ভেজা ভেজা ভেনিসে- শেগুফতা শারমিন
রেল রাস্তার পাশে ফুটে আছে রক্তাক্ত পপি। গত বছর মে মাসেও ফুটেছিল। এবারও ফুটেছে। গতবার দেখেছিলাম চর্মচক্ষে। এ বছর খবর পাই ক্ষুদে বার্তায়। পলাশ পাঠায় পপির খবর। সেদিন আবহাওয়ার পূর্বাভাসে ছিল দুপুর থেকে বৃষ্টির সংকেত।
তাই বলে সকালটা মোটেও গোমড়া ছিল না। বরং রোদ জ্বলজ্বল হাসিখুশি একটা দিন। ছঁধৎঃড় ফ’ধষঃরহড় নামের ছোট মফস্বলীয় স্টেশন থেকে প্রায় ৪০ মিনিটের যাত্রা ভেনিসের মূল স্টেশন ভেনিস সান্তা লুগিয়ায়। ট্রেনে ওঠার পর প্রথম প্রথম সাধারণ দৃশ্যমালা। ছোট ছোট কটেজ বাড়ি, আঙ্গুর ক্ষেত, রেল লাইনের দুইপাশে পপি আর গোলাপের সারি। ঝকঝকে নীল আকাশ। এরকমই ছিল প্রায় পুরোটা পথ। হঠাৎই দৃশ্য বদল। ১০ বছর আগেও ঢাকা থেকে সাভার যাওয়ার পথে যেমন দেখা যেত পানি, পানি আর পানি। মাঝে মাঝে উঁকি দেয় কিছু কিছু বাড়িঘর। সারা বছরই একটা বন্যার আমেজ। একবারে হুবহু প্রায় সেরকম এলাকা। বিস্তীর্ণ জলাজমি, সমুদ্রের অংশ। একটা কেমন যেন সমুদ্রের ঘ্রাণও যেন পাই। অনেক বড় একটা প্রায় প্রাগৈতিহাসিক ব্রিজ পার হয় আমাদের ট্রেন। পাশ দিয়ে বিলাসবহুল বাস। ব্রিজ পেরোতেই ভেনিসের মূল স্টেশন।
আগের দিন রাতে এসে পৌঁছেছি ভেনিস মেস্ত্রেতে। জুরিখ থেকে মিলান হয়ে মেস্ত্রে। কবেকার কোন কৈশোরের কোনো এক গোলাপি রঙা শ্রাবণী বিকেল থেকে আমার ধ্যানে জ্ঞানে ইতালি। ছোটবেলার বন্ধুরা পর্যন্ত জানে আমার ইতালির প্রতি পক্ষপাতের কথা। তো সেই ইতালিতে আগের দিন সন্ধ্যাযাত্রায় তেমনটা চোখে পড়েনি কিছু। আজ সকালে তাই দু’চোখ মেলে যতটা দেখে নেয়া যায়। রেলগাড়ির ঘষা কাঁচ, স্টেশনে মালদিনি চেহারার ফিটফাট পুলিশ। কিছুই নজর এড়ায় না। চোখ খোঁজে পনিটেলের ব্যাজ্জিও। সুন্দর মানুষ, সুন্দর প্রকৃতির ভুবনে ভেনিস আমাদের প্রথম গন্তব্য। সঙ্গী পলাশ ভাই, সারা বিশ্বের মানুষের পরম আগ্রহের শহর ভেনিস, যার কাছে নিতান্তই অফিস বাড়ি। আমার কাছে শেক্সপিয়ারের ভেনিস, পোর্শিয়া আন্তনিও বা সাইলকের ভেনিস আর দূর সমুদ্রে জাহাজ ভাসিয়ে বাণিজ্যে যাওয়া সওদাগরের শহর ভেনিস। ভেনিস নিয়ে অনেক শুনেছি। অনেক কল্পনা। মানুষ কীভাবে থাকে, কীভাবে হাঁটে, কীভাবে চলে, কোনোমতেই মাথায় ঢুকত না। পানির মধ্যে একটা শহর! সেই শহরের মূল স্টেশনটা থেকে বাইরে আসতেই দেখি লোকে লোকারণ্য। আর কোথায় সাইলক, কোথায় পোর্শিয়া? বেশিরভাগই তো দেখি আমার বাংলাদেশের ভাই বেরাদার। আমাদের পুরনো ঢাকা যেমন ৫২ গলি ৫৩ বাজারের শহর। ভেনিসও প্রায় তা-ই। অলিগলি, দোকান, বাজার, পুরনো আদি অকৃত্রিম ছাঁচে যতেœ রেখে দেয়া গায়ে গা লাগানো বাড়িঘর। আর একটা-দু’টো সারি বাড়ির পরই কাকচক্ষু জলের খাল। সমুদ্র থেকে সরাসরি এসে ভেনিস শহর এফোঁড়-ওফোঁড় করে মিলেছে আবার সমুদ্রে। এরকম কয়েকশ’ খাল বা ক্রিকের ফাঁকে ফাঁকেই গড়ে উঠেছে কিংবদন্তির ভেনিস। সেই ভেনিসের পথঘাট ব্যবসা বাণিজ্য প্রায় পুরোটাতেই বাঙালির প্রাধান্য। রাস্তার ধারে রংবেরঙের ফলের দোকান বা ভাসমান মুখোশের টং, জমজমাট ওয়ান স্টপ পিৎজা শপ থেকে বড় বড় হোটেল রেস্টুরেন্ট, সবখানেই বাঙালির পদচারণ। এক ঝলক ভেনিস দেখায় মনে হয় এখানে দু’রকম মানুষ। একরকম বাঙালি আরেকরকম টুরিস্ট। সারা বিশ্ব থেকে টুরিস্ট আসে ভেনিস দেখতে আর বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অভিবাসী মানুষ ভেনিস দেখায়। আমরাও সেদিন ভেনিস দেখি। সকাল থেকে গা ভাসানো মিষ্টি রোদ, দুপুরের পর ঝিরঝিরে বৃষ্টি। রোদ বৃষ্টিতে মাখামাখি হয়ে পার হয়ে যাই গলির পর গলি তস্য গলি। ছোট্ট ছোট্ট পুল। কেউ কেউ ৪০০ বছরের পুরনো। খালের ধারে গাছের নিচে অনেকটা জায়গা রেখে একটা পিৎজার দোকান। মালিক দুই বাংলাদেশি ভাই। প্রমাণ সাইজ রিয়েল ইতালিয়ান পিৎজায় লাঞ্চ। বিকেলের আগে এসে পৌঁছনো একটা খোলা চত্বরে। পিয়াৎসা সান্তা মার্কো বা সেন্ট মার্কস স্কয়ার। চারিদিকে অনেক পুরনো রয়্যাল ক্যাসেল টাইপ বিল্ডিং। একটু দূরে একটা বনেদি গির্জা। পুরো চত্বরে ছুটি কাটানো মানুষের হই-হট্টগোল। এর থেকে কিছুটা দূরে এগিয়ে গেলেই সমুদ্র, উদার। ঘাটে বাঁধা একেকটা গোন্ডলা একাই দোলে ঢেউয়ের তালে। মাঝ দরিয়ার ভেতর কিছু একলা বসতবাড়ি। কি জানি কে থাকে, কারা থাকে দূরে পানির ভেতর ওইসব ঘরে। আকাশ থেকে পানি পড়ে, পায়ের নিচে পানি, নিঃসঙ্গ ওই বসত দেখে আমার চোখেও পানি।
ভেনিস মেস্ত্রেতে আমাদের তিন দিনের যাপিত জীবনে আমি সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছি মানুষের নিঃসঙ্গতা। মাইলের পর মাইল লোক নাই, জন নাই। হঠাৎ পথের ধারে একলা একটা রেস্টুরেন্ট। মনে হয় কোন সুদূর থেকে হঠাৎ মাথা তুলে বের হয়েছে। উঠোনজুড়ে ঝরাপাতার দল। এক বিকেলে ওখানটায় গিয়ে আরেকবার মোচড় দেয় ভেতরটা। অদ্ভুত গাঢ় সবুজ রঙের ধান আর গমের ক্ষেত প্রায় পুরোটা মেস্ত্রেজুড়েই। বরফ গলার পর থেকে আবার বরফ পড়া পর্যন্ত যেটুকু সময় পাওয়া যায় তার মধ্যে তিনটা ফসল উঠবে। ধানগাছ বা গমগাছ তাই সময় পায় খুব কম। চোখের সামনে ধেই ধেই করে বড় হয়ে ওঠে। এইরকম একটা দিগন্তজোড়া ধানের ক্ষেতের কাছে, কুয়ার্তো ডি আলতিনো নামে ছোট্ট একটা রেল স্টেশনের পাশে হাতে গোনা কয়েকটা ভিলা নিয়ে একটা লোকালয়। প্রায় সবগুলো বাড়িই খালি থাকে বেশি সময়। বেশিরভাগই শহুরে লোকের ছুটি কাটানোর ঠিকানা। এখানেই একটা বাসায় পলাশ ভাই থাকে। একটা ট্যুরিজম এজেন্সিতে কাজ করে। নিজে একটা কম্যুনিটি রেডিও চালায় শখে। সবকিছুতে অসম্ভব নির্বিকার, প্রতিদিনের অকারণ র্যাট রেসের শেষ বিন্দুতে থাকাটাই যার পছন্দ। একটা টুডোরের গাড়ি চালায়। পেছনের সিটে কেউ বসে থাকলে বেশিরভাগ সময়ই তার মনে থাকে না। এরকম একজন মানুষের সঙ্গে আমাদের তিনদিনের ভেনিস যাপন। ভেনিসের সেই অলিগলি, জল পথ থেকে, মেস্ত্রের ক্ষেতখামার আর আমাদের সব সময়ের পছন্দের গন্তব্য স্থানীয় কাঁচা বাজার। কোথাও গেলে স্থানীয় মানুষের হাটবাজার দেখা আমার প্রিয় একটা কাজ। ইউরোপেই বা তা বাদ পড়ে কেন? একদিন সকালে সোজা তাই মেস্ত্রের মাছ বাজার। সমুদ্র থেকে ধরে আনা মাছ বিক্রি করেন ইতালিয়ান জেলেরা। ছোট-বড় নানা প্রজাতির। আর মাছ বাজারের পরেই সবজির বাজার। এখানেও সবচেয়ে বড় দোকানের মালিক বাংলাদেশের মানুষ। লাইন দিয়ে সেই দোকান থেকে সদাই করে পশ্চিমা ক্রেতা। আর তাদের নিজস্ব লোকদের দোকান ক্রেতাশূন্য।
সওদাগরের ভেনিসে যেমন কিছু বাঙালি সফল ব্যবসায়ী, তেমন আবার অসংখ্য বাঙালি আছে কাজ নাই, কিছু নাই। ভেনিসের রাস্তাতেই চোখে পড়ে কতজন ছোটখাটো যেকোনো কাজের আশায় দাঁড়িয়ে। তুলনামূলক ভালো থাকা স্বাচ্ছন্দ্যে থাকা বাঙালিদের আবার আরেক টানাপড়েন। দেশ না বিদেশ। মেয়েরা বড় হচ্ছে, এদেশে আর থাকা যাবে না। ভাবখানা এরকম, বিদেশে থাকলে মেয়েদের যত সর্বনাশ হবে আর দেশে আসলে যেন সবকিছু নিরাপদ। মেস্ত্রেতেই থাকে পলাশ ভাইয়ের বোন আর দুলাভাই। সঙ্গে তাদের ৭ বছরের মেয়ে মালিহা। ছোট্ট প্রজাপতির মতো একটা মেয়ে এত মিষ্টি, এত লক্ষ¥ী। বাসার পাশে ৩ মিনিট হাঁটলে সুন্দর একটা স্কুল। মেয়েটা সারা পথ নাচতে নাচতে স্কুলে যায়। এবাড়ি-ওবাড়ির সামনে ফুটে থাকা ফুল দেখে। একা একা গান গায়। দুয়েকটা পাড়াতো বন্ধুর সঙ্গে বাসার সামনে খেলা করে। ওর সবচেয়ে পছন্দের একটা ভিলা দেখিয়ে বলে, একদিন সেও একটা ওরকম বাড়ি কিনবে। খুবই বন্ধুবৎসল, মিশুক মেয়েটার মধ্যে আমি কোনো ‘আদব কায়দা’র অভাব দেখি না। অথচ ওর স্বপ্নের সঙ্গে ওর মা বাবার স্বপ্নের বিস্তর ফারাক। তারা প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখেন আর কয়েকটা দিন, এরপরই দেশে ফিরে যাব। মেয়ে বড় হচ্ছে ‘আদব কায়দা’ শেখাতে হবে। দেশে না গেলে যেন কোনো উপায় নাই। অতঃপর তারা ফিরে এসেছেন আমরা ভেনিস থেকে ফেরার মাস ছয়েকের মধ্যেই। আমি যতবার মালিহার কথা ভাবি, মনে মনে শিউরে উঠিÑ এতটুকু একটা শিশুকে তার চেনা পরিবেশ, চেনা স্কুল, চেনা বন্ধু, চেনা সিস্টেম থেকে তুলে এনে অন্য একটা দেশে মাঠহীন বাক্সমার্কা স্কুলে বইপত্রের অতিরিক্ত চাপে আটকে দেয়াটা ওদের জন্য কতটা কঠিন! এরকম টানাপড়েনে ভোগেন প্রবাসে থাকা পরিবারগুলোর একটা বড় অংশ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মেয়েশিশুর মা-বাবারাই দিন-রাত এক করে ফেলেন দেশ না বিদেশ, এই দুশ্চিন্তায়। জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা একটা পরিবেশ থেকে শিকড় কাটার মতো আঘাত কতটা গ্রহণযোগ্য এই ভাবনাটা মনে হয় কারও মনেই আসে না। সবসময় একেক প্রজন্ম একেক ধরনের পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যায়। প্রবাসে থাকা পরিবারের সমসাময়িক সময়ের শিশুদের জন্য এখন এটাই এক ধরনের বাস্তবতা।
তিনদিন ভেনিসবাসের পর এক ভোরে ট্রেনে চেপে রোম। তারপর এখানে ওখানে আরও কয়েকটা শহর। কিন্তু সেই জলে ভাসা ভেনিস সান্তালুসিয়া বা ধানক্ষেতে দামাল ছেলের মতো বাতাস নাচানো ভেনিস মেস্ত্রের মতো একাকী জনপদের যে কী জাদু আছে, জানি না। চোখ বুজলেই আমি এখনও সেই পপি ফুল দেখি, খোলা মাঠে বয়ে যাওয়া বাতাসের শোঁ শোঁ আওয়াজ শুনি, পায়ে হাঁটা পথের ধারের ম্যাগনোলিয়ার ঘ্রাণ পাই। কোন গভীর থেকে উঠে আসে সমুদ্রের টান। অনেক ঘন নীল আকাশের নিচে এরকম ভেজা ভেজা বাতাসের নিঃসঙ্গ লোকালয় আমি এখন পর্যন্ত আর কোথাও দেখিনি।-ংযবমঁভঃধ@ুধযড়ড়.পড়স
0 comments:
Post a Comment