Tuesday, May 7, 2019

রবীন্দ্রনাথ ও রোলিং: আলাদা হয়েও অভিন্ন


মোজাফ্ফর হোসেন

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনের ব্যাপ্তিকাল ছিল ১৮৬১-১৯৪১ পর্যন্ত। বাংলা সাহিত্যে কবিতা, উপন্যাস, নাটক, গান ও প্রবন্ধে তাঁর মেধা ও গভীর জীবনদর্শনের যে পূর্ণতা ঘটেছিল তা তাঁর ছোটগল্পে এসে অনেকখানি উপচে পড়েছে। প্রায় ১১৯ টির মতো ছোটগল্প লিখেছেন তিনি, যার মধ্যে ‘পোস্টমাস্টার’পাঠকদের মনে আলাদাভাবে জায়গা করে নিয়েছে।

অন্যদিকে গভীর জীবনবোধ সম্পন্ন আমেরিকান আরেক গল্পকার মারজরি কিনান রোলিং Marjorie Kinnan Rawlings,, ১৮৯৬-১৯৫৩) সাহিত্যের সব শাখায় পদচারণা না করলেও গল্প ও উপন্যাস The Yearling) লিখে বিশ্ব সাহিত্যে বেশ সম্মানের সাথে ঠাঁই পেয়েছেন। তাঁর রচিত গল্পের সংখ্যা ২৮টি; যা রবীন্দ্রনাথের তুলনায় বেশ কম। আরও বহুদিক থেকে অমিল থাকা স্বত্বেও মারজরি কিনান রোলিং-এর ছোটগল্প ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ (A Mother in Mannville) এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘পোস্টমাস্টার’ উভয়ের মধ্যে এনে দিয়েছে চিন্তা, চেতনা ও অনুভবের এক অসম্ভব ঐক্য।

খ.
রোলিং ইংরেজি সাহিত্যে ছোটগল্পের এক দক্ষ কারিগর হিসেবে সুপরিচিত। তাঁর গল্পের বিশেষত্ব হচ্ছে: মানুষের সাথে পরিবেশ ও পরিস্থিতির মধ্যেকার দ্বন্দ্বের শৈল্পিক উপস্থিতি। তিনি প্রকৃতির মাঝে থাকতে বেশি পছন্দ করতেন; তাইতো প্রায়ই দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করে ফ্লোরিডা থেকে ছুটে যেতেন দক্ষিণ ক্যারোলিনা দ্বীপপুঞ্জের নিশ্চুপ, ছন্দময় প্রকৃতির মাঝে। অনেকে মনে করেন, লেখিকা এখানে জেরি নামক একটি অনাথ শিশুর সাক্ষাৎ পান, তার জন্যে তিনি খুব কষ্ট অনুভব করেন। ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পে একজন শিল্পীর দায়িত্ববোধ থেকেই লেখিকা জেরির আবেগ-অনুভূতির সার্থক বহিঃপ্রকাশ ঘটান।

জমিদারি তদারকি উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙলার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়ান, পরিচিত হন বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি ও মানুষের সাথে; যার নির্যাস পাওয়া যায় তাঁর প্রতিটি গল্পে।‘পোস্টমাস্টার’গল্পটিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিছক মনগড়া কাহিনী নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে তিনি পেয়েছেন এই গল্পের চরিত্রগুলোর পরিচয়। যে অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি নিজে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখেছিলেন, “পোস্ট মাস্টারটি আমার বজরায় এসে বসে থাকত। ফটিককে দেখেছি পদ্মার ঘাটে। ছিদামদের দেখেছি আমাদের কাছারিতে। ওই যারা কাছে এসেছে তাদের কতকটা দেখেছি, কতকটা বানিয়ে নিয়েছি।” অন্যত্রে লিখেছিলেন,“আমার গল্পে বাস্তবের অভাব কখন ঘটে নি। যা কিছু লিখেছি, নিজে দেখেছি, মর্মে অনুভব করেছি, সে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা।” একই মনোভাব তাঁর আরও একটি উক্তিতে ফুটে ওঠে,’আমি একটা কথা বুঝতে পারি নে, আমার গল্পগুলোকে কেন গীতিধর্মী বলা হয়। এগুলো নেহাত বাস্তব জিনিস। যা দেখেছি, তাই বলেছি। ভেবে বা কল্পনা করে আর কিছু বলা যেত, কিন্তু তা তো করি নে আমি।’ বাস্তবতার স্পর্শ থাকে বলেই ‘পোস্টমাস্টার’ ও ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পের অন্যতম প্রধান চরিত্র রতন ও জেরির আবেগ-অনুভূতি পাঠকদের বিশেষভাবে নাড়া দেয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটি লেখেন ১৮৯১ সালে আর ‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পটি লেখা হয় ১৯৩৬ সালে।

দুটি গল্পে পরিবেশ, কাল ও পাত্র ভিন্ন হলেও পরিসীমা, প্রকাশভঙ্গী, ঘটনার প্রবাহ, চরিত্রের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও বোঝাপড়া, জীবনদর্শন এবং সর্বোপরি পাঠকের বেদনা ও আত্মপোলব্ধিতে আশ্চর্যরকমের ছন্দ খুঁজে পাওয়া যায়। গল্পদুটি শুরু হয় দুটি চরিত্রের নতুন পরিবেশে আগমনের মধ্যে দিয়ে। ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে পোস্টমাস্টার কলকাতার ছেলে, নিতান্তই কাজের প্রয়োজনে উলাপুর নামক ছোট্ট একটি গ্রামে এসে তাকে থাকতে হয়। এখানে তার সঙ্গী বলতে পিতৃ-মাতৃহীনা অনাথ বালিকা রতন ছাড়া আর বিশেষ কেউ হয়ে ওঠে না।

‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পে লেখিকা ক্যারোলিনা দ্বীপপুঞ্জে কয়েকটি লেখা শেষ করার উদ্দেশ্যে ছুটি কাটাতে যান; যেখানে জীবনের আনাগোনা খুবই কম, কান পাতলে শোনা যায় প্রকৃতির ফিস্ফাস্। এখানে এসে লেখিকা জেরি নামক এক বালকের সাথে পরিচিত হন; জেরি হয়ে ওঠে লেখিকার খুব কাছের একজন।

গ.

দুটি গল্পে চারপাশের চিত্র ও চরিত্রকে স্বল্প পরিসরে স্পষ্টভাবে অংকন করা হয়েছে। এক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতিকে নিয়ামক হিসাবে উপস্থাপন করেছেন।‘পোস্টমাস্টার’ গল্পে প্রকৃতির মাঝে ডুব দিয়ে অনুভব করতে হয় গল্পের প্রধান চরিত্র, পোস্টমাস্টার আর রতনের অনুভূতি। গল্পের কাহিনীর শুরু এবং সমাপ্তি ঘটে উলাপুর নামক ছোট্ট একটি গ্রামে। পোস্টমাস্টার শহরের ছেলে তাই নিতান্তই কাজের প্রয়োজনে এখানে থাকতে হয়। অন্ধকার আটচালার মধ্যে তার অফিস; দূরে একটি পানা পুকুর আছে যার চারিধার জঙ্গলে ঘেরা। পর্যাপ্ত আলো বাতাসের অভাব না ঘটলেও পোস্টমাস্টারের অবস্থা ডাঙায় তোলা মাছের মতন। গ্রামের মানুষজনের ভদ্রসমাজের আচার-রীতি জানা নেই, এছাড়াও নিকটে নীল কুঠি থাকায় অনুমান করা যেতে পারে, গ্রামে ইংরেজদের শাসন ও শোষণ দুটোই বিদ্যমান। তাইতো পোস্টমাস্টারের সাথে বাইরের জগতের কোন যোগসূত্র থাকে না। হাতে কাজ না থাকলে কবিতা লেখার চেষ্টা করেন, তাতে প্রকৃতির স্তব গান রচিত হয় ঠিকই—“কিন্তু অন্তর্যামী জানেন, যদি আরব্য উপন্যাসের কোনো দৈত্য আসিয়া এক রাত্রের মধ্যে এই শাখাপল্লব-সমেত সমস্ত গাছগুলো কাটিয়া পাকা রাস্তা বানাইয়া দেয়, এবং সারি সারি অট্টালিকা আকাশের মেঘকে দৃষ্টিপথ হইতে রুদ্ধ করিয়া রাখে, তাহা হইলে এই আধমরা ভদ্রসন্তানটি পুনশ্চ নবজীবন লাভ করিতে পারে।”

সন্ধ্যায় যখন গ্রামের গোয়ালঘর থেকে ধূপের ধোঁয়া রাজ্যভ্রমণে বের হয়, ঝোপে ঝাড়ে ঝিল্লি ডাকে, নেশাখোর বাউলের দল উচ্চস্বরে গেয়ে ওঠে; আবার যখন—বর্ষায় ‘মেঘমুক্ত দ্বিপ্রহরে ঈষৎ-তপ্ত সুকোমল বাতাস’ বইতে থাকে এবং ভেজা প্রকৃতির গন্ধে মাতাল হয়ে একটি পাখি তার’একটানা সুরের নালিশ ...করুন সুরে বার বার আবৃতি’ করে তখন পোস্টমাস্টারের মন প্রিয়জনদের জন্য আনচান করে ওঠে। এ যেন প্রকৃতির সাথে ব্যথার আত্মার আত্মীয়তা !

আবার পোস্টমাস্টার যখন রতনকে বলে,’আর আসব না’। তখন তাদের গভীর নীরবতা ভেঙ্গে, ঘরের জীর্ণ চাল ভেদ করে একটি মাটির সরার উপর টপটপ করে বৃষ্টির জল পড়তে থাকে। প্রকৃতি আর মানব হৃদয় যেন একই সুরে গাঁথা! তাইতো পোস্টমাস্টার যখন রতনকে রেখে নৌকায় ওঠে-- বর্ষায় প্লাবিত জলরাশি পোস্টমাস্টারের চোখের অশ্রুর মতো ছলছল করতে থাকে, পোস্টমাস্টারকে জানিয়ে দেয় রতনকে সঙ্গে আনার কথা, একইসাথে পালের হাওয়া ও অনুকূল স্রোতধারা নদীকূলের শ্মশান ঘাট দেখিয়ে পোস্টমাস্টারের বেদনাহত হৃদয়কে জানান দেয়-- বিচ্ছেদই জীবনের চিরন্তন সত্য।

দুটি গল্পেই, বিদায়ী যাত্রায় প্রকৃতি পোস্টমাস্টার ও লেখিকার জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পোস্টমাস্টারের নৌকা অনুকূল স্রোত ও পালের হাওয়ায় দ্রুততার সাথে গন্তব্যের দিকে ধাবিত হয়। এবং লেখিকা গাড়িতে চড়ে অনুধাবন করেন-- "The sun was in the west and I should do well to be out of the mountains by nightfall.”

‘এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পে প্রকৃতিকে তুলে ধরা হয়েছে উপমা (Simile) ও রূপকের (Metaphor) মাধ্যমে। গল্পের শুরুতে ক্যারোলিনা দ্বীপপুঞ্জের চিত্র আঁকা হয়েছে এভাবে--

"...fog hides the Mountain peaks, the snow swirls down the valleys, and wind blows so bitterly that the orphanage boys…reach the door with fingers stiff in an agony of mumbness…”

লেখিকা জেরির শৈল্পিকভাবে কাঠ কাটার শব্দকে তুলে ধরেছেন এভাবে--

" The sounds no more of an interruption than a consistence rain.”

এবং জেরি যখন কাঠ চেরাই শেষ করে লেখিকার কেবিনের দিকে উঠে আসে তখন প্রকৃতির অবস্থা তুলে আনা হয় এভাবে--

"The sun was dropping behind the farthest mountain and valleys were purple with something deeper than the asters.”

লেখিকা জেরির স্বরূপ বর্ণনাতেও রূপকের ও উপমার আশ্রয় "His hair was the colour of the corn shocks, and his eyes, very direct, were like the mountain sky when rain is pending-gray…” এবং "…light came over him, as though the setting sun had touched him with the same suffused glory with which it touched the mountains.” Ges A curtain lifted, so that I saw deep into the clean well of his eyes and gratitude was there, and affection, soft over the firm granite of his character.” এছাড়াও লেখিকার চলে যাবার কথা শুনে জেরির নীরবে চলে যাবার দৃশ্যটি বর্ণনা করা হয়েছে "...a new moon hung over the mountain, and I watched him go in silence up the hill.” এমনিভাবে লেখিকা রোলিং “এ মাদার ইন ম্যানভিল গল্পে” দক্ষতার সাথে শৈল্পিক উপায়ে প্রকৃতিকে ফুটিয়ে তুলেছেন।

ঘ.

অনাথ শিশু রতন ও জেরি-- এই দুটি চরিত্রকে কেন্দ্র করে গল্পদুটি আবর্তিত হয়। রতন নিজের সম্পর্কে খুব বেশি বলে না, চাইলেও বাবার সন্ধ্যাবেলার ঘরে ফেরার দৃশ্য ও ছোটভাইয়ের সঙ্গে মিছামিছি মাছ ধরার খেলা ছাড়া আর বিশেষ কিছু স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে না তার; তাইতো পোস্টমাস্টারের পারিবারিক গল্প শোনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে থাকে এবং আলাপচারিতায় চিরপরিচিতের ন্যায় পোস্টমাস্টারের পরিবারের সকলকে’মা দিদি দাদা’ বলেই সম্বোধন করে। রতন আর পোস্টমাস্টারের সম্পর্ক তখন আর কাজের মেয়ে ও প্রভুর সম্পর্ক থাকে না; বয়সের পার্থক্য ও শ্রেণিবৈষম্য ঘুচে গড়ে ওঠে মানবিক সম্পর্ক। লেখিকা ও জেরির মধ্যেও অভিন্ন সমীকরণ লক্ষ্য করা যায়। তবে’পোস্টমাস্টার’গল্পটিতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধুমাত্র গল্পকথকের ভূমিকায় অবতীর্ণ (3rd person narrative) হওয়াই রতনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তেমন করে ফুটে ওঠে না যেমন করে “এ মাদার ইন ম্যানভিল” গল্পে জেরির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। “এ মাদার ইন ম্যানভিল” গল্পে মারজোরি কিনান নিজেই অন্যতম প্রধান চরিত্র (1st person narrative), তাই জেরিকে খুব কাছ থেকে অনুভব করতে পারেন-- গল্পটি অনেকাংশে হয়ে ওঠে চরিত্র নির্ভর।

জেরির তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার পরিচয় মেলে যখন জেরি লেখিকার দ্বিধা দূর করতে "Size don’t matter chopping wood.” এবং জেরির সততা ও স্বাধীনচেতার পরিচয় পাওয়া যায় যখন হাতল ভাঙ্গা কুড়াল দেখিয়ে লেখিকাকে বলে-- "I’ll pay for it, I broke it. I brought the axe down careless.” তখন লেখিকার ব্যবহৃত Integrity শব্দটি জেরির ক্ষেত্রে যথার্থই মনে হয়। এছাড়াও উপহার পেলে জেরি একবার উপহার, একবার লেখিকার দিকে তাকায়-- ধন্যবাদ শব্দটির উপস্থিতি যেন তার অভিধানে নেই; লেখিকা তার চোখের দিকে তাকিয়ে অনুধাবন করেন কৃতজ্ঞতা ও মুগ্ধতার এক মিশ্র অনুভূতি।

ঙ.

শিশুদের সাথে পরিবারের সম্পর্ক শক্তিশালী ও অবিচ্ছেদ্য। মা-বাবা ও ভাই-বোনের অকৃত্রিম ভালোবাসা তাদের শিরা উপশিরায় বয়ে আনে অপার আনন্দ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এবং রোলিং তাঁদের গল্পের উপজীব্য হিসেবে তুলে নিয়েছেন অনাথ শিশু রতন আর জেরিকে। গল্পে দুজনের পরিচয় দেওয়া হয়েছে এভাবে--

‘মেয়েটির নাম রতন বয়স বারো-তেরো।’ (পোস্টমাস্টার ) এবং

"his name was Jerry; he was about twelve years old and he had been at the orphanage since he was four.’ (এ মাদার ইন ম্যানভিল )।

পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ও ভালোবাসার কাঙাল হওয়ার দরুন রতন ও জেরি খুব সহজে তাদের মনিব পোস্টমাস্টার ও লেখিকাকে আপন করে নিয়েছে।

রতন তার দাদাবাবু অর্থাৎ পোস্টমাস্টারের পরিবারের গল্প শুনে নিজেকে সেই পরিবারের একজন হিসেবে ভাবতে থাকে। পোস্টমাস্টারের সেবায় সে তার বালিকা হৃদয় উজাড় করে দেয়। রান্না করা, গোসলের পানি আনা, তামাক সাজার কাজগুলো এত মনোযোগ ও ভালোলাগার সাথে করে যে কাজগুলো করে এতটুকু ক্লান্তিবোধ করে না। পোস্টমাস্টার রতনকে পড়ালে রতন বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়তে থাকে; রতন পড়াশুনার মর্ম উপলব্ধি না করলেও দাদার আগ্রহে যাতে কমতি না ঘটে সে জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে। পোস্টমাস্টার অসুস্থ হলে রতন তার সেবায় নিজেকে উজাড় করে দেয়। বালিকা রতন আর তখন বালিকা থাকে না।’সেই মুহূর্তে সে জননীর পদ অধিকার করিয়া বসিল’। রতন ডাক্তার ডেকে আনে, যথাসময়ে ঔষধ খাওয়ায়, সারারাত শিয়রে জেগে থাকে আর থেকে থেকে জানতে চায়,’হাঁগো দাদাবাবু, একটুখানি ভালো বোধ হচ্ছে কি?’ রতন দাদাবাবুর সান্নিধ্য পাবার জন্য ঘরের বাইরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। সুযোগ পেলেই একজন যথার্থ শ্রোতার বেশে দাদাবাবুর হাঁটুর কাছে বসে পড়ে। এই সখ্যর সূত্র ধরে গল্পের শেষের দিকে পোস্টমাস্টার চলে যেতে চাইলে রতন একবুক আশা নিয়ে পোস্টমাস্টারের সঙ্গী হবার আশাবাদ ব্যক্ত করে।

একইভাবে, জেরি এবং লেখিকার সম্পর্কও তথাকথিত মনিব ও কাজের ছেলের সম্পর্ক ভেঙ্গে নতুন এক সম্পর্কের জন্ম দেয়। কাঠচেরাই করার জন্য জেরিকে ঠিক করা হলেও সে সার্বিকভাবে লেখিকা ও তাঁর কুকুরটির খোঁজখবর রাখে। লেখিকা যাতে বৃষ্টির মৌসুমে শুকনো কাঠ পায় সে জন্যে কিছু কাঠ গর্তে সরিয়ে রাখে, এছাড়াও লেখিকার হাঁটার পথে একটি পাথর পড়ে থাকলে জেরি গর্ত করে সেঁটে দেয়, যে কাজগুলোকে লেখিকা বলেছেন’ Ô...unnecessary things…done only by the great of heart.’ সময়ের পরিক্রমায় জেরি ও লেখিকা পরস্পরের খুব কাছের মানুষ হয়ে ওঠে। জেরিও রতনের মতন লেখিকার সান্নিধ্য পাবার জন্য কেবিনের বাইরে ঘোরাফেরা করে এবং সুযোগ পেলেই লেখিকার পাশে বসে পড়ে। গল্পে বেশ কয়েকবার এই দৃশ্যের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে --

"He made simple excuses to come and sit with.”

"He sat by fire with me.”

"He came everyday…and stayed to talk.”

"He would lie on the floor…and wait quietly for me.”

একরাতে জেরি খুব আবেগপ্রবণ হয়ে লেখিকাকে বলে,’তুমি দেখতে খানিকটা আমার মার মতোই’, যে ম্যানভিলে বাস করে এবং প্রতি বড়দিন ও জন্মদিনে তাকে উপহার পাঠায়। জেরি গর্বের সাথে বলে, গত বড়দিনের আগেরবার তার মা তাকে একজোড়া জুতা উপহার দিয়েছে এবং আরো জানায়, লেখিকার দেওয়া এক ডলার টাকা দিয়ে সে তার মাকে একজোড়া হাত মোজা কিনে দেবে। গল্পের শেষে লেখিকার প্রতি জেরির ভালোবাসা আরো তীব্রভাবে ধরা দেয় যখন মিস ক্লার্ক বলেন, "He has no mother. He has no skates.’ জেরি লেখিকাকে তার ম্যানভিলে বসবাসরত মায়ের গল্প শোনায়, যে প্রকৃতপক্ষে তার স্বপ্নে বাস করে, কারণ সে লেখিকার মধ্যে তার মায়ের প্রতিচ্ছবি খুঁজে পায়। জেরি লেখিকার ভেতরের মাতৃত্বকে ছুঁতে চায় সর্বাঙ্গে। জেরি লেখিকা ও তাঁর পোষা প্রাণীটিকে জীবনের একটি পরিপূর্ণ অধ্যায়রূপে ভাবতে শুরু করে এবং লেখিকাকে তা অবগত করাতে সাধ্যমত চেষ্টা করে।

একইভাবে, পোস্টমাস্টার গল্পে রতন তার নারীসুলভ আচরণ দিয়ে পোস্টমাস্টারের হৃদয়ে পাকাপক্ব আসন গেড়ে নিতে চায়।

এখানে রতন আর জেরির প্রতি পোস্টমাস্টার ও লেখিকার ভালোবাসা দায়িত্ববোধ ও করুনা থেকে নিঃসৃত কিন্তু তাঁদের প্রতি রতন আর জেরির যে ভালোবাসা তাতে কোন খাদ নেই; অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে এ ভালোবাসার স্রোতধারা প্রবাহিত হয় -- সমাজের চিরন্তন কোন নিয়মের ছাঁচে পিষ্ট হয়ে নয়।

চ.
‘পোস্টমাস্টার’ ও’এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পের সমাপ্তির দিকে এসে পাঠকদের হৃদয়ে একই ব্যথার সুর অনুরণিত হয়। পোস্টমাস্টার যখন রতনকে বলে,’রতন, কালই আমি যাচ্ছি।’ এবং লেখিকা জেরিকে, "I am leaving tomorrow’। রতন আর জেরি যেন বাক হারিয়ে প্রাচীন বৃক্ষের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে নির্লিপ্তভাবে। নিজেদের ভেতর আর থাকে না তারা, নিমিষে পৃথিবীর সবখানে কি যেন হাতড়ে আসে! রতন পোস্টমাস্টারের সাথে যাবার ইচ্ছা পোষণ করে বলে, “দাদাবাবু, আমাকে তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে?” কিন্তু জেরি আর কোন কথাই বলে না। সে হয়ত বুঝতে পেরেছিল পোস্টমাস্টারের মতো লেখিকাও বলবে, “সে কী করে হবে।”

পোস্টমাস্টার চলে যাবার সময় বলে, “রতন, আমার জায়গায় যে লোকটি আসবে তাঁকে বলে দিয়ে যাব, তিনি তোকে আমারই মতন যত্ন করবেন; আমি যাচ্ছি বলে তোকে কিছু ভাবতে হবে না।” এবং “রতন, তোকে আমি কখনো কিছু দিতে পারি নি। আজ যাবার সময় তোকে কিছু দিয়ে গেলুম, এতে তোর দিন কয়েক চলবে।” তাঁর কথাগুলো রতনের গায়ে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতন বিঁধে। বালিকা রতন আর আবেগকে দমিয়ে রাখতে পারে না; পোস্টমাস্টারের পা জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে, “দাদাবাবু, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে কিছু দিতে হবে না; তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমার জন্য কাউকে কিছু ভাবতে হবে না।”

একইভাবে, লেখিকার অনুভূতি -- "You have been my good friend, Jerry. I shall often miss you. Pat will miss you too.’ এবং æbut here’s some money I’d like to leave with you to buy things for him…” জেরির কাছে আরো অসহনীয় হয়ে ওঠে। সে দুপুরের খাবার না খেয়ে সবার আড়াল হয়ে যায়।

বিদায়ী মুহূর্তে পোস্টমাস্টারের সাথে রতনের এবং লেখিকার সাথে জেরির আর দেখা হয় না। নৌকা ছাড়লে পোস্টমাস্টার রতনের জন্য গভীর ব্যথা অনুভব করে; ইচ্ছা করে -- “ফিরিয়া যাই, জগতের ক্রোড়বিচ্যুত সেই অনাথিনীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসি।” কিন্তু ততক্ষণে সময় পেরিয়ে গেছে অনেক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন নদীকূলের শ্মশান ঘাট দেখিয়ে পোস্টমাস্টারকে আত্ম-সান্ত¡নার গভীর দর্শন উপলব্ধি করান -- “জীবনে এমন কত বিচ্ছেদ, কত মৃত্যু আছে, ফিরিয়া ফল কী। পৃথিবীতে কে কাহার।” সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে। একইভাবে,’এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পে লেখিকা জেরির শেষ দর্শন না পেয়ে আত্ম-সান্ত¡নার দর্শন আওড়ায়-- "I was almost relieved for I knew I should never see him again, and it would be easier not to say good-bye to him”. কিন্তু রতন আর জেরি আত্ম সান্ত¡নার কোন উপলক্ষ দাঁড় করাতে পারে না। আত্মসমর্পণ করে মানব জীবনের সহজ ও সাধারণ মূর্খতার কাছে, তা হল আশা করা। রতন অফিস কক্ষের চতুর্দিকে ঘুরতে থাকে তার “দাদাবাবু যদি ফিরিয়া আসে” এই আশাতে। জেরি কতদিন লেখিকার কেবিনের চারপাশে আশায় বুক বেধে নিয়ে ছুটে গেছে কে জানে!

ছ.

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’পোস্টমাস্টার’গল্পে কলকাতার উলাপুর গ্রামে ভরা বর্ষার আবহে যে বার বর্ষীয়ান অনাথা বালিকার স্বপ্ন ভঙ্গের ইতিহাস রচনা করেছেন তার--ই পুনরাবৃত্তি ঘটেছে মারজোরি কিনান রোলিং এর’এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পে ক্যারোলিনা দ্বীপপুঞ্জে অসহনীয় শীতের মাঝে বসবাসরত আরেক বার বর্ষীয়ান অনাথ বালক জেরির মধ্য দিয়ে। দুটি গল্প ভিন্ন দুটি আবহ ও ভিন্ন ভিন্ন চরিত্র নিয়ে গড়ে উঠলেও বেশ কয়েকটি দিক থেকে অভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। রবীন্দ্রনাথ ও রোলিং তাঁদের গল্পের উপজীব্য হিসেবে দুটি বার বছর বয়সের অনাথ শিশুকে বেছে নিয়েছেন। এক্ষেত্রে, রবীন্দ্রনাথ য়ুংয়ের (Jung) ‘ইলেক্টা কমপ্লেক্স’ (Electra Complex) ও রোলিং ফ্রয়েডের (Freud)’ইডিপাস কমপ্লেক্স’ (Oedipus Complex) -কে চরিত্র চয়নের ক্ষেত্রে প্রাধান্য দিয়েছেন।’পোস্টমাস্টার’গল্পের প্রধান চরিত্র পুরুষ হওয়ায় রবীন্দ্রনাথ অন্য একটি প্রধান চরিত্র হিসাবে রতন নামের একটি বালিকাকে দাঁড় করিয়েছেন। একইভাবে, রোলিং তাঁর’এ মাদার ইন ম্যানভিল’ গল্পে দুটি বিপরীত লিঙ্গের সহাবস্থান দেখান: লেখিকা ও জেরি। ছেলেরা মাকে বেশি ভালোবাসে, মেয়েরা বাবাকে -- প্রকৃতির চিরন্তন নিয়ম এটাই। তাইতো জেরি খুব সহজেই লেখিকাকে মায়ের স্থানে ভাবতে পারে, রতন পোস্টমাস্টারকে দাদা ডেকে আপন করে নেয় নিমিষে। ভালোবাসার দুর্বোধ্য এই জালে জড়িয়ে পড়েন লেখিকা এবং পোস্টমাস্টারও।

রবীন্দ্রনাথ ও রোলিং গল্পের শিশুচরিত্র রতন ও জেরির জেন্ডার বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। রতনের মাতৃসুলভ আচরন ও জেরির কাঠ কাটার সামর্থ তাদের ভেতরের নারী ও পুরুষ সত্তার প্রকাশ ঘটাই। রতনের সুপ্ত নারীসত্তা যেমন পোস্টমাষ্টারকে কাছে নেটে নেয়, তেমনি জেরির ভেতরের সুপ্ত পুরুষত্ব লেখিকাকে আপন করে নিতে সাহায্য করে।

দুটি গল্পেই রতন ও জেরি তাদের একাকীত্ব ঘুঁচিয়ে পোস্টমাস্টার ও লেখিকাকে অবলম্বন করে নতুন জীবনের সন্ধান করতে চায়। কিন্তু পোস্টমাস্টার ও লেখিকা তা পারেন না। তারা জগতের নিয়মের কাছে অপারগতা প্রকাশ করেন। যে রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরের সেই অমোধ বানী-- লেট দেয়ার বি লাইট, সো দেয়ার ওয়াজ লাইট, কথাটি আরোপ করলেন ব্যক্তির ওপরে-- আমি ফুলকে বললাম সুন্দর, সুন্দর হল সে। এখানে সেই রবীন্দ্রনাথই দাড় করালেন অস্তিত্ব বিরোধী (anti-existentialist) পোস্টমাস্টারকে। রোলিংও ব্যর্থ হলেন সিদ্ধান্ত নিতে। এখানেই অবুঝ রতন আর জেরির কাছে পরাজয় ঘটলো অভিজ্ঞ পোস্টমাস্টার ও লেখিকার। বাস্তবতার দোহায় দিয়ে মানবতার পরাজয় ঘটলো জীবনবাদী দুই লেখকের গল্পেই।

পোস্টমাস্টারের এই পরাজয়ের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল ঔপনিবেশিক চেতনা। কেননা তার যে অস্তিত্ব সেটা ছিল সর্বাংশে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে বাঁধা। যে কারণে রতনের মতো মানবিক সম্পর্কের বোধ তার ছিল না। রতন তার সঙ্গে যেতে চাইলে সে এই চাওয়ার কোনো হেতু খুঁজে পায় না। পরিবর্তে সে টাকা দিতে চায়। সবকিছু মাপার মাণদ- হলো অর্থ, এ জ্ঞান তার ঔপনিবেশিক শাষণ ব্যাবস্থার কাছ থেকে রপ্ত। নামহীন এই পোস্টমাস্টার কলকাতা ফিরে যেতে পারলেই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে, অথচ সে গ্রাম্যপ্রকৃতির প্রতি মুগ্ধতা দেখিয়ে কাব্যচর্চা করে। এমনই মিথ্যাচার সে বহন করে মানবিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। অন্যদিকে রোলিংও অবচেতনে পোস্টমাস্টারের মতোই সাম্রাজ্যবাদী চেতনার বাহক। তিনি জীবন নিয়ে লিখবেন বলে জীবনের কাছাকাছি গেলেন, লেখা শেষ হতেই সেই জীবনকে কোন তোয়াক্তা না করেই আবার নিজের মধ্যবিত্তের ভোগবাদী জীবনের মোহে শহরে ফিরে আসলেন। একইরকম স্ববিরোধী চেতনার বাহক তিনি নিজেও। দুটি গল্পেই দুই জীবনবাদী লেখক তাদের নিজেদের অবস্থান নিয়ে নিজেরাই উপহাস করলেন।

Sunday, May 5, 2019

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প : ক্ষুধিত পাষাণ


আমি এবং আমার আত্মীয় পূজার ছুটিতে দেশভ্রমণ সারিয়া কলিকাতায় ফিরিয়া আসিতেছিলাম, এমন সময় রেলগাড়িতে বাবুটির সঙ্গে দেখা হয়। তাঁহার বেশভূষা দেখিয়া প্রথমটা তাঁহাকে পশ্চিমদেশীয় মুসলমান বলিয়া ভ্রম হইয়াছিল। তাঁহার কথাবার্তা শুনিয়া আরো ধাঁধা লাগিয়া যায়। পৃথিবীর সকল বিষয়েই এমন করিয়া আলাপ করিতে লাগিলেন, যেন তাঁহার সহিত প্রথম পরামর্শ করিয়া বিশ্ববিধাতা সকল কাজ করিয়া থাকেন। বিশ্বসংসারের ভিতরে ভিতরে যে এমন-সকল অশ্রুতপূর্ব নিগূঢ় ঘটনা ঘটিতেছিল, রুশিয়ানরা যে এতদূর অগ্রসর হইয়াছে, ইংরাজদের যে এমন-সকল গোপন মতলব আছে, দেশীয় রাজাদের মধ্যে যে একটা খিচুড়ি পাকিয়া উঠিয়াছে, এ-সমস্ত কিছুই না জানিয়া আমরা সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হইয়া ছিলাম।
আমাদের নবপরিচিত আলাপটি ঈষৎ হাসিয়া কহিলেন: There happen more things in heaven and earth, Horatio, than are reported in your newspapers।আমরা এই প্রথম ঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়াছি, সুতরাং লোকটির রকমসকম দেখিয়া অবাক হইয়া গেলাম। লোকটা সামান্য উপলক্ষে কখনো বিজ্ঞান বলে, কখনো বেদের ব্যাখ্যা করে, আবার হঠাৎ কখনো পার্সি বয়েত আওড়াইতে থাকে। বিজ্ঞান বেদ এবং পার্সিভাষায় আমাদের কোনোরূপ অধিকার না থাকাতে তাঁহার প্রতি আমাদের ভক্তি উত্তরোত্তর বাড়িতে লাগিল। এমন-কি, আমার থিয়সফিস্ট্‌ আত্মীয়টির মনে দৃঢ় বিশ্বাস হইল যে, আমাদের এই সহযাত্রীর সহিত কোনো এক রকমের অলৌকিক ব্যাপারের কিছু-একটা যোগ আছে; কোনো একটা অর্পূব ম্যাগ্‌নেটিজ্‌ম্‌ অথবা দৈবশক্তি, অথবা সূক্ষ্ণ শরীর, অথবা ঐ ভাবের একটা-কিছু। তিনি এই অসামান্য লোকের সমস্ত সামান্য কথাও ভক্তিবিহ্বল মুগ্ধভাবে শুনিতেছিলেন এবং গোপনে নোট করিয়া লইতেছিলেন; আমার ভাবে বোধ হইল, অসামান্য ব্যক্তিটিও গোপনে তাহা বুঝিতে পারিয়াছিলেন এবং কিছু খুশি হইয়াছিলেন।

গাড়িটি আসিয়া জংশনে থামিলে আমরা দ্বিতীয় গাড়ির অপেক্ষায় ওয়েটিংরুমে সমবেত হইলাম। তখন রাত্রি সাড়ে দশটা। পথের মধ্যে একটা কী ব্যাঘাত হওয়াতে গাড়ি অনেক বিলম্বে আসিবে শুনিলাম। আমি ইতিমধ্যে টেবিলের উপর বিছানা পাতিয়া ঘুমাইব স্থির করিয়াছি, এমন সময়ে সেই অসামান্য ব্যক্তিটি নিম্নলিখিত গল্প ফাঁদিয়া বসিলেন। সে রাত্রে আমার আর ঘুম হইল না।

রাজ্যচালনা সম্বন্ধে দুই একটা বিষয়ে মতান্তর হওয়াতে আমি জুনাগড়ের কর্ম ছাড়িয়া দিয়া হাইদ্রাবাদে যখন নিজাম-সরকারে প্রবেশ করিলাম তখন আমাকে অল্পবয়স্ক ও মজবুত লোক দেখিয়া প্রথমে বরীচে তুলার মাশুল-আদায়ে নিযুক্ত করিয়া দিল।

বরীচ জায়গাটি বড়ো রমণীয়। নির্জন পাহাড়ের নীচে বড়ো বড়ো বনের ভিতর দিয়া শুস্তা নদীটি (সংস্কৃত স্বচ্ছতোয়ার অপভ্রংশ) উপলমুখরিত পথে নিপুণা নর্তকীর মতো পদে পদে বাঁকিয়া বাঁকিয়া দ্রুত নৃত্যে চলিয়া গিয়াছে। ঠিক সেই নদীর ধারেই পাথর-বাঁধানো দেড়-শত-সোপান-ময় অত্যুচ্চ ঘাটের উপরে একটি শ্বেতপ্রস্তরের প্রাসাদ শৈলপদমূলে একাকী দাঁড়াইয়া আছে-- নিকটে কোথাও লোকালয় নাই। বরীচের তুলার হাট এবং গ্রাম এখান হইতে দূরে।

প্রায় আড়াই শত বৎসর পূর্বে দ্বিতীয় শা-মামুদ ভোগবিলাসের জন্য প্রাসাদটি এই নির্জন স্থানে নির্মাণ করিয়াছিলেন। তখন হইতে স্নানশালার ফোয়ারার মুখ হইতে গোলাপগন্ধী জলধারা উৎক্ষিপ্ত হইতে থাকিত এবং সেই শীকরশীতল নিভৃত গৃহের মধ্যে মর্মরখচিত স্নিগ্ধ শিলাসনে বসিয়া কোমল নগ্ন পদপল্লব জলাশয়ের নির্মল জলরাশির মধ্যে প্রসারিত করিয়া তরুণী পারসিক রমণীগণ স্নানের পূর্বে কেশ মুক্ত করিয়া দিয়া সেতার-কোলে দ্রাক্ষাবনের গজল গান করিত।

এখন আর সে ফোয়ারা খেলে না, সে গান নাই, সাদা পাথরের উপর শুভ্র চরণের সুন্দর আঘাত পড়ে না--এখন ইহা আমাদের মতো নির্জনবাসপীড়িত সঙ্গিনীহীন মাশুল-কালেক্টরের অতি বৃহৎ এবং অতি শূন্য বাসস্থান। কিন্তু আপিসের বৃদ্ধ কেরানি করিম খাঁ আমাকে এই প্রাসাদে বাস করিতে বারম্বার নিষেধ করিয়াছিল; বলিয়াছিল, ইচ্ছা হয় দিনের বেলা থাকিবেন, কিন্তু কখনো এখানে রাত্রিযাপন করিবেন না। আমি হাসিয়া উড়াইয়া দিলাম। ভৃত্যেরা বলিল, তাহারা সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করিবে, কিন্তু রাত্রে এখানে থাকিবে না। আমি বলিলাম, তথাস্তু। এ বাড়ির এমন বদনাম ছিল যে, রাত্রে চোরও এখানে আসিতে সাহস করিত না।

প্রথম প্রথম আসিয়া এই পরিত্যক্ত পাষাণপ্রাসাদের বিজনতা আমার বুকের উপর যেন একটা ভয়ংকর ভারের মতো চাপিয়া থাকিত, আমি যতটা পারিতাম বাহিরে থাকিয়া অবিশ্রান্ত কাজকর্ম করিয়া রাত্রে ঘরে ফিরিয়া শ্রান্তদেহে নিদ্রা দিতাম।

কিন্তু সপ্তাহখানেক না যাইতেই বাড়িটার এক অপূর্ব নেশা আমাকে ক্রমশ আক্রমণ করিয়া ধরিতে লাগিল। আমার সে অবস্থা বর্ণনা করাও কঠিন এবং সে কথা লোককে বিশ্বাস করানোও শক্ত। সমস্ত বাড়িটা একটা সজীব পদার্থের মতো আমাকে তাহার জঠরস্থ মোহরসে অল্পে অল্পে যেন জীর্ণ করিতে লাগিল।

বোধ হয় এ বাড়িতে পদার্পণমাত্রেই এ প্রক্রিয়ার আরম্ভ হইয়াছিল-- কিন্তু আমি যেদিন সচেতনভাবে প্রথম ইহার সূত্রপাত অনুভব করি সেদিনকার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে।

তখন গ্রীষ্মকালের আরম্ভে বাজার নরম; আমার হাতে কোনো কাজ ছিল না। সূর্যাস্তের কিছু পূর্বে আমি সেই নদীতীরে ঘাটের নিম্নতলে একটা আরাম-কেদারা লইয়া বসিয়াছি। তখন শুস্তানদী শীর্ণ হইয়া আসিয়াছে; ও পারে অনেকখানি বালুতট অপরাহ্নের আভায় রঙিন হইয়া উঠিয়াছে; এ পারে ঘাটের সোপানমূলে স্বচ্ছ অগভীর জলের তলে নুড়িগুলি ঝিক্‌ ঝিক্‌ করিতেছে। সেদিন কোথাও বাতাস ছিল না। নিকটের পাহাড়ে বনতুলসী পুদিনা ও মৌরির জঙ্গল হইতে একটা ঘন সুগন্ধ উঠিয়া স্থির আকাশকে ভারাক্রান্ত করিয়া রাখিয়াছিল।

সূর্য যখন গিরিশিখরের অন্তরালে অবতীর্ণ হইল তৎক্ষণাৎ দিবসের নাট্যশালার একটা দীর্ঘ ছায়াযবনিকা পড়িয়া গেল-- এখানে পর্বতের ব্যবধান থাকাতে সূর্যাস্তের সময় আলো আঁধারের সম্মিলন অধিকক্ষণ স্থায়ী হয় না। ঘোড়ায় চড়িয়া একবার ছুটিয়া বেড়াইয়া আসিব মনে করিয়া উঠিব-উঠিব করিতেছি, এমন সময়ে সিঁড়িতে পায়ের শব্দ শুনিতে পাইলাম। পিছনে ফিরিয়া দেখিলাম, কেহ নাই।

ইন্দ্রিয়ের ভ্রম মনে করিয়া পুনরায় ফিরিয়া বসিতেই একেবারে অনেকগুলি পায়ের শব্দ শোনা গেল, যেন অনেকে মিলিয়া ছুটাছুটি করিয়া নামিয়া আসিতেছে। ঈষৎ ভয়ের সহিত এক অপরূপ পুলক মিশ্রিত হইয়া আমার সর্বাঙ্গ পরিপূর্ণ করিয়া তুলিল। যদিও আমার সম্মুখে কোনো মূর্তি ছিল না তথাপি স্পষ্ট প্রত্যক্ষবৎ মনে হইল যে, এই গ্রীষ্মের সায়াহ্নে একদল প্রমোদচঞ্চল নারী শুস্তার জলের মধ্যে স্নান করিতে নামিয়াছে। যদিও সেই সন্ধ্যাকালে নিস্তব্ধ গিরিতটে, নদীতীরে নির্জন প্রাসাদে কোথাও কিছুমাত্র শব্দ ছিল না, তথাপি আমি যেন স্পষ্ট শুনিতে পাইলাম নির্ঝরের শতধারার মতো সকৌতুক কলহাস্যের সহিত পরস্পরের দ্রুত অনুধাবন করিয়া আমার পার্শ্ব দিয়া স্নানার্থিনীরা চলিয়া গেল। আমাকে যেন লক্ষ্য করিল না। তাহারা যেমন আমার নিকট অদৃশ্য, আমিও যেন সেইরূপ তাহাদের নিকট অদৃশ্য। নদী পূর্ববৎ স্থির ছিল, কিন্তু আমার নিকট স্পষ্ট বোধ হইল, স্বচ্ছতোয়ার অগভীর স্রোত অনেকগুলি বলয়শিঞ্জিত বাহুবিক্ষেপে বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছে; হাসিয়া হাসিয়া সখীগণ পরস্পরের গায়ে জল ছুঁড়িয়া মারিতেছে, এবং সন্তরণকারিণীদের পদাঘাতে জলবিন্দুরাশি মুক্তামুষ্টির মতো আকাশে ছিটিয়া পড়িতেছে।

আমার বক্ষের মধ্যে একপ্রকার কম্পন হইতে লাগিল; সে উত্তেজনা ভয়ের কি আনন্দের কি কৌতুহলের, ঠিক বলিতে পারি না। বড়ো ইচ্ছা হইতে লাগিল ভালো করিয়া দেখি, কিন্তু সম্মুখে দেখিবার কিছু ছিল না; মনে হইল ভালো করিয়া কান পাতিলেই উহাদের কথা সমস্তই স্পষ্ট শোনা যাইবে, কিন্তু একান্তমনে কান পাতিয়া কেবল অরণ্যের ঝিল্লিরব শোনা যায়। মনে হইল, আড়াই শত বৎসরের কৃষ্ণবর্ণ যবনিকা ঠিক আমার সম্মুখে দুলিতেছে-- ভয়ে ভয়ে একটি ধার তুলিয়া ভিতরে দৃষ্টিপাত করি-- সেখানে বৃহৎ সভা বসিয়াছে, কিন্তু গাঢ় অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না।

হঠাৎ গুমট ভাঙিয়া হু হু করিয়া একটা বাতাস দিল-- শুস্তার স্থির জলতল দেখিতে দেখিতে অপ্সরীর কেশদামের মতো কুঞ্চিত হইয়া উঠিল, এবং সন্ধ্যাছায়াচ্ছন্ন সমস্ত বনভূমি এক মুহূর্তে একসঙ্গে মর্মরধ্বনি করিয়া যেন দুঃস্বপ্ন হইতে জাগিয়া উঠিল। স্বপ্নই বল আর সত্যই বল, আড়াই শত বৎসরের অতীত ক্ষেত্র হইতে প্রতিফলিত হইয়া আমার সম্মুখে যে এক অদৃশ্য মরীচিকা অবতীর্ণ হইয়াছিল তাহা চকিতের মধ্যে অন্তর্হিত হইল। যে মায়াময়ীরা আমার গায়ের উপর দিয়া দেহহীন দ্রুতপদে শব্দহীন উচ্চকলহাস্যে ছুটিয়া শুস্তার জলের উপর গিয়া ঝাঁপ দিয়া পড়িয়াছিল তাহারা সিক্ত অঞ্চল হইতে জল নিষ্কর্ষণ করিতে করিতে আমার পাশ দিয়া উঠিয়া গেল না। বাতাসে যেমন করিয়া গন্ধ উড়াইয়া লইয়া যায়, বসন্তের এক নিশ্বাসে তাহারা তেমনি করিয়া উড়িয়া চলিয়া গেল।

তখন আমার বড়ো আশঙ্কা হইল যে, হঠাৎ বুঝি নির্জন পাইয়া কবিতাদেবী আমার স্কন্ধে আসিয়া ভর করিলেন; আমি বেচারা তুলার মাশুল আদায় করিয়া খাটিয়া খাই, সর্বনাশিনী এইবার বুঝি আমার মুণ্ডপাত করিতে আসিলেন। ভাবিলাম, ভালো করিয়া আহার করিতে হইবে; শূন্য উদরেই সকল প্রকার দুরারোগ্য রোগ আসিয়া চাপিয়া ধরে। আমার পাচকটিকে ডাকিয়া প্রচুরঘৃতপক্ক মসলা-সুগন্ধি রীতিমত মোগলাই খানা হুকুম করিলাম।

পরদিন প্রাতঃকালে সমস্ত ব্যাপারটি পরম হাস্যজনক বলিয়া বোধ হইল। আনন্দমনে সাহেবের মতো সোলাটুপি পরিয়া, নিজের হাতে গাড়ি হাঁকাইয়া, গড় গড় শব্দে আপন তদন্তকার্যে চলিয়া গেলাম। সেদিন ত্রৈমাসিক রিপোর্ট্‌ লিখিবার দিন থাকাতে বিলম্বে বাড়ি ফিরিবার কথা। কিন্তু সন্ধ্যা হইতে না হইতেই আমাকে বাড়ির দিকে টানিতে লাগিল। কে টানিতে লাগিল বলিতে পারি না; কিন্তু মনে হইল, আর বিলম্ব করা উচিত হয় না। মনে হইল, সকলে বসিয়া আছে। রিপোর্ট্‌ অসমাপ্ত রাখিয়া সোলার টুপি মাথায় দিয়া সেই সন্ধ্যাধূসর তরুচ্ছায়াঘন নির্জন পথ রথচক্রশব্দে সচকিত করিয়া সেই অন্ধকার শৈলান্তবর্তী নিস্তব্ধ প্রকাণ্ড প্রাসাদে গিয়া উত্তীর্ণ হইলাম।

সিঁড়ির উপরে সম্মুখের ঘরটি অতি বৃহৎ। তিন সারি বড়ো বড়ো থামের উপর কারুকার্যখচিত খিলানে বিস্তীর্ণ ছাদ ধরিয়া রাখিয়াছে। এই প্রকাণ্ড ঘরটি আপনার বিপুল শূন্যতাভরে অহর্নিশি গম্‌ গম্‌ করিতে থাকে। সেদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে তখনো প্রদীপ জ্বালানো হয় নাই। দরজা ঠেলিয়া আমি সেই বৃহৎ ঘরে যেমন প্রবেশ করিলাম অমনি মনে হইল ঘরের মধ্যে যেন ভারি একটা বিপ্লব বাধিয়া গেল-- যেন হঠাৎ সভা ভঙ্গ করিয়া চারি দিকের দরজা জানলা ঘর পথ বারান্দা দিয়া কে কোন্‌ দিকে পলাইল তাহার ঠিকানা নাই। আমি কোথাও কিছু না দেখিতে পাইয়া অবাক হইয়া দাঁড়াইয়া রহিলাম। শরীর একপ্রকার আবেশে রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। যেন বহুদিবসের লুপ্তাবশিষ্ট মাথাঘষা ও আতরের মৃদু গন্ধ আমার নাসার মধ্যে প্রবেশ করিতে লাগিল। আমি সেই দীপহীন জনহীন প্রকাণ্ড ঘরের প্রাচীন প্রস্তরস্তম্ভশ্রেণীর মাঝখানে দাঁড়াইয়া শুনিতে পাইলাম-- ঝর্ঝর শব্দে ফোয়ারার জল সাদা পাথরের উপরে আসিয়া পড়িতেছে, সেতারে কী সুর বাজিতেছে বুঝিতে পারিতেছি না, কোথাও বা স্বর্ণভূষণের শিঞ্জিত, কোথাও বা নুপুরের নিক্কণ, কখনো বা বৃহৎ তাম্রঘণ্টায় প্রহর বাজিবার শব্দ, অতি দূরে নহবতের আলাপ, বাতাসে দোদুল্যমান ঝাড়ের স্ফটিকদোলকগুলির ঠুন্‌ ঠুন্‌ ধ্বনি, বারান্দা হইতে খাঁচার বুলবুলের গান, বাগান হইতে পোষা সারসের ডাক আমার চতুর্দিকে একটা প্রেতলোকের রাগিণী সৃষ্টি করিতে লাগিল।

আমার এমন একটা মোহ উপস্থিত হইল, মনে হইল, এই অস্পৃশ্য অগম্য অবাস্তব ব্যাপারই জগতে একমাত্রসত্য; আর সমস্তই মিথ্যা মরীচিকা। আমি যে আমি-- অর্থাৎ আমি যে শ্রীযুক্ত অমুক, ৺অমুকের জ্যেষ্ঠ পুত্র, তুলার মাশুল সংগ্রহ করিয়া সাড়ে চারশো টাকা বেতন পাই, আমি যে সোলার টুপি এবং খাটো কোর্তা পরিয়া টম্‌টম্‌ হাঁকাইয়া আপিস করিতে যাই, এ-সমস্তই আমার কাছে এমন অদ্ভুত হাস্যকর অমূলক মিথ্যা কথা বলিয়া বোধ হইল যে,আমি সেই বিশাল নিস্তব্ধ অন্ধকার ঘরের মাঝখানে দাঁড়াইয়া হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিলাম।

তখনই আমার মুসলমান ভৃত্য প্রজ্জ্বলিত কেরোসিন ল্যাম্প হাতে করিয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল। সে আমাকে পাগল মনে করিল কি না জানি না, কিন্তু তৎক্ষণাৎ আমার স্মরণ হইল যে, আমি ৺অমুকচন্দ্রের জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীযুক্ত অমুকনাথ বটে; ইহাও মনে করিলাম যে, জগতের ভিতরে অথবা বাহিরে কোথাও অমূর্ত ফোয়ারা নিত্যকাল উৎসারিত ও অদৃশ্য অঙ্গুলির আঘাতে কোনো মায়া-সেতারে অনন্ত রাগিণী ধ্বনিত হইতেছে কি না তাহা আমাদের মহাকবি এবং কবিবরেরাই বলিতে পারেন, কিন্তু এ কথা নিশ্চয় সত্য যে, আমি বরীচের হাটে তুলার মাশুল আদায় করিয়া মাসে সাড়ে চারশো টাকা বেতন লইয়া থাকি। তখন আবার আমার পূর্বক্ষণের অদ্ভুত মোহ স্মরণ করিয়া কেরোসিন-প্রদীপ্ত ক্যাম্প্‌টেবিলের কাছে খবরের কাগজ লইয়া সকৌতুকে হাসিতে লাগিলাম।

খবরের কাগজ পড়িয়া এবং মোগলাই খানা খাইয়া একটি ক্ষুদ্র কোণের ঘরে প্রদীপ নিবাইয়া দিয়া বিছানায় গিয়া শয়ন করিলাম। আমার সম্মুখবর্তী খোলা জানালার ভিতর দিয়া অন্ধকার বনবেষ্টিত আরালী পর্বতের উর্ধ্বদেশের একটি অত্যুজ্জ্বল নক্ষত্র সহস্র কোটি যোজন দূর আকাশ হইতে সেই অতিতুচ্ছ ক্যাম্প্‌খাটের উপর শ্রীযুক্ত মাশুল-কালেক্টরকে একদৃষ্টে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতেছিল ইহাতে আমি বিস্ময় ও কৌতুক অনুভব করিতে করিতে কখন ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলেন বলিতে পারি না। কতক্ষণ ঘুমাইয়াছিলাম তাহাও জানি না। সহসা এক সময় শিহরিয়া জাগিয়া উঠিলাম; ঘরে যে কোনো শব্দ হইয়াছিল তাহা নহে, কোনো যে লোক প্রবেশ করিয়াছিল তাহাও দেখিতে পাইলাম না। অন্ধকার পর্বতের উপর হইতে অনিমেষ নক্ষত্রটি অস্তমিত হইয়াছে এবং কৃষ্ণপক্ষের ক্ষীণচন্দ্রালোক অনধিকারসংকুচিত ম্লানভাবে আমার বাতায়নপথে প্রবেশ করিয়াছে।

কোনো লোককেই দেখিলাম না। তবু যেন আমার স্পষ্ট মনে হইল, কে একজন আমাকে আস্তে আস্তে ঠেলিতেছে। আমি জাগিয়া উঠিতেই সে কোনো কথা না বলিয়া কেবল যেন তাহার অঙ্গুরীখচিত পাঁচ অঙ্গুলির ইঙ্গিতে অতি সাবধানে তাহার অনুসরণ করিতে আদেশ করিল।

আমি অত্যন্ত চুপিচুপি উঠিলাম। যদিও সেই শতকক্ষপ্রকোষ্ঠময় প্রকাণ্ডশূন্যতাময়, নিদ্রিত ধ্বনি এবং সজাগ প্রতিধ্বনি-ময় বৃহৎ প্রাসাদে আমি ছাড়া আর জনপ্রাণীও ছিল না তথাপি পদে পদে ভয় হইতে লাগিল, পাছে কেহ জাগিয়া উঠে। প্রাসাদের অধিকাংশ ঘর রুদ্ধ থাকিত এবং সে-সকল ঘরে আমি কখনো যাই নাই।

সে রাত্রে নিঃশব্দপদবিক্ষেপে সংযতনিশ্বাসে সেই অদৃশ্য-আহ্বান-রূপিণীর অনুসরণ করিয়া আমি যে কোথা দিয়া কোথায় যাইতেছিলাম, আজ তাহা স্পষ্ট করিয়া বলিতে পারি না। কত সংকীর্ণ অন্ধকার পথ, কত দীর্ঘ বারান্দা, কত গম্ভীর নিস্তব্ধ সুবৃহৎ সভাগৃহ, কত রুদ্ধবায়ু ক্ষুদ্র গোপন কক্ষ পার হইয়া যাইতে লাগিলাম তাহার ঠিকানা নাই।

আমার অদৃশ্য দূতীটিকে যদিও চক্ষে দেখিতে পাই নাই, তথাপি তাহার মূর্তি আমার মনের অগোচর ছিল না। আরব রমণী, ঝোলা আস্তিনের ভিতর দিয়া শ্বেতপ্রস্তরচিতবৎ কঠিন নিটোল হস্ত দেখা যাইতেছে, টুপির প্রান্ত হইতে মুখের উপরে একটি সূক্ষ্ণ বসনের আবরণ পড়িয়াছে, কটিবন্ধে একটি বাঁকা ছুরি বাঁধা।

আমার মনে হইল, আরব্য উপন্যাসের একাধিক সহস্র রজনীর একটি রজনী আজ উপন্যাসলোক হইতে উড়িয়া আসিয়াছে। আমি যেন অন্ধকার নিশীথে সুপ্তিমগ্ন বোগদাদের নির্বাপিতদীপ সংকীর্ণ পথে কোনো এক সংকটসংকুল অভিসারে যাত্রা করিয়াছি।

অবশেষে আমার দূতী একটি ঘননীল পর্দার সম্মুখে সহসা থমকিয়া দাঁড়াইয়া যেন নিম্নে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া দেখাইল। নিম্নে কিছুই ছিল না, কিন্তু ভয়ে আমার বক্ষের রক্ত স্তম্ভিত হইয়া গেল। আমি অনুভব করিলাম, সেই পর্দার সম্মুখে ভূমিতলে কিংখাবের-সাজ-পরা একটি ভীষণ কাফ্রি খোজা কোলের উপর খোলা তলোয়ার লইয়া দুই পা ছড়াইয়া দিয়া বসিয়া ঢুলিতেছে। দূতী লঘুগতিতে তাহার দুই পা ডিঙাইয়া পর্দার এক প্রান্তদেশ তুলিয়া ধরিল।

ভিতর হইতে একটি পারস্য-গালিচা-পাতা ঘরের কিয়দংশ দেখা গেল। তক্তের উপরে কে, বসিয়া আছে দেখা গেল না--কেবল জাফরান রঙের স্ফীত পায়জামার নিম্নভাগে জরির-চটি-পরা দুইখানি ক্ষুদ্র সুন্দর চরণ গোলাপি মখমল-আসনের উপর অসলভাবে স্থাপিত রহিয়াছে দেখিতে পাইলাম। মেজের এক পার্শ্বে একটি নীলাভ স্ফটিকপাত্রে কতকগুলি আপেল নাশপাতি নারাঙ্গি এবং প্রচুর আঙুরের গুচ্ছ সজ্জিত রহিয়াছে এবং তাহার পার্শ্বে দুইটি ছোটো পেয়ালা ও একটি স্বর্ণাভ মদিরার কাচপাত্র অতিথির জন্য অপেক্ষা করিয়া আছে। ঘরের ভিতর হইতে একটা অপূর্ব ধূপের একপ্রকার মাদক সুগন্ধি ধূম আসিয়া আমাকে বিহ্বল করিয়া দিল।

আমি কম্পিতবক্ষে সেই খোজার প্রসারিত পদদ্বয় যেমন লঙ্ঘন করিতে গেলাম অমনি সে চমকিয়া জাগিয়া উঠিল-- তাহার কোলের উপর হইতে তলোয়ার পাথরের মেজেয় শব্দ করিয়া পড়িয়া গেল।

সহসা একটা বিকট চীৎকার শুনিয়া চমকিয়া দেখিলাম, আমার সেই ক্যাম্পখাটের উপরে ঘর্মাক্তকলেবরে বসিয়া আছি, ভোরের আলোয় কৃষ্ণপক্ষের খণ্ড-চাঁদ জাগরণক্লিষ্ট রোগীর মতো পাণ্ডুবর্ণ হইয়া গেছে-- এবং আমাদের পাগলা মেহের আলি তাহার প্রাত্যহিক প্রথা অনুসারে প্রত্যুষের জনশূন্য পথে 'তফাত যাও' 'তফাত যাও' করিয়া চীৎকার করিতে করিতে চলিয়াছে।

এইরূপে আমার আরব্য উপন্যাসের এক রাত্রি অকস্মাৎ শেষ হইল-- কিন্তু এখনো এক সহস্র রজনী বাকি আছে।

আমার দিনের সহিত রাত্রের ভারি একটা বিরোধ বাধিয়া গেল। দিনের বেলায় শ্রান্তক্লান্তদেহে কর্ম করিতে যাইতাম এবং শূন্যস্বপ্নময়ী মায়াবিনী রাত্রিকে অভিসম্পাত করিতে থাকিতাম, আবার সন্ধ্যার পরে আমার দিনের বেলাকার কর্মবদ্ধ অস্তিত্বকে অত্যন্ত তুচ্ছ মিথ্যা এবং হাস্যকর বলিয়া বোধ হইত।

সন্ধ্যার পরে আমি একটা নেশার জালের মধ্যে বিহ্বলভাবে জড়াইয়া পড়িতাম। শত শত বৎসর পূর্বেকার কোনো-এক অলিখিত ইতিহাসের অন্তর্গত আর-একটা অপূর্ব ব্যক্তি হইয়া উঠিতাম, তখন আর বিলাতি খাটো কোর্তা এবং আঁট প্যাণ্টলুনে আমাকে মানাইত না। তখন আমি মাথায় এক লাল মখমলের ফেজ তুলিয়া, ঢিলা পায়জামা, ফুলকাটা কাবা এবং রেশমের দীর্ঘ চোগা পরিয়া, রঙিন রুমালে আতর মাখিয়া, বহুযত্নে সাজ করিতাম এবং সিগারেট ফেলিয়া দিয়া গোলাপজলপূর্ণ বহুকুণ্ডলায়িত বৃহৎ আলবোলা লইয়া এক উচ্চগদিবিশিষ্ট বড়ো কেদারায় বসিতাম। যেন রাত্রে কোন্‌-এক অপূর্ব প্রিয়সম্মিলনের জন্য পরমাগ্রহে প্রস্তুত হইয়া থাকিতাম।

তাহার পর অন্ধকার যতই ঘনীভূত হইত ততই কী-যে এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটিতে থাকিত তাহা আমি বর্ণনা করিতে পারি না। ঠিক যেন একটা চমৎকার গল্পের কতকগুলি ছিন্ন অংশ বসন্তের আকস্মিক বাতাসে এই বৃহৎ প্রাসাদের বিচিত্র ঘরগুলির মধ্যে উড়িয়া বেড়াইত। খানিকটা দূর পর্যন্ত পাওয়া যাইত তাহার পরে আর শেষ দেখা যাইত না। আমিও সেই ঘূর্ণ্যমান বিচ্ছিন্ন অংশগুলির অনুসরণ করিয়া সমস্ত রাত্রি ঘরে ঘরে ঘুরিয়া বেড়াইতাম।

এই খণ্ডস্বপ্নের আবর্তের মধ্যে-- এই ক্কচিৎ হেনার গন্ধ, ক্কচিৎ সেতারের শব্দ, ক্কচিৎ সুরভিজলশীকরমিশ্র বায়ুর হিল্লোলের মধ্যে একটি নায়িকাকে ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎশিখার মতো চকিতে দেখিতে পাইতাম। তাহারই জাফরান রঙের পায়জামা এবং দুটি শুভ্র রক্তিম কোমল পায়ে বক্রশীর্ষ জরির চটি পরা, বক্ষে অতিপিনদ্ধ জরির ফুলকাটা কাঁচুলি আবদ্ধ, মাথায় একটি লাল টুপি এবং তাহা হইতে সোনার ঝালর ঝুলিয়া তাহার শুভ্র ললাট এবং কপোল বেষ্টন করিয়াছে।

সে আমাকে পাগল করিয়া দিয়াছিল। আমি তাহারই অভিসারে প্রতি রাত্রে নিদ্রার রসাতলরাজ্যে স্বপ্নের জটিলপথসংকুল মায়াপুরীর মধ্যে গলিতে গলিতে কক্ষে কক্ষে ভ্রমণ করিয়া বেড়াইয়াছি।

এক-একদিন সন্ধ্যার সময় বড়ো আয়নার দুই দিকে বাতি জ্বালাইয়া যত্নপূর্বক শাহজাদার মতো সাজ করিতেছি এমন সময় হঠাৎ দেখিতে পাইতাম, আয়নায় আমার প্রতিবিম্বের পার্শ্বে ক্ষণিকের জন্য সেই তরুণী ইরাণীর ছায়া আসিয়া পড়িল-- পলকের মধ্যে গ্রীবা বাঁকাইয়া, তাহার ঘনকৃষ্ণ বিপুল চক্ষুতারকায় সুগভীর আবেগতীব্র বেদনাপূর্ণ আগ্রহকটাক্ষপাত করিয়া, সরস সুন্দর বিম্বাধরে একটি অস্ফুট ভাষার আভাসমাত্র দিয়া, লঘু ললিত নৃত্যে আপন যৌবনপুষ্পিত দেহলতাটিকে দ্রুতবেগে উর্ধ্বাভিমুখে আবর্তিত করিয়া, মুহূর্তকালের মধ্যে বেদনা বাসনা ও বিভ্রমের, হাস্য কটাক্ষ ও ভূষণজ্যোতির স্ফুলিঙ্গ বৃষ্টি করিয়া দিয়া, দর্পণেই মিলাইয়া গেল। গিরিকাননের সমস্ত সুগন্ধ লুণ্ঠন করিয়া একটা উদ্দাম বায়ুর উচ্ছ্বাস আসিয়া আমার দুইটা বাতি নিবাইয়া দিত; আমি সাজসজ্জা ছাড়িয়া দিয়া, বেশগৃহের প্রান্তবর্তী শয্যাতলে পুলকিতদেহে মুদ্রিতনেত্রে শয়ন করিয়া থাকিতাম-- আমার চারি দিকে সেই বাতাসের মধ্যে, সেই আরালী গিরিকুঞ্জের সমস্ত মিশ্রিত সৌরভের মধ্যে, যেন অনেক আদর অনেক চুম্বন অনেক কোমল করস্পর্শ নিভৃত অন্ধকার পূর্ণ করিয়া ভাসিয়া বেড়াইত-- কানের কাছে অনেক কলগুঞ্জন শুনিতে পাইতাম, আমার কপালের উপর সুগন্ধ নিশ্বাস আসিয়া পড়িত, এবং আমার কপোলে একটি মৃদুসৌরভরমণীয় সুকোমল ওড়না বারম্বার উড়িয়া উড়িয়া আসিয়া স্পর্শ করিত। অল্পে অল্পে যেন একটি মোহিনী সর্পিণী তাহার মাদকবেষ্টনে আমার সর্বাঙ্গ বাঁধিয়া ফেলিত, আমি গাঢ় নিশ্বাস ফেলিয়া অসাড় দেহে সুগভীর নিদ্রায় অভিভূত হইয়া পড়িতাম।

একদিন অপরাহ্নে আমি ঘোড়ায় চড়িয়া বাহির হইব সংকল্প করিলাম-- কে আমাকে নিষেধ করিতে লাগিল জানি না-- কিন্তু সেদিন নিষেধ মানিলাম না। একটা কাষ্ঠদণ্ডে আমার সাহেবি হ্যাট এবং খাটো কোর্তা দুলিতেছিল, পাড়িয়া লইয়া পরিবার উপক্রম করিতেছি, এমন সময় শুস্তানদীর বালি এবং আরালী পর্বতের শুষ্ক পল্লবরাশির ধ্বজা তুলিয়া হঠাৎ একটা প্রবল ঘুর্ণাবাতাস আমার সেই কোর্তা এবং টুপি ঘুরাইতে ঘুরাইতে লইয়া চলিল এবং একটা অত্যন্ত সুমিষ্ট কলহাস্য সেই হাওয়ার সঙ্গে ঘুরিতে ঘুরিতে কৌতুকের সমস্ত পর্দায় পর্দায় আঘাত করিতে করিতে উচ্চ হইতে উচ্চতর সপ্তকে উঠিয়া সূর্যাস্তলোকের কাছে গিয়া মিলাইয়া গেল।

সেদিন আর ঘোড়ায় চড়া হইল না এবং তাহার পরদিন হইতে সেই কৌতুকাবহ খাটো কোর্তা এবং সাহেবি হ্যাট পরা একেবারে ছাড়িয়া দিয়াছি।

আবার সেইদিন অর্ধরাত্রে বিছানার মধ্যে উঠিয়া বসিয়া শুনিতে পাইলাম কে যেন গুমরিয়া গুমরিয়া, বুক ফাটিয়া ফাটিয়া কাঁদিতেছে-- যেন আমার খাটের নীচে, মেঝের নীচে, এই বৃহৎ প্রাসাদের পাষাণভিত্তির তলবর্তী একটা আর্দ্র অন্ধকার গোরের ভিতর হইতে কাঁদিয়া কাঁদিয়া বলিতেছে, 'তুমি আমাকে উদ্ধার করিয়া লইয়া যাও-- কঠিন মায়া, গভীর নিদ্রা, নিষ্ফল স্বপ্নের সমস্ত দ্বার ভাঙিয়া ফেলিয়া, তুমি আমাকে ঘোড়ায় তুলিয়া, তোমার বুকের কাছে চাপিয়া ধরিয়া, বনের ভিতর দিয়া, পাহাড়ের উপর দিয়া, নদী পার হইয়া তোমাদের সূর্যালোকিত ঘরের মধ্যে আমাকে লইয়া যাও। আমাকে উদ্ধার করো।'

আমি কে! আমি কেমন করিয়া উদ্ধার করিব। আমি এই ঘুর্ণ্যমান পরিবর্তমান স্বপ্নপ্রবাহের মধ্য হইতে কোন্‌ মজ্জমানা কামনাসুন্দরীকে তীরে টানিয়া তুলিব। তুমি কবে ছিলে, কোথায় ছিলে হে দিব্যরূপিণী। তুমি কোন্‌ শীতল উৎসের তীরে খর্জুরকুঞ্জের ছায়ায় কোন্‌ গৃহহীনা মরুবাসিনীর কোলে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলে। তোমাকে কোন্‌ বেদুয়ীন দস্যু বনলতা হইতে পুষ্পকোরকের মতো মাতৃক্রোড় হইতে ছিন্ন করিয়া, বিদ্যুৎগামী অশ্বের উপরে চড়াইয়া, জ্বলন্ত বালুকারাশি পার হইয়া, কোন্‌ রাজপুরীর দাসীহাটে বিক্রয়ের জন্য লইয়া গিয়াছিল। সেখানে কোন্‌ বাদশাহের ভৃত্য তোমার নববিকশিত সলজ্জকাতর যৌবনশোভা নিরীক্ষণ করিয়া স্বর্ণমুদ্রা গনিয়া দিয়া, সমুদ্র পার হইয়া, তোমাকে সোনার শিবিকায় বসাইয়া, প্রভুগৃহের অন্তঃপুরে উপহার দিয়াছিল। সেখানে সে কী ইতিহাস। সেই সারঙ্গীর সংগীত, নুপুরের নিক্কণ এবং সিরাজের সুবর্ণমদিরার মধ্যে মধ্যে ছুরির ঝলক, বিষের জ্বালা, কটাক্ষের আঘাত। কী অসীম ঐশ্বর্য, কী অনন্ত কারাগার। দুই দিকে দুই দাসী বলয়ের হীরকে বিজুলি খেলাইয়া চামর দুলাইতেছে। শাহেনশা বাদশা শুভ্র চরণের তলে মণিমুক্তাখচিত পাদুকার কাছে লুটাইতেছে; বাহিরের দ্বারের কাছে যমদূতের মতো হাবশি দেবদূতের মতো সাজ করিয়া, খোলা তলোয়ার হাতে দাঁড়াইয়া। তাহার পরে সেই রক্তকলুষিত ঈর্ষাফেনিল ষড়যন্ত্রসংকুল ভীষণোজ্জ্বল ঐশ্বর্যপ্রবাহে ভাসমান হইয়া, তুমি মরুভূমির পুষ্পমঞ্জরী কোন্‌ নিষ্ঠুর মৃত্যুর মধ্যে অবতীর্ণ অথবা কোন্‌ নিষ্ঠুরতর মহিমাতটে উৎক্ষিপ্ত হইয়াছিলে?

এমন সময় হঠাৎ সেই পাগলা মেহের আলি চীৎকার করিয়া উঠিল, 'তফাত যাও, তফাত যাও। সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়।' চাহিয়া দেখিলাম, সকাল হইয়াছে; চাপরাশি ডাকের চিঠিপত্র লইয়া আমার হাতে দিল এবং পাচক আসিয়া সেলাম করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আজ কিরূপ খানা প্রস্তুত করিতে হইবে।

আমি কহিলাম, না, আর এ বাড়িতে থাকা হয় না। সেইদিনই আমার জিনিসপত্র তুলিয়া আপিস-ঘরে গিয়া উঠিলাম। আপিসের বৃদ্ধ কেরানি করিম খাঁ আমাকে দেখিয়া ঈষৎ হাসিল। আমি তাহার হাসিতে বিরক্ত হইয়া কোনো উত্তর না করিয়া কাজ করিতে লাগিলাম।

যত বিকাল হইয়া আসিতে লাগিল ততই অন্যমনস্ক হইতে লাগিলাম-- মনে হইতে লাগিল, এখনই কোথায় যাইবার আছে-- তুলার হিসাব পরীক্ষার কাজটা নিতান্ত অনাবশ্যক মনে হইল, নিজামের নিজামতও আমার কাছে বেশি কিছু বোধ হইল না-- যাহা-কিছু বর্তমান, যাহা-কিছু আমার চারি দিকে চলিতেছে ফিরিতেছে খাটিতেছে খাইতেছে সমস্তই আমার কাছে অত্যন্ত দীন অর্থহীন অকিঞ্চিৎকর বলিয়া বোধ হইল।

আমি কলম ছুঁড়িয়া ফেলিয়া, বৃহৎ খাতা বন্ধ করিয়া তৎক্ষণাৎ টম্‌টম্‌ চড়িয়া ছুটিলাম। দেখিলাম টম্‌টম্‌ ঠিক গোধূলিমুহূর্তে আপনিই সেই পাষাণ-প্রাসাদের দ্বারের কাছে গিয়া থামিল। দ্রুতপদে সিঁড়িগুলি উত্তীর্ণ হইয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলাম।

আজ সমস্ত নিস্তব্ধ। অন্ধকার ঘরগুলি যেন রাগ করিয়া মুখ ভার করিয়া আছে। অনুতাপে আমার হৃদয় উদ্‌বেলিত হইয়া উঠিতে লাগিল, কিন্তু কাহাকে জানাইব, কাহার নিকট মার্জনা চাহিব খুঁজিয়া পাইলাম না। আমি শূন্য মনে অন্ধকার ঘরে ঘরে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। ইচ্ছা করিতে লাগিল একখানা যন্ত্র হাতে লইয়া কাহাকেও উদ্দেশ করিয়া গান গাহি; বলি, 'হে বহ্নি, যে পতঙ্গ তোমাকে ফেলিয়া পলাইবার চেষ্টা করিয়াছিল, সে আবার মরিবার জন্য আসিয়াছে। এবার তাহাকে মার্জনা করো, তাহার দুই পক্ষ দগ্ধ করিয়া দাও, তাহাকে ভস্মসাৎ করিয়া ফেলো।'

হঠাৎ উপর হইতে আমার কপালে দুই ফোঁটা অশ্রুজল পড়িল। সেদিন আরালী পর্বতের চূড়ায় ঘনঘোর মেঘ করিয়া আসিয়াছিল। অন্ধকার অরণ্য এবং শুস্তার মসীবর্ণ জল একটি ভীষণ প্রতীক্ষায় স্থির হইয়া ছিল। জলস্থল আকাশ সহসা শিহরিয়া উঠিল; এবং অকস্মাৎ একটা বিদ্যুদ্দন্তবিকশিত ঝড় শৃঙ্খলছিন্ন উন্মাদের মতো পথহীন সুদূর বনের ভিতর দিয়া আর্ত চীৎকার করিতে করিতে ছুটিয়া আসিল। প্রাসাদের বড়ো বড়ো শূন্য ঘরগুলো সমস্ত দ্বার আছড়াইয়া তীব্র বেদনায় হুহু করিয়া কাঁদিতে লাগিল।

আজ ভৃত্যগণ সকলেই আপিস-ঘরে ছিল, এখানে আলো জ্বালাইবার কেহ ছিল না। সেই মেঘাচ্ছন্ন অমাবস্যার রাত্রে গৃহের ভিতরকার নিকষকৃষ্ণ অন্ধকারের মধ্যে আমি স্পষ্ট অনুভব করিতে লাগিলাম-- একজন রমণী পালঙ্কের তলদেশে গালিচার উপরে উপুড় হইয়া পড়িয়া দুই দৃঢ় বদ্ধ মুষ্টিতে আপনার আলুলায়িত কেশজাল টানিয়া ছিঁড়িতেছে, তাহার গৌরবর্ণ ললাট দিয়া রক্ত ফাটিয়া পড়িতেছে, কখনো সে শুষ্ক তীব্র অট্টহাস্যে হাহা করিয়া হাসিয়া উঠিতেছে, কখনো ফুলিয়া ফুলিয়া ফাটিয়া ফাটিয়া কাঁদিতেছে, দুই হস্তে বক্ষের কাঁচুলি ছিঁড়িয়া ফেলিয়া অনাবৃত বক্ষে আঘাত করিতেছে, মুক্ত বাতায়ন দিয়া বাতাস গর্জন করিয়া আসিতেছে এবং মুষলধারে বৃষ্টি আসিয়া তাহার সর্বাঙ্গ অভিষিক্ত করিয়া দিতেছে।

সমস্ত রাত্রি ঝড়ও থামে না, ক্রন্দনও থামে না। আমি নিষ্ফল পরিতাপে ঘরে ঘরে অন্ধকারে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। কেহ কোথাও নাই; কাহাকে সান্ত্বনা করিব। এই প্রচণ্ড অভিমান কাহার। এই অশান্ত আক্ষেপ কোথা হইতে উত্থিত হইতেছে।

পাগল চীৎকার করিয়া উঠিল, 'তফাত যাও, তফাত যাও! সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়।'

দেখিলাম ভোর হইয়াছে এবং মেহের আলি এই ঘোর দুর্যোগের দিনেও যথানিয়মে প্রাসাদ প্রদক্ষিণ করিয়া তাহার অভ্যস্ত চীৎকার করিতেছে। হঠাৎ আমার মনে হইল, হয়তো ঐ মেহের আলিও আমার মতো এক সময় এই প্রাসাদে বাস করিয়াছিল, এখন পাগল হইয়া বাহির হইয়াও এই পাষাণ-রাক্ষসের মোহে আকৃষ্ট হইয়া প্রত্যহ প্রত্যুষে প্রদক্ষিণ করিতে আসে।

আমি তৎক্ষণাৎ সেই বৃষ্টিতে পাগলার নিকট ছুটিয়া গিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, 'মেহের আলি, ক্যা ঝুট হ্যায় রে?'

সে আমার কথায় কোনো উত্তর না করিয়া আমাকে ঠেলিয়া ফেলিয়া অজগরের কবলের চতুর্দিকে ঘুর্ণমান মোহাবিষ্ট পক্ষীর ন্যায় চীৎকার করিতে করিতে বাড়ির চারিদিকে ঘুরিতে লাগিল। কেবল প্রাণপণে নিজেকে সর্তক করিবার জন্য বারম্বার বলিতে লাগিল, 'তফাত যাও, তফাত যাও, সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়।'

আমি সেই জলঝড়ের মধ্যে পাগলের মতো আপিসে গিয়া করিম খাঁকে ডাকিয়া বলিলাম, 'ইহার অর্থ কী আমায় খুলিয়া বলো।'

বৃদ্ধ যাহা কহিল তাহার মর্মার্থ এই: একসময় ঐ প্রাসাদে অনেক অতৃপ্ত বাসনা, অনেক উন্মত্ত সম্ভোগের শিখা আলোড়িত হইত-- সেই-সকল চিত্তদাহে, সেই-সকল নিষ্ফল কামনার অভিশাপে এই প্রাসাদের প্রত্যেক প্রস্তরখণ্ড ক্ষুধার্ত তৃষার্ত হইয়া আছে; সজীব মানুষ পাইলে তাহাকে লালায়িত পিশাচীর মতো খাইয়া ফেলিতে চায়। যাহারা ত্রিরাত্রি ঐ প্রাসাদে বাস করিয়াছে, তাহাদের মধ্যে কেবল মেহের আলি পাগল হইয়া বাহির হইয়া আসিয়াছে, এ পর্যন্ত আর কেহ তাহার গ্রাস এড়াইতে পারে নাই।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, 'আমার উদ্ধারের কি কোনো পথ নাই।'

বৃদ্ধ কহিল, 'একটিমাত্র উপায় আছে তাহা অত্যন্ত দুরূহ। তাহা তোমাকে বলিতেছি-- কিন্তু তৎপূর্বে ঐ গুলবাগের একটি ইরানী ক্রীতদাসীর পুরাতন ইতিহাস বলা আবশ্যক। তেমন আশ্চর্য এবং তেমন হৃদয়বিদারক ঘটনা সংসারে আর কখনো ঘটে নাই।'

এমন সময় কুলিরা আসিয়া খবর দিল, গাড়ি আসিতেছে। এত শীঘ্র? তাড়াতাড়ি বিছানাপত্র বাঁধিতে বাঁধিতে গাড়ি আসিয়া পড়িল। সে গাড়ির ফার্স্ট্‌ ক্লাসে একজন সুপ্তোত্থিত ইংরাজ জানলা হইতে মুখ বাড়াইয়া স্টেশনের নাম পড়িবার চেষ্টা করিতেছিল, আমাদের সহযাত্রী বন্ধুটিকে দেখিয়াই 'হ্যালো' বলিয়া চীৎকার করিয়া উঠিল এবং নিজের গাড়িতে তুলিয়া লইল। আমরা সেকেণ্ড ক্লাসে উঠিলাম বাবুটি কে খবর পাইলাম না, গল্পেরও শেষ শোনা হইল না।

আমি বলিলাম লোকটা আমাদিগকে বোকার মতো দেখিয়া কৌতুক করিয়া ঠকাইয়া গেল; গল্পটা আগাগোড়া বানানো।

এই তর্কের উপলক্ষে আমার থিয়সফিস্ট আত্মীয়টির সহিত আমার জন্মের মতো বিচ্ছেদ ঘটিয়া গেছে।

Thursday, May 2, 2019

কার্ল সেগানের বর্ণিল ও ব্যস্ত জীবন নিয়ে সংক্ষিপ্ত জীবনী


carl sagan publicity

আইজাক অ্যাসিমভ নাকি অসম্ভব দাম্ভিক লোক ছিলেন। কাউকেই তেমন পাত্তা দিতেন না। উনি বলেছেন, ‘‘পৃথিবীতে আমার চেয়েও বুদ্ধিমান মাত্র দুজন ব্যক্তি আছেন। তার মধ্যে একজন কার্ল সেগান।’’

এই লোকটার নতুন করে পরিচয় করে দেওয়াটা খুব কঠিন। তার সম্পর্কে যাই বলা হোক না কেন, সেটা ওনার ব্যক্তিত্বের মাহাত্ম্যকে ফুটিয়ে তুলতে পারবেনা কখনোই। জ্যোতির্বিজ্ঞানী, কসমোলজিস্ট, জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী, লেখক, বিজ্ঞান জনপ্রিয়কারী, এবং আমার চোখে বিজ্ঞান বিপ্লবী, ক্ষণজন্মা পুরুষ কার্ল সেগান। এই বিশাল অন্ধকার মহাকাশে, পৃথিবী নামে এই ছোট্ট নীল বিন্দুটির ততোধিক নগণ্য অধিবাসী হিসেবে আমাদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস, হিংসা, দুঃখ, স্বার্থগুলো যে কতো অর্থহীন, তা বার বার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন এই লোক। আবার সম্মিলিত ভাবে একই উদ্দেশ্যে কাজ করে গেলে একসময় আমরা গ্যালাক্সী থেকে গ্যালাক্সী পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বো- এই স্বপ্নও দেখিয়েছেন।

তার জীবনে অর্জন ছিলো প্রচুর। কিন্তু পাশাপাশি, উপযুক্ত সময়ের অনেক আগে জন্ম নেয়ার ঝামেলাও কম সইতে হয়নি লোকটাকে। আসুন, তার বর্ণিল, ব্যস্ত, আর সর্বোপরি ছোট্টো জীবনটা নিয়ে আলোচনা করে কিছুটা সময় কাটাই।

10520899_886060838105959_6110680841282843510_n

১৯৩৪ সালের নভেম্বরের ৯ তারিখে নিউইয়র্ক শহরে তার জন্ম। Demon-Haunted World বইতে সেগান এক যায়গায় বলেছেন, ছোটোবেলায় বাবা স্যাম সেগানকে প্রশ্ন করে করে পাগল করে ছাড়তেন! তার যাবতীয় প্রশ্নই ডায়নোসর দিয়ে শুরু হয়ে এক পর্যায়ে পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশ পর্যন্ত চলে যেতো। তার বাবা ধৈর্য ধরে প্রতিটা প্রশ্নের জবাব দেয়ার চেষ্টা করে যেতেন, আরও প্রশ্ন করার উৎসাহ দিতেন। তার সেগান হয়ে ওঠার পেছনে ঐ বিজ্ঞান না-জানা ভদ্রলোকের অবদান কম নয়।

৫ বছর বয়সে নিউইয়র্কের পাবলিক লাইব্রেরীতে গিয়ে “স্টার” এর ওপরে লেখা চেয়েছিলেন। সামনে দাঁড়ানো পুঁচকে ছোঁড়া দেখে লাইব্রেরিয়ান তাকে হলিউড “সুপারস্টার”-দের ওপরে লেখা ধরিয়ে দিলো। কিন্তু তিনি চেয়েছিলেন, সত্যিকারের নক্ষত্র নিয়ে লেখা বই। লাইব্রেরিয়ান অবাক হলো, কিন্তু এবার ঠিকঠাকমত একটা বই দিলো। সেগান সেখানেই পড়লেন, সূর্য-ও একটা নক্ষত্র; রাতের আকাশে যে তারাগুলো দেখা যায়, সেগুলোর মতই। কিন্তু সেগুলো এতো দূরে যে, ওগুলো খুব ছোটো মনে হয়।

হঠাৎ করে পুরো মহাবিশ্বটা তার কাছে বিশাল হয়ে গেলো। তিনি এই বিশালতায় মুগ্ধ হয়ে গেলেন। সারা জীবন সেই মুগ্ধতা থেকে আর বের হতে পারেননি তিনি। পেশা আর আবেগ, দুটো দিয়েই জড়িয়ে ধরলেন নক্ষত্রবিদ্যা।

139

ইউনিভার্সিটি অফ শিকাগো থেকে ১৯৫৫ সালে পদার্থবিদ্যায় অনার্স, আর ৫৬ সালে মাস্টার্স করেছিলেন। এরপরেই তার নক্ষত্রবিদ্যা আর জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করলেন। সবাই মাস্টার্স বা পিএইচডি লেভেল থিসিস লিখলেও উনি অনার্সে থাকাকালেই ফিজিক্যাল কেমিস্ট H. C. Urey এর সাথে প্রাণের উৎস নিয়ে একটা থিসিস লিখেছিলেন। পিএইচডি করে বের হবার পর দু বছর ফেলো হিসেবে ছিলেন ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলে-তে।

কেউ ম্যাসাচুসেটস এর কেম্ব্রিজে বেড়াতে গেলে, স্মিথসোনিয়ান অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল অবজার্ভেটরি’র আশেপাশে বাতাস খেয়ে আসবেন। বার্কলে থেকে বের হবার পর, ৬২ থেকে ৬৮ সাল পর্যন্ত সেগান এখানেই কাজ করেছেন। একই সাথে হার্ভার্ডে গবেষণা করেছেন, লেকচার দিয়েছেন, এবং বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য একের পর এক প্ল্যান হাতে নিয়েছেন। এই অপরাধেই ৬৮ সালের পর হার্ভার্ডে তার চাকরির মেয়াদ আর বাড়ানো হয়নি। কারণ হিসেবে অন্যান্য প্রফেসররা যা বলেছিলেন তা হচ্ছে- ‘‘বিজ্ঞান টিজ্ঞান ভুয়া কথা। শালায় নিজে বিখ্যাত হইতে চায়! এরে হার্ভার্ডে দরকার নাই!’’

সেগান বিখ্যাত হতে চাননি। কসমস প্রচার হওয়ার পর, পাওয়ার ম্যাকিনটশ ৭১০০ মডেলের কম্পিউটারের কোড নেইম দেয়া হয়েছিলো ‘কার্ল সেগান’। এই তথ্য জানার পর সেগান অ্যাপলের নামে মামলা করে দিয়ে বলেছিলেন, নিজের নাম ভাড়া দিয়ে পয়সা বানানো বা বানাতে দেয়ার ইচ্ছা- কোনোটিই তার নেই।

হার্ভার্ডের পর সেগান জয়েন করেন তার জন্মস্থান নিউইয়র্ক স্টেটেরই আরেক শহর ইথাকা’র কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে। এখানেই কয়েক বছর পর এক ছেলের কলেজ অ্যাপ্লিকেশন দেখে তাকে তিনি ডেকে পাঠান। প্রচণ্ড ব্যস্ততার ভেতরেও অনেকক্ষণ কথা হয় দুজনের। ছেলেটির ভাষায়- ‘‘আমি জানতাম, আমি বিজ্ঞানীই হতে চাই। তবে মানুষ হিসেবে আমার কি হওয়া উচিৎ, তা ওই বিকেলে কার্ল সেগান আমাকে শিখিয়েছিলেন।’’…………… সেই হাইস্কুল সিনিয়রের নাম Neil Degrasse Tyson – বাকীটা ইতিহাস। টাইসন একা নন, কত হাজার হাজার মানুষকে কে যে সেগান বিজ্ঞানের রাস্তায় নিয়ে এসেছেন, তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

তার বিজ্ঞান সংক্রান্ত আবিষ্কারগুলোর কথা তো বলাই হলোনা। শনির উপগ্রহ টাইটানে বা জুপিটারের গ্রহ ইউরোপাতে পানির সম্ভাবনা থাকার কথা তিনিই প্রথমদিকে বলেছিলেন। সবাই ভেনাসকে স্বর্গের মত বলে দাবি করলেও তিনি বলেছিলেন, ভেনাস আসলে জ্বলন্ত দোজখ, যেখানে ভূ-পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৫০০ ডিগ্রী। তার কাজের জন্য ন্যাশনাল একাডেমি অফ সায়েন্সের সর্বোচ্চ সম্মান Public Welfare Medal পেয়েছিলেন তিনি।

আমেরিকার মহাকাশ যাত্রার একদম শুরু থেকে সাথে ছিলেন তিনি। ১৯৫০ সাল থেকেই তিনি নাসার নাসার উপদেষ্টা  অ্যাপোলো প্রোগ্রামের যে মহাকাশচারীরা চাঁদে যেতো, তাদের সাথে কথা বলাটা তার চাকরির দায়িত্ব ছিলো। UFO (Unidentified Flying Object), এলিয়েনদের দ্বারা কিডন্যাপ হবার রিপোর্ট—এসব বিষয়ে এতোই উৎসাহী ছিলেন যে তাকে ইউ এস এয়ার ফোর্সের UFO সংক্রান্ত অনুসন্ধান প্রজেক্ট- Project Blue Book-এর এর অ্যাড হক কমিটির মেম্বার করা হয়েছিলো। অনেকে দাবি করতো, ওরা এলিয়েন দেখেছে। ওদের কথা সত্যি হলেই তিনি বেশি খুশি হতেন, কিন্তু সত্যের প্রতি তার ভালোবাসা ছিলো আরো বেশি। সবসময়ই বলে গেছেন, অন্য গ্রহের প্রাণীর সাথে যোগাযোগ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ, তবে চেষ্টা ছাড়েননি। ভিনগ্রহের প্রাণীদের সাথে যোগাযোগ নিয়ে তার লেখা সায়েন্স ফিকশন CONTACT বইয়ের উপর ভিত্তি করে মুভিও আছে একটা, একই নামে।

contactcover

সায়েন্স ফিকশন CONTACT এর কথা তো বললামই। এছাড়াও তার লেখা বিখ্যাত বইগুলোর মধ্যে আছে Billions and Billions, Pale Blue Dot, Demon Haunted World, Broca’s Brain, The Dragons of Eden প্রভৃতি। তার মধ্যে Pale Blue Dot বইটার একটা অডিও ভার্সন বের করেছিলেন তার ভরাট, মোহনীয়, আবেগী কণ্ঠে। ওনার সেই কথাগুলো একটা ছেলেকে এতোই মুগ্ধ করেছিলো যে, সে ঐ অডিও থেকে ৪/৫ মিনিটের ক্লিপ নিয়ে নিজে দৃশ্য যোগ করে ভিডিও বানিয়েছে। সেই সিরিজেরই নাম “সেগান সিরিজ”।

আরেকটা বইয়ের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, COSMOS: A Personal Voyage. এই বইটার সাথেই শুধু না, কসমস শব্দটার সাথেই কার্ল সেগানের নাম জুড়ে গেছে। অনেকেই যখন কসমস শব্দটা শোনে, সাথে সাথে একজনের চেহারা ভেসে ওঠে – কার্ল সেগানের চেহারা।

7475736_orig

১৯৮০ সালে সেগান নিয়ে এলেন, তার জীবনের সবচেয়ে বিশাল প্রজেক্ট। এই প্রজেক্ট তাকে পরিচিত করে তুলেছিলো গোটা বিশ্বের কাছে। আমার মতে, তিনি বিজ্ঞানী থেকে বিপ্লবীতে পরিণত হয়েছিলো এই প্রজেক্টের মাধ্যমে। আর সেই প্রজেক্টটা হচ্ছে বিজ্ঞানভিত্তিক বিখ্যাত টেলিভিশন সিরিজ, Cosmos: A Personal Voyage. কসমস মানে সবকিছু, তাই তের পর্বের এই সিরিজের মধ্যে তিনি দেখালেন সবকিছু। অনুবাদকদের আড্ডা থেকে এই সিরিজের বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে।

02.-onubadokder-adda4

আমরা যখন অর্বাচীনের মতো নিজ স্বার্থে পৃথিবী ধ্বংসে পারদর্শিতা দেখাচ্ছি, সেগান তখন কসমস সিরিজে গ্রীন হাউজ ইফেক্টের কথা বলে আমাদের সাবধান করার চেষ্টা করছেন, যুদ্ধের উদ্দেশ্যে পারমাণবিক বোমার ব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়েছেন, কখনও শনির উপগ্রহ টাইটান দেখে হতাশ হচ্ছেন, আবার জুপিটারের উপগ্রহ ইউরোপার ভূপৃষ্ঠের বেশ কিছু অংশে পানির অস্তিত্ব আছে বলে প্রমাণ করছেন। ইউরোপা ভবিষ্যতে মানুষ বসবাসের উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলা যেতে পারে বলে স্বপ্ন দেখছেন। পৃথিবীকে আরও বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করেছেন, আবার মরিয়া হয়ে আমাদের জন্য পৃথিবীর বাইরে আরেকটা বসত খুঁজে বেড়িয়েছেন!

সেগান প্রমাণ করেছেন, বিজ্ঞান শুধু ল্যাবরেটরীর বন্ধ দরজার অন্যদিকে আবদ্ধ থাকার বিষয় না। পৃথিবীর প্রতিটা মানুষের যেমন বিজ্ঞান চর্চার অধিকার আছে, তেমনই আছে বৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্বন্ধে প্রত্যেকটা তথ্য জানার অধিকার! এই সিরিজ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বার বার। কর্নেলে ক্লাসের পর ক্লাস মিস গেছে; ব্যক্তিগত জীবন বলতে কিছু ছিলো না। অন্য প্রফেসরদের কঠোর সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে। কসমস দেখতে দেখতে অনেকবার মনে হয়েছে, কতো কষ্ট ভেতরে লুকিয়ে দিনের পর দিন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়েছেন। হাসিমুখে আমাদেরকে সৃষ্টির আদি অন্তের গল্প শুনিয়ে গেছেন। কোনো নির্দিষ্ট মানুষ বা জাতি না- সমস্ত পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষকে এমনভাবে কখনও কি কেউ ভালোবাসতে পেরেছে?

Slide13

প্রিয় সেগান,

আমি এখন ১৯৯৬ সালে। এখনও বেঁচে আছো তুমি। তিনবার মেরুদণ্ডের মজ্জা প্রতিস্থাপন (bone marrow transplant) করার অসম্ভব যন্ত্রণা ভোগ করার পর তোমাকে নিউমোনিয়ায় ধরেছে। কী করছো তুমি এখন? কষ্ট হচ্ছে খুব? শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা আছে নিশ্চয়ই! সেই কষ্ট? নাকি পৃথিবীকে আরও সময় দিতে পারলে না, সেই কষ্ট? বোকা মানুষগুলোকে আরেকটু বেশী ভালোবাসা দিতে পারলে না, সেই কষ্ট? নাকি এদের জন্য বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্রের কোথাও আরেকটা ঘর খুঁজে দিয়ে যেতে পারলে না—সেই দুঃখটাই বেশি ছিলো?

আমার এক বন্ধু একবার আমাকে বলেছিলো, ‘‘তুমি মানুষকে নিয়ে এতো ভাবো? এক টুকরো সেগান তোমার ভেতরেও আছে।’’

আমার বন্ধুর কথা সত্য।

আমি মানতে চাই না, তুমি নেই।

পৃথিবীতে একটা মানুষও যতদিন তোমার আদর্শ বুকে নিয়ে কাজ করে যাবে, ততদিন তুমি থাকবে।

এই মহাবিশ্বের যে কোনো প্রান্তেই হোক, তুমি থাকবে।

সেদিনও কেউ এমনভাবেই বলবে, “কার্ল এডওয়ার্ড সেগান, তোমার মতো করে কেউ কখনও আমাদের ভালোবাসেনি। তুমি বেঁচে থাকো অনন্তকাল”।

 

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/carl_sagan_short_biography/

Wednesday, May 1, 2019

রিডিং, মিসরিডিং ও গ্যুন্টার গ্রাস্ ব্যক্তিগত


জাহেদ আহমদের প্রবন্ধ : রিডিং, মিসরিডিং ও গ্যুন্টার গ্রাস্ ব্যক্তিগত

মানুষ আপোস করে বাঁচে, কবিতা কিন্তু আপোস চেনে না; — গ্যুন্টার গ্রাস্ বলেছিলেন কথাটা। প্রিন্সটন য়্যুনিভার্সিটিতে একটা ভাষণ দিচ্ছিলেন তিনি, বেশ অনেক-বছর আগে, সেই-সময়ের কথা। আমি অবশ্য ওই ইভেন্টে যেয়ে সরেজমিন প্রেজেন্ট হই নাই, ফিজিক্যালি ম্যুভ করার দরকারও হয় না আদৌ অন্তত বক্তৃতা শোনাশুনিতে, অ্যাপ্সযুগে তো পড়া-শোনা-জানা ইত্যাদি ক্রিয়াকলাপে ফিজিক্যাল প্রেজেন্সের নেসেসিটি নগণ্যই; কিংবা আস্ত বক্তৃতাটাও শুনি নাই, আমি শুনেছিলাম কখনো কথাচ্ছলে সুমনের মুখে। সেইটাও ওই ইন্টার্ভিউ মারফতে।
একটা ইন্টার্ভিউ পড়েছিলাম কবীর সুমনের, প্রসঙ্গক্রমে সেখানে কোথাও কবীরজি স্পিচটার উল্লেখ করেছিলেন। মোদ্দা কথা, মানুষের বাঁচা আপোসের ভিতর দিয়া হলেও কবিতা অনাপোস। কবিতার বাঁচা আপোস দিয়া হয় না। কবি নিশ্চয় ব্যক্তিজীবনে আপোস করতেই পারেন, কিন্তু কবিতায় সেই আপোসের ছায়াপাত ঘটলেই ঘাপলা। যা-হোক। কবিতা আপোসবিরুদ্ধ বলেই কি কবিতার পাঠক সংখ্যায় চিরকাল অল্প? স্বভাবে আপোসকামী, কিন্তু লোক-দেখানিয়া ডাঁট বজায় রেখে চলতে-চাওয়া মানুষ কবিতার কাছ থেকে তাই কি তিনশ পঁয়ষট্টি কিলোমিটার দূরে থাকতে চায়? কে জানে, হতে পারে, হয়তো-বা।


খালি কবিতার কথাই-বা কেন বলা হবে? কেন উপন্যাসের কথা বলা হবে না? কেন গল্পের ক্ষেত্রেও অভিন্ন বক্তব্য হবে না? বা সিনেমা বা প্রবন্ধ বা শিল্পসাহিত্যের অন্য সমস্ত ফর্মের ক্ষেত্রেই কেন কথাটা প্রযোজ্য হবে না? সাহিত্যের, বা বিজ্ঞানের, বা গণিতের কি চিত্রকলার কোথাও কোনো কর্নারে একরত্তি আপোসও কি অবগুণ্ঠিত থাকে শেষ-পর্যন্ত? সর্বাঙ্গসফল অব্যর্থ লক্ষ্যভেদী হওয়া আদৌ সম্ভব হয়েছে কোনো সৃজনের পক্ষে আপোসবৈশিষ্ট্য শরীরে ধারণ করে? এই প্রশ্ন গ্যুন্টার গ্রাসকে কোনো ইন্টার্ভিয়্যুয়ার করেছেন কি না জানি না, আদৌ চোখে ঠেকে নাই, প্রশ্নটা করা যেত অবশ্য; উত্তর যদিও, বব ডিলানের গানের ন্যায়, জানা আমাদের। না, আপোস দিয়া আবহমানের সাম্পানে ওঠা যায় না, আপোসে সৃজনকলা ব্যাহত হবারই কথা। আপোস দিয়া টাকাকড়ি হয়, 'কুবেরের বিষয়-আশয়' হয় না, আপোসে 'টিন ড্রাম' হবার নয়।


ইন্টার্ভিউতে কেউ প্রসঙ্গক্রমে এই প্রশ্ন করেছিল কি না, জানি না। তবে একটা কোটেশন পাচ্ছি যেখানে গ্যুন্টার গ্রাস্ উবাচ, "শিল্প সদা আপোসহীন এবং জীবন স্বভাবত সম্পূর্ণ আপোসের।" কাজেই বিষয়টা গ্রাসের ভাবনায় ক্রিয়া করেছে দেখতে পাচ্ছি। বিষয়টা এমনই যে, শিল্পকলার শিরোমণি হিশেবে আমরা কবিতা শাখাটাকেই ভাবতে অভ্যস্ত। ফলে আমরা যে-কোনো কথাবার্তা সাঙ্কেতিক ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করতে যেয়ে এভাবে প্রায়শ বলে ফেলি যে কবিতার বাইরে দুনিয়ায় আর কুন্তা নাই, শিল্প মানেই কবিতা আর কবিতা মানেই শিল্প। কেন করি এমনটা? একটা কারণ হয়তো এ-ই যে, যে-কোনো কাজের কাজিকে পার্ফেকশনিস্ট বলতে যেয়ে কবি বলে সম্বোধিতে অভ্যস্ত আমরা তার কারণ, কবিতা এখানে পার্ফেক্টনেস্ ও কম্প্যাক্টনেসের পরিবর্ত পদ হিশেবে ভাবি আমরা। তাই তো বলি, অমুক ক্যামেরার কবি, তমুক কম্প্যুটার গ্রাফিক্সের কবি ইত্যাদি। কিন্তু আরেকটা কারণ হতেও পারে যে ইন্ডাস্ট্রি অর্থে কবিতাশিল্প একটি সিক্ ইন্ডাস্ট্রি, এর থেকে অর্থাগম চিরদিনই কম, কাজেই এটি চিররুগণ ইন্ডাস্ট্রি। সেহেতু সমাদরে একটু উচ্চে আসন দেয়া কবিতা মাহতারিমাকে, একটা গার্লফ্রেন্ড-ভোলানিয়া সান্ত্বনা দেয়া, তা-ই কি? দেখতে পাই যে যে-কোনো মশহুর কবির চেয়েও শতগুণ শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক কবিতাকে একদম বুলন্দ দরোয়াজা দান করছেন যুগে যুগে। যেমন আমাদের ভাষার সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে বলতে শুনি, "কবিরা লেখক নয়। তারা লেখে না। কবিতা শুরু হয় সেখান থেকে যেখানে লেখার শেষ।" সন্দীপন এ-ধাঁচের কথা আরও অনেক বলেছেন কবিতার জয়গাথা গেয়ে, এমনও বলেছেন : "আমি গদ্য পাই কবিতা ও মানুষের মুখের ভাষা থেকে।" এই-রকম কথাবার্তা ভালো, অনেকটা ভাবনা-জাগানিয়া, আবার এগুলোর মধ্যে একটা বাড়াবাড়ি অনড় অভ্যস্ততা আছে কি না ভাবায়। একটা মাইন্ডসেট। অ্যানিওয়ে। এহেন কবিতামান্য কথাসাহিত্যিক হিশেবে আমরা গ্যুন্টার গ্রাসকেও দেখতে পাই, যিনি বলেন : "আমি বলব না যে কবিতাই সব; কিন্তু এভাবে ছাড়া কোনো উপন্যাসই আমার শুরু করা হয় না। কবিতাই হচ্ছে আমার সূচনাবিন্দু।"


কবিতাই ছিল 'দ্য টিন ড্রাম', গোড়াতে; — জানিয়েছেন খোদ ম্যাৎজেরাতের জনক গ্যুন্টার গ্রাস্। ল্যং পোয়েম বলে যাকে, সেইটাই; কিন্তু কবিতাটা গ্রাস্ নিজেই ফ্লপ বুঝতে পেরেছিলেন এবং ফলত ঘরকোণে ফেলে রেখেছিলেন কোথাও। অবশ্য কবিতাভার্শন ডম্বরুবাদকের আখ্যানভাগ বা আখ্যানবিন্যাস উপন্যাসপ্রতিরূপের হুবহু কিছু ছিল না আদৌ, পুরোপুরি ভিন্নই ছিল; কথাগুলো উদাহরণ সমেতই স্মৃতিকথাশৈল্পিক প্রবন্ধ 'দ্য টিন ড্রাম ইন রেট্রোস্পেক্ট' থেকে জানতে পারছি। ছিলেন তিনি তখন গেয়র্গ ট্র্যাকল, অ্যাপোলিন্যায়ার, রাইনার রিল্কে এবং লোর্কা প্রমুখ কবিদের কবিতাস্পৃষ্ট ও রীতিমতো প্রভাবিত, ইনফ্লুয়েন্সড বাই দি গ্রেইট পোয়েটস্; — কবুলতি গ্যুন্টারের। ওই বছর, ইন নাইন্টিন ফিফ্টি-টু, পড়তি গ্রীষ্মে, ব্যর্থ কবিতা-অভিজ্ঞতাটা আখ্যানে ট্র্যান্সফর্ম করবার বীজটা পেয়ে যান সহসা। আগাগোড়া অভিজ্ঞতার রূপান্তরিত নবনির্মিতি বিষয়ে সেই প্রবন্ধে তিনি বিশদে বলেছেন। তবে সেই বীজটা নাড়াচাড়া করার মতো ফুরসত করে উঠতে উঠতে এরই মধ্যে একে একে তিন-তিনটে বছর যায়। ইত্যবসরে স্থাপত্যবিদ্যায় স্টাডি শুরু করেন, প্রথম স্ত্রী অ্যানা আসেন জীবনে এবং কাফকা-প্যাটার্নে জীবনের প্রথম গদ্য লিখে ওঠেন, প্রচুর স্কেচ করেন বিহঙ্গসদৃশ ফিগার এবং অলঙ্কৃত মুর্গি কিংবা ঘাসফড়িং ইত্যাদি। একটা নাটকও হয়ে যায় লেখা, বাই দিজ টাইম, কিন্তু উপন্যাসবীজটা দানা বাঁধতে বাঁধতে পাক্কা তিন বছর সময় খেয়ে নেয়। এবং লিখতে শুরু করে একটানে তিনটা ড্রাফ্ট; উপন্যাসনামও তিনবার : প্রথমত 'অস্কার দ্য ড্রামার', পরে ছোটখাটো 'দ্য ড্রামার' এবং চূড়ান্ত 'দ্য টিন ড্রাম'; উপন্যাস রচনায় তিন গণিতটা গ্রাসের পিছু ছাড়ে নাই, তিনটা ড্রাফ্টই গিয়েছেন করে তন্বিষ্ঠ প্রত্যেকটা আখ্যানের ফাইন্যাল শেইপে যেতে, আমৃত্যু।


কবিদের উচিত নয় গদ্য লেখা, এই-রকম মতের লোকজনের দেখা আমরা প্রারম্ভজীবনে পেয়েছি মনে পড়ে। একিন করার মতো, আস্থাযোগ্য অনেক লেখকই ওই সাবধানবাণীটি দিয়ে গেছেন। ভ্যার্নার ল্যাম্বের্সি নামে একজন ফ্রেঞ্চ কবির একটা কাব্যগ্রন্থ — 'যদিও আমার হৃদয় গর্জমান' সেই কাব্যবইয়ের অনূদিত নাম — অনুবাদ করেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও মঞ্জুষ দাশগুপ্ত। ওইখানে জেনেছিলাম যে ল্যাম্বেরেসি জীবনে একটা লাইনও গদ্য লেখেন নাই; তিনি মনে করতেন, গদ্য লিখলে কবিতা কলুষিত হয়ে যাবার আশঙ্কা সাংঘাতিক বেড়ে যায়। এর উল্টো মতের লোকজনও কম নাই অবশ্য, যারা মনে করেন গদ্য শক্তিশালী না-হলে একজন কবি চির-ইম্যাচিউর রয়ে যান। তখন বুঝতাম না, এখন বুঝি 'কবিদের গদ্য লেখা আদৌ উচিত নয়' কথাটার অন্তর্নিহিত মিনিং। কবিতা নাজুক খুবই, সে পেশীশক্তি বরদাস্ত করে না, তার চাই ক্ষ্যামতা-লুকানোর মতো ক্ষমতাবানের হাত। গদ্যের ক্যারেক্টারই হচ্ছে যে সে ক্ষ্যামতা দেখাবে; পদ্যের পরাক্রম ক্ষমতা আড়াল করতে পারার মধ্যেই নিহিত। কবিতাকারক ক্ষমতা প্রদর্শন শুরু করলে, একবার গদ্যে লেগে গেলে, বেচারার হিয়া আর বিরাম পায়নাকো। কবিতা দাবি করে সর্বাংশ ও সর্বস্ব মনোযোগ। অন্যদিকে গদ্যে একবার পা বাড়ালে, বিশেষত কবিরা গদ্যে পা বাড়ালে, ফেরা যায় না আর নিরিবিলি জলশুখা নদীটির তীরে। এবং ফিরলেও, সম্ভবত, নদীবর্তী বিরিখ-পৈখ-মাছ-মেছোবক-গেছোবিলাইয়েরা প্রত্যাবর্তিত কবির গায়ে পায় পেশীশক্তিস্বেদের গন্ধ।


গ্যুন্টার গ্রাস্ কবি ছিলেন, কথাসাহিত্যিক ছিলেন, এবং আরও অন্যান্য পরিচয়েও বহাল ছিলেন তিনি। কিন্তু কথাসাহিত্যিক পরিচয়টাই রিপ্রেজেন্ট করছে তাকে আবিশ্বভূমণ্ডলে, এইটা দেখতে পাই। এই পরিচায়নের পেছনে তো পরিচয়-করানো ব্যক্তিটির সম্মতি/কন্সেন্ট/অ্যাপ্রুভ্যাল গ্রহণের কোনো প্রোসেস পরিলক্ষিত হয় না। পরিচয় যে করিয়ে দেয়, তথা বিগ-ক্যাপিট্যাল পাব্লিশার্স, এইটা তার/তাদেরই কাজ। গ্যুন্টার তো কবি পরিচয়টাই প্রেফার করতেন। অনেক ইন্টার্ভিউতে এইটা প্রামাণ্য। সব্যসাচী বলে যে-একটা শব্দ বাংলায় আছে, সেইটাই ছিলেন সর্বার্থে তিনি, এহেন পরিচয়ে যত লেখক আমরা দেখতে পাই তাদের আইডেন্টিটি আতান্তরে কবি আইডিটাই খোয়া যাইতে দেখি সবসময়। গ্রাসের ক্ষেত্রেও ঘটনা এই-ই ঘটেছে। ইংরেজিতে এবং বাংলায় ট্র্যান্সলেটেড অনেক কবিতা পড়ে আমরা গ্রাসকে জেনেছি ঠিকই, কিন্তু পরিচয় দেবার সময় ঠিকই 'টিন ড্রাম' বা বড়জোর 'ফ্লাউন্ডার্স'-এর রাইটার বলি। ইন্ট্রেস্টিং!



কবিতা দিয়েই শুরু করেছিলেন গ্রাস্, কবিতাবই বিরতি দিয়ে দিয়ে সবসময়ই বেরিয়েছে তার, সর্বশেষ কবিতাবইয়ের নাম 'দ্য লাস্ট ড্যান্স', শেষ বইটার বেশকিছু কবিতা তাঁর লোকান্তরোত্তর ছাপা হয়েছে ইতিউতি। বিভিন্ন ক্রিটিক গ্রাসের কবিতার উচ্চপ্রশংসা করে এক-দুইটা কথা বাংলায় ঘুরিয়েফিরিয়ে বলেন এইভাবে যে তিনি বস্তুপুঞ্জকে তার কবিতায় জীবন্ত করে তোলার কিমিয়া জানেন। কথা হলো, সমস্ত কবিই কমবেশ এই কিমিয়া জানেন ও প্রয়োগ করেন। রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত ব্যোদলেয়্যরকাব্য পড়ে একটু বিরক্তিভরেই বলেছিলেন 'আসবাবপত্রের কবি'। কাজেই জড়জগতের জীবরূপায়ণ, অনুরূপ উল্টোটাও, কবিতায় একটা প্রাথমিক ও প্রধান কাজ। বঙ্গে কিংবা ইঙ্গে কোনো ক্রিটিককেই দেখলাম না এই জায়গায় গ্রাসের নবত্ব অঙ্গুলিনির্দেশিতে। কেমন করে তিনি কবিতায় মৃত্যুচিন্তা পাঞ্চ করেছেন উইটি হিউমারাস্ কায়দা এস্তেমালপূর্বক, পোলিটিক্যাল ফিউটিলিটি নিয়া রিডিকিউল করছেন কীভাবে, এইসব নিয়া বাংলায় কাউকেই লিখতে দেখি না। গ্রাসের আখ্যানকাজে অ্যানিম্যাল কিংডম ব্যবহৃত হয়েছে ক্যারেক্ট্যারিস্টিক্যালি; কিন্তু কই, কাউকেই দেখা গেল না কোনো প্রবন্ধে এ নিয়ে একপ্যারা বাক্য ব্যয়িতে! কেবল এইটুকুই বিবৃতি নিবন্ধান্তরে যে গ্যুন্টার গ্রাসের উপন্যাসে ব্যাঙ-কুত্তা-ইন্দুর-বিলাই মনুষ্য চরিত্রের সমমর্যাদায় ডেপিক্টেড। সমগ্রের কিয়দংশও পড়া থাকলে এহেন উপর-টপকা বাক্যালাপে এস্কেইপ করার কথা না। মামলা এখানেই শেষ না, আরও থোড়া আছে। ড্যানজিগ ট্রিলোজি হিশেবে খ্যাত গ্যুন্টারের 'দ্য টিন ড্রাম', 'ক্যাট অ্যান্ড মাউস্' ও 'ডগ ইয়ার্স' একপাতে রেখে এখনও কোনো প্রবন্ধ রচিতে হেরিলাম না গ্রাসরচনাসামগ্র্য-পড়ুয়া দাবিদার বাংলাবাজারের লিখুয়া কাউরেই। গ্রিম ব্রাদার্সের ফেয়ারি টেইল গ্রাসরচনার বুননে কেমন করে ক্রিয়াশীল, কিংবা হিস্পানি পিকারেস্ক নভেলের ফ্যান্টাসি এবং ব্ল্যাক-কমেডির কৌশলগত অনুসৃতি ইত্যাদি নিয়া বাংলাগ্রামে কেউ লিখেছেন মর্মে এতাবধি ত্রিনয়নে হেরি নাই দ্বিকর্ণেও শুনি নাই। কিংবা আছে যেটুকু, সমস্তই বিলকুল স্ট্যাটমেন্ট বৈ ভিন্ন কুস্তা না। সাধারণ বিবৃতির অসাধারণ বাক্যাবলি। কিন্তু তজ্জন্য তো গ্যুন্টারসমগ্র পড়ার ভান ধরতে হয় না। গ্রাসগ্রন্থের ব্লার্বভাষ্য পড়লেই, ফ্ল্যাপকথনে নজর বুলাইলেই, কিংবা গ্রাসের সমস্ত বইয়ের ব্যাক-কাভারে মুদ্রিত সিলেক্টেড প্রেইজ ও ক্রিটিক্যাল অ্যাক্লেইমগুলো পড়িয়া লইলেই বিবৃতিবাচক বাগবহুল অমন বঙ্গচন্দ্র প্রণয়ন করা যায়। গুগলবাহিত নলেজের খবর আর না-ই বলি বরং।


যতটা দাবি, ততটা বাস্তবিক পড়াপড়ির অভ্যাস নাই আমাদের। যেটুকু আমি জানি, যেভাবে ও যে-প্রক্রিয়ায় জেনেছি, যতই লুকাতে চাই না কেন রচনায় সেইটা আবডাল থাকে না। সার্চ ইঞ্জিনের বদৌলতে লেখা বাংলা পাণ্ডিত্যপঙ্গু প্রবন্ধ-নিবন্ধ আজকাল মার্কেটে ব্যাপক মারমার-কাটকাট চাহিদাসম্পন্ন। শতেক কাগুজে পত্রিকা, নানা বাহারি লিটলম্যাগ ও দৈনিকী, হাজারখানেক অনলাইন প্রকাশনা, তাদিগের উদরসর্বস্ব পৃষ্ঠ ভরাইতে যেয়ে বাংলা মননশীল রিসোর্সফ্যুল মেকানিক্স ও মেশিনারিজের এহেন দুষ্পরিবর্তনীয় দশা। বাংলা মাননিক সাহিত্যের সূতিকাগার আজকাল শোচনীয়ভাবে একমেবাদ্বিতীয়ম গুগলের সার্চ ইঞ্জিন! গুগলজ্ঞানীর বাইরে কে আছে হেন অচলায়তনের ত্রাণকর্তা?


গ্রাসের 'টিন ড্রাম' পড়েছিলাম শুধু, অনুবাদে, ননফিকশন ধারার গুটিকয় দিনলিপি-জার্নাল-ইন্টার্ভিউ ইত্যাদি ছাড়া গ্রাসপাঠের ব্যক্তিগত গ্রাফটা আমার এ-ই। 'টিন ড্রাম' পড়েছিলাম শুধু, অনুবাদে, বাংলায়। নিশ্চয় অনুবাদেরও অনুবাদ হবে সেইটা। ভালো লাগে নাই অনুবাদটা। কার করা, নাম বলছি না। আচ্ছা, ভালো কথা, জার্মান না-জেনে কিংবা আংরেজি না-পড়ে কেমন করে বলছি যে অনুবাদ ভালো হয় নাই? কিন্তু আমি বলেছি ভালো লাগে নাই, ভালো হয় নাই তো বলি নাই। যা-হোক, অনুবাদ পড়তে বসে তো আর অনুবাদ পড়ি না, আখ্যানভাগের সঙ্গে মিশে যেতে চাই। কিন্তু কখনো মনে হয় যে মিশতে না-পারার কারণ অনুবাদের আড়ষ্টতা। বা নানান প্রকার ইম্যচিয়্যুরিটি তো সনাক্ত হয়ে যায় টেক্সট ধরে এগোতে যেয়ে। সেইটাই আর-কি। কিন্তু ততক্ষণে স্টোরিলাইনটা জানা হয়ে যায়, যেমন হয়েছিল 'টিন ড্রাম' বঙ্গানুবাদন পড়তে যেয়ে। অ্যানিওয়ে। একটা বাছাই প্রবন্ধচয়নিকা পড়েছি 'অন রাইটিং অ্যান্ড পোলিটিক্স ১৯৬৭-১৯৮৩' শিরোনামে, ট্র্যান্সলেইট করেছেন সেই র‌্যাল্ফ ম্যানহাইম। পঠিত গোটা-একটা ডায়েরি, 'ফ্রম জার্মানি টু জার্মানি', ১৯৯০ সালের সূচনা-জানুয়ারি থেকে শুরু এই ডায়েরির এন্ট্রি, যখন বার্লিনদেয়াল ভেঙে একত্র হয়েছে দুই জার্মানি, সেই-সময়টায় গ্রাস্ বছরভর প্রচুর ট্র্যাভেল করেছেন এক জার্মানি থেকে আরেক জার্মানির প্রত্যন্ত সবখানে এবং টুকে গেছেন এই দিনলিপি। এই দিনলিপিটি ইংরেজিতে এনেছেন জনৈক কৃষ্ণ উইন্সটন। এর বাইরে গ্যুন্টার গ্রাস্ পড়েছি ইতিউতি বাংলা সাপ্তাহিক সাময়িকীপৃষ্ঠাগুলোতে। অ্যাওয়ার্ড পাবার পরে যে-একটা ধামাকা হয় বাংলায়, সেই ধাক্কার চোটে বহুকিছুই তো জানা হয়ে যায় নোবেল লরিয়েটদের জীবন ও সাহিত্যের। গ্যুন্টার গ্রাস্ যেহেতু এইটিসিক্সে বাংলাবিহারে এসেছিলেন, কাজেই প্রচুর সংস্পর্শধন্য ও সান্নিধ্য-পাওয়া দাবিদার বেরিয়েছিলেন নোবেল লাভের সংবাদ বেরোবামাত্র। পত্রিকায় প্রচুর ফোটোফিচার হয়েছিল বছরভর, ১৯৯৯-এ, চিঠি-নিবন্ধ ইত্যাদি ছাপানো হয়েছিল অনুবাদপূর্বক। এইটুকু গ্যুন্টার গ্রাস্ আমার সম্বল।

১০
'পিলিং দ্য অনিয়ন' একচ্যাপ্টার পড়েছিনু, সত্যের খাতিরে বলা ভালো। উনি যখন নাৎসি পার্টির সঙ্গে নিজের সংযুক্ততা ছিল মর্মে কনফেশন করেছিলেন, তখন যে হল্লা উঠেছিল, সেই-সময়টায় বেশ আলোচনায় এসেছিলেন বিধায় গ্রাস্ বেশ খানিকটা আবার টুকটুক বাংলায় পড়া হয়। লিটলম্যাগাজিনগুলো বরাতে কবিতা পড়েছি অনেক-কটা, ডায়েরি ইত্যাদিও। সিলেক্টেড পোর্শন। ইন্ডিয়ান বাংলা লিটলম্যাগে 'জিভ কাটো লজ্জায়' শীর্ষক রচনাটার নির্বাচিত অংশ পড়েছি। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ড্রয়িং-স্কেচেসের সঙ্গে চোখাচোখি হয়েছে ইতিউতি। সর্বশেষ ইজরাইলি নাৎসিতুল্য হত্যাচার নিয়া তার কবিতাটা পড়েছি, ইংরেজি ও বাংলায়, সোশিওপোলিটিক্যাল কমেন্ট্রি হিশেবে কবিতাটা টাচ করেছিল মনে পড়ে। এইটাই কি গ্রাসের সর্বশেষ লেখা কবিতা? নাকি লিখেছেন আরও কয়েকটা তারপরেও? খোঁজ জানি না। যা-হোক, কবিতাটা বেশ ইন্টেলেকচুয়্যলি ইমোশন্যাল কিংবা বলা যায় ইমোশন্যালি ইন্টেলেকচুয়্যল হয়েছিল বটে। এ-ই তো।

১১
গ্যুন্টার গ্রাস্ সম্পর্কে এইটুকু সম্পর্কিত আমি, এর বেশি না। বাবু সন্দীপনের আদলে বলি : গ্যুন্টার গ্রাস্ সম্পর্কে ২টা/১টা পাণ্ডিত্য যা আমি অর্জন করেছি তা এতক্ষণে ঝেড়ে ফেলা যাইল। বস্তার ভেতরে আর-কিছুই নাই অবশেষ। তবুও নটেগাছ অল্পে কে কবে পেরেছে গল্পের বাইরে বাস্তবে মুড়ায়ে শেষ-নিকেশ করে নিতে? এইখানেও কথা তাই ফুরায় না। এইটুকু গ্যুন্টারপাঠের এক্সপেরিয়েন্স নিয়া আর্টিক্যল ফাঁদতে বসা কেন, কৈফিয়ৎ দেয়ার চেষ্টাটা খানিক করা যাক এখানে, যথাসাধ্য সংক্ষেপে। প্যারা বাই প্যারা।

১২
গ্রাস্ পড়তে যেয়ে, এটুকু গ্যুন্টার গ্রাস্ পড়ার পরে একটা পর্যায়ে এসে, বেশকিছু খটকার মতো কোয়েশ্চন গজিয়েছে ভেতরে। এগুলোর উত্তর খুঁজেছি বিভিন্ন সময়ে, এইসব বাহারি লিট্যার‌্যারি সাপ্লিমেন্টের নিবন্ধপ্রবন্ধে, যেসব হপ্তাহান্তিক সাহিত্যমোচ্ছব হয়ে আসছে সেই কোন সুদূরের অতীত হতে এই চিলমারি বন্দরের দেশে। মেলেনিকো উত্তর। দিবসের শেষ সূর্য, তথা গ্রাস্, অস্তমিত ইত্যবসরে। সেই খটকারাশি নিবন্ধপত্রের, অত্র বক্ষ্যমাণ নিবন্ধপত্রের, প্রতিপাদ্য।

১৩
গ্যুন্টার গ্রাস্ পড়া/না-পড়ার হাওয়ায় একটা ব্যাপার, একটা আন্তর্জিজ্ঞাসার জবাব, দীর্ঘদিন ধরেই খুঁজছিলাম। ব্যাপারটা খানিক বিশদেই বলি। দুনিয়া জুড়েই তো যুদ্ধজঙ্গ সংঘটিত হয়ে আসছে এবং শিল্পী-সাহিত্যিকদেরে কেউই তো জিগায় না আখাম্বা মাইরধইর-দাঙ্গা বাঁধাবার আগে। লেখক-কবি-শিল্পীরা হানাহানিদীর্ণ সময়ে একটা ফাঁপড়ে তো পড়েনই তাদের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ প্রভৃতি নিয়ে। এর মধ্যে আবার যুদ্ধজঙ্গময়দানে হারু পার্টির তাঁবুর লেখক-শিল্পীদের বাস্তবতা আরও সঙ্কটাপন্ন হয়ে থাকে নিশ্চয়। ভ্রান্ত রাজনীতি ও দৈত্যদানো স্বদেশজ ও আন্তর্জাতিক নেতৃত্বের ভিক্টিম হতে হয় দেশের ক্লান্ত ও জজবাজ্যান্ত জনসাধারণকে, সেইসঙ্গে সে-দেশের লেখক-শিল্পীদেরেও। জনসাধারণ তবু সোজাসাপ্টা বাস্তবে ফেরে একসময়; কিন্তু শিল্পী-সাহিত্যিকরা যেহেতু অনাপোসের সৃজনযজ্ঞের যাজ্ঞিক, সঙ্কটটা তাদের ভয়াবহ। গ্যুন্টার গ্রাস্ যে-ভূখণ্ডের মানুষ, সেখানকার ইতিহাসধিক্কৃত অপকাণ্ড দুনিয়াবিদিত। জয়-পরাজয়ের সমিল সমীকরণের মামলা না সেইটা, তারচেয়েও জটিল একটা আবর্তে জার্মানির শিল্পী-সাহিত্যিক-দার্শনিকরা আজোবধি ইতিহাসতোপের মুখোমুখি দিন গুজরান করছেন। তুলনীয় অভিজ্ঞতা আমাদের নাই, ভাগ্যিস, জার্মানির মতো হন্তারক অভিধা পাবার বদনসিব যেন কোনো জনজাতির না-হয় অধিকন্তু। অপরাধবোধি, বিবেকদংশন, গ্লানি ও হেঁটমুণ্ড লজ্জার সেই ইতিহাসতাড়না তারা কীভাবে মোকাবেলা করেন তাদের সৃজিত রচনায়? নিস্তব্ধতার নির্মোক পরে থাকেন এবংবিধ প্রসঙ্গত? গ্যুন্টার গ্রাস্ কেমন করে এর মোকাবেলা করেন? সাক্ষাৎকার বা আত্মজৈবনিক নোটগুলোতে কিংবা গ্রাসের নির্বাচিত প্রবন্ধগুলো থেকে এইটা জানি বলা যায় এক-রকমে; কিন্তু ফিকশনে এইটা কীভাবে মোকাবেলা করেন তিনি? ইতিহাসচৈতন্য ও পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান, যেমন বলেছিলেন জীবনানন্দ, মহান একজন লেখককে এই গিভেন কন্টেক্সটে কেমন করে কল্পনাচালিত করে? এই ব্যাপারটা কি গ্রাসের রচনা পাঠকালে কেউ আমরা খেয়াল করে দেখেছি? 'টিন ড্রাম' পড়ে তো সব হাঁড়ির খবর বলা যাবে না ভায়া! ম্যাজিশিয়্যান মননমিস্ত্রীরা পারবেন হয়তো-বা। যারা পড়েছেন আরও দুই-চারিটি গ্যুন্টারনভেল, তারা জানান নাই কিচ্ছুটি ফিকশন থেকে উৎকলনপূর্বক। স্বল্পপ্রাসঙ্গিক হলেও উল্লেখ্য, গত শতকস্থ হননমুখা জার্মানির কালিলিপ্ত ইতিহাস সম্পর্কে যে-একটা চালু সচেতনতা আমাদের রয়েছে, যেই ঘৃণা ও বিবমিষা সেই বিশেষ সময়পর্ব ও ক্রীড়নকদের নিয়ে, সেইটাও মনে হয় এখন আর এককভাবে হিটলারল্যান্ডের প্রাপ্য মনোপোলি কিচ্ছু নয়; ঢের দেখিয়েছে এরপরে একজন অন্যে, অ্যামেরিকা বা ইজরাইল হয়তো-বা নাম তার, বটে; এখন বরং হিংস্রতা আর অমানবিক দানোবৃত্তিতে এককালের জার্মানিকেও টপকে গেছে এহেন অধিপতি ও আধিপত্যশীল/হেজেমোনিক কায়কারবার পৃথিবীতে ঢের বেশি বিরাজিছে। এই ইশ্যু নিয়া গ্রাস্ বলতেও শুরু করেছিলেন শেষদিকে; সেইটা আলাদা আলাপ।

১৪
অবশ্য অপরাধী কিংবা মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড করে ফ্যালে যেসব ভূখণ্ড, তারা নিজেদের ধরনে নিজেদের অস্তিত্বের ফেভ্যরে একটা ব্যাখ্যা/ইন্টার্প্রিটেশন গড়ে তোলে নিজেদেরই সার্ভাইভ্যালের তাগিদে; এইটা আমরা নানাভাবেই দেখতে পাই ইতিহাস জুড়ে, যে যত বেশি কৃতকর্মের পক্ষে/বিপক্ষে একটু উদার ব্যাখ্যা/পাল্টাব্যাখ্যার অনুশীলন জারি রেখে যেতে পারে, সে-ই সার্ভাইভ করতে পারে তুলনামূলক রোয়াবের সঙ্গে। এমনটা না-হলে তো দুনিয়াব্যাপ্ত কলোনিয়্যাল সাম্রাজ্যলুঠেরাদের পক্ষে সবিবেক বেঁচে থাকা মুশকিলের হতো। ফরাশি কি ব্রিটিশ কি অ্যামেরিক্যান সাম্রাজ্যাগ্রাসীদের মুখ ও মদমত্ততা স্মর্তব্য। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের কাছে ধরা-খাওয়া হানাদার পাকিস্তানীরা তাদের হাউশ মিটিয়ে এত হত্যা-নিপীড়ন চালিয়েও পরাজিত হওয়াটাকে একটা ব্যাখ্যাজনক বোধসন্দর্ভের আওতায় না-আনতে পারলে তো হেঁটমুণ্ড লজ্জায় এদ্দিনে মরেই যেত গণ্ডগোখরা পাকি। কিংবা আমাদের এই ছোট্ট দেশের ভেতরেও খুব কম মাত্সান্যায়ের ঘটনাই অ্যাক্নোলেজ করি আমরা। পাহাড়িপীড়ন, ক্ষুদ্রায়ত নৃগোষ্ঠী নিপীড়ন, ডমিন্যান্ট ধর্মচৈতন্যের অত্যাচার আমরা নানাভাবে লেজিটিমেইট করে নিতে দেখি। ইন্টার্প্রিটেশন দিয়ে এই লেজিটিমেইসি প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইন্টার্প্রিটেশনের অনুশীলন এখানে মন্থর ও গোবেচারা টাইপের বলে আমাদের ম্যাচিউরিটি ক্ষীণস্রোতা। গ্রাস্ ও তার সমসাময়িক কবি-লিখিয়েরা কাজেই ইন্টার্প্রিটেশন তথা সাহিত্যের ভেতর দিয়া জাতিটাকেই রিভাইভ করতে দিয়েছেন মনে হয়। দাশাউ-আউসবিত্স ইত্যাদির পরবর্তীকালের সাহিত্যিকেরাই হিটলারবলাত্কৃত জার্মান জাতিটাকে বাঁচায়েছেন। কিন্তু কই? গ্রাস্ ও তার সতীর্থ সাহিত্যিক বন্ধুদের গ্রুপ-ফোর্টিসেভেন নিয়া বাংলায় লেখাজোখা আগাগোড়া নাই-ই তো!

১৫
'অন রাইটিং অ্যান্ড পোলিটিক্স ১৯৬৭-১৯৮৩' শিরোনামক প্রবন্ধগুচ্ছের অ্যান্থোলোজিটা নানা কারণেই ইম্পোর্ট্যান্ট। ননফিকশনের গ্যুন্টার গ্রাস্ সংহত ও শাণিত কতটা, ভালো বোঝার একটা রাস্তা এই বইটিতে মেলে। এক-মলাটের ভেতর দুইটা আলাদা ভাগায় লেখাগুলো সুবিন্যস্ত। প্রথম ভাগ 'অন রাইটিং', দ্বিতীয় ভাগ 'অন পোলিটিক্স'। অন রাইটিং পোর্শনে একটা কাফকাসাহিত্য-মূল্যাঙ্কন প্রবন্ধ সুলভ যার শিরোনাম 'কাফকা অ্যান্ড হিজ এক্সিকিউটর্স'। প্রবন্ধটা এমন জাতের যে এইটা বাংলাভাষান্তর করতে পারলে একটা কাজের কাজ হয় এবং উপরন্তু প্রবন্ধটা নিয়া আলগ কথাবার্তাও জরুরি বিবেচিত হবে। এইটা পড়ে যে-কারো মনে হবে যে কবি ও কথাসাহিত্যিকের দ্বিজ গ্যুন্টার গ্রাসের প্রবন্ধ পড়াও অভিজ্ঞতা হিশেবে কেমন উজ্জ্বল ও ইউনিক। যদিও প্রবন্ধসমূহ পড়ব ইংরেজি ভাষায়, জার্মান ল্যাঙ্গুয়েজে এগুলোর আস্বাদন তো সম্ভব নয় গ্যাটে ইন্সটিট্যুটের সহায়তা ছাড়া আমাদের কারো পক্ষে, গ্রাসের যুক্তিবিন্যাস ও চিন্তাপ্রাখর্য তো ধরা যায় যে-কোনো অনুবাদনে। এইটাই সম্ভবত গ্রন্থটির সর্বদীর্ঘ সুগ্রথিত প্রবন্ধ। এছাড়া আছে এখানে যেসব অন্যান্য, উল্লেখ করা যাক কয়েকটার নাম : প্রথম উপন্যাসের পূর্বাপর স্মৃতি নিয়ে ইতিহাস-মন্থন-করা আলেখ্য 'দ্য টিন ড্রাম ইন রেট্রোস্পেক্ট', আরেকটা আছে 'রেইসিং উইথ দি ইউটোপিয়াস্', অসাধারণ উপন্যাসোপম প্রবন্ধ 'হোয়াট শ্যাল উই টেল আওয়ার চিল্ড্রেন?' পড়ে সেরে এমন স্বগতোক্তি আপনার মুখ দিয়া আপনাআপনিই বেরিয়ে আসতে পারে যে এই বিবেচনাবোধ ও কথনভঙ্গির মানুষ গল্পোপন্যাসকবিতা না-লিখলেও সে শিল্পীই। যাকগে। অ্যান্থোলোজির দ্বিতীয়াংশ বক্তৃতাভাষণার লিখিত রূপ নিয়া গ্রাসের গোটা-আটেক অনবদ্য রচনাকালেকশন। কয়েকটার নামপঙক্তি শুনলেই বোঝা যাবে ভেতরে কেমনধারা বারুদ ও মধুপূর্ণ বনতুলসী : 'লিট্রেচার অ্যান্ড রেভোল্যুশন', 'দি আর্টিস্ট'স্ ফ্রিডম অফ অপিনিয়ন ইন আওয়ার সোসাইটি', 'দি ডেস্ট্রাকশন অফ ম্যানকাইন্ড হ্যাজ বিগান', 'অন দ্য রাইটস্ টু রেসিস্ট' প্রভৃতি।

১৬
প্রাগুক্ত প্রবন্ধগ্রন্থ থেকে এক-দুইটে এক্সার্প্ট চয়ন করা যাক, র‌্যান্ডোম স্যাম্পলিং, যাতে টের পাওয়া যায় এর মধ্যস্থিত মধু ও মননের টেইস্ট। প্রথমেই দেখা যাক আমার বিবেচনায় এই গ্রন্থের আশ্চর্য স্কলার্লি আর্টিক্যল 'কাফকা অ্যান্ড হিজ এক্সিকিউটর্স'-এর ভেতরভাগে কেমনধারা মাল পোরা; আশ্চর্য, কেননা অ্যাকাডেমিক স্টাডি টাইপের জিনিশ না-হয়েও রচনা যে কী ক্রিটিক্যালি অ্যানালিটিক্যাল হতে পারে, গ্রাসের এই রচনা সেক্ষেত্রে উদাহরণীয়। আরেকটা কথা, কাফকা বিষয়ে এন্তার রচনা আপনি পড়েছেন এই জিন্দেগিতে, গ্যুন্টারের কাফকাবিবেচনা আপনাকে একবার ট্রাই করতেই হবে, এবং ঠকা খাবেন না অ্যাশিয়্যুর করা যাচ্ছে। একাংশ উদ্ধৃতি নিচ্ছি ইংরেজি থেকে, র‌্যাল্ফ ম্যানহাইমের ট্র্যান্সল্যাশন থেকে, ব্যাকাত্যাড়া বাংলায়, দেখুন : “ফ্রানৎস কাফকা-র অসমাপ্ত উপন্যাস 'দ্য ক্যাসল', আখ্যানভাগের সূচনাকাল ১৯২২, ... উপন্যাসটায় যে-অন্তর্দৃষ্টিজাত বোধের পরিচয় আমরা পাই তা কাফকায়েস্ক ন্যাচার অফ ব্যুরোক্রেইসি হিশেবে মশহুর। এদিকে আমরা সকলেই এখন জানি যে ২১ অগাস্ট ১৯৬৮ পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনাবলির বিস্তর রাজনৈতিক বিশ্লেষণী বয়ান হাজির রয়েছে, কাজেই আমি চেষ্টা করব কাফকা-র সামগ্র্যবাদী প্রশাসন সম্পর্কিত রূপরেখা থেকে দৃষ্টান্ত চয়নপূর্বক গোটা-কতক প্রশ্ন তুলতে বিশেষভাবেই এর কাঠামো সম্পর্কে যেখানে আমরা দেখতে পাবো যে, কেবল সামরিক ক্ষমতার দিক থেকেই নয়, আর্থনীতিক এবং ভাবাদর্শিক ক্ষমতার দিক বিবেচনায় নিয়েও পুব ও পশ্চিমের সমাজগুলো সমগ্রতাবাদী আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনরাজনীতিজালের মুঠোবন্দী, ইতিহাসে যা একদম অভূতপূর্ব।” বিসমিল্লায় এহেন প্রস্তাবনা জানায়ে রেখে এর পরের প্যারায় যেয়ে এক-নজরে এন্টায়ার প্রবন্ধের সার্চ-অব্জেক্টিভগুলো কয়েকটা প্রশ্ন আকারে জানিয়ে দিচ্ছেন : “কে অথবা কী এমন জোরালো শক্তি যার কারণে আইনগত এখতিয়ার ও বৈচারিক ব্যবস্থা প্রভাবিত হয় এবং উভয়ের মধ্যস্থিত ন্যূনতম বিভাজনরেখাগুলোও মুছে যেতে থাকে? এমনটা কেন ঘটে যে এক-ও-অভিন্ন জনৈক সবকিছুর জন্য দোষী/দায়ী সাব্যস্ত হয় এবং আখেরে যে কোনোকিছুরই দায়ভাগী না বা বেকসুর আদতে? একে অপরের সঙ্গে কোন সম্পর্কের ছুতো ধরে আমলাতন্ত্র ও দুর্নীতি বিকশিত হয় এবং বাড়ে বা কমে? কাফকাবীক্ষণ অনুসারে প্রশাসনিক প্রক্রিয়াপদ্ধতি-যন্ত্রপাতিগুলো কখন অতিপ্রাকৃত ও ভূতুড়ে-সাঙ্কেতিক হয়ে ওঠে?” এখন বলুন, এই তরিকায় এহেন প্রশ্নালোকে এর আগে কাফকাসাহিত্য অবলোকনের কেন্দ্রে নেয়া হয়েছিল? অন্যত্র একটা জায়গায় গ্রাস বলছেন : “সকল ভাবাদর্শিক ক্ষমতা চালিত হয় একটা আখাম্বা দুনিয়াজোড়া দাবি নিয়া, দাবিটা হচ্ছে এ-ই যে তাদেরই হাতে নাকি রয়েছে একমাত্র সত্যের সত্ত্বাধিকার ও পূর্ণ মালিকানা, তাই তারা পারস্পরিক বিয়োগনীতির ভিত্তিতে কামড়াকামড়ি চালায় এবং একে অন্যেরে মৃত্যুদরোজায় নিয়া যাইতে সদা সচেষ্ট রয়, এই ভাবাদর্শদোকানিরা প্রত্যেকেই অদ্বিতীয়-একটা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থানতজানু : ব্যবস্থাটার ডাকনাম আমলাতন্ত্র। ব্যুরোক্রেইসি/আমলাব্যবস্থা নিজেকে সর্বশক্তিমান মনে করে এবং সেই-মতো রোয়াব চালায়। সে নিজেই নিজের হোতা ও মদতদাতা। ভাবাদর্শিক ব্যবস্থার পরিবর্তন/পটবদল হতে পারে, কিন্তু ব্যুরোক্রেইসি নিজের গতিতে সক্রিয় ও সচল রয় এমনকি হেঁচকা হাল্কা ধাক্কা বা এতটুকু টুটাফাটা ঝাঁকি ছাড়াই, কারণ ব্যুরোক্রেইসির নাই কোনো মূল্যবোধগত বিচারবালাই, নাই তার নতুন কোনো তন্ত্র/প্রক্রিয়া/ব্যবস্থার সঙ্গে নিজেরে খাপ খাইয়ে নেয়ার মাথাব্যথা। এমনকি রাজনৈতিক শত অস্থিরতার মধ্যেও, বিপ্লবী বিক্ষুব্ধতার বৈরী বাতাঘূর্ণিতেও, ব্যুরোক্রেইসি নিজের নির্ধারিত নীতির ওপর আস্থা রাখে এবং অনড় ও অটলভাবে অটুট থাকে; ব্যুরোক্রেইসি বদলাবে দূর অস্ত, এমনকি তার খুশবু-বদবু পর্যন্ত অবিকল অপরিবর্তনীয় রয়ে যায়।” এই রচনা আস্ত গ্র্যাব না-করে কি আপনি তিষ্ঠোতে পারবেন ক্ষণকাল?

১৭
পরপর দুইটা ভাষণের গোছানো রূপ থেকে এক/দুই কিয়দংশ উদ্ধার করা যায় কি না এ-পর্যায়ে দেখা যাক। প্রথমেই 'লিট্রেচার অ্যান্ড রেভোল্যুশন' থেকে; এইটা গ্রাস বেলগ্রেইড রাইটার্স কনফারেন্সে অক্টোবর নাইন্টিন-সিক্সটিনাইনে অ্যাড্রেস্ করেছিলেন। গোড়ায় লেইডিস্ অ্যান্ড জেন্টলমেন সম্ভাষণপূর্বক সরাসরি বোমা : “কথাটা সোজাসাপ্টা বলি : বিপ্লবের বিরুদ্ধে আমি। বিপ্লবের নাম নিয়ে যে-একপ্রকার ধুন্দুমার বলীদানের যজ্ঞ যুগে যুগে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এইটা আমি তীব্রভাবে ঘেন্না করি। ঘৃণা করি আমি এর অতিমানবীয় লক্ষ্যগুলো, এর চূড়ান্ত চাহিদা, এর অমানবিক অসহিষ্ণুতা; আমার সভয় বিকর্ষণ রয়েছে বিপ্লব নামের মেকানিজমটার প্রতি, বিপ্লব সবসময় একটা পার্মানেন্ট পাল্টিবিপ্লবের পথ খোলা রাখে একপ্রকার প্রতিষেধক/অ্যান্টিডোট হিশেবে। সেইটে এই প্রাগের বিপ্লব বলি কিংবা রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব, যদিও সামরিক/মিলিটারি সাফল্য ফলেছে এগুলো থেকে, বস্তুতপক্ষে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে শেষমেশ এই অর্থে যে এগুলো পুনরায় যেই-লাউ-সেই-কদু অর্থাৎ ট্র্যাডিশন্যাল স্ট্রাকচার্স অফ পোলিটিক্যাল ক্ষমতাকেই রিস্টোর করেছে। বিপ্লব সবসময় এক নির্ভরশীলতা হঠিয়ে আরেক নির্ভরশীলতা স্থাপন ও প্রতিষ্ঠা করে থাকে, এক দমনপীড়ন হঠাতে যেয়ে আরেক অতিদৈত্য দমনপীড়ন ডেকে এনে বসায়।” এইটুকু বলে নিয়ে পরে আরও স্পষ্ট করে বলছেন যে তিনি রিভিশ্যনিস্ট এবং অধিক স্পষ্টত সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট। গ্যুন্টার গ্রাসের পোলিটিক্যাল এনগেইজমেন্ট সম্পর্কে কে না অবগত যে এই স্পষ্টভাষণের পটভূমি ও পার্সপেক্টিভ বুঝতে অসুবিধে হবে? এবারে দ্বিতীয় আরেকটা ভাষণ থেকে একাংশ : “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অব্যবহিত পরবর্তী প্রেক্ষাপটে জার্মান রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের ন্যাক্কারজনক ভূমিকায় পর্যুদস্ত ও অপরাধন্যুব্জ হয়ে আমি ভাবছিলাম, লেখক হিশেবে আমি নিজের ভেতর থেকেই তাগিদ বোধ করছিলাম, সৃষ্টিশীল লেখকের কল্পিত স্বাধীনতা যা আলাদাভাবে লেখক আকাঙ্ক্ষা করেন তা আসলেই অলীক তথা আস্ত একটি ফিকশন বস্তুত, মনে রাখা চাই যে লেখক শুধু তার কাজ বা তার লেখালেখিসৌত্রিক ভূমিকা দিয়ে সমাজে ছাপ রাখেন বা শুধু সময়ের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলার মহত্তর কাজ করেন তা-ই নয়, একইভাবে এইটাও সত্যি যে লেখকও সমাজেরই পয়দা বা সমাজগর্ভে-সমাজৌরসে জন্ম তার, সমাজেরই সৃষ্ট সন্তান তিনি — ব্যাপকাংশে বখাটে সন্তান, সৎপাত্র তথা বিপিতা/বিমাতার ঘরে লালিত-বর্ধিত সন্তান, অথবা রাষ্ট্রেরই যোগসাজশকারী একটা হাত। অতএব আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সেই সময়েই যে লেখার মধ্য দিয়েই আমি আমার রাজনৈতিক হিস্যা আদায় করে নেব তথা আমার যা করণীয় নগরসভ্যতায় একজন লেখক হিশেবে তা আমি লিখেই পালন করে যাব।” দ্য কাউন্সিল অফ য়্যুরোপ এবং এর শিক্ষা ও সংস্কৃতি কমিশন কর্তৃক আহূত একটি সিম্পোজিয়্যমে অ্যাড্রেসটা গ্রাস্ করেছিলেন নাইন্টিন সেভেন্টিথ্রি-র জুন মাসে ফ্লোরেন্সে। একটা ভাষণে যেন গ্যুন্টার গ্রাস্ ঘুরে আসেন গোটা মানবসভ্যতার ইতিহাস, যেখানে লেখক-শিল্পী ও মুক্তমতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে দেশে-দেশান্তরে কালে-কালান্তরে ক্ষমতানতজানু প্রথাবাধ্য সমাজ দুঃসহ দমন-নিপীড়ন চালিয়ে চলেছে এক-ও-অভিন্ন অনমনীয় মতৈক্যে থিতু থেকে। এই বিভীষিকার আবহ থেকে লেখক-শিল্পীদের জন্য রৌদ্রকরোজ্জ্বল মুক্তচিত্ত নির্ভয়ের নির্ভরতা নিশ্চিত করতে সিম্পোজিয়্যমে প্রেজেন্ট সমগ্র য়্যুরোপের পার্লামেন্টারিয়্যান সকলের কাছে সনির্বন্ধ দাবি জানাচ্ছেন। অন্য অনুচ্ছেদে যেয়ে বলছেন : “যদিও 'হিউমাস্', 'হিউম্যাইন্' ও 'হিউম্যর' ইত্যাকার শব্দরাজির উৎস ও ব্যুৎপত্তি ভিন্নতাহীন একই এবং এই জিনিশগুলো সভ্যতায় জীবনদায়ক আর্দ্রতার যোগান দিয়ে চলে নিরন্তর, কিন্তু হিউম্যানিজম বা মানবতাবাদের রাজনৈতিক প্রয়োগ/ব্যবহার, য়্যুরোপিয়্যন রেনেসাঁসের সেই মানবতাবাদ ধারণা যা আজও প্রযুক্ত হয়ে চলেছে, এই চালু মানবতাবাদ/হিউম্যানিজম প্রতিনিয়ত চায় হিউম্যরলেস্ একটা শ্বাসরুদ্ধ পরিস্থিতি জারি রেখে যেতে, মরুবৈশিষ্ট্যের মাটিতে এই প্রশাসনিক স্বতঃস্ফূর্ততানিরুদ্ধ হিউম্যানিজম নিরন্তর হিউম্যরলেসনেসের চারা রুয়ে রেখে যায়, হিউম্যানিজমের ভেতর হিউম্যরের একটুখানি ছিঁটেফোঁটা রাখতেও গররাজি থাকে। কেবল ইস্টার্ন ব্লকের লেখকশিল্পীরাই নয়, আমরা যারা পশ্চিমের অংশে লেখকশিল্পীর ভূমিকায় অবতীর্ণ রয়েছি আমাদের সকলেরই দায়িত্ব হচ্ছে যেখানেই হিউম্যানিজম লুণ্ঠিত দেখা যাবে সেখানেই নির্দিষ্ট নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া হাজির রেখে যে-কোনোধারা মানবতা/মানবাধিকার লঙ্ঘন/পদদলনের প্রতিবাদ করা।” গোটা জাহানের সর্বত্র ছবিটা আদৌ নড়চড়হীন, ভয়ের এই আবহ, ক্ষমতাশাসন ও রাষ্ট্রযন্ত্রের এই হিউম্যরহীনতা, রামগরুড়ের ছানার এই হাসতে মানা পরিস্থিতি জীবনবিরুদ্ধতারই প্রকাশ, ওরা জানে না যাপন করতে নিজেরাই, হিউম্যরলেস্ গরুড়ের ছানা, আপনারে-আমারে ওরা যাপন করতে দেবে কেমন করে! এই কথাগুলোই রিডিং বিটুয়িন দ্য লাইনস্ মনে হচ্ছিল গ্যুন্টারের অভিভাষণ পড়তে পড়তে। এইখানে গ্রাস্ জর্জ অরওয়েল, সোলজিনিৎসিন সহ অনেক লেখকের বিরুদ্ধে খোদ লেখক-শিল্পীসমাজেরই বিরূপাচরণ সম্পর্কে এত শার্প পর্যবেক্ষণ ও বিবেচনা হাজির করেছেন যে থমকে ভাবতে হবে বারবার। বক্তৃতাপ্রান্তে যেয়ে গ্রাস্ বলছেন, “আমি কি অতিরঞ্জিত করে বলে গেলাম এতক্ষণ? অন্তত আমি তা মনে করি না; অতিরঞ্জন তো করিই নাই, উপরন্তু কইবার কথাটুকুও কমিয়েই কয়েছি। আমার অন্তরে একটাই নিশানা, আর তা হচ্ছে প্রাগ এবং অ্যাথেন্সের জখম খুলে দেখানো। এখন আপনারা যারা রাজনীতিবিদ ও বিধানপ্রণেতা, আপনাদেরই এখতিয়ারে এখন এই সামর্থ্য রয়েছে যে এতক্ষণ ধরে প্রকাশিত আমার ভয়টাকে যেন সমূলে দূর করা যায় চিরতরে।” এই আস্ত রচনাটা বাংলায় ট্র্যান্সল্যাইট করা এই মুহূর্তে, এই ২০১৫ বাংলাদেশে, এই শিল্পীর বিরুদ্ধে শিল্পীর বাংলাদেশে, এই লেখকের বিরুদ্ধে লেখকের বাংলাদেশে, এই চাপাতিকোপের মুখে চোয়াল পেতে রেখে লিখে চলা বাংলাদেশে, আর্জেন্ট। গ্যুন্টার দেহান্তরের পরবর্তীকালিক এত বাংলা সাহিত্যসাময়িকী আর ওয়েবক্ষেত্রজ সবিশেষ আয়োজনে এহেন কোনো তর্জমা নজরে এল না।

১৮
গ্রাসের জন্মভূখণ্ড ও জনগোষ্ঠী ইতিহাসে যে-কারণে ধিক্কার পেয়ে এসেছে, এক ভয়াবহ নির্মম ও নৃশংস হন্তারক রাজনীতিগত ছদ্মদর্শন ও নেতৃত্বের হোতা জার্মান জাতি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থিয়োডোর অ্যাডর্নো যে-কারণে বলেছিলেন ‘আউসবিৎসের পর আর কবিতা মনে হয় না মানুষের পক্ষে লেখা আদৌ উচিত বা সম্ভব’, সেই রিয়্যালিটিটা গ্রাস্ কেমন করে ফেইস্ করেছেন? — অনেকদিন থেকে একটা মেইড-ইজি অ্যান্সার তালাশ করছিলাম, বলেছি নিবন্ধের অন্য কোনো অনুচ্ছেদে। এই বইটাতে একটা আন্দাজ পাওয়া যায় এই সার্চের রেজাল্টের। অন্য কোনো কোটেশন প্লাক না-করে এর মুখবন্ধের দ্বারস্থ হওয়া যাক। বইটার দুর্ধর্ষ ফরোয়ার্ড লিখেছেন সালমান রুশদি। টেরিফিক, এক-কথায় বলতে গেলে, দুর্ধর্ষ। রুশদিকে দেখলাম এই ইন্ট্রোডাকশনে একদম নিরাবেগ নির্ভাবালু গলায় গ্রাসের ভৌগোলিক জন্মদেশ জার্মানির সেই ইতিহাসসন্ধিক্ষণে সংঘটিত ভ্রান্তিজাল ও তৎসঞ্জাত অমোচনীয় বেদনার প্রতিবেদন প্রকাশিতে, রুশদীয় অনন্য ও অননুকরণীয় বৈভববিন্যাসের ইংরেজিতে। সেখানে রুশদি গ্রাসকে প্লেইস্ করছেন মাইগ্র্যান্ট হিশেবে, দেশান্তরিত, ভূখণ্ডান্তরিত, ভাষাই যার একমাত্র ভূখণ্ড; প্রথমে দেখাচ্ছেন গ্যুন্টার একজন অর্ধ-স্থলান্তরিত, হাফ-মাইগ্র্যান্ট, পরে পূর্ণ, চূড়ান্ত বিবেচনায় রুশদি প্রোপোজ করছেন গ্যুন্টার একজন ডাবল-মাইগ্র্যান্ট। তর্জমার থ্যাঁতলা আয়াসে না-যাই বরং, কারণ রুশদির শার্প সিন্ট্যাক্স অর্ডার এবং প্যাটার্ন অফ মেইকিং ন্যারেটিভস্ আমার এবড়োখেবড়ো ভোঁতা বাক্যপ্রয়াসের চেয়ে বেটার, কয়েকটা বাক্য শুধু গুঁজে রাখি বাংলায়, যদিও বঙ্গানুবাদনের ক্ষ্যামতা না-থাকা সত্ত্বেও বোঝাবুঝিটুকু বিনিময় করতে যেয়ে এসে যায় এমনধারা তারছেঁড়া বাংলা : “আমার মনে হয় এইভাবে বলাটাই ভালো হবে যে, এবং আমার কাছে এই ব্যাপারটা নানাভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রতীয়মান হয়েছে যে, লেখক হিশেবে গ্যুন্টার গ্রাস্ যেন ভুবনাভিবাসী, তিনি মাইগ্র্যান্ট রাইটার হিশেবে ফ্র্যাগমেন্ট বা পার্সেন্টেজের যে-কোনো অঙ্কে বেশিকিছু। জাতীয় ভূখণ্ডের সীমান্ত পারায়ে অন্য ভূখণ্ডে গমন ও বসবাস মাইগ্র্যাশন/অভিবাসন/স্থানান্তরণের একমাত্র ফেনোমেনা না। ... আলোচনাটাকে আমি আক্ষরিকার্থিক না-রেখে এগোতে চাই কিছুটা রূপকার্থবহ মুক্তির আশ্রয়ে; কেননা মাইগ্র্যাশন/অভিবাসন শব্দটা/ধারণাটা আমাদের সময়ের সেরা ও সমৃদ্ধ রূপক/মেটাফরগুলোর একটি। মেটাফর শব্দটা লক্ষণীয়, গ্রিক ভাষায় যার ব্যুত্পত্তিগত অর্থ ‘কোনোকিছু বহন করা’ বা যাকে বলে ‘বেয়ারিং অ্যাক্রোস্’, শব্দটার ভেতরে একটা স্থানান্তরণ সংক্রান্ত সুন্দর ইঙ্গিত বিধৃত, চিন্তা স্থানান্তরিত হয় চিত্রে, মেটাফর প্রক্রিয়ায় এ-ই ঈপ্সিত, তথা মাইগ্র্যশন অফ আইডিয়াস্ ইন্টু ইমেইজেস্। ... গ্যুন্টার গ্রাস্ আপন অতীত থেকে স্থানান্তরিত একজন অভিবাসী, কিন্তু আমি এখানে কেবল ড্যানজিগের কথাই ইশারা করছি ভাববেন না। গ্রাস্ বেড়ে উঠেছেন, যেমনটা তিনি নিজে বলেছেন, এমন একটা জায়গায় এবং এমন এক যুগপর্বে যেখানে নাৎসি-বাস্তবতাই ছিল দুনিয়ার অত্যন্ত স্বাভাবিক অব্জেক্টিভ রিয়্যালিটি। ঠিক যে-মুহূর্তে অ্যামেরিক্যানরা আসা শুরু করেছে দৃশ্যপটে, একেবারে যুদ্ধের উপান্তে, তরুণ গ্রাস্ তখন ইতিউতি শুনতে পাচ্ছেন জন্মভূখণ্ড জার্মানির আঁতের ঘা ও গ্যাংগ্রিন, বুঝতে শুরু করছেন নাৎসিদের ধারাবাহিক মিথ্যাচার আর খণ্ড দিয়ে সমগ্র প্রদর্শনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পাঁয়তারা। ভাবুন অবস্থাটা : একজন মানুষ সহসা সবিস্ময়ে আবিষ্কার করছে যে এতাবধি নির্মিত তার চারপাশের পৃথিবীটা আদ্যোপান্ত মিথ্যা, খালি মিথ্যায়িত নয় সেই জগৎ, দানবিকতা দিয়ে ঘেরা তার আগাপাশতল ও গোটা ভিত্তিমূল।” উদ্ধৃতি দীর্ঘ হয়ে গেলেও গ্যুন্টার গ্রাসকে এভাবে কেউ প্রতিবেদিত করেছেন আগে এমনটা আমরা দেখেছি কি? ইন্ট্রোডাকশনটা মারাত্মক প্রখরতাবাহী বিশ্লেষণঋদ্ধ। মোজ্যাইক অফ প্রোজ বলতে যা বোঝায়, রুশদির গদ্যটা আক্ষরিক তা-ই হয়তো। বঙ্গে কিংবা জার্মানে একজন রুশদি তুমি কোথাও খুঁজে পাবেনাকো। রুশদির মশহুর সেন্স অফ হিউম্যরও সিরিয়াস এই গদ্যকাজ থেকে বাদ পড়েনি। অ্যানিওয়ে। একটুখানি আরও : “গ্রাসকে আমার কাছে, সত্যি বলতে কি, একজন দ্বৈত অভিবাসী তথা ডাবল মাইগ্র্যান্ট বলে মনে হয় : স্বীয় সত্তার সীমান্তপরিব্রাজক ভ্রমণগৌতম, এবং সময়ট্র্যাভেল্যর। গ্রাসের রচনারাজির অন্তর্শায়িত/আন্ডার্লায়িং ভিশ্যন/রূপকল্পন, উভয়ত ফিকশনে এবং ননফিকশনে, আমার বিবেচনায়, একাধিক কোণ থেকে একজন সর্বদা-স্থানান্তরতত্পর ঠাঁইনাড়া মানুষের ভিশ্যন।” কোটেশনকণ্টকে পেতেছেন শয্যা আপনে যেহেতু, অতএব অধিকন্তু ন-দোষায় নিশ্চয়, অন্তিম বাক্যে একটু রসের নিশ্চয়তাও দিচ্ছি : “এই তৃতীয়-পর্যায়িক ব্যাহত/চূর্ণ-হওয়া/ভাঙা বাস্তবতা মাইগ্র্যান্টদিগেরে ক্রমাগত গড়েপিটে নেয় : যে-বাস্তবতা বানানো ও মনুষ্যসৃষ্ট কৃত্রিম জিনিশ, যা কিনা নির্মিত হবার আগ অব্দি নিরস্তিত্ব, এবং যা, বানানো অন্যান্য সবকিছুর মতো, হতে পারে সুচারূ অথবা দায়সারা বানানো, অবশ্য মনুষ্যনির্মিত সমস্তকিছুরই ন্যায় যা দায় সেরে যাবার পরে নস্যাৎ হয়ে যেতেও সময় লাগে না। গ্রাস্ তার এই দীর্ঘ পরিভ্রমণের সময় ইতিহাসব্যাপ্ত সড়ক ধরে যেতে যেতে যা শিখেছেন তা বাক্য-সংকোচনে সন্দেহ/সংশয় হিশেবে চেনা যায়। এতদূর পর্যন্ত পাড়ি দিয়ে এসে তিনি তীব্র অবিশ্বাস করেন সবাইকেই যারা দাবি করে যে তাদেরই দখলে রয়েছে মেদিনীমণ্ডলের সর্বশেষ অভিজ্ঞানসমূহ তথা অ্যাবসল্যুট ফর্মস অফ নলেজ; যা-কিছুই কিংবা যারা দাবি করে দুনিয়ার যাবতীয় অনুবোধন ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কব্জায় আয়ত্ত হয়ে সারা তাদের, চিন্তানুশীলনজাত সমুদয় ব্যবস্থাপ্রণালি তাদের অধিগত বলে গলা উঁচায় যারা, তাদের সম্পর্কে এবং তা-সবকিছু সম্পর্কে গভীর সন্দেহ পোষণ করেন গ্যুন্টার গ্রাস্। গোটা দুনিয়ার গ্রেট লেখকদের মধ্যে তিনি প্রতিমূর্তিগতভাবেই অনিশ্চয়তার/আনসার্টেইনটির মহান শিল্পী। ... মাইগ্র্যাশন/স্থানান্তরণ/অভিবাসনের যে-কোনো ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জনের মানে অপরের দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্ব অনুধাবন করার শিক্ষালাভ তথা পরমতসহিষ্ণুতায় দীক্ষিত ও দীপ্ত হয়ে ওঠা। আপনি নিশ্চয় বুঝতে পারছেন যে মাইগ্র্যাশন/অভিবাসনের অভিজ্ঞতা আমাদের হবু সমস্ত গণতন্ত্রানুশীলকদের জন্য অত্যাবশ্যক প্রশিক্ষণ হিশেবে গণ্য হওয়া বাঞ্চনীয়।” অট্টহাস্য অন্তিম বাক্যবাণে। এইটাই ইন্ট্রো ফরোয়ার্ডে একলা-একা বাক্যবাণ নয়, যদি জিজ্ঞেস করেন।

১৯
একজন পাঠক তার একজীবনে কয়জন লেখকের সমগ্র রচনাবলি পড়ে উঠতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর আসলে সেভাবে জানা জরুরি হয়তো নয়, কিন্তু প্রশ্ন তো পুনঃপুনঃ খোঁচাতেই থাকে ভেতরে। একজন বা দুইজন বা পাঁচজনের রচনাবলি বিগিনিং টু এন্ড হয়তো পড়ে ওঠা যায়, এর বেশি আদ্যোপান্ত রচনাবলি-পড়ুয়া পাঠকদের সোচ্চার দাবির ব্যাপারে সন্দিগ্ধ হওয়াই ভালো। যদিও কোনোকিছু সমগ্রত পড়া, তদুপরি একজন লেখকের সৃষ্টিপৃথিবীর শাঁসমূল সহ পূর্ণত মগজাধঃকরণ, আদৌ কতদূর পর্যন্ত সম্ভব এই প্রশ্নটা পাঠ-ও-পাঠান্তরতত্ত্বাবলির আলোকে একাধিক পরিসরে রেখে দেখা ও দেখানো কঠিন হবে না কারো পক্ষে। এহেন গপ্পোগুলের দেশে জন্মেছি আমরা যেখানে লেখকেরা দাবি করেন হরহামেশা : আরে মশাই, কী-যে বলেন আর করেন না আপনেরা, আমরা তো মিঞা রামায়ণ ও মহাভারত তারপর ওইদিক দিয়া মনে করেন যে বেয়্যুল্ফ আর অডিসি পিচ্চিবেলা দাদিমা/ঠাম্মার চামড়া-চিমসানো কোলে ঝুলে দুলে দুলে পড়ে পড়ে বেড়ে উঠেছি! ফিউ ডেইজ ব্যাক এই বাংলাদেশেরই কী-এক লেখক, ভুলে গেছি সেই হুজুরের নাম বা তার কোনোকিছু পড়েছি কোনোদিন ইয়াদ হয় না, তার নিজের ক্লেইম অনুযায়ী তিনি লেখক, তা তো বটেই, তিনি বলছিলেন যে তিনি নাকি নিজের প্রথম গল্পটা বাংলার পাট-জাগ-দেয়া পানিবিধৌত ভূমিতে ভচাৎ শব্দে প্রসবের আগে তেরোশত গল্প পড়ে এয়েচেন! শুনে সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম ইলিয়াসের সেই দুশ্চিন্তার তাৎপর্য, মনে হয়েছিল বরং একটা আর্টিক্যল লিখিলেই হয় এই শীর্ষক : বাংলা ছোটগল্প কি ইন্তিকাল করছে তেরোশ' গল্পপড়ার গণ্ডমূর্খামির চিপায় চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে? এইসব পুরস্কৃত অর্বাচীনের অলাবুভক্ষণোদ্গত উদ্গারের বদবু ছোটগল্পের বাংলা মায়াবী ভুবনটাকে এতটা আবিল অবস্থায় ফেলেছে কি না আজিকে, কে জানে। এদের খপ্পর থেকে বাংলা আখ্যানরাজ্য উদ্ধারের রাস্তাঘাট ম্যালা আছে, একটা সম্ভাব্য : পুরস্কারদাতার পালঙ্কের পাঁচশ পঁচাশি নিরালোকবর্ষ দূর দিয়া হাঁটিয়া বাংলা আখ্যানের পরিণতমনস্ক কর্মকাণ্ডগুলো গোচরীভূত করা পাঠকের; তেরোশ' গল্প পড়িয়া আবোলতাবোল বদুখাঁ আমলের গল্প প্রসবিবার পয়্মালি ইগ্নোর করা সর্বোতভাবে লেখকদিগের প্রাইমারি ডিউটি নিশ্চয়ই। কিন্তু পরিতাপের ব্যাপার এ-ই হয় যে, এতদপ্রসঙ্গে, বাংলা ছোটগল্পে এহেন-দৃষ্ট সঙ্কটমোচনকল্পে, হের্ গ্যুন্টার গ্রাস্ মশাই কিচ্ছুটি বলিয়া যান নাই!

২০
ফি-বছর দুনিয়াজোড়া সাহিত্যে অ্যাওয়ার্ড ঘোষণার পরে একেকজন নতুন-আলোচনাকেন্দ্রে-আসা রচয়িতার সঙ্গে আমাদের চিনপরিচয় ঘটে, আমরা তাদের কাজকর্মের খোঁজখবর নিতে একটু উত্সুক হই কিছুদিন, এরপর দেখতে-না-দেখতে আরেকটা অ্যাওয়ার্ড ডিক্লেয়ার হয় এবং আনকা আরেক লেখকের দিকে ধাবিত হই। এইটুকু অনুমেয় অল্প অবসরে সেইসব লেখকদিগের সমগ্র আমরা সাধন করে ফেলি! জিনিশটা খানিক গোলমেলে নয়? এতদঞ্চলে আমরা কমপক্ষে তিন-তিনটে অ্যাওয়ার্ডের প্রাপক-গ্রাহক রচয়িতা আর তাদের রচনাচিহ্নের খোঁজপাত্তা রাখতে ব্যগ্র হইয়া থাকি। এক হচ্ছে নোবেল, দুই বুকার এবং তিন পুলিত্জার। পুরস্কারপ্রাপক রচয়িতা যদি কবি হন, সেক্ষেত্রে একটু সুবিধে হয় যে একটানে বেশকিছু কবিতা আয়াস ব্যতিরেকেই পড়া হয়ে যায়। কিন্তু গোল বাঁধে ঔপন্যাসিকদের বেলায়। খেয়াল করে দেখেছি যে, বেশিরভাগ পাঠক পুরস্কৃত উপন্যাসকার বা আখ্যানকারের সৃজনাশ্রয়ী রচনাপত্র অল্প পড়ে বা একেবারেই না-পড়ে সেই রচয়িতা সম্পর্কে নানাবিধ ওভার্ভিয়্যু পড়ে একটা আন্দাজ করে নেন। প্রশ্ন হচ্ছে যে একজন ফিকশনপ্রণেতার মুখাবয়ব সম্যক বোঝা আদৌ সম্ভব কি না তার সৃজিত রচনা না-পড়ে? অ্যাট-লিস্ট ঔপন্যাসিক/গল্পকারের সৃজিত প্রধান-পরিগণিত নমুনাগুলো তথা তার গল্প-উপন্যাস না পড়ে সেই সৃষ্টিশীল লেখকের সঙ্গে করমর্দন সম্ভব? ঔপন্যাসিক/গল্পকার/কবি নিজের সৃজনাশ্রয়ী লিখনকর্মাদির বাইরে বাইপ্রোডাক্ট হিশেবে কথিত মননাশ্রয়ী যে-ভুবন গড়ে তোলেন, সেইটার সঙ্গেই যেনবা পাঠকবর্গ সক্রিয় হতে চান বেশি। নিবন্ধ/প্রবন্ধ/দিনলিপি/স্মৃতিকথা/সাক্ষাৎকার ইত্যাদি পড়ে একজন কবি বা ঔপন্যাসিক বা সিনেমাকারের সঙ্গে সহজে পরিচিত হওয়া যায়; সেই পরিচয়ও বটে একপ্রকার পরিচয়, কিন্তু ওইভাবে হ্যান্ডশেইক যখন অতিমাত্রায় ট্রেন্ডি হয়ে ওঠে, দস্তুর হয়ে যায় এ-ধারা আইসব্রেইকিং, তখনই চিন্তার ব্যাপার। এমন অসংখ্য দর্শক-শ্রোতা-পাঠক পাওয়া যাবে এখন যারা কি-না আইজেনস্টাইন-ফেলিনি-কুরোসাওয়া না-দেখেই সিনেমাকর্ম ও সিনেমাকারদের সম্পর্কে ঢের জানেন ও বিস্তর জানাতেও পারেন; শেইক্সপিয়্যর-ব্যোদলেয়্যরের কোনো রচনা না-পড়ে কেবল ক্রিটিকস্কন্ধ ভর করে একবাক্যে বিচার-সালিশি সেরে ফেলেন তারা; মার্ক্স-এঙ্গেল্সের রচনাবলি পড়া তো বহুদ্দুরের, এমনকি কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টোর গোটা-কয়েক প্যারা না-পড়ে রেভোল্যুশনারি চিন্তানুশীলক এখন বাংলার ঘরে ঘরে হরেদরে বসন্তঋতু পয়্দাইতে ব্যস্ত দিনাতিপাত করছে। এইগুলো সুখের, বটে, সেইসঙ্গে এইটা প্রবণতা হিশেবে শঙ্কা ও সঙ্কটেরও বৈকি।

২১
রিকগ্নিশন পাবার পরে একজন লেখককে নিয়ে যে-হুল্লোড় হয়, সেই হুল্লোড়ে একলপ্তে বেশকিছু তথ্য-অবহিতকরণমূলক রচনা পাব্লিশ হয় এবং পাঠকের জেনারেল নলেজ উন্নীত হয় খানিকটা। আবার এর ফলে, এই হুল্লোড়ের আফটারম্যাথ হিশেবে, লেখকের ঈপ্সিত রচনাপাঠক গড়ে-ওঠার স্বভাবপ্রাকৃতিক প্রক্রিয়া ব্যহত হয়ে পড়বার বিপদটা থাকিয়া যায়। স্টিফেন হকিং হার্ডকোর ফিজিক্স-পড়ুয়াদের বাইরেকার পাঠকগোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে ম্যাথেম্যাটিক্যাল ইক্যুয়েশন যথাসাধ্য কমিয়ে এনে 'অ্যা ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম' নামে একটা বই লিখে প্রকাশ করেছিলেন গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। সেই বই প্রকাশের পর বিজ্ঞানপ্রকাশনার ইতিহাসে বেস্ট-সেলার আইটেম হিশেবে এইটা অচিরে খ্যাতি পেয়ে যায়। অ্যামেরিকায় বিপুলসংখ্যক পাঠক বইটি কিনে ব্যক্তিগত সংগ্রহের শেলফে তোলে; এমনকি অ্যামেরিকায় এককভাবে বই বিক্রির দিক থেকে এইটা বাইবেলের রেকর্ডও ছুঁয়ে ফেলে বলে শোনা যায়। একটা পাঠকজরিপে দেখা যায় যে ক্রেতাগোষ্ঠীর শতেকাংশও গোটা বইটা আদ্যোপান্ত উল্টেপুল্টে দেখেনি; সহস্রাংশ বইপাঠক এর প্রিফেস্ পার্টটুকু পড়ার চেষ্টা করে শেষে ক্ষান্তি দিয়েছে। কিন্তু বইটা আজও দুনিয়াব্যাপী বিক্রয়তালিকায় শীর্ষ না-হলেও সচল। অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে এই বইয়ের তামাম জাহানে; এবং বাংলাতে এর তর্জমা ও তফসির এত লোকের হাত দিয়ে বেরিয়েছে যা আদৌ অঙ্গুলিমেয় নয়। একই কথা খাটানো যায় গীতা-বাইবেল-কোরান ইত্যাদি স্ক্রিপ্চারগুলোর ক্রেতা ভার্সাস পাঠকগোষ্ঠীর ব্যাপারে। বিস্ময়কর এই বিপুলায়তন খরিদকর্মা পাঠকের পৃথিবী!

২২
কিন্তু গ্যুন্টার গ্রাসের ব্যাপারটা আসলেই ভিন্ন। নোবেল পাবার আগে থেকেই তিনি এই গোলার্ধের পাঠকের কাছে বেশ পরিচিত। অল্পবিস্তর পঠিতও। ১৯৮৬ সালে তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। যদিও 'টিন ড্রাম' উপন্যাসের সুবাদে এবং এর কাহিনিভিত্তিক ম্যুভি নির্মাণের দৌত্যে এতদঞ্চলের মানুষ তথা পাঠক-দর্শক গ্রাস্ মশাইকে চেনেন আগে থেকেই। বাংলাদেশ ভ্রমণের প্রাক্কালে গ্রাসকে নিয়ে এখানকার পত্রপত্রিকায় নিবন্ধ ছাপিয়ে স্বাগত জানানো হয়। এমন একটা রচনা আমরা পেয়েছি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের হাত দিয়ে; এই নিবন্ধাকৃতির রচনাটি 'গুন্টার গ্রাস ও আমাদের গ্যাস্ট্রিক আলসার' শিরোনামে ইলিয়াসের একমাত্র প্রবন্ধসংকলন 'সংস্কৃতির ভাঙা সেতু' বইয়ের অন্তর্ভূত। লক্ষ করলে দেখা যাবে যে ইলিয়াসলিখিত রচনাটাও ওই অর্থে গ্যুন্টারপাঠের কোনো তুলনামূলক বক্তব্য হাজির করে না আমাদের সামনে; এরচেয়ে বরং রচনাটায় এরশাদশাহির একতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে নিবন্ধকারের অবস্থান অনেকটা আত্মজৈবনাবেগিক কণ্ঠে অভ্যাগত মহান মেহমানকে জানানোর অভিপ্রায় যেন ফুটে উঠতে দেখি আমরা। যার ফলে ঠিক বলা যাচ্ছে না আমাদের অন্যতম শক্তিমান আখ্যানকার ইলিয়াস মশহুর জর্মন আখ্যানকার গ্যুন্টার গ্রাসের লেখাপত্র মর্মমূলে কতটুকু ও কীভাবে নিয়েছিলেন। উপলক্ষ্যের লেখা বলেই ডিটেইলে সবকিছু বলা আদৌ সম্ভবও ছিল না হয়তো। যদিও বলে নিয়েছেন ইলিয়াস গোড়াতেই যে তিনি কেবল 'টিন ড্রাম' আর কতিপয় নিবন্ধপ্রবন্ধাদি তথা আরও বেশকিছু বইপত্র পড়েছেন গ্যুন্টারপ্রণীত, তখন পর্যন্ত, এর বেশি কিছুই ডিসক্লোজ করা নাই নিবন্ধটায় এ-বাবতে। একদম স্টার্ট প্যারায় ইলিয়াস একবাক্যে জানিয়েছেন, "গুন্টার গ্রাসের 'টিন ড্রাম' পড়ি ১৯৭১ সালে।" এরপর থার্ড প্যারায় যেয়ে এটুকু মোটে টেক্সট সম্পর্কে হার্মেন্যুটিক্স : "অসকার ড্রাম পেটায় আর তার আকাশ-ফাটানো আওয়াজ কানে ঢোকে বজ্রপাতের মতো। এবং কানের পর্দা ছিঁড়ে চলে যায় মগজে, মগজ থেকে এ-শিরা ও-শিরা হয়ে পড়ে রক্তধারার ভেতর। অসকারের ঐটুকু হাতের বাড়ি এতটাই প্রচণ্ড যে তা ছাপিয়ে ওঠে মেশিনগান স্টেনগানের ব্রাশফায়ারকে। আমরা কয়েকজন বন্ধু একে একে বইটা পড়ি আর হাড়ের মধ্যে মজ্জার কাঁপন শুনি : ঘোরতর বিপর্যয়েও মানুষ বাঁচে। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকলেও বাঁচা যায়। বাঁচার ইচ্ছা যদি তীব্র হয় তা হলে তা-ই পরিণত হয় সংকল্পে। তখন মৃত্যুর আতঙ্ক মাথা নত করে।" সেই তো স্টোরিলাইন অল্পশব্দে, একটুখানি জিস্ট। অথবা তার বাদের প্যারায় : "টিনড্রাম কিন্তু আমাদের বিজয়ের ডঙ্কা শোনায়নি। বিজয় সম্পর্কে আমাদের প্রধান প্রেরণা ও একমাত্র ভরসা ছিল আমাদের প্রতিরোধের অদম্য স্পৃহা। সেনাবাহিনীর নৃশংস নির্যাতনে এই স্পৃহা নতুন নতুন শিখায় জ্বলে উঠেছিল। কিন্তু কবুল করতে দ্বিধা নেই, ১৯৭১ সালের শেষ কয়েকটা মাস অসকারের ড্রামের ডম্বরু আমাদের ভয় ও আতঙ্ককে শ্লেষ, কৌতুক, বিদ্রুপ ও ধিক্কার দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে দেখতে আমাদের প্ররোচিত করে। নিজেদের আতঙ্কের এই ময়না-তদন্তের ফলে আতঙ্ককে বাগে আনা সহজ হয়েছিল।'' যদিও বোঝা সম্ভব নয় এই রচনা পড়ে যে এই 'টিন ড্রাম' ছাড়া আখতারুজ্জামান ইলিয়াস গ্যুন্টারের আর কি কি পড়েছিলেন, শুধু বলছেন এইটুকু : "আরও অনেক বইয়ের সঙ্গে গুন্টার গ্রাসের আরও বই জোগাড় করে পড়ি। তাঁর কবিতা পড়ি। এখানে-ওখানে আঁকা তাঁর স্কেচও দেখি। বেশিরভাগই আত্মপ্রতিকৃতি। অদ্ভুত, ভয়াবহ ও বীভৎস সব ছবি। ১৯৮৫ সালে এক সন্ধ্যায় 'টিন ড্রাম' চলচ্চিত্রটা দেখে ফেলি।'' ফিল্মটা ভালো লাগে নাই ইলিয়াসের, এইটাও বোঝা যাচ্ছে : "১৯৭১ সালে বই পড়ার সময় ড্রামের যে-পিটুনি কানে তালা লাগিয়ে দিয়েছিল, বরং বলা যায় কানের তালা খুলে দিয়েছিল, ১৯৮৫ সালে ফিল্মে তা অনেকটা ফাঁপা মনে হলো। কিন্তু ফিল্ম হিসাবে তো টিন ড্রাম বেশ ভালো। তবে? হয়তো ফিল্মের দোষ নয়, কয়েক বছরে আমার কানও বোধহয় ভোঁতা হয়ে গেছে।" এ-ই, দৃশ্যত, ইলিয়াসের গ্যুন্টারপাঠ। প্রকৃত প্রস্তাবে এইটা আনুষ্ঠানিক লেখাও নয়, বলা বাহুল্য, একটু ফর্ম্যাল গ্যুন্টারপাঠের রেস্পন্স ধারার লেখা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যদি লিখে যেতে পারতেন, কতই-না ভালো হতো! ফুরসত বা মওকা পেলে নিশ্চয় লিখতেন তিনি।

২৩
রিয়্যাকশন আর রেস্পন্সের মধ্যে যে-একটা ফারাক, সেইটা না-জেনেই যেন আমাদের ক্রিটিকধর্মী নিবন্ধপ্রবন্ধের ভুবন গড়ে উঠেছে। বেশিরভাগ লেখাতেই রিয়্যাকশন সুলভ, রেস্পন্স কদাচ কখনো, অথচ রিডার্স রেস্পন্স অভিপ্রেত সবসময় সাবালক সাহিত্যসমালোচনা শাখায়। এইটা ঘাটতি হিশেবেই থেকে গেল অনড় আজও। বিশেষভাবেই উল্লেখ্য যে একটা-কোনো অন্যভাষী সাহিত্যকর্ম পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিকভাবেই হবে রেসিপিয়েন্ট রিডারের ভাষাভূখণ্ডের কোনো-একটা বা একাধিক সমধর্মী লিট্যার‌্যারি পিসের সঙ্গে অভিজ্ঞতা বিনিময়মূলক তুল্যমূল্য। হতে পারে কি এমন যে গ্যুন্টার গ্রাসের সাহিত্যকর্ম এতই অভূতপূর্ব অভাবিত ও মহান যে এর পাশে রেখে একটু কথা বলার মতো কোনো কথাখ্যান আমাদের ভাষায় বা আমাদের শিল্পকলার অপরাপর কোনো প্রশাখায় নেই? কিন্তু কমনসেন্স দিয়ে এই বিবৃতির পজিটিভ রিপ্লাই খণ্ডন করা যায়। কেননা তা প্রায় সম্ভবই নয়; একটা আগন্তুক ভাষাবাস্তবতার শিল্পকর্ম যতই ইউনিক ও অভিনব হোক, আমার ভাষাবীক্ষায় সেই অভিজ্ঞতার লেশমাত্র না-থাকলে সেই সাহিত্যকর্ম বোঝা বা অনুভূতিভুক্ত করা সাধারণ যুক্তিবিদ্যার ইশারানুসারে একদম অসম্ভব। প্রায়োর নলেজ ছাড়া নতুন কোনো লেসনই লার্ন করা বা এক্সপেরিয়েন্স আর্ন করা পসিবল হয় না মানুষের পক্ষে।

২৪
নোবেল লরিয়েট লেখকদের রচনাপাঠবস্তু কতটুকু পর্যন্ত পড়ি আমরা? ব্যক্তিগত প্রবণতাটা একটু কনফেস্ করা যায় এখানে। যেমন, অলরেডি বিবৃত হয়েছে এই নিবন্ধে, কবিদের কাজকর্ম অনায়াসে বেশাংশ বা একটা উল্লেখযোগ্যাংশ পড়া হয়েই যায়। কিন্তু উপন্যাস বা নাটক-আখ্যান পড়ার জন্য রিক্যোয়্যার্ড সময় এবং শ্রমটা সাধারণত কমই দেয়া হয়। ভিসোয়াভা শিম্বোর্সকা আমাদের উঠতি দিনগুলোতে নোবেল পাবার অব্যবহিত পরেই পড়ে ফেলি তার কবিতা একসঙ্গে অনেক; তেমনি শেইমাস হিনি কিংবা টোমাস ট্র্যান্সট্রোমার; শেষোক্ত দু-জনের কবিতাবলি আমরা তাদের পুরস্কারপ্রাপ্তির আগে থেকেই চিনেছি যদিও। উপন্যাসকার আর নাট্যকারদের ব্যাপারে এই রিডিংগ্রাফটা কেমন, একবার দ্রুতরেখায় দেখে নেয়া যাক। পরবর্তী অনুচ্ছেদের কথাগুলো ক্রোনোলজি মেনে কিংবা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বলা হচ্ছে, এমন নয় সবটুক; বহুলাংশে তা-ই যদিও, বলা বাহুল্য।

২৫
গত দুই/তিন দশকের সীমায় নাট্যাখ্যান ও উপন্যাস রচনায় যারা নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন তাদের মধ্যে যেমন উদাহরণত গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস বা চিনুয়া আচেবে এই-রকম কয়েকজন আছেন ব্যতিক্রম। এরা প্রাইজ উইনার লেখক হবার আগে থেকেই অত্র ভূখণ্ডে পরিচিত ও পঠিত বলিয়া গণ্য। যদিও মার্কেস নোবেল পেয়েছেন এই নিবন্ধকার পাঠক হিশেবে লায়েক হয়ে উঠবার আগেই। ইন্সট্যাণ্স হিশেবে যে-দুইজনার নাম বলা হলো, এদের লেখাপত্র আমরা নানাভাবেই পড়েছি, এক্সটেন্সিভলি, তাদের উপন্যাস-গল্প ও অন্যান্য রচনাদিও, নোবেল লাভের আগে থেকেই এরা এবং এদের মতো আরও আছেন অনেকেই যারা আমাদের পড়াপড়ির জগতে পরিচিত। গ্যুন্টার গ্রাস্ এই লিস্টির লেখক। যদিও নোবেলওয়ালারা মার্কেস বা গ্রাস্ প্রমুখের মতো জগজ্জোড়া খ্যাত ও পাঠকপূজিত সাহিত্যব্যক্তিত্বদেরে সম্মান জানিয়েছে স্ট্যাটিস্টিক্যালি কম সংখ্যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রায়-আগন্তুক লেখকেরা আমাদের সামনে এসেছেন নোবেল পেয়ে। এদের অনেকেরই নামের সঙ্গে সেভাবে পরিচয় ছিল না আমাদের, কাম-ধামের সনে চিনাজানা তো অনেক পরের কথা, অন্তত আমাদের ন্যায় পেশাদার জার্নালিজমের সঙ্গে সংশ্রবহীন ভোলাভালা সাধারণ পাঠকের ক্ষেত্রে এইটা ট্রু স্টেটমেন্ট বটে, আমরা তো না-পড়েই তিন-কলাম তেত্রিশ ইঞ্চি লিখতে পারার পারঙ্গমতা নিয়া ভূমিষ্ঠ হই নাই; অ্যানিওয়ে, এমন কয়েকজনের নাম স্মরণ করা যাক যাদের নামের সঙ্গেই ঠিক পরিচয়টাও ছিল না আমাদের নোবেল উইনের আগে : জে. এম. কোয়েৎসি, হ্যারল্ড পিন্টার, ডোরিস লেসিং, দারিয়ো ফো, এলেফ্রিদা ইয়েলিনেক, হের্টা ম্যুলার, ইম্রে কার্তেস, ল ক্লেজিয়ো, মো ইয়ান, অ্যালিস্ মানরো, প্যাট্রিক মোডিয়্যানো প্রমুখ। অনেকের নামোচ্চার করা যায় যারা নোবেলপ্রাপ্তিনিরপেক্ষভাবে তাদের রচনাপাঠকৃতির জোরে এতদঞ্চলে পঠিত হয়ে এসেছেন সবসময়; যেমন : পাবলো নেরুদা, নাগিব মাহফুজ, টি. এস. এলিয়ট, অক্টাভিও পাজ্, চেশোয়াভ মিউশ, ব্যাশেভিস্ সিঙ্গার, সোলজিনিৎসিন, স্যাম্যুয়েল বেকেট, সার্ত্রে, বার্ট্রান্ড রাসেল, জন স্টেইনবেক, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, আলব্যের ক্যামু, সাঁ-জন পের্স, হিমেনেথ, পাস্তার্নক, উইলিয়্যম ফক্নোর, হের্মান হেস্, মারিয়ো বার্গাস য়োসা, পার্ল এস. বাকের নাম করা যায় এই তালিকায়। এছাড়াও রয়েছেন ওরহান পামুক, জোসেফ ব্রডস্কি, হাইনরিশ ব্যোল, স্যল বেলো, টনি মরিসন, কেনজাবারো ওয়ে, ডেরেক ওয়্যাল্কট, ওলে সোয়িঙ্কা, ন্যাডিন গর্ডিমার প্রমুখ। ওদিকে ইয়েটস্, জর্জ বার্নার্ড শ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ কয়েকজনের নাম ও কামকাজ তো অত্র তল্লাটে ন্যাশন্যাল কারিকুলাম অফ টেক্সটবুক বোর্ডের কেরানিকুলেরও পছন্দসই। কিন্তু উত্থাপিত প্রশ্নটার সুরাহা তাতে হলো কই! লিখিত অতগুলো নামের কয়জনের রচনাপাড়া মাড়ায়েছি আমরা? আঙুলরেখায় গণনীয় কয়েকজন ছাড়া বাকিদেরকে যে-প্রক্রিয়ায় পাঠ করি, কিছু কম কিছু বেশি প্রোক্ত সকলেরই পাঠক আমরা নিশ্চয়, সেই প্রক্রিয়াটি লিপিবদ্ধ থুয়ে যাওয়াও কর্তব্য। ওই রচয়িতাব্যক্তিদের কথনবিশ্ব উপজীব্য করে লেখা তারিফি/খারিজি নিবন্ধ-প্রবন্ধাদিতে একটা পাঠপ্রোসেস্ ডক্যুমেন্টেশনও অভিপ্রেত।

২৬
ওই-যে, এদের মধ্যে যারা নাট্যকার/উপন্যাসকার/গল্পকার হিশেবে অ্যাওয়ার্ডটা পান তাদের কয়জনের নাটক-উপন্যাস-গল্প পড়ি আমরা সাগ্রহ সধৈর্য শ্রম লগ্নি করে? হ্যারল্ড পিন্টার নোবেল পেয়েছেন নাটকের জন্য, অথবা দারিয়ো ফো, শুধু পিন্টারের কবিতা আর ফো-র নোবেলস্পিচ ইত্যাদি ছাড়া তাদের মূল ক্ষেত্র তথা তাদের নাট্যাখ্যান পড়েছি ইয়াদ হয় না। এলেফ্রিদা ইয়েলিনেক পেয়েছেন অনুরূপ উপন্যাস ও নাট্যাখ্যান রচনায় গভীরপ্রভাবী অবদানের জন্য, বক্তৃতা আর ইন্টার্ভিউ ছাড়া এদেরও তো খুব বেশি পড়েছি ক্লেইম করতে পারব না। আমরা কত শতাংশ লুইজি পির‌্যান্ডেলো বা ইয়্যুজিন ও'নীলের প্লে পড়েছি? নিতান্ত অল্প ও সীমিত সংখ্যক পাঠক দাবি করতে পারবেন সমগ্র-সূচ্যগ্র পঠনের। অথচ এদের সম্পর্কে, এবং এই-রকম আরও অনেক কথাকারের কাজ সম্পর্কে, আমরা জানি বিস্তর। এই জানাটা, এইভাবে জানাটা, আদৌ সন্তোষজনক জানা বলা যায় কি?

২৭
একটা বই একেবারেই না পড়ে সেটি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের মতামত রাখা আজকাল যৌক্তিক কারণেই অসম্ভব কিছু নয়। সর্বকালেই মিথ্যাবাদী একশ্রেণির পাঠক থাকে, এদের দৌরাত্ম্য ধরার আগেই কালক্ষেপণ হয়ে যায় অনেক। ফলে মিথ্যা পাঠে এবং মিছেমিছি পাঠোত্তর প্রতিক্রিয়ায় ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে যায় মিথ্যাচার সনাক্ত করার ঢের আগে। একটা সময় ছিল যখন কেবল অন্যের মুখে শোনা বা বড়জোর বইয়ের মলাটে পরিচিতিমূলক বাক্যরচনাগুলো পড়ে বইটি সম্পর্কে বেশ ‘জ্ঞান’ অর্জন করত ওই মিথ্যাবাদী/মিথ্যাচারভরা পাঠকেরা। আজকাল প্রযুক্তিস্ফীতির ফলে নানাভাবে একটা বইয়ের ভালোমন্দ চাউর হয় চারপাশে। মূল বই না পড়ে কারো সাক্ষাৎকার বা ব্লগ ইত্যাদি থেকে একটা বই সম্পর্কে বেশ সহজেই জেনে যায় ওই চৌকস মিথ্যাপাঠকেরা। তার মানে আগের যে-কোনো সময়ের তুলনায় এই সময়টা পাঠামোদীদের জন্য অধিক জটিল ও বিভ্রান্তিবিস্তৃত সময়। মিথ্যাচারী পাঠকের পায়াভারী পদচারণায় পীড়িত ও পর্যুদস্ত সত্যিকারের নিরিবিলি পাঠকভুবন। সত্যিপাঠকের কোণঠাসা হালত পরিবর্তনের পরিবেশ যদি ফেরে কোনোদিন, কোনো সৌভাগ্যরজনীদিনে, দারুণ হবে তখন। আপাতত সান্ত্বনা এ-ই যে, সেই মহান পাঠক পড়বেন স্রেফ নিজের সংবেদন তৃপ্ত করার গরজে, দেখানোপনার জন্য নয়।

২৮
উমবের্তো একো ওই পড়া/না-পড়া বা পঠন-অপঠন নিয়ে একেবারে চমকে দেয়ার মতো অভিমত প্রকাশ করেছেন, সেদিন একটা ছোট্ট রচনা চোখে পড়ল উমবের্তোর ঠিক এ-সংক্রান্ত। হুবহু লেখাটা সামনে নেই, স্মৃতি থেকে টেনে বের করছি এখন। মোদ্দা বক্তব্যটা হলো, উমবের্তো বলছেন, তিনি তার আলমিরায় ছিৎরে-থাকা বিচিত্র সব গ্রন্থাবলির ভেতর থেকে অতি কিয়দংশই পড়েছেন। বেশিরভাগ বই খুলেও দেখা হয় নাই, যদিও সযত্নে সেগুলো সংরক্ষিত তার ব্যক্তিগত গ্রন্থঘরে তিন-চার দশক ধরে। আবার তিনি এ-ও বলছেন, বইগুলো তার না-পড়া/অপঠিত নয় একেবারে। কেননা একটা বই একবারও পৃষ্ঠা না উল্টে পড়ে ফেলার বহু পথ রয়েছে, একো জানাচ্ছেন। একটা পথ, ওই বইটি সম্পর্কে বিভিন্ন আলোচনা থেকে, যেমন বুকরিভিয়্যু প্রভৃতির মাধ্যমে, বেশ জেনে ফেলা যায়। অপরাপর লেখক বা পাঠকের নানান প্রতিক্রিয়া থেকে এটি খুবই সম্ভব কোনো-একটা বইয়ের গুণাগুণ আন্দাজ করে ফেলা। এটি আরও সম্ভব রেফারেন্স-টীকাটিপ্পনী পড়তে যেয়ে ফুটনোটে এর সম্পর্কে বেশ ইশারা-ইঙ্গিত ইত্যাদি পেয়ে যাওয়া। ফলে বেশিরভাগ বই সম্পর্কেই আমাদের কাজোপযোগী ভালো বোঝাপড়া একটা হয়েই যায় সেসব বই একবারটি না-খুলেও।

২৯
পড়া/না-পড়া বিষয়ে একোর সেই লেখাটা ‘সাময়িকী’ নামের একটা ওয়েবপত্রিকায় তিন-চার বছর আগে বেরিয়েছিল বঙ্গানূদিত হয়ে; এখন ওই ওয়েবক্ষেত্রটা কার্যত লুপ্ত-লিঙ্কবিচ্ছিন্ন বলে ঘেঁটে বের করা যাবে না আর। কাজেই ওই রাস্তা মাড়ানো সম্ভব নয়। নিবন্ধকারের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে সেই কোটেশনটুকু পুনরুদ্ধার করা যেতে পারে। এই রচনাটাতে রয়েছে একো-র বইপাঠাভ্যাস বিষয়ক অটোবায়োগ্রাফিক অভিমত। সচরাচর লেখকেরা তাদের বইপাঠের অভ্যাস ও প্রবণতা বিষয়ে বলতে যেয়ে যেমন উচ্চাঙ্গকণ্ঠী হয়ে ওঠেন, উমবের্তোর এই একপ্যারা স্বীকারোক্তি বিপরীতস্বর এবং ইন্ট্রেস্টিং। এখানে লেখাটা আরেকবার পড়া যাক, পুরোটাই, ছোট্ট রচনাটার বঙ্গানুবাদক মাহবুব মোর্শেদ। ‘‘দুনিয়ায় পড়ার মতো যত বই, সময় তার চাইতে অনেক কম। ফলে আমরা না-পড়া বইগুলা দিয়া গভীরভাবে প্রভাবিত হই — যে পড়ার সময় আমাদের নাই। কে 'ফিনেগান্স্ ওয়েক' শুরু থিকা শেষ পর্যন্ত আসলেই পড়ছে? কিংবা কে বাইবেলের 'জেনেসিস' থিকা 'অ্যাপোক্যালিপ্স্' পর্যন্ত পড়ছে? তারপরও যে-বইগুলা আমি পড়ি নাই সেইগুলা সম্পর্কে আমার সন্তোষজনক ও সঠিক ধারণা আছে। অস্বীকার করব না যে 'ওয়ার অ্যান্ড পিস্' আমি ৪০ বছর বয়সে পড়ছি। কিন্তু এ-বইয়ের মূল ব্যাপারগুলা এর আগে থিকাই আমার জানা আছিল। 'মহাভারত' আমি কখনোই পড়ি নাই, তারপরও আমার কালেকশনে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় মহাভারতের তিনটা সংস্করণ আছে। কে সত্যিকার অর্থে 'কামসূত্র' পড়ছে? তারপরও সবাই এই নিয়া কথা বলে, কিছু লোক তো চর্চাও করে। আমরা দেখি দুনিয়াটা না-পড়া বইয়ে ভরা, তবু আমাদের জানাশোনা ভালোই। এখন একটা না-পড়া বই হাতে তুইলা নিলে যে আমরা দেখি বিষয়টা আমাদের জানা, কেমনে এইটা ঘটে? প্রথমত বুঝনেঅলাদের ব্যাখ্যা — আমি না-চাইতে ওই বই থিকা কিছু তরঙ্গ হয়তো আমার মধ্যে আইসা ঢুকছে। দ্বিতীয়ত, এইটা হয়তো ঠিক না যে বইটা আমি কখনোই খুলি নাই। সময়ের পরিক্রমায় আমি তো বাধ্যগতভাবেই বইটা এক জায়গা থিকা আরেক জায়গায় নিয়া গেছি, জায়গা বদলের সময় হয়তো পাতা উল্টাইছি। কিন্তু পাতা যে উল্টাইছি, সেইটা পরে ভুইলা গেছি। তৃতীয়ত, বছর বছর আমি যে বইগুলা পড়ছি তাতে এই বইটার উল্লেখ হইছে। ওইভাবে বইটা আমার চেনা হয়ে উঠছে। যখন লোকে আমারে জিগায় যে অমুক কি তমুক বইটা আমি পড়ছি নিকি, আমি একটা নিরাপদ উত্তর দেই। বলি, আপনে তো জানেন আমি লেখক, পাঠক না। এমনে লোকের মুখ বন্ধ হয়। তারপরও কিছু প্রশ্ন সময়ে সময়ে ঘুইরা ফিইরা আসতে থাকে। যেমন, আপনে কি থ্যাকারের ভ্যানিটি ফেয়ার উপন্যাসটা পড়ছেন? উত্তর দিতে দিতে হতাশ হয়া বইটা তিনটা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আমি তুইলা নিছিলাম, পড়ার চেষ্টাও করছি। কিন্তু দেখলাম, বইটা ভয়ানক বাজে।”

৩০
একো-র এহেন অভিব্যক্তি কতটুকু গুরুত্বের সঙ্গে নেব, প্রশ্ন বটে। এখানে তথ্য হিশেবে এটুকু উল্লেখ করা যাক, ষাটের দশকের শুরুতে একো মশাই ইতালির একটা সাহিত্যপত্রিকায় ব্যঙ্গকৌতুকভরা মাসিক কলাম লিখতে শুরু করেন, যার বেশকিছু রচনা বাছাইপূর্বক জনৈক উইলিয়াম ওয়েভার 'মিসরিডিংস্' নামে ইংরেজি ভাষান্তর করেন। কোনো-এক প্রকাশনা সংস্থার পক্ষে এডিটর হিশেবে নিযুক্ত উমবের্তো ওই কলামে পেশাদার পাঠকের পরামর্শমূলক প্রতিক্রিয়ার আদলে দুর্ধর্ষ মজাদার কিছু রচনা লিখেছিলেন, বাংলায় এর সঙ্গে তুলনীয় রচনার মধ্যে এ-মুহূর্তে মনে পড়ছে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের না-কাহিনিমূলক লেখাগুলোর কথা, যার অধিকাংশ ধরা রয়েছে 'আগুন, মুখোশ পরচুলা ইত্যাদি' বইটিতে। একো-র এই রচনাগুলোর কথা প্রথম জেনেছিলাম মঈন চৌধুরী সম্পাদিত প্রান্ত ১৯৯৩ সংখ্যায়। এখন তো গুগল সার্চ দিয়ে এই বই, ইংরেজি ‘মিসরিডিংস্’, ইচ্ছেমতো পড়ে নেয়া যায় যে-কোনো সময়। এখন প্রশ্ন যদি ওঠে একো-র বক্তব্য কতটা গ্রাহ্য, খুঁজতে দেরি হলেও জবাব পেতে দেরি হবে না আশা করি। বিশেষ করে এখানে লেখকদের বা কবিদের উদাহরণ পেশ প্রাসঙ্গিক হবে। এমনটা প্রায় ব্যতিক্রমহীন লক্ষ করা যায় যে, লেখার ভেতর দরকারে-বেদরকারে এক বা একাধিক গ্রন্থের অনুষঙ্গ যখন টানতে হয় একজন কবি কিংবা লেখককে, এমনভাবে তারা তা টানেন যে পড়ে মনে হবে সেই গ্রন্থ/গ্রন্থগুলো পূর্ণাঙ্গপ্রত্যঙ্গ পঠিত তাদের। কিন্তু পুরোটাই ধাপ্পা, প্রায় ব্যতিক্রমহীন ধাপ্পাবাজি পুরোটাই, আসলে একটা 'রামায়ণ' একটা 'মহাভারত' একটা 'ইডিপাস' একটা 'অডিসি' একটা 'বেউল্ফ্' পূর্ণাঙ্গের সিকিভাগও না পড়ে একজন লেখক সেসব গ্রন্থ থেকে এক-আধলা উদ্ধৃতি এমনভাবে চয়ন করেন যেন ওইসব সমস্তই তার আদ্যোপান্ত পড়া। ভীষণ ভান একটা। আসলে তিনি ওইসব উদ্ধৃতির উৎস বই/বইগুলোর কিয়দংশও পড়েন নাই। কিন্তু কথা শুনে মনে হবে বা তার ন্যারেটিভ ধরে এগোলে মনে হতে পারে যেন মাতৃগর্ভে ভ্রুণাবস্থার আগে থেকেই ওইসব বইপত্র পড়া তার, যেন তিনি পুরাণবিশারদ, জাতিস্মর! বলে দিলেই তো হয় একটা বইয়ের একাংশ-আধাংশ পড়ে এবং অধিকাংশ না পড়ে নানাভাবে উদ্ধৃতি সংগ্রহ করে লেখাটা তৈরি করেছেন লেখক। পড়া মানে বাধ্যতামূলকভাবে একটা বই আদি থেকে অন্ত-উপান্ত পর্যন্ত পড়ে যাওয়া নয় নিশ্চয়ই, কিন্তু বেশিরভাগ সময় লেখকেরা পাঠকদেরকে কেন জানি মিছেমিছি ইম্প্রেসড করবার চেষ্টায় থাকেন, সর্বগ্রন্থপাঠক বলে জাহির করতে চান নিজেদেরকে। এর তো কোনো দরকার নাই। কিন্তু এ-রকম অস্বচ্ছতা সর্বদেশে সর্বকালে লেখকেরা আশ্রয় করে থাকেন দেখতে পাই। সম্ভবত এই অস্বচ্ছতাটুকু লেখালেখি প্রক্রিয়ারই অংশ। সৃজনের অন্ধকার দিক বলতে এটাকেই মিন করা হয় কি না? আসল কথাটা হলো, উমবের্তো বলে দিয়েছেন আগেই, না-পড়েও একটা বই সম্পর্কে নানাভাবেই বুঝ-সমঝ করে নেয়া যায়। লেখক তার পড়া জাহির করেন, রচনার শরীরে, কিন্তু না-পড়া আড়াল করেন কেন? লুকোচুরি কি ধরা যায় না? নাকি গোপন থাকে আখেরে এই লুকোছাপা? পাঠক ঠিকই ধরে ফেলে লেখকের পড়া/না-পড়ার দৌড়। হয়তো সকলের দৌড় সমান অবিলম্বে/অনতিবিলম্বে ধরা যায় না সবসময়, কিন্তু ধরা তাকে খেতেই হয়। কাজেই, সাধু কেন খানিক সেয়ানা হবেন না, মিছেমিছি কেন ধাপ্পা মারবেন এই উইকিপিডিয়াপাণ্ডিত্যের নৈপুণ্যদুনিয়ায়?

৩১
একো সম্পর্কে এক-দুইটা বাক্য অপ্রাসঙ্গিক/অতিপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে এমনটা আশঙ্কা সত্ত্বেও বলে ফেলা যাক। বাংলায় একো মোটামুটি বিখ্যাতই বলতে হবে। এই চিহ্নতাত্ত্বিক উপন্যাসকারের লেখাপত্তর বাংলাদেশের বইদোকানগুলোতে বেশ সুলভ বলা যায়। বিশেষভাবে একো-র নিবন্ধপ্রবন্ধের অ্যান্থোলোজিগুলো যথেষ্ট জনপ্রিয়ও। পড়া, না-পড়া, বোঝা, না-বোঝা, ব্যাখ্যা, অতিব্যাখ্যা, বয়ান, অতিবয়ান প্রভৃতি বিষয় নিয়া তার উদয়াস্ত উঠাবসা-নাড়াচাড়ার কারণে পোস্টমডার্ন পড়াপড়ির জগতে একো সমাদৃত। উমবের্তো একো উপন্যাস লিখেছেন সেমিয়োটিক্স নিয়া তার পাণ্ডিত্য দুনিয়াজোড়া পাঠকমহলে প্রশংসা লাভ ও লব্ধপ্রতিষ্ঠার ঢের পরে ১৯৮০ সালে এসে। জেমস জয়েস নিয়া আলোচনা করেছেন সাহিত্যতাত্ত্বিক আতশকাচ প্রয়োগপূর্বক। চিহ্নবিজ্ঞানের তত্ত্ব, চিহ্নবিজ্ঞান ও ভাষার দর্শন, পাঠকের ভূমিকা প্রভৃতি শিরোনামে একোর বইগুলো নব্বই-পরবর্তী বিশ্বে পাঠকাদৃত। উপন্যাসকার হিশেবে একো-র অভিষেক 'দ্য নেইম অফ দ্য রোজ' প্রকাশের মধ্য দিয়ে; এরপর 'ফ্যুকো-র পেন্ডুলাম' নামে একটা আখ্যান। প্রথমোক্ত বইটা ইংরেজি থেকে জি.এইচ হাবীব, যদ্দুর মনে পড়ে, বাংলায় এনেছেন। মজার ব্যাপার হলো, উপন্যাসের ভেতরে একো চিহ্নতত্ত্বীয় দর্শনটাই কীর্ণ করেছেন দেখতে পাই; রিডিং, মিসরিডিং, রিজিডিটি অফ রিডিং, স্যুপার্স্টিশন অফ রিডিং ইত্যাদি বিষয় নিয়েই ডিল্ করেছেন 'গোলাপটার নাম' উপন্যাসে; মিথ অফ রিডিং বলে যেতে যেতে ডিমিথিফাই করেছেন গোটা রিডিং কাণ্ডটাকে। 'ফ্যুকো-র পেন্ডুলাম' অবশ্য নজরে হেরি নাই, কিন্তু প্লট আবর্তিত হয়েছে ওই একই ফিলোসোফি ঘিরে — এইটুকু তথ্য জেনেছি রিভিয়্যু পড়ে। একটা প্রাচীন ইতালীয় মঠের চৌহদ্দিতে একের-পর-এক কয়েকটা অ্যাসাসিনেশনের রহস্যভেদ 'গোলাপটার নাম' উপন্যাসের উপজীব্য। অনুসন্ধানকারী হিশেবে ইংল্যান্ডের পরিব্রাজক-সন্ন্যাসী উইলিয়্যমের ইনভেস্টিগেশন ও সেমিয়োটিক্স চাবিকাঠির সহযোগে রহস্যজাল ছিন্নকরণের থ্রিলিং কাহিনি আমরা জানতে পারি ইনভেস্টিগেটরের তরুণ সঙ্গী শিক্ষানবীশ অ্যাডসো-র জবানিতে। এক গ্রন্থাগারিকের গোঁড়া সংস্কার ও ক্ষমতালিপ্সা আবিষ্কারের পরতে পরতে পাওয়া যায় চিহ্নবিজ্ঞানেরই থ্রিল ও সাস্পেন্সভরা অ্যাডভেঞ্চার। এই ধরনের বইয়ের কাহিনিটা খোলস মাত্র, অন্তরাত্মা বা শাঁস তো খোলস খোলাসা করে দেখানো সম্ভব না। যা সম্ভব, এই ধাঁচা না-কাহিনিপ্রধান বই পড়ে যা পাঠকের পক্ষে সম্ভব, তা হচ্ছে একের-পর-এক উত্থাপিত প্রসঙ্গসূত্র/ইন্টার্প্রিটেশন রি-ইন্টার্প্রেট করা। না, ইয়েস্তেন গার্ডারের 'সোফির জগৎ'-আদলে একো উপন্যাস লেখেন নাই; কিংবা ড্যান ব্রাউনের বেস্টসেলার 'দ্য ভিঞ্চি কোড' মোটেও নয়। চিহ্নব্যাখ্যার এক অনেকান্ত ও অনিয়ত ন্যাচারের কথাই যেন উমবের্তো একো বলতে চেয়েছেন তার ফিকশন ও ননফিকশন রচনারাজিতে। একটা-কিছু পড়া মানেই হলো অনাদিঅন্ত বয়ান/ইন্টার্প্রিটেশন থেকে একটামাত্রই ইন্টার্প্রিটেশন অ্যাক্সেস্ করা; আর পড়া মানেই হলো অনন্ত না-পড়া; আর ভুলপড়া দার্শনিকার্থে এগজিস্ট করে না আদতে; ভুল যদি কিছু থাকে জগতে, একো-র পয়েন্ট-অফ-ভিয়্যু থেকে, সেইটে একটা-কোনো বয়ান/ব্যাখ্যা/ইন্টার্প্রিটেশন ব্রহ্ম বলিয়া জ্ঞান করা। এইটাই ইন্টার্প্রিটেশন হিশেবে অ্যাপ্রোপ্রিয়েইট, অন্যান্য সমস্ত বয়ানাদি মিসিন্টার্প্রিটেশন — ভুল বলি বা বোকাপাঁঠার দম্ভ বলি এইটাই। বাংলা সাহিত্যে এই ভুল/বোকাপাঁঠাভ্যাভ্যা বাগানস্থ ফুল হিশেবেই নিরবধি ফুটিয়া যাইতে দেখি।

৩২
রিডিং ইজ অলোয়েজ নেসেসারিলি মিসরিডিং, — বলেছিলেন প্যল দ্য ম্যন। কথাটা রিভার্স করলেও অসত্য হবে কি? মিসরিডিং ইজ অলোয়েজ নেসেসারিলি রিডিং , — মনে হয় না? আপসাইড ডাউন যাকে বলে, একদমই ইনভার্টেড পজিশন থেকে দেখলেও ভুলপড়া ছাড়া আদৌ পড়ার অস্তিত্বও রয় না। কাজেই রিডিং এবং মিসরিডিং উভয়েরই কিনারা যাপিত জীবনে একাট্টা, গায়ে গা লাগানো, সংলগ্ন ও সন্নিহিত। একবারটা ভাবুন দিকিনি, মিসরিডিং অ্যালাও না-করলে এত এত গুচ্ছগাদার বাংলা সাময়িকী নিবন্ধপ্রবন্ধাদির চল্লিশা খাবে কে এসে, — ভূতে? কে এসে এই মিসরিড-আউট অযথাদীর্ঘ রচনাখানিরে একটা আচ্ছাসে ঠ্যাঙানি দেবে, ভবিষ্যতে?

৩৩
কোনোদিন কি পড়া হবে ফের গ্যুন্টার গ্রাস্? — সহসা না বলেই মনে হয়।

 

উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ..