Monday, December 2, 2019

বিজ্ঞানের সেরা দশ রহস্য


বিজ্ঞানের অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে কথা উঠলে অনেককে হয়তো বলতে শুনবেন বিবর্তনবাদের সত্যতা, দ্রুত জলবায়ু পরিবর্তনের অস্তিত্বের কথা, অথবা ভ্যাকসিন আসলেই নিরাপদ কিনা। কিন্তু এগুলো নিয়ে আসলে বিজ্ঞানে কোনো বিতর্ক নেই। বিবর্তনবাদ আসলেই প্রমাণিত সত্য, জলবায়ু পরিবর্তনও ঘটছে খুব দ্রুত, এবং ভ্যাকসিন আসলেই শিশুদের জন্য নিরাপদ। এগুলোর একদম নগণ্য কিছু ব্যাপার নিয়ে বিতর্ক আছে, কিন্তু মূল বিষয়গুলো নিয়ে নয়। তাই বলে বিজ্ঞানীরা কিন্তু এই মহাবিশ্বের ব্যাপারে সব জেনে বসে নেই।

পদার্থবিদ ব্রায়ান কক্স বলেছিলেন, “অজানা বিষয় আমাকে নার্ভাস করে না – বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য তো এটাই। এমন বিলিয়ন বিলিয়ন জায়গা আছে, যেগুলোর ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না। আর এই না জানাটা আমাকে আগ্রহী করে তোলে, সেগুলোর ব্যাপারে জানার জন্য। এবং এটাই বিজ্ঞান। অজানার ব্যাপারে ভাবতে গিয়ে আপনি যদি সহজ হতে না পারেন, তাহলে বিজ্ঞানী হওয়াটা আপনার জন্য বেশ কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। আমি কেবল একটা উত্তর চাই না। আমি সবকিছুর উত্তর চাই না। আমি চাই – এমন কিছু ব্যাপার থাকুক, যেটার উত্তর খুঁজতে হবে।”

তো, বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় রহস্যগুলো কী? এই নিন, আমাদের সেরা দশ!

(১)


পার্টিক্যাল ফিজিক্স নিয়ে আমাদের সাম্প্রতিক ধারণা বলে যে, ম্যাটার এবং এন্টিম্যাটার (বস্তু ও প্রতিবস্তু) আসলে সমান ও বিপরীতমুখী। যখন এদের মোলাকাত ঘটে, তখন এরা একজন আরেকজনকে ধ্বংস করে দেয়, কিছুই বাকি রাখেনা। এবং এ ধরনের অধিকাংশ ধ্বংসযজ্ঞ ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির প্রথম দিকে হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরেও এতো এতো বস্তু রয়ে গেছে যেগুলো দিয়ে আমাদের বিলিয়ন বিলিয়ন ছায়াপথ, নক্ষত্র, গ্রহ, এবং অন্যান্য সবকিছু তৈরি হয়েছে। তাহলে, এন্টিম্যাটার কই?

Slide2

কিছু কিছু ব্যাখ্যা আছে মেসনকে কেন্দ্র করে। মেসন হচ্ছে ক্ষণজীবী সাব-এটমিক পার্টিক্যাল, যা একটা কোয়ার্ক এবং একটা এন্টি-কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি। বি-মেসন কণাগুলো এন্টি-বি-মেসনের চেয়ে একটু ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। এর ফলাফল অনুসারে, যথেষ্ট পরিমাণ বি-মেসন কণা টিকে গেছে, আর তা দিয়েই ব্রহ্মাণ্ডের সকল বস্তু তৈরি হয়েছে। তাছাড়া, বি, ডি, এবং কে-মেসন কণা নিজেদের স্পিন পরিবর্তন করতে পারে – একবার এন্টি-পার্টিক্যাল, আবার পার্টিক্যাল হতে পারে। রিসার্চে দেখা গেছে, মেসন কণা সাধারণত নরম্যাল অবস্থা (পার্টিক্যাল/বস্তুর রুপ) ধারণ করে, আর এজন্যেই সাধারণ বস্তুর পরিমাণ প্রতিবস্তুর চেয়ে বেশি।

(২)


ব্রহ্মাণ্ডের শুরুর দিকে, তাপমাত্রা ছিলো অনেক বেশি। তখন হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, আর লিথিয়ামের আইসোটোপ বেশ ব্যাপক হারে সংশ্লেষিত (synthesized) হয়েছে। হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম এখনো ব্যাপকভাবে বিদ্যমান। বলতে গেলে, ব্রহ্মাণ্ডের পুরো ভরটুকু এগুলো দিয়েই তৈরি। কিন্তু লিথিয়াম-৭ আইসোটোপ যতটুকু দেখা যাওয়ার কথা, তার মাত্র ৩৩% আমরা দেখতে পাই।

Slide3

কেন এমনটা ঘটলো, সেটার পেছনে বেশ কিছু ধরনের ব্যাখ্যা শোনা যায়। একটা হাইপোথিসিস হচ্ছে, অ্যাক্সিয়ন নামে একটা হাইপোথেটিক্যাল বোসন কণার উপস্থিতি। অন্যরা মনে করেন, লিথিয়াম আটকে গেছে নক্ষত্রগুলোর একদম গভীরে, কেন্দ্রের কাছাকাছি। আর এটা তো আমাদের বর্তমান টেলিস্কোপ বা অন্যান্য যন্ত্রপাতি দিয়ে সনাক্ত করা যাবে না। যাই হোক, একেবারে শক্তপোক্ত কোনো ব্যাখ্যাই এই দৌড়ে পরিষ্কারভাবে এগিয়ে নেই।

(৩)


আমরা এতোটুকু জানি যে, মানবদেহ একটা চক্রাকার ঘড়ির সাথে তাল মিলিয়ে চলে, আর সেটাই মানুষকে ঘুম আর জেগে থাকার চক্র মেনে চলতে সহায়তা করে। এর পেছনের কারণটা কিন্তু আমরা জানিনা। ঘুমের সময়টাতে আমাদের দেহ টিস্যু মেরামত করে, অন্যান্য রক্ষণাবেক্ষণমূলক কাজ করে। বলতে গেলে, আমরা আমাদের জীবনের তিন ভাগের এক ভাগ নাক ডেকেই কাটাই। আবার, কোনো কোনো প্রাণী তো একেবারেই ঘুমায় না। আমরা কেন ঘুমাই?

Slide4

বেশ কিছু ধারণা প্রচলিত আছে এ ব্যাপারে, কিন্তু কেউই একদম পাকা কোনো উত্তর দিতে পারেনি। কেউ কেউ বলেন, বিবর্তনের সুবাদে যেসব প্রাণী শিকারীদের হাত থেকে লুকানোর সামর্থ্য অর্জন করেছে, তারা ঘুমানোর সুযোগ বের করে নিতে পেরেছে। কিন্তু যাদেরকে সবসময়েই সতর্ক থাকতে হয়, তারা ঘুম ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে বিশ্রাম নেয়ার বা নতুন উদ্যম অর্জন করার সামর্থ্য পেয়ে গেছে। বিজ্ঞানীরা যদিও জানেন না আমরা কেন ঘুমাই, কিন্তু তারা বুঝতে পারছেন, ঘুমের প্রয়োজনীয়তা বা গুরুত্ব আসলে কতখানি (যেমন, মস্তিষ্কের স্থিতিস্থাপকতা ঠিক রাখা)…

(৪)


সবাই জানি যে, চাঁদের আকর্ষণের ফলে জোয়ার-ভাটা হয়, পৃথিবীর অভিকর্ষের ফলে আমরা মাটিতে আটকে থাকি, বা সূর্যের মহাকর্ষেই গ্রহগুলো নির্দিষ্ট কক্ষপথে ঘুরতে থাকে। কিন্তু, আসলে আমরা কতটুকু বুঝি মহাকর্ষের?

Slide5

বস্তু থেকে এ ধরনের শক্তিশালী একটা বল তৈরি হয়, এবং দানবীয় বস্তুগুলোর অন্যান্য বস্তুকে আকর্ষণ করার ক্ষমতাও বেশি। বিজ্ঞানীরা ভালোই বোঝেন, মহাকর্ষ কীভাবে কাজ করে। কিন্তু জানা নেই, কেন এই বল অস্তিত্বশীল। কেন পরমাণু জিনিসটা বলতে গেলে পুরোটাই ফাঁপা? পরমাণুকে যে বল ধরে রাখে, কেন সেটা মহাকর্ষের চেয়ে ভিন্ন। মহাকর্ষ কি আসলে কোনো বস্তু? পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে আমাদের বর্তমান যে ধারণাগুলো আছে, সেগুলো দিয়ে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়া যায় না এখনো।

অনুবাদক নোট – মহাকর্ষ কিভাবে কাজ করে, তা বোঝার ক্ষেত্রে আমরা আরেক ধাপ এগিয়ে গেছি মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আবিষ্কারের পর।

(৫)


দৃশ্যমান ব্রহ্মাণ্ডের ব্যাস ৯২/৯৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। অর্থাৎ, এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত যেতে, আলোর লেগে যাবে ৯২/৯৩ বিলিয়ন বছর। বিশাল এই মহাবিশ্ব ছায়াপথ, নক্ষত্র, আর গ্রহ দিয়ে ঠাসা। কিন্তু এখন পর্যন্ত পৃথিবী ছাড়া অন্য কোথাও প্রাণের যথোপযুক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পরিসংখ্যানগত দিক থেকে, পুরো মহাবিশ্বে আমরাই একমাত্র প্রাণসমৃদ্ধ গ্রহের বাসিন্দা, এমনটা হবার সম্ভাবনা প্রায় একেবারেই অসম্ভব। তাহলে, এখন পর্যন্ত কারো সাথে যোগাযোগ তৈরি হলো না কেন?

Slide6

এটাকে বলে ফার্মি’র ধাঁধাঁ (Fermi Paradox). এবং কেন মহাজাগতিক প্রাণীর দেখা পেলাম না – এটার ব্যাখ্যা আছে বেশ কয়েক ডজন, প্রত্যেকটা শুনতে আগেরটার চেয়ে চমৎকার। ঐ সম্ভাবনাগুলো নিয়ে আমরা দিনের পর দিন আলোচনা করে যেতে পারি – আমরা কি কোনো সিগন্যাল মিস করলাম, তারা কি এসে আমাদের অজান্তেই চলে গেলো, ওরা কি আমাদের সাথে কথা বলতে পারেনি অথবা ওদের ইচ্ছাই হয়নি, নাকি সবচেয়ে অদ্ভুত এবং প্রায় অসম্ভব (পৃথিবীই একমাত্র প্রাণময় গ্রহের) ব্যাখ্যাটাই সত্য?

(৬)


মহাবিশ্বের সমগ্র ভরের প্রায় ৮০ ভাগই ডার্ক ম্যাটার দিয়ে তৈরি। ডার্ক ম্যাটার জিনিসটা বড় অদ্ভুত, এরা তো কোনো আলো প্রতিফলিত করেনা। যদিও ৬০ বছর আগে এদের অস্তিত্বের তত্ত্ব হাজির করা হয়েছিলো, তবু এখন পর্যন্ত এদের অস্তিত্বের কোনো যথাযথ প্রমাণ নেই।

Slide7

অনেক বিজ্ঞানী ধারণা পোষণ করেন যে, ডার্ক ম্যাটার আসলে দুর্বলভাবে মিথষ্ক্রিয়ারত দানবীয় বস্তু, যাকে ইংরেজিতে বলে WIMP (Weakly Interacting Massive Particle). জিনিসটা প্রোটনের চেয়ে ১০০ গুণ দানবীয় হতে পারে। কিন্তু, baryonic matter এর সাথে এরা স্বাভাবিক অবস্থায় কোনো প্রতিক্রিয়া করে না। আর তাই, সনাক্ত করার জন্য আমরা যে যন্ত্রপাতিগুলো ব্যবহার করি, সেগুলোতে এদেরকে ধরা যায়না। ডার্ক ম্যাটারের উপাদান হবার দৌড়ে এগিয়ে আছে axions, neutralinos, and photinos.

(৭)


পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব কীভাবে হলো? কোত্থেকে এলো? যারা মনে করেন, আদিম/মৌলিক স্যুপ মডেলকে কারণ হিসেবে মনে করেন, তাদের ধারণা – আদিম পৃথিবী এতোটা পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ ছিলো যে, সেখান থেকে জটিল থেকে জটিলতর অণু তৈরি হয়েছে, যা অবশেষে প্রাণের উৎপত্তি ঘটিয়েছে। এটা গভীর সমুদ্রের তলদেশে, আগ্নেয়গিরির জালামুখে ঘটে থাকতে পারে, কাদাতেও হতে পারে, বরফের নিচেও হতে পারে। ভিন্ন ভিন্ন মডেলে, প্রাণের উৎপত্তির ক্ষেত্রে, বজ্রপাত বা আগ্নেয়গিরির কর্মকাণ্ডকে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার গুরুত্ব দেয়া হয়ে থাকে।

Slide8

এখন পৃথিবীতে প্রাণের সর্বময় ভিত্তি হচ্ছে ডিএনএ (DNA). বিজ্ঞানীদের ধারণা, প্রথমদিকের প্রাণের ক্ষেত্রে আরএনএ (RNA)-ই প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। পাশাপাশি, অন্য কিছু বিজ্ঞানী DNA, RNA ছাড়া অন্যান্য নিউক্লিক এসিডের উপস্থিতির কথাও প্রস্তাব করেছেন। প্রাণ কি মাত্র একবারই তৈরি হয়েছে? নাকি তৈরি হয়ে, বিলুপ্ত হয়ে, আবার তৈরি হয়েছে? কেউ কেউ panspermia তে বিশ্বাস করেন, যে মত অনুসারে পৃথিবীতে প্রাণ নিয়ে এসেছে কোনো ধূমকেতু বা মহাজাগতিক প্রস্তরখণ্ড। এমনটা যদি ঘটে থাকে, তাহলে প্রশ্ন রয়েই যায়, ঐ প্রাণ কীভাবে তৈরি হলো?

(৮)


শুনতে আশ্চর্য লাগলেও, কনটিনেন্টাল প্লেটের নড়াচড়া, মহাদেশকে নতুন আকৃতি দেয়া, ভূমিকম্প ঘটানো, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, এমনকি পর্বতের উত্থান – এই থিওরিগুলো আসলে খুব সাম্প্রতিক সময়ে জনপ্রিয় হয়েছে। যদিও ১৫০০ সালের দিকেই প্রস্তাব এসেছিলো যে, মহাদেশগুলো একসময় একটাই ভূ-খণ্ড ছিলো (মানচিত্র দেখলে যে কেউই বুঝতে পারার কথা), তবু ১৯৬০ সালের আগে পর্যন্ত এই ধারণাটা পালে হাওয়া পায়নি। ঐ সময়টাতেই সাগরের মেঝের বিস্তৃতির সপক্ষে শক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়, আর তখনই সাড়ে চারশো বছর পুরনো থিওরি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সাগরের মেঝের বিস্তৃতির ধারণাটা হচ্ছে, ভূ-পৃষ্ঠ থেকে শিলাগুলো ম্যান্টল স্তরে পৌঁছে যায়, ওখানেই রিসাইকেল হয়, এবং আবার ভূ-পৃষ্ঠে উঠে আসে ম্যাগমা হয়ে।

Slide9

অবশ্য, বিজ্ঞানীরা জানেন না, কেন প্লেটগুলো স্থির নেই, অথবা ঠিক কীভাবে প্লেটগুলোর সীমানা নির্ধারিত হলো। আছে থিওরি বেশ কয়েকটাই, কিন্তু কোনোটাই সবগুলো ব্যাপারকে একসাথে ব্যাখ্যা করতে পারেনা।

(৯)


অনেক প্রাণী আর কীটপতঙ্গ এক স্থান থেকে বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করে অন্য স্থানে বাসস্থান স্থাপন করে – প্রধানত, ঋতু ও তাপমাত্রার পরিবর্তন এড়ানোর জন্য, পানি বা খাদ্যের ঘাটতির জন্য, অথবা সংগীর খোঁজে। কিছু কিছু মাইগ্রেশন তো হাজার হাজার কিলোমিটার দূরত্বের হয়ে থাকে। তো, কীভাবে এরা বছরের পর বছর, বারবার যাওয়া-আসার সেই পথের সন্ধান পায়?

Slide10

একেক প্রাণী একেক ধরনের সিস্টেম ব্যবহার করে, যাতায়াতের দিক নির্ণয়ের (ন্যাভিগেশনের) জন্য। কেউ কেউ পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র ব্যবহার করতে পারে, নিজেদের মস্তিষ্কের কম্পাস ব্যবহার করে। যদিও বিজ্ঞানীরা এখনো জানেন না, কীভাবে এই বৈশিষ্ট্য বিবর্তিত হলো; অথবা কীভাবে প্রশিক্ষণ ছাড়াই এই প্রাণীগুলো মৌসুমের পর মৌসুম ধরে ঠিকঠাক ধরে ফেলছে যে আসলেই কোথায় যেতে হবে।

(১০)


বিজ্ঞানের সকল রহস্যের মধ্যে “ডার্ক এনার্জি” হয়তো সবচেয়ে বেশি সাসপেন্সে ভরপুর। একদিকে, ডার্ক ম্যাটার মহাবিশ্বের সমগ্র ভরের ৮০% এর জন্য দায়ী। আর অন্যদিকে, ডার্ক এনার্জি একটা হাইপোথেটিক্যাল এনার্জি, যাকে কৃতিত্ব দেয়া হয় মহাবিশ্বের সকল কিছুর ৭০% তৈরির জন্য।

Slide11

এটার পেছনে অনেক রহস্য এখনো খোলাসা না হলেও, মহাবিশ্বের প্রসারের পেছনে ডার্ক এনার্জির হাত আছে বলে প্রস্তাব করা হয়েছে। অমীমাংসিত রহস্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রথম ও প্রধানটা হলো, ব্যাটা কী দিয়ে তৈরি? ডার্ক এনার্জির পরিমাণ কি অপরিবর্তনীয়? নাকি মহাবিশ্বের একেক জায়গায় একেক রকম? ডার্ক এনার্জির ঘনত্ব কেন সাধারণ বস্তুর ঘনত্বের কাছাকাছি মনে হয়? ডার্ক এনার্জি কি আইনস্টাইনের থিওরি অফ রিলেটিভিটি এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ? নাকি এই থিওরিকে নতুন করে মূল্যায়ন করতে হবে?

 

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/unsolved_mysteries_of_science/

Sunday, December 1, 2019

আমার শহর- ঈপ্সিতা পালভৌমিক


এখানে আকাশ নীল।

নীলের বাড়াবাড়িই। বাড়াবাড়ি তো সবই। বড়বড়ও। এক্স এক্স এল। এক্স এস খুঁজে পাওয়া দায়। আর এদিকে সব এক্সেস। যেদিকে তাকাও। উপরে তাকাও তো এক্সেল কাচা এক্সট্রা হোয়াইট মেঘ। মুখ তুলে তাকাও তো এক্সট্রা হোয়াইটেনিং টুথপেস্টচর্চিত স্মাইল। সামনে তাকাও তো সুপার স্বচ্ছ দরজা। দরজা যে আদৌ আছে তা-ই বোঝা দায়। প্রথম কদিন তো দুর্যোধনবাবুর ইন্দ্রপ্রস্থ ভ্রমণসমদশা।

এমনকি চাঁদটাকেও প্রথম কোজাগরীতে দেখে ব্যোমকে গেছিলাম। একেই কি বলে সুপারমুন?
সুপারমুন, সুপারম্যান, সুপারসাইজ, সুপারবোল , সুপারস্টোর, সুপারপাওয়ার ... বলতে গেলে কেমনি সুপারলাইকই করে ফেলছিলাম। করবনা?
পিকচার ম্যানেজার-ট্যানেজারের দরকার-টরকারই নেই। ব্রাইটনেস, কন্‌ট্রাস্ট সব অটো অ্যাডজাস্ট হয়ে বসে আছে। প্রি কি পোস্ট প্রসেসিং বিলকুল অপ্রয়োজনীয়। সুপারস্টোরের ট্রলিতে ভর্তি প্রসেসড ফুড। ক্যামেরায় ভর্তি প্রসেসড ছবি। অ-সুপারলাইক।
নির্মেঘ নিকোনো নীলের ব্যাকগ্রাউণ্ডে কখনো ঝুলন্ত ডগ টিউলিপের ফুটফুটে গোলাপি কন্‌ট্রাস্ট, কখনও বা জেটের সুপার সফেদ ফেনিল ট্রেইলের কাটাকুটির কেরামতি। অঠিক অমনিতর সফেন নীল সাগরজলের কন্‌ট্র্যাস্টে ঠিক অমনপানা সাদা ডানা ভাসানো সীগাল।
বাঁধানো রাস্তার ধারে সাজানো লাল নীল সবুজের মেলা। উজ্জ্বল হালকা সবুজ ঘাস, উজ্জ্বল গাঢ় সবুজ পাতা। সেই রেডিমেড কনট্র্যাস্টে আরও ব্রাইট লাগে।
ব্রাইট, চকচকে।
এ দেশটা শাইনিং।
এক চিলতে ধুলো নেই।
এখানে আকাশের গায়েও ধুলো নেই।
চোখ ধাঁধিয়ে যায়।
কী ব্রাইট, কী চকচকে, কী শাইনিং।
এখানে রোদের গায়েও ধুলো নেই।
সীগালের ডানায় রোদের গন্ধ কী চড়া।
রোদে ভরে যায় আমার চারপাশ।
আমি ঐ রোদকে ক্যামেরায় ভরি।
ক্যামেরা ভরে যেতে থাকে।
ছবি আর ছবিতে।
ঝকঝকে হাসি, চকচকে লোকজন, ঝকঝকে রোদ্দুর, চকচকে আকাশ - শাইনিং শহরের ছবি।
আর, তারপর একদিন দেখি, আসলে আমার কোন শহরই নেই। আছে কেবল শহরের ছবি। আমি ছবি তুলে চলেছি কতগুলো ছবির।
সবই তো ছবির মতন।
সবাই তো ছবির মতন।
ছবির মতন সুন্দর। পিকচারপারফেক্ট।
আর বেসিক্যলি আমি সেই ছবির ছবি তুলে চলেছি। এক ছবি থেকে আরেক ছবিতে চলে বেড়াচ্ছি। এক ছবি থেকে আরেক ছবিতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। ধাক্কা খাচ্ছি। একটা ছবি পেরিয়ে আরেকটা ছবির মুখে পড়ছি। একটা ছবির পিছনে ঘুরতে ঘুরতে আরেকটা ছবির সামনে গিয়ে পড়ছি।
সব পিকচারপারফেক্ট।
খাপে খাপ।
ডিসক্রিট।
কোন ভীড় নেই। তাই কোন মিশে যাওয়াও নেই।
কোন মীড় নেই।
সব আলাদা আলাদা। একক। ইন্ডিভিজ্যুয়াল। সবাই একক।। সবাই একা।
কোন ভীড় নেই।
কেবল ছবির ভীড়।
আমি হাঁপিয়ে যাই। কিছু ছবির মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে। আমি সারাদিন কেবল একটা ছবি থেকে আরেকটা ছবিতে ঘুরি।
হাঁপিয়ে যাই।
আমি কোন শহর খুঁজে পাই না।
আমি আমার শহরকে খুঁজে পাই না।
আমি ধুলো খুঁজতে শুরু করি। একটু কম ব্রাইটনেস। একটু কম কন্‌ট্রাস্ট।
একটু কম বাড়াবাড়ি।
ছবিগুলো পোস্ট প্রসেস করতে শুরু করি। আলো কমাই। অশার্পনেস কমাই। স্যাচুরেশন কমাই।
ক্রপ করা শুরু করি। কাটাকুটি করে সব এদিক ওদিক এলোমেলো করে দিই। খাপ থেকে খাপ সরিয়ে একের খোপে অন্যকে ঢোকাতে থাকি। আর এইসব ছবি আপ্লোড করে আলবাম নিয়ে নাড়াচাড়া করি। শহরের মধ্যে আর ছবি খুঁজিনা। এই ছবিগুলোর মধ্যে একটু একটু করে শহরকে খুঁজতে থাকি।
পাইও কি?

আমি দোকানে গিয়ে এক রোদ চশমা খুঁজে আনি। তাকে দেখতে বড় বাজে। কিন্তু তাকে দিয়ে দেখতে বড় ভাল লাগে।
চশমাটা একটু আধটু ম্যাজিক জানে। রোদ্দুরকে নরম করে দিতে জানে। চারপাশ আর অমনি পরিষ্কার ঠেকে না। অনেক অনুঙ্কÄল। একটু মরা মরা। একটু পুরানো। একটু হলুদ মেশানো সেপিয়া টোন।
আমার খারাপ লাগা গুলো একটু একটু কমে।
এমনকি আমি অল্প অল্প রিনরিনে ভাললাগাও পাই।
ম্যাজিক?

আর তাই থেকেই আইডিয়াটা আসে।
আমি আবার ক্যামেরা ধরি। ক্যামেরা দিয়েই দেখা শুরু করি। একটু ম্যাজিক করে। ফিল্টার লাগিয়ে।
প্রি-প্রসেস করি। পোস্ট প্রসেসের কারিকুরি জারি করি ছবি তোলার সময়ই।
জলের উপর রোদ্দুরকে হীরের কুচি বানিয়ে দি। চাঁদে লাগাই ঝিলের জলের জোয়ার। ন্যাড়া মেপলের ডাল দিয়ে তার ক্ষত-বিক্ষত গালে আরো আঁচড় কেটে দি। ঝকঝকে সূর্যাস্তকে বিষণ্ন করে দি। সেই বিষণ্ন আলো এসে পড়ে ধবধবে সাদা বি এম ডব্লুর উপর। একলা পাতা ঝরানো গাছের নিচে সে দু:খী দু:খী একলা দাঁড়িয়ে থাকে, আমার বাড়ি ফেরার সেপিয়া রাস্তায়।
বিকেলটা দু:খী হয়ে যায়।
আমি অল্প চিনচিনে সুখ পাই।

বাড়ি ফিরতে গিয়ে ফুটপাথে দেখি চারটে স্ল্যাব। তৈরি হয়ে গেছে এক এক কোয়াড্র্যান্ট। নিজের ছায়াকে প্লেস কঞ্চরে দি থার্ড কোয়াড্র্যান্টে। একটা শুকনো ঝরা পাতাকেও একটু সরিয়ে নিয়ে আসি, আমার পাশে। রেসিডেন্টস অব দ্য থার্ড কোয়াড্র্যান্ট।
নিজেকে ঠিকঠাক দু:খের কো-অর্ডিনেটে প্লেস করে ভারি একটা সুখ হয়।
একঘর ভর্তি আলো থেকে এক চিলতে আলো তুলে নিয়ে বাকিটা ফেলে দি।
ছাপোষা নিয়ন আলোর সন্ধেকে ভিজিয়ে দি সোডিয়ামের হলুদ বাষ্পে।
বৃষ্টিদিনের কান্নার ফোঁটাটুকুকে পষ্ট ফোকাসে রাখি। বাকি সবকিছু কান্নাভেজা ঝাপসা করে দি।
রাতের আলোর সামনে শাটার স্পিড কমিয়ে দি। চলন্ত গাড়ি থেকে তোলা ছবিতে আলোগুলো সব আঁকাবাঁকা রেখা হয়ে যায়। ক্যামেরা নাড়িয়ে নাড়িয়ে আমি আমার মত ছবি আঁকি। একটার সাথে আরেকটা আলো মিশে যায়। আর ডিসক্রিট নেই কিছু। সব মিশে যায়। আমি আমার মত ছবি আঁকি। ছবিতে গল্প।
আবার কখনো বা সেই রাতের আলোর সামনে শাটার স্পিড বাড়িয়ে দি। অ্যাপারচার ছোট করি। আশপাশ থেকে আর সব মুছে দি। জেগে থাকে কেবল সাঁঝবাতিগুলো। সেই সাঁঝবাতির আলোর মুখোমুখি বসে আমি প্রাণহীন শহরের রূপকথা খুঁজতে থাকি। সাঁঝবাতির রূপকথারা আমাকে দুজ্ঞদণ্ড শান্তি দ্যায়।
কেমন ম্যাজিক?
পচা ম্যাজিক। ধুর! ম্যাজিক তেমন করতে পারি কই? ম্যাজিকের ট্রিক তেমন জানি কই? বই খুলে টের পাই, কথা বলে চলেছি, অথচ ভাষার ব্যাকরণই শিখি নাই! আমার নড়বড়ে লজ্ঝড়ে ক্যামেরায় ফোকাস হারিয়ে হারিয়ে যায়। আমাকে ব্যাকরণবিদেরা বলেন, লেন্স কেনো, নিয়ম মানো, টেকনিক শেখো।
অক্ষমের আস্ফালনে বলি, টেকনিক, টেকনিক! তোমার মন নাই ফোটোগ্রাফি?

আর তখনই সেই সত্যিকারের ম্যাজিকটা হয়।

দেখি,অবাক হয়ে দেখি, এইসব প্রি পোস্ট প্রসেসিং এর অ্যাডজাস্টমেন্টও আর আমাকে করতে হয়না। এলোমেলো এ সব কিছুই একটু একটু করে খুঁজে পেতে থাকি। দেখি, সব তো এলোমেলো হয়ে আছে। কেবল ক্যামেরার অ্যাঙ্গল আর ফ্রেমটুকুর অপেক্ষা।
দেখি সামনের অ্যাপার্টমেন্টের সাজানো গোছানো ঘরে ঢুকে পড়েছে এক চিলতে আকাশ আর এক ফালি মেঘে ঢাকা সূর্য্য।
দেখি আমার অগোছালো ল্যাব চলে গেছে আকাশে ছড়ানো মেঘেদের কাছাকাছি। ১৩৭৩৫ টুইনব্রুক পার্কওয়ের বাড়ির আর নেই ঠিকানা! ল্যাব করিডর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখি লালে লেখা [ন:ভঢ় ]আমাকে নিয়ে শূন্যে পাড়ি দিয়েছে, সেই বাড়ির পথে।
ক্যামেরার ফ্রেমে, জানলার ফ্রেম পেতে ক্যাচ ধরে ফেলি দশটা সূর্যোদয়।
দেখি ওদিকের ঐ সুখী ছিমছাম বাড়িটা খাপে খাপে জোড়া ইঁট জুড়ে ফাটল ধরিয়ে দিয়েছে এপাশের ন্যাড়া মেপল গাছের ছায়ারা।
বরফ সাদা স্ক্রীনে হেঁটে চলে যায় ছায়াছবিরা।
একটু আগে হয়ে যাওয়া বৃষ্টির জমে থাকা জলে ঝুঁকে পড়া ধোয়া মোছা আকাশটাকে আর অমনি ঝকঝকে তকতকে লাগে না। কালো পিচরাস্তার বুকে ভাঙ্গা আয়নায় তার মুখ বিষণ্ন লাগে, তিরতিরে হাওয়ায় সে মুখ কেবলি ভাঙ্গে। কেবলি ভাঙ্গা মুখের জন্ম হয়।
আর কোন অ্যাডজাস্টমেন্ট নয়, প্রসেসিং নয়, আমি শুধু ফ্রেমিংটুকু করি।
আর এমনি বৃষ্টি হলে, এমনি জল জমলে , আমার যেমনটি ইচ্ছে শহরটা তেমনটিই হয়ে যায় যে!
এমনি বৃষ্টির দিনে গল্পরা কবিতা হয়ে যায়, মনে পড়ারা মন কেমন, ইতিহাসেরা রূপকথা আর তাই ফোটোগুলো হয়ে যায় আঁকা ছবি।
বৃষ্টি হলে সব সত্যিগুলো আমি দেখতে পাই। এই যেমন, আমার বরাবরের সন্দ ছিল এই কালো পীচঢালা রাস্তাটার ঠিক নীচেই একটা শহর আছে। রাস্তা আছে। আলো আছে। যে শহরে সব উল্টো হয়। উলটে থাকে। বৃষ্টি হলে সেই শহরটাকে খুঁজে পেয়ে যাই।
দেখি, সেই শহরের রাস্তায় নিটোল যুবতী চাঁদ টালমাটাল।
আর দেখি, রাস্তার লাল নীল সবুজ আলোগুলো সব ধুয়ে যাচ্ছে। একটার সাথে আরেকটা মিশে যাচ্ছে। আর কিছু ডিসক্রিট নেই। মিশে যাচ্ছে, মীড়ের টানে।
দেখি, সেই শহরের রাস্তায় নিটোল যুবতী চাঁদের শরীর ছিঁড়েখুঁড়ে ছড়ানো।
ম্যাজিক। ম্যাজিক কি?
কোন শাটার স্পিড,অ্যাপারচার অ্যাডজাস্টোমেন্ট আর করতে হয় না। ফ্রেমটুকুন করি মাত্র।
দেখি, আমার সাঁঝবাতির হ্যালোজেন রূপকথা ছেড়ে বেরিয়ে এসে বৃষ্টিতে রং লিখছে। আমাকে পাঠাচ্ছে।
পড়তে পড়তে আমার মন ভালো হয়ে যায়। এই শহরে। প্রথমবারের মত।
যদিও এ ঠিক আমার শহর নয়।

এমনিই ছিলাম। মন্দ না। ক্যামেরা দিয়ে দেখতে দেখতে। দেখতে মন্দ না।
মন্দ লাগছিল সেদিন বিকেলবেলা। দোলের আগের বিকেল।
এ শহরে কোন দোল ছিলনা। এ শহরে কোন রঙ ছিলনা। এ শহরে তখনও রাতভরে বরফ। এ শহরে তখনও বসন্ত দূর অস্ত।
একটু অবাক হয়েই দেখলাম, আমার বিষাদবিলাসী মন এই সত্যিকারের দু:খে তেমন সুখী হল না। মন কেমন করছিল। আমার শহরের জন্য।

মন খারাপ করছিল। সত্যিকারের।
আর তখনি দেখলাম।
অপূর্ব সেই আলো। শেষ বিকেলের। আর ঝকঝকে তকতকে আকাশে রঙের সে কী খেলা!
কী ব্রাইটনেস। কী কন্‌ট্রাস্ট। কী ভরপুর স্যাচুরেশন। টোনের কী ভ্যারিয়েশন। হ্যু এর কী রেঞ্জ।
লাল গোলাপী কমলা হলুদ, নীল আবীরে যত শেড হয়, স-অ-ব। স্পেক্‌ট্রার স-অ-ব ফ্রিকোয়েন্সি ছুঁয়ে গেছে। স-অ-ব।
বসন্ত আসুক না আসুক, বসন্তোৎসব এসেছে।
এই প্রথমবার চেয়ে দেখলাম। ক্যামেরা ছাড়া।
এই প্রথমবার ভাল লাগল। ক্যামেরা ছাড়া।
এই প্রথমবার আমার শহরকে খুঁজে পেলাম।
ম্যাজিক কার্পেটে চার সাগর পেরিয়ে আমার শহর এখানে ল্যাণ্ড করলো।
নেমে এলো। সন্ধে নামার এই একটু আগে। পুব দিকে নয়,পশ্চিমেতেই।
আমার এই পশ্চিম খোলা জানলায়।
ম্যাজিক! ম্যাজিক! ম্যাজিক!

তিন সত্যি।

আর তারপর থেকে ম্যাজিকটা থেকে থেকেই ঢুঁ মেরে যায়।
এই শহরে অনেক পুজো আছে, কিন্তু শহরের কোন পুজো নেই। আমারো তাই পুজো নেই।
কোনবারেই থাকেনা। মনখারাপ ছাড়া আর কেউ থাকেনা।
সব পুজো কেমন হারিয়ে যায় কাশফুলের ওই খ্যঁ¡কশিয়ালি রঙের রোঁয়ার ভিতর।
আর সেদিন, এই ঠিক এক মাস আগে ফ্লাইটে উঠতেই, ফ্লাইটটা একটু উঠতেই দেখি সারি সারি কাশ।
এই ঠিক এক মাস আগেই আরো অকালে বোধন হয়ে গেল।

ম্যাজিক।

সত্যি।

নদীর ধারে বাড়ি - অচিন্ত্যরূপ রায়


ছোট্ট দুটো হলদে প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে এঘর থেকে ওঘর, ওঘর থেকে সেঘর। নদীর দিক থেকে হাওয়া আসছে। অশথ গাছের পাতায় আওয়াজ হচ্ছে ঝিরঝির ঝিরঝির। সামনের ঘাসছাড়া টুকরো মাঠটায় ধুলো উড়ে যাচ্ছে পাক খেয়ে। দোতলা বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে ভূতের মত।


ভূত নয়। বিরাট কোনো জানোয়ারের শরীরের মত। মরা। ছালচামড়া ঝরে ঝরে পড়ছে, হাড়গোড় কিছু ভেঙ্গেছে, কিছু পাথর হয়ে জমে বসেছে। কিম্বা, বিশাল একটা জাহাজের মত। যার কাজ ফুরিয়ে গেছে অনেকদিন আগে। নদীর দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে এখন দিনরাত শুধু ঝিমোচ্ছে আর ঝিমোচ্ছে।

সামনের ফালি মাঠটার নাম নাকি এককালে ছিল লন। নরম সবুজ ঘাসে ঢাকা ছিল,এদিকে ওদিকে সাজানো ফুলের কেয়ারি ছিল। মালী ছিল, দেখাশোনা করত। লনের চারদিক ঘেরা উঁচু পাঁচিল ছিল। রাস্তা থেকে লনে ঢোকার জন্য ছিল বিশাল সিং-দরোজা। এখন দেখলে বোঝা কঠিন। সে পাঁচিলের একটা ইঁটও পড়ে নেই কোত্থাও। মাঠের পারে পলেস্তারা-খসা সিং-দরোজার খাম্বাদুটো শুধু দাঁড়িয়ে আছে বোকার মত। যেন তালাভাঙ্গা সিন্দুক পাহারা দিচ্ছে দুই বুড়ো সেপাই।

সেপাই ছিল। সান্ত্রীও ছিল। টগবগে ওয়েলার ঘোড়া ছিল, ঘোড়ায়-টানা গাড়িও ছিল। থাকবে না? বাড়িটা যে লাটসায়েবের। এই নদীর পাড়ে এসে থাকবেন বলে বানিয়েছিলেন সাহেব। সে প্রায় দেড়শ বছর আগে। থাকতেনও এসে মাঝে সাঝে। আজকের চড়া-পড়া এই নদীর ধারে তখন শহর তৈরির প্রস্তুতি। তারপর একদিন ঝড়ের দাপটে, নদীর দাপটে সব ভেঙ্গেচুরে গুঁড়িয়ে গেল। শহরের স্বপ্নশুদ্ধ। প্রকৃতির খেয়াল। সায়েবসুবোর খেয়াল। পড়ে রইল শুধু সাহেবের মস্ত দুইমহলা প্রাসাদ। সাহেব আর আসেননি কোনোদিন।

সে দুই মহলের এক মহল ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে তাও কতদিন হয়ে গেল। ইঁট কাঠ কড়ি বরগা যা যা ছিল বেচে দেওয়া হয়েছে সব। জমি-বাড়ির ব্যবসা যারা করে, তাদের হাতে চলে গেছে জমি। ঘর উঠেছে সেখানে। ছোট ছোট একতলা, দোতলা। গাঁ-গঞ্জে একটু পয়সা-করা মানুষরা এসে সেখানে বাসা পেতেছে। লাল সিমেণ্টের মেঝে হয়েছে,বারান্দায় শুকোতে দেওয়া হয়েছে টিয়া-সবুজ রং-এর শাড়ি।

মাঠের চারদিকে ঝোপঝাড়। বাবলা গাছ কয়েকটা, বুনো ঝোপড়া, লতা। একদিকে তিনটে তালগাছ। আখাম্বা লম্বা হয়ে উঠে গেছে আকাশের দিকে। বাড়িটার চেয়েও উঁচু। গোড়াগুলো খুব কাছাকাছি। একসঙ্গে লাগানো প্রায়। তাদের থেকে খানিক দূরেই বুড়ো অশথ গাছটা। অনেকটা জায়গার ওপর ছায়া পেতে দাঁড়িয়ে রয়েছে। হালকা একটুকখানি বাতাস দিলেও পাতায় পাতায় মিষ্টি আওয়াজ। ঝিরঝির ঝিরঝির শব্দে ঝিম ধরে যায়। ছায়া নড়ে, রোদ্দুর নড়ে,আঁকিবুকি কাটে মাটিতে।

দোতলা বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে ভূতের মত। না, কাজ-ফুরোনো জাহাজের মত। নাকি মরা জানোয়ারের শরীরের মত, কে জানে। পুরোনো আমলের চুন-সুরকীতে গাঁথা মোটা দেওয়াল, বিশাল বিশাল ঘর, একেক তলায় এগারোটা করে। দেড়-মানুষ উঁচু উঁচু দরজার পাল্লায় ওপর থেকে নিচ অবধি খড়খড়ি দেওয়া। ঘরগুলোর সামনে টানা ঢাকা বারান্দা। সারি সারি খিলেনের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার কড়ি-বরগাওয়ালা ছাদ। সামনের দিকটায় গাড়িবারান্দা। তার দু দিকে দুই মস্ত খিলেন, সেখান দিয়ে যাতায়াত করত লাটসাহেবের চৌঘুড়ি। পরে, অনেক পরে, কে এনেছিল কে জানে, একটা মোটরগাড়ি থাকত সেখানে। যেমন তেমন গাড়ি নয়, বিলিতি গাড়ি, রোলস রয়েস। রাজা-রাজড়ায় চড়ে। পরাণ ঘোষকে তাতে করে মাঝে মাঝে গাঁয়ের রাস্তা দিয়ে যেতেও দেখেছে লোকে। পুরোন দিনের গাড়ি, কালো রং-এর, ইঞ্জিনের সামনেটা জালি-জালি গ্রিল দিয়ে ঢাকা। ভঁপ ভঁপ করে হর্ন বাজত। সে গাড়িও পরে পড়ে থেকে থেকে নষ্ট হয়ে গেল। গাড়ির তেলের খরচাই বা কে দেবে আর। সিটের গদি কেটে ইঁদুরে বাসা করল, দরজায় মর্চে পড়ে ভেঙ্গে ঝুলে পড়ল, তারপর পরাণই বোধহয় একদিন পুরোনো লোহালক্কড়ের দামে বেচে দিল সেটাকে।

বাড়িটার ভিতটা অদ্ভুত। গোটা দেওয়াল মাটির ভেতর থেকে তোলা হয়নি। তার বদলে সেখানেও পর পর তৈরি করা হয়েছে খিলেন। তার ওপরে দাঁড়িয়ে রয়েছে এই এত্তবড় বাড়িখানা। সেকালে কোন ইঞ্জিনিয়ারের মাথায় এমন বুদ্ধি খেলেছিল কে জানে। জল-ঝড়ের দেশ, নদীর বাঁধ উপচে জল উঠে এলে কলকল করে বয়ে যেত নিচ দিয়ে। বাড়ির ক্ষতি হত না। সে জন্যই তো ঝড় আর নদীর দাপটে যখন ভেঙ্গেচুরে গেল শহর তৈরির স্বপ্ন, তখনও এ বাড়ির কিচ্ছুটি হয়নি। এ বাড়ির, আর পাশের বাড়ির। পাশের সেই বাড়ি ভাঙ্গা হয়েছে পরে, বিক্রি হয়ে গেছে ইঁট-কাঠ লোহা লক্কড়। সেও তো কত বছর আগেকার কথা।

বাড়িটার সারা গায়ে গাছ। বটগাছ শিকড় চালিয়ে দিয়েছে দেয়ালের ফাঁকে ফোকরে। ফুলে ওঠা শিরার মত শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে কিছু শিকড় নেমে এসেছে মাটি পর্যন্ত। আরও নানা রকম আগাছা এখানে ওখানে ঝুলে আছে। বাড়ছে। ছাদ ভর্তি ঘাস গজিয়ে আছে,চুলের মত। হালকা হাওয়ায় দুলছে। দেয়ালের পলেস্তারা খসে খসে পড়েছে। কার্নিশের পাশে, থামের গায়ে অল্পই লেগে আছে কোথাও কোথাও, আবছা হয়ে আসা মনখারাপের মত । লাল লাল পাতলা ইঁটে নোনা ধরেছে অনেক জায়গায়। চুন-সুরকী ঝরে গেছে। গাড়িবারান্দার কোনার দিকের পিলারটা নিচের দিক থেকে খুবলে খেয়ে গেছে লোনা হাওয়ায়।

পিলারটাকে ডাইনে রেখে মস্ত খিলেনের মধ্যে দিয়ে ঢুকে পড়। কেউ আটকাবে না। সায়েবের চৌঘুড়ি যেখানে এসে দাঁড়াত, অধৈর্য ঘোড়াগুলো যেখানে পা ঠুকত মাটিতে,চামরের মত লেজের ঝাপটায় ডাঁশ-মশা তাড়াত, সে জায়গার ঠিক ওপরেই ধসে গেছে ছাদের অংশটা। লম্বাটে ফোকরের মধ্যে দিয়ে ঝুলে পড়ছে ঘাস, বুনো গাছের ডালপালা। উল্টোদিকের খিলেনটা ভেঙ্গে পড়েছে কবে। কড়িবরগার টুকরো ঝুলে রয়েছে বিপজ্জনক ভাবে। বাঁদিকে বারান্দায় ওঠার ছোট্ট দুধাপ সিঁড়ি। তার ঠিক পাশে পড়ে আছে কবেকার বাতিল করে দেওয়া কি এক মেশিনের কলকব্জা। জং-ধরা, ভারী দুটো লোহার চাকা লাগানো।

বাড়িটা বসে যাচ্ছে মাটিতে। ঝড় বাদলের সময় মেঝের নিচে যে সব খিলেনের মধ্যে দিয়ে বয়ে যেত নদীর হাওয়া আর জলের স্রোত, সেগুলি আর দেখাই যায় না প্রায়। এখন সেখানে সারি সারি ঘুপচি কালো ফোকর, অন্ধ মানুষের চোখের কোটরের মত। সাপখোপের বাসা।

দু ধাপ সিঁড়ি উঠলে একতলার বারান্দা। ঘরগুলির সামনে দিয়ে চলে গেছে টানা -- উত্তর থেকে দক্ষিণে। খিলেনের মধ্যে দিয়ে ট্যারছা হয়ে রোদ এসে পড়েছে। ছায়া, আলো, ছায়া,আলো, আবার ছায়া। তিনটে কুকুরছানা খেলা করছে বারান্দায়। আর ছোট্ট দুটো হলদে প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে এঘর থেকে ওঘর থেকে সেঘর।

একতলার চারটে ঘর ভাড়া দেওয়া হয়েছে টাইগার প্রজেক্টকে। বেশিরভাগ সময় তালাবন্ধই থাকে ঘরগুলো। নাকি গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পাঁচ নম্বর ঘরটার ছাদ আধখানা ভেঙ্গে ঝুলছে। সে ঘরের দরজা খোলা। ভেতরে রাজ্যের ঝুল, ধুলোবালি,খসে পড়া ইঁট-কাঠ, পলেস্তারা। তার পরে দরজাটা সিঁড়িঘরের। তার একখানা পাল্লা নেই। ছ নম্বর সেই দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেই ঝটপট করে উড়ে যায় পায়রা। বকবক আওয়াজ করে অস্বস্তিতে। ঘাড় হেলিয়ে তাকালে অনেক উঁচুতে দেখা যায় ছাদ। তার মাঝখানে ফোকর। কবে ভেঙ্গে পড়েছিল কে জানে। ফোকরের ওপর ঢেউ-টিন দিয়ে আড়াল করা। ফাঁক দিয়ে অল্প আলো চুঁইয়ে ঢুকছে। আধোঘুমের স্বপ্নের মত আলো। একটু ভ্যাপসা গন্ধ জায়গাটায়। সামনে তিন পা দূরে শুরু হয়েছে চওড়া কাঠের সিঁড়ি,কয়েকধাপ উঠে ল্যাণ্ডিং, তারপর হঠাৎ ডাইনে বাঁক নিয়ে সিঁড়িটা দোতলার দিকে চলে গেছে ধীরে সুস্থে।

সাত নম্বর দরজাটা আসলে ছ নম্বর ঘরের। তাতে আছে মাদুর-পাতা বিশাল একটা তক্তপোষ। কালচে হয়ে আসা পুরোনো পাঁচকোণা বেডসাইড টেবিলের ওপর একটা মাটির কুঁজো, আর বিশাল বেলজিয়ান আয়না লাগানো মেহগনি কাঠের একটা ড্রেসিং টেবিল। আর কিচ্ছু না। তক্তপোষটা এত বড় যে ডবল মাদুরে সবটা ঢাকে না। ড্রেসিং টেবিলের পুরু আয়নার কাচে রাজ্যের ধুলো জমে আছে, সামনে গিয়ে দাঁড়ালে নিজের মুখটা পর্যন্ত ভালো করে চেনা যায় না। এ ঘরে থাকে সন্ধ্যারাণী। পরাণের দিদি। বাতে অথর্ব। সারাদিনই প্রায় শুয়ে শুয়ে কাতরায়। এঘর থেকে ভেতরের দিকে যাওয়ার একটা দরজা আছে। সেখান দিয়ে মাঝে মাঝে নেমে আসে পরাণ। দিদির ওষুধ দিয়ে যায়। ভাত বেড়ে দেয়। খাবার আসে স্টেশনের কাছের একটা ভাতের হোটেল থেকে। রান্না করার তো কেউ নেই। এঁটো বাসনগুলো কোনোরকমে জল-সাবান বুলিয়ে পরাণই ধুয়ে রাখে।

আট নম্বর দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। কিন্তু বাঁদিকের পাল্লার ওপরের খড়খড়িগুলোর একটাও নেই আর এখন। ভেতরে উঁকি মারা যায়। সেখানে ঝুল, ধুলো, পায়াভাঙ্গা চেয়ার আর ভটভটি নৌকোর একটা মর্চে-পড়া ইঞ্জিন। এ ঘর থেকেও ভেতরে যাওয়ার দরজা আছে। সেটাও বন্ধ।

বাকি ঘর চারটে ভেতরের দিকে। দরজা বন্ধই থাকে। তালা দেওয়া।

একতলায় থাকে সন্ধ্যারাণী, দোতলায় পরাণ। বাইশখানা ঘর-ওয়ালা বাড়িতে এই দুটি প্রাণী। পরাণ বিয়ে করেনি। দিদির বিয়ে হয়েছিল কোনকালে পাড়ার লোকের মনে নেই। স্বামী মারা যেতে ফিরে এসেছে বাপের বাড়ি, সেও নয় নয় করে বছর পঞ্চাশ তো হবেই। বাপের বাড়ি। মানে সাহেববাড়ি। গাঁয়ে সেই নামেই জানে সবাই। পরাণ আর সন্ধ্যার বাপ জীবনলালও তার জীবনের বেশিরভাগটাই এই বাড়িতেই কাটিয়েছে। এসেছিল কেয়ারটেকার হয়ে। দেখাশোনা করত বাড়ির, মাইনে পেত বোম্বাইয়ের এক পার্শী কোম্পানির কাছ থেকে। লাটসাহেবের বাড়িদুটো সে কোম্পানি কিনে নিয়েছিল একশ বছরেরও বেশী আগে। বিশাল জায়গার ওপর এরকম বিশাল দুই বাড়ি, পুরোনো দিনের দামী আসবাব, জরিপের নানা যন্ত্রপাতি, প্রচুর বই আর কাগজপত্রে ঠাসা -- হয়ত কোনোদিন কোনো লাভের আশা করেছিল তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে কোম্পানির মালিকানাও হাতবদল হল, আর নতুন মালিকদের বিশেষ উৎসাহ ছিল না কেয়ারটেকার রেখে এত দূরের দুখানা পুরোনো প্রাসাদের ঝামেলা সামলানোর। তারাই প্রস্তাবটা দিয়েছিল পরাণের বাপকে। ততদিনে জীবনলালও কিছু টাকাপয়সা জমিয়েছে। বোম্বাই থেকে আসা মাস মাইনে তো ছিলই, তাছাড়া পুরোনো জিনিসপত্রও মালিকদের অজান্তে বিক্রি হয়েছে মাঝে মধ্যে। জলের দরে বাড়িদুটো কিনে ফেলল জীবনলাল।

তবে কিনা সংসারে কেউ আসে কিনতে, আর কেউ আসে বেচতে। জীবনলালের বড় ছেলে বাঁচেনি বেশিদিন। তার ছেলেরা লায়েক হয়ে বিক্রি করে দিল দক্ষিণের বাড়ি। কদিনের মধ্যেই তারপর মুছে গেল লাটসাহেবের তৈরি দুইমহলার এক মহল। গাঁয়ের আর পাঁচটা পাড়ার সঙ্গে সে জায়গার কোনো তফাৎ রইল না আর। পরাণের বাড়ি কিন্তু রয়ে গেল। পরাণ আর সন্ধ্যারাণীর বাড়ি।

।। ২ ।।

বাড়িটায় বড় মায়া। নদীর হাওয়াটায় মায়া। বুড়ো অশথগাছের পাতায় ঝিরঝির আওয়াজে মায়া। মায়া আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি পরাণ। নহলে তো কবেই বিক্রি হয়ে যেত এ বাড়িও। ভেঙ্গেচুরে ঘর উঠত খালি জমিতে। ছোট ছোট একতলা, দোতলা। টানাটানিও থাকত না আর। বাতের ব্যথা বাড়লে সন্ধ্যারাণী এই নিয়ে বকাবকি করে ভাইকে। পরাণ কখনো শোনে, কখনো শোনে না। এমনিতেই তো আপন মনে কত বকবক করে দিদি। একা একাই। বয়েস হয়ে রোগা কাঠির মত হয়ে গেছে সন্ধ্যার চেহারা। ছেলেবেলার লম্বা চুল হয়েছে টিকটিকির লেজ। কাঁচাপাকা সেই চুল ছোট্ট একটুখানি বড়ি খোঁপা করে বেঁধে রাখে মাথার পেছনে। মেজাজ খিটখিটে হয়েছে। কিন্তু কাকে আর দেখাবে মেজাজ। নিজেই বকবক বিড়বিড় করে যায় তাই। নদীর হাওয়ায় ভেসে যায় কথা।

গাঁয়ের লোকে বলে বাড়িটার নিচে নাকি একটা সুড়ঙ্গ আছে। এক সময় নাকি সুড়ঙ্গ দিয়ে জোড়া ছিল দুই বাড়ি। বাজে কথা। ছোটবেলা থেকে পরাণ খুঁজে দেখেছে। সুড়ঙ্গ নেই। চোরকুঠুরি নেই। গুপ্তধন নেই। শুধু কবেকার এক খেয়ালি সাহেবের স্বপ্ন ছড়িয়ে আছে বাড়িটা জুড়ে। তালাবন্ধ ঘরগুলির দরজার পেছনে, ঘোড়ার খুরের মত দেখতে মেহগনি কাঠের সেক্রেটারিয়েট টেবিলের দেরাজে, দেয়াল-জোড়া বিশাল বিশাল আলমারিগুলোর ভেতরে।

এ সব আসবাব একতলায় রাখেনি পরাণ। মানুষের বড় কৌতূহল। উঁকিঝুঁকি মারে, ঘরে ঢুকে দেখতে চায়। কখনো কখনো কেউ কেউ কিনেও নিতে চেয়েছে পুরোনো কালের জিনিস। পরাণের মন সায় দেয় নি। স্বপ্ন কি ব্যবসার জিনিস? নাকি টাকা দিয়ে তা কেনা যায়? গাঁয়ের লোকদের তাই ঘরে ঢুকতে দিতে আপত্তি পরাণের। আসেও না কেউ।

গাঁয়ের লোকের সঙ্গে মেশে না পরাণ। শহরের লোকের সঙ্গেও না। ভালবেসে তো কেউ আসে না। সবাই আসে যে যার ধান্দায়। আসবাব বেচো, কিনব। বাড়ি বেচে দাও,হোটেল বানাব। পরাণ দেবে না। সাফ বলে দিয়েছে দেবে না। কাউকে দেবে না, সে ফিলিম স্টারই হোক কি রাজনীতির নেতাই হোক। ছাদ থেকে জল ঝরুক, দেওয়ালে লোনা ধরুক -- যাবে তো যাবে পরাণের যাবে, অন্যদের অত মাথাব্যথার কি আছে? কি আছে সে কথা পরাণ ভালই জানে। লোকের সঙ্গে তাই মেশে না সে। গায়ে পড়ে কেউ আলাপ করতে এলে দরজা থেকেই বিদেয় করে দেয়।

দিনে একটিবার শুধু বাড়ি থেকে বেরোয় পরাণ। অনাথের চায়ের দোকানে গিয়ে ছোট কাচের গ্লাসে লিকার চা খায়। ষাট পয়সা দাম দিয়ে বাড়ি চলে আসে। সপ্তাহে একদিন খবরের কাগজ কিনে আনে। সেটাই পড়ে সাত দিন ধরে একটু একটু করে। মাসে একদিন যায় পোস্টাপিসে। বাবার জমা রাখা টাকার সুদ তুলে আনতে। বেশ অনেক টাকাই জমিয়েছিল বাবা। এক সময় তার সুদে পরাণ নবাবের মত থেকেছে। চাকরি করতে হয়নি কোনদিন। কিন্তু সে টাকারও দাম কমেছে। বহুদিন আগেকার কথা মনের মধ্যে থাকতে থাকতে যেমন ফিকে হয়ে যায়, তেমনি কবে যেন আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে গেছে জীবনলালের জমানো টাকার দাম। পরাণ আগে গাড়ি চড়ত। গাড়ি চড়া বন্ধ হল। কলকাতার অনেক বড় বাড়িতে টেলিফোনের লাইন আসার আগে ফোন বসেছিল এ বাড়িতে। সে ফোনের লাইন কাটা গেল। সময় মত বিল দেওয়ার পয়সা জোটে না বলে বিজলির লাইনও কেটে দিল। সন্ধেবেলা দুটো বাল্‌ব জ্বালানোর জন্য রাস্তার উল্টোদিকে শীতলের টিনের-চাল বাড়ি থেকে একটা তার টানতে হয়েছে তারপর। একটা জ্বলে দোতলায়, একটা একতলায়। তাও অর্ধেক সময় কারেণ্ট থাকে না। কিন্তু মাসে মাসে পঁয়তাল্লিশটা টাকা গুণে দিতে হয় শীতলকে। আগে পাখাও ছিল। প্রত্যেকটা ঘরে। জীবনলাল লাগিয়েছিল। তারও আগে ছিল টানা পাখা। ওপরের একটা ঘরে এখনো রয়ে গেছে টানাপাখা ঝোলানোর রড। ইলেকট্রিক ফ্যানগুলো বিক্রি হয়ে গেছে আস্তে আস্তে। পরাণই বেচে দিয়েছে টানাটানির সময়। লাইনই কেটে দিয়েছে তো পাখা নিয়ে কি হবে?পাখা চালানোর জন্য শীতলকে পয়সা দেওয়ার রেস্তও পরাণের আর নেই। তাছাড়া,দরকারটাই বা কি? হু হু করে হাওয়া আসে খড়খড়ি-ভাঙ্গা জানালা দিয়ে। নদীর হাওয়া। ঝড়ের সময় তো সামাল দেওয়াই দায়। দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে হয় জানালার পাল্লা। যে জানালাগুলো বেঁধে রাখার অবস্থাতেও নেই, সেগুলো আছড়ে আছড়ে এসে পড়ে ফ্রেমের ওপরে। ভেঙ্গে যদি নিচে পড়ে যায় কোনোটা, ঝড় থামলে পরাণ যত্ন করে তুলে এনে রেখে দেয় সেটাকে। পুরোনো আমলের সেগুন কাঠের পাল্লা। একা মানুষের পক্ষে তুলে আনাও কঠিন, এত ভারী।

ভারী মায়া পরাণের। বাড়িটার জন্য মায়া। বাড়ির গায়ে লেগে থাকা পুরোনো সব গল্পগুলোর জন্য মায়া। কত আশা করে এ বাড়ি বানানো হয়েছিল সে কথা সাহেবের ফেলে যাওয়া পুরোনো খাতায় পড়েছে পরাণ। কত লোকজন কত দিন ধরে খেটে লাটসাহেবের থাকার জন্যে তৈরি করেছিল দুই মহলা প্রাসাদ। শুধু কি প্রাসাদ? তার সঙ্গে তৈরি হয়েছিল রাস্তা, বসানো হয়েছিল লাইন, রেলগাড়ি ছুটবে সে লাইন দিয়ে। বানানো হয়েছিল বন্দর, দেশ বিদেশ থেকে জাহাজ এসে লাগবে সেখানে। স্বপ্নের সেই শহর আর বন্দর তৈরির জন্য কত হিসাব কেতাব, কত অঙ্ক, কত নকশা, কত ছবি। যন্ত্রপাতিই বা কত। সে সব এখনও ডাঁই হয়ে পড়ে আছে আলমারিতে, দেরাজে। মাঝে মধ্যে নামিয়ে দেখে পরাণ। বই-খাতাগুলো পড়ে, যন্ত্রপাতিগুলোতে হাত বোলায়। কত রকমের কত যন্ত্র। কাঠের, লোহার, পেতলের। সব বিলেতে তৈরি। পেতল দিয়ে বানানো লম্বা একটা টেলিস্কোপ আছে। গায়ে খোদাই করা বিলিতি কোম্পানির নাম এখনও পড়া যায় -- লরেন্স অ্যাণ্ড মেয়ো। সে টেলিস্কোপ চোখে লাগালে কিছুই দেখা যায় না এখন। ছাতা পড়ে ঝাপসা হয়ে গেছে কাচ। একবার এক ক্যামেরার দোকানে জিনিসটা নিয়ে গিয়েছিল পরাণ, যদি সারানো যায়। দোকানদার বলল কলকাতা থেকে সাফ করিয়ে আনতে হবে লেন্স। কমসে কম পাঁচশ টাকার ধাক্কা। অত টাকা খরচ করার ক্ষমতা কি পরাণের আছে? পড়েই রয়েছে জিনিসটা তাই দোতলার ঘরের এক কোণে। একবার, অনেক বছর আগে, এক রিপোর্টার এসেছিল কোন খবরের কাগজ থেকে। টেলিস্কোপটা দেখে তার তো চোখ কপালে। বলে ও মশাই, শুধু এইটা বিক্রি করলেই তো যে পয়সা পাবেন তাতে বেশ কিছুদিন চলে যাবে আপনার। সে কথা পরাণ কি আর জানে না? কিন্তু বেচতে মন চায় না তার। থাক, যেখানকার জিনিস সেখানেই থাক।

রিপোর্টার অনেক এসেছে। এই বাড়ি নিয়ে কত গল্প লিখেছে, দেশে বিদেশে কত কাগজে ছাপা হয়েছে সে সব লেখা। লণ্ডনের টাইমস পত্রিকায় পর্যন্ত। সে লেখা বেরোনোর পর বিলেতের রাজবাড়ি থেকে চিঠি এসেছিল পরাণের কাছে। বুকটা দশহাত হয়ে গিয়েছিল গর্বে। মনে মনে আশা হয়েছিল হয়ত এবার বাড়িটা দেখভালের একটা ব্যবস্থা হবে। কিছু হয়নি। তার পরেও এসেছে রিপোর্টাররা। তাদের আর ঢুকতে দেয়নি পরাণ। কথাও বলেনি। দূর করে দিয়েছে দরজা থেকে। বাড়িটা রয়ে গেছে যেমনকে তেমন। একলা আর নিঝুম।

।। ৩ ।।

নদীর দিক থেকে অল্প অল্প হাওয়া আসছে। ফিসফিস ঝিরঝির করে নিজের মনে কথা বলছে বুড়ো অশথগাছ। বাড়িটা কান পেতে শুনছে। লম্বা টানা বারান্দাটায় সারি সারি খিলেনের ফাঁক দিয়ে ট্যারছা হয়ে এসে পড়েছে লালচে রোদ্দুর। বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে ভূতের মত। কিম্বা বিরাট কোনো জানোয়ারের শরীরের মত। মরা। শুধু ছোট্ট দুটো হলদে প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে এঘর থেকে ওঘর, ওঘর থেকে সেঘর।

অচিন উইলো ও ঘুমন্ত বালিকা হারুকি মুরাকামি


অনুবাদ : রাফিক হারিরি
(পরিচিতি:  জাপানিজ ঔপন্যাসিক ও ছোটগল্পকার হারুকি মুরাকামি গত কয়েক বছর ধরেই নোবেল তালিকায় মনোনীতদের শীর্ষে ছিলেন। তবে নোবেল তাঁর ভাগ্যে এলো না। ‘অচিন উইলো ও ঘুমন্ত বালিকা’ গল্পটি হারুকি মুরাকামির সর্বশেষ গল্পগ্রন্থ ব্লাইন্ড উইলো স্লিপিং উইমেন গ্রন্থের। এই গ্রন্থের গল্পগুলো ১৯৮১ থেকে ২০০৫-এর মধ্যে লেখা। ব্লাইন্ড উইলো স্লিপিং উইমেন গল্পগ্রন্থটি লিখে হারুকি মুরাকামি বলেন, ‘উপন্যাস লেখা আমার কাছে সব সময়ই চ্যালেঞ্জ। সে-তুলনায় গল্প খুব স্বচ্ছন্দে লেখা যায়।
কারণ উপন্যাস লেখা হলো বিশাল একটা বন তৈরি করা আর গল্প হলো ছোট্ট শৌখিন বাগান তৈরির মতো।’ জাপানিজ ঔপন্যাসিক হারুকি মুরাকামির জন্ম ১৯৪৯-এ জাপানের কোয়েটায়। তাঁর অন্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে নরওয়েজিয়ান উড, কাফকা অন দ্য শোর, হিয়ার দ্য উইন্ড সং, অ্যা ওয়াইল্ড শিপ চেজ উল্লেখযোগ্য।)



চোখ বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই বাতাসের ঘ্রাণ আমার ওপর আছড়ে পড়ল। মে মাসের বাতাস শুষ্ক রুক্ষ চামড়ার ফল যেন অনেকগুলো বীজ নিয়ে ফুলে-ফেঁপে উঠছে। আমার হাতের ওপর বীজগুলো ছিটকে পড়ে ব্যথার একটা অনুভূতি তৈরি করে দিয়েছে।‘কয়টা বাজে?’ আমার চাচাতো ভাই আমাকে জিজ্ঞেস করল। সে আমার চেয়ে লম্বায় আট ইঞ্চি ছোট, আমার সঙ্গে কথা বলার সময় ওপরের দিকে মুখ তুলে কথা বলতে হয় তাকে।

আমি ঘড়ির দিকে একপলক তাকিয়ে বললাম, ‘দশটা বিশ।’

‘ঘড়িটা কি ঠিকমতো সময় দেয়?’

‘আমার তো তাই মনে হয়।’

আমার চাচাতো ভাই আমার কব্জিটাকে শক্ত করে ধরে ঘড়িটা দেখল। তার চিকন পাতলা শুকনা আঙুলগুলোতে দারুণ জোর।

‘এই ঘড়িটা কি অনেক দামি?’

‘নাহ। বেশ সস্তা এটা।’ আমি ঘড়িটার দিকে আবারো তাকিয়ে বললাম।

সে কোনো উত্তর দিলো না।

আমার চাচাতো ভাইয়ের চোখেমুখে কেমন একটা বিভ্রান্তির দৃষ্টি।

‘ঘড়িটা আসলেই সস্তা।’ আমার ভাইয়ের ডান পাশে সাবধান চোখ রেখে আবারো বললাম। ‘ঘড়িটা সস্তা কিন্তু খুব ভালো সময় দেয়।’

আমার চাচাতো ভাই মৃদু মাথা নাড়ল।

চাচাতো ভাই তার ডান কানে ভালো শুনতে পায় না। প্রাথমিক স্কুলে পড়ার সময় তার ডান কানে বেস বলের আঘাত লাগে। তারপর থেকেই ডান পাশ দিয়ে শোনার বারোটা বেজে গেছে। সেটা এখন আর ভালো কাজ করে না। ক্লাসে সে সবসময় সামনের সারিতে বসত আর ডান পাশে থাকত। যাতে করে তার বাম কানটা শিক্ষকদের দিকে ভালোভাবে রেখে সব কথা শোনা যায়। তার পরীক্ষার ফলাফলও খারাপ ছিল না। তবে বছরে একবার কি দুবার তার দুই কান দিয়েই সে কোনো কিছু শুনতে পেত না। এই রকম যখন ঘটত তখন তার জীবন যেন জানালা দিয়ে পালাত। সে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিত। ডাক্তাররা তার এই সমস্যা নিয়ে বেশ বিপদে ছিলেন। কারণ তারা কখনোই কানের এই রকম কোনো সমস্যার কথা শোনেননি। ফলে তাদের কিছুই করার ছিল না।

‘ঘড়ি দামি হলেই যে সেটা ভালো সময় দেবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।’ আমার চাচাতো ভাই আমাকে খুশি করার জন্য বলল। ‘আমি খুব দামি একটা ঘড়ি একসময় ব্যবহার করতাম। কিন্তু সেটা অধিকাংশ সময় বন্ধ থাকত। ঘড়িটা পাওয়ার এক বছরের মধ্যেই আমি সেটা হারিয়ে ফেললাম। তারপর আমি আর ঘড়ি ব্যবহার করিনি। আমাকে ঘড়ি কিনে দেওয়া হয়নি।’

‘ঘড়ি ছাড়া চলাটা মুশকিল’ আমি বললাম।

‘কী?’ সে জিজ্ঞেস করল।’

‘একটা ঘড়ি ছাড়া চলতে বেশ অসুবিধা, ঠিক না?’ তার ডান পাশে তাকিয়ে আমি কথাটা আবারো বললাম।

‘না মোটেও সেরকম না। আমি কোনো পাহাড়ি অঞ্চল কিংবা দুর্গম এলাকায় বসবাস করছি না। ঘড়ির সময় জানতে চাইলে কাউকে জিজ্ঞেস করলেই হবে।’ সে মাথা নেড়ে বলল।

‘সত্য কথা।’ আমি বললাম।

কিছুক্ষণের জন্য আমরা আবারো চুপ হয়ে গেলাম।

আমি জানতাম হাসপাতালে পৌঁছার আগ পর্যন্ত আমার ভাইটিকে একটু শান্ত রাখতে, তার প্রতি একটু ভালোবাসা প্রকাশ করতে আমাকে আরো বেশি কিছু বলতে হবে।

আমার ভাইটিকে আমি সর্বশেষ দেখেছিলাম পাঁচ বছর আগে। এর মধ্যে সে নয় থেকে চৌদ্দ বছরে উন্নীত হয়েছে আর আমি বিশ থেকে পঁচিশ বছরে পড়লাম। কিন্তু বয়স আমাদের মাঝে ছোট একটা বাধা তৈরি করে দিয়েছে। ফলে আমি যখনই ভাইটিকে কিছু বলতে যাই আমার গলা শুকিয়ে আসে, ঢোক গিলতে হয়।

‘এখন কয়টা বাজে?’ সে আবারো জিজ্ঞেস করল।

‘দশটা ঊনত্রিশ।’ আমি বললাম।

ঠিক দশটা বত্রিশে বাসের দেখা মিলল।

যে-বাসটা এলো সেটা একেবারেই নতুন ধরনের। আমি স্কুলে যেতে যে-বাস ব্যবহার করতাম এটা দেখতে মোটেও সেরকম না। চালকের সামনের কাচটা বেশ বড়, আর বাসটাতে আমার ধারণার চাইতেও বেশি ভিড় ছিল। কেউ দাঁড়িয়ে ছিল না, কিন্তু তারপরও আমরা বসতে পারিনি। আমরা খুব বেশি দূর যাব না। তাই বাসের ঠিক দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম। ঠিক এই সময়টাতেই কেন বাসটাতে এত ভিড় সেটা একটা রহস্য। কারণ বাসটা কোনো পর্যটক এলাকার ভেতর দিয়ে আসে না। আর যে-এলাকার ভেতর দিয়ে আসে সেখানে এত ভিড় হওয়ার কথা না।

গাড়িটা একদম নতুন ছিল। সরাসরি ফ্যাক্টরি থেকে চলে এসেছে। গাড়ির দেয়ালগুলো এত মসৃণ ছিল যে, সেখানে তোমার চেহারার প্রতিফলন দেখা যাবে।

গাড়িটা নতুন কিন্তু গাড়ির ভেতর অপ্রত্যাশিত ভিড় আমাকে চুপসে দিয়েছে। সম্ভবত আমি সর্বশেষ এই বাস দিয়ে যাতায়াত করার পর বাসের রাস্তা বদলেছে। বাসটি এখন নতুন রুটে চলাচল করে। আমি সাবধানে বাসের ভেতর আর তার চারপাশটা মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম। নাহ, ঠিকই আছে। বাইরে সেই পরিচিত আবাসিক এলাকা। আমার মনে পড়ছে।

‘আমরা তো ঠিক বাসেই উঠেছি?’ আমার চাচাতো ভাই কিছুটা শঙ্কা নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল। আমরা যখনই বাইরে কোথাও গিয়েছি তখনই আমার চেহারায় একটা শঙ্কার ভাব ছিলই।

‘ভয় পেয়ো না।’ আমার ভাইকে আর নিজেকে কিছুটা সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে বললাম। ‘এই রুটে কেবলমাত্র একটা বাসই চলাফেরা করে। সেটা হলো এই বাস।’

‘তুমি যখন হাইস্কুলে পড়তে তখন কি এই বাসটা দিয়েই যাতায়াত করতে?’ আমার ভাই জিজ্ঞেস করল।

‘হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ।’

‘স্কুল তোমার ভালো লাগত?’

‘তেমন ভালো না। তবে সেখানে আমার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হতো। ফলে এই যাত্রাটা খুব লম্বা মনে হতো না।’ আমি বললাম।

‘তাদের সঙ্গে কি তোমার এখনো দেখা হয়?’

‘না দীর্ঘদিন তাদের সঙ্গে দেখা হয় না।’ আমি খুব সাবধানে বললাম।

‘কেন দেখা হয় না? কেন তুমি তাদের সঙ্গে দেখা করো না?’

‘কারণ আমরা একে অপর থেকে অনেক দূরে থাকি।’ এটা আসলে মূল কারণ ছিল না। কিন্তু আমি বিষয়টাকে আরো ভালোভাবে ব্যাখ্যা করার অন্য কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

আমার ডান পাশেই বুড়োদের একটা দল বসেছিল। একটু পরেই আমি বুঝতে পারলাম এই জন্যই বাসটা আজ খুব বেশি ভিড় মনে হচ্ছে। সব মানুষই পাহাড়ে ওঠার অদ্ভুত পোশাক পরে আছে। তাদের দেখতে যে কী অদ্ভুত লাগছিল। কিন্তু যে-বিষয়টা আমার কাছে অদ্ভুত লাগছে সেটা হলো বাসের এই রুটে তো কোনো পাহাড়ে চড়ার কিছু নেই। আশপাশে কোনো পাহাড় নেই যেখানে অভিযানপ্রিয় মানুষগুলো উঠতে পারে। তাহলে এই লোকগুলো পৃথিবীর কোথায় যাচ্ছে?

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই আমি বিষয়টা ভাবছিলাম। কিন্তু আমার মাথায় ভালো কোনো ব্যাখ্যা এলো না।

‘চিকিৎসায় যদি এই মুহূর্তে আঘাত আরো বেশি হয় তাহলে আমি অবাক হব।’ আমার চাচাতো ভাই বলল।

‘আমি জানি না। আমি বিস্তারিত কিছুই শুনিনি এ-বিষয়ে।’ আমি বললাম।

‘তুমি কি কখনো কানের ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলে?’

উত্তরে আমি মাথা নাড়লাম। আমি জীবনে একবারের জন্যও কানের ডাক্তারের কাছে যাইনি।

‘এটা কি আগেও কোনো কষ্ট দিয়েছিল?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘না তেমন কষ্ট দেয়নি। আসলে এটাতে তেমন কোনো ব্যথা বোধ নেই। মাঝে মাঝে একটু-আধটু ব্যথা লাগে। তবে সেটা তেমন ভয়ংকর কিছু না।’

‘আশা করি আজকেও সেই একইরকম হবে। তোমার মা বলেছে যে তারা স্বাভাবিকের বাইরে ব্যতিক্রম কিছুই করবে না।’

‘কিন্তু তারা যদি সব সময় একই কাজ করে তাহলে সেটা কতটুকু ফলপ্রসূ হবে?’

‘তুমি জানো না। কারণ অনেক সময় অপ্রত্যাশিত অনেক কিছুই ঘটে যেতে পারে।’

‘তুমি কি বলতে চাও যেভাবে একটা বল এসে কানে আঘাত করে, এরকম কিছু?’

আমি ভালো করে লক্ষ করে দেখলাম আমার ভাইয়ের কথায় কোনো ঠাট্টা বা শ্লেষ আছে কিনা। তবে সেরকম কিছুই দেখলাম না।

‘নতুন একজন ডাক্তারের কাছে গেলে বিষয়টা ভিন্ন রকমও হতে পারে। একটু পরিবর্তন হয়তো পুরো প্রক্রিয়াটায় নতুন কোনো ফলাফল আনতে পারে। আমি এত সহজে হারতে চাই না।’ আমি বললাম।

‘আমিও হারতে চাই না।’ আমার চাচাতো ভাই বলল। ‘তবে তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি কিছুটা বিরক্ত। ভয় কোনো বিপজ্জনক কিছু না। তবে আমি যে ব্যথার কল্পনা করছি সেটা মূল ব্যথার চেয়েও অধিক বেদনাদায়ক। তুমি বুঝতে পারছ আমি কি বলতে চাই?’

‘হ্যাঁ। আমি জানি।’ আমি বললাম।

সেই বসন্তে অনেক কিছুই ঘটে গেল।

একটা নতুন পরিস্থিতির কারণে আমি ছোট্ট যে বিজ্ঞাপনী সংস্থাটিতে গত দুবছর ধরে কাজ করতাম সেখানকার চাকরিটা আমি ছেড়ে দিলাম। একই সময়ে আমার কলেজজীবনের সঙ্গী প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গে সম্পর্কটা ভেঙে গেল। তারও এক মাস পর আমার দাদি মারা গেল। গত পাঁচ বছরের মধ্যে এই প্রথম ছোট্ট একটা সুটকেস হাতে নিয়ে আমি এই শহরে ঢুকলাম। আমার পুরনো ঘরটা আমি যেভাবে রেখে এসেছিলাম সেভাবেই আছে। বুক-সেলফের বইগুলো সেই আগের মতোই গোছানো, সাউন্ড রেকর্ডগুলোও আছে। তবে সবকিছু একেবারে শুকনা খটখটে, ধুলায় আচ্ছন্ন। অনেক আগেই এদের গন্ধ আর রং হারিয়ে গেছে। সময় শুধু সেখানে একা দাঁড়িয়ে আছে।

দাদির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ হওয়ার দুইদিন পর আমি আবারো টোকিওতে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। একটা কাজ বাগাতে হবে। ভাবলাম দৃশ্যপট পাল্টানোর জন্য নতুন একটা ফ্ল্যাটে উঠব। কিন্তু সেটা আর হয়ে উঠল না। আমার পুরনো ঘরে পুরনো রেকর্ড শুনে আর পুরনো বইগুলো পড়েই আমার সময় কাটতে লাগল। বাগানের আগাছা পরিষ্কারের কাজে নেমে গেলাম। কারো সঙ্গেই আমার দেখা হলো না। তবে কয়েকদিন পর আমার পরিবারেরই একজন সদস্যের সঙ্গে কথা হলো। আমার চাচি এসে বলল আমি যেন আমার চাচাতো ভাইকে হাসপাতালে নিয়ে যাই। তাঁর নিজেরই নিয়ে যাওয়া উচিত ছিল কিন্তু একটা কাজের জন্য তিনি সেটা করতে পারছেন না। আমারও কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিল না। তাই আমি প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যান করলাম না। হাসপাতালটা আমার পুরনো স্কুলের কাছেই ছিল। চাচি একটা খামে করে কিছু টাকা দিলেন আমাদের দুপুরের খাবারের জন্য।

হাসপাতাল পাল্টানোর কারণ হলো পুরনো হাসপাতালের চিকিৎসায় আমার চাচাতো ভাইয়ের তেমন কোনো উপকার হচ্ছিল না। চাচি হাসপাতালের ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললে ডাক্তার বলল সমস্যাটার চিকিৎসা হাসপাতাল থেকে বাড়ির ভেতরের পরিবেশের ওপর নির্ভর করছে বেশি। আমার চাচাতো ভাই কাছেই থাকত। কিন্তু আমি ছিলাম তার চেয়েও দশ বছরের বড়। ফলে তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু কোন একটা কারণে ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল। আমি বুঝতে পারছিলাম না কেন এমনটা হলো। আমি লক্ষ করলাম সে আমার কথা শোনার জন্য যখনই বাম কানটা ঘুরাত তখন বিষয়টা আমার কাছে খুব স্পর্শকাতর মনে হতো।

আমাদের বাসটা সাত থেকে আটটা স্টপেজ পার হওয়ার পর আমার চাচাতো ভাই উদ্বিগ্ন চোখে আমার দিকে তাকাল।

‘হাসপাতালটা কি আরো দূরে?’ সে বলল।

‘হ্যাঁ। আরো কিছু পথ বাকি আছে। এটা খুব বড় হাসপাতাল, আমাদের চোখ এড়াবে না।’

জানালা দিয়ে আসা বাতাসে বাসের ভেতর যে বৃদ্ধরা বসে ছিল তাদের মাথার টুপির ফিতাগুলো বারবার উড়ছিল। আমি ভাবছিলাম এই বৃদ্ধগুলো কোথায় যাচ্ছে?

‘হেই তুমি কি আমার বাবার কোম্পানিতে কাজ করবা?’ আমার ভাই জিজ্ঞেস করল।

আমার চাচার অনেক বড় একটা ছাপাখানার অফিস আছে। এই ধারণাটা আমাকে কেউ এর আগে বলেনি।

‘কই আমাকে তো কেউ এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। তুমি কেন এটা জিজ্ঞেস করলে?’ আমি বললাম।

আমার ভাই একটু হেসে বলল, ‘আমি ধারণা করেছিলাম তুমি সেখানে কাজ করবে। কিন্তু কেন তুমি সেটা করছ না? এখান থেকে তোমার চলে যাওয়া ঠিক হবে না। তুমি থাকো। সবাই খুশি হবে।’

বাসের রেকর্ড মেসেজে পরবর্তী স্টপেজের ঘোষণা দিচ্ছিল। কিন্তু কাউকে সেখানে নামার তেমন তোড়জোড় দেখা গেল না।

‘টোকিওতে আমার কাজ আছে। আমাকে ফিরে যেতে হবে।’ আমি বললাম।

আমি জানতাম সেখানে আমার কোনো কাজ ছিল না। তারপরও এখানে কোনোভাবেই আমি থাকতে পারছি না।

বাসটা যখন পাহাড়ে উঠছিল, আমি লক্ষ করলাম আশপাশের ঘরবাড়ির সংখ্যা কমে আসছে।

কয়েকটা অদ্ভুত ডিজাইনের বাড়ি আমরা দেখলাম। বাসটা যখনই পাহাড়ের বাঁকে উঠছিল তখনই আমরা অনেক দূরে নিচে সমুদ্রের দৃশ্যটা দেখছিলাম। আবার মুহূর্তেই সেটা মিলিয়ে যাচ্ছে।

অবশেষে হাসপাতালের সামনে বাসটা থামলে আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ সেই দৃশ্য দেখলাম।

‘যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবে সেটা আমি একাই সামলাতে পারব। ভয় নেই। তুমি অন্য কোথাও গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করো।’ আমার চাচাতো ভাই বলল।

ডাক্তার আসার পর আমি ঘর থেকে বের হয়ে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে হাঁটা দিলাম।

সকালে খুব হালকা নাশতা করেছিলাম। তাই টের পেলাম আমি বেশ ক্ষুধার্ত। কিন্তু মেনুতে ক্ষুধা দূর করার মতো তেমন খাবার পেলাম না। এক কাপ কফির অর্ডার দিয়ে চুপচাপ বসে থাকলাম।

সপ্তাহের ছুটির দিন ছিল এটা। ক্যাফেতে শুধুমাত্র ছোট্ট একটা পরিবার আর আমি ছিলাম। পরিবারের বাবার বয়স চল্লিশ হবে, নীল রঙের একটা শার্ট পরা, সঙ্গে প্যান্ট, পায়ে হালকা প্লাস্টিকের স্যান্ডেল। মার সঙ্গে যমজ মেয়ে, তারা দুজনেই সাদা পোশাক পরা। মেয়েদুটোর চেহারায় খুব সিরিয়াস একটা ভাব। তারা কমলার জুস খাচ্ছে। নিচে বেশ বড় খোলামেলা জায়গা। সবুজে ঢাকা। গ্রীষ্মের বাতাস বইছে সবুজ ঘাসগুলোর ওপর দিয়ে। পাশেই একটা টেনিস কোর্ট। অনেক দূরে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। আমার মনে হলো এই দৃশ্যটা আমি আগেও একবার দেখেছি। কমলার জুস খাওয়া দুটি মেয়ে আমার পাশে বসে আছে, নিচে বিশাল সমুদ্র। এটা নিশ্চয় আমার মনের কল্পনা ছাড়া আর কিছু না। কারণ আমি এই হাসপাতালে আগে কখনোই আসিনি।

ক্যাফেটেরিয়ার চেয়ারে লম্বা করে আমার পা বিছিয়ে দিয়ে দীর্ঘ একটা শ্বাস নিলাম। চোখ বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারের মাঝে স্মৃতির একটু আলোর ঝলকানি দেখা গেল। আস্তে আস্তে সে-আলোটা বিস্তৃত হতে থাকল। নানা আকৃতি দেখা গেল। বিভিন্ন রকমের স্মৃতির চরিত্ররা ফুটে উঠতে থাকল।

আট বছর আগে আমি অন্য আরেকটি হাসপাতালে গিয়েছিলাম। সমুদ্রের পারে ছোট্ট একটা হাসপাতাল। খুব পুরনো, আর হাসপাতালটার মধ্যে কেমন বৃষ্টির ঘ্রাণ। আমার বন্ধুর প্রেমিকার বুকের অপারেশন হয়েছিল। আমরা দুজন তাকে দেখতে গিয়েছিলাম সেই হাসপাতালে। ওর অপারেশনটা তেমন মেজর কিছু ছিল না। খুব অল্প সময়েই মেয়েটার অপারেশন শেষ হয়ে গেল। কিন্তু ডাক্তার কোনো ঝুঁকি নিতে চাইলেন না। তাই আমার বন্ধুর প্রেমিকাকে হাসপাতালে দশ দিন থাকতে হয়েছিল। আমি আর আমার বন্ধু বাইক হাঁকিয়ে সেখানে গেলাম। রাস্তার মাঝখানে সে একটা দোকান থেকে কিছু চকোলেট আর খাবার কিনল। আমি পেছনে বসেছিলাম। গ্রীষ্মের গরম। দুজনেই ঘেমে উঠছিলাম আবার সেই ঘাম বাতাসে শুকিয়ে যাচ্ছিল। আমার বন্ধুর ঘামের গন্ধ আমি পাচ্ছিলাম। তবে সে মারা যাওয়ার পর খুব বেশিদিন গন্ধটা আমার মাথায় ছিল না।

বন্ধুর প্রেমিকা আমি আর বন্ধু আমরা তিনজন ক্যাফেটেরিয়াতে বসলাম। সিগারেট খেলাম। বন্ধুর প্রেমিকা ক্ষুধার্ত ছিল। সে একটা হটডগ খেল, কোক খেল, আইসক্রিম খেল।

আমার বন্ধু তার প্রেমিকাকে বলল, ‘হাসপাতাল থেকে বের হওয়ার পর তোমাকে ভালো কোথাও যেতে হবে সুস্থতার জন্য।’

‘ভয় নেই আমি সুস্থ হয়ে উঠব।’ প্রেমিকা বলল।

তারা যখন কথা বলছিল তখন আমি বাইরে জানালা দিয়ে অনেক দূরে তাকিয়ে থাকলাম। ক্যাফেটেরিয়ায় হাসপাতালের গন্ধ ছিল। এমনকি খাবারেও।

আমরা এভাবে কিছুক্ষণ বসে থাকার পর আমার বন্ধুটি যৌনতা নিয়ে কথা বলা শুরু করল। সে সত্যিকার অর্থেই গল্প বলতে জানে। এমনভাবে সে যৌন গল্পগুলো বলা শুরু করল যে, তার বান্ধবী গলা ফাটিয়ে হাসতে শুরু করল।

‘দয়া করে আমাকে এভাবে হাসিও না। জোরে হাসলে আমার বুক ব্যথা করে।’ বান্ধবী বলল।

‘ঠিক কোথায় ব্যথা করে?’ আমার বন্ধু জিজ্ঞেস করল।

মেয়েটা তার জামার ওপর বাঁ-বুকের ঠিক ডানপাশটা দেখাল।

আমার বন্ধু এটা নিয়েও মজার কিছু বলল। তার বান্ধবী তখন আবারো হেসে উঠল।

আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। এগারোটা পঁয়তাল্লিশ বাজে। আমার চাচাতো ভাইটা এখনো ফিরে আসেনি।

দুপুরের খাবার সময় হয়ে যাচ্ছে। ক্যাফেটেরিয়াতে লোকজনের ভিড় আস্তে আস্তে বাড়ছে। নানা ধরনের শব্দের পাশাপাশি সিগারেটের ধোঁয়ায় ক্যাফেটা আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছিল। আমি আবারো সেই পুরনো স্মৃতির ভেতর ডুব দিলাম।

আমার মনে পড়ছে আমার বন্ধুর প্রেমিকার বুক পকেটে একটা সোনালি রঙের কলম ছিল। আমার এখন মনে পড়ছে সে এই কলমটা দিয়ে ন্যাপকিন পেপারের ওপর কিছু একটা লিখেছিল। খুব সম্ভবত সে একটা ছবি এঁকেছিল। ন্যাপকিনটা এত নরম ছিল যে কলমের খোঁচায় সেটা বারবার কুঁচকে উঠেছিল। এর মধ্যেই সে খুব সাবধানে একটা পাহাড়ের ছবি অাঁকল, পাহাড়ের ওপর ছোট্ট একটা ঘরের ছবি। সেই ঘরে একটা মেয়ে ঘুমিয়ে আছে। বাড়ির চারপাশে অদ্ভুত দর্শনের উইলো গাছ। সেই উইলো গাছের ছায়ায় আর বাতাসে মেয়েটা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।

‘এটা আবার কেমন উইলো গাছ?’ আমার বন্ধুটি বলল।

‘এইরকম একটা গাছ আছে।’

‘আমি কখনোই এমন গাছের কথা শুনিনি।’

‘সেজন্যই এটা আমি তৈরি করেছি।’ আমার বন্ধুর প্রেমিকা বলল। ‘এই অচিন উইলো গাছের ফুলের পরাগ অনেক বেশি। পাতাগুলো খুব সরু। ফুলের গন্ধ আর বাতাস মেয়েটাকে আরামে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে।’

বন্ধুর প্রেমিকা আবার নতুন আরেকটা পেপার নিয়ে সেখানে অচিন উইলো গাছের ছবি অাঁকল।

‘এই অচিন উইলো গাছটি ওপরে দেখতে ছোট হলেও মাটির নিচে এর শেকড় অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। এই গাছটা বড় অদ্ভুত। গাছটার ফুলগুলোর অনেক পরাগরেণু। আর ঘরের মেয়েটি এই গাছের ছায়াতেই ঘুমিয়ে আছে। গাছটার পরাগগুলোতে অনেক অনেক শুয়োপোকা। সেই পোকাগুলো ঘুমন্ত মেয়েটাকেও চাদরের মতো ঢেকে রেখেছে। তারপর পোকাগুলো মেয়েটাকে আস্তে আস্তে খেয়ে নিচ্ছে।’

আমার মনে পড়ে সেই গ্রীষ্মে আমার বন্ধুর বান্ধবী কেবল অচিন উইলো গাছ নিয়ে দীর্ঘ একটা কবিতা লিখেছিল। এটাই ছিল তার সামারের অ্যাসাইনমেন্ট। মেয়েটা আরো অনেক চিন্তাভাবনা করে নানা রকম কল্পনার ভেতর দিয়ে একটা গল্প দাঁড় করিয়েছিল। একজন তরুণ সেই পাহাড় বেয়ে ওপরে উঠে অচিন উইলো গাছটি তার শাখা-প্রশাখা দিয়ে যে মেয়েটাকে আটকে রেখে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল তাকে উদ্ধার করার জন্য উঠল।

‘তাহলে সেই ছেলেটা নিশ্চয় আমি ছিলাম।’ আমার বন্ধু আবারো মজা করার চেষ্টা করল।

‘না সেটা তুমি না।’ বান্ধবী বলল।

‘তুমি নিশ্চিত?’

‘হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত। তুমি কি রাগ করলে? রাগ করো না।’

‘তুমি বাজি ধরো সেই ছেলেটা আমি।’ আমার বন্ধু ভ্রু কুঁচকে রসিকতার ছলে বলল।

আমার বন্ধুর বান্ধবী তখন তার ছবির গল্পটা আবারো বলা শুরু করল। তো সেই যুবকটাই প্রথমবারের মতো অচিন উইলো গাছগুলোর সব বাধা উপেক্ষা করে তার চারপাশে গুনগুন করা প্রজাপতি আর মাছিগুলোকে তাড়িয়ে পাহাড়ের ওপর উঠে গেল মেয়েটিকে লম্বা ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলার জন্য।

‘কিন্তু ছেলেটা সেখানে পৌঁছার আগেই মেয়েটাকে পোকাগুলো খেয়ে ফেলে ঠিক না?’ আমার বন্ধু বলল।

তার বান্ধবী কোনো কিছু না বলে আমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি কী মনে করো এই গল্পের বিষয়ে।’

‘দেখে মনে হচ্ছে এটা একটা দুঃখের কাহিনি।’ আমি বললাম।

বারোটা বিশে আমার চাচাতো ভাই ফিরে এলো। আমার ছোট ভাইয়ের হাতে একটা ওষুধের ব্যাগ। তার চোখেমুখে অন্যরকম কিছু একটা আছে। সে ক্যাফেতে ঢুকে আমাকে খুঁজে বের করতে তার বেগ পেতে হলো। যখন আমাকে দেখল তখন দুলতে দুলতে আমার কাছে এলো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে নিজের শরীরের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছে না।

আমার কাছে এসে লম্বা করে একটা শ্বাস নিল।

‘সব কিছু ঠিকমতো হয়েছে তো?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘ইমম।’ আর কিছুই বলল না।

আমি অপেক্ষা করছিলাম সে আর কিছু বলবে। কিন্তু কিছুই বলল না।

‘তোমার কি ক্ষুধা লেগেছে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

সে মৃদু মাথা নাড়ল।

‘তুমি কি এখানেই খাবে নাকি বাস ধরে শহরে গিয়ে খাবে?’

আমার ছোট্ট চাচাতো ভাই খুব অনিশ্চিতভাবে তার চারপাশে তাকিয়ে বলল, ‘এখানেই ভালো।’

আমি খাবারের টিকিট নিয়ে এলাম। খাবার আসার আগ পর্যন্ত আমার ভাই আমার মতো করেই একদম চুপ হয়ে বাইরের যে-দৃশ্যগুলো আমি দেখছিলাম সেদিকে তাকিয়ে দূর-সমুদ্রের দৃশ্য দেখতে থাকল।

আমাদের টেবিলের পাশেই মধ্যবয়স্ক একজোড়া দম্পতি তাদের এক বন্ধুর বিষয়ে আলোচনা করছিল, যার পাকস্থলীর ক্যান্সার হয়েছে। আমাদের খাবারের মেনু খুব সামান্যই ছিল। ভাজা সাদা মাছ, সবজি, সালাদ আর রোল। আমরা দুই ভাই পাশাপাশি বসে চুপচাপ খেতে লাগলাম। আমাদের পাশেই সেই দম্পতি তখনো ক্যান্সার নিয়ে আলোচনা করছে। স্ত্রী প্রশ্ণ করছে আর স্বামী উত্তর দিচ্ছে।

‘সব জায়গায় তুমি একই বিষয়ই দেখবে। সেই গৎবাঁধা পরীক্ষা-নিরীক্ষা।’ আমার ভাই তার হাতের দিকে নীরবে তাকিয়ে বলল।

হাসপাতালের সামনে একটা বেঞ্চে বসে আমরা বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। যখনই বাতাস আসছে তখনই আমাদের মাথার ওপর সবুজ পাতাগুলো ঝরঝরিয়ে উঠছে।

‘কখনো কি এমন হয় যে তুমি কিছুই শুনতে পাও না?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছ। তখন আমি কিছুই শুনতে পাই না।’ চাচাতো ভাই বলল।

‘আসলে সেটার অনুভূতিটা কি রকম?’

মাথাটাকে সে একদিকে ঝুঁকিয়ে একটু চিন্তা করল। তারপর বলল, ‘হঠাৎ করেই এমন হয় যে আমি কিছুই শুনতে পাই না। তবে কখনো কখনো সেটা উপলব্ধি করা যায় যে তুমি একটু পরেই আর কিছু শুনতে পাবে না। এটা এমন যে, কানের দুই পাশে তুমি ইয়ার প্লাগ লাগিয়ে সমুদ্রের গভীর তলদেশে শুয়ে আছো।’

‘এটা কি বিরক্তিকর?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

সে তার মাথাটা নেড়ে বলল, ‘আমি জানি না কেন, তবে সত্য কথা বলতে কী এটা আমাকে তেমন বিরক্ত করে না।’

বিষয়টা আমি ভাবার চেষ্টা করলাম। তবে কল্পনা করে তেমন কোনো চিত্র অাঁকতে পারলাম না।

‘তুমি কি কখনো জন ফোরডের ফোর্ট এপাচি মুভিটা দেখেছ?’ আমার চাচাতো ভাই জিজ্ঞেস করল।

‘অনেক আগে দেখেছি।’ আমি বললাম।

‘টিভিতে কয়েকদিন আগে দেখাল। মুভিটা আসলেই খুব ভালো।’

‘হুম।’ আমি সম্মতি দিলাম।

আমার ভাইটা কিছুক্ষণ সেভাবে বসে থাকল। তারপর আবার বলল, ‘তুমি কি আমার কানের ভেতরটা একটু দেখবে?’

‘তোমার কানের ভেতর?’ আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

‘বাইরে থেকে কেবল কানের ভেতরটা দেখবে আর কিছু না।’

‘ঠিক আছে। কিন্তু কেন তুমি আমাকে এটা করতে বলছ?’

‘আমি জানি না। আমি কেবলমাত্র চাচ্ছিলাম যে, তুমি দেখো তারা আমার কানের ভেতর কী দেখেছে।’

‘ঠিক আছে আমি দেখব।’

আমার চাচাতো ভাই ঘুরে বসল। তার কানের আকৃতি আসলেই ভালো। আমি এর আগে কারো কানই এত মনোযোগ দিয়ে দেখিনি। আসলে কানের ভেতরে তাকালে এর গঠনটা সত্যিকার অর্থেই রহস্যময় মনে হবে। কানের ভেতরে তাকালে মনে হবে যে অন্ধকার কোনো গুহার ভেতর আস্তে আস্তে নেমে যাচ্ছে।

তখন আমার সেই বন্ধুর প্রেমিকার কথা মনে পড়ল। আমি যেন দেখতে পাচ্ছিলাম ছোট ছোট শুয়োপোকা বন্ধুর প্রেমিকার কানের ভেতর আস্তে আস্তে বাসা বাঁধছে। ছয় পা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। মস্তিষ্কের ভেতর বাসা বানিয়ে সেখানকার সব তরল খেয়ে তার ভেতর ডিম পারছে।

‘ঠিক আছে এতেই চলবে।’ আমার ভাই বলল। ‘তুমি কি কানের ভেতর উল্টাপাল্টা কিছু দেখছ?’

‘বাইরে থেকে আমি যা দেখলাম ভেতরটা তেমন স্বাভাবিকই মনে হলো।’

‘তেমন কিছু দেখো নি? কোনো অনুভূতি কিংবা অন্য কোনো ধরনের অভিজ্ঞতা?’

‘তোমার কান আমার কাছে বেশ স্বাভাবিকই মনে হলো।’

আমার চাচাতো ভাইকে এই উত্তরে বেশ বিমর্ষ দেখাল। মনে হয় আমি সঠিক কথাটা বলতে পারিনি।

‘ডাক্তার কি তোমাকে চিকিৎসা করতে গিয়ে কষ্ট দিয়েছে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘না। সবকিছু আগের মতোই হয়েছে।’

‘ওইতো ২৮ নাম্বার। ওটা নিশ্চয় আমাদের বাস?’ আমার চাচাতো ভাই কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল।

আমি কিছু একটা চিন্তায় ডুবে গিয়েছিলাম। যে-বাসটা আসছিল সেটার সামনে ২৮ নাম্বার থাকলেও সেটাই কি আমাদের বাস ছিল কিনা? আমি কিছুতেই বসার বেঞ্চ থেকে উঠতে পারছিলাম না। চোখের সামনে আমার বন্ধুর প্রেমিকার কথা মনে হচ্ছিল। মেয়েটাকে অচিন উইলো গাছের শাখা আটকে রেখেছিল।

আমার চাচাতো ভাই বেশ জোরেশোরে আমার কাঁধ ঝাঁকি দিয়ে বলল, ‘তুমি ঠিক আছো? কোনো সমস্যা হয়নি তো?’

আমি আবার সেই সময় বাস্তবে ফিরে এলাম। এক ঝটকায় আমি বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলাম। এবার আমার দাঁড়াতে কোনো সমস্যা হলো না। আমি আবারো আমার ত্বকে মে মাসের মিষ্টি বাতাসের স্পর্শ টের পেলাম। আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য আবারো সেই দৃশ্যের সামনে দাঁড়ালাম। আমি যা দেখছিলাম এখন সেগুলোর কোনো অস্তিত্বই নেই। আমাদের ২৮ নাম্বার সঠিক বাসটা চলে এলো।

দুজনেই বাসের ভেতর উঠে ভালো একটা জায়গায় চলে গেলাম।

আমার চাচাতো ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে আমি তাকে বললাম, ‘আমি ঠিক আছি। ভয় নাই।’

উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ...

হেঁসোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি - সুকুমার রায়


প্রফেসর হুঁশিয়ার আমাদের উপর ভারি রাগ করেছেন। আমরা সেকালের জীবজন্তু সম্বন্ধে নানাকথা ছাপিয়েছি; কিন্তু কোথাও তাঁর অদ্ভুত শিকার কাহিনীর কোনো উল্লেখ করি নি। সত্যি এ আমাদের ভারি অন্যায়। আমরা সে-সব কাহিনী কিছুই জানতাম না। কিন্তু প্রফেসর হুঁশিয়ার তাঁর শিকারের ডায়েরি থেকে কিছু কিছু উদ্ধার করে আমাদের পাঠিয়েছেন। আমরা তারই কিছু কিছু ছাপিয়ে দিলাম। এ-সব কথা সত্যি কি মিথ্যা তা তোমরা বিচার করে নিয়ো।


২৬শে জুন ১৯২২- কারাকোরম্, বন্দাকুশ পাহাড়ের দশ মাইল উত্তর। আমরা এখন সবসুদ্ধ দশজন- আমি, আমার ভাগ্নে চন্দ্রখাই, দুইজন শিকারী (ছক্কড় সিং আর লক্কড় সিং) আর ছয়জন কুলি। আমার কুকুরটাও সঙ্গে সঙ্গেই চলেছে।

নদীর ধারে তাঁবু খাটিয়ে জিনিসপত্র সব কুলিদের জিম্মায় দিয়ে, আমি, চন্দ্রখাই আর শিকারী দুজনকে সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে বন্দুক, ম্যাপ আর একটা মস্ত বাক্স, তাতে আমাদের যন্ত্রপাতি আর খাবার জিনিস। দুঘণ্টা পথ চলে আমরা এক জায়গায় এলাম, সেখানকার সবই কেমন অদ্ভুতরকম। বড়ো-বড়ো গাছ, তার একটারও নাম আমরা জানি না। একটা গাছে প্রকাণ্ড বেলের মতো মস্ত-মস্ত লাল রঙের ফল ঝুলছে; একটা ফুলের গাছ দেখলাম, তাতে হলদে সাদা ফুল হয়েছে, এক-একটা দেড় হাত লম্বা। আর-একটা গাছে ঝিঙের মতো কি সব ঝুলছে, পঁচিশ হাত দূর থেকে তার ঝাঁঝালো গন্ধ পাওয়া যায়। আমরা অবাক হয়ে এই-সব দেখছি, এমন সময় হঠাত্ হুপ্‌হাপ গুব্‌গাপ্ শব্দে পাহাড়ের উপর থেকে ভয়ানক একটা কোলাহল শোনা গেল।

আমি আর শিকারী দুজন তত্ক্ষণাত্ বন্দুক নিয়ে খাড়া; কিন্তু চন্দ্রখাই বাক্স থেকে দুই টিন জ্যাম বের করে নিশ্চিন্তে বসে খেতে লাগল। ঐটে তার একটা মস্ত দোষ; খাওয়া পেলে আর তার বিপদ আপদ কিছু জ্ঞান থাকে না। এইভাবে প্রায় মিনিট দুই দাঁড়িয়ে থাকবার পর লক্কড় সিং হঠাত্ দেখতে পেল হাতির চাইতেও বড়ো একটা জন্তু গাছের উপর থেকে তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাসছে। প্রথমে দেখে মনে হল একটা প্রকাণ্ড মানুষ, তার পর মনে হল মানুষ নয় বাঁদর, তার পর দেখি মানুষও নয়, বাঁদরও নয়- একেবারে নতুন রকমের জন্তু। সে লাল লাল ফলগুলোর খোসা ছাড়িয়ে খাচ্ছে আর আমাদের দিকে ফিরে ফিরে ঠিক মানুষের মতো করে হাসছে। দেখতে দেখতে পঁচিশ-ত্রিশটা ফল সে টপাটপ্ খেয়ে শেষ করল। আমরা এই সুযোগে তার কয়েকখানা ছবি তুলে ফেললাম। তার পর চন্দ্রখাই ভরসা করে এগিয়ে গিয়ে তাকে কিছু খাবার দিয়ে আসল। জন্তুটা মহা খুশি হয়ে এক গ্রাসে আস্ত একখানা পাঁউরুটি আর প্রায় আধসের গুড় শেষ করে, তার পর পাঁচ-সাতটা সিদ্ধ ডিম খোলাসুদ্ধ কড়মড়িয়ে খেয়ে ফেলল। একটা টিনে করে গুড় দেওয়া হয়েছিল, সেই টিনটাও সে খাবার মতলব করেছিল, কিন্তু খানিকক্ষণ চিবিয়ে হঠাত্ বিশ্রী মুখ করে সে কান্নার সুরে গাঁও গাঁও শব্দে বিকট চীত্কার করে জঙ্গলের মধ্যে কোথায় মিলিয়ে গেল। আমি জন্তুটার নাম দিয়েছি হ্যাংলাথেরিয়াম্।

২৪শে জুলাই, ১৯২২- বন্দাকুশ পাহাড়ের একুশ মাইল উত্তর। এখানে এত দেখবার জিনিস আছে, নতুন নতুন এত-সব গাছপালা জীবজন্তু, যে তারই সন্ধান করতে আর নমুনা সংগ্রহ করতে আমাদের সময় কেটে যাচ্ছে। দুশোরকম পোকা আর প্রজাপতি আর পাঁচশো রকম গাছপালা ফুলফল সংগ্রহ করেছি; আর ছবি যে কত তুলেছি তার সংখ্যাই হয় না। একটা কোনো জ্যান্ত জানোয়ার ধরে সঙ্গে নেয়ার ইচ্ছা, দেখা যাক কতদূর কি হয়। সেবার যখন কট্ক টোডন্ আমায় তাড়া করেছিল, তখন সে কথা কেউ বিশ্বাস করে নি। এবার তাই জলজ্যান্ত প্রমাণ সংগ্রহ করে নিচ্ছি।

আমরা যখন বন্দাকুশ পাহাড়ে উঠেছিলাম, তখন পাহাড়টা কত উঁচু তা মাপা হয়নি। সেদিন জরীপের যন্ত্র দিয়ে আমি আর চন্দ্রখাই পাহাড়টাকে মেপে দেখলাম। আমার হিসেব হল ষোলোহাজার ফুট। কিন্তু চন্দ্রখাই হিসাব করল বেয়াল্লিশহাজার। তাই আজ আবার সাবধানে দুজনে মিলে মেপে দেখলাম, এবার হল মোটে দু’হাজার সাতশো ফুট। বোধ হয় আমাদের যন্ত্রে কোনো দোষ হয়ে থাকবে! যাহোক এটা নিশ্চয় যে এপর্যন্ত ঐ পাহাড়ের চুড়োয় আর কেউ ওঠে নি। এ-এক সম্পূর্ণ অজানা দেশ, কোথাও জন মানুষের চিহ্নমাত্র নাই, নিজেদের ম্যাপ নিজেরা তৈরি করে পথ চলতে হয়।

আজ সকালে এক কাণ্ড হয়ে গেছে। লক্কড় সিং একটা গাছে হলদে রঙের ফল ফলেছে দেখে তারই একটুখানি খেতে গিয়েছিল। এক কামড় খেতেই হঠাত্ হাত-পা খিঁচিয়ে সে আর্তনাদ করে মাটিতে পড়ে ছট্ফট্ করতে লাগল। তাই দেখে ছক্কড় সিং “ভাইয়া রে, ভাইয়া” বলে কেঁদে অস্থির। যাহোক মিনিট দশেক ঐরকম হাত-পা ছুঁড়ে লক্কড় সিং একটু ঠাণ্ডা হয়ে উঠে বসল। তখন আমাদের চোখে পড়ল যে একটা জন্তু কাছেই ঝোপের আড়াল থেকে অত্যন্ত বিরক্ত মতন মুখ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চেহারা দেখলে মনে হয় যে, সংসারে তার কোনো সুখ নেই, এ-সব গোলমাল কান্নাকাটি কিছুই তার পছন্দ হচ্ছে না। আমি তার নাম দিয়েছি গোমড়াথেরিয়াম্। এমন খিট্খিটে খুঁতখুঁতে গোমড়া মেজাজের জন্তু আর আমরা দ্বিতীয় দেখি নি। আমরা তাকে তোয়াজ টোয়াজ করে খাবার দিয়ে ভোলাবার চেষ্টা করেছিলাম। সে অত্যন্ত বিশ্রী মতো মুখ করে, ফোঁস্ ফোঁস্ ঘোঁত্ ঘোঁত্ করে অনেক আপত্তি জানিয়ে, আধখানা পাঁউরুটি আর দুটো কলা খেয়ে তার পর একটুখানি পেয়ারার জেলি মুখে দিতেই এমন চটে গেল যে রেগে সারা গায়ে জেলি আর মাখন মাখিয়ে আমাদের দিকে পিছন ফিরে মাটিতে মাথা ঠুকতে লাগল।

১৪ই আগস্ট, বন্দাকুশ পাহাড়ের পঁচিশ মাইল উত্তর- ট্যাপ্ ট্যাপ্ থ্যাপ্ থ্যাপ্ ঝুপ্ ঝাপ্- সকালবেলায় খেতে বসেছি, এমন সময় এইরকম একটা শব্দ শোনা গেল। একটুখানি উঁকি মেরে দেখি আমাদের তাঁবুর কাছে প্রায় উটপাখির মতন বড়ো একটা অদ্ভুতরকম পাখি অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সে কোন দিকে চলবে তার কিছুই যেন ঠিক-ঠিকানা নেই। ডান পা এদিকে যায় তো বাঁ পা ওদিকে; সামনে চলবে তো পিছনভাগে চায়, দশ পা না যেতেই পায়ে পায়ে জড়িয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে। তার বোধ হয় ইচ্ছা ছিল তাঁবুটা ভালো করে দেখে, কিন্তু হঠাত্ আমায় দেখতে পেয়ে সে এমন ভড়কে গেল যে তক্ষুনি হুমড়ি খেয়ে হুড়্মুড়্ করে পড়ে গেল। তার পর এক ঠ্যাঙে লাফাতে লাফাতে প্রায় হাত দশেক গিয়ে আবার হেলেদুলে ঘাড় বাঁকিয়ে আমাদের দেখতে লাগল। চন্দ্রখাই বলল, “ঠিক হয়েছে, এইটাকে ধরে আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যাক।” তখন সকলের উত্সাহ দেখে কে! আমি ছক্কড় সিংকে বললাম, “তুমি বন্দুকের আওয়াজ কর, তা হলে পাখিটা নিশ্চয়ই চমকে পড়ে যাবে আর সেই সুযোগে আমরা চার-পাঁচজন তাকে চেপে ধরব!” ছক্কড় সিং বন্দুক নিয়ে আওয়াজ করতেই পাখিটা ঠ্যাং মুড়ে মাটির উপর বসে পড়ল, আর আমাদের দিকে তাকিয়ে ক্যাট্ ক্যাট্ শব্দ করে ভয়ানক জোরে ডানা ঝাপ্টাতে লাগল। তাই দেখে আমাদের আর এগুতে সাহস হল না। কিন্তু লক্কড় সিং হাজার হোক তেজী লোক, সে দৌড়ে গিয়ে পাখিটার বুকে ধাঁই করে এক ছাতার বাড়ি বসিয়ে দিল। ছাতার বাড়ি খেয়ে পাখিটা তত্ক্ষণাত্ দুই পা ফাঁক করে উঠে দাঁড়াল। তার পর লক্কড় সিং-এর দাড়িতে কামড়ে ধরে তার ঘাড়ের উপর দুই পা দিয়ে ঝুলে পড়ল। ভাইয়ের বিপদ দেখে ছক্কড় সিং বন্দুকের বাঁট দিয়ে পাখিটার মাথাটা থেঁত্লে দেবার আয়োজন করেছিল। কিন্তু সে আঘাতটা পাখিটার মাথায় লাগল না, লাগল গিয়ে লক্কড় সিং-এর বুকে। তাতে পাখিটা ভয় পেয়ে লক্কড় সিংকে ছেড়ে দিল বটে, কিন্তু দুই ভাইয়ে এমন মারামারি বেঁধে উঠল যে আমরা ভাবলাম দুটোই এবার মরে বুঝি। দুজনের তেজ কি তখন! আমি আর দুজন কুলি লক্কড় সিং-এর জামা ধরে টেনে রাখছি, সে আমাদের সুদ্ধ হিঁচড়ে নিয়ে ভাইয়ের নাকে ঘুষি চালাচ্ছে। চন্দ্রখাই রীতিমতো ভারিক্কে মানুষ; সে ছক্কড় সিং-এর কোমর ধরে লটকে আছে, ছক্কড় সিং তাইসুদ্ধ মাটি থেকে তিন হাত লাফিয়ে উঠে বন্বন্ করে বন্দুক ঘোরাচ্ছে। হাজার হোক পাঞ্জাবের লোক কি না। মারামারি থামাতে গিয়ে সেই ফাঁকে পাখিটা যে কখন পালালো তা আমরা টেরই পেলাম না। যা হোক এই ল্যাগ্ব্যাগ পাখি বা ল্যাগ-ব্যাগর্নিসের কতকগুলো পালক আর কয়েকটা ফোটোগ্রাফ সংগ্রহ হয়েছিল। তাতেই যথেষ্ট প্রমাণ হবে।

১লা সেপ্টেম্বর, কাঁকড়ামতী নদীর ধারে- আমাদের সঙ্গের খাবার ইত্যাদি ক্রমেই ফুরিয়ে আসছে। তরিতরকারি যা ছিল, তা তো আগেই ফুরিয়েছে। টাটকা জিনিসের মধ্যে সঙ্গে কতগুলো হাঁস আর মুরগী আছে, তারা রোজ কয়েকটা করে ডিম দেয়, তা ছাড়া খালি বিস্কুট, জ্যাম, টিনের দুধ আর ফল, টিনের মাছ, আর মাংস। এই-সব কয়েক সপ্তাহের মতো আছে, সুতরাং এই কয়েক সপ্তাহের মধ্যে আমাদের ফিরতে হবে। আমরা এই সব জিনিস গুনছি আর সাজিয়ে গুছিয়ে রাখছি, এমন সময় ছক্কড় সিং বলল, যে লক্কড় সিং ভোরবেলা কোথায় বেরিয়েছে, এখন পর্যন্ত ফেরে নি। আমরা বললাম, “ব্যস্ত কেন, সে আসবে এখন। যাবে আবার কোথায়?” কিন্তু তার পরেও দুই-তিন ঘণ্টা গেল অথচ লক্কড় সিং-এর দেখা পাওয়া গেল না। আমরা তাকে খুঁজতে বেরুবার পরামর্শ করছি, এমন সময় হঠাত্ একটা ঝোপের উপর দিয়ে একটা প্রকাণ্ড জানোয়ারের মাথা দেখা গেল। মাথাটা উঠছে নামছে আর মাতালের মতো টলছে। দেখেই আমরা সুড়্সুড়্ করে তাঁবুর আড়ালে পালাতে যাচ্ছি, এমন সময় শুনলাম লক্কড় সিং চেঁচিয়ে বলছে, “পালিয়ো না, পালিয়ো না, ও কিছু বলবে না।” তার পরের মুহূর্তেই দেখি লক্কড় সিং বুক ফুলিয়ে সেই ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল। তার পাগড়ীর কাপড় দিয়ে সে ঐ অত বড়ো জানোয়ারটাকে বেঁধে নিয়ে এসেছে। আমাদের প্রশ্নের উত্তরে লক্কড় সিং বলল, যে সে সকালবেলায় কুঁজো নিয়ে নদী থেকে জল আনতে গিয়েছিল। ফিরবার সময় এই জন্তুটার সাথে তার দেখা। তাকে দেখেই জন্তুটা মাটিতে শুয়ে কোঁ-কোঁ শব্দ করতে লাগল। সে দেখল জন্তুটার পায়ে কাঁটা ফুটেছে আর তাই দিয়ে দর্দর্ করে রক্ত পড়ছে। লক্কড় সিং খুব সাহস করে তার পায়ের কাঁটাটি তুলে, বেশ করে মুছে, নিজের রুমাল দিয়ে বেঁধে দিল। তার পর জানোয়ারটা তার সঙ্গে সঙ্গে আসছে দেখে সে তাকে পাগড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে এসেছে। আমরা সবাই বললাম, “তা হলে এটা ঐরকম বাঁধাই থাক, দেখি ওটাকে সঙ্গে করে দেশে নিয়ে যাওয়া যায় কিনা।” জন্তুটার নাম রাখা গেল ল্যাংড়াথেরিয়াম্।

সকালে তো এই কাণ্ড হল; বিকালবেলা আর এক ফ্যাসাদ উপস্থিত। তখন আমরা সবেমাত্র তাঁবুতে ফিরেছি। হঠাত্ আমাদের তাঁবুর বেশ কাছেই একটা বিকট চীত্কারের শব্দ শোনা গেল। অনেকগুলো চিল আর পেঁচা একসঙ্গে চেঁচালে যেরকম আওয়াজ হয়, কতকটা সেইরকম। ল্যাংড়াথেরিয়ামটা ঘাসের উপর শুয়ে শুয়ে একটা গাছের লম্বা-লম্বা পাতা ছিঁড়ে খাচ্ছিল; চীত্কার শুনবামাত্র সে, ঠিক শেয়াল যেমন করে ফেউ ডাকে সেইরকম ধরনের একটা বিকট শব্দ করে, বাঁধন-টাঁধন ছিঁড়ে, কতক লাফিয়ে কতক দৌড়িয়ে এক মুহূর্তের মধ্যে গভীর জঙ্গলের ভিতর মিলিয়ে গেল। আমরা ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে না পেরে, ভয়ে ভয়ে খুব সাবধানে এগিয়ে গিয়ে দেখি, একটা প্রকাণ্ড জন্তু- সেটা কুমিরও নয়, সাপও নয়, মাছও নয়, অথচ তিনটারই কিছু আদল আছে- সে এক হাত মস্ত হাঁ করে প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে; আর একটা ছোটো নিরীহ গোছের কি যেন জানোয়ার হাত-পা এলিয়ে ঠিক তার মুখের সামনে আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে। আমরা মনে করলাম, এইবার বেচারাকে খাবে বুঝি, কিন্তু পাঁচ মিনিট গেল, দশ মিনিট গেল, কেবল চীৎকারই চলতে লাগল; খাবার কোনো চেষ্টা দেখা গেল না। লক্কড় সিং বলল, ““আমি ওটাকে গুলি করি।” আমি বললাম, “কাজ নেই, গুলি যদি ঠিকমতো না লাগে, তা হলে জন্তুটা ক্ষেপে গিয়ে কি জানি করে বসবে, তা কে জানে?” এই বলতে বলতেই ধেড়ে জন্তুটা চীত্কার থামিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে নদীর দিকে চলে গেল। চন্দ্রখাই বলল, “এ জন্তুটার নাম দেওয়া যাক চিল্লানোসরাস্।” ছক্কড় সিং বলল, “উ বাচ্চাকো নাম দেও, বেচারাথেরিয়াম্।”

৭ই সেপ্টেম্বর, কাঁকড়ামতী নদীর ধারে- নদীর বাঁক ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা পাহাড়ের একেবারে শেষ কিনারায় এসে পড়েছি। আর কোনোদিকে এগোবার জো নাই। দেওয়ালের মতো খাড়া পাহাড়, সোজা দুশো তিনশো হাত নীচে সমতল জমি পর্যন্ত নেমে গিয়েছে। যেদিকে তাকাই সেই দিকেই এরকম। নীচের যে সমতল জমি সে একেবারে মরুভূমির মতো; কোথাও গাছপালা, জনপ্রাণীর চিহ্নমাত্র নাই। আমরা একেবারে পাহাড়ের কিনারায় ঝুঁকে পড়ে এই-সব দেখছি, এমন সময় আমাদের ঠিক হাত পঞ্চাশেক নীচেই কি যেন ধড়্ফড়্ করে উঠল। দেখলাম বেশ একটা মাঝারি গোছের তিমি মাছের মতো মস্ত কি একটা জন্তু পাহাড়ের গায়ে আঁকড়ে ধরে বাদুড়ের মতো মাথা নিচু করে ঘুমাচ্ছে। তখন এদিক-ওদিক তাকিয়ে এইরকম আরো পাঁচ-সাতটা জন্তু দেখতে পেলাম। কোনোটা ঘাড় গুঁজে ঘুমাচ্ছে, কোনোটা লম্বা গলা ঝুলিয়ে দোল খাচ্ছে, আর অনেক দূরে একটা পাহাড়ের ফাটলের মধ্যে ঠোঁট ঢুকিয়ে কি যেন খুঁটে খুঁটে বের করে খাচ্ছে। এইরকম দেখছি এমন সময় হঠাত্ কট্ কটাং কট্ শব্দ করে সেই প্রথম জন্তুটা হুড়ুত্ করে ডানা মেলে একেবারে সোজা আমাদের দিকে উড়ে আসতে লাগল। ভয়ে আমাদের হাত-পাগুলো গুটিয়ে আসতে লাগল; এমন বিপদের সময়ে যে পালানো দরকার, তা পর্যন্ত আমরা ভুলে গেলাম। জন্তুটা মুহূর্তের মধ্যে একেবারে আমাদের মাথার উপরে এসে পড়ল। তার পর যে কি হল তা আমার ভালো করে মনে নাই- খালি একটু একটু মনে পড়ে, একটা অসম্ভব বিটকেল গন্ধের সঙ্গে ঝড়ের মতো ডানা ঝাপটানো আর জন্তুটার ভয়ানক কট্ কটাং আওয়াজ। একটুখানি ডানার ঝাপটা আমার গায়ে লেগেছিল তাতেই আমার দম বেরিয়ে প্রাণ বের হবার যোগাড় করেছিল। অন্যসকলের অবস্থাও সেইরকম অথবা তার চাইতেও খারাপ। যখন আমার হুঁশ হল তখন দেখি সকলেরই গা বেয়ে রক্ত পড়ছে। ছক্কড় সিং-এর একটা চোখ ফুলে প্রায় বন্ধ হবার যোগাড় হয়েছে, লক্কড় সিং-এর বাঁ হাতটা এমন মচকে গিয়েছে যে সে যন্ত্রণায় আর্তনাদ করছে, আমারও সমস্ত বুকে পিঠে বেদনা ধরে গিয়েছে; কেবল চন্দ্রখাই এক হাতে রুমাল দিয়ে কপালের আর ঘাড়ের রক্ত মুছছে, আর-এক হাতে একমুঠো বিস্কুট নিয়ে খুব মন দিয়ে খাচ্ছে। আমরা তখনই আর বেশি আলোচনা না করে জিনিসপত্র গুটিয়ে বন্দাকুশ পাহাড়ের দিকে ফিরে চললাম।

[ প্রফেসর হুঁশিয়ারের ডায়েরি এইখানেই শেষ। কিন্তু আমরা আরো খবর জানবার জন্য তাঁকে চিঠি লিখেছিলাম। তার উত্তরে তিনি তাঁর ভাগ্নেকে পাঠিয়ে দিয়ে লিখলেন, “এর কাছেই সব খবর পাবে।” চন্দ্রখাই-এর সঙ্গে আমাদের যে কথাবার্তা হয় খুব সংক্ষেপে তা হচ্ছে এই-

আমরা। আপনারা যে-সমস্ত নমুনা সংগ্রহ করেছিলেন সে-সব কোথায় গেলে দেখতে পাওয়া যায়?

চন্দ্র। সে-সব হারিয়ে গেছে।

আমরা। বলেন কি! হারিয়ে গেল? এমন সব জিনিস হারিয়ে ফেললেন!

চন্দ্র। হ্যাঁ, প্রাণটুকু যে হারায় নি তাই যথেষ্ট। সে-দেশের ঝড় তো আপনারা দেখেন নি। তার এক-এক ঝাপটায় আমাদের যন্ত্রপাতি, বড়ো-বড়ো তাঁবু আর নমুনার বাক্স, সব কাগজের মতো হুস্ করে উড়িয়ে নেয়। আমাকেই তো পাঁচ-সাতবার উড়িয়ে নিয়েছিল। একবার তো ভাবলাম মরেই গেছি। কুকুরটাকে যে কোথায় উড়িয়ে নিল, সে তো আর খুঁজেই পেলাম না। সে যা বিপদ! কাঁটা কম্পাস, প্ল্যান ম্যাপ, খাতাপত্র কিছুই আর বাকি রাখে নি। কি করে যে ফিরলাম, তা শুনলে আপনার ঐ চুল দাড়ি সব সজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে উঠবে। আধপেটা খেয়ে, কোনোদিন না খেয়ে, আন্দাজে পথ চলে, দুই সপ্তাহের রাস্তা পার হতে আমাদের পুরো তিনমাস লেগেছিল।

আমরা। তা হলে আপনাদের প্রমাণ-টমান যা কিছু ছিল সব নষ্ট হয়েছে?

চন্দ্র। এই তো আমি রয়েছি, মামা রয়েছেন, আবার কি প্রমাণ চাই, আর এই আপনাদের জন্য কতকগুলো ছবি এঁকে এনেছি; এতেও অনেকটা প্রমাণ হবে।

আমাদের ছাপাখানার একটা ছোকরা ঠাট্টা করে বলল, “আপনি কোন থেরিয়াম?” আর-একজন বলল, “উনি হচ্ছেন গপ্পথেরিয়াম- বসে বসে গপ্প মারছেন।” শুনে চন্দ্রখাই ভীষণ রেগে আমাদের টেবিল থেকে একমুঠো চীনেবাদাম আর গোটা আষ্টেক পান উঠিয়ে নিয়ে গজ্গজ্ করতে করতে বেরিয়ে গেল। ব্যাপার তো এই। এখন তোমরা কেউ যদি আরো জানতে চাও, তা হলে আমাদের ঠিকানায় প্রফেসর হুঁশিয়ারকে চিঠি লিখলে আমরা তার জবাব আনিয়ে দিতে পারি। ]

 

হাইনরিখ বোল-এর সাক্ষাৎকার : দি আর্ট অব ফিকশন


জীবন-যাপনের মধ্যে একটা আধ্যাত্মিক তাৎপর্য খুঁজে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় লিখেছেন হাইনরিখ বোল। তাঁর জন্ম জার্মানির কোলনে, ১৯১৭ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে হয় তাঁকে। রাশিয়া আর ফ্রান্সের রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেন, আহত হন, মার্কিন যুদ্ধবন্দী শিবিরে তাঁকে কয়েদি জীবন যাপন করতে হয়। পরে, তাঁর মহৎ সাহিত্যকর্মে তাঁর দুঃসহ যুদ্ধজীবনের কথা স্থান পাবে। রচিত হবে- দ্য ম্যাড ডগ, দ্য ক্লাউন, গ্রুপ পোট্রেট উইথ লেডি, দ্য লস্ট অনার অব ক্যাথরিনা ব্লুম, দ্য ট্রেন ওয়াজ লেট, বিলিয়ার্ডস অ্যাট হাফপাস্ট নাইন। নোবেল পেয়েছেন ১৯৭২ সালে। ১৯৮০ সালে পৃথিবী হারায় এই মানুষটিকে, যার জীবন ভরে ছিল মহাযুদ্ধের হতাশায়। দ্য প্যারিস রিভিউয়ের সাক্ষাৎকারটিতে হাইনরিখ বোল তাঁর টেকনিক নিয়ে কথা বলেছেন, আর এই কারণে আমাদের কাছে সাক্ষাৎকারটি সারবান। অনুবাদ- এমদাদ রহমান।

সাক্ষাৎকারী

'অ্যাডাম, কোথায় ছিলে তুমি'-তে আপনার কাজ পাঠককে চমকে দেবার ক্ষমতা দেখে আমি বিস্মিত, যেখানে তার শেষ পৃষ্ঠায় মুখ্য চরিত্রটি মারা যায় কিংবা 'গ্রুপ পোট্রেট উইথ লেডি'-তে বর্ণনাকারীর সঙ্গে লেনি পিফেইফার সাক্ষাতের অপেক্ষায় থাকায় পাঠক উৎকন্ঠিত হয়, এটা আপনি শুধুমাত্র কয়েকটা শব্দে তুলে ধরেছেন। হঠাৎ চমকে দেবার এই খেলাটা কোন উদ্দেশ্য থেকে করে থাকেন? আপনি কি আপনার উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই বিস্মিত করাকে কৌশল করে নেন?
বোল

না, আমি কখনোই তা মনে করি না। 'গ্রুপ পোট্রেট উইথ লেডি'-তে, এরকম হয়ে যাবার কারণ খুব যথাসম্ভব- আমি এই যথাসম্ভব কথাটির উপর জোর দিচ্ছি- বর্ণনাকারী বেশ দূরে দূরে থেকেছেন পুরো বইয়ে। তিনি একজন গবেষকে পরিণত হয়েছেন আর গবেষণার কাজে সহায়ক অনুভুতিগত প্রতিক্রিয়া, ঘটনার পেছনের ঘটনা, বাস্তবতা, মনের গতি-প্রকৃতি আর ঘটনাগুচ্ছকে সংগ্রহ করছেন। তিনি সম্ভবত প্রতিপক্ষের মুখোমুখিও হচ্ছেন না, দূরে থাকছেন। 'অ্যাডাম, কোথায় ছিলে তুমি'-তে যথাসম্ভব বলতে হবে, একটি বিশেষ পরীক্ষামূলক অংশ আছে, যা উপন্যাসে অন্যতম। আমেরিকানদের হাতে বন্দি হওয়ার আগে, জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলে যুদ্ধের শেষ মাসটি আমি কাটিয়েছি। সেখানে প্রত্যক্ষ করেছিলাম যে জার্মান সৈন্যরা সেখানকার বাড়িগুলোতে ওড়ানো সাদা পাতাকা নামিয়ে ফেলবার জন্য গুলি ছুঁড়ত। আমেরিকার সৈন্যরা যতই অগ্রসর হচ্ছিল, রণাঙ্গনের মাঝখানের গ্রাম ও ছোট শহরগুলি তাদের আগমনের জন্য অপেক্ষা করত আর টাঙিয়ে দিত সাদা পাতাকাগুলি, সাদা পতাকা উত্তোলন ছিল নিষিদ্ধ, মৃত্যুদণ্ড দিয়ে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। খুব স্বাভাবিকভাবেই, রণাঙ্গন বদলে যাবার কারণে কিছু গ্রামে দখলদারিত্বেরও পরিবর্তন হয়। জার্মান আর্মি কিংবা তাদের নির্দিষ্ট ইউনিট সাদা পতাকা উড়ানো বাড়িগুলোকে পুড়িয়ে দিয়েছিল। ‍এইসব কারণে, সাদা পতাকা আমার কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটা প্রতীক। সম্ভবত- আমি জানতামই না সেই সময়ে আমার মনে আসলে কী ছিল, আমার একটাই ভাবনা ছিল- শেষ মুহূর্তে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমার জীবনের সমাপ্তি ঘটবে যা আমাকে গল্পের শেষ দিকে নিয়ে যাবে- এই উপায়ে। অজস্র লোকের ভাগ্যে কিন্তু এই ঘটনাই ঘটেছিল। রাইনল্যান্ড-এ রণাঙ্গন থেকে পালানো বিপুল সংখ্যক মানুষকে মৃত্যুর ঢেউ এসে তলিয়ে দিয়েছিল, এমনকি সেখানকার মৃত্যুদণ্ড সম্বন্ধে এখনো সব জানা যায়নি। গাছে ঝুলিয়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতো, দেখামাত্রই গুলি করে হত্যা করা হতো পালিয়ে বেড়ানোদের। সেখানে একটি স্বেচ্ছাচারী বিচারব্যবস্থা ছিল। আমার বিশ্বাস হয়েছিল যে, যে-কেউই যেকোন পলাতক সৈন্যকে নির্বিচারে গুলি করে মেরে ফেলবার পক্ষে হিটলারের অনুমোদন ছিল। এদিকে, যুদ্ধের শেষ মাসে, আমার ভাইকে সঙ্গে নিয় স্বয়ং আমি, রণাঙ্গন থেকে পালিয়ে যাওয়া সৈন্য হিসেবে এক নিরন্তর ভয়ের মধ্যে দিন কাটাতে লাগলাম : 'আমরা কি পালিয়ে গিয়ে বাঁচতে পারব? আমরা কি এখান থেকে জীবিত বের হতে পারব, বিরুদ্ধস্রোতে বেঁচে থাকবার চেষ্টাটা করতে কি পারব? তারপরে, সমূহ বিপন্নতা থেকে জেভাবেই হোক বের হবার প্রাণান্ত চেষ্টায়- মনে হল যে এটাই সবচে নিরাপদ পন্থা- আবার আমি আর্মিতে ফিরে যাই। পনেরো-ষোলো দিনের মধ্যেই আমি সেনাবাহিনীর দ্বারা না মরে আমেরিকানদের হাতে বন্দী হই। আমি প্রায়ই দেখেছি সাদা পতাকার সঙ্গে কী ঘটছিল। আর, অবশ্যই আমার জন্য- সেই বিশেষ রঙের থেকে পালিয়ে যাওয়া আমি, যে কি না তার নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কায় আছে, ভীত- সাদা ব্যাপারটা সে সময় আমার মনে গভীর রেখাপাত করে। এটা কোনওভাবেই ইচ্ছাপূরণের মতো পরিসমাপ্তি নয়।


সাক্ষাৎকারী 

আমি সেই সৈন্যটির সঙ্গে তার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম যেখানে একটা সাদা পতাকা পতপত করে উড়ছিল, এবং ঠিক যখনই পৃষ্ঠাটা উলটালাম দেখলাম সেখানে এক অতর্কিত, হতবিহ্বল-করা মুহূর্ত। আমি যেন নিজেকে প্রায় ভেঙে ফেললাম।
বোল

আমার এক তরুণের কথা মনে আছে, সে ছিল ননকমিশনড অফিসার, যে রণাঙ্গন ছেড়ে মায়ের সঙ্গে কফি খেতে গিয়েছিল। মাত্র চার কিলোমিটার কিংবা আরও একটু বেশি হয়তো দূরত্ব ছিল তার মা'র ঘরের। সে পালিয়ে গেছে ধরে নিয়ে তাকে হত্যা করা হয়েছিল।
সাক্ষাৎকারী 

সে কি একা ছিল না?


বোল 

সেটা পরিষ্কার নয়। সে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শীও ছিল না কিংবা অত্যুৎসাহী সৈনিকও ছিল না, কিন্তু সে তার মা'র সঙ্গে দেখা করতে মাত্র চার কিংবা পাঁচ কিলোমিটার পথ গিয়েছিল, তারপর তারা তাকে হত্যা করে। এমন ঘটনা কিন্তু অজস্র অজস্র ঘটেছে। ১৯৪৫-এর মার্চে কোলন সফরে গিয়ে, ভারী বোমাবর্ষণের পর, শত শত পলাতক সৈন্যের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়, যারা ভাঙা ইট দিয়ে একটা ঘুপচিতে বাস করছিল, আবার, অনেকে রোমান আমলের পরিত্যাক্ত ভূগর্ভের কুঠরিতেও লুকিয়ে ছিল। ফ্রান্সের রণাঙ্গন থেকে তারা পালিয়ে এসে এখানে নিজেদেরকে লুকিয়ে ফেলেছিল। কালোবাজারে বিড়ি বিক্রি করে, জিনিসের বদলে জিনিস অদল-বদল ইত্যাদি নানা রকম ফন্দিফিকির করে তারা বেচে ছিল। যারা যুদ্ধ থেকে পালিয়ে এখানে এসেছিল লোকজন তাদের পছন্দ করত, তা সত্ত্বেও শেষ মুহূর্তে তাদের হত্যা করা হতো- এ বিষয়টা আসলে সবিশেষ তাৎপর্য্পূর্ণ ছিল। সাদা পতাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ মোটিফ। এখনো মনে আছে, বাবা বেশ আগে থেকেই একটা সাদা পতাকা সঙ্গে রাখতেন। আমেরিকানরা এখানে আসার অনেক আগে থেকেই বাবার সঙ্গে সব সময়ই একটা রুমাল আর একটা পতাকা উড়াবার খুঁটি প্রস্তুত থাকত, তিনি সেগুলি বের করতে চাইতেন, সঙ্গে সঙ্গে আমরা চিৎকার করতাম- 'এখন দেখো, পরিস্থিতি খুবই খারাপের দিকে যাচ্ছে, এত জলদি এটা দেখানো ভাল হবে না, সেই সময় এখনো আসেনি।' আপনি তাহলে বুঝতেই পারছেন- সাদা পতাকা আমার কাছে কতটা বিশেষ অর্থ বহন করছে।
সাক্ষাৎকারী

দীর্ঘদিন ধরেই দেখছি- আপনার লেখার একটা বিশেষ ঝোঁক কিংবা জোর দেওয়ার বিষয় হল আগমন আর প্রস্থান... কেন্দ্রবিন্দু হয় ট্রেন স্টেশন।
বোল

ওহ, হ্যাঁ। তবে আমি মনে করি, এই ঝোঁকটা কিছুটা হলেও যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত, কারণ, যুদ্ধের এই সময়েই তো থাকে শয়ে শয়ে প্রস্থান, আর, চিরবিদায়। এই সময়ে নিরুদ্দেশ যাত্রা মানেই তো চূড়ান্ত প্রস্থান। কেউ জানে না- 'আমরা কি আবার একজন আরেকজনকে দেখতে পাব?' যুদ্ধের এইসব দিনরাত্রির বিদায়ের দর্শন সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা আছে, এমন কী আজকের দিনেও যখন আমি কোন জায়গা থেকে বিদায় নিই কিংবা স্থানীয় কোনও স্থান থেকে অন্যস্থানে চলে যাই, দুর্ভাগ্যক্রমে প্রায়ই আমি এরকম করে থাকি। বিদায়কে সব সময়ই বিবেচনা করা হয়েছে একটা পরিসমাপ্তি হিসেবে। এমনকি আমাদের একটি বাড়ি থেকে বের হয়ে অন্য বাড়িটিতে- আমরা যে বাড়িতে প্রায় সময়ই থাকি, সে-বাড়িটি ছেড়ে, অন্য বাড়িতে আসতে হলে- জিনিসপত্র সব বেঁধে ফেলতে হয়। ট্যাক্সিতে চড়তে হয় মালপত্রের বোঝা নিয়ে। প্রস্থান হল চিরকালের সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার; বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি কোনও একটি রূপকের মাধ্যম হতে অস্বীকার করে না- এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা হল : এখানে এই পৃথিবীতে আমরাই আমাদেরকে খুঁজে একটি অপেক্ষাগৃহে।
সাক্ষাৎকারী

আপনি বলেছেন- এই পৃথিবীই আমাদের পুনর্মিলনের স্থান।


বোল 

হ্যাঁ, তা আপনি বলতে পারেন। কিন্তু আমি তো চরম প্রস্থানের আগ পর্যন্ত এখানেই এই মিলনস্থলে অবস্থান করব। সময় থাকতে থাকতে কিছু একটা করে ফেলতে হয়।
সাক্ষাৎকারী 

দ্য ক্লাউন-এর হান্স শিনার-এর কথা মনে পড়েছে- ঠিক কীভাবে সে সিঁড়ির ধাপে বসে ছিল।


বোল

যুদ্ধের কিম্ভূতকিমাকার পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যেতে যেতে আমরা দেখি যে চারপাশে যেন একটা স্থির আর অপরিবর্তনীয় অবস্থা বিরাজমান রয়েছে, আবার একটা স্থায়ী পরিবর্তনও ঘটতে থাকে প্রায় নিয়মিতই- এইরকম অদ্ভুত অবস্থা বিরাজ করে যুদ্ধকালে। আপনাকে যদি কোনও একটা ট্রেনে তুলে দেয়া হয়, এবং কোথায় পাঠিয়ে দেয়া হয়, তখন আপনি কোথাও না কোথাও পৌঁছে যাবেন, কিছুদিন সেখানে থাকবেন, তারপর আপনাকে আবারও ট্রেনে তুলে দেয়া হবে, পাঠিয়ে দেয়া হবে অন্য কোথাও- এই ধরনের কিম্ভূতকিমাকার অবস্থা নিয়ে আসে যুদ্ধগুলি। আপনি যদি সাধারণ জনতা আর সৈনিকদের কাছে এই পরিস্থিতিটা সঠিকভাবে তুলে ধরেন, তাহলে দেখবেন যে সকলেই পালিয়ে যেতে চাইবে।
সাক্ষাৎকারী

শুধু কি যুদ্ধের সময়ই এমন ঘটে?


বোল

সেখানে এই পরিস্থিতিটা অবশ্য যুদ্ধের আগে থেকেই ছিল। ক্ষমতায় যারা ছিল অর্থাৎ নাৎসিরাই ভয়ভীতি প্রদর্শন করত, ভয়ের কারণ ছিল তো তারাই, লোকজনকে দেশত্যাগে তারাই বাধ্য করেছিল। আপনি যেকোনো সময় তাদের হাতে আটক হতে পারতেন, তারপর যেকোনো অজানা জায়গায় আপনাকে পাঠিয়ে দেয়া হতো। সেই সময়ের সংকটময় অর্থনীতিও আমাদেরকে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য করেছিল। বাড়ি ভাড়া পরিশোধের সংকট তো ছিলই, গভীর সংকট। শুধু এই ব্যাপারটা ভেবে দেখেন- একটি ছেলে, বয়েস দশ কি বারো, অর্থনীতি বিষয়ে যার কোনও ধারণাই নেই কিন্তু সে এই বিষয়টা বুঝে গিয়েছিল যে- 'হে ঈশ্বর, আমি আশা করি আমরা বাড়িভাড়া দিতে পারব কিংবা আমাদেরকে তাড়িয়ে দেয়া হবে। সবকিছুই একটির সঙ্গে অন্যটি সম্পর্কিত। আমার পিতা কয়েকটি বাড়ির মালিক ছিলেন, তার একটিতে আমরা থাকতাম, তিনি সেই বাড়িটিও বেচে দিলেন, আর্থিক মন্দার কারণে। এদিকে, মহামন্দা শুরু হল ঠিক তার পরের বছর যখন একটি ব্যাংক পরিস্থিতির কারণে ব্যর্থ হল। আমরা নিজেদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য হলাম। বাড়িটা নিলামে বিক্রি হয়ে গেল আর সেই সঙ্গে ভয়েরও শুরু হল- 'মাথা গুঁজবার জায়গা কি আছে তোমাদের? বিছানা-বালিশ আছে?' পরে, আমার ছেলেদের জন্য, আমার সার্বক্ষণিক ভাবনা হয়ে দাঁড়াল তাদের জন্য একটা বাড়ি, একটা খাট, আর একটা কম্বলের ব্যবস্থা করা। পরিস্থিতিটা সব মিলিয়ে এমন বাজে হয়ে গিয়েছিল। রেলওয়ে স্টেশন তো আর বাড়ি নয়, আপনি তো জানেন, স্টেশন কিংবা ওয়েটিং রুমও বাড়ি নয়, আর- সবকিছুই হয়ে গিয়েছিল আর্মি ব্যারাক।

সাক্ষাৎকারী

কখনও আপনাকে হেমিংওয়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়। আপনি কি ভেবে দেখেছেন যে এই তুলনাটা সঠিক কিনা?


বোল

আমি অবশ্যই পুরোপুরি একমত নই। আমি প্রভাবিত হয়েছিলাম তার আঙ্গিকের দ্বারা। আঙ্গিকটা খুবই স্পষ্ট। তাঁর লেখার স্টাইলটা আমাদের জন্য ছিল বিপুল-বিস্ময়ে অভিভূত হওয়ার মত, এবং, আমরা প্রবলভাবে আকর্ষিত হয়েছিলাম কারণ খুবই স্পষ্টভাবে বলতে চাইছি- আমি খুব স্পষ্টভাবে বলছি- তিনি ছিলেন চরমভাবে অগভীর... আমাদের প্রখ্যাত জার্মান নিগূঢ়তার বিপ্রতীপে উপরিগত। কিন্তু এর পেছনে যা স্পষ্ট তা হল, সাংবাদিকতার ভাষায় বলতে চাইছি- অগভীরতাই কাউকে করে তোলে গভীরতার অধীশ্বর। আমি যেখানে তাঁর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করি- তার পৌরুষের ট্রমা'র মাঝে থেকেই- এটা সম্ভবত একটা ট্রমা, অবশ্যই তাঁর ক্ষেত্রে, কিংবা সেই নায়কোচিত ভক্তি! আমি কখনোই তা পছন্দ করিনি। ব্যাপারটা আমার মাঝে কোনও বিশেষ আকর্ষণ তৈরি করেনি আর এটা আমার কাছে খুবই অপছন্দের। তা সত্ত্বেও, তাঁর প্রকাশ-ভঙ্গিটি কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সাক্ষাৎকারী

জার্মানীর জে. ডি. সালিঙ্গারের লেখা 'দ্য ক্যাচার ইন দি রাই'-এর সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে দেওয়ার জন্যে আপনি আর আপনার স্ত্রীর বেশ ভালোই ভূমিকা আছে।


বোল

হ্যাঁ, আসলে হয়েছে কী, এই বইটির অনুবাদ করা হয়েছিল, খুবই ভাল অনুবাদ হয়েছিল বইটার, কিন্তু তবু পাঠক পাচ্ছিল না। এমন কি পাঠকের নজরে পড়বার জন্যও তেমন কিছু করা হচ্ছিল না। একজন সুইস প্রকাশককে দিয়েই তা যথাযথভাবে করানো হয়েছিল। আমরা মূল ইংরেজির সঙ্গে অনুবাদটির তুলনা করলাম, বই হয়ে সেটা বের হল, কঠোর সেন্সরশিপের কারণে এর কিছু অংশ অনুবাদে বাদ পড়ে গেল। সুইসরা বইটির উল্লেখযোগ্য অংশকে সেন্সর করেছিল, বিশেষ করে যৌনতা এবং সামরিক আগ্রাসনের বিরোধিতার ব্যাপারগুলি। কী আর করা, আমাদেরকে তখন অন্য প্রকাশ খুঁজতে হল, আমাদের নিজেদের প্রকাশক, তাকে রাজি করানো গেল, যদিও রাজি করানোটা ছিল খুব কষ্টকর, তিনি মোটেই বইটা ছাপাতে চাচ্ছিলেন না- আমরা পুনরায় 'দ্য ক্যাচার ইন দি রাই' বইটি পড়লাম, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, যা যা সংশোধন করার, তা করা হল; আর, যে অংশগুলি আগে বাদ দেওয়া হয়েছিল তা সংযুক্তও করা হল। আমরা সালিঙ্গারের অন্যান্য লেখাগুলিও অনুবাদ করলাম- ফ্রানি এন্ড জুইয়ে, রেইজ হাই দ্য রুফবিম, ক্যার্পেন্টারস।
সাক্ষাৎকারী

সালিঙ্গারের সঙ্গে কি ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ করেছিলেন?


বোল

না। সাক্ষাৎ করাটা খুবই কষ্টকর কঠিন ব্যাপার ছিল।



সাক্ষাৎকারী

আপনি কি নিজেকে সমাজ থেকে দূরে একটি দেয়ালের পেছনে লুকিয়ে রেখেছিলেন, ঠিক যেমনটা তিনি করেছিলেন?


বোল

না। তবে আমি মনে করি যা-ই হয়েছে, তা হয়েছে জার্মানির ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। আমি কল্পনা করতে পারি, যদি নাৎসিরা যুদ্ধকালীন এবং যুদ্ধোত্তর সময়ের রাজনৈতিক উন্নয়নে যদি কোনও ভূমিকাই না রাখত, তাহলে আমাকে অবশ্যই একটি গোপন জীবন-যাপন করতে হত, একেবারে গোপন একটা জায়গায়, কিন্তু একটি ফেডারেল রিপাব্লিকের নাগরিক হিসেবে আমি কোনোভাবেই তা ঠিকমত করতে পারতাম না। মাঝে মাঝে আমি অবশ্য তা করতে চেষ্টা করেছি, আইরিশ এবং অবলোমভ-এর সমন্বয়ে কিছু একটা হতে চেয়েছি, যাকে বলা যাবে- আইরিশ-অবলোমভ, কিন্তু চেষ্টা করেও আমি তা হতে পারিনি। আমি অবশ্যই, সালিঙ্গারের নিঃসঙ্গতার, তার নিঃসঙ্গ জীবন-যাপনের ব্যাপারটা সম্পর্কে জানি। আমি এই জীবনকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করি।
সাক্ষাৎকারী

এক সময় তো রাশিয়া থেকে আপনার প্রচুর বই প্রকাশিত হয়েছিল, এমনকি সেটা ছিল আমেরিকা থেকেও পরিমাণে বেশি। তো, রুশ অনুবাদ সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
বোল 

একটি বই বের হয়েছে এখানে, যার রচয়িতা হলেন হেনরি গ্লাদ, তিনি একজন আমেরিকান-স্লোভিক স্কলার, তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নে আমার বইয়ের গ্রহণ-বর্জন সম্পর্কে বিস্তর লেখালেখি করেছেন। তিনি একজন রুশ-জার্মান পণ্ডিতের সঙ্গে মিলে রুশ অনুবাদগুলি দেখেছেন, যিনি আবার অনুবাদকও। ফলাফল ভীতিকর অনুবাদ। ঠিক যে প্রক্রিয়ায় রাশিয়ায় আমি পরিচিত হচ্ছিলাম ভুল অনুবাদে, সেটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে শুরু করলাম। বইয়ের অনুবাদকর্মগুলি হয়েছে খুবই নিকৃষ্ট মানের, আর এতে করে অবশ্যই রাশিরার পাঠকরা বিভ্রান্ত হয়েছেন। কিছু কিছু বিষয় তারা বুঝতেই পারেননি, তারা ভেবেছেন- হে ঈশ্বর, লোকটার ভিতর কী ঢুকেছিল! দুঃখজনক এই ব্যাপারটা।

সাক্ষাৎকারী

আপনি কি রাশিয়াতে আগের মত এখনও পঠিত হচ্ছেন?


বোল

দেখেন, ১৯৭২-এর পর (প্রকৃতপক্ষে সালটা হবে ১৯৭৪) আমার বইগুলো ওখানে আর প্রকাশিতই হয়নি, তার মূল কারণ রাশিয়ার চেকোচোস্লোভিয়া দখল, তখন আমি আমার নিজের বক্তব্যটা খুব শক্তভাবেই প্রকাশ করেছিলাম।
সাক্ষাৎকারী 

তখন কি আপনি প্রাগেই ছিলেন?


বোল 

হ্যাঁ, আমি যখন সেখানে ছিলাম তখনই সেখানে আক্রমণ শুরু হয়ে গিয়েছিল। আমার চেক বন্ধুদের সঙ্গে থেকেই আমি সেই অভিজ্ঞতা নিচ্ছিলাম। আমার দৃষ্টিভঙ্গি, আমার সাক্ষাৎকার এবং আমার লেখালেখিতে এইসব ব্যাপার এতই দ্ব্যর্থহীন ছিল যে, দীর্ঘ সময়ের জন্য আমি যেন 'বাজে ছেলে'-তে পরিণত হই। '৭২-এ রাশিয়া থেকে আমার গল্পের ছোট্ট একটা সংগ্রহ বের হয়েছিল, তারপর আর কোনও বই বের হয়নি। বিক্রির জন্য আমার একটা বইও ছিল না সেখানে, মস্কোর কালোবাজার ছাড়া।
সাক্ষাৎকারী

আর এর পেছনের কারণটা ছিল, সলঝেনিৎসিন মুক্তি পেলে আপনি তাকে স্বাগত জানালেন। তিনি যখন বের হয়ে এলেন, কেউই তার সাহায্যে এগিয়ে আসেননি।
বোল

খুব সম্ভবত, ব্যাপারটা তা নয়, আর সকলেই তখন এগিয়ে এসেছিলেন। এমনকি সলঝেনিতসিন যখন থেকে সবার সঙ্গে এখানে এসে থাকতে শুরু করলেন, আমিও তখন সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিলাম। আমি এখনও মাঝে মাঝে সেখানে ঘুরতে যাই।
সাক্ষাৎকারী

আমার ধারণা রাশিয়ায় আপনার কাছে বেশ টাকাপয়সা ছিল।


 
বোল

 
না, না, এমন কোনও ব্যাপার নয়, আমার কাছে যা ছিল তা খুব বেশি তো অবশ্যই নয়, অল্প কয়টা টাকা ছিল।



 
সাক্ষাৎকারী

আপনি কিন্তু বেশ উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় অনূদিত হয়েছেন। একজন লেখকের জন্য তার রচনার অনুবাদকদের কোন দিকটি গুরুত্বপূর্ণ? আপনি কি এ সম্পর্কে সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন?
বোল

অনুবাদের ক্ষেত্রে আমি শুধু তাকেই বিচার করতে পারি আর তা হল আমার লেখার ইংরেজি অনুবাদগুলো। এবং হয়তো তা যথাযথ অনুবাদও হয়নি, তবুও। আমার সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক যোগাযোগটা হয়ে থাকে আমার অনুবাদকদের সঙ্গে। কোনও একটি পরিচ্ছেদ সম্পর্কে তাদের সংবেদনশীলতা দেখে আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ি, এমনকি অনুবাদক যদি ভাল জার্মান না জানে, তবুও তাদের অনুবাদে ব্যর্থতার ব্যাপারটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় না। অবশ্য, রুশ অনুবাদকরা কখনোই আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেননি, কিন্তু ফরাসি, ইটালিয়ান আর ইংলিশ অনুবাদকরা যথাযথভাবেই যোগাযোগ করেছেন, যার কারণে অনেক ভুল বোঝাবুঝি দূর হয়েছে, নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ের অস্পষ্টতা কেটেছে। ভুলগুলোকে এড়িয়ে যাওয়া গেছে- আর এই ব্যাপারগুলো আমাকে অনেক আনন্দ দিয়েছে।

সাক্ষাৎকারী

আমার মনে হয় যে এইসব কাজ থেকে আপনি নিজেও অনেক কিছু আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন।

 

বোল

হ্যাঁ, শিখেছি তো অবশ্যই। কারণ, আপনাকে ঐতিহাসিক বিষয়গুলোকে ব্যাখ্যা করতে হবে। বিশেষ করে, এই ব্যাখ্যাটা কিন্তু করতে হবে খানিকটা বিস্তারে গিয়ে। আপনাকে খুঁটিনাটি বিষয়গুলিকে বলতে হবে। নাৎসি আমলে এই কাজটা কিন্তু খুব জটিল ছিল। না, না, কাজটা আমার জন্য ছিল বেশ উপভোগ্য।



সাক্ষাৎকারী

আপনার লেখার কৌতুকপূর্ণ দিক সম্পর্কে কী বলবেন?

 

বোল 

আমি কী ভাবছি? আপনি কী মনে করছেন সেটা বলেন।



সাক্ষাৎকারী

আমি কিন্তু আপনার লেখায় খুব জটিল পরিস্থিতিতেও হাস্যরস খুঁজে পেয়েছি, যেমন- 'দ্য ক্লাউন'-এ আপনি টলিফোনের ওপার থেকে ক্লাউনটি বিভিন্ন জিনিসের গন্ধ পাচ্ছে।
বোল

না, না। দুর্ভাগ্যবশত, তা কখনোই নয়।



সাক্ষাৎকারী

তারপর হান্স শিনার কী করে এই ধারণা পায় যে সে টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকেও গন্ধ পেতে পারে?


বোল 

আমি বলতে পারি না।



সাক্ষাৎকারী

আপনি জানেন না।


বোল

না, আসলেই না। হাস্যরস হচ্ছে সত্যিকার অর্থে ধরতে পারার পক্ষে খুবই কঠিন ব্যাপার, এই ব্যাপারটা কিন্তু অনিশ্চিত অর্থ কিংবা অভিপ্রায়বিশিষ্ট। বলা যায়- দ্ব্যর্থক। আপনি ধরতে পেরেও ধরতে পারছেন না। আবার, বুদ্ধি দিয়ে কখনোই আপনি হাস্যরসকে বুঝতে পারবেন না। সত্যিকারের হাস্যরসের এটাই সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক। হাস্যরসিক কথকের হাস্যরস। এই ব্যাপারটা কিন্তু সাংঘাতিক হতে পারে। এটা আমাকে বিষাদগ্রস্ত করে ফেলে, কারণ এটা অনেকটাই কৃত্তিমতা দিয়ে ভরা। আপনি কোনোভাবেই সবসময় রসিকতায় পূর্ণ হতে পারবেন না কিন্তু পেশাদার রসিককে তা পারতে হয়। এটা হল একটা দুঃখজনক ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যাপার।



সাক্ষাৎকারী

ক্লাউনের কাছে তা কিন্তু মোটেও একই জিনিস নয়।


বোল

ওহ না, মোটেও না।



সাক্ষাৎকারী

তাহলে, একজন ক্লাউনের কাছে হাস্যরস ব্যাপারটা অনেকটাই অগভীর, ভাসা ভাসা।


বোল

হ্যাঁ, তা ঠিক কিন্তু এখানে একটু বিভ্রম আছে। অলীকতা আছে। মূল কথাটা কিন্তু এই- হাস্যরস হচ্ছে গভীর বিষণ্ণতা আর হতাশার প্রকাশ। অনেক ক্লাউনকে গভীর হতাশার মধ্যেও ভাঁড়ামি করতে হয়। অনেক ক্লাউন নিজেদেরকে শেষ করে দেয় উন্মাদ রোগে। আমি আসলেই বুঝতে পারছি না আপনি ঠিক কী খুঁজে পেয়েছেন, কী ভাঁড়ামি খুঁজে পেয়েছেন?
সাক্ষাৎকারী

আমার মনে আপনার বিদ্রুপ রচনা 'মুরকি'র সমস্ত নীরবতা' থেকে ডাক্তার মুরকি'র নীরবতাটুকুর কথাই বলছিলাম (বইটি বোলের ছোটোগল্পের সংকলন, জার্মান ভাষায় সেটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে আর ইংরেজিতে ১৯৬৩-তে।)। কিন্তু, সেটা আসলে কোনওভাবেই নীরবতা ছিল না ।
বোল

হ্যাঁ, হতে পারে।



সাক্ষাৎকারী

আর আপনার সেই গল্প- 'ছুঁড়ে-ফেলা লোকটি'।


বোল

হ্যাঁ, সেই লোকটি কিন্তু ভাল নয়, মন্দ, খারাপ।



সাক্ষাৎকারী

মন্দ বা খারাপ সে হতেই পারে, আমার কথা হল যে আপনার গতিমুখটি কিন্তু সঠিক। নিশ্চিতভাবে, যে-সমাজে আমরা থাকি, সেখানে এরকম প্রচুর বিষয় আছে যাকে শুধু ছুঁড়েই ফেলা হয়।



বোল

একটা লিখিত রূপ আসলে। আমি ঠিক জানি না সেই ছুঁড়ে- ফেলা লোকটি'তে হাস্যরস আছে কি না। গল্পটা লিখতে গিয়ে আমাকে বেশকিছু সমস্যা তৈরি করে ফেলেছিলাম।
সাক্ষাৎকারী

লেখার শুরুটা কীভাবে হয়? একেবারে প্রথমে মনে কোন জিনিসটা আসে? এটা কি একটা কোনও ছবি- কিংবা একটি চরিত্র, বা বিশেষ কোনও পরিস্থিতি?
বোল

লেখার শুরুটা আসলে একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে একজনকে দিয়েই হয় (বেশি হলে দু'জন) আর এভাবে শুরু হলেই লেখায় দেখা দেয় দ্বন্দ্ব এবং দুশ্চিন্তা। নানা রকমের উদ্বেগ। লেখায় পাঠকের 'দম নেবার অবসর' কিংবা লেখার দীর্ঘতা- এগুলি নির্ভর করে ঠিক কতগুলি চরিত্র জরুরিভাবে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়তে চায়, তার উপর।
সাক্ষাৎকারী

একটি লেখা এগিয়ে যেতে যেতে কি কখনও আপনার মূল ভাবনা থেকে সরে যায়?


বোল

ভাবনার পরিবর্তন? হ্যাঁ, আমার ক্ষেত্রে তো অবিরাম এই পরিবর্তন ঘটতে থাকে, লিখতে লিখতে খুব কম লেখাই আমি মূল ভাবনা পরিবর্তন না করে শেষ করতে পেরেছি। প্রতিটি লেখার ক্ষেত্রেই একটা ধারণাগত গাণিতিক ব্যাপার থাকে যা লেখাটির সীমারেখা নির্ধারণ করে থাকে- সাহিত্যকর্মটির দৈর্ঘ্য, ব্যাপ্তি কিংবা সংক্ষিপ্ততা আসলে নির্ধারিত হয় একটা ছবির জন্য ঠিক কোন আকারের ফ্রেমের দরকার, তার উপর।

সাক্ষাৎকারী

কার জন্য লেখেন? আপনার কি কোনও কল্পিত পাঠক আছে?

 

বোল

আমার সেই 'অদেখা', 'কল্পিত পাঠকটি' অশিক্ষিত হতে পারে কিন্তু সেই পাঠকটির এমন এক দ্বিধান্বিত আশাবাদ আছে যে, মাঝেমাঝেই যে আশাবাদ নৈরাশ্যবাদীর রূপ ধারণ করে, হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে। আমি এখনও, শুরু থেকেই মনে করি- ভাষা হবে এই পাঠকটির সঙ্গে যোগাযোগের একটা উপায়। এমনকি, জটিল ও দুর্বোধ্য পরিস্থিতিতেও- হোক তা প্রবন্ধ কিংবা সমালোচনামূলক লেখা- ভাষা হবে অশিক্ষিত পাঠকের সঙ্গে একটা যোগাযোগ তৈরি করার উপযুক্ত।


সাক্ষাৎকারী

লেখালেখির ঠিক কোন দিকটি আপনার কাছে সবচেয়ে কঠিন?


বোল

হ্যাঁ, এইতো, আমার সেই অদেখা, কল্পিত পাঠকের কথা বিবেচনায় এনে, কোনও একটি বিষয়কে খুব সহজ করে ফেলে যাকে আসলে কোনোভাবেই সহজ বলা যায় না কিংবা প্রথমে যাকে খুব সহজে লেখার চিন্তা ছিল তাকেই পরে অপ্রয়োজনীয়ভাবে দুর্বোধ্য করে ফেলা।
সাক্ষাৎকারী

নোবেল পুরস্কার কি আপনার জীবনকে কিছুটা বদলে দিয়েছে?


বোল

যখন আমি নোবেল পুরস্কারটা পেলাম, নিজেকে বললাম যে এই পুরস্কারটা আমাকে না খুব চালাক করে ফেলেছে না অনেক বেশি নির্বোধ। নিজেকে আমি এটাও বলেছিলাম যে- এই আমরা, জার্মানরা, কখনওই কল্পনা শক্তিহীন লোক নই; এবং, এই পুরস্কারটা নিয়ে আনন্দিতই হয়েছিলাম। তবে, নোবেল আমার ব্যক্তিজীবনকে একটুও বদলায়নি। এটা বিশেষ কিছু সম্প্রদান করে, টাকা-পয়সার দিক থেকেও খুব একটা মন্দ নয়, কোনওভাবেই। কোলোন-এ, নোবেলের টাকায় যুদ্ধ-পূর্ববর্তী সময়ের একটা এপার্টমেন্ট কিনেছিলাম; যাই হোক, সেখানে আমি কোনওদিনও থাকিনি।
সাক্ষাৎকারী

একটা লেখা শুরু করতে গিয়ে কি আপনি বিশেষ কোনও নিয়ম মেনে চলেন?


বোল 

না, না, আমি যখন কোনও একটি বড় কাজে লেগে পড়ি, তখন আসলে তেমন কোনও বিশেষ আয়োজন থাকে না। সোজা লেখাটি শুরু করে দিই, যতক্ষণ না ক্লান্তি আর একঘেয়েমি জোর করে বন্ধ করে দেয়। আবার, ছোট লেখার ক্ষেত্রে আমি বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলি- ডেস্কে খুব ঋজু ভঙ্গিতে বসে আবারও ডেস্কটাকে ঠিকঠাক করে তুলি যাতে খুব সহজে ব্যবহার করা যায়। তারপর, খবরের কাগজ পড়ি, একটু হাঁটতে বের হই, ঘরের বইয়ের তাকগুলি গুছিয়ে ফেলি, চা কিংবা কফির মগে চুমুক দিই, যে- মহিলাটিকে আমি বিয়ে করেছি, তার সঙ্গে বসে। প্রচুর ধূমপান করি; তারপর, দর্শনার্থীদের সঙ্গে দেখা করবার জন্য প্রস্তুত হই, টেলিফোনে কথা বলি, এমনকি কিছুক্ষণ রেডিও শুনি- এসব করবার ঠিক পর মুহূর্তেই একেবারে সত্যিকার অর্থে শুরু করা বলতে যা বোঝায়, তা-ই করি : লাফ মেরে ট্রেনে উঠে পড়ি। আর এই কাজটা যদি আপনি করতে সক্ষম হন, তাহলে ট্রেনটাই আপনাকে স্টেশন থেকে স্টেশনে নিয়ে যাবে।
সাক্ষাৎকারী

স্টকহোমে, নোবেল গ্রহণকালে আপনি তো আপনার লেখার টেবিলটির কথা বলেছেন। এই ঘরে কি ওই টেবিলটি আছে?


বোল

না, এই ঘরে নেই, টেবিলটাকে আমার অন্য ঘরে লেখবার কালে ব্যবহারের জন্য রেখে দিয়েছি।



সাক্ষাৎকারী

এই টেবিলটি ছাড়া কি আপনি লিখতে পারেন?


বোল

হ্যাঁ, হ্যাঁ, পারি, তবে ভাল করে পারি না। একমাত্র এই টেবিলটাতে বসেই আমি আমার সেরা লেখাটা লিখতে পারি।



সাক্ষাৎকারী

এটা বেশ বড় একটা টেবিল?


বোল

না, বেশ ছোটো। তাই, অনেক বড়!



সাক্ষাৎকারী

আর বক্তৃতায় যে টাইপরাইটারটির কথা বলেছিলেন?


বোল

হ্যাঁ, সেই টাইপরাইটারটা তো এখনও আছে। ১৯৫৭ সালের তৈরি 'ট্রাভেলরাইটার ডিলাক্স'। তবে, এটা এখন বড় বেশি ঘট ঘট শব্দ করে আর আমি মাঝে মাঝেই ভাবি, জিনিসটা বুঝি আর বেশি দিন টিকবে না!

সাক্ষাৎকারী

তবে কি একটা বৈদ্যুতিক টাইপরাইটার কিনে ফেলবেন?

 

বোল

না না, নিজের কাছে একটা বৈদ্যুতিক মোটর নিয়ে আমি অন্তত লেখালেখির কাজ করতে পারব না। এই পুরোনো টাইপরাইটারটা সত্যিই আমার কাছে একটা বিশেষ যন্ত্র।
সাক্ষাৎকারী

একটা পেন্সিলের মতোই দরকারি কিছু?


বোল 

হ্যাঁ, আমি আসলে বলতে চাইছি, এই যে তার ভয়ানক ঘট ঘট শব্দ... তার সঙ্গে আমি যখন লেখার কাজ করছি সে শব্দ করতে করতে এমনভাবে চলতে থাকে, মনে হয় ঘরে যেন একটি বাদ্যযন্ত্র বেজে চলেছে। আমি ভুলেই যাই যে আমি একটি মেশিনের সঙ্গে আছি!
সাক্ষাৎকারী

টাইপ করার সময় আপনি কি সবগুলো আঙুল ব্যবহার করেন?


বোল

না, না, সব নয়- ছয় কি সাতটা আঙুল ব্যবহার করি। আমি তো কখনোই শিখিনি যে ঠিক কীভাবে টাইপ করতে হয় আর তাই সব সময়ই ব্যাপক ভুল করতাম। যে-ভদ্রমহিলাকে আমি বিয়ে করেছি, তিনি সেই ভুলগুলোকে ঠিক করতেন, আবার আমি নিজেও করতাম। লেখাটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত মূল লেখাটাকে আমি যেকোনওভাবে নিজ হাতে লিখে শেষ করি, কাউকে দিয়ে লেখাই না। টাইপরাইটারে লেখার ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই তৃপ্তিকর একটা প্রক্রিয়া, সৃষ্টিমুখর একটা ব্যাপার। এই যন্ত্রটা ব্যবহার করতে করতে আমি অভ্যস্থ হয়ে পড়েছি; কারণ এর রয়েছে চলার নির্দিষ্ট একটা ছন্দ। যন্ত্রটার শেষ বিদায়ের দিন আমার অসম্ভব কষ্ট হবে। কিন্তু একটা বৈদ্যুতিক যন্ত্র আমি কল্পনাও করতে পারি না। আমার লেখার টেবিলে বৈদ্যুতিক মোটরের স্থান হবে না কোনওভাবেই। মোটরটা একটু একটু গুনগুন করতে পারে- তাই না?
সাক্ষাৎকারী

স্টকহোমে, আপনার বলা সেই কথাটা মনে করিয়ে দিচ্ছি। আপনি বক্তৃতায় বলেছিলেন যে ভাষা এবং কল্পনার শক্তি আসলে একই ব্যাপার। এই কথাটি দিয়ে আপনি আসলে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন?
বোল

প্রতিটি শব্দের পেছনে যেন একটা পুরো দুনিয়া লুকিয়ে থাকে- এই ব্যাপারটাকে আসলে আমাদেরকে অবশ্যই কল্পনা করে নিতে হবে। আসলে, প্রতিটি শব্দের থাকে স্মৃতির এক বিপুল ভার। তবে, হ্যাঁ, এটা নির্দিষ্ট কোনও ব্যক্তির স্মৃতি নয়- পুরো মানবজাতির স্মৃতি। আসুন, আমরা একটা শব্দকে ভাবি। ধরুন, শব্দটা 'রুটি'। কিংবা- যুদ্ধ। আবার, এখন আসুন, আরও একটি শব্দকে ভাবি, ধরুন সেটা 'চেয়ার', কিংবা 'বিছানা' কিংবা 'স্বর্গ'। ভেবে দেখুন, প্রতিটি শব্দের পেছনে যেন পুরো দুনিয়াটা ঢুকে পড়েছে। আমার ভয় লাগে এই ব্যাপারটা ভেবে যে, শব্দের ভেতরে যে বিপুল স্মৃতি লুকিয়ে আছে তা না জেনেই বেশির ভাগ লোক শব্দকে এমনভাবে ব্যবহার করে, যেন খুব মামুলি কোনও কিছুকে তারা ছুঁড়ে ফেলছে! তবে হ্যাঁ, শব্দঘোরের এই ব্যাপারটা কবিতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি তাৎপর্যময়, কিংবা লিরিকের ক্ষেত্রে। গদ্যের চেয়ে কবিতায় শব্দের ব্যবহার অনেক বেশি প্রগাঢ়, অনেক গভীর। যদিও গদ্যের সঙ্গে কবিতার খুব বেশি দ্বন্দ্ব নেই, উদ্দেশ্য তো একই।
সাক্ষাৎকারী

আপনার রাজনৈতিক ও সামাজিক-সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনায় নিয়েই আমি আলরিখ মেইনহোফ-এর মতো সংস্কারপন্থি বিপ্লবীদের কথা ভাবছি এবং প্রেস সম্পর্কে আপনার সেই সমালোচনাগুলি নিয়েই ভাবছি- এতে করে তো আপনি আপনার সহকর্মী আর পরিচিত পরিমণ্ডলে জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন, এবং...
বোল

... হ্যাঁ, ব্যাপকভাবেই হারিয়েছি।



সাক্ষাৎকারী

... তাহলে কেন করতে গেলেন?


বোল

লোকের কাছে অপ্রিয় হবার জন্য আমি আসলে এসব বলিনি। তার আসল কারণ হল- যা নিয়ে এই এখন আমরা কথা বলছি, সেই শব্দ নিয়ে- হয়েছে কী, শব্দের কল্পনাশক্তিহীন ব্যবহার আমাকে বড় হতাশ করে। ভেবে দেখুন, আলরিখ মেইনহোফ এবং তাঁর কমরেডদের কথা একবার চিন্তা করে করে দেখুন। তাদের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ প্রমাণিত হবার আগেই তাদেরকে খুনি বলা হচ্ছে। এটাকে আমি অত্যন্ত নিষ্ঠুর আর নীতিবর্জিত ঘটনা হিসেবেই দেখছি। আমার কাছে মনে হল- এই ধরণের মিথ্যা অপবাদ আর এইসব অপরিণামদর্শী কাজের খুব বেশি চর্চা এখানে হচ্ছে। প্রধান প্রধান প্রকাশকরাই শুধু নয়, অন্যরাও বেপরোয়া হয়ে পড়েছে এইসব বাজে কাজে। নাৎসিদের হয়ে ইহুদি-বিরোধী প্রেস ক্যাম্পেইনের কথা আমার মনে পড়ে, শুধু টাই নয়, ক্যাম্পেইনটা ছিল কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে; এবং, পরবর্তীতে চার্চের বিরুদ্ধে। আসলে আমার আবেগ কিংবা সত্যিকার ক্রোধ-টা হল- আমার কথা বলবার সেই পদ্ধতিটি : এখানে থামুন! থামুন এবং দেখুন যে আমার মনোভাবটি কিন্তু সব সময়ই শব্দের সঙ্গে সম্পর্কিত। আমি এক একটি শব্দকে বেছে নিই এবং দেখি যে শব্দটার পেছনে কোন অর্থ লুকিয়ে আছে, দেখি যে- শব্দের ভুল ব্যবহারে কী অঘটন ঘটতে পারে। আমার বেশ কয়েকজন সহকর্মী কিন্তু ব্যাপারটাকে বুঝতে পারেন না, তারা মনে করেন- হ্যাঁ ঈশ্বর! সে দেখছি সন্ত্রাসবাদীদের সমর্থন করে যাচ্ছে। বিষয়টা কিন্তু এখানেই শেষ হয়ে যাচ্ছে না, তারা আমার লেখার ভেতর থেকেও এই সমর্থনের বিষয়টাকে খুঁজে পাচ্ছে! আমার লেখা থেকে বেশ কিছু শব্দকে তারা চিহ্নিত করেছে, যা আমাকে আর আমার পরিবারকে বেশ একটা জটিল পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। কিন্তু সবক্ষেত্রেই বিষয়টি কিন্তু শব্দের সঙ্গেই সম্পর্কিত হয়ে থাকছে। শব্দের এই ব্যাপারটা- যা আমাদের নিজেদের ইতিহাসেই আছে- ভাষার সঙ্গে মিশে গিয়ে ব্যক্তির সমস্ত চিন্তাকে অধিকার করে ফেলা! আমি এভাবেই বিবেচনা করছি। শুনুন, তরুণ থাকতে আমি নিয়মইত স্টুমার পড়তাম এবং সেটা ছিল সেই কুতসিত নাৎসিদের প্রচারণা-পত্র, যারা শুধুমাত্র ইহুদিদেরকেই তাদের উদ্দেশ্যমূলক বাজে প্রোপ্যাগান্ডা চালানোর বিষয়ই করেনি, অন্যান্য সামাজিক গোষ্ঠীগুলোরও বিরুদ্ধে লেগেছিল- সমকামীদের বিরুদ্ধে, ক্যাথলক যাজক আর শেষ পর্যন্ত- সরাসরি কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে। আমি আসলে এই মুহূর্তে খুবই স্পর্শকাতর হয়ে আছি। যখন আজকের দিকে একদল লোকের বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো হয় তাদের একেকজনের নাম নিয়ে নিয়ে, বিশেষ করে বিষয়টাকে যদি আমাদের নিজেদের ইতিহাসের আলোয় দেখি, দেখব যে- কুৎসাকারীরা সবাই ছিল অতিমাত্রায় ঈর্ষাকাতর আর নিজেদেরকে অতি দ্রুত গণতন্ত্রী হিসেবে পালটে ফেলা লোক- এভাবে বলতে হবে- ১৯৪৫ সালের মার্চে তারা ছিল নাৎসি আর ১৯৪৫-এর অক্টোবরে তারা খুব দ্রুত নিজেদেরকে গণতন্ত্রীতে রূপান্তরিত করে ফেলে। আমি তাদেরকে অবিশ্বাস করি কিন্তু আমি এই ব্যাপারে আস্থাশীল যে গণতন্ত্র একটা বেশ দীর্ঘ প্রক্রিয়ার উপর নির্ভর করে। আপনি অতি দ্রুত কোনওভাবেই গণতন্ত্রী হতে পারবেন না। অনেক কিছুই এর সঙ্গে জড়িত থাকে। না, আমি বিষয়টাকে নিয়ে অনুতাপ করছি না, আক্ষেপ করছি না; হ্যাঁ, হয়তো আমি আমার ক্রোধ থেকে কিছু কথা বলেছি, পরে আমি নিজে নিজেই বুঝতে পেরেছি, উপলব্ধি করেছি যে- এইসব দুঃখজনক প্রচারণাসহই আমরা গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে পারি, এগিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়াটা খুব জরুরি।
সাক্ষাৎকারী

আপনি কি মনে করেন যে সত্যকে খুঁজে পাওয়া কষ্টকর, এমনকি সত্য যখন বিদ্যমান থাকে ঠিক তখনও? কেউ একজন কীভাবে সত্যকে খোঁজেন? কী মনে করেন, উপন্যাসে কি সত্য লুকিয়ে থাকে, উদাহরণস্বরূপ বললাম?
বোল

হ্যাঁ, উপন্যাসে থাকতে পারে, মানবীয় সত্য। বহু সংখ্যক উপন্যাস আছে যেগুলি পাণ্ডিত্যপূর্ণ বইপত্রের চেয়েও গভীরতাস্পর্শী ভাব ধারণ করে অনেক বেশি। একটা উদাহরণ দেবার দরকার : দক্ষিণ আমেরিকায়, আর্জেন্টিনার সাবাতো থেকে গুয়েতেমালার আস্তুরিয়াস পর্যন্ত বিস্তৃত জায়গাটিতে অনেক লেখক আছেন, মারিয়ো ভারগাস ইয়েওসা, গারসিয়া মার্কেসের মত আরও অনেক, তারা সংখ্যায় একশোরও বেশি- এইসব মহৎ লেখকদের মধ্য দিয়েই এই উপমহাদেশটির মানুষের গভীর ধ্যান ও ধারণাগুলি সত্যের আলোক স্পর্শে উদ্ভাসিত হয়েছে। আমি নিজেকে লেখক হিসেব সীমাবদ্ধ করছি না কিন্তু, তবে, বিষয় হল- সত্যকে অবশ্যই জোড়া দিয়ে দিয়ে একসূত্রে মিলিয়ে দিতে হবে। যুদ্ধোত্তর জার্মানীতে- ১৯৪৫ থেকে ১৯৬০ কিংবা '৭০, খুব স্বাভাবিকভাবেই, একটিমাত্র উপন্যাস আপনাকে কিন্তু সত্যের ধারণা দিতে পারবে না কোনোভাবেই, কিন্তু বিশটি উপন্যাস তা দিতে পারবে, যেমন- ক্রিসটা উলফের 'প্যাটার্ন্স অব চাইল্ডহুড', গুন্টার গ্রাসের 'দ্য টিন ড্রাম' এবং ওউই জনসনের উপন্যাস- কোয়েপ্পেন। একটা দুইটা আমরা উপন্যাসগুলির সংখ্যা গুণতে পারব না কিন্তু তারা সম্ভবত, সবাই মিলে ইতিহাসের বৈশিষ্ট্যসূচক সেই সত্যকেই লিখেছেন। ইতিহাস ও উপন্যাস (ফিকশন) অবশ্যই একে অপরকে শ্রদ্ধা করবে। আর এর সঙ্গে এসে মিলে যাবে চিত্রকলা, সঙ্গীত, বিশেষ করে স্থাপত্যকলা... ইতিহাসের কোনও একটি সময়ে যা কিছুই উৎপাদিত হয় তা-ই তার অংশ হয়ে যায়। সত্য অবশ্যই অস্তিমান, তবে তার খণ্ডিত অংশগুলিকে মেলবন্ধনে মেলানো বড় কঠিন, এই সত্য সব সময়ই একটি অংশে অংশে মিলিত সত্য, ঐতিহাসিক লেখাপত্র সেই সত্যেরই একটা অংশ, তবে আমি বিশ্বাস করি না যে ইতিহাস সম্পূর্ণ সত্যটিকে উপস্থাপন করতে পারে। যদি আপনি ছোটখাট চুরি কিংবা একটা ডির্ভোস কেইসের সত্যটাকে বুঝতে না পারেন, তবে ইতিহাস লিখতে গিয়ে আপনাকে একই সমস্যায় পড়তে হবে, তার উৎসের সন্ধান করতে গিয়ে।
সাক্ষাৎকারী

উৎস সম্বন্ধে আপনাকে অবশ্যই সচেতন থাকতে হবে।

 

বোল 

উৎস জানতে বিশদ জেরা করতে থাকুন, প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে থাকুন। অফিসের অধিকারিক ব্যক্তিটি কী লিখলেন, কীভাবে সাজিয়ে লিখলেন- ভাষাগত অভিব্যক্তি হল নিষ্পত্তিকারক- তিনি কি লিখতে গিয়ে কিছু একটা বাদ দিয়ে দিলেন? তবে বেশি কিছু অবশ্য বাদ পড়ে না।
সাক্ষাৎকারী 

একটা শব্দের অর্থ এবং সেই অর্থের সত্যের গুরুত্ব সম্পর্কে আপনি বলে থাকেন। শব্দগুলি কি কখনোই অযাথার্থিক হবে না শেষ পর্যন্ত?
বোল

ভাষা- সঙ্গীত ও চিত্রকলার চেয়েও বেশি সারবান, পূর্ণগর্ভ। তবুও, তা 'যথাযথ' এমন নয়। কিন্তু আসল ব্যাপারটা হল- একটা শব্দের বহুসংখ্যক অর্থ থাকে, শুধুমাত্র একটা ভাষার অন্তর্গত হয়েই শুধু নয় ভাষা থেকে বের হয়েও সে অর্থময়, সুতরাং এই ব্যাপারটিকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে হবে যে শব্দ আর ভাষার মূলে গিয়ে তাকে অর্থকে বের করে আনা। এই ব্যাপারটাই হল সাহিত্যের সবচেয়ে ধ্রুব প্রয়াস। পরম অর্থ অন্যকোথাও অস্তিমান থাকুক; যে অর্থটিকে আমরা এখনও খুঁজে পাইনি।
সাক্ষাৎকারী 

কোন বিষয়টি আপনাকে লেখার কাজে আটকে রাখে?


বোল

হ্যাঁ, ভাষায় কোনও বিশেষ কিছুকে প্রকাশের আকাঙ্ক্ষার কথাই প্রথম বলব। কিন্তু এখানে রয়েছে নানামুখি প্রবর্তনা। আছে না? এটা হল সম্পূর্ণরূপে ভাষাবিজ্ঞানের ব্যাপার। একটা বাক্য কিংবা একটা বিশেষ পরিস্থিতি- আমার মধ্যে জন্ম নেয়।
সাক্ষাৎকারী

লেখার নাম কি আগেই ঠিক করে লিখতে শুরু করেন?


বোল

না। লেখার নামটা আসলে লেখা শেষ করবার পর আসে, সাধারণত কিছু সংশোধনমূলক সমস্যার কথা চিন্তা করেই এরকম হয়, নামটা পরে আসে। আমার মনে আছে 'দ্য ট্রেন ওয়াজ অন টাইম' লেখাটার নাম কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্নরকম কিন্তু লেখাটার পূর্বনাম ছিল 'বিটুইন লেমবার্গ টু ঝিরনোইতজ। প্রকাশক বললেন- 'হায় ঈশ্বর, এ তো দেখছি দুইটি জায়গার নাম।' আমাকে নাম বদলাতে বলা হল, কিন্তু আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে নয়; আমি নাম বদলে ফেললাম। লেখার ভিত্তি নামটি প্রায় সময়ই বদলে যায়।
সাক্ষাৎকারী

আপনার প্রতিদিনকার লেখালেখির কথা বলতে বললে কী বলবেন?


বোল

আমার? বিগত কয়েকটি বছর আমার জন্য বেশ কষ্টের ছিল, এর কারণ দীর্ঘদিন আমি অসুস্থ ছিলাম আর এখনও আছি। আমি লিখি সকালের দিকে, নাস্তা খেয়েই শুরু করি আর কাজটা চলতে থাকে সাড়ে বারোটা পর্যন্ত। তারপর কিছুটা বিরতি নিয়ে বিকেল পর্যন্ত; এবং সন্ধ্যাতেও লেখার কাজটা চলতে থাকে। তবে সন্ধ্যার ব্যাপারটা হল যদি খুব কাজের ইচ্ছেটা খুব তীব্র থাকে। দুভাগ্যবশত, কিছু গুরুত্বহীন ব্যাপার ঘটে যায়, কেউ না কেউ হস্তক্ষেপ করেই ফেলে, আর তাতেই চলতে থাকা কাজটাই কঠিন হয়ে পড়ে।
সাক্ষাৎকারী

আপনি কি পুনঃপাঠ ও সংশোধন না করেই একনাগাড়ে লেখেন?


বোল

ওহ না, না, না, আমি একটা লেখার আগাগোড়া বার বার দেখি। বার বার ঠিক করি আর শুধু- বদলাই, এমনকি আমার নিজের বক্তব্য-প্রকাশক খুব ছোট একটা গদ্যও, তা মাত্র টাইপ করা দুই পৃষ্ঠাই হোক না কেন- চার থেকে পাঁচবার সংশোধন করি।



সাক্ষাৎকারী

লেখাটি সম্পূর্ণ শেষ হবার পরই কি পড়ে দেখেন?


বোল

হ্যাঁ, দেখি; তারপর দরকারি সংশোধনটুকু করি কিংবা নোট লিখি পেনসিল কিংবা বলপয়েন্ট দিয়ে, তারপর আবার কাজে লেগে যাই, ঘষামাজা করি, দরকারি সংযোজন করি। তবে, দুর্ভাগ্যবশতঃ এটা ঘটে কালেভদ্রে, আর খুব দ্রুতই কথাগুলি লিখে ফেলি। অবশ্যই, কাজটা চটপট করতে হয় না হলে হয়ত চূড়ান্ত কথাটি পরে আর ধরা দেবে না। মাঝেমাঝে আমি লিখতে শুরু করি আর হঠাৎ করে ভাবনাগুলিও চলে আসে, সে হয়তো তৃতীয় পৃষ্ঠাতেই; আমি সব ছেড়ে লিখতে ডুবে যাই আর লেখাও এগিয়ে চলে। লেখালেখির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ার পক্ষে এর চেয়ে ভাল কিছু আর হয় না। লিখতে শুরু করার একেবারে প্রথম দিকে এমন অনেক কিছুই লেখাটির অনুষঙ্গে ঘটতে থাকে, যা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করলে সেগুলি আবারও ফিরে আসে।
সাক্ষাৎকারী

চরিত্রদের নামের প্রসঙ্গে আসি, এই নামগুলি কি আপনার কাছে খুব তাৎপর্যপূর্ণ?


বোল

হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব। মানে অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। আমি তো লেখাটা শুরুই করতে পারি না যদি তাদের নাম আমি না জানি। এটাই আমার এখনকার সমস্যা। আমার মনে একটা ছক থাকে, তা যে কোনও লেখা নিয়েই হতে পারে, হয়তো উপন্যাস। তখন আসলে আমাকে পাঁচ থেকে ছয়টি নাম অবশ্যই মনে রাখতে হয়, যা এখন আর সম্ভব হয় না। অবশ্যই আমি নিজেকে নিজেই নামগুলি মনে রাখতে সাহায্য করি- এটা এমন কঠিনও নয়- সবগুলি নামকে একটা নামেই ভাবতে শুরু করি। তাদের সবার ডাকনাম হয় একটা। এটা করি কেবলমাত্র লেখাটাকে এগিয়ে নেবার জন্য। তবে নাম নিয়ে আমি আসলে খুব বেশি ভাবিত হই না।
সাক্ষাৎকারী

আপনার লেখায় মানে ছাড়া চরিত্রের নাম নেই এমন কিছু আছে কি? নামটি যেখানে...


বোল 

... পেশা ভিত্তিক? না, আমি তো সেটা পছন্দ করি না। এরকম কিছু করাকে আমি আনাড়ি কাজ বলে ধরে নিই, কারণ আপনি একজন ব্যক্তিকে কোনও একটি নাম দিয়ে যা ইচ্ছা বিশেষায়িত করতে পারেন না। কোনও একটি নামকে একজন ব্যক্তির নির্দেশক করে ফেলা কিংবা বিশেষ অর্থবোধক করে ফেলাটা- একটা কদর্য ভুল। একজন ব্যক্তির নাম আমার কাছে সত্যিই খুব পবিত্র। অনেক কিছুই বরবাদ হয়ে যাবে সেই কারণে আমি কোনওভাবেই চরিত্রের জন্য নির্দিষ্ট নাম খুঁজি না। মাঝেমধ্যে আমি টাইপরাইটার চালাতে চালাতে পিয়ানোর মতো সুর সৃষ্টি করি, ঠিক যেমন করে কেউ পিয়ানো বাজায়। আমি ভাবি, এই বাজানোটা শুরু হল ডি দিয়ে, তারপর আমি ই-র উপর চাপ দিলাম, তারপর এন... এভাবে এগিয়ে যেতে থাকলাম। দেখা গেল চরিত্রটির নাম এই অক্ষরগুলি দিয়েই তৈরি হয়ে যাচ্ছে, বিপদ কিংবা সংকেত কিংবা ছায়া- এইসব আশ্চর্য সব নাম।
সাক্ষাৎকারী

আপনি কি কখনো লিখতে গিয়ে আটকে গেছেন, কিংবা লিখতে অসমর্থ হয়েছেন? আর যদিও তা হয়ে থাকেন, তাহলে সেই অবস্থাটি ঠিক কীভাবে কাটিয়ে উঠেছিলেন?
বোল 

লিখতে গিয়ে হঠাৎ আটকে যাওয়া কিংবা লিখতে না পারা- এই ব্যাপারগুলি কিন্তু এখন আমার দ্বিতীয় সত্ত্বার মত হয়ে উঠেছে। এর কারণটা কিন্তু বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে। আমি এমন একট দেশে বাস করছি যে দেশটির ভাণ্ডারে রক্ষিত আছে দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি আণবিক মারণাস্ত্র- আরও নতুন নতুন আণবিক অস্ত্র দেশটির অস্ত্র ভাণ্ডারে যুক্ত হচ্ছে। এই ভয়ানক ব্যাপারগুলি আপনার নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেবে, আপনার জীবন-যাপনের আনন্দকে ধ্বংস করে দেবে। যে-লেখায় কোথাও ক্ষোভ কিংবা ক্রোধ থাকে, লেখায় কোনও একটা বিশেষ মানে তৈরি হয় সেই লেখাকেও বন্ধ করে দেয়। লেখককে থামিয়ে দেয়। কোনও সময় সঙ্গীত, বিশেষ করে ধ্রুপদি সঙ্গীত লেখা আটকে যাওয়ার হাত থেকে আমাকে বাঁচাত, যেমন- বিটোভেনের ব্রেদ, যা শুনলেই আমার ভেতর পশ্চিম-ইউরোপ আর রাইনের মতো স্থানের বোধ জেগে উঠত। লেখালেখির এই নির্দিষ্ট সমস্যাটি এমন অদ্ভুত যে আমি বুঝতেই পারি না ঠিক কেমন করে কোনও কিছুকে প্রকাশ করতে হয়; এমনকি যখন আমি একটা ছোট্ট রিভিউ লিখতে শুরু করি, আমার মনে হয় আবার সবকিছু নতুন করে পড়তে হবে। আমার কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকে না।
সাক্ষাৎকারী

কিন্তু সেটা কি একজন লেখকের জন্য খুব রক্তাক্ত উপলব্ধি নয়?


 
বোল

 
না, আসলে তা উপকারীই- লেখককে একটা ধরাবাঁধা অবস্থা থেকে বের করে আনে।



 
সাক্ষাৎকারী

 
আপনি এই পৃথিবীর কোন পরিবর্তনটি দেখতে ইচ্ছা করেন?


 
বোল 

 
এই পৃথিবীর?



 
সাক্ষাৎকারী

 
হ্যাঁ।


 
বোল 

 
একটা মাত্র প্রশ্নই আমাকে অবিরাম রক্তাক্ত করে চলে- কার জন্য এই পৃথিবীটা?



 
সাক্ষাৎকারী

 
আপনি কি নিজেকে একজন আশাবাদী মানুষ বলবেন?


 
বোল 

 
আমি?


 
সাক্ষাৎকারী

 
হ্যাঁ।


 
বোল 

 
আমি এক সঙ্গে দুই রকমের মানুষ।



 
সাক্ষাৎকারী

 
একই সঙ্গে আশাবাদী আবার নৈরাশ্যবাদীও?

 

বোল

আমার এই আশাবাদিতা কিন্তু একজন সারভাইভারের। জোর করে টিকে নিজেকে টিকিয়ে রাখবার অনুভূতিটা প্রায় সময়েই মারাত্মক আকার ধারণ করে যখন আপনি উপলব্ধি করতে পারবেন অনেকেই ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। আমি এখনও সম্পূর্ণ টিকে আছি, এবং এখানেই আছি- এটাই হল আমার নিজেকে খাপ খাইয়ে চলবার শক্তি। আমি যে টিকে থাকবার লড়াইটা করছি তার একটা অনুভূতি। আজকের প্রজন্মের সমস্যাটা তাদের মধ্যে কিন্তু এই ব্যাপারগুলি নেই। কিন্তু তাদের বেলায়, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আঘাতটা পেয়েছে, পোল্যান্ডের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোয়,- যে নিপীড়ন চালান হয়েছিল; এবং রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডগুলি- বিবেকহীনতার সেই তীব্র সময়েও, তাদের মধ্যে ছিল একটা তীব্র আশাবাদ।