আমার শহর- ঈপ্সিতা পালভৌমিক
এখানে আকাশ নীল।
নীলের বাড়াবাড়িই। বাড়াবাড়ি তো সবই। বড়বড়ও। এক্স এক্স এল। এক্স এস খুঁজে পাওয়া দায়। আর এদিকে সব এক্সেস। যেদিকে তাকাও। উপরে তাকাও তো এক্সেল কাচা এক্সট্রা হোয়াইট মেঘ। মুখ তুলে তাকাও তো এক্সট্রা হোয়াইটেনিং টুথপেস্টচর্চিত স্মাইল। সামনে তাকাও তো সুপার স্বচ্ছ দরজা। দরজা যে আদৌ আছে তা-ই বোঝা দায়। প্রথম কদিন তো দুর্যোধনবাবুর ইন্দ্রপ্রস্থ ভ্রমণসমদশা।
এমনকি চাঁদটাকেও প্রথম কোজাগরীতে দেখে ব্যোমকে গেছিলাম। একেই কি বলে সুপারমুন?
সুপারমুন, সুপারম্যান, সুপারসাইজ, সুপারবোল , সুপারস্টোর, সুপারপাওয়ার ... বলতে গেলে কেমনি সুপারলাইকই করে ফেলছিলাম। করবনা?
পিকচার ম্যানেজার-ট্যানেজারের দরকার-টরকারই নেই। ব্রাইটনেস, কন্ট্রাস্ট সব অটো অ্যাডজাস্ট হয়ে বসে আছে। প্রি কি পোস্ট প্রসেসিং বিলকুল অপ্রয়োজনীয়। সুপারস্টোরের ট্রলিতে ভর্তি প্রসেসড ফুড। ক্যামেরায় ভর্তি প্রসেসড ছবি। অ-সুপারলাইক।
নির্মেঘ নিকোনো নীলের ব্যাকগ্রাউণ্ডে কখনো ঝুলন্ত ডগ টিউলিপের ফুটফুটে গোলাপি কন্ট্রাস্ট, কখনও বা জেটের সুপার সফেদ ফেনিল ট্রেইলের কাটাকুটির কেরামতি। অঠিক অমনিতর সফেন নীল সাগরজলের কন্ট্র্যাস্টে ঠিক অমনপানা সাদা ডানা ভাসানো সীগাল।
বাঁধানো রাস্তার ধারে সাজানো লাল নীল সবুজের মেলা। উজ্জ্বল হালকা সবুজ ঘাস, উজ্জ্বল গাঢ় সবুজ পাতা। সেই রেডিমেড কনট্র্যাস্টে আরও ব্রাইট লাগে।
ব্রাইট, চকচকে।
এ দেশটা শাইনিং।
এক চিলতে ধুলো নেই।
এখানে আকাশের গায়েও ধুলো নেই।
চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
কী ব্রাইট, কী চকচকে, কী শাইনিং।
এখানে রোদের গায়েও ধুলো নেই।
সীগালের ডানায় রোদের গন্ধ কী চড়া।
রোদে ভরে যায় আমার চারপাশ।
আমি ঐ রোদকে ক্যামেরায় ভরি।
ক্যামেরা ভরে যেতে থাকে।
ছবি আর ছবিতে।
ঝকঝকে হাসি, চকচকে লোকজন, ঝকঝকে রোদ্দুর, চকচকে আকাশ - শাইনিং শহরের ছবি।
আর, তারপর একদিন দেখি, আসলে আমার কোন শহরই নেই। আছে কেবল শহরের ছবি। আমি ছবি তুলে চলেছি কতগুলো ছবির।
সবই তো ছবির মতন।
সবাই তো ছবির মতন।
ছবির মতন সুন্দর। পিকচারপারফেক্ট।
আর বেসিক্যলি আমি সেই ছবির ছবি তুলে চলেছি। এক ছবি থেকে আরেক ছবিতে চলে বেড়াচ্ছি। এক ছবি থেকে আরেক ছবিতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। ধাক্কা খাচ্ছি। একটা ছবি পেরিয়ে আরেকটা ছবির মুখে পড়ছি। একটা ছবির পিছনে ঘুরতে ঘুরতে আরেকটা ছবির সামনে গিয়ে পড়ছি।
সব পিকচারপারফেক্ট।
খাপে খাপ।
ডিসক্রিট।
কোন ভীড় নেই। তাই কোন মিশে যাওয়াও নেই।
কোন মীড় নেই।
সব আলাদা আলাদা। একক। ইন্ডিভিজ্যুয়াল। সবাই একক।। সবাই একা।
কোন ভীড় নেই।
কেবল ছবির ভীড়।
আমি হাঁপিয়ে যাই। কিছু ছবির মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে। আমি সারাদিন কেবল একটা ছবি থেকে আরেকটা ছবিতে ঘুরি।
হাঁপিয়ে যাই।
আমি কোন শহর খুঁজে পাই না।
আমি আমার শহরকে খুঁজে পাই না।
আমি ধুলো খুঁজতে শুরু করি। একটু কম ব্রাইটনেস। একটু কম কন্ট্রাস্ট।
একটু কম বাড়াবাড়ি।
ছবিগুলো পোস্ট প্রসেস করতে শুরু করি। আলো কমাই। অশার্পনেস কমাই। স্যাচুরেশন কমাই।
ক্রপ করা শুরু করি। কাটাকুটি করে সব এদিক ওদিক এলোমেলো করে দিই। খাপ থেকে খাপ সরিয়ে একের খোপে অন্যকে ঢোকাতে থাকি। আর এইসব ছবি আপ্লোড করে আলবাম নিয়ে নাড়াচাড়া করি। শহরের মধ্যে আর ছবি খুঁজিনা। এই ছবিগুলোর মধ্যে একটু একটু করে শহরকে খুঁজতে থাকি।
পাইও কি?
আমি দোকানে গিয়ে এক রোদ চশমা খুঁজে আনি। তাকে দেখতে বড় বাজে। কিন্তু তাকে দিয়ে দেখতে বড় ভাল লাগে।
চশমাটা একটু আধটু ম্যাজিক জানে। রোদ্দুরকে নরম করে দিতে জানে। চারপাশ আর অমনি পরিষ্কার ঠেকে না। অনেক অনুঙ্কÄল। একটু মরা মরা। একটু পুরানো। একটু হলুদ মেশানো সেপিয়া টোন।
আমার খারাপ লাগা গুলো একটু একটু কমে।
এমনকি আমি অল্প অল্প রিনরিনে ভাললাগাও পাই।
ম্যাজিক?
আর তাই থেকেই আইডিয়াটা আসে।
আমি আবার ক্যামেরা ধরি। ক্যামেরা দিয়েই দেখা শুরু করি। একটু ম্যাজিক করে। ফিল্টার লাগিয়ে।
প্রি-প্রসেস করি। পোস্ট প্রসেসের কারিকুরি জারি করি ছবি তোলার সময়ই।
জলের উপর রোদ্দুরকে হীরের কুচি বানিয়ে দি। চাঁদে লাগাই ঝিলের জলের জোয়ার। ন্যাড়া মেপলের ডাল দিয়ে তার ক্ষত-বিক্ষত গালে আরো আঁচড় কেটে দি। ঝকঝকে সূর্যাস্তকে বিষণ্ন করে দি। সেই বিষণ্ন আলো এসে পড়ে ধবধবে সাদা বি এম ডব্লুর উপর। একলা পাতা ঝরানো গাছের নিচে সে দু:খী দু:খী একলা দাঁড়িয়ে থাকে, আমার বাড়ি ফেরার সেপিয়া রাস্তায়।
বিকেলটা দু:খী হয়ে যায়।
আমি অল্প চিনচিনে সুখ পাই।
বাড়ি ফিরতে গিয়ে ফুটপাথে দেখি চারটে স্ল্যাব। তৈরি হয়ে গেছে এক এক কোয়াড্র্যান্ট। নিজের ছায়াকে প্লেস কঞ্চরে দি থার্ড কোয়াড্র্যান্টে। একটা শুকনো ঝরা পাতাকেও একটু সরিয়ে নিয়ে আসি, আমার পাশে। রেসিডেন্টস অব দ্য থার্ড কোয়াড্র্যান্ট।
নিজেকে ঠিকঠাক দু:খের কো-অর্ডিনেটে প্লেস করে ভারি একটা সুখ হয়।
একঘর ভর্তি আলো থেকে এক চিলতে আলো তুলে নিয়ে বাকিটা ফেলে দি।
ছাপোষা নিয়ন আলোর সন্ধেকে ভিজিয়ে দি সোডিয়ামের হলুদ বাষ্পে।
বৃষ্টিদিনের কান্নার ফোঁটাটুকুকে পষ্ট ফোকাসে রাখি। বাকি সবকিছু কান্নাভেজা ঝাপসা করে দি।
রাতের আলোর সামনে শাটার স্পিড কমিয়ে দি। চলন্ত গাড়ি থেকে তোলা ছবিতে আলোগুলো সব আঁকাবাঁকা রেখা হয়ে যায়। ক্যামেরা নাড়িয়ে নাড়িয়ে আমি আমার মত ছবি আঁকি। একটার সাথে আরেকটা আলো মিশে যায়। আর ডিসক্রিট নেই কিছু। সব মিশে যায়। আমি আমার মত ছবি আঁকি। ছবিতে গল্প।
আবার কখনো বা সেই রাতের আলোর সামনে শাটার স্পিড বাড়িয়ে দি। অ্যাপারচার ছোট করি। আশপাশ থেকে আর সব মুছে দি। জেগে থাকে কেবল সাঁঝবাতিগুলো। সেই সাঁঝবাতির আলোর মুখোমুখি বসে আমি প্রাণহীন শহরের রূপকথা খুঁজতে থাকি। সাঁঝবাতির রূপকথারা আমাকে দুজ্ঞদণ্ড শান্তি দ্যায়।
কেমন ম্যাজিক?
পচা ম্যাজিক। ধুর! ম্যাজিক তেমন করতে পারি কই? ম্যাজিকের ট্রিক তেমন জানি কই? বই খুলে টের পাই, কথা বলে চলেছি, অথচ ভাষার ব্যাকরণই শিখি নাই! আমার নড়বড়ে লজ্ঝড়ে ক্যামেরায় ফোকাস হারিয়ে হারিয়ে যায়। আমাকে ব্যাকরণবিদেরা বলেন, লেন্স কেনো, নিয়ম মানো, টেকনিক শেখো।
অক্ষমের আস্ফালনে বলি, টেকনিক, টেকনিক! তোমার মন নাই ফোটোগ্রাফি?
আর তখনই সেই সত্যিকারের ম্যাজিকটা হয়।
দেখি,অবাক হয়ে দেখি, এইসব প্রি পোস্ট প্রসেসিং এর অ্যাডজাস্টমেন্টও আর আমাকে করতে হয়না। এলোমেলো এ সব কিছুই একটু একটু করে খুঁজে পেতে থাকি। দেখি, সব তো এলোমেলো হয়ে আছে। কেবল ক্যামেরার অ্যাঙ্গল আর ফ্রেমটুকুর অপেক্ষা।
দেখি সামনের অ্যাপার্টমেন্টের সাজানো গোছানো ঘরে ঢুকে পড়েছে এক চিলতে আকাশ আর এক ফালি মেঘে ঢাকা সূর্য্য।
দেখি আমার অগোছালো ল্যাব চলে গেছে আকাশে ছড়ানো মেঘেদের কাছাকাছি। ১৩৭৩৫ টুইনব্রুক পার্কওয়ের বাড়ির আর নেই ঠিকানা! ল্যাব করিডর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখি লালে লেখা [ন:ভঢ় ]আমাকে নিয়ে শূন্যে পাড়ি দিয়েছে, সেই বাড়ির পথে।
ক্যামেরার ফ্রেমে, জানলার ফ্রেম পেতে ক্যাচ ধরে ফেলি দশটা সূর্যোদয়।
দেখি ওদিকের ঐ সুখী ছিমছাম বাড়িটা খাপে খাপে জোড়া ইঁট জুড়ে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে এপাশের ন্যাড়া মেপল গাছের ছায়ারা।
বরফ সাদা স্ক্রীনে হেঁটে চলে যায় ছায়াছবিরা।
একটু আগে হয়ে যাওয়া বৃষ্টির জমে থাকা জলে ঝুঁকে পড়া ধোয়া মোছা আকাশটাকে আর অমনি ঝকঝকে তকতকে লাগে না। কালো পিচরাস্তার বুকে ভাঙ্গা আয়নায় তার মুখ বিষণ্ন লাগে, তিরতিরে হাওয়ায় সে মুখ কেবলি ভাঙ্গে। কেবলি ভাঙ্গা মুখের জন্ম হয়।
আর কোন অ্যাডজাস্টমেন্ট নয়, প্রসেসিং নয়, আমি শুধু ফ্রেমিংটুকু করি।
আর এমনি বৃষ্টি হলে, এমনি জল জমলে , আমার যেমনটি ইচ্ছে শহরটা তেমনটিই হয়ে যায় যে!
এমনি বৃষ্টির দিনে গল্পরা কবিতা হয়ে যায়, মনে পড়ারা মন কেমন, ইতিহাসেরা রূপকথা আর তাই ফোটোগুলো হয়ে যায় আঁকা ছবি।
বৃষ্টি হলে সব সত্যিগুলো আমি দেখতে পাই। এই যেমন, আমার বরাবরের সন্দ ছিল এই কালো পীচঢালা রাস্তাটার ঠিক নীচেই একটা শহর আছে। রাস্তা আছে। আলো আছে। যে শহরে সব উল্টো হয়। উলটে থাকে। বৃষ্টি হলে সেই শহরটাকে খুঁজে পেয়ে যাই।
দেখি, সেই শহরের রাস্তায় নিটোল যুবতী চাঁদ টালমাটাল।
আর দেখি, রাস্তার লাল নীল সবুজ আলোগুলো সব ধুয়ে যাচ্ছে। একটার সাথে আরেকটা মিশে যাচ্ছে। আর কিছু ডিসক্রিট নেই। মিশে যাচ্ছে, মীড়ের টানে।
দেখি, সেই শহরের রাস্তায় নিটোল যুবতী চাঁদের শরীর ছিঁড়েখুঁড়ে ছড়ানো।
ম্যাজিক। ম্যাজিক কি?
কোন শাটার স্পিড,অ্যাপারচার অ্যাডজাস্টোমেন্ট আর করতে হয় না। ফ্রেমটুকুন করি মাত্র।
দেখি, আমার সাঁঝবাতির হ্যালোজেন রূপকথা ছেড়ে বেরিয়ে এসে বৃষ্টিতে রং লিখছে। আমাকে পাঠাচ্ছে।
পড়তে পড়তে আমার মন ভালো হয়ে যায়। এই শহরে। প্রথমবারের মত।
যদিও এ ঠিক আমার শহর নয়।
এমনিই ছিলাম। মন্দ না। ক্যামেরা দিয়ে দেখতে দেখতে। দেখতে মন্দ না।
মন্দ লাগছিল সেদিন বিকেলবেলা। দোলের আগের বিকেল।
এ শহরে কোন দোল ছিলনা। এ শহরে কোন রঙ ছিলনা। এ শহরে তখনও রাতভরে বরফ। এ শহরে তখনও বসন্ত দূর অস্ত।
একটু অবাক হয়েই দেখলাম, আমার বিষাদবিলাসী মন এই সত্যিকারের দু:খে তেমন সুখী হল না। মন কেমন করছিল। আমার শহরের জন্য।
মন খারাপ করছিল। সত্যিকারের।
আর তখনি দেখলাম।
অপূর্ব সেই আলো। শেষ বিকেলের। আর ঝকঝকে তকতকে আকাশে রঙের সে কী খেলা!
কী ব্রাইটনেস। কী কন্ট্রাস্ট। কী ভরপুর স্যাচুরেশন। টোনের কী ভ্যারিয়েশন। হ্যু এর কী রেঞ্জ।
লাল গোলাপী কমলা হলুদ, নীল আবীরে যত শেড হয়, স-অ-ব। স্পেক্ট্রার স-অ-ব ফ্রিকোয়েন্সি ছুঁয়ে গেছে। স-অ-ব।
বসন্ত আসুক না আসুক, বসন্তোৎসব এসেছে।
এই প্রথমবার চেয়ে দেখলাম। ক্যামেরা ছাড়া।
এই প্রথমবার ভাল লাগল। ক্যামেরা ছাড়া।
এই প্রথমবার আমার শহরকে খুঁজে পেলাম।
ম্যাজিক কার্পেটে চার সাগর পেরিয়ে আমার শহর এখানে ল্যাণ্ড করলো।
নেমে এলো। সন্ধে নামার এই একটু আগে। পুব দিকে নয়,পশ্চিমেতেই।
আমার এই পশ্চিম খোলা জানলায়।
ম্যাজিক! ম্যাজিক! ম্যাজিক!
তিন সত্যি।
আর তারপর থেকে ম্যাজিকটা থেকে থেকেই ঢুঁ মেরে যায়।
এই শহরে অনেক পুজো আছে, কিন্তু শহরের কোন পুজো নেই। আমারো তাই পুজো নেই।
কোনবারেই থাকেনা। মনখারাপ ছাড়া আর কেউ থাকেনা।
সব পুজো কেমন হারিয়ে যায় কাশফুলের ওই খ্যঁ¡কশিয়ালি রঙের রোঁয়ার ভিতর।
আর সেদিন, এই ঠিক এক মাস আগে ফ্লাইটে উঠতেই, ফ্লাইটটা একটু উঠতেই দেখি সারি সারি কাশ।
এই ঠিক এক মাস আগেই আরো অকালে বোধন হয়ে গেল।
ম্যাজিক।
সত্যি।
0 comments:
Post a Comment