Thursday, August 15, 2019

ইগনাজ ফিলিপ সেমলভাইস – যাঁর বৈপ্লবিক আবিষ্কার মেনে নেয়নি মানুষ


মীনা কার্টুনের সেই পর্বটার কথা মনে আছে? মীনা আলাদিনের জাদুর চেরাগের থেকে দৈত্য বের করে আনে। পরে তার কাছে তিনটা ইচ্ছাপূরণের কথা প্রকাশ করে। সবাই যেখানে ধন-দৌলত, প্রাসাদ-অট্টালিকা চায়; সেখানে আমাদের মীনা চেয়েছিলো সবার জন্যে নিরাপদ পানি আর পরিচ্ছন্ন ভাবে হাত ধোয়ার সুব্যবস্থা। তার ইচ্ছার কথা শুনে চেরাগের জ্বিনের চোখ কপালে উঠে গিয়েছিলো। এতো দামী দামী জিনিস রেখে সে এসব চেয়ে বেড়াচ্ছে কেন? পাগল নাকি! যদিও পরে মাথা চুলকাতে চুলকাতে জ্বিন মীনার ইচ্ছাগুলো ঠিকই পূরণ করে দিয়েছিলো।

মীনাকে চেরাগের জ্বিন বোকা ভাবলেও ঘটনা অন্তত আর আগে না বেড়ে সেই পর্যন্তই ছিলো। কিন্তু ইতিহাসে এমন এক ব্যক্তি আছেন, যিনি মানুষজনকে হাত ধোয়ার কথা বলায় তাঁকে সবাই পাগল ঠাওরেছিলো। তাঁর হাত ধোয়ার পরামর্শে কান না দিয়ে তাঁকে নিয়ে হাসাহাসি করেছিলো। তাঁর চাকরি চলে গিয়েছিলো। শেষে তাঁকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিলো পাগল হয়ে যাবার অভিযোগে। আর তাঁকে নিয়ে ট্রল করার মাঝের সময়টাতে সঠিকভাবে হাত না ধোয়ার কারণে মারা গিয়েছিলো আরো বহু মানুষ। আমাদের আজকের লেখাটা সেই ব্যক্তিকে নিয়ে। তাঁর নাম ‘ইগনাজ ফিলিপ সেমলভাইস’। জন্মসূত্রে তিনি হাঙ্গেরিয়ান। তাঁকে ধরা হয় মেডিকেলে সার্জারিতে এন্টিসেপ্টিক পদ্ধতি অনুসরণের পথিকৃৎ হিসেবে।



১৮৫০ সাল নাগাদ ইউরোপে সন্তান জন্মদানের অবস্থা খুব একটা সুবিধাজনক ছিলো না। সেখানকার চাইল্ড কেয়ার ক্লিনিকগুলোতে প্রায়ই Puerperal Fever নামক জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মা ও শিশুর মৃত্যু ঘটতো। এটাকে ‘চাইল্ডবেড ফিভার’ নামেও ডাকা হয়। সেই সময় যদি বাসাবাড়িতে ধাত্রীর মাধ্যমে সন্তান প্রসব করানো হতো, তবে হাজারে হয়তো ৫ জন মা মারা যেতেন। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে হাসপাতালে এই মৃত্যুর হার ছিলো আরো বেশি। প্রায় ১০-১৫ গুণ! কিন্তু কেন, সেই প্রসঙ্গে একটু পরেই আসছি।

আমাদের আলোচ্য ব্যক্তি ইগনাজ সেমলভাইস ১৮৪৬ সালে অস্ট্রিয়ার ভিয়েনায় এক জেনারেল হাসপাতালে প্রসূতি সেবা বিভাগের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। তাঁর অধীনে দু’টো ওয়ার্ড ছিলো। একটায় প্রফেশনাল ডাক্তাররা সেবা দিতেন, আরেকটায় ধাত্রীবিদ্যা জানেন কিন্তু ডাক্তারি ডিগ্রি নেই, এমন সাধারণ মানুষজন সেবা দিতেন। এই হাসপাতালগুলো খোলা হয়েছিলো মূলত পরিবার ও সমাজ যেসব মা ও সন্তানের দায়ভার নিতে চায় না (যেমন – যৌনকর্মী), তাদের কথা স্মরণে রেখে। তা না হলে ঐসময়ে সাধারণত বাড়িতে ধাত্রী ডেকে এনেই সন্তান প্রসব করানো হতো। এখন এদের মধ্যে যাদের পকেটের অবস্থা ভালো, তারা প্রথম ওয়ার্ডে সেবা নিতেন। আর যাদের বাচ্চা জন্মদানের খরচ বহন করার সামর্থ্য নেই, তারা যেতেন দ্বিতীয় ওয়ার্ডে।

কথা হলো, প্রথম ওয়ার্ডে রোগীদের চাইল্ডবেড ফিভারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার ছিলো ১০%। আর দ্বিতীয় ওয়ার্ডে এই মৃত্যুহার ছিলো ৪%। অর্থাৎ, যে ওয়ার্ডে প্রফেশনাল ডাক্তারেরা সেবা দিতেন, সেখানে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুহার ছিলো দুস্থ-গরীবদের জন্যে খোলা ওয়ার্ডের মৃত্যুহারের চেয়ে বেশি। সাধারণ ধাত্রীদের হাতে অনেক বেশি সংখ্যক শিশু সুস্থ শরীরে জন্ম নিয়ে মায়ের কোলে বাসায় ফিরে যাচ্ছিলো। প্র্যাক্টিক্যালি, প্রথম ওয়ার্ডে টাকা দিয়ে সন্তান প্রসব করানোর চেয়ে দ্বিতীয় ওয়ার্ডে বিনা পয়সায় সন্তান প্রসব করানো ভালো। আর সেটার থেকেও ভালো কোনো হাসপাতালে না গিয়ে রাস্তায় সন্তান প্রসব করালে!



“কি! হাসপাতালের দ্বিতীয় ওয়ার্ডে সিট খালি নাই!! ড্রাইভার সাব, আমাকে সাইডে চাপায়ে নামায় দ্যান। আমি রাস্তাতেই বাচ্চা প্রসব করাবো।”




যাই হোক, হাসপাতালের এই পরিসংখ্যানটা ঐ অঞ্চলের কমবেশি সকলেরই জানা ছিলো। ফলে সকলেই প্রফেশনাল ডাক্তারদের ওয়ার্ডে ভর্তি না হয়ে দ্বিতীয় ওয়ার্ডে ভর্তি হতে চাইতো। এতে করে এমেচার ধাত্রীদের সামনে পড়াশুনা জানা ডাক্তারদের ইজ্জতের ফালুদা হবার দশা হলো। ডিপার্টমেন্টের দায়িত্ব পেয়েই এই ব্যাপারটা নিয়ে কাজ শুরু করলেন সেমলভাইস। তাঁর নিজের ভাষ্যেই, “এই ব্যাপারটা এতো বেশি পীড়া দিচ্ছে যে, জীবনটাকে অর্থহীন মনে হচ্ছে।” তিনি দুই ওয়ার্ডকে পর্যবেক্ষণে রাখা শুরু করলেন। দুই ওয়ার্ডে যে সব ব্যাপারে পার্থক্য আছে, সেগুলো নোট করা শুরু করলেন।

এখন পর্যন্ত পার্থক্য এক জায়গাতেই। প্রথম ওয়ার্ডে প্রফেশনাল ডাক্তার, দ্বিতীয় ওয়ার্ডে সাধারণ ধাত্রীবিদ্যা জানা মানুষেরা। বেশি মানুষের জনসমাগমকে সেমলভাইস শুরুতেই বাদ দিয়ে দিলেন। কারণ দ্বিতীয় ওয়ার্ডে মানুষ বেশি ভর্তি হতে চাইতো। তাতে রোগীর সংখ্যা ছিলো অত্যধিক। কিন্তু মৃত্যুহার ছিলো ঐখানেই কম। সুতরাং এই পথে আগানো অর্থহীন। তাই তিনি অন্য সব দিকে পার্থক্য খুঁজে বেড়াতে শুরু করলেন। কিছুদিন বাদেই সেমলভাইস দেখলেন, প্রথম ওয়ার্ডে মায়েদের পিঠের উপরে ভর দিয়ে শুইয়ে সন্তান প্রসব করাচ্ছেন ডাক্তারেরা, যেখানে দ্বিতীয় ওয়ার্ডে ধাত্রীরা মায়েদের পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে সন্তান প্রসব করান। এটাই কি তবে কারণ হতে পারে? সেমলভাইস নির্দেশ দিলেন প্রথম ওয়ার্ডেও মায়েদের পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে সন্তান প্রসব করাতে। তাঁর কথা অনুযায়ী তাই শুরু করা হলো। কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করে ফলাফল পাওয়া গেলো শূন্য। চাইল্ডবেড ফিভারে মৃত্যুহার সেই একই। পাশ ফিরে শোয়া না শোয়ার সাথে এই জ্বরের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য!

তার কিছুদিন বাদে আরেকটা ব্যাপার নজরে পড়লো সেমলভাইসের। যখন কোনো রোগী মারা যেতেন চাইল্ডবেড ফিভারে, তখন হাসপাতালের চার্চের একজন যাজক সেই রোগীর বেডের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতেন। তার পেছন পেছন একজন অ্যাটেনডেন্ট হাতে ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে হাঁটতো। সেমলভাইস ভাবলেন, যাজককে দেখে এবং তার ঘণ্টার শব্দ শুনে রোগীরা কি আঁতকা ভয় পেয়ে উঠে নাকি, যাতে গায়ে জ্বর চলে আসে আর রোগী মারা যায়? কোনো কারণে প্রথম ওয়ার্ডে বেশি রোগী মারা যাওয়ায় যাজক বেশিবার এসেছিলেন ওখানে। তাকে দেখে এবং ঘণ্টার শব্দ শুনে আরো বেশি রোগী মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে গেছে। ফলে চেইন রিঅ্যাকশনে আরো বেশি রোগী মারা গেছে। ব্যাপারটা কি এমন? এই সব আবোলতাবোল ভেবে তিনি যাজককে বললেন, রোগী মারা গেলে হাসপাতালের ভিতর দিয়ে তিনি যাতে অন্য পথ ধরে হাঁটেন। যাজক তাই শুরু করলেন। কিছুদিন পরে দেখা গেলো এতেও ফলাফল শূন্য। জ্বর আসা না আসার পেছনে যাজক এবং তার ঘণ্টার কোনো প্রভাব নেই। এই জ্বর পুরা নাস্তিক, যাজক এবং তার ঐশ্বরিক ঘণ্টার বাজনাকে ভয় পায় না!

এই পর্যায়ে সেমলভাইসের মেজাজ পুরো বিলা হয়ে গেলো। হতাশায় তিনি কিছুদিন ছুটি কাটাতে চাইলেন। ছুটি নিয়ে চলে গেলেন তিনি ভেনিসে। বেশ দীর্ঘ একটা ছুটি কাটিয়ে যখন তিনি হাসপাতালে ডিউটিতে ফিরলেন, তখন কানে এলো একটা দুঃসংবাদ। তাঁর এক কলিগ, যিনি ছিলেন প্যাথলজিস্ট, অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন। জ্বর হয়েছিলো তার। ঐ সময়ে প্যাথলজিস্টদের জ্বরের ফলে মৃত্যু সংবাদ একটু বেশিই নিয়মিত ছিলো। প্যাথলজিস্ট সমাজের সদস্যদের জ্বরের কারণে মৃত্যুর খবর বেশ ঘনঘন পাওয়া যেতো। সেমলভাইসের কলিগ একটা লাশের অটোপসি করার সময়ে সুঁইয়ের খোঁচা খেয়েছিলেন আঙ্গুলে। এরপরে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মারা যান।

সেমলভাইস তাঁর সেই কলিগের জ্বরের লক্ষণগুলো ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করলেন। করে দেখলেন, হাসপাতালের গর্ভবতী মায়েদের মতো তাঁর কলিগও ঠিক একই জ্বরে মারা গেছেন। এইটাই ছিলো পুরো ঘটনার মোড় ঘুরে যাওয়ার সূত্রপাত। সেমলভাইস হাইপোথিসিস দাঁড় করালেন যে, কেন প্রথম ওয়ার্ডে প্রফেশনাল ডাক্তারদের হাতে অনেক বেশি পরিমাণে রোগী মারা যাচ্ছে! কারণ প্রথম ওয়ার্ডের ডাক্তারেরা প্রায়ই লাশের অটোপসি করেন, যেটা দ্বিতীয় ওয়ার্ডের ধাত্রীদের করতে হয় না। তার মানে লাশের শরীরে এমন কিছু বিষাক্ত পদার্থ থাকতে পারে, যেগুলো অটোপসি করা ডাক্তারদের হাতে করে চলে যাচ্ছে মায়েদের শরীরের ভেতরে। পরে তাদের শরীরে বিষক্রিয়া ঘটিয়ে আনছে জ্বর। তাতে মারা যাচ্ছেন মায়েরা। সেমলভাইস এই বিষাক্ত পদার্থগুলোর নাম দিলেন ‘Cadaverous Particles’ বা শব কণা। (বর্তমানে এই রোগের জন্যে দায়ী করা হয় ‘Group A hemolytic streptococcus’ জীবাণুদের)



Group A hemolytic streptococcus




তিনি নির্দেশনা জারি করলেন, ডাক্তারেরা যাতে ক্লোরিন দিয়ে ভালোমতো হাত এবং সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি ধুয়ে তারপরে মায়েদের সন্তান প্রসব করান। এখন পর্যন্ত ক্লোরিন সেরা জীবাণুনাশকগুলোর মধ্যে একটা। কিন্তু সেমলভাইসের সময়ে তিনি কিংবা অন্য কোনো মানুষ জীবাণুর ব্যাপারে তেমন জানতেন না। সেমলভাইসের স্রেফ মনে হয়েছিলো, হাত থেকে লাশের গন্ধ দূর করতে ক্লোরিন বেশ ভালো এক পরিষ্কারক পদার্থ। তাই তিনি সবাইকে ক্লোরিন দিয়ে হাত এবং সার্জিকাল যন্ত্রপাতি ধোবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। এই নির্দেশনা পালন শুরু হবার পরেই নাটকীয়ভাবে প্রথম ওয়ার্ডে রোগীদের মৃত্যুহার কমে গেলো।

কিন্তু ঘটনা প্যাঁচ লাগতে শুরু করলো অন্য দিক দিয়ে।

ঘটনার কারণ উপলব্ধি করে সকলের বিস্ময়ে চোখ বড় হয়ে যাবার বদলে ডাক্তারদের মেজাজ পুরো বিলা হয়ে গেলো। তাদের মনে হলো, যে ডাক্তারেরা জীবন বাঁচান তারাই রোগ ছড়িয়ে রোগীদের মারছেন, এমনটাই উপস্থাপন করা হচ্ছে জনসমাজে। ফলে সেমলভাইসের ধারণার বিপরীতে তীব্র প্রতিরোধ আসা শুরু করলো। ‘চার্লস ডেলুসেনা মেইগস’ নামের আরেক ডাক্তার ঘোষণা করলেন, কোনো ডাক্তার হাত ধুবে না। ডাক্তারেরা হচ্ছেন ভদ্রলোক। আর ভদ্রলোকদের হাতে ময়লা থাকে না।



“এই দেখেন! আমি জেন্টেলম্যান। আমার হাত আমি সবসময় বগলে ঢুকিয়ে রাখি। আমার হাতে কোনো ময়লা নাই।” – ডেলুসেনা মেইগ




মেইগসের গলার সুরে সুর মিলিয়ে এগিয়ে এলেন অন্য ডাক্তারেরাও। তারা কেউ হাত ধুবেন না। হাত না ধুয়েই তারা প্রসূতিদের সেবা দিবেন। ডাক্তারদের হাত ধোয়া মানে তারাই যে জ্বর ছড়াচ্ছে, সে কথা স্বীকার করে নেওয়া। এটা হতে দেয়া যাবে না। ডাক্তার মেইগের সাথে ‘জোহান ক্লাইন’ নামের আরেক ডাক্তার এসে যোগ দিলেন। এই দু’জনের তীব্র বিরোধিতার মুখে চাকরি চলে গেলো ডাক্তার সেমলভাইসের। তিনি ভিয়েনা ছেড়ে চলে গেলেন বুদাপেস্টে।

এরপরেও কয়েকবার তিনি বিভিন্ন হাসপাতালে চাকরির জন্যে আবেদন করেছিলেন। তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়েছিলো তাঁকে। ১৮৫১ সাল নাগাদ ‘যেইন্ট রোকুস’ হাসপাতালে বিনা বেতনে হেড ফিজিশিয়ানের দায়িত্ব নেন তিনি। সেখানেও ভীষণ চাইল্ডবেড ফিভারের সমস্যা ছিলো। সেমলভাইসের ক্লোরিন দিয়ে হাত ধোয়ার থেরাপিতে আশাতীত ফলাফল পাওয়া যায়। সেখানেও মায়েদের মৃত্যুহার হ্রাস পায়। তাঁর কাজের রিপোর্ট চলে যায় উপর মহলে। তারা যথারীতি খিক খিক করে হেসে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেন সেই সব রিপোর্ট। কেউ মানতেই চাননি ডাক্তারদের হাতের মাধ্যমে প্রসূতি মায়েদের শরীরে জ্বর ছড়ানোর ব্যাপারটা।

কয়েকটা পেপারও লিখেছিলেন সেমলভাইস তাঁর আবিষ্কৃত এই ব্যাপারটা নিয়ে। কিন্তু তাঁর পেপারের বিপরীতে পালটা পেপার লিখে হাত ধোয়ার ব্যাপারটাকে নাকচ করে দেন অনেকে। এর মধ্যে উপরে উল্লিখিত ডাক্তার ডেলুসেনা মেইগসও আছেন। পুরো ডাক্তার সমাজে হাসির পাত্র হয়ে উঠেন সেমলভাইস। ফেসবুক, ইন্টারনেট থাকলে হয়তো তাঁকে নিয়ে হাস্যকর সব মিম (Meme) বানানো হতো। বিভিন্ন পেইজে কুটি কুটি লাইক কামাতো সেই সব মিম (কারণ অধিকাংশ মানুষ বৈপ্লবিক চিন্তার বিপরীতে গিয়ে গতানুগতিক ধারায় থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, তা সেটা যতই সত্য কথা হোক না কেন)।



“হাত ধুতেই থাকো, ধুতেই থাকো……”




এই বৈপ্লবিক আবিষ্কারের মাত্র এক যুগের মাথায় সেমলভাইস পুরো হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। তিনি মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়লেন। নিয়মিত হারে যৌনকর্মীদের সাথে সময় কাটাতে শুরু করলেন। প্রায়ই মাতাল হয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ডাক্তারদের “কসাই, জানোয়ার, অশিক্ষিত গণ্ডমূর্খের দল” বলে গালাগাল করতেন। তাঁর পরিবারের লোকজনও তাঁর এই মেন্টাল ব্রেক ডাউনে অস্থির হয়ে পড়লো। তারা ১৮৬৫ সাল নাগাদ ভিয়েনার এক মানসিক হাসপাতালে চিঠি লিখলো সেমলভাইসের মানসিক অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে। সেই হাসপাতালের প্রধান ডাক্তার ফার্দিনান্দ রিটার ভন হেবরা এসে সেমলভাইসের সাথে পরিচিত হলেন। তাঁকে ভিয়েনার মানসিক হাসপাতালটা ঘুরিয়ে দেখাবার জন্যে সাথে যাবার আমন্ত্রণ দিলেন। সেমলভাইস খুশি মনেই রওনা হলেন তার সাথে। ১৮৬৫ সালের ৩০ জুলাই উপস্থিত হলেন সেখানে। কিন্তু সেখানে নিয়েই আটকে ফেলা হলো তাঁকে। এরপরে শুরু হলো পাগলের চিকিৎসা, হাত-পা বেঁধে শক্ত করে মার দেয়া। হ্যাঁ, সেই আমলে ইউরোপের মানসিক হাসপাতালগুলো “মাইরের উপরে ভাইটামিন নাই” নীতিতেই চলতো।

মাত্র দুই সপ্তাহের মাথায়, ১৮৬৫ সালের ১৩ আগস্ট মারা যান সেমলভাইস। মারা যাবার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় শক্ত মারের কারণে শরীরে বেশি ভিটামিন ঢুকে যাওয়াকে (সারকাজম এলার্ট)! দু’দিন বাদে ১৫ আগস্ট সমাহিত করা হয় তাঁকে ভিয়েনাতে।

সেমলভাইসের ১৮৪৫ সালে আবিষ্কৃত হাত ধোয়ার ধারণা যে কতোটা যুগান্তকারী ছিলো, সেটা বুঝতে আরো বহু বছর সময় লেগেছিলো মানুষের। লুই পাস্তুর এবং তাঁর প্রকাশিত জার্ম থিওরিকে প্রয়োজন পড়েছিলো মানব সভ্যতার, বিশেষত ডাক্তারদের, সেমলভাইসের হাত ধোয়ার ধারণাটাকে হজম করতে। কিন্তু যতদিনে তারা উপলব্ধি করেছিলো সত্যটা, ততদিনে সেমলভাইসকে পাগল বানিয়ে দুনিয়া থেকে বিদেয় করে দেয়া হয়েছে। অস্ট্রিয়া এবং হাঙ্গেরিতে বর্তমানে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয় ডাক্তার সেমলভাইসকে। সেই সাথে তাঁকে অভিহিত করা হয় “Saviour of Mothers” নামে।



যেইন্ট রোকুস হাসপাতালের সামনে প্রতিস্থাপিত ডাঃ সেমলভাইসের মূর্তি


উৎস ঃ https://bigganjatra.org/ignaz_philipp_semmelweis/



Friday, August 2, 2019

কেমন গ্রহে প্রাণ থাকতে পারে?


নতুন একটা গবেষণা থেকে বলা হচ্ছে, আমাদের ছায়াপথ অর্থাৎ আকাশগঙ্গাতেই থাকতে পারে ১০ কোটি প্রাণসমৃদ্ধ গ্রহ। আজ থেকে কত কত বছর আগে, কার্ল সেগান তার “কসমস” বই আর টিভি সিরিজের মধ্যে একটা চমৎকার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন – চিন্তা করলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে যায়! সম্প্রতি এ জাতীয় গবেষণাগুলো করা হচ্ছে আরো বর্ণনামূলকভাবে, আরো গাণিতিকভাবে। আসুন, আজ কিছু গবেষণার কথা জানি, কিছু মজার বিষয় শিখি।

Habitability Index


ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস, এল পাসো- এর শিক্ষক ডঃ লুইস আরউইন, তার কলিগদেরকে নিয়ে গ্রহগুলোর জন্য একটা ইনডেক্স তৈরি করেছেন। ইনডেক্সের মধ্যে ফ্যাক্টরগুলো হচ্ছে গ্রহের তাপমাত্রা, কক্ষপথ, বাহ্যিক ও রাসায়নিক গঠন, ইত্যাদি। ইনডেক্সের রেঞ্জ হচ্ছে শূন্য থেকে এক। এক মানে সেইরকম, শূন্য মানে “ম্যাহ”!

এই ইনডেক্স কোনো এলিয়েন অনেকদূর থেকে ফলো করলে পৃথিবী পাবে ০.৯৭, একের অনেক কাছাকাছি। ডঃ লুইস আরউইন কিন্তু পৃথিবীতে বসে একটা গ্রহকে একদম গোটা ১ দিয়ে ফেলেছেন, ওটার নাম Gliese 581c

Goldilock Zone


জীবনধারণের জন্য পানি লাগে, তাই গ্রহের অবস্থান হতে হবে এমন যাতে নক্ষত্রের বেশি কাছাকাছি না হয়, তাহলে পানি বাষ্প হয়ে যাবে। আবার যাতে বেশি দূরেও না হয়, নইলে পানি বরফ হয়ে যাবে। গ্রহকে থাকতে হবে একটা সুবিধাজনক “গোল্ডিলক জোন” এর মধ্যে। পৃথিবী, এমন একটি গ্রহ। এটা একটা ক্রাইটেরিয়া। এমন আরো কিছু বৈশিষ্ট্য আছে।

২০১৪ এর আগস্টে, দ্যা এস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল লেটারসে একটা আর্টিক্যাল ছাপা হয়েছিলো। সেখানে ফার্স্ট অথর জ্যাকলিন ফ্যাহারটি বলেছেন, মাত্র ৭ আলোকবর্ষ দূরে একটা ব্রাউন ডোয়ার্ফ গ্রহ পাওয়া গেছে। গ্রহটার near-infrared image আর্টিক্যালে দেখানো হয়েছে। এই আর্টিক্যালের abstract এর শেষ লাইনে বলা হচ্ছে, আমাদের সৌরজগতের বাইরে জলীয়বাষ্পের মেঘযুক্ত গ্রহের সরাসরি প্রমাণের জন্য এটাই প্রথম ক্যান্ডিডেট। এর আগে বায়ুমণ্ডলে পানির উপস্থিতি পাওয়া গেছে, কিন্তু পানির মেঘ এই প্রথম। চিলির লা কাম্পানা অবজার্ভেটরীর সাড়ে ৬ মিটার মেগেল্যান টেলেস্কোপ দিয়ে প্রাপ্ট ডেটা থেকে এই আর্টিক্যাল লেখা হয়েছিলো।

২০০৯ সাল থেকেই নাসা’র কেপলার স্পেস টেলিস্কোপ পৃথিবীর জমজ ভাই খুঁজে বেড়াচ্ছে সৌরজগতের বাইরে। ২৩ জন সায়েন্টিস এর এক টীম, এমনই এক গ্রহের আবিষ্কার নিয়ে একটা সায়েন্টিফিক আর্টিক্যাল পাবলিশ করেছিলেন ২০১৪ সালে।

গোল্ডিলক জোনের মধ্যে থাকলেই যে বসবাসযোগ্য হবে, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। আর এটা ঠিক পৃথিবীর জমজ ভাই না, চাচাতো ভাই বলতে পারেন। আছে বেশ কিছু মিল, কিন্তু একদম এক বাপ-মায়ের সন্তান না, এই আর কী!

গোল্ডিলক জোনের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া আরেকটা গ্রহ হচ্ছে কেপলার ১০-সি। বিজ্ঞানীরা এটাকে আদর করে ডাকছেন গডজিলা প্ল্যানেট। কারণ, এর ব্যস ২৯,০০০ কিলোমিটার, পৃথিবীর চেয়ে ২.৩ গুণ বেশি। এটা পৃথিবীর চেয়ে ১৭ গুণ ভারী। এটা যে নক্ষত্রকে কেন্দ্র করে ঘোরে, সেটা বিগ ব্যাং এর মাত্র ৩ বিলিয়ন বছর পরেই তৈরি হয়েছিলো। অর্থাৎ, বিজ্ঞানীরা এখন অনেক পুরনো নক্ষত্রের সোলার সিস্টেমের মধ্যেও বাসযোগ্য গ্রহ বা প্রাণের সন্ধান চালাতে পারেন।

আমাদের সূর্যের বেশ কাছাকাছি আছে আরেকটা নক্ষত্র, আলফা সেন্টোরী বি। এবং তার দখলে আছে একটা বাসস্থান হিসেবে চরম একটা গ্রহ, এইরকম একটা সম্ভাবনার কথা বলছেন গবেষকরা। নিচের ছবিতে এদের রিলেটিভ সাইজ দেয়া আছে।


01. Science

Image Source – http://bit.ly/1hezNd0




পৃথিবীর মত দ্বীপ, অগভীর সাগর, মোটামুটি সমতল ঢাল আছে, এমন গ্রহকে বলে সুপারহ্যাবিটেবল প্ল্যানেট। আলফা-সেন্টোরি বি এর দখলে থাকা গ্রহটা এমন এক সুপারহ্যাবিটেবল প্ল্যানেট। এই নতুন গ্রহের এমন সবকিছুই থাকার কথা, যেখানে প্রাণধারণ সম্ভব। শুধু সমস্যা একটা, এটার অভিকর্ষ এক চতুর্থাংশ বেশি হবে। হলো না হয়, সমস্যা নেই……… আরো ডিটেইলস ভালোভাবে পাওয়া গেলে জটিল হতো! বিজ্ঞানীরা সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০১৭ সালে, নাসা TESS নামে একটা স্যাটেলাইট ছাড়ার প্ল্যান করছে যার কাজই হবে গ্রহ সন্ধান করা। এটা আমাদেরকে সৌরজগতের বাইরের এই এক্সোপ্ল্যানেটগুলোর আকার, ভর, বায়ুমণ্ডল নিয়ে আরো ভালো তথ্য দিতে পারবে। ২০১৬ সালে, জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ চালু করা হবে। নাসার মতে, এটা আমাদেরকে অন্য গ্রহের রঙ, ঋতু, আবহাওয়া, এমনকি উদ্ভিদের উপস্থিতির ব্যাপারেও অভাবনীয় তথ্য দিতে পারবে।

২০০৯ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত, কেপলার মিশনের মাধ্যমে আবিষ্কৃত যেসব গ্রহকে পৃথিবীর মাসতুতো ভাই বলা হচ্ছে, তার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪,৬৯৬টিতে। এগুলোতে প্রাণ সত্যিই আছে কিনা, সেই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, “আমরা এখনো ওদের কাছ থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাইনি”……… দেখি কোনো দিন পাই কিনা।

 

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/possible_habitable_planets/

Thursday, August 1, 2019

বিশ্বে মার্কেজ একজনই ।। হাসান আজিজুল হক


মার্কেজের বই প্রথম পাই সত্তরের দশকের শেষের দিকে। আমরা তখন বই অনেক পরে পেতাম, অনেক দেরিতেই আসত এবং এটা লজ্জাকরও বটে আমাদের জন্য। মার্কেজের প্রথম যে বইটা পাই, তার নাম ‘ক্রনিকল অব এ ডেথ ফোরটোল্ড’। মনে হয় যেন খবরের কাগজের একটা খবর। একটা খবরকে যে উপন্যাসের রূপ দেয়া যেতে পারে ‘ক্রনিকল অব এ ডেথ ফোরটোল্ড’-ই তার প্রমাণ। একজনের মৃত্যু হবেই হবে অর্থাৎ এটি একটি পূর্বনির্ধারিত মৃত্যুর ঘটনা। সে এক অদ্ভুদ বই। মার্কেজের লেখা প্রথম পড়া বই এটি। যতদূর মনে পড়ে, বইটি আমি পড়েছিলাম সত্তরের শেষের দিকে।

‘ক্রনিকল অব এ ডেথ’ বইটি পড়ার পরপরই আমি ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচ্যুট’ (নিঃসঙ্গতার এক শ বছর) বইটি পড়ি। এটি আমার পড়া মার্কেজের সেরা উপন্যাস। অসাধারণ এক উপন্যাস, বেশ বড় লেখা। নিঃসন্দেহে বলা যায়, বইটি পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখবে, একই সঙ্গে কত জিনিস যে এক বইয়ের ভেতর পাইয়ে দেবে, সে কল্পনা করা যায় না। লাতিন আমেরিকান তথা কলাম্বিয়ান সমাজ, আদিবাসীদের জীবনা-যাপন, জীবন ব্যবস্থা ইত্যাদি উঠে এসেছে এ বইয়ে।


কলাম্বিয়ার সমুদ্র তীরবর্তী একটি গ্রামের নাম মাকান্দো। সেখানে মার্কেজের নানা বাড়ি। ওই অঞ্চলে নানা-নানির কাছেই মার্কেজ বড় হয়েছেন। তার নানা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসার ছিলেন।

লাতিন আমেরিকার সমাজ ব্যবস্থা অনেকটা আমাদের ভারতবর্ষের মতো— ইউরোপ আমেরিকার সঙ্গে মিলবে না। স্প্যানিশ জগৎ আলাদা। সেটা আমি সারভান্তেস পড়ে বুঝেছি। এটা জার্মানি, ইংল্যান্ড বা ইতালির মতো নয়। অনেকাংশেই আমাদের মতো। নানা-নানি, দাদা-দাদির কাছে সন্তান রেখে মানুষ করা ইত্যাদি আমাদের মতো তাদেরও ছিল।

যাহোক, তিনি নানির কাছে মানুষ হওয়ার সময় নানি তাকে নানা গল্প বলতেন। গল্পগুলো এমনভাবে বলতেন যে, সত্য মিথ্যার কোনো প্রভেদ থাকত না। আর নানা রকম প্রবচন— যেমন আমাদের দেশে আছে— দুপুরবেলা কাক ডাকলে সেটা অশুভ, দুই শালিক দেখলে শুভ, জলভরা পাত্র দেখা ভালো, জলশূন্য পাত্র দেখা মানে যাত্রা অশুভ ইত্যাদি। এরকম কথাবার্তা গ্রামে প্রচলিত আছে। এসব বৈজ্ঞানিক কথা নয়। তবে মানুষ বিশ্বাস করে। এরকম প্রবচন-কুসংস্কার ইত্যাদিতে ভর্তি ছিল মার্কেজের নানির মাথা। তিনি সেগুলো ব্যবহার করতেন।


আগেই বলেছি স্প্যানিশ জগৎ একটু আলাদা। নানি বলতেন, আমার স্বামী কত নারীর সংসর্গে যে গিয়েছেন এবং তাদের প্রত্যেকের ঘরেই অন্তত একটি করে ছেলে হয়েছে। এসব ছেলেরাও তো এ বংশেরই ছেলে। (স্প্যানিশ ওয়ার্ল্ডের যৌনতা একটি স্বাভাবিক উন্মুক্ত বিষয়। পুরুষরা এ সুবিধা পুরোমাত্রায় ভোগ করে। নারীরাও করে, তবে পুরষদের মতো নয়।) তো মার্কেজের নানি তাঁর স্বামী সম্পর্কে এসব গল্প করতেন। মার্কেজ এসব গল্পই তাঁর নানির বলা ভঙ্গিতেই ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিচ্যুট’ উপন্যাসে তুলে ধরেন। উপন্যাসের শেষে দেখা যায় মাকান্দোতে সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন।

কিউবায় যেমন প্রচুর আখ হয় তেমনি কলাম্বিয়াতেও প্রচুর আখ হতো। মাকান্দোতে ছিল বিশাল ইক্ষুমাঠ। সেখানে একবার আখশ্রমিকরা বিদ্রোহ করে। এতে অংসখ্য শ্রমিককে হত্যা করা হয়। ইতিহাসে এসব চাপা পড়ে যায়। ইতিহাস আর কথা বলে না। ইতিহাস যখন কথা বলে না তখন সেটা সমাজের নিস্তব্ধতা। ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অব সলিচ্যুট’ হচ্ছে শতবছরের নিস্তব্ধতা। যেমন অসাধারণ নাম তেমনই অসাধারণ লেখা। এখন তো এই বইয়ের বাংলা অনুবাদ পাওয়া যায়। জি এইচ হাবিবের অনুবাদটা মন্দ হয়নি। রাম শরণের অনুবাদটাও বেশ ভালো।

আমি মার্কেজের এই বইটি পড়েছি। ‘ক্রনিকল অব এ ডেথ ফোরটোল্ড’ পড়েছি। তারপর ‘লিফস্টর্ম’ (Leaf Storm—1955) পড়েছি। ‘ইন ইভিল আওয়ার’ (In Evil Hour—1962), পড়েছি এবং তার আত্মজীবনী ‘লিভিং টু টেল দ্য টেল’ (Living to Tell the Tale—2002), ‘নিউজ অব এ কিডনাপিং’ (News of a Kidnapping — 1996), ‘মেমোরিজ অব মাই মেলানকলি হোরস’ (Memories of My Melancholy Whores — 2004), ‘দ্য জেনারেল ইন হিজ ল্যাবিরিন্থ’ (The General in His Labyrinth —1989), তারপর ‘লাভ ইন দ্য টাইম অব কলেরা’ (Love in the Time of Cholera—1985) পড়েছি। এটি মার্কেজের আরেকটি বিখ্যাত উপন্যাস। ‘দি ইনক্রেডিবল এন্ড স্যাড টেল অব ইননোসেন্ট এরেন্দিরা এন্ড হার হার্টলেস গ্রান্ডমাদার (The Incredible and Sad Tale of Innocent Erendira and Her Heartless Grandmother — 1978), কালেক্টেড স্টোরিজ (Collected Stories—1984) প্রভৃতি গল্প, ছোটগল্পও পড়েছি। অর্থাৎ মার্কেজকে আমি বেশ ভালো করেই পড়েছি, যদিও অনুবাদে পড়েছি।

মার্কেজ প্রসঙ্গে অনেকেই ম্যাজিক রিয়ালিজমের কথা বলেন। সৃজনশীল সাহিত্যে আমি কোনো রকম ইজম বা মতবাদের পক্ষপাতী না। আমি মনে করি যে, ইজম করে কেউ কোনোদিন লেখক হয় না। মার্কেজ কখনোই নিজেকে ম্যাজিক রিয়ালিস্ট বলে দাবিও করেন নাই।

‘দি ফ্রাগ্রেন্স অব গুয়েভা’ (The Fragrance of Guava—1982) —পেয়ারার সুবাস বলে একটা বই আছে। সেখানে তিনি বলেছেন, আমার নানি-দাদিরা যেভাবে গল্প বলতেন আমিও সেভাবেই বলি, এটা ম্যাজিক রিয়ালিজম কী-না জানি না। আপনি যদি মনে করেন, আপনার নানি-চাচিরা যেভ‍াবে গল্প করেন আপনিও সেভাবেই লিখবেন। এটা হতেই পারে। আমি যেমন অনেকটা ‘আগুনপাখি’-তে করেছি। কিন্তু তাই বলে তো আর ‘আগুনপাখি’ মার্কেজ প্রভাবিত নয়। কিন্তু এক ধরনের ম্যাজিক রিয়ালিস্ট তো বটেই। লাতিন আমেরিকার অন্যদের লেখায়ও তো ম্যাজিক রিয়ালিজম আছে। কিন্তু তারাও তো মার্কেজের মতো নন। অর্থাৎ লাতিন আমেরিকার ম্যাজিক রিয়ালিজমও এক রকম নয়। যেমন ম্যাক্সিকান সাহিত্যের প্রধান পুরুষ হুয়ান রুলফোর পেদ্রো পারামো-তেও তো ম্যাজিক রিয়ালিজম আছে। আবার মারিও বার্গাস য়োসাকেও তো বলা হয় ম্যাজিক রিয়ালিস্ট। যারা সমালোচক তারা এসব তত্ত্ব আবিষ্কার করে। আর নতুন প্রজন্মের যারা লেখক হচ্ছেন, তারা এসব পড়ে উত্তেজিত হয়। কিন্তু এসব তত্ত্বে উত্তেজিত বা বিভ্রান্ত হওয়া যাবে না, উত্তেজিত হলেই বরং লেখার ক্ষতি। ম্যাজিক রিয়ালিজম নিয়ে আমি কখনই হৈ-হল্লা করিনি। তবে এর একটা জোরজবরদস্তি প্রভাব অনেকের মধ্যেই পড়েছে। যেমন শহীদুল জহিরের একটি উপন্যাসে উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে, একজন বেশ্যার দুজন লোকের উপর রাগ ছিল। সে তাদের বলল যে, ভাই আমাকে নৌকায় নিয়ে চলো। তারপর সে নৌকাতে ওই দুজনের সঙ্গে এমন রমণক্রিয়ায় মত্ত হলো যে শেষ পর্যন্ত ওই দুজনের মৃত্যুই ঘটল। আমি বলেছি, এগুলো বেশ কষ্টকল্পিত। এ ধরনের লেখা বাঙালি লেখকদের পক্ষে সম্ভব না। সৈয়দ শামসুল হক বা এমন অনেকেই বলছেন, এগুলো নিয়ে মাতামাতির কোন অর্থ হয় না। এগুলো বাংলা সাহিত্য কেন সব সাহিত্যেই বহুকাল ধরে আছে।

কিন্তু মার্কেজ ম্যাজিক রিয়ালিজমেই ফুরিয়ে যান না। তার প্রত্যেকটি গল্প, প্রত্যেকটা চরিত্রের প্রতীকী মূল্য আছে। এজন্যই মার্কেজ এত বিখ্যাত। দুখিনী এরেন্দিরা বারবার ধর্ষিত হচ্ছে এটা যেন সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসনে লাঞ্ছিত দেশমাতৃকারই প্রতিচ্ছবি। আমার ‘সাবিত্রী’ উপাখ্যানেও এরকম চিত্র আছে। মার্কেজের মৃত্যুতে আমার মনে হলো যেন একটা ইন্দ্র পতন হলো, আকাশ থেকে একটা জ্যোতিষ্ক যেন খসে পড়ল। কিন্তু স্বান্ত্বনার বিষয় হলো এই যে মৃত্যুর সময় বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর, এই বয়সে এসে তার বিশ্বকে নতুন কিছু দেওয়ারও ছিল না।

মার্কেজের সাহিত্য আমাদের সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে সত্য কিন্তু যেভাবে প্রভাবিত করেছে তার ধরনটি আমার কাছে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয়নি। আমি মনে করি যে পৃথিবীতে কোনো দুজন লেখক এক রকম নন— যদি তিনি প্রকৃত লেখক হন। আবার ইচ্ছে করলেও দুজন লেখক এক রকম হতে পারেন না, হওয়া যায় না। পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ থেকে প্রত্যেকটা মানুষ আলাদা। পৃথিবীতে দুজন মানুষ অবিকল এক রকম পাওয়া যায় না। এটা হয় স্রষ্টার অক্ষমতা না হয় তিনি চান না যে দুজন এক রকম হোক। লেখকরাও তো ওই রকম স্রষ্টা, তারা যেসব সন্তান উৎপাদন করবে তা তো হুবহু হওয়ার কথা নয়। সুতরাং যারা একজন লেখকের সঙ্গে আরেকজনের তুলনা করেন, তারা হয় বোকা না হয় মুর্খ।

অতএব বিশ্বে মার্কেজও একজনই। কেউ চেষ্টা করলেও আরেকজন মার্কেজ হতে পারবেন না

নদীতে - গী দ্য মোপাসাঁ


মূল: গী দ্য মোপাসাঁ
অনুবাদ :  শামসুজ্জামান হীরা

গত গ্রীষ্মে আমি প্যারি থেকে বেশ কয়েক লিগ (প্রায় সাড়ে চার কিলোমিটারে ফরাসি এক লিগ -- অনুবাদক) দূরে সিন নদীর পাড়ে ছোট্ট একটা গ্রামীণ কুটির ভাড়া নিয়েছিলাম। প্রতিসন্ধ্যায় সেখানে যেতাম ঘুমানোর জন্য। কিছুদিনের মধ্যেই আমার প্রতিবেশীদের মধ্য থেকে ত্রিশ-চল্লিশ বছর বয়সের একজনের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। সে ছিল নিঃসন্দেহে আমার দেখামতে সবচেয়ে অদ্ভুত প্রকৃতির একজন মানুষ। এক পুরনো নৌচালক এবং নৌচালনায় বাতিকগ্রস্ত। সবসময় থাকত জলের ধারে, জলের ওপর, বা জলের মধ্যে। খুবসম্ভব নৌকাতেই তার জন্ম হয়েছিল এবং আখেরে নির্ঘাত সে মারাও যাবে নৌকাতেই!


এক সন্ধ্যায় যখন আমরা সিন নদীর পাড় ধরে হাঁটছিলাম, আমি তাকে তার জীবনে নদী নিয়ে কিছু অভিজ্ঞতার গল্প বলতে বললাম। চমৎকার লোকটি তৎক্ষণাৎ বেশ উদ্দীপ্ত হল, তার পুরো অভিব্যক্তিতে এল পরিবর্তন, সে হয়ে উঠল প্রগলভ, প্রায় কবিসুলভ। তার হৃদয় জুড়ে ছিল প্রবল আবেগ; এক সর্বগ্রাসী, অনিবার আবেগ — আর তা নদীকে নিয়ে।

আহ্, সে আমাকে বলল, কত স্মৃতিই না আমার আছে নদীকে ঘিরে, যা তুমি দেখছ, বয়ে চলেছে আমাদের পাশ দিয়ে। তোমরা যারা শহুরে কিছুই জান না নদী সম্পর্কে। কিন্তু একজন জেলের কাছ থেকে শোনো কী অর্থে সে ‘নদী’ এই শব্দটাকে বোঝে। তার কাছে এটা একটা রহস্যময় বস্তু, বিশাল, অজ্ঞাত, আলেয়া ও অলীক কল্পনার এক জগৎ, যেখানে কেউ রাতে যা দেখে আদপে তার কোন অস্তিত্ব নেই, যে শব্দ শোনে তা বাস্তবে শোনা যায় না; কেন, তা না-বুঝেই গায়ে কাঁটা দেয়, যেমন গোরস্থানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ঘটে — এবং এটা আসলেই তো সবচেয়ে ভয়াল গোরস্থানগুলোর একটি, যেখানে নেই কোনও সমাধিস্তম্ভ।

নদীর নৌচালকের কাছে স্থলভাগকে মনে হয় সীমাবদ্ধ, এবং অন্ধকার রাতে যখন আকাশে থাকে না চাঁদ, নদীকে মনে হয় সীমাহীন। একজন নাবিকের কিন্তু এরকম অনুভূতি জাগে না সমুদ্র সম্পর্কে। সমুদ্র প্রায়শই অনুশোচনাহীন এবং নির্দয়, এ-কথা সত্যি, তবে ওটা ভয়াবহ শব্দ তোলে, গর্জন করে, সেজন্যই সমুদ্র সৎ — বিশাল; কিন্তু নদী নিঃশব্দ এবং ছলনাময়ী। সে কথা বলে না, বয়ে চলে শব্দহীনভাবে, আর জলের প্রবহমান এই নিরন্তর গতি আমার কাছে সমুদ্রের বিশাল তরঙ্গের চেয়েও ভয়াবহ মনে হয়!

কল্পনাবিলাসীদের ধারণা, সাগর তার বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখে বিপুল নীলের জগৎ, সেখানে যারা ডোবে তারা ঘুরে বেড়ায় বড় বড় মাছের সঙ্গে, উদ্ভট বনাঞ্চলে এবং স্বচ্ছ কাঁচের গুহায়। নদীর আছে শুধুমাত্র কৃষ্ণ গভীরতা যেখানে একজন কাদার মধ্যে পড়ে থেকে পচে। তা যাই হোক, নদী যখন উদীয়মান সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করে এবং খসখস ধ্বনি-তোলা নলখাগড়া আচ্ছাদিত পাড়ে মৃদুভাবে চাপড় দেয় তখন তাকে অপরূপ দেখায় বৈকি।

সমুদ্র নিয়ে কবি বলেন,

“হে তরঙ্গমালা, কত মর্মন্তুদ বিয়োগগাঁথাই না তোমরা জানো

—গভীর তরঙ্গমালা, নতজানু মায়েদের হৃদয়ের ভয়াল আতঙ্ক!

তোমরা সেগুলো বলাবলি কর একে অন্যেতে যখন গড়িয়ে চল

বহমান জোয়ারের ওপর, এবং এটা তাই যা দেয় প্রতিনিয়ত

তোমাদের কণ্ঠস্বরে হতাশার বিরামহীন, বিরামহীন বিষণ্ন নিস্বন

যখন সন্ধ্যাকালে তোমরা লুটিয়ে পড় উত্তাল জোয়ারের তোড়ে।”

হ্যাঁ, আমি ভাবি, গর্জমান ঢেউগুলো যা বলে তার চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ বিয়োগান্ত গল্প তুচ্ছ তৃণগুলো ফিসফিসিয়ে বলে তাদের অতি মৃদু স্বরে।

কিন্তু তুমি যখন আমাকে আমার স্মৃতি থেকে কিছু বলতে বলছ, আমি একটি মাত্র ঘটনার কথা বলব, যা বছর দশেক আগে ঘটেছিল।

এখন যেখানে আছি সেখানেই থাকতাম আমি, অর্থাৎ মাদার ল্যাফোঁর বাড়িতে, এবং আমার একজন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ল্যুই বার্নেত, যে এখন সুপ্রিম কোর্টে চাকরি করার কারণে নৌকা বাওয়া, চটি জুতা পরা এবং উদাম গলায় থাকা ছেড়ে দিয়েছে, সে বসবাস করত ‘সি’ নামের গ্রামে, নদী থেকে আরও দু লিগ দূরে। আমরা প্রতিদিন একসঙ্গে খাবার খেতাম, কখনও তার কখনও বা আমার ঘরে।

এক সন্ধ্যায় আমার বারো-ফুট লম্বা নৌকা, যা প্রতিরাতেই খুব কষ্ট করে বেয়ে থাকি তা নিয়ে যথেষ্ট পরিশ্রান্ত হয়ে আমি বাড়ি ফিরছিলাম। রেলওয়ে ব্রিজের দুশো মিটার দূরে ওই নলখাগড়া আচ্ছাদিত স্থানে কিছুক্ষণের জন্য দম নিতে থামলাম ।

চমৎকার রাত, চাঁদ উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছিল, নদীও ঝলমল করছিল, বাতাস ছিল শান্ত এবং নরম। প্রকৃতির এই প্রশান্তভাব আমাকে মোহিত করল। আমি নিজে নিজেই ভাবলাম, এই জায়গাটাতে একটু মৌজ করে পাইপ টানলে মন্দ হয় না। নোঙর তুলে নিয়ে আমি ওটা নদীতে ফেললাম।

নৌকা স্রোতের টানে ভাসতে ভাসতে ভাটির দিকে চলল এবং নোঙরের শেকলের শেষ প্রান্তে গিয়ে থেমে গেল। আমি নৌকার পেছন দিকটায় ভেড়ার চামড়ার ওপরে যদ্দুর সম্ভব আরাম করে বসলাম। কোনও শব্দ শোনা যাচ্ছিল না, শুধুমাত্র মাঝেমধ্যে মনে হচ্ছিল আমি শুনছিলাম পাড়ের গায়ে জলের প্রায় অনুপলব্ধ চাপড়, আর দেখছিলাম লম্বা নলখাগড়াগুলোর ঝোপ, যেগুলোকে আকারে অদ্ভুত দেখাচ্ছিল এবং মনে হচ্ছিল সময় সময় নড়ছে।

নদীটি ছিল পুরোপুরি শান্ত, কিন্তু নিজেকে মনে হল কেমন এক অস্বাভাবিক নৈঃশব্দ্য দ্বারা পরিবেষ্টিত। সকল সৃষ্টি, বিভিন্ন জাতের ব্যাঙ এবং জলাভূমির সকল নৈশকালীন গায়ক যেন নীরব।

হঠাৎ করেই আমার ডান পাশে খুব কাছ থেকে একটি ব্যাঙ ডেকে উঠল। আমি চমকে উঠলাম। ডাক বন্ধ হল। আমি আর কিছু শুনলাম না এবং মনকে সহজ করবার জন্য ধূমপানের সিদ্ধান্ত নিলাম। যদিও পাইপ-রংকারী হিসেবে যথেষ্ট নামডাক ছিল আমার, কিন্তু পাইপ ফুঁকতে পারছিলাম না। দ্বিতীয়বার টান দিতেই বমি-বমি লাগল; সিদ্ধান্ত ত্যাগ করলাম অবশেষে। গলা ছেড়ে গান গাইতে শুরু করলাম। কিন্তু নিজের গলার আওয়াজ নিজের কাছেই বিরক্তিকর ঠেকছিল। কী আর করা, অগত্যা নিঃসাড় শুয়ে থাকলাম। কিন্তু নৌকার সামান্য দুলুনিও তখন আমার বিরক্তি উৎপাদন করছিল। মনে হচ্ছিল, যেন ওটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিচ্ছে নদীর এ-পাড় থেকে ও-পাড়ে, বারংবার স্পর্শ করছে প্রতি পাড়। তখন আমার মনে হল, কোনও এক অদৃশ্য শক্তি, বা সত্তা নৌকাটাকে জল থেকে টেনে ওপরে তুলে ধরছিল, তুলে ধরছিল ওটাকে ফের ফেলে দেবার জন্য। ঝড়ের মধ্যে আমাকেও যেন শূন্যে ছুড়ে দেওয়া হচ্ছিল। চারপাশে হট্টগোল শুনতে পাচ্ছিলাম। আমি দ্রুততার সঙ্গে এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালাম। আর কী আশ্চর্য, সবকিছু শান্ত, জল চকচক করছিল।

আমি অনুভব করলাম, আমার স্নায়ুতন্ত্র যথেষ্ট নড়বড়ে দশায়, এবং সিদ্ধান্ত নিলাম স্থান ত্যাগ করবার। নোঙরের শেকল ধরে টানলাম, নৌকা নড়তে শুরু করল; কিন্তু কেমন এক বাধা অনুভব করলাম। আরও জোরে টানতে লাগলাম, কিন্তু নোঙর উঠে এল না; নদীর তলদেশে কিছু একটার সঙ্গে ওটা এমনভাবে আটকে গিয়েছিল যে, আমি টেনে তুলতে পারছিলাম না। আবার টানলাম, কিন্তু সব চেষ্টা বৃথা। তখন নোঙরের অবস্থান পরিবর্তনের জন্য বৈঠা দিয়ে নৌকার মাথা স্রোতের উজানের দিকে ঘোরালাম। এতেও কিছু হল না, ওটা তখনও আটকেই থাকল। আমি ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে জোরে জোরে নোঙরের শেকল ঝাঁকাতে থাকলাম। নাহ্, একচুলও নড়ল না! হতাশ হয়ে আমি বসে পড়লাম এবং আমার অবস্থা নিয়ে ভাবতে লাগলাম। আমি শেকলটা ভেঙে ফেলা বা ওটাকে নৌকা থেকে বিচ্ছিন্ন করার কথা কল্পনাও করতে পারলাম না, কেননা ওটা ছিল যথেষ্ট মোটা এবং আমার বাহুর মত পুরু এক বাঁকানো কাষ্ঠখণ্ডের সঙ্গে আটকানো। যাহোক, যেহেতু আবহাওয়া ছিল চমৎকার, ভাবলাম খুব বেশি দেরি হবে না, যখন জেলেরা আমার সাহায্যে এগিয়ে আসবে। দুর্ভাগ্য, মনে হল, আমার পিছু ছেড়েছে। আমি বসে পড়লাম এবং শেষপর্যন্ত পাইপ টানতে সক্ষম হলাম। এক বোতল রাম ছিল; দু তিন গ্লাশ পান করলাম, এবং এ-অবস্থায় একটু হাসতেও পারলাম। ভালোই গরম, দরকার হলে তারাভরা মুক্ত আকাশের নিচে ঘুমোনো যায় বড় ধরনের কোনও বিপদের আশঙ্কা না করে।

হঠাৎ করেই নৌকার পাশে একটা ছোট্ট আঘাতের শব্দ কানে এল। আমি আঁতকে উঠলাম এবং শীতল ঘামে আমার সারা শরীর ভিজে গেল। শব্দটি, নিঃসন্দেহে স্রোতের সাথে ভেসে যাওয়া কোনও কাঠের টুকরো থেকে উৎপন্ন। ব্যস, ওটাই যথেষ্ট, আমি আবার অদ্ভুত স্নায়বিক আলোড়নের শিকারে পরিণত হলাম। আমি শেকলটা ধরলাম এবং আমার পেশিগুলোকে মরিয়া প্রচেষ্টায় টানটান করলাম। নোঙর সেভাবেই আটকে রইল। অবসন্ন আমি, আবার বসে পড়লাম।

নদী ধীরে ধীরে ঢেকে গেল জলের কাছাকাছি ঝুলে-থাকা গাঢ় শাদা কুয়াশায়, যে কারণে উঠে দাঁড়িয়েও না দেখতে পেলাম নদী, না আমার পদযুগল, না আমার নৌকা, কিন্তু আঁচ করতে পারলাম নলখাগড়ার ডগা, এবং কারও দূরে চাঁদের আলোয় শুয়ে-থাকা ধবধবে শাদা সমতলভূমি; ওখান থেকে কিছু বড় কালো কালো ছোপ উঠে গেছে আকাশের পানে, যা সৃষ্টি হয়েছে ইতালিয়ান পপলার গাছের সারিগুলো দ্বারা। মনে হল আমি তুলোর মত শাদা মেঘে কোমর অবধি সমাধিস্থ, এবং বহুরকম অদ্ভুত কল্পনা আমার মনে এসে ভিড় করল। মনে হল কেউ একজন আমার নৌকায় ওঠার চেষ্টা করছে, যা আমি আর পার্থক্য করতে পারছি না, এবং গাঢ় কুয়াশায় আবৃত নদী ভরে আছে উদ্ভট যত সৃষ্টিতে, যেগুলো সাঁতার কাটছে আমার চারপাশে। আমি ভয়ানক অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম, মনে হচ্ছিল আমার কপালের চারদিক আঁটোসাটো পট্টি দিয়ে বাধা, হৃদস্পন্দন এমনই পর্যায়ে, যেন প্রায় শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে আমার এবং প্রায় হতভম্ব আমি ওই স্থানটি থেকে সাঁতরে পালাতে চাইলাম। কিন্তু সেই বিশেষ চিন্তাটি আমাকে আবার ভয়ে কাঁপিয়ে তুলল। এধরনের গাঢ় কুয়াশায়, ঘাস এবং নলখাগড়ার দঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাজার চেষ্টা করেও আমি পালাতে পারব না, এটা অনুমান করে আমি চরম হতাশায় হাবুডুবু খেতে থাকলাম। আমার নিশ্বাস ভয়ে ঘরঘর করছিল, না দেখছিলাম পাড়, না পাচ্ছিলাম খুঁজে আমার নৌকা; এবং মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমার পা ধরে ওই কালো জলের গভীরে টেনে নিতে চাচ্ছে।

আসলে, আমাকে আরও পাঁচশো মিটার উজানে যেতে হবে, যদি আমি নামবার মত কোনও স্থান পেতে চাই; এমন এক স্থান যা ঘাস এবং নলখাগড়া থেকে মুক্ত। যেরকম বিরূপ পরিস্থিতি তাতে মনে হয় না, আমি কোনও পথ খুঁজে পাব এই কুয়াশায় এবং আমি যতই ভালো সাঁতার জানি না কেন, ডুবে যাবই।

আমি নিজেকে যুক্তি দ্বারা বোঝাতে চেষ্টা করি। আমার ইচ্ছাশক্তি ভয় না পেতে শক্তি যোগায়, কিন্তু ইচ্ছাশক্তির বাইরেও আমার মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল যা ছিল ভীত। নিজেকে জিজ্ঞেস করি, ভয় পাওয়ার আছেটা কী। আমার সাহসী সত্তা ভীরু সত্তাকে ঠাট্টা করে, এবং সেদিনের আগে কখনও আমি এটা বুঝিনি যে, আমাদের মধ্যে দুটো বিরোধী ব্যক্তিত্ব বিরাজ করে — একটা প্রত্যাশা করে কোনও কিছুর, অপরটা বাধা দেয়; এবং প্রত্যেকটাই পালাক্রমে জেতে।

এই নির্বোধ, ব্যাখ্যাতীত ভীতি বেড়েই চলল এবং ত্রাসে পরিণত হল। চলৎশক্তিহীন আমি, চোখ আমার স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে ছিল, কিছু একটার প্রত্যাশা নিয়ে কান খাড়া। কিসের? আমি জানিনি, কিন্তু তা ছিল অবশ্যই ভয়ঙ্কর। আমি বিশ্বাস করি, একটি মাছ জলের বাইরে লাফিয়ে পড়লে অহরহই যেমন ঘটে, এরচেয়ে বেশি আর কী ঘটতে পারত আমার ক্ষেত্রে, অনড় — অচেতন।

যাহোক, বেপরোয়া প্রচেষ্টার দ্বারা আমি ফের প্রায় যুক্তিবাদী হতে সফল হলাম। রাময়ের বোতলটা থেকে বেশ কবার টানলাম। তখন আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এল, আমি সর্বশক্তি দিয়ে সবদিকে লক্ষ করে বারংবার চিৎকার করতে লাগলাম। আমার গলা যখন প্রায় অসাড়, অনেক দূর থেকে এক কুকুরের ডাক শুনতে পেলাম।

আরও খানিকটা রাম খেয়ে আমি নিজেকে নৌকার নিচের দিকে নিয়ে এলাম। ওখানে কাটালাম প্রায় এক ঘণ্টা, সম্ভবত দু ঘণ্টা, না ঘুমিয়ে, চোখ পুরোপুরি খোলা রেখে, আমার যত দুঃস্বপ্ন নিয়ে। উঠে দাঁড়াবার সাহস না করলেও আমি দারুণভাবে চাইছিলাম তা। কিন্তু কাজটা করতে বারবারই আমি বিলম্ব করছিলাম। নিজেকেই বলছিলাম:“ওঠো, উঠে দাঁড়াও!” যদিও নড়াচড়া করতে ভয় পাচ্ছিলাম আমি। অবশেষে অতি সাবধানতার সঙ্গে আমি নিজেকে তুলে ধরলাম, যেহেতু আমার জীবন নির্ভর করছিল আমার মুখ থেকে ক্ষীণভাবে হলেও শব্দ উচ্চারিত হওয়ার ওপর। নৌকাটির কানার ওপর দিয়ে তাকিয়ে থাকলাম আমি। দেখবার মত অত্যন্ত সুন্দর, অত্যন্ত আশ্চর্যজনক দৃশ্য আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিতে থাকল। এটা যেন সেইসকল পরীরাজ্যের অলীক কল্পনা, যেগুলো বহু দূরের দেশ ভ্রমণ করে ফিরে এসে পরিব্রাজকরা আমাদের কাছে বর্ণনা করে, আমরা যাদের কথা শুনি, কিন্তু বিশ্বাস থোড়াই করি।

দুই ঘণ্টা আগে যে কুয়াশা জলের ওপর ভাসছিল, ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল এবং তা পাড়ের ওপর জমা হচ্ছিল, নদীকে সম্পূর্ণ পরিষ্কার রেখে দুই পাড়ে অবিচ্ছিন্ন ছয় বা সাত মিটার উঁচু দেওয়ালের সৃষ্টি করেছিল, যা চাঁদের আলোতে চকচক করছিল তুষারের চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বলতায়। এই দুই শাদা পর্বতের মধ্যবর্তী আলোকোজ্জ্বল নদী ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছিল না, এবং আমার মাথার ওপর নীলাভ শুভ্র আকাশে ভাসছিল বিরাট পূর্ণ চাঁদ।

জলের সকল প্রাণী জেগে ছিল। ব্যাঙগুলো ডাকছিল ভয়ানকভাবে, সারাক্ষণ আমি শুনছিলাম, প্রথমে ডানে পরে বামে, আচমকা, একঘেয়ে এবং বিষাদগ্রস্ত ধাতব ধ্বনি ছিল কোলাব্যাঙগুলোর। আশ্চর্য, আমি আর ভয় পাচ্ছিলাম না। আমি এমনই এক অস্বাভাবিক প্রকৃতির মধ্যে ছিলাম যে, অতি বিশিষ্ট বস্তুগুলোও আর আমাকে বিস্মিত করতে পারছিল না।

কতক্ষণ এরকম চলছিল আমার জানা নেই, কেননা আমি শেষে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। যখন চোখ খুললাম, চাঁদ নেমে গেছে এবং আকাশ ভরে আছে মেঘে। জল তালি দিচ্ছে বিষণ্নভাবে, বাতাস বইছে জোর, পিচরঙা কালো চরাচর। আমি অবশিষ্ট রামটুকু পান করলাম, তারপর নলখাগড়ার খসখস ধ্বনি এবং নদীর অলক্ষুণে ইঙ্গিতবহ শব্দ শুনে আমি কাঁপতে থাকলাম। আমি দেখতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু পার্থক্য করতে পারলাম না নৌকাকে, এমন কি আমার হাত দুটোকে যা আমি চোখের একদম কাছে তুলে ধরেছিলাম।

একটু একটু করে, যাহোক অন্ধকার কিছুটা কমে এল। হঠাৎ মনে হল, আমি একটা ছায়াকে আমার বেশ কাছ দিয়ে ছুটে যেতে দেখলাম। চিৎকার করে ডাকলাম আমি, একটি কণ্ঠের প্রত্যুত্তর পাওয়া গেল; সে ছিল এক জেলে। ডাকলাম তাকে; কাছে এল সে, এবং আমি তাকে আমার দুর্ভাগ্যের কথা বললাম। আমার নৌকার পাশ ঘেঁষে সে তার নৌকা বাইতে থাকল এবং আমরা দুজনে নোঙরের শেকল ধরে টানলাম। নোঙর নড়ল না। দিনের আগমন ঘটল, বিষণ্ন ধূসর, বৃষ্টিভেজা এবং ঠাণ্ডা, সেরকম একটা দিন যা নিয়ে আসে কারও জন্য দুঃখ এবং অমঙ্গল। আরেকটা নৌকা নজরে এল। ডাকলাম ওটাকেও। ওটার আরোহী লোকটি আমাদের চেষ্টায় হাত লাগাল, এবং ক্রমশ নোঙরটা উঠে এল। ওটা উঠল, কিন্তু ধীরে ধীরে, যথেষ্ট ভারী এক বোঝা নিয়ে। অবশেষে আমরা লক্ষ করলাম একটি কালো বস্তু; এবং ওটাকে আমরা নৌকায় টেনে তুললাম। ওটা ছিল গলায় বড় পাথর জড়ানো এক বৃদ্ধা নারীর মৃতদেহ।

 

উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ..

নদীতীরে - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


তারপর আমি ইন্দিরা গান্ধীকে জিজ্ঞেস করলুম, আপনি বই পড়তে ভালোবাসেন?
উনি একটু হেসে বললেন, ছেলেবেলায় আমি বইয়ের পোকা ছিলুম।
—এখন বই-টই পড়ার সময় পান না বোধ হয়?
সে রকম সময় পাই না, তা ঠিকই। তবে, যেটুকু সময় বাঁচানো যায়… যেমন ধরো, যখন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হয়—এ রকম প্রায়ই যেতে হয়, বিমানে বসে আমি কারোর সঙ্গে কথা বলি না, শুধু বই পড়ি। একবার আসামে যাওয়ার সময় আদ্রে মলরোর ‘অ্যান্টি মেমোয়ার্স’ বইখানা পড়ছিলাম, মাত্র আটচল্লিশ পাতা পড়া হলো, সেখানে পেজ-মার্ক দিয়ে রাখলাম, আর সুযোগই পাইনি, তারপর লুঙ্মেবার্গ যাওয়ার পথে আবার ঊনপঞ্চাশ পৃষ্ঠা থেকে—
—এই বইটাতে আপনার বাবার সম্পর্কে চমৎকার লিখেছেন।
—হুঁ।
কথা থামিয়ে তিনি পাশ থেকে একটা কাগজের রুমাল তুলে নিলেন। সেটাতে সুগন্ধ রয়েছে। বিমানযাত্রার সময় এ রকম কাগজের রুমাল দেয়, আমি দেখেছি, একটু ভিজে ভিজে থাকে—মুখ মুছে নিলে পরিষ্কারও হয় এবং গন্ধের জন্য মন ভালো হয়। এয়ার হোস্টেস যখন ট্রে-টা বাড়িয়ে দিয়েছিল, তখন আমি একটার বদলে তিনটা তুলে নিয়েছিলাম। এ রকম নিয়ম নয়, তবে আপত্তি করে না।
ইনি কি একটার বদলে তিনটা তুলে নেন কখনো? তারপর মনে পড়ল, ওঁর দরকার হয় না। ওঁকে এ রকম দ্বিধায় পড়তে হয় না।
উনি পায়ের ওপর পা তুললেন। উরুর কাছে শাড়ি প্লেন করলেন এক হাত দিয়ে, শিশুর মতো চিবুকটি উঁচু করে এক পলক চিন্তা করে নিলেন অন্য কিছু।
তারপর উদাসীনভাবে বললেন, সবাই আমার কাছে এসে নানারকম প্রশ্ন করে। আমি কাউকে কোনো প্রশ্ন করি না। আমার কাজ শুধু উত্তর দেওয়া।
—এবং অধিকাংশই অবান্তর প্রশ্ন।
—প্রায়।
—আমার আর একটাই প্রশ্ন আছে। কী রকম লাগে জীবনটা? এর নাম কি সুখ?
—সুখ?
হ্যাঁ।
—সুখের কথা চিন্তা করিনি। জীবনে যখনই কোনো সংকট এসেছে, তখনই ভেবেছি আমায় যেন কেউ হারাতে না পারে। কখনো তো হারিনি আমি। অনেক কিছুই অসম্পূর্ণ আছে। কিন্তু হেরে যাইনি।
—আপনি বোধ হয় রবীন্দ্রনাথের ‘গান্ধারীর আবেদন’ পড়েননি। সেখানে তিনি এ কথাই দুর্যোধনের মুখে বসিয়েছেন :
‘সুখ চাহি নাই মহারাজ—
জয়! জয় চেয়েছিনু, জয়ী আমি আজ।
ক্ষুদ্র সুখে ভরে নাকো ক্ষত্রিয়ের ক্ষুধা—’
—তুমি আমার সঙ্গে দুর্যোধনের তুলনা করলে?
—এবার আপনি প্রশ্ন করছেন।
—এটা পাল্টা প্রশ্ন। উত্তরটাকেই পরিষ্কার করে নেওয়ার জন্য।
—না, তুলনা করিনি। কাব্যের সঙ্গে জীবনের তুলনা চলে না। তা ছাড়া, মহাভারতে দুর্যোধন আর রবীন্দ্রনাথের দুর্যোধন এক নয়। আমি বলতে চাইছিলাম, যাদের হাতে শাসনভার থাকে, তাদের কাছে জয়টাই প্রধান। ‘রাজধর্মে, ভ্রাতৃধর্ম, বন্ধুধর্ম নাই, শুধু জয়ধর্ম আছে—’
—আমি ওটা আমার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে বলছিলাম। —আপনার কোনো ব্যক্তিগত জীবন নেই। আপনি কতদিন একা কোথাও যাননি, কতদিন কোনো নদী দেখেননি।
—নদী দেখিনি?
—সেতু উদ্বোধন করার সময় দেখে থাকতে পারেন বটে।
তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলো।
আমি মনে করলাম, সময় হয়ে গেছে, তাই উনি আমাকে যেতে বলছেন। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী আবার বললেন, চলো তোমার সঙ্গে কোনো নদী দেখে আসি।
আমি বললাম, আপনার বয়েসী কোনো নারীর সঙ্গে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার জন্য আমার প্রলুব্ধ হওয়ার কথা নয়। তবে আপনার একটা আলাদা আকর্ষণ আছেই। শুধু রাষ্ট্রপ্রধান বলেই নয়, বয়স হওয়া সত্ত্বেও আপনি এখনো যেন যৌবনের প্রতীক। আপনার হাবভাব, চলাফেরা ও পোশাকের মধ্যে এখনো যৌবনসুলভ ব্যাপার আছে। শুনেছি আপনি খুব নিষ্ঠুর, কিন্তু আপনার মুখে তার কোনো রেখা পড়েনি।
—আমরা নদী সম্পর্কে কথা বলছিলাম, যাবে?
—সঙ্গে আপনার সাতান্নজন দেহরক্ষীও যাবে নিশ্চয়ই!
উনি একটু হেসে বললেন, সাতান্নজন! তুমি গুনেছ নাকি? আমি তো জানি না।
—একবার রবীন্দ্রসদনে একটা উৎসবে আপনাকে দেখেছিলাম, তখনই শুনেছিলাম, সর্বসমেত সাতান্নজন ব্যক্তি আপনাকে পাহারা দিচ্ছে। বাইরে জল খেতে গেছি, সেখানেও দেখি কলের কাছে একজন লোক দাঁড়িয়ে। দেখলেই বোঝা যায়, প্রহরী। তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি বলে কেউ জল খেতে আসছে না। অথচ, আমার এখানেই দাঁড়াবার কথা।
—এ রকম হয় বুঝি?
যাই হোক, চলো, আজ আমি একাই গঙ্গার ধারে যাব। এ কথা ঠিক, আমি পৃথিবীর সর্বত্র গেছি, করতলের মতনই পৃথিবীটা চিনি। অনেক অনেকদিন কোনো নির্জন নদীতীরে দাঁড়াইনি। কলকাতার গঙ্গার ধার খুব সুন্দর?
—পৃথিবীর বিখ্যাত দৃশ্যগুলোর একটি। কিন্তু আপনি সেখানে যেতে পারবেন না। আপনি নিষেধ করলেও রক্ষীরা শুনবে না। একটু দূরে থেকে অনুসরণ করবে। তা ছাড়া—
—তা ছাড়া কী?
—বলতে আমার দ্বিধা হচ্ছে। অভয় পেলে বলতে পারি।
—বলো।
—গঙ্গার ধারের সেই আততায়ী যে রয়েছে।
—তার মানে?
—পৃথিবীর প্রতিটি জায়গায়ই কী আপনার জন্য একজন আততায়ী অপেক্ষা করে বসে নেই? নইলে এত রক্ষী কেন?
—উনি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তা আছে। এটা তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমাকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে অনেকেরই স্বার্থ আছে। পৃথিবীর সব রাষ্ট্রপ্রধানের ক্ষেত্রেই এ রকম হয়।
—জানি। কিন্তু সব সময়ই আমাকে কেউ হত্যা করতে চায়, এই চিন্তাটা কেমন লাগে।
—সব সময় মনে থাকে না।
—সব সময় রক্ষী থাকা মানেই চেতনে হোক অবচেতনে হোক এটা মেনে নেওয়া।
—অভ্যেস হয়ে যায়। এটাও পার্ট অব গেম।
—রবীন্দ্রসদনের বাইরে জলখাবার জায়গায় যে লোকটি একা দাঁড়িয়ে ছিল, তার সেই দাঁড়িয়ে থাকার ভঙ্গির মধ্যে অদ্ভুত একটা কিছু ছিল। সেই জন্য আমি সপ্রশ্ন চোখে তাকিয়েছিলাম। তার ভঙ্গি অলস অথচ সতর্ক। অন্যমনস্কের ভান অথচ নজর তীক্ষ্ন। নিশ্চয়ই ওর কাছে কোনো অস্ত্র ছিল। ঐ লোকটিকেও আমি আততায়ী ভাবতে পারতাম। কিন্তু ও ছিল প্রহরী। ভেবে দেখতে গেলে আততায়ী ও প্রহরীর মধ্যে বেশ মিল আছে।
উনি আমার কথা শুনে একটু বিরক্ত হলেন মনে হলো। বিখ্যাত ভঙ্গিতে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন একটুক্ষণ। তারপর বললেন, কথায় কথা বাড়ে। আমি নদীর কাছে যেতে চেয়েছিলাম একা।
—একা।
—হ্যাঁ। এবং তুমি আমায় রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে যাবে। জানো বোধ হয়, আমি কোনো শহরেরই রাস্তা চিনি না। হঠাৎ ভিড়ের কলকাতা শহরের মাঝখানে আমাকে ছেড়ে দিলে আমি বাচ্চা মেয়ের মতো হারিয়ে যাব।
—কিন্তু তার আগে গঙ্গার ধারের সেই আততায়ীর ব্যাপারটা নিষ্পত্তি হওয়া দরকার নয় কি?
—মনে হয়, সেখানে কোনো আততায়ী নেই। তুমিই তো বললে, সেটা খুব সুন্দর জায়গা।
—আব্রাহাম লিঙ্কন যখন মুগ্ধ হয়ে নাটক দেখছিলেন, তখন মঞ্চের ওপর থেকেই লাফিয়ে এসেছিল আততায়ী। খুনির সৌন্দর্যবোধ নেই।
—কিন্তু আমাকে মারতে চাইবে কেন? আমি কি এই দেশটাকে বাঁচাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছি না?
দেশটাকে বাঁচানো বড়ো কথা নয়, কথা হচ্ছে কে তাকে বাঁচাবে। সবকিছুর থেকেই বড় হচ্ছে সেই আমি। মৃত্যু না হলে কিংবা নিহত না হলে কেউ তো দেশের পরিত্রাতার ভূমিকা ছাড়তে চায় না।
—আমরা কথা বলছিলাম নদী সম্পর্কে।
—নদী নয়, নদীর তীরে একা দাঁড়ানো সম্পর্কে।
—ঠিক, তুমি হঠাৎ এ কথাটা বলেছিলে কেন? আমি কতদিন কোনো নদী দেখিনি।
—আপনি বলেছিলেন আপনার ব্যক্তিগত জীবনের সম্পর্কে কিছু একটা—আমি বলেছিলাম, আপনার কোনো ব্যক্তিগত জীবন নেই। সে জন্যই নদীর কথা আসে। আপনার অ্যারোপ্লেন আছে, হুকুম আছে, সেতু উদ্বোধনের তারিখ আছে, কিন্তু আপনার কোনো নদী নেই।
—তাতে কিছু যায় আসে?
—না।
—তাহলে?
—তবু হঠাৎ আপনি নদী দেখতে চাইলেন।
—চলো। আমাকে কেউ চিনতে পারবে না। কেউ বিশ্বাসযোগ্য মনে করবে না আমার চেহারা। বড়জোর বলাবলি করবে, ওকে ঠিক ইন্দিরা গান্ধীর মতন দেখতে। স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধী হতেই পারে না।
—এ রকম বিভ্রম কোনো চিত্রতারকা সম্পর্কে হতে পারে, কিন্তু আপনার সম্পর্কে সন্দেহের কোনো কারণই নেই—প্রতিদিন বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আপনার অসংখ্য ছবি ছাপা হয়।
—কথায় কথা বাড়ে।
—চলুন তাহলে দেখা যাক পরীক্ষা করে।
রাজভবনের গেটের বাইরে আমি অপেক্ষা করছিলাম, উনি একটা সাদা শাল জড়িয়ে বেরিয়ে এলেন। সন্ধে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। আমাকে দুটো সিগারেট পোড়াতে হয়েছিল।
—উনি এসে বললেন, কোনোদিন আমি এখানে পায়ে হেঁটে ঢুকিনি কিংবা বেরোইনি, তাই আমাকে কেউ লক্ষ করেনি। সবাই আমার গাড়িটা পাহারা দিচ্ছে।
—নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গে প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর আরো অসংখ্য লোকের দেখা করার কথা ছিল; অনেক দাবি, অনেক অনুগ্রহ, অনেক প্রতিবাদ।
—তা ছিল। কিন্তু যুবক, তুমি নিজেকে বিশেষ সৌভাগ্যবান মনে করো না। মনে রেখো, তুমি আমার পথপ্রদর্শক মাত্র।
—অদূরে গঙ্গা, আপনি সোজা চলে যান।
—তুমি রাগ করলে?
—আপনাকে একটু আগে আমি বলেছিলাম যে নারীর সঙ্গে সান্ধ্যভ্রমণে আমি কখনো নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি বটে, কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে সে কথা আসে না।
ইংরেজিতে যাকে বলে ফুল থ্রোটেড লাফটার, তিনি সেইভাবে হাসলেন। এ কথা ঠিক, সব প্রবীণ পুরুষ ও নারীর মধ্যেই কখনো কখনো একটি শিশুকে খুঁজে পাওয়া যায়।
রেডিও ভবনের পাশ দিয়ে, স্টেডিয়ামের গা ঘেঁষে আমরা হাঁটছিলাম। আবছা অন্ধকারের রাত্রি, পথে অনেক মানুষজন, কিন্তু কেউ আমাদের লক্ষ করছে না। অল্পবয়সী যুবক ও যুবতীরা নিজেদের নিয়েই মত্ত। একটি ভিখারি শিশু অনেকক্ষণ ধরে আমাদের পেছনে পেছনে আসছিল, উনি একটু বিব্রত বোধ করলেন, উনি সঙ্গে পয়সা আনেননি—খুব সম্ভবত কোনোদিনই ওঁর নিজের কাছে টাকা-পয়সা থাকে না। অন্তত গত কয়েক বছর।
উনি আমার দিকে তাকালেন।
আমি বললাম, খুচরো পয়সা আমার কাছে আছে, কিন্তু ভিক্ষে দেওয়াটা কি ঠিক নীতি?
—নিজের বিবেককে প্রশ্ন করো।
—আমার বিবেক একেক রকম নির্দেশ দেয়, সে জন্যই আপনার কাছে জানতে চাইছিলাম।
—আমি মানুষকে নীতিবোধ শেখাই না।
আমি ভিখারি শিশুটিকে দশ পয়সা দিলাম। সে চলে যাওয়ার পর আমি বললাম, ওর প্রতি দয়াবশত আমি পয়সা দিইনি, আমি চাইছিলাম ও যেন আর বিরক্ত না করে।
—কলকাতায় ও-ই কি একমাত্র ভিখারি?
—না, এখানে ভিখারির সংখ্যা তিন লাখ একজন।
—একজন মানে?
—আমাকে নিয়ে।
—তুমি কিসের ভিখারি?
আমি একটু চুপ করে রইলাম। তারপর উত্তর দিলাম, বলতে যাচ্ছিলাম, ভালোবাসার, তারপর মনে হলো, এটা একটা ক্লিশে, আবার মনে হলো, ক্লিশে হলেও সত্যি—অথচ এসব মুখে বলা যায় না।
—তুমি ভালোবাসা পাওনি?
—তা পেয়েছি, তবু একটা ভিখারিপনা থেকেই যায়।
—যাদের ও রকম থাকে, তারা জীবনে কোনো বড় কাজ করতে পারে না।
—আপনার ঐ দুর্বলতা নেই?
—ছিল এক সময়। খুবই। যখন আমার মায়ের খুব অসুখ…থাক্।
—ছেলেবেলায় একটা লেখা পড়েছিলাম, সক্রেটিস ইন অ্যান ইন্ডিয়ান ভিলেজ—
—আমার ক্ষেত্রে সেটা খাটে না।
ইডেন উদ্যানের কোণটায় এসে আমরা দাঁড়াই। রাস্তার মাঝখানে গোল একটা স্থাপত্য—এক সময় ওখানে বিদেশি কোনো রাজপুরুষের মূর্তি ছিল, এখন শূন্য প্যাডেস্টাল। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। মনোরম হাওয়া দিচ্ছে।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, পথ প্রদর্শক, এবার কোন দিকে?
আমি বললাম, রাস্তা পার হতেই হবে। পারবেন?
সট সট করে গাড়ি ছুটে যাচ্ছে, মাঝেমধ্যে বিশালকায় ট্রাক। উনি বহুদিন একলা এভাবে ট্রাফিকের মধ্যে হেঁটে রাস্তা পার হননি। কিন্তু সব ব্যাপারেই ওঁর একটা সপ্রতিভতা আছে। ডান দিক ও বাঁ দিকে তাকিয়ে ধীর পদক্ষেপে রাস্তা পার হয়ে এলেন, এই গতিভঙ্গিতে একটা আভিজাত্য আছে। ব্যস্ততা ওঁকে মানাত না।
তখনই কিন্তু গঙ্গার দিকে না গিয়ে আমি ওঁকে নিয়ে কেল্লার দিকের রাস্তা ধরে আরো একটু হাঁটলাম। হাওয়া ক্রমশ প্রবল হচ্ছে। বেশ শীতের শিরশিরে ভাব। উনি শালটা ভালোভাবে জড়িয়ে নিলেন শরীরে। আপন মনেই বললেন, কলকাতায় আছি, অথচ এতখানি সময় আমার নিজস্ব, এটা যেন ঠিক বিশ্বাসই করতে পারছি না। কলকাতায় অভিযোগ অনেক বেশি থাকে।
আমি চুপ করে রইলাম। আমার দেশলাইয়ের কাঠি ফুরিয়ে গেছে, সিগারেট ধরাতে পারছি না, এইটাই আমার একমাত্র চিন্তা। উল্টোদিক থেকে একজন লোক হেঁটে আসছিল, মুখে সিগারেট, আমি তাকে বললাম, দাদা একটু আগুনটা দেবেন? লোকটি থমকে দাঁড়াল। আমার সিগারেট ধরাতে যেটুকু সময় লাগল, সেই সময়ে লোকটি তাকাল ভারত কিংবা পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত নারীটির দিকে। চিনতে পেরেছে কি না কে জানে, তবে নিশ্চিত অবাক হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আমার দিকে এবং তাঁর দিকে দুবার তাকাল।
উনি একটু পাশে সরে দাঁড়িয়ে স্থির চোখে তাকিয়ে আছেন এদিকে।
হঠাৎ আমার একবার মনে হলো, এই লোকটিই কি গঙ্গার ধারের সেই আততায়ী? এরা ঠিক খবর পেয়ে যায়।
আমি লোকটিকে বললাম, ধন্যবাদ।
না, লোকটি চিনতে পারেনি। আবার হাঁটতে আরম্ভ করল। আমি ওঁকে বললাম, আমি একটু বেশি সিগারেট খাই, আপনি কিছু মনে করছেন না তো?
উনি হাতের ভঙ্গিতে কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, আমরা নদীর দিকে যাচ্ছি না কেন?
আমি বললাম, ঠিক কোন জায়গায় আপনাকে মানাবে, ঠিক বুঝতে পারছি না। পথপ্রদর্শকের অনেক দায়িত্ব।
উনি বললেন, আমি নদী দেখতে এসেছি। আমাকে সবচেয়ে বেশি মানায় উঁচু মঞ্চে, সেটা আলাদা কথা।
আবার রাস্তা পার হওয়ার একটা ব্যাপার হলো। ছোটো রেললাইন পেরিয়ে আমরা এলাম স্ট্যান্ডে। জায়গাটা নির্জন।
নদী এখন কালো এবং গম্ভীর। একটা আলো ঝলমল বিদেশি জাহাজ খুব কাছেই। জলে পড়েছে লম্বা লম্বা আলোর রেখা। দূরে কয়েকটা ডিঙি নৌকার লণ্ঠনকে এখান থেকে জোনাকি বলে ভ্রম হয়।
উনি মুখ তুলে তাকালেন নদীর দিকে। বললেন, কই কিছুই হলো না তো?
—কী?
—আমি ভেবেছিলাম অন্যরকম মনে হবে। কিন্তু আমার মনে পড়ছে ফরাক্কার কথা, কলকাতা বন্দরের সমস্যা, বাংলাদেশের প্রয়োজনের কথা এবং দ্বিতীয় সেতু—
আমি বললাম, আপনি এখনো মঞ্চে দাঁড়িয়ে আছেন কিংবা রাজভবনে প্রতিনিধি সম্মেলনে। আপনি নদীর কাছে আসেননি।
উনি চোখ বুজে আবার চোখ খুললেন। বললেন, এবার তো ভালো করে দেখতে পাচ্ছি নদীকে।
—জয় না সুখ, কোন্টা?
—প্রশ্ন করো না।
—কী অসহায় মনে হচ্ছে আপনাকে।
একটু দর্পিত ভঙ্গিতে আমার দিকে ঘুরে বললেন, অসহায় কেন?
—জয় না সুখ আপনি বুঝতে পারছেন না।
—আমি আত্মচিন্তা করি না। আমাকে সারা দেশের কথা চিন্তা করতে হয়।
—এখানে কোনো দেশ নেই। এখানে শুধু নদী, চিরকালীন।
উনি খানিকটা অহংকার ও অভিমান মিশ্রিত মুখে তাকিয়ে রইলেন নদীর দিকে। ওঁর ঠোঁট কাঁপছে। কিছু যেন বলতে চান।
তারপর নিজেই সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে গেলেন জলের কাছে। নিচু হয়ে জলে হাত দিলেন।
আমি ভাবলাম, উনি নিশ্চয়ই নদীর জল মাথায় ছিটাতে চান। পরক্ষণে মনে হলো, হয়তো নদীর কাছে গেলেন কোনো গোপন কথা বলার জন্য। আর তো কেউ নেই।

চীনে পটকা - সুকুমার রায়


আমাদের রামপদ একদিন এক হাঁড়ি মিহিদানা লইয়া স্কুলে আসিল! টিফিনের ছুটি হওয়ামাত্র আমরা সকলেই মহা উৎসাহে সেগুলি ভাগ করিয়া খাইলাম। খাইল না কেবল ‘পাগলা দাশু’।


পাগলা দাশু যে মিহিদানা খাইতে ভালোবাসে না, তা নয়। কিন্তু, রামপদকে সে একেবারেই পছন্দ করিত না- দুজনের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া চলিত! আমরা রামপদকে বলিলাম, “দাশুকে কিছু দে!” রামপদ বলিল, “কি রে দাশু, খাবি নাকি? দেখিস, খাবার লোভ হয়ে থাকে তো বল আর আমার সঙ্গে কোনোদিন লাগতে আসবি নে- তা হলে মিহিদানা পাবি।” এমন করিয়া বলিলে তো রাগ হইবারই কথা, কিন্তু দাশু কিছু না বলিয়া গম্ভীরভাবে হাত পাতিয়া মিহিদানা লইল, তার পর দরোয়ানের কুকুরটাকে ডাকিয়া সকলের সামনে তাহাকে সেই মিহিদানা খাওয়াইল! তার পর খানিকক্ষণ হাঁড়িটার দিকে তাকাইয়া কি যেন ভাবিয়া মুচ্‌কি মুচ্‌কি হাসিতে হাসিতে স্কুলের বাহিরে চলিয়া গেল। এদিকে হাঁড়িটাকে শেষ করিয়া আমরা সকলে খেলায় মাতিয়া গেলাম- দাশুর কথা কেউ আর ভাবিবার সময় পাই নাই।

টিফিনের পর ক্লাশে আসিয়া দেখি দাশু অত্যন্ত শান্তশিষ্টভাবে এককোণে বসিয়া আপন মনে অঙ্ক কষিতেছে। তখনই আমাদের কেমন সন্দেহ হইয়াছিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি রে দাশু, কিছু করেছিস নাকি?” দাশু অত্যন্ত ভালোমানুষের মতো বলিল, “হ্যাঁ, দুটো জি-সি-এম করে ফেলেছি।” আমরা বলিলাম, “ধুত্‍‌! সে কথা কে বলছে? কিছু দুষ্টুমির মতলব করিস নি তো?” এ কথায় দাশু ভয়ানক চটিয়া গেল। তখন পণ্ডিতমহাশয় ক্লাশে আসিতেছিলেন, দাশু তাঁহার কাছে নালিশ করে আর কি! আমরা অনেক কষ্টে তাহাকে ঠাণ্ডা করিয়া বসাইয়া রাখিলাম।

এই পণ্ডিতমহাশয় মানুষটি মন্দ নহেন। পড়ার জন্য কোনোদিনই তাড়াহুড়া করেন না। কেবল মাঝে মাঝে একটু বেশি গোল করিলে হঠাৎ সাংঘাতিকরকম চটিয়া যান। সে সময় তাঁর মেজাজটি আশ্চর্যরকম ধারালো হইয়া উঠে। পণ্ডিতমহাশয় চেয়ারে বসিয়াই, “নদী শব্দের রূপ কর” বলিয়া ঘুমাইয়া পড়িলেন। আমরা বই খুলিয়া, হড়্‌বড়্ করিয়া যা তা খানিকটা বলিয়া গেলাম- এবং তাহার উত্তরে পণ্ডিতমহাশয়ের নাকের ভিতর হইতে অতি সুন্দর ঘড়্‌ঘড়্ শব্দ শুনিয়া বুঝিলাম নিদ্রা বেশ গভীর হইয়াছে। কাজেই আমরাও শ্লেট লইয়া ‘টুকটাক্’ আর ‘দশ-পঁচিশ’ খেলা শুরু করিলাম। কেবল মাঝে মাঝে যখন ঘড়্‌ঘড়ানি কমিয়া আসিত- তখন সবাই মিলিয়া সুর করিয়া ‘নদী নদ্যৌ নদ্যঃ’ ইত্যাদি আওড়াইতাম। দেখিতাম, তাহাতে ঘুমপাড়ানি গানের ফল খুব আশ্চর্যরকম পাওয়া যায়।

সকলে খেলায় মত্ত, কেবল দাশু এককোনায় বসিয়া কি যেন করিতেছে- সেদিকে আমাদের কোনো খেয়াল নাই। একটু বাদে পণ্ডিতমহাশয়ের চেয়ারের তলায় তক্তার নীচ হইতে ‘ফট্’ করিয়া কি একটা আওয়াজ হইল। পণ্ডিতমহাশয় ঘুমের ঘোরে ভ্রূকুটি করিয়া সবেমাত্র ‘উঃ’ বলিয়া কি যেন একটা ধমক দিতে যাইবেন, এমন সময় ফুট্‌ফাট্, দুম্‌দাম্, ধুপ্‌ধাপ্ শব্দে তাণ্ডব কোলাহল উঠিয়া সমস্ত স্কুলটিকে একেবারে কাঁপাইয়া তুলিল। মনে হইল যেন যত রাজ্যের মিস্ত্রি-মজুর সবাই একজোটে বিকট তালে ছাত পিটাইতে লাগিয়াছে- দুনিয়ার কাঁসারি আর লাঠিয়াল সবাই যেন পাল্লা দিয়ে হাতুড়ি আর লাঠি ঠুকিতেছে। খানিকক্ষণ পর্যন্ত আমরা, যাহাকে পড়ার বইয়ে ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ বলে, তেমনি হইয়া হাঁ করিয়া রহিলাম। পণ্ডিতমহাশয় একবার মাত্র বিকট শব্দ করিয়া তার পর হঠাত্‍‌ হাত-পা ছুঁড়িয়া একলাফে টেবিল ডিঙাইয়া একেবারে ক্লাশের মাঝখানে ধড়্‌ফড়্ করিয়া পড়িয়া গেলেন। সরকারি কলেজের নবীন পাল বরাবর ‘হাইজাম্পে’ ফার্স্ট প্রাইজ পায়; তাহাকেও আমরা এরকম সাংঘাতিক লাফাইতে দেখি নাই। পাশের ঘরে নীচের ক্লাশের ছেলেরা চীত্‍‌কার করিয়া ‘কড়াকিয়া’ মুখস্থ আওড়াইতেছিল- গোলমালে তারাও হঠাত্‍‌ আড়ষ্ট হইয়া থামিয়া গেল। দেখিতে দেখিতে স্কুলময় হুলস্থূল পড়িয়া গেল- দরোয়ানের কুকুরটা পর্যন্ত যারপরনাই ব্যস্ত হইয়া বিকট কেঁউ কেঁউ শব্দে গোলমালের মাত্রা ভীষণরকম বাড়াইয়া তুলিল।

পাঁচ মিনিট ভয়ানক আওয়াজের পর যখন সব ঠাণ্ডা হইয়া আসিল, তখন পণ্ডিতমহাশয় বলিলেন, “কিসের শব্দ হইয়াছিল দেখ।” দরোয়ানজি একটা লম্বা বাঁশ দিয়া অতি সাবধানে, আস্তে আস্তে তক্তার নীচ হইতে একটা হাঁড়ি ঠেলিয়া বাহির করিল- রামপদর সেই হাঁড়িটা; তখনো তার মুখের কাছে একটু মিহিদানা লাগিয়াছিল। পণ্ডিতমহাশয় ভয়ানক ভ্রূকুটি করিয়া বলিলেন, “এ হাঁড়ি কার?” রামপদ বলিল, “আজ্ঞে, আমার।” আর কোথা যায়- অমনি দুই কানে দুই পাক! “হাঁড়িতে কি রেখেছিলি?” রামপদ তখন বুঝিতে পারিল যে গোলমালের জন্য সমস্ত দোষ তাহারই ঘাড়ে আসিয়া পড়িতেছে! সে বেচারা তাড়াতাড়ি বুঝাইতে গেল, “আজ্ঞে, ওর মধ্যে করে মিহিদানা এনেছিলাম, তার পর” – মুখের কথা শেষ না হইতেই পণ্ডিতমহাশয় বলিলেন, “তার পর মিহিদানাগুলো চীনে পটকা হয়ে ফুটতে লাগল- না?” বলিয়াই ঠাস্ ঠাস্ করিয়া দুই চড়!

অন্যান্য মাস্টাররাও ক্লাশে আসিয়া জড়ো হইয়াছিলেন; তাঁহারা একবাক্যে হাঁ হাঁ করিয়া রুখিয়া আসিলেন। আমরা দেখিলাম বেগতিক। বিনা দোষে রামপদ বেচারা মার খায় বুঝি! এমন সময় দাশু আমার শ্লেটখানা লইয়া পণ্ডিতমহাশয়কে দেখাইয়া বলিল, “এই দেখুন, আপনি যখন ঘুমোচ্ছিলেন, তখন ওরা শ্লেট নিয়ে খেলা কচ্ছিল- এই দেখুন, টুকটাকের ঘর কাটা।” শ্লেটের উপর আমার নাম লেখা- পণ্ডিতমহাশয় আমার উপর প্রচণ্ড এক চড় তুলিয়াই হঠাৎ কেমন থতমত খাইয়া গেলেন। তাহার পর দাশুর দিকে কট্‌মট্ করিয়া তাকাইয়া বলিলেন, “চোপ্‌রও, কে বলেছে আমি ঘুমোচ্ছিলাম?” দাশু খানিকক্ষণ হাঁ করিয়া বলিল, “তবে যে আপনার নাক ডাকছিল?” পণ্ডিতমহাশয় তাড়াতাড়ি কথাটা ঘুরাইয়া বলিলেন, “বটে? ওরা সব খেলা কচ্ছিল? আর তুমি কি কচ্ছিলে?” দাশু অম্লানবদনে বলিল, “আমি তো পটকায় আগুন দিচ্ছিলাম।” শুনিয়াই তো সকলের চক্ষুস্থির! ছোকরা বলে কি?

প্রায় আধমিনিটখানেক কাহারো মুখে আর কথা নাই! তার পর পণ্ডিতমহাশয় ঘাড় বাঁকাইয়া গম্ভীর গলায় হুংকার দিয়া বলিলেন, “কেন পটকায় আগুন দিচ্ছিলে?” দাশু ভয় পাইবার ছেলেই নয়, সে রামপদকে দেখাইয়া বলিল, “ও কেন আমায় মিহিদানা দিতে চাচ্ছিল না?” এরূপ অদ্ভুত যুক্তি শুনিয়া রামপদ বলিল, “আমার মিহিদানা আমি যা ইচ্ছা তাই করব।” দাশু তৎক্ষণাৎ বলিয়া উঠিল, “তা হলে, আমার পটকা, আমিও যা ইচ্ছা তাই করব।” এরূপ পাগলের সঙ্গে আর তর্ক করা চলে না! কাজেই মাস্টারেরা সকলেই কিছু কিছু ধমকধামক করিয়া যে যার ক্লাশে চলিয়া গেলেন। সে ‘পাগলা’ বলিয়া তাহার কোনো শাস্তি হইল না।

ছুটির পর আমরা সবাই মিলিয়া কত চেষ্টা করিয়াও তাহাকে তাহার দোষ বুঝাইতে পারিলাম না। সে বলিল, “আমার পটকা রামপদর হাঁড়ি। যদি আমার দোষ হয়, তা হলে রামপদরও দোষ হয়েছে। বাস্! ওর মার খাওয়াই উচিত।”