Monday, September 10, 2018

কৃষ্ণগহ্বর, তথ্য বিভ্রান্তি এবং স্টিফেন হকিং


২০১৫ এর ২৫ আগস্ট মঙ্গলবারে প্রথিতযশা পদার্থবিদ স্টিফেন হকিং কৃষ্ণগহ্বর বিষয়ে তার নতুন তত্ত্ব প্রকাশ করেন। স্টকহোমের কেটিএইচ রয়্যাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে অনেক গুণীমানী বিজ্ঞানী ও গবেষকদের সামনে তিনি একটি বক্তৃতায় এই তত্ত্ব বর্ণনা করেছেন।


A blackhole and its event horizon

একটি কৃষ্ণগহ্বর। কালো অংশের সীমানায় যে বৃত্ত দেখা যাচ্ছে, সেটাই ঘটনা দিগন্ত




তার এই নতুন তত্ত্ব মূলত কৃষ্ণগহ্বরের ‘ইনফরমেশন প্যারাডক্স‘কে সমাধান করার চেষ্টা করছে। তাহলে চলুন প্রথমে জেনে নিই ইনফরমেশন প্যারাডক্স বলতে কী বুঝায়। আমরা জানি কৃষ্ণগহ্বর হচ্ছে এমন একটি বস্তু যার প্রচণ্ড ঘনত্বের কারণে মহাকর্ষ বলের টান অত্যন্ত বেশি, এতোটাই বেশি যে এই গহ্বরের ঘটনা দিগন্ত (Event Horizon) [] থেকে আলোও ফিরে আসতে পারে না, গহ্বরের অতল তলে হারিয়ে যায়। যখন কোন অতিকায় নক্ষত্র কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হয়, যেটাকে আমরা নক্ষত্রের ‘মৃত্যু’ বলে অভিহিত করি, তখন সেই নক্ষত্রের আলো ও আলোর ভেতরে থাকা সকল তথ্যও হারিয়ে যায়। কিন্তু কোয়ান্টাম ফিজিক্সের মতে মহাবিশ্বের তথ্যও শক্তির মতো অপরিবর্তনীয়, এর বিনাশ বা ক্ষয় নেই, তা কেবল এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিণত হয়। তাহলে কৃষ্ণগহ্বরে রূপান্তর হওয়া নক্ষত্রের তথ্য গেল কোথায়? এই বিভ্রান্তিকেই ইনফরমেশন প্যারাডক্স বলা হয়।


information paradox

ইনফরমেশন প্যারাডক্স। ছবিটি বড় করে দেখতে ছবির ওপরে ক্লিক করুন




এই প্যারাডক্স গত ৪০ বছর ধরে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে বাঘা বাঘা সব পদার্থবিদদের। সকলেই একমত হয়েছেন যে তথ্যটা আসলে আক্ষরিক অর্থে হারিয়ে যায় না। তাহলে কী হয় সেই তথ্যের? হকিং গত মঙ্গলবার সেই বিষয়েই তার হাইপোথিসিস উপস্থাপন করেছেন। তার প্রস্তাবনার মূল সারাংশগুলো কী কী?

  • নক্ষত্রের তথ্য কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে ‘জমা’ থাকে না, বরং তা আসলে ‘জমা’ থাকে গহ্বরের ঘটনা দিগন্তে। কোন কণা যখন কৃষ্ণগহ্বরে প্রবেশ করে, তখন তার ইনফরমেশনের সুতো ঘটনা দিগন্তে রয়ে যায়। ব্যাপারটাকে পিঁপড়ার পথের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। পিঁপড়ারা যখন খাদ্যের খোঁজে বের হয়, তখন পেছনে ফেরোমনের ট্র্যাক রেখে যেতে থাকে। যে ট্র্যাক ধরে অন্য পিঁপড়ারা তার পিছু পিছু আসতে পারবে। আলোর কণাও কৃষ্ণগহ্বরে ‘হারিয়ে’ যাওয়ার আগে ঘটনা দিগন্তে নিজের ‘ছায়া’ রেখে যায়!

  • সমস্যা হলো, এই রেখে যাওয়া তথ্যকে বিশ্লেষণ করার কোন উপায় নেই। ঘটনা দিগন্তের নিজস্ব পরিবেশে এই তথ্যের বিকৃতি ঘটে এবং তা পুরোপুরি ভগিজগিতে (gibberish) পরিণত হয়। মূল তথ্য কী ছিল, সেটা আর কোনভাবেই জানা সম্ভব হয় না। আরেকটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। ধরুন, আপনি বাংলা একাডেমীর বাংলা টু ইংলিশ ডিকশনারিটি পুড়িয়ে দিলেন, তবে ছাইটুকু রেখে দিলেন। টেকনিক্যালি, এই ছাই বইটারই ভিন্ন রূপ, কিন্তু সেই ছাই থেকে “অসম্ভব” শব্দের ইংরেজি বের করা ইমপসিবল!

  • ঘটনা দিগন্তে তথ্যের এই রূপান্তর তাহলে কী রকম? হকিংয়ের মতে এই রূপান্তরের ফলে কণার এক মাত্রার (dimension) তথ্য হারিয়ে যায়। একটি ত্রিমাত্রিক কণার তথ্য দুই মাত্রার কোন স্থানে সংরক্ষণ করলে যা ঘটবে, একটি মাত্রার তথ্য মিশে যাবে অপর দুই মাত্রার তথ্যের সাথে। ফলে কোন মাত্রার তথ্যকেই আর আলাদা করে পাঠোদ্ধার করা যাবে না।

  • এখানে আরো উল্লেখ্য যে এসব কণা যদি ঘটনা দিগন্ত থেকে ফিরে আসে, তাহলে যাবার সময় রেখে যাওয়া তথ্যের কিছুটা নিয়েই ফিরে আসে। ১৯৭০ সালে কৃষ্ণগহ্বরের এই বিকিরণকে স্টিফেন হকিংই আবিষ্কার করেছিলেন, যাকে ‘হকিং রেডিয়েশন’ বলা হয়ে থাকে। গত মঙ্গলবারে দেয়া তার নতুন প্রস্তাবনার সাথে হকিং রেডিয়েশনের যোগসূত্র আছে।


    Stephen Hawking

    কৃষ্ণগহ্বর বিষয়ে নতুন প্রস্তাবনা দিচ্ছেন স্টিফেন হকিং, ছবি কৃতজ্ঞতাঃ Håkan Lindgren)




  • হকিংয়ের প্রস্তাবনা সত্য হলে আরেকটি নতুন সম্ভাবনাও সত্য হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে ঢুকে পড়া কণাগুলো যেহেতু পুরোপুরি ধ্বংস হচ্ছে না, সেহেতু আমরা কি ধারণা করতে পারি যে সেটি গহ্বরের ভেতর থেকে অপর প্রান্ত দিয়ে ‘বেরিয়ে’ আসবে? হকিং বলছেন, এই সম্ভাবনাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। কৃষ্ণগহ্বরে ঢুকে পড়া কণাগুলো ঘটনা দিগন্তে নিজেদের তথ্য রেখে যেতে পারছে, তার মানে কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরেও তারা নিজেদেরকে অক্ষুণ্ণ রেখেই প্রবেশ করছে। এটা সত্যি যে গহ্বরের ভেতরে কী ঘটছে তা আমরা এখনও জানি না।হকিংয়ের মতে, গহ্বরে প্রবেশ করা কণাগুলো অন্য প্রান্তে বেরিয়ে আসলে আমাদের মহাবিশ্বে ফেরত আসবে না, বরং তারা পৌঁছে যাবে আমাদেরই সমান্তরাল অন্য একটি মহাবিশ্বে। অনেক পদার্থবিদের মতে, কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে আরেকটি ক্ষুদে মহাবিশ্ব তৈরি হয়। কণাগুলো সেখানেও থাকতে পারে।


সম্ভাবনার যেটাই সত্য হোক না কেন, এটুকু নিশ্চিত যে এই প্রস্তাবনার ওপর ভিত্তি করে কৃষ্ণগহ্বর ও মহাবিশ্বের নতুন আবিষ্কারের পথ খুলে গেল। কে জানে, হয়তো এই গবেষণা থেকেই বেরিয়ে আসবে সমান্তরাল মহাবিশ্বের সন্ধান!

 

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/black_hole_information_paradox_hawking/

Monday, September 3, 2018

কোয়ান্টাম ভালোবাসা ও একটা বিড়ালের উপাখ্যান


কুকুর বিড়ালের বিখ্যাত হওয়ার ঘটনা ইতিহাসে কম নয়। লাইকা নামের কুকুরটার কথাই ভাবুন। মানুষের আগে সে মহাশূন্য ভ্রমণ করেছিল। যদিও বেঁচে ফিরতে পারেনি। তবু মহাকালের ইতিহাসে তার নাম লেখা হয়ে গেছে। এমন ভাগ্য কুকুর দূরে থাক, কজন মানুষের হয়? সিনেমায় অভিনয় করে, মালিককে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে অনেক পোষা প্রাণী অংশ হয়ে গেছে ইতিহাসের। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ইতিহাসেও তেমনি অমর হয়ে আছে একটা বিড়াল। শ্রডিংগারের বিড়াল। শ্রোডিংগার কুকুর-বিড়াল ভালোবাসতেন কিনা জানা যায়নি। তাহলে তাঁর বিড়াল কোত্থেকে এলো? শ্রডিংগারের কোনো বিড়াল ছিল না। তবু তাঁর বিড়াল অমর।

কোয়ান্টাম কণিকাদের মতোই রহস্যময় শোনাচ্ছে না কথাটা? আসলে কোয়ান্টামের রহস্যময়তার মাহত্ম্য বোঝাতেই শ্রোডিংগার এক কাল্পনিক বিড়ালের জন্ম দিয়েছিলেন। সেই বিড়ালটাই পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে অমর হয়ে গেছে। কেন এই বিড়ালের কাহিনি তৈরি করেছিলেন, সেটার জন্য আমাদের আইনস্টানের কাছে যেতে হবে আবার।

১৯২৭ সাল থেকেই আইনস্টাইন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিরোধিতা শুরু করেন। বিশেষ করে অনিশ্চয়তা নীতিটা নিয়েই তাঁর আপত্তি ছিল। তখনকার তরুণ, প্রবীণ প্রায় সব বিজ্ঞানীই কোয়ান্টামের প্রেমে মজেছেন, মেনে নিয়েছেন অনিশ্চয়তা তত্ত্ব। শুধু আইনস্টাইন বিষয়টা মানতে পারছেন না। অবশ্য একজনকে সঙ্গে পেয়েছিলেন। এরউইন শ্রোডিংগার। আমার আগের অধ্যায়গুলোতেই দেখেছি শ্রোডিংগার আর হাইজেনবার্গের তত্ত্ব মিলেমিশে কীভাবে অনিশ্চিয়তা তত্ত্বের জন্ম দিল। কিন্তু এর শুরুটা মোটেও সুখকর ছিল না। শ্রোডিংগার-আইনস্টাইন, কেউই হাইজেনবার্গের ম্যাট্রিক্স বলবিদ্যা মানতে পারেননি। অন্যদিকে হাইজেনবার্গও মানতে পারেননি শ্রোডিংগারের তরঙ্গ বলবিদ্যা। বিরোধ তুঙ্গে উঠল একসময়। আইনস্টাইনের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন ছিল, ইলেকট্রন এক কক্ষপথ থেকে আরেক কক্ষপথে লাফ দেয় কীভাবে? সেকথা তিনি বর্নের কাছে জানতে চাইলেন। বর্ন যে জবাব দিয়েছিলে, তাতে আইনস্টানের মনে হয়েছিল এই জবাব সত্যি হলে তাঁর ব্যখ্যা করা ফটো-তড়িৎ ক্রিয়াও অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে যায়। ফোটনের আঘাতে কক্ষপথ থেকে ছিটকে বেরিয়ে যাওয়া ইলেকট্রন নাকি নিজেই ঠিক করবে সে কোনদিকে যাবে। আইনস্টাইনের কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হলো। বললেন, বিজ্ঞান এতটাই অনিশ্চিত হবে আগে জানলে বিজ্ঞানী হতাম না, হতাম সরাইখানার বেয়ারা নয়তো ফুটপাথের মুচি।

এরপর শুরু হলো চ্যালেঞ্জ, পাল্টা চ্যালেঞ্জ। তৈরি হলো একটা যুদ্ধক্ষেত্রও। ১৯২৭ সালে বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে বিজ্ঞানীদের সমেম্মলন। সলভে সম্মেলন। সেই সম্মেলনে মুখোমুখি হলো দুইদল। আর সেখানেই আইনস্টানের যুক্তি খ-ন করলেন বোর তার সম্পূরক নীতি ব্যাখ্যা করলেন। আইস্টাইন তাঁর বিপরীতে কোনো যুক্তি দিতে পারলেন না। হার হলো তাঁদের। তবুও আইনস্টাইন মানতে পারেননি অনিশ্চয়তা তত্ত্ব।

বোর কোপেনহেগেন ব্যাখ্যা দিলেন। শ্রোডিংগার সেটা মেনে নিলেন। অন্য যেসব বিজ্ঞানীর অনিশ্চয়তা তত্ত্ব নিয়ে সন্দেহ ছিল, তারাও মেনে নিয়েছিলেন কোপেনেহেগেন ব্যাখ্যা। মানতে পারেননি কেবল আইনস্টাইন। সেটা আমৃত্যু। বোরের ব্যাখ্যা অসার প্রমাণের জন্য তিনি নানা রকম চেষ্টা-চরিত করেন। আসলে আইনস্টাইন সুনির্দিষ্ট তত্ত্বে বিশ্বাসী। পদার্থবিজ্ঞানে অনিশ্চয়তা তত্ত্বের মতো পরাবাস্তব একটা বিষয় এসে পড়বে এটাই মানতে পারছিলেন না। বোর তাঁকে বুঝিয়ে পারছিলেন না, সাধারণ চিরায়ত জগতের সাথে কোয়ান্টাম জগতের ফারাক যোজন যোজন। বাস্তব জগতে যেটা অসম্ভব মনে হয় কোয়ান্টাম জগতে সেটাই সম্ভব।

১৯৩৫ সাল। আইনস্টাইন অনিশ্চয়তা তত্ত্বের ওপর আরেকবার আঘাত হানতে চাইলেন। প্রমাণ করতে চাইলেন বোর ভুল। এজন্য তিনি সামনে টেনে আনলেন আপেক্ষিকতা থেকে বেরিয়ে আসা তার চিরায়ত সেই স্বীকার্য-- কোনো বস্তুর বেগ আলোর বেগের চেয়ে বেশি হতে পারে না। আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা প্রকাশের আগ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা মনে করতেন মহাকর্ষ বল দূরক্রিয়া। অর্থাৎ মহাকর্ষ বলের খবর পৌঁছতে সময় লাগে না। ধরা যাক, কোনোভাবে সূর্য ধ্বংস হয়ে গেল। তার প্রভাব পৃথিবীর ওপরে পড়বে। সূর্য না থাকলে পৃথিবীও আর নিজের কক্ষপথে ঘুরতে পারবে না। সরলরৈখিক গতিতে ছিটকে যাবে অসীম মহাশূন্যের দিকে। কিন্তু পৃথিবী কতক্ষণে বুঝবে সূর্য ধ্বংস হয়ে গেছে? কখনই বা সে বন্ধ করে দেবে কক্ষপথে ঘোরা।

নিউটনের সূত্র এমনভাবে গড়ে উঠেছে, মহকর্ষ বলের প্রভাব সাথে সাথে কাজ করে, দুটি বস্তু যত দূরেই থাক। তাই সূর্য ধ্বংস হয়ে গেলে পৃথিবী সঙ্গে সঙ্গেই সে খবর পেয়ে যাবে। নিজের কক্ষপথে ঘোরা বাদ দিয়েধেয়ে যাবে অসীম মহশূন্যের দিকে। কিন্তু আইনস্টাইন বললেন, সেটা সম্ভব নয়। বিশেষ আপেক্ষিক তত্তর গড়েই উঠেছিল ওই স্বীকার্যের ওপর ভিত্তি করে-- মহাবিশ্বের কোনোকিছুর বেগ আলোর চেয়ে বেশি হতে পারে না। তাই আলোর বেগের চেয়ে বেশি গতিতে কোনো তথ্য আদান-প্রদান করা সম্ভব নয়। সূতরাং মহাকর্ষ বলকেও সেটা মানতে হবে। মহাকর্ষীয় প্রভাব কখনোই আলোর বেগেরে চেয়ে বেশি বেগে যেতে পারে না। আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বে দেখালেন সেটাই। এটা করতেই গিয়েই বেরিয়ে এলো মহাকর্ষ তরঙ্গ নামে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক তরঙ্গ। মহাকর্ষ বলের সংবাদ বয়ে নিয়ে যায় এই তরঙ্গ। সেটা আলোর বেগের সমান গতিতে। এ বিষয়ে বিস্তারিত পাবেন অন্বেষা থেকে প্রকাশিত আমার লেখা ‘মহাকর্ষ তরঙ্গ’ বইটিতে।

আইনস্টাইন দেখলেন অনিশ্চয়তা তত্ত্বে এসে ধাক্কা খায় তার এই তত্ত্ব। কোয়ান্টাম কণাগুলো নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান প্রদান করতে পারে মুহূর্তের মধ্যেই। এজন্য তিনি বোরিস পোডেলস্কি আর নাথান রোজেনকে সাথে নিয়ে এপিআর (ঊচজ, আইনস্টাই, পেডোলস্কি আর রোজেনের নামের আদ্যক্ষর সাজিয়ে এই নাম) নামে একটা বিভ্রমের (চধৎধফড়ী) জন্ম দিলেন। সত্যিই সেটা এক মজার ধাঁধা। সেই ধাঁধা থেকেই জন্ম হলো কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট (ঊহঃধহমবষসবহঃ) নামে এক নতুন তত্ত্বের।





আলবার্ট আইনস্টাইনন, বোরিস পেডোলস্কিও ও নাথান রোজেন



কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট কি সেটা বোঝার জন্য আমরা একটা সিনেমার উদাহরণ দিতে পারি। আশির দশকের জনপ্রিয় এক বংলা সিনেমার নাম লাইলি মজনু। বিখ্যাত আরব্য লোককথা অবলম্বনেই সিনেমাটা বানানো হয়েছে। লাইলি-মজনুর প্রেমের গভীরতা কোন পর্যায়ে গিয়েছিল সেটা তুলে ধরা হয়েছে সিনেমায়। তাদের প্রেমে পারিবারিক ও সামাজিক বাধা প্রকট। সমাজ-সংসারের চাপে এক সময় পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় দুজন। বহুদুরের তাঁদের অবস্থান। লাইলিকে ভুলে যাবার জন্য নানারকম চাপ আসে মজনুর ওপর। সেই সাখে অবর্ণনীয় অত্যাচার। যারা মজনুকে অত্যাচার করছে তারা লাইলির আপনজন। লাইলির ক্ষতি তাঁরা চায় না। কিন্তু ওরা জানে না, মজনুর গায়ে যেকটা আঘাত পড়ছে, তার সবুগলোর ব্যাথ্যা অনুভব করছে লাইলি। অনেক দূর থেকেও। এমনকী মজনুর পিঠে যেখানে যেখানে চাবুকের আঘাত পড়ছে, লাইলির পিঠেও সেখানে সেখানে আঘাতের দাগ তৈরি হচ্ছে। এ অদ্ভুত, অবাস্তব ভালোবাসা, কখোনই সম্ভব নয়।

লাইলি-মজনুর সেই ভালোবাসায় যেন উঠে এলো আইনস্টাইনের ( (EPR) প্যারাডক্সে। ১৯৩৫ সাল নাগাদ কোয়ান্টাম মেকানিক্স ততদিনে দাঁড়িয়ে গেছে শক্ত ভিতের ওপর। ঠিক সেমসময় আঘাত হানলেন আইনস্টাইন। রোজেন আর পোডোলস্কিকে নিয়ে ফিজিক্যাল রিভিউতে লিখলেন চার পৃষ্ঠার একটা প্রবন্ধ। তাতে একটা থট এক্সপেরিমেন্ট বা মানস পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করালেন পাঠককে। ধরা যাক, দুটো ইলেকট্রন ছুটছে পরস্পরের দিকে। দুটোর গতি আর ভরবেগ সমান। তারপর একসময় তাদের সংর্ঘষ হবে। পরস্পরকে তারা দেবে জোর ধাক্কা। দুটো ইলেকট্রন সমান গতিতে পরস্পরের দিকে ছুটতে থাকবে বিপরীত। ধরা যাক, এভাবে ইলেকট্রন দুটি পরস্পর থেকে কিলোমিটার দূরে চলে গেল। একজন বৈজ্ঞানিক একটা ইলেকট্রন পরীক্ষা কলেলন। নির্ণয় করলেন তার ভরবেগ আর গতিশক্তি।

সেই মুহূর্তে অন্য ইলেকট্রনের ভাগ্যে কী ঘটছে? যখন বিজ্ঞানী ইলেকট্রনের গতিশক্তি বা অবস্থান বের করছেন, সেই মুহূর্তে তিনি অন্য ইালেকট্রনের গতিশক্তিও বের করে ফেললেত পারবেন। কারণ দুটোরই ভর, গতি সমান। তাই একটা দেখেই আরেকটার অবস্থান, ভরবেগ বের করে ফেলা যায়। অথচ সেই ইলেকট্রনটা তার থেকে এক কিলোমিটার দূরে। অর্থাৎ সময় ব্যায় না করে এক কিলোমিটার দূরের আরেকটা ইলেকট্রনের ধর্ম বের করে ফেলা যাচ্ছে।

ধরা যাক, এভাবে ইলেকট্রন দুটি দুটি চলতে চলতে বহদূরের পথ পাড়ি দিল। দুজনের মধ্যবর্তী দূরত্ব এখন ২৫ লক্ষ আলোকবর্ষ। একটার অবস্থান আমাদের পৃথিবীতে হলে আরেকটা চলে গেছে অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিতে। আমরা পৃথিবীবর ইলেকট্রনের ভরবেগ আর গতিশক্তি ও অন্যান্য ধর্ম পরীক্ষা করে বলে দিতে পারি, অ্যান্ড্রোমিডাতে চলে যাওয়া সেই ইলেকট্রনের এই মুহূর্তের ধর্মও।

এই পরীক্ষার মধ্যদিয়ে আসলে আইনস্টাইন কোয়ান্টাম অনিশ্চিয়তাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করলেন। এত দূর থেকেই যদি একটা কণার অবস্থা বলে দেওয়া যায়, কোয়ান্টামের অনিশ্চয়তা কোথায়? এখানেই আইনস্টাইনের প্রশ্ন।

ইপিআর নাড়া দিল শ্রোডিংগারকে। তিনি একটু অন্যভাবে ব্যাখ্যা করতে চাইলেন বিষয়টাকে। বললেন দুটো কোয়ান্টাম কণা, পরস্পরের সাথে মিলিত হয়েছে। এতেই তাদের ভেতর তৈরি হয়ে হয়ে গেছে সেই মিলিত হওয়ার রেশ। ভালোবাসাও বলা যেতে পারে এটাকে। কোয়ান্টাম ভালোবাসা। তাই বহুদূনের গিয়েও রয়ে গেছে তাদের সেই ভালোবাসার রেশ। লাইলি-মজনুর ভালোবাসার মতো। এই ব্যাপারটার নাম দিলেন কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গেমেন্ট। অর্থাৎ একজোড়া কণার মধ্যে তৈরি হয়ে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। আর সেই সম্পর্কের জের কণা দুটো বয়ে বেড়ায় বহদূর থেকেও। শ্রোডিংগার বললেন, কোয়ান্টামের জগৎটাই আসলে অদ্ভুত। কতটা? সেটার জন্য তিনিও একটা মানস পরীক্ষার উদাহরণ দিলেন। জন্ম দিলেন তাঁর বিখ্যাত বিড়াল কাহিনীর।

শ্রোডিংগার বললেন, একটা ধাতব বাক্স, তার ভেতরে বন্দী করে রাখা হলো একটা বিড়ালকে। রাখা হলো একটা তেজস্ক্রিয় পদার্থের উৎস, একটা হাতুড়ি আর একটা বিষপাত্র। হাইড্রোসায়ানিক বিষ আছে সেই পাত্রে। যেকেনো সময় তেজস্ক্রিয় উৎসাটার একটা পরমাণু ভাঙতে পারে। তার ফলে বিকিরত হবে শক্তি। সেই শক্তি হাতুড়িকে নাড়িয়ে দেবে। হাতুড়িটা তখন আঘাত করবে বিষপাত্রের গায়ে। পাত্র যাবে ভেঙে, বিষক্রিয়ায় মারা পড়বে বিড়ালটি।

এখন বাক্সটা এভাবে বন্ধ করে রাখা হলো এক ঘণ্টা। বাইরে থেকে বাক্সের ভেতরটা দেখা যায় না। তাহলে বলতে পারবেন বিড়ালটা এই মুহূর্তে জীবিত না মৃত?





শ্রোডিংগারের বিড়াল



পারবেন না। কারণ তেজস্ক্রিয় উৎস থেকে কখন একটা পরমাণু ভাঙবে কিনা সেটা আপনি নিশ্চিত করে বলতে পারেন না। তাই নিশ্চিত করে বলতে পারেন না হাতুড়িটা নড়েছে কি-না। তাই আপনি নিশ্চিত নন গ্যাসপাত্র অক্ষত আছে কি-না। গ্যাসপাত্রের অবস্থা নিশ্চিত নয় বলে নিশ্চত নন, বিড়ালটা বেঁচে আছে না মারা গেছে। আপনার জন্য এখন দুটো সম্ভাবনাই সমান। তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ঘটেছে অথবা ঘটেনি। হাতুড়ি নড়েছে অথবা নড়েনি। বিষপাত্র ভেঙেছে অথবা ভাঙেনি। বিড়ালটা জীবত অথবা মৃত। অর্থাৎ একটা বিড়াল এখন আপনার কাছে দুটো হয়ে গেছে। একটা জীবিত, একটা মৃত। এখানে তৈরি হয়ে গেছে একটা এন্ট্যাঙ্গেলমেন্ট। যখনই আপনি বাক্সের ডালাটা আলগা করবেন, তখন আবার বিড়াল একটা হয়ে যাবে। শুধু জীবিত অথবা শুধু মৃত। এন্ট্যাঙ্গেলমেন্টের হিসাবটা এখানে তেজস্ক্রিয় পরমাণুর সাথে হাতুড়ির। হাতুড়ির সাথে বিষপাত্রের। বিষপাত্রের সাথে বিড়ালের। আপনি যদি নিশ্চিত হন, তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ঘটেছে, তাহলে সাথে সাথেই নিশ্চিত হয়ে যাবেন বিড়ালটিও মৃত। শ্রোডিংগার বললেন, যখনই আপনি সুনির্দিষ্টভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন, তখনই বিড়ালটার সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ছে। তিনি বললেন, কোয়ান্টাম কণিকাদের ক্ষেত্রেও হিসাবটা এরকম। আপনি যখন কোয়ান্টাম কণাদের কোনো সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য পর্যক্ষণ করতে যাবেন, কণাগুলো সেই চরিত্রই আপনাকে দেখাবে। বিষয়টা আরো পরিষ্কারভাবে বোঝার জন্য আমি নিজের লেকার উদাহরণ দিতে পারি। জনপ্রিয় কিশোর ম্যাগাজিনে ২০১৬ সালে ‘বিজ্ঞানের গোলকধাঁধা’ নামে এটা ফিচার লিখেছিলাম, সেটারই অংশবিশেষ তুলে দিলাম কোয়ান্টাম কণিকাদের চরিত্র বোঝার জন্য-

“ইলেকট্রন বা ক্ষুদ্র কণারা তাদের চলার পথে ঠিক কোন জায়গায় অবস্থান করে?বিজ্ঞান বলে তারা এক সাথে চলার পথের সবখানে থাকে। পথ একাধিক হলে সবগুলো পথে একসাথে চলে! রহস্য না ধাঁধা?

ধরো একই কোয়র্টারে তোমারা চার বন্ধু থাকো। তোমাদের কোয়ার্টার থেকে স্কুলে যাবার চারটা পথ আছে। তোমরা সবাই একই সাথে স্কুলে যাও। ঠিক কোনপথে যাও সেটা কেউ জানে না। ধরা যাক, তোমরা একেজন একেকটা ইলেক্ট্রন। ১ ও ৪ নং পথ দুটো খুব নোংরা। ওই পথে যাওয়া বারণ। কিন্তু তোমার বাবার সন্দেহ হলো। তিনি একদিন চুপি চুপি ১ নং পথে গিয়ে বসে থাকলেন। দেখলেন, যে তোমরা সেই পথেই যাচ্ছো। আরেক দিন ৪ নং পথে গিয়ে দেখলেন তোমরা সেই পথেই যচ্ছো। এবার দেখলেন ভালো পথে যাও কিনা। পর পর দুদিন ২ ও ৩ নং পথে পাহারা দিলেন। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন তিনি যেদিন যে পথে পাহারায় থাকছেন সেদিন সেই পথে তোমরা যাচ্ছ। অথচ তোমার বাবার এই পাহারা দেবার ঘটনটা তোমাদের জানার কথা নয়।

তোমার বাবা তোমার বন্ধুদের বাবাকে বললেন ঘটনাটা। তাঁরা আলাপ করে একেকজন একেক পথে পাহরা বসালেন। তাঁরা অবাক হয়ে দেখলেন এবার তোমরা আর একসাথে যাচ্ছ না। প্রত্যেক পথে আলাদা আলাদা পথে যাচ্ছ। যিনি যে পথে বসছেন, তাঁর ছেলে সেই পথেই যাচ্ছে।

এবার বাবারা অন্য ফন্দি আঁটলেন। দুজন করে পাহারা বসালেন দুই পথে। ২ ও ৪ নং পথে। আরও অবাক ব্যাপার, তোমরা এবার দুজন দুজন করে সেই দু পথেই যাচ্ছ। কোন দুজন কোন পথে? যার যার বাবা যে পথে, তারা সেই পথেই! রহস্য, বড়ই রহস্য! নাকি গোলকধাঁধা। তোমরা কোনওভাবে জেনে যাচ্ছো আগে থেকেই তোমার বাবার কোন পথে পাহারা দেবেন? কিন্তু মনে রেখো তোমারা হচ্ছো ইলেক্ট্রন। জড় বস্তু। আর তোমার বাবার ভূমিকায় নামকরা সব বিজ্ঞানীরা!

এবার বাবারা একসাথে ঝটিকা অভিযান চালালেন। এবার তারা মোটর বাইকে করে তোমাদের ওপর নজর রাখলেন। প্রথমে ১ং পথে গিয়ে দেখলেন তোমরা চারজনই সেই পথে। তোমাদের স্কুলে পৌঁছানের আগেই তাঁরা ৩ নং পথে চলে গেলেন। ততক্ষণে তোমাদের ২নং পথে স্কুলের খুব কাছে পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাবারা হতভম্বের মতো দেখলেন, তোমরা চারজনই ৩নং পথ দিয়ে স্কুলের খুব কাছে পৌঁছে গেছ! কোনওভাবেই বাবাদের আগে তোমরা ৩ং পথে যেতে পারো না।

এটা কণা বিজ্ঞানের এক মস্ত রহস্য। তবে প্রমাণিত সত্য। এর ব্যাখ্যা কী?বিজ্ঞানী রিচার্ড ফাইনম্যান অন্যভাবে ভাবলেন। ক্ষুদ্র কণারা তাদের সামনে খোলা যতগুলো পথ আছে সবগুলোতে একসাথে চলে। আমরা যখন নির্দিষ্ট একটা পথ খুঁজি তখন ওরা সেই পথেই যায়। দুই পথেই তাহলে সবগুলোকে একই সাথে পাওয়ার কথা।





একই সাথে অসংখ্য পথে চলে পারমাণবিক কণারা



যখন দুটো পথে আলাদা আলাদা একই সাথে পাহারা বসানো হচ্ছে, তখন কণাগুলো দুভাগে ভাগ হয়ে যাচ্ছে কেন? ফাইনম্যানের যুক্তি হলো, কণাদের আচারণ অদ্ভুত হলেও তারা বাস্তব কণা। নিজেদের সংখ্যা বাড়াতে পারে না কখনোই। তাই একাধিক পর্যবেক্ষণের সময় ওরা ভাগ হয়ে যায়।’


এটাই আসলে কোয়ন্টাম এন্ট্যাঙ্গেলমেন্টের চিত্র। ধরা যাক, ইয়াংয়ের ডাবল স্লিটের মতো একটা পরীক্ষা করবেন আপনি। তবে আলোর বদলে আপনি ছিদ্র দিয়ে ইলেকট্রন পাঠাবেন। দুটো ছিদ্র আছে। তার ভেতর দিয়ে আপনি দশ হাজার, ইলেকট্রন পাঠাবেন। দেখবেন ইলেকট্রনগুলো দুই ছিদ্রের ভেতর দিয়েই যাচ্ছে এবং পর্দার ওপর একটা অপবর্তন প্যাটার্ন তৈরি করছে। কোন ছিদ্র দিয়ে কতগুলো ঢুকল। হিসেব করলে দেখবেন, দুটো ছিদ্র দিয়েই ৫ হাজার করে ইলেকট্রন ঢুকেছে। অর্থাৎ ইলেকট্রনের তরঙ্গ ধর্ম আপনি পেয়ে গেলেন এই পরীক্ষায়। এবার একটা ছিদ্র বন্ধ করে দিন। ইলেকট্রন হিসাব অনুযায়ী একটা ছিদ্র দিয়ে ৫ হাজার ইলেকট্রন একসাথে ঢোকার কথা। কিন্তু দেখবেন, ৫ হাজার নয়। দশ হাজার ইলেকট্রনই একসাথে এক ছিদ্র দিয়ে ঢুকছে। ওপাশের পর্দায় গিয়ে জড়ো হচ্ছে একটা বিন্দুতে। তখন ইলেকট্রনের আর অপবর্তন প্যাটার্ন পাবেন না। অর্থাৎ ইলেকট্রন এবার কণার মতো আচরণ করবে।

আসলে প্রথমবার রআপনার ছিদ্র ছিল দুটো। ও্টা তো ব্যাতিচার মাপার মাপার জন্য। তখন ইলেকট্রন আপনাকে তার তরঙ্গ ধর্ম দেখিয়ে দিয়েছে। পরে আপনি একটা ছিদ্র রেখেছেন। একটা ছিদ্র আসলে কণাধর্ম পরীক্ষা করার জন্যই। এক্ষেত্রে ইলেকট্রন আপনাকে কণা ধর্ম দেখিয়েছে। তার মানে কী? আপনি যেভাবে ইলেকট্রনকে দেখতে চান, ষেটা সে বুঝে ফেলছে, আপনাকে সেভাবেই তার চেহারা দেখাচ্ছে। বিচিত, বড়ই বিচিত্র ব্যাপার। আইনস্টাইনস্টাইন এটা মানতে চাননি। তাই তিনি বলেছিলেন, নিশ্চয়ই ইশ্বর পাশা খেলা করেন না।

অনিশ্চিয়তাবাদীরা কোয়ান্টাম কণিকাদের এই অদ্ভুতুড়ে আচরণ মেনে নিয়েছিলেন। তাই বোর, আইনস্টাইনের জবাব দিয়ে বলেছিলেন, আপনাকে বলে দিতে হবে না, ইশ্বর কী করবেন না করবেন না।

আইনস্টাইর মানুন আর না মানুন। কোয়ান্টাম কণিকাদের এই অদ্ভুত চরিত্রই কিন্তু পরে প্রমাণ হয়। ১৯৮১ সালে এবং ১৯৯৭ সালের দুটি পরক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ হয় কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গেলমেন্ট সঠিক।


উৎস ঃ https://web.facebook.com/notes/abdul-gaffar-rony/%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%AE-%E0%A6%AB%E0%A6%BF%E0%A6%9C%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B8-%E0%A7%A9%E0%A7%A9-%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%AE-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%8B%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%BE-%E0%A6%93-%E0%A6%8F%E0%A6%95%E0%A6%9F%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A7%9C%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%89%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%96%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%A8/1298429160237489/?fref=mentions

Saturday, September 1, 2018

গল্পপাঠ : শ্যামলের গল্প (ভিক্টোরিয়ার হিরো)


কুলদা রায়

১.

গল্পটি মাত্র সোয়া তিন পৃষ্ঠার। লেখক শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। নাম ভিক্টোরিয়ার হিরো।

শুরুর সময়টা ১৮৬৯ ইং। তখন রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয়ে গেছে। বয়স আট। বাবার সঙ্গে হিমালয়ে গেছেন। মীরাট, না, দিল্লীতে সিপাহী বিদ্রোহ শেষ হয় গেছে। এটা নিয়ে আমাদের মাথাব্যাথা নেই। শ্যামল আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন মাছরং গ্রামে। থানা–বানারীপাড়া। জিলা–বরিশাল। ধানকাটা শেষ হয়ে গেছে। নদীর পাড়ে পালাগান বসেছে। দলের নাম নট্ট কোম্পানী।

রাধাকৃষ্ণের পালা। আয়ান ঘোষ সেজেছেন গিরিশ গাঙ্গুলি। তিনি খুব চিন্তিত। তার ছয়টি মেয়ে হয়েছে। আবার বাড়িতে দাই এসেছে। বাড়িটা পালামাঠের ওপারে–বাইশাড়ি গ্রামে। আজ আরেকটি ছেলে কি মেয়ে হবে তাই নিয়ে ভাবতে ভাবতে গানের বানী গেছেন ভুলে। গেয়ে উঠেছেন–আমারই বঁধুয়া আনবাড়ি যায় আমারি আঙিনা দিয়ে। ভাগ্নে কৃষ্ণের সঙ্গে অভিসারে চলেছে আয়ানের বউ রাধা। এই গানটিও আখ্যানের সঙ্গে লেগে গেছে। লোকের চক্ষে জল। এ সময়ই বঙ্কিমচন্দ্র দুর্গেশ নন্দিনী বলে একটা বই লিখে ফেলেছেন। কলকাতা থেকে কুষ্টিয়ায় রেলগাড়ি এসে গেছে। বরিশালে রেলগাড়ি আসবে না। এত নদী পার হয়ে কিন্তু ব্রাহ্মধর্ম এসে পড়েছে। ঠিক এ সময়ই সন্ধ্যানদী পার হয়ে বানারীপাড়ার বিখ্যাত দাই উষাঙ্গিনী নট্ট কোম্পানী অধিকারী বৈকুণ্ঠ নট্টের কানে কানে এসে বললেন, নট্ট মশাই গিরীশচন্দ্রের আবারও মেয়ে হয়েছে। তার সাহস নেই সদ্যোজাত মেয়েটির বাবা গিরিশের কানে খবরটি পৌঁছে দেওয়ার।

শ্যামল লিখেছেন, পালাগানতো থেমে থাকতে পারে না। বৈকুণ্ঠ নট্টকে ঘিরে বসা বাঁশিবাজিয়েরা ততক্ষণে কৃষ্ণের বাঁশির টান ধরেছে। কিন্তু আজ যে নিশিথিনী ননদিনী জেগে থাকবে পাহারায়। এর পরের বিবরণটুকু শ্যামল দেন না। আমাদের মর্মে এসে পড়ে। এর মধ্যেই রাধিকা অভিসারে যাবেন। যাওয়াটাই নিয়তি। গিরিশ গাঙ্গুলির অবাক করে বলে দিলেন উষাঙ্গিনীকে, মাইয়ার নাম দিলাম ভিক্টোরিয়া। ভিক্টোরিয়া মা ভালো আছে। গল্পটি এই ভিক্টোরিয়া মাকে নিয়েই।

দেড় পৃষ্ঠা পার হওয়ার পরেই আমরা বুঝতে পারি–এরপর অনেকদিন কেটে গেছে। বঙ্কিমচন্দ্র ঋষি হয়ে স্বর্গে গেছেন। নট্ট কোম্পানী কলকাতায় শোভাবাজারে বাড়িভাড়া করে অফিস খুলেছে। গিরিশচন্দ্র জোড়া মহিষ মানত করে ছেলের বাবা হয়েছেন। সেই ছেলে এখন খুলনার কোর্টে কাজ করেন। কিরণকুমারী নাম তার বউয়ের। দুতিনটে ছেলেমেয়ে। কিরণকুমারী ভিক্টোরিয়ার ননদিনী।

ভিক্টোরিয়ার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু মুখরা বলে তিনদিনও স্বামীর সংসারের টিকতে পারেনি। ভাইয়ের সংসারে এসেছে। সেটা ১৯২৫ সালের কথা। তখন দেশবন্ধু পরপারে। গিরিশচন্দ্রও। ইংলন্ডেশ্বরী রানী খোদ ভিক্টোরিয়ার নামে কলকাতার বুকে গড়ের মাঠে বাড়ি উঠেছে। মো. গান্ধী নামে একজন লোক প্রায়ই জেলে যান।খুলনায় কিরণকুমারী দিনে ঘরের কাজ করেন। রাতে ঘুমাতে পারেন না। জেগে জেগে ননদিনীর পাহারায় থাকেন। ননদিনী ভিক্টোরিয়া প্রদীপা জ্বালিয়ে ঘরের মধ্যে শ্রীকৃষ্ণের ছবির সামনে অভিসারী রাধিকা হয়ে নাচেন। কিরণকুমারীর ভয়–পাছে কাপড়ে আগুন লেগে যায়। ভিক্টোরিয়ার বয়েস হয়ে যাচ্ছে। ষাটের কাছে এসেছে। নাচতে গেলে পা ভাঙতে পারে। কৃষ্ণই তার স্বামী। বহুদিন আগে তাঁর নিজের স্বামীটি মারা গেছেন। তাঁর কোনো স্মৃতি তার মনে নেই। তবু তিনি থান পরেন।

এক সন্ধ্যায় ভৈরব নদীর পাড়ে কিরণকুমারী ননদিনীকে রাধাকৃষ্ণের মন্দিরে নিয়ে যান। সেখান থেকে বাতাসা পেয়েছেন। ফেরার পথে বাতাসাখানি হাত থেকে পড়ে গেল। জ্যোৎস্না নেমেছে। ঘাসের মধ্যে বাতাসাখানি খুজে পেলেন না ভিক্টোরিয়া। ননদিনীকে কাতর কণ্ঠে বলছেন, ও বউ, আমার সোয়ামি? হাতড়ে হাতড়ে সোয়ামিকে খুঁজে পেলেন। এবার আর হাতে নয়। মুখে পুরে মন দিয়ে চুষতে লাগলেন। যত চুষছেন–তত ব্যথা লাগছে। তবু কিছু বলছেন না। স্বামী তো। নিজেকে মন মনে বোঝালেন–স্বামী তো কিছু শক্তই হয়।

বাসায় এসে হারিকেনের আলোতে বাতাসাখানি মুখ থেকে বের করে ভিক্টোরিয়া ধরলেন। বলছেন, দ্যাখ তো বউ আমার সোয়ামী কেন এত শক্ত? শ্যামল এরপর লিখেছেন, অন্ধকারে বাতাসা ভেবে রাস্তা তৈরীর ছোট পাথর কুড়িয়ে মুখে দিয়েছেন ভিক্টোরিয়া।

কাণ্ড! এই বাইশাড়ি গ্রামে আমি বহুদিন গিয়েছি। মাছরং গ্রামের বটতলায় বসে থেকেছি। ভিক্টোরিয়া নামে ননদিনীর কথা আমাকে কেউ কখনো বলেনি। শ্যামল বলেছেন। বলেছেন, কিরণকুমারীর ছেলেটির নাম শ্যামল রেখেছিলেন সেই ননদিনী ভিক্টোরিয়া। এসো শ্যামল সুন্দর।

২.

গল্পটির শুরুতেই শ্যামল আমাদের একটা গান শোনাচ্ছেন–

আমি বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি
যেন সে কিছুতেই বাঁশি না বাজায়
আজি নিশীথিনী ননদিনী
জাগিয়া জাগিবে প্রহরায়।

ইমন বিলাবল। দ্রুত একতাল। একটু তাল ঠুকেও দিচ্ছেন শ্যামল–ধা গেড়ে নাগ কদ্দি–ধেড়ে নাগ—-। ঘুরে ঘুরে কাঠের খোলা উঁচু পাটাতনে গোয়ালিনী রাধা গাইছেন। এই পাটাতনটি কোথায়? বৃন্দাবনে? কৃষ্ণের বাড়ি গোপপল্লী? সেটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু শ্যামলের গল্পে সেটা পালামাঠে–সন্ধ্যানদীর কুলে। শ্যামল গোপপল্লীর গল্পটি কইছেন না। এটা নিশ্চিত করেন বাক্যের প্রথমেই পাটাতন শব্দটি দিয়ে। ইমেজটি তৈরি করেন–পাটাতনের সামনেই নীচে বৈকুণ্ঠ নট্ট বসে। তাকে ঘিরে খোল, করতাল, ঢোল, বাঁশি, ক্লারিওনেট বাজছে। এই গান বেঁধেছেন বৈকুণ্ঠ নট্ট। সুরও দিয়েছেন তিনি। পালাটিও তার রচনা। এ পালায় গিরিশ গাঙ্গুলি নামে বাইশাড়ী গ্রামের এক সম্পন্ন চাষী আয়ান ঘোষ সেজেছেন। আয়ান ঘোষের খালি গা। রীতিমত সুপুরুষ। উদাত্ত গলায় গান করতে পারেন। গল্পের বীজ এই আয়ান ঘোষ ওরফে গিরিশ গাঙ্গুলি।

বীজের মধ্যে প্রাণ থাকে। সেটা কিন্তু সত্যি নয়। প্রাণের ঘুমন্ত রূপ। এই বীজ ভেঙে যখন তার বিস্তারটি ঘটে, শেকড়, শাখা, প্রশাখা, পাতা, কুঁড়ি, ফুল, ফলে বৃক্ষ হয়ে ওঠে, আকাশ স্পর্শ করে, তখন সত্যিটা প্রকাশিত হয়। সে সত্যির কোনো সীমা থাকে। অরূপ হয়ে ওঠে।

এই রূপ ভেঙে ভেঙে অরূপটি বিনির্মাণ করেছেন শ্যামল এই সোয়া তিন পৃষ্ঠায়। শুরু হয়েছিল–বাইশারী গ্রাম থেকে। সেটা চলে এসেছে মীরাটে, না, দিল্লীতে, বরিশালে, কলকাতায়, শিয়ালদাহে, কুষ্টিয়া, খুলনা থেকে ইংলন্ডে। বঙ্কিম থেকে ম গান্ধিতে। ফাঁকে দেশবন্ধু থেকে মহারানী ভিক্টোরিয়াতে। চলে গেছেন ননদিনী জটিলাকুটিলা থেকে কিরণকুমারিতে। মৃতস্বামী থেকে শ্রীকৃষ্ণে। বাতাসা থেকে রাস্তাবানাবার ছোট পাথরের টুকরোতে। পাথরের টুকরোটিকে আর পাথর বলে মানতে পারছেন না ষাটোর্ধ রাধাভাবে আকুল ভিক্টোরিয়া। পাথরের টুকরোটিকে ধরে নিয়েছেন সোয়ামি হিসেবে। সোয়ামি তো পাথরের টুকরোর মতোই। শক্ত। পাথর কি প্রাণে আরাম দিতে পারে? পারে না। ব্যথা দেন।

এইখানে ইমন রাগটি বাগেশ্রীতে এসে পড়ে। তাঁর রূপের রূপান্তর হয়ে যায়। বলে, সে যেন সে কিছুতেই বাঁশি না বাজায়। বাজালে ননদিনীকে এড়িয়ে অভিসারে যেতে হবে। দেখতে হবে আয়ান ঘোষ পাটাতনে দাঁড়িয়ে কান্না করছেন– আমারি বঁধুয়া আনবাড়ি যায় আমারি আঙিনা দিয়া। পথে পথে কাঁটা। জঙ্গলের মধ্যে সাপ খোপ। যমুনা নদী ফুঁসে উঠেছে। আর কৃষ্ণের কাছে গেলে ব্যথা লাগে। ব্যথা ছাড়া আর কি আছে ভালোবাসায়?

৩.

এই ভালোবাসার গল্পটিই বলছেন শ্যামল। আমাদের সঙ্গে হাওলা করে দিচ্ছেন–আয়ান ঘোষের সঙ্গে গিরিশ গাঙ্গুলিকে। রানী ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে বাইশারীর সদ্যোজাত ভিক্টোরিয়াকে। জটিলাকুটিলার সঙ্গে ননদিনী কিরণকুমারীকে। ঘর-ছাড়া-করা বাঁষিএ সঙ্গে প্রদীপের খোলা আগুণে। স্বামীর সঙ্গে বাতাসাকে। বাতাসার সঙ্গে কালো পাথরের টুকরোকে। এর সঙ্গে বাঁশি বাজে কি প্রকারে?

বাজে। শ্যামল বাজান। শ্যামল বাঁশি বাজিয়ে দেন শব্দের বিশ্বস্ত প্রয়োগে। পুরান থেকে ইতিহাসে। ইতিহাস থেকে সমকালে। শ্যামল আমাদের সঙ্গে সময় নিয়ে কানামাছি খেলেন। ঘটনাগুলো তার মতো করে ভেঙে দেন। ভেঙে যেতে যেতে নতুন একটা ঘটনার জন্ম হয়। সে ঘটনার ফাঁদে আমরা পড়ি। এই ফাঁদে পড়াটাই আমাদের নিয়তি। সেই নিয়তির বীজটি অঙ্কুরিত হয়। শাখা হয়। প্রশাখা হয়। পল্লবিত হয়। বৃক্ষের মধ্যে সৃষ্টিশীল প্রাণের জন্ম হয়।

শ্যামল নিয়তিকে লেখেন।

অতনু ফিরে যাবে - সুনীল গংগোপাধ্যায়


এটা কি আগে এখানে ছিল, না ছিল না? একটা বেঁটে মতো গম্বুজ, তার সবদিকই নানারকম পোস্টারে মোড়া, একটা বড় ফিল্মের পোস্টারে এক যুবতী দু’চোখ দিয়ে হাসছে।
এক পাশে ছিল ধানক্ষেত আর জলা, রাস্তার অন্যপাশে দোকানপাট। হ্যাঁ, স্পষ্ট মনে আছে অতনুর, ধানক্ষেতের পাশে যে অগভীর জলাভূমি, সেখানে গামছা দিয়ে মাছ ধরত কয়েকটি কিশোর, মাছ বিশেষ পাওয়া যেত না, ঝাঁপাঝাঁপি, কাদা মাখামাখিই সার, কখনও হয়তো পাওয়া যেত কিছু কুচো চিংড়ি, বেলে আর পুঁটি। একদিন অতনু দুটো খলসে মাছ পেয়েছিল। সব মিলিয়ে এতই কম যে, নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যায় না, তাই এক একদিন এক একজন সবটা, কম হোক বা বেশি হোক, যার ভাগ্যে যেমন আছে। খলসে মাছের কথা বিশেষভাবে মনে থাকার কারণ, কই মাছের গরিব আত্মীয় হলেও এই মাছের গায়ে রামধনু রঙের ঝিলিক থাকত। সেই মাছ দুটো রান্না করার বদলে একটা কাচের বয়ামে জল ঢেলে তার মধ্যে রেখে দিয়েছিল অতনু। তিন দিনের বেশি বাঁচেনি। কই-মাগুর জাতীয় মাছ মরে গেলে খেতে নেই বলে মা ছোট খলসে দুটো ফেলে দিয়েছিলেন। এ গল্প অতনু যাকেই বলতে গেছে, সবাই তাকে শুনিয়ে দিয়েছে যে, খলসে মাছ এখন আর পাওয়াই যায় না, খলসে এখন বিলুপ্ত প্রজাতি। সেই ধানক্ষেত আর জলাভূমিও অদৃশ্য। এখন সেখানে সার সার এক ধরনের বাড়ি, চারতলা, মেটে রঙের। মনে হয় কোনো বড় সংস্থার কর্মচারীদের কোয়ার্টার। অদৃশ্য হওয়াই তো স্বাভাবিক, সীতারামপুর নামে পুর হলেও একসময় তো গ্রামই ছিল, এখন শহর হতে চলেছে, শহরের এত ধার ঘেঁষে কি ধানক্ষেত থাকে নাকি? অতনুদের ছেলেবেলায় এখানে রেলস্টেশন ছিল না, চার মাইল হেঁটে চকবাজারে যেতে হতো। এখন স্টেশন হয়েছে বলেই ধাঁ ধাঁ করে বদলে যাচ্ছে গ্রাম। পরিবর্তনগুলো ঠিক ঠিক মিলিয়ে নিতে পারে না অতনু। অনেক দিনের ব্যবধান, ১৭ বছরে সে সীতারামপুর ছেড়েছিল, এখন তার বয়স ৪২। কিন্তু মাঝখানে কি সে আর কখনও আসেনি, তা তো নয়, বেশ কয়েকবার ঘুরে গেছে। কিন্তু স্মৃতির এমনই কারসাজি, কৈশোরের ছবিগুলো এখনও জ্বলজ্বল করে, মাঝখানে অনেক দিনের শূন্যতা। অবশ্য মাঝখানে এসে সে আগে দু’তিন দিনের বেশি থাকেনি, ভালো করে চারপাশটা তাকিয়ে দেখেনি।
শেষ এসেছিল সাত বছর আগে, মায়ের মৃত্যুর সময়। তখন আবার অতনুর ওদিকেও খুব ব্যস্ততা। একটা প্রমোশন নিয়ে দর কষাকষি চলছিল, তবু মা বলে কথা, আসতেই হয়, শেষ দেখা হয়নি, শুধু শ্রাদ্ধের জন্য তিনদিন। মাতৃশোকের চেয়েও মন বেশি অস্থির ছিল চাকরির জন্য, তখন এখান থেকে আফ্রিকায় টেলিফোন করারও সুবিধে ছিল না।
খাল ধালে একটা ছিল ভূতের বাড়ি। কৈশোরেরও আগে, বাল্যস্মৃতিতে একটা গা-ছমছমে ভাব। বেশ বড় তিনতলা বাড়ি, দেয়ালে দেয়ারে বট-অশথ গাছ গজিয়ে গিয়েছিল, ভূত ছাড়াও সাপ-খোপেরও অভাব ছিল না! আসলে হয়তো কোনো শারিকি গণ্ডগোলে পরিত্যক্ত বাড়ি, কোনো সমৃদ্ধ মুসলমানের সম্পত্তিও হতে পারে, দেশ ভাগের পর চলে গিয়েছিল ওপারে, এখনও ওখানে কাছাকাছি মুসলমানদের একটি পল্লী আছে। এখন সেই ভূতের বাড়ির জায়গায় একটি ঝকঝকে রিসর্ট, প্রচুর আলো ঝলমল করে, শহরের লোকেরা এখানে ছুটি কাটাতে আসে। ওরকম ভূতের বাড়ি আরও নানা জায়গায় ছিল, সবই হয়ে গেছে নিশ্চিহ্ন, হবেই তো, এরই নাম উন্নতি।
তবে, সেই রিসর্টের দিকে তাকিযে এখনও অতনু কল্পনায় সেই ভূতের বাড়িটা দেখতে পায়। তার মনে হয়, গ্রামে-ট্রামে ও রকম দু’একটা হানাবাড়ি থাকা বোধহয় উপকারীই ছিল, ওই সব বাড়িতে বাচ্চা ছেলেমেয়েদের ভয় ভাঙার ট্রেনিং হতে আস্তে আস্তে। অতনুরা প্রথম প্রথম ট্রেনিং হতো আস্তে আস্তে। অতনুরা প্রথম প্রথম ওই বাড়ির আশপাশে ঘুরে বেড়াত, একটা কিছু আওয়াজ শুনলেই দৌড়ে পালাত ভয়ে। একটু বয়েস বাড়লে সাহস করে পাড় দিয়েছিল বাগানে বাড়িটার কাছ ঘেঁষত না, বাড়িটার মধ্যে সত্যি সত্যি মাঝে মাঝে উৎকট শব্দ হতো, কেউ কেউ নাকি আগাগোড়া কালো সিল্কের বোরখায় ঢাকা এক মহিলাকে ধীর পায়ে দোতলার বারান্দায় হাঁটতে দেখেছে, কয়েক মুহূর্ত মাত্র, তারপরই তিনি মিলিয়ে যেতেন হাওয়ায়। উনি রাবেয়া বেগম, মারা গেছেন সাতাশ বছর আগে।
কী করে যেন হঠাৎ একদিন ভয় ভেঙে গেল। মধ্য কৈশোরে চার-পাঁচজন বন্ধুর সঙ্গে অতনু উঠে গিয়েছিল দোতলায়। গাঢ় দুপুরে, যখন চারপাশে কোনো শব্দ থাকে না, সে সময় ভূতরা এসে পেছন থেকে ঠেলা মারে। কই কিছুই তো হলো না, কোনো ঘরেরই দরজা-জানলা নেই, চতুর্দিক প্রচুর ভাঙা কাছ ছড়ানো, আর ধুলোতে কিছু কিছু পায়ের ছাপ, ভূতেরা পায়ের ছাপ ফেলতে পারে কি না, তা ঠিক জানা ছিল না তখন। অনেক পায়রার বাসা ছিল।
সে দিনটার কথা খুব ভালোই মনে আছে অতনুর। কারণ সেদিন সে শুধু ভূতের বাড়ি জয় করেনি। সেইদিনই জীবনে প্রথম সে সিগারেট খায়, তার বন্ধু রতন শিখিয়েছিল। সিগারেট টানার মতন অমন নিরিবিলি জায়গা আর পাওয়া যাবে কোথায়? লেবু পাতা চিবিয়ে বাড়ি ফিরলেও কী করে যেন ধরা পড়ে গিয়েছিল মায়ের কাছে। মা কি কোনো শাস্তি দিয়েছিলেন? মায়ের দেওয়া শাস্তি কোনো মানুষই মনে রাখে না। বাবা চুলের মুঠি ধরে মাথাটা দেয়ালে ঠুকে দিতেন, সেটা মনে আছে।
সেই দিনটায় তাদের দলে একটা মেয়েও ছিল না? কী যেন নাম তার, চিনু, চিনু, সে একটা গেছো মেয়ে, তাকে নেওয়া হবে না, তবু এসেছিল জোর করে। রোগা-প্যাংলা চেহারা, সেই তেরো-চৌদ্দো বছর বয়সে তাকে মেয়ে বলেই মনে হতো না, বুকেও বোধহয় ঢেউ খেলেনি, হাফ-প্যান্ট আর শার্ট পরে থাকত। সিগারেট টানার সময় সেও জেদ ধরেছিল, আমায় দাও, আমিও খাব, আমিও খাব, কিন্তু তাকে দেওয়া হয়নি, কে যেন একটা চড়ও মেরেছিল তাকে। কোথায় হারিয়ে গেছে সেই মেয়েটা।
এবারে তিন সপ্তাহের ছুটিতে এসেছে অতনু। সীতারামপুরে তার আর কোনোও আকর্ষণ নেই, এখানে কয়েকটা দিন নষ্ট করার কোনোও মানে হয় না, হঠাৎ মায়ের কথা খুব মনে পড়ছিল, এসেছে সেই নস্টালজিয়ায়। আসার পরই মনটা পালাই পালাই করছে।
যৌথ পরিবার ছিল একসময়, তারপর অনেক ভাগ হয়েছে, মায়ের মৃত্যুর পর তার দাদা এসে নিজেদের অংশটা বিক্রি করে দিয়ে যায় এক কাকাকে। সেই কাকা অতনুর বাবার বৈমাত্রেয় ভাই, ছোটবেলায় খুব ভালোবাসতেন অতনুকে। সেই স্মৃতিতে এখানে আসা, কাকার পরিবার বেশ খাতির-যত্ন করছে তাকে, তবু অতনুর অস্বস্তি কাটছে না। কাকা বুড়ো হয়ে গেছেন, অসুখের কথা ছাড়া আর কোনো কথা জানেন না। দুই খুড়তুতো ভাইকেই অচেনা মনে হয়, দুই ভাইয়ের স্ত্রী খুব ঝগড়া করে। কিন্তু চাষের জমি আছে, তার থেকে উপার্জন অনিশ্চিত, বাজারে একটা জামা-কাপড়ের দোকানে সিকি ভাগ মালিকানা, সে আয়ও যথেষ্ট নয়।
মা যে ঘরটায় থাকতেন, সে ঘরটা এখন বৈঠকখানা। কয়েকটা ছেঁড়া ছেঁড়া বেতের চেয়ার, একটা তক্তাপোশ আর একটা টিভি। মায়ের কোনো চিহ্নই নেই। খুড়তুতো ভাইয়ের দুই স্ত্রীর মধ্যে একজন নিঃস্তান, অন্যজনের তিনটে ছেলেমেয়ে তিনটির বয়েস নয়, বারো, চৌদ্দ, মেয়েটিই বড়। অতনুর আর বিয়ে-থা করা হয়নি। ছোট ছেলেমেয়েদের সে ভালোবাসে। ওদের সঙ্গেই তার বেশি সময় কাটে। মাঝে মাঝে অতনু মনে মনে ওদের সঙ্গে তুলনা করে তার বাল্য-কৈশোর বয়সের। তখন এখানে প্রচুর ফাঁকা জায়গা ছিল, কিছু কিছু বাগান আর পুকুর ছিল, অতনু তার বন্ধুদের সঙ্গে হুটোপুটি করে বেড়াত, বাঁদরের মতন লাফালাফি করত অন্যদের বাগানের গাছে, ফল-পাকুড় খেয়েছে, লাঠির বাড়িও খেয়েছে। সন্ধের পরেও দেরি করে বাড়ি ফিরলে বকুনি। খেয়েছে বাবার কাছে। এখন তার খুড়তুতো ভাইয়ের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়, বাড়িতে কিছুক্ষণ পড়তে বসে, আর বাকি সব সময়টা টিভি দেখে। বাড়ির বাইর কোথাও যায় না, খেলতেও যায় না, তাই তারা লক্ষ্মী ছেলেমেয়ে। অতনু বুঝতে পারে, এরা হয়তো সারাজীবন এই গ্রামেই থাকবে, আর কোথাও যাবে না।
অতনুকেও ওদের সঙ্গে টিভি দেখতে হয়। অতনু খানিকটা কৌতূহল নিয়েই টিভির অনুষ্ঠানগুলো, বিশেষত বিজ্ঞাপন দেখে। কোনোও দেশের অনেকখানি সমাজের ছবি বিজ্ঞাপন দেখলেই বোঝা যায়। এখানকার বিজ্ঞাপন দেখে সে প্রায় হতবাক। মনে হয় যেন ইন্ডিয়া নামের দেশটা পুরোপরি ওয়েস্টার্নাইজড হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েদের কী সব চোখ ঝলসানো পোশাক, কতরকম গাড়ি, কমপিউটার দারুণ কেরামতি, আর কত টাকা খরচ হয় একটা বিজ্ঞাপনে! এসব দেখে হাসে অতনু। দূরে থাকলেও সে তো মোটামুটি খবর রাখে দেশের। ইন্টারনেটেও পড়া যায় কলকাতার খবরের কাগজে।
টিভিতে অনেকগুলো বাংলা চ্যানেল, তাতে সিনেমা দেখায়, আর হরেক সিরিয়াল কাহিনী, বিদেশের মতোন। এসব একটা সিনেমারও সে নাম শোনেনি, এখনকার অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরও সে চেনে না। উত্তমকুমার চলে গেছেন, সে জানে, কিন্তু বসন্ত চৌধুরী, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, রবি ঘোষ, অরুন্ধতী, অনুপ, এঁরা কেউ নেই! পুরনোদের মধ্যে রয়েছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, আর একালের একজন নায়িকাকে কেন যেন তার চেনাচেনা মনে হয়, যদিও তার একটা ফিল্মও সে আগে দেখেনি, অথচ কোথায় তাকে দেখেছে, তা মনে করতে পারছে না।
এই সীতারামপুরেও অতনুর পুরনো কালের চেনা অনেকেই নেই। তার স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে চার-পাঁচজন এখানকার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে চলে গেছে কলকাতায় বা বিদেশে। আর যারা রয়ে গেছে, তারা রাজনীতির কচকচি বেশ ভালোই ভোজে। কিন্তু অন্য কোনো বিষয়ে তারা প্রায়ই কিছুই খবর রাখে না। আফ্রিকা সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ। যাদের সঙ্গে তুই তুই সম্পর্ক ছিল, তারা এখন তাকে তুমি বলে। এদের সবারই বিশ্বাস, বিদেশে যারাই থাকে, তারা সবাই খুব বড়লোক। এনআরআই-রা অনেক টাকা পকেটে নিয়ে দেশে বেড়াতে আসে।
অবশ্য এনআরআই বলতে ইউরোপ-আমেরিকার অনাবাসীদের কথাই সবাই ভাবে। তারা ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বা বিজ্ঞানী বা বড় বড় বিদ্বান। অতনু এর কোনোটাই নয়। ছোটবেলায় সে ভেবেছিল, ডাক্তার হবে। এখানে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ার পর সে গিয়েছিল চক বাজারের হাইস্কুলে। রেজাল্ট মোটামুটি ভালোই ছিল, কলকাতায় গিয়ে ডাক্তারি পড়া যেত অনায়াসেই, থাকতে হবে হস্টেলে। সব যখন প্রায় ঠিকঠাক, তখন একদিন রাত্রির খাওয়া-দাওয়ার পর তার বাবা একটা সিগারেট ধরিয়ে টানছেন বারান্দায় বসে, হঠাৎ প্রবল ভাবে কাঁপতে কাঁপতে পড়ে গেলেন মেঝেতে, বুকে ছুরিবিদ্ধ মানুষের মতোন গড়াতে গড়াতে আর্তনাদ করতে লাগলেন। একজন ডাক্তারকে ধরে আনা হয়েছিল দু’ঘণ্টা বাদে, ততক্ষণে বাবার শ্বাস-প্রশ্বাস খরচ হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে শেষ হয়ে গেল অতনুর ডাক্তারি পড়ার স্বপ্ন।
দাদা তখন রেশনিং অফিসে কেরানির চাকরি পেয়ে বর্ধমানে পোস্টেড, ছোট বোনের বিয়ে হয়নি। অতনু পড়াশোনা বন্ধ করে এক বছর পড়ে রইল এখানে। তার পরেও থেকে যেতে পারত গ্রামের অন্য ছেলেদের মতো, সেই ষোলো বছর বয়সেই সংসারের অনটন দেখে চেষ্টা করছিল টুকটাক উপার্জনের। বাবা অনেক ধার রেখে গেছেন। কিছুদিন সে আরও প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে হাঁস-মুরগির ডিম কিনে এনে সাপ্লাই দিত বাজারের কাছের দুটো ভাতের হোটেলে। শুধু মা দুঃখ করে বলতেন, তোর আর পড়াশোনা হবে না রে তনু! আমার গয়না বিক্রি করে দেব, তুই তবু পড়। ক’খানাই বা গয়না মায়ের, তা বিক্রি করে শহরে গিয়ে বেশিদিন পড়াশুনা চালানো যায় না। তা ছাড়া ছোট বোনের বিয়ের সময় গয়নাগুলো লাগবে না?
মায়ের বড় ভাই থাকতেন পুনায়। তিনি সেখানে স্কুলশিক্ষক। তিনি প্রস্তাব দিলেন, অতনুকে তার কাছে পাঠিয়ে দিলে তিনি ওর পড়াশোনার দায়িত্ব নেবেন। অতনু চলে গেল পুনায়। এসবই যেন সাপ-লুডোর ওঠানামা।
সংসারে আর একটি খাওয়ার পেট বৃদ্ধি পাওয়ায় বড় মামিমা প্রথম থেকেই অতনুকে পছন্দ করেননি। তাঁকে খুব দোষ দেওয়া যায় না, তাঁদেরও অভাবের সংসার আর বড় মামাও খানিকটা আলাভোলা মানুষ। তিনি অতনুকে ডাক্তারি পড়াতে পারেননি, তবু ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন হোটেল ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে। সেখান থেকে পাস করার পরই খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে সে চাকরি পেয়ে যায় আফ্রিকার কেনিয়ায়। সীতারামপুর গ্রামের একটি ছেলে চাকরি করতে যাবে কেনিয়ার হোটেলে! নিয়তির নির্বন্ধ।
আফ্রিকা থেকে মাকে নিয়মিত টাকা পাঠিয়েছে অতনু। তখনই ছোট বোনের বিয়ে হয়। দাদা বাড়ির সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রাখেনি। আফ্রিকায় অতনুর চাকরি নিয়ে অনেক ঝঞ্ঝাট হয়েছে বেশ কয়েক বছর। ওখানে হোটেল ম্যানেজমেন্টে ইন্ডিয়ান ট্রেনিংয়ের চেয়েও সুইজারল্যান্ডের ট্রেনিং সার্টিফিকেটের কদর অনেক বেশি। কেনিয়ার ট্যুরিজম ও হোটেল ম্যানেজমেন্টে অনেক সুইস কাজ করে। তাদের সঙ্গে রেষারেষিতে অতনুর পদোন্নতি আটকে যায় বারবার। একবার তার কর্মস্থান-হোটেলটা বিক্রি হয়ে যায়, নতুন মালিকরা প্রথমে তাকে রাখতেই চায়নি, রাখলেও অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারের পদ তাকে দিতে চায়নি। সেই সময়েই মা মারা যান।
মাকে নিজের কাছে নিয়ে রাখতে চেয়েছিল অতনু। মা রাজি হননি। শুধু বলতেন, আফ্রিকা, ওরে বাবা! না না, ওখানে গিয়ে থাকতে পারব না। মা ভাবতেন, শুধু নেংটি পরা, বর্শা হাতে দুর্ধর্ষ ধরনের মানুষরাই সেখানে ঘুরে বেড়ায়। মাকে কিছুতেই বোঝাতে পারেনি অতনু যে নাইরোবি খুবই আধুনিক শহর, সেখানকার মেথররাও প্যান্ট-শার্ট ও জুতো পরে। মা না হয় স্বল্প শিক্ষিত মহিলা, ও রকম ধারণা থাকতেই পারে, কিন্তু এখানকার অনেক শিক্ষিত ভদ্রলোকেরও তো আধুনিক আফ্রিকা সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার নয়। যতবার সে দেশে এসেছে, প্রতিবারই কেউ না কেউ বলেছে, তুমি আফ্রিকায় পড়ে আছ কেন, বিলেত-আমেরিকায় চলে যেতে পারলে না? ওসব দেশে তো হোটেল অনেক বেশি। এবারেও একজন বলছে। কলকাতাতেও অনেক নতুন নতুন হোটেল খুলছে, তুমি এখানে কাজ পাও কি-না দেখো না! গত পাঁচ বছর ধরে অতনু নাইরোবির যে হোটেলে কাজ করছে, সেটা কলকাতার গ্র্যান্ড বা তাজের চেয়ে অনেক বড়। সেখানকার কাজে সে বেশ খুশি। একটি বেলজিয়ান মেয়ের সঙ্গে সহবাস করে।
কলকাতা শহরটা অনেকটা বদলেছে ঠিকই। এয়ারপোর্ট থেকে আসবার যে নতুন রাস্তাটা হয়েছে, সে রাস্তার পাশে পাশে নতুন নতুন প্রাসাদ দেখে সে মুগ্ধ হয়ে গেছে। তার মনে হয়, কলকাতার চেয়ে সে নাইরোবি শহর অনেক বেশি চেনে। কলকাতায় তো সে কখনও থাকেনি।
এবারে অবশ্য সে একটা ভালো জায়গা পেয়েছে। রাজেশ আগরওয়াল নামে মাড়োয়ারি ভদ্রলোকের ব্যবসা আছে কিনিয়া আর তানজানিয়ায়। তিনি নাইরোবিতে প্রায়ই যান এবং প্রতিবারই রয়াল ক্রাউন হোটেলে ওঠেন। ভদ্রলোক বাংলা বলেন মাতৃভাষার মতো। মেনটেন্যান্স ম্যানেজারের নাম অতনু ঘোষ দেখেই তিনি তার সঙ্গে আলাপ করেছেন। মাঝে-মধ্যে সন্ধেবেলা গল্প হয়ে অনেকক্ষণ।
অতনু নিজের কোয়ার্টারে তাকে নেমন্তন করেও খাইয়েছে, তিনিও অতনুকে আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখেছিলেন কলকাতায়। তার নিজের বাড়িতে নয়, আগরওয়ালদের একটি ননফেরাস মেটালের কারখানা আছে টালিগঞ্জ অঞ্চলে, অতনুর থাকার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, দেয়াল ঘেরা এলাকাটিতে রয়েছে সুসজ্জিত বাগান, একটি গাড়িও বরাদ্দ করা আছে তার জন্য।
অতনু অবশ্য মেট্রো ট্রেনে যাতায়াত করে বেশ নতুনত্ব বোধ করে। কলকাতা শহরের মাটিরতলা দিয়ে ট্রেন চলে, এ খবর তার না জানার কথা নয়, যদিও আগে কখনও স্বচক্ষে দেখেনি, তাই প্রথম দিনে সেই ট্রেনে ওঠা যেন মনে হয়েছিল আবিষ্কারের মতন।
রাত আটটা ন’টায় ট্রেন থেকে নামলে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু মেয়েকে দেখা যায়। তাদের স্বাস্থ্য এত খারাপ কেন? ভাল করে সাজতেও জানে না। যে শহরের বার-নারীদের অবস্থা করুণ, সে শহরের নৈতিক স্বাস্থ্যও খারাপ হয়, অর্থাৎ অনেক সুখী সংসারের মধ্যেই নৈতিকতার পতন হয়েছে। সত্যি কি তাই? জাগতিক উন্নতি আর নেতিকতার পতন পাশাপাশি চলে! এই শহর থেকেই সবচেয়ে বেশি কিশোর ও যুবতী পাচার হয়ে যায় বাইরে, খবরের কাগজেই ছাপা হয়। সে সব মেয়েদের জায়গা হয় না এই উন্নতির মধ্যে!
ভাল পেনের ব্যবহার তো উঠেই গেছে। এখন সবাই সস্তার পেন দিয়ে লেখালেখি করে। অতনুর বাবার পকেট থেকে একটা শেফার্স পেন চুরি গিয়েছিল লোকাল ট্রেনে। এখন সেই সব পেন পকেটমাররা বেকার, সাত-আট টাকার ডট পেন মেরে কোনো লাভ হয় না। মেট্রো সিনেমার সামনে একজন সিড়িঙ্গে চেহারার প্রৌঢ় সেই পেন বিক্রি করতে এসেছিল অতনুকে। হোটেলে যারা কাজ করে, তাদের কাছে এই পেন যে কত গণ্ডা থাকে, তার ঠিক নেই। সীতারামপুরে বিলি করার জন্য অতনু তার হোটেলে নাম লেখা এই ধরনের পেন এনেছিল পাঁচ ডজন।
লোকটিকে দেখে অতনু চমকে উঠে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল।
সে চিনতে পেরেছে। কিন্তু সেটা জানানো ঠিক নয়। এই লোকটি তাদের সীতারামপুরের স্কুলের ইন্দুভূষণ স্যারের ছেলে বিশ্বনাথ, অতনুর সহপাঠী। অথচ এর মধ্যেই এত বুড়োটে চেহারা হয়ে গেছে। দারিদ্র্য আয়ু হরণ করে নেয়, স্বাস্থ্য, শরীরের জ্যোতি, সবই খেয়ে নেয়। অতনুর এখনও অটুট চেহারা, গায়ের রং কালো হলেও অনেকে তাকে সুপুরুষই বলে। বিশ্বনাথ ইস্কুল মাস্টারের ছেলে, অথচ তার এই পরিণতিং জুয়া খেলে নে, না নেশা করে? উন্নতির দৌড়ে সে পা মেলাতে পারেনি!
মস্ত বড় হোর্ডিং-এ বাংলা ফিল্মের এক নায়িকার মুখ দেখে তার খটকা লাগে। কোথায় একে দেখেছে? কোনও ফিল্মে নয়।
কলকাতার সংস্কৃতি জগতের সঙ্গে রাজেশ আগরওয়ালের বেশ যোগাযোগ আছে। তার অনেক ব্যবসা, তা ছাড়াও ফিণ্ম প্রোডিউস করেন। এতগুলো ব্যবসার কথা মাথায় রাখেন কী করে? এত টাকা নিয়েই বা কী পরমার্থ হবে!
মাঝে মাঝেই তিনি পাঁচতারা হোটেলে পার্টি দেন। একটা শহরের, যাদের বলে গ্গ্নটারেট্টি, তারা অনেকেই আসেন, কিছু কিছু রাজনীতির লোকও। সার্থকভাবে ব্যবসা চালাতে গেলে টেবিলের তলা দিয়েও কিছু কিছু আদান-প্রদান করতে হয়। সবাই জানে। তবুও জিনিসটা চাপা দেবার জন্য মাঝে মাঝে সংস্কৃতির অনুষ্ঠানের আয়োজন করা বেশ সুবিধেজনক। বাঙালিদের ধারণা, যারা সংস্কৃতি ভালবাসে, তারা উচ্চ মার্গের মানুষ। তারা কখনও কোনও নোংরা ব্যাপারে জড়াতে পারে না।
রাজেশ আগরওয়াল অতি সজ্জন ও বিনয়ী ব্যক্তি। হয়তো সত্যি তিনি সংস্কৃতি প্রেমিক। পার্টিতে ঢোকার দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে হাত জোড় করে তিনি নিজে সব অতিথিকে অভ্যর্থনা জানান, অনেককেই তিনি ব্যক্তিগতভাবে নাম ধরে চেনেন। ভদ্রতাবশত তিনি অতনুকেও আজকের পার্টিতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।
হোটেল সংলগ্ন বিস্তৃত লনে পার্টি। সবুজ ঘাস ঘিরে চেয়ার, অতিথি অন্তত পঞ্চাশজন তো হবেই। মাঝখানে একটা অস্থায়ী মঞ্চে একটি মেয়ে গান গাইছে। আজকাল গায়িকাদের খুব স্বল্প পোশাক পরাই রীতি। সারা গা ঢেকে গান আজকাল পুজোর অনুষ্ঠানেও চলে না। গরম দেশ, তবু এর মধ্যে অনেক পুরুষেরই অঙ্গে কোট আর টাই। আর মেয়েদের শরীরের অনেকটাই খোলামেলা।
এত লোক হলে, ছোট চোট দলে ভাগ হয়ে আড্ডা হয়। দু’চারজন মদের গেলাস হাতে ঘুরে ঘুরে অনেকের সঙ্গে আরাপ করে। আর বেশির ভাগ অতিথি বসে থাকে একই চেয়ারে।
অতনু এখানে একজনকেও চেনে না। সে গ্রামের ছেলে, কলকাতায় কখনও পাত্তা পায়নি। তারপর পুনা থেকে চলে গেছে ধাদ্ধারা গোবিন্দপুরের চেয়েও অনেক দূরে কালো মানুষদের দেশে। এই ধরনের পার্টিতে এলে সে জানে একা একা বেশি মদ খেয়ে নিতে হয়। আর দেখতে হয় অন্যদের। হোটেল ম্যানেজমেন্টের ট্রেনিং থেকে সে জানে। মদ খেয়ে কখনও বেচাল হতে নেই, একটা সময়ে মদের গেলাস শুধু হাতে ধরে রাখলেও চুমুক দেবার বদলে মাঝে মাঝে ফেলে দিতে হয় মাটিতে।
অতনু নিজে থেকে কারও সঙ্গে আলাপ করে না, তবে অচেনা কেউ কথা বলতে এলে সে গুটিয়ে থাকে না। একটা কিছু হাসি-ঠাট্টার প্রসঙ্গ খুঁজে নেয়।
পার্শ্ববর্তী পাঁচ ছ’জনের দলের একজন সুবেশা তরুণী তার দিকে ঝুঁকে বলল, আপনার সঙ্গে আমাদের আলাপ নেই। আমার নাম সুদর্শনা রায় গুপ্ত, আমি একজন সাংবাদিক।
অতনু নিজের নাম জানিয়ে বলল, গ্ল্যাড টু মিট ইউ, আপনি কোন কাগজের?
সুদর্শনা নিজের কাগজের একটা কার্ড দিয়ে বলল, আপনি কোথায়?
অতনু বলল, আমি থাকি আফ্রিকায়। কয়েকদিনের জন্য এসেছি।
আফ্রিকা শুনেই একজন পুরুষ গলা বাড়িয়ে বলল, আপনি আফ্রিকায় থাকেন? কোথায়?
এই ধরনের বাঙালি আড্ডায় কথা জমাবার জন্য অতনুর একটা বাঁধা রসিকতা আছে।
সে বলল, আমি থাকি কেনিয়ার নাইরোবি শহরে। রবীন্দ্রনাথ এই শহর নিয়ে গান লিখেছেন, আপনারা জানেন?
এবার অনেকগুলি কৌতূহলী মুখ কাছে ঝুঁকে আসে। একজন বলল, রবীন্দ্রনাথ আফ্রিকা নিয়ে একটা বড় কবিতা লিখেছেন জানি। কিন্তু লাইব্রেরি নিয়ে—
অতনু বলল, রবীন্দ্রনাথ নিজের নাম নিয়ে অনেক কবিতা ও গান লিখেছেন। তাই রবি’র সঙ্গে কবি, ছবি,হবি এই সব মিল দিয়েছেন, মিল খুঁজতে খুঁজতে একবার নাইরোবীও পেঁৗছে গেছেন একটা গানে। সেই গানটা হল, সকালবেলার আলোয় বাজে, বিদায় ব্যথার ভৈরবী/ আন বাঁশি তোর, আর কবি… এরপর একটা লাইন হল নাই যদি রোস নাই রবি, সেদিন নাইরবি…
সবাই কলহাস্যমুখর হয়।
আর কিছু বলার আগেই একটা গুঞ্জন ও কিছু লোকের ব্যস্ততা দেখা যায় প্রবেশ মুখে। বিশিষ্ট কোনো অতিথি এসেছেন।
রাজেশ আগরওয়াল হাত জোড় করে ও কোমর ঝুঁকিয়ে সেই অতিথিকে নিয়ে আসছেন, অতিথি একজন মহিলা। সাদা সিল্কের শাড়ি পরা, তার থেকে ঝিলিক মারছে অনেক জরির চুমকি, মাথার চুল চুড়ো করে বাঁধা, পালিশ করা মুখ, খুব গ্গ্ন্যামারের ছড়াছড়ি।
অতনু সাংবাদিকটিকে জিজ্ঞেস করল, ইনি কে?
সে বলল, সে কী। আমাকে বলেছেন বলেছেন, আর কারুকে বলবেন না। লোকে আপনাকে গেঁয়ো ভূত ভাববে। সুরশ্রী মিত্র, বাংলা ফিল্মের সবচেয়ে নামী নায়িকা, মুম্বাই থেকেও ডাক এসেছে, চলে গেল বলে।
আর একবার তাকিয়ে দেখে বুঝল। কয়েকদিন আগেই টিভির কোনও ফিল্মে সে এই নায়িকাটিকে দেখেছে, গ্রাম্য মেয়ের ভূমিকায় সাজপোশাক ছিল অন্যরকম? কেন ওকে একটু চেনা চেনা লাগছিল তার কারণটাও বোঝা গেল, সীতারামপুরের গোল গম্বুজটার গায়ে ফিল্মের পোস্টারে এরই মুখের ছবি ছিল, যাতায়াতের পথে সে অনেকবার দেখেছে।
একটু বাদে রাজেশ আগরওয়াল তার এই প্রাইজড পজেশানটি সকলকে ভাল করে দেখাবার জন্য নিয়ে আসলেন প্রতিটি চেয়ারের সামনে। জনে জনে হাত তুলে নমস্কার করছে। উত্তরে মিষ্টি হাসি বিলোচ্ছেন নায়িকাটি।
অতনুর কাছে এসে সে একটু থমকে দাঁড়িয়ে চেয়ে রইল নির্নিমেষে! তারপর অস্ফুট গলায় বলল, তনুদা?
অতনুরও আর চিনতে দেরি হলো না, সেও সঙ্গে সঙ্গে বলল চিনু! তাই না?
নায়িকা জিজ্ঞেস করল, তুমি এখানে কোথা থেকে এলে? তুমি তো হারিয়ে গিয়েছিলে।
অতনু বলল, এসেছি এক জঙ্গলের দেশ থেকে। দৃশ্যটি একটু বেশি নাটকীয়। তাই বেশিক্ষণ টানা যায় না। অভ্যেস মতন অতনুকেও একটু হাসি উপহার দিয়ে এগিয়ে গেল নায়িকা অন্যদের দিকে।
এই সেই দস্যি মেয়ে চিনু, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। সেই যে রূপকথার গল্পে আছে, একটা ব্যাঙ একদিন হঠাৎ রাজপুত্র হয়ে গেল। এ যেন ঠিক তার উল্টো। সেদিনের সেই রোগা প্যাংলা মেয়েটা আজকের এই রূপসী!
মহিলা সাংবাদিকটি জিজ্ঞেস করল, আপনি একে পার্সোনালি চেনেন বুঝি?
অতনু তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল, সে অনেক ছেলেবেলায়।
সে বুঝিয়ে দিল যে, এই বিষয়ে সে আলোচনা চালাতে উৎসাহী নয়। সে চুমুক দিল গেলাসে। একটু পরেই এক যুবক এসে অতনুকে বলল, আপনাকে একবার ওদিকে ডাকছে।
আলোর বৃত্ত থেকে একটু বাইরে। আধো-অন্ধকারে একটা চেয়ারে বসে আছে নায়িকা। তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন।
অতনুকে দেখে সে অন্যদের বলল, এই এখানে একটা চেয়ার দাও। আর তোমরা একটু যাও, ওঁর সঙ্গে আমার কথা আছে।
অতনু বসবার পর একটু ঝুঁকে এসে তার একটা হাত ধরে নায়িকা সম্পূর্ণ অভিনয়হীন গলায় বলল, তনদুা, তোমাকে কতদিন পর দেখলাম। আগরওয়ালজি বললেন, তুমি এখন আফ্রিকায় থাকো।
অতনু বলল, হ্যাঁ। চিনু, তুই কবে সিনেমার নায়িকা হয়েছিস? শুনলাম তার খুব নাম, এসব আমি কিছুই জানি না। তোর ভালো নামও তো আমি জানতাম না।
চিনু বলল, কেন তোমাদের ওখানে বাংলা ফিল্ম যায় না?
অতনু বলল, কী জানি। হিন্দি ফিল্ম কখনও সখনও প্রাইভেটলি দেখানো হয় শুনেছি। তাও আমার দেখা হয় না। তুই হিন্দিতেও করেছিস।
করেছি দু’একটা। সব বাঙালিরাই আমাকে চেনে, একমাত্র তুমি ছাড়া।
তারপর একটু দুষ্টুমির হাসি দিয়ে সে আবার বলল, কিংবা, একমাত্র তুমি আমাকে যেভাবে চেন, সেভাবে এখন আর কেউ চেনে না।
তুই কী করে নায়িকা হয়ে গেলি রে? চেহারাটাও বদলে গেছে।
ওসব কথা ছাড়ো। হয়ে গেছি কোনো রকমে। তুমি কেমন আছ, বলো। বিয়ে করেছ?
ভালোই আছি রে। না বিয়ে করিনি। তবে একজন বিদেশিনী মেয়ের সঙ্গে ভাব আছে। তুই?
আমার একটা বিয়ে ভেঙে গেছে। আর একটা, নাঃ, এখনও কিছু ঠিক নেই।
তুই আমাকে দেখে চিনলি কী করে? আমি তো তোকে চিনতে পারিনি, শুধু একটু একটু মনে হচ্ছিল, তোর নাকটা শুধু…
হ্যাঁ, আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা আমাকে বলে নাকেশ্বরী। তোমার চেহারা তো প্রায় একই রকম আছে। পুরুষরা বিশেষ বদলায় না। আমাদের তো মেক-আপ টেক-আপ দিয়ে…
অতনু একটা সিগারেট ধরালো।
চিনু বলল, তুমি এখনও সিগারেট খাও? অনেকেই তো… আমিও ফিল্ম লাইনে এসে প্রথম প্রথম খুব খেতাম, এখন একদম ছেড়ে দিয়েছি, অন্তত সাত বছর, দাও, তোমার থেকে একটা টান দিই।
সিগারেটটা হাতে নিয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেল চিনু।
অতনু জিজ্ঞেস করল, তুই আর সীতারামপুরে যাস?
চিনু বলল, নাঃ। ওখানে তো ছিল আমার মামাবাড়ি। প্রায়ই যেতাম এক সময়, আমাদের বাড়ি ছিল ব্যারাকপুরে। তারপর বাবা বদলি হয়ে গেলেন নর্থ বেঙ্গলের মালবাজারে।
অতনু বলল, ও হ্যাঁ, মামাবাড়ি। ওঁরা আর কেউ নেই শুনেছি। তোর একটা ফিল্ম কয়েকদিন আগে দেখলাম টিভিতে। নামটা বোধহয় ‘আশালতা’, তাই না?
হ্যাঁ।
তাতে তুই একটা গ্রামের মেয়ে, ডুরে শাড়ি পরা, একটা সিনে আছে, তুই একটা পুকুর থেকে ডুব দিয়ে উঠে এলি… হ্যাঁরে চিনু, তুই ও রকম কোমর দুলিয়ে হাঁটা কোথায় শিখলি রে? গ্রামের মেয়েরা কি ওইভাবে হাঁটে?
তুমি কী যে বল তনুদা? সিনেমা করতে গেলে কত কী শিখতে হয়। গ্রামের মেয়েরা ওইভাবে হাঁটে না, ওসব মেক বিলিভ, অধিকাংশ সিনেমাই তো রূপকথা, তাই না?
তুই নাচ জানিস?
মাঝে মাঝে নাচতে হয়, কিন্তু তাকে নাচ বলে না।
একজন যুবক হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, মিস, আপনাকে ওদিক আসতে বলছেন আগরওয়ালজি। সবাই আপনাকে চাইছে।
চিনু রুক্ষ গলায় বলল, একটু পরে যাচ্ছি, এখন ডিস্টার্ব কোরো না।
ছেলেটি ফিরে যাবার পর চিনু বলল, একটু নিরিবিলিতে যে তোমার সঙ্গে গল্প করব, তার উপায় নেই। তুমি কতদিন আছ?
অতনু বলল, পরশু ফিরে যাব।
চিনু বলল, এই রে, এই দু’দিন আমার টানা শুটিং। আউটডোর। তুমি আসবে, ডায়মন্ডহারবারে? না থাক, শুটিং-এর সময় আমি তোমার সঙ্গে ভালো করে কথা বলতে পারব না। তোমারও বোরিং লাগবে।
অতনু বলল, শুটিং দেখা আমার পোষাবে না।
আবার একজন যুবক দৌড়ে এসে বলল, মিস, আপনার নাম অ্যানাউন্স করা হয়ে গেছে, আপনাকে একবার সেন্টার স্টেজে দাঁড়াতে হবে।
চিনু বলল, ঠিক আছে। যাচ্ছি।
উঠে দাঁড়িয়ে সে অনেকটা আপন মনে বলল, নায়িকা টায়িকা হতে গেলে অনেক কিছু মূল্য দিতে হয়, সে তুমি বুঝবে না।
অতনু মনে মনে ভাবল, না বোঝার কী আছে? সব দেশেই তো এক।
চিনু আবার বলল, যে কোনো লাইনেই ওপরে উঠতে গেলে কিছু না কিছু মূল্য দিতে হয়ই, তাই না? আমাদের ফিল্ম লাইনেও… কোনো ইনহিবিশন রাখলে চলে না। যাই। তোমার সঙ্গে আবার কখনও দেখা হবে কিনা জানি না। তবু একটা কথা বলতে খুব ইচ্ছে করছে। বলব?
বল!
তনুদা, তোমার সেই দিনটার কথা মনে আছে? সেই ভুতুড়ে বাড়িটায়…
মনে থাকবে না কেন? তোর যে মনে আছে, সেটাই আশ্চর্যের।
তনুদা, জীবনে আমি অনেক অভিজ্ঞতা পার হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু সেদিন, আমি যে তীব্র আনন্দ পেয়েছিলাম তার কোনো তুলনা হয় না। তোমাকে দেখে… সে রকম আর কখনও… চলি ওরা আর থাকতে দেবে না।
হঠাৎ কি চিনুর গলায় কান্না এসে গেল? মুখ নিচু করে সে দ্রুত পায়ে চলে গেল আলোর বৃত্তের দিকে।
অতনু আরও কিছুক্ষণ বসে রইল সেখানেই। সেই বট-অশ্বত্থের ফাটল ধরানো পোড়োবাড়ি। গা-ছমছমে দুপুর। সিগারেট খেতে চেয়েছিল চিনু, একদিন অতনুকে ধরে ঝুলোঝুলি, তাই বন্ধুদের বাদ দিয়ে শুধু চিনুকে নিয়ে এক দুপুরে চুপি চুপি সেই বাড়িতে গিয়েছিল অতনু।
সিগারেটে প্রথম টান দিয়েই কাশতে শুরু করেছিল চিনু, তার পিঠে ছোট ছোট চাপড় মেরে দিচ্ছিল অতনু, তারপর কী যেন হল, পর পর পাঁচটা চুমু খেয়েছিল সে। চিনু অবাক হয়নি, প্রথমবারের পর, পাখির বাচ্চা যেমন পাখি-মায়ের সামনে ঠোঁট ফাঁক করে থাকে, সেইভাবে চিনু এগিয়ে দিয়েছিল ঠোঁট।
তাদের দুজনেরই সেই প্রথম অভিজ্ঞতা। তার পর নদী দিয়ে কত জল গড়িয়ে গেছে, সেই বাড়িটা আর নেই, চিনু কত বদলে গেছে। অনেক কিছুই বদলে গেছে, তবু চিনু যে আজ বলল, সে রকম তীব্রতা সে আর জীবনে পায়নি, তার চোখে জল এসে গেল… এই স্মৃতি নিয়েই ফিরে যাবে অতনু।

বন্ধু ও শত্রু আলবেয়ার কামু ও জঁ পল সার্ত্রে - শাহনেওয়াজ বিপ্লব


আলবেয়ার কামু (জন্ম : ৭ নভেম্বর ১৯১৩, মৃত্যু : ৪ জানুয়ারি ১৯৬০)



আলবেয়ার কামু এবং জঁ পল সার্ত্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ও এর পরের বছরগুলোতে ফ্রান্সের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক ও তাত্ত্বিক তো বটেই এবং সেই সঙ্গে অস্তিত্ববাদী দর্শনকে বিশ্বের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সুবাধে দুজনকেই বিবেচনা করা হয় বিংশ শতকে পৃথিবীর অন্যতম সেরা সাহিত্যিক হিসেবে।

আলবেয়ার কামু এবং জঁ পল সার্ত্রে- লেখালেখির জীবনের শুরু থেকেই দুজন ছিলেন একই পথের যাত্রী। তাঁরা উভয়ে একই সঙ্গে নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সমালোচক, দার্শনিক এবং দুজন একই সঙ্গে ছিলেন পত্রিকার সম্পাদকও; দুজনই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন কয়েক বছরের ব্যবধানে। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চিন্তার বাইরে ব্যক্তিগত জীবনযাপনেও অনেক বিষয়ে মিল ছিল দুজনের মধ্যে। দুজনই খুব পছন্দ করতেন নারীসঙ্গ। 'নারীসঙ্গ কী খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন লেখকের সত্যিকারের লেখক হয়ে ওঠার জন্য?'- ১৯৪০ সালে সার্ত্রে প্রশ্ন রেখেছিলেন তাঁর ডায়েরিতে। তারপর লিখেছেন, 'নারীসঙ্গবিহীন একাকী জীবন সত্যিই বিরক্তিকর আর কৌতূহলহীন।'

আর এর পরের ঘটনা তো সবারই জানা। সিমোন দ্য বোভোয়ারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হওয়ার পর প্যারিসের সব সাহিত্য আলোচনায়, ক্যাফে হাউসে অথবা ডিসকোতে সবাই সব সময় একই সঙ্গে দেখেছে সার্ত্রে আর বোভোয়ারকে।

অন্যদিকে আলবেয়ার কামুও ঠিক সার্ত্রের মতোই তাঁর বান্ধবী তানিয়াকে নিয়ে সাহিত্য আড্ডা বা সাহিত্য আড্ডার বাইরে যাতায়াত করতেন। পরে অবশ্য আলবেয়ার কামু তানিয়া ছাড়াও অন্য মেয়েদের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন এবং দুবার বিয়েও করেছেন।

১৯৪৩ সালের গ্রীষ্মে জঁ পল সার্ত্রের নাটক 'দ্য ফ্লাইজ' দেখতে গিয়েই কামুর সঙ্গে সার্ত্রের প্রথম পরিচয় হয়, তারপর নানা সাহিত্য আড্ডায় এমনকি ব্যক্তিগত জীবনদর্শনের দিক দিয়েও একে অপরের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। দুজনই প্রচুর পরিশ্রম করেছিলেন অস্তিত্ববাদী দর্শনকে সাহিত্য ও শিল্পকলায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। দুজনই ছিলেন কমিউনিজমের প্রতি অনুরক্ত। ১৯৪৪ সালে আলবেয়ার কামু 'কমব্যাট' পত্রিকার সম্পাদক হয়ে বিপ্লবী অনেকগুলো কলাম লিখেন, যা সে সময় ফ্রান্সের জনগণের ভেতর বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। কামুর আমন্ত্রণে সার্ত্রেও মাঝেমধ্যে কলাম লিখেছিলেন 'কমব্যাট' পত্রিকায়। পরে আলবেয়ার কামুকে অনুসরণ করে জঁ পল সার্ত্রেও ১৯৪৫-এ প্রতিষ্ঠা করেন তাঁর পত্রিকা 'মডার্ন টাইমস'। তিনিও কামুর মতোই সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে সব কলাম লিখতেন। ফলে একই পথের পথিক হিসেবে সাহিত্য, দর্শন আর সাংস্কৃতিক মিলের সুবাদে তাঁদের ভেতর ঐক্য আর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল। এমনকি ১৯৪৫ সালে আমেরিকায় গিয়ে 'ফ্রান্সের নয়া সাহিত্য'তত্ত্ব উপস্থাপন করার সময় সার্ত্রে ফ্রান্সের নতুন সাহিত্য যুগের প্রতিনিধি হিসেবে আলবেয়ার কামুর নাম ঘোষণা করেন, যেটিকে কামুর প্রতি সার্ত্রের বড় রকমের বন্ধুত্বের পরিচয় বলে অনেকেই মনে করেন।

অবশ্য তাঁদের এ বন্ধুত্ব বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আলবেয়ার কামুর কমিউনিজমের প্রতি বিরাগ ও স্ট্যালিনের সমালোচনা, সার্ত্রের সঙ্গিনী বোভোয়ারের কামুর প্রতি আকর্ষিত হওয়ার ঘটনায় এবং অস্তিত্ববাদ বাদ দিয়ে উদ্ভটবাদ তত্ত্বের দিকে কামুর ঝুঁকে পড়া নিয়ে তাঁদের পরস্পরের মধ্যে বিরোধ বাড়তে থাকে। অবশ্য দুজনের ভেতর প্রথম বিরোধের সূচনা সিমোন দ্য বোভোয়ারকে নিয়ে। সিমোন দ্য বোভোয়ার ছিলেন সার্ত্রের আজীবনের বিশ্বাসযোগ্য সঙ্গিনী। কিন্তু সার্ত্রের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হওয়ার প্রথমদিকের দিনগুলোতে সিমোন দ্য বোভোয়ার কিছুটা আকর্ষিত হয়ে পড়েছিলেন কামুর প্রতি এবং এ ঘটনাকে সহজভাবে গ্রহণ করেননি সার্ত্রে। পরে এ ঘটনার প্রতিশোধ নিতে আলবেয়ার কামুর বান্ধবী তানিয়াকে, সার্ত্রে নিজের দিকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হন, যেটা অনেক পরে সিমোন দ্য বোভোয়ারকে লেখা এক চিঠিতে স্বীকার করেছিলেন সার্ত্রে। সেই চিঠি থেকে জানা যায়, তানিয়া সার্ত্রেকে জানিয়েছিলেন যে কামুর চেয়ে সার্ত্রেকেই অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য এবং ভালোমানুষ মনে হয়েছিল তানিয়ার কাছে।

এ ঘটনা ছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কমিউনিজম নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকা ও স্ট্যালিনের সমালোচনায় মুখর হন আলবেয়ার কামু। অবশ্য ১৯৩৫ সালে ফ্রান্স কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে সব সময় সরব ছিলেন কামু, যে কারণে ট্রটস্কিপন্থী আখ্যা দিয়ে কামুকে একবার বহিষ্কারও করা হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি থেকে। অন্যদিকে কমিউনিজমে মুগ্ধ সার্ত্রে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ না দিলেও নিজেকে মার্কসবাদী বলে দাবি করতেন, তিনিও কামুর মতো সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে মানবাধিকার আর নাগরিক পরাধীনতার সমালোচনা করতেন, তবে সেটা কামুর মতো অতটা কঠোর ছিল না। যে কারণে কামুর সঙ্গে সার্ত্রে এবং কমিউনিস্ট পার্টির অনেক নেতা-কর্মীর বিরোধ তৈরি হয়েছিল।

এ ছাড়া অস্তিত্ববাদ বাদ দিয়ে উদ্ভটবাদ নামে খানিকটা অস্তিত্ববাদের বিরোধী মতবাদ প্রতিষ্ঠিত করা নিয়েও সার্ত্রের সঙ্গে কামুর বিরোধ ছিল। আলবেয়ার কামু, জঁ পল সার্ত্রে এবং সিমোন দ্য বোভোয়ার- তিনজন মিলেই অস্তিত্ববাদী ধারায় কাজ করলেও পরে অস্তিত্ববাদ প্রতিষ্ঠায় অন্যতম তাত্ত্বিক হিসেবে নিজের নাম ও অবদানের কথা অস্বীকার করেন কামু। মূলত ১৯৫১ সাল পর্যন্ত আলবেয়ার কামুর সঙ্গে জঁ পল সার্ত্রের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।

আলবেয়ার কামু এবং জঁ পল সার্ত্রের পারস্পরিক শত্রুতা নিয়ে অনেক গুজব প্রচলিত থাকলেও দুজনের কেউ কখনো তা স্বীকার করেননি। তবে কামুর মৃত্যুর পর আলবেয়ার কামুকে লেখা এক খোলা চিঠিতে সার্ত্রে লিখেছিলেন, 'প্রিয় কামু, আমাদের দুজনের মধ্যে যতটা বন্ধুত্ব ছিল, ততটাই ছিল শত্রুতা; কিন্তু তার পরও আমি আজ স্বীকার করছি যে আগামী দিনগুলোতে আপনার অনুপস্থিতি অনুভব করব আমি। কারণ আপনিই ছিলেন প্যারিসের একমাত্র সাহিত্যিক, যিনি আমাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিলেন।' এ ছাড়া কামুর মৃত্যুতে সার্ত্রে শোক প্রকাশ করে লিখেছিলেন, 'অবধারিতভাবেই কামু আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রধানতম ব্যক্তিবর্গের একজন হয়ে উঠেছিলেন এবং ফ্রান্সের ইতিহাস ও তার নিজের শতাব্দীর তিনি ছিলেন এক স্বতন্ত্র প্রতিনিধি।'

অবশ্য জীবদ্দশায় আলবেয়ার কামু নোবেল পুরস্কার গ্রহণ করার জন্য সুইডেনের স্টকহোমে গেলে সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেছিলেন সার্ত্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে। জবাবে কামু বলেছিলেন, সার্ত্রের সঙ্গে আমার লেখালেখি বা ভাবনার যে বিরোধ, সেটিই সবার চোখে পড়ে। কিন্তু তার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো বিরোধ নেই। তবে বলা দরকার যে সাহিত্য ভাবনায় সাহিত্যিকদের মধ্যে নানা রকম পক্ষ-বিপক্ষ আছে বলেই বিংশ শতকের সাহিত্য শক্তিশালী হয়েছে অন্য শতকগুলোর তুলনায়।

১৯৬০ সালের জানুয়ারিতে এক সড়ক দুর্ঘটনায় কামুর মৃত্যুর পর আরো ২০ বছর বেশি বেঁচে ছিলেন জঁ পল সার্ত্রে। মৃত্যুর পাঁচ বছর আগে পত্রিকার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সার্ত্রে জানিয়েছিলেন, সাহিত্যিকদের মধ্যে আলবেয়ার কামুই তাঁর সবচেয়ে সেরা ও সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিলেন।


উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ..

অন্ধকারে বসে থাকেন আমার বাবা - জেরোম ওয়াইডম্যান


অনুবাদ : মোজাফ্ফর হোসেন

আমার বাবার একটা আজব অভ্যাস আছে-- তিনি একাকী অন্ধকারে বসে থাকতে পছন্দ করেন।

প্রায়ই আমি বেশ রাত করে বাড়ি ফিরি। সমস্ত বাড়ি অন্ধকারের চাদরে মোড়ানো থাকে। আমি যতটা সম্ভব নিরবে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করি যাতে আমার মার অর্ধঘুমন্ত অবস্থার কোন ব্যঘাত না ঘটে। পা টিপে টিপে আমি আমার রুমের ভেতর যাই এবং অন্ধকারে পোষাক পরিবর্তন করি। অতঃপর একইভাবে পানি পান করার জন্য রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াই। ভেতরে ঢোকা মাত্রই বাবার সাথে ধাক্কা লাগার উপক্রম হয়। তিনি পায়জামা পরিহিত অবস্থায় রান্না ঘরের একটি চেয়ারে বসে আছেন। হাতের চুরুটটা তখনো জ্বলছে।


‘কেমন আছো বাবা?’

‘এই তো...!’

‘তুমি এখনো ঘুমুতে যাওনি কেন, বাবা?’

‘খুব শীঘ্রই যাবো।’-- তিনি বললেন।

কিন্তু তিনি যান না। আমার যতক্ষণ না ঘুম আসে আমি টের পাই, বাবা ঠায় বসে আছেন, জ্বলছে হাতের চুরুটটাও।

মাঝে মধ্যে আমি বইয়ের মধ্যে ঢুবে থাকি। মা ততক্ষণে ঘুমানোর জন্য ঘরটা প্রস্তুত করছেন। আমার ছোটবোনটা তার রুমের মধ্যে প্রবেশ করে। তার ঘুমানোর আগ পর্যন্ত চুল আচড়ানো থেকে শুরু করে এটা-ওটার শব্দ ভেসে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যে শুনতে পাই, মা বাবাকে ‘শুভরাত্রি’ বলে রাতের শেষ কথা সেরে নিচ্ছেন। আমি তখনও পড়তে থাকি। অল্পকিছুক্ষণের মধ্যেই আমার পানি পিপাসা পায়। স্বাভাবিকের তুলনায় আমি একটু বেশিই পানি পান করি। রান্নাঘরে পা দেওয়া মাত্রই বাবার সাথে আমার হোঁচট লেগে যায় প্রায়। বেশিরভাগ সময় আমি বেশ চমকে উঠি, বাবার কথা প্রায়ই ভুলে যাই। তিনি তেমনি করে চুরুট হাতে বসে থাকেন আর কি যেন ভাবেন।

‘তুমি এখনো শুতে যাওনি কেন, বাবা?’

‘এই তো গেলাম বলে।’

কিন্তু তিনি যান না। চুরুট হাতে সেখানেই বসে থাকেন আর কি যেন ভাবতে থাকেন। আমি বুঝে উঠতে পারি না কিছুই, বিষয়টা আমাকে বেশ পিড়া দেয়। একদিন আমি জিজ্ঞেস করেই বসলাম--

‘বাবা, তুমি সবসময় এতো কি ভাবো?’

‘কই, কিছু নাতো!’

একসময় আমি তার কাছ থেকে সরে আসলাম। কয়েক ঘন্টা পরে আবারো আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমি খুব তৃষ্ণার্ত ছিলাম ফলত পানি খাওয়ার উদ্দেশ্যে রান্নাঘরে গেলাম। তিনি তখনো বসে ছিলেন। তাঁর হাতের চুরুট শেষ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু তিনি বসে ছিলেন পূর্বের ন্যায় ঠায়, রান্নাঘরের দেয়ালের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে। খুব তাড়াতাড়ি আমি অন্ধকারের সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে পানি পান করলাম। তিনি বসে ছিলেন প্রশান্ত-পলকহীন। আমার মনে হল, আমার অবস্থান সম্পর্কে তিনি অবগত নন। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।

‘তুমি এখনো শুতে যাওনি কেন, বাবা?’

‘এক্ষুনি যাবো। তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করো না।’

‘কিন্তু,’ বললাম আমি, ‘তুমি সেই কখন থেকে বসে আছো! কি হয়েছে তোমার? কি নিয়ে ভাবছ এতো?’

‘ও কিছু না’, তিনি বললেন, ‘এমনিই, এই একটু বিশ্রাম নিচ্ছি আর কি!’

তাঁর বলার ভঙ্গিটা সব সহজ করে দিল। তাঁকে মোটেই চিন্তিত মনে হল না। তাঁর কন্ঠস্বর ছিল শীতল, অন্যসব সময়ের মতই। কিন্তু আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না-- অন্ধকারে একটি কাঠের চেয়ারে এভাবে একাকী বসে থাকার মধ্যে প্রশান্তির কি আছে? অন্য কি কারণ থাকতে পারে? আমি আর সব সম্ভাবনার কথা ভেবে দেখলাম। আমি নিশ্চিৎ, এটা টাকা-পয়সা জনিত কোন ব্যাপার না। আমাদের খুব বেশি টাকা নেই বটে তবে অর্থনৈতিক কোন সমস্যার কথা তিনি গোপন রাখেন না। সমস্যটা তাঁর স্বাস্থ্য নিয়েও নয়। তিনি স্বাস্থ্য নিয়ে বেশ উদাসীন। পরিবারের অন্যকারো স্বাস্থ্যও আলোচ্য সমস্যার কারণ হতে পারে না। আমাদের যথেষ্ট টাকা-পয়সা না থাকলেও স্বাস্থ্যের অবস্থা ঢ়ের ভালো। তাহলে কারণটা কি? -- আমি শত হাতড়েও পাই না। তবে তাতে আমার চিন্তা দমে যায় না মোটেও, বরং দ্বিগুন শক্তি সঞ্চয় করে ফিরে আসে আবার, বার বার।

হতে পারে তিনি তাঁর ভাইদের নিয়ে চিন্তা করেন। কিংবা তাঁর নিজের মা এবং তার দুই সৎ মা অথবা তাঁর বাবাকে নিয়ে ভাবতে থাকেন। কিন্তু তাই বা হয় কি করে! -- তাঁরা তো সবাই মৃত। তাছাড়া তিনি তাঁদের নিয়ে এভাবে ভাববেন না। তিনি যে আসলে দুশ্চিন্তা করেন তাও কিন্তু নয়, এমনকি তাঁকে দেখলে চিন্তিতও মনে হয় না। তাঁকে খুব প্রশান্ত মনে হয়। ঠিক তৃপ্ত না তবে খুব উৎকণ্ঠশূন্য। তাঁর ভাষায় -- শান্তিময়। কিন্তু তা কি করে সম্ভব, আমি বুঝে পাই না। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমি খুব চিন্নিত হয়ে পড়ি।

তিনি কেন অন্ধকারে ঐভাবে বসে থাকেন? তিনি কি খুব অন্যমনস্ক হয়ে উঠেছেন আজকাল? কিন্তু সবে তাঁর বয়স তেপান্ন, এবং তিনি আগের মতই সকল বিষয়ে উৎসাহি। আমার তো মনে হয় কোন দিক দিয়েই তাঁর কোন পরিবর্তন ঘটেনি। তিনি এখনও সুফ খেতে খুব পছন্দ করেন। এখনো তিনি দিনের শেষভাগে পড়তে বসেন। এখনো লম্বা কলার বিশিষ্ট শার্ট পরেন। মোদ্দাকথা, তাঁর কোন পরিবর্তনই ঘটেনি। এমনকি পাঁচ বছর আগে যেমন দেখাতো এখনও তেমনই দেখায়। ‘স্বাস্থ্যটাকে বেশ ধরে রেখেছেন তো!’ -- অনেকে প্রায়ই বলেন। কিন্তু কি আশ্চর্য, তিনি একাকী অন্ধকারে চুরুট হাতে ঠায় বসে থাকেন!

যদি তাঁর কথা ঠিক বলে ধরে নিই, আমার আর কিছুই বলার থাকে না। কিন্তু ধরো তিনি যা বলছেন সঠিক না। হতে পারে এটা এমন কিছু একটা যার আমি কোন কূল-কিনারা পাচ্ছি না। খুব সম্ভবত তাঁর কারও সহযোগিতার প্রয়োজন। কেনই বা তিনি কথা বলেন না, হাসেন না, কাঁদেন না? কেনই বা তিনি নিজেকে কোন কাজের মধ্যে ডুবিয়ে রাখেন না? এইভাবে বসে থাকার কোন মানে হয়?

শেষের দিকে আমার ধৈর্যচ্যুত ঘটলো। হতে পারে কোন সঠিক কারণ না খুঁজে পেয়ে আমি খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছিলাম। আমার ভেতরে একধরনের রাগ তৈরি হল।

‘কোন সমস্যা বাবা?’

‘কিছু না। এমনিতেই...।’

কিন্তু এইবার এই উত্তরে দমে যাওয়ার পাত্র আামি না, আমার রাগ এখন মাথায় চড়ে গিয়েছে।

‘তাহলে তুমি এখানে এভাবে একাকী এতো রাত পর্যন্ত বসে আছো কেন?’

‘খুব শান্তিময়! আমার বেশ ভালো লাগে, তাই।’

আমি বাড়িতেই আছি। কাল আবার তিনি এমনি করে বসে থাকবেন। আমি ঘাবড়ে যাব, চিন্নিত হব। না, আজ এর একটা বিহিত করতেই হবে।

‘আচ্ছা, তুমি কি নিয়ে এত ভাবো বলো তো? শুধু এই একই স্থানে বসো কেন? তোমার কিসের এত চিন্তা, সত্যি করে বলবে কি?’

‘কোন কিছুই আমার চিন্তার কারণ না। আমি সম্পূর্ণ ঠিক আছি। আমার বসে থাকতে ভালো লাগে, এটুকুই..। তুমি ঘুমুতে যাও।’

আমার রাগ দূর হয়ে যায়। তবে চিন্তার দাবানলে এখনো পুড়তে থাকি। একটা যৌক্তিক কারণ আমাকে খুঁজে পেতেই হবে। বিষয়টা খুব পাগলামো ঠেকছে। তিনি কেনইবা আমাকে কিছু বলছেন না? মনে হচ্ছে এর কোন কারণ না খুঁজে পেলে আমিই পাগল হয়ে যাবো। আমি আরও জোর দিয়ে বললাম--

‘কিন্তু তুমি কি নিয়ে ভাব, বাবা? বিষয়টি কি?”

‘ও কিছু না। টুকটাক এটা-ওটা নিয়ে। তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।’

আমি আমার উত্তর পাই না।

অনেক রাত হয়ে গেছে। রাস্তায় শূনশান নিরাবতা, অন্ধকারের কুন্ডুলি পাকিয়ে বসে আছে বাড়িটা। আমি সিঁড়ি বেয়ে শব্দহীন উঠে যাই। যেখানে পা পড়লে শব্দ হতে পারে আমি সেখানটা এড়িয়ে যায়। আমার চাবির সাহায্যে নিয়ে ভিতরে যাই এবং পা টিপেটিপে আমার রুমে প্রবেশ করি। পোষাক পাল্টে অনুভব করি, আমি তৃষ্ণার্ত। খালি পায়ে রান্নাঘরের দিকে যাই। আমি জানি, তিনি বসে আছেন। আমি অন্ধকারে তাঁর বাকানো শরীর স্পষ্ট দেখতে পাই। সেই একই চেয়ারে একইভাবে বসে আছেন -- হাটুতে কনুই চেপে, নিভন্ত চুরুট ঠোঁটে নিয়ে এবং পলকহীন দৃষ্টি সামনে নিযুক্ত রেখে। তাঁকে দেখে মনে হল না তিনি আমার অবস্থান টের পেয়েছেন। তিনি আমার আসার কোন শব্দ শুনতে পান নি। আমি দরজার গোড়াই শব্দহীন দাঁড়িয়ে থেকে তাঁকে পরখ করি। সবকিছুই শব্দহীন-আত্মনিবিষ্ট; কেবলই রাতের ফিসফাস শব্দ শোনা যায়। আমি ওখানে জড়বস্তুর ন্যায় দাঁড়িয়ে থেকে সেই শব্দ শুনতে পাই : কাটাওয়ালা ঘড়ির টিকটিক শব্দ, অনেকদূর থেকে একটা মোটরগাড়ির শব্দ ভেসে আসে, পিচের রাস্তায় বাতাসের কাগজকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে জাওয়ার শব্দ চাপা নিঃশ্বাসের মত ওঠে আর নামে। খুব অদ্ভূত সুখকর একটা অনুভূতি। আমার ঠোঁটের শুষ্কতায় টের পেয়ে যাই রান্না ঘরে প্রবেশ করার কারণ।

‘কি করছ বাবা?’

‘কিছু না।’-- তিনি বললেন। তাঁর কণ্ঠস্বর চাপা, স্বপ্নের ভেতর শোনার মত শোনালো।

তিনি বিন্দু মাত্র নড়লেন না, দৃষ্টি সেই আগের স্থানেই নিবিষ্ট রইল। জানালা দিয়ে হালকা আলোক-ছায়া রুমে এসে রুমটিকে আরো অন্ধকার করে তুলেছিল। আমি রুমের মাঝখানে গিয়ে সুইসে চাপ দিলাম। তিনি একটা ঝাঁকি দিয়ে সোজা হয়ে বসলেন, যেন তাঁকে আঘাত করা হয়েছে।

‘কি হয়েছে বাবা?’

‘কিছু না।’-- তিনি বললেন। ‘আমি আলো সহ্য করতে পারি না।’

‘আলোতে তোমার সমস্যা কি?’

‘কিছু না। আমি আলো পছন্দ করি না।’

আমি আলো বন্ধ করে দিলাম, সাবধানে পানি পান করালাম। আমাকে উত্তেজিত হলে চলবে না, নিজেকে নিজে বললাম। আমাকে বিষয়টির একেবারে তলানিতে প্রবেশ করতে হবে।

‘তুমি শুতে যাও না কেন? তুমি কেন এত রাত অব্দি অন্ধকারে এইখানে বসে থাকো?’

‘আমার ভালো লাগে।’-- তিনি বললেন। আমি আলোতে স্বাভাবিক হতে পারি না। আমি যখন য়্যুরোপে ছোট ছিলাম তখন আমাদের এই আলো ছিল না।’

আমার ভেতরটা হালকা করে কেঁপে উঠল এবং আমি প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আমার মনে হল, আমি বুঝতে শুরু করেছি। আমি অস্ট্রিয়াই তাঁর বাল্যকালের গল্পগুলো স্মরণ করলাম। আমি দেখতে পেলাম, বড় বড় বর্গা বিশিষ্ট বারে আমার দাদাভাই বসে আছেন। অনেক রাত হয়ে এসেছে। খদ্দেররা সব চলে গেছে। এবং দাদুভাই ঝিমুচ্ছেন। পোড়া কয়লার একটা স্তুপ দেখতে পেলাম, এখনো হালকা উত্তাপ ছড়াচ্ছে।

ইতোমধ্যে অন্ধকার গ্রাস করে ফেলেছে চারপাশ, এবং আরো অন্ধকার চতুর্দিক থেকে ধেয়ে আসছে। আমি ছোট্ট একটা বালককে দেখলাম, আগুনের পাশে একটা কাঠের মাস্তুলের ওপর গুড়িমুড়ি করে বসে আছে। তার উজ্জ্বল চোখ মৃত প্রায় আগুনের দিকে নিবিষ্ট।

এই বালকটিই আমার বাবা। আমি দরজার গোড়ায় নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে তাঁকে দেখে ঐ সুখকর মুহূর্তটির অনুভূতি টের পেলাম।

‘তুমি বলতে চায়ছো, কোন সমস্যা নেই? তুমি অন্ধকারে বসে থাকো কারণ তোমার ভালো লাগে, তাই না বাবা? আনন্দে আমার চিৎকার দিতে ইচ্ছে করলো।

‘হুম। তাই। আমি বাতি জ্বললে চিন্তা করতে পারি না।’

আমি গ্লাসটি রেখে রুমে চলে আসলাম।

‘শুভরাত্রি, বাবা!’-- আমি বললাম।

‘শুভরাত্রি!’-- বাবা বললেন।

তারপর আমার মনে পড়ে, আমি ঘুরে তাকালাম এবং জিজ্ঞেস করলাম--

‘তুমি কি চিন্তা করো, বাবা?’

তাঁর কন্ঠস্বর মনে হল বহুদূর থেকে ভেসে আসছে।

‘কিছু না’, তিনি খুব সহজভাবে বললেন, ‘তেমন বিশেষ কিছু না।’

এই গল্পটির কলকব্জা
মোজাফফর হোসেন
অন্ধকারে বসে থাকেন আমার বাবাজোরোম ওয়াইডম্যানের ‘অন্ধাকারে বসে থাকেন বাবা’ গল্পটি মূডনির্ভর গল্প। গল্পে বাবার অন্ধকারে বসে থাকা এবং এ নিয়ে ছেলের ভাবনা ছাড়া আর তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা নেই। বাবা কেন অন্ধকারে বসে থাকেন তার উপযুক্ত জবাবও এখানে মেলে না। আলো ভাল লাগে না তাই অন্ধকারে বসে থাকেন, বাবার এমন উত্তরে ছেলে যেমন পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারে না, তেমনি পারে না পাঠকও। এভাবে রাতের পর রাত অন্ধকারে বসে থাকার যথেষ্ঠ কারণ এটি নয়। তার মানে গল্পটি গল্পের ভেতরে কোথাও লুকানো আছে, কিংবা তোলা আছে গল্পের বাইরে কোথাও। পাঠককে তার সন্ধান চালাতে হবে। প্রথমে গল্পের মূডটি ধরতে হবে। আর গল্পের মূড ধরতে হলে গল্পের চরিত্র ও আবহটাকে বুঝতে হবে। আমরা দেখেছি, হেমিংওয়ের ‘অ্যা ওয়েল লাইটেড প্লেস’ গল্পে এক বৃদ্ধ পান করে ভোর রাত পর্যন্ত পানশালায় বসে থাকেন। বিত্তশালি মানুষ, তবুও ঘরে ফেরবার তাড়া তার নেই। বিশ^যুদ্ধোত্তর কালে যে লস্ট জেনারেশন তৈরি হয়েছিল, ঐ বৃদ্ধ তাদেরই একজন। বেঁচে থাকা এবং মৃত্যু -- দুটোই ছিল তার কাছে সমান অর্থহীন। শুরুতে এমন লস্ট জেনারেশনেরই একজন বলে মনে হয় আলোচ্য গল্পের বাবাকে। কিন্তু খানিক পরে জানা যায়, তিনি তা নন। তার স্ত্রী আছে, আছে মেয়ে ও ছেলে। পরিবারের স্বাস্থ্য ও অর্থ নিয়ে তার তেমন কোনো ভাবনা নেই। আপাতদৃষ্টিতে একটি সুখি পরিবারের মালিক তিনি। হেমিংওয়ের বৃদ্ধের মতো এমন হতাশাগ্রস্ত ও বিষাদগ্রস্ত তিনি নন। তার কাছে বেঁচে থাকার অর্থটা আছে; তবে তিনি বেঁচে থাকতে চান তার অতীত জীবনে। তিনি আলো বন্ধ করে সেই জীবনে চলে যান। তার ছেলেবেলায় বিদ্যুৎ ছিল না, বিধায় বৈদ্যুতিক বাতির উপস্থীতিতে তিনি সময়কে অতিক্রম করতে পারেন না। আলো তার কাছে একটা প্রতিকী অর্থ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি আলো অফ-অন করার মধ্য দিয়ে দুটি কাল বদল করেন। এটা গল্পের ভেতরের লুকানো বিষয়। আর গল্পের বাইরে তোলা বিষয় হল-- বৃদ্ধ পরবাস জীবনযাপন করছেন। তার আসল দেশ অস্ট্রিয়া। তিনি আমেরিকার অধিবাসী। আমেরিকাকে তিনি নিজের দেশ ভাবতে পারছেন না। আবার স্মৃতিতে আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে অস্ট্রিয়া। তিনি এখন অস্তিত্ব সংকটে ভুগছেন। অন্ধকারে বসে থেকে তিনি তার অস্তিত্বের শেষ অবলম্বন-স্বরূপ স্মৃতিটাকে আকড়ে রাখতে চাচ্ছেন।

লেখকের বায়োগ্রাফিক্যাল স্ট্যাডি থেকে যানা যায়-- গল্পের বাবাই গল্পকার জেরোমের বাস্তব-জীবনের বাবা। শিশুকালে বাবার হাত ধরে তিনি অস্ট্রিয়া ছেড়ে আমেরিকায় আসেন। কর্ম জুটিয়ে নেন পোশাকশিল্পে শ্রমিক হিসেবে। জীবন সায়াহ্নে এসে তিনি নস্টালজিক হয়ে পড়েছেন। বাবা যখন বলছেন তার আলো ভাল লাগে না তখন গল্পের ন্যারেটর তার বাবার সম্পর্কে পূর্বে শোনা গল্প থেকে উপলিব্ধ করে-- বাবা ছোট্ট শিশু হয়ে থিতু হয়ে আসা কাঠের আগুনের পাশে বসে আছেন। তখন বাবা মুখে কিছু ভাবছেন না বললেও তার ভাবনাকে ধরতে সমস্যা হয় না গল্পকথকের।

লেখক পরিচিতি
জেরোম ওয়াইডম্যান

১৯৫০ এবং ৬০’র দশকে বহুল পঠিত ছিলেন মার্কিন লেখক জেরোম ওয়াইডম্যান। তাঁর জন্ম ১৯১৩ সালে নিউ ইয়র্ক শহরে। মৃত্যু ১৯৯৮ সালে, একই শহরে। তিনি ছিলেন নাট্যকার ও কথাসাহিত্যিক। ২২টি উপন্যাস এবং ৭টি ছোটগল্পের সংকলন লিখেছেন। ১৯৬০ সালে তিনি নাটকের জন্য পুলিৎজার পুরস্কার পান। বাবার অধিবাসী হওয়ার বিষয়টি তাঁর লেখায় ঘুরেফিরে এসেছে। ওয়াইম্যান জন্মসূত্রে মার্কিন হলেও তাঁর বাবা ছিলেন অস্ট্রিয়ান।