Tuesday, September 26, 2017

খোশগল্প --সৈয়দ মুজতবা আলী



যখন-তখন লোকে বলে, “গল্প বলো।”
এ বাবদে স্বৰ্গত ক্ষিতিমোহন সেনের একাধিক রসাল। উত্তর আছে। তিনি বাঙাল উচ্চারণে তখন বলতেন, ঘর লেপ্যা মুছা, আতুড় ঘর বানাইয়া, মা ষষ্ঠীর গেছে বাচ্যা বাচালেই তো আর বাচ্যা পয়দা হয় না। নয় মাস দশ দিন সময় লাগে।” অর্থাৎ গল্পের সময় এলে তবে গল্প বেরবে।’
ইহুদিদের গল্প এর চেয়ে একটু ভালো। কেন, সে-কথা পরে বলছি।
এক ভালো কথক রাববী (ইহুদিদের পণ্ডিত পুরুৎ) অনেকখানি হাঁটার পর অতিথি হয়ে উঠেছেন এক পরিচিত চাষার বাড়িতে। চাষা-বৌ জানত, রাব্বী গল্প করতে ভারি ওস্তাদ। পাদ্য-অর্ঘ্য না দিয়েই আরম্ভ করেছে, “গল্প বলুন, গল্প বলুন।’ ইতিমধ্যে চাষা ভিনগায়ের মেলা থেকে ফিরেছে একটা ছাগী কিনে। চাষা-বৌ সঙ্গে সঙ্গেই গল্পের বায়না বন্ধ করে দুইতে গেছে ছাগীকে ইহুদি তো! একফোটা দুধ বেরল না। দেখে চাষা-বীে বেজার-মুখে স্বামীকে শুধােল, “এ কী ছাগী আনলে গো?” বিচক্ষণ চাষা হেসে বললে, “ওটা হেঁটে হেঁটে হয়রান হয়ে গিয়েছে। দানাপানি দাও-দুধ ঠিকই দেবে।” রাববী সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, “সেই কথাই তো হচ্ছে। দানাপানি না পেলে আমিই-বা গল্প বলি কী করে?”
ক্ষিতিমোহনবাবু ইহুদি ছিলেন না বলে, নিজের সুবিধেটা উত্তরের মারফতে গুছিয়ে নিতে পারেননি-ইহুদি পারে।
এ গল্পটা মনে রাখবেন। কাজে লাগবে। অন্তত চা-টা পাপড়ভাজটা আসবে নিশ্চয়ই।
সঙ্গে সঙ্গে ইহুদি, স্কটম্যান সাইকল চালাতে আরম্ভ করে দেবেন। সে আবার কী?
এসোসিয়েশন অফ আইডিয়াজ, অর্থাৎ এক চিন্তার খেই ধরে অন্য চিন্তা, সেটা থেকে আবার অন্য চিন্তা, সেইরকম করে করে মোকামে পৌছে যাবেন। এখনো বুঝতে পারলেন না? তবে একটা গল্প দিয়েই বোঝাই ।

সেই যে বাঁদর ছেলে কিছুতেই শটকে শিখবে না, এ ছেলে তেমনি পেটুক— যা-কিছু শিখতে দেওয়া হয়, পেঁৗছে যাবেই যাবে মিষ্টি-সন্দেশে। তাকে একং দশং শিখতে দেওয়া হয়েছে। বলছে,
“একং, দশং, শতাং, সহস্ৰ, অযুত, লক্ষ্মী, সরস্বতী—”
(মন্তব্য : “লক্ষ' না বলে বলে ফেলেছে লক্ষ্মী' এবং তিনি যখন দেবী তখন তাঁর এসোসিয়েশন অব আইডিয়াজ থেকে চলে গেছে আরেক দেবী সরস্বতীতে; তার পর বলছে)

“লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কাৰ্তিক, অগ্রহায়ণ—” (মন্তব্য : ‘কার্তিক’ মাসও বটে, তাই এসোসিয়েশন অব আইডিয়াজে চলে গেল অগ্রহায়ণ পৌষে) অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাগ, ছেলে-পিলে—”
(মন্তব্য : 'মাঘ'কে আমরা মাগই উচ্চারণ করে থাকি। তার থেকে “ছেলে-পিলে।”)
“পিলে, জ্বর, শব্দী, কাশী-”
(মন্তব্য ; তার থেকে যাবতীয় তীৰ্থ!-)
"কাশী, মথুরা, বৃন্দাবন, গয়া, পুরী--"
'পুরী , সন্দেশ , রসগোল্লা , মিহিদানা, বোঁদে , খাজা, লোডেকিনি-'
ব্যাস! পুরী তো খাদ্য,এবং ভালো খাদ্য। অতএব তার এসোসিয়েশনে বাদবাকি উত্তম উত্তম আহারাদি! পৌছে গেল মোকামে!
এই এসোসিয়েশন অব আইডিয়াজ থেকে গল্পের খেই ধরে নেওয়া যায় । ইহুদির কথা যখন উঠেছে তখন ইহুদির কঞ্জসী, স্কটম্যানের কঞ্জসী তাবৎ কঞ্জসীর গল্প আরম্ভ করে দিতে পারেন।
এগুলোকে আবার সাইক্লও বলা হয়। এটা হল কঞ্জসীর সাইক্ল'-অৰ্থাৎ দুনিয়ার যতরকম হাড়কিপটেমির গল্প এই সাইক্লে ঢুকে যাবে। ঠিক সেইরকম আরো গণ্ডায় গণ্ডায় সাইক্ল আছে। স্ত্রী কর্তৃক স্বামীর উপর অত্যাচার, স্ত্রীকে লুকিয়ে পরস্ত্রীর সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি, ট্রেন লেটের সাইক্ল, ডেলি পেসেঞ্জারের সাইক্ল, চালাকির সাইক্ল-
চালাকির সাইক্ল এদেশে গোপালভাড় সাইক্লই বলা হয়। অর্থাৎ চালাকির যে-কোনো গল্প আপনি গোপালের নামে চালিয়ে যেতে পারেন, কেউ কিছু বলবে না। ইংরেজীতে এটাকে ‘ব্ল্যাঙ্কেট” “অমনিবাস’ গল্পগুষ্টিও বলা চলে।
গোপালের অপজিট নাম্বার অর্থাৎ তারই মতো চালাক ছোকরা প্ৰায় সব দেশেই অধিকাংশ গল্পই সমাজে কন্ধে পায় না, ভিয়েনার ভাষায় গেজেলশাফটফেইষ নয় (সমাজে আচল)। সেদিক দিয়েও গোপালের সঙ্গে তাঁর গলাগলি । কিন্তু এ সংসারে বুদ্ধিমানের চেয়ে আহাম্মুখের সংখ্যাই বেশি, তাই আহাম্মুখীর " সাইক্লই পাবেন, দুনিয়ার সর্বত্র। অধুনা কেন্দ্রের এক প্রাক্তন মন্ত্রীকে কেন্দ্র করে একটি বিরাট সাইক্ল তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে। এঁর জুড়ি ভিয়েনাতে গ্রাফ ফন বাবে, পশ্চিম ভারতে শেখ চিল্লি (আমার ঠিক মনে নেই, তবে বোধ করি শ্ৰীযুক্তা সীতা শান্তার হিন্দুস্থানী উপকথাতে এঁর গল্প আছে), এবং সুইটজারল্যান্ডে পলাডি। পলডির গল্প অফুরন্ত। আমি গত দশ বছরে ধরে একখানা সুইস পত্রিকার গ্রাহক। প্রতি সপ্তাহে পলাডি নিয়ে একটি ব্যঙ্গচিত্র থাকে। চলেছে তো চলেছে। এখনো তার শেষ নেই। কখনো যে হবে মনে হয় না। কিছুমাত্র না ভেবে গোটা কয়েক বলি :-
বন্ধু ; জানো পলুডি অকসিজেন ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। ১৭৭০-এ ওটা আবিষ্কৃত হয় !
পলডি : (আমেরিকান টুরিস্টকে এক কাসূল দেখিয়ে) ঐ ওখানে আমার জন্ম হয়। আপনার জন্ম হয় কোন খানে?
টুরিস্ট : হাসপাতালে।
পলডি : সৰ্বনাশ!! কী হয়েছিল আপনার?
কিংবা
বাড়িউলী : সে কি মি. পলডি? দশ টাকার মনিঅৰ্ডার, আর আপনি দিলেন পাঁচ টাকা বিকশিশ!
পলডি : হেঁ, হেঁ, ঐ তো বোঝে না। আর কিণ্টেমি করো। ঘন ঘন আসবে যে!
কিংবা
পলডি ঘোড়ার রেসে গিয়ে শুধোচ্ছেন : ঘোড়াগুলো এরকম পাগল-পারা ছুটছে কেন?
বন্ধু : কী আশ্চর্য, পলডি তাও জানো না! যেটা ফাস্ট হবে সেটা প্রাইজ পাবে যে।
পলডি : তা হলে অন্যগুলো ছুটছে কেন?
এর থেকে আপনি রেসের গল্পের মাধ্যমে কুট্টি সাইক্লে অনায়াসে চলে যেতে পারেন। যেমন,
কুট্টি রেসে গিয়ে বেটু করেছে এক অতি নিকৃষ্ট ঘোড়া। এসেছে সর্বশেষে। তার এক বন্ধু—আরেক কুট্টি—ঠাট্টা করে বললে, “কী ঘোড়া (উচ্চারণ অবশ্য 'গোরা”— আমি বোঝার সুবিধের জন্য সেগুলো বাদ দিয়েই লিখছি) লাগাইলায় মিয়া! আইলো সকলের পিছনে?”
কুট্টি দমবার পাত্র নয়। বললে, “কন কী কত্তা! দ্যাখলেন না, যেন বাঘের বাচ্চা— বেবাকগুলির খ্যাদাইয়া লইয়া গেল!”
কুট্টি সম্প্রদায়ের সঙ্গে পুব-পশ্চিম উভয় বাঙলার রসিকমণ্ডলীই একদা সুপরিচিত ছিলেন। নবীনদের জানাই, এরা ঢাকা শহরের খানদানী গাড়োয়ান-গোষ্ঠী। মোগল সৈন্যবাহিনীর শেষ ঘোড়সওয়ার বা ক্যাভালরি। রিকশার অভিসম্পাতে এরা অধুনা লুপ্তপ্রায়। বহুদেশ ভ্ৰমণ করার পর আমি নিৰ্ভয়ে বলতে পারি, অশিক্ষিত জনের ভিতর এদের মতো wity (হাজির-জবাব এবং সুরসিক বাকচতুর) নাগরিক আমি হিল্লী-দিল্লী কলোন-বুলোন কোথাও দেখিনি।
এই নিন। একটি ছোট ঘটনা। প্রথম পশ্চিমবাঙলার ‘সংস্করণটি দিচ্ছি। এক পয়সার তেল কিনে ঘরে এনে বুড়ী দেখে তাতে একটা মরা মাছি। দোকানিকে গিয়ে অনুযোগে জানাতে সে বললে, “এক পয়সার তেলে কি তুমি মরা হাতি আশা করেছিলে!” এর রাশান সংস্করণটি আরো একটু কাঁচা। এক কপেকের (প্রায় এক পয়সা) রুটি কিনে এনে ছিড়ে দেখে এক বুড়ি তাতে একটুকরো ন্যাকড়া।
দোকানিকে অনুযোগ করাতে সে বললে, “এক কপেকের রুটির ভিতর কি তুমি আস্ত একখানা হীরের টুকরো আশা করেছিলে?’এর ইংরেজি সংস্করণ” আছে, এক ইংরেজ রমণী এক শিলিঙে একজোড়া মোজা কিনে এনে বাড়িতে দেখেন তাতে একটি ল্যাডার (অর্থাৎ মই—মোজার একটি টানা সুতো ছিড়ে গেলে পড়েনের সুতো একটার পর একটা যেন মইয়ের এক একটা ধাপ-কাঠির মতো দেখায় বলে ওর নাম ল্যাডার।) দোকানিকে অনুযোগ জানাতে সে বললে, “এক শিলিঙের মোজাতে কি আপনি, ম্যাডাম, একখানা রাজকীয় মার্বেল স্টেয়ারকেস আশা করেছিলেন!” এবারে সর্বশেষ শুনুন কুট্টি সংস্করণ। সে একখানা ঝুরঝুরে বাড়ি ভাড়া দিয়েছে পুলিসের এসাইকে। বর্ষাকালে কুট্টিকে ডেকে নিয়ে তিনি দেখাচ্ছেন, এখানে জল ঝরছে, ওখানে জল পড়ছে—জল জল সর্বত্র জল পড়ছে। পুলিসের লোক বলে কুট্টি সাহস করে কোনাে মন্তব্য বা টিল্পনী কাটতে পারছে না, যদিও প্রতি মুহুর্তেই মাথায় । খেলছে। বিস্তর। শেষটায় না থাকতে পেরে বেরবার সময় বললে, "ভাড়া তো দ্যান কুল্লে পাঁচটি টাকা। পানি পড়বে না তো কি শরবৎ পড়বে?” কুট্টি সম্বন্ধে আমি দীর্ঘতর আলোচনা অন্যত্র করেছি—পাঠক সেটি পড়ে দেখতে পারেন। আমার শোক-পরিতাপের অন্ত নেই যে, এ সম্প্রদায় প্রায় নিশ্চিহ্ন হতে চলল। আমি জানি এদের উইট, এদের রিপোর্ট লেখাতে ও ছাপাতে সঠিক প্রকাশ করা যায় না; কিন্তু তৎসত্ত্বেও এ-সম্প্রদায় সম্পূর্ণ লোপ পাওয়ার পূর্বে পুব-বাঙলার কোনো দরদীজন যদি এদের গল্পগুলির একটি সংগ্ৰহ প্ৰকাশ করেন, তবে তিনি উভয় বাঙলার রসিকমণ্ডলীর ধন্যবাদাহঁ হবেন।

পাঠক ভাববেন না, আমি মিষ্ট মিষ্ট গল্প বলার জন্য এ-প্রবন্ধের অবতারণা করেছি। আদপেই না। তাহলে আমি অনেক উত্তম উত্তম গল্প পেশ করতুম। এখানে গল্পের সাইকল ও এসোসিয়েশন অব আইডিয়াজ, কিংবা বলতে পারেন এসোসিয়েশন অব মিশিয়ে কয়েকটি গল্প নিবেদন করেছি মাত্র। (এবং সত্য বলতে কী, আসলে কোনো গল্পই কাঁচা কিংবা পাকা, নিরেস কিংবা সরেস নয়। মোকা-মাফিক জুৎসই করে যদি তাগ-মাফিক গল্প বলতে পারেন, তবে অত্যন্ত কাঁচা গল্পও শ্রোতৃমণ্ডলীর চিত্তহরণ করতে সমর্থ হবে, পক্ষান্তরে তথাকথিত শ্ৰেষ্ঠ গল্পও যদি হঠাৎ বেমক্কা বলে বসেন, তবে রসিকমণ্ডলী বিরক্ত হয়ে ভুরু কুচকাবেন।) গল্প বলার আর্ট, গল্প লেখার আর্টেরই মতো বিধিদত্ত প্ৰতিভা ও সাধনা সহযোগে শিখতে হয়—এবং দুই আর্টই ভিন্ন। অতি সামান্য, সাধারণ গল্পও পূজনীয় স্বৰ্গত ক্ষিতিমোহন অতি সুন্দর রূপ দিয়ে প্রকাশ করতে পারতেন—অথচ তাঁর লেখা রচনায় সে জিনিসের কোনো আভাসই পাবেন না; পক্ষান্তরে শ্রদ্ধেয় স্বৰ্গত রাজশেখরবাবু লিখে গিয়েছেন বিশ্বসাহিত্যের কয়েকটি শ্রেষ্ঠ হাসির গল্প, অথচ তিনি বৈঠক-মজলিসে ছিলেন

রাশভারী প্রকৃতির। গল্পবলার সময় কেউ কেউ অভিনয় যোগ করে থাকেন। সুলেখক অবধূত এ বাবদে একটি পয়লা নম্বরী ওস্তাদ। যদি কখনাে তাঁর সঙ্গে আপনার দেখা হয় তবে চন্দননগর চুচড়ো অঞ্চলের বিশেষ সম্প্রদায়ের লোক কীভাবে নিমন্ত্রণ রক্ষা করেন তার বর্ণনা দিতে বলবেন। কিন্তু এ প্রবন্ধের গোড়াতে যে সাবধানবাণী দিয়ে আরম্ভ করেছি, সেটি ভুলবেন না। বেমক্কা যখন-তখন অনুরোধ করেছেন, কি মরেছেন। অবধূত তেড়ে আসবে। অবধূত কেন, রসিকজন মাত্ৰই তেড়ে আসে। এই তো সেদিন অবধূত বলছিল, জানেন, মাস কয়েক পূর্বে ১১০ ডিগ্রির গরমে যখন ঘন্টাতিনেক আইঢাই করার পর সবে চোখে অল্প একটু তন্দ্ৰা লেগে আসছে এমন সময় পাড়া সচকিত করে টেলিগ্রাফ পিয়ন ঢঙের সজোরে কড়া নাড়া। দরজা খুলতে দেখি দুই অচেনা ভদ্রলোক। কড়া-রদূরে, রাস্তার ধুলোমুলোয় জড়িয়ে চেহারা পর্যন্ত ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। কী ব্যাপার? ‘আর্জেন্তু, আদালতে শুনতে পেলুম, আমাদের মোকদ্দমা উঠতে এখনও ঘণ্টাদুয়েক বাকি, তাই আপনার সঙ্গে দুদণ্ড রসালাপ করতে এলুম।” আমি অবধূতকে শুধােলুম, “আপনি কী করলেন?” অবধূত উদাস নয়নে ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে। আমি বেশি ঘাটালুম না। কারণ মনে পড়ে গেল, মোটামুটি ঐ সময়ে চুচড়োর জোড়াঘাটের কাছে, সদর রাস্তার উপর দুটাে লাশ পাওয়া যায়। খুনি ফেরার। এখনো ব্যাপারটা হিল্যে হয় নি। ভালো করে গল্প বলতে হলে আরো মেলা জিনিস শিখতে হয়—এবং সেগুলো শেখানো যায় না। আমি স্বয়ং তো আদৌ কোনো প্রকারের গল্প বলতে পারি নে। প্লট ভুলে যাই, কী দিয়ে আরম্ভ করেছিলুম কী দিয়ে শেষ করব তার খেই হারিয়ে ফেলি, গল্প আরম্ভ করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেই খিলখিল করে হাসতে আরম্ভ করি, “ঐযযা, কী বলছিলুম' প্রতি দু’সেকেন্ড অন্তর অন্তর আসে, ইতিমধ্যে কেউ হাই তুললে তাকে তেড়ে যাই, শেষটায় সভাস্থ কেউ দয়াপরবশ হয়ে গল্পটা শেষ করে দেন—কারণ যে-গল্পটি অন্তত পঞ্চাশবার শুনে, জোড়াতাড়া দিয়ে খাড়া করতে পেরেছে। তদুপরি আমার জিভে ক্রনিক বাত, আমি তোৎলা এবং সামনের দুপাটিতে আটটি দাঁত নেই। তাহলে শুধোবেন, তবে তুমি এ প্রবন্ধ লিখছ কেন? উত্তর অতি সরল। ফেল করা স্টুডেন্ট ভালো প্রাইভেট টু্যটরি হয়। আমি গল্পবলার আর্টটা শেখার বিস্তর কস্ত করে ফেল মেরেছি বলে এখন এর টু্যটরি লাইনে আমিই সম্রাট।

কিন্তু এ আর্ট এখন মৃতপ্রায়; কারণটা বুঝিয়ে বলি। পূর্বেই নিবেদন করেছি, গল্পের কাঁচা পাকা কিছুই নেই, মোকা-মাফিক বলতে
পারা, এবং বলার ধরনের উপর ঐ জিনিস সম্পূর্ণ নির্ভর করে। এ তত্ত্বটি সবচেয়ে ভালো করে জানেন, বিশ্ব-গল্পকথক সম্প্রদায় (ওয়ার্ল্ড
স্টরি-টেলােরস্ ফেডারেশন)। মার্কিন মুলুকে প্রতি বৎসর এঁদের অধিবেশন হয় এবং

পৃথিবীর সর্বকোণ থেকে ডাঙর ডােঙর সদস্যরা সেখানে জমায়েত হন। এঁরা বিলক্ষণ জানেন, গল্প মোকা-মাফিক এবং কায়দা-মাফিক বলতে হয়। চীনের ম্যান্ডারিন সদস্য যে-গল্পটি বলতে যাছেন সেটি হয়তো সবচেয়ে ভালো বলতে পারেন বঙ্গো-ইন-কঙ্গোর লুসাবুবু। ওদিকে পৃথিবীর তাবৎসরেস গল্পই এঁরা জানেন। কী হবে, চীনার কঁচাভাষায় পাকা দাড়িওয়ালা ঐ গল্প তিনশ তেষট্টি বারের মতো শুনে। অতএব ঐরা একজোটে বসে পৃথিবীর সবকটি সুন্দর সুন্দর গল্প জড়ো করে তাতে নম্বর বসিয়ে দিয়েছেন। যেমন মনে করুন, কুট্টির সেই পানিপড়ার বদলে শরবৎ পড়ার গল্পটার নম্বর ১৯৮।
এখন সে অধিবেশনে গল্প বলার পরিস্থিতিটা কী রূপ?
যেমন মনে করুন, কথার কথা বলছি, সদস্যরা অধিবেশনের গুরু গুরু কর্মভার সমাধান করে ব্যানকুয়েট খেতে বসেছেন। ‘ব্যানকুয়েট’ বললুম। বটে, আসলে অতি সস্তা লাঞ্চ—“লাঞ্ছনা’ও বলতে পারেন, একদম দাঠাকুরের পাইস হােটেল মেলের। এক মেম্বর ডালে পেলেন মরা মাছি। অমনি তাঁর মনে পড়ে গেল, সেই বুড়ির এক পয়সার তোলে মরা মাছি, কিংবা ‘পানি না পড়ে শরবৎ পড়বে নাকি' গল্প। তিনি তখন গল্পটি না বলে শুধু গষ্টীর কণ্ঠে বললেন নম্বর ১৯৮’!
সঙ্গে সঙ্গেই হাে হাে অট্টহাস্য। একজন হাসতে হাসতে কাৎ হয়ে পাশের জনের পাঁজরে খোচা দিয়ে বার বার বলছেন, “শুনলে? শুনলে? কী রকম একখানা খাসগল্প ছাড়ালে!’ আরেকজনের পেটে খিল ধরে গিয়েছে—তাকে মাসাজ করতে শুরু করেছেন আরেক সদস্য ।

অতএব নিবেদন, এসব গল্প শিখে আর লাভ কী? এদেশেও কালে বিশ্বগল্পকথক-সম্প্রদায়ের ব্রাঞ্চ-আপিস বসবে, সব গল্পের কপালে কপালে নম্বর পড়বে, আপনি আমি কোনাে-কিছু বলার পূর্বেই কেউ-না-কেউ নম্বর হেঁকে যাবে। তারপর নীলাম ।। ৯৮ নম্বর বলতে-না-বলতেই এসোসিয়েশন অব আইডিয়াজ কারো মনে পড়ে যাবে অন্য গল্প তিনি হাঁকবেন ২৭২।। তারপর ৩১৮—আর সঙ্গে সঙ্গে হাসির হররা, রগড়ের গড়িয়াহাট-আপনি আমি তখন কোথায়?
হ্যা, অবশ্য, যতদিন-নাব্ৰাঞ্চ-আপিস কায়েম হয় ততদিন অবশ্য এইসব টুটা-ফুটা গল্প দিয়ে ত্রি-লেগেড রেস রান করতে পারেন। কিংবা দুষ্ট ছেলেকে শাসন করার জন্য গুরুমশাই যেরকম বলতেন, যতক্ষণ বেত না আসে ততক্ষণ কানমলা চলুক।”
বাই দি উয়ে-এ গল্পটাও কাজে লাগে। নেমন্তন বাড়িতে চপ-কাটলেট না-আসা পর্যন্ত লুচি-ছােলার ডাল খেতে খেতে বলতে পারেন, যতক্ষণ বেত না আসে ততক্ষণ কানমলা চলুক।”

0 comments:

Post a Comment