Wednesday, October 2, 2019

কেন ‘লিওনার্দো দা ভিঞ্চি’ একজন বন্ড ভিলেন হবার জন্যে উপযুক্ত – ২য় পর্ব


আমরা জেনেছিলাম রেনেসাঁ যুগের ইতালিয়ান আবিষ্কারক লিওনার্দো দা ভিঞ্চির কিছু তুলনামূলক ভাবে কম আলোচিত আবিষ্কারের কথা, যেগুলো তাকে যে কোনো বন্ড মুভিতে ভিলেনের রোল পাইয়ে দেবার জন্যে যথেষ্ট। সত্যি কথা হলো, এমআই সিক্সের সব ফিউচারিস্টিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা এজেন্ট ‘জিরো জিরো সেভেন’ যদি মধ্যযুগে ভিঞ্চির এসব প্রযুক্তিগত আবিষ্কার দেখতো, তবে সেও নির্দ্বিধায় মূর্ছা যেতো। কারণ ভিঞ্চির কিছু কিছু আবিষ্কারের আইডিয়া এতই ফিউচারিস্টিক ছিলো যে সেগুলোকে বাস্তবে কার্যকর করতে আমাদের প্রায় চারশ’-পাঁচশ’ বছরের মতো সময় লেগে গেছে। যেমন বলা যায়-

সাবমেরিন

আজকাল ‘মেরিন ওয়ারফেয়ার’ বা ‘পানির মধ্যে যুদ্ধের কলা-কৌশল’ জানা ছাড়া কোনো দেশেরই শক্তিশালী প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করা সম্ভব নয়। আর এই মেরিন ওয়ারফেয়ারে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা হচ্ছে সাবমেরিনের। কিন্তু এই সাবমেরিন কিছুকাল আগেও ছিলো শুধুমাত্র মানুষের কল্পনায়। উনিশ শতকের জুল ভার্ন রচিত কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যসমূহে সাবমেরিনের কথা পড়ে সেই সময়ে অনেকেরই পিলে চমকে গিয়েছিলো। কপাল ভালো তারা পনেরশ’ শতকে জন্ম নেয়নি। কারণ, সেই সময়ে জন্ম নিলে হয়তো ভিঞ্চির আবিষ্কৃত সাবমেরিন দেখে তারা হার্ট অ্যাটাক করেই মারা যেতো।

ভিঞ্চির মূল ডিজাইন
ভিঞ্চির আমলে, তখন পর্যন্ত অখণ্ড রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে না পারা, ইতালির সবচেয়ে শক্তিশালী দুই সুপার-পাওয়ার ছিলো ‘ভেনিস’ এবং ‘জেনোয়া’। ভেনিস এবং জেনোয়া- উভয়েরই ছিলো অপ্রতিরোধ্য নৌ-বাহিনী। ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চলে কেউ এই দুই সুপার-পাওয়ারের সাথে অবস্থান করে টিকে থাকতে চাইলে সামনে রাস্তা খোলা ছিলো দুটো।

১। তাদের সব কথার প্রত্যুত্তরে “ইয়েস বস” বলা। অথবা,
২। তাদের সাথে সমান তালে ‘পাংগা’ নিতে সক্ষম নিজস্ব এক নৌ-বাহিনী থাকা।

কিন্তু সেই আমলে চলমান ক্রুসেডের ফলে ঘটা ক্ষয়ক্ষতির কারণে দ্বিতীয় পথ বেছে নেবার মত শক্তিমত্তা সম্পন্ন আর কেউ ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চলে অবশিষ্ট ছিলো না। তাই, তুর্কীরা এই দুর্বলতার সুযোগে বিশাল নৌবহর নিয়ে ইতালির উপকূলে উপস্থিত হবার আশংকায়, ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার্থে এগিয়ে এলেন ‘মাস্টারমাইন্ড’ ভিঞ্চি। তিনি বানালেন নিচের ছবিতে উপস্থাপিত বস্তুটা।

367241a9fea920c38b040c24a4cbc5f9
জ্বি হ্যাঁ, এটা একটা সাবমেরিন যেটার মাথায় বসানো আছে দানবাকৃতির এক ধারালো ছুরির ফলা। ভিঞ্চি জানতেন, ভেনিস কিংবা জেনোয়ার বিশাল নৌ-বহরের সাথে জলের উপরিভাগে সামরিক শক্তি প্রদর্শন করতে যাওয়া আর খালি হাতে জলে নেমে কুমীরের সাথে কুস্তি করা একই জিনিস। দুনিয়াতে তো সবাই আর ‘এইস ভেঞ্চুরা’ নয়। তাই তিনি আগালেন সম্পূর্ণ ভিন্ন উপায়ে। জলের নিচে দিয়ে। এরকম দু-চারটা সাবমেরিনই পুরো ভেনিস এবং জেনোয়ার নৌ-বহরের তলায় ফুটো করে দিয়ে তাদের সলিল সমাধি ঘটাতে যথেষ্ট ছিলো। সেই সাথে যথেষ্ট ছিলো মন্দিরে ‘পসাইডন’ দেবতার পাশে নিজের আরেকটা মূর্তি স্থাপন করে সেটার সামনে সবাইকে গড় হয়ে প্রণাম করাতে। কারণ উপস্থিত সবাই দেখতো- কোনো কারণ ছাড়াই একের পর এক যুদ্ধ জাহাজ পানির নিচে সিরিয়াল ধরে ডুবে যাচ্ছে।

কিন্তু বাকি আরো কিছু আবিষ্কারের মত ভিঞ্চি তার এই আবিষ্কারটার কথাও বেমালুম চেপে গিয়েছিলেন। তিনি নিজেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন- কী ভয়াবহ জিনিস তিনি আবিষ্কার করে ফেলেছেন। ফলে তার মৃত্যুর পরে বারো ভলিউমের ‘কোডেক্স অ্যাটলান্টিকাস’ প্রকাশ হবার আগ পর্যন্ত কেউ কিসসু টের পায়নি এই আবিষ্কারের ব্যাপারে।

কতটুকু কার্যকরী ছিলো এই ডিজাইন?
ভিঞ্চির এই সাবমেরিনের কার্যকারিতা নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো প্রশ্নের উদয় হয়নি। এতেই বুঝা যায় কতটা নিখুঁত ছিলো তার এই ডিজাইন। কিন্তু একটা ব্যাপার। এই সাবমেরিন যারা চালাবে (টেকনিক্যালি দাঁড় বাইবে যারা) তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারটায় কী চিন্তা করেছিলেন ভিঞ্চি? তারা অতল জলরাশিতে কীভাবে…………

.

.

.


"ওহ......আচ্ছা! আমার প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেছি।"

“ওহ……আচ্ছা! আমার প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেছি।”




উপরের ছবিতে দেখতে পাচ্ছেন ভিঞ্চির ডিজাইন করা ‘স্কুবা গিয়ার’। কোনো কারণে জাহাজ ধ্বংস না করে সেটা দখল নিতে চাইলে সৈন্যরা প্রথমে সাবমেরিন দিয়ে জাহাজের কাছাকাছি পৌঁছাবে। তারপর ভিঞ্চির ডিজাইন করা এই ‘স্কুবা গিয়ার’ পরিহিত বিশেষ কমান্ডো বাহিনী অন্ধকারে জাহাজের ডেকে উঠে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে দখলে নিয়ে ফেলবে পুরো জাহাজ। যদিও আমাদের মতে- হামলা চালানো ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়িই বটে। শুধু এই গিয়ার পরে পানি হতে জাহাজের ডেকে উঠে আসলেই কাজ হয়ে যাবার কথা ছিলো বলে আমাদের বিশ্বাস। মধ্যযুগীয় কোনো সৈন্য এই মূর্তিমান আতংককে সামনাসামনি দেখেও যদি জাহাজ থেকে পানিতে লাফ না দেয়, তাহলে এর মানে দাঁড়ায় দুটো। হয় সে ইতোমধ্যেই মারা গেছে, না হয় ভয়ে জমে এতটাই বরফ হয়ে গেছে যে তার আর নড়াচড়ার ক্ষমতা অবশিষ্ট নেই।

এই স্কুবা গিয়ারের ভেতরে অত্যন্ত জটিল সব ডিজাইন খুঁজে পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে সরলটা হলো ‘মূত্র সংরক্ষণকারী থলে’, যেটা বর্তমানের স্কুবা ডাইভারদের স্যুটের মাঝেও পাওয়া যায়। এটার কাজ হলো পানির নিচে ডাইভারকে উষ্ণতা প্রদানে সহায়তা করা। অর্থাৎ উনিশ শতকে মানুষ যখন সবে সাবমেরিন কল্পনায় দেখা শুরু করেছিলো, তার চারশ’ বছর আগেই ভিঞ্চি শুধু সাবমেরিনই বানিয়ে যাননি। তিনি সেই সাথে প্রতিষ্ঠা করে গেছিলেন তার নিজস্ব ‘নেভী সীল (Seal) বাহিনী’!

ক্লাস্টার বোমা

কম পরিশ্রমে বহু সংখ্যক মানুষ নিধনে যখন মানবসভ্যতা নিত্য-নতুন উপায় খুঁজে বেড়াচ্ছিলো, তখন ২য় বিশ্বযুদ্ধের কিছু সময় আগে ক্লাস্টার বোমার আবির্ভাব। ক্লাস্টার বোমার মূলনীতি হলো “এক ঢিলে অনেক-অনেক পাখি”। এই বোমায় একটা শেলের ভেতরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অনেক বোমা ভরে দেয়া থাকে। সেই শেল ছোঁড়া হলে সেটা মাটিতে পড়ার আগেই ফেটে যায়, আর ভিতরের ক্ষুদ্র বোমাগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে চারপাশে। পরে সেগুলো আরেক দফায় বিস্ফোরণ ঘটায়। এরকম শুধু একটা শেল দিয়েই বিশাল এক এলাকা পুরো ধ্বসিয়ে দেয়া সম্ভব।

কথা হচ্ছে, বিংশ শতাব্দীতে এসে ক্লাস্টার বোমা নিয়ে মানবসভ্যতা বেশ পুলক অনুভব করলেও ভিঞ্চি এই ভয়াবহ জিনিসটার আইডিয়া তৈরি করে গেছেন আরো ৫০০ বছর আগেই।

ভিঞ্চির মূল ডিজাইন
ফ্রান্স বনাম ইংল্যান্ডের মধ্যেকার শতবর্ষ ব্যাপী (১৩৩৭-১৪৫৩) যুদ্ধে মধ্যযুগীয় রণকৌশলে আমূল পরিবর্তন চলে এসেছিলো। এই যুদ্ধের আগে ঘোড়সওয়ারী নাইটদের দুর্জেয় হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু পাঁচ প্রজন্ম ধরে চলা এই যুদ্ধে ঘোড়সওয়ারী নাইটেরা হয়ে পড়েছিলো পুরোপুরি অসহায়। ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত নাইটেরা যেখানে ঘোড়ার পিঠে চড়ে যুদ্ধ করতো, সেখানে রাজা তৃতীয় এডওয়ার্ড একই খরচে গড়ে তুলেছিলেন তিনগুণ বড় পদাতিক বাহিনী। তারা অতি হালকা বর্ম পরতো। তীরন্দাজ, পাইক ম্যান এবং ম্যান-অ্যাট-আর্মস এর সমন্বয়ে গড়ে তোলা বাহিনী হালকা বর্ম পরলেও যুদ্ধক্ষেত্রে দেখা গেলো তারাই কার্যকর বেশি। একে তো তারা অত্যন্ত ক্ষিপ্রগতিতে ছুটে চলতে এবং অস্ত্র চালাতে পারে; তার উপর যে খরচে একটা নাইট বাহিনী গড়ে তোলা হয়, সেই একই খরচে তার তিনগুণ আয়তনের এই পদাতিক বাহিনী গড়ে তোলা সম্ভব ছিলো। যেকোনো স্ট্রাটেজি ভিডিও গেমারকে জিজ্ঞেস করলেও তিনি সুন্দর করে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিতে পারবেন- নাইটদের নিকট ‘পাইক ম্যান-ম্যান অ্যাট আর্মস’ কম্বিনেশন কেন পুরো দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিলো!


দুঃস্বপ্ন!!

দুঃস্বপ্ন!




যাই হোক, শতবর্ষ ব্যাপী এই যুদ্ধ হতে অন্যান্য দেশ নতুন রণকৌশল সম্পর্কে বেশ ভালোই শিক্ষা নিয়েছিলো। তারাও পাইকারি হারে পাইক-ম্যানদের নিয়ে বাহিনী গঠন করতে শুরু করে দিলো। ফলে নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিলো, এই বিশাল সংখ্যক পদাতিক বাহিনীকে কীভাবে ঠেকানো যাবে? স্পেন, ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের অগণিত পদাতিক বাহিনীর সামনে ইতালি কীভাবে নিজেদের স্বল্প সংখ্যক সৈন্য (যাদের অধিকাংশই বাইরের দেশ হতে ভাড়া করা) দিয়ে নিজেদের প্রাসাদ এবং দুর্গ প্রতিরক্ষা করবে? যথারীতি এগিয়ে এলেন ভিঞ্চি।

tumblr_n4368oGKFc1rwjpnyo1_500
তিনি ডিজাইন করলেন এমন এক কামানের যেটার একশ গজের ভেতরে আসতে আসতেই শত্রুপক্ষের পুরো পদাতিক বাহিনী কচুকাটা হয়ে একটা সীমিত এবং নিয়ন্ত্রিত সংখ্যায় চলে আসবে। ইতালির শুধু প্রয়োজন হবে ক্ষুদ্র একটা দলের- যারা সেই কামানগুলোকে পাহারা দিবে, আর অনবরত এর ভেতরে ‘বিশেষ ধরণের গোলার’ জোগান দিবে। পরবর্তীতে বাকীরা গিয়ে সেই পদাতিক বাহিনীর অবশিষ্ট সৈন্যদের শেষ করবে।

কতটুকু কার্যকরী ছিলো এই ডিজাইন?
ভিঞ্চির ডিজাইন করা কামানের প্রতিটা গোলার ভেতরে ভরে দেয়া ছিলো অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাথরের টুকরো। যখন কামান হতে গোলাটা ছোঁড়া হতো, তখন সেই গোলাটা ফেটে যেতো আর পঙ্গপালের মত প্রচণ্ড বেগে ছুটে আসতো তীক্ষ্ম সব পাথরের টুকরো। ব্যাপারটাকে অনেকটা বলা যায় কোন যন্ত্র দিয়ে পাথরের টুকরো স্প্রে করার মত, যেখানে চূর্ণ করা টুকরোগুলো প্রচণ্ড বেগে বৃষ্টির মতো এসে আঘাত হানতো শরীরে।

যারা এখনো বুঝতে পারছেন না এই কামানের ভয়াবহতা, তারা কখনো সুযোগ পেলে দু-চার মিনিট শিলা বৃষ্টির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করুন।

Biggest_Ice_rain_car

উড়ুক্কু যান

আকাশে উড়ার সাধ ছিলো মানুষের আজন্ম লালিত। সেই অনাদিকাল হতে কল্পনাবিলাসী মানুষ মাটিতে শুয়ে আকাশে পাখিদের ওড়া-উড়ি দেখতো আর দীর্ঘশ্বাস ফেলতো। কিন্তু পাখিরা মানুষের মাথায় মলত্যাগ করে এই ব্যাপারটাই স্মরণ করিয়ে দিতো যে- আকাশের সীমানায় রাজত্ব শুধু তাদেরই, কোন মানুষের নয়। জবাবে অটো লিলিয়েনথেল এবং রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের মত বিজ্ঞানীরা কোমর বেঁধে নামলেন আকাশে মানুষের ক্ষমতা অধিষ্ঠিত করতে। তাদের নিরলস পরিশ্রমের ফলেই আজ শুধু ঊর্ধ্ব বায়ুমণ্ডল নয়, মহাশূন্যেও মানুষের পদচারণা অতি নিয়মিত এক ব্যাপার।

কিন্তু কথা হলো, আকাশে আধিপত্য বিস্তারের প্রশ্নে লিলিয়েনথেল কিংবা রাইট ভাইদের মাধ্যমেই মানুষের পর্দায় আবির্ভাব ঘটেছিলো- একথা সত্যি নয়। বরং সফলভাবে এই রহস্য উদঘাটনে মানুষদের পর্দায় আবির্ভাব ঘটেছিলো সেই ভিঞ্চির আমলেই– পুরোপুরি ব্যাটম্যান স্টাইলে!

medium
ভিঞ্চির মূল ডিজাইন
ভিঞ্চির রেখে যাওয়া সব নোট, খাতাপত্র এবং ডায়েরি ঘেঁটে তার বিভিন্ন প্রশ্ন ও চিন্তা-ভাবনার মধ্যে যেটা সবচেয়ে বেশি খুঁজে পাওয়া গেছে, সেটা হলো- কী করে মানুষের পক্ষে আকাশে উড়া সম্ভব? শুধু এই এক প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়েই ভিঞ্চি তার জীবনের এক বড় অংশ ব্যয় করে ফেলেছিলেন। তার ডায়েরি এবং খাতার পাতার জায়গায় জায়গায় ভর্তি ছিলো ডানা মেলা পাখিদের নানারকম স্কেচে। তিনি পাখিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী পর্যবেক্ষণ করেছিলেন বাদুড়দের উড়ার কৌশলকে। যার ফলাফল ছিলো নিম্নরূপ-

ছবিতে যেটা দেখতে পাচ্ছেন তার নাম হচ্ছে ‘অর্নিথপ্টার (Ornithopter)’। এটাকে সাধারণ ‘গ্লাইডার’ এর মত ভাবলে ভুল করবেন। অর্নিথপ্টার ছিলো গ্লাইডারের থেকেও বেশী কিছু। এই যন্ত্রে পাইলট মাটির দিকে মুখ করে পুরো শরীর ভূমির সমান্তরালে রেখে অবস্থান গ্রহণ করতো। পায়ের কাছে ছিলো একজোড়া পেডাল। সেই পেডাল রড এবং পুলি সিস্টেমের মাধ্যমে সংযুক্ত ছিলো যন্ত্রটার দুই ডানার সাথে। যখন পা দিয়ে পেডাল ঘোরানো হতো, তখন পাখিদের ডানা ঝাপটানোর মত করে যন্ত্রটার দুই ডানা উপরে-নিচে সমানে ঝাপটে চলতো।

এক ডানা হতে আরেক ডানা পর্যন্ত পুরো যন্ত্রটার দৈর্ঘ্য ছিলো ৩৩ ফুট। যন্ত্রে বিভিন্ন কাঠের ফ্রেমগুলো বানানো হয়েছিলো পাইন গাছের মত হালকা কিন্তু দৃঢ় কাঠ দিয়ে। কাপড়ের অংশে ব্যবহৃত হয়েছিলো সিল্কের কাপড়। পায়ের কাছে পেডালের সাথে সাথে হাতের কাছেও ক্র্যাঙ্কের (Crank) এর মত একটা বস্তু ছিলো, যেটার ভূমিকা ছিলো অনেকটা গিয়ারের মত। অর্থাৎ ক্র্যাঙ্কটা ঘুরিয়ে যন্ত্রের ডানা-ঝাপটানোর হার বাড়ানো-কমানো যেতো। আর উড়ার সময় দিক নির্দেশ করার জন্যে মাথার কাছে ছিলো আরেকটা বিশেষ ‘হেড পিস’।

কতটুকু কার্যকরী ছিলো এই ডিজাইন?
এই যন্ত্রের সমস্যা ছিলো একটাই। ভূমি হতে আকাশে উড্ডয়ন। উঁচু পাহাড় বা বিল্ডিং এর ছাদ হতে যন্ত্রটা নিয়ে লাফিয়ে পড়া ছাড়া এটাকে বাতাসে ভাসানোর আর কোন উপায় ছিলো না। কিন্তু কোনক্রমে একবার বাতাসে ভাসাতে পারলেই যন্ত্রটা দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা উড়ে বেড়ানো যেতো। অর্থাৎ, যন্ত্রটা আকাশে উড়ার ক্ষেত্রে সফল হলেও প্রাথমিকভাবে ভূমি হতে পৃথিবীর অভিকর্ষ বলের বিপক্ষে গিয়ে আকাশে উড্ডয়ন করানোর মত যথেষ্ট শক্তির যোগান দেয়া সম্ভব হয়নি এই যন্ত্রটাতে। এর প্রথম কারণ ছিলো, সেই সময়কার প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতা। আর দ্বিতীয় ও সবচেয়ে বড় কারণ ছিলো, এই যন্ত্রটা নিয়ে বিভিন্ন পরীক্ষণ-নিরীক্ষণে সাহসী ভলান্টিয়ারের অভাব। ফলে ভিঞ্চিকে যন্ত্রটার এই আপাত কিছু গুণ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিলো………এবং না, পরে কোনো চোরেদের সংগঠন জাতীয় কিছুর সহায়তায়ও এই যন্ত্রের পরীক্ষণে ভিঞ্চি আর উৎসাহী হননি।


সত্য কথা বলেন- কতক্ষণ যাবত এই ছবিটা আসার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন?

সত্য কথা বলেন- কতক্ষণ যাবত এই ছবিটা আসার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন?




কিন্তু তারপরেও একটা প্রশ্ন থেকে যায়। যদি কোনভাবে পাইলটের জরুরি ভিত্তিতে অবতরণের প্রয়োজন হয়- তাহলে? মানে ধরুন, কোনোভাবে আকাশে উড়ার সময় যন্ত্রটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আর……

.

.

.

.


"অ্যাঁ-মানে-ইয়ে......ধুর! ভিঞ্চির আবিষ্কার নিয়ে আর কোনো প্রশ্নই করবো না।"

“অ্যাঁ-মানে-ইয়ে……ধুর! ভিঞ্চির আবিষ্কার নিয়ে আর কোনো প্রশ্নই করবো না।”




উপরের ছবিতে দেখছেন ভিঞ্চির ডিজাইন করা প্যারাসুট। আধুনিক প্যারাসুটের সাথে এর তফাৎ ছিলো- আধুনিক প্যারাসুট ভিঞ্চিরটার মত পিরামিড আকৃতিবিশিষ্ট নয়। ফলে অনেক ‘অ্যারোডায়নামিক্স’ বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছিলেন- এটা বাতাসের বাধাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে কোনো মানুষকে বাতাসে ভাসিয়ে রাখতে এবং নিরাপদ অবতরণ করাতে সক্ষম হবে না। এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে পেতে ‘ডেয়ার ডেভিল’ নামে খ্যাত ব্রিটিশ স্কাই-ডাইভার ‘অ্যাড্রিয়ান নিকোলাস’ ২০০০ সালে হুবহু একই ধরনের একটা প্যারাসুট বানান আর ১০,০০০ ফুট উঁচুতে থাকা বেলুন হতে লাফ দেন। ৭,০০০ ফুট উচ্চতায় নেমে আসার পরে তিনি তার সেই প্যারাসুট খুলেন এবং তথাকথিত ‘অ্যারোডায়নামিক্স’ বিশেষজ্ঞদের মুখে ছাই ঢেলে নিরাপদে মাটিতে অবতরণ করেন।

DaVinci-Parachute002
পরবর্তীতে তিনি মিডিয়াকে জানিয়েছিলেন– ভিঞ্চির ডিজাইন করা প্যারাসুটের মাধ্যমে “আধুনিক প্যারাসুটের চেয়েও অনেক মসৃণভাবে” তিনি মাটিতে অবতরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই সাথে তিনি এটাও বলেছিলেন, “It took one of the greatest minds who ever lived to design it, but it took 500 years to find a man with a brain small enough to actually go and fly it”.

 

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/vinci_as_bond_villain_02/

Tuesday, October 1, 2019

অদ্বৈত মল্লবর্মণ তর্পণ : তিতাস তীরের তাল-তরঙ্গ


মুহাম্মাদ আমানুল্লাহ

তিরিশ দশকের সাহিত্য আন্দোলন বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বিচিত্র ধারা উপধারার জন্ম দেয়—এর অনিবার্য প্রভাব পড়ে বাংলা কথাশিল্পে। শিল্পের উপজীব্য এবং উপস্থাপন প্রক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তন ও অভিনবত্ব দেখা দেয়। বিদেশি সাহিত্যের প্রভাব, ফ্রয়েডের অবচেতনলোকের আবিষ্কার, জাতীয় আন্দোলন, মার্কস এঙ্গেলস-এর দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের নবীন জ্ঞান শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রবলভাবে আলোড়িত করে। বঙ্কিম-রবীন্দ্র-শরত্ কথাসাহিত্যের সঙ্গে নব নব চেতনাবোধ, বিষয়বৈচিত্র্য ও শিল্প দর্শনের সমন্বয় ঘটে মূলত এ সময়ে। কথাশিল্পের এ ধারায় কাব্যধর্মী উপন্যাসে বুদ্ধদেব বসু, বুদ্ধিদীপ্ত জীবন সমালোচনায় প্রেমেন্দ্রমিত্র, জীবনসমস্যা প্রধান উপন্যাসে অন্নদাশঙ্কর রায় এবং জীবনে সাংকেতিকতা ও শ্রেণি সচেতনতার প্রয়োগ করে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় স্বতন্ত্র শিল্পশৈলীর পরিচয় প্রদান করেন।

পথের পাঁচালীর বিভূতিভূষণ, রাইকমলের তারাশঙ্কর এবং পদ্মানদীর মাঝির মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা কথাশিল্পের ত্রিশ-চল্লিশের দশকের শীর্ষস্থানীয় কথাশিল্পী। এ তিনজনই মাটি ও মানুষকে ভালোবাসতেন অকৃপণভাবে। তথাপি তারাশঙ্করের মাটি রুক্ষতায় গৈরিক, বিভূতিভূষণের মাটি স্নেহমায়ায় স্নিগ্ধ আর মানিকের মাটি জীবন সংগ্রামের জটিলতায় কৃষ্ণদগ্ধ।

নদীকেন্দ্রিক বাংলা উপন্যাসের মত্স্যজীবী সমাজের জীবন জীবিকার প্রথম সফল রূপকার মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯০৮-১৯৫৬)। পরবর্তীকালে এই ধারা আরও বিকশিত ও ঋদ্ধ হয়েছে সমরেশ বসু, অদ্বৈত মল্লবর্মণ প্রমুখ কথাশিল্পীদের রচনায়।

'তিতাস একটি নদীর নাম' (১৯৫৫) উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের নদীভিত্তিক উপন্যাসের ক্ষেত্রে বিরল সম্মানে অভিষিক্ত। নদীমাতৃক বাংলাদেশের একটি নদী তিতাস ও সন্নিহিত উপকূলের মালো পাড়াই এই উপন্যাসের কেন্দ্রস্থল। উপন্যাসের কৌতূহলী পাঠকমাত্রই লক্ষ করবেন, এ উপন্যাসে প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মানদীর মাঝি'র প্রভাব সুস্পষ্ট। সাদৃশ্য-সাজুয্যের পরও এই উপন্যাসের নর-নারীর বিচিত্র হূদয়বৃত্তি ও মানসসংকট এখানে প্রধান নয়; এখানে একটি অবহেলিত জনপদের প্রবঞ্চিত শোষিত ছিন্নমূল জনগোষ্ঠীর সমাজ ধর্ম সংস্কৃতিই প্রধানভাবে বিধৃত।

প্রায় সাড়ে চারশ পাতার এ উপন্যাসটি চার পর্বের বিভিন্ন বিভাগ-উপবিভাগে সুবিন্যস্ত। ১. তিতাস একটি নদীর নাম—প্রবাস খণ্ড ২. নয়া বসত-জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ ৩. রামধনু-রাঙ্গা নাও ৪. দু'রঙা প্রজাপতি-ভাসমান। এ উপন্যাস কোনো কাহিনি প্রধান উপন্যাস নয়। তারপরও বিভিন্ন বিভাগের ক্রমানুসারে একটি বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ঘটনাক্রমকে আশ্রয় করে উপন্যাসটি বিস্তৃতি লাভ করেছে।

তিতাস তীরের জনগোষ্ঠী মূলত উপন্যাসটিকে একটি মহাকাব্যিক বিস্তৃতি দান করেছে। জেলে, চাষি, বাউল, বৈষ্ণব—বিচিত্র পেশার ও বিবিধ ধর্ম-বর্ণের অসংখ্য চরিত্র এ উপন্যাসে ঠাঁই পেয়েছে। এ উপন্যাস মালো সমাজের বিভিন্ন নর-নারীর আগমন প্রস্থানে দুই প্রজন্মের বেশ কয়েকটি চরিত্র স্থায়ী অস্থায়ী উপস্থিতিতে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে গেছে। প্রথম খণ্ডে কিশোর, সুবল; দ্বিতীয় খণ্ডে কিশোরের স্ত্রী তথা অনন্তের মা ও সুবলের বউ; তৃতীয় খণ্ডে অনন্ত উদয়তারা কাদির প্রমুখ ও চতুর্থ খণ্ডে অনন্ত, অনন্তবালা, বনমালী প্রমুখ চরিত্রে মালো জীবনের সমষ্টিগত জীবনস্পন্দন উত্কীর্ণ। এই উপন্যাসে কোনো চরিত্র কেন্দ্রিক তাত্পর্যের প্রাধান্য পরিলক্ষিত না হলেও পৃথিবীর অনেক উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মতো এখানেও লেখকের আত্মপ্রক্ষেপণ রয়েছে। মালো জীবনের বহির্জগতের দীন-হীন দৈন্যদশা অবলম্বন করেও অনন্ত চরিত্রে লেখক এক কল্পনাপ্রবণচিত্তের অনন্য ঐশ্বর্য মর্মস্পর্শী শব্দচিত্রে তুলে ধরেছেন। এভাবে কিশোর ও কিশোরপুত্র অনন্ত এই দুই প্রজন্মের পরিধিতে এ উপন্যাসে মালো জীবনের একটি প্রামাণ্যরূপ বস্তুনিষ্ট ছবি ধরা পড়েছে।

প্রকৃতি ও মহাজনি শোষণের শিকার গ্রাম-বাংলার শ্রমজীবী কৃষক-জেলেসহ সাধারণ মানুষ। মহাজন ও মালিক শ্রেণি অন্ত্যজ শ্রেণির মালোদেরকে তাঁদের ক্রীতদাসে পরিণত করার হীন ষড়যন্ত্রে লিপ্ততার বিরুদ্ধে এই অঞ্চলের সম্মিলিত জনগোষ্ঠীর আমৃত্যু লড়াইয়ের এক মৃত্যুঞ্জয়ী জীবনালেখ্য তিতাস একটি নদীর নাম। এই উপন্যাসের মহাকাব্যিক বিস্তৃতি অসংখ্য নরনারীর আগমন প্রস্থানে একটি অবহেলিত জনপদের দুঃখদীর্ণ জীবন প্রবাহকে প্রকটিত করে।

এ উপন্যাসের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য, লেখকের ব্যক্তিজীবন-অভিজ্ঞতার মহাকাব্যিক রূপায়ণ। একজন আত্মজৈবনিক ঔপন্যাসিকের মতো তিনি মালোপাড়ার সমাজসংস্কৃতি ধর্মের পাশাপাশি মালো জীবনের দুঃখ-দুর্দশার কারণ অনুসন্ধানেও সমান তত্পর। তাঁর সমাজচিন্তা বৈরী সমাজব্যবস্থার বিপ্রতীপ বিন্যাসকে স্পষ্ট করে তোলে।

'মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই পদ্মানদীর মাঝির সঙ্গে তুলনা করলেও তিতাস একটি নদীর নাম অনন্য হয়ে ওঠে। অদ্বৈতের অভিজ্ঞতা মানিকের মতো অর্জিত নয়; স্বয়ং ঔপন্যাসিক এই অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ অংশীদার।' শান্তনু কায়সার; অদ্বৈত মল্লবর্মণ; বাংলা একাডেমি (১৯৮৭) ঢাকা; পৃষ্ঠা-২৩।

এভাবে ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ এই উপন্যাসে প্রাকৃতজীবনের মূল শিকড়কে জীবনলগ্নতা ও জীবনচর্যার ঘনিষ্ঠ গভীরতায় রেখায়িত করতে সক্ষম হয়েছেন।

প্রাকৃতিক সম্পদ ও সৌন্দর্যে সকল মানুষের অধিকার জন্মগত। কিন্তু তিতাস পাড়ের জেলে-কৃষক যারা ডাঙা ও জলের প্রকৃত মালিক; বংশানুক্রমিক দারিদ্র্য ও বৈরী সমাজব্যবস্থা তাদের এ মালিকানা সহজে প্রতিষ্ঠিত হতে দেয় না; মহাজন ও জমিদারের কাছে তারা বংশপরম্পরায় বন্দি হয়ে আছে। তাদের কারও কাছে নিজেদের জাল নেই, পরের জাল বেয়ে সারাজীবন মাছ ধরে, আবার নিজেদের জমি নেই পরের জমিতে 'মুনীষ' খাটে। বলদ ও ষাড়ের মতো এ শ্রমজীবী মানুষ শুধু শ্রম বিক্রি করে; অধিকার বা মালিকানা লাভের কোনো সুযোগ তাদের নেই। আবার কোনো জেলের শুধু জাল থাকলেও চলে না—'নাও' থাকতে হয়, প্রয়োজন হয় পুঁজি বিনিয়োগের। সংসারের শত ছিদ্রের মাঝে নৌকা ও জালের রক্ষণাবেক্ষণ করে নদীতে মাছ ধরার মতো পুঁজি তাদের কখনো হয় না। তাই সুবলের বাবা মাগন মালোর সারাজীবন পরের জালে খাটতে থাকে, তেমনি সুবলেরও নাও-জাল কিছুই হয় না। প্রথমে সে কিশোরের নৌকায় খাটে, তারপর একদিন পাগল হয়ে যায়। অবশেষে একদিন মুনিব কালোচরণ বেপারির আদেশে ঝড় থেকে নৌকা বাঁচাতে গিয়ে জলের অতলে তলিয়ে যায়। এভাবে তিতাস তীরের মালো সমপ্রদায় ও তিতাস পারের রায়তগণ বংশানুক্রমিকভাবে মহাজন, জমিদার ও মাছ ব্যবসায়ীদের তীব্র শোষণে বাস্তুহারায় পরিণত হয়, মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক অধিকার বঞ্চিত মালো সমপ্রদায় শেষ পর্যন্ত বৈরী শক্তি ও প্রতিকূল প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এ আত্মসমর্পণে নদী তীরবর্তী উপকূলীয় অসহায় বাঙালিদের করুণ আর্তস্বর বেজে ওঠে। তারপরও বাসন্তী ও মোহনের মতো কেউ কেউ একটি বিহিত ব্যবস্থার নিমিত্তে অস্থির হয়ে ওঠে। মোহনের চোয়াল অসহায় ক্রোধে শক্ত হতে থাকে, চোখ-মুখ-ঠোঁটে আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত তিতাস শুকিয়ে গেলে এই উপকূলবর্তী মালো সমপ্রদায়ের শেষ অবলম্বনটুকুও ফুরিয়ে যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বান, নদীর নব্যতা হরাস ও চড়া পড়া মহাজন-জমিদারদের মালো আর রায়তদেরকে তীব্র শোষণের সুযোগ এনে দেয়, বিপন্ন হয়ে পড়ে উত্পাদনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত সাধারণ প্রাকৃত মালো সমপ্রদায়।

ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণের এই উপন্যাস নদীতীরবর্তী হিন্দু মালো সমাজের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের সরস রূপায়ণ। লেখক তাঁর গ্রন্থে বৈষ্ণব, বাউল, ভাটিয়ালি গানের পাশাপাশি লোকজীবনের বিচিত্র উত্সব—নৌকাবাইচ, পদ্মপুরাণ পাঠ ও জন্ম-মৃত্যু-বিয়ে নিয়ে নানাবিধ উচ্ছ্বাস বেদনা উল্লাসের বর্ণনা দিয়েছেন বিশ্বস্ততার সঙ্গে। অন্ত্যজ শ্রেণির প্রাকৃত জীবনের এ অনুষ্ঠানগুলো আমাদেরকে প্রাণের স্পন্দনে সজীব রাখে, খুব সহজে পারিবারিক কলহ ও আর্থিক দৈন্যদশাকে ভুলে থাকতে সুযোগ করে দেয়। ঔপন্যাসিক মালো সমপ্রদায়ের একটি সুখপাঠ্য উত্সব বিবরণী তুলে ধরেছেন। এগুলোর মধ্যে মাঘমণ্ডলের ব্রত, আবিরবন্ধন, পাঁচ পীরের বদরধ্বনি, গুরুকরণ, কালী পূজার বারোয়ারী আয়োজন, উত্তরায়ণ সংক্রান্তি , তুলসী তলায় প্রণাম ও মনসা পূজার আয়োজন প্রধান।

এক. মাঘ মাসের শেষ দিনে কুমারীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয় মাঘমণ্ডলব্রত। মালো তরুণীদের কণ্ঠে তখন সমস্বরে ধ্বনিত হয় 'লও লও সুরুজ ঠাকুর লও পূজার জল'। কাঁচা কলাগাছের কাটা ফালি জড়ো করে তার ওপর রঙিন কাগজের চৌয়ারি তৈরি করে ঢোল কাঁসি বাজাতে বাজাতে সমস্বরে গান গেয়ে এ চৌয়ারি তিতাস জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। তখন নারীকণ্ঠের মধুর সংগীতে নেচে ওঠে তিতাস তীর।

দুই. পৌষের দিন শেষে অনুষ্ঠিত হয় উত্তরায়ণ সংক্রান্তি। তখন মালো সমাজে মুড়ি ভেজে ছাতু কুটার ধুম পড়ে। চালের গুড়ো রোদে শুকিয়ে মালো বধূরা পূর্ণরাত্রি বিনিদ্র নয়নে বিচিত্র আদলের পিঠা-পায়েস তৈরি করে। ঘরে বসে নানা উপকরণের পঞ্চান্ন ব্যঞ্জন রান্না করে।

'কালী পূজার সময় গানবাজনায় আমোদ-আহ্লাদে মালোরা অনেক টাকা খরচ করে সত্য, কিন্তু খাওয়া-দাওয়ার জন্য খরচ করে এই উত্তরায়ণ সংক্রান্তির দিনে। এই দিন পৌষ মাসের শেষ। পাঁচ-ছয় দিন আগে থেকেই ঘরে গুঁড়ি কোটার ধুম পড়ে।... ... ...পরবের আগের দিন সারাদিন জাগিয়া মেয়েরা পিঠা বানায়। পিঠা রকমে যেমন বিচিত্র, সংখ্যায়ও তেমনি প্রচুর।'

তিন. মালো পাড়ার প্রত্যেক বাড়িতে আছে তুলসী গাছ। ছোট্ট একটি বেদির ওপর বসানো এই তুলসী গাছে সবাই প্রণাম জানায়।

চার. কালী পূজাতে সমারোহ হয় সবচেয়ে বেশি। মূর্তি তৈরির জন্য বিদেশ থেকে কারিগর আসে, পূজার অনেক আগেই শুরু হয় সেই মূর্তি তৈরির কাজ। পূজার আগেই নির্বাচিত হয় এ পূজাতে কারা কারা সংযমী থাকবে; কারণ যাঁরা সংযমী থাকবে, তারা পূজার আগের দিন নিরামিষ খায় আবার পূজার দিনে প্রাতঃস্নান করে। সাধারণত সংযমীরা পূজার যাবতীয় কাজে পুরোহিতকে সহযোগিতা করে। তারাই পূজার জল তোলে, ফুল বাছাই করে, ভোগ-নৈবেদ্য সাজায় আর পুরোহিতদের আদেশ মতো নানা দ্রব্য এগিয়ে দেয়। এই পূজাতে তাই সংযমীদের গৌরব অনেক বেশি।

পাঁচ. শ্রাবণ মাসে প্রতিরাতে অনুষ্ঠিত হয় পদ্মপুরাণ পাঠ। লাচারী, দিশা ইত্যাদি সুরে তারা পদ্মপুরাণ পাঠ করে।

ছয়. আবার শ্রাবণ শেষ হওয়ার সাথে সাথে প্রতি ঘরে মনসাপূজার আয়োজন চলে। শুরু হয় জালা বিয়ে। মালো তরুণীরা বেহুলার এয়োতির স্মরণচিহ্নরূপে মেয়েতে মেয়েতে বিয়ের এ অভিনয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

'শ্রাবণ মাসের শেষ তারিখটিতে মালোদের ঘরে ঘরে এই মনসা পূজা হয়। অন্যান্য পূজার চাইতে এ পূজার খরচ কম, আনন্দ বেশি।'

ঔপন্যাসিক এ উপন্যাসে বাংলাদেশের নদীতীরবর্তী উপকূলীয় সমাজের বিচিত্র পূজা-পার্বণের বিশ্বস্ত চিত্র উপস্থাপন করেছেন। লোকজীবনের বিভিন্ন উত্সব ও হিন্দু সমপ্রদায়ের এ পূজা-পার্বণের মধ্যে খুব সহজেই আলোচিত হয়েছে উপকূলীয় গণমানুষের লোকজ ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার। জীবন অন্বেষী কৌতূহলী পাঠকমাত্রই ঔপন্যাসিকের এ উপস্থাপনায় সচকিত হবেন। একটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনচর্যা বর্ণনায় লেখক খুব সহজে আমাদের হূদয়ে নাড়া দেন; ভরে তোলেন জীবনের পেয়ালা সৌন্দর্যে সৌকর্যে।

শুধু তা-ই নয়, অদ্বৈত মল্লবর্মণ এ উপন্যাসে ব্রহ্মমন্ত্র, নাপিতের গুরুবচন, কীর্তনের শ্লোক, চাঁদ সওদাগরের কাহিনি, পদ্মপুরাণ পাঠ, মুর্শিদা বাউল, বারোমাসী প্রভৃতির অনায়াস ব্যবহারে উপকূলবর্তী মালো সমপ্রদায়ের জীবনযাত্রার বিচিত্র বিন্যাসকে রেখায়িত করেছেন। শ্লোক-বচনের অজস্র ব্যবহার এই উপন্যাসকে একটি আলাদা মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। এ জাতীয় সংগীতগুলো উপকূলীয় বাংলার সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের সাথি হয়ে আছে। মূলত এ অনুষঙ্গ বাদ দিয়ে গ্রামীণ মানুষের হাসি-কান্নার পূর্ণ রূপায়ণ অসম্ভব।

পদ্মপুরাণ পাঠ : 'শ্রাবণের শেষ দিন পর্যন্ত পদ্মপুরাণ পাঠ করা হয়, কিন্তু পুঁথি সমাপ্ত করা হয় না। লখিন্দরের পুনর্মিলন ও মনসা বন্দনা বলিয়া শেষ দুইটি পরিচ্ছেদ রাখিয়া দেয়া হয় এবং তাহা মনসাপূজার পরের দিন সকালে, সেদিন মালোরা জাল বাহিতে যায় না। খুব করিয়া পদ্মপুরাণ গায়, আর খোল করতাল বাজায়।'

গুরুবচন : 'শুন শুন সভাজন শুন দিয়া মন/ শিবের বিবাহ কথা অপূর্ব কথন।/ কৈলাশ শিখরে শিব ধ্যানেতে আছিল,/ উমার সহিত বিয়া নারদে ঘটাইল।'

মুর্শিদা বাউল :'এলাহির দরিয়ার মাঝে নিরঞ্জনের খেলা,/ শিল পাথর ভাসিয়া গেল শুকনায় ডুবল ভেলা।/ জলের আনন জলের বসন দেইখ্যা সরাসরি,/ বালুচরে নাও ঠেকাইয়া পলাইল বেপারী।'

বারোমাসী :'এহীত আষাঢ় মাসে বরীষা গম্ভীর,/ আজ রাত্রি হবে চুরি লীলার মন্দির।'

তিতাস তীরের মালো সমপ্রদায়ের নিজস্ব সংস্কৃতি—গানে গল্পে, প্রবাদ-প্রবচনসহ লোকসাহিত্যের অন্যান্য উপকরণে একসময় বেশ সমৃদ্ধ ছিল। পূজা-পার্বণে, হাসি-ঠাট্টায় দৈনন্দিন জীবনের আত্মপ্রকাশের ভাবসম্পদে তাদের সাংস্কৃতিক জীবনের বিকাশ ঘটে বংশ পরম্পরায়, উত্তরাধিকারসূত্রে। কিন্তু পরবর্তীকালে মালো সমপ্রদায়ের এই ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিচর্চা অবক্ষয়ের শিকারে জীর্ণ হয়ে পড়ে। ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ এই উপন্যাসে মালো সমপ্রদায়ের সংস্কৃতি অনুশীলন ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পদ্মানদীর মাঝি' কিংবা শহীদুল্লাহ কায়সারের 'সারেং বৌ' উপন্যাসের সাথে তুলনামূলক বিচারে বলা যেতে পারে, এই উপন্যাসে কোন বিশেষ নিরীক্ষা, শ্রেণি সচেতনতা, নায়ক-নায়িকার প্রণয়-বিগ্রহ ইত্যাদি প্রধান নয়; কুবের-কপিলার মনোদৈহিক প্রণয়, বা নবিতুন-কদম সারেং-এর দাম্পত্য প্রেমের সুগভীর অনুভব এখানে অপ্রধান। এ ধরনের জীবন অন্বেষী অনুষঙ্গ ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ খুব সহজে এড়িয়ে গেছেন। ঔপন্যাসিকের জীবন অন্বেষণ একটু আলাদা, বিপরীত বৈচিত্র্যের। তিনি জীবন থেকে মুখ ফিরিয়ে জীবনের স্পন্দন খুঁজেছেন আচ্ছন্নতায়, বিতৃষ্ণায়, দূরত্বে; কখনো বা আকণ্ঠ বুঁদ হয়ে থাকেন ঐতিহ্যে, ধর্মে-সংস্কৃতিতে-সংস্কারে। তাই তাঁর উপস্থাপিত এই ছিন্নমূল জনগোষ্ঠীর পারিবারিক দায়বদ্ধতা, সামাজিক সচেতনতা ও জীবনের প্রতি ভালোবাসার একান্ত অভাব দৃশ্যমান। জীবনের শত দুঃখ-দারিদ্র্য-বিবর্ণতা সত্ত্বেও তাঁরা কীর্তনে, পূজায়, বাউলগানে ও দোল উত্সবে নাচে আর গান গায়; সুখটানে বিভোর হয়ে পড়ে। এভাবে তিতাস তীরবর্তী মালোদের জীবন কখনো পরিচিত গণ্ডি ছাড়িয়ে হয়ে পড়ে অরণ্যচারী, নদী বিহারী ও স্বপ্নবিলাসী। জীবন তখন ক্ষণকালের জন্য হলেও মুক্তি পিয়াসী হয়ে ওঠে।

সহায়ক গ্রন্থ :অদ্বৈত মল্লবর্মণ :তিতাস একটি নদীর নাম, কলিকাতা-৬ প্রথম সংস্করণ ১৩৬৩।

হোর্হে লুই বোর্হেসের আত্মজীবনী



অনুবাদ : 
রাজু আলাউদ্দিন 
রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী

প্রস্তাবনাআত্মজীবনীটি আকারে সংক্ষিপ্ত হলেও মূলত বোর্হেসের লেখা সবচেয়ে দীর্ঘ একক রচনা। এক বেপরোয়া প্রতিশ্রুতির প্রকোপে জট পাকানো কিছু পরিস্থিতির ফসল এই রচনা।১৯৭০ সালের শুরুর দিকে, আমরা যখন ‘আলেফ অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ (১৯৩৩-১৯৬৯) গল্পগ্রন্থের কাজ প্রায় শেষ করে আনছিলাম, তখন আমি মনের মধ্যে এক ধরনের অস্বস্তিবোধ থেকে পাঠকদের জন্য বোর্হেসের আরেকটি গদ্য সংকলনের কথা ভাবতে শুরু করলাম, যেটি ইংরেজিতে প্রকাশিত বোর্হেসের প্রথম সাতটি বইয়ের তৃতীয় খণ্ড। ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস কয়েক আগে নিজের বিষয়ে দেওয়া বোর্হেসের বক্তৃতার পর আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম, বোর্হেসের জীবনের গল্প_তাঁর সমস্ত লেখালেখির কথা এবং তাঁর আর্জেন্টাইন বংশপরিক্রমা ও উৎসের প্রসঙ্গ তুলে ধরা_নিয়ে একটি রচনা দাঁড় করাতে পারলে উত্তম হয়। বোর্হেস রাজি হলেন এবং সেভাবেই আমাদের নিউইয়র্কের প্রকাশকের সঙ্গে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলাম। ওকলাহোমা থেকে বোর্হেস যখন আমাকে ২০ পৃষ্ঠার খসড়াটা পাঠালেন, আমি চুপসে গেলাম। বক্তৃতাটি ছিল বেশ উপভোগ্য ও ভালো। কিন্তু লিখিত আকারে দেখি, জায়গায় জায়গায় সমস্যা।


ব্যাপারটি নিয়ে বোর্হেস যতটা না, তার চেয়ে বেশি আমি নিরাশ হলাম। বোর্হেস খুশি মনে বললেন, আমরা আবার গোড়া থেকে শুরু করব। আমরা তা-ই করলাম। কিন্তু কাজটা খুব ঢিমেতালে এগোচ্ছিল। নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কাজটি শেষ করতে হবে। কিন্তু ওদিকে স্ত্রীর সঙ্গে বোর্হেসের ছাড়াছাড়ি প্রায় চূড়ান্ত; এবং ঠিকমতো বসে যে লিখবেন, সেই মন তাঁর নেই। শেষ পর্যন্ত আমরা ৬০ পৃষ্ঠার যে রচনাটি দাঁড় করালাম, সেটি শেষ করতে তিন মাসের বেশি সময় লাগল। সত্যি সত্যি মনোযোগের সঙ্গে যখন লেখার কাজটি ঘটল, তখন সেটি ছিল যুদ্ধের মধ্যে একটু করে শান্তির ডেরায় পলায়নের মতো।

নরম্যান টমাস ডি জোভানি্ন

আমার মা লেওনোর আসেবেদো দে বোর্হেস আর্হেন্তিনীয় এবং উরুগুয়াই বংশোদ্ভূত। ৯০ বছর বয়সেও তিনি বলিষ্ঠ, হৃদয়বান এবং একজন ভালো ক্যাথলিক। আমি যখন বেড়ে উঠছিলাম, ধর্ম ছিল তখন নারী আর শিশুদের বিষয়। বুয়েন্স আয়ার্সের বেশিরভাগ পুরুষই ছিলেন মুক্তচিন্তার অধিকারী। যদিও কেউ প্রশ্ন করলে নিজেকে তারা হয়তো ক্যাথলিক বলেই পরিচয় দিতেন। মানুষ সম্পর্কে শ্রেষ্ঠতম ভাবনার গুণ এবং বন্ধুত্বের গভীর চেতনাও, আমি মনে হয়, মায়ের কাছ থেকেই পেয়েছি। অতিথিপরায়ণ মানসিকতা আমার মায়ের সব সময়ই ছিল। আমার বাবার কাছ থেকে ইংরেজি শেখার সময় থেকে আমার মা তার বেশিরভাগ পড়াশোনা করেছেন ওই ভাষাতেই। বাবার মৃত্যুর পর লক্ষ করলেন, তিনি মুদ্রিত কাগজে মনস্থির করতে পারছেন না। মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করার জন্য তিনি উইলিয়াম সারোইয়ানের দ্য হিউম্যান কমেডি অনুবাদে হাত দিতে চেষ্টা করলেন। অনুবাদটি পরে মুদ্রিতও হয়; এবং এজন্য বুয়েন্স আয়ার্সে আর্মেনিয়ান সোসাইটি তাকে সম্মাননা জ্ঞাপন করে। পরে তিনি হর্থনের কিছু গল্প, শিল্প বিষয়ক হার্বার্ট রিডের একটি বই, মেনভিল, ভার্জিনিয়া উলফ এবং ফকনারের কিছু অনুবাদও করেছেন, যেগুলো আমার বলে বিবেচনা করা হয়। তিনি আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়ে আছেন। বিশেষ করে পরের বছরগুলোতে আমি যখন অন্ধ হয়ে যাই, তখন তিনি হয়ে ওঠেন সমমনস্ক এক ক্ষমাশীল বন্ধু। বহু বছর ধরেই একেবারে ইদানীংকাল পর্যন্ত আমার সচিবের কাজ, চিঠিপত্রের উত্তর দেওয়া, পড়ে শোনানো, আমার ডিকটেশন নেওয়া_এগুলো তিনিই করছেন। বিভিন্ন উপলক্ষে দেশ-বিদেশে আমার সফরসঙ্গীও তিনিই। তিনিই নীরবে এবং কার্যকরভাবে আমার সাহিত্যিক বৃত্তিকে তৈরি করেছেন, যদিও তার এই দিকটির প্রতি আমি কখনোই মনোযোগ দেইনি।

তার দাদা ছিলেন কর্নেল ইসিদোরো সুয়ারেস, যিনি ১৮২৪ সালে ২৪ বছর বয়সে পেরুভিয়ান এবং কলোম্বিয়ান অশ্বারোহী বাহিনীর বিখ্যাত নেতৃত্ব দেন, যা পেরুর হুনিনে যুদ্ধের গতিপথ বদলে দিয়েছিল। এ ছিল দক্ষিণ আমেরিকায় শেষ স্বাধীনতা যুদ্ধের অব্যবহিত আগের ঘটনা। ১৮৩৫ থেকে ১৮৫২ পর্যন্ত আর্হেন্তিনার স্বৈরাচারী হুয়ান মানুয়েল দে রোসাসের দ্বিতীয় কাজিন ছিলেন সুয়ারেস। কিন্তু তিনি বুয়েন্স আয়ার্সে স্বৈরাচারী শাসনের জাঁতাকলে বাস করার চেয়ে মন্তেবিদেওতে নির্বাসন এবং দারিদ্র্যকেই বেছে নিয়েছিলেন। সন্দেহ নেই, তার জমিজমা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল এবং তার এক ভাইকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়েছিল। আমার মায়ের পরিবারের আরেকজন হচ্ছেন ফ্রান্সিসকো দে লাপ্রিদা, যিনি ১৮১৬ সালে যে কংগ্রেস আর্হেন্তেনীয় কনফেডারেশনের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল, তার সভাপতিত্ব করেছিলেন। ১৮২৯ সালের গৃহযুদ্ধে তিনি নিহত হন। আমার নানা ইসিদোরো আসেবেদো বেসামরিক লোক হলেও তিনি ১৮৬০ ও ১৮৮০ সালের গৃহযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। সুতরাং আমার পরিবারের পিতৃকুল ও মাতৃকুল_দু’দিক থেকেই আমার রয়েছে সামরিক পূর্বসূরি। আমার মহাকাব্যিক নিয়তির প্রতি আমার আকুলতার পেছনে এগুলো বিবেচ্য হতে পারে, যদিও ঈশ্বর আমাকে তা থেকে বঞ্চিতই করেছেন। সন্দেহ নেই, তা ভালোর জন্যই করেছেন।

ইতিমধ্যেই বলেছি, আমার শৈশবের একটা বড় সময় কেটেছে ঘরের ভেতর। শৈশবে কোনো বন্ধু-বান্ধব না থাকায় আমার বোন আর আমি দুটো কাল্পনিক সঙ্গী আবিষ্কার করেছিলাম_যেকোনো কারণেই হোক। তাদের একটির নাম কুইলোস (Quilos), আর অন্যটির নাম উইন্ডমিল। (আমরা ওই দুটোতে শেষমেশ বিরক্ত হয়ে গেলে পরে মাকে বলতাম, ওরা মরে গেছে) আমার ক্ষীণ দৃষ্টির খুব সমস্যা ছিল সব সময়ই। তাই চশমা পরতে হতো। আমি ছিলাম দুর্বল প্রকৃতির। আমাদের পরিবারের বেশিরভাগ লোকই যেহেতু সৈনিক ছিলেন, এমনকি আমার চাচাও ছিলেন নৌবাহিনীর অফিসার এবং আমি জানতাম, আমি সে রকম কিছু হবো না, তাই সেই প্রথমদিকেই, অ্যাকশনধর্মী লোক না হয়ে বইমুখী লোক হওয়ায় আমি লজ্জিত বোধ করতাম। গোটা শৈশবে, আমার মনে হতো, প্রিয়ভাজন হওয়াটা আসলে অন্যায়। কোনো বিশেষ ভালোবাসা আমার প্রাপ্য বলে আমি অনুভব করিনি; এবং মনে পড়ে, জন্মদিনের অনুষ্ঠানগুলোতে আমি লজ্জায় ডুবে যেতাম। কারণ, আমি যখন মনে করতাম, কোনোকিছুই আমার প্রাপ্য নয়, তখন সবার দেওয়া উপহারের স্তূপ এসে জড়ো হতো আমার ওপর। নিজেকে আমার ভুয়া কিছু মনে হতো। বছর তিরিশেক পড়ে অবশ্য এই অনুভূতি আর থাকেনি।

বাড়িতে ইংরেজি এবং স্প্যানিশ_দুটোই চলত। আমার জীবনের প্রধান ঘটনার কথা যদি জানতে চাওয়া হয়, তাহলে আমি আমার বাবার গ্রন্থাগারের কথাই বলব। আসলে, মাঝেমধ্যে ভাবি, গ্রন্থাগারের বাইরে আমি কখনোই এলোমেলো ঘুরে বেড়াইনি। এখনো আমি তা দেখতে পাই। একটা রুমের মধ্যে কাচের দরজাসমেত বইয়ের তাক; এবং নিশ্চয়ই কয়েক হাজার বই তো হবেই। খুব ক্ষীণদৃষ্টির হওয়ায় তখনকার বেশিরভাগ চেহারাই আমি ভুলে গেছি (সম্ভবত এমনকি আমি যখন আমার নানা আসেবেদোর কথা ভাবি, তখন তার ছবির কথাই আমার মনে পড়ে)। তারপর পরিষ্কারভাবে আমার মনে পড়ে, চেম্বার্স এনসাইক্লোপিডিয়া এবং ব্রিটানিকার অসংখ্য স্টিল এনগ্রেভিংস। সেই সময় আমার প্রথম পড়া উপন্যাসটি হচ্ছে হাকলবেরি ফিন। এরপর রাফিংইট এবং ফ্লাশ ডেইস ইন ক্যালিফোর্নিয়া। ক্যাপ্টেন ম্যারইয়াটের বইগুলোও পড়েছি। ওয়েলসের ফার্স্ট ম্যান ইন দ্য মুন, পো, লংফেলোর একখণ্ডের এক সংস্করণ, ট্রেজার আইল্যান্ড, ডিকেন্স, দোন কিহোতে, টম ব্রাউন’স স্কুল ডেজ, গ্রিমসের ফেইরি টেলস, লুইস ক্যারল, দ্য অ্যাডভেঞ্চার্স অব মি. ডের্ভান্ট গ্রিন (এখন বিস্মৃত), কার্টনের এ থাউজ্যান্ড নাইটস অ্যান্ড এ নাইট। তখনকার দিনে অশ্লীলতায় পূর্ণ হিসেবে বিবেচিত বার্টন ছিল নিষিদ্ধ। আমাকে তা পড়তে হয়েছিল ছাদের ওপর লুকিয়ে। কিন্তু আমি এর জাদুতে এতই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম যে, আপত্তিকর অংশগুলো আমার চোখেই পড়েনি। গল্পগুলোর অন্য কোনো অর্থ সম্পর্কে অসচেতনভাবেই পড়ে গেছি। উল্লিখিত সব বই-ই পড়েছি ইংরেজিতে। পরে আমি যখন মূল ভাষায় দোন কিহোতে পড়লাম, তখন আমার কাছে তা অনুবাদের মতো মনে হয়েছিল। আমার এখনো সেই গার্নিয়ের সংস্করণের স্বর্ণের অক্ষরের লাল খণ্ডগুলোর কথা মনে পড়ে। আমার বাবার গ্রন্থাগারটি অংশত ভেঙে যায়; এবং আমি যখন অন্য এক সংস্করণে দোন কিহোতে পড়লাম, তখন মনে হলো, এটা আসল ‘কিহোতে’ নয়। পরে আমার এক বন্ধুকে বললাম, একই ধরনের স্টিল এনগ্রেভিংস, একই পাদটীকা আর একই শুদ্ধিপত্রের গার্নিয়েরের সংস্করণটা আমার জন্য জোগাড় করতে। আমার কাছে এসব কিছু মিলিয়েই হচ্ছে বইটি। এটাকেই আমি আসল ‘কিহোতে’ বলে মনে করি। স্প্যানিশ, আর্হেন্তিনীয় মাস্তান/দস্যু (Outlaws) এবং দুঃসাহসীদের (Desperadoes) নিয়ে লেখা এদুয়ার্দো গুতিয়েররেজের অনেক বইও আমি পড়েছি। সেগুলোর মধ্যে হুয়ান মোরেইরা হচ্ছে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য; ‘সিলুয়েতাস মিলিতারেস’ও তার মধ্যে একটি। এই বইটির মধ্যে রয়েছে কর্নেল বোর্হেসের মৃত্যুর বলিষ্ঠ (Forceful) বিবরণ। মা আমাকে মার্তিন ফিয়েররো পড়তে বারণ করেছিলেন। কারণ, ওই বইটি নাকি গুণ্ডা আর স্কুলের ছেলেপেলের জন্যই কেবল উপযোগী। তাছাড়া ওটা সত্যিকারের গাউচোদের নিয়ে নয় মোটেই। সেটাও আমি লুকিয়ে পড়েছি। তার এই ধারণার ভিত্তি হচ্ছে, এর্নান্দেস রোসাসের (Rosas) সমর্থক। অতএব আমাদের ইউনিটারিয়ান পূর্বপুরুষদের শত্রু। সার্মিয়েন্তোর ‘ফাকুন্দো’ও পড়েছি। গ্রিসের অসংখ্য বই। পরে নর্স, পুরাণ, কবিতা_এগুলো পড়েছি ইংরেজিতে। আমার বাবার ভীষণ প্রিয় শেলি, কিটস, ফিটজেরাল্ড এবং সুইনবার্ন তো আছেই, যাদের ভূরি ভূরি উদ্ধৃতি তিনি দিতে পারতেন এবং দিতেনও।

আমার বাবার পরিবারে সাহিত্যের ঐতিহ্য প্রবহমান ছিল। তাঁর চাচাতো দাদা (Great-uncle) হুয়ান ক্রিসোস্তোমো লাফিনুর ছিলেন আর্হেন্তিনার প্রথমদিককার কবিদের একজন। ১৮২০ সালে তাঁর বন্ধু জেনারেল মানুয়েল বেলগ্রানোর মৃত্যুতে একটি শোকগাথা (Ode) লিখেছিলেন। আমার বাবার এক নিকটাত্দীয় ভাই আলবারো মেলিয়ান লাফিনুরকে আমি শৈশব থেকেই চিনতাম। তিনি ছিলেন নেতৃস্থানীয় এক সৌন কবি। পরে তিনি আর্হেন্তিনীয় একাডেমি অব লেটার্সে যোগ দিয়েছিলেন। আমার বাবার মাতৃকূলের দাদা এডওয়ার্ড ইয়াং হাশলাম আর্হেন্তিনায় প্রথমদিককার ইংরেজি পত্রিকাগুলোর একটি সাউদার্ন ক্রস সম্পাদনা করেছেন। আমার ঠিক মনে নেই। তিনি হাইডেলবার্গের কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব ফিলোসফি বা ডক্টর অব লেটার্স করেছিলেন।

হাশলামের সামর্থ্যে কুলায়নি অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজে পড়াশোনা করার। ফলে তিনি জার্মানি চলে যান। সেখানে পুরো কোর্স লাতিনে করে ডিগ্রি নিয়েছিলেন। ঘটনাক্রমে তিনি মারা যান পারানাতে। আমার বাবা একটা উপন্যাস লিখেছিলেন। ১৯২১ সালে তা মাহোর্কা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। এর বিষয় ছিল এন্দ্রে রিওসের ইতিহাস। সেটার নাম ছিল দ্য কাউদিইয়ো। তিনি একটি প্রবন্ধের বই লিখেছিলেন (এবং ধ্বংস করে ফেলেন)। আর মূল ছন্দের অনুসরণে ফিটজেরাল্ডের ওমর খৈয়ামের অনুবাদ প্রকাশ করেছিলেন। অ্যারাবিয়ান নাইটসের অনুসরণে প্রাচ্যগল্পের একটি বই তিনি বাতিল করেছিলেন। আর সন্তানের ব্যাপারে পিতার হতাশা সম্পর্কে লেখা নাটক আছিয়া লা নাদা (শূন্যতার প্রতি) লিখেছিলেন। আর্হেন্তিনীয় কবি এনরিকে বাঞ্চের অনুকরণে কিছু সুন্দর সনেট প্রকাশ করেছিলেন। আমার শৈশবে তিনি অন্ধ হয়ে গেলে, এটা না বললেও বোঝা যাচ্ছিল, যে পরিবেশ-পরিস্থিতির কারণে আমার বাবা সাহিত্যিক নিয়তি থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন, আমাকে তা পূরণ করতে হবে। এটা একরকম অনুমোদিত হয়েছিল (আর এ ধরনের ব্যাপারে একেবারে কথিত বিষয়গুলোর চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ)। আমি লেখক হবো_এটাই ছিল প্রত্যাশিত।

আমি প্রথম লেখা শুরু করেছিলাম ছয়-সাত বছর বয়সে। আমি অনুকরণের চেষ্টা করেছিলাম স্প্যানিশ চিরায়ত লেখকদের। যেমন, মিগেল দে সের্বান্তেস। একেবারেই বাজে ইংরেজিতে আমি গ্রিক পুরাণ নিয়ে একটা পুস্তিকা লিখেছিলাম। সন্দেহ নেই, তা ছিল লেম্প্রিয়েখ্-এর নকল। এটাই হয়তো আমার প্রথম সাহিত্যিক অভিযান। আমার প্রথম গল্পটি ছিল সের্বান্তেসের ধরনে লেখা এক আবোলতাবোল রচনা, লা বিসেরা ফাতাল (The fatal helmet) নামের এক পুরনো ধরনের রোমান্স। খুব পরিপাটিভাবে এগুলো আমি কপিবুকে লিখেছিলাম। আমার বাবা এসবে কখনো নাক গলাতেন না। আমার নিজস্ব ভুলগুলো আমি করি_এটা তিনি চাইতেন; আর বলতেন, ‘বাচ্চারাই বাবাদের শেখায়; বাবারা নয়।’

আমার বয়স যখন ৯ বা তার কাছাকাছি, তখন আমি অস্কার ওয়াইল্ডের হ্যাপি প্রিন্স স্প্যানিশে অনুবাদ করি এবং তা বুয়েন্স আয়ার্সের একটি দৈনিক পত্রিকা এল পাইসে ছাপা হয়। লেখাটিতে লেখক হিসেবে যেহেতু কেবল হোর্হে বোর্হেস উল্লিখিত ছিল, সেহেতু লোকজন ধরেই নিয়েছিল, ওটা আমার বাবার করা অনুবাদ।

আমার প্রথম দিককার স্কুলজীবনের দিনগুলো স্মরণ করে কোনো আনন্দ খুঁজে পাই না। প্রথমত, ৯ বছর না হওয়া পর্যন্ত আমি স্কুলে যাওয়া শুরু করিনি। এর কারণ হলো, আমার বাবা নৈরাশ্যবাদী হিসেবে রাষ্ট্র কর্তৃক যাবতীয় উদ্যোগে আস্থাহীন ছিলেন। ইটন কলার ও টাইসহ পোশাকের সঙ্গে চশমা পরার কারণে আমার স্কুলের বেশিরভাগ সঙ্গীই ঠাট্টা-মশকরা এবং গালমন্দ করত। ওরা ছিল শৌখিন মাস্তান। স্কুলের নামটা আমার মনে পড়ছে না। তবে মনে হয়, ওটা ছিল টমাস স্ট্রিটে। আমার বাবা প্রায়ই বলতেন, আর্হেন্তিনীয় ইতিহাস এখন প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে শিক্ষাদানের জায়গায় পৌঁছেছে। সুতরাং আর্হেন্তিনীয় সবকিছুর প্রতি আমার ভক্তি-শ্রদ্ধা থাকা উচিত। যেমন, বিভিন্ন ভূখণ্ড এবং তার গড়ে ওঠা বহু শতাব্দী সম্পর্কে কোনো ধারণা হওয়ার আগেই আমাদের আর্হেন্তিনার ইতিহাস শেখানো হয়েছিল। স্প্যানিশে যেভাবে লেখা হয়, বেশ ফুলেল বর্ণনায়, আমাদের লিখতে শেখানো হয়েছিল : aquettos quo lucharon your ura yatria, bibre, iodeyeodieote, gloriora (যারা গৌরবময়, স্বাধীন-সার্বভৌম জাতির জন্য লড়াই করেছিল...)। পরে জেনেভায় গিয়ে আমি জানলাম, এ ধরনের লেখা অর্থহীন এবং বিষয়গুলো আমার নিজস্ব চোখ দিয়ে দেখা উচিত। ১৯০১ সালে জন্ম নেওয়া আমার বোন নোরা অবশ্যই গার্লস স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। ওই সময়ে আমরা গ্রীষ্মকালটা সাধারণত বুয়েন্স আয়ার্স থেকে ১০-১৫ মাইল দক্ষিণে আদ্রোগেতে কাটাতাম। আমাদের নিজস্ব ভিটায় তৈরি লম্বা একতলা বাড়ির দুটি সামারগাউজ, একটা উইন্ডমিল, আর একটা ঝাঁকড়াচুলের বাদামি শিপডগ ছিল। আদ্রোগে তখন ছিল গ্রীষ্মকালীন আবাসগুলোর হারিয়ে যাওয়া এক শান্ত গোলকধাঁধা। গেটপোস্ট, উদ্যান আর রাস্তার পাশে গাছপালার শোভিত আয়রন ফেন্সে সৃদৃশ্য ছিল এর আশপাশ। বিভিন্ন প্লাজাকে উজ্জ্বল করে রাখত এই পরিবেশ। আর ইউক্যালিপ্টাসের ঘ্রাণ ছিল সর্বব্যাপী। কয়েক দশক পর্যন্ত আদ্রোগেতে আমাদের যাতায়াত ছিল।

পাম্পা (pamya) সম্পর্কে আমার সত্যিকারের অভিজ্ঞতা হয় ১৯০৯ সালে। বুয়েন্স আয়ার্সের উত্তর-পশ্চিম দিকে সান নিকোলাসের অপেক্ষাকৃত কাছাকাছি এক জায়গায় আমরা বেড়াতে গিয়েছিলাম। মনে পড়ে, দিগন্তে সবচেয়ে কাছের একটা বাড়িকে আবছা মতো দেখাচ্ছিল। দেখলাম, এই অন্তহীন দূরত্বকেই পাম্পা বলা হতো। আর যখন জানলাম, এদুয়ার্দো গুতিয়ের্রেসদের চরিত্রের মতো গাউচোরাই (Gaucho) হচ্ছে খামারকর্মী, যা তাদের আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

আমি সব সময়ই বইয়ে পড়ার পরই বিষয়গুলো সম্পর্কে সজাগ হই। একবার খুব সকালে ঘোড়ায় চড়ে ওদের সঙ্গে গরুর পাল নিয়ে নদীতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। লোকগুলো ছিল ছোটখাটো আর একটু কালো ধরনের। প্রশস্ত আর ঢিলেঢালা ধরনের; ট্রাউজার বোম্বাচা (bombache) পরিহিত।

আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম, ওরা সাঁতার জানে কি না, তখন ওরা বলল, ‘পানি তো গরুর জন্য’। আমার মা একটা লম্বা কার্ডবোর্ডের বাক্সের ভেতর সাজানো একটা পুতুল উপহার দিয়েছিলেন সর্দারের মেয়েকে। পরের বছর গিয়ে আমরা ওই ছোট্ট মেয়েটির কথা জিজ্ঞেস করলাম। ওরা বলল, ‘ওই পুতুলটা পেয়ে ও যে কী খুশি!’ আমাদের ওটা দেখাল। তখনো ওটা ওই বাক্সের ভেতর। দেয়ালে একটা ছবির মতো ঝোলানো রয়েছে। মেয়েটাকে নিশ্চয়ই কেবল ওটা দেখার সুযোগ দেওয়া হতো; ছুঁয়ে দেখার জন্য। কারণ, তাতে ওটা ভেঙে বা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। বিপদসীমার বাইরে ওপরে ঝুলিয়ে রাখা ওটা ছিল দূর থেকে ভক্তি জানানোর জন্য। লুগোনেস লিখেছেন, কোর্দোবায়, পত্র-পত্রিকা আসার আগে, তিনি গাউচোদের ঝুপড়ির দেয়ালে খেলার তাসকে ছবির মতো ঝুলিয়ে রাখতে দেখেছেন বহুবার। ছোট্ট সিংহ আর দুই সৌধের চার কোপাই (Coyas) ছিল বিশেষভাবে কাঙ্ক্ষিত। জেনেভা যাওয়ার আগে মনে হয়, কবি আস্কাসুবির অনুকরণে গাউচোদের নিয়ে একটি কবিতা শুরু করেছিলাম। মনে পড়ছে, যতটা সম্ভব গাউচো শব্দ দিয়ে কাজটা করার চেষ্টা করেছিলাম। তবে কলা-কৌশলগত সমস্যাগুলো আমার বাইরে থেকে গেছে। অল্প কিছু স্তবকের বেশি আমি কখনোই এগোতে পারিনি।

ইউরোপ

১৯১৪ সালে আমরা ইউরোপে যাই। আমার বাবার দৃষ্টিশক্তি অবনতির দিকে যাচ্ছিল। বাবার একটা উক্তি মনে পড়ছে_’আমি যদি পড়তেই না পারি, তাহলে এই ধরাধামে আইনি কাগজপত্রে স্বাক্ষর করব কিভাবে?’ নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বাধ্যতামূলক অবসর গ্রহণের পর ঠিক ১০ দিনের মধ্যে তিনি আমাদের সফরের পরিকল্পনা করেন। পৃথিবী তখন সন্দেহবাতিকগ্রস্ত ছিল না। পাসপোর্ট লাগত না কিংবা লালফিতার কোনো বালাই ছিল না। প্রথমে আমরা কয়েক সপ্তাহ প্যারিসে কাটাই। প্যারিস আমাকে কখনোই বিশেষভাবে মুগ্ধ করেনি, যেমনটা প্রত্যেক আর্হেন্তিনীয়কে করে থাকে। সম্ভব, অজান্তেই আমি সব সময়ই ছিলাম একটু ব্রিটিশ ভাবাপন্ন। আসলে ওয়াটারলুকে আমি সব সময়ই বিজয় হিসেবে মনে করি। আমার বোন এবং আমার কাছে সফরের ধারণাটি ছিল জেনেভার স্কুলে যাওয়া। আমরা থাকতাম নানির কাছে, যিনি আমাদের মহাদেশ সফরকালেই মারা গিয়েছিলেন। ওই সময় আমার বাবা জেনেভার বিখ্যাত এক চক্ষু চিকিৎসকের চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। সেই সময় বুয়েন্স আয়ার্সের তুলনায় ইউরোপে সবকিছু সস্তা ছিল, আর্জেন্তিনীয় মুদ্রার মান ভালো ছিল সেই সময়। যাকগে, ইতিহাস সম্পর্কে আমরা এতটাই অজ্ঞ ছিলাম যে, আগস্টেই যে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে, সেই ধারণা আমাদের ছিল না। যখন এ ঘটনা ঘটে, বাবা-মা তখন জার্মানিতে। তবে জেনেভায় আমাদের কাছে তাঁরা ফিরে আসতে পেরেছিলেন। যুদ্ধ সত্ত্বেও, বছরখানেক বা তারও কিছু পরে আমরা তখন উত্তর ইতালির আল্পস অঞ্চলে ঘুরে বেড়াচ্ছি। ভেরোনা এবং ভেনিস নিয়ে আমার উজ্জ্বল স্মৃতি রয়েছে। ভেরোনার বিশাল শূন্য এমফিথিয়েটারে আস্কাসুবির একাধিক গাউচো কবিতা দরাজ গলায় আবৃত্তি করেছিলাম।

১৯১৪ সালের প্রথম গ্রীষ্মে জন ফেলভিনের প্রতিষ্ঠিত কলেজ অব জেনেভায় পড়াশোনা শুরু করি। ওটা ছিল ডে-শিফটের স্কুল। ক্লাসে আমরা ৪০ জনের মতো ছিলাম। অর্ধেকটাই বিদেশি ছাত্রছাত্রী। প্রধান বিষয় ছিল লাতিন। এবং অচিরেই লক্ষ করলাম, লাতিন ভালো জানলে অন্য বিষয়গুলোতে অত মনোযোগ না দিলেও কোনো ক্ষতি নেই। যাহোক, অন্য বিষয়গুলো হচ্ছে অ্যালজেব্রা, কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স, মিনের্যালজি, বোটানি, জুওলজি_এগুলো পড়ানো হতো ফরাসি ভাষায়। ওই বছর ফরাসি ছাড়া বাকি সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম সাফল্যের সঙ্গেই। আমাকে কিছু না বলেই আমার স্কুলের ছাত্ররা সবার স্বাক্ষরসহ হেডমাস্টারের কাছে আবেদন করে বসল। তারা বলল, সব পাঠ্য বিষয় আমাকে ফরাসিতে পড়তে হবে। ফলে এটাও আমাকে শিখতে হলো। হেডমাস্টারকে তারা বিষয়টি বিবেচনায় নিতে বলল। এবং তিনি দয়া করে তা-ই করলেন। ফরাসি ধরনে এক স্বরে (Syllable) আমার নামটি উচ্চারণ করায় প্রথমে আমি বুঝতেই পারিনি, শিক্ষক আমার নাম ধরে ডাকছেন (Call)। এ বর্ণটা আমরা স্কটিশ ঐ বর্ণের মতো উচ্চারণ করি। ফলে প্রত্যেকবার আমাকে সাড়া দিতে হতো পাশের সহপাঠীর কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে।

আমরা থাকতাম শহরের দক্ষিণ দিকে বা পুরনো অঞ্চলে, এক ফ্ল্যাটে। এখনো পর্যন্ত বুয়েন্স আয়ার্সের চেয়ে জেনেভা আমি অনেক ভালো চিনি। এর সহজ কারণ হলো, জেনেভার রাস্তার দুটো কোনা এক রকম নয়। যে কেউ সহজেই এই পার্থক্যটা দ্রুত বুঝে ফেলতে পারেন। প্রতিদিন আমি শহরের একেবারে ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া সবুজ আর বরফি নদী রনের (Rhone) পাশ দিয়ে হাঁটতাম; দেখতে একেবারে ভিন্ন_এ রকম সাতটা সেতু পর্যন্ত লম্বা পথ হেঁটে যেতাম। সুইসরা একটু গর্বিত এবং অমিশুক ধরনের। পোলিশ ইহুদি বংশোদ্ভূত আমার দুই ঘনিষ্ঠ ইয়ার সিমোন হিশলিনিস্কি এবং মোরিস আব্রামোভিচ_তাদের একজন লয়াব আর অন্যজন ফিজিশিয়ান হয়েছিলেন। ওদের আমি ত্রুকো (Rhone) খেলা শিখিয়েছিলাম। খেলাটা ওরা এত ভালো আর দ্রুত শিখেছিল যে, প্রথম দিনের খেলায়ই আমাকে ওরা একেবারে কানাকড়িহীন করে ফেলে। আমার ব্যক্তিগত বেশিরভাগ পড়াশোনা যখন ইংরেজিতে করছিলাম, তখন আমি বেশ ভালো লাতিন বোদ্ধা (Scholar) হয়ে উঠি। বাসায় আমরা স্প্যানিশ বলতাম। তবে আমার বোন ফরাসি ভাষায় এতই দক্ষ হয়ে উঠেছিল যে, স্বপ্নও দেখত সে ওই ভাষাতেই। মনে পড়ে, মা একদিন বাসায় ফিরে দেখেন, নোরা লাল প্লাশ (plush) পর্দার আড়ালে লুকিয়ে ভয়ে চিৎকার করে বলছে_’Une mouche, une mouche (মাছি, মাছি)!’ মাছি যে ভয়ঙ্কর_ফরাসি এই ধারণায় সে একাত্ম হয়ে গেছে বলে মনে হয়। ‘ওখান থেকে বেরিয়ে এসো’_মা ওকে বকলেন, কিছুটা আদেশাত্মকভাবেই। ‘তুমি এই মাছির মধ্যে জন্মেছ এবং বড় হয়েছ! ইতালি সফর এবং সুইজারল্যান্ডের ভেতরে ঘোরাঘুরি ছাড়া যুদ্ধের ফলে আর কোথাও যাইনি আমরা। পরে জার্মান সাবমেরিনকে অগ্রাহ্য করে কেবল চার/পাঁচজন যাত্রীসহ ইংরেজ দাদি আমাদের কাছে চলে আসেন। স্কুলের বাইরে নিজ উদ্যোগে জার্মান শেখায় হাত দেই। এই অভিযানে লিপ্ত হওয়ার জন্য দায়ী কার্লাইলের সার্তর রেসার্তুস (The taibor retailored), যা আমাকে অভিভূত এবং মুগ্ধ করেছিল। নায়ক ডায়জেনস ডেভিলসডাং ভাববাদের জার্মান এক প্রফেসর। জার্মান সাহিত্যে আমি ট্যাসিটাসের ধরনের কিছু জার্মান বিষয় খুঁজছিলাম। তবে আমি সেটা কেবল পরে ওল্ড ইংলিশ এবং ওল্ড নরসে খুঁজে পেয়েছিলাম। জার্মান সাহিত্য রোমান্টিক এবং রুগ্ন হয়ে পড়েছিল। প্রথমে আমি কান্টের ক্রিটিকিউ অব পিওর রিজন দিয়ে শুরু করেছিলাম। কিন্তু বেশিরভাগ লোকের মতো, এমনকি বেশিরভাগ জার্মানের মতোই এতে পরাজিত হই। পরে ভাবলাম, সংক্ষিপ্ততার কারণে কবিতা হয়তো সহজ হবে।

সুতরাং হাইনের প্রথমদিকের কবিতার বই লিরিক্স ইন্টের্মেজ্জো (Lyriches Intermesso) আর একটা জার্মান-ইংলিশ অভিধান জোগাড় করলাম। একটু একটু করে হাইনের সহজ শব্দাবলি আয়ত্ত করার পর দেখলাম, অভিধান ছাড়াই পড়তে পারছি। দ্রুতই আমি ভাষার সৌন্দর্যে নিজের মতো প্রবেশ করতে পারলাম। মেইরিস্কের উপন্যাস ‘ডের গোলেম’ও পড়ে ফেললাম। (১৯৬৯ সালে আমি যখন ইসরায়েলে ছিলাম, তখন গের্শম স্কোলেমের সঙ্গে গোলেমের বোহেমীয় লিজেন্ড নিয়ে আলাপ করেছিলাম। স্কোলেম হচ্ছেন ইহুদি মরমিবাদের একজন নেতৃস্থানীয় পণ্ডিত। গোলেম বিষয়ে আমার নিজের এক কবিতায় সম্ভাব্য ছন্দময় শব্দ হিসেবে তাঁর নামটি দুই বার ব্যবহার করেছি।) কার্লাইল এবং ডিকুয়েন্সির সুবাদে আমি জাঁ পল বিক্টারের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম। এটা ১৯১৭ সালের ঘটনা। তবে অচিরেই আমি আবিষ্কার করলাম, এই পড়াশোনায় আমি বেশ বিরক্ত (Bored) হয়ে পড়েছি। তার দুই ইংরেজ প্রবক্তা সত্ত্বেও রিক্টারকে বেশ ক্লান্তিকর (Long winded) এবং আবেগহীন মনে হয়েছে।

যাহোক, আমি জার্মান এক্সপ্রেশনিজমে আগ্রহী হয়ে উঠি। সমকালীন অন্যসব মতবাদ, যেমন ইমেজিজম, ক্যুবিজম, ফিউচারিজম, সুররিয়ালিজম ইত্যাদি থেকে এক্সপেশনিজমকে আমি এখনো আলাদাভাবে দেখি। কয়েক বছর পর মাদ্রিদে বেশ কয়েকজন এক্সপ্রেশনিস্ট কবির কবিতা স্প্যানিশ ভাষায় অনুবাদের প্রথম এবং সম্ভবত একমাত্র উদ্যোগ নিয়েছিলাম।

সুইজারল্যান্ডে থাকার সময় আমি শোপেনহাওয়ার পড়তে শুরু করি। আজ যদি আমাকে কেবল একজন দার্শনিক পছন্দ করতে বলা হয়, তাহলে আমি তার নামই বলব। বিশ্বজগতের ধাঁধা যদি শব্দাবলিতে প্রকাশিত হয়ে থাকে, তাহলে আমার ধারণা, সেই শব্দাবলিকে খুঁজে পাওয়া যাবে তাঁর লেখায়। আমি তাকে বহুবার পড়েছি, জার্মান ভাষায় এবং অনুবাদে, আমার বাবা ও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মাসেদোনিও ফের্নান্দেসের সঙ্গে। জার্মান এখনো আমার কাছে সুন্দর ভাষা মনে হয়; সম্ভবত এই ভাষার সাহিত্যের চেয়ে বেশি সুন্দর। মতবাদ এবং আন্দোলনের প্রতি মুগ্ধতা থাকলেও কূটাভাসিক ধরনে ফরাসি ভাষার রয়েছে সুন্দর সাহিত্য। তবে ভাষাটাকে আমার বরং কুৎসিত মনে হয়। ফরাসিতে কিছু বললে তা গুরুত্বহীন মনে হয়। স্প্যানিশ শব্দগুলো খুব দীর্ঘ এবং ভারী হলেও, এই দুই ভাষার মধ্যে স্প্যানিশকেই আমার ভালো মনে হয়। আর্হেন্তিনীয় একজন লেখক হিসেবে এর সঙ্গে আমার এঁটে (Coye with) উঠতে সমস্যা হয়নি, আর আমি এর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে খুবই সচেতন। মনে পড়ে, গ্যেটে লিখেছিলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে বাজে ভাষাটি নিয়ে তাকে কাজ করতে হচ্ছে_ জার্মান। ভাষা নিয়ে কাজ করেন_ এ রকম বেশিরভাগ লেখকই মনে হয় এ ধারণার সঙ্গে একমত। যেমন ইতালীয় ভাষার কথা ধরা যাক। বারটা ভাষার চেয়ে বেশি ভিন্ন সংস্করণে আমি বার বার দ্য ভিডাইন কমেডি পড়েছি। আরিওস্তো, তাসসো, ফ্রোচে এবং জেন্টিনও পড়েছি। তবে ইতালীয় বলতে বা ইতালীয় নাটক বা ছায়াছবি দেখতে আমি একেবারেই পারি না।

জেনেভাতেই আমি প্রথম ওয়াল্ট হুইটম্যানের সঙ্গে পরিচিত হই, যদিও জোহানেস স্কলাফের জার্মান অনুবাদে। আমেরিকান কবিকে জার্মান অনুবাদে পড়ার এই অদ্ভুতুড়ে ব্যাপারটা আমাকে নিশ্চয়ই আলোচিত করেছিল। অতএব লন্ডন থেকে লিভস অব গ্লাসের একটা কপি পাঠানোর অর্ডার দিই। ওটা এখনো আমার মনে পড়ে_সবুজ রঙের বাঁধাই। একটা সময় হুইটম্যানকে আমি কেবল মহান নয়, একমাত্র কবি বলে মনে করতাম। আসলে আমি ভাবতাম ১৮৫৫ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর সব কবিই হুইটম্যানের প্রতি পুরোপুরি ঝুঁকে পড়েছিলেন এবং তাঁর অনুকরণ না করাটা ছিল অজ্ঞতারই প্রমাণ। এ অনুভূতিটা আমার ইতিমধ্যে তখন ঘটেছিল কার্লাইলের গদ্যের ক্ষেত্রে, যা এখন আমার কাছে অসহ্য মনে হয়, আর ঘটেছিল সুইনবার্নের কবিতার বেলায়ও। এ পর্যায়গুলোই আমি পার হয়েছিলাম। পরে, বিশেষ কিছু লেখকের দ্বারা অভিভূত হওয়ার ফলে ওই রকম একই অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল।

১৯১৯ সাল পর্যন্ত আমরা সুইজারল্যান্ডেই ছিলাম। তিন থেকে চার বছর জেনেভায় কাটানোর পর বছরখানেক লুগানোতে থাকি। ইতিমধ্যে আমার ব্যাচেলর ডিগ্রি নেয়া হয়েছে এবং তখন বুঝতে পারছিলাম যে লেখাতে আমার মনোযোগী হতে হবে। বাবাকে আমার পাণ্ডুলিপি দেখাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু বললেন, তিনি উপদেশ দেয়ায় বিশ্বাস করেন না এবং ট্রায়াল অ্যান্ড এররের মধ্য দিয়ে আমার নিজের ধরনে আমাকে অবশ্যই কাজ করতে হবে। আমি ইংরেজি এবং ফরাসি ভাষায় সনেট লিখছিলাম। ইংরেজি সনেটগুলো ছিল ওয়ার্ডসওয়ার্থের দুর্বল (poor) অনুকরণ, আর ফরাসিগুলো ছিল পানসে ধরনের, প্রতীকবাদী কবিতার অনুকরণ। ফরাসি নিরীক্ষার আমার একটি পঙক্তি এখনো মনে আছে : ‘petste Boste nosre your Le violon cosse’. কবিতার শিরোনাম ছিল ‘poeme your etrc recite avec un accent russe’. আমি যেহেতু জানতাম আমি লিখছি বিদেশির ফরাসি ভাষায়, তাই ভাবলাম আর্হেন্তিনীয়র চেয়ে রুশ শ্বাসাঘাত বরং ভালো। আমার ইংরেজি পরীক্ষা-নিরীক্ষার ১৮ শতকের আবহ এবং অভ্যাসগুলো আনতে চেয়েছিলাম, যেমন over-এর পরিবর্তে ‘O'er’, ছন্দমিলের খাতিরে ‘Sings’-এর বদলে ‘doth sing’ ব্যবহার করতাম। যাই হোক, আমি জনতাম স্প্যানিশই হবে আমার অনিবার্য নিয়তি।

আমরা বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিলাম, তবে প্রথমে বছরখানেক স্পেনে কাটিয়ে। স্পেন তখন আর্হেন্তিনীয়দের দ্বারা ধীরে ধীরে আবিষ্কৃত হচ্ছে। তখনো পর্যন্ত লেওপোলদো লুগনেস এবং রিকার্দো গুইরালদেসের মতো বিখ্যাত লেখকরা ইউরোপ ভ্রমণের সময় স্পেনকে ইচ্ছে করে এড়িয়ে যেতেন। এটা কোনো হুজুক ছিল না। বুয়েন্স আয়ার্সে স্পেনীয়রা সব সময় নিম্নস্তরের কাজ করত, যেমন চাকর-বাকর, রেস্তোরাঁর ওয়েটার এবং শ্রমিক কিংবা ছোটখাটো ব্যবসায়ী আর আমরা আর্হেন্তিনীয়রা নিজেদের স্পেনীয় ভাবতাম না। আসলে আমরা স্পেনীয় হওয়াটা ছেড়ে দিয়েছি ১৮১৬ সালে, যখন আমরা নিজেদের স্পেন থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলাম। ছেলেবেলায় আমি যখন প্রেসকটের পেরু বিজয় (Conquest of peru) পড়ি, তখন বিজয়ীদের (Conquestadores) রোমান্টিক ধরনে উপস্থাপন করতে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। এই কর্মকর্তাদের থেকে আসা লোকদের আমার কাছে খুব একটা কৌতূহল-উদ্দীপক মনে হয়নি। যাই হোক, ফরাসিদের মতে লাতিন আমেরিকার লোকজন স্পেনীয়দের দেখত প্রাণবন্ত হিসেবে, গার্সিয়া লোরকার পরিভাষায়_জিপসি, বুলফাইট এবং মুসলিম যুগের স্থাপত্য। যদিও স্প্যানিশ আমাদের ভাষা এবং আমরা স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ রক্তের ধারাবাহিকতা, তারপরও আমাদের পরিবার তিনশ বছরের অনুপস্থিতির পরও স্পেন ঘুরে আসার কথা ভাবেনি।

আমরা গিয়েছিলাম মাহোর্কা (Majorca), কারণ ওই জায়গাটা তখন ছিল সস্তা, সুন্দর আর আমরা ছাড়া অন্য কোনো ট্যুরিস্টও খুব একটা ছিল না। পাহাড়ের ওপর পালমা এবং বাইয়াদেমোসা গ্রামে প্রায় গোটা বছর কাটিয়েছিলাম। লাতিন চর্চা করে যাচ্ছিলাম। এবার অবশ্য এক পুরুতের (priest) অধীনে যিনি বলেছিলেন, যেহেতু প্রয়োজনীয় সহজাত ছিল যথেষ্ট, তাই তিনি কখনো উপন্যাস পড়ার উদ্যোগ নেননি। আমরা ভার্জিল পড়ছিলাম, যাঁকে আমি এখনো উঁচুস্তরের মনে করি। মনে পড়ে স্থানীয় লোকদের আমি চমৎকার সাঁতারের মাধ্যমে চমৎকৃত করে দিয়েছিলাম। এর কারণ আমি স্রোতশীল বিভিন্ন নদীতে, যেমন উরুগুয়াই এবং রন নদীতে সাঁতার শিখেছি, অন্যদিকে মাহোর্কার লোকজন শিখেছে শান্ত, স্রোতহীন সাগরে। বাবা তাঁর উপন্যাস লিখে যাচ্ছিলেন, যার বিষয় তাঁর জন্মস্থান এন্ত্রে রিওসের ১৮৭০ সালের গৃহযুদ্ধের পুরনো দিনগুলো। মনে পড়ে তাঁকে আমি বেশ বাজে কিছু মেটাফর দিয়েছিলাম, যেগুলো জার্মান এক্সপ্রেশনিজম থেকে ধার করা। তিনি সেগুলো নিরুপায় হয়ে গ্রহণ করেছিলেন। শ’পাঁচেক মুদ্রিত কপি ছিল বইটির। সেগুলো তিনি বুয়েন্স আয়ার্সে এনে বন্ধুদের বিতরণ করেন।

পাণ্ডুলিপিতে যতবার তাঁর হোম টাউন ‘পারানা’ শব্দটি পাওয়া গেছে, প্রুফরিডার সব বদলে দিয়ে ‘পানামা’ বানিয়ে দিয়েছে। তারা ধরে নিয়েছে পাণ্ডুলিপির ভুল সংশোধন করে দিচ্ছে। বাবা ওদের কোনো সমস্যায় না ফেলে শব্দটা ওরকমই রেখে দিয়েছেন। দেখলেন তাতে করে ব্যাপারটা মজারই হচ্ছে। এখন আমার অনুতাপ হয় এ বইয়ে যৌবনকালে অনুপ্রবেশের কারণে। সতের বছর পরে, তাঁর মৃত্যুর আগে, তিনি আমাকে বললেন বেগুনি তালি-তাপ্পি বাদ দিয়ে সুন্দর ভাষায় সরাসরি ভঙ্গিতে উপন্যাসটি আমি পুনর্লিখন করলে তিনি খুব খুশি হবেন। সেই সময় আমি নিজে নেকড়ে-মানব (werewolf) নিয়ে একটা গল্প লিখে তা লা এসফেরা নামে মাদ্রিদের একটি জনপ্রিয় সাময়িকীতে পাঠিয়েছিলাম। সম্পাদক সেটি প্রত্যাখ্যান করে খুবই জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছেন।

১৯১৯-২০ সালের শীতকালটা আমরা সের্বিইয়েতে কাটাই। ওখানেই আমার কবিতা প্রথম মুদ্রিত হয়। ওটার শিরোনাম ছিল ‘সমুদ্রের প্রতি স্তুতি’, ১৯১৯ সালে ৩১ ডিসেম্বরে গ্রেসিয়াতে ছাপা হয়েছিল। কবিতাটিতে আমি যতটা সম্ভব ওয়াল্ট হুইটম্যান হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম :

হে সমুদ্র! হে পুরাণ! হে সবিতা!
হে বিশাল শ্রান্তির স্থল!
আমি জানি কেন ভালোবাসি তোমাকে।
জানি আমরা দুজনেই ভীষণ প্রাচীন,
বহু বহু শতাব্দী ধরে মোরা চিনি দুজনাকে...
হে প্রটীয়, জন্ম আমার তোমাতে_
আমরা পরস্পর শৃঙ্খলিত আর ভ্রাম্যমাণ;
আমরা দুজনেই তৃষ্ণার্ত নক্ষত্রের তরে,
দুজনেই আশা আর নিরাশায় বাঁধা...!

আজকাল সমুদ্র নিয়ে খুব একটা ভাবি না। এমনকি নিজের ব্যাপারেও না। অনেক বছর পর, আর্নল্ড বেনেটের The third-rate grandiose বাক্যবন্ধের মুখোমুখি হই, আমি সঙ্গে সঙ্গে এর অর্থ বুঝতে পেরেছিলাম। কয়েক মাস পর আমি যখন মাদ্রিদ আসি, যেহেতু ওটাই ছিল আমার একমাত্র প্রথম মুদ্রিত কবিতা, তাই লোকজন আমাকে সমুদ্রের গায়ক বলে ধরে নিয়েছে।

গ্রেসিয়াকে ঘিরে যে-দলটা যখন ছিল, আমি সের্বিইয়েতে গিয়ে পড়লাম ওই দলের মধ্যে। এ দলটি নিজেদের উলত্রাইস্ত বলে ডাকত। শিল্পের শাখা-সাহিত্যের নবায়নের জন্য যাত্রা শুরু করলেও ওরা এর কিছুই জানত না। ওদের একজন আমাকে একদিন বলল, ওর সব পঠন-পাঠন হচ্ছে গিয়ে বাইবেল, সের্বান্তেত, দারিও এবং গুরু রাফায়েল কান্সিনোস-আসেন্স দু-একটি বই, এ ব্যাপারটা আমার আর্হেন্তিনীয় মনকে বেশ ভাবনার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল : ওদের ফরাসি জ্ঞান নেই এবং ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। মানবতাবাদী হিসেবে স্থানীয়ভাবে জনপ্রিয় এবং পরিচিত একজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল, যার লাতিন-জ্ঞান আমার চেয়েও কম ছিল। আর গ্রেসিয়ার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে তা হলো এর সম্পাদক ইসাক ফেল বান্দো বিইয়ারের পুরো কাব্যসামগ্রী তাঁর কোনো না কোনো অধস্তন সহকর্মীর দ্বারা লিখিত। মনে পড়ে এদের একজন একদিন আমাকে বললেন, ‘আমি খুবই ব্যস্ত ইসাক একটি কবিতা লিখছে।’

পরে আমরা গেলাম মাদ্রিদ, সেখানে আমার জীবনে যে বিরাট ঘটনা ছিল তা হলো রাফায়েল কান্সিনোস আসেন্সের সঙ্গে বন্ধুত্ব। আমি এখনো নিজেকে তাঁর শিষ্য ভাবতে পছন্দ করি। তিনি ছিলেন সেবিইয়ের লোক, সেখানে তিনি কামেল (priesthood) হওয়ার পড়াশোনা করেন, কিন্তু ইনকুইজিশনের দলিল-দস্তাবেজে কান্সিনোস নামটি দেখে তিনি যে ইহুদি_এ সিদ্ধান্তে আসেন। এই আবিষ্কার তাঁকে হিব্রু চর্চায় উদ্বুদ্ধ করে এবং পরে তিনি খতনাও করেন। আন্দালুসিয়ার সাহিত্যিক বন্ধুরা আমাকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। আমি সলজ্জভাবে তাঁকে অভিনন্দন জানাই সমুদ্রবিষয়ক তাঁর একটি কবিতার জন্য। ‘হ্যাঁ, তিনি বললেন, মৃত্যুর আগে তা দেখার কী যে সাধ’ সব ধরনের কান্তিয়দের (Casilian) প্রতি আন্দালুসীয় ঘৃণা নিয়ে তিনি ছিলেন দীর্ঘদেহী। কান্সিনোসের ব্যাপারে যেটা লক্ষণীয় তা হলো টাকা এবং খ্যাতির প্রতি কোনো মোহ ছাড়াই তিনি পুরোপুরি সাহিত্যের জন্য বেঁচে ছিলেন। ভালো কবি ছিলেন এবং একটি সপ্তবাহুর ঝাড় লণ্ঠন (El condelabro de los siete brases) নামে একটি প্রধানত আদিরসের স্তোত্র গ্রন্থ লিখেছিলেন। ১৯১৫ সালে বইটি বেরিয়েছিল। প্রবন্ধ, গল্প এবং উপন্যাসও লিখেছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার যখন পরিচয় হয় তখন তিনি একটি সাহিত্যচক্রের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন।

প্রতি শনিবার আমি কাফে কলোনিয়াতে যেতাম, মধ্যরাতে আমরা একত্রিত হতাম আর আড্ডা চলতো ভোর পর্যন্ত। কখনো কখনো ২০ থেকে ৩০ জনের মতো হতাম। দলটা সব ধরনের স্পেনীয় স্থানিকতাকে (Locol color) ঘৃণা করত, যেমন_কান্তে হোন্দো এবং ষাঁড়ের লড়াই। ওরা বেশি পছন্দ করত আমেরিকান জাজ আর স্পেনীয় হওয়ার চেয়ে ইউরোপীয় হওয়াটাই। কান্সিনোস বিষয় প্রস্তাব করত_রূপক, ফ্রি ভার্স, কবিতার ঐতিহ্যবাহী প্রকরণ, আখ্যান কবিতা, বিশেষণ, ক্রিয়া। একেবারে তাঁর নিজের ধরনে তিনি ছিলেন একনায়ক (Dictator), সমকালীন লেখকদের অবন্ধুসুলভ। পরোক্ষ উল্লেখ তিনি অনুমোদন করতেন না এবং আলাপ-আলোচনাকে তিনি উঁচুস্তরে ধরে রাখার চেষ্টা করতেন।

কান্সিনোস ছিলেন গোগ্রাসি পাঠক। তিনি ডি-কুয়েন্সির ‘গাঁজাখোর’ (Oyium-Easer) গ্রিক থেকে মার্কাস আউবেলিয়াসের ‘অনুধ্যান’, বারবুসের উপন্যাস এবং স্কোউবের ভিয়ে ইমাহিনারি (vies inaginares) পরে গ্যোটে এবং দস্তয়েভস্কির সমগ্র রচনা অনুবাদ করেন। আরব্য রজনীর প্রথম সংস্করণও তাঁরই করা, যা বার্টন এবং লেনের তুলনায় অনেক খোলামেলা (Free) হলেও আমার ধারণা, তা পড়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশি উপভোগ্য। একবার তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। আমাকে তাঁর গ্রন্থাগারে নিয়ে গেলেন। বরং বলা ভালো, তাঁর পুরো ঘরটাই ছিল গ্রন্থাগার। অরণ্যে পথ করে নেয়ার মতো ব্যাপার আর কি! শেলফ কেনার সামর্থ্য তাঁর ছিল না আর বইগুলো মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত একটার উপর আরেকটা উঁচু করে রাখা, যার ফলে আলম্ব এই বইয়ের স্তম্ভের মধ্য দিয়ে সাবধানে হাঁটা ছাড়া উপায় থাকে না। কান্সিনোসকে আমার কাছে মনে হয়েছিল যেন তিনি পেছনে ফেলে আসা ইউরোপের গোটা অতীত_প্রাচ্য এবং প্রতীচ্য, সব সংস্কৃতির এক প্রতীকের মতো। তবে ওনার মধ্যে যে বিকৃতি ছিল তা ওনাকে নেতৃস্থানীয় সমসাময়িকদের কাছাকাছি যেতে বাধা দিয়েছে। দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির লেখকদের ভূয়সী প্রশংসা করে বই লেখার মধ্যে এ ব্যাপারটা রয়েছে। ওর্তেগা ই গাসেৎ তখন খ্যাতির চূড়ায়, কিন্তু কান্সিনোস তাঁকে বাজে দার্শনিক এবং বাজে লেখক হিসেবে গণ্য করতেন। ওনার কাছ থেকে আমি আসলে যে জিনিসটা পেয়েছি তা হলো সাহিত্যিক আলাপের আনন্দ। আমি তাঁর Fardlung পাঠের দ্বারাও উদ্বুদ্ধ ছিলাম। লেখায় আমি তাঁর অনুকরণ করতে শুরু করেছিলাম। লেখায় তিনি অস্প্যানিশ এবং তীব্র হিব্রু স্বাদের দীর্ঘ এবং প্রবহমান বাক্য লিখতেন।

অনেক বেখাপ্পা মনে হলেও, কান্সিনোসই ১৯১৯ সালে আল্ট্রাইম পরিভাষাটি উদ্ভাবন করেন। তিনি মনে করতেন, স্প্যানিশ সাহিত্য সময় থেকে সর্বদাই পিছিয়ে আছে। হুয়ান লাস ছদ্মনামে তিনি কিছু ছোটগল্প, কিছু আলট্রাইস্ট Laconic লেখা লিখেছেন। গোটা বিষয়টাই এখন দেখলে মনে হয় রসিকতার (Mockeru) মানসিকতা থেকে করা। কিন্তু আমরা তরুণরা তখন এটাকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলাম। গিইয়ের্মো দে তোররে ছিল পাঁড় অনুসারীদের একজন, যার সঙ্গে আমার মাদ্রিদে দেখা এবং নয় বছর পরে আমার বোন নোরার সঙ্গে তার বিয়ে হয়।

সেই সময় মাদ্রিদে রামোন গোমেস দেলা ছেরনাকে ঘিরে আরেকটা দল ছিল। একবার আমি সেখানে গিয়েছিলাম কিন্তু আচার-আচরণ আমার ভালো লাগেনি।

১৯২১ সালের মার্চের শেষ দিকে ‘রেইনা বিক্তোরিয়া এউহেনিয়া’ জাহাজে চেপে আমরা বুয়েনস আয়ার্সে ফিরে এলাম। অনেক ইউরোপীয় শহরে থেকে আসার পর জেনেভা, জুরিখ, নিমস, কর্ডোভা ও লিসবনের অজস্র স্মৃতি নিয়ে নিজ শহরে ফিরে আসার পর বিস্মিত হলাম এর চেহারা দেখে, কত বড় হয়ে গেছে আমার এত চেনা শহরটা! চেনাই যায় না নতুন বিশাল এলোমেলোভাবে গড়ে ওঠা শহরটাকে। আনুভূমিক ছাদওয়ালা নিচু নিচু ভবনের সারি যেন শেষই হয় না, পশ্চিমে সীমানা ছাড়িয়ে চলে গেছে এদিকটায় যেটাকে ভূগোলবিদ আর সাহিত্যের লোকজন পাম্পা নামে ডাকে। ঘরে ফেরা নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু : পুনরাবিষ্কার। আমি খুব উৎসাহ নিয়ে আগ্রহসহকারে বুয়েনস আয়ার্সকে দেখতে পেলাম। কেননা বহুদিন হয় আমি এর কাছ থেকে দূরে ছিলাম। এত দিন পর একে দেখে যেমন করে অদ্ভুত এক ধাক্কা আমার অনুভূতিতে দোলা দিল, যেমন করে আমাকে উত্তেজিত করে তুলল আমার এই শহর_সেটা বিদেশে যদি কোনো দিন না যেতাম তাহলে ঘটত কি না জানি না। অবশ্যই গোটা শহরের কথা বলছি না, বরং এর কিছু কিছু জায়গা যার একটা অন্যরকম আবেদন ছিল আমার কাছে, যার অনুপ্রেরণায় আমার এখন প্রকাশিত বই কাব্যগ্রন্থ ‘ফের্বোর দে বুয়েনস আয়ার্স’-এর কবিতাগুলো লেখা।

কবিতাগুলো লিখেছিলাম ১৯২১ এবং ১৯২২ সালে আর বই আকারে বের হলো ১৯২৩ সালের শুরুতে। বইটা আসলে ছাপা হয়েছিল পাঁচ দিনে; চটজলদি ছাপাতে হয়েছিল, কারণ হঠাৎ আমাদের ইউরোপ ফিরে যেতে হচ্ছিল। চৌষট্টি পৃষ্ঠার একটা বই করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কিন্তু পাণ্ডুলিপিটি বেশি বড় হয়ে গেল এবং শেষ পর্যন্ত পাঁচটি কবিতা বাদ পড়ল। আমার কোনো কিছুই আজ মনে নেই। এক ধরনের ছেলেমানুষি মনোভাব নিয়ে বইটার কাজ হয়েছিল। কোনো রকম প্রুফ দেখা হয়নি, কোনো সূচিপত্র ছিল না, আর কোনো পৃষ্ঠা সংখ্যাও দেওয়া হয়নি। আমার বোন প্রচ্ছদের জন্য একটা কাঠখোদাই চিত্র ব্যবহার করল এবং মোট ৩০০ কপি ছাপা হয়েছিল। তখনকার দিনে বই প্রকাশনার কাজটা ছিল একটা ব্যক্তিগত উদ্যোগের ব্যাপার। বই বিক্রেতাদের কাছে কিংবা বইয়ের আলোচনার জন্য কাউকে কোনো কপি পাঠানোর কথা আমি কখনো ভাবিনি। বেশির ভাগ কপিই আমি এদিক-ওদিক বিলি করেছি। কিভাবে বিলি করেছিলাম তার একটা পন্থা মনে আছে। সেই সময় বহুকাল ধরে পরিচিত নির্ভরযোগ্য ম্যাগাজিনগুলোর একটি ছিল ‘নোসোত্রোস’। খেয়াল করলাম, বহু লোক ওই ম্যাগাজিনের অফিসে যায় এবং ক্লোকরুমে তাদের ওভারকোট ঝুলিয়ে রেখে ভেতরে ঢোকে। আমার বইয়ের ৫০ কি ১০০টা কপি নিয়ে ওই ম্যাগাজিনের অন্যতম সম্পাদক আলফ্রেদো বিয়াঞ্চির কাছে গেলাম। বিয়াঞ্চি আমার দিকে বিস্ময়-মেলে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি চাইছো তোমার এই বইগুলো আমি বিক্রি করে দিই?’ ‘না’_আমি উত্তরে বললাম। ‘যদিও কবিতাগুলো আমারই লেখা, কিন্তু আমি ঠিক ওই অর্থে পাগল নই। আমি ভাবছি, আপনাকে হয়তো বলতে পারি, এ বইগুলোর কয়েকটা ওইখানে ঝুলে থাকা কোটগুলোর পকেটে ঢুকিয়ে দিতে পারেন কি না।’

বইটা ছিল মূলত রোমান্টিক ধাঁচের, যদিও লেখা হয়েছিল যৎসামান্য সাদামাটা ভঙ্গিতে এবং প্রচুর পরিমাণে স্বল্পবাক রূপকালংকার ব্যবহার করেছিলাম। সূর্যাস্ত, নির্জন জায়গা এবং শহরের অপরিচিত সব কোনাঘুপচির বন্দনা গীত করা হয়েছে বইটিতে; একটু সাহস করে বার্কলির অধিবিদ্যায় চলে গেছি কখনো কখনো; আর আছে প্রথম সব প্রেমের কথা। একই সঙ্গে কাব্যগ্রন্থটিতে সপ্তদশ শতাব্দীর স্প্যানিশ কবিতার অনুকরণ আছে এবং মুখবন্ধে আমি স্যার টমাস ব্রাউনের রেলিহিও মেদিসির উল্লেখ করেছি। পরিতাপের সঙ্গে বলতেই হয়, বইটা সব মিলিয়ে ছিল বড়দিনের কিশমিশ বসানো পুডিংয়ের মতো_এত কিছু একসঙ্গে। কিন্তু তার পরও পেছন ফিরে দেখলে বলতে হয়, আমার মনে হয় না আমি পরে ওই বই থেকে বের হতে পেরেছি। আমার ধারণা, আমার পরবর্তী সব রচনার বীজ এই প্রথম বইটিই। আমার মনে হয়, আমার বাকি জীবন ধরে ওই একটা বই-ই বার বার লিখে যাচ্ছি।

‘ফের্বোর দে বুয়েনস আয়ার্স’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলি কি আলট্রাইস্ট? ইউরোপ থেকে আমি যখন ফিরে এলাম ১৯২১ সালে, আমি সঙ্গে করে ‘আলট্রাইজম’-এর লেবাস নিয়ে এসেছিলাম। সাহিত্যের ঐতিহাসিকদের কাছে এখনো আমি ‘আর্জেন্টাইস আলট্রাইজমের জনক’ হিসেবে পরিচিত। দেশে ফিরে আমি যখন বিষয়টা নিয়ে এদুয়ার্দো গোঞ্জালেস লানুসা, নোরাহ্ ল্যাঞ্জ, ফ্রান্সিসকো পিলিয়েরো, আমার মামাতো ভাই গিইয়ের্মো হুয়ান (বোর্হেস) এবং রোবের্তো ওর্তেইয়ি প্রমুখ সমকালীন কবির সঙ্গে আলোচনায় বসি, তখন শেষ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে আধুনিকতা ও গেজেটের তোপে স্প্যানিশ আলট্রাইজম অতিমাত্রায় ভারাক্রান্ত, ফিউচারিজমের মতোই। রেলট্রেন, প্রোপেলার, এরোপ্লেন এবং ইলেকট্রিক ফ্যান_এর কোনো কিছুই আমাদের আকর্ষণ করল না। আমাদের ইশতেহারে আমরা রূপকের প্রাধান্য বজায় রেখে পরিবর্তন ও আলংকারিক বিশেষণকে খারিজ করে দিয়ে আসলে লিখতে চাইছিলাম মৌলিক কবিতা_আজ এবং এই স্থান, এই কালের গণ্ডি পেরোনো কবিতা, দেশজ বৈশিষ্ট্য বিবর্জিত এবং সমকালীন ঘটনাপ্রবাহের কাছ থেকে মুক্ত, স্বাধীন। আমার ধারণা, PLAINNESS নামের কবিতাটি আমি ব্যক্তিগতভাবে যা লিখতে চাইছিলাম-তার যথাযথ প্রকাশ ঘটায় : The garden’s grill works gate

opens with the ease of a page
in a much thumbed book,
and, once inside, our eyes
have no need to dwell on objects
already fixed and exact in memory.
Here habits and minds and the private language
all families invent
are everyday things to me.
What necessity is there to speak
or pretend to be someone else?
The whole house knows me,
they�re aware of my worries and weakness.
This is the best that can happeng-
what Heaven perhaps will grant us;
not to be wondered at or required to succeed
but simply to be let in
as part of an undeniable Reality,
like stones of the road, like trees.

আমার ধারণা, আমার প্রথম দিককার স্প্যানিশ আলট্রাইস্ট ধাঁচের কবিতাগুলোর মুখচোরা অতি উচ্ছ্বাসের চেয়ে একেবারেই অন্য রকম। আমার সেসব কবিতা ছিল এ রকম : বন্দুক কাঁধে লোককে দেখেছি ট্রলি কার হিবেসে, সূর্যোদয়ের মধ্যে দেখেছি চিৎকার, কিংবা সূর্যাস্তকে পশ্চিমে ক্রুশবিদ্ধ হতে। পরে এক সময় এ ধরনের অদ্ভুত সব বাক্যবন্ধ পড়িয়ে শোনাতেই আপাদমস্তক সুস্থ আমার এক বন্ধু বলেছিল, ‘ওহ্, আমি বুঝতে পারছি তোমার কাছে কবিতার মূল লক্ষ্যই হলো কাউকে চমকে দেওয়া।’ ফের্বোর দে বুয়েনস আয়ার্স’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো আলট্রাইস্ট কি না তার সদুত্তর আমার হয়ে আমার বন্ধু ও ফরাসি অনুবাদক নেস্তোর ইবাররা দিয়েছিল, ‘তার প্রথম আলট্রাইস্ট কবিতা লেখার সঙ্গে সঙ্গে বোর্হেস আলট্রাইস্ট কবিদের গোত্রমুক্ত হয়ে পড়েন।’ এখন আমি শুধু আমার শুরুর দিকে চড়া সুরের আলট্রাইস্ট কবিতাগুলোর জন্যই আফসোস করতে পারি। প্রায় অর্ধশতাব্দী পর আজও আমার জীবনের সেই বিদঘুটে পর্বটাকে মানিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি।

বুয়েনস আয়ার্স ফিরে আসার পর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ছিল মাসেদোনিও ফের্নান্দেসে’র সাক্ষাৎ। আমার জীবনে যত মানুষের দেখা পেয়েছি, যাঁদের মধ্যে আছেন অসাধারণ কয়েকজন_তাঁদের মধ্যে মাসেদোনিওর মতো এতটা গভীরভাবে আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখেননি আর কেউ। কালো একটা বোউলার টুপি পরা ছোটখাটো একজন মানুষ, আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন উত্তরা দার্সেনা বন্দরে। জাহাজ ভেড়ার পর বাবার সূত্র ধরে পরিচয় এবং সেই থেকে বন্ধুত্ব। তাঁরা দুজনই সমান বয়সী ছিলেন। জন্মেছিলেন ১৮৭৪ সালে। আপাত বিরোধিতা ছিল তাঁর চরিত্রে, একদিকে ছিলেন তুখোড় আলাপচারী আবার অন্যদিকে এমনিতে দীর্ঘ সময় থাকতেন চুপচাপ, কথা বলতেন মেপে মেপে। আমরা এক কাফেতে প্রতি শনিবার সন্ধ্যায় দেখা করতাম, প্লাসা দেল ওন্নের পেলা কাফেতে। ওখানে বসে ভোর না হওয়া পর্যন্ত আমরা কথা বলতাম, মাসেদোনিও হলেন গুরু আর আমি শিষ্য, এভাবে কথাবার্তা চলত। মাদ্রিদে যেমন কান্সিনোস ছিলেন সব শিক্ষার আধার আর এখন মাসেদোনিও হয়ে উঠলেন বিশুদ্ধ ভাবনার অবতার। ওই সময়টায় আমি ছিলাম এক গোগ্রাসী পাঠক, ঘর থেকে খুব একটা বের হতাম না (রাতের খাবারের পর, প্রতি রাতেই আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে আবার পড়তাম), কিন্তু আমার পুরো সপ্তাহটা কেটে যেত এই আশায় যে শনিবার মাসেদোনিওর সঙ্গে আমার দেখা হবে এবং মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনব। তিনি আমাদের বাড়ির কাছেই থাকতেন এবং চাইলেই যখন-তখন তাঁর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ আমার ছিল, কিন্তু আমার কেন যেন মনে হতো যে এ রকম একটি বাড়তি সুবিধা নেওয়ার কোনো অধিকারই আমার নেই এবং শনিবার পুরোপুরি করে মাসেদোনিওর কাছ থেকে অনেক কিছু নেব বলে সপ্তাহের বাকি দিনগুলোয় তাঁকে বিরক্ত না করাই ভালো। মাসেদোনিওর সঙ্গে যখন আমার দেখা হতো, তিনি সব মিলিয়ে হয়তো তিন কী চারবার সবিস্তারে কথা বলতেন। বাকি সময়টা তাঁর সঙ্গে বসা আমাকেই পর্যবেক্ষণ করতেন আর আমার কথার ফাঁকে ফাঁকে হয়তো দু-একটা মন্তব্য করতেন। মন্তব্যগুলো কখনোই উৎসাহব্যঞ্জক কিছু ছিল না। মাসেদোনিও অতিশয় ভদ্র ছিলেন, ছিলেন মিতভাষী, বলতেন এরকম, ‘আচ্ছা, আমার মনে হয় তুমি ব্যাপারটা খেয়াল করেছো...?’ এর পরই তাঁর কষ্টে উচ্চারিত হতো শূলবাঁধা অব্যর্থ মৌলিক কোনো চিন্তা। কিন্তু স্থিরচিত্তে, মন্তব্যটা ছুড়ে দিতেন তাঁর শ্রোতার প্রতি।

হ্যাংলা-পাতলা গোছের বিষণ্ন এক মানুষ ছিলেন তিনি। ছাই রঙা চুল এবং গোঁফ, দেখে মনে হতো মার্ক টোয়েন। লোকে এই সাদৃশ্যটার কথা বললে তিনি খুশি হতেন, কিন্তু যখন তাঁকে এও বলা হতো, তাঁর সঙ্গে পল ভালেরিরও যথেষ্ট মিল, তখন তিনি খেপে যেতেন, ফরাসিদের প্রতি তাঁর কোনো বিশেষ অনুরাগ ছিল না। তিনি সব সময় ওই বোউলার টুপিটা পরে থাকতেন এবং আমি যত দূর জানি ওটা পরে ঘুমাতেনও। শুতে যাওয়ার সময় তিনি কখনোই কাপড়-চোপড় পাল্টাতেন না। আর রাতে হাওয়ার দমকে না জানি আবার দাঁতের ব্যথা শুরু হয়, সে ভয়ে মাথার মধ্যে একটা তোয়ালে পেঁচিয়ে রাখতেন। তখন তাঁকে দেখে মনে হতো এক আরব। তাঁর অন্য পাগলামির মধ্যে ছিল তাঁর জাতীয়তাবাদ (একের পর এক সব আর্জেন্টাইন প্রেসিডেন্টকে তিনি অপ্রশংস দৃষ্টিতে দেখেছেন এই যুক্তি দেখিয়ে যে আর্জেন্টিনার নির্বাচন কমিশন ভুল করতে পারে না), দাঁত আর দাঁতের ডাক্তার নিয়ে তাঁর অদ্ভুত ভয় (মানুষজনের সামনেই হাত দিয়ে দাঁত ধরে টানাটানি করতেন, যাতে একটা সমাধান হয় এবং ডাক্তারের কাছে যেতে না হয়) এবং রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া পথচারী নারীদের প্রেমে পড়তেন ঘনঘন।

লেখক হিসেবে মাসেদোনিও অন্য ধরনের বেশ কিছু রচনা প্রকাশ করেছিলেন এবং তাঁর মৃত্যুর ২০ বছর পরও তাঁর অনেক অপ্রকাশিত লেখা গ্রন্থিত হচ্ছে এখন। ১৯২৮ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম বইটার নাম ছিল নো তোদা এস বিহিলিয়া লা দে লোস ওহোস্ আবিয়ের্তোস (আমরা চোখ খুলে থাকলেই জেগে থাকি না। আদর্শবাদ নিয়ে একটা সুবিস্তারে লেখা বই ছিল ওটা, জট পাকানো দুর্বোধ্য শৈলীতে লেখা; আমার ধারণা, বাস্তবতার জট পাকানো অবস্থাকে তুলে ধরার জন্য। পরের বছর পাপেলেস দে রেসিয়েনবেনিদো (এক নবিসের লেখা) শিরোনামে বিচিত্র সব রচনা নিয়ে তাঁর আরেকটি বই বের হয়, যেটাতে আমিও ছোটখাটো একটা ভূমিকা রেখেছিলাম, অধ্যায়গুলো দাঁড় করানো ও বিন্যাসের কাজে। ঠাট্টাচ্ছলে ঠাট্টা-তামাশা করে লেখা বিচিত্র সব রচনাকে একত্র করা যাকে বলে। মাসেদোনিও উপন্যাস এবং কবিতাও লিখেছেন, যার সবই চমকপ্রদ কিন্তু দুর্বোধ্য, পড়া যায় না। ২০ অধ্যায়ের একটা উপন্যাস আছে তাঁর যেটাতে মুখবন্ধে ৫৬টি ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা লেখা। বিশেষ চমৎকারিত্ব ছিল তাঁর, কিন্তু আমার মনে হয় না মাসেদোনিও তাঁর লেখার মধ্যে পাওয়া যায়। সত্যিকারের আসল মাসেদোনিওকে খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর কথোপকথনে।

মাসেদোনিও অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন, থাকতেন বোর্ডিং হাউসে, একেক সময়ে একেক জায়গায়। এর কারণ তিনি সব সময় ভাড়া দেওয়ার প্রসঙ্গ এলেই কেটে পড়তেন। প্রতিবার এক জায়গা থেকে আরেকটা নতুন জায়গায় যাওয়ার সময় গাদায় গাদায় পাণ্ডুলিপি সব পড়ে থাকত আগের বোর্ডিং হাউসে। একবার তাঁর বন্ধুরা এটা নিয়ে তাঁকে বেশ বকাঝকা করেছিলেন, বলেছিলেন যে এভাবে এত লেখা হারিয়ে যাচ্ছে ব্যাপারটা খুবই খারাপ। তিনি আমাদের বলেছিলেন, ‘তোমাদের কি ধারণা যে আমি যথেষ্ট ধনী যে সব হারিয়ে ফেলছি?’

যাঁরা হিউম এবং শোপেনহাওয়ার পড়েছেন, তাঁদের কাছে মাসেদোনিওর রচনায় নতুন করে কিছু পাওয়ার নেই, কিন্তু উল্লেখযোগ্য ব্যাপারটা হলো এ ব্যাপারে শেষ কথাটা তিনি নিজেই নিজের সম্পর্কে বলেছিলেন। পরে তিনি আগ্রহ সহকারে হিউম, শোপেনহাওয়ার, বার্কলি এবং উইলিয়াম জেমস পড়েছিলেন, কিন্তু আমার সন্দেহ হয় যে অন্যদের লেখা তিনি তেমন একটা পড়েননি, আর সব সময় একটা লেখকদের উদ্ধৃতিই দিতেন তিনি। তাঁর কাছে স্যার ওয়াল্টার স্কট ছিল শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক, হয়তো ছোটবেলায় পড়ে যে মুগ্ধতা তৈরি হয়েছিল তা থেকে আর বের হতে পারেননি। একবার উইলিয়াম জেমসের সঙ্গে তাঁর পত্রমিতালী গড়ে উঠেছিল, যাঁকে তিনি ইংরেজি, জার্মান ও ফরাসি মেলানো এক ভাষায় চিঠি লিখতেন, এর জন্য ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছিলেন যে ‘এই তিনটি ভাষা আমি এত কম জানি যে আমাকে অনবরত এ ভাষা থেকে ও ভাষায় গিয়ে শব্দ খুঁজতে হয়।’ আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, মাসেদোনিওর লেখা এক কি দুই পৃষ্ঠা পড়ার পর ভাবনারা এসে জড়ো হয়। তিনি বারংবার বলেন যে স্বপ্নের মতোই আমাদের নির্মাণ, কিন্তু এটা তিনি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে আমরা সবাই একটা স্বপ্নের পৃথিবীতে বাস করছি। সত্যের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে কি না এ নিয়ে মাসেদোনিওর সংশয় ছিল। তাঁর ধারণা, কতিপয় দার্শনিক সেটা আবিষ্কার করেছেন, যদিও কিন্তু তাঁরা ওটার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছেন সম্পূর্ণরূপে। যদিও পাশাপাশি তিনি বিশ্বাস করতেন, জাগতিক সব কিছু এবং নিজেকে ও নিজের খোঁজকে ভুলে গিয়ে যদি তিনি পাম্পাসে গিয়ে শুয়ে বসে থাকতে পারেন তাহলে হয়তো হঠাৎ সত্য এসে তাঁর দেখা দেবে। তিনি আরো বলেছেন, হঠাৎ দেখা পাওয়া ওই প্রজ্ঞাকে ব্যাখ্যা করা অবশ্যই অসম্ভব।

জ্ঞানী-গুণী প্রতিভাবান ব্যক্তিদের মুখের ছোট ছোট কথাবার্তা সব জড় করে লিখে রাখার একটা শখ ছিল মাসেদোনিওর। এরকমই একটা নোটে আমি রীতিমতো অবাক হয়ে আমাদের পরিচিত এক মিষ্টি স্বভাবের মহিলার নাম দেখলাম। তার নাম ছিল কিকা গোনসালেস্ আচা দে টমকিনসন আলবেয়ার। আমি মুখ হাঁ করে মাসেদোনিওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। হিউম এবং শোপেনহাওয়ারের নামের সঙ্গে কিকা, ওই মহিলার নাম কিভাবে আসে সেটা আমার বোধগম্য নয়। কিন্তু মাসেদোনিও বললেন, ‘দার্শনিকরা বিশ্বটাকে উপলব্ধি এবং ব্যাখ্যা করার চেষ্টাটা করে গেছেন, আর কিকা সহজেই ওটা বুঝে, অনুভব করে।’ তিনি কিকাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘কিকা, অস্তিত্ব কি?’ কিকা উত্তর দেয়, ‘আমি জানি না তুমি কি বলছ, মাসেদোনিও।’ দেখলে, মাসেদোনিও আমাকে বলেন, ‘সে এতটাই সঠিকভাবে বুঝে যে সে এমনকি এটাও বুঝতে পারে না যে আমরা ধাঁধায় পড়ে আছি।’ কিকা যে একজন প্রতিভাবান নারী, এ কথাই সেটা প্রমাণ করে তাঁর কাছে। পরে আমি যখন তাঁকে বললাম যে আপনি তো একটি শিশু বা বিড়ালের ব্যাপারেও একই কথা বলতে পারেন, তখন মাসেদোনিও রেগে যান। মাসেদোনিওর সঙ্গে পরিচয়ের আগে আমি বরাবর ছিলাম এমন এক পাঠক যে যেকোনো কিছু পড়লেই সেটা বিশ্বাস করে ফেলে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব পড়া উচিত_এ ধারণাটা আমার মধ্যে পুঁতে দেন মাসেদোনিও, আমার জন্য এটাই তাঁর সবচেয়ে বড় উপহার। শুরুতে আমি তাঁকে পুরোপুরি নকল করে এটা-ওটা লিখেছি, তাঁর শৈলী ও আঙ্গিকগত কিছু বৈশিষ্ট্য আমার মধ্যে এসে গিয়েছিল, যার জন্য পরবর্তী সময়ে আমার অনেক অনুশোচনা হয়েছে। এখন পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলে মাসেদোনিওকে মনে হয় স্বর্গোদ্যানে কিংকর্তব্যবিমূঢ় এক আদম। বিস্ময় জাগানিয়া প্রতিভা নিয়ে তিনি আজও আছেন আমাদের মাঝে, কিন্তু তাঁর রচনার সামান্যই আজ পড়া হয়; তাঁর প্রভাবটা অনেকটা সক্রেটিস ধাঁচের। আমি তাঁকে আসলেই ভালোবাসতাম, পূজাই করতাম বলা চলে।

১৯২১ থেকে ১৯৩০_এই সময়টা ছিল সৃষ্টিশীলতার দিক থেকে বেশ বড় একটা অধ্যায়। কিন্তু বোধকরি এর বেশির ভাগই ছিল বাঁধভাঙা আবেগী এবং এমনকি অর্থহীন। কম করে হলেও সাতটি বই রচনা ও প্রকাশ করেছিলাম এই সময়টায়_এদের চারটি বই প্রবন্ধের আর বাকি তিনটি কবিতার। পাশাপাশি তিনটি ম্যাগাজিনও বের করেছিলাম আর ডজনখানেক শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা যেমন লা প্রেন্সা, নোসোত্রোস, ইনিসিয়াল, ক্রিতেরিও এবং সিন্তেসিসর জন্য প্রায়ই এটা-ওটা লিখেছি। এত লেখা কিভাবে লিখলাম সেটা ভাবলেই অবাক হতে হয়। কারণ ওই সময়ে লেখা রচনাগুলোর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা অনেক দূরের। চারটি প্রবন্ধ বইয়ের তিনটি_যেগুলোর নাম আর মনে না করাই ভালো_আমি আর দ্বিতীয়বার ছাপাতে দিইনি। ঘটনাবশত ১৯৫৩ সালে আমার বর্তমান প্রকাশক এমেসে যখন আমার ‘সমগ্র রচনা’ বের করার প্রস্তাব দিল, একমাত্র এই কারণে আমি তাদের প্রস্তাবে সায় দিলাম। আমার ওইসব অসংগত রচনাগুলো থাকতে পারবে না। আমার এখন মার্ক টোয়েনের কথা মনে পড়ছে, যিনি একবার বলেছিলেন যে একটা ভালো পাঠাগারের সূচনা হতে পারে। এর সংগ্রহ জেন অস্টেনের বইগুলো না রেখেও এবং এমনকি ওই পাঠাগারে যদি একটাও কোনো বই না থাকে তাও ভালো, এই কারণে যে অন্তত জেন অস্টেনের বইগুলো তো বাদ গেল।

এই সময়কালের কবিতাগুলোর মধ্যে আমার দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থটিও বোধকরি বাদ দেওয়া উচিত ছিল। ১৯২৫ সালে প্রকাশিত লুনা দে এনফ্রেন্তে (মুন অ্যাক্রস দ্য ওয়ে) নামের এই কাব্য সংকলনটি একেবারে দেশজ রূপ-রস-গন্ধে ভরা। উনবিংশ শতাব্দীর চিলিয়ান রীতিতে আমার প্রথম নাম ঔড়ৎমব’র বানান ‘ঔড়ৎলব’ করে ছেপেছিলাম বইটি যা একটি ছেলেমানুষি বই আর কিছুই নয়। স্প্যানিশ প্রমিত বানান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার একটা বৃথা চেষ্টা আর কি! বইটির পরবর্তী সংস্করণে আমি সবচেয়ে বাজে কবিতাগুলো বাদ দিয়ে দিলাম, খামখেয়ালি ভাবকে ছেঁটে কেটে ফেলে অনেক বিয়োজন ও সম্পাদনার পর কবিতাগুলোকে একটি মার্জিত রূপে নিয়ে আসলাম। এ সময়কালের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থটিতে (কুয়াদের্নো সান মার্তিন শিরোনামের) বেশ ভালো কিছু কবিতা ঠাঁই পেল, যেমন লা নোচে কে এন এল সুর লো বেলারোন, যে নামটি রবার্ট ফিটজেরাল্ড চমৎকারভাবে ইংরেজিতে ডেথওয়াচ অন দ্য সাউথসাইড নামে অনুবাদ করেছেন। আর ছিল মুয়ের্তেস দে বুয়েনোস আইরেস (ডেথস অব বুয়েনোস আইরেস)। যে কবিতাটি আর্জেন্টিনার রাজধানীর দুইটি প্রধান কবরস্থান নিয়ে লেখা। বইটির একটি কবিতা (আমার পছন্দের তালিকায় এটি নেই) কেমন করে জানি আর্জেন্টিনায় বেশ সাড়া ফেলে দিয়ে ক্ল্যাসিকে পরিণত হয়েছে : ‘দি মিথিক্যাল ফাউন্ডিং অব বুয়েনোস আইরেস।’ এই বইটিও পরিমার্জিত বা পরিশুদ্ধ করা হয়েছে, বছরের পর বছর ধরে নানা বিয়োজন ও সংশোধনের পর।

১৯২৯ সালে আমার তৃতীয় প্রবন্ধ সংকলনটি এক হাজার পেসো মূল্যমানের দ্বিতীয় মিউনিসিপ্যাল পুরস্কারে ভূষিত হয়, ওই সময়ে যে অর্থ বেশ অনেকখানি। ওই অর্থের একটি পরিমাণ দিয়ে আমি এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকার একাদশ সংস্করণের একটি পুরনো সেট কিনলাম। আর বাকিটা আমার এক বছর নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দেওয়ার যোগান করে দিল এবং আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আর্জেন্টিনার কিছু নিয়ে ব্যাপক আকারে একটি দীর্ঘ বই লিখব। আমার মা চাইলেন আমি আস্কাবুসি, আলমাফুয়ের্তে কিংবা লুগোনেস_এই তিন গুরুত্বপূর্ণ কবির যেকোনো একজনকে নিয়ে লিখি। আজ মনে হচ্ছে, সেটা করলেই হতো। বরং আমি এবারিস্তো কাররিয়েগো নামের প্রায় এক অখ্যাত কবিকে নিয়ে লিখলাম। আমার মা ও বাবা বললেন যে, তাঁর কবিতা তো ভালো না। ‘কিন্তু তিনি আমাদের বন্ধু এবং প্রতিবেশী’ আমি বললাম। ‘ভালো, তুমি যদি মনে কর এই কারণে তাঁকে বিষয় করে একটি বই লেখা যায়, তাহলে লেখো,’ তাঁরা বললেন। পরিত্যক্ত জীর্ণশীর্ণ শহরতলি_আমার শৈশবের পালের্মোকে কেন্দ্রে রেখে যে সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব এ ব্যাপারটা কার্বিয়েগোই চিহ্নিত করেছিলেন। ট্যাংগো নাচ ও সংগীতের বেড়ে ওঠার মতোই তাঁর জীবন ও জীবিকা আমোদ-ফুর্তিতে মেতে ওঠা, দুঃসাহসিক, শুরুতে নির্ভীক যা পরে সেন্টিমেন্টাল হয়ে ওঠে। ১৯১২ সালে, মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে, যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান_ একটামাত্র বই লিখে। ওই বইয়ের একটা কপির কথা আমার মনে আছে, আমার বাবার সংগ্রহে ছিল। আমরা জেনেভায় যাওয়ার সময় যেসব আর্জেন্টাইন বই নিয়ে গিয়েছিলাম সঙ্গে করে তার মধ্যে ছিল ওটা, যা আমি ওখানে বারবার পড়েছি। ১৯০৯ সালে কার্বিয়েগো আমার মাকে একটি কবিতা উৎসর্গ করেন। আসলে আমার মায়ের ফটো অ্যালবামে কবিতাটি লিখে দিয়েছিলেন। ওটাতে তিনি আমার কথা উল্লেখ করেছিলেন: চাইব... তোমার ছেলে... আরো এগিয়ে যাক, উৎসাহের বিশ্বস্ত পাখনায় ভর দিয়ে, এক পূর্ববার্তা নিয়ে, উত্তুঙ্গ আঙ্গুর থেকে একদিন সে যেন সংগীতের সুরা ফলায়।’ কিন্তু আমি যখন বইটা লেখা শুরু করলাম তখন আমার ক্ষেত্রে একই ব্যাপার ঘটল_ যেমনটা ফ্রেডরিক দ্য গ্রেট লিখতে গিয়ে কার্লাইলের হয়েছিল। যতই লিখছিলাম, ততই আমার রচনার নায়ককে ভুলে যাচ্ছিলাম। একেবারে সোজাসাপ্টা একটা জীবনী লিখতে শুরু করে মাঝপথে এসে বারংবার চলে যাচ্ছিলাম পুরনো বুয়েনেস আয়ারেসে, যাবতীয় কৌতূহল নিয়ে। পাঠকরা ওটা পড়তে শুরু করলে বেশিদূর যেতে হয় না এটা বুঝতে যে, বইটির নাম এবারিস্তো কার্বিয়েগোর সঙ্গে এর ভেতরের তেমন কোনো যোগসূত্র নেই, এ বইটার সুরে ছন্দপতন ঘটে। ১৯৫৫ সালে, পঁচিশ বছর পর যখন এর দ্বিতীয় সংস্করণ বের হয় আমার রচনাসমগ্রের চতুর্থ খণ্ড হিসেবে, তখন আমি আরো কিছু নতুন অধ্যায় সংযোজন করে বইটির কলেবর বৃদ্ধি করি। যাতে হিস্ট্রি অব ট্যাংগো নামে একটি অধ্যায় ছিল। এই সংযোজনের কারণে আমার বিশ্বাস এবারিস্তো কার্বিয়েগো বইটিতে বাড়তি ভালো কিছু পাওয়া যায়।

ওই বছরগুলো ছিল বেশ সুখের; কেননা অনেক বন্ধুত্ব জুটেছিল আমার। নোরাহ ল্যাঞ্জ মাসেদোনিও, পিনিয়েরো এবং আমার বাবার বন্ধুত্বের কথা আলাদাভাবে বলতে হয়। আমাদের সবার কাজের পিছনে একটা নিষ্ঠা ছিল; আমাদের মনে হচ্ছিল আমরা গদ্য ও পদ্য দুটোকেই নতুন করে সাজাচ্ছি। আর সব তরুণের মতন আমিও, অবশ্যই, যতটা অসুখী থাকা যায় সেই চেষ্টা করছিলাম_ হ্যামলেট ও রাস্কোলনিকভ এ দুই চরিত্রকে জড়ো করলে যা হয় সেরকম কিছু একটা। আমরা যা অর্জন করেছিলাম সেটা ভালো কিছু না, কিন্তু আমাদের সহমর্মিতা ও বন্ধুত্ব টিকে ছিল।

১৯২৪ সালে, আমি দুই ধারার সাহিত্য গোষ্ঠীর মধ্যে গিয়ে পড়লাম। একটা ধারা, যেটার স্মৃতি মনে করে আজো আমি আনন্দিত হয়ে উঠি, ছিল রিকালদো গুইলারদেসর। যিনি তখনো দোন সেগুন্দো সোম্ব্রা লেখেননি। গুইরালদেস আমার প্রতি অত্যন্ত সদয় ছিলেন। আমি তাঁকে হয়তো একটা বেশ জবরজং কবিতা দিলাম আর তিনি সেটা একেবারে ছত্র ছত্র ধরে পড়ে বলে দিতেন যে, আমি কী বলতে চাইছি; কিন্তু সাহিত্যিক অদক্ষতার কারণে সেটা বলতে পারছি না ঠিকভাবে। তারপর তিনি অন্যদের সঙ্গে কবিতাটি নিয়ে কথা বলতেন_ যাঁরা তাঁর আলোচনা শুনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেতেন যে, ওই বিষয়গুলো তো তারা পড়ে বুঝতে পারেননি। অন্য ধারার গোষ্ঠীটি, যার জন্য আমার অনুশোচনাই হয়, সেটি ছিল মার্তিন ফিয়েররো সাময়িকীর। মার্তিন ফিয়েররো যে ধারার সাহিত্য চর্চা করত সেটা আমার মোটেই পছন্দ ছিল না। তাদের বক্তব্য ছিল ফরাসি এ ভাবধারার যে, সাহিত্য প্রতিনিয়তই পুনর্জাগরিত হচ্ছে। আদম প্রতিদিন সকালেই নতুন করে জন্ম নিচ্ছেন এবং এ ধারণা যে, সাহিত্য মানেই প্যারিস, ওখানেই সব, আমাদের উচিত হবে ওদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা এবং ওদেরকে অনুসরণ করা। এ দুই ধারার কারণে একটি সাহিত্যিক কলহ দানা মেলল বুয়েনেস আয়ারেসে_ফ্লোরিদা আর বোয়েদোর মধ্যে। একদিকে ফ্লোরিদা হলো শহরের ধনী কেন্দ্রভাগকে প্রতিনিধিত্ব করছে আর অন্যদিকে বোয়েদো হলো প্রোলেতারিয়েত। আমি বোয়েদো গোষ্ঠীর মধ্যেই থাকার পক্ষপাতী, কেননা পুরনো শহরতলী, এর উত্তরভাগ, বস্তি, দুঃখ-দুর্দশা এবং সূর্যাস্ত নিয়েই আমি লিখছিলাম। কিন্তু দুই ষড়যন্ত্রকারী দলের একজন করে এসে আমাকে জানাল_ ফ্লোরিদার এনেস্তো পালাসিও এবং বোয়েদোর রোবের্তো মারিয়ানি_ যে আমি নাকি ফ্লোরিদা যোদ্ধাদের একজন হয়েই আছি এরই মধ্যে, এখন আর আমার ভেবে লাভ নেই, যা দেরি হওয়ার হয়েই গেছে, চাইলেও এখন আর অন্য দলে যাওয়ার উপায় নেই। পুরো ব্যাপারটাই ছিল গোলমেলে, যে যার মতো করে ঘট পাকাচ্ছিল। কয়েকজন লেখক ছিলেন দুই গোষ্ঠীরই_যেমন রোবের্তো আর্লত্ এবং নিকোলাস ওলিবারি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিশ্বাসপ্রবণ পণ্ডিতরা এ কলহটাকে নিয়ে এখন অনেক গবেষণা করেন। কিন্তু আদতেই ওটা ছিল কিছুটা পাবলিসিটি আর কিছুটা ছেলেমানুষি।

এ সময়ের সঙ্গে আরো জড়িয়ে আছে সিলবিনা ও বিক্তোরিয়া ওকাম্পোর নাম। আরো ছিলেন কবি কার্লোস মাস্ত্রোনার্দি, এদুয়ার্দো মাইয়েআ এবং বিশেষ করে আলেহান্দো শুল সোলার। সোজাসাপ্টাভাবে বলতে গেলে, বলা যায় যে, শুল_যিনি ছিলেন মরমী কবি ও চিত্রশিল্পী, হলেন আমাদের উইলিয়াম ব্লেক। একই সময়ে, আলফোনসো রেয়েসর সঙ্গেও আমার পরিচয় হয়েছিল। আর্জেন্টিনায় মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত ছিলেন তিনি এবং প্রতি রবিবার আমাকে তাঁর দূতাবাসে রাতের আহারের নিমন্ত্রণ জানাতেন। আমার মতে রেয়েস এ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ গদ্যশিল্পী এবং আমার রচনার সাদাসিধেভাবে, ঋজুতার অনেকটুকু তাঁর কাছ থেকেই শেখা।

আমার জীবনের এই পর্বটাকে এক কথায় হাজির করতে গিয়ে আমি সেই সময়ের উদ্ধত সেই তরুণের কথা ভেবে কোনো অনুকম্পাই বোধ করছি না। ওই বন্ধুরা, আজো দিব্যি আছেন এবং আমার সঙ্গে তাঁদের সুসম্পর্ক আজো বিদ্যমান। সত্যি কথা বলতে কি, তাঁরা আমার এক অমূল্য অংশ। বন্ধুত্ব, আমার ধারণা, একটি দুঃখমোচনীয় আর্জেন্টাইন প্যাশন।

১৯৬৮ থেকে ১৯৭২_এই পাঁচ বছর বুয়েনস আয়ার্সে ছিলেন নরম্যান টমাস ডি জোভানি্ন, যার ফলে বিশ্বসাহিত্যের ভাণ্ডারে যোগ হয়েছে হোর্হে লুই বোর্হেসের রচনার অনবদ্য কয়েকটি ইংরেজি অনুবাদগ্রন্থ। নিজ জীবন নিয়ে কোনো কিছু লেখার কোনো রকম আগ্রহ কোনো দিনই ছিল না বোর্হেসের। এই নরম্যানই তাঁকে বাধ্য করেন সেই কাজে, যার ফসল ইংরেজিতে লেখা ২০ হাজার শব্দের আত্মজৈবনিক রচনা। বোর্হেসের পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবনের এই দলিলখানা উপহার দেওয়ার জন্য নরম্যান টমাস ডি জোভানি্নর কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

হোর্হে লুই বোর্হেস ও নরম্যান টমাস ডি জোভানি্ন রচিত মূল ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন: রাজু আলাউদ্দিন ও রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী। 




গী দ্য মোপাসঁ এর গল্প - নববর্ষের উপহার


অনুবাদ: শামসুজ্জামান হীরা

জ্যাক দ্য রাঁদাল, ঘরেই খাওয়া-দাওয়া সেরে তার গৃহপরিচারককে চলে যেতে বলে টেবিলে গিয়ে চিঠি লিখতে বসল।

এভাবেই সে বছরের সমাপ্তি টানে, লিখে এবং স্বপ্ন দেখে। জীবনের ঘটনাগুলোর মূল্যায়ন করে সে বিগত বছরের শুরু থেকে, যে বিষয়গুলো ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে: এবং যে আনুপাতিক গুরুত্ব নিয়ে তার বন্ধুদের চেহারা তার সম্মুখে হাজির হয়, জানুয়ারির প্রথম দিনেই নববর্ষের অভিনন্দন জানিয়ে সে তাদেরকে কয়েক ছত্র লেখে।


সুতরাং সে বসে পড়ল, ড্রয়ারটা খুলল, বার করল এক মহিলার ফটোগ্রাফ, কয়েক মুহূর্ত ওটার দিকে তাকিয়ে থাকল, চুমু খেল। তারপর ওটাকে এক টুকরো কাগজের ওপর বিছিয়ে রেখে সে শুরু করল:

“আমার প্রিয় ইরেনি: তুমি নিশ্চয়ই এরই মধ্যে আমার পাঠানো ক্ষুদ্র উপহারটি পেয়ে থাকবে, পরিচারিকাকে

তুমি যেভাবে বলেছিলে। আজ সন্ধ্যায় আমি সবকিছু থেকে নিবৃত রয়েছি তোমাকে এ-কথা বলতে যে...”

কলম এখানেই থেমে গেল। জ্যাক উঠে দাঁড়াল এবং এদিক-ওদিক পায়চারি করতে লাগল।

গত দশ মাস যাবত তার একজন প্রেমিকা রয়েছে। অন্য কারও মত নয়, যেমন নাট্যজগত বা অভিজাতসমাজের কোনও রমণী যার সঙ্গে কেউ গোপন কিছুতে লিপ্ত হয়। এমন একজন মহিলা যাকে সে ভালোবাসে এবং জয় করেছে। যদিও এখন তার সেই যৌবন আর নেই, তবে তুলনামূলকভাবে অনেকের চেয়েই সে এখনও যথেষ্ট যুবক। জীবনকে সে দেখে বাস্তব ও ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে।

সে নিয়মমাফিক আবেগের ব্যালান্সশিট, মানে স্থিতিপত্র তৈরি করে সেইভাবে, যেভাবে সাংবৎসরিক হিসাব কষে ছেড়ে-যাওয়া বন্ধুদের এবং বিশেষ পরিস্থিতিতে তার জীবনে নতুনভাবে আবির্ভূত ব্যক্তিদের।

তার প্রাথমিক প্রবল প্রেমানুভূতি কিছুটা থিতিয়ে এলেও, মহিলাটির সঙ্গে তার হৃদয়ের সম্পর্কটা কোন পর্যায়ে এবং ভবিষ্যতে এটা কী রূপ নিতে পারে, একজন ব্যবসায়ীর নির্ভুলতা নিয়ে হিসাব কষে ওটার ওপর একটা ধারণা সে গড়ে তোলে।

সে দেখল, মহিলাটির প্রতি তার প্রবল এবং গভীর মমত্ববোধ গড়ে উঠেছে করুণা, কৃতজ্ঞতা এবং হাজারও অস্পষ্ট অনুভূতির সমন্বয়ে, এবং তা জন্ম দিয়েছে দীর্ঘ ও শক্তিশালী এই সম্পর্কের।

দরজায় ঘণ্টা বেজে ওঠায় সে সচকিত হল; কিছুটা ইতস্তত করল। দরজা খুলবে কি? অতঃপর আপন মনেই বলল, নববর্ষের রাতে প্রত্যেকেরই দরজা খোলা উচিত। যেই হোক না কেন, কড়া নাড়লে অপরিচিত হলেও সাড়া দেওয়া উচিত।

সে মোমবাতিটা হাতে তুলে নিল, বৈঠকখানার মধ্য দিয়ে এগোল, ছিটকিনি খুলল, চাবি ঘোরাল, কপাট টানল এবং দেখল মৃত মানুষের মত ফ্যাকাশে চেহারা নিয়ে তার প্রেয়সী দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

সে অবাক হয়ে তোতলাল:

“কী হয়েছে তোমার?”


মহিলা পাল্টা প্রশ্ন করল:“তুমি কি একা?”

“হ্যাঁ।”

“চাকর-বাকর নেই?”

“উহুঁ।”

“তুমি বাইরে যাচ্ছ না?”

“না।”

মেয়েলি ঠাঁট নিয়ে সে তার চেনা ঘরটিতে প্রবেশ করল। ড্রয়িংরুমে ঢুকেই সে সোফাতে গা ডুবিয়ে দিয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে করুণ সুরে কান্না শুরু করে দিল।

রাঁদাল তার পায়ের কাছে হাঁটুগেড়ে বসে মুখের ওপর থেকে তার হাত সরানোর চেষ্টা করল, যেন সে ওর চেহারা দেখতে পায়, এবং বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠল:

“ইরেনি, ইরেনি, তোমার কী হয়েছে? আমি মিনতি করছি, বল, কী হয়েছে তোমার?”

তখন ফোঁপাতে ফোঁপাতে অনুচ্চ সুরে সে বলল:

“আমি এভাবে আর বাঁচতে পারব না।”

“এভাবে বাঁচতে পারবে না, কী বোঝাচ্ছ তুমি?”

“হ্যাঁ। আমি আর এভাবে বাঁচতে পারব না। অনেক সহ্য করেছি। আজ বিকেলে আমার গায়ে হাত তুলেছে সে।”

“কে? তোমার স্বামী?”

“হ্যাঁ, আমার স্বামী।”

“আহ্, বলো কী !”

সে রীতিমত আশ্চর্য, কখনও ভাবতেই পারেনি যে তার স্বামী এত নিষ্ঠুর হতে পারে। সে একজন সামাজিক ব্যক্তি, উঁচু শ্রেণির, আড্ডাবাজ, ঘোড়ার ভালো সমঝদার, নাট্যামোদী এবং একজন দক্ষ তলোয়ারচালক। সে অনেকের পরিচিত, তাকে নিয়ে সোচ্চার অনেকে, সর্বত্র প্রশংসিত, অতি ভদ্র ব্যবহার, যদিও খুব মাঝারি গোছের বুদ্ধিমত্তা, শিক্ষাদীক্ষার বালাই নেই, তবুও সদ্বংশীয় লোকেরা যেভাবে চিন্তা করে সেরকম সব প্রয়োজনীয় খাঁটি সংস্কৃতি, মোদ্দা কথায় চিরাচরিত প্রথার প্রতি আছে তার অটল শ্রদ্ধাবোধ।

একজন ধনী এবং সদ্বংশীয় লোকের যেমনটি মানায় তেমনই সে তার স্ত্রীর প্রতি অনুগত। স্ত্রীর ইচ্ছা, স্বাস্থ্য, পোশাক এবং এর বাইরেও অনেককিছু নিয়ে সে সবসময় চিন্তায় থাকে; তাকে দেয় পরিপূর্ণ স্বাধীনতা।

ইরেনির বন্ধু হওয়াতে প্রীতিভরে তার হাত ধরার অধিকার জ্যাক লাভ করে, যা প্রতিটি ভদ্রস্বভাবের স্বামী তার স্ত্রীর ঘনিষ্ঠজনকে দিয়ে বাধিত হয়। তারপর, যখন জ্যাক বন্ধু থেকে প্রেমিকে পরিণত হল তখন ইরেনির স্বামীর সঙ্গে তার সম্পর্ক যথাযথ মাত্রায় অধিকতর আন্তরিক হয়ে উঠল।

জ্যাক স্বপ্নেও ভাবেনি যে, এই পরিবারের ওপর দিয়ে কখনও ঝড়ঝঞ্ঝা বইতে পারে, এবং সেকারণেই সে এই ঘটনা শুনে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়ল।

সে জিজ্ঞেস করল:

“ঘটনাটা ঘটল কীভাবে?”

ইরেনি তখন সব খুলে বলতে লাগল, বিয়ের পর থেকে বিস্তারিত কাহিনি, তাদের প্রথম মতবিরোধ, যা ঘটেছিল তেমন কোনও কারণ ছাড়াই, তারপর থেকে একের পর এক মতপার্থক্য দেখা দিয়ে চলে দু’জন ভিন্ন প্রকৃতির মানুষের মধ্যে।

তারপর শুরু হয় ঝগড়া, সম্পূর্ণ আলাদাভাবে বসবাস, কথার-কথা নয়, সত্যি সত্যিই। পরে তার স্বামী আক্রমণাত্মক ও সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে। এখন সে ঈর্ষাকাতর, জ্যাককে নিয়ে ঈর্ষাকাতর হয়ে উঠেছে এবং ঠিক সেদিনের সেই ঘটনার পর সে তার গায়ে হাত তোলে।

সিদ্ধান্ত জানানোর ভঙ্গিতে সে যোগ করল:

“আমি আর তার কাছে ফিরে যাব না। আমাকে নিয়ে তুমি যা খুশি কর।”

হাঁটু গেড়ে জ্যাক তার মুখোমুখি বসল, তাদের একে অন্যের হাঁটুতে হাঁটু লেগে রইল। সে তার হাত চেপে ধরে বলল:

“ইরেনি, আমার প্রেম, তুমি একটা বিরাট এবং অসংশোধনযোগ্য বোকামি করতে যাচ্ছ। তুমি যদি তোমার স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদই চাও তাকে খারাপ অবস্থায় ফেল, যাতে ভালো মেয়ে হিসাবে তোমার অবস্থান অটুট থাকে।

জ্যাকের দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করল:

“তাহলে আমাকে তুমি কী পরামর্শ দিতে চাইছ?”

“ঘরে ফিরে যাও, যতদিন পর্যন্ত-না সম্মানজনকভাবে তুমি আলাদা থাকার বা বিচ্ছেদের লড়াইয়ে জিতছ, ততদিন ঘরে থাক।”

“তুমি কী আমাকে এমন কাজ করতে বলছ না, যা কিছুটা ভীরুতার শামিল?”

“না; এটা সঠিক এবং যুক্তিযুক্ত। সমাজে তোমার আছে উঁচু অবস্থান, সুনাম, এসব তোমাকে রক্ষা করতে হবে, রক্ষা করতে হবে বন্ধুদের এবং অক্ষুণ্ন রাখতে হবে সব সম্পর্ক। খামখেয়ালির বশবর্তী হয়ে তুমি এগুলো খোয়াতে পার না।”

সে উঠে দাঁড়াল এবং ঝাঁজ মেশানো সুরে বলল:

“না, আমি এ-অত্যাচার আর সহ্য করতে পারব না! এটা শেষ প্রান্তে এসে ঠেকেছে! একেবারে শেষ প্রান্তে!”

তারপর তার প্রেমিকের কাঁধের ওপর দু’হাত রেখে, এবং সরাসরি তার মুখের দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করল:

“তুমি কি আমাকে ভালোবাস?”

“হ্যাঁ।”

“সত্যিসত্যি এবং আন্তরিকভাবে?”

“হ্যাঁ।”

“তাহলে আমার দায়িত্ব নাও।”

সে চেঁচিয়ে উঠল:

“তোমার দায়িত্ব? আমার বাড়িতে? এখানে? তুমি কেন পাগলামি করছ। এর অর্থ দাঁড়াবে তোমাকে চিরতরে হারানো; তোমাকে ফিরে পাওয়ার সব আশা দূর হয়ে যাওয়া! তুমি পাগল হলে!”

সে জবাব দিল ধীরে এবং গুরুত্ব সহকারে, এমন একজন মহিলার মত যে জানে তার কথার গুরুত্ব:

“শোনো জ্যাক, সে আমাকে তোমার সাথে দেখা করতে নিষেধ করেছে, আর আমি তোমার ঘরে গোপনে আসা-যাওয়া করার এই রঙ্গ চালিয়ে যেতে চাই না। তুমি হয় আমাকে গ্রহণ কর, না-হয় চিরতরে হারাও।”

“আমার প্রিয় ইরেনি, সেক্ষেত্রে তুমি তালাক নাও, আমি তোমাকে বিয়ে করব।”

“হ্যাঁ, তুমি আমাকে বিয়ে করবে — খুব তাড়াতাড়ি হলেও দুবছর পর। তোমার প্রেম খুবই ধৈর্যশীল!”

“দ্যাখো! চিন্তা কর! তুমি এখানে থাকলে সে কালই তোমাকে নিতে এখানে চলে আসবে। সে তোমার স্বামী, তার অধিকার আছে এবং আইন তার পক্ষে।”

“আমি তোমার ঘরে আমাকে রাখতে বলিনি জ্যাক, বলেছি তোমার পছন্দমত যেকোনও জায়গায় আমাকে নিয়ে যেতে। আমি মনে করেছিলাম, তুমি আমাকে যথেষ্ট ভালোবাস তাই তেমন কিছু করবে। আমি ভুল করেছি। চলি, শুভ বিদায়!”

সে ঘুরে দাঁড়ালো এবং দরজার দিকে এত দ্রুত ছুটে গেল যে, জ্যাক কোনওক্রমে ঘরের বাইরে গিয়ে তাকে ধরে ফিরিয়ে নিয়ে এল।

“শোনো ইরেনি।”

সে নিজের সঙ্গে লড়ছিল, ওর কথায় কান দিচ্ছিল না। তার দু’চোখ জলে ভরে উঠল এবং সে তোতলাতে লাগল:

“আমাকে একা থাকতে দাও! আমাকে একা থাকতে দাও! একা থাকতে দাও আমাকে!”

জ্যাক তাকে জোর করে বসাল, এবং আরেকবার তার পায়ের কাছে হাঁটুগেড়ে বসে আউড়ে চলল এন্তার যুক্তি। তাকে বোঝাতে চেষ্টা করল তার পরিকল্পনার ভ্রান্তি এবং ভয়ঙ্কর ঝুঁকি সম্পর্কে। তার উত্তেজিত দৃঢ় মতের প্রতি নিজের যথেষ্ট অনুরাগ টের পেলেও তাকে বোঝানোর জন্য তার জানামত প্রয়োজনীয় এমন কোনও কিছুই সে বাদ রাখল না।

সে নিশ্চুপ এবং শীতল ছিল বরফের মত। জ্যাক তার কছে অনুনয় করল, আবেদন জানাল তার কথা শুনবার জন্য, তাকে বিশ্বাস করবার জন্য এবং তার উপদেশ মানবার জন্য।

তার কথা শেষ হওয়ার পর সে শুধুমাত্র প্রত্যুত্তর করল:

“তুমি কি চাও আমি চলে যাই? তোমার হাত সরাও, আমাকে নিজ পায়ে দাঁড়াতে দাও।”

“দ্যাখো, ইরেনি।”

“আমাকে যেতে দেবে?”

“তোমার সিদ্ধান্ত কি অপরিবর্তনীয়, ইরেনি?”

“তুমি কি আমাকে যেতে দেবে?”

“আমাকে শুধু বল, এই সিদ্ধান্ত, উদ্ভট এই সিদ্ধান্ত, যার জন্য তোমাকে খুব পস্তাতে হবে, একেবারেই অপরিবর্তনীয়?”

“হ্যাঁ — আমাকে যেতে দাও!”

“তাহলে থাকো। ভালোভাবেই জানো যে এখানে থাকতে তোমার কোনও অসুবিধা হবে না। কাল সকালেই আমরা অন্য কোথাও চলে যাব।”

সে কারও সাহায্য ছাড়াই নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াল এবং কড়া সুরে বলল:

“না, অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি কারও ত্যাগ চাই না; চাই না আনুগত্য।”

“দাঁড়াও! আমার যা করা উচিত ছিল তাই করেছি; তাই বলেছি যা বলা উচিত ভেবেছি, তোমার ব্যাপারে এ-ছাড়া আমার আর কোনও দায়িত্ব ছিল না। আমার বিবেক এখন শান্তি পাচ্ছে। এখন বল আমাকে কী করতে হবে, যা বলবে আমি তাই করব।”

সে পুনরায় বসল, তার দিকে তাকিয়ে থাকল অনেকক্ষণ, এবং তারপর অত্যন্ত শান্ত স্বরে বলল:

“ঠিক আছে, তাহলে খুলে বল।”

“কী খুলে বলব? বল, আমার কাছ থেকে কী জানতে চাও?”

“সবকিছু — সবকিছু, তোমার মন পরিবর্তনের আগে যা-কিছু ভাবছিলে। তখন আমি ভাবব আমার কী করা উচিত।”

“কিন্তু আসলে আমি কিছু নিয়েই ভাবছিলাম না। আমি তোমাকে শুধু সতর্ক করে দিচ্ছিলাম, তুমি একটি নির্বুদ্ধিতার কাজ করতে যাচ্ছ। কিন্তু যখন দেখলাম তুমি নিজ সিদ্ধান্তে অনড়; তখন আমি তোমার এই জেদের ভাগিদার হওয়ার কথা ভাবলাম; বলতে কী, আমি দৃঢ়ভাবেই তোমার মতের পক্ষে অবস্থান নিলাম।”

“অত তাড়াতাড়ি কারও মন বদলানো স্বাভাবিক নয়।”

“শোনো, আমার সোনামণি, এটা ত্যাগ বা আনুগত্যের ব্যাপার নয়। যেদিন, যখন আমি বুঝলাম যে তোমাকে আমি ভালোবাসি, আমি নিজেকে তাই বললাম যা এরকম ক্ষেত্রে প্রতিটি প্রেমিকের নিজেকে বলা উচিত: ‘যে লোক কোনও মেয়েকে ভালোবাসে, চেষ্টা করে তাকে জয় করবার, যে তাকে পায়, যে তাকে গ্রহণ করে, সে নিজের এবং সেই নারীর সঙ্গে একটি পবিত্র চুক্তিতে আবদ্ধ হয়। এটা অবশ্যই তোমার মত নারীর সঙ্গে, তেমন নারীর সঙ্গে নয় যারা অস্থিরমনা এবং সহজেই মুগ্ধ হয়।’

“বিয়ের আছে বিশাল সামাজিক মূল্য, বিরাট আইনি মূল্য, যদিও আমার চোখে সেটার সামান্যই নৈতিক মূল্য আছে, যেভাবে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে থাকে তা বিবেচনায় নিলে।

“সুতরাং, যখন একজন নারী স্বামীর সাথে এই আইনের দ্বারা যুক্ত হয় কিন্তু স্বামীর সঙ্গে থাকে না কোনও মানসিক বন্ধন, যাকে সে পারে না ভালোবাসতে; সেক্ষেত্রে একজন নারী যার হৃদয় মুক্ত, এমন কোনও পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে যাকে সে পছন্দ করে, এবং নিজেকে সমর্পণ করে তার কাছে, যখন একজন পুরুষেরও অন্য কোনও বন্ধন নেই, একজন নারীকে এভাবে গ্রহণ করে। আমি বলি, তারা একে অন্যেতে স্বাধীন এক অঙ্গীকারে আবদ্ধ থাকে, যা কিনা ‘মেয়র’-এর সম্মুখে ‘হ্যাঁ’ উচ্চারণ করার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

“আমি বলি, যদি তারা উভয়েই সম্মানীত ব্যক্তি হয়, বিবাহ সংক্রান্ত সব পূন্যকর্ম সম্পাদন করার চেয়েও তাদের বন্ধন অবশ্যই অনেক বেশি আন্তরিক, বাস্তব, সর্বাত্মক।

“এই নারী সবকিছুতে ঝুঁকি নেয়। প্রেমের কারণে সে সবকিছুই উজাড় করে দেয়, তার হৃদয়, তার দেহ, তার আত্মা, তার সম্ভ্রম, এমনকি তার জীবন পর্যন্ত — সে সাহস পায় বেপরোয়াভাবে এবং নিঃসংকোচে কাজ করতে, এমনকি ভবিষ্যতের সমস্ত দুর্দশা, বিপদ, মহাদুর্যোগ দেখতে পেয়েও সে যেকোনও পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে প্রস্তুত থাকে — এমনকি তার স্বামীর হাতে খুন, কিংবা সমাজচ্যুত হতেও সে পরোয়া করে না। এই জন্যই সে ভালোবাসা এবং সম্মান পাওয়ার যোগ্য, তার বৈবাহিক জীবনের অসততার মধ্যেও, এ-কারণেই তার প্রেমিকেরও তাকে গ্রহণ করা উচিত সবকিছু আগে থেকে ভেবেই, এবং পরিণামে যা কিছুই ঘটুক না কেন তাকেই সবার চেয়ে বেশি পছন্দ করা উচিত। আর কিছুই বলার নেই আমার। একজন সচেতন ব্যক্তি হিসাবে আমার দায়িত্ব ছিল তোমাকে সাবধান করা, শুরুতেই বলেছি; এবং এখনও বলছি আমি নেহাত একজন ব্যক্তি, যে কেবল তোমাকে ভালোবাসে — আদেশ কর, আর আমি তা পালন করি।”

আনন্দে অভিভূত ইরেনি গভীর চুম্বনে তার মুখ বন্ধ করে দিল এবং নিচু স্বরে বলল:

“যা-কিছু বলেছি, তা একটুও সত্যি নয়, প্রিয়! এধরনের কিছুই ঘটেনি! আমার স্বামী কিছুই সন্দেহ করেনি। কিন্তু আমি দেখতে চেয়েছিলাম, আমি জানতে চেয়েছিলাম, আমি চাইলে তুমি নববর্ষের উপহার হিসাবে আমাকে কী দিতে পার — যে নেকলেসটি উপহার হিসাবে পাঠিয়েছ তারচেয়েও বেশি কিছু, তোমার হৃদয়। হ্যাঁ, তুমি ওটা আমাকে দিয়েছ। ধন্যবাদ! ধন্যবাদ তোমাকে! আমাকে যে সুখ তুমি দিয়েছ সেজন্য ঈশ্বরকেও ধন্যবাদ!”



হযবরল - সুকুমার রায়


বেজায় গরম। গাছতলায় দিব্যি ছায়ার মধ্যে চুপচাপ শুয়ে আছি, তবু ঘেমে অস্থির। ঘাসের উপর রুমালটা ছিল, ঘাম মুছবার জন্য যেই সেটা তুলতে গিয়েছি অমনি রুমালটা বলল “ম্যাও!” কি আপদ! রুমালটা ম্যাও করে কেন?


চেয়ে দেখি রুমাল তো আর রুমাল নেই, দিব্যি মোটা-সোটা লাল টক্টকে একটা বেড়াল গোঁফ ফুলিয়ে প্যাট্ প্যাট্ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে!

আমি বললাম, “কি মুশকিল! ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বেড়াল।”

অমনি বেড়ালটা বলে উঠল, “মুশকিল অবার কি? ছিল একটা ডিম, হয়ে গেল দিব্যি একটা প্যাঁক্পেঁকে হাঁস। এ তো হামেশাই হচ্ছে।”

আমি খানিক ভেবে বললাম, “তা হলে তোমায় এখন কি বলে ডাকব? তুমি তো সত্যিকারের বেড়াল নও, আসলে তুমি হচ্ছ রুমাল।”

বেড়াল বলল, “বেড়ালও বলতে পার, রুমালও বলতে পার, চন্দ্রবিন্দুও বলতে পার।” আমি বললাম, “চন্দ্রবিন্দু কেন?”

শুনে বেড়ালটা “তাও জানো না?” বলে এক চোখ বুজে ফ্যাঁচ্‌ফ্যাঁচ্ করে বিশ্রীরকম হাসতে লাগল। আমি ভারি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। মনে হল, ঐ চন্দ্রবিন্দুর কথাটা নিশ্চয় আমার বোঝা উচিত ছিল। তাই থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি বলে ফেললাম, “ও হ্যাঁ-হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি।”

বেড়ালটা খুশি হয়ে বলল, “হ্যাঁ, এ তো বোঝাই যাচ্ছে- চন্দ্রবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ, রুমালের মা- হল চশমা। কেমন, হল তো?”

আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না, কিন্তু পাছে বেড়ালটা আবার সেইরকম বিশ্রী করে হেসে ওঠে, তাই সঙ্গে সঙ্গে হুঁ-হুঁ করে গেলাম। তার পর বেড়ালটা খানিকক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাত্ বলে উঠল, “গরম লাগে তো তিব্বত গেলেই পার।”

আমি বললাম, “বলা ভারি সহজ, কিন্তু বললেই তো আর যাওয়া যায় না?”

বেড়াল বলল, “কেন, সে আর মুশকিল কি?”

আমি বললাম, “কি করে যেতে হয় তুমি জানো?”

বেড়াল একগাল হেসে বলল, “তা আর জানি নে? কলকেতা, ডায়মন্ডহারবার, রানাঘাট, তিব্বত, ব্যাস্! সিধে রাস্তা, সওয়া ঘণ্টার পথ, গেলেই হল।”

আমি বললাম, “তা হলে রাস্তাটা আমায় বাতলে দিতে পার?”

শুনে বেড়ালটা হঠাত্ কেমন গম্ভীর হয়ে গেল। তার পর মাথা নেড়ে বলল, “উঁহু, সে আমার কর্ম নয়। আমার গেছোদাদা যদি থাকত, তা হলে সে ঠিক-ঠিক বলতে পারত।”

আমি বললাম, “গেছোদাদা কে? তিনি থাকেন কোথায়?”

বেড়াল বলল, “গেছোদাদা আবার কোথায় থাকবে? গাছে থাকে।”

আমি বললাম, “কোথায় গেলে তাঁর সাথে দেখা হয়?”

বেড়াল খুব জোরে মাথা নেড়ে বলল, “সেটি হচ্ছে না, সে হবার জো নেই।”

আমি বললাম, “কিরকম?”

বেড়াল বলল, “সে কিরকম জানো? মনে কর, তুমি যখন যাবে উলুবেড়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, তখন তিনি থাকবেন মতিহারি। যদি মতিহারি যাও, তা হলে শুনবে তিনি আছেন রামকিষ্টপুর। আবার সেখানে গেলে দেখবে তিনি গেছেন কাশিমবজার। কিছুতেই দেখা হবার জো নেই।”

আমি বললাম, “তা হলে তোমরা কি করে দেখা কর?”

বেড়াল বলল, “সে অনেক হাঙ্গাম। আগে হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় নেই; তার পর হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় থাকতে পারে; তার পর দেখতে হবে, দাদা এখন কোথায় আছে। তার পর দেখতে হবে, সেই হিসেব মতো যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছবে, তখন দাদা কোথায় থাকবে। তার পর দেখতে হবে-”

আমি তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললাম, “সে কিরকম হিসেব?”

বেড়াল বলল, “সে ভারি শক্ত। দেখবে কিরকম?” এই বলে সে একটা কাঠি দিয়ে ঘাসের উপর লম্বা আঁচড় কেটে বলল, “এই মনে কর গেছোদাদা।” বলেই খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে চুপ করে বসে রইল।

তার পর আবার ঠিক তেমনি একটা আঁচড় কেটে বলল, “এই মনে কর তুমি,” বলে আবার ঘাড় বাঁকিয়ে চুপ করে রইল।

তার পর হঠাত্ আবার একটা আঁচড় কেটে বলল, “এই মনে কর চন্দ্রবিন্দু।” এমনি করে খানিকক্ষণ কি ভাবে আর একটা করে লম্বা আঁচড় কাটে, আর বলে, “এই মনে কর তিব্বত-“, “এই মনে কর গেছোবৌদি রান্না করছে-“, “এই মনে কর গাছের গায়ে একটা ফুটো-”

এইরকম শুনতে-শুনতে শেষটায় আমার কেমন রাগ ধরে গেল। আমি বললাম, “দূর ছাই! কি সব আবোল তাবোল বকছে, একটুও ভালো লাগে না।”

বেড়াল বলল, “আচ্ছা, তা হলে আর একটু সহজ করে বলছি। চোখ বোজ, আমি যা বলব, মনে মনে তার হিসেব কর।” আমি চোখ বুজলাম।

চোখ বুজেই আছি, বুজেই আছি, বেড়ালের আর কোনো সাড়া-শব্দ নেই। হঠাত্ কেমন সন্দেহ হল, চোখ চেয়ে দেখি বেড়ালটা ল্যাজ খাড়া করে বাগানের বেড়া টপকিয়ে পালাচ্ছে আর ক্রমাগত ফ্যাঁচ্‌ফ্যাঁচ্ করে হাসছে।

কি আর করি, গাছতলায় একটা পাথরের উপর বসে পড়লাম। বসতেই কে যেন ভাঙা-ভাঙা মোটা গলায় বলে উঠল, “সাত দু’গুনে কত হয়?”

আমি ভাবলাম, এ আবার কে রে? এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি, এমন সময় আবার সেই আওয়াজ হল, “কই জবাব দিচ্ছ না যে? সাত দু’গুনে কত হয়?” তখন উপর দিকে তাকিয়ে দেখি, একটা দাঁড়কাক শ্লেট পেনসিল দিয়ে কি যেন লিখছে, আর এক-একবার ঘাড় বাঁকিয়ে আমার দিকে তাকাচ্ছে।

আমি বললাম, “সাত দুগুনে চোদ্দো।”

কাকটা অমনি দুলে-দুলে মাথা নেড়ে বলল, “হয় নি, হয় নি, ফেল্।”

আমার ভয়ানক রাগ হল। বললাম, “নিশ্চয় হয়েছে। সাতেক্কে সাত, সাত দু’গুনে চোদ্দো, তিন সাত্তে একুশ।”

কাকটা কিছু জবাব দিল না, খালি পেনসিল মুখে দিয়ে খানিকক্ষণ কি যেন ভাবল। তার পর বলল, “সাত দুগুনে চোদ্দোর নামে চার, হাতে রইল পেনসিল!”

আমি বললাম, “তবে যে বলছিলে সাত দুগুনে চোদ্দো হয় না? এখন কেন?”

কাক বলল, “তুমি যখন বলেছিলে, তখনো পুরো চোদ্দো হয় নি। তখন ছিল, তেরো টাকা চোদ্দো আনা তিন পাই। আমি যদি ঠিক সময় বুঝে ধাঁ করে ১৪ লিখে না ফেলতাম, তা হলে এতক্ষণে হয়ে যেত চোদ্দো টাকা এক আনা নয় পাই।”

আমি বললাম, “এমন আনাড়ি কথা তো কখনো শুনি নি। সাত দু’গুনে যদি চোদ্দো হয়, তা সে সব সময়েই চোদ্দো। একঘণ্টা আগে হলেও যা, দশদিন পরে হলেও তাই।”

কাকটা ভারি অবাক হয়ে বলল, “তোমাদের দেশে সময়ের দাম নেই বুঝি?”

আমি বললাম, “সময়ের দাম কিরকম?”

কাক বলল, “এখানে কদিন থাকতে, তা হলে বুঝতে। আমাদের বাজারে সময় এখন ভয়ানক মাগ্যি, এতটুকু বাজে খরচ করবার জো নেই। এই তো কদিন খেটেখুটে চুরিচামারি করে খানিকটে সময় জমিয়েছিলাম, তাও তোমার সঙ্গে তর্ক করতে অর্ধেক খরচ হয়ে গেল।” বলে সে আবার হিসেব করতে লাগল। আমি অপ্রস্তুত হয়ে বসে রইলাম।

এমন সময়ে হঠাত্ গাছের একটা ফোকর থেকে কি যেন একটা সুড়ুত্ করে পিছলিয়ে মাটিতে নামল। চেয়ে দেখি, দেড় হাত লম্বা এক বুড়ো, তার পা পর্যন্ত সবুজ রঙের দাড়ি, হাতে একটা হুঁকো তাতে কলকে-টলকে কিচ্ছু নেই, আর মাথা ভরা টাক। টাকের উপর খড়ি দিয়ে কে যেন কি-সব লিখেছে।

বুড়ো এসেই খুব ব্যস্ত হয়ে হুঁকোতে দু-এক টান দিয়েই জিজ্ঞাসা করল, “কই হিসেবটা হল?”

কাক খানিক এদিক-ওদিক তাকিয়ে বলল, “এই হল বলে।”

বুড়ো বলল, “কি আশ্চর্য! উনিশ দিন পার হয়ে গেল, এখনো হিসেবটা হয়ে উঠল না?”

কাক দু-চার মিনিট খুব গম্ভীর হয়ে পেনসিল চুষল তার পর জিজ্ঞাসা করল, “কতদিন বললে?”

বুড়ো বলল, “উনিশ।”

কাক অমনি গলা উঁচিয়ে হেঁকে বলল, “লাগ্ লাগ্ লাগ্ কুড়ি।”

বুড়ো বলল, “একুশ।” কাক বলল, “বাইশ।” বুড়ো বলল, “তেইশ।” কাক বলল, “সাড়ে তেইশ।” ঠিক যেন নিলেম ডাকছে।

ডাকতে-ডাকতে কাকটা হঠাত্ আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি ডাকছ না যে?”

আমি বললাম, “খামকা ডাকতে যাব কেন?”

বুড়ো এতক্ষণ আমায় দেখে নি, হঠাত্ আমার আওয়াজ শুনেই সে বন্‌বন্ করে আট দশ পাক ঘুরে আমার দিকে ফিরে দাঁড়াল।

তার পরে হুঁকোটাকে দূরবীনের মতো করে চোখের সামনে ধরে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। তার পর পকেট থেকে কয়েকখানা রঙিন কাঁচ বের করে তাই দিয়ে আমায় বার বার দেখতে লাগল। তার পর কোত্থেকে একটা পুরনো দরজির ফিতে এনে সে আমার মাপ নিতে শুরু করল, আর হাঁকতে লাগল, “খাড়াই ছাব্বিশ ইঞ্চি, হাতা ছাব্বিশ ইঞ্চি, আস্তিন ছাব্বিশ ইঞ্চি, ছাতি ছাব্বিশ ইঞ্চি, গলা ছাব্বিশ ইঞ্চি।”

আমি ভয়ানক আপত্তি করে বললাম, “এ হতেই পারে না। বুকের মাপও ছাব্বিশ ইঞ্চি, গলাও ছাব্বিশ ইঞ্চি? আমি কি শুওর?”

বুড়ো বলল, “বিশ্বাস না হয়, দেখ।”

দেখলাম ফিতের লেখা-টেখা সব উঠে গিয়েছে, খালি ২৬ লেখাটা একটু পড়া যাচ্ছে, তাই বুড়ো যা কিছু মাপে সবই ছাব্বিশ ইঞ্চি হয়ে যায়।

তার পর বুড়ো জিজ্ঞাসা করল, “ওজন কত?”

আমি বললাম, “জানি না!”

বুড়ো তার দুটো আঙুল দিয়ে আমায় একটুখানি টিপে-টিপে বলল, “আড়াই সের।”

আমি বললাম, “সেকি, পট্লার ওজনই তো একুশ সের, সে আমার চাইতে দেড় বছরের ছোটো।”

কাকটা অমনি তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “সে তোমাদের হিসেব অন্যরকম।”

বুড়ো বলল, “তা হলে লিখে নাও- ওজন আড়াই সের, বয়েস সাঁইত্রিশ।”

আমি বললাম, “ধুত্! আমার বয়স হল আট বছর তিনমাস, বলে কিনা সাঁইত্রিশ।”

বুড়ো খানিকক্ষণ কি যেন ভেবে জিজ্ঞাসা করল, “বাড়তি না কমতি?”

আমি বললাম, “সে আবার কি?”

বুড়ো বলল, “বলি বয়েসটা এখন বাড়ছে না কমছে?”

আমি বললাম, “বয়েস আবার কমবে কি?”

বুড়ো বলল, “তা নয় তো কেবলই বেড়ে চলবে নাকি? তা হলেই তো গেছি! কোনদিন দেখব বয়েস বাড়তে বাড়তে একেবারে ষাট সত্তর আশি বছর পার হয়ে গেছে। শেষটায় বুড়ো হয়ে মরি আর কি!”

আমি বললাম, “তা তো হবেই। আশি বছর বয়েস হলে মানুষ বুড়ো হবে না!”

বুড়ো বলল, “তোমার যেমন বুদ্ধি! আশি বছর বয়েস হবে কেন? চল্লিশ বছর হলেই আমরা বয়েস ঘুরিয়ে দিই। তখন আর একচল্লিশ বেয়াল্লিশ হয় না- উনচল্লিশ, আটত্রিশ, সাঁইত্রিশ করে বয়েস নামতে থাকে। এমনি করে যখন দশ পর্যন্ত নামে তখন আবার বয়েস বাড়তে দেওয়া হয়। আমার বয়েস তো কত উঠল নামল আবার উঠল, এখন আমার বয়েস হয়েছে তেরো।” শুনে আমার ভয়ানক হাসি পেয়ে গেল।

কাক বলল, “তোমরা একটু আস্তে আস্তে কথা কও, আমার হিসেবটা চট্পট্ সেরে নি।”

বুড়ো অমনি চট্ করে আমার পাশে এসে ঠ্যাং ঝুলিয়ে বসে ফিস্‌ফিস্ করে বলতে লাগল, “একটা চমত্কার গল্প বলব। দাঁড়াও একটু ভেবে নি।” এই বলে তার হুঁকো দিয়ে টেকো মাথা চুলকাতে-চুলকাতে চোখ বুজে ভাবতে লাগল। তার পর হঠাত্ বলে উঠল, “হ্যাঁ, মনে হয়েছে, শোনো- ”

“তার পর এদিকে বড়োমন্ত্রী তো রাজকন্যার গুলিসুতো খেয়ে ফেলেছে। কেউ কিচ্ছু জানে না। ওদিকে রাক্ষসটা করেছে কি, ঘুমুতে-ঘুমুতে হাঁউ-মাঁউ-কাঁউ, মানুষের গন্ধ পাঁউ বলে হুড়্ মুড়্ করে খাট থেকে পড়ে গিয়েছে। অমনি ঢাক ঢোল সানাই কাঁশি লোক লস্কর সেপাই পল্টন হৈ-হৈ রৈ-রৈ মার্-মার্ কাট্-কাট্- এর মধ্যে রাজামশাই বলে উঠলেন, ‘পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?’ শুনে পাত্র মিত্র ডাক্তার মোক্তার আক্কেল মক্কেল সবাই বললে, ‘ভালো কথা! ন্যাজ কি হল?’ কেউ তার জবাব দিতে পারে না, সুড়্সুড়্ করে পালাতে লাগল।”

এমন সময় কাকটা আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “বিজ্ঞাপন পেয়েছ? হ্যাণ্ডবিল?”

আমি বললাম, “কই না, কিসের বিজ্ঞাপন?” বলতেই কাকটা একটা কাগজের বাণ্ডিল থেকে একখানা ছাপানো কাগজ বের করে আমার হাতে দিল, আমি পড়ে দেখলাম তাতে লেখা রয়েছে-

শ্রীশ্রীভূশণ্ডিকাগায় নমঃ
শ্রীকাক্কেশ্বর কুচ্কুচে
৪১ নং গেছোবাজার, কাগেয়াপটি
আমরা হিসাবী ও বেহিসাবী খুচরা ও পাইকারী সকলপ্রকার গণনার কার্য বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন করিয়া থাকি। মূল্য এক ইঞ্চি ১৷৴৹। CHILDREN HALF PRICE অর্থাত্ শিশুদের অর্ধমূল্য। আপনার জুতার মাপ, গায়ের রঙ, কান কট্কট্ করে কি না, জীবিত কি মৃত, ইত্যাদি আবশ্যকীয় বিবরণ পাঠাইলেই ফেরত ডাকে ক্যাটালগ পাঠাইয়া থাকি।

সাবধান! সাবধান!! সাবধান!!!
আমরা সনাতন বায়সবংশীয় দাঁড়িকুলীন, অর্থাত্ দাঁড়কাক। আজকাল নানাশ্রেণীর পাতিকাক, হেঁড়েকাক, রামকাক প্রভৃতি নীচশ্রেণীর কাকেরাও অর্থলোভে নানারূপ ব্যবসা চালাইতেছে। সাবধান! তাহাদের বিজ্ঞাপনের চটক দেখিয়া প্রতারিত হইবেন না।

কাক বলল, “কেমন হয়েছে?”

আমি বললাম, “সবটা তো ভালো করে বোঝা গেল না।”

কাক গম্ভীর হয়ে বলল, “হ্যাঁ, ভারি শক্ত, সকলে বুঝতে পারে না। একবার এক খদ্দের এয়েছিল তার ছিল টেকো মাথা-”

এই কথা বলতেই বুড়ো মাত্-মাত্ করে তেড়ে উঠে বলল, “দেখ্! ফের যদি টেকো মাথা বলবি তো হুঁকো দিয়ে এক বাড়ি মেরে তোর শ্লেট ফাটিয়ে দেব।”

কাক একটু থতমত খেয়ে কি যেন ভাবল, তার পর বলল, “টেকো নয়, টেপো মাথা, যে মাথা টিপে-টিপে টোল খেয়ে গিয়েছে।”

বুড়ো তাতেও ঠাণ্ডা হল না, বসে-বসে গজ্‌গজ্ করতে লাগল। তাই দেখে কাক বলল, “হিসেবটা দেখবে নাকি?”

বুড়ো একটু নরম হয়ে বলল, “হয়ে গেছে? কই দেখি।”

কাক অমনি “এই দেখ” বলে তার শ্লেটখানা ঠকাস্ করে বুড়োর টাকের উপর ফেলে দিল। বুড়ো তত্ক্ষণাত্ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল আর ছোটো ছেলেদের মতো ঠোট ফুলিয়ে “ও মা, ও পিসি, ও শিবুদা” বলে হাত-পা ছুঁড়ে কাঁদতে লাগল।

কাকটা খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে, বলল, “লাগল নাকি! ষাট-ষাট।”

বুড়ো অমনি কান্না থামিয়ে বলল, “একষট্টি, বাষট্টি, চৌষট্টি-”

কাক বলল, “পঁয়ষট্টি।”

আমি দেখলাম আবার বুঝি ডাকাডাকি শুরু হয়, তাই তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, “কই হিসেবটা তো দেখলে না?”

বুড়ো বলল, “হ্যাঁ-হ্যাঁ তাই তো! কি হিসেব হল পড় দেখি।”

আমি শ্লেটখানা তুলে দেখলাম ক্ষুদে-ক্ষুদে অক্ষরে লেখা রয়েছে-

“ইয়াদি কির্দ অত্র কাকালতনামা লিখিতং শ্রীকাক্কেশ্বর কুচ্কুচে কার্যঞ্চাগে। ইমারত্ খেসারত্ দলিল দস্তাবেজ। তস্য ওয়ারিশানগণ মালিক দখলিকার সত্ত্বে অত্র নায়েব সেরেস্তায় দস্ত বদস্ত কায়েম মোকররী পত্তনীপাট্টা অথবা কাওলা কবুলিয়ত্। সত্যতায় কি বিনা সত্যতায় মুনসেফী আদালতে কিম্বা দায়রায় সোপর্দ আসামী ফরিয়াদী সাক্ষী সাবুদ গয়রহ মোকর্দমা দায়ের কিম্বা আপোস মকমল ডিক্রীজারী নিলাম ইস্তাহার ইত্যাদি সর্বপ্রকার কর্তব্য বিধায়-”

আমার পড়া শেষ না হতেই বুড়ো বলে উঠল, “এ-সব কি লিখেছ আবোল তাবোল?”

কাক বলল, “ও-সব লিখতে হয়। তা না হলে আদালতে হিসেব টিকবে কেন? ঠিক চৌকস-মতো কাজ করতে হলে গোড়ায় এ-সব বলে নিতে হয়।”

বুড়ো বলল, “তা বেশ করেছ, কিন্তু আসল হিসেবটা কি হল তা তো বললে না?”

কাক বলল, “হ্যাঁ, তাও তো বলা হয়েছে। ওহে, শেষ দিকটা পড় তো?”

আমি দেখলাম শেষের দিকে মোটা-মোটা অক্ষরে লেখা রয়েছে-

সাত দুগুণে ১৪, বয়স ২৬ ইঞ্চি, জমা ৴২॥ সের, খরচ ৩৭ বত্সর।

কাক বলল, “দেখেই বোঝা যাচ্ছে অঙ্কটা এল-সি-এম্ও নয়, জি-সি-এম্ও নয়। সুতরাং হয় এটা ত্রৈরাশিকের অঙ্ক, নাহয় ভগ্নাংশ। পরীক্ষা করে দেখলাম আড়াই সেরটা হচ্ছে ভগ্নাংশ। তা হলে বাকি তিনটে হল ত্রৈরাশিক। এখন আমার জানা দরকার, তোমরা ত্রৈরাশিক চাও না ভগ্নাংশ চাও?”

বুড়ো বলল, “আচ্ছা দাঁড়াও, তা হলে একবার জিজ্ঞাসা করে নি।” এই বলে সে নিচু হয়ে গাছের গোড়ায় মুখ ঠেকিয়ে ডাকতে লাগল, “ওরে বুধো! বুধো রে!”

খানিক পরে মনে হল কে যেন গাছের ভিতর থেকে রেগে বলে উঠল, “কেন ডাকছিস?”

বুড়ো বলল, “কাক্কেশ্বর কি বলছে শোন্।”

আবার সেইরকম আওয়াজ হল, “কি বলছে?”

বুড়ো বলল, “বলছে, ত্রৈরাশিক না ভগ্নাংশ?”

তেড়ে উত্তর হল, “কাকে বলছে ভগ্নাংশ? তোকে না আমাকে?”

বুড়ো বলল, “তা নয়। বলছে, হিসেবটা ভগ্নাংশ চাস, না ত্রৈরাশিক?”

একটুক্ষণ পর জবাব শোনা গেল, “আচ্ছা, ত্রৈরাশিক দিতে বল।”

বুড়ো গম্ভীরভাবে খানিকক্ষণ দাড়ি হাতড়াল, তার পর মাথা নেড়ে বলল, “বুধোটার যেমন বুদ্ধি! ত্রৈরাশিক দিতে বলব কেন? ভগ্নাংশটা খারাপ হল কিসে? না হে কাক্কেশ্বর, তুমি ভগ্নাংশই দাও।”

কাক বলল, “তা হলে আড়াই সেরের গোটা সের দুটো বাদ গেলে রইল ভগ্নাংশ আধ সের, তোমার হিসেব হল আধ সের। আধ সের হিসেবের দাম পড়ে- খাঁটি হলে দুটাকা চোদ্দোআনা, আর জল মেশানো থাকলে ছয় পয়সা।”

বুড়ো বলল, “আমি যখন কাঁদছিলাম, তখন তিন ফোঁটা জল হিসেবের মধ্যে পড়েছিল। এই নাও তোমার শ্লেট, আর এই নাও পয়সা ছটা।”

পয়সা পেয়ে কাকের মহাফুর্তি! সে `টাক্-ডুমাডুম্ টাক্-ডুমাডুম্’ বলে শ্লেট বাজিয়ে নাচতে লাগল।

বুড়ো অমনি আবার তেড়ে উঠল, “ফের টাক-টাক বলছিস্? দাঁড়া। ওরে বুধো বুধো রে! শিগ্গির আয়। আবার টাক বলছে।” বলতে-না-বলতেই গাছের ফোকর থেকে মস্ত একটা পোঁটলা মতন কি যেন হুড়্মুড়্ করে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল। চেয়ে দেখলাম, একটা বুড়ো লোক একটা প্রকাণ্ড বোঁচকার নীচে চাপা পড়ে ব্যস্ত হয়ে হাত-পা ছুঁড়ছে! বুড়োটা দেখতে অবিকল এই হুঁকোওয়ালা বুড়োর মতো। হুঁকোওয়ালা কোথায় তাকে টেনে তুলবে না সে নিজেই পোঁটলার উপর চড়ে বসে, “ওঠ্ বলছি, শিগ্গির ওঠ্” বলে ধাঁই-ধাঁই করে তাকে হুঁকো দিয়ে মারতে লাগল।

কাক আমার দিকে চোখ মট্কিয়ে বলল, “ব্যাপারটা বুঝতে পারছ না? উধোর বোঝা বুধোর ঘাড়ে। এর বোঝা ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে, এখন ও আর বোঝা ছাড়তে চাইবে কেন? এই নিয়ে রোজ মারামারি হয়।”

এই কথা বলতে-বলতেই চেয়ে দেখি, বুধো তার পোঁটলাসুদ্ধ উঠে দাঁড়িয়েছে। দাঁড়িয়েই সে পোঁটলা উঁচিয়ে দাঁত কড়্মড়্ করে বলল, “তবে রে ইস্টুপিড্ উধো!” উধোও আস্তিন গুটিয়ে হুঁকো বাগিয়ে হুংকার দিয়ে উঠল, “তবে রে লক্ষ্মীছাড়া বুধো!”

কাক বলল, “লেগে যা, লেগে যা- নারদ-নারদ!”

অমনি ঝটাপট্, খটাখট্, দমাদম্, ধপাধপ্! মুহূর্তের মধ্যে চেয়ে উধো চিত্পাত শুয়ে হাঁপাচ্ছে, আর বুধো ছট্ফট্ করে টাকে হাত বুলোচ্ছে।

বুধো কান্না শুরু করল, “ওরে ভাই উধো রে, তুই এখন কোথায় গেলি রে?”

উধো কাঁদতে লাগল, “ওরে হায় হায়! আমাদের বুধোর কি হল রে!”

তার পর দুজনে উঠে খুব খানিক গলা জড়িয়ে কেঁদে, আর খুব খানিক কোলাকুলি করে, দিব্যি খোশমেজাজে গাছের ফোকরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। তাই দেখে কাকটাও তার দোকানপাট বন্ধ করে কোথায় যেন চলে গেল।

আমি ভাবছি এইবেলা পথ খুঁজে বাড়ি ফেরা যাক, এমন সময় শুনি পাশেই একটা ঝোপের মধ্যে কিরকম শব্দ হচ্ছে, যেন কেউ হাসতে হাসতে আর কিছুতেই হাসি সামলাতে পারছে না। উঁকি মেরে দেখি, একটা জন্তু- মানুষ না বাঁদর, প্যাঁচা না ভূত, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না- খালি হাত-পা ছুঁড়ে হাসছে, আর বলছে, “এই গেল গেল- নাড়ি-ভুঁড়ি সব ফেটে গেল!”

হঠাত্ আমায় দেখে সে একটু দম পেয়ে উঠে বলল, “ভাগ্যিস তুমি এসে পড়লে, তা না হলে আর একটু হলেই হাসতে হাসতে পেত ফেটে যাচ্ছিল।”

আমি বললাম, “তুমি এমন সাংঘাতিক রকম হাসছ কেন?”

জন্তুটা বলল, “কেন হাসছি শুনবে? মনে কর, পৃথিবীটা যদি চ্যাপটা হত, আর সব জল গড়িয়ে ডাঙায় এসে এসে পড়ত, আর ডাঙার মাটি সব ঘুলিয়ে প্যাচ্প্যাচে কাদা হয়ে যেত, আর লোকগুলো সব তরা মধ্যে ধপাধপ্ আছাড় খেয়ে পড়ত, তা হলে- হোঃ হোঃ হোঃ হো-” এই বলে সে আবার হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ল।

আমি বললাম, “কি আশ্চর্য! এর জন্য তুমি এত ভয়ানক করে হাসছ?”

সে আবার হাসি থামিয়ে বলল, “না, না, শুধু এর জন্য নয়। মনে কর, একজন লোক আসছে, তার এক হাতে কুলপিবরফ আর-এক হাতে সাজিমাটি, আর লোকটা কুলপি খেতে গিয়ে ভুলে সাজিমাটি খেয়ে ফেলেছে- হোঃ হোঃ, হোঃ হো, হাঃ হাঃ হাঃ হা-” আবার হাসির পালা।

আমি বললাম, “কেন তুমি এই-সব অসম্ভব কথা ভেবে খামকা হেসে-হেসে কষ্ট পাচ্ছ?”

সে বলল, “না, না, সব কি আর অসম্ভব? মনে কর, একজন লোক টিকটিকি পোষে, রোজ তাদের নাইয়ে খাইয়ে শুকোতে দেয়, একদিন একটা রামছাগল এসে সব টিকটিকি খেয়ে ফেলেছে- হোঃ হোঃ হোঃ হো-”

জন্তুটার রকম-সকম দেখে আমার ভারি অদ্ভুত লাগল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “তুমি কে? তোমার নাম কি?”

সে খানিকক্ষণ ভেবে বলল, “আমার নাম হিজি বিজ্ বিজ্। আমার নাম হিজি বিজ্ বিজ্, আমার ভায়ের নাম হিজি বিজ্ বিজ্, আমার বাবার নাম হিজি বিজ্ বিজ্, আমার পিসের নাম হিজি বিজ্ বিজ্-”

আমি বললাম, “তার চেয়ে সোজা বললেই হয় তোমার গুষ্টিসুদ্ধ সবাই হিজি বিজ্ বিজ্।”

সে আবার খানিক ভেবে বলল, “তা তো নয়, আমার নাম তকাই! আমার মামার নাম তকাই, আমার খুড়োর নাম তকাই, আমার মেসোর নাম তকাই, আমার শ্বশুরের নাম তকাই-”

আমি ধমক দিয়ে বললাম, “সত্যি বলছ? না বানিয়ে?”

জন্তুটা কেমন থতমত খেয়ে বলল, “না না, আমার শ্বশুরের নাম বিস্কুট।”

আমার ভয়ানক রাগ হল, তেড়ে বললাম, “একটা কথাও বিশ্বাস করি না।”

অমনি কথা নেই বার্তা নেই, ঝোপের আড়াল থেকে একটা মস্ত দাড়িওয়ালা ছাগল হঠাত্ উঁকি মেরে জিজ্ঞাসা করল, “আমার কথা হচ্ছে বুঝি?”

আমি বলতে যাচ্ছিলাম ‘না’ কিন্তু কিছু না বলতেই তড়্তড়্ করে সে বলে যেতে লাগল, “তা তোমরা যতই তর্ক কর, এমন অনেক জিনিস আছে যা ছাগলে খায় না। তাই আমি একটা বক্তৃতা দিতে চাই, তার বিষয় হচ্ছে- ছাগলে কি না খায়।” এই বলে সে হঠাত্ এগিয়ে এসে বক্তৃতা আরম্ভ করল-

“হে বালকবৃন্দ এবং স্নেহের হিজি বিজ্ বিজ্, আমার গলায় ঝোলানো সার্টিফিকেট দেখেই তোমরা বুঝতে পারছ যে আমার নাম শ্রী ব্যাকরণ শিং বি. এ. খাদ্যবিশারদ। আমি খুব চমত্কার ব্যা করতে পারি, তাই আমার নাম ব্যাকরণ, আর শিং তো দেখতেই পাচ্ছ। ইংরাজিতে লিখবার সময় লিখি B.A. অর্থাত্ ব্যা। কোন-কোন জিনিস খাওয়া যায় আর কোনটা-কোনটা খাওয়া যায় না, তা আমি সব নিজে পরীক্ষা করে দেখেছি, তাই আমার উপাধি হচ্ছে খাদ্যবিশারদ। তোমরা যে বল- পাগলে কি না বলে, ছাগলে কি না খায়- এটা অত্যন্ত অন্যায়। এই তো একটু আগে ঐ হতভাগাটা বলছিল যে রামছাগল টিকটিকি খায়! এটা এক্কেবারে সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা। আমি অনেকরকম টিকটিকি চেটে দেখেছি, ওতে খাবার মতো কিচ্ছু নেই। অবশ্যি আমরা মাঝে-মাঝে এমন অনেক জিনিস খাই, যা তোমরা খাও না, যেমন- খাবারের ঠোঙা, কিম্বা নারকেলের ছোবড়া, কিম্বা খবরের কাগজ, কিম্বা সন্দেশের মতো ভালো ভালো মাসিক পত্রিকা। কিন্তু তা বলে মজবুত বাঁধানো কোনো বই আমরা কক্ষনো খাই না। আমরা ক্বচিত্ কখনো লেপ কম্বল কিম্বা তোষক বালিশ এ-সব একটু আধটু খাই বটে, কিন্তু যারা বলে আমরা খাট পালং কিম্বা টেবিল চেয়ার খাই, তারা ভয়ানক মিথ্যাবাদী। যখন আমাদের মনে খুব তেজ আসে, তখন শখ করে অনেকরকম জিনিস আমরা চিবিয়ে কিম্বা চেখে দেখি, যেমন, পেনসিল রবার কিম্বা বোতলের ছিপি কিম্বা শুকনো জুতো কিম্বা ক্যামবিসের ব্যাগ। শুনেছি আমার ঠাকুরদাদা একবার ফুর্তির চোটে এক সাহেবের আধখানা তাঁবু প্রায় খেয়ে শেষ করেছিলেন। কিন্তু তা বলে ছুরি কাঁচি কিম্বা শিশি-বোতল, এ-সব আমরা কোনোদিন খাই না। কেউ-কেউ সাবান খেতে ভালোবাসে, কিন্তু সে-সব নেহাত ছোটোখাটো বাজে সাবান। আমার ছোটভাই একবার একটা আস্ত বার্-সোপ খেয়ে ফেলেছিল-” বলেই ব্যাকরণ শিং আকাশের দিকে চোখ তুলে ব্যা-ব্যা করে ভয়ানক কাঁদতে লাগল। তাতে বুঝতে পারলাম যে সাবান খেয়ে ভাইটির অকালমৃত্যু হয়েছিল।

হিজি বিজ্ বিজ্টা এতক্ষণ পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিল, হঠাত্ ছাগলটার বিকট কান্না শুনে সে হাঁউ-মাঁউ করে ধড়্মড়িয়ে উঠে বিষম-টিষম খেয়ে একেবারে অস্থির! আমি ভাবলাম বোকাটা বুঝি মরে এবার! কিন্তু একটু পরেই দেখি, সে আবার তেমনি হাত-পা ছুঁড়ে ফ্যাক্ফ্যাক্ করে হাসতে লেগেছে।

আমি বললাম, “এর মধ্যে আবার হাসবার কি হল?”

সে বলল, “সেই একজন লোক ছিল, সে মাঝে-মাঝে এমন ভয়ংকর নাক ডাকাত যে সবাই তার উপর চটা ছিল! একদিন তাদের বাড়ি বাজ পড়েছে, আর অমনি সবাই দৌড়ে তাকে দমাদম মারতে লেগেছে- হোঃ হোঃ হোঃ হো-” আমি বললাম, “যত-সব বাজে কথা।” এই বলে যেই ফিরতে গেছি, অমনি চেয়ে দেখি একটা নেড়ামাথা কে-যেন যাত্রার জুড়ির মতো চাপকান আর পায়জামা পরে হাসি-হাসি মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দেখে আমার গা জ্বলে গেল। আমায় ফিরতে দেখেই সে আবদার করে আহ্লাদীর মতো ঘাড় বাঁকিয়ে দুহাত নেড়ে বলতে লাগল, “না ভাই, না ভাই, এখন আমায় গাইতে বোলো না। সত্যি বলছি, আজকে আমার গলা তেমন খুলবে না।”

আমি বললাম, “কি আপদ! কে তোমায় গাইতে বলছে?”

লোকটা এমন বেহায়া, সে তবুও আমার কানের কাছে ঘ্যান্ঘ্যান্ করতে লাগল, “রাগ করলে? হ্যাঁ ভাই, রাগ করলে? আচ্ছা নাহয় কয়েকটা গান শুনিয়ে দিচ্ছি, রাগ করবার দরকার কি ভাই?”

আমি কিছু বলবার আগেই ছাগলটা আর্ হিজি বিজ্ বিজ্টা একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, “হ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁ, গান হোক, গান হোক।” অমনি নেড়াটা তার পকেট থেকে মস্ত দুই তাড়া গানের কাগজ বার করে, সেগুলো চোখের কাছে নিয়ে গুনগুন করতে করতে হঠাত্ সরু গলায় চীত্কার করে গান ধরল- “লাল গানে নীল সুর, হাসি হাসি গন্ধ।”

ঐ একটিমাত্র পদ সে একবার গাইল, দুবার গাইল, পাঁচবার, দশবার গাইল।

আমি বললাম, “এ তো ভারি উত্পাত দেখছি, গানের কি আর কোনো পদ নেই?”

নেড়া বলল, “হ্যাঁ আছে, কিন্তু সেটা অন্য একটা গান। সেটা হচ্ছে- অলিগলি চলি রাম, ফুটপাথে ধুমধাম, কালি দিয়ে চুনকাম। সে গান আজকাল আমি গাই না। আরেকটা গান আছে- নাইনিতালের নতুন আলু- সেটা খুব নরম সুরে গাইতে হয়। সেটাও আজকাল গাইতে পারি না। আজকাল যেটা গাই, সেটা হচ্ছে শিখিপাখার গান।” এই বলে সে গান ধরল-

মিশিপাখা শিখিপাখা আকাশের কানে কানে
শিশি বোতল ছিপিঢাকা সরু সরু গানে গানে
আলাভোলা বাঁকা আলো আধো আধো কতদূরে,
সরু মোটা সাদা কালো ছলছল ছায়াসুরে।

আমি বললাম, “এ আবার গান হল নাকি? এর তো মাথামুণ্ডু কোনো মানেই হয় না।”

হিজি বিজ্ বিজ্ বলল, “হ্যাঁ, গানটা ভারি শক্ত।”

ছাগল বলল, “শক্ত আবার কোথায়? ঐ শিশি বোতলের জায়গাটা একটু শক্ত ঠেকল, তা ছাড়া তো শক্ত কিছু পেলাম না।”

নেড়াটা খুব অভিমান করে বলল, “তা, তোমরা সহজ গান শুনতে চাও তো সে কথা বললেই হয়। অত কথা শোনাবার দরকার কি? আমি কি আর সহজ গান গাইতে পারি না?” এই বলে সে গান ধরল-

বাদুড় বলে, ওরে ও ভাই সজারু,
আজকে রাতে দেখবে একটা মজারু।

আমি বললাম, “মজারু বলে কোনো-একটা কথা হয় না।”

নেড়া বলল, “কেন হবে না- আলবত্ হয়। সজারু কাঙ্গারু দেবদারু সব হতে পারে, মজারু কেন হবে না?”

ছাগল বলল, “ততক্ষণ গানটা চলুক-না, হয় কি না হয় পরে দেখা যাবে।” অমনি আবার গান শুরু হল-

বাদুড় বলে, ওরে ও ভাই সজারু,
আজকে রাতে দেখবে একটা মজারু।
আজকে হেথায় চাম্চিকে আর পেঁচারা
আসবে সবাই, মরবে ইঁদুর বেচারা।
কাঁপবে ভয়ে ব্যাঙগুলো আর ব্যাঙাচি,
ঘামতে ঘামতে ফুটবে তাদের ঘামাচি,
ছুটবে ছুঁচো লাগবে দাঁতে কপাটি,
দেখবে তখন ছিম্বি ছ্যাঙা চপাটি।

আমি আবার আপত্তি করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু সামলে গেলাম। গান আবার চলতে লাগল,

সজারু কয়, ঝোপের মাঝে এখনি
গিন্নী আমার ঘুম দিয়েছেন দেখ নি?
এনে রাখুন প্যাঁচা এবং প্যাঁচানি,
ভাঙলে সে ঘুম শুনে তাদের চ্যাঁচানি,
খ্যাংরা-খোঁচা করব তাদের খুঁচিয়ে-
এই কথাটা বলবে তুমি বুঝিয়ে।
বাদুড় বলে, পেঁচার কুটুম কুটুমী,
মানবে না কেউ তোমার এ-সব ঘুঁতুমি।
ঘুমোয় কি কেউ এমন ভুসো আঁধারে?
গিন্নী তোমার হোঁত্লা এবং হাঁদাড়ে।
তুমিও দাদা হচ্ছ ক্রমে খ্যাপাটে
চিমনি-চাটা ভোঁপসা-মুখো ভ্যাঁপাটে।

গানটা আরো চলত কি না জানি না, কিন্তু এইপর্যন্ত হতেই একটা গোলমাল শোনা গেল। তাকিয়ে দেখি আমার আশেপাশে চারদিকে ভিড় জমে গিয়েছে। একটা সজারু এগিয়ে বসে ফোঁত্ ফোঁত্ করে কাঁদছে আর একটা শাম্‌লাপরা কুমির মস্ত একটা বই নিয়ে আস্তে-আস্তে তার পিঠ থাবড়াচ্ছে আর ফিস্‌ফিস্ করে বলছে, “কেঁদো না, কেঁদো না, সব ঠিক করে দিচ্ছি।” হঠাত্ একটা তক্‌মা-আঁটা পাগড়ি-বাঁধা কোলাব্যাঙ রুল উঁচিয়ে চীত্কার করে বলে উঠল- “মানহানির মোকদ্দমা।”

অমনি কোত্থেকে একটা কালো ঝোল্লা-পরা হুতোমপ্যাঁচা এসে সকলের সামনে একটা উঁচু পাথরের উপর বসেই চোখ বুজে ঢুলতে লাগল, আর একটা মস্ত ছুঁচো একটা বিশ্রী নোংরা হাতপাখা দিয়ে তাকে বাতাস করতে লাগল।

প্যাঁচা একবার ঘোলা-ঘোলা চোখ করে চারদিকে তাকিয়েই তক্ষুনি আবার চোখ বুজে বলল, “নালিশ বাতলাও।”

বলতেই কুমিরটা অনেক কষ্টে কাঁদো-কাঁদো মুখ করে চোখের মধ্যে নখ দিয়ে খিমচিয়ে পাঁচ ছয় ফোঁটা জল বার করে ফেলল। তার পর সর্দিবসা মোটা গলায় বলতে লাগল, “ধর্মাবতার হুজুর! এটা মানহানির মোকদ্দমা। সুতরাং প্রথমেই বুঝতে হবে মান কাকে বলে। মান মানে কচু। কচু অতি উপাদেয় জিনিস। কচু অনেকপ্রকার, যথা- মানকচু, ওলকচু, কান্দাকচু, মুখিকচু, পানিকচু, শঙ্খকচু, ইত্যাদি। কচুগাছের মূলকে কচু বলে, সুতরাং বিষয়টার একেবারে মূল পর্যন্ত যাওয়া দরকার।”

এইটুকু বলতেই একটা শেয়াল শাম্‌লা মাথায় তড়াক্ করে লাফিয়ে উঠে বলল, “হুজুর, কচু অতি অসার জিনিস। কচু খেলে গলা কুট্কুট্ করে, কচুপোড়া খাও বললে মানুষ চটে যায়। কচু খায় কারা? কচু খায় শুওর আর সজারু। ওয়াক্ থুঃ।” সজারুটা আবার ফ্যাঁত্ফ্যাঁত্ করে কাঁদতে যাচ্ছিল, কিন্তু কুমির সেই প্রকাণ্ড বই দিয়ে তার মাথায় এক থাবড়া মেরে জিজ্ঞাসা করল, “দলিলপত্র সাক্ষী-সাবুদ কিছু আছে?” সজারু নেড়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “ঐ তো ওর হাতে সব দলিল রয়েছে।” বলতেই কুমিরটা নেড়ার কাছ থেকে একতাড়া গানের কাগজ কেড়ে নিয়ে হঠাত্ এক জায়গা থেকে পড়তে লাগল-

একের পিঠে দুই গোলাপ চাঁপা জুঁই সান্ বাঁধানো ভুঁই
চৌকি চেপে শুই ইলিশ মাগুর রুই গোবর জলে ধুই
পোঁটলা বেঁধে থুই হিন্চে পালং পুঁই কাঁদিস কেন তুই।

সজারু বলল, “আহা ওটা কেন? ওটা তো নয়।” কুমির বলল, “তাই নাকি? আচ্ছা দাঁড়াও।” এই বলে সে আবার একখানা কাগজ নিয়ে পড়তে লাগল-

চাঁদনি রাতের পেতনীপিসি সজনেতলায় খোঁজ্ না রে-
থ্যাঁতলা মাথা হ্যাংলা সেথা হাড় কচাকচ্ ভোজ মারে।
চালতা গাছে আল্তা পরা নাক ঝুলানো শাঁখচুনি
মাক্ড়ি নেড়ে হাঁকড়ে বলে, আমায় তো কেঁউ ডাঁকছ নি!
মুণ্ডু ঝোলা উল্টোবুড়ি ঝুলছে দেখ চুল খুলে,
বলছে দুলে, মিন্সেগুলোর মাংস খাব তুলতুলে।

সজারু বলল, “দূর ছাই! কি যে পড়ছে তার নেই ঠিক।”

কুমির বলল, “তাহলে কোনটা, এইটা?- দই দম্বল, টেকো অম্বল, কাঁথা কম্বল করে সম্বল বোকা ভোম্বল- এটাও নয়? আচ্ছা তা হলে দাঁড়াও দেখছি- নিঝুম নিশুত রাতে, একা শুয়ে তেতালাতে, খালি খালি খিদে পায় কেন রে?- কি বললে?- ও-সব নয়? তোমার গিন্নীর নামে কবিতা?- তা সে কথা আগে বললেই হত। এই তো- রামভজনের গিন্নীটা, বাপ রে যেন সিংহীটা! বাসন নাড়ে ঝনার্ঝন, কাপড় কাচে দমাদ্দম্।- এটাও মিলছে না? তা হলে নিশ্চয় এটা-

খুস‌খুসে কাশি ঘুষ‌ঘুষে জ্বর, ফুস‌ফুসে ছ্যাঁদা বুড়ো তুই মর্।
মাজ‌রাতে ব্যথা পাঁজ‌রাতে বাত, আজ রাতে বুড়ো হবি কুপোকাত!”

সজারুটা ভয়ানক কাঁদতে লাগল, “হায়, হায়! আমার পয়সাগুলো সব জলে গেল! কোথাকার এক আহাম্মক উকিল, দলিল খুঁজে পায় না!”

নেড়াটা এতক্ষণ আড়ষ্ট হয়ে ছিল, সে হঠাত্ বলে উঠল, “কোনটা শুনতে চাও? সেই যে- বাদুড় বলে ওরে ও ভাই সজারু- সেইটে?”

সজারু ব্যস্ত হয়ে বলল, “হ্যাঁ-হ্যাঁ, সেইটে, সেইটে।”

অমনি শেয়াল আবার তেড়ে উঠল, “বাদুড় কি বলে? হুজুর, তা হলে বাদুড়গোপালকে সাক্ষী মানতে আজ্ঞা হোক।”

কোলাব্যাঙ গাল-গলা ফুলিয়ে হেঁকে বলল, “বাদুড়গোপাল হাজির?”

সবাই এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখল, কোথাও বাদুড় নেই। তখন শেয়াল বলল, “তা হলে হুজুর, ওদের সক্কলের ফাঁসির হুকুম হোক।”

কুমির বলল, “তা কেন? এখন আমরা আপিল করব?”

প্যাঁচা চোখ বুজে বলল, “আপিল চলুক! সাক্ষী আন।”

কুমির এদিক-ওদিক তাকিয়ে হিজি বিজ্ বিজ্‌কে জিজ্ঞাসা করল, “সাক্ষী দিবি? চার আনা পয়সা পাবি।” পয়সার নামে হিজি বিজ্ বিজ্ তড়াক্ করে সাক্ষী দিতে উঠেই ফ্যাক্‌ফ্যাক্
করে হেসে ফেলল।

শেয়াল বলল, “হাসছ কেন?”

হিজি বিজ্ বিজ্ বলল, “একজনকে শিখিয়ে দিয়েছিল, তুই সাক্ষী দিবি যে, বইটার সবুজ রঙের মলাট, কানের কাছে নীল চামড়া আর মাথার উপর লালকালির ছাপ। উকিল যেই তাকে জিজ্ঞাসা করেছে, তুমি আসামীকে চেন? অমনি সে বলে উঠেছে, আজ্ঞে হ্যাঁ, সবুজ রঙের মলাট, কানের কাছে নীল চামড়া, মাথার উপর লালকালির ছাপ- হোঃ হোঃ হোঃ হো-”

শেয়াল জিজ্ঞাসা করল, “তুমি সজারুকে চেন?”

হিজি বিজ্ বিজ্ বলল, “হ্যাঁ, সজারু চিনি, কুমির চিনি, সব চিনি। সজারু গর্তে থাকে, তার গায়ে লম্বা-লম্বা কাঁটা, আর কুমিরের গায়ে চাকা-চাকা ঢিপির মতো, তারা ছাগল-টাগল ধরে খায়।” বলতেই ব্যাকরণ শিং ব্যা-ব্যা করে ভয়ানক কেঁদে উঠল।

আমি বললাম, “আবার কি হল?”

ছাগল বলল, “আমার সেজোমামার আধখানা কুমিরে খেয়েছিল, তাই বাকি আধখানা মরে গেল।”

আমি বললাম, “গেল তো গেল, আপদ গেল। তুমি এখন চুপ কর।”

শেয়াল জিজ্ঞাসা করল, “তুমি মোকদ্দমার কিছূ জানো?”

হিজি বিজ্ বিজ্ বলল, “তা আর জানি নে? একজন নালিশ করে তার একজন উকিল থাকে, আর একজনকে আসাম থেকে ধরে নিয়ে আসে, তাকে বলে আসামী। তারও একজন উকিল থাকে। এক-একদিকে দশজন করে সাক্ষী থাকে! আর একজন জজ থাকে, সে বসে-বসে ঘুমোয়।”

প্যাঁচা বলল, “কক্ষনো আমি ঘুমোচ্ছি না, আমার চোখে ব্যারাম আছে তাই চোখ বুজে আছি।”

হিজি বিজ্ বিজ্ বলল, “আরো অনেক জজ দেখেছি, তাদের সক্কলেরই চোখে ব্যারাম।” বলেই সে ফ্যাক্ফ্যাক্ করে ভয়ানক হাসতে লাগল।

শেয়াল বলল, “আবার কি হল?”

হিজি বিজ্ বিজ্ বলল, “একজনের মাথার ব্যারাম ছিল, সে সব জিনিসের নামকরণ করত। তার জুতোর নাম ছিল অবিমৃষ্যকারিতা, তার ছাতার নাম ছিল প্রত্যুত্পন্নমতিত্ব, তার গাড়ুর নাম ছিল পরমকল্যাণবরেষু- কিন্তু যেই তার বাড়ির নাম দিয়েছে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অমনি ভূমিকম্প হয়ে বাড়িটাড়ি সব পড়ে গিয়েছে। হোঃ হোঃ হোঃ হো-”

শেয়াল বলল, “বটে? তোমার নাম কি শুনি?”

সে বলল, “এখন আমার নাম হিজি বিজ্ বিজ্।”

শেয়াল বলল, “নামের আবার এখন আর তখন কি?”

হিজি বিজ্ বিজ্ বলল, “তাও জানো না? সকালে আমার নাম থাকে আলুনারকোল আবার আর একটু বিকেল হলেই আমার নাম হয়ে যাবে রামতাড়ু।”

শেয়াল বলল, “নিবাস কোথায়?”

হিজি বিজ্ বিজ্ বলল, “কার কথা বলছ? শ্রীনিবাস? শ্রীনিবাস দেশে চলে গিয়েছে।” অমনি ভিড়ের মধ্যে থেকে উধো আর বুধো একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, “তা হলে শ্রীনিবাস নিশ্চয়ই মরে গিযেছে!”

উধো বলল, “দেশে গেলেই লোকেরা সব হুস্হুস্ করে করে মরে যায়।”

বুধো বলল, “হাবুলের কাকা যেই দেশে গেল অমনি শুনি সে মরে গিয়েছে।”

শেয়াল বলল, “আঃ, সবাই মিলে কথা বোলো না, ভারি গোলমাল হয়।”

শুনে উধো বুধোকে বলল, “ফের সবাই মিলে কথা বলবি তো তোকে মারতে মারতে সাবাড় করে ফেলব।” বুধো বলল, “আবার যদি গোলমাল করিস তা হলে তোকে ধরে এক্কেবারে পোঁটলা-পেটা করে দেব।”

শেয়াল বলল, “হুজুর, এরা সব পাগল আর আহাম্মক, এদের সাক্ষীর কোনো মূল্য নেই।”

শুনে কুমির রেগে ল্যাজ আছড়িয়ে বলল, “কে বলল মূল্য নেই? দস্তুরমতো চার আনা পয়সা খরচ করে সাক্ষী দেওয়ানো হচ্ছে।” বলেই সে তক্ষুনি ঠক্ঠক্ করে ষোলোটা পয়সা গুণে হিজি বিজ্ বিজের হাতে দিয়ে দিল।

অমনি কে যেন ওপর থেকে বলে উঠল, “১নং সাক্ষী, নগদ হিসাব, মূল্য চার আনা।” চেয়ে দেখলাম কাক্কেশ্বর বসে-বসে হিসেব লিখছে।

শেয়াল আবার জিজ্ঞাসা করল, “তুমি এ বিষয়ে আর কিছু জানো কি-না?”

হিজি বিজ্ বিজ্ খানিক ভেবে বলল, “শেয়ালের বিষয়ে একটা গান আছে, সেইটা জানি।”

শেয়াল বলল, “কি গান শুনি?”

হিজি বিজ্ বিজ্ সুর করে বলতে লাগল, “আয়, আয়, আয়, শেয়ালে বেগুন খায়, তারা তেল আর নুন কোথায় পায়-”

বলতেই শেয়াল ভয়ানক ব্যস্ত হয়ে উঠল, “থাক্-থাক্, সে অন্য শেয়ালের কথা, তোমার সাক্ষী দেওয়া শেষ হয়ে গিয়েছে।”

এদিকে হয়েছে কি, সাক্ষীরা পয়সা পাচ্ছে দেখে সাক্ষী দেবার জন্য ভয়ানক হুড়োহুড়ি লেগে গিয়েছে। সবাই মিলে ঠেলাঠেলি করছে, এমন সময় হঠাত্ দেখি কাক্কেশ্বর ঝুপ্ করে গাছ থেকে নেমে এসে সাক্ষীর জায়গায় বসে সাক্ষী দিতে আরম্ভ করেছে। কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করবার আগেই সে বলতে আরম্ভ করল, “শ্রীশ্রীভূশণ্ডীকাগায় নমঃ। শ্রীকাক্কেশ্বর কুচ্কুচে, ৪১নং গেছোবাজার, কাগেয়াপটি। আমরা হিসাবী ও বেহিসাবী খুচরা পাইকারী সকলপ্রকার গণনার কার্য-”

শেয়াল বলল, “বাজে কথা বোলো না, যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দাও। কি নাম তোমার?”

কাক বলল, “কি আপদ! তাই তো বলছিলাম- শ্রীকাক্কেশ্বর কুচ‌কুচে।”

শেয়াল বলল, “নিবাস কোথায়?”

কাক বলল, “বললাম যে কাগেয়াপটি।”

শেয়াল বলল, “সে এখান থেকে কতদূর?”

কাক বলল, “তা বলা ভারি শক্ত। ঘণ্টা হিসেবে চার আনা, মাইল হিসাবে দশ পয়সা, নগদ দিলে দুই পয়সা কম। যোগ করলে দশ আনা, বিয়োগ করলে তিন আনা, ভাগ করলে সাত পয়সা, গুণ করলে একুশ টাকা।”

শেয়াল বলল, “আর বিদ্যে জাহির করতে হবে না। জিজ্ঞাসা করি, তোমার বাড়ি যাবার পথটা চেন তো?”

কাক বলল, “তা আর চিনি নে? এই তো সামনেই সোজা পথ দেখা যাচ্ছে।”

শেয়াল বলল, “এ-পথ কতদূর গিয়েছে?”

কাক বলল, “পথ আবার কোথায় যাবে? যেখানকার পথ সেখানেই আছে। পথ কি আবার এদিক-ওদিক চরে বেড়ায়? না, দার্জিলিঙে হাওয়া খেতে যায়?”

শেয়াল বলল, “তুমি তো ভারি বেয়াদব হে! বলি, সাক্ষী দিতে যে এয়েছ, মোকদ্দমার কথা কি জানো?”

কাক বলল, “খুব যা হোক! এতক্ষণ বসে-বসে হিসেব করল কে? যা কিছু জানতে চাও আমার কাছে পাবে। এই তো প্রথমেই, মান কাকে বলে? মান মানে কচুরি। কচুরি চারপ্রকার- হিঙে কচুরি, খাস্তা কচুরি নিমকি আর জিবেগজা! খেলে কি হয়? খেলে শেয়ালদের গলা কুট্কুট্ করে, কিন্তু কাগেদের করে না। তার পর একজন সাক্ষী ছিল, নগদ মূল্য চার আনা, সে আসামে থাকত, তার কানের চামড়া নীল হয়ে গেল- তাকে বলে কালাজ্বর। তার পর একজন লোক ছিল সে সকলের নামকরণ করত- শেয়ালকে বলত তেলচোরা, কুমিরকে বলত অষ্টাবক্র, প্যাঁচাকে বলত বিভীষণ-” বলতেই বিচার সভায় একটা ভয়ানক গোলমাল বেধে গেল। কুমির হঠাত্ খেপে গিয়ে টপ্ করে কোলাব্যাঙকে খেয়ে ফেলল, তাই দেখে ছুঁচোটা কিচ্ কিচ্ কিচ্ কিচ্ করে ভয়ানক চেঁচাতে লাগল, শেয়াল একটা ছাতা দিয়ে হুস্ হুস্ করে কাক্কেশ্বরকে তাড়াতে লাগল।

প্যাঁচা গম্ভীর হয়ে বলল, “সবাই চুপ কর, আমি মোকদ্দমার রায় দেব।” এই বলেই কানে-কলম-দেওয়া খরগোশকে হুকুম করল, “যা বলছি লিখে নাও: মানহানির মোকদ্দমা, চব্বিশ নম্বর। ফরিয়াদী- সজারু। আসামী-দাঁড়াও। আসামী কই?” তখন সবাই বল, “ঐ যা! আসামী তো কেউ নেই।” তাড়াতাড়ি ভুলিয়ে-ভালিয়ে নেড়াকে আসামী দাঁড় করানো হল। নেড়াটা বোকা, সে ভাবল আসামীরাও বুঝি পয়সা পাবে, তাই সে কোনো আপত্তি করল না।

হুকুম হল- নেড়ার তিনমাস জেল আর সাতদিনের ফাঁসি। আমি সবে ভাবছি এরকম অন্যায় বিচারের বিরুদ্ধে আপত্তি করা উচিত, এমন সময় ছাগলটা হঠাত্ “ব্যা-করণ শিং” বলে পিছন থেকে তেড়ে এসে আমায় এক ঢুঁ মারল, তার পরেই আমার কান কামড়ে দিল। অমনি চারদিকে কিরকম সব ঘুলিয়ে যেতে লাগল, ছাগলটার মুখটা ক্রমে বদলিয়ে শেষটায় ঠিক মেজোমামার মতো হয়ে গেল। তখন ঠাওর করে দেখলাম, মেজোমামা আমার কান ধরে বলছেন, “ব্যাকরণ শিখবার নাম করে বুঝি পড়ে-পড়ে ঘুমোনো হচ্ছে?”

আমি তো অবাক! প্রথমে ভাবলাম বুঝি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম। কিন্তু, তোমরা বললে বিশ্বাস করবে না, আমার রুমালটা খুঁজতে গিয়ে দেখি কোথাও রুমাল নেই, আর একটা বেড়াল বেড়ার ওপর বসে বসে গোঁফে তা দিচ্ছিল, হঠাত্ আমায় দেখতে পেয়েই খচ্‌মচ্ করে নেমে পালিয়ে গেল। আর ঠিক সেই সময়ে বাগানের পিছন থেকে একটা ছাগল ব্যা করে ডেকে উঠল।

আমি বড়োমামার কাছে এ-সব কথা বলেছিলাম, কিন্তু বড়োমামা বললেন, “যা, যা, কতগুলো বাজে স্বপ্ন দেখে তাই নিয়ে গল্প করতে এসেছে।” মানুষের বয়স হলে এমন হোঁতকা হয়ে যায়, কিছুতেই কোনো কথা বিশ্বাস করতে চায় না। তোমাদের কিনা এখনো বেশি বয়স হয়নি, তাই তোমাদের কাছে ভরসা করে এ-সব কথা বললাম।