ওড়াউড়ির দিন -আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
[আমেরিকার ছিটেফোঁটা]
ক্যালিফোর্নিয়া
১
লস এঞ্জেলেসের হোটেল ম্যারিয়ট ছেড়ে সোজা এসে উঠলাম জাহিদের বাসায়। ওর স্ত্রী লাকিকে অনেক আগেই দেখেছিলাম ঢাকায়, ওদের বিয়ের পর পরই। মিষ্টি শ্যামলা চেহারা আর সপ্রতিভ চাউনির লাকি প্রাণের দীপ্তিতে সারাক্ষণ ঝলমল করে। মোটামুটি দীর্ঘাঙ্গী, পরিশ্রমী আর আত্মপ্রত্যয়ী এই মেয়েটি আমেরিকায় আমার দেখা সেই বাঙালি মেয়েদের একজন, যারা ও দেশের সংগ্রামী পরিবেশের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকার ও জয়ী হওয়ার ক্ষমতা রাখে। ঘর-সংসার-ছেলেমেয়েদের দেখভাল থেকে শুরু করে অফিসে চাকরি, জাহিদের সঙ্গে ‘বাংলাদেশ একাডেমি’তে ছেলেমেয়েদের গান, আবৃত্তি, বাংলা শেখানো, বাড়িতে নিয়মিত রিহার্সেলের একটানা কাজ এই একহারা গড়নের মজবুত মেয়েটি যে কী হাসিমুখে করে দেখলে অবাক লাগে। জাহিদ ওর কিছুটা উল্টো স্বভাবেরÑ একেবারেই স্বপ্নে-পাওয়া ঘোর লাগা মানুষ। বাস্তব পৃথিবীটাকে যেন ঠিকমতো দেখতে পায় না, তাই পদে পদে সবখানে ঠকে। হয়ত তরুণ বয়েসে বেশকিছু দিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের চত্বরে কাটিয়ে যাওয়ায় একটা সম্পন্ন জীবনের স্বপ্ন আজও ওর রক্তে গেঁথে আছে। সারাক্ষণ কিছু না কিছু সাংস্কৃতিক কাজ নিয়ে মাতাল হয়ে থাকবেই। ঘর-সংসার নিয়ে খুব একটা ভাবে বলেও যেন মনে হয় না, যেন এর যাবতীয় দায়-দায়িত্ব লাকির। সারাক্ষণ যেন কোনো শ্রেয় বা শুভ লক্ষ্যের দিকে ও অনির্বাণভাবে জ্বলছে। আপাতভাবে জাহিদ খুবই শান্ত স্বভাবের কিন্তু ভেতরটায় উত্তেজিত আর অস্থির। যা নিয়ে মেতে ওঠে, তার মধ্যে পুরো জীবন বিছিয়ে দেয়। এতটুকু তাড়াহুড়াও করে না, আবার কিছু ছাড়ে না।
জাহিদের সঙ্গে কয়েকদিনের মধ্যে এঞ্জেলেস প্রায় চষে ফেললাম। ড্রাইভার হিসেবে জাহিদ নিরাপদ নয় কেবল, পুরোপুরি চৌকস। মেয়ে ড্রাইভারদের চেয়ে ছেলে ড্রাইভাররা সবসময়ই বেশি বিপজ্জনকÑ পদে পদে তাদের হাতে জীবন হারানোর আশঙ্কা। তবু পৃথিবীর যে কজন হাতে-গোনা পুরুষ ড্রাইভারের গাড়িতে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে কাটানো যাবে, ও তাদের একজন। এতটুকু উত্তেজনা নেই। উদাসীনতাও নেই। যেন এক অন্তহীন নিরুদ্বেগ বিশাল অবকাশ ওকে ঘিরে আছে।
আমি ওর ড্রাইভিংয়ের প্রশংসা করতেই ওর মুখে তুবড়ি ছোটা শুরু হল। বলল, ভালো করে তাকিয়ে দেখেন তো স্যার আমার গড়িতে ব্রেক কটা? পাশের সিট থেকে ওর পায়ের দিকে তাকিয়ে ভয়ে আঁতকে উঠলাম, কী ব্যাপার! তোমার গাড়িতে দুটো ব্রেক কেন?
আত্মতৃপ্তিভরা হাসি হেসে জাহেদ বলল, দেখেন আমি যে ভালো ড্রাইভ করি তার কারণ আমি শুধু গাড়ি চালাই না, আমি ড্রাইভিং শেখাইও। চৌদ্দ বছর ধরে কাজটা করছি স্যার। অন্তত শ’তিনেক লোককে আমি ড্রাইভিং শিখিয়েছি।
কিন্তু ব্রেক দুটো কেন?
শিক্ষানবীশরা ঘাবড়ে গিয়ে ব্রেক করতে না পারলে আমি অন্যটা চেপে ধরি।
কথায় কথায় এগিয়ে চলছিলাম। আত্মপ্রশংসা ওর থামে না।
এ দেশে ভুল গাড়ি চালালে ফাইন দিতে হয় স্যার। অনেক সময় লাইসেন্সও হারাতে হয়। কিন্তু আজও পুলিশ এ ব্যাপারে আমার ভুল ধরতে পারেনি। হয়ত পারবেও না। ওর কথাটা মানা যায়। এমন ছবির মতো নির্ভুল ড্রাইভিং করলে কে-ই-বা ধরতে পারবে? সত্যি ছবির মতো গাড়ি চালায় জাহিদ। আমরা এভাবে কথা বলতে বলতেই হঠাৎ সামনে এসে পড়ল একটা মোড়। ছবির মতোই বাঁয়ে মোড় নিল ও। কিন্তু একী! হঠাৎ সামনে পুলিশ কেন? মনে হল রাস্তা ফুঁড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আচমকা হাত তুলে জাহিদকে থামতে বলছে। কী ব্যাপার? থামতে বলার এখানে কী আছে? ও তো ঠিকই মোড় নিয়েছে। জাহিদ গুটিগুটি রাস্তার ধারে গাড়ি পার্ক করতেই পুলিশটা এগিয়ে এসে সৌজন্যের সঙ্গে বলল :
আপনার লাইসেন্সটা স্যার।
জাহিদ লাইসেন্স বের করল। হয়ত নিয়মিত ট্রাফিক চেকিং। পরীক্ষা করেই ছেড়ে দেবে।
লাইসেন্সের পাতা উল্টে পুলিশ কী যেন করল। হয়ত কিছু লিখল। তারপর এগিয়ে এসে একই রকম সৌজন্যের সঙ্গে বলল, আপনার অপরাধ আপনি বাঁ দিকে মোড় নিয়েছেন। ফাইন দু’শ ডলার।
জাহিদ যুক্তি দেখাল, মাসখানেক আগেও এখানে ও নিয়মিত বাঁয়ে মোড় নিয়েছে। এটাই এখানকার নিয়ম। পুলিশ জানাল, কথাটা ঠিক। কিন্তু দিন পনেরো-বিশ আগে নিয়মটা পাল্টে গেছে। তাছাড়া মোড় নেওয়ার সময় লাল আলো ছিল। আপনি দেখেননি।
জাহিদের এতক্ষণের দম্ভোক্তি ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেল। পুলিশের চেয়ে অপ্রস্তুত হল আমার কাছে। ওকে করুণ আর বিষণœ লাগছে। এ ধরনের বিরাট বিরাট আত্মদম্ভের হাতে-নাতে মাঠে মারা যাওয়ার গল্প পৃথিবীতে নতুন নয়। জুলিয়াস সিজারকে নিয়েও এমনি একটা মর্মান্তিক গল্প আছে। এক ভবিষ্যৎকথক একবার নাকি জুলিয়াস সিজারকে বলেছিলেন, আপনার মৃত্যু অমুক তারিখে।
জীবনের কথা ভুললেও মৃত্যুর কথা মানুষ ভোলে না। সিজারও ভোলেননি। ঠিক ঐ তারিখেই পাত্রমিত্র নিয়ে জুলিয়াস সিজার যাচ্ছিলেন সেনেটের দিকে। হঠাৎ রাস্তায় ঐ ভবিষ্যৎকথকের সঙ্গে দেখা। সিজার উপহাস করে তাঁকে বললেন, অমুক তারিখ তো এসে গেছে, আমি তো এখনও মরলাম না।
গণক বললেন, এসেছে, কিন্তু চলে যায়নি। সবাই জানেন, সেদিন সেনেটে কিছুক্ষণ পরেই কীরকম নৃশংসভাবে তিনি নিহত হয়েছিলেন।
নেহাতই হয়ত গল্প। সত্য হলেও হয়ত কাকতালীয়। তবু এরকম কাকতালীয় ব্যাপার পৃথিবীতে কমবেশি ঘটে।
২
আমি বহুবার ভেবেছি, কেন ওসব দেশের মানুষ আইন-কানুনকে আমাদের তুলনায় এত শ্রদ্ধা করে। কেন আমরা করি না। মানুষ হিসেবে ওদের মূল্যবোধ উন্নতÑ শুধু এই জন্য? হয়ত তাও। কিন্তু আমার ধারণা, এটুকুই সব নয়। ওরা যে আইনের ব্যাপারে এত অনুগত তার আরও কারণ আছে। তা হল, জনগণ যাতে আইন মানতে বাধ্য হয় তার একটি নিñিদ্র কঠোর ব্যবস্থা ওসব দেশে গড়ে তোলা হয়েছে। পথে-ঘাটে সেখানে প্রহরী, অলিতে-গলিতে গুপ্তচর, প্রতিটা মুখের ওপর সার্চলাইট। সেইসব কোটি কোটি জাগ্রত চোখ থেকে কারও নিষ্কৃতি নেই, হোক সে ইংল্যান্ডের রানির বোন, আর আমেরিকান প্রেসিডেন্টের মেয়ে। নির্দয় চক্ষুহীন সে আইন সবার জন্য সমান। সেখানে কঠোর হাতে মানুষকে আইন মানতে এমন নিষ্ঠুরভাবে বাধ্য আর অভ্যস্ত করা হয় যে আইনের প্রতি শ্রদ্ধা তাদের মূল্যবোধ, সংস্কৃতি বা ব্যক্তিগত গৌরবের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তখন আইন মানা তাদের জন্য হয়ে ওঠে পরিশীলিত মানুষের আচরণ, মর্যাদা, গৌরব আর উচ্চতর মনুষ্যত্বের প্রতীক।
একটা কথা যেন না ভুলি যে আমরা প্রতিটা মানুষ আসলে জন্মাই সারা পৃথিবীর জন্য, এই বিশ্বচরাচরের যাবতীয় রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শের জন্য। মহাভারতের রাজা যযাতি সুদীর্ঘ জীবন পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করার পর বলেছিলেন, এই পৃথিবীর সমুদয় যব, ধান্য, হিরণ্য ও নারী একটিমাত্র পুরুষের বাসনা চরিতার্থ করার জন্যও যথেষ্ট নয়। এই তো মানুষ। পৃথিবীর প্রতিটি জিনিশের জন্য অনির্বাণ বাসনা আর ক্ষুধা নিয়ে তার জন্ম। এর যতটুকু তার ছাড় দিতে হয়, সে পরিমাণে সে ছোট হয়ে যায়। মানুষ যদি এ পৃথিবীতে একা জন্মাত তবে জগতের যাবতীয় সবকিছু একা পেতে তার অসুবিধা হত না। কিন্তু নির্জন দ্বীপের রবিনসন ক্রসোর সে তো পৃথিবীর একমাত্র মানুষ নয়। তার মতো আরও কোটি কোটি মানুষ তো আছে পৃথিবীতে। তাই আসে এই সীমিত সম্পদকে ভাগ করে নেবার বা ছাড় দেবার কথা। এক কথায় নিজেকে ছোট করে ফেলার কথা। যুক্তিহীন অদমিত ব্যক্তি মানুষ এই ছাড় দিতে নারাজ। সবার হক একা কেড়ে নিয়ে নিজ অস্তিত্বের ভাঁড়ারকে পূর্ণতা দেবার জন্যে সে মরিয়া। এই ব্যক্তি মানুষকে দমন করে তার প্রাপ্যের কুঠরিতে তাকে সীমিত করার জন্য সামষ্টিক মানুষকে তার ওপর দ্বিমুখী আক্রমণ চালাতে হয়েছে। একদিকে শক্তিপ্রয়োগ করে তার ভেতরকার বর্বর স্বার্থলিপ্সু মানুষটাকে একটু একটু করে নিস্তেজ করে আনতে হয়েছে, অন্যদিকে মহত্তের স্পর্শ দিয়ে তাকে মমতাবান, উদার ও মনুষ্যত্বসম্পন্ন করে তুলতে হয়েছে। প্রথমটার জন্য তাদের সৃষ্টি করতে হয়েছে রাষ্ট্রযন্ত্র। সেখানে চৌকিদার, দফাদার, আনসার, পুলিশ, সেনাবাহিনী, আদালত, বিচারক, জেল, ফাঁসি, মৃত্যুদ দিয়ে তার ভেতরকার অসভ্য আদিম জন্তুসুলভ মানুষটারে কয়েদ করা হয়েছে। অন্যদিকে শিল্প, সংগীত, চিত্রকলা, সাহিত্য, দর্শন, সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ, শিক্ষা, ধর্মÑ এসবের মাধ্যমে তার হৃদয়কে সুকুমার আর মানবিক করে তোলা হয়েছে। স্বার্থান্ধ ব্যক্তি-মানুষের পশুসুলভ প্রবৃত্তিকে শমিত করে তার ভেতর শুভবুদ্ধি জাগানোর লক্ষ্যে সামাজিক মানুষের এই যে নির্মম ও আপ্রাণ চেষ্টা এর নামই সভ্যতা। কাজেই সভ্যতার লক্ষ্য যে মানুষকে কেবল শ্রেয়বোধে প্রাণিত করা তা নয়, শ্রেয়বোধের পথে সে যেন অনুগত থাকে তার বাস্তব বাধ্যবাধকতাও নিশ্চিত করা। এই পথটা আদৌ কুসমাস্তীর্ণ নয়। বরং রাষ্ট্রের মতোই সে নিষ্ঠুর ও নির্যাতনকারী; কঠোর ও রক্তসংকুল।
তাই মানুষকে উন্নত মহৎ করে তোলার অনেক শুভ উদ্যোগ যেমন ওসব দেশে দেখা যায়, তেমনি দেখা যায় দেশের প্রতি মোড়ের আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ, প্রতিটি অফিস আর রাস্তার পাশে সার্কিট ক্যামেরা। সুশাসনের সেই নিñিদ্র জাল ছিঁড়ে একটি প্রাণীও যেন পালাতে না পারে সে ব্যবস্থা সেখানে নিরঙ্কুশ। অনেককে বলতে শুনেছি জাপান, ইংল্যান্ড, আমেরিকায় অপরাধ করে পালাবার জো নেই। রাস্তা ফুঁড়ে পুলিশ দাঁড়িয়ে যায়। এমন নির্মম ব্যবস্থা কী করে গড়ে উঠল? পুলিশ কি জাদু বা ভেল্কিবাজি দিয়ে ঠিক জায়গায় ঠিক সময়ে হাজির হয়? দেশের প্রতিটি জায়গায় বা চোখের আড়ালে পুলিশকে চব্বিশ ঘণ্টা কর্মরত করে রাখা হয় বলেই সে ঠিক সময়ে ঠিক দরকারে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। এ জন্যে দরকার বিপুল সম্পদের। যে দেশের সম্পদ যত বেশি, আইনের সুষ্ঠু নিশ্চয়তাও সেখানে তত বেশি।
অনেককে দুঃখ করতে শুনিÑ আমাদের দেশে আইন আছে, তার প্রয়োগ নেই। কী করে থাকবে? জনস্বার্থে উদ্বুদ্ধ হয়ে সংসদে না হয় অনেক ভালো আইনই পাশ আমরা করলাম। কিন্তু তাদের প্রয়োগ বা বাস্তবায়নের জন্যে যে বিপুল জনবল, অর্থবল দরকার বা যে স্বচ্ছ জবাবদিহিতাপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বা প্রযুক্তির আয়োজন, আমাদের এই সম্পদ দিয়ে তার সুরাহা কতটুকু সম্ভব?
আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ চাইলে বেশিরকম আদর্শের বুলি না কপচিয়ে আমাদের নজর বাড়ানো উচিত সম্পদ সৃষ্টির দিকে, এর সুপ্রয়োগের দিকে।
0 comments:
Post a Comment