Monday, May 21, 2018

আমি যা দেখি তুমি তা দেখো কি?


“আমি যা দেখি তুমি তা দেখো কি?” – ছোটবেলা আমরা সবাই হয়তো এই খেলাটা খেলেছি। অনেক সময় আমরা মেঘের মধ্যে খরগোশ-পুতুল-মানুষের মুখ খুঁজে পেতাম। আহ ছোটবেলা।

cloud_formation4

বড়বেলায় এসেও আমাদের অনেকেই সেই ভ্রম থেকে বের হতে পারেন না। বিস্কিট-ব্রেডে যিশুখ্রিস্ট থেকে শুরু করে, চাঁদ-মঙ্গলে মানুষের মুখাবয়ব হয়ে, হাবলের সুপারনোভা বিস্ফোরণের ছবিতে কোনো কোনো ধর্মের স্রষ্টার নাম দেখতে পাওয়া পর্যন্ত এই ভ্রম ছড়িয়ে আছে। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এই বিশেষ ব্যাপারটিকে বলা হয় Pareidolia। উইকি মতে  para (παρά, “পাশে, পাশাপাশি, পরিবর্তে”, ত্রুটিপূর্ণ বা ভুল কিছু অর্থ এই প্রেক্ষাপটে) এবং বিশেষ্য eidōlon (εἴδωλον, “চিত্র, গড়ন, আকৃতি” ) এই দুটি গ্রীক শব্দ থেকে প্যারেডোলিয়া শব্দটি এসেছে। বুঝতেই পারছেন প্যারেডোলিয়া মানে দাঁড়াচ্ছে- ত্রুটিপূর্ণ গড়ন বা আকৃতি।

কেন হয় প্যারেডোলিয়া


কারণে যাওয়ার আগে চলুন দেখে নিই কয়েকটি উদাহরণ।

Hand-of-God

Staclevenish

980x

obama_toast

মানুষের মস্তিস্কের একটা মারাত্মক ক্ষমতা হচ্ছে মুখাবয়ব চিনতে পারা, আমরা ছোটবেলা থেকেই চেহারা বা প্যাটার্ন চিনতে পারদর্শী। কার্ল সেগান মনে করতেন এর একটা বিবর্তনীয় ব্যাখা আছে, আর সেটা হচ্ছে-
“বাচ্চারা দেখা শুরু করার সাথে সাথে, আমরা দেখি, তারা চেহারা চিনতে পারে। আমরা এখন জানি যে এই ক্ষমতাটি মস্তিকে প্রোথিত আছে। মিলিয়ন বছর আগে যে বাচ্চারা তার চেহারা দেখে হাসতে পারতো না তারা হয়তো কম স্নেহ পেত, আর তাদের এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা কম হতো হয়তো। এখনকার সময়ে সব বাচ্চাই চেহারা বুঝতে পারে, আর একটা হাসি দিয়ে প্রতিউত্তর দেয়”। (সূত্র- The Demon-Haunted World – Science as a Candle in the Dark (New York: Random House, 1995)

উনি আরো ব্যাখ্যা করেছিলেন যে, প্যাটার্ন চিনতে পারার ক্ষমতা প্রজাতি হিসেবে টিকে থাকার জন্যেও দরকার ছিলো। নক্ষত্রের অবস্থান বছরের বিশেষ একটি সময় বা ঋতুকে নির্দেশ করতো। এবং ঐ সময়ে শিকার করার পশু পাওয়া যেত, বা ফল পাকার সময় আসতো। তাই, রাতের আকাশে নক্ষত্র চেনার জন্য এবং মনে রাখার জন্য সেগুলোর মধ্যে আকৃতি খোঁজারও চেষ্টা করেছি হাজার হাজার বছর ধরে।

চেহারা আর প্যাটার্ন চিনতে পারাটা যদিও একটা লাভজনক বৈশিষ্ট্য, এর অপকারিতাও নেহায়েত কম না। নীল টাইসন খুব সুন্দর করে বলেন, “আমরা আকৃতি খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে এতটাই দক্ষ যে আসলে আমরা অদক্ষ হয়ে গেছি। যা যেখানে নেই, সেটাকেও সেখানে দেখে ফেলছি।” একটা সময় হয়তো এই ক্ষমতা আমাদের পূর্বপুরুষদের জন্য সুফল বয়ে এনেছিল, শিকার আর শিকারীর ব্যাপারে সাবধানতা আনতে, এখন এই ব্যাপারটা অনেকগুলা প্রভাবক দিয়ে প্রভাবিত হয় বলে তথ্যউপাত্ত আছে। আমাদের শ্রদ্ধা, কামনা, ঘোর, আকাঙ্ক্ষা প্যারেডোলিয়ার ক্ষেত্রে, এসব চিত্র গঠনের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখে। মনস্তত্ববিদেরা মস্তিস্কের এই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে মানুষের মানসিকতার বিশ্লেষণ করেন  পরীক্ষার মাধ্যমে।

6a00d834515f9b69e201a3fd05c735970b-800wi

এ সংক্রান্ত আলোচনায় এক ব্যক্তিকে একবার টোস্টে যিশুর ছবি দেখানো হলে সে দেখতে পায় না, কারণ এই ছবিটির সাথে তার পরিচয় কম। কিন্তু সেই একই লোক হাবলের তোলা সুপারনোভার ছবিতে নিজের স্রস্টার নামের অবয়ব খুঁজে পেয়েছিল, যেখানে এই অবয়বের সাথে অপরিচিত একজন লোক দেখছিলেন ডাইনোসরের মাথা!

কার্ল সেগান, এক সাক্ষাৎকারে এক প্রশ্নের সম্মুখীন হন; প্রশ্নকর্তা জানতে চান মঙ্গলের পৃষ্ঠে মানুষের মুখের অবয়বের একটি পাহাড়ের কথা।
সেগান উত্তরে বলেন- “মঙ্গল গ্রহে একটা জায়গা আছে সিডোনিয়া নামে, ভাইকিং ১৯৭৬ এর মিশনে এই জায়গাটির অনেক ছবি তোলা হয়, এই মিশনের সাথে আমি যুক্ত ছিলাম। একটা ছবিতে পাহাড় পর্বত মিলে এমন একটা জায়গা তৈরি করেছে যেটা দেখতে অবিকল একটা মানুষের চেহারার মতো মনে হয়, তিন কিলোমিটারের মতো প্রস্থ আর এক কিলোমিটার উচ্চতার একটা জায়গা। এটা মঙ্গল পৃষ্ঠে শুয়ে আছে, আর আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, এটার মাথায় একটা হেলমেটের মত কিছু দেখা যাচ্ছে, এর একটা চোখ আছে আরেকটা চোখ ছায়ায়, একটা নাকও আছে। আপনার মনে হবে এটা কৃত্রিমভাবে বানানো। আর রিচার্ড হ্যোগল্যান্ড এই ছবি দেখে বলেন মঙ্গলে পুরোনো একটা এলিয়েন জাতি ছিল। তিনি তাঁদের একটা সময়কালও ধরে দেন, ৫০০,০০০ বছর আগে বা এর কাছাকাছি। ঐ সময়ে তো আমাদের পূর্বপুরুষরা মহাকাশ ভ্রমণে যেতে পারতেন না সেটা মোটামুটি নিশ্চিত, কিন্তু এটা থেকেই অনেকে অনেক ধরনের কল্পকাহিনী বানানো শুরু করেন। “আমরা মঙ্গল থেকে এসেছি” আর “অন্য একটা নক্ষত্র থেকে এলিয়েনরা এসে মঙ্গলে এই মূর্তি বানিয়েছিল আর আমাদের পৃথিবীতে রেখে গেছে”। তবে এদের কেউই বলতে পারেন না কেনো আমাদের সাথে শিম্পাঞ্জীর সক্রিয় জিনের ৯৯.৬ ভাগ একই রকম। আমাদের যদি এখানে রেখেই যাওয়া হয়, তবে আমাদের সাথে শিম্পাঞ্জীদের এতো মিল কেনো? তাদের এই অবস্থানের ভিত্তি কী? সেই ভিত্তি কত মজবুত? আমি সাধারণত এসব তর্কের ক্ষেত্রে একটা ঘটনার কথা বলি। সাবেক রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনের চেহারা সম্বলিত একটি বেগুনের গল্প। বেগুনটির একটি খাড়া নাকের মত অংশ আছে- আর রিচার্ড নিক্সনকে এই বেগুনে দেখার মত মানুষের কোনো অভাব নেই। এই ঘটনা থেকে আমরা কী বুঝবো? এলিয়েনরা আমাদের বেগুন নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছে? নাকি এটা কোনো অলৌকিক ঘটনা? নাকি ঈশ্বর বেগুনের মাঝে করে আমাদের সাথে যোগাযোগ করছেন? অথবা, ইতিহাসে হয়তো হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ বেগুন ছিল যেগুলো দেখতে সাধারণ বেগুনের মতো ছিলো না, আর এই বড় সংখ্যার বেগুনের মাঝে ২/১টা বেগুন দেখে আমাদের মানুষের চেহারার মতো মনে হতেই পারে। আমরা মানুষরা চেহারা বুঝতে পারদর্শী। আমার মনে হয় পরের কারণটা যৌক্তিক। এবার মঙ্গলের চেহারাটা দেখা যাক…হাজার লক্ষ পাহাড় আর টিলার হাজার লক্ষ রকম বৈশিষ্ট্য আছে। আমরা এমন একটা দেখলাম যেটা মানুষের চেহারার মতো দেখতে। ছবির আলোকপাতের পরিবর্তন করলে দেখা যায় এটাকে আর চেহারা মনে হয় না। আবারো বলি, আমরা চেহারা চিনতে পারদর্শী। হাজার লক্ষ পাহাড়ের মাঝে একটা পাহাড় দেখতে মানুষের চেহারার মতো, এটা কি এলিয়েনদের অস্তিত্বের নিশ্চিত প্রমাণ? আমার মনে হয় না। আমি সেই লোকদের দোষ দিচ্ছি না যারা নাসার আর্কাইভ থেকে এসব ছবি খুঁজে বেড়ান, এটা বৈজ্ঞানিক মনোভাব। আমি তাদেরও দোষ দিচ্ছি না যারা এলিয়েনদের বা তাদের চিহ্ন খুঁজছেন, আমার মনে হয় এটা ভালো বুদ্ধি। কিন্তু আমার সমস্যা তাদের ক্ষেত্রে যারা অতিরঞ্জিত আর অপ্রতুল প্রমাণকে নিশ্চিত প্রমাণ বলে প্রচার করেন”।

980x-1

সাক্ষাৎকারটা ১৯৯৬ সালের। পরে নাসা মঙ্গলের আরো ছবি প্রকাশ করেছে, আর স্বভাবতই মানুষ সেখানে খুঁজে পেয়েছে নারী, কুকুর, ষাঁড়, বৌদ্ধের প্রতিমা আরো নানান কিছু। সবাই কেনো ধরে নিচ্ছে মঙ্গলে যদি কোনো প্রাণী থেকেই থাকে সেগুলো আমাদের পরিচিত প্রাণী বা জিনিসের মতোই হবে দেখতে? কেনো কেউ ভাবছে না অপরিচিত স্থানে পরিচিত কিছুর অবয়ব খুঁজে পাওয়া হয়তো দর্শকের ভুল? বা সেই ভুল থেকে মানুষ গড়ে তুলছে আশ্চর্য উপসংহার, মেনে নিচ্ছে অনস্তিত্বশীল জিনিসের অস্তিত্ব।

image_4049e-DEM-L316A

সুপারনোভার মত এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ, যার চাপ ও তাপে আমাদের মহাবিশ্বের সকল ভারী মৌলের জন্ম, যে বিস্ফোরণে আশেপাশের গ্রহ, সৌরজগত ছিন্ন বিচ্ছিন হয়ে যায়, সেখানে মানুষ খুঁজে নিচ্ছে পরম করুণাময়, পরম দয়ালু ঈশ্বরের নামের অস্তিত্ব? এই দ্বিমুখিতা কারো কাছে সন্দেহজনক মনে হয় না কেনো?

 

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/pareidolia/

Wednesday, May 2, 2018

দ্যা লিটল ম্যাচ গার্ল – Hans Christian Anderson এর ছোটো গল্প


বছরের শেষ সন্ধ্যাটা ছিলো তুষারাবৃত, ভীষণ ঠাণ্ডা আর বেশ খানিকটা অন্ধকার। একটি ছোট দরিদ্র মেয়ে সেই অন্ধকার আর ঠাণ্ডায় একাকী রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো। তার মাথা ঢাকা ছিলো না, পাও খালি ছিলো। বাড়ি থেকে বের হবার সময় তার পায়ে চটি ছিলো। কিন্তু তাতে লাভের লাভ কিছু হয়নি। কারণ, চটি জোড়ার সাইজ ছিলো বেশ বেঢপ বড়; দীর্ঘকাল যাবত এটা তার মা ব্যবহার করেছে। আর হ্যাঁ, রাস্তায় দুটি ঘোড়ার গাড়ি ভয়ানক গতিতে ছুটাছুটি করছিলো। তখন রাস্তা দিয়ে এলোপাতাড়ি দৌড়াতে গিয়ে মেয়েটি তার চটি হারিয়ে ফেলেছে।

চটির এক পাটি কোথাও খুঁজে পেল না মেয়েটা। দেখতে পেলো, অন্য পাটি রাস্তার একটা ছেলের হাতে। ছেলেটি চটি নিয়ে পালিয়ে গেল, যেমনটি ছেলেবেলায় সবাই করে থাকে। নিরুপায় হয়ে ছোট্টো কুমারী মেয়েটি খালি পায়েই হাঁটতে লাগলো। ছোট ছোট পা! ঠাণ্ডায় তার পা রক্তবর্ণ হয়ে গেলো, নীলচে হয়ে গেলো!

তার পুরোনো এপ্রনের মধ্যে কিছু দিয়াশলাই ছিলো, হাতে ছিলো আরেক বান্ডিল। সারাদিনে কেউ একটাও কিনলো না ওর কাছ থেকে। তাই সেদিন সে চারআনা পয়সাও রোজগার করতে পারেনি। ঠাণ্ডা আর ক্ষুধায় বেচারী হামাগুড়ি দিয়ে কাঁপছিলো। দৃশ্যটা দেখতে কী যে খারাপ লাগে!

তার কাঁধের উপর কোঁকড়ানো চুলে তুষারের স্তর জমা হতে লাগলো। কিন্তু সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। তার লক্ষ্য রাস্তার পাশের বাড়িগুলোর জানালা থেকে আসা উজ্জ্বল মোমবাতির আলো আর রান্না করা সুস্বাদু রাজহাঁসের রোস্টের গন্ধের প্রতি।

মেয়েটি দুটি বাড়ির মাঝে দেয়ালের পাশে হাত পা কাছে টেনে জড়সড় হয়ে বসে পড়লো। কিন্তু তার ঠাণ্ডা যেন আরো বেড়ে গেলো।  বাড়ি ফিরে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না ওর! কেননা দিয়াশলাই বেচে কোনো রোজগার হয়নি আজ, তাই বাড়ি গেলে নির্ঘাত বাবার হাতে মার খাবে। তাছাড়া সেখানে ঠাণ্ডাও বেশি। বাড়িতে শুধু একটি ছাদ ছিলো। খড় আর পুরানো জামা দিয়ে আটকানো বেড়ার বড় ছিদ্র দিয়ে হুহু করে বাতাস ঢোকে।

তার ছোট হাত দুটি ঠাণ্ডায় প্রায় জমে গেলো। দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালালে কিন্তু নিজেকে গরম রাখতে পারে।

সে একটি কাঠি নিল।

ফুসসসস! বাহ! সুন্দর জ্বলে উঠলো। কাঠিটি পুড়ছে। এটি মোমবাতির মতই উজ্জ্বল শিখায় জ্বলছে। মেয়েটি তার হাত আগুনের উপর রাখলো। বেশ দারুণ আলো! সে ভাবতে লাগলো, পিতলের মুকুট লাগানো আর পিতলে মোড়া পা-দানি দেওয়া লোহার উনুনের পাশে সে বসে আছে। আলোটা যেন তাকে উষ্ণ রাখতেই জ্বলছে। যেই না সে পা গরম করতে উনুনের কাছে গেল, অমনি কাঠি নিভে গেল। সাথে সাথে তার গরম  লোহার চুলার স্বপ্নও ভেঙে গেল। হাতে পরে রইল পোড়া দিয়াশলাইয়ের কাঠি।

আরেকটা কাঠি ঘষা দিল সে। জ্বলে উঠল এটি। আবারো সে ভাবতে লাগল। দেয়ালের যেখানে আলো পড়েছে সেখান থেকে যেন একটা যবনিকা সরে যাচ্ছে। দেয়ালটা স্বচ্ছ হয়ে পড়লো। তার ভিতর দিয়ে মেয়েটি ঘরের দৃশ্য দেখছিল। একটি টেবিল। টেবিলের উপরে তুষারশুভ্র টেবিলক্লথ ছড়ানো। টেবিলে জমকালো চিনামাটির পাত্র রাখা। পাত্রের ভিতর থেকে আপেল আর শুকনো বড়ই মেসানো রাজহাঁসের রোস্ট গরম বাষ্প ছড়াচ্ছে। এবার সে দেখলো, হাঁসের রোস্ট যেন একপায়ে লাফ দিয়ে মেঝেতে পড়ে গেল। রোস্টের বুকে কাঁটা চামচ আর ছুরি ঢুকানো। সেটি গড়িয়ে গড়িয়ে তার কাছে আসতেই দিয়াশলাইয়ের কাঠি নিভে গেল। পরে রইল শুধু ভিজে মোটা দেওয়াল।

সে আবার একটি কাঠি জ্বালাল। এবার সে নিজেকে আবিষ্কার করল জাঁকালো বিশাল খ্রিস্টমাস গাছের নিচে, যা দোকানে বিক্রি করতে রাখা গাছের চেয়েও বেশি সাজানো। গাছটির সবুজ শাখায় হাজার হাজার আলো জ্বলছে, আর ঝুলানো আছে রংবেরঙের ছবি। এমন ছবি সে দোকানের জানলা দিয়ে দেখেছে। ছবিগুলো তার দিকে তাকিয়ে ছিলো। যেই না সে ছবিগুলো ছুঁতে যাবে, অমনি কাঠি নিভে গেলো। খ্রিস্টমাস গাছের আলোগুলো যেন অনেক উপরে উঠে স্বর্গের তারা হয়ে গেলো।

একটি তারা আলো ছড়াতে ছড়াতে খসে পড়লো।

“কেউ একজন মারা গেছে” মেয়েটি বললো।

তার বৃদ্ধা ঠাকুরমা তাকে বলেছিল যে, একটি আত্মা যখন ঈশ্বরের কাছে যায়, তখন একটি তারা খসে পড়ে।

ঠাকুরমা তাকে খুব ভালবাসতো, কিন্তু তিনি আর নেই।

সে আবার আরেকটি কাঠি জ্বালালো। আবার আলো। সেই আলোর মাঝে ভেসে আছেন উজ্জ্বল দ্যুতিময় বৃদ্ধা ঠাকুরমা। তার চোখে মুখে সেই আগেকার ভালবাসা।

“ঠাকুরমা” ডুকরে কেঁদে উঠলো সে।

“আমাকে তোমার সাথে নিয়ে চলো। কাঠি পুড়ে শেষ হতেই তুমি চলে যাও! উনুনের মত, রোস্টের মত আর বিশাল খ্রিস্টমাস গাছের মত তুমি অদৃশ্য হয়ে যাবে!” সে বলল ঠাকুরমাকে।

ঠাকুরমাকে কাছে রাখতে তাই সে তার হাতের দিয়াশলাই বান্ডিলের সব কাঠি ঘষে জ্বালালো। দিনের আলোর চেয়েও বেশি আলো ছড়িয়ে পড়লো চারদিকে। ঠাকুরমাকে খুব সুন্দর আর অনেক লম্বা লাগছিল। আগে কখনো তাকে এত সুন্দর দেখায়নি। ঠাকুরমা মেয়েটিকে তার কোলে নিলেন। দুজনে আলোয় ভেসে অনেক উপরে চলে গেলেন, অনেক উপরে। যেখানে কোনো ঠাণ্ডা নেই, নেই ক্ষুধা আর যন্ত্রণা। শুধু ঈশ্বর ছিলেন তাদের সাথে।

………………………………

সকাল হয়ে গেলো। ঠাণ্ডা সকাল। মেয়েটি সেখানেই পড়ে আছে। স্বচ্ছ দেওয়াল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত অবলোকন করা মেয়ে সে। তার ঠাণ্ডা গোলাপি গালে হাসি ফুটে আছে।

অসাড় নিথর মেয়েটি দিয়াশলাই নিয়ে পড়ে আছে। এক বান্ডিল দিয়াশলাই পোড়া। লোকে মনে করলো, দিয়াশলাই দিয়ে সে নিজেকে গরম রাখতে চেয়েছিলো। কিন্তু কেউই বিন্দুমাত্র ধারণা করতে পারলো না কী মজার জিনিস সে দেখেছে।

কেমন মজায় সে আর ঠাকুরমা নতুন বছর পালন করেছে!

উৎস ঃ http://onubadokderadda.com/the_little_match_girl/

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর ভালবাসার গল্প ; মহামায়া



Robindronath

প্রথম পরিচ্ছেদ



মহামায়া এবং রাজীবলোচন উভয়ে নদীর ধারে একটা ভাঙা মন্দিরে সাক্ষাৎ করিল।

মহামায়া কোনো কথা না বলিয়া তাহার স্বাভাবিক গম্ভীর দৃষ্টি ঈষৎ ভর্ৎসনার ভাবে রাজীবের প্রতি নিক্ষেপ করিল। তাহার মর্ম এই, তুমি কী সাহসে আজ অসময়ে আমাকে এখানে আহ্বান করিয়া আনিয়াছ। আমি এ পর্যন্ত তোমার সকল কথা শুনিয়া আসিতেছি বলিয়াই তোমার এতদূর স্পর্ধা বাড়িয়া উঠিয়াছে?

রাজীব একে মহামায়াকে বরাবর ঈষৎ ভয় করিয়া চলে, তাহাতে এই দৃষ্টিপাতে তাহাকে ভারি বিচলিত করিয়া দিল-- দুটো কথা গুছাইয়া বলিবে মনে করিয়াছিল, সে আশায় তৎক্ষণাৎ জলাঞ্জলি দিতে হইল। অথচ অবিলম্বে এই মিলনের একটা-কোনো-কিছু কারণ না দেখাইলেও চলে না, তাই দ্রুত বলিয়া ফেলিল, 'আমি প্রস্তাব করিতেছি, এখানে হইতে পালাইয়া গিয়া আমরা দুজনে বিবাহ করি।' রাজীবের যে-কথাটা বলিবার উদ্দেশ্য ছিল সে-কথাটা ঠিক বলা হইল বটে, কিন্তু যে-ভূমিকাটি মনে মনে স্থির করিয়া আসিয়াছিল তাহার কিছুই হইল না। কথাটা নিতান্ত নীরস নিরলংকার, এমন-কি, অদ্ভুত শুনিতে হইল। নিজে বলিয়া নিজে থতমত খাইয়া গেল-- আরো দুটো-পাঁচটা কথা জুড়িয়া ওটাকে যে বেশ-একটু নরম করিয়া আনিবে, তাহার সামর্থ্য রহিল না। ভাঙা মন্দিরে নদীর ধারে এই মধ্যাহ্নকালে মহামায়াকে ডাকিয়া আনিয়া নির্বোধ লোকটা সুদ্ধ কেবল বলিল, 'চলো, আমরা বিবাহ করিগে!'

মহামায়া কুলীনের ঘরের কুমারী। বয়স চব্বিশ বৎসর। যেমন পরিপূর্ণ বয়স, তেমনি পরিপূর্ণ সৌন্দর্য। যেন শরৎকালের রৌদ্রের মতো কাঁচাসোনার প্রতিমা-- সেই রৌদ্রের মতোই দীপ্ত এবং নীরব, এবং তাহার দৃষ্টি দিবালোকের ন্যায় উন্মুক্ত এবং নির্ভীক।

তাহার বাপ নাই, বড়ো ভাই আছেন-- তাঁহার নাম ভবানীচরণ চট্টোপাধ্যায়। ভাইবোন প্রায় এক প্রকৃতির লোক-- মুখে কথাটি নাই কিন্তু এমনি একটা তেজ আছে যে, দিবা দ্বিপ্রহরের মতো নিঃশব্দে দহন করে। লোকে ভবানীচরণকে অকারণে ভয় করিত।

রাজীব লোকটি বিদেশী। এখানকার রেশমের কুঠির বড়োসাহেব তাহাকে নিজের সঙ্গে লইয়া আসিয়াছে। রাজীবের বাপ এই সাহেবের কর্মচারী ছিলেন, তাঁহার মৃত্যু হইলে সাহেব তাঁহার অল্পবয়স্ক পুত্রের ভরণপোষণের ভার নিজে লইয়া তাহাকে বাল্যাবস্থায় এই বামনহাটির কুঠিতে লইয়া আসেন। বালকের সঙ্গে কেবল তাহার স্নেহশীলা পিসি ছিলেন। ইঁহারা ভবানীচরণের প্রতিবেশীরূপে বাস করিতেন। মহামায়া রাজীবের বাল্যসঙ্গিনী ছিল এবং রাজীবের পিসির সহিত মহামায়ার সুদৃঢ় স্নেহবন্ধন ছিল।

রাজীবের বয়স ক্রমে ক্রমে ষোলো, সতেরো, আঠারো, এমন-কি, উনিশ হইয়া উঠিল, তথাপি পিসির বিস্তর অনুরোধসত্ত্বেও সে বিবাহ করিতে চায় না। সাহেব বাঙালির ছেলের এরূপ অসামান্য সুবুদ্ধির পরিচয় পাইয়া ভারি খুশি হইলেন; মনে করিলেন, ছেলেটি তাঁহাকেই আপনার জীবনের আদর্শস্থল করিয়াছে। সাহেব অবিবাহিত ছিলেন। ইতিমধ্যে পিসিরও মৃত্যু হইল।

এদিকে সাধ্যাতীত ব্যয় ব্যতীত মহামায়ার জন্যও অনুরূপ কুলসম্পন্ন পাত্র জোটে না। তাহারও কুমারী বয়স ক্রমে বাড়িতে লাগিল।

পাঠকদিগকে বলা বাহুল্য যে, পরিণয়বন্ধন যে-দেবতার কার্য তিনি যদিও এই নরনারীযুগলের প্রতি এযাবৎ বিশেষ অমনোযোগ প্রদর্শন করিয়া আসিতেছেন, কিন্তু প্রণয়বন্ধনের ভার যাঁহার প্রতি তিনি এতদিন সময় নষ্ট করেন নাই। বৃদ্ধ প্রজাপতি যখন ঢুলিতেছিলেন, যুবক কন্দর্প তখন সম্পূর্ণ সজাগ অবস্থায় ছিলেন।

ভগবান কন্দর্পের প্রভাব ভিন্ন লোকের উপর ভিন্ন ভাবে প্রকাশিত হয়। রাজীব তাঁহার প্ররোচনায় দুটো-চারটে মনের কথা বলিবার অবসর খুঁজিয়া বেড়ায়, মহামায়া তাহাকে সে অবসর দেয় না-- তাহার নিস্তব্ধ গম্ভীর দৃষ্টি রাজীবের ব্যাকুল হৃদয়ে একটা ভীতির সঞ্চার করিয়া তোলে।

আজ শতবার মাথার দিব্য দিয়া রাজীব মহামায়াকে এই ভাঙা মন্দিরে আনিতে কৃতকার্য হইয়াছে। তাই মনে করিয়াছিল, যতকিছু বলিবার আছে আজ সব বলিয়া লইবে, তাহার পরে হয় আমরণ সুখ নয় আজীবন মৃত্যু। জীবনের এমন একটা সংকটের দিনে রাজীব কেবল কহিল, 'চলো, তবে বিবাহ করা যাউক।' এবং তার পরে বিস্মৃতপাঠ ছাত্রের মতো থতমত খাইয়া চুপ করিয়া রহিল। রাজীব যে এরূপ প্রস্তাব করিবে মহামায়া যেন আশা করে নাই। অনেকক্ষণ তাই নীরব হইয়া রহিল।

মধ্যাহ্নকালের অনেকগুলি অনির্দিষ্ট করুণধ্বনি আছে, সেইগুলি এই নিস্তব্ধতায় ফুটিয়া উঠিতে লাগিল। বাতাসে মন্দিরের অর্ধসংলগ্ন ভাঙা কবাট এক-একবার অত্যন্ত মৃদুমন্দ আর্তস্বর-সহকারে ধীরে ধীরে খুলিতে এবং বন্ধ হইতে লাগিল-- মন্দিরের গবাক্ষে বসিয়া পায়রা বকম্ বকম্ করিয়া ডাকে, বাহিরে শিমূলগাছের শাখায় বসিয়া কাঠঠোকরা একঘেয়ে ঠক্ ঠক্ শব্দ করে, শুষ্ক পত্ররাশির মধ্য দিয়া গিরগিটি সর্সর্ শব্দে ছুটিয়া যায়, হঠাৎ একটা উষ্ণ বাতাস মাঠের দিক হইতে আসিয়া সমস্ত গাছের পাতার মধ্যে ঝর্ঝর্ করিয়া উঠে এবং হঠাৎ নদীর জল জাগিয়া উঠিয়া ভাঙা ঘাটের সোপানের উপর ছলাৎ ছলাৎ করিয়া আঘাত করিতে থাকে। এই-সমস্ত আকস্মিক অলস শব্দের মধ্যে বহুদূর তরুতল হইতে একটি রাখালের বাঁশিতে মেঠো সুর বাজিতেছে। রাজীব মহামায়ার মুখের দিকে চাহিতে সাহসী না হইয়া মন্দিরের ভিত্তির উপর ঠেস দিয়া দাঁড়াইয়া একপ্রকার শ্রান্ত স্বপ্নাবিষ্টের মতো নদীর দিকে চাহিয়া আছে।

কিছুক্ষণ পরে মুখ ফিরাইয়া লইয়া রাজীব আর-একবার ভিক্ষুকভাবে মহামায়ার মুখের দিকে চাহিল। মহামায়া মাথা নাড়িয়া কহিল, 'না, সে হইতে পারে না।'

মহামায়ার মাথা যেমনি নড়িল রাজীবের আশাও অমনি ভূমিসাৎ হইয়া গেল। কারণ, রাজীব সম্পূর্ণ জানিত, মহামায়ার মাথা মহামায়ার নিজের নিয়মানুসারেই নড়ে, আর-কাহারো সাধ্য নাই তাহাকে আপন মতে বিচলিত করে। প্রবল কুলাভিমান মহামায়ার বংশে কত কাল হইতে প্রবাহিত হইতেছে-- সে কি কখনো রাজীবের মতো অকুলীন ব্রাহ্মণকে বিবাহ করিতে সম্মত হইতে পারে। ভালোবাসা এক এবং বিবাহ করা আর। যাহা হউক, মহামায়া বুঝিতে পরিল, তাহার নিজের বিবেচনাহীন ব্যবহারেই রাজীবের এতদূর স্পর্ধা বাড়িয়াছে; তৎক্ষণাৎ সে মন্দির ছাড়িয়া চলিয়া যাইতে উদ্যত হইল।

রাজীব অবস্থা বুঝিয়া তাড়াতাড়ি কহিল, 'আমি কালই এদেশ হইতে চলিয়া যাইতেছি।'

মহামায়া প্রথমে মনে করিয়াছিল যে ভাবটা দেখাইবে-- সে খবরে আমার কী আবশ্যক। কিন্তু পারিল না। পা তুলিতে গিয়া পা উঠিল না-- শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করিল, 'কেন।'

রাজীব কহিল, 'আমার সাহেব এখান হইতে সোনাপুরের কুঠিতে বদলি হইতেছেন, আমাকে সঙ্গে লইয়া যাইতেছেন।'

মহামায়া আবার অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। ভাবিয়া দেখিল, দুইজনের জীবনের গতি দুই দিকে-- একটা মানুষকে চিরদিন নজরবন্দি করিয়া রাখা যায় না। তাই চাপা ঠোঁট ঈষৎ খুলিয়া কহিল, 'আচ্ছা।' সেটা কতকটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাসের মতো শুনাইল।

কেবল এই কথাটুকু বলিয়া মহামায়া পুনশ্চ গমনোদ্যত হইতেছে, এমন সময় রাজীব চমকিয়া উঠিয়া কহিল, 'চাটুয্যেমহাশয়!'

মহামায়া দেখিল, ভবানীচরণ মন্দিরের অভিমুখে আসিতেছে, বুঝিল তাহাদের সন্ধান পাইয়াছে। রাজীব মহামায়ার বিপদের সম্ভাবনা দেখিয়া মন্দিরের ভগ্নভিত্তি দিয়া লাফাইয়া বাহির হইবার চেষ্টা করিল। মহামায়া সবলে তাহার হাত ধরিয়া আটক করিয়া রাখিল। ভবানীচরণ মন্দিরে প্রবেশ করিল-- কেবল একবার নীরবে নিস্তব্ধভাবে উভয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলেন।

মহামায়া রাজীবের দিকে চাহিয়া অবিচলিত ভাবে কহিল, 'রাজীব, তোমার ঘরেই আমি যাইব। তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করিয়ো।'

ভবানীচরণ নিঃশব্দে মন্দির হইতে বাহির হইলেন, মহামায়াও নিঃশব্দে তাঁহার অনুগমন করিল-- আর, রাজীব হতবুদ্ধি হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল-- যেন তাহার ফাঁসির হুকুম হইয়াছে।


দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ


সেই রাত্রেই ভবানীচরণ একখানা লাল চেলি আনিয়া মহামায়াকে বলিলেন, 'এইটে পরিয়া আইস।'


মহামায়া পরিয়া আসিল। তাহার পর বলিলেন, 'আমার সঙ্গে চলো।'



ভবানীচরণের আদেশ, এমন-কি, সংকেতও কেহ কখনো অমান্য করে নাই। মহামায়াও না।সেই রাত্রে উভয়ে নদীতীরে শ্মশান-অভিমুখে চলিলেন। শ্মশান বাড়ি হইতে অধিক দূর নহে। সেখানে গঙ্গাযাত্রীর ঘরে একটি বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিল। তাহারই শয্যাপার্শ্বে উভয়ে গিয়া দাঁড়াইলেন। ঘরের এক কোণে পুরোহিত ব্রাহ্মণ উপস্থিত ছিল, ভবানীচরণ তাহাকে ইঙ্গিত করিলেন। সে অবিলম্বে শুভানুষ্ঠানের আয়োজন করিয়া লইয়া প্রস্তুত হইয়া দাঁড়াইল; মহামায়া বুঝিল, এই মুমূর্ষুর সহিত তাহার বিবাহ। সে আপত্তির লেশমাত্রও প্রকাশ করিল না। দুইটি অদূরবর্তী চিতার আলোকে অন্ধকারপ্রায় গৃহে মৃত্যুযন্ত্রণার আর্তধ্বনির সহিত অস্পষ্ট মন্ত্রোচ্চারণ মিশ্রিত করিয়া মহামায়ার বিবাহ হইয়া গেল।

যেদিন বিবাহ তাহার পরদিনই মহামায়া বিধবা হইল। এই দুর্ঘটনায় বিধবা অতিমাত্র শোক অনুভব করিল না-- এবং রাজীবও মহামায়ার অকস্মাৎ বিবাহসংবাদে যেরূপ বজ্রাহত হইয়াছিল, বৈধব্যসংবাদে সেইরূপ হইল না। এমন-কি, কিঞ্চিৎ প্রফুল্ল বোধ করিতে লাগিল। কিন্তু সে-ভাব অধিকক্ষণ স্থায়ী হইল না। দ্বিতীয় আর-একটা বজ্রাঘাতে রাজীবকে একেবারে ভূপাতিত করিয়া ফেলিল। সে সংবাদ পাইল, শ্মশানে আজ ভারি ধুম। মহামায়া সহমৃতা হইতেছে।

প্রথমেই সে ভাবিল, সাহেবকে সংবাদ দিয়া তাঁহার সাহায্যে এই নিদারুণ ব্যাপার বলপূর্বক রহিত করিবে। তাহার পরে মনে পড়িল, সাহেব আজই বদলি হইয়া সোনাপুরে রওনা হইয়াছে-- রাজীবকেও সঙ্গে লইতে চাহিয়াছিল কিন্তু রাজীব একমাসের ছুটি লইয়া থাকিয়া গেছে।

মহামায়া তাহাকে বলিয়াছে, 'তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করিয়ো।' সে কথা সে কিছুতেই লঙ্ঘন করিতে পারে না। আপাতত এক মাসের ছুটি লইয়াছে, আবশ্যক হইলে দুই মাস, ক্রমে তিন মাস-- এবং অবশেষে সাহেবের কর্ম ছাড়িয়া দিয়া দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করিয়া খাইবে, তবু চিরজীবন অপেক্ষা করিতে ছাড়িবে না।

রাজীব যখন পাগলের মতো ছুটিয়া হয় আত্মহত্যা নয় একটা-কিছু করিবার উদ্যোগ করিতেছে, এমন সময় সন্ধ্যাকালে মুষলধারায় বৃষ্টির সহিত একটা প্রলয়-ঝড় উপস্থিত হইল। এমনি ঝড় যে রাজীবের মনে হইল, বাড়ি মাথার উপর ভাঙিয়া পড়িবে। যখন দেখিল বাহ্য প্রকৃতিতেও তাহার অন্তরের অনুরূপ একটা মহাবিপ্লব উপস্থিত হইয়াছে, তখন সে যেন কতকটা শান্ত হইল। তাহার মনে হইল, সমস্ত প্রকৃতি তাহার হইয়া একটা কোনোরূপ প্রতিবিধান করিতে আরম্ভ করিয়া দিয়াছে। সে নিজে যতটা শক্তি প্রয়োগ করিতে ইচ্ছা করিত মাত্র কিন্তু পরিত না, প্রকৃতি আকাশপাতাল জুড়িয়া ততটা শক্তিপ্রয়োগ করিয়া কাজ করিতেছে।

এমন সময়ে বাহির হইতে সবলে কে দ্বার ঠেলিল। রাজীব তাড়াতাড়ি খুলিয়া দিল। ঘরের মধ্যে আর্দ্রবস্ত্রে একটি স্ত্রীলোক প্রবেশ করিল, তাহার মাথায় সমস্ত মুখ ঢাকিয়া ঘোমটা। রাজীব তৎক্ষণাৎ চিনিতে পারিল, সে মহামায়া।

উচ্ছ্বসিত স্বরে জিজ্ঞনসা করিল, 'মহামায়া, তুমি চিতা হইতে উঠিয়া আসিয়াছ?'




মহামায়া কহিল, 'হাঁ। আমি তোমার কাছে অঙ্গীকার করিয়াছিলাম, তোমার ঘরে আসিব। সেই অঙ্গীকার পালন করিতে আসিয়াছি। কিন্তু রাজীব, আমি ঠিক সে আমি নাই, আমার সমস্ত পরিবর্তন হইয়া গিয়াছে। কেবল আমি মনে মনে সেই মহামায়া আছি। এখনো বলো, এখনো আমার চিতায় ফিরিয়া যাইতে পারিব। আর যদি প্রতিজ্ঞা কর, কখনো আমার ঘোমটা খুলিবে না, আমার মুখ দেখিবে না-- তবে আমি তোমার ঘরে থাকিতে পারি।মৃত্যুর হাত হইতে ফিরিয়া পাওয়াই যথেষ্ট, তখন আর-সমস্তই তুচ্ছ জ্ঞান হয়। রাজীব তাড়াতাড়ি কহিল, 'তুমি যেমন ইচ্ছা তেমনি করিয়া থাকিয়ো-- আমাকে ছাড়িয়া গেলে, আর আমি বাঁচিব না।'

মহামায়া কহিল, 'তবে এখনই চলো-- তোমার সাহেব যেখানে বদলি হইয়াছে, সেইখানে যাই।'

ঘরে যাহা কিছু ছিল, সমস্ত ফেলিয়া রাজীব মহামায়াকে লইয়া সেই ঝড়ের মধ্যে বাহির হইল। এমনি ঝড় যে দাঁড়ানো কঠিন-- ঝড়ের বেগে কঙ্কর উড়িয়া আসিয়া ছিটাগুলির মতো গায়ে বিঁধিতে লাগিল। মাথার উপরে গাছ ভাঙিয়া পড়িবার ভয়ে, পথ ছাড়িয়া উভয়ে খোলা মাঠ দিয়া চলিতে লাগিল। বায়ুর বেগ পশ্চাৎ হইতে আঘাত করিল। যেন ঝড়ে লোকালয় হইতে দুইটা মানুষকে ছিন্ন করিয়া প্রলয়ের দিকে উড়াইয়া লইয়া চলিয়াছে।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

গল্পটা পাঠকেরা নিতান্ত অমূলক অথবা অলৌকিক মনে করিবেন না। যখন সহমরণপ্রথা প্রচলিত ছিল, তখন এমন ঘটনা কদাচিৎ মাঝে মাঝে ঘটিতে শুনা গিয়াছে।

মহামায়ার হাতপা বাঁধিয়া তাহাকে চিতায় সমর্পণ করিয়া যথাসময়ে অগ্নিপ্রয়োগ করা হইয়াছিল। অগ্নিও ধূ ধূ করিয়া ধরিয়া উঠিয়াছে, এমন সময়ে প্রচণ্ড ঝড় ও মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হইল। যাহারা দাহ করিতে আসিয়াছিল, তাহারা তাড়াতাড়ি গঙ্গাযাত্রীর ঘরে আশ্রয় লইয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিল। বৃষ্টিতে চিতানল নিবিতে বিলম্ব হইল না। ইতিমধ্যে মহামায়ার হাতের বন্ধন ভস্ম হইয়া তাহার হাতদুটি মুক্ত হইয়াছে। অসহ্য দাহযন্ত্রণায় একটিমাত্র কথা না কহিয়া, মহামায়া উঠিয়া বসিয়া পায়ের বন্ধন খুলিল। তাহার পর, স্থানে স্থানে দগ্ধ বস্ত্রখণ্ড গাত্রে জড়াইয়া উলঙ্গপ্রায় মহামায়া চিতা হইতে উঠিয়া প্রথমে আপনার ঘরে ফিরিয়া আসিল। গৃহে কেহই ছিল না, সকলেই শ্মশানে। প্রদীপ জ্বালিয়া একখানি কাপড় পরিয়া মহামায়া একবার দর্পণে মুখ দেখিল। দর্পণ ভূমিতে আছাড়িয়া ফেলিয়া একবার কী ভাবিল। তাহার পর মুখের উপর দীর্ঘ ঘোমটা টানিয়া অদূরবর্তী রাজীবের বাড়ি গেল। তাহার পর কী ঘটিল পাঠকের অগোচর নাই।

মহামায়া এখন রাজীবের ঘরে, কিন্তু রাজীবের জীবনে সুখ নাই। অধিক নহে, উভয়ের মধ্যে কেবল একখানিমাত্র ঘোমটার ব্যবধান। কিন্তু সেই ঘোমটাটুকু মৃত্যুর ন্যায় চিরস্থায়ী, অথচ মৃত্যুর অপেক্ষা যন্ত্রণাদায়ক। কারণ, নৈরাশ্যে মৃত্যুর বিচ্ছেদ-বেদনাকে কালক্রমে অসাড় করিয়া ফেলে, কিন্তু এই ঘোমটার বিচ্ছেদটুকুর মধ্যে একটি জীবন্ত আশা প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে পীড়িত হইতেছে।

একে মহামায়ার চিরকালই একটা নিস্তব্ধ নীরব ভাব আছে, তাহাতে এই ঘোমটার ভিতরকার নিস্তব্ধতা দ্বিগুণ দুঃসহ বোধ হয়। সে যেন একটা মৃত্যুর মধ্যে আবৃত হইয়া বাস করিতেছে। এই নিস্তব্ধ মৃত্যু রাজীবের জীবনকে আলিঙ্গন করিয়া প্রতিদিন যেন বিশীর্ণ করিতে লাগিল। রাজীব পূর্বে যে মহামায়াকে জানিত তাহাকেও হারাইল এবং তাহার সেই আশৈশব সুন্দর স্মৃতিকে যে আপনার সংসারে প্রতিষ্ঠিত করিয়া রাখিবে, এই ঘোমটাচ্ছন্ন মূর্তি চিরদিন পার্শ্বে থাকিয়া নীরবে তাহাতেও বাধা দিতে লাগিল। রাজীব ভাবিত, মানুষে মানুষে স্বভাবতই যথেষ্ট ব্যবধান আছে-- বিশেষত মহামায়া পুরাণবর্ণিত কর্ণের মতো সহজকবচধারী-- সে আপনার স্বভাবের চারিদিকে একটা আবরণ লইয়াই জন্মগ্রহণ করিয়াছে, তাহার পর মাঝে আবার যেন আর-একবার জন্মগ্রহণ করিয়া আবার আরো একটা আবরণ লইয়া আসিয়াছে| অহরহ পার্শ্বে থাকিয়াও সে এতদূরে চলিয়া গিয়াছে যে, রাজীব যেন আর তাহার নাগাল পায় না-- কেবল একটা মায়াগণ্ডির বাহিরে আসিয়া অতৃপ্ত তৃষিত হৃদয়ে এই সূক্ষ্ণ অথচ অটল রহস্য ভেদ করিবার চেষ্টা করিতেছে-- নক্ষত্র যেমন প্রতিরাত্রি নিদ্রাহীন নির্নিমেষ নতনেত্রে অন্ধকার নিশীথিনীকে ভেদ করিবার প্রয়াসে নিষ্ফলে নিশিযাপন করে।

এমনি করিয়া এই দুই সঙ্গীহীন একক প্রাণী কতকাল একত্র যাপন করিল।

একদিন বর্ষাকালে শুক্লপক্ষ দশমীর রাত্রে প্রথম মেঘ কাটিয়া চাঁদ দেখা দিল। নিষ্পন্দ জ্যোৎস্নারাত্রি সুপ্ত পৃথিবীর শিয়রে জাগিয়া বসিয়া রহিল। সে রাত্রে নিদ্রা ত্যাগ করিয়া রাজীবও আপনার জানালায় বসিয়া ছিল। গ্রীষ্মক্লিষ্ট বন হইতে একটা গন্ধ এবং ঝিল্লির শ্রান্তরব তাহার ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিতেছিল। রাজীব দেখিতেছিল, অন্ধকার তরুশ্রেণীর প্রান্তে শান্ত সরোবর একখানি মার্জিত রুপার পাতের মতো ঝক্ ঝক্ করিতেছে। মানুষ এরকম সময় স্পষ্ট একটা কোনো কথা ভাবে কি না বলা শক্ত। কেবল তাহার সমস্ত অন্তঃকরণ একটা কোনো দিকে প্রবাহিত হইতে থাকে-- বনের মতো একটা গন্ধোচ্ছ্বাস দেয়, রাত্রির মতো একটা ঝিল্লিধ্বনি করে। রাজীব কী ভাবিল জানি না কিন্তু তাহার মনে হইল, আজ যেন সমস্ত পূর্ব নিয়ম ভাঙিয়া গিয়াছে। আজ বর্ষারাত্রি তাহার মেঘাবরণ খুলিয়া ফেলিয়াছে এবং আজিকার এই নিশীথিনীকে সেকালের সেই মহামায়ার মতো নিস্তব্ধ সুন্দর এবং সুগম্ভীর দেখাইতেছে। তাহার সমস্ত অস্তিত্ব সেই মহামায়ার দিকে একযোগে ধাবিত হইল।




স্বপ্নচালিতের মতো উঠিয়া রাজীব মহামায়ার শয়নমন্দিরে প্রবেশ করিল। মহামায়া তখন ঘুমাইতেছিল।রাজীব কাছে গিয়া দাঁড়াইল-- মুখ নত করিয়া দেখিল-- মহামায়ার মুখের উপর জ্যোৎস্না আসিয়া পড়িয়াছে। কিন্তু হায়, এ কী! সে চিরপরিচিত মুখ কোথায়। চিতানলশিখা তাহার নিষ্ঠুর লেলিহান রসনায় মহামায়ার বামগণ্ড হইতে কিয়দংশ সৌন্দর্য একেবারে লেহন করিয়া আপনার ক্ষুধার চিহ্ন রাখিয়া গেছে।

বোধ করি রাজীব চমকিয়া উঠিয়াছিল, বোধ করি একটা অব্যক্ত ধ্বনিও তাহার মুখ দিয়া বাহির হইয়া থাকিবে। মহামায়া চমকিয়া জাগিয়া উঠিল-- দেখিল সম্মুখে রাজীব। তৎক্ষণাৎ ঘোমটা টানিয়া শয্যা ছাড়িয়া একেবারে উঠিয়া দাঁড়াইল। রাজীব বুঝিল, এইবার বজ্র উদ্যত হইয়াছে। ভূমিতে পড়িল-- পায়ে ধরিয়া কহিল, 'আমাকে ক্ষমা করো।'

মহামায়া একটি উত্তরমাত্র না করিয়া, মুহূর্তের জন্য পশ্চাতে না ফিরিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল। রাজীবের ঘরে আর সে প্রবেশ করিল না। কোথাও তাহার আর সন্ধান পাওয়া গেল না। সেই ক্ষমাহীন চিরবিদায়ের নীরব ক্রোধানল রাজীবের সমস্ত ইহজীবনে একটি সুদীর্ঘ দগ্ধচিহ্ন রাখিয়া দিয়া গেল।

সময় সম্পর্কিত মাথা ঘোরানো কয়েকটি তত্ত্ব


এই জগতে কিছু জিনিস আছে অপরিবর্তনীয়, তাই তাদের উপর আমাদের অগাধ আস্থা। যেমন- প্রত্যেক সকালে সূর্য পূর্বদিকে উঠে আর সন্ধ্যায় পশ্চিমে অস্ত যায়, নির্দিষ্ট কাল পর পর ঋতুর বদল হয়, সময় শুধুই সামনে ছুটে চলে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই নিয়মগুলো ধ্রুব সত্য। এদের কোনো পরিবর্তন নেই।

কিন্তু সত্যি কথা হলো – সূর্য কোথাও ওঠেও না, নামেও না। সে তার জায়গাতেই চুপচাপ বসে আছে (আসলে সেও ঘুরছে গ্যালাক্সির কেন্দ্রকে মাঝখানে রেখে)। বরং পৃথিবীই পশ্চিম হতে পুবে ঘোরে। এদিকে ঋতুর পরিবর্তনও আস্তে আস্তে প্রকৃতি হতে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আর সময়…………সময় শুধু ছুটেই চলে না, সে মাঝে মাঝে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়েও চলে। এমনকি মন চাইলে ব্রেক চেপে দাঁড়িয়েও যেতে পারে। কিভাবে? আসুন তাহলে সময় সম্পর্কিত কিছু বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব এবং ধারণার দিকে চোখ বোলানো যাক। বিস্ময়ের মাত্রার দিক থেকে যেটা সবচেয়ে কম, সেটা দিয়ে শুরু করছি।

 আমাদের জীবনটা হচ্ছে রেডিও-টিভির লাইভ অনুষ্ঠান (যেটা কিছুটা বিলম্বে সম্প্রচারিত হচ্ছে)


আপনি কি বিশ্বাস করবেন যদি বলা হয় যে- আমরা যেটাকে বর্তমান বলে জানি, সেই মুহূর্তটা আসলে সামান্য অতীতে অবস্থিত? আমরা সবাই ধরে নিয়েছি যে আমাদের জীবনটা হচ্ছে একটা সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠান। কিন্তু সত্যি কথা হলো, জীবন হচ্ছে একটা সরাসরি অনুষ্ঠান যেটা সামান্য বিলম্বে সম্প্রচারিত হচ্ছে। এই বিলম্বের সময়টুকু আপনার ব্রেইন বিভিন্ন জটিল এডিটিং এবং সেন্সরিং এর কাজে নিয়োজিত থাকে। সেটা হয়ে গেলেই এডিট করা অংশটুকু সে আপনার দেখার জন্যে ছেড়ে দেয়।

বিলম্বটা অবশ্য বেশি নয়- মূল ঘটনা ঘটার এবং আপনার সেটাকে অনুভব করার মধ্যকার তফাত মাত্র ৮০ মিলি-সেকেন্ড। তেমন একটা বেশি নয়, তাই না? কিন্তু মনোবিজ্ঞানীরা তাতে একমত নন। তারা পরীক্ষার মাধ্যমে দেখিয়েছেন, এই সামান্য বিলম্বই “আগে কর্ম, পরে ফল” তত্ত্ব কে পালটে “আগে ফল, পরে কর্ম” করে দিতে সক্ষম। যেমন, এক পরীক্ষায় ভলান্টিয়ারদের বলা হয়েছিলো একটা বাটন চাপতে, যেটা চাপলে সামান্য পরেই একটা বাতি দপ করে জ্বলে আবার নিভে যাবে। ভলান্টিয়াররা বাটনটা ১০-১৫ বার চাপার পর দেখতে পেলো বাতিটা সামান্য কিছু পরে না জ্বলে বরং বাটনটা চাপার সাথে সাথেই জ্বলে উঠছে। অর্থাৎ, তাদের ব্রেইন যখন দেখলো যে এই সামান্য পরিমাণ বিলম্ব উহ্য করা যায় তখন সে সেটুকু কেটে এডিট করে বাদ দিয়ে দিলো। এর ফলে বাস্তবে একটু বিলম্বে বাতি জ্বললেও, ভলান্টিয়াররা বাটন চাপার সাথে সাথেই বাতি জ্বলতে দেখতে পাচ্ছিলো।

কিন্তু চমকের ব্যাপার সেটা নয়। মূল চমকটা শুরু হল একটু পরেই, যখন বিজ্ঞানীরা ভলান্টিয়ারদের কিছুই না জানিয়ে সেই বিলম্বিত অংশটুকু সরিয়ে দিলেন। অর্থাৎ বাস্তবেই এখন বাটন চাপার সাথে সাথে বাতি জ্বলছে। এরপর ভলান্টিয়ারদের যখন জিজ্ঞেস করা হল- তারা কী দেখতে পাচ্ছে, তারা পুরোপুরি বিভ্রান্ত গলায় জানালো বাটন চাপার সামান্য আগে আগেই তারা বাতিটা জ্বলতে দেখতে পাচ্ছে! ভলান্টিয়ারদের ব্রেইন পুরো জিনিসটা এডিট করতে গিয়ে এই পর্যায়ে পুরো তাল হারিয়ে ফেলেছিলো এবং “আগে কর্ম, পরে ফল” দেখানোর বদলে “আগে ফল, পরে কর্ম” দেখাতে শুরু করেছিলো।

এখনো বুঝে উঠতে পারেননি? তাহলে এটা চেষ্টা করে দেখুন: আপনার নাক এবং পায়ের একটা আঙ্গুল একই সময় স্পর্শ করার চেষ্টা করুন। সাধারণ যুক্তি বলবে যে, আপনি নাকের স্পর্শ অনুভব করবেন আগে আর পায়ের আঙ্গুলের স্পর্শ অনুভব করবেন পরে। কারণ নাক ব্রেইনের কাছে আর পায়ের আঙ্গুল ব্রেইনের সবথেকে দূরে। তাই পায়ের আঙ্গুলের চেয়ে নাকের স্পর্শের সিগন্যাল আপনার ব্রেইনে আগে পৌঁছুবে। কিন্তু বাস্তবে কি দেখছেন? দুটো স্পর্শই আপনি ঠিক একই মুহূর্তে অনুভব করছেন।

মনোবিজ্ঞানী ডেভিড ঈগলম্যানের মতে, এর কারণ হলো – ব্রেইন সবসময় চেষ্টা করে শরীরের সমস্ত অনুভূতির তথ্যগুলো একসাথে সমন্বিত করে উপস্থাপন করতে। এক্ষেত্রে সে নাকের স্পর্শের সিগন্যালটা আগে পেলেও সেটাকে প্রসেস করার পর একটু স্ট্যান্ডবাই (অপেক্ষা করিয়ে) রেখে পায়ের আঙ্গুলের সিগন্যালটা গ্রহণ করে। সেটাকে প্রসেস করে। তারপর দুটোকে একসাথে ছেড়ে দেয় আমাদের অনুভবের জন্য। ফলে আমরা দুটো স্পর্শই একসাথে অনুভব করি। আর পুরো ব্যাপারটি ঘটা সম্ভব হয় কারণ কয়েক মিলি-সেকেন্ড আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটাকে ব্রেইন আমাদের কাছে ঠিক এখন ঘটছে এমনভাবে উপস্থাপন করে থাকে বলে। ব্যাপারটা অনেকটা ঝুঁকি এড়াতে রেডিও-টিভির সরাসরি অনুষ্ঠান ৮-১০ সেকেন্ড বিলম্বে সম্প্রচার করার মত।

আমাদের বাস্তবতায় এই পুরো ঘটনার ফলাফল হল- যে যত বেশি লম্বা, সে আসলে তত বেশী অতীতে থাকে। কারণ শরীরের বিভিন্ন অংশ হতে ব্রেইনে সিগন্যাল পৌঁছুতে বেশি সময় লাগে। তার মানে হল বামনেরা বর্তমানের সবচেয়ে কাছাকাছি অংশে বাস করে।

কিন্তু এটা তো হল আমরা সময়কে যেভাবে অনুভব করি সেটা। বাস্তবে তো আর সময়ের গতি সত্যি সত্যি ধীর হয়ে যাচ্ছে না কিংবা বেড়েও যাচ্ছে না – তাই না?

 ভূ-পৃষ্ঠ হতে যত উঁচুতে বাস করবেন বয়সও তত তাড়াতাড়ি বাড়বে


যদি আপনি সত্যি সত্যি সময়ের বিকৃতির (time warp) অভিজ্ঞতা নিতে চান, তাহলে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠা শুরু করুন। কারণ সময় সবজায়গায় সমানভাবে চলে না- উঁচু স্থানে সময় দ্রুত চলে। এক পরীক্ষায় বিজ্ঞানীরা দুটো আণবিক শক্তি-চালিত ঘড়িকে (atomic clock) দুটো টেবিলে একদম সমান তলে বসান। তারপর একটা টেবিলকে ৩৩ সেন্টিমিটার উপরে উঠিয়ে দেন। দেখা যায় উপরের ঘড়িটা নিচের ঘড়ির থেকে এক সেকেন্ডের ৯০ বিলিয়ন অংশ দ্রুতগতিতে চলছে।

আণবিক ঘড়ি হচ্ছে সবচেয়ে নিখুঁতভাবে সময় প্রদানকারী ঘড়ি, এবং এই দুটো ঘড়ির মাঝে একমাত্র তফাত ছিলো পৃথিবীপৃষ্ঠ হতে তাদের উচ্চতা। এর মানে হচ্ছে যারা উঁচু স্থানে বাস করে তারা নিচু স্থানের মানুষের চেয়ে বুড়ো হয় তাড়াতাড়ি। যারা স্কোর-কার্ডে স্কোর টুকে রাখছেন, তারা নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছেন, খাটো মানুষেরা ২ গোল – উঁচু মানুষেরা 0 গোল!

এটাকে বলে time dilation. এমনটা ঘটে কারণ আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুযায়ী অভিকর্ষের কারণে সময় এবং স্থান বেঁকে যায়। আপনি যত ভূমির কাছাকাছি থাকবেন ততবেশি পৃথিবীর অভিকর্ষ আপনার সময়ের উপরে প্রভাব বিস্তার করবে এবং সময় ধীরে চলবে। পক্ষান্তরে, আপনি যদি উঁচু স্থানে যান, তবে অভিকর্ষের টান কমে যাবার দরুণ সময়ও কম বাঁকাবে, এবং দ্রুতগতিতে চলবে।

এখানে এতক্ষণ পর্যন্ত যা বললাম তাতে দেখতেই পাচ্ছেন যে সময়টুকু পরিবর্তনের কথা বলছি – তা অতি ক্ষুদ্র এবং পুরোপুরি তাৎপর্যবিহীন। বাস্তব জীবনে এর কোন প্রভাবই চোখে পড়ে না; অবশ্য যদি না আপনি জিপিএস সিস্টেম ব্যবহার করে থাকেন। মহাশূন্যে জিপিএস স্যাটেলাইটের ভেতরে যে ঘড়ি থাকে সেটা প্রতিদিন পৃথিবীর ঘড়ি হতে ৩৮ মিলি-সেকেন্ড এগিয়ে যায়। স্যাটেলাইটের সাথে সংশ্লিষ্ট একটা কম্পিউটার প্রতিদিন সেটাকে পৃথিবীর ঘড়ির সাথে এডজাস্ট করে নেয়। তা না হলে এর ফলাফল হতো ভয়াবহ। মাত্র একদিনের ব্যবধানে পুরো জিপিএস ব্যবস্থাটাই সরে যেতো মূল অবস্থান হতে ১০ কিলোমিটার দূরে। আর ঘটনা তো সবে শুরু।


"আপনি এখন নিউমার্কেট এসে পৌঁছেছেন। ধন্যবাদ আমাদের জিপিএস পরিষেবা গ্রহণের জন্যে!"

“আপনি এখন নিউমার্কেট এসে পৌঁছেছেন। ধন্যবাদ আমাদের জিপিএস সেবা গ্রহণের জন্যে!”




কিন্তু কথা হচ্ছে অভিকর্ষই একমাত্র সময়ের সাড়ে চৌদ্দটা বাজায় না………

 আপনি যত দ্রুত চলবেন, সময় তত ধীরে চলবে


জিপিএস স্যাটেলাইটগুলোতে আরেকটা যে ব্যাপার মুখ্য সেটা হল ‘গতি’। কোনো বস্তু যত দ্রুত চলে, সময় সেই বস্তুর জন্যে তত আস্তে চলে। আইনস্টাইন দাদুর কল্যাণে আমরা সবাই এই তথ্যটা এখন জানি। দ্রুত চলতে চলতে আপনার গতি যদি আলোর গতির কাছাকাছি চলে যায়, তাহলে সময় মোটামুটি থেমে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো সময়ের গতি ধীর করতে আলোর গতিতে চলতে সক্ষম এমন স্পেসশিপের দরকার নেই আপনার। এক বিকেলে সিএনজিতে চড়ে কিংবা আপনার ভাঙ্গাচোরা গাড়িটা নিয়ে হাওয়া খেতে বের হলেই চলবে।

পূর্বে উল্লেখিত আণবিক ঘড়িগুলো ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন সময়ের গতির হ্রাস-বৃদ্ধি প্রতিদিনই আমাদের জীবনে ঘটে চলেছে, যদিও তা অতি ক্ষুদ্র পরিমাণে। একটা ঘড়িকে প্রতি ঘণ্টায় মাত্র ৩৬ কিলোমিটার বেগে ধাবমান গাড়িতে রেখে তারা দেখেছেন ঘড়িটা প্রতি সেকেন্ডে ৬ x ১০-১৬ সেকেন্ড পরিমাণ স্লো হয়ে গেছে। যারা এই সংখ্যাটা বুঝতে পারছেন না তাদের জন্যে বলি- সংখ্যাটা খুব একটা বেশি না, কিন্তু তারপরও অনেক!

অর্থাৎ, বলা যায় আপনি যদি প্রতিদিন ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার বেগে গাড়িতে চড়ে বাসা হতে কর্মস্থলে যান, তবে যতক্ষণ গাড়ি এই বেগে চলে, ততক্ষণ আপনি স্থির বসে থাকার চাইতে 0.000000000000000২ শতাংশ কম হারে বুড়ো হতে থাকেন।


"অফিস যেতে যেতেই তো মনে হয় বুড়ো হয়ে যাবো!"

“অফিস যেতে যেতেই তো মনে হয় বুড়ো হয়ে যাবো!”




আরেক পরীক্ষায় একটা আণবিক ঘড়িকে জেটপ্লেনে চড়িয়ে পুরো দুনিয়া ঘুরিয়ে আনা হয়েছিলো যেখানে এর সাথের জোড়াটাকে রেখে দেয়া হয়েছিলো বাসায় (স্বীকার করেন, আপনার হাতে যদি এমন দুটো ঘড়ি থাকতো তবে আপনিও এরকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করতেন)। শুরুতে যদিও ঘড়ি দুটোর সময় একই ছিলো, পরীক্ষা শেষে দেখা গেলো ভ্রমণকারী ঘড়িটা ৫০ ঘণ্টায় ৮০০ কিলোমিটার ভ্রমণ শেষে স্থির ঘড়ির চেয়ে ২৩০ ন্যানো-সেকেন্ড পিছিয়ে আছে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, ভ্রমণকারী ঘড়িটা পৃথিবী হতে অনেক উপরে দিয়ে চলার কারণে সময় এগিয়ে গিয়েছিলো (আগের এন্ট্রি অনুযায়ী ভূ-পৃষ্ঠের অনেক উপরে থাকায় সময় দ্রুত চলবে)। কিন্তু একইসাথে ঘড়িটার বেগ ছিল বেশি যার ফলে সময় পিছিয়েও যাচ্ছিলো (দ্রুত চলার কারণে সময় ধীর হয়ে যায়)। শেষমেশ দেখা গেল উপরে দিয়ে চলার কারণে ঘড়িটা যে সময়টুকু বেশি পেয়েছিলো, তার পরিমাণ দ্রুত চলার কারণে হারানো সময় থেকে কম। কিন্তু এর থেকেও বড় ব্যাপার ভ্রমণকারী ঘড়িটার যদি অনুভূতি থাকতো, তবে সে দেখতো বাড়িতে বসে থাকা ঘড়িটা তার থেকে দ্রুত চলছে। আসলে আমরা নিজেরা কখনোই টের পাওয়া সম্ভব না যে সময় ধীরে চলছে নাকি দ্রুত চলছে। শুধুমাত্র বাইরে থেকে কেউ আমাদের দেখলেই সেটা বুঝতে পারবে।

এই ব্যাপারটাই আমাদের টেনে নিচ্ছে সময়ের এই গোলকধাঁধার আরও গভীরে, যেখানে…………

 সময় সবার জন্যে সমান গতিতে চলে না


এই পর্যন্ত যা বললাম, তার পুরোটার ফলাফল হচ্ছে বিভিন্ন মানুষ ‘একই ঘটনা’ বিভিন্ন গতিতে চলতে দেখে। আইনস্টাইনের বক্তব্য অনুযায়ী- একটা নির্দিষ্ট গতিতে ছুটে চলা মানুষ যে ঘটনাটাকে যুগপৎ ঘটতে দেখছে, সেই একই ঘটনাটা একটা স্থির মানুষের কাছে যুগপৎ নাও মনে হতে পারে। সুতরাং বাস্তবতা হচ্ছে আলাদা আলাদা টাইমলাইন-সম্পন্ন মানুষের সমষ্টি, যাদের টাইমলাইন কখনো কখনো একজন আরেকজনের সাথে যুগপৎ মিলে যাচ্ছে কিংবা কখনো মিলছে না।

মনোবিজ্ঞানী ‘ওয়ারেন মেক (Warren Meck)’ আমাদের ব্রেইনের সময়ানুভূতি যে আপেক্ষিক সেটা প্রমাণে কয়েকটি পরীক্ষা করেছিলেন। একটা পরীক্ষায় তিনি প্রথম ধাপে কয়েকটা ইঁদুরকে একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর ছোট্ট লিভার টানতে শিখিয়েছিলেন। ইঁদুরেরা ঠিক ঐ নির্দিষ্ট সময় পর পরই লিভারটা টানতো। এর পরের ধাপে তিনি এমন ব্যবস্থা করলেন যাতে ইঁদুরদের সময়ের তাল-জ্ঞান পুরো হারিয়ে গেলো। কারো কাছে ১০ সেকেন্ডকেই মনে হতে লাগলো ঐ ৩০ সেকেন্ডের নির্দিষ্ট বিরতির মত, আবার কারো কাছে ৯০ সেকেন্ডকে মনে হতে লাগলো ৩০ সেকেন্ডের মত। আপনাদের কারো ইঁদুর নিয়ে ব্যাপারটা পরীক্ষার দরকার নেই। গাড়িতে চলার সময় কখনো যদি পাশে অনর্থক বকবক করা সহযাত্রী পান – তাহলে দ্রুতগতিতে চলার কারণে আপনি ধীরে বুড়ো হবেন তো ঠিকই, সেই সাথে আপনার পাশের সহযাত্রীর কারণে সময় আরও ধীরে ধীরে চলা শুরু করবে।

কথা হল, বিজ্ঞানী মেকের বক্তব্য অনুযায়ী- আমাদের সবার টাইমলাইন তো অন্যদের থেকে আলাদা বটেই, সেই সাথে প্রত্যেকের ব্রেইনে একটা নয় বরং অনেকগুলো ঘড়ি ভরে দেয়া আছে। সবকটাই একেকরকম গতিতে চলছে। সুতরাং, ট্রেনে ছুটে চলা ব্যক্তি কিংবা জিপিএস অনুসরণ করা ব্যক্তি অথবা বাসের সেই অসহায় ভদ্র যাত্রী- প্রত্যেকেই আমাদের সবার ব্রেইনের ভেতর আছে। ব্রেইন শুধু সিদ্ধান্ত নেয় কখন কার ঘড়িটা মেনে চলতে হবে।

সময়ের প্রতি আমাদের এই অনুভূতি আরও অনেকভাবে পালটে যেতে পারে। যেমন- ড্রাগ, মানসিক সমস্যা, বার্ধক্য, এমনকি দূরত্বও। সুতরাং ভবিষ্যতে দেরীতে কর্মস্থলে উপস্থিত হলে যুক্তি হিসেবে বলুন আলাদা আলাদা টাইমলাইনের কথা। এতে অনেকে আপনাকে ফাজিল ভাবতে পারে, কিন্তু সেটা কাজে ফাঁকিবাজির জন্যে নয়।

 নিউট্রিনো কণার আলোর চেয়ে বেশি গতিই প্রমাণ করে সময় পরিভ্রমণ সম্ভব


নিউটনীয় পদার্থবিজ্ঞান এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সকল সূত্র একটা কথার উপর ভিত্তি করেই বর্তমান – কোনো বস্তুই আলোর গতিতে চলতে পারেনা। এর একমাত্র ব্যতিক্রম সম্ভবত পেট খারাপের রোগীদের বদনা হাতে বাথরুমে ছুটে চলার গতি। কিন্তু বদনা হাতে বাথরুমে ঢুকার আগে এটুকু জেনে যান, নিউটনীয় পদার্থবিজ্ঞান এর হয়তো সব জায়গায় ছড়ি ঘোরানোর দিন শেষ! সার্ন (CERN) এর বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে এসেছেন- হয়তো, নির্দিষ্ট কিছু শর্তে, পদার্থের ক্ষুদ্রতর কণা নিউট্রিনোরা আলোর চেয়ে বেশি গতিতে চললেও চলতে পারে।

বর্তমানে বৈজ্ঞানিক সমাজে এই ব্যাপারটা নিয়ে ব্যাপক ইট-পাটকেল ছোঁড়াছুড়ি এবং ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমাদের ধৈর্য ধরে সাইড-লাইনে বসে পুরো ঘটনাটা দেখা ছাড়া উপায় নেই। যদি কোনো ভাবে সার্নের বিজ্ঞানীরা জিতে যান তবে তার মানে হচ্ছে, নিউট্রিনো কণার এই আলোর গতির চেয়ে বেশি গতিতে ছুটে চলার সাইড এফেক্ট হিসেবে আমরা পাবো সময় পরিভ্রমণ!

তবে এখানে একটু কথা আছে। গাছে কাঁঠাল, গোঁফে তেলের মত আগেভাগেই ইতিহাসের কোন কোন সেলিব্রেটিদের সাথে গিয়ে হ্যান্ডশেইক করবেন, সেই লিস্ট বানানোর আগে আরেকটু পড়ুন। আমরা এখানে সময় পরিভ্রমণ বলতে টাইম মেশিন বুঝাচ্ছি না। প্রথমে হয়তো আমরা শর্ট মেসেজ আকারে কোনো কিছু পাঠাতে পারবো অতীতে, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়। যেমনটা রেডিও আবিষ্কারের শুরুর দিকে ‘মেরি হ্যাড এ লিটল ল্যাম্ব’ ছড়াটা বার্তা হিসেবে পাঠানো হয়েছিলো।

115497_v1

অর্থাৎ সময় পরিভ্রমণকারী হিসেবে বিবস্ত্র ‘আর্নল্ড শোয়ার্জেনেগার’ এর বদলে টুইটার বার্তাকে কল্পনা করুন। কিন্তু তবুও কথা থাকে। নিউট্রিনো কণারা এক প্রকার অদৃশ্য এবং সরাসরি ত্রিমাত্রিক বস্তু ভেদ করে যেতে পারে। সুতরাং, অতীতে মেসেজ পাঠালে সেটা কেউ দেখতে পাবে কিনা তাও সন্দেহ!

কিন্তু একই সাথে হয়তো এটা সেই বহুল জিজ্ঞাসিত- “কেন আমরা ভবিষ্যৎ হতে এখনো কোন টাইম ট্রাভেলার এর দেখা পাইনি” প্রশ্নের একটা যুক্তিযুক্ত উত্তরও বটে।

 কৃষ্ণগহ্বরের সীমানায় গেলে সময় থেমে যায়


কৃষ্ণগহ্বর সম্বন্ধে একটা সাধারণ ভুল ধারণা হলো – এরা ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের মত সব শুষে নেয়, কিন্তু সেটা সত্য নয়। আসল ব্যাপারটা হলো ব্ল্যাক-হোলদের ঘনত্ব এত বেশি থাকে যে এদের কেন্দ্রের অভিকর্ষ বল হয় অসীম। এটাকে বলা হয় gravitational singularity. এটাই এর আশেপাশের গ্রহাণু হতে শুরু করে আলো পর্যন্ত সব কিছুকে নিজের ভেতরে টেনে নেয়। তবে কথা হলো- একটা নির্দিষ্ট সীমার ভেতরে থেকে। আমরা একটু আগেই দেখিয়েছি, অভিকর্ষ এবং সময়ের সম্পর্কটা একটু দা-কুমড়ো টাইপের। সময় চায় ছুটে চলতে, কিন্তু অভিকর্ষ চায় সময়কে বশে রাখতে। সুতরাং, কী ঘটবে যদি সময় এমন একটা অভিকর্ষ বল দ্বারা ঘেরাও হয়ে যায় যেটা থেকে আলোও নিস্তার পায় না?

সময় থেমে যাবে। প্রত্যেকটা ব্ল্যাক-হোলকে ঘিরে বাইরের দিকে চক্রাকারে একটা এলাকা আছে। এটাকে বলে ‘ঘটনা দিগন্ত (event horizon)’। এই ইভেন্ট হরাইজন হচ্ছে ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন’। অর্থাৎ এই ইভেন্ট হরাইজন রেখা অতিক্রম করে গেলে ব্ল্যাক-হোলের হাত থেকে আপনাকে বাঁচানোর সাধ্য আর কারো নেই।

ব্ল্যাক-হোলের মাথা নষ্ট করা অভিকর্ষের কল্যাণে এই ইভেন্ট হরাইজনের এপার এবং ওপারে বিচিত্র সব কাণ্ড-কারখানা ঘটে। ধরা যাক আপনি আছেন ঘটনা দিগন্তের এই পাশে এবং পুরোপুরি নিরাপদ অবস্থায়। কিন্তু আপনার বন্ধুর দফারফা অবস্থা। কারণ সে বেশি লাফঝাঁপ করতে গিয়ে ইভেন্ট হরাইজনের ওপাশে গিয়ে ব্ল্যাক-হোলের খপ্পরে পড়ে গেছে।

তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, ব্ল্যাক হোল তাকে টেনে ছিঁড়ে অণু-পরমাণুতে রূপান্তরিত করেনি। সেক্ষেত্রে আপনি দেখবেন আপনার সেই বন্ধু ব্ল্যাক-হোল দিয়ে যেতে যেতে ক্রমান্বয়ে তার গতি কমে যাচ্ছে। গতি কমতে কমতে এক পর্যায়ে সে পুরোপুরি স্থির হয়ে গেলো। আর সেই স্থির অবস্থাতেই ভাসতে থাকলো- আজীবন ধরে। যতদিন বিশ্বব্রহ্মাণ্ড থাকে ততদিন। অর্থাৎ, আপনার মনে হবে বন্ধুটা সারাজীবন ধরেই ব্ল্যাক-হোলের মাঝ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। কিন্তু আপনার বন্ধুর ক্ষেত্রে এসব কিছুই মনে হবে না। সে কোনো পরিবর্তনও দেখতে পাবে না। সময় তার জন্যে স্বাভাবিকভাবেই চলবে।

যদি কোনোভাবে আপনার সেই বন্ধুটা ব্ল্যাক-হোল থেকে আবার বের হতে পারে, তাহলে সে হয়তো দেখবে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কয়েক মিলিওন বছর পেরিয়ে গেছে। টাইম ট্রাভেল যে সম্ভব এর জন্যে এটাই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি নির্ভরযোগ্য প্রমাণ। কিন্তু ঘটনা হলো ব্ল্যাক-হোল হচ্ছে টেনিস বল সাইজের, এবং এটার মাঝে যাবার চেষ্টা করলে আপনার দেহাবশেষও খুঁজে পাওয়া যাবে না। অবশ্য আমরা যখন কৃষ্ণগহ্বরের আকারের কথা বলি, তখন এর চারপাশের ঘটনা দিগন্তের আকারের কথাই বলি। এখন পর্যন্ত জ্যোতির্বিদেরা ৬ বর্গমাইল থেকে শুরু করে আমাদের সৌরজগতের সমান বিশালাকারের ঘটনা দিগন্তের সন্ধান পেয়েছেন।

যদিও সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা হলো, আমাদের আর কখনোই সময় পরিভ্রমণ করা সম্ভব হবে না। এর কারণ এই নয় যে টাইম ট্রাভেল অসম্ভব।  এর কারণ হলো, টাইম ট্রাভেল আবিষ্কার করতে করতে…………………

 সময় নিজেও একদিন মারা যাবে


সময় কারো জন্যে অপেক্ষা করে না। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে একটু অদ্ভুত আচরণ করে ঠিকই, কিন্তু তারপরও সে চলতে থাকে অবিরাম। এমনকি আমাদের মৃত্যুর পরেও সে চলতে থাকবে। তবে বেশিদিন নয়!

দেখুন, মহাবিশ্ব কিভাবে চলছে সেটার বিভিন্ন ফর্মুলা বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন সম্ভাব্যতার ভিত্তিতে। অর্থাৎ প্রথমে তারা ধরে নেন যে “ব্যাপারটা এমন হলেও হতে পারে”। তারপর সেটা যুক্তি-প্রমাণ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা প্রমাণ করেন। সেই প্রোবাবিলিটির হিসেবে যদি তারা ধরে নেন সময় হচ্ছে অসীম তবে গাণিতিকভাবে দেখা যায়, সঠিক সময়ে আপনার চিঠি আসা থেকে শুরু করে সঠিক সময়ে সূর্যের সুপারনোভার মাধ্যমে মারা যাওয়া পর্যন্ত সবকিছুর প্রোব্যাবিলিটিই মহা-বৈশ্বিক স্কেলে সমান। অর্থাৎ আগামীকাল আপনি একটা চিঠি পাবেন এটা যেমন সত্য, তেমনি আগামীকাল আমাদের সূর্য নিশ্চিত সুপারনোভার মাধ্যমে মারা যাবে- এটাও সমান পরিমাণ সত্য। কিন্তু দুটোর প্রোব্যাবিলিটিতো সমান হতে পারে না!

বিজ্ঞানীরা তাই ধরে নিয়েছেন, এখানে নিশ্চয়ই অন্য কোনো জবাব আছে। সেই জবাবটা হলো- সময় আসলে অসীম নয়। এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড একটা নির্দিষ্ট সময় হাতে নিয়ে আজ হতে বিলিয়ন বছর পূর্বে যাত্রা শুরু করেছিলো। একটা পর্যায় পরে বিশ্ব তো ধ্বংস হবেই, সেই সাথে সময় নিজেও মারা যাবে।

তাহলে হাতে কেমন সময় আছে? মোটামুটি ৫টা তত্ত্বের মধ্যে ৪টাতেই বলা হয়েছে সময় মারা যাবে আজ থেকে ৩.৩-৩.৭ বিলিয়ন বছর বাদে। কিন্তু ৫ম থিওরিতে বলা হচ্ছে আপনি এই আর্টিকেলটা পড়ে শেষ করার আগেই সময় মারা যেতে পারে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আমাদের জগতটা হচ্ছে দাদার আমলের সেই প্রাচীন ঘড়িটার মত। যে কোনো মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর যখন এমনটা ঘটবে, তখন আমরা সেটা টেরও পাবো না (যদি সেই সময় পর্যন্ত আমরা বেঁচে থাকি আর কি)। ব্যাপারটা দেখতে মনে হবে, আপনার সেই বন্ধুটার ব্ল্যাক-হোলের মাঝ দিয়ে যাবার মত। সবকিছু ক্রমান্বয়ে ধীর হতে থাকবে, তারপর হঠাৎ থেমে যাবে। যেটা যেখানে যে অবস্থাতে ছিল সেটা ওখানে ওভাবেই স্থির হয়ে যাবে। এভাবেই থাকবে…………বাকী পুরো অসীম কাল জুড়ে।

সুতরাং, যারা বদনা নিয়ে দৌড়াচ্ছিলেন, তারা এবার বাথরুমে যেতে পারেন। আমরাও চাই না বাথরুম চেপে রাখা অবস্থায় আপনি চিরকালের জন্যে ফ্রিজ হয়ে যান!

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/amazing_theories_about_time/

Tuesday, May 1, 2018

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রবন্ধ-- বাংলা ছোটগল্প কি মরে যাচ্ছে?


বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় উৎপন্ন ‘ব্যক্তি’র বিশেষ কোনো সমস্যা কী সংকটকে কেন্দ্রবিন্দু করে তাকে তীক্ষ্ণভাবে দেখার জন্য ছোটগল্পের চর্চা হয়ে আসছে আজ দেড়শো বছর ধরে। ‘ছোটগল্প মরে যাচ্ছে...’ এই চরম জবাবটি শুনে মনে হতে পারে, ঐ সমাজ-ব্যবস্থা ও তার হাল মুমূর্ষু অবস্থায় এসে পৌঁছেছে।
যেমন সামন্তব্যবস্থার অবসানের সঙ্গে মহাকাব্যকে বিদায় নিতে হয়েছে। অথচ মানুষের বীরত্ব ও মহত্ব, দয়া ও নিষ্ঠুরতা, করুণা ও হিংস্রতা, ক্ষমা ও ঈর্ষা, ক্রোধ ও ভালবাসা এবং ভোগ ও ত্যাগের সর্বোচ্চ রূপের প্রকাশের মধ্যে সেই সময়ের মূল্যবোধ ও বিশ্বাসকে পরম গৌরব দেওয়া হয়েছে মহাকাব্যেই। দিন যায়, অন্য যুগের পাঠকের কাছে মানুষের এই দেবত্ব লোপ পেলেও সে মহত্তর গৌরব নিয়ে উদ্ভাসিত হয়। মহাকাব্যের গৌরব বাড়ে। কিন্তু অন্যদিনে এসে মানুষকে প্রকাশ করার জন্য এই প্রকরণটিকে শিল্পী আর ব্যবহার করতে পারেন না, নতুন সমাজে মানুষ আর অতিমানব নয়, সে নিছক ব্যক্তিমাত্র। বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তির উত্থানের সঙ্গে তার প্রকাশের স্বার্থে, বিকাশের তাগিদেও বটে, জন্ম হয় উপন্যাসের। প্রথম দিকের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোতে সমাজের নতুন মানুষ ‘ব্যক্তি’কে গৌরব দেওয়ার উদ্যোগ স্পষ্ট, কিন্তু পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামোর কারণেই ব্যক্তিস্বাধীনতা যখন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের পিচ্ছিল পথ ধরে বন্দি হল ব্যক্তিসর্বস্বতার স্যাঁতস্যাঁতে কোটরে তখন এই মাধ্যমটিই তার ক্ষয় ও রোগ শনাক্ত করার দায়িত্ব তুলে নেয় নিজের ঘাড়ে। আজ রোগ ও ক্ষয়ের শনাক্তকরনের সঙ্গে আরও খানাতল্লাশি চালিয়ে ব্যক্তির মানুষে উন্নীত হওয়ার সুপ্ত শক্তির অন্বেষণে নিয়োজিত হয়েছে উপন্যাসই। আর ছোটগল্প তো তার জন্মলগ্ন থেকেই বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তির রোগ ও ক্ষয়কে তীক্ষ্ণভাবে নির্ণয় করে আসছে। এই সমাজব্যবস্থার একটি ফসল হয়েও ছোটগল্প এই ব্যবস্থার শ্রীচরণে তাঁর সিদুরচর্চিত মুণ্ডুখানি কোনোদিনই ঠেকিয়ে রাখেনি যে এর মহাপ্রয়াণ ঘটলে তাকেও সহমরণে যেতে হবে। তা ছাড়া, এই বুর্জোয়া শোষণ ও ছলাকলার আশু-অবসানের কোনো লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে না।

তবে হ্যাঁ, ছোটগল্পের একটা সংকট চলছে বটে। বাংলা ভাষায় বেশকিছু ছোটগল্প লেখা হয়েছে বলেই এই সংকটটি চোখে পড়ে বেশি। রবীন্দ্রনাথ তো ছিলেনই, তারপরেও আন্তর্জাতিক মানের গল্প লিখেছেন বেশ কয়েকজন কথাসাহিত্যিক। তাদের বেশিরভাগই মারা গেছেন। জীবিতদের বেশীরভাগই হয় কলম গুটিয়ে রেখেছেন নয়তো মনোযোগ দিয়েছেন অন্য মাধ্যমে। প্রকাশকের নজরও উপন্যাসের দিকে। গল্পের বই ছাপলে তাদের নাকি লোকসান। প্রতিষ্ঠিত পত্রিকাগুলোর বিশেষ সংখ্যা মানে হাফ-ডজন হাফ-ডজন উপন্যাস, ছোটগল্পের পাত্তা সেখানেও নেই। এখন লোকে নাকি গল্প পড়তে চায় না, ঘরে বসে ভিসিআরে গল্প দেখে। কিন্তু তাহলে উপন্যাস বিক্রি হয় কি করে? গড়পড়তা উপন্যাস আর গড়পড়তা ভিসিআরের মধ্যে তফাতটা কোথায়? জনপ্রিয় উপন্যাস হলেই সেটাকে তরল বলে উড়িয়ে দেওয়ার মানে হয়না, লেখকের উদ্দেশ্য বা মতলব যা-ই থাক, নিজের সমস্যাকে কোনো-না-কোনোভাবে শনাক্ত হতে না-দেখলে পাঠক একটি বইয়ের অনুরাগী হবে কেন? আর শিল্পমানে উন্নত উপন্যাস পৃথিবী জুড়ে যত লেখা হচ্ছে ঐ মাপের ছোটগল্পের পরিমান সে-তুলনায় নগণ্য। ছোটগল্পের প্রকাশ কিন্তু আগেও খুব একটা ছিলনা, উপন্যাসের তুলনায় ছোটগল্পের পাঠক বরাবরই কম। তবু আগে ছোটগল্প লেখা হয়েছে এখন অনেক কম হচ্ছে। মনে হয় এই সংকটের কারণটা খুজতে হবে ছোটগল্পের ভেতরেই।

কোনো একটি সমস্যাকে কেন্দ্রবিন্দু করে একরৈখিক আলোর মধ্যে তাকে যথাযথভাবে নির্দিষ্ট করার শর্তটি পালন করা সৃজনশীল লেখকের দিনদিন কঠিন হয়ে পড়ছে। একটি মানুষকে একটিমাত্র অনুভূতি বা সমস্যা দিয়ে চিহ্নিত করা এখন অসম্ভব। লেখকের কলম থেকে বেরুতে-না-বেরুতে এখনকার চরিত্র বেয়াড়া হয়ে যায়, একটি সমস্যার গয়না তাকে পরিয়ে দেওয়ার জন্য লেখক হাত তুললে সে তা ছুঁড়ে দিয়ে গায়ে তুলে নেয় হাজার সংকটের কাঁটা। লেখকের গলা শুকিয়ে আসে, একটি সমস্যার কথা তুলে ধরার জন্য। এত সংকটের ব্যাখ্যা করার সুযোগ এখানে কোথায়? অর্জুনের মত নজরে পরা চাই পাখির মাথাটুকু, লক্ষ ভেদ করতে হবে সরাসরি, আশপাশে তাকালে তীর ঐ বিন্দুটিতে পৌঁছবে কী করে? লেখক তখন থেমে পড়েন, গলার সঙ্গে শুকোয় তার কলম। কারণ, ছোটগল্পের শাসন তিনি যতই মানুন, এটাওতো তিনি জানেন যে তার চরিত্রটির উৎস যে-সমাজ তা একটি সচল ব্যবস্থা, সেখানে ভাংচুর চলছে এবং তার রদবদল ঘটছে অবিশ্বাস্য রকম তীব্রগতিতে। পরিবর্তনের লক্ষ হল শোষণপ্রক্রিয়াকে আরো শক্ত ও স্থায়ী করা। এর প্রধান হাতিয়ার হল রাষ্ট্র, রাষ্ট্র ক্রমেই স্ফীতকায় হচ্ছে। মানুষের ন্যুনতম কল্যানের পক্ষে পদক্ষেপ না-নিলেও রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করে চলেছে তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। সুস্পষ্ট কোনো কৃষিনীতি সে নেবে না, কিন্তু সারের দাম বাড়িয়ে চাষির মাথায় বাড়ি মারবে নির্দ্বিধায়; পাটের দামের ওপর নিয়ন্ত্রন শিথিল করে চাষিকে সে সর্বস্বান্ত করে ছাড়ে। বন্যার পর, দুর্ভিক্ষের সময় জমি থেকে উৎখাত হয়ে নিরন্ন গ্রামবাসী বিচ্যুত হয় নিজের পেশা থেকে, কিন্তু নতুন পেশা খুঁজে নিতে রাষ্ট্র তাকে সাহায্য করবেনা। ব্যক্তিস্বাধীনতার ডংকা বাজিয়ে যে ব্যবস্থার উদ্ভব, সেখানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বলেও কি কিছু অবশিষ্ট আছে? দম্পতির শোবার ঘরে উঁকি দিয়ে রাষ্ট্র হুকুম ছাড়ে, ছেলে হোক মেয়ে হোক দুটি সন্তানের বেশি যেনো পয়দা কোরো না। কিন্তু ছেলেমেয়েদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও খাদ্যের দায়িত্ব নিতে তার প্রবল অনীহা। গনতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে নির্বাচনের মচ্ছব চলে, সেখানে ব্যবস্থা এমনই মজবুত যে কোটিপতি ছাড়া কারও ক্ষমতা নেই যে নির্বাচিত হয়। দফায়-দফায় গণআন্দোলনে নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী প্রাণ দেয়, রাষ্ট্রের মালিক পালটায়, ফায়দা লোটে কোটিপতিরা। রাষ্ট্রের মাহাত্ম্যপ্রচারের জন্য গ্রামে পর্যন্ত টেলিভিশন পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন কাউন্সিল অফিসে চাষাভুষারা বসে বসে টেলিভিশনের পর্দায় আমেরিকানদের সাম্প্রতিক জীবনযাপন দেখে, সেখানে মেয়েপুরুষ সব তীব্রগতিতে গাড়ি চালায়, রকেট ছোড়ে, তাদের একটি প্রধান চরিত্রের নাম কম্পিউটার, তার কীর্তিকলাপও বিস্তারিত দেখা যায়। বাড়ি ফিরে ঐ চাষি পায়খানা করে ডোবার ধারে, ঐ ডোবার পানি সে খায় অঞ্জলি ভরে, টেলিভিশনে মস্ত করিডোরওয়ালা হাসপাতাল দেখে মুগ্ধ চাষি বৌছেলেমেয়ের অসুখ হলে হাঁস-মুরগি বেচে উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্স পর্যন্ত পৌঁছে শোনে যে ডাক্তার সাহেব কাল ঢাকা গেছে, ডাক্তার সাহেব থাকলে শোনে যে এখানে ওষুধ নেই। তখন তার গতি পানি-পরা-দেওয়া ইমাম সাহেব। রবীন্দ্রনাথের সময় বাংলার গ্রাম এই-ই ছিল, তার আগে বঙ্কিমচন্দ্র বঙ্গদেশের কৃষকের যে-বিবরণ লিখে গেছেন, তাতে এই একই পরিচয় পাই। পরে শরৎচন্দ্র কৃষকের ছবি আঁকেন, তাতেও তেমন হেরফের কই? তারাশংকর, মানিক বন্দোপাধয়, এমনকি সেদিনের সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ যে-চাষিকে দেখেছিলেন সেও এদেরই আত্মীয়। কিন্তু একটা বড় তফাত রয়েছে। যন্ত্রের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল রেলগাড়ি আর টেলিগ্রাফের তার দেখা পর্যন্ত, বড়জোর রেলগাড়িতে চড়ার ভাগ্য কারও কারও হয়ে থাকবে। আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটেছে আরও পরে। বাংলাদেশের নিভৃত গ্রামের বিত্তহীন চাষি বিবিসি শোনে, টেলিভিশন দেখে, জমিতে শ্যালো মেশিনের প্রয়োগ সম্বন্ধেও সব জানে। কিন্তু প্রযুক্তির ব্যবহার তার জীবনে আর সম্ভব হয়না। টেলিভিশনের ছবি তার কাছে রূপকথার বেশি কিছু নয়। রূপকথা এবং অল্পক্ষণের জন্য হলেও তার কল্পনাকে রঙিন করতে পারত, একটা গল্প দেখার সুখ সে পেত। গান আর গাথার মত রূপকথা শোনাও তার সংস্কৃতিচর্চার অংশ। পক্ষিরাজ তো কল্পনার ঘোড়া, এর ওপর সেও যেমন চড়তে পারেনা, গ্রামের জোতদার মাহাজনও তাকে নাগালের ভেতর পাবে না। কিন্তু টেলিভিশনে-দেখা-জীবন তো কেউ কেউ ঠিকই ভোগ করে। ঢাকা শহরের কেউ-কেউ এর ভাগ পায় বইকী। তাদের মধ্যে তার চেনাজানা মানুষও আছে। এই দুই দশকে শ্রেণীর মেরুকরণ এত হয়েছে যে গ্রামের জোতদারের কী সচ্ছল কৃষকের বেপরোয়া ছেলেটি ঢাকায় গিয়ে কী করে কী করে অনেক টাকার মালিক হয়ে বসেছে, সে নাকি এবেলা ওবেলা সিঙ্গাপুর-হংকং করে। চাষিরা নিজেদের কাছে তাই আরও ছোট হয়ে গেছে। তবে কি ঐ জীবনযাপন করতে তার আগ্রহ হয়না? না, হয় না। তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের স্পৃহাকে সংকল্পে রূপ দিতে পারে যে-রাজনীতি তার অভাব আজ বড় প্রকট। রাজনীতি আজ ছিনতাই করে নিয়েছে কোটিপতির দল। এদের পিছে পিছে ঘোরাই এখন নিম্নবিত্ত মানুষের প্রধান রাজনৈতিক তৎপরতা। এখনকার প্রধান দাবি হল রিলিফ চাই।। এনজিওতে দেশ ছেয়ে গেল, নিরন্ন মানুষের প্রতি তাদের উপদেশঃ তোমরা নিজের পায়ে দাঁড়াও। কী করে?-না, মুরগি পোষো, ঝুড়ি বানাও, কাঁথা সেলাই করো। ভাইসব, তোমাদের সম্পদ নেই, সম্বল নেই, মুরগি পুষে, ডিম বেচে, ঝুড়ি বেচে তোমরা স্বাবলম্বী হও। কারন, সম্পদ যারা হাইজ্যাক করে নিয়ে গেছে তা তাদের দখলেই থাকবে, ওদিকে চোখ দিও না। রাষ্ট্রক্ষমতা লুটেরা কোটিপতিদের হাতে, তাদের হাতেই ওটা নিরাপদ থাকবে, ওদিকে হাত দিতে চেষ্টা কোরো না। তাদের মানুষ হয়ে বাঁচবার আকাঙ্ক্ষা, অধিকার আদায়ের স্পৃহা এবং অন্যায় সমাজব্যবস্থা উৎখাত করার সংকল্প চিরকালের জন্য বিনাশ করার আয়োজন চলছে। নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী তাই ছোট থেকে আরও ছোট হয়, এই মানুষটির সংস্কৃতির বিকাশ তো দূরের কথা, তার আগের অনেক অভ্যাস পর্যন্ত লুপ্ত হয়। কিন্তু নতুন সংস্কৃতির স্পন্দন সে কোথাও অনুভব করে না।

এখন এই লোকটিকে নিয়ে গল্প লিখতে গেলে কি ‘ছোট প্রান ছোট কথা’র আদর্শ দিয়ে কাজ হবে? তার একটা সমস্যা ধরতে গেলেই তো হাজারটা বিষয় এসে পড়ে, কোনোটা থেকে আরগুলো আলাদা নয়। একজন চাষির প্রেম করা কী বউকে তালাক দেওয়া, তার জমি থেকে উচ্ছেদ হওয়া কী ভুমিহীনে পরিণত হওয়া তার ছেলের বাড়ি থেকে বেরিয়ে শহরের দিকে রওয়ানা হওয়া এবং সেখান থেকে সৌদি আরব যাওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষায় টাউটের পাল্লায় পড়া, তরুন চাষির প্রেমিকার মুখে এসিড ছুড়ে মারা- এসবের সঙ্গে সারের ওপর ভরতুকি তুলে নেওয়া কিংবা জাতীয় পরিষদের ইলেকশনে তিন কোটিপতির ইলেকশন ক্যাম্পেনে টাকার খেল দেখানো কিংবা এনজিওর কার্যক্রমের সরাসরি বা পরোক্ষ সম্পর্ক থাকা এমনকিছু বিচিত্র নয়। ছোটগল্প লিখতে গিয়ে কোন ব্যাপারটা আনব আর কোনটা আনব না, সমস্যাকে তুলে ধরতে গেলে কতদূর পর্যন্ত যেতে পারি, ছোটগল্পের সীমারেখা কোথায়-এসব প্রশ্ন কি ছোটগল্প লেখাকে জটিল করে তুলছে না?

মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত কী উচ্চমধ্যবিত্তের চরিত্র অনুসরন করা কঠিন। নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত আর বাপ-দাদার শ্রেনীতে পড়ে থাকতে চায় না, সবারই টার্গেট বড়লোক হওয়া। যে যে-পেশায় থাকুক-না, ওর মধ্যেই পয়সা বানাবার ফন্দিফিকির বার করার তালে থাকে। এখন মধ্যবিত্তের সংস্কার বলি, মূল্যবোধ বলি কিংবা মূল্যবোধ বলে চালানো সংস্কার, অথবা অভ্যাস, রেওয়াজ, আদবকায়দা, বেয়াদবি বেতমিজি- এগুলো মোটামুটি সবারই কমবেশি জানা। খারাপ লেখকও জানেন ভালো লেখকও জানেন। কিন্তু যে-লোকটি মানুষ হয়েছে নিম্নবিত্তের ঘরে, কী মধ্যবিত্তের সংস্কার যার রক্তে, সে যখন শয়নে স্বপনে পশ লিভিংয়ের ধান্দায় থাকে তখন সে বড় দুর্বোধ্য মানুষে পরিণত হয়। আবার চুরিচামারি করে, ঘুষ খেয়ে অজস্র মানুষের গলায় লালফিতার ফাঁস পরিয়ে, স্টেনগান, মেশিনগান বা বাখোয়াজির দাপটে, এমনকি বিদ্যা বেচেও কয়েক বছরে যারা উচ্চবিত্তের প্রাসাদে প্রবেশ করেছে এবং তারপর সারাজীবনের অভ্যাস, সংস্কার, রেওয়াজ, প্রথা সব পালটে ‘উইথ রেট্রোস্পেক্টিভ এফেক্ট’ বুর্জোয়া হওয়ার সাধনায় ব্যস্ত বরং বলি ব্যতিব্যস্ত, ছোটগল্পে তাদের যথাযথ শনাক্ত করা কি কম কঠিন কাজ! ভণ্ডামি মধ্যবিত্তের স্বভাবের অংশ বহু আগে থেকেই। কিন্তু ভণ্ডামির ভেতরেও যে সামঞ্জস্য থাকে, এখন তাও খুঁজে পাওয়া ভার। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহাচ্যাম্পিয়ন, বাংলার ‘ব’ বলতে প্রাণ আনচান করে ওঠে, চোখের জলে বুক ভাসায় এমন অনেকের ছেলেমেয়ে জন্ম থেকে থাকে বাইরে, বাংলা ভাষা বলতেও পারে না। রাজনীতি থেকে সর্বক্ষেত্রে বিসমিল্লাহ্‌র বুলি হাঁকায় এমন অনেক সাচ্চা মুসলমানের মক্কা হল আমেরিকা, ছেলেমেয়েদের আমেরিকা পাঠিয়ে তাদের গ্রীন কার্ড, ব্লু কার্ড না রেড কার্ড করার রঙিন খোয়াবে তারা বিভোর। আমেরিকায় ছেলেমেয়েরা যে-জীবনযাপন করে তা কি কোনোদিক থেকে ইসলামি? পিরসাহেবের হুজরায় গিয়ে আল্লাহর করুণা পাবার জন্য কেঁদে জারজার হয়ে হুজুরপাকের তবারক নিয়ে সেই বিরিয়ানি খায় হুইস্কি সহযোগে এবং নগদ টাকার সঙ্গে সেই পবিত্র হুইস্কি নিবেদন করে আমলাদের সেবায় টেন্ডার পাবার উদ্দেশ্যে- এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্ত কোন আধ্যাত্মিক সাধনায় নিয়োজিত?

শহুরে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত প্রযুক্তির সুযোগ যা পাচ্ছে পাশ্চাত্যের দেশগুলোর তুলনায় তা অনেক ক্ষেত্রেই কম নয়। প্রযুক্তি আসছে, কিন্তু বিজ্ঞান চর্চার বালাই নেই। জীবনে বিজ্ঞান পড়েনি এমন সব বিদ্যাদিগগজরা টেলিভিশনে ডারউইনের তত্ব নিয়ে বিরূপ ঠাট্রা করার স্পর্ধা দেখায়। এমন কি বিজ্ঞানের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পাওয়া পন্ডিতেরা সরকারি মাধ্যমগুলোতে প্রচার করে যে, বিজ্ঞানীদের যাবতীয় কথা পবিত্র ধর্মগ্রন্থেই নিহিত রয়েছে, বিজ্ঞানীদের কর্ম সব ঐসব বই থেকে চুরি করে সম্পন্ন করা হয়। পাকিস্তানের নরখাদক সেনাবাহিনীর গোলামরা গাড়ি হাঁকিয়ে দেশের এ-রাত ও-রাত ঘোরে, ফ্রিজের কোকাকোলায় চুমুক দিতে দিতে মাইকে ঘেউ ঘেউ করে, সাম্যবাদের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হল শয়তানের কারসাজি। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষের মধ্যে বিজ্ঞান্মনস্কতার প্রসার ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা চলে। টেলিভিশন আর ভিসিআরের কল্যাণে এখন ঘরে ঘরে আমেরিকা। কিন্তু কাজের প্রতি ওদের মনোযোগ ও দায়িত্ববোধ কি আমাদের ভদ্রলোকদের কিছুমাত্র প্রভাবিত করেছে? রাস্তায় কেউ কি ট্রাফিক আইন মানে? বিজ্ঞানচর্চায় আগ্রহ বাড়ে? স্বাস্থসম্মত জীবনযাপনে উৎসাহী হয়? যা এসেছে তা হল আগ্নেয় অস্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহারের কৌশল রপ্ত করা। বিজ্ঞানচর্চা বাদ দিয়ে প্রযুক্তির ব্যবহারের ফল ভয়াবহ, এর ফল হল নিদারূন সাংস্কৃতিক শূন্যতা এবং অপসংস্কৃতির প্রসার। কোন সাংস্কৃতিক পরিবেশে তরুণদের এই ধারনা বদ্ধমুল হয় যে, এই দেশ বসবাসের অযোগ্য? কোটি কোটি টাকা খরচ করে রাষ্ট্র দখলের যুদ্ধে যারা নামে তারা কি এইসব তরুণদের হতাশা মোচন করার কোনো কর্মসূচি নেয়? গণতন্ত্রের উদ্দেশ্যে কোটি কোটি টাকা অপচয় করা যায়, কিন্তু টাকার অভাবে বিপুল সংখ্যক সরকারি পদ বছরের পর বছর শূন্য পড়ে থাকে। রাষ্ট্রেরই-বা ক্ষমতা কতটা? রাষ্ট্রেরও বাপ আছে, রাষ্ট্র কি ইচ্ছা করলেই মানুষের কর্মসংস্থান করতে পারে? তার বাপ কি তাকে সুবিধামতো কলকারখানা তৈরি করতে দেবে? সারের ওপর ভরতুকি কি সে ইচ্ছা করলেই অব্যাহত রাখতে পারে? কর্মীদের বেতন নির্ধারন করতে পারে? রাষ্ট্রের কোমরে বাঁধা দড়ির প্রান্তটি যে-সাম্রাজ্যবাদী শক্তির হাতে তাকে লক্ষ করাওতো ছোটগল্প লেখকের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। বাঙালি বনাম বাংলাদেশি যুদ্ধে প্রাণ দেয় ইউনিভার্সিটির ছেলে, ইউনিভা্সিটিতে তালা ঝোলে আর গ্রামে পাটের দাম না পেয়ে পাটে আগুন জ্বালিয়ে দেয় বৃদ্ধ চাষি। সেই রিক্ত চাষির গালে কার হাতের থাপ্পড়ের দাগ? কার হাত? মায়ের গয়না বেচে যে তরুণ পাড়ি দিয়েছে জার্মানি কি আমেরিকায় সে তো আর ফেরে না তার মায়ের নিঃসঙ্গতাকে কি শুধু মায়ের ভালবাসা বলে গৌরব দেওয়ার জন্য গদগদচিত্তে লেখক ছোটগল্প লিখবে? কর্মসংস্থান করতে না-পেরে যে-যুবক দিনদিন অস্থির হয়ে উঠছে, নিজের গ্লানিবোধকে চাপা দিতে হয়ে উঠছে বেপরোয়া, অসহিষ্ণু এবং বেয়াদব, আর ছিনতাইকারী হয়ে ওঠা, কিছুদিনের মধ্যে এই পেশায় তার সহকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া, একটির পর একটি গোষ্ঠী পালটানো এবং এ থেকে সবাইকে অবিশ্বাস করার প্রবণতার ভয়াবহ শিকারে পরিণত হওয়া এবং শেষ পর্যন্ত মাদকাসক্ত হয়ে অনুভূতিহীন, স্পৃহাবঞ্চিত নিম্নস্তরের প্রাণী হয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা- এই লোকটিকে পরিচিত করানো তো বটেই, এমনকি শুধু উপস্থাপন করতেও কত বিচিত্র বিষয়কেই-না মনে রাখতে হয়। বলা যায় যে, এসবের উৎস হল অভাব, অভাব তো আমাদের পুরোনো সঙ্গী। কিন্তু তা কি আগে কখনোই এরকম ব্যাপক, গভীর এবং সর্বোপরি জটিল প্রক্রিয়ার ভেতর আবর্তিত হয়েছে? আমাদের অভাব এখন পুঁজিবাদী ব্যক্তির সম্পদ। আমাদের অভাবমোচনের মহান দায়িত্বপালনের এরকম সুযোগ আগে কোনোদিন তারা পায়নি। এই উদ্দেশ্যে তারা এখন অবাধে যেখানে সেখানে ঢোকে, তারাই আমাদের প্রভু, তাদের নিপুণ কার্যক্রমে তাদের প্রভুত্ব মেনে নিতে সব দ্বিধাদ্বন্দ্বই আমরা ঝেড়ে ফেলেছি। তাদের দরাজ হাতে আমাদের দায়ভার তুলে দিতে আমরা উদগ্রীব। ফলে অভাবমোচনের জন্য মানুষের সমবেত স্পৃহাকে বিনাশ করার আয়োজনে তারা অনেকটাই সফল। অভাব হয়ে ওঠে মানুষের কাছে নিয়তি। সমাধানের স্পৃহা না-থাকলে সমস্যাকে সমস্যা বলে বিবেচনা করা যায় না। নিরাময় করতে চাই বলেই রোগকে রোগ বলি, নইলে সর্দি থেকে শুরু করে ক্যান্সার এইডস পর্যন্ত যাবতীয় ব্যাধিকে দাড়িগোঁফ গজানো আর চুল পাকা আর দাঁত পরার মতো শারীরিক নিয়ম বলে মেনে নিতাম। সমস্যা-উত্তরনের সঙ্কল্পের জায়গায় এখন সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবনতাই প্রধান। এর ওপর চলছে সমাজতন্ত্রকে হেয়প্রতিপন্ন করার সাম্রাজ্যবাদী তৎপরতা, যা কিনা অভাব থেকে মুক্তির স্পৃহাকে দমন করা এবং মানুষ হয়ে বাঁচবার সংকল্পকে মুচড়ে দেওয়ার চক্রান্তের একটি অংশ। মানুষের শাসিত স্পৃহা ও দমিত সংকল্পকে আবর্জনার ভেতর থেকে খুঁজে বার করে আনার দায়িত্বও বর্তায় কথাসাহিত্যিকের ঘাড়ে।

সমাজের প্রবল ভাংচুর, সমাজব্যবস্থায় নতুন নতুন শক্তি ও উপাদানের সংযোগ প্রভৃতির ফলে মানুষের গভীর ভেতরের রদবদল ও অনুসন্ধানের কাজে নিয়োজিত ছোটগল্পের শরীরেও পরিবর্তন ঘটতে বাধ্য। উপন্যাসে এই পরিবর্তনটি আসছে লেখকের প্রয়োজোনেই। কাহিনী ফাঁদা আর চরিত্র উপস্থাপন এখন উপন্যাসের জন্য যথেষ্ট নয়, কেবল ধারাবাহিকতা রক্ষা করলেই গল্পের সমস্ত দায়িত্ব পালন করা হয় বলে এখন আর কেউ মনে করে না। গল্প ভেঙ্গে উপন্যাসের মধ্যে আরেকটি গল্প তৈরী হচ্ছে, আবার একই গল্প লেখকের কয়েকটি ছোটগল্পে আসছে নানামাত্রায়, নানা ভঙ্গিতে। একই চরিত্র একই নামে বা ভিন্ন নামে লেখকের কয়েকটি ছোটগল্পে আসতে পারে, তাতেও না-কুলালে এ-চরিত্র আসন করে নিচ্ছে লেখকের উপন্যাসে। ‘ছোট প্রাণ ছোট কথা’ বলে এখন কিছু আছে কি? ‘ছোট দুঃখ’ কোনটি? প্রতিটি ছোট দুঃখের ভেতর চোখ দিলে দেখা যায় তার মস্ত প্রেক্ষাপট, তার জটিল চেহারা এবং তার কুটিল উৎস। ছোটগল্পের হৃৎপিণ্ডে যে-প্রবল ধাক্কা আসছে তা থেকে তার শরীর কি রেহাই পাবে?

ব্যক্তির একটি আপাত-সামান্য ও আপাত-ছোট সংকটকে পাঠকের সামনে পেশ করতে হাজির করতে হচ্ছে আপাত-অপ্রাসঙ্গিক একটি সাহায্যসংস্থার রিপোর্টের অংশ। খবরের কাগজের ভাষা এমনকি একটি কাটিং নিহত সন্তানের মায়ের উদ্বিগ্ন শোকের প্রেক্ষাপট বোঝাতে সাহায্য করতে পারে। গার্মেন্টসে নিয়োজিত তরুণীর গ্লানিবোধ নিয়ে আসার লক্ষে লেখক বিজ্ঞাপনের একটি লাইন তুলে দিতে পারেন। খরায় ধুকতে থাকা একটি চাষের জমিকে প্রধান চরিত্র করে প্রকাশিত হতে পারে শুধু সেখানকার সমাজ নয়, শহরের একটি বেয়াদব মাস্তানের অসহায় অবস্থা। সরকারি প্রজ্ঞাপনের আকারে উপস্থাপন করা যায় মুষ্টিমেয় বিত্তবানের সম্পদ কুক্ষিগত করার লালসাকে। কোথাও খুব পরিচিত কবিতার একটি পঙক্তি এমন বেঁকেচুরে এসে পড়ে যে মূল কবিতাকে আর চেনা যায় না, এই বিকৃত কবিতার লাইন হাতকাটা কোনো শ্রমিকের পায়ে ঝিঝি ধরাকে যথাযথ প্রেক্ষিতে তুলে ধরার জন্য হয়তো বিশেষভাবে দরকারি। একটা শ্যালোমেশিনের কলকব্জার মিস্ত্রি সুলভ বর্ণনায় উন্মোচিত হয় একটা গোটা এলাকার মানুষের হতাশ হৃদয়। একজন খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ কী বুদ্ধিজীবীর কোনো পরিচিত কর্মকাণ্ডের বিশ্বস্ত বিবরণের সঙ্গে সঙ্গে তার স্বভাবের গভীর ভেতরকার কোনো বৈশিষ্ট্য বোঝাতে লেখক তাঁকে করতে পারেন ফ্যান্টাসির চরিত্র, এতেও একই সঙ্গে প্রকাশিত হতে পারে নামহীন গোত্রহীন হাজার মানুষের বিশেষ কোনো সংকট।

ছোটগল্পের এই পরিবর্তন যে ঘটছে না তা নয়; কিন্তু তা তেমন চোখে পড়ে না। তার প্রধান কারণ এই যে, প্রতিষ্ঠিত লেখকদের ভূমিকা এই ব্যাপারে গৌণ। তাদের মধ্যে সৎ ও ক্ষমতাবানেরা কিছুদিন আগে সামাজিক ধসের ভেতর থেকে হাড্ডিমাংস জোড়া দিয়ে মানুষকে উপস্থিত করেছিলেন পাঠকের সামনে, সাম্প্রতিক সময়কে উন্মোচন করার স্বার্থেই যে এই মাধ্যমটিকে গড়েপিটে নেওয়া দরকার তা নিশ্চয়ই হাড়ে হাড়ে বোঝেন তাঁরা। তাহলে তাঁরা গল্প লেখেন না কেন? খ্যাতি লেখককে প্রেরনা হয়তো খানিকটা দেয়, তবে খ্যাতি তাঁকে আরও বেশি সতর্ক করে রাখে খ্যাতি নিরাপদ রাখার কাজে । নিজের ব্যবহৃত, পরিচিত ও পরীক্ষিত রীতিটি তার বড় পোষমানা, এর বাইরে যেতে তার বাধো বাধো ঠেকে। কিংবা নিজের রেওয়াজ ভাঙতে তাঁর মায়া হয়। তাই ছোটগল্পের জন্য ভরসা করতে হয় লিটল ম্যাগাজিনের ওপর। প্রচলিত রীতির বাইরে লেখেন বলেই লিটল ম্যাগাজিনের লেখকদের দরকার হয় নিজেদের পত্রিকা বার করার। বাংলাদেশে এবং পশ্চিম বাংলায় ছোটগল্পের ছিমছাম তনুখানি অনুপস্থিত, সাম্প্রতিক মানুষকে তুলে ধরার তাগিদে নিটোল গপ্পো ঝেড়ে তাঁরা তৈরী করছেন নানা সংকটের কাঁটায় ক্ষতবিক্ষত ছোটগল্পের খরখরে নতুন শরীর। এইসব লেখকদের অনেকেই অল্পদিনে ঝরে পড়বেন, সমালোচকদের প্রশংসা পাবার লোভ অনেকেই সামলাতে না-পেরে চলতে শুরু করবেন ছোটগল্পের সনাতন পথে। হাতে গোনা যায় এমন কয়েকজনও যদি মানুষের এখনকার প্রবল ধাক্কা খাওয়াকে উপযুক্ত শরীরে উপস্থাপনের দায়িত্বপালন অব্যাহত রাখেন তো তাতেও ছোটগল্পের মুমূর্ষু শরীরে প্রাণসঞ্চার সম্ভব। এঁরা তো বটেই, এমনকী যারা ঝরে পড়বেন বা সমালোচকদের পিঠ-চাপড়ানোর কাছে আত্মসমর্পণ করবেন, তাদের অল্পদিনের তৎপরতাও ভবিষ্যৎ লেখকদের যেমন অনুপ্রাণিত করবে, তেমনি বিরল সততাসম্পন্ন মুষ্টিমেয় অগ্রজ লেখকও এঁদের কাজ দেখে পা ঝেড়ে উঠতে পারেন।

বুদ্ধদেব বসুর গল্প "আবছায়া"


আই এ পাশ ক’রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেদিন ভর্তি হলাম সেদিন মনে ভারি ফুর্তি হ’লো। বাস্ রে, কত বড়ো বাড়ি! করিডরের এক প্রান্তে দাঁড়ালে অন্য প্রান্ত ধু-ধু করে। ঘরের পরে ঘর, জমকালো আপিশ, জমজমাট লাইব্রেরি, কমনরুমে ইজিচেয়ার, তাসের টেবিল, পিংপং, দেশ-বিদেশের কত কত পত্রিকা-সেখানে ইচ্ছেমতো হল্লা, আড্ডা, ধূমপান সবই চলে, কেউ কিছু বলে না। কী যে ভালো লাগলো বলা যায় না। মনে হ’লো এতদিনে মানুষ হলুম, ভদ্রলোক হলুম। এত বড়ো একখানা ব্যাপার-যেখানে ডীন আছে, প্রভস্ট আছো, স্টুঅর্ড করতে হয়, আরো কত কী আছে, যেখানে বেলাশেষে আধ মাইল রাস্তা হেঁটে টিউটরিয়াল ক্লাশ করতে হয়, তারও পরে মাঠে গিয়ে ডনকুস্তি না-করলে জরিমানা হয়, যেখানে পার্সেন্ডেজ রাখতে হয় না, আনুয়েল পরীক্ষা দিতে হয় না, যেখানে আজ নাটক কাল বক্তৃতা পরশু গান-বাজনা কিছু না-কিছু লেগেই আছে, রমনার আধখানা জুড়ে যে-বিদ্যায়তন ছড়ানো, সেখানে আমারও কিছু অংশ আছে, এ কি কম কথা! অধ্যাপকেরা দেখতে ভালো, ভালো কাপড়চোপড় পরেন, তাঁদের কথাবর্তার চলই অন্যরকম, সংস্কৃত যিনি পড়ান তিনি বিশুদ্ধ ইংরেজি বলেন-ঘন্টা বাজলে তাঁরা যখন লম্বা করিডর দিয়ে দিগি¦দিকে ছোটেন, তাঁদের গম্ভীর মুখ আর গর্বিত চলন দেখে মনে হয় বিশ্বজগতের সমস্ত দায়িত্বই তাঁদের কাঁধে ন্যস্ত। এ-সব দেখে-শুনে আমারও আত্মসম্মান বাড়লো, এ-সংসারে আমি যে আছি সে-বিষয় অতিমাত্রায় সচেতন হ’য়ে উঠলুম। মন গেলো নিজের চেহারার দিকে, কেশবিন্যাস ও বেশভূষা সম্বন্ধে মনোযোগী হলুম। শার্ট ছেড়ে পাঞ্জাবি ধরলুম, সদ্যোজাত দাড়িগোঁফের ওপর অকারণে ঘন-ঘন ক্ষুর চালিয়ে ছ-মাসের মধ্যেই মুখমণ্ডল এমন শক্ত দাড়ি গজিয়ে তুললুম যে আজ পর্যন্ত কামাতে বসে চোখের জলে সেই স্বকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। তখন অবশ্য ভবিষ্যতের ভাবনা মনে ছিলো না, বালকত্বের খোলশ ছেড়ে খুব চটপট যুবাবয়সের মূর্তি ধারণ করাই ছিলো প্রধান লক্ষ্য।


এর অবশ্য আরো একটু কারণ ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি ছাত্রীও ছিলেন। ওখানকার নানারকম অভিনবত্বের মধ্যে এ-জিনিশটাই ছিলো আমার চোখে-প্রায় সব ছেলেরই চোখে-সবচেয়ে অভিনব। যখনকার কথা বলছি, তখনও মেয়েদের মধ্যে উচ্চশিক্ষার বান ডাকেনি, সারা বিদ্যালয়ে পাঁচটি কি ছ-টি মেয়ে মাত্র ছিলো সব সুদ্ধু। আমার সঙ্গে অপর্ণা দত্ত নামে একজন ভর্তি হয়েছিলো।


পাৎলা ছিপছিপে মেয়ে, শ্যামলা রং, ফিকে নীল শাড়ি প’রে কলেজে আসে। দু-শো ছেলের সঙ্গে ব’সে একটিমাত্র মেয়ের বিদ্যাভ্যাস ব্যাপারটা বিশেষ সোজা নয়, বিশেষত যখন ক্লাশে ছাড়া আর সবখানেই ছেলেদের থেকে তাকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ক’রে রাখার আঁটোসাঁটো ব্যবস্থা থাকে। অপর্ণার কেমন লাগতো জানি না, কিন্তু আমার ওর জন্য দুঃখ হ’তো। ছেলেদের মধ্যে ওকে নিয়ে নানারকম আলোচনা শুনতুম, তার সবগুলো বলবার মতো নয়। তাদের ভদ্রতার আদর্শ সমান ছিলো না। মনের মধ্যে যে-চাঞ্চল্যটা স্বাভাবিক কারণেই হ’তো, সেটাকে ব্যক্ত করবার উপায়ও ছিলো এক-এক জনের এক-এক রকম; বেশির ভাগ শুধু কথা ব’লেই খুশি থাকতো-অর্থাৎ জীবনে যা ঘটবার কোনো সম্ভাবনাই নেই, নিজের মনে সে-সব কল্পনা ক’রে নিয়ে গল্প করতো; কয়েকজন দুঃখসাহসী কোনো-না-কোনো অছিলায় মেয়েদের কমনরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে অপর্ণার সঙ্গে আলাপ ক’রে এলো; আর কেউ-কেউ ছিলো একেবারে চুপ। ব’লে রাখা ভালো আমি ছিলুম এই শেষের দলে। ক্লাসে আমি বসতুম সব শেষের বেঞ্চিতে; অনেকগুলো মাথার ফাঁক দিয়ে হঠাৎ কখনো কখনো অপর্ণাকে আমার চোখে পড়তো-তার স্বতন্ত্র চেয়ারে ব’সে খোলা বইয়ের দিকে তাকিয়ে, একটি হাত গালের উপর ন্যস্ত। ফ্রেমে বাঁধানো ছবির মতো সেই মুখ, বসবার সেই ভঙ্গিটি আমার মুখস্থ হ’য়ে গিয়েছিলো, এখনো মনে করতে পারি। সরু হাতে একটি মাত্র চুড়ি, মাথার কাপড়ের চওড়া পাড় মখখানাকে ঘিরে আছে। লক্ষ্য করতুম, অপর্ণা আগাগোড়া বইয়ের উপরেই চোখ রাখে, যেন অত্যন্ত সংকুচিত হ’য়ে নিজেকে দিয়েই নিজেকে আড়াল ক’রে রাখতে চায়। শুধু মাঝে-মাঝে অতগুলো কালো মাথা ভেধ ক’রে ওর চোখের দৃষ্টি আমারই মুখের উপর যেন এসে পড়তো। তবে এটা খুব সম্ভব আমার কল্পনা।

চার বছর অপর্ণা ছিলো আমার সহপাঠিনী, কিন্তু তার মধ্যে এটুকুই আমার সঙ্গে ওর পরিচয়। সে-চার বছরে ওর কণ্ঠস্বর পর্যন্ত আমি কোনোদিন শুনিনি, মুখোমুখি কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ওকে দেখিনি কখনো। ও-সব পুরস্কার লাভের জন্য আমার চেয়ে যোগ্য অনেকেই ছিলো। তার মধ্যে অশোক ছিলো পয়লা নম্বর। অশোক কাপ্তেন গোছের ছেলে, বাপের দেদার পয়সা, মাঝে-মাঝে বাড়ির গাড়ি চ’ড়ে কলেজে আসে, শীতকালে ফ্ল্যানেলের পাৎলুন আর বিলেতি শার্ট পরে, সিগারেট নিজে খায় যত, বিলোয় তার বেশি, সমস্ত ইউনিভার্সিটিতে নিংসন্দেহে সে সব চেয়ে পপুলার। চমৎকার চেহারা, তাছাড়া গুণও তার অনেক। টেনিস খেলতে পারে, অভিনয় করতে পারে, সাইকেল চালাতে অদ্বিতীয় ইত্যাদি ইত্যাদি। হল-এর ড্রামাটিক সেক্রেটারি থেকে আরম্ভ ক’রে ইউনিভার্সিটি ইউনিয়নের সেক্রেটারি পর্যন্ত যেটার জন্যই যখন দাঁড়িয়েছে, অসম্ভবরকম বেশি ভোট পেয়ে অনায়েসে নির্বাচিত হয়েছে। সত্যি বলতে, ওর প্রতিদ্ব›দ্বী হবার মতো ছেলে আর ছিলো না।


এই অশোকের কাছে অপর্ণার কথা অনেক শুনতুম। সে তুখোড় ছেলে; কমনরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে দু-মিনিট আলাপ ক’রেই তৃপ্ত হয়নি, গেছে অপর্ণার বাড়িতে, চা খেয়েছে তার মা-কে মাসিকা ডেকেছে; তার বাবার সঙ্গে পলিটিক্স চর্চা করেছে ভাই-বোনদের সঙ্গে ভাব জমিয়েছে; এক কথায়, যা-যা করা দরকার সবই করেছে সে। এক বছরের মধ্যে এই ভাগ্যবান পুরুষ এমন জমিয়ে তুললো যে অন্য ছেলেরা তাকে মনে-মনে ঈর্ষা ও বাইরে খোশামোদ করতে লাগলো-যদি তার সূত্রে তারাও সেই অমরাবতীর কাছাকাছি পৌঁছতে পারে। কিন্তু অন্য সকলকে অগ্রাহ্য ক’রে অশোক গায়ের প’ড়েই আমার কাছে শুধু ঘেঁষতো, তার কারণ বোধহয় এই যে, আমি ছিলুম আদর্শ শ্রোতা, আমার কাছে কাছে মনে সমস্ত কথা উজোড় ক’রে সে ভারি আরাম পেতো। কতদিন আমাকে নিয়ে ক্লাশ পালিয়েছে, শীতের সুন্দর দুপুরবেলায় ঘাসে উপর ব’সে আমাকে শুনিয়েছে অফুরন্ত অপর্ণা-চরিত। এ ধরনের গল্প সাধারণত ক্লান্তিকরই হয়, কিন্তু আমি স্বীকার করবো যে, আর কিছু না হোক, বার-বার ঐ অপর্ণা নামটি শুনতেই আমার ভালো লাগতো।

সব কথার শেষে অশোক আমাকে প্রায়ই বলতো, ‘চলো না তুমি একদিন ওদের বাড়ি।’

আমি বলতুম, ‘পাগল।’

‘ও চায় তোমার সঙ্গে আলাপ করতে। ডক্টর করের সঙ্গে ও টিউটরিয়াল করে, তিনি ওকে প্রায়ই বলেন কিনা তোমার কথা।’

এখানে লজ্জার সঙ্গে ব’লে রাখি যে লেখাপড়ায় বরাবরই আমি একটু ভালোর দিকে। আত্মীয়রা আশা করেছিলেন হোমরা-চোমরা মস্ত চাকুরে হবো, কিন্তু কিছুই হ’লো না, সামান্য মাষ্টারি ক’রে সংসার টিকে আছি।

অশোকের কথা আমি রাখিনি, একদিনও যাইনি ওর সঙ্গে অপর্ণার বাড়ি। অপর্ণার সঙ্গে আলাপ করার লোভ আমার ছিলো না এমন অসম্ভব কথা আপনাদের বিশ্বাস করতে বলছি না। খুবই ছিলো। কিন্তু অত্যন্ত লাজুক হ’লেও ভিতরে-ভিতরে আমি ছিলাম গর্বিত। অশোকের মধ্যস্থতায় অপর্ণার সঙ্গে আলাপিত হওয়া আমার পক্ষে অসম্মান। আমিই বা ওর চেয়ে কম কিসে! তাছাড়া ছাত্রজীবনের নানারকমের কাজে ও অকাজে, দিন ভ’রে আড্ডা আর রাত জেগে পড়ায় এত ব্যস্ত ছিলুম যে, তার মধ্যে অপর্ণার কথা ভাববার খুব বেশি সময়ও ছিলো না।

হু-হু ক’রে কাটতে লাগলোা দিন, বি. এ. পরীক্ষা হ’য়ে গেলো। আমার বিষয় ছিলো দর্শন, আজগুবি রকমের ভালো নম্বর পেয়ে ফাস্ট ক্লাশে উৎরের গেলুম। অপর্ণা আর অশোক দু-জনেই ছিলো পাশ-কোর্সে, এম. এ.-র শেষ বছরে এসে অপর্ণা আমার নিকটতর সহপাঠিনী হ’লো, কারণ সেও দর্শনে এম. এ. নিয়েছিলো। মর্ডান ইয়ং ম্যান অশোক নিয়েছিলো ইকনমিক্স, কিন্তু অধ্যয়নের ব্যবধান ডিঙিয়ে সে সমীপরবর্তিতায় মৌরশিপাট্টার ব্যবস্থা ক’রে এনেছিলো। একদিন খুব চুপে-চুপে আমাকে বললে কথাটা। সবই ঠিকঠাক এম. এ.টা হ’য়ে গেলেই হয়।

পাঠ্যবিষয়ের মধ্যে দর্শনের বাজার-দর তখন থেকেই নামতে শুরু করেছে। সবসুদ্ধু আমরা সাতজন ছিলাম ক্লাশে, ছ-টি ছেলে ও একটি মেয়ে। আলাপ করার সুযোগ ছিলো অবারিত। পড়াশুনোয় সাহায্য করার অছিলা হাতের কাছেই, আর আমার মুখে সেটা ফাঁকা বুলিও শোনাতো না। কিন্তু যখনই কথা আমার মনে হ’তো তখনই আমার ভিতর থেকে কে আর একজন ব’লে উঠতো-‘তুমি গিয়ে কারো সঙ্গে যেচে আলাপ করবে-ছি!’

একদিকে অশোক আমাকে বড়োই পিড়াপিড়ি করতে লাগরো অপর্ণাদের বাড়ি যাবার জন্য। কান্ট দুর্বোধ্য ঠেকছে অপর্ণার, আমার সাহায্য দরকার। আমি হেসে বললুম, ‘বড়ো-বড়ো বিদ্বান মাষ্টার মশাইদের মুখে শুনে যা সরল হচ্ছে না, তা কি বোঝাতে পারবো পারবো আমি!’ আর একদিন অশোকের হাকুম, হেগেল সম্বন্ধে আমার কী-কী নোট আছে দিতে হবে। শুনে মনে হ’লো, হায় হায়, কেন অন্য ছেলেদের মতো নোট রাখিনি! কিন্তু আমার যে কোনো নোটই নেই, এ-কথা অশোক বোধহয় বিশ্বাস করলো না; ভাবলো পরীক্ষা সংক্রান্ত আমার সব গোপনীয় তুকতাক ফুশমন্তরে আমি অন্য কাউকে অংশী করতে চাই না। যাই হোক,ত অপর্ণার হ’য়ে অশোক আমাকে পড়াশুনো বিষয়ে আর কোনো কথা জিগেস করেনি।


অতএব দর্শনের ছোটো ক্লাসে দুটো বেঞ্চির ওপারে অপর্ণার দিকে তাকিয়ে-তাকিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বছরটা কাটলো। আমার মনে হ’তো, অপর্ণা আমার দিকে ঘন-ঘনই তাকাচ্ছে কিন্তু এই নিশ্চয়ই আমার মনে ভুল।

এম. এ. পরীক্ষা হ’য়ে গেলো। বিশ্ববিদ্যালয়কে বিদায় দিয়ে বেকার-বাহিনীতে ভর্তি হবার সময় যখন ঘনাচ্ছে, এমন সময় অশোক একদিন আমার বাড়ি এসে সুখবর দিয়ে গেলো। তারিখ পর্যন্ত ঠিক। আজ সন্ধ্যায় কন্যার আশীর্বাদ উপলক্ষ্যে অপর্ণাদের বাড়িতে উৎসব, আমি যেন অবশ্যই যাই।

আমি তক্ষুনি বললুম, ‘যাবো।’ আমার হঠাৎ মনে হ’লো আজ আর আমার যাবার কোনো বাধা নেই, যদিও এতদিন যে কী বাধা ছিলো তাও আমি জানি না।

এই প্রথম আমি অপর্ণাকে কাছাকাছি দেখলুম, তার কথা শুনলুম। কিন্তু সেদিন তার সম্পূর্ণ অন্য মূর্ডু, কপালে চন্দন, পরনে খয়েরি রঙের রেশমি শাড়ি, গা ভরা গয়না। চেনাই যায় না। যে-ঘরটায় গিয়ে বসলুম সেখানে অনেক লোক। অধিকাংশই আমার অচেনা, সুতরাং জড়োসড়োভাবে চুপ ক’রে রইলুম।

অশোক এক সময়ে আমার কাছে এসে চুপি চুপি বললে, ‘এখানে তোমার ভালো লাগছে না, বুঝতে পারছি। চলো আমার সঙ্গে।’

নিয়ে গেলো আমাকে পাশের একটি ছোটো ঘরে, অপর্ণার পড়ার ঘর সেটা। চারদিকে দর্শনের বই দেখে খানিকটা আরাম পেলাম। আমাকে বসিয়েই অশোক যেন কোথায় অন্তর্হিত হ’লো, ভারি ব্যস্ত সে। একা ব’সে আমি একটি বইয়ের পাতা ওল্টাতে লাগলুম।

মৃদু শব্দ শুনে চমকে তাকিয়ে দেখি অপর্ণা একটু দূরে দাঁড়িয়ে। সন্ত্রস্ত হ’য়ে উঠে দাঁড়ালুম, কী বলবো ভেবে পেলুম না।

অপর্ণা প্রথমে কথা বললে, ‘এতদিনে আপনি এলেন!’

আমি বললুম, ‘আমার অভিনন্দন আপনাকে জানাই।’

‘এতদিন আসেননি কেন?’

‘আসিনি-আসিনি-তার মানে-আসা হয়নি আরকি।’

‘অশোক আপনাকে বলেনি আসতে?’

‘বলেছে।’

‘আপনি কি ওর কথা বিশ্বাস করেননি?’

‘অবিশ্বাস করিনি, তবে-’

‘তবে আমার সঙ্গে আলাপ করার আপনার ইচ্ছে হয়নি, এই তো?’

‘না-না-ইচ্ছে হবে না কেন।’

অপর্ণা একটু মুচকি হেসে বললে, ‘থাক, এখন আর ভদ্রতার কথা ব’লে কী লাভ-এখন তো আর সময় নেই।’

শেষের কথাটা শুনে হঠাৎ আমার বুকের ভিতরটা ধ্বক ক’রে উঠলো। অপর্ণা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললে, ‘এই চার বছরে অশোককে দিয়ে এতবার আপনাকে খবর পাঠালুম,-একবার এলেন না!’ তারপর একটু চুপ ক’রে থেকে ঈষৎ মাথা নেড়ে খুব নিচু গলায় বললে, ‘কিচ্ছু বোঝেন না আপনি!’ সঙ্গে-সঙ্গে শুনতে পেলুম অপর্ণার দীর্ঘশ্বাস, কিন্তু সেটাও বোধ হয় আমার কল্পনা।

বাড়ি ফিরে অনেক রাত অবধি ঘুমোতে পারলুম না, হয়তো তার একটা এই যে অন্যমনস্কভাবে ও-বাড়িতে অত্যন্ত বেশি খেয়ে ফেলেছিলুম। শুয়ে-শুয়ে অনেক কথা মনে হ’লো। অপর্ণার কথাগুলি বিষাক্ত পোকার মতো মগজের মদ্যে যেন কামড়ে ফিরছে। ভাবনাগুলো যেখান থেকেই শুরু হোক, খানিক পরে এক অন্ধ গলির সামনে এসে পড়ে, তারপর আর রাস্তা নেই। আমি যে কত বড়ো বোকা তা উপলব্ধি ক’রে স্তম্ভিত হ’য়ে গেলুম। অন্ধকারে চোখ মেলে নিজের মনে বার-বার বললুম, ও আমাকেই চেয়েছিলো, আমাকেই চেয়েছিলো, হয়তো এখনো-না, না, এখন আর সময় নেই, আর সময় নেই।

কয়েকদিন পরেই অপর্ণার বিয়ে হ’য়ে গেলো, আর আমি চ’লে এলুম কলকাতায় চাকরির চেষ্টায়।

দশ বছর কেটে গেছে। আমি এখনো বিয়ে করিনি, তার কারণ আমার ক্ষীণ আয়ের উপর মা-বাবা-ভাই-বোনের নির্ভর, আমি বিয়ে করলেই তাদের ভাগে কম পড়বে, অতএব সে-বিষয়ে আমার উদাসীন থাকাই কর্তব্য। অশোক ঢুকেছিলো ইনকাম ট্যাক্সে, এতদিনে নিশ্চয়ই অফিসার হয়েছে, হয়তো রংপুরে, হয়তো বরিশালে, হয়তো চাটগাঁয়ে হাকিমি করছে। আমার জীবন অত্যন্ত শান্ত ও নিয়মিত; কোনো আক্ষেপ, কোনো উচ্চাশা, কোনো কল্পনা নেই। দর্শন পড়ি ও পড়াই, নিছক বুদ্ধিবৃত্তির চর্চাকেই জীবনের একমাত্র সুখ ব’লে মেনে নিয়েছি। ভালোই আছি।

শুধু মাঝে-মাঝে অনেক রাত্রে সেই একটি তরণ শ্যামলা মুখ আমার মনে পড়ে, সরু হাতে একটিমাত্র চুড়ি, নীল শাড়ির পাড় মাথাটিকে ঘিরেছে। অন্ধকারের কে যেন চুপি-চুপি কথা বলে-‘এত দেরি ক’রে এলেন-আর তো সময় নেই।’ 

অতিকায় ডানাঅলা অতিশয় বৃদ্ধ এক লোক- গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস


মূল: গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস


অনুবাদ: শামসুজ্জামান হীরা


বাদল নামার তৃতীয় দিনে তারা ঘরের মধ্যে এত কাঁকড়া মেরেছিল যে, পেলাইয়োকে তার বর্ষণসিক্ত উঠান পেরিয়ে ওগুলোকে সমুদ্রে ছুড়ে ফেলতে হয়েছিল, কারণ নবজাত শিশুটির সারা রাত জ্বর ছিল, এবং তাদের ধারণা হয়েছিল এর জন্য কাঁকড়ার তীব্র দুর্গন্ধই দায়ী।
মঙ্গলবার থেকে বিষণ্নতায় ছেয়ে ছিল বিশ্বচরাচর। সাগর আর আকাশ একাকার ছিল ছাইরঙে এবং সৈকতের বালুকারাশি, মার্চ মাসের রাতে যা গুড়ো-করা আলোর মত চমকায়, তখন হয়ে পড়েছিল কাদা এবং পচা শক্ত খোলযুক্ত মাছগুলোর আধাসেদ্ধ ব্যঞ্জনের ন্যায়।


পেলাইয়ো যখন কাঁকড়াগুলো ফেলে ঘর মুখো ফিরছিল, দুপুরবেলাতেই আলো এতটাই কম ছিল যে, উঠানের পেছন দিকটায় কী যেন একটা নড়ছিল এবং গোঙাচ্ছিল যা দেখা তার পক্ষে বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাকে খুব কাছে গিয়ে দেখতে হল। ওটা এক বুড়ো, অতিশয় বৃদ্ধ এক লোক। কাদায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। প্রবল প্রচেষ্টাতেও উঠে দাঁড়াতে পারছে না; বাধা সৃষ্টি করছে তার অতিকায় ডানা দুটো।


দুঃস্বপ্নে আতঙ্কগ্রস্ত পেলাইয়ো তার স্ত্রী এলিসেন্দার কাছে ছুটে গেল। এলিসেন্দা তার অসুস্থ শিশুর কপালে জলপট্টি দিচ্ছিল। পেলাইয়ো তাকে উঠানের পেছনে নিয়ে গেল। তারা উভয়েই হতভম্ব হয়ে সেখানে পড়ে থাকতে দেখল একটা নিঃশব্দ-অসাড় দেহকে। বুড়ো লোকটির পরনে ছিল আবর্জনাস্তূপ থেকে ন্যাকড়া সংগ্রহকারীদের মত পোশাক। তার টেকো মাথায় সামান্য কটা ধূসর চুল, মুখগহ্বরে অল্প কটা মাত্র দাঁত — ভিজে জবজবে প্রপিতামহতুল্য লোকটির এতটাই করুণ দশা যে তার কখনও ঠাটবাট থাকতে পারে সে বোধটুকুও যেন মুছে গিয়েছিল। ঈগলের মত তার বিশাল ডানা, নোংরা এবং আদ্দেক পালক ওঠানো, কাদার মধ্যে যেন চিরতরে জড়িয়ে গিয়েছিল। খুব কাছ থেকে এবং বেশ কিছুক্ষণ ধরে তার দিকে তাকিয়ে থেকে সহসাই পেলাইয়ো ও এলিসেন্দা তাদের বিস্ময় থেকে বেরিয়ে এল, এবং অবশেষে তাকে পরিচিত মনে হল। তখন তারা সাহস সঞ্চয় করে তার সঙ্গে কথা বলল। সে দুর্বোধ্য ভাষায় একজন নাবিকের চড়া গলায় কথার জবাব দিল। এভাবে তারা ডানা নিয়ে যে দ্বিধায় ছিল তা এড়িয়ে গেল, এবং যথেষ্ট বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাল যে, সে ঝড়ে বিধ্বস্ত কোনও বিদেশি জাহাজের একজন নিঃসঙ্গ নাবিক। তা সত্ত্বেও, তারা তাকে দেখাবার জন্য প্রতিবেশী এক নারীকে ডাকল, যে জীবন-মৃত্য সম্পর্কে সবকিছু জানত, মহিলাটির শুধু প্রয়োজন ছিল একনজর দেখে তাদের ভ্রম শুধরে দেওয়া।


“সে একজন দেবদূত”, মহিলাটি বলল। “সে নিশ্চয়ই শিশুদের জন্য আসছিল, কিন্তু বেচারা এতটাই বুড়ো যে বৃষ্টি তাকে মাটিতে ফেলে দিয়েছে।”


পরদিন সবাই জানল যে, একজন রক্তমাংসের দেবদূতকে পেলাইয়োর বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছে। দেবদূতরা সেই সময়ে ছিল স্বর্গীয় ষড়যন্ত্রের কারণে জীবিত পলাতক, তার কাছে মনে হলেও, বিজ্ঞ প্রতিবেশী মহিলার এই বিচারের বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলবার ইচ্ছা জাগল না তাদের মধ্যে। পেলাইয়ো সারা বিকেল তার সেপাইয়ের লাঠি হাতে নিয়ে রান্নাঘর থেকে তার প্রতি নজর রাখল, এবং শুতে যাওয়ার আগে সে তাকে কাদা থেকে টেনে তুলে জালে তৈরি মুরগির খাঁচায় আটকে রাখল। মাঝরাতে যখন বৃষ্টি থেমে গিয়েছিল, পেলাইয়ো ও এলিসেন্দা তখনও কাঁকড়া মেরে চলেছিল। কিছুসময় পর শিশুটির জ্বর সেরে গেল; কিছু খাওয়ার ইচ্ছায় সে জেগে উঠল। তখন তারা প্রসন্ন বোধ করল এবং দেবদূতকে বিশুদ্ধ জল ও তিন দিনের প্রয়োজনীয় বিবিধ সরঞ্জামসহ ভেলায় তুলে দিয়ে গভীর সমুদ্রে তার নিয়তির ওপর ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিল। প্রত্যুষের প্রথম আলোতে যখন তারা আঙ্গিনার দিকে গেল, গ্রাম ভেঙে-আসা সকল প্রতিবেশীকে মুরগির খাঁচার কাছে দেবদূতের সঙ্গে কৌতুক-মশকরায় মেতে থাকতে দেখল। সামান্যতম সম্মানবোধের বালাই নেই। তারা খাঁচার তারের ফাঁক-ফোকর গলিয়ে খাওয়ার জন্য বিভিন্ন দ্রব্য তার দিকে ছুড়ে ছুড়ে দিচ্ছিল। যেন সে কোনও অলৌকিক কিছু নয়, সার্কাসের জন্তু মাত্র!


খবরটা জেনে বিস্মিত ফাদার গোনজাগা সকাল সাতটা বাজার আগেই এসে হাজির। ততক্ষণে ভোরবেলায় আসা দর্শনার্থীদের তুলনায় সদ্য আগত দর্শকদের মধ্যে উৎসাহে কিছুটা ভাটা পড়েছিল, তারা বন্দির ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভিন্ন জল্পনা-কল্পনায় মেতে উঠেছিল। তাদের মধ্যে সবচেয়ে যে ছিল সরল, সে ভেবেছিল তাকে ‘বিশ্বের মেয়র’আখ্যা দেওয়া উচিত। কঠোর-মনের অন্যেরা ভাবল তাকে পাঁচ-তারকা-বিশিষ্ট জেনারেলে পদোন্নতি দেওয়া উচিত যেন সে সব যুদ্ধে জিততে পারে। কোনও কোনও কল্পনাবিলাসী আশা করল, তাকে উন্নত প্রজাতি সৃষ্টির কাজে লাগানো যেতে পারে, যাতে করে সে মানবজাতিকে পাখনাবিশিষ্ট বিজ্ঞ প্রজাতিতে পরিণত করার বীজ পৃথিবীতে বপন করতে পারে, যারা গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দায়িত্ব নিতে সক্ষম হবে! তবে ফাদার গোনজাগা, ধর্মযাজক হবার আগে যিনি ছিলেন একজন জবরদস্ত কাঠুরে, খাঁচার পাশে দাঁড়িয়ে চটজলদি ধর্মানুশাসন ঘেঁটে দেখলেন, তাদেরকে খাঁচার দরজা খুলতে বললেন, যাতে তিনি বেচারা লোকটিকে খুব কাছ থেকে দেখতে পারেন, যাকে উচ্ছ্বল মুরগিছানাগুলোর মধ্যে বিশাল জরাজীর্ণ এক মুরগির মত দেখাচ্ছিল। সে এক কোনায়, ভোরে-আসা দর্শনার্থীদের তার দিকে ছুড়ে-দেওয়া ফল-ফলারি ও প্রতঃরাশের উদ্বৃত্তের মধ্যে শুয়ে সূর্যালোকে তার ডানা শুকাচ্ছিল। ফাদার গোনজাগা যখন তার খাঁচার ভেতর ঢুকে লাতিন ভাষায় তাকে সুপ্রভাত জানালেন, পৃথিবীর অভদ্র আচরণ সম্পর্কে অপরিচিত সে তখন শুধু তার প্রাচীন চোখজোড়া তুলে তার ভাষায় চাপাস্বরে কিছু একটা বলল। ছোট গির্জার যাজকের প্রথমেই সন্দেহ হল, সে একজন প্রতারক, যখন দেখলেন, সে ঈশ্বরের ভাষা বোঝে না, জানে না কীভাবে প্রভুর প্রতিনিধিকে অভ্যর্থনা জানাতে হয়। তারপর তিনি লক্ষ করলেন, কাছ থেকে দেখে তাকে অনেক বেশি মানুষ বলে বোধ হচ্ছিল: তার গা থেকে ভেসে আসছিল ভিনদেশীয় অসহনীয় গন্ধ, তার ডানার পেছন দিকটায় ছড়ানো ছিল পরজীবী-ছত্রাক, ডানার মূল পালকগুলো জাগতিক কোনও ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, একজন গর্বিত দেবদূত হওয়ার মত তার মধ্যে কিছুই ছিল না। তখন খাঁচা থেকে বেরিয়ে এসে তিনি কৌতূহলী নিরীহ লোকদেরকে এ-ব্যাপারে সাবধান থাকতে সংক্ষিপ্ত নসিয়ত করলেন। তিনি তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, অসাবধান লোকদেরকে বিভ্রান্ত করবার জন্য শয়তানেরও খ্রিস্টীয় উৎসবের সময় চালাকি চালানোর কূটঅভ্যাস আছে। তিনি যুক্তি দিয়ে বোঝালেন, পাখা যদি উড়োজাহাজ আর বাজপাখির ভেতর তফাত নির্ণয়ের কোনও উপাদান হিসাবে বিবেচিত না-হয়, একজন দেবদূত নির্ণয়ে তা আরও বেশি বিবেচিত না-হওয়ার কথা। যাহোক, তিনি প্রতিশ্রুতি দিলেন যে, এ ব্যাপারে তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন পাদ্রির কাছে পত্র লিখবেন যেন তিনি তা বিভাগীয় পর্যায়ের পুরোহিতের কাছে পাঠান এবং তিনি যেন মহামান্য পোপের সমীপে এর ওপর সর্বোচ্চ আদালতের একটা রায় চেয়ে সেই পত্রখানা পাঠান।


তাঁর জ্ঞান অনুর্বর হৃদয়সমূহে নাড়া দিল। বন্দি দেবদূতের খবরটি এত দ্রুত ছড়াল যে, ক’ঘণ্টার মধ্যেই উঠানটি হৈচৈমুখর বাজারে পরিণত হল এবং বিশৃঙ্খল জনতাকে, যারা তাদের ঘরটিকে প্রায় ধসিয়ে দেওয়ার উপক্রম করেছিল, ছত্রভঙ্গ করবার জন্য বেয়োনেটসহ সেনা তলব করতে হল। জটলার এত জঞ্জাল ঝাট দিয়ে পরিষ্কার করতে করতে এলিসেন্দার মেরুদণ্ড প্রায় মুচড়ে গিয়েছিল, তখন তার মাথায় চমৎকার এক বুদ্ধি এল, উঠানটিকে ঘিরে ফেললে এবং দেবদূতকে দেখার জন্য জনপ্রতি পাঁচ টাকা করে প্রবেশমূল্য নির্ধারণ করলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়!


কৌতূহলীরা দূরদূরান্ত থেকে এসেছিল। উড়ন্ত দড়াবাজসহ (acrobat) চলমান এক আনন্দমিছিল এল। দড়াবাজটি জনসমাগমের মাথার ওপর দিয়ে সশব্দে বারবার উড়ে চক্কর দিচ্ছিল। কিন্তু কেউ তাতে আমল দিলে তো! দেবদূতের ডানার মত তার ডানা থাকলে তো! তারটা ছিল ছোট, খুদে বাদুড়ের ডানার মত! স্বাস্থ্যের খোঁজে এসেছিল পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্ভাগা অক্ষম ব্যক্তিরা: এক বেচারি স্ত্রীলোক এসেছিল যে বাল্যকাল থেকে গুণে আসছিল আর হৃদস্পন্দন, গনার সংখ্যা এখন তার হাতে আর নেই ; এসেছিল একজন পর্তুগিজ, যে রাতে তারকাদের হট্টগোলের জ্বালাতনে ঘুমাতে পারে না; একজন ঘুমেহাঁটা-লোক এসেছিল যে রাতে জেগে ওঠে, জাগ্রত অবস্থায় যাকিছু সে করেছিল ঘুমের ঘোরে তা বাতিল করবার জন্য; তুলনামূলক কম অসুস্থতা নিয়ে এসেছিল আরও অনেকে। দুনিয়া কাঁপানো জাহাজভাঙা বিশৃঙ্খলার মধ্যে পেলাইয়ো এবং এলিসেন্দা পরিশ্রমে খুশিই ছিল, কেননা সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে তারা তাদের কক্ষগুলো টাকায় ভরে ফেলেছিল এবং ভেতরে প্রবেশের জন্য অপেক্ষমাণ তীর্থযাত্রীদের লাইন তখনও দিগন্ত ছাড়িয়ে চলে গেছে!


একমাত্র দেবদূতই যে তার নিজের এই নাটকে কোনও অংশ নিচ্ছিল না। সে সময় কাটাচ্ছিল তার ধার-নেওয়া নীড়ে স্বস্তিতে থাকার চেষ্টায়, কুপি-বাতি এবং তারের বেড়া বরাবর স্থাপিত পবিত্র মোমবাতিগুলোর বিদঘুটে গরমে কেমন এক বিহ্বলতা নিয়ে। শুরুতে, দেবদূতদের জন্য নির্ধারিত খাদ্য বলে সেই বিজ্ঞ প্রতিবেশী মহিলার ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী তারা তাকে ন্যাপথালিন খাওয়াতে চেষ্টা করল। কিন্তু ওগুলো সে ফেলে দিতে থাকল, যেমন সে ফেলে দিচ্ছিল পোপের দেওয়া খাদ্য, যা পাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আনা হয়েছিল। তারা খুঁজে পাচ্ছিল না কী তার খাদ্য, হয়ত এজন্য যে, সে একজন দেবদূত অথবা এজন্য যে, সে একজন অতি বৃদ্ধ মানুষ। শেষপর্যন্ত সে খেয়েছিল আর কিছুই নয় — বেগুনের ঘেঁট। ধৈর্যই ছিল, মনে হয়, তার একমাত্র অলৌকিক গুণ। বিশেষ করে প্রথম দিনে, যখন তার ডানায় ছড়িয়ে থাকা ব্যাপক বাসি পরজীবী-ছত্রাকের খোঁজে মুরগিগুলো তাকে ঠোঁকরাচ্ছিল, এবং পঙ্গু-খোড়ারা তার ডানার পালক তুলে নিচ্ছিল নিজেদের শরীরের খুঁতে ছোঁয়াবার জন্য, তাদের মধ্যে যারা ছিল সবচেয়ে দয়ালু তারাও ছুড়ছিল পাথরের ঢিল, চেষ্টা করছিল সে যেন উঠে দাঁড়ায়, যেন তারা তাকে দাঁড়ানো দেখতে পায়। একবারই তারা তাকে জাগাতে পারল, যখন তারা বলদের গায়ে চিহ্ন দেওয়ার তপ্ত শিক দিয়ে তার একপাশে ছ্যাঁকা দিল। সে বহুক্ষণ যাবত অসাড় পড়ে থাকায় তাকে তারা মৃত ভেবেছিল। সে সচকিত হয়ে জেগে উঠল, জলভরা চোখে রাগত স্বরে অপার্থিব ভাষায় গর্জে উঠল, এবং বার দুয়েক ডানা ঝাপটাল, যা সৃষ্টি করল মুরগি-বিষ্ঠা, মিহি ধুলোর ঘুর্ণিবাত্যা, এমন এক ভীতিকর ঝড় যা এই ধরাধামের নয় বলে মনে হল। যদিও কেউ কেউ ভাবল, তার এই প্রতিক্রিয়া ক্রোধ নয় বরং বেদনাসঞ্জাত, সেই থেকে তারা তাকে বিরক্ত করা থেকে সতর্ক থাকল, কারণ অধিকাংশ লোক মনে করল, তার এই নিস্পৃহতা কোনও বীরের নিজেকে সহজ রাখা নয়, বরং প্রলয়ের শান্ত ভাব ধরে থাকা।


পুরো বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তি ও বিরক্তির কারণে জনতার ছ্যাবলামো থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন ফাদার গোনজাগা। অপেক্ষা করছিলেন বন্দিটির ব্যাপারে চূড়ান্ত রায় পাওয়ার। কিন্তু রোম থেকে আসা পত্রের ক্ষেত্রে কোনও দ্রুততা দেখা যাচ্ছিল না। তারা সময় ক্ষেপণ করছিল, বন্দির নাভি আছে কিনা, তার ভাষার সঙ্গে ‘আরামিক’ (প্রায় ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সিরিয়া অঞ্চলের চালু ভাষা -- অনু:) ভাষার কোনও মিল আছে কিনা, কতবার একটা সুচের ডগায় নিজেকে সে আঁটাতে পারে (এটা মধ্যযুগীয় খ্রিস্টীয় ধারণা যে, যেহেতু দেবদূতরা দেহধারী নয়, দেহ ধারণ করলেও অলৌকিক সত্তা, তাই একটি সুচের ডগায় অসংখ্য দেবদূত নিজেদের আঁটাতে পারে -- অনু:), নাকি সে কেবলই পক্ষবিশিষ্ট কোনও এক নরওয়েবাসী। সেই ক্ষুদ্র পত্রগুলো সময় শেষ না-হওয়া পর্যন্ত আসা-যাওয়া করতে পারত যদি না এক দৈবাধীন ঘটনা যাজকের ক্লেশের সমাপ্তি ঘটাত।


ঘটনাটা এরকম ঘটল যে, সেই দিনগুলোতে অনেক ভ্রাম্যমাণ আনন্দমেলার আকর্ষণের মধ্যে, শহরে আবির্ভূত হল এক নারী যে তার পিতামাতার অবাধ্য হওয়াতে একটি মাকড়শায় রূপান্তরিত হয়েছিল। তাকে দেখার দর্শনি দেবদূতকে দেখার দর্শনির চেয়ে কম ছিল না, কিন্তু তাকে তার এই উদ্ভট দশা সম্পর্কে যেকোনও ধরনের প্রশ্ন করবার সুযোগ ছিল যে-কারও, তাকে আগাপাশতলা নিরীক্ষা করবার সুযোগ ছিল, যাতে তার আতঙ্ককর অবস্থা সম্পর্কে কারও মনে কোনও সন্দেহ না থাকে। সে ছিল ভয়ঙ্কর এক ‘তেরান্তুলা’ (দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলীয় অঞ্চলের অতিকায় একধরনের বিষাক্ত রোমশ মাকড়শা যা ছোট পাখি, গিরগিটি বা ব্যাঙ ধরে খেয়ে ফেলতে পারে -- অনু:), আকারে ভেড়ার মত — মাথাটা বিষণ্ন কুমারীর। যা ছিল সবচেয়ে হৃদয়বিদারক, তা তার বিশ্রী আকৃতি নয়, বরং তার দুর্দশার আন্তরিক বিস্তারিত বয়ান। যখন সে বলতে গেলে বালিকা, পিতৃগৃহ থেকে চুপিচুপি পালিয়েছিল এক নাচের আসরে যোগ দেওয়ার জন্য। বিনা অনুমতিতে সারা রাত নেচে যখন সে বনের মধ্য দিয়ে ফিরে আসছিল, একটা ভয়াবহ বজ্রধ্বনি আকাশকে দ্বিখণ্ডিত করেছিল এবং সেই ফাটল গলিয়ে বজ্রের উজ্জ্বল শিখা এসে তাকে মাকড়শায় পরিণত করেছিল। তার একমাত্র পুষ্টিকর খাদ্য ছিল মংসের বড়া, যা তার মুখে ছুড়ে দিত দানশীল আত্মারা। ওরকম দৃশ্য, এত মানবিক সত্যতায় পূর্ণ, এত ভয়াবহ শিক্ষণীয়, সেই উদ্ধত দেবদূত, যে মাঝেমধ্যে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল মানুষগুলোর দিকে তাকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছিল। উপরোন্তু, দেবদূতের ওপর আরোপিত কিছু অলৌকিকত্ব নেহাত মানসিক বৈকল্যের সাক্ষ্য দিয়েছিল, যেমন অন্ধ ব্যক্তিটি তার দৃষ্টিশক্তি ফেরত পায়নি, তবে তার নতুন তিনটি দাঁত গজিয়েছিল, অথবা যে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হাঁটতে পারত না, লটারিতে প্রায় জিতে গিয়েছিল সে, আর যে কুষ্ঠরোগী এসেছিল, তার ক্ষত থেকে বার হচ্ছিল সূর্যমুখিগাছের চারা। সেসব সান্ত্বনামূলক অলৌকিকত্ব, যা ছিল হাস্যকর কৌতুকের চেয়েও বেশি, দেবদূতের সুনামকে এরই মধ্যে নষ্ট করে দিয়েছিল। সেই নারীটি, যে মাকড়শায় রূপান্তরিত হয়েছিল, শেষমেশ একেবারে ধ্বংসই করে দিয়েছিল তার যত নামডাক। এটা এরকম যে, ফাদার গোনজাগা তাঁর নিদ্রাহীনতা রোগ থেকে চিরতরে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন এবং পেলাইয়োর উঠান তিনদিন আগে বৃষ্টি শুরুর পূর্বাবস্থায় যেমন ফাঁকা ছিল, কাঁকড়াগুলো শোবার ঘরের মধ্যদিয়ে হেঁটে যেত না, সে অবস্থায় ফিরে গিয়েছিল।


গৃহমালিকদের অনুশোচনার কোনও কারণ ছিল না। জমানো টাকা দিয়ে তারা ঝোলানো বারান্দাঅলা দোতলা বাড়ি বানাল, সৃজন করল বাগান এবং উঁচু জালের ঘেরাওয়ের ব্যবস্থা করল যাতে শীতকালে ভেতরে কাঁকড়া ঢুকতে না পারে, এবং জানালায় লাগাল লোহার শিক যেন আর কোনও দেবদূত ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। পেলাইয়ো শহরের কাছে খোরগোশের এক বিশাল খামার গড়ে তুলল, চিরতরে ইস্তফা দিল কোর্টের সেপাইয়ের চাকরি থেকে, এবং এলিসেন্দা কিনল সেই এলাকায় সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত এবং কাঙ্ক্ষিত মহিলারা রোববারে যেসব পোশাক-আশাক ব্যবহার করত, উঁচু হিলের পায়ের পাতা আবৃতকারী জুতা, প্রচুর ঝলমলে সিল্কের পোশাক, যা আলোর হেরফেরে রং বদলায়। মুরগির খাঁচাটাই একমাত্র বস্তু যা কোনও গুরুত্ব পেল না। তারা যদিও তা জীবাণুনাশক ‘ক্রেওলিন’ দিয়ে ধুয়ে সাফ করত, প্রায়শই লোবান জ্বালাত, সেটা আদৌ দেবদূতের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য নয়, বরং বিষ্ঠাস্তূপের অতি দুর্গন্ধ যা তখনও ভূতের মত সর্বত্র ঝুলে থাকছিল এবং নতুন বাড়িটাকে পুরনোটাতে পরিণত করছিল, তা দূর করবার জন্য। ওদের বাচ্চাটা যখন সবে হাঁটতে শুরু করেছিল, তারা খুব সতর্ক থাকত যেন বাচ্চাটা মুরগির খাঁচার খুব কাছে যেতে না পারে। পরে তারা তাদের ভয় থেকে মুক্ত হতে লাগল এবং দুর্গন্ধের সঙ্গে মানিয়ে নিতে থাকল। বাচ্চাটির দ্বিতীয় দাঁত ওঠার আগে সে মুরগির খাঁচার ভেতর খেলা করতে যেতে লাগল। অযত্নে খাঁচাটির তারের বেড়া ছিড়ে গিয়েছিল। দেবদূত অন্যলোকদের চেয়ে বাচ্চাটির সঙ্গে যে কম উদ্ধত ছিল, তা নয়, কিন্তু সে কুকুরের নির্মোহ ধৈর্য নিয়ে বাচ্চাটির যত উদ্ভট অবজ্ঞা সহ্য করে যাচ্ছিল। তারা উভয়েই একই সঙ্গে জলবসন্ত রোগে আক্রান্ত হল। ডাক্তার, যে শিশুটির চিকিৎসা করছিল, দেবদূতের হৃদয়ের ধুকপুকোনি শুনবার ইচ্ছা থেকে নিজেকে নিবৃত রাখতে পারল না, এবং সে লক্ষ করল হৃৎপিণ্ডে অতি জোর শিসের ধ্বনি, এবং কিডনিতে অতি বিচিত্র সব আওয়াজ, এতে করে তার মনে হল, বুড়োর বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। সে যাহোক, যা তাকে খুব আশ্চর্য করল তাহল তার ডানার যৌক্তিকতা। সেগুলোকে মানুষের পুরো দেহে এতটাই স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল যে, সে বুঝতে পারছিল না, কেন অন্য সব মানুষের শরীরে ওগুলো লাগানো হল না।


যখন শিশুটি স্কুলে যেতে শুরু করল, সেই সময়ের মধ্যে রোদ-বৃষ্টিতে ধসে গিয়েছিল মুরগির খাঁচা। দেবদূতটি একজন পরিত্যক্ত মৃতপ্রায় লোকের মত নিজেকে হেথা-হোথা টেনে-হিঁচড়ে বেড়াতে থাকল। তারা তাকে ঝেঁটিয়ে শয়নকক্ষ থেকে দূর করলেও মুহূর্তের ব্যবধানে তাকে রান্নাঘরে দেখতে পাওয়া যেতে লাগল। তাকে একই সময়ে অনেক জায়গায় দেখা যেতে লাগল, তাতে তাদের মনে হল তার প্রতিলিপি অনবরত তৈরি হয়ে চলেছে, যেন সে নিজেকে পুনরুৎপাদন করে চলেছে সারা ঘরময়, এবং এলিসেন্দা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ক্রোধে চিৎকার করে উঠল: দেবদূতদের এই নারকীয় দঙ্গলের মধ্যে বাস করা অসম্ভব! বুড়োটি থোড়াই কিছু খেতে পারছিল এবং তার প্রাচীন চক্ষুদ্বয় এতই ঘোলা হয়ে পড়েছিল যে, কাঠের দণ্ডের ওপর বারবার তার আছড়ে পড়বার উপক্রম হচ্ছিল। তার শুধুমাত্র যা অবশিষ্ট ছিল তাহল শেষ পালকগুলোর সরু নল। পেলাইয়ো তার ওপর একটা কম্বল ছুড়ে দিল। তার প্রতি দয়া দেখাল ছাউনিতে শোওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে, আর ঠিক তখনই তারা টের পেল যে, রাতে তার গায়ে জ্বর এবং উন্মত্ত অবস্থা, জড়ানো জিহ্বায় সে প্রলাপ বকছিল একজন বৃদ্ধ নরওয়েবাসীর মত। এটা অনেক সময়ের মধ্যে প্রথম, যখন তারা উদ্বিগ্ন হল এই ভেবে যে, সে মারা যাচ্ছে এবং প্রতিবেশী বিজ্ঞ মহিলাটিও হয়ত মৃত দেবদূতকে নিয়ে কী করা যায় তা বলতে সক্ষম হবে না।


কিন্তু সে যে কেবল খারাপ শীতকালটাই উতরে গেল তাই নয়, বরঞ্চ মনে হল প্রথম সূর্যালোকিত দিন থেকেই তার অবস্থার উন্নতি হতে থাকল। উঠানের সবথেকে দূর কোনায় সে নিঃসাড় অবস্থায় পড়ে থাকল বেশ কিছুদিন। সেখানে কেউ তাকে দেখতে যেত না। ডিসেম্বরের শুরু থেকে কিছু খাড়া পালক তার ডানায় গজাতে লাগল। কাকতাড়ুয়ার পালক, যাকে আরেকটি দুর্ভাগা জরার আভাস বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু সে নিশ্চয়ই জেনে থাকবে এই পরিবর্তনের কী কারণ, কারণ সে যথেষ্ট সতর্ক ছিল যেন কেউ ওগুলো লক্ষ না করে, যেন কেউ না শোনে সাগর-নাবিক-গীত যা সে গায় আকাশের নক্ষত্রের নিচে। এক সকালে এলিসেন্দা কিছু পেঁয়াজ কাটছিল দুপুরের খাবার রান্না করবার জন্য, তার মনে হল একঝলক বাতাস যেন দূর-সাগর থেকে এসে রান্নাঘরে ঝাপটা দিল। তখন জানালার কাছে গিয়ে দেবদূতকে তার উড়ালের প্রথম প্রচেষ্টাতেই সে দেখতে পেল। এটা এতটাই অগোছালো, কৌশলহীন প্রচেষ্টা ছিল যে, তার নখরগুলো সবজিখেতের স্থানে স্থানে খাঁজ কেটে দিচ্ছিল এবং তার এলোমেলো ডানা ঝাপটানো ছাপরাটিকে ভেঙে ফেলার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল, আলোতে পিছলে যাচ্ছিল ডানা, বাতাস আঁকড়ে ধরতে পারছিল না সে জুত মত। যাহোক, অনেক চেষ্টা করে সে উচ্চতা লাভ করতে সক্ষম হল। এলিসেন্দা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল, নিজের জন্য এবং তার জন্য, যখন সে দেখল, শেষ বাড়িগুলোও সে পেরিয়ে যাচ্ছে বৃদ্ধ-জরাগ্রস্ত শকুনের ঝুঁকিপূর্ণ ডানা ঝাপটানির দ্বারা নিজেকে কোনওভাবে শূন্যে সামলে রেখে। সে তাকে দেখতেই থাকল, এমন কী যখন সে পেঁয়াজ কাটছিল, সে দেখতেই থাকল ততক্ষণ পর্যন্ত, যখন তাকে দেখা আর সম্ভব হল না। কারণ তখন সে তার জীবনে বিরক্তি উৎপাদনকারী আর কিছু নয় — সমুদ্রের দিগন্তরেখায় একটি কল্পনিক বিন্দু মাত্র।