বন্ধু ও শত্রু আলবেয়ার কামু ও জঁ পল সার্ত্রে - শাহনেওয়াজ বিপ্লব
আলবেয়ার কামু (জন্ম : ৭ নভেম্বর ১৯১৩, মৃত্যু : ৪ জানুয়ারি ১৯৬০)
আলবেয়ার কামু এবং জঁ পল সার্ত্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ও এর পরের বছরগুলোতে ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক ও তাত্ত্বিক তো বটেই এবং সেই সঙ্গে অস্তিত্ববাদী দর্শনকে বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সুবাধে দুজনকেই বিবেচনা করা হয় বিংশ শতকে পৃথিবীর অন্যতম সেরা সাহিত্যিক হিসেবে।
আলবেয়ার কামু এবং জঁ পল সার্ত্রে- লেখালেখির জীবনের শুরু থেকেই দুজন ছিলেন একই পথের যাত্রী। তাঁরা উভয়ে একই সঙ্গে নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সমালোচক, দার্শনিক এবং দুজন একই সঙ্গে ছিলেন পত্রিকার সম্পাদকও; দুজনই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন কয়েক বছরের ব্যবধানে। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চিন্তার বাইরে ব্যক্তিগত জীবনযাপনেও অনেক বিষয়ে মিল ছিল দুজনের মধ্যে। দুজনই খুব পছন্দ করতেন নারীসঙ্গ। 'নারীসঙ্গ কী খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন লেখকের সত্যিকারের লেখক হয়ে ওঠার জন্য?'- ১৯৪০ সালে সার্ত্রে প্রশ্ন রেখেছিলেন তাঁর ডায়েরিতে। তারপর লিখেছেন, 'নারীসঙ্গবিহীন একাকী জীবন সত্যিই বিরক্তিকর আর কৌতূহলহীন।'
আর এর পরের ঘটনা তো সবারই জানা। সিমোন দ্য বোভোয়ারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হওয়ার পর প্যারিসের সব সাহিত্য আলোচনায়, ক্যাফে হাউসে অথবা ডিসকোতে সবাই সব সময় একই সঙ্গে দেখেছে সার্ত্রে আর বোভোয়ারকে।
অন্যদিকে আলবেয়ার কামুও ঠিক সার্ত্রের মতোই তাঁর বান্ধবী তানিয়াকে নিয়ে সাহিত্য আড্ডা বা সাহিত্য আড্ডার বাইরে যাতায়াত করতেন। পরে অবশ্য আলবেয়ার কামু তানিয়া ছাড়াও অন্য মেয়েদের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন এবং দুবার বিয়েও করেছেন।
১৯৪৩ সালের গ্রীষ্মে জঁ পল সার্ত্রের নাটক 'দ্য ফ্লাইজ' দেখতে গিয়েই কামুর সঙ্গে সার্ত্রের প্রথম পরিচয় হয়, তারপর নানা সাহিত্য আড্ডায় এমনকি ব্যক্তিগত জীবনদর্শনের দিক দিয়েও একে অপরের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। দুজনই প্রচুর পরিশ্রম করেছিলেন অস্তিত্ববাদী দর্শনকে সাহিত্য ও শিল্পকলায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। দুজনই ছিলেন কমিউনিজমের প্রতি অনুরক্ত। ১৯৪৪ সালে আলবেয়ার কামু 'কমব্যাট' পত্রিকার সম্পাদক হয়ে বিপ্লবী অনেকগুলো কলাম লিখেন, যা সে সময় ফ্রান্সের জনগণের ভেতর বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। কামুর আমন্ত্রণে সার্ত্রেও মাঝেমধ্যে কলাম লিখেছিলেন 'কমব্যাট' পত্রিকায়। পরে আলবেয়ার কামুকে অনুসরণ করে জঁ পল সার্ত্রেও ১৯৪৫-এ প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর পত্রিকা 'মডার্ন টাইমস'। তিনিও কামুর মতোই সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে সব কলাম লিখতেন। ফলে একই পথের পথিক হিসেবে সাহিত্য, দর্শন আর সাংস্কৃতিক মিলের সুবাদে তাঁদের ভেতর ঐক্য আর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। এমনকি ১৯৪৫ সালে আমেরিকায় গিয়ে 'ফ্রান্সের নয়া সাহিত্য'তত্ত্ব উপস্থাপন করার সময় সার্ত্রে ফ্রান্সের নতুন সাহিত্য যুগের প্রতিনিধি হিসেবে আলবেয়ার কামুর নাম ঘোষণা করেন, যেটিকে কামুর প্রতি সার্ত্রের বড় রকমের বন্ধুত্বের পরিচয় বলে অনেকেই মনে করেন।
অবশ্য তাঁদের এ বন্ধুত্ব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আলবেয়ার কামুর কমিউনিজমের প্রতি বিরাগ ও স্ট্যালিনের সমালোচনা, সার্ত্রের সঙ্গিনী বোভোয়ারের কামুর প্রতি আকর্ষিত হওয়ার ঘটনায় এবং অস্তিত্ববাদ বাদ দিয়ে উদ্ভটবাদ তত্ত্বের দিকে কামুর ঝুঁকে পড়া নিয়ে তাঁদের পরস্পরের মধ্যে বিরোধ বাড়তে থাকে। অবশ্য দুজনের ভেতর প্রথম বিরোধের সূচনা সিমোন দ্য বোভোয়ারকে নিয়ে। সিমোন দ্য বোভোয়ার ছিলেন সার্ত্রের আজীবনের বিশ্বাসযোগ্য সঙ্গিনী। কিন্তু সার্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হওয়ার প্রথমদিকের দিনগুলোতে সিমোন দ্য বোভোয়ার কিছুটা আকর্ষিত হয়ে পড়েছিলেন কামুর প্রতি এবং এ ঘটনাকে সহজভাবে গ্রহণ করেননি সার্ত্রে। পরে এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে আলবেয়ার কামুর বান্ধবী তানিয়াকে, সার্ত্রে নিজের দিকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হন, যেটা অনেক পরে সিমোন দ্য বোভোয়ারকে লেখা এক চিঠিতে স্বীকার করেছিলেন সার্ত্রে। সেই চিঠি থেকে জানা যায়, তানিয়া সার্ত্রেকে জানিয়েছিলেন যে কামুর চেয়ে সার্ত্রেকেই অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য এবং ভালোমানুষ মনে হয়েছিল তানিয়ার কাছে।
এ ঘটনা ছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কমিউনিজম নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা ও স্ট্যালিনের সমালোচনায় মুখর হন আলবেয়ার কামু। অবশ্য ১৯৩৫ সালে ফ্রান্স কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে সব সময় সরব ছিলেন কামু, যে কারণে ট্রটস্কিপন্থী আখ্যা দিয়ে কামুকে একবার বহিষ্কারও করা হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি থেকে। অন্যদিকে কমিউনিজমে মুগ্ধ সার্ত্রে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ না দিলেও নিজেকে মার্কসবাদী বলে দাবি করতেন, তিনিও কামুর মতো সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে মানবাধিকার আর নাগরিক পরাধীনতার সমালোচনা করতেন, তবে সেটা কামুর মতো অতটা কঠোর ছিল না। যে কারণে কামুর সঙ্গে সার্ত্রে এবং কমিউনিস্ট পার্টির অনেক নেতা-কর্মীর বিরোধ তৈরি হয়েছিল।
এ ছাড়া অস্তিত্ববাদ বাদ দিয়ে উদ্ভটবাদ নামে খানিকটা অস্তিত্ববাদের বিরোধী মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করা নিয়েও সার্ত্রের সঙ্গে কামুর বিরোধ ছিল। আলবেয়ার কামু, জঁ পল সার্ত্রে এবং সিমোন দ্য বোভোয়ার- তিনজন মিলেই অস্তিত্ববাদী ধারায় কাজ করলেও পরে অস্তিত্ববাদ প্রতিষ্ঠায় অন্যতম তাত্ত্বিক হিসেবে নিজের নাম ও অবদানের কথা অস্বীকার করেন কামু। মূলত ১৯৫১ সাল পর্যন্ত আলবেয়ার কামুর সঙ্গে জঁ পল সার্ত্রের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।
আলবেয়ার কামু এবং জঁ পল সার্ত্রের পারস্পরিক শত্রুতা নিয়ে অনেক গুজব প্রচলিত থাকলেও দুজনের কেউ কখনো তা স্বীকার করেননি। তবে কামুর মৃত্যুর পর আলবেয়ার কামুকে লেখা এক খোলা চিঠিতে সার্ত্রে লিখেছিলেন, 'প্রিয় কামু, আমাদের দুজনের মধ্যে যতটা বন্ধুত্ব ছিল, ততটাই ছিল শত্রুতা; কিন্তু তার পরও আমি আজ স্বীকার করছি যে আগামী দিনগুলোতে আপনার অনুপস্থিতি অনুভব করব আমি। কারণ আপনিই ছিলেন প্যারিসের একমাত্র সাহিত্যিক, যিনি আমাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।' এ ছাড়া কামুর মৃত্যুতে সার্ত্রে শোক প্রকাশ করে লিখেছিলেন, 'অবধারিতভাবেই কামু আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রধানতম ব্যক্তিবর্গের একজন হয়ে উঠেছিলেন এবং ফ্রান্সের ইতিহাস ও তার নিজের শতাব্দীর তিনি ছিলেন এক স্বতন্ত্র প্রতিনিধি।'
অবশ্য জীবদ্দশায় আলবেয়ার কামু নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করার জন্য সুইডেনের স্টকহোমে গেলে সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেছিলেন সার্ত্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে। জবাবে কামু বলেছিলেন, সার্ত্রের সঙ্গে আমার লেখালেখি বা ভাবনার যে বিরোধ, সেটিই সবার চোখে পড়ে। কিন্তু তার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো বিরোধ নেই। তবে বলা দরকার যে সাহিত্য ভাবনায় সাহিত্যিকদের মধ্যে নানা রকম পক্ষ-বিপক্ষ আছে বলেই বিংশ শতকের সাহিত্য শক্তিশালী হয়েছে অন্য শতকগুলোর তুলনায়।
১৯৬০ সালের জানুয়ারিতে এক সড়ক দুর্ঘটনায় কামুর মৃত্যুর পর আরো ২০ বছর বেশি বেঁচে ছিলেন জঁ পল সার্ত্রে। মৃত্যুর পাঁচ বছর আগে পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সার্ত্রে জানিয়েছিলেন, সাহিত্যিকদের মধ্যে আলবেয়ার কামুই তাঁর সবচেয়ে সেরা ও সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিলেন।
উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ..
0 comments:
Post a Comment