Sunday, June 2, 2019

কসমসঃ এ পার্সোনাল ভয়েজ – রিভিউ


কার্ল সেগানের কসমস সিরিজ নিয়ে সারা পৃথিবীতে এতো ভাষায় এতো কিছু লেখা হয়েছে, যে আর কী লেখার বাকী আছে, সেটা ভেবে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্ত তখনই মনে পড়লো সিরিজের প্রথম লাইন – ‘‘কসমস হচ্ছে, যা কিছু বর্তমান,যা অতীতে ছিলো,বা ভবিষ্যতে আসবে।’’ যে সিরিজের শুরুই এই বাক্য দিয়ে (অ্যান ড্রুইয়ানের বক্তব্য অরিজিনাল কসমস-এ ছিলো না। কার্ল সেগানের মৃত্যুর পর তা যুক্ত করা হয়েছে) সেটা নিয়ে যতোই লেখা হোক না কেন, তা কখনোই যথেষ্ট নয়।

এ মুহূর্তে আপনি যেখানে আছেন, আপনার হাতের তালু থেকে শুরু করে ওই দূর আকাশ পার হয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন আলোকবর্ষ – এই ক্রমপ্রসারমান মহাবিশ্ব, এর গঠন-উপাদান-ইতিহাস-ভবিষ্যৎ, সবই কসমস-এর অংশ। কাজেই প্রশ্ন হচ্ছে উল্টো। এতো বড় রিভিউতেও কসমসঃ এ পার্সোনাল ভয়েজ নিয়ে কতটুকু বলা সম্ভব?

সিরিজ পরিকল্পনাঃ
কসমস সিরিজের কাঠামো অনেকটা ক্লাসিক ওল্ড স্কুল টাইপের। ‘যা শিখবে, তার ইহকাল-পরকাল-মহাকাল সব জানবে’- এমন। এক এপিসোডে শতেক বিষয়ের মারদাঙ্গা নেই। আমাদের সাথে নিয়ে কাল্পনিক জাহাজে করে যে যাত্রা শুরু করেছিলেন সেগান, তার পথে যখন যা দেখেছেন, এক এপিসোডে তাতেই ফোকাস করেছেন। মানুষের ইতিহাস ও বিবর্তন, পৃথিবী, তার ছায়াপথের অবস্থান, নক্ষত্রপুঞ্জের জন্ম-মৃত্যু-দ্বৈরথ, পদার্থবিজ্ঞান, শরীরবিজ্ঞান বা বিজ্ঞানের কোনো একটি শাখার কোনো একটি অংশ হাতে নিয়ে – তার অতীত থেকে শুরু করে, তাকে নিয়ে মানুষের মাঝে গড়ে ওঠা কল্পনা/মিথ, বিজ্ঞানীদের কৌতুহল, অনুমান, অন্বেষণ, গবেষণা, তার সত্য মিথ্যা যাচাই আলোচনা, তার আজকের অবস্থান, ভবিষ্যৎ, কোনো সিদ্ধান্তে পৌছুনো বা প্রশ্ন জারি রাখা, এবং এপিসোডের সেই বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সাথে কসমস-এর যোগাযোগ করিয়ে দেয়া- এভাবেই একেকটি এপিসোড এগিয়েছে। সেগান সতর্ক ছিলেন একবারের জন্যও যেনো তাকে শিক্ষক না মনে হয়। মনে হয়েছে কাল্পনিক জাহাজে আমরাও তার সহযাত্রী, একই সাথে কসমসকে একটু একটু করে আবিষ্কার করছি। আমাদেরই আবিষ্কার তাঁর জবানীতে শুনছি।

এপিসোডভিত্তিক বিষয়বস্তঃ

এপিসোড ১, মহাজাগতিক সমুদ্রের সৈকত – কাল্পনিক জাহাজে করে আট বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূর থেকে রওনা হলেন সেগান; লোকাল গ্রুপ, ওরিয়ন নেবুলা, অ্যান্ড্রোমিডা, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি’র পরিচয় দিতে দিতে আসলেন পৃথিবীতে। যে আশ্চর্য উপায়ে প্রায় দু হাজার বছর আগে এরাটোসথিনিস পৃথিবীর পরিধি বের করেছিলেন, তার বর্ণনা এবং লাইব্রেরি অফ আলেকজান্ড্রিয়ায় জ্ঞানচর্চার স্বর্ণযুগের কথা বললেন। মহাজাগতিক ক্যালেন্ডার এবং তাতে মানুষের অবস্থানের সাথে আমাদের পরিচয় করালেন।



কল্পনার আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি




এপিসোড ২, মহাজাগতিক সুরের ঐকতান – এপিসোডের শুরুতে সেগান জাপানের হেইকে সভ্যতার সামুরাইদের গল্প দিয়ে কৃত্রিম নির্বাচন প্রকৃয়া বোঝালেন, তারপর ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনবাদ, মানবদেহে জিন, ডিএনএ, ও বিবর্তনের সাহায্যকারী হিসেবে মিউটেশনের কাজ আলোচনা করেছেন।

এপিসোড ৩, সকল জগতের সামঞ্জস্য – জ্যোতিষশাস্ত্র এবং জ্যোতিষীদের ভন্ডামির কথা দিয়ে শুরু হয়েছে এই এপিসোড। এসেছে পৃথিবীকেন্দ্রিক ও সূর্যকেন্দ্রিক ব্রহ্মাণ্ডের থিওরী নিয়ে টলেমী আর কোপার্নিকাসের বিবাদের কথা। সেগান আরও বলেছেন, ইয়োহানেস কেপলার নামে এক প্রায় উদ্বাস্তু জার্মান গণিতবিদ-জ্যোতির্বিদ তার সারা জীবনের সাধনায় কিভাবে বের করলেন গ্রহের গতি সংক্রান্ত তিনটি সূত্র।



এপিসোড ৪, স্বর্গ আর নরক – এপিসোড শুরু হয়েছে তুঙ্গুসকা ইভেন্টের সঠিক কারণ অনুসন্ধান, এ বিষয়ে বিভিন্ন ধারণা ও মতবাদের আলোচনা নিয়ে। পর্যায়ক্রমে এসেছে, ধূমকেতু নিয়ে প্রাচীন কাল থেকে মানুষের ভীতি, কুসংস্কার, ক্যান্টারবীউরি সন্ন্যাসীদের অভিজ্ঞতা থেকে চাঁদের ওপর আঘাতের গল্প, শুক্রের ভূ-পৃষ্ঠ ও বিষাক্ত বায়ুমণ্ডলের কথা এবং পৃথিবীতে গ্রিনহাউজের প্রভাব।

এপিসোড ৫, রক্তিম গ্রহের জন্য সুনীল ছোঁয়া – সেগানের প্রিয় বিষয়, মঙ্গল গ্রহ-এর প্রতি উৎসর্গ করা হয়েছে পুরো এপিসোড। এখানে আছে মঙ্গল নিয়ে যুগ যুগ ধরে মানুষের কৌতুহল, সায়েন্স ফিকশন, এডগার রাইজ বারৌস-এর রগরগে নভেলে মঙ্গলবাসীদের নিয়ে অদ্ভুতুড়ে কল্পনার কথা। এসবের মাঝখানে আছে, পৃথিবীর প্রথম তরল জ্বালানীর রকেট উদ্ভাবন করার উদ্দেশ্যে রবার্ট গডার্ডের যাত্রা, মঙ্গলের ভূ-পৃষ্ঠ, আগ্নেয়গিরি, পিরামিড আর পর্বতমালার কথা, এবং ভাইকিং ১ এবং ২-এর মঙ্গলভ্রমণের বর্ণনা।


শিল্পীর চোখে এডগার রাইজ বারৌস-এর 'বারসুম'

শিল্পীর চোখে এডগার রাইজ বারৌস-এর ‘বারসুম’




এপিসোড ৬, অভিযাত্রীদের গল্প- দুই সময়ের দুই দল অভিযাত্রীদের গল্প আছে এতে। একদল, সপ্তদশ শতাব্দীর ডাচ- যারা স্থাপত্যশিল্প, বিজ্ঞান, অনুবাদ সাহিত্য, সঙ্গীতে অগ্রগামী ছিলো; যারা সমুদ্রাভিযান করতো অজানা সব দেশের উদ্দেশ্যে। আরেকদল এদেরই ভবিষ্যৎ কর্ণধার, যারা কয়েকশ বছর পর, অন্য আরেক অজানার উদ্দেশ্যে ভয়েজার ওয়ান এবং টু ভাসিয়েছে মহাকাশে।

এপিসোড ৭, রাতের মেরুদণ্ড– প্রাচীনকাল থেকে রাতের রহস্যময় আকাশের তারাদের প্রতি মানুষের কল্পনা, মিথ ও জিজ্ঞাসা অবলম্বনে তৈরি এই এপিসোড। প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে এবং তারাদের নিয়ে গ্রীক আয়োনিয়ান বিজ্ঞানীদের ধারণাগুলো দেখাতে, আমাদের নিয়ে সেগান চলে গিয়েছিলেন ডেমোক্রিটাস আর অ্যারিস্টার্কাসের জন্মস্থান, মাইলিটাস আর এবডেরাতে। আর একইসাথে গিয়েছিলেন ব্রুকলিনে, নিজের স্কুলে – বাচ্চাদের চমৎকার সব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে।


backbonenight_600x337

গ্রীসের উপকূলে কার্ল সেগান




এপিসোড ৮, স্থান ও কালের অভিযাত্রীগণ– পাওলো ও ভিনচেজো দুই ভাইয়ের গল্প দিয়ে, উত্তর ইটালির টাসকানিতে বসে সেগান বললেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা সূত্রের মতো জটিল জিনিস, টাইম ডায়লেশন প্যারাডক্স, আলোর গতির সাপেক্ষে আমাদের গতি-সীমাবদ্ধতা, কী হবে আলোর গতির অর্ধেকের চেয়ে বেশি বা কাছাকাছি গতিতে গেলে, সময়ই বা চলবে কী গতিতে। বলেছেন ওয়ার্মহোলের বেসিকস এবং এর ওপর ভিত্তি করে লেখা তার উপন্যাস ‘কনট্যাক্ট’-এর কথা।

এপিসোড ৯, নক্ষত্রদের জীবন –  একটা সামান্য অ্যাপেল পাইয়ের টুকরো থেকে সেগান আমাদের নিয়ে গেছেন বস্তুর পরমাণুর গঠন, এর বৈশিষ্ট্য, পরমাণুর আবিষ্কারের ইতিহাস, বস্তুর মৌলিক কণা- নিউক্লিয়াস, ইলেকট্রন ও প্রোটনের কথা; নিউক্লীয় ফোর্স যাদের আলাদা হতে দেয়না। বড় সংখ্যা নিয়ে ‘গুগল’ এবং গুগলপ্লেক্স-এর মজার গল্প করতে গিয়ে বিস্তর দৌড়ঝাঁপও করেছেন! এরপর ছোঁ মেরে উঠিয়ে নিয়েছেন মহাবিশ্বে। বলেছেন নক্ষত্রের বুকে জন্ম নেয়া পরমাণুর কথা, তারার জন্ম-মৃত্যুতে কেমিক্যাল এলিমেন্টের ভূমিকা, তার মাঝখানে রেড জায়ান্ট, সুপারনোভা, নিউট্রন স্টার, পালসার, এবং ব্ল্যাক হোলের কথা।

9

এপিসোড ১০, নিরন্তরের প্রান্ত – এ পর্বে আছে বিগ ব্যাং, এবং মহাবিশ্বের গঠন, বিভিন্ন ছায়াপথের রুপ, একাকীত্ব এবং ছায়াপথগুলোর সংঘর্ষ। সরস ভাষায় কাল্পনিক ‘ফ্ল্যাটল্যান্ড’ দিয়ে বিভিন্ন ডাইমেশন সম্বন্ধে ধারণা দিয়েছেন। গিয়েছেন ভারতে, শিবের তাণ্ডবনৃত্য দিয়ে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি ও ধ্বংসের ধারণার কথা বলেছেন আমাদের।

এপিসোড ১১, স্মৃতির স্থায়িত্ব – শুরুতেই সেগান সাগরতলের তিমিদের জীবনধারা, তাদের মধ্যে যোগাযোগ, বুদ্ধিমত্তার প্রমাণ দিয়েছেন কাব্যিক ভাষায়। এরপর এসেছেন মানব মস্তিষ্কের গল্প বলতে। বলেছেন, মস্তিষ্ক কী,এর বিভিন্ন অংশের কাজ, মস্তিষ্কের বিবর্তন, কিভাবে এখানে লাইব্রেরীর মতো কোন স্মৃতি, কোথায় রয়ে যায় এবং কিভাবে বই, কম্পিউটার, ও গ্রন্থাগারের সাহায্যে আমরা সমষ্টিগত জ্ঞান সংরক্ষণ করে চলেছি।


Cosmos-11-Persistence-of-Memory[06-05-47]

সেগান বোঝাচ্ছেন, আমাদের ব্রেইন নিয়ে।




এপিসোড ১২, ছায়াপথের জ্ঞানকোষ – সেগানের আরেক প্রিয় বিষয়- পৃথিবীর বাইরের বুদ্ধিমান সভ্যতা/এলিয়েন। বলেছেন, সঠিক কসমিক রেডিও সোর্স ডিটেক্ট করার মাধ্যমে কিভাবে তাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব। অন্যদিকে দেখিয়েছেন,UFO নিয়ে মানুষের ভুয়া গল্প, কুসংষ্কার! গল্পের মত বলে গেছেন কিভাবে হায়ারোগ্লিফিকস-এর পাঠোদ্ধার করেছেন শ্যাম্পোলিয়ন, হায়ারোগ্লিফিকস পড়ার পদ্ধতি! আর সবশেষে, সেগানের কল্পনায় এসেছে ভিনগ্রহবাসীদের তৈরি বিভিন্ন বিশ্বের তথ্য সমৃদ্ধ এনসাইক্লোপেডিয়া গ্যালাক্টিকা।


Cosmos-12-Encyclopaedia-Galactica[06-10-19]

তরুণ শ্যাম্পোলিয়নের চরিত্র বিস্মিত হচ্ছে হায়ারোগ্লিফিকস দেখে; এমন এক ভাষা দেখে, যার অর্থ ঐ সময়ে কেউই জানতো না। যে ভাষার অর্থ একদিন সেই বের করবে।




এপিসোড ১৩, পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব করবে কে? – পুরো সিরিজের সারমর্ম বলা চলে এই শেষ এপিসোডকে। একটু একটু করে বার বার বলে গেছেন, যা দেখিয়েছেন গত বারো পর্বে। আলেকজান্ড্রিয়া লাইব্রেরির ধ্বংস, এর শেষ কিউরেটর হাইপেশিয়ার হত্যা থেকে শুরু করে, বর্তমান পৃথিবীর নিউক্লিয়ার টেকনোলজি- এই লোভ এবং যুদ্ধবাজ প্রবৃত্তি মানুষকে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম/পৃথিবীকে কিভাবে নরক বানাতে পারে, তা নিয়ে শংকা প্রকাশ করেছেন। মানবজাতি তার মৃত্যুর স্বার্থে যুগের পর যুগ ধরে যে অর্থ ঢেলে যাচ্ছে, সেটা বিজ্ঞানচর্চায় উৎসর্গ করলে একদিন আমাদের আন্তঃনাক্ষত্রিক ভ্রমণের স্বপ্ন সত্যি হবে, আমরা ছড়িয়ে পড়বো দৃশ্যমান ব্রহ্মাণ্ডের সবখানে, কার্ল সেগান সেই আশার আলো দেখিয়েছেন।

বাংলা সাবটাইটেল by অনুবাদকদের আড্ডা
কসমস-এর বাংলা সাবটাইটেল, এক কথায় ম্যাজিক! কোথাও সেগান বা তার ভাষাকে ছাপিয়ে যাবার চেষ্টা ছিলো না। অনুবাদে সাবধানতা, সংযম, বিনয় এবং সেগানের প্রতি শ্রদ্ধা- এই চার বৈশিষ্ট্যই চমৎকারভাবে চোখে পড়ে। অরিজিনাল এবং অনুবাদ সাংঘর্ষিক ছিলো না কোথাওই; বরং প্রতিটি বাক্যের গঠন এমন, যেনো কার্ল সেগানের কথা শোনা এবং সাবটাইটেল পড়া- দুটো কাজই আপনি সমানভাবে চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেন। এছাড়াও, যেখানে প্রয়োজন, তথ্যের আপডেট হিসেবে বা আরেকটু ভালো করে বোঝার সুবিধার্থে, অনুবাদের পাশাপাশি সম্পাদকের ছোট্ট ছোট্ট নোটও আছে।

উপস্থাপনাঃ
কার্ল সেগান ছিলেন এক প্রেমিক বিজ্ঞানী! সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড ঘুরে, ভালোবাসার টানে পৃথিবীতে ফিরে এসেছেন বার বার! শুক্রের উত্তপ্ত বায়ুমণ্ডলের কথা বলতে গিয়ে পৃথিবীতে গ্রীনহাউজ প্রভাব নিয়ে আতংকিত হয়েছেন। লাল গ্রহ মঙ্গলের গান গেয়েছেন নীল পৃথিবীর সুরকে সাথে নিয়ে। কাল্পনিক জাহাজে চড়ে, ব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোথাও বুদ্ধিমান প্রাণের স্বপ্ন দেখতে দেখতে পৃথিবীর সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়েছেন তিমিদের মহাকাব্য শোনার আশায়, ভয়েজার ১ তার অনন্ত যাত্রার আগে শেষবারের মতো সৌরগ্রহগুলোর যে ছবি তুলে পাঠিয়েছিলো, তাতে পৃথিবীর ছবির কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন! আবার, কল্পনায় ভিনগ্রহবাসীদের তৈরী ‘ছায়াপথের জ্ঞানকোষ’-এ হাতড়ে হাতড়ে লক্ষ বিশ্বের মাঝখানেও পৃথিবীর নাম খুঁজেছেন, এই গ্রহ সংক্রান্ত তথ্য খুঁজেছেন!



কসমস সিরিজের একটি এপিসোডের আপডেট অংশ।




কার্ল সেগান এক অদ্ভুত শান্ত প্রকৃতির বিজ্ঞানী ছিলেন। বিপ্লবী, কিন্ত বিদ্রোহীদের মতো আচরণ ছিলো না তার। কোনো মতবাদই, যা আজ ভুল প্রমাণিত হয়েছে, তা শুরুতেই ঝেড়েঝুড়ে ফেলে দেননি। সাথে রেখেছেন। বলেছেন, “বিজ্ঞান একটা সমন্বিত প্রচেষ্টা, যার বিস্তৃতি অনেক প্রজন্ম জুড়ে”। তা সে যুগের পর যুগ ধরে আকাশের নক্ষত্রপুঞ্জে ঘটিবাটি দেখা মানুষ হোক, তুঙ্গুসকা ইভেন্টের ব্ল্যাকহোল-অ্যান্টিম্যাটার-অ্যালিয়েন স্পেসশিপ থিওরিবাজ লোকজন হোক, ভিনগ্রহবাসীদের আকৃতি বা জ্ঞানচর্চা নিয়ে ক্রিশ্চিয়ান হইগেনস-এর মতো জ্যোতির্বিজ্ঞানীর অদ্ভুত সব কল্পনা হোক, হেইকে সামুরাই কাঁকড়া নিয়ে জেলেদের বিশ্বাস, বিজ্ঞানীদের পর্যবেক্ষণের সীমাবদ্ধতার ফলাফল স্বরুপ শুক্রে ডায়নোসরের উপস্থিতি বিষয়ক রুপকথা হোক, বা বাইবেলের ঘটনাবলীতে ধুমকেতুর প্রভাব সংক্রান্ত ইমানুয়েল ভেলিকভস্কির ধারণা!

সেগান সব ঝুলিতে নিয়ে, ঠাণ্ডা মাথায়, তার অপ্রতিম কণ্ঠে গল্পের মতো বলে গেছেন একটার পর একটা। নম্র ভাষায় প্রশ্ন করতে করতে ধীরে ধীরে তার পক্ষে-বিপক্ষে প্রমাণ হাজির করেছেন। এমনকি ব্রহ্মাণ্ডে উন্নত সভ্যতার সাথে যোগাযোগের বিষয়ে নিজের আজীবন উত্তেজনাকে শেষ পর্যন্ত লাগাম পরিয়ে বন্দী করেছেন ফ্র্যাংক ড্রেক ইকুয়েশনের খাঁচায়!

কসমস সিরিজ নিয়ে সেগানের এই সাধনা অব্যাহত ছিলো বহু বছর ধরে। এই সিরিজ প্রচার হওয়ার দশ বছর পরেও বিভিন্ন বিষয়ের আপডেট রেকর্ড করে, ওই সংক্রান্ত এপিসোডে যুক্ত করেছেন কার্ল সেগান।

লোকেশন ও মিউজিকঃ
কার্ল সেগান একদম প্রথম এপিসোডে বলেছিলেন, তাকে সুযোগ দেয়া হলে তিনি দু হাজার বছর আগের রয়্যাল লাইব্রেরী অফ আলেকজান্ড্রিয়ায় চলে যেতে চান। তাদের রেকর্ডিং প্রসেস, দৈনন্দিন কর্মপদ্ধতি নিজের চোখে দেখতে চান। বিজ্ঞানের সুফল ভোগ করার বিলাসিতা নয়, এর ভিত্তি হতে চেয়েছিলেন তিনি। সেই অন্বেষণে কসমস সিরিজ সাথে নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন আলেকজান্ড্রিয়ার রাজপথ থেকে নাসা’র জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরি পর্যন্ত।


ডেথ ভ্যালীতে কসমস শ্যুটিং এর ছবি।

ডেথ ভ্যালীতে কসমস শ্যুটিং এর ছবি।




আরামদায়ক, সাজানো রয়্যাল বোট্যানিক গার্ডেন অফ ইংল্যান্ড থেকে নিউ মেক্সিকোর জ্বলজ্বলে সূর্যের নিচে। কখনও কোলাহল মুখর গ্রীসে, আবার ইটালির শান্ত গ্রাম টাসকানিতে। ব্রুকলিনের ব্যস্ত রাস্তা থেকে ‘রেজিনা ম্যারিস’ জাহাজে! নীল নদ পার হয়ে, শ্যাম্পোলিয়নের ভূত ঘাড়ে নিয়ে গিয়েছেন মিশরের সেই গ্রেট টেম্পল অফ কারন্যাক-এ! আবার এসেছেন আমাদের ঘরের কাছে ইন্ডিয়ায়।

পেছনে কখনও কসমস-এর বিশালতা, কখনও পৃথিবীর জন্য হাহাকার করে বেজে চলেছে বাখ, বিটোফেন, স্ট্যাকোভিক, টেডি লারসি, হেলডন, পিঙ্ক ফ্লয়েড, ট্র্যাডিশনাল জাপানিজ সুর এবং আরও অসামান্য সব মিউজিক! বিশেষ করে  ইভ্যাঞ্জেলোস ওডেসিয়াস পাপাথানাসিউ (ভ্যাঞ্জেলিস নামে পরিচিত) এর কথা বলতে হয়, যার অপূর্ব সুন্দর কিছু মিউজিক, যেমন আলফা, ক্রিয়েশন, পালস্টার… কসমস এর সঙ্গীতকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।



মিউজিক কম্পোজার ভ্যাঞ্জেলিস




শুধু তা-ই নয়। কসমস এর টাইটেল এবং এন্ড ক্রেডিটের মিউজিকও নেয়া হয়েছে এই অসাধারণ মেধাবী গ্রীক কম্পোজারের এর কম্পোজ করা মিউজিক ‘হেভেন অ্যান্ড হেল’ এর লাস্ট মুভমেন্টের অংশ থেকে (3rd movement)।

অরিজিনাল কসমস-এর শেষ দৃশ্যে (আপডেট ছাড়া অংশে) ড্যান্ডেলায়ন বীজের মতো দেখতে, সেই কাল্পনিক জাহাজের ক্যাপ্টেনের সিটটা শূন্য ফেলে চলে যান কার্ল সেগান। অসম্ভব কষ্টকর একটা মুহূর্ত! এবং অসম্ভব আনন্দেরও… চলে গিয়ে সেগান যেনো বুঝিয়ে দেন, তার আলাদা কোনো সত্তা নেই, কসমসের সাথে একাত্ব হয়ে গেলেন তিনি, ঠিক যেভাবে ড্যান্ডেলায়ন বীজটাকে একদিন বাতাসে উড়িয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন।
এই যাত্রা চলবে!

 

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/carl_sagan_cosmos_review/

Saturday, June 1, 2019

মিলান কুন্ডেরার দীর্ঘ সাক্ষাৎকার : গল্পের শৈলী


সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ক্রিশ্চিয়ান স্যালমন

অনুবাদ : নৃপেন্দ্র নাথ সরকার



১৯৮৩ সালের ফলে প্যারিসে মিলান কুন্ডেরার সাথে কয়েকবার মিলিত হওয়ার সুবাদের ফসলই এই সাক্ষাৎকার। মন্টপারনাসির কাছে তাঁর চিলেকোঠা এপার্টমেন্টে আমাদের সাক্ষাৎ হত। কুন্ডেরা তার ছোট ঘরটা অফিসের কাজে ব্যবহার করতেন। সাক্ষাতের জন্য আমরা সেখানেই সাক্ষাৎ করতাম। দর্শন এবং সংগীত শাস্ত্রের পুস্তকে তাঁর শেলফগুলো ঠাসা থাকত। ঘরে একটা পুরাতন আমলের টাইপরাইটার এবং একটি টেবিল ছিল। কক্ষটিকে কখনওই একজন বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিত্বের মনে হত না, মনে হত এটা যেন কোন একজন ছাত্রের পড়ার ঘর। একটা দেয়ালে পাশাপাশি দুটো ছবি টাঙ্গানো ছিল। একটা ছিল তাঁর বাবার – পিয়ানো বাজাতেন। আর একটা ছিল লিওস জানাচেকের। লিওস চেকোশ্লোভাকিয়ার একজন গীতিকার ছিলেন। মিলান তাঁকে খুবই শ্রদ্ধা করতেন।


আমরা অনেকবার এখানে সাক্ষাত করেছি। জার্মান ভাষায় আমাদের দীর্ঘ আলাপ হত। আলাপের সময় আমাদের টেপ রেকর্ডার থাকত না। একটা টাইপরাইটার থাকত। আর থাকত একটা কাঁচি এবং আঠা। ধারণকৃত অনেক কাগজ আমরা ফেলে দিতাম। অনেকবার ঘষামাজা করার পর ধীরে ধীরে চুড়ান্ত সাক্ষাতকারটি বেরিয়ে আসত। 

“দি আনবিয়ার‍্যাবল লাইটনেস অফ বিইং” বইটি প্রকাশের সাথে সাথেই এটি বেস্ট সেলারের মর্যাদা লাভ করে। আর এই সাক্ষাৎকারটির ব্যবস্থা করা হয় ঠিক এই সময়টাতেই। খুব হঠাৎ করে এত যশ লাভ তাঁকে খুবই ব্যতিব্যস্ত করে তুলে। কুন্ডেরা অবশ্যই একমত হবেন ম্যালকমের সাথে যে, “একজনের বসতবাড়ীতে আগুন লাগার চেয়েও সাফল্য যেন একটু বেশী রকমই বিভৎস্য দুর্ঘটনা। যশ আত্নার অন্তস্থল হরণ করে ফেলে।” একদিন তাঁর উপন্যাসের উপর গনমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু মন্তব্যের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। তিনি বললেন, “আমার উপর খুবই বাড়াবাড়ি করা হয়েছে।”

অনেক সমালোচকই লেখকের সৃষ্টিশীলতা বাদ দিয়ে লেখকদের ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক বিচারবোধ, এবং ব্যক্তিগত জীবন-যাপনের প্রতিই বেশী আগ্রহী হয়ে থাকে। নিজকে নিয়ে কিছু আলোচনায় কুন্ডেরার অনীহা এসব সমালোকদেরকে আশাহত হয়ে থাকেন। “লে নওভেল অবজারভেটিওর”কে কুন্ডেরা বিরক্তি প্রকাশ করে বলেছেন, “নিজের সমন্ধে বলাটা খুবই বিরক্তিকর। চরিত্র সৃষ্টির শৈলী এবং সংগীত বা কবিতা রচনা শৈলীর মধ্যে এখানেই তফাৎ।”

কাজেই নিজের সমন্ধে বলতে অনীহাই উপন্যাসের প্রতি মনোযোগ, সাহিত্য সৃষ্টি এবং এর গঠনই হয়ে উঠে অনুরাগের কেন্দ্র ভূমি।


ক্রিশ্চিয়ান স্যালমন : আপনি বলেছেন যে আপনি আধুনিক সাহিত্য জগতের যে কোন ঔপন্যাসিকের চেয়ে ভিয়েনার ঔপন্যাসিক রবার্ট মুসিল এবং হারম্যান ব্রকের প্রতিই আপনি বেশী নৈকট্য অনুভব করেন। আপনার মতই ব্রক মনে করেন – মনস্তাত্তিক উপন্যাসের দিন শেষ হয়ে গেছে। ভিন্ন ভাবে তিনি এটাকে বলেন, “পলিহিস্টোরিক্যাল” উপন্যাস।

মিলান কুন্ডেরা : মুসিল এবং ব্রক নভেলের উপর বিপুল পরিমান দায়িত্ববোধ আরোপ করে থাকেন। তাঁরা এটাকে দার্শনিক উদ্ভাবনের চুড়ান্ত সমন্বয়করণ হিসেবেই দেখেন। মানবসমাজ শেষমেষ এই একটি জায়গাতেই কেবল প্রশ্ন রাখতে পারে। তাঁরা অনুধাবন করেছেন যে উপন্যাস দর্শন সমন্বয়ের এক শক্তিশালী ক্ষেত্র বিশেষ; এটা কবিতা হতে পারে, বা ফ্যান্টাসী, দর্শন, সংক্ষিপ্ত সত্যভাষণ কিম্বা কোন একীভূত প্রবন্ধ মাত্র। এ বিষয়ে ব্রক একটি চিঠিতে একটি বলিষ্ঠ দৃষ্টান্ত রাখেন। সে যা হোক, আমার মনে হয়, “পলিহিস্টোরিক্যাল নভেল” জাতীয় শব্দ চয়ন করে তিনি তাঁর নিজের উদ্দেশ্যকেই অস্পষ্ট করে ফেলেছেন। আসলে ব্রকের স্বদেশী, এডেলবার্ট স্টিফারের ১৮৫৭ সালে প্রকাশিত “ডার নাশুমার” (ভারতীয় গ্রীষ্মকাল) একটি খাটি পলিহিস্টোরিক্যাল নভেল এবং একটি বিশুদ্ধ অস্ট্রিয়ান গদ্য সাহিত্য। উপন্যাসটি খুবই বিখ্যাতঃ নিটশ্যাযে এটিকে জার্মান সাহিত্যের চারটি বিখ্যাত কাজের একটি কাজ বলেই গ্রহন করে। অধূনা এটি অপঠনযোগ্য। এর মধ্যে আছে ভূবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা, চারুশিল্প, অংকন শিল্প, এবং স্থাপত্যবিদ্যা; কিন্তু এই বিশাল উর্দ্ধমূখী তথ্যভান্ডার প্রকারান্তরে মানুষ এবং তার পরিবেশকে বাইরেই রাখে। সুক্ষ্ণভাবে এর কারণ, “ডার নাশুমার” একটি পলিহিস্টোরিক্যাল, বিশেষ নভেল বলতে যা বুঝায় তা এটি নয়। ব্রকের বেলায় কিন্তু এটি নয়। ভিন্নতঃ! “একটা উপন্যাস যা উদ্ভাসিত করতে পারে” তিনি তাই উৎসারিত করতে সচেষ্ট ছিলেন। ব্রক একটি বিশেষ বস্তুর অস্তিত্বকে “উপন্যাসিক উপলব্ধি” নামে অভিহিত করতে চাইছেন। আমার মতে, “পলিহিস্টোরিক” শব্দটির ব্যাখ্যা হবে, “এই শব্দ দ্বারা কোন অস্তিত্বকে প্রকাশ করতে প্রতিটি পদ্ধতি এবং জ্ঞানের সব মাধ্যমকে একীভূত করা বুঝায়।” হ্যা, আমি এই ব্যাখ্যার সাথেই একমত পোষণ করি। 



ক্রিশ্চিয়ান স্যালমন : “লে নোওভেল অবজারভেটিওর” মেগাজিনে প্রকাশিত আপনার দীর্ঘ প্রবন্ধ পড়ে ফ্রেঞ্চবাসীরা ব্রককে নতুন করে আবিষ্কার করেছে। আপনি তাঁর অনেক প্রশংসা করেছেন, কিন্তু তার পরেও আপনি তাঁর একজন সমালোচক। প্রবন্ধের শেষে আপনি লিখেছেন, “সব বড় মাপের লেখাই (যেহেতু তা বড় মাপের) কিছুটা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।”

মিলান কুন্ডেরা : শুধু ব্রকের অর্জন নয়, তিনি যে সব লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন নি সব মিলিয়েই তিনি আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস। যে সব কাজ তিনি সম্পূর্ণ করতে পারেননি তা আমাদেরকে আর্টের নতুন আদল বুঝতে সহায়তা করে, যেমনঃ (১) অপ্রয়োজনীয় জিনিষ বর্জন (স্থাপত্যের স্বচ্ছতাটুকু বিসর্জন না দিয়ে আধুনিক পৃথিবীতে অস্তিত্বের জটিলতাটুকু ধারণ); (২) “নভেলিস্টিক কাউন্টারপয়েন্ট” (দর্শন, বর্ণনা এবং কল্পনা সমন্বয়ে এক একক সংগীতভূবন সৃষ্টি); (৩) বিশেষত উপন্যাসমূলক প্রবন্ধ সাহিত্য (অন্য কথায় বলা যেতে পারে, সরাসরি এবং পরিচ্ছন্নভাবে প্রকাশের ভংগী দাবী না করে, অনুকল্প, বিনোদন ভঙ্গিমা বা তীর্যকারে প্রকাশ)।


ক্রিশ্চিয়ান স্যালমন : আপনার সমুদয় সৃষ্টিই মনে হয় এই তিনটি সূচকের আওতায় পড়ে।

মিলান কুন্ডেরা : কোন উপন্যাসকে পলিহিস্টোরিক্যাল আলোর অস্তিত্বে আনতে গেলে, আপনাকে অপ্রয়োজনীয় শব্দ সমূহ বাদ দেওয়ার কায়দাটা রপ্ত করতে হবে, এটাকে সংক্ষিপ্ত করনের কৌশল বলা যেতে পারে। অন্যথায় আপনি অসীম দীর্ঘ রচনা লেখার অভ্যাসের দাসে পরিনত হবেন। মুসিলের যে দুই-তিনটা উপন্যাস আমি খুবই ভাল মনে করি “দি ম্যান ওইদাওট কোয়ালিটিস” তাদের মধ্যে একটা। কিন্তু আপনি আমাকে এদের মধ্যে অতিকায় এবং অসম্পূর্ণ লেখাকে তারিফ করতে বলবেন না। একটা রাজপ্রাসাদের কথা ভাবুন। আপনার চোখ কখনই গোটাটাকে একসাথে দেখতে পারবে না। নয় ঘন্টা ব্যাপী একটা স্ট্রিং কোয়ার্টেটের কথাই ভাবুন। মানুষের অনুধাবনের একটা সীমাবদ্ধতা আছে। এই সীমার বাইরে যাওয়া ঠিক নয়। আমাদের মনে রাখারও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। আপনি একটা লেখা শেষ করেছেন, তারপরেও আপনি লেখার শুরুটা মনে করতে পারবেন। যদি না হয়, উপন্যাসটি তার স্বরূপ হারায়। এর “আরকিটেক্টনিক ক্ল্যারিটি” হয় ঘোলাটে।


ক্রিশ্চিয়ান স্যালমন : “দি বুক অফ লাফটার এন্ড ফরগেটিং” সাতটি অধ্যায়ের সমন্বয়। আপনি সংক্ষেপ করনের দিকে নজর না দিলে আপনি সাতখানি পূর্ণ দৈর্ঘ্য উপন্যাস লিখতে পারতেন।

মিলান কুন্ডেরা : আমি সাতটি পৃথক উপন্যাস লিখলে, আমি সবচাইতে মূল্যবান বিষয়টি হারাতামঃ আমি যে কোন একটি বইতে “আধুনিক পৃথিবীতে মানুষের জটিল অবস্থানটি” তুলে ধরতে পারতাম না। স্বল্প অবয়বে প্রকাশ করার ক্ষমতা নির্মোহভাবে একটি দরকারী বিষয়। এবং বিষয়ের সরাসরি অন্তঃস্থলে প্রবেশ করা দরকার। এব্যাপারে শৈশব থেকেই আমি চেকোশ্লোভাকিয়ার গীতিকার, লিওস জানাচেককে সহৃদয় শ্রদ্ধা করি। তিনি আধুনিক গানের তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ গীতিকারদের একজন। আনুসঙ্গিক বিষয়গুলোর চেয়ে স্ট্রিপ মিউজিকের উপ তিনি যুগান্তকারী অবদান রাখেন। এটা অবশ্য ঠিক যে, নানাবিধ প্রযুক্তি সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় প্রতিটি সংগীতঃ মূল বক্তব্যের প্রকাশ, তার উন্নয়ন এবং পরিব্যাপ্তি, পলিফোনিক কাজ (এটা নিরন্তন ভাবেই হয়ে থাকে), অর্কেস্ট্রা সংগঠন, গতিময়তা, ইত্যাদি। আজকের দিনে অনেকেই কম্পিউটার দিয়েই গীত রচনা করলেও কম্পিউটারটি কিন্তু থাকছে তার মাথাতেই – চাইলে কোন মৌলিক ধারণা ছাড়াই গীত রচনা করে ফেলতে পারেন। গীত রচনার নিয়ম মেনে “সাইবারনেটিক” মাধ্যমে গীত রচনার নতুন পথ। জানাচেকের উদ্দেশ্য ছিল এরকম কম্পিউটার পদ্ধতিকে নিরোৎসাহিত করা। চলমান প্রক্রিয়ার পরিবর্তে নির্মোহ মিশ্রণ। ব্যাপ্তির চেয়ে পূনরাবৃত্তি – সব সময়ই বিষয়ের অন্তস্থলে অবস্থানঃ শুধু অবশ্য প্রয়োজনীয় আংগিকের উপর গুরুত্ব আরোপ। উপন্যাসের ক্ষেত্রেও প্রায় তাই; এখানেও “প্রযুক্তির” আধিক্য আছে, এভাবেই একজন গ্রন্থকারকে প্রভাবিত করেঃ তিনি একটা চরিত্র তৈরী করেন, তার সামাজিক অবস্থান নির্নয় করেন, ঐতিহাসিক পটভূমি তৈরী করেন, চরিত্রটির ইতিহাস ভরে উঠে অপ্রয়োজনীয় ঘটনাবলী নিয়ে। প্রতিটা দৃশ্যের জন্য দরকার হয় নতুন অভিযান, বর্ণনা, এবং ব্যাখ্যা। আমার উদ্দেশ্যটাও জানাচেকের মতইঃ উপন্যাস লেখার পদ্ধতি থেকে স্বয়ংক্রিয়তা দূর করা।


ক্রিশ্চিয়ান স্যালমন : আপনি বলেছেন “নভেলিস্টিক কাউন্টাপয়েন্ট” আপনার দ্বিতীয় রচনা শৈলী।

মিলান কুন্ডেরা : চৌখোশ সমন্বয়ের জন্য উপন্যাস মূল্যবান অবদান রাখলেও স্বাভাবিক ভাবেই এটি “পলিফোনি” সমস্যার সৃষ্টি করে। এই সমস্যাটার একটা নিস্পত্তি হওয়া দরকার। ব্রকের “দি স্লিপওয়াকার”এর তৃতীয় অংশের কথাই ভাবুন; এটা পাঁচটি ভিন্ন উপাদান নিয়ে গঠিতঃ (১) প্যাসেনো, ইশ এবং হিউগোনো এই তিনটি চরিত্র নিয়ে “নভেলিস্টিক” বর্ণনা, (২) হান্না ওয়েন্ডিং এর ব্যক্তিগত গল্প, (৩) একটা মিলিটারী হাসপাতাল জীবনের সত্য ঘটনার বিবরণ, (৪) স্যাল্ভেশন সেনাবাহিনীর একটি মেয়ে নিয়ে কাব্যিক (আংশিক) বর্ণনা, (৫) বৈজ্ঞানিক আঙ্গিকে অবক্ষয়ের উপর একটা দার্শনিক লেখা। এর প্রতিটা অংশই দুর্দান্ত রকমের লেখা। কিন্তু আসল ব্যাপারটি হল প্রতিটা অংশই যুগপৎভাবে লেখা এবং পলিফোনিক কায়দায় একটার সাথে আর একটা ঘুরে ফিরে আসছে। তার পরেও পাঁচটি অংশ আলাদা থাকছে। অন্য কথায় বলা যায়, এর পরেও তারা আসলে পলিফোনিক নয়। 


ক্রিশ্চিয়ান স্যালমন : পলিফোনি শব্দটা সাহিত্যের ক্ষেত্রে ব্যবহার করার আড়ালে আপনি কি বলতে চাচ্ছেন উপন্যাস সম্ভবত এভাবে টিকে থাকতে পারেনা?

মিলান কুন্ডেরা : উপন্যাস বাইরের বিষয়াদি দুভাবে গ্রহন করতে পারে। ডন কুইক্সট ভ্রমণের সময় নানারকম লোকের সাথে মিশেছেন। এরা তার কাছে তাদের গল্প বলতেন। এভাবে ভিন্ন ভিন্ন গল্প একীভূত হয়ে একটা উপন্যাসের রূপ নিত। সপ্তদশ এবং অষ্টাদশ শতকে এভাবেই উপন্যাস লেখা হত। ঈশ এবং হিউগোএনও এর মূল কাহিনীতে হান্না ওয়েনডলিং এর গল্প গুলো না মিশিয়ে ব্রক কিন্তু আলাদা পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। সার্ত্রে (“দি রিপ্রাইভ” এ) এবং তাঁরও আগে ডস প্যাসোসও একই ভাবে পাশাপাশি প্রবাহমান পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। আসলে তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল ঔপন্যাসিক গল্প গুলো একত্রিত করা। অন্য কথায় ব্রকের মত সাহিত্যের উপাদান গুলোর মধ্যে বিভাজন না ঘটিয়ে একীভূত মিশ্র দ্রবন সৃষ্টি করা। তাদের এই পদ্ধতির ফলে কাব্যময়তা হ্রাস পেয়েছে। বরং আমার কাছে এটা খুবই যান্ত্রিক মনে হয়েছে। এ ধরণের সৃষ্টিকে আমি “পলিফোনি” বা “কাউন্টারপয়েন্ট” ছাড়া আর কোন ভাল শব্দ দ্বারা সনাক্ত করতে পারিনা। অধিকন্তু, রূপক অর্থে সংগীত শব্দটিকেও ব্যবহার করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, প্রথমত যে জিনিষটা আমার কাছে বিরক্তিকর মনে হয় তা হল “দি স্লিপওয়াকারের” তৃতীয় অংশ যার কারণে পাঁচটি উপাদান কোনমতেই একসমান নয়। লক্ষ্য করুন, প্রতিটি স্বর সমান হওয়াটা মিউজিক্যল কাউন্টারপয়েন্টের মূল ভিত্তি, যেমন, “সিনে কোয়া নন।” ব্রকের কাজে, অন্য উপাদানগুলোর তুলনায় প্রথম উপাদানটি (ঈশ এবং হিউগোএনোর ঔপন্যাসিক বর্ণনা) অনেক দীর্ঘাকার হয়েছে এবং এটা প্রয়োজনের তাগিদেই হয়েছে। উপন্যাসের আগের দুটো উপাদানের সাথে যোগসাজস নিয়েই এটা করা হয়েছে। এটা একীভূত করার উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে। এতে করে আকর্ষন বেড়েছে এবং অন্য উপাদান গুলোর গুরুত্ব চুপসে গেছে। দ্বিতীয় যে জিনিষটা বিরক্তিকর মনে হয়েছে তা হলো, হান্না ওয়েডলিং এর গল্প বা মূল্যবোধের শ্লথ গতি নিয়ে লেখা যেগুলো একক লেখা হিসেবেই দাঁড় করানো যেতো। আলাদা করে বলা যেতে পারে যে, এতে করে এই লেখা গুলোর কোন বক্তব্য এবং মূল্য কখনোই হ্রাস হত না।

আমার মতে “নভেলিস্টিক কাউন্টারপয়েন্ট”এর প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো হলোঃ (১) উপাদান সমূহের গুনগত মান; (২) গুটা জিনিষটার অবিচ্ছিন্নতা। “দি এঞ্জেল” শেষ করার দিনটা আমার মনে পড়ছে। বইটার তৃতীয় অংশটা হল, “দি বুক অব লাফটার এন্ড ফরগেটিং”। আমার দারূণ গর্ববোধ হচ্ছিল। আমি নিশ্চিত ভাবে আবিষ্কার করলাম একটা লেখা নতুন করে সংযোজন করার চাবিটি নিশ্চিত ভাবে আবিষ্কার করলাম। বিষয়বস্তুটি যে উপাদান নিয়ে গঠিত তা হলোঃ (১) দুই ছাত্রীর লেভিটেশন নিয়ে একটি অবতারণা; (২) একটি অটোব্যায়োগ্রাফিক্যাল আলেখ্য; (৩) নারীবাদী বইয়ের উপর একটি নিরীক্ষামূলক লেখা; (৪) দেব-দেবী এবং দানব নিয়ে একটি অলৌকিক গল্প; (৫) পল ইলার্ডের প্রাগের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার স্বপ্লিল বর্ণনা। এদের একটি অন্যটি ছাড়া অস্তিত্বহীন। প্রতিটিই উজ্জ্বল এবং একটা অন্যটাকে প্রকাশে সহায়তা করে, যেন সবগুলোই একটি মাত্র থিমকেই উদ্ভাসিত করে এবং মাত্র একটি প্রশ্ন সেখানেঃ “অশরীরি আত্মা কী।”

“দি এঞ্জেল” নামের ষষ্ঠ অংশটির উপাদান হলঃ (১)টামিনার মৃত্যুর স্বপ্নীল বর্ণনা; (২) আমার বাবার মৃত্যুর উপর নিজের লেখা; (৩) মিউজিকোলোজিক্যাল রিফ্লেকশন্স; (৪) সর্বতোভাবে অগ্রাহ্যের প্রভাবে প্রাগের ভয়াভহ অবস্থা। সন্তানদের দ্বারা টামিনার উপর অত্যাচারের সাথে আমার বাবার কী সম্পর্ক? এটা “একটা সেলাই মেশিন এবং একটা ছাতার মিটিং”এর অভিব্যক্তি এবং লট্রিমন্টের বিখ্যাত প্রতিচ্ছবির সাথেই তুলনীয়। পদ্ধতিগত গুরুত্বের চেয়ে নভেলিস্টিক পলিফোনির কাব্যিক মূল্য বেশী। সাহিত্যজগতে কোথাও পলিফোনিক কাব্যের এমন উদাহরণ দেখিনা, কিন্তু এলেন রেসনাইসের সর্বশেষ ছবিটা দেখে আমি মুগ্ধ। তাঁর কাউন্টাপয়েন্ট পদ্ধতি ব্যবহারের দক্ষতা প্রসংশনীয়।


ক্রিশ্চিয়ান স্যালমন : “দি আনবিয়ার‍্যাবল লাইটনেস অব বিয়িং”এ কাউন্টারপয়েন্ট তেমনভাবে ফুটে উঠেনি।

মিলান কুন্ডেরা : সেটাই তো আমার উদ্দেশ্য। এখানে আমি চেয়েছি স্বপ্ন, বর্ণনা, ঘটনার দৃশ্যপট অবিভাজ্য থাকুক এবং সব মিলিয়ে একটা স্বাভাবিক গতিময়তা সৃষ্টি হউক। কিন্তু উপন্যাসের পলফোনিক চরিত্রটি ষষ্ঠ অংশে দারূণভাবে ফুটে উঠেছেঃ স্ট্যালিনের ছেলের কাহিনী, ধর্মীয় অবদান, এশিয়ার রাজনৈতিক দৃশ্যপট, ব্যাংককে ফ্র্যাঞ্জের মৃত্যু, এবং বোহিমিয়ায় টমাসের শেষকৃত্য সব মিলিয়ে সর্ব কালের সেই একই প্রশ্নঃ “কীশ কী জিনিষ?” গোটা উপন্যাসটিকে পলিফোনিক পদ্ধতিটি ধরে রেখেছে। এটাই এই স্থাপনাটির গোপন চাবিকাঠি।

ক্রিশ্চিয়ান স্যালমন : “দি স্লিপওয়াকারস”এ যেমনটা দেখি, “বিশেষ উপন্যাসিক বর্ণনা”র মাধ্যমে আপনার লেখনীতে বিভিন্ন নিজস্বতা এবং দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।

মিলান কুন্ডেরা : এটা একটা দুর্দান্ত রচনা!

ক্রিশ্চিয়ান স্যালমন : উপন্যাসে এর সম্পৃক্তকরণ আপনার সংশয় আছে। ব্রক তাঁর বৈজ্ঞানিক পরিভাষা ব্যবহারের কোনটাই বাদ দেননি। তিনি কোন কিছুই ঢেকে না রেখে নিজের দৃষ্টিভংগি ম্যান অথবা মুসীলের মত চরিত্রের মাধ্যমে সোজাসাপ্টা প্রকাশ করেছেন। এই যে সাহসিক পদক্ষেপ তিনি নিয়েছেন এটা কি তাঁর একটা মৌলিক অবদান নয়?

মিলান কুন্ডেরা : তা ঠিক, তিনি তাঁর এই সাহসের ব্যাপারে পুরোপুরি সচেতন ছিলেন। কিন্তু এর মধ্যে একটা ঝুকি ছিলঃ তাঁর রচনার “সার বস্তু”টুকু উপন্যাসের আদর্শগত চাবি হিসেবেই গ্রহন করা যেতে পারত, একটা ভাবনা প্রকাশের মাধ্যম হিসেবেই উপন্যাসের বাকীটুকু চিহ্নিত হতে পারত। এতে করে উপন্যাসের ভারসাম্য ব্যাহত হয়; উপন্যাসের বিষয়বস্তু খুবই ভারী মনে হয়, উপন্যাসের ক্ষনিক আংগিক পরিবর্তন চুপসে যেতে পারে। উপন্যাসের মাধ্যমে কোন তত্ত্ব প্রকাশের উদ্দেশ্য না থাকলে (ব্রক এজাতীয় উপন্যাসকে অপছন্দ করতেন!) কেউ হয়ত পড়বে কিন্তু তার যবনিকা ওখানেই হবে। একটা লেখা কীভাবে উপন্যাসের মর্যাদা পাবে? একটা মৌলিক সত্য মনে রাখতে হবেঃ যে মূহুর্তে লেখার মধ্যে একটা মৌলিকত্ব আসবে তখনই উপন্যাসের আংগিক তৈরী হবে। উপন্যাসের কেন্দ্রে থাকবে একটা জিজ্ঞাসাঃ একজন দার্শনিক, রাজনীতিক, এমন কি একজন দারোয়ানেরও নিশ্চিত ভাবে জানতে হবে তিনি কী বলতে চান। উপন্যাস এমনই একটি ক্ষেত্র যেখানে সরাসরি কোন বক্তব্য রাখা হয়না; এই ক্ষেত্রে নাটকীয়তা আছে, আছে নাটকীয়ভাবে ভাবপ্রকাশ। অনেক সত্য জিনিষ উপন্যাসে ভাবনাপ্রসূত হিসেবে দেখানো হয়।

ক্রিশ্চিয়ান স্যালমন : কিন্তু একজন উপন্যাসিক উপন্যাসে তার নিজ আদর্শ পরিষ্কার এবং দৃঢ় ভাবে প্রকাশ করা থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখতে চাইবে?

মিলান কুন্ডেরা : কারণ তার কিছুই নাই! লোকে অনেক সময়ই চখভ, কাফকা বা মুসীলের আদর্শের কথা বলে থাকে। কিন্তু চেষ্টা করে দেখুন তাঁদের লেখায় কোন যুক্তিসংগত আদর্শ আছে কিনা! এমন কি তাদের নোটবুকে যখন তাঁরা তাঁদের কোন চিন্তাভাবনা প্রকাশ করতে চান, নির্দিষ্ট কোন আদর্শের চাইতে মেধার কসরত থাকে, যুক্তি-বুদ্ধির তাড়না থাকে, অথবা ভাল একটা কিছু করার চেষ্টা থাকে। এবং যে দার্শনিকরা উপন্যাস লিখেন তাঁর আসলে অপ্রকৃত উপন্যাসিক – উপন্যাসের আদলে তাঁরা নিজেদের ধারণা প্রকাশ করে থাকেন। ভল্টায়্যার কিম্বা ক্যামোসে কেউই “উপন্যাস আসলে কী প্রকাশ করতে পারে” তা অনুধাবনই করতে পারেন নি। আমার জানা মাত্র একটি ব্যতিক্রম আছে, তা হল জ্যাক্স লে ফ্যাটালিস্টিএর ডাইডেরট। কী আশ্চর্য ব্যাপার! উপন্যাসের পরিমন্ডল পরিব্যাপ্তি শেষে বিখ্যাত দার্শনিকরাও সাধারন চিন্তকই রয়ে গেলেন। সারা উপন্যাসে কোন জুৎসই বাক্য নেই – সবটাই খেলা। সেই জন্যই এই উপন্যাসটি ফ্রান্সে অসম্ভবভাবে নিম্নমানের। অবশ্য ফ্রান্স যে সব হারিয়েছে এবং তা পূনরুদ্ধার প্রত্যাখানের সমস্ত বিবরণ জ্যাক্স লে ফ্যাটালিস্টি লিপিবদ্ধ করেছে। ফ্রান্সে কাজের চেয়ে চিন্তাশীলতাকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। জ্যাক্স লে ফ্যাটালিস্টিকে চিন্তাশীলতার ভাষা হিসেবে গন্য করা যাবে না। কাজেই, এটাকে চিন্তার জগতে স্থান দেওয়া যাবে না।

ক্রিশ্চিয়ান স্যালমন : “দি জোক” এ একমাত্র জারোস্লেভ মিউজিলোজিক্যাল তত্ত্ব সৃষ্টি করেন। তাঁর চিন্তায় তাই তত্ত্বীয় চরিত্র দৃশ্যমান। কিন্তু “দি বুক অব লাফটার এন্ড ফরগেটিং” এ মিউজিকোলোজিক্যাল মেডিটেশন হল গ্রন্থকারের অর্থাৎ আপনার নিজস্ব। তাহলে আমি কী ভাবে বুঝবো এরা শুধুই তত্ত্বীয় নাকি বাস্তব সত্য?

মিলান কুন্ডেরা : সবই নির্ভর করে কী ভঙ্গিমায় আমরা একটি জিনিষ প্রকাশ করি। শুরু থেকেই আমার লক্ষ্য থাকে স্বতঃস্ফূর্ততা, রূপক, উদ্রেককারী, পরীক্ষামূলক অথবা প্রশ্নমূলক একটা অভিব্যক্তি। দি আনবিয়ার‍্যাবল লাইটনেস অফ বিইং (“দি গ্র্যান্ড মার্চ”) এর ষষ্ঠ পর্বের পুরোটাই “কিশ”এর উপর একটা রচনা যার প্রধান অভিব্যক্তি হলঃ বিরক্তি উৎপাদক বস্তুর অস্তিত্বকে একেবারে অস্বীকার করাই হল কিশ। কিশ নিয়ে এই ধারণা আমার কাছে একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিষ। বিস্তর চিন্তাভাবনা, অভিজ্ঞতা, গবেষনা এবং আন্তরিকতা থেকেই এমন ধারণা হয়েছে। তারপরেও অভিব্যক্তিটি অত সতর্কতাপূর্ণ নয়; এটা চিন্তা উদ্রেককারী। উপন্যাসের বাইরে এই লেখাটি অচিন্তনীয়, এটা খাঁটি নভেলিস্টিক ধারণা।

ক্রিশ্চিয়ান স্যালমন : আপনার উপন্যাসে পলিফোনিক ব্যাপারটিতে আরেকটি জিনিষ আছে, তার নাম হল – স্বপ্নীল বর্ণনা। এটা লাইফ ইজ এভরিহোয়ার এর দ্বিতীয় অংশের সর্বত্র বিদ্যমান, আর এটিই ষষ্ঠ পর্ব, দি বুক অব লাফটার এন্ড ফরগেটিং এর ভিত্তি। এটা টেরেযার স্বপ্নের মাধ্যমে দি আনবিয়ার‍্যাবল লাইটনেস অফ বিইং পর্যন্ত চলতে থাকে।

মিলান কুন্ডেরা : এই অংশটা থেকে সহজেই ভুল ধারণা সৃষ্টি হতে পারে, কারণ এখান থেকে মানুষ কিছু খন্ডিত ধারণা বের করতে চায়। টেরেযার স্বপ্ন দিয়ে প্রকাশ করার কিছু নেই। এগুলো মৃত্যু সংক্রান্ত কবিতাবলী। এগুলোর মর্মার্থ এদের সৌন্দর্যের মধ্যেই নিহীত। এটাই টেরাযাকে মোহাচ্ছন্ন করে। প্রসংগক্রমে বলছি, আপনি কি জানেন কাফকা কীভাবে পড়তে হবে মানুষ কিন্তু তা জানেনা কারণ তারা চায় তাকে সোজাসুজি দেখতে? তার অসম চিন্তাশক্তির সাথে নিজেদেরকে না মিশিয়ে, তারা তার রূপক দিকটার দিকেই তাকিয়ে থাকে, ফলে তারা শুধু উত্থান-পতনই দেখতে পায়ঃ জীবন খুবই অবিশ্বাস্যতাপূর্ণ (অথবা এটা অসম্ভব), ঈশ্বরের কাছাকাছি পৌছা অসম্ভব (অথবা ঈশ্বর আমাদের মধ্যেই আছেন), অনেকটা এরকম। কল্পনার একটা নিজস্ব মূল্য আছে, এটা না বুঝলে, কলাবিদ্যার, বিশেষতঃ আধুনিক কলাবিদ্যা, আপনি কিছুই বুঝবেন না। স্বপ্নকে প্রশংসা করতে গিয়ে নভালিস এটা জানতে পারেন। “স্বপ্ন জীবনের একাকীত্ব থেকে আমাদেরকে মুক্ত রাখে”, তিনি বলেন, “স্বপ্নের মত খেলা আমাদেরকে জীবনের তিক্ততা থেকে মুক্ত করে।” স্বপ্ন এবং স্বাপ্নিক কল্পনা উপন্যাসে কী দ্বায়িত্ব পালন করতে পারে তিনিই তা প্রথম উপলব্ধি করেন। তিনি তাঁর হিনরিচ ভন অফটারডিনজেন উপন্যাসটি দ্বিতীয় খন্ড লেখার পরিকল্পনা করেন; সেখানে এমন বর্ণনা থাকবে যা স্বপ্ন এবং বাস্তবতা এমন অংগাঙ্গিভাবে মিশে থাকবে যে কেউ তাকে আলাদা বলতে পারবে না। দুঃখজনকভাবে দ্বিতীয় খন্ডটি নোট আকারেই থেকে গেল সেখানে নোভালিস তাঁর দক্ষতাই বর্ণনা করলেন। একশত বছর পরে, তাঁর উচ্চাশাটা কাফকা পূর্ণ করলেন। কাফকার উপন্যাস স্বপ্ন এবং বাস্তবতায় পরিপূর্ণ; অর্থাৎ এরা স্বপ্নও নয় আবার বাস্তবতাও নয়। সব কিছুর উপরে, কাফকা দক্ষতার একটা বিপুল পরিবর্তন আনলেন। দক্ষতার এক অবিশ্বাস্য সৃষ্টি। তিনি যা করেছেন কেউ তা পূনর্ব্যক্ত করতে পারবে না। কিন্তু আমি তাঁর এবং নোভালিসের মত উপন্যাসে স্বপ্ন এবং স্বাপ্নিক কল্পনা সংযোজন করি। শুধু স্বপ্ন এবং বাস্তবতার মিশ্রণ ব্যতিরেকে আমি এটা পলিফোনিক যুক্তিসহ করি। স্বপ্ন-বর্ণনা করা কাউন্টারপয়েন্টের একটা উপাদান।

ক্রিশ্চিয়ান স্যালমন : দি বুক অব লাফটার এন্ড ফরগেটিং এর শেষ অংশে পলিফোনিক জাতীয় কিছু নেই, তার পরেও সম্ভবত এই অংশটিই বইটার সবচাইতে আকর্ষনীয় হয়েছে। এতে চৌদ্দটি অধ্যায় আছে। এখানে জেন নামের একজন মানুষের জীবন নিয়ে অনেক রসনা উদ্রেককারী ব্যাপার-স্যাপার আছে।

মিলান কুন্ডেরা : আর একটা সঙ্গিতীয় শব্দঃ এই আখ্যানটি হল “ভিন্নতার খেলা” নিয়ে। ব্যাপারটা যেন একটা সীমানা রেখা যেটা অতিক্রম করলে কোন কিছুর অর্থ বদলে যায়। সীমা রেখার কাছাকাছি একটা জায়গায় আমাদের জীবন খুলে যায়, এবং আমরা ঝুকি নিয়ে সীমানার ওপারের মূহুর্তটিতে যেতে চাই। সীমারেখার সন্ধিক্ষনে চৌদ্দটি অধ্যায়ে চৌদ্দটি ভিন্নতা আছে একই জিনিষের অর্থ এবং অনর্থকে ঘিরে।

ক্রিশ্চিয়ান স্যালমন : আপনি “ভিন্নতার আঙ্গিকে” দি বুক অব লাফটার এন্ড ফরগেটিং উপন্যাসটি রচনা করেছেন। কিন্তু এর পরেও কি এটি একটি উপন্যাস?

মিলান কুন্ডেরা : ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় কোন একাত্মতা নেই, সেজন্যই এটাকে একটি উপন্যাসের মত মনে হয় না। কেউ এই একাত্মতা ছাড়া কোন উপন্যাস ভাবতেই পারেনা। এমনকি নোভিও রোম্যান এর পরীক্ষা-নিরীক্ষাও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার একাত্মতা নির্ভর ছিল (অথবা কোন ক্রিয়াহীন)। একাত্নতাকে ভঙ্গুরের পর্যায়ে রেখে স্টার্ন এবং ডাইডেরট মজা করতেন। দি জার্নী অফ জ্যাকস এবং তার প্রভু দি জ্যাকস লে ফালালিস্টি এর গৌন অংশটি নিয়েছেন; এটা শুধুই বিনোদনের মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত বিষয়, গল্প, চিন্তার প্রকাশের মাধ্যম। যাই হউক, একটা উপন্যাসকে উপন্যাস করে তুলতে এই “আঙ্গিক”এর প্রয়োজন। দি বুক অফ লাফটার এন্ড ফরগেটিং এ এধরনের কোন আলোকপাত নেই। ভাবধারাগুলোর মধ্যে একাত্মতা এবং তাদের ভিন্নতাই গোটা বিষয়টা একত্রে ধরে রাখছে। এর পরেও কি এটা একটা উপন্যাস? হ্যা। উপন্যাস হল একটা স্থিতিসত্ত্বার উপর মনোসংযোগ যা বিভিন্ন চরিত্রের ভিতর দিয়ে দেখতে হয়। মাধ্যমটিতে স্বাধীনতা অসীম। উপন্যাসের ইতিহাসে এর অসীম সম্ভাবনাময় জগতের সমস্ত সুবিধাগুলো কখনই নেওয়া সম্ভব হয়নি। এই সুযোগ সবাই মিস করেছে।

ক্রিশ্চিয়ান স্যালমন : কিন্তু দি বুক অব লাফটার এন্ড ফরগেটিং ছাড়া আপনার অন্য সব উপন্যাসই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার একাত্মতা উপরেই হয়েছে, যদিও দি আনবিয়্যার‍্যাবল লাইটনেস অফ বিইং গৌনভাবে এই দলভূক্ত।

মিলান কুন্ডেরা : হ্যা, কিন্তু একাত্নতার অন্য অনেক মূল্যবান উপাদান একে পূর্ণাংগ করেছেঃ একাত্মতার অন্যান্য মৌলিক প্রশ্ন, একই আদল, এবং সবকিছু মিলিয়ে ভিন্নতা (উদাহরণস্বরূপ, দি ফেয়ারওয়েল পার্টি র পিতৃত্বের আদল)। আমি দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, উপন্যাসটি মূলতঃ কিছু আদি শব্দমন্ডলীর উপর প্রতিষ্ঠিত, যেমন স্কয়েনবার্গের নোট সিরিজ। দি বুক অফ লাফটার এন্ড ফরগেটিং এ সিরিজটা হলঃ ভুলে যাওয়া, অট্টহাসি, এঞ্জেল, “লিটস্ট”, সীমা রেখা। উপন্যাসটিতে এই পাঁচটি শব্দ বিশ্লেষণ, গবেষনা, বর্ণনা, পূনরায় বর্ণনা, এবং পরিশেষে এগুলোকে স্থিতির পর্যায়ে নেওয়া হয়েছে। একটা কাঠামোর উপর যেমন বাড়ী নির্মান করা হয়, এই রকম কিছু বিভাগের উপরই এটা তৈরী করা হয়েছে। দি আনবিয়্যার‍্যাবল লাইটনেস অফ বিইং কাঠামো হলঃ ওজন, ওজনহীনতা, আত্মা, অংগ, দি গ্র্যান্ড মার্চ, শিট, কিশ, কম্প্যাশন, ভারটিগো, শক্তি এবং দুর্বলতা। এদের নিজস্ব দৃঢ় বৈশিষ্ট্যের কারণেই এই শব্দগুলোকে অন্য কোন সমার্থক শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায় না। অনুবাদককে এই শব্দ গুলো বারবার ব্যাখ্যা করতে হবে, যারা নিজস্ব “স্টাইল” অনু্যায়ী পূনরাবৃত্তি পরিহার করতে চাইবে।

ক্রিশ্চিয়ান স্যালমন : আঙ্গিক পরিচ্ছন্নতার কারণে, আমি ধরেই নিয়েছিলাম মাত্র একটি ছাড়া আপনার সব উপন্যাসকে সাতটি ভাগে ভাগ করা যায়।

মিলান কুন্ডেরা : যখন আমি আমার প্রথম উপন্যাস দি জোক শেষ করি, এর যে সাতটি অংশ আছে তা নিয়ে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। তারপর আমি লিখি, লাইফ ইজ এলসহোয়ার। উপন্যাসটি যখন প্রায় শেষ, তখন এর ছয়টি অংশ ছিল। আমি স্বাচ্ছন্দবোধ করলাম না। অকস্মাৎ একটা গল্প জুড়ে দেওয়ার ধারণা মাথায় এল। নায়কের মৃত্যুর তিন বছর পরে এটা। অন্য কথায় উপন্যাসের মূল অংশের বাইরে এটি। এখন এটা সাতটার ষষ্ঠ অংশ, নাম হল, “দি মিডল-এজেড ম্যান”। সাথে সাথেই উপন্যাসের গঠন পরিপূর্ণ হল। পরে, আমি অনুভব করলাম ষষ্ঠ অংশটি দি জোকস (“কস্টকা”) এর ষষ্ঠ অংশের সমতূল্য হয়ে গেছে। এখানেও একটি বাইরের চরিত্র সংযোজন করা হয়েছে, এবং উপন্যাসের দেয়ালে একটি গোপন জানালা খুলে দেওয়া হয়েছে। “লাফ্যাবল লাভ” দশটি ছোট গল্প নিয়ে শুরু হয়েছে। চুড়ান্ত সংকলনে এক করতে গিয়ে আমি তিনটি বাদ দিয়েছি। সংকলনটি বেশ জুড়ালো হয়েছে। এটা দি বুক অফ লাফটার এন্ড ফরগেটিং কে ছাড়িয়ে গেছে। ডক্টর হ্যাভেল নামের চরিত্রটি চতুর্থ এবং ষষ্ঠ গল্পকে বেঁধে রেখেছে। দি বুক অফ লাফটার এন্ড ফরগেটিং এ চতুর্থ এবং ষষ্ঠ অংশকে টামিনা নামের একই লোক বেঁধে রেখেছে। আমি যখন দি আনবিয়্যার‍্যাবল লাইটনেস অফ বিইং লিখি আমার দৃঢ় প্রত্যয় ছিল আমি সাত সংখ্যাটিকে পরিহার করব। তারপর আমি ছয়টি অংশ নিয়ে লেখার সিদ্ধান্ত নেই। কিন্তু প্রথম অংশ সব সময়ই গোলমেলে থেকে যায়। শেষে বুঝতে পারি এটা আসলে দুটো অংশ নিয়ে গঠিত। সায়ামিজ ট্যুইনদের বেলায় যা হয়, শেষমেশ শল্যব্যবচ্ছেদ করতে হয়। আমার এত সব বলার কারণ হচ্ছে নম্বর নিয়ে আমার কোন কুসংস্কার নেই। আমি কোন হিসেব কষেও এসব করি না। গভীর মনোনিবেশের ফলে মনের অজানতেই প্রয়োজনের তাগিদেই এসব হয়ে যায়, যা থেকে আমি বেরিয়ে আসতে পারছি না। আমার সব উপন্যাস সাত নম্বরটিকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে।

ক্রিশ্চিয়ান স্যালমন : বিচ্ছিন্ন উপাদানকে সাতটি সুন্দর পর্বে বিভক্ত করে এক একটি উপন্যাস রচনা করা আপনার একক উদ্দেশ্য হিসেবে দেখা যেতে পারে। আপনার উপন্যাসের প্রতিটা অংশই যেন একটি আপন ভূবন। নিজস্ব স্বকীয়তার জন্য একে অন্য থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু একটি উপন্যাসকে যদি কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়, তাহলে প্রতিটি ভাগ আবার অধ্যায়ে বিভক্ত কেন?

মিলান কুন্ডেরা : অধ্যায় গুলো নিজেদেরকেই নিজেদের ভূবন তৈরী করতে হবে; এদের মোটামুটি স্বকীয় বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে। সেজন্যই আমি আমার প্রকাশককে চাপে রাখি যেন নম্বরগুলো স্পষ্ট থাকে এবং অধ্যায়গুলো আলাদা আলাদা থাকে। অধ্যায়গুলো যেন সংগীতের স্কোর! অনেক অংশ আছে যেখানে অধ্যায়গুলো লম্বা, অন্যগুলো ছোট, কোথাও আবার অনিয়মিত। প্রত্যেকটি অংশে সংগীতের মত লয় আছেঃ মডারেটো, প্রেস্টো, এন্ডেন্টে, ইত্যাদি। লাইফ ইজ এলসহোয়্যার এর ষষ্ঠ অংশ হল এন্ডেন্টেঃ শান্ত, মিষ্টি সুরের মূর্ছনার মত, একটা মধ্য বয়েসী লোক এবং জেল থেকে সদ্য ছাড়া পাওয়া একটি মেয়ের মধ্যে সংক্ষিপ্ত বাক-বিনিময়। শেষ অংশ হল প্রেস্টিসিমো; এটা ছোট ছোট অধ্যায়ে লেখা। এখানে আছে ঝটপট পরিবর্তনের ছোয়া – জারোমিল থেকে রিমবোড, লারমন্টোভ, এবং পুশকিন। আমি প্রথমে দি আনবিয়্যার‍্যাবল লাইটনেস বিইং কে সংগীতের মতই ভেবেছিলাম। আমি মনে করি শেষের অংশটা হবে পিয়ানিসিমো এবং লেন্টোঃ এটার লক্ষ্যটা হল ছোট পরিসর, তেমন ঘটনাবিহীন, একই জায়গা, এবং শান্ত সুর। আমি মনে করতাম এই অংশটার আগে থাকবে প্রেস্টিসিমোঃ যে অংশটা হল “দি গ্র্যান্ড মার্চ।”

ক্রিশ্চিয়ান স্যালমন : সাত নম্বর নিয়ে একটি ব্যতিক্রম আছে। দি ফেয়ারওয়েল পার্টি তে আছে মাত্র পাঁচটি অংশ।

মিলান কুন্ডেরা : দি ফেয়ারওয়েল পার্টি টি অন্য আর একটি গাথুনীতে তৈরীঃ এটা একেবারে একরকম উপাদানে গঠিত। একটি মাত্র বিষয়, একটা টেম্পোটে পরিবেশিত; এটি নাটকীয় ঢংএ রচনা। এর আদলটা এসেছে ফার্চ থেকে। “লাফ্যাবল লাভ” এর “দি সিম্পোজিয়াম” গল্পটিও একেবারে একইভাবে তৈরী – পাঁচ অংকের ফাররচ নাটক।

ক্রিশ্চিয়ান স্যালমন : ফার্চ বলতে আপনি কী বুঝান?

মিলান কুন্ডেরা : নাটক এবং এর অংশবিশেষে গুরুত্ব দেওয়ার কথাই বলি। যেখানে অনাকাঙ্খিত এবং অসাধারণ ঘটনার সন্নিবেশ থাকবে। নাটক বা ফার্সিক্যাল বাড়াবাড়ির মত উপন্যাসে কোন কিছুই চমকানো, অদ্ভূতুড়ে, অচল, গুরুত্বহীন, এবং স্বাদহীন হবে না। ফ্লোবার্টের পর থেকে, উপন্যাসিকরা নাটকের নাটকিয়তাকে পরিহার করেছেন। সেজন্যই উপন্যাসের তেজে ভাটা পড়েছে। আপনি অসম্ভব একটি গল্প বললেন, তারপর বলবেন এটা হতে পারেনা! ঠিক এভাবেই কাফকা আমেরিকা র ধারণা তৈরী করে। প্রথম অধ্যায়ে অনেকগুলো অসম্ভব ঘটনাবলীর মাধ্যমেই কার্ল তার আঙ্কেলের সাথে মিলিত হয়। কাফকা তাঁর প্রথম “ সার-রিয়্যাল” ভূবনে প্রবেশ করেন, এটা তাঁর প্রথম “স্বপ্ন এবং বাস্তবের সংমিশ্রন”, একটা নাটকের মাধ্যমে এবং সেটা ফার্চের ভিতর দিয়েই।

ক্রিশ্চিয়ান স্যালমন : কিন্তু আপনি কেন ফার্চকে উপন্যাসের জন্য পছন্দ করলেন? উপন্যাসে তো বিনোদনের জন্য নয়।

মিলান কুন্ডেরা : কিন্তু এটা একটা বিনোদন! আমি বুঝতে পারিনা যে অপছন্দের জিনিষটিতে ফ্রেঞ্চরা বিনোদন পাবে, আবার তারাই “ডাইভারটিসমেন্ট” শব্দটি নিয়ে লজ্জিত হবে। এখানে বোর হওয়ার চেয়ে লজ্জার মাত্রাটি কম। তারা কিশের জন্যও ঝুকি নিতে পারেন, গোলাপী-রংএর আলো মিলে একটা লোলুভ জিনিষ মাত্র। এটা ইলার্ডের কবিতা অথবা ইটোরে স্কোলার সাম্প্রতিক ছবি, লে বাল, যার ভাষান্তরিত নাম হতে পারেঃ “ফ্রেঞ্চ হিস্টোরী অব কিশ”কেও ছাপিয়ে যায়। হ্যা, কিশ কোন বিনোদন নয়, একটা খাঁটি কারিগরী অসুস্থতা! বিখ্যাত ইউরোপীয় উপন্যাস বিনোদন দিয়েই শুরু হয়েছিল, এবং প্রত্যেক উপন্যাসিক এই সব উপন্যাসের প্রতি দুর্বল। আসলে এইসব বিখ্যাত বিনোদনের আঙ্গিক খুবই সিরিয়াস – সারভ্যান্টিসের কথাই ভাবুন! ফেয়ারওয়েল পার্টি র প্রশ্ন হল, মানুষ কি এই পৃথিবীতে বসবাসের উপযোগী? “মানুষের হাত থেকে পৃথিবীটাকে মুক্ত করা” কি কারও দায়িত্ব নয়? আমার সারাজীবনের উচ্চাশা হল যথাসম্ভব সিরিয়াস প্রশ্নকে যথাসম্ভব হালকা মাধ্যমে একীভূত করা। এটা শুধুমাত্র কল্পনা প্রসূত আকাংখাই নয়। হাল্কা ভাবনার সাথে সিরিয়াস ব্যাপারগুলো একত্র করতে পারলে নাটক (যেগুলো আমাদের আশেপাশে নিত্য হচ্ছে এবং যেগুলো আমরা ঐতিহাসিক রংগমঞ্চে অভিনয় করি) এবং তার বাজে ও অপ্রয়োজনীয় বিষয়বস্তু থেকে অনেক সত্য বেরিয়ে আসতে পারে। আমরা আনবিয়্যার‍্যাবল লাইটনেস বিইং কে অনুভব করি।

ক্রিশ্চিয়ান স্যালমন : কাজেই আপনি আপনার সর্বশেষ নভেল, দি ফেয়ারওয়েল পার্টি র নামটি ব্যবহার করেছেন?

মিলান কুন্ডেরা : আমার প্রতিটি উপন্যাসেরই নাম হতে পারে, আনবিয়্যার‍্যাবল লাইটনেস বিইং অথবা দি জোকস অথবা লাফ্যাবল লাভস; নামগুলো বদলাবদলী যোগ্য। যেসব ভাবনা আমাকে মোহাচ্ছন্য করে রাখে, আমাকে প্রকাশ করে, এবং দুঃখজনক ভাবে আবদ্ধ করে রাখে তার মাত্র খানিকটাই এরা প্রকাশ করে। এসব থিমের বাইরে, আমার লেখা বা বলার কিছু নাই।

ক্রিশ্চিয়ান স্যালমন : তাহলে, আপনার উপন্যাস থেকে দুটি ধারা লক্ষ্য করা যেতে পারেঃ (১) পলিফোনি, যা ভিন্ন উপাদানকে একীভূত করে সাতটি অংশে, (২) ফার্চ, যা একই প্রকৃতির উপাদানে নাটকের আদলে গঠিত এবং যা অসম্ভবতাকে পরিহার করে। এই দুই ধারার বাইরেও কি কুন্ডেরা আছেন?

মিলান কুন্ডেরা : আমি সব সময়ই এক অসম্ভব অবিশস্ততার স্বপ্ন দেখি। কিন্তু আমি এখনও নীতি বহির্ভূত বৈবাহিক অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হইনি।


উৎস : http://www.galpopath.com/2014/02/blog-post_9190.html?m=1 

ইয়াহিয়া হাক্কির গল্প "গণক পাথর " (একটি আরবি গল্পের অনুবাদ)


ইয়াহিয়া হাক্কি (১৯০৫-১৯৯৩)

কায়রোর এক দরিদ্র পরিবারে জন্ম হয় মিশরের এই ছোট গল্পাকার ও সাহিত্য ব্যক্তিত্বের। কায়রো স্কুল অব ল থেকে বৃত্তি পেয়ে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন ১৯২৬এ। এর পর পরই তিনি মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপের বেশ কিছু দেশে নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করে কুটনীতিতে দীর্ঘ দিনের সফল ক্যারিয়ারের সূচনা করেন। নিজ ভাষা ছাড়াও ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ, ইটালিয়ান এবং তুর্কী ভাষায় বিশেষ পারদর্শী এই লেখক ১৯২৩ সাল হতে ছোট গল্প লিখতে শুরু করেন। সারা মিশর জুড়ে তাঁকে ছোট গল্পের জনক বলেই গন্য করা হয়। কিন- ১৯৪৪এ ছোট গল্প “দ্যা ল্যাম্প অব উম হাসিম” ছাপা হবার আগ পর্যন- তাঁর তেমন একটা পরিচিতি ছিলোনা। এই গল্পে পূর্ব পশ্চিম সংস্কৃতি তাদের একে ওপরের ওপর কি ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে তাই ফুঁটে উঠেছে। ১৯৭৩ এ “দ্যা সেইন্ট’স ল্যাম্প এন্ড আদার স্টোরিজ” শিরোনামে এমএম বাদাওয়ে গল্পগুলোর ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন। ১৯৫৫তে “দ্যা পোস্ট ম্যান” ছাপা হবার বছরে তিনি কায়রো ফাইন আটস্‌ বিভাগের পরিচালকের দ্বায়িত্বভার গ্রহন করেন। এর পর জাতীয় গ্রন'াগারের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এন্টার এন্ড জুলেটি (১৯৬১); এ স্যুটকেস ইন দ্যা হ্যান্ড অব আ ট্রভেলার (১৯৬৯); দ্যা এম্পটি বেড এন্ড আদার স্টোরিজ; পিপল ইন দ্যা স্যাডো (১৯৭১); এবং ব্লাড এন্ড মাড তাঁর গল্প গুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৯৯৯এ তাঁর তিনটি উপন্যাস অনুবাদ করেন পেইরি ক্যসিয়া। এর আগে ১৯৮৭ সালে গুড মনিং এন্ড আদার স্টেরিজ নামে গল্প গ্রনে'র অনুবাদ করেন মিরিয়াম কুকি। লেখক জিবনের সমস- সময় জুড়েই হাক্কি নিজের পরিচয়ে পরিচিত হবার এক গভীর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন নিজের যাবতীয় লেখার মাধ্যদিয়ে। তবে তিনি অনেক বেশী পরিমানের লেখা উপহার দিয়ে যাননি পাঠককে। তার পরেও মিশরের কল্প কাহিনিকারদের মধ্যে এক প্রবাদ পুরুষ হিসেবে গন্য করা হয় তাঁকে। ১৯৭৫ সালে মিশরের সাহিত্য সমাজ তাঁর লেখক জিবনের রজত জয়ন-ী উদযাপন করেন।



গনক পাথর

ভাগ্য বলে দেওয়া যায় এমন কথা আমি একদমই বিশ্বাস করিনা। এমন কি আমি ভাগ্যেই বিশ্বাস করিনা। আমি একদমই বুঝতে পারিনা কেন অযথা লোকে এর পেছনে তাদের সময় ব্যয় করে আর এসব গাঁজা খুরি গল্পে বিশ্বাস করে। বালির ওপরকার বলি রেখা দেখে ভাগ্য বলতে পারে এমন লোকেরা বেশীরভাগ সময়ই নিজের ইচ্ছে মত বালির ওপর যাচ্ছে তাই আঁকিবুকি করে, আর আন্দাজে কারো ভাগ্যের শুভাশুভ আওড়াতে থাকে। সেই সঙ্গে অযথাই এমন দাবি করে যেন এর সবই সে একদম চোখের সামনে স্পস্ট দখেতে পাচ্ছে। 



এর পরই আসে তাসের কথা। টেক্কা উঠলে চিঠি আসবে, তিন উঠলে ভ্রমন, আর চার উঠলেই বাড়ি ? বিশেষ কোন কার্ড উঠলে ভাগ্যে এই এই ঘটবে এমন কথা কে বলে দিয়েছে তাদের ? আর বার বার তাদের এই কার্ডের মানেও বদলে যায় কি করে সেটাই এখনো পর্যন- বুঝে উঠতে পারিনি। যেমন ধরুন কোন এক গনক বল্লো সত্বর তার চিঠি পাবেন। তার মানে এবার দূরে কোথাও ভ্রমনের সুযোগ আসছে আপনার। অথবা যখনই সে আপনাকে অভিনন্দনের সুরে বলবে শীঘ্রই হাতে মোটা অঙ্কের টাকা আসতে যাচ্ছে তখন বুঝে নিবেন সে আসলে আপনার দেউলিয়া হয়ে যাবার ভবিষ্যতবাণী করছে ? তাসের অঙ্কের সঙ্গে মানুষের জিবনের এই সংযোগ আমার মাথায় একদমই ঢুকতে চায়না।



এবং তার চাইতে খারাপ হলো কফি কাপের বিষয়টি। কি করে কারো ভবিতব্য, ভুত-ভবিষ্যত বিশেষ ধরনের কফি এবং কাপের পুরুত্বের সঙ্গে জুড়ে থাকতে পারে ? কোন এক গনক একবার আমাকে বলেছিলো সে তার কাপে ভয়ঙ্কর কাঁপুনি টের পাচ্ছে। “এতে আমি মোটেই অবাক নই” সে বল্লো। “আজকে যে কফি আমি পান করছি তা কঙ্গো থেকে আনানো।” সামনে বসা সুদানি সেই মহিলার সব কথাই আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিলো। তার সামনাসামনি নিচু এক খড়ের কেদারার ওপর আরাম করে বসে ছিলাম আমি। পাসেই বয়ে যাওয়া ঝর্ণার যাদুকরি আবহের মধ্যে সে তার পাথর গুলো ছড়িয়ে চেহারায় ভারি কোন চিন'কের ভাব টেনে বসে ছিলো। বছরের সব শনিবার গুলোতে আমি তার কাছে যেতাম। আর বলতে গেলে কোন শুক্রবারেই সে তার পাথর ছড়িয়ে এভাবে বসতো না। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই আমি জেনেছি সপ্তাহের প্রথম কয়েক দিন পাথর গুলো ভরপুর জিবন- থাকে ও হুবহু সত্য বলতে পারে। এসময় এগুলোর কথায় কোন ছলাকলা থাকেনা আর পেছনের ব্যপার নিয়েও খুব একটা ঘাটাঘাটি করেনা। কিন' সপ্তাহের শেষের দিকে কেমন যেন একটা এঘেয়ে বিরক্তিকর সুর কানে ঠেকে। তখন যে কেউ বুঝতে পারবে সবাইকে নানান কথা বলতে বলতে আর লোক জনের কথা শুনতে শুনতে শব্দে যেন ঘারতি পরছে। সামনে দাড়ানো সাবাইকেই এরা লোভি আর অর্থকাতর হিসেবে ভাবে, যেন এদের সবাই পরিশ্রম করে আয়করেনি এমন অর্থ বাগিয়ে নিতে উন্মুখ হয়ে আছে। অথবা আসন্ন কোন কল্পিত সর্বনাসের আতঙ্কে ভয়কাতর কাপুরুষের মতো মনে হচ্ছে, অথবা মনে করছে কুচক্রী কোন মহিলা যার পরিচিত ও প্রতিবেশীদের প্রতি ঘোষিত সব ধরনের বন্ধুত্বই আসলে তিক্ততা ও স'ায়ী ঘৃনায় ভরা, যেকিনা আসলে মন খুলে তার চক্রানে-র সাফল্যের ব্যপারে জানতে এসেছে।



এমন সময় সেই বৃদ্ধা মহিলা আমাকে বল্লো: 

“একটা লোক আর এক মেয়েলোক,” সে বলতে লাগলো “সুখে শানি-তে এক সাথে বসবাস করছিলো। কিন' তাদের কাছাকাছি থাকে এমন লম্বা, কালো ভুতুরে চেহারার এক মহিলা একবার এলো তাদের সেই সুখ নষ্ট করতে। সে এসে তাদের বল্লো আমি স্পস্ট দেখতে পাচ্ছি শীঘ্রই তোমরা সরকারের চিঠি পাবে, ঘরে নতুন নতুন সব আসবাব আসবে।”



আমি সেই লম্বা কালো মহিলাকে চিনতাম-তার নাম উম্ম মাহমুদ, মোটাসোটা দুষ্টবুদ্ধির ধাড়ি চড়ম এক দালাল। সে শুধু আমার স্ত্রীকে ঋণের মাঝেই ফেলেনি একই সঙ্গে তার মাথাও পুরোটা খেয়ে নিয়েছে মনে হয়, প্রায়ই সে শয়তানিটার সঙ্গে এখানে সেখানে যাচ্ছে আমাকে কিছু না যানিয়ে। এ নিয়ে সন্দেহ হবার পরই আমি বউকে চড়ম সতর্ক করে দিয়ে বলেছি যাতে বেটির পা এ বাড়িতে আর কখনই না পরে। তার পর পরই আবার ঋণ সুধতে হাত ঘড়ি আর চেইনটা খোয়াতে হলো।



সেই চিঠির কি হলো, যেটা সরকারের কাছ থেকে আসবে বলে আমি ভেবে ছিলাম ? যে চাকুরিটা পাবার জন্য আমি ডজন ডজন জুতো ক্ষয় করেছি, চিঠিতে কি তাতে নিয়োগের কথাই থাকছে ? আমি ভেবে ছিলাম এতে বড় জোড় দু’দিন কি তিন দিন সময় নিবে, মোটেই মাস বা বছর নয়। খোদাই জানেন কবে আসবে সেই চিঠি ! 



নতুন আসবাবের বেলায়ও সেই পাথরটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার মনের গভিরে লুকিয়ে থাকা না বলা মোক্ষম কথাটিই বলেছে: সেদিনের অনেক আগেই আমি মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম চাকরিটা পাওয়ার মাসখানেকের মধ্যেই নতুন একটা মাদুর আর বিছানা কিনবো।



পাথরটা আমার মনের সব ভয়-ভীতি আর শঙ্কা একদম দূর করে দিল, আগের চাইতে আমি অনেক বেশী এগুলোর উপর ভরসা করতে লাগলাম। শুধু ভাবতে লাগলাম যে সব হাদারামেরা কফি কাপ, তাস বা বালির বলিরেখা দেখে ভাগ্য গননায় বিশ্বাস করে তারা অনায়াসেই তাদের সেই বোকামি ফেলে রেখে গনক পাথরে বিশ্বাস স'াপন করতে পারে ! বুড়ির হাতের ওপর যখন পাথর গুলো কথার জবাবে একদম জিবন- হয়ে কাঁপতে শুরু করে তখন একেই বিশ্বাসের সবচাইতে বড় চিহ্ন বলে মেনে নিতে অত্যুক্তি হয়না ? আপনার সামনেই দুজন নাড়ি পুরুষকে এক সঙ্গে দেখলেন, তার পর তারা আলাদা হয়ে গেলো, ধরুন একলোক যে সুন্দরি নাড়িটাকে ফুসলিয়েছে তাকেই আবার ফুসলিয়ে গেলো এক কালো কদাকার বুড়ি। এই টুকুর মধ্যেইকি জিবনের সব সমস্যা এসে জট পাকিয়ে জায়নি ? সবুজ রঙ্গের এই মনি-মাণিক্যর ভেতরে বুনো স্বপ্নের হাতছানিতে তার সব সম্পদ কি উজার করে দেয়নি ? গনক পাথরের কথা কখনই বিফলে যায়না, কিন' এর সঙ্গে কথা বলতে হলেই গুনে গুনে পুরো বিশ কুরদাস খরচ করতে হয়। তবে পথের ধুলায় তা কুড়িয়ে পেলে হবেনা। কারন ভবিষ্যত বক্তাতো সেটা বুঝেই ফেলবেন আপনি কি কুড়িয়ে পেয়েছেন; তবে বুঝে ফেল্লেই বা ক্ষতি কি, আসলে পাথরের গুনে আপনি যে আর কতকিছুর মালিক বনে যেতে পারেন সেটাই সবার আগে আপনাকে গুনায় ধরা উচিত। 





বাড়ি ফেরার পর বউ এগিয়ে এসে আমাকে জামা জুতো খুলতে সাহায্য করতে লাগলো। গনকের কথা মনে পরতেই আমি বউকে শান- ও ধীর গলায় বলতে লাগলাম, তোমাকে আমি বলিনি “যে উম্ম মাহমুদ আর যেনো এখানে না আসে ?”

সঙ্গে সঙ্গে আমাকে অবাক করে দিয়ে ঝাঁকুনি খেয়ে ওর পুরো মুখ একদম সাদাটে হয়ে গেলো। এর পর পরই ও সিড়িঁর মুখের দড়জা খানা খুলে হুট করে বেরিয়ে গেলো, আর নিচের তলার প্রতিবেশীকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো।

“কিরে, আসমা,” আরো গলা চড়িয়ে। “তোর ওই পোড়া মুখটাকে কখনইকি তুই বন্ধ রাখতে পারিস না মুখপুড়ি ? ইশ্‌রে ? তুইকি সারা দিন আমার ঘরের দুয়ার পাহারা দিস, নাকি অন্য কোন মতলব আছে, শুনি ?”

তার পর সে এমন সব বাজে আর বিষাক্ত কথা বলতে শুরু করে যে আমারো পিলে চমকে যাবার যোগার হলো। এমন করেই সেই ভবিষ্যতবাণীর প্রথম অংশটা পুরোপুরি এক সময় ফলে গেলো।

তাই আমি ভাবছি, দ্বিতীয় অংশটাকেই বা কেন সত্য হতে দেইনা, তার পর পরই সরকারের কাছ থেকে সেই চিঠি আসলো যার জন্য আমি অনেক দিন ধরে অপেক্ষায় ছিলাম।



সোমবারে এক ছোট্ট ছেলে এসে হাজির।

“সিড়িঁর গোড়ায় এক লোক দাড়িয়ে আছে,” ও বল্লো “সুন্দর কাপড়-চাপড় পরা এক লোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাইছে।” 

আমি সিড়িঁ ভেঙ্গে নিচে নেমে এলাম, আর সেখানে এক বান্ডেল কাগজ বগলদাবা করে এক জন অপরিচিত লোক দাড়িয়ে ছিলেন। এবং তার হতে ছিলো আবলুস কাঠের একটি কলম, যা দিয়ে কেবল আরবির চাইতেও জটিল কোন হায়রোগ্লাফিকস ধরনের লেখা লিখা সম্ভব। আমার বুক ধরফর করতে লাগলো।

“কি চাই আমার কাছে ?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“আমি পরোয়ানা নিয়ে এসেছি” লোকটি বল্লো। “আপনিকি এখানে আপনার সাক্ষর বা টিপসই দিবেন ?”

“এটা কি ?” 

“জন সমক্ষে হেয় করায় আপনি এবং আপনার স্ত্রীর বিরুদ্ধে সিট্ট আসমার দায়ের করা আইনি অভিযোগ। আসছে মঙ্গলবার কেসটা আদালতে উঠছে।” 

এরপর যতই আমি সিড়িঁ বেয়ে উপরে উঠছিলাম, দুর্দৈব যেন আমাকে পুরো শক্তি দিয়ে গ্রাস করতে চাইছিলো। এর থেকে বাঁচার জন্য ভেতরে ঢুকে আমি আগুন দেখার জন্যেও প্রস-ত ছিলাম।

“ভালো!” আমি বল্লাম। “এখন তোমার শানি- লাগছেতো ?” এর পর দেখতে দখেতে দু’দিন গেলো। ঝগড়াটা হয়েছিলো হুবহু তারো দু’দিন আগে, পাথরতো দেখছি একদমই সত্য কথা বলেছে, কিন' এতো সেই সত্য নয় যা আমি চোখের সামনে দেখতে চাইছিলাম !

পরের দিন সকালে প্রতিবেশীর সঙ্গে আমার বউয়ের আবার ঝগড়া হলো। 

এত সব দেখে রক্ত আমার টগবগিয়ে উঠলো।

“প্রতি দু’দিন পর পর কি তুমি আমাকে নতুন নতুন মামলা-মোকদ্দমার মধ্যে ফেলতে চাও নাকি ?” আমি বল্লাম।

“তোমার আর ক্ষেপার দরকার নেই প্রিয়।” ও ফোঁস করে জবাবে বলে উঠলো। “এখনি আমি বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছি।”

রেগেমেগে শেষমেস ও চলে গেলো, আর আমি একা পরে রইলাম। পঞ্চাশ পেইসটারসের মতো খরচ হতে পারে এমন মোটা অঙ্কের মার্কদমা থেকে আমি বাঁচতে চাচ্ছিলাম, এর বদলে আমি জেল, জরিমানা এমনকি স্ত্রীর খোরপোষ দেবার জন্যও প্রস-ত ছিলাম।

এরই মধ্যে হঠাৎ এক ফাঁকে আমি বাড়ির বাইরে যাই, এমন সময় আমার স্ত্রীর কয়েক জন আত্নীয় স্বজন সহ দু’জন পুলিশ ও চারজন মুটে এসে ঘরের সব আসবাবপত্র নিয়ে চলেযায়।

ফিরে আসার পর ঘরের চার পাসে রংচটা চার দেওয়াল ছাড়া আর কিছুই আমার চোখে পরেনি। এমন কি খাবার জল রাখার কলসিটা পর্যন- তারা সাথে করে নিয়ে গেছে।

আমি বোবার মত দাড়িয়ে রইলাম। 

“একেই কি পাথরটা আমার নতুন আসবাব বলে বুঝিয়ে ছিলো ?” বসে বসে এই একটি কথাই শুধু ভাবছি এখন।



অনুবাদ: সোহরাব সুমন

উৎস :http://m.somewhereinblog.net/mobile/blog/lights007/29246885

কৃষণ চন্দরের গল্প : সুন্দরী প্রতিযোগিতা


অনুবাদ : জাফর আলম

দুই বন্ধু যদি আইসিএস কর্মকর্তা হয় তাহলে ভারসাম্য বজায় রাখা বড়ই কষ্টকর। কিন্তু সুন্দরী রণভা বিচক্ষণতার সঙ্গে দুই প্রেমিকের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখেছে। কারণ রণভা সুন্দরী। তার কমনীয় চেহারা দেখলে বিদেশী আর্ট ম্যাগাজিনের কভার মনে হয়। তার দেহের চামড়া নাইলনের কাপড়ের মতো মোলায়েম দাগহীন আর তার উদ্ভিন্ন যৌবন ভরা দেহখানি নতুন মডেলের গাড়ির মতো যেন স্প্রিংযুক্ত। অন্য মেয়েদের দেখলে মনে হয় তাদের মাতাপিতা অনভিজ্ঞ হাতে লালন পালন করেছে। কিন্তু রণভা যেন আধুনিক কারখানায় নিপুণভাবে তৈরি মডেল। তার দেহের প্রতিটি ভাঁজ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেন নিখুঁতভাবে কারিগর যথাস্থানে সেট করে দিয়েছে। তাই মন চায় রণভাকে জিজ্ঞাসা করতে কোন কারখানায় তার দেহ তৈরি যেখানে আরও দশ হাজার তারই মতো নিখুঁত স্বাস্থ্য দেহের অধিকারী মেয়ে সরবরাহের অর্ডার দেয়া যায় কিনা?


যমুনা রণভার ন্যায় সুন্দরী নয়। কিন্তু এমনভাবে হেলেদুলে হাঁটত যেন হ্রদের পানির বুকে ছোট ছোট ঢেউ পরস্পর কোলাকুলি করছে আর দেহের প্রতিটি ভাঁজ এমন ভঙ্গিমার সৃষ্টি করতে থাকে, একমাত্র বেহালার ছন্দময় সঙ্গীতের সঙ্গে তুলনা করা চলে। পাহাড়ের ধারে ত্রপ্রোমাল রোডে যখন সে ভোরে পায়চারি করতে বের হতো তখন লোকজন তার সদ্য ঘুম থেকে জেগে ওঠা দেহের নিখুঁত স্বাস্থ্য লাবণ্য দেখে মোহিত হয়ে পড়ত।

তম্বী জোবেদার কণ্ঠ ছিল সুমধুর। তাকে দেখলে গ্রামোফোন কোম্পানির রেকর্ডের কথা মনে পড়ে, হাসি তার মুখে লেগেই থাকত। তার শ্যামলা কমনীয় চেহারায় শুভ্র দাঁতগুলো হাসলে অপূর্ব লাগত। সে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লে মনে হতো যেন শ্যাম্পেনের দুটি গ্লাস একটা অন্যটার সঙ্গে টোকা লেগেছে। তাই অনেকেই এই ধরনের মহিলার সান্নিধ্য লাভের ফলে ক্লাবে মাদকরস গলাধকরণ না করেই নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। মৃণালিনীর চোখ ছিল উদাস আর ঠোঁট ছিল অত্যন্ত সুন্দর। তার দৃষ্টি হালকা রঙের গালিচার ন্যায় মনোরম। তাকে দেখলে মনে হয়, জীবনের একই একঘেয়ে কণ্টকময় পথে গাছের ছায়ার ন্যায় তার কাজল কালো চোখের ভ্রুর ছায়ায় বিশ্রাম নিলে মন্দ হত না। মৃণালিনীকে দেখে দার্জিলিং-এর চায়না শৃঙ্গে যেতে পথে ফুটপাথের পাশের রেস্তোরাঁর কথা স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে। এই সব রেস্তোরাঁর নিস্তব্ধ নিঝুম বারান্দায় আবছা আলোতে দণ্ডায়মান বেয়ারা আর সতেজ লাইম জুইস সব কিছু মিলিয়ে অপূর্ব রোমান্টিক পরিবেশ। এই সব চীনা রেস্তোরাঁয় বসে অধিকাংশ সময় মৃণালিনীর কথা মনে পড়ে। কারণ মৃণালিনীর সৌন্দর্যের কমনীয়তা ছিল ভিন্নধর্মী।

রোজ গোলাপের ন্যায় সুন্দরী ছিল না কিন্তু মযূরীর ন্যায় অবশ্যই ছিল। নৃত্যের তালে তালে অনেকের হৃদয়ে ভূকম্পনের সৃষ্টি করত। রক এন রোল থেকে আধুনিক ক্ল্যাসিকাল কিন্তু প্রেমিক ছিল মাত্র একজন। সেই প্রেমিকের জন্য সে আজ দু’বছর যাবত অপেক্ষায় আছে। কারণ রোজ প্রেমিককে বিয়ে করতে চায়। বিয়ের জন্য ধৈর্য ধরা প্রয়োজন। এ্যানে পেড্রোজার জন্য প্রতীক্ষা করছে সে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হল পেড্রোজা আর অপেক্ষার তোয়াক্কা করেনি। কারণ সে একজন আইসিএস কর্মকর্তা। রণভার ন্যায় অপূর্ব সুন্দরী মেয়েও তাকে লিফট দিতে গৌরববোঁধ করত। কিন্তু রোজ তার তুলনায় রণভাকে অধিকতর সুন্দরী মনে করে না। রোজের দেহের গড়ন ১২/১৩ বছরের কিশোরীর ন্যায় পাতলা লিকলিকে। তার সুমধুর কণ্ঠ আর ববকাটা চুল সুন্দর মানাত। তার ববকাটা চুল দেখলে অর্কেস্ট্রার কথা মনে পড়বে। তার দেহের গড়ন জেট বিমানের ন্যায় নাজুক খুচরা যন্ত্রপাতি দিয় তৈরি। রণভার কি সাধ্য পেড্রোজাকে তার বুক থেকে ছিনিয় নেয়।

ইলা ইতোপূর্বে ছিলেন মিসেস ফিলচাদ, এখন নিঃসঙ্গ। স্বামীর কাছ থেকে তালাক নিয়েছে। এখনও তার দেহের ভাঁজে ভাঁজে যৌবনের ঈশারা। তিনি ছিলেন নেপালী। স্বাস্থ্যটাকে অক্ষুণ্ন রেখেছেন অতিযত্নে। আর্য আর চীনা বিউটি তার দেহে একাকার হয়ে গেছে।

আবার হিল স্টেশনে চিফ কমিশনার সাহেবের তিন কন্যা রয়েছে। কমিশনার সাহেব এদের যোগ্য বরের সন্ধ্যানে আছেন। এদের নাম যথাক্রমে সুধা, মাধুরী আর আশা। তিনজনের মধ্যে আশা ছিল কুশ্রী। অবশ্য মাধুরী সুধাও তেমন কমনীয় ছিল না। হাজার হোক কমিশনার সাহেবের মেয়ে, তাই ওদেরও সুশ্রী হিসেবে গণ্য করা যায়। কারণ ইদানিং মন্ত্রীদের বক্তৃতাকেও সাহিত্য মর্যাদা দেয়া হয়। তাছাড়া শীতা মেলহোত্রা, ব্রজেস, আবদূর রহমান, বলসিয়ার কাউর, খুরশীদ গোরদালা আর মনঞ্জুর আনন্দের মেয়ে গৌরীও হিল স্টেশনের বার্ষিক সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছে। এই সুন্দরী প্রতিযোগিতা ছিল স্টেশনের সবচেয়ে বড় জাতীয় উৎসব। সেদিন ক্লাবের লনে বহু লোকের সমাগম হয়েছে। রংবেরঙের পতাকা লতাপাতা দিয়ে লনকে সাজানো হয়েছে। চোখ ঝলসানো দামী শাড়ি পরিহিতা মহিলা শিশুর ভিড়। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী তরুণীদের ভয়মিশ্রিত হাসি আর প্রেমিক মাতাপিতার সাহস প্রদান শেষ মুহূর্তে ব্লাউজ পরিবর্তন আর শাড়ির ভাঁজ দূরস্ত করা চলছে। বাপরে, সুন্দরী প্রতিযোগিতা নয় যেন আইসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি পর্ব চলছে। সুন্দরী প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকারিণী তরুণীর গৌরব কম নয়। প্রতিবছর এই প্রতিযোগিতায় ডজনের অধিক মেয়ে অংশগ্রহণ করে থাকে আর অভিভাবক মাতাপিতা আনন্দে এতে অংশগ্রহণের অনুমতি দিয়ে থাকেন।

সেদিন ছিল সুন্দরী প্রতিযোগিতার ফাইনাল। রোহিলাখণ্ডের সাবেক চিফ কমিশনার কুমার বান্ডা সিং আর বিশিষ্ট কবি সীতারাম হলেন সুন্দরী বাছাইয়ের বিচারক। বিচারের পাল্লা যাতে কোনদিক ঝুঁকে না পড়ে এবং নিরপেক্ষ বিচার হয় এজন্য সাবেক বিচারপতি দেশপান্ডেকে বিচারকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ব্যারিস্টার সৈয়দ এমতিয়াজ হোসনকে কমিটির সদস্য করা হয়েছে। কথিত আছে ব্যারিস্টার সাহেব রোজ নাকি স্ত্রীকে মারধর করেন। বিচারক মণ্ডলীর পঞ্চম সদস্য হলেন কুমায়ুনের বিশিষ্ট ধনী দেওয়ান বলরাজ শাহ। ভদ্রলোক আবার উল্টো দৈনিক স্ত্রীর কাছে পিটুনি খেতেন। কমিটিতে কোন মহিলা সদস্য নেয়া হয়নি। কারণ মেয়েরা নিজের চেয়ে অন্য কাউকে অধিক সুন্দরী মনে করে না। তাই অনেক চিন্তা-ভাবনার পর কোন মহিলা বিচারককে কমিটিতে নেয়া হয়নি। সুন্দরী প্রতিযোগিতার বাছাই কমিটিতে মোট পাঁচজন সদস্যই থাকল। যারা শ্রেষ্ঠ সুন্দরীদের গুণাগুণ বিচার করে ফলাফল ঘোষণা করবেন। সর্বপ্রথম ঘোষক ক্লাবের বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনবার ঘণ্টা বাজান। ঘণ্টাধ্বনি শুনে ক্লাবের বিভিন্ন কামরা থেকে লোকজন বেরিয়ে লনে সমবেত হন। প্রথম সারিতে সোফায় পাঁচজন বিচারক বসেছেন। তার পর বিশিষ্ট সদস্যগণ, তার পর ক্লাবের বিশিষ্ট সদস্যগণ, তৃতীয় সারিতে শহরের বিশিষ্ট নাগরিকবৃন্দ, তার পর সাধারণ দর্শক উপবিষ্ট। পেছনের সারিতে সমবেত লোকজনের হৈ চৈ। ঘোষক জোরে ঘণ্টা বাজিয়ে চুপ করতে অনুরোধ জানান।

বিচারপতি দেশপান্ডে দাঁড়িয়ে সর্বপ্রথম প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী তরুণীদের নাম ঘোষণা করেন। অতঃপর ব্যান্ডের বাজনা শুরু হয়। ব্যান্ডের তালে তালে দর্শকদের দৃষ্টি ক্লাবের সিঁড়িতে গিয়ে পড়ে। ক্লাবের কক্ষে প্রসাধনরত সুন্দরীরা একে একে বের হয়ে বিচারকমণ্ডলীর সামনে হাজির হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সিঁড়ি থেকে নিচে লন পর্যন্ত লাল গালিচা বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। এই গালিচার ওপর সুন্দরীরা নিজেদের রূপ যৌবনের মহড়া দেখাবেন। অনেক দর্শক দূরবীণ বের করে নিয়েছে।

সর্বপ্রথম ইলা গাঢ় রংয়ের শাড়ি পরে কোমর দুলিয়ে সিঁড়ি থেকে নিচে নামে। ইলার ব্যবহৃত সেন্টের সৌরভে পুরো অঙ্গন মুখরিত আর তার মুখে বিজয় সুলভ হাসি। বিচারকদের সামনে ইলা নানা ভঙ্গিমায় তার দেহ সৌন্দর্যের কলাকৌশল প্রদর্শন করে। কোমল হাত বাড়িয়ে শাড়ির আঁচল সামলিয়ে নিয়ে এক ঝটকায় বিচিত্র ভঙ্গিতে মোড় ঘুরলে দর্শকদের প্রাণে দোলা দিয়ে যায়।

এরপর মোগল রাজকুমারীর বেশে দর্শক সমীপে হাজির হয় লাস্যময়ী জোবায়দা। পরনে গাঢ় জামরঙের গারারা আর গায়ে হালকা হলুদ রঙের দুলের লাখনৌ স্টাইলের কামিজ। মাথায় চুমকি লাগানো ওড়না। মদের পান পাত্রের ন্যায় চিকন তার গলা; ইচ্ছে হয় পানপাত্র থেকে ঢেলে সব মদ এক নিঃশ্বাসে পান করে নিই। গলায় পাথর খচিত জরির গলাবন্ধ তার কমনীয়তা আরও বৃদ্ধি করেছে। ভিন্নতর স্টাইলে কোমর দুলিয়ে জোবায়দা বিচারকদের সামনে এসে হাজির হয়। মুখে তার স্মিত হাসি আর এই হাসির ফাঁকে তার শুভ্র সমুজ্জ্বল দাঁতগুলো মুক্তোর ন্যায় ঝিকঝিক করছিল। সুন্দরী রোজ গাঢ় সবুজ রঙের সেমিজ আর আটসাঁট ব্লাউজ পরে দর্শকদের সামনে এসে হাজির। ব্লাউজের কাপড় ঠেলে তার উদ্ভিন্ন যৌবন যেন ফেটে পড়ছিল। তার চিকন কোমর আর নাদুস নুদুস পায়ের ভিরু পদচারণা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। দর্শকদের অবিরাম হর্ষধ্বনি আর হাততালিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে। ফটোগ্রাফাররা ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দে রোজের ছবি তুলতে থাকে। মুচকি হেসে সুন্দরী রোজ দর্শকদের অভিনন্দন মাথা নত করে গ্রহণ করে আর তাদের কুর্নিশ জানায়। এরপর আসে চিফ কমিশনার সাহেবের তিন কন্যা প্রথমে সুধা মেহতা, তার পর মাধুরী মেহতা আর সর্বশেষ আশা মেহতা। তাদের সৌন্দর্য মোটামুটি চলনসই, যার বর্ণনা দেয়ার প্রয়োজন নেই। যেহেতু চিফ কমিশনার সাহেবের কন্যা, তাই তার মন রাখার জন্য বিচারকমণ্ডলী থেকে শুরু করে অনেকেই হাততালি দেন। কিন্তু আশা মেহতাকে দেখে দর্শকবৃন্দ হাততালি দিতেও ভুলে যান। কারণ মেকাপেও তার কুশ্রী রূপ ঢাকা পড়েনি। আশা মেহতা চলে গেলে যেন দর্শকরা হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। সীতা মেহলহোত্রা একটা মিহি তসরের বেনারসী শাড়ি পরে এসে দর্শকদের অভিবাদন জানালেন। পরনের পেটিকোটও তার বেশ দামী। ভাব দেখে অনুমিত হয় পরনের পেটিকোট নাইলনের হলে বেশি নাম্বার মিলবে।

এবার এলেন দেবদাসী বেশে এলোকেশে খোঁপা বেঁধে মাথায় ফুল গুঁজে মৃণালিনী। এক নজরে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে, যেন বনের হরিণ শহরে এসে পথ হারিয়ে ফেলেছে। অতঃপর একে একে যমুনা প্রজেস, খুরশীদ ঘোরী প্রমুখ তরুণী বাইরে এসে নিজেদের রূপযৌবন প্রদর্শন করে ভেতরে চলে যায়। সর্বশেষ এলো সুন্দরী রণভা, সঙ্গে সঙ্গে ব্যান্ডের বাজনা বেজে উঠল। রণভা পাজামা, কামিজ আর সেলোয়ার পরে এসে দর্শকদের অভিবাদন জানায়। তার দেহের প্রতিটি ভাঁজে ফুটে উঠেছিল যৌবনের রূপরেখা। দর্শকরা বাহবা দিতে থাকে। সকলের অভিমত এবারের সুন্দরী প্রতিযোগিতায় রণভাই প্রথম স্থান অধিকার করবে।

প্রতিযোগী তরুণীদের মহড়া শেষ হল। এবার বিচারকরা ক্লাবে গিয়ে শলা পরামর্শ করতে থাকেন কে প্রথম আর কে দ্বিতীয় তৃতীয় স্থানের অধিকারী যোগ্য গুণাগুণের দিক থেকে। দর্শকদের মধ্যে জোর জল্পনা-কল্পনা চলছে সুন্দরীদের গুণাগুণ নিয়েই কে প্রথম হবে এবার। অধিকাংশ অভিভাবক নিজ নিজ মেয়ের সৌন্দর্য চর্চায় ব্যস্ত। অধিকাংশ দর্শকই রণভার সপক্ষে বায় দিয়ে বসে সেই একমাত্র প্রথম হওয়ার যোগ্য। কেউ কেউ আবার জোবায়দা, যমুনা প্রভৃতিকে প্রথম হওয়ার যোগ্য বলে রায় দিচ্ছে।

পনের মিনিট পর বিচারপতি দেশপাণ্ডে সুন্দরীদের তালিকার কাগজ নিয়ে দর্শকদের সামনে এসে হাজির হলেন, দর্শকদের মাঝে আর গুঞ্জন নেই। বিচারপতি দেশপান্ডে চশমা ঠিকভাবে চোখে লাগিয়ে ঘোষণা করলেন, সুন্দরী প্রতিযোগতিার বিচারকমণ্ডলী একমত হয়ে বছরের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী হিসেবে গুণাগুণ বিচারের পর নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রথম স্থান অধিকারের যোগ্য বিবেচিত হয়েছেন মিস সুধা মেহতা, দ্বিতীয় মিস মাধুরী মেহতা এবং তৃতীয় মিস জোবায়দা।

এদিকে চিফ কমিশনার সাহেবের বাড়িতে দারুণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ এক সঙ্গে দুই তনয়া বিউটি কন্টেস্টে প্রথম দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। কিন্তু এতেও বেগম সাহেবা সন্তুষ্ট নন। কারণ আশা মেহতা বাড়িতে গিয়ে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছিল। দু‘বোন পুরস্কার পেয়েছে অথচ সে বাদ পড়েছে।

সন্ধ্যায় চিফ কমিশনার সাহেব ক্লাব থেকে বাড়ি ফিরলে বেগম সাহেবা এক হাত নিলেন আর বললেন, হায় মেয়েটা সকাল থেকে কেঁদে কেঁদে হয়রান, তুমি আশার দিকে একটুও খেয়াল করলে না। তুমি কিসের চিফ কমিশনার, যখন আমার মেয়েটা পুরস্কারই পেল না সুধা আর মাধুরী তো বর পাবেই। অথচ যে মেয়েটার প্রতি বিশেষ নজর দেয়া উচিত ছিল, তা দিলে না, হায় আমার কপাল।”

চিফ কমিশনার সাহেব গর্জন করে উঠেন, তুমি কি পাগল হয়েছ। তোমার দুই কন্যাকে যে কোন প্রকারে পুরস্কার দেয়ার ব্যবস্থা করেছি। আবার তৃতীয় কন্যাকেও যদি পুরস্কার দেয়া হয়, তাহলে লোকে কি বলবে বলত। প্রকৃত পক্ষে ‘ন্যায়বিচার’ বলে একটা প্রবাদ তো রয়েছে।

 

উৎস : http://www.galpopath.com/2015/09/blog-post_47.html?m=1 

তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প : বেদেনী


শম্ভু বাজিকর এ মেলায় প্রতি বৎসর আসে। তাহার বসিবার স্থানটা মা কঙ্কালীর এস্টেটের খাতায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো কায়েমি হইয়া গিয়াছে। লোকে বলে, বাজি; কিন্তু শম্ভু বলে 'ভোজবাজি-ছারকাছ'।

ছোট তাঁবুটার প্রবেশপথের মাথার উপরেই কাপড়ে আঁকা একটা সাইনবোর্ডেও লেখা আছে 'ভোজবাজি-সার্কাস'। লেখাটার একপাশে একটা বাঘের ছবি, অপরদিকে একটা মানুষ, তাহার এক হাতে রক্তাক্ত তরবারি, অপর হাতে একটি ছিন্নমুণ্ডু। প্রবেশমূল্য মাত্র দুইটি পয়সা। ভিতরে আছে কিন্তু 'গোলকধামে'র খেলা। ভিতরে পট টাঙাইয়া কাপড়ের পর্দায় শম্ভু মোটা লেন্স লাগাইয়া দেয়, পল্লীবাসীরা বিমুগ্ধ বিস্ময়ে সেই লেন্সের মধ্যে দিয়া দেখে 'আংরেজ লোকের যুদ্ধ,' 'দিল্লীকা বাদশা', 'কাবুলকে পাহাড়', 'তাজ-বিবিকা কবর'। তারপর শম্ভু লোহার রিং লইয়া খেলা দেখায়, সর্বশেষে একটা পর্দা ঠেলিয়া দিয়া দেখায় খাঁচায় বন্দি একটা চিতাবাঘ। বাঘটাকে বাহিরে আনিয়া তাহার উপরে শম্ভুর স্ত্রী রাধিকা বেদেনী চাপিয়া বসে, বাঘের সম্মুখের থাবা দুইটা ধরিয়া টানিয়া তুলিয়া আপন ঘাড়ের উপর চাপাইয়া তাহার সহিত মুখোমুখি দাঁড়াইয়া বাঘের চুমা খায়, সর্বশেষে বাঘটার মুখের ভিতর আপনার প্রকাণ্ড চুলের খোঁপাটা পুরিয়া দেয়, মনে হয়, মাথাটাই বাঘের মুখের মধ্যে পুরিয়া দিল। সরল পল্লীবাসীরা স্তম্ভিত বিস্ময়ে নিশ্বাস রুদ্ধ করিয়া দেখিতে দেখিতে করতালি দিয়া উঠে। তাহার পরেই খেলা শেষ হয়, দর্শকের দল বাহির হইয়া যায়, সর্বশেষ দর্শকটির সঙ্গে শম্ভুও বাহির হইয়া আসিয়া আবার তাঁবুর দুয়ারে জয়ঢাক পিটিতে থাকে_দুম-দুম, দুম। জয়ঢাকের সঙ্গে স্ত্রী রাধিকা বেদেনী প্রকাণ্ড একজোড়া করতাল বাজায় ঝন- ঝন-ঝন।


মধ্যে মধ্যে শম্ভু হাঁকে, বড় বাঘ! এ বড় বা-ঘ।

পক্ষীরাজ ঘোড়া হয়, মানুষের চুমা খায়, জ্যান্ত মানুষের মাথা মুখের মধ্যে পোরে, কিন্তু খায় না।

কথাগুলো শেষ করিয়াই সে ভিতরে গিয়ে বাঘটাকে একটা তীক্ষ্নাগ্র অঙ্কুশ দিয়া খোঁচা মারে, সঙ্গে সঙ্গে বাঘটা বার বার গর্জন করিতে থাকে। তাঁবুর দুয়ারের সম্মুখে সমবেত জনতা ভীতিপূর্ণ কৌতূহলস্পন্দিত বক্ষে তাঁবুর দিকে অগ্রসর হয়।

দুয়ারের পাশে দাঁড়াইয়া বেদেনী দুইটি করিয়া পয়সা লইয়া তবে প্রবেশ করিতে দেয়। এ ছাড়াও বেদেনীর নিজের খেলাও আছে। তাহার আছে একটা ছাগল, বাঁদর আর গোটাকয়েক সাপ। সকাল হইতেই সে আপনার ঝুলি-ঝাঁপি লইয়া গ্রামে বাহির হয়, গৃহস্থের বাড়ি বাড়ি খেলা দেখাইয়া, গান গাহিয়া উপার্জন করিয়া আনে।

এবার শম্ভু কঙ্কালীর মেলায় আসিয়া ভীষণ ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল। কোথা হইতে আর একটা বাজির তাঁবু আসিয়া বসিয়া গিয়াছে। তাহার জন্যে নির্দিষ্ট জায়গাটা অবশ্য খালিই পড়িয়া আছে, কিন্তু এ বাজির তাঁবুটা অনেক বড় এবং কায়দাকরণেও অনেক অভিনবত্ব আছে। বাহিরে দুইটা ঘোড়া, একটা গরুর গাড়ির উপর প্রকাণ্ড একটা খাঁচা, নিশ্চয় উহাতে বাঘ আছে।

গরুর গাড়ি তিনখানা নামাইয়া শম্ভু নূতন তাঁবুর দিকে মর্মান্তিক ঘৃণায় হিংস্র দৃষ্টিতে চাহিল, তারপর আক্রোশভরা নিম্নকণ্ঠে বলিল, শালা!

তাহার মুখ ভীষণ হইয়া উঠিল। শম্ভুর সমগ্র আকৃতির মধ্যে একটা নিষ্ঠুর হিংস্র ছাপ যেন মাখানো আছে। ক্রূর নিষ্ঠুরতা পরিব্যঞ্জক একধারার উগ্র তামাটে রং আছে শম্ভুর দেহবর্ণ সেই উগ্র তামাটে; আকৃতি দীর্ঘ, সর্বাঙ্গে একটা শ্রীহীন কঠোরতা, মুখে কপালের নিচেই নাকে একটা খাঁজ, সাপের মতো ছোট ছোট গোল চোখ, তাহার উপর সে দন্তু, সম্মুখের দুইটা দাঁত কেমন বাঁকা হিংস্র ভঙ্গিতে অহরহ বাহিরে জাগিয়া থাকে। হিংসায়, ক্রোধে সে যেন ভয়াবহ হইয়া উঠিল।

রাধিকাও হিংসায়, ক্রোধে, ধারালো ছুরি যেমন আলোকের স্পর্শে চকমক করিয়া উঠে, তেমনই ঝকমক করিয়া উঠিল, সে বলিল, দাঁড়া খাঁচায় দিব গোক্ষুরার ডেঁকা ছেড়্যা!

রাধিকার উত্তেজনার স্পর্শে শম্ভু আরো উত্তেজিত হইয়া উঠিল, সে ক্রুদ্ধ দীর্ঘ পদক্ষেপে অগ্রসর হইয়া নূতন তাঁবুটার ভিতর ঢুকিয়া বলিল, কে বেটে, মালিক কে বেটে? কি চাই? তাঁবুর ভিতরের আর একটা ঘরের পর্দা ঠেলিয়ে বাহির হইয়া আসিল একটি জোয়ান পুরুষ, ছয় ফিটেরও অধিক লম্বা, শরীরের প্রতি অবয়বটি সবল এবং দৃঢ়, কিন্তু তবুও দেখিলে চোখ জুড়াইয়া যায়, লম্বা হাল্কা দেহ, তাজা ঘোড়া যেমন একটি মনোরম লাবণ্যে ঝকমক করে লোকটির হাল্কা অথচ সবল দৃঢ় শরীরে তেমনই একটি লাবণ্য আছে। রং কালোই, নাকটি লম্বা টিকালো, চোখ দুইটি সাধারণ, পাতলা ঠোঁট দুইটির উপর তুলি দিয়া আঁকা গোঁফের মতো এক জোড়া গোঁফ-সূচাগ্র করিয়া পাক দেওয়া, মাথায় বাবরি চুল, গলায় ঝুলানো একটি সোনার ছোট চৌকা তক্তি, সে আসিয়া শম্ভুর সম্মুখে দাঁড়াইল!

দুজনেই দুইজনকে দেখিতেছিল।

কি চাই? নূতন বাজিকর আবার প্রশ্ন করিল, কথার সঙ্গে সঙ্গে মদের গন্ধে শম্ভুর নাকের নিচের বায়ুস্তর ভুরভুর করিয়া উঠিল।

শম্ভু খপ করিয়া ডান হাত দিয়া তাহার বাঁ হাতটা চাপিয়া ধরিল, বলিল, এ জায়গা আমার।

আমি আজ পাঁচ বৎসর এইখানে বসছি।

ছোকরাটিও খপ করিয়া আপন ডান হাতে শম্ভুর বাঁ হাত চাপিয়া ধরিয়া মাতালের হাসি হাসিল, বলিল, সে হবে, আগে মদ খাও টুকটা।

শম্ভুর পিছনে জলতরঙ্গ বাদ্যযন্ত্রে দ্রুততম গতিতে যেন গৎ বাজিয়া উঠিল, রাধিকা কখন আসিয়া শম্ভুর পিছনে দাঁড়াইয়াছিল, সে খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল, বলিল, কটি বোতল আছে তুমার নাগর মদ খাওয়াইবা?

ছোকরাটি শম্ভুর মুখ হইতে পিছনের দিকে চাহিয়া রাধিকাকে দেখিয়া বিস্ময়ে মোহে কথা হারাইয়া নির্বাক হইয়া গেল। কালো সাপিনীর মতো ক্ষীণতনু দীর্ঘাঙ্গিনী বেদেনীর সর্বাঙ্গে যেন মাদকতা মাখা; তাহার ঘন কুঞ্চিত কালো চুলে, চুলের মাঝখানে সাদা সুতার মতো সিঁথিতে, তাহার ঈষৎ বঙ্কিম নাকে, টাকা অর্ধ-নিমীলিত ভঙ্গির মদিরদৃষ্টি দুটি চোখে, সূচালো চিবুকটিতে সর্বাঙ্গে মাদকতা। সে যেন মদিরার সমুদ্রে সদ্য স্নান করিয়া উঠিল; মাদকতা তাহার সর্বাঙ্গ বাহিয়া ঝরিয়া ঝরিয়া পড়িতেছে। মহুয়াফুলের গন্ধ যেমন নিশ্বাসে ভরিয়া দেয় মাদকতা, বেদেনীর কালো রূপও চোখে তেমনই একটা ধরাইয়া দেয় নেশা। শুধু রাধিকাই নয়, এই বেদেজাতের মেয়েদের এটা একটা জাতিগত রূপবৈশিষ্ট্য। এই বৈশিষ্ট্য রাধিকার রূপের মধ্যে একটা যেন প্রতীকের সৃষ্টি করিয়াছে; কিন্তু মোহময় মাদকতার মধ্যে আছে ক্ষুরের মতো ধার, মোহমত্ত পুরুষকেও থমকিয়া দাঁড়াইতে হয়, মোহের মধ্যে ভয়ের চেতনা জাগাইয়া তোলে, বুকে ধরিলে হৃৎপিণ্ড পর্যন্ত ছিন্নবিচ্ছিন্ন হইয়া যাইবে।

রাধিকার খিল খিল হাসি থামে নাই, সে নূতন বাজিকরের বিস্ময়বিহ্বল নীরব অবস্থা দেখিয়া আবার বলিল, বাক হর‌্যা গেল যে নাগরের?

বাজিকর এবার হাসিয়া বলিল, বেদের বাচ্চা গো আমি। বেদের ঘরের মদের অভাব! এস। কথা সত্য, এই অদ্ভুত জাতটি মদ কখন কিনিয়া খায় না। উহারা লুকাইয়া চোলাই করে, ধরাও পড়ে, জেলেও যায়। কিন্তু তা বলিয়া স্বভাব কখন ছাড়ে না। শাসন-বিভাগের নিকট পর্যন্ত ইহাদের এ অপরাধটা অতি সাধারণ হিসাবে লঘু হইয়া দাঁড়াইয়াছে।

শম্ভুর বুকখানা নিশ্বাসে ভরিয়া এতখানি হইয়া উঠিল। আহ্বানকারীও তাহার স্বজাতি, নতুবা । সে রাধিকার দিকে ফিরিয়া কঠিন দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিল, তুই আইলি কেনে এখেনে?

রাধিকা এবারও খিল খিল করিয়া হাসিয়া বলিল, মরণ তুমার! আমি মদ খাব নাই?

তাঁবুর ভিতরে ছোট একটা প্রকোষ্ঠের মধ্যে মদের আড্ডা বসিল। চারদিকে পাখির মাংসের টুকরা টুকরা হাড়ের কুচি ও একরাশি মুড়ি ছড়াইয়া পড়িয়া আছে; একটা পাতায় এখনও খানিকটা মাংস, আর একটায় কিছু মুড়ি, পেঁয়াজ, লঙ্কা, খানিকটা নুন, দুইটি খালি বোতল গড়াইতেছে, একটা বোতল অর্ধসমাপ্ত। বিস্রস্তবসনা একটি বেদের মেয়ে পাশেই নেশায় অচেতন হইয়া পড়িয়া আছে, মাথার চুল ধুলায় রুক্ষ, হাত দুইটি মাথার উপর দিয়া ঊর্ধ্ববাহুর ভঙ্গিতে মাটির উপর লুণ্ঠিত, মুখে তখনও মদের ফেনা বুদ্বুদের মতো লাগিয়া রহিয়াছে। হৃষ্টপুষ্ট শান্তশিষ্ট চেহারার মেয়েটি।

রাধিকা তাহাকে দেখিয়া আবার খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। বলিল, তুমার বেদেনী? ই যি কাটা কলাগাছের পারা পড়েছে গো!

নূতন বাজিকর হাসিল, তারপর সে স্খলিতপদে খানিকটা অগ্রসর হইয়া একটা স্থানের আলগা মাটি সরাইয়া দুইটা বোতল বাহির করিয়া আনিল।

মদ খাইতে খাইতে কথা যাহা বলিবার বলিতেছিল নূতন বাজিকর আর রাধিকা।

শম্ভু মত্ততার মধ্যেও গম্ভীর হইয়া বসিয়া ছিল। প্রথম পাত্র পান করিয়াই রাধিকা বলিল, কি নাম গো তুমার বাজিকর?

নূতন বাজিকর কাঁচা লঙ্কা খানিকটা দাঁতে কাটিয়া বলিল, নাম শুনলি গালি দিবা আমাকে বেদেনী।

কেনে?

নাম বটে কিষ্টো বেদে।

তা গালি দিব কেনে?

তুমার নাম যে রাধিকা বেদেনী, তাই বুলছি।

রাধিকা খিল খিল করিয়া হাসিয়া গড়াইয়া পড়িল। পরক্ষণেই সে কাপড়ের ভিতর হইতে ক্ষিপ্রহস্তে কি বাহির করিয়া নূতন বাজিকরের গায়ে ছুড়িয়া দিয়া বলিল, কই, কালিয়দমন কর দেখি কিষ্টো, দেখি!

শম্ভু চঞ্চল হইয়া পড়িল; কিন্তু কিষ্টো বেদে ক্ষিপ্র হাতে আঘাত করিয়া সেটাকে মাটিতে ফেলিয়া দিল। একটা কালো কেউটের বাচ্চা। আহত সর্পশিশু হিস গর্জন করিয়া ফণা তুলিয়া দংশনোদ্যত হইয়া উঠিল : শম্ভু চিৎকার করিয়া উঠিল, আ-কামা! অর্থাৎ বিষ দাঁত এখনও ভাঙা হয় নাই। কিষ্টো কিন্তু ততক্ষণে তাহার মাথাটা বাঁ হাতে চাপিয়া ধরিয়া হাসিতে আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। হাসিতে হাসিতে সে ডান হাতে ট্যাঁক হইতে ছোট একটা ছুরি বাহির করিয়া দাঁত দিয়া খুলিয়া ফেলিল এবং সাপটার বিষদাঁত ও বিশেষ থলি দুইই কাটিয়া ফেলিয়া রাধিকার গায়ে আবার ছুড়িয়া দিল। রাধিকাও বাঁ হাতে সাপটাকে ধরিয়া ফেলিল; কিন্তু রাগে সে মুহূর্ত পূর্বের ঐ সাপটার মতোই ফুলিয়া উঠিল, বলিল আমার সাপ তুমি কামাইলা কেনে?

কিষ্টো বলিল, তুমি যে বলল্যা গো দমন করতে। বলিয়া সেও একবার হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিল।

রাধিকা মুহূর্তে আসন ছাড়িয়া উঠিয়া তাঁবু হইতে বাহির হইয়া গেল।

সন্ধ্যার পূর্বেই।

নূতন তাঁবুতে আজ হইতেই খেলা দেখানো হইবে, সেখানে সমারোহ পড়িয়া গিয়াছে।

বাহিরে মাচা বাঁধিয়া সেটার উপর বাজনা বাজিতে আরম্ভ করিয়াছে, একটা প্রেট্রোম্যাঙ্ আলো জ্বালিবার উদ্যোগ হইতেছে। রাধিকা আপনাদের ছোট তাঁবুটির বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহাদের খেলার তাঁবু এখনও খাটানো হয় নাই। রাধিকার চোখ দুইটি হিংস্রভাবে যেন জ্বলিতেছিল।

শম্ভু নিকটেই একটা গাছতলায় নামাজ পড়িতেছিল; আরও একটু দূরে আর একটা গাছের পাশে নামাজ পড়িতেছিল কিষ্টো। বিচিত্র জাত বেদেরা। জাতি জিজ্ঞাসা করিলে বলে, বেদে। তবে ধর্মে ইসলাম। আচারে পুরা হিন্দু, মনসাপূজা করে, মঙ্গলচণ্ডী, যষ্ঠীর ব্রত করে, কালী দুর্গাকে ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করে, নাম রাখে শম্ভু শিব কৃষ্ণ হরি, কালী দুর্গা রাধা লক্ষ্মী। হিন্দু পুরাণ কথা ইহাদের কণ্ঠস্থ। এমনই আরো একটি সম্প্রদায় পট দেখাইয়া হিন্দু পৌরাণিক গান করে, তাহারা নিজেদের বলে পটুয়া, পট তাহারা নিজেরাই আঁকে। বিবাহ আদান প্রদান সমগ্রভাবে ইসলাম ধর্মসম্প্রদায়ের সঙ্গে হয় না, নিজেদের এই বিশিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যেই আবদ্ধ। বিবাহ হয় মোল্লার নিকট ইসলামীয় পদ্ধতিতে, মরিলে পোড়ায় না, কবর দেয়। জীবিকায় বাজিকর, সাপ ধরে, সাপ নাচাইয়া গান করে, বাঁদর ছাগল লইয়া খেলা দেখায়, অতি সাহসী কেহ কেহ এমনই তাঁবু খাটাইয়া বাঘ লইয়া খেলা দেখায়। কিন্তু এই নূতন তাঁবুর মতো সমারোহ করিয়া তাহাদের সম্প্রদায়ের কেহ কখন খেলা দেখায় নাই। রাধিকার চোখ ফাটিয়া জল আসিতেছিল। তাহার মনশ্চক্ষে কেবল ভাসিয়া উঠিতেছিল উহাদের সবল তরুণ বাঘটির কথা। ইহার মধ্যে লুকাইয়া সে বাঘটাকে কাঠের ফাঁক দিয়া দেখিয়া আসিয়াছে। সবল দৃঢ় ক্ষিপ্রতাব্যঞ্জক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, চকচকে চিকন লোম, মুখে হিংস্র হাসির মতো ভঙ্গি যেন অহরহই লাগিয়া আছে! আর তাহাদের বাঘটা স্থবির শিথিলদেহ, কর্কশলোম, খসখসে লোমগুলো দেখিলে রাধিকার শরীর ঘিনঘিন করিয়া উঠে। কতবার সে শম্ভুকে বলিয়াছে একটা নূতন বাঘ কিনিবার জন্য, কিন্তু শম্ভুর যে কি মমতা ঐ বাঘটির প্রতি, যাহার হেতু সে কিছুতেই খুঁজিয়া পায় না।

নামাজ সারিয়া শম্ভু আসিতেই সে গভীর ঘৃণা ও বিরক্তির সহিত বলিয়া উঠিল, তুর ঐ বুড়া বাঘের খেলা কেউ দেখতে আসবে নাই।

ক্রুদ্ধস্বরে শম্ভু বলিল, তু জানছিস সব!

রাধিকা নাসিকা কুঞ্চিত করিয়া কহিল, না জেনে না আমি! তু-ই জানছিস সব!

শম্ভু চুপ করিয়া রহিল, কিন্তু রাধিকা থামিল না, কয়েক মুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া সে বলিয়া উঠিল, ওরে মড়া, বুড়ার নাচন দেখতে কার কবে ভালো লাগে রে? আমারে বলে, তু জানছিস সব!

শম্ভু মুহূর্তে ক্ষিপ্ত হইয়া উঠিল, পরিপূর্ণভাবে তাহার সিংস্র দুই পাটি দাঁত ঐ বাঘের ভঙ্গিতেই বাহির করিয়া সে বলিল, ছোকরার উপর বড় টান দেখি তুর!

রাধিকা সর্পিণীর মতো গর্জন করিয়া উঠিল, কি বুললি বেইমান?

শম্ভু আর কোনো কথা বলিল না, অঙ্কুশভীত মাঘের মতো ভঙ্গিতেই সেখান হইতে চলিয়া গেল।

ক্রোধে অভিমানে রাধিকার চোখ ফাটিয়া জল আসিল। বেইমান তাহাকে এতবড় কথাটা বলিয়া গেল? সব ভুলিয়া গিয়াছে সে? নিজের বয়সটাও তাহার মনে নাই? চলি্লশ বৎসরের পুরুষ, তুই তো বুড়া! রাধিকার বয়সের তুলনায় তুই বুড়া ছাড়া আর কি? রাধিকা এই সবে বাইশে পা দিয়েছে। সে কি দায়ে পড়িয়া শম্ভুকে বরণ করিয়াছে? রাধিকা তাড়াতাড়ি আপনাদের তাঁবুর ভিতরে ঢুকিয়া গেল।

সত্য কথা। সে আজ পাঁচ বৎসর আগের ঘটনা। রাধিকার বয়স তখন সতেরো। তাহারও তিন বৎসর পূর্বে শিবপদ বেদের সহিত তাহার বিবাহ হইয়াছিল। শিবপদ ছিল রাধিকার চেয়ে বৎসর তিনেকের বড়। আজও তাহার কথা মনে করিয়া রাধিকার দুঃখ হয়। শান্ত প্রকৃতির মানুষ, কোমল মুখশ্রী, বড় বড় চোখ, সে চোখের দৃষ্টি যেন মায়াবীর দৃষ্টি! সাপ, বাঁদর, ছাগল এ সবে তাহার আসক্তি ছিল না। সে করিত বেতের কাজ, ধামা বুনিত, চেয়ার পাল্কির ছাউনি করিত, ফুলের সৌখিন সাজি তৈয়ারি করিত, তাহাতে তাহার উপার্জন ছিল গ্রামের সকলের চেয়ে বেশি। তাহারা স্বামী-স্ত্রীতে বাহির হইত, সে কাঁধে ভার বহিয়া লইয়া যাইত তাহার বেতের জিনিস; রাধিকা লইয়া যাইত তাহার সাপের ঝাঁপি, বাঁদর, ছাগল। শিবপদর সঙ্গে আরো একটি যন্ত্র থাকিত, তাহার কোমরে গোঁজা থাকিত বাঁশের বাঁশি। রাধিকা যখন সাপ নাচাইয়া গান গাহিত, শিবপদ রাধিকার স্বরের সহিত মিলাইয়া বাঁশি বাজাইত। ইহা ছাড়াও শিবপদর আর একটা কত বড় গুণ ছিল। তাহাদের সামাজিক মজলিসে বৃদ্ধদের আসরেও তাহার ডাক পড়িত। অতি ধীর প্রকৃতির লোক শিবপদ এবং লেখাপড়াও কিছু কিছু নিজের চেষ্টায় শিখিয়াছিল, এই জন্য তাহার পরামর্শ প্রবীণরাও গ্রহণ করিত। গ্রামের মধ্যে সম্মান কত তাহার! আর সেই শিবপদ ছিল রাধিকার ক্রীতদাসের মতো। টাকা-কড়ি সব থাকিত রাধিকার কাছে। তাঁতে বোনা কালো রঙের জমির উপর সাদা সুতার খুব ঘন ঘন ঘরকাটা শাড়ি পরিতে রাধিকা খুব ভালোবাসিত, শিবপদ বারো মাস সেই কাপড়ই তাহাকে পরাইয়াছে।

এই সময় কোথা হইতে দশ বৎসর নিরুদ্দেশ থাকার পর আসিল এই শম্ভু, সঙ্গে এই বাঘটা, একটা ছেঁড়া তাঁবু, আর এক বিগতযৌবনা বেদেনী। বাঘ ও তাঁবু দেখিয়া সকলের তাক লাগিয়া গেল। প্রথম যেদিন রাধিকা শম্ভুকে দেখিল, সেই দিনের কথা আজও তাহার মনে আছে! সে এই উগ্র পিঙ্গলবর্ণ, উদ্ধতদৃষ্টি, কঠোর বলিষ্ঠ দেহ মানুষটিকে দেখিয়া বিস্মিত হইয়া গিয়াছিল।

শম্ভু তাহাকে দেখিতেছিল মুগ্ধ বিস্ময়ের সহিত; সেই প্রথম ডাকিয়া বলিল, এই বেদেনী, দেখি তুর সাপ কেমন?

রাধিকার কি যে হইয়াছিল, সে ফিক করিয়া হাসিয়া বলিয়াছিল, নাগরের সখ যে দেখি খুব! পয়সা দিবা?

বেশ মনে আছে, শম্ভু বলিয়াছিল, পয়সা দিব না, তু সাপ দেখাবে আমি বাঘ দেখাব। বাঘ! রাধিকা বিস্ময়ে স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছিল। কে লোকটা? যেমন অদ্ভুত চেহারা; তেমনি অদ্ভুত কথা; বলে বাঘ দেখাইবে! সে তাহার মুখের দিকে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিয়াছিল, সত্যি বলছ?

বেশ, দেখ, আগে আমার বাঘ দেখ! সে তাহাকে তাঁবুর ভিতরে লইয়া গিয়া সত্যই বাঘ দেখাইয়াছিল। রাধিকা সবিস্ময়ে তাহাকে প্রশ্ন করিয়াছিল, ই বাঘ নিয়া তুমি কি কর?

লড়াই করি, খেলা দেখাই।

হাঁ?

হাঁ, দেখবি তু? বলিয়া সঙ্গে সঙ্গেই খাঁচা খুলিয়া বাঘটাকে বাহির করিয়া তাহার সামনের দুই থাবা দুই হাতে ধরিয়া তুলিয়া বাঘের সহিত মুখোমুখি দাঁড়াইয়াছিল। বেশ মনে আছে, রাধিকা বিস্ময়ে হতবাক হইয়া গিয়াছিল। শম্ভু বাঘটাকে খাঁচায় ভরিয়া রাধিকার সম্মুখে দাঁড়াইয়া বলিয়াছিল, তু এইবার সাপ দেখা আমাকে!

রাধিকা সে কথার উত্তর দেয় নাই, বলিয়াছিল, উটা তুমার পোষ মেনেছে?

হি হি করিয়া হাসিয়া শম্ভু সবলে তাহাকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিয়াছিল, হিঁ, বাঘিনী পোষ মানাইতে আমি ওস্তাদ আছি।

কি যে হইয়াছিল রাধিকার এক বিন্দু আপত্তি পর্যন্ত করে নাই। দিনকয়েক পরেই সে শিবপদর সমস্ত সঞ্চিত অর্থ লইয়া সম্ভুর তাঁবুতে উঠিয়াছিল। শিবপদর চোখের জলে বুক ভাসিয়া গিয়াছিল, কিন্তু রাধিকার মমতা হওয়া দূরের কথা, লজ্জা হওয়া দূরে থাক, ঘৃণায় বীতরাগে তাহার অন্তর রি-রি করিয়া উঠিয়াছিল। রাধিকার মা-বাপ, গ্রামের সকলে তাহাকে ছি-ছি করিয়াছিল, কিন্তু রাধিকা সে গ্রাহ্যই করে নাই।

সেই রাধিকার আনীত অর্থে শম্ভুর এই তাঁবু ও খেলার অন্য সরঞ্জাম কেনা হইয়াছিল, সে অর্থ আজ নিঃশেষিত হইয়া আসিয়াছে, দুঃখেই দিন চলে আজকাল, শম্ভু যাহা রোজগার করে, সবই নেশায় উড়াইয়া দেয়, কিন্তু রাধিকা একটি দিনের জন্যেও দুঃখ করে নাই। আর সেই বেইমান কিনা এই কথা বলিল? সে একটা মদের বোতল বাহির করিয়া বসিল।

ওদিকে নূতন তাঁবুতে আবার বাজনা বাজিতেছে! দোসরা দফায় খেলা আরম্ভ হইবে। মদ খাইয়া রাধিকা হিংস্র হইয়া উঠিয়াছিল, ঐ বাজনার শব্দে তাহার সমস্ত অন্তরটা যেন রি-রি করিয়া উঠিল। উহাদের তাঁবুতে নিশীথ রাত্রে আগুন ধরাইয়া দিলে কেমন হয়? সহসা তাহাদের তাঁবুর বাহিরে শম্ভুর ক্রুদ্ধ উচ্চ কণ্ঠস্বর শুনিয়া সে মত্ততার উপর উত্তেজিত হইয়া বাহির হইয়া আসিল। দেখিল, শম্ভুর সম্মুখে দাঁড়াইয়া কিষ্টো। তাহার পরনে ঝকঝকে সাজ-পোশাক, চোখ রাঙ্গা, সেই তখন কথা বলিতেছিল, কেনে, ইথে দোষটা কি হলো? তুমরা ব'সে রইছ, আমাগোর খেলা হচ্ছে। খেলা দেখবার নেওতা দিলাম, তা দোষটা কি হলো?

শম্ভু চিৎকার করিয়া উঠিল, খেল দেখাবেন খেলোয়াড়ি আমার! অপমান করতে আসছিস ত!

কিষ্টো কি বলিতে গেল, কিন্তু তাহার পূর্বেই উত্তেজিত রাধিকা একটা ইট কুড়াইয়া লইয়া সজোরে তাহাকে লক্ষ্য করিয়া মারিয়া বসিল। অব্যর্থ লক্ষ্য, কিন্তু কিষ্টো অদ্ভুত, সে বলের মতো সেটাকে লুফিয়া ধরিয়া ফেলিল, তাহার পর ইটটাকে লুফিতে লুফিতে চলিয়া গেল। রাধিকা বিস্ময়ে সামান্য কয়েকটি মুহূর্ত যেন স্তম্ভিত হইয়া গিয়াছিল, সে ঘোর কাটাইতে সে বর্ধিত উত্তেজনায় আবার একটা ইট কুড়াইয়া লইল; কিন্তু শম্ভু তাহাকে নিবৃত্ত করিল, সে সাদরে তাহার হাত ধরিয়া তাঁবুর মধ্যে লইয়া গেল। রাধিকা বিপুল আবেগে শম্ভুর গলা জড়াইয়া ধরিয়া ফোঁপাইয়া ফোঁপাইয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিল।

শম্ভু বলিল, এই মেলার বাদেই বাঘ কিনে লিয়ে আসব।

ওদিকের তাঁবু হইতে কিষ্টোর কণ্ঠস্বর ভাসিয়া আসিল, খোল কানাৎ, ফেলে দে খুল্যে। তাঁবুর একটা ছেঁড়া ফাঁক দিয়া রাধিকা দেখিল, তাঁবুর কানাৎ খুলিয়া দিতেছে, অর্থাৎ ভিতরে না গেলেও তাহারা যেন দেখিতে বাধ্য হয়। সে ক্রোধে গর্জন করিয়া উঠিল, দিব আগুন ধরাইয়া তাঁবুতে।

শম্ভু গম্ভীর হইয়া ভাবিতেছিল। কিষ্টো চলন্ত ঘোড়ার পিঠে দাঁড়াইয়া কসরৎ দেখাইতেছে। রাধিকা একটা গভীর দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, নতুন খেলা কিছু বার কর তুমি, নইলে বদনামি হবে, কেউ দেখবে না খেলা আমাগোর।

শম্ভু দাঁতে দাঁত চাপিয়া বলিল, কাল পুলিশে ধরাইয়া দিব শ্যালাকে। মদের সন্ধান দিয়া দিব।

ওদিকে টিয়াপাখিতে কামান দাগিল, সেই মেয়েটা তারের উপর ছাতা মাথায় দিয়া নাচিল, বাঘটার সহিত কিষ্টো লড়াই করিল, ইঃ একটা থাবা বসাইয়াছে বাঘটা।

রাধিকা আপনাদের খেলার দৈন্যের কথা ভাবিয়া ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল! সঙ্গে সঙ্গে আক্রোশও ফুলিতেছিল। তাঁবুটা আগুন ধরিয়া ধু-ধু করিয়া জ্বলিয়া যায়! কেরোসিন তেল ঢালিয়া আগুন ধরাইয়া দিলে কেমন হয়?

পরদিন সকালে উঠিয়া রাধিকার একটু দেরি হইয়া গিয়াছিল : উঠিয়া দেখিল শম্ভু নাই; সে বোধ হয় দুই চারজন মজুরের সন্ধানে গ্রামে গিয়াছে। বাহিরে আসিয়া সে শিহরিয়া উঠিল।

কিষ্টোর তাঁবুর চারিপাশে পুলিশ দাঁড়াইয়া আছে। দুয়ারে একজন দারোগা বসিয়া আছেন। এ কি? সে সটান গিয়া দারোগার সামনে সেলাম করিয়া দাঁড়াইল। দারোগা তাহার আপাদমস্তক দেখিয়া বলিলেন, ডাক সব, আমরা তাঁবু দেখব।

আবার সেলাম করিয়া বেদেনী বলিল, কি কসুর করলাম হুজুর?

মদ আছে কিনা দেখব আমরা। ডাক বেটাছেলেদের। এইখান থেকেই ডাক। রাধিকা বুঝিল, দারোগা তাহাকে এই তাঁবুরই লোক ভাবিয়াছেন, কিন্তু সে আর তাঁহার ভুল ভাঙিল না। সে বলিল, ভিতরে আমার কচি ছেলে রইছে হুজুর আচ্ছা ছেলে নিয়ে আসতে পার তুমি। আর ডেকে দাও পুরুষদের। রাধিকা দ্রুত তাঁবুর মধ্যে প্রবেশ করিয়া সেই দেখা জায়গাটার আলগা মাটি সরাইয়া দেখিল, তিনটা বোতল তখনও মজুদ রহিয়াছে। সে একখানা কাপড় টানিয়া লইয়া ভাঁজ করিয়া বোতল তিনটাকে পুরিয়া ফেলিল, সুকৌশলে এমন করিয়া বুকে ধরিল শীতের দিনে সযত্নে বস্ত্রাবৃত অত্যন্ত কচি শিশু ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। তাঁবুর মধ্যেই কিষ্টো অঘোরে ঘুমাইতেছিল, পায়ের ঠেলা দিয়া তাহাকে জাগাইয়া দিয়া রাধিকা বলিল, পুলিশ আসছে, ব'সে রইছে দুয়ারে উঠ্যা যাও।

সে অকল্পিত সংযত পদক্ষেপে স্তন্যদানরত মাতার মতো শিশুকে যেন বুকে ধরিয়া বাহির হইয়া গেল। তাহার পিছনে পিছনেই কিষ্টো আসিয়া দারোগার সম্মুখে দাঁড়াইল।

দারোগা প্রশ্ন করিলেন, এ তাঁবু তোমার?

সেলাম করিয়া কিষ্টো বলিল, জি, হুজুর।

দেখব তাঁবু আমরা, মদ আছে কিনা দেখব।

মেলার ভিড়ের মধ্যে শিশুকে বুকে করিয়া বেদেনী ততক্ষণে জলরাশির মধ্যে জলবিন্দুর মতো মিশিয়া গিয়াছে। শম্ভু গুম হইয়া বসিয়া ছিল, রাধিকা উপুড় হইয়া পড়িয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতেছিল। শম্ভু তাহাকে নির্মম প্রহার করিয়াছে। শম্ভু ফিরিয়া আসিতে বিপুল কৌতুকে সে হাসিয়া পুলিশকে ঠকানোর বৃত্তান্ত বলিয়া তাহার গায়ে ঢলিয়া পড়িল, বলিল, ভেল্কি লাগায়ে দিছি দারোগার চোখে।

শম্ভু কঠিন আক্রোশভরা দৃষ্টিতে রাধিকার দিকে চাহিয়া রহিল, রাধিকার সে দিকে ভ্রূক্ষেপও ছিল না, সে হাসিয়া বলিল, খাবা, ছেলে খাবা?

শম্ভু অতর্কিতে তাহার চুলের মুঠি ধরিয়া নির্মমভাবে প্রহার করিয়া বলিল, সব মাটি ক'রে দিছিস তু; উহাকে আমি জেহেল দিয়ার লাগি, পুলিশে ব'লে এলাম, আর তু করলি ই কাণ্ড!

রাধিকা প্রথমটায় ভীষণ উগ্র হইয়া উঠিয়াছিল, কিন্তু শম্ভুর কথা সমস্তটা শুনিয়াই তাহার মনে পড়িয়া গেল গত রাত্রির কথা। সত্যই, এ কথা শম্ভু তো বলিয়াছিল! সে আর প্রতিবাদ করিল না, নীরবে শম্ভুর সমস্ত নির্যাতন সহ্য করিয়া উপুড় হইয়া পড়িয়া ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিতে লাগিল।

আজ অপরাহ্ন হইতে এ তাঁবুতেও খেলা আরম্ভ হইবে।

শম্ভু আপনার জীর্ণ পোশাকটা বাহির করিয়া পরিয়াছে, একটা কালো রঙের চোঙার মতো প্যান্টালুন, আর একটা কালো রঙেরই খাটো হাতা কোট। রাধিকার পরনের পুরনো রঙিন ঘাঘরা আর অত্যন্ত পুরনো একটা ফুলহাতা বডিস। অন্য সময় মাথার চুল সে বেণি বাঁধিয়া ঝুলাইয়া দিত; কিন্তু আজ সে বেণিই বাঁধিল না, আপনার সকল প্রকার দীনতা ও জীর্ণতার প্রতি অবজ্ঞায় ক্ষোভে তাহার যেন লজ্জায় মরিতে ইচ্ছা হইতেছিল। উহাদের তাঁবুতে কিষ্টোর সেই বিড়ালির মতো গাল মোটা, স্থবিরার মতো স্থূলাঙ্গি মেয়েটা পরিয়াছে গেঞ্জির মতো টাইট পাজামা, জামা, তাহার উপর জরিদার সবুজ সাটিনের একটা জাঙ্গিয়া ও কাঁচুলি ঢঙের বডিস। কুৎসিত মেয়েটাকেও যেন সুন্দর দেখাইতেছিল। উহাদের জয়ঢাকের বাজনার মধ্যে কাঁসা-পিতলের বাসনের আওয়াজের মতো একটা রেশ শেষকালে ঝঙ্কার দিয়া উঠে। আর এই কতকালের পুরনো একটা ঢ্যাপঢ্যাপে জয়ঢাক, ছি-!

কিন্তু তবুও সে প্রাণপণে চেষ্টা করে, জোরে জোরে করতাল পেটে।

শম্ভু বাজনা থামাইয়া হাঁকিল, ও-ই ব-ড়-বা-ঘ!

রাধিকা রুদ্ধস্বর কোনোমতে সাফ করিয়া লইয়া প্রশ্ন করিল, বড় বাঘ কি করে?

শম্ভু খুব উৎসাহভরেই বলিল, পক্ষীরাজ ঘোড়া হয়, মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ করে, মানুষের মাথা মুখে ভরে, চিবায় না।

সে এবার লাফ দিয়া নামিয়া ভিতরে গিয়ে বাঘটাকে খোঁচা দিল, জীর্ণ বৃদ্ধ বনচারী হিংসক আর্তনাদের মতো গর্জন করিল।

সঙ্গে সঙ্গে ও-তাঁবুর ভিতর হইতে সবল পশুর তরুণ হিংস্র ক্রুদ্ধ গর্জন ধ্বনিত হইয়া উঠিল। মাচার উপরে রাধিকা দাঁড়াইয়াছিল, তার শরীর যেন ঝিমঝিম করিয়া উঠিল। ক্রূর হিংসাভরা দৃষ্টিতে সে ঐ তাঁবুর মাচানের দিকে চাহিয়া দেখিল, কিষ্টো হাসিতেছে! রাধিকার সহিত চোখাচোখি হইতেই সে হাঁকিল, ফিন একবার!

ও-তাঁবুর ভিতর হইতে দ্বিতীয়বার খোঁচা খাইয়া উহাদের বাঘটা এবার প্রবলতর গর্জনে হুঙ্কার দিয়া উঠিল। রাধিকার চোখে জ্বলিয়া উঠিল আগুন।

অল্প কয়টি লোক সস্তায় আমোদ দেখিবার জন্য শম্ভুর তাঁবুতে ঢুকিয়াছিল। খেলা শেষ হইয়া গেল, শম্ভু হিংস্র মুখ ভীষণ করিয়া বসিয়া রহিল। রাধিকা দ্রুতপদে মেলার মধ্যে বাহির হইয়া গেল। কিছুক্ষণ পরেই সে ফিরিল কিসের একটা টিন লইয়া।

শম্ভু বিরক্তি সত্ত্বেও সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, কি উটা?

কেরাচিনি। আগুন লাগায়ে দিব উয়াদের তাঁবুতে। পুরা পেলম নাই, দু সের কম রইছে।

শম্ভুর চোখ হিংস্র দীপ্তিতে জ্বলিয়া উঠিল। সে বলিল, লিয়ে আয় মদ।

মদ খাইতে খাইতে রাধিকা বলিল, দাউ দাউ ক'রে জ্বলবেক যখন! সে খিল খিল করিয়া হাসিয়া উঠিল। সে অন্ধকারের মধ্যে বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল, ঐ তাঁবুতে তখনো খেলা চলিতেছে। তাঁবুর ছেঁড়া মাথা দিয়া দেখা যাইতেছিল, কিষ্টো দড়িতে ঝুলানো কাঠের লাঠিতে দোল খাইতে খাইতে কসরৎ দেখাইতেছে।

উঃ, একটা ছাড়িয়া আর একটা ধরিয়া দুলিতে লাগিল! দর্শকেরা করতালি দিতেছে।

শম্ভু তাহাকে আকর্ষণ করিয়া বলিল, এখুনলয়, সে-ই নিশুত-রাতে!

তাহারা আবার মদ লইয়া বসিল।

সমস্ত মেলাটা শান্ত স্তব্ধ; অন্ধকারে সব ভরিয়া উঠিয়াছে। বেদেনী ধীরে ধীরে উঠিল, এক মুহূর্তের জন্য তাহার চোখে ঘুম আসে নাই। বুকের মধ্যে একটা অস্থিরতায়, মনের একটা দুর্দান্ত জ্বালায় সে অহরহ যেন পীড়িত হইতেছে। সে বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। গাঢ় অন্ধকার থমথম করিতেছে। সমস্ত নিস্তব্ধ। সে খানিকটা এদিক হইতে ওদিক পর্যন্ত ঘুরিয়া আসিল, কেহ কোথাও জাগিয়া নাই। সে আসিয়া তাঁবুতে ঢুকিল, ফস করিয়া একটা দেশলাই জ্বালাইল, ঐ কেরাসিনের টিনটা রহিয়াছে। তারপর শম্ভুকে ডাকিতে গিয়া দেখিল, সে শীতে কুকুরের মতো কুণ্ডলী পাকাইয়া অঘোরে ঘুমাইতেছে। তাহার উপর ক্রোধে ঘৃণায় রাধিকার মন ছি-ছি করিয়া উঠিল। অপমান ভুলিয়া গিয়াছে, ঘুম আসিয়াছে! সে শম্ভুকে ডাকিল না, দেশলাইটা চুলের খোঁপায় গুঁজিয়া, টিনটা হাতে লইয়া একাই বাহির হইয়া গেল।

ঐ পিছন দিক হইতে দিতে হইবে। ওদিকটা সমস্ত পুড়িয়া তবে এদিকে মেলাটার লোকে আলোর শিখা দেখিতে পাইবে। ক্রূর হিংস্র সাপিনীর মতো সে অন্ধকারের মধ্যে মিশিয়া শনশন করিয়া চলিয়াছিল। পিছনে আসিয়া টিনটা নামাইয়া সে হাঁপাইতে আরম্ভ করিল।

চুপ করিয়া বসিয়া সে খানিকটা বিশ্রাম করিয়া লইল। বসিয়া থাকিতে থাকিতে তাঁবুর ভিতরটা একবার দেখিয়া লইবার জন্য সে কানাতটা সন্তর্পণে ঠেলিয়া বুক পাড়িয়া মাথাটা গলাইয়া দিল। সমস্ত তাঁবুটা অন্ধকার! সরীসৃপের মতো বুকে হাঁটিয়া বেদেনী ভিতরে ঢুকিয়া পড়িল। খোঁপার ভিতর হইতে দেশলাইটা বাহির করিয়া ফস করিয়া একটা কাঠি জ্বালিয়া ফেলিল।

তাহার কাছেই এই যে কিষ্টো অসুরের মতো পড়িয়া অঘোরে ঘুমাইতেছে। রাধিকার হাতের কাঠিটা জ্বলিতেই লাগিল, কিষ্টোর কঠিন সুশ্রী মুখে কী সাহস! উঃ, বুকখানা কী চওড়া, হাতের পেশিগুলো কী নিটোল! তাহার আশপাশে ঘোড়ার খুরের দাগ-ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে কিষ্টো নাচিয়া ফেরে! ঐ যে কাঁধে সদ্য ক্ষতচিহ্নটা ঐ দুর্দান্ত সবল বাঘটার নখের চিহ্ন! দেশলাইটা নিভিয়া গেল।

রাধিকার বুকের মধ্যটা তোলপাড় করিয়া উঠিল, যেমন করিয়াছিল শম্ভুকে প্রথম দিন দেখিয়া। না, আজিকার আলোড়ন তাহার চেয়েও প্রবল। উন্মত্ত বেদেনী মুহূর্তে যাহা করিয়া বসিল, তাহা স্বপ্নের অতীত, সে উন্মত্ত আবেগে কিষ্টোর সবল বুকের উপর ঝাঁপ দিয়া পড়িল। কিষ্টো জাগিয়া উঠিল, কিন্তু চমকাইল না, ক্ষীণ নারী তনুখানি সবল আলিঙ্গনে আবদ্ধ করিয়া বলিল, কে? রাধি

তাহার মুখ চাপিয়া ধরিয়া রাধিকা বলিল, হ্যাঁ, চুপ।

কিষ্টো চুমায় তাহার মুখ ভরিয়া দিয়া বলিল, দাঁড়াও, মদ আনি।

না। চল উঠ, এখুনই ইখান থেক্যে পালাই চল। রাধিকা অন্ধকারের মধ্যে হাঁপাইতেছিল।

কিষ্টো বলিল, কুথা?

হু-ই, দেশান্তরে।

দেশান্তরে? ই তাঁবুটাবু

থাক পড়্যা। উ ঐ শম্ভু লিবে। তুমি উয়ার রাধিকে লিবা, উয়াকে দাম দিবা না? সে নিম্নস্বরে খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।

উন্মত্ত বেদিয়া তাহার উপর দুরন্ত যৌবন-কিষ্টো দ্বিধা করিল না, বলিল, চল।

চলিতে গিয়া রাধিকা থামিল, বলিল, দাঁড়াও।

সে কেরাসিনের টিনটা শম্ভুর তাঁবুর উপর ঢালিয়া দিয়া মাঠের ঘাসের উপর ছড়া দিয়া চলিতে চলিতে বলিল, চল।

টিনটা শেষ হইতেই সে দেশলাই জ্বালিয়া কেরাসিনসিক্ত ঘাসে আগুন ধরাইয়া দিল। খিলখিল করিয়া হাসিয়া বলিল মরুক বুড়া পুড়্যা।