Thursday, December 21, 2017

বিলিওন এবং বিলিওন


আমি এই কথা কখনো বলিনি। সত্যি বলছি। ও আচ্ছা, আমি বলেছিলাম সেখানে হয়তো ১০০ বিলিওন গ্যালাক্সী এবং ১০ বিলিওন ট্রিলিওন নক্ষত্র আছে। আসলে কোনো বড় সংখ্যা ব্যবহার ব্যতীত মহাশূন্য নিয়ে কথা বলা খুবই কঠিন। আমি ‘কসমস’ টিভি সিরিজে “বিলিওন” কথাটা বহুবার বলেছি, যেটা বহু মানুষ দেখেছিলো। কিন্তু আমি কখনোই বলিনি “বিলিওন এবং বিলিওন”। এর একটা কারণ হচ্ছে, এটা খুবই অস্পষ্ট। কত বিলিওনে আসলে “বিলিওন এবং বিলিওন” হয়? অল্প কিছু বিলিওনে? বিশ বিলিওনে? একশ বিলিওনে? “বিলিওন এবং বিলিওন” আসলে খুবই ভাসাভাসা। যখন আমরা সিরিজটাকে পুনর্বিন্যস্ত এবং আরো উন্নত করে সাজিয়েছিলাম, আমি তখনো যাচাই করে দেখেছি- এবং আমি নিশ্চিত, আমি এটা কখনো বলিনি।

কিন্তু জনি কারসন- যার ‘টুনাইট শো’ তে আমাকে এতগুলো বছরে প্রায় ত্রিশবারের মত উপস্থাপন করা হয়েছে – সে বলেছে। সে একটা মোটা কাপড়ের জ্যাকেট, একটা গলাবদ্ধ সোয়েটার এবং ঘর মোছার ন্যাকড়ার মত কিছু একটা মাথায় পরচুলা হিসেবে পরে উপস্থিত হতো। সে প্রায় আমার কাছাকাছি ছদ্মবেশ ধারণ করেছিলো, অনেকটা প্রতিমূর্তির মত! সে মধ্যরাতের টিভি অনুষ্ঠানে অনবরত বলে বেড়াতো “বিলিওন এবং বিলিওন”। আমি একটু বিরক্তই হচ্ছিলাম যে আমার ব্যক্তিছবির একটা প্রতিমূর্তি নিজে নিজে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর এমন সব কথা বলছে যেগুলো পরদিন সকালে আমার বন্ধু এবং সহকর্মীরা আমার কাছে এসে রিপোর্ট করছে। (ছদ্মবেশ ধারণ সত্ত্বেও, কারসন- একজন একনিষ্ঠ শিক্ষানবীশ জ্যোতির্বিদ- প্রায়ই আমার অনুকরণে বলা কথাগুলোকে সত্যিকারের বিজ্ঞান বানিয়ে ছাড়তো।) বিস্ময়করভাবে, “বিলিওন এবং বিলিওন” প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেলো। মানুষেরা কথাটাকে পছন্দ করে ফেললো। এমনকি আজও আমাকে রাস্তায় কিংবা বিমানে কিংবা পার্টিতে দাঁড় করানো হয় আর জিজ্ঞেস করা হয়, একটু বিনয়ের সাথেই, যে আমি কি- শুধু তাদের জন্যেই- একবার শুধু “বিলিওন এবং বিলিওন” শব্দটা বলতে পারবো কিনা।
“আসলে, আমি এই কথাটা কখনো বলিনি”, আমি জবাবে তাদের বলি।
“আরে ব্যাপার না”, তারা প্রত্যুত্তরে বলেন। “তবুও বলুন একবার শুনি”।

আমাকে বলা হয়েছিলো শার্লক হোমস নাকি কখনোই বলেনি, “এতো অতি সাধারণ ব্যাপার, প্রিয় ওয়াটসন” (অন্তত আর্থার কোনান ডয়েলের বইগুলোতে); জিমি ক্যাগনে কখনো বলেনি, “হতচ্ছাড়া ধাড়ি ইঁদুর কোথাকার”; এবং হামফ্রে বোগার্ট কখনো বলেনি, “আরেকবার বাজাও, স্যাম”। কিন্তু তারা হয়তো এগুলো বলেছেও, কারণ এই প্রশ্নসাপেক্ষ বস্তুগুলোই তাদেরকে জনপ্রিয় শিল্পগুলোতে সুকৌশলে প্রতিষ্ঠা পাইয়ে দিয়েছে।

কম্পিউটার ম্যাগাজিন (“যেমনটা কার্ল সেগান বলে থাকেন, এর জন্যে প্রয়োজন বিলিওন বিলিওন বাইট”), অর্থনীতি বিষয়ক পত্রিকা, খেলোয়াড়দের বেতনবিষয়ক আলোচনা অনুষ্ঠানগুলোতে এখনো আমার নাম উল্লেখ করে বলা হয় আমি নাকি এই সহজ-সরল কথাটা উচ্চারণ করেছি। একটা সময়, ছেলেমানুষি করে জিজ্ঞেস করা হলেও, আমি এই কথাটা উচ্চারণ করতাম না। কিন্তু আমি এখন সেই জড়তাটা কাটিয়ে উঠেছি। তাই, সেটার প্রমাণ হিসেবেই, এখানে একবার বলা হয়ে যাকঃ

“বিলিওন এবং বিলিওন”

কোন ব্যাপারটা আসলে “বিলিওন এবং বিলিওন” কথাটাকে জনপ্রিয় করে তুলেছে? এক কালে তো অগণিত সংখ্যক কিছু বুঝাতে বিকল্প হিসেবে “মিলিওন” শব্দটা ব্যবহৃত হতো। ফাটাফাটি ধনীরা ছিলো মিলিওনেয়ার। যীশুর সময়ে পৃথিবীর জনসংখ্যা ছিলো ২৫০ মিলিওন। ১৭৮৭ সালে সংবিধান প্রণয়নের সময় আমেরিকানদের সংখ্যা ছিলো ৪ মিলিওন; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে জনসংখ্যা ছিলো ১৩২ মিলিওন। পৃথিবী হতে সূর্যের দূরত্ব ৯৩ মিলিওন মাইল (১৫০ মিলিওন কিলোমিটার)। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ৪০ মিলিওন মানুষকে হত্যা করা হয়েছিলো; যেটা ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৬০ মিলিওন। ৩১.৭ মিলিওন সেকেন্ডে এক বছর (খুব সহজেই যাচাই করে নেয়া যায়)। ১৯৮০’র শেষে সারাবিশ্বে মজুদকৃত পারমাণবিক অস্ত্রসমূহের সম্মিলিত বিস্ফোরণ ক্ষমতা ১ মিলিওন হিরোশিমাকে ধ্বংসের জন্যে যথেষ্ট। বহু উদ্দেশ্য সাধনে এবং বহুসময় ধরে “মিলিওন” ছিলো বিশাল বড় সংখ্যার সার্থক উদাহরণ।

কিন্তু সময় বদলে গেছে। এখন পৃথিবীতে মিলিওনেয়ারদের সংখ্যাও আর বেঁধে রাখা যাচ্ছে না- এবং এর কারণ শুধু মুদ্রাস্ফীতি নয়। পৃথিবীর বয়স মোটামুটি ৪.৬ বিলিওন বছর হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত। এর জনসংখ্যা এখন ৬ বিলিওন ছাড়িয়ে যাচ্ছে। প্রতিটা জন্মদিন নির্দেশ করে সূর্যের চারপাশে বিলিওন কিলোমিটার পথ আবর্তনের (ভয়েজার মহাশূন্যযান যত দ্রুত পৃথিবী হতে দূরে সরে যাচ্ছে, পৃথিবী তার চেয়েও দ্রুতগতিতে সূর্যকে পরিক্রমণ করে চলছে)। চারটা বি-২ বোমারু বিমানের মূল্য হচ্ছে বহু বিলিওন ডলার (কেউ কেউ বলেন ২ এমনকি ৪ বিলিওন পর্যন্ত)। আমেরিকার প্রতিরক্ষা বাজেট হচ্ছে, যখন গোপন ব্যয়গুলোও হিসেবে ধরা হয়, বছরে ৩০০ বিলিওন ডলারেরও বেশি। আমেরিকা এবং রাশিয়ায় কোনক্রমে যুদ্ধ বেঁধে গেলে প্রাণহানি ঘটবে প্রায় এক বিলিওন মানুষের। সামান্য ইঞ্চি পরিমাণ দূরত্বে প্রায় এক বিলিওন অণু অবস্থান করে। আর এর বাইরে বিলিওন সংখ্যক সেই নীহারিকা এবং নক্ষত্রগুলোতো আছেই।

১৯৮০ সালে, যখন কসমস টিভি সিরিজ প্রথম প্রদর্শিত হয়েছিলো, মানুষ বিলিওন এর জন্যে প্রস্তুত ছিলো। গুটিকয় মিলিওন হয়ে পড়েছিলো নগণ্য, কেতাদুরস্তহীন, তুচ্ছ। প্রকৃতপক্ষে, এই দুটো শব্দই উচ্চারণে এমন কাছাকাছি যে তাদের আলাদা করে বোঝাতে আপনাকে খুব সতর্ক হতে হয়। এই কারণেই, কসমসে, আমি “বিলিওন” কথাটা বলেছিলাম “বি” এর স্পৃষ্ট উচ্চারণের মাধ্যমে, যেটাকে অনেক মানুষই ব্যক্তিভেদে আলাদা আলাদা উচ্চারণরীতি হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। এর বিকল্প হিসেবে, যেমনটা টিভি বক্তাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বলা হয়, “এটা হচ্ছে বিলিওন যার শুরুর অক্ষর হচ্ছে বি”- তুলনামূলকভাবে অধিক ঝামেলাপূর্ণ।

একটা কৌতুক প্রচলিত আছে যেখানে এক প্লানেটারিয়াম বক্তা তার শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে বলছিলেন যে ৫ বিলিওন বছরের মধ্যে সূর্য ফুলে-ফেঁপে উঠে রেড জায়ান্ট হয়ে উঠবে, বুধ এবং শুক্রকে গিলে খাবে আর সেইসাথে সম্ভবত পৃথিবীটাকেও। এরপরেই এক উদ্বিগ্ন শ্রোতা তাকে থামিয়ে প্রশ্ন করলেনঃ
“দুঃখিত ডক্টর, কিন্তু আপনি কি বলেছেন যে সূর্য ৫ বিলিওন বছরের মধ্যে পৃথিবীকে পুড়িয়ে ছাই করে দিবে?”
“হ্যাঁ, এর বেশি বা কমও হতে পারে”।
“সব ঈশ্বরের দয়া! এক মূহুর্তের জন্যে আমি ভেবেছিলাম আপনি বলেছেন ৫ মিলিওন”।

এটা ৫ মিলিওন কিংবা ৫ বিলিওন যাই হোক না কেন, আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে এর খুব সামান্য প্রভাবই আছে, তা পৃথিবীর পরিণতি যতই চমকপ্রদ হোক না কেন। কিন্তু মিলিওন এবং বিলিওনের পার্থক্য নিরুপণ জাতীয় বাজেট, বৈশ্বিক জনসংখ্যা এবং পারমাণবিক যুদ্ধের সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি হিসাব করার জন্যে অতীব বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

যদিও “বিলিওন এবং বিলিওন” এর জনপ্রিয়তা এখনো পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি, কিন্তু এই সংখ্যাটাও ধীরে ধীরে নগণ্য, সংকীর্ণ দৃষ্টির এবং উহ্য হয়ে পড়ছে। এর থেকেও কেতাদুরস্ত সংখ্যাটাকে এখন দিগন্তে কিংবা আরও কাছাকাছি দেখা যাচ্ছে। ট্রিলিওন এখন আমাদের উপর প্রায় উপনীত।

উৎস ঃ http://onubadokderadda.com/billions_and_billions_01/

Sunday, December 10, 2017

যোগ ও মনোবিজ্ঞান - স্বামী বিবেকানন্দ



পাশ্চাত্যে মনোবিজ্ঞানের ধারণা অতি নিম্নস্তরের। ইহা একটি শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান; কিন্তু পাশ্চাত্যে ইহাকে অন্যান্য বিজ্ঞানের সমপর্যায়ভুক্ত করা হইয়াছে—অর্থাৎ অন্যান্য বিজ্ঞানের মত ইহাকেও উপযোগিতার মাপকাঠিতে বিচার করা হয়। কার্যতঃ মানবসমাজের উপকার ইহার সাহায্যে কতটা সাধিত হইবে? আমাদের ক্রমবর্ধমান সুখ ইহার মাধ্যমে কতদূর বর্ধিত হইবে? যে-সকল দুঃখ-বেদনায় আমরা নিয়ত পীড়িত হইতেছি, সেগুলি ইহা দ্বারা কতদূর প্রশমিত হইবে? পাশ্চাত্যে সব-কিছুই এই মাপকাঠিতে বিচার করা হয়।

প্রাণের আধ্যাত্মিক রূপ



যোগিগণের মতে মেরুদন্ডের মধ্যে ইড়া ও পিঙ্গলা নামক দুইটি স্নয়বীর শক্তিপ্রবাহ ও ‘সুষুম্না’ নামে একটি শূন্য নালী আছে। এই শূন্য নালীর নিম্নপ্রান্তে ‘কুন্ডলিনী পদ্ম’ অবস্থিত, যোগীরা বলেন, উহা ত্রিকোণাকার। যোগীদের রূপক ভাষায় ঐ স্থানে কুন্ডলিনী শক্তি কুন্ডলাকৃতি হইয়া বিরাজমানা। যখন এই কুন্ডলিনী জাগরিতা হন, তখন তিনি এই শূন্য নালীর মধ্য দিয়া পথ করিয়া উঠিবার চেষ্টা করেন, এবং যতই তিনি এক-এক সোপান উপরে উঠিতে থাকেন, ততই মনের যেন স্তরের পর স্তর খুলিয়া যাইতে থাকে; আর সেই যোগীর নানারূপ অলৌকিক দৃশ্য দর্শন ও অদ্ভুত শক্তি লাভ হইতে থাকে। যখন সেই কুন্ডলিনী মস্তিষ্কে উপনীত হন, তখন যোগী সম্পূর্ণরূপে শরীর ও মন হইতে পৃথক্ হইয়া যান এবং তাঁহার আত্মা স্বীয় মুক্তভাব উপলদ্ধি করে

প্রাণায়াম - স্বামী বিবেকানন্দ



প্রাণায়াম বলিতে কি বোঝায়, প্রথমে আমরা তাহা একটু বুঝিতে চেষ্টা করিব। বিশ্বের যত শক্তি আছে, অধ্যাত্মবিজ্ঞানে তাহার সমষ্টিকে ‘প্রাণ’ বলে। দার্শনিকদের মতে এই সৃষ্টি তরঙ্গাকারে চলে; তরঙ্গ উঠিল, আবার পড়িয়া মিলাইয়া গেল, যেন গলিয়া বিলীন হইল। আবার এই-সব বৈচিত্র্য লইয়া উঠিয়া আসিল, এবং ধীরে ধীরে আবার চলিয়া গেল। এইভাবে পর পর ওঠা-নামা চলিতে থাকে। জড়পদার্থ ও শক্তির মিলনে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডও রচিত হইয়াছে; সংস্কৃতশাস্ত্রাভিজ্ঞ দার্শনিকেরা বলেনঃ কঠিন, তরল প্রভৃতি যে-সব বস্তুকে আমরা জড়পদার্থ বলিয়া থাকি, সে-সবই একটি মূল জড়পদার্থ হইতে উৎপন্ন হইয়াছে; তাঁহারা এই মূল পদার্থের নাম দিয়াছেন ‘আকাশ’ (ইথার); আর প্রকৃতির যে-সব শক্তি আমরা দেখিতে পাই, সেগুলিও যে মূল শক্তির অভিব্যক্তি, তাহার নাম দিয়াছেন ‘প্রাণ’। আকাশের উপর এই প্রাণের কার্যের ফলেই বিশ্বসৃষ্টি হয়, এবং একটি সুনির্দিষ্ট কালের অন্তে—অর্থাৎ কল্পান্তে—একটি সৃষ্টির বিরতি-সময় আসে।

ধ্যান - স্বামী বিবেকানন্দ



[স্বামীজীর এই বক্তৃতাটি ১৯০০ খ্রীঃ ৩ এপ্রিল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিস্কো শহরে ওয়াশিংটন হলে প্রদত্ত। সাঙ্কেতিক লিপিকার ও অনুলেখিকা—আইডা আনসেল। যেখানে লিপিকার স্বামীজীর কিছু কিছু কথা ধরিতে পারেন নাই, সে-সব স্থলে কয়েকটি বিন্দুচিহ্ন … দেওয়া হইয়াছে। প্রথম বন্ধনীর () মধ্যেকার শব্দ বা বাক্য স্বামীজীর নিজের নয়, ভাব-পরিস্ফুটনের জন্য নিবদ্ধ হইয়াছে। মূল ইংরেজী বক্তৃতাটি হলিউড বেদান্তকেন্দ্রের মুখপত্র Vedanta and the West পত্রিকায় ১১২তম সংখ্যায় (মার্চ-এপ্রিল, ১৯৫৫) মুদ্রিত হইয়াছে।]

Thursday, December 7, 2017

কিউবা ভ্রমণ -রোজানা নাসরীন





মেঘের উপরে সোনার বিকেল। উড়ে যাচ্ছি। অনুভবের গভীরে এক ধরনের ভাল লাগার চমক কিংকিণী বাজিয়ে চলেছে। একদিন মুক্ত মনে পাখিদের আকাশে ওড়ার আনন্দ দেখে মানুষের মনে সাধ জেগেছিল আকাশে ওড়ার। তারপর থেকে মানুষ গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছে নিশিদিন। মনে মনে রাইট   ব্রাদার্সকে স্যালুট জানাচ্ছি। শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তার প্রশংসা ধারণ করেই যারা চোখ মুদে থাকেননি তারাই আকাশে ওড়ার গূঢ় রহস্যকে আবিষ্কার করেছেন। মানুষের সামনে নিয়ে এসেছেন আনন্দের ঝর্ণা ধারা। আকাশে মেঘের উপরে স্বর্ণালী সন্ধ্যা দেখতে দেখতে আনন্দে আত্মহারা হয়ে মনে হচ্ছিল এই যে যন্ত্রের উড়োজাহাজে চড়ে আমরা গন্তব্যে যাচ্ছি তার চেয়ে প্রকৃতির অংশ হয়ে মেঘে ভিজে ভিজে, গায়ে সোনালী আলো মেখে মেখে যদি উড়ে যেতে পারতাম, যদি হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করতে পারতাম সোনার আলোকে তাহলে কতইনা ভাল লাগত। এভাবে একসময় পথ শেষ হয়ে গেল, পৌঁছে গেলাম কিউবার ভারাডেরো বিমান বন্দরে।
আমরা ‘ সান উইং’ কম্পানির একটা বাসে উঠে পড়লাম যেটা আমাদের জন্য নির্ধারিত ছিল। কারণ ‘ সান উইং’ কম্পানির সাথেই আমাদের ভ্রমণ প্যাকেজের চুক্তি করা ছিল তাই এয়ার বাসটিও ছিল ‘ সান উইং’  কম্পানির। ছোট্ট শহর। নতুন দেখা বাতাবরণ আর পুরানো অভিজ্ঞতার সাথে নতুন সব অনুভবের অংশবিশেষ এবং অভিজ্ঞতা যুক্ত হচ্ছে। কিউবা রাষ্ট্রটি একটি  লম্বা দ্বীপ। চারিদিকে আটলান্টিক মহাসাগর।  কোন কোন রাস্তার পাশেই আছড়ে পড়ছে সাগরের ঢেউ। মন চঞ্চল হয়ে উঠছে , অনেকটা রোমাঞ্চকর লাগছে। সবুজ প্রকৃতিতে আছে অনেক অনেক নারিকেল গাছ, মাঝে মাঝে জায়ান্ট ক্যাকটাস আরও অনেক ধরনের গাছের পাতারা হাত নেড়ে নেড়ে যেন আমদেরকে স্বাগত জানাচ্ছে। তখন রাতের আলো আঁধারের খেলার  সাথে নতুন দেশকে যেন একসাথে জেনে নেওয়ার চঞ্চলতা একটি  কথাই কানে কানে বলে যায় সে হল, ‘ভাল লাগছে।‘  মোটামুটি পরিচ্ছন্ন রাস্তা-ঘাট, বাড়িঘর  অবলোকন করে চোখের স্বস্তি আর মনের আনন্দ মিলে  মিশে বিচিত্র এক সুখানুভুতির সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমে একদল  লোককে  নামানো হল ‘টুক্সপান’ নামক একটি রিসোর্ট অ্যান্ড হোটেলে। সুন্দর রিসোর্ট, নয়ন অভিরাম করে  সাজানো, চারিদিকে ফুলের বাগান, চমৎকার ভাবে গুছানো। নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার দেশ তাই সেখানে দেখতে পেলাম বাংলাদেশে ফেলে আশা তারা ফুল, রঙ্গন ফুল, যাদেরকে কতদিন দেখিনা। তখন মনে হল আমার দেশের সাথে যতটুকু মিল পেয়েছি তার মূল্য আমার কাছে অনেক। তারপর পৌঁছাল আর একটি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টে যার নাম ‘ব্লাও ভারাডেরো’ মনে  হল এখানে আর্কিটেক্ট আর একটু বেশী  মনোযোগ দিয়েছিল। এভাবে একটার পর একটা রিসোর্টে বেড়াতে আশা লোকদেরকে ছুটির আনন্দিত সময় কাটানোর জন্য রেখে যাচ্ছে। পথে পথে গাড়ির মধ্যেই আনন্দ প্রকাশ করার জন্য ড্রাইভার সাহেব মজার মজার কথা বলছেন, অনেক তরুণ উৎসাহী তার সাথে গলা মিলাচ্ছে। একেবারে শেষে পৌঁছে গেলাম হোটেল গ্র্যান্ড মেমোরিতে। ড্রাইভার সাহেব চিৎকার করে বললেন, এবার আমরা পৌঁছে গেছি দা লাস্ট অ্যান্ড বেস্ট হোটেলে। যাত্রীরা হাতে তালি দিয়ে, কন্ঠে উল্ল­াস প্রকাশ করে  নামতে শুরু করল হোটেল চত্বরে। তাকিয়ে দেখলাম বড় বড় ইংলিশ অক্ষরে লেখা আছে ‘গ্র্যান্ড মেমরি অ্যান্ড স্পা’ মানে এটাই আমাদের গন্তব্য। হোটেলে চেক ইন করার পর আমাদের একটি জায়গায় অপেক্ষা করতে বলা হল। বেলবয় এসে ইঞ্জিন চালিত ছোট একটি গাড়িতে আমাদের তুলে নিল এবং পৌঁছে দিল আমদের নির্ধারিত বিল্ডিংএ এবং রুমে ঢুকে আমাদেরকে সকল সুযোগ সুবিধার কথা বুঝিয়ে দিল। এখানে আমরা সাত দিন থাকব, এজন্য কি ধরনের আয়োজন আছে সবকিছুই। কিউবার রাষ্ট্র ভাষা স্প্যানিশ। ট্যুরিস্টদের সাথে মানে আমাদের সাথে সবাই ইংলিশে কথা বলছে ঠিকই তবে বেশীরভাগ মানুষ ভেঙ্গে ভেঙ্গে স্প্যানিশ এক্সেন্টে ইংলিশ বলছে। তবে সবকিছুই স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। তখন মনে হল মানুষ যদি মানুষের মনের কাছাকাছি যেতে চায় তাহলে ভাষা কোন প্রতিবন্ধকই নয়। এখানে তিন ধরনের মানুষ দেখা যাচ্ছে, সাদা, কালো, এবং বাদামী গায়ের রঙয়ের মানুষ। সবাই কিউবান। সে রাতটি ছিল গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির রাত। ভিজে ভিজে খাবার সন্ধানে ঘুরছি আমরা তিনটে পরিবার। যাদের সাথে প্লে­নেই আলাপ হয়েছিল। হোটেলের ডাইনিং তখন বন্দ হয়ে গেছে কিন্তু স্নাকবার চব্বিশ ঘণ্টার জন্য খোলা আছে। বৃষ্টির পানিতে গা ভিজিয়ে, পা ভিজিয়ে, পুল ডিঙ্গিয়ে স্নাকবারে পৌঁছলাম। ওখানে কথা বলে জানলাম, ডাইনিং একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খোলা থাকে। কিন্তু সব  বার গুলি (বিচের ধারের বার গুলি ছাড়া) চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে এবং আমরা জানতাম সব রকম খাবারই ইনক্লুসিভ। অনেকটা স্বস্তি অনুভব করলাম। গভীর রাত পর্যন্ত আমদের গল্প হল, তারপর ঘুমের জন্য ফিরে গেলাম যে যার রুমে। সকালে টিপ টিপ বৃষ্টি উপেক্ষা করে  ডাইনিংএ গেলাম, নাস্তা সেরে দিনের আলোতে সবকিছু বুঝে নেওয়ার তাগিদে ঘুরতে বের হলাম। আবহাওয়ার কথা না বললেই নয়।  কানাডায় ফল সিজন চলছে, তাপমাত্রা পনেরো, সতেরো থেকে জিরো ডিগ্রি সেলসিয়াস এ অবস্থান  করছে, ঠিক সেই সময় ভারাডেরো তে তাপমাত্রা ছিল সাতাশ, আটাশ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ভারাডেরোতে তখন একটি ডিপ্রেশন চলছিল যা দুইদিন স্থায়ী হয়েছিল। অনুকুল তাপমাত্রার কারণে ডিপ্রেশনের আবহাওয়া তেমন কোন বিরক্তির কারণ হতে পারেনি। তৃতীয় দিন সকালে আলোর বন্যায় যেন হাসতে লাগল, ভাসতে লাগল সকলই।

কিউবা সমাজতান্ত্রিক দেশ। কিউবার অর্থনীতির একটি বিশাল অংশ জুড়ে আছে ট্যুরিজম। এখনে অনেক দেশ থেকেই ট্যুরিস্ট আসে বিশেষ করে শীতের দেশগুলি থেকে ট্যুরিস্ট এসে বেশি ভিড় করে। অনেকের   সাথে কথা বলে জানলাম  ইউরোপ, কানাডা, বলিভিয়া, ব্রাজিল, এমনি  বিভিন্ন দেশ থেকে ভ্রমণ পাগল লোকেরা এখানে ছুটি কাটাতে এসেছে। কিউবার কারেন্সি স্ট্যান্ডার্ট হিশেবে ইউএস ডলার প্রচলিত। কানাডিয়ান ডলারের প্রচলন আছে তবে ইউএস ডলারই নির্ধারিত মূল্যমান। দেশটির সাথে কানাডার সম্পর্ক বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ তাই কানাডিয়ানদের মনে হয়েছিল একটু বেশী খাতির করে ওদেশের লোকেরা। হয়ত কানাডা বিশ্বের ধনী দেশগুলির একটি এবং সামাজিক নিরাপত্তার দিক থেকে প্রথমে অবস্থান করছে বলেই দেশটিকে গুরত্বের সংগে বিবেচনা করা হচ্ছে। কিউবার কারেন্সিকে বলা হয় ‘পেসো’। ট্যুরিস্টদের জন্য সিইউসি নামে এক ধরনের কারেন্সি প্রচলিত আছে। একশত ইউএস ডলারে পাওয়া  যায় সত্তুর পেসো। ট্যুরিস্টদের জন্য সকল পণ্যের মূল্য সিইউসি তে নির্ধারিত থাকে। বৃষ্টির ঝামেলা উপেক্ষা করে ভারাডেরো ডাউন টাউনের দিকে পা বাড়ালাম। ডাবল ডেকার বাসে চড়তে আনন্দ অনুভব করলাম। আমরা একেবারে উপরে উঠে বসলাম তখন বৃষ্টি নেই। বাসের দোতলায় কোন ছাদ নেই, উন্মুক্ত স্থান থেকে সমস্ত শহর দেখা যাচ্ছে। আমার কাছে মনে হয়েছে শহরের মূল আকর্ষণই হল আটলান্টিক মহাসাগর। যার রূপ দেখে দেখে তৃপ্তি হয়না। পথিমধ্যে একটা জায়গা অপূর্ব লেগেছে, নদী এসে একটা বাঁক নিয়ে নির্দ্বিধায় যেন সাগরে মিশে গেছে। সত্যিই অতুলনীয় দৃশ্য। আকাশ আর সীমাহীন সাগরের মাঝখানে কিউবা যেন একটি অপরূপ ভূখন্ড হিসাবে জেগে আছে, একথা ভাবতে ভাবতে মন বলাকা পাখা মেলে দিল। রবীন্দ্রনাথের বলাকার মতই মন ছুটতে  লাগল, নিজেকে মনে হতে লাগল মুক্ত বিহঙ্গের মত। তিনি যেমন বলেছিলেন, ‘হেথা নয় হোথা নয়, আর কোথা অন্য কোনখানে’  ঠিক তেমন করে  কী যেন এক  বেগের  আবেগে মন ছুটছে , কোথাও কোন বন্ধন নেই। আজ মন যেখানে যেমন ইচ্ছা ঘুরতে যেতে পারে তাই   সাগরের বুকে উড়ে যাচ্ছে মন বলাকা। কোন লক্ষ্য নেই। শুধু ছুটে চলাই একমাত্র উদ্দেশ্য, গতিই যেন জীবনের সবটুকু অনুভব জুড়ে সত্য হয়ে আছে আর কিছু নয়। সাগরের বিশালতা প্রত্যক্ষ করলে হয়ত মানুষের মন এমন  চঞ্চল হয়ে যায়। রাস্তার দুই পাশে  চমৎকার সবুজ প্রকৃতি দেখে ক্যমেরা ক্লিক ক্লিক করতে লাগল। প্রথমে একটা মার্কেটে পৌঁছলাম। মার্কেটটি সাজানো গোছানো। নাম লেখা আছে ‘প্ল­াজা আমেরিকা’। নাম দেখে ভাল লাগছিলনা। স্বাভাবিকভাবে একটি উপলব্ধি কাজ করছিল যে আমরা আমেরিকা অথবা কানাডার কোন কিছু দেখতে এখানে আসিনি এসেছি কিউবান নিদর্শন দেখতে। অনিচ্ছা নিয়ে দুএকটা দোকানে ঘুরলাম। সব পণ্যের গায়ে লেখা আছে সিইউসির নাম।
কোনটি ৫০, কোনটি ৩০  কোনটি ২০ সিইউসি এমনি নানা রকম পণ্য এবং নানা ধরনের মূল্যমান। তখন মনে হল এখানে সব পণ্যেরই মূল্য কিছুটা বেশী। খানিকটা অস্বস্তি লাগছে  ট্যুরিস্টদের জন্য সকল পণ্যের একটু বেশী মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে বলে। যারা  ট্যুরে আসে তারা শপিং এর চেয়ে বেশী ব্যস্ত থাকে দর্শনের আকর্ষণে। তারা বেশী শপিং করেনা বলে আমার ধারনা।  তাছাড়া একই মানের পণ্য আমেরিকা-কানাডায় আরো খানিকটা কম মূল্যে পাওয়া যায়। উল্লে­খ করার মত  তেমন কিছু কেনা হলনা কিন্তু অভিজ্ঞতা হল  দেশের অর্থনৈতিক মানসের একটি পার্ট সম্পর্কে। তখন আমার মনে হতে লাগল যদি পণ্যের মূল্য আরো কম করে নির্ধারণ করা হত তাহলে হয়ত ট্যুরিস্টরা কিছু বেশী পন্য ক্রয় করত। ওখান থেকে ফিরে আমরা গেলাম  একেবারে ভারাডেরো ডাউন টাউনের ফ্লি মার্কেটে। মার্কেটটি বাইরে থেকে দেখে মনে হল কতগুলি টেন্ট লাগানো একটা অস্থায়ী ব্যবস্থা। ভিতরে ঢুকে দেখলাম ওখানে কিউবান সুবিনিয়ারে ঠাঁসা। কাঠের তৈরি পণ্য, সমুদ্রের ঝিনুক দ্বারা তৈরি বিভিন্ন ধরনের পণ্য, সত্যিকারের স্টোন এবং পার্লের গয়না দিয়ে সাজানো রয়েছে। আবার যে গয়নাটি যে স্টোন দিয়ে তৈরি তার একটুকরা নমুনা পাশে রাখা আছে। মুক্তার গয়নার পাশে মুক্তাওয়ালা ঝিনুক রাখা আছে। কোন পণ্যের দামই নির্দিষ্ট করা নেই। তবে মনে হচ্ছিল টুরিস্টদের কাছে সব পন্যের দামই একটু বাড়িয়ে চাচ্ছে। অর্থাৎ যার কাছ থেকে যতটুকু বেশি মূল্য রাখা যায়  ততটুকুই যেন তাদের লাভের অংশ হিসাবে গণ্য হবে। এটা এক ধরণের মনস্তাত্ত্বিক দীনতা। প্রথমে তারা  জিজ্ঞেস করছে  কানাডা থেকে এসেছি কিনা। আমি দোকানে কানাডার নাম  বলার পর কিছুতেই কোন পণ্যের দাম এতটুকু কমাতে রাজি হয়নি তাই বেশি দামেই কিছু কিনে নিতে হল। ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকলাম  আর ভবতে থাকলাম, অনাকাঙ্ক্ষিত মূল্যে বেশী কিছু কেনা যাবেনা অথচ অনেক  কিছুই কিনতে ইচ্ছে করছে।  হঠাৎ করে দেখতে পেলাম দুজন কেনেডিয়ান মহিলা বলল তারা ইন্ডিয়া থেকে এসেছে। তাদের গায়ের রঙ ছিল বাদামী, হয়ত তারা ছিল ইন্ডিয়া থেকে আগত ইমিগ্রান্ট। ইন্ডিয়া শুনে অনেকেই দামের ব্যাপারে তাদের সাথে কিছুটা  নমনীয় ভূমিকা পালন করল যা পরিষ্কার বুঝতে  পারলাম। ঘুরতে যেমন ভাললাগল তেমনি  তাদের মানসিক প্রবণতা প্রকাশ পেল এবং মনে হল এ যেন এক চেনা মার্কেটের চরিত্র, যাকে অনেক পিছনে ফেলে এসেছি । তৃতীয়  বিশ্বের মার্কেট গুলোর সাথে কিছুটা চারিত্রিক মিল পেলাম। চোখের  সামনে ভেসে উঠল ইন্ডিয়া-বাংলাদেশের মার্কেটের চরিত্র। তবে ক্রেতাদের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে উল্লি­খিত দেশ দুটির চেয়ে এদেশের মার্কেট ও পণ্যের মান অনেক উন্নত মান সম্পন্ন যা ইউরোপ এবং আমেরিকা, কানাডার সম পর্যায়ের । ফেরার সময় প্রচন্ড বৃষ্টির কবলে পড়ে ফ্লি মার্কেটে ঘোরার আনন্দ অনেকটা হ্রাস পেল। আর ছাদে বসা হলনা এবার জানালা দিয়ে শহর দেখছি।  শহরের বাড়িগুলি দেখছি আর ভাবছি সব দেশের মানুষেরই হয়ত মনের অনুভূতি একই রকম। হয়ত সব দেশের নাগরিক গণ বিশ্বাস করে  আমাদেরই মত “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবেনাক তুমি/ সকল দেশের রানী সেজে আমার জন্মভূমি।“ বিকেলে হোটেলের স্যুইমিং পুল যেন আমদেরকে অনেকটা টেনে নিয়ে গেল। তখন আর বৃষ্টি নেই, চমৎকার মিউজিক বেজে চলেছে। ‘সালসা’ ওদের প্রিয় মিউজিক। পুলের সঙ্গেই মিনি বার সেখানে সব ধরনের পানীয় পাওয়া যায়। একদিকে স্নাকবার আছে ইচ্ছে করলে সেখানে কিছু খেয়ে আবার পুলে ফিরে আসা যায়। ও দেশে আইনের প্রয়োগ খুব কঠিন। ওখানে কোন অপরাধ সংগঠিত হয়না। অপরাধ কাকে বলে সাধারণ কিউবানরা হয়ত এর রূপ ভুলে গেছে। সরকার আইনের মাধ্যমে যা নিষিদ্ধ করেছে তা ভঙ্গ করার ক্ষমতা কারো নেই। সব রকম পানীয় অবাধে মানুষ খেতে পারে। যে যত ইচ্ছা ড্রিঙ্ক করতে পারবে  কিন্তু ড্রাংক অবস্থায় সব ধরনের অপরাধ নিষিদ্ধ। তাই তারা ক্রাইম থেকে মুক্ত। একটি দেশে সাধারণ মানুষের সমাজে কোন ক্রাইম সংগঠিত না হলে সামাজিক ও মানসিক ভাবে নাগরিকগন সর্বাধিক নিরাপদে বসবাস করতে পারে। একটা আর্থিক দীনতা কিউবা বাসীর অন্তরে অন্তরে ক্ষীণ ধারায় বইছে  যা আমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করেছি। তখন আমাকে একটা চিন্তা অসম্ভব ভাবিয়ে তুলেছে; আমরা একটা সংস্কার নিয়ে বড় হয়েছি যে, অভাবে স্বভাব নষ্ট ;অর্থাৎ দারিদ্রতার কারণে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। কিউবাকে দেখে আমার সেই আজন্ম বয়ে আনা ধারনা সমূলে উৎপাটিত হয়ে গেল। বোধটা আরও সুস্পষ্ট হল যে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে অপরাধ প্রবণতা কালচারের ঘারে চড়ে আসে, কখনো দারিদ্রতার ঘারে চড়ে আসেনা। মানুষ স্বভাবতই অপরাধ প্রবণ কিন্তু আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারাটাই কালচারের অঙ্গ। কিউবান সরকার সেটুকু পেরেছেন। সামাজিক জীবনের চারিদিক কণ্টক মুক্ত করতে পারা এবং সমাজের আর্থিক উন্নতিকে গতিমান করাই বুদ্ধিমানের কাজ। কেবল দেশের মানুষ ধনী হলেই সব  কিছুর সমাধান হয়ে যায়না; আর্থিক উন্নতির পাশাপাশি প্রয়োজন নৈতিক জীবন বোধ এবং সকল মানুষের অবাধে সমাজে বিচরণ করার নিশ্চয়তা। ধর্ম, গোত্র, সেক্স নির্বিশেষে রাষ্ট্রীয় আইন মেনে সকলের  জীবনকে বন্ধনহীন করে তোলাই সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত। কিউবাতে কিছুটা আর্থিক দীনতা থাকলেও তারা মানুষের যাপিত জীবনে এবং সংস্কারে অনেকখানি অপরাধ মুক্ত। এখানে নারী ও পুরুষের মধ্যে বাহ্যিক কোন প্রভেদ নেই। যদিও অন্তরে কি আছে আমরা বাইরে থেকে তার খোঁজ রাখিনা। সকলেই এখানে মানুষ হিসাবে গন্য হয় এবং সবক্ষেত্রেই তাদের অধিকার সমান। নারী পুরুষের মধ্যে সামাজিক বিভেদ বলতে দৃশ্যমান কিছু চোখে পড়েনি। যা  মানুষ হিসাবে আমাকে আকর্ষণ করেছে। আমি যে সামাজিক নিয়মগুলি দেখে বেড়ে উঠেছি, যাকে কোনভাবে সমর্থন করতে পারিনি কোনদিন, সেই নিয়মগুলি কোনখানে নেই , যা অনেকখানি মানসিক স্বস্তি নিয়েই অনুভব করেছি। ওখানে সেক্সের  শাসন  মানুষকে  প্রথার দড়ি দিয়ে টেনে পেছনে নিয়ে যাচ্ছেনা। এক শ্রেণীর মানুষের অবমাননায় আর এক শ্রেণী ধন্য হয়না, কারণ সেখানে আইন ভঙ্গকারী আইন ভাঙ্গাকে বীরত্ব মনে করেনা। প্রথাদৈত্যই একমাত্র জীবনসঙ্গী হয়ে ওঠেনি, জীবনের সবটুকু পরিসর জুড়ে নির্ভীক প্রথার অভয় দৌড় নেই ওখানে যেটা এশিয়ানদেশগুলিতে চরম ভাবে প্রতিয়মান। (চলবে)
যেসব পণ্য তারা উৎপাদন করছে তার মধ্যে চিনি শিল্প আর সিগারেট শিল্প দেশটিকে সমৃদ্ধ করেছে। এক সময়য়ের বিশ্ব নন্দিত হাভানা চুরুটের কথা সর্বজন বিদিত। আখের চাষ করার জন্য আফ্রিকা থেকে এবং চায়না থেকে সেøভ ধরে এনেছিল প্রথম দিকের স্প্যানিশ রাজাগণ। কার্লোস নামে একজন স্বাধীন চেতনায় সমৃদ্ধ মানুষ যিনি ছিলেন একজন আখ চাষি তিনিই প্রথম সেøভদেরকে মুক্ত করার কথা ভাবেন এবং একসময় স্প্যানিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। তার মুক্ত মানবিক চিন্তাই মানুষের বন্ধন থেকে মানুষকে মুক্ত করেছে। চিরদিনের জন্য বিদায় নিয়েছে সেø­ভিয়ান প্রথা।
কেটে গেল আরও একটি রাত। সময়ের ঘোড়া দ্রুত গতিতে ছুটতে লাগল।পরের দিন সকালে ঝলমলে রোদের মধ্যে মন ছুটাছুটি করতে শুরু করল। মনে হচ্ছিল মানুষ কেবল শুভ বোধের দ্বারাই সুখকর ও কল্যাণকর বোধ খুঁজে পেতে পারে। মনে হবে আলোর সাথে এসব মনে হওয়ার সম্পর্ক কি? আসলে  বাঁধন হারা সময় টুকুই এসব ভাবনার কারণ হয়ে উঠেছে হয়তবা। যখন আমরা ছুটি কাটাতে গিয়ে বাঁধন হারা সুখ অনুভব  করছি ঠিক সেই মুহূর্তে পৃথিবীর অনেক নিরীহ মানুষ প্রথার বন্ধনে নির্যাতিত হয়ে সন্ত্রাসে মারা যাচ্ছে। পৃথিবী জুড়ে এভাবেই  সুখে অসুখে মিলেমিশে মানব জাতি ছুটে যাচ্ছে কোন এক লক্ষের দিকে।
আটলান্টিক মহাসাগরের উদার আহ্বান আমাকে চুম্বকের মত টানছে। আমরা আটলান্টিকের বিচে গিয়ে পৌঁছলাম। বিচের চেয়ারগুলিতে কেউ শুয়ে শুয়ে বই পড়ছে, কেউ গায়ে সোনার রোদ মাখার জন্য শুয়ে চোখ বন্ধ করে আছে, কেউ বেলা ভূমিতে ঝিনুক কুড়াচ্ছে, কেউবা সমুদ্রের জলে ঝাপ দিয়ে ধেয়ে আসা ঢেউ গুলির সাথে খেলা করছে। সবার চোখে মুখেই একটা আনন্দের ঝলকানি সুস্পষ্ট। আমি অপেক্ষা করতে পারলামনা ঝাপ দিলাম অতল সীমাহীন সাগরের বুকে। ছোটবেলায় আমি এই বক্তব্যের  ভাব সম্প্রসারণ করেছিলাম, ‘সমুদ্রের বুকে ঝাপ দাও, তরঙ্গকে আঁকড়ে ধরো ওখানেই আছে অনন্তজীবন।‘ কথাটা তখনকার চেয়ে আজ যেন বেশী বেশী অনুভব করছি। যে কথাগুলি আমাকে সারা জীবন ধরে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে , এবং সেই আত্মসঙ্গী হয়ে যাওয়া কথাগুলি যে একটা চিত্রকল্প বহন করে বেড়াচ্ছে সে যেন বাস্তব রূপ ধারণ করে আমার সামনে উপস্থিত হল । যদিও এর   অর্থগত দিকটা অনেক ব্যাপক কিন্তু আজকের সমুদ্রের বিশালতার কাছে, ব্যাপকতার কাছে যার সমস্ত বিস্তৃতি হারিয়ে কেবল জেগে আছে ঢেউয়ের সাথে খেলা করার আবেদনটুকু। তাই সমুদ্রের জোয়ারের সাথে একাকার হয়ে  গেলাম শুধু।
এবার হাভানা যাওয়ার আয়োজন চলছে। হাভানা কিউবার রাজধানী। শহরটি বিশাল নয় তবে তাদের জাতীয় জীবনের ইতিহাস বেশ দীর্ঘ। চারশ’ বছর ধরে স্পেন কিউবার শাসন ক্ষমতায় থাকার পর  আমেরিকার সাথে স্পেন এর যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় কিউবার মালিকানা নিয়ে। ১৮৯৮ সালে যুদ্ধ শেষ হয় এবং  আমেরিকা যুদ্ধে জয় লাভ করে এবং রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে। এরপর ক্রমাগত ইতিহাসের পট পরিবর্তনের  মধ্য দিয়ে একসময় কিউবা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়।  এসব উত্থান পতনের  নিদর্শন তাদের  স্থাপত্য শিল্পে বহন করে চলছে। শহরটিতে আমেরিকা এবং স্পেনের শাসন কালের নিদর্শন এখনও জীবন্ত। কিউবার ডিক্টেটর নামে পরিচিত ফিদেল ক্যাস্ট্রো দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। ফিদেল ক্যাস্ট্রোর বাবা স্পেন থেকে আগত একজন ইমিগ্রান্ট ছিলেন। ফিদেল ক্যাস্ট্রো দেশের সংবিধান সহ অনেক পরিবর্তন সাধন করেন। পরবর্তীতে তিনি শারীরিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে তার ভাই রাউল ক্যাস্ট্রোর কাছে ক্ষমতা হস্তার করেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির প্রধান এর পদ থেকেও তিনি অবসর গ্রহণ করেন। কিন্তু পরোক্ষভাবে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় তার দর্শনকে চলমান রেখেছিলেন। বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন দেশের শাসক গোষ্ঠী ক্ষমতাসীন হওয়ার ফলে দেশের সামাজিক এবং  ধর্মীয় সংস্কার বহু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে একটা নিজস্ব রূপ ধারন করেছে। যদিও ধর্মের শাসন নিয়ে কোনরকম বাড়াবাড়ি নেই, তবু সাধারন জনগণের মধ্যে একটি অস্পষ্ট ধর্মীয় অনুভূতি কাজ করছে সেটি হল ক্যাথলিক খ্রীস্ট ধর্ম। হাভানা ক্যাথলিক চার্চ তার দৃষ্টান্ত  বহন করছে। চার্চের  পাশেই রয়েছে ধর্ম শিক্ষার স্কুল। ইচ্ছে করলে দেশের যে কোন নাগরিক সেখানে ধর্ম শিক্ষা পেতে পারে। পোপ হলেন সেই স্কুলের প্রধান ব্যক্তি।
হাভানা যাওয়ার পথে একটি জায়গায় আমরা থেমেছিলাম কিছু খাওয়া দাওয়া আর ফ্রেশ হওয়ার জন্য। সেখানে একটা রেস্টুরেন্টে আমরা যে যার মত বিভিন্ন প্রকার স্নাক খেলাম ফ্রেশ হলাম আবার চললাম গন্তব্যের দিকে। ভ্রমণের ফর্মুলা অনুযায়ী মিউজিয়াম, প্রধান চার্চ, দুর্গ, রেভুলেশন স্কয়ার, মহানায়কদের শ্বেত পাথরের মূর্তি, ঐতিহাসিক নিদর্শন বর্ণনা এবং ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দ মিলে কখন সময় ফুরিয়ে গেল টের পাইনি। ভ্রমণে যাওয়া বেশ কয়েকজন টরন্টোবাসীর সংগে বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল এরা কেউ ইমিগ্রান্ট, কেউ টরন্টোরিয়ান, সবাই মিলে আমরা এক দেশের অস্তিত্ব বহন করছি বলে সবাইকে একই সংস্কৃতির মানুষ মনে হচ্ছিল। আমরা কানাডিয়ানরা সবাই মিলে লাঞ্চের জন্য রেস্টুরেন্টে একটি টেবিলে বসেছি , গল্পের ছলে যে যার অভিজ্ঞতার কথা বলে চলল। কেউ নেতিবাচক ভঙ্গী প্রকাশ করল কেউ আবার অনেকটা ইতিবাচক মত প্রকাশ করল, তবে নেতিবাচক কথার দিকেই সকলের ঝোঁকটা একটু বেশী ছিল। আসলে কেউ ঠিকঠাক করে বলতে পারেনা যে টেবিল টক কোন দিকে ঝুঁকে পড়বে, আমদের বেলায়ও তাই হল। ফেরার পথে আমরা একটা অতি পুরাতন দুর্গ দেখার জন্য থেমেছিলাম সেখানে ছোট একটি মার্কেট আছে যেখানে সব কিউবান সুবিনিয়ার কেনার জন্য একটা বিশেষ জায়গা, ছোট ছোট একচালা ছাউনির মধ্যে দোকানের জৌলুস মন্দ নয়। কিছু কেনাকাটা সেরে ফিরতে বেশ অন্ধকার হয়ে গেল, তখন জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’ কবিতার মত করে মনে হতে লাগল সব পাখী ঘরে ফেরার লগ্ন এলো এবার।

আমরা কোন ট্যুরে কিভাবে কখন যাবো তার একটা নির্দেশনা পেয়ে গিয়েছিলাম আগেই, কারণ প্রথমে রেজিস্ট্রি করতে হয়েছিল এবং টাকা জমা দিতে হয়েছিল আমাদের হোটেলেই। সমস্ত দিনের  ভ্রমণের আনন্দের রেশ পরের দিনেও যেন সতেজ হয়ে আছে। পরের দিন প্রভাত আলোয় শরীর ভিজিয়ে আমরা কোন এক আনন্দের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম। এবার সমুদ্রে যাবো, অনুভূতিটা এরকম যেন অনেক আগেই মনটা সমুদ্র যাত্রায় নেমে পড়েছে তাই সে সাগরের বিশালতায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। নতুন নতুন দৃশ্যাবলী পেছনে রেখে আমরা ছুটছি , ক্রমাগত চলে যাচ্ছি কোন এক আনন্দের সাজানো ঘরে। আমাদেরকে বহনকারী বাস এসে পৌঁছল একটা টার্মিনালে যেখান থেকে দেখতে পেলাম সাগরের বুকে ভেসে যাচ্ছে  শত শত প্রমোদ তরী। এর মধ্যে একটা এসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, নাম তার ‘কাটামারাং।‘ লাইন ধরে একে একে উঠে  পড়লাম যার সাহায্যের প্রয়োজন ছিল তাকে হাত ধরে সাহায্য করল ভ্রমণ আয়োজকরা । এভাবে  সবাই  উঠে গেলাম সমুদ্রের বুকে ভেসে যাওয়া একটি বোটে। হৃদয় তখন কি এক ভাললাগার আনন্দে বিভোর।  বোটের আকৃতি জাহাজের মত নয় অনেকটা বন্ধনহীন ভেসে বেড়ানোর উপযোগী করেই তৈরি। বোটের মধ্যে যেন আনন্দের ঝর্ণাধারা বইছেতো  বইছেই। নাচে গানে মাতোয়ারা সকলে। যেন পৃথিবীর সব আনন্দ এখানে এসে জমা হয়েছে। সকলেই সুইমিং কস্টিউম পরে আছে, আমি এমন একটি দেশে জন্মেছি এবং বেড়ে উঠেছি যে দেশের মানুষ মনে করে মেয়ে মানুষের অঙ্গ দেখলে পুরুষ মানুষ হামলে পড়বে তাঁর উপর, তাই আমার হৃদয়ে চলছে অনুসন্ধানের যজ্ঞ। আমার চোখ সকলের মুখ অনুসন্ধানে  তৎপর হয়ে উঠল, বুঝতে  চেষ্টা করছি কারো মুখে ভেসে উঠছে নাকি ধর্ষণের আগ্রহ। কোন মানুষের চোখে মুখে  মেয়ে মানুষের অঙ্গ দেখে তাঁকে ধর্ষণের অভিলাষ জেগে উঠতে দেখিনি। কোন পুরুষকেই পাপী মনে হচ্ছেনা যে তাকে দেখে মেয়েরা অঙ্গ ঢাকতে তৎপর হয়ে উঠবে। কোন পুরুষ মানুষকে দেখে  মনে হচ্ছেনা নারীকে সুইমিং কস্টিউম পরা দেখে লালসার যাতনায় মরে যাচ্ছে। এখানে আনন্দটা নির্মল। এটাকেই বলে স্বাধীনতা, যা বাংলাদেশে প্রথার মধ্যে হারিয়ে গেছে।  যেখানে প্রথার আগ্রাসনেই  রচিত হয় নারী ও পুরুষের বিভেদের ফারাক। নারীর অঙ্গ দেখলে পুরুষের আগ্রাসী চিন্তা বেড়ে যায় কেবল দৃষ্টিভঙ্গির কারণে; যারা নারীর দিকে শুধুমাত্র যৌনতার দৃষ্টিতেই তাকায়। মনে হয় আজন্ম লালিত কী যেন এক আক্রোশ বহন করে চলছে নারীদের প্রতি পুরুষ চরিত্রগুলো। তাই তাকে ধর্ষণের পর মেরে ফেললে জীবনের প্রতি কোন অন্যায় করা হয়না যেন। তাদের বেঁচে থাকা এবং মৃত্যু বরণ করা দুটোই যেন  পুরুষের অভিলাষ। নারী একজন মানুষ একথা কোনভাবেই  যেন  ভাবতে পারেনা তারা। কিন্তু ঐ ভাবনার বৃত্তের বাইরে যারা অবস্থান করেন তাদের মাথায় ধর্ষণের চিন্তা বা মতলব কোনটাই আসেনা। এর মনস্তাত্ত্বিক  কারণ হল যখন এসব সামাজিক প্রথাগুলি তৈরি  হয়েছে তখন মানুষের জীবনে যৌনতার আনন্দ ছাড়া আর কোন আনন্দের ব্যবস্থা ছিলনা। মানুষের মনে কখনও আসেনি যে যৌনতাকে অতিক্রম করেও সকল মানুষ মিলে নির্মল আনন্দের ব্যবস্থা করা যায়। আজকের সভ্য জগতে যৌনতার আনন্দ কেবল নিতান্তই ব্যাক্তিগত; মানে সেটা কেবল দুটি মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এবং নিয়মতান্ত্রিক । কিন্তু নৈর্ব্যক্তিক আনন্দের ব্যবস্থা করতে হলে ঐ সীমাবদ্ধ ভাবনার বাইরে গিয়ে  সকলের আনন্দের উৎসকে খুঁজে বের করতে হয়। যে আনন্দের নেপথ্যে থাকবেনা কোন ভীতির  কুহেলিকা। মানুষের আনন্দ লোভী মন সভ্য মানুষকে তাগিদ দেয় যে অনেকে মিলে যতটুকু আনন্দে ভেসে যাওয়া যায় সেটুকুই জীবনকে সহজ ও স্বাভাবিক করে রাখে। কুসংস্কার মুক্ত করে এবং মানুষকে উদার হওয়ার মন্ত্র শিখায়। মানুষের অন্তরে অন্তরে সর্বদা দুটি মন্ত্র সক্রিয়, একটি হল মানুষে মানুষে আনন্দের মাধ্যমে সৌন্দর্য মণ্ডিত মানব সভ্যতা গড়ে তোলা, অন্যটি হল কোন প্রথা ও  কোন সংস্কারের কারণে মানুষে মানুষে  শত্রু  ভাবাপন্ন সম্পর্ক তৈরি করা, এবং প্রথাবদ্ধতাকে  অন্তরে ধারণ করে মানুষের  ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য সকল সৌন্দর্যকে উপেক্ষা করা।  এই দুটি সত্যের মধ্যে মানব জাতি কোনটিকে গ্রহণ করবে তা নির্ভর করে  তাদের মানসিক প্রবণতার উপর। এভাবেই জাতিগত বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়।
সীমাহীন সমুদ্রের মাঝে একটি নির্দিষ্ট স্থানে এসে আমাদের বোটটি থামল। সাগরের বুকে একটি  সুবিধা জনক জায়গা পছন্দ করে বিশেষ ব্যাবস্থায় স্টেশন করা আছে। একইভাবে দুটি স্টেশন তৈরি করা আছে। একটা বড় এরিয়া জুড়ে কোন কিছু আটকে রাখার মত করে  গোলাকৃতি আয়োজন রয়েছে। যখন সেই স্টেশনে আমরা নেমে পড়লাম আনন্দে মনটা যেন চঞ্চল হয়ে উঠল। চারিদিকে অন্তহীন সাগর  মাঝখানে  মানব সৃষ্ট একটি ঘাটি , ডলফিনদের আবদ্ধ রাখার জন্য এ ব্যবস্থা। তবে  ডলফিনদের অবরুদ্ধ রাখার প্রক্রিয়াটি দেখে মনে হল সাগরের বিশালতাকে ব্যাহত করা হয়নি এতটুকু। ডলফিনরা সেখানে বসবাস করলেও তাদের অবরোধ করে রাখা হয়েছে সে রকম মনে হচ্ছেনা। দেখে মনে হচ্ছে এ এক অদৃশ্য অবরোধ। কারণ এই গোলাকৃতি জায়গাটির মেকানিজম চমৎকার। যেহেতু ডলফিন বড় আকৃতির মাছ তাই তার শারীরিক আকৃতির তুলনায় খানিকটা ছোট ছোট ফাকা দিয়েই রচিত বন্ধন।। তাঁরা ছুটে যেতে পারছেনা তবে তাদের অবরোধের কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছেনা । একে একে সকলে নেমে গেল ডলফিনের সাথে খেলা করতে। ডলফিনের পছন্দের খাবার হিসাবে এক ধরণের মাছ তাদেরকে খেতে দেওয়ার কারণে যেন উৎফুল্ল হয়ে শিখানো খেলা দেখাতে লাগল পরম উৎসাহে।  যখন ডলফিনের পিঠে চড়ে সাগরের জলে ঘুরছি তখন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিল , মনে হচ্ছিল সমস্ত বাস্তবতা স্বপ্নের জগতে হারিয়ে গেছে। রিসোর্টের পক্ষ থেকে ক্যামেরা ম্যান ছিল, প্রায় সবাই ডলফিনের সঙ্গে চমৎকার যত ছবি  উঠাল। ডলফিন  মাছ হয়ে মানুষের গালে চুম্বন করছে ফটো স্যুটের জন্য। দৃশ্যটি দেখে আমার মনে আনন্দের ঝর্ণা বয়ে গেল।
এবার একটা মজার ইভেন্ট আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে যার নাম ‘স্নোর কেলিং।‘ মহাসাগরের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে মানুষেরা জলের তলদেশে গিয়ে কতকি রহস্য উদ্ধার করেছে, ঠিক তাদের মতই যেন আমরা সকলে খেলায় মেতেছি। দেখে মনে হচ্ছে সবাই সাগর মন্থনে নেমেছে। কিছু ভীতু মানুষেরা জিজ্ঞেস করে যখন জানতে পারল পানির গভীরতা এখানে একেবারেই নেই তখন তাদেরকে এক একজনকে সম্রাটের মত মনে হল, তাদের চোখ মুখ ঝলকানি দিয়ে উঠল। কেউ মাছদের খাবার দিয়ে  জড়ো করেছে , কেউ সাঁতার কাটছে । এভাবে প্রকৃতির সাথে মানুষের মেলেমেশাটাকে অবাঁধ না হলে মানুষ এক বিপুল  আনন্দ থেকে বঞ্চিত  হয়। ওখানে পানির সচ্ছতা দেখে মন যেমন মুগ্ধ হয়েছে তেমনি নিজেকে অনেক বেশী মুক্ত মানুষ ভাবতে ইচ্ছে করেছে , যে মুক্তি আমার নেপথ্যে ফেলে আশা সংস্কৃতির মধ্যে কিঞ্চিৎ  ম্রিয়মান ছিল। এভাবে ত্রিশ মিনিট কি ভাবে কেটে গেল টের পেলামনা। কারণ আমাদের ত্রিশ মিনিটই বরাদ্দ ছিল। সকল বয়সের মানুষেরা আবার একে একে উঠে এল বোটের মধ্যে। আমাদের কাপড়  আমাদের শরীরেই শুকাল। ক্রমাগত আনন্দ ধারা সামনে নিয়ে চলল আমাদেরকে, আমরা ছুটতে ছুটতে একটা ছোট্ট দ্বীপে পৌঁছে গেলাম। দ্বীপটির  শুভ্র সৈকত এখনও মনের নির্জনে জেগে আছে। সেই সৈকতের রূপ যুগান্তরের মুগ্ধতাকে অতিক্রম করে গেছে । প্রকৃতি সম্পর্কে মানব গোষ্ঠী এবং তাদের পূর্ব পুরুষেরা যতটুকু ভাবতে পেরেছে তার চেয়েও যেন  সুন্দর  কোন দৃশ্য এখানে, অন্তত আমার মনে তেমনই একটা অনুভূতি এসে জুটেছে। রবি ঠাকুরের সেই গানটি আমার হৃদয়কে চঞ্চল করে তুলছে , ‘ওরে ওরে ওরে আমার মন মেতেছে/ তারে আজ থামায় কেরে।‘ এখানে এসে মনে  হল মন যেন মুক্ত ও সাবলীল। দিগন্তব্যাপী শুভ্রতার মধ্যে একটি দ্বীপ জেগে আছে যেন পরম তৃপ্তি নিয়ে। যে দ্বীপটি মানব সভ্যতার পদচারনায় অনেক বেশী মুখর ,  অনেক বেশী পরিপাটি । এখানে  প্রয়োজনীয়  সব ব্যবস্থাই রয়েছে। লাঞ্চ সেরে সমুদ্র সৈকতে নেমে পড়ল সবাই। যতদূর দৃষ্টি যায় শুভ্র রঙের বালুচর আর সঙ্গে সমুদ্রের সচ্ছ পানি। শুভ্র সমুদ্র সৈকতে যেন কী আনন্দে সকলে লুটোপুটি করছে আর সাথে সাথে ক্যমেরা ক্লিক ক্লিক করে চলেছে। কেউ সেলফি তুলছে , কেউ অন্যের সাহায্য নিচ্ছে , এভাবে আলোর গল্প , আনন্দের গল্প , মুক্তির গল্প , প্রকৃতির কাছে ছুটে যাওয়ার গল্প দিয়ে ভরে উঠল আমার অভিজ্ঞতার ঝুলি। সমুদ্র থেকে যেন কুড়িয়ে আনা অজস্র স্ফূর্তির ঝিনুক মালা গেঁথে যাচ্ছে হৃদয়ের অন্তরালে বসে কে যেন , যাকে শুধু অনুভব করা যায় দেখা যায়না কখনও ।


লিও তলস্তয়ের ছোটগল্প – গড সীজ দ্য ট্রুথ, বাট ওয়েটস (God Sees the Truth, But Waits)


ভ্লাদিমির শহরে ইভান দিমিত্রিচ আকসিনভ নামে এক তরুণ ব্যবসায়ী বাস করত। তাঁর নিজের দুটি দোকান আর একটা বাড়ি ছিল।

আকসিনভ দেখতে ছিল সুদর্শন, মাথা ভর্তি সুন্দর কোঁকড়ানো চুল, সারাটা দিন হাসিঠাট্টা করে কাটিয়ে দিত, আর গান গাইতে খুব ভালোবাসত। খুব অল্প বয়সেই মদ খাওয়া শুরু করেছিল সে, যখন একটু বেশি খেয়ে ফেলত একেবারে বুনো হয়ে উঠত; কিন্তু বিয়ের পর মদ খাওয়া ছেড়ে দিল, অবশ্য কখনো সখনো টুকটাক একটু খেত।

এক গ্রীষ্মে আকসিনভ নিৎসনি মেলায় যাচ্ছিল, পরিবারের কাছে থেক বিদায় নিল, তাঁর বউ বলল, “ইভান দিমিত্রিচ, তুমি আজকে রওনা দিও না; তোমাকে নিয়ে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছি আমি।”

আকসিনভ হেসে বলল, “আমি মেলায় যেয়ে পাছে হাসি গানে মেতে উঠি, এই ভয় পাচ্ছ তুমি।”

তাঁর বউ বলল, “জানি না কিসের জন্য ভয় পাচ্ছি আমি; শুধু জানি আমি একটা স্বপ্ন দেখেছি। তুমি শহর থেকে ফিরেছ, যখন তোমার টুপিটা খুললে, দেখলাম তোমার চুলগুলো সব ধূসর হয়ে গেছে।”

আকসিনভ হেসে বলল, “এটা তো শুভ লক্ষণ। দেখো, আমার সব মালপত্র বিক্রি না করে, তোমার জন্য কিছু একটা উপহার না এনে মেলা থেকে ফিরব না আমি।”

এরপর, সে পরিবারের কাছে থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।

অর্ধেক পথ ভ্রমণ করার পর, তার পূর্ব পরিচিত এক ব্যবসায়ীর সাথে দেখা হয়ে গেল, তাঁরা একই সরাইখানায় উঠলেন। এক সাথে চা খেলেন, এরপর পাশাপাশি দুই রুমে ঘুমাতে গেলেন।

অনেক বেলা পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমানোর অভ্যেস নেই আকসিনভের, তখনো বাইরে বেশ ঠান্ডা ছিল, তবুও সে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়তে চাইল, সকাল হবার আগেই তাঁর ঘোড়সওয়ারকে জাগিয়ে তুলে ঘোড়াগুলোকে ঠিক করতে বলল।

এরপর, সরাইখানার মালিকের বাড়ির দিকে গেল সে (তিনি পিছনে একটা কুটিরে থাকতেন), বিল পরিশোধ করে আবার যাত্রা শুরু করল।

পচিশ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে ঘোড়াগুলোকে খাওয়ানোর জন্য সে থামল। সরাইখানার পথের উপর কিছু সময় বিশ্রাম নিয়ে বারান্দার পথ ধরে এগোল, একটা সামোভারে পানি গরম করার ফরমাশ দিয়ে গিটারটা বের বাজাতে শুরু করল।

হঠাৎ করেই একটা ট্রয়কা গাড়ি টুং-টাং, টুং-টাং ঘন্টি বাজিয়ে সেখানে এলো, দুই জন সৈনিককে সাথে নিয়ে এক জন অফিসার নামল। আকসিনভের কাছে এসে সে তাকে জেরা করতে শুরু করল, জানতে চাইল সে কে, আর কোথা থেকেই বা এসেছে। আকসিনভ ঠিকঠাক সব প্রশ্নের জবাব দিল, বলল, “এক কাপ চা নিন না আমার সাথে?” কিন্তু অফিসারটি তাকে জেরা করা চালিয়ে গেল, জানতে চাইল, “কাল রাতে কোথায় ছিলেন আপনি? সেখানে কি একা ছিলেন নাকি সাথে পরিচিত অন্য কোন ব্যবসায়ী ছিল? আপনি কি সেই ব্যবসায়ীকে আজ সকালে দেখেছিলেন? ভোর হবার আগেই কেন সরাইখানা ত্যাগ করলেন?”

আকসিনভ বিস্মিত হল কেন সে এই সব প্রশ্ন করছে তাকে, তবুও সে সব কিছুর বর্ণনা দিল যা ঘটেছিল, এরপর যোগ করল, “আপনি আমাকে জেরা করছেন কেন, আমি কি চোর না ডাকাত? আমার নিজের ব্যবসার প্রয়োজনেই ভ্রমণ করছি আমি, আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার কোন প্রয়োজন নেই।”

সৈনিকদের ডাকতে ডাকতে অফিসার বলল, “আমি এই জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার, আর আপনাকে জেরা করছি, কারন গতকাল আপনি যে ব্যবসায়ীর সাথে রাতে ছিলেন তাকে আজ গলাকাটা অবস্থায় পাওয়া গেছে। আমরা অবশ্যই আপনার জিনিসপত্র তল্লাশি করে দেখব।”

তাঁরা ঘরের ভিতর ঢুকল। পুলিশ অফিসার আর সৈনিক দুইজন মিলে আকসিনভের মালপত্রের গিঁট খুলে তল্লাশি চালাল। পুলিশ অফিসার হঠাৎ একটা ব্যাগ থেকে একটা ছুরি বের করল, চিৎকার করে জানতে চাইল, “এই ছুরিটি কার?”

আকসিনভ তাকাল, দেখল তার ব্যাগ থেকে একটা রক্ত মাখা ছুরি বের করে আনা হচ্ছে, সে ভয় পেয়ে গেল।

“এই ছুরিতে রক্ত এলো কি করে?”
আকসিনভ উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু একটা শব্দও উচ্চারন করতে পারল না, শুধু তোতলালো, “আমি — জানি না –আমার না।” এরপর, পুলিশ অফিসার বলল, “আজ সকালে সেই ব্যবসায়ীকে তার বিছানায় গলা কাটা অবস্থায় পাওয়া গেছে। আপনিই একমাত্র লোক যে এই কাজটি করতে পারে। ঘরটি ভিতর থেকে তালা দেওয়া ছিল, আর কেউ সেখানে ছিল না। এখন আপনার ব্যাগ থেকে এই রক্তমাখা ছুরিটি পাওয়া গেল, আপনার চেহারা, আপনার আচরণ আপনার অজান্তেই সত্য প্রকাশ করে দিয়েছে! আমাকে বলুন, কিভাবে তাঁকে খুন করেছেন আপনি, আর কত টাকা আপনি চুরি করেছেন?”

আকসিনভ শপথ করে বলল সে খুন করে নি; রাতে একসাথে চা খাবার পর সেই ব্যবসায়ীকে সে আর দেখে নি; নিজের আট হাজার রুবল ছাড়া তাঁর কাছে আর কোন টাকা নেই; আর এই ছুরিটিও তাঁর নয়। কিন্তু তার কণ্ঠস্বর ছিল ভাঙা, চেহারা ফ্যাঁকাসে, এবং ভয়ে কাঁপছিল, এ কারনে দোষী স্যাবস্ত হয়ে গেল সে।

পুলিশ অফিসার আকসিনভকে বেঁধে ফেলে গাড়িতে তোলার নির্দেশ দিল সৈনিকদেরকে। তাঁরা তাঁর পা দুটো একসাথে বেঁধে গাড়িতে ছুঁড়ে ফেলল, আকসিনভ বুকে ক্রুশ এঁকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। টাকা-পয়সা, মালপত্র নিয়ে নেওয়া হল তাঁর কাছে থেকে, এবং তাঁকে নিকটবর্তী শহরে পাঠিয়ে দেয়া হল বন্দী করে রাখার জন্য। ভ্লাদিমিরে তার চরিত্র সম্পর্কে তদন্ত করা হল। ব্যবসায়ী ও শহরের অন্যান্য অধিবাসীরা বলল, আগের দিনগুলোতে সে মদে আসক্ত ছিল এবং সময় নষ্ট করত, কিন্তু সে একজন ভালো মানুষ ছিল। এরপর বিচার শুরু হল : রায়াৎসান শহরের এক ব্যবসায়ীকে হত্যা ও তার কাছে থেকে কুড়ি হাজার রুবল ডাকাতির দায়ে তাকে অভিযুক্ত করা হলো।

আকসিনভের বউ হতাশায় ভেঙে পড়ল, কিভাবে বিশ্বাস করবে বুঝতে পারল না। তাঁর ছেলেরা সবাই ছোট ছোট, একটা শিশু এখনও বুকের দুধ খায়। ওদের সবাইকে নিয়ে শহরে গেল সে, যেখানে তাঁর স্বামীকে বন্দী করে রাখা হয়েছে। প্রথমে তাঁর সাথে দেখা করার অনুমতি পেল না, কিন্তু অনেক মিনতির পর অফিসারদের কাছে থেকে তার অনুমতি মিলল, স্বামীর কাছে নিয়ে যাওয়া হলো তাঁকে। স্বামীকে কয়েদির পোষাক আর শিকল পড়ানো অবস্থায় চোর ও অপরাধীদের সাথে তালাবদ্ধ দেখে পড়ে গেল সে এবং দীর্ঘ সময় ধরে জ্ঞান ফিরে এলো না তাঁর। এরপর, ছেলেদেরকে কাছে টেনে নিয়ে স্বামীর পাশে বসল। আকসিনভকে বাড়ির কথা বলল, জানতে চাইল কি হয়েছিল তাঁর। আকসিনভ তাঁকে সব বলল, বউ জানতে চাইল, “এখন আমরা কি করতে পারি?”
“আমরা অবশ্যই জারের কাছে আবেদন করব যেন একজন নিরাপরাধীকে ধ্বংস হতে না দেন তিনি।”

তাঁর বউ বলল, সে জারের কাছে একটা আবেদন পাঠিয়েছিল, কিন্তু সেটা গৃহীত হয় নি।

আকসিনভ কোন জবাব দিল না, শুধু নিচের দিকে চেয়ে রইল।

এরপর, তাঁর বউ বলল, “আর কিছুই না, আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম তোমার চুল ধূসর হয়ে গেছে। মনে আছে তোমার? ঐদিন তোমার যাত্রা শুরু করা উচিত হয় নি।” আঙুল দিয়ে আকসিনভের চুলে বিলি কাটতে কাটতে সে বলে চলল, “ঈশ্বরের দেওয়া সবচেয়ে মূল্যবান উপহার তুমি আমার প্রিয়তম, তোমার বউকে সত্য বল; যে কাজটা করেছিল সে কি তুমি ছিলে না?”

“তাহলে তুমিও আমাকে সন্দেহ করলে!” আকসিনভ দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। এরপর একজন সৈনিক এসে বলল, তাঁর বউ ও ছেলেদেরকে এখুনি চলে যেতে হবে; আকসিনভ শেষবারের মতো তাঁর পরিবারকে বিদায় জানাল।

ওরা চলে গেলে, আকসিনভ এতক্ষণ ধরে যেসব কথা হয়েছে সেগুলোকে মনে করতে লাগল, যখন মনে পড়ল তার বউও তাকে সন্দেহ করছে, সে আপন মনে বলল, “মনে হচ্ছে শুধু ঈশ্বরই সত্য জানতে পারে; শুধু তার কাছেই পুনর্বিচারের প্রার্থণা করা উচিৎ, শুধু তার কাছে থেকেই করুণা আশা করা উচিৎ।

এরপর আকসিনভ আর কোন আবেদন লিখল না, সব আশা ছেড়ে দিল, শুধু ঈশ্বরের কাছে প্রার্থণা করে গেল।

আকসিনভকে চাবুক দিয়ে পেটানোর শাস্তি দেওয়া হলো এবং খনিতে পাঠানো হল। একটা গিঁট বাঁধা চাবুক দিয়ে তাঁকে পেটানো হল, এবং যখন গিঁটের আঘাতে সৃষ্ট ক্ষত সেরে উঠল, তাঁকে অন্যান্য কয়েদির সাথে সাইবেরিয়ায় পাঠানো হল।

ছাব্বিশ বছর ধরে কয়েদি হিসেবে আকসিনভ সাইবেরিয়ায় কাটাল। তুষারের মত সাদা হয়ে উঠল তার চুলগুলো, দাড়ি লম্বা, চিকন ও ধূসর হয়ে গেল। তার সব আনন্দ উচ্ছলতা হারিয়ে গেল, নিজেকে ছোট করে ফেলল, হাঁটত ধীরে ধীরে, কম কথা বলত, কখনো হাসত না, কিন্তু প্রায় সব সময় প্রার্থণা করত।
বন্দী থাকার সময় আকসিনভ বুট জুতো বানানো শিখল, অল্প কিছু টাকা যা আয় করল তা দিয়ে ‘দ্য লাইভস অব দ্য সেইন্টস’ বইটি কিনল। জেলখানায় যখন পর্যাপ্ত আলো থাকত, তখন সে এই বইটি পড়ত; রবিবারে জেলখানার গীর্জায় বাইবেল থেকে অনুচ্ছেদ পাঠ করত এবং ধর্মসঙ্গীত গাইত; তখনো তার কণ্ঠস্বর অনেক ভালো ছিল।

আকসিনভের নম্রতা আর ধৈর্য্যশীলতার জন্য কারাকর্তৃপক্ষ তাকে পছন্দ করত, তাঁর সহ-কয়েদিরা তাঁকে সম্মান করত; ‘গ্রান্ডফাদার’ ও ‘দ্য সেইন্ট’ নামে ডাকত। যখন তাঁরা কর্তৃপক্ষের কাছে কোন বিষয়ে আবেদন করতে চাইত, সব সময় আকসিনভকে তাঁদের মুখপাত্র বানাত। যখন কয়েদিদের মধ্যে ঝগড়া বেঁধে যেত, সঠিক জায়গা মনে তাঁরা তাঁর কাছে আসত, বিষয়টির বিচার করার জন্য।

আকসিনভের বাড়ি থেকে কোন খবর পৌঁছত না, এমনকি সেও জানত না তাঁর বউ ও ছেলেরা এখনো বেঁচে আছে কিনা।

একদিন এক দল নতুন কয়েদি এলো জেলখানায়। সন্ধ্যায় পুরনো কয়েদিরা নতুনদের চারিদিকে সমবেত হল, তাঁদের কাছে জানতে চাইল তাঁরা কোন শহর বা গ্রাম থেকে এসেছে, কিসের জন্য তাঁদের দণ্ড দেওয়া হয়েছে। আকসিনভ নতুনদের কাছেই বসেছিল, মাথা নিচু করে কথা শুনছিল।

নতুনদের মধ্যে এক জন কয়েদি, ষাট বছর বয়সী, লম্বা, শক্তপোক্ত মানুষ, ঘন করে ছাঁটা ধূসর দাড়ি, অন্যদেরকে বলছিল কিসের জন্য তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।

“বেশ, বন্ধুরা,” সে বলল, “স্লেজ গাড়ির সাথে বাঁধা একটা ঘোড়া নিয়েছিলাম শুধু, এরপর গ্রেপ্তার হলাম আমি, আমাকে চুরির দায়ে অভিযুক্ত করা হল। বললাম, শুধু দ্রুত বাড়ি ফেরার জন্য এটি নিয়েছিলাম, বাড়ি ফিরে এটিকে চলে যেতে দিতাম আমি; এছাড়া, ঘোড়সওয়ার ছিল আমার ব্যক্তিগত বন্ধু। তাই আমি বললাম, ‘সব ঠিক আছে।’ ‘না,” তাঁরা বলল, “তুমি এটা চুরি করেছ।’ কিন্তু কিভাবে ও কোথায় আমি চুরি করেছি তাঁরা বলতে পারল না। একটা সময় আমি সত্যি কিছু ভুল করেছিলাম, আইন অনুসারে এখানে আমার অনেক আগেই আসা উচিৎ ছিল, কিন্তু সেই সময়ে আমাকে খুঁজে পায় নি। আমাকে এখন এখানে পাঠানো হলো একেবারে অকারনেই…এহ, আমি আপনাদেরকে মিথ্যে বলেছি; আমি সাইবেরিয়াতে এর আগেও এসেছি, কিন্তু আমি দীর্ঘ সময় থাকি নি।”

“আপনি কোথা থেকে এসেছেন?” কেউ একজন জানতে চাইল।
“ভ্লাদিমির থেকে। আমার পরিবার ঐ শহরেই থাকে। আমার নাম মাকর, আর পরিবারের লোকেরা আমাকে সেমিওনিচ নামেও ডাকে।”

আকসিনভ মাথা তুলে বলল, “আমাকে বলুন, সেমিওনিচ, আপনি কি ভ্লাদিমিরের আকসিনভ ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে কিছু জানেন? তাঁরা কি এখনো বেঁচে আছে?”

“তাদের সম্পর্কে জানি কিনা? অবশ্যই জানি আমি। আকসিনভেরা ধনী, যদিও তাঁদের বাবা সাইবেরিয়া থাকে; আমাদের মতই একজন অপরাধী, আমার ধারণা! আপনার কথা বলুন, গ্রান’ড্যাড, আপনি এখানে কিভাবে এসেছেন?”

আকসিনভ তাঁর দুর্ভাগ্য নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে না। শুধু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আমার পাপের কারনে এই ছাব্বিশ বছর ধরে বন্দী আছি আমি।”

“কি পাপ?” জানতে চাইল মাকর সেমিওনিচ।

আকসিনভ শুধু বলল, “বেশ, বেশ – এটা আমার প্রাপ্যই ছিল।” সে আর কিছু বলল না, কিন্তু তাঁর সাথীরা নতুনদেরকে বলল কিভাবে আকসিনভ সাইবেরিয়ায় এলো, কিভাবে কেউ একজন ব্যবসায়ীকে খুন করেছিল, এবং আকসিনভের মালপত্রের মধ্যে ছুরিটি রেখেছিল, আর আকসিনভ অন্যায়ভাবে দণ্ড পেল।

মাকর সেমিওনিচ এটা শুনে আকসিনভের দিকে তাকাল, নিজের হাঁটুতে চপেটাঘাত করে বিস্ময় নিয়ে বলল,”বেশ, এটা বিস্ময়কর! সত্যিই বিস্ময়কর! কিন্তু আপনি কতটা বুড়িয়ে গেছেন গ্রান’ড্যাড!”

অন্যরা তাঁকে জিজ্ঞেস করল কেন সে এত আশ্চর্য হল, আকসিনভকে আগে কোথায় দেখেছে কিনা; কিন্তু মাকর সেমিওনিচ কোন উত্তর দিল না। সে শুধু বলল, “এটা বিস্ময়কর, আমাদের এখানে দেখা হয়ে গেল, বৎস্য!”

এই কথাগুলো আকসিনভকে বিস্মিত করল, হয়ত এই লোকটি জানে কে ব্যবসায়ীকে খুন করেছিল; তাই সে বলল, “সেমিওনিচ, সম্ভবত, এই বিষয়ে আপনি শুনেছিলেন, অথবা আপনি আমাকে আগে হয়ত দেখেছেন?”

“আমি কিভাবে শুনব? এই পৃথিবীটা গুজবে ঠাসা। কিন্তু এটা অনেক আগের কথা, আমি যা শুনেছিলাম ভুলে গেছি।”

“সম্ভবত আপনি শুনেছিলেন কে ব্যবসায়ীকে খুন করেছিল?” জানতে চাইল আকসিনভ।

মাকর সেমিওনিচ হেসে উত্তর দিল, “এটা অবশ্যই সে যার ব্যাগে ছুরিটি পাওয়া গেছে!
যদি কেউ সেখানে ছুরিটি লুকিয়ে রাখে, প্রবাদে বলে ‘যতক্ষণ পর্যন্ত সে ধরা না পড়ে সে চোর নয়।’ কিভাবে কেউ একজন আপনার ব্যাগে ছুরিটি রাখতে পারল, যখন এটা আপনার মাথার নিচে ছিল? এটা অবশ্যই আপনাকে জাগিয়ে তুলত।”

আকসিনভ এই কথাগুলো শুনে নিশ্চিত হয়ে গেল, এই সেই লোক যে ব্যবসায়ীকে হত্যা করেছে। সে উঠে চলে গেল। সারাটা রাত আকসিনভ বিছানায় শুয়ে জেগে রইল। ভয়ানক অসুখী বোধ করল, সব ছবি তার মনে জেগে উঠল। তাঁর বউয়ের ছবি, বউয়ের কাছে থেকে বিদায় দিয়ে মেলায় যাচ্ছিল সে ছবি। সে তাঁকে দেখল, যেন সে এখানেই আছে; তাঁর মুখ, চোখ দুটি চোখের সামনে ভেসে উঠল; সে তাঁর কণ্ঠ, তাঁর হাসি শুনতে পেল। এরপর সে তাঁর ছেলেদেরকে দেখল, সেই সময়ে ওরা ছিল বেশ ছোট; একজন ছোট আলখেল্লা পড়া, অন্যজন মায়ের কোলে। আর এরপর, নিজেকে মনে পড়ল, তাঁর থাকার কথা ছিল তরুন ও প্রফুল্ল। তাঁর মনে পড়ল কিভাবে সে সরাইখানার বারান্দায় বসে গিটার বাজাচ্ছিল, যেখানে সে গ্রেপ্তার হয়েছিল, সে কতটা দুশ্চিন্তা মুক্ত ছিল। তাঁর মনে ভেসে উঠল, সেই জায়গা যেখানে তাঁকে চাবুক দিয়ে পেটানো হয়েছিল, যে চাবুক মেরেছিল, তাঁকে ঘিরে দাঁড়ানো লোকগুলো; সেই শিকল, সেই সব কয়েদি, তাঁর বন্দী জীবনের সেই ছাব্বিশ বছর, তাঁর অকাল বার্ধক্য। এই সব ভাবনায় নিজেকে এত হতভাগা মনে হলো, সে নিজেকেই নিজে হত্যা করতে তৎপর হয়ে উঠল।

“ঐ বদমায়েশটার জন্যই এত কিছু!” আকসিনভ ভাবল। মাকর সেমিওনিচের বিরুদ্ধে তাঁর এত ভয়ানক রাগ হল, সে প্রতিশোধ নেবার আকাঙ্ক্ষা করল, এমনকি এর জন্য নিজেকে ধ্বংস করে দিয়ে হলেও। সে সারা রাত বার বার প্রার্থণা করল, কিন্তু কোন শান্তি পেল না। দিনের বেলা সে মাকর সেমিওনিচের কাছেও ঘেঁষল না, এমনকি তাঁর দিকে তাকালও না।

এভাবে এক পক্ষকাল কেটে গেল। আকসিনভ রাতে ঘুমাতে পারত না, অবস্থা এতই দুর্বিষহ হয়ে উঠল, সে বুঝতে পারল না কি করবে।

এক রাতে সে হাঁটাহাটি করছিল, সে খেয়াল করল জেলখানায় বন্দীরা যে তাকগুলোতে ঘুমায় তার একটির নিচ থেকে কিছু মাটি গড়িয়ে আসছে। কী ঘটছে এটা জানার জন্য সে থামল। তাকের নিচ থেকে হটাৎ মাকর সেমিওনিচ হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এলো, আতঙ্কিত চেহারা নিয়ে আকসিনভের দিকে তাঁকাল সে। আকসিনভ তাঁর দিকে না তাকিয়েই পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইল, কিন্তু মাকর তাঁর হাত ধরে ফেলল, বলল, সে দেয়ালের নিচে একটা গর্ত খুঁড়েছে, আলগা মাটিগুলো তার উঁচু বুট দুটোতে ভরত, এবং প্রতিদিন রাস্তায় এসে খালি করত, যখন বন্দীদেরকে কাজের জন্য নিয়ে সা হতো।

“বুড়ো, আপনি একদম চুপ করে থাকবেন, তাহলে আপনিও বেরিয়ে যেতে পারবেন। যদি আপনি বোকার মতো ফাঁস করে দেন, ওরা চাবকিয়ে আমার জীবন বের করে নিবে, তবে এর আগেই আমি আপনাকে খুন করব।”

আকসিনভ রাগে কাঁপছিল যেন সে তার শত্রুর দিকে তাকাচ্ছিল। সে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “আমার পালানোর ইচ্ছে নেই, আর আমাকে হত্যা করার প্রয়োজন নেই আপনার; আপনি আমাকে অনেক আগেই হত্যা করেছেন। আপনাকে শুধু এটুকুই বলার আছে — ঈশ্বর যেভাবে নির্দেশনা দেবে আমি তাই করব অথবা করব না।”

পরের দিন, যখন কয়েদিদেরকে কাজের জন্য বাইরে নিয়ে আসা হল, নিরাপত্তারক্ষী সৈনিকরা লক্ষ্য করল, বন্দীদের ভিতরে কেউ একজন বা অন্য কেউ তার বুট জুতো দুটি দিয়ে কিছু মাটি এনে ফেলেছে। জেলখানা তল্লাশি করে একটা সুড়ঙ্গ খুঁজে পাওয়া গেল। গভর্নর এসে কে গর্ত খুঁড়েছে এটা বের করার জন্য সকল বন্দীকে জেরা করল। সকলেই অস্বীকার করল এই বিষয়ে কোন জানাশোনার ব্যপারে। যে জানত, সে মাকর সেমিওনিচের সাথে বিশ্বাসভঙ্গ করল না, জানত তাঁকে প্রায় মৃত্যু পর্যন্ত চাবুক দিয়ে পিটানো হবে। অবশেষে গভর্নর আকসিনভের দিকে ফিরল, যাকে সে জানত একজন ন্যায়পরায়ণ মানুষ হিসেবে, বলল, “আপনি একজন বিশ্বস্ত বৃদ্ধ মানুষ; ঈশ্বরকে সামনে রেখে আমাকে বলুন, কে গর্ত খুঁড়েছে?”

মাকর সেমিওনিচ এমনভাবে দাঁড়িয়েছিল যেন সে মোটেই সংশ্লিষ্ট নয়, আকসিনভের দিকে বেশি একটা পলক না ফেলে বরং গভর্নের দিকে চেয়ে রইল। আকসিনভের ঠোঁট ও হাত কেঁপে উঠল, এবং অনেকক্ষণ ধরে সে একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারল না। সে ভাবল, “কেন আমি তাঁকে আড়াল করব যে আমার জীবনটা ধ্বংস করে দিল? আমি যেই কষ্ট সয়েচি সেটা তাঁকে পরিশোধ করে দিতে দেওয়া হোক। কিন্তু আমি যদি বলে দেই, তাঁরা হয়ত চাবুকপেটা করে তাঁর জীবন বের করে দেবে, হয়তবা আমি তাঁকে ভুলভাবে সন্দেহ করছি। আর, সব শেষে, এতে আমার কী ভালো হবে?”

“বেশ, বুড়ো,” গভর্নর পুনরায় জানতে চাইল,”আমাকে সত্যি করে বলুন; দেয়ালের নিচে কে খুঁড়েছে?”
আকসিনভ মাকর সেমিওনিচের দিকে এক পলক তাকাল, বলল, “মহামান্য, আমি বলতে পারি না। এটা ঈশ্বরের ইচ্ছে নয় যেন আমি বলি! আমাকে নিয়ে যা ইচ্ছা তাই করুন; আমি আপনার হাতে।”

যাইহোক, গভর্নর অনেক চেষ্টা করল! আকসিনভ কিছুই বলল না আর, তাই বিষয়টা এখানেই পড়ে রইল।

সেদিন রাতে, যখন আকসিনভ তার বিছানায় শুয়ে মাত্রই ঘুমে ঢুলে পড়তে শুরু করেছে, কেউ একজন নীরবে এসে তার বিছানার উপর বসল। সে অন্ধকারের মধ্যে অর্ধনিমীলিত চোখে তাকিয়ে মাকরকে চিনতে পারল।

“আমার কাছে আপনি আর কী চান?” জিজ্ঞাসা করল আকসিনভ। “কেন আপনি এখানে এসেছেন?”

মাকর সেমিওনিচ চুপ করে রইল। তাই আকসিনভ উঠে বসল, বলল, “আপনি কী চান? চলে যান, অথবা আমি গার্ড ডাকব!”

মাকর সেমিওনিচ ঝুঁকে আকসিনভের আরও কাছে গেল, একান্তে বলল, “ইভান দিমিত্রিচ, আমাকে ক্ষমা করে দিন!”

“কিসের জন্য?” জিজ্ঞেস করল আকসিনভ।

“আমিই সে যে ব্যবসায়ীকে খুন করেছিল এবং আপনার জিনিসপত্রের মধ্যে ছুরি লুকিয়ে রেখেছিল। আমি আপনাকেও হত্যা করতে গিয়েছিলাম, কিন্তু বাইরে একটা শব্দ শুনলাম, তাই আপনার ব্যাগে ছুরিটি লুকিয়ে জানালা দিয়ে পালিয়ে যাই।”

আকসিনভ চুপ করে রইল, বুঝতে পারছিল না কি বলবে। মাকর সেমিওনিচ দ্রুত বিছানা থেকে নেমে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসল। “ইভান দিমিত্রিচ,” সে বলল, “আমাকে ক্ষমা করে দিন! ঈশ্বরের ভালোবাসার দোহাই, আমাকে ক্ষমা করে দিন! আমি অপরাধ স্বীকার করে বলব, আমিই সে যে ব্যবসায়ীকে খুন করেছে, আর আপনি মুক্তি পেয়ে আপনার বাড়ি চলে যেতে পারবেন।”

“এটা বলা আপনার জন্য সহজ,” আকসিনভ বলল, “কিন্তু আমি যন্ত্রণা সয়েচি এই ছাব্বিশ বছর ধরে। আমি এখন কোথায় যেতে পারব? … আমার বউ মরে গেছে, আর আমার ছেলেরা আমাকে ভুলে গেছে। আমার কোথাও যাবার নেই…”
মাকর সেমিওনিচ উঠল না, মাথা দিয়ে মেঝেতে আঘাত করতে লাগল। “ইভান দিমিত্রিচ, আমাকে ক্ষমা করে দিন!” সে কেঁদে ফেলল, “যদি তাঁরা আমাকে গিঁট বাঁধা চাবুক দিয়ে মারত সেটা সহ্য করা এত কঠিন ছিল না, যতটা না আপনাকে দেখে এখন হচ্ছে… এত কিছুর পরও আপনি আমাকে করুণা করলেন, আর কিছুই বললেন না। যিশু খ্রিস্টের দোহাই আমাকে ক্ষমা করে দিন, কতটা জঘন্য আমি!” ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল সে।

যখন আকসিনভ তার ফুঁপিয়ে কান্না শুনতে পেল, সেও চোখের পানি ফেলে বলল, “ঈশ্বর আপনাকে ক্ষমা করে দিবেন! হয়ত আমি আপনার চেয়েও শতগুণ খারাপ লোক।” আর এই কথা বলার পর তার হৃদয় হালকা হয়ে এলো, বাড়ি ফেরার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তার পিছে পড়ে রইল। এই জেলখানা ছেড়ে যাওয়ার আর কোন ইচ্ছে তার রইল না, শুধু তার শেষ সময় আসার আশায় পড়ে রইল।

আকসিনভ যা বলেছিল তা সত্ত্বেও, মাকর সেমিওনিচ তার অপরাধ স্বীকার করে নিল। কিন্তু তার মুক্তির আদেশ যখন এলো, ততক্ষণে আকসিনভ মরে গেছে।

Saturday, December 2, 2017

এইজ অফ ইউরোপিয়ান ডিসকভারি - ২


আটলান্টিক মহাসাগর সম্পর্কে ইউরোপে তখন চাউর ছিল হাজার রকম গুজব।
গভীর কুয়াশা আর অন্ধকারাচ্ছন্ন এই সাগরের গভীরে নাকি ড্রাগন,ক্র্যাকে
ন,হাইড্রা সহ হাজারটা দানবের বাস।বুড়োরা বলতো,এই সাগরের কোন শেষ নেই।
স্পেন বা পর্তুগাল থেকে তাই কোন জাহাজই পশ্চিমে বেশিদুর যেতে রাজি হত না।পশ্চিমে গেলেই সর্বনাশ।
কলম্বাস যখন পর্তুগালের রাজা জনের কাছে গেলেন,তখন এসবের সাথে সাথে জন আরেকটা কথাও ভাবলেন,পশ্চিমে যেতে যেতে সে যদি জাহাজ নিয়ে সূর্য ডোবার জায়গাটা পার হয়ে যায় তাহলে তো সে আর কোনদিনই ফিরে আসতে পারবে না,তখন যে টাকা পয়সা খরচ করে তাকে আমি পাঠাবো,সেটার কি হবে!!
মূলত এই চিন্তা করেই তিনি কলম্বাসকে পশ্চিমে পাঠানোর জন্য ফাণ্ডিং করতে রাজি হলেন না।কস্ট-বেনিফিট
ে পোষানোর কোন সম্ভাবনাই নাই এমন প্রজেক্টে ইউরোপিয়ান রাজারা হাত দেয়া বাদ দিয়েছেন ফিফটিন্থ সেন্ঞুরির মাঝামাঝি থেকেই।
কলম্বাস যখন পর্তুগীজ রাজার কাছ থেকে ফাণ্ডিং পেলেন না,তখন তাকে যেতে হল স্পেনের রানী ইসাবেলার দরবারে।
তার পশ্চিম দিক থেকে ভারতে যাবার পাগলাটে পরিকল্পনাটা প্রথম প্রথম রাণীর ভাল না লাগলেও একটা পর্যায়ে এসে রাণী ভাবলেন,এক দান জুয়া খেলাই যায়।
অন্ধকার বিপজ্জনক সাগরে হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়া নাবিককে ফাণ্ডিং করা যে সে জুয়া না।এই জুয়া খেলতে ইউরোপ রাজি হওয়ার পেছনে মূল কারন ছিল দুটো।
এক নম্বর কারন,ক্রুসেড আর রিকনকুইস্তায় খরচ করতে করতে ইউরোপের স্টকে সোনা রুপার অভাব পড়ে গেছিল মারাত্মক রকম।ইটালিয়ান ব্যাংকগুলো পোপ আর সম্রাটদের চাহিদা মেটাতে মেটাতে মোটামুটি ফতুর।তার ওপর ইউরোপের মহাজন ছিল ইহুদীরা।তাদের কাছ থেকে ধার কর্জ নিতে নিতে ইউরোপের অর্থনীতি পুরোপুরি ইহুদীদের পকেটে চলে যাচ্ছিল।
তারপরও পূর্বে অটোমান আর পশ্চিমে বার্বারদের মোকাবেলা করতে সম্রাট ও চার্চের প্রয়োজন ছিল নতুন সোনা-রুপার মজুদের,যা দিয়ে তারা মুদ্রা বানিয়ে বড় সেনাবাহিনী পুষতে পারেন।
দুই নম্বর কারন ছিল,মসলা।
ইউরোপের শীতকাল ভীষন রকম লম্বা।অক্টোবর থেকে মার্চ পর্যন্ত শীত,এপ্রিল-মে যাকে তারা বসস্ত বলে ওটাও নেহায়েত কম ঠাণ্ডা না।
মোট কথা,বছরে আটমাসই ইউরোপ থাকে ঠাণ্ডা।এই আট মাসের ছয় মাস ঘর থেকে বের হওয়াই দায়।এসময়টার জন্য সবাই ঘরে খাবার মজুদ করে রাখতো।সে সময়কার প্রধান মজুদ খাবার ছিল গোশত।
টানা ছয় মাস গোশতকে মজুদ করে রাখার পর তা খাবার উপযোগী করতে তাদের প্রয়োজন হত মশলার।এই মশলা আমদানির মনোপলি ছিল ভেনিসের।
অটোমানদের ট্যাক্স দিতে দিতে ভেনিসের তখন নাই নাই অবস্থা।
স্পেন-পর্তুগাল ভালমতই বুঝলো,পূর্বদিক দিয়ে তাদের জাহাজকে অটোমানরা ব্যবসা করতে দেবে না।কিন্তু যেহেতু দুনিয়াটা গোল,আর আফ্রিকাটার পূর্বে ভারত,কোনমতে আফ্রিকাটা ঘুরে পূর্বে পোছালেই ভারতে যাওয়া সম্ভব।
এই ধারনা বাস্তবে রুপ দেয়ার নথে প্রথম পদক্ষেপটা নেন পর্তুগীজ রাজা হেনরি দ্যা নেভিগেটর।
তিনি ইতালি,স্পেন,ফ্রান্স,পর্তুগাল,জ
ার্মানী,হল্যাণ্ড,মরক্কো,তিউনিস
িয়া,আলজেরিয়া ছেঁকে চ্যাম্পিয়ন সব নেভিগেটর,নাবিক,মেরিন ইন্জিনিয়ারদের নিয়ে আসেন,তেরি করেন এক রয়্যাল মেরিটাইম স্কুল।
এই স্কুল থেকে বের হতে থাকে দারুন সব আইডিয়া।গ্রীকো-রোমান আমলের নেভাল নলেজের সাথে তারা ইসলামিক সায়েন্সের ফিউশন ঘটায়,আল খাওয়ারিজমীর সুরত আল আরদ,আল ইদ্রিসীর তাবুলা রজারিয়াস,খাওয়ার
িজমীর অ্যাস্ট্রোল্যাব আর অ্যালজেব্রা,সেই সাথে আল বেরুনির ত্যিকোণমিতিকে তারা দারুণভাবে বশে এনেছিল,সেই সাথে অনেক ভুলত্রুটি শুধরে সেগুলোকে দিয়েছিল তখনকার সময়ের সবচাইতে অ্যাডভান্সড রুপ।
এরসাথে তারা ব্যবহার করতে শিখেছিল গ্রহ-নক্ষত্র দিয়ে সমুদ্রে নিজেদের অবস্থান বোঝার আরব টেকনোলজি ইফিমেরিস।
হেনরি মারা গেলেও তার বংশধররা স্কুলের ফাণ্ডিং বজায় রাখলেন।
সোনার ডিম পাড়া রাজহাস তার প্রথম ডিমটা দিল ১৪৮০ সালের দিকে।
দুই ধরনের স্পেশাল জাহাজ বানিয়ে ফেললো পর্তুগীজ রাজা জনের মেরিন ইন্জিনিয়াররা।
একটাকে বলা হত ক্যারাভেল,আরেকট
াকে বলা হত নাও।
ক্যারাভেল ছিল তখনকার সময়ের যে কোন জাহাজের চাইতে অনেক বেশি দ্রুতগতির।সামান্যতম বাতাসকেও এই জাহাজ কাজে লাগাতে সক্ষম ছিল।
ক্যারাভেলের এই তাক লাগানো গতির পেছনে মূল নায়ক ছিল পাল।এর আগ পর্যন্ত জাহাজে যে পাল খাটানো হত সেগুলো ছিল চারকোণা,ক্যারাভেলই প্রথম জাহাজ যাতে তিনকোণা ল্যাটিন পাল ব্যবহার করা হয়।
আর নাওগুলো ছিল একেকটা দানব।একেকটা নাও বহন করতে পারতো পাচশো থেকে দুই হাজার টন পর্যন্ত বিপুল ওজন,যা তখনকার যুগে ছিল এক বিস্ময়।বড় বড় কামানগুলো অনায়াসে লুকিয়ে রাখা যেত নাওয়ের ভেতরের কম্পার্টমেন্টে।
সেই সাথে ইউরোপের পশ্চিমে তখন আবিষ্কৃত হয়েছিল যুগান্তকারী এক ফুড টেকনোলজির।
তখনও মানুষ জানতো না যে লবণ দিয়ে ডিহাইড্রেটেড করে মাসের মাস ধরে খাবার তরতাজা রাখা যায়।
যখন এই টেকনোলজি পর্তুগীজরা পেয়ে গেল,তখন তাদের দুর দুরান্তে অভিযান চালাতে আর একটা মাত্রই বাধা রইলো,সেটা হল ফাণ্ডিং।
এই ফাণ্ডিংটা তখনকার স্পেন-পর্তুগালে
র রাজারা করতে রাজি হয়েছিলেন বলেই দুঃসাহসী নাবিকেরা বারবার বেরিয়ে পড়েছেন সমুদ্রজয়ে।
১৪৮৯ তে বার্থেলোমিউ ডায়াজের কেইপ অফ গুড হোপ জয় করার পর থেকে ১৫০০ সালে ক্যাব্রালের ব্রাজিলে নোঙ্গর করা,এর মধ্যে পর্তুগীজ-স্প্যানিশরা আবিষ্কার করে ফেলে পৃথিবীর দুই নতুন দিগন্ত,পূর্ব আর পশ্চিম,আবিষ্কার করে সম্পদে পরিপুর্ন সম্পুর্ন অজানা এক মহাদেশ,যার নাম তারা দিয়েছিল নতুন পৃথিবী।
ইউরোপ যেভাবে নতুন করে জগতটাকে আবিষ্কার করেছিল,তার মূলে ছিল রেনেসার যুগের সবকিছুকে নতুন করে দেখার আগ্রহ,আর এই আগ্রহের জন্ম দিয়েছিল তাদের তীব্র প্রয়োজন।ক্রুসেড করে করে,আর মসলার ব্যবসায় লালবাতি জ্বালিয়ে,দুশো বছরের ব্ল্যাক ডেথকে মোকাবেলা করে ইউরোপের এই ঘুরে দাড়ানোর গল্প চিরদিনের জন্য অবিস্মরনীয় হয়ে থাকবে পৃথিবীর ইতিহাসে।
ইউরোপ কেন মুসলিমদের সায়েন্স অ্যাণ্ড টেকনোলজিকে আপডেট করে ঘুরে দাড়াতে পারলো,মুসলিমরা কেন পারলো না,তার পেছনের মুল কারন তিনটা।
এক.প্রয়োজন
দুই.নতুন করে জগতকে জানার ইচ্ছা
তিন.পলিটিক্যাল উইল আর সবকিছুকে কস্ট বেনিফিট মডেলে ফেলার ইকনোমিক চিন্তা ভাবনা।

 

উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ...

পদার্থবিজ্ঞানের আলোকে সময় ভ্রমণ


সময় ভ্রমণ নিয়ে আমাদের কল্পনা কম নয়। এই ধারণাটাই আমাদের গায়ের লোম খাড়া করে দেয়। এই সময় ভ্রমণ নিয়ে আলোচনা করার মত অনেক দিক আছে। সম্ভব কিনা, সম্ভব হলে কোন দিকে (অতীতে নাকি ভবিষ্যতে) বা কীভাবে, ইত্যাদি। আমরা এখনো সময় ভ্রমণ সম্ভব করতে পারিনি। তবে এটা নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত কল্পনা করতে পারছি ঠিকই। আসুন, ঠিক তেমন কিছু দিক নিয়ে আমরা আলোচনা করি।

পিতামহ স্ববিরোধ (Grandfather Paradox)


স্টিফেন হকিং একবার বলেছিলেন, ভবিষ্যৎ থেকে যদি কোনো আগন্তুক এসে থাকে, তবে তারা এখন কোথায়? হ্যাঁ, হকিং সময় ভ্রমণের কথাই বলেছেন, তবে একটু ভিন্নভাবে। ভবিষ্যৎ থেকে অতীতে, অর্থাৎ ভবিষ্যৎ থেকে আমাদের সময়ে আসার কথা বলা হচ্ছে, কারণ ভবিষ্যতের মানুষ টাইম মেশিন আবিষ্কার করে ফেলতেও পারে। অতীতে যে সেরকম কিছু হয়নি সেটা আমরা বেশ ভালোই জানি। তাই অতীতের মানুষগুলোর এখন তথা আমাদের এই সময়ে ভ্রমণ করতে আসার সম্ভাবনা পুরোপুরি বাতিল করে দেয়া যায়। তবে বিজ্ঞানীরা কিন্তু অতীতের তুলনায় ভবিষ্যতে যাওয়ার বিষয়টিকে বেশি প্রাধান্য দেন। তার একটি কারণ হচ্ছে পিতামহ স্ববিরোধ। এই স্ববিরোধে বলা হচ্ছে, কেউ যদি অতীতে গিয়ে তার পিতা জন্মাবার আগেই পিতামহকে হত্যা করে, তবে তো সব হিসাব-নিকাশই ওলটপালট হয়ে যাবে। বাবার বংশগতির ধারক সেই কেউ একজন তাহলে পৃথিবীতে এলো কীভাবে?



পিতামহ স্ববিরোধ আসলে কোনো সমস্যাই না, যদি মহাবিশ্বের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটনাগুলোকে পূর্বনির্ধারিত ও অপরিবর্তনশীল ধরা হয়। বিষয়টিকে একটু বুঝিয়ে বলা যাক।

দেড় ঘণ্টার একটি সিনেমার কথাই ধরুন। আপনি সিনেমাটি দেখুন আর না-ই দেখুন, সিনেমার দৃশ্যের কোথাও কোনো পরিবর্তন হবে না। ধারণ করার পর যেভাবে চূড়ান্ত সম্পাদনা করা হয়েছে, ঠিক সেভাবেই থাকবে। অর্থাৎ আপনি কোনোভাবেই সিনেমার উপর আপনার নিজের প্রভাব খাটাতে পারবেন না।

সময়ে সংঘটিত ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আপনি অতীতে গিয়েও অবশ্যম্ভাবী কোনো ঘটনাকে পরিবর্তন করে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন না। যা ঘটার, তা ঘটবেই। আপনি হয়তো অতীতে গিয়ে আপনার পিতামহের সাথে কোনো এক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়লেন এবং আপনার পকেটে রাখা রিভলবারটি বের করে ট্রিগারও চাপলেন। কিন্তু হয়তো দেখা যাবে, রিভলবারের গুলি শেষ হয়ে গিয়েছে অথবা কোনো এক অজানা কারণে রিভলবারটি ঠিকমতো কাজ করছে না। অর্থাৎ আপনার পিতামহকে বাঁচানোর সকল বন্দোবস্ত যেন আগে থেকেই হয়ে রয়েছে!

আলোর চেয়ে বেশি বেগে ছোটার মাধ্যমে সময় ভ্রমণ


তাছাড়া আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বে আলোর বেগ একটি সীমা নির্দেশ করে, যে সীমানাটাকে অতিক্রম করতে পারলে হয়তো সময়ের পেছনের দিকে যাওয়া সম্ভবপর হতে পারে। কিন্তু আজ অব্দি সে রকম কোনো সম্ভাবনা দেখা যায়নি। আবার বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বেরই আরেকটি সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে ভ্রমণ করে যদি ভ্রমণকারীর সময়ের গতিকে ধীর করে দেয়া যায়। ফলে আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে সোজা মহাকাশের দিকে নভোযানকে চালিত করে যদি পুনরায় পৃথিবীতে ফিরে আসা যায়, তবে পৃথিবীতে অতি অগ্রসরমান এক জীবন ব্যবস্থা দেখা যেতে পারে। নভোচারীর সম্পূর্ণ ভ্রমণের সময়কাল তার নিজের ঘড়ি অনুযায়ী যদি কয়েক দশক হয়, তবে পৃথিবীতে হয়তো শত বছর পার হয়ে যাবে। নভোচারী তার মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারায় পৃথিবীতে ফিরে তার রেখে যাওয়া সমাজ ব্যবস্থাকেই আশা করবে, যদিও সে দেখবে অন্য এক পৃথিবীকে। এটাকে “ভবিষ্যতে গমন” ছাড়া আর কীই বা বলা যেতে পারে?

মহাকর্ষের মাধ্যমে সময় ভ্রমণ


সময়ের সাথে মহাকর্ষের একটা দড়ি টানাটানির মত সম্পর্ক। মহাকর্ষ যত বেশি, সময় তত ধীরে চলবে। আর মহাকর্ষ কম হলে সময় চলবে অপেক্ষাকৃত দ্রুত। তাই, কৃষ্ণগহ্বরের কাছাকাছি কোনো জায়গায়, যেখানে মহাকর্ষ অনেক বেশি, সেখানে অবস্থান করলে দেখবেন পৃথিবীর চেয়ে আপনার সময় অনেক ধীরে কেটেছে। ধরুন, আপনার কাছে মনে হচ্ছে একদিন পেরিয়েছে। ওদিকে পৃথিবীতে চলে গেছে শত বছর। অর্থাৎ, কৃষ্ণগহ্বরের কাছাকাছি গিয়েও সময় ভ্রমণের অনুরূপ অভিজ্ঞতা অর্জন করা সম্ভব। এটা মূলত মহাকর্ষজনিত সময় প্রসারণের ফল।

সমান্তরাল মহাবিশ্বে ভ্রমণের মাধ্যমে সময় ভ্রমণ


চিরায়ত পদার্থবিদ্যা এমন যে, কিছু সূত্র, স্বীকার্য আর গাণিতিক নিয়মের অধীনে কোনো একটি ঘটনার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে, অথবা ঘটনার পূর্ববর্তী অবস্থাটি কী ছিলো, সেটা নিশ্চিতভাবে বলে দেয়া যায়। অর্থাৎ চিরায়ত পদার্থবিদ্যার জগত হচ্ছে নিশ্চয়তার জগত।

আমাদের শরীর অসংখ্য কণার সমষ্টি। চিরায়ত পদার্থবিদ্যা অনুসারে এসকল কণার প্রতিটি চলাচলও পদার্থবিদ্যার নিয়ম অনুসারে পূর্বনির্ধারিত। ফলে আমাদের নিজেদের স্বাধীন ইচ্ছাকেও অনেক সময় জলাঞ্জলি দিতে হয়। অপরদিকে কোয়ান্টাম তত্ত্বে, বিশেষ করে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতি প্রকাশিত হওয়ার পর প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এখানে প্রকৃতি এবং পর্যবেক্ষক – উভয়ই একটি সিস্টেমের অংশ এবং এদেরকে আলাদা করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। ফলে পূর্বনির্ধারণ বা কঠোরভাবে অপরিবর্তনশীলতার কোনো সুযোগ এখানে নেই।

কোয়ান্টাম তত্ত্বানুসারে বহু মহাবিশ্বের (Multi universe) সম্ভাবনাকে পুরোপুরি বাতিল করে দেয়া যায় না। বহু মহাবিশ্বের ধারণা থেকেও অতীত ভ্রমণের যৌক্তিকতা তুলে ধরা যায়। এক্ষেত্রে আপনি অতীতে গেলেন এবং আপনার পিতামহকে হত্যাও করলেন – কোনো সমস্যা নেই। তবে ঘটনাটি ঘটবে কোনো এক সমান্তরাল মহাবিশ্বে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে আপনাকে শুধু সময় ভ্রমণ করলেই চলবে না, স্থানকেও অতিক্রম করতে হবে। আপনি অন্য একটি মহাবিশ্বে গিয়ে আপনার পিতামহের মিরর ইমেজকে হত্যা করলে আপনার পিতার মাধ্যমে সেই মহাবিশ্বে আপনার জন্ম হবে না। তবে সেখানেও আপনার অস্তিত্ব থাকবে ভবিষ্যৎ থেকে আগত এক ঘাতক হিসেবে, যিনি অমুক নামের এক লোককে হত্যা করেছেন।

স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয়া সিলিন্ডারের সাহায্যে সময় ভ্রমণ


১৯৩৭ সালে স্কটিশ পদার্থবিদ ভ্যান স্টকাস টাইম মেশিন সম্পর্কিত একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বকে ব্যবহার করেন। তিনি ঘনত্বপূর্ণ ও অসীম দূরত্ব পর্যন্ত বিস্তৃত একটি ঘূর্ণায়মান (এর মূল অক্ষ সাপেক্ষে) সিলিন্ডার কল্পনা করেছিলেন, যেটা ঘূর্ণনের সাথে এর আশপাশের স্থান-কালকেও এর সাথে ঘুরতে বাধ্য করবে। ঐ ঘূর্ণায়মান কালের মধ্যে প্রবেশ করে অতীতে চলে যাওয়া সম্ভব। স্টকাসের মতে, এভাবে যাত্রা শুরুর আগেই যাত্রা শুরুর পূর্বের সময়ে চলে যাওয়া সম্ভব হবে। চিন্তাটি ছিলো কাল্পনিক, যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক।

কীটগহ্বর (Worm Hole) এর মাধ্যমে সময় ভ্রমণ


সময় ভ্রমণের আরো একটি তাত্ত্বিক সম্ভাবনা হচ্ছে ওয়ার্মহোল বা কীটগহ্বর। ওয়ার্মহোল হচ্ছে অতি অল্প সময়ে মহাজাগতিক দূরত্ব অতিক্রম করার এক তাত্ত্বিক সম্ভাবনা, যেটার কথা আইনস্টাইন ও নাথান রোজেন ১৯৩৫ সালে প্রথম বলেন, এবং যেটা পরিচিত ছিলো আইনস্টাইন-রোজেন ব্রিজ নামে।

পঞ্চাশের দশকে বিশিষ্ট পদার্থবিদ জন হুইলার ওয়ার্মহোল নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেন এবং “ওয়ার্মহোল” শব্দটির উৎপত্তি ঘটান। ওয়ার্মহোলকে যদিও আমরা মহাকাশ ভ্রমণের সংক্ষিপ্ততম পথ বলেই জানি, তবুও কিপ থর্নের গবেষণার মাধ্যমে সময় ভ্রমণের বিষয়টিও উঠে আসে। কার্ল সেগান তার “কন্ট্যাক্ট” বইয়ের কাজ করার সময় লেখার প্রয়োজনেই বন্ধু কিপ থর্নের সাথে যোগাযোগ করেন এবং ওয়ার্মহোল নিয়ে আরো বিস্তারিত গবেষণা করার অনুরোধ করেন। তখন আইনস্টাইনের তত্ত্বে বিশেষজ্ঞ যে কয়জন বিজ্ঞানী ছিলেন, কিপ থর্ন ছিলেন তাদের একজন। সেগানের অনুরোধে থর্ন ওয়ার্মহোল নিয়ে গবেষণা শুরু করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য বের করে আনতে সক্ষম হন। তবে এই ওয়ার্মহোল ঠিক আমরা যেরকম চিন্তা করি সেরকম অর্থাৎ এর প্রবেশমুখ ও বহির্মুখ পরস্পরের সাপেক্ষে স্থির হলে চলবে না।

ওয়ার্মহোলের মাধ্যমে সময় ভ্রমণ

কেননা এক্ষেত্রে সময় একই হারে চলবে। কিন্তু যদি বহির্মুখ সাপেক্ষে প্রবেশমুখকে গতিশীল করা যায় (এবং এতে একটি সময় পার্থক্য তৈরি হবে) তবে সময় ভ্রমণ সম্ভব হতে পারে। ওয়ার্মহোল একটি তাত্ত্বিক বিষয়। বাস্তবে যদি ওয়ার্মহোল থাকেও, তবুও কোয়ান্টাম অস্থিরতার জন্য সেটা টিকিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে উঠবে। কিপ থর্নসহ অনেক বিজ্ঞানী ওয়ার্মহোলের স্থিতি প্রদানের জন্য উত্তেজক পদার্থের কথা বলেন, যেগুলোর ঋণাত্মক শক্তি থাকায় মহাকর্ষ বিরোধী ক্রিয়াও আছে। হিসাব করে দেখা গেছে, ১ মিটার চওড়া একটি ওয়ার্মহোলকে স্থির রাখার জন্য সূর্যের ১০ বিলিয়ন বছরেরও অধিক সময়ে উৎপাদিত শক্তির সমান ঋণাত্মক শক্তির যোগান দিতে হবে!

উপসংহার


উপরের আলোচনা পাঠকদের কাছে বাস্তবতাবর্জিত কল্পকাহিনী মনে হতে পারে এবং সেটাই স্বাভাবিক। কেননা, সময় ভ্রমণ করার মতো প্রযুক্তির আশপাশে আমরা এখনও পৌঁছুতে পারিনি। তবে আমরা যখন সময় ভ্রমণ নিয়ে কথা বলি, তখন মূলত সুপ্রতিষ্ঠিত কিছু বৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে সামনে রেখেই সেটা বলে থাকি। ফলে সময় ভ্রমণ সংক্রান্ত আলোচনা বিজ্ঞানের বাইরের কোনো বিষয় নয়। সময়কে যেহেতু বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত করা গেছে সেহেতু সময় ভ্রমণ বিষয়টাও আপনা আপনিই বিজ্ঞানের আওতায় চলে আসে।

সময় ভ্রমণ আদৌ সম্ভবপর হবে কীনা অথবা হলেও কবে হবে, সেটা আমাদের পক্ষে এখনই জানা সম্ভব নয়। তবে সময় ভ্রমণ তত্ত্বীয় বিজ্ঞানের অংশ হওয়ায়, এটা নিয়ে গবেষণা অব্যাহত থাকবে। সুদূর ভবিষ্যৎ থেকে হয়তো কোনো আগন্তুক নিভৃতে অতীত ভ্রমণে এসেছিলেনও, তবে সেটা আমাদের সময়ে নয়, আরো বহু বহু পূর্বের কোনো এক সময়ে, যার কোনো প্রমাণ আমাদের হাতে নেই।

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/time-travel/

বাঙ্গালীর হাসির গল্পঃ বোকা সাথী -( জসীম উদ্দিন)


 

এক নাপিত। তার সঙ্গে এক তাঁতীর খুব ভাব। নাপিত লোককে কামাইয়া বেশি পয়সা উপার্যন করিতে পারে না। তাঁতি কাপড় বুনিয়া বেশি লাভ করিতে পারে না। দুই জনেরই খুব টানাটানি। আর টানাটানি বলিয়া কাহারও বউ কাহাকে দেখিতে পারে না। এটা কিনিয়া আন নাই, ওটা কিনয়িা আন নাই বলিয়া বউরা দিনরাই কেবল মিটির মিটির করে। কাতই আর ইহা সহ্য করা যায়। একদিন তাঁতি যাইয়া নাপিতকে বলিল, ‘বউ এর জ্বালায় আর ত বাড়িতে টিকিতে পারি না’। নাপিত জবাব দিল, ‘ভাইরে ! আমারও সেই কথা। দেখনা আজ পিছার বাড়ি দিয়া আমার পিঠের ছাল আর রাখে নাই’ তাঁতি জিজ্ঞাসা করে, ‘ আচ্ছা ভাই, ইহার কোন বিহিত কারা যায় না?’ নাপিত বলে, ‘চল ভাই, আমরা দেশ ছাড়িয়া বিদেশে চলিয়া যাই। যেখানে বউরা আমাদের খুজিয়াও পাইবে না; আর জ্বালাতনও করিতে পারিবে না। সত্যি সত্যিই একদিন তাহারা দেশ ছাড়িয়া পালাইয়া চলিল। এদেশ ছাড়াইয়া ওদেশ ছাড়াইয়া যাইতে যাইতে তাহারা এক বিজন বন-জঙ্গলের মধ্যে আসিয়া পড়িল। এমন সময় হালুম হালুম করিয়ো এক বাঘ আসিয়া তাদের সামনে খাড়া। ভয়ে তাঁতি ত ঠির ঠির করিয়া কাপিতেছে নাপিত তাড়াতাড়ি তার ঝুলি হইতে একখানা আয়না বাহির করিয়া বাঘের মুখের সামনে ধরিয়া বলিল, ‘এই বাঘটা ত আগেই ধরিয়াছি। তাঁতী ! তুই দড়ি বাহির কর- সমনের বাঞটাকেও বাঁধিয়া ফেলি’। বাঘ অঅয়নার মধ্যে তার নিজের ছবি দেখিয়া ভাবিল, ‘এরা না জানি কতবড় পালোয়ান। একটা বাঘকে ধরিয়া রাখিয়াছে। আবার আমাকেও বাঁধিয়া রাখিতে দড়ি বাহির করিতেছে’। এই না ভাবিয়া বাঘ লেজ উঠাইয়া দে চম্পট। তাঁতি তখনো ঠির ঠির করিয়া কাঁপিতেছে। বনের মধ্যে আঁধার করিয়া রাত আসিল। ধারে কাছে কোন ঘর বাড়ি নাই। সেখানে দাঁড়াইয়া থাকিলে বাঘের পেটে যাইতে হবে। সামনে ছিল এক বড় গাছ। দউজনে যুক্তি করিয়া সেই গাঠে উঠিয়া পড়িল। এদিকে হইয়াছে কি? সেই যে বাঘ ভয় পাইয়া পালাইয়া গিয়াছিল, সে যাইয়া আর বাঘদের বলিল, ‘অমুক গাছের তলায় দুইজন পালোয়ান আসিয়াছে। তাহারা একটা বাঘকে ধরিয়া রাখিয়াছে। আমাকেও বাঁধিতে দড়ি বাহির করিতেছিল। এই অবসরে আমি পালাইয়া আসিয়াছি। তোমরা কেহ ওপথ দিয়া যাইও না’। বাঘদের মধ্যে যে মোড়ল- সেই জাঁদরেল বাঘ বলিল, ‘কিসের পালোয়ান? মানুষ কি বাঘের সাথে পারে? চল সকলে মিলিয়া দেখিয়া আসি’ জঙ্গী বাঘ-সিঙ্গিবাঘ-মামুদ বাঘ- খুতখুতে বাঘ-কুতকুতে বাঘ, সকল বাঘ তর্জন-গর্জণ করিয়া সেই গাছের তলায় আসিয়া পৌছিল। একে ত রাত অন্ধারী, তারউপর বাঘের হম্কারী- অন্ধকারে জোড়া জোড়া বাঘের চোখ জ্বলিতেছে। তাই না দেখিয়া তাঁতি ত ভয়ে কাঁপিয়া অস্থির। নাপিত যত বলে- ‘তাঁতী এক সহসে ভরকর!’ তাঁতী ততই কাপেঁ। তখন নাপিত দড়ি দিয়া তাঁতীকে গাছেল ডালের সঙ্গে বাঁধিয়া রাখিল’। কিন্তু তাহারা গাছের আগডালে আছে বলিয়া বাঘ তাহাদের নাগাল পাইতেছে না। তখন জাঁদরেল বাঘ আর সব বাঘদের বলিল, ‘দেখ তোরা একজন আমার পিঠে ওঠে-তারপিঠে আরেক জন ওঠ- তার পিঠে আরেক জন ওঠ-এমন কলিয়া উপরে উটিয়া হাতের থাবা দিয়া এই লোক দু’টোকে নামাইয়া লইয়া আয়’ এই ভাবে একজনের ঠিঠে আর একজন তার পিঠে আর একজন করিয়া যেই উপরের বাঘটি তাঁতিকে ছুতে যাইবে, অমনি ভয়ে ঠির ঠির করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে দড়িসমতে তাঁতী ত মাটিতে পড়িয়া গিয়োছে। উপরের ডাল হইতে নাপিত বলিল- ‘তাঁতী তুই দড়ি দিয়া মাটির উপর হইতে জাঁদরেল বাঘটিকে আগে বাধ, আমি উপরের দিক হইতে একটা একটা করিয়া সবগুলি বাঘকে বাঁধিতেছি’। এই কথা শুনিয়া নিচের বাঘ ভবিল আমাকেই ত আগে বাঁধিতে আসিবে। তখন সে লেজ উঁচাইয়া দে দৌড়- তখন এ বাঘের উপর পড়ে ও বাঘ, সে বাঘের উপর পড়ে আরেক বাঘ। নাপিত উপর হইতে বলে, ‘ জোলা মজবুত করিয়া বাঁধ- মজবুত করিয়া বাঁধ। একটা বাঘও যেন পালাইতে না পারে’। সব বাঘ তখন পালাইয়া সাফ। বাকি রাত টুকু কোনরকমে পাড় করিয়া পরদিন সকাল হইলে তাঁতী আর নাপিত বন ছাড়াইয়া আর এক রাজার রাজ্যে আসিয়া উপস্থিত হইল। রাজা রাজসভায় বসিয়া আছেন। এমন সময় নাপিত তাঁতীকে সঙ্গে লইয়া রাজার সামনে যাইয়া হজির। ‘মজারাজ প্রণাম হই’। রাজা বলিল, ‘ কি চাও তোমরা?’ নাপিত বলিল’ ‘আমরা দুইজন বীর পালোয়ান। আপনার এখানে চাকুরি চাই’। রাজা বলিলেন, ‘তেমারা কেমন বীর তা পরখ না করিলে ত চাকরি দিতে পারি না? আমার রাজবাড়িতে আছে দশজন কুস্তিগীর, তাহাদের যদি কুস্তিতে হারাইতে পার তবে চাকরি মিলিবে’। নাপিত বলিল, ‘মাহারাজের আর্শিবাদে নিশ্চয় তাহাদের হারাইয়া দিব’। তখন রাজা কুস্তি পরখের একটি দিন স্থির কলিয়া দিলেন। নাপিত বলিল, ‘মাহারাজ ! কুস্তি দেখিবার জন্য ত কত লোক মজা হইবে। মাঠের মধ্যে একখানা ঘর তৈরী কিরিয়া দেন। যদি বৃষ্টি-বাদল হয়, লোকজন সেখানে যাইয়া আশ্রয় লাইবে’। রাজার আদেশে মাঠের মধ্যে প্রকান্ড খড়ের ঘর তৈরী হইল। রাতে নাপি চুপি চুপি যাইয়া তাহার ক্ষুর দিয়া ঞরের সমস্ত বাঁধন কাটিয়া দিল। প্রকান্ড খড়ের ঞর কোনরকমে খামের উপর খাড়া হইয়া রহিল। পরের দিন কুস্তি দেখিতে হাজার হাজার লোক জমা জইয়াছে। রাজা আসিয়াছেন- রানী আসিয়াছেন- মন্ত্রী, কোটাল, পাত্রমিত্র কেহ কোথাও বাদ নাই। মঠের মধ্যখানে রাজাবাড়ির বড় বড় কুস্তিগীরেরা হায়ে মাটি মাখাইয়া লড়াইয়ের সমস্ত কায়দাগুলি ইস্তেমাল করিতেছে। এমন সময় কুস্তিগীরের পোশাক পরিয়া নাপিত আর তাঁতী মাঠের মধ্যখানে উপস্থিত। চারিদিকে লোক তাহাদের দেখিয়া হাততালি দিয়া উঠিল। নাপিত তখন তাঁতীকে সঙ্গে করিয়া লাফাইয়া একবার একদিকে যায় আবার ওদিকে যায়। আর ঘরের এক একখানা চালা ধরিয়া টান দেয়। হুমড়ি খাইয়া ঘর পড়িয়া যায়। সভার সব লোক অবাক। রাজবাড়ির কুস্তিগীরেরা ভাবে ‘হায় হায় না জানি ইহারা কত বড় পালোয়ান। হাতের এক ঝাঁকুনি দিয়া এত বড় আটচালা ঘরখানা ভাঙ্গিয়া ফেলিল। ইহাদের সঙ্গে লড়িতে গেলে ঘরেরই মত উহারা আমাদের হাত-পাগুলো ভাঙ্গিয়া ফেলিবে। চল আমরা পালাইয়া যাই’। তাহারা পালাইয়া গেলে নাপিত তখন মাঠের মধ্যখানে দাঁড়াইয়া বুক ফুলাইয়া রাজাকে বলিল, ‘মহারাজ ! জলদী করিয়া আপনার পালোয়ানদের ডাকুন দেখি ! তাগাদের কার গায়ে কত জোর’। কিন্তু কে কার সঙ্হে কুস্তি করে? তাহারা ত আগেই পালাইয়াছে। রাজা তখন নাপিত আর তাঁতীকে তাঁর রাজ্যের সেনাপতি নিযুক্ত করিলেন। সেনাপতির চাকরি পাইয়া তাঁতী আর নাপিত ত বেশ সুখেই আছে। এর মধ্যে কোথা হইতে এক বাঘ আসিয়া রাজ্যে মহা উৎপাত লাগাইয়াছে। কাল এর ছাগল লইয়া যায়, পরশু ওর গরু লইয়া যায়, তারপর মানুষও লইয়া যাইতে লাগিল। রাজা তখন নাপিত আর তাঁতীকে বলিল, ‘ তোমরা যদি এই বাঘ মারিতে পার তবে আমার দুই মেয়ের সঙ্গে তোমাদের দই জনের বিবাহ দিব’। নাপিত বলিল, এর আর এমন কঠিন কাজ কি? অবে আমাকে পাঁচ মন ওজনের একটি বড়শি আর গোটা অস্টেক পাঁঠা দিতে হইবে। রাজার আদেশে পাঁচমন ওজনের একটি লোহার বড়শি তৈরি হইল। নাপিত তখন লোকজনের নিকট হইতে জানিয়া লইল. কোথায় বাঘের উপদ্রব বেশি, আর কোন সময় বাঘ আসে। তারপর নাপিত সেই বড়শির সঙ্গে সাত-আটটা পাঁঠা গাঁথিয়া এক গাছির লোহার শিকলে সেই বড়শি আটকাইয়া এক গাছের সঙ্গে বাঁধিয়া রাখিল। তারপর তাঁতীকে সঙ্গে লইয়া গাছের আগ ডালে উঠিয়া বসিয়া রহিল। অনেক রাতে বাঘ আসিয়া সেই বড়শি সমতে পাঠা গিলিতে লাগিল। গিলিতে গিলিতে গলায় বড়শি আটকাইয়া গিয়া তর্জন-গর্জন করিতে লাগিল। সকাল হইলে লোকজন ডাইকয়া নাপিত আর তাঁতি লাঠির আঘাতে মাঘটিকে মারিয়া ফেলিল। এ খবর শুনিয়া রাজা ভারী খুশী। তারপর ঢোল-ডগর বাজাইয়া নপিত আর তাঁতীর সঙ্গে দুই মেয়ের বিবাহ দিয়া দিল। বিবাহরে পরে বু্ লইয়া বাসর ঘরে যাইতে হয়। তাঁতী এক বাসর ঞরে যাইতে ভয় পায়। নাপিতকে সঙ্গে যাইতে অনুরোধ করে। নাপিত বলে, ‘ বেটা তাঁতী ! তোর বাসর ঘর আমি যাইব কেন করিয়া ? আমাকে ত আমার বউ এর সঙ্গে ভিন্ন বাসর ঘরে যাইতে হইবে। তুই কোন ভয় করিস না। খুব সাহসের সঙ্গে থাকিবি’। এই বলিয়া তাহাকে বাসর ঘরের মধ্যে ঠিলিয়া দিন। বাসর ঞরে যাইয়া তাঁতী এদিক চায়-ওদিক চায়। আহা হা কত ঝাড়-কত লণ্ঠন ঝিকিমিকি জ্বলিতেছে। আর বিছানা ভরিয়া কত রঙ্গের ফুল। তাঁতী কোখায় বসিবে তাহাই ঠিক করিতে পারে না। তখন অতি শরমে পাপোশখানার উপর কুচিমুচি হইয়া বসিয়া তাঁতী ঘামিতে লাগিল।কিছুক্ষণ পরে পানের বাটা লইয়া, পায়ে সোনার নুপুর ঝুমুর ঝুমুর বাজাইয়া পঞ্চসখী সঙ্গে করিয়া রাজকন্যা আসিয়া উপস্থিত। তাঁতী তখন ভয়ে জড়সড় । সে মনে করিল, হিন্দুদের কোন দেবতা যেন তাহাকে কাটিতে অসিয়াছে। সে তখন তাড়াতাড়ি উটিয়া রাজকন্যার পায়ে পড়িয়া বলিল, ‘মা ঠাকরুন ! আমার কোন অপরাধ নাই। সকলই নাপিত বেটার কারসাজি’। রাজকন্যা সকলই বুঝিতে পারিল। কথা রাজার কানেও গেল। রাজা তখন তাঁতী আর নাপিতকে তাড়াইয়া দিলেন। নাপিত রাগিয়া বলে, ‘বোকা তাঁতী। তোর বোকামীর জন্য অমন চাকুরিটাত গেলই- সেই সঙ্গে রাজকন্যাও গেল। তাঁতী নাপিতকে জড়াই ধরিয়া বলিল, ‘তা গেল ! চল ভাই , দেশে যাইয়া বউদের লাথি গুতা খাই। সেত গা সওয়া হইয়া গিয়াছে। এমন সন্দেহ আর ভয়ের মধ্যে থাকার চাইতে সেই ভাল’।

Friday, December 1, 2017

পরিবেশবান্ধব কম্পিউটার


কম্পিউটার থেকে কার্বনের নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে পরিবেশবান্ধব কম্পিউটার তৈরি করছে আয়ারল্যান্ডের প্রতিষ্ঠান মাইক্রোপ্রো। ‘আইএমইকো পিসি’ নামের পরিবেশবান্ধব এই টাচস্ক্রিন কম্পিউটার কাঠের তৈরি। এক খবরে এ তথ্য জানিয়েছে ডেইলি মেইল।
নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান মাইক্রোপ্রোর দাবি, এই কম্পিউটারটির ৯৮ শতাংশ রিসাইকেল করা যায়। কম্পিউটারটিতে কাঠের তৈরি কাঠামোর সঙ্গে টাচস্ক্রিন যুক্ত করা হয়েছে। কম্পিউটারের ফ্যানের পরিবর্তে কপার পাইপের বিশেষ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে, এর ফলে এতে শব্দ হয় না। এটি সাধারণ কম্পিউটারের তুলনায় ৭০ শতাংশ কম কার্বন নিঃসরণ করে।
জার্মান বিজ্ঞানী আলেকজান্ডার স্লসারের নকশা করা এই কম্পিউটার ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ইকোলেবেল ‘ফ্লাওয়ার’ পুরস্কার জিতেছে।
আলেকজান্ডার স্লসার পরিবেশবান্ধব এ কম্পিউটার প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, টাচস্ক্রিনের এই কম্পিউটারটি খুব কম শক্তিতে চলে। আইএমইকো পিসির পর কাঠের তৈরি ল্যাপটপ তৈরি করার ঘোষণাও দিয়েছেন তিনি।

 

উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ...

ঘুমের আগে প্রভাবশালী লোকেরা যে ৫টি কাজ করতে অভ্যস্ত


আমরা জানি যে, সফল ব্যক্তিরা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে এবং বিশ্বজয় সম্পর্কে চিন্তা করে যখন পৃথিবীর বাকি মানুষেরা সকালের কফির স্বাদ নিতে থাকে। কিন্তু তারা সারাদিন কি কাজ করে থাকে তা আমরা জানি না। তবে রাতে শোবার আগে তারা কি করে? জানতে চান এই গোপন তথ্য? তারা পরবর্তী দিন যেন আরও সুন্দর করতে পারে সে প্রত্যয় নিয়ে চিন্তা করে। যে কাজ গুলো করতে তারা অভ্যস্ত-

# এক ঘণ্টা বই পড়া
মাইক্রোসফট এর মালিক বিল গেটস প্রত্যক রাতে ঘুমাতে যাবার আগে এক ঘণ্টা বর্তমান ইভেন্ট ও রাজনীতির উপর লিখা বই পরেন। বই পড়ার কারনে জ্ঞান বৃদ্ধি পায়। এর ফলে স্ট্রেস কমে ও মেধা বৃদ্ধি পায়। ২০০৯ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেসে ৬ মিনিট বই পড়লে সারাদিনের ৬৮% স্ট্রেস কমে যায়। প্রতিদিন বই পড়ার অভ্যাস করলে স্বাস্থ্যের জন্য অনেক ভালো হয়।

# অসংযুক্ত
আরিআন্না হাফিংটন তার মাথায় আঘাত পাবার পর থেকে রাতে ঘুমাবার আগে তার ফোন অন্য কক্ষে রেখে আসে। যাতে তার ঘুমে কোন সমস্যা না হয়। বিজ্ঞানীদের মতে, মোবাইলের লাইট ও আওয়াজ আমাদের শরীরের বিভিন্ন অংশের জন্য খারাপ হতে পারে। এতে আমাদের ব্রাইন এর সমস্যা হতে পারে।

# হাটা
বাফার এর সিইও ঘুমাতে যাবার আগে হাঁটাহাঁটি করেন। এতে তার সারাদিনের অফিসের চিন্তা দূর হয় এবং তিনি আসতে আসতে ক্লান্তিবোধ করেন।
একজন ব্যস্ত মানুষের জন্য সারাদিনের কাজের পর রাতে রুটিন করে প্রতিদিন হাটা একটি ভালো বিষয়। এতে তার সারাদিনের স্ট্রেস দূর হয়। তাছাড়া কাজ করার সময় কোন কিছু মুক্তভাবে চিন্তা করা যায় না। হাটার সময় অনেক কিছু নিয়ে মুক্তভাবে চিন্তা করা যায়।

# মেডিটেশন
মিডিয়া ম্যাভেন প্রতিদিনই রাতে মেদিতাতিওন করেন। সারাদিনের স্ট্রেস দূর করার সব থেকে কার্যকর উপায় হল মেডিটেশন। সবসময়ই একটি তর্ক ছিল যে মেডিটেশন কি আদৌ কোন উপকারে আসে কিনা। তবে ২০১৪ সালে ১৯০০০ লোকের উপর একটি গবেষণায় এই কথা প্রমাণিত হয় যে, মেডিটেশন মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, বিষণ্ণতা ও ব্যথা কমাতে সাহায্য করে।

# পরের দিনের পরিকল্পনা করা
দ্যা আমেরিকান এক্সপ্রেস এর সিইও তার সময় কে অনেক প্রাধান্য দেন। উনি প্রতি রাতে পরবর্তী দিনে করণীয় তিনটি কাজ চিন্তা করে রাখেন। যাতে পরের দিন সকালে উঠে তা সময় মত করতে পারে।

 

উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ...

গন্ধগোকুলের বিষ্ঠা থেকে বিশ্বের সবচেয়ে দামি কফি উৎপাদন হয়


স্থানীয় এলাকায় ভাম বা গন্ধগোকুলের উৎপাত নিয়ে বন দপ্তরে খবর দেন। এদের দেখলেই মেরে ফেলাই এক রকমের রীতি। আপনার বাড়ির পিছনের পরিত্যক্ত জমিটিতেও ভামের বাসা থাকতে পারে। কিন্তু আমরা বলি কি, বাড়িতে এ বার দু-চারটে পুষেই ফেলুন। আপনার কোটিপতি হওয়া আটকায় কে!


কি, বিশ্বাস হচ্ছে না? তাহলে জানাই, বিশ্বের সব থেকে দামি কফি ভামের বিষ্ঠা থেকে তৈরি হয়। ইন্দোনেশিয়ার কারণে সবাই এই কফিকে ‘কোপি লুওয়াক’ বলে চেনে। যার এক কাপের দাম প্রায় ৫০ মার্কিন ডলার। ভারতও পিছিয়ে নেই। কর্নাটকে এই ধরনের অনেক কফি ফার্ম রয়েছে। এমনই এক ফার্মের মালিক টি এস গণেশ। তাঁর ফার্মেই অনেকগুলো ভাম পোষা হয়।


কিন্তু ভামই কেন?


বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, ভাম বিড়াল সব থেকে ভালো কফি চেনে। তারা বেছে বেছে সব থেকে পাকা কফি গুলো খেয়ে নেয়। কিন্তু কফি বিন গুলি হজম করতে পারে না। ফলে তা বিষ্ঠার সঙ্গে বেরিয়ে আসে। কিন্তু আসার আগে তাদের এনজাইমের সঙ্গে মিশে এই অসাধারণ কফির জন্ম দেয়। এর জন্যই কফিতে চকোলেট বা ক্যারামেলের একটি ফ্লেভার আসে। গণেশের এই কফি ব্র্যান্ডের নাম ‘কারি বেক’। তিনি ১ কেজি কফি ১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। তিনি জানান, ‘আমার বেশির ভাগ খরিদ্দারই বড় বড় হোটেল ব্যবসায়ী। বিশেষ অতিথিদের আপায়নের জন্য এই কফি কেনেন।’


ইবলিসের গির্জা - খোয়াকিম মারিয়া মাচাদো দি আসিস


অনুবাদ : রওশন জামিল

প্রথম অধ্যায়
একটি চমৎকার ভাবনা
এক প্রাচীন বেনেডিক্টীয় পাণ্ডুলিপিতে কথিত আছেএকদিন ইবলিসের মাথায় একটি গির্জা পত্তনের বুদ্ধি চাপল। যদিও তার মুনাফা অব্যাহত ছিল এবং পরিমাণও কমতি ছিল না, তবু যুগ যুগ ধরে পালন-করে-আসা নিজের ভূমিকায় সে অপমানিত বোধ করছিল। তার না আছে সংগঠন, না নিয়ম, না বিধান, না আচার। সে, বলতে কী, ঈশ্বরের উচ্ছিষ্ট, আর মানুষের অনুগ্রহ আর অসতর্কতার ওপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। কোনকিছুই নির্দিষ্ট নয়, কোনকিছুই নিয়মিত না। তার নিজের একটা গির্জা হবে না কেন? অন্যান্য ধর্মের সঙ্গে লড়াই এবং সেগুলোকে চিরদিনের মতো নির্মূল করার জন্য ইবলিসের গির্জা হবে একটি কার্যকর পন্থা।
‘বেশ, তাহলে গির্জাই সই,’ সিদ্ধান্তে পৌঁছল সে। ‘ধর্মগ্রন্থের বিপরীতে পাল্টা ধর্মগ্রন্থ, প্রার্থনাপুস্তকেরবিপরীতে পাল্টাপ্রার্থনাপুস্তক। আমার নিজের উপাসনা-উৎসব, অঢেল সুরা আর রুটিসহ, ধর্মোপদেশ, অনুশাসন, প্রার্থনা, এবং অন্যান্য ধর্মীয় জাঁকজমক সব থাকবে। আমার কৃষ্টি হবে শাশ্বত চৈতন্যের সারাৎসার, আমার গির্জা ইব্রাহিমের অন্যতম তাঁবু। এবং তারপর যখন কলহে বিদীর্ণ হবেঅন্যান্য ধর্ম, তখন আমার গির্জাইহবে অদ্বিতীয়। মোহাম্মদ বা লুথার কেউই আমাকে অতিক্রম করতে পারবে না। বিশ্বাসের পথ বহু, সবকিছু অস্বীকারের পথ একটাই।’

একথা বলতে বলতে, মাথা ঝাঁকায় ইবলিস, রাজকীয় পৌরুষোচিত ভঙ্গিতে নিজের বাহু প্রসারিত করে। তক্ষুনি নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেয় সে ঈশ্বরের কাছে যেতে হবে, স্বীয় ভাবনা দিয়ে তাঁকে মোকাবেলা করতে হবে, এবং তাঁকে শক্তিপরীক্ষায় আহ্বান জানাতে হবে। ইবলিস এবার চোখ তুলল, বিদ্বেষে রক্তিম, প্রতিহিংসায় কঠোর; নিজেকে বলল সে: ‘যাওয়া যাক, এটাই সময়।’ পরক্ষণে পাতালের প্রতিটি কন্দর আন্দোলিত করে সজোরে ডানা ঝাপটে, চকিতে ছায়া থেকে অনন্ত নীলিমায় সে উড়ল।

দ্বিতীয় অধ্যায়
ঈশ্বর এবং ইবলিসের কথোপকথন


ঈশ্বর একজন বৃদ্ধকে বরণ করছিলেন যখন বেহেশতে উপস্থিত হলইবলিস। নতুন অতিথিকে ফুলমাল্য দিয়ে বরণরত দেবদূতেরা অবিলম্বে বন্ধ করল নিজেদের কাজ, আর ইবলিস দাঁড়িয়ে রইল দরজায়, চোখ ঈশ্বরের ওপর।

‘আমার কাছেকী চাই তোমার?’ প্রশ্ন করলেন প্রভু।

‘আমি আপনার কাছে আপনার গোলাম ফাউস্টের পক্ষ হয়ে আসিনি,’চাপা হেসে জবাব দিল ইবলিস, ‘আমি এসেছি সকল সময়ের সকল ফাউস্টের হয়ে।’

‘ব্যাখ্যা কর।’

‘প্রভু, এর ব্যাখ্যা সহজ, তবে তার আগে আপনার উদ্দেশে আমাকে একটা কথা বলতে দিন: আপন করে নিন এই সদাশিব বৃদ্ধ ভদ্রলোককে, তাঁকে স্বর্গের শ্রেষ্ঠ স্থানটি বরাদ্দ করুন,তাঁকে সর্বানুপম সুরে-বাঁধা বীণা আর সুরম-লের ঐকতানে বরণ করে নেয়ার জন্য আদেশ দিন...’

‘তুমি জান ও কী করেছে?’ প্রশ্ন করলেন প্রভু, দৃষ্টিতে অপার দয়া।

‘না, তবেউনিই সম্ভবত শেষ ব্যক্তিদের একজন হতে যাচ্ছেন যাঁরা আপনার কাছে আসবেন। সেই অবস্থা হতে বেশিদিন লাগবে না যখন স্বর্গ বেশি ভাড়ার হোটেলের মতো ফাঁকা পড়ে থাকবে। আমি সস্তা বোর্ডিংহাউস তৈরি করতে যাচ্ছি, অর্থাৎ কিনা, আমি আমার নিজের গির্জা প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছি। আমি আমার বিশৃঙ্খলা, এবং আমার অপরিকল্পিত ও অস্থানিক রাজত্বে ক্লান্ত। এখন আমার চূড়ান্ত ও পূর্ণাঙ্গ বিজয়লাভ করার সময় হয়েছে। আমি আনুগত্যের খাতিরে আপনাকে জানাতে এসেছি একথা, যাতে আপনি আমার বিরুদ্ধে চাতুরীর অভিযোগ না আনেন। চমৎকার চিন্তা, না?’

‘তুমি আমাকে জানাতে এসেছ, অনুমোদন নেয়ার জন্য না,’উল্লেখ করলেন প্রভু।

‘আপনি ঠিক ধরেছেন,’ জবাব দিল ইবলিস, ‘তবে মনিবের প্রশংসা শুনলে আত্মগরিমায় তৃপ্তি হয়। অবশ্যি এটাও ঠিক, এক্ষেত্রে এটি হবে পরাজিত মনিবের প্রশংসা, আর... প্রভু, আমি পৃথিবীতে নেমে গিয়ে আমার ভিত্তি স্থাপন করতে যাচ্ছি।’

‘তথাস্তু।’

‘আপনি কি চান আমি ফিরে এসে আপনাকে অবহিত করি সবকিছু কীভাবে ঘটল?’

‘তার প্রয়োজন হবে না। আমাকে শুধু বল কেন, এতকাল নিজের বিশৃঙ্খলায় অসন্তুষ্ট থাকার পর, আজ তোমার মনে নিজস্ব গির্জা স্থাপনের সাধ জেগেছে?’

বিদ্রুপ আর বিজয়োল্লাসের সুরে হাসল ইবলিস। একটি নিষ্ঠুর উৎক্রোশ ছিল ওর অন্তরে, স্মৃতির থলেতে জমান একটা বিষাক্ত মন্তব্য, এমন একটা-কিছু যা তাকে বিশ্বাস করাল যে সে মহাকালের ওই ক্ষণিক মুহূর্তে ইশ্বরের চেয়ে শক্তিমান। তবে হাসি সংবরণ করল সে এবংবলল:

‘মাত্র এখুনি একটি পর্যবেক্ষণ শেষ করেছি আমি যা শুরু করেছিলাম কয়েক শতক আগে--আমি দেখেছি যে সব সুনীতি, যারা স্বর্গের কন্যা,অনেকাংশে সেসব রানির সঙ্গে তুলনীয় যাদের রেশমি আলখাল্লায় সুতির ঝালরথাকে। এখন আমি ইচ্ছা করছি ওই ঝালর ধরে আকর্ষণ করব ওদের এবং সবাইকে আমার গির্জায় নিয়ে যাব। ওদের পেছনে আসবে বিশুদ্ধ সিল্কের ঝালর...’

‘বস্তাপচা বাগাড়ম্বর!’ বিড়বিড় করলেন প্রভু।

‘কিন্তু দেখুন। এরকম অনেক তনু, যারা মর্ত্যরে মন্দিরগুলোয় আপনার পায়ের কাছে নতজানু হয়, তারা বৈঠকখানা আর রাস্তা থেকে ঘাঘরা ফুলিয়ে আসে, একই পাউডারে রঞ্জিত তাদের মুখম-ল, তাদের রুমালগুলোয় একই সৌরভ, আর তাদের চোখপবিত্র গ্রন্থ আর পাপ-গুম্ফের প্রতি ঔৎসুক্য আর অনুরক্তি জ্বলজ্বল করে। দেখুন কী ব্যগ্রতা--বা কমপক্ষে ঔদাসীন্য--নিয়ে ওইসুশীল জাহির করে বেড়ায় সে মুক্তহাতে কী কী সুবিধা খয়রাত করেথাকে--কাপড় জুতো, টাকাপয়সা, বা জীবনের জন্য প্রয়োজন অন্য কোন জিনিস...। তবে আমি চাই না,এটা মনে হোক যে আমি তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি। যেমন, আমি বলছি না কেমন আত্মতুষ্টির সঙ্গে ওই ধর্মযাজক কাফেলায় ভক্তিভরে আপনার ভালবাসা আর ধর্মীয় অলঙ্কার ধারণ করেন...। আমি আরো গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের কথা বলছি...।’

একথায় ডানা ঝাপটাল দেবদূতেরা, বেদম ক্লান্তি আর অবসাদভরে। মিকায়েল আর জিবরায়েল সকাতরে তাকাল প্রভুর দিকে। ইবলিসকে বাধা দিলেন ঈশ্বর:

‘তুমি একটা অকিঞ্চিৎকর, তোমার মত প্রেতাত্মার জন্য এটাই হচ্ছে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা যা ঘটতে পারে। তুমি যা-কিছু বলছ বা বলতে পার তার সবই এর আগে মর্ত্যের নীতিবাগিশদের মুখে কথিত এবং পুনর্কথিত হয়েছে। এটি একটি জীর্ণ বিষয়। তোমার যদি বিষয়টাকে নতুন দৃষ্টিতে আবার বলার মতো যথেষ্ট রসদ বা মৌলিকতা না থাকে, তাহলে তোমার জন্য সবচেয়ে ভাল হচ্ছে চুপ করা এবং ব্যাপারটা ভুলে যাওয়া। দেখ, আমার অগুনতি সেনার চেহারায় তোমার কথায় কীরকম নিদারুণ একঘেয়েমির ছাপ পড়েছে। ওই বৃদ্ধকে বিতৃষ্ণ দেখাচ্ছে, তুমি জান ও কী করেছে?’

‘আমি আগেই বলেছি আমি জানি না।’

‘সৎ জীবনযাপনের পর, সে এক মহীয়ান মৃত্যুবরণ করেছে। জাহাজডুবিতে পড়ে, একটা ভাঙা তক্তা ধরে নিজেকে বাঁচাতে যাচ্ছিল সে, কিন্তু দেখল দুই নবদম্পত্তি, তারুণ্যে প্রস্ফুটিত, মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। জীবনদায়ী তক্তাটা ওদেরকে দান করে, সে অনন্ত-মাঝে ঝাঁপ দিয়েছে। কেউ এই কীর্তি চাক্ষুষ করেনি, কারণ তার চারপাশে ছিল শুধু পানি আর ওপরে আকাশ। এর মাঝে কোথায় তুমি সুতির ঝালর দেখছ?’

‘প্রভু, আপনি জানেন, আমি হচ্ছি সেই সত্তা যে অস্বীকার করে।’

‘তুমি কি এই মৃত্যুর নিঃস্বার্থপরতা অস্বীকার কর?’

‘আমি সবকিছুই অস্বীকার করি। পরহিতের ছদ্মবেশে নরবিদ্বেষ হাজির হতে পারে--কারণ একজন নরবিদ্বেষীর জন্য অন্যদের জীবনদান তাদেরকে ঘৃণা করার সমান...’

‘ফন্দিবাজ, বাগাড়াম্বর!’ চেঁচিয়ে উঠলেন প্রভু। ‘যাও, যাও তোমার গির্জা স্থাপন কর গিয়ে। সব সুনীতিকে ডাক, সব ঝালর জড় কর, সব মানুষকে আহ্বান কর...। কিন্তু ভাগ এখান থেকে!’

আরো হাঁকডাকের ব্যর্থচেষ্টা করল ইবলিস। ঈশ্বর মূক করে দিয়েছেন ওকে। ঈশ্বরের ইশারায় দেবদূতেরা তাদের প্রার্থনাগীতের ঐকতানে স্বর্গ ভরিয়ে তুলল। অকস্মাৎ ইবলিসের মনে হলো সে শূন্যে ভাসছে--ডানাদুটো ভাঁজ করল সে, বিজলিপাতের মতো মর্ত্যে ভূপাতিত হলো।

তৃতীয় অধ্যায়
মানবজাতির জন্য সুখবর


মর্ত্যে এসে, একমুহূর্ত অপচয় করল না ইবলিস। যেহেতু সুনামের পরিধেয়, দ্রুত একটি বেনেডিক্টীয় আলখাল্লা গায়ে চাপাল সে, তারপর এক অভূতপূর্ব ও অসাধারণ মতবাদ প্রচার করতে শুরু করল এমন এক কণ্ঠে যা শতাব্দী-গভীরে প্রতিধ্বনিত হল। তার শিষ্য ও অনুগতদের মর্ত্যরে সমস্ত আনন্দ, যশ আর ভোগসুখের প্রতিশ্রুতি দিল সে। কবুল করল সে হচ্ছে ইবলিস, তবে সে এটা স্বীকার করল তার সম্পর্কে মানুষের ধারণা পরিবর্তন এবং ধর্মভীরু বুড়িদের বয়ান অস্বীকার করার জন্য।

‘হ্যাঁ, আমি হচ্ছি ইবলিস,’ পুনরাবৃত্তি করল সে, ‘তবেনরকাগ্নিময় রাত আর ঘুমপাড়ানিয়া কাহিনি, বা শিশুদের ভয়-দেখান ইবলিস নয়, বরং একমেবাদ্বিতীয়ম ইবলিস, প্রকৃতির সেই নিয়ন্তা যাকে মানুষের হৃদয় থেকে অপসারণ করার জন্য এই নাম দেয়া হয়েছে। দেখ, আমি কত সুশিক্ষিত আর সুসভ্য। আমিই হচ্ছি তোমাদের প্রকৃত পিতা। এসো, আমাকে অনুসরণ করো এবং সেই নাম গ্রহণ করো যা আমাকে অসম্মান করার জন্য আবিষ্কার করা হয়েছে, এ থেকে প্রতীক এবং আদর্শমান তৈরি করো, আমি তোমাদের সব দেবো, সব...।’

উৎসাহ উসকাতে আর উদাসীনকে জাগ্রত করতে, অন্য কথায়, নিজের চারপাশে বিপুল সমাবেশ ঘটাতে এভাবে কথা বলল সে। এবং ওরা এল। আর ওরা আসামাত্রই নিজের মতবাদ ব্যাখ্যা করতে অগ্রসর হল ইবলিস। সারমর্মের বিচারে, অবিশ্বাসী কোন আত্মা থেকে এমনটাই প্রত্যাশা করতে পারে একজন--আর রূপকল্পের বিচারে এটা কখনো অত্যন্ত পরিশীলিত, আবার কখনো ধৃষ্ট আর নির্লজ্জ শোনাল।

সে ঘোষণা করল, স্বীকৃত সুনীতিগুণগুলো অবশ্যই অন্যকিছু দিয়ে বদল করতে হবে, এমনকিছু যেগুলো প্রাকৃতিক এবং বৈধ। অহঙ্কার, লালসা, আলস্য এসব আবার পুনর্বহাল করা হল। সেই সঙ্গে ধনলিপ্সাও, যাকে সে অর্থনীতির জননী বলে ঘোষণা করল, উভয়ের মধ্যে পার্থক্য কেবলজননী হলেন স্বাস্থ্যবতী আর কন্যা অস্থিচর্মসার। হোমরের সময়ে রোষনিজের শ্রেষ্ঠ ন্যায়সঙ্গত মর্যাদা লাভ করেছিল--আকিলিসের ক্রোধ ছাড়া ইলিয়াড হত না: ‘কাব্যলক্ষ্মী, পেলাস পুত্র আকিলিসের ক্রোধের গান কর...।’ অতিভোজনের ব্যাপারেও একই কথা বলল সে, রাবেলেইসের শ্রেষ্ঠ পাতা আর ক্রাজ ডি সিলভার হিসোপোর বহু সুন্দর কবিতার জন্ম দিয়েছে। এটা এতই শ্রেয়তর গুণ যে কেউ লুকলাসের যুদ্ধের কথা স্মরণ করে না, শুধু তার ভোজসভার কথা স্মরণ করে: বস্তুত অতিভোজই তাকে অবিস্মরণীয় করেছে। আর কেউ যদি এসব সাহিত্যিক এবং ঐতিহাসিক যুক্তি অগ্রাহ্য করে শুধু অতিভোজের অন্তর্নিহিত অর্থ বিবেচনা করতে চায়, তারপরেও কে অস্বীকার করতে পারে যে মুখে আর পেটে সুখাদ্যের প্রাচুর্য একগ্রাস খাবার বা অনাহারের লালার চেয়ে ভাল বোধ হয়?ঈশ্বরের আঙুরবাগানের পরিবর্তে, একটি রূপকী অভিব্যক্তি, ইবলিসের আঙুরবাগান প্রতিষ্ঠার ওয়াদা করল ইবলিস, একটি সোজাসাপটা এবং নির্ভেজাল কথার কথা, যেহেতু সে কখনই তার অনুগামীদের বিশ্বের সুন্দরতমদ্রাক্ষা জোগানয় ব্যর্থ হবে না। আর ঈর্ষার ব্যাপারে শীতলকণ্ঠে সে প্রচার করল, এটাই হচ্ছে প্রধান গুণ, অনন্ত সমৃদ্ধির উৎস, একটি আনন্দদায়ক ভাব যা অন্যান্য গুণ ও প্রতিভার ঘাটতি পূরণ করে।

জনতা উৎসাহভরে ছুটল তার পেছনে। বাগ্মিতার প্রাবল্যে ইবলিস তার অনুগামীদের মধ্যে দুনিয়া সম্পর্কে ধারণা বদলে দিয়ে, বিকৃতির প্রতি ভালবাসা আর শুভের প্রতি বিতৃষ্ণা জাগ্রত করে, নয়া শৃঙ্খলা সঞ্চারিত করল।

যেমন, তার অসততার সংজ্ঞার চেয়ে আজগুবি আর কিছুই হতে পরে না।একে মানুষের বাম হাত বলল সে, যেহেতু ডান হাত হচ্ছে শক্তি, এবং রায় দিলো যে বেশিরভাগ মানুষই হচ্ছে বামহাতি। তবে সব মানুষকে বামহাতি হতে হবেএমন আবশ্যক করল না--সে নতুন সদস্য গ্রহণে অনাগ্রহী নয়। যারা বামহাতি কিংবা ডানহাতি তাদেরকে গ্রহণ করল সে, কিন্তু যারা কোনটাই নয় তাদেরকে জায়গা দিল না।অর্থলালসার ওপর সে সবচেয়ে প্রগাঢ় এবং প্রচ- ব্যাখ্যা দিল: তৎকালীন একজন কূটতার্কিক এমনকি এও স্বীকার করলেন যে এটা হচ্ছে যুক্তির এক মিনার। অর্থলালসা, ইবলিস বলল, অন্য সব অধিকারের চেয়ে শ্রেয়তর এক অধিকারের প্রয়োগ। তুমি যদি তোমার বাড়ি বিক্রি করতে পার, তোমার ষাঁড়, জুতো, কিংবা টুপি বিক্রি করতে পার--তুমি যেগুলোর বৈধ ও আইনসঙ্গত মালিক সেসব জিনিস--তাহলে তোমার মতামত, ব্রত, কথা, কিংবা বিশ্বাস--যেগুলো তুচ্ছ বিষয়আশয়ের চেয়ে বেশি মূল্যবান কারণ সেগুলো তোমার বিবেকের, অর্থাৎ, তোমার আত্মার উপকরণ--বিক্রি করা যাবে না কেন? এটা অস্বীকারের অর্থ হচ্ছে অযৌক্তিকতা আর অসঙ্গতিতে পতিত হওয়া। কোন কোন মেয়ে কি তাদের চুল বিক্রি করে না? একজন মানুষ কি আরেকজন রক্তাল্পতাগ্রস্ত মানুষকে দেয়ার জন্য নিজের কিছু রক্ত বিক্রি করতে পারে না? রক্ত, চুল--দেহের নানা অংশ--এগুলো কি চরিত্র--মানুষের নৈতিক অংশের চেয়ে চেয়ে বেশি মর্যাদাবান? এভাবে অর্থলালসার নীতিগুলো প্রদর্শন করে, ইবলিস এর দুনিয়াবি এবং আর্থিক সুবিধা ব্যাখ্যা করতে দেরি করল না। তারপর, সে দেখাল যে সামাজিক কুসংস্কারের প্রেক্ষাপটে এধরনের বৈধ অধিকারগুলো আড়াল করা যথাযথ হবে। আর এটা করার মাধ্যমে, অর্থলালসা ও ভণ্ডামি একইসঙ্গে প্রয়োগ করতে সমর্থ হবে একজন এবং এভাবে দ্বিগুণ যোগ্য হয়ে উঠবে।

সবকিছু পরীক্ষা আর শোধরানর জন্য একই সময়ে সব জায়গায় সমুপস্থিত রইল সে। স্বাভাবিকভাবেই ভুলের জন্য ক্ষমা, এবং দয়া ও আন্তরিকতা পরিচায়ক এমন নীতিগুলোর বিরোধিতা করল। যদিও সে বিনামাশুলে অপবাদ সুনির্দিষ্টভাবে নিষিদ্ধ করল না, তবে সবসময় আর্থিক বা অন্য কোন ধরনের দক্ষিণার কথা মাথায় রেখে এর চর্চা সুপারিশ করল। তবে, অপবাদ যখন সম্পূর্ণতই কল্পনার সীমাহীন বিস্তার, সে পারিশ্রমিকগ্রহণ নিষিদ্ধ করল, কেননা সেটা হবে নিশ্বাসগ্রহণের জন্য মজুরি পাওয়ার সমতুল। সামাজিক ও ব্যক্তিগত শিষ্টাচারের সম্ভাব্য উপকরণ হিশেবে উল্লেখ করে, সব ধরনের আদবকায়দার নিন্দা করল সে, কেবল এর ব্যতিক্রম হল যখন ব্যক্তিগত ফায়দা হাসিলের জন্য মোসাহেবি আবশ্যক হয়। তবে এই ব্যতিক্রমকে শেষে খারিজ করা হল এই সত্য দিয়ে যে ব্যক্তিগত লাভের আকাক্সক্ষা আদবকে নিছক চাটুকারিতায় পরিণত করে--সুতরাং এধরনের ক্ষেত্রে আদব নয়, চাটুকারিতাই হচ্ছে প্রযোজ্য যথার্থ মনোভাব।

সতীর্থদের প্রতি ভালবাসার ধারণা ওর নতুন প্রতিষ্ঠানের জন্য মারাত্মক বাধা এটা লক্ষ করে,নিজেরকাজ সম্পন্ন করার জন্য ইবলিস উপলব্ধি করল মানুষের সমস্ত সংহতি ধ্বংস করাই যথাযথ হবে। সে দেখাল যে এই ধারণা মূলত পরগাছা এবং দেউলে ব্যবসায়ীদের আবিষ্কার, বস্তুত সতীর্থদের প্রতি উদাসীনতা--এবং কোন কোন ক্ষেত্রে, ঘৃণা বা অবজ্ঞা--ছাড়া কিছুই প্রদর্শন করা উচিত নয়। সংস্কৃতবান ও পরিশীলিত নেয়াপোলিতীয় পাদ্রি, ফার্নান্দো গালিয়ানি, যিনি সাবেক শাসনামলেএকজন সম্ভ্রান্ত মহিলাকে লিখেছিলেন: ‘জাহান্নামে যাক সতীর্থজন। সতীর্থ বলে কিছু নেই!’ এই কথাগুলো উদ্ধৃত করে ‘সতীর্থ’ ধারণাটা ভুল প্রমাণিত করতে চেষ্টা করল সে। মাত্র একটি পরিস্থিতিতেই মানুষকে আর কাউকে ভালবাসার অনুমতি দিলো ইবলিস, আর সেটা হচ্ছে পরস্ত্রীকে ভালবাসা। কেননা এধরনের ভালবাসায় আসলে ব্যক্তির নিজেকে ভালবাসার অতিরিক্ত কিছুুই নেই। আর যখন কয়েকজন শিষ্য আবিষ্কার করল যে এধরনের মারিফতি ব্যাখ্যা সাধারণ মানুষের বোধের অগম্য, ইবলিস একটি রূপকের আশ্রয় নিলো: একশ লোক ব্যাংকের শেয়ার কেনে অভিন্ন কর্মসম্পাদনার জন্য, কিন্তু প্রত্যেক শেয়ারমালিক শুধু নিজের লাভের ব্যাপারে আগ্রহী থাকে। ব্যভিচারীদের বেলায়ও তা-ই ঘটে। এই হিতোপদেশটি সে তার জ্ঞান পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত করল।


চতুর্থ অধ্যায়
সুবিধা, আরো সুবিধা


ইবলিসের ভবিষ্যদ্বাণীই সত্য হল। সব সুনীতি, যাদের রেশমি আলখাল্লা সুতির ঝালরে শেষ হয়েছে, নিজেদের আলখাল্লাগুলো পরিত্যাগ করল বিছুটি ঝোপে, ঝালরে টান পড়ার পর নতুন গির্জায় যোগ দেয়ার জন্য দৌড়ে এল। অন্যরা অনুসরণ করল ওদের, এবং প্রতিষ্ঠানটি সময়ের আশীর্বাদ লাভ করল। গির্জা স্থাপিত হল; মতাদর্শ ছড়িয়ে পড়ল; দুনিয়ার এমন কোন অঞ্চল রইল না যা এর সঙ্গে পরিচিত হল না, এমন কোন ভাষা বাদ রইল না যে-ভাষায় এটি অনূদিত হল না, অথবা এমন কোন জাতি রইল না যে একে ভালবাসল না। ইবলিস সাফল্যের তুমুল আওয়াজ তুলল।

কিন্তু, একদিন, অনেক বছর বাদে, ইবলিস লক্ষ করল অনেক বিশ্বাসী গোপনে সনাতন সুনীতিগুলোর চর্চা করছে। তার সব চর্চা করছে না, বা পুরোপুরিও করছে না, কিন্তু কোন কোনটা অংশত করছে এবং যেমনটি বলা হয়েছে আগেই, গোপনে করছে। কোন কোন পেটুক বছরে তিন-চারবার পিছু হটেছে মিতাহার করার জন্য, ঠিক যেসব দিনে ক্যাথলিক অনুশাসনে নির্দিষ্ট করা হয়েছে। অনেক কৃপণ রাতে অথবা জনবিরল রাস্তায় দান-খয়রাত করেছে। রাজকোষ ফাঁকি দিয়েছে এমন অনেকে মাঝে মাঝে কিছুটা ফেরত দিয়েছে। কখনো-সখনো, অসৎ লোকেরা নির্ভেজাল সত্যকথা বলেছে, কিন্তু নিজেদের চেহারায় প্রতারকের অভিব্যক্তি ধরে রেখেছে ধাপ্পাবাজির ধারণা দেয়ার জন্য।

এই আবিষ্কার শঙ্কিত করে তুলল ইবলিসকে। দুষ্টকে আরো কাছে থেকে লক্ষ করতে লাগল সে এবং দেখল যে এটা প্রভূত বৃদ্ধি পেয়েছে। কোন কোন ঘটনা ধারণার বাইরে, লেভিন্থিয়ান ওই ওষুধ বিক্রেতার ঘটনাটি যেমন। বহুকাল ধরে একটি বিশেষ পরিবারের পুরো একটি প্রজন্মকে বিষপ্রয়োগ করে আসছিল সে, কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তের ছেলেমেয়েদেরকে ওষধটির উপজাত পদার্থের সাহায্যে উদ্ধার করেছে। কায়রোয় এক অনুশোচনাহীন উট চোরের দেখা পেল ইবলিস যে তার মুখ ঢেকে রেখেছিল যাতে মসজিদে ঢুকতে পারে। এক মসজিদের প্রবেশপথে ইবলিস পাকড়াও করল লোকটাকে এবং তার আচরণের জন্য ভর্ৎসনা করল। কিন্তু অভিযোগ অস্বীকার করল চোর, বলল সে মসজিদে যাচ্ছিল এক পথপ্রদর্শকের উট চুরি করার জন্য। তবে, ইবলিসের উপস্থিতিতে চুরি করার পর, ওটা সে দান করল মুয়াজ্জিনকে যিনি আল্লাহর কাছে তার জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। বেনেডিক্টিীয় পাণ্ডুলিপিতে আরো অনেক অসাধারণ আবিষ্কারের উল্লেখ ছিল, যেগুলোর মধ্যে এটি ইবলিসের মাথা সম্পূর্ণ হতবুদ্ধি করে দিয়েছিল। ক্যালাব্রিয়ান ওর সেরা শিষ্যদের একজন, বয়স পঞ্চাশ, একজন খ্যাতনামা দলিল জোচ্চর যার রোমের গ্রামাঞ্চলে চিত্রকলা, মূর্তি ও পাঠাগারশোভিত চমৎকার একটি বাড়ি ছিল। চোখেমুখে জোচ্চর লোকটা--সুস্থ আছে একথা যেন স্বীকার করতে না হয় সেজন্য বিছানাগত হলো। কিন্তু ইবলিস আবিষ্কার করল, লোকটা জুয়াতেও যেমন চুরি করে না তেমনি তার ভৃত্যদেরও বখশিস দেয়। একজন পাদ্রির সঙ্গে বন্ধুত্ব হওয়ার পর প্রত্যেক সপ্তাহে নির্জন উপসনাকক্ষে যায় সে নিজের অপরাধ স্বীকার করার জন্য এবং যদিও বন্ধুর কাছে নিজের গোপন কর্মকাণ্ডের কথা প্রকাশ করে না সে, কিন্তু সবসময়ে দুবার ক্রুশআঁকে, একবার যখন নতজানু হয় এবং আরেকবার যখন উঠে দাঁড়ায়। এরকম ছলনা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় ইবলিসের, কিন্তু এব্যাপারে কোন সন্দেহ ছিল--ঘটনাটা সত্যি।

একমুহূর্ত নষ্ট করল না সে। ধাক্কাটা তাকে বর্তমান অবস্থার সঙ্গে অতীতের কোন মিল খুঁজে পাওয়ার জন্য চিন্তাভাবনা করা, তুলনা করা বা সিদ্ধান্তে পৌঁছানর সময় দিলো না। আবার স্বর্গে উড়ে গেল সে, ক্রোধে উন্মত্ত, এরকম একটি বিরল ঘটনার গুপ্তরহস্য জানবার জন্য ব্যাকুল। সীমাহীন সন্তোষের সঙ্গে ওর কথা শুনলেন ঈশ্বর কিন্তু বাধা দিলেন না বা জবাব দিলেন না এবং এমনকি ইবলিসের যন্ত্রণা নিয়ে উল্লসিতও হলেন না। তিনি সোজা তাকালেন ইবলিসের চোখের দিকে, বললেন:

‘তুমি কী প্রত্যাশা করেছিলে, হে আমার বেচারা ইবলিস?সুতির আলখাল্লাগুলোয় এখন রেশমি ঝালর রয়েছে, ঠিক যেমন ওই রেশমিগুলোর সুতির ঝালর ছিল। তুমি কী প্রত্যাশা করেছিলে? এটাই হলোমানুষের অনন্ত স্ববিরোধিতা।’

(‘আ ইগরেহা দু দিয়াবো” নামে এই গল্পটি ১৮৮৪ সালে মাচাদো দি আসিসের ছোটগল্প সংগ্রহে প্রকাশিত হয়। এই বাংলা অনুবাদের ভিত্তি টেক্সাস প্যান অ্যামেরিকান সিরিজভুক্ত জ্যাক শ্মিট ও লোরি ইশিমাৎসু অনূদিত ও সম্পাদিত ইংরেজি দি ডেভিলস্ চার্চ অ্যান্ড আদার স্টোরিজ-ভুক্ত ‘দি ডেভিলস চার্চ।’)