, যে প্রতিষ্ঠানটি সে সময় গোটা যুক্তরাষ্ট্রের ৯০ শতাংশ তেলের উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করত।

১৯১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় আয়কর রিটার্ন বিভাগ সূত্রে জানা যায়- রকফেলার প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদের মালিক ছিলেন, যা সে বছর গোটা দেশটির মোট আয়ের দুই শতাংশ ছিল।

ওই বছরের দেড় বিলিয়ন ডলার ২০১৪ সালের বাজারমূল্যে ৩৪১ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ।

৬. অ্যান্ড্রু কার্নেগি

rich-7

সংবাদমাধ্যমের মনোযোগ টানতে সক্ষম হয়েছিলেন রকফেলার। কিন্তু গোটা যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ধনী ব্যক্তি সম্ভবত অ্যান্ড্রু কার্নেগিই। তার প্রতিষ্ঠান ইউএস স্টিল ১৯০১ সালে ৪৮০ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করেছিলেন জেপি মর্গানের কাছে। সে সময়ে এই অর্থ তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের মোট জিডিপি’র ২.১ শতাংশ ছিল। আর কার্নেগির মোট সম্পদ ২০১৪ সালের বাজারমূল্যে ৩৭২ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ।

৫. জোসেফ স্তালিন

5-stalin-ew111
আধুনিক অর্থনীতির ইতিহাসে স্তালিনের নাম খুব একটা শোনা যায় না। প্রবল প্রতাপশালী স্তালিন ছিলেন একজন স্বৈরশাসক এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি। সোভিয়েত ইউনিয়নের মোট সম্পদ থেকে স্তালিনের মোট সম্পত্তি পৃথক করা দৃশ্যত অসম্ভব হলেও এই দুইয়ের মিশেলের কারণেই বিশেষজ্ঞরা তাকে সর্বকালের সেরা অন্যতম ধনী ব্যক্তি হিসেবে মনোনীত করে থাকেন।





৪. সম্রাট আকবর

akbar

ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ অধিপতি সম্রাট আকবর তার সময়ে সারা বিশ্বের মোট আয়ের এক-চতুর্থাংশের মালিক ছিলেন।

ইতিহাসবিদরা বলেন, আকবরের অধীনে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি তৎকালীন রানী এলিজাবেথের শাসনাধীন ইংল্যান্ডের মাথাপিছু জিডিপি’র সাথে তুলনীয় ছিল। কিন্তু সম্রাট আকবর ও তার অধীনে শাসক শ্রেণির ‘অমিতব্যয়ী ও অসংযত জীবনযাপনের কারণেই ইউরোপীয় সমাজের তুলনায় পিছিয়ে পড়ে’ ভারত।

জনগণের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের দিক থেকে মোগল সাম্রাজ্য ছিল ইতিহাসের অন্যতম সফল সাম্রাজ্য।

৩. সম্রাট শেনজং

3
চীনের সং সাম্রাজ্য (৯৬০-১২৭৯) ছিল অর্থনৈতিক দিক থেকে সর্বকালের অন্যতম প্রভাবশালী সাম্রাজ্য। তামকাং ইউনিভার্সিটির সং সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ, চীনা অধ্যাপক রোনাল্ড এ এডওয়ার্ডস জানান, শাসনের সফলতম সময়ে সং সাম্রাজ্যের জাতীয় আয় ছিল সারা বিশ্বের অর্থনীতির ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ।

আয়কর সংগ্রহে দারুণ দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন- এই দুইই ছিল সং সাম্রাজ্যের বিপুল সম্পদের মূল উৎস। ইউরোপীয় সরকার আমলের কয়েকশ’ বছর আগেই এই বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছিল সং সাম্রাজ্য।

এ ছাড়া, সং সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা ছিল ভীষণরকমের কেন্দ্রীভূত। অর্থাৎ গোটা অর্থনীতির ওপরেই সম্রাটের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ ছিল।

২. অগাস্টাস সিজার

Augustus

অগাস্টাস সিজার ছিলেন এমন একটি সাম্রাজ্যের অধিপতি, যার মোট আয় ছিল তৎকালীন সময়ে গোটা বিশ্বের মোট আয়ের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ। শুধু তাই নয়, শাসনের এক পর্যায়ে সাম্রাজ্যের মোট অর্থনীতির এক-পঞ্চমাংশের সমপরিমাণ ব্যক্তিগত সম্পদ অর্জন করেছিলেন তিনি, যা ২০১৪ সালের বাজারমূল্যে ৪.৬ ট্রিলিয়ন ডলারের সমতুল্য।





১. মনসা মুসা

musa
টিমবুক্তুর রাজা মনসা মুসা, যাকে এক কথায় সর্বকালের ইতিহাসে সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে স্বীকার করেন আজকের বিশ্বের প্রত্যেক ইতিহাসবিদ।

গবেষণা বলে, মুসার পশ্চিম আফ্রিকান রাজ্য ছিল বিশ্বের বৃহত্তম স্বর্ণ উৎপাদনকারী অঞ্চল, তাও এমন এক সময়ে- যখন স্বর্ণের ব্যাপক চাহিদা ছিল।
কেমন ধনী ছিলেন মুসা? তার সম্পদের সঠিক পরিমাণ নির্ণয় করা যায়নি আজও। তথ্যেরও রয়েছে অভাব, বলতে গেলে তথ্য নেইই। সমসাময়িক সূত্রে জানা যায়, মুসা যতোটা ধনী ছিলেন- ততটা ধনী হওয়ার বিষয়ে সে সময়ে অন্য কারো জন্য অসম্ভব এবং কল্পনাতীত ছিল।

মক্কায় হজযাত্রী হিসেবে মনসা মুসার যাত্রার ঘটনা বেশ বিখ্যাত এবং এ বিষয়ে রয়েছে প্রচুর গল্পও। সে সময়ে মুসার জীবনযাত্রা এতটাই বিলাসবহুল ছিল যে এর ফলে মিশরের মুদ্রাবাজারে ব্যাপক সংকট শুরু হয়ে যায়। ওই হজযাত্রায় মুসার বহরে থাকা অর্ধশতাধিক উটের পিঠে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কয়েকশ’ পাউন্ড ওজনের স্বর্ণ।

অনেকে বলেন- কেবল ওই এক যাত্রাতেই মুসার সাথে যাত্রা করা সেনাবাহিনীতে ৪০ হাজার জন তীরন্দাজসহ ছিল দুই লাখ সৈনিক, আজকের বিশ্বে অনেক পরাশক্তিশালী দেশই যে সংখ্যক সৈনিক যুদ্ধের ময়দানে নামানোর কথা ভাবতেই পারবে না।

যখন কারো সম্পদের পরিমাণ নির্ণয়ই করা সম্ভব হয়ে ওঠে না, তখন বুঝতেই হবে যে তিনি কল্পনাতীত রকমের ধনাঢ্য!

Monday, July 3, 2017

প্লুটো নিয়ে কয়েক ছত্র



দোজখের দেবতা
নাম-পরিচয় নিয়ে এমন শোরগোল বোধহয় আর কখনও পাকেনি, কারও বেলায়। তর্কাতর্কির এক চূড়ান্ত চিত্র। বিচিত্র এই মহাজাগতিক জাতকের জীবনে বিপর্যয় বুঝি লেখা ছিল তার জন্ম কুণ্ডলীতেই! আবিষ্কারের দিন থেকেই সবার চোখে ও চিহ্নিত হয়েছে বেয়াড়া হিসেবে। সহজাত সহোদরদের চেয়ে স্বভাব-চরিত্র যে তার একটু আলাদাই। আকিকার সময় তার নাম রাখা হয়েছিল প্লুটো। পদবিতে ছিল গ্রহ। কিন্তু যুক্তির যুদ্ধ শুরু জন্ম থেকেই। ৭৬ বছর পর, ২০০৬ সালে তার নাম গেল পাল্টে। বদলি নাম হল প্লুটোইড। পাল্টে গেল পদবিও। গ্রহ নয়, পরিচয় তার এখন বামন গ্রহ। প্লুটোর পতন নয়, এই প্রতিবেদনে থাকছে প্লুটো আবিষ্কারের পেছনের গল্প।
পৃথিবী থেকে খালি চোখে দেখা যায় সূর্যের পাঁচ সন্তানকে- বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি আর শনি। যন্ত্রের চোখে ধরা পড়া প্রথম গ্রহ হচ্ছে ইউরেনাস। আবিষ্কারকের নাম উইলিয়াম হার্শেল। এই আবিষ্কারে সাড়া পড়ে গেল চারদিকে। নেহাতই শখের এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী (যার আয়-রোজগার হয় কনসার্ট করে, অর্গান বাজিয়ে!) কি না খোঁজ দিলেন এক মহাজাগতিক বস্তুর। ইউরেনাসের আবিষ্কারে সৌরমণ্ডলের পরিধি বেড়ে গেল, হল দ্বিগুণ। গ্রিক পুরাণে স্যাটার্নের বাবা এবং আকাশের দেবতা ওউরানোস। এই দেবতার নামেই নতুন গ্রহের নাম রাখা হল ‘ইউরেনাস’।
এই গ্রহ আবিষ্কারের পর থেকেই বড় এক বিভ্রান্তি গ্রাস করেছে জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের। সবচেয়ে নামিদামি লেন্সের দূরবীণে চোখ তাদের। তারা সূর্যকে ঘিরে ইউরেনাসের চলার পথপরিক্রমা যতই পর্যবেক্ষণ করছেন, ততই বাড়ছে সেই বিভ্রান্তি। একটি নক্ষত্রের চারপাশে গ্রহরা কীভাবে আবর্তিত হবে, তা বলে দিতে পারে আইজাক নিউটনের বিখ্যাত মহাকর্ষ সূত্র। সমীকরণের সাহায্যে আগেভাগেই বলে দেওয়া সম্ভব, আজ থেকে অনেকদিন পর বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি বা শনি-কে কোথায় থাকবে। বিপত্তি বাধল ইউরেনাসের বেলায়। দেখা গেল, ইউরেনাসের কক্ষপথ অনুমানে নিউটনের তত্ত্ব অসার! বহুকাল দূরের গল্প, এক বছর পরে কোথায় দেখা যাবে গ্রহটাকে, সেই গণনাও বাস্তবে মিলছে না। তবে কি নিউটনের তত্ত্ব ভুল? না, তা নয়।
গোলমালটা অন্যখানে-সন্দেহ জাগল দুই গবেষকের। না, তারা কেউ জ্যোতির্বিজ্ঞানী নন। দু’জনেই গণিতজ্ঞ। কখনও চোখ রাখেননি কোনো দূরবীণে। কিন্তু গ্রহের কক্ষপথ গণনা যেহেতু গণিতের ব্যাপার, তাই ইউরেনাস ঘিরে সমস্যা নিরসনে এগিয়ে এসেছিলেন তারা। এদের একজন ব্রিটিশ অধ্যাপক জন কাউচ অ্যাডামস এবং ফরাসি গণিত গবেষক আরবা জাঁ-জোসেফ লিভেরি। ইংলিশ চ্যানেলের দু’পারের দু’জনা। একে অন্যের গবেষণার খবর কিন্তু কেউ তারা জানতেন না। অথচ কী বিস্ময়, গণনার শেষে ১৮৪৫ সালে দু’জনেই এসে পৌঁছলেন একই সিদ্ধান্তে! ইউরেনাসের বেহিসাবি কক্ষপথের মূলে রয়েছে আরও দূরের এক গ্রহ। এত দিন দেখা যায়নি তো কী, দূরবীণে ঠিকমতো খুঁজলে ধরা পড়বেই। আকাশের কোথায় খুঁজতে হবে সেই লুকিয়ে থাকা গ্রহটিকে, তাও হিসাব করে বের করে ফেললেন তারা দু’জন। আর তারপর পেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের অনুরোধ করলেন রাতের আকাশে ওই এলাকাটা খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে। অবশেষে ১৮৪৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর। বার্লিন অবজারভেটরির জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহান গটফ্রিড গল ও তার ছাত্র হেনরিখ লুডভিগ দূরবীণ ঘুরিয়ে সত্যিই খুঁজে পেলেন গ্রহটিকে।
এর কয়েকদিনের মধ্যে পাওয়া গেল আরেক খবর। ব্রিটেনের দু’জন জ্যোতির্বিজ্ঞানীও নাকি অ্যাডামসের পরামর্শ শুনে আকাশ খুঁজে পেয়েছেন একই গ্রহের খোঁজ! তা হলে কী নাম রাখা হবে এখন নতুন এই গ্রহটির? দূরবীণে ঈষৎ সবুজাভ দেখায় বলে সমুদ্রের দেবতার নাম অনুসারে গ্রহটির নাম দেওয়া হল ‘নেপচুন’। কিন্তু আবিষ্কর্তা? এবার কৃতিত্বের কাজিয়া শুরু হল ইংলিশ চ্যানেলের দু’পারের দুই দেশে। শেষমেশ অবশ্য রফা হল। লিভেরি এবং অ্যাডাম্স নেপচুনের যৌথ আবিষ্কর্তা।
কৃতিত্বের ভাগ নিয়ে ঝগড়ার কথা বাদ দিলে প্লুটোর আবিষ্কারের গল্পটাও ওই নেপচুন-কাহিনীর মতো। কী রকম? দেখা গেল, নেপচুনের উপস্থিতি ইউরেনাসের কক্ষপথের বিচ্যুতি অনেকটাই ব্যাখ্যা করছে বটে, তবে পুরোটা নয়। অতএব? হ্যাঁ, খুঁজলে মিলবে হারাধন সূর্যের আরও এক সন্তান! এই খোঁজে অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন পারসিভাল লোয়েল। ধনকুবের আমেরিকান। ১৮৯৪ সালে আরিজোনায় মরুভূমির বুকে গড়ে তুলেছেন তার নিজস্ব মানমন্দির। আর তার পর দূরবীণে চোখ রেখে মঙ্গল গ্রহের বুকে আবিষ্কার করেছিলেন ওখানকার ‘মানুষের তৈরি নদী-নালা’। এহেন খবরে হইচই পড়ে গিয়েছিল। এবং এতটাই যে, লেখক হারবার্ট জর্জ ওয়েলস কাহিনী (‘ওয়র অব দ্য ওয়ার্ল্ডস’) লিখে ফেলেন মঙ্গলের প্রাণীদের নিয়ে। শোরগোলের পর পেশাদার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বিদ্রূপের শিকার হন লোয়েল। মঙ্গলের বুকে খানাখন্দকে বড় তাড়াহুড়া করে প্রাণীর তৈরি বলে প্রচার করায়। বদনাম ঘোচাতেই অজানা গ্রহের খোঁজে মনপ্রাণ সঁপেন লোয়েল। ওটার একটা নামও আগাম দেন তিনি। ‘প্ল্যানেট-এক্স’।
১৯১৬ সালে লোয়েল মারা গেলেন তার সাধ অপূর্ণ রেখে। সে স্বপ্ন সফল করলেন ক্লাইভ টমবাও নামে এক তরুণ। বিদ্যার দৌড় যার স্রেফ স্কুল অবধি। নেহাতই আকাশ দেখার শখে লোয়েলের মানমন্দিরে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন যিনি।
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি প্ল্যানেট-এক্স খুঁজে পেলেন টমবাও। কিন্তু লোয়েলের বিধবা পত্নী কনস্টান্সের অনুরোধে গোপন রাখা হল আবিষ্কারের খবর। অবশেষে ঘোষণা হল ১৩ মার্চ, লোয়েলের ৭৫তম জন্মদিন আর ইউরেনাস আবিষ্কারের ১৪৯তম বর্ষপূর্তিতে। কনস্টান্স চাইলেন প্ল্যানেট-এক্স পরিচিত হোক ‘লোয়েল’ কিংবা ‘কনস্টান্স’ নামে। অবশ্য মানমন্দিরের কর্মীরা এর বদলে বেছে নিলেন ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড থেকে টেলিগ্রামে পাঠানো ১১ বছরের এক মেয়ের প্রস্তাব। সূর্যের দূরতম গ্রহ (না, এখন কিন্তু গ্রহ নয়, বামন গ্রহ)। আবার এমন জায়গায় বাস তার, আলো প্রায় পৌঁছয় না। তাই তার নাম রাখা হোক ‘প্লুটো’। গ্রিক পুরাণে প্লুটো হচ্ছে এক দেবতার নাম। দোজখের দেবতা! প্লুটো নাম রাখলে আরেকটা বাড়তি সুবিধা থাকছে। নামের প্রথম দুটো অক্ষর (পি এবং এল) বহন করে পারসিভাল লোয়েলের স্মৃতিও! তাই শেষ পর্যন্ত খুশিই হলেন লোয়েলের স্ত্রী কনস্টান্স।
আবিষ্কারের সময় থেকেই জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ধন্দে ফেলেছে প্লুটো। সূর্যকে ঘিরে বাকি আটখানা গ্রহের কক্ষপথ যেন এক সমতলে। কিন্তু প্লুটোর কক্ষপথ? শুধু অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি ডিম্বাকারই নয়, তা আবার ওই তল থেকে উঠে-নেমে রয়েছে। আরও নানা রকম অসঙ্গতি। এসব লক্ষ করে যুক্তরাষ্ট্রের জ্যোতির্বিজ্ঞানী জেরার্ড কুইপার ১৯৫০-এর দশকে সন্দেহ প্রকাশ করলেন প্লুটোর ‘জাত’ নিয়ে। ওটা কি আসলেই কোনো গ্রহ? নাকি নেপচুনের চেয়েও বেশি দূরে বিশাল এলাকা জুড়ে বিচরণকারী নানান আকৃতির অনেক বস্তুর একটি মাত্র? ওই এলাকা এখন চিহ্নিত ‘কুইপার বেল্ট’ নামে। আর ওখানকার বস্তুগুলোকে বলা হয় কুইপার বেল্ট অবজেক্ট বা ‘কেবিও’। আজ পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছে ছয়শ’রও বেশি কেবিও।
১৯৭৮ সালে আবিষ্কৃত হল প্লুটোর উপগ্রহ ‘ক্যারন’। আবিষ্কারের পরই গোল বাধল। ওটাকে ঠিক উপগ্রহ বলা যায় কি না তা নিয়ে। অন্য উপগ্রহরা যেখানে আকারে তাদের গ্রহদের ১০০ ভাগের ১ ভাগের মতো, ক্যারন সেখানে প্লুটোর প্রায় অর্ধেক। তার চেয়েও বড় কথা, চাঁদ যেভাবে পৃথিবীকে ঘিরে চক্কর দেয়, ক্যারন কিন্তু মোটেই সেভাবে প্লুটোর চারদিকে ঘোরে না। তা হলে? প্লুটো আর ক্যারন যেন ওদের মাঝখানে মহাশূন্যে একটা বিন্দুর চারদিকে ঘোরে। এ জন্য প্লুটো আর ক্যারনকে একসঙ্গে ‘ডাবল প্ল্যানেট’ নামেও ডাকা হতো। এদিকে সূর্যের চারদিকে প্লুটোর কক্ষপথ এতই চ্যাপ্টা ডিম্বাকার যে, চলতে চলতে একেক সময় সে ঢুকে পড়ে একেবারে নেপচুনের কক্ষপথের ভেতরে। এদিকে ২০০৫ সালের জানুয়ারিতে জন্ম নিল আরেক প্রশ্ন। ক্যালটেকের জ্যোতির্বিজ্ঞানী মাইকেল ব্রাউন। তিনি কুইপার বেল্টের মধ্যে প্লুটোর চেয়ে বড় একটা বস্তুর সন্ধান পেলেন। শুধু বড় নয়, প্লুটোর পাঁচ গুণ! নতুন এই বস্তুটার নাম রাখা হলো এরিস। সাংবাদিকদের লেখনীতে মূল নাম ছাপিয়ে এরিসের পরিচিতি ‘জেনা’ নামে। এই জেনা আবিষ্কারের পর থেকেই প্লুটোর স্ট্যাটাস নিয়ে ঘোর সংশয় দেখা দিল। প্লুটো যদি গ্রহ হতে পারে, তবে জেনাই বা তা নয় কেন? সুতরাং…? হ্যাঁ, প্লুটো এবং জেনা-দুটোই তবে ‘বামন গ্রহ’। সিদ্ধান্তটা চূড়ান্ত হয়েছিল ২০০৬ সালের ২৪ আগস্ট।



উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন  ..