এই পথ চলাতেই আনন্দ - ফখরুল আবেদীন
‘ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক কী?’ ফেসবুকে এই স্ট্যাটাস দিয়ে রীতিমতো বিপদে পড়ে গেছি। ৭৯টা লাইক আর ৩৬টা ‘গেট ওয়েল সুন’ বলে বন্ধুদের মন্তব্য। অফিসের সহকর্মীরা চাঁদা তুলে আপেল, কমলা আর এক বোতল মেয়াদোত্তীর্ণ বিদেশি ফলের রস নিয়ে উপস্থিত হলো আমাকে দেখতে। আমাকে হাঁটতে-চলতে দেখে তারা একজন আরেকজনের মুখ চাওয়া-চাওয়ী করতে লাগল। আসলে বান্দরবান যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ওখানকার মশার কামড়ে নাকি ম্যালেরিয়া হয়। তাই ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক খুঁজছিলাম। আর বন্ধুরা ভেবেছে আমার বুঝি ম্যালেরিয়াই হয়েছে। কী আর করা, ম্যালেরিয়া না হওয়ার ওষুধ খেয়ে নিয়ে বউ-বাচ্চা আর খালা-খালুর বিশাল লটবহর নিয়ে ডিসেম্বরের এক কাকডাকা ভোরে রওনা দিলাম বান্দরবানের দিকে।
হাজির হলাম মিলনছড়ির রিসোর্টে। ছিমছাম পরিপাটি রিসোর্টটায় পা দিয়েই মন ভালো হয়ে গেল। রেস্তোরাঁর বিশাল ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলাম দিগন্তের দিকে। দৃষ্টিসীমা আটকে যায় হাজারো ঢেউ খেলানো পাহাড়ের চূড়ায়। পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে যেই না ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দিতে যাব, অমনি পেছন থেকে বড় খালার গলা ভেসে এল। বাথরুমে গরম পানি আসছে না। এই নিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে ঝামেলা বাধিয়ে ফেললেন। চায়ের কাপ ফেলে রেখেই ছুটলাম ঝগড়া মেটাতে। এরপর বেরিয়ে পড়লাম বান্দরবান শহর ঘুরতে।
ছোট্ট ছিমছাম শহর। হেঁটে বেড়াতেই ভালো লাগে, নানা রঙের মানুষ। এর মধ্যে রাস্তার পাশে আধুনিক দোকানপাটে এক তরুণী বিক্রেতার সঙ্গে দর-কষাকষি চালিয়ে যাচ্ছেন আমার খালা। আর আমিও এই সুযোগে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম শহর চষে বেড়াতে। পরদিন ঘোরাঘুরি করার জন্য গাড়িও তো ঠিক করতে হবে।
ঘুম ভাঙল খুব ভোরে, হাজারো পাখির কিচিরমিচিরে কান পাতা দায়। যেন এক পাখির দেশে চলে এসেছি। ভোর হচ্ছে বান্দরবানে। সারা রাতের তীব্র শীতে জমে যাওয়া মেঘগুলো পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে আশ্রয় নিয়েছে। সূর্যের উষ্ণতা পেয়ে উড়ে যাচ্ছে আকাশ ছুঁতে। এ এক অপার্থিক দৃশ্য। ঘুম থেকে উঠে মেয়েটা যে কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, টেরও পাইনি।
বাবা, আমরা কি আকাশের কাছে চলে এসেছি?
কেন রে মা?
ওই যে দেখো, মেঘগুলো আমাদের নিচে।
তাই তো! ঠিক বলেছ, আমরা আকাশের কাছে।
এরই মধ্যে খোলা জিপ চলে এল আমাদের নিতে। যাকে বলে চান্দের গাড়ি। গাড়ি দেখেই খালার চোখমুখ কুঁচকে গেল। এ কেমন গাড়ি রে বাবা! আমি তো ভেবেছিলাম এসি গাড়ি হবে। এ গাড়িতে যাব না। শেষে বহু কষ্টে খালাকে রাজি করিয়ে বসিয়ে দিলাম চালকের পাশের আসনে আর আমরা পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখেমুখে বাতাসের ঝাপটা মেখে নিচে ছুট লাগালাম বান্দরবান।
প্রথমেই গাড়ি গিয়ে দাঁড়াল মেঘলা পর্যটনের গেটে। ছিমছাম সাজানো-গোছানো এক পর্যটনকেন্দ্র, যার মূল আকর্ষণ এর কৃত্রিম হ্রদ আর হ্রদের ওপর দিয়ে বানানো ঝুলন্ত সেতু। ঢাকা শহরের অত্যাধুনিক সব রাইডে চড়া শিশু-কিশোররাও এখানকার সাদামাটা পার্কটিতে ঘুরে বেশ ভালোই আনন্দ পাবে। হ্রদ, ঝুলন্ত সেতু, পাহাড়ি পথ বেয়ে হেঁটে চলে বেশ অনায়াসে কেটে গেল বান্দরবানের মিষ্টি সকালটা।
পরের গন্তব্য শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের নীলাচল স্পট। টাইগার পাড়ার এই স্থানটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দুই হাজার ফুট ওপরে। আর তাই এখান থেকে পুরো শহরটাকে দেখা যায়। ভালো লাগে। আরও ভালো লাগল বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের পবিত্র গোল্ডেন টেম্পল। অসাধারণ এর নির্মাণশৈলী। কেমন যেন শান্তি লাগে এখানে। চিম্বুক, নীলগিরি যাওয়ার পথেই আমাদের রিসোর্ট পড়ে। চটপট স্থানীয় মেনুু দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়েই ছুটলাম সেদিকে। পথে খানিকটা যাত্রাবিরতি শৈলপ্রপাতে। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ আর ঠান্ডা জল নেমে আসছে শৈলপ্রপাতের গা বেয়ে। স্থানীয় বোম নারীরা সেই পানিতেই সেরে নিচ্ছে গেরস্থালির কাজকর্ম।
গাড়ির পেছনের অংশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিম্বুক যাচ্ছি আমরা। শোঁ শোঁ বাতাসে চোখ খোলা দায়। আঁকাবাঁকা পথে রোলার কোস্টারের মতো চলল আমাদের গাড়ি। একেকটা বাঁক পেরোয় আর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করি সবাই। এই পথ চলাতেই আনন্দ। এলোমেলো চুল আর মুখভর্তি হাসি নিয়ে হাজির হলাম চিম্বুকে। চারপাশের পাহাড়গুলো যেন আরও কাছে। দূরে বয়ে চলা সাংগু নদী ফিতার মতো বয়ে চলেছে। শহুরে মানুষগুলো মুঠোফোনের সিগন্যাল পাওয়ার জন্য এদিক-সেদিক ঘুরছে। হায়রে।
আর আমরা আরও একবার হইচই করতে করতে পৌঁছে গেলাম নীলগিরিতে। আহ, কেমন শান্তি শান্তি ভাব পুরো এলাকাজুড়ে। এখানকার রিসোর্টে একবার না থাকলে এর সৌন্দর্য পুরো উপভোগ করা যাবে না। এটা বোধ করি বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর পর্যটনকেন্দ্রগুলোর একটি। চারপাশটা হেঁটে বেড়াতে মুগ্ধ হই বান্দরবানের সৌন্দর্যে। কী নেই এখানে? নানা রঙের মানুষ, নানান ভাষার মানুষ, সাংগু আর মাতামুহুরী নদী বয়ে চলে এর বুক চিরে।
এখানে কেওক্রাডং আছে, তাজিং ডং আছে। আরও আছে বগা লেক, নাফাখুম জলপ্রপাত ও লাইখ্যানগিরি ঝরনা।
সন্ধ্যা নেমে আসছে দ্রুত। পাখিরা ব্যস্ত ঘরে ফিরতে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে মেঘ জমা শুরু করেছে। ঠান্ডা হিমেল হাওয়া গাঁ ছুয়ে হারিয়ে যায় অন্য কোনো গিরিখাদে। হঠাৎ করেই চোখ পড়ল খালার মুখের দিকে। খালা কাঁদছেন।
খালা কাঁদছেন কেন?
দেখেছ, আমাদের দেশটা কত সুন্দর।
দূর, এটা আবার সুন্দর হলো নাকি? আপনিই তো বললেন দার্জিলিং অনেক সুন্দর।
আমি ভুল বলেছি। দার্জিলিং দেখে বুকটা হু হু করে ওঠে না। চোখ বেয়ে পানি আসে না।
খালা চলেন, অন্ধকার হয়ে আসছে।
চলো। আর শোনো, আমি কিন্তু জিপের পেছনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে করতে যাব।
0 comments:
Post a Comment