আমি যা দেখি তুমি তা দেখো কি?
“আমি যা দেখি তুমি তা দেখো কি?” – ছোটবেলা আমরা সবাই হয়তো এই খেলাটা খেলেছি। অনেক সময় আমরা মেঘের মধ্যে খরগোশ-পুতুল-মানুষের মুখ খুঁজে পেতাম। আহ ছোটবেলা।

বড়বেলায় এসেও আমাদের অনেকেই সেই ভ্রম থেকে বের হতে পারেন না। বিস্কিট-ব্রেডে যিশুখ্রিস্ট থেকে শুরু করে, চাঁদ-মঙ্গলে মানুষের মুখাবয়ব হয়ে, হাবলের সুপারনোভা বিস্ফোরণের ছবিতে কোনো কোনো ধর্মের স্রষ্টার নাম দেখতে পাওয়া পর্যন্ত এই ভ্রম ছড়িয়ে আছে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এই বিশেষ ব্যাপারটিকে বলা হয় Pareidolia। উইকি মতে para (παρά, “পাশে, পাশাপাশি, পরিবর্তে”, ত্রুটিপূর্ণ বা ভুল কিছু অর্থ এই প্রেক্ষাপটে) এবং বিশেষ্য eidōlon (εἴδωλον, “চিত্র, গড়ন, আকৃতি” ) এই দুটি গ্রীক শব্দ থেকে প্যারেডোলিয়া শব্দটি এসেছে। বুঝতেই পারছেন প্যারেডোলিয়া মানে দাঁড়াচ্ছে- ত্রুটিপূর্ণ গড়ন বা আকৃতি।
কেন হয় প্যারেডোলিয়া
কারণে যাওয়ার আগে চলুন দেখে নিই কয়েকটি উদাহরণ।




মানুষের মস্তিস্কের একটা মারাত্মক ক্ষমতা হচ্ছে মুখাবয়ব চিনতে পারা, আমরা ছোটবেলা থেকেই চেহারা বা প্যাটার্ন চিনতে পারদর্শী। কার্ল সেগান মনে করতেন এর একটা বিবর্তনীয় ব্যাখা আছে, আর সেটা হচ্ছে-
“বাচ্চারা দেখা শুরু করার সাথে সাথে, আমরা দেখি, তারা চেহারা চিনতে পারে। আমরা এখন জানি যে এই ক্ষমতাটি মস্তিকে প্রোথিত আছে। মিলিয়ন বছর আগে যে বাচ্চারা তার চেহারা দেখে হাসতে পারতো না তারা হয়তো কম স্নেহ পেত, আর তাদের এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম হতো হয়তো। এখনকার সময়ে সব বাচ্চাই চেহারা বুঝতে পারে, আর একটা হাসি দিয়ে প্রতিউত্তর দেয়”। (সূত্র- The Demon-Haunted World – Science as a Candle in the Dark (New York: Random House, 1995)
উনি আরো ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, প্যাটার্ন চিনতে পারার ক্ষমতা প্রজাতি হিসেবে টিকে থাকার জন্যেও দরকার ছিলো। নক্ষত্রের অবস্থান বছরের বিশেষ একটি সময় বা ঋতুকে নির্দেশ করতো। এবং ঐ সময়ে শিকার করার পশু পাওয়া যেত, বা ফল পাকার সময় আসতো। তাই, রাতের আকাশে নক্ষত্র চেনার জন্য এবং মনে রাখার জন্য সেগুলোর মধ্যে আকৃতি খোঁজারও চেষ্টা করেছি হাজার হাজার বছর ধরে।
চেহারা আর প্যাটার্ন চিনতে পারাটা যদিও একটা লাভজনক বৈশিষ্ট্য, এর অপকারিতাও নেহায়েত কম না। নীল টাইসন খুব সুন্দর করে বলেন, “আমরা আকৃতি খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে এতটাই দক্ষ যে আসলে আমরা অদক্ষ হয়ে গেছি। যা যেখানে নেই, সেটাকেও সেখানে দেখে ফেলছি।” একটা সময় হয়তো এই ক্ষমতা আমাদের পূর্বপুরুষদের জন্য সুফল বয়ে এনেছিল, শিকার আর শিকারীর ব্যাপারে সাবধানতা আনতে, এখন এই ব্যাপারটা অনেকগুলা প্রভাবক দিয়ে প্রভাবিত হয় বলে তথ্যউপাত্ত আছে। আমাদের শ্রদ্ধা, কামনা, ঘোর, আকাঙ্ক্ষা প্যারেডোলিয়ার ক্ষেত্রে, এসব চিত্র গঠনের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। মনস্তত্ববিদেরা মস্তিস্কের এই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে মানুষের মানসিকতার বিশ্লেষণ করেন পরীক্ষার মাধ্যমে।

এ সংক্রান্ত আলোচনায় এক ব্যক্তিকে একবার টোস্টে যিশুর ছবি দেখানো হলে সে দেখতে পায় না, কারণ এই ছবিটির সাথে তার পরিচয় কম। কিন্তু সেই একই লোক হাবলের তোলা সুপারনোভার ছবিতে নিজের স্রস্টার নামের অবয়ব খুঁজে পেয়েছিল, যেখানে এই অবয়বের সাথে অপরিচিত একজন লোক দেখছিলেন ডাইনোসরের মাথা!
কার্ল সেগান, এক সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নের সম্মুখীন হন; প্রশ্নকর্তা জানতে চান মঙ্গলের পৃষ্ঠে মানুষের মুখের অবয়বের একটি পাহাড়ের কথা।
সেগান উত্তরে বলেন- “মঙ্গল গ্রহে একটা জায়গা আছে সিডোনিয়া নামে, ভাইকিং ১৯৭৬ এর মিশনে এই জায়গাটির অনেক ছবি তোলা হয়, এই মিশনের সাথে আমি যুক্ত ছিলাম। একটা ছবিতে পাহাড় পর্বত মিলে এমন একটা জায়গা তৈরি করেছে যেটা দেখতে অবিকল একটা মানুষের চেহারার মতো মনে হয়, তিন কিলোমিটারের মতো প্রস্থ আর এক কিলোমিটার উচ্চতার একটা জায়গা। এটা মঙ্গল পৃষ্ঠে শুয়ে আছে, আর আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, এটার মাথায় একটা হেলমেটের মত কিছু দেখা যাচ্ছে, এর একটা চোখ আছে আরেকটা চোখ ছায়ায়, একটা নাকও আছে। আপনার মনে হবে এটা কৃত্রিমভাবে বানানো। আর রিচার্ড হ্যোগল্যান্ড এই ছবি দেখে বলেন মঙ্গলে পুরোনো একটা এলিয়েন জাতি ছিল। তিনি তাঁদের একটা সময়কালও ধরে দেন, ৫০০,০০০ বছর আগে বা এর কাছাকাছি। ঐ সময়ে তো আমাদের পূর্বপুরুষরা মহাকাশ ভ্রমণে যেতে পারতেন না সেটা মোটামুটি নিশ্চিত, কিন্তু এটা থেকেই অনেকে অনেক ধরনের কল্পকাহিনী বানানো শুরু করেন। “আমরা মঙ্গল থেকে এসেছি” আর “অন্য একটা নক্ষত্র থেকে এলিয়েনরা এসে মঙ্গলে এই মূর্তি বানিয়েছিল আর আমাদের পৃথিবীতে রেখে গেছে”। তবে এদের কেউই বলতে পারেন না কেনো আমাদের সাথে শিম্পাঞ্জীর সক্রিয় জিনের ৯৯.৬ ভাগ একই রকম। আমাদের যদি এখানে রেখেই যাওয়া হয়, তবে আমাদের সাথে শিম্পাঞ্জীদের এতো মিল কেনো? তাদের এই অবস্থানের ভিত্তি কী? সেই ভিত্তি কত মজবুত? আমি সাধারণত এসব তর্কের ক্ষেত্রে একটা ঘটনার কথা বলি। সাবেক রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনের চেহারা সম্বলিত একটি বেগুনের গল্প। বেগুনটির একটি খাড়া নাকের মত অংশ আছে- আর রিচার্ড নিক্সনকে এই বেগুনে দেখার মত মানুষের কোনো অভাব নেই। এই ঘটনা থেকে আমরা কী বুঝবো? এলিয়েনরা আমাদের বেগুন নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছে? নাকি এটা কোনো অলৌকিক ঘটনা? নাকি ঈশ্বর বেগুনের মাঝে করে আমাদের সাথে যোগাযোগ করছেন? অথবা, ইতিহাসে হয়তো হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ বেগুন ছিল যেগুলো দেখতে সাধারণ বেগুনের মতো ছিলো না, আর এই বড় সংখ্যার বেগুনের মাঝে ২/১টা বেগুন দেখে আমাদের মানুষের চেহারার মতো মনে হতেই পারে। আমরা মানুষরা চেহারা বুঝতে পারদর্শী। আমার মনে হয় পরের কারণটা যৌক্তিক। এবার মঙ্গলের চেহারাটা দেখা যাক…হাজার লক্ষ পাহাড় আর টিলার হাজার লক্ষ রকম বৈশিষ্ট্য আছে। আমরা এমন একটা দেখলাম যেটা মানুষের চেহারার মতো দেখতে। ছবির আলোকপাতের পরিবর্তন করলে দেখা যায় এটাকে আর চেহারা মনে হয় না। আবারো বলি, আমরা চেহারা চিনতে পারদর্শী। হাজার লক্ষ পাহাড়ের মাঝে একটা পাহাড় দেখতে মানুষের চেহারার মতো, এটা কি এলিয়েনদের অস্তিত্বের নিশ্চিত প্রমাণ? আমার মনে হয় না। আমি সেই লোকদের দোষ দিচ্ছি না যারা নাসার আর্কাইভ থেকে এসব ছবি খুঁজে বেড়ান, এটা বৈজ্ঞানিক মনোভাব। আমি তাদেরও দোষ দিচ্ছি না যারা এলিয়েনদের বা তাদের চিহ্ন খুঁজছেন, আমার মনে হয় এটা ভালো বুদ্ধি। কিন্তু আমার সমস্যা তাদের ক্ষেত্রে যারা অতিরঞ্জিত আর অপ্রতুল প্রমাণকে নিশ্চিত প্রমাণ বলে প্রচার করেন”।
সাক্ষাৎকারটা ১৯৯৬ সালের। পরে নাসা মঙ্গলের আরো ছবি প্রকাশ করেছে, আর স্বভাবতই মানুষ সেখানে খুঁজে পেয়েছে নারী, কুকুর, ষাঁড়, বৌদ্ধের প্রতিমা আরো নানান কিছু। সবাই কেনো ধরে নিচ্ছে মঙ্গলে যদি কোনো প্রাণী থেকেই থাকে সেগুলো আমাদের পরিচিত প্রাণী বা জিনিসের মতোই হবে দেখতে? কেনো কেউ ভাবছে না অপরিচিত স্থানে পরিচিত কিছুর অবয়ব খুঁজে পাওয়া হয়তো দর্শকের ভুল? বা সেই ভুল থেকে মানুষ গড়ে তুলছে আশ্চর্য উপসংহার, মেনে নিচ্ছে অনস্তিত্বশীল জিনিসের অস্তিত্ব।
সুপারনোভার মত এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ, যার চাপ ও তাপে আমাদের মহাবিশ্বের সকল ভারী মৌলের জন্ম, যে বিস্ফোরণে আশেপাশের গ্রহ, সৌরজগত ছিন্ন বিচ্ছিন হয়ে যায়, সেখানে মানুষ খুঁজে নিচ্ছে পরম করুণাময়, পরম দয়ালু ঈশ্বরের নামের অস্তিত্ব? এই দ্বিমুখিতা কারো কাছে সন্দেহজনক মনে হয় না কেনো?
উৎস ঃ https://bigganjatra.org/pareidolia/
0 comments:
Post a Comment