Saturday, November 2, 2019

কেন ‘লিওনার্দো দা ভিঞ্চি’ একজন বন্ড ভিলেন হবার জন্যে উপযুক্ত – শেষ পর্ব


আগের দুই পর্বে (পর্ব ১, পর্ব ২) আমরা জেনেছিলাম, রেনেসাঁ যুগের মাস্টার মাইন্ড লিওনার্দো দা ভিঞ্চির কিছু প্রযুক্তিগত চিন্তা-ভাবনার কথা, যেগুলো দেখলে ‘এম আই সিক্স’ এর মত বাঘা কোনো ইন্টেলিজেন্স সংস্থারও প্যান্ট নষ্ট হয়ে যেতো। যদি ভিঞ্চির আমলে তাদের অস্তিত্ব থাকতো, তবে তারা চাইতো ভিঞ্চিকে তাদের দলে ভেড়াতে। কিন্তু যেহেতু ভিঞ্চি বাস্তবে তার এইসব ভয়াবহ আবিষ্কার পুরোপুরি গোপন রেখে গিয়েছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত, তাই ধারণা করা যায়- তিনি এম আই সিক্সের সেই অফারও ফিরিয়ে দিতেন। তখন বাধ্য হয়ে এম আই সিক্স তাদের ‘টপ টেরর’ তালিকার এক নাম্বারে নাম ঘোষণা করতো ভিঞ্চির। ভিঞ্চির লাইফ তামা তামা করতে তারা সবার সামনে তাকে উপস্থাপন করতো “মানবতার জন্যে হুমকি” হিসেবে। আর এদিকে এজেন্ট ‘জিরো জিরো সেভেন’ কে গোপনে লেলিয়ে দিতো ভিঞ্চির এসব আবিষ্কারের ব্লু-প্রিন্ট চুরি করার জন্যে। (হলিউডের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমাদের থেকে বন্ড মুভির এই আইডিয়াটা ধার নিতে পারেন। না, কোনো টাকাপয়সা লাগবে না। এজেন্ট জিরো জিরো সেভেনের বিপরীতে ভিঞ্চির মত একজন মাস্টার মাইন্ডকে ভিলেন হিসেবে পেয়েই আমরা খুশি!)

কথা হচ্ছে- ভিঞ্চিকে সবার সামনে স্কারম্যাঙ্গা, গোল্ডফিঙ্গার, কিংবা ব্লোফেল্ড এর মত কিংবদন্তীতুল্য বন্ড ভিলেন হিসেবে উপস্থাপন করতে এম আই সিক্সের বেশী বেগ পেতে হতো না। এর কারণ আমাদের এই মাস্টার মাইন্ডের রেখে যাওয়া কিছু আবিষ্কারের নকশা; যেগুলো ভিঞ্চির শান্তিকামী, সৌন্দর্যপিপাসু শিল্পী-সত্তার আড়ালে এক ভয়াবহ সাইকোপ্যাথের উপস্থিতিকেই নির্দেশ করে। যেমন-

৭। ঘোড়ায় টানা রথ (ম্যাড ম্যাক্স স্টাইল)


১৯৭০ এর দশকে যখন কল্প-বিজ্ঞানভিত্তিক মুভি সিরিজ ‘ম্যাড ম্যাক্স’ এর প্রথম কিস্তি মুক্তি পায়, তখন সেটা ‘ইনস্ট্যান্ট ক্লাসিক’ মুভির তালিকায় চলে যায়। এর প্রধান কারণ ছিলো- গতানুগতিক কল্পবিজ্ঞান গল্পের সাথে উদ্ভট সব অ্যাকশন সিকোয়েন্সের সমাহার। পারমাণবিক যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিরান পৃথিবীতে কীভাবে মানব সভ্যতা একটু খাদ্য এবং নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে পুরোপুরি উন্মাদ হয়ে উঠতে পারে- সেটাই ছিলো এই মুভি সিরিজের মূল আলোচ্য বিষয়। এই ‘ম্যাড ম্যাক্স’ হতে অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীতে ‘ফলআউট’ ভিডিও গেইম সিরিজ তৈরি করা হয়েছিলো- যেটা তিন প্রজন্ম পরে এখনো এত জনপ্রিয় যে, খুব শীঘ্রই এই একই নামে একটা টিভি সিরিজ তৈরি করার চিন্তা-ভাবনাও চলছে

ব্যাপার হলো- ম্যাড ম্যাক্সের রক্ত টগবগ করা উন্মাদ সব অ্যাকশন সিকোয়েন্সকে আরো ব্যাপকভাবে ফুটিয়ে তুলতে সহায়তা করেছিলো এর বিশেষভাবে ডিজাইন করা সব যানবাহন। ম্যাড ম্যাক্স সিরিজের প্রতিটা মুভিতেই এসব ভয়াবহ আকৃতির যানবাহনের ছিলো সরব উপস্থিতি। এদের একটা হতে আগুনের হলকা বেরুচ্ছে তো আরেকটা হতে মেশিনগানের মত গুলি ছুটছে। কিন্তু সত্যি কথা হলো- পারমাণবিক যুদ্ধ পরবর্তী বিরান প্রান্তরে, সীমিত কিছু সম্পদ নিয়ে টিকে থাকার লড়াইয়ে নামা উন্মাদ মানবগোষ্ঠীর সদস্যরাই এইসব যানবাহন প্রথম তৈরি করেনি। এসব ভয়াবহ যানের আবির্ভাব ফিকশনের জগতেই প্রথম নয়। বরং বাস্তবে আরো পাঁচশ’ বছর আগেই ভিঞ্চির কল্পনায় এদের আবির্ভাব। ভিঞ্চির কল্পনাদ্ভূত এসব ডিজাইন দেখলে বিরান প্রান্তরের একচ্ছত্র অধিপতি ‘লর্ড হিউমোঙ্গাস’ এরও মাথা খারাপ হয়ে যেতো!

ভিঞ্চির মূল ডিজাইন

এই লেখার দ্বিতীয় পর্বে ভিঞ্চির ‘ক্লাস্টার বোমা’ তৈরির ডিজাইন নিয়ে আলোচনায় উল্লেখ করেছিলাম- কীভাবে ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের মধ্যেকার শত-বর্ষব্যাপী যুদ্ধে ঘোড়া-নির্ভর বাহিনীরা ‘অজেয়’ হতে পুরো ‘অসহায়’ হয়ে পড়েছিলো নিত্য-নতুন সব প্রযুক্তি এবং যুদ্ধ-কৌশলের সামনে। সেই যুদ্ধে ঘোড়সওয়ারী নাইটদের হটিয়ে পাইক-ম্যান এবং ম্যান-অ্যাট-আর্মসদের সমন্বয়ে গড়ে তোলা পদাতিক বাহিনীরা হয়ে উঠেছিলো যুদ্ধ ময়দানের মূল নিয়ন্ত্রণ শক্তি।

হাজারে হাজারে ঘোড়সওয়ার বাহিনীর বিরুদ্ধে লাখে লাখে পদাতিক বাহিনীর এইভাবে যুদ্ধের ময়দানে আবির্ভাবের পর বাঘা বাঘা যুদ্ধকৌশল বিদেরা চিন্তা করতে লাগলেন কীভাবে ঘোড়া-নির্ভর বাহিনীকে ঢেলে সাজানো যায়। যুদ্ধের ময়দানে পাইক-ম্যানদের অতি পছন্দের টার্গেট ছিলো ঘোড়ারা। ধরুন, তীব্র বেগে নাইট ঘোড়া ছুটিয়ে এগিয়ে আসছে। সেটার ভয়ানক গতির সামনে পড়ে বিপক্ষ শিবিরের সৈনিকদের দফারফা অবস্থা। যারা কোনোক্রমে পাশ কাটিয়ে সরে যাচ্ছে তাদেরও নিস্তার নেই। নাইটের খোলা তলোয়ারে পরের মুহূর্তেই তাদের মুণ্ডু ধড় হতে আলাদা। ঠিক এই সময় শত্রুপক্ষের এক ফাজিল পাইক-ম্যান ঘোড়ার ছুটে চলা চার পায়ের মাঝে বাঁধিয়ে দিলো বিশাল লম্বা বর্শা। ঘোড়া মুখ থুবড়ে পড়লো মাটিতে। নাইট ছিটকে পড়লো আরো এক মাইল দূরে। কীভাবে এমন লেজে-গোবরে পরিস্থিতি হতে ঘোড়ার মত একটা দুর্ধর্ষ যুদ্ধের বাহনের উত্তরণ সম্ভব?

উত্তর হচ্ছে- সেই দুর্ধর্ষতার সাথে এক চিমটি উন্মত্ততা যোগ করে দেয়া। ভিঞ্চিও আগালেন সেই পথে। তিনি ডিজাইন করলেন এমন এক ঘোড়ার রথের, যেটার ভয়াবহতা দেখে মানবতাবাদী ‘জেনেভা যুদ্ধ আইন’ প্রণেতারা সবাই হার্ট-অ্যাটাক করে মারা যাবে।

Scythed_chariot_by_da_Vinci
উপরের ছবিতে দেখতে পাচ্ছেন ভিঞ্চির ডিজাইন করা ‘ঘূর্ণনক্ষম’ ধারালো ব্লেডযুক্ত ঘোড়ার রথ। ‘ডাবল হর্স-পাওয়ার’ বিশিষ্ট (দুই ঘোড়ায় টানা) এই রথকে দুটি আলাদা মডেলে ভিঞ্চি বাজারে নামাতে চেয়েছিলেন। একটায় ঘুরন্ত ব্লেড থাকবে রথে ঘোড়ার অবস্থানের ঠিক সামনে, আরেকটায় থাকবে পেছনে (উপরের ছবি দ্রষ্টব্য)। ঘোড়ারা যখন রথটাকে টেনে নিয়ে যাবে, তখন সেটার চাকার ঘূর্ণনগতি (যেটা ভূমির সাথে লম্ব) রড এবং গিয়ার মেকানিজমের মাধ্যমে সঞ্চারিত হবে ভূমির সমান্তরালে থাকা ধারালো ব্লেডে। সেই ব্লেডটাও তখন বৈদ্যুতিক পাখার মত সাঁই সাঁই করে ঘুরতে থাকবে, আর আশেপাশে থাকা সব বস্তুকে (এক্ষেত্রে ময়দানের সৈন্যদের) মসৃণভাবে কেটে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে এক ঘাস কাটার যন্ত্রকে চালু করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে মাঠে, আর সেটা বিশাল বড় বড় সব দূর্বাঘাস কাটতে কাটতে সুন্দর একটা পথ তৈরি করে সামনে আগাচ্ছে!


ঠিক এমন, তবে কল্পনা করুন- চুলের বদলে পুরো মাথাটাই নেই!

ঠিক এমন, তবে কল্পনা করুন- চুলের বদলে পুরো মাথাটাই নেই!




কতটুকু কার্যকরী ছিলো এই ডিজাইন?
একটু বেশিই! যারা যুদ্ধ যানটার কার্যপদ্ধতি বুঝেছেন, তারা ইতোমধ্যেই উপলব্ধি করেছেন যে এই যন্ত্রের শত্রু-মিত্র বাছ-বিচারের কোনো বালাই নেই। যুদ্ধের ময়দানের একধার হতে সে স্রেফ ঘাস কাটার মত করে সবকিছুকে কাটতে কাটতে আগাবে। ভিঞ্চি নিজেও জানতেন তার ডিজাইনের এই ত্রুটির কথা। কিন্তু তাতে খুব একটা ক্ষতি-বৃদ্ধি হয়নি। এর কারণ সম্ভবত ইতালির বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের অভাব। মিলান দু চক্ষে দেখতে পারতো না ভেনিসকে, ভেনিস সহ্য করতে পারতো না জেনোয়াকে, আর জেনোয়া তো পারলে লাঠি নিয়ে তাড়া করে ফ্লোরেন্সকে! এদিকে আগেই বলেছিলাম, ইতালির সৈন্যরা প্রায় সবাই ছিলো বাইরের দেশ হতে ভাড়া করা। মিত্র সংখ্যা কম হবার ফলে যুদ্ধের ময়দানে কে এই যন্ত্রের তলে কাটা পড়লো- সেটা নিয়ে তাই বেশি ভাবতে হয়নি ভিঞ্চিকে। ফলে যেটুকু সময় বেঁচে গিয়েছিলো, সেটুকু সময় তিনি ব্যয় করেছিলেন রথের ডিজাইনের আশপাশে মনের মাধুরী মিশিয়ে সব ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন মানুষের শরীর এঁকে তার এই ভয়াবহ আবিষ্কারের কার্যকারিতা প্রমাণে (ছবিতে লক্ষ্য করুন ভালোমতো)। পরে সেটা উপস্থাপন করেছিলেন মিলানের ডিউক ‘লুদভিকো ইল মোরো’ এর নিকট। যদিও পরবর্তীতে মিলানের ডিউক আর এই ভয়াবহ বস্তুটা বানানোর মত পর্যাপ্ত সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারেননি।

৮। মেশিন গান


আহ, মেশিন গান! অটোমেটিক বন্দুকদের রাজা। যুদ্ধের ময়দানে প্রতিরোধকারী পক্ষের পরম বন্ধু। বদমাশ ভিলেনের দফা-রফা করতে শোওয়ার্জেনেগার এবং স্ট্যালোনের মত হিরোদের প্রথম পছন্দ! যদিও বন্দুক এবং গান পাউডার ভিত্তিক অন্যান্য অস্ত্রসমূহের আবির্ভাব আরো আগেই ঘটেছিলো, কিন্তু উনিশ শতকের মধ্যভাগের আগ পর্যন্ত মেশিন গানের বাস্তব ব্যবহারের দেখা মেলেনি। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আমেরিকান নেভী সর্বপ্রথম যুদ্ধের ময়দানে ‘গ্যাটলিং গান’ নামক এক বস্তুর আমদানি করে। সেটা দিয়েই আধুনিক যুদ্ধের ইতিহাসে মেশিন গানের পদচারণা শুরু। কিন্তু মেশিন গান নিয়ে আমাদের সবার কিছু ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। যেমন মেশিন গানের কথা বললেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে এই ধরনের ছবি।

sylvester-stallone-rambo-ii
অথচ বাস্তবতা হলো- শোওয়ার্জেনেগার কিংবা স্ট্যালোনদের মত হেভি ওয়েট অ্যাকশন হিরোরা যেসব দানবাকৃতির বন্দুক দিয়ে নিয়মিতভাবে ভিলেনদের পশ্চাতদেশের ছাল ছাড়ান, সেগুলোই একমাত্র মেশিন গান নয়। সেগুলো মেশিনগানের এক বিশেষ শ্রেণীতে পড়ে মাত্র, যেটা হচ্ছে ‘হেভি মেশিনগান’। বাস্তবে মেশিনগান পিস্তলের মত অতি হালকা এবং এক হাতে বহনযোগ্যও হতে পারে, যেমন- উজি গান, ম্যাক-১০ ইত্যাদি। টেকনিক্যালি, যে বন্দুকে ট্রিগার শুধু একবার টেনে ধরে রাখলেই সেটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটানা ফায়ার করে পুরো ম্যাগাজিন খালি করে দিতে পারে- সেটাই মেশিনগান।

আর আরেকটা ভুল তথ্য হলো, মেশিন গান পুরোপুরি আধুনিক মানুষদের আবিষ্কার নয়। এর গোড়াপত্তন মূলত ৫০০ বছর আগে ভিঞ্চির হাতে, সেই সময়ে যখন ঢাল-তলোয়ার আর বল্লম-সড়কির মতো অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে একে অন্যের ঘাড়ের উপরে লাফিয়ে পড়ার রীতি প্রচলিত ছিলো!

ভিঞ্চির মূল ডিজাইন
আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আমার নীতি খুবই কঠোর : যদি আমার আশেপাশে কোনো আগ্নেয়াস্ত্র থাকে, তবে সেটার নিয়ন্ত্রণ আমি আমার হাতেই চাই!  ক্লিন্ট ইস্টউড (আমেরিকায় আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে এক প্রশ্নের উত্তরে)

কথা হচ্ছে, ‘ক্লিন্ট ইস্টউড’ এই ব্যাপারে পুরোপুরি একা নন। তার বক্তব্যকে “ভালো, মন্দ, কুৎসিত”- যাই মনে হোক না কেন, কথা সত্য! ইতিহাস কলম দিয়ে লেখা হয় না, লেখা হয় বন্দুক দিয়ে। বন্দুকের নিয়ন্ত্রণ যার হাতে, ইতিহাসও তার পক্ষেই সবসময় “হুজুর! হুজুর!” করতে থাকে। যাই হোক, বন্দুকের উদ্ভব ‘গান পাউডার’ নামক যে উপাদান হতে, সেই গান পাউডারের আবির্ভাব ঘটে সর্বপ্রথম চীনে নবম শতকের দিকে। কিন্তু সেই গান পাউডার হতে আধুনিক বন্দুকের মত কাছাকাছি যন্ত্রের আবির্ভাব ঘটতে সময় লাগে আরো প্রায় তিনশত বছর। চাইনিজ সেনাবাহিনীতে দ্বাদশ শতকের মধ্যভাগে যোগ করা হয় ‘হ্যান্ড ক্যানন’ বিশিষ্ট সৈনিকদের। তবে সেই হাত কামানগুলোকে পরবর্তীতে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করে তুর্কীরা তাদের দুর্ধর্ষ ‘জেনিসারী’ বাহিনীর মাধ্যমে।

হাত কামান প্রযুক্তি দিয়ে চাইনিজ এবং টার্কিশরা মধ্যযুগের ইতিহাসে নিজেদের সুপার-পাওয়ার হিসেবে অধিষ্ঠিত করলেও যুদ্ধের ময়দানে এসব হ্যান্ড ক্যানন ব্যবহার করা ছিলো বেশ ঝামেলাপূর্ণ। প্রথমত, প্রতিবার গুলি ছোঁড়ার পর ধৈর্য ধরে বসে বসে রিলোডিং করা ছিলো অত্যন্ত বিপজ্জনক কাজ। দ্বিতীয়ত, কিছুক্ষণ পরপরই যাচাই করে দেখে নিতে হতো ব্যারেলগুলো বেশী উত্তপ্ত হয়ে উঠছে কিনা। বেশী উত্তপ্ত হলে হাত কামান গুলি ছোঁড়ার বদলে নিজের মুখের উপরেই ফেটে যাবে। আর সেই সাথে বোনাস উত্তেজনা হিসেবে ছিলো- নিখুঁত নিশানা-ভেদে এসব হাত কামানদের ব্যর্থতা। যথারীতি, ভিঞ্চি ভাবতে বসলেন হাত কামানের এসব সংকট দূর করার ব্যাপারে। কিন্তু তাঁর জিনিয়াস মাইন্ড আমাদের সাধারণ আই-কিউ বিশিষ্ট মানুষদের ব্রেইনের মতো ‘হ্যান্ড ক্যানন’ হতে ‘হ্যান্ড গান’ এ যায়নি। সেটা সরাসরি চলে গেলো ‘মেশিন গান’ এ!

gun_l
উপরে দেখতে পাচ্ছেন ভিঞ্চির ডিজাইন করা আগ্নেয়াস্ত্র, যেটাকে নির্দ্বিধায় প্রথম প্রজন্মের মেশিন গান বলা যায়। যেহেতু, তার সব আবিষ্কারকে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিবিশিষ্ট না করা পর্যন্ত ভিঞ্চির পেটের ভাত হজম হতো না, সেহেতু তিনি তার এই আবিষ্কারকেও স্বয়ংক্রিয় করে ফেললেন। এই মেশিন গানে গুলি ছোঁড়া বন্ধ না করেই একই সময়ে ব্যারেল ঠাণ্ডা করার এবং বুলেট লোড করতে থাকার ব্যবস্থা ছিলো। ছবিতে যেমন দেখতে পাচ্ছেন- এই মেশিন গানে একটা কাঠের তৈরি প্রিজম আকৃতির ফ্রেমে প্রতি সেটে এগারটা করে তিন সেটে মোট ব্যারেলের সংখ্যা ছিলো তেত্রিশটা। এক সেটের ফায়ারিং শেষ হবার সাথে সাথে মেশিন গানটার দায়িত্বে থাকা একজন সৈনিক সামনের প্রিজম আকৃতির কাঠের ফ্রেমটা ঘুরিয়ে দিতো। ফলে সদ্য ব্যবহৃত ব্যারেলগুলো কিছুক্ষণের জন্যে অবসরে চলে যেতো ঠাণ্ডা হবার উদ্দেশ্যে, আর নতুন এক সেট ব্যারেল সম্মুখে চলে আসতো ফায়ারিং এর লক্ষ্যে। যে দুই সেট অবসরে থাকতো, সৈনিকেরা বসে বসে সেই দুই সেটের ব্যারেলে বুলেট লোড করতো- ঠিক একই সময়ে যখন ফায়ারিং করতে থাকা হতো তৃতীয় সেটের ব্যারেলগুলো হতে। বুলেটের কথা যখন আসলোই, তখন ভিঞ্চির ডিজাইন করা এই মেশিনগানের বুলেটগুলোও দেখুন।

17795
কতটুকু কার্যকরী ছিলো এই ডিজাইন?
টার্কিশ জেনিসারীরা রণক্ষেত্রে যতটা ভয়াবহ ছিলো- সেটাকে গুণ দিন তিন দিয়ে (হাত কামানের রিলোডিং, ওভার হিটিং এবং নিখুঁত নিশানা-ভেদের সমস্যা দূর করতে পারার জন্যে)। তারপর প্রাপ্ত সংখ্যাটাকে আবার গুণ দিন তেত্রিশ দিয়ে (তেত্রিশটা ব্যারেলের জন্যে)। সর্বশেষ ফলাফল যেটা পেলেন, সেটাই ভিঞ্চির মেশিন গানের কার্যকারিতা মাত্রা। অর্থাৎ ভিঞ্চির সমসাময়িক সব গান পাউডার প্রযুক্তির (বড় কামান বাদে) তুলনায় নিরানব্বই গুণ শক্তিশালী ছিলো তার আবিষ্কৃত এই মেশিন গান! ভিঞ্চি আদর করে তার এই আবিষ্কারের নাম রেখেছিলেন ‘অর্গান’, যেটা আমাদের মতে- ভিঞ্চির পক্ষ হতে আমাদের ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের মানুষদের উদ্দেশ্যে ছোঁড়া এক নির্মম রসিকতা ব্যতীত আর কিছুই নয়। কপাল ভালো, ভিঞ্চি পরে আর এই ভয়াবহ জিনিসটা বানানোর জন্যে সময় বের করে উঠতে পারেননি। তাই, আমাদের আরেকটা বাস্তব এবং কার্যকর মেশিনগান পেতে অপেক্ষা করতে হয়েছিলো উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ বাঁধার আগ পর্যন্ত।

৯। মরণ-রশ্মি বা ডেথ-রে


সায়েন্স ফিকশনের এক অনবদ্য উপাদান হলো ‘ডেথ-রে’। বহুযুগ ধরে সায়েন্স ফিকশন আমাদের লেজার মারণাস্ত্রের লোভ দেখিয়ে রাতের ঘুম হারাম করিয়ে আসলেও এখন পর্যন্ত সেই রকম ভয়ংকর কোনো লেজার মারণাস্ত্রের দেখা আমরা পাইনি। আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত ভয়ংকর ডেথ-রে বলতে আছে এই জিনিসটা,


আতশ কাঁচ- পিঁপড়েদের লাইফ সফলতার সাথে তামা তামা করে আসছে, সেই ১৯৫৩ সাল থেকে!

আতশ কাঁচ- পিঁপড়েদের লাইফ সফলতার সাথে তামা তামা করে আসছে, সেই ১৯৫৩ সাল থেকে!




কথা হচ্ছে, ডেথ-রে আধুনিককালে নিকোলা টেসলার মত দুর্ধর্ষ প্রযুক্তিবিদই প্রথম আবিষ্কার করে যাননি। এবং না, এটার সূত্রপাত তালিকার বাকি সব নামগুলোর মত ভিঞ্চির হাতেও হয়নি। এটার সূত্রপাত হয়েছিলো খ্রিস্টের জন্মের পূর্বে তৃতীয় শতকে বিজ্ঞানী ‘আর্কিমিডিস’ এর হাতে। কিন্তু ভিঞ্চি আর্কিমিডিসের সেই আবিষ্কারকে আরো ভয়াবহ রূপদান করেছিলেন।

ভিঞ্চির মূল ডিজাইন
আর্কিমিডিসের মতো ভিঞ্চিও জানতেন সৌররশ্মির ক্ষমতা সম্পর্কে। আমরা যেখানে শৈশবে আতশ-কাঁচ দিয়ে পিঁপড়েদের মতো পরিশ্রমী প্রাণীদের জীবনটা তামা তামা করতে ব্যস্ত ছিলাম, সেখানে ভিঞ্চি স্বপ্ন দেখেছিলেন আরো বড় কিছুর। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন আশেপাশের এলাকা হতে অনেকগুলো আয়নার মাধ্যমে সমস্ত সৌর রশ্মি সংগ্রহ করে সেটাকে এক বিন্দুতে স্থির করলে ফলাফলটা কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে। এই চিন্তা-ভাবনা হতেই তিনি কিছু আঁকিবুঁকি করেছিলেন, যেটা পরে পাওয়া গিয়েছিলো তারই রচিত ‘কোডেক্স অ্যাটলান্টিকা’ নামক গ্রন্থে।

web-fire2
ভিঞ্চির ইচ্ছা ছিলো কেন্দ্রীভূত সৌর রশ্মির এই ক্ষমতা ব্যবহার করে তিনি কিছু যন্ত্রপাতি বানাবেন। যেমন- ধাতু ঝালাই (soldering) করার যন্ত্র, পানি গরম করার যন্ত্র, ইত্যাদি। ইতালির ফ্লোরেন্টিন অঞ্চল ছিলো উলের পোশাক উৎপাদনের জন্যে বিখ্যাত। ভিঞ্চি পরিকল্পনা করেছিলেন আধা মাইল ব্যাসার্ধ ব্যাপী এমন এক আয়না বানাতে যেটা দিয়ে পুরো ফ্লোরেন্টিন অঞ্চলের উল পোষাকশিল্পের জন্যে গরম পানি সরবরাহ করা যাবে। সেই সাথে চেয়েছিলেন বাসা-বাড়ির সুইমিং পুলগুলোতেও গরম পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে। কারণ-  ‘জাকুজি’ এর হট পানিতে আরাম পেতে কে না পছন্দ করে? রোমানরা তো বটেই!


হট!!

হট!




কতটুকু কার্যকরী ছিলো এই ডিজাইন?
ভিঞ্চির এই ডিজাইনকে সাধারণ আয়না বলে অভিহিত করা আসলে ভুল। সাধারণ আয়নারা শুধু সূর্যের আলোকে প্রতিফলিত করে। কিন্তু ভিঞ্চির ডিজাইনে ব্যবহৃত আয়নাগুলো সূর্যের আলোর ক্ষমতাকে বহুগুণে বাড়িয়ে ফেলার ক্ষমতা রাখতো। সেগুলো ‘অ্যামপ্লিফায়ার’ হিসেবে ভূমিকা পালন করতে সক্ষম ছিলো। কেউ চাইলে এসব আয়না কোনো টাওয়ারের উপর স্থাপন করে সমুদ্রের উপরে ভাসমান শত্রু জাহাজে আগুন ধরিয়ে দিতে পারতো। কিন্তু সেটা আর পরে করা হয়ে ওঠেনি। কে জানে, হয়তো সেটাই হতো আমাদের ‘ডেথ স্টার’ তৈরি করার প্রথম পদক্ষেপ!

আমাদের এই পুরো ‘ভিঞ্চি’ ট্রিলজির সারকথা হলো- এটা মানবজাতির সৌভাগ্য যে রেনেসাঁ যুগের মাস্টার মাইন্ড ‘লিওনার্দো দা ভিঞ্চি’ এসব ভয়াবহ আবিষ্কারের চেয়ে তার রং-তুলির ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত থাকতে বেশী পছন্দ করতেন। যদি সত্যি সত্যি তিনি ক্যারিয়ার সুইচ করে বন্ড ভিলেন হিসেবে আবির্ভূত হতেন, তবে সেই মুভিতেই আমাদের এজেন্ট ‘জিরো জিরো সেভেন’ এর দফা-রফা হয়ে যেতো। ব্লু-প্রিন্ট চুরি করতে ভিঞ্চির দুর্ভেদ্য দুর্গে ঢুকতে গিয়েই হয়তো সোলার টাওয়ারের রশ্মিতে বেঘোরে মারা পড়তো, না হয় ক্লাস্টার বোমায় ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতো। কিংবা ব্লু-প্রিন্ট চুরি করে ট্যাংকে চড়ে পালানোর সময় হয়তো রোবট আর্মির সামনে পড়ে দফা-রফা হয়ে যেতো। অথবা কে জানে, মুভির শেষ ফাইটে হয়তো স্বয়ং ভিঞ্চি তার উড়ুক্কু যানে করে জিরো জিরো সেভেনকে ধাওয়া করতেন আর মেশিন গানের গুলিতে এজেন্টের এমনভাবে দফা-রফা করে দিতেন যে ‘বন্ড’ মুভির কোনো সিকুয়েল বানানোরও আর সুযোগ থাকতো না!


"মাই নেইম ইজ ভিঞ্চি......লিওনার্দো দি স্যার পিয়েরো দ্যা ভিঞ্চি!"

“মাই নেইম ইজ ভিঞ্চি……লিওনার্দো দি স্যার পিয়েরো দ্যা ভিঞ্চি!”




 

 

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/vinci_as_bond_villain_03/

Friday, November 1, 2019

আবদুল মান্নান সৈয়দের ছোটগল্পে ফ্রয়েডীয় মন


শাদমান শাহিদ


ষাট দশকে যাদের নেতৃত্বে বাংলাদেশের ছোট গল্পের শরীরে নতুন হাওয়া লেগে ছিল তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩-২০০৯)। সাহিত্যের সুডৌল দেহে তাঁর হাতের স্পর্শ লাগা মানে নতুন কিছু প্রত্যক্ষ করা। একজন সফল সব্যসাচী লেখক হিসেবে সাহিত্যের অঙ্গনে ঈর্ষণীয় খ্যাতি অর্জন করেছেন। কি কবিতা- কি কথাসাহিত্য-কি প্রবন্ধ সবখানেই আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেছেন। নতুন কিছু দেখলে প্রথমে অচেনা লাগবে এটাই স্বাভাবিক। অতীতেও এমন অনেক হয়েছে। শেষে চশমার গ্লাস পরিষ্কার করে সমালোচকরা লজ্জিত হয়েছে। মান্নান সৈয়দের বেলায়ও এমন একটা আবহাওয়া লেগে ছিল- বুঝি না। ‘মান্নান বুঝি না’। অথচ এখন অনেকের কাছেই মান্নান সৈয়দ অনুসরণীয়।

তাঁর প্রথম ছোটগল্পের বই ‘সত্যের মতো বদমাশ’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৮ সালে। এবং অশ্লীলতার ধোঁয়া তুলে তৎকালীন সরকার সেটা বাজেয়াপ্ত করে দেয়। পরবর্তীতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে সেটা পুনরায় প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রতিটি গল্পেরই ভাব, ভাষা এবং আঙ্গিক সম্পূর্ণ নতুন। তিনি কাব্যের মতো গল্পের কোমল দেহেও ফ্রয়েডীয় এবং পরাবাস্তববাদের মসলা ঢেলেছেন। এটা তাঁর ব্যাপক গবেষণা কর্মের প্রভাব। তিনি মানিক আর জীবনানন্দের উপর ব্যাপক কাজ করেছেন। সেটাই তাঁর সাহিত্যের অন্তর নির্মাণে সামান্য রং লেগেছে। বিংশ শতাব্দির ঠিক শুরুতেই অর্থাৎ ১৯০০ সালের দিকে অস্ট্রীয় মনঃরোগবিশারদ সিগমন্ড ফ্রয়েড(Sigmund Freud, ১৮৫৮-১৯৩৯) মনঃসমীক্ষণ মতবাদ প্রবর্তন করলে সারা বিশ্ব জুড়ে এক আলোড়ন সৃষ্টি হয় এবং অনেকেই এ মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তিনি মানব চরিত্রের একজন নিখুঁত বিশ্লেষক। ফ্রয়েডের মতে ব্যক্তিত্ব কাঠামোতে তিনটি উপাদান কাজ করে। অদস্‌ বা ইদ(Id), অহম বা ইগো(Ego) এবং অতি অহম বা সুপার ইগো (Super ego)। অদস্‌, অহম এবং অতি অহম কখনো বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করে না। ব্যক্তিত্বের সাথে এগুলো নিবিড়ভাবে সংযুক্ত। ব্যক্তির পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে উপযোজনে এগুলো সম্মিলিত ভাবে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে। অহমকে বলা হয় ব্যক্তিত্বের নির্বাহী সত্ত্বা (Executive self )। অদস চায় জৈবিক তাড়নার চরিতার্থ। অতি অহম চায় জৈবিক তাড়নাকে একেবারে অস্বীকার করে আদর্শ ও উৎকর্ষের দিকে ব্যক্তিকে পরিচালিত করতে। অহমের কাজ হচ্ছে বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় এনে অদস এবং অতি অহমের দাবির মধ্যে সমন্বয় সাধন করে ব্যক্তিকে সুষ্ঠু ও সফল উপযোজনে সাহায্য করা। এদিক থেকে অহমকে বেশ গুরু দায়িত্ব পালন করতে হয়। অহম দুর্বল হলে এবং অদস,অতি অহমের যুদ্ধ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে ব্যক্তিত্বের বিপর্যয় দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। (ড. জহিরুল হক, সমাজ মনোবিজ্ঞান)।অধ্যাপক মো. নূরনবীর মতে-‘মন শুধু কতকগুলো চেতনা, প্রতীতিবোধ এবং বিবেক ইত্যাদি সম্পন্ন প্রতিক্রিয়ার সমষ্টি নয়। মন চিন্তাশীল আধ্যাত্মিক দ্রব্যও নয়। মন হলো রহস্যময় সমুদ্রতলদেশের ন্যায়। মনে রহস্য উদঘাটন করতে হলে আমাদেরকে যেতে হবে আরো ভেতরে অর্থাৎ মনের অচেতন ও অজ্ঞানভাগের গভীরে। চেতনের চেয়ে অচেতন বেশি গভীর এবং বিস্তৃত। বিবেকের চেয়ে আবেগ বেশি অর্থপূর্ণ। স্বপ্ন এবং দিবাস্বপ্ন বা অলীক কল্পনা প্রাচীন মনোবিদ্যায় তত প্রয়োজনীয় বলে পরিগণিত হয়নি। কিন্তু ফ্রয়েডিয়ান মনোবিদ্যায় এগুলো বিশেষ স্থান দখল করে আছে। কেননা তাদের মতে, এগুলোই আমাদের মনের গভীরে উৎসের উদঘাটন করে। ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, আবেগ, কামনা, বাসনা, লালসা, কামরিপু প্রভৃতি মনের স্বরূপকে বেশি জ্ঞাত করে। অবশ্য তাঁরা মনে বুদ্ধিক্রিয়াকে অস্বীকার করেন নি। বিবেক পাহারাদারের মত টহল দিতে থাকে বলে আমরা অশোভন কার্য এবং অন্যায় প্রবৃত্তি থেকে অনেকটা বিরত থাকি। ফলে বাইরে বাইরে আমরা ভদ্র মার্জিত। আসলে আমরা কুৎসিত এবং স্বার্থপর। বিবেকের শাসনে আমরা জোর করে ভদ্র হয়ে ওঠি। ফলে আমরা আমাদের অনেক কামনা, বাসনা, ইচ্ছাকে দমন করি, মনের গভীরে ঠেলে দিই। সেখানে সেগুলো সৃষ্টি করে নানা অশান্তি। ফলে আমরা ভুগি সাইকোসিস, নিউরোসিস, হিসটেরিয়া এবং আরো অনেক অশান্তিকর মানসিক রোগে।'(অধ্যাপক মো. নূরনবী: দর্শনের সমস্যাবলী)

আমি আগেই বলেছি ফ্রয়েডের এ ধরনের মনঃসমীক্ষণ মতবাদে অনেকই আকৃষ্ট হয়ে তাদের লেখায় এ নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছেন। মান্নান তাঁদেরই একজন কৌতূহলী উত্তরসূরী। তাঁর মাতৃহননের নান্দীপাঠ, চাবি, রাস্তা, গল্প ১০৬৪, জলপুরি, মাছ, অমরতার জন্যে মৃত্যু, অস্তিত্ব অন্যত্র, আম্রকাননে, রাজা, আব্দুল হাফিজ: জীবন ও সাহিত্য, হোসেন মিয়ার সঙ্গে, জীবনানন্দের একটি অপ্রকাশিত গল্প, নারী হৃদয় প্রেম গৃহ অর্থ কীর্তি সচ্ছলতা,বিদ্যা-সুন্দর কাহিনী, যাত্রা, চমৎকার অবচেতন, গতবৃষ্টি, সাপ, একরাত্রি, এক অমানুষের গল্প, ভয় ইত্যাদি গল্পে কোথাও না কোথাও হয় মানিক, নয় জীবনানন্দ। একজন না একজন আছেই। ‘মাতৃহননের নান্দীপাঠ’ গল্পে দর্শনের ছাত্র যুবক আতিকুল্লাহর ৪৫ বছর বয়স্কা বিধবা মা পরিণত এক ভদ্র লোকের প্রতি প্রেমাসক্ত হয়ে পড়ে। লোকটি প্রতিদিনই গোপনে তার সঙ্গে দেখা করে, সিগারেট খায়, আলাপ করে, সময় কাটায়। যা সমাজের চোখে অত্যন্ত গর্হিত কাজ। মা সমাজের চোখে ফাঁকি দিলেও ঘরের ছেলেকে ফাঁকি দিতে পারে না। যে কোনো সময় ধরা পড়ে যেতে পারে, এ ভয়ে সব সময় ছেলেকে চোখে চোখে রাখে, তার গতি বিধি লক্ষ রাখে। যা আতিকুল্লাহর কাছে বিষের মতো লাগে। সে জানায়- যেখানেই আমি যাই দু’টি নির্নিমেষ চোখ পিছনে ছুটছে, পিছলে পড়ছে না একবারো, সরে যাচ্ছে না, এমনকি পলক ফেলছে না কখনো, যেন মানুষের চোখ নয়। মানুষের অবশ্য, তবু মানবীয় নয়। দানবীয় এক যন্ত্রে পরিণত হয়েছে সে … আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে মৃত্যুর অভিমুখে, কবর পর্যন্ত আমাকে পৌঁছিয়ে না দিয়ে শান্তি নেই তার।…’ সেটাকে সে মায়ের ভালোবাসা মনে করে। এবং এ অসম্ভব ভালোবাসায় অতিষ্ট হয়ে এক পর্যায়ে তাকে হত্যা করতে প্রবৃত্ত হয় তখনই তার সামনে এসে দাঁড়ায় যুক্তিবাদ। কী অপরাধে সে মাকে হত্যা করতে চায় ? এবং কাজের জন্য উপযুক্ত কারণও খুঁজে পায় সে। ৪৫ বছর বয়স্কা মায়ের ঘরে একজন অপিরিচিত লোককে দেখতে পায়। তার উপস্থিতিতে মাও বেশ বিব্রত বোধ করে। এতে তার চরম সন্দেহ হয়। মায়ের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি হয়। কারণ হিসেবে এটাই যথেষ্ট। তারপরও যুক্তি আছে। মায়ের পদস্খলনের পিছনে আরো কারণ থাকতে পারে, দর্শনের ছাত্র হিশেবে যুক্তির পিঠে পাল্টা যুক্তি সেট করে সিদ্ধান্তে আসতে হবে তাকে। এজন্য সে নিজের সামনে নিজেকে হাজির করে এবং অভিজ্ঞ আইনজীবীর মতো একের পর এক জেরা করতে থাকে। যুক্তি হিসেবে তুলে ধরে ফ্রয়েডকে। নিজেকে বোঝায়- ‘তুমি ফ্রয়েড পাঠ করেছো, অতএব তোমার বোঝা উচিত কেন তোমার মা এই বয়সে দ্বিধায় পড়েছেন।’
‘চাবি’ গল্পে তরুণ অধ্যাপক ভ্রমণ থেকে বাসায় ফিরে এসে পকেটে হাত দিয়ে দেখে চাবি নেই। চাবি নেই এবং কোথাও নেই। বাসার অন্যান্য ফ্ল্যাটের ভাড়াটেদের জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে পদে পদে বিব্রত হয়। এক পর্যায়ে তেতলার সবচেয়ে কোণার ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখে কয়েকটি মেয়ে। তারা দেহ ব্যবসা করে। ওরা জানতে চায় তার কাছে টাকা আছে কি না। বেশি টাকা লাগবে না। তিনি ক্লান্ত ছিলেন বলে আগ্রহ দেখাননি। এক পর্যায়ে তিনি চলে আসেন। আসার সময় শুনেন, একটি মেয়ে বলছে- ‘উনি তো চাবি খুঁজতে এসেছিলেন, যান, আপনার যখন চাবি নেই, তখন এখানে থেকে কী করবেন।’ ‘চাবি পেলে আসবেন, এখানে কয়েকটি দরোজা-বন্ধ করা ঘর আছে’। ‘ আমরাও যে চাবি খুঁজছি গো-‘। তিনি মেয়েদের এ কাজটিকে ইতিবাচক ভাবে দেখেছেন। তিনি তাদের যাপিত জীবনের কষ্টের কথা চিন্তা করে ব্যথিত হয়েছেন,’ওরা হাসছিলো, আমি ওদের জন্যে মনে মনে কাঁদছিলাম। ওরা খিল খিল করে হাসছিলো। ‘চাবি খুঁজছি গো মহারাজ!’ আমি মনে মনে হু হু করে কাঁদছিলাম,’ চাবি খুঁজছি গো মহারাজ!’

‘গল্প ১৯৬৪’ গল্পে বন্ধু অমল সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় নিরাপত্তার স্বার্থে বোন শোভাকে কবিরের কাছে রেখে সে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরকে নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে যায়। এদিকে কবিরও ছোট বোনের মতো দেখে দায়িত্ব পালন করে আসছিল। এবং প্রতিরাতেই তাঁর মধ্যে অসদ——————— তথা জৈবিক তাড়না নাড়া দিয়ে ওঠে। সুপার ইগো তথা বিবেক তাকে পাহারা দিয়ে রাখে। এভাবে চলতে চলতে একসময় অদসের কাছে বিবেক হেরে গেলে নেমে আসে বিপর্যয়। কবির বলে- ‘সব সমস্ত চলছিলো ঠিক ভাবে। কিন্তু এক রাতে আমার মধ্যে জানোয়ার জেগে উঠেছিলো; আমি কিছুতেই নিজেকে সংযত করতে পারিনি। শোভাও হয়তো ভয় পেয়ে বাধা দেয়নি, চিৎকার করেনি।’

জলপরি’ গল্পে তরুণ অধ্যাপক এক বিয়ের অনুষ্ঠানে শম্পাকে দেখে তার পছন্দ হয়ে যায়। তারপর পরিচয়। ‘পরিচয় থেকে আলাপ। শম্পা আমার হৃদয়ে দাঁড়িয়ে হাসতে লাগলো। আমি তার চোখের ভেতরে পালাতে চাইলাম- যে চোখ ধরে ফেলেছে আমাকে। আমার ভালো লাগতে লাগলো। ধরা পড়েও আমি খুশি হলাম। যে ধরে সে শুধু ধরেই না, সে-ও খানিকটা ধরা দেয় এই সত্য আমি জানলাম। তাদের এ প্রেম বিয়ে পর্যন্ত গড়ায় না। শম্পার বিয়ে হয়ে যায় অন্যখানে। শম্পাকে হারিয়ে অধ্যাপকের বিপর্যস্ত অবস্থা। তাই একদিন তিনি শম্পার স্বামীর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হলেন। শম্পাকে দেখে ভেতরে মোচড় দিয়ে ওঠে অতীত। তিনি বলেন,’ শম্পা ঝকঝকে টিপয় থেকে চা ঢালছিলো। তার ডান কানের দুল বিকেলের তারার মতন জ্বলছিলো। তার মুখে খুশি, চুলে খুশি, পোশাকে খুশি। চার পাশে ফুলের বেড। তাতে একশরকম ফুল ফুটেছিলো। একশ রঙের স্বপ্ন ফুটেছিলো।’
তারপর থেকে তিনি প্রতিদিনই শম্পার বাড়িতে যান। গল্প করেন। তার ভালো লাগে। এ জায়গাটায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘দিবারাত্রির কাব্য’ উপন্যাসের কথা মনে পড়ে। সেখানেও নায়ক ইংরেজি অধ্যাপক স্ত্রী-ছেড়ে অন্যত্র বিয়ে হয়ে যাওয়া পূর্ব প্রেমিকার প্রতি আসক্ত। এ যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে স্ত্রী আত্মহত্যা করে। স্ত্রীর মৃত্যুর পর অধ্যাপক সাহেব তার প্রেমিকার বাড়িতে ঘন ঘন যাতায়াত করেন। এ সবই ফ্রয়েডের তাড়না। যত বড় ব্যক্তিত্ববানই হোক না কেন, একবার তার মধ্যে অদস জেগে ওঠলে তাকে সামাল দেয়া বড় দায়। তরুণ অধ্যাপক দুজনই বিবেকহীন কাজে নেমে গিয়ে অপমানিত হন। শম্পার স্বামী তাকে (অধ্যাপককে) অপমান করে তাদের বাড়ি থেকে বের করে দেয়। বের করে দেয়ার পরও তিনি শম্পাকে ভুলতে পারেন না। রাতের আঁধারে শম্পার বাড়ির পেছনে অবস্থিত পুকুর পাড়ে গিয়ে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকেন। অদস শক্তিশালী হলে এভাবেই মানুষকে ব্যক্তিত্বের চরম নিম্নসীমায় নামিয়ে দেয়।

‘হোসেন মিয়ার সঙ্গে’ গল্পে বউবাজারের গলিতে পতিতালয়ের কথা আলোচিত হয়েছে। আগেই বলে রাখি মানিক, হোসেন মিয়া, কুবের মাঝি, কপিলা প্রভৃতি সব চরিত্রই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘ পদ্মানদীর মাঝি’র অবলম্বনে রচিত। সে উপন্যাসে সমাজতন্ত্র চাপিয়ে ফ্রয়েডেরই বিজয় ঘোষিত হয়েছে। ‘আমারে নিবা মাঝি লগে’ বিবেকের শত বাধা সত্ত্বেও কাম উত্তেজক শ্যালিকার এ আহ্বান সে অস্বীকার করতে পারে না। উপন্যাসে প্রথম দিকে সমাজতন্ত্রের ঘন প্রভাব প্রকাশিত হলেও কপিলার আগমনে তা ফিকে হয়ে যায়। এ পরের সব টুকুই মান্নান সৈয়দকে আকৃষ্ট করে। যার কারণে বউবাজারের পতিতালয়ে মান্নান সৈয়দ ইচ্ছা করে স্বয়ং মানিককেই শেফালির ঘরে পাঠিয়ে দেয়। মানিক বাবু ঘন ঘন যাতায়াত করে। পুলিশ আসছে খবর শুনেও সে বিচলিত হয় না। বলে-‘কেন ভয় পাবো ? এখানে তো আইনতই বেশ্যাবৃত্তি হয়। বউবাজারের এটা চিহ্নিত রেড লাইট এরিয়া-‘। সেখান থেকে এসে দেখা হয় হোসেন মিয়ার সঙ্গে। তাকে নিয়ে যায় মানিক বাবুর প্রেসে, সেখানে হোসেন মিয়া কুবেরকে পায়। কিন্তু ময়নাদ্বীপ থেকে পালিয়ে এসেছে বলে হোসেন মিয়া কুবেরের উপর রাগ করে না। তার আজন্ম রহস্যময় হাসি ছড়িয়ে বলে, কেমন আছো, কুবির ভাই?’…… তারপরে বর্ণনায় আসে কপিলার কথা। সংসারের যাপিত জীবনে সে মোটামুটি ক্লান্ত। কামনা ফিকে হয়ে আসছে কিছুটা। লুলা বোন মালারে একবার দেখার জন্য জন্য বড় কাতর। কিন্তু কুবের তারে নিয়ে কেতুপুরে যেতে চায় না। লজ্জা তাকে বেঁধে রাখে। এ গল্পটি সম্পূর্ণই ফ্রয়েড প্রভাবিত।
‘বিদ্যা-সুন্দর কাহিনী’ গল্পে বৃদ্ধ আজিজ আহমদ- তরুণ কবি স্বপ্না সুলতানার প্রেম।’ এখানেও ফ্রয়েড। এখানেও কাম চরিতার্থতার বাণী উচ্চারিত হয়েছে কবিতার মাধ্যমে। প্রেমের কবিতার পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আজিজ আহমদ নিজেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ শেষের কবিতা’ উপন্যাসের নায়ক অমিত ভাবতে থাকে। ঘটনাক্রমে স্বপ্নাও লাবণ্য হয়ে উচ্চারণ করে-
‘ বৃষ্টির চাদর মুড়ি দিয়ে সারারাত আজ
ঘুমিয়েছি তর কোলে।
ফোঁটা ফোঁটা
জলের হিরে আদর বুলিয়েছে আমার চোখে,
মুখে, ঠোঁটে ও চিবুকে। অনর্গল করেছি
ঘ্রাণ সেই আদরের নরম নরম স্পর্শে।
প্রতি স্পর্শে শিহরণ, কম্পন, চমক,
বিদ্যুৎস্পৃষ্ট শরীর ছুঁয়েছে তোর শরীরের ভাঁজ,
ঘ্রাণ আর ম-ম-করা নোনা আস্বাদ।
ভেজা ভেজা উষ্ণতা ছড়িয়েছে
তোর শরীরে ওম। সেই ওমে ঘুমিয়েছি
আমি শঙ্কাহীন
মধুর নিঃসংকোচে।
তৃপ্তির অনুপম মাধুর্যে।’
মান্নান সৈয়দ আপাদমস্তক একজন শক্তিশালী গদ্য লেখক ছিলেন বলেই চরিত্রের অনুভূতির সূক্ষ্ণ কণিকায় নিজেকে ঢুকাতে পেরেছেন। আর সেখানে প্রতি নিয়ত কী চাহিদা দাবি করছে তা তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পাঠকের সামনে তুলে ধরতে পেরেছেন। এটা হাতে গোণা কয়েকজন বাদে অন্যদের পক্ষে সম্ভব নয়। এভাবে চরিত্র নিয়ে বিশ্লেষণ ধর্মী কাজ করতে গিয়ে অনেকে খেই হারিয়ে ফেলেছেন। এ ক্ষেত্রে মান্নান সৈয়দ সার্থক। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।


উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ...

মুরাকামি’র সঙ্গে আলাপ


সাক্ষাৎকার
মুরাকামি’র সঙ্গে আলাপ
জন ফ্রিম্যান
অনুবাদ : এমদাদ রহমান

[‘বাতাস যেখানে গান গেয়েছিল’ নামে মুরাকামি তাঁর প্রথম উপন্যাসটি লিখেছিলেন ১৯৭৯ সালে, তারপর এক নাগাড়ে তিন দশক তিনি মানুষের কল্পনাজগতের ‘অন্ধকার আর আশ্চর্য দিকগুলি’কে পর্যবেক্ষণ করেছেন। জাপানের কিয়োটো’য়, ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি ১২ তাঁর জন্ম। তিনি উপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, অনুবাদক, সাংবাদিক। এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ, নরওয়েজিয়ান উড, দি উইন্ড-আপ বার্ড ক্রনিকল, কাফকা অন দি শোর, স্পুটনিক সুইটহার্ট, ওয়ানকিউএইটফোর তাঁর অন্যতম সৃষ্টি। ২০০৮ সালে বের হয় তাঁর স্মৃতিকথা ‘হোয়াট আই টক অ্যাবাউট হোয়েন আই টক অ্যাবাউট রানিং’, মূলত এই বইকে কেন্দ্রে রেখেই লেখক, সমালোচক জন ফ্রিম্যান কথা বলেন মুরাকামির সঙ্গে, ২০০৮ সালেই। ফ্রিম্যানের সাক্ষাৎকারভিত্তিক বই ‘হাউ টু রিড অ্যা নভেলিস্ট’ বই থেকে এই আলাপচারীতা বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।]

কিছু মানুষ চার্চে গিয়ে জীবনের তাৎপর্যকে উপলব্ধি করে গভীরভাবে আর কিছু মানুষের থাকে পর্বতের শিখর থেকে শিখরে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। পয়লা এপ্রিল ১৯৭৮, হারুকি মুরাকামি আসলেন জিংগু বেসবল মাঠের পেছনের ঘাসে ঢাকা ছোট পাহাড়ে, টোকিও’য়। মুরাকামি কি একটি উপন্যাস লিখতে লিখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন?

তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে লেখালেখি আর প্রায় তিন ডজন বই প্রকাশ হবার পর, এটা পরিষ্কার যে, মুরাকামি উপযুক্ত সময়েই সাড়া দিয়েছেন। তার অদ্ভুত, স্বতন্ত্র, সৌন্দর্যময়, মর্মভেদী উপন্যাসগুলি, ‘এ ওয়াইল্ড শিপ চেজ’ থেকে ‘আফটার ডার্ক’ বিশ্বব্যাপী পেয়েছে অভাবনীয় জনপ্রিয়তা, আর অনুবাদ হয়েছে আটচল্লিশেরও বেশি ভাষায়।

তবে, তিনি যেমন করে তাঁর স্মৃতিকথায় – হোয়াট আই টক অ্যাবাউট হোয়েন আই টক অ্যাবাউট রানিং-এ যেভাবে বর্ণনা করেছেন, এই বিপুল পরিমাণ সৃষ্টি হয়ত অসম্ভব হয়ে যেত যদি না— বহু বছর আগে যেমনটি শুরু হয়েছিল— তা পর্যায়ক্রমিকরূপে চলে না আসত— এক বিশেষ উপলব্ধি, ঠিক যেন দৈনিক তিন প্যাকেট সিগারেটে আসক্ত কোনও ব্যক্তির কাছে এ এক অভাবনীয় ব্যাপার— যদি সে প্রাতঃভ্রমণে বের হয়, তাহলে কী ঘটবে?

শহরের মধ্যস্থিত ম্যানহাটান হোটেলের লবিতে, অল্প-আলোয়, ইতোমধ্যে শরীরের ঘুম-ভাঙা-সব-চিহ্ন মুছে ফেলে, খানিকটা দৌড়ে এসে, কিছুক্ষণ লিখে আর আরেকটি সাক্ষাৎকারের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে, ঊনষাট বছর বয়সী দীপ্তিমান উপন্যাসিক ব্যাখ্যা করছিলেন কবে, কীভাবে শুরু করেছিলেন, মনে হচ্ছিল এ যেন এক বিপুল বিস্তৃত জীবন; তিনি বলছিলেন কীভাবে জীবন-সংগঠনের নীতিগুলিকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছিলেন। আমার একটা থিওরি আছে— তিনি কথা বলছিলেন গভীর মন্দ্র এক স্বরে— আপনি যদি খুব তীব্রভাবে পুনরায়-আবর্তনমূলক জীবন যাপন করেন, তাহলে আপনার ইমাজিনেশন খুব ভাল কাজ করবে। ইমাজিনেশনের শক্তিটুকু তখন খুবই কার্যকর থাকবে। তাই, প্রতিটি দিনেই আমি খুব ভোরে জেগে উঠি, প্রতিটি দিন; আর আমি আমার টেবিলে বসে পড়ি আর লেখার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাই।

লেখালেখি নিয়ে বলছিলেন যখন, মুরাকামির বলা প্রতিটি শব্দকেই মনে হচ্ছিল যেন এক নিঃসঙ্গ অস্তিত্ববাদীর কথা। মনে হচ্ছিল তিনি যেন এক পেশাদার খেলোয়াড়, তাকে মনে হচ্ছিল এক উদ্বুদ্ধকারী বক্তা। ‘এটাকে মনে করুন এক অন্ধকার ঘরে যাওয়ার মত ব্যাপার’— তিনি বলছিলেন, তার বলার ভঙ্গি কিছুটা ধীর, শান্ত— ‘আমি সেই অন্ধকার ঘরে প্রবেশ করলাম, ঘরের সেই দরোজা খুলে ফেললাম, এবং, দেখলাম অন্ধকার, পুরাপুরি অন্ধকার। তবে, আমি অবশ্যই কিছু দেখলাম, এবং আমি কোনও কিছু স্পর্শ করলাম, তারপর ফিরে এলাম এই চেনা পৃথিবীতে, এখানে, এই দিকে, তারপর তার সবকিছুই লিখে ফেললাম।’

কথাগুলি বলার পর মুরাকামি হঠাৎ এমনভাবে দীর্ঘ বিরতি নিলেন যেন চার্চে প্রার্থনারত মানুষরা এক দীর্ঘ নীরবতায় মগ্ন, এবং তারপর, তিনি যেন কিছু দরকারি শর্তের কথা বললেন, কিছু আবশ্যকীয় শর্ত—‘আপনার নিজেকে খুব শক্তিমান হতে হবে, আপনাকে নাছোড়বান্দা হতে হবে, বেপরোয়া হতে হবে, কী করতে চাইছেন তার পক্ষে আপনাকে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে— যদি আপনার সেই অন্ধকার কক্ষে ঢুকবার ইচ্ছে থাকে।’

এমনকি, মুরাকামি যখন জাপানেও থাকেন না, তখনও তিনি কিছু কঠোর বিধি মেনে চলেন। খুব ভোরে জাগেন, কয়েক ঘণ্টা লেখালেখি করেন, দৌড়ান আর বিকালগুলি কাটতে থাকে সাহিত্যের অনুবাদে। এর মধ্যে তিনি অনুবাদও করে ফেলেছেন দ্য গ্রেট গেটসবি, কেচার ইন দ্য রে, এবং অধুনা রেমন্ড চান্ডলারের ফেয়ারওয়েল, মাই লাভলি।

তার দিনযাপনের সঙ্গে এইরকম নির্দিষ্ট করা নিয়মগুলি তার সৃষ্ট চরিত্রগুলোর সঙ্গে তেমন একটা পার্থক্য তইরি করে না, অবশ্যই। মুরাকামি মানুষের সেইসব কথাই লেখেন, যারা জীবনভর পার্শ্ববর্তী পথ দিয়ে দৈবক্রমে হেঁটে চলে কিংবা অস্বাভাবিক, উদ্ভট পারিপার্শ্বিক অবস্থার দ্বারা তাড়িত হয়। তার ‘কাফকা অন দ্য শোর’ হল কথা বলতে পারে এমন বেড়ালদের নিয়ে, ‘আফটার দ্য কোয়েক’-এ আছে এমন এক মানুষের গল্প যে কিনা বিশ্বাস করে বসে আছে যে এক অতিকায় ব্যাঙ টোকিও’র ওপর থেকে কথা বলছে।

যদিও তিনি কোঠর নিয়মানুবর্তী জীবন যাপন করেন, অভ্যাসগুলিকে খুব মেনে চলেন, তবুও, মুরাকামি জানেন যে কীভাবে নিয়তি মানুষের জীবনকে বদলে দেয়। দুটি ঘটনা তার নিজের ভিতর বিশাল বদল এনেছিল, আশির শেষের দিকে ঘটেছিল প্রথম ঘটনাটি। তিনি যেন কিছুটা ক্লান্ত কিংবা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, কথাটা এমনভাবে বলেন-- ‘পিঠ চুলকাতে চুলকাতে পান করে যাওয়া’। কথাটা বলেন টোকিও’র সাহিত্যিক সমাজকে উদ্দেশ্য করে, যে-সমাজে নিজেকে তিনি বিবেচনা করেন একজন আউটসাইডার হিসেবে। তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান আর লেখেন একখানা উপন্যাস, নরওয়েজিয়ান উড।

বইটি বিক্রি হল, দেদারসে বিক্রি হল আশারও অতীত সংখ্যক কপি, মুরাকামি বলেন, হাসতে হাসতে— ‘দুই বছরে বিশ লাখ কপি। তাই কিছু মানুষ আমাকে আগের চেয়েও বেশি ঘৃণা করতে শুরু করলেন। ইন্টেলেকচুয়াল লোকজন বেস্ট সেলার অপছন্দ করেন।’ মুরাকামি তখন আরও দূরে সরে গিয়েছিলেন। আমেরিকায় এবং তারপরই এসেছিল ১৯৯৫ সাল। এই বছর জাপানের অর্থনীতিতে দেখা দেয় ভয়ানক বিপর্যয়। সাবওয়েগুলোয় সন্ত্রাসীরা গ্যাস বিস্ফোরণ ঘটায়। নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তইরি করে। অর্থাৎ, মানবিক বিপর্যয়। মুরাকামি তখন দেশে ফেরেন। পুরো একটি বছর ধরে মন দিয়ে শুনেন ক্ষতিগ্রস্তদের কথা। মুখে মুখে শুনা এই ইতিহাসকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তিনি তাঁর ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ গ্রন্থে তুলে ধরেন। এই অভিজ্ঞতা তাকে বদলে দেয় অনেকখানি। তিনি সেইসব মানুষদের কাছ থেকে শিখে নেন কীভাবে চরিত্রদের নিয়ে লিখতে হয়। ‘জানেন, আমাদের মাঝে অনেকেই আছেন যারা অন্যদের কোনও কথাই মন দিয়ে শুনেন না।’ মুরাকামি বলতে থাকেন, ‘আমাদের চিন্তাটা এরকম যে অন্যদের সব কথাই বিরক্তিকর। কিন্তু দেখুন, আমরা যদি অন্যদের কথাগুলি গুরুত্ব দিয়ে শুনি, তো মনে হবে যে তাদের গল্পগুলি কতটা মুগ্ধ করার মত আকর্ষণীয়।’

তার নিজের এই উপলব্ধির পরেই, মুরাকামি শুধু তার চরিত্রগুলিকেই ভিন্নরকমভাবে লিখেছেন, তা-ই নয়, তিনি কতগুলি বন্ধ জানালা খুলে দিয়েছেন। চরিত্রগুলিকে সেই খোলা জানালা দিয়ে কিছু না কিছু দেখাচ্ছেন, বারবা। বছরের দুই মাস তিনি তার পাঠকের ইমেইলের উত্তর দেন। ‘আমি শুধু আমার পাঠকদের সঙ্গেই কথা বলতে চাই’, তিনি বলেন- ‘আমি তাদের কণ্ঠস্বর শুনতে চাই’।

আর তারপর, তিনি জানালা বন্ধ করে দেন। তার লেখার স্থির পদ্ধতিগুলি, পুনর্বার যেন শব্দের ঢেউয়ের ভিতর কম্পন জাগায় না, তার কারণ, তিনি চান যে পরবর্তী বইখানা আগের চেয়ে আলাদা হয়, সম্পূর্ণরূপে। আগে যা লিখেছেন তারচেয়েও যেন আরও ভাল হয়। আর এখনও তার ভিতর এই সন্দেহটি দানা বেঁধে আছে যে আরেকটি বিশেষ মুহূর্ত আসবে হঠাৎ করেই, এক মহান উপলব্ধির জন্ম হবে। ‘আমি হয়ত মনে করতে পারব যে কী সেই তাৎপর্যময় উপলব্ধি, যা আমি অনুভব করেছিলাম। তিনি তার প্রথম বইটি লেখবার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘এটা আসলেই এক বিশেষ অনুভূতি। তবে একটি বই লেখার জন্য এমন একটি অনুভবই যথেষ্ট। আমি মনে করি, মানুষ তার জীবনকালে এরকম অনুভূতি কেবল একবারই লাভ করে। আমি হতাশাগ্রস্ত এই ভেবে যে অধিকাংশ মানুষই ব্যাপারটা বুঝতে পারেন না।’

 

উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ..

আলো ও ছায়া - শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়


এক


প্রথমেই যদি তোমরা ধরিয়া ব’স, এমন কখ্খনো হয় না, তবে ত আমি নাচার। আর যদি বল হইতেও পারে—জগতে কত কি যে ঘটে, সবই কি জানি? তা হলে এ কাহিনী পড়িয়া ফেল; আমার বিশ্বাস, তাহাতে কোন মারাত্মক ক্ষতি হইবে না। আর গল্প লিখিতে এমন কিছু প্রতিজ্ঞা করিয়া বসা হয় না যে, সবটুকু খাঁটি সত্য বলিতে হইবে। হ’লই বা দু-এক ছত্র ভুল, হ’লই বা একটু-আধটু মতভেদ—এমনই বা তাহাতে কি আসে যায়? তা নায়কের নাম হইল যজ্ঞদত্ত মুখুজ্যে—কিন্তু সুরমা বলে আলোমশাই। নায়িকার নাম ত শুনিলে, কিন্তু যজ্ঞদত্ত তাকে বলে ছায়াদেবী। দিন-কতক তাহাদের ভারী কলহ বাধিয়া গেল, কে যে আলো—কে যে ছায়া, কিছুতেই মীমাংসা হয় না; শেষে সুরমা বুঝাইয়া দিল, এটা তোমার সূক্ষ্মবুদ্ধিতে আসে না যে, তুমি না থাকিলে আমি কোথাও নাই—কিন্তু আমি না থাকিলে তুমি চিরকাল চিরজীবী; তাই তুমি আলো, আমি ছায়া।
যজ্ঞদত্ত হাসিল, এক তরফা ডিগ্রী পেতে চাও কর, কিন্তু বিচারটা কোন কাজের হ’ল না।
সুরমা। খুব হয়েছে, বেশ হয়েছে, চমৎকার হয়েছে আলোমশাই, আর ঝগড়া করতে হবে না। তুমি আলোমশাই, আমি শ্রীমতী ছায়াদেবী। বলিতে বলিতে ছায়াদেবী নানারূপে আলোমশাইকে ব্যস্ত করিয়া তুলিল।
গল্পের এতটুকু ত হ’ল। কিন্তু এইবার তোমাদের সঙ্গেই দ্বন্দ্বযুদ্ধ না বাধিয়া গেলে বাঁচি। তুমি কহিবে, ইহারা স্ত্রী-পুরুষ; আমি কহিব, স্ত্রী-পুরুষ বটে, কিন্তু স্বামী-স্ত্রী নয়। নিশ্চয় তুমি চোখ রাঙ্গাইবে, তবে কি অবৈধ প্রণয়? আমি বলিব, খুব শুদ্ধ ভালবাসা। কিছুতেই তোমরা তাহা বিশ্বাস করিবে না, মুখ ভার করিয়া জিজ্ঞাসা করিবে, কত বয়স? আমি কহিব, আলোর বয়স তেইশ, আর ছায়ার বয়স আঠার। এর পরেও যদি শুনিতে চাও, আরম্ভ করিতেছি।
যজ্ঞদত্তের ছোট করিয়া দাড়ি ছাঁটা, চোখে চশমা, মাথায় ল্যাভেন্ডারের গন্ধ, পরনে কুঞ্চিত ঢাকাই কাপড়, সার্টে এসেন্স মাখান, পায়ে মখমলের কাজ-করা শ্লিপার—ছায়া স্বহস্তে ফুল তুলিয়া দিয়াছে। লাইব্রেরিতে এক-ঘর পুস্তক, বাটীতে বিস্তর দাসদাসী। টেবিলের ধারে বসিয়া যজ্ঞদত্ত পত্র লিখিতেছিল। সম্মুখে মস্ত মুকুর। পর্দা সরাইয়া ছায়াদেবী সাবধানে প্রবেশ করিল।

ইচ্ছা, চুপি চুপি চোখ টিপিয়া ধরে; পিঠের কাছে আসিয়া হাত বাড়াইতে গিয়া সম্মুখে দর্পণে নজর পড়িল। দেখিল, যজ্ঞদত্ত তাহার মুখপানে চাহিয়া মুখ টিপিয়া হাসিতেছে। সুরমাও হাসিয়া ফেলিল; বলিল, কেন দেখে ফেললে?
যজ্ঞ। সেটা কি আমার দোষ?
সুরমা। তবে কার?
যজ্ঞ। অর্ধেকটা তোমার, আর অর্ধেকটা ঐ আরশিখানার।
সুরমা। এখনই আমি ওটা ঢেকে দেব।
যজ্ঞ। তা দিও, কিন্তু বাকীটার কি হবে?
সুরমা বার-দুই নড়িয়া চড়িয়া কহিল, আলোমশাই!
যজ্ঞ। কেন ছায়াদেবী?
সুরমা। তুমি রোগা হয়ে যাচ্চ কেন?
যজ্ঞ। তা ত আমার বিশ্বাস হয় না।
সুরমা। তুমি খাও না কেন?
যজ্ঞদত্ত হাসিয়া উঠিল—সুরো, কোন্দল করতে এসেচ?
সুরমা। হুঁ।
যজ্ঞ। আমি তাতে রাজী নই।
সুরমা। তুমি বিয়ে করবে না কেন?
যজ্ঞ। সে জবাব ত রোজই একবার করে দিয়ে এসেচি!
সুরমা। না, করতেই হবে।
যজ্ঞ। সুরো, তুমি একটি বিয়ে কর না কেন?
সুরমা যজ্ঞদত্তের হাত হইতে পত্রখানি কাড়িয়া লইয়া কহিল, ছিঃ, বিধবার কি বিয়ে হয়?
যজ্ঞদত্ত খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, কে জানে? কেউ বলে হয়, কেউ বলে হয় না।
সুরমা। তবে আমাকে এ নিমিত্তের ভাগী করবার চেষ্টা কেন?
যজ্ঞদত্ত দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া কহিল, তবে কি চিরকাল শুধু আমারই সেবা করে কাটাবে?
হুঁ, বলিয়া সে ঝরঝর করিয়া কাঁদিয়া ফেলিল।
যজ্ঞদত্ত অশ্রু মুছাইয়া দিয়া কহিল, সুরো, কি তোমার মনের সাধ, আমাকে খুলে বলবে না?
সুরমা। আমাকে বৃন্দাবনে পাঠিয়ে দাও।
যজ্ঞ। আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে?
সুরমার মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না—দক্ষিণে ও বামে বার-দুই মাথা নাড়িতে গিয়া চোখের জল উৎসের মত ছুটিয়া বাহির হইয়া পড়িল।
দুই
সুরমা। যজ্ঞদাদা, সেই গল্পটা আবার বল না!
যজ্ঞ। কোন্‌টা সুরো?
সুরমা। সেই যে আমাকে যবে বৃন্দাবনে কিনেছিলে। কত টাকায় কিনেছিলে গো?
যজ্ঞ। পঞ্চাশ টাকায়। আমার তখন আঠার বছর বয়স। বি. এ. এক্‌জামিন দিয়ে পশ্চিমে বেড়াতে যাই। মা তখন বেঁচে, তিনিও সঙ্গে ছিলেন। একদিন দুপুরবেলায় মালতী-কুঞ্জের ধারে একদল বৈষ্ণবী গান গাইতে আসে, তারই মধ্যে প্রথম তোমাকে দেখতে পাই।
যৌবনের প্রথম ধাপটিতে পা দিয়ে জগৎটাকে এমন সুশ্রী দেখতে হয় যে, শুধু নিজের দুটি চোখে সে মাধুর্য সবটুকু উপভোগ করতে পারা যায় না; সাধ হয়, মনের মতন আর দুটি চোখ এমনি করে একসাথে এমনি শোভা সম্ভোগ করতে পারে যদি তাকে বুঝিয়ে বলতে পারি—ও কি সুরমা, কাঁদচ যে?
সুরমা। না—তুমি বল।
যজ্ঞ। তুমি তখন তের বছরের নবীন বৈষ্ণবী, হাতে মন্দিরা, গান গাইছিলে।
সুরমা। যাও—আমি বুঝি গান গাইতে পারি?
যজ্ঞ। তখন ত পারতে, তার পর অনেক পরিশ্রমে তোমাকে পাই, তুমি ব্রাহ্মণের মেয়ে, বালবিধবা। মা তোমার তীর্থে এসে আর ফিরে যেতে পারেন নি—স্বর্গে গিয়েচেন। আমার মার কাছে তোমায় এনে দিই, তিনি বুকে তুলে নিলেন—তার পর মৃত্যুকালে আবার আমাকেই ফিরিয়ে দিয়ে গেলেন।
সুরমা। যজ্ঞদাদা, আমার বাড়ি কোথায়?
যজ্ঞ। শুনেছি, কৃষ্ণনগরের কাছে।
সুরমা। আমার আর কেউ নেই?
যজ্ঞ। আমি আছি, তাই যে তোমার সব, সুরমা।
সুরমার চক্ষু আবার জলে ভিজিয়া আসিল, কহিল, তুমি আমাকে আবার বেচতে পার?
যজ্ঞ। না, তা পারি না। নিজেকে না বেচে ফেললে ওটি কিছুতেই হতে পারে না।
সুরমা কথা কহিল না, তেমনিভাবে সজল-নয়নে তাহার পানে চাহিয়া রহিল। বহুক্ষণ পরে ধীরে ধীরে কহিল, তুমি দাদা, আমি ছোট বোন—আমাদের দু’জনার মাঝখানে একটি বৌ আন না দাদা!
যজ্ঞ। কেন বল দেখি?

সুরমা। সমস্ত দিন ধরে সাজিয়ে গুজিয়ে তাকে আমি তোমার কাছে বসিয়ে রাখব।
যজ্ঞ। তা কি প্রাণ ধরে পারবে?
সুরমা মুখ তুলিয়া চোখের উপর চোখ পাতিয়া কহিল, আমি কি তেমনি অধম যে হিংসা করব?
যজ্ঞ। হিংসা নাই করলে, কিন্তু নিজের স্থানটি বিলিয়ে দেবে?
সুরমা। বিলিয়ে কেন দিতে যাব! আমি রাজা, রাজাই থাকব, শুধু একটি মন্ত্রী বাহাল করব, দু’জনে মিলে তোমার রাজ্যটা চালাতে আমোদ হবে।
যজ্ঞ। দেখ ছায়া, বিবাহে প্রবৃত্তি নেই, কিন্তু তোমার যদি একজন সাথীর বড় প্রয়োজন হয়ে থাকে ত বিবাহ করব।
সুরমা। হাঁ, নিশ্চয় কর, খুব আমোদ হবে; দু’জনে খুব মনের সুখে দিন কাটাব। মনে মনে কহিল, তিন কুলে আমার কেউ নাই, আমার মান-অপমান তাও নাই, কিন্তু তুমি কেন আমাকে নিয়ে বিশ্বের কলঙ্ক কুড়াবে? দেবতা আমার! তুমি বিবাহ কর, তোমার মুখ চেয়ে আমার সব সইবে।
তিন
কলিকাতায় প্রতিবাসীর খবর অনেকে রাখে না। অনেকে আবার খুব রাখে। যাহারা রাখে তাহারা বলে, যজ্ঞদত্ত এম. এ. পাস করুক, কিন্তু বয়াটে ছেলে। ইশারায় তাহারা সুরমার কথাটা
উল্লেখ করে। সুরমা ও যজ্ঞদত্ত মাঝে মাঝে তাহা শুনিতে পায়। শুনিয়া দুইজনে হাসিতে থাকে।
কিন্তু তুমি ভাল হও আর মন্দ হও, বড়মানুষ হইলে তোমার বাড়িতে লোক আসিবেই, বিশেষ মেয়েমানুষ। কেহ বা বলে, সুরমা, তোমার দাদার বিয়ে দাও না?

সুরমা। দাও না দিদি, একটি ভাল মেয়ে খুঁজে-পেতে।
যে সুরমার সখী সে হাসিয়া ফেলে—তাইত, ভাল মেয়ে মেলা শক্ত, তোমার রূপে যার চোখ ভরে আছে, —তার—
দূর, পোড়ারমুখী! বলিতে বলিতে কিন্তু সুরমার সমস্ত মুখমন্ডল স্নেহ ও গর্বে রঞ্জিত হয়ে উঠে।
সেদিন দুপুরবেলা ঝুপঝাপ করিয়া বৃষ্টি পড়িতেছিল, সুরমা ঘরে প্রবেশ করিয়া বলিয়া উঠিল, একটি মেয়ে পছন্দ করে এলাম।
যজ্ঞদত্ত। আঃ একটা দুর্ভাবনা গেল। কোথায় বল দেখি?
সুরমা। ও-পাড়ার মিত্তিরদের বাড়ি।
যজ্ঞদত্ত। বামুন হয়ে কায়েতের ঘরে?
সুরমা। কায়েতের ঘরে কি বামুন থাকতে নেই? তার মা ও-বাড়িতে রেঁধে খেতো, মেয়েটি শুনেচি ভাল; দেখে এসে যদি মনে ধরে ত ঘরে আন।
যজ্ঞদত্ত। আমি কি এমনি হতভাগা যে, রাজ্যের ভিখিরি ছাড়া আমার অন্ন জুটবে না!
সুরমা। ভিখিরি কুড়িয়ে আনা কি তোমার নূতন কাজ?
যজ্ঞদত্ত। আবার!
সুরমা। না যাও, দেখে এস। মনে ধরে ত না ব’ল না।
যজ্ঞদত্ত। মনে কিছুতেই ধরবে না।
সুরমা। ধরবে গো ধরবে—একবার দেখেই এস না।
ছায়াদেবী তখন আলোমশাইকে এমন সাজাইয়া দিল, এত গন্ধ লাগাইয়া মাজিয়া ঘষিয়া চুল আঁচড়াইয়া দিয়া এমনিভাবে আরশির সম্মুখে দাঁড় করাইয়া দিল যে, যজ্ঞদত্তের লজ্জা করিত লাগিল। ছিঃ, এ যে বড় বাড়াবাড়ি হয়ে গেল।
সুরমা। তা হোক, দেখে এস।
গাড়ি করিয়া যজ্ঞদত্ত মেয়ে দেখিতে গেল। পথে একজন বন্ধুকেও তুলিয়া লইল। চল, মিত্তির বাড়িতে জলযোগ করে আসি।
বন্ধু। তার মানে?
যজ্ঞদত্ত। সে বাড়িতে একটা ভিখিরি মেয়ে আছে। তাকে বিয়ে করতে হবে।
বন্ধু। বল কি, এমন প্রবৃত্তি কে দিলে?
যজ্ঞদত্ত। তোমরা যার হিংসেয় মরে যাও তিনিই, সেই ছায়াদেবী।
যজ্ঞদত্ত বন্ধুকে লইয়া মেয়ে দেখিতে ঘরে ঢুকিলেন। মেয়ে কার্পেটের আসনের উপর বসিয়া, পরনে দেশী কাপড়, কিন্তু অনেক ধোপপড়া সূতাগুলা মাঝে মাঝে জালের মত হইয়া গিয়াছে। হাতে বেলোয়ারি চুড়ি এবং একজোড়া পাক দেওয়া তামার মত রংয়ের সোনার বালা—মাঝে মাঝে এক-এক জায়গায় ভিতরের গালাটা দেখা যাইতেছে। মাথায় এত তেল যে কপালটা পর্যন্ত চকচক করিতেছে, ব্রহ্মতালুর উপর শক্ত খোঁপাটা কাঠের মত উঁচু হইয়া আছে। দুই বন্ধুতে মুখ টিপিয়া হাসিয়া ফেলিলেন। হাসি চাপিয়া মেয়েটির দিকে চাহিয়া যজ্ঞদত্ত কহিল, কি নাম তোমার?
মেয়েটি বড় বড় কালো চোখ দুটো শান্তভাবে তাহার মুখের প্রতি রাখিয়া কহিল, প্রতুল।
যজ্ঞদত্ত বন্ধুর গা টিপিয়া মৃদু হাসিয়া কহিল, ওহে, গদাধর নয় ত?
বন্ধু ঈষৎ ঠেলিয়া দিয়া কহিল, জ্যাঠামি করো না, তাড়াতাড়ি পছন্দ করে নাও।
হাঁ, এই নিই—
বেশ—বেশ, কি পড়?
কিছু না।
আরো ভালো।
কাজ-কর্ম করতে জান?
প্রতুল মাথা নাড়িল—নিকটে একজন ঝি দাঁড়াইয়াছিল, সে ব্যাখ্যা করিয়া দিল—ভারী কর্মী মেয়ে বাবু, রাঁধা-বাড়া সংসারের কাজ-কর্মে মায়ের হাত পেয়েচে। আর, মুখে কথাটি নেই—ভারী শান্ত।
তা বুঝেছি।
তোমার বাপ বেঁচে নেই?
না।
মাও মরে গেছেন?
হাঁ।
যজ্ঞদত্ত দেখিল, এই হাবা মেয়েটার চোখে জল আসিয়া পড়িয়াছে।—তোমার কি কেউ নেই?
না।
আমার বাড়ি যাবে?
সে ঘাড় নাড়িল, হুঁ। এই সময় জানালার দিকে নজর পড়ায় সে দেখিল খড়খড়ির ফাঁক দিয়া দুটো কালো চোখ যেন অগ্নিবর্ষণ করিতেছে, ভয় পাইয়া সে বলিল, না।
বাহিরে আসিয়া মিত্তিরমহাশয়ের সাক্ষাৎলাভ।
কেমন দেখলেন?
বেশ।
বিবাহের তবে দিন স্থির হোক।
হোক।
চার

বার-তের বৎসরের বালকের হাত হইতে কোন নির্দয় রসহীন অভিভাবক তাহার অর্ধ-পঠিত কৌতুকপূর্ণ নভেলটা টানিয়া লুকাইয়া রাখিয়া দিলে তাহার যেমন অবস্থা হয়, ভিতরের প্রাণটা ব্যাকুলভাবে সেই শুষ্কমুখ শঙ্কিত বালককে এ-ঘর ও-ঘর ছুটাইয়া লইয়া বেড়ায়, ভয়ে ভয়ে তীব্র চক্ষু দুটি শুধু যেমন সেই প্রিয় পদার্থটিকে আবিষ্কার করিবার জন্য ব্যস্ত এবং বিরক্ত হইয়া থাকে, আর সর্বদাই যেন কাহার উপর রাগ করিতে ইচ্ছা করে, তেমনিভাবে সুরমা যজ্ঞদত্তের জন্য ছটফট করিতে লাগিল। কি যেন কি একটা খুঁজিয়া বাহির করিবে। চেয়ার, বেঞ্চ, সোফা, শয্যা, ঘর, বারান্দা—সবগুলার উপরেই সে বিরক্ত হইয়া উঠিল। রাস্তার দিকের একটা জানালাও তাহার পছন্দ হইল না, একবার এটাতে, একবার ওটাতে বসিতে লাগিল। যজ্ঞদত্ত ঘরে ঢুকিলেন।
কি হ’ল আলোমশাই? আলোমহাশয়ের মুখ গম্ভীর।
সুরমা। পছন্দ হল?
যজ্ঞ। হ’ল।
সুরমা। কবে বিয়ে?
যজ্ঞ। বোধ হয় এই মাসেই।
নিরানন্দ উৎসাহে সুরমা কাছে আসিল, কিন্তু কোনরূপ উপদ্রব করিল না—আমার মাথা খাও, সত্যি বল।
কি বিপদ, সত্যিই ত বলচি!
আমার মরামুখ দেখ—বল, পছন্দ হয়েছে?
হাঁ।
হঠাৎ যেন সুরমা আর কোন কথা খুঁজিয়া পাইল না। বালক-বালিকারা ধমক খাইয়া কাঁদিবার পূর্বে যেমন এদিক-ওদিক ঘাড় নাড়িয়া একটা অর্থহীন কথা বলিয়া ফেলে, সুরমা তেমনি ছেলেমানুষটির মত মাথা হেলাইয়া গাঢ়স্বরে কহিল, তবে বলেছিলাম ত—
যজ্ঞদত্ত নিজের ভাবনায় ব্যস্ত ছিল, তাই বুঝিতে পারিল না যে, এ কথার একেবারে কোন অর্থই নাই; কেননা, প্রথমতঃ ‘পছন্দই হবে’ এমন কথা সুরমা কোনকালে উচ্চারণ করে নাই। দ্বিতীয়তঃ, সে নিজেও মেয়ে দেখে নাই বরং এমনটি সে মোটেই আশা করে না যে, এত অল্পে পছন্দ হইবে, এবং এত শীঘ্র সম্বন্ধ পাকা হইবে। তাই সে সমস্ত দিনটা নিজের ঘরে বসিয়া এই কথা তোলাপাড়া করিতে লাগিল।

দু’দিন পরে কিন্তু যজ্ঞদত্ত অনেক কথা বুঝিতে পারিল, কহিল, সুরো, এ বিয়ে দিও না দিদি।
সুরমা। বাঃ তা কি হয়? সব যে স্থির হয়ে গেছে।
যজ্ঞ। স্থির কিছুই নয়।
সুরমা। না, তা হতে পারে না, দুঃখীর মেয়েকে সুখী করবে এটাও ভেবে দেখ, বিশেষ কথা দিয়ে ফেরাবে?
যজ্ঞদত্তের প্রতুলকুমারীর মুখ মনে পড়িল, সহিষ্ণুতা ও শান্তভাবের নিগূঢ় ছায়া যেন সেদিন তাহার কালো চোখ দুটিতে সে দেখিতে পাইয়াছিল—তাই সে চুপ করিয়া রহিল, তবু যজ্ঞদত্ত অনেক কথা ভাবিতে লাগিল। সুরমার কথাই বেশী ভাবিল। বর্ষার দিনে বাদলপোকাগুলা হঠাৎ যেমন ঘর ভরিয়া দেয় তেমন তাহার মনটা যেন অস্বস্তিতে ভরিয়া উঠিল, কিন্তু তাহাদিগের নিভৃত বাসগহ্বরটা যেমন কিছুতেই খুঁজিয়া বাহির করা যায় না, তেমনি সুরমার মুখের কথাগুলো কোন্‌ গুপ্ত আকাঙ্ক্ষার ভিতর দিয়া দলে দলে বাহির হইতে লাগিল, সেইটাই খুঁজিয়া পাইল না। চোখে তার এমনি ঝাপসা জাল লাগিয়া রহিল যে, কোনক্রমেই সুরমার মুখখানি সুস্পষ্ট দেখিতে পাইল না।
পাঁচ

বিবাহ করিয়া যজ্ঞদত্ত বধূ ঘরে আনিল।বিকারগ্রস্ত রোগী ঘরে লোক না থাকিলে যেমন সমস্ত শক্তি এক করিয়া জলের ঘড়াটার পানে ছুটিয়া গিয়া আঁকড়াইয়া ধরে, সুরমা তেমনি করিয়া নূতন বধূকে আলিঙ্গন করিল। নিজের যতগুলি গহনা ছিল পরাইয়া দিল, যতগুলি বস্ত্র ছিল সমস্ত তাহার বাক্সে ভরিয়া দিল। শুষ্কমুখে সমস্ত দিন ধরিয়া বধূ সাজাইবার ধুম দেখিয়া যজ্ঞদত্ত মুখ চুন করিয়া রহিল। গাঢ় স্বপ্নটা সহ্য হয়—কেননা, অসহ্য হইলেই ঘুম ভাঙ্গিয়া যায়, কিন্তু জাগিয়া স্বপ্ন দেখাটায় যেন দম আটকাইতে থাকে, কিছুতেই সেটা শেষও হয় না—ঘুমও ভাঙ্গে না। মনে হয় একটা স্বপ্ন, মনে হয় এটা সত্য, ‘আলো ও ছায়া’র দু’জনেরই এই ভাবটা আসিতে লাগিল। একদিন ঘরে ডাকিয়া যজ্ঞদত্ত কহিল, ছায়াদেবী!
কি যজ্ঞদাদা?
আলোমশাই বললে না?
মুখ নত করিয়া সুরমা কহিল, আলোমশাই!
যজ্ঞদত্ত দুই হাত বাড়াইয়া কহিল, অনেকদিন কাছে এস নাই—এস।
সুরমা একবার মুখপানে চাহিয়া দেখিল; পরক্ষণেই বলিয়া উঠিল, বাঃ, আমি ত খুব! বৌকে একলা ফেলে এসেছি। বলিতে বলিতে সে ছুটিয়া পলাইয়া গেল।
রাগের মাথায় যদি হঠাৎ কোন অপরিচিত ভদ্রলোকের গালে চড় মারা যায়, আর সে যদি শান্তভাবে ক্ষমা করিয়া চলিয়া যায়, তাহা হইলে মনটা যেমন খারাপ হইয়া থাকে, তেমনি ক্ষমাপ্রাপ্ত অপরাধীর মত তাহারও মনটা ক্রমাগত দমিয়া পড়িতে লাগিল। কেবলি মন হয়, সে অপরাধ করিয়াছে আর সুরমা প্রাণপণে ক্ষমা করিতেছে।
সুরমা সর্বাভরণা নববধূকে জোর করিয়া তাহার পার্শ্বে বসাইয়া দেয়। সন্ধ্যা হইলেই বাহির হইতে কট্‌ করিয়া তালা বন্ধ করিয়া দেয়। গালে হাত দিয়া যজ্ঞদত্ত ভাবিতে থাকে। বৌও কতক বুঝিতে পারে; সে সেয়ানা মেয়ে নয়, তবুও ত সে নারী; সাধারণ স্ত্রীবুদ্ধিটুকু হইতে ভগবান কাহাকেও বঞ্চিত করেন না। সেও সারা রাত্রি জাগিয়া থাকে। আজ আট দিনও বিবাহ হয় নাই, এরি মধ্যে যজ্ঞদত্ত একদিন প্রত্যূষে সুরমাকে ডাকিয়া কহিল, সুরো, বর্ধমানে পিসীমাকে বৌ দেখিয়ে আনি।
দামোদর-পারে পিসীমার বাড়ি। সেখানে পৌঁছাইয়া যজ্ঞদত্ত কহিল, পিসীমা, বৌ এনেচি, দেখ।
পিসীমা। ওমা, বিয়ে করেছিস বুঝি, আহা বেঁচে থাক। দিব্যি চাঁদপানা বৌ, এইবার মানুষের মত ঘর-সংসার কর্‌।

যজ্ঞ। সেই জন্যেই ত সুরো জোর করে বিয়ে দিলে।
পিসিমা। সুরো বুঝি বিয়ে দিয়েচে?
যজ্ঞ। সেই ত দিলে, কিন্তু কপাল মন্দ—বৌ নিয়ে ঘর করা চলে না।
পিসীমা। কেন রে?
যজ্ঞ। জানো ত পিসীমা, আমার নর-গণ, বৌয়ের হ’ল রাক্ষস-গণ। একসঙ্গে থাকলে গণৎকার বলে—বাঁচি না বাঁচি।
পিসীমা। ষাট ষাট, সে কথা—
যজ্ঞ। তখন তাড়াতাড়ি এসব দেখা হয়নি, এখন ত তোমার কাছে থাকবে, মাসে পঞ্চাশ টাকা পাঠাব, তাতে চলবে না পিসীমা?
পিসীমা। হ্যাঁ তা চলে যাবে। পাড়াগাঁয়ে বিশেষ কষ্ট হবে না। আহা, চাঁদের মত মেয়ে, ডাগর হয়েচে, হাঁরে যজ্ঞ, একটা শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করলে হয় না?
যজ্ঞ। হতে পারে। আমি ভট্টাচার্যের মত নিয়ে যা ভাল হয় তোমাকে জানাব।
পিসীমা। তা জানাস বাছা।
সন্ধ্যার সময় বৌকে কাছে ডাকিয়া যজ্ঞদত্ত কহিল, তবে তুমি এখানেই থাক।
সে ঘাড় নাড়িয়া বলিল, আচ্ছা।
যা তোমার দরকার হবে আমাকে জানিয়ো।
আচ্ছা।
তুমি চিঠি লিখতে জান?
না।
তবে কি করে জানাবে?
নববধূ গৃহপালিতা হরিণীর মত চক্ষু দুইটি স্বামীর মুখের উপর রাখিয়া চুপ করিয়া রহিল। যজ্ঞদত্তও মুখ ফিরাইয়া চলিয়া গেল।
পিসীমার বাটীতে বৌ ভোরে উঠিয়া কাজ করিতে লাগিল। বসিয়া থাকিতে সে শিখে নাই, নূতন লোক হইলেও সে পরিচিতের মত ঘরকন্নার কাজ করিতে শুরু করিল। দুই-চার দিনেই পিসীমা বুঝিলেন, এমন মেয়ে সবাই গর্ভে ধরে না।
বৌয়ের অনেক গহনা, পাড়াসুদ্ধ ঝেঁটিয়ে লোক তা দেখতে আসে।
কে দিয়েচে গা? তোমার বাপ?
না, বাপ-মা আমার নাই, ঠাকুরঝি দিয়েচেন।
দু-একজন সমবয়সীর সহিত ভাব হইলে তাহারা খুঁটিয়া খুঁটিয়া কথা বাহির করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। তোমার ঠাকুরঝি বুঝি খুব বড়লোক?
হ্যাঁ।
সব গহনা তারি?
সব। তাঁর দরকার নেই, তিনি বিধবা, এ-সব পরেন না।

কত বয়স বৌ?
আমাদের চেয়ে কিছু বড়। তিনি জোর করে আমার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন।
তোমার বর বুঝি তাঁর খুব অনুগত?
হ্যাঁ, তিনি সতীলক্ষ্মী, সবাই তাঁকে ভালবাসে।

 

ছয়

উপরের জানালা হইতে সুরমা দেখিল, যজ্ঞদত্ত বাড়ি ফিরিয়া আসিল, কিন্তু সঙ্গে বৌ নাই। ঘরে প্রবেশ করিলে কহিল, যজ্ঞদাদা, বৌকে কোথায় রেখে এলে?
পিসীর বাড়ি।
সঙ্গে আনলে না কেন?
থাক, কিছুদিন পরে আনলেই হবে।
কথাটা সুরমার বুকে বিঁধিল। দুইজনেই চুপ করিয়া রহিল। প্রিয়জনের সহিত তর্ক করিতে গিয়া হঠাৎ বচসা হইয়া গেলে যেমন দুইজনেই কিছুক্ষণ ক্ষুণ্ণমনে চুপ করিয়া বসিয়া থাকে, এ দুইজনও কিছুদিন তেমনি চুপচাপ দিন কাটাইতে লাগিল। সুরমা কহে, নেয়ে খেয়ে নাও, অনেক বেলা হল। যজ্ঞদত্ত বলে, হাঁ এই যাই, এমনি করিয়াও কিছুদিন কাটিল। একসঙ্গে ঘর করিতে গিয়া চিরদিন এভাবে চলে না, তাই আবার মিল হইতে লাগিল। যজ্ঞদত্ত আবার আদর করিয়া ডাকিতে লাগিলেন—ও ছায়াদেবী! ছায়া কিন্তু আর আলোমশাই বলে না—যজ্ঞদাদা বলে, কখনও বা শুধু দাদা বলিয়াই ডাকে।
সুরমা একদিন কহিল, দাদা, প্রায় তিনমাস হতে চলল, এইবার বৌকে আনো। যজ্ঞদত্ত কাটাইয়া দেয়, হাঁ তা হবে এখন।
মনের ভাব বুঝিয়া সুরমা চুপ করিয়া থাকে।
পিসীর পত্র মাঝে মাঝে আসে। পিসী লেখেন, বৌয়ের ম্যালেরিয়া জ্বর হইতেছে, চিকিৎসা হওয়া প্রয়োজন। মনের ভাব বুঝিয়া যজ্ঞদত্ত কতকগুলো টাকা বেশী করিয়া পাঠাইয়া দেয়। আর মাস-খানেক কোন কথা উঠে না।
এমন সময় একদিন হঠাৎ চিঠি আসিল যে, পিসী মরিয়া গিয়াছে। যজ্ঞদত্ত বর্ধমানে চলিয়া গেল। যাইবার সময় সুরমা মাথার দিব্য দিয়া বলিয়া দিল, বৌকে নিয়ে এস।
বর্ধমানে পিসীর শ্রাদ্ধশান্তি হইয়া গেলে একদিন দুপুরবেলা যজ্ঞদত্ত বারান্দায় দাঁড়াইয়া বাড়ি যাইবার কথা ভাবিতেছিল। উঠানে একটা ধানের মরাইয়ের পাশে, নতুন বৌ দাঁড়াইয়া, চোখে পড়িল। চোখাচোখি হইবামাত্র সে হাত দিয়া ইশারা করিয়া ডাকিল।
যজ্ঞদত্তও স্ত্রীর নিকটে পৌঁছিল।
কি?
আপনাকে কিছু বলব।
বেশ ত বল।
নতুন বৌ ঢোক গিলিয়া কহিল, একদিন আপনি বলেছিলেন যদি আমার কোন দরকার হয়—
যজ্ঞদত্ত। বেশ ত, কি দরকার বল?
বৌ। বাড়িতে সবাই বলাবলি কচ্ছিলেন, আমি বড় অলক্ষণা, তাই এখানে আর থাকতে ইচ্ছে করে না।

যজ্ঞদত্ত। কোথায় থাকতে চাও?
বৌ। কলকাতায় যদি কোন ভদ্র-পরিবারে স্থান পাই—আমি ত সব কাজ কত্তে পারি।
যজ্ঞদত্ত। তোমার নিজের বাড়িতে যাবে?
বৌ। আমার নিজের বাড়ি? সে আবার কোথা? তাঁরা কি আর থাকতে দেবেন?
যজ্ঞদত্ত হাত দিয়া স্ত্রীর মুখ তুলিয়া ধরিয়া কহিল, আমার বাড়িতে যাবে?
বৌ। যাব।
যজ্ঞদত্ত। সুরমা তোমার জন্য বড় ব্যস্ত হয়েছে।
সুরমার কথায় তাহার মুখ প্রফুল্ল হইয়া উঠিল,—ঠাকুরঝি আমায় মনে করেন?
যজ্ঞদত্ত। করেন বৈ কি।
বৌ। তবে নিয়ে চলুন।
জগতে একরকমের লোক আছে, তাহারা পরের সম্বন্ধে মতামত প্রকাশ করিবার বুদ্ধি কিছুতেই খুঁজিয়া পায় না, কিন্তু এমন একটা সহজ বুদ্ধি রাখে যে, তাহার উপর নির্ভর করিয়া নিজের সম্বন্ধে অপরের পরামর্শ মোটেই প্রয়োজন বোধ করে না। নূতন বৌটি এই শ্রেণীর। সে নিজের কথা নিজেই ভাবে—পরকে জিজ্ঞাসা করে না। ভাবিয়া কহিল, আপনাদের অকল্যাণ করবার বড় ভয় আমার, কিন্তু থাকি বা কোথায়? না হয়, আমি নীচেই থাকব, সব কাজকর্ম করতে নীচে থাকাই সুবিধের।
যজ্ঞ। উপরে কি তোমার থাকবার ঘর নেই?
বৌ। আছে, কিন্তু নীচের ঘরেই বেশ থাকবো।
যজ্ঞদত্ত আর কোন কথা কহিল না। ভাবিতে লাগিল যে, খুব বোকার মত ত এ কথাগুলো নয় এবং কয়েকবার মনে করিল, বলিয়া ফেলে যে সে অলক্ষণা নহে, রাক্ষসগণ প্রভৃতি মিথ্যা কথা। কিন্তু মিথ্যা কথার কারণটি কি, তা কি করিয়া বলা যায়! বিশেষ বাড়ি গিয়া সে তাহার অতীত এবং ভবিষ্যৎ ব্যবহারে যে বেশ মিল করিয়া তুলিতে পারিবে, সে ভরসাও মনে করিতে পারিল না।

 

সাত

সুরমা দেখিল বৌ আসিয়াছে। উগ্র নেশার প্রথম ঝোঁকটা কাটাইয়া দিয়া সে স্থির হইয়াছে। তাই বৌ দেখিতে বাড়াবাড়ি করিল না। শান্ত ধীরভাবে প্রিয়সম্ভাষণ করিল, মৌখিক নহে, অন্তরগত মঙ্গলেচ্ছা তাহার শুষ্ক মুখের উপর জ্যোতি ফিরাইয়া আনিল।
বৌ, কৈ ভাল ছিলে না ত?
বৌ মাথা নাড়িয়া কহিল, মাঝে মাঝে জ্বর হ’ত।
সুরমা তাহার কপালের ঘাম মুছাইয়া বলিল, এখানে চিকিৎসা হলেই সব ভাল হয়ে যাবে।
দুপুরবেলা সুরমা সংবাদ পাইল যে, বৌয়ের জন্য নীচে ঘর পরিষ্কার হইতেছে। অপমানে তাঁহার চোখে জল আসিল। সংবরণ করিয়া যজ্ঞদত্তের কাছে গিয়া বলিল, দাদা, বৌ কি নীচে শোবে? তুমি কিছু বলবে না?
আর কি বলব? যার যা খুশি তা করুক।
সুরমা লজ্জা ও ধিক্কারে আপনাকে শাসন করিতে পারিল না, সম্মুখেই কাঁদিয়া পলাইয়া গেল। উপরের গোলযোগটা কিন্তু নীচে পৌঁছিল না।
নূতন বৌ নূতন করিয়া সংসারের কাজকর্ম লইয়া ব্যস্ত হইয়া পড়িল। ক্রমে ক্রমে ধীরে ধীরে সে সুরমার সব কাজগুলি নিজের হাতে তুলিয়া লইল। শুধু উপরে যায় না—স্বামীর সহিত দেখা করে না। ক্রমে সুরমাও উপর ছাড়িয়া দিল। বৌ প্রফুল্ল গম্ভীরমুখে কাজ করিত, সুরমা পাশে বসিয়া থাকিত। একজন দেখাইত কর্ম করিয়া কত সুখ, অপর বুঝিত কর্মস্রোতে অনেক দুঃখ ভাসাইয়া দিতে পারা যায়। দু’জনের কেহই বেশী কথা কহে না, তাহাদের সহানুভূতি ক্রমে গাঢ়তর হইয়া আসিতে লাগিল।
মাঝে মাঝে নূতন বধূর প্রায় জ্বর হয়, দুই-চারিদিন উপবাস থাকিয়া আপনি সারিয়া ওঠে। ঔষধে প্রবৃত্তি নাই, ঔষধ খায় না। সে-সময়ের কাজকর্মগুলা দাসদাসীতেই করে; সুরমা পারিয়া উঠে না, ইচ্ছা থাকিলেও সামর্থ্যে কুলায় না। সোনার প্রতিমা সুরমা দেবীর এখন সে রং নাই, সে কান্তি নাই, অত লাবণ্য দুই মাসের মধ্যে কোথায় উড়িয়া গিয়াছে। বৌ মাঝে মাঝে বলে, ঠাকুরঝি, তুমি দিন দিন এমন হয়ে যাচ্ছ কেন?

আমি? আচ্ছা বৌ, শরীরটা ভাল করবার জন্যে আমি যদি বিদেশে যাই, তোমার কষ্ট হবে না ত?
হবে বৈ কি।
তবে যাব না?
না ঠাকুরঝি, যেয়ো না, তুমি ঔষধ খেয়ে এখানেই ভাল হও।
সুরমা স্নেহভরে তাহার ললাট চুম্বন করিল।
একদিন সুরমা যজ্ঞদত্তের খাবার সাজাইতেছিল। যজ্ঞদত্ত তাহার মলিন কৃশ মুখখানি সতৃষ্ণ চক্ষে দেখিতেছিল। সুরমা মুখ তুলিলে, সে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিল, মনে হয় মলেই বাঁচি!
কেন? বলিতেই সুরমার চক্ষে জল আসিল। ভয় হয় আর কতদিন এ প্রাণটাকে বয়ে বেড়াতে হবে। বন্দুকের গুলি খাইয়া বনের পশু যেমন মাটি ছাড়িয়া আকাশে পলাইবার জন্য প্রাণপণে লাফাইয়া উঠে, কিন্তু আকাশ তাহার কেহ নয়, তাই সেই আশ্রয়শূন্য মরণাহত জীব শেষে চিরদিনের আশ্রয় পৃথিবীকেই জড়াইয়া ধরিয়া প্রাণত্যাগ করে, তেমনি ছটফট করিয়া সুরমা প্রথমে আকাশ পানে চাহিয়া দেখিল, তার পর তেমনি করিয়া ভূলুন্ঠিত হইয়া কাঁদিতে লাগিল, যজ্ঞদাদা, আমাকে ক্ষমা কর, আমি তোমার শত্রু, আমাকে আর কোথাও পাঠিয়ে দিয়ে, তুমি সুখী হও।
তখনি হয়ত দাসী আসিয়া পড়িবে, যজ্ঞদত্ত হাত ধরিয়া তাহাকে তুলিয়া ধরিল। সস্নেহে অশ্রু মুছাইয়া কহিল, ছিঃ, ছেলেমানুষি ক’র না।
অশ্রু মুছিতে মুছিতে সুরমা তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়া দ্বার রুদ্ধ করিয়া দিল।
আট

তার পরে একদিন সুরমা বৌকে টানিয়া কাছে লইয়া কহিল, বৌ, দাদা কি তোমাকে কখন কিছু বলেচেন?
বৌ সহজভাবে উত্তর দিল, কি আবার বলবেন?
তবে তুমি কখন তাঁর কাছে যাও না কেন? তোমার কি যেতে ইচ্ছা করে না?
বৌয়ের প্রথমটা লজ্জা করিতে লাগিল, পরে মুখ নত করিয়া কহিল, করে দিদি, কিন্তু যাবার ত জো নেই!
কেন বৌ?
তোমার কি মনে নেই?
কৈ না।
ওঃ, তুমি বুঝি ভুলে গেছ ঠাকুরঝি, আমার যে রাক্ষস-গণ, ওঁর নর-গণ।
কে বলেচে?
উনিই পিসীমাকে বলেছিলেন, তাইতে—
সুরমা শিহরিয়া উঠিল—এ যে মিছে কথা বৌ।
মিছে কথা?
চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া সে সুরমার মুখপানে চাহিয়া রহিল। সুরমা বার বার শিহরিয়া উঠিল—মিছে কথা বৌ, ভয়ানক মিছে কথা।

আমার বিশ্বাস হয় না, উনি মিছে কথা বলবেন।
সুরমা আর সহিতে পারিল না—দুই বাহুর মধ্যে দৃঢ় করিয়া আলিঙ্গন করিয়া ফুকারিয়া কাঁদিয়া উঠিল, বৌ, আমি মহাপাতকী।
বধূ আপনাকে ছাড়াইয়া লইয়া ধীরে ধীরে কহিল, কেন ঠাকুরঝি?
উঃ, তা আর শুনতে চেয়ো না। আমি বলতে পারর না।
ঝড়ের মত সুরমা যজ্ঞদত্তের সম্মুখে আসিয়া পড়িল—বৌকে এমন করে ঠকিয়ে রেখেচ, উঃ, কি ভয়ানক মিথ্যাবাদী তুমি!
যজ্ঞদত্ত অবাক হইয়া গেল। ও কি সুরো!
কৃতবিদ্য তুমি, ছি ছি, তোমার লজ্জা হওয়া উচিত।
যজ্ঞদত্ত অর্থ বুঝিল না, শুধু কটুকথা শুনিতে লাগিল।
কি ভেবে বিয়ে করেছিলে? কি ভেবে ত্যাগ করে আছ? আমার জন্য? আমার মুখ চেয়ে এই প্রতারণা করে আসচ?
সুরমা, পাগল হয়ে গেলে?
পাগল আমি? তোমার চেয়ে আমার জ্ঞান আছে, দাও আমাকে কোথাও পাঠিয়ে। সুরমার চক্ষু রক্তবর্ণ, হাঁপাইতে হাঁপাইতে কহিল, এক দন্ডও আমি থাকতে চাই না, ছিঃ ছিঃ!
যজ্ঞদত্ত চিৎকার করিয়া কহিল, কি বলচ?

বলচি তুমি মিথ্যাবাদী—প্রতারক!
নিমেষে যজ্ঞদত্তের মাথার ভিতর আগুন জ্বলিয়া উঠিল। অকারণে মনে হইল, তাহার ভিতরের অন্তরটা বাহির হইয়া তাহার সহিত যুদ্ধ করিতে ডাকিতেছে। জ্ঞানশূন্য হইয়া সে টেবিলের উপরিস্থিত ভারী রুলার তুলিয়া লইয়া চিৎকার করিয়া কহিল, আমি অধম, আমি প্রতারক, আমি মিথ্যাবাদী, এই তার প্রায়শ্চিত্ত করচি।
বিপুল বলের সহিত যজ্ঞদত্ত স্ব-মস্তকে ভীষণ আঘাত করিল। মাথা ফাটিয়া ঝরঝর করিয়া রক্তস্রোত বহিল। সুরমা অস্ফুটে ডাকিল, মাগো! তার পর অচৈতন্য হইয়া ভূমিতলে পড়িয়া গেল। যজ্ঞদত্ত তাহা দেখিল, দেখিল তার সমস্ত মুখ রক্তে ভাসিতেছে, চোখের ভিতর রক্ত ঢুকিয়া সমস্ত ঝাপসা বোধ হইতেছে। সে উন্মত্তের মত বলিয়া উঠিল, আর কেন? এই সময় পিছন হইতে কে ধরিয়া ফেলিল। ফিরিয়া দেখিল, স্ত্রী; কাঁদিয়া বলিল, তুমি? স্কন্ধের উপর মাথা রাখিয়া সেও মূর্ছিত হইয়া পড়িল।
সুরমা যেমন করিয়া নীচে হইতে উপরে ছুটিয়া আসিল, নূতন বধূ তাহাতে আশ্চর্য ও শঙ্কিত হইয়া নিঃশব্দে পিছনে আসিয়া দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া সব কথা শুনিল, সব কাণ্ড দেখিল। অনেকখানি সত্য তাহার মাথার ভিতরে সূর্য্যের আলোকের ন্যায় প্রতিভাত হইল, তাহারও বক্ষ-স্পন্দন দ্রুত হইয়া আসিয়াছিল, চক্ষের বাহিরে কু্জ্ঝটিকার সৃষ্টি হইতেছিল, কিন্তু সে আপনাকে সামলাইয়া লইয়া বিপদের সময় স্বামীকে ক্রোড়ে করিয়া বসিল।

 

নয়

ছয় দিন পরে ভাল করিয়া জ্ঞান হইলে, সুরমা জিজ্ঞাসা করিল, দাদা কেমন আছেন?

দাসী কহিল, ভাল আছেন।
আমি দেখে আসব। কিন্তু উঠিতে গিয়া আবার শুইয়া পড়িল।
দাসী কহিল, তুমি বড় দুর্বল, তাতে জ্বর হয়েছে, উঠো না, ডাক্তার বারণ করেছে।
সুরমা আশা করিল যজ্ঞদাদা দেখিতে আসিবে, বৌ দেখিতে আসিবে।
একদিন দুইদিন করিয়া ক্রমে এক সপ্তাহ অতীত হইয়া গেল, তবু কেহ আসিল না, কেহ খোঁজও লইল না।
জ্বর সারিয়াছে, কিন্তু বড় দুর্বল। উঠিতে চেষ্টা করিলে হয়ত উঠিতে পারিত, কিন্তু বিষম অভিমানে তাহার শয্যাত্যাগ করিতে প্রবৃত্তি হইল না। নিজের মনে ফুলিয়া ফুলিয়া কাঁদিত, চোখ মুছিয়া ভাবিত—তাহাদের আলো ও ছায়ার কাহিনী।
দীপ্ত আলো ও গাঢ় ছায়া লইয়া তাহারা খেলা আরম্ভ করিয়াছিল, এখন আলো নিভিয়া আসিতেছে। মধ্যাহ্নের সূর্য্য পশ্চিমে ঝুঁকিয়াছে, গাঢ় ছায়া তাই অস্পষ্ট ও বিকৃত হইয়া প্রেতের মত কঙ্কালসার হইয়াছে। অজানা অন্ধকারের পানে সে ছায়া যেন মিশিয়া যাইবার জন্য ধীরে ধীরে সরিয়া যাইতেছে। কাঁদিয়া কাঁদিয়া সুরমা ঘুমাইয়া পড়িল।
গায়ের উপর তপ্ত হস্ত রাখিয়া কে যেন ডাকিল, দিদি!
সুরমা উঠিয়া বলিল, একি বৌ? চক্ষু তাহার রক্তবর্ণ, মুখ শুষ্ক, ওষ্ঠদ্বয় যেন কালিমাখা।—কেন বৌ, কি হয়েছে তোমার?
কি হয়েছে আমার! তুমি আমাকে এ-বাড়িতে এনেছিলে, তাই বলতে এসেচি দিদি, ছুটি দাও আমাকে। আমি যাব—
কেন দিদি, কোথা যাবে?
নূতন বধূ সুরমার পায়ের উপর মাথা রাখিয়া লুটাইয়া পড়িল।
সুরমা দেখিল তাহার দেহ অগ্নির মত উত্তপ্ত।—একি! এ যে বড় জ্বর হয়েচে।
এমন সময় একজন দাসী চিৎকার করিয়া ছুটিয়া আসিল, দিদি, বৌ কোথা গেল? ওমা জ্বরের ঝোঁকে পালিয়ে এসেচেন! আজ আট দিন বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলেন। মা গো! কি করে এলেন?
আট দিন জ্বর! ডাক্তার দেখচে?

কেউ না দিদি, কেউ না, পরশুদিন সকালবেলাও বৌমা এক ঘণ্টা কলতলায় মাথা পেতে বসেছিলেন, এত মানা করলুম, কিছুতেই শুনলেন না।
সন্ধ্যার পূর্বে সুরমা যজ্ঞদত্তের ঘরে গিয়া কাঁদিয়া পড়িল, দাদা, বৌ আর বাঁচে না।
বাঁচে না! কি হয়েচে?
আমার ঘরে এসে দেখ দাদা, বৌ বুঝি বাঁচে না।
দুই-তিনজন ডাক্তার আসিয়া দেখিয়া বলিল, প্রবল বিকার। সমস্ত রাত্রি বিফল পরিশ্রম করিয়া তাহারা ভোরবেলায় চলিয়া গেল।
সমস্ত রাত্রি যজ্ঞদত্ত মাথার শিয়রে বসিয়া রহিল, কতবার মুখের কাছে মুখ লইয়া গেল, বধূ কিন্তু স্বামীকে চিনিতে পারিল না।
ডাক্তার চলিয়া গেলে যজ্ঞদত্ত কাঁদিয়া উঠিল, বৌ, একবার চেয়ে দেখ, একবার বল ক্ষমা করলে?
সুরমা পায়ের উপর মুখ লুকাইয়া অস্ফুটে বলিল, বৌদিদি, কেন এ শাস্তি দিয়ে গেলে?
কে কথা কহিবে? সমস্ত মান, অভিমান, তাচ্ছিল্য, অবহেলা সরাইয়া দিয়া সে ধীরে ধীরে অনন্তে মিলাইয়া গেল।
সুরমা কহিল, দাদা কোথায়?
দাসী উত্তর করিল, কাল তিনি পশ্চিমে চলে গেছেন।
কবে আসবেন?
জানিনে, বোধ হয় শিগগির আসবেন না।
আমি কোথায় থাকব?
সরকারমশায়কে বলে গেছেন, যত ইচ্ছে টাকা নিয়ে তোমার যেখানে খুশি থেকো।
সুরমা আকশপানে চাহিয়া দেখিল, জগতের আলো নিভিয়া গিয়াছে—সূর্য্য নাই, চন্দ্র নাই, একটি তারাও দেখা যায় না। পাশে চাহিয়া দেখিল, সে অস্ফুট ছায়াটিও কোথায় সরিয়া গিয়াছে—চতুর্দিক ঘনান্ধকার, বক্ষ-স্পন্দন তাহার যেন বন্ধ হইয়া আসিতেছে, চক্ষের জ্যোতি ম্লান ও স্থির হইয়া আসিতেছে।
দাসী ডাকিল, দিদি!
ঊর্ধ্বনেত্রে সুরমা ডাকিল, যজ্ঞদাদা!
তারপর ধীরে ধীরে শুইয়া পড়িল।

ঝুনুমাসীর বিড়াল - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


ঝুনুমাসী একদম বিড়াল পছন্দ করতেন না। বিড়ালরা নাকি বড্ড নোংরা হয়। তারা যখন-তখন ছাদে যায়, ছাইগাদার ওপর ঘোরে, আবার সুযোগ পেলেই টুক করে বিছানার ওপর লাফিয়ে ওঠে। বিড়ালরা এমনই আদুরে যে, বিছানায় না শুলে তাদের ঘুমই আসে না। একদিন তো ঝুনুমাসী তাঁর বিছানার ওপর কোথাকার একটা উটকো বিড়ালকে দেখে একেবারে কেঁদেই ফেলেছিলেন।
সেই বিড়ালই একদিন ঝুনুমাসীকে জব্দ করে দিল। বাড়ির কাজের লোকদের ঝুনুমাসী হুকুম দিয়ে রেখেছিলেন, বাড়ির ত্রিসীমানায় যেন বিড়াল না আসে। বিড়াল দেখলেই তাড়াতে হবে। একটা গোঁফওয়ালা হাঁড়িমুখো বিড়াল প্রায়ই জানলা দিয়ে উঁকি মারে, আমরা হৈ-হৈ করে সেটাকে তাড়া করে যাই!
এত পাহারা-টাহারা দিয়েও শেষ পর্যন্ত কিছু করা গেল না। এর মধ্যেই একদিন সকল বেলা কী করে যেন একটা বাচ্চা-বিড়াল ঢুকে গেল। ফুটফুটে সাদা রং, টুলটুলে দুটি চোখ, ছোট্ট সেই বিড়ালটা প্রায় একটা উলের বলের মতন ঝুনুমাসীরই খাটের কাছে লাফালাফি করছে।


ঝুনুমাসী একেবারে আঁতকে উঠলেন। চ্যাঁচামেচি করে ডাকলেন সবাইকে। বললেন, “এক্ষুনি তাড়াও, এক্ষুনি বিদেয় করো হতভাগাকে!”
আমরা হ্যাট হ্যাট, হুশ হুশ করলাম। বিড়ালটা যাবার নামই করে না। আমাকে হাততালি দিতে দেখে সে ভাবলো বুঝি সেটা একটা খেলা। অমনি হাততালির সঙ্গে সঙ্গে ডিগবাজি দিতে লাগলো। তাই দেখে ঝুনুমাসীর ছেলে পল্টু হেসে ফেলতেই ঝুনুমাসী তার দিকে কটমট করে তাকালেন। তারপর বললেন, “হাসছিস কী! তোর হাসি দেখলে ও লাই পেয়ে যাবে না? সুখন, বিলু, জটার মা, তোমরা বিড়ালটাকে তাড়াতে পারছো না?”
বিড়ালকে তো ভয় দেখালেই পালায়। কিন্তু এই বিড়ালছানাটা যে একটুও ভয় পাচ্ছে না। আমরা যতই তাড়া করি, ততই সে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে খেলা দেখায়। ও বোধহয় এখনো ভয় পেতেই শেখেনি। সুখনের হাতে মস্ত বড় একটা ডান্ডা, কিন্তু ঐটুকু বিড়ালকে তো আর মারা যায় না। সুখন লাঠিটা নিয়ে ওর পাশে ঠুকতে লাগলো। তাতেও ভয় পায় না। ফুড়ুত ফুড়ুত করে তালে তালে লাফায়।
ছোটমাসী বললেন, “উসকো কান পাকাড়কে বাইরে ফেলে দাও।”
বিড়ালকে হাতে করে তুলে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কে তুলবে। সবাই তাই ভাবছে। এমন সময় বিড়ালটা ধপাস করে পাশ ফিরে শুয়ে চোখ বুজে একেবারে স্থির হয়ে গেল।
ঝুনুমাসী ভয় পেয়ে গেলেন। চেঁচিয়ে বললেন, “ওমা, বিড়ালটা মরে গেল নাকি? বাড়িতে বিড়াল মরলে যে ভীষণ পাপ হয়। এই সুখন, তুই ঐটুকু প্রাণীটাকে লাঠি দিয়ে মারলি?”
সুখন জিভ কেটে বললো, “না মাইজী, মা কালীর দিব্যি, আমি একবারও ওকে মারিনি। শুধু ভয় দেখিয়েছি!”

“তা হলে মরে গেল কী করে? অত বেশি ভয় দেখালি কেন, নিশ্চয়ই হার্ট ফেল করেছে।”
পল্টু বললো, “মরেনি মা, চোখ পিটপিট করছে।”
ঝুনুমাসী ধমক দিয়ে বললেন, “মরেনি, কিন্তু মরতে কতক্ষণ! কী অলুক্ষুনে কাণ্ড! বাড়িতে বিড়াল মরে যাবে? কত পাপ হবে!”
আমি বললাম, “মরবে কেন? এতক্ষণ খেলা করে হাঁপিয়ে গেছে, তাই জিরিয়ে নিচ্ছে।”
ছোটমাসী তক্ষুনি হুকুম দিলেন, “জটার মা, শিগগির এক বাটি দুধ নিয়ে এসো। দুধ খেয়ে সুস্থ হয়ে নিক, তারপর ওকে ভালোয়-ভালোয় বাড়ির বাইরে রেখে আসবে।”

জটার মা একটা এনামেলের বাটিতে খানিকটা দুধ নিয়ে এলো। ঝুনুমাসী সেটা দেখেই আবার বকুনি দিয়ে উঠলেন, “ঐটুকু দুধে বিড়ালের পেট ভরে? বিড়াল কি তোমার-আমার মতন ভাত খায়? তোমাকে কিপ্টেমি করতে কে বলেছে?”
আবার বাটি ভরে আনা হলো। দুধের গন্ধ পেয়েই বিড়ালছানাটা গা ঝাড়া দিয়ে উঠলো। তারপর দুধ খেতে লাগলো চুকচুক চুকচুক শব্দ করে। আমরা গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম।
সবটা দুধ শেষ করে সে খুব আরাম করে জিভ চাটলো কিছুক্ষণ। পল্টু বললো, “মা, এবার আমি ওকে রাস্তায় ফেলে আসবো?”
ঝুনুমাসী বললেন, “রাস্তায় নয়, ফুটপাথে। দেখিস খুব সাবধানে, যেন গাড়ি-টাড়ি চাপা না পড়ে।”

কিন্তু তার আগেই বিড়ালটা এক কাণ্ড করলো। সে এক দৌড়ে গিয়ে ঝুনুমাসীর পায়ে মাথা ঘষতে লাগলো। এবং এই প্রথম সে খুব মিষ্টি করে আস্তে ডাকলো মিউ-উ!
তখনই আমরা বুঝে গেলাম। ওটা মোটেই বিড়ালছানা নয়। ছদ্মবেশী কোনো মহামানব। ও নিশ্চয়ই মানুষের ভাষা জানে। না হলে কী করে বুঝলো যে, ঝুনুমাসীই ওকে তাড়াতে চাইছে!
ততক্ষণে ঝুনুমাসী একেবারে গলে জল হয়ে গেছেন। পা সরিয়েও নিলেন না। নরমভাবে বললেন, “আহা রে, মা ষষ্ঠীর জীব, বড্ড মায়া লাগে। রাস্তা ঘাটে কোথায় গিয়ে মরবে! থাক, এখন থাক।”
সেই থেকে বিড়ালছানাটা থেকেই গেল। ঝুনুমাসীর সব ঘেন্না চলে গেছে। এখন তিনি উল বুনতে বসলেই বিড়ালটা লাফিয়ে এসে তাঁর কোলে বসবে। পল্টুর চেয়েও তার আদর অনেক বেশী।

প্রথম কদিন তার অনেকগুলো নাম রাখা হয়েছিল। মিনি, পুষি, বিধুমুখী, পুঁচকি, গুলগুলি, ভুলভুল, দুষ্টু, মিষ্টি- এইসব। শেষ পর্যন্ত তার নাম হলো ফ্লসি। ইংরিজি নামটা ঝুনুমাসীরই বেশি পছন্দ। লোকে কুকুর পুষলেই ইংরিজি নাম দেয়, বিড়ালেরই বা কেন ইংরিজি নাম হবে না? বিড়াল কি কুকুরের চেয়ে কম?
ফ্লসি সারা বাড়ি তুরতুর করে ঘুরে বেড়ায়। সে খুব শৌখিন, কক্ষনো নোংরা থাকে না। সব সময় সেজে-গুজে ফুটফুটে। ঝুনুমাসী তাকে মাছের কাঁটা খাওয়াবার অভ্যেস করাননি। মাছের কাঁটা ওরা মুখে করে এখানে-সেখানে নিয়ে গিয়ে নোংরা করে। তাই ফ্লসিকে শুধু দুধ খাওয়া অভ্যেস করানো হলো। কখনো-সখনো এক-আধ টুকরো মাছ তাকে দেওয়া হয় বটে, তাও কাঁটা বেছে, যাতে সেটা খাওয়ার টেবিলের নীচেই শেষ করে।

ফ্লসি সত্যিই মানুষের কথা বোঝে। বাড়িতে লোকজন এলে ঝুনুমাসী যেই বলেন, “ফ্লসি, একটু নাচ দেখাও তো!” অমনি সে দু হাত তুলে দাঁড়ায়। তারপর টেবিলের একেবারে পাশে একটা বিস্কুট রেখে দিলে সে লাফিয়ে উঠে সেটাকে মুখে করে নেয়। সকলেই অবাক হয়ে যায়। ঝুনুমাসী গর্বের সঙ্গে বলেন, “এত সুন্দর বিড়াল থাকতে কেন যে লোকে কুকুর পোষে, তাও তো বুঝি না।”
প্রথম-প্রথম সে যেখানে-সেখানে, এমনকী দরজার সামনে হিসি করে দিত। ঝুনুমাসী একদিন তার কান ধরে ছাদে নিয়ে গিয়ে একটা কোণ দেখিয়ে বলেছিলেন, “এইটা তোর বাথরুম, বুঝলি পোড়ারমুখী! ফের যদি অন্য জায়গা নোংরা করবি…”
কী আশ্চর্য, তারপর থেকে ফ্লসি ঠিক ছাদেই বাথরুম করতে যায়।

এক বছরের মধ্যেই ফ্লসি বেশ বড় হয়ে উঠলো। দারুণ সুন্দর হয়েছে চেহারা। রাজকুমারীর মতন সে সগর্বে বারান্দার রেলিংয়ের ফুটোয় মুখ বাড়িয়ে রাস্তা দেখে। কক্ষনো সে রাস্তার বাজে বিড়ালদের সঙ্গে মেশে না। সবচেয়ে মজার হচ্ছে তার চোখ দুটো। তার দুটো চোখ দু’রকমএকটা নীল, আর একটা হলদে। তোমরা বিশ্বাস করছো না? সত্যি এরকম হয়। আমার নিজের চোখে দেখা।
সেবার পুজোর ছুটিতে বাইরে বেড়াতে যাবার সময়ও ঝুনুমাসী ফ্লসিকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন। বাড়িতে একা-একা সে কার কাছে থাকবে? ঝি-চাকররা যদি যত্ন না করে? প্রথমে কথা ছিল দার্জিলিং যাবার। কিন্তু বিড়াল কি অত ঠান্ডা সহ্য করতে পারবে? বেশী শীতে যদি ফ্লসির লোম উঠে যায়? তাই মত বদলে ঝুনুমাসী দার্জিলিং না গিয়ে ঘুরে এলেন পুরী থেকে।

ঝুনুমাসীরও এক মাসী আছেন। তাঁর নাম টুনুমাসী। ইনিও কিন্তু খুব বড় নন। ঝুনুমাসীরই প্রায় সমান বয়েসী। এই টুনুমাসী অনেক দিন ধরে থাকেন দিল্লিতে, কয়েকদিনের জন্য এসেছেন কলকাতায়। একদিন বেড়াতে এলেন ঝুনুমাসীর বাড়িতে। অনেক দিন পরে এসেছেন তো, তাই সকলেরই খুব আনন্দ। কথা বলতে বলতে তিনি বসবার ঘরের সোফার ওপর বসে পড়েই ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “ওরে বাবারে, একী?”
কেউ লক্ষ্য করেনি, ফ্লসি শুয়ে ছিল সোফার এক কোণে। এ বাড়ির সব জায়গায় তার অবাধ অধিকার। টুনুমাসী না দেখে বসে পড়েছেন ফ্লসির গায়ের ওপর। ফ্লসিও ভয় পেয়ে ডেকে উঠেছে ম্যা-অ্যা-ও!
টুনুমাসী তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বললেন, “ এ ম্যাগো! একটা বিড়াল এলো কোত্থেকে! অ্যাঁ? দেখলেই ঘেন্না লাগে। এই যা, যাঃ!”

ফ্লসি যাবে কেন? তার জ্ঞান হবার পর কেউ তো কখনো তাকে তাড়িয়ে দেয়নি। সে গ্যাঁট হয়ে বসে রইলো। টুনুমাসী তখন ফ্লসির ঘাড় ধরে তুলে বেশ জোরে ছুঁড়ে দিলেন মাটিতে। বললেন, “যা, বেরোঃ। দূর হ।”
আমরা সবাই আড়ষ্ট হয়ে রইলাম। ফ্লসির এরকম অপমান! কেউ কোনোদিন তাকে ছুঁড়ে ফেলেনি। ঝুনুমাসীর মুখখানা থমথমে।
টুনুমাসী বললেন, “কলকাতাতে বড্ড বেশী বিড়াল। আমাদের দিল্লিতে এ উৎপাত নেই। বিড়াল দেখলেই আমার এমন ঘেন্না করে!”
ঝুনুমাসী বললেন, “তুমি অত জোরে ছুঁড়ে দিলে? যদি পা-টা ভেঙে যায়!”
“ওদের আবার পা ভাঙবে। ছাদ থেকে ফেলে দিলেও মরে না। সারা বাড়ি নোংরা করে, অসুখ-বিসুখ ছড়ায়।”

এক বছর আগে ঝুনুমাসীরও ঠিক এই মতই ছিল। সেটা যে এর মধ্যে বদলে গেছে সেটা আর টুনুমাসী জানবেন কী করে! সুতরাং তিনি আরও কিছুক্ষণ বিড়ালের নিন্দে করে গেলেন। ঝুনুমাসী শুধু একবার বললেন, “সব বিড়াল এক রকম হয় না!”
যাই হোক, একটু বাদেই টুনুমাসী দিল্লির গল্প শুরু করতেই বিড়ালের কথা চাপা পড়ে গেল। আমরা সবাই রাত দশটা পর্যন্ত গল্পে মশগুল হয়ে রইলাম।
সে-রাত্রে আর ফ্লসিকে খুঁজে পাওয়া গেল না। টুনুমাসী তাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবার পর সে দৌড়ে ঘর থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। আর তাকে দেখা যায়নি। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা ফ্লসিকে খোঁজাখুঁজি করলাম। ঝুনুমাসী কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন।
পরের দিনও ফ্লসি ফিরে এলো না। তার পরের দিনও না। একেবারে উধাও হয়ে গেছে।

বিড়ালেরও কি অভিমান হয়? আমাদের সকলের সামনে, এমন কী ঝুনুমাসীর সামনেই একজন তাকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিল। তক্ষুনি তো আমরা কেউ তাকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করিনি। সেই অভিমানে ফ্লসি চিরদিনের মতন বাড়ি ছেড়ে চলে গেল?
আমরা পাগলের মতন খোঁজাখুঁজি করলাম কয়েকদিন। ঝুনুমাসী সব সময় কান্নাকাটি করছেন। আমাদের মধ্যে একমাত্র পল্টুই তেমন ভালোবাসতো না ফ্লসিকে। এখন তার মায়ের অবস্থা দেখে সে নিজেও ফ্লসিকে ফিরিয়ে আনার সব রকম চেষ্টা করলো। কিন্তু কোথাও তাকে দেখতেই পাওয়া গেল না।
দিন সাতেক বাদে ঝুনুমাসী আমাদের কারুকে না জানিয়ে কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিলেন।

ফ্লসি, ফিরে এসো।
তোমায় আর কেউ কোনোদিন মারবে না।
তুমি যা যাও তাই পাবে
তোমার জন্য আমি শয্যাশায়ী।
ইতি তোমার মা
ঝুনু

সেই বিজ্ঞাপন পড়ে সবচেয়ে বেশী হাসলেন ঝুনুমাসীর বর। আমাদের ছোটমেসো। তিনি ঝুনুমাসীকে বললেন, “তুমি তো তোমার বিড়ালকে অনেক কিছুই শিখিয়েছিলে জানি। তাকে কি খবরের কাগজ পড়তেও শিখিয়েছিলে নাকি? তার চেয়ে বলো, পুলিশের মধ্যে আমার অনেক বন্ধুবান্ধব আছে, তাদের খবর দেবো?”
এই সময় ঠাট্টা-ইয়ার্কি ঝুনুমাসীর একদম ভালো লাগে না। তিনি কান্নায় ফোঁস ফোঁস করতে করতে বললেন, “জানি, তুমি তো ফ্লসি মরে গেলেই খুশী হও। সে কি রাস্তায়-ঘাটে হাঁটতে শিখেছে কখনো। না জানি এতদিনে তার কী হয়েছে।”
শেষ পর্যন্ত ছোটমেসোই লিখে দিলেন খবরের কাগজে আর একটা বিজ্ঞাপন:
হারাইয়াছে! হারাইয়াছে!
একটি ফুটফুটে সাদা রঙের বিড়াল
কপালে শুধু টিপের মতন একটি কালো দাগ
ল্যাজ ঠিক আড়াই ইঞ্চি মোটা
বয়েস এক বছর এক মাস
খুব শান্ত স্বভাব, মাছের কাঁটা খায় না
কেহ সন্ধান দিলে একশো টাকা পুরস্কার!

সেই বিজ্ঞাপন পড়ে দলে দলে লোক আসতে লাগলো। প্রত্যেকেরই কোলে একটি বা দুটি বিড়াল, কেউ কেউ থলেতে ভরে অনেকগুলো বিড়ালছানাও আনে। গেটের কাছে আমি, পল্টু আর সুখন মিলে একটা কমিটী বসালাম। সব বিড়াল পরীক্ষা করে দেখি। ফ্লসির মতন সুন্দর একটাও নয়।
ঝুনুমাসীকে নিয়ে হলো মুশকিল। উনিও আমাদের কমিটীতে থাকতে চান। তার ফল হলো সাঙ্ঘাতিক।
দুপুরের দিকে তিনটে ছেলে এলো, সঙ্গে একটা জাঁদরেল খয়েরী রঙের বিড়াল। মুখখানা দারুণ রাগী রাগী। তাকে জোর করে ধরে রাখা হয়েছে।
একটি ছেলে ঝুনুমাসীকে দেখেই বললো, “মাসীমা, আপনার বিড়াল হারিয়েছে? এই নিন্।”

ঝুনুমাসী তিন পা পিছিয়ে গিয়ে বললেন, ‘‘এটা তো আমার বিড়াল নয়।”
“তাতে কী হয়েছে! বিড়াল তো সবই এক!”
“না, না, আমি আমার সেই বিড়ালটাই শুধু চাই।”
“নিন না, শস্তা করে দিচ্ছি। আপনি একশো টাকা পুরস্কার দেবেন বলেছিলেন তো? পঞ্চাশ টাকা দিন, তা হলেই এটা ছেড়ে দেবো!”
“না, অন্য বিড়াল আমার চাই না।”
“তা হলে পঁচিশ টাকা দিন। আচ্ছা, দশ টাকা?”
“বলছি তো, অন্য বিড়াল নেবো না আমি।”
ছেলেটি এবার নিরাশ ভাবে বললো, “নেবেন না? ঠিক আছে, তা হলে এটাকে লেকের জলে ডুবিয়ে মারবো।”
ঝুনুমাসী ভয় পেয়ে বললেন, “কী করবে?”
“জলে ডুবিয়ে মারবো।”
“কেন, মেরে ফেলবে কেন?”
“এটা সাঙ্ঘাতিক বদমাস! যেখানেই ছেড়ে দিই, ঠিক বাড়ি ফিরে যাবে! একবার হাওড়ায় ছেড়ে দিয়ে এসেছিলাম। একবার ব্যারাকপুরে। তাও রাস্তা চিনে ফিরে এসেছে! উঃ! এ পর্যন্ত সাতাশখানা মাছ ভাজা চুরি করে করেছে। একে মারবো না?”

ঝুনুমাসী ধমক দিয়ে বললেন, “না, মারবে না। ভগবানের জীবকে কেউ কখনো এমনি-এমনি মারে?”
দশ টাকা দিয়ে সেই বিশ্রী বিড়ালটা রাখতে হলো আমাদের।
এর পরে এলো একজন বুড়ো-মতন লোক। সঙ্গে দুটো বিড়াল। তার মধ্যে একটাকে দেখতে প্রায় ফ্লসিরই মতন। আমরা খুব উৎসাহী হয়ে উঠলাম। কপালে সেই কালো রঙের দাগটা পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু পল্টু সেই জায়গাটায় আঙুল দিয়ে ঘষতেই দেখা গেল রং উঠে আসছে। ওটা এঁকে আনা হয়েছে। তা ছাড়া ফ্লসি কখনো আমাদের দেখে ফঁ্যাচফ্যাঁচ করে?
ধরা পড়ে যাওয়ায় বুড়ো লোকটি একটু দুঃখিত ভাবে বললেন, “যাঃ, তাও মিললো না! সারা শহর খুঁজে খুঁজে সাদা বিড়াল ধরে আনলাম।
তারপর তিনি বিড়াল দুটোকে মাটিতে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “যাঃ, যা!”
আমরা বললাম, “এ কী! এখানে বিড়াল ছেড়ে দিচ্ছেন কেন? এখানে ছাড়া চলবে না।”
লোকটি এবার রেগেমেগে বললেন, “তা হলে কি আমি ফেরত নিয়ে যাবো নাকি? বিড়াল কি কেউ কখনো ফেরত নেয়? কোনোদিন শুনেছেন?”
সে বিড়াল দুটোও রয়ে গেল এ বাড়িতে। সন্ধের মধ্যে দশ বারোটি বিড়াল জমে গেল। অনেকেই বিড়াল নিয়ে এসে আর ফেরত নিয়ে যায় না। একশো টাকার পুরস্কারের লোভে রাস্তার ছেলেরা এক-একটা বিড়াল ধরে আনছে রাস্তা থেকে। পুরস্কার না পেয়ে রাগের চোটে সে-বিড়াল ছেড়ে যাচ্ছে এ-বাড়িতেই। দু-একটা অবশ্য এদিক-ওদিক পালিয়ে গেল। কিন্তু ঝুনুমাসী সব কটার জন্য দুধ বরাদ্দ করে দিলেন। তিনি নিজে থেকে কোনো বিড়ালই তাড়াবেন না!

সন্ধেবেলা দুজন প্যান্টপরা লোক একটা টেমপো ভর্তি করে নিয়ে এলো একশো পঁচিশটা বিড়াল। শাড়ির দোকানে যেমন একটা শাড়ি পছন্দ না হলেই সঙ্গে সঙ্গে আর-একটা শাড়ি বার করে দেখায়, ওরাও তেমনি এক-একটা বিড়ালের ঘাড় ধরে তুলে জিজ্ঞেস করে, “এটা আপনাদের? এটা নয়? তা হলে এটা?”
এক-এক করে একশো পঁচিশটা বিড়ালই দেখা হলো। কোনোটাই ফ্লসি নয়। লোক দুটো কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, “তা হলে আর কী হবে! চলো হে গঙ্গাচরণ।”
ঝুনুমাসী জিজ্ঞেস করলেন, “আপনারা এত বিড়াল পেলেন কোথা থেকে? এগুলো নিয়ে কী করবেন?”
একটা লোক বললো, “আমরা লেবরেটরিতে সাপ্লাই দিই!”
“লেবরেটরিতে? সেখানে কী হয়?”
“সেখানে বিড়ালের ওপর নানা রকম ওষুধ দিয়ে পরীক্ষা করা হয়। এদের কেটে কুটে দেখা হয়। আমরা পার পীস তিন টাকা করে বিক্রি করি।”
“পার পীস মানে?”
“এক-একটা তিন টাকা। ভাবলুম, আপনারটা যদি মিলে যায়, তা হলে একশো টাকা পাওয়া যাবে।”
“তার মানে এতগুলো বিড়ালকে আপনারা মারতে পাঠাচ্ছেন? নামান! গাড়ি থেকে নামান সবগুলোকে!”
সে এক প্রায় পাগলের কাণ্ড। সারা বাড়িতে প্রায় দেড়শো বিড়াল। ঝুনুমাসীর ধারণা, তাঁর ফ্লসিকেও নিশ্চয়ই কেউ লেবরেটরিতে চালান করে দিয়েছে। তিনি আমাদের বলতে লাগলেন, “যা, সব লেবরেটরি দেখে আয়। যেখানে যত বিড়াল দেখবি কিনে নিয়ে আয়।”

ছোটমেসো রাত্তিরে বাড়ি ফিরে প্রায় নাচতে লাগলেন। কোথাও পা ফেলার উপায় নেই। সব জায়গায় বিড়াল। তিনি ঝুনুমাসীকে বললেন, “তুমি পাগল হয়েছো, না আমি চোখের ভুল দেখছি? এ কখনো হয়? এটা বাড়ি, না চিড়িয়াখানা? হঠাও, সব কটাকে হঠাও!”
ঝুনুমাসী বললেন, “আমি যদি থাকি, তা হলে বিড়ালও থাকবে।”
সারা বাড়িতে ম্যাও মিয়াঁও ক্যাঁও কিঁও চিঁউ ওয়াঁও এইরকম নানারকম ডাক। কত রকম সাইজের কত রকম রঙের বিড়াল। এর মধ্যে মানুষের থাকা সত্যি অসম্ভব। আমরা ভাবলুম, ঝুনুমাসীর জন্য ডাক্তার ডাকবো কি না।
রাত্তিরে খেতে বসারও উপায় নেই। খাবার টেবিলের চার পাশে দেড়শো বিড়াল। অনেকগুলোই লাফিয়ে টেবিলে উঠে আসছে। সুখন একটা লাঠি নিয়ে সেগুলো তাড়াতে গেলেও যায় না।

হঠাৎ ঝুনুমাসী চেঁচিয়ে উঠলেন, “ঐ তো! চুপ, ঐ তো, শোন্!”
সেই চিৎকারে সবাই চুপ করে গেল। এমনকী বিড়ালগুলো পর্যন্ত। আমরা শুনতে পেলাম, বন্ধ সদর দরজার বাইরে কে যেন মিষ্টি গলায় ডাকছে, মিঁউ!
ঝুনুমাসী ছুট্টে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। অমনি ফ্লসি ভেতরে এসে ঝুনুমাসীর পায়ে মাথা ঘষতে লাগলো। ঝুনুমাসী তাকে কোলে তুলে নিয়ে একেবারে কেঁদে ফেললেন। তাকে আদর করে বলতে লাগলেন, “ওরে সোনা, তুই কোথায় গিয়েছিলি, তুই মায়ের ওপর রাগ করেছিলি? আহা তোর বুঝি খুব লেগেছিল সেদিন?”
ঠিক মনে হচ্ছে মা মেয়ের অভিমান ভাঙাচ্ছে।

অন্য বিড়ালগুলো ফ্লসির এই আদর মোটেই ভালো চোখে দেখলো না। কয়েকটা বিচ্ছিরি চেহারার হুলো বিড়াল রীতিমতন রাগী চোখে তাকিয়ে রইলো।
ছোটমেসো বললেন, “যাক, পেয়েছো তো! তোমার আদরের বেড়ালকে পেয়েছো তো? এবার বাকিগুলো সব তাড়াও!”
কিন্তু বিড়াল তাড়ানো কি সহজ? যে-বাড়িতে বিড়ালকে একবার আদর করে খাবার দেওয়া হয়েছে, সে-বাড়ি ছেড়ে তারা কিছুতেই যাবে না। ঝুনুমাসীর কোলে চেপে ফ্লসি খুব ভয়ে-ভয়ে তাকিয়ে আছে। এত বিড়াল সেও সহ্য করতে পারবে না।
আমি, সুখন আর পল্টু তিনটে লাঠি নিয়ে বিড়ালগুলোকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে বাড়ির বাইরে পাঠাই। একটু বাদেই তারা ঠিক ফিরে আসে। এক সঙ্গে অত বিড়ালকে আটকানো অসম্ভব। জানলা দিয়ে, ছাদ দিয়ে ফিরে আসবেই।

আরও দুটো দিন এরকম অবস্থায় কাটাবার পর বোঝা গেল, একটা কিছু ব্যবস্থা না করলে এ-বাড়িতে থাকাই অসম্ভব। রাস্তায় ঘাটে এক সঙ্গে এত বিড়াল ছেড়ে আসা যায় না। লোকেরা আপত্তি করবে। শেষ পর্যন্ত একটা বুদ্ধি মেসোমশাই-ই বার করলেন। রং তুলি নিয়ে অনেকগুলো কাগজে পোস্টার লেখা হলো:
প্রদর্শনী, বিরাট প্রদর্শনী
অভূতপূর্ব বিড়াল প্রদর্শনী
ধর্মতলা কার্জন পার্কে আজ সন্ধ্যা ছটায়
আপনার গৃহপালিত বিড়াল আনুন
প্রথম পুরস্কার এক হাজার টাকা
আরও অন্যান্য অনেক পুরস্কার!

এই পোস্টারগুলো মেরে দেওয়া হলো কার্জন পার্কের কাছাকাছি সব রাস্তায়। তারপর এ-বাড়ির সবকটা বিড়ালকে ধরে তোলা হলো একটা লরিতে। ভোরবেলা সেই লরিভর্তি বিড়াল এনে ছেড়ে দিলাম কার্জন পার্কে। আমরা আর কেউ লরি থেকে নামলাম না পর্যন্ত। যদি কোনো বিড়াল পায়ে এসে আবার লুটিয়ে পড়ে!
লরিটা ছাড়বার পর ছোটমেসো বললেন, “কার্জন পার্কে অনেক ইঁদুর আছে, বিড়ালগুলো ভালো থাকবে। তা ছাড়া প্রদর্শনীতে পুরস্কার পাওয়ার লোভে কেউ কেউ ওদের কটাকে পুষ্যিও নিতে পারে। মোট কথা, ব্যবস্থাটি বেশ ভালোই হয়েছে, কী বলো?”
বাড়ি ফিরে ঝুনুমাসীকে সব শোনাতে হলো। ফ্লসি তার কোলের কাছে শুয়ে। অন্য বিড়ালগুলো তাড়াবার জন্য ঝুনুমাসী খুব খুশী নন। সব শুনে-টুনে তিনি ফ্লসির গায়ে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, “সত্যি-সত্যি একটা বিড়ালের প্রদর্শনী যদি হতো, তাহলে আমার ফ্লসিই নিশ্চয়ই ফার্স্ট হতো! তাই না?”
আমরা কেউ কোনো প্রতিবাদ করলাম না।

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের গল্প : আগস্টের অপচ্ছায়া


অনুবাদক : অমিতাভ রায়

দুপুরের একটু আগে আমরা আরেসো পৌঁছে গেলাম। দুর্গটা খুঁজে বের করতেই দু’ঘণ্টা লেগে গেল। দুর্গটা কিনেছেন ভেনেজুয়েলার কথাশিল্পী মিগুয়েল ওতেরো সিলভা। তুসকানির গ্রামাঞ্চলের এক প্রত্যন্ত প্রান্তে শান্ত মনোরম পরিবেশে রেঁনেসা আমলের এই দুর্গের অবস্থান। আগস্টের গোড়ার দিকের গুমোট গরমে এক জমজমাট রবিবার। রাস্তায় পর্যটকদের ভিড়। সামান্য কিছু চেনা-জানা লোক খুঁজে পাওয়াও সহজ কাজ নয়। বেশ কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টার পর গাড়িতে ফিরে এলাম।
শহর ছেড়ে একটা রাস্তা ধরলাম। দু’পাশে সাইপ্রাস গাছের সারি। কিন্তু কোথাও কোনও দিকচিহ্ন নেই। জনৈকা বৃদ্ধা হাঁসের যত্নআত্তি করছিলেন। তিনিই দুর্গটার অবস্থান নির্দিষ্টভাবে বলতে পারলেন। বিদায় জানাবার আগে তিনি জিজ্ঞেস করলেন আমাদের ওই দুর্গে রাত কাটাবার কোনও পরিকল্পনা আছে কিনা। শুধু মধ্যাহ্নভোজই আমাদের উদ্দেশ্য বলে তাঁকে জানালাম। আসলে সেটাই ছিল আমাদের প্রাথমিক অভিপ্রায়। বৃদ্ধা বললেন, “সেই ভালো। ওটা তো প্রেতপুরী”

গিন্নি আর আমি বৃদ্ধার সরল বিশ্বাসে হেসে উঠলাম। কারণ, দিনেদুপুরে আমরা কেউই অশরীরী কোনও কিছুতেই বিশ্বাস করি না। কিন্তু আমাদের দু’ছেলে, যাদের একজনের বয়স সাত, আরেকজনের ন’ বছর, দারুণ মজা পেয়ে গেল। রক্তমাংসের শরীরে কোনও প্রেতের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়ে যাবে এই ভাবনায় ওরা মজে গেল।

মিগুয়েল ওতেরো সিলভা অনবদ্য অতিথিপরায়ণ। যেমন দারুণ পান-রসিক তেমনি ভালো লেখক। মধ্যাহ্নভোজের আসরে এমন সব খাদ্য সাজিয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, যেগুলোকে ভুলে যাওয়া অসম্ভব। আমরা দেরিতে পৌঁছেছি। খাবার টেবিলে বসার আগে দুর্গের ভেতরটা দেখার সময় হল না। তবে বাইরের দিক থেকে দুর্গটার চেহারা ভয় পাওয়ার মত নয়। ফুলে ছাওয়া খোলা উঠোনে বসে খাবার খেতে খেতে গোটা শহরটার দৃশ্য চোখের সামনে ফুটে উঠল। মন থেকে যে কোনও অস্বস্তি উবে যাওয়ার জন্য এমন দৃশ্য যথেষ্ট। এই পাহাড়ের মধ্যে ভিড় করে থাকা বাড়িগুলোয় যেখানে নব্বই হাজার লোকের জায়গাই হয় না সেখানে কত অমর প্রতিভার জন্ম হয়েছে বিশ্বাস করা কঠিন। মিগুয়েল ওতেরো সিলভা তাঁর ক্যারিবিয়ান কায়দায় ঠাট্টা ছুঁড়ে দিয়ে বললেন,--‘তাঁদের মধ্যে কেউই আরেসোর সবচেয়ে নামী নয়’।

তিনি বললেন,--‘তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হলেন,--লুদোভিকো’। শুধুই নাম। পরিবারের কোনও পদবি নেই। লুদোভিকো শিল্পকলা আর যুদ্ধের মহান পৃষ্ঠপোষক। তাঁর যন্ত্রণা দিয়ে গড়া এই দুর্গ। খাবার পুরো সময়টুকু ধরে লুদোভিকোর কথা শোনালেন মিগুয়েল। লুদোভিকোর বিপুল ক্ষমতা, বিপন্ন প্রেম, ভয়ংকর মৃত্যুর কথাই আমাদের শোনালেন। তিনি আমাদের শোনালেন কেমন করে হৃদয়ের ক্ষণিক উন্মাদনায় লুদোভিকো তাঁর প্রেমিকাকে সেই বিছানার ওপর ছুরি মেরেছিলেন যেখানে তার একটু আগেই তাঁরা শরীর নিয়ে প্রেমোন্মত্ত ছিলেন। পোষা হিংস্র ও লড়িয়ে কুকুরটাকে নিজের ওপর লেলিয়ে দিয়ে লুদোভিকো কীভাবে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিলেন,--সে কাহিনীও শোনা হল। বেশ গুরুত্ব দিয়ে মিগুয়েল আমাদের আশ্বস্ত করলেন যে মাঝরাতের পর বাড়িটার অন্ধকার ধরে লুদোভিকোর প্রেত হেঁটে-চলে বেড়িয়ে নিজের প্রেমের পায়শ্চিত্তের শ্রান্তি খুঁজে বেড়ায়।

দুর্গটা সত্যিই বিশাল আর আলো-আঁধারিতে বিষাদময়। কিন্তু ভরা পেটে দিনের আলোয়, খোশ মেজাজে লুদোভিকোর এই কাহিনীটিকে মিগুয়েলের অতিথি আপ্যায়নের অনেক আকর্ষণীয় উপাদানের একটা বলে মনে হল। খাবার পর একটু ঝিমিয়ে নিয়ে কোনও আসন্ন বিপদের আশঙ্কা ছাড়াই ঘুরে ঘুরে দেখলাম। বিরাশিটা ঘর। মালিক পরম্পরায় সেগুলোর কিছু পরিবর্তন হয়েছে। দোতলাটা সম্পূর্ণ সংস্কার করিয়েছেন মিগুয়েল। আধুনিক কায়দায় শোবার ঘর। মার্বেল পাথরের মেঝে। বিশ্রাম, বসা ও শোয়ার জন্য এক-একটা আলাদা ঘর। ব্যায়ামের সরঞ্জামও আছে। এর ওপর আছে চমৎকার ফুলে সাজানো খোলামেলা একটা আঙিনা যেখানে বসে আমরা মধ্যাহ্নভোজ সেরেছি।

তিনতলাটাই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত। শতাব্দীর পর শতাব্দী। ছিরিছাঁদহীন ঘরের পর ঘরে বহুযুগের পুরনো আসবাবপত্র নিয়তির ভরসায় পরিত্যাক্ত হয়ে পড়ে আছে। একদম ওপরতলায় একটা ঘর যেমন ছিল ঠিক তেমনিভাবেই সংরক্ষিত রয়েছে। লুদোভিকোর শোয়ার ঘরটা পরিদর্শনের কথা সময় ভুলে গেছে।

এ এক অলীক মুহূর্ত। বিছানাটা পড়ে আছে। সোনালি সুতোয় বোনা পর্দা। চাদরের বিস্ময়কর কারুকাজ আত্মনিবেদিত প্রেমিকের শুকনো রক্ত এখনও জমাট হয়ে আছে। ফায়ার প্লেসের ছাইগুলো জমে বরফ হয়ে গেছে। শেষ জ্বালানি কাঠটাও পাথরে রূপান্তরিত। অস্ত্রাগারে অস্ত্রের ঝলকানি। সোনার ফ্রেমে বাঁধানো ফ্লোরেনটিনের কোনও এক মহান শিল্পীর আঁকা এক বিষণ্ণ নাইটের তেলরঙা ছবিটা দেওয়ালে ঝুলছে। ছবিটা এখনও সমকালকে পেরিয়ে আসতে পারেনি। সবচেয়ে আশ্চর্য লাগল,---শোয়ার ঘরের সর্বত্র তাজা স্টবেরির অলৌকিক গন্ধ।

তুসকানির গ্রীষ্মের দিনগুলো দীর্ঘ আর অলস। রাত প্রায় ন’টা পর্যন্ত দিগন্ত দেখা যায়। পাঁচটা বাজার পর দুর্গের মধ্যে হাঁটা শেষ হল। তারপর সানফ্রান্সেস্কো গির্জার দেওয়ালে পিয়েরো দেইয়া ফ্রান্সেস্কোর আঁকা ছবি দেখার জন্য মিগুয়েল জোরাজুরি করতে লাগল। তারও পরে আঙিনার মধ্যে একটা গাছের তলায় বসে কফি খেতে খেতে কেটে গেল আরও কিছুটা সময়। অবশেষে স্যুটকেস নিতে ফিরে এসে দেখি, আমাদের জন্য খাবার সাজানো রয়েছে। সান্ধ্যভোজে আমরা বসে গেলাম।

খাওয়াদাওয়া সারবার সময় রক্তিম সন্ধ্যাকাশে শুধু একটি তারা ভাসছিল। ছেলেরা রান্নাঘর থেকে মশাল জ্বালিয়ে ওপরতলায় অন্ধকার খুঁজতে চলল। টেবিলে বসে আমরা সিঁড়িতে বুনো ঘোড়ার পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। শোকার্ত দরজার শব্দ শোনা যাচ্ছে। বিবর্ণ ঘরের মধ্য থেকে সহর্ষ চিৎকারে লুদোভিকোকে ডাকা হচ্ছে। রাতে এখানো ঘুমানোর কুচিন্তা যাদের মাথায় খেলেছে এটা তাদেরই চিৎকার। কিন্তু ওদের বারণ করার মতো সামাজিক সাহসিকতা আমরা দেখাতে পারলাম না।

যা ভেবেছিলাম তার উলটো হল। ঘুমটা ভালোই হল। দোতলার একটা শোয়ার ঘরে আমি আর আমার স্ত্রী, ছেলেরা পাশের ঘরে। দুটো ঘরকেই আধুনিকীকরণ করা হয়েছে। কোনও ঘরেই বিষণ্ন ব্যাপারটা নেই। ঘুমের জন্য প্রতীক্ষা করতে করতে ঘড়ির কাঁটার বারোটা নিদ্রাহীন আঘাত শুনতে লাগলাম। হাঁস পালন করা সেই বৃদ্ধার ভয়ংকর সাবধানবানী আমার মনে পড়ল। কিন্তু আমরা এত ক্লান্ত যে চট করে এক গভীর এবং ছেদহীন ঘুমে ঢলে পড়লাম। সকাল সাতটার পর ঘুম থেকে উঠে দেখি জানালায় লতিয়ে ওঠা আঙুরলতায় সূর্য ঝলমল করছে। পাশ থেকে আমার স্ত্রী নি্রীহভাবে শান্ত স্বরে মন্তব্য করল,--‘কী বোকামি’। আমি নিজের মনে বললাম,--‘এই যুগে, এই জগতে,--এখনও অশরীরীতে বিশ্বাস!’

ঠিক তখনই তাজা স্ট্রবেরির গন্ধে চমকে উঠলাম। শেষ কাঠের টুকরোটা পাথর হয়ে গেছে। এক বিষণ্ন নাইটের সোনার ফ্রেমে বাঁধানো ছবি তিন শতাব্দী পেরিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। গতরাতে যেখানে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তোতলার শোয়ার ঘরে, আমরা সেখানে নেই। আমরা পড়ে আছি লুদোভিকোর শোয়ার ঘরের শামিয়ানার নিচে। জানালায় ধুলো ভরা পর্দা, আর আমরা লুদোভিকোর অভিশপ্ত বিছানায়, এখনও গরম রক্তে ভেজা চাদরের ওপর পড়ে আছি।

 

উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ...