আসুন ঘোড়ার ঘাস কাটি (আনিসুল হক)
আসুন, ঘোড়ার ঘাস কাটি। একটা ঘাস কাটলে পাব ১০০ টাকা। কাটবেন?
ভাবছেন, রসিকতা করছি!
ঘোড়ার ঘাস কাটা নিয়ে আমরা অনেক রসিকতা করেছি। কিন্তু ঘোড়ার ঘাস কাটা মোটেও রসিকতার বিষয় নয়। বিশেষ করে সেই ঘাস যদি জাতীয় সংসদ ভবন এলাকার হয়ে থাকে। ধরা যাক, ১০টা লোক রোজ সংসদ ভবন এলাকার ঘাস কাটে। রোজ তারা দুশ টাকা করে পায়। রোজ ব্যয় দু হাজার টাকা। ৩৬৫ দিনে তারা ব্যয় করবে ৭ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা। আবার ওই ঘাস বিক্রি করে কিছু আয়ও হবে। এবং আমার ধারণা, সেটা ব্যয়ের চেয়ে বেশিই হবে। তা না হলে যারা ঘাস কেটে বিক্রি করেন, তারা সেটা করতে পারতেন না।
তার মানেটা হলো, ৭ লক্ষ ত্রিশ হাজার টাকা ব্যয় করলেও সেখান থেকে ৮ লাখ টাকা আয়ও করা সম্ভব। নিট প্রফিট দাঁড়াবে ৭০ হাজার টাকা। এখন যদি গত সংসদ ভবন এলাকায় ৯৬ লাখ টাকার শুধু ঘাসই কাটা হয়ে থাকে এক বছরে, তখন ঘাস কাটা ব্যাপারটা আর ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের বিষয় থাকে না। ব্যাপারটা হয়ে যায় রীতিমতো প্রতিযোগিতার ব্যাপার।
ঘটক গেছে পাত্রীপক্ষের সঙ্গে বিয়ের আলাপ পাড়তে।
‘ছেলে করে কী?’
‘ঘাস কাটে।’
‘ঘাস কাটে! তাই নাকি? আরে কে আছিস, চেয়ার দে! আরে হারামজাদা মুছে দে, সাহেবকে বসতে দে। বসুন। বসুন। তা বলুন কী খাবেন?’
‘না না খাব আর কী। খাওয়া-দাওয়াটা তো আসল কথা না। আসল কথা হলো আন্তরিকতা। আত্মার সঙ্গে আত্মা মিললে না আত্মীয়তা।’
‘তা ছেলে কোথাকার ঘাস কাটে?’
‘কোথায় আবার। সংসদ ভবনের।’
‘বলেন কী। সংসদ ভবনের। এই কী চেয়ার দিলি, একটা গদিওয়ালা চেয়ার দে। আপনি ভাই আমার এই চেয়ারে বসেন। তা ছেলের মাসিক আয় কত?’
‘বাংলাদেশের সরকারি চাকরিতে সবচেয়ে বেশি বেতন কত? এইবার প্রস্তাব করা হয়েছে সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার টাকা। এটা পাবেন কে? ধরা যাক মহামান্য রাষ্ট্রপতি। তাহলে তার বার্ষিক আয় কতো। ১০ লাখ টাকার মতো। কিন্তু আমাদের পাত্র হাবু তো আর প্রেসিডেন্ট নয়। সে ঘাস কাটে। তার নিট আয় ৯৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এ থেকে একে ওকে দিয়ে থুয়ে যা থাকে, তাও ওই আপনের ১০ লাখের চেয়ে ঢের বেশি। তাহলে এখন বলেন সর্বোচ্চ বেতনের সরকারি চাকরিওয়ালা পাত্র ভালো নাকি ওই সংসদ ভবনের ঘাস কাটা ছেলে ভালো?’
‘না, ছেলে আপনাদেরটাই ভালো। সে তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু আপনার কাছে আর কোনো পাত্রের সন্ধান নাই? একটু তুলনা করে দেখতাম।’
‘আছে। আমি কি আর সেই রকম ঘটক যে আমার কাছে মাত্র একটা পাত্রের খবর থাকবে। আরও আছে। সংসদ ভবনের ওষুধ সাপ্লায়ার। যখন দেশে কোনো সংসদ ছিল না, ওই দুই বছরেও সে লক্ষ লক্ষ টাকার ওষুধ সাপ্লাই করেছে। ভাবুন তাহলে সে কী রকম গুণধর।’
‘তাই তো। তাই তো। ওই ছেলে তো দেখছি আরও গুণধর।’
‘হ্যাঁ এমনি সব গুণধর ছেলে নিয়েই আমার কারবার। রাজি হয়ে যান। এই রকম সুপাত্র আর পাবেন না।’
এই কথোপকথন আরও বাড়ানো যায়। দরকার কী। দরকার নেই, কারণ এই ধরনের সুপাত্রের খবর আমাদের জানা নেই। তবে যা জানা যাচ্ছে, তা হলো জাতীয় সংসদ ভবন চত্বরে ঘাস কাটা ও ঘাস লাগানোর কাজ হয়েছে চার পর্বে, প্রত্যেক পর্বে ব্যয় হয়েছে ২৪ লাখ টাকা, মোট ব্যয় হয়েছে ৯৬ লাখ টাকা। খুব কি বেশি?
তবে ঘাস নাকি লাগানো হয়নি ঠিকভাবে, তোলা হয়েছে, তারপর এই সুজলা-সুফলা-শস্যশ্যামলা উর্বর পলিমাটির দেশে ঘাস নাকি আপনা-আপনিই গজিয়ে গেছে।
আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যখন কোনো সংসদ ছিল না, তখন প্রায় অর্ধকোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে সংসদ সদস্যদের জন্যে ওষুধখাতে।
সংসদ না থাকলেও স্পিকার ও সংসদ সচিবালয় ২০০৭-২০০৮ অর্থবছরে বিদেশ সফর বাবদ ব্যয় করেছেন ৭০ লক্ষ টাকা।
আর স্পিকার জমির উদ্দিন সরকারের চিকিৎসার জন্যে সরকারের কাছে মুচলেকা দিয়ে ২৮ লাখ টাকা তোলা হয়েছে।
এসবই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর।
সাবেক স্পিকার জমির উদ্দিন সরকারের দুর্নীতি তদন্তে গঠিত কমিটি সুত্রেই প্রধানত এইসব খবর বেরিয়েছে।
আমরা এইসব অভিযোগের সত্য-মিথ্যা জানি না। সাবেক স্পিকার অবশ্য ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমে বলেছেন, ঘাস কাটার দায়িত্ব গণপূর্ত বিভাগের, তাঁর নয়।
খন্দকার দেলোয়ার সাহেবের বক্তব্যও আমরা সম্প্রতি পেয়েছি। তিনি বলেছেন, সংসদীয় কমিটির কোনো এখতিয়ারই নেই সাবেক স্পিকারের দুর্নীতির তদন্ত করতে পারে।
পারে কি পারে না সেটা আইনের ব্যাপার। দুর্নীতি হয়েছে কি হয়নি, হলে সেটার প্রতিবিধান কী, সেটা সাধারণ জনগণ জানতে চায়।
আর কেউ নন, স্বয়ং স্পিকার যদি এইসব করে থাকেন তাহলে আমাদের মাথা হেট না হয়েই পারে না।
তবে সম্প্রতি ব্রিটেনেও হইচই হচ্ছে সেখানকার আইন প্রণেতাদের খরচাপাতি নিয়ে। ব্রিটেনে এমপিরা দ্বিতীয় একটা বাড়ির জন্যে খরচ সংসদ থেকে তুলতে পারেন। গত বছর হাউজ অফ কমনসের ৬৪৬ সদস্য এই খাত থেকে ৯ কোটি ৩০ লক্ষ পাউন্ড তুলেছেন। আগে এরা এসবের কোনো ভাউচারও দিতেন না। সম্প্রতি ভাউচার দেওয়া বাধ্যতামূলক করার পর দেখা গেছে এমপিরা এমনকি পর্নো ছবি কেনার রশিদও জমা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউনের ভাই ৬৫০০ পাউন্ড তুলেছেন সাফসুতরো করার কাজে। ২০০৪ থেকে ২০০৬-এর মধ্যে তিনি এই পরিমাণ অর্থ তোলেন। তার অফিস থেকে বলা হচ্ছে, দুই জন পরিষ্ককারকর্মীর পক্ষে প্রধানমন্ত্রীর ভাই এই টাকা তুলেছেন, নিজে খরচ করেননি।
তিন বছরে পরিষ্ককারের জন্যে খরচ বাংলাদেশী টাকায় মোটে ৬৫ লাখ টাকার মতো। আমাদের আমাদের ওন ল্যান্ড’স গবর্মেন্ট বা ‘নিজস্ব জমির সরকার’ তাদের চেয়ে এগিয়ে আছেন। যদিও পাউন্ড টাকার চেয়ে অনেক শক্তিশালী।
এখন আমাদের সরকার বাহাদুর ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে উদাহরণ দেবেন, নাকি ব্রিটিশ পার্লামেন্টেরিয়ানরা বাংলাদেশের সংসদের নজির উপস্থাপন করেন, সেটাই দেখার বিষয়।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
0 comments:
Post a Comment