Monday, August 21, 2017

অন্য যে জগত হাতছানি দেয়



মূল রচনা The Other World That Beckons
লেখক— কার্ল সেগান
“কর্তৃত্বের প্রতি আমার অবজ্ঞার কারণে আমাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য নিয়তি খোদ আমাকেই কর্তৃত্বে পরিণত করেছে।” —আইনস্টাইন

আলবার্ট আইনস্টাইন ঠিক এক শতাব্দী আগে ১৮৭৯ সালে জার্মানির উল্‌মে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যে কোনো কালের অল্প সংখ্যক প্রতিভাধর মানুষের মধ্যে অন্যতম যিনি গতানুগতিক বিজ্ঞতার প্রতি নিগূঢ় আপত্তি জানানোর জন্য পুরাতন জিনিসকে নতুন করে হৃদয়ঙ্গম করার মাধ্যমে বিশ্বকে পুনর্নির্মাণ করেছেন। বহু দশক ধরে তিনি ছিলেন একজন সাত্ত্বিক ও সম্মানিত ব্যক্তিত্ব, একমাত্র বিজ্ঞানী যার নাম সাধারণত মানুষ তৎক্ষণাৎ বলতে পারতো। কিছু মাত্রায় অন্তত অস্পষ্টভাবে হলেও জনসাধারণের দ্বারা তাঁর বৈজ্ঞানিক দক্ষতাকে উপলব্ধি করার কারণে; কিছু মাত্রায় সামাজিক বিষয়ে তাঁর সাহসিকতাপূর্ণ অবস্থানের কারণে; এবং কিছু মাত্রায় সাত্ত্বিক ব্যক্তিত্বের কারণে আইনস্টাইন সারা বিশ্ব জুড়ে প্রশংসিত ও সম্মানিত হয়েছেন। অভিবাসী বাবা-মায়ের বিজ্ঞানানুরাগী সন্তান হিসেবে, কিংবা আমার মতোই মহামন্দার সময়ে বেড়ে ওঠা আইনস্টাইনের অর্জিত শ্রদ্ধা প্রমাণ করে যে, এমন বিজ্ঞানীর জন্য বৈজ্ঞানিক পেশা একেবারে আশাতীত ছিলো না। একজন বৈজ্ঞানিক রোল মডেল হিসেবে তিনি অবচেতনভাবে একটি মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন। আইনস্টাইন না থাকলে ১৯২০ সালের পরবর্তী সময়ের নবীন বিজ্ঞানীরা হয়ত বৈজ্ঞানিক কর্মোদ্যোগের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতেই পারতেন না। আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের যুক্তি
আরো একশ বছর আগে বিকশিত হতে পারতো; কিন্তু অনেকের পূর্বাভাসসূচক অন্তর্দৃষ্টি থাকা সত্ত্বেও আপেক্ষিকতাবাদকে আইনস্টাইনের জন্য প্রতীক্ষায় থাকতে হয়েছে। তথাপি বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের পদার্থবিদ্যা মৌলিকভাবে খুবই সহজ; আর দরকারী ফলাফলের অনেকগুলো হাই স্কুলের বীজগণিত দিয়ে এবং স্রোতের অনুকূলে ও প্রতিকূলে নৌকার বৈঠা চালানোর গণনা থেকে প্রতিপাদন করা যায়। প্রতিভা ও শ্লেষ, তাঁর সময়ের বিচার্য বিষয়ের প্রতি অনুরাগ, শিক্ষার প্রতি সম্যক দর্শন, বিজ্ঞান ও রাজনীতির মধ্যে সংযোগ এবং মোটের ওপর ব্যক্তিবিশেষের দ্বারা বিশ্বকে পরিবর্তন করতে পারার দৃষ্টান্ত স্থাপনের মাধ্যমে আইনস্টাইনের জীবন পরিপূর্ণতা লাভ করেছে।

শৈশবে আইনস্টাইন তাঁর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অল্পই আভাস দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেছেন,
“আমার বাবা-মা চিন্তিত ছিলেন কারণ আমি তুলনামূলভাবে দেরিতে কথা বলতে শুরু করেছিলাম, এবং এ জন্য তাঁরা ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। আমার বয়স তখন কম করে হলেও তিন তো হবেই!”

তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাঝারি মানের ছাত্র ছিলেন। তিনি বলেছেন, শিক্ষকদের কথা স্মরণ করলে ড্রিল সার্জেন্টদের কথা মনে পড়ে যেতো তাঁর। আইনস্টাইনের যৌবনকালে বাগাড়ম্বরপূর্ণ জাতীয়তাবাদ ও বুদ্ধিবৃত্তিক অনমনীয়তা ছিলো ইউরোপীয় শিক্ষার পরিচায়ক। তিনি শিক্ষার প্রাণহীন, যান্ত্রিক পদ্ধতির বিরোধিতা করেছিলেন। “মুখস্থ করে বকবক করার চেয়ে আমি সব ধরনের শাস্তি সহ্য করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম।” আইনস্টাইন সবসময় শিক্ষায়, বিজ্ঞানে ও রাজনীতিতে কঠোর নিয়মানুবর্তী লোকদের দারুণ অপছন্দ করতেন। পাঁচ বছর বয়সে তিনি একটি কম্পাসের রহস্য দ্বারা আলোড়িত হয়েছিলেন। পরে তিনি আরো লিখেছিলেন,
“১২ বছর বয়সে আমি ইউক্লিডীয় সমতল জ্যামিতির একটি ছোট বইতে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের দ্বিতীয় বিস্ময়ের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলাম…এখানে কিছু প্রমাণ ছিলো, যেমন কোনো একটি ত্রিভুজের লম্বত্রয়ের একটি বিন্দুতে প্রতিচ্ছেদ সন্দেহাতীতভাবে নিশ্চয়তার সাথে প্রমাণ করা যায়, যদিও এটি কোনোমতেই দৃষ্টিলব্ধ হয় না। এই স্বচ্ছতা ও নিশ্চয়তা আমার ওপর অবর্ণনীয় প্রভাব ফেলেছিলো।”

আনুষ্ঠানিক শিক্ষাদান এমন গভীর চিন্তায় কেবল অসন্তোষজনক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলো। আইনস্টাইন তাঁর স্বশিক্ষা সম্বন্ধে লিখেছেন,
“১২ থেকে ১৬ বছর বয়সে আমি ডিফারেন্সিশাল ও ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাসের মূলনীতিসহ গণিতের উপাদানগুলোর সাথে নিজেকে অভ্যস্ত করে তুলেছিলাম। এটি করতে গিয়ে আমার সেসব বই খোঁজার সৌভাগ্য হয়েছিলো যেগুলো কেবল যৌক্তিক কাঠিন্যে খুব যথাযথ ছিলো না, তথাপি মূল চিন্তাগুলোকে পরিষ্কারভাবে ও সারাংশরূপে প্রকাশ করার সুযোগ করে দেওয়ার মাধ্যমে গঠিত হয়েছে…চমৎকার নন্দিত বর্ণনায় প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সমগ্র ক্ষেত্রের দরকারী ফলাফল ও পদ্ধতি সম্পর্কে জানার সৌভাগ্যও আমার হয়েছিলো, যেগুলো প্রায় গুণগত দৃষ্টিভঙ্গির সর্বত্র জুড়ে সীমাবদ্ধ…এই কাজ আমি রুদ্ধশ্বাস মনোযোগ সহকারে পড়েছিলাম।”

অধুনা বিজ্ঞানের জনপ্রিয়কারীরা স্বস্তি পেতে পারেন। আইনস্টাইনের কোনো শিক্ষক তাঁর প্রতিভাকে ঠাহর করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। মিউনিখ শহরের নেতৃস্থানীয় মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মিউনিখ জিমনেসিয়ামের এক শিক্ষক তাঁকে বলেছিলেন, “তুমি কখনোই কোনো কিছুকে পূর্ণতা দিতে পারবে না, আইনস্টাইন।” আইনস্টাইনের বয়স যখন ১৫ বছর তখন এক শিক্ষক তাঁকে স্কুল ছাড়ার জন্য জোর পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেই শিক্ষক মন্তব্য করেছিলেন, “তোমার উপস্থিতি আমার প্রতি ক্লাসের সম্মানকে নষ্ট করে দেয়।” আইনস্টাইন এই পরামর্শকে সাগ্রহে গ্রহণ করে ইতালির উত্তরাঞ্চলে কয়েক মাস উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন।

পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে আইনস্টাইনের কৌতূহল ও নৈসর্গিক মহাবিশ্ব নিয়ে তাঁর বিস্ময় দ্রুতই আনুষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি তাঁর বিতৃষ্ণাকে পরাস্ত করে এবং মাধ্যমিক স্কুলের ডিপ্লোমা ছাড়াই সুইজারল্যান্ডের জুরিখে ফেডারেল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে ভর্তির জন্য আবেদন করেন। ভর্তি পরীক্ষায় তিনি অকৃতকার্য হয়েছিলেন। ফলে তাঁর ঘাটতি মেটাবার জন্য তিনি একটি সুইস মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তালিকাভুক্ত হন এবং পরের বছর ফেডারেল ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। কিন্তু তখনও তিনি মাঝারি মানের ছাত্র ছিলেন। নির্দেশিত পাঠ্যক্রমে তিনি বিরক্ত হয়ে যেতেন ও নিজের প্রকৃত কৌতূহল চরিতার্থ করার জন্য লেকচার রুম এড়িয়ে চলতেন। তিনি পরে লিখেছেন, “স্বভাবত এখানে বাধা ছিলো, পছন্দ করলে কিংবা না করলেও পরীক্ষার জন্য এই সমস্ত জিনিস মুখস্থ করতে হতো।”

তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু মার্সেল গ্রসম্যান একাগ্র হয়ে ক্লাসে হাজির থাকতেন এবং আইনস্টাইনের সাথে নোট শেয়ার করতেন যে কারণে তিনি স্নাতক সম্পন্ন করতে সক্ষম হন। বহু বছর পরে গ্রসম্যানের মৃত্যুতে আইনস্টাইন লিখেছেন,
“আমাদের ছাত্র জীবনের কথা আমার মনে পড়ে। সে ছিলো নিখুঁত ছাত্র, আমি ছিলাম অগোছালো ও স্বাপ্নিক। শিক্ষকদের সাথে সখ্যতা ও সব কিছুর বোঝাপড়ায় সে ছিলো ভালো, আমি ছিলাম অন্ত্যজ, অতৃপ্ত ও অল্প প্রিয়। …তারপর আমাদের পড়াশোনার শেষে– জীবনের প্রারম্ভে খেই হারিয়ে ফেলে হঠাৎ সবার কাছে আমি অপাঙক্তেয় হয়ে গেলাম।”

গ্রসম্যানের নোটে গভীরভাবে মনোনিবেশ করে আইনস্টাইন কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু, তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, ফাইনাল পরীক্ষার পড়াশোনার
“এমন একটি ভীতিকর প্রভাব আমার ওপর ছিলো যে…পুরো এক বছর ধরে কোনো বৈজ্ঞানিক সমস্যার চিন্তাকে আমার কাছে অরুচিকর মনে হতো। …শিক্ষাদানের আধুনিক পদ্ধতি যে ইতোমধ্যে অনুসন্ধানের পবিত্র কৌতূহলকে পুরোপুরিভাবে স্তব্ধ করে দেয়নি সেটা অলৌকিক ঘটনার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়, কারণ প্রারম্ভিক উদ্দীপনা বাদেও এই পলকা ছোট্ট গাছটির জন্য দরকারি স্বাধীনতা ছাড়া তা নিশ্চিতভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। …আমি বিশ্বাস করি, ক্ষুধার্ত থাকুক কিংবা না থাকুক, একটি স্বাস্থ্যবান শিকারী পশুকে চাবুক মেরে বিরামহীনভাবে খেতে বাধ্য করা গেলে তাকে তার লোভ থেকে বঞ্চিত করা যায়।”

আমরা যারা বিজ্ঞানে উচ্চ শিক্ষায় নিয়োজিত আছি, তাঁর এই মন্তব্য তাদের ভাবনার খোরাক যোগায়। পাঠ্যক্রম ও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা জোর করে গেলানোর মাধ্যমে কত প্রতিভাধর আইনস্টাইনকে যে স্থায়ীভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে তা ভেবে আমি অবাক হয়ে যাই।

নৈমিত্তিক কাজ করে নিজের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করে এবং আকাঙ্ক্ষিত পদগুলোতে উপেক্ষিত হবার পর মার্সেল গ্রসম্যানের বাবার হস্তক্ষেপে আইনস্টাইন বার্নে অবস্থিত সুইস পেটেন্ট অফিসে আবেদনপত্রের পরীক্ষক হবার প্রস্তাব গ্রহণ করেন। প্রায় একই সময়ে তিনি তাঁর জার্মান জাতীয়তা ত্যাগ করে সুইস নাগরিক হন। তিন বছর পর ১৯০৩ সালে তিনি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রেমিকাকে বিয়ে করেন।

তাঁর অন্যতম জীবনীকার ব্যানেশ হফম্যান লিখেছেন, পেটেন্ট অফিসে আইনস্টাইন “তাঁর দৈনন্দিন কাজগুলো দ্রুত দক্ষতার সাথে শিখেছিলেন যার ফলে তিনি তাঁর নিজের গোপনীয় হিসাবের জন্য মূল্যবান কিছু সময় বের করতে পেরেছিলেন, যা পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলে তিনি অপরাধীর মতো ড্রয়ারে লুকিয়ে রাখতেন।” এমনই ছিলো মহান আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের জন্মকে ঘিরে পারিপার্শ্বিক অবস্থা। কিন্তু আইনস্টাইন পরবর্তীতে স্মৃতিকাতর হয়ে বলেছেন, পেটেন্ট অফিসটি “সেই নির্জন সাংসারিক স্থান যেখানে আমি আমার সবচেয়ে সুন্দর ধারণাগুলোকে সৃষ্টি করেছিলাম।” তিনি তাঁর সহকর্মীদের অনেকবার বলেছেন যে, একজন বিজ্ঞানীর জন্য বাতিঘর রক্ষকের পেশা একটি উপযুক্ত স্থান হতে পারে কারণ কাজটি তুলনামূলকভাবে সহজ এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় গভীর চিন্তার সুযোগ করে দিতে সক্ষম। তাঁর সহকর্মী লিওপোল্ড ইনফেল্ড বলেছেন,
“একাকীত্ব, বাতিঘরের জীবন আইনস্টাইনের জন্য সবচেয়ে উদ্দীপনাময় হতো যা তাঁকে অনেক বিরক্তিকর দায়িত্ব মুক্তি দিতে পারতো। আসলে এটিই হতো তাঁর জন্য আদর্শ জীবন। কিন্তু প্রায় প্রত্যেক বিজ্ঞানী এর বিপরীতটা চিন্তা করেন। এটি আমার জীবনের অভিশাপ যে দীর্ঘ সময় ধরে আমি বৈজ্ঞানিক হালচালে ছিলাম না, পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে কথা বলার মতো কাউকে আমি পাইনি।”

আইনস্টাইন এও বিশ্বাস করতেন যে, পদার্থবিজ্ঞান পড়িয়ে টাকা কামানোর মধ্যে অসাধুতা আছে। তিনি যুক্তি সহকারে বলেছেন, অন্য কোনো সাধারণ ও সৎ শ্রমের মাধ্যমে নিজের ভরণপোষণ করা এবং অবসর সময়ে পদার্থবিজ্ঞান চর্চা করা একজন পদার্থবিজ্ঞানীর জন্য ঢের ভালো। অনেক বছর পরে আমেরিকায় একই কথা বলার সময় আইনস্টাইন আনমনা হয়ে বলেছিলেন, তিনি প্লাম্বার হতে পছন্দ করতেন এবং অনতিবিলম্বে প্লাম্বার ইউনিয়নের সাম্মানিক সদস্যের পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন।

সুইস পেটেন্ট অফিসে তাঁর অবসর সময়ের কাজের ফসল হিসেবে আইনস্টাইন ১৯০৫ সালে জার্মানির নেতৃস্থানীয় পদার্থবিজ্ঞান সাময়িকী Annalen der Physik এ চারটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। প্রথমটিতে প্রমাণ করা হয়েছে যে আলোর কণার পাশাপাশি তরঙ্গ ধর্ম আছে, এবং আগেকার বিভ্রান্তিকর আলোক-তড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যা করা হয়েছে যেখানে কঠিন পদার্থ আলো দ্বারা উদ্ভাসিত হলে তা থেকে ইলেকট্রন নিঃসৃত হয়। দ্বিতীয়টিতে বাধাপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রাকৃতি কণার সাংখ্যিক “ব্রাউনীয় গতি” ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে অণুর প্রকৃতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তৃতীয় ও চতুর্থটিতে বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব উপস্থাপন করা হয়েছে এবং প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়েছিলো বিখ্যাত E=mc2 সমীকরণ যা খুব সচরাচর উদ্ধৃত হয় ও খুব কমই উপলব্ধ হয়।

এই সমীকরণ প্রকাশ করে যে পদার্থকে শক্তিতে ও বিপরীতভাবে শক্তিকে পদার্থে রূপান্তরিত করা যায়। শক্তি ও ভরকে কখনো সৃষ্টি ও ধ্বংস করা যায় না— যদিও শক্তি অথবা পদার্থের এক রূপকে অন্য রূপে রূপান্তরিত করা যায়, যাকে বিবৃত করার মাধ্যমে এটি শক্তির সংরক্ষণশীলতা নীতিকে শক্তি ও ভরের সংরক্ষণশীলতা নীতিতে বিস্তৃত করা যায়। এই সমীকরণে শক্তি E হলো ভর m এর সমানুপাতিক। আদর্শ পরিস্থিতিতে ভর m থেকে mc পরিমাণ শক্তি নিষ্কাশিত করা যায়, যেখানে c হলো আলোর বেগ যা প্রতি সেকেন্ডে ৩০ বিলিয়ন সেন্টিমিটার। আলোর বেগকে কখনো বড় হাতের অক্ষর দিয়ে প্রকাশ না করে ছোট হাতের c দিয়ে প্রকাশ করা হয়। m-কে গ্রাম ও c-কে সেন্টিমিটার/সেকেন্ড দ্বারা পরিমাপ করা হলে E-কে শক্তির একক erg দ্বারা পরিমাপ করা হয়ে থাকে। এক গ্রাম ভরকে সম্পূর্ণরূপে erg-তে রূপান্তর করলে দাঁড়ায় 1 x (3 x 1010)2 = 9 x 1020 ergs যা মোটামুটিভাবে এক হাজার টন টিএনটি (TNT)-র বিস্ফোরণের সমতুল্য। এভাবে অতি ক্ষুদ্র পরিমাণ পদার্থে বিপুল শক্তি মজুদ থাকে, যদি শক্তি নিষ্কাশন করার উপায় আমাদের জানা থাকে। পারমাণবিক অস্ত্র ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র হচ্ছে আইনস্টাইনের দেখানো শক্তিকে নিষ্কাশিত করার উদ্দেশ্যে আমাদের দ্বিধাগ্রস্ত ও নীতিগতভাবে সন্দিগ্ধ প্রচেষ্টার সাধারণ পার্থিব দৃষ্টান্ত। একটি তাপ-পারমাণবিক অস্ত্র তথা একটি হাইড্রোজেন বোমা, m ভরের হাইড্রোজেন থেকে এক শতাংশেরও কম mc2 নিষ্কাশন করতে সক্ষম।

১৯০৫ সালে প্রকাশিত আইনস্টাইনের চারটি গবেষণাপত্র একজন পদার্থবিজ্ঞানীর সারা জীবনের পুরো গবেষণাকর্মের চিত্তাকর্ষক ফসল। ২৬ বছর বয়সের একজন সুইস পেটেন্ট কেরানির এক বছরব্যাপী অতিরিক্ত সময়ের কাজ হিসেবে এটি সত্যি বিস্ময়কর। বিজ্ঞানের অনেক ইতিহাসবিদ ১৯০৫ সালকে annus mirabilis বা অলৌকিক বছর হিসেবে অভিহিত করেছেন। পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে এর আগে কেবল এমন আরেকটি বছর ছিলো: ১৬৬৬ সাল যখন ২৪ বছর বয়সী আইজ্যাক নিউটন বাধ্য হয়ে গ্রামে অন্তরীণ (বুবোনিক প্লেগের প্রাদুর্ভাবের কারণে) থেকে সূর্যালোকের বর্ণালীগত (spectral) প্রকৃতির ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছিলেন, ডিফারেন্সিয়াল ও ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস আবিষ্কার করেছিলেন এবং মাধ্যাকর্ষণের সর্বজনীন তত্ত্ব উদ্ভাবন করেছিলেন। ১৯১৫ সালে প্রথমবারের মতো সূত্রবদ্ধ হওয়া সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব এবং ১৯০৫ সালের গবেষণাপত্রগুলো আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক জীবনের প্রধান কাজকে চিত্রিত করে। আইনস্টাইনের আগে পদার্থবিজ্ঞানীরা সাধারণত বিশেষ সুবিধাজনক প্রসঙ্গ কাঠামো (frames of reference), যেমন পরম স্থান ও পরম কালের উপস্থিতিকে ধরে নিতেন। আইনস্টাইনের শুরুটা ছিলো যে, সকল প্রসঙ্গ কাঠামো—স্থান, গতি ও ত্বরণ নির্বিশেষে সকল পর্যবেক্ষক—একই ভাবে প্রকৃতির মৌলিক নীতিগুলো মেনে চলবে। প্রসঙ্গ কাঠামো নিয়ে আইনস্টাইনের দৃষ্টিভঙ্গি সম্ভবত ১৯ শতকের শেষ দিকে জার্মানিতে সোচ্চার জাতীয়তাবাদ ও উগ্র দেশপ্রেমের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান এবং তাঁর সামাজিক ও রাজনৈতিক মনোভাব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে বলে মনে হয়। আপেক্ষিকতাবাদ সেই অর্থে বহুল ব্যবহৃত নৃ-তাত্ত্বিক পরিভাষায় পরিণত হয়েছে এবং সমাজবিজ্ঞানীরা সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদের ধারণাকে গ্রহণ করেছেন: বিভিন্ন মানব সমাজ দ্বারা প্রকাশিত বিবিধ সামাজিক প্রেক্ষাপট ও বিশ্ববীক্ষা, নৈতিক ও ধর্মীয় অনুশাসন বিদ্যমান আছে এবং এগুলোর তুলনীয় ন্যায্যতা আছে।

প্রথম দিকে বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বকে প্রশ্নাতীতভাবে সাধারণত স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। আইনস্টাইন তাঁর কাজের প্রমাণ হিসেবে ইতিপূর্বে প্রকাশিত আপেক্ষিকতাবাদের গবেষণাপত্রটি সুইজারল্যান্ডের বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা দিয়ে আরো একবার শিক্ষাজীবনে প্রবেশ করার চেষ্টা চালান। তিনি একে স্পষ্টভাবে একটি সার্থক গবেষণা হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। একে দুর্বোধ্য বলে অগ্রাহ্য করা হয় এবং আইনস্টাইন ১৯০৯ সাল পর্যন্ত পেটেন্ট অফিসে কর্মরত থাকেন। কিন্তু তাঁর প্রকাশিত কাজগুলো আর অগোচরে থাকেনি। আইনস্টাইন সর্বকালের অন্যতম সেরা পদার্থবিজ্ঞানী হতে পারেন এমন সম্ভাবনার কথা কয়েকজন ইউরোপীয় পদার্থবিজ্ঞানী ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে শুরু করেছিলেন। এরপরও আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে তাঁর কাজ বিতর্কিত ছিলো। একজন নেতৃস্থানীয় জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী একটি চিঠিতে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পদে আইনস্টাইনের জন্য সুপারিশ করতে গিয়ে তাঁকে সত্যিকারের একজন উৎকৃষ্ট চিন্তাবিদ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন, যদিও তিনি আপেক্ষিকতাবাদকে একটি প্রকল্পিত প্রমোদ ও ক্ষণিকের বিকার হিসেবে ইঙ্গিত করেছিলেন। (১৯২১ সালে প্রাচ্য ভ্রমণের সময় আইনস্টাইন আলোক-তড়িৎ ক্রিয়ার ওপর লিখিত গবেষণাপত্র ও তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে অন্যান্য অবদানের জন্য তাঁর নোবেল প্রাপ্তির সংবাদ জানতে পারেন। তখনও আপেক্ষিকতাবাদকে এত বিতর্কিত মনে করা হতো যে একে বিশদভাবে উল্লেখ করা হতো না।)

ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে আইনস্টাইনের দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। তাঁর বাবা-মা জাতিতে ইহুদী হলেও ধর্মীয় রীতিনীতি পালন করতেন না। “ঐতিহ্যগত শিক্ষাযন্ত্র, রাষ্ট্র ও স্কুলের মাধ্যমে” আইনস্টাইন প্রথমে গতানুগতিক ধার্মিকতার সংস্পর্শে এসেছিলেন। তবে ১২ বছর বয়সে এর আকস্মিক সমাপ্তি  ঘটেছিলো:
“জনপ্রিয় বিজ্ঞানভিত্তিক বইগুলো পড়ে আমি অচিরেই বুঝতে পারলাম যে বাইবেলের অনেক গল্প  সত্য হতে পারে না। মিথ্যার মাধ্যমে রাষ্ট্র কর্তৃক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে যুবকদেরকে প্রতারিত করার প্রভাবের পাশাপাশি নির্দিষ্টরূপে উগ্র যুক্তিবাদ ছিলো এর পরিণাম; এটি ছিলো এক হৃদয়বিদারক অনুভূতি। এই অভিজ্ঞতা থেকে সব ধরনের কর্তৃত্বের প্রতি সন্দেহ, যেকোনো সামাজিক পরিবেশে ক্রিয়াশীল বিশ্বাসের প্রতি এক ধরনের সংশয়ী মনোভাব গড়ে ওঠেছিলো—এই মনোভাব আর কখনো আমি ত্যাগ করিনি, যদিও পরে কার্যকারণ সংযোগের প্রতি আরো ভালো সূক্ষ্ম দৃষ্টির দরুন এর কিছু আসল তীব্রতা নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো।”

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হবার ঠিক পূর্বে আইনস্টাইন বার্লিনস্থ সুবিখ্যাত কাইজার উইলহেলম ইনস্টিটিউটে প্রফেসরশিপের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। জার্মান সামরিকতন্ত্রের প্রতি বিরাগের তুলনায় তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের নেতৃস্থানীয় কেন্দ্রস্থলে থাকার অভিপ্রায় অল্প সময়ের জন্য আইনস্টাইনের মধ্যে প্রবলতর ছিলো। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামায় আইনস্টাইনের স্ত্রী ও দুই পুত্র সুইজারল্যান্ডে আটকা পড়ে যান, তাঁরা জার্মানিতে ফিরতে পারেননি। এই বাধ্যতামূলক বিচ্ছেদ কয়েক বছর পর তাদেরকে বিবাহ বিচ্ছেদের দিকে নিয়ে যায়; পুনরায় বিয়ে করার পরও আইনস্টাইন ১৯২১ সালে প্রাপ্ত নোবেল পুরস্কারের পুরো ৫০,০০০ মার্কিন ডলার তাঁর প্রথম স্ত্রী ও সন্তানদের দান করেন। তাঁর প্রথম পুত্র পরবর্তীতে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়ে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন; দ্বিতীয় পুত্র আইনস্টাইনকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন কিন্তু ছোটকালে ত্যাগ করার কারণে পরবর্তী বছরগুলোতে তাঁকে দোষারোপ করে নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছেন।

নিজেকে সমাজতন্ত্রী বলে পরিচয় প্রদানকারী আইনস্টাইন বুঝতে পারেন যে “শাসকশ্রেণী”র কুচক্রীপনা ও অযোগ্যতাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য বহুলাংশে দায়ী। অনেক সমকালীন ইতিহাসবিদ এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত পোষণ করে থাকেন। অন্য জার্মান বিজ্ঞানীরা যখন তাদের দেশের সামরিক অভিযানকে সল্লোসে সমর্থন করেছিলেন তখন আইনস্টাইন শান্তিবাদের পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। আইনস্টাইন যুদ্ধকে “একটি মহামারী মোহ” হিসেবে অভিহিত করে প্রকাশ্যে এর নিন্দা করেন। শুধুমাত্র সুইস নাগরিকত্ব থাকার কারণে তিনি কারাবরণ থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন, কিন্তু একই সময়ে ও একই কারণে তাঁর বন্ধু দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলকে ইংল্যান্ডে কারাবরণ করতে হয়েছিলো। যুদ্ধ সম্পর্কে আইনস্টাইনের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে জার্মানিতে তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়নি।

যা-ই হোক, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরোক্ষভাবে আইনস্টাইনের নামকে অধিক পরিচিত করে তুলতে ভূমিকা রাখে। সারল্য, সৌন্দর্য ও শক্তিতে বিস্ময়জাগানিয়া সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদে আইনস্টাইন এই প্রস্তাবের (proposition) বিশ্লেষণ করেছেন যে, দুটি ভরের নিকটবর্তী সাধারণ ইউক্লিডীয় স্থানের বিকৃতি সাধন ও বক্রীকরণের মাধ্যমে তাদের মধ্যে মহাকর্ষজনিত আকর্ষণ ঘটে থাকে। যে সঠিকতার মাধ্যমে এই পরিমাণগত তত্ত্বটি পরীক্ষা করা হয়েছিলো, তার মাধ্যমে এটি নিউটনের সর্বজনীন মহাকর্ষ সূত্রকে পুনর্গঠন করেছিলো। কিন্তু পরবর্তী দশমিক স্থানে, নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ নিউটনের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য অনুমান করেছিলো। বিজ্ঞানের ধ্রুপদী ঐতিহ্যে নতুন তত্ত্বগুলো পুরাতনগুলোর দ্বারা প্রমাণিত ফলাফলকে বজায় রাখে কিন্তু এক গুচ্ছ নতুন ভবিষ্যদ্বাণী করার মাধ্যমে দুটো দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটি নিষ্পত্তিমূলক পার্থক্য নির্দেশ করে। আইনস্টাইনের প্রস্তাবিত সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তিনটি পরীক্ষায় জড়িত ছিলো বুধ গ্রহের কক্ষপথের ঘূর্ণনে পূর্বের অনুসূর হতে গ্রহটির কৌণিক দূরত্ব, একটি বিশাল নক্ষত্রের বর্ণালী রেখার লোহিত অপসারণ (red shift), এবং সূর্যের নিকটবর্তী স্থানে নক্ষত্রের আলোর বেঁকে গিয়ে ভিন্ন পথে গমন। ১৯১৮ সালে যুদ্ধবিরতি স্বাক্ষরিত হবার আগে ব্রাজিলে ও পশ্চিম আফ্রিকা থেকে প্রিন্সিপ দ্বীপে পূর্ণ গ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী নক্ষত্রের আলো ভিন্ন পথে সরে যায় কিনা তা পর্যবেক্ষণ করার জন্য একটি ব্রিটিশ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিলো। নক্ষত্রের আলো ভিন্ন পথে সরে গিয়েছিলো; আইনস্টাইনের দৃষ্টিভঙ্গি সত্য প্রমাণিত হয়েছিলো। দুটি দেশ যখন অদ্যাবধি যুদ্ধরত অবস্থায় ছিলো তখন একজন জার্মান বিজ্ঞানীর কাজের সত্যতা প্রমাণের জন্য ব্রিটিশ অভিযানের প্রতীকতা জনসাধারণের শ্রেয়তর প্রবৃত্তিকে নাড়া দিয়েছিলো।

তবে একই সময়ে আইনস্টাইনের বিরুদ্ধে জার্মানিতে প্রচুর অর্থায়নে একটি গণ-প্রচারাভিযান শুরু হয়। আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বকে বর্জন করার জন্য বার্লিন ও অন্যান্য স্থানে ইহুদী-বিরোধী গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। আইনস্টাইনের সহকর্মীরা এতে অবাক হন, কিন্তু তাদের অধিকাংশই রাজনীতিতে এত ভীরু ছিলেন যে এই প্রচারাভিযানের বিরোধিতা করার সাহস তাদের ছিলো না। ১৯২০ এর দশকে ও ১৯৩০ এর দশকের শুরুতে নাৎসীদের উত্থানের সময় আইনস্টাইন গভীর চিন্তার প্রতি তাঁর স্বভাবগত ঝোঁক থেকে বের হয়ে এসে প্রায়ই সাহসিকতার সাথে উচ্চকণ্ঠে আওয়াজ তুলতে শুরু করেন। তিনি জার্মান আদালতে বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের বিষয়ে সাক্ষ্য দেন। জার্মানিতে ও এর বাইরের রাজনৈতিক বন্দীদের (সাক্কো ও ভিজনেত্তি এবং যুক্তরাষ্ট্রে স্কটসবরো “বয়েজ” সহ) ক্ষমা প্রদানের জন্য তিনি আবেদন জানান। ১৯৩৩ সালে হিটলার চ্যান্সেলর হবার পর আইনস্টাইন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীকে সাথে নিয়ে জার্মানি ছেড়ে চলে যান।

নাৎসীরা আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক কাজ ও ফ্যাসিবাদ-বিরোধী লেখকদের অন্যান্য বই জনসমক্ষে আগুন পুড়িয়ে ফেলে। সর্বশক্তি প্রয়োগ করে আইনস্টাইনের বৈজ্ঞানিক কীর্তির ওপর আক্রমণ চালানো হয়। এই আক্রমণের নেতৃত্বে ছিলেন নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ফিলিপ লেনার্ড যিনি তাঁর ভাষায় “আইনস্টাইনের গাণিতিকভাবে তালগোল পাকানো তত্ত্ব” এবং “বিজ্ঞানের এশীয় চেতনা”কে বর্জন করেছেন। তিনি আরো বলেছেন,
“আমাদের ফুয়েরার রাজনীতি ও জাতীয় অর্থনীতিতে এই একই চেতনাকে পরিহার করেছেন যা মার্ক্সবাদ নামে পরিচিত। এরপরও, আইনস্টাইনের ওপর অত্যধিক জোর আরোপ করার কারণে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে এই প্রভাব এখনো বজায় আছে। আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে একজন ইহুদীর বুদ্ধিবৃত্তিক অনুসারী হওয়া একজন জার্মানের জন্য অশোভনীয় ব্যাপার। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান, যথাযথভাবে বললে, সম্পূর্ণরূপে আর্য-উদ্ভূত।… হাইল হিটলার!”

আইনস্টাইনের “ইহুদী” ও “বলশেভিক পদার্থবিজ্ঞান”-এর বিরোধিতায় অনেক নাৎসী স্কলার যোগ দেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রায় একই সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে বিখ্যাত স্টালিনবাদী বুদ্ধিজীবীরা আপেক্ষিকতাবাদকে “বুর্জোয়া পদার্থবিজ্ঞান” হিসেবে অভিহিত করে একে বর্জন করেন।

আইনস্টাইনের নিজের ইহুদী পরিচয়টি, ঐতিহ্যগত ধর্ম থেকে তাঁর অন্তর্নিহিত বিচ্ছিন্নতা সত্ত্বেও, ১৯২০ এর দশকে জার্মানিতে ইহুদী-বিরোধী ডামাডোলের কারণে সামনে চলে আসে। এই কারণে তিনিও জায়নবাদী হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর জীবনীকার ফিলিপ ফ্রাঙ্কের মতে, সকল জায়নবাদী দল আইনস্টাইনকে স্বাগত জানায়নি কারণ তিনি বিজড়িত জটিল আবেগময় বিষয়ের মাধ্যমে সাংস্কৃতিক আপেক্ষিকতাবাদের প্রতি অধিকতর প্রভাব বিস্তারকারী অনুরাগ হিসেবে– আরবদের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে ও তাদের জীবনধারাকে বুঝার জন্য ইহুদীদের প্রচেষ্টার দাবি করেছিলেন। যাই হোক, জায়নবাদের প্রতি তিনি তাঁর সমর্থন অব্যাহত রাখেন, বিশেষ করে ১৯৩০ এর দশকে যখন ইউরোপীয় ইহুদীদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান ক্রোধ গোচরীভূত হতে শুরু করে। (১৯৪৮ সালে আইনস্টাইনকে ইসরায়েলের প্রেসিডেন্ট হবার প্রস্তাব দেয়া হলে তিনি সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন।)

জার্মানি ছাড়ার পর আইনস্টাইন জানতে পারেন যে নাৎসীরা তাঁর মাথার মূল্য ২০,০০০ মার্ক নির্ধারণ করেছে। (“এর দাম যে এত বেশি তা আমার জানা ছিলো না।”) তিনি নিউ জার্সির প্রিন্সটনে সদ্য প্রতিষ্ঠিত ইনস্টিটিউট ফর এডভান্সড স্টাডিতে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করেন যেখানে তিনি তাঁর বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। কাঙ্ক্ষিত পারিশ্রমিকের পরিমাণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি ৩,০০০ মার্কিন ডলারের প্রস্তাব দেন। ইনস্টিটিউটের প্রতিনিধির মুখে বিস্ময়ের ছাপ দেখে তিনি ভেবেছিলেন যে বেশি চেয়ে ফেলেছেন এবং অপেক্ষাকৃত কম টাকার কথা বলেছিলেন। তাঁর পারিশ্রমিক ঠিক হয়েছিলো ১৬,০০০ মার্কিন ডলার, ১৯৩০ এর দশকে যা ছিলো অনেক টাকা।

আইনস্টাইনের মর্যাদা এত ঊর্ধ্বগামী ছিলো যে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনে সম্ভাব্য জার্মান প্রচেষ্টাকে পেছনে ফেলার জন্য একটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার প্রস্তাব দিয়ে প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্টের কাছে চিঠি লেখার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে অন্যান্য দেশান্তরিত ইউরোপীয় পদার্থবিজ্ঞানীরা ১৯৩৯ সালে তাঁর দ্বারস্থ হন। যদিও আইনস্টাইন পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানে কাজ করছিলেন না এবং পরবর্তীতে ম্যানহাটন প্রজেক্টে তাঁর কোনো ভূমিকা ছিলো না, তবুও তিনি প্রারম্ভিক চিঠিটি লিখেছিলেন যা ম্যানহাটন প্রজেক্ট স্থাপনে পথ দেখিয়েছিলো। সম্ভবত, আর যাই হোক, আইনস্টাইনের আহ্বান ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র বোমা তৈরি করে ফেলতো। E=mc2 থাকা সত্ত্বেও বেকেরেল কর্তৃক তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার ও রাদারফোর্ড কর্তৃক পারমাণবিক নিউক্লিয়াসের অনুসন্ধান— এগুলোর কোনোটিই আইনস্টাইনের মুখাপেক্ষী নয়— খুব  সম্ভবতঃ পারমাণবিক অস্ত্র বিকশিত করার পথ বাতলে দিতে পারতো। বহু দিন ধরে আইনস্টাইন নাৎসী জার্মানির যে আতঙ্ক প্রত্যক্ষ করেন, সেই কারণে তিনি দুঃখের সাথে তাঁর শান্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করতে বাধ্য হন। কিন্তু পরে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে নাৎসীদের অসমর্থ হবার কথা জানতে পেরে আইনস্টাইন আক্ষেপের সুরে বলেছেন, “আমি যদি জানতাম জার্মানরা পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে সফল হবে না তাহলে বোমা নিয়ে কিছুই করতাম না।” ১৯৪০ এর দশকের শেষ দিকে ও ১৯৫০ এর দশকের প্রথম দিকে ম্যাককার্থিজমের অন্ধকার সময়ে আইনস্টাইন যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিক স্বাধীনতার একজন জোরালো সমর্থক ছিলেন। হিস্টেরিয়ার উত্থিত জোয়ার প্রত্যক্ষ করার পর ১৯৩০ সালে জার্মানিতে একই রকম পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করার অনুভূতি তাঁর মনে জেগে উঠেছিলো। তিনি হাউজের আন-আমেরিকান এক্টিভিটিজ কমিটিতে সাক্ষ্য না দেওয়ার জন্য সমর্থকদের আহ্বান জানিয়ে বলেন, প্রত্যেক নাগরিকের “কারাগার ও আর্থিক ক্ষতির জন্য…তাঁর দেশের স্বার্থে…তাঁর ব্যক্তিগত উন্নয়ন বিসর্জন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকা উচিত।” তিনি মনে করতেন যে “ব্যক্তিবিশেষের সাংবিধানিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করে এমন উদ্যোগে সহযোগিতা না করা একটি কর্তব্য। এটি বিশেষত নাগরিকদের ব্যক্তিগত জীবন ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার সাথে জড়িত সকল তদন্তের ক্ষেত্রে খাটে…” এই অবস্থান নেওয়ার কারণে আইনস্টাইনকে পত্রিকায় ব্যাপক আক্রমণের শিকার হতে হয়েছিলো। আর ১৯৫৩ সালে সিনেটর জোসেফ ম্যাককার্থি এমন উপদেশ প্রদানকারী ব্যক্তিকে “স্বয়ং আমেরিকার শত্রু” অ্যাখ্যায়িত করে বিবৃতি দেন। প্রিন্সটনে অতিবাহিত বছরগুলোতে সবসময়ের মতো মননশীল জীবন নিয়ে আইনস্টাইনের গভীর আসক্তি ছিলো। মহাকর্ষ, বিদ্যুৎ ও চৌম্বকত্বকে একটি সাধারণ ভিত্তির ওপর সংযুক্ত করবে এমন একটি সম্মিলিত ক্ষেত্র তত্ত্বের ওপর তিনি দীর্ঘ সময় ধরে প্রচুর কাজ করেন; তবে এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে বলে সচরাচর বিবেচনা করা হয়। তিনি তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বকে সংঘবদ্ধভাবে বড় মাপের কাঠামো ও মহাবিশ্বের বিবর্তনকে বুঝার জন্য প্রধান হাতিয়ার হিসেবে দেখে গিয়েছেন, এবং আজকের দিনে জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের সবল প্রয়োগ দেখতে পেলে আনন্দিত হতেন। তাঁকে যে পরিমাণ শ্রদ্ধার সাথে অধিষ্ঠিত করা হতো তা কখনো তিনি বুঝে উঠতে পারেননি এবং আদপেই অনুযোগ করেছিলেন যে তাঁর সহকর্মীরা ও প্রিন্সটনের গ্র্যাজুয়েট ছাত্ররা তাঁকে বিরক্ত করার ভয়ে আগে থেকে না জানিয়ে তাঁর সাথে দেখা করতে আসতো না।

তবে তিনি লিখেছেন:
“নারী ও পুরুষের সাথে সরাসরি সম্বন্ধের প্রতি আমার ইচ্ছার ঘাটতি চোখে পড়ার মতো হলেও সামাজিক ন্যায়বিচার ও সামাজিক দায়িত্ব নিয়ে আমার আবেগপূর্ণ আগ্রহ রয়েছে। আমি একমাত্র সাজ পরিহিত কোনো ঘোড়া নই যাকে ঘোড়ার গাড়ি ও দলগত কাজের জন্য আলাদা করা হয়েছে। আমি কখনো মনেপ্রাণে দেশ বা রাষ্ট্র, আমার বন্ধু মহল এবং এমনকি আমার নিজ পরিবারের অংশ ছিলাম না। এই সকল বন্ধন সবসময় এক ধরনের অস্পষ্ট নিঃসঙ্গতার সংসর্গে আছে, আর নিজের মধ্যে ডুবে থাকার বাসনা দিনকে দিন আরো বেড়েছে। এমন নিঃসঙ্গতা অনেক সময় বেদনাদায়ক মনে হয়, কিন্তু অন্য মানুষের সহানুভূতি ও বোঝাপড়া থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য আমি আফসোস করি না। এর মাধ্যমে নিশ্চিতভাবে আমি অনেক কিছু খুঁইয়ে ফেলি, কিন্তু অন্যদের প্রথা, মতামত ও কুসংস্কার থেকে স্বতন্ত্র প্রতিপন্ন করার মাধ্যমে আমি নিজের ক্ষতি পুষিয়ে নিই এবং এমন পরিবর্তনশীল ভিত্তির উপর আমার মনের শান্তিকে স্থাপন করার জন্য প্রলুব্ধ হই না।”

সারা জীবন জুড়ে তাঁর প্রধান অবসরকালীন বিনোদন ছিলো বেহালা বাজানো ও নৌকায় ভ্রমণ করা। এই বছরগুলোতে আইনস্টাইনকে ক্ষেত্রবিশেষে কিছুটা বুড়ো হিপ্পির মতো দেখাতো। তিনি তাঁর সাদা চুলগুলোকে বেড়ে উঠতে দিয়েছিলেন, আর গণ্যমান্য সাক্ষাতপ্রার্থীদের আতিথ্য প্রদর্শনের সময়ও স্যুট ও টাইয়ের পরিবর্তে সোয়েটার ও লেদার জ্যাকেট পড়তে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। পুরোদস্তুরভাবে কোনো রকম ভণ্ডামি ও ভণিতা ছাড়া তিনি কৈফিয়ত দিয়েছেন, “আমি সবার সাথে একই ভাবে কথা বলি, হোক সে ব্যক্তি কোনো ময়লাওয়ালা কিংবা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট।” জনসাধারণের কাছে তিনি ছিলেন খোলামেলা, সবসময় সফলতার সাথে না হলেও মাঝেমধ্যে জ্যামিতির সমস্যা নিয়ে হাই স্কুলের ছাত্রদের সাহায্য করার ইচ্ছা পোষণ করতেন।

ধর্মের বিষয়ে আইনস্টাইন অন্য অনেকের চেয়ে বেশি ভেবেছেন এবং বারবার তাঁকে ভুল বুঝা হয়েছে। আমেরিকায় আইনস্টাইনের প্রথম ভ্রমণের সময়ে, বোস্টনের কার্ডিনাল ও’কনেল আপেক্ষিকতাবাদকে “নাস্তিকতার ভয়ানক অপচ্ছায়া” হিসেবে সতর্ক করেন। নিউ ইয়র্কের এক ইহুদী ধর্মগুরু এতে ভীত সতস্ত্র হয়ে আইনস্টাইনকে তারবার্তায় জিজ্ঞাসা করেন, “আপনি কি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন?”  আইনস্টাইন তারবার্তায় উত্তর দেন, “আমি স্পিনোজার ঈশ্বরে বিশ্বাস করি যিনি সকল সত্তার ঐকতানে নিজেকে প্রকাশিত করেন। আমি সেই ঈশ্বরে বিশ্বাস করি না যিনি মানুষের ভাগ্য ও কর্ম নিয়ে ভাবিত”— এই অধিকতর কৌশলী ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান সময়ের ধর্মতাত্ত্বিকরা গ্রহণ করে থাকেন। আইনস্টাইনের ধর্মবিশ্বাস ছিলো সত্যিকার অর্থে খুবই অকৃত্রিম। ১৯২০ ও ১৯৩০ এর দশকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার একটি মৌলিক নীতি নিয়ে তিনি গুরুতর সন্দেহ প্রকাশ করেন: তা হলো পদার্থের সবচেয়ে মৌলিক পর্যায়ে কণাগুলো হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি অনুসারে এক প্রকার অনিশ্চিত আচরণ করে। আইনস্টাইন বলেছেন: “ঈশ্বর মহাবিশ্ব নিয়ে পাশা খেলেন না।” আবার অন্য জায়গায় তিনি বলেছেন, “ঈশ্বর কৌশলী কিন্তু তিনি বিদ্বেষপরায়ণ নন।” প্রসঙ্গত আইনস্টাইন এমন প্রবচনের প্রতি এত অনুরক্ত ছিলেন যে ডেনিশ পদার্থবিজ্ঞানী নীলস বোর একবার তাঁর দিকে ফিরে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, “ঈশ্বর কী করবেন তা নিয়ে কথা বলা বন্ধ করুন।”

কিন্তু অনেক পদার্থবিজ্ঞানী মনে করতেন যে একমাত্র আইনস্টাইন-ই ঈশ্বরের অভিপ্রায় সম্পর্কে জানেন। বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের অন্যতম একটি নীতি হচ্ছে কোনো ভৌত বস্তু আলোর গতিতে এত দ্রুত ভ্রমণ করতে পারে না। আলোর এই প্রতিবন্ধকতা অনেকের মাঝে বিরক্তির উদ্রেক করেছে, যারা মনে করেন যে মানুষের চূড়ান্তভাবে অসাধ্য কিছু নেই। তবে আলোর সীমাবদ্ধতা বিশ্বের অনেক কিছু আমাদের সহজে ও মসৃণভাবে বুঝতে সাহায্য করে যেগুলো আগে রহস্যময় মনে করা হতো। যা-ই হোক, আইনস্টাইন যেখান থেকে নিয়েছেন সেখানে কিছু দিয়েছেনও বটে। বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের কতিপয় ফলাফলকে দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার বিপরীতে স্বজ্ঞাবিরুদ্ধ (counterintuitive) মনে হয় কিন্তু কাণ্ডজ্ঞান দিয়ে তা খুব সামান্যই উপলব্ধি করা যায়, আলোর কাছাকাছি গতিতে ভ্রমণ করা গেলে এগুলো শনাক্তকারী কায়দায় উদ্ভূত হয়। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ফলাফল হচ্ছে আমরা পর্যাপ্তভাবে আলোর গতির যত কাছাকাছি যেতে পারবো ততই আমাদের হাতঘড়ি, আমাদের পারমাণবিক ঘড়ি, আমাদের জৈবিক বার্ধক্য তথা সময় মন্থর হয়ে আসবে। পরিণামস্বরূপ আলোর গতির খুব কাছাকাছি গতিতে ভ্রমণকারী কোনো মহাকাশযান যেকোনো দুটি স্থানের মাঝে, দূরত্ব যতই হোক, গ্রহ থেকে নয় বরং মহাকাশযান থেকে হিসাব করলে যেকোনো সুবিধাজনক স্বল্প সময়ে ভ্রমণ করতে পারবে। এভাবে আমরা হয়তো কোনো এক সময় মিল্কি ওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে ভ্রমণ করতে পারি এবং মহাকাশযান থেকে হিসাবকৃত সময় অনুসারে কয়েক দশকের মধ্যে ফেরত আসতে পারি। কিন্তু পৃথিবী থেকে হিসাব করলে অতিবাহিত সময় দাঁড়াবে ৬০ হাজার বছর, আর আমাদের বিদায় জানানো বন্ধুদের মধ্যে খুব কমজনই আমাদের প্রত্যাবর্তনের স্মৃতিকে স্মরণ করবে।

আইনস্টাইন শেষ জনহিতকর কাজ হিসেবে বার্ট্রান্ড রাসেল এবং অন্য আরো বিজ্ঞানী ও স্কলারদের সাথে যোগ দিয়ে পারমাণবিক অস্ত্রের বিকাশ ও ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করানোর জন্য বিফল প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। তাঁর মতে, পারমাণবিক অস্ত্র আমাদের চিন্তাপদ্ধতি ব্যতীত আর সবকিছু পরিবর্তন করেছে। শত্রুতাপূর্ণ রাষ্ট্রে বিভক্ত এই পৃথিবীতে পারমাণবিক অস্ত্রকে তিনি মানবজাতির টিকে থাকার পক্ষে সবচেয়ে ভয়াবহ বিপদ হিসেবে দেখেছেন। “আমাদের বেছে নিতে হবে”, তিনি বলেছেন, “পারমাণবিক হাতিয়ার বর্জন অথবা সর্বজনীন ধ্বংস।… জাতীয়তাবাদ একটি শিশুসুলভ ব্যাধি।… এটি মানবজাতির জন্য ছোঁয়াচে রোগস্বরূপ। আমাদের স্কুলের বইগুলো যুদ্ধকে মহিমান্বিত করে এর ভয়াবহতাকে আড়াল করে রাখে। এগুলো শিশুদের শিরায় শিরায় ঘৃণার আবেশ ছড়ায়। আমি যুদ্ধের চেয়ে বরং শান্তির শিক্ষা দেবো। আমি ঘৃণার চেয়ে বরং ভালোবাসার শিক্ষা দেবো।”

১৯৫৫ সালে মারা যাবার নয় বছর আগে, ৬৭ বছর বয়সে আইনস্টাইন তাঁর সমগ্র জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্য সম্বন্ধে বলেছেন, “এই বিশাল বিশ্ব আমাদের মনুষ্য প্রজাতি থেকে স্বাধীনভাবে, অন্ততপক্ষে আংশিকভাবে, আমাদের পরিদর্শন ও চিন্তাশক্তির সাহায্যে উপলব্ধি করার ক্ষমতা প্রদানের মাধ্যমে আমাদের সামনে এক বৃহৎ, শাশ্বত প্রহেলিকা হয়ে দৃশ্যমানতার ঊর্ধ্বে তার অস্তিত্ব নিয়ে বিরাজমান ছিলো। এই বিশ্বকে নিয়ে গভীর ধ্যান এক রকমের মুক্তির হাতছানি দিয়েছে… এই স্বর্গের পথ ধর্মীয় স্বর্গের মতো আরামদায়ক ও প্রলোভনদায়ক ছিলো না; কিন্তু এটি নিজেকে নির্ভরযোগ্য হিসেবে প্রমাণ করেছে, আর এটি বেছে নেওয়ার কারণে আমি কখনো আফসোস করিনি।”

উৎস ঃ http://onubadokderadda.com/the_other_world_that_beckons/

Sunday, August 20, 2017

প্রেম আসলে কোথায় থাকে ???



আমরা অনেকেই  এভাবে বলতে শুনেছি- "আমি তোমাকে হৃদয় দিয়ে ভালবাসি"।আর ভালবাসার চিহ্ন হিসেবে আমরা হৃদপিণ্ডের তিন কোণাকৃতি একটা চিহ্ন  ♥  ব্যবহার করি।তার মানে আমরা সবাই মনে করি প্রেম থাকে হৃদয় বা হৃদপিণ্ডে।আজ আপনাদের আমি  বলব প্রেম বা ভালবসা আসলে কোথায় থাকে।

dopa

অ্যামেরিকার স্নায়ুবিজ্ঞানি ব্রান্দন এরাজনা দীর্ঘদিন প্রেমাসক্তি নিয়ে গবেষণা চালিয়েছেন।এবং দীর্ঘদিন গবেষণা শেষে তিনি প্রেম সম্পর্কে বেশকিছু অভিনব তথ্য আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন।এরাজনা দেখিয়েছেন , মস্তিষ্কের নিউক্লিয়াস  অ্যাকুবেন্স নামক উপ- করটিকেল(Sub-cortical ) এলাকাটিতে অবস্থিত ডোপামিন নিউরোট্রান্সমিটার দ্বারা পরিচালিত স্নায়ুবিক সার্কিট সক্রিয় হলে প্রেমানুভুতির সৃষ্টি হয়।এই স্নায়ুবিক সার্কিটির নিয়মিত মস্তিষ্কের এই এলাকাটিকে নতুনভাবে বিন্নস্ত করে।এই নতুন বিন্যাস দীর্ঘস্থায়ী প্রেমের সম্পর্কের সাথে জড়িত।মস্তিষ্কের নিউক্লিয়াস  অ্যাকুবেন্স হচ্ছে সেই উপ- করটিকেল(Sub-cortical ) এলাকা যেটি কিনা প্রেষণা জনিত আচরণ ও কোন বিশেষ মানুষের প্রতি আসক্তি তৈরির সাথে জড়িত।আর এই আবিস্কার প্রেমানুভুতির বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে আরও অনেক বেশী ত্বরান্বিত করবে বলে অনেক বিজ্ঞানী মন্তব্য করেছেন।তাহলে বুঝতেই পারছেন আপনি তাকে কি দিয়ে ভালবাসেন?ভাল লাগলে মন্তব্য করতে ভুলবেন না যেন?



উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ...

নীল ডিগ্রাস টাইসনের The Search for Life in the Universe সেমিনার উপভোগেরঅভিজ্ঞতা



জ্যোতির্বিজ্ঞানী (আরো ভালো করে জ্যোতিঃপদার্থবিদ), বিজ্ঞান জনপ্রিয়কারী, সোশ্যাল এডুকেটর নীল টাইসনের পরিচয় নতুন করে দেয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না। নভেম্বরের ১০ তারিখে Neil Degrass Tyson আসবেন লুইজিয়ানার নিউ অরলিয়েন্সে। আমি যেখানে থাকি, সেই ব্যাটন রুজ শহর থেকে গাড়িতে করে যেতে মাত্র সোয়া এক ঘণ্টার মত লাগে। এই সুযোগ তো হেলায় হারানো যায় না। তাই, খবর পেয়ে টিকেট কেটে রেখেছিলাম অক্টোবরেই। নির্দিষ্ট দিনে জায়গামত হাজির হয়ে গেলাম ৬ঃ১০ এর দিকে। সাড়ে ছয়টায় খুলবে সেইংগার থিয়েটারের গেইট, আর প্রোগ্রাম শুরু হবে সাড়ে সাতটায়।

20151110_182149__1447289981_68.105.159.97

গেইটে দাঁড়িয়ে অনেকের সাথে কথা বললাম। সবাই বেশ উত্তেজিত। এদের মধ্যে কেউ কেউ আবার দেড় বছর আগের সেমিনারেও এসেছিলেন, ওটা নাকি ভিন্ন একটা টপিক নিয়ে ছিলো। এবারের টপিক – ব্রহ্মাণ্ডে প্রাণের সন্ধান (In Search of Life in Universe). যাই হোক, সাড়ে ছয়টায় গেইট খোলা হলো। আস্তে আস্তে ২৭০০ দর্শক ধারণক্ষমতাসম্পন্ন গ্যালারি পূর্ণ হয়ে যেতে শুরু করলো। প্রোগ্রাম শুরুর ঠিক আগে আগে আর কোনো সিটই ফাঁকা রইলো না। বেশ সুন্দর একটা থিয়েটার। আশেপাশে বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন ডিজাইন করা ছিলো। আর ওপরে নীল আকাশের মত সিলিং-এ ছোটো ছোটো বাতি মিটমিট করছিলো।

20151110_182149__1447289850_68.105.159.97

৭ঃ৩৫ এর দিকে হুইল চেয়ারে করে এক আমেরিকান ফুটবলার (নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না) এসে সেমিনার উদ্বোধন করলেন। তিনিও স্টিফেন হকিং এর মত মেশিন দিয়ে কথা বলেন। বললেন, তিনি বিজ্ঞানের প্রতি প্রবল আগ্রহী এবং পরম কৃতজ্ঞ; কারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ছাড়া উনি চলতে পারতেন না, কথা বলতে পারতেন না। আরো বললেন, তার প্রিয় ব্যক্তিত্বদের তালিকাতে নীল ডিগ্রাস টাইসন আছেন দুই নম্বরে, বিজ্ঞানের প্রচার নিয়ে তার কাজকর্মের জন্য। আর তালিকার এক নম্বরে আছেন কার্ল সেগান। উল্লেখ্য, কার্ল সেগানের নাম এই দুই-আড়াই ঘণ্টার সেমিনারে এবারই প্রথম উচ্চারণ হলো, তবে এবারই শেষ নয়। বারবার, কিছুক্ষণ পরপরই সেগানের নাম নিয়েছেন নীল টাইসন। সেই গল্প যথাসময়ে আসছে।

অতঃপর টাইসন এলেন, হাততালিতে গমগম করতে লাগলো গোটা গ্যালারি। তাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য ফুটবলার সাহেবকে ধন্যবাদ দিলেন। এবং ওনার উদ্দেশ্যে বললেন, “কার্ল সেগানকে উনি এক নাম্বারে রেখেছেন, কিন্তু তাতে আমার এতোটুকু আপত্তি নেই। সেগানের সাথে একই লিস্টে থাকতে পেরে আমি কৃতজ্ঞ।” এরপরেই কৌতুক করে বললেন, “তবে একটা জিনিস ঠিক – ওনার প্রিয় ব্যক্তিত্বদের তালিকায় জীবিতদের মধ্যে আমিই এক নম্বর।”

প্রথমে তিনি আমাদেরকে একটু বাজিয়ে দেখতে চাইলেন। বললেন, “শুরুতেই আপনাদের প্রত্যাশাটাকে একটু বাগে নিয়ে আসা প্রয়োজন মনে করছি। আমি জানি, এটা একটা স্টেজ, আপনারা দর্শক আর আমি এক ধরনের পারফর্মার। কিন্তু একটা জিনিস পরিষ্কার করে নেয়া দরকার। আমি কিন্তু এখানে দাঁড়িয়ে শুধু কথা বলবো, আর কিছু কিন্তু করবো না। অন্য কোনো ধরনের পারফর্ম্যান্স (নাচ, গান) কিন্তু করবো না। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু বিজ্ঞান নিয়ে কথা বলবো। সবাই আমার বক্তব্যটা বুঝতে পারছেন তো?”

সবাই ব্যাপক হাসি আর হাততালিতে ফেটে পড়লো। মাইক্রোসফটকে ধন্যবাদ দিয়ে তিনি স্লাইড চড়ালেন।

The Search for Life in the Universe


শুরুতেই তিনি আমাদের সৌরজগতের বাইরের গ্রহগুলো নিয়ে কথা বলা শুরু করলেন। ব্রহ্মাণ্ডটা অনেক বিশাল। কতটুকু বিশাল? আমাদের ধারণার চেয়েও বিশাল। আপনি যত বড় কল্পনা করতে পারছেন, অসীম কিন্তু তার চেয়েও বড়। আর এই নিরন্তর ব্রহ্মাণ্ডের দিকে আমরা চোখে মেলেছি কেবল। কেপলার উপগ্রহ এই মুহূর্তে তাকিয়ে আছে প্রায় দেড় লক্ষ নক্ষত্রের দিকে। সৌরজগতের বাইরে এখন পর্যন্ত ৪০০০ জগতকে গ্রহ বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা, ১০০০ এর বেশি জগতকে গ্রহ হিসেবে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হওয়া গেছে। গত দুই বছরেই (২০১৪ আর ২০১৫ সালেই) সবচেয়ে বেশি সংখ্যক গ্রহকে এই তালিকায় যুক্ত করেছে কেপলার। এবং ধারণা করা হচ্ছে, ব্যাপক সংখ্যক গ্রহ শীঘ্রই এই তালিকায় যুক্ত হবে।

এ যাবত যত গ্রহ পাওয়া গেছে, তার মধ্যে Kepler 452b কে পৃথিবীর খুব কাছাকাছি বলে মনে করা হচ্ছে। পৃথিবীর সাথে এর এতোটাই মিল যে একে Earth 2.0 বলা হচ্ছে। অবশ্য এই নামটা নীল টাইসনের পছন্দ হয়নি বলে জানালেন। কারণ, শুনতে মনে হচ্ছে, এটা পৃথিবীর পরের সংস্করণ, আরো উন্নত সংস্করণ। এটাতে নাকি পৃথিবীকে খাটো করে দেখা হচ্ছে। আর আমরা শুধু দূর থেকে দেখেছি, এখনো অনেক কিছু জানা বাকি, যে কাজটা কেপলার করার চেষ্টা করছে প্রতিনিয়ত।

এরপরেই তিনি সবাইকে মিডিয়া কিভাবে এসব সংবাদকে প্রচার করে, সে ব্যাপারে সাবধান করলেন। উদাহরণের জন্য তিনি কয়েকদিন আগের একটা রিসার্চ পেপারের সারাংশ পুরোটা পড়ে শোনালেন, একদম প্রত্যেকটা শব্দ। মূল কথাটা হলো, একটা নক্ষত্রের আলোর মধ্যে কিছুটা অনিয়মিতভাবেই বেশ অনেকটা পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। এবং বিজ্ঞানীরা এর কারণ হিসেবে ধারণা করছেন ঐ নক্ষত্রের সৌরজগতের বাইরের কিছু ধূমকেতুর অংশের জন্য এমন হয়ে থাকতে পারে (এটাও সারাংশে আছে)। আর সেই প্রবন্ধটিকে কেন্দ্র করে সব জায়গাতে, এমনকি অনেক জনপ্রিয় বিজ্ঞান ব্লগেও, সংবাদগুলোর শিরোনাম প্রচার করা হলো এভাবে – কেপলার কি এলিয়েন মেগাস্ট্রাকচার খুঁজে পেয়েছে? তিনি বললেন, আমরা প্রাণের সন্ধান করে যাবো, তবে এই চর্চাতে আরো সতর্কতার প্রয়োজন আছে।

মানুষ যে কত সহজে ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারে! যেমন, UFO (Unidentified Flying Object বা অসনাক্তকৃত উড়ন্ত বস্তু) এর সাথে তাৎক্ষণিকভাবেই ভিনগ্রহবাসীদেরকে যুক্ত করে ফেলে। আরে বাপ, আপনারা নিজেরাই তো বলছেন Unidentified, তার মানে আপনি জানেন না এটা কী! তাহলে একদম পরের লাইনেই এটাকে এলিয়েনদের মহাকাশযান হিসেবে সনাক্ত করে ফেললেন কী করে? এক লাইনের মধ্যেই “সম্পূর্ণ অনিশ্চিত” থেকে “সম্পূর্ণ নিশ্চিত” ক্যামনে হলেন? এরকম ভুল তো আমরা আগেও করেছি। পিরামিড কী করে বানানো হয়েছে, কোনো ধারণাই নেই। তার মানে, নির্ঘাৎ এলিয়েন। আরে ভাই, এইমাত্র না বললেন, “কোনো ধারণাই নেই”?

ধর্মগুলোর ব্যাপারেও এমনটাই হয়েছে। এবং ইতিহাসের অনেক মেধাবী ব্যক্তিও এই ভুল করে গেছেন। নিউটন জানতেন, মহাকর্ষের কারণেই গ্রহগুলো সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। কিন্তু স্পর্শ না করেও সূর্য কিভাবে গ্রহগুলোকে ঘোরাচ্ছে, সে ব্যাপারে নিউটনের কোনো ধারণা ছিলো না। তখন তিনি লিখেছিলেন, “হয়তো ঈশ্বর এখানে হস্তক্ষেপ করেছেন।” পরে মাইকেল ফ্যারাডে এসে প্রমাণ করলেন, সূর্য নিজে স্পর্শ করে না ঠিকই, কিন্তু তার চারপাশে যে মহাকর্ষ ক্ষেত্র আছে, সেটা ঠিকই পৃথিবীর মহাকর্ষ ক্ষেত্রকে স্পর্শ করে, এবং এভাবেই সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ঘোরে।

আমাদের সৌরজগত


প্লুটো


এরপর তিনি আমাদের সৌরজগতের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন। একটা স্লাইডে শুধু একটা কথা লেখা ছিলো, PLUTO. পরের স্লাইডে লেখা NO. Get Over it. এখনো যারা মনে করে, প্লুটো আমাদের সৌরজগতের একটি গ্রহ, শুরুতেই তাদের জন্য এটা খোলাসা করে দিলেন তিনি যে “না, প্লুটো এখন আর গ্রহ নয়। মাফ করেন।” অতঃপর, চলুন মুখ ফেরাই মঙ্গলের দিকে।

মঙ্গল


স্ক্রিনে মঙ্গলের ভূ-পৃষ্ঠের একটা ছবি ভেসে এলো, যেটা ওখানেই থাকা একটা রোভার (ভ্রমণকারী যন্ত্র) তুলেছে। ছবিটা আসার পর তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন, দর্শক কিছু বলছে না দেখে তিনি বললেন, “আরে, কী আশ্চর্য! কারো মধ্যে দেখি কোনো উত্তেজনা নেই! এটা ভিন্ন একটা গ্রহের ছবি! পৃথিবীতে বসানো কোনো স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিও না, ওখানেই ঘোরাফেরা করছে এমন একটা রোভারের তোলা ছবি! এসব কি চাট্টিখানি কথা নাকি? দাঁড়ান, আরেকবার ট্রাই করি।” বলে আগের স্লাইডে গিয়ে আবার মঙ্গলের ছবিতে এলেন। দর্শকদের মধ্যে কেউ কেউ হাসতে লাগলো। আর অনেকেই বিস্ময়সূচক “ওওওওওও” করে উঠলো। নীল টাইসনও হেসে ফেললেন, “এইবার হয়েছে। হা হা হা”।

মঙ্গলে প্রাণ আছে কিনা, সেই গবেষণা শুরু হয়েছে পার্সিভেল লাওয়েলের সময় থেকে। তার কাছে ঐ সময়কার সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ ছিলো। তিনি মঙ্গলের গায়ে কিছু খাঁজ দেখেছিলেন। একই সময় ইতালিতে আরেকজন সেই খাঁজগুলোকে বলেছিলেন “ক্যানালি”, কারণ ইতালিয়ান ভাষায় প্রণালী বা চ্যানেলকে বলা হয় ক্যানালি। সেই “চ্যানেল” আমেরিকাতে এসে লাওয়েলের দেয়া জ্বালানিতে হয়ে গেলো ক্যানেল বা খাল। এখন, খাল জিনিসটার সাথে বুদ্ধিমান প্রাণীর যোগসূত্র আছে। ঐ সময়েই মোটামুটি অনেকেই জানতো, মঙ্গলের দুই মেরুতে বরফ আছে, অর্থাৎ আটকে পড়া পানি আছে। লাওয়েল সিদ্ধান্ত নিলেন, নিশ্চয়ই সেখান থেকে বিষুব অঞ্চলে পানি আহরণের জন্য কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী এই খাল বানিয়েছে। তাকে চ্যালেঞ্জ করার মত তেমন কেউ ছিলো না। কে চ্যালেঞ্জ করবে? সবচেয়ে শক্তিশালী টেলিস্কোপ তো তার কাছে। আর গল্প যে কিভাবে চেঞ্জ হয়, এটা তো ৭ বছরের বাচ্চাদেরকে ক্লাসরুমে শেখানো হয়। এই জায়গায় এসে টাইসন দর্শকদের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, “এখানে আছে নাকি এমন কেউ, যার বয়স ৭/৮ বছর?”

সামনের সারিতে একটা বাচ্চা ছেলে হাত তুললো। উনি বললেন, “তুমি কি ক্লাসে এমন কোনো খেলা খেলেছো, যেখানে টিচার একজনের কানে কানে একটা গল্প বলে। আর সেখান থেকে প্রত্যেকটা বাচ্চা আরেকজনের কানে বলতে থাকে, এভাবে এগিয়ে যায়?” ছেলেটা বললো, “হ্যাঁ, খেলেছি।” তখন টাইস জিজ্ঞেস করলেন, “শেষ ব্যক্তিটা যখন গল্প বলে, তখন কী হয়?” বাচ্চাটা বললো, “একদম আলাদা একটা গল্প হয়”। টাইসন বিজয়ীর হাসি দিয়ে বললেন, “সেটাই”।

খেয়াল করলে দেখবেন, লাওয়েলের বই Mars and its canals এবং Mars as the abode of life বইগুলোর ঠিক পরবর্তী সময়েই এইচ জি ওয়েলসের বই War of the Worlds বের হয়েছিলো, যেখানে এলিয়েনরা আমাদের এখানে এসে নিজেদের আস্তানা গড়তে চাইছিলো। টাইসন জিজ্ঞেস করলেন, “জানেন নিশ্চয়ই, ঐ এলিয়েনরা কোত্থেকে এসেছিলো?” এটার উত্তর মোটামুটি সবাই জানে, মঙ্গল থেকে।

কিন্তু আসলেই মঙ্গলে প্রাণ আছে কিনা, সেটা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা আবিষ্কার হয়েছিলো ১৯৯৬ সালে। একটা উল্কাপিণ্ড পাওয়া গিয়েছিলো পৃথিবীতে, যেটার বৈশিষ্ট্যগুলো মঙ্গলের শিলাখণ্ডের সাথে মিলে যায়? কিভাবে বোঝা গেলো যে এটা মঙ্গলের সাথে মেলে? কারণ, আমরা মঙ্গলে যান পাঠিয়েছি, সেখানকার বায়ুমণ্ডলের গঠন জানি। আর এই উল্কাপিণ্ডের ভেতরে যে ছিদ্র ছিলো, সেগুলোর ভেতর থেকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে বাতাস সংগ্রহ করা হয়েছে, এবং দেখা গেছে বায়ুমণ্ডলের উপাদানগুলোর শতকরা হার একদম মঙ্গলের সমান। আর এতে আরো একটা জিনিস পাওয়া গেছে, PAH – Polycyclic Aromatic Hydrocarbon. এটা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করে না যে, মঙ্গলে আসলেই কোনো একসময় প্রাণ ছিলো কিনা, কিন্তু এটা একটা হাইড্রোকার্বন এবং প্রাণের ভৌত ভিত্তিমূলক উপাদান এগুলোই। যদি এমন হয়ে থাকে যে্‌ মঙ্গল থেকে উড়ে আসা এই ধরনের উপাদানগুলোই পৃথিবীতে প্রাণের সৃষ্টির জন্য দায়ী, তাহলে আমরা সবাই কিন্তু এক হিসেবে মঙ্গলবাসী।

টাইসন বললেন – বাই দ্যা ওয়ে, একটা জিনিস খেয়াল করে দেখেছেন, জীববিজ্ঞানীরা নামকরণের ব্যাপারে খুব কাব্যিক। আমরা, জ্যোতির্বিদ (astronomer) বা জ্যোতিঃপদার্থবিদ (astrophysicist)-রা এই ক্ষেত্রে একদমই কাব্যপ্রতিভার পরিচয় দেই না। আমাদের নামগুলো একটু বেশিই আক্ষরিক। যেমন, লাল রঙের দানবীয় নক্ষত্রদেরকে আমরা কী বলি? Red Giants! আলোও বের হয় না, এমন কালো রঙের গহবরকে আমরা কী বলি? Black Hole! সৃষ্টির শুরুতে বিশাল বিস্ফোরণকে আমরা কী বলি? Big Bang! – – – এখানে অবশ্য আমি বলতে চেয়েছিলাম, কথাটা আসলে ঠিক না। জীববিজ্ঞানীরাও মাঝে মাঝে বেশ অল্প সময়ে অকাব্যিক নাম দিয়ে থাকেন। যেমন, যে তিমি হত্যা করে – Killer Whale, যে তিমি দেখতে শুক্রাণুর মত – Sperm Whale, ইত্যাদি।

যাই হোক, টপিকে ফিরে আসি। উনি বললেন, যে কারণে ঐ উল্কাপিণ্ড থেকে জোরালোভাবে ধারণা করা হচ্ছে যে মঙ্গলে একসময় প্রাণ ছিলো, তার কারণ হচ্ছে লোহা। সেখানে দুই ধরনের আয়রন পাওয়া গেছে – জারিত লোহা (oxidized iron), এবং কম ঘনত্বের লোহা (reduced iron). ঠিক যেমনটা আমাদের শরীরে পাওয়া যায়। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন পর্যন্ত একটা প্রেস কনফারেন্স ডেকেছিলেন এটা নিয়ে, যে দৃশ্যটা ১৯৯৭ সালে Contact মুভিটাতে ব্যবহার করা হয়েছিলো। তবে কনট্যাক্টের কাহিনী মঙ্গলের উল্কা নিয়ে নয়, আমাদের সৌরজগত থেকে অনেক দূরে কোনো এক গ্রহ থেকে আসা সংকেত নিয়ে। সেই সংকেতের প্রেস কনফারেন্স হিসেবে এই দৃশ্যটা দেখানো হয়েছিলো। আপনারা জানেন হয়তো যে, Contact কার্ল সেগানের লেখা সায়েন্স ফিকশন!

দূর থেকে তোলা মঙ্গলের ছবিতে অনেকেই মানুষের মুখ দেখেছেন। তখন অনেকে ওখানে প্রাণ আছে বলে লাফালাফি করেছিলো। ওরা এটা চিন্তা করলো না যে এতো প্রাণী থাকতে মানুষের মুখ কেন থাকতে যাবে? পৃথিবীতেই তো প্রায় সব রকম প্রাণীর চেহারা মানুষের চেয়ে ভিন্ন। তাহলে ভিন্ন একটা গ্রহতে কেন মানুষের চেহারা সমৃদ্ধ কোনো গঠন বানাবে কেউ?

images

পরে যখন আমরা রো হাই রেজোলিউশনে ছবি তুললাম, তখন দেখলাম যে আসলে ওখানে কিছু নেই।

Mars_face

আমরা প্যাটার্ন বা নকশা জিনিসটা ধরতে বেশ ওস্তাদ। কিন্তু মাঝে মাঝে এমন জায়গাতেও নকশা দেখি যেখানে ওটা নেই। অর্থাৎ, আমরা নকশা সনাক্তকরণে এতোটাই দক্ষ যে সেটাই অদক্ষতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ইংরেজিতে উনি বলেছিলেন, We are so good at pattern recognition that we are bad. আমরা যা দেখতে চাই, সেটা দেখি। আমাদের চেহারা যদি গলদা চিংড়ির মত হতো, তাহলে আমরা সেখানে গলদা চিংড়ি দেখতে পেতাম। এখানে তিনি জানিয়ে রাখলেন, গলদা চিংড়ি তার সবচেয়ে প্রিয় খাবার।

বৃহস্পতি


বৃহস্পতির আলোচনা তিনি শুরুই করলেন কার্ল সেগানের লেখা একটা সায়েন্স আর্টিকেল দিয়ে, যেটার নাম ছিলো Particles, environments, and possible ecology in the Jovian atmosphere. এটা ১৯৭৬ সালে পাবলিশ হয়েছিলো। ওখানে বলা হয়েছিলো, বৃহস্পতির যা আমরা দেখি তার সবই আসলে গ্যাস, এবং যদি কোন শক্ত ভূপৃষ্ঠ থাকেও, সেটা অনেক গভীরে। সেখানে কোনো প্রাণ থাকলে হয়তো বায়ুমণ্ডলে থাকবে। এক আর্টিস্ট সেখান থেকে ধারণা নিয়ে কিছু ছবি এঁকেছিলেন, যেগুলো সেগান ১৯৮০ এর জনপ্রিয় বিজ্ঞানভিত্তিক টিভি শো কসমস-এ দেখিয়েছিলেন।

floaterhunter

যাই হোক, জুপিটারের চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো প্রার্থী হচ্ছে জুপিটারের চাঁদ Enceladus. ওটা বরফ দিয়ে ঢাকা, কিন্তু সেখানে কিছু Geyser বা উষ্ণ প্রস্রবণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, তরল পানি। তরল পানি মানে সেখানে একশন থাকতে পারে, প্রাণ থাকতে পারে। অবশ্য জুপিটারের চাঁদগুলোর মধ্যে Europa নাকি টাইসনের সবচেয়ে প্রিয়। ইউরোপা নিয়ে ওনার কিছু বক্তব্য ছিলো, যেগুলো Europa Report নামে একটা সায়েন্স ফিকশন মুভিতে ব্যবহার করতে চেয়ে প্রযোজক যোগাযোগ করেছিলো। উনি বললেন, “আচ্ছা, সমস্যা নাই। এরপর ওরা আমাকে একটা চেক পাঠিয়ে দিলো। এর চেয়ে সহজে টাকা কামাই আমি আর কখনো করিনি।” মজা করে কোনো এক অদৃশ্য তৃতীয় পক্ষকে বললেন, “That’s great. Do you want more?” জানালেন, মুভিটা নেটফ্লিক্সে আছে। সময় পেলেই দেখে ফেলবো ঠিক করলাম।

শনি


এটাই নাকি আমাদের সৌরজগতে টাইসনের দ্বিতীয় প্রিয় গ্রহ। প্রথমটা অবশ্যই পৃথিবী! উনি বললেন, “আপনারা সবাই তো জানেন, শনির চারপাশে একটা বলয় আছে। কিন্তু এটা কি কেউ জানেন যে, শনিগ্রহে অরোরা-ও আছে?” এরপর তিনি অরোরা’র ছবি দেখালেন…


Saturn Aurora
Image: NASA



অরোরা মানে হচ্ছে শনিরও পৃথিবীর মত একটা চৌম্বকক্ষেত্র আছে, যেটা সৌরবায়ুকে ঠেলে মেরুর দিকে পাঠিয়ে দেয়, এবং সেটা রাতের আকাশে আয়নের সাথে বিক্রিয়া করে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। শনিতে প্রাণ আছে কিনা, সেই আলাপে না গিয়ে তিনি চলে গেলেন শনির চাঁদগুলোর মধ্যে একটাতে, Titan-এ। ওখানে মিথেনের হ্রদ আছে। আর মিথেন তো হাইড্রোকার্বন, যার গুরুত্ব নিয়ে আগেই বলা হয়েছে। কার্ল সেগানের কসমস এসেছিলো ১৯৮০ সালে। ২০১৪ তে যখন টাইসন আরো একবার কসমস নিয়ে এলেন, তখন সেখানে কাল্পনিক জাহাজে করে উনি আমাদেরকে টাইটানে নিয়ে গিয়েছিলেন।

এই পর্যায়ে এসে উনি দর্শকদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে যে কসমস দেখেনি?” দর্শকদের মধ্যে প্রায় সবারই দেখা ছিলো, একদম হাতে গোণা কয়েকজন হাত তুললো। টাইসন তাদের মধ্যে একজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তাহলে আপনাকে কে টেনে এনেছে এখানে? কারণ, আমি কে, কী করি, সেই ব্যাপারে তো আপনার কোনো ধারণাই নেই।” মহিলা জবাবে ইউটিউবে ভিডিও দেখেছেন এই টাইপ কিছু একটা বলেছিলো।

ভেনাস, নেপচুন, আর ইউরেনাস নিয়ে তিনি তেমন কিছু আর বললেন না। চলে এলেন পৃথিবীতে…

পৃথিবী


স্লাইডে বড় করে EARTH কথাটা ভেসে এলো। উনি বললেন, “পৃথিবীর কথা ভাবলেই আমাদের এক মমতাময়ী স্তন্যপায়ী মায়ের কথা মনে হয়। এজন্যে আমরা একে মাদার আর্থ বলি। এখানে, একটু নির্দিষ্ট করে স্তন্যপায়ী শব্দটা বলা জরুরি। কারণ, এমন অনেক মা আছে প্রাণীজগতে যে সন্তানকে টুপ করে গিলে ফেলে।” তবে, পৃথিবী কি আসলেই খুব মমতাময়ী?

এবার, স্লাইডে EARTH লেখাটার নিচে ভেসে এলো WANTS TO KILL YOU. বন্যা, দুর্ভিক্ষ, ভূমিকম্প, জলোচ্ছাস, অগ্ন্যুৎপাত, হারিকেন/টাইফুন (উনি মজা করে বললেন, এটার কথা তো আপনাদের ভাল করেই জানা। নিউ অরলিয়েন্সবাসীর তো একদম সামনাসামনি অভিজ্ঞতা আছে।), এমন আরো অনেক কিছুই আপনাকে ধ্বংস করতে চায়। আর ব্রহ্মাণ্ড?

ব্রহ্মাণ্ডও আপনাকে ধ্বংস করতে চায়। গামা রশ্মির বিস্ফোরণ, সুপারনোভা বিস্ফোরণ, কৃষ্ণগহবর, সৌরঝড়, ধূমকেতুর আক্রমণ, গ্রহাণুর আক্রমণ – সব মিলিয়ে ব্রহ্মাণ্ড আপনার ওপরে খুবই ক্ষ্যাপা। ডায়নোসরদেরকে তো একটা গ্রহাণু এসে একেবারে বিলুপ্তই করে দিলো, প্রায় ৬৫ মিলিয়ন বছর আগে। ১৯০৮ সালে একটা ধূমকেতু এসে আঘাত করেছিলো সাইবেরিয়াতে, যেটাকে তুঙ্গুসকা ইভেন্ট বলে। কার্ল সেগান তার (১৯৮০ সালের) কসমসের চতুর্থ এপিসোড Heaven and Hell-এ দেখিয়েছিলেন। কয়েক বছর আগে (২০১৩ সালে), রাশিয়াতে একটা উল্কা আঘাত করলো, যাতে প্রায় ১৬০০ জন আহত হয়েছিলো, কিন্তু কেউ মারা যায়নি। কারণ, তুঙ্গুসকা ইভেন্টের মত ওটাও মাটিতে আঘাত করার আগেই বায়ুমণ্ডলে বিস্ফোরিত হয়েছিলো। কিন্তু একটা শকওয়েভ তো ছিলোই, যে কারণে যারা “ও মা গো, আকাশে আলো” দেখে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো, তাদের জানালার কাঁচ ফেটে ওরা আহত হয়েছিলো।

টাইসনের কাছে নাকি এই এস্টেরয়েড বা গ্রহাণুগুলো প্রকৃতির কাছ থেকে আসা একেকটা সতর্কসংকেতের মত।

CHyVUMBW8AAXqbO

যেন প্রকৃতি জিজ্ঞেস করছে, “তো, স্পেস প্রোগ্রামের আপডেট কী, অ্যাঁ?”

ব্রহ্মাণ্ডের গঠন এবং পৃথিবীতে প্রাণের গাঠনিক উপাদান


ব্রহ্মাণ্ডের গঠন কী দিয়ে? কোন কোন মৌল সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় ব্রহ্মাণ্ডে? এই প্রশ্নের জবাবে টাইসন একটা তালিকা দেখালেন। সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় হাইড্রোজেন, কারণ এটাই সবচেয়ে সরল মৌল, বানাতে মাত্র একটা প্রোটন লাগে। এটা রইলো তালিকায় সবার ওপরে। এরপর দুই প্রোটনওয়ালা হিলিয়াম। এরপর যথাক্রমে অক্সিজেন, কার্বন, নাইট্রোজেন, এবং ওনার সবচেয়ে প্রিয় মৌল – অন্যান্য। হা হা হা!

এইবার দেখালেন, আমাদের এই পৃথিবীতে পাওয়া প্রাণের শরীর কী দিয়ে তৈরি। আমাদের শরীরে সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন, কারণ শরীরের বেশির ভাগই পানি। আর পানি বানাতে লাগে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেন। ব্রহ্মাণ্ডের গঠনেও এই দুটো প্রথম তিনটার মধ্যেই আছে। মাঝ থেকে হিলিয়াম আমাদের শরীরে একেবারে নেই বললেই চলে। কেন? কারণ, হিলিয়াম একটা নিষ্ক্রিয় গ্যাস, একে দিয়ে কিছু করানো যায় না।

এরপরেই আছে কার্বন – ব্রহ্মাণ্ডের গঠনেও, আমাদের শরীরেও! আমরা কার্বনভিত্তিক প্রাণী। কার্বন কিভাবে প্রাণের এতো বৈচিত্র্য ধারণে সক্ষম হলো? কারণ, কার্বন যত উপায়ে যৌগ গঠন করতে পারে, আর কেউ পারে না। কার্বন উপস্থিত, এমন যতগুলো যৌগ আছে, সকল মৌল মিলেও এতো যৌগ নেই। এখানে তিনি মজা করে বললেন, কে যেন ওনাকে বলেছিলেন যে কার্বন নাকি পর্যায় সারণির বেশ্যা (Slut of the periodic table)….. হা হা হা!

তাই, এই ব্রহ্মাণ্ডের প্রাণ কার্বনভিত্তিক হলে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। এরপর আমাদের শরীরে আছে নাইট্রোজেন, ঠিক ব্রহ্মাণ্ডের মতই। তারপর আছে, আবারো ওনার ফেভারিট – অন্যান্য। এখান থেকে দুটো জিনিস প্রমাণ হয়, বললেন টাইসন।

১) আমরা যে নিজেদেরকে স্পেশাল মনে করি, তা গাঠনিক দিক থেকে অন্তত ঠিক না। ব্রহ্মাণ্ডে সবচেয়ে বেশি যে মৌলগুলো পাওয়া যায়, আমরা সেগুলো দিয়েই তৈরি। এমন যদি হতো যে, আমরা বিসমাথ দিয়ে তৈরি, তাহলে বরং আমরা স্পেশাল হতাম। কারণ, ঐ ব্যাটাকে সহজে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।

২) কিন্তু তাই বলে কি আমরা স্পেশাল নই? অন্য একটা দিক থেকে আমরা স্পেশাল। কিভাবে? আমরা যে শুধু এই ব্রহ্মাণ্ডে আছি, তাই নয়। বরং ব্রহ্মাণ্ড নিজেই আমাদের মধ্যে আছে। ব্রহ্মাণ্ডের উপাদান দিয়েই আমরা তৈরি। আমাদের সাথে ব্রহ্মাণ্ডের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর।

যাই হোক, আমাদের পৃথিবীতে সকল প্রাণই কার্বনভিত্তিক, আমরা অন্যান্য প্রাণীদের চেয়ে আলাদা কিছু নই। আগে একটা প্রাণবৃক্ষ (Tree of life) দেখানো হতো, যেখানে মানুষ ছিলো সবার ওপরে। দেখে মনে হতো যেন, বিবর্তনের উদ্দেশ্য বা শেষ লক্ষ্য হচ্ছে মানুষ তৈরি করা। নতুন একটা প্রাণবৃক্ষ বানানো হয়েছে, যা আরো নিখুঁতভাবে প্রাণের বিবর্তনকে তুলে ধরে।

tree

লাল একটা উপবৃত্ত দেখতে পাচ্ছেন? অনেকবার জুম করলে সেখানে পাবেন You are here; ওখানেই মানুষের অবস্থান। আমাদের খুব কাছাকাছিই আছে ইঁদুর আর শিম্পাঞ্জী। আর এজন্যেই ইঁদুরের ওপর এতো গবেষণা।

ব্রহ্মাণ্ডে বুদ্ধিমান প্রাণীর উপস্থিতি


ওপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম, ব্রহ্মাণ্ডের অনেক জায়গাতেই কার্বনভিত্তিক প্রাণ থাকা মোটেও অসম্ভব কিছু না। হয়তো বিলিয়ন জগতে কার্বনভিত্তিক প্রাণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সেমিনারের এক জায়গাতে তিনি বলেছিলেন, “Billions. Ah, love that word! কেমন একটা বুম আওয়াজ হয় এই শব্দটাতে! বিলিয়ন্স! আসুন, সবাই মিলে একসাথে এই শব্দটা বলি – কার্ল সেগানের জন্য। ১, ২, ৩…… “

দর্শকদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি একসাথে বলে উঠলো, BILLIONS. গমগম করে উঠলো গোটা গ্যালারি। এরপরেই সেগানের উদ্দেশ্যে হাততালিতে ফেটে পড়লো।

যারা জানেন না, তাদের জন্য বলছি, সেগানের একটা বই আছে, Billions and Billions. সেটার ভূমিকার একাংশ বাংলা অনুবাদে পড়তে পারেন অনুবাদকদের আড্ডার ব্লগে। অনেকের কাছেই এই শব্দটা কার্ল সেগানের ইমেজ বয়ে নিয়ে আসে। আর টাইসন তো সেগানের অনেক বড় ভক্ত, তা তো সবাই বুঝেই ফেলেছেন।

এই পর্বে এসে টাইসন আলোচনা করলেন, ব্রহ্মাণ্ডের কত জায়গায় প্রাণ থাকতে পারে, সেটা নিয়ে বানানো ফ্র্যাংক ড্রেইকের সমীকরণ নিয়ে। সেই সমীকরণ নিয়ে যারা জানতে চান, তারা সেগানের ভিডিওটা দেখতে পারেন। সেগান ড্রেইকের বন্ধু ছিলেন, আর বন্ধুর সমীকরণ নিয়ে কসমস সিরিজে বিস্তারিত আলোচনা করেছিলেন। অনুবাদকদের আড্ডার অনুবাদও আছে ভিডিওর সাথে। টাইসন সেটার আরো সহজ একটা সংস্করণ দেখালেন,

N – civilizations = N – stars  x  f – planets  x  f – life  x  f – intelligent life

এখানে N দিয়ে সংখ্যা আর f দিয়ে ভগ্নাংশ বোঝানো হচ্ছে। কতগুলো নক্ষত্র, তার কয়টাতে গ্রহ আছে, গ্রহগুলোর কয়টাতে প্রাণ আছে, আর কত ভগ্নাংশে বুদ্ধিমান প্রাণ আছে, তা এই সমীকরণে বোঝানো হচ্ছে।

এরপর তিনি বললেন, Contact সিনেমার প্রিমিয়ারে ওনাকে ডাকা হয়েছিলো। কারণ, ওটার লেখক কার্ল সেগান, আর সেগানের সদ্য বিধবা স্ত্রী অ্যান ড্র্যুইয়ানকে (সেগান ১৯৯৬ সালে মারা গিয়েছিলেন, আর সিনেমা বের হয়েছিলো ১৯৯৭ সালে) টাইসন চিনতেন। সেখানে নায়িকা জুডি ফস্টার কথায় কথায় নায়ক ম্যাথিউ ম্যাককোনাহেইকে এই সমীকরণটা বলছিলো। জুডি বলছিলো, “দেখেছো, আমাদের এই ছায়াপথেই ৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্র আছে। যদি প্রত্যেক মিলিয়নের মধ্যে একটা নক্ষত্রে গ্রহ থাকে, যদি সেরকম মিলিয়ন গ্রহের একটাতেও যদি প্রাণ থাকে, আর সেই গ্রহগুলোর মিলিয়নের মধ্যে একটাতেও যদি বুদ্ধিমান প্রাণ থাকে, তবুও এই ছায়াপথে বুদ্ধিমান প্রাণসমৃদ্ধ মিলিয়ন গ্রহ থাকবে।”

টাইসন পুরো ক্লিপটা দেখালেন। এরপর বললেন, “এটা দেখে আমি বলে উঠেছিলাম, ‘কী?’।”

Untitled

এটা তো ১ এর চেয়েও কম। টাইসন এই ব্যাপক ভুলের জন্য জুডি ফস্টারকে দুষলেন। বললেন, “সে তো নিজের স্ক্রিপ্ট পড়ে দেখেছে, আর নিশ্চয়ই সে হাই স্কুল বীজগণিতের জ্ঞানও রাখে। একটু হিসাব করে দেখবে না?”

সিনেমা হলে আমার কয়েক সিট পাশেই দেখি – ফ্র্যাংক ড্রেইক স্বয়ং সেখানে উপস্থিত। তাকে বললাম সাথে সাথে, “এটা কী হলো?” তিনি সামান্য মুচকি হেসে বললেন, “chill out”…… ফ্র্যাংক ড্রেইক নিজে, তার নিজের সমীকরণের ভুল দেখে আমাকে বললেন, “আরে রাখো মিয়া, বাদ দাও।”

অবশ্য মুভির মধ্যে প্রভূত ভুল নিয়ে টাইসন খুবই সচেতন। যেমন, টাইটানিকের যে সিনে জ্যাক ডুবে যাচ্ছিলো, সেটার আকাশ দেখে টাইসন বলে উঠেছিলেন, “ভুয়া! কারণ, নক্ষত্রগুলো ঠিক জায়গাতে নেই। আকাশের অর্ধেক সাইড বাকি অর্ধেকটার প্রতিবিম্ব। এই ভুল ধরতে হলে এস্ট্রোনমার হওয়া লাগে না।”

যাই হোক, বেশির ভাগ সিনেমাতেই এলিয়েনদেরকে খারাপ শত্রু হিসেবে দেখানো হয়। টাইসন কোনোভাবেই এটা মেনে নিতে রাজি নন যে, এলিয়েন এলে ওরা আমাদের ক্ষতি করতে চাইবে। আমরা ওদেরকে খারাপ হিসেবে দেখি, কারণ আমাদের কাছে উদাহরণ হিসেবে শুধু আমাদের নিজেদের কাজকর্মই আছে। আমরা নিজেরা মানবপ্রজাতির অন্যদের সাথে যেমন ব্যবহার করি, এলিয়েনরাও আমাদের সাথে তাই করবে বলে মনে করি।

ব্রহ্মাণ্ডের ভিন্ন সভ্যতার কাছে পাঠানো বাণী


আমাদের সৌরজগতের মায়া ছেড়ে, সূর্যের মহাকর্ষ ছিন্ন করে বেরিয়ে যাওয়া প্রথম দুটো মহাকাশযানের নাম হচ্ছে Pioneer 10 and 11. এই দুটোই নাসার মহাকাশযান, এবং সেগান দীর্ঘদিন নাসার উপদেষ্টা বোর্ডে দায়িত্ব পালন করেছেন। পাইওনিয়ার প্রজেক্টের কথা জানার পর তিনি প্রস্তাব করলেন, “যদি এরা অন্য কোনো নক্ষত্রের দিকেই যায়, তাহলে এগুলোর মধ্যে আমরা নিজেদের কোনো বার্তা যোগ করছি না কেন?” এই বলে তিনি একটা টীম গঠন করলেন, যারা একটা ফলক বানালো। ফলকসহ সেগানের ছবি দেখালেন টাইসন।

PioneerPlaque3

এরপর তিনি ব্যাখ্যা করলেন, সেই ফলকে কী কী আছে। প্রথম মৌল হাইড্রোজেনের প্রতীক, আশেপাশের বিভিন্ন পালসার-এর অবস্থান যাতে আমাদের সূর্যের অবস্থান বোঝা যায়, সৌরজগতের কোন গ্রহে আমরা আছি, আর একটা পুরুষ ও একটা নারীর চিত্র।

Pioneer-F-Plaque-Annotated

টাইসন বললেন, এই ছবিটা দেখে অনেক নারীবাদী রেগে গিয়ে বলেন, পুরুষটা কেন অভিবাদন দিচ্ছে, নারীটা দিচ্ছে না কেন? কিন্তু তারা ভুলে যাচ্ছেন, যে সময়ে এটা বানানো হয়েছিলো, নারীর চিত্র যোগ করাটাই অনেক সাহসের ব্যাপার ছিলো, তাও আবার নগ্ন চিত্র। একটা কমিকস বের হয়েছিলো, যেখানে স্যুট পরা একটা এলিয়েন এই ফলক খুঁজে পেয়ে আরেক এলিয়েনকে দেখিয়ে বলছে, “এই দ্যাখো, এরা দেখতে আমাদের মতই। পার্থক্য হচ্ছে, এরা কাপড় পরে না।”

সেটা ১৯৭২ সালের কথা। ১৯৭৭ সালে আরো দুটো মহাকাশযানকে সৌরজগতের বাইরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। এই দুটোই সবচেয়ে বিখ্যাত – ভয়েজার ১ এবং ২। এবার সেগান সেখানে গোটা একটা রেকর্ড যোগ করলেন। যেটাকে বলা হয়, Sounds of Earth. এখানে অনেক অনেক প্রাকৃতিক শব্দ আছে, প্রাণীর ডাক আছে। এটাতে ৫০টার বেশি ভাষায় অভিবাদন আছে, যেগুলো নিউইয়র্কের রাস্তায় বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছিলো। এতে মোজার্ট, বিটোফেন, বাখ এর মিউজিক আছে।

ভয়েজার যখন শনির কক্ষপথ পার করে ফেলেছে, সেই ৩.৭ বিলিয়ন মাইল দূরত্ব থেকে, পৃথিবীর একটা ছবি তোলার জন্য নাসাকে অনুরোধ করলেন কার্ল সেগান। সেই ছবিটা দেখানোর আগে, টাইসন ম্যানেজমেন্টকে অনুরোধ করলেন গ্যালারির সব আলো নিভিয়ে ফেলতে। বললেন, “I want maximum impact for this photo”. গ্যালারির সিলিং-এ তারার মত মিটমিটে আলো জ্বলছিলো তখনো, কিন্তু বাকি সব আলো নিভিয়ে দেয়া হলো। তারপর স্ক্রিনে ভেসে এলো এই ছবিটা…

064c463bf

টাইসন অন্ধকারের মধ্যেই বলতে লাগলেন, এই ছবিটা খুবই বিখ্যাত হয়েছিলো। এটাকে দেখে কার্ল সেগান পৃথিবীর নাম দিয়েছিলেন Pale Blue Dot. এই নামে উনি একটা বইও লিখেছিলেন। সেই বই থেকে একটা অংশ পড়ে আজকের এই সেমিনার শেষ করছি……



“এই সুবিশাল দূরত্ব থেকে, পৃথিবীকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে হওয়ার কথা না। কিন্তু আমাদের জন্য ব্যাপারটা একটু ভিন্ন।

বিন্দুটির দিকে আরেকবার তাকান – এটাই পৃথিবী, আমাদের বসত, আমরা এটাই। এখানেই ওরা সবাই – যাদের আমরা ভালোবেসেছি, যতজনকে আমরা চিনি, যাদের যাদের কথা আমরা শুনেছি – তাদের সবাই এখানেই তাদের জীবন কাটিয়েছে। আমাদের সারা জীবনের যত দুঃখ কষ্ট, হাজার হাজার ধর্ম, আদর্শ আর অর্থনৈতিক মতবাদ, যত শিকারী আর লুণ্ঠনকারী, যত সাহসী-ভীরু, সভ্যতার নির্মাতা আর ধ্বংসকারী, যত রাজা আর প্রজা, যত প্রেমিক-প্রেমিকা, যত বাবা মা, স্বপ্নে বিভোর শিশু, আবিষ্কারক, পরিব্রাজক, যত নীতিবান শিক্ষক, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, যত “সুপারস্টার”, যত জাঁহাবাজ নেতা, মানব ইতিহাসের সকল সাধু আর পাপী, সবাই তাদের জীবন কাটিয়েছে আলোয় ভেসে থাকা ধূলোর ঐ ছোট্টো কণাটিতে।

অসীম এই মহাবিশ্বে, খুব ছোট একটা মঞ্চ আমাদের এই পৃথিবীটা।

ভাবুন তো, সেনাপতি আর দিগ্বিজয়ী বীরের দল কত রক্ত ঝরিয়েছে – ক্ষুদ্র এই বিন্দুর ক্ষুদ্র একটা অংশ জয় করে, মহান হবার আশায়। ভাবুন তো সেই সীমাহীন হিংস্রতার কথা; ছোট্টো এই বিন্দুর আরো ছোটো এক প্রান্তের মানুষ যা ঘটিয়েছে, অন্য প্রান্ত জয় করবে বলে।

কী দ্বন্দ্ব তাদের নিজেদের মাঝে! রক্তের জন্য তাদের কী পিপাসা! কী প্রকট তাদের জিঘাংসা! আমাদের নাক-উঁচু ভাব, আমাদের কাল্পনিক অহমিকা, ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে আমরাই সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছি – সেই বিভ্রম, প্রশ্নবিদ্ধ হয় এই ঝাপসা নীল আলো দিয়ে।

আমাদের এই গ্রহ… মহাজাগতিক অন্ধকারের মধ্যে নিতান্তই ক্ষুদ্র একটা বিন্দু। আমাদের অজ্ঞানতায়, এই বিশালতায়, এমন কোনো ইঙ্গিত নেই যে কেউ আসবে, আমাদেরকে নিজেদের হাত থেকে রক্ষা করতে।

আমাদের জানামতে পৃথিবীই একমাত্র বাসযোগ্য গ্রহ। অন্য কোথাও, অন্তত নিকট ভবিষ্যতে, আমাদের প্রজাতি আস্তানা গাড়তে পারবেনা।

ভ্রমণ? সম্ভব।

বসতি, এখনো নয়।

ভাল লাগুক আর নাই লাগুক, এই মুহূর্তে পৃথিবীই আমাদের একমাত্র আশ্রয়।

বলা হয়ে থাকে জ্যোতির্বিজ্ঞান আমাদের বিনয়ী করে তোলে, চরিত্র গঠনে সাহায্য করে। মানুষের অহংকারকে ধূলিস্যাৎ করার জন্য দূর থেকে তোলা ছোট্টো পৃথিবীর এই ছবিটার চেয়ে ভালো উদাহরণ আর হয় না। আমার মতে, এটা মনে করিয়ে দেয়, কতটা জরুরি পরস্পরের প্রতি আরেকটু সহানুভুতিশীল হওয়া; কতটা জরুরি এই ছোট্টো নীল বিন্দুটাকে, আমাদের জানা একমাত্র বাড়িটাকে, সংরক্ষণ আর উপভোগ করা।”



উৎস ঃ https://bigganjatra.org/neil_tyson_in_new_orleans/

Tuesday, August 15, 2017

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অসামান্য জনপ্রিয় এবং শক্তিমান তরুণ কবি সুকান্তভট্টাচার্যের জন্মদিনে ঃ



বাংলা সাহিত্যের মার্কসবাদী ভাবধারায় বিশ্বাসী এবং প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী তরুণ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার বৈপ্লবিক ভাবধারাটি যাঁদের সৃষ্টিশীল রচনায় সমৃদ্ধ হয়েছে, সুকান্ত তাঁদের অন্যতম। তারুণ্যের শক্তি দিয়ে উন্নত শিরে মানুষের মর্যাদার জন্য মানুষকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান সুকান্তের কবিতায় লক্ষণীয়। সুকান্তের কবিতা সাহসী করে, উদ্দীপ্ত করে। তাঁর কবিতার ছন্দ, ভাষা, রচনাশৈলী এত স্বচ্ছন্দ, বলিষ্ঠ ও নিখুঁত যে, তাঁর বয়সের বিবেচনায় এরূপ রচনা ছিলো অসাধারণ ও বিস্ময়কর। সুকান্তের কবিতা সব ধরনের বাধা-বিপত্তিকে জয় করতে শেখায়। তার বক্তব্যপ্রধান সাম্যবাদী রচনা মানুষকে জীবনের সন্ধান বলে দেয়। যাপিত জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণাকে মোকাবেলা করার সাহস পাওয়া যায় তাঁর কবিতা থেকে। অভিনবত্বের চেয়েও প্রকাশ ভঙ্গির বলিষ্ঠতা এবং প্রতিমা নির্মাণের অভিনবত্বের জন্য পাঠক সমাজে অকুণ্ঠ প্রশংসা পেয়েছে | উচ্চতর মানবিক চেতনায় উজ্জীবিত কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য পার্টি ও সংগঠনের কাজে অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ১৯৪৭ সালের আজকের দিনে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। মানবতার জয়ের জন্য লড়াকু ভূমিকায় অবতীর্ণ প্রগতিশীল চেতনার অধিকারী কবির আজ ৭০তম মৃত্যুবার্ষিকী। তারুণ্যের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের মুত্যুদিনে আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্ট কলকাতার ৪৩, মহিম হালদার স্ট্রীটের মাতুতালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা নিবারণ ভট্টাচার্য কলকাতার কলেজ স্ট্রিটে বইয়ের ব্যবসা করতেন এবং মা সুনীতি দেবী ছিলেন গৃহবধূ। তাঁদের পৈতৃক নিবাস ছিল ফরিদপুর জেলার (বর্তমান গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া থানার উনশিয়া গ্রামে)। কবির জন্মের পূবেই তার পূর্ব পূরুষেরা এ দেশ থেকে ভারতে চলে যায়। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সুকান্তের নিজের ভাতুষ্পুত্র। সুকান্তের বাড়িতে সাহিত্যের খুব ভাল পরিবেশ ছিল। মনীন্দ্রলাল বসুর ‘রমলা’উপন্যাসের নায়ক সুকান্তের নামেই আদরের ভাইটির নাম রেখেছিলেন জ্যাঠতুতু দিদি রানি। রানি দিদির উৎসাহেই লেখালেখিতে সুকান্তের হাতে খড়ি। স্কুলের ছাত্র হিসেবে ভালো মার্ক্স পাওয়া মেধাবী ছাত্র হবার নজির ছিলোনা সুকান্তের। অর্থাৎ সাধারণ মানের ছাত্র ছিলেন তিনি। তাই লেখাপড়ায় খুব একটা আগ্রহ দেখাতেন না। তদূপরী ভারত জুড়ে ভারতীয়দে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের কারণে লেখাপড়া বাধা গ্রস্থ হচ্ছিলো তার। এ সময় ছাত্র আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ায় ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষাতে অকৃতকার্য হলে তাঁর আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটে।

কৈশোর থেকেই সুকান্ত যুক্ত হয়েছিলেন সাম্যবাদী রাজনীতির সঙ্গে | পরাধীন দেশের দুঃখ দুর্দশাজনিত বেদনা এবং শোষণ মুক্ত স্বাধীন সমাজের স্বপ্ন, শোষিত মানুষের কর্ম জীবন এবং ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য সংগ্রাম তাঁর কবিতার মূল প্রেরণা | ১৯৪১ সালে সুকান্ত কলকাতা রেডিওর গল্পদাদুর আসরের যোগদান করেন। সেখানে প্রথমে তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করেন। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর সেই আসরেই নিজের লেখা কবিতা পাঠ করে তাঁকে শ্রদ্ধা জানান। গল্পদাদুর আসরের জন্য সেই বয়সেই তাঁর লেখা গান মনোনীত হয়েছিল আর তাঁর সেই গান সুর দিয়ে গেয়েছিলেন সেকালের অন্যতম সেরা গায়ক পঙ্কজ মল্লিক। সুকান্তকে আমরা কবি হিসেবেই জানি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেমন কেবল মাত্র কবি ছিলেন না, সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রে তাঁর ছিলো অবাধ বিচরণ। তেমনি সুকান্তও ঐ বয়সেই লিখেছিলেন কবিতা ছাড়াও, গান, গল্প, নাটক এবং প্রবন্ধ। তাঁর ‘ছন্দ ও আবৃত্তি’ প্রবন্ধটি পাঠেই বেশ বোঝা যায় ঐ বয়সেই তিনি বাংলা ছন্দের প্রায়োগিক দিকটিই শুধু আয়ত্বে আনেন নি, সে নিয়ে ভালো তাত্বিক দক্ষতাও অর্জন করেছিলেন। ১৯৪৫ সালে সুকান্ত কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা দৈনিক স্বাধীনতার ‘কিশোর সভা’ বিভাগ সম্পাদনা করতেন।

আট ন’ বছর বয়স থেকেই সুকান্ত লিখতে শুরু করেন। স্কুলের হাতে লেখা পত্রিকা ‘সঞ্চয়ে’ একটি ছোট্ট হাসির গল্প লিখে আত্মপ্রকাশ করেন। তার দিনকতক পরে বিজন গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিখা’ কাগজে প্রথম ছাপার মুখ দেখে তাঁর লেখা বিবেকান্দের জীবনী। মাত্র এগার বছর বয়সে ‘রাখাল ছেলে’ নামে একটি গীতি নাট্য রচনা করেন। এটি পরে তাঁর ‘হরতাল’ বইতে সংকলিত হয়। বলে রাখা ভালো, পাঠশালাতে পড়বার কালেই ‘ধ্রুব’ নাটিকার নাম ভূমিকাতে অভিনয় করেছিলেন সুকান্ত। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাল্য বন্ধু লেখক অরুণাচল বসুর সঙ্গে মিলে আরেকটি হাতে লেখা কাগজ ‘সপ্তমিকা’ সম্পাদনা করেন। অরুণাচল তাঁর আমৃত্যু বন্ধু ছিলেন। মার্কসবাদী চেতনায় আস্থাশীল কবি হিসেবে সুকান্ত কবিতা লিখে বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র স্থান করে নেন। সুকান্তকে বলা হয় গণমানুষের কবি। অসহায়-নিপীড়িত সর্বহারা মানুষের সুখ, দুঃখ তার কবিতার প্রধান বিষয়। অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ের স্বার্থে ধনী মহাজন অত্যাচারী প্রভুদের বিরুদ্ধে নজরুলের মতো সুকান্তও ছিলেন সক্রিয়। যাবতীয় শোষণ-বঞ্চনার বিপক্ষে সুকান্তের ছিল দৃঢ় অবস্থান। তিনি তার কবিতার নিপুণ কর্মে দূর করতে চেয়েছেন শ্রেণী বৈষম্য। মানবতার জয়ের জন্য তিনি লড়াকু ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। অসুস্থতা অর্থাভাব তাকে কখনো দমিয়ে দেয়নি। মানুষের কল্যাণের জন্য সুকান্ত নিরন্তর নিবেদিত থেকেছেন। তিনি মানবিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে বিদ্রোহের ডাক দিয়েছেন। তার অগ্নিদীপ্ত সৃষ্টি প্রণোদনা দিয়ে সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে প্রয়াসী ছিলেন। মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বাংলা কাব্যধারার প্রচলিত প্রেক্ষাপটকে আমূল বদলে দিতে পেরেছিলেন।

ক্ষনজন্মা এই কবির রচনার সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। কিন্তু যদি তাঁর বয়সটির কথা মনে রাখি, তবে সেই সংখ্যা অবিশ্বাস্য। তাঁর রচনাবলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলোঃ ছাড়পত্র (১৯৪৭), পূর্বাভাস (১৯৫০), মিঠেকড়া (১৯৫১), অভিযান (১৯৫৩), ঘুম নেই (১৯৫৪), হরতাল (১৯৬২), গীতিগুচ্ছ (১৯৬৫) প্রভৃতি। পরবর্তীকালে উভয় বাংলা থেকে সুকান্ত সমগ্র নামে তাঁর রচনাবলি প্রকাশিত হয়। সুকান্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পিসঙ্ঘের পক্ষে আকাল (১৯৪৪) নামে একটি কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন। সুকান্তের কবিতা বিষয়বৈচিত্র্যে ও লৈখিক দক্ষতায় অনন্য। সাধারণ বস্তুকেও সুকান্ত কবিতার বিষয় করেছেন। বাড়ির রেলিং ভাঙা সিঁড়ি উঠে এসেছে তার কবিতায়। সুকান্তের কবিতা সব ধরনের বাধা-বিপত্তিকে জয় করতে শেখায়। যাপিত জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণাকে মোকাবেলা করার সাহস সুকান্তের কবিতা থেকে পাওয়া যায়। তারুণ্যের শক্তি দিয়ে উন্নত শিরে মানুষের মর্যাদার জন্য মানুষকে প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান সুকান্তের কবিতায় লক্ষণীয়। সুকান্তের কবিতা সাহসী করে, উদ্দীপ্ত করে। তার বক্তব্যপ্রধান সাম্যবাদী রচনা মানুষকে জীবনের সন্ধান বলে দেয়। স্বল্প সময়ের জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্যকে অনেক কিছু দিয়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, দিজেন্দ্রলাল রায়, জীবনানন্দ দাশসহ সে সময়ের বড় বড় কবির ভিড়ে তিনি হারিয়ে যাননি। নিজের যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন নিজ প্রতিভা, মেধা ও মননে। সুকান্ত তার বয়সিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেছেন তার পরিণত ভাবনায়। ভাবনাগত দিকে সুকান্ত তার বয়স থেকে অনেক বেশি এগিয়ে ছিলেন।

মনীন্দ্র বসুর উপন্যাসের সুকান্তকেও অকালেই যক্ষা রোগে চলে যেতে হয়েছিল। কবি সুকান্তেরও সেই একই গতি হবে তা হয়তো পরিবারে কেউ ভাবেন নি। একাধারে বিপ্লবী ও স্বাধীনতার আপোসহীন সংগ্রামী কবি সুকান্ত ছিলেন কমুনিষ্ট পার্টির সারাক্ষণের কর্মী। পার্টি ও সংগঠনের কাজে অত্যধিক পরিশ্রমের ফলে নিজের শরীরের উপর যে অত্যাচারটুকু তিনি করলেন তাতে তাঁর শরীরে প্রথম ম্যালেরিয়া ও পরে দুরারোগ্য ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৩ই মে মাত্র ২১ বছর বয়সে কলিকাতার ১১৯ লাউডট ট্রিষ্ট্রের রেড এড কিওর হোমে মৃত্যুবরণ করেন। সুকান্ত ভট্টাচার্যের জীবন মাত্র মাত্র ২১ বছরের আর লেখালেখি করেন মাত্র ৬/৭ বছর। সামান্য এই সময়ে নিজেকে মানুষের কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। তাঁর রচনা পরিসরের দিক থেকে স্বল্প অথচ তা ব্যাপ্তির দিক থেকে সুদূরপ্রসারী।

উৎস ঃ http://www.somewhereinblog.net/blog/nurubrl/30194438

Friday, August 11, 2017

ড্যান ব্রাউনের ইনফার্নোর প্রথম অধ্যায় (অনুবাদ)



আমিই সেই ছায়াআমি ছুটে যাই, বিষণ্ন শহরের পথ ধরেআমি ছুটতে থাকি, চিরন্তন বিষণ্ণতা চিরে

আর্নো নদীর তীর ধরে আমি ছুটছি, অবিশ্রান্ত…… ভিয়া দেই কাস্তেলানির দিকে এসে বাম দিকে মোড় নেই, ছুটতে থাকি উত্তরের দিকে, উফিৎজি (Ufizi museum)-এর ছায়ার মধ্যে গাদাগাদি করে!

এখনো তারা আমার পিছু ধাওয়া করছে। তাদের পদধ্বনি এখন আগের চেয়ে স্পষ্ট, যেন তাদের শিকারের ইচ্ছা আগের চেয়েও দৃঢ়।

বছরের পর বছর ধরে তারা আমাকে খুঁজে বেড়িয়েছে। তাদের গোয়ার্তুমি আমাকে ঠেলে দিয়েছে ভূ-গর্ভে…… বাধ্য করেছে প্রায়শ্চিত্তস্থলে থাকতে…… ভূ-গর্ভস্থ দানবের মত হাতড়ে বেড়াতে।

আমিই সেই ছায়া

আর এখন মাটির ওপরে, আমি উত্তর আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকাই, কিন্তু মোক্ষলাভের সুনির্দিষ্ট কোন পথ খুঁজে পাই না…… এপেনাইন পর্বতমালা ভোরকে এখনো অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছে বলে।

এক-হাতওয়ালা ঘড়ি আর খাঁজকাটা মিনারওয়ালা পালাজ্জো কে পেছনে ফেলে সাপের মত এঁকে-বেঁকে আমি ছুটে যাই, পাশ কাটাই পিয়াজ্জা দি সান ফিরেঞ্চির প্রত্যুষের মাতাল বিক্রেতাদেরকে। বার্জেলো-কে অতিক্রম করে, আমি বাঁক নেই পশ্চিমে, বাদিয়ার কুণ্ডলীর দিকে এবং ছুটে চলি সিঁড়ির গোড়ার লৌহ নির্মিত গেটের দিকে।

সকল দ্বিধা ঝেড়ে ফেলতে হবে এখন।

Thursday, August 10, 2017

দুই ঠগের গল্প( আনিসুল হক)



বাংলাদেশের গ্রামেগঞ্জে, জনপদে অনেক হাসির গল্প প্রচলিত আছে। এর মধ্যে একটা গল্প আছে দুই ঠগের।
এক দেশে ছিল দুই ঠগ। অতি বিখ্যাত প্রতারক এরা।
তো একদিন সকালবেলা দুই প্রতারক বের হয়েছে কিছু আয়-রোজগারের আশায়। একজন নিল এক বস্তা আমের শুকনো পাতা। আরেকজন নিয়েছে এক বস্তা কলার বিচি। এরা কেউ কাউকে চেনে না। পথে একজন বস্তা রেখে বিশ্রাম করছে। তাকে দেখে অন্যজনও মাথা থেকে বস্তা নামিয়ে তার পাশে বসে পড়ল।
‘তোমার বস্তায় কী ভাই?’
‘আমারটায় তেজপাতা। তোমারটায়?’
‘গোলমরিচ।’
দুজনেই খুশি। বেটাকে ঠকাতে হবে। ওঠার সময় দুজনেই ভুল বস্তা ঘাড়ে তুলল।
হাটে গিয়ে দুজনেই বস্তা খুলল। এ দেখে ওর ভেতরে আমের পাতা, ও দেখে কলার বিচি।
কে কাকে ঠকাবে!

সেই বিতর্কিত প্রশ্ন ডিম আগে না মুরগি আগে ?



লেখাটির শিরোনাম হয়তো অনেকের কাছেই ফালতু মনে হয়েছে।কিন্তু কখনো কি আপনি বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভেবে দেখেছেন , যে ডিমের সৃষ্টি আগে না মুরগির সৃষ্টি আগে?এটি যদি আপনি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখেন তাহলে হয়তো আপনি কখনো এই প্রশ্নটির সঠিক কোন উত্তরে পৌছতে পারবেন না।কারন এই প্রশ্নটিকে আপনি যে ভাবেই দেখেন না কেন এ রকম অনেক প্রশ্ন নিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষ ও প্রাচীনকালের মানুষেরা অনেক ভেবেছেন।কেউ কেউ হয়তো  এগুলকে ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেছেন আবার কেউ হয়তো এগুলকে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেছেন।আপনি যদি সঠিক ভাবে বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ না করেন তবে আপনি আজকের এই প্রশ্নটিতে এক এক সময় এক এক সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছবেন।কারন ডিম ছাড়া যেমন মুরগি সৃষ্টি সম্বব না, তেমনি মুরগি ছাড়া এই ডিমটি  এল ই বা কোথা থেকে তাই না?

images (1)

এবার কাজের কথায় আসি,আমাদের জানা দরকার যে সৃষ্টির প্রথমে এই ডিম বা মুরগি কোনটিই আসলে ছিল না।সকল প্রকারের প্রানের উৎপত্তি আসলে সেই আদি কোষ(যে আদি কোষের উৎপত্তি হয় আদি জলজ ও উত্তপ্ত পরিবেশে এবং সেটি ছিল এককোষী) থেকেই হয়েছে।তবে আমাদের উদ্দেশ্য হল মুরগির উৎপত্তি।যাই হোক, মুরগি এক ধরনের পাখি।আর পাখিদের উৎপত্তি হয়েছিল আদি সরীসৃপদের থেকে।লক্ষ করে দেখবেন সরীসৃপরাও পাখিদের মত ডিম পারে এবং ডিম ফুটে বাচ্চা হয়।প্রথম মুরগীটির উৎপত্তিটি আসলে কোন মুরগির ডিম থেকে হয়েছিল না।কোন সরীসৃপ এর ডিমে ঘটে যাওয়া আচমকা মিউটেশন বা হঠাৎ জিনগত রদবদল  ফলে সৃষ্টি হয়ছিল আদিম পাখিদের।আর সেই প্রগইতিহাসিক পাখিদের মধ্যে থেকে পুনঃপুনঃ মিউটেশনের ফলে সৃষ্টি হয়েছে আজকের এই মুরগির।প্রথম যে মুরগি সৃষ্টি হয়েছিল সেই মুরগির সাথে হয়তো আজকের এই মুরগির অনেক বেশিই অমিল।যেহেতু মিউটেশনটি ডিমের মধ্যে ঘটে যাওয়ার ফলে সেই আদি মুরগীটির উৎপত্তি হয়েছিল তার মানে ডিমটির আগে কোন মুরগি ছিল না।তার  মানে আমরা বলতে পারি মুরগির আগে ডিম এসেছে।তাই ডিম ই আগে আর মুরগি পরে। 😀



উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ...

Monday, August 7, 2017

এইজ অফ ইউরোপিয়ান ডিসকভারি



#১৮২৪
মিশরের ফারাও দ্বিতীয় রামসিসের কফিন যেদিন প্রথম খোলা হয়,সেদিন তার মমির ভেতর দুটো অদ্ভুত জিনিস পাওয়া যায়।এই দুটো জিনিসের সেখানে থাকার কথা ছিল না।
জিনিস দুটো হল তামাক আর কোকোয়া।
আজ থেকে সাড়ে পাচশো বছর আগে ইউরেশিয়া বা আফ্রিকার কোথাও এই দুটো জিনিস ছিল না।তাহলে এই দুটো জিনিস সাড়ে তেত্রিশ শো বছর আগে মিশরে গেল কিভাবে??
¥ ¥ ¥
সাড়ে তিন হাজার বছর পুরানো এক সভ্যতা ছিল মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন অংশে।নাম ওলেমাক।
এই সভ্যতার বাসিন্দাদের নাক অদ্ভুত রকম থ্যাবড়া,দাতের সামনের পাটি উচু,কপালটাও উচু থেকে ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে গেছে,অনেকটাই আফ্রিকানদের মত।
কিন্তু সাড়ে তিন হাজার বছর আগে কোন আফ্রিকান লোক সেখানে গেছে বলে জানা যায় নাই।অন্তত লিখিত কোন প্রমান নাই।
মেক্সিকোতে জিনোনি নামে একটা ট্রাইব আছে।এদের জেনেটিক প্রোফাইল টেস্ট করে পিউর জাপানিজ বেশ কিছু জিন পাওয়া গেছে।জিনোনিরা মেক্সিকান অন্যান্য ট্রাইব থেকে সম্পুর্ন আলাদা,তাদের চাল চলন ও আচার আচরনই শুধু নয়,আকার আকৃতিতেও।
¥ ¥ ¥
১৮৮২ সালে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ার দক্ষিণ পশ্চিমে একটা খাল খননের সময় শ্রমিকেরা ২৫টি মুদ্রার সন্ধান পায়,মুদ্রার গায়ে লেখা হিজিবিজি ভাষা পড়ার ক্ষমতা তাদের ছিল না।
একটু একটু করে সেই খবর পোছাল খনন কারীদের সাথে থাকা প্রত্নতাত্ত্বিক
ের কাছে।
তিন বছর পর জানা গেল এগুলো চীনা রাজবংশ শাঙ ডাইন্যাস্টির সম্রাট হুঙেটির মুদ্রা।
সম্রাট হুঙেটির রাজত্বকাল ছিল কবে শুনলে আশ্চর্য হতে হয়।
খ্রিস্টপুর্ব ২৬০০অব্দে,আইমিন আজ থেকে ৪৬০০ বছর আগে,যখন গিজাতে ফারাও খুফু পিরামিড বানাচ্ছিলেন,তখনকার কথা।
¥ ¥ ¥
মানুষ কখনই এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকার মত সুশীল প্রাণী ছিল না।
পৃথিবীর বুকে পা রাখার পর থেকেই সে ঘুরে বেড়িয়েছে এখান থেকে ওখানে,বারবার চিনতে চেয়েছে অজানাকে।
আফ্রিকা বা আরব উপদ্বীপের কাছাকাছি কোথাও থেকে মানুষের ওই যাত্রার শুরু বলে বিজ্ঞানীরা ধারনা করে থাকেন।
সভ্য হবার পর প্রত্যেক সভ্যতাই চেষ্টা করেছে নিজেদের সভ্যতার কথা পৃথিবীর অন্যান্য অংশে নিয়ে যেতে।
আমেরিকা আবিষ্কারের যে গল্প এখন আমাদের শোনানো হয় তা কোনভাবেই আমেরিকা অবিষ্কারের প্রথম গল্প না।সেই গল্পটা বড়জোর প্রথমবারের মত আমেরিকাকে কলোনী বানানোর গল্প।
তার আগে বহুবার দুঃসাহসী মানুষেরা আমেরিকায় গেছেন।
নতুন পৃথিবী আবিষ্কারের এই রেসে সম্ভবত পাইওনিয়ার ছিল চাইনিজরা।
চাইনিজরা এখন পর্যন্ত দাবি করছে মিং ডাইন্যাস্টির অ্যাডমিরাল ঝেং হোর কথা,কিন্তু ঝেং হো আমেরিকাতে পৌছেছেন তার কোন প্রমান সরাসরি দেয়া সম্ভব হয় নাই।
ঝেং হো একজন মুসলিম ছিলেন।
তার আগেও মুসলিমরা বারবার চেষ্টা করেছে অসীম আটলান্টিক পাড়ি দিতে।এদের মধ্যে একজনের নাম ইতিহাসে পাওয়া যায়,নাম খাসখাস ইবনে সাইদ ইবনে আসওয়াদ,তার সম্পর্কে আল মাসউদী নবম শতাব্দীতে লিখেছেন তিনি আটলান্টিক পেরিয়ে ওপারে গিয়েছিলেন এবং তারপর,সেই দেশ থেকে জাহাজ বোঝাই করে প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে এসেছিলেন।আল মাসউদী এই কথা লিখেছেন ৮৮৯ সালে,তার বই মুরুয আদ দ্বোয়াহাব ওয়াল মাদিন আল জাওহারে,কর্দোবার খলিফা আবদুল্লাহ ইবনে মুহাম্মাদের আমলে।
এই দুজনের মাঝখানে চাপা পড়ে গেছে পৃথিবীর সবচাইতে বড় অ্যাডভেন্ঞারার সম্রাঠের কথা।
মালি সাম্রাজ্যের নাম যারা শুনেছেন তারা অবশ্যই জানেন ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দীতে পৃথিবীর সবচাইতে সমৃদ্ধ সাম্রাজ্য ছিল মালি সাম্রাজ্য।পৃথিবীর ইতিহাসে সবচাইতে সম্পদশালী ব্যক্তি বলা হয় এই সাম্রাজ্যের সম্রাট মানসা মুসাকে।
মানসা মুসার চাচা দ্বিতীয় আবুবকর এতই অ্যাডভেন্ঞার প্রিয় ছিলেন যে তিনি একবার সিদ্ধান্ত নেন তিনি আটলান্টিক মহাসাগর কোথায় শেষ তা দেখে ছাড়বেন।
এই সিদ্ধান্ত ঠিক রাখতে গিয়ে তিনি নিজের সিংহাসন ছেড়ে চারশো জাহাজের এক বহর নিয়ে বেরিয়ে পড়েন পশ্চিম আফ্রিকা উপকূল থেকে সোজা পশ্চিমে,সাত বছর পর তিনি ফিরে আসেন,চারশো জাহাজের মধ্যে কেবল একটি নিয়ে,কিন্তু তাতে তিনি অনেক সম্পদ বোঝাই করে নিয়ে এসেছিলেন।
কিন্তু এরাই আমেরিকার মাটি ছোয়া পুরানো দুনিয়ার প্রথম সভ্য মানুষ নন।
ব্রিটিশ কলাম্বিয়াতে পাওয়া চীনা সম্রাটের মুদ্রা,ফারাওয়ের মমিতে পাওয়া তামাক আর কোকোয়া এবং ওলেমাক সভ্যতা ও জিনোনি উপজাতির মানুষের দৈহিক গড়ন,এই তিনটি বিষয় আমাদের কাছে স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে দেয়,হাজার হাজার বছর আগে থেকেই মানুষ পুরানো পৃথিবী থেকে নতুন পৃথিবীতে আসা যাওয়া করছে।
খ্রিস্টান ইউরোপ বা মুসলিম মধ্যপ্রাচ্য থেকে নয়,মানুষের আমেরিকার টিকিট কাটা শুরু হয়েছিল জাপান,চীন বা আফ্রিকার কোন কালো মানুষের মাধ্যমেই।
অথবা,শুরুটা পলিনেশিয়ান নাবিকদের দিয়েও হতে পারে,প্যাটাগোনিয়ার মালভুমিতে একবার দুটো মুরগির শুকনো হাড় পাওয়া যায়,কার্বন টেস্ট করে পাওয়া গেছিল,মুরগি দুটো সেখানে এসেছে অন্তত তিন হাজার বছর আগে,এবং সেগুলো পলিনেশিয়ান বনমুরগি।
আমেরিকা আবিষ্কারের পেটেন্ট তাই ইউরোপিয়ান এক্সপ্লোরার বা ইসলামিক মুবাল্লিগ কারোরই প্রাপ্য নয়,সেটা বরং পেতে পারেন কোন আফ্রিকান বা পলিনেশিয়ান নাবিক বা চাইনিজ অভিযাত্রী।
কিন্তু তাদের দুটো ঘাটতি ছিল।
এক নম্বর ঘাটতি ছিল,তারা ঐ জায়গাগুলোকে কলোনাইজ করতে পারেন নি।
দুই নম্বর ঘাটতি হল,তারা কখনোই আসা যাওয়ার রাস্তাকে নেভিগেশন চার্টে নিয়ে আসতে পারেন নি।খাসখাস ইবনে সাইদের চার্ট নাকি ছিল,কিন্তু হালাকু খানের হাতে বাগদাদের বাইতুল হিকমাহ ধ্বংসের সাথে সাথে সেটাও হারিয়ে গেছে।
তাই, ১৪৯২ সালে কলম্বাস যখন আমেরিকা আবিষ্কার করেন,তখন একটা নতুন যুগের শুরু হয়।তিনি শুধু গিয়ে ফিরে আসেন নি,আসা যাওয়ার পুরো পথ নেভিগেশন করে খুলে দিয়েছেন অজানাকে জানার স্থায়ী পথ।
সেই সাথে তিনি জন্ম দিয়েছেন দুটো
শব্দের,কলোনাইজেশান আর গ্লোবালাইজেশান।
ভু-গোলকটা কিভাবে ইউরোপের হাতের মুঠোয় ঢুকলো,সেই গল্পের শুরুটা এখানেই।

উৎস ঃ http://www.somewhereinblog.net/blog/smahmud8810/30195508

Saturday, August 5, 2017

আমি কিন্তু খুব সহজেই কেঁদে ফেলি – পাওলো কোয়েলহো



বর্তমান সময়ের লেখকদের মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ব্রাজিলিয়ান লেখক পাওলো কোয়েলহো। কোয়েলহোর সবচে’ বিখ্যাত বই দি অ্যালকেমিস্ট ১৯৮৮ সালে প্রকাশ পাবার পর থেকে এ পর্যন্ত ৬৯টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। তাঁর এ সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করেছিলো ইন্ডিপেন্ডেন্ট অনলাইন, ১২ জানুয়ারী, ২০১২ তারিখে। ব্যক্তি জীবনে কেমন মানুষ পাওলো কোয়েলহো? এ বিশটি প্রশ্নে তার পুরোপুরি জবাব না মিললেও কিছুটা চেনা যাবে প্রিয় লেখককে…

ইন্ডিপেন্ডেন্ট : আপনার বাবা-মা সম্পর্কে কিছু বলুন-

পাওলো কোয়েলহো : উনাদের সম্পর্কে তেমন কিছু বলার নেই। আমার লেখক হবার কথা শুনে আমার বাবা-মা এতোটাই আশাহত হয়ে গিয়েছিলেন যে তারা আমাকে তিন-তিনবার মানসিক হাসপাতালে বন্দী করে রেখেছিলেন! সেই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার আলোকে আমি ৩৫ বছর পর একটি বই লিখি, Veronica decides to die।

Wednesday, August 2, 2017

কণা পদার্থবিদ্যার প্রথম পাঠ


প্রজাতি হিসাবে আমাদের বড় গর্বের একটা ব্যাপার যে আমরা মানুষেরা এই আপাত অসীম বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ঘটে চলার নানা ঘটনার পেছনের কারণগুলো ব্যাখ্যা করতে পারি। এটার কারণ আমরা কৌতুহলী। আমরা আমাদের আশেপাশের অনেক কিছুই পর্যবেক্ষণ করি। সেগুলো বিচার বিশ্লেষণ করে কোন একটা নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলার চেষ্টা করি কিংবা নতুনভাবে কিছু ধারণার জন্ম দেই। নতুন ধারণাগুলোর পরীক্ষা করি। পরীক্ষায় উৎরে গেলে সেটাকে আগলে রাখি, না হলে বাদ দেই। এভাবেই আমাদের জ্ঞান বিকশিত হয়, নতুন নতুন ধারণা আসে আর আমরা একটু একটু করে এগোই। পদার্থের গঠন সংক্রান্ত ব্যাপারেও তার ব্যত্যয় ঘটে নি।

পদার্থের গঠন  নিয়ে সবার আগে যিনি তার চিন্তাভাবনা প্রকাশ করেন তার নাম ডেমোক্রিটাস। এই গ্রীক দার্শনিকের ভাবতেন যে প্রত্যেক পদার্থ  ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা দ্বারা তৈরি।এগুলোর তিনি নাম দিয়েছিলেন এটম বা পরমাণু। উনি ভাবতেন পরমাণু অবিভাজ্য ,অপরিবর্তনশীল ও অবিনশ্বর। তার সমসাময়িক লিউসিপাস নামের আরেকজন অনেকটা তার মতো করেই পদার্থের ক্ষুদ্রতম অংশ নিয়ে কথা বলেছিলেন।

ডেমোক্রিটাস ও লিউসিপাসের মৃত্যুর অনেক বছর পরে ১৮০৩ সালে জন ডালটন পরমাণু নিয়ে আরো সুসঙ্গত কিছু মতবাদ প্রকাশ করেন। যেটাকে আমরা ডালটনের পরমাণুবাদ হিসাবে জানি।  ডেমোক্রিটাসের পরমাণু সংক্রান্ত বেশ কিছু ধারণায় পরিবর্তন আনলেও ডালটন পরমাণুর অবিভাজ্যতার ব্যাপারটা মেনে নিয়েছিলেন অর্থাৎ ডালটনের কাছেও মনে হতো পরমাণুই সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম কণিকা।

ডালটন ভুল ছিলেন। অবশ্য এতে তাকে খুব বেশী দোষারোপ করা যায় না কারণ ডালটন যে যুগে জন্মেছিলেন সে যুগে আসলে প্রযুক্তিগত সুযোগসুবিধা ছিলো অপ্রতুল আর একেবারেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে গবেষণা চালিয়ে যাওয়া স্কুলশিক্ষক ডালটনের পক্ষে এরচেয়ে বেশি কিছু করাটাও বেশ কষ্টসাধ্য ছিলো। ডালটনের মতবাদের ভুলটা ধরা পড়ে ১৮৯৭ সালের দিকে। ইংরেজ পদার্থবিজ্ঞানী জোসেফ জন থমসন ক্যাথোড রশ্মির প্রকৃতি বা আচরণ নির্ণয় করতে গিয়ে পরমাণুর অভ্যন্তরে ঋণাত্বক একপ্রকার কণার অস্তিত্ব খুঁজে পান। উনি এগুলোর নাম দিয়েছিলেন ‘করপুসলস (Corpuscles)”। পরে এই কণাগুলোর নাম দেয়া হয় ইলেকট্রন। তার এই আবিষ্কারের পরপরই এটা নিশ্চিত হয়ে যায় যে আসলে পরমাণু অবিভাজ্য নয়। থমসন দেখিয়েছিলেন যে পরমাণুর মোট ভর ও আয়তনের তুলনায় ইলেকট্রন খুবই সামান্য । থমসন ভেবেছিলেন যে পরমাণু একটা ধনাত্বক চার্জের ক্ষেত্র যার বিভিন্ন অংশে সুষমভাবে ছড়িয়ে আছে ঋণাত্বক চার্জবিশিষ্ট ইলেকট্রন। পরমাণুর এই ধরনের গঠনটার নাম দেয়া হয় “Plum Pudding Model” ।



তবে এই গঠনশৈলি বা মডেল খুব বেশিদিন টেকেনি। থমসনেরই ছাত্র পদার্থবিজ্ঞানী রাদারফোর্ড ১৯১১ সালে বিখ্যাত আলফা কণা বিচ্ছুরণ সংক্রান্ত পরীক্ষার মাধম্যে এটা দেখাতে সক্ষম হন যে পরমাণু আসলে কোন ধনাত্বক চার্জের ক্ষেত্র নয়, বরং তার একটি অতিক্ষুদ্র, ভারী ধনাত্বক চার্জবিশিষ্ট কেন্দ্র আছে এবং এই ভারী ধনাত্বক চার্জের কেন্দ্রকে ঘিরেই ঋনাত্বক চার্জবিশিষ্ট ইলেকট্রন আবর্তিত হয়। এই কেন্দ্রের নাম দেয়া হয় নিউক্লিয়াস। তবে নিউক্লিয়াসের আকার পরমাণুর তুলনায় একেবারেই নগন্য। পরমাণুর ব্যাসের প্রায় এক লক্ষ ভাগের এক ভাগ হল নিউক্লিয়াসের ব্যাস।



রাদারফোর্ডের এই আবিষ্কারের পর স্বাভাবিকভাবেই এটা ধরে নেওয়া হয় যে পরমাণুর কেন্দ্র বা নিউক্লিয়াস কিছু ধনাত্বক আধানযুক্ত কণা দ্বারা তৈরি। এদের নামকরণ করা হয় প্রোটন( প্রোটন>প্রোটস(গ্রীক, অর্থঃ প্রথম) )। তবে ১৯৩২ সালের মাঝামাঝি সময়ে রাদারফোর্ডেরই একজন সহকর্মী যার নাম জেমস চ্যাডউইক পরমাণুর নিউক্লিয়াসে আরো একটি কণার অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। একেবারেই চার্জবিহীন এই কণার নাম দেয়া হয় নিউট্রন। দেখা গেল চার্জবিহীন এই কণাটির ভর প্রোটন ও ইলেকট্রন থেকে অনেক অনেক বেশী। যেহেতু প্রোটন ধনাত্বক আধানবিশিষ্ট তাহলে সেক্ষেত্রে কুলম্বের সুত্র অনুযায়ী সমধর্মী প্রোটনগুলো পরস্পর বিকর্ষিত হয়ে একে অপরের থেকে দূরে সরে যাবার কথা ছিলো, কিন্তু তারা কেন সহাবস্থানে আছে সেটার ব্যাখ্যা রাদারফোর্ড বা চ্যাডউইক কেউই দিতে পারেননি।



এই পর্যায়ে আমরা প্রকৃতিতে ক্রিয়াশীল মৌলিক বলগুলো নিয়ে একটু আলোচনায় আসতে পারি। প্রথম বলের আবিষ্কারক স্যার আইজ্যাক নিউটন। উনি ১৬৬৪ সালে মহাকর্ষ বল আবিষ্কার করেন। এটিই সবচেয়ে দুর্বলতম বল তবে এর পাল্লা বা প্রভাব-বলয় অসীম। এর কেবলমাত্র আকর্ষণ ক্ষমতা আছে। এরপর আছে বৈদ্যুতিক বল ও চৌম্বকীয় বল। পরে অবশ্য ১৯৭৮ সালে সালাম-ভাইনবার্গ বৈদ্যুতিক ও চৌম্বকীয় বলকে একটি অভিন্ন বল হিসাবে দেখাতে সক্ষম হন এবং এর নাম দেয়া হয় তড়িৎচুম্বকীয় বল। এটা আকর্ষণও করে আবার বিকর্ষণও করতে পারে।  যখন চ্যাডউইক এবং রাদারফোর্ড পরমাণুর কেন্দ্রে একই চার্জবিশিষ্ট প্রোটনের সহাবস্থানের ব্যাখ্যা দিতে পারেননি, তখন জাপানী বিজ্ঞানী হিডেকি ইউকাওয়া নিউক্লিয়াসে আরো এক ধরনের বলের অস্তিত্বের থাকার ব্যাপারে নিজের মত প্রকাশ করেন। ১৯৪৬ সালে তার এই অনুমান সঠিক প্রমাণিত হয়। দেখা যায় পরমাণুর নিউক্লিয়াসে আরো একধরনের বলের অস্তিত্ব আছে যেটা এতটাই শক্তিশালী যে প্রোটন প্রোটন বিকর্ষণ বলকেও অগ্রাহ্য করে সে একই চার্জযুক্ত প্রোটন ও নিউট্রনগুলোকে বেঁধে রাখতে পারে। অর্থাৎ নিশ্চিতভাবেই এই বল তড়িতচ্চুম্বকীয় বলের চেয়েও বেশী শক্তিশালী। এই বলের নাম দেয়া হল নিউক্লিয় বল। প্রকৃতপক্ষে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃক বলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী বল নিউক্লিয় বল, তবে অন্য বলগুলোর মত এটার পাল্লা অতটা বড় নয়, অতীব ক্ষুদ্র। কেবলমাত্র নিউক্লিয়াসের মধ্যেই এই বল কাজ করতে পারে। নিউক্লিয় বলের দুটি ভাগ আছে, একটিকে বলা হয় সবল নিউক্লিয় বল ও দুর্বল নিউক্লিয় বল। তবে যেহেতু নিউক্লিয় বলের পাল্লা বা প্রভাব-বলয় অত্যন্ত ক্ষুদ্রাকায় সেকারনেই বেশি প্রোটন সমৃদ্ধ পরমাণুর ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা রক্ষা করা সম্ভব হয় না। এইজন্য নিউক্লিয়াস কিছু বিশেষ অবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে অধিকতর স্থিতিশীল হবার চেষ্টা করে, যাকে বলা হয় তেজস্ক্রীয়তা। যাদের পারমানবিক সংখ্যা ৮২’র অধিক তারাই তেজস্ক্রিয় পরমাণু। সবচেয়ে জনপ্রিয় উদাহরণ হল “ইউরেনিয়াম”।

তো নিউট্রন আবিষ্কারের পরে অনেকে ভেবেছিলেন সম্ভবত কণা-পদার্থবিদ্যার সমাপ্তি ঘটেছে। অনেকে ভেবেছিলেন, যেহেতু পরমাণু ইলেকট্রন প্রোটন ও নিউট্রন দ্বারা তৈরি তাই সম্ভবত এরাই মৌলিক কণা এবং এদেরকে হয়তো আর বিভাজিত করা যাবে না। কিন্তু দ্রুতগতির প্রোটন ও ইলেকট্রনের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটিয়ে দেখা গেছে যে এরাও অবিভাজ্য নয় বরং এরা আরো ক্ষুদ্রতম কণা দিয়ে গঠিত। পদার্থবিজ্ঞানী মারে গিলম্যান এদের নামকরণ করেন “কোয়ার্ক”।



পদার্থবিদ মারে গিলম্যান




বৈশিষ্টের ভিন্নতার ভিত্তিতে কোয়ার্কদের ছয়টি ফ্লেভারে বা বিভাগে ভাগ করা হয়েছে যথা UP, Down, Strange, Charmed ও bottom. প্রত্যেক ফ্লেভারে আবার লাল, নীল, সবুজ এই তিন রংয়ের কোয়ার্ক আছে। বস্তুত কোয়ার্কের কোন রং বা ফ্লেভার নেই কেবলমাত্র একটা চিহ্ন বা বোঝার সুবিধার্থেই এই শব্দগুলো ব্যবহার করা হয়ে থাকে। দুটি UP ও একটি bottom কোয়ার্ক নিয়ে একটি প্রোটন বা দুটি bottom ও একটি UP কোয়ার্ক নিয়ে একটি নিউট্রন তৈরি হয়। আবার অনেকের মতে কোয়ার্কও অবিভাজ্য নয়। প্রিয়ন নামের একপ্রকার কণা দ্বারা তৈরি হয় কোয়ার্ক। যদিও প্রিয়ন নামের কণাটির অস্তিত্ব আজো পাওয়া যায়নি। তবে কোয়ার্করা ক্রিয়াশীল হয় অন্য একটি কণার প্রভাবে, যার নাম গ্লুওন।



কোয়ার্ক দিয়ে প্রোটন নিউট্রনের গঠন




মূলত ১৯৫০ সালের পরে পার্টিকেল এক্সিলারেটরের ও ডিটেক্টরের প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়। এর ফলে ১৯৫০ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু ক্ষণস্থায়ী ও তুলনামূলক দীর্ঘস্থায়ী কণিকা আবিষ্কৃত হয়। বেশ কজন বিজ্ঞানী নতুন নতুন কণিকা শনাক্ত করে নোবেলও পেয়েছেন।   পার্টিকেল এক্সিলারেটর, বাংলায় যার অর্থ কণা-ত্বরক এটি এক ধরণের যন্ত্র যেটি তড়িৎচুম্বকীয় ক্ষেত্র ব্যবহার করে একটা কণাকে প্রায় আলোর গতির কাছাকাছি গতিতে গতিশীল করতে সক্ষম। তবে কণা পদার্থবিদ্যায় (particle Physics) পার্টিকেল এক্সিলারেটর মূলত ব্যবহার করা হয় সংঘর্ষকারী (collider) হিসেবে। যেমন সার্নের (C. E. R. N = European Organization for Nuclear Research) তৈরি L. H. C. (Large Hadron Collider) । এটি সবচেয়ে বড় পার্টিকেল এক্সিলারেটর। মাটির নিচে প্রায় ১৭৫ মিটার গভীরে থাকা ২৭ কিলোমিটার ব্যাপ্তির এই বিশাল যন্ত্র ফ্রান্স সুইজারল্যান্ডের সীমানায় স্থাপন করা হয়েছে।



সার্ণের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারের একটি অংশ






পার্টিকেল এক্সিলারেটর ও সাথে বেশ কিছু পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে (যেমন কসমিক রে) এখন পর্যন্ত একশোরও অধিক মৌলিক কণা আবিষ্কার করা সম্ভব হয়েছে। কিছু বৈশিষ্টের উপর ভিত্তি করে কণাগুলোকে ভাগ করা হয়। তবে শুধুমাত্র ভরের তারতম্যের উপর ভিত্তি করে আমরা কণাগুলোকে দুইভাগে ভাগ করতে পারি যথাঃ ১। লেপটন ২। হ্যাড্রন।

হ্যাড্রনরা অন্যসব কণিকার চেয়ে তুলনামূলক ভারী। হ্যাড্রন আবার ব্যারিয়ন (উদাহরণ- প্রোটন) এবং মেসন (উদাহরণ-পাইওন) এই দুইটি ভাগে বিভাজিত। এরা নিউক্লিয় বলের প্রভাবেই থাকে এবং কোয়ার্ক দিয়েই তৈরি। এখানে মেসন কিছুটা ভিন্নধর্মী কারণ এতে একটি কোয়ার্ক ও একটি প্রতি-কোয়ার্ক বা অ্যান্টি কোয়ার্ক থাকে। অন্যদিকে লেপটনরা দূর্বল নিউক্লিয় বলের প্রভাবে থাকে। লেপটনের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দুটি কণিকা ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো। ইলেকট্রনকে ভাঙা এখনও সম্ভব হয় নি। আর নিউট্রিনোকে কিছুদিন আগ পর্যন্তও ভরহীন ভাবা হলেও দেখা গেছে যে এদেরও যৎসামান্য ভর আছে। কয়েক বছর আগে একটা পরীক্ষায় নিউট্রিনো আলোর বেগের চেয়েও বেশী বেগে ধাবিত হবার কথা শোনা গেলেও পরে সেটা ভুল প্রমানিত হয়েছিলো।

আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত সকল কণিকাদের নিয়ে একটা সুশৃঙ্খল বিন্যাস করা করা হয়েছে, যা অনেকটাই পর্যায় সারণীর মতো দেখতে এবং তার নাম দেওয়া হয়েছে দ্যা স্ট্যান্ডার্ড মডেল। বহু বিজ্ঞানীর পরিশ্রমের ফসল স্ট্যান্ডার্ড মডেল এখন পর্যন্ত সবচেয়ে সফলতম বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলোর একটি। এখনো পর্যন্ত ১৭ টি কণা এই মডেলে স্থান পেয়েছে । এটার একটা অংশে রাখা হয়েছে ফার্মিওনদের যারা মূলত পদার্থের গাঠনিক উপাদান হিসেবে কাজ করে (Matter Particle)। আরেকটি অংশ বোসনদের জন্য যারা মূলত বলের বাহক(Force Carirrer) হিসেবে কাজ করে।  সর্বশেষ ২০১২ সালে আবিষ্কৃত হিগস বোসন নামের কণা এই মডেলের একটি অমীমাংসিত  অংশকে পূরণ করেছে।



স্ট্যান্ডার্ড মডেল




প্রকৃতির তিনটা মৌলিক বল (সবল ও দুর্বল নিউক্লিও বল এবং তড়িৎচুম্বকীয় বল) কিভাবে কাজ করে বা করতে পারে তার সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা দেয় স্ট্যান্ডার্ড মডেল । তবে এটি এখনো পর্যন্ত মহাকর্ষ বলের ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেনি। তবুও এই মডেলকে কেন্দ্র করেই একটা একীভূত তত্ত্ব (Unified Field Theory) তৈরির চেষ্টা চলছে যেটা দিয়ে প্রকৃতির চারটা বলের সবকিছুই ব্যাখ্যা করা যাবে। আরেকটু সুন্দরভাবে বললে বলা যায় The Theory of Everything.

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে কণাদের নিয়ে আমাদের জ্ঞানটা প্রতিনিয়তই বিকশিত হচ্ছে। কে জানে আরো চমকপ্রদ কোন কিছু অপেক্ষা করছে আমাদের সামনে। সেটা আপাতত তোলা থাক সময়েরই হাতেই।

উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ..

লাস্ট লিফ by ও হেনরী




ওয়াশিংটন স্কয়ারের পশ্চিমে এক ছোট জেলা, যেখানে রাস্তাগুলো অনিরাপদভাবে ছুটে চলেছে এবং ভেঙে ভেঙে নিজেদের ভিতরে ছোট ছোট ‘গলি’ তৈরী করেছে। এই গলিগুলোতে গড়ে উঠেছে অদ্ভুত সব কোণা কানছি আর বাঁক। একটি রাস্তা নিজের উপর দিয়ে এক দুইবার করে অতিক্রম করে গেছে। একবার এক চিত্রশিল্পী এই রাস্তাটির মাঝে এক মূল্যবান সম্ভাবনা আবিষ্কার করে বসলেন। মনে করুন, একজন সংগ্রাহক রঙ, কাগজ এবং ক্যানভাসের জন্য বিল সাথে নিয়ে এই পথের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, হঠাৎকরে দেখল সে আগের জায়গায়ই ফিরে এসছে, এর জন্য তাকে এক পয়সাও খরচ করতে হয় নি!

তাই, চিত্রশিল্পীরা খুব তাড়াতাড়ি ঘুরতে ঘুরতে এই অদ্ভুত পুরনো গ্রিনিচ গ্রামে চলে এল, খুঁজে বের করল উত্তর দিকের জানালাসহ আঠার শতকের পুরনো গ্যাবল (ডাচ গ্যাবল জ্যাকোবিয়ান সময়ের ইংল্যান্ডের বিশেষ স্থাপত্যের বাড়ী), কম ভাড়ায় এক ডাচ চিলেকোঠা। এরপর তাঁরা ছয় নম্বর এভিনিউ থেকে রান্না করা ও খাবার গরম রাখার জন্য চুল্লিযুক্ত দুই একটি পাত্র এবং কিছু পিউটর মগ নিয়ে এসে এখানে কলোনি গড়ল।