Saturday, May 20, 2017

অপরাধ দমনে ৩ হাজার লোক নেবে ফেসবুক



বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফেসবুক। দৈনন্দিন জীবনের নানা ঘটনার স্ট্যাটাস ফেসবুকে পোস্ট করেন অনেকেই। একই সঙ্গে খুনসহ নানা অপরাধমূলক পোস্টও দিন দিন বেড়ে চলেছে। এ ধরনের পোস্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নতুন করে জনবল নিতে যাচ্ছে ফেসবুক।

গ্যাজেট নাও-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফেসবুকের সহ-প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ সম্প্রতি জানান, ‘ফেসবুকে পোস্ট হওয়া সমস্ত ভিডিও এবং ছবি পর্যবেক্ষণ করতে নতুন করে আরো তিন হাজার লোক নিয়োগ দেওয়া হবে। ২০১৮ সালের মধ্যেই এই নিয়োগ শেষ করা হবে।’

জাকারবার্গ জানান, ‘এরই মধ্যে ফেসবুকের সব পোস্ট মনিটর করার জন্য চার হাজার ৫০০ লোক রয়েছে। যাদের কাজ কোনো পোস্ট সম্পর্কে ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে রিপোর্ট পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া। তিনি বলেন, ফেসবুকের শর্ত না মেনে কোনো পোস্ট করা হলে অভিযোগ না পেলেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

পুলিশের ভাষ্যমতে, গত সপ্তাহে থাইল্যান্ড বসবাসকারী এক বাবা তাঁর মেয়েকে ফেসবুক লাইভে হত্যা করেন। মুহূর্তেই সেই ভিডিও তিন লাখ ৭০ হাজার মানুষ দেখে। পরবর্তী সময়ে সেই লাইভ ভিডিও মুছে দেয় ফেসবুক কর্তৃপক্ষ।

এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে কিশোরীকে ধর্ষণ ও যুক্তরাষ্ট্রের ক্লিভল্যান্ডে ৭৪ বছরের রবার্ট গুডউইন নামক ব্যক্তিকে ফেসবুকে লাইভে গুলি করে হত্যার ভিডিও মুছে দেয় ফেসবুক।

আসছে ফেসবুক টিভি



ভাবছেন, আসছে ঈদে বোনাসের টাকায় একটা টিভি কিনে ফেলবেন? এতগুলো টাকা কেন টিভি কিনে নষ্ট করবেন? তার চেয়ে একটু সবুর করুন। আর কয়েক দিনের মধ্যে ফেসবুকেই পেতে যাচ্ছেন টিভির সুবিধা। না, কোনো লাইভ স্ট্রিমিং নয়, একবারে চিরাচরিত সেই টিভির মতো নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট অনুষ্ঠান আপনি ফেসবুকেই দেখতে পাবেন।

বিজনেস ইনসাইডারের বরাত দিয়ে ম্যাশেবল জানায়, ভিডিওকে অগ্রাধিকার দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে ফেসবুক। কেমন হবে ফেসবুকের টিভি? এমন প্রশ্নের উত্তরে সামাজিক যোগাযোগের দৈত্যাকৃতির এই মাধ্যমটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানায়, এ বছর জুনে টেলিভিশনের ধরন এবং অনুষ্ঠান নিয়ে তাদের ওয়েবসাইটে একটি তালিকা প্রকাশ করতে যাচ্ছে। যদিও অনুষ্ঠানের নাম এবং এতে কারা কাজ করবেন, সে ব্যাপারে কিছুই আপাতত জানা যায়নি। তবে প্রতিবেদন বলছে, অনুষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় দুই ডজনের কাছাকাছি।

ম্যাশেবলের বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবর অনুযায়ী জানা যায়, ফেসবুক মূলত দুই ধরনের অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে তাদের পরিকল্পনা সাজিয়েছে : চিরাচরিত টিভি অনুষ্ঠানের মতো স্ক্রিপ্টকে কেন্দ্র করে বড় বাজেটের অনুষ্ঠান এবং ছোট বাজেটের কিছু অনুষ্ঠান, যা প্রতিনিয়ত হালনাগাদ করা হবে। নেটফ্লিক্স, হুলু ও অ্যামাজনের মতো প্রতিষ্ঠানও এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু তাদের ভাগ্যও হয়েছে অ্যাপল, ভার্টিজন, স্ন্যাপচ্যাট এবং বর্তমান টুইটারে মতো। তারা টিভি খুললেও প্রকৃতপক্ষে মানসম্মত অনুষ্ঠান দিতে পারেনি কেউ।

আর বর্তমানে ফেসবুকের প্রতি মানুষের যে নির্ভরতা, তাতে যদি এর সঙ্গে টিভি যোগ করা হয় তাহলে আমরা আশা করতেই পারি যে ‘গেম অব থ্রোন’ অথবা ‘ওয়াকিং ডেড’-এর পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলো চিরাচরিত টিভি কিংবা ইন্টারনেটের সার্ভারগুলোতে নয়, বরং ফেসবুকের টিভিতেই দেখতে পাব। পাশাপাশি ফেসবুকের অন্য সুবিধাদি তো থাকছেই। ফলে ফেসবুকে ঢুঁ মারতে গিয়ে অনুষ্ঠান বা খেলার গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছুটে যাওয়ার আর কোনো আশঙ্কাই নেই

ইউসি ব্রাউজার বাংলাদেশে নিয়ে এলো বিডি এক্সপ্রেস



চীনের আলিবাবা মোবাইল বিজনেস গ্রুপের পোর্টফোলিও প্রতিষ্ঠান ইউসিওয়েব নিয়ে এসেছে ‘বিডি এক্সপ্রেস’। আজই প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে এই নিউজ এগ্রেগেটরটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। পাঠকের সংবাদপ্রাপ্তির অভিজ্ঞতাকে বদলে দেওয়ার লক্ষ্যে দেশের খ্যাতনামা নিউজপোর্টালগুলোর সহযোগিতায় অভিনবভাবে কাজ করবে বিডি এক্সপ্রেস। এনটিভি অনলাইন শুরু থেকেই এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে।

বিডি এক্সপ্রেস একটি শক্তিশালী অ্যালগরিদমসম্পন্ন নিউজ এগ্রেগেটর, যা কন্টেন্ট সংগ্রহের চিরাচরিত পথকে পরিবর্তন করে। এটি বিগ ডাটা নিখুঁতভাবে নিউজ পুশিং এবং পাঠককে সঠিক সংবাদ দিতে সক্ষম। আর এভাবেই প্রত্যেক ব্যবহারকারীর দৈনন্দিন তথ্য গ্রহণের সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে এটি।

ইউসি ব্রাউজারের অ্যানড্রয়েড ভার্সনের জন্য বিডি এক্সপ্রেস আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হয় ৫ আগস্ট। ইউসি ব্রাউজার ব্যবহারকারীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হওয়ার মাধ্যমে বিডি এক্সপ্রেস বাংলাদেশের প্রায় ১৬ লাখ ব্যবহারকারীকে আকৃষ্ট করেছে। বিডি এক্সপ্রেস রাজনীতি, প্রযুক্তি, বিনোদন, খেলাধুলা, লাইফস্টাইল, লেটেস্ট ট্রেন্ডসহ বিভিন্ন ধরনের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ পরিবেশন করবে। এটি একটি বিজ্ঞাপনমুক্ত সেবা, যা ব্যবহারকারীকে দ্রুত স্ট্রিমিং ও ব্রাউজিং অভিজ্ঞতা দেবে। এ অর্জনকে উদযাপন করতে, ইউসিওয়েব বিভিন্ন ক্ষেত্রের সেলিব্রেটির অংশগ্রহণে একটি ক্যাম্পেইন করবে।

চিরাচরিত অন্যান্য সংবাদ উৎসের সঙ্গে পার্থক্য করে বাংলাদেশে ইউসি ব্রাউজারের প্রোডাক্ট ম্যানেজার সিহাই ইও বলেন, ‘ইউসি ব্রাউজারের বিগ ডাটা এবং অ্যালগরিদম প্রযুক্তির ভিত্তিতে বিডি এক্সপ্রেস ব্যবহারকারীর সুবিধার্থে কাস্টমাইজড সংবাদ পরিবেশন করে, যা অন্যান্য সংবাদ উৎস থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। পাশাপাশি ইউসি ব্রাউজার পুশ নোটিফিকেশনের সহায়তায় ব্যবহারকারীরা তাৎক্ষণিক ব্রেকিং নিউজ পাবেন, যা তাদের জন্য আগ্রহজনক। এর অর্থ হলো, আমাদের ব্যবহারকারীদের কোনো স্প্যাম পেজ ফিল্টার করার দরকার নেই এবং তাঁরা তাঁদের চাহিদামতো প্রাসঙ্গিক সংবাদগুলো তাৎক্ষণিকভাবে পাবেন।’

অ্যাডভান্সড ক্লাউড এক্সেলারেশন এবং ডাটা কমপ্রেশন প্রযুক্তিগুলো অন্য যেকোনো ব্রাউজারের চেয়ে ইউসি ব্রাউজার নিউজ লোডিংয়ের ক্ষেত্রে দ্রুততর গতি নিশ্চিত করে। এতে রয়েছে শক্তিশালী অ্যাড-ব্লকিং ফাংশন, যার ফলে অন্যান্য নিউজ ওয়েবসাইটগুলোর মতো বিরক্তিকর ও অপ্রাসঙ্গিক বিজ্ঞাপন থেকে বিরত রেখে ব্যবহারকারীকে আরামদায়ক পড়ার পরিবেশের নিশ্চয়তা দেয়।

বিডি এক্সপ্রেসের প্রত্যাশা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রসঙ্গে হাওয়ার্ড লিয়াং—যিনি ইউসিওয়েব, আলিবাবা মোবাইল বিজনেস গ্রুপের বিজনেস ডিরেক্টর অব ইমার্জিং মার্কেট—তিনি বলেন, ‘অনন্য সব ফিচারকে ভিত্তি করে ইউসি ব্রাউজার এর গ্রাহকের মোবাইল ব্রাউজিং অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশে বিডি এক্সপ্রেস চালু হওয়ার মাধ্যমে ইউসি ব্রাউজারকে কন্টেন্টের টুল হিসেবে প্রস্তুত করতে আমাদের জন্য এটি একটি নতুন পদক্ষেপ। ইউসিওয়েব এবং আলিবাবা মোবাইল বিজনেস গ্রুপের পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে কন্টেন্ট ব্যবহারের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করা।’

আলিবাবা মোবাইল বিজনেস গ্রুপের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইউসিওয়েব ইনকরপোরেট (ইউসিওয়েব) শীর্ষস্থানীয় মোবাইল ইন্টারনেট সফ্টওয়্যার ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। ২০০৪ সালের শুরু থেকে ইউসিওয়েব সারা বিশ্বের মানুষের সেরা মানের মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারের অভিজ্ঞতা দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। ইউসিওয়েবের আন্তর্জাতিক পণ্য পোর্টফোলিওতে রয়েছে ইউসি ব্রাউজার (মোবাইল ব্রাউজিং সার্ভিস), ইউসি নিউজ (কন্টেন্ট এগ্রেগেটর) ৯ অ্যাপস (অ্যানড্রয়েড অ্যাপ স্টোর), ইউসি ইউনিয়ন (মোবাইল ট্যারিফ অ্যান্ড মোনেটাইজেশন প্ল্যাটফর্ম) ইত্যাদি। ইউসি ব্রাউজার বিশ্বের দ্বিতীয় মোবাইল ব্রাউজার, যেটি ২০১৬ সালের মে পর্যন্ত ২০ শতাংশের বেশি পেজ ভিউ মার্কেট শেয়ার নিয়ে রয়েছে (স্ট্যাট কাউন্টার অনুযায়ী)। মে, ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইউসি ব্রাউজার ৪০ কোটি সক্রিয় ব্যবহারকারী পেয়েছে, যেখানে ৯ অ্যাপসের ২৫ কোটি।

ইউসিওয়েব এবং এর বিভিন্ন পণ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ভিজিট করুন-www.ucweb.com

আলিবাবা মোবাইল বিজনেস গ্রুপ শীর্ষস্থানীয় মোবাইল কন্টেন্ট ও সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান। এর পোর্টফোলিও পণ্যতে রয়েছে মোবাইল ব্রাউজার, মোবাইল সার্চ, লোকেশন-বেইজড সার্ভিস, মোবাইল গেমিং, অ্যাপ স্টোর এবং মোবাইল রিডার অপারেশন। অত্যাধুনিক প্রযুক্তিগুলো এবং বিগ ডাটা নিয়ে আলিবাবা মোবাইল বিজনেস গ্রুপ মোবাইল ইন্টারনেটে নতুনত্ব ও নির্ভরযোগ্যতা আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

নতুন ক্রোমবুক আনছে স্যামসাং



অর্ধযুগ পার করল গুগলের ক্রোমবুক। আর এই লম্বা সময়ে গুগল তাদের ক্রোমবুক নির্মাণ করেছে ডেল, অ্যাসার কিংবা স্যামসাংয়ের মতো টেকজায়ান্টের সঙ্গে। স্বল্পমূল্য এবং মধ্যম ধাঁচের স্পেসিফিকেশনের নোটবুক কম্পিউটার হিসেবে ক্রোমবুকের পরিচিত থাকলেও নতুন ক্রোমবুকে সম্মিলন ঘটেছে বেশ শক্তিশালী হার্ডওয়্যারের। এ খবর জানাচ্ছে ফোর্বস।

স্যামসাংয়ের নির্মিত ক্রোমবুক প্রো বাজারে আসতে যাচ্ছে আগামী এপ্রিলে। ইন্টেলের কোর এমথ্রি-৬ওয়াই৩০ হেক্সাকোর প্রসেসর ব্যবহার করা হয়েছে ক্রোমবুক প্রোতে। ৪ গিগাবাইট র‍্যাম এবং ৩২ গিগাবাইট স্টোরেজ থাকবে এখানে। ওয়েব ব্রাউজিং থেকে শুরু করে বিভিন্ন অ্যানড্রয়েড অ্যাপ এখানে চলবে বাধাহীনভাবে।

তবে নতুন ক্রোমবুকে সবচেয়ে বেশি উন্নতি ঘটেছে তার পর্দায়। ২৪০০ x ১৬০০ রেজ্যুলুশনের টাচস্ক্রিন এলইডি পর্দা অ্যাপলের ম্যাকবুকের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার যোগ্যতা রাখে। অন্যদিকে ক্রোমবুক প্রো মাত্র ০.৫৫ ইঞ্চি পুরু এবং ওজন এক কেজির কিছু বেশি। সঙ্গে থাকছে দুটি ইউএসবি-সি পোর্ট। ৩.৫ মিমি হেডফোন জ্যাক, মাইক্রোএসডি কার্ড স্লট এবং ব্লুটুথের মতো আইও সুবিধা থাকছে অন্যান্য সাধারণ ল্যাপটপের মতো। অপারেটিং সিস্টেম বরাবরের মতই ক্রোম ওএস।

ক্রোমবুকের সঙ্গে থাকবে একটি টাচস্ক্রিন পর্দার উপযোগী পেন, যার ফলে বিভিন্ন অ্যাপ আরো বেশি স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবহার করা যাবে। ৩৬০ কোণে বাঁকানো যাবে ক্রোমবুক প্রোকে, যার ফলে ট্যাব হিসেবেও ব্যবহারে কোনো সমস্যা থাকবে না।

গুগলের ক্রোমবুক দিন দিন আরো বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠছে। এমনকি অনেক শক্তিশালী পিসি এবং ম্যাকবুকের সঙ্গেও প্রতিযোগিতায় নামতে যাচ্ছে তারা। মার্চ মাস থেকে পাওয়া যাবে ক্রোমবুক প্রো, যার দাম ধরা হয়েছে ৫৪৯ মার্কিন ডলার।

সবচেয়ে শক্তিশালী সুপারকম্পিউটার চীনের কাছে



বর্তমানে সারা বিশ্বে হাতে গোনা কয়েকটি সুপার কম্পিউটার রয়েছে। সেই সংক্ষিপ্ত তালিকায় এবার নাম লেখালো চীনে নির্মিত সুপার কম্পিউটার ‘সানওয়ে তাইহু লাইট’। শুধু নাম লেখানোতেই থেমে থাকেনি। তালিকায় সবচেয়ে শক্তিশালী কম্পিউটারের জায়গাটিও দখল করেছে চীনা সুপার কম্পিউটারটি। প্রযুক্তিবিষয়ক ওয়েবসাইট ম্যাশেবলের এক প্রতিবেদনে এ খবর জানানো হয়েছে।

সুপার কম্পিউটারের মালিক হওয়া চীনের জন্য নতুন কিছু নয়। এর আগে শীর্ষ স্থান দখল করে থাকা সুপার কম্পিউটারটিও চীনাদের হাতেই তৈরি। তবে একদিক থেকে সানওয়ে তাইহু লাইট পূর্ববর্তী সকল চীনা সুপার কম্পিউটার থেকে অনন্য।

কারণ চীনাদের নতুন এই সৃষ্টির আপাদমস্তক চীনে তৈরী যন্ত্রাংশ দিয়ে নির্মিত। আগের তিয়ানহি-২ সুপার কম্পিউটারে ব্যবহার করা হয়েছিল মার্কিন প্রতিষ্ঠান ইন্টেলের চিপ।
চীনের এই সুপার কম্পিউটারের বিশালত্ব বোঝানোর জন্য এটির চিপকে তুলনা করা যেতে পারে ইন্টেলের সর্বশেষ কোরআই ৭ প্রসেসরের সাথে। যেখানে ইন্টেলের এই প্রসেসরে রয়েছে ১০টি কর্মক্ষম কোর সেখানে সানওয়ে তাইহু লাইটে রয়েছে এক কোটিরও বেশি কোর।

তালিকায় তৃতীয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী সুপার কম্পিউটার টাইনের সাথে কার্যক্ষমতার দিকে থেকে যার তফাৎ অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়নে থাকা টাইটান রয়েছে ওক রিজ ন্যাশলান ল্যাবরেটরিতে, যার কোর সংখ্যা পাঁচ লক্ষ ৬০ হাজার।

সুবিশাল সুপার কম্পিউটারটি কাজের দিক থেকেও অতীতের সকল সুপার কম্পিউটারের চাইতে অনেক এগিয়ে। প্রতি সেকেন্ডে ৯৩ কোয়াডড্রিলিয়ন গণনা পরিচালনা করতে পারে। সংখ্যাটিকে অংকে লিখতে হলে ৯৩ এর পর বসাতে হবে ১৫টি শূণ্য।

তবে এত কর্মক্ষম হয়েও শক্তি খরচের দিক থেকে দারুণ কিপটে সানওয়ে তাইহু লাইট। খুব কম শক্তি খরচ করে কাজ চালাতে পারবে এটি। একই সাথে র‍্যাম ব্যবহারের ক্ষেত্রেও সাশ্রয়ী।

টপ ৫০০ ওয়েবসাইটে মোট ৫০০ সুপার কম্পিউটারের তালিকাতেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে হারিয়ে দিয়েছে চীন। মোট সুপার কম্পিউটারের হিসাবে এখন শীর্ষে অবস্থান করছে চীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানায় যেখানে ১৬৫টি সুপার কম্পিউটার রয়েছে সেখানে চীনের মালিকানায় রয়েছে ১৬৭টি।

গ্যালাক্সি এস৮-এর ৮ চমক!



উন্মোচিত হয়েছে বছরের অন্যতম আলোচিত স্মার্টফোন স্যামসাং গ্যালাক্সি এস৮। ফিচার এবং স্পেসিফিকেশনের দিক থেকে স্যামসাংয়ের এই ফ্ল্যাগশিপ সিরিজ সব সময়ই নতুন এক মাত্রা সৃষ্টি করে। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বেজেললেস পর্দা, হোম বাটনকে বিদায় জানানো, উন্নত সেলফি ক্যামেরাসহ বেশ কিছু ফিচার এরই মাঝে প্রযুক্তি দুনিয়ায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।

দ্য ভার্জ তাদের এক প্রতিবেদনে এ রকম বেশ কিছু অভিনব এবং চমক জাগানো ফিচারের কথা জানাচ্ছে। চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক সেসব ফিচারে-

১। ইনফিনিটি ডিসপ্লে

গ্যালাক্সি এস৮-এ থাকছে পাঁচ দশমিক আট ইঞ্চির পর্দা। বর্তমানে অন্যান্য ফ্ল্যাগশিপের মতোই পর্দার আকার হলেও একদিক থেকে অভিনব এস৮। উপরে এবং নিচের সামান্য অংশ বাদ দিলে স্মার্টফোনের সম্মুখভাগের প্রায় সম্পূর্ণই সুপার অ্যামোলেডের পর্দা। অবশ্য এই বিশালাকার পর্দার জন্য অ্যাসপেক্ট রেশিওতে এসেছে পরিবর্তন। ১৬:৯ অ্যাসপেক্ট রেশিওর পরিবর্তে এস৮-এ সেটি ১৮.৫:৯। অন্যদিকে ছয় দশমিক দুই ইঞ্চির এস৮ প্লাস নামের আরেকটি সংস্করণও নির্মাণ করেছে স্যামসাং।

২। ফোর্স টাচ

অ্যাপলের মতো স্যামসাং তাদের নতুন ফিচারকে ঠিক ‘ফোর্স টাচ’ নামে না ডাকলেও আদতে তার কার্মপদ্ধতি একই। অন্যদিকে স্যামসাং তাদের ফোনের আইকনিক হোম বাটনকে বিদায় জানিয়েছে। তার পরিবর্তে জায়গা করে নিয়েছে ভার্চুয়াল হোম বাটন। তা ছাড়া ফিংগার প্রিন্ট স্ক্যানারের অবস্থান এখন ফোনের পেছনে ক্যামেরার ঠিক পাশে।

৩। উন্নত সেলফি ক্যামেরা

গ্যালাক্সি সিরিজের স্মার্টফোনগুলোর ক্যামেরার ব্যাপারে স্যামসাং সব সময় গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তবে এস৮-এর ক্ষেত্রে মূল ক্যামেরার তেমন একটা পরিবর্তন আসেনি। তবে সেলফি ক্যামেরায় উৎকর্ষ সাধন করেছে স্যামসাং। ৮ মেগাপিক্সেল এফ/১.৭ লেন্সে রয়েছে অটোফোকাস সুবিধা।

৪। ফেস স্ক্যানিং

‘ফেসিয়াল রিকোগনিশান’ অ্যানড্রয়েড স্মার্টফোনের জন্য একদম নতুন কিছু নয়। তবে গ্যালাক্সি এস৮-এ এই ফিচার আরো বেশি নির্ভুল এবং দ্রুত। ফিংগার ফ্রিন্ট স্ক্যানার ফোনের পেছনে চলে যাওয়ার কারণে এখন আঙ্গুলের পরিবর্তে ব্যবহারকারীর মুখচ্ছবিই আরো বেশি কার্যকর হয়ে উঠবে ফোনের লক খোলার কাজে।

৫। বিক্সবি

মাইক্রোসফট, গুগল কিংবা অ্যাপলের দেখানো পথ অনুসরণ করল স্যামসাং। এস৮ স্মার্টফোনে থাকছে স্যামসাংয়ের নিজস্ব ভার্চুয়াল অ্যাসিস্টেন্ট ‘বিক্সবি’। মূলত ফোনের বিভিন্ন ফিচার ব্যবহার-বান্ধব করার দায়িত্বে থাকবে বিক্সবি। রিমাইন্ডার ব্যবহার কিংবা ওয়াই-ফাইয়ের মাধ্যমে ফোনকে অন্য কোনো ডিভাইস যেমন টিভির সঙ্গে যুক্ত করা যাবে বিক্সবির মাধ্যমে।

৬। ডেক্স

শুধু হাতের স্মার্টফোনের মাধ্যমে ডেস্কটপ কম্পিউটারের সব কর্ম সমাধান এখন আর স্বপ্ন নয়। এইচপিসহ বেশ কিছু প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে সে উদাহরণ দেখিয়েছে। এস৮-এর মাধ্যমে ডেস্কটপ কম্পিউটারের অভিজ্ঞতা দেওয়ার জন্য স্যামসাং নির্মাণ করেছে ডেক্স। ডেক্স মূলত স্মার্টফোনের সঙ্গে ডেস্কটপ কম্পিউটারকে যুক্ত করার জন্য একটি স্ট্যান্ড, যেখানে থাকছে ইউএসবি-সি-সহ আরো কিছু পোর্ট। যেকোনো ডেস্কটপ কম্পিউটার পর্দাকেই বানিয়ে ফেলবে এস৮-এর ডেস্কটপ সংস্করণ।

৭। ৩.৫ মিমি হেডফোন জ্যাক

অন্যসব টেক জায়ান্ট যখন তাদের ফ্ল্যাগশিপ থেকে ৩.৫ মিমি হেডফোন জ্যাক সরিয়ে ফেলায় ব্যস্ত, স্যামসাং তখনো এস৮-এ যত্নসহ জায়গা দিয়েছে হেডফোন জ্যাককে। যদিও এস৮ সর্বশেষ ব্লুটুথ প্রযুক্তি ব্লুটুথ ৫ সমর্থন করে, তারপরও হেডফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে তারা সম্পূর্ণ ব্লুটুথের ওপর নির্ভরশীল হয়নি। পুরোনো হেডফোন জ্যাকই এখনো বেশির ভাগ ব্যবহারকারীর জন্য বেশ আস্থার নাম।

৮। নিরাপদ ব্যাটারি

স্যামসাংয়ের জন্য এক কালো অধ্যায়ের নাম নোট ৭। তাদের এই ফ্ল্যাগশিপের ব্যাটারি বিস্ফোরণ শুধু তাদের বিলিয়ন ডলারের লোকসানই করেনি, চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তাদের ভাবমূর্তি। ক্রেতাদের আস্থার জায়গাতেও বড় একটি ফাটল ধরিয়েছে। তবে এস৮-এ এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটবে না বলেই মনে করছে প্রতিষ্ঠানটি। স্যামসাং জানিয়েছে, আট ধাপে বিভিন্ন ধরনের নিরীক্ষা চালানো হয়েছে ব্যাটারি নিয়ে। আশা রাখা যায়, নোট ৭-এর ভাগ্য বরণ করতে হবে না এস৮-কে।

মোবাইল ফোন চার্জ নিয়ে ভুল ধারণা



মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের প্রতিদিনই নিজের ফোনটিকে চার্জ দিতে হয়। এটি একটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছে ব্যবহারকারীদের। তবে এই চার্জ দেওয়া নিয়ে কিছু ভুল ধারণা আমরা লালন করি, বা পালন করি। মানে বলা হয়, এটা করলে ফোনের ক্ষতি হবে, ওটা করলে ব্যাটারির সমস্যা হবে ইত্যাদি।

প্রায় সব স্মার্টফোনেই থাকে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি। আর মাঝেমধ্যেই এসব ব্যাটারির বিস্ফোরণের খবর পাওয়া যায়। কিছুদিন আগেই স্যামসাং গ্যালাক্সি নোট ৭ মোবাইল ফোনের ব্যাটারি বিস্ফোরণ প্রসঙ্গটি আলোচনায় এসেছে। ফলে ব্যাটারি সংক্রান্ত ভুল ধারণাগুলো আরো পাকাপোক্ত হয়েছে। যদিও  স্যামসাং গ্যালাক্সি নোট ৭-এর ব্যাটারি বিস্ফোরণ নির্মাণজনিত ত্রুটি ছাড়া আর কিছুই নয়।

মোবাইল ফোনে যেন আগুন না ধরে যায় সেভাবেই যন্ত্রটির ব্যাটারি বানানো হয়। আর সঠিকভাবে নির্মিত লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি অন্তত আপনার পকেটে জ্বলে উঠবে না। কাজেই অযথা ভয় না পেয়ে চলুন জেনে নিই চার্জ দেওয়া নিয়ে ছয়টি ভুল ধারণার কথা। ধারণাগুলো প্রকাশ করা হয়েছে ম্যাশেবল নামের এক ওয়েবসাইটে।

ধারণা ১ : সারারাত মোবাইলে চার্জ দেওয়া খারাপ

কিছু পুরোনো মডেলের মোবাইল ফোন ছাড়া বেশির ভাগ স্মার্ট ফোন নিজে থেকেই বুঝে নেয় যে তার চার্জ পরিপূর্ণ হয়েছে। যখন চার্জ পূর্ণ হয় তখন নিজে থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে চার্জ নেওয়া বন্ধ করে দেয় ফোন। স্মার্টফোনের এই বৈশিষ্ট্যের কারণেই আপনি নিরাপদ।

ধারণা ২ : সম্পূর্ণ চার্জ শেষ না হওয়া পর্যন্ত নতুনভাবে চার্জ দেওয়া যাবে না

এটা সচরাচর না করাই ভালো। লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি আপনার টিভির রিমোটের ব্যাটারির মতো নয় যে ব্যাটারির শক্তি শেষ হওয়ার আগেই নতুন ব্যাটারি ব্যবহার করা যাবে না। অথবা ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে না গেলে নতুনভাবে চার্জ দেব না- এরকম ধারণা রাখাই উচিত নয়। পুরোনো নিকেল-মেটাল হাইড্রাইড ব্যাটারির মতো মেমোরি এফেক্ট (পুরোনো ব্যাটারির ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ চার্জ শেষ না হলে নতুনভাবে চার্জ না নেওয়াকে বলে মেমোরি এফেক্ট) আপনার নতুন স্মার্টফোন এবং মোবাইল ফোনের ব্যাটারির ক্ষেত্রে নেই। বরং এ রকম মনে করে সম্পূর্ণ চার্জ শেষ করে চার্জ দিলে আপনার মোবাইল ফোনের ক্ষতি হতে পারে। তাই যখন খুশি তখন, উপযুক্ত জায়গা পেলে, সেখানেই চার্জ দেবেন।

ধারণা ৩ : ফোন চার্জের সময় তা ব্যবহার করা যাবে না

চার্জের সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা না থাকলেও অনেকে পরামর্শ দেন এটি না করার জন্য। কারণ তারা মনে করেন এটি করলে তা মোবাইল ফোনের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। যদিও অন্যসব ভুল ধারণার মতো এটিরও কোনো ভিত্তি নেই। এই ভুল ধারণাটি আরো শক্ত হয় ২০১৪ সালে, সেসময় চার্জ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী এক নারীর মৃত্যু হয়। ঘটনাটি ঘটে অস্ট্রেলিয়ায়। যদিও কর্তৃপক্ষ পরে দেখেছেন, কম দামি ইউএসবি চার্জার ব্যবহার করার জন্যই এ ঘটনা ঘটেছিল। তাই চার্জ দিয়ে মোবাইল ফোন ব্যবহার সম্পূর্ণ নিরাপদ, তবে সস্তা চার্জার থেকে সাবধান। আর ভেজা হাতে চার্জ লাগানো মোবাইল না ধরাই ভালো।

ধারণা ৪ : সকল চার্জার একইভাবে নির্মিত

চার্জার আপনার মোবাইল ফোনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে, এটার মধ্যে আর কতটুকু বৈচিত্র্য থাকতে পারে? চার্জার নিয়ে এ রকম ধারণা অনেকেরই আছে। কিন্তু আসলে একটি ভালো চার্জারের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। তাই নকল চার্জার ব্যবহার করা উচিত নয়। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ কেন শেরিফ বাজারে অ্যাপলের চার্জারের ছদ্মবেশে থাকা বেশকিছু নকল চার্জার নিয়ে গবেষণা করেছেন। এগুলোই মূলত আপনার মোবাইল ফোনকে নষ্ট করা এবং আগুন ধরিয়ে দেওয়ার জন্য দায়ী। নামকরা ব্র্যান্ডের চার্জার না কিনলেও চার্জারের ভালো-মন্দ দেখে সেটা কেনা উচিত। ভালো চার্জার মানেই আপনার মোবাইল দ্রুত চার্জ হওয়ার পাশাপাশি বিদ্যুতের অতিরিক্ত তাপে তা গলে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে।

ধারণা ৫ : সপ্তাহে সাতদিন ২৪ ঘণ্টা মোবাইল চালু রাখা যাবে না

সারাক্ষণ মোবাইল খোলা রাখলে আপনার ব্যাটারির জীবনের মেয়াদের ওপর প্রভাব পড়তে পারে কিন্তু মোবাইল ফোনটি বন্ধ করে রাখা এর কোনো সমাধান নয়। এ জন্য সপ্তাহে একবার মোবাইল রিবুট অপশন থেকে পুনরায় বুট করে নেওয়া উচিত। এতে আপনার মোবাইলের কর্মক্ষমতা উন্নয়নেও তা সহায়ক হবে।

ধারণা ৬ : ‘লোকেশন সার্ভিস’ বা অবস্থান সংক্রান্ত সেবা আপনার ব্যাটারির ক্ষমতা নষ্ট করছে

মোবাইল ফোনে চালু অ্যাপগুলো যা অবস্থান সংক্রান্ত সেবা দিয়ে থাকে তা ব্যবহারের কারণে ব্যাটারির ধারণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে, এ রকম অভিযোগ অনেকের কাছেই শুনে থাকবেন। আইটি বিষয়ক সাইট অ্যান্ড্রয়েড অথরিটির মতে এই ধারণাটিও ভুল। এ রকম অনেক সেবামূলক অ্যাপ রয়েছে যা ব্যবহার করলে আপনার অ্যাপের চার্জ দ্রুত ফুরিয়ে যেতে পারে, তার মানে এই নয় যে এটি আপনার মোবাইল ফোনের ব্যাটারির জন্য ক্ষতিকর। আপনি আপনার মোবাইল ফোনে লোকেশন সার্ভিস ব্যবহার করতে চাইলে তা নির্বিঘ্নে ব্যবহার করতে পারেন। এটি কখনই আপনার ব্যাটারির জীবননাশ করবে না।

আপনার এন্ড্রয়েড ফোনটি গুগল সার্টিফায়েড কি না, নিজেই দেখুন!



গুগল প্লেস্টোরের সেটিং অপশনে গিয়ে দেখে নিতে পারেন আপনার এন্ড্রয়েড ডিভাইসটি গুগল সার্টিফায়েড কি না। সেটিং-এর একেবারে নিচে ডিভাইস সার্টিফিকেশন (Device Certification) নামে একটি মেন্যু দেখতে পাবেন, যেখানে আপনার ডিভাইসের সার্টিফিকেশন স্ট্যাটাস দেওয়া থাকবে। যদি আপনার স্মার্টফোনটি গুগল দ্বারা সার্টিফায়েড হয় তবে এখানে Certified কথাটি লেখা দেখতে পাবেন, না হলে লেখা থাকবে Uncertified।

ডিভাইস সার্টিফিকেশন (Device Certification) কি?
এন্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমটি যেহেতু ওপেন সোর্স সফটওয়ার সেহেতু যে কোনো স্মার্টফোন প্রস্তুতকারক এন্ড্রয়েড সোর্সকোড নিয়ে তার মতো করে এন্ড্রয়েড হ্যান্ডসেট তৈরি করতে পারে। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও বেশ কয়েকটি এন্ড্রয়েড হ্যান্ডসেট প্রস্তুতকারক কোম্পানি গড়ে উঠেছে এন্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেমের এই সহজলভ্যতার কারণে। যেহেতু প্রত্যেকটি কোম্পানি তার মতো করে যন্ত্রাংশ এবং কনফিগারেশন নিয়ে হ্যান্ডসেট বানাচ্ছে, সেহেতু এন্ড্রয়েড ইকোসিস্টেমে একধরনের শৃঙ্খলার অভাব দেখা দেয়। এ কারণে এন্ড্রয়েড হ্যান্ডসেটগুলো নানা রকম অভিযোগের মুখে পড়ে যেমন- অনেক সময় অ্যাপ্লিকেশনগুলো ঠিকমতো চলে না, ধীরগতিতে সাড়া দেয়, হ্যাং হয়ে যাওয়া, ব্যাটারি দ্রুত শেষ হয়ে যাওয়া, ভাইরাসের আক্রমণ ইত্যাদি।

এ কারণেই গুগল এন্ড্রয়েড ইকোসিস্টেমে শৃঙ্খলা তৈরি করা এবং নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করার জন্য ডিভাইস সার্টিফিকেশন ব্যবস্থাটি সামনে নিয়ে আসে। এর মাধ্যমে প্রতিটি হ্যান্ডসেটকে একটি কম্পেটিবিলিটি টেস্ট বা সামঞ্জ্যতা পরীক্ষায় পাস করতে হয়। এই পরীক্ষায় পাস করা মানে হচ্ছে হ্যান্ডসেটটি গুগল মোবাইল সার্ভিস (জিএমএস) Google Mobile Service (GMS)  ব্যবহারের জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত। গুগল প্লেস্টোর সেবা এবং গুগলের অন্যান্য প্রধান এন্ড্রয়েড অ্যাপ যেমন জিমেইল, ম্যাপস, ফটোজ, ক্রোম, ইউটিউব, ড্রাইভকে একসঙ্গে গুগল মোবাইল সার্ভিস (জিএমএস) বলে থাকে।

mob



আপনার সেটটি সার্টিফায়েড না হলে?
তার মানে এই নয় যে আপনার সেটটি নকল। এর মানে হতে পারে গুগলের ডিভাইস সার্টিফিকেশন পরীক্ষার জন্য আপনার কোম্পানি চুক্তিবদ্ধ নয়। অথবা চুক্তিবদ্ধ কিন্তু এখনো পর্যন্ত কম্পেটিবিলিটি টেস্ট বা সামঞ্জস্যতা পরীক্ষায় পাসের সার্টিফিকেশন পাওয়া যায়নি। হতাশ হওয়ার কিছু নেই; বাজারে বিদ্যমান বেশ কিছু নামিদামি ব্র্যান্ডের কম মূল্যের সেট আনসার্টিফায়েড (Uncertified) অবস্থায় পাওয়া গেছে।

উল্লেখ্য, গুগল সার্টিফায়েড ম্যানুফ্যাকচারার লিস্টে বাংলাদেশের ওয়ালটন এবং সিম্ফোনির নাম দেখা যাচ্ছে। তার মানে কোম্পানি দুটি গুগল পার্টনার কোম্পানি হিসেবে এন্ড্রয়েড অপারেটিং সফটওয়ার তাদের হ্যান্ডসেটে ব্যবহার করছে। নিচের লিংকে গিয়ে খুঁজে নিন আপনার হ্যান্ডসেট প্রস্তুতকারকের নাম :

https://www.android.com/gms/partners/

এখনই দেখে নিন আপনার সেটটি গুগল সার্টিফায়েড কি না!

বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত পদার্থবিজ্ঞানী জাহিদ হাসান



এরকম যে একটা কণার অস্তিত্ব থাকতে পারে, ৮৫ বছর আগেই হারম্যান ভাইল নামে এক বিজ্ঞানী প্রথম জানিয়েছিলেন। কিন্তু ভাইলের সেই কণাকে গবেষণাগারে শনাক্ত করে ফেলেন আমেরিকার প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত পদার্থবিজ্ঞানী জাহিদ হাসান। সত্যেন বসুর বোসন আবিষ্কারের ৯১ বছর পর আর এক বাঙালি গবেষকের নেতৃত্বে আবিষ্কৃত হল নতুন গ্রুপের একটি কণা, যা আবিষ্কারের পর কেবল তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান পাল্টে যাবে না, ইলেকট্রনিক ও কম্পিউটার দুনিয়ায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। গত বৃহস্পতিবার আমেরিকার সায়েন্সপত্রিকা ‘সায়েন্স’-এ জাহিদ হাসানের নেতৃত্বে গবেষক দলের এই সাফল্যের খবর ও ‘ভাইল ফার্মিয়ন’ কণার সন্ধান মেলার প্রামাণ্য তথ্য বিশদভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। জাহিদ হাসান জানিয়েছেন, ভাইল ফার্মিয়নের অস্তিত্ব প্রমাণিত হওয়ায় দ্রুতগতির ও অধিকতর দক্ষ ইলেকট্রনিক্স যুগের সূচনা হবে। কেমন হবে সেই নতুন যুগের ইলেকট্রনিক সামগ্রী? অধ্যাপক হাসানের কথায়, এই আবিষ্কার কাজে লাগিয়ে আরও কার্যকর নতুন প্রযুক্তির মোবাইল ফোন বাজারে এসে যাবে, যা ব্যবহারে তাপ সৃষ্টি হবে না। কারণ, ভাইল ফার্মিয়ন কণার ভর নেই। এটি ইলেকট্রনের মতো পথ চলতে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ে না। তৈরি হবে নতুন প্রযুক্তির কম্পিউটার ও বৈদ্যুতিক নানা সামগ্রী। এম জাহিদ হাসান ছোটবেলায় ঢাকার ধানমন্ডি গভ. বয়েজ স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। ঢাকা কলেজের প্রাক্তন এই ছাত্রের পিএইচডি স্টানফোর্ডে। এরপরশিক্ষকতা ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ায়। এখন প্রিন্সটনে গবেষণার পাশাপাশিশিক্ষকতা করছেন এই বাংলাদেশী পদার্থবিদ। এই পৃথিবী, যাবতীয় গ্রহ-নক্ষত্র, নদীনালা, সমুদ্র, পর্বত, প্রাণিজগৎ, গাছপালা, মানুষ সব ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার পি-। মহাজগতের এসব বস্তুকণাকে বিজ্ঞানীরা দুটি ভাগে ভাগ করেন। একটি ‘ফার্মিয়ন’, অন্যটি ‘বোসন’, যা আবিষ্কার করেছিলেন বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, তার নামেই ‘বোসন’ কণা। ‘ফার্মিয়ন’ কণার একটি উপদল হল ‘ভাইল ফার্মিয়ন’। ১৯২৯ সালে বিজ্ঞানী হারম্যান ভাইল এই ‘ভাইল ফার্মিয়ন’ কণার অস্তিত্বের কথা জানিয়েছিলেন, তার নামেই এই অধরা কণার নামকরণ হয়েছিল। ১৯২৯ সাল থেকেই পদার্থবিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালিয়ে গেছেন ‘ভাইল ফার্মিয়ন’-এর অস্তিত্ব প্রমাণের। ৮৫ বছর ধরে সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সন্ধান মিলল সেই অধরা কণা ‘ভাইল ফার্মিয়ন’-এর। অধ্যাপক জাহিদ হাসান জানিয়েছেন, মোট তিন ধরনের ফার্মিয়নের মধ্যে ‘ভিরাক’ ও ‘মায়োবানা’ ফার্মিয়নের খোঁজ আগেই পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু বহু পরীক্ষায় দীর্ঘ দিনেও ‘ভাইল ফার্মিয়ন’-এর সন্ধান না মেলায় মাঝে তারা ভেবেছিলেন, নিউট্রিনোই সম্ভবত ভাইল ফার্মিয়ন। কিন্তু পরে এ ভাবনা পরিত্যক্ত হয়েছে কারণ নিউট্রিনোর ভর আছে, ভাইল ফার্মিয়ন ভরশূন্য। অবশেষে তার সন্ধান মিলল। ইলেকট্রনিক্সের নবযুগ আসন্ন। সূত্র : টাইমস অব ইন্ডিয়া।

চুমু নিয়ে নতুন গবেষণা



চুমু নিয়ে প্রকাশিত নতুন গবেষণা থেকে জানা যায়, সুনির্দিষ্ট হরমোনের কারণে মানুষ চুমু খায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চুমু অনেক সম্পর্ককে আরো গভীর করে আবার একদমই ভেঙেও দেয়। চুমু থেকে একজন মানুষ অন্য একজনের রুচি, তার শরীরের গন্ধ, এমনকি রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে পারে। যৌনমিলনের আগে নারীর কাছে চুমুর গুরুত্ব পুরুষের চেয়ে বেশি। গবেষণার এ তথ্যগুলো প্রকাশিত হয়েছে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস উপলক্ষে।
চুমু খাওয়ার বৈজ্ঞানিক নাম ফিলেমাটোলজি । গবেষকরা এখন কেন মানুষ চুমু খায়, তার কার্যকারণ নিয়ে গবেষণা করছেন। তবে চুমু নিয়ে এটিই প্রথম গবেষণা নয়। অতীতের গবেষণাগুলো থেকে জানা যায়, বিশ্বের সব দেশের সব সংস্কৃতিতে চুমু খাওয়ার রেওয়াজ আছে। রোমান্টিক সম্পর্ক আছেÑ এমন ব্যক্তিরা একে অন্যকে চুমু খান। এর পেছনে জৈবিক কারণটি এখন বেশি করে খোঁজা হচ্ছে। ১৩ ফেব্রুয়ারি আমেরিকার শিকাগো শহরে আমেরিকান অ্যাডভান্সমেন্ট অফ সায়েন্স একাডেমির বার্ষিক সভায় চুমু খাওয়ার বৈজ্ঞানিক কারণগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। দুনিয়ার অনেক নামকরা বিজ্ঞানী ও গবেষক এতে অংশ নেন।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ গর্ডন গালফ জুনিয়র তার এক গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বলেন, পরস্পরকে পছন্দ করে প্রেমে জড়িয়েছেনÑ এমন ৫৯ শতাংশ পুরুষ ও ৬৬ শতাংশ নারী প্রথম চুমুর পর তাদের সম্পর্কের ইতি টেনেছেন। ১ হাজার কলেজ পড়–য়া ছেলেমেয়ের ওপর পরিচালিত এক জরিপ থেকে আরো জানা গেছে, নারীরা যৌনমিলনের আগে চুমু খেতে বেশি পছন্দ করেন।
অন্যদিকে সভাতে নিউরোসায়েন্সের অধ্যাপক ওয়েন্ডি হিল জানিয়েছেন, অক্সিটোসিন (ড়ীুঃড়পরহ) নামের একটি হরমোন মানুষকে চুমু খেতে আগ্রহী করে তোলে কিংবা বলা চলে প্ররোচিত করে। তাই কেউ কেউ এ হরমোনকে ‘লাভ হরমোন’ বা ভালোবাসার হরমোন বলেন। মানুষের মধ্যে যে সামাজিক বন্ধনের আকাক্সক্ষা ও মানসিক চাপ তৈরির ঘটনা ঘটে, তার পেছনেও এ হরমোনের ভূমিকা রয়েছে।
ওই দিনের সভায় চুমু নিয়ে আরো অনেক মজার আলোচনাও হয়েছে। সেসঙ্গে চুমুর উৎপত্তি নিয়েও কথা হয়েছে। একজন গবেষক জানিয়েছেন, সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা থেকে চুমুর উৎপত্তি। তিনি যুক্তি দিয়েছেন, আগেকার দিনে যখন কৌটাভর্তি শিশুখাদ্য ছিল না কিংবা খাবার শিশুদের উপযোগী করার কৌশল মানুষ জানতো না। তখন মা খাবার চিবিয়ে শিশুর উপযোগী করে সেটি চুমুর মাধ্যমে নিজের মুখ থেকে সরাসরি শিশুর মুখে দিয়ে দিতেন। সেখান থেকেই মানুষ ভালোবাসার প্রকাশ ঘটাতে থাকে আর এখন প্রিয় মানুষের মুখে মুখ লাগিয়ে চুমু খায়।

সাগরের ব্যাকটেরিয়া থেকে মহৌষধ



বায়োটেকনোলজির জগতে এ প্রথমবারের মতো অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি হবে সাগরে খুঁজে পাওয়া ব্যাকটেরিয়া থেকে। নরওয়ের সিনটাফ ও ইউনিভার্সিটি অফ বার্গেন-এর গবেষকদের আবিষ্কৃত ৯ প্রজাতির ব্যাকটেরিয়ার তৈরি উপাদান ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে সক্ষম। আবিষ্কৃত আরো ৩টি ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে নতুন অ্যান্টিবয়োটিক প্রস্তুত করা সম্ভব। গবেষকরা বলেন, এদের একটিও যদি সফল হয় তাতেও চিকিৎসাবিজ্ঞান এগিয়ে যাবে। ইতোমধ্যে সাগরের ব্যাকটেরিয়া থেকে ১১টি ক্যান্সার প্রতিরোধকারী উপাদান লিউকেমিয়া, পাকস্থলী, কোলন ও প্রোস্টেট ক্যান্সারের বিরুদ্ধে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। যা কিনা কিছু ক্যান্সার কোষ পুরোপুরি ধ্বংস করতে পেরেছে। সুস্থ কোষের ক্ষতি ছাড়াই! লাইভসায়েন্স

কৃত্রিম মস্তিষ্ক!



আলঝেইমার্স রোগ থেকে মুক্তি দিতে বিজ্ঞানীরা তৈরি করছেন কৃত্রিম নার্ভাস সিস্টেম তথা মস্তিষ্ক। মানুষের মস্তিষ্কের মূল অংশগুলোর রেপ্লিকা তৈরির কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে বলে জানিয়েছে যুক্তরাজ্যের এস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা। বিশেষজ্ঞরা টিউমার থেকে সংগৃহীত কোষকে রিপ্রোগ্রাম করে তা দিয়েই øায়ুতন্ত্রের রেপ্লিকা তৈরি করছেন। টেলিগ্রাফকে গবেষকরা বলেন কৃত্রিম মস্তিষ্ক ডিমনেশিয়া রোধে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। গবেষণা দলের প্রধান মিশেল কোলমেন বলেন, ‘মানুষের মস্তিষ্কের যে অংশটি প্রাথমিক চিন্তাভাবনা করে, কৃত্রিম মস্তিষ্কও ঠিক একই কাজ করতে পারবে। আমরা যা তৈরি করেছি তা মস্তিষ্কের প্রাথমিক একটা অংশ।’ সেলগুলোকে জীবিত রাখতে প্রতি দুই দিন পরে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে পুষ্টি ও তরল পদার্থ দেয়া হচ্ছে। টাইমস অফ ইন্ডিয়া

ধূমপান পরিহারের ওষুধ!



বিশ্বে প্রতিবছর ধূমপানজনিত ক্যান্সারের জন্য ১ মিলিয়ন মানুষ অপরিণত বয়সে মৃত্যুবরণ করে। আর এই ধূমপান ত্যাগ করতে সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের মেডিসিন কন্ট্রোল এজেন্সি ‘বিউপ্রপিয়ন’ নামক একটি ওষুধকে অনুমোদন দিয়েছে। ধূমপান পরিহারের মূলত এটিই এখন পর্যন্ত একমাত্র ওষুধ। এটিমূলত এন্টি ডিপ্রেশেন্ট হলেও রাসায়নিকভাবে অন্য এন্টি ডিপ্রেশেন্ট থেকে আলাদা। ধূমপান বন্ধ করতে এটি কিভাবে কাজ করে তা জানা না গেলেও ধারণা করা হয় যে, এটা ডোপামিনের ঘনত্ব বাড়িয়ে দেয়, যা ধূমপান আসক্তিতে হয়ে থাকে। ইউনিভার্সিটি অব নটিংহামের একদল গবেষকের নেতৃত্বে গবেষণায় দেখা যায় যে, দৈনিক ৩শ’ মিলিয়ন বিউপ্রপিয়ন সেবনে ধূমপায়ীর সংখ্যা ২৩.১% হ্রাস পেয়েছে। ৬১৫ ধূমপায়ীর ওপর সাত সপ্তাহব্যাপী এ গবেষণা চালানো হয়। ধূমপান পরিহারে এটিই অদ্যাবধি অর্জিত সবচেয়ে বড় সাফল্য। তদুপরি কিছু কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যেমন অনিদ্রা, মুখ শুকিয়ে যাওয়া, কিছুটা অবসন্ন লাগা ইত্যাদি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী বহুলাংশে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। সুতরাং ধূমপান ত্যাগ করুন আর সেই সঙ্গে ফুসফুসের ক্যান্সারসহ মারাত্মক ঘাতক ব্যাধিতে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি এড়ান এবং ভাল থাকুন।

সত্য হবে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী!



পাঁচ শ বছর আগে শিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি যখন আকাশে ওড়ার যন্ত্রের ছবি এঁকেছিলেন, তখন এটি আজকালকার বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মতোই ছিল। এখনকার খুব অগ্রসর বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীকে যেমন অবাস্তব আর অসম্ভব মনে হয়, তখনো নিশ্চয়ই আকাশে ওড়ার বিষয়টি সত্য হবে, তা কেউ ভাবেনি। সেদিনকার সেই অসম্ভব আজ সত্য হয়েছে। কে জানে, অনেক বছর পর আজকের এই অবাস্তব কল্পকাহিনী হয়তো বদলে যাবে কোনো ঘটমান বাস্তবে।
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী যে শুধু বিনোদন-উপকরণ, তা কিন্তু নয়। এগুলো মানুষকে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে সাহস জোগায়; জোগায় চিন্তার খোরাক। অ্যালিয়েন কিংবা মানুষের মতো বুদ্ধিমান রোবট সামনে এসে দাঁড়ালে পৃথিবীর মানুষ হয়তো আজ আর অতটা অবাক হবে না। মানুষের মতো রোবট থাকতে পারে, এটা যেন সবাই মেনেই নিয়েছে। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী আর এ ধরনের গল্পভিত্তিক চলচ্চিত্রের কল্যাণে এ প্রজন্েনর শিশুদের ঘুম ভাঙে মঙ্গল গ্রহের হ্রদে হাঁটা কিংবা বুধের জঙ্গলে দৌড়ঝাঁপের স্বপ্ন দেখে। এটাকেও নতুন যুগের সুচনা বলে মনে করছেন অনেকেই। তবে প্রশ্ন একটাই, আজ আমরা যা অসম্ভব মেনেই কল্পনা করছি, তা একদিন সত্য হবে কি না। আর সত্য হলেও সেটা কেমন হবে আমাদের জন্য? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সম্প্রতি বিবিসি ইউরোপের সবচেয়ে জনপ্রিয় চারজন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখকের কাছে গিয়েছিল। লেখক কেন ম্যাকলিয়ডের একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর বইয়ের শুরুই এমন: একটি রোবট বলছে, ‘বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী এখন বিজ্ঞানের বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে।’ ম্যাকলিয়ড সব সময় বিশ্বাস করেন, বিজ্ঞানের কল্যাণে আজকের কল্পকাহিনী অবশ্যই বাস্তবতার মুখ দেখবে। বিজ্ঞান বর্তমান গতিতে চলতে থাকলে সেটা হতে খুব বেশি দেরিও হবে না। তিনি বলেন, ‘বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী হচ্ছে আমাদের সাহিত্যের একমাত্র জায়গা, যেখান থেকে নিজেদের এগিয়ে নেওয়ার খোরাক পাওয়া যায়; ঘরে এসে ভাবার ফুরসত তৈরি হয়। তবে এ জন্য তথ্য উপস্থাপনায় বিজ্ঞানমনস্কতা ও বৈজ্ঞানিক যুক্তির সঠিক উপস্থাপন থাকতে হবে। আমরা যদি অসম্ভবকে কল্পনা করতে জানি, তাহলে অ্যালিয়েন কিংবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মেনে নিতে খুব একটা কঠিন হবে না। তবে এ যুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি যে গতিতে এগোচ্ছে, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী সে গতি ধরতে পারছে না। এখানটাতে আমাদের মতো লেখকদের আরও দক্ষতার সঙ্গে এগোতে হবে।’
পল কর্নেল মনে করেন, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী একটা ঘটনা শুরু করে দেয়। আর তাকে বাস্তবে দেখান বিজ্ঞানীরা। এখন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী অনেকটাই সত্য হতে যাচ্ছে। এতে তেমন গোঁজামিল দেওয়া হয় না। কাহিনীর কোনো একটা অংশকে ‘যদি এমন হয়’ ধরে নিয়ে বাকি ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা দেখানো হয়। এটাও বিজ্ঞান।
ইয়েন ব্যাংকস মনে করেন, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীও বিজ্ঞানের একটি শাখা। বিজ্ঞান যেমন একটা গতিতে চলে, এটাও আলাদা গতিতে চলে। এই গতি ধরে রাখার জন্য লেখকদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান থাকতে হবে। এই কল্পকাহিনীগুলো সত্য হবে কি না, সে প্রশ্নের উত্তরে ব্যাংকস বলেন, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীগুলোয় আসলে আসন্ন ভবিষ্যৎই তুলে ধরা হয়।
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর আরেক জনপ্রিয় লেখক ইয়ান ওয়াটসন মনে করেন, যাঁরা এ ধরনের ঘটনা লেখেন, তাঁরা ভবিষ্যৎ দেখতে পারেন। এ কাহিনীগুলো মূলত কিছুই না, আজ বসে ভবিষ্যৎকে দেখামাত্র। টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখকদের ডেকেছিল পরবর্তী সন্ত্রাসী হামলা সম্পর্কে ধারণা নিতে। তবে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী সত্য হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি, যত বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে এ কাহিনীকে সাজানো হয়।

ক্রীতদাসী ছিলেন মোনালিসা!



ভিঞ্চি ছিলেন বাঁহাতি এবং নিরামিষভোজী যা ইতালীয়দের সাধারণ জীবনপ্রণালী থেকে ব্যতিক্রমী

‘মোনালিসা’ নিয়ে তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা, অনুসন্ধিৎসা সেই ১৫০০ শতক থেকে। চিত্রকলার ইতিহাসে এই চিত্রকর্মটির মতো আর কোনোটি এত আলোচিত হয়নি। মোনালিসার মতো তার স্রষ্টা লিওনার্দো দা ভিঞ্চিও কম রহস্যময় নন। সেই আলোচনায় নতুন মাত্রা এনেছেন ইতালির ঐতিহাসিক ও ঔপন্যাসিক অ্যাঞ্জেলো প্যারাটিকো। তার দাবি- মোনালিসা আসলে ভিঞ্চির মায়েরই প্রতিকৃতি। আর তিনি ছিলেন চীনা ক্রীতদাসী।


অ্যাঞ্জেলো প্যারাটিকো তার নতুন গ্রন্থ ‘লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি : অ্য চাইনিজ স্কলার লস্ট ইন রেনেসাঁস ইতালি’ বইতে এ দাবি করেছেন। ভিঞ্চির বহু অজানা কাহিনী সমৃদ্ধ বইটি আগামী বছর বাজারে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।


প্যারাটিকো গত ২০ বছর ধরে হংকংয়ে বাস করছেন। সেখানে তিনি তার মাতৃভূমি ও চীনের মধ্যে গত ৫০০০ বছরের সম্পর্ক নির্ণয়ে গবেষণা চালাচ্ছেন।


সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টকে অ্যাঞ্জেলো প্যারাটিকো বলেন, আমি নিশ্চিত ভিঞ্চির মা প্রাচ্যেরই ছিলেন। গবেষণায় আমরা অবরোহী পদ্ধতি ব্যবহার করে দেখেছি তিনি চীনা ছিলেন।


ইতিহাসবিদদের মতে, মোনালিসার অমর স্রষ্টা লিওনার্দো ছিলেন পিয়েরে দ্য ভিঞ্চি এবং ক্যাটেরিনার অবৈধ সন্তান। ১৪৫২ সালের ১৫ এপ্রিল রাতে জন্ম নেওয়া এই শিল্পির বাবা পিয়েরে ছিলেন ফ্লোরেন্সের এক নোটারি এবং মা ক্যাটেরিনা কৃষাণী।


আর প্যারাটিকোর ধারণা- ভিঞ্চির মা ক্যাটেরিনা ছিলেন তার বাবার এক ধনী মক্কেলের দাসী । আর এই ক্যাটেরিনাই সেই মোনালিসা। ইতালির নবজাগরণের সময় সেদেশে প্রাচ্যের যেসব দাস-দাসী ছিলেন ক্যাটেরিনা তাদেরই বংশধর।


“১৯১০ সালে সিগমুণ্ড ফ্রয়েডও দাবি করেছিলেন, মোনালিসা সম্ভবত ভিঞ্চির মায়ের প্রতিকৃতি। মোনালিসার পিঠে চীনা ল্যান্ডস্কেপ আছে এবং তার মুখ অনেকটা চীনাদের মতো”, বলেন তিনি।


প্যারাটিকো বলেন, এই রহস্য সম্পূর্ণ উন্মোচন সম্ভব হবে যদি কবর থেকে ভিঞ্চির কিছু আত্মীয়ের লাশ তুলে ডিএনএ পরীক্ষা করা যায়।

হারিয়ে যাওয়া শহর মাচুপিচু



কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে অনেক সভ্যতা কিন্তু তাদের অস্তিত্ব আজো আছে ইতিহাসের পাতায়। আর কোন সভ্যতার নিদর্শন আজো পৃথিবীর বুকে টিকে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। পৃথিবীর ইতিহাসে সমৃদ্ধতম ও বিখ্যাত সভ্যতাগুলোর একটি হচ্ছে ইনকা সভ্যতা । আর এই ইনকাদের হারিয়ে যাওয়া একটি আধুনিক শহর হচ্ছে মাচুপিচু। এটিকে সূর্যনগরী নামেও ডাকা হয়। ইতিহাসবিদদের গবেষণায় এ শহর সম্পর্কে অজানা সব তথ্য ওঠে এলেও অনেক রহস্যেরই এখনো পর্যন্ত কূলকিনারা করতে পারেননি তারা। অনেকের ধারণা পেরুর মাচুপিচু হচ্ছে ইনকা সভ্যতার সবচেয়ে পরিচিত নিদর্শন, যাকে ‘ইনকাদের হারানো শহর’ বলা হয় ।


আন্দিজ পর্বতমালা পেরুর অংশের দিকে একটি পর্বতের চূড়ায় অবস্থিত ইনকাদের সেই হারানো শহর মাচুপিচু । এখন অবশ্য গোটা পাহাড়টির নাম হয়ে গেছে মাচুপিচু । সেখানে শহরটির অবস্থান ছিল অত্যন্ত সুরক্ষিত। অন্যদের পক্ষে এই শহর খুঁজে পাওয়া যেমন দুষ্কর ছিল, তেমনি খুঁজে পাওয়ার পর শহরটিতে আক্রমণ করতে গেলেও কেউ সুবিধা করতে পারবে না । পাহাড়ের এক পাশ চূড়া থেকে একেবারে খাড়াভাবে ৬০০ মিটার নিচে উরুবাম্বা নদীর পাদদেশে গিয়ে মিশেছে । অন্যদিকে হুয়ানা পিচু নামের আরেকটি পর্বত খাড়া ওঠে গেছে আরও কয়েক হাজার ফুট উঁচুতে। সুতরাং দুই দিক দিয়েই শহরটি প্রাকৃতিকভাবেই বেশ নিরাপদ ছিল। এ কারণে শহরটিকে ইনকাদের প্রাচীন দুর্গনগরী নামেও ডাকা হয় ।


মাচুপিচু শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২,৪০০ মিটার (৭,৮৭৫ ফুট) উঁচুতে অবস্থিত । অর্থাৎ আমাদের দেশের সর্বোচ্চ চূড়া তাজিন ডং (১২৩১ মিটার) এর প্রায় দ্বিগুণ উচ্চতায় অবস্থিত এই শহরটি! এত উঁচুতে কীভাবে তারা একটা আস্ত শহর তৈরি করে ফেলল সেটাই সবচেয়ে বড় রহস্য। তাও আবার অনেক বছর আগে। মাচুপিচু নির্মিত হয়েছিল প্রায় ৫৫০ বছর আগে, ১৪৫০ সালের দিকে । এর ১০০ বছর পরেই স্প্যানিশরা ইনকা সভ্যতা আক্রমণ করে। ধ্বংস করে ফেলে তাদের বেশির ভাগ শহরই। কিন্তু কী আশ্চর্যের বিষয় হলো ওরা মাচুপিচু শহরটি খুঁজেই পায়নি ! এদিকে মানুষজন না থাকার কারণে শহরটিও ধীরে ধীরে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। কয়েকশ বছর ধরে তো মানুষ এই ঐতিহাসিক শহরটিকে খুঁজেই পায়নি । এরপর ১৯১১ সালে হাইরাম বিংহাম নামের এক মার্কিন ঐতিহাসিক মাচুপিচু শহরটি আবিষ্কার করেন ।


মাচু পিচুর এই বসতিতে শুধুমাত্র ২০০টি বাসভবন ছিল এবং সেখানে প্রায় ১০০০ এর মতো মানুষ বসবাস করতো । ধারণা করা হয়, মাচু পিচুতে আবাদযোগ্য অনেক জমি থাকায় ইনকারা এখানে বসতি স্থাপন করেছিল । কিছু প্রত্নতত্ত্ববিদগণের মতে, এখানে ইনকা জনবসতি গড়ে উঠেছিল শুধুমাত্র কোকো চাষের জন্য । কিন্তু মাচু পিচুর রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে বেড়িয়ে এসেছে একটু ভিন্ন তথ্য, আর সেটি হলো- বিশেষ করে ধর্ম সংক্রান্ত উৎসবাদি এবং অন্যান্য উৎসব পালন করার জন্য নির্মিত হয়েছিল এই শহর । এই শহরে রয়েছে অনেক ধর্মীয় উপাসনালয়, যেগুলো অতি শতর্কতার সাথে নির্মাণ করা হয়েছিল । যার মধ্যে একটি হলো- সূর্যদেবের মন্দির । যা খুব নিখুঁত পাথরের কারুকাজ দ্বারা নির্মিত একটি অর্ধবৃত্তাকার মিনার । যা মানমন্দির হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের সময় কাছের ঝর্ণাতে গোসলের কাজটি সাড়া হতো । কন্ডোরের মন্দিরে ইনকার চিত্রকররা পাথরে একটি বিশালাকৃতির শকুনের ছবি খোদাই করে, যার কারণ আজও অজানা ।- তথ্যসূত্র: ওয়েবসাইট।

স্বপ্নচালিত দালি



বিংশ শতাব্দিতে এসে পাশ্চাত্য চিত্রকলা শুধু মাত্র ছবি আঁকায় সীমাবন্ধ থাকে না। তা জন্ম দেয় নানা শিল্প আন্দোলনেরও। এসব আন্দোলন ছবির সঙ্গে সঙ্গে কবিতা, নাটক, সিনেমা ইত্যাদি নানা শিল্প মাধ্যমকে প্রভাবিত করে। বিংশ শতাব্দীতে এমন সব প্রভাব বিস্তারকারী শিল্প আন্দোলনের যারা উদ্গাতা তাদের একজন সালভাদোর দালি। এই সুররিয়ালিস্ট শিল্পীর জন্ম ১১ মে ১৯০৪-এ। তাঁর জন্মদিনে তাঁকে নিয়ে লিখেছেন মইনুদ্দীন খালেদ। এ সংখ্যায় আরো থাকছে ফিলিস্তিনী সাহিত্য বিষয়ক একটি রচনা এবং গত সংখ্যায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথ ও রামমোহনকে নিয়ে লেখার শেষাংশ

বার্সেলোনার আকাশে বাঁকা চাঁদ ওঠে। সমুদ্রও বার্সেলোনাকে ঘিরে রেখেছে চাঁদের মত। স্পেনের কাতালানের মানুষেরা কি এ জন্যই স্বপ্নচারী হয়? তাদের নিশি পায়? ঘোরলাগা স্বপ্নবৎ তারা হেঁটে যায়। সব মানুষের ওপরই নক্ষত্রের প্রভাব আছে। কারও কারও সত্তায় নাক্ষত্রিক গ্রন্থিগুলো সজীব, সচল। সুররিয়ালিস্ট শিল্পচূড়া মনি সালভাদোর দালিকে (১৯০৪-১৯৮৯) কাতালানের স্বপ্নভূমি আজন্ম আমৃত্যু আবিষ্ট করে রেখেছিল। তিনি যেন আকাশবিহারী হয়ে এই মর্ত্যভূমি অবলোকন করেছেন; তিনি যেন সাগরে ডুব দিয়ে ঊর্ধ্বপানে চেয়ে জলের লেন্সে আকাশে আঁখি মেলেছেন। সব সময়ই তার ছবিতে তুমুল নাটক। স্পেসে লণ্ডভণ্ড খেলা। এলোপাতাড়ি উড়ছে বস্তুরাশি কিংবা বস্তুরাশি চেনা অবয়বে নেই আর। দূরকে তিনি দূরতম দেখেছেন, বৃহৎকে নামিয়ে এনেছেন ক্ষুদ্রতম সর্ষে দানায়, কঠিন ইমারতকে গলিয়ে দিয়েছেন মাখনের মত। কেন এই চাল? কারণ তা স্বপ্নের ব্যাকরণ মেনে চলছে। স্বপ্নে পর্বতও আকাশে উড্ডীন হতে পারে। কিন্তু এই যুক্তিহীনতার ঝঞ্ঝার উৎসভূম খুঁজতে গেলে আমাদের যুদ্ধের মধ্যে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। দালি দুটি বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন। দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে দাঁড়িয়ে শুনেছেন তার মনের কথাই ইশতেহার আকারে পাঠ করছেন কবি অঁদ্রে ব্রতোঁ: শুদ্ধ মানসিক স্বয়ংচাল। কথায় বা অন্য কোনো মাধ্যমে চিন্তার সত্য প্রক্রিয়া প্রকাশ পাবে; চলবে সবই চিন্তার নির্দেশে। উধাও হবে যুক্তির অনুশীলন। নৈতিক ও নান্দনিক বেষ্টনের কোনো জায়গাই থাকবে না।”

সুরারিয়ালিস্টরা এই স্বাধীনচারী সৃজন খেয়ালের মন্ত্রণা পেয়েছিলেন অস্বভাবী মনোবিজ্ঞানীদের আদি পিতা ফ্রয়েডের কাছ থেকে। তার ‘স্বপ্নের বয়ান’ গ্রন্থ প্রকাশ পাওয়ার পর মানুষ সত্যকে নতুন করে পেল। যারা ‘স্বপ্নবয়ান’ পড়েননি তারাও জানেন যে মানুষের চলাচল অন্তর্গত নির্দেশে সক্রিয়। স্বপ্নই শুধু সত্য। বিচিত্র স্বপ্নজালে মানুষ বন্দি। স্বপ্নের মধ্যেই আসল মানুষ বিরাজ করে। স্বপ্ন ঘুমে ও জাগরণে। স্বপ্ন সুখদোলার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নের। তুমুল নাটকীয়তা ছাড়া কোনো স্বপ্নই রচিত হয় না। স্নায়ুর কম্পনে সব কিছুই ভিন্ন রূপ লাভ করে। এসবই আছে দালির শিল্পে।

সাদা চোখে দেখা পৃথিবীর বাস্তবতা আচম্বিতে বদলে যায় কিউবিজমে। কিউবিক পিকাসো ছিল উঠতি যুবক দালির স্বপ্নপুরুষ। প্যারিসে এসেই দালি পিকাসোর সঙ্গে দেখা করেন। দালি বলেছিলেন, “আমি লুভরে না গিয়ে আপনার কাছে এসেছি।” মহাতপা ঋষি পিকাসোর অসংকোচ উত্তর, “আপনি একদম ঠিক কাজটি করেছেন।” এই সংলাপ বিনিময়ে যে শ্রদ্ধা দালি পিকাসোকে দেখিয়েছেন তা শেষ পর্যন্ত অক্ষুণœ থাকেনি। সৌরজাগতিকভাবে বেঁচে থাকা, অনন্ত আকাশগ্রন্থি ধরে বেঁচে থাকা, যুক্তির অতীতলোকে ভ্রাম্যমাণ থেকে বেঁচে থাকা দালি মরমিতা নেই বলে পিকাসোকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ফ্রয়েড দালিকে দেখে বলেছিলেন, ‘স্পেনীয়দের মধ্যে এমন ফ্যানটিক তিনি আর দেখেননি। মানুষ মাতৃগর্ভ থেকে যে জন্মলক্ষণ নিয়ে ভূমিষ্ঠ হয়, যে অভিজ্ঞতার চক্রমণে রচিত হয় তার মনোলোক তা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারে না। তবে যতদূরই যাওয়া যাক না কেন, পায়ে পায়ে যায় শৈশব।

তবে যুদ্ধের তাপে আর মানুষের হিংস্রতা দেখে দালির স্বপ্নে এসেছে রক্তের দাগ-ধর্ষকামের চিহ্ন। যুদ্ধের ‘অশনিসংকেত’ ছবিতে আমরা মানুষের অঙ্গের স্থাপত্য দেখি। বলা ভাল সেই স্থাপত্যে গুড়িয়ে যাওয়া দেখি। কে যে শিকার আর কে যে শিকারী তা উদ্ধার করা যায় না ছবিটি দেখে। দীর্ঘবাহু, দীর্ঘ আজঙ্গ পা, স্তন, বিক্ষুব্ধ মুখোভঙ্গি, সব মিলিয়ে এক উত্তুঙ্গ পরিস্থিতি, কেবলই পীড়ন।

দালির চোখে নারীর মুখ হয়ে যায় নাটকের মঞ্চ অথবা ড্রইংরুম। ‘মে ওয়েস্টের মুখ’-এর নামক কাজটিতে চুলরাশি উত্তোলিত হয়েছে মঞ্চের পর্দার মত। চোখ দুটি দেয়ালে টাঙানো দুটি পেইন্টিং। দুনাকের ছিদ্রপথ ফায়ারস্পেস আর সবচেয়ে গাঢ় নাটক দুটি ডাগর লাল ঠোঁটে। আসলে ঠোঁটগুলো ঠোঁট নয়। লাল সোফা। ওই সোফাতেই ঠাঁই চায় পুরুষ, ঠাঁই খোঁজে আত্মরূপমুগ্ধ নারী নিজেও।

‘দা পাবসিসটেন্স অফ মেমোরি’ দালির সবচেয়ে আলোচিত ছবি। এ ছবির প্রধান চরিত্র ঘড়ি। অনেকগুলো ঘড়ির অভিব্যক্তিতে যুক্তির অতীত এবং কালাতীত অবস্থাকেও দালি ধরতে চেয়েছেন। এখানে সময় বর্তমানে লুপ্ত কোনো প্রাণীর মত, এখানে সময় ঝুলে পড়েছে কাপড়ের মত, গলে পড়েছে মাখনের মত, এখানে সময় দংশিত কালো পিঁপড়াদের সামুষ্ঠিক আক্রমণে। এখানে সময় সাগরবেলায়, সাগরে, সাগরপাড়ের পাহাড়ে, দূর আকাশে। এখানে সময় পায়ের কাছে এবং এখানে দৃষ্টির অজান্তে ধাবমানতা আছে। আরও আছে বিশাল পর্বতের নিচে ক্ষুদ্রতম অনুষঙ্গ। এ নাটক তো দালিতে থাকেই। এ ছবির সূচনা ডাইনিং টেবিলে। ফ্রান্সের বিখ্যাত পনির ক্যামোবের। গ্রীষ্মের উষ্ণতায় পনির নরম হয়ে এসেছিল। সাদা গলিত পনিরের দিকে চেয়ে জগৎশ্রেষ্ঠ দূরাভিসারী (ভিশনারি) দালির মনে হল সময় এভাবেই চলছে, গলে পড়ছে, রূপান্তরিত হচ্ছে। ক্রমে গলিত পনিরের জায়গায় উপস্থিত হল ঘড়িগুলো।

সময়ের অস্থিরতা স্মারক ঘড়িগুলোর কোনোটাই সদর্থকতার ইঙ্গিত দেয় না। ঘড়ির যে গোলাকার ডায়াল সময়ের ঘূর্ণমানতাকে প্রকাশ করে সেই বৃত্তের বেড়ি ভেঙ্গে পড়েছে এ ছবিতে। যেখানে বৃত্ত রয়েছে সেখানেও পিপীলিকার দংশনে সব সংখ্যা মুছে গেছে আর দংশনে ঘড়ির দেহ হয়েছে রক্তললা। আরেকটি ঘড়িতে মাছি বসেছে। সেই ঘড়ির ভেতরকার নীল জল পান করছে মাছি। সময়ের এক অনন্ত বয়ান দালির এই ছবি।

সত্যকে যেভাবে জানেন সেভাবে প্রকাশ করুন: খুশবন্ত সিং




৮৭ বছর খুশবন্ত সিংয়ের আত্মজীবনী Truth, Love and a little Malice প্রকাশিত হয়। এই প্রকাশনাকে উপলক্ষ করে একটি সাক্ষাৎকার নেন শিলা রেড্ডি। সেখানে তিনি বলেন, সত্যকে যেভাবে জানেন সেভাবে প্রকাশ করুন। সর্বাধিক পঠিত এই সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ তুলে ধরা হলো।



প্রশ্ন : আপনি যেমন খোলামেলা আত্মজীবনী লিখেছেন ভারতে এ ধরনের আত্মজীবনী লেখার সমস্যা কোথায়?



খুশবন্ত : সত্যকে আপনি যেভাবে জানেন সেভাবে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে, এটা তেমন কোনো সমস্যা নয়। আমি নিজের জন্য কোনো অজুহাত সৃষ্টি করিনি, সেটাও কোনো কঠিন কাজ নয়, কারণ আমার নিজের সম্পর্কে খুব উঁচু ধারণা নেই। আমার আত্মজীবনী লেখার সমস্যা একটাই- আমার জীবন তেমন কৌতূহলোদ্দীপক কিছু নয়। কিন্তু পাঠকের কাছে তা মজার করে তুলে ধরতে হয়েছে। তবে লেখাকে মজার বিষয় করে তোলার শিল্পের চর্চা আমি বহু বছর ধরে করে যাচ্ছি।



প্রশ্ন : কিন্তু আপনার লেখা যখন সমাজের উঁচু ও ক্ষমতাসীনদেরও অন্তর্ভুক্ত করবে, তখন এর প্রকাশনা কি দুরূহ নয়?



খুশবন্ত : আমি তো এর মধ্যেই খেসারত দিয়েছি। এই বইটি প্রকাশ করতে আমাকে ছয় মাস অপেক্ষা করতে হয়েছে। কিন্তু যেসব ক্ষমতাসীন মানুষ ক্ষমতার অপব্যবহার করে আমি তাদের বিরুদ্ধে মুগুর হাতে নিতে তৈরি। যারা প্রত্যাঘাত করতে পারে, তাদের বিরুদ্ধে লেখা মজার কোনো বিষয় নয়।



প্রশ্ন : আদালতের অভিজ্ঞতা কি আপনাকে সতর্ক করতে পেরেছে?



খুশবন্ত : তেমন পারেনি। নসিহতকারী রায় শুনে আমি ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম, রায়ে নসিহত করা হয়েছে আমার মতো বিশাল অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন মানুষের কী লেখা উচিত আর কিভাবে তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করা উচিত। আমি মনে করি এটি একটি হাস্যকর রায়।



প্রশ্ন : আমরা কি আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের অন্য দেশের নেতাদের চেয়ে বেশি বীরপূজা করি?



খুশবন্ত : আমরা সবাই ‘আইকন’ খুঁজি। বীরপূজা করার জন্য ঈশ্বরের মতো অবয়ব খুঁজি। এমনকি আমিও। গান্ধী এমন একটি আইকন যার সামান্য একটু ক্ষতও আমি মেনে নিতে রাজি নই। গান্ধী নিজে যা বলে গেছেন সেই দুর্বলতাগুলো এবং আমাদের চোখে চারিত্রিক যে দুর্বলতা পড়েছে এর সবগুলোর দিনেই আমি চোখ মুদে থাকি। তিনি যেসব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন বিশেষ করে বিছানায় যুবতী নারী নিয়ে কেন তাকে নগ্ন হয়ে ঘুমোতে হবে। আমি তার সুরাহা করতে পারিনি। তারপরও তিনি আমার কাছে ‘আইকন’ই রয়ে যান, আমি তাকে দেখি খাঁটি মানুষ হিসেবে যা তিনি কখনো ছিলেন না। তিনি নিজের ছেলেদের সাথে যে আচরণ করেছেন-দাম্ভিক ও ক্ষমাহীন-এসব মেনে নেয়া যায় না।



প্রশ্ন : ভারতীয়রা কি অন্য দেশীয়দের চেয়ে বেশি ভণ্ড?



খুশবন্ত : এটা যে সত্যি সে বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত। আমরা যতো কথা বলি অন্য দেশের কাউকে এমন বলতে শুনিনি। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা সবচেয়ে বড় মিথ্যাবাদী। ক্ষমতায় ঝুলে থাকার জন্য তারা তাদের নীতিজ্ঞান ও বন্ধুবান্ধব বিসর্জন দিতে রাজি।



প্রশ্ন : লেখাকে মজার করে তুলতে কখনো কখনো সত্যকে কি কিঞ্চিৎ বিকৃত করতে হয়?



খুশবন্ত : সত্যকে বিকৃত করার কাজ আমি সচেতনভাবে করিনি কিন্তু সচেতনভাবে নিজেকে উন্মুক্ত করেছি। আমার এই প্রক্রিয়া অবশ্যই কাউকে আঘাত করে থাকবে। আমার যে ক’জন বন্ধু আছে তার মধ্যে কয়েকজনকে হারানোর ঝুঁকি আমি নিয়েছি। আমার সাথে অনেকের যোগাযোগ আছে কিন্তু অনেক বন্ধু নেই। তাদের একজন ইকবাল সিং তার সম্পর্কে যা লিখেছি তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে আমাকে লিখলেন, ‘আমি জানতাম না আপনার ভেতর এত বিষ আছে।’ আমি ভেবেছিলাম আমি তার সম্পর্কে যা লিখেছি তা খুব মজার, প্রতিহিংসাপরায়ণ কিছু নয়। এটা একজন বন্ধুকে চুনোপুঁটি বলে ডাকার মতো। আদরটা তো বন্ধুকে বুঝতে হবে।



প্রশ্ন : খোলামেলা স্মৃতিকথা কেন প্রকাশিত হয় না?



খুশবন্ত : পশ্চিমের দেশগুলোতে কিছু হয়েছে। যেমন আর্থার কোয়েনলোরের দুই বা তিন খণ্ডের স্মৃতিকথা। আমি যতটা করতে পারব তার চেয়েও অনেক সুলিখিত এই স্মৃতিকথা। ভারতের এ ধরনের আত্মকথার কথা আমি চিন্তাই করতে পারি না। অধিকাংশ স্মৃতিকথাতেই আত্মগরিমা প্রকাশ করা হয়ে থাকে।



প্রশ্ন : এত বছর পর আপনার ও সাক্ষাতের এত খুঁটিনাটি বিবরণ স্মরণ করেন কেমন করে?



খুশবন্ত : আমি বছরের পর বছর ডায়েরি লিখেছি। তবে এই বই লেখার সময় সেসব ঘাঁটতে হয়নি। আমার সাথে রয়েছে তুলনামূলক সতেজ অনেক স্মৃতি। আমি যখনই কারো কথা মনে করি তার মুদ্রাদোষ ও আচরণের বিভিন্ন দিক আমার সামনে ভেসে ওঠে। হাস্যকর মানুষ সব সময়ই আমাকে আকৃষ্ট করতে পেরেছে। তাদের স্মৃতি চিরদিনই থেকে যায়। এটা একধরনের বাছাই করা স্মৃতিচিত্র- সে কারণেই অনেক নোংরা মানুষ স্মৃতিতে রয়ে যায় কিন্তু ভালো মানুষের স্মৃতি মুছে যায়। কিছু মানুষ ও কিছু ঘটনা চিরদিনের। যেমন জ্ঞানী জৈল সিং একবার আমাকে রাষ্ট্রপতি ভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তিনি সাদামাটা পোশাকে, মাথায় হলুদ পট্টি বাঁধা। আমাকে তার বেডরুমে নিয়ে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তারপর তার খাটের তলা থেকে আমার জন্য বের করে আনলেন এক বোতল স্কচ ও সোডা। যে প্রেসিডেন্ট তার চারপেয়ের তলা থেকে আপনার জন্য সোডা বের করে আনেন তাকে ভুলবেন কেমন করে? আর এ ধরনের বোতলও আমি অনেক দিন দেখিনি, বোতলের গলায় মার্বেল ঢুকানো।



প্রশ্ন : আপনার আত্মজীবনী কি তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে?

খুশবন্ত : নিজের গুণগান না করে সৎভাবে লিখতে পারলে তা মানুষ গ্রহণ করে। পাঠকই ঠিক করে থাকেন তারা লেখকের সত্যটা গ্রহণ করবেন, না রাজনীতিবিদের সত্যটা নেবেন।

-

পল্লীকবি জসীমউদ্দীন এর হাসির গল্প



হাটে একটি প্রকাণ্ড বোয়াল মাছ উঠিয়াছে। এক ফকীর ভাবিল, এই বোয়াল মাছটার পেটি দিয়া যদি চারটি ভাত খাইতে পারিতাম! সে মাছের দোকানের কাছে দাঁড়াইয়া রহিল। একজন চাষী আসিয়া মাছটি কিনিয়া লইল।



মুসাফির তাহার পিছে পিছে যাইতে লাগিল। লোকটি যখন বাড়ির ধারে আসিয়াছে তখন মুসাফির তাহার নিকটে যাইয়া বলিল, ‘সাহেব! আমি মুসাফির লোক। ভিক্ষা করিয়া খাই। কোনোদিন ভালো খাওয়া হয় না। আজ হাটে যাইয়া যখন ঐ বড় মাছটি দেখিলাম, মনে বড় ইচ্ছা হইল এই মাছটির পেটি দিয়া যদি চারটি ভাত খাইতে পারিতাম! তাই আপনার পিছে পিছে আসিয়াছি। দয়া করিয়া যদি আমার মনের ইচ্ছা পূরণ করেন বড়ই সুখী হইব।’
লোকটি বড়ই দয়ালু। সে খুব আদর করিয়া মুসাফিরকে আনিয়া বৈঠকখানায় বসাইল। তারপর মাছটি ভিতরে লইয়া গিয়া তাহার বউকে মুসাফিরের সমস্ত ঘটনা বলিয়া হুকুম করিল, ‘এই মাছটির পেটি বেশ পুরু করিয়া কাটিবে। পেটিখানা মুসাফিরকে দিতে হইবে।’
এমন সময় লোকটির একটি গরু ছুটিয়া গেল। সে তাড়াতাড়ি গরুটির পিছে পিছে দৌড়াইল।
মাছ কুটিতে কুটিতে চাষীর বউ ভাবিল, ‘বাড়িতে ভালো কিছু খাবার পাক করিলে আমার স্বামী এমনি করিয়া মুসাফির লইয়া আসে। মুরগীর রানটা, মাছের পেটিটা সব সময়ই মুসাফিরদের দিয়া খাওয়ায়। এই বড় মাছের পেটিখানাও মুসাফিরকে খাওয়াইবে। যেমন করিয়াই হোক মুসাফিরকে আজ তাড়াইব।’
এই কথা ভাবিয়া বউটি খালি পাটার উপর পুতাখানা ঘষিতে আরম্ভ করিল আর সুর করিয়া কাঁদিতে লাগিল।
অনেকক্ষণ কান্না শুনিয়া মুসাফির ভাবিল, না জানি বউটির কি হইয়াছে। সে বাড়ির ভিতর আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘মা জননী! তুমি কাঁদিতেছ কেন? তোমার কি হইয়াছে?’
বউটি বলিল, ‘বাবারে! সে কথা তোমাকে বলিবার নয়। আমার স্বামী মানা করিয়াছেন।’
মুসাফির বলিল, ‘মা! আমি তোমার ছেলে। আমার কাছে কোনো কথা গোপন করিও না।’
বউটি তখন আধেক কাঁদিয়া আধেক কাঁদিবার ভান করিয়া বলিল, ‘আমার স্বামী বাড়ির ভিতরে আসিয়া আমাকে বলিল, এই মুসাফির বড়ই লোভী। আমাদের পুতাখানা পাটায় ধার দিয়া চোখা করিয়া রাখ। মুসাফিরের গলার ভিতর দিয়া ঢুকাইয়া দিব। যাহাতে সে আর কাহারও মাছ দেখিয়া লোভ করিতে না পারে। তাই আমি কাঁদিতেছি। হায়! হায়! আমার স্বামী এই মোটা পুতা তোমার গলার ভিতরে ঢুকাইলে নিশ্চয় তুমি মরিয়া যাইবে, তাই আমি কাঁদিতেছি। কিন্তু স্বামীর হুকুম তো আমাকে মানিতেই হইবে।’
শুনিয়া মুসাফিরের তো চক্ষুস্থির। সে বলিল, ‘মা জননী! তুমি একটু আস্তে আস্তে পুতা ঘষ। আমি এখনই চলিয়া যাইতেছি।’ এই বলিয়া মুসাফির তাড়াতাড়ি লাঠি-বোঁচকা লইয়া দে চম্পট। এমন সময় বাড়ির কর্তা ফিরিয়া আসিয়া দেখে কাছারি ঘরে মুসাফির নাই। বউকে জিজ্ঞাসা করিল, ‘মুসাফির চলিয়া গেল কেন?’
বউ নথ নাড়িতে নাড়িতে বলিল, ‘তুমি বাড়ি হইতে চলিয়া গেলে মুসাফির বলে কি, ‘তোমাদের পুতাটা আমাকে দাও।’ দেখ তো, আমাদের একটা মাত্র পুতা। তা মুসাফিরকে দেই কেমন করিয়া? পুতা দেই নাই বলিয়া মুসাফির রাগিয়া চলিয়া গেল।’ স্বামী বলিল, ‘সামান্য পুতাটা দিলেই পারিতে। আমি না হয় বাজার হইতে আর একটি পুতা কিনিয়া আনিতাম। শিগ্গীর পুতাটা আমাকে দাও, আর মুসাফির কোন্ দিকে গিয়াছে বল!’
বউ পুতাটি স্বামীর হাতে দিয়া বলিল, ‘মুসাফির এই দিক দিয়া গিয়াছে।’ পুতাটি হাতে লইয়া সে সেই দিকে দৌড়াইয়া চলিল। খানিক যাইয়া দেখিল, মুসাফির অনেক দূর হন্ হন্ করিয়া চলিয়াছে। সে ডাকিয়া বলিতে লাগিল, ‘ও মুসাফির, দাঁড়াও—দাঁড়াও—পুতা লইয়া যাও।’ শুনিয়া মুসাফির উঠিয়া পড়িয়া দৌড়। চাষী যতই জোরে জোরে বলে, ‘ও মুসাফির! পুতা লইয়া যাও!—পুতা লইয়া যাও! মুসাফির আরও জোরে জোরে দৌড়ায়। সে ভাবে সত্যই চাষী তাহার গলায় পুতা ঢুকাইতে আসিতেছে। বোঁচকা-বুঁচকি বগলে ফেলিয়া সে মরিয়া হইয়া দৌড়ায়।

হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাত্‍কার




হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সময়ের অভাবনীয় এক জনপ্রিয় লেখকের নাম৷ কথাসাহিত্যে তার প্রতিভার বিসত্মার ঘটলেও, তিনি শুরম্ন করেছিলেন কবিতা দিয়ে৷ তারপর নাটক, ছোটদের জন্য লেখা, সাইন্সফিকশন, চলচ্চিত্র পরিচালনা- শিল্প-সাহিত্যের এমনি নানা বিষয়ে হাত দিয়েছেন এবং প্রতিটি ৰেত্রে ছাপ রেখেছেন অনন্যতার৷ এই অভাবনীয় জনপ্রিয় লেখকের সঙ্গে এক দীর্ঘ আলাপচারিতা ঘটে আরেক জনপ্রিয় লেখক ইমদাদুল হক মিলন-এর৷ সেই দীর্ঘ আলাপচারিতার উলেস্নখযোগ্য অংশ ‘ইত্তেফাক সাহিত্য সাময়িকী’তে প্রকাশিত হয়েছিল৷ ষাটতম জন্মদিনের প্রাক্কালে প্রকাশিত এই সাৰাত্‍কারটি পাঠকদের আরো আনত্মরিকভাবে হুমায়ূন আহমেদকে চিনতে সহায়তা করবে বলে আমাদের বিশ্বাস

ইমদাদুল হক মিলন: আপনি লেখক৷ তাই লেখালেখি দিয়েই শুরম্ন করা ভাল৷ আপনার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ লেখা কি একেবারেই আচমকা? এর আগে আপনি কি কিছু লিখেছেন কখনো?

হুমায়ূন আহমেদ: কবিতা লিখেছি৷ দৈনিক পাকিসত্মান পত্রিকায় ছাপাও হয়েছে৷ তবে নিজের নামে লিখি নি৷ কবিতাগুলি আমার ছোটবোন মমতাজ আহমেদ শিখুর নামে পাঠাতাম৷ তার নামেই ছাপা হতো৷

মিলন: উপন্যাসে আসার ঘটনাগুলো বলেন- এই ধরেন- কীভাবে শুরম্ন, কীভাবে আইডিয়াটা এলো মাথায়ঃ

হুমায়ূন আহমেদ: প্রথমে তো আমি লিখলাম ‘শঙ্খনীল কারাগার’৷ যদিও প্রথমে এটা ছাপা হয়নি, কিন্তু উপন্যাস প্রথমে লেখা হয়েছিল ‘শঙ্খনীল কারাগার’৷ কিছুই করার ছিল না সেই সময়৷ আমার ঠিকমতো মনেও নেই৷ তবে এই উপন্যাসটা আমার বাবা পড়েছেন- এটা আমার জন্যে খুবই আনন্দের একটা ঘটনা৷

মিলন: মানে আপনার হাতে লেখা কপিটাই পড়েছেন ?

হুমায়ূন আহমেদ: হঁ্যা৷

মিলন: পড়ে কী বললেন ?

হুমায়ূন আহমেদ: আমাকে কিছু বললেন না৷ বাবার সঙ্গে আমাদের ভাইবোনদের দূরত্ব ছিল৷ বাবা সরাসরি আমাদের কিছু বলতেন না৷ ভায়া মিডিয়া কথা বলতেন৷ তাঁর যা বলার তিনি মা’কে বলতেন৷ মা আমাদের বলতেন৷

মিলন: তিনি আপনার মা’কে কী বললেন ?

হুমায়ূন আহমেদ: পৃথিবীর সমসত্ম পিতাই সনত্মানদের সামান্য প্রতিভাতেই মুগ্ধ হন৷ তিনিও হয়েছিলেন৷ তাঁর মুগ্ধতা যে উঁচু পর্যায়ে ছিল তার প্রমাণ পেলাম কিছুদিন পর৷ উনি তখন একটা রেডিও নাটক লিখে শেষ করেছেন৷ নাম ‘কত তারা আকাশে’৷ হঠাত্‍ সেই নাটকের পাণ্ডুলিপি আমার হাতে দিয়ে বললেন- তুই তোর মতো করে ঠিকঠাক করে দে৷ আমি আমার এক জীবনে অনেক সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছি- ঐ দিনের সাহিত্য পুরস্কার সব পুরস্কারের উপরে৷

ইমদাদুল হক মিলন: আমেরিকা থেকে আপনি ফিরে এলেন ‘৮৪-এর দিকে বোধহয় ? তার আগে, মাত্র চারটা বই লিখে বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন৷ এটা একটা অবিস্মরণীয় ঘটনা৷ আপনি ফিরে এসে আবার লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত হবার কথা ভাবলেন কী করে?

হুমায়ূন আহমেদ: হয়তো লেখালেখির বিষয়টা ভেতরে ছিল সবসময়৷ যদি ভেতরে থাকে তাহলে ‘লেখালেখি’ বিষয়টা মাথার গভীরে একধরনের চাপ দিতেই থাকে৷ এই চাপটা একটা কারণ হতে পারে৷ দেশে ফিরে এসেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করেছি৷ আবার আমি যে একজন লেখকও, ঐটাও তো মাথায় ছিল৷

মিলন: লেখালেখির ৰেত্রে বড় গ্যাপ পড়লে একটা অস্বসত্মি তৈরি হয়৷ আপনার সে অস্বসত্মিটা কি তৈরি হয়েছিল যে, এতদিন পরে আমি আবার শুরম্ন করলাম!

হুমায়ূন আহমেদ: এটা আসলে মনে করতে পারছি না৷ মনে হয় না ছিল৷ কারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যারা লেখালেখি করে, তারা এগুলো নিয়ে মাথা ঘামায় না৷ অনেকদিন লিখিনি তাতে কি হয়েছে? আবার লিখব৷ ইচ্ছা না করলে আবার বন্ধ করে দেব৷

মিলন: কিন্তু এই স্বতঃস্ফূর্ততা কি আপনার প্রথম থেকে ছিল নাকি আসত্মে আসত্মেঃ?

হুমায়ূন আহমেদ: না, আমার মনে হয় এটা শুরম্ন থেকেই ছিল৷ মাঝেমধ্যে এটা একটু কেটে গেছে, এটা বলতে পারো৷ কিছু কিছু লেখার ৰেত্রে খুবই চিনত্মা-ভাবনা করে লাইনগুলো লিখতে হয়েছে৷ একটা লাইন লিখে দ্বিতীয় লাইনটির জন্যে অপেৰা করতে হয়েছে৷ দ্বিতীয় লাইন আসি আসি করছে, আসছে না৷ এই অবস্থা৷

মিলন: এই যে দেশের বাইরে থেকে ফিরেই একটার পরে একটা বই আপনি লিখতে থাকলেন৷ তারপর ‘৮৫-তে আপনি ‘এইসব দিনরাত্রি’ শুরম্ন করেছিলেন৷ একটার পর একটা লেখা, পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করা, এই যে এই অবস্থাটা তৈরি হলো, এর পেছনে রহস্যটা কি বলে আপনার মনে হয়?

হুমায়ূন আহমেদ: এই অবস্থা যে তৈরি হয়েছিল, এই বিষয়টার একটা নরমাল আর একটা আধিভৌতিক ব্যাখ্যা আছে৷

মিলন: আপনি বলেন- আমরা দুটোই শুনি৷

হুমায়ূন আহমেদ: নরমাল ব্যাখ্যা হলো- আমি নাটক লেখা শুরম্ন করলাম৷ আমাদের দেশে নাটকের দর্শক তো অনেক বেশি৷ ‘এইসব দিনরাত্রি’ বহু লোক দেখা শুরম্ন করল এবং এরা মনে করল এই যে লোকটি নাটক লিখছে, তার একটা বই পড়ে দেখি না কেন! তারা বই কিনতে শুরম্ন করল৷ পাঠকদের আমার বইয়ের প্রতি আগ্রহী হবার পেছনে ‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকটা কাজ করেছে বলে আমার নিজের ধারণা৷ একজন নতুন লেখক লিখবে আর সঙ্গে সঙ্গেই তার বই বিক্রি হবে- এটা তো হবার কথা না৷ আমার ধারণা আমার নাটক দেখে লোকজন আগ্রহী হয়েছে, একটা বই পড়ে হয়তো সেকেন্ড বই পড়তে চেয়েছে- এটা হতে পারে৷ আর আধিভৌতিক ব্যাখ্যা যেটা হলো- শহীদুলস্নাহ হলে যখন থাকি, তখন একসঙ্গে প্রকাশকদের কাছ থেকে আমি হঠাত্‍ কিছু বড় অংকের টাকা পেয়ে গেলাম৷ ২৫-৩০ হাজার টাকা৷ সেই সময় ২৫-৩০ হাজার টাকা অনেক টাকা৷ বই বিক্রির টাকা৷ তখনো বই লেখা বাবদ অ্যাডভান্স দেয়া শুরম্ন হয়নি৷ যেহেতু টাকা পেয়েছি, আমার খুব হাত উশখুশ করছিল টাকাটা খরচ করার জন্য৷ কাজেই করলাম কী গুলতেকিন এবং বাচ্চাদের নিয়ে গেলাম ইন্ডিয়াতে৷ এই টাকা শেষ না হওয়া পর্যনত্ম দেশ ভ্রমণ হবে এই হলো পরিকল্পনা৷ প্রথমে গেলাম নেপালে, নেপাল থেকে দিলিস্ন৷ ভাবলাম এত কাছে যখন এলাম মরম্নভূমি দেখে যাই৷ জয়সলমীরের উদ্দেশে রওয়ানা দিলাম৷ জয়সলমীরের পথে পড়লো আজমীর শরীফ৷ এত নাম শুনেছি- পথে যখন পড়লই তখন ভাবলাম যে, আজমীর শরীফ দেখে যাই৷ আজমীর শরীফ গেলাম৷ আমার সবচেয়ে ছোট মেয়েটি, বিপাশা, সে খুবই বিরক্ত হয়ে গেল; বলল- কোথায় নিয়ে এলে? চারদিকে ফকির৷ ফকিরে ভর্তি জায়গাটি৷ বিপাশার বয়স তখন তিন সাড়ে তিন; আমি তাকে বোঝালাম যে, এখানে একজন অতি বড় সাধু মানুষের কবর আছে৷ এখানে এলে আলস্নাহর কাছে যা চাওয়া যায়, তা পাওয়া যায়৷ দেখা গেল যে, এই কথা শুনে মানসিকভাবে সে স্বসত্মি বোধ করলো৷ তখন তাকে নিয়ে গেলাম কবর জিয়ারত করতে, জিয়ারত শেষ করে চলে আসবো, দেখি বিপাশা দাঁড়িয়ে৷ ব্যাপার কী? বিপাশা বলল, আমি যেটা চেয়েছি সেটা তো পাইনি৷ না পেলে যাব না৷ আমি বললাম, মা, তুমি কী চেয়েছ? বিপাশা বলল, আলস্নাহর কাছে আমি এক হাজার বসত্মা টাকা চেয়েছি৷ এই টাকা না পাওয়া পর্যনত্ম এখান থেকে আমি যাব না৷ করবস্থানের পাশে রেলিংটা ধরে সে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো৷ আমি ও তার মা তাকে নিয়ে টানাটানি করতে লাগলাম৷ না, সে এ জায়গা ছেড়ে নড়বে না৷ এদিকে বাংলাভাষাভাষী কিছু লোক ছিল, তারা খুবই মজা পেয়ে গেল৷ একটি মেয়ে এক হাজার বসত্মা টাকা আলস্নাহর কাছে চাইছে, না পাওয়া পর্যনত্ম সে যাবে না- এটা তো মজার বিষয়ই৷ তখন বিপাশাকে বোঝালাম যে, এখন টাকাটা পেলে বরং সমস্যা হবে৷ এতগুলো টাকা দেশে নিয়ে যেতে হবে৷ কান্নাকাটি না করে চলো দেশে যাই৷ দেশে গেলে টাকাটা পেয়ে যাবে৷ অবশ্যই পাবে৷ আমরা দেশে ফিরে এলাম৷ আসার পর পরই জলের মতো হুহু করে টাকা আসতে লাগল৷ কেউ যখন আমাকে জিজ্ঞেস করে লেখালেখি করে বিপুল অর্থ উপার্জন আপনি কীভাবে করলেন? আমি বলি, আমার ছোট মেয়ে বিপাশার কারণে করেছি- এখানে আমার কোনো হাত নেই৷

মিলন: আপনি তো বহু বিষয়ে ইন্টারেস্টেড৷ এর মধ্যে আপনার একটি খুব প্রিয় বিষয় হচ্ছে ভূত এবং বহু স্মরণীয় ভূতের গল্প লিখেছেন আপনি৷ আপনার ছোট ছোট অনেক অভিজ্ঞতার কথা জানি আমরা৷ এই ভূত ব্যাপারটা নিয়ে আপনার বিশ্বাসটা কি?

হুমায়ূন আহমেদ: বিশ্বাসটা হলো- আমি মনে করি না ভূত বলে কিছু আছে৷ ভূত না থাকলেও ভূতের ভয় আছে৷ ভূতের ভয় আছে বলেই ভূতের গল্প আছে৷

মিলন: তাহলে কী বলব? আপনি বানিয়ে বানিয়ে লিখেন?

হুমায়ূন আহমেদ: গল্প-উপন্যাস মানেই কি বানানো বিষয় না ? গল্প-উপন্যাস তো ইতিহাস না৷ তারপরেও কিছু কিছু ব্যাপার ঘটেও যায়৷

মিলন: আপনি লেখালেখির শুরম্নর দিকে কবিতা লিখেছেন, আপনার বোনের নামে সেগুলো ছাপা হয়েছে এবং হুমায়ূন আহমেদ নামেও একটি কবিতার কার্ড ছাপা হয়েছে৷ তাতে কি আপনার কবিতার প্রতি তীব্র টান প্রকাশিত হয় না?

হুমায়ূন আহমেদ: আমি একটি উপন্যাস লিখেছি৷ নাম ‘কবি’৷ তারাশঙ্করও এই নামে একটি উপন্যাস লিখেছেন- বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর মধ্যে এটি একটি৷ সেইখানে আমার মতো একজন লেখকের আরেকজন কবিকে নিয়ে উপন্যাস লেখার ব্যাপারটি কি দুঃসাহসিক নয়? তারাশঙ্করের কবি ছিলেন সেই সময়ের কবি, আর আমার কবি হচ্ছে আজকের কবি৷ তাদের জীবনবোধ, জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে৷ তারাশঙ্করের কবি ছিল অতিদরিদ্র, আমার কবিও অতিদরিদ্র৷ দু’জনের মধ্যেই কাব্য প্রতিভা আছে৷ এই জিনিসটাকে নিয়েই লেখালেখির চেষ্টা করেছিলাম আর কি৷ তো এই উপন্যাসের জন্যেই কবিতার দরকার পড়ল৷ কাকে বলবো? ভাবলাম আমিই লিখি৷ একইভাবে আমার একটি টিভি সিরিয়ালে গ্রাম্য গায়কের কিছু গানের দরকার ছিল৷ নাটকের গান তো, সিকোয়েন্স অনুযায়ী লিখতে হয়, কাকে দিয়ে গান লেখাবো? নিজেই লিখলাম৷ দায়ে পড়ে আর কি! আমি হলাম দায়ে পড়ে কবি, দায়ে পড়ে গীতিকার৷

মিলন: ‘কবি’ উপন্যাসে যে টুকরো টুকরো কবিতার লাইন ব্যবহার করেছেন বা আপনার প্রথম উপন্যাস ‘শঙ্খনীল কারাগার’-এ যে কবিতার লাইনগুলো রয়েছে- ‘দিতে পারো একশ’ ফানুস এনে/ আজন্ম সলজ্জ সাধ একদিন আকাশে ফানুস ওড়াই৷’ এটা একজন কবির লেখা কবিতা- তা আপনি যতই ঠাট্টা-তামাশা করম্নন না কেন! কবিতার ছন্দ, শব্দের ব্যবহার এসব নিয়েও আপনি অনেক ভেবেছেন৷ এ ব্যাপারে আপনার ব্যাখ্যা কী?

হুমায়ূন আহমেদ: না, আমি কোনো ব্যাখ্যায় যেতে চাচ্ছি না৷ আমি নিজেকে একজন গল্পকার মনে করি এবং গল্পকার পরিচয়েই আমি অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করি৷ কবিতাকে বলা হয় সাহিত্যের ফাইনেস্ট ফর্ম৷ এই ফাইনেস্ট ফর্মে কাজ করার ৰমতা আমার নেই৷ গদ্যটা হয়তো খানিকটা লিখতে পারি৷ কবিতা নিয়ে মাঝে মাঝে একটু চেষ্টা চলতে পারে, তাই বলে নিজেকে কখনোই আমি কবি বলি না৷ সেই প্রতিভাও আমার নেই৷

মিলন: স্বাধীনতাউত্তর সময়ে এদেশের সাহিত্যের দুটি শাখা খুবই ডেভেলপড্- কবিতা ও মঞ্চনাটক৷ এদেশের কবিদের সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?

হুমায়ূন আহমেদ: বাংলাদেশের সাহিত্যে যারা কবিতা লিখছেন- আগে যারা লিখেছেন, এখন যারা লিখছেন- তাদের কাব্য প্রতিভা সম্পর্কে আমার কোনো সংশয় নেই৷ বাংলাদেশ কবির দেশ৷

মিলন: দু’চারজন পছন্দের কবির কথা কি বলবেন?

হুমায়ূন আহমেদ: আমার প্রিয় কবিদের মধ্যে অনেকেই আছেন- শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ আছেন৷ এছাড়া রয়েছেন আল মাহমুদ- এখন তার ব্যক্তিগত বিশ্বাস কবিতাকে কতখানি ৰতিগ্রসত্ম করেছে, সেই প্রসঙ্গে আমি যাচ্ছি না৷

ইমদাদুল হক মিলন: সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?

হুমায়ূন আহমেদ: কবিতার চেয়ে তাঁর গদ্য আমার বেশি পছন্দ, তার পরেও তিনি যে কবি সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই৷

মিলন: আপাতদৃষ্টিতে আপনি একজন গম্ভীর মানুষ৷ আপনার সঙ্গে কিছুৰণ মেশার পর বোঝা যায়, আপনি অসম্ভব একজন ঠাট্টা প্রিয় মানুষ৷ আপনি ঠাট্টা করেন, মজা করেন, চমত্‍কার গল্প বলতে পারেন৷ এই গুণগুলি কি আপনার ছোটবেলা থেকেই তৈরি হয়েছিল?

হুমায়ূন আহমেদ: আমাদের ভাই-বোনদের প্রত্যেকেই খুবই গল্পবাজ৷ আমার মাও গল্প করতে খুবই পছন্দ করেন৷ আমার বাবাও গল্প-গুজব করতে পছন্দ করতেন৷ ব্যাপারটা হয়তোবা জিনের মাধ্যমে এসেছে, জেনেটিক্যালি এসেছে৷ আর গম্ভীর টাইপের মানুষ যেটা বলেছো, আমি তো বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছি, ২০ বা ২১ বছরের মতো, অধ্যাপকদের মুখে তো সবসময় একটা আলাদা ভাব তৈরি করে রাখতে হয়৷ কিছুৰণের মধ্যেই সেই চামড়াটা ফেলে দিয়ে অরিজিন্যাল হুমায়ূন আহমেদ যখন বেরিয়ে আসে, তখন মনে হয় লোকটা খারাপ না৷

মিলন: আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন কতদিন? ঐ সময় ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন ছিল? শিৰক হিসেবে আপনি কেমন জনপ্রিয় ছিলেন?

হুমায়ূন আহমেদ: আমি অধ্যাপনা করেছি প্রায় কুড়ি বছরের মতো৷ আমি জনপ্রিয় ছিলাম কি না, এটা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল৷ আমার কোনো ছাত্র-ছাত্রী পাওয়া গেলে ওদেরকে জিজ্ঞেস করলে ওরা হয়তো বলতে পারত৷ আসলে হয়েছিল কী, আমি শেষের দিকে এমন একটা সাবজেক্ট পড়াতাম যেটা ছিল খুবই জটিল৷ সাবজেক্টটা হচ্ছে, কোয়ান্টাম কেমিস্ট্রি৷ যে সমসত্ম শিৰক এই সাবজেক্ট পড়ান তারা ছাত্রদের কাছে খুব দ্রম্নত আন-পপুলার হয়ে যান৷ কারণ এ ধরনের সাবজেক্ট খুব অ্যাবস্ট্রাক্ট৷ সাবজেক্ট অ্যাবস্ট্রাক্ট হওয়ায় কোনো ধরনের মেন্টাল ছবি দাঁড় করানো যায় না৷ অংকের সাহায্যে জিনিসটা বুঝতে হয়৷ আর এমনিতেই তো আমাদের কেমিস্ট্রির ছাত্রদের মেথমেটিক্স জ্ঞানটা একটু কম থাকে অর্থাত্‍ সেইভাবে জোরালো জ্ঞান মেথমেটিক্সের ওপর থাকে না৷ বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীই বুঝতে পারে না, কী পড়ানো হচ্ছে৷ যখন বুঝতে পারে না তখন সাবজেক্টটার ওপর একটা বিতৃষ্ণা তৈরি হয়৷ যিনি পড়াচ্ছেন তার প্রতিও বিতৃষ্ণা তৈরি হয়৷ এই জিনিসটা আমার ৰেত্রে ঘটেছে কিনা আমি বলতে পারব না৷ আমি খুবই চেষ্টা করেছি, যতটা সম্ভব সহজভাবে এই অ্যাবস্ট্রাক্ট জিনিসটি বোঝানোর৷ আমার কাছে মনে হয়, হয়তোবা পেরেছি৷ আমার দিক থেকে এই জটিল বিষয় তাদের বুঝানোর চেষ্টায় খাদ ছিল না৷ আমি যখন দেখলাম কোয়ান্টাম মেথড ওরা বুঝতে পারছে না, আমি তখন এই বিষয়ে একটি বই লিখে ফেললাম বাংলায়৷ আমি এই বইয়ে যতটা পারি সহজভাবে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করেছি৷ মিলন: আমার মনে আছে, এই বই বেরিয়েছিল কাকলী প্রকাশনী থেকে৷ ওরকম বই বাংলা ভাষায় আপনার আগে কেউ লিখে নি, এই তথ্যটা কি আপনি জানেন?

হুমায়ূন আহমেদ: আমি সেটা জানি না৷ অতি জটিল একটা বিষয় নিয়ে বাংলায় মজা করে লেখার চেষ্টা করেছি৷ অনেকেই সায়েন্সফিকশন মনে করে এই বই কিনে নিয়ে ধরা খেয়েছে৷

মিলন: এই বইটি কি আপনার ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে সেইভাবে পপুলার হয়েছিল?

হুমায়ূন আহমেদ : আমি যতদিন ক্লাস নিয়েছি ততদিন তারা এই বইটি পড়েছে৷

মিলন: আপনি এমন একটি দুরূহ বিষয়ের টিচার হবার পরও এত জনপ্রিয় একজন লেখক হয়ে গেলেন, এই বিষয়ে আপনার ছাত্র-ছাত্রীদের আগ্রহ বা প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?

হুমায়ূন আহমেদ: আমার প্রতি আগ্রহ তাদের বেশ ভালোই ছিল৷ রসায়ন অনার্স ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রী কম, হঠাত্‍ দেখি আমার ক্লাসে ছাত্র-ছাত্রী বেশি বেশি লাগছে৷ ছাত্রসংখ্যা বড় জোর ৩০ হলেও, দেখা যেত উপস্থিত আছে ৪২/৪৩ জন৷ দেখা গেল, এরা কেমিস্ট্রির ছাত্র না৷ কেউ জিওগ্রাফির, কেউ সয়েল সায়েন্সের, আবার দেখা গেল কেউ কেউ এসেছে আর্টস ফ্যাকাল্টি থেকে৷ ওরা এসেছে জাস্ট দেখার জন্য, এই লেখক মানুষটি কীভাবে ক্লাস নেয়৷ এটি যখন মোটামুটি জানাজানি হয়ে গেল তখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে বলা হলো, আমি যেন আমার ক্লাসে বাইরের কাউকে এলাউ না করি৷ কাজেই পরবর্তীতে ক্লাস নেবার শুরম্নতে দেখে নিতে হতো, ক্লাসের ছাত্র কারা আর ক্লাসের বাইরের ছাত্র কারা৷

মিলন: ছোটদের জন্য লেখালেখি নিয়ে আপনার ভাবনা কী? প্রথম ছোটদের জন্য কবে থেকে লেখা শুরম্ন করেন?

হুমায়ূন আহমেদ: প্রথম লেখাটা বোধহয় ‘নীল হাতি’৷ কবে বের হয়েছিল সেটা ঠিকঠাক বলতে পারব না৷ অবজারভার গ্রম্নপ বাচ্চাদের জন্য একটা পত্রিকা বের করেছিল৷ পত্রিকাটির নাম বোধহয় ‘কিশোর বাংলা’৷ ওটার প্রথম সংখ্যার জন্য লেখাটা দিলাম৷ ভয়ে ভয়ে ছিলাম, বাচ্চাদের জন্য প্রথম লেখা তোঃ কেমন হয় ? ওটাই আমার প্রথম লেখা বাচ্চাদের জন্য৷ তারপর আমার নিজের বাচ্চারা যখন বড় হলো, তখন ওদের পড়ার জন্য ওদের উপযোগী করে বেশ ক’টি লেখা দাঁড় করাই৷ ওগুলোতে বেশিরভাগ চরিত্রগুলোর নাম ওদের নামেই- নোভা, শীলা, বিপাশা, নুহাশ৷ একটা সময় বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রচুর বাচ্চাদের বই লিখি৷ বাচ্চারা কিন্তু কঠিন পাঠক৷ বাচ্চাদের মা-বাবা আমাকে ধমক দিতে ভয় পায়৷ কিন্তু বাচ্চারা পায় না৷ তারা ধমক দিয়ে আমাকে বলে, কী ব্যাপার, নতুন বই কই? বই নাই কেন? তখন আমি খুব আনন্দ পাই৷ আমি তখন তাদের বলি, আগামী বইমেলায় তোমাদের জন্য নতুন একটা বই থাকবে৷ ওদের মুখের দিকে তাকিয়েই আমাকে কথা রাখতে হয়৷

মিলন: আপনারা তিনভাই তিনবোন৷ আপনার এক ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল একজন বড় মাপের লেখক৷ আরেক ভাই আহসান হাবীব কার্টুন এঁকে রম্য লিখে বিখ্যাত হয়েছেন৷ একই পরিবারের তিনজন মানুষ তিনরকমভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন৷ এ বিষয়ে আপনার অনুভূতি কেমন?

হুমায়ূন আহমেদ: এরা প্রত্যেকেই নিজ যোগ্যতায় আজকের পর্যায়ে পেঁৗছেছে, নিজস্বভাবেই তারা প্রতিষ্ঠিত৷ এরা প্রত্যেকে আলাদা মানুষ৷ সাধারণভাবে একই পরিবারে দুই-তিনজন লেখক তৈরি হলে একজনের ছাপ অন্যজনের ওপর পড়ে৷ এটাই স্বাভাবিক৷ কিন্তু আমার ভাইদের মধ্যে ছাপের কোনো ব্যাপার নাই৷ জাফর ইকবাল লিখছে একেবারে তার নিজস্ব স্টাইলে৷ আমার লেখার কোনো ছাপ তার মধ্যে নাই৷ আহসান হাবীব লিখছে সম্পূর্ণ তার মতো করে৷ ছবি-টবি অাঁকছে তার নিজস্ব চিনত্মা থেকে৷ বড় দুই ভাইয়ের কোনো ছাপ তার মধ্যে নাই৷ প্রত্যেকেই প্রত্যেকের আলাদা জায়গায় কাজ শুরম্ন করেছে এবং ভালো কাজ করছে৷ আমরা ভাইবোনেরা ইনক্লডিং মাই সিস্টার্স, যারা লেখালেখির লাইনে আসে নাই- এরা প্রত্যেকেই যে কাজটি করে খুব সিনসিয়ারলি করে৷ এটা আমাদের পারিবারিক গুণ বলা যেতে পারে৷ আমরা ভাইবোনেরা কোনো কাজ হাতে নিলে সেটা ঠিকভাবে করব, এটা স্বতঃসিদ্ধ৷

মিলন: বাংলা ভাষায় আপনার প্রিয় লেখক কারা কারা ? যাদের লেখা আপনি সবই প্রায় পড়েছেন ?

হুমায়ূন আহমেদ: একদম শুরম্ন থেকে বলি৷ বঙ্কিমচন্দ্র৷ কেননা তাঁর গল্প তৈরির ৰমতা অসাধারণ৷ তারপর আমাদের শরত্‍চন্দ্র৷

মিলন: একটি ভিন্ন বিষয়ে আপনাকে প্রশ্ন করতে চাই৷ বিষয়টি হলো ‘মৃতু্য-চিনত্মা’৷ আমি জানি যে, আপনি মৃতু্য নিয়ে ভাবেন৷ জাগতিক বিষয়ের পাশাপাশি মৃতু্য-পরবর্তী জগত্‍ নিয়েও আপনি ভাবেন৷ আপনার মৃতু্য-চিনত্মাটা কী রকম?

হুমায়ূন আহমেদ: আমি থাকব না, এই পৃথিবী পৃথিবীর মতো থাকবে৷ বর্ষা আসবে, জোছনা হবে৷ কিন্তু সেই বর্ষা দেখার জন্য আমি থাকব না৷ জোছনা দেখার জন্য আমি থাকব না৷ এই জিনিসটি আমি মোটেও নিতে পারি না৷ আগেও কখনো পারতাম না, এখনো যতই ঐদিকে এগিয়ে যাচ্ছি ততই আর পারছি না৷

মিলন: বড় লেখকদের ৰেত্রে কালজয়ী শব্দটা বাংলা ভাষায় আছে৷ যারা সময়কে জয় করে নেন নিজের লেখার মধ্য দিয়ে৷ আপনি আপনার লেখার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবেন, এই ফিলিংসটা আপনার কেমন?

হুমায়ূন আহমেদ: এই বিষয়টা একেবারেই আমার মাথায় আসে না৷ আমিই নেই আর আমার লেখা লোকজন পাঠ করছে, এতে আমার কী যায় আসে?

মিলন: কিন্তু এরকম কি কখনো মনে হয় না, আমার যে লেখাগুলো আমি রেখে যাচ্ছি, তার মধ্যেই আমি বেঁচে থাকব, লোকজন আমাকে স্মরণ করবে?

হুমায়ূন আহমেদ: না, সেরকম মনে হয় না৷ মিলন, আমি তোমাকে সিরিয়াসলি বলছি, আই অ্যাম টেলিং ইউ ফ্রম মাই হার্টঃ এই চিনত্মাটা কখনো আমার হয় না যে, ৫০ বছর পর লোকে আমার লেখা পড়বে, আমি কত ভাগ্যবান! আমি সারাজীবন লেখালেখি করেছি নিজের আনন্দের জন্যে৷

মিলন: আপনি বললেন যে, বেশ কয়েকবার মৃতু্য খুব কাছ থেকে দেখেছেন৷ যখন আপনার বাইপাস সার্জারিটা হলো, যখন আপনাকে এনেসথেশিয়া দেয়া হচ্ছে, আপনার সেন্সটা অন্য জগতে চলে যাচ্ছে৷ এই যে ঘুমে তলিয়ে যাবার সময়টা, যতৰণ পর্যনত্ম আপনার চেতনা ছিল, সেই মুহূর্তে আপনি বিশেষ কিছু কি ভেবেছেন? আপনার মনে পড়ে?

হুমায়ূন আহমেদ: আমি তো মুসলমানের ছেলে৷ ধর্ম-বিশ্বাসটা জন্মের পর থেকেই খুব শক্তভাবে মাথায় ঢোকানো৷ সেই মুহূর্তে আমি যে ক’টা সুরা জানতাম, বারবার সেগুলোই মনে মনে পড়ার চেষ্টা করেছি এবং সুরা পাঠের সঙ্গে সঙ্গে বেঁচে যাবার প্রার্থনা করছিলাম৷ পুত্র-কন্যা-স্ত্রী-ভাই-বোন এদের কারোর কথাই মনে হয়নি৷

মিলন: আচ্ছা হুমায়ূন ভাই, বাংলাদেশ নিয়ে আপনি কী ধরনের স্বপ্ন দেখেন? এই দেশের স্বাধীনতার জন্য একটা মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, এই মুক্তিযুদ্ধে আপনার বাবা প্রাণ দিয়েছিলেন৷ বহু উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে এই দেশের আজকের প্রেৰাপটে আপনি অনেক বড় লেখক৷ এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আপনি বাংলাদেশ নিয়ে কী স্বপ্ন দেখছেন?

হুমায়ূন আহমেদ: আমি আমার নিজের দেশ নিয়ে অসম্ভব রকম আশাবাদী৷ আমাকে যদি একলৰবার জন্মাবার সুযোগ দেয়া হয় আমি একলৰবার এই দেশেই জন্মাতে চাইব৷ এই দেশের বৃষ্টিতে ভিজতে চাইব৷ এই দেশের বাঁশবাগানে জোছনা দেখতে চাইব৷

ভয়ের ভূতের গল্পছায়াসঙ্গী(হুমায়ূন আহমেদ)


প্রতি বছর শীতের ছুটির সময় ভাবি কিছুদিন গ্রামে কাটিয়ে আসব। দলবল নিয়ে যাব- হৈচৈ করা যাবে। আমার বাচ্চারা কখনও গ্রাম দেখেনি- তারা খুশি হবে। পুকুরে ঝাঁপাঝাঁপি করতে পারবে। শাপলা ফুল শুধু যে মতিঝিলের সামনেই ফোটে না, অন্যান্য জায়গাতেও ফোটে তাও স্বচক্ষে দেখবে।
আমার বেশির ভাগ পরিকল্পনাই শেষ পর্যন্ত কাজে লাগাতে পারি না। এটা কেমন করে জানি লেগে গেল। একদিন সত্যি সত্যি রওনা হলাম।
আমাদের গ্রামটাকে অজ পাড়াগাঁ বললেও সম্মান দেখানো হয়। যোগাযোগ-ব্যবস্থার এমন সুন্দর সময়েও সেখানে পৌঁছাতে হয় গরুর গাড়িতে। বর্ষার সময় নৌকা, তবে মাঝখানে একটা হাওর পড়ে বলে সেই যাত্রা অগস্ত্যযাত্রার মতো।
অনেকদিন পর গ্রামে গিয়ে ভালো লাগল। দেখলাম আমার বাচ্চাদের আনন্দবর্ধনের সব ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে। কোত্থেকে যেন একটা হাড়জিরজিরে বেতো ঘোড়া জোগাড় করা হয়েছে। এই ঘোড়া নড়াচড়া করে না, এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে। খুব বেশি বিরক্ত হলে দীর্ঘনিশ্বাসের মতো একটা শব্দ করে এবং লেজটা নাড়ে। বাচ্চারা এতবড় একটা জীবন্ত খেলনা পেয়ে মহাখুশি। দু-তিনজন একসঙ্গে ঘোড়ার পিঠে উঠে বসে থাকে।
তাদের অসংখ্য বন্ধু-বান্ধবও জুটে গেল। যেখানেই যায় তাদের সঙ্গে গোটা পঞ্চাশেক ছেলেপুলে থাকে। আমার বাচ্চারা যা করে তাতেই তারা চমৎকৃত হয়। আমার বাচ্চারা তাদের বিপুল জনপ্রিয়তায় অভিভূত। তারা তাদের যাবতীয় প্রতিভা দেখাতে শুরু করল-কেউ কবিতা বলছে, কেউ গান, কেউ ছড়া।
আমি একগাদা বই সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমার পরিকল্পনা- পুরোপুরি বিশ্রাম নেওয়া। শুয়ে বসে বই পড়া, খুব বেশি ইচ্ছা করলে খাতা-কলম নিয়ে বসা। একটা উপন্যাস অর্ধেকের মতো লিখেছিলাম, বাকিটা কিছুতেই লিখতে ইচ্ছা করছিল না। পান্ডুলিপি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। নতুন পরিবেশে যদি লিখতে ইচ্ছা করে।
প্রথম কিছুদিন বই বা লেখা কোনোটাই নিয়ে বসা গেল না। সারাক্ষণই লোকজন আসছে। তারা অত্যন্ত গম্ভীর গলায় নানান জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনায় উৎসাহী। এসেই বলবে- ‘দেশের অবস্থাডা কী কন দেহি ছোডমিয়া। বড়ই চিন্তাযুক্ত আছি। দেশের হইলডা কী? কী দেশ ছিল আর কী হইল?’
দিন চার-পাঁচেকের পর সবাই বুঝে গেল দেশ সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। গল্পগুজবও তেমন করতে পারি না। তারা আমাকে রেহাই দিল। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। গ্রামের নতুন পরিবেশের কারণেই হোক বা অন্য কোনও কারণেই হোক আমি লেখালেখির প্রবল আগ্রহ বোধ করলাম। অসমাপ্ত পান্ডুলিপি নিয়ে বসলাম। সারাদিন লেখালেখি কাটাকুটি করি, সন্ধ্যায় স্ত্রীকে সঙ্গে করে বেড়াতে বের হই। চমৎকার লাগে। প্রায় রাতেই একজন দুজন করে ‘গাতক’ আসে। এরা জ্যোৎস্নাভেজা উঠোনে বসে চমৎকার গান ধরে-
“ও মনা
এই কথাটা না জানলে প্রাণে বাঁচতাম না।
না না না-আমি প্রাণে বাঁচতাম না।”
সময়টা বড় চমৎকার কাটতে লাগল। লেখার ব্যাপারে আগ্রহ বাড়তেই লাগল। সারাদিনই লিখি।
এক দুপুরের কথা- একমনে লিখছি। জানালার ওপাশে খুট করে শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখি খালিগায়ে রোগামতো দশ-এগারো বছরের একটা ছেলে গভীর আগ্রহে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে আগেও দেখেছি। জানালার ওপাশ থেকে গভীর কৌতূহলে সে আমাকে দেখে। চোখে চোখ পড়লেই পালিয়ে যায়। আজ পালাল না।
আমি বললাম- কী রে?
সে মাথাটা চট করে নামিয়ে ফেলল।
আমি বললাম- চলে গেলি নাকি?
ও আড়াল থেকে বলল- না।
‘নাম কী রে তোর?’
‘মন্তাজ মিয়া।’
‘আয় ভেতরে আয়।’
‘না।’
আর কোনও কথাবার্তা হল না। আমি লেখায় ডুবে গেলাম। ঘুঘুডাকা শ্রান্ত দুপুরে লেখালেখির আনন্দই অন্যরকম। মন্তাজ মিয়ার কথা ভুলে গেলাম।
পরদিন আবার এই ব্যাপার। জানালার ওপাশে মন্তাজ মিয়া। বড় বড় কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে আছে। আমি বললাম- কী ব্যাপার মন্তাজ মিয়া? আয় ভেতরে।
সে ভেতরে ঢুকল।
আমি বললাম, থাকিস কোথায়?
উত্তরে পোকা-খাওয়া দাঁত বের করে হাসল।
‘স্কুলে যাস না?’
আবার হাসি। আমি খাতা থেকে একটা সাদা কাগজ ছিঁড়ে তার হাতে দিলাম। সে তার এই বিরল সৌভাগ্যে অভিভূত হয়ে গেল। কী করবে বুঝতে পারছে না। কাগজটার গন্ধ শুঁকল। গালের উপর খানিকক্ষণ চেপে রেখে উল্কার বেগে বেরিয়ে গেল।
রাতে খেতে খেতে আমার ছোট চাচা বললেন- মন্তাজ হারামজাদা তোমার কাছে নাকি আসে? আসলে একটা চড় দিয়ে বিদায় করবে।
‘কেন?’
‘বিরাট চোর। যা-ই দেখে তুলে নিয়ে যায়। ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দিবে না। দুই দিন পরপর মার খায় তাতেও হুঁশ হয় না। তোমার এখানে এসে করে কী?’
‘কিছু করে না।’
‘চুরির সন্ধানে আছে। কে জানে এর মধ্যে হয়তো তোমার কলম-টলম নিয়ে নিয়েছে।’
‘না, কিছু নেয়নি।’
‘ভালো করে খুঁজে-টুজে দ্যাখো। কিছুই বলা যায় না। ঐ ছেলের ঘটনা আছে।’
‘কী ঘটনা?’
‘আছে অনেক ঘটনা। বলব একসময়।
পরদিন সকালে যথারীতি লেখালিখি শুরু করেছি। হৈচৈ শুনে বের হয়ে এলাম। অবাক হয়ে দেখি মন্তাজ মিয়াকে তিন-চারজন চ্যাংদোলা করে নিয়ে এসেছে। ছেলেটা ফোঁপাচ্ছে। বোঝাই যাচ্ছে প্রচন্ড মার খেয়েছে। ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ছে। একদিকের গাল ফুলে আছে।
আমি বললাম, কী ব্যাপার?
শাস্তিদাতাদের একজন বলল, দেখেন তো এই কলমটা আপনের কি না। মন্তাজ হারামজাদার হাতে ছিল।
দেখলাম কলমটা আমারই, চার-পাঁচ টাকা দামের বলপয়েন্ট। এমন কোনও মহার্ঘ বস্তু নয়। আমার কাছে চাইলেই দিয়ে দিতাম। চুরি করার প্রয়োজন ছিল না। মনটা একটু খারাপই হল। বাচ্চা বয়সে ছেলেটা এমন চুরি শিখল কেন? বড় হয়ে এ করবে কী?
‘ভাইসাব, কলমটা আপনার?’
‘হ্যাঁ। তবে আমি এটা ওকে দিয়ে দিয়েছি। ছেড়ে দিন। বাচ্চা ছেলে এত মারধর করেছেন কেন? মারধর করার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করে নেবেন না?’
শাস্তিদাতা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, এই মাইরে ওর কিছু হয় না। এইডা এর কাছে পানিভাত। মাইর না খাইলে এর ভাত হজম হয় না।
মন্তাজ মিয়া বিস্মিত চোখে আমাকে দেখছে। তাকে দেখেই মনে হল সে তার ক্ষুদ্র জীবনে এই প্রথম একজনকে দেখছে যে চুরি করার পরও তাকে চোর বলেনি। মন্তাজ মিয়া নিঃশব্দে বাকি দিনটা জানালার ওপাশে বসে রইল। অন্যদিন তার সঙ্গে দুএকটা কথাবার্তা বলি, আজ একটা কথাও বলা হল না। মেজাজ খারাপ হয়েছিল। এই বয়সে একটা ছেলে চুরি শিখবে কেন?
মন্তাজ মিয়ার যে একটা বিশেষ ঘটনা আছে তা জানলাম আমার ছোট চাচির কাছে। চুরির ঘটনারও দুদিন পর। গ্রামের মানুষদের এই একটা অদ্ভুত ব্যাপার। কোন ঘটনা যে গুরুত্বপূর্ণ, কোনটা তুচ্ছ তা এরা বুঝতে পারে না। মন্তাজ মিয়ার জীবনের এত বড় একটা ব্যাপার কেউ আমাকে এতদিন বলেনি, অথচ তুচ্ছ সব বিষয় অনেকবার করে শোনা হয়ে গেছে। মন্তাজ মিয়ার ঘটনাটা এই-
তিন বছর আগে কার্তিক মাসের মাঝামাঝি মন্তাজ মিয়া দুপুরে প্রবল জ্বর নিয়ে বাড়ি ফেরে। সেই জ্বরের প্রকোপ এতই বেশি যে শেষ পর্যন্ত মন্তাজ মিয়ার হতদরিদ্র বাবা একজন ডাক্তারও নিয়ে এলেন। ডাক্তার আনার কিছুক্ষণের মধ্যেই মন্তাজ মিয়া মারা গেল। গ্রামে জন্ম এবং মৃত্যু দুটোই বেশ স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করা হয়। মন্তাজ মিয়ার মা কিছুক্ষণ চিৎকার করে কাঁদল। তার বাবাও খানিকক্ষণ ‘আমার পুত কই গেলরে’ বলে চেঁচিয়ে স্বাভাবিক হয়ে গেল। বেঁচে থাকার প্রবল সংগ্রামে তাদের লেগে থাকতে হয়। পুত্রশোকে কাতর হলে চলে না।
মরা মানুষ যত তাড়াতাড়ি কবর দিয়ে দেওয়া হয় ততই নাকি সোয়াব এবং কবর দিতে হয় দিনের আলো থাকতে থাকতে। কাজেই জুম্মাঘরের পাশে বাদ আছর মন্তাজ মিয়ার কবর হয়ে গেল। সবকিছুই খুব স্বাভাবিকভাবে।
অস্বাভাবিক ব্যাপারটা শুরু হল দুপুর রাতের পর, যখন মন্তাজ মিয়ার বড় বোন রহিমা কলমাকান্দা থেকে উপস্থিত হল। কলমাকান্দা এখান থেকে একুশ মাইল। এই দীর্ঘ পথ একটি গর্ভবতী মহিলা পায়ে হেঁটে চলে এল এবং বাড়িতে পা দিয়েই চেঁচিয়ে বলল, তোমরা করছ কী? মন্তাজ বাঁইচ্যা আছে। কবর খুঁইড়া তারে বাইর কর। দিরং কবরা না।
বলাই বাহুল্য, কেউ তাকে পাত্তা দিল না। শোকে-দুঃখে মানুষের মাথা খারাপ হয়ে যায়। কবর দিয়ে দেওয়ার পর নিকট আত্মীয়-স্বজনরা সবসময় বলে-“ও মরে নাই।” কিন্তু মন্তাজ মিয়ার বোন রহিমা এই ব্যাপারটা নিয়ে এতই হৈচৈ শুরু করল যে সবাই বাধ্য হল মৌলানা সাহেবকেডেকে আনতে।
রহিমা মৌলানা সাহেবের পায়ে গিয়ে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, মন্তাজ বাঁইচ্যা আছে- আপনে এরে বাঁচান। আপনে না বললে কবর খুঁড়ত না। আপনে রাজি না হওয়া পর্যন্ত আমি পাও ছাড়তাম না। মৌলানা সাহেব অনেক চেষ্টা করেও রহিমাকে ঝেড়ে ফেলতে পারলেন না। রহিমা বজ্রআঁটুনিতে পা ধরে বসে রইল।
মৌলানা সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন- বাঁইচা আছে বুঝলা ক্যামনে? রহিমা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল, আমি জানি।
গ্রামের মৌলানারা অতি কঠিনহৃদয়ের হয় বলে আমাদের একটা ধারণা আছে। এই ধারণা সত্যি নয়। মৌলানা সাহেব বললেন- প্রয়োজনে কবর দ্বিতীয়বার খোঁড়া জায়েজ আছে। এই মেয়ের মনের শান্তির জন্যে এটা করা যায়। হাদিস শরীফে আছে…
কবর খোঁড়া হল।
ভয়াবহ দৃশ্য!
মন্তাজ মিয়া কবরের গায়ে হেলান দিয়ে বসে আছে। পিটপিট করে তাকাচ্ছে। হঠাৎ চোখে প্রবল আলো পড়ায় চোখ মেলতে পারছে না। কাফনের কাপড়ের একখ- লুঙ্গির মতো পেঁচিয়ে পরা। অন্য দুটি খন্ড সুন্দর করে ভাঁজ করা।
অসংখ্য মানুষ জমা হয়ে আছে। এই অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখে কারো মুখে কোনও কথা সরল না। মৌলানা সাহেব বললেন- কীরে মন্তাজ?
মন্তাজ মৃদুস্বরে বলল, পানির পিয়াস লাগছে।
মৌলানা সাহেব হাত বাড়িয়ে তাকে কবর থেকে তুললেন।
এই হচ্ছে মন্তাজ মিয়ার গল্প। আমি আমার এই জীবনে অদ্ভুত গল্প অনেক শুনেছি, এ রকম কখনো শুনিনি।
ছোট চাচাকে বললাম, মন্তাজ তারপর কিছু বলেনি? অন্ধকার কবরে জ্ঞান ফিরবার পর কী দেখল না-দেখল এইসব?
ছোট চাচা বললেন- না। কিচ্ছু কয় না। হারামজাদা বিরাট বজ্জাত।
‘জিজ্ঞেস করেননি কিছু?’
‘কত জনে কত জিজ্ঞেস করছে। এক সাংবাদিকও আসছিল। ছবি তুলল। কত কথা জিজ্ঞেস করল-একটা শব্দ করে না। হারামজাদা বদের হাড্ডি।’
আমি বললাম, কবর থেকে ফিরে এসেছে-লোকজন তাকে ভয়-টয় পেত না?
‘প্রথম প্রথম পাইত। তারপর আর না। আল্লাহ্‌তায়ালার কুদরত। আল্লাহ্‌তায়ালার কেরামতি আমরা সামান্য মানুষ কী
বুঝব কও?’
‘তা তো বটেই। আপনারা তার বোন রহিমাকে জিজ্ঞেস করেননি সে কী করে বুঝতে পারল মনত্মাজ বেঁচে আছে?’
‘জিজ্ঞেস করার কিছু নাই। এইটাও তোমার আল্লাহ্‌র কুদরত। উনার কেরামতি।’
ধর্মকর্ম করুক বা না-করুক গ্রামের মানুষদের আল্লাতায়ালার ‘কুদরত’ এবং কেরামতির’ উপর অসীম ভক্তি। গ্রামের মানুষদের চরিত্রে চমৎকার সব দিক আছে। অতি তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে এরা প্রচুর মাতামাতি করে, আবার অনেক বড় বড় ঘটনা হজম করে। দার্শনিকের মতো গলায় বলে ‘আল্লাহ্‌র কুদরত’।
আমি ছোট চাচাকে বললাম, রহিমাকে একটু খবর দিয়ে আনানো যায় না? ছোট চাচা বিস্মিত হয়ে বললেন, কেন?
‘কথা বলতাম।’
‘খবর দেওয়ার দরকার নাই। এম্নেই আসব।’
‘এম্নিতেই আসবে কেন?’
ছোট চাচা বললেন- তুমি পুলাপান নিয়া আসছ। চাইরদিকে খবর গেছে। এই গেরামের যত মেয়ের বিয়া হইছে সব অখন নাইওর আসব। এইটাই নিয়ম।
আমি অবাকই হলাম। সত্যি সত্যি এটাই নাকি নিয়ম। গ্রামের কোনো বিশিষ্ট মানুষ আসা উপলক্ষে গ্রামের সব মেয়েনাইওর আসবে। বাপের দেশের আসার এটা তাদের একটা সুযোগ। এই সুযোগ তারা নষ্ট করবে না।
আমি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেউ কি এসেছে?
‘আসব না মানে? গেরামের একটা নিয়ম-শৃঙ্খলা আছে না?’
আমি ছোট চাচাকে বললাম, আমাদের উপলক্ষে যেসব মেয়ে নাইওর আসবে তাদের প্রত্যেককে যেন একটা করে দামি শাড়ি উপহার হিসেবে দেওয়া হয়, একদিন খুব যত্ন করে দাওয়াত খাওয়ানো হয়।
ছোট চাচা এটা পছন্দ করলেন না। তবে তাঁর রাজি না হয়েও কোনও উপায় ছিল না। আমাদের জমিজমা তিনি দীর্ঘদিন ধরে ভোগদখল করছেন।
গ্রামের নিয়মমতো একসময় রহিমাও এল। সঙ্গে চারটি ছোট ছেলেমেয়ে। হতদরিদ্র অবস্থা। স্বামীর বাড়ি থেকে সে আমার জন্যে দুটা ডালিম নিয়ে এসেছে।
আমার স্ত্রী তাকে খুব যত্ন করে খাওয়াল। খাওয়ার শেষে তাকে শাড়িটি দেওয়া হলো। মেয়েটি অভিভূত হয়ে গেল। এ রকম একটা উপহার বোধহয় তার কল্পনাতেও ছিল না। তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়তে লাগল। আমি তাকে আমার ঘরে ডেকে নিলাম। কোমল গলায় বললাম, কেমন আছ রহিমা?
রহিমা ফিসফিস করে বলল, ভালো আছি ভাইজান।
‘শাড়ি পছন্দ হয়েছে?’
‘পছন্দ হইব না! কী কন ভাইজান! অত দামি জিনিস কি আমরা কোনোদিন চউক্ষে দেখছি!’
‘তোমার ভাইয়ের ব্যাপারটা জানতে চাচ্ছিলাম। তুমি কী করে বুঝলে ভাই বেঁচে আছে?’
রহিমা অনেকটা সময় চুপ করে থেকে বলল, কী কইরা বুঝলাম আমি নিজেও জানি না ভাইজান। মৃত্যুর খবর শুইন্যা দৌড়াইতে দৌড়াইতে আসছি। বাড়ির উঠানে পাও দিতেই মনে হইল মন্তাজ বাঁইচ্যা আছে।
‘কীজন্যে মনে হল?’
‘জানি না ভাইজান। মনে হইল।’
‘এইরকম কি তোমার আগেও হয়েছে? মানে কোনও ঘটনা আগে থেকেই কি তুমি বলতে পার?’
‘জ্বি না।’
‘মন্তাজ তোমাকে কিছু বলেনি? জ্ঞান ফিরলে সে কী দেখল বা তার কী মনে হল?’
‘জ্বি না।’
‘জিজ্ঞেস করনি?’
‘করছি। হারামজাদা কথা কয় না।’
রহিমা আরও খানিকক্ষণ বসে পানটান খেয়ে চলে গেল।
আমার টানা লেখালেখিতে ছেদ পড়ল। কিছুতেই আর লিখতে পারি না। সবসময় মনে হয় বাচ্চা একটি ছেলে কবরের বিকট অন্ধকারে জেগে উঠে কী ভাবল? কী সে দেখল? তখন তার মনের অনুভূতি কেমন ছিল? মন্তাজ মিয়াকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে, আমার মনে হয় জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবে না। সবসময় মনে হয় বাচ্চা একটি ছেলেকে ভয়স্মৃতি মনে করিয়ে দেওয়াটা অন্যায় কাজ। এই ছেলে নিশ্চয়ই প্রাণপণে এটা ভুলতে চেষ্টা করছে। ভুলতে চেষ্টা করছে বলেই কাউকে কিছু বলতে চায়
না। তবু একদিন কৌতূহলের হাতে পরাজিত হলাম।

দুপুরবেলা।
গল্পের বই নিয়ে বসেছি। পাড়াগাঁর ঝিম-ধরা দুপুর। একটু যেন ঘুম-ঘুম আসছে। জানালার বাইরে খুট করে শব্দ হল। তাকিয়ে দেখি মন্তাজ। আমি বললাম- কী খবররে মন্তাজ?
‘ভালো।’
‘বোন আছে না চলে গেছে?’
‘গেছেগা।’
‘আয় ভেতরে আয়।’
মন্তাজ ভেতরে চলে এল। আমার সঙ্গে তার ব্যবহার এখন বেশ স্বাভাবিক। প্রায়ই খানিকটা গল্পগুজব হয়। মনে হয় আমাকে সে খানিকটা পছন্দও করে। এইসব ছেলে ভালোবাসার খুব কাঙাল হয়। অল্পকিছু মিষ্টি কথা, সামান্য একটু আদর এতেই তারা অভভূত হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে বলে আমার ধারণা।
মন্তাজ এসে খাটের এক প্রান্তে বসল। আড়ে আড়ে তোমাকে দেখতে লাগল। আমি বললাম, তোর সঙ্গে কয়েকটা কথা
বলি, কেমন?
‘আইচ্ছা।’
‘ঠিকমতো জবাব দিবি তো?’
‘হুঁ।’
‘আচ্ছা মন্তাজ, কবরে তুই জেগে উঠেছিলি, মনে আছে?’
‘আছে।’
‘যখন জেগে উঠলি তখন ভয় পেয়েছিলি?’
‘না।’
‘না কেন?’
মন্তাজ চুপ করে রইল। আমার দিক থেকে অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল। আমি বললাম, কী দেখলি- চারদিক অন্ধকার?
‘হ।’
‘কেমন অন্ধকার?’
মন্তাজ এবারও জবাব দিল না। মনে হচ্ছে সে বিরক্ত হচ্ছে।
আমি বলালম, কবর তো খুব অন্ধকার তবু ভয় লাগল না?
মন্তাজ নিচুস্বরে বলল, আরেকজন আমার সাথে আছিল সেইজন্য ভয় লাগে নাই।
আমি চমকে উঠে বললাম, আরেকজন ছিল মানে? আরেকজন কে ছিল?
‘চিনি না। আন্ধাইরে কিচ্ছু দেখা যায় না।’
‘ছেলে না মেয়ে?’
‘জানি না।’
‘সে কী করল?
‘আমারে আদর করল। আর কইল, কোনও ভয় নাই।’
‘কীভাবে আদর করল?’
‘মনে নাই।’
‘কী কী কথা সে বলল?’
‘মজার মজার কথা-খালি হাসি আসে।’
বলতে বলতে মন্তাজ মিয়া ফিক করে হেসে ফেলল।
আমি বললাম, কীরকম মজার কথা? দুএকটা বল তো শুনি?
‘মনে নাই।’
‘কিছুই মনে নাই? সে কে এটা কি বলেছে?’
‘জ্বি না।’
‘ভালো করে ভেবেটেবে বল তো-কোনোকিছু কি মনে পড়ে?’
‘উনার গায়ে শ্যাওলার মতো গন্ধ ছিল।’
‘আর কিছু?’
মন্তাজ মিয়া চুপ করে রইল।
আমি বললাম, ভালো করে ভেবেটেবে বল তো! কিছুই মনে নেই?
মন্তাজ মিয়া অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, একটা কথা মনে আসছে।
‘সেটা কী?’
‘বলতাম না। কথাডা গোপন।’
‘বলবি না কেন?’
মন্তাজ জবাব দিল না।
আমি আবার বললাম, বল মন্তাজ, আমার খুব শুনতে ইচ্ছা করছে।
মন্তাজ উঠে চলে গেল।
এই তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা।বাকি যে-ক’দিন গ্রামে ছিলাম, সে কোনোদিন আমার কাছে আসেনি। লোক পাঠিয়ে খবর দিয়েছি তবু আসেনি। কয়েকবার নিজেই গেলাম। দূর থেকে দেখতে পেয়ে সে পালিয়ে গেল। আমি আর চেষ্টা করলাম না।
কিছু রহস্য সে তার নিজের কাছে রাখতে চায়। রাখুক। এটা তার অধিকার। এই অধিকার অনেক কষ্টে সে অর্জন করেছে। শ্যাওলাগন্ধী সেই ছায়াসঙ্গীর কথা আমরা যদি কিছু নাও জানি তাতেও কিছু যাবে আসবে না।

Friday, May 19, 2017

কথার কথা (আনিসুল হক)


আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’ বহুদিন আগে জীবনানন্দ দাশের মা কবি কুসুমকুমারী দাশ এই কবিতা লিখেছিলেন। তাঁর লেখার ধরনটা ছিল বড় মজার। রান্না করছিলেন হয়তো। তাঁদেরই ব্রাਜ਼সমাজ পত্রিকার সম্পাদক এসে বললেন, লেখা দিতে হবে। তরকারিতে হলুদ ছিটিয়ে দিতে দিতে কোলে খাতা মেলে ধরলেন। তরকারি রান্না হওয়ার আগেই কবিতার পরিবেশন শেষ। তবে কবিতাটিতে তিনি লিখেছিলেন লাখ কথার এক কথা। বুঝেছিলেন, বাঙালি মাত্রই কথায় পটু, কাজে তেমন নয়। কথাই শুধু বলে গেলাম আমরা। দেশটা কেন পিছিয়ে−এ নিয়ে কত কথা যে আমরা বললাম! যার কাছে যাবেন, তার কাছেই সমস্যার সমাধান আছে। কত কথা যে তিনি আমাদের বলতে পারবেন! আর যে বিষয়ে যে কম জানে, সেই বিষয়ে সে বলতে পারে সবচেয়ে বেশি, সবচেয়ে ভালো।
আগে তো কথা হতো শুধু সামনাসামনি, মুখে মুখে; এখন কথা হচ্ছে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা। হ্যাঁ, মোবাইল ফোনে তো বটেই, ওরা তো স্েলাগানই দিয়ে রেখেছে−ওরে, কত কথা বলে রে! আরও আছে টেলিভিশন। শোর নামই টক শো। নেন, কথা বলেন। চলছে কথা। খালি কথা। ইস, কথার ওপর যদি ট্যাক্স নেওয়া যেত!
বলছে বলুক। অন্তত একটা গর্ব আমরা করতে পারি, আমাদের বাকস্বাধীনতা আছে। তাই আমরা বলেই চলেছি। বলার সময় কম বলি না। আমাদের প্রতিটি জনসভা ‘ঐতিহাসিক’। আমাদের প্রতিটি কর্মসুচি ‘স্নরণকালের বৃহত্তম’। আমাদের প্রতিটি স্থাপনা ‘এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সেরা’।
সবকিছুতে আমাদের হারানো যাবে, কথায় যাবে না।
এবার বোধহয় আমাদের কথাগুলোকে কাজেও পরিণত করতে হবে। হবে তো বটে, কিন্তু করবে কে? আমি করব না। আপনি করুন।

সূর্যদীঘল বাড়ী উপন্যাসের পটভূমি এবং আবু ইসহাক


উপন্যাসটি প্রকাশের কোনো ব্যবস্থা না হওয়ায় লেখক ভীষণ মনোকষ্টে ভোগেন। এর মধ্যে গোলাম মোস্তফা সম্পাদিত ‘নওবাহার’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ১৯৫১-৫২ সালে এটি প্রকাশিত হয়। তখনো উপন্যাসটি কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়। অবশেষে এটি ১৯৫৫ সালে কলকাতা থেকে পুস্তকাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় এবং ঢাকা ও কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় এর আলোচনা বের হয়। ফলে এটি সহজেই সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং নানা মহলে এটি আলোড়ন সৃষ্টি করে।

লোকসংস্কার আর সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করেই ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ উপন্যাসের সূত্রপাত। গ্রামে সাধারণত দক্ষিণমুখী ঘরবাড়ি তৈরি করা হয়, কিন্তু সূর্যদীঘল বাড়ী ছিল পূর্ব-পশ্চিমমুখী। যেমন কথা বলে:
‘দক্ষিণ দুয়ারী ঘরের রাজা
পুব দুয়ারী তাহার প্রজা
উত্তর দুয়ারীর খাজনা নাই
পশ্চিম দুয়ারীর মুখে ছাই।’
সেজন্যই ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ জনজীবনের অন্যরকম রূপ পেয়েছিল। সংস্কার আর কুসংস্কারে আচ্ছাদিত ছিল বাড়িটি। এই ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ উপন্যাস লিখেই আবু ইসহাক (১৯২৬-২০০৩) রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেনÑ নজরুলের ‘বিদ্রোহী’, জসীম উদ্দীনের ‘কবর’ এবং মধুসূদনের ‘মেঘনাদ বধ’ কবিতা ও কাব্যের মতো। জীবনের বাস্তবতা ও সমাজের নিরঙ্কুশ সত্য প্রকাশে আবু ইসহাক সদা তৎপর ছিলেন। ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ ওই বিশেষ ভাবসত্যের পরিচয়ই বহন করেছে। এ উপন্যাসে বাংলাদেশের পল্লী অঞ্চলের মানুষের সমাজ ও জীবনের প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়েছে।
এই উপন্যাসের পটভূমি মূলত গ্রাম হলেও লেখক শহরে বসেই এর কাহিনী, চরিত্র ও পারিপার্শ্বিকতা নির্মাণ করেন। লেখকের নিজের কথায় : “১৯৪৪ থেকে ১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত আমি নারায়ণগঞ্জেই ছিলাম। তখন ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’র প্লট আমার মধ্যে শাখা বিস্তার করতে শুরু করেছে। এক শয্যাবিশিষ্ট দুই কামরার একটায় থাকেন পুরনো সহকর্মী ফজলুল করিম। আমি যে কিছু লেখালেখি করি তা তিনি জানতেন। তাকে বললাম, ‘ভাই, আপনার রুমটা আমাকে ছেড়ে দিয়ে আপনি যদি আমার জায়গায় আসেন তাহলে আমার লেখালেখির কাজটা চলতে পারে’।… ফজলুল করিমের উদারতায় আমি সেই আশ্রয় পেয়েছিলাম। সেখানে দরজা বন্ধ করে নিবিষ্ট মনে লেখালেখির সুযোগ আমি পেয়েছি। সেই নিভৃত কক্ষেই আমি ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ লেখা শুরু করি। উপন্যাসটির অর্ধেকটা ওখানে বসেই লেখা।… এর প্লট তিনি ট্রেনে আসা-যাওয়ার সময় সাধারণ মানুষের জীবন থেকে সংগ্রহ করেছিলেন।
১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে আমি বদলি হয়ে যাই পাবনা। সেখানে কিছুদিন এক মেসে থেকে বুঝতে পারলাম হট্টগোলের মধ্যে লেখা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ঠিক সেই সময়ে পাবনা শহরের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত এক প্রখ্যাত সপ্ততীর্থ প-িতের সপ্ততীর্থকুটির ভাড়া দেয়া হবে শুনে একাই সে দোতলা বাড়িটা নিলাম মাসিক পঞ্চাশ টাকা ভাড়ায়। সেই বাড়ির নিভৃতে নির্জনে দোতলায় বসে ১৯৪৮ সালের আগস্ট মাসে ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ লেখা শেষ করি” (অপরিশোধ্য ঋণ/স্মৃতি বিচিত্রা, পৃ-২৩-২৪)।
উপন্যাস লেখাই বড় কথা নয়। এর প্রকাশনাও আরেকটি দিক। তিনি এর জন্য কোনো প্রকাশক জোগাড় করতে পারেননি। তার নিজের কথায়: ‘ঢাকা ও কলকাতার অনেক প্রকাশকের দ্বারে ধরনা দিয়েও উপন্যাসটি প্রকাশের ব্যবস্থা করতে পারিনি।’ একদিন ঘটনাচক্রে কবি জসীম উদ্দীনের সঙ্গে সাক্ষাৎ। তখনকার সময়ে তেজগাঁও থানার দাঙ্গা পরিস্থিতি সম্পর্কিত ও কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্নের উত্তর দেয়ার এক ফাঁকে লেখক সঙ্কোচের সঙ্গে কবিকে বললেন, ‘আমার কিছু গল্প সওগাত, আজান ইত্যাদি পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে।’
জসীম উদ্দীন বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তাই! তাই তো আপনার বক্তৃতার ভাষা এতো সুন্দর। পুলিশের লোক সাহিত্য সাধনা করে, এ তো ভাবাই যায় না’।…
‘আমি একটা উপন্যাস লিখছি। কিন্তু প্রকাশক পাচ্ছি না।’ কুণ্ঠার সঙ্গে বললাম আমি।
আমার কথা শুনে তিনি কিছুটা অবাক হলেন। তবে তেমন গুরুত্ব দিলেন বলে মনে হলো না। বললেন, ‘লিখতে থাকুন, লিখতে লিখতে হাত পাকা হবে। লেখা ভালো হলে অবশ্যই প্রকাশক পাবেন।’
‘আমি কি একদিন পা-ুলিপি নিয়ে আপনার বাসায় যাবো? আপনি একটু দেখবেন?’
‘তা আসুন একদিন। যখন আসবেন রবিবার ছুটির দিন নয়টা-দশটার দিকে আসবেন।’
নানা কাজের ঝামেলায় কবি সাহেবের বাসায় আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এর মধ্যে তিন মাস পেরিয়ে গেছে। অবশেষে এক রবিবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে তখনকার ফুলবাড়িয়া স্টেশনের কাছে কবির বাসা ‘ফুলবাড়ি’ গিয়ে হাজির হলাম ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’র পা-ুলিপি নিয়ে। পা-ুলিপি হাতে দিতেই তিনি বললেন, আমি তো খুব ব্যস্ত মানুষ, তুমি পা-ুলিপি থেকে কিছু পড়ে শোনাও’।
‘পড়তে শুরু করলাম।… উপন্যাসের একটি চরিত্র হাসু। পড়ার সময় ‘হাসু’ নামটি উচ্চারিত হতেই খিলখিল হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। সেদিকে তাকাতেই একজনকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দুজন হাসছে আর বলছে ‘এই যে হাসু, এই যে হাসু।’ যাকে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছিল সে কবির জ্যেষ্ঠপুত্র হাসু’।
সেদিন উপন্যাসের দুটো অধ্যায় কবি শুনেছিলেন। তিনি বললেন, ‘ তোমার লেখার হাত তো খুব ভালো।’
উপন্যাসটি প্রকাশের কোনো ব্যবস্থা না হওয়ায় লেখক ভীষণ মনোকষ্টে ভোগেন। এর মধ্যে গোলাম মোস্তফা সম্পাদিত ‘নওবাহার’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ১৯৫১-৫২ সালে এটি প্রকাশিত হয়। তখনো উপন্যাসটি কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়। অবশেষে এটি ১৯৫৫ সালে কলকাতা থেকে পুস্তকাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় এবং ঢাকা ও কলকাতার বিভিন্ন পত্রিকায় এর আলোচনা বের হয়। ফলে এটি সহজেই সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং নানা মহলে এটি আলোড়ন সৃষ্টি করে।
লেখকের নিজের কথায়: ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ প্রকাশিত হওয়ার কিছুদিন পরই আমি করাচি বদলি হয়ে যাই। এর মধ্যে আর কবি জসীম উদ্দীনের সঙ্গে আমার দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি। তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয় ১৯৬১ সালে। তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের অনেক কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে তিনি রাইটারস গিল্ড-এর সম্মেলনে যোগ দিতে করাচি গিয়েছিলেন। তিনি আমাকে একান্তে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘ভাই ইসহাক আমি তোমার ওপর সুবিচার করিনি। তোমার উপন্যাসের কিছুটা তুমি পড়ে শুনিয়েছিলে। অতোটুকু শুনে তখন উপন্যাসটি মূল্যায়ন করতে পারিনি। এজন্য আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইবো কি, আমি নিজেই নিজকে ক্ষমা করতে পারছি না।’
আবু ইসহাক আরো লিখেছেন: ১৯৬২ সালে তিনি একবার আমার বাসায় গিয়েছিলেন। তিনি বললেন, ‘তোমার সূর্যদীঘল বাড়ী’ চেক ভাষায় অনুবাদ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ডক্টর দুসন একদিন এসে আমাকে বললেন, ‘উপন্যাসে যেসব জায়গার উল্লেখ আছে সেসব জায়গায় তাকে নিয়ে যেতে হবে। তাকে নিয়ে দুদিনে নারায়ণগঞ্জ স্টিমার স্টেশন, রেলস্টেশন, রেলওয়ে ওভারব্রিজ, নম্বরী কুলি, খুদে কুলি, ফতুল্লা স্টেশন ইত্যাদি সব ঘুরে ঘুরে দেখিয়েছি। লোকটার নিষ্ঠা দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি’ (অম্লান স্মৃতি/স্মৃতি-বিচিত্রা-পৃ-১১১-১১৬)।
‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ উপন্যাসের কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র ১৯৭৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর মুক্তিলাভ করে। দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকার ‘স্মরণীয় দিন’ কলামে ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’ চলচ্চিত্রের মুক্তিলাভের দিনটিকে ‘স্মরণীয় দিন’ বলে উল্লেখ করেছেন। চলচ্চিত্রটি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়েছে এবং ছয়টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছে। বিদেশের কয়েকটি পত্রপত্রিকা চলচ্চিত্রটির রিভিউতে বলেছে: ঞযব সড়ারব রং নধংবফ ড়হ ধ ঢ়ড়বিৎভঁষ ংঃড়ৎু. বস্তুত তেতাল্লিশের মন্বন্তরকে কেন্দ্র করেই এর কাহিনী আবর্তিত হয়েছে। বাস্তব জীবন ও সমাজের ছবি আবু ইসহাক তার কলমের তুলির টানে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করেছেনÑ যেমন জয়নুল আবেদিন তার তুলির আঁচড়ে মন্বন্তরের বাস্তব জীবনের জীবন্ত ছবি এঁকেছিলেন এবং সার্থকতা অর্জন করেছিলেন। দুটোই শিল্পকর্ম। একজন কলম ব্যবহার করেছেন, অন্যজন তুলি।
‘সূর্যদীঘল বাড়ী’র সাফল্যের পর আবু ইসহাক আরো একটি বড় উপন্যাস লিখেছিলেন ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ নামে। এটিও পাঠক সমাজে বিপুলভাবে সমাদৃত হয়েছে। এর সম্পর্কে প্রফেসর কবীর চৌধুরী লিখেছেন: “তাঁর প্রথম উপন্যাসের মতো এটিও পল্লীজীবন ভিত্তিক, এখানেও জীবনবোধ তীক্ষè, বাস্তব জীবনের পরিবেশ অকৃত্রিম ও সত্যনিষ্ঠ। তবে ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’র চেয়ে বর্তমান উপন্যাসের পরিম-ল বৃহত্তর, জীবন সংগ্রামের চিত্র এখানে আরো দ্বন্দ্বমুখর ও তীব্র নাটকীয়তায় তা অধিকতর উজ্জ্বল এবং পটভূমি পরিবেশেও ভিন্নতর।… উপন্যাসটিতে লেখক একই সঙ্গে গভীরতা ও বিস্তার এনে একে এপিকধর্মী করার প্রয়াস পেয়েছেন। উপন্যাসের পটভূমি, ঘটনাবলীর বর্ণনা, চরিত্রচিত্রণ, সংলাপ সবই জীবনঘনিষ্ঠ বাস্তবতার স্পর্শম-িত। লেখক যে জীবনের ছবি এখানে এঁকেছেন তা তিনি ভালো করে মেনে নিয়েছেন, যেসব আঞ্চলিক শব্দ তিনি ব্যবহার করেছেন তা সুপ্রযুক্ত, রচনাটিকে তা এক ঋজু বলিষ্ঠতা দান করেছে।… দীর্ঘদিন পর (১৯৮৬) তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস প্রকাশিত হলেও আবু ইসহাক ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ উপহার দিয়ে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাসাহিত্যিক হিসেবে তার পূর্ব খ্যাতি শুধু অমলিনই রাখেননি, আমার বিবেচনায় তাকে সম্প্রসারিত করেছেন।” অন্যপক্ষে যাদবপুর বিশ্ববদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান ডক্টর সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’ সম্পর্কে লিখেছেন: এই উপন্যাসের বর্ণনা প্রত্যক্ষ, পুঙ্খানুপুঙ্খ অথচ সংযত, অশ্লীল কাহিনীতে কোথাও শ্লীলতার অভাব দেখা যায় না।… ব্যভিচারের এমন পুঙ্খানুপুঙ্খ অথচ সংযত বর্ণনা আর কোথাও পড়িয়াছি বলিয়া মনে হয় না।… তিনি আরো লিখেছেন: এই উপন্যাসে জরিনার মতো চরিত্র এক শরৎচন্দ্রই আঁকিতে পারিতেন। একাধিকবার পড়ার পরও আমি এই চরিত্রটির রহস্য অনুধাবন করিতে চেষ্টা করি। বারংবার প্রশ্ন জাগেÑ যদি হেকমত জীবিতাবস্থায় ফিরিয়া আসিত তাহা হইলে এই ধীরস্থির অবিচল নারী কি উত্তর দিত ইত্যাদি।
চতুরঙ্গ লিখেছেন: ‘আবু ইসহাকের এই উপন্যাসটি সাহিত্য রসাস্বাদক। টানাপোড়েন সমাজজীবনের জলজ্যান্ত নিখুঁত উপন্যাসটিকে ভরিয়ে তোলায় লেখক আর একবার প্রমাণ করলেন, নিছক কাহিনী নয়, আমাদের দৈনন্দিন জীবনের পারিপার্শ্বিক অবস্থা জীবন সংগ্রাম, প্রেম যা আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপকে ভাবায়, প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়, কাঁদায় সেগুলোই সাহিত্যের আসল মূলধন। এই মূলধনকে সাহিত্য করে তোলায় আবু ইসহাকের ক্ষমতা অপরিসীম। তাই তার রচনা সমাজের রসকষহীন প্রিনটেড ডকুমেন্ট হয়ে ওঠেনি। আবু ইসহাক পাঠককে টেনে রাখার জাদু জানে না গ্রাম্য সেন্টিমেন্টের সঙ্গে ত্রিকোণ প্রেম, ত্রিকোণ প্রেমের সঙ্গে বাস্তববোধ, বাস্তববোধের সঙ্গে রাজনীতি সব মিলিয়ে একটি আদর্শ উপন্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে’ (এপ্রিল ’৮৭)।
এরপর লেখেন জাল (১৯৮৮)। এটি একটি নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাস। হারেম (১৯৬২) এবং মহাপতঙ্গ (১৯৬৩) নামে তার দুটো গল্পগ্রন্থও রয়েছে। তার সবচেয়ে বড় কাজ সমকালীন বাংলা ভাষার অভিধান (১৯৯৩) রচনা। এটি তাকে কীর্তিমান ও উজ্জ্বল করেছে।
এই আবু ইসহাকের সঙ্গেই আমার পরিচয় ঘটেছিল ১৯৯৮ সালের কোনো এক সময় অলক্ত সাহিত্য পুরস্কারকে কেন্দ্র করে। এর আগে তার সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় ছিল না। শুধু কিছু লেখার সঙ্গে পরিচয় ছিল। তিনি যে অমায়িক, বন্ধুবৎসল, বিনয়ী, ভদ্র, সংবেদনশীল, মার্জিত ও সজ্জন ব্যক্তিÑ তা পরিচয়ের পরই জানা গেল।
আবু ইসহাক খুব উচ্চৈঃস্বরে কথা বলতেন না। তিনি হই চইপ্রবণও ছিলেন না। তিনি ধীরস্থির আস্তে আস্তে কথা বলতেন। হেমন্তের নমিত শব্দের মতো। তার হাঁটাচলার মধ্যেও একটি সারল্য আমরা লক্ষ্য করি। তিনি সহজ, সরল। তিনি কথাবার্তায়/পোশাকে-আশাকেও ছিলেন আদর্শের প্রতীক। জাঁকজমক কিংবা চাকচিক্য তার পছন্দ ছিল না। তিনি সাদাসিধে জীবনই বেছে নিয়েছিলেন এবং সে জীবনকেই তিনি গভীর ভালোবেসেছিলেন। তার উপন্যাসের অনেক চরিত্রের মতোই ছিল তার দিনযাপন পদ্ধতি।
তিনি বাস্তব সত্য থেকে কখনো বিচ্যুত হননি। তিনি জীবনে যা ভালো, যা শুভ এবং কল্যাণকর মনে করতেনÑ তা করতে তিনি কখনো দ্বিধাবোধ করতেন না। নিজের মানসিক দৃঢ়তার মতো করেই তিনি তার উপন্যাসের চরিত্রগুলো সাজিয়েছেন। চরিত্রচিত্রণে কোথাও তিনি গোঁজামিলের আশ্রয় নেননি। না জয়গুন না ঝরিনাÑ উভয় চরিত্রই একটা বাস্তব আদর্শের ওপর উপস্থাপন করেছিলেন। ফলে দুই উপন্যাসে দুটো চরিত্রই সবার আকর্ষণের কারণ ঘটিয়েছে। তিনি চরিত্র নির্মাণেও প্রযতœশীলতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
আবু ইসহাকের অহংবোধ ছিল, কিন্তু অহঙ্কার বোধ ছিল না। আবার জীবনে সবকিছু তিনি সহজে মেনেও নেননি। তার খুঁতখুঁতে একটি স্বভাব ছিলÑ রবীন্দ্রনাথের মতো। তিনি যখন মঞ্চে বক্তৃতা দিতেন সেখানে তার গলার স্বর চড়া ছিল না। তিনি বক্তৃতায় কথামালা সৃষ্টি করতেন। তা দিয়েই তিনি শ্রোতা-দর্শকদের মুগ্ধ করতেন। তার প্রত্যুপন্নমতিত্ব, বিচারবুদ্ধি, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তাকে এক অন্য মানুষে রূপান্তর করতো তখন। তিনি তখন সবার প্রিয় ভাষকে পরিণত হতেন।
৫ মে, ২০০১ সালে অলক্ত পুরস্কার অনুষ্ঠানে আবু ইসহাক একটি সংক্ষিপ্ত অথচ চিন্তাকর্ষক ভাষণ দিয়েছিলেন। সেখানে প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, “পুরস্কার পেলে সবাই খুশি হয়। ব্যতিক্রম তেমন হয় না। বার্নাড শ ব্যতিক্রম ছিলেন। সবাই যেমন খুশি হয় আমিও তেমন খুশি হয়েছি। আমি যা লিখেছি তা খুবই সামান্য। তা যে আপনাদের ভালো লেগেছে তাই আমার সাহিত্যপ্রীতি। আপনারা যে আমাকে পুরস্কৃত করলেন সেজন্য আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমাদের দেশে সাহিত্যিকরা অবহেলিত। বাংলাদেশের কিছু সাহিত্য সংস্থা আছে যারা সাহিত্যিকদের সাহিত্যের স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন। এসব প্রতিষ্ঠান লেখকদের জন্য কল্যাণকর। আসলে আমি আমার ‘সূর্যদীঘল বাড়ী’র নিচে চাপা পড়ে গেছি। এরপরও আমার উপন্যাস বেরিয়েছে ‘পদ্মার পলিদ্বীপ’। এ উপন্যাস সম্পর্কে অনেকে জানে না। আপনারা পড়েছেন কি না জানি না। আজকের দিনটি আমার জন্য স্মরণীয়। অলক্ত সংগঠনের সঙ্গে জড়িত সবাইকে আমার ধন্যবাদ জানাই।”
আবু ইসহাক পুলিশ অফিসার ছিলেন। চাকরিকালে পুলিশকর্মেও তিনি দক্ষতা প্রদর্শন করেছিলেন। ন্যায়পরায়ণতা, নীতিবোধ, দৃঢ়চেতা মনোভাব, সাধুতা ও কল্যাণকামী পদক্ষেপÑ তার চরিত্রকে ঐশ্বর্য দান করেছে। তিনি পুলিশ অফিসার হিসেবে সৎ ছিলেন, সদগুণের অধিকারী ছিলেন। সর্বোপরি মানুষ ছিলেন। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য/তাহার উপরে নাই’Ñ এই বিবেচনাও তার ছিল। সে কারণে তার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে। যাকে আমরা রাতদিন খুঁজে বেড়াই তিনিই সে মানুষ যাঁর অবস্থান ছিল আমাদের মধ্যেই। আজ তিনি নেই। অকস্মাৎ উটের গ্রীবার মতো মৃত্যু এসে তাকে ওপারে নিয়ে যায়।