Wednesday, February 21, 2018

প্রাণসমৃদ্ধ গ্রহের সম্ভাবনাঃ ড্রেক সমীকরণ ব্যাখ্যা করছেন কার্ল সেগান


পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রেডিও/রাডার টেলিস্কোপ টি আছে – অ্যারেসিবো পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে। অবস্থান – পুয়ের্তো রিকো দ্বীপের প্রত্যন্ত উপত্যকা। এটা রেডিও সিগন্যাল প্রেরণ করে, গ্রহণও করে। এটা এতো বিশাল আর শক্তিশালী যে ১৫ হাজার আলোকবর্ষ দূরের রেডিও টেলিস্কোপের সাথেও যোগাযোগ করতে পারে। অর্থাৎ, আকাশগঙ্গার কেন্দ্র থেকে অর্ধেক পথ। অ্যারেসিবো পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রটা মহাশূন্যে ভিন্ন সভ্যতার সিগন্যাল খোঁজে। শুধু একবার, একটা বার্তা পাঠানো হয়েছিলো দূরবর্তী নক্ষত্রপুঞ্জ M13-এ। কিন্তু আলাপ করার মত কেউ কি আছে? শুধু আকাশগঙ্গার ৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্রের মধ্যে, আমাদের পৃথিবীটাই কি একমাত্র বসতিপূর্ণ গ্রহ? এই সম্ভাবনা কতটুকু যে, আমাদের ছায়াপথ প্রাণের দোলায় স্পন্দিত হচ্ছে, গুণগুণ করছে? হয়তো রাতের আকাশের ঐ আলোর বিন্দুগুলো থেকে, আমাদের চেয়ে একদম ভিন্ন কেউ, আলস্য নিয়ে সূর্য নামক নক্ষত্রের দিকে তাকায় আর ক্ষণিকের জন্য (এখানে প্রাণ থাকার) অবিশ্বাস্য কল্পনা করে।

নক্ষত্রের সংখ্যা অগণিত। তাদের কয়েকটাতে বাসযোগ্য গ্রহ থাকবে। সেই গ্রহগুলোর কয়েকটাতে বুদ্ধিমত্তা জন্ম নেবে। সেই সভ্যতাগুলোর কয়েকটা হয়তো নিজেদের প্রযুক্তি আর আবেগের ফাঁদ এড়াতে পারবে। সভ্যতা অনেক হলে অন্তত একটা কাছাকাছি থাকার কথা। সভ্যতার সংখ্যা কম হলে সবচেয়ে কাছেরটাও হয়তো অনেক দূরে। চমৎকার একটা প্রশ্ন হলো – কয়টা উন্নত সভ্যতা আছে আকাশগঙ্গা ছায়াপথে, যারা অন্তত রেডিও এস্ট্রোনমিতে সক্ষম?

ধরি, এমন সভ্যতার সংখ্যা বড় হাতের N. সংখ্যাটা অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। আকাশগঙ্গায় থাকা মোট নক্ষত্রের সংখ্যার উপর নির্ভর করে। ধরি, সংখ্যাটা N_x. যেসব নক্ষত্রে গ্রহ আছে, তার ভগ্নাংশকে ধরি, f_p. প্রাণের অনুকূল পরিবেশ আছে, সৌরজগতে এমন গ্রহের সংখ্যাকে ধরি n_e. যতগুলো অনুকূল গ্রহে আসলেই প্রাণ জন্ম নেয়, সেই ভগ্নাংশকে ধরি f_l. যতগুলো বসতিপূর্ণ গ্রহে বুদ্ধিমত্তার উত্থান হয়, সেই ভগ্নাংশকে ধরি f_i. যেসব গ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণীরা প্রযুক্তি আর যোগাযোগের ক্ষমতা অর্জন করে, সেই ভগ্নাংশকে ধরি f_c. সবশেষে, এটি নির্ভর করে – গ্রহটির আয়ুর কতটুকু অংশ প্রযুক্তিগত সভ্যতা ধারণ করে। সেটাকে ধরি f_L. সবগুলো সংখ্যাকে গুণ করলে পাই N এর মান, প্রতিষ্ঠিত সভ্যতার সংখ্যা।

সমীকরণটি কর্নেল ভার্সিটির ফ্র্যাংক ড্রেকের বানানো। এটা আসলে একটা বাক্য, যার ক্রিয়াপদ হচ্ছে “সমসংখ্যক হওয়া”। আসুন দেখি, সমীকরণটি কীভাবে কাজ করে। খুব সাবধানে, আকাশের একটি ছোটো কিন্তু আদর্শ অংশে নক্ষত্রের সংখ্যা গুণে আমরা দেখলাম যে, আকাশগঙ্গায় নক্ষত্রের সংখ্যা প্রায় ৪০০ বিলিয়ন। অর্থাৎ, অনেক অনেক নক্ষত্র। আর গ্রহ? জোড়া নক্ষত্র, আশেপাশের নক্ষত্রের গতি, আর অনেক তত্ত্বীয় গবেষণা, বেশ জোরালো ইঙ্গিত দেয় যে, অনেক (হয়তো অধিকাংশ) নক্ষত্রেরই গ্রহসঙ্গী রয়েছে।

ধরুন, f_p, অর্থাৎ গ্রহযুক্ত নক্ষত্রের সংখ্যা হচ্ছে – এক চতুর্থাংশ। অর্থাৎ, গ্রহযুক্ত সৌরজগতের সংখ্যা ৪০০ x ১/৪ = ১০০ বিলিয়ন। সর্বশেষ হিসাবটা লাল রঙে লিখে রাখবো। তো, প্রত্যেক সৌরজগতে যদি আমাদেরটার মত ১০টা গ্রহ থাকে, তাহলে, ১০০ বিলিয়ন x ১০ = ১ ট্রিলিয়ন গ্রহ আছে এই ছায়াপথে। মহাজাগতিক নাটক রচনার জন্য এক বিশাল রঙ্গমঞ্চ!

আমাদের সৌরজগতের বেশ কিছু জায়গা হয়তো কোনো না কোনো প্রাণের উপযোগী। পৃথিবী তো আছেই। সম্ভাবনা আছে মঙ্গল, টাইটান, হয়তো বৃহস্পতিতেও। অন্য জগতগুলো এমনই হলে, অনুকূল জগতের সংখ্যাটা কম হবে না। যাই হোক, আসুন, উত্তেজনা কমিয়ে n_e এর মান ধরি ২। প্রতি সৌরজগতে ২টি বাসযোগ্য গ্রহ! তাহলে প্রাণের উপযোগী গ্রহের সংখ্যা দাঁড়াবে ১০০ বিলিয়ন x ২ = ২০০ বিলিয়ন। আর প্রাণ? মহাবিশ্বের অত্যন্ত স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে প্রাণের অণুগুলো তৈরি হয় অনায়াসে, গঠিত হয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে।

কিছু বাধা আসতেই পারে। যেমন ধরুন, জেনেটিক কোডের উৎপত্তিতে ঝামেলা! যদিও বিলিয়ন বিলিয়ন বছরের বিবর্তনে সেই সম্ভাবনা কম। পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব বেশ দ্রুতই হয়েছিলো; গ্রহ গঠিত হবার পরপরই। আসুন, f_l, অর্থাৎ প্রাণ জন্ম নিয়েছে এমন বাসযোগ্য গ্রহের সংখ্যাকে ধরি ১/২. অর্থাৎ, আকাশগঙ্গার যত গ্রহে একবার হলেও প্রাণের উদ্ভব হয়েছে, তার সংখ্যা ১০০ বিলিয়ন x ২ x ১/২ = ঘুরেফিরে সেই ১০০ বিলিয়ন।

১০০ বিলিয়ন প্রাণময় গ্রহ! হিসাবটা এখানে এসে কঠিন হয়ে যায়। অনেক আলাদা আলাদা এবং দুষ্প্রাপ্য ঘটনা ঘটেছে আমাদের প্রজাতি এবং সভ্যতা বিকাশের পথে। আবার, উন্নত প্রযুক্তিতে পৌঁছানোর হয়তো অনেক উপায় আছে। কিছু বিজ্ঞানী মনে করেন, ট্রাইলোবাইট থেকে রেডিও টেলিস্কোপের সমমানের পথ সব গ্রহেই মোটামুটি নিশ্চিত। অন্য বিজ্ঞানীরা তা মানতে নারাজ। আসুন, মাঝামাঝি কিছু ধরি। f_i এর মান ধরি ১/১০. f_c এর মানও ধরলাম ১/১০. ১/১০ x ১/১০ = মাত্র ১% প্রাণযুক্ত গ্রহে শেষ পর্যন্ত প্রযুক্তিভিত্তিক সভ্যতা আসবে। সবগুলো উপাদান গুণ করলে আসে, ১০০ বিলিয়ন x .১ x .১। অর্থাৎ ১ বিলিয়ন গ্রহ – যেখানে একবার হলেও সভ্যতার উত্থান হয়েছে।

তো, একটি গ্রহ তার আয়ুর শতকরা কতটুকু অংশে প্রযুক্তির শীর্ষে থাকে? পৃথিবীতে, রেডিও এস্ট্রোনমিতে সক্ষম সভ্যতা আছে মাত্র কয়েক দশক ধরে, যেখানে এর আয়ু কয়েক বিলিয়ন বছর। আগামীকালই নিজেদের ধ্বংস করে ফেলার সম্ভাবনাটাও তুচ্ছ না। এটাই যদি স্বাভাবিক হয়, তাহলে f_L হবে কয়েক বিলিয়ন বছরের মধ্যে মাত্র কয়েক দশক। ১০০ মিলিয়নের প্রায় ১ ভাগ…খুবই ছোটো সংখ্যা। তাহলে N হবে ১ বিলিয়নের শত মিলিয়ন ভাগের ১ ভাগ। অর্থাৎ, N হচ্ছে মাত্র ১০ টি সভ্যতা। ক্ষুদ্র, নগণ্য, করুণ কয়েকটা মাত্র প্রযুক্তিসমৃদ্ধ সভ্যতা, বিশাল এই ছায়াপথে। বিলিয়ন বিলিয়ন বছর লেগে যায় বিবর্তনের পথ ধরে সভ্যতার উত্থান হতে। এরপর হেলাফেলার এক তুড়িতেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় চিরতরে। এমনটাই যদি সবখানে ঘটে, বাকি থাকবে খুব অল্পই।

কে জানে, কথা বলার মত হয়তো কেউই থাকবে না। কিন্তু বিকল্পটা চিন্তা করুন। মাঝে মাঝেই কিছু সভ্যতা উচ্চ প্রযুক্তির সাথে বাঁচতে শিখে নিচ্ছে। টিকে যাচ্ছে ভূ-তাত্ত্বিক, এমনকি নাক্ষত্রিক বিবর্তনের সময়কাল। যদি ১% সভ্যতাও প্রযুক্তির উদ্দাম কৈশোর সামলে উঠতে পারে তাহলে f_L এর মান ১/১০০ মিলিয়ন হবে না, ১/১০০ হবে শুধু। আর তখন সভ্যতার সংখ্যা দাঁড়াবে ১ বিলিয়ন x ১/১০০. তখন ছায়াপথের সভ্যতার সংখ্যা হিসাব করা হবে মিলিয়নে। মিলিয়ন মিলিয়ন প্রযুক্তিসমৃদ্ধ সভ্যতা! তাই সভ্যতা যদি নিজেকে রেডিও অ্যাস্ট্রোনমি আবিষ্কারের পরপরই ধ্বংস না করে ফেলে, তাহলে হয়তো অন্তরীক্ষ গুণগুণ করছে দূর নক্ষত্র থেকে আসা বার্তা দিয়ে। এমন এক সভ্যতার বার্তা, যা আমাদের চেয়ে অনেক প্রাচীন, অনেক বিজ্ঞ।

উৎস ঃ http://onubadokderadda.com/drake_equation_explained/

Friday, February 2, 2018

জেমস জয়েসের গল্পঃ এভেলিন


জানালার ধারে বসে সে দেখছিলো এভিনিউতে সন্ধ্যা নামার দৃশ্যটা। তার মাথাটা ঝুঁকে ছিলো জানালার পর্দাগুলোর দিকে, আর তার নাকে লেগে ছিলো ধুলায় মলিন কাপড়ের গন্ধ। সে ছিলো ক্লান্ত।

কয়েকটা লোক অতিক্রম করে গেলো। সর্বশেষ কুঠি থেকে বের হওয়া লোকটাও রওনা দিলো বাড়ির দিকে। শান বাঁধানো রাস্তায় হেঁটে চলা লোকটার পায়ের খটখট আওয়াজ ভেসে আসছিলো তার কানে। পরক্ষণেই লোকটা লাল বাড়িগুলোর সামনের কয়লা কাঠের রাস্তা ধরে কচকচ শব্দে এগুতে লাগলো। একসময় সেখানটায় একটা মাঠ ছিলো, যেখানে তারা প্রতি সন্ধ্যায় অন্য ছেলেমেয়ের সাথে খেলতো। তারপর বেলফাস্ট থেকে এক লোক এসে কিনে নিলো পুরো মাঠটা, বাড়ি বানালো তার উপর। এই বাড়িগুলো তাদের ছোট্ট বাদামি বাড়িগুলোর মত নয়, বরং চকচকে ছাদওয়ালা ইটের ইমারত। সে আর তার ভাইবোন আর ডেবিন, ওয়াটার, ডান পরিবারের বাচ্চারা মিলে খেলা করতো সেই মাঠে। সাথে আরও থাকতো ছোট্ট বিকলাঙ্গ কয়েগ।

আর্নেস্ট কখনো খেলতো না। সে ছিলো একটু বেশিই বড়। তার বাবা প্রায়ই তাদেরকে একটা কালো লাঠি হাতে তাবড়ে বেড়াতো। ছোট্ট কয়েগ সবসময়ই নজর রাখতো, আর তার বাবাকে আসতে দেখলেই আওয়াজ দিতো। তবু মনে হতো তখনই বরং তারা সুখী ছিলো। তার বাবার স্বভাব তেমন খারাপ ছিলো না। তাছাড়া তার মাও তখন বেঁচে ছিলেন। সে কতকাল আগের কথা! সে আর তার ভাইবোনেরা ইতিমধ্যেই বড় হয়ে উঠেছিলো, যখন তাদের মা মারা যান। টিজি ডানও মরে গিয়েছিলো তখন। আর ওয়াটার পরিবারটা ফিরে গিয়েছিলো ইংল্যান্ডে। সবকিছুই বদলে যায়। এখন সেও অন্যদের মত চলে যেতে বসেছে। ছেড়ে যাচ্ছে নিজের ঘর।

ঘর!

কক্ষটায় ঘুরে ঘুরে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো সে সবগুলো পরিচিত আসবাব আর জিনিস। যাদেরকে সপ্তাহে অন্তত একবার ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করতো সে, বছরের পর বছর একই রুটিন মাফিক, আর ভাবতো কোথা থেকে যে এত ধুলো ময়লা  আসে! হয়তো আর কোনদিনই সে পরিচিত জিনিসগুলো দেখতে পাবে না। অথচ সে স্বপ্নেও ভাবেনি, এগুলোর সাথে তার বিচ্ছেদের কোনো সম্ভাবনা থাকতে পারে। আর এতগুলো বছরেও সে কোনোদিন জানতে পারেনি, ভাঙ্গা হারমোনিয়ামের উপরের দিকের দেয়ালে ঝুলতে থাকা হলদে ছবির ঐ পাদ্রীর নাম কী। পাদ্রী লোকটা ছিলো তাঁর বাবার বিদ্যালয়ে পড়ার সময়কার বন্ধু। যখনই তাঁর বাবা কোনো অতিথিকে ছবিটা দেখাতো, তখন ছবিটা তার হাতে দিতে দিতে গা ছাড়া ভঙ্গিতে বলতো, “সে এখন মেলবোর্নে আছে।”

সে চলে যেতে সম্মত হয়েছে। সে রাজি হয়েছে নিজের ঘর ছেড়ে যেতে। কাজটা কি ঠিক হলো? প্রশ্নের দুটো দিকের মধ্যেই সে ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করলো। তাঁর এই ঘরে আশ্রয় ছিলো, খাদ্য ছিলো, ছিলো তারা যাদেরকে সে চিনে এসেছে সারাটি জীবন। অবশ্য তাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হতো, ঘর আর ব্যবসা দু’জায়গাতেই। দোকানের ঐ লোকেরা কী বলবে তাঁকে নিয়ে, যখন জানতে পারবে সে একটা ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে? হয়তো বলবে মেয়েটা আসলে বোকা। তার থাকার জায়গাটা ভরে যাবে বিজ্ঞাপনে। মিস গাবান খুব খুশি হবে। মহিলাটার সবসময়ই একটা ঝাঁঝ ছিলো তার উপর। বিশেষ করে, যখন লোকজন শুনতে পেতো।

“মিস হিল, তুমি দেখতে পাচ্ছো না মহিলারা অপেক্ষা করছে?”

“একটু প্রাণবন্ত থাকো, মিস হিল, প্লিজ।“

দোকান থেকে বিদায় নেওয়ার বেলায় সে খুব একটা জল ঝরাবে না চোখে। কিন্তু তাঁর অজানা দূরের দেশের বাড়িতে কোনোকিছুই তো এমন থাকবে না। তখন সে হবে বিবাহিতা, বিবাহিতা এভেলিন। মানুষজন তাকে সম্মান দেখাবে। তার সাথে এমন কোনো আচরণ করা হবে না, যা তার মায়ের সাথে করেছিলো মানুষ। এমনকি এখনও, যদিও সে এখন উনিশের উপরে, মাঝে মাঝে তার বাবার হিংস্রতায়  নিজেকে অনিরাপদ মনে হয়। সে জানতো, বাবার এই হিংস্রতাই তার সকল শিহরণের মূল কারণ।

যখন তারা বেড়ে উঠছিলো, তখন বাবা কখনই তার দিকে চোখ তুলে তাকায়নি। কারণ সে ছিলো একটা মেয়ে। বাবা সবসময় হ্যারি আর আর্নেস্টকে মাথায় তুলে রাখতো। কিন্তু পরে লোকটা তাকে হুমকি ধামকি দেয়া শুরু করলো। তার মরা মায়ের দোহাই দিয়ে বলতে লাগলো, সে তাকে কী করতো যদি তার মা বেঁচে থাকতো।

তাকে রক্ষা করার মত কেউই ছিলো না। আর্নেস্ট ছিলো মৃত, আর হ্যারি, যে কিনা গির্জায় সাজগোজের ব্যবসা করতো, সবসময়েই গ্রামের এক কোণায় পড়ে থাকতো। তাছাড়া শনিবার রাতে টাকার জন্য একঘেয়ে তুচ্ছ ঝগড়াগুলো তাকে প্রচণ্ড ক্লান্ত করে তুলেছিলো। সে সর্বদাই তার পারিশ্রমিকের পুরোটা, সাত শিলিং, সংসারে দিয়ে দিতো। আর হ্যারি সবসময় যতটুকু পারে, পাঠাতো। কিন্তু সমস্যাটা বাধতো তার বাবার কাছ থেকে টাকা বের করতে গিয়ে।

বাবা বলেছিলো, সে নাকি সব টাকা উড়িয়ে নষ্ট করে ফেলে। তাই তার মাথা এতটা খারাপ হয়নি যে, নিজের কষ্টার্জিত টাকা সে মেয়েকে দিবে উড়ানোর জন্যে। এমন আরও অনেক কিছুই বলতো সে। শনিবারের রাতগুলোতে সাধারণত খারাপের চরমে পৌঁছে যেতো বাবা। সবশেষে টাকাটা মেয়ের হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করতো, রবিবারের রাতের খাবার কেনার তার কোনো ইচ্ছে আছে কিনা। এভেলিন তখন যত দ্রুত সম্ভব দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে বাজারে যেতো কেনাকাটা করতে। শক্ত হাতে কালো চামড়ার পার্সটা নিয়ে ভিড় ঠেলে নিজের রাস্তা বের করে সে এগুতে থাকতো। সকল নিয়ম কানুনের বোঝা মাথায় নিয়েই দেরি করে ফিরতো বাসায়। বাড়ির সবকিছু ঠিকঠাক রাখতে গিয়ে তাকে করতে হতো কঠোর পরিশ্রম। দেখতে হতো তার কাছে থাকা বাচ্চা দুটো ঠিকমতো স্কুলে যাচ্ছে কিনা, নিয়মিত চারটে খেতে পাচ্ছে কিনা। এটা ছিলো কঠোর পরিশ্রমের কঠিন একটা জীবন। কিন্তু এখন সে ছেড়ে যেতে বসেছে এসব কিছু। তার কাছে এই জীবনটা পুরোপুরি অনাকাঙ্ক্ষিত মনে হলো না।

সে ফ্র্যাঙ্কের সাথে সম্পূর্ণ নতুন এক জীবনকে আবিষ্কার করতে যাচ্ছে। ফ্র্যাঙ্ক ছিলো দয়ালু, পুরুষালী, আর খোলা মনের মানুষ। সে ফ্র্যাঙ্কের হাত ধরে রাতের নৌকায় চড়ে পাড়ি জমাতে যাচ্ছে বুয়েনস আইরেসে, যেখানে তার জন্যে অপেক্ষা করছে একটা ঘর। যে ঘরে সে হবে ফ্র্যাঙ্কের স্ত্রী। স্পষ্টভাবে এখনো মনে পড়ে ফ্র্যাঙ্কের সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের দিনটার কথা। ফ্র্যাঙ্ক প্রধান সড়কটার পাশে একটা কুঠিতে লজিং থাকতো, যেখানে সে মাঝে মাঝে যেতো। মনে হচ্ছিলো যেন এই তো সপ্তাহ খানেক আগের কথা।

ফ্র্যাঙ্ক দাঁড়িয়ে ছিলো দরজার সামনে, তার সূচালো টুপিটা ছিলো মাথার পেছন দিকে সরানো। চুলগুলো তার তামাটে চেহারার উপর গড়াগড়ি খাচ্ছিলো। তারপর চেনা জানা হলো পরস্পরের সাথে।

ফ্র্যাঙ্ক প্রতি সন্ধ্যায় দোকানের বাইরে তার সাথে দেখা করতো, আর তাকে বাড়ি পৌঁছে দিতো। সে তাকে ‘দ্যা বোহেমিয়ান গার্ল’ দেখতে নিয়ে যেতো। এভেলিন খুশি হতো ফ্র্যাঙ্কের সাথে থিয়েটারের অস্বাভাবিক অংশটায় বসতে পেরে। ফ্র্যাঙ্ক ছিলো ভয়ঙ্কর রকমের গান পাগলা, আর একটু আধটু গাইতও। মানুষ জানতো যে, তাঁরা একে অন্যের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।

ফ্র্যাঙ্ক যখন বালিকা মেয়ের গানটা গাইতো যাকে নাবিক ভালোবাসে, এভেলিন একটা সুখময় দ্বিধায় ডুবে যেতো। ফ্র্যাঙ্ক তাকে মজা করে ‘পপেন্স’ নামে ডাকতো। একজন সঙ্গী পাওয়াটা তার কাছে ছিলো উত্তেজনাকর বিষয় এবং তারপর সঙ্গীটিকে তার ভালো লাগতে শুরু করলো।

ফ্র্যাঙ্কের জীবনে দূর দেশের অনেক গল্প ছিলো। এলান লাইনের কানাডাগামী জাহাজে সে প্রথম মাসিক এক পাউন্ড বেতনে ডেক বয় হিসেবে কাজ শুরু করেছিলো। কত জাহাজে সে কত রকমের কাজ করেছে, তা নিয়ে এভেলিনের সাথে গল্প করতো। মাগেলান সাগরে পাড়ি জমানোর গল্প কিংবা পাতাগনিয়ানদের ভয়ঙ্কর সব গল্পও সে শোনাতো তাকে। বুয়েনস আইরেসে এসে সে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে। এবং তার পুরনো দেশে ফিরে এসেছে শুধুমাত্র ছুটি কাটানোর জন্যে। অবশ্য, এভেলিনের বাবা তাদের সম্পর্কের কথাটা জেনে গিয়েছিলো আর ফ্র্যাঙ্কের সাথে যোগাযোগ রাখতে নিষেধ করেছিলো।

“এই ধরনের নাবিক ছেলেদের আমার চেনা আছে।” সে বললো।

একদিন সে ফ্র্যাঙ্কের সাথে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিয়েছিলো। আর তারপর থেকে এভেলিনকে লুকিয়ে দেখা করতে হতো ফ্র্যাঙ্কের সাথে।

এভিনিউতে সন্ধ্যাটা গাঢ় হয়ে আসছিলো। তার কোলের উপর রাখা দুটি চিঠির শুভ্রতাও ধীরে অস্পষ্ট হয়ে উঠছিলো। একটা চিঠি হ্যারিকে লেখা, আরেকটা তার বাবাকে। আর্নেস্টই তার প্রিয় ছিলো। কিন্তু হ্যারিকেও সে পছন্দ করতো। সে খেয়াল করলো, আজকাল বাবা বুড়িয়ে যাচ্ছে। লোকটা তাকে মিস করবে।

মাঝে মাঝে বাবা খুব সুন্দর ব্যবহার করতো। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, যখন সে দিনের বেলায় ঘুমুতে গিয়েছিলো, আর বাবা পাশে বসে ভূতের গল্প পড়ে শুনিয়েছিলো। আর আগুনের পাশে বসে তার জন্য টোস্ট বানিয়েছিলো। অন্য একদিন, যখন তাদের মা বেঁচে ছিলেন, সবাই মিলে তারা পিকনিকে গিয়েছিলো হাউথের পাহাড়ে। এখনো মনে পড়ে, তার বাবা বাচ্চাদের হাসানোর জন্যে মায়ের ঘোমটাটা পরিয়ে দিচ্ছিলো।

তার সময় ফুরিয়ে আসছিলো। কিন্তু সে জানালার পর্দায় মাথা ঠেকিয়ে বসেই ছিলো। তার নিঃশ্বাসে মিশে ছিলো ধুলোয় মলিন কাপড়ের গন্ধ। এভিনিউর নিচে দূরে কোথাও থেকে তার কানে ভেসে আসছিলো স্ট্রিট অর্গানের সুর। সে ঐ অদ্ভুত বাতাসটাকে চিনতো, যেটা প্রতি রাতে এসে তাকে মনে করিয়ে দেয় মাকে দেয়া তার প্রতিজ্ঞাগুলোর কথা। মাকে সে বলেছিলো, ঘরটাকে সে আগলে রাখবে যতদিন সম্ভব। তার মনে পড়লো মায়ের অসুস্থতার শেষ দিনটার কথা। সে আবারও হলের অপর পাশের সেই অন্ধকার বদ্ধ ঘরটায় ছিলো এবং শুনতে পাচ্ছিলো ইতালির বাতাসে একটা বিষণ্ণ সুর। অর্গান-প্লেয়ারটাকে ছ-পেনির পয়সা ধরিয়ে দিয়ে চলে যেতে বলা হয়েছিলো। তার মনে পড়লো, তার বাবা সদর্পে সিক-রুমে ঢুকে বলছিলোঃ

“হারামজাদা ইতালিয়ান! আসছে এখানে!”

সে ডুবে গিয়েছিলো ধ্যানে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠলো মায়ের করুণ জীবনের ছবি। সেটার আবেশ খুব দ্রুত তার পুরো সত্ত্বাটাকে সম্মোহিত করে ফেলেছিলো। গতানুগতিক সাধারণ জীবন তার সবকিছুই ত্যাগ করে দেয় জীবনের শেষ পাগলামিতে। সে কেঁপে উঠলো আবারও, তার মায়ের গলার আওয়াজ শুনে, তার অবিরাম একগুঁয়ে অর্থহীন আওড়ানো বুলি শুনেঃ

“দেরেভুয়ান সেরাউন! দেরেভুয়ান সেরাউন!”

সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো একটা আতঙ্কের তাড়নায়। পালাও! তাকে যে পালাতে হবে! ফ্র্যাঙ্ক থাকলে এখন তাকে রক্ষা করতো। ফ্র্যাঙ্ক তার জীবনটা ফিরিয়ে দিতো, হয়তো একটু ভালবাসাও দিতো। কিন্তু সে তো বাঁচতে চেয়েছে। তাকে কেন অসুখী হতে হবে? তারও তো সুখে একটু অধিকার রয়েছে। ফ্র্যাঙ্ক তাকে এখন বুকে টেনে নিতো, আগলে রাখতো দু’ বাহুতে। সে তাকে বাঁচাতো।

নর্থ ওয়ালের স্টেশনে প্রবল ভিড়ের মধ্যে সে দাঁড়িয়েছিলো। ফ্র্যাঙ্ক তার হাতটা ধরেছিলো। সে বুঝতে পারছিলো, ফ্র্যাঙ্ক তাকে কিছু একটা বলছে, প্যাসেজ সম্পর্কে কিছু একটা বারবার বলেই যাচ্ছে। বাদামী ব্যাগওয়ালা সৈনিকে ভরে গিয়েছিলো পুরো স্টেশনটা। ইঞ্জিনশালার প্রশস্ত দরজাগুলো দিয়ে সে কালো নৌকাটা এক পলক দেখলো।

নৌকাটা শুয়ে আছে ঘাটের দেয়ালটার পাশে, তার আলোকোজ্জ্বল জানালাগুলো নিয়ে। সে কোনো উত্তর দিলো না। সে অনুভব করলো তাঁর গালটা ধীরে ধীরে বিবর্ণ আর শীতল হয়ে উঠছিলো। প্রবল মানসিক চাপে পড়ে সে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করলো তাকে পথ দেখাতে। সে চাইলো ঈশ্বর যেন বলে দেয়, তাঁর এখন কী করা উচিৎ।

নৌকাটা একটা দীর্ঘ শোকাবহ হুইসেলের আওয়াজ ছুঁড়ে দিলো কুয়াশায়। যদি সে যেতো, তাহলে আগামীকাল সে ফ্র্যাঙ্কের সাথে সাগরে ভেসে বুয়েনস আইরেসের দিকে এগুতে থাকতো। তাদের প্যাসেজ ভাড়া করা হয়ে গিয়েছিলো। এতকিছুর পরেও কি সে এখন ফিরে যেতে পারবে? তার এই উভয় সঙ্কট পুরো শরীরে একটা ঘৃণার জাগরণ সৃষ্টি করলো। তার ঠোঁটগুলো কাঁপতে লাগলো নীরব আকুল প্রার্থনায়।

তার হৃদপিণ্ডে একটা বেল ঝনঝন করে উঠলো। সে টের পেল ফ্র্যাঙ্ক তার হাতটা চেপে ধরেছেঃ

“আসো!”

পৃথিবীর সবকটি সাগর যেন গড়াগড়ি খেলো তার হৃদপিণ্ডের আশেপাশে। ফ্র্যাঙ্ক তাকে সেই সাগরগুলোয় টেনে নিয়ে যাচ্ছিলো। সে তাকে ডুবিয়ে মারবে। সে দু’ হাতে শক্ত করে চেপে ধরল লোহার রেলিংটা।

“আসো!”

না! না! না! এটা ছিলো অসম্ভব। তার হাত দুটো উন্মত্ত থাবায় আঁকড়ে ধরলো লোহাটাকে। সমুদ্রগুলোর বুকে সে একটা চিৎকারের আওয়াজ ছুঁড়ে দিলো যন্ত্রণায় আর ক্ষোভে।

“এভেলিন! এভি!”

ফ্র্যাঙ্ক দৌড়ে ব্যারিয়ার পার হয়ে গেলো আর তাকে ডেকে বললো পিছে পিছে আসতে। সে চিৎকার করে বলছিলো নৌকা না থামাতে। আবার এভেলিনকেও সে ডাকছিলো। এভেলিন তার শুভ্র মুখটাকে তার দিকে তাক করে রাখলো… অসাড়, আর অসহায় এক প্রাণির মতো। তার চোখে ফ্র্যাঙ্কের জন্যে কোনো ভালোবাসা ছিলো না, ছিলো না কোনো বিদায়ের কিংবা পরিচয়ের চিহ্ন।

উৎস ঃ http://onubadokderadda.com/literature/short-story-translation/

কৃষ্ণ গহ্বর (Black Hole) ও টুকিটাকি


ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর কী?


দৃশ্যমান মহাবিশ্বে (The observable universe) রয়েছে কমপক্ষে ১০০ বিলিওন ছায়াপথ। প্রতিটা ছায়াপথে রয়েছে ১০০ বিলিওন থেকে ১০০ ট্রিলিওন তারা বা নক্ষত্র। সৃষ্টির শুরু থেকেই এই তারাগুলোতে প্রতিনিয়ত ঘটছে ভয়ানক বিস্ফোরণ। নিউক্লিয়ার ফিউশন বা সংযুক্তি বিক্রিয়ার কারণে এই বিস্ফোরণ হয়ে থাকে। একাধিক হাইড্রোজেন পরমাণু একত্রিত হয়ে হিলিয়াম তৈরি করে আর প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সাথে শক্তি হিসাবে নির্গত করে আলো, তাপ, তেজস্ক্রিয়তা ইত্যাদি। কিন্তু তারকাদের এই জ্বালানি (হাইড্রোজেন) এক সময় শেষ হয়ে যায়। বিস্ফোরণ, আলো, তাপ কিছুই দেওয়ার ক্ষমতা থাকে না। তখন সূর্যের চেয়ে ১০-১২ গুণ বা আরও বেশি ভরবিশিষ্ট নক্ষত্রগুলো প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সাথে নিভে যায়। এই নিভে যাওয়া নক্ষত্রগুলোকেই ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর বলা হয়।

কৃষ্ণগহ্বরের সৃষ্টি কীভাবে হয়?


নক্ষত্রগুলোর মধ্যে সর্বদাই সংযুক্তি বিক্রিয়ার বিস্ফোরণ চলতে থাকে এবং সেই কারণেই একটা শক্তিশালী বহির্মুখী চাপ (radiation) সৃষ্টি হয়, অর্থাৎ বিক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট বস্তুগুলোকে (particles) নক্ষত্রের বাহিরের দিকে ঠেলতে থাকে। আবার নক্ষত্রে অধিক শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করে, যা ওই বস্তুগুলোকে ভিতরের দিকে টানতে থাকে। এই দুই বলের কারণে তৈরি হয় একটা সুষম ভারসাম্য (সমতা) যা চলতে থাকে অনেক বিলিওন বছর ধরে। কিন্তু মূল জ্বালানি হাইড্রোজেন হিলিয়ামে রুপান্তরিত হতে হতে এক সময় একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়। তখন বাকি থাকে শুধুই হিলিয়াম। তখন পর্যায়ক্রমে কার্বন আর অক্সিজেন সংশ্লেষণ/তৈরি করে শক্তি উৎপাদনের প্রক্রিয়া চালু রাখা হয়।

আমাদের সূর্যের মত ছোট তারকা গুলো মোটামুটি এখানেই থেমে যায়। যথেষ্ট ভর না থাকায় এরা আর কোনো বিক্রিয়া চালাতে সক্ষম হয় না। আর তখনই মৃত্যু ঘটে এই তারকার। এই অবস্থায় এদেরকে বলা হয় White Dwarf. সংযুক্তি বিক্রিয়া না চললেও অত্যাধিক তাপমাত্রার কারণে এরা জ্বলজ্বল করে। বিলিওন বিলিওন বছর পরে এগুলো নীরবে ঠাণ্ডা হয়ে অন্য অবস্থায় রুপান্তরিত হয় যাকে বলা হয় Planetary Nebula বা নীহারিকা। পরবর্তীতে এসব নীহারিকা থেকেই সৃষ্টি হয় নতুন নতুন গ্রহ নক্ষত্রের।


ক্র্যাব নেবুলা। মুহম্মদ জাফর ইকবালের একটি গল্পবইও আছে এই নেবুলাকে নিয়ে

ক্র্যাব নেবুলা। মুহম্মদ জাফর ইকবালের একটি গল্পবইও আছে এই নেবুলাকে নিয়ে




সূর্যের চেয়ে সামান্য বড় বা কয়েক গুণ বড় তারকা গুলো আরও কয়েক ধাপে ফিউশন (সংযুক্তি) বিক্রিয়া চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এদের মাধ্যাকর্ষণ বল যথেষ্ট শক্তিশালী হয় ইলেক্ট্রন আর প্রোটনকে প্রচণ্ড চাপে নিউট্রন আর নিউট্রিনোতে পরিণত করার জন্য। নিউট্রিনো অন্যন্ত গতিশীল হওয়ার কারণে এরা শূন্যে হারিয়ে যায়, রয়ে যায় শুধু নিউট্রন। নিউট্রনকে ভেঙ্গে শক্তি উৎপাদন করার মত যথেষ্ট শক্তি না থাকায় এই তারকাগুলো এখানেই থেমে যায়। এই অবস্থায় এদেরকে বলা হয় Neutron Star.

এদের ঘনত্ব এত বেশি হয় যে এক চা চামচ নিউট্রন নক্ষত্রের ভর পুরো মাউন্ট এভারেস্টের ভরের সমান। নিউট্রন স্টারের ভিতরে কিছু কিছু প্রোটন আর ইলেক্ট্রন তখনো পর্যন্ত অবশিষ্ট থেকে যায় যা এর মধ্যে একটা শক্তিশালী Magnetic field বা চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে। নিউট্রন নক্ষত্রগুলো প্রচণ্ড গতিতে ঘুরতে থাকে, এটা নিজ অক্ষে মিনিটে ৪০ হাজার বার পর্যন্ত হতে পারে। প্রচণ্ড ঘূর্ণন গতি আর শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রের (Magnetic field) কারণে নিউট্রন নক্ষত্র থেকে শক্তিশালী আলোক রশ্মি নির্গত হয় যা লাইট হাউজের আলোর মত জ্বলছে আর নিভছে মনে হয়। এই ধরনের নিউট্রন স্টারকে বলা হয় Pulsar.



কিন্তু সূর্যের চেয়ে ১০-১২ গুণ বা তারও বেশি ভর বিশিষ্ট তারকাগুলো তখন পর্যন্ত সংযুক্তি বিক্রিয়া চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এরা নিউট্রনকে ভেঙ্গে শক্তি উৎপাদন করে বিক্রিয়া চালু রাখে। এভাবে পর্যায়ক্রমে পর্যায় সারণির সিলিকন, অ্যলুমিনিয়াম, পটাসিয়াম তৈরি করতে করতে এক সময় লোহায় এসে থামে। এরপরে আর শক্তি উৎপাদন করা সম্ভব হয় না তাই মুহূর্তেই ওই তারকার বহির্মুখী চাপ উৎপাদনকারী প্রসারণ বন্ধ হয়ে যায় আর রয়ে যায় শুধু মধ্যাকর্ষণ শক্তি।

যেহেতু অন্তর্মুখী বল (মাধ্যাকর্ষণ শক্তি) ছাড়া অন্য কোনো শক্তি তখন আর কার্যকর থাকে না তাই নক্ষত্রের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। আর এক সেকেন্ডের মিলিওন ভাগের এক ভাগ সময়ের মধ্যে গোটা নক্ষত্রটা তার নিজের ভিতরেই collapse করে বা ধসে পড়ে। ধসে পড়ার মুহূর্তে তার বহির্ভাগে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয় যাকে বলা হয় Super Nova. আমাদের সূর্যের চেয়ে অনেক বেশি বড় নক্ষত্র (Super massive Stars) গুলোর ক্ষেত্রে এই বিষ্ফোরণকে বলা হয় Hyper Nova. এই বিস্ফোরণগুলো বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের সবচেয়ে বড় ও উজ্জ্বলতম বিস্ফোরণ, যার প্রথম ১ সেকেন্ডে যে পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়, তা আমাদের সূর্যের সারা জীবনে (নিভে যাওয়ার আগ পর্যন্ত) নির্গত সব শক্তির চেয়ে ১০০ গুণ বেশি হয়ে থাকে।

অন্য দিকে ভয়াবহ মধ্যাকর্ষণ বলের চাপে তারকাটা ছোট হতে হতে তার নিজের আয়তনের ট্রিলিওন ট্রিলিওন ভাগের এক ভাগের সমান আকৃতি ধারণ করে (নোটঃ ভর ঠিক রেখে পৃথিবীকে ছোট করতে করতে যদি একটা চীনা বাদামের সমান করা যায় তাহলে ওই চীনা বাদামটা হবে পৃথিবীর ব্ল্যাক হোল।) যার ফলে এর ভিতরের ঘনত্ব আর মাধ্যাকর্ষণ বল অসীম আকার ধারণ করে আর সৃষ্টি হয় এক নতুন কৃষ্ণগহ্বরবিজ্ঞানীরা এই অবস্থাকে বলে Singularity যেখানে স্থান এবং কাল হয়ে পড়ে অর্থহীন। আর চিরাচরিত পদার্থবিজ্ঞানের সব সূত্র অকেজো হয়ে যায়। বিস্ফোরণের পর মুহূর্তেই নব্য সৃষ্ট এই কৃষ্ণগহ্বরের দুই পাশ দিয়ে অত্যাধিক উত্তপ্ত কণার দুটো ফোয়ারা (Super heated Particles) দুই দিকে ছুটে যেতে থাকে আলোর গতিতে। চলার পথে এদের সংস্পর্শে আসা সব কিছু পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এটাকে বলা হয় Gamma ray burst. কৃষ্ণগহ্বরের ভিতরে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এতই বেশি থাকে যে এর সীমানার (Event Horizon বা ঘটনা দিগন্ত) মধ্যে যা কিছু আসে তার সবই এর ভিতরে হারিয়ে যায়। এমনকি আলোও এর আকর্ষণ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না যার কারণে কৃষ্ণগহ্বর কখনো দেখাও যায় না (ব্যতিক্রম নিয়ে একটু পরেই আলোচনা করা হবে)। এজন্যই এর নামকরণ করা হয়েছে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর।

টুকিটাকি


প্রায় প্রত্যেকটা ছায়াপথের কেন্দ্রে অত্যন্ত বিশাল আকৃতির শক্তিশালী একটা করে কৃষ্ণগহ্বর থাকে, যেগুলো সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির (Big Bang) সাথে সাথেই। কেন্দ্রের এই Super Massive Black Hole গুলো পরবর্তীতে নতুন ছায়াপথ তৈরিতে সাহায্য করে। ক্ষেত্র বিশেষে এরা এত বড় হয় যে এ যাবত আবিষ্কৃত সকল ব্ল্যাক হোলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভরের কৃষ্ণগহ্বর হচ্ছে আমাদের সূর্যের চেয়ে ৪০ বিলিওন বা ৪০০ কোটি গুণ ভারী (২০১৬ এর মার্চ পর্যন্ত)। আমাদের নিজস্ব ছায়াপথ আকাশগঙ্গার কেন্দ্রেও রয়েছে একটি অতিকায় কৃষ্ণগহ্বর যা আমাদের সৌরজগৎ থেকে প্রায় ২৬ হাজার আলোক বর্ষ (light years) দূরে যার আকৃতি সূর্যের চেয়ে প্রায় ৪০ লক্ষ গুণ ভারী।

(নোটঃ আলোক বর্ষ বা light year কোনো বছরের হিসাব না। এটা একটা দূরত্বের একক – মাইল বা কিলোমিটারের মত। আলোর গতি সেকেন্ডে প্রায় ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল বা ৩ লক্ষ কিলোমিটার। আলোর গতিতে ১ বছর চললে যে দূরত্ব অতিক্রম করা যাবে, ওই দূরত্ব কে ১ আলোক বর্ষ বা 1 light year বলা হয়।)


শক্তিশালী চৌম্বক আবেশের কারণে এই কৃষ্ণগহ্বরগুলোর চারপাশে জমে থাকা ধুলোকণার মেঘ, গ্যাস ইত্যাদি প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়ে শক্তিশালী x-ray আর radio wave তৈরি করে যা এর দুই পাশ দিয়ে প্রচণ্ড গতিতে রশ্মির মত বিকিরিত হতে থাকে। এই রশ্মিগুলো পার্শ্ববর্তী ছায়াপথের ধুলিকণার মেঘ, গ্যাস ইত্যাদিকে অত্যাধিক চাপ ও তাপে উত্তপ্ত করে, যার ফলে পরবর্তীতে ওই ছায়াপথে নতুন নতুন তারকারাজির সৃষ্টি হয়। একে বলা হয় AGN বা Active Galactic Nucleus. সব ছায়াপথে AGN থাকে না, যেমন আমাদের কেন্দ্রীয় কৃষ্ণগহ্বরের কোনো AGN নেই। আমরা যখন আমাদের অবস্থান থেকে এই বিকিরিত রশ্মিগুলোকে উল্লম্বভাবে দেখি তখন একে বলা হয় Radio Galaxy. যখন কোনো কোণ থেকে দেখি, তখন একে বলা হয় Quasar বা কোয়েইজার। আর যখন আমরা সরাসরি আলোর উৎস বরাবর রশ্মির কেন্দ্রের দিকে দেখি, তখন একে বলা হয় Blazar. মূলত একই জিনিসকে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি আর অবস্থানের কারণে ভিন্ন ভিন্ন নাম দেয়া হয়ে থাকে।

কৃষ্ণগহ্বরের মৃত্যু


ব্ল্যাক হোল নিজেই একটা মৃত তারকা, তারও আবার মৃত্যু আছে? আছে। যে জিনিষের শুরু আছে তার অবশ্যই একটা শেষ আছে। কৃষ্ণগহ্বরেরও মৃত্যু হয়।


কৃষ্ণগহ্বরের মাধ্যাকর্ষণ বল এতই শক্তিশালী যে এর ভেতর থেকে কোনো কিছুই (এমনকি আলোও) বেরিয়ে আসতে পারে না। যত বেশি বস্তু কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে হারিয়ে যাবে, কৃষ্ণগহ্বরের আকৃতি দিনে দিনে ততই বড় হবে। তবে জ্যোতিঃপদার্থবিদ (astrophysicist) স্টিফেন হকিং এর মতে, কৃষ্ণগহ্বরও কিছু জিনিস নির্গত করে, আর তা হচ্ছে রেডিয়েশন বা বিকিরণ। তার মতে, কৃষ্ণগহ্বর থেকে প্রতিনিয়ত রেডিয়েশন বিকিরিত হতে হতে এক সময় (বিলিওন ট্রিলিওন বছর) কৃষ্ণগহ্বর শূন্যে মিলিয়ে (Evaporate) যাবে। মহাশূন্যের প্রতিটা জায়গায় মূহূর্তে মূহূর্তে স্বল্প সময়ের জন্য ধনাত্মক ও ঋণাত্মক ভর যুক্ত sub-atomic particles তৈরি এবং ধ্বংস হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া যখন কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্তের আশেপাশে হয়, তখন ধনাত্মক ভরবিশিষ্ট কণাগুলো অত্যাধিক শক্তিশালী হওয়ার কারণে বিকিরিত হয়ে যায়। বিকিরণের এই তত্ত্বকে বলা হয় Hawking Radiation. অন্যদিকে, ঋণাত্মক ভরবিশিষ্ট কণাগুলো কৃষ্ণগহ্বরের শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণের কারণে এর ভিতরে পড়ে হারিয়ে যায়। ঋণাত্মক ভরবিশিষ্ট হওয়ার কারণে এরা কৃষ্ণগহ্বরের ভর খানিকটা কমিয়ে দেয়। এভাবে বিলিওন ট্রিলিওন বছর ধরে একই প্রক্রিয়া চলতে চলতে এক সময় কৃষ্ণগহ্বরের ভরও শূন্য হয়ে যাবে, আর কৃষ্ণগহ্বরের মৃত্যু হবে।


কিন্তু হকিং’এর এই সমাধান বিজ্ঞানীদের বড় এক প্রশ্নের সম্মুখীন করে। কৃষ্ণগহ্বর যদি এভাবে একদিন শূন্যে মিলিয়ে যায়, তাহলে এর ভিতরের সব তথ্যও এর সাথে চিরতরে হারিয়ে যাবে, যা চিরাচরিত কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মৌলিক বিধানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বিধান মতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে শক্তি সবসময় সমান থাকবে। একে কখনো সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যাবে না। আর এজন্যই হকিং এর থিওরি নতুন এক প্রশ্নের সৃষ্টি করে যাকে বলা হয় Black Hole Information Paradox. তাহলে এর সমাধান কী?


এই সমস্যা সমাধানের প্রেক্ষিতে সম্প্রতি হকিং নতুন এক তত্ত্ব প্রদান করেন। তার মতে, যেসব তথ্য কৃষ্ণগহ্বরের ভিতরে হারিয়ে যায় তার কোনোকিছুই এর কেন্দ্রে অবস্থান করে না, বরং অবস্থান করে তার ঘটনা দিগন্তের মধ্যে। তার মতে, এই তথ্যগুলো সংরক্ষিত হয় হলোগ্রামের আকারে। একে বলা হয় Holographic Principle. এই তত্ত্ব মতে, ত্রিমাত্রিক কোনো বস্তুর ভিতরের প্রত্যেকটা তথ্য, দ্বিমাত্রিক তথ্য হিসেবে সংরক্ষণ করা সম্ভব, যার মানে হচ্ছে – তথ্যগুলো হারিয়ে যাছে না, বরং অন্য অবস্থায় রুপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। তবে বিজ্ঞানীরা এখনো খুঁজে বের করতে পারেননি যে কিভাবে ওই তত্ত্ব কৃষ্ণগহ্বরের ঘটনা দিগন্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। আমরা হকিং এর পরবর্তী গবেষণাগুলোর জন্য অপেক্ষা করি, আর দেখি তিনি এই সমস্যার যুক্তিযুক্ত কোনো সমাধান বের করতে পারেন কিনা।


উৎস ঃ https://bigganjatra.org/blackhole/

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এর গল্প - "সমুদ্রের স্বাদ"


সমুদ্র দেখিবার সাধটা নীলার ছেলেবেলার! কিছুদিন স্কুলে পড়িয়াছিল। ভূগোলে পৃথিবীর স্থলভাগ আর জলভাগের সংক্ষিপ্ত বিবরণ আছে। কিন্তু তার অনেক আগে হইতে নীলা জানিত পৃথিবীর তিন ভাগ জল, এক ভাগ স্থল। সাত বছর বয়সে বাবার মুখে খবরটা শুনিয়া কী আশ্চর্যই সে হইয়া গিয়াছিল। এ কি সম্ভব? কই, সে তো রেলে চাপিয়া কত দূরদেশে ঘুরিয়া আসিয়াছে, মামাবাড়ি যাইতে সকালবেলা রেলে উঠিয়া সেই রাত্রিবেলা পর্যন্ত ক্রমাগত হু হু করিয়া ছুটিয়া চলিতে হয়, কিন্তু নদীনালা খালবিল ছাড়া জল তো তার চোখে পড়ে নাই। চারিদিকে মাঠ, মাঝে মাঝে জঙ্গল, আকাশ পর্যন্ত শুধু মাটি আর গাছপালা।

তারপর কতভাবে কত উপলক্ষে ছাপার অক্ষর, মুখের কথা আর স্বপ্নের বাহনে সমুদ্র তার কাছে আসিয়াছে। বলাইদের বাড়ির সকলে পুরী গিয়া কেবল সমুদ্র দেখা নয়, সমুদ্রের স্নান করিয়া আসিল। কলিকাতায় সাহেব-কাকার ছেলে বিনুদা বিলাত গেল_ সমুদ্রের বুকেই নাকি তার কাটিয়া গেল অনেকগুলি দিন। সমুদ্রের জল মেঘ হইয়া নাকি বৃষ্টি নামে, মাছ-তরকারিতে যে নুন দেওয়া হয় আর থালার পাশে একটুখানি যে নুন দিয়া মা দুবেলা ভাত বাড়িয়া দেন, সে নুন নাকি তৈরি হয় সমুদ্রের জল শুকাইয়া! সারাদিন গরমে ছটফট করিবার পর সন্ধ্যাবেলা যে ফুরফুরে বাতাস গায়ে লাগানোর জন্য তারা ছাদে গিয়া বসে, সে বাতাস নাকি আসে সোজা সমুদ্র হইতে!
'সমুদ্দুর বুঝি দক্ষিণ দিকে বাবা?'
'চারিদিকে সমুদ্দুর আছে। দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগর_ আমাদের খুব কাছে।'
ঠিক। ম্যাপে তাই আঁকা আছে। কিন্তু চারদিকে সমুদ্র? উত্তর দিকে তো হিমালয় পর্বত, তারপর তিব্বত আর চীন! ম্যাপটা আবার ভালো করিয়া দেখিতে হইবে।
'আমায় সমুদ্দুর দেখাবে বাবা?'
বাবা অনেকবার প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন, এবারো দিলেন। সমুদ্র দেখার আর হাঙ্গামা কী? একবার তীর্থ করিতে পুরীধামে গেলেই হইল, সুবিধামতো একবার বোধ হয় যাইতেও হইবে। নীলার মার অনেক দিনের সাধ।
কিন্তু কেরানির স্ত্রীর সহজ সাধও কি সহজে মিটিতে চায়! অনেক কষ্টে এক রকম মরিয়া হইয়া একটা বিশেষ উপলক্ষে স্ত্রীর সাধটা যদি-বা মেটানো চলে, ছেলেমেয়ের সাধ অপূর্ণই থাকিয়া যায়।
রথের সময়ে যে ভিড়টাই হয় পুরীতে, ছেলেমেয়েদের কি সঙ্গে নেওয়া চলে? তাছাড়া, সকলকে সঙ্গে নিলে টাকায়ও কুলায় না। ছোট ভাইবোনদের দেখাশোনাই বা করিবে কে?
নীলাকে সঙ্গে না নেওয়ার আরো কারণ আছে।
'না গো, বিয়ের যুগ্যি মেয়ে নিয়ে ওই হট্টগোলের মধ্যে যাবার ভরসা আমার নেই।'
বিয়ের যুগ্যি মেয়ে কিন্তু বিয়ের অযুগ্যি অবুঝ মেয়ের মতো কাঁদিয়া কাঁদিয়া চোখ ফুলাইয়া ফেলিল। কয়েকদিন চোখের জলের নোন্তা স্বাদ ছাড়া জিভ যেন তার ভুলিয়া গেল অন্য কিছুর স্বাদ। মা-বাবা তীর্থ সারিয়া ফিরিয়া আসিলে কোথায় হাসিমুখে তাঁদের অভ্যর্থনা করিবে, তীর্থযাত্রার গল্প শুনিবার জন্য ব্যাকুল হইয়া উঠিবে, একটি প্রশ্ন করিয়াই নীলা কাঁদিয়া ভাসাইয়া দিল।
'সমুদ্দুরে চান করেছ বাবা?'
গাড়ি হইতে নামিয়া সবে ঘরে পা দিয়াছেন, নীলার বাবা বসিয়া বলিলেন, 'করেছি রে, করেছি। একটু দাঁড়া, জিরিয়ে নেই, বলবখন সব।'
কী বলিবেন? কী প্রয়োজন আছে বলিবার? নীলা কি পুরীর সমুদ্র-স্নানের বর্ণনা শোনে নাই? বলাইদের বাড়ির তিনতলার ছাতে উঠিয়া চারিদিকে যেমন আকাশ পর্যন্ত ছড়ানো স্থির অনড় রাশি রাশি বাড়ি দেখিতে পায়, তেমনি সীমাহীন জলরাশিতে বাড়ির সমান উঁচু ঢেউ উঠিতেছে নামিতেছে আর তীরের কাছে বালির উপর আছড়াইয়া পড়িয়া সাদা ফেনা হইয়া যাইতেছে, এ কল্পনায় কোথাও কি এতটুকু ফাঁকি আছে নীলার? কেবল চোখে দেখা হইল না, এই যা। বাপের আদূরে মেয়ে সে, অন্তত সকলে তাই বলে, তার সমুদ্র দেখা হইল না, কিন্তু বাপ তার সমুদ্র দেখিয়া, স্নান করিয়া ফিরিয়া আসিল। নীলা তাই কাঁদিয়া ফেলিল।
বাবা তাড়াতাড়ি আবার প্রতিজ্ঞা করিলেন, 'পুজোর সময় যেমন করে পারি তোকে সমুদ্র দেখিয়ে আনব নীলা, ধার করতে হলে তাও করব। কাঁদিস নে নীলা, সারারাত গাড়িতে ঘুমোতে পাই নি, দোহাই তোর, কাঁদিস নে।'
সমুদ্র দেখাইয়া আনিবার বদলে পূজার সময় নীলাকে কাঁদাইয়া তিনি স্বর্গে চলিয়া গেলেন। বলাই বাহুল্য যে, এবার সমুদ্র দেখা হইল না বলিয়া নীলা কাঁদিয়া কাঁদিয়া চোখ ফুলাইয়া চোখের জলের নোন্তা স্বাদে আর সবকিছুর স্বাদ ডুবাইয়া দিল না, কাঁদিল সে বাপের শোকেই। কেবল সে একা নয়, বাড়ির সকলেই কাঁদিল। কিছুদিনের জন্য মনে হইল, একটা মানুষ, বিশেষ অবস্থার বিশেষ বয়সের বিশেষ একটা মানুষ, চিরদিনের জন্য নীলার মনের সমুদ্রের মতো দুর্বোধ্য ও রহস্যময় একটা সীমাহীন কিছুর ওপারে চলিয়া গেলে, সংসারে মানুষের কান্না ছাড়া আর কিছুই করিবার থাকে না। 
ছেলেবেলা হইতে আরো কতবার নীলা কাঁদিয়াছে। বাড়ির শাসনে কাঁদিয়াছে, অভিমানে কাঁদিয়াছে, খেলার সাথীর সঙ্গে সংঘর্ষ হওয়ায় কাঁদিয়াছে, পেটের ব্যথায় ফোঁড়ার যাতনায় কাঁদিয়াছে, সমুদ্র দেখার সাধ না মেটায় কাঁদিয়াছে, অকারণেও সে দু-চারবার কাঁদে নাই এমন নয়। এমন কষ্ট হয় কাঁদিতে!_ দেহের কষ্ট, মনের কষ্ট। শরীরটা যেন ভারি হইয়া যায়, জ্বর হওয়ার মতো সর্বাঙ্গে অস্বস্তিকর ভোঁতা টনটনে যাতনা বোধ হয়, চিন্তা জগৎটা যেন বর্ষাকালের আকাশের মতো ঝাপসা হইয়া যায়, একটা চিরস্থায়ী ভিজা স্যাঁতসেঁতে ভাব থমথম করিতে থাকে। শরীর ও মন দুরকম কষ্টেরই আবার স্বাদ আছে_ বৈচিত্র্যহীন আলুনি ও কড়া নোন্তা স্বাদ।
স্বাদটা অনুভব করিবার সময় নীলার লাগে এক রকম, আবার কল্পনা করিবার সময় লাগে অন্যরকম_ রক্তের স্বাদের মতো। ছুরি দিয়া পেন্সিল কাটিতে, বঁটি দিয়া তরকারি কুটিতে, কোনো কিছু দিয়া টিনের মুখ খুলিতে, নিজের অথবা ভাইদের আঙুল কাটিয়া গেলে তার প্রচলিত চিকিৎসার ব্যবস্থা অনুসারে নীলা কাটাস্থানে মুখ দিয়া চুষিতে আরম্ভ করে_ রক্তের স্বাদ তার জানা আছে।
নীলার বাবার মৃত্যুর পর সকলে মামাবাড়ি গেল। বিয়ের যুগ্যি মেয়েকে সঙ্গে করিয়া অতদূর মফস্বলের ছোট শহরে যাওয়ার ইচ্ছা নীলার মার ছিল না। তিনি বলিলেন, 'আর কটা মাস থেকে মেয়েটার বিয়ে দিয়ে গেলে হত না দাদা? একটা ছোটখাটো বাড়ি ঠিক করে নিয়ে_'
মেজ মামা বলিলেন, 'মাথা খারাপ নাকি তোর? অরক্ষণীয়া নাকি মেয়ে তোর? বাপ মরেছে, একটা বছর কাটুক না।'
'ও!' বলিয়া নীলার মা চুপ করিয়া গেলেন।
কেবল তাই নয়, শহরে তাদের দেখাশোনা করিবে কে, খরচ চালাইবে কে? মামারা তো রাজা নন। সুতরাং সকলে মামাবাড়ি গেল। সকালে গাড়িতে উঠিয়া অনেক রাত্রি পর্যন্ত হু হু করিয়া চলিলে সেখানে পেঁৗছানো যায়। স্থানটির পরিবর্তন হয় নাই, অনেক কালের ভাঙা ঘাটওয়ালা পানাভরা পুকুরটার দক্ষিণে ছোট আমবাগানটির কাছে নীলার দুই মামার বাড়িখানিরও পরিবর্তন হয় নাই। কেবল মামারা, মামিরা, আর মামাতো ভাইবোনেরা এবার যেন কেমন বদলাইয়া গিয়াছে। কোথায় সেই মামার বাড়ির আদর, সকলের আনন্দ-গদগদ ভাব, অফুরন্ত উৎসব? এবার তো একবারও কেউ বলিল না, এটা খা, ওটা খা? তার বাবার জন্য কাঁদাকাটা শেষ করিয়া ফেলিবার পরেও তো বলিল না! একটু কাঁদিবে নাকি নীলা, বাবার জন্য মাঝে মাঝে যেটুকু কাঁদে তারও উপরে মামাবাড়ির অনাদর অবহেলার জন্য একটু বেশিরকম কান্না?
কিছুকাল কাটিবার পর এ বিষয়ে ভাবিয়া কিছু ঠিক করিবার প্রয়োজনটা মিটিয়া গেল, আপনা হইতে যথেষ্ট কাঁদিতে হইল নীলাকে। ছেঁড়া ময়লা কাপড় তো নীলা জীবনে কখনো পরে নাই; গোবর দিয়া ঘর লেপে নাই, পানাপুকুরে বাসন মাজে নাই; কলসি কাঁখে জল আনে নাই, বিছানা তোলা, মসলা বাটা, রান্না করা লইয়া দিন কাটায় নাই, এমন ভয়ানক ভয়ানক খারাপ কথার বকুনিও শোনে নাই। হায়, একটু ভালো জিনিস পর্যন্ত সে যে খাইতে পায় না, এমনিই তার শরীরের নাকি এমন পুষ্টি হইয়াছে যে কোনো ভদ্রঘরের মেয়ের যা হয় না, হওয়া উচিত নয়! কিন্তু তারই না হয় অভদ্ররকমের দেহের পুষ্টি হইয়াছে, তার ভাইবোনেরা তো রোগা, মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে ওরাও একটু দুধ পায় না কেন, পিঠা-পায়েসের ভাগটা ওদের এত কম হয় কেন? এমন ভিখারির ছেলের মতো বেশ করিয়া তার ভাই দুটিকে স্কুলে যাইতে হয় কেন? মামাদের জন্য ভাইরা যে তার দুবেলা খাইতে পাইতেছে, স্কুলে পড়িতে পাইতেছে, এটা নীলার খেয়ালও থাকে না, মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে নিজের ভাইবোনদের আহার-বিহারের স্বাভাবিক পার্থক্যটা তাকে কেবলি কাঁদায়।
বড়মামি বলেন, 'বড় তো ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে তোমার ঠাকুরঝি?'
মেজ মামি বলেন, 'আদর দিয়ে দিয়ে মেয়ের মাথাটি খেয়েছ একেবারে।'
নীলার মা বলেন, 'দাও না তোমরা ওর একটা গতি করে, মেয়ে যে দিন দিন কেমনতরো হয়ে যাচ্ছে?'
পাত্র খোঁজা হইতে থাকে আর নীলা ভাবিতে থাকে, বিবাহ হইয়া গেলে সে আবার শহরের সেই বাড়ির মতো একটা বাড়িতে গিয়া থাকিতে পাইবে, সকলের আদর-যত্ন জুটিবে, অবসর সময়ে বলাইদের মতো কোনো প্রতিবেশীর তিনতলা ছাদে উঠিয়া চারিদিকে বাড়ির সমুদ্র দেখিতে পারিবে, বলাইয়ের মতো কারো কাছে সমুদ্রের গল্প শোনা চলিবে?
ইতিমধ্যে ম্যালেরিয়ায় ভুগিতে ভুগিতে নীলার একটি ভাই মরিয়া গেল। নীলার মা কী একটা অজানা অসুখে ভুগিতে ভুগিতে শয্যা গ্রহণ করিলেন। বড়মামার মেজ মেয়ে সন্তান প্রসব করিতে বাপের বাড়ি আসিয়া একখানা চিঠির আঘাতে একেবারে বিধবা হইয়া গেল। পানাভরা পুকুরটার অপর দিকের বাড়িতেও একটি মেয়ে আরো আগে সন্তানের জন্ম দিতে বাপের বাড়ি আসিয়াছিল, একদিন রাতভর চেঁচাইয়া সে নিজেই মরিয়া গেল। আমবাগানের ওপাশে আট-দশখানা বাড়ি লইয়া যে পাড়া, সেখানেও পনের দিন আগে-পিছে দুটি বাড়ি হইতে বিনাইয়া বিনাইয়া শোকের কান্না ভাসিয়া আসিতে শোনা গেল।
তারপর একদিন অনাদি নামে সদর হাসপাতালের এক কম্পাউন্ডারের সঙ্গে নীলার বিবাহ হইয়া গেল। সমস্ত অবস্থা বিবেচনা করিয়া সকলেই একরকম স্বীকার করিল যে, ধরিতে গেলে নীলার বিবাহটা মোটামুটি ভালোই হইয়াছে বলা যায়। মেয়ের তুলনায় ছেলের চেহারাটাই কেবল একটু যা বেমানান হইয়াছে। কচি ডাল ভাঙিয়া ফেলিলে শুকাইয়া যেমন হয়, কতকটা সেইরকম শুষ্ক ও শীর্ণ চেহারা অনাদির, ব্রণের দাগ-ভরা মুখের চামড়া কেমন মরা-মরা, চোখ দুটি নিষ্প্রভ, দাঁতগুলি খারাপ। এদিকে মামাবাড়ির অনাদর অবহেলা সহিয়া এবং বাবা ও ছোটভাইটির জন্য কাঁদিয়াও নীলার চেহারাটি বেশ একটু জমকাল ছিল, একটু অতিরিক্ত পারিপাট্য ছিল তার নিটোল অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলির গঠন-বিন্যাসে।
কিছু বলিবার নাই, কিছু করিবার নাই, মুখ বুজিয়া সব মানিয়া লইতে হইল নীলার। বিশেষ আর এমন কী পরিবর্তন হইয়াছে জীবনের? বাস কেবল করিতে হয় অজানা লোকের মধ্যে, যাদের কথাবার্তা চালচলন নীলা ভালো বুঝিতে পারে না; আর রাত্রে শুইয়া থাকিতে হয় একটি আধ-পাগলা মানুষের কাছে, যার কথাবার্তা চালচলন আরো বেশি দুর্বোধ্য মনে হয় নীলার। কোনোদিন রাত্রে সংসারের সমস্ত কাজ শেষ হওয়ার পর ছুটি পাইয়া ঘরে আসিবামাত্র অনাদি দরজায় খিল তুলিয়া দেয়, হাত ধরিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে কী যে সে বলিতে আরম্ভ করে, নীলা ভালো বুঝিতেই পারে না। কেবল বুঝিতে পারে, আবেগে উত্তেজনায় অনাদি থরথর করিয়া কাঁপিতেছে, চোখের দৃষ্টি তার উদ্ভ্রান্ত। মনে হয়, নীলার আসিতে আর একটু দেরি হইলে সে বুঝি বুক ফাটিয়া মরিয়াই যাইত! কোনো দিন ঘরে আসিয়া দেখিতে পায় অনাদির মুখে গভীর বিষাদের ছাপ, স্তিমিত চোখে দৃষ্টি আছে কি না সন্দেহ। ঘুম আসে নাই, রাত্রি শেষ হইয়া আসিলেও ঘুম যে আজ তার আসিবে না, নীলা তা জানে, কিন্তু হাই সে তুলিতেছে মিনিটে মিনিটে।
কী বলিবার আছে, কী করিবার আছে? হয় দাঁতের ব্যথা, নয় মাথা ধরা, নয় জ্বরভাব, অথবা আর কিছু অনাদিকে প্রায়ই রাত জাগায়, অন্যদিন সে রাত জাগে নীলার জন্য। সুযোগ পাইলে নীলা চুপি চুপি নিঃশব্দে কাঁদে। সজ্ঞানে মনের মতো স্বামীলাভের তপস্যা সে কোনোদিন করে নাই, কী রকম স্বামী পাইলে সুখী হইবে, কোনোদিন এ কল্পনা তার মনে আসে নাই, সুতরাং আশাভঙ্গের বেদনা তার নাই। আশাই সে করে নাই, তার আবার আশাভঙ্গ কিসের? অনাদির সোহাগেই সোহাগ পাওয়ার সাধ মিটাইয়া নিজেকে সে কৃতার্থ মনে করিতে পারিত, উত্তেজনা ও অবসাদের নাগরদোলায় ক্রমাগত স্বর্গ ও নরকে ওঠানামা করার যে চিরন্তন প্রথা আছে জীবনযাপনের, তার মধ্যে নরকে নামাকে তুচ্ছ আর বাতিল করিয়া দিয়া সকলের মতো সেও একটা বিশ্বাস জন্মাইয়া নিতে পারিত যে স্বর্গই সত্য, বাকি সব নিছক দুঃস্বপ্ন। কিন্তু স্বামীই তো মেয়েদের সব নয়, গত জীবনের একটা বড় রকম প্রত্যাবর্তন তো নীলা আশা করিয়াছিল, যে প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে শহরে তাদের সেই আগেকার বাড়িতে থাকা, সকলের না হোক অন্তত একজনের কাছে সেইরকম আদর-যত্ন পাওয়া, অবসর সময় বলাইদের মতো কোনো প্রতিবেশীর তিনতলা বাড়ির ছাদে উঠিয়া চারিদিকে বাড়ির সমুদ্র দেখা আর বলাইয়ের মতো কারো মুখে আসল সমুদ্রের গল্প শোনার মোটামুটি একটা মিল আছে। এখানে নীলাকে বিশেষ অনাদর কেউ করে না, লজ্জায় কম করিয়া খাইলেও মামাবাড়ির চেয়ে এখানেই তার পেটভরা খাওয়া জোটে; এখানে তাকে যে দয়া করিয়া আশ্রয় দেওয়া হয় নাই, এখানে থাকিবার স্বাভাবিক অধিকারই তার আছে, এটা সকলে যেমন সহজভাবে মানিয়া লইয়াছে, সে নিজেও তেমনি আপনা হইতে সেটা অনুভব করিয়াছে। মামাবাড়ির চেয়েও এখানকার অজানা অচেনা নরনারীর মধ্যে ঘোমটা দেওয়া বধূজীবন যাপন করিতে আসিয়া নীলা তাই স্বস্তি পাইয়াছে অনেক বেশি। তবু একটা অকথ্য হাতাশার তীব্র ঝাঁজালো স্বাদ সে এখন অনভব করিয়াছে এখানে। গুমরাইয়া গুমরাইয়া এই কথাটাই দিবারাত্রি মনের মধ্যে পাক খাইয়া বেড়াইতেছে যে সব তার শেষ হইয়া গিয়াছে, কিছুই তার করার নাই, বলার নাই, পাওয়ার নাই, দেওয়ার নাই_ সানাই বাজাইয়া একদিনে তার জীবনের সাধ, আহ্লাদ, সুখ, দুঃখ, আশা, আনন্দের সমস্ত জের মিটাইয়া দেওয়া হইয়াছে।
'কাঁদছ নাকি? কী হয়েছে?'
'কাঁদি নি তো।'
কাঁদিতে কাঁদিতেই নীলা বলে সে কাঁদে নাই। জানুক অনাদি, কী আসিয়া যায়? কাঁদা আর না-কাঁদা সব সমান নীলার। নীলার কান্নার মৃতসঞ্জীবনী যেন হঠাৎ মৃতপ্রায় দেহে মনে জীবন আনিয়া দিয়াছে এমনিভাবে অনাদি তাকে আদর করে; ব্যাকুল হইয়া জানিতে চায়, কেন কাঁদিতেছে নীলা, কী হইয়াছে নীলার? এখানে কেউ গালমন্দ দিয়াছে? মা-বোনের জন্য মন কেমন করিতেছে? অনাদি নিজে না জানিয়া মনে কষ্ট দিয়াছে তার? একবার শুধু মুখ ফুটিয়া বলুক নীলা, এখনই অনাদি প্রতিকারের ব্যবস্থা করিবে!
কিন্তু কী বলিবে নীলা, বলার কী আছে? সে কি নিজেই জানে, কেন সে কাঁদিতেছে? আগে প্রত্যেকটি কান্নার কারণ জানা থাকিত, কোন কান্না বকুনির, কোন কান্না অভিমানের, কোন কান্না শোকের, আর কোন কান্না সমুদ্র দেখার সাধের মতো জোরালো অপূর্ণ সাধের। আজকাল সব যেন একাকার হইয়া গিয়াছে। কান্নার সমস্ত প্রেরণাগুলি যেন দল বাঁধিয়া চোখের জলের উৎস খুলিয়া দেয়।
সেদিন অনাদি ভাবে, কান্নার কারণ অবশ্যই কিছু আছে, নীলা মুখ ফুটিয়া বলিতে পারিল না। পরদিন আবার তাকে কাঁদিতে দেখিয়া সে রীতিমতো ভড়কাইয়া যায়, কান্নার কারণটা তবে তো নিশ্চয়ই গুরুতর! আরো বেশি আগ্রহের সঙ্গে সে কারণ আবিষ্কারের চেষ্টা করে এবং কিছুই জানিতে না পারিয়া সেদিন তার একটু অভিমান হয়। তারপর দুদিন নীলা কাঁদে কি না সে জানে না, দাঁতের ব্যথা আর মাথার যন্ত্রণায় বিব্রত থাকায় অনাদি টের পায় না।
পরদিন আবার নীলার কান্না শুরু হইলে রাগ করিয়া অনাদি বলিল, 'কী হয়েছে, যদি নাই বলবে, বারান্দায় গিয়ে কাঁদো, আমায় জ্বালিও না।'
এতক্ষণ কাঁদিবার কোনো প্রত্যক্ষ কারণ ছিল না, এবার স্বামীর একটা কড়া ধমক খাইয়া নীলা অনায়াসে আরো বেশি আকুল হইয়া কাঁদিতে পারিত, কিন্তু ধমক খাওয়া মাত্র নীলার কান্না একেবারে থামিয়া গেল।
'দাঁত ব্যথা করছে তোমার?'
অনাদি বলিল, 'না।'
'মাথার যন্ত্রণা হচ্ছে?'
'না।'
'তবে?'_ নীলা যেন অবাক হইয়া গিয়াছে। দাঁতও ব্যথা করিতেছে না, মাথার যন্ত্রণা নাই, কাঁদিবার জন্য তবে তাকে ধমক দেওয়া কেন, বারান্দায় গিয়া কাঁদিতে বলা কেন? দাঁতের ব্যথা, মাথার যন্ত্রণা না থাকিলে তো তার প্রায় নিঃশব্দ কান্নায় অনাদির অসুবিধা হওয়ার কথা নয়!
তারপর ধমক দিয়া কয়েকবার নীলার কান্না বন্ধ করা গেল বটে, কিন্তু কিছুদিন পরে ধমকেও আর কাজ দিল না। মাঝে মাঝে তুচ্ছ উপলক্ষে, মাঝে মাঝে কোনো উপলক্ষ ছাড়াই নীলা কাঁদিতে লাগিল। মনে হইল, তার একটা উদ্ভট ও দুর্নিবার পিপাসা আছে, নিজের নাকের জল চোখের জলের স্রোত অনেকক্ষণ ধরিয়া অবিরাম পান না করিলে তার পিপাসা মেটে না। 
তারপর ক্রমে ক্রমে অনাদি টের পাইতে থাকে, বৌয়ের তার কান্নার কোনো কারণ নাই, বৌটাই তার ছিঁচকাঁদুনে, কাঁদাই তার স্বভাব।
অনাদির মা-ও কথাটায় সায় দিয়া বলেন, 'এদ্দিন বলি নি তোকে, কী জানি হয়তো ভেবে বসবি আমরা যন্ত্রণা দিয়ে বৌকে কাঁদাই, তোর কাছে বানিয়ে বানিয়ে মিছে কথা বলছি_ বড্ড ছিঁচকাঁদুনে বৌ তোর। একটু কিছু হল তো কেঁদে ভাসিয়ে দিলে। আগে ভাবতাম, বৌ বুঝি বড্ড অভিমানী, এখন দেখছি তা তো নয়, এ যে ব্যারাম! আমাদের কিছু বলতে কইতে হয় না, নিজে নিজেই কাঁদতে জানে। ওবেলা ও-বাড়ির কানুর মা মহাপ্রসাদ দিতে এল, বসিয়ে দুটো কথা বলছি, বৌ কাছে দাঁড়িয়ে শুনছে, বলা নেই কওয়া নেই ভেউ ভেউ করে সে কী কান্না বৌয়ের! সমুদ্দুরে চান করার গল্প থামিয়ে কানুর মা তো থ বনে গেল। যাবার সময় চুপি চুপি আমায় বলে গেল, বৌকে মাদুলি তাবিজ ধারণ করাতে। এসব লক্ষণ নাকি ভালো নয়।'
অনাদির মা কান পাতিয়া শোনে, দরজার আড়াল হইতে অস্ফুট একটা শব্দ আসিতেছে।
'ঐ শোন। শুনলি?'
বাহিরে গিয়া অনাদি দেখিতে পায়, দরজার কাছে বারান্দায় দেয়াল ঘেঁষিয়া বসিয়া নীলা বঁটিতে তরকারি কুটিতেছে। একটা আঙুল কাটিয়া গিয়া টপ্টপ্ করিয়া ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়িতেছে আর চোখ দিয়া গাল বাহিয়া ঝরিয়া পড়িতেছে জল। মাঝে মাঝে জিভ দিয়া নীলা জিভের আয়ত্তের মধ্যে যেটুকু চোখের জল আসিয়া পড়িতেছে সেটুকু চাটিয়া ফেলিতেছে।

আনিসুল হকের গল্প-চুরি নিয়ে খোলা আলাপ : তিন সুন্দরীর নিদ্রা-জার্নি - কুলদা রায়


এক। ভূমিকা

বাংলাদেশের দৈনিক প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকী শিল্প ও সাহিত্য বিভাগে গেল মাসে (১৮ সেটেম্বর, ২০১৫) আনিসুল হকের একটি গল্প প্রকাশিত হয়েছিল , নাম--পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী নারী, আপনার জন্য

আনিসুল হকের গল্পটি প্রকাশিত হওয়ার পরে অনলাইনে তুমুল বিতর্ক ওঠে। প্রথম অভিযোগটি ওঠে আনিসুল হক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর বেঁচে থাকো সর্দিকাশি গল্পটি নকল করে লিখেছেন। এর পরে আরেকটি অভিযোগ ওঠে, নোবেল পুরস্কারজয়ী কলাম্বিয়ান লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘নিদ্রিতা সুন্দরী ও একটি এ্যারোপ্লেন ‘ নামে একটি বিখ্যাত গল্পের নকল।
এ ধরনের অভিযোগ স্বস্তিকর নয়। আনিসুল হকের মত মূলধারার লেখক অন্য লেখকের লেখা  নকল করে লিখবেন সেটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না।  এ ধরনের ঘটনা থেকে নবীন লেখক-পাঠক লেখালেখির নামের-শিল্পকর্ম নির্মাণ বিষয়ে ভুল বার্তা পেতে পারেন। ফলে লেখা তিনটি গভীরভাবে পড়ে পাঠ করে অভিযোগ খতিয়ে দেখা ছাড়া উপায় থাকে না।

এই পরিপ্রেক্ষিতে মূল গল্প তিনটি, , তাদের তুলনামূলক নিকট বিশ্লেষণ ও সংশ্লিষ্ট কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে এই লেখাটি করা হয়েছে।

দুই। মার্কেজ, মুজতবা ও আনিসুলের তিন রমনীর জার্নি--
১.
মার্কেজের গল্পটি শুরু হয়েছে—একটি নারী প্যাসেঞ্জারের রূপ বর্ণনা করে। প্যাসেঞ্জারের সঙ্গে গল্পের উত্তম পুরুষের কথকের দেখা হয়েছে প্যারিসের চার্লস ডি গল বিমানবন্দরে। তিনি যাচ্ছেন নিউ ইয়র্কে। সুন্দরীর রূপ বর্ণনা করছেন মার্কেজ—


নমনীয় এক সৌন্দর্য ছিল তার পুরো অঙ্গে। স্নিগ্ধ ত্বকে পাউরুটির মতো তুলতুলে আমেজ ও পটলচেরা চোখের চাহনির গভীরে আমি তা দেখেছি। সেই সঙ্গে কাঁধ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া সোজা কালো চুলে এক চিরন্তন সৌন্দর্যের ঢেউ খেলছিল। হয়তো ইন্দোনেশিয়া বা আন্দিজের মতো প্রাচীন সে সৌন্দর্য, তবে মহাকালিক। তার পরিধেয় প্রতিটি পোশাকে ছিল সূক্ষ্ম রুচির পরিচয়-লিনেক্স (বনবিড়ালের চামড়া) জ্যাকেট, সূক্ষ্ম ফুল অঙ্কিত ঢিলেঢালা সিল্কের ব্লাউজ, লিনেন কাপড়ের ট্রাউজার আর বাগানবিলাস রঙের ছোট ছোট ডোরাকাটা জুতা।

আনিসুল হকের গল্পের কথকও উত্তম পুরুষ। তিনি আসছেন প্লেনে নয়-- ট্রেনে। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায়। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে কথক দেখেছেন একটি নারীকে। শুরুতেই তার রূপ বর্ণিত হচ্ছে—

পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী নারীটি পুরোনো প্ল্যাটফর্মে এইমাত্র পা রাখল।
আমি ঘ্রাণ নিলাম। বাতাস আমাকে জানিয়ে দিল। হ্যাঁ, এসেছে একজন।
আমি পেছনে ফিরে তাকালাম। মেয়েটি পরেছে ঘিয়ে রঙের একটা ফতুয়া, গ্যাবাডিনের একটা ট্রাউজার। তার চুল খোলা। মেয়েটির নাকে একটা নাকফুল। মেয়েটি ঈষৎ শ্যাম বর্ণ।

মার্কেজের বর্ণনার মধ্যে ধ্রুপদী রূপকল্প এসে যাচ্ছে। চোখের বর্ণনার পরেই আসছে চুলের বর্ণনা। তারপরে গায়ের পরিধেয় পোশাকের কথা।

আর আনিসের লেখায় আসছে—শুরুতে পোষাকের বিবরণী। তারপর ঢেউ খেলানো চুল।

মার্কেজ বলে দিচ্ছেন, 'এ পর্যন্ত দেখা সকল মেয়ের মধ্যে তুমি সবচেয়ে সুন্দর'। রূপ বর্ণনার পরেই এই 'সব চেয়ে সুন্দর' হিসেবে সিদ্ধান্ত দিচ্ছে। আনিস তার গল্পের নারীটিকে শুরুতেই, রূপবর্ণনার আগে বলে দিচ্ছেন, আমি পেছনে না তাকিয়ে শুধু বাতাসে শ্বাস নিয়ে বলতে পারি, এক শ হাত পেছনে একটি অত্যন্ত রূপবতী তরুণী অবস্থান করছে।

২.
তুষার ঝড়ের জন্য মার্কেজের বিমান ছাড়তে দেরি হচ্ছে। বলা হচ্ছে এই ঝড়টি এ শতাব্দীর মধ্যে সব চেয়ে বড় ঝড়। কিন্তু মেয়েটিকে দেখার পরে বিমানবন্দরের সকল ঝোড়ো হাওয়া বসন্তের হাওয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে। কথক বোর্ডিং পাসের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছেন একজন ডাচ মহিলার পেছনে। তার ঝগড়ার কারণে ঘণ্টাখানেক দেরি হল। এর মধ্যেই সেই সুন্দরী চলে গেলেন সামনে। টার্মিনালে হারিয়ে গেলেন। মেয়েটির দেখার বাসনা লুপ্ত হল। টিকিট চেকার মহিলার সঙ্গে কথক একটু রঙ্গ রসিকতা করলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেন, প্রথম দর্শনে ভালোবাসায় তিনি বিশ্বাস করেন কি না। ভদ্রমহিলা আমাকে বললেন, 'অবশ্যই, বরং এ ছাড়া অন্য কিছু অসম্ভব'। এ সবই মার্কেজ সেই সুন্দরী নারীটির প্রতি তার আকর্ষণের ইঙ্গিত হিসেবে বলছেন। পাঠককে ঘোর লাগিয়ে দিচ্ছেন। এরপরে কথক প্লেনের টিকিট পেয়েছেন। ৪ নং সিট বেছে নিয়েছেন। প্রথম শ্রেণীর টিকিট। তার বিমান সকালের বদলে সন্ধ্যায় ছাড়ল।



আনিসের গল্পে মেয়েটিকে কথক কাছ থেকে ব্যাকুল হয়ে দেখতে লাগলেন। তার রূপের সংগে মোম্বাই সিনেমার এক নায়িকার কথা বললেন। তার ঘাড়, নাক, নাকফুলের সৌন্দর্য বর্ণনা করছেন। ট্রেন মিস হতে পারে এই ভয়ে সুন্দরীকে রেখে আরেকটি প্লাটফর্মে তিনি চলে যেতে বাধ্য হলেন। টিকিট করা ছিল। ট্রেনে বোর্ডিং পাস লাগে না। টিকিট নং আগে থেকেই দেওয়া থাকে। চেকিংও দরকার হয় না। ফলে আনিসের গল্পে এটা বাদ। কথক ট্রেনে উঠে পড়লেন। তবে মার্কেজের মত এই টিকিটও প্রথম শ্রেণীর।

৩.
মার্কেজের কথক জানতেন না তার চার নম্বর সিটের পাশের সিট কোন যাত্রীর। কিন্তু তিনি দেখলেন, যে-রূপবতী নারীকে দেখেই তিনি পাগল হয়েছিলেন তিনিই হলেন তার পাশের সিটের যাত্রী।
আনিসের গল্পের মেয়েটিও কাকতালীয়ভাবে তার মুখোমুখি সিটে বসেছে। অদ্ভুত মিল ঘটছে দুটি গল্পেই।
মার্কেজের মেয়েটি কথকের সঙ্গে কথা বললেন না। একটু প্রসাধনী করলেন। তারপর ঘুমিয়ে পড়লেন।

আনিসের গল্পের রূপবতী মেয়েটিও কথকের সঙ্গে কথা বললেন না। ঘুমিয়ে পড়লেন।

৪.
ঘুমিয়ে পড়ার পরে মার্কেজের সুন্দরীকে কথক মন ভরে দেখতে লাগলেন। তার কাছে মেয়ে প্রকৃতির সবচেয়ে সুন্দর সৃষ্টি বলে  বিশ্বাস হচ্ছে। তাই তার পাশে শুয়ে থাকা মোহিনীর জাদু থেকে এক মুহূর্তের জন্যও বের হতে পারছিলেন না। কোনো খাবার খেলেন না। কথক মদ খেতে খেতে ঘুমন্ত মেয়েটির প্রতি চিয়ার্স করলেন। তাকে নিয়ে সুখ স্বপ্নও দেখলেন। বাথরুমেও গেলেন। আট ঘণ্টা পরে তার ঘুম ভাঙল।

আনিসের গল্পের মেয়েটি ঘুমিয়ে পড়ার পরে কথক তাকে দেখতে লাগলেন বিভোর হয়ে। এর মধ্যে খাবার খেলেন। মেয়েটি উঠল না খেতে। বাঙালিরা প্রকাশ্যে মদ খায় না বলে কথককে মদ খেতে দেখা গেল না। মার্কেজের কথকের মত আনিসের কথকও বাথরুমে ঘুরে এলেন।

মেয়েটির ঘুম ভাঙল টঙ্গি স্টেশনে। তেজগাঁ বিমানবন্দর স্টেশনের আগের স্টেশনে।

৫.
আনিসের সুন্দরীটি একটা ফার্স্ট এইড বক্স খুলে তার পায়ের একটা আঙ্গুলে লাগালেন। এ সময় কথকের সঙ্গে কোন কথা বললেন না। এরপরে ঘটনাটুকুতে মার্কেজের গল্প থেকে আনিস একটু সরে গেলেন। আনিস একটি ছোট্ট উপকাহিনী যুক্ত করলেন। সেটি কী? মেয়েটি ফ্যান ঘোরাতে গিয়ে ব্যর্থ হল। কথক তার জন্য ফ্যান ঘুরিয়ে দিতে গিয়ে আঙুল কেটে ফেলল। মেয়েটি দয়াপরবশ হয়ে তার আঙুলে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল।





এই আঙুল কাটা আর ব্যান্ডেজ বাঁধার উপকাহিনীটি পাওয়া যাচ্ছে সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বেঁচে থাকো সর্দি কাশি’ গল্পে। গল্পে এক ডাক্তার এ-রকম রেল ভ্রমণে গেছেন। সেখানে অচেনা এক সুন্দরী সহযাত্রিনীকে দেখে কাতর হয়েছেন ডাক্তারটি। মেয়েটি তার সঙ্গে কথা বলছে না। জানালা বন্ধ করতে গিয়ে ডাক্তারের আঙুল কেটে গেল। মেয়েটি তখন তার হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল। মুজতবা আলীর ডাক্তার ধন্য হয়ে গেল। আনিসের কথকও ধন্য হয়ে গেল। নারী স্পর্শে পৃথিবীর সকল পুরুষই ধন্য হয়ে যায়। তাকে ধন্যবাদ দিলে মেয়েটি শুধু একটি হাসল। কোনো কথা বলল না।

এরপরে মুজতবা আলী শেষ। আনিসের গল্পটি আবার খুঁজে পাওয়া যায় মার্কেজের গল্পে।

মার্কেজের সুন্দরীটি বিমানবন্দরে নামলেন। স্প্যানিশ প্রথায় একটু ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। এটা শুধু প্রথা। সকলকেই করতে হয়। তারপর সুন্দরী নিউ ইয়র্কের আমাজান জঙ্গলে হারিয়ে গেলেন।

আনিসের মেয়েটিকে নিতে এসেছিল একটি যুবক। এসেছিল তার সঙ্গে সুন্দরীটি চলে গেল। আনিস লিখছেন—মিশে গেল কমলাপুর রেলস্টেশনের ভিড়ে।

মার্কেজের মিশে যাওয়া আর আনিসের কমলাপুর রেনস্টেশনের ভিড়ে মিশে যাওয়া ব্যাপারটি তো একই ঘটনার দুরকম শব্দের প্রকাশ মাত্র। ভাবে কোনো পার্থক্য নেই।

তিন। ফেসবুকের একটি পোস্ট--

ফেসবুকে ঝড় ওঠার পরে বেশ কয়েকদিন আনিসুল হক নিশ্চুপ ছিলেন। এই অভিযোগ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।

তবে আনিস আহমেদ নামে ভয়েস অফ আমেরিকয় কর্মরত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক ফেসবুকে আনিসুল হকের উদ্দেশে একটি পোস্ট দেন। তিনি লেখেছেন--

সম্প্রতি জনৈক ... চৌধুরী এবং আরও কয়েকজন এ রকম একটি অভিযোগ এনেছেন যে আপনার সাম্প্রতিক একটি গল্প, সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্পের অনুকরণে লেখা হয়েছে। আমি প্রথম আলোয় প্রকাশিত আপনার গল্পটি এবং সৈয়দ মুজতবা আলির গল্পটি পড়ে নিশ্চিত হয়েছি যে কোন ক্রমেই আপনি তাঁকে অনুকরণ করেননি। ট্রেন যাত্রা এবং আঙুল কেটে যাবার ঘটনায় মিল আছে বটে কিন্তু দুটি গল্পের প্রেক্ষপট, কাহিনীর বিস্তার, সংলাপ ও চরিত্র ভিন্নধর্মী। সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্পটি রসাত্মক এবং মিলনাত্মক, আপনার গল্পটি বিয়োগান্তক। আপনার গল্পের নায়িকা বাকশক্তি রহিত ব্যক্তি। আর রেলগাড়িতে সহযাত্রী কারও জন্য আবেগ আপ্লুত হয়ে যাওয়া র ঘটনা তো নতুন কিছু নয়। সেটা অনুকরণের অভিযোগ অমূলক। আমি ভাবছিলাম আপনি আপনার ফেইবসুক বন্ধু ও অনুরাগীদের উদ্দেশ্যে এটা পরিস্কার করে দিতে পারেন কি না যে এই আভিযোগ- ভিত্তিহীন এবং সম্ভবত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত...

চার। আনিসুল হক উপর্যুক্ত পোস্ট পড়ে ফেসবুকে একটি প্রতিক্রিয়া লেখেন। প্রতিক্রিয়াটি হুবহু তুলে দেওয়া হল--

আনিস স্যার বলায় এই পোস্ট দেয়া আমার কর্তব্য বলে মনে করছি... আনিস স্যার আমার পক্ষ সমর্থন করে ফেসবুকে লিখছেন, আর আমি চুপচাপ বসে আছি এটা ঠিক নয়। আনিস স্যারকে ধন্যবাদ। শ্রদ্ধেয় স্যার, আমি কেন এতক্ষণ চুপচাপ ছিলাম, সেটা আগে বলে নিই।

আমি কখনোই কোনো বিতর্কে জড়াতে চাই না। কারণ আমি শ্রমিক মানুষ, কাজ করে খাই। বিতর্ক অকারণে সময় নষ্ট করে। মনোযোগ নষ্ট করে। ওই সময়টা আমি পড়তে পারি, লিখতে পারি, ঘুমাতে পারি, টিভি দেখতে পারি, ঝিমুতে পারি। তর্ক করে সময় নষ্ট করব, সেই সময় আমার কই। কাজেই আমাকে আপনারা বিতর্ক করতে দেখবেন খুব কম। তবে ফেইসবুকের একটা প্রচারণা আমাকে ফোন করে ও ইনবক্সে মেইল করে জানিয়েছেন আমার বন্ধুরা। এটাও আমার কাছে একটা রহস্য। দেশে ও বিদেশের পত্র-পত্রিকায় আমার বই নিয়ে মাঝে-মধ্যে ইতিবাচক আলোচনাও ছাপা হয়েছে। কেউ সেটা আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করে না। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে একটা পোস্ট ফেইসবুকে বেরিয়েছে, এটা আমাকে জানানোর জন্য আমার বন্ধুদের দায়িত্ববোধ আমাকে বিস্মিত করেছে। শ্রদ্ধেয় আনিস আহমেদ স্যার যখন আমার পক্ষে লড়ছেন, তখন ভাবলাম, আর চুপচাপ থাকা উচিত হবে না। শিক্ষক ও অগ্রজ লেখকের পরামর্শই আমার জন্য আদেশ।

আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ হলো, আমি দেশ-বিদেশের প্রচুর লেখা নকল করে নিজের নামে চালিয়েছি। সর্বশেষ যা করেছি, তাহলো সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্প মেরে দিয়ে নিজের নামে চালিয়েছি।

আমার এই গল্পটা, যা গত শুক্রবারের প্রথম আলো সাময়িকীতে বেরিয়েছে, তার প্রেরণা কোত্থেকে কোত্থেকে পেয়েছি, সেটা আগে বলে নিই।

গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘স্লিপিং বিউটি এন্ড দি এরোপ্লেন।’ গল্পে আছে, বিমানবন্দরে একটা খুব সুন্দর মেয়েকে তিনি দেখলেন, আশ্চর্য সে তারই প্লেনে উঠল, আশ্চর্য সে তারই পাশে বসল এবং বসেই ঘুমিয়ে পড়ল। ট্রেনে হাত কাটার ঘটনা আমার নিজের জীবনের ঘটনা। চট্টগ্রাম থেকে আসার পথে ফ্যানে হাত দিয়ে আঙুল কেটেছিলাম। তর্জনী। এই কারণে এখন আমাকে টাইপ করতে দেখবেন, দেখবেন যে আমি ডান হাতের তর্জনী ব্যবহার করি না। ডান হাতের মধ্যমা আর বাম হাতের তর্জনী ব্যবহার করি। আমার সেই এক্সিডেন্টের সাক্ষী আছেন আমার স্ত্রী ছাড়াও গৌতম চক্রবর্তী আর সুমনা শারমীন। ব্যান্ডেজ বেঁধে দেওয়ার বর্ণনার সময় আমার খুব বেশি মনে পড়ছিল নির্মলেন্দু গুণের একটা কবিতা, আমার ভালোবাসা বা প্রেম সংক্রান্ত কোনো স্মৃতি নেই। তাতে তিনি লিখেছিলেন, ডেটলে রক্তাক্ত ক্ষত মুছে দিয়ে পূরবী বলেছিল, তোর বউ তোকে খুব ভালোবাসবে দেখিস। পূরবী বা রানুদি কিছু একটা। আমার এই গল্পের লাইন-- নারী আর ঘুমন্ত নারী এক নয়--সুনীলের কবিতার লাইন। এ ছাড়া রবীন্দ্রনাথ তো ব্যবহার করেছিই। আপনারা সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্পটাও পড়ুন, আমারটাও পড়ুন, কোনো মিল পেলে তা হবে এই যে তারটাতেও ছেলে আর মেয়ের প্রেম হয়, আমারটাতেও। ছেলে ছেলে বা মেয়ে মেয়ের প্রেম নিয়ে আমরা কেউই লিখি নাই। তারটাতেও আঙুল কাটা যায়, আমারটাতেও। তবে আমি যখন লিখি, তখন বেঁচে থাকো সর্দি-কাশির কোনো স্মৃতি আমার মধ্যে দূরবর্তীভাবেও কাজ করেনি। আর ইশারা ভাষায় কথা বলাটার ধারণাও আমি পেয়েছি আমার সাপ্তাহিক পূর্বাভাসের দিনগুলোয়, তখন আমরা থাকতাম নয়াপল্টনে, পাশেই একটা মূক ও বধির বিদ্যালয় ছিল। সেখানকার ছাত্রছাত্রীরা হাত নেড়ে নেড়ে ভাব বিনিময় করত। তার মানে আমার বা লেখকদের গল্পের পেছনে থাকে জীবনের অভিজ্ঞতা আর পাঠের অভিজ্ঞতা।

আর আমার বিরুদ্ধে বিদেশি গল্প মেরে দেওয়ার অভিযোগ কেন। আমি একটা গদ্যকার্টুনে অনেকগুলো জোকস, ডিটবিটস, অ্যানেকডটস ব্যবহার করেছিলাম ইন্টারনেট থেকে নিয়ে। সেটা গদ্যকার্টুনে স্বীকার করা আছে। পরে সেইসব কৌতুক, অ্যানেকডটস আলাদা আলাদাভাবে স্টাটাস দিয়েছিলাম। তখনই বলা শুরু হলো, আমি নকল করে গল্প লিখেছি। এদেরকে কেউ বোঝান, কৌতুক কেউ বানায় না। ধরা যাক, আমি লিখলাম, আইনস্টাইন ছোটবেলায় বলেছিলেন, কবুতরের বাচ্চা হয়েছে তার জন্য একটা ছোট দরজা বানাতে হবে, কারণ মা কবুতর বেরুবে বড় দরজা দিয়ে, বাচ্চার জন্য তো ছোট লাগবে। এইটার জন্য সূত্র উল্লেখ করতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। তাহলে সৈয়দ মুজতবা আলীর বইকেনা প্রবন্ধের নিচে ফুটনোট বোঝাই থাকত। আর আমার লেখা স্টাটাসকে আমি আমার লেখা গল্প বলে কখনো দাবি করি না।

দুটো গল্প পড়ুন। নকলবাজ লেখককে হাতে নাতে ধরুন।

আমি যখনই কোনো দেশি বা বিদেশি গল্প থেকে নিই, সঙ্গে সঙ্গে তা স্বীকার করি, কারণ তাতে আমার গৌরব বাড়ে। কমে না।

আনিস আহমেদ স্যারকে আবারো ধন্যবাদ।


পাঁচ। আনিসুল হকের প্রতিক্রিয়ার সার সংক্ষেপ--

আনিসুল হক মার্কেজের গল্পটি নকল করে লেখেননি বলে দাবি করেন। বলেন, একটু অনুপ্রেরণা গ্রহণ করেছেন মাত্র। মার্কেজের গল্পের সুন্দরী মেয়েটি যুবকটির পাশের সিটে ঘুমিয়ে পড়ে। তার গল্পের নায়িকাও কিছু সময় ট্রেনে ঘুমিয়ে পড়ে। আর কোনো মিল নেই। মার্কেজের চেয়ে আনিসুল হক সৈয়দ মুজতবা আলীর বেঁচে থাকো সর্দি কাশি গল্পের আলোচনা করে দেখিয়েছেন যে তিনি যে গল্পটি লিখেছেন সেটা নিজের জীবনেই ঘটেছিল। সেটা মুজতবা আলীর গল্প থেকে নকল করেননি। এবং তিনি আরও দাবি করেন বিদেশি পত্র-পত্রিকা থেকে নানা বিষয় নিয়ে পুনরুৎপাদন করে লেখা যায়। সেজন্য কোনো সূত্র উল্লেখ করার দরকার নেই।

ছয়। একটু বিশ্লেষণ

সেদিন হয়তো আনিসুল হক সত্যি সত্যি ট্রেনে করে আসছিলেন সপরিবারে। তার আঙুলও কেটেছিল হয়তো। ঘটনা হয়তো গল্পটির মতো ঘটেছে। ঘটতেই পারে জীবনে। গল্পতো জীবনের বাইরে নয়।

আনিস স্বীকার করছেন, মার্কেজের গল্পটি থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েছেন। তার মানে মার্কেজের গল্পটিও আনিস পড়েছেন। সেটি তার মনে আছে। মুজতবা আলীর গল্পটি এত জনপ্রিয় যে সেটা তার মতো গল্পকারের না পড়ার কথা নয়। এবং মার্কেজের লেখার শক্তিটি এমন যে তা পাঠকের মনে গভীর প্রভাব সৃষ্টি করে।

সেক্ষেত্রে গল্প দুটির মত একই ঘটনা লেখকের জীবনে ঘটে থাকলে তিনি তাদের মতো করে লিখবেন না। অন্যরকম করে লিখবেন। ভিন্ন পারসপেকশন থেকে ঘটনাটিকে দেখবেন। লিখলে সেটা হবে তাদের গল্প থেকেও শিল্পমানে আরও সুন্দর। ভিন্ন সৌন্দর্য থাকবে। ভিন্ন আঙ্গিক থাকবে। ভিন্ন ভাষাভঙ্গি থাকবে। ভিন্ন উদ্দেশ্যে থাকবে।
নাহলে একই ঘটনা নিয়ে লেখার তো অর্থ হয় না।

অথবা লেখক বলে দিতে পারেন, যে ঘটনা তার নিজের জীবনে ঘটেছে সেটা মার্কেজ এবং মুজতবা আলীর গল্পের সঙ্গে মিল আছে। গল্পের মধ্যেই তার সূত্র উল্লেখ করে দেবেন। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবেন। লেখকের সৃষ্টিকে সম্মান দেখাবেন। সেটাই লেখকের সততা। সেটাই নৈতিকতা। কিন্তু সেটা করেননি আনিসুল হক।

গল্প তিনটির তুলনামূলক আলোচনা করে দেখা যায়, আনিসুল হকের গল্প মৌলিক নয়। মার্কেজের গল্পের সঙ্গে ৯০% মিল রয়েছে। মার্কেজের গল্পের সঙ্গে একটু পার্থক্য আনতে মুজতবা আলীর গল্প থেকে আঙুল কাটার অংশটা নিয়েছেন। নিজের কোনো নির্মাণ দিচ্ছেন না। ভিন্ন পারসপেকশন হাজির করতে পারছেন না। জোলো বিবরণী দিচ্ছেন। কিশোর বয়েসী প্রেমের তুল্য ভাষা দিচ্ছেন। এটা একজন মৌলিক লেখক করেন না। কিন্তু আনিসের গল্পটিকে ‘মেরে দেওয়া’র মতই মনে হয়। এবং তিনি ‘মেরে দেওয়া’কে জায়েজ করার জন্য সাক্ষী রাখছেন তার নিজের পরিবারকে। চুরিবিদ্যার দায় পরিবারের উপরও চাপাচ্ছেন। সর্বোপরি এ গল্পটি ছাড়া তাঁর অন্য লেখাতেও ইন্টারনেট থেকে তুলে নিয়ে বাংলায় অনুবাদ করে নিজের লেখা বলে চালিয়েছেন, তারও প্রমাণ রয়েছে। (লিঙ্ক--নীড়পাতা)। সেগুলোর কোনো সূত্র দেননি।
যে-কাহিনী বিশ্বসাহিত্যের অংশ, সেটা অনুপ্রেরণা হতে পারে। কিন্তু চুরি করা হতে পারে না।

ঝুম্পা লাহিড়ীর অপরিচিত ভূমি নামের গল্পের শুরুতেই Nathaniel Hawthaome র একটি কবিতার উদ্ধৃতি দিচ্ছেন। সেই কবিতার মূল কথার সঙ্গে ঝুম্পার গল্পের মূল ভাব মিলে গেছে। কিন্তু ঝুম্পারটা গল্প। আর উদ্ধৃতি দিয়ে অনুপ্রেরণার সূত্রও জানিয়ে দিচ্ছেন। এটাই তো রীতি।

তাহলে সাহিত্য কী হলে নকল হয় ওঠে। চুরি হয়ে ওঠে—সেটা নিয়ে একটু তত্ত্ব-তল্লাশ করা যেতে পারে।

সাত। কুম্ভীলকবৃত্তি ওরফে সাহিত্য-চুরি কি জিনিস

Plagiarism নামের ইংরেজিতে যে শব্দটি আছে তাকেই বাংলা ভাষায় কুম্ভীলকবৃত্তি বলা যেতে পারে। একে বলা হয়--অন্যায়ভাবে অপরের সৃষ্ট বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ আত্মসাৎ। কোনো লেখকের ভাষা, চিন্তা, আইডিয়া বা ভাব, অভিব্যক্তিকে, উপস্থাপনকে অন্য কোনো লেখক যদি নকল বা চুরি করে নিজের নামে চালায় তবে তাকে কুম্ভীলকবৃত্তি বলা হবে। অন্যের অনুমতি ছাড়া কোনো জিনিস নকল করাকে সাহিত্যের চুরি হিসেবে ধরা হয়।




 plagiarism as the "use, without giving reasonable and appropriate credit to or acknowledging the author or source, of another person's original work, whether such work is made up of code, formulas, ideas, language, research, strategies, writing or other form.


অক্সফোর্ড ডিকশোনারিতে লেখা হয়েছে-- the wrongful appropriation or purloining and publication as one's own, of the ideas, or the expression of the ideas… of another। একডেমিক দিক থেকে এই ঘটনাকে অসৎ কর্ম হিসেবে গন্য করা হয়। সাংবাদিকতা পেশায়ও এটাকে নীতির লঙ্ঘন বলে ধরা হয়। বলা হয় এ ঘটনা হল-- unfair competition or a violation of the doctrine of moral rights।




কুম্ভীলকবৃত্তি সহজাতভাবে একাডেমীক ও শিল্প ক্ষেত্রে মারাত্মক কোনো অপরাধের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু কপিরাইট আইনের লঙ্ঘন হিসেবে এটাকে অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে প্রবাদ রয়েছে--তুমি যে জিনিসটি নিজে সৃষ্টি করো নি, সেটা নিজের কোনো কাজে ব্যবহারের আগে তার প্রতি ঋণ স্বীকার করো। Plagiarism is also considered a moral offense against anyone who has provided the plagiarist with a benefit in exchange for what is specifically supposed to be original content (for example, the plagiarist's publisher, employer, or teacher). In such cases, acts of plagiarism may sometimes also form part of a claim for breach of the plagiarist's contract, or, if done knowingly, for a civil wrong.

ফেনেল হাডসন নামে একজন ব্রিটিশ লেখকের মতে, যে সব লেখক অন্য লেখকের লেখা নকল বা চুরি করে তারা আসলে অন্যের ঘুমের ভেতরে ঢুকে পড়তে চায়। অন্যের স্বপ্ন চুরি করতে চায়। এটাকে তিনি মন্দ কাজ বলে মনে করেন।

আট। আলেক্স হ্যালির রুটস নিয়ে মামলা

রুটস আলেক্স হ্যালির বিখ্যাত উপন্যাস। এটা পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিল। আফ্রিকা থেকে দাস হিসেবে  কালো মানুষদেরকে আমেরিকায় নিয়ে আসা হয়েছিল-- তাদেরই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের কাহিনী এই রুটস। ২৯৭৮ সালে যখন রুটস মিনি সিরিজ আকারে বের হচ্ছিল, তখন হ্যারল্ড কোরল্যান্ডার নামে একজন লেখক হ্যালীর নামে মামলা করেছিলেন। তাঁর দি আফ্রিকান নামের বই থেকে হ্যালী চুরি করে লিখেছেন বলে হ্যারল্ড অভিযোগ তুলেছিলেন। প্রমাণসহকারে অভিযোগ করেছিলেন, হ্যালী অন্তত ৮১ টি স্তবক তাঁর বই থেকে সরাসরি নিয়েছেন।



কোর্টে হ্যারল্ডের আইনজীবী বলেন, হ্যালী তার মক্কেলের বই থেকে বেশ কিছু নকল করেছেন। দুটো বই তুলনা করলেই এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। দি আফ্রিকান বইতে আফ্রিকান প্রবাদ,, ঘটনা, আইডিয়া, লেখার প্লট ও ভঙ্গি রুটসের সঙ্গে মিলে যায়। দি আফ্রিকান বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৭ সালে। রুটস প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৭ সালে। আফ্রিকান দাসের পলায়নী স্বভাব, একজন বুড়ো দাসের মনস্তত্ত্ব, একজন দাস নেতার স্বভাব এবং দাস জীবনের সব অনুষঙ্গই দি আফ্রিকান বইতে আছে। ঠিক এগুলোই হ্যালী রুটসে ব্যবহার করেছেন।



হ্যালী স্বীকার করেন এগুলোর মিল আছে সত্যি তবে রুটস লেখার সময়ে দি আফ্রিকান বইটি তিনি পড়েন নি। কোর্ট বলেন যে, হ্যালী চুরি করেছে। তখন হ্যালী ৬.৫ লাখ ডলার দিয়ে হ্যারল্ডের সঙ্গে মিমাংসা করেন। এবং লিখিত ভাবে অভিযোগ স্বীকার করেন। বিচার শেষ হওয়ার পর স্কিডমোর কলেজের মাইনোরিটি স্টাডিজের শিক্ষক জোসেফ ব্রুচাক জানান, ১৯৭০-১৯৭১ সালে হ্যালীকে দি ফ্রিকান বইটি পড়তে দেন। বইটি নিয়ে তার সংগে আলোচনা করেন। ১৯৮০ সালে আলেক্স হ্যালী লিংকন সেন্টারে বক্তৃতা করতে এসেছিলেন। তখন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ফিলিপ নোবিল কোনো রাখঢাক না করে হ্যালীকে  প্রশ্ন করেন, ৬.৫ লাখ ডলার জরিমানা দেওয়ার পরেও কেনো একজন অপরাধীর বদলে নায়ক হিসেবে তাকে গণ্য করা হবে না?

নয়। অনুপ্রেরণা নামের জিনিসটি

লেখালেখিতে অনুপ্রেরণা বলে একটি ব্যাপার আছে। যে কোনো লেখকই কারো না কারো লেখা পড়ে অনুপ্রাণিত বোধ করেন। সেই লেখাগুলোর মধ্যে এমন কিছু তিনি দেখতে পান যা তাকে এই ধরনের আরেকটি গল্পের সন্ধান দেয়। তাকে এরকম আরেকটি গল্প লিখতে উদ্বুদ্ধ করে। সাধারণত রোমান্টিক উপন্যাসের শক্তিটিই এরকম। পড়ে পাঠক দেখতে পান, এ ধরনের ঘটনা তার জীবনেও আছে। তিনিও লিখতে পারেন। তিনি লেখা শুরু করেন। এক সময় শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত উপন্যাসের রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্তের প্রেমের মত কাহিনী লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে অনেক লেখককে। দেবদাস উপন্যাস বোধহয় সর্বাধিক প্রেরণা সৃষ্টিকারী লেখা। হূমায়ুন আহমদ গেল তিরিশ বছরে নবীন লেখকদের অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছেন। টিভি নাটকের ক্ষেত্রে তিনি একটি টাইপড ফরমাট দিয়ে গেছেন। তাহলে এই অনুপ্রেরণা থেকে তারা লিখছেন কেন? লিখে সহজে নাম করার জন্য। অর্থ অর্জনের জন্য। এর বাইরে আরো কিছু কারণ আছে। তবে প্রতিভাবানরা কিছুদিনের মধ্যে এই অনুপ্রেরণা বা প্রভাব থেকে বের হয়ে আসেন।

অনেক গল্পেরই একই ধরনের উপাদান থাকে। ক্রিস্টোফার বুকারের মতে সব গল্পই সাত ধরনের মৌলিক প্লটের অন্তর্ভুক্ত। এদের কোনোটির সঙ্গে  স্পষ্টভাবে মিল থাকে। কোনটির সঙ্গে কিছুটা অস্পষ্টভাবে মিল থাকে। সাত ধরনের প্লট হল--ক) দানবীয় শক্তিকে পরাজিত করা , খ )গরীব নায়কের ধনসম্পদ অর্জন করা যা পূর্বে সে হারিয়েছিল, গ) গুপ্তধন উদ্ধার, ঘ) সমুদ্রযাত্রা ও ফিরে আসা, ঙ) মিলনাত্মক বা Comedy, চ) বিষাদাত্মক বা Tragedy ও ছ) স্বভাবের রপান্তর বা Rebirth।

তবে প্রতিভাবান গল্পকাররা একই ধরনের প্লটকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে  উপস্থাপন করে গল্পটিকে অন্যদের থেকে আলাদা করে ফেলেন। আবার কেউ কেউ প্রকাশ মাধ্যমটাকেই বদলে নেন। কোনো গল্পকে নাটকে বা কবিতায় লেখেন। মহাভারতের আখ্যান নিয়ে ভারত প্রেমকথা নামে গল্পসংকলন লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন কবিতা, গীতিনাট্য। বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন কাব্যনাট্য।

সুজান কলিন প্রাচীন গ্রিক নায়ক থিসেউস এবং এথেনীয় যুবক ও তরুণীদের নিয়ে লিখেছেন দি হাঙার গেমস। কিন্তু কলিন গল্পের সময়কাল আর সেটিংস পালটে দিয়েছেন।

আবার গল্পের আখ্যানে মিল থাকলেও পরিণতিও ভিন্ন করে দেন। মিলনাত্মক ঘটনাকে বিয়োগাত্মক করে নেন।

little red ridind hood নামেএকটি শিশুতোষ গল্প আছে। গল্পে একটি ছোট মেয়ে বনে পথ হারিয়ে ফেলে। একটি নেকড়ে তাকে খেয়ে ফেলে। এই গল্পটি শিশুদের মনে বিভৎস রস সৃষ্টি করে। ফলে গল্পটি ভালো হলেও শিশুদের পড়তে দেওয়া হত না। পরে গল্পটিকে আরেকজন লেখক নতুন করে লেখেন। সেখানে শিশুটিকে একজন শিকারী নেকড়ের কবল থেকে রক্ষা করে। তখন গল্পটি শিশুদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

কেউ কেউ চরিত্র বদলে দেন। বয়স, লিঙ্গ অথবা স্বভাব বদলে দেন। ফলে চরিত্র বদলে যাওয়ার জন্য আখ্যানেও নতুনত্ব আসে।

আবার কেউ কেউ সিরিয়াস গল্পকে প্যারোডি বা হাস্যরসাত্মক করে ফেলেন। The Lord of the Rings নামের গল্পটির বিখ্যাত প্যারোডি Bored of the Rings।

জে কে রোলিং নামের লেখিকা হ্যারিপটার নামে বিখ্যাত রহস্য কাহিনী লিখেছেন। তার এই বইটির উপাদান দুই বা ততোধিক বই থেকে নিয়েছেন। তবে রোলিং যাদুবিদ্যাকে হ্যারিপটারে এনে ধার করা কাহিনীকে নিজের কাহিনী করে ফেলেছেন।

আবার কেউ কেউ একাধিক থিমকে একসঙ্গে জুড়ে দেন। রোমাঞ্চের সঙ্গে ফ্যান্টাসি এবং ভৌতিক আখ্যানের সঙ্গে প্রেম জুড়ে দেন। সেটা নতুন হয়ে ওঠে।

পুরাকালের প্রেমের ঘটনাকে একালের প্রেমের ঘটনার সঙ্গে, স্বাভাবিক প্রেমের সঙ্গে অস্বাভাবিক প্রেম, সহজ প্রেমের সঙ্গে রহস্যময় প্রেম, কল্পনার সঙ্গে ইতিহাসের যোগসূত্র করে গল্পে নতুনত্ব আনার রীতি রয়েছে। একে এক ধরনের ডিকনস্ট্রাকশন বলে।



 



দশ। বিদেশি গল্পের ছায়া নিয়ে লেখা

বিদেশী গল্পের ছায়া নিয়ে অনেকেই লিখেছেন। যেমন বাংলাদেশের কাজী আনোয়ার হোসেন সারা জীবন ধরে বিদেশি গল্পের ছায়া নিয়ে মাসুদ রানা সিরিজ লিখেছেন। ছায়া নিয়ে লেখা ফিকশনের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান সেবা প্রকাশনীও গড়েছেন। কিন্তু প্রতিটি লেখার নিচে, প্রতিটি বইয়ের শুরুতেই স্পষ্ট করে লিখে দেন—বইটি বিদেশি কাহিনীর ছায়া অবলম্বনে লেখা। এটা লিখে দিয়ে মূল লেখাটির প্রতি ক্রেডিট প্রদান করেন। যারা আরো দ্বায়িত্বশীল লেখক/ প্রকাশক তারা বিদেশি মূল লেখক ও লেখাটির সূত্র উল্লেখ করে দেন। এবং যারা শতভাগ সৎ লেখক/প্রকাশক তারা ছায়া অবলম্বনে না লিখে মূল বইটি সরাসরি অনুবাদ করে দেন। বইটি অনুবাদ কাহিনী হিসেবে পাঠক পড়তে পারেন। প্রতিভা ও সামর্থ্য থাকলে কোনো লেখক নিজের মৌলিক লেখাটাই লেখেন।

তাছাড়া একটি শক্তিশালী লেখার গুণই এমন যে লেখাটি পড়লে পাঠককে নতুন নতুন গল্প ভাবতে উদ্বুদ্ধ করে। অন্যান্য লেখকের মধ্যে নতুন লেখার জন্ম দেয়। তবে প্রকৃত লেখক খুব সতর্কভাবে এইখান থেকে নিজেকে বের করে নিয়ে আসেন। নিজের গল্পটিই লেখেন। সেটাই তার প্রতিভা। সেটাই তার শক্তি।

সমস্যা হল সেইসব লেখকদের জন্য যারা লিখতে চান, লিখতে চান অনেক--অনেক। লিখে নাম করতে চান, পদক পেতে চান, অর্থ পেতে চান, ক্ষমতা পেতে চান, সুবিধা পেতে চান--তারা কিন্তু ধীরে ধীরে অন্যের লেখার ওপর ভর করেই লেখেন। কখনও ভাব থেকে ধার নেন। এই ধার নিতে নিতে এক সময় অন্যের লেখার আখ্যান মেরে দিতে শুরু করেন। নিজের নিয়ন্ত্রিত পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ করেন। তারা মনে করেন, যে-চৌর্যবৃত্তিটা তিনি করছেন, সেটা কেউ ধরতে পারবে না। এটা শুধু তার লেখার বন্ধ্যাত্বই প্রকাশ করে না, সঙ্গে সঙ্গে নিজের নির্বুদ্ধিতাও প্রকাশ করে ফেলে। ইন্টারনেটের সময়ে চুরি করে পার পাওয়া কঠিন। কেউ না কেউ ধরে ফেলে। আনিসুল হকের গল্পটিও সে রকম Plagiarism-এর একটি উদাহরণ। সোজা ভাষায় বলা যায়- চুরি।

তবে আনিসুল হকের বয়স কম। লেখার ভাষাটিও আয়ত্ত্ব আছে। সেজন্য তিনি নিজের লেখাতেই ফিরে যাবেন আশা করতে পারি। সেটা তাঁর জন্য ও বাংলা ভাষার তরুণ লেখকদের জন্যই স্বাস্থ্যকর।







Thursday, February 1, 2018

শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প : শিয়ালদা কেমন আছে?


হৃদয়লাল খেতে বসে জানতে চাইলেন, এ মাছের দাম কত?


তার ছেলে অশোক বলল, দাম জেনে কি হবে? খেতে বসেছ খাও। অশোকের নতুন বিয়ে-করা বউ নন্দা মাথার ঘোমটা টেনে বলল, দাম জেনে কি হবে বাবা? আরেকখানা দেব?


না না-বলে ছেলের বউকে থামালেন হৃদয়লাল। এই হজম হোক আগে।


অশোক খেতে খেতে ফোড়ন কাটল, দাম শুনলে এও হজম হবে না। কথাটা নন্দাকে লক্ষ করেই চাপা গলায় বলা। কিন্তু সে কথাও যে হৃদয়লাল শুনতে পাবেন--ভাবতে পারেনি অশোক।


হৃদয়লাল ভাত খাওয়া বন্ধ করে এঁটো হাতে সিধে হয়ে বসলেন। ছোট ডাইনিং টেবিল। এতদিন অশোক আর হৃদয়লাল মুখোমুখি বসে এসেছেন। এখন খেতে বসলে নতুন সঙ্গী নন্দা। সে জানতে চাইল, কি হল বাবা?


কত দাম?


শুনবেই?--বলে অশোক জানাল, পঞ্চান্ন টাকা করে তিনশ' এনেছি--ষোল টাকা পঞ্চাশ।


সের আড়াই টাকা কাটাপোনার সময়ে স্কুল থেকে রিটায়ার করে আর বাজার যান নি হৃদয়লাল। তিনি তিনশ' গ্রামের দাম শুনে হেসে ফেললেন, তোর জন্মে দাই নিয়েছিল সাকুল্যে ছ-টাকা।


বেশ চাপা গলায় অশোক রসিকতা করল। শুধু নন্দাকে শোনাবে বলেই। সস্তায় কাজ সেরেছ! তাই তো মা অসময়ে চলে গেল--


হৃদয়লাল এবার শুনতে না পেয়ে জানতে চাইলেন, কি বললি?


বলছিলাম--পাঞ্জাবীর কাপড় তো অনেকগুলো পেলে। বিয়ে, পুজো, পয়লা বৈশাখ মিলে কম পাও নি। বিকেলে নন্দার সঙ্গে বেরিয়ে মাপ দিয়ে এস--


অশোকের ঘুরিয়ে দেওয়া কথার শেষটুকু শুনে হৃদয়লাল বললেন, না। আমার দত্তপুকুরের টেলারিংয়েই দেব।


ওঃ! তোমার সেই ছাত্রের দোকানে-


হৃদয়লাল ভাত ভেঙেই কথা বলতে লাগলেন। তড়বড় করে। তার মানে স্রেফ আন্দাজে। কেননা- এসব তিনি কিছুই শুনতে পাননি। প্রথমেই বললেন, তোদের কলকাতায় সবই গলাকাটার দর।


অশোক বলল, তোমার ছাত্রের দোকান তো! এখনো দু-টাকাই পাঞ্জাবি সেলাই নেবে তোমার কাছ থেকে। সেই আশায় বসে থাক।


এবারও কিছুই শুনতে পাননি হৃদয়লাল। তুব আনকোরা ছেলের বউয়ের সামনে কিছু একটা বলতে হয়। তাই তিনি চোখ কপালে তুলে জানতে চাইলেন পঞ্চান্ন টাকা মাছের কেজি। তুই কত টাকা আয় করিস?


অশোক তার ছোটছেলে। অন্য ছেলেরা অশোকের চেয়ে বেশি মাইনের চাকরি করে। তারা তাদের বিপত্নীক বাবাকে এড়িয়ে গিয়ে আলাদা সংসার পেতেছে। সে-কথা মনে পড়তে অশোক খেপে উঠে বলল, আমার চেয়ে যারা বেশি মাইনে পায়--তারা তো বিজয়ার প্রণাম করেই কেটে পড়ে!


এ-কথাও শুনতে পেলেন না হৃদয়লাল। তার পৃথিবীতে শব্দ বড় কম। পাড়ার কুচো মস্তানরা পেটো ফাটালে শুনতে পান। আর শুনতে পান মাইক বাজলে। কিংবা ভাসানের তাসা পার্টির আওয়াজ।


নন্দা অশোককে চোখ টিপল। মুখে বলল, বাবাকে ও ভাষায় কথা বলে না।


মুখ মুছতে মুছতে অশোক বলল, না--বলবে না। সব জানে বুড়ো। পেনশন পাচ্ছে প্রায় চল্লিশ বছর--পেনশনই তো পাচ্ছে আগের চেয়ে এখন তিনগুণ। তা জিনিসের দাম বাড়বে না?


অশোক অফিসে চলে যেতে পাশের ঘরে নতুন বিয়ের নতুন পালঙ্কে গিয়ে নতুন বউ ঘুমিয়ে পড়ল। শ্বশুর আছে। স্বামী আছে। ভাসুর জা সব কলকাতায় ছড়িয়ে ছড়িয়ে আছে। ননদদের বিয়ে অনেকদিন হল হয়ে গেছে। শাশুড়ি স্রেফ দেওয়ালের ফটোতে। ঠিকে ঝি, কাজের মেয়ে -দুজনই কাজ তুলে দিয়ে বাড়ি গেছে।


হৃদয়লাল রোদে পিঠ দিয়ে কাগজ দেখলেন সকালের। তারপর এই চল্লিশ বছর ধরে সকাল, বিকেল, সন্ধে-যা করে আসছেন তাতে নেমে পড়লেন। এটাই এখন তার বড় কাজ। বছরের পর বছর তিনি পদ্মছন্দে মহাভারত অনুবাদ করে আসছেন। কলম ধরলেই একরকমের ছন্দ নাচতে নাচতে এসে নিবে ভর করে। অনুবাদে অনুবাদে তক্তপোশের তলাটা বোঝাই। শেষে র‌্যাক বানাতে হয়েছে। দীর্ঘকাল মহাকাব্যের অলিতে-গলিতে ঘুরতে ঘুরতে হৃদয়লাল এখন নিজের জীবন, মানুষের জীবন, পৃথিবীর জীবন পরিষ্কার জীবন পরিষ্কার দেখতে পান। ছন্দে একটা মাইকেলি চাল চেলে তিনি আলাদা একটা আনন্দ পান।


অর্জুনের প্রতিজ্ঞা ( দ্রোণ পর্ব)

ত্রয়োদশ দিবসের রণ যবে হল

শেষ। দিন-মণি গেল চলি ক্লান্ত দেহে

অস্তাচলে, ক্ষণ কাল লইতে বিশ্রাম।


এই অব্দি লিখে হৃদয়লাল থামলেন। দিনমণি তো চিরকালই অস্তাচলে যায়। ঠিক এখন ঘরের বাইরে, দিনমণির কী দশা একবার দেখি না কেন? বাইরে বেরিয়ে দেখলেন-ঝকঝকে রোদ। সারা পাড়া খাঁ খাঁ। তার বয়সী কোনো লোক এ-পাড়ায় নেই যে তার সঙ্গে গিয়ে তিনি বসতে পারেন। দুটো রাস্তা পরে শিকদার লেন থেকে মন্মথবাবু আসতেন বিকেল বিকেল। হৃদয়লালের চেয়ে সাত বছরের বড় ছিলেন। খুব সাবধানী লোক। বৈশাখ মাসেও গলায় মাফলার। তা তিনিও ওপরে চলে গেছেন।


আচমকা কী মনে হল হৃদয়লালের। বেলা তো বেশি নয়। পাশের ঘরে বউমা ঘুমিয়ে। গায়ে জামা গলিয়ে রাস্তায় নামলেন হৃদয়লাল। কাঁধের ঝোলায় সারা বছরের উপহার পাওয়া পাঞ্জাবির কাপড় সব। ছেলেরা দিয়েছে। মেয়েরা দিয়েছে। দিয়েছেন নতুন বেয়াই। কাপড়ের জুতো গলিয়ে নিজের ঘরের দরজার বাইরে থেকে তালা দিলেন তিনি। এই ব্যবস্থাই আজ ক-বছর অশোকের সঙ্গে। বিয়ের আগে অশোকও তাই করত।


শিয়ালদা কেমন আছে?


কতকাল এ স্টেশনটায় যাওয়া হয় নি হৃদয়লালের। এই স্টেশন দিয়েই একদিন তিনি দেশভাগের পর কলকাতায় ঢোকেন। চাকরির শেষদিনটায় এই স্টেশন দিয়েই তিনি দত্তপুকুরে গিয়ে উঠেছিলেন। তখনো স্কুলে স্কুলে সংস্কৃত ছিল। এখনকার মত এমন করে তুলে দেওয়া হয় নি তখনো। আর হৃদয়লাল ছিলেন সংস্কৃতের হৃদয় স্যার।


বেলা তিনটে নাগাদ দত্তপুকুরে গিয়ে নামলেন তিনি। স্টেশন, প্ল্যাটফর্ম, বাইরের রাস্তা সব পাল্টে গেছে। তখন রেলের হ্যারিকেনে সন্ধের পর আলো জ্বলত। এখন বাইরের রাস্তাতেও নিওন আলো।


শ্রী টেলারিং খুঁজে বের করতে দেরি হল না হৃদয়লালের। স্টেশন ছাড়িয়ে লেবেল ক্রসিংয়ের গায়ে স্কুল। ক্রুসিংয়ের ওপারেই বাজার। বাজারের গায়ে পুকুরপাড়ে বাঁশের চ্যাটাই-ঘেরা শ্রী টেলারিং। বাইরে মাচায় ঘষা কাচের চশমা চোখে একজন লোক পা তুলে বসেছিল। হাঁটু বের করে। ঘরের ভেতর থেকে পা-কলের একটানা ঘর ঘর। একটা মশারির মটকা সেলাই হতে হতে একা একাই দোর ছাড়িয়ে দুব্বো ঘাসে পড়েছে। হৃদয়লাল জানতে চাইলেন, শ্রীধর আছে?


চশমা চোখে লোকটি মুখ তুলে বলল, আমি শ্রীধর। কে আপনি?


নিজের আবছা দৃষ্টিতে হৃদয়লাল বুঝলেন, এই শ্রীধর বিশেষ দেখতে পায় না। মুখে বললেন, তুমিই সেই শ্রীধর-


আজ্ঞে। আপনি কে তা তো বুঝি না।


অনেক্ষণ চুপ করে থেকে একটা বড় ‘ওঃ’! বলেই শ্রীধর লোকটি মাচা থেকে নেমে দাঁড়াল। চিনতে পারিনি স্যার। চোখে ছানি এসে-


কাটাওনি কেন? বলে মাচায় বসলেন হৃদয়লাল। কটা জামা বানিয়ে দিতে হবে যে-


আমি তো আজকাল আর বানাই না স্যার।


তোমার কল তো চলে দেখছি।


তা চলে স্যার। সেই বছর সাত-আট আগে এসে একবার বানিয়ে নিয়ে গেলেন। সেবার আমি পৌঁছে দিয়েছিলাম।


এবারও দিতে হবে।


সেই বাড়িতে আছেন তো। ভাইপোটাকে পাঠাব তাহলে।


ও-কথায় মন না দিয়ে হৃদয়লাল বলতে লাগলেন, পাশ করে বসে আছ। বললাম-একটা দর্জির দোকান দাও। নিজে কাজ শেখো। তা খারাপ হয়নি। কি বলো-


চলে যাচ্ছে স্যার। কলেজে পড়ার পয়সাও ছিল না। আর পড়লে জায়গা-জমিও দেখা হত না। পথে ভেসে যেতাম।


একটু পরে মাপ নিতে নিতে আর দিতে দিতে কথা হচ্ছিল দুজনে। মাপ বিশেষ কিছু নয়। একটা ফিরে হাতে অন্ধ শ্রীধর। মাথার ওপর বটগাছে পাখি ফল খেয়ে বিচি ফেলচে নিচে। ছাগল চরছে গাছতলায়। বিকেল হবে বলে জায়গাটা জেগে উঠেছে। ছাগলটা বাংলা বুঝলে সে এইসব কথা জানতে পারত-


স্কুল তো বারো ক্লাস হয়ে গেছে স্যার।


ভাল।


অশোক বড়টি এখন?


বিয়ে করেছে।


তাই নাকি।


হু। আমিওই পুকুরপাড়ে ঘরভাড়া করে থাকতাম। তা ওখানে তো দেখছি এখন পাকাবাড়ি।


স্কুল কোয়ার্টার হয়েছে স্যার।


ভাল করে মাপ নাও। বউমা বলে আমার সব পাঞ্চাবি নাকি পাশ-বালিশের খোল।


সে আপনার ভাবতে হবে না।


সে আমি জানি শ্রীধর। মোহিত বিশ্বাস-রোল টুয়েলভকে মনে পড়ে? ঢ্যাঙা মত-শিবনিবাস থেকে নদী পেরিয়ে স্কুলে আসত?


খুব মনে আছে স্যার। আপনার কথায় তো ডেন্টিস্ট হল। এখন বনগ্রামের মতিগঞ্জ বাজারে চেম্বার খুলেছে।


ওর কাছে একবার দাঁত তুললাম। বছর কুড়ি আগে। তা এমনই দাঁত বাঁধিয়ে দিল-সজনে ডাটা চিবিয়েও ফিট হল না। এখনো জলে ভেজানোই থাকে।


জামা নিয়ে ভাববেন না স্যার।


দাঁত তোলা বলো--পাঞ্জাবি মাপ দেওয়া বলো--এখনো ছাত্রদের কাছে ছুটে আসি কেন জান শ্রীধর?


নিজের হাতে তৈরি ডেন্টিস্ট-দর্জি--আসবেনই তো স্যার।


আজকাল বিশেষ শুনতে পাই না। তবু দরদাম যা শুনি--শুনে মাথা খারাপ হবার জোগাড়! একটা পাঞ্জাবি বানাতে বিশ টাকা চায় কলকাতায়-


ছিঃ! ছিঃ! বলেন কি স্যার?


সেবারে দু-টাকা করে মজুরি নিয়েছিলে। এখন কত নিচ্ছ?


দু-টাকা করেই দেবেন স্যার।


না। তোমার একটা যাতায়াত খরচও তো আছে। ছটা পাঞ্জাবি মোট-প্রত্যেকটা আড়াই টাকা করেই নিও। এখন একটা লাউ নাকি তিন কেজি হলেই ছ-টাকা। ছ-আনা ছিল রেলের টিকিট। এলাম তিন টাকা দিয়ে। যেতেও হবে তিন টাকা দিয়ে। হল কি বলো তো দেশের।


মানুষের মুখের কথা শুনতে শুনতে গাছতলায় চরে বেড়ানো ছাগলী এই সময় তিড়িং করে লাফ দিল।


শ্রীধর বলল, ফিতে তুলে রাখি স্যার।


রাখিস'খন। একটু বস। এদিকে এখন ঘর ভাড়া কি রকম?


কেন? চলে আসবেন কলকাতা ছেড়ে?


আরে না। এদিককার অবস্থাটা জানছি। সারা দুনিয়াই কি একদশা?


তা একখানা ভাল ঘর দেড়শ-দুশ। মানে পাকা ঘর আর কি।


আমি তো তিনখানা ঘর নিয়ে থাকতাম সতোরো টাকায়। আর যখন কলেজে পড়েছি কলকাতায়-- তখন তো মেসে ২ টাকা সিটরেন্ট মাসে। খাওয়া-দাওয়া সারা মাসে ছ-টাকা। মাংস খেতাম না বলে আমায় আলাদা করে রাবড়ি খাওয়াত মেসের ম্যানেজার। তখন ভাল ভাল খাইয়েরা মিষ্টির দোকানে গিয়ে পেটচুক্তি করত।


সে কি রকম স্যার?


দোকান সুদ্ধ চক্তি হত। যতক্ষণ খেতে পারবে খাবে। সেই মত একটা টাকা ধরে দেওয়া। শ্রীধরেরও বছর ষাট-বাষট্টি হবে। মশারিটা সেলাই হতে হতে দুব্বোর মাঠে এসে পড়েছে। চ্যাটাই-ঘেরা ঘরে পা-কলের কোনো থামান নেই। পুকুরে মাছরাঙা ডুব দিল বোধহয়। কেমন একটা গুড়ুম শব্দ প্রায়ই শুনতে পাচ্ছেন হৃদয়লাল। ঝমঝম করে একবার ট্রেন চলে গেছে কলকাতার দিকে।


শ্রীধর দেখতে পায় না বিশেষ। হৃদয়লাল শুনতে পান না। দেখতে পান সামান্য। ছাগলটা দেখতে পায়। শুনতেও পায়। গাছে মগডালে পাখিগুলো দেখছিল। শুনছিল। খাচ্ছিল।


হৃদয়লাল বলল, যা শুনি--তা কি সত্যি শ্রীধর? একটা লাউ ছ-টাকা? মাছের কিলো পঞ্চান্ন? পাঞ্চাবি সেলাই বিশ টাকা? দুনিয়ার সব জায়গাই কি এরকম হয়ে উঠল।


ছাগলটা এ-কথা শুনে খুব বড় একটা লাফ দিল। একটা বড় মাছি তার ঘাড়ের ওপর ঘাতে এসে বারবার বসছিল। সে শিং দিয়ে মাছিটাকে গুঁতোতে গিয়ে এই কাণ্ড করে বসল। শিং কখনো মাছির নাগাল পায়! চারপায়ে জটাঘটি পাকিয়ে ছাগলটা পড়ে গেল। বিষম ব্যথায় সে উঠতে পারল না।


শ্রীধর বলল, চলুন স্যার। স্টেশন অব্দি এগিয়ে দিয়ে আসি আপনাকে।


এরপর সেই পাঁচটা চল্লিশ। শেয়ালদা চিনতে পারবেন না রাতে। তারপরও তো রাস্তা আছে।


হৃদয়লাল বললেন, চলো।


দুজনে রওনা হতে যাবেন এমন সময় হৃদয়লালের পরিষ্কার মনে হল- সে নিজেও কি মহাভারতের মত অতটা মহাকাব্য না হলেও--নিদেন জীবন নামে একটা চ্যাপ্টা নভেলের কোনো ভাঙাগলি ধরে স্টার্ট দিচ্ছেন না! ওই পুকুর--এই বটতলা--স্কুলবাড়ি, রেললাইন, শ্রীটেলারিং পেছনে ফেলে!

গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের গল্প : নিদ্রিতা সুন্দরীও একটি অ্যারোপ্লেন


অনুবাদ : তুষার তালুকদার

নমনীয় এক সৌন্দর্য ছিল তার পুরো অঙ্গে। স্নিগ্ধ ত্বকে পাউরুটির মতো তুলতুলে আমেজ ও পটলচেরা চোখের চাহনির গভীরে আমি তা দেখেছি। সেই সঙ্গে কাঁধ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়া সোজা কালো চুলে এক চিরন্তন সৌন্দর্যের ঢেউ খেলছিল। হয়তো ইন্দোনেশিয়া বা আন্দিনের মতো প্রাচীন সে সৌন্দর্য, তবে মহাকালিক। তার পরিধেয় প্রতিটি পোশাকে ছিল সূক্ষ্ম রুচির পরিচয়-লিনেক্স (বনবিড়ালের চামড়া) জ্যাকেট, সূক্ষ্ম ফুল অঙ্কিত ঢিলেঢালা সিল্কের ব্লাউজ, লিনেন কাপড়ের ট্রাউজার আর বাগানবিলাস রঙের ছোট ছোট ডোরাকাটা জুতা। আমি প্যারিসের চার্লস ডি গল বিমানবন্দরের চেকলাইনে অপেক্ষা করছিলাম। আর ঠিক তখনই আমি তাকে দেখলাম, সিংহীর মতো লম্বা লম্বা পা ফেলে সন্তর্পণে হেঁটে যাচ্ছে। আমার মন তখন অবচেতনভাবেই বলে উঠল, 'এ পর্যন্ত দেখা সকল মেয়ের মধ্যে তুমি সবচেয়ে সুন্দর'। ঠিক অতিপ্রাকৃত কোনো আত্মা ওই মূহূর্তের জন্য এল আর চোখের নিমিষে টার্মিনালের ভিড়ে হারিয়ে গেল।



তখন সকাল ন'টা। সারারাত বরফ পড়ার কারণে সকালের দিকে রাস্তায় যানবাহন তুলনামূলক বেশিই ছিল। হাইওয়েগুলোতে গাড়ির গতি ছিল বেশ ধীর। রাস্তার দু'পাশে ট্রাকগুলো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিল। বরফ ঝরার আধিক্যে অটোমোবাইলগুলোও নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল। তবে টার্মিনালের ভেতরের আবহাওয়াটা বসন্তের মেজাজেই ছিল।আমি একজন ডাচ ভদ্রমহিলার পেছনে দাঁড়িয়েছিলাম। বয়ে আনা এগারোটা স্যুটকেস নিয়ে তিনি কথা কাটাকাটি করছিলেন। এতে প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় পার হয়ে যায়। আমি কিছুটা বিরক্তই হচ্ছিলাম। কিন্তু অতিপ্রাকৃত সুন্দরী ঠিক সেই মুহূর্তেই আমার সামনে দিয়ে হেঁটে গেল। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। তাই ডাচ ভদ্রমহিলার ঝগড়ার নিষ্পত্তির ঘটনাটা আমি বলতে পারব না। তবে টিকিট চেকারের ঝাঁঝালো কণ্ঠস্বরে আমি স্বপ্ন থেকে বাস্তবে ফিরে এসেছিলাম। আর স্বপ্নটাকে পাশ কাটাতে তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু। তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, প্রথম দর্শনে ভালোবাসায় তিনি বিশ্বাস করেন কি না। ভদ্রমহিলা আমাকে বললেন, 'অবশ্যই, বরং এ ছাড়া অন্য কিছু অসম্ভব'। আমার সঙ্গে কথা বলার সময়টুকুতে তার চোখ কম্পিউটারের পর্দায়ই নিবিষ্ট ছিল। ঠিক সেভাবেই তিনি আমাকে একটা চেয়ার দেখিয়ে তাতে বসতে বললেন। সঙ্গে এও জানালেন যে, ইচ্ছে করলে ধূমপান করতেও আমি তা ব্যবহার করতে পারি। প্রত্যুত্তরে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বিদ্বেষের সুরেই বললাম, 'যতক্ষণ পর্যন্ত এগারো স্যুটকেস বহনকারী ভদ্রমহিলার পেছনে আছি, এটা কোনো ব্যাপার নয়'।

আমার কথায় তিনি একটু প্রশংসাসূচক বাণিজ্যিক হাসি হাসলেন, তবে পর্দার ওপর থেকে চোখ সরালেন না।

এরপর তিনি আমাকে বললেন, 'তিন, চার বা সাতের মধ্যে যেকোনো একটা সিট নাম্বার পছন্দ করুন'।

আমি বললাম, 'চার'।

ক্ষণিকের জন্য দেখলাম তার হাসিটা দীপ্তিময় হয়ে উঠল। তিনি বললেন, 'আমার পনেরো বছরের দীর্ঘ কর্মজীবনে প্রথমবারের মতো আপনাকে পেলাম যিনি সাত নাম্বার সিট পছন্দ করেননি'।

বোর্ডিং পাসে আমার সিট নাম্বার লিখে অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে তিনি আমাকে তা ফিরিয়ে দিলেন। আর একমাত্র তখনই পিঙ্গল চোখে আমার দিকে তাকান তিনি। সেই অতিপ্রাকৃত সুন্দরীকে পুনরায় দেখার আগ পর্যন্ত এই দৃষ্টিই ছিল আমার সান্ত্বনা। তখন আমি আরও জানতে পারি যে বিমানবন্দরের সকল ফ্লাইট দেরিতে যাত্রা করবে।

'কতক্ষণ লাগতে পারে?'

আমার প্রশ্নের উত্তরে একটা মুচকি হাসি দিয়ে তিনি বললেন, 'ঈশ্বর জানেন'। তবে রেডিওতে বলা হচ্ছে, এ বছরের সবচেয়ে বড় তুষার ঝড় আজ সকালে হচ্ছে।'

আসলে তথ্যটি ছিল ভুল। শতাব্দীর সবচেয়ে বড় ঝড় হচ্ছিল সেদিন। কিন্তু ওয়েটিং রুমের প্রথম শ্রেণীর কক্ষগুলোতে সতেজ ফুল আর কোমল সুরের মূর্ছনায় বসন্ত বয়ে চলছিল। এই সৃষ্টির স্রষ্টা হয়তো এমন মনমাতানো পরিবেশই উপহার দিতে চেয়েছিলেন। সবকিছু সেই অতিপ্রাকৃত সুন্দরীকে আপন করে নেওয়ার জন্য একদম ঠিকঠাক মনে হচ্ছিল। ওয়েটিং রুমের চারপাশে আমি তাকে নিবিড়ভাবে খুঁজতে লাগলাম। তবে আমার এমনতর আচরণে আমি নিজেও কিছুটা বিভ্রান্ত ছিলাম। আশপাশে বসে থাকা সব পুরুষই ইংরেজি খবরের কাগজ পড়ছিলেন। বোঝা যাচ্ছিল যে তারা নিখুঁত বাস্তব জীবনের প্রতিনিধি। আর তাদের স্ত্রীরা সচল দৃশ্যমান জানালার ভেতর দিয়ে অচল বিমানগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলেন। হয়তো তারা অন্য কারো কথা ভাবছিল নয়তো হিংস্র সিংহের মতো ঝড়ের আক্রমণে বিধ্বস্ত রয়েসির মাঠের দিকে নির্ভার তাকিয়ে ছিলেন। দুপুর হতে না হতেই ওয়েটিং রুমের চারপাশ জনাকীর্ণ হয়ে পড়ল।

ওয়েটিং রুমের বাইরের দৃশ্যটা আরও চমকপ্রদ ছিল। অন্যান্য প্রতিটি ওয়েটিং রুম বিভিন্ন ধরনের মানুষে পরিপূর্ণ। যাত্রীরা তাদের পশু-পাখি, ছেলে-মেয়ে ও ভ্রমণ অনুষঙ্গ নিয়ে সংকীর্ণ করিডোর ও সিঁড়িপথের চারপাশে ক্যাম্পের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। শহরের সঙ্গে যোগাযোগ বিঘ্নিত হচ্ছিল। স্বচ্ছ প্লাস্টিকের তৈরি ভবনটিকে মহাকাশে প্রেরিত বিধ্বস্ত এক প্রকাণ্ড ক্যাপসুলের মতো লাগছিল। তবে সে মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল, এ পোষ্য পালের ভিড়ে সুন্দরী কোথাও লুকিয়ে আছে। নতুন উদ্দীপনায় আমি তার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

দুপুরে খাবারের সময় আমার কেন জানি সবাইকে জাহাজডুবিতে সহায়সম্বলহীন মনে হচ্ছিল। সাতটা রেস্টুরেন্ট, ক্যাফে ও বারগুলোর সামনে মানুষের অন্তহীন লাইন অপেক্ষা করছিল। তিন ঘণ্টার চেয়ে কম সময়ের মধ্যে সবগুলো বন্ধ হয়ে যায়। খাওয়ার বা পান করার মতো সেখানে কিছু অবশিষ্ট ছিল না। একই সঙ্গে মনে হচ্ছিল যেন পৃথিবীর সব বাচ্চা একত্রিত হয়ে তাদের কান্নায় কান ঝালাপালা করা এক বিচ্ছিরি অবস্থার সৃষ্টি করেছে। কিছুক্ষণের জন্য সবাই যেন পুরোপুরি জৈবিক হয়ে উঠেছিল। এ অবস্থায় আমি খাওয়ার মতো দু'কাপ ভ্যানিলা আইসক্রিম পেলাম, তাও আবার বাচ্চাদের একটা দোকানে। প্রতিটি ক্যাফেতে ক্রেতারা উঠার পর পরই ওয়েটাররা চেয়ারগুলো টেবিলের ওপর রেখে দিচ্ছিল। কাউন্টারের পাশে দাঁড়িয়ে খুব আরাম করে খাচ্ছিলাম এবং বারবার নিজেকে আয়নায় দেখছিলাম। আমার হাতে ছিল কাডবোর্ডের তৈরি শেষ কাপ ও চামচ এবং মাথায় ছিল সেই সুন্দরীর চিন্তা।

সকাল এগারোটার নির্ধারিত ফ্লাইট অবশেষে রাত আটটায় বিমানবন্দর ছাড়ল। অন্যান্য যাত্রীরা যখন তাদের সিটে পৌঁছে গিয়েছিল, আমি মাত্র বোর্ড পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছিলাম। অবশেষে এক ফ্লাইট সহকারীর সহায়তায় আমি আমার সিটে পৌঁছাই। আমার হূত্কম্পন প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিল যখন দেখলাম সুন্দরী আমার পাশের সিটে বসে আছে। একজন অভিজ্ঞ পর্যটকের মতো জানালার পাশের সিটে বসে আছে সে। আমি মনে মনে ভাবলাম, 'ব্যাপারটা এতই কাকতালীয় যে আমার লেখা হয়তো কেউ কেউ বিশ্বাস না-ও করতে পারে'। আমি কিছুটা তোতলামো করে সুন্দরীর সঙ্গে তাত্ক্ষণিক শুভেচ্ছা বিনিময় করতে চাইলাম। কিন্তু সে তা শুনলই না। তার বসার ভঙ্গিমা ও জিনিসপত্র গোছানোর স্টাইল দেখে মনে হচ্ছিল যে সে সেখানে অনেকদিন বাস করতে যাচ্ছিল। প্রত্যেকটা জিনিসকে সঠিকভাবে নাগালের মধ্যে রেখে সে একটা আদর্শ বাড়ির আদল আনতে চাচ্ছিল। পরক্ষণে, একজন বিমানবালা আমাদের শ্যাম্পেন দ্বারা স্বাগত জানাতে এগিয়ে আসল। আমি একটা গ্লাস তার জন্য তুলে নিলাম ঠিকই কিন্তু সাধলাম না। ভাবলাম, ঠিক সময় এলেই দেওয়া ভালো। সুন্দরী তখন প্রথমে দুর্বোধ্য ফ্রেঞ্চ ও পরে চলনসই ইংরেজিতে বিমানবালার কাছে এক গ্লাস পানি চাইল। আরও জানাল যে ফ্লইট চলাকালে তাকে যেন কেউ না জাগায়। তার উষ্ণ ও গম্ভীর কণ্ঠস্বরে প্রাচ্যের বিষাদ ঘিরে ছিল।

পানি দিয়ে যাবার পর, সে একটা প্রসাধনীর বাক্স থেকে দুটো সোনালি রঙের পিল বের করল। বাক্সটা অনেকটা দাদিমার আমলের ট্রাঙ্কের মতো, কোণাগুলো তামা দিয়ে বাঁধানো এবং সেখানে আরও বিভিন্ন রঙের পিল ছিল। সে সবকিছু খুব সুন্দরভাবে ও নিয়মমাফিক করল। জন্মের পর থেকে কোনোকিছু তার ইচ্ছার বাইরে হয়নি—এমনটাই দেখে মনে হলো। তারপর সে জানালার পর্দা নামিয়ে দিল, সিটটাকে যতটুকু সম্ভব নিচু করল, জুতাসহ কোমর পর্যন্ত কম্বল মুড়ে দিল, স্লিপিং মাস্ক পরল এবং আমার দিকে পেছন ফিরে ঘুমিয়ে পড়ল। নিউ ইয়র্ক যাওয়া পর্যন্ত পুরোটা সময় সে ঘুমিয়ে কাটাল। এই আট ঘণ্টা ও অতিরিক্ত বারো মিনিটের মধ্যে সে একটুও বিরতি দিল না, একটা দীর্ঘশ্বাসও ছাড়ল না, এমনকি একটু নড়ল না পর্যন্ত ।

আমার জন্য পুরো সময়টাই ছিল অস্থির। একটা মেয়ে প্রকৃতির সবচেয়ে সুন্দর সৃষ্টি বলে আমার বিশ্বাস। তাই আমার পাশে শুয়ে থাকা মোহিনীর জাদু থেকে আমি এক মুহূর্তের জন্যও বের হতে পারছিলাম না। বিমান উড্ডয়নের সঙ্গে সঙ্গে সেই বিমানবালার পরিবর্তে একজন কার্তেসিয়ান নিযুক্ত হলো। একটি টয়লেটারি বাক্স ও এয়ারফোন দেওয়ার জন্য লোকটি সুন্দরীকে জাগানোর চেষ্টা করল। আর রাতের খাবার দেওয়া হবে কি না তা জিজ্ঞেস করাটাও তার জন্য জরুরি ছিল। আমার বারবার নিষেধ সত্ত্বেও সে তাকে জাগানোর জন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগল। শেষ পর্যন্ত স্বয়ং বিমানবালা এসে তাকে নিরস্ত করল। তারপরও খানিকটা অসন্তোষ ছাপ তার চেহারায় ছিল সুস্পষ্ট। কারণ, সুন্দরীর গলায় 'বিরক্ত করো না' জাতীয় কোনো নোটিশ লাগানো ছিল না ।

আমি একা একা রাতের খাবার খেলাম। সুন্দরী জেগে থাকলে তাকে যা বলতাম তা নিজেকেই মনে মনে বললাম। সে নির্বিঘ্নে ঘুমাচ্ছিল। ঘুমের ঔষধগুলো যেন মৃত্যুর আহ্বায়ক। প্রতিবার পান করার সময় গ্লাস উঁচিয়ে তাকে অভিবাদন জানালাম—

'সুন্দরী তোমার সুস্বাস্থ্য কামনায়।'

রাতের খাবারের পর বাতিগুলো নিষপ্রভ হয়ে এল। একটা মুভি চলছিল পর্দায়, কেউ দেখছিল না। শুধু আমরা দু'জন, এক অন্ধকার জগতে... একাকী...। শতাব্দীর বড় ঝড় থেমে গিয়েছিল। অসংখ্য তারার মাঝে বিমানটিকে মনে হচ্ছিল গতিহীন। সে মূহূর্তে আমি তাকে দেখলাম। নিবিড়ভাবে। শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি মেপে মেপে, কয়েক ঘণ্টা ধরে। তার কপালে স্বপ্ন উড়ে যাচ্ছিল। পানির ওপর ভেসে থাকা মেঘের ছায়ার মতো। জীবনের স্পন্দনও শুধু সেখানেই ছিল। গলার হারটি সোনালি ত্বকের মাঝে ডুবেছিল। সুগঠিত কানে কোনো ছিদ্র ছিল না। মেদবহুল আঙ্গুল থেকে গোলাপি আভা ছড়াচ্ছিল। আর বাম হাতে একটা মসৃণ বালা। সবমিলে বিশ বছরের বেশি মনে হলো না। তবু সন্দেহ হলো, এ বালা আবার বিয়ের প্রতীক না হয়ে থাকে। পরক্ষণে ভাবলাম, এটি হয়তো ক্ষণস্থায়ী বাগদানের স্মারক। আমি জেরার্দো ডিয়েগোর চমত্কার সনেটটি মনে মনে আবৃত্তি করছিলাম। তখন শ্যাম্পেনের ওপর জমে থাকা বুদবুদের চূড়ার দিকে তাকিয়ে বললাম, 'আমার বদ্ধহাতের পাশে তোমার ঘুমকে নিশ্চিত ও নিরাপদ করতে আমার নিঃস্বার্থ অকৃত্রিম বিশ্বস্ততা প্রমাণ করাটাই আমার স্বস্তি'। তারপর আমি সিটটাকে তার সিটের কাছাকাছি নামিয়ে আনলাম। বাসর ঘরের বিছানা থেকেও নিজেদের কাছাকাছি মনে হলো আমার। কণ্ঠের মতোই গম্ভীর ছিল তার শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি। আর ত্বক থেকে বেরিয়ে আসা কোমল গন্ধটা ছিল তার সৌন্দর্যের একরকম বিশেষায়ণ। সে সময় ইয়াসুনারি কাউয়াতার একটা উপন্যাসের কথা মনে পড়ে গেল আমার। বইটা আমি গত বসন্তে পড়েছিলাম। প্রাচীন কিয়োটা বুর্জোয়াদের ওপর লেখা। সেখানে তারা শহরের সবচেয়ে সুন্দর মেয়েদের নগ্ন ও নেশাগস্ত অবস্থায় দেখতে প্রচুর সময় ব্যয় করত। হয়তো মিলনের ঐকান্তিক ইচ্ছা যন্ত্রণায় উন্মত্ত হয়ে উঠত, কিন্তু তারা সেই মেয়েগুলোকে স্পর্শ করে জাগানোর চেষ্টা করত না। ঘুমন্ত রমণীদের অবলোকন করার মাঝেই ছিল তাদের প্রকৃত সুখ। সেই রাতে সুন্দরীকে অবলোকন করতে গিয়ে আমিও ঠিক একই জরাগ্রস্ত আনন্দ খুঁজে পেয়েছিলাম। শুধু উপভোগ নয়, ধারণ করেছিলাম আমি তা। অবিশ্বাস্য, তাই না?

শ্যাম্পেনের ঝাঁঝ আমাকে উত্তেজিত করে তুলেছিল। তখন নিজেই নিজেকে বললাম, 'এই অসময়ের অভিসারে প্রাচীন জাপানিই হই আর যা-ই হই, কী আসে যায় তাতে'। শ্যাম্পেনের তীব্রতা আর মুভির নিঃশব্দ বিস্ফোরণে কিছুক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠার পর মনে হচ্ছিল যেন মাথা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। আমি বাথরুমে গেলাম। যাওয়ার পথে দেখলাম, আমার দু'সিট পেছনে এগারো স্যুটকেস বহনকারী মহিলা দু'পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। যুদ্ধক্ষেত্রে ভুল করে রেখে যাওয়া মৃতদেহের মতো দেখাচ্ছিল তাকে। নানা রঙের মুক্তোয় বাঁধা রিডিং গ্লাসটি পথের মাঝখানে পড়েছিল। আমি এটা কুড়িয়ে তুললাম না। কেমন যেন একটা পৈশাচিক আনন্দ পেলাম তাতে আমি।

শ্যাম্পেনের তীব্রতা থেকে মুক্ত হওয়ার পর প্রথম আমি নিজেকে আয়নায় দেখলাম। ভালোবাসার প্রগাঢ়তা আমার চেহারাকে ঘৃণ্য ও কুিসত করে তুলেছিল। কোনো পূর্বসতর্কতা ছাড়াই তখন হঠাত্ বিমানটি দিক পরিবর্তন করল। তবে কিছুক্ষণ পরই আবার দ্রুতগতিতে সোজা চলতে লাগল। 'সিটে ফিরে আসুন' সংকেতটি বারবার দেখানো হচ্ছিল। আমি তাড়াতাড়ি সিটে ফিরে এলাম। ভেবেছিলাম, ঈশ্বরের বিক্ষুব্ধ প্রকৃতি হয়তো ইতিমধ্যে সুন্দরীকে জাগিয়ে তুলেছে। আর সুন্দরী হয়তো ভয় থেকে বাঁচবার জন্য আমার বাহুবিষ্ট হতে পারে। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আমি ডাচ ভদ্রমহিলার চশমায় প্রায় পা ফেলতে চলেছিলাম। তেমনটা হলে হয়তো খুশিই হতাম। তবে শেষপর্যন্ত আমি পেছনে সরে এলাম। চশমাটাকে তার কোলে ফিরিয়ে দিলাম। আমার আগে সে চার নাম্বার সিটটি পছন্দ করেনি বলে তার প্রতি এক আকস্মিক কৃতজ্ঞতাবোধ জন্ম নিল।

সুন্দরীর ঘুম অজেয় ছিল। বিমানটি থামানোর পর তাকে জাগানোর তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে আমি নিজেকে কোনোমতে সংযত করলাম। ফ্লাইটের শেষ ঘণ্টাটিতে তাকে জাগ্রত দেখার ভীষণ ইচ্ছা ছিল আমার। এই ইচ্ছা তার প্রচণ্ড রাগের কারণ হলেও ক্ষতি নেই। হয়তো এই শেষ দেখা আমার স্বাধীনতা ও যৌবনকে পুনরুজ্জীবিত করত। কিন্তু আমি ব্যর্থ হলাম। নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বললাম, 'চুলোয় যাক, কেন যে টৌরাস হয়ে জন্মালাম না'।

অবতরণের পর বাতি জ্বলে উঠার সময়টুকুতে সুন্দরী নিজেই জেগে উঠল। সে যেন একটা গোলাপের বাগানে ঘুমিয়েছিল, তাকে এত সুন্দর ও সতেজ লাগছিল। অনেকক্ষণ পর আমার মনে হলো, বিমানে পাশাপাশি বসে থাকা মানুষগুলো জেগে উঠার পর বয়স্ক দম্পতির মতো একে অপরকে শুভ সকালটুকুও জানায় না। যেমনটা সে জানায়নি। সুন্দরী তার স্লিপিং মাস্কটা খুলে ফেলল, দীপ্তিময় চোখ মেলে তাকাল, সিটটাকে সোজা করল, কম্বলটিকে পাশে সরিয়ে রাখল, চুলগুলো নেড়ে ঠিক করল এবং সবশেষ প্রসাধনীর বাক্সটাকে হাঁটুর ওপর রাখল। অনেকটা সময় নিয়ে দ্রুত ও অপ্রয়োজনীয় কিছু সাজসজ্জা করল। বিমানের গেইট না খোলা পর্যন্ত সে আমার দিকে তাকায়নি। একটু পর লিনেক্স জ্যাকেটটি পরে লাতিন আমেরিকান স্প্যানিশের মাধ্যমে প্রথাগত ক্ষমাপ্রার্থনা জানিয়ে প্রায় আমার ওপর দিয়ে চলে গেল সে। আমাদের দু'জনের গড়া সুন্দর রাতটির জন্য আমাকে একটা ধন্যবাদও জানাল না। এমনকি বিদায় সম্ভাষনটুকুও না। আজকের সকালের মতো সেদিনের সূর্য উদ্ভাসিত আলোয় উজ্জ্বল থাকা সত্ত্বেও সুন্দরী নিউ ইয়র্কের আমাজান জঙ্গলে হারিয়ে গেল।