অলৌকিক গল্প প্রফেসর শঙ্কুর ডায়রি একশৃঙ্গ অভিযান(সত্যজিৎ রায়)
১লা জুলাই
আশ্চর্য খবর। তিব্বত পর্যটক চার্লস উইলার্ডের একটা ডায়রি পাওয়া গেছে। মাত্র এক বছর আগে এই ইংরাজ পর্যটক তিব্বত থেকে ফেরার পথে সেখানকার কোনো অঞ্চলে খাম্পা শ্রেণীর এক দস্যুদলের হাতে পড়ে। দস্যুরা তার অধিকাংশ জিনিস লুট করে নিয়ে তাকে জখম করে রেখে চলে যায়। উইলার্ড কোনো রকমে প্রায় আধমরা অবস্থায় ভারতবর্ষের আলমোড়া শহরে এসে পৌঁছায়। সেইখানেই তার মৃত্যু হয়। এসব খবর আমি খবরের কাগজেই পড়েছিলাম। আজ লন্ডন থেকে আমার বন্ধু ভূতত্ত্ববিদ জেরেমি সন্ডার্সের একটা চিঠিতে জানলাম যে উইলার্ডের মৃত্যুর পর তার সামান্য জিনিসপত্রের মধ্যে একটা ডায়রি পাওয়া যায়, এবং সেটা এখন সন্ডার্সের হাতে। তাতে নাকি এক আশ্চর্য ব্যাপারের উলেস্নখ আছে। আমার তিব্বত সম্বন্ধে প্রচন্ড কৌতূহল, আর আমি তিব্বতী ভাষা জানি জেনে সন্ডার্স আমাকে চিঠিটা লিখেছে। সেটার একটা অংশ এখানে তুলে দিচ্ছি-
‘…উইলার্ড আমার অনেক দিনের বন্ধু ছিল সেটা তুমি জান কি না জানি না। তার বিধবা স্ত্রী এডউইনার সঙ্গে পরশু দেখা করতে গিয়েছিলাম। সে বলল আলমোড়া থেকে তার মৃত স্বামীর যে সব জিনিস পাঠানো হয়েছিল তার মধ্যে একটা ডায়রি রয়েছে। সে ডায়রি আমি তার কাছ থেকে চেয়ে আনি। দুঃখের বিষয় ডায়রির অনেক লেখাই জল লেগে অস্পষ্ট হয়ে গেছে, তাই পড়া মুশকিল। কিন্তু তার শেষ পৃষ্ঠার কয়েকটা লাইন পড়তে কোনো অসুবিধা হয়নি। ১৯শে মার্চের একটা ঘটনা তাতে লেখা রয়েছে। শুধু দুটি লাইন- ‘আই স এ হার্ড অফ ইউনিকর্নস টু ডে। আই রাইট দিস্ ইন ফুল্ পোজেশন অফ মাই সেন্সেস।’ তার পরেই একটা প্রচন্ড ঝড়ের ইঙ্গিত পেয়ে উইলার্ড ডায়রি লেখা বন্ধ করে। তার এই অদ্ভুত উক্তি সম্বন্ধে তোমার কী মত জানতে ইচ্ছে করে’- ইত্যাদি।
উইলার্ড একপাল উইনিকর্ন দেখেছে বলে লিখেছে। আর তার পরেই বলছে সেটা সে সম্পূর্ণ সুস্থ মস্তিষ্কে দেখেছে। এটা বলার দরকার ছিল এই জন্যেই যে ইউনিকর্ন নামক প্রাণীটিকে আবহমানকাল থেকেই সারা বিশ্বের লোকে কাল্পনিক প্রাণী বলেই জানে। একশৃঙ্গ জানোয়ার। কপাল থেকে বেরোনো লম্বা প্যাঁচানো শিং-বিশিষ্ট ঘোড়া। ইউনিকর্নের চেহারা বিলাতি আঁকা ছবিতে যা দেখা যায় তা হল এই। যেমন চীনের ড্রাগন কাল্পনিক, তেমনি ইউনিকর্নও কাল্পনিক।
কিন’ এই কাল্পনিক কথাটা লিখতে গিয়েও আমার মনে খটকা লাগছে। আমার সামনে টেবিলের উপর একটা বই খোলা রয়েছে, সেটা মোহেঞ্জোদাড়ো সম্পর্কে। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এই মোহেঞ্জোদাড়োর মাটি খুঁড়ে আজ থেকে চার হাজার বছর আগেকার এক আশ্চর্য ভারতীয় সভ্যতার যে সব নমুনা পেয়েছিলেন তার মধ্যে ঘর বাড়ি রাস্তাঘাট হাঁড়ি কলসী খেলনা ইত্যাদি ছাড়াও এক জাতের জিনিস ছিল, যেগুলো হচ্ছে মাটির আর হাতির দাঁতের তৈরি চারকোনা সীল।
এই সব সীলে খোদাই করা হাতি বাঘ ষাঁড় গন্ডার ইত্যাদি আমাদের চেনা। জানোয়ার ছাড়াও এক রকম জানোয়ার দেখা যায়, যার শরীরটা অনেকটা বলদের মতো কিন’ মাথায় রয়েছে একটিমাত্র পাকানো শিং। এটাকে প্রত্নতাত্ত্বিকেরা কাল্পনিক জানোয়ার বলেই মেনে নিয়েছে। কিন’ এতগুলো আসল জানোয়ারের পাশে হঠাৎ একটা আজগুবী জানোয়ার কেন খোদাই করা হবে সেটা আমি বুঝতে পারি না।
এ জানোয়ার যে কাল্পনিক নয় সেটা ভাবার আরেকটা কারণ হচ্ছে যে দু হাজার বছর আগের রোম্যান পন্ডিত পিস্ননি তাঁর বিখ্যাত জীবতত্ত্বের বইয়েতে স্পষ্ট বলে গেছেন যে, ভারতবর্ষে একরকম গরম্ন আর একরকম গাধা পাওয়া যায় যাদের মাথায় মাত্র একটা শিং। গ্রীক মনীষী অ্যারিস্টটলও ভারতবর্ষে ইউনিকর্ন আছে বলে লিখে গেছেন। এ থেকে কি এমন ভাবা অন্যায় হবে যে, এককালে এদেশে এক ধরনের একশৃঙ্গ জানোয়ার ছিল যেটা এখান থেকে লোপ পেলেও হয়তো তিব্বতের কোনো অজ্ঞাত অঞ্চলে রয়ে গেছে, আর উইলার্ড ঘটনাচক্রে সেই অঞ্চলে গিয়ে পড়ে এই জানোয়ার দেখতে পেয়েছেন? এ কথা ঠিক যে গত দুশো বছরে অনেক বিদেশি পর্যটকই তিব্বত গিয়ে তাঁদের ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখেছেন, এবং কেউই ইউনিকর্নের কথা লেখেননি। কিন’ তাতে কী প্রমাণ হল? তিব্বতে এখনো অনেক জায়গা আছে যেখানে মানুষের পা পড়েনি। সুতরাং সে দেশের কোথায় যে কী আছে তা কেউ সঠিক বলতে পারে?
সন্ডার্সকে আমার এই কথাগুলো লিখে জানাব। দেখি ও কী বলে।
১৫ই জুলাই
আমার চিঠির উত্তরে লেখা সন্ডার্সের চিঠিটা তুলে দিচ্ছি-
প্রিয় শঙ্কু,
তোমার চিঠি পেলাম। উইলার্ডের ডায়রির শেষ দিকের খানিকটা অংশ পড়তে পেরে আরো বিস্মিত হয়েছি। ১৬ই মার্চ সে লিখছে ‘টুডে আই ফ্লু উইথ দ্য টু হান্ড্রেড ইয়ার ওল্ড লামা।’ ফ্লু মানে কি এরোপেস্ননে ওড়া? মনে তো হয় না। তিব্বতে রেলগাড়িই নেই, এরোপেস্নন যাবে কী করে। কিন’ তাহলে কি সে কোনো যন্ত্রের সাহায্য ছাড়াই আকাশে ওড়ার কথা বলছে? তাই বা বিশ্বাস করি কী করে? এসব কথা পড়ে উইলার্ডের মাথা ঠিক ছিল কি না সে বিষয়ে সন্দেহ জাগে। অথচ আলমোড়ার যে ডাক্তারটি তাকে শেষ অবস্থায় দেখেছিলেন (মেজর হর্টন) তাঁর মতে উইলার্ডের মাথায় গন্ডগোল ছিল না। ১৩ই মার্চের ডায়রিতে থোকচুম-গোম্ফা নামে একটা মঠের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। উইলার্ডের মতে- ‘এ ওয়ান্ডারফুল মনাস্ট্রি। নো ইউরোপিয়ান হ্যাজ এভার বিন হিয়ার বিফোর।’ তুমি কি এই মঠের নাম শুনেছ কখনো? … যাই হোক, আসল কথা হচ্ছে- উইলার্ডের এই ডায়রি পড়ে আমার মনে তিব্বত যাবার একটা প্রবল বাসনা জেগেছে। আমার জার্মান বন্ধু উইলহেলম ক্রোলও এ ব্যাপারে উৎসাহী। তাকে অবশ্যি উড়ন্ত লামার বিবরণই বেশি আকর্ষণ করেছে। জাদুবিদ্যা, উইচক্রাফট্ ইত্যাদি সম্পর্কে ক্রোলের মূল্যবান গবেষণা আছে, তুমি হয়তো জান। সে পাহাড়েও চড়তে পারে খুব ভালো। বলা বাহুল্য, আমরা যদি যাই তো আমাকে সঙ্গী হিসেবে পেলেই খুব ভালো হবে। এ মাসেই রওনা হওয়া যেতে পারে। কী সি’র করা সেটা আমাকে জানিও। শুভেচ্ছা নিও। ইতি।
জেরেমি সন্ডার্স
উড়ন্ত লামা! তিব্বতী যোগী মিলারেপার আত্মজীবনী আমি পড়েছি। ইনি তান্ত্রিক জাদুবিদ্যা শিখে এবং যোগ সাধনা করে নানারকম আশ্চর্য ক্ষমতার অধিকারী হয়েছিলেন। তার মধ্যে একটা ছিল উড়ে বেড়াবার ক্ষমতা। এই জাতীয় কোনো মহাযোগীর সাহায্যেই কি উইলার্ড আকাশে উড়েছিলেন?
সব মিলিয়ে ব্যাপারটা আমারও মনে প্রচন্ড কৌতূহল উদ্রেক করেছে। তিব্বত যাইনি; কেবল দেশটা নিয়ে ঘরে বসে পড়াশোনা করেছি, আর তিব্বতী ভাষাটা শিখেছি। ভাবছি সন্ডার্সের দলে আমিও যোগ দেব। এতে ওদের সুবিধাই হবে, কারণ আমার তৈরি এমন সব ওষুধপত্র আছে যার সাহায্যে পার্বত্য অভিযানের শারীরিক গস্নানি অনেকটা কমিয়ে দেওয়া যায়।
২৭শে জুলাই
আজ আমার পড়শি ও বন্ধু অবিনাশবাবুকে তিব্বত অভিযানের কথা বলতে তিনি একেবারেই হাঁ হাঁ করে উঠলেন। দু-দুবার আমার সঙ্গে ভারতবর্ষের বাইরে গিয়ে নানান বিচিত্র অভিজ্ঞতার ফলে ওঁর এই প্রৌঢ় বয়সে ভ্রমণের নেশা চাগিয়ে উঠেছে। তিব্বত জায়গাটা খুব আরামের নয়, এবং অনেক অজানা দুর্গম জায়গায় আমাদের যেতে হবে শুনে ভদ্রলোক বললেন, ‘সে হোক্ গে। শিবের পাহাড় কৈলাসটা যদি এবার চাক্ষুষ দেখতে পারি তো আমার হিন্দু জন্ম সার্থক।’ কৈলাস যে তিব্বতে সেটা জানলেও তার পাশের বিখ্যাত হ্রদটির কথা অবিনাশবাবু জানতেন না। বললেন, ‘সে কী মশাই, মানস সরোবর তো কাশ্মীরে বলে জানতুম!’
একশৃঙ্গ আর উড়ন্ত লামার কথাটা আর অবিনাশবাবুকে বললাম না, কারণ ও দুটো নিয়ে এখনো আমার মনে খটকা রয়ে গেল। খাম্পা দস্যুদের কথাটা বলতে ভদ্রলোক বললেন, ‘তাতে ভয়ের কী আছে মশাই? আপনার ওই হনলুলু পিস্তল দিয়ে ওদের সাবাড় করে দেবেন।’ অ্যানাইহিলিন যে হনলুলু কী করে হল জানি না।
কাঠগোদাম থেকেই যাওয়া সি’র করেছি। আজ সন্ডার্সকে টেলিগ্রামে জানিয়ে দিয়েছি যে আমি পয়লা কাঠগোদাম পৌঁছাব। জিনিসপত্র বেশি নেওয়ার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। অবিনাশবাবুকেও সেটা বলে দিলাম। উনি আবার পাশবালিশ ছাড়া ঘুমোতে পারেন না, তাই ওঁর জন্যে ফুঁ দিয়ে ফোলানো যায় এমন একটা লম্বাটে বালিশ তৈরি করে দেব বলেছি। শীতে পরার জন্য আমারই আবিষ্কৃত শ্যাঙ্কলন পস্নাস্টিকের হাল্কা পোশাক নিচ্ছি, এয়ার-কন্ডিশনিং পিল নিচ্ছি, বেশি উঁচুতে উঠলে যাতে নিশ্বাসের কষ্ট না হয় তার জন্য আমার তৈরি অক্সিমোর পাউডার নিচ্ছি। এছাড়া অম্নিস্কোপ ক্যামের্যাপিড ইত্যাদি তো নিচ্ছিই। সব মিলিয়ে পাঁচ সেরের বেশি ওজন হবার কথা নয়। পায়ে পরার জন্য পশমের বুট আলমোড়াতেই পাওয়া যাবে।
ক’দিন হল খুব গুমোট হয়েছে। এইবার ঘোর বর্ষা শুরম্ন হবে বলে মনে হচ্ছে। হিমালয়ের প্রাচীর পেরিয়ে একবার তিব্বতে পৌঁছাতে পারলে মনসুন আর আমাদের নাগাল পাবে না।
২রা আগস্ট । গারবেয়াং
এর মধ্যে ডায়রি লেখার সময় পাইনি। আমরা কাঠগোদাম ছেড়ে মোটরে করে আলমোড়া পর্যন্ত এসে, তারপর ঘোড়া করে উত্তর-পূর্ব পাহাড়ের রাস্তা ধরে প্রায় দেড়শো মাইল অতিক্রম করে কাল সন্ধ্যায় গারবেয়াং এসে পৌঁছেছি।
গারবেয়াং দশ হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত একটা ভুটিয়া গ্রাম। আমরা এখনো ভারতবর্ষের মধ্যেই রয়েছি। আমাদের পুবদিকে খাদের নিচ দিয়ে কালী নদী বয়ে চলেছে। নদীর ওপারে নেপাল রাজ্যের ঘন ঝাউবন দেখা যাচ্ছে। এখান থেকে আরো বিশ মাইল উত্তরে গিয়ে ১৬০০০ ফুট উঁচুতে একটা গিরিবর্ত্ম পেরিয়ে লিপুধুরা। লিপুধুরা পেরোলেই ভারতবর্ষ ছাড়িয়ে তিব্বতে প্রবেশ।
কৈলাস-মানস-সরোবর তিব্বতের সীমানা থেকে মাইল চল্লিশেক। দূরত্বের দিক দিয়ে বেশি নয় মোটেই, কিন’ দুর্গম গিরিপথ, বেয়াড়া শীত, আর তার সঙ্গে আরো পাঁচরকম বিপদ-আপদের কথা কল্পনা করে, ভারতবর্ষের শতকরা ৯৯.৯ ভাগ লোকই আর এদিকে আসার নাম করে না। অথচ এই পথটুকু আসতেই আমরা যা দৃশ্যের নমুনা পেয়েছি, এর পরে না জানি কী আছে সেটা ভাবতে এই বয়সেও আমার রোমাঞ্চ হচ্ছে।
এবার আমাদের দলটার কথা বলি। সন্ডার্স ও ক্রোল ছাড়া আরো একজন বিদেশী আমাদের সঙ্গ নিয়েছেন। এর নাম সের্গেই মার্কোভিচ। জাতে রাশিয়ান, থাকেন পোল্যান্ডে। ইংরেজিটা ভালোই বলেন। আমাদের মধ্যে ইনিই অপেক্ষাকৃত কমবয়সী। দোহারা লম্বা চেহারা, ঘোলাটে চোখ, মাথায় একরাশ অবিন্যস্ত তামাটে চুল, ঘন ভুরম্ন, আর ঠোঁটের দুপাশে ঝুলে থাকা লম্বা গোঁফ। এঁর সঙ্গে আমাদের আলাপ আলমোড়াতেই। ইনিও নাকি তিব্বত যাচ্ছিলেন, তার একমাত্র কারণ ভ্রমণের নেশা, তাই আমরা যাচ্ছি শুনে আমাদের দলে ভিড়ে পড়লেন। এমনিতে হয়তো লোক খারাপ নন, কিন’ ঠোঁট হাসলেও চোখ হাসে না দেখে মনে হয় তেমন অবস্থায় পড়লে খুন-খারাপিতেও পেছ-পা হবেন না। সেই কারণেই বোধহয় ক্রোলের একে পছন্দ না। ক্রোলের নিজের হাইট সাড়ে পাঁচ ফুটের বেশি না। টেকো মাথার দুপাশে সোনালী চুল কানের উপর এসে পড়েছে। বেশ গাঁট্টাগোঁট্টা চেহারা। তবে আদৌ হিংস্র নয়। তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই যে পাঁচবার ম্যাটারহর্নের চূড়োয় উঠেছে। লোকটা মাঝে মাঝে বেজায় অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে, তিনবার নাম ধরে ডাকলে তবে জবাব দেয়। আর প্রায়ই দেখি ডান হাতের আঙুল নেড়ে নেড়ে কী যেন হিসেব করে। আমরা যেমন কড়ে আঙুল থেকে শুরম্ন করে পাঁচ আঙুলের গাঁটে গাঁটে বুড়ো আঙুল ঠেকিয়ে এক থেকে কুড়ি পর্যন্ত গুনতে পারি, ইউরোপের লোকেরা দেখেছি সেটা একেবারেই পারে না। এরা একটা আঙুলে এক গোনে। গাঁটের ব্যবহারটা বোধহয় ভারতীয়।
সন্ডার্স আমার থেকে পাঁচ বছরের ছোট। সুগঠিত সুপুরম্নষ চেহারা, বুদ্ধিদীপ্ত হাল্কা নীল চোখ, প্রশসত্ম ললাট। সে এই ক’দিনে তিব্বত সম্বন্ধে খান দশেক বই পড়ে অভিযানের জন্য তৈরি হয়ে এসেছে। যোগবল বা ম্যাজিকে তার বিশ্বাস নেই। এসব বই পড়েও সে বিশ্বাস জাগেনি, এবং এই নিয়ে ক্রোলের সঙ্গে তার মাঝে মাঝে তর্কবিতর্কও হয়েছে।
এই তিনজন ছাড়া অবিশ্যি রয়েছেন আমার প্রতিবেশী তীর্থযাত্রী শ্রীঅবিনাশচন্দ্র মজুমদার, যিনি আপাতত আমাদের থেকে বিশ হাত দূরে খাদের পাশে একটা পাথরের খন্ডে বসে হাতে তামার পাত্রে তিব্বতী চা নিয়ে কাছেই খুঁটির সঙ্গে বাঁধা একটা ইয়াক বা চমরী গাইয়ের দিকে চেয়ে আছেন। আজ সকালেই ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘মশাই, সেই ছেলেবেলা থেকে পুজোর কাজে চামরের ব্যবহার দেখে আসছি, আর অ্যাদ্দিনে তার উৎপত্তিস’ল দেখলাম।’ সাদা চমরীর ল্যাজ দিয়েই চামর তৈরি হয়। এখানে যে চমরীটা রয়েছে সেটা অবিশ্যি কালো।
আমরা বাকি চারজনে বসেছি একটা ভুটিয়ার দোকানের সামনে। সেই দোকান থেকেই কেনা তিব্বতী চা ও সাম্পায় আমরা ব্রেকফাস্ট সারছি। সাম্পা হল গমের ছাতুর ডেলা। জলে বা চায়ে ভিজিয়ে খেতে হয়। এই চা কিন’ আমাদের ভারতীয় চা নয়। এ চা চীন দেশ থেকে আসে, এর নাম ব্রিক-টী। দুধ-চিনির বদলে নুন আর মাখন দিয়ে এই চা তৈরি হয়। একটা লম্বা বাঁশের চোঙার মধ্যে চা ঢেলে আরেকটা বাঁশের ডান্ডা দিয়ে মোড়্গম ঘাঁটান দিলে চায়ে-মাখনে একাকার হয়ে এই পানীয় প্রস’ত হয়। তিব্বতীরা এই চা খায় দিনে ত্রিশ-চল্লিশ বার। চা আর সাম্পা ছাড়া আরো যেটা খায় সেটা হল ছাগল আর চমরীর মাংস। এসব হয়তো আমাদেরও খেতে হবে, যদিও চাল ডাল সব্জি কফি টিনের খাবার ইত্যাদি আমরা সঙ্গে নিয়েছি। সে সব যতদিন চলে চলবে, তারপর সবকিছু ফুরোলে রয়েছে আমার ক্ষুধা-তৃষ্ণানাশক বড়ি বটিকা ইন্ডিকা।
অনিবাশবাবু আমায় শাসিয়ে রেখেছেন- ‘আমাকে মশাই আপনার ওই সাহেব বন্ধুদের সঙ্গে মিশতে বলবেন না। আপনি চৌষট্টিটা ভাষা জানতে পারেন, আমার বাংলা বৈ আর সম্বল নেই। সকাল সন্ধে গুড মর্নিং গুড ইভনিংটা বলতে পারি, এমন কি ওনাদের কেউ খাদে-টাদে পড়ে গেলে গুড বাইটাও মুখ থেকে বেরিয়ে যেতে পারে- তার বেশি আর কিছু পাবেন না। আপনি বরং বলে দেবেন যে আমি একজন মৌনী সাধু, তীর্থ করতে যাচ্ছি।’ সত্যি অবিনাশবাবু খুবই কম কথা বলছেন। আমি একা থাকলেও কথা বলেন
ফিস্ফিস্ করে। একটা সুবিধা এই যে ভদ্রলোকের ঘোড়া চড়তে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। এসব অঞ্চলে ঘোড়া ছাড়া গতি নেই। ছ’টা ঘোড়া, মাল বইবার জন্য চারটে চমরী আর আটজন ভুটিয়া কুলি আমরা
সঙ্গে নিচ্ছি।
উইলার্ডের ডায়রিটা নিজের চোখে দেখে আমার উইনিকর্ণ ও উড়নত্ম লামা সম্পর্কে কৌতূহল দশগুণ বেড়ে গেছে। এখানে একদল তিব্বতী পশমের ব্যাপারী এসেছে, তাদের একজনের সঙ্গে আলাপ করে একশৃঙ্গ জানোয়ারের কথা জিজ্ঞেস করাতে সে বোধহয় আমাকে পাগল ভেবে দাঁত বার করে হাসতে লাগল! উড়ন্ত লামার কথা জিজ্ঞেস করাতে সে বলল সব লামাই নাকি উড়তে পারে। আসলে এদের সঙ্গে কথা বলে কোনো ফল হবে না। উইলার্ডের সৌভাগ্য আমাদের হবে কি না জানি না। একটা সুখবর আছে এই যে, উইলার্ডের ১১ই মার্চের ডায়রিতে একটা জায়গায় উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে যেটার নাম দেওয়া নেই, কিন’ ভৌগোলিক অবস্থান দেওয়া আছে। সেটা হলো ল্যাটিচিউড ৩৩.৩ নর্থ আর লঙ্গিচিউড ৮৪ ইস্ট। ম্যাপ খুলে দেখা যাচ্ছে সেটা কৈলাসের প্রায় একশো মাইল উত্তর-পশ্চিমে চাংথাং অঞ্চলে। এই চাংথাং ভয়ানক জায়গা। সেখানে গাছপালা বলতে কিছু নেই, আছে শুধু দিগন্ত বিস্তৃত বালি আর পাথরে মেশানো রুক্ষ জমির মাঝে মাঝে একেকটা হ্রদ। মানুষ বলতে এক যাযাবর শ্রেণীর লোক ছাড়া কেউ থাকে না ওখানে। শীতও নাকি প্রচন্ড। আর তার উপরে আছে বরফের ঝড়- যাকে বলে বিস্নজার্ড- যা নাকি সাতপুরম্ন পশমের জামা ভেদ করে হাড় পর্যনত্ম কাঁপিয়ে দেয়।
সবই সহ্য হবে যদি যাত্রার উদ্দেশ্য সফল হয়। অবিনাশবাবু বলছেন, ‘কোনো ভাবনা নেই। ভক্তির জোর, আর কৈলাসেশ্বরের কৃপায় আপনাদের সব মনস্কামনা পূর্ণ হবে।’
৪ঠা আগস্ট। পুরাং উপত্যকা
১২০০০ ফুট উঁচুতে একটা খরস্রোতা পাহাড়ী নদীর ধারে আমরা ক্যাম্প ফেলেছি। হাপরের সাহায্যে ধুনি জ্বালিয়ে তার সামনে মাটিতে কম্বল বিছিয়ে বসেছি। বিকেল হয়ে আসছে; চারদিকে বরফে ঢাকা পাহাড়ে ঘেরা এই জায়গাটা থেকে রোদ সরে গিয়ে আবহাওয়া দ্রম্নত ঠান্ডা হয়ে আসছে। আশ্চর্য এই যে, এখানে সন্ধ্যা থেকে সকাল অবধি দুর্জয় শীত হলেও দুপুরের দিকে তাপমাত্রা চড়ে গিয়ে মাঝে মাঝে ৮০/৯০ ডিগ্রী ফারেনহাইট
উঠে যায়।
গারবেয়াং থেকে রওনা হবার আগে, চড়াই উঠতে হবে বলে নিশ্বাসের যাতে কষ্ট না হয় তার জন্য আমি সকলকে অক্সিমোর পাউডার অফার করি। সন্ডার্স ও অবিনাশবাবু আমার ওষুধ খেলেন। ক্রোল বলল সে জার্মানির পার্বত্য অঞ্চলে মাইনিঙ্গেন শহরে থাকে, ছেলেবেলা থেকে পাহাড়ে চড়েছে, তাই তার ওষুধের দরকার হবে না। মার্কোভিচকে জিজ্ঞেস করাতে সেও বলল ওষুধ খাবে না। কেন খাবে না তার কোনো কারণ দিল না। বোধ হয় আমার তৈরি ওষুধে তার আস্থা নেই। সে যে অত্যন্ত মূর্খের মতো কাজ করেছে সেটা পরে নিজেও বুঝতে পেরেছিল। ঘোড়ায় চড়ে দিব্যি চলেছিলাম আমরা পাহাড়ে পথ ধরে। বেঁটে বেঁটে তিব্বতী ঘোড়ার পিঠে আমরা পাঁচজন, আর আমাদের পিছনে কুলি আর মালবাহী চমরীর দল। ষোল হাজার ফুটে গুরুপলা গিরিবর্ত্ম পেরোতেই হিমেল বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ ছাপিয়ে একটা অদ্ভুত আওয়াজ আমাদের কানে এল। আমাদের মধ্যে কে যেন প্রচন্ড জোরে হাসতে
শুরম্ন করেছে।
এদিক ওদিক চেয়ে একটু হিসেব করে শুনে বুঝতে পারলাম হাসিটা আসছে সবচেয়ে সামনের ঘোড়ার পিঠ থেকে। পিঠে রয়েছেন শ্রীমান সেরগেই মার্কোভিচ। তার হাসিটা এমনই বিকট ও অস্বাভাবিক যে আমাদের দলটা আপনা থেকেই থেমে গেল।
মার্কোচিভ থেমেছে। এবার সে ঘোড়ার পিঠ থেকে নামল। তারপর তার সমস্ত দেহ কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে অত্যন্ত বেপরোয়া ও বেসামালভাবে সে রাস্তার ডান দিকে এগোতে লাগল। ডাইনে খাদ, আর সে খাদ দিয়ে একবার গড়িয়ে পড়লে অন্তত দু হাজার ফুট নিচে গিয়ে সে গড়ানো থামবে এবং অবিনাশবাবুর ‘গুড বাই’ বলার সুযোগ
এসে যাবে।
সন্ডার্স, ক্রোল ও আমি ঘোড়া থেকে নেমে ব্যস্তভাবে মার্কোভিচের দিকে এগিয়ে গেলাম। লোকটার চোখ ঘোলাটে; তার হাসিও ঘোলাটে মনের হাসি। এবারে বুঝতে পাললাম তার কী হয়েছে। বারো হাজার ফুটের পর থেকেই আবহাওয়ায় অক্সিজেনের রীতিমতো অভাব হতে শুরম্ন করে। কোনো কোনো লোকের বেলায় সেটা নিশ্বাসের কষ্ট ছাড়া আর কোনো গ-গোলের সৃষ্টি করে না। কিন’ একেকজনের ক্ষেত্রে সেটা রীতিমতো মস্তিষ্কের বিকার ঘটিয়ে দেয়। তার ফলে কেউ কাঁদে, কেউ হাসে, কেউ ভুল বকে, আবার কেউ বা অজ্ঞান হয়ে যায়। মার্কোভিচকে হাসিতে পেয়েছে। আমাদের কুলিরা বোধহয় এ ধরনের ব্যারাম কখনো দেখেনি, কারণ তারা দেখছি মজা পেয়ে নিজেরাও হাসতে শুরম্ন করে দিয়েছে। ন’টি পুরম্নষের অট্টহাসি এখন চারদিকে পাহাড় থেকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
ক্রোল হঠাৎ আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘ওকে মারি একটা ঘুষি?’
আমি তো অবাক। বললাম, ‘কেন, ঘুষি মারবে কেন? ওর তো অক্সিজেনের অভাবে ওই অবস্থা হয়েছে।’
‘সেই জন্যেই তো বলছি। এই অবস্থায় ওকে তোমার ওষুধ খাওয়াতে পারবে না। বেহুঁশ হলে জোর করে গেলানো যেতে পারে।’
এর পরে আমি কিছু বলার আগেই ক্রোল মার্কোভিচের দিকে এগিয়ে গিয়ে একটা প্রচন্ড ঘুষিতে তাকে ধরাশায়ী করে দিল। অজ্ঞান অবস্থায় তার মুখ হাঁ করে তার গলায় আমার পাউডার গুঁজে দিলাম। দশ মিনিট পরে জ্ঞান হয়ে ভদ্রলোক ফ্যাল ফ্যাল করে এদিক ওদিক দেখে তার চোয়ালে হাত বুলোতে বুলোতে সুবোধ বালকের মতো তার ঘোড়ার পিঠে চেপে বসল। আমরা সকলে আবার
রওনা দিলাম।
পুরাঙে এসে ক্যাম্প ফেলে আগুন জ্বেলে বসবার পর ক্রোল ও সন্ডার্সের সঙ্গে ইউনিকর্ন নিয়ে কথা হল। সন্ডার্স বলল, ‘বিংশ শতাব্দীতে পৃথিবীতে হঠাৎ একটা নতুন জাতের জানোয়ার আবিষ্কার করাটা কী সাংঘাতিক ব্যাপার বল তো! আর, একটা আধটা নয়, একেবারে দলে দলে।’
ইউনিকর্ন থেকে আলোচনাটা আরো অন্য কাল্পনিক প্রাণীতে চলে গেল। সত্যি, পুরাকালে কতরকমই না উদ্ভট জীবজন’ সৃষ্টি করেছে মানুষের কল্পনা। অবিশ্যি কোনো কোনো পন্ডিত বলেন যে, এসব নিছক কল্পনা নয়। প্রাগৈতিহাসিক যুগে মানুষ যে সব প্রাণীদের দেখত, তার আবছা স্মৃতি নাকি অনেক যুগ পর্যন্ত মানুষের মনে থেকে যায়। সেই স্মৃতির সঙ্গে কল্পনা জুড়ে মানুষই আবার এই সব উদ্ভট প্রাণীর সৃষ্টি করে। এই ভাবে প্রাগৈতিহাসিক টেরোড্যাকটিল বা ঈপিয়র্নিস পাখির স্মৃতির থেকেই হয়তো সৃষ্টি হয়েছে গরম্নড় বা জটায়ু বা আরব্যোপন্যাসের সিন্দবাদ নাবিকের গল্পের অতিকায় রক পাখি- যার ছানার খাদ্য ছিল একটা আসত্ম হাতি। মিশর দেশের উপকথায় তি-বেন্নু পাখির কথা আছে, পরে ইউরোপে যার নাম হয়েছিল ফীনিক্স। এই ফীনিক্সের নাকি মৃত্যু নেই। একটা সময় আসে যখন সে নিজেই নিজেকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলে, আর পরমুহূর্তেই তার ভস্ম থেকে নতুন ফীনিক্স জন্ম নেয়। আর আছে ড্র্যাগন- যার অসি-ত্ব পূর্ব-পশ্চিম দুদিকের লোকই বিশ্বাস করত। তফাৎ এই যে পশ্চিমের ড্র্যাগন ছিল অনিষ্টকারী দানব, চীন বা তিব্বতের ড্র্যাগন ছিল মঙ্গলময় দেবতা।
এই সব আলোচনা করতে করতে আমি মার্কোভিচের কথাটা তুললাম। আমার মতে তাকে আমাদের অভিযানের আসল উদ্দেশ্যটা জানানো দরকার। চাংথাং অঞ্চলের ভয়াবহ চেহারাটাও তার কাছে পরিষ্কার করা দরকার। সেটা জেনেও যদি সে আমাদের সঙ্গে যেতে চায় তো চলুক, আর না হলে হয় সে নিজের রাসত্মা ধরম্নক, না হয় দেশে ফিরে যাক।
ক্রোল বলল, ‘ঠিক বলেছ। যে লোক আমাদের সঙ্গে ভালোভাবে মিশতে পারে না, তাকে সঙ্গে নেওয়া কী দরকার। যা বলবার এখনি বলা হোক্।’
সন্ডার্স বলল সে মার্কোভিচকে পশ্চিমের তাঁবুতে যেতে দেখেছে। আমরা তিনজনে তাঁবুর ভেতর ঢুকলাম।
মার্কোভিচ একপাশে অন্ধকারে ঘাড় গুঁজে বসে আছে। আমরা ঢুকতে সে মুখ
তুলে চাইল। সন্ডার্স ভনিতা না করে সরাসরি উইলার্ডের ডায়রি আর একশৃঙ্গের কথায় চলে গেল। তার কথার মাঝখানেই মার্কোভিচ বলে উঠল, ‘ইউনিকর্ন? ইউনিকর্ন তো আমি ঢের দেখেছি। আজকেও আসার সময় দেখলাম। তোমরা দেখনি বুঝি?’
আমরা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। মার্কোভিচ যেমন বসেছিল তেমনি বসে আছে। সে যে ঠাট্টা করে কথাটা বলেছে সেটা তার ভাব দেখে মোটেই মনে হয় না। তাহলে কি আমার ওষুধ পুরোপুরি কাজ দেয়নি? তার মাথা কি এখনো পরিষ্কার হয়নি?
ক্রোল গুনগুন করে একটা জার্মান সুর ভাঁজতে ভাঁজতে বাইরে চলে গেল। বুঝলাম সে হাল ছেড়ে দিয়েছে। এবার আমরা দুজনেও উঠে পড়লাম। বাইরে এলে পরে ক্রোল তার পাইপ ধরিয়ে বিদ্রূপের সুরে বলল, ‘এটাও কী তোমার অক্সিজেনের অভাব বলে মনে হয়?’ আমি আর সন্ডার্স দুজনেই চুপ। ‘আমরা নিঃসন্দেহে একটা পাগলকে সঙ্গে নিয়ে চলেছি’- বলে ক্রোল তার ক্যামেরা নিয়ে হাত পঞ্চাশেক দূরে একটা প্রকা- পাথরের গায়ে খোদাই করা তিব্বতী মহামন্ত্র ‘ওঁ মণিপদ্মে হুম্’-এর ছবি তুলতে চলে গেল।
মার্কোভিচ কি সত্যিই পাগল, না সাজা-পাগল? আমার মনটা খুঁৎ খুঁৎ করছে।
আমাদের মধ্যে অবিনাশবাবুই বোধহয় সবচেয়ে ভালো আছেন। প্রায় চলিস্নশ বছর ধরে ভদ্রলোককে দেখছি, ওঁর মধ্যে যে কোনো রসবোধ আছে তা আগে কল্পনাই করতে পারিনি। আমার বৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্পর্কে উনি চিরকালই ঠাট্টা করে এসেছেন; আমার যুগানত্মকারী আবিষ্কারগুলোও ওঁর মনে কোনোদিন বিস্ময় বা শ্রদ্ধা জাগাতে পারেনি। কিন’ ওই যে দুবার আমার সঙ্গে বাইরে গেলেন- একবার আফ্রিকায়, আরেকবার প্রশানত্ম মহাসাগরের সেই আশ্চর্য দ্বীপে- তার পর থেকেই দেখেছি ওঁর চরিত্রে একটা বিশেষ পরিবর্তন এসেছে। ভ্রমণে মনের প্রসার বাড়ে বলে ইংরাজিতে একটা কথা আছে, সেটা অবিনাশবাবুর ড়্গেত্রে চমৎকারভাবে ফলেছে। আজ বারবার উনি আমার কানের কাছে এসে বিড়বিড় করে গেছেন- ‘কৈলাস ভূধর অতি মনোহর, কোটি শশী পরকাশ, গন্ধর্ব কিন্নর যক্ষ্ম বিদ্যাধর অপ্সরাগণের বাস।’ কৈলাস সম্বন্ধে পৌরাণিক ধারণাটা অবিনাশবাবু এখনো বিশ্বাস করে বসে আছেন। আসল কৈলাসের সাড়্গাৎ পেয়ে ভদ্রলোককে কিঞ্চিৎ হতাশ হতে হবে। আপাতত উনি কুলিদের রান্নার আয়োজন দেখতে ব্যসত্ম। বুনো ছাগলের মাংস রান্না করছে ওরা।
দূরে, বহুদূরে, আমরা যেই রাসত্মা দিয়ে যাব সেই রাসত্মা দিয়ে ঘোড়ার পিঠে একদল লোক আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। এতড়্গণ দলটাকে কতগুলো চলমান কালো বিন্দু বলে মনে হচ্ছিল। এখন তাদের চেহারাটা ক্রমে স্পষ্ট হয়ে আসছে। এদের দেখতে পেয়ে আমাদের লোকগুলোর মধ্যে একটা চাঞ্চল্য লড়্গ করছি। কারা এরা?
শীত বাড়ছে। আর বেশিড়্গণ বাইরে বসা চলবে না।
৪ঠা আগস্ট। সন্ধ্যা সাতটা
একটা বিশেষ চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে গেল এই কিছুড়্গণ আগে। দূর থেকে যে দলটাকে আসতে দেখেছিলাম সেটা ছিল একটা খাম্পা দস্যুদল। এই বিশেষ দলটিই যে উইলার্ডকে আক্রমণ করেছিল তারও প্রমাণ পেয়েছি।
বাইশটা ঘোড়ার পিঠে বাইশজন লোক, তাদের প্রত্যেকের মোটা পশমের জামার কোমরে গোঁজা তলোয়ার, কুক্রি, ভোজালি, আর পিঠের সঙ্গে বাঁধা আদ্যিকালের গাদা বন্দুক। এ ছাড়া দলে আছে পাঁচটা লোমশ তিব্বতী কুকুর।
দলটা যখন প্রায় একশো গজ দূরে, তখন আমাদের দুজন লোক- রাবসাং ও টু ুপ- হনত্মদনত্ম হয়ে আমাদের কাছে এসে বলল, ‘আপনাদের সঙ্গে যা অস্ত্রশস্ত্র আছে তা তাঁবুর ভিতর থেকে বাইরে নিয়ে আসুন।’ আমি বললাম, ‘কেন, ওদের দিয়ে দিতে হবে নাকি?’ ‘না, না। বিলাতি বন্দুককে ওরা সমীহ করে চলে। না হলে ওরা সব তছনছ করে লুট করে নিয়ে যাবে। ভারী বেপরোয়া দস্যু ওরা।’
আমাদের সঙ্গে তিনটে বন্দুক- একটা এনফিল্ড ও দুটো অস্ট্রিয়ান মান্লিখার। সন্ডার্স ও ক্রোল তাঁবু থেকে টোটাসমেত বন্দুক বার করে আনল। মার্কোভিচের বেরোবার নাম নেই, আমি প্রয়োজনে পকেট থেকে আমার অ্যানাইহিলিন পিসত্মল বার করব, তাই হাত খালি রাখতে হবে, অথচ দুজনের হাতে তিনটে বন্দুক বেমানান, তাই অবিনাশবাবুকে ডেকে তার হাতে একটা মান্লিখার তুলে দেওয়া হল। ভদ্রলোক একবার মাত্র হাঁ হাঁ করে
থেমে গিয়ে কাঁপা হাতে বন্দুকটা নিয়ে দস্যুদলের উল্টো দিকে মুখ করে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন।
২
দস্যুদল এসে পড়ল। ধুম্সো লোমশ তিব্বতী কুকুরগুলো আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রচ- ঘেউ ঘেউ করছে। তাদেরও ভাবটা দস্যুদেরই মতো। আমাদের দলের লোকগুলোর অবস’া কাহিল। যে যেখানে ছিল সব জবুথবু হয়ে বসে পড়েছে। এই সব দস্যু সাধারণত যাযাবরদের আসত্মানায় গিয়ে পড়ে সর্বস্ব লুট করে নিয়ে চলে যায়। উপযুক্ত অস্ত্র ছাড়া এদের বাধা দিতে যাওয়া মানে নিশ্চিত মৃত্যু। অবিশ্যি এরা যদি তিব্বতী পুলিশের হাতে পড়ে তাহলে এদের চরম শাসিত্মর ব্যবস’া আছে। গর্দান আর ডান হাতটা কেটে নিয়ে সেগুলোকে সোজা রাজধানী লাসায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কিন’ এই ধু ধু প্রানত্মরে বরফে ঢাকা গিরিবর্ত্মের আনাচে কানাচে এদের খুঁজে বের করা মোটেই সহজ নয়। এও শুনেছি যে এই সব দস্যুর নিজেদেরও নাকি নরকভোগের ভয় আছে। তাই এরা লুটপাট বা খুনখারাপি করে নিজেরাই, হয় কৈলাস প্রদড়্গিণ করে, না হয় কোনো উঁচু পাহাড়ের চূড়োয় দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে নিজেদের পাপের ফিরিসিত্ম দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করে নেয়।
দস্যুদের সামনে যে রয়েছে তাকেই মনে হল পালের গোদা। নাক থ্যাবড়া, কানে মাক্ড়ি, মাথার রম্নড়্গ চুল টুপির পাশ দিয়ে বেরিয়ে রয়েছে, বয়স বেশি না হলেও মুখের চামড়া কুঁচকে গেছে, কুৎকুতে চোখে অত্যনত্ম সন্দিগ্ধভাবে আমাদের চারজনকে নিরীড়্গণ করছে। বাকি লোকগুলো যে যেখানে ছিল সেখানেই চুপ করে ঘোড়ার লাগাম ধরে অপেড়্গা করছে; বোঝা যাচ্ছে নেতার হুকুম না পেলে কিছু করবে না।
এবারে দস্যুনেতা ঘোড়ার পিঠ থেকে নামল। তারপর ক্রোলের দিকে এগিয়ে এগিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে চাপা ঘড়ঘড় গলায় বলল- ‘পেলিং?’ পেলিং মানে ইউরোপীয়। ক্রোলের হয়ে আমিই ‘হ্যাঁ’ বলে জবাব দিয়ে দিলাম। দিয়েই খট্কা লাগল। ইউরোপীয় দেখে চিনল কী করে এরা?
লোকটা এবার ধীরে ধীরে সন্ডার্সের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর তার পায়ের কাছ থেকে একটা বেক্ড বীন্সের খালি টিন তুলে নিয়ে সেটাকে উল্টে পাল্টে দেখে তার গন্ধ শুঁকে আবার মাটিতে ফেরে ভারী ভারী বুটের গোঁড়ালির এক মোড়্গম চাপে সেটাকে থেঁতলে মাটির সঙ্গে সমান করে দিল। সন্ডার্স হাতে বন্দুক নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে দস্যু নেতার ঔদ্ধত্য হজম করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
কোত্থেকে জানি মাঝে মাঝে একটা দাঁড়কাকের গম্ভীর কর্কশ কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। এ ছাড়া কেবল নদীর কুলকুল শব্দ। কুকুরগুলো আর ডাকছে না। এই থম্থমের মধ্যে আবার দস্যুনেতার ভারী বুটের শব্দ পাওয়া গেল। সে এবার অবিনাশবাবুর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ভদ্রলোক যে কেন তাকে মাথা হেঁট করে নমস্কার করলেন তা বোঝা গেল না। দস্যুনেতার বোধহয় ব্যাপারটা ভারী কমিক বলে মনে হল, কারণ সে সশব্দে একটা বর্বর হাসি হেসে অবিনাশবাবুর হাতের বন্দুকের বাঁটে একটা খোঁচা মারল।
এবার ক্রোলের দিকে চোখ পড়াতে সভয়ে দেখলাম সে তার বন্দুকটা দস্যুনেতার দিকে উঠিয়েছে, প্রচ- রাগে তার কপালের শিরাগুলি ফুলে উঠেছে। আমি চোখ দিয়ে ইসারা করে তাকে ধৈর্য হারাতে মানা করলাম। ইতিমধ্যে সন্ডার্স আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। সে ফিস্ ফিস্ করে বলল, ‘দে হ্যাভ অ্যান এনফিল্ড টু।’
কথাটা শুনে অন্য দস্যুগুলোর দিকে চেয়ে দেখি তাদের মধ্যে একজন হিংস্র চেহারার লোক ঘোড়ার পিঠে সামনের দিকে এগিয়ে এসেছে। তার কাঁধে সত্যিই একটা এনফিল্ড রাইফ্ল। উইলার্ডের ডায়রি থেকে জেনেছি যে তার নিজের একটা এনফিল্ড ছিল। সেটা কিন’ আলমোড়ায় ফেরেনি। এই বন্দুক, আর ইউরোপীয়দের দেখে চিনতে পারা- এই
দুটো ব্যাপার থেকে বেশ বোঝা গেল যে এইদুস্যদলই উইলার্ডের মৃত্যুর জন্য দায়ী।
কিন’ তাহলেও আমাদের হাত-পা বাঁধা। এরা দলে ভারী। লড়াই লাগলে হয়তো আমাদের বন্দুক আর আমার পিসত্মলের সাহায্যে এদের রীতিমতো শিড়্গা দেওয়া যেত, কিন’ সে খবর যদি অন্য খাম্পাদের কাছে গিয়ে পৌঁছায় তাহলে কি তার প্রতিরোধ না নিয়ে ছাড়বে?
লড়াইয়ের প্রয়োজন হবে কি না ভাবছি, দস্যুনেতা অসীম সাহসের সঙ্গে আমাদের পূর্বদিকের ক্যাম্পটার দিকে এগিয়ে চলেছে, এমন সময় এক অদ্ভুত কা- ঘটল। অন্য ক্যাম্পটা থেকে হঠাৎ মার্কোভিচ টলতে টলতে বেরিয়ে এলো- তার ডান হাতটা সামনের দিকে তোলা, তার তর্জনী নির্দেশ করছে দস্যুদের তিব্বতী কুকুরগুলোর দিকে।
পরমুহূর্তেই তার গলায় এক অদ্ভুত উলস্নসিত চিৎকার শোনা গেল- ‘ইউনিকর্ন! ইউনিকর্ন!’
আমরা ভালো করে ব্যাপারটা বোঝার আগেই মার্কোভিজ দুহাত বাড়িয়ে এগিয়ে গেল একটা বিশাল লোমশ ম্যাস্টিফ কুকুরের দিকে। হয়তো তাকে আক্রমণ করা হচ্ছে মনে করেই কুকুরটা হঠাৎ রম্নখে দাঁড়িয়ে একটা বিশ্রী গর্জন করে মার্কোভিচের দিকে দিল একটা লাফ।
কিন’ মার্কোভিচের নাগাল পাবার আগেই সে কুকুর ভেলকির মতো ভ্যানিশ করে গেল। এর কারণ আমার অ্যানাইহিলিন পিসত্মল। আমার ডান হাতটা অনেকড়্গণ থেকেই পকেটে পিসত্মলের উপর রাখা ছিল। মোড়্গম মুহূর্তে সে হাত পিসত্মল সমেত বেরিয়ে এসে কুকুরের দিকে তাক করে ঘোড়া টিপে দিয়েছে।
কুকুর উধাও হবার সঙ্গে সঙ্গেই মার্কোভিচ মুহ্যমান অবস’ায় মাটিতে বসে পড়ল। ক্রোল আর সন্ডার্স মিলে তাকে কোলপাঁজা করে তাঁবুর ভিতর নিয়ে গেল।
আর এদিকে এক অদ্ভুত কা-। আমার পিসত্মলের মহিমা দেখে দস্যু দলের মধ্যে এক অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া শুরম্ন হয়েছে। তারা কেউ কেউ ঘোড়া থেকে নেমে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়েছে, কেউ আবার ঘোড়ার পিঠ থেকেই বার বার গড় করার ভাব করে উপুড় হয়ে পড়ছে। দস্যুনেতাও বেগতিক দেখে ইতিমধ্যে তার ঘোড়ার পিঠে উঠে পড়েছে। বাইশজন দস্যুর সম্মিলিত বেপরোয়া ভাব এক মুহূর্তে এভাবে উবে যাবে তা ভাবতে পারিনি।
এবার আমার মাথায় এক বৃদ্ধি খেলে গেল। যে লোকটার কাছে এনফিল্ডটা ছিল তার কাছে গিয়ে বললাম, ‘হয় তোমার বন্দুক দাও, না হয় তোমাদের পুরো দলকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলব।’ সে কাঁপতে কাঁপতে তার কাঁধ থেকে বন্দুক খুলে আমার হাতে তুলে দিল। এবার বললাম, ‘এই বন্দুক যার, তার আর কী কী জিনিস তোমাদের কাছে আছে বার কর।’
এক মিনিটের মধ্যে এর ওর ঝোলা থেকে বেরিয়ে পড়ল দু টিন সসেজ, একটা গিলেট সেফটি রেজার, একটা আয়না, একটা বাইনোকুলার, একটা ছেঁড়া তিব্বতের ম্যাপ, একটা ওমেগা ঘড়ি, আর একটা চামড়ার ব্যাগ। ব্যাগ খুলে দেখি তাতে রয়েছে একটা বাইবেল, আর তিব্বত সম্বন্ধে মোরক্রফ্ট ও টিফেনটালেরের লেখা দুটো বিখ্যাত বই। বই দুটোতে উইলার্ডের নাম লেখা রয়েছে তার নিজের হাতে।
জিনিসগুলোকে বাজেয়াপ্ত করে সবে ভাবছি দস্যুনেতাকে কিছু সতর্কবাণী শুনিয়ে তাদের বিদায় নিতে বলব, কিন’ তার আগেই তাদের পুরো দলটা চড়্গের নিমেষে যে পথে এসেছিল সেই পথেই ঘোড়া ছুটিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে আবছা হয়ে আসা পাহাড়ের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।
আপদ বিদায় করে অবিনাশবাবুকে মানলিখারের ভারমুক্ত করে পশ্চিম দিকের তাঁবুতে গেলাম মার্কোভিচের অবস’া দেখতে। সে মাটিতে কম্বলের উপর শুয়ে আছে চোখ বুজে। মুখের উপর টর্চ ফেলতে সে ধীরে ধীরে চোখ খুলল। এইবারে তার চোখের পাতা আর মণি দেখেই বুঝতে পারলাম যে সে নেশা করেছে। আর সে নেশা সাধারণ নেশা নয়; অত্যনত্ম কড়া কোনো মাদক ব্যবহার করেছে সে। হয়তো এটা তার অনেক দিনের অভ্যাস, আর তার প্রভাবেই সে যেখানে সেখানে ইউনিকর্ন দেখতে পাচ্ছে। কোকেন, হেরয়েন, মর্ফিয়া বা ওই জাতীয় কোনো মাদক খেলে বা ইঞ্জেকশন নিলে শুধু যে শরীরের ড়্গতি করে তা নয়, তা থেকে ব্রেনের বিকার ও তার ফলে চোখে ভুল দেখা কিছুই আশ্চর্য না।
মার্কোভিচের মতো নেশাখোরকে সঙ্গে নিলে আমাদের এই অভিযান ভ ুল হয়ে যাবে। হয় তাকে তাড়াতে হবে, না হয় তার নেশাকে তাড়াতে হবে।
৫ই আগস্ট, সকাল ৭টা
কাল রাত্রে তাকে ডাকা সত্ত্বেও মার্কোভিচ যখন খেতে এল না, তখন নেশার ধারণাটা আমার মনে আরো বদ্ধমূল হল। আমি জানি এ জাতীয় ড্রাগ বা মাদক ব্যবহার করলে মানুষের ড়্গিদে-তেষ্টা অনেক কমে যায়। কথাটা বলতে সন্ডার্স একেবারে ড়্গেপে উঠল। বলল, ‘ওকে সরাসরি জেরা করতে হবে এড়্গুনি।’ ক্রোল বলল, ‘তুমি অত্যনত্ম বেশি ভদ্র, তোমাকে দিয়ে জেরা হবে না। ব্যাপারটা আমার হাতে ছেড়ে দাও।’
খাবার পরে ক্রোল সোজা তাঁবুর ভিতর গিয়ে আধঘুমনত্ম মার্কোভিচকে বিছানা থেকে হিঁচড়ে টেনে তুলে সোজা তার মুখের ওপর বলল, ‘তোমার কাছে কী ড্রাগ আছে বার কর। আমরা জানি তুমি নেশা কর। এ নেশা তোমার ছাড়তে হবে, নয়তো তোমাকে আমরা বরফের মধ্যে পুঁতে দিয়ে চলে যাব; কেউ টের পাবে না।’
মার্কোভিচ পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারল কিনা জানি না, কিন’ সে ক্রোলের ভাব দেখে যে ভয় পেয়েছে সেটা স্পষ্টই বোঝা গেল। সে কোনোরকমে ক্রোলের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ব্যাগের ভিতর হাত ঢুকিয়ে কিছুড়্গণ হাতড়ে তার থেকে একটা মাথার বুরম্নশ বার করে ক্রোলের হাতে দিল। আমার প্রথমে মনে হয়েছিল এটা তার পাগলামিরই আরেকটা লড়্গণ; কিন’ ক্রোলের জার্মান বুদ্ধি এক নিমেষে বুঝে ফেলল যে মার্কোভিচ আসল জিনিসটাই বার করে দিয়েছে। বুরম্নশের কাঠের অংশটায় চাড় দিতে সেটা বাক্সের ডালার মতো খুলে গেল, আর তার তলা থেকে বেরিয়ে পড়ল ঠিক ট্যালকাম পাউডারের মতো দেখতে মিহি সাদা কোকেনের গুঁড়ো। আধ মিনিটের মধ্যে সে গুঁড়ো তিব্বতের হিমেল বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল, আর বুরম্নশটা নিড়্গিপ্ত হল খরস্রোতা পাহাড়ি নদীর জলে।
কিন’ শুধু কোকেন দূর করলেই তো হবে না, মার্কোভিচের নেশাটাকেও দূর করা চাই। আজ সকালে তার হাবভাবে মনে হচ্ছে আমার আশ্চর্য ওষুধ মিরাকিউলের কাজ দিয়েছে। সে ইতিমধ্যেই চার গেলাস মাখন চা, সেরখানেক ছাগলের মাংস আর বেশ কিছুটা সাম্পা খেয়ে ফেলেছে।
৭ই আগস্ট, সাংচান ছাড়িয়ে
এখন দুপুর আড়াইটা। আমরা মানস সরোবরের পথে একটা গুম্ফা বা তিব্বতী মাঠের বাইরে বসে একটু বিশ্রাম করে নিচ্ছি। পথে আসতে আসতে আরো অনেক গুম্ফা দেখেছি। এগুলোর প্রত্যেকটাই একেকটা পাহাড়ের চুড়ো বেছে বেছে তার উপর তৈরি করা হয়েছে, এবং প্রত্যেকটা থেকেই চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়। লামাদের সৌন্দর্যবোধ আছে একথা স্বীকার করতেই হয়।
আমাদের সামনে উত্তর দিকে ২৫০০ ফুট উঁচু গুর্লা-মান্ধাতা পর্বত সদর্পে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এছাড়া চারদিকে আরো অনেক বরফে ঢাকা পাহাড়ের চুড়ো দেখতে পাচ্ছি। আর কিছুদূর গেলেই কৈলাস-মানস সরোবরের দর্শন মিলবে, অবিনাশবাবুর যাত্রা সার্থক হবে। আপাতত মান্ধাতা দেখেই তাঁর সম্ভ্রম ও বিস্ময়ের সীমা নেই। বার বার বলছেন, ‘গায়ে কাঁটা দিচ্ছে মশাই। মহাভারতের যুগে চলে এসেছি। উঃ কী ভয়ানক ব্যাপার!’
বলা বাহুল্য, এখনো পর্যনত্ম একশৃঙ্গের কোনো চিহ্ন নেই। জানোয়ারের মধ্যে বুনো ছাগল ভেড়া গাধা চমরী এসব তো হামেশাই দেখছি। মাঝে মধ্যে এক আধটা খরগোশ ও মেঠো ইঁদুরও দেখা যায়। হরিণ আর ভালুক আছে বলে জানি, কিন’ দেখিনি। কাল রাত্রে ক্যাম্পের আশপাশে নেকড়ে হানা দিচ্ছিল, তাঁবুর কাপড় ফাঁক করে টর্চ ফেলে তাদের জ্বলনত্ম সবুজ চোখ দেখতে পাচ্ছিলাম।
সন্ডার্সের মনে একটা নৈরাশ্যের ভাব দেখা দিয়েছে। ওর ধারণা হয়েছে উইলার্ডও মার্কোভিচের মতো নেশা করে আজগুবী দৃশ্য দেখেছে আর আজগুবী ঘটনার বর্ণনা করেছে। উড়নত্ম লামা, ইউনিকর্ন এরা সবই তার ড্রাগ-জনিত দৃষ্টিভ্রম। সন্ডার্স ভুলে যাচ্ছে যে আমরাআলমোড়াতে মেজর হর্টনের সঙ্গে দেখা করেছি। উইলার্ড সম্বন্ধে তার রিপোর্ট দেখেছি। তাতে ড্রাগের কোনো ইঙ্গিত
ছিল না।
আমরা যে গুম্ফার সামনে বসেছি তাতে একটি মাত্র লামা বাস করেন। আমরা এই কিছুড়্গণ আগে তার সঙ্গে দেখা করে এক অভিনব অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে এসেছি। এমনিতে হয়তো যেতাম না, কিন’ রাবসাং যখন বলল লামাটি পঞ্চাশ বছর কারম্নর সঙ্গে কথা বলেননি, তখন স্বভাবতই আমাদের একটা কৌতূহল হল। আমরা রাসত্মা থেকে দুশো ফুট উপরে উঠে মৌনী লামাকে দর্শন করার জন্য গুম্ফায় প্রবেশ করলাম।
পাথরের তৈরি প্রাচীন গুম্ফার ভিতরে অন্ধকার দেয়ালে শেওলা। আসল কড়্গের ভিতর পিছন দিকে একটা লম্বা তাকে সাত আটটা মাঝারি আকারের বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তি রয়েছে, তার মধ্যে অনত্মত তিনখানা যে খাঁটি সোনার তৈরি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রদীপ জ্বলছে। এক পাশে একটা পাত্রে একতাল মাখন রাখা রয়েছে, ঘিয়ের বদলে এই মাখনই ব্যবহার হয় প্রদীপের জন্য। একদিকের দেয়ালের গায়ে তাকের ওপর থরে থরে সাজানো রয়েছে লাল কাপড়ে মোড়া প্রাচীন তিব্বতী পুঁথি। অবিনাশবাবু একটা বিশেষ জায়গায় আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘ভৌতিক ব্যাপার বলে মনে হচ্ছে মশাই।’ চেয়ে দেখি সেখানে একটা মড়ার
খুলি রয়েছে। আমি বললাম, ‘ওটা চা খাওয়ার পাত্র।’ অবিনাশবাবুর চোখ কপালে উঠে গেল।
মৌনী লামা ছিলেন পাশের একটা ছোট্ট অন্ধকার ঘরে। ঘরের পুবের দেয়ালে একটা খুপরি জানালা, সেই জানালার পাশে বসে লামা জপযন্ত্র ঘোরাচ্ছেন। মাথা মুড়োন, শীর্ণ চেহারা, বসে থেকে থেকে হাত পাগুলো অস্বাভাবিক রকম সরম্ন হয়ে গেছে। আমরা তাঁকে একে একে অভিবাদন জানালাম, তিনি আমাদের প্রত্যেকের হাতে একটি করে লাল সুতো দিয়ে আশীর্বাদ করলেন। তাঁর সামনে একটা নিচু কাঠের বেঞ্চিতে আমরা পাঁচজন বসলাম। লামা কথা বলবেন না, তাই তাকে এমন প্রশ্ন করতে হবে যার উত্তর কথা না বলে দেওয়া যায়। আমি আর সময় নষ্ট না করে সোজা আসল প্রশ্নে চলে গেলাম।
‘তিব্বতের কোথাও একশৃঙ্গ জানোয়ার আছে কি?’
লামা কয়েক মুহূর্তে হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। আমাদের পাঁচ জোড়া চোখের উৎসুক দৃষ্টি তাঁর দিকে নিবন্ধ। এইবার তিনি ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন, উপর থেকে নিচে। একবার, দুবার, তিনবার। অর্থাৎ- আছে। আমরা চাপা উৎকণ্ঠায় আড়চোখে একবার পরস্পরের দিকে চেয়ে নিলাম। কিন’ লামা যে আবার মাথা নাড়ছেন! এবার পাশাপাশি। অর্থাৎ – নেই।
এটা কি রকম হল? এর মানে কী হতে পারে? আগে ছিল, কিন’ এখন নেই? ক্রোল আমাকে ফিসফিসে গলায় বলল, ‘ কোথায় আছে জিজ্ঞেস করো।’
মার্কোভিচও দেখছি অত্যনত্ম মন দিয়ে আমাদের কথাবার্তা শুনছে। এই প্রথম সে সুস’ অবস’ায় আমাদের অভিযানের উদ্দেশ্যের
কথা শুনল।
ক্রোলের প্রসত্মাব অনুযায়ী প্রশ্নটা করাতে লামা তার শীর্ণ বাঁ হাতটা তুলে উত্তর-পশ্চিম দিকে ইঙ্গিত করলেন। আমরা তো ওই দিকে যাচ্ছি। কৈলাস ছাড়িয়ে চাংথাং অঞ্চলে! আমি এবার আরেকটা প্রশ্ন না করে পারলাম না।
‘আপনি যোগীপুরম্নষ। ভূত ভবিষ্যৎ আপনার জানা। আপনি বলুন তো আমরা এই আশ্চর্য জানোয়ার দেখতে পাব কিনা।’
লামা আবার মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন। উপর থেকে নিচে। তিনবার।
ক্রোল রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। এবার বেশ জোরেই বলল, ‘আস্ক হিম অ্যাবাউট ফ্লাইং লামাজ।’
আমি লামার দিকে ফিরে বললাম, ‘আমি আপনাদের মহাযোগী মিলারেপার আত্মজীবনী পড়েছি। তাতে আছে তিনি মন্ত্রবলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় উড়ে যেতে পারতেন। এখনও এমন কোনো তিব্বতী যোগী আছেন কি যিনি এই আশ্চর্য ড়্গমতার অধিকারী?’
মৌনী লামার চাহনিতে যেন একটা কাঠিন্যের ভাব ফুটে উঠল। তিনি এবার বেশ দৃঢ়ভাবেই মাথাটাকে নাড়লেন। পাশাপাশি অর্থাৎ না, নেই। তারপর তিনি তাঁর ডানহাতের তর্জনীটা খাড়া করে সেই অবস’ায় পুরো হাতটাকে মাথার উপর তুলে কিছুড়্গণ ধরে ঘোরালেন। তারপর হাত নামিয়ে বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতের উচোন তর্জনীটাকে চাপ দিয়ে নামিয়ে দিলেন। মানেটা বুঝতে কোনো অসুবিধা হল না। মিলারেপা একজনই ছিলেন। তিনি মন্ত্রবলে উড়তে পারতেন। তিনি এখন আর নেই।
গুম্ফা থেকে বেরোনোর আগে আমরা কিছু চা আর সাম্পা মৌনী লামার জন্যে রেখে এলাম। এখানকার যাত্রী ও যাযাবরদের মধ্যে যারা মৌনী লামার কথা জানে তারা এই গুম্ফার পাশ দিয়ে গেলেই লামার জন্যে কিছু না কিছু খাবার জিনিস রেখে যায়।
বাইরে এসে সন্ডার্স আর ক্রোলের মধ্যে তর্ক লেগে গেল। সন্ডার্স লামার সংকেতে আমল দিতে রাজি নয়। বলল, ‘একবার হ্যাঁ, একবার না এ আবার কী? আমার মতে হ্যাঁ-য়ে না-য়ে কাটাকাটি হয়ে কিছুই থাকে না। অর্থাৎ আমরা বৃথা সময় নষ্ট করছি।’
ক্রোল কিন’ লামার সংকেতের সম্পূর্ণ অন্য মানে করেছে। সে বলল, ‘আমার কাছে মানেটা খুব স্পষ্ট। হ্যাঁ মানে ইউনিকর্ন আছে, আর না মানে সেটা এমন জায়গায় আছে যেখানে আমাদের যেতে সে বারণ করছে। কিন’ বারণ করলেই তো আর আমরা বারণ মানছি না।
মার্কোভিচ এইবার প্রথম আমাদের কথায় যোগ দিল। সে বলল, ‘ইউনিকর্ন যদি সত্যিই পাওয়া যায়, তাহলে সেটাকে নিয়ে আমরা কী করব সেটা ভেবে দেখা হয়েছে কি?’
লোকটা কী জানতে চাইছে সেটা পরিষ্কার বোঝা গেল না। ক্রোল বলল, ‘সেটা আমরা এখনো ভেবে দেখিনি। আপাতত জানোয়ারটাকে খুঁজে বের করাই হচ্ছে
প্রধান কাজ।’
‘হুঁ’ বলে মার্কোভিচ চুপ মেরে গেল। মনে হল তার মাথায় কী যেন একটা ফন্দি খেলছে। কোকেনমুক্ত হবার পর থেকেই দেখছি তার উদ্যম অনেক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে লামাদের সম্পর্কে তার একটা বিশেষ কৌতূহল লড়্গ করছি, যার জন্য কাল থেকে নিয়ে সাতবার সে দল ছেড়ে পাহাড়ে উঠে গুম্ফা দেখতে গেছে। কোকেনখোর কি শেষটা ধর্মজ্ঞানী হয়ে দেশে ফিরবে?
৩
৯ই আগস্ট, সকাল দশটা
আমরা এইমাত্র চুসুং-লা গিরিবর্ত্ম পেরিয়ে রাবণ হ্রদ ও তার পিছনে কৈলাসের তুষারাবৃত ডিম্বাকৃতি শিখরের সাড়্গাৎ পেলাম। এই রাবণ হ্রদের তিব্বতী নাম রাড়্গস-তাল, আর কৈলাসকে এরা বলে কাং-রিমপোচে। হ্রদটা তেমন পবিত্র কিছু নয়, কিন’ কৈলাস দেখামাত্র আমাদের কুলিরা সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করল। অবিনাশবাবু প্রথমে কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিলেন। শেষটায় খেয়াল হওয়ামাত্র এক সঙ্গে শিবের আট দশটা নাম উচ্চারণ করে হাঁটুগেড়ে বার বার মাটিতে মাথা ঠেকাতে লাগলেন। রাবণ হ্রদের পুব দিকে মানস সরোবর। কালই পৌঁছে যাব বলে মনে হয়।
১০ই আগস্ট, দুপুর আড়াইটা
মানস সরোবরের উত্তর পশ্চিমে একটা জলকু-ের ধারে বসে আমরা বিশ্রাম করছি। আমাদের বাঁ দিকের চড়াইটা পেরিয়ে খানিকটা পথ গেলেই হ্রদের দেখা পাব।
গত এক মাসে এই প্রথম আমরা সকলে স্নান করলাম। প্রচ- গরম জল, তাতে সালফার বা গন্ধক রয়েছে। জলের ওপর ধোঁয়া আর শেওলার আবরণ। আশ্চর্য তাজা বোধ করছি স্নানটা করে।
এখন ডায়রি লিখতাম না, কিন’ একটা ঘটনা ঘটে গেছে যেটা লিখে রাখা দরকার।
আমি আর অবিনাশবাবু কু-ের পশ্চিম দিকটায় নেমেছিলাম, আর সাহেব তিনজন নেমেছিলেন দড়্গিণ দিকে। স্নান সেরে ভিজে কাপড় শুকোনোর অপেড়্গায় বসে আছি, এমন সময় ক্রোল আমার কাছে এসে গল্প করার ভান করে হাসি হাসি মুখে চাপা গলায় বলল, ‘খুব জটিল ব্যাপার’। আমি বললাম, ‘কেন, কী হয়েছে?’
‘মার্কোভিচ।’
‘ লোকটা ভ- জোচ্চোর।’
‘আবার কী করল?’ আমি জানি ক্রোল মার্কোভিচকে মোটেই পছন্দ করে না। বললাম, ‘ব্যাপারটা
খুলে বল।’
ক্রোল সেই রকম হাসি হাসি ভাব করেই বলতে লাগল, ‘একটা পাথরের পিছনে আমাদের গরম জামাগুলো খুলে আমরা জলে নেমেছিলাম। আমি একটা ডুব দিয়েই উঠে পড়ি। মার্কোভিচের কোট আমার কোটের পাশেই রাখা ছিল। ভিতরের পকেটটা দেখতে পাচ্ছিলাম। তাতে কী আছে দেখার
লোভ সামলাতে পারলাম না। তিনটে
চিঠি ছিল। ব্রিটিশ ডাকটিকিট।
প্রত্যেকটিই জন মার্কহ্যাম নামক কোনো ভদ্রলোককে লেখা।’
‘মার্কহ্যাম?’
‘মার্কহ্যাম- মার্কোভিচ। ব্যাপারটা বুঝতে পারছ কি?’
আমি বললাম, ‘ঠিকানা কী ছিল?’
‘দিলস্নীর ঠিকানা।’
জন মার্কহ্যাম… জন মার্কহ্যাম … নামটা চেনা চেনা মনে হচ্ছে। কোথায় শুনেছি আগে? ঠিক কথা, বছর তিনেক আগের খবরের কাগজের একটা খবর। সোনা স্মাগল করার ব্যাপারে লোকটা ধরা পড়েছিল- জন মার্কহ্যাম। জেলও হয়েছিল। কী ভাবে যেন পালায়। একটা পুলিশকে গুলি করে মেরেছিল জন মার্কহ্যাম। লোকটা ইংরেজ। ভারতবর্ষে আছে বহুদিন। নৈনিতালে একটা হোটেল চালাত। পলাতক আসামি। এখন নাম ভাঁড়িয়ে পোল্যান্ডবাসী রাশিয়ান সেজে আমাদের সঙ্গ নিয়েছে। তিব্বত হবে তার গা ঢাকা দেবার জায়গা। কিংবা আরো অন্য কোনো কুকীর্তির মতলবে এসেছে এখানে। ভ-ই বটে। ডেঞ্জারাস লোক। ক্রোলের গোয়েন্দাগিরির প্রশংসা করতে হয়। প্রথমে ওর অন্যমনস্কভাব দেখে ও যে এতটা চতুর তা বুঝতে পারিনি। আমি ক্রোলকে মার্কহ্যামের ঘটনাটা বললাম।
ক্রোলের মুখে এখনো হাসি। সেটার প্রয়োজন এই কারণে যে মার্কোভিচ কু-ের দড়্গিণ দিক থেকে আমাদের দেখতে পাচ্ছে। তার বিষয়ে কথা হচ্ছে সেটা তাকে বুঝতে দেওয়া চলে না। ক্রোল খোশগল্পের মেজাজে একবার সশব্দে হেসে পরড়্গণেই গলা নামিয়ে বলল, ‘আমার ইচ্ছা ওকে ফেলে রেখে যাওয়া। ওর তুষার সমাধি হোক। ওটাই হবে ওর শাসিত্ম।’
প্রসত্মাবটা আমার কাছে ভালো মনে হল না। বললাম, না। ও আমাদের সঙ্গে চলুক। ওকে কোনোরকমেই জানতে দেওয়া হবে না যে ওর আসল পরিচয় আমরা জেনে ফেলেছি। আমাদের লড়্গ হবে দেশে ফিরে গিয়ে ওকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া।’
শেষ পর্যনত্ম ক্রোল আমার প্রসত্মাবে রাজি হল। সন্ডার্সকে সুযোগ বুঝে সব বলতে হবে, আর সবাই মিলে মার্কোভিচের প্রতি কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে।
১০ই আগস্ট, বিকেল সাড়ে পাঁচটা। মানস সরোবরের উপকূলে
মেঘদূতে কালিদাসের বর্ণনায় মানস সরোবরে রাজহাঁস আর পদ্মের কথা আছে। এসে অবধি রাজহাঁসের বদলে ঝাঁকে ঝাঁকে বুনো হাঁস দেখেছি, আর পদ্ম থাকলেও এখনো চোখে পড়েনি। এছাড়া আজ পর্যনত্ম মানস সরোবরের যত বর্ণনা শুনেছি বা পড়েছি, চোখের সামনে দেখে মনে হচ্ছে এ হ্রদ তার চেয়ে সহস্রগুণে বেশি সুন্দর। চারিদিকের বালি আর পাথরের রম্নড়্গতার মধ্যে এই পঁয়তালিস্নশ মাইল ব্যাসযুক্ত জলখ-ের অস্বাভাবিক উজ্জ্বল ও স্বচ্ছ নীল রঙ মনে এমনই একটা ভাবের সঞ্চার করে, যার কোনো বর্ণনা দেওয়া আমার পড়্গে সম্ভব নয়। হ্রদের উত্তরে বাইশ হাজার ফুট উঁচু কৈলাস, আর দড়্গিণে প্রায় যেন জল থেকে খাড়া হয়ে ওঠা গুর্লা-মান্ধাতা। চারিদিকে পাহাড়ের গায়ে ছোট-বড় সব গুম্ফা চোখে পড়ছে, তাদের সোনায় মোড়া ছাতগুলোতে রোদ পড়ে ঝিকমিক করছে।
আমরা ক্যাম্প ফেলেছি জল থেকে বিশ হাত দূরে। এখানে আরো অনেক তীর্থযাত্রী ও লামাদের দেখতে পাচ্ছি। তাদের কেউ কেউ হামাগুড়ি দিয়ে হ্রদ প্রদড়্গিণ করছে, কেউ হাতে প্রেয়ার হুইল বা জপযন্ত্র ঘোরাতে ঘোরাতে পায়ে হেঁটে প্রদড়্গিণ করছে। হিন্দু বৌদ্ধ দুই ধর্মাবলম্বী লোকের কাছেই কৈলাস-মানস সরোবরের অসীম মাহাত্ম্য। ভূগোলের দিক দিয়ে এই জায়গার বিশেষত্ব হল এই যে, এক সঙ্গে চারটে বিখ্যাত নদীর উৎস রয়েছে এরই আশেপাশে। এই নদীগুলো হল ব্রহ্মপুত্র, শতদ্রম্ন, সিন্ধু ও কর্ণালী।
অবিনাশবাবু এখানে এসেই বালির ওপর শুয়ে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম তো করলেনই, তারপর আমাদের সঙ্গী সাহেবদেরও ‘সেক্রেড, সেক্রেড- মোর সেক্রেড দ্যান কাউ’ ইত্যাদি বলে গড় করিয়ে ছাড়লেন। তারপরে যেটা করলেন সেটা অবিশ্যি বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি। হ্রদের ধারে গিয়ে গায়ের ভারী পশমের কোটটা খুলে ফেলে দুহাত জোড় করে এক লাফে ঝপাং করে জলের মধ্যে গিয়ে পড়লেন। পরমুহূর্তেই দেখি তাঁর দাঁত কপাটি লেগে গেছে। ক্রোল ব্যাপারটা বুঝতে পেরে তৎড়্গণাৎ জলে নেমে ভদ্রলোককে টেনে তুলল। তারপর তাঁকে ব্র্যান্ডি খাইয়ে তাঁর শরীর গরম করল। আসলে মানস সরোবরের মতো এমন কনকনে ঠা-া জল ভারতবর্ষের কোনো নদী বা হ্রদে নেই। অবিনাশবাবু
ভুলে গেছেন যে এখানকার উচ্চতা পনের হাজার ফুট।
ভদ্রলোক এখন দিব্যি চাঙ্গা। বলছেন, ওর বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের গাঁটে নাকি ছাব্বিশ বছর ধরে একটা ব্যথা ছিল, সেটা এই এক ঝাঁপানিতেই বেমালুম সেরে গেছে। দুটো হর্লিকসের খালি বোতলে ভদ্রলোক হ্রদের পবিত্র জল নিয়ে নিয়েছেন, সেই জলের ছিটে দিয়ে আমাদের যাবতীয় বিপদ-আপদ দূর করার মতলব করেছেন।
এই অঞ্চলেই গিয়ানিমাতে একটা বড় হাট বসে। আমরা সেখান থেকে কিছু খাবার জিনিস, কিছু শুকনো ফল, ঠা-ায় জমে যাওয়া পাথরের মতো শক্ত চমরীর দুধ আর পশমের তৈরি কিছু কম্বল ও পোশাক কিনে নিয়েছি। ক্রোল দেখি একরাশ মানুষের হাড়গোড় কিনে এনেছে, তার মধ্যে একটা পায়ের হাড় বাঁশির মতো বাজানো যায়। এসব নাকি তার জাদুবিদ্যার গবেষণা কাজে লাগবে। মার্কোভিচ গিয়ানিমার বাজারে কিছুড়্গণের জন্য দলছাড়া হয়ে গিয়েছিল। দশ মিনিট হল সে ফিরেছে। থলিতে করে কী এনেছে বোঝা গেল না। সন্ডার্সের নৈরাশ্য অনেকটা কমেছে। সে বুঝেছে যে এক শৃঙ্গের দেখা না পেলেও, মানস সরোবরের এই পার্থিব সৌন্দর্য আর এই নির্মল আবহাওয়া এও কিছু কম পাওয়া নয়।
কাল আমরা সরোবর ছেড়ে চাং-থাং-এর উদ্দেশে যাত্রা শুরম্ন করব। আমাদের লড়্গ্য হবে ল্যাটিচিউট ৩৩.৩ নর্থ ও লঙ্গিচিউড ৮৪ ইস্ট।
অবিনাশবাবু তাঁর পকেট-গীতা খুলে কৈলাসের দিকে মুখ করে পিঠে রোদ নিয়ে বসে আছেন। এইবার বোঝা যাবে তাঁর ভক্তির দৌড় কতদূর।
১২ই আগস্ট । চাং থাং। ল্যা. ৩০
ন-লং ৮১ ই
সকাল সাড়ে আটটা। আমরা একটা ছোট লেকের ধারে ক্যাম্প ফেলেছি। কাল রাত্রে এক অদ্ভুত ঘটনা। বারোটার সময় মাইনাস পনের ডিগ্রি শীতে ক্রোল আমার ক্যাম্পে এসে আমার ঘুম ভাঙিয়ে বলল, সে মার্কোভিচের জিনিসপ্রত্র ঘেঁটে অনেক কিছু পেয়েছে। আমি তো অবাক। বললাম, ‘তার জিনিস ঘাঁটলে ? সে টের পেল না?’
‘পাবে কী করে?- কাল সন্ধেবেলা যে ওর চায়ের সঙ্গে বারবিটুরেট মিশিয়ে দিয়েছিলাম। হাত-সাফাই কি আর অমনি অমনি শিখেছি? ও এখানো নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে।’
‘কী জিনিস পেলে?’
‘চলো না দেখবে।’
গায়ে একটা মোটা কম্বল চাপিয়ে আমাদের ক্যাম্প ছেড়ে ওদেরটায় গিয়ে ঢুকলাম। ঢুকতেই একটা তীব্র আধ-চেনা গন্ধ নাকে এল। বললাম, ‘এ কিসের গন্ধ?’
ক্রোল বলল, ‘এই তো-এই টিনের মধ্যে কী জানি রয়েছে।’ টিনের কৌটোটা হাতে নিয়ে ঢাকনা খুলতেই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম।
‘এ যে কস’রী!’-ধরা গলায় বললাম আমি।
কস’রীই বটে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। তিব্বতে কস’রীমৃগ বা সঁংশফববৎ পাওয়া যায়। সারা পৃথিবী থেকেই প্রায় লোপ পেতে বসেছে এই জানোয়ার। একটা মাঝারি কুকুরের সাইজের হরিণ, তার পেটের ভিতর পাওয়া যায় কসত্মরী নামক এই আশ্চর্য জিনিস। এটার প্রয়োজন হয় গন্ধদ্রব্য বা পারফিউমতৈরির কাজে। এক তোলা কস’রীর দাম হল প্রায় ত্রিশ টাকা। আসবার পথে ভারতবর্ষ ও তিব্বতের সীমানায় আসকোট শহরে এক ব্যবসাদারের কাছে জেনেছিলাম যে, তিনি একাই সরকারি লাইসেন্সের গত বছরে প্রায় চার লাখ টাকার কস’রী বিদেশে রপ্তানি করেছেন। আমি বললাম, ‘এই কস’রী কি গিয়ানিমার হাটে কিনেছে নাকি মার্কোভিচ?’
‘কিনেছে?’
প্রশ্নটা করল সন্ডার্স; তার কথায় তিক্ত ব্যঙ্গের সুর। ‘এই দেখ না এগুলো কি সব
ওর কেনা?’
সন্ডার্স একটা ঝোলা ফাঁক করে একরাশ কালো চমরীর লোমের ভিতর থেকে পাঁচটা বৌদ্ধ দেবদেবীর মূর্তি বার করল। সেগুলোর সাইজ এক বিঘতের বেশি না, কিন’ প্রত্যেকটি মূর্তি সোনার তৈরি। এছাড়া আরো মূল্যবান জিনিস ঝোলায় ছিল একটা পাথর বসানো সোনার বজ্র, একটা সোনার পাত্র, খান ত্রিশেক আলগা পাথর ইত্যাদি।
‘উই হ্যাভ এ রিয়েল রবার ইন আওয়ার মিডস্ট’, বলল সন্ডার্স। ‘শুধু খামপারাই দস্যু নয়, ইনিও একটি জলজ্যানত্ম দস্যু। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি এ কস’রী সে গিয়ানিমার বাজার থেকে চুরি করে এনেছে, যেমন এই মূর্তিগুলো চুরি করেছে গুম্ফা থেকে।’
এখন বুঝতে পারলাম মার্কোভিচ কেন আমাদের দল ছেড়ে বার বার গুম্ফা দেখতে চলে যায়। লোকটার বেপরোয়া সাহসের কথা ভাবলে অবাক হতে হয়।
আজ মার্কোভিচের ভাব দেখে মনে হল যে কালকের ঘটনা কিছু টের পায়নি। তার জিনিসপত্র যেভাবে ছিল আবার ঠিক সেইভাবেই রেখে আমরা ঘুমোতে চলে যাই। যাবার আগে এটাও দেখেছিলাম যে, মার্কোভিচের সঙ্গে একটি অস্ত্রও আছে- একটা ৪৫ কোল্ট অটোম্যাটিক রিভলবার। এটার কথা মার্কোভিচ আমাদের বলেনি। সে রিভলবার অবিশ্যি তার আর কোনো কাজে লাগবে না, কারণ ক্রোল তার টোটাগুলি সযত্নে সরিয়ে ফেলেছে।
১৫ই আগস্ট। চাং থাং-ল্যা. ৩২.৫ ন, লং ৮২ই। বিকেল সাড়ে চারটা
চাং থাং অঞ্চলের ভয়াবহ চেহারাটা ক্রমে আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে আসছে। এই জায়গার উচ্চতা সাড়ে ষোল হাজার ফুট। আমরা এখন একটা অসমতল জায়গায় এসে পড়েছি। মাঝে মাঝে ৪০০/৫০০ ফুট উঠতে হচ্ছে, তারপর একটা গিরিবর্ত্মের মধ্যে দিয়ে গিয়ে আবার নামতে হচ্ছে।
কাল সকাল থেকে একটি গাছ, একটি তৃণও চোখে পড়েনি। যেদিকে দেখছি খালি বালি পাথর আর বরফ। তিব্বতীরা কিন’ এসব অঞ্চলেও পাথরের গায়ে তাদের মহামন্ত্র ‘ওঁ মণিপদ্মে হুম’ খোদাই করে রেখেছে। গুম্ফার সংখ্যা ক্রমে কমে আসছে, তবে মাঝে মাঝে এক একটা সত্মূপ বা চর্টেন দেখা যায়।
বসতি একেবারেই নেই।
পরশু একটা যাযাবরদের আসত্মানায় গিয়ে পড়েছিলাম। প্রায় শ’পাঁচেক মহিলা পুরম্নষ তাদের কাচ্চা বাচ্চা ছাগল ভেড়া গাধা চমরী নিয়ে অনেকখানি জায়গা জুড়ে পশমের তাঁবু খাটিয়ে বসতি গেড়েছে। লোকগুলো ভারী আমুদে, মুখে হাসি ছাড়া কথা নেই, এই ভ্রাম্যমাণ শিকড়হীন অবস’াতেও দিব্যি আছে বলে মনে হয়। এদের দু-একজনকে একশৃঙ্গ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে কোনো ফল হল না।
আমরা আরো উত্তরের দিকে যাচ্ছি শুনে এরা বেশ জোর দিয়ে বারণ করল। বলল, উত্তরে ডুংলুং-ডো আছে। সেটা পেরিয়ে যাওয়া নাকি মানুষের অসাধ্য। ডুংলং-ডো কী জিজ্ঞেস করাতে যা বর্ণনা দিল তাতে বুঝলাম সেটা অনেকখানি জায়গা জুড়ে একটা দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর। তার পিছনে কী আছে কেউ জানে না। এই প্রাচীর এরা কেউই দেখেনি, কিন’ বহুকাল থেকেই নাকি তিব্বতীরা এর কথা জানে। আদ্যিকালে কোনো কোনো লামা নাকি সেখানে গেছে, কিন’ গত তিনশো বছরের মধ্যে কেউ যায়নি।
মৌনী লামার হেঁয়ালি কথাতেও যখন আমরা নিরম্নদ্যম হইনি, তখন যাযাবরদের বারণ আমরা মানব কেন? চার্লস উইলার্ডের ডায়রি রয়েছে আমাদের কাছে। তার কথার উপর ভরসা রেখেই আমাদের চলতে হবে।
১৮ই আগস্ট । চাং থাং-ল্যা. ৩২ন,
লং ৮২.৮ ই
একটা লেকের ধারে ক্যাম্পের ভিতর বসে ডায়রি লিখছি। আজ এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। একটা প্রায় সমতল উপত্যকা দিয়ে হেঁটে চলেছি, আকাশে ঘন কালো মেঘ, মনে হচ্ছে ঝড় উঠবে, এমন সময় সন্ডার্স চেঁচিয়ে উঠল ‘ওগুলো কী?’
সামনে বেশকিছু দূরে যেখানে জমিটা খানিকটা উপর দিকে উঠছে, তার ঠিক সামনে কালো কালো অনেকগুলো কী যেন দাঁড়িয়ে আছে। জানোয়ারের পাল বলেই তো মনে হচ্ছে। রাবসাংকে জিজ্ঞেস করতে সে সঠিক কিছু বলতে পারল না। ক্রোল অসহিষ্ণুভাবে বলল, ‘তোমার অমনিস্কোপে চোখ লাগাও।’
অমনিস্কোপ দিয়ে দেখে মনে হল সেগুলো জানোয়ার, তবে কী জানোয়ার, কেন ওভাবে দাঁড়িয়ে আছে কিছুই বোঝা গেল না। ‘শিং আছে কি?’ কোল জিজ্ঞেস করল। সে ছেলেমানুষের মতো ব্যসত্ম হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে বলতে হল যে শিং আছে কি নেই তা বোঝা যাচ্ছে না।
কাছে গিয়ে ব্যাপার বুঝে সত্মম্ভিত হয়ে গেলাম। একটা বুনো গাধার পাল, সংখ্যায় প্রায় চলিস্নশটা হবে, সব ক’টা মরে শুকিয়ে কাঠ হয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে আছে। রাবসাং এইবার ব্যাপারটা বুঝেছে। বলল, শীতকালে বরফের ঝড়ে সেগুলো মরেছে। তারপর গরমকালে বরফ গলে গিয়ে মৃতদেহগুলো সেই দাঁড়ানো অবস’াতেই আবার বেরিয়ে পড়েছে।
আমাদের খাবারের স্টক কমে আসছে। যাযাবরদের কাছ থেকে ভারতীয় টাকার বিনিময়ে কিছু চা আর মাখন কিনে নিয়েছিলাম, সেটা এখনো চলবে কিছুদিন। মাংসে আমাদের সকলেরই অরম্নচি ধরে গেছে। শাক সবজি গম ইত্যাদি ফুরিয়ে এসেছে। এর মধ্যে আমার তৈরি ড়্গুধাতৃষ্ণানাশক বটিকা ইন্ডিকা খেতে হয়েছে সকলকেই। আর কিছুদিন পরে ওই বড়ি ছাড়া আর কিছুই খাবার থাকবে না। ক্রোল মেক্সিকো থেকে আরম্ভ করে বোর্নিও পর্যনত্ম এগারটা বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন রকম ম্যাজিক প্রয়োগ করে গুনে বার করতে চেষ্টা করছে আমাদের কপালে একশৃঙ্গ দেখার সৌভাগ্য হবে কিনা। পাঁচটা ম্যাজিক বলছে না, ছ’টা বলছে হ্যাঁ।
আমরা যেখানে ক্যাম্প ফেলেছি তার উত্তরে অর্থাৎ আমরা যেদিকে যাব সেই দিকে প্রায় ৩০/৪০ মাইল দূরে একটা অংশ দেখে মনে হচ্ছে সেখানে জমিটা যেন একটা সিঁড়ির ধাপের মতো উপর দিকে গেছে। অমনিস্কোপ দিয়ে দেখে সেটাকে একটা টেবল মাউন্টেনের মতো মনে হচ্ছে। এটাই কি ডুংলুং ডো? উইলার্ড তার ডায়রিতে যে জায়গার অবস’ানের কথা উলেস্নখ করেছে আমরা তার খুবই কাছে এসে পড়েছি।
কিন’ উইলার্ড যাকে ‘এ ওয়ান্ডারফুল মনাস্ট্রি’ বলেছে সেই থোকচুম-গুম্ফা কোথায়? আর দুশো বছরের উড়নত্ম লামাই বা কোথায়?
আর ইউনিকর্নই বা কোথায়?
0 comments:
Post a Comment