Monday, September 2, 2019

কেন ‘লিওনার্দো দা ভিঞ্চি’ একজন বন্ড ভিলেন হবার জন্যে উপযুক্ত – ১ম পর্ব


আধুনিক যুগে পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্বীয় জগতের ডন যদি হন আইনস্টাইন, তাহলে মধ্যযুগে সেই ডন ছিলেন নিউটন। ঠিক তেমনি ফলিত বিজ্ঞানের আধুনিক যুগের ডন যদি হন নিকোলা টেসলা, তাহলে মধ্যযুগে সেটা ছিলেন ‘লিওনার্দো দা ভিঞ্চি’। বস্তুতপক্ষে, টেসলার সাথে ভিঞ্চির মিল অসাধারণ! দুজনেই ছিলেন শিল্পের ভালো সমঝদার (ভিঞ্চি ছিলেন দুর্ধর্ষ চিত্রশিল্পী আর টেসলা ছিলেন দুর্ধর্ষ কবি)। দুজনেই ছিলেন অসাধারণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী। দুজনেই অন্য কারো কাজ থেকে অনুপ্রাণিত হওয়া ব্যতিরেকেই, প্রায় শূন্য হতে ম্যাজিকের মত আইডিয়া মাথায় এনে সেটা নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে সক্ষম ছিলেন। দুজনের কাছেই বিভিন্ন কাল্পনিক চরিত্ররা ছুটে গিয়েছিলো অলৌকিক সব ক্ষমতা পাবার উদ্দেশ্যে (ভিঞ্চির নিকট গিয়েছিলো কিংবদন্তীতুল্য এক অ্যাসাসিন, আর টেসলার নিকট গিয়েছিলো কিংবদন্তীতুল্য এক ম্যাজিশিয়ান)। দুজনেরই সব আবিষ্কারের মাহাত্ম্য উপলব্ধি করতে আমাদের, সৃষ্টির সেরা বুদ্ধিমান প্রাণীদের, মোটামুটি ১০০ বছরের মত সময় লেগে গেছে।

দুজনের মাঝে এত এত মিল দেখে যখন আমরা বিজ্ঞানযাত্রা হতে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম ‘নিকোলা টেসলা’ কে নিয়ে লেখা প্রবন্ধের একটা প্রিকুয়েল (Prequel) নামাতে, যেখানে মূলনায়ক থাকবেন মধ্যযুগের আবিষ্কারকদের ডন ‘লিওনার্দো দা ভিঞ্চি’, তখন আমাদের চোখ পড়লো ভিঞ্চির কিছু আবিষ্কারের দিকে। আর আমরা সিদ্ধান্তে আসলাম টেসলার সাথে এখানেই ভিঞ্চির সবচেয়ে বড় ফারাক। টেসলা যদি হন বন্ড মুভির ‘কিউ’, তাহলে ভিঞ্চি হচ্ছেন সেই মুভির পুরাদস্তুর একজন বন্ড ভিলেন। মধ্যযুগে ইউরোপে যদি ‘এমআই-সিক্স’ এর অস্তিত্ব থাকতো তবে তারা এজেন্ট ‘জিরো জিরো সেভেন’ কে লেলিয়ে দিতো ভিঞ্চির পেছন পেছন।


"মাই নেইম ইজ বন্ড.........জেমস বন্ড!"

“মাই নেইম ইজ বন্ড………জেমস বন্ড!”




কারণ জানতে চান? তাহলে তাকান নিচে ভিঞ্চির বিভিন্ন আবিষ্কারের আইডিয়ার মাঝে-

অসাধারণ রকমের এক দুর্ভেদ্য দুর্গ


বন্ড ভিলেন হবার প্রথম শর্ত হচ্ছে এটা। ভিলেন তার মাস্টারপ্ল্যান বানাবে তার নিজস্ব এক গোপন দুর্গে বসে (যদিও বন্ড সিরিজের সর্বশেষ কিছু পর্বে এই ধারণাটাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে)। এই দুর্গে অনুপ্রবেশের চিন্তা করা দূরের কথা, মোটামুটি মাইল দুয়েকের ভেতর যাবার চেষ্টা করলেই বেঘোরে মারা পড়তে হবে। ভিঞ্চিও তৈরি করেছিলেন এমন এক দুর্গের ডিজাইন যেটায় হাল আমলের এমআই সিক্স এজেন্টের অনুপ্রবেশ করতেও রীতিমত ঘাম ছুটে যাবে।

ভিঞ্চির মূল ডিজাইন
‘সান জু’ তার লিখিত ‘আর্ট অব ওয়ারে’ বলেছিলেন, “অজেয়তা নিহিত আছে দুর্ভেদ্য প্রতিরোধে, এবং বিজয়ের সম্ভাবনা আছে আক্রমণে”। অর্থাৎ আক্রমণে জয়-পরাজয় সবই ঘটতে পারে। কিন্তু যে প্রতিরোধ সহজে ভেঙ্গে পড়েনা, সেটা সবসময়ই অজেয়। লিওনার্দো তার নিজের জীবনেও এই ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী। ১৪৫৩ সালে সুলতান দ্বিতীয় মাহমুদ কর্তৃক কন্সট্যান্টিনোপল দখল হবার আগের বছর তিনি জন্মেছিলেন। রেনেসাঁ যুগের যুদ্ধকৌশল এবং রাজনীতির প্রত্যক্ষদর্শী তিনি। তিনি নিজ চোখে দেখেছেন এক মাইল দূর হতে ছোঁড়া সুলতান মাহমুদের কামানের গোলাগুলোর সামনে কীভাবে তথাকথিত দুর্ভেদ্য সব দুর্গ হুড়মুড় করে ধ্বসে পড়ে।


"মাত্র এক মাইল? এটার ছোঁড়া গোলা তো মঙ্গলে গিয়ে পড়ার কথা!"

“মাত্র এক মাইল? এটার ছোঁড়া গোলা তো মঙ্গলে গিয়ে পড়ার কথা!”




টার্কিশ কামানের সামনে যখন মধ্যযুগীয় দুর্গের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দফারফা হয়ে গেলো, তখন ভিঞ্চির মত সামরিক পরিকল্পনাবিদদের হাতে পড়লো এদের নিরাপত্তা বর্ধনের দায়িত্ব। অনেকেই অনেক রকমের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। যেমন- কেউ প্রস্তাব করলেন দুর্গের বাইরে চার-পাঁচ স্তরে সীমানা প্রাচীর নির্মাণের। কেউবা বললেন শুধু চার-পাঁচ স্তরের দেয়াল বানালেই হবে না, সেগুলোকে আরো উঁচু করে বানাতে হবে- যাতে কামানের গোলা দুর্গের দেয়াল টপকে সরাসরি ভেতরে এসে আঘাত হানতে না পারে। কেউ কেউ আবার প্রস্তাব করেছিলেন- ভুয়া একটা দুর্গ বানিয়ে সেটার ভেতরে আরেকটা আসল দুর্গ বানাতে। দুই দুর্গের মাঝে হাজারে হাজারে তেলের ড্রাম রাখা হবে। যখন শত্রুরা ভুয়া দুর্গে ঢুকে পড়বে, তখন আসল দুর্গের প্রতিরক্ষাকারীরা সেসব তেলের ড্রামে আগুন ধরিয়ে দিবে- ইত্যাদি ইত্যাদি এমন আরো অনেক ধরনের পরিকল্পনা।


আমাদের বিজ্ঞানযাত্রা হতেও এমন একটা প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হলো।

আমাদের বিজ্ঞানযাত্রা হতেও এমন একটা প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হলো।




কিন্তু সব ধরণের পরিকল্পনাতেই বড় রকমের খুঁত ছিলো। চার-পাঁচ স্তরের দেয়াল দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনী বানাতে গেলে দুর্গের চারপাশে বিশাল জায়গার প্রয়োজন হবে। অনেক সময় সেটা পাওয়া যাবে না। তাছাড়া আগেই বলেছি তুর্কিদের কামানের গোলা মাইল খানেক দৌড়াতে সক্ষম। তাতে ফলাফল কতটা আশাব্যঞ্জক হবে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। আর তেলের ড্রাম থিওরিতে গেলে তো ফলাফল আরো ভয়াবহ। বাইরের শত্রুদের নকল দুর্গের ভেতর আটকে ফেলে চারপাশে আগুন ধরিয়ে দেয়া না হয় গেলো, কিন্তু ভেতরের আসল দুর্গের লোকদের পালানোর প্রয়োজন পড়লে তখন কি হবে? যদি অন্যান্য দুর্গের মত এটায়ও গোপন টানেল ধরেই পালাতে হয়, তাহলে দুর্গের এত নিরাপত্তার আর প্রয়োজন কী?

তাই ভিঞ্চি তৈরি করলেন তার নিজস্ব দুর্গের নকশা– যেটা প্রয়োজনের অতিরিক্ত জায়গা দখল করে না, অন্যান্য দুর্গের কিংবা প্রাসাদের চেয়েও বেশী নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে (যেমন- প্রতিরক্ষাকারী কামান, তীরন্দাজ ইত্যাদির সুকৌশল অবস্থান গ্রহণ) সমর্থন করে এবং একই সময়ে এর দেয়াল কামানের গোলার তীব্র ধাক্কা হজম করতে পারে।

কতটুকু কার্যকরী ছিলো এই ডিজাইন?
আপনারাই দেখুন আর বিচার করুন।

LeonardoFort3
যদি এটাকে হলিউডি সাই-ফাই মুভির দৃশ্য হতে উঠে আসা কোন ফিউচারিস্টিক স্থাপত্যকলার নিদর্শনের মত না মনে হয়, তাহলে বলবো আপনার আরো বেশী করে ‘স্টার ওয়ার্স’ মুভিগুলো দেখা উচিৎ (আধুনিক তিনটা প্রিকুয়েল বাদ দিয়ে। ওগুলো হচ্ছে পরিচালক জর্জ লুকাসের ‘স্টার ওয়ার্স’ সিরিজকে সম্ভ্রমহানি করার ফলে সৃষ্ট তিনটা অবৈধ সন্তান)। এটা যদি একজন বন্ড ভিলেনের নিখুঁত দুর্ভেদ্য আস্তানা না হয়, তবে আমাদেরও ধারণা নেই সেটা আর কীভাবে হতে পারে।

কামানের গোলার কার্যকারিতা কমাতে এক পর্যায়ে মধ্যযুগের বিভিন্ন দুর্গ এবং প্রাসাদের দেয়াল চক্রাকারে বানানো শুরু হয়েছিলো। এতে পুরোপুরি নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়নি। কিন্তু কামানের গোলার বিরুদ্ধে আরেকটু বেশী ঘাতসহ হয়ে উঠেছিলো এগুলো। ভিঞ্চি সেই ধারণাটাকেই আরো বহুদূর নিয়ে গিয়েছিলেন এই অতি ফিউচারিস্টিক এক স্থাপত্য নকশায়।

কিন্তু কথা হলো, সেই গোপন আস্তানায় আমাদের এই বন্ড ভিলেন কী এমন গোপন জিনিস তৈরি করবেন? অনেক কিছু, যেগুলো দিয়ে পুরো দুনিয়ার ক্ষমতা হাতের মুঠোয় পাওয়া যায়। যেমন- প্রথমত বলা যায়……….

রোবট আর্মি


রোবটের ধারণাকে যত আধুনিক মনে করা হয় আসলে সেটা তত আধুনিক নয়। বরং খ্রিস্টের জন্মেরও ২৭০ বছর আগে গ্রীক প্রকৌশলী ‘টেসিবিয়াস’ মানবসভ্যতাকে রোবট সম্পর্কে ধারণা দেন। কিন্তু সেই রোবটকে আরো আধুনিকায়ন করে ‘ড্রোন আর্মি’ বানিয়ে তাদের যুদ্ধের ময়দানে ছেড়ে দেয়ার আইডিয়াতো সাম্প্রতিক কালের ঘটনা, ঠিক না? না, ভুল! আধুনিক মানুষদের মাথায় এই আইডিয়া আসার আরো বহু শতাব্দী পূর্বেই ভিঞ্চি এই ‘ড্রোন আর্মি’ বানানোর পরিকল্পনা করে গিয়েছিলেন।

ভিঞ্চির মূল ডিজাইন
ইতালিয়ান সামরিক বাহিনী যে সব অপদার্থদের সমন্বয়ে গঠিত, এই তথ্য মধ্যযুগীয় দার্শনিক এবং রাজনীতি বিশেষজ্ঞ ‘নিকোলো মাকিয়াভেল্লি’ এর চেয়ে ভালো আর কেউ জানতো না। তার ‘দ্যা ডিসকোর্সেস’ এবং ‘দ্যা প্রিন্স’ পুস্তকসমূহের জায়গায় জায়গায় তিনি মোটামুটি ঘুরেফিরে এই কথাই বলেছেন যে- ইউরোপের পবিত্র রোমান সাম্রাজ্য অতল অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে যুদ্ধের ময়দানে তার নিজের সৈন্যদের কামান হতে ছোঁড়া গোলায় নিজেরাই ধরাশায়ী হয়ে। আধুনিক যুগেও ইতালির সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মাকিয়াভেল্লির এই বক্তব্য সমানভাবে প্রযোজ্য। উদাহরণস্বরূপ- ইতালি বনাম ইথিওপিয়ার যুদ্ধের ইতিহাসের দিকে তাকালেই হয়।

যাই হোক, এই ব্যাপারে সেই সময়ে ইতালির সমস্যা ছিলো দ্বিমুখী। প্রথমত, তখনো ইতালি একত্রিত হয়ে একটি সঙ্ঘবদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারেনি। ফলে নিজস্ব ‘সঙ্ঘবদ্ধ’ সেনাবাহিনীও গড়ে উঠেনি। দ্বিতীয়ত, ইতালির ডিউক এবং যুবরাজেরা বহির্দেশের, বিশেষত সুইজারল্যান্ডের, ভাড়া করা সৈন্যদের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। ইতালির অর্থ-সম্পদের এক বিশাল অংশই ব্যয় হতো এই ভাড়া করা সৈন্যবাহিনীর খরচ যোগাতে। কিন্তু তাতেও সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া যাচ্ছিলো না। এই ভাড়া করা সৈন্যরা মাঝে মাঝেই মোটা টাকার বিনিময়ে বিশ্বাসঘাতকতা করে বিপরীত শিবিরে যোগ দিতো। তথ্য পাচার করতো।

এই সমস্যা মোকাবিলায় এগিয়ে এলেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। তিনি মানুষের শরীরের পেশী এবং সেসব পেশীর চলনের নেপথ্যের সব মেকানিক্যাল প্রসেসগুলো নিখুঁতভাবে লিপিবদ্ধ করতে লাগলেন বিভিন্ন চিত্রাঙ্কন সহকারে। এখনকার রোবটিক্সের জগতের দুর্ধর্ষ সব চিন্তাবিদেরাও স্বীকার করেন ভিঞ্চি ঠিক পথেই আগাচ্ছিলেন। তিনি প্রায় নিখুঁতভাবে উদ্ধার করেন মানবশরীরের বিভিন্ন পেশীর নড়ন-চড়নের পেছনের সব নেপথ্য কারিগরদের রহস্য। এরপরে কাজ ছিলো একটাই। যন্ত্রপাতির কলাকৌশল ব্যবহার করে সেই একই প্রক্রিয়াগুলো একটা যন্ত্রমানবের ভেতরে ঘটানো। তিনি এই লক্ষ্যে কিছু ডিজাইনও প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু সেই সময়কার প্রযুক্তিগত অনেক সীমাবদ্ধতার কারণে তিনি তার ডিজাইনগুলোকে আর বাস্তবে রূপদান করতে সক্ষম হননি।
05_anatomist_fullsize
কতটুকু কার্যকরী ছিলো এই ডিজাইন?
ভিঞ্চির ডিজাইন করা রোবটেরা বর্তমান বাজারের ড্রয়েডদের থেকে যোজন যোজন দূরে ছিলো- একথা সত্যি। কিন্তু ভিঞ্চির চিন্তাধারা সঠিক পথেই চলছিলো এ ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। তার রেখে যাওয়া ডিজাইন অনুসরণ করে বর্তমানে যে রোবট দাঁড় করানো হয়েছে, সেটা মানুষের মতই হাত-পা নাড়াতে এবং চলাফেরা করতে পারে।

Leonardo-Robot3
তার কাগজে অংকিত রোবটেরা বর্তমানের বদলে সেই আমলেই মানুষের মত চলতে ফিরতে সক্ষম হতো যদি তিনি তাদের চালাতে একটা নির্ভরযোগ্য শক্তির উৎসের সন্ধান পেতেন। যদি সেই আমলে বৈদ্যুতিক মোটর কিংবা নিদেনপক্ষে বাষ্পীয় ইঞ্জিনের ধারণাও চালু থাকতো, তাহলে বর্তমানের মানুষদের ‘স্কাইনেট’ এর শাসনাধীনে থাকাটাও বিচিত্র কিছু ছিলো না। তবে এটুকু অন্তত বলা যায়, মাকিয়াভেল্লিকে সেইসব মডেল রোবট আর বাস্তবের ইতালিয়ান সেনাবাহিনীর মধ্য হতে বাছাই করতে বললে তিনি পূর্বেরটাকেই সমর্থন দিতেন যুদ্ধের ময়দানে নামানোর জন্যে।

ট্যাংক


আধুনিক মানুষ তথা হোমো স্যাপিয়েন্সদের দুই লক্ষ বছরের মারামারি-কাটাকাটির ইতিহাসে ট্যাংক এক নব সংযোজন। ট্যাংককে বলা হয় যুদ্ধের ময়দানের রাজা। আর যুদ্ধ যদি না চলে, তবে অবসরে জনবসতিতে ট্যাংক নিয়ে ঢুকে পড়ে মানুষকে ভয় দেখানোর মত আনন্দেরও কোন তুলনা নেই। উপরের তিনটি বাক্যের মধ্যে একটা হচ্ছে আংশিক ভুল। কোনটা ধারণা করুন তো! যারা বলছেন “তৃতীয়” তাদের বলবো আপনারা জীবনে একবার হলেও ‘গ্র্যান্ড থেফট অটো’ খেলার চেষ্টা করে দেখুন, আর যাচাই করুন তৃতীয় বাক্যের সত্যতা (সেই সাথে উপরের ঐ বাক্যের লিংকগুলোও চেক করুন)। যারা বলছেন “প্রথম”, তারাই আসলে সঠিক। কিন্তু প্রথম বাক্যের কোন অংশটা মিথ্যা? “হোমো স্যাপিয়েন্সদের দুই লক্ষ বছরের মারামারি-কাটাকাটির ইতিহাস”?

না, তা নয়। ভুল হলো “ট্যাংক এক নব সংযোজন” এর অংশটা। ভিঞ্চি বহু শতাব্দী আগেই ট্যাংক আবিষ্কার করে গেছেন।

ভিঞ্চির মূল ডিজাইন
মানুষের অভ্যাসই হলো সব কিছুকে পোর্টেবল সাইজে নিয়ে আসা যাতে সে বস্তুটাকে সাথে নিয়ে ঘুরতে পারে। সেটা আগের আমলের টু-ব্যান্ড রেডিও কিংবা ক্যাসেট প্লেয়ারকে সস্তা চায়না মোবাইলের ভেতরে ঢুকিয়েই হোক, কিংবা জন সুবিধার্থে টয়লেট নিজের কাঁধে বয়ে নিয়ে বেড়ানোই হোক। আগের পয়েন্টে বর্ণিত মধ্যযুগীয় কামানগুলোও দেখা গেলো একই পরিণতির দিকে আগাচ্ছে। তারা দিনকে দিন পোর্টেবল সাইজের হয়ে যাচ্ছে, অথচ তাদের ক্ষমতা বাড়ছে বৈ কমছে না। কিন্তু একটা ব্যাপারে এগুলোর দুর্বলতা তখনো রয়ে গেছে। কামানগুলোকে যারা পরিচালনা করছে তাদের মেরে ফেললেই কামানগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যাচ্ছে।

ভিঞ্চি যথারীতি এগিয়ে এলেন তার মাস্টারপ্ল্যান নিয়ে। তিনি কামানটাকে খোলের মত আবরণে ঢেকে ফেললেন। অনেকে হয়তো ভাবছে- এ আর এমন কী ব্যাপার? ‘ব্যাটারিং র‍্যাম’ এর ক্ষেত্রেও তো এমন করা হয়েছিলো। তাহলে আরেকটু পড়ুন। ভিঞ্চির ডিজাইন করা ট্যাংকগুলো ৩৬০ ডিগ্রীর পুরোটা জুড়েই কার্যকর ছিলো, যেটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ট্যাংকের আবির্ভাবের আগ পর্যন্ত আর কোথাও দেখা যায়নি।

KONICA MINOLTA DIGITAL CAMERA

কিন্তু মূল ঘটনা সেটাও নয়। ঘটনা হলো আপনি এটার ৩৬০ ডিগ্রী ফায়ারিং রেঞ্জের ভেতর দিয়ে কোনরকমে গা বাঁচিয়ে কাছাকাছি পৌঁছে ট্যাংকটার ঢাকনি উপড়ে ফেললেন, আর প্রস্তুতি নিলেন ভেতরে থাকা সবাইকে কচুকাটা করার। কিন্তু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলেন ভেতরে কেউ নেই, এটা নিজে নিজেই চলছে!

কতটুকু কার্যকরী ছিলো এই ডিজাইন?
লিওনার্দো যখন দেখলেন কামানের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে এর পরিচালনাকারী ব্যক্তিরা, তিনি তখন তার ডিজাইনে সেই ব্যক্তিদেরই সরিয়ে দিলেন। ঘোড়ায় টেনে সরিয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থাও স্বয়ংক্রিয় করে ফেলা হলো তার ডিজাইনে। গিয়ার-পুলি মেকানিজমের মাধ্যমে এমন ব্যবস্থা করলেন যাতে এটা নিজে নিজেই ফায়ার করতে থাকে।

3786295193_49f3ce354f
আধুনিক যুদ্ধ-তত্ত্ব বিষয়ক গবেষণায় ভিঞ্চির এই ট্যাংকের ডিজাইনের অনেক ত্রুটি পাওয়া গেছে। তবে সামরিক কলা-কৌশল বিদেরা স্বীকার করেছেন ভিঞ্চির আইডিয়া হতেও আধুনিক যুগের ট্যাংক অনেক অনুপ্রেরণা লাভ করেছে। কিন্তু পিলে চমকে উঠার ব্যাপার হলো, সম্প্রতি কালে ভিঞ্চির আরো কিছু গবেষণার নকশা খুঁজে পাওয়ায় বিশেষজ্ঞরা একমত হয়েছেন- পূর্বে ট্যাংকের ডিজাইনে খুঁজে পাওয়া ত্রুটিগুলো ছিলো আসলে ইচ্ছাকৃত ভাবে ঘটানো! ভিঞ্চি নিজেই তার ডিজাইনগুলো এইভাবে ত্রুটিযুক্ত করে রেখে গেছেন। তার মূল চেষ্টা ছিলো এইসব ডিজাইন অন্য কারো হাতে যাতে না পড়ে। আর পড়লেও যাতে সেটা হতে কোন সুবিধা আদায় করতে না পারে।

তাহলে কি সত্যি সত্যিই তার ডিজাইন করা মনুষ্যবিহীন মূল ট্যাংকগুলো নিখুঁত রকমের কার্যকর ছিলো  ।

 

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/vinci_as_bond_villain_01/

Sunday, September 1, 2019

অস্তরাগ - সুচিত্রা ভট্টাচার্য


অটো থেকে নেমে কয়েক সেকেন্ড থমকে দাঁড়িয়ে রইল সুজাতা। মনে মনে ঝালিয়ে নিল ঠিকানাটা। বীথি কাল যেমনটা বলেছিল তাতে তো বাসরাস্তা থেকে দূরে হওয়ার কথা নয়। হাঁটাপথে বড়জোর মিনিট পাঁচেক। একটা রিকশা নিয়ে নেবে? থাক গে, বয়স যাই হোক এখনও তো পা দুটো অচল হয়নি।
অঘ্রানের দুপুর। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। একটা মলিন রোদ বিছিয়ে আছে শহরের গায়ে। বাতাসে সামান্য শিরশিরে ভাব। তাঁতের শাড়ির আঁচলখানা ভাল করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে সুজাতা চলা শুরু করল। ক’পা গিয়ে ঘড়ি দেখল কব্জি উল্টে। অমনি মন খচখচ। আড়াইটে বাজে, আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে নাতিনাতনি স্কুল থেকে ফিরবে হুড়মুড়িয়ে। ওই সময়টায় সুজাতার বাড়িতে না থাকাটা কি ঠিক হল? মাম্পি ভুতুমের অবশ্য ঠাম্মাকে আর তেমন প্রয়োজন হয় না, তাকে আর সে ভাবে ওরা আমলও দেয় না। ঠাম্মা নামের একটা মানুষ আদৌ ঘরে আছে কি নেই, সেটুকুও খেয়াল করবে কি না সন্দেহ। বৈকালিক জলখাবার বানিয়ে দেওয়ার জন্যে বাড়িতে মালতী মজুত, তড়িঘড়ি ইউনিফর্ম ছেড়ে, নাকেমুখে যা হোক গুঁজে, ভাইবোন তো ধাঁ মারবে যে যার মতো। মাম্পি যাবে টিউশন পড়তে, ভুতুম সামনের পার্কে। অতএব তাদের কথা ভেবে সুজাতার গৃহে অবস্থান করাটা তো নেহাতই মূল্যহীন, নয় কি?

তবু চিন্তা পিছু ছাড়ে কই। যদি কোনও কারণে সময় মতো না ফেরে ছেলেমেয়ে দুটো? যদি পথে স্কুলবাস খারাপ হয়? যদি অন্য কোনও সমস্যায় আটকা পড়ে স্কুলে? রুমা তো মাঝে মাঝেই চারটে নাগাদ ফোন করে অফিস থেকে, খোঁজখবর নেয় ছেলেমেয়ের। তখন যদি শোনে ওরা এখনও আসেনি, ও দিকে শাশুড়িঠাকরুন কোথাও একটা চরতে বেরিয়ে গিয়েছে, রুমা খুব প্রীত হবে কি? মুখে হয়তো বলবে না কিছু, তাও…।
নাহ্, রুমাকে বোধ হয় সকালে জানিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। কী করবে, আজই যে বীথির ডেরায় ছুটবে এমন তো পরিকল্পনা ছিল না। বহু দিন পর কাল বীথির ফোনটা পেয়ে জোর চমকেছিল বটে, অবিলম্বে দেখা করার বাসনাও জেগেছিল, তার পর সন্ধেবেলা টিভি সিরিয়াল দেখতে দেখতে কখন যেন চাপাও পড়ে গিয়েছিল ইচ্ছেটা। সকালে বাড়ি ফাঁকা হতে ফের কৌতূহলটা এমন চাগাড় দিয়ে উঠল!

যাক গে, মরুক গে, অত টেনশন করার কোনও মানেই হয় না। সুজাতার হাতে সংসারটা ছাড়া থাকে বলে তার কি ইচ্ছেমতো বেরোনোর স্বাধীনতাও নেই? রুমা কবে দেরিতে ফিরবে, বাবুন কবে অফিস টুরে বাইরে যাবে, কিছু কি আগে থেকে জানতে পারে সুজাতা? বলার প্রয়োজন বোধ করে কেউ? পরশুই তো দু’জনে কোন বন্ধুর ম্যারেজ অ্যানিভার্সারিতে গেল, রাত্তিরে যে তারা খাবে না, শুনতে হল কিনা মালতীর মুখ থেকে! তা হলে…?
চিন্তা ছিঁড়ে গেল সহসা। শান্তিনীড় এসে গিয়েছে।
কালো গেটের গায়ে সাদা হরফে লেখা নাম-ঠিকানাটা চোখ কুঁচকে এক বার পড়ল সুজাতা। তার পর চশমা ঠিক করে ভেজানো গেট ঠেলে ঢুকেছে অন্দরে। সামনেই একফালি সবুজ। তিন ধারে তার মরশুমি ফুলের সমারোহ। গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, ডালিয়া, পমপম…। কুঁড়ি এসেছে ডালিয়ায়, ছোট ছোট গাঁদা ঝিকঝিক হাসছে। মাঝখানে একটা তুলসীমঞ্চও আছে। বাঁধানো। বাগান ঘিরে ইউ শেপের দোতলা বাড়ি, টানা বারান্দাওয়ালা। সুজাতা যেখানে দাঁড়িয়ে, তার ওপারেই বুঝি অফিসঘর। কারা যেন কাজ করছে সেখানে।

অদ্দূর অবধি অবশ্য যেতে হল না। তার আগেই এক বয়স্কা মহিলা একতলার সরু বারান্দায় কাকে খুঁজছেন?
সুজাতা এক পা এগোল বীথি… মানে বীথিকা ঘোষাল…?
বীথি? একটু দাঁড়ান, ডেকে দিচ্ছি।
মিনিট কয়েকের মধ্যেই চটি মশমশিয়ে বীথির আবির্ভাব। সুজাতার মতো ভারিক্কি হয়নি শরীর, একই রকম রোগা আছে এখনও। একই রকম ঋজুও।
বীথির লম্বাটে মুখে একগাল হাসি ওমা, তুই? আজই আসবি, কাল তো বললি না?

সুজাতা মিটিমিটি হাসছে তুই একাই সারপ্রাইজ দিবি নাকি? ভাবলাম আমিও তোকে…
বেশি করেছিস। আয়।
হাত ধরে প্রায় কিশোরীর উচ্ছলতায় সুজাতাকে দোতলায় নিয়ে এল বীথি। যেতে যেতে বকে যাচ্ছে অবিরাম। এখন নাকি একতলার বড় ঘরে টিভি দেখছিল অনেকে মিলে। দুপুরের দিকে এই সময়টায় টিভি সিরিয়াল দেখা নাকি একটা ছল, দিবানিদ্রা এড়ানোর জন্য নাকি জড়ো হয়, নাম কা ওয়াস্তে টিভি চলে, যে যার মতো গল্প করে যায়। এতে নাকি দুপুরগুলো হুশহুশিয়ে কাটে।
টানা বারান্দার প্রায় শেষ প্রান্তে নিজের ঘরখানায় সুজাতাকে এনে বসাল বীথি। ছোট্ট ঘর, মেরেকেটে দশ বাই দশ। তার মধ্যেই একটা সিঙ্গল বেড খাট, ছোট আলনা, বেঁটে আলমারি, এক সেট টেবিল-চেয়ার, খুদে টিভি স্ট্যান্ড। দেওয়ালে আয়না, দরজার ধারে ছোট টুলে জলের কুঁজো। এত জিনিস ঢুকল কী করে এখানে? লাগোয়া একটি বাথরুমও আছে, আয়তনে ঘরের সঙ্গে মানানসই, শাওয়ার প্রায় কমোডের ওপর ঝুলছে।

পলকের জন্য বীথির শ্বশুরবাড়িখানা ভেসে উঠল সুজাতার চোখে। প্রাচীন বাড়ির একটা অংশে থাকত বটে, কিন্তু কী বিশাল বিশাল ঘর। কত বছর আগে গিয়েছিল সুজাতা, তবু এখনও মনে গেঁথে আছে। কী এমন হল, যাতে ঠাঁই নাড়া হয়ে বৃদ্ধাশ্রমের এই খুপরিতে এসে মাথা গুঁজতে হল বীথিকে?
প্রশ্নটা জিভে এসে গিয়েছিল, তার আগেই বীথি জিজ্ঞেস করল কী রে, চা খাবি তো?
এখন…? সুজাতা একটু আমতা আমতা করল তোদের লোকজনরা বিশ্রাম করছে…
তুৎ। ঘরেই বানাব। ইলেকট্রিক কেটলি আছে।
বানা তা হলে। আমি কিন্তু চিনি-দুধ খাই না।

আমিও না। খাটের তলা থেকে বৈদ্যুতিক কেটলিখানা বার করল বীথি। বোর্ডে প্লাগ গুঁজে আন্দাজ মতো জল চড়িয়ে দিয়ে বলল, তোকেও কি শুগারে ধরেছে? আমার মতো?
না রে, মুটিয়ে যাচ্ছি তো। বিছানায় বসল সুজাতা আর দুধটা না খেলে অম্বলও কম হয়।
ভালই করেছিস। চা-ই তো আসল। দুধ-চিনি তো বাহুল্য। বীথি মুচকি হাসল, আমার যেমন এই ঘরটুকুতেই কুলিয়ে যায়। ভবানীপুরের বাড়ির এত এত জায়গাকে এখন বাড়তি বলে মনে হয়।
কিছু যেন গোপন করছে বীথি। সন্দিগ্ধ স্বরে সুজাতা বলল, সেই জন্যই বুঝি চলে এসেছিস?

বীথি জবাব দিল না। জল ফুটে গিয়েছে, দেওয়ালের র্যাক থেকে চা-পাতা পাড়তে পাড়তে আনমনে বলল, কত দিন পর তোর সঙ্গে দেখা হল?
তা প্রায় ষোলো বছর। সেই স্কুলের গোল্ডেন জুবিলিতে তুই গিয়েছিল, বেশিক্ষণ থাকলি না… তখনই বোধ হয় তোর বরের অসুখটা…
হুম্। তার চার মাস পরেই তো চলে গেল। বীথি ফোঁস করে একটা শ্বাস ফেলল, ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম। সনু তখন সবে চাকরিতে ঢুকেছে, রাজা হায়ার সেকেন্ডারি দেবে…।

এগারো বছর আগে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে চলে যাওয়া সেই নিজের মানুষটিকে যেন ঝলক দেখতে পেল সুজাতা। ব্যাঙ্কের ব্যস্ত অফিসার রিটায়ারমেন্টটাকে যেন মানতেই পারল না। কী অদ্ভূত এক ছটফটানিতে ভুগত সারাক্ষণ। বছর ঘুরতে না ঘুরতে মৃত্যু এসে সব চাঞ্চল্য ঘুচিয়ে দিল। তখন সে সুজাতার মনের ওপর দিয়ে কী ঝড় গিয়েছে। দিনের পর দিন। মাসের পর মাস। এখনও কি থিতিয়েছে পুরোপুরি?

যেন বীথিকে নয়, যেন নিজেকে শুনিয়ে সুজাতা বলল, জানি রে। সহেলিদের মুখে শুনেছি তুই কারও সঙ্গে আর মিশতিস না, কোথাও যেতিস না…
ভাল লাগত না। কিচ্ছু ভাল লাগত না তখন। সারা দিন শুধু শুয়ে থাকতাম। কেমন জবুথবু মেরে গিয়েছিলাম। আমাকে চাঙ্গা করার জন্য সনু বোধ হয় তাড়াতাড়ি বিয়েটা করে ফেলল। সুজাতাকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিয়ে ম্লান হাসল বীথি কিন্তু লাভ কী হল? সনুর বউকে নতুন খেলনা ভেবে গড়েপিটে মানুষ করতে চাইলাম। তবে তাই কি হয়? সে এখনকার মেয়ে, সে মানবে কেন? হঠাৎ এক দিন শুনলাম, ছেলে চাকরি বদলে চলে যাচ্ছে দিল্লি। তখন বুঝিনি, ছেলে ছেলের বউকে চরম স্বার্থপর ভেবেছি। এখন টের পাই, আমার পুতুলখেলার বাড়াবাড়িতে অতিষ্ঠ হয়ে তারা পালিয়েছে।

কাপে চুমুক দিয়ে চা’টা কেমন বিস্বাদ ঠেকল সুজাতার। বাবুন আর রুমার সঙ্গে তার সম্পর্কটা ঠিক এই ধরনের নয় ঠিকই, তবে বাবুনের বিয়ের জন্য সে উঠে পড়ে লেগেছিল অনেকটা তো সেই কারণেই। বাবুনের বউ তার সঙ্গী হবে, তাকে একাকিত্ব থেকে মুক্তি দেবে…। চাকরি করা মেয়েকে বাবুন নিজে পছন্দ করে বিয়ে করল সুজাতা যে একা সেই একাই। এখনও কি সে রুমাকে মন থেকে মানতে পেরেছে? মাঝখান থেকে সে বনে গিয়েছে বাবুন আর রুমার সংসারের পাহারাদার।
মনোবেদনা গোপন রেখে সুজাতা আলগোছে প্রশ্ন করল, তোর বড় ছেলে কি এখনও দিল্লিতে?
নাহ্। আরও দূরে। দুবাই চলে গিয়েছে।
আর ছোটটার কী খবর?
এখানেই আছে। চাকরিবাকরি করছে।
বিয়ে দিয়েছিস তো?
আমি আর দেওয়াদেয়িতে ছিলাম না। নিজেরাই করেছে। বীথি খালি কাপ দু’খানা রাখল টেবিলে। কী যেন ভাবতে ভাবতে ছিটের পর্দা ঘেরা জানলায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আপন মনে বলল, ঠিক করেছিলাম এ বার আর কোনও কিছুতে নাক গলাব না। যথাসম্ভব দূরে দূরে থাকব। তাতেও কি স্বস্তি মিলল?
কেন? অসুবিধে কী হল?
সংসারে ওটাই তো আয়রনি রে। তুই ভাববি এক, লোকে তোকে বুঝবে আর এক। বীথি পায়ে পায়ে খাটে ফিরল। সুজাতার মুখোমুখি বসে বলল, রাজা আর রাজার বউয়ের মনে হতে লাগল ওদের আমি সহ্য করতে পারি না। নরম ভাবে কিছু বললে ভাবে প্যাঁচ কষছি। স্বর কড়া হলে তো কথাই নেই, দু’জনে হুলুস্থুলু বাধিয়ে পাড়া মাথায় করবে। এমন একটা অবস্থা দাঁড়াল, শামুকের মতো খোলে গুটিয়ে থাকি…। তখনই ভেবে দেখলাম যৎসামান্য সঞ্চয় তো আছে, ফ্যামিলি পেনশনও কিছু খারাপ পাই না, ওই দিয়ে কোনও মতে যদি…
ওল্ড এজ হোমে চলে এলি?
সহজে এন্ট্রি পাইনি। দরখাস্ত করে লাইন দিয়ে বসেছিলাম। কপাল ভাল, হঠাৎ দু’তিনটি সিট একসঙ্গে খালি হল এখানে…
ছেলে, ছেলের বউ আসতে দিল?
প্রথমে খানিক গাঁইগুঁই করছিল। লোকের কাছে মুখ দেখানো বলেও একটা কথা আছে না? তবে আমার জেদের সঙ্গে পেরে উঠল না।
সুজাতা ক্ষণিক ভাবার চেষ্টা করল, সে যদি এ রকম চলে আসতে চায় কী প্রতিক্রিয়া তবে বাবুন-রুমার? মাম্পি ভুতুমও কি মেনে নিতে পারবে? প্রস্তাবটা পেড়ে এক বার পরখ করে দেখলে হয়।
হঠাৎই সুজাতার গা শিরশির করে উঠল। কেন যে করল?
তাড়াতাড়ি বলে উঠল, তুই ছ’মাস হল এসেছিস, তাই না রে?
একটু বেশি। সাত মাস।
ওরা আসে দেখা করতে?
ওই… সময় সুযোগ পেলে…। আমিও যাই। মায়া বলে তো একটা ব্যাপার আছে, না কী? সেটাকেই বা পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলি কী করে? এই তো, নাতনির জন্য মন কেমন করছিল বলে পুজোর পুরো একটা দিন ভবানীপুরে কাটিয়ে এলাম।
এখানে তা হলে খুব সুখে নেই? কথাটা বলতে পেরে সুজাতা যেন একটা গোপন স্বস্তি বোধ করল। পলকা ঠাট্টার সুরে বলল, মন তা হলে খারাপ হয়?
অবশ্যই। আমি তো পাথরের মানুষ নই। আর মনও তার নিজের নিয়মেই চলে। কপালে এক গাছি চুল এসে পড়েছিল, আঙুল দিয়ে সরাল বীথি। ঈষৎ কেঠো গলায় বলল, তবে একটা সত্যি কথা শুনে রাখ। আমি এখানে মোটেই খারাপ নেই। ইচ্ছে মতন খাচ্ছিদাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি, গল্পগুজব করছি, প্রাণ চাইলে বেরিয়েও পড়ি এ দিক ও দিক। কাজকম্মোও করছি না যে তা নয়। সেই স্কুলের মতো দল জুটিয়ে এখানেই ফাংশন চলছে। কবিতাপাঠ, গান, যে যা পারে শোনায়। সামনের বার বসন্তোৎসবও হবে। এ ছাড়া আলপনা দেওয়ার প্রতিযোগিতা, রান্নার কম্পিটিশন…। এখন তো প্ল্যান করছি, পাশের বস্তির ছেলেমেয়েগুলোকে লেখাপড়া শেখাব।

এ বার হাসি পেয়ে গেল সুজাতার। খানিক ব্যঙ্গের সুরে বলল, বুঝেছি।
বীথি চমকে তাকাল, কী? কী বুঝেছিস?
এই সব সাতসতেরো নিয়ে নিজেদের একটু ব্যস্ত রাখিস, যাতে মনের কষ্টটা কম হয়।
আমিও প্রথম প্রথম তাই ভাবতাম রে। এখন বুঝি, এটা অন্য কিছু।
কী রকম?
আমার জীবনটা তুই ভাব। বিয়ের পর থেকে বর আর দুই ছেলে ছাড়া আমার তো কোনও জগৎই ছিল না। বরও ততটা নয়, যতটা দুই ছেলে। তাদের পড়াশুনো, তাদের কেরিয়ার, তাদের যাতে ব্রাইট ফিউচার হয় তাই নিয়ে ভাবনা… এতেই তো গড়িয়ে গেল বিশ-পঁচিশটা বছর। তার পর হঠাৎ এক দিন দেখলাম ওরা কেউ আর আমার আঁচলে নেই, ডানা মেলে যে যার মতো উড়ছে। তখন আমার আর কিচ্ছু করার নেই। জীবনটা বিলকুল ফাঁকা। তাই বোধ হয় ছেলের সংসারে বেশি বেশি করে জড়িয়ে পড়ছিলাম। জোর করে। সনু ঠোক্কর দিয়ে আমায় বুঝিয়ে দিল, তুমি মা হতে পারো, কিন্তু আমার সংসারে তুমি অনুপ্রবেশকারী। সেটা এমনই মজ্জায় মিশে গেল, রাজার সংসারে আর স্বাভাবিক হতে পারলাম না। বীথি একটু দম নিল, এখানে এসে টের পাচ্ছি, আমি শুধু রাজা সনুর মা নই, প্রশান্ত ঘোষালের বউ নই, এর বাইরেও একটা বীথিকা ছিল। যাকে ইচ্ছেয় হোক, অনিচ্ছেয় হোক, আমি ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিলাম। সেই বীথিকাটাই এখন এই শান্ত নীড়ে বাস করতে এসেছে। যদ্দিন শরীর সক্ষম থাকবে, কিংবা এখানকার দীপালিদি রত্নাদিদের মতো ভীমরতি ধরবে না, তদ্দিন তো নতুন বীথিকাটা তার মতো করে বাঁচুক।
সুজাতা আচ্ছন্নের মতো শুনছিল। অস্ফুটে বলল, তুই যে ভাল আছিস সেটা দেখানোর জন্যেই বুঝি আমায় ডাকলি?
না রে, ঠিক তা নয়। মাঝে মাঝে ছোটবেলার বন্ধুদের কথা মনে পড়ে তো, তারা কে কেমন আছে জানতে ইচ্ছে করে। বীথি নির্মল হাসল, তুই নিশ্চয়ই খারাপ নেই? চাকরিবাকরি করতিস, নিজের একটা পৃথিবী ছিল, ছেলেও তো শুনি খুব বুঝদার…
বুকটা চিনচিন করে উঠল সুজাতার। সত্যি কি তার কোনও আলাদা ভুবন ছিল? আছে? ঘরোয়া গৃহবধূ বীথির সঙ্গে তার যাপিত জীবনে কতটুকুই বা তফাত? বাবুন-রুমা যথেষ্ট ভদ্র শালীন, মাকে খুব অযত্ন করে না, কিন্তু তাতে কি সুজাতার অবস্থানের কিছু অদলবদল ঘটেছে? এই যে হঠাৎ হঠাৎ হৃৎপিণ্ড দুকদুক করে উঠছে, অজান্তেই ঘড়ির কাঁটায় চোখ চলে যাচ্ছে বার বার, এটা কার উৎকণ্ঠা? মাম্পি-ভুতুমের ঠাম্মার? রুমার শাশুড়ির? বাবুনের মায়ের? অন্তত সুজাতার যে নয়, এ তো হলফ করে বলতে পারে সুজাতা।

অঘ্রানের দুপুর কখন বিকেলে মিশে গিয়েছে। একটানা বকবক করেই চলেছে বীথি। মুড়ি চানাচুর মেখে খাওয়াল। শোনাচ্ছে শান্তিনীড়ের আরও অনেকের গল্প। এই বোর্ডার, ওই বোর্ডার, এই দিদি, সেই দিদি…। ছেলেমেয়ে আসে না বলে কে সারাদিন গুমরে গুমরে কাঁদে, কে কবিরাজি কাটলেট কিনে এনে লুকিয়ে লুকিয়ে খায়, কে যেন দিবারাত্র পুজোআর্চা নিয়ে পড়ে আছে, কারা দল বেঁধে সিনেমা দেখতে যায় কত গল্পই না বলছে রসিয়ে রসিয়ে।
কিছু শুনছিল সুজাতা। কিছু শুনছিল না। কেবলই তার মনে হচ্ছিল, না এলেই বুঝি ভাল হত। না এলেই তো ভাল হত।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গদ্য : জাদু বাস্তবতা ও মার্কেজের গল্প


পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই এখন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত লেখকরা আর ছোটোগল্প লেখেন না। ছোটোগল্পের স্বর্ণযুগ যেন ক্ষীয়মাণ। এককালের নবীন লেখকরা প্রথমে ছোটোগল্প লিখে হাত পাকাতেন, তারপর কিছুটা আত্মবিশ্বাস অর্জন করলে শুরু করতেন উপন্যাস। এখন অনেকে শুরুতেই সরাসরি উপন্যাসে চলে আসেন।
তার অন্যতম কারণ, সাহিত্য-পত্রিকাগুলির বিলুপ্তি। একসময় লেখকরা পরিচিত হতেন এইসব পত্রিকার মাধ্যমে। এখন উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি সরাসরি চলে যায় প্রকাশকের কাছে। সালমন রুশদি, বিক্রম শেঠ কিংবা অমতাভ ঘোষ কখনও ছোটোগল্পের দিকে মনোযোগই দেননি।

বাংলাতেও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর পরবর্তী প্রধান লেখকরা অনেক ছোটোগল্প রচনা করেছেন। বস্তুত, বাংলা সাহিত্যে সার্থক উপন্যাস অঙ্গুলিমেয় কিন্তু হীরকদ্যুতির মতন বিস্ময়কর ছোটোগল্প অজস্র। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতন লেখকদের একটি দুটি উপন্যাসের কথাই আমাদের মনে পড়ে। কিন্তু তাঁদের অনেক ছোটোগল্পই অবিস্মরণীয়। সত্যিই বাংলায় একসময় ছোটোগল্পের স্বর্ণযুগ ছিল, অনায়াসেই বলা যায়। অনেক বিশ্বমানের ছোটোগল্প রচিত হয়েছে বাংলাভাষায়। কিন্তু আফসোসের কথা এই, এখনও অনেক উচ্চাঙ্গের ছোটোগল্প লেখা হয় বটে, কিন্তু প্রকাশপ ও পাথকমহলে ছোটোগল্পের তেমন সমাদর বা চাহিদা নেই।

এখনকার পৃথিবীতে জীবিত লেখকদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য গাবরিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ অবশ্য বেশ-কিছু ছোটোগল্প লিখেছেন। মোট সংখ্যা উনচল্লিশ। গল্পগুলি আকর্ষণীয় একটি বিশেষ কারণে। নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত উপন্যাস নিঃসঙ্গতার এক শতাব্দির লেখক হিসেবেই মার্কেজ সর্বশেষ পরিচিত এবং তাঁর নাম শুনলেই মনে পড়ে ম্যাজিক রিয়েলিজমের কথা। কিন্তু সেই বিশিষ্ট শিল্প আঙ্গিক মার্কেজের অনেক গল্পেই অনুপস্থিত। এই ছোটোগল্পগুলির রচয়িতা যেন অন্য এক মার্কেজ। বড়জোর তাঁর কয়েকটি গল্পকে বলা যায় ম্যাজিক রিয়েলিজম আঙ্গিকের আঁতুড়ঘর। অন্যান্য গল্পগুলিতে টানা বর্ণনারীতিই অনুসৃত হয়েছে।

ম্যাজিক রিয়েলিজম ব্যাপারটা কী? গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে এই অভিধা চিত্রশিল্প সম্পর্কে প্রথম প্রযোজ্য হয়েছিল। তারপর এটা সাহিত্যের আঙ্গিক হিসেবেই বেশি ব্যবহৃত হয়। আর্জেন্টিনার প্রসিদ্ধ লেখক হর্হে লুইস বোর্হেস, জার্মানির গুন্টার গ্রাস কিংবা ইংল্যান্ডের জন ফাউলসের রচনাতেও এই উপাদান পাওয়া যায়। সেইসঙ্গে নাইজেরিয়ার বেন ওকোরি আর কিউবার আলেহো কারপেনতিয়ের অবশ্যই। তবে মার্কেজই এর প্রধান প্রবক্তা হিসেবে গণ্য। রূপকথা, উপকথায় ফ্যান্টাসি, যার অনেকখানিই অবিশ্বাস্য, তাঁর সঙ্গে আধুনিক জীবনের অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য ঘটনার খুঁটিনাটি মিলিয়ে নেওয়াকেই ম্যাজিক রিয়েলিজম বলা যেতে পারে সংক্ষেপে। মার্কে জ এই আঙ্গিকটি কী করে আয়ত্ত্ করলেন, তা বুঝতে গেলে তাঁর জীবনীর কিছু কিছু ঘটনা জানা দরকার।

বাচ্চা বয়েসে মার্কেজ থাকতেন কলম্বিয়ার আরাকা টাকা নামে একটা ছোটো শহরে দাদু ও দিদিমার কাছে। দাদু অবসরপ্রাপ্ত জবরদস্ত এক কর্নেল। মস্তবড়ো বাড়ি, পুরোনো ও রহস্যময়, কেউ কেউ বলে ভূত আছে। দিদিমা ছাড়াও অনেক মাসি-পিসি মিলিয়ে বাড়ি ভরতি অনেক বুড়ি মহিলা, সবাই কুসংস্কারগ্রস্ত ও ভূত-প্রেত-অলৌকিক ঘটনায় বিশ্বাসী, তারা অনবরত সেইসব গল্প বলতেন। তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ গল্প বলিয়ে ছিলেন মার্কেজের দিদিমাই। তাঁর মুখচোখের ভঙ্গি এমন হত গল্প বলার সময়, যেন তিনি ওইসব অলৌকিক ঘটনা একেবারে দেখতে পাচ্ছেন চোখের সামনে। এসব গল্পই বালক মার্কেজের মনে দাগ কেটে যায়। পরবর্তীকালে ওইসব চরিত্রও তাঁর গল্প-উপন্যাসে এসে পড়েছে। এরকম তো অনেক লেখকের রচনাতেই তাঁদের বাল্য বয়েসের দেখা চরিত্র ও ঘটনার প্রতিফলন হয়। মার্কেজের জীবনে এর বিশেষত্ব কী?

আইন পাশ করে উকিল হবার বদলে মার্কেজ যখন সাংবাদিকতা ও গল্প-উপন্যাসে হাত পাকাচ্ছিলেন, তখনও তিনি নিজস্ব আঙ্গিকটি খুঁজে পাননি। তাঁকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে ফ্রান্‌ৎস কাফ্কার 'মেটামরফসিস' নামে গল্পটি এবং উইলিয়াম ফকনারের রচনা। কাফকা ও ফকনারের রচনারীতির কোনো মিল নেই। কাফকার গল্পটি পড়ে মার্কেজ উপলব্ধি করেন যে একেবারে প্রথার বাইরে গিয়ে সম্পূর্ণ অপ্রাকৃত বিষয়কেও বাস্তবসম্মত করে লেখা যায়। আর ফকনারের রচনায় অপ্রাকৃতের কোনো স্থান নেই, তিনি তাঁর চেনাশুনো পরিবেশ ও মানুষগুলি নিয়েই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লিখেছেন।

মার্কে জ এই দুই বিপরীত আঙ্গিককেই মেলাতে চেয়েছেন, সেটাই তো ম্যাজিক রিয়েলিজম। কিন্তু এই আঙ্গিকও তাঁর কাছে সহজে আসেনি। নিজের লেখায় সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। ফকনার যেমন একটি কাল্পনিক অঞ্চল তৈরি করে তাঁর মধ্যে তাঁর বাল্যকালের পরিচিত চরিত্রগুলি ঢুকিয়ে দিচ্ছিলেন, মার্কেজও সেইরকম মাকুন্দো নামের একটি অঞ্চল তৈরি করতে চাইছিলেন। তারপর সেই অলৌকিক ঘটনাটি তাঁর নিজের জীবনেই ঘটে।

১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে দারিদ্র ও অস্থির ভুবনের মধ্যে একদিন মার্কেজ তাঁর স্ত্রী-পুত্রকে নিয়ে আলকাপুলশোর দিকে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ মাঝপথে তাঁর এক বিস্ময়কর উপলব্ধি হল। বিদ্যুৎচমকের মতন তিনি যেন তাঁর নতুন উপন্যাসটির প্রথম পরিচ্ছেদের প্রতিটি লাইন দেখতে পেলেন। তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠল তাঁর দিদিমার মুখ। তাঁর উপলব্ধি হল যে কল্পিত নগরীতে দিদিমার মুখে শোনা গল্পগুলি শুধু ব্যবহার করলে তা কৃত্রিম হতে বাধ্য। দিদিমা যখন গল্প বলতেন, তখন তাঁর মুখের যে ভাব, লেখককে সেটাই ব্যবহার করতে হবে, অর্থাৎ লেখককেও ওইসব অলৌকিক ও ভূতের গল্প সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেই লিখতে হবে! বেড়াতে যাওয়া হল না। গাড়ি ঘুরিয়ে মার্কেজ ফিরে এলেন বাড়িতে। নিজের ঘরের মধ্যে বন্দি হয়ে। সংসার কী করে চলবে, না চলবে তাঁর তোয়াক্কা না করে লিখতে বসলেন। প্রায় এক বছর পর সমাপ্ত হল তাঁর যুগান্তকারী উপন্যাস নিঃসঙ্গতার এক শতাব্দী।

ছোটোগল্পগুলি লেখার মাঝে মাঝে মার্কে জ বেশ কিছু চলচ্চিত্র ও টিভি ফিলমের চিত্রনাট্যও লিখেছেন। তখন তিনি ইনগমার বার্গমানের চলচ্চিত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন কি না জানা যায় না। বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে বার্গমানের ছবিতে ম্যাজিক রিয়েলিজম প্রত্যক্ষভাবে ফুটে আছে। দা সেভেনথ সিল, ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিস কিংবা ফ্যানি অ্যান্ড আলেকজান্ডার ছবিগুলি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তবে মার্কে জের কিছু কিছু ছোটোগল্পে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের প্রভাব খুঁজে পাওয়া দুষ্কর নয়। একসময় তিনিও হেমিংওয়ের মতন প্যারিসের ল্যাটিন কোয়ার্টারর্সে কাটিয়েছেন কিছুদিন। তাঁর 'বিমানে এক ঘুমন্ত রূপসী' গল্পটি একেবারে হেমিংওয়ের ঘরানার গল্প। মার্কে জও বোধহয় এ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, খোঁজাখুঁজি করছেন নিজস্ব স্টাইল। 'কর্নেলকে কেউ চিঠি লেখে না' গল্পটি তিনি এগারোবার লিখেছেন ও ছিঁড়েছেন।

হোর্হে লুইস বোর্হেস'এর গল্প : দা আলেফ



অনুবাদ : প্রফেসর শঙ্কু


'O God! I could be bounded in a nutshell, and count myself a King of infinite space...'

Hamlet, II, 2


'But they will teach us that Eternity is the Standing still of the Present Time, a Nunc-stans (as the schools call it); which neither they, nor any else understand, no more than they would a Hic-stans for an Infinite greatness of Place.'

Leviathan, IV, 46



অগ্নিক্ষরা এক ফেব্রুয়ারি দুপুরে বিয়াট্রিয ভিটেরবো মারা গেল।


তার মৃত্যুতে বুকের ভেতরে বিষাক্ত ক্ষতের মত কিছু বিষাদ জড়ো হয়েছিল। ব্যথা কমাতে হাঁটতে হাঁটতে রাস্তার পাশের বিলবোর্ডগুলো দেখছিলাম। পুরনোটা বদলে ওখানে একটা নতুন বিজ্ঞাপনের উদয় ঘটেছে, কোন একটা আমেরিকান সিগারেটের রংচঙে ছবি টানানো হয়েছে। ব্যাপারটা আমাকে আহত করল, কারণ এই নতুন সিগারেটের ব্র্যান্ড চিৎকার করে বলছিল- বিয়াট্রিযকে ছাড়াই জগৎ নিজের ভঙ্গিতে এগিয়ে যাবে। এই সামান্য পরিবর্তন সামনের বহু বহু অশেষ পরিবর্তনের কথা ঘোষণা করছিল সদম্ভে। অবশ্য কেমন একটা অন্তঃসারশূন্য ভাবনা ঘুরছিল মাথায়, বিশ্ব পালটালেও আমি তো পালটাচ্ছি না...


আমি জানি, মাঝে মাঝে আমার খাদহীন ভালবাসার প্রকাশে ও বিরক্ত হয়েছে। আমাকে অপমান করেছে, দূরে ঠেলেও দিয়েছে। এখন অন্ততঃ 'মৃত' বিয়াট্রিযকে আমার সর্বস্ব দিয়ে ভালবাসতে পারি। তাতে প্রতিউত্তর না পাই, অন্ততঃ অপমানিত হবার ভয় তো থাকে না! আমার মনে আছে এপ্রিলের তিরিশে ওর জন্মদিন। এই দিনে যদি বিয়াট্রিযের বাবা আর কার্লোস আরজেন্টিনো দানেরি- ওর চাচাত ভাইয়ের সাথে দেখা করি, ভালো হয় না? ওদের বাসাটা গ্যারেই স্ট্রীটে। আরেকবার সেই ছোট, বিক্ষিপ্ত সাজানো ড্রয়িংরুমে বসে অপেক্ষা করব। দেয়ালে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে থাকা ওর অসংখ্য ছবির খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ করব সানন্দে। বিয়াট্রিয ভিটেরবোর প্রোফাইল ছবি, একটা ছবি ঝকঝকে রঙিন। বিয়াট্রিয একটা মুখোশ পরে আছে- ১৯২১ এর কার্নিভ্যালের সময়কার ছবি। বিয়াট্রিয- গির্জার পাশে দাঁড়িয়ে আছে; বিয়াট্রিয- বিয়ের পোশাকে গির্জার মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে চুমু খাচ্ছে জামাই রবার্তো আলেসান্দ্রি-কে; বিয়াট্রিয- ডিভোর্সের কিছুদিন পর টার্ফ ক্লাবের পার্টিতে; বিয়াট্রিয- কুইলমসের বীচে চাচাত ভাই আর ভাইবৌয়ের সাথে; বিয়াট্রিয- কোলে একটা বলিরেখাসমৃদ্ধ কুকুর নিয়ে (কুকুরটা ভিলেগাস হাইডো দিয়েছিল- বজ্জাত লোক); বিয়াট্রিয- হাসছে, চিবুকের ওপরে হাত রেখে,...অন্ততঃ এবারে আগের মত র‍্যাপিং পেপারে মুড়ে বই নিয়ে যেতে হবে না, নিজের অস্তিত্বের কথা ওকে জানান দেবার জন্য। বিয়াট্রিয, দেখো, আমি আছি! কিন্তু ও বইগুলো খুলেও দেখত না। কিভাবে জানলাম?


বইগুলোর মাঝখান থেকে সেলাই কেটে আমি আলগা করে রাখতাম, যাতে বই খুললেই পাতাগুলো পড়ে যায়। কিন্তু মাসদুয়েক পর যখন বইগুলোকে ড্রয়িংরুমের এককোণে পড়ে থাকতে দেখতাম, তখনও তারা অক্ষত থাকত, হাসত আমার দিকে চেয়ে, জিব বের করে ভেংচে দিত। যাক, সে অন্ততঃ র‍্যাপিং পেপারটা তো খুলত!


বিয়াট্রিয ভিটেরবো মারা গেল ১৯২৯ সালে। তখন থেকে, প্রতিবছর তিরিশে এপ্রিল আমি ওদের বাড়িতে যেতাম। ঠিক সাতটা পনেরোতে বাড়িতে ঢুকতাম, ভেতরে বসে থাকতাম প্রায় বিশ পঁচিশ মিনিটের মতো। প্রতিবার আগের বছরের চেয়ে একটু পরে ঢুকতাম, আর বেরোতাম আরেকটু দেরিতে। ১৯৩৩ সালে, বাড়িতে ঢোকার পরপরই মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল, ফলে বিয়াট্রিযের পরিবার বাধ্য হয়েই আমাকে ডিনারের দাওয়াত দিল (স্বাভাবিকভাবেই, আমি লুফে নিলাম সুযোগটা)। ১৯৩৪ সালে, আমি বাড়িতে গেলাম একটা সান্তা ফে ক্রিম কেক নিয়ে, আর এবারও আমাকে ডিনারের জন্য থাকতে বলা হল। এভাবে অনর্থক বিষাদে ভরপুর সব অনুষ্ঠান আর মেকি দুঃখের মাখামাখির মধ্য দিয়ে ঘুরপাক খেতে খেতে একদিন আমি আবিষ্কার করলাম, বিয়াট্রিযের পরিবার, বিশেষ করে কার্লোস আরজেন্টিনো দানেরি আমাকে একজন বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে।


বিয়াট্রিয ছিল লম্বা, রোগা, সামান্য কুঁজো হয়ে হাঁটত; ওর হাঁটার ভঙ্গিতে একধরণের সংশয়হীন সাবলীলতা ছিল। দারুণ সতেজতা ছিল। আর কার্লোস আরজেন্টিনো হল গোলাপি-মুখো, ভীষণ মোটা, ধূসর চুলের একটা অপদার্থ। একমাত্র এর হাতটা শিল্পীদের মত (আসলে বিয়াট্রিযের মত); সুন্দর, রুচিশীল। সে কাজ করত বুয়েন্স আয়ার্সের দক্ষিণাংশে একটা ছোট্ট লাইব্রেরিতে। তাকে বাসায় খুঁজে পাওয়া যেত খুব কম, লাইব্রেরিতেই পড়ে থাকত সারাদিন। দুই পুরুষ ধরে আর্জেন্টিনায় বাস করা সত্ত্বেও, ইতালিয়ান রক্তের প্রভাব তার কথাবার্তায়, চলনবলনে স্পষ্ট ছিল। কথা বলার সময় অর্থহীন ভারি বিশেষণ ব্যবহার করতে, বা একটা কথা বলার আগে বিনা কারণে বিরতি নিতে তার মনে হয় খুব ভাল লাগত। নিজেকে একজন দারুণ সাহিত্যবোদ্ধা মনে করত গাধাটা। যেমন একবার সে পড়ল এক অখ্যাত কবি, পল ফোর্টকে নিয়ে। 'ইনি হলেন কাব্যশাস্ত্রের রাজপুত্র', দানেরি (বিনা কারণে) গলা উঁচু করে চিল্লাত, 'মানুষ তাকে যথোপযুক্ত সম্মান দেয় না, বুঝলে বোর্হেস, কিন্তু একদিন এরাই তাকে মাথায় করে নাচবে।'


১৯৪১ সালের তিরিশে এপ্রিলে, সান্তা ফে কেকের সাথে সাথে একটা আরজেন্টাইন কগনাক নিয়ে বিয়াট্রিযের বাসায় গেলাম আমি। দানেরি গ্লাসে একচুমুক গিলল, ঘোষণা করল, 'ভালো জিনিস', এবং আরও কয়েক চুমুক পরে গা এলিয়ে দিয়ে মানুষের আধুনিক জীবনের মহিমা ব্যাখ্যা করা শুরু করল।


'দেখো', সে অস্বাভাবিক উৎসাহ নিয়ে শব্দবমি করতে লাগল, 'আমাদের চারপাশে কত ভালো ভালো জিনিস আবিষ্কৃত হচ্ছে। টেলিফোন, টেলিগ্রাফ, ফোনোগ্রাফ, ওয়্যারলেস সেট, স্লাইড প্রজেক্টর, চলচ্চিত্র (বলে হিক! করে উঠল), ডিজিটাল ডিকশনারি, টাইমটেবিল, হ্যান্ডবুক, বুলেটিন...'


ও বারবার বলতে লাগল যে, মানুষ এতো যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছে যে, এখন সত্যিকারের ভ্রমণ করাটা হল অনর্থক খরচ। বলল, 'এই বিংশ শতাব্দিতে কোন জায়গা তুমি দেখতে চাও? তোমাকে ওইখানে যেতে হবে না। জায়গা-ই তোমার কাছে আসবে। আর ভবিষ্যতে মানুষ ভ্রমণ করবে বাড়ি থেকে না বেরিয়েই।' তার ব্যাখ্যা ভীষণ বোকা-বোকা, অবাস্তব আর ফাঁপা লাগল আমার কাছে। তাই সাথে সাথে আমি কথার স্রোত অন্যদিকে সরিয়ে দিলাম, বললাম সে এইসব 'গুরুত্বপূর্ণ' আইডিয়া লিখে রাখে না কেন। এবং সবচেয়ে বড় ভুলটা করলাম।


দানেরি বলল যে এই কাজ সে ধরেছে বহুদিন আগে থেকেই। এই আইডিয়া, এবং এইরকম আরও বহু বহু আইডিয়া সে তার কবিতায় ঢুকিয়ে দিয়েছে। অনেক বছর ধরেই সে এই কবিতা লিখছে, একাকীত্ব এসে হানা দিয়েছে- কাজ এসে বিরক্ত করেছে- তবুও সে কবিতাটা লেখা থামায় নি। প্রথমে দানেরি নিজের 'কল্পনার দরজা হাট করে খুলে দিয়েছে', তারপর 'কলম তুলে নিয়ে কাগজের ক্যানভাসে ছবি এঁকেছে' (গাধা কোথাকার)। কবিতার নাম ছিল 'পৃথ্বী', এবং তাতে পৃথিবীর রূপক-নির্ভর বর্ণনার কোন অভাব ছিল না।


ভদ্রতার খাতিরে আমি তাকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, সে কবিতার কয়েকটা লাইন পড়ে শোনাতে চায় কিনা। দানেরি তার ডেস্কের ড্রয়ার থেকে একগাদা কাগজ বের করল, তারপর কণ্ঠে পরিতৃপ্তি নিয়ে পড়তে লাগল,


সেই বৃদ্ধ গ্রিকের মতই, আমার চোখেতে লেগে আছে

তোমাদের নগরী

তোমাদের খ্যাতি

তোমাদের কাজ, সেই দিন, সেই রাত বিবর্ণ হয়ে

অম্বরে অটুট;

কোন নাম, কারো বাস্তবতা না পাল্টে-

আমি নিঃসঙ্গ প্রাচীন সমুদ্রযাত্রায় নামি...অতোঁয়া দে

মাকামব্রেঁ।


'যেদিক থেকেই দেখো না কেন, এই প্রথম স্তবকটা ভীষণ ইন্টারেস্টিং', দানেরি নিজের মতামত দিল, 'সাধারণ পাবলিকের কথা বাদই দিলাম, যেকোনো সাহিত্যের প্রফেসর কিংবা সমালোচকও মুগ্ধ হয়ে যাবে শব্দচাষ দেখে।'


'দ্বিতীয় স্তবকে দেখবে মহাকবি হোমার থেকে শুরু করে হেসিয়ড পর্যন্ত যারা যারা মহাকাব্য রচনা করেছেন, তাঁদের সেই প্রাচীন ধারা পুনর্জীবিত করা হয়েছে। আর তৃতীয়টা- ক্ষয়িষ্ণু Baroque শিল্পরীতি ফলো করে দুই শ্লোকে কবিতার আসল, বিশুদ্ধ ফর্ম তুলে আনা হয়েছে। চার নম্বর শ্লোকে দেখবে আবারো একটু ফ্রেঞ্চ ভাষা এসেছে, সেই সাথে কবিতার যে সতেজতা, যে তীব্র আবেদন- তার সাবলীল হৃদপ্রকাশ ঘটেছে। আসলে পুরো কবিতায়, কখনো দুই দুই চার ফরম্যাট আবার কখনো পাঁচ আট তিন ফরম্যাটে আমি একটা গল্প বলে গেছি। গল্পটা ত্রিশ শতাব্দী ধরে সমৃদ্ধ হওয়া সাহিত্যের গল্প। এখানে Odessey-র মহাকাব্যিক এসেন্স আছে, Works and Days-এর সারমর্ম আছে, Xavier de Maistre-র মত তুচ্ছ কিন্তু হালকা মেজাজের গীতিকাব্যের সুখস্পর্শও আছে!'


দানেরি আমাকে আরও অনেক অনেক স্তবক পড়ে শোনাল, আর প্রত্যেক স্তবকের ওপরে দীর্ঘ ব্যাখ্যা-বক্তৃতা দিয়ে নিজের প্রতিভার কথা ঘেউঘেউ করে বলতে লাগল। কবিতার লাইনগুলো মোটেই আকর্ষণীয় ছিল না। একেকটা স্তবক কে কত ভারি তাই নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, অপ্রয়োজনীয় টীকা-টিপ্পনী আর অপরিচিত শব্দ নিয়ে পুরো কবিতা ভরপুর। আমার দুঃখ হতে লাগল, ইস, কাগজের কি নিদারুণ অপচয়!


জীবনে মাত্র একবার আমার সুযোগ হয়েছিল মাইকেল ড্রেটনের Polyolbion পড়ে দেখার। এই বইয়ে তিনি ইংল্যান্ডের উদ্ভিদ ও প্রাণীজীবন, জলবিদ্যা, সামরিক ইতিহাস, স্থাপত্যবিদ্যা- সবগুলোর ওপর আহরিত জ্ঞান এবং পর্যবেক্ষণের ফলাফল প্রকাশ করেছিলেন। আমি নিশ্চিত, এমনকি এই সুবিশাল সৃষ্টিও কার্লোস দানেরির কবিতা থেকে অনেক অনেক বেশি ইন্টারেস্টিং। দানেরি ঠিক করেছিল পুরো পৃথিবীর বর্ণনা সে কবিতায় তুলে ধরবে, এবং ১৯৪১ সালের মধ্যে সে প্রায় দেড় লাখের মত শব্দ লিখে ফেলেছিল (অবশ্যই, কবিতার শব্দসংখ্যা কত সেটা দানেরি-ই জানিয়েছিল)। নতুন অনেক শব্দ সে আবিষ্কার করেছিল। তার মতে আকাশের আসল রঙ 'দিব্যশ্বেত', নদী 'কাঁকড়ার মত ঘষটে ঘষটে' বয়ে চলে, এবং মাথাব্যথা করার সময় যে অনুভূতি হয় তার নাম 'স্পর্শজ'। মাঝরাতের দিকে আমি জান নিয়ে কোনোমতে পালিয়ে এলাম।


দুই সপ্তাহ পর, দানেরি আমাকে কল করল- সম্ভবত ওর জীবনে প্রথমবারের মত। 'আমার বাড়িওয়ালা দুই বুড়ো-বুড়ি আছে না, জুনিনো আর জুনগ্রি? ওরা আজকে একটা ককটেল পার্টি থ্রো করেছে, 'স্যালন বারে'। কি বল বোর্হেস, যাবে?' দানেরি পার্টির দাওয়াত দিল আমাকে। উৎসাহ ছিল না, কিন্তু সময় কাটানোর মত কিছু পাচ্ছিলাম না (আর ফ্রি খাবার কে-ই বা মিস করতে চায়?) - তাই রাজি হয়ে গেলাম।


স্যালন বারে গিজগিজ করছিল মানুষ, টেবিল খুঁজে পাওয়াই দায়। বারের চেহারায় আধুনিক ধাঁচ আনার অস্বাভাবিক চেষ্টা করা হয়েছে- অবশ্য যা আশা করেছিলাম তারচেয়ে একটু কুৎসিত কমই। পাশের টেবিলে বসে থাকা লোকজন চোখ বড় বড় করে দম না ফেলে বকবক করছিল- 'দেখেছ, পার্টিতে কি পরিমাণ খরচ করেছে? ওরে বাপ, জুনিনো জুনগ্রি কি দিলখোলা মানুষ!' দানেরি আশেপাশে তাকিয়ে মুগ্ধ হবার ভান করছিল, একবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল, 'যা-ই বল বোর্হেস, আমার দেখা বেস্ট পার্টিগুলোর মধ্যে এটা একটা।'


সে তারপর তার কবিতার চার-পাঁচটা অংশ আবার পড়ে শোনাল। কে জানত এই লোক পকেটে কবিতা-লেখা একতাড়া কাগজ নিয়ে ফেরে! তার সোজা শব্দকে অনর্থক প্যাঁচানোর অভ্যাসটা আমার মাথা ধরিয়ে দিচ্ছিল। যেখানে স্রেফ 'নীল' ব্যবহার করলেই হয়, সেখানে 'জলোবিম্ব' লাগিয়ে দিয়েছে। 'মায়ের দুধ'টা তার জন্য 'বেশি সোজা' হয়ে যায়, এর বদলে বেছে নিয়েছে 'পয়ঃ', 'স্তন্যক্ষীর', এমনকি একটা শব্দ বানিয়েও ফেলেছে- 'পয়স্বিনী'! কিছুক্ষণ কবিতা নিয়ে কথা বলেই দানেরি আসল কথাটা পাড়ল: 'বুঝলে, আসলে সকল গ্রেট সাহিত্যকর্ম শুরু হওয়া উচিত একটা গ্রেট মুখবন্ধ দিয়ে। ধর মোটামুটি পরিচিত একজন রাইটার যদি একটা বইয়ের শুরুতে কিছু লিখে দেয়, তাহলে পাঠকের কাছে বইটার গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়ে যায়। আমি চিন্তা করছি আমার কবিতাটার প্রথম ভল্যুমটা বের করে ফেলব। বেশি না, ২৫ হাজারের মত শব্দ থাকবে ওটাতে...'


এতক্ষণে আমাকে পার্টিতে ডাকার মাজেজা বুঝতে পারলাম। দানেরি বই লিখছে, আর আমাকে চেপে ধরবে তার বইয়ের শুরুতে ভাল ভাল কিছু কথা লিখে দেবার জন্য। তার এই শব্দের জগাখিচুড়িকে ভাল বলে স্বীকৃতি দিলে, আমার লেখক জীবনের কি অবস্থা হবে তাই নিয়ে ভয় ধরে গেল। সৌভাগ্যক্রমে দানেরি জানাল, আমাকে না, সে চায় আমার পরিচিত এক রাইটার- আলভারো মেলিয়ান লাফিনোঅরকে। আমি যেন আলভারোকে অনুরোধ করে ব্যাপারটা সেটল করে ফেলি। দানেরি আরও যোগ করল, 'আর বিয়াট্রিয বেঁচে থাকলে তোমাকে ও-ই বলত কাজটা করে দিতে।'


হাতে ধরা বিয়ারের প্রভাবেই হয়তো, আমি উচ্ছ্বসিতভাবে রাজি হলাম। 'হু, ঠিক ঠিক। সামনের বৃহস্পতিবারে রাইটার্স ক্লাবে ডিনারের দাওয়াত আছে আমার, ওখানে আলভারোর সাথে কথা হবে। ওকে তোমার কথাটা বলে দেখব, হুঁ? আচ্ছা, আসি তাহলে।' বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম।


সামনের মোড়টা ঘুরতে ঘুরতে আমি অপশনগুলো ভেবে দেখতে লাগলাম।

১) আমি আলভারোকে বলতে পারি, ভাই, আমার মৃত প্রেমিকার চাচাত ভাই একটা বিশাল আবর্জনা প্রসব করেছে, প্রকাশ করতে চায়। তুমি একটা প্রিফেস লিখে দাও।


২) কিছুই না বলে চুপচাপ ডিনার খেয়ে এসে পড়া।


হুমম...নম্বর দুই। নিঃসন্দেহে দুই।


কিন্তু, পরবর্তী শুক্রবারটা শুরু হলো একপ্রকার আত্মা-ধকধক-করা ভয় নিয়ে। ফোনের দিকে তাকিয়ে আমি কুঁকড়ে যেতে থাকলাম। একটু অপরাধীও মনে হচ্ছিল নিজেকে। যে যন্ত্র একসময় বিয়াট্রিযের সিল্কের মত কোমল কণ্ঠস্বর বয়ে নিয়ে আসত, সেই একই যন্ত্রে আজ হয়তো দানেরির ধোঁকা-খাওয়া রাগান্বিত গলা শুনতে হবে। খোদার অসীম রহমতে, কেউ ফোন করল না।


তার পরের দিনও না।


তার পরের দিনও না।


ক্রমান্বয়ে দানেরির ফোনকল যে আসতে পারে, এই কথাটাই আমি ভুলে যাচ্ছিলাম। কিন্তু অক্টোবরের শেষের দিকে একদিন, ফোন বাজল। লাইনে ছিল দানেরি। আমি প্রথমে ওর কণ্ঠ চিনতে পারিনি দেখে বিরক্ত হলো, একটু আহতও হলো মনে হয়। আমি ভাবছিলাম হয়তো বইয়ের কথা তুলবে, কিন্তু দানেরি কথা বলল আরেক বিষয়ে, 'জানো, হতভাগা জুনিনো-জুনগ্রি আমার বাড়ি ভেঙে ফেলতে চায়? ওরা নাকি স্যালন-বারটাকে আরও বড় করবে!' তারপর সে সুর করে অর্ধেক-কান্না অর্ধেক-গালাগালির মত একটা কিছু করতে লাগল।


তার হতাশা আমাকেও ছুঁয়ে গেল। আসলে বয়স পঞ্চাশের কোঠা পার হয়ে গেলে, একটা সময় সকল পরিবর্তনই বিষবৎ মনে হয়। তাছাড়া আমার বিয়াট্রিযের সব স্মৃতির বসবাস তো ওখানেই। আমি সামান্য অস্বস্তির সাথে তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু দানেরি আমার কথা কানেই তুলল না। ও বলতে লাগল, 'ওরা যদি সত্যি সত্যি বাড়িটা ভেঙে ফেলে, আমি মামলা ঠুকে দেব। ডাঃ জুনিকে হায়ার করে মামলা লড়ব। না হলেও পঞ্চাশ হাজার ডলার ড্যামেজ ফী দেওয়াবো ওদের দিয়ে।'


ডাঃ জুনির নাম শুনে আমি একটু নিশ্চিত হলাম। এ ব্যাটা সাত ঘাটের পানি খাওয়া লোক, এবং পুরো এলাকায় তুখোড় উকিল নামে পরিচিত। আমি দানেরিকে বললাম তাড়াতাড়ি তাকে হায়ার করে ফেলতে, দানেরি সম্মতি জানিয়ে বলল সে এই বিকালেই কল করবে। তারপর, কোন গোপন কথা বলার সময় আমরা যেমন গলা নামিয়ে ফেলি, তেমনি করে ও জানাল, কবিতাটা ও শেষ করতে পারেনি। মাটির নিচের ঘরের 'আলেফ'টা নষ্ট হয়ে গেলে পারবেওনা।


'জিনিসটা ডাইনিং রুমের নিচের ঘরে', দানেরি গলা আরও নামিয়ে ফেলল, 'আলেফের ভিতরে, জানো বোর্হেস, পুরো পৃথিবীটা ঢুকে বসে আছে। ওটা আমার--আমার! একেবারে ছোট্ট থাকতে আমি খুঁজে পেয়েছিলাম ওটাকে। নিচের ঘরে যাবার সিঁড়িগুলো খুব ঢালু দেখে চাচা-চাচি আমাকে কখনো ওখানে যেতে দিতেন না আমাকে। একদিন যখন কেউ বাসায় ছিল না, আমি চুপিচুপি নিচে নামতে শুরু করি। কিন্তু সিঁড়িতে হোঁচট খেয়ে গড়াতে গড়াতে নিচে পড়ে যাই। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। যখন চোখ খুললাম, তখনি সামনে দেখতে পেলাম জিনিসটা। আলেফ।'


'আলেফ?' আমি বোকার মত পুনরাবৃত্তি করলাম।


'হ্যাঁ, পৃথিবীর একমাত্র জায়গা যেখানে পুরো পৃথিবী ঢুকে বসে আছে। সমস্ত পৃথিবীর সবকিছু তুমি একত্রে দেখতে পাবে, সকল সম্ভাব্য অ্যাঙ্গেল থেকে, পুরোপুরি পরিস্কারভাবে- কিন্তু তবুও একটার সাথে আরেকটা কক্ষনো গুলিয়ে যাবে না। এই আবিস্কারের কথা আমি কাউকে বলিনি। এরপরে সুযোগ পেলেই মাটির নিচের অন্ধকার ঘরটায় গিয়ে আলেফের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আলেফের কারণেই তো কবিতাটা লিখতে পারছিলাম, সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে করে। আর ওরা আমার আলেফ নিয়ে যাবে? নষ্ট করে দেবে? কক্ষনো না। আলেফটা শুধু আমার, আমার। ডাঃ জুনি সবার সামনে কোর্টে প্রমাণ করে দেবেন।'


আমি যুক্তি দিয়ে দানেরিকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, 'তুমি না বললে ঘরটা অন্ধকার? তাহলে আলেফটাকে দেখলে কি করে?'


-'আরে যদি মহাবিশ্বের সকল কিছু আলেফের ভিতরে থাকে, তাহলে তো সব তারা-নক্ষত্র, সব আলোর উৎসও এর ভিতরে আছে। তাহলে এর বাইরে তো অন্ধকারই থাকবে। সোজা জিনিসটা ধরতে পারছ না?'


'আচ্ছা তুমি দাঁড়াও, আমি আসছি।'

দানেরি কিছু বলতে পারার আগেই ফোনটা নামিয়ে রাখলাম। হাঃ! নিজেকে আস্ত গাধা মনে হচ্ছে আমার। এই ব্যাপারটা আগে চোখে পড়েনি কেন? ভিটেরবো বংশের সকল পুরুষের মতই, কার্লোস আরজেন্টিনো দানেরি-ও একটা পাগল ছাড়া আর কিছু নয়। পাগলামির লক্ষণ আগেই ছিল, বাড়ি ভেঙে ফেলার কথায় মাথার ওপরে হয়তো চাপ পড়েছে; পুরোপুরি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। তার এই পাগলামিতে আমার কেমন একটা যেন স্যাডিস্টিক আনন্দ হতে লাগল। আনন্দের পরিপূর্ণতা আসবে চোখের সামনে ওকে পাগলামি করতে দেখলে। মনের গহিনে, কেন যেন এই গাধাটাকে প্রথম দিন থেকেই ঘৃণা করে আসছি। কে জানে, হয়তো ও-ও একই রকম ঘৃণা করে আমায়!


গ্যারেই স্ট্রীটের বাসাটায় ঢুকলাম। কাজের মেয়েটা বলল অপেক্ষা করতে, কারণ দানেরি সেলার রুমে 'ছবি ডেভেলপ করছে'। সোফার পাশে পুরনো পিয়ানো, কেউ বাজায় না বোঝাই যাচ্ছে। ধুলো জমে গেছে। তার পাশে একটা ফুলহীন শূন্য ফুলদানি। ফুলদানির পেছনে দেয়ালে বিয়াট্রিযের বিশাল চকচকে ছবি। আমি আশেপাশে তাকাই।


কেউ নেই।


আমি মোহগ্রস্ত প্রেমিকের মত সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াই। ছবিটার ওপর মুখ ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলি, 'এই, এই বিয়াট্রিয, এই বিয়াট্রিয ইলেনা ভিটেরবো, তাকাও তাকাও, দেখ, দেখ আমি, আমি বোর্হেস- এসেছি।'


কিছুক্ষণ পর কার্লোস এলো। শুকনো গলায়, কোন প্রকার কুশল জিজ্ঞাসায় না গিয়ে বলল, 'প্রথমে এক গ্লাস সুয়েডো-কগন্যাক গিলবে। তারপর যাবে সেলারে। শোনো, কোন আলো নিয়ে যেতে পারবে না। সেলারের মেঝেতে চিত হয়ে শোবে, আর চোখ রাখবে সিঁড়ির উনিশ নম্বর ধাপে। তুমি নিচে যাবার পর আমি দরজাটা বন্ধ করে দেব। কোন নড়াচড়া করবে না, চোখ সরাবে না। আর ইঁদুর গায়ের ওপর দিয়ে দৌড়ে গেলে ভয় পেয়ো না, ওরা কামড়ায় না...সাধারণতঃ।'


-'তারপর?'


'তাকিয়ে থাকার দুই এক মিনিটের মধ্যেই তুমি আলেফ দেখতে পাবে। আলেফ, আমার সত্যিকারের সম্পদ, আমার আত্মা! কত ভাগ্যবান তুমি ভেবে দেখ, এই জিনিস তোমাকে দেখতে দিচ্ছি!' দানেরির চোখমুখে নাটুকে একটা ভঙ্গি ফুটে উঠল।


ডাইনিং রুমে যেতে যেতে সে যোগ করল, 'আর, যদি দেখতেই না পাও, তাহলে বুঝতে হবে তোমার ভাগ্য খারাপ, নয়তো চোখ নষ্ট। এখন যাও যাও, তাড়াতাড়ি কর। ফিরে এসে বিয়াট্রিযের ছবির ওপর যত খুশি হুমড়ি খেয়ে পড়ে থেকো।'


ওর বারংবার তাগাদায় কিছুটা বিরক্ত হয়েই আমি সেলারের সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলাম। সত্যি বলতে অন্ধকার সেলারটাকে কালো সর্বগ্রাসী একটা গহ্বরের মত লাগছিল। অন্ধকার আস্তে আস্তে চোখে কিছুটা সয়ে আসতে লাগল। আবছা আলোয় দেখতে পেলাম ঘরে কয়েকটা শূন্য কমদামি বিয়ার-কেস পড়ে আছে, এখানে ওখানে ক্যানভাসের শূন্য বস্তা দুএকটা ইতস্ততঃ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দানেরি বস্তাগুলোর একটা তুলে দু'ভাঁজ করল, তারপর সিঁড়ির সামনা-সামনি একটা জায়গায় বিছিয়ে দিল। আমি একটু বিরক্ত হবার ভঙ্গি করলাম।


'আহা, বালিশ হিসেবে হয়তো খুব একটা সুবিধার না', দানেরি শুকনো মুখে বলল, 'কিন্তু যদি জিনিসটা আর হাফ ইঞ্চিও বেশি পুরু হয়, তাহলে কিচ্ছু দেখতে পাবে না, গাধার মত শুয়ে থাকতে হবে শুধু শুধু। সুতরাং অমন করে মুখ বেঁকিও না। চটপট শুয়ে পড়ো এখানে, তারপর মেঝে থেকে গুণে গুণে উনিশ নম্বর ধাপের দিকে তাকিয়ে থাক।'


ও যা বলল একে একে সবই করলাম, তারপরে অবশেষে দানেরি দূর হল। দরজাটা লাগিয়ে দেবার পর, সত্যি বলতে একটু ভয় ভয় লাগছিল। আবছা আবছা যে আলোটা এতক্ষণ আসছিল, সেটাও দূর হয়ে যাওয়ায় কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। নিজের হাত পা মাথা সব কেমন বিচ্ছিন্ন, আলাদা আলাদা মনে হচ্ছিল। পরম অন্ধকারে ডুব দিলে যা হয়। এরকম অবস্থায় ভাবতে ভাবতে প্রথম বারের মত বুঝতে পারলাম, নিজেকে কি পরিস্থিতিতে ছুঁড়ে ফেলেছি। দানেরি পাগল তাতে কোন সন্দেহ নেই। তার পাগলামিতে আমি যদি সায় না দেই, যদি বলি আমি সত্যিই কোন আলেফ-টালেফ দেখিনি, তাহলে ও কি করবে? নিজের পাগলামি লুকিয়ে রাখতে মেরে ফেলবে আমাকে? নাকি এই ব্যবস্থা আরও আগে করে রেখেছে? কগন্যাকে বিষ মিশিয়ে দেয়নি তো??--ভাবতে ভাবতে আমার হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠতে থাকে, আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি-- তারপর চোখ খুলি আবার। তখনই আমি দেখতে পেলাম আলেফ-টা।


গল্পের এই অংশে এসে আমাকে থেমে পড়তে হচ্ছে বারবার। একজন লেখক হিসেবে নিজের অক্ষমতারও মুখোমুখি হচ্ছি। তবুও, চেষ্টা করি।


প্রতিটি ভাষাই কয়েকটি নির্দিষ্ট প্রতীক, চিহ্ন নিয়ে গড়ে ওঠে। আর প্রতীক বা চিহ্নগুলো বেছে নেওয়া হয় ব্যবহারের ক্ষেত্রবিশেষে, অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। তাহলে যে জিনিসটা আগে আমি কখনো চোখে দেখিনি, অনুভব করিনি, তাকে কি দিয়ে বর্ণনা করব? অন্ধকে আকাশের রং যে নীল, বধিরকে পিয়ানোর সুর যে কেমন মিষ্টি - সেটা কি রূপক দিয়ে বোঝানো যায়?


সুফিরাও খোদাকে নিয়ে গান বাঁধতে গিয়ে, লিখতে গিয়ে এরকম সমস্যায় পড়েছেন। তারা এর সমাধানে আবার রূপক-ই বেছে নিয়েছেন। ঈশ্বরের অস্তিত্ব বোঝাতে গিয়ে এক পার্সিয়ান সুফি একটা পাখির কথা বলেছেন, যেটা একইসাথে পৃথিবীর সব পাখির অংশ। ফ্রেঞ্চ দার্শনিক Alanus de Insulis সেই ১১৬০ সালে একটা গোলকের কথা বলেছেন; মহাবিশ্বের প্রতিটি বিন্দু এর কেন্দ্র, কিন্তু এর কোন পরিধি নেই। আরও আছে চারমুখো Ezekiel-এর কাহিনি; যে একই সময়ে একই সাথে উত্তরে-দক্ষিণে-পূর্বে-পশ্চিমে যেতে পারে (বিনা কারণে এগুলো বলছি না, আলেফের আইডিয়াটার সাথে এদের প্রত্যেকের কোন না কোন দিকে মিল আছে)। হয়তো আমি আরও উদাহরণ দিতে পারব, কিন্তু তাতে জিনিসটার বর্ণনা আরও ঘোলাটে, অস্পষ্ট লাগবে আপনাদের কাছে। সসীমের মাঝে কখনো অসীমের ধারণা ঢোকানো সম্ভব কি? আলেফের দিকে তাকানোর সাথে সাথে কোটি কোটি মানুষের হাসি-কান্না-আবেগের ছবি (আসলে চলমান সিনেমার মত প্রত্যেকটা, কিন্তু বিভ্রান্তি কমানোর জন্য 'ছবি' শব্দটা ব্যবহার করছি) আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, প্রত্যেকে সম্পূর্ণ পরিষ্কারভাবে, কোথাও কোন অস্পষ্টতা নেই। প্রত্যেকটা ঘটনা ঘটছিল একই সাথে। কিন্তু তাদের বর্ণনা দিতে গিয়ে এখন যা লিখব, তা আসবে ক্রমান্বয়ে। কারণ ভাষা বর্ণনার ওপর নির্ভরশীল, আর সকল বর্ণনাই একটা ক্রম মেনে চলে।


উনিশ নম্বর ধাপের একটু পেছনে, আঁধারের মাঝে, ছোট একটা গোলক শূন্যের ওপর ভাসতে ভাসতে ধীরে ধীরে ঘুরছিল। আমি আরেকটু ভাল করে দেখলাম। না, আসলে ওটা স্থির, কিন্তু গোলকের মাঝে অসংখ্য জিনিস ঘুরছে, ফিরছে, পাক খাচ্ছে - তাই পুরো জিনিসটাই নড়ছে বলে ভ্রম হচ্ছে। গোলকটা ব্যাসে কত হবে? এক ইঞ্চি, নইলে এক ইঞ্চির একটু বেশি। কিন্তু বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবটাই ওই এক ইঞ্চি গোলকের মধ্যে ভাসছিল। কোন কিছুকে যত ভাবে দেখা সম্ভব, তার ওপর যতভাবে আলো ফেলা যায়, ঠিক ততভাবেই আমি প্রত্যেকটা বস্তুকে দেখছিলাম। আয়নার বিপরীতে আরেকটা আয়না লাগিয়ে একটা নির্দিষ্ট কোণ থেকে তাকিয়ে দেখবেন, মনে হয় একটার পর একটা অসংখ্য আয়না দেখা যাচ্ছে। তেমনি, বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে একটা জিনিসের অসংখ্য রূপ একই সাথে আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।


আমি দেখতে পেলাম বিশাল সুনীল সমুদ্র, দেখলাম রাত নেমে আসতে, দেখলাম ভোর হচ্ছে। প্রতিটা মানুষকে আলাদা করে দেখলাম। কালো পিরামিডের অন্ধকার কোণে এক মাকড়সার রূপালি জাল দেখলাম। একটা বিক্ষিপ্ত গোলকধাঁধার মত জায়গা দেখলাম (পরে মনে হল ওটা সম্ভবতঃ লন্ডন ছিল)। দেখলাম অসংখ্য চোখ আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন তারা আয়নায় নিজেকেই দেখছে। আমি পৃথিবীর সবগুলো আয়না দেখলাম, কিন্তু কোথাও নিজের প্রতিবিম্ব খুঁজে পেলাম না। আমি...বুকে বাতাস ভরে নিলাম অনেকটা। চোখ বন্ধ করলাম। তারপর তাকালাম আবার।


সোলার স্ট্রীটের একটা বাড়ির সামনের উঠোন। বাড়ির চকচকে টাইলস।

সেই একই টাইলস, যা ত্রিশ বছর আগে ফ্রে বেন্তোসে এক বাসায় দেখেছিলাম।

আঙুর-শাখা।

তুষার।

টোব্যাকোর ঘ্রাণ।

ধাতুর কাঁচা খণ্ড, দূষিত বাষ্প।

মরুভূমির উঁচুনিচু বালুর স্তুপ।

বালুর স্তুপের প্রতিটি আলাদা আলাদা কণা।

লম্বা করে একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা। তার চেহারা ভুলব না কখনো। দেখলাম তার জট-পাকানো চুল, তার ডান স্তনে ক্যান্সারের সংক্রমণ।

ফুটপাথের একপাশে একটা জায়গায় পড়ে থাকা আলগা মাটি। আগে একটা গাছ ছিল এখানে।


আদ্রোঁগ শহরের এক কোণে একটা সামার হাউস। দেখলাম বাসাটার এক ঘরে ফিলেমন হল্যান্ডের প্রথম বইটার ইংরেজি অনুবাদের প্রথম কপি, পড়ে আছে অযত্নে। একই সময়ে বইটার প্রতিটা পাতার প্রতিটা অক্ষর ফুটে উঠল চোখের সামনে (ছোট থাকতে মাঝে মাঝে মনে হত- আচ্ছা, কোন বই যখন বন্ধ করে শেলফে তুলে রাখা হয়, তখন অক্ষরগুলো আলগা হয়ে একটা আরেকটার সাথে মিশে যায় না কেন?)

জাপানের এক শহরে সূর্য অস্ত যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছিল বাংলার একটা গোলাপ ফুলের রং এসে মিশে গেছে সূর্যে।


শূন্য ঘর। আমার ঘর।

আলকামারের একটা ক্লজিটে দুটো আয়নার মধ্যে একটা গ্লোব রাখা। আয়নাদুটোয় গ্লোবের অসংখ্য প্রতিবিম্ব।

সন্ধ্যা নামছে। কাস্পিয়ান সাগরের তীর ধরে দৌড়ে যাওয়া একদল বন্য ঘোড়ার কেশর উড়ছে বাতাসে।

কারো হাতের হাড়গুলোর সূক্ষ্ম কাঠামো।

যুদ্ধরত সৈনিকরা বাড়িতে পাঠাচ্ছে ছবিঅলা পোস্টকার্ড।

মির্জাপুরের এক দোকানের শোকেসে স্প্যানিশ তাসের প্যাকেট।

একটা গ্রিনহাউসের মেঝেতে নুয়ে পড়া ফার্ণের ছায়া।

বাঘ এগোচ্ছে সাবধানে পাতা মাড়িয়ে, শিকারি চোখে ।

বন্য মোষের দল।

নদীতে জোয়ার ভাটা চলছে।

একটা প্রাচীন পার্সিয়ান জ্যোতির্মন্দির।

পৃথিবীর যত পিঁপড়ে আছে সবগুলোকে দেখলাম। সব।

একটা টেবিলের ড্রয়ারে কতগুলো চিঠি (হাতের লেখাটা দেখে আমি কাঁপতে শুরু করলাম), অবিশ্বাস্য অশ্লীল আর কামুক চিঠি।

বিয়াট্রিয লিখেছে কার্লোস আরজেন্টিনোকে।

দেখলাম একটা সমাধিফলক, যা আমি একসময় পূজা করতাম। তার নিচে পচাগলা অবশিষ্টাংশ, হাড় হয়ে গেছে ধুলো-মাটি। এদের সবার একসময় 'বিয়াট্রিয ভিটেরবো' নামক একটা একক, লোভনীয় অস্তিত্ব ছিল।

দেখলাম নিজের কালচে রক্তপ্রবাহ।

প্রেমিক-প্রেমিকারা মিলিত হচ্ছে।

প্রেম করছে।

মরে যাচ্ছে।

বিচ্ছিন্ন হচ্ছে।


প্রত্যেক বিন্দু, প্রত্যেক কোণ থেকে আমি দেখলাম- আমি তাকিয়ে আছি আলেফের দিকে।

আলেফের ভেতরে দেখলাম পৃথিবী।

পৃথিবীর ভেতরে আলেফ।

আলেফে পৃথিবী।

পৃথিবীতে আলেফ।

আলেফ... পৃথিবী...

পৃথিবী...আলেফ...

তারপর নিজের পা, মুখ চোখ দেখলাম। নিজের নাড়িভুঁড়ি দেখলাম। তোমাকে দেখলাম। আমাকে দেখলাম। তারপর হাসলাম, চোখ বন্ধ করে কাঁদতে চাইলাম কিন্তু পারলাম না। মাথা ঘুরতে লাগল। বমি বমি কেমন যেন। মানুষ যাকে চেনে মহাবিশ্ব নামে, কিন্তু যার প্রকৃত রূপ- সম্পূর্ণ রূপ- সে কখনো দেখেনি- আমি সেই নিষিদ্ধ রূপ দেখলাম।


কি অসীম বিস্ময়, কি অসীম আনন্দ!


-'হা হা, পুরো বোকা হয়ে গেছ, তাই না?' একটা খুশি খুশি, আমুদে কণ্ঠস্বর বলে উঠল, 'যে জিনিস দেখালাম, এই ঋণ হাজার বছরেও শোধাতে পারবে না। জিনিসটা এক কথায় স্বর্গীয়, তাই না বোর্হেস, অ্যাঁ?'


কার্লোস আরজেন্টিনো দাঁড়িয়ে ছিল সিঁড়ির সবচে ওপরের ধাপটায়। দরজার ফাঁক দিয়ে যে ক্ষীণ হলুদ রশ্মি চুইয়ে চুইয়ে আসছিল, তার আলোয় আমি নিজের পায়ে উঠে দাঁড়ালাম, তারপর বিড়বিড় করে জবাব দিলাম ওকে, 'স্বর্গীয়? হু, স্বর্গীয়ই বটে।'


আমার কণ্ঠে আশ্চর্যের সুরটাকে কার্লোস ভুল করে বিদ্রূপ ভাবল। একটু উদ্বেগে পড়ে গিয়ে ও জিজ্ঞেস করল, 'তুমি তো সব দেখেছ, না? একেবারে পরিষ্কার করে?'


ওই মুহূর্তেই আমি আমার প্রতিশোধের উপায় খুঁজে পেলাম।


সরাসরি ওকে দয়া দেখানোর ভান করে, কোমল স্বরে ওর আতিথেয়তার জন্য কৃতজ্ঞতা জানালাম। বললাম, সেলারে শুয়ে থেকে আমি অনেক 'আনন্দ' পেয়েছি। সেই সাথে কাঁধে হাত দিয়ে মেকি সহানুভূতি দেখিয়ে বললাম, 'বাড়িটা ভেঙে ফেলা তো আর ঠেকানো যাবে না, তুমি এক কাজ কর - ক'দিন গ্রাম দিয়ে ঘুরে এস। শহরের পরিবেশটা এত বাজে, তোমাকে কি আর বলব- আমারই তো মাঝে মাঝে মাথা নষ্ট হয়ে যায়!'


দানেরিকে কেমন অসহায় দেখাচ্ছিল। ও আলেফের কথা বলতে চাইল, কিন্তু আমি হাত নেড়ে জোর করে সে নিয়ে আর কথাই বললাম না। বেরিয়ে আসার আগমুহূর্তে আমি ওর সাথে ভীষণ আবেগের সাথে কোলাকুলি করলাম; তারপর আরও একবার গ্রামের তাজা আলোবাতাসের উপকারিতা নিয়ে একটা ছোটোখাটো ভাষণ দিয়ে খুশিমনে বেরিয়ে এলাম। পেছনে পড়ে রইল বিধ্বস্ত দানেরি।


বাইরে বেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে, সিঁড়ি বেয়ে কনস্টিটিউশন স্টেশনে নামতে নামতে একটা ভয় আমাকে আঁকড়ে ধরতে শুরু করল। সাবওয়ের ট্রেনে চড়তেই ভয়টা আরও ঘনীভূত হল। এই জায়গায় আমি আগে কখনো আসিনি, কিন্তু যেখানে তাকাচ্ছি, যার দিকে তাকাচ্ছি- প্রত্যেকটা বাঁক, প্রত্যেকটা মুখ অনেকদিনের পরিচিত বলে মনে হচ্ছে। আমি এদের সবাইকে চিনি। সবকিছু দেখা হয়ে গেছে। সব পথ চলা হয়ে গেছে। একটা অবর্ণনীয় অনুভূতি চড়ে বসল বুকের ওপর। আমি কি আর কখনো নতুন কিছু দেখব না? শুনব না নতুন কোন সুর?


সম্পূর্ণ বিশ্বজগতের জ্ঞান আমাকে পাগলামির দিকে ঠেলে দিচ্ছিল, খুব আস্তে আস্তে।


সৌভাগ্যক্রমে, নির্ঘুম কয়েকটা রাত কাটানোর পর একদিন সকালে আবিষ্কার করলাম, পাখির এই ডাকটা আগে কখনো শুনিনি। বাইরের সূর্যোদয়টা নতুন মনে হচ্ছে। নতুন! এভাবেই বিস্মৃতির অতলে আলেফের কথাগুলো ডুবে গেল একদিন।



 
পুনশ্চ - 

 
গ্যারেই স্ট্রীটের 'কোন একটা' পুরনো বাড়ি ভেঙে ফেলার ছয় মাস পরের কথা। প্রোক্রাস্ট অ্যান্ড কো. নামের এক প্রকাশনী কি জানি কোন কারণে দানেরির 'মহাকাব্যে'র একটা অংশ প্রকাশ করল। পুরোটা না, আর্জেন্টিনার বর্ণনার অংশটুকু। তারপর কি হল সেটাকে কি বলা যায়? (আমি বলব আমাদের সাহিত্যমানের জন্য একটা অশনিসংকেত) কার্লোস আরজেন্টিনো দানেরি জাতীয় সাহিত্য পুরষ্কারে দ্বিতীয় স্থান লাভ করল। ('প্রিয় বোর্হেস, তোমার অভিনন্দন-পত্র পেয়েছি', ক'দিন পর আমাকে ও চিঠি পাঠাল, 'ভদ্রতার মুখোশের নিচে তোমার ঈর্ষা আর বিদ্বেষের বাহার দেখে আমোদিত হলাম। তবে যা-ই বল, তোমাকে স্বীকার করতেই হবে এবারের জয়মাল্যটা আমারই প্রাপ্য। আমার মুকুটেই সাহিত্যের পদ্মরাগমণিটির যথার্থ স্থান') প্রথম পুরষ্কার পেলেন ড. আইতা, তৃতীয় পুরষ্কার গেল ড. মারিও বনফান্তির কাছে। সবচে অবিশ্বাস্য ব্যাপারটা হল- আমার বই 'শানানো শব্দের চিরকুট' একটা ভোটও পেল না! নীরস আর মানহীন বাজারি লেখকদের জয় হল আরেকবার! দানেরির সাথে আমি কয়েকবার দেখা করার চেষ্টা করেছি। বাজারে গুজব আছে তার নাকি আরেকটা কবিতার বই বেরুবে। তিনটে বড় বড় প্রকাশনী ওর পেছনে লাইন দিয়ে বসে আছে। আলেফের প্রভাবমুক্ত হয়ে তার কলমও ঘন ঘন গর্ভবতী হয়ে পড়ছে, এখন লিখছে আমাদের জাতীয় বীর জেনারেল স্যান মারটিনকে নিয়ে (খুব সম্ভব একটা মহাকাব্য)।


আলেফ সম্পর্কে আমি কয়েকটা ধারণা যোগ করতে চাই- একটা এর প্রকৃতি নিয়ে, আরেকটা এর নাম নিয়ে। 'আলেফ' হচ্ছে হিব্রু বর্ণমালার প্রথম অক্ষর। এই শব্দটি কাব্বালা ধর্মে 'En Soph' নামে পরিচিত, যার আভিধানিক অর্থ হচ্ছে 'ঈশ্বরের বিশুদ্ধ ও সীমাহীন বৈশিষ্ট্য'; এবং 'En Soph' বা আলেফ যদি মানুষের রূপ ধারণ করে, তাহলে তার মাথা স্পর্শ করে স্বর্গ এবং পায়ের পাতা স্পর্শ করে পৃথিবী (এই ধর্মে পৃথিবী-স্বর্গের মাঝে দূরত্ব অসীম ধরা হয়)। জর্জ ক্যান্টরের Mengenlehre গ্রন্থে আলেফকে ধরা হয়েছে ট্রান্সফাইনাইট সংখ্যার প্রতীক হিসেবে, (যেসব সংখ্যা যেকোনো সসীম সংখ্যার চেয়ে বড় কিন্তু অসীম সংখ্যা নয়) যেমন আলেফ-ওয়ান, আলেফ-নাল ইত্যাদি। অর্থাৎ আলেফ নিতান্তই কোন মনগড়া শব্দ নয়, এর পেছনে অনেক ইতিহাস আছে। সুতরাং প্রশ্ন হচ্ছে দানেরি জানল কি করে, তার সেলারের জিনিসটার নাম 'আলেফ'?


আমার ধারণা, গ্যারেই স্ট্রিটের বাসায় আমি যা দেখেছিলাম- ওটা আসল আলেফ নয়। নকল।


আগে কয়েকটা তথ্য দেই। রিচার্ড ফ্র্যান্সিস বার্টন ১৮৬৭ সালের দিকে ব্রাজিলের সাও পাওলোতে ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ৭৫ বছর পর, জুলাই ১৯৪২ সালে এক গবেষক সাও পাওলোর লাইব্রেরিতে স্বয়ং বার্টনের হাতে লেখা একটা পাণ্ডুলিপি খুঁজে পান। পাণ্ডুলিপিতে বলা হয়েছে এক রহস্যময় আয়নার কথা, যাতে তাকালে ধরা পড়ে 'পুরো বিশ্বের প্রতিবিম্ব'। বার্টন বলছেন এই আয়নার মালিক ইস্কান্দার জুলকারনাইন, মুসলমানদের একটা অংশ বিশ্বাস করে ইনি একজন আল্লাহ-প্রেরিত নবী ছিলেন। একে পশ্চিমা বিশ্ব চেনে ম্যাসিডোনিয়ার 'আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট' নামে।


বার্টন একইরকম আরও কয়েকটা বিশেষ বস্তুর নাম করেছেন -- পার্সিয়ান সম্রাট কায়খসরু-র সাকির পেয়ালা- যাতে অনন্তকাল ধরে সাকি ঢাললেও অর্ধেকের বেশি ভরতো না কখনো। আরব্য এক হাজার এক রজনীর গল্পে আছে - তারিক-ইবনে-যিয়াদ সুউচ্চ এক দালানে খুঁজে পেয়েছিলেন আয়না- যাতে মানুষ বাদে আর সবকিছুর প্রতিবিম্ব দেখা যেত (Thousand and One Nights, 272)। জুলস ভার্ন, এইচ.জি ওয়েলসের প্রায় দুই হাজার বছর আগে সিরিয়ার অধিবাসী লুসিয়ান প্রথম সায়েন্স ফিকশন লেখেন, 'ট্রু হিস্টোরি' বা 'সত্যিকারের ইতিহাস' নামে। এই বইয়ে আছে চাঁদের গায়ে লেগে থাকা একটা আয়নার কথা (True History, I, 26)। দার্শনিক ক্যাপেলার Satyricon বইয়ে আয়নার তৈরি এক বর্শার উল্লেখ আছে - যা কারো গায়ে বিঁধলে সে অদৃশ্য হয়ে যেত।


জাদুকর মারলিনের আয়নার বর্ণনায় বলা হচ্ছে, 'এটি ছিল গোলাকার, ফাঁপা, এবং ফাঁপা অংশটিতে সত্যিকারের জগতের অবস্থান। আমাদের জগত ওই জগতটির প্রতিবিম্ব মাত্র (The Faerie Queene, III, 2, 19)।'


কায়রোতে 'আমর ইবনে আল-আসের মসজিদ' নামে একটি মসজিদ আছে। যেসব বিশ্বাসীরা ওই মসজিদে জড়ো হন- তাদের মাঝে একটি শতাব্দীপ্রাচীন ধারণা বিদ্যমান, যে- যেসব স্তম্ভ এত বছর ধরে মসজিদের ভার বহন করে চলেছে, তাদের একটির ভেতরে গোল একটা পাথর ঢোকানো আছে। অবশ্য পাথরটি কেউ কখনো দেখেনি। কিন্তু স্তম্ভগুলোর একটিতে কান পেতে থাকলে নাকি পুরো মহাবিশ্বের গুঞ্জন শোনা যায়। অনুভব করা যায়। মসজিদটি সপ্তম শতাব্দীতে তৈরি করা হয়। কিন্তু এর গায়ের ইটপাথর বা স্তম্ভগুলোর উৎস সম্পর্কে কোন তথ্য পাওয়া যায় না। যেমনটা ইবনে খালদুন লিখেছেন, 'যখন বেদুইনরা সভ্যতা গড়ে, তখন মরুভূমি তাদের বালু ছাড়া আর কিছু দিতে পারে না। তাই তারা সভ্যতা গড়বার উপাদান ধার করে বাকি বিশ্বের কাছ থেকে।' ।


তাহলে যুগ যুগ ধরে আলেফের অস্তিত্ব কোথায় ছিল? মারলিনের আয়নায়? কায়রোর ওই মসজিদের কোন এক স্তম্ভে? সসীম কিছুতে অসীমকে অনুভব করা কি আদৌ সম্ভব? নাকি দানেরির ওই সেলারের মেঝেতে শুয়ে আমি সত্যিই 'আলেফ' দেখেছিলাম, এখন সেই অভিজ্ঞতা কোনোভাবে ভুলে গেছি, তাই সংশয় মাথাচাড়া দিচ্ছে?


আমাদের জগতটা পরিবর্তনশীল। সবসময় ঘুরছে, ফিরছে, রক্তের মত মেঝে বেয়ে গড়াচ্ছে, বদলে যাচ্ছে, পাল্টে যাচ্ছে। মানুষের মনটা তেমনি, বাঁচতে বাঁচতে একসময় কুয়াশার মত বিস্মৃতি এসে ঢেকে দেয় প্রিয়- পরিচিত সবকিছুকে। আমি নিজেও বদলে যাচ্ছি। হারিয়ে যাচ্ছি। বছরের পর বছরেরা এসে বাড়িয়ে দিচ্ছে ক্লান্তি। ভুলিয়ে দিচ্ছে আলেফ কি ছিল কি না ছিল।


ভুলিয়ে দিচ্ছে বিয়াট্রিযের মুখ।


                                    সমাপ্ত

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------


আর্জেন্টাইন লেখক হোর্হে লুইস বোর্হেস, স্প্যানিশ সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক, সম্ভবতঃ ১৯৪৫ সালে এই গল্পটি লেখেন, 'এল আলেফ' নামে তা প্রকাশিত হয়। তার লেখনীর মূল বিষয়গুলোর প্রায় সবই এই গল্পে কোন না কোন ভাবে এসেছে, আর তাই 'এল আলেফ'কে বোর্হেসের সবচে পরিণত গল্পগুলোর একটি বলে ধরা হয়।


বোর্হেসের ছোট গল্পগুলোতে আমরা নির্দিষ্ট কয়েকটা থিম বারংবার আসতে দেখি। স্বপ্ন, বই, লাইব্রেরি, গোলকধাঁধা, আয়না, অসীম সংখ্যা বা ধারণা ইত্যাদির সাথে ধর্ম, ঈশ্বরের আইডিয়া মিলেমিশে অদ্ভুত এক পরিবেশের সৃষ্টি করে। বাস্তবের সাথে পরাবাস্তবতা মিশে যায়। জন্ম হয় জাদুবাস্তবতার। বোর্হেস ব্যক্তিগতভাবে অজ্ঞেয়বাদী ছিলেন, তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের পক্ষে ঈশ্বরকে বোঝা, তার অস্তিত্বের অসীমতা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। কিন্তু তার প্রতিটি গল্পই এর বিপরীতে লড়ে যায়, চেষ্টা করে অসীমকে বুঝতে।

১৯৫০ সালের শুরুর দিকে বোর্হেস সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যান। গল্প লেখালেখি প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। অন্যের সহায়তা ছাড়া চলতে পারতেন না। জীবনের শেষ দিকে এসে তিনি ক্রমশ হতাশাবাদী হয়ে পড়ছিলেন, দুনিয়াজোড়া পরিচিতি পাওয়া সত্ত্বেও নিজেকে ব্যর্থ লেখক মনে করতেন। অবশেষে ১৯৮৬ সালে লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে জেনেভায় তার মৃত্যু হয়।


তার অন্যান্য ছোটগল্পের সংকলনের মাঝে 'The Book of Sand', 'Dr. Brodie's Report', 'Historia universal de la infamia', 'Garden of Forking Paths' ইত্যাদি অন্যতম।




আলমারি - নরেন্দ্রনাথ মিত্র


স্ত্রীর সঙ্গে রোজ ঝগড়া হয় পরিতোষ সরকারের। দামি কাপড়চোপড় রাখবার মতো একটা আলমারি নেই ঘরে। ট্রাঙ্কে সুটকেসে অতি কষ্টে জিনিসপত্র গুঁজে গুঁজে রাখতে হয়। একটা কিছু বার করতে হলে একেবারে লণ্ডভণ্ড, কুরুক্ষেত্র কাণ্ড। সুপ্রীতি বলে, “আমি আর পারব না তোমার ঘর গোছাতে। আর এই দামি দামি জিনিসগুলি যদি নষ্ট হয় তার জন্যেও আমাকে দায়ী করতে পারবে না।“ পরিতোষ নির্লিপ্ত থাকবার ভাণ করে বলে, “ বেশ, করব না দায়ী। সব দোষ তুমি আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ো।” সুপ্রীতি রাগ করে বলে, “দোষ চাপালে আর কী হবে। গেলে আমার জিনিসই সব যাবে।”
তা ঠিক। বসনভূষণের ভাগ সুপ্রীতিরই চৌদ্দ আনা। পরিতোষের নিজস্ব বলতে আছে একটা গরদের পাঞ্জাবি, পৈত্রিক আমলের একখানি শাল। বিয়ের পাওয়া আংটি আর সোনার বোতাম। পরিতোষ কিছুতেই ব্যবহার করে না। ওর নাকি লজ্জা করে। তবে ঘড়ি আর পেনটি সঙ্গে সঙ্গেই রাখে। সুপ্রীতি খোঁচা দিয়ে বলে, “ও-সবও তো গয়না। ওগুলিও তো আমার বাবার দেওয়া জিনিস।”


পরিতোষ জবাব দেয়, “তোমার বাবার দেওয়া সব জিনিসের ওপরই যে আমার বিরাগ একথা, বলতে পার না। “ সুপ্রীতি বলে, “থাক থাক, আর রসিকতা করতে হবে না। তুমি যে কত ভালবাস আমাকে তা জানা আছে।”

বছর দশেক হল বিয়ে হয়েছে ওদের। তার এক বছর পর থেকেই এ ধশরনের খোঁটা শুনতে হচ্ছে পরিতোষকে। শুনতে শুনতে কান-সওয়া হয়ে গেছে।

কিন্তু পত্নীপ্রীতির যে নিদর্শন সুপ্রীতি স্বামীর কাছে চায় তা এনে দেওয়া তার পক্ষে দুঃসাধ্য। গ্লাস-বসানো ইস্পাতের আলমারির দাম অন্তত শ’তিনেক টাকা।

পরিতোষের দেড় মাসের মাইনে। বিমা কোম্পানির কেরানি যদি অমন নবাবি করে তার সংসার থেকে ছ’মাসের মধ্যে অভাব অনটন দূর হবে না। শুধু স্ত্রীর আবদার মেটালেই তো চলবে না পরিতোষকে। সংসারে পোষ্য অনেক। দুটি ছেলেমেয়ে হয়েছে। একটি বোন কলেজে পড়ে। ভাইটিও সামনেবার স্কুলের গণ্ডি ছাড়বে। খরচ কি কম! পরিতোষ যুক্তি দেখায়, “ তা ছাড়া অমন দামি আর ভারি জিনিস ভাড়াটে বাড়িতে এনে রাখতে নেই। টানাটানিতে কম হাঙ্গামা-হুজ্জোত পোহাতে হয়? কোথায় কখন থাকি তার কি কিছু ঠিক আছে? আমাদের তো সারা শহর ভরে বাসঘর আর বাসরঘর ছড়ানো। আজ বেলেঘাটা—কাল পাথুরেঘাটা, আজ টালা, কাল টালিগঞ্জ। একটু স্থিত হয়ে বসে নিই—।”

সুপ্রীতি বলে, “হুঁ, কবে তুমি চৌরঙ্গিতে বাড়ি করবে তারপর সব ফার্নিচার আসবে, সেই ভরসাতেই থাকি।” দু-চারদিন যায়, আর সুপ্রীতি সেই আলমারির কথা তোলে। বলে , “ আজও গিয়েছিলাম বিডন রোয়ে সুচিরাদের বাড়ি। কী চমৎকার আলমারিই না কিনেছে। শাড়ি রাখ, গরম কাপড়চোপড় রাখ, সব ব্যাপারেই সুবিধে। গয়নাগাঁটিও বেশ নিশ্চিন্তে রাখা যায়। কেউ খুলে নিয়ে যাবে এমন সাধ্য নেই।

অনেকগুলি ড্রয়ার। যেটায় যা খশি রাখ। তারপরে গ্লাস সেট করা আছে। তুমি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে তার সামনে বসে দিব্যি দাড়ি কামাতে পারবে।” পরিতোষ চোখ কপালে তুলে বলে, “ওরে বাবা। ওই আলমারি যদি একবার কিনে বসি তাহলে কি সারা জীবনের মধ্যে আমার ব্লেড কেনার পয়সা জুটবে?”

সুপ্রীতি রাগ করে পাশ ফিরে শুতে শুতে বলে, না জোটাই উচিত। তুমি দাড়ি গোঁফ রেখে বনে চলে যাও। বিয়ে করাই তোমার ভুল হয়েছিওল।”

পরিতোষ স্বীকার করে বলে, “ভুলটা বড় পরে ধরা পড়েছে। এখন আর শোধরাবার জো নেই। কিন্তু তুমি বোধ হয় এহনও শোধরাতে পার। সুচিরাদের বাড়িতে কিছুদিন যাতায়াত বন্ধ করে দাও। তাহলে জিনিসটা তোমার চোখেও পড়বে না। মনও খারাপ হবে না।” সুচিরা দত্ত কলেজে বছর দুই সুপ্রীতির সহিপাঠিনী ছিল। বড় ডাক্তারের মেয়ে মেজো ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে।

সে-রাত্রে সুপ্রীতি পরিতোষের সঙ্গে কিছুতেই কথা বলল না। তাতে পরিতোষ যে খুব চিন্তিত হল তা নয়। এমন মান ভঞ্জনের পালা দাম্পত্য-জীবনে ঘুরে ফিরে আসে। না আসলেই বরং জীবন একঘেয়ে হয়ে যায়। কিন্তু দিন দুই বাদে এক কাণ্ড ঘটল তাতে পরিতোষ আর অত অবিচলিত থাকতে পারল না। অফিস থেকে ফিরে ঘরে এসে ঢুকতে না ঢুকতেই ছোট বোন অঞ্জলি আর ছোট ভাই রন্টু একসঙ্গে এসে খবর দিল, “দাদা, সর্বনাশ হয়েছে।”

পরিতোষ উদ্বিঘ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কো হয়েছে রে? খোকন আর বুড়ি কোথায়? কোন অ্যাক্সিডেন্ট?” অঞ্জলি আশ্বাস দিয়ে বলল যে, সে সব কিছু নয়। পরিতোষের ছেলেমেয়ে দুটি ভালই আছে। কিন্তু সর্বনাশ হয়েছে তার স্ত্রীর। ট্রাঙ্কের ভিতরে পোকা ঢুকে বেনারসি আর মুর্শিদাবাদি সিল্ক দু’খনাই কেটে ফেলেছে। ঘরের দিকে ভাল করে তাকিয়েই ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার বুঝতে পারল পরিতোষ। সারা ঘরময় সুপ্রীতির পোশাকি শাড়িগুলি ছড়ানো। পুজোর সময় আর বিবাহবার্ষিকীতে পঁচিশ ত্রিশ টাকার যে সব শাড়ি পরিতোষ স্ত্রীকে উপহার দিয়েছে সব মেঝেয় লুটোতে লুটোপুটি খাচ্ছে। আর পাশের ঘরে তক্তপোষের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে ফুলে ফুলে কাঁদছে সুপ্রীতি। এক পাশে কীটদষ্ট বেনারসিখানা পড়ে রয়েছে। দোরের কাছে বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে খোকন আর বুড়ি। পরিতোষের সাত আর পাঁচ বছরের দুটি পুত্রকন্যা। পরিতোষ স্ত্রীর পিঠে সস্নেহে হাত রেখে বলল, “বোধহয় এখনও রিপু করিয়ে নিলে চলবে। আর অন্য শাড়িগুলিও বাক্সে তুলে রাখ। নষ্ট করে লাভ কী।”

সুপ্রীতি বলল, “তুলে আর কী হবে। ওই ভাঙা বাক্সে তুলে রাখাও যা, বাইরে ফেলে দেওয়াও তাই। একই কথা। আমার কিছু আর রাখবার দরকার নেই। তুমি রাখতে হয় রাখো।” শেষ পর্যন্ত পরিতোষ প্রতিশ্রুতি দিল, এক সপ্তাহের মধ্যে সুপ্রীতির পছন্দমতো আলমারি সে কিনে আনবে। একই সঙ্গে যা মজবুত আর শৌখিন। বড় আয়না-বসানো আলমারি। পাশাপাশি দাঁড়ালে, দু’জনের প্রতিচ্ছবি যাতে ফুটে উঠবে। ঘরে একখানা বড় আয়না না থাকলে কি চলে। আয়্নায় তো শুধু মুখই দেখা যায় না, সুখও দেখা যায়। দু’খানা সুখী পরিতৃপ্ত মুখের প্রতিবিম্ব। তার চেয়ে বড় ঐশ্বর্য আর কী আছে।

আলমারি তো কিনবে। কিন্তু তিনশো সাড়ে তিনশো টাকা কোত্থেকে জোগাড় করবে পরিতোষ। হাজার দুই টাকার ইন্সিওরেন্স আছে। তার থেকে…ধার নেওয়া যায়। কিন্তু সুপ্রীতি বলল, ‘ খবরদার ও টাকায় তুমি হাত দিতে পারবে না।”

ব্যাঙ্কে একটা নামমাত্র একাউন্ট আছে। সর্বসাকুল্যে তাতে শখানেক টাকাও হবে ক না সন্দেহ। পরিতোষ বলল, “নিজেদের আলমারি্ত আনতে গিয়ে কি পরের সিদুকে হাত দেব?”

সুপ্রীতি বলল, “কে তা দিতে বলেছে? দরকার নেই এখন কিনে? পুজোর সময় যদি বোনাস টোনাস পাও তখন দেখা যাবে।”

কিন্তু পরিতোষের মনটা খুঁত খুঁত করতে থাকে। কথা যতদিন দেয়নি ততদিন একরকম ছিল। কিন্তু কথা দেওয়ার পর জিনিসটা কিনে না আনতে পারলে স্ত্রীর কাছে আর মান থাকে না। সুপ্রীতি তাহলে ভাববে পরিতোষ একেবারেই পথের ফকির। এত বড় শহরে তিনশো সাড়ে তিনশো টাকা সংগ্রহ করে আনার মতো ক্ষমতাই নেই তার।

সুতরাং পরিতোষ ধারের চেষ্টায় নামল। ক্রেডিট মানে কৃতিত্ব। যার যত ধার বেশি, তার বুদ্ধির ধার তত অসামান্য। গোপনে দুওজন সহকর্মী অফিসারের কাছ থেকে শ’খানেক টাকা নিল। পুরনো সহপাঠীদের মধ্যে একজন ইটের কারবার করে। টোকা দিয়ে দেখল সুরথের হৃদয় অতখানি শক্ত হয়ে যায়নি। জরুরি দরকার এবং অসুখবিসুখের দোহাই দেওয়ায় সে শ’দুইই টাকা দিল। বাকি পঞ্চাশ টাকা তুলল নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে। মনটা তবু খুত খুত করতে লাগল, কোথায় যেন হীনমন্যতা আছে এই ধার করার মধ্যে। বন্ধুদের কাছে হাত পাততে গেলে যে হতমান হতে হয় তাতে পরিতোষের কোনও সন্দেহ নেই।
টাকা জোগাড় হওয়ার পর সেদিন বিকাল বেলায় স্ত্রীকে নিয়ে যখন জিনিস কিনতে বেরুল তখন মনে আর তেমন গ্লানি রইল না পরিতোষের। এই উপলক্ষে সে অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। সুপ্রীতির নিষেধ সত্বেও শ্যামবাজার থেকে ট্যাক্সি ভাড়া করে চলল বরবাজারের দিকে। পথে স্ত্রীকে নিয়ে ভাল একটা রেস্টুরেন্টে খেল। সুপ্রীতি হেসে বলল, “জিনিসটা আগে কেনা হোক। পথেই যদি এত টাকা উড়িয়ে দাও তাহলে জিনিসটা কিনবে কী করে।”

পরিতোষ বলল, “বিশ্বাস কর, এই টাকা ক’টা ওড়াবার শক্তি আমার আছে।”

সুপ্রীতি বলল, “কিন্তু কেন এত ব্যয় করছ শুনি। আজ তো আমার ম্যারেজ ডে অ্যানিভারসারি নয়, কি অন্য কোন উৎসব-টুৎসব নয়।”

পরিতোষ বলল, “আজ আলমারির জন্মোৎসব। আর সে আলমারি শুধু ইস্পাত দিয়ে তৈরি নয়, আমাদের দু’জনের আনন্দ দিয়ে তৈরি।”

সুপ্রীতি বলল, “থাক, কবিত্ব রাখ। ফুলটুল কেনার সময় ওরকম কবিত্ব মানায়।”

পরিতোষ প্রতিবাদ করল, “আর আলমারির বেলায় বুঝি কবিত্ব বেমানান? আজকালকার কবিদের ও ধরনের পক্ষপাত নেই।”নেতাজী রোডে গাড়িটাকে জোর করে ছাড়িয়ে দিল সুপ্রীতি। বলল, “আর মিটার বাড়িয়ে লাভ নেই। এবার হেঁটে হেঁটে দেখতে দেখতে চল।”

পরিতোষ বলল, “ অন্য জিনিস দেখব কী। তোমাকে দেখেই কূল পাইনে।”

সুপ্রীতি মুখ টিপে হেসে বলল, “সত্যি?”

পরিতোষ বলল, সত্যি ছাড়া আর কী। এমন সাজ সেজে এসেছ যে চেনাই যায় না।”

সুপ্রীতি খুশি হয়ে বলল, “বাড়াবাড়ি কোরো না।”

ওরা প্রথমে নামজাদা দোকানের দামি জিনিসগুলি দেখতে লাগল। জিনিস দেখে চোখ লুব্ধ হয়, কিন্তু দাম শুনে সেই চোখই আবার কপালে ওঠে। সুপ্রীতি বলল, “অত দামি জিনিস কেনার দরকার নেই। তা ছাড়া দেখেনি আরও পাঁচটা দোকান। এত দামের জিনিস নেব, যাচাই করে নেব না?”

দেখতে দেখতে ওরা অপেক্ষাকৃত ছোট একটা দোকানে উঠল। চন্দ এন্ড কোম্পানি। কয়েকটা আলমারি ভালই দেখা গেল। বড় দোকানের অনুকরণে তৈরি হলেও জিনিস খারাপ নয়, দেখতেও বেশ সুন্দর। সেলসম্যান দাম বলল, আড়াইশো। আশ্চর্য, সুচিরার ঘরে যা দেখে এসেছে সুপ্রীতি, অবিকল সেই রকম। শুধু কোম্পানির নাম আলাদা। কত বেশি কমিশন চন্দ এন্ড কোম্পানি দিতে পারবেন তাই নিয়ে কথাবার্তা চলছে হঠাৎ পিছনের অফিস রুম থেকে স্যুটপরা সুদর্শন এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। বয়স পঁয়ত্রিশ ছত্রিশের বেশি নয়। ছিমছাম শৌখিন পুরুষ।

সুপ্রীতি তার দিকে চেয়ে একটুকাল অবাক হয়ে থেকে বলল, “ নির্মলদা তুমি এখানে?”

সেলসম্যান বলল, “ আমাদের বড়বাবু মিঃ চন্দ। ওঁদেরই তো কোম্পানি।”

সুপ্রিটি খুশিহয়ে বলল, “তাই বল!”

নির্মল বলল, “এবার আমি জিজ্ঞেস করছি, তুমি এখানে!”

সুপ্রীতি বলল, “আলমারি কিনতে। কিন্তু বড্ড বেশি দাম তোমাদের দোকানে।“

নির্মল স্মিতমুখে বলল, “ তা দাম তো একটু বেশি হবেই। জিনিস নেবে দাম দেবে না?”

নির্মল নিজেই যেচে পরিচয় করল পরিতোষের সঙ্গে। নিজেরও পরিচয় দিল। বলল, “সুপ্রীতি আমাদের অঙ্কের প্রফেসরের মেয়ে। অঙ্কের চেয়ে বেশি ভয় করতাম ওকে। এত উৎপাত করত। রাজসাহী শহর সুদ্ধ লোক ওর জ্বালায় অস্থির ছিল।”

জ্বালাটা কী রকমের, অস্থিরতাই বা কী ধরনের তা পরিতোষ নির্মলের মুখের দিকে চেয়ে অনুমান করার চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই পেরে উঠল না। নির্মলের মুখে হাসি, চোখে চাতুর্য। চেহারায় আভিজাত্য।

খানিকক্ষণ ধরে কুশল প্রশ্নের বিনিময় চলল। পরিতোষের কানে কয়েকটি অশ্রুতপূর্ব সর্বনাম। যে সঙ্কেত ভেদ করবার চাবি তার কাছে নেই। তারপর নির্মল জজ্ঞাসা করল, “কোন আলমারিটা তোমার পছন্দ তাই বল।” সুপ্রীতি উল্লাসের সুরে বলল, “পছন্দ তো সবগুলিই।”

নির্মল বলল, “বেশ তো সবই নাও। পাইকারি দরে দিতে পারব।”

পরিতোষ হাতঘড়ির দিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, “ আমার একটু তাড়া আছে। একটা আলমারিই নেব আমরা।”

নির্মল বলল, “বেশ তো।” কিন্তু মুশকিলের কথা হল, নির্মল কিছুতেই দাম নেবে না। সুপ্রীতি দামের কথা বলায় হেসেই উড়িয়ে দিল নির্মল। ধমকও দিল দুটো-একটা। পরিতোষের দিকে চেয়ে বলল, “ ওর বিয়ের সময় দেশে ছিলাম না। তখন কিছুই প্রেজেন্ট করতে পারিনি। আজ এটা ওকে দিলাম।”

সুপ্রীতি বলল, “না না সে কি হয়।”

নির্মল বলল, “ না হয় তোমার মাসিমার কাছে দাম দিয়ে এসো। আমি নিতে পারব না।” মাসিমা মানে নির্মলের মা। তিনি আজও বেঁচে আছেন। শেষ পর্যন্ত আলমারিটা বিনামূল্যেই সুপ্রীতিকে গছিয়ে দিল নির্মল। সুপ্রীতি একান্তে স্বামীকে বলল, “আচ্ছা দামটা আমরা অন্যভাবে শোধ করে দেব।”

পরিতোষ নিঃশব্দে রাস্তায় নেমে এল। ধার-করা টাকাগুলি এবার অনায়াসে শোধ দিতে পারবে। কিন্তু অত বড় আলমারিটা যে ঘরজুড়ে থাকবে তাকে ভুলবে কী করে?
রচনাকাল : জুলাই ১৯৫৬