Friday, September 29, 2017

ঋষি নদীর ধারে




রিশপে এসেছি দুদিন হলো। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কালিম্পং থেকে ৩৭ কিলোমিটার দূরে রিশপ। এখানে আসার পরদিন ভোরে মেঘের জন্য সূর্যোদয়ের সময় সোনারাঙা কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়নি। মেঘের ওপর খানিকটা অভিমান নিয়েই ভোরে রিশপ ট্যুরিস্ট লজের উঠোনে চেয়ার পেতে বসে আছি আরও একটি সূর্যোদয়ের জন্য। চারদিকে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, যেন সবাই অপেক্ষা করছে আমার মতো। হালকা সাদা হয়ে আসছে চারপাশ। পাখিগুলোর ঘুম ভাঙছে এর সঙ্গে। কনকনে ঠান্ডা হাওয়া কাঁপন ধরিয়ে দেয় দেহে। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি দিগন্তের দিকে।
কাঞ্চনজঙ্ঘাটা ওখানেই কোথাও আছে। পাখিদের কোলাহল কেবলই বাড়ছে। কান পাতা দায়, খানিকক্ষণ অন্যমনস্ক করে দিল পাখিগুলো। এর ফাঁকেই কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়াটা টকটকে লাল হয়ে গেল। সেই লাল ছড়িয়ে পড়ল গোটা চূড়াতে। তারপর কমলা থেকে হলুদ, শেষে ধবধবে সাদা পাহাড়টা দাঁড়িয়ে গেল চোখের সামনে, যেন কোনো এক জাদুর কাঠির স্পর্শে ঘুম ভেঙে উঠল। আমি তাকিয়েই রইলাম, তাকিয়েই রইলাম।
রিশপের পরের পাহাড়টাই পেডং। শান্ত নিরিবিলি জনপদ। আঁকাবাঁকা পাথুরে পথ বেয়ে পেডংয়ে আসতেই সকালের নাশতা হজম হয়ে গেল। আমরা যাব পেডং থেকে ১৭ কিলোমিটার নিচের ঋষি নদীর পারের ঋষি ইকো ট্যুরিজম রিসোর্টে। আগে থেকে বুকিং না দিয়ে চলে এসেছি, সঙ্গে সেবাস্টিন প্রধানের ফোন নম্বর। ভাবলাম পেটে কিছু দানাপানি দিয়ে নাহয় জিপে উঠি। হোটেলে ঢুকে অর্ডার দিলাম।
ভাই, ডিম হ্যায়?
ক্যায়া?
মানে আন্ডা আছে?
ক্যায়া?
আরে ভাই ডিম ডিম, মানে আন্ডা আন্ডা।
এবার বুঝল হোটেলের বেয়ারা। ডিম-রুটি খেয়ে হেঁটে হেঁটে সোজা জিপ স্ট্যান্ডে। চলল তুমুল দরদাম। সব ড্রাইভার একজোট, আর আমি যেন এক বেচারা।
শেষে বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। সেবাস্টিন প্রধানের নাম বলতেই জোট ভেঙে গেল দ্রুত। আমি সেবাস্টিনের বন্ধু জানাতেই ৩০০ রুপির ভাড়া হয়ে গেল ২৫০ রুপি আর ড্রাইভারের গোমড়া মুখ হয়ে গেল উজ্জ্বল হাসিমাখা। ১৭ কিলোমিটার পথ গড়াতে গড়াতে এসে থামলাম সিকিমের চেকপোস্টে। ইকো ট্যুরিজম রিসোর্ট পশ্চিমবঙ্গ আর সিকিম সীমান্তে। সিকিমের চেকপোস্ট দিয়ে ঢুকে একটা নদীর সেতুর পার হয়ে রিসোর্টে যেতে সময় কম লাগে। তাই সিকিম চেকপোস্টে আসা। বাংলাদেশিদের সিকিমে ঢুকতে বিশেষ অনুমতি লাগে, যেটা আমার নেই। তাই নিজের পরিচয় লুকিয়ে সিকিম ঢোকার চেষ্টাই করলাম না। ফোন দিলাম সেবাস্টিনকে। ১৫-২০ মিনিটের মধ্যেই হাজির ছিপছিপে গড়নের এক শক্তপোক্ত লোক। চেকপোস্টে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল। গার্ডগুলো বেশ হাসিমুখেই আমাকে ঢুকতে দিল। পাঁচ-সাত মিনিট হেঁটে তারপর ছোট একটা কাঠের সেতু পেরিয়ে আবার পা পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে। নদীর পাড় ধরে খানিকটা হেঁটে এসে পৌঁছালাম রিসোর্টের  আঙিনায়। ‘রিসোর্ট’ শব্দটির মধ্যে যে রকম ভারিক্কি একটা ব্যাপারস্যাপার আছে, তার কিছুই নেই এখানে। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা নানা রকমের ঘর। আর মাঝখানে একচিলতে উঠান। এর এক পাশ দিয়ে বয়ে চলছে তিস্তার ছোট্ট একটা শাখা নদী। কত চওড়াই বা হবে, এই ধরুন ২০-২৫ ফুট। কোথাও হাঁটুপানি, কোথাও কোমরপানি, কিন্তু কী যে তার গর্জন। বড় বড় পাথরকে কোন মুলুক থেকে তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে এখানে কে জানে? উঠোনের অন্য পাশটা পাহাড়ি বন। ঘন সবুজ পাইন বনের ভেজা বাতাস দূর করে দেয় সব ক্লান্তি।
দুপুরটা কেটে গেল ঋষি নদীতে মাছ ধরে আর হাঁটুপানিতে হুটোপুটি করে। ঋষি নদী দিয়ে বয়ে চলা হিমালয়ের বরফ গলা কনকনে ঠান্ডা পানি হাড়ে কাঁপন ধরিয়ে দিল। দুপুরের খাবারের মেনুতে ঠাঁই পেল নদীতে ধরা ছোট ছোট মাছ ভাজা, সবজি আর ডাল। ছিমছাম পরিবেশে ছিমছাম খাওয়া। বিকেলে ঘুরে বেড়ালাম নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে।
ঋষিতে সন্ধ্যা নেমে এল ঝুপ করে। কুপি আর হারিকেনের মিটিমিটি আলোতে অদ্ভুত এক আলো-আঁধারি পরিবেশ। হাজার হাজার পাখি ঘরবাড়ি নিয়ে ঝগড়া করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। দুই পাশে পাহাড় আর মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর পাড়ে বসে আছি সেবাস্টিন প্রধানের সঙ্গে।
সেবাস্টিনের পুরো নাম সেবাস্টিন সত্য প্রকাশ সাঙে চোগিয়াল প্রধান। জন্ম তাঁর খ্রিষ্টান পরিবারে। যুবক বয়সে হিন্দু ধর্মে দীক্ষা নেন, আর এখন বৌদ্ধ। জিজ্ঞেস করেছিলাম, এর কারণ বললেন ‘আগে খেয়ে নাও তারপর শুনো।’ রাতের মেনু বেশ ভারী। গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের সঙ্গে মুরগির ঝোল, সবজি আর ডাল। খোলা আকাশের নিচে হারিকেনের আলোয় ঠান্ডায় জমে যাওয়া হাত গরম ভাতের সঙ্গে উষ্ণতা খুঁজে নিল।
সেবাস্টিনের গল্প শুরু হয়। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনি, কীভাবে একটা লোক পাল্টে দেন একটা গোটা জনপদ। কীভাবে একটা লোক নিজ হাতে পরিষ্কার করেন পেডংয়ের রাস্তার জঞ্জাল, কীভাবে ঘোরের মাঝে উড়ে বেড়ান হিমালয়ের ওপর।
রাতের আকাশে লক্ষ কোটি তারা মিটমিট করছে।রাত গভীর হয়। নদীর পথগুলোর শব্দ আরও তীব্র হয়। ঠান্ডা হাওয়া জেঁকে ধরে চারপাশ থেকে। জঙ্গল থেকে ভেসে আসে পাহাড়ি পোকার তীক্ষ্ম ডাক। সেবাস্টিনের কানে কিছুই পৌঁছায় না, সেবাস্টিন ঘোর লাগা মানুষের মতো গল্প বলেই যায়, বলেই যায়।

Tuesday, September 26, 2017

খোশগল্প --সৈয়দ মুজতবা আলী



যখন-তখন লোকে বলে, “গল্প বলো।”
এ বাবদে স্বৰ্গত ক্ষিতিমোহন সেনের একাধিক রসাল। উত্তর আছে। তিনি বাঙাল উচ্চারণে তখন বলতেন, ঘর লেপ্যা মুছা, আতুড় ঘর বানাইয়া, মা ষষ্ঠীর গেছে বাচ্যা বাচালেই তো আর বাচ্যা পয়দা হয় না। নয় মাস দশ দিন সময় লাগে।” অর্থাৎ গল্পের সময় এলে তবে গল্প বেরবে।’
ইহুদিদের গল্প এর চেয়ে একটু ভালো। কেন, সে-কথা পরে বলছি।
এক ভালো কথক রাববী (ইহুদিদের পণ্ডিত পুরুৎ) অনেকখানি হাঁটার পর অতিথি হয়ে উঠেছেন এক পরিচিত চাষার বাড়িতে। চাষা-বৌ জানত, রাব্বী গল্প করতে ভারি ওস্তাদ। পাদ্য-অর্ঘ্য না দিয়েই আরম্ভ করেছে, “গল্প বলুন, গল্প বলুন।’ ইতিমধ্যে চাষা ভিনগায়ের মেলা থেকে ফিরেছে একটা ছাগী কিনে। চাষা-বৌ সঙ্গে সঙ্গেই গল্পের বায়না বন্ধ করে দুইতে গেছে ছাগীকে ইহুদি তো! একফোটা দুধ বেরল না। দেখে চাষা-বীে বেজার-মুখে স্বামীকে শুধােল, “এ কী ছাগী আনলে গো?” বিচক্ষণ চাষা হেসে বললে, “ওটা হেঁটে হেঁটে হয়রান হয়ে গিয়েছে। দানাপানি দাও-দুধ ঠিকই দেবে।” রাববী সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, “সেই কথাই তো হচ্ছে। দানাপানি না পেলে আমিই-বা গল্প বলি কী করে?”
ক্ষিতিমোহনবাবু ইহুদি ছিলেন না বলে, নিজের সুবিধেটা উত্তরের মারফতে গুছিয়ে নিতে পারেননি-ইহুদি পারে।
এ গল্পটা মনে রাখবেন। কাজে লাগবে। অন্তত চা-টা পাপড়ভাজটা আসবে নিশ্চয়ই।
সঙ্গে সঙ্গে ইহুদি, স্কটম্যান সাইকল চালাতে আরম্ভ করে দেবেন। সে আবার কী?
এসোসিয়েশন অফ আইডিয়াজ, অর্থাৎ এক চিন্তার খেই ধরে অন্য চিন্তা, সেটা থেকে আবার অন্য চিন্তা, সেইরকম করে করে মোকামে পৌছে যাবেন। এখনো বুঝতে পারলেন না? তবে একটা গল্প দিয়েই বোঝাই ।

সেই যে বাঁদর ছেলে কিছুতেই শটকে শিখবে না, এ ছেলে তেমনি পেটুক— যা-কিছু শিখতে দেওয়া হয়, পেঁৗছে যাবেই যাবে মিষ্টি-সন্দেশে। তাকে একং দশং শিখতে দেওয়া হয়েছে। বলছে,
“একং, দশং, শতাং, সহস্ৰ, অযুত, লক্ষ্মী, সরস্বতী—”
(মন্তব্য : “লক্ষ' না বলে বলে ফেলেছে লক্ষ্মী' এবং তিনি যখন দেবী তখন তাঁর এসোসিয়েশন অব আইডিয়াজ থেকে চলে গেছে আরেক দেবী সরস্বতীতে; তার পর বলছে)

Monday, September 25, 2017

কুলদা রায়ের অনুগল্প : আলো ও হাওয়ার গল্প



মেয়েটোর নাম পরী। এই পরী মেয়েটিকেই একদিন পরীতে পেলো। আমাদের উঠোনে তখন ঘাস উঠেছে। এই ঘাসগুলো তুলে ফেলতে ফেলতে দেখলাম-- পরীর পিঠে দুটো ডানা উঠেছে। কী অসাধারণ ডানা দুটো। রেশমী। রোদে চিকমিকিয়ে ওঠে। ঘাস তুলবো কি চেয়ে চেয়ে দেখি- সেই ডানা মেলে মাটি থেকে অনেকটা উপরে উঠে গেছে পরী। চুলগুলো হাওয়ায় উড়ছে। আর হাসি হাসি মুখ।


পরী উড়ে গেল পেয়ারা গাছের ডালে। সবে রং ধরেছে পেয়ারায়। কামড়ে কামড়ে খেলো। কচ কচ শব্দ কানে এলো। একটি শিউলি তলায় ফুল ঝরে থাকত। আর পাতায় শিশির। পরী সেই শিশির বিন্দুগুলো তার দুহাত ভরে কুড়িয়ে নিল। সেই প্রথম একটি মালা গাঁথল শিশির দিয়ে। মুক্তোর চেয়েও লাবণ্যময় সেই মালাটি। গলায় পরে সেদিনই পরী একটি নতুন গান গাইল। কী গাইল, বুঝতে পারিনি। কী আশ্চর্য গানের কথাগুলো। যেন অনেক দূর থেকে ভেসে আসা। অনেক দূরে ভেসে চলে যাওয়া। আমরা শোনার আগেই ভুলে গেলাম। কেবল তার যাওয়া আসার সুরটি কানের মধ্যে বাজতে লাগল। এই সুর জীবনে এর আগে কখনো শুনিনি। 

বলাই বাহুল্য - তারাপদ রায়



কানাই এবং বলাই দু’জন সমবয়সি যুবক, পরস্পর বন্ধু এবং প্রতিযোগী। যেমন সাধারণত হয়ে থাকে। আর কী।
সমবয়সি বন্ধু হলেও দু'জনের মধ্যে প্রায় কোনও বিষয়েই মিল নেই। কানাই ধনী, বলাই গরিব। কানাই উচ্চশিক্ষিত, বলাইয়ের লেখাপড়া তেমন নয়। কানাই দেখতে ভাল, লম্বা, ফর্সা। বলাই মোটেই দেখতে ভাল নয়, মোটা, বেঁটে, গায়ের রঙ কালো!

শ্বশুরবাড়ির শাল - সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়



বড়বাজারের এক ঘূপচিগলির দােকানের দােতলায় শালের আড়ত। সারা ভারতবর্ষের শাল, দােশাল, তুষ, মলিন্দা—এই একেবারে মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত ডাই হয়ে আছে। স্বয়ং মালিক টেরি কটনের ধুতি পরে একটু উরু দোকানের অন্যতম দর্শনীয় বস্তু মনে করে, বের করে বসে আছেন। পেছনে একটি মানানসই দশাসই তাকিয়া। বঙ্কিম এখন ক্রেতা। ফিনানসিয়ার তার সম্বন্ধী । শীতে ভগ্নীপতিকে একটি শাল দেবার কথা ছিল। দিচ্ছি। দেব করে দুটাে শীত পার করে দিয়েছে। এই থার্ড উইন্টারে বঙ্কিমবাবুর কাধে শাল উঠবেই। দােকানটা সম্বন্ধীরই আবিষ্কার। আড়ত থেকে কিনলে দুটা পয়সা সস্তা হবে। মালিক জংঘাদেশ আয়েশ করে চুলকোতে চুলকোতে জিজ্ঞাসা করলেন ঃ পকেটের খবর কী? সেই অনুসারে মাল ফিট করবেন। পকেট তাে সম্বন্ধীর । উত্তরটা সেই দেবে। বঙ্কিম উদাস হয়ে মালিকের থাই দেখতে লাগল। ছেলেবেলায় ওয়ার্ডবুকে পড়েছিল—শূকরের শুষ্ক লবণাক্ত জঙ্ঘা, হ্যাম। কেন জানে না তার এই কথাটাই মনে পড়ল। সম্বন্ধী টাকার অঙ্ক বলে দিয়েছে : দেড়শো, ম্যাকসিমাম একশো পঁচাত্তর। ওই দামের শালেরা সব অ্যালুমিনিয়ামের মই বেয়ে বঙ্কিমের সামনে নেমে এল। দেড়শো টাকায় আর কত ভালো জিনিস হবে ? হালকা একরোখা কাজ। জমি তেমন ভালো নয়। মধ্যবিত্তের শাল এর চেয়ে ভালো হলে মানাবেও না। বঙ্কিম দেখেশুনে একটা সাদা শাল পছন্দ করে নিল। সম্বন্ধী ফিসফিস করে বলল, দ্যাখো এইটাই নেবে তো? রাখতে পারবে না। কিন্তু। বঙ্কিমের মনে হল-সম্বন্ধীর এই কথায় নিশ্চয়ই কোনো ইন্টারেস্ট আছে। সাদা থেকে বঙ্কিমকে তুতে রঙেরটায় নামাতে পারলেই, পঁচিশ টাকা সেভিংস। বঙ্কিম কানে কানে বলল, তোমার বোনকে যখন রাখতে পেরেছি, শালটাকেও না-পারার কোনো কারণ নেই। মেইন্টিন্যান্স ইজ এন আর্ট। দােকানের মালিক আর্ট শব্দটা শুনতে পেয়ে বললেন-হ্যা হ্যা ইয়ে আর্টিস্ট লোককো লিয়ে হায়। পরের পয়সামে যো লোক টিংচার আইডিন ভী, পিতা হায় এ সাদা শাল উঃ বঙ্কিম মনে মনে বললে—ধুর ব্যাটা। পরের পয়সা কি রে! হিসেব করে দেখ— সারাজীবন একটা মেয়েকে মেনটেন করার কষ্ট, আর শ্বশুরবাড়ির সারা জীবনের পাওয়া— ইনভার্স রেশিওতে চলে। সবশেষে ওই জামাই ষষ্ঠী। তা-ও বন্ধ হয়ে যায়। ওয়ান জামাই গােজ, অ্যানাদার জামাই কামস। দাঁত পড়া, চুলে পাক ধরা জামাইরা লিস্ট থেকে বাদ পড়ে যায়। আসল দখল করে থাকে ফুল কি রাঙা জামাই। আদরের ধর্মই হল উজ্জ্বল রঙের মতাে ক্রমশ ফেড় করে আসে। বিবর্ণ দাম্পত্যজীবন এই শাল দিয়ে চাপা দেওয়া যাবে।

পরশুরামের গল্প ---(চিঠি-বাজি)



সুকান্ত দত্ত অতি ভালো ছেলে, এম.এস-সি পাস করার কিছুদিন পরেই পি-এইচ.ডি. ডিগ্রি পেয়েছে একটি। ভালো চাকরি জোগাড় করে প্রায় বছরখানিক সিন্দ্রির সার-কারখানায় কাজ করছে। তার বাপ-মা নেই, মামাই তাকে মানুষ করেছেন। আজ সকালের ডাকে মামার কাছ থেকে সুকান্ত একটি চিঠি পেয়েছে। তিনি লিখেছেন : সুনন্দার সঙ্গে। বনেদি বংশ, বিজয়বাবু আমাদের কাছাকাছি শাখারিপাড়াতে থাকেন। মেয়েটি সুগ্ৰী, খুব ফরসা, বি,এস-সি পাস করতে পারে নি, তবে বেশ চালাক। ফোটাে পাঠলুম। তোমারই উচিত ছিল নিজে দেখে পাত্রী পছন্দ করা, কিন্তু একালের ছেলে হয়ে কেন-যে তুমি আমার ওপর ভার দিলে তা বুঝতে পারি না। যাইহােক, আমি যথাসাধ্য দেখেশুনে এই পাত্রী স্থির করেছি, আশা করি তোমারও পছন্দ হবে। তেইশ ফাল্গুন বিবাহ, পাঁচ সপ্তাহ পরেই। তুমি এখন থেকে চেষ্টা কর যাতে পনেরো দিনের ছুটি পাও| বিবাহের অন্তত দুদিন আগে তোমার আসা চাই। সুকান্ত মামার চিঠিটা মন দিয়ে পড়ল, ফোটােটাও ভালো করে দেখল। কিছুক্ষণ ভেবে সে তার রঙের বাক্স থেকে তিন-চার রকম রঙ নিয়ে এক-টুকরো কাগজে লাগাল এবং নিজের বঁ-হাতের কবজির উপর কাগজখানা রেখে বারবার দেখল তার গায়ের রঙের সঙ্গে মিল হয়েছে কিনা। তারপর আরও খানিকক্ষণ ভেবে এই চিঠি লিখল : শ্ৰীযুক্ত সুন্দা ঘোষ সমীপে। আমার সঙ্গে আপনার বিবাহের সম্বন্ধ স্থির হয়েছে। মামাবাবুর চিঠিতে জানলুম। আপনি খুব

Sunday, September 24, 2017

এই পথ চলাতেই আনন্দ - ফখরুল আবেদীন




‘ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক কী?’ ফেসবুকে এই স্ট্যাটাস দিয়ে রীতিমতো বিপদে পড়ে গেছি। ৭৯টা লাইক আর ৩৬টা ‘গেট ওয়েল সুন’ বলে বন্ধুদের মন্তব্য। অফিসের সহকর্মীরা চাঁদা তুলে আপেল, কমলা আর এক বোতল মেয়াদোত্তীর্ণ বিদেশি ফলের রস নিয়ে উপস্থিত হলো আমাকে দেখতে। আমাকে হাঁটতে-চলতে দেখে তারা একজন আরেকজনের মুখ চাওয়া-চাওয়ী করতে লাগল। আসলে বান্দরবান যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ওখানকার মশার কামড়ে নাকি ম্যালেরিয়া হয়। তাই ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক খুঁজছিলাম। আর বন্ধুরা ভেবেছে আমার বুঝি ম্যালেরিয়াই হয়েছে। কী আর করা, ম্যালেরিয়া না হওয়ার ওষুধ খেয়ে নিয়ে বউ-বাচ্চা আর খালা-খালুর বিশাল লটবহর নিয়ে ডিসেম্বরের এক কাকডাকা ভোরে রওনা দিলাম বান্দরবানের দিকে।
হাজির হলাম মিলনছড়ির রিসোর্টে। ছিমছাম পরিপাটি রিসোর্টটায় পা দিয়েই মন ভালো হয়ে গেল। রেস্তোরাঁর বিশাল ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলাম দিগন্তের দিকে। দৃষ্টিসীমা আটকে যায় হাজারো ঢেউ খেলানো পাহাড়ের চূড়ায়। পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে যেই না ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দিতে যাব, অমনি পেছন থেকে বড় খালার গলা ভেসে এল। বাথরুমে গরম পানি আসছে না। এই নিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে ঝামেলা বাধিয়ে ফেললেন। চায়ের কাপ ফেলে রেখেই ছুটলাম ঝগড়া মেটাতে। এরপর বেরিয়ে পড়লাম বান্দরবান শহর ঘুরতে।
ছোট্ট ছিমছাম শহর। হেঁটে বেড়াতেই ভালো লাগে, নানা রঙের মানুষ। এর মধ্যে রাস্তার পাশে আধুনিক দোকানপাটে এক তরুণী বিক্রেতার সঙ্গে দর-কষাকষি চালিয়ে যাচ্ছেন আমার খালা। আর আমিও এই সুযোগে রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম শহর চষে বেড়াতে। পরদিন ঘোরাঘুরি করার জন্য গাড়িও তো ঠিক করতে হবে।
ঘুম ভাঙল খুব ভোরে, হাজারো পাখির কিচিরমিচিরে কান পাতা দায়। যেন এক পাখির দেশে চলে এসেছি। ভোর হচ্ছে বান্দরবানে। সারা রাতের তীব্র শীতে জমে যাওয়া মেঘগুলো পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে আশ্রয় নিয়েছে। সূর্যের উষ্ণতা পেয়ে উড়ে যাচ্ছে আকাশ ছুঁতে। এ এক অপার্থিক দৃশ্য। ঘুম থেকে উঠে মেয়েটা যে কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, টেরও পাইনি।
বাবা, আমরা কি আকাশের কাছে চলে এসেছি?
কেন রে মা?
ওই যে দেখো, মেঘগুলো আমাদের নিচে।
তাই তো! ঠিক বলেছ, আমরা আকাশের কাছে।
এরই মধ্যে খোলা জিপ চলে এল আমাদের নিতে। যাকে বলে চান্দের গাড়ি। গাড়ি দেখেই খালার চোখমুখ কুঁচকে গেল। এ কেমন গাড়ি রে বাবা! আমি তো ভেবেছিলাম এসি গাড়ি হবে। এ গাড়িতে যাব না। শেষে বহু কষ্টে খালাকে রাজি করিয়ে বসিয়ে দিলাম চালকের পাশের আসনে আর আমরা পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখেমুখে বাতাসের ঝাপটা মেখে নিচে ছুট লাগালাম বান্দরবান।
প্রথমেই গাড়ি গিয়ে দাঁড়াল মেঘলা পর্যটনের গেটে। ছিমছাম সাজানো-গোছানো এক পর্যটনকেন্দ্র, যার মূল আকর্ষণ এর কৃত্রিম হ্রদ আর হ্রদের ওপর দিয়ে বানানো ঝুলন্ত সেতু। ঢাকা শহরের অত্যাধুনিক সব রাইডে চড়া শিশু-কিশোররাও এখানকার সাদামাটা পার্কটিতে ঘুরে বেশ ভালোই আনন্দ পাবে। হ্রদ, ঝুলন্ত সেতু, পাহাড়ি পথ বেয়ে হেঁটে চলে বেশ অনায়াসে কেটে গেল বান্দরবানের মিষ্টি সকালটা।
পরের গন্তব্য শহর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরের নীলাচল স্পট। টাইগার পাড়ার এই স্থানটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দুই হাজার ফুট ওপরে। আর তাই এখান থেকে পুরো শহরটাকে দেখা যায়। ভালো লাগে। আরও ভালো লাগল বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের পবিত্র গোল্ডেন টেম্পল। অসাধারণ এর নির্মাণশৈলী। কেমন যেন শান্তি লাগে এখানে। চিম্বুক, নীলগিরি যাওয়ার পথেই আমাদের রিসোর্ট পড়ে। চটপট স্থানীয় মেনুু দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়েই ছুটলাম সেদিকে। পথে খানিকটা যাত্রাবিরতি শৈলপ্রপাতে। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ আর ঠান্ডা জল নেমে আসছে শৈলপ্রপাতের গা বেয়ে। স্থানীয় বোম নারীরা সেই পানিতেই সেরে নিচ্ছে গেরস্থালির কাজকর্ম।
গাড়ির পেছনের অংশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চিম্বুক যাচ্ছি আমরা। শোঁ শোঁ বাতাসে চোখ খোলা দায়। আঁকাবাঁকা পথে রোলার কোস্টারের মতো চলল আমাদের গাড়ি। একেকটা বাঁক পেরোয় আর গলা ফাটিয়ে চিৎকার করি সবাই। এই পথ চলাতেই আনন্দ। এলোমেলো চুল আর মুখভর্তি হাসি নিয়ে হাজির হলাম চিম্বুকে। চারপাশের পাহাড়গুলো যেন আরও কাছে। দূরে বয়ে চলা সাংগু নদী ফিতার মতো বয়ে চলেছে। শহুরে মানুষগুলো মুঠোফোনের সিগন্যাল পাওয়ার জন্য এদিক-সেদিক ঘুরছে। হায়রে।
আর আমরা আরও একবার হইচই করতে করতে পৌঁছে গেলাম নীলগিরিতে। আহ, কেমন শান্তি শান্তি ভাব পুরো এলাকাজুড়ে। এখানকার রিসোর্টে একবার না থাকলে এর সৌন্দর্য পুরো উপভোগ করা যাবে না। এটা বোধ করি বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর পর্যটনকেন্দ্রগুলোর একটি। চারপাশটা হেঁটে বেড়াতে মুগ্ধ হই বান্দরবানের সৌন্দর্যে। কী নেই এখানে? নানা রঙের মানুষ, নানান ভাষার মানুষ, সাংগু আর মাতামুহুরী নদী বয়ে চলে এর বুক চিরে।
এখানে কেওক্রাডং আছে, তাজিং ডং আছে। আরও আছে বগা লেক, নাফাখুম জলপ্রপাত ও লাইখ্যানগিরি ঝরনা।
সন্ধ্যা নেমে আসছে দ্রুত। পাখিরা ব্যস্ত ঘরে ফিরতে। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে মেঘ জমা শুরু করেছে। ঠান্ডা হিমেল হাওয়া গাঁ ছুয়ে হারিয়ে যায় অন্য কোনো গিরিখাদে। হঠাৎ করেই চোখ পড়ল খালার মুখের দিকে। খালা কাঁদছেন।
খালা কাঁদছেন কেন?
দেখেছ, আমাদের দেশটা কত সুন্দর।
দূর, এটা আবার সুন্দর হলো নাকি? আপনিই তো বললেন দার্জিলিং অনেক সুন্দর।
আমি ভুল বলেছি। দার্জিলিং দেখে বুকটা হু হু করে ওঠে না। চোখ বেয়ে পানি আসে না।
খালা চলেন, অন্ধকার হয়ে আসছে।
চলো। আর শোনো, আমি কিন্তু জিপের পেছনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করতে করতে যাব।

সুবোধ ঘোষ এর ভালবাসার গল্প : জতুগৃহ



এত রাত্রে এটা কোন ট্রেন ? এই শীতার্ত বাতাস, অন্ধকার আর ধোঁয়া ধোঁয়া বৃষ্টির মধ্যে ট্রেনটা যেন হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে ছুটে এসে রাজপুর জংশনের প্লাটফর্মের গায়ে লাগলো। 
খুব সম্ভব গঙ্গার ঘাটের দিক থেকে ট্রেনটা এসেছে। এখনো অদূর গঙ্গার বুকে সেই স্টিমারের চিমনি বাঁশির শব্দ শোনা যায়, যে স্টিমারটা একদল যাত্রীকে ঘাটে নামিয়ে দিয়ে একটু হালকা হয়ে আর হাঁপ ছেড়ে আবার ওপারে চলে যাচ্ছে।
প্লাটফর্মের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ট্রেনের এঞ্জিন আস্তে আস্তে হাঁপাতে থাকে। ফাস্ট ক্লাস ওয়েটিংরুমে বয়টা একটু ব্যস্ত হয়ে ওঠে। টেবিল চেয়ার বেঞ্চ আর আয়নাটার ওপর ঝটপট তোয়ালে চালিয়ে একটু পরিচ্ছন্ন করে ফেলে। জমাদার এসে রুমের টুকিটাকি আবর্জনা বড় বড় ঝাড়ুর টান দিয়ে সরিয়ে নিয়ে যায়। 
ঘাটের ট্রেনটা ছোট হলেও এবং যাত্রীর সংখ্যা কম হলেও ফাস্ট ক্লাসের যাত্রী দু-একজন তার মধ্যে পাওয়াই যায় । হয়তো কাটিহারের কোন চিনিকলের মহাজন, অথবা দার্জিলিং-ফেরত কোন চা-বাগানের সাহেব, এই ধরনের কুলিন শ্রেণীর যাত্রীও থাকেন, শুধু সাঁওতাল কুলির দলই নয় । 
কিন্তু আজ এখন যাঁরা এই ক্লান্ত ট্রেন থেকে নেমে ব্যস্তভাবে এসে ফাস্ট ক্লাস ওয়েটিংক্রমে
আশ্রয় নিলেন, তাঁদের সঙ্গে চিনিকল অথবা চা-বাগানের কোন সম্পর্ক নেই।
কুলির মাথায় বাক্স-বেডিং চাপিয়ে প্লাটফর্মের ওপর দিয়ে ওঁড়ো-ওঁড়ো বৃষ্টির মধ্যে তরতর করে হেঁটে ওয়েটিংক্রমে প্রথম এসে ঢুকলেন এক বাঙালী মহিলা । গায়ে কাশ্মিরী পশমে তৈরি একটা মেয়েলী আলস্টার, কানে ইহুদী প্যাটানের ছোট ফিরোজার দুল, খোঁপা বিলিতি ধাঁচে ফাঁপানো । 

Friday, September 22, 2017

‘কালো তিলের বিনিময়ে যে দুই নগর’



এই দুই নগরের পথে পথে যেন আজও ছড়িয়ে আছে আলেকজান্ডার, চেঙ্গিস খান, মার্কো পোলো আর তৈমুর লংয়ের মতো দিগিবজয়ীদের পদচিহ্ন। কেউ কেউ এই নগর যুগলকে বলেছেন ‘রোমান্স আর কবিতার তীর্থ’। কেউ বলেছেন ‘প্রাচ্যের রোম’। কিন্তু এক সময় শুধুমাত্র ‘প্রিয়ার চিবুকের একটা কালো তিলের বিনিময়ে’ এ দুই নগর লিখে দিতে চেয়েছিলেন জগদ্বিখ্যাত কবি-দার্শনিক ওমর খৈয়াম!
প্রাচীন কিন্তু এখনো জনবসতিময় নগরগুলোর মধ্যে অন্যতম সেরা এ দুই নগরের নাম সমরখন্দ ও বোখারা। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংযোগকারী বাণিজ্যপথ ‘সিল্ক রুট’ বা রেশমপথেই গড়ে ওঠে এ দুই নগর। প্রাচীন রেশমপথের ব্যবসায়ী জনগোষ্ঠী ‘সোগদিয়া’রা এ নগর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বর্তমানে উজবেকিস্তানে অবস্থিত সমরখন্দ ও বোখারা এখন যথাক্রমে দেশটির দ্বিতীয় ও পঞ্চম বৃহত্তম নগর।
ইতিহাসে প্রাচ্যের রোম বলে খ্যাত সমরখন্দের পত্তন হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ অব্দে। রেশমপথের সব নগরের মধ্যে সমরখন্দই নিঃসন্দেহে ইতিহাসের সবচেয়ে প্রবল স্মারক। ‘দ্য গোল্ডেন রোড টু সমরখন্দ’ গ্রন্থের রচয়িতা উনিশ শতকের প্রাচ্য-তত্ত্ববিদ জেমস ইলোরি ফ্লেকার এ নগর সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘সমরখন্দ প্রাচ্যের রোমান্স আর কাব্যের তীর্থ।’
প্রায় ২ হাজার ৫০০ বছর ধরে মধ্য এশিয়ায় রেশমপথের সবচেয়ে সমৃদ্ধ এবং জনবহুল নগর হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রেখেছিল সমরখন্দ। দূরপ্রাচ্যের চীন থেকে পাশ্চাত্যে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত এদিকে-সেদিকে বিস্তৃত বহু পথে বাণিজ্যের প্রসার, পণ্য পরিবহন, অভিযাত্রী আর অগুনতি মানুষের যাতায়াতের সঙ্গে সঙ্গেই সংস্কৃতি ও দর্শনেরও মেলবন্ধন ঘটিয়েছিল ওই রেশমপথ।
তৈমুর লংয়ের রাজধানী সমরখন্দ
একই সঙ্গে বীরত্বের জন্য কিংবদন্তি এবং নৃশংসতার জন্য কুখ্যাত হয়ে ওঠা তুর্কি-মঙ্গল শাসক তৈমুর লং চতুর্দশ শতকে তাঁর রাজধানী স্থাপনের পর থেকেই তিলোত্তমা হয়ে ওঠে সমরখন্দ। চারদিকে সাম্রাজ্য বিস্তারের মধ্য দিয়ে মধ্য এশিয়ার একক অধীশ্বর হয়ে ওঠা তৈমুর বিপুল অর্থ ব্যয়ে দ্রুতগতিতে গড়ে তোলেন একের পর এক সুবিশাল মসজিদ, মাদ্রাসা, বাগান, নগরচত্বর, ফটক, মিনার, সমাধি আর অট্টালিকা। শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় স্মরণীয় হয়ে থাকা তৈমুরের এসব অনন্য স্থাপত্য-কীর্তি শুধু সেই সময়েই নয়, আজও জগত্ সেরা হয়ে আছে।
কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস ছড়িয়ে থাকা এই নগরে ভ্রমণে গেলে আজকের দিনে যে কেউ প্রথমেই যা দেখে ধাক্কা খাবেন তাহলো সমরখন্দের এখনো ঝকঝক-তকতক করতে থাকা রূপ। মনে হবে প্রাচীন নগরের ভেঙে পড়া ধ্বংসাবশেষ কই? জীর্ণশীর্ণ দালানকোঠা আর ধুলা ওড়া অলিগলিই বা কই? চারপাশের প্রশস্ত সড়ক আর সুরম্য সব অট্টালিকা সবই যেন অনন্ত-যৌবনা।
স্থাপত্যের জাদুঘর-নগর বোখারা
রেশমপথের উত্তর-দক্ষিণ এবং পূর্ব-পশ্চিম পথের সংযোগস্থলে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০ অব্দে গড়ে উঠেছিল বোখারা। সে সময়ই এটা দুনিয়ার খুবই গুরুত্বপূর্ণ নগর হিসেবে স্বীকৃত। আর এখন এটা হয়ে দাঁড়িয়েছে দুনিয়ার স্থপতি ও শিল্পানুরাগীদের অন্যতম এক তীর্থে, স্থাপত্যের এক জাদুঘর-নগরীতে।
১৯৯৭ সালে বোখারার ২ হাজার ৫০০ বছর পূর্তিকে ঘিরে শেষ করা হয়েছিল এখানকার স্থাপত্য সংস্কারের শেষ পর্যায়ের কাজ। চারিদিকে ১৩ কিলোমিটারের বিশাল দুর্গ-প্রাচীর আর অনেকগুলো ফটক ঘিরে রেখেছে একদার রোমহর্ষক এ দুর্গ-নগরীকে। এ অঞ্চলের সর্বশেষ স্বাধীন রাজ্য হিসেবে টিকে ছিল বোখারা। ১৯২০ সালে রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবীদের কাছে পরাস্ত হয়ে বোখারার আমির আফগানিস্তানে পালিয়ে গেলে এ নগরের পতন ঘটেছিল।
বোখারায় অট্টালিকা, নগর-দুর্গ ও প্রাচীর, ফটক, মিনার, প্রাসাদসহ প্রায় ১৪০টি স্থাপনার সংস্কার করে সেগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো বিশাল প্রবেশদ্বারসহ মূল নগর-দুর্গের পুনর্র্নিমাণের কাজ। আসল আকৃতির মাত্র ৩০ ভাগ আকারে পুনর্নির্মিত হয়েছে এই বিশাল ফটক। অনন্য এই স্থাপত্যের দিকে প্রথম দর্শনেই যে কারোরই দম বিস্ময়ে আটকে যেতে পারে, বিশেষত দর্শক যখন বুঝতে পারবেন যে আসলে উনি কোনো ফিল্ম সেটে দাঁড়িয়ে নেই এবং নিপুণ অলংকরণে সজ্জিত এই ফটক একটি সত্যিকারের স্থাপত্য।
স্থাপত্য সংস্কারের অনন্য নজির
সমরখন্দ এবং ২৫০ কিলোমিটার দূরের বোখারার নিপুণ স্থাপত্য-সংস্কার যে কাউকে মুগ্ধ করবেই। সংস্কারকাজের পাশাপাশি নগর দুটির আধুনিকায়নও চোখে পড়ার মতো। সোভিয়েত ঘরানার প্রশস্ত সব সরণি এঁকেবেঁকে চলে গেছে নগরের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত। গত শতকে সোভিয়েত রাশিয়ার শাসনামলে সম্পন্ন করা হয় এই স্থাপত্য সংস্কারের কাজ। বিশুদ্ধতাবাদীরা চূড়ান্ত মাত্রার এই স্থাপত্য-সংস্কারের সমালোচনা করলেও এটা স্বীকার করতেই হবে যে, এটা করা না হলে সুবিশাল ওই অট্টালিকাগুলো হয়তো এত দিনে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতো।
সমরখন্দের নগর-কেন্দ্রের প্রধান চত্বরের নাম ‘রেগিস্তান স্কয়ার’। এটা প্রায় দুটি ফুটবল মাঠের চেয়েও বড়। এর তিনদিক জুড়ে রয়েছে পার্শ্ববর্তী মাদ্রাসার সুউচ্চ প্রবেশ ফটক। এক শতক আগের ধ্বংসস্তূপের ওপর নতুন করে এই ফটকগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। পাশেই তৈমুর লংয়ের সমাধিতে আছে ৬ ফুট চওড়া কালো জেড পাথরের ফলক। এটা সে সময়ের মতো এখনো বিশ্বের সবচেয়ে বড় জেড পাথর হিসেবে স্বীকৃত।
ইতিহাসের পাতাটি এখনো জীবন্ত
১৯৯১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই ৭০ বছরের সোভিয়েত রাশিয়ার শাসনামলের ছাপ মুছে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট উজবেকিস্তান। এ প্রয়াসে প্রথমেই তৈমুর লংকে ‘জাতীয় নেতা’ ঘোষণা করে উজবেকিস্তান। একই সঙ্গে রাষ্ট্র কাঠামো এবং সংস্কৃতিচর্চায় উজবেক সংস্কৃতির চর্চাকে উত্সাহিত করতে নেওয়া হয় নানা পদক্ষেপ। তবে সোভিয়েত আমলের যেসব ছাপ এখনো স্পষ্ট, তার মধ্যে অন্যতম উজবেক সমাজে নারীর উপস্থিতি। এশীয় এবং মুসলিম-অধ্যুষিত একটি দেশ হলেও উজবেকিস্তানে নারীদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো।
আধুনিক সমরখন্দ বোখারায় সবকিছুই ঝকঝকে তকতকে। তবে নগরের রাস্তাঘাটে, বাজারে, দোকানে কেনাকাটায় গেলে পাওয়া যাবে ঐতিহাসিক বাণিজ্যপথের স্বাদ। একটা দোকানে ঢুকলে কিছু না কিনে যেন আপনি বেরোতে পারবেন না, নাছোড়বান্দা দোকানিরা আপনার কাছে কিছু না কিছু বিক্রি করেই ছাড়বেই। এতে হয়তো আপনি খুঁজে পাবেন আগের দিনের রেশমপথের দিনগুলোর নানা দেশের নানা সংস্কৃতির ব্যবসায়ীদের ক্রয়-বিক্রয়, বাট্টা আর পণ্যবিনিময়ের সেই হইচইয়ের স্বাদের কিছুটা। তবে এই বাজার-ঘাট কিন্তু খুবই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর আধুনিক, তা রাস্তার ধারের খোলা দোকানই হোক বা কোনো শপিং-মল; এর যে কোনোটিই আজকের দিনের ইউরোপে অনায়াসে খাপ খাইয়ে নিতে পারার মতো আধুনিক।
সুস্বাদু ও বিচিত্র সব উজবেক খাবারদাবার
মধ্য-এশিয়ার এই অঞ্চলে বেড়াতে গেলে আর যা-ই করুন না কেন, উজবেকিস্তানের স্থানীয় খাবারদাবার চেখে দেখতে ভুলবেন না। উজবেক পোলাও, মান্টি, শুরপা, সাসলিক, লাগমান, সমুচা…খাবারের নামগুলোও যেন জিভে জল নিয়ে আসে, আর এগুলোর গন্ধ নাকে এলে নিজেকে সংবরণ করাই মুশকিল হয়ে যেতে পারে আপনার।
বেশির ভাগ ঐতিহ্যবাহী উজবেক খাবার রান্নারই আছে কয়েক শতাব্দীর পুরোনো ইতিহাস। তুর্কি, কাজাখ, তাতার ও মঙ্গল প্রভাবের সঙ্গে স্থানীয় বাবুর্চিগিরির মুনশিয়ানায় এসব খাবারের বৈচিত্র আপনাকে অভিভূত করবে। এমনকি একটি প্রাত্যহিক উজবেক ডিশেও এত পদের খাবার থাকে যে আপনি চমকে উঠতে পারেন। টেবিলের এ মাথায় তা হয়তো শুরু হবে মিষ্টি, ফল আর সালাদ দিয়ে, এরপর আসবে স্যুপের পালা, বহু ধরনের স্যুপের মধ্যে জনপ্রিয় দুটি হলো শুরপা আর মাস্তাভা। আপনার পেট ইতিমধ্যেই ভরে গেলে আপনি হিসাব কষতে খুবই ভুল করেছেন! কেননা এবার আসবে আসল ডিশ মান্টি, লাগমান, সাসলিক বা পোলাও।
সুগন্ধি চালের সঙ্গে ভেড়ার মাংস, পেঁয়াজ, গাজর ইত্যাদি দিয়ে রান্না করা এ খাবারের স্বাদ বলে বোঝানো সম্ভব নয়, এটা আপনাকে নিজের জিবেই পরখ করতে হবে। সমরখন্দ আর বোখারার যেকোনো ভালো রেস্তোরাঁতেই এ পোলাও পাওয়া যাবে, স্বাদ সব খানেই ভালো। কিন্তু সুযোগ পেলে যেতে পারেন বোখারার এম ইকবাল স্ট্রিটে খোলা আকাশের নিচে ‘ক্যারাভান রেস্তোরাঁয়’। আপনার যাত্রা বৃথা যাবে না।
পর্যটক-বান্ধব নগর
সমরখন্দ-বোখারার অসাধারণ স্থাপত্য সংস্কারকাজের পাশাপাশি যে বিষয়টা আপনার অবশ্যই চোখে পড়বে তা হলো এ নগর যে পর্যটক-বান্ধব তার প্রমাণ সর্বত্র ফুটে আছে। পথেঘাটে বেশ কয়েকটি ভাষায় দিকচিহ্ন, ঐতিহাসিক স্থানের পরিচিতিসহ পর্যটকদের সুবিধা বিবেচনা করা হয়েছে সব খানেই। এর মানে এই নয় যে, বিষয়টা জাদুঘর দেখতে যাওয়ার মতো। নগরের দোকানপাট, আর নানা প্রতিষ্ঠানেই সবাই স্বাগত জানাবে পর্যটকদের। একটা গালিচার দোকানে গিয়ে লাগোয়া বুনন ঘরেই উজবেক রীতির গালিচা বুননের চমৎকার শৈলী চাক্ষুষ করতে পারবেন আপনি।
এই বিষয়টা কেবল সমরখন্দ বা বোখারাতেই নয়, পাশের হিভা আর কাশগড়ে গেলেও এই একই বিষয় অভিভূত করবে আপনাকে। রেশমপথের পূর্ব-পশ্চিম পথের সংযোগস্থলে আরেক ঐতিহাসিক নগর হিভা ঘুরে দেখার সুযোগ হারানোটা ঠিক হবে না আপনার। এখানেও স্থাপত্য সংস্কারের কাজ হয়েছে নিপুণ দক্ষতায়। চৈনিক-উজবেক রীতির হস্ত ও কারুশিল্পের অনন্যধারা বিকশিত হয়েছে হিভা নগরে। চমত্কার পশমি টুপি, রেশমি কাপড়ের সমাহার চোখে পড়বে এখানকার দোকানপাটে। এর কাছেই আছে পশ্চিম চীন ও মধ্য এশিয়ার সীমান্তবর্তী গুরুত্বপূর্ণ নগর কাশগড়। হাতে সময় থাকলে ঘুরে আসতে পারেন কাশগড়ে। ঐতিহাসিক রেশমপথের এই নগরগুলো আপনাকে উজ্জীবিত করবে এক অনন্য রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতায়।
(রয়টার্সে প্রকাশিত লেখক-সাংবাদিক পিটার ওয়ার্ডের ফিচার অবলম্বনে)

সুবোধ ঘোষ : চোখ গেল



শিলং-এর কুয়াশা খেয়ালী হলেও কেমন একটু অলস ও শান্ত। দেখে তবু বোঝা যায়, আর কতক্ষণ থাকবে, কোন দিকে চলে যাবে, কিংবা গলেই যাবে কিনা।

কিন্তু সেই শিলং-এরই মিস্টার নাগের ভাগ্নী অপরাজিত রায় যেন এক ছটফটে খেয়ালের কুয়াশা। গত পূজার সময় কলকাতার দিক থেকে শিলং-এ এল এবং এখনও শিলং-এই আছে । কিন্তু আর কতদিন যে থাকবে, কিংবা একেবারে থেকেই যাবে কিনা, দেখে কিছু বোঝা যায় না ।

থাকলেও শেষ পর্যন্ত দুজনের মধ্যে কার দিকে যে ঢলে পড়বে আর গলে যাবে এই নবাগতা কুহেলিকা, তাও এখনো কিছুই অনুমান করতে পারা যাচ্ছে না। 



বাজার-দোকানের কলমুখরতার প্রান্ত থেকে একটু দূরে, লাবান-এর নিভৃতে একটা গড়ানো জমির গায়ে ছবিঘরের মত সাজানো ছোট বাংলোটাই হলো মিস্টার নাগের বাড়ি । বাড়ির ফটকটা লতানে গোলাপের তোরণের মত। লতার মধ্যে থোকা থোকা সাদা গোলাপ হাসে, আর, যেন সেই লতানে গোলাপের হাসি নিজের মুখে তুলে নিয়ে অপরাজিতা রায় ঐ ফটকের কাছে দাঁড়িয়ে কিংশুককে স্বাগত ভঙ্গি নিবেদন করে সকালের দিকে, আর হিরন্ময়কে সন্ধ্যায়। হাসির কম-বেশি হয় না। তাই বুঝতে পারা যায় না, অপরাজিতার মন কোন দিকে, কার দিকে ? খিল-খিল করে হেসে ওঠে সামনের বাড়ির ঐ জানালার কাছে প্রফেসরের দুই মেয়ে, মীরা আর হীরা। 

তারাপদ রায়ের গল্প | মত্ত



একটা মামলার প্রয়োজনে একটা জেলা শহরে যেতে হয়েছিল। যথারীতি জেলা আদালতের উঠোনে এবং গেটের পাশে অনেকগুলি ভাতের হোটেল, পান-সিগারেট এবং মিষ্টির দোকান। এরই মধ্যে সবচেয়ে বড় মিষ্টির দোকানটায় গিয়ে দোকানের মালিককে জিজ্ঞাসা করলাম,‘আচ্ছা এখানে সবচেয়ে বড় উকিল কে? আমি বাইরে থেকে এসেছি, একটু জানতে পারলে উপকার হয়।’


আমার জিজ্ঞাসা শুনে প্রবীণ মিষ্টান্ন বিক্রেতা কি যেন একটু ভেবে তারপর বললেন,‘সবচেয়ে ভাল উকিল?’

আমি বললাম,‘হ্যাত্ষ। আমার একটা মামলার ব্যাপারে বিশেষ দরকার।’

‘সবচেয়ে ভাল উকিল হলেন বলাইবাবু, আমাদের এই জেলার মধ্যে,’ তারপর ভদ্রলোক কিঞ্চিত ইতস্তত করে বললেন, ‘অবশ্য তিনি যদি মাতাল অবস্থায় না থাকেন।’

অজিত কৌর এর গল্প - আলীবাবার মৃত্যু




অনুবাদ : রশীদ হায়দার

পরিণামে যেসব লোক ধুঁকতে ধুঁকতে মরে যায়, অসংখ্য মানুষের ভিড়ে যারা একটা অফিসে যাবতীয় কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য চাকরি করে, তাদের নাম কেরানি। তাদেরই একজন টাউন হল অফিসের সর্বোচ্চ তলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে মরে গেছে।

বন-জ্যোৎস্না ---নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়



জঙ্গলের মধ্যে জ্যোৎস্না পড়েছে।
দুপাশে নিবিড় শালের বন। কিন্তু নিবিড় হলেও পত্রাচ্ছাদন লতাগুল্মে জটিল নয়—পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিয়েছে পূর্ণিমার চাঁদ। আলো-আঁধারির মায়ায় অপরূপ হয়ে আছে অরণ্য।

সরু পায়ে চলার পথ দিয়ে শিউকুমারী এগিয়ে চলেছিল। কাঁখের কলসি দেহের ললিত ছন্দে দোল খাচ্ছে—শুকনো শালের পাতা পায়ের নিচে যেন আনন্দে গান গেয়ে উঠেছে। এই সন্ধ্যায় একা জঙ্গলের পথ নিরাপদ নয়। বাঘ আছে, ভালুক আছে, হাতি আছে, নীলগাই আছে, বরা আছে—কী নেই এই বিশাল অরণ্যে? তবু শিউকুমারীর ভয় করে না। তা ছাড়া ডুয়ার্সের বাঘ নিতান্তই বৈষ্ণব, পারতপক্ষে তারা মানুষের গায়ে থাবা তোলে না, এমনই একটা জনশ্রুতিতেও এ দেশের লোক প্রগাঢ়ভাবে আস্থাবান।

বনের মধ্য দিয়ে একা চলেছে শিউকুমারী। গায়ের রুপোর গয়নায় জ্যোৎস্নার ঝিলিক। জঙ্গলের বুকে একটা গভীর ক্ষতচিহ্নের মতো বিসর্পিত রেখায় ঝোরার জল যেখানে বয়ে গেছে, সেখানকার ঘন-বিন্যস্ত ঝোপের ভেতর উঠেছে বুনো ফুলের গন্ধ। জ্যোৎস্নায় মাতাল হয়ে ডেকে চলেছে হরিয়াল—পূর্ণিমা-রাত্রির মায়ায় তারও চোখ থেকে ঘুম দূর হয়ে গেছে। শুধু থেকে থেকে কোথায় তীব্রস্বরে চিৎকার করছে একটা ময়ূর—পাখা ঝটপট করছে, হয়তো বেকায়দায় পেয়ে কোথাও আক্রমণ করেছে শিশু একটা পাইথনকে। অকৃপণ পূর্ণিমা আর অনাবরণ সৌন্দর্যের মধ্যেও আরণ্যক আদিম হিংসা নিজেকে ভুলতে পারেনি—হরিয়ালের সুরে আর ময়ূরের ডাকে রুদ্র-মধুরের ঐকতান বেজে চলেছে।

তারাপদ রায়ের গল্প : কাঁঠাল কাঠের পিঁড়ি



আমাদের গ্রামের বাড়ির সামনে দিয়ে ইউনিয়ন বোর্ডের, মানে তৎকালীন পঞ্চায়েতের রাস্তাটা ছিল খুব নিচু। সেটা ছিল ইংরেজরা যাকে বলে ফেয়ার ওয়েদার রোড। অর্থাৎ, ভাল আবহাওয়ায় ব্যবহার করা যায়। অন্য সময়ে জল-কাদার জন্যে যাতায়াত কঠিন। তবে, বর্ষাকালে ধলেশ্বরীর জল ওই রাস্তা দিয়ে ঢুকে যেত। রীতিমত স্রোত। নৌকো চলে যেত ওই রাস্তা ধরে। তখন আমাদের গ্রাম হয়ে উঠত ভেনিস শহরের মতো। প্রত্যেক বাড়ির উঠোনে একটা করে নৌকো। এ বাড়ি-ও বাড়ি যাতায়াত হত নৌকোয়। বাজারে, ইস্কুলে যেতে হলে নৌকো ছাড়া গতি নেই।


আমাদের বাড়ির সদরে ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তার পাশ ঘেঁষে একটা প্রাচীন কাঁঠালগাছ ছিল। বর্ষাকালে যখন খাল দিয়ে নৌকো চলাচল শুরু হত, ওই কাঁঠালগাছটার গুঁড়ির সঙ্গে নৌকো এসে বাঁধত। আমাদের বাইরের বাড়ির সামনের অংশটুকুর নামই হয়ে গিয়েছিল কাঁঠালঘাট। কেউ কেউ বলত, মান্ধাইঘাট।