Tuesday, April 2, 2019

একজন মহাজাগতিক যাত্রীর গল্প


১৯৭৫ সালের ২০ ডিসেম্বর। ১৭ বছরের একজন তরুণের জীবনে অভিভূত হবার মত একটা ঘটনা ঘটল। তার হাতে এসে পৌছুল খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষের চিঠি। যিনি খুবই জনপ্রিয় একজন ব্যক্তি, যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটির অ্যাস্ট্রনমির অধ্যাপক এবং গবেষক। তিনি সেই সতের বছরের তরুণকে চিঠির মাধ্যমে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন সামনের শনিবার উইকএন্ডে কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে তাঁর সাথে সময় কাঁটানোর জন্য। ঘটনার আকস্মিকতায় তরুণ মুগ্ধ, অভিভূত। মাত্র কিছুদিন আগেই সে কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে পড়ার জন্য আবেদন করেছে। সেই আবেদনপত্রটি দেখে প্রফেসরের মনে হয়েছে এই তরুণের সাথে কথা বলা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

নীল টাইসনকে লেখা চিঠি

চিত্রঃ নীল টাইসনকে লেখা চিঠি

সেই কাঙ্খিত শনিবারটি তরুণের জীবনের সবচেয়ে গুরূত্বপূর্ণ ঘটনা। প্রফেসর সেই তরুণকে কর্নেল ইউনিভার্সিটির সমস্ত ল্যাব ঘুরে দেখান, উপহার হিসেবে তরুণকে দেন তাঁর লিখা জনপ্রিয় একটি বিজ্ঞানের বই—The Cosmic Connection, যার কভারে লিখা ছিল “To Neil Tyson, a future astronomer”.

SAGAN TO TYSON
চিত্রঃ The Cosmic Connection বইয়ের উপরে নীল টাইসনকে উদ্দেশ্য করে লেখা প্রফেসরের উক্তি

সেইদিনের সতের বছরের তরুণ আজকের জনপ্রিয় বিজ্ঞানী, গবেষক, সঞ্চালক Neil deGrasse Tyson সেই শনিবারের ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন এভাবে—

সেই দিন শেষে তিনি আমাকে ড্রাইভ করে বাস স্টেশন পর্যন্ত পৌছে দিলেন। সেসময় খুব ঝড়ো হাওয়ার সাথে প্রচন্ড তুষারপাত হচ্ছিল। তিনি একটি ছোট্ট কাগজে তাঁর ফোন নাম্বার এবং তাঁর বাসার ফোন নাম্বার লিখলেন, এবং কাগজটি আমাকে দিয়ে বললেন—বাসটি যদি কোন কারণে না পৌছায় আমাকে ফোন করো, আজকের রাতটি আমার বাসায় আমার পরিবারের সাথে কাটাও।

আমি সবসময়ই জানতাম এবং মনে করতাম বড় হয়ে অবশ্যই আমি একজন বিজ্ঞানী হব। কিন্তু সেদিনের সেই বিকেলবেলা কার্ল সেগানের সাথে সময় পার করে আমি বুঝতে পারলাম আমি কীরকম মানুষ হতে চাই। আমি ছাড়াও অসংখ্য মানুষকে তিনি অনুপ্রণিত করেছেন পড়ালেখা, গবেষণা, বিজ্ঞান বিষয়ে। শিখিয়েছেন কীভাবে সত্যিকার অর্থে শিখাতে হয়। বিজ্ঞান হচ্ছে সহযোগিতামূলক একটি উদ্যোগ, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতে হয় সবার মাঝে।

যদিও নীল টাইসন কর্নেল ইউনিভার্সিটির পরিবর্তে হার্ভার্ড ইউনিভাসিটিতে অ্যাস্ট্রোনমিতে গ্রাজুয়েশন সম্পূর্ণ করেন, তিনি সবসময় বলেন এটি আমার দায়িত্ব আমার শিক্ষার্থীদের যেকোন আবেদনে সাড়া দেওয়া, যেরকমটি আমি পেয়েছি কার্ল সেগানের কাছ থেকে।

 টাইসন এবং সেগান
চিত্রঃ টাইসন এবং সেগান

কার্ল এডওয়ার্ড সেগান, শুধু একটি নাম নয়, তিনি সকল বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের জন্য একজন অনুপ্রেরণা। আমাদের আজকের গল্প কার্ল সেগানকে নিয়ে, যিনি সত্যিকার অর্থেই একজন মহাজাগতিক যাত্রী।

কার্ল এডওয়ার্ড সেগান, একজন মহাজাগতিক যাত্রী
চিত্রঃ কার্ল এডওয়ার্ড সেগান, একজন মহাজাগতিক যাত্রী

কার্ল সেগান সারাজীবন অনুসন্ধান করে গেছেন এই মহাবিশ্বে স্থান ও সময়ের মাঝে আমাদের অবস্থান। কীভাবে আমরা আজকের অবস্থায় আসলাম, ভবিষ্যত পৃথিবীতে আমাদের অবস্থা কেমন হবে। আমাদের পূর্বপুরুষরা কীভাবে চিন্তা করত। এই সমগ্র মহাবিশ্বে পৃথিবীই কি একমাত্র গ্রহ যেখানে প্রাণের বিকাশ ঘটেছে?? নাকি অন্য কোন সভ্যতা মহাবিশ্বের অন্য প্রান্তে বসে আমাদের মতই চিন্তা করছে?? তিনি সবাইকে বোঝাতে চেয়েছেন সমগ্র মহাবিশ্বের তুলনায় আমাদের অবস্থান কতই না নগণ্য। আমাদের বসবাসের জায়গাটি কতটুকু ক্ষীণ। আমরা কীভাবে আমাদের প্রাণের সঞ্চারক এই ছোট পৃথিবীকে নিজেদের অজান্তে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছি। তিনি আমাদের সতর্ক করেছেন বারবার। পৃথিবীতে আমাদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন নিজেদের ভিতর সহনশীলতা। পৃথিবীকে বসবাসের অনুপযোগী করার জন্য আমরা নিজেরাই কি বহুলাংশে দায়ী নই??

কার্ল সেগানের জন্ম ১৯৩৪ সালের ৯ নভেম্বর ব্রুকলিনের একটা ছোট্ট পরিবারে। তাঁর বাবা স্যামুয়েল সেগান ছিলেন একজন গার্মেন্টস্ কর্মী, যিনি তৎকালীন রাশিয়া থেকে অভিবাসী হয়ে নিউয়র্কে এসেছিলেন। মা রাচেল মলি গ্রুবার ছিলেন সাধারণ একজন গৃহিণী। কার্ল সেগানের একজন বোন ছিল, যার নাম ছিল ক্যারোল। বাবা মা কেউই বিজ্ঞানের সাথে তেমন সংশ্লিষ্ট ছিলেন না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কার্ল সেগানের বিজ্ঞানপ্রেমী হয়ে ওঠার পিছনে তাদের যথেষ্ট অবদান ছিল। কার্ল সেগানের ভাষায়—

কিন্তু আমি যদি পিছনে ফিরে তাকাই তাহলে এটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, আমি আমার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস স্কুল শিক্ষকদের কাছ থেকে নয়, এমন কি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের কাছেও নয়, বরং শিখেছি আমার পিতামাতার কাছ থেকে, যাঁরা বলতে গেলে বিজ্ঞান সম্পর্কে কিছুই জানতেন না।

ছোটবেলা থেকেই কার্ল সেগান প্রশ্ন করতে পছন্দ করতেন। ছোটবেলায় তার প্রশ্ন করার প্রিয় বিষয় ছিল ডায়নোসর এবং আকাশের তারা। এইসব বিষয়ে ছেলের কৌতুহল বুঝতে পেরে তার মা তাকে একটা লাইব্রেরী কার্ড এনে দেয়, তখন সেগানের বয়স মাত্র পাঁচ। মাত্র পাঁচ বছর বয়সের ছোট্ট সেগান একা একা হেঁটে হেঁটে লাইব্রেরীতে গিয়ে লাইব্রেরীয়ানকে বলেছিল স্টারের উপর একটা বই দিতে। বই হাতে নিয়ে বাসায় এসে অবাক হয়ে আবিষ্কার করলো বইটিতে ‘স্টার’ সম্পর্কে কিছু লিখা নেই, পৃষ্ঠা জুড়ে হলিউডের নায়ক নায়িকাদের ছবি!! সেগান বইটি লাইব্রেরীয়ানকে ফেরত দিয়ে সত্যিকার স্টারের উপর লিখা বই চাইলো। তখন মাত্র লাইব্রেরীয়ান বুঝতে পারলো পাঁচ বছরের এই ছোট্ট বাচ্চা আকাশের স্টারদের নিয়ে লিখা বই চাচ্ছে, হলিউডের কোন স্টার নয়!

প্রাণের উদ্ভব এবং এর বিবর্তন নিয়ে কার্ল সেগানের বেশ ছোটবেলা থেকেই আগ্রহ ছিল। যখন সেগানের বয়স ছয় কি সাত তখন সে তার এক ঘনিষ্ট বন্ধুকে সাথে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিল নিউয়র্ক সিটির আমেরিকান ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব নেচারাল হিস্টরিতে। সেখানে প্রকৃতিতে বিলুপ্ত হওয়া বিভিন্ন প্রাণি ছাড়াও ছিল প্রাচীন পৃথিবীতে আঘাত করা বিভিন্ন গ্রহাণুপুঞ্জের প্রস্তরখণ্ড। সেই যাদুঘরে পৃথিবীর বিভিন্ন পরিবর্তনগুলো খুব সুন্দরভাবে প্রদর্শিত হয়েছিল। সেখানে প্রাচীন পৃথিবীতে ডায়নোসররা কীভাবে বসবাস করত তার একটা চমৎকার ধারণা দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে এই যাদুঘর কার্ল সেগানের বিজ্ঞান দর্শনে খুব বড় একটা প্রভাব ফেলেছিল। এমনকি পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও তার প্রথম থিসিসের বিষয় ছিল প্রাচীন পৃথিবীর তেজষ্ক্রিয় পরিবেশে কীভাবে প্রাণের প্রথম উপাদান অ্যামোনিয়া উৎপন্ন হয়েছিল তার উপর।

ছোটবেলায় সেগানের খেলার প্রধান উপাদান ছিল কেমিস্ট্রি সেট। এটি সেগানের বাবা মা তাকে উপহার হিসেবে দিয়েছিল। সায়েন্স ফিকশন ছিলো মজার একটি অনুসঙ্গ। ছোটবেলায় কার্ল এইচ. জি. ওয়েসের সায়েন্স ফিকশন পড়ার সময় চিন্তা করতো মঙ্গল গ্রহে যদি প্রাণের উদ্ভব হয় তাহলে সেটি কেমন হবে। ১৯৪৭ সালে ‘অ্যাস্টাউন্ডিং’ নামে একটি সায়েন্স ফিকশন পত্রিকা কার্লের চোখে পড়ল। হার্ডকোর সায়েন্স ফিকশন বলতে যা বোঝায়, অর্থ্যাৎ যে সায়েন্স ফিকশনগুলো বিজ্ঞানের নিয়ম একেবারে অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে—এমন ধারণা সে মূলত এই পত্রিকা থেকেই পেয়েছিল। মহাজাগতিক বুদ্ধিমত্তার ব্যাপারে কার্লের আগ্রহ সম্ভবত সেখান থেকেই রূপ পেয়েছিল।

কার্ল সেগানের শিক্ষাজীবন শুরু হয় নিউজার্সির রাহওয়ে হাইস্কুল থেকে। অবশ্য তিনি গ্রাজুয়েশন শেষ করেছিলেন ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো থেকে। গ্রাজুয়েশনের পর পোস্টগ্রাজুয়েশনও করলেন পদার্থবিজ্ঞানের উপর। পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়লেও তার প্রথম থিসিস পেপার ছিল প্রাণের উৎপত্তি ও বিকাশের উপর। ১৯৬০ সালে পি এইচ ডি ডিগ্রী সম্পূর্ণ করার পর কার্ল সেগান গবেষক ও শিক্ষক হিসেবে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন। ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত সেখানে শিক্ষকতা করার পর তার শিক্ষকতার মেয়াদ আর বাড়ানো হয়নি। হার্ভার্ডের কিছু প্রফেসর তার বিরুদ্ধে কাজ করতে শুরু করে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ হিসেবে বলা হয়, তিনি মেধার জোরে না, বরং জনপ্রিয়তার জোরে টিকে আছেন! তাই তাকে আর হার্ভার্ডে প্রয়োজন নেই!

হার্ভার্ড থেকে ফিরে এসে কার্ল সেগান যোগ দেন কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে। সেখানে ১৯৭১ সালে ফুল প্রফেসর হিসেবে নিয়োগ পান। সেখানে তিনি গ্রহ নক্ষত্রের গতিবিধি নিয়ে গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। দীর্ঘ নয় বছর কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে সেন্টার ফর রেডিওফিজিক্স অ্যান্ড স্পেস রিসার্চে অ্যাসোসিয়েট ডিরেকটর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। ১৯৫০ সালের পর থেকে নাসা যে কয়টি স্পেস প্রোগ্রাম পরিচালনা করেছে তার প্রায় সবকয়টিতেই সেগান ছিলেন পরামর্শক হিসেবে। কার্ল সেগানই প্রথম ব্যক্তি যিনি পৃথিবীর বাইরের কোন বুদ্ধিমত্তার সাথে কিভাবে যোগাযোগ করা যায়, তার একটি প্রকল্প নিয়ে চিন্তা করেন। ভয়েজার স্পেসক্রাফটের সাথে যে বার্তাটি সোনার প্লেটে খোদাই করা ছিল, সেটি ছিল মানবজাতির প্রথম বার্তা, যেটি মহাজাগতিক কোন প্রাণীর উদ্দেশে পাঠান হয়েছিল।

VOYEGER RECORD EXPLANNATION

যেন অন্য কোন মহাজাগতিক প্রাণী এই বার্তাটি দেখে পৃথিবীর প্রানি এবং মানুষ সম্পর্কে ধারণা নিতে পারে। সোনার প্লেটে যে বার্তাটি ছিল তাতে আঁকা ছিল হাইড্রোজেন পরমাণু, ইলেকট্রনের স্পিন। গ্যালাক্সিতে আমাদের সূর্যের অবস্থান, এবং আমাদের সৌরজগৎ, যেখানে আমাদের একমাত্র বাসস্থান- পৃথিবী অবস্থিত। সৌরজগৎের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো নাসার রোবোটিক স্পেসক্রাফ্ট প্রজেক্টেও কার্ল সেগান একজন পরামর্শক হিসেবে ছিলেন। নিউমোনিয়ার আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কার্ল সেগান কর্নেল ইউনিভার্সিটির ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং বিষয়ে পড়িয়ে গেছেন।

ভয়েজার স্পেসক্রাফটে পাঠানো বুদ্ধিমান প্রাণিদের উদ্দেশ্যে মানবজাতির প্রথম বার্তা
চিত্রঃ ভয়েজার স্পেসক্রাফটে পাঠানো বুদ্ধিমান প্রাণীদের উদ্দেশ্যে মানবজাতির বার্তা

কার্ল সেগানের একসময়কার ছাত্র ডেভিড মরিসন সেগানকে বর্ণনা করেছেন একজন আইডিয়াবাজ মানুষ হিসেবে। তার বিভিন্ন বিষয়ে আইডিয়াগুলো শুধুমাত্র চমকপ্রদ তাই নয়, অন্যান্য ছাত্র এবং তার অধীনস্ত বিজ্ঞানীদেরও মোটিভেট করতে এগুলো কাজে লাগতো।

কসমোলজিতে সেগানের মূল গবেষণার বিষয় ছিল শুক্র গ্রহের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ও এর প্রকৃতি নির্ণয় সম্পর্কে। ১৯৬০ সালের দিকে সৌরজগৎের গ্রহগুলোর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ও পরিবেশ সম্পর্কে কারো কোন ধারণা ছিল না। কার্ল সেগান ধারণা করেছিলেন শুক্র গ্রহ খুবই শুষ্ক এবং এর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা মাত্রাতিরিক্ত বেশী। পরে সেগান শুক্র গ্রহ থেকে নির্গত রশ্মি পর্যবেক্ষণ করে এর পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৫০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস নির্ণয় করেন। পরে আমরা জানতে পারি শুক্রের অতিরিক্ত তাপমাত্রা শুধুমাত্র সূর্যের কাছাকাছি থাকার কারণে নয় বরং এর পিছনে গ্রীন হাউস ইফেক্ট একটা বড় কারণ। এরপরে আমরা সতর্ক হই পৃথিবীর গ্রীন হাউস ইফেক্ট কমানোর জন্য। আমরা দেখতে পারি সাময়িক সুবিধা আদায়ের জন্য আমরা আমাদের পৃথিবীকেও আমরা ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছি।

সেগানই প্রথম ব্যক্তি যিনি শনির উপগ্রহ টাইটানে তরলের অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপায় পানির উপস্থিতি থাকতে পারে। পরে ‘গ্যালিলিও’ স্পেসক্রাফটের সাহায্যে এর প্রমাণ মিলে। টাইটানে তরলের উপস্থিতির কারণ ছিল সেখানে প্রচুর পরিমাণে জৈব তরলের বৃষ্টিপাত। সেগান বৃহস্পতি গ্রহের বায়ুমণ্ডল এবং মঙ্গলে ঋতুর পরিবর্তন নিয়েও গবেষণা করেছিলেন। সেগান মঙ্গলের পৃষ্ঠের রঙের পরিবর্তন কারণ হিসেবে বর্ণনা করেন এর উপর বয়ে যাওয়া বালুর ঝড়কে। এর আগে মঙ্গলের ঋতু পরিবর্তনকে এর কারণ হিসেবে দায়ী করা হত। সেগান এবং তার কর্নেল ভার্সিটির কলিগ এডুইন আর্নেস্ট সালপিটার বৃহস্পতির বায়ুমণ্ডলকে পর্যবেক্ষণ করেন এবং এর বায়ুমণ্ডলে প্রচুর পরিমাণে জৈব পদার্থের উপস্থিতি লক্ষ্য করেন। বৃহস্পতির অত্যন্ত ঘন বায়ুমণ্ডল মূলত এই জৈবপদার্থের উপস্থিতির কারণেই সৃষ্ট।

বহুমুখী গবেষণামূলক কার্যক্রমের সাথে জড়িত থাকলেও সেগান মূলত বিখ্যাত ছিলেন পৃথিবীর বাইরের প্রাণ সৃষ্টির উপর গবেষণা জনিত কারণে এবং প্রাচীন পৃথিবীর পরিবেশে বৈদ্যুতিক সংযোগের ফলে প্রাণের প্রধান উপাদান অ্যামিনো অ্যাসিড তৈরী সংক্রান্ত পরীক্ষার জন্য।

কার্ল সেগান ও তার সহধর্মিনী অ্যান ড্রুইয়ান
চিত্রঃ কার্ল সেগান  ও তার সহধর্মিনী অ্যান ড্রুইয়ান

সেগান আমাদের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, আমাদের যুক্তিগুলোকে অবারিত করেছেন। একই সাথে তিনি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন মানবজাতির সীমাবদ্ধতার কথা। তার আইডিয়াগুলো আমাদের মহাবিশ্বকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে। তিনি মানবজাতির পৃথিবীতে টিকে থাকার গুরূত্ব সম্পর্কে যতটুকু বলেছেন ততটুকুই তুলনা করেছেন মহাবিশ্বের বিশালতার সাথে পৃথিবীর ক্ষুদ্রতার। তার সবচেয়ে গুরূত্বপূর্ণ কাজ, তের পর্বের প্রবল জনপ্রিয় বিজ্ঞান বিষয়ক টেলিভিশন সিরিজ Cosmos: A Personal Voyage তৈরী করেছেন তার যোগ্য সহধর্মিনী অ্যান ড্রুইয়ানকে সাথে নিয়ে। কসমস তৈরী করার সময় ছিল না কোন ইন্টারনেট, ছিল না বিজ্ঞানকে বোঝানোর জন্য প্রয়োজনীয় অ্যানিমেশন অথবা প্রযুক্তিগত সহয়তা। তবু কসমসে কার্ল সেগানের মোহনীয় কণ্ঠ তার বিজ্ঞানকে সহজভাবে বোঝানোর ভঙ্গি আজও আমাদের শিহরিত করে, প্রজন্ম নিয়ে আমাদের স্বপ্নগুলোকে প্রতিফলিত করে।

ANN DRUYAN
চিত্রঃ কার্ল সেগানের সহধর্মিনী অ্যান ড্রুইয়ান

কসমসে বিজ্ঞানের বিস্তৃত বিষয় সম্পর্কে সাবলীল আলোচনার মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। মাঝে মাঝে অতীতকে স্মরণ করা হয়েছে, কখনো ভবিষ্যৎের দিকে আলোকপাত করা হয়েছে। এখানে পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব থেকে শুরু করে মহাবিশ্বে আমাদের স্থান ও কালগত অবস্থান ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এটি ১৯৮০ সালে প্রথম টেলিভিশনে সম্প্রচারিত হয় এবং পৃথিবী প্রায় ৬০ টি দেশের প্রায় ৫০ কোটি মানুষের কাছে এটির সম্প্রচার করা হয়।

কসমস সম্প্রচারকালীন সময়ে কার্ল সেগান
চিত্রঃ কসমস সম্প্রচারকালীন সময়ে কার্ল সেগান

পৃথিবীর বাইরের প্রাণ এবং এর অস্তিত্ব নিয়ে কার্ল সেগানের সীমাহীন আগ্রহ ছিল। বিজ্ঞান সমাজের কাছে তিনি রেডিও টেলিস্কোপের মাধ্যমে বাইরের বুদ্ধিমান প্রাণির সন্ধানের গুরূত্ব তুলে ধরেন। এছাড়া তিনি ১৯৭৪ সালের ১৬ই নভেম্বর পৃথিবীর বাইরে বুদ্ধিমান প্রাণিদের উদ্দেশ্যে পাঠানো ফ্রাঙ্ক ড্রেক কতৃক লিখিত মেসেজ লিখতে সাহায্য করেছিলেন।

সেগান দি প্লানেটারি সোসাইটির সহপ্রতিষ্ঠাতা। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মানুষদের সংঘ যারা মহাকাশ সম্পর্কে আগ্রহী। তিনি জনপ্রিয় বিজ্ঞান সম্পর্কে বেশ কিছু বই লিখেছিলেন, যার একটি হচ্ছে Pale Blue Dot: A Vision of the Human Future in Space, এই বইটি ছিল Cosmos এর সিক্যুয়েল। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন সোভিয়েৎ ইউনিয়নে ভিতরকার স্নায়ু যুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন The Demon-Haunted World।

সেগান ছিলেন একজন মুক্তমনা। কসমসে ব্যবহৃত তার কিছু উক্তি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তার একটি হচ্ছে “Extraordinary claims require extraordinary evidence.” সেগান অদ্ভুৎ উপায়ে চিন্তা করতে পারতেন। বই সম্পর্কে তার চিন্তা ছিল এরকম, যা আজও অভিভূত করে—

“What an astonishing thing a book is. Its’ a flat object from a tree, with flexible parts on which are imprinted lot of funny squiggles. But one glance at it and you’re inside the mind of another person. Maybe somebody dead for thousands of years. Across the millennia an author is speaking clearly and silently inside your head, directly to you. Writing is perhaps the greatest of human inventions. Binding together people who never knew each other. Citizens of distance epochs. Books breaks the shackles of time. A book is proof that humans are capable of working magic. And this room(library) is filled with magics.”

সেগান বিজ্ঞানকে সাধারণ জনগনের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। তিনি আমাদের জানাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন আমাদের উৎস সম্পর্কে, জানতে চেয়েছিলেন আমাদের মানবজাতির ভবিষ্যৎ। একদিকে তিনি বোঝাতে চেষ্টা করেছেন মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষায় আমাদের কতটা সতর্ক হতে হবে, অন্যদিক দিয়ে তিনি আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিয়েছেন- এই বিশাল মহাবিশ্বের তুলনায় আমাদের জাতিগত বিভেদ, দলীয় ক্ষুদ্রতা কতটা সংকীর্ণ। খুব অল্প সময়ের জন্য তিনি পৃথিবীতে এসেছিলেন। মাত্র ৬২ বছর বয়সে, ১৯৯৬ সালের ২০ ডিসেম্বর সিয়াটলের ফ্রেড হাচিনসন ক্যান্সার রিসার্চ সেন্টারে নিওমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

 

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/a_cosmic_voyager/

Monday, April 1, 2019

শওকত আলী - জীবন ও শিল্পের অক্লান্ত কারিগর


নূর কামরুন নাহার



বাংলা কথাসাহিত্যে এক প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব শওকত আলী। কথাসাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই রয়েছে তার পদচারণা তবে গল্প আর উপন্যাসে তিনি এঁকেছেন জীবনের ঘনিষ্ঠ চিত্র। তুলে ধরেছেন শোষিত ও অন্ত্যজ মানুষের সুখ-দুঃখ, আশা-নিরাশা আর বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রাম। নৃতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান ও ইতিহাসে তাঁর আগ্রহ অত্যন্ত গভীর। বাংলার প্রায় লুপ্ত ও বিস্মৃত ইতিসাসে তাঁর সৃজনশীল নিরীক্ষাধর্মী অনুসন্ধান আমাদের সাহিত্যকে করেছে সমৃদ্ধ আর কথাসাহিত্যে সংযোজন করেছে নতুন মাত্রা।






জন্ম ও বাল্যকাল




দিনাজপুরের রায়গঞ্জ নামের এক থানা শহরে শওকত আলীর জন্ম। স্কুলের রেকর্ড অনুযায়ী তাঁর জন্ম ১৯৩৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। তবে তাঁর মতে তাঁর জন্ম সম্ভবত ১৯৩৫ সালে। মায়ের তৃতীয় সন্তান তিনি কিন্তু সন্তানদের মধ্যে চতুর্থ কারণ বড় দু’বোন যমজ। বেশ বড় একটা বাড়িতে কেটেছে তাঁর বাল্যকাল। অনেকখানি জায়গাজুড়ে পুকুর আর চারদিকে বাগান ছিল সে বাড়িটির। শিশু বয়সে ঐ গাছপালা, বাগান আর প্রকৃতি দেখতেন তিনি। বাবা ছিলেন তাঁর দাদা দাদির প্রথম সন্তান। তাঁর জন্মের আগেই মারা যান দাদা। দাদি তাঁকে খুব আদর করতেন। রাতে দাদির কাছেই থাকতেন। দাদির কোলে বসে শুনতেন কাহানী। যা তাঁকে শিশুকাল থেকেই গল্পের প্রতি আকৃষ্ট করেছিল। জন্মের পর থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত রায়গঞ্জেই ছিলেন। তারপর শ্রীরামপুর, হুগলি জেলায়। সেখানে টেক্সটাইল ইনস্টিটিউটে মা ভর্তি হলেন ডিপ্লোমা করতে। বাবা ছিলেন হোমিও প্যাথিক ডাক্তার। বাবাও শ্রীরামপুরে চলে আসলেন। ডাক্তারির প্র্যাকটিস শুরু করলেন। বাবা কলকাতায় হোমিওপ্যাথিক ডিগ্রী নিতে ভর্তি হলেন, ডিগ্রী নিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে তখন, কলকাতায় শুরু হয়েছে বোমা হামলা। তাই আবার তারা ফিরে এলেন রায়গঞ্জ।




শিক্ষা ও রাজনীতি




উনিশ খ্রিস্টাব্দের আগেই এই পরিবারে শিক্ষা প্রবেশ করেছিল। রায়গঞ্জের উকিলপাড়ায় থাকতেন তাঁরা। ও পাড়ায় ওটাই ছিল একমাত্র মুসলিম পরিবার। সে সময়টায় মুসলিম পরিবারে মেয়েদের লেখাপড়ার চল ছিল না। কিন্তু এই পরিবারের মেয়েরা লেখাপড়া করেছিল। শওকত আলীর মা লেখাপড়া শিখেছিলেন। একজন দিদিমনিকে রেখে ঘরেই শিখেছিলেন ইংরেজী। মা ডিপ্লোমা করতে গিয়েছিলেন শ্রীরামপুর।




তাঁর স্কুল জীবনও শুরু হয়েছিল শ্রীরামপুর মিশনারী স্কুলে। খুব প্রাচীন স্কুল এটি। সম্ভবত উইলিয়াম কেরী স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পরে রায়গঞ্জ করনেশন ইংলিশ হাইস্কুলে ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হন তিনি। এই স্কুল থেকেই প্রথম বিভাগে ১৯৫১ সালে ম্যাট্রিক পাস করেন ঐ সালেই সুরেন্দ্রনাথ কলেজে আইএ ভর্তি হন এবং ১৯৫৩ সালে দ্বিতীয় বিভাগে আইএ পাস করেন।




এ সময় জড়িয়ে পড়েন ছাত্র রাজনীতিতে। মূলত রাজনীতি ছিল তাঁর রক্তে। জন্মের পরই দেখেছেন কংগ্রেসের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বাবার সক্রিয় অংশগ্রহণ, মা মুসলিম লীগের পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক। পরস্পর বিপরীতমুখী দুই স্রোত। ওটা রাজনীতির একটা জটিল সময়। এই জটিল সময়টি তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন সমস্ত বোধ দিয়ে। বুঝতে পেরেছিলেন মুসলমানরা অবহেলিত, তাদের অবস্থার উন্নতি করতে হবে। ব্রিটিশ তাড়াতে হবে। আবার দেখেছেন বাঙালী মুসলমানরা একটা বৈষম্য থেকে মুক্তির জন্যই পাকিন্তান চাইছে। আবার যখন পাকিস্তান হলে জিন্নাহ যখন ঢাকায় এসে ঘোষণা দিলেন ‘উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’ রেডিওতে এটি যখন খুব প্রচার হলো তখন মা খুব অসুস্থ। তখন সব ভাইবোনকে ডেকে তাঁর মাথায় হাত দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছিলেন, ‘ওই পাকিস্তানে তোরা যাবি না। যে পাকিস্তানের জন্য তিনি দিনরাত পরিশ্রম করেছেন, সেই পাকিস্তান যেতেই তিনি নিষেধ করেছিলেন। ১৯৪৯ সালে মায়ের মৃত্যু হলে তাঁকে আর পাকিস্তান আসতে হয়নি। কিন্তু তাঁর পুরো পরিবার পূর্ব পাকিস্তানে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। পকিস্তানে এসে আবার বুঝেছিলেন বাঙালী মুসলমানরা যে বৈষম্য থেকে মুক্তির জন্য পাকিস্তান চেয়েছিলেন তা পূরণ হয়নি। বাঙালী জাতিসত্তার বিকাশের প্রয়োজন। এসব কিছুই তাঁকে নানাভাবে রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল




কলেজে পড়ার সময় জড়িয়ে পড়েন ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে। তৃণমূল মানুষের জন্য কাজ করা, তাদের মুক্তির জন্য লড়াই করা, ছিল তার রাজনৈতিক বিশ্বাস। তারপর বাঙালী জাতীয়তাবাদের জাগরণ। রাষ্ট্রভাষার জন্য আন্দোলন পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলন সবকিছু তাঁকে আন্দোলিত করে। এ সময় ছাত্র ইউনিয়নের ডিস্ট্রিক সহ-সভাপতি বানানো হয় তাঁকে। ১৯৫৪ সালে ৯২(ক) ধারা জারি হয়। চলে ব্যাপক ধরপাকড় তিনি আর কমরেড মোঃ ফরহাদ একসঙ্গে জেল খাটেন। হাজী মোঃ দানেশ বিখ্যাত নেতা ছিলেন। তাঁর সঙ্গেও সক্রিয় রাজনীতি করেন। জেল থেকে বের হয়ে ১৯৫৫ সালে বিএ পরীক্ষা দেন এবং তৃতীয় বিভাগে পাশ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ বাংলায় ভর্তি হন ও ১৯৫৮ সালে এমএ পাস করেন।




সাংবাদিক ও শিক্ষক জীবন




ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়েই বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রকাশিত হতে শুরু করে। সে সময় আবার তিনি সাংবাদিকতাও শুরু করেন। ১৯৫৫ সালেই দৈনিক মিল্লাতে চাকরি নেন তিনি। এ সময় পরিচয় ঘটে বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কিছু মানুষের সঙ্গে। যাদের মধ্যে ছিলেন কবি হাসান হাফিজুর রহমান এবং সমকালের সম্পাদক কবি সিকান্দার আবু জাফর।




এমএ পাস করার পর আসেন বীরগঞ্জে যোগ দেন শিক্ষক হিসেবে। ১৯৫৯ সালের শেষের দিকে বাংলার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ঠাকুরগাঁও কলেজে। দুই বছর থেকে যান ঠাকুরগাঁওয়ে। এ সময় পছন্দ করে বিয়ে করেন ইডেন কলেজের ছাত্রী শওকত আরাকে। কিন্তু ঢাকা তখন তাঁকে ডাকছে। সাংবাদিকতার সেই দিনগুলো, লেখালেখির নেশা আর লেখক বন্ধুদের টানে ও উৎসাহে চলে আসেন ঢাকায়। এ সময় তিনি সমকাল পত্রিকায় কাজ করেন। ১৯৬২ সালে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন জগন্নাথ কলেজে। কর্মজীবনে স্থিতু হন। তারপর টিকাটুলিতে জায়গা কিনে ঢাকায়ও তিনি স্থাযী হন। ২৫ বছর চাকরি করেন এই কলেজে। ১৯৮৮ সালে জেলা গেজেটিয়ারের ঢাকার হেড অফিসে যোগ দেন এখানে ডিরেক্টর হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৮৯ সালে তাঁকে সরকারি সঙ্গীত কলেজের প্রিন্সিপাল করা হয। এরপর ১৯৯৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন।




জগন্নাথ কলেজে যোগদানকালে বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক অজিত কুমার গুহ। এ সময় সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান মমতাজউদ্দিন আহমেদ, শামসুজ্জামান খান, রাহাত খান, হারুন অর রশিদকে। তাঁর আর একজন জুনিয়র সহকর্মী ছিলেন কথাশিল্পী আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। যিনি তাঁর টিকাটুলির বাসায়ও ছিলেন। যার সঙ্গে তার আন্তরিক ঘনিষ্ঠতা ছিল দীর্ঘকাল। সাংবাদিকতা জীবন এবং কলেজ জীবনের সহকর্মীররা তাঁকে নানাভাবে লেখালেখির প্রেরণা জুগিয়েছে।




লেখক হয়ে ওঠা




বাড়িতে প্রচুর বই ছিল। বাবার লেখাপড়ার প্রতি খুবই আগ্রহ ছিল। মাও ছিলেন লেখাপড়া জানা শিক্ষিত এবং শিল্পিত মননের মানুষ। সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক ছিল দুজনেরই। বাড়িতে ইংরেজী পত্রিকা, মাসিক পত্রিকা মোহাম্মদী, পরে সওগাত, আনন্দবাজার, যুগান্তর পত্রিকা আসত। ছোটবেলার ঐ প্রকৃতি আর রায়গঞ্জে প্রচুর বৃষ্টি হতো। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আম কুড়ানো। লুকিয়ে বিলে, খালের উজানে মাছ ধরা, এগুলো খুব আনন্দ দিয়েছে তাঁকে আর এগুলোই নানাভাবে প্রভাবিত করেছে তাঁর লেখক জীবনকে ।




ক্লাস থ্রিতে থাকতেই লিখতে চেষ্টা করেছিলেন কবিতা। ক্লাস নাইন টেনে- স্কুল ম্যাগাজিনে লিখলেন প্রবন্ধ। বই পুরস্কার পেলেন। যা তাঁকে লেখার প্রতি উৎসাহ যোগালো। দেশভাগের পর দিনাজপুরে এসে তাঁর প্রথম লেখা একটি গল্প প্রকাশিত হয় কলকাতার বামপন্থীদের ‘নতুন সাহিত্য’ নামের পত্রিকায়। এরপর দৈনিক মিল্লাত, মাসিক সমকাল, ইত্তেফাকে তাঁর অনেক গল্প, কবিতা এবং বাচ্চাদের জন্য লেখা প্রকাশিত হয় এবং লেখাটা হয়ে ওঠে সাধনার আর অস্তিত্বের। নিজের লেখক হয়ে ওঠা সম্পর্কে তিনি বলেনÑ




যত দূর মনে পড়ে আমার প্রথম গল্প ছাপা হয়, দিনাজপুরের কোন কাগজে। সেই কাগজের নাম কিংবা সেই গল্পের নাম কোনটাই এখন আর মনে নেই। পরে বিএ পরীক্ষা দিয়ে ঢাকায় এসে জুটে গেলাম কবি হাসান হাফিজুর রহমানের সঙ্গে। তাঁর সূত্রেই পরিচয় হলো সমকাল পত্রিকার সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফরের সঙ্গে। তখন থেকেই সমকালে লেখালেখি ও কাজের শুরু। আজ পেছন ফিরে তাকালে মনে হয়, এই দুই কীর্তিমান লেখক আমার লেখক-জীবনকে নানাভাবে পরিচর্যা করেছেন।




প্রত্যেক লেখকের বেড়ে ওঠার পেছনে অনেকের অবদান থাকে, প্রভাব থাকে। আজ মনে হয়, আমার লেখক হয়ে ওঠার শুরুর দিনগুলোতে পরিবার ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল আমাকে (আমার (লেখালেখি, শওকত আলী, প্রথম আলো, ২৯.৫,২০১৫)



 



প্রকাশিত বই




উপন্যাস-




পিঙ্গল আকাশ, ওযারিশ, প্রদোষে প্রাকৃতজন, উত্তরের খেপ, নাঢাই, বসত স্থায়ী ঠিকানা, দলিল, ঘরে যেতে চাই, দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালস্রোত, পূর্বরাত্রি, পূর্বদিন, কোথায় আমার ঘরবাড়ি, ত্রিপদী, দুই রকম পতন ও ভিতর গড়ের তিন মূর্তি (কিশোর উপন্যাস)




গল্পগ্রন্থ : উন্মুল বাসনা, ‘লেলিহান সাধ’, ‘শুন হে লখিন্দর’।




পুরস্কার




বাংলা ছোটগল্পে বিশেষ অবদান রাখার জন্য বাঙলা ১৯৬৮ সালে একাডেমি পুরস্কার পান। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ লেখক শিবির তাঁকে হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করে। ১৯৮৩ সালে পান অজিত গুহ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৬ সালে ফিলিপ্স সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৮৯ সালে আলাওল সাহিত্য পুরস্কার এবং ১৯৯০-এ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদকে ভূষিত হন।




তাঁর সৃষ্টির জগত




জ্ঞান-বুদ্ধি হওয়ার সময়ই শুনতে পাই, সারা দুনিয়াতে যুদ্ধ হচ্ছে আর দেখি রাতের বেলা ভূতের কান্নার মতো সাইরেন বাজছে আর সব বাতি নিভিয়ে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার করে ফেলা হচ্ছে সারা শহরটাকে। একদিন সত্যি সত্যি বোমা পড়ল কলকাতার কাছে আর তখন শুরু হলো পালাও পালাও রব। গাঁটরি-বোঁচকা নিয়ে মানুষ ছুটছে রেলস্টেশনের দিকে উদ্দেশ্য, গ্রামগঞ্জে, নয়তো মফস্বল শহরে ঠাঁই নেবে। ওই যুদ্ধ চলার সময়ই আবার লেগে গেল দুর্ভিক্ষ। রাস্তায় রাস্তায় কঙ্কালসার মানুষকে বসে নয়তো দাঁড়িয়ে ভিক্ষে চাইতে দেখা যেত। কাউকে কাউকে ডাস্টবিন থেকে পচা আর উচ্ছিষ্ট জিনিস তুলে নিয়ে খেতেও দেখা গেছে। বাইরে বেরোলেই মরা মানুষের লাশ চোখে পড়ত (আমার লেখালেখি, শওকত আলী, প্রথম আলো, ২৯.৫,২০১৫)




যুদ্ধ, হানাহানি, অস্থিতিশীল-উত্তপ্ত সময়, মানবিকতার পরাজয়, মানুষের বেঁচে থাকার প্রাণান্ত চেষ্টা এসবের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তিনি। যা তার মনে ব্যাপক রেখাপাত করেছিল। সাধারণ মানুষের এই মানবেতর জীবন, দুর্ভিক্ষ, মানুষের পচা লাশ দেখার পাশাপাশি তিনি আবার দেখেছিলেন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, হিন্দু-মুসলিমের রায়ট, দেশভাগ এবং ভিটেমাটি ছাড়া মানুষের দুর্বহ কষ্ট।




যুদ্ধ-দুর্ভিক্ষ দুই-ই শেষ হলো বটে, তবে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মুখে সেøাগান শোনা যেতে লাগল। একদিকে জয় হিন্দু আর ভারতমাতা কী জয়, অন্যদিকে, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। খবর শোনা গেল কলকাতা আর বিহারের মুঙ্গেরে মুসলমানদের মেরে কেটে সাফ করে দিচ্ছে হিন্দুরা আর মুসলমানরা নোয়াখালী, বরিশাল আর ঢাকায় একজন হিন্দুকেও রাখেনি। সবাইকে মেরে বাড়িঘর, সহায়-সম্পদ লুট করে নিচ্ছে। ওই রকম খবর শুনতে শুনতেই একদিন জানা গেল, ব্রিটিশরাজ্যের দিন শেষ, তাদের ভারত সাম্রাজ্যকে হিন্দুস্তান আর পাকিস্তান এই দুই ভাগে ভাগ করা হয়ে গেছে। পাকিস্তানে হিন্দুর জায়গা নেই আর হিন্দুস্তানে মুসলমান থাকলে তারা বেঘোরে মারা পড়বে। (আমার লেখালেখি, শওকত আলী, প্রথম আলো, ২৯.৫,২০১৫)




এই দেশভাগ তাঁকে জন্মভূমি ত্যাগে বাধ্য করেছিল। জন্মভূমির মাটি হারানোর গভীর বেদনা, শোষিত মানুষের পরাজয় তাঁকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল। শওকত আলীর উপন্যাস ও গল্পের প্রধান অংশজুড়ে রয়েছে নিম্নবর্গের মানুষ, তাদের শোষিত জীবনের কথকতা। সামন্তবাদী সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে শওকত আলীর মনের বিদ্রোহ আজীবন। খুব কাছ থেকে তিনি দেখেছেন অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষদের দুঃখ বেদনা, হাহাকার বঞ্চনা আর গভীর অনুভবে তাদের সঙ্গে একাত্ম হতে পেরেছেন।




ইতিহাসের পালাবদল, শাসকের পালাবদলের ধারায় সাধারণ মানুষের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া, সাধারণ মানুষের জীবন প্রেম ও অনুভব এবং ৮০০ বছর আগের ইতিহাস আশ্রয়ী তাঁর কালজয়ী উপন্যাস ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসের নামকরণটাও সে চিন্তা থেকেই এসেছে। প্রদোষকাল মানে দিন এবং রাত্রির মাঝামাঝি সময়। হিন্দু শাসন চলে যাচ্ছে মুসলমান শাসকেরা আসছে এই মাঝামাঝি সময়ে সাধারণ মানুষের কী অবস্থা তারা কী ভাবছেন?




আমার চিন্তাটা এ কারণেই এসেছিল যে, এখানকার সাধারণ মানুষ ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজ্যশাসনের যে প্রক্রিয়াটা ছিল, তা তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছেন। দক্ষিণ এশিয়ার এই প্রান্তে মুসলমান ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা এতবেশি হওয়ার কারণ কী? এটা আমার একটা প্রশ্ন ছিল। আমি অনেককে প্রশ্ন করেছি কিন্তু কোন সঠিক উত্তর পাইনি।...




যবনরা আসছে শুনে অতবড় রাজা লক্ষণ সেন রান্না করা খাবার না খেয়েই নৌকা নিয়ে পালিয়ে গেলেন। এ ঘটনাগুলো পড়ে আমার মনে হয়েছিল এ উপাদানগুলো নিয়ে একটা উপন্যাস লিখলে কেমন হয়। আমি ইসলাম প্রচার করতে যাচ্ছি না। কী হয়েছিল না হয়েছিল সেসবের কোন সিদ্ধান্তও আমি দিইনি। এর মধ্যে প্রেমের ব্যাপারটা আছে। প্রেমিক-প্রেমিকারা যে সমাজ পরিবর্তনের জন্য উত্থান-পতন, গৃহযুদ্ধ সবকিছুতেই অংশ নিয়েছে। প্রেমিকাকে ফেলে প্রেমিক যুদ্ধে যাচ্ছে, সে কোন যুদ্ধে যাচ্ছে? কার জন্য যাচ্ছে? তার ধর্ম কী? একটি ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ পরিবর্তনের কথাই আমি বলতে চেয়েছি। (সাক্ষাৎকার, ১৯.৫.২০১৩, শিলালিপি)




তার এ উপন্যাসে আছে মানব মনের এক চিরন্তন প্রশ্ন এই জীবন জীবনের জন্য যুদ্ধ এই শাসক শ্রেণী এই যে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার লড়াই আবার ক্ষমতা হারিয়ে কাপুরুষের মতো পলায়ন এই যে বারবার ভাঙ্গা-গড়া এর শেষ কোথায়Ñ দেখ, এই কি মানুষের জীবন? সুখ নেই, স্বস্তি নেই, গৃহ নেই, কেবল প্রাণ নিয়ে পলায়ন করতে হচ্ছেÑ এর শেষ কোথায়? এ জীবন কি যাপন করা যায়? বলো, কতদিন এভাবে চলবে?




উপন্যাসের এক চরিত্রের এই প্রশ্ন মানুষের অস্তিত্ব আর জীবনের সর্বজনীন এক প্রশ্নে পরিণত হয়েছে।




দক্ষিণায়নের দিন, কুলায় কালস্রোত এবং পূর্বরাত্রি পূর্বদিন যেগুলোকে একসঙ্গে ত্রয়ী উপন্যাসের জন্য তিনি ফিলিপস্ পুরস্কার পান। ষাটের দশকের মানুষের মধ্যে চিন্তাভাবনার যে পরিবর্তন আসছে যেটাই ‘দক্ষিণায়নের দিন’ যার মানে হচ্ছে শীতকাল আসছে। ‘কুলায় কালস্রোত’ হচ্ছে পরিবর্তন যেখানে একবারে আঘাত করছে। আর ‘পূর্বরাত্রি পূর্বদিন’ হচ্ছে নতুন সময়টি আসার একেবারে আগের সময়টি। মূলত ষাটের দশকে মধ্যবিত্ত এবং সমগ্র সমাজব্যবস্থায় যে পরিবর্তন আসে, যে নতুন একটা চিন্তা-চেতনা দ্বারা আলোড়িত হয় পুরো সমাজ সমগ্র জীবনব্যবস্থা, ধ্যান-ধারণা আর চাল-চলনে যে পরিবর্তনের সুর বেজে ওঠে তা নিবিড় পর্যবেক্ষণে অত্যন্ত সুন্দরভাবে উঠে এসেছে এ উপন্যাসে।




নিম্নবর্গীয় মানুষের জীবন ও বিচরণের পাশাপাশি আদিবাসীর জীবনও উঠে এসেছে তার গল্পে। স্কুলে এবং কলেজে শিক্ষকতার সময় তিনি মাটিসংলগ্ন মানুষের সঙ্গে মিশেছেন ঘনিষ্ঠভাবে। তাঁর উপন্যাস গল্প তাই অন্ত্যজ মানুষের হাহাকার, শোষণ আর বঞ্চনার চারণভূমি। শুধু শোষণ আর নিপীড়নের ঘনিষ্ঠ চিত্র নয়। শোষিত মানুষের জেগে ওঠা, বঞ্চনার বিরুদ্ধে জ্বলে ওঠা জীবন আর অত্যাচারিতের বিজয়েও তিনি আশাবাদী। তাঁর গল্পের নিপীড়িত জনতা তাই জ্বালিয়ে দেয় প্রতিরোধের আগুন, খড়ের গাদায় পুড়িয়ে দেয় মহাজনের ঘর, মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কড়ায়-গ-ায় হিসাব চায়। ‘লেলিহান স্বাদ’ গল্পে আমরা দেখি শেষ পর্যন্ত প্রতিবাদী মানুষ আগুন ধরিয়ে দেয় ‘শুন হে লখিন্দর’ গল্পে দেখি মহাজনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে হিসাব চায় নিপীড়িত মানুষ। প্রতিশোধে সাপের ঝাঁপি খুলে দেয় অন্ধকারে।




শওকত আলীর মানসিক জগৎ ছিল বিশ্রামহীন। সাধারণ নিপীড়িত জনতার মুক্তি আর সৃষ্টির উন্মাদনায় উন্মাতাল, উত্তাল। তিনি যেমন আপোসহীন ছিলেন তৃণমূল মানুষের মুক্তি ও প্রাপ্তির জায়গায় তেমনি শিল্পসৃষ্টি লেখনী ও প্রকাশের জায়গায়। তাই তাঁর উপন্যাস গল্পে যেমন ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে সাধারণ মানুষের শোষণ, নির্যাতন, বঞ্চনা এবং মুক্তির আকাক্সক্ষা তেমনি প্রকাশের ঋজুতা, বর্ণনা, ভাষা ও প্রকাশভঙ্গির ভিন্নতায় তা হয়ে উঠেছে শিল্পোত্তীর্ণ জীবনের ঘনিষ্ঠ পাঠ।




শওকত আলী জীবনকে দেখেছেন নির্মোহভাবে। তাঁর কলমের দক্ষতায় এঁকেছেন মানুষের জীবনছবি। সে জীবনছবি আমাদের ইতিহাস, শ্রেণী, শ্রেণী সংগ্রাম আর জীবন আকাক্সক্ষার। তাঁর লেখা কোন বিচ্ছিন্নতা বোধে আক্রান্ত নয়, জীবনের বাইরে, জীবনের গল্পের বাইরে অথবা আখ্যানহীন কোন কিছু তিনি আঁকতে চাননি। তিনি জীবনের প্রতি ভাঁজ থেকে গল্প তুলে এনেছেন। তাই তার গল্পে, তার সৃষ্টিতে যেমন আছে মানবিকতার পরাজয় ও দলিত জনতা, মানুষের অন্ধকার, মৃত্তিকালগ্ন মানুষ তেমনি আছে বিদ্রোহী-প্রতিবাদী মানুষ বিপ্লব, স্বপ্ন, জাগরণ আর মানুষের বিজয়। তিনি বিশ্বাস করেন জীবনে আর জীবনকেই ভাবেন শিল্প। জীবন আর শিল্পের এক অক্লান্ত কারিগর তিনি।




বর্তমান সময়ে তিনি




কথাসাহিত্যের এ কিংবদন্তি পুরুষ এখন সময় কাটান টিকাটুলিতে তাঁর বাসার নির্জন কক্ষে। বার্ধক্যের নানা শারীরিক সমস্যায় এখন আর তেমন লিখতে পারেন না। একটা পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী লেখার ইচ্ছা বহুদিনের। কাজটায় হাতও দিয়েছিলেন। সেখানে জীবন আর সময়কে আঁকতে চান তিনি। কিন্তু স্মৃতি মাঝে মাঝেই তাঁকে প্রতারিত করছে। অনেককিছুই স্মরণ করতে পারছেন না। লিখতে না পারলেও বই তাঁর অবসরের প্রিয় সঙ্গী। পড়েন গল্প, উপন্যাস, রাজনীতি ইতিহাসের বই। একটি পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী তিনি লিখে যেতে পারবেন কি নাÑ এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলেও আশাবাদী তিনি। যা আমরা করতে পারিনি তা নতুন প্রজন্ম করবে, যা আমরা জয় করতে পারিনি তা নতুন প্রজন্ম করবে এই স্বপ্ন জীবনের প্রতি তাকে করে ইতিবাচক ও আশাবাদী। আর তাই জীবনের জয় বা পরাজয় এবং সবকিছুর পরে আবার উত্তসূরির হাতে রেখে যাওয়া সৃষ্টির নিশানাতেই তিনি বিশ্বাসী। আর সে কারণেই দৃঢ় কণ্ঠে তার উচ্চারণ




জীবনের কথাই যদি সাহিত্যের কথা হয়, তাহলে পাশবিকতা, ধ্বংস ও বিপর্যয় যেমন বাস্তবতা এবং সাহিত্যের বিষয়, তেমনি ওই সবের পাশাপাশি ফুল ফোটানোর বাস্তবতাও সাহিত্যের বিষয়। এটা গ্রিক সভ্যতার যুগে যেমন সত্য, এই বিশ্বায়নের যুগেও তেমনি সমান বা খানিক বেশি রকমই সত্য। ব্যক্তির আপেক্ষিকতা মুক্ত স্বয়ম্ভর বিচ্ছিন্ন অস্তিত্বের যতই গুণগান করা হোক, কি সংসার-সম্পর্কহীনতাকে যতই প্রগতিশীলতার পরিচায়ক বলে ঘোষণা করা হোক, ভবিষ্যতে কী হবে জানি না, তবে এখনও ওসব কথা চমকমারা বুলি ছাড়া অন্য কিছু মনে হয় না।





ভার্জিনিয়া উলফ এর গল্প : ‘সোম অথবা মঙ্গলবার’


অনুবাদ - মৌসুমী কাদের

(আধুনিকতাবাদী লেখক ভার্জিনিয়া উলফ ১৯২১ সালে এই গল্পটি লিখেছিলেন। একজন নারীবাদী লেখকের কাজ ততখানি মানসিক উৎকর্ষতা না থাকলে হজম করা কঠিন । সাড়া বিশ্বে বিপুল সাহিত্যপ্রেমীর কাছে তিনি সমাদৃত হয়েছিলেন। এই গল্পটি একটি দিনের মন ও চিন্তার সহজ পরিবেশন মনে হলেও আসলে তা প্রখর অন্তর্দৃষ্টি ও মানবিক স্বত্তার প্রকাশ। যা সহজকে ছাপিয়ে ধারালো পাতের তীক্ষ্ণ ভাষায় প্রখর হয়ে উঠেছে। সরাসরি অর্থ, বাক্যের মূল আকুতি, বিচ্ছিন্ন বা অন্তর্নিহিত সংস্কৃতি, আবহে অথবা শব্দ-পরমাণুর জন্মে, হুবহু বোধ ধরে রেখে ভাষান্তর কঠিন। তারপরও অনুবাদটি থেকে একটি বাংলা গল্পের স্বাদ পাবার চেষ্টা করা ।)


সোম অথবা মঙ্গলবার; অলস,অন্যরকম এবং উদাসীন। স্বতঃস্ফূর্ত কেঁপে উঠা ডানা ঝাপটানোয় বোঝা যায় তার গন্তব্য সুনির্দিষ্ট। গীর্জার ঠিক উপরে, আকাশের তলদেশে হেরন পাখিটা উড়ে যায়।

সুদূর ধবল শুভ্রতায় নিজেকে লুকিয়ে রাখে সে, সীমাহীন আকাশ আবৃত করে অনাবৃতদের, অবিরাম ক্লান্তিহীন স্থীর উড়ে চলায়। একটা হ্রদ, যার পাড়গুলো স্পষ্টরেখায় এঁকে গেছে! আর সেই পাহাড় চূড়া? কি নিখুঁত! সোনারোদ আভা লেগে আছে ঢালে, নিচে বয়ে চলেছে সেই ধারা। অজস্র ফার্ন অথবা নরম সাদা পালক খসে পড়ছে নিস্তব্ধতায়-

বড় আকাঙ্ক্ষিত এই ‘সত্য’ এবং এর জন্যেই বড় বেশী অপেক্ষা; অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কিছু শব্দের উচ্চারন , চিরতরের কিছু চাওয়া-(বা দিক থেকে কান্নাটা শুরু হয়, আবার ডানপাশে, ধর্মঘটে চাকা বন্ধ, বাসের চাকা পিন্ডীভূত হয় দ্বন্দে, চিরকালের সেই আকাঙ্ক্ষা -(ঘড়িটা দৃঢ়তায় বারোটি স্বতন্ত্র শব্দে শপথ করে ঘোষণা দেয়-এটা মধ্যাহ্ন, হালকা স্বর্ণের আবরণে আলো ও শিশুদের কলোরব)। চিরকালের প্রতীক্ষা, এসবই কি তবে সত্য?
লাল গম্বুজ; গাছের পাতায় ঝুলে থাকা ধাতব মুদ্রা, লেজ গুটিয়ে চিমনির ধোঁয়া উড়ে যাওয়া, চিৎকার, শোরগোল, ফেরিওয়ালার ডাক; ‘লোহা কিনবেন, লোহা’? কিন্তু সত্য? সত্য তাহলে কি? এটাই কি সত্য?

পুরুষ অথবা নারীর পায়ের পাতায় দৃশ্যমান শিরা, কালো অথবা সোনা খচিত আলো (এই কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া; সে কি মধুর? না, ধন্যবাদ-ভবিষ্যতের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রসমূহ), আগুনের শিখা ঘরগুলোকে আলো করে ফেলছে; রক্ষা করছে কালো মানুষ এবং তাদের উজ্জ্বল চোখ। হয়ত বাইরে তখন একটি ভ্যান মালামাল খালাশে ব্যাস্ত। মিস থিংগামী তার চেয়ারে বসে চা পান করছে, আর কাচের টুকরোগুলো ভরে রাখছে পশমী কোটের পকেটে---

বাতাসে পাতার দোলা, কোনায় পড়ে থাকা নরম আলো, গতির উল্টোপথে চলা, হালকা রুপোলী জলের ছিটা, ঘর কিংবা আশ্রয়হীন, সমষ্টি, বিচ্ছিন্নতা, নানা মাত্রায় তছনছ, টুটে পড়া, ডুবে যাওয়া; এই সবকিছুর সমন্বয়ই কি তবে সত্য?

এখন সাদা মার্বেলপাথরের চত্বরে জ্বলন্ত আগুনের আঁচে দাঁড়িয়ে কেবলি মনে করা। গজদন্ত থেকে উৎসরিত শব্দগুলো কালো ছায়াগুলোকে ঢেকে ফেলে ফুটিয়ে তুলছে আলো। অন্তর্দৃষ্টির দেখা; আগুনের শিখায়, ধোঁয়ায়, মূহুর্তের স্ফুলিঙ্গে অথবা কোন সমুদ্রযাত্রায়, মার্বেল চত্বর আর মিনারগুলোর অন্তরালে চলে যাওয়া, আর ভেসে চলা ভারত সাগর; যখন শূন্যতা নীল রঙে ছেয়ে যায় আর জ্বলজ্বলে তারা ভিড় বাড়ায়।–সত্য ?
সত্য আসলে কি? অথবা এখন, এসব কিছুই কি সত্যের খুব ঘনিষ্ট?

অলস এবং উদাসীন হেরন পাখিটি ফিরে আসে। আকাশটা তাঁরায় তাঁরায় আবৃত হয়, আবার নিরাভরণ।

 

উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ..

কিন্নরদল - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়


পাড়ায় ছ’সাত ঘর ব্রাহ্মণের বাস মোটে। সকলের অবস্থাই খারাপ। পরস্পরকে ঠকিয়ে পরস্পরের কাছে ধার-ধোর করে এরা দিন গুজরান করে। অবিশ্যি কেউ কাউকে খুব ঠকাতে পারে না, কারণ সবাই বেশ হুঁশিয়ার। গরিব বলেই এরা বেশি কুচুটে ও হিংসুক, কেউ কারো ভালো দেখতে পারে না বা কেউ কাউকে বিশ্বাসও করে না।

আগেই বলেছি, সকলের অবস্থা খারাপ এবং খানিকটা তার দরুন, খানিকটা অন্য কারণে সকলের চেহারা খারাপ। কিশোরী মেয়েদেরও তেমন লালিত্য নেই মুখে, ছোট ছোট ছেলেরা এমন অপরিষ্কার অপরিচ্ছন্ন থাকে এবং এমন পাকা পাকা কথা বলে যে, তাদের আর শিশু বা বালক বলে মনে হয় না। কাব্যে বা উপন্যাসে যে শৈশবকালের কতই প্রশস্তি পাঠ করা যায়, মনে হয় সে সব এদের জন্য নয়, এরা মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়ে একেবারে প্রবীণত্বে পা দিয়েছে।

পাড়ায় একঘর গৃহস্থ আছে, তারা এখানে থাকে না, তাদের কোঠাবাড়িটা চাবি দেওয়া পড়ে আছে আজ দশ-বারো বছর। এদের মস্তবড় সংসার ছিল, এখন প্রায় সবাই মরে হেজে গিয়ে প্রায় পাঁচটি প্রাণীতে দাঁড়িয়েছে। বাড়ির বড় ছেলে পশ্চিমে চাকরি করে, মেজ ছেলে কলেজে পড়ে কলকাতায়, ছোট ছেলেটি জন্মাবধি কালা ও বোবা—পিসিমার কাছে থেকে মূকবধির বিদ্যালয়ে পড়ে। বড় ছেলে বিবাহ করেনি, যদিও তার বয়স ত্রিশ-বত্রিশ হয়েছে। সে নাকি বিবাহের বিরোধী, শোনা যাচ্ছে যে এমনিভাবেই জীবন কাটাবে।

পাড়ার মধ্যে এরাই শিক্ষিত ও সচ্ছল অবস্থার মানুষ। সেজন্য এদের কেউ ভালো চোখে দেখে না, মনে মনে সকলেই এদের হিংসে করে এবং বড় ছেলে যে বিয়ে করবে না বলছে, সে সংবাদে পাড়ার সবাই পরম সন্তুষ্ট। যখন সবাই ছোট ও গরিব, তখন একঘর লোক কেন এত বাড় বাড়বে? বড় ছেলে বিয়ে করলেই ছেলেমেয়ে হয়ে জাজ্বল্যমান সংসার হবে দুদিন পরে, সে কেউ সহ্য করতে পারবে না। মেজ ছেলে মোটে কলেজে পড়ছে, এখন সাপ হয় কী ব্যাঙ হয় তার কিছু ঠিক নেই, তার বিষয়ে দুশ্চিন্তার এখনো কারণ ঘটেনি, তবে বয়েসও বেশি নয়।

মজুমদার-বাড়িতে ভাঙা রোয়াকে দুপুরে পাড়ার মেয়েদের মেয়ে-গজালি হয়। তাতে রায়-গিনি্ন, মুখুজ্যে-গিনি্ন, চক্কত্তি-গিনি্ন প্রভৃতি তো থাকেনই, অল্প-বয়সী বৌয়েরা ও মেয়েরাও থাকে। সাধারণত যেসব ধরনের চর্চা এ মজলিসে হয়ে থাকে, তা শুনলে নারীজাতি সম্বন্ধে লিখিত নানা সরল প্রশংসাপূর্ণ বর্ণনার সত্যতার সম্বন্ধে ঘোর সন্দেহ যাঁর উপস্থিত না হবে, তিনি নিঃসন্দেহে একজন খুব বড় ধরনের অপটিমিস্ট।

আজ দুপুরে যে বৈঠক বসেছে, তাতে আলোচিত বিষয়গুলো থেকে মোটামুটি প্রতিদিনের আলোচনা ও বিতর্কের প্রকৃতি অনুমান করা যেতে পারে।

বোস-গিনি্ন বলছিলেন—আরে বাপু দিচ্ছি তো রোজই, আমার গাছের কাঁটাল খেয়েই তো মানুষ, আমাদের যখন কাঁটাল পাড়ানো হয়, ছেলেমেয়েগুলো হ্যাংলার মতো তলায় দাঁড়িয়ে থাকে—ঘেয়ো কী ভুয়ো এক-আধখানা যদি থাকে তো বলি, যা নিয়ে যা। তোদের নেই, যা খেগে যা। তা কি পোড়ার মুখে কোনো দিন সুবাক্যি আছে? ওমা, আজ আমার মেয়ে দুটো নেবু তুলতে গিয়েছে ডোবার ধারের গাছে, তা বলে কি না রোজ নেবু তুলতে আসে, যেন সরকারি গাছ পড়ে রয়েছে আরকি—চব্বিশ ঝুড়ি কথা শুনিয়ে দিলে মন্টুর মা। আচ্ছা বলো তো তোমরাই—

মন্টুর মা—যাঁকে উদ্দেশ করে এ কথা বলা হচ্ছিল, তিনি এঁদের মজলিসে কেবল আজই অনুপস্থিত আছেন নইলে রোজই এসে থাকেন। তাঁর অনুপস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করে সবাই তাঁর চালচলন, ধরন-ধারণ, রীতি-নীতির নানারূপ সমালোচনা করল।

প্রিয় মুখুজ্যের মেয়ে শান্তি—ষোল-সতেরো বছরের কুমারী—তার মায়ের বয়সী মন্টুর মায়ের সম্বন্ধে অমনি বলে বসল—ওঃ, সে কথা আর বোলো না খুড়িমা, কী ব্যাপক মেয়েমানুষ ওই মন্টুর মা। ঢের ঢের মেয়েমানুষ দেখিচি, অমন লঙ্কাপোড়া ব্যাপক যদি কোথাও দেখে থাকি, ক্ষুরে নমস্কার, বাবা বাবা!

ছোট মেয়ের ওই জ্যাঠামি কথার জন্য তাকে কেউ বকলে না বা শাসন করলে না, বরং কথাটা সকলেই উপভোগ করলে।

তারপর কথাটার স্রোত আরো কত দূর গড়াত বলা যায় না, এমন সময় রায়-বাড়ির বড়বৌ হঠাৎ মনে-পড়ার ভঙ্গিতে বললেন—হাঁ, একটা মজার কথা শোনোনি বুঝি। শ্রীপতি যে বিয়ে করেছে, বটঠাকুরের কাছে চিঠি এসেচে, শ্রীপতির মামা লিখেচে।

সকলে সমস্বরে বলে উঠল—শ্রীপতি বিয়ে করেচে!

তারপর সকলেই একসঙ্গে নানারূপ প্রশ্ন করতে লাগল :

—কোথায়, কোথায়?

—কবে চিঠি এলো?

—তবে যে শুনলাম শ্রীপতি বিয়ে করবে না বলেচে।

শ্রীপতির বিয়ের খবরে অনেকেই যেন একটু দমে গেল। খবরটা তেমন শুভ নয়। কারো উন্নতির সংবাদ এদের পক্ষে আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করা অসম্ভব। তাদের যখন উন্নতি হলো না, তখন অপরের উন্নতি হবে কেন? কিন্তু এরপরেই যখন রায়-বৌ মুখ টিপে হেসে আস্তে আস্তে বললেন—বৌটি নাকি বামুনের মেয়ে নয়—তখন সকলে খাড়া হয়ে সটান উঠে বসল, তাদের মরা-মরা ভাবটা এক মুহূর্তে গেল কেটে। একটা বেশ সরস ও মুখরোচক পরনিন্দা আর ঘোঁটের আভাস ওরা পেলে, রায়-বৌয়ের চাপা ঠোঁটের হাসি থেকে।

শান্তি উৎসুক চোখে চেয়ে হাসিমুখে বললে—ভেতরে তাহলে অনেকখানি কথা আছে!

বোস-গিনি্ন বললেন—তাই বল! নইলে এমনি কোথাও কিছু নয় শ্রীপতি বিয়ে করলে, এ কি কখনো হয়। কি জাত মেয়েটার? হিঁদু তো?

অর্থাৎ তাহলে রগড়টা আরো জমে। রায়বৌ বললেন—হিঁদুই, মেয়েটা বদ্দি বামুন।

এদেশে বৈদ্যকে বলে থাকে ‘বদ্দি বামুন’—এ অঞ্চলের ত্রিসীমানায় বৈদ্যের বাস না থাকায় বৈদ্যজাতির সমাজতত্ত্ব সম্বন্ধে এদের ধারণা অত্যন্ত অস্পষ্ট। কারো বিশ্বাস ব্রাহ্মণের পরেই বৈদ্যের সামাজিক স্থান, তারা একপ্রকারের নিম্নবর্ণের ব্রাহ্মণ, তার চেয়ে নিচু নয়—আবার কারো বিশ্বাস তাদের স্থান সমাজের নিম্নতর ধাপের দিকে।

শান্তি বললে—বৌয়ের বয়েস কত?

ওঃ, তা অনেক। শুনচি চব্বিশ-পঁচিশ—

সকলে সমস্বরে আবার একটা বিস্ময়ের রোল তুললে। চব্বিশ-পঁচিশ বছর পর্যন্ত মেয়ে আইবুড়ো থাকে ঘরে! এ আবার কোথাকার ছোট জাত, রামোঃ। ছিঃ—

শান্তির মা বললেন—তাহলে মেয়ে আর নয়, মাগী বল! পাঁড় শসা—বাপ-মা বুঝি ঘরে বীজ রেখেছিল!

কে একজন মুখ টিপে হেসে বললেন—বিধবা না তো?

চক্কত্তি-গিন্নি বললেন—আগের পক্ষের ছেলেমেয়ে কিছু আছে নাকি মাগীর!

এ কথায় শান্তিই আগে মুখে আঁচল দিয়ে খিল্খিল্ করে হেসে উঠল—তারপরে বাকি সকলে তার সঙ্গে যোগ দিলে। হ্যাঁ, এটা একটা নতুন ও ভারি মজার খবর বটে, মেয়ে-গজালির কিছুদিনের মতো খোরাক সংগ্রহ হলো। আমচুরি কাঁটালচুরির গল্প একটু একঘেঁয়ে হয়ে পড়েছিল।

ঠিক পরের দিনই এক অপ্রত্যাশিত ব্যাপার ঘটল। শ্রীপতির মেজ ভাই উমাপতি গাঁয়ে এসে বাড়ির চাবি খুলে লোক লাগিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করতে লাগল। তার দাদা বৌদিদিকে নিয়ে শীগ্গির আসবে এবং কিছুদিন নাকি গাঁয়েই বাস করবে। বৌদিদি পাড়াগাঁ কখনো দেখেননি,—গ্রামে আসবার তাঁর খুব আগ্রহ। তার দাদাও কলকাতায় বদলি হবার চেষ্টা করছে।

মেয়ে মজলিসে সবাই তো অবাক। শ্রীপতি কোন্ মুখে অজাতের বউ নিয়ে গাঁয়ে এসে উঠবে। মানুষের একটা লজ্জা-শরমও তো থাকে, করেই ফেলেছিস না হয় একটা অকাজ। এসব কি খিরিস্টানি কাণ্ডকারখানা, কালে কালে হলো কী! আর সে ধিঙ্গি মাগীটারই বা কী ভরসা, ব্রাহ্মণদের মধ্যে ব্রাহ্মণপাড়ায় বিয়ের বউ সেজে সে কোন সাহসে আসবে।

শ্রীপতি অবিশ্যি বৌ নিয়ে পৈতৃক বাড়িতে আসার বিষয়ে এঁদের মত জিজ্ঞাসা করেনি। একদিন একখানা নৌকো এসে গ্রামের ঘাটে দুপুরের সময় লাগল এবং নৌকো থেকে নামল শ্রীপতি, তার নববিবাহিত বধূ, একটা ছোক্রা চাকর ও দুটি ট্রাঙ্ক ও একটা বড় বিছানার মোট, একটা ঝুড়ি-বোঝাই টুকিটাকি জিনিস। ঘাটে দু-একজন যারা অত বেলায় স্নান করছিল, তারা তখুনি পাড়ার মধ্যে গিয়ে খবরটা সবাইকে বললে। তখন কিন্তু কেউ এলো না, অত বেলায় এখন শ্রীপতিদের বাড়ি গেলে তাদের খেতে বলতে হয়। অসময়ে এখন এসে তারা রান্নাবান্না চড়িয়ে খাবে, সেটা প্রতিবেশী হয়ে হতে দেওয়া কর্তব্য নয়, সুতরাং সে ঝঞ্ঝাট ঘাড়ে করবার চেয়ে এখন না যাওয়াই বুদ্ধির কাজ।

কিন্তু রাসু চক্কতি আর প্রিয় মুখুজ্যের বাড়ির মেয়েরা অত সহজেই রেহাই পেলেন না। শ্রীপতি নিজে গিয়ে একেবারে অন্তঃপুরের মধ্যে ঢুকে বললে—ও পিসিমা, ও বৌদিদি, আপনারা আপনাদের বৌকে হাতে ধরে ঘরে না তুললে কে আর তুলবে? আসুন সবাই। বাধ্য হয়ে কাছাকাছির দু-তিন বাড়ির মেয়েরা শাঁক হাতে, জলের ঘটি হাতে নতুন বৌকে ঘরে তুলতে এলেন—খানিকটা চক্ষুলজ্জায়, খানিকটা কৌতূহলে। মজা দেখবার প্রবৃত্তি সকলের মধ্যেই আছে। ছোটবড় ছেলেমেয়েও এলো অনেকে, শান্তি এলো, কমলা এলো, সারদা এলো।

শ্রীপতিদের বাড়ির উঠোনে লিচুতলায় একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, দূর থেকে মেয়েটির ধপ্ধপে ফর্সা গায়ের রং ও পরনের দামি সিল্কের শাড়ি দেখে সকলে অবাক হয়ে গেল। সামনে এসে আরো বিস্মিত হবার কারণ ওদের ঘটল—মেয়েটির অনিন্দ্যসুন্দর মুখশ্রী দেখে। কী ডাগর ডাগর চোখ! কী সুকুমার লাবণ্য সারা অঙ্গে। সর্বোপরি মুখশ্রী—অমন ধরনের সুন্দর মুখ এসব পাড়াগাঁয়ে কেউ কখনো দেখেনি।

সকলে আশা করেছিল গিয়ে দেখবে কালো কালো একটা মোটা-মতো মাগী আধ-ঘোমটা দিয়ে উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্যাট্ প্যাট্ করে চেয়ে রয়েছে ওদের দিকে। কিন্তু তার পরিবর্তে দেখল, এক নম্রমুখী সুন্দরী তরুণী মূর্তি...। মুখখানি এত সুকুমার যে, মনে হয় ষোল-সতেরো বছরের বালিকা।

বিকেলে ওপাড়ার নিতাই মুখুজ্যের বৌ ঘাটের পথে চক্কত্তি-গিনি্নকে জিজ্ঞেস করলেন—কী দিদি, শ্রীপতির বৌ দেখলে নাকি? কেমন দেখতে?

চক্কত্তি-গিন্নি বললেন—না, দেখতে বেশ ভালোই—

চক্কত্তি-গিন্নির সঙ্গে শান্তি ছিল, সে হাজার হোক ছেলেমানুষ, ভালো লাগলে পরের প্রশংসার বেলায় সে এখনো কার্পণ্য করতে শেখেনি, সে উচ্ছ্বসিত সুরে বলে উঠলে—চমৎকার, খুড়িমা, একবার গিয়ে দেখে আসবেন, সত্যিই অদ্ভুত ধরনের ভালো।

নিতাই মুখুজ্যের বৌ পরের এতখানি প্রশংসা শুনতে অভ্যস্ত ছিলেন না—বুঝতে পারলেন না শান্তি কথাটা ব্যঙ্গের সুরে বলছে, না সত্যিই বলছে। বললেন—কী রকম ভালো?

এবার চক্কত্তি-গিনি্ন নিজেই বললেন—না, বৌ যা ভেবেছিলাম তা নয়। বৌটি সত্যিই দেখতে ভালো। আর কেনই বা হবে না বলো শহরের মেয়ে, দিনরাত সাবান ঘষছে, পাউডার ঘষছে, তোমার-আমার মতো রাঁধতে হতো, বাসন মাজতে হতো, তো দেখতাম চেহারার কত জলুস বজায় রাখে।

এই বয়সে তো দূরের কথা, তাঁর বিগত যৌবন দিনেও অজস্র পাউডার সাবান ঘষলেও যে কখনো তিনি শ্রীপতির বৌয়ের পায়ের নখের কাছে দাঁড়াতে পারতেন না—চক্কত্তি-গিন্নির সম্বন্ধে শান্তির একথা মনে হলো। কিন্তু চুপ করে রইল সে।

বিকেলে এ-পাড়ার ও-পাড়ার মেয়েরা দলে দলে বৌ দেখতে এলো। অনেকেই বললে, এমন রূপসী মেয়ে তারা কখনো দেখেনি। কেবল হরিচরণ রায়ের স্ত্রী বললেন—আর বছর তারকেশ্বরে যাবার সময় ব্যান্ডেল স্টেশনে তিনি একটি বৌ দেখেছিলেন, সেটি এর চেয়েও রূপসী।

মেয়ে-মজলিসে পরদিন আলোচনার একমাত্র বিষয় দাঁড়াল শ্রীপতির বউ। দেখা গেল তার রূপ সম্বন্ধে দু-মত নেই সভ্যদের মধ্যে, কিন্তু তার চরিত্র সম্বন্ধে নানারকম মন্তব্য অবাধে চলেছে।

—ধরন-ধারণ যেন কেমন-কেমন—অত সাজগোজ কেন রে বাপু?

—ভালো ঘরের মেয়ে নয়। দেখলেই বোঝা যায়—

—বাসন মাজতে হলে ও-হাত আর বেশিদিন অত সাদাও থাকবে না, নরমও থাকবে না।

—ঠ্যালা বুঝবেন পাড়াগাঁয়ের। গলায় নেক্লেস ঝুলুতে আমরাও জানি—

—বেশ একটু ঠ্যাকারে। পাড়াগাঁয়ে মাটিতে যেন গুমরে পা পড়ছে না, এমনি ভাব। বামুনের ঘরে বিয়ে হয়ে ভাবছে যেন কী—

—তা তো হবেই, বদ্দি বামুনের মেয়ে, বামুনের ঘরে এসেছে, ওর সাত-পুরুষের সৌভাগ্যি না?

নববধূর স্বপক্ষে বললে কেবল শান্তি ও কমলা। শান্তি ঝাঁজের সঙ্গে বললে—তোমরা কারো ভালো দেখতে পার না বাপু! কেন ওসব বলবে একজন ভদ্দর ঘরের মেয়ের সম্বন্ধে? কাল বিকেলে আমি গিয়ে কতক্ষণ ছিলাম নতুন বৌয়ের কাছে। কোনো ঠ্যাকার নেই, অহংকার নেই, চমৎকার মেয়ে!

কমলা বললে—আমাদের উঠতে দেয় না কিছুতেই—কত গল্প করলে, খাবার খেতে দিলে, চা করলে—আর, খুব সাজগোজ কি করে? সাদাসিধে শাড়ি সেমিজ পরে তো ছিল। তবু খুব ফর্সা কাপড়চোপড়—ময়লা একেবারে দুচোখে দেখতে পারে না—

শান্তি বললে—ঘরগুলো এরই মধ্যে কী চমৎকার সাজিয়েছে! আয়না, পিক্চার, দোপাটি ফুলের তোড়া বেঁধে ফুলদানিতে রেখে দিয়েছে—শ্রীপতিদার বাপের জন্মে কখনো অমন সাজানো ঘরদোরে বাস করেনি—ভারি ফিটফাট গোছালো বৌটি—

দিন দুই পরে ডোবার ঘাটে নববধূকে একরাশ বাসন নিয়ে নামতে দেখে সকলে অবাক হয়ে গেল। চারদিকে বনে ঘেরা ঝুপসি আধ-অন্ধকার ডোবাটা যেন মেয়েটির স্নিগ্ধ রূপের প্রভায় এক মুহূর্তে আলো হয়ে উঠল, একথা যারা তখন ডোবার অন্যান্য ঘাটে ছিল, সবাই মনে মনে স্বীকার করলে। দৃশ্যটাও যেন অভিনব ঠেকলে সকলের কাছে, এমন একটা পচা এঁদো জঙ্গলে ভরা পাড়াগেঁয়ে ডোবার ঘাটে সাধারণত কালো কালো, আধ-ময়লা শাড়িপরা শ্রীহীনা ঝি-বৌ বা ত্রিকালোত্তীর্ণ প্রৌঢ়া বিধবাদের গামছা-পরিহিতা মূর্তিই দেখা যায়, বা দেখার আশা করা যায়—সেখানে এমন একটি আধুনিক ছাঁদে খোঁপা বাঁধা, ফর্সা শাড়ি ব্লাউজ-পরা, রূপকথার রাজকুমারীর মতো রূপসী, নব-যৌবনা বধূ সজনেতলার ঘাটে বসে ছাই দিয়ে নিটোল সুগৌর হাতে বাসন মাজছে, এ দৃশ্যটা খাপ খায় না। সকলের কাছেই এটা খাপছাড়া বলে মন হলো। প্রৌঢ়ারাও ভেবে দেখলে গত বিশ-ত্রিশ বছরের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটেনি এই ক্ষুদ্র ডোবার ইতিহাসে।

রায়পাড়ার একটি প্রৌঢ়া বললেন—আ-হা, বৌ তো নয়, যেন পিরতিমে—কিন্তু অত রূপ নিয়ে কি এই ডোবায় নামে বাসন মাজতে! না ও হাতে কখনোই ছাই দিয়ে বাসন মাজা অভ্যেস আছে! হাত দেখেই বুঝেছি।

তার পর থেকে দেখা গেল ঘর-সংসারের যা কিছু কাজ শ্রীপতির বৌ সব নিজের হাতে করছে।

ইতিমধ্যে শ্রীপতির কলকাতায় বদলি হবার খবর আসতে সে চলে গেল বাড়ি থেকে। পাড়ার মেয়েদের মধ্যে শান্তি ও কমলা শ্রীপতির বৌয়ের বড় ন্যাওটা হয়ে পড়ল। সকাল নেই বিকেল নেই, সব সময়েই দেখা যায় শান্তি ও কমলা বসে আছে ওখানে।

পাড়াগাঁয়ের গরিব ঘরের মেয়ে, অমন আদর করে কেউ কখনো রোজ রোজ ওদের লুচি-হালুয়া খেতে দেয়নি।

একদিন কমলা বলে—বৌদিদি, তোমার ঘরে কাপড়-মোড়া ওটা কী?

শ্রীপতির বৌ বলল, ওটা এসরাজ।

—বাজাতে জানো বৌদি?

—একটুখানি অমনি জানি ভাই, কিন্তু এ্যাদ্দিন ওকে বার পর্যন্ত করিনি। কেন জানো গাঁয়েঘরে কে কী হয়তো মনে করবে।

শান্তি বলল, নিজের বাড়ি বসে বাজাবে, কে কী মনে করবে? একটু বাজিয়ে শোনাও না, বৌদি!

একটু পরে রায়-গিন্নি ঘাটে যাবার পথে শুনতে পেলেন বাড়ির মধ্যে কে বেহালা না কী বাজাচ্ছে, চমৎকার মিষ্টি। কোনো ভিখিরি গান গাচ্ছে বুঝি? দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ শুনে তিনি ঘাটে চলে গেলেন।

ঘাটে গিয়ে তিনি মজুমদার-বৌকে বললেন কথাটা।

ওই শ্রীপতির বাড়ি কে একজন বোষ্টম বেহালা বাজাচ্ছে শুনে এলাম। কী চমৎকার বাজাচ্ছে দিদি, দুদণ্ড দাঁড়িয়ে শুনতে ইচ্ছে করে।

দুপুরের মেয়ে-মজলিশে শান্তির মা বললেন—শ্রীপতির বৌ চমৎকার বাজাতে পারে, এসরাজ না কী বলে, এ রকম বেহালার মতো। শান্তিদের ওবেলা শুনিয়েছিল—

রায়-বৌ বললেন, ও! তাই ওবেলা নাইতে যাবার সময় শুনলাম বটে। সে যে ভারি চমৎকার বাজনা গো, আমি বলি বুঝি কোনো ফকির বোষ্টম ভিক্ষে করতে এসে বাজাচ্ছে।

এমন সময় শান্তি আসতেই তার মা বললেন, ওই জিজ্ঞেস কর না শান্তিকে।

শান্তি বলল, উঃ, সে আর তোমায় কী বলব খুড়িমা, বৌদিদি যা বাজাল, অমন কখনো শুনিনি—শুনবে তোমরা? তাহলে এখন বলি বাজাতে—বললেই বাজাবে।

শান্তি শ্রীপতিদের বাড়ি চলে যাবার অল্প পরেই শোনা গেল শ্রীপতির বৌয়ের এসরাজ বাজনা। অনেকক্ষণ কারো মুখে কথা রইল না।

চক্কত্তি-গিন্নি বললেন, আহা, বড় চমৎকার বাজায় তো!

সকলেই স্বীকার করল শ্রীপতির বৌকে আগে যা ভাবা গিয়েছিল, সে-রকম নয়, বেশ মেয়েটি।

এসরাজ বাজনার মধ্য দিয়ে পাড়ার সকলের সঙ্গে শ্রীপতির বৌয়ের সহজভাবে আলাপ পরিচয় জমে উঠল। দুপুরে, সন্ধ্যায় প্রায়ই সবাই যায় শ্রীপতিদের বাড়ি বাজনা শুনতে।

তারপর গান শুনল সবাই একদিন। পূর্ণিমার রাত্রে জ্যোৎস্নাভরা ভেতর-বাড়ির রোয়াকে বসে বৌ এসরাজ বাজাচ্ছিল, পাড়ার সব মেয়েই এসে জুটেছে। শ্রীপতি বাড়ি নেই।

কমলা বলল, আজ বৌদি একটা গান গাইতেই হবে—তুমি গাইতেও জানো ঠিক—শোনাও আজকে।

বৌদি হেসে বলল, কে বলেছে ঠাকুরঝি আমি গাইতে জানি?

—না, ওসব রাখো—গাও একটা।

সকলেই অনুরোধ করল। বলল, গাও বৌমা, এ পাড়ায় মানুষ নেই, আস্তে আস্তে গাও, কেউ শুনবে না।

শ্রীপতির বৌ একখানা মীরার ভজন গাইল।

রাণাজি, ম্যায় গিরধর কে ঘর যাঁহু
গিরধর মেরা সাচো প্রিতম্ দেখত রূপ লুভাঁউ।

গায়িকার চোখে-মুখে কী ভক্তিপূর্ণ তন্ময়তার শোভা ফুটে উঠল গানখানা গাইতে গাইতে—শান্তি একটা গন্ধরাজ আর টগরের মালা গেঁথে এনেছিল বৌদিদিকে পরাবে বলে—গান গাইবার সময়ে সে আবার সেটা বৌয়ের গলায় আলগোছে পরিয়ে দিল—সেই জ্যোৎস্নায় সাদা সুগন্ধি ফুলের মালা গলায় রূপসী বৌয়ের মুখে ভজন শুনতে শুনতে মন্টুর মায়ের মনে হলো এই মেয়েটিই সেই মীরাবাই, অনেককাল পরে পৃথিবীতে আবার নেমে এসেছে, আবার সবাইকে ভক্তির গান গেয়ে শোনাচ্ছে।

মন্টুর মা একটু বাইরের খবর রাখতেন, যাত্রায় একবার মীরাবাই পালা দেখেছিলেন তার বাপের বাড়ির দেশে।

তারপর আর একখানা হিন্দিগান গাইল বৌ, এঁরা অবিশ্যি কিছু বুঝলেন না। তবে তন্ময় হয়ে শুনলেন বটে।

তারপর একখানা বেহাগ। বাংলা গান এবার। সকলে শুয়ে পড়ল। শান্তির চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। অনেকে দেখল বৌয়েরও চোখ দিয়ে জল পড়ছে গান গাইতে গাইতে—রূপসী গায়িকা একেবারে যেন বাহ্যজ্ঞান ভুলে গিয়েছে গানে তন্ময় হয়ে।

সেদিন থেকেই সকলে শ্রীপতির বৌকে অন্য চোখে দেখতে লাগল।

ওর সম্বন্ধে ক্রমে উচ্চ ধারণা করতে সকলে বাধ্য হলো আরো নানা ঘটনায়। পাড়াগাঁয়ে সকলেই বেশ হুঁশিয়ার, এ কথা আগেই বলেছি। ধার দিয়ে—সে যদি এক খুঁচি চাল কি দু পলা তেলও হয়—তার জন্যে দশবার তাগাদা করতে এদের বাধে না। কিন্তু দেখা গেল শ্রীপতির বৌ সম্পূর্ণ দিলদরিয়া মেজাজের মেয়ে। দেবার বেলায় সে কখনো না বলে কাউকে ফেরায় না, যদি জিনিসটা তার কাছে থাকে। একেবারে মুক্তহস্ত সে বিষয়ে—কিন্তু আদায় জানে না, তাগাদা করতে জানে না, মুখে তার রাগ নেই, বিরক্তি নেই, হাসিমুখ ছাড়া তার কেউ কখনো দেখেনি।

শ্রীপতির বৌয়ের আপন-পর জ্ঞান নেই, এটাও সবাই দেখল। পাশের বাড়িতে চক্কত্তি-গিন্নি বিধবা, একাদশীর দিন দুপুরে তিনি নিজের ঘরে মাদুর পেতে শুয়ে আছেন, শ্রীপতির বৌ এক বাটি তেল নিয়ে এসে তাঁর পায়ে মালিশ করতে বসে গেল। যেন ও তাঁর নিজের ছেলের বৌ।

চক্কত্তি-গিন্নি একটু অবাক হলেন প্রথমটা। পাড়াগাঁয়ে এ রকম কেউ করে না, নিজের ছেলের বৌয়েই করে না তো অপরের বৌ।

—এসো, এসো মা আমার এসো। থাক থাক, তেল মালিশ আবার কেন মা? তোমায় ওসব করতে হবে না, পাগলি মেয়ে—

এই পাগলি মেয়েটি কিন্তু শুনল না। সে জোর করেই বসে গেল তেল মালিশ করতে। মাথার চুল এসে অগোছালোভাবে উড়ে এসেছে মুখে, সুগৌর মুখে অতিরিক্ত গরমে ও শ্রমে কিছু কিছু ঘাম দেখা দিয়েছে—চক্কত্তি-গিন্নি এই সুন্দরী বৌটির মুখ থেকে চোখ যেন অন্যদিকে ফেরাতে পারলেন না। বড় স্নেহ হলো এই আপন-পর জ্ঞানহারা মেয়েটার ওপর।

ইতিমধ্যে কমলার বিয়ে হয়ে গেল। শ্বশুরবাড়ি যাবার সময়ে সে শ্রীপতির বৌয়ের গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলল, বৌদিদি, তোমায় কী করে ছেড়ে থাকব, ভাই? মাকে ছেড়ে যেতে কত কষ্ট না হচ্ছে, তত হচ্ছে তোমায় ছেড়ে যেতে।...এই এক ব্যাপার থেকেই বোঝা যাবে শ্রীপতির বৌ এই অল্প কয়েক মাসের মধ্যে গ্রামের তরুণ মনের কী রকম প্রভাব বিস্তার করেছিল।

পূজার সময় এসে পড়েছে। আশ্বিনের প্রথম, শরতের নীল আকাশে অনেক দিন পরে সোনালি রোদের মেলা, বনশিমের ফুল ফুটেছে ঝোপে ঝোপে, নদীর চরে কাশফুলের শোভা। পাশের গ্রাম সত্রাজিৎপুরে বাঁড়ুজ্যে-বাড়ি পুজো হয় প্রতিবছর, এবারও শোনা যাচ্ছে মহানবমীর দিন তাদের বাড়ি আর বছরের মতো যাত্রা হবে কাঁচড়াপাড়ার দলের।

শ্রীপতির বৌ গান-পাগলা মেয়ে, এ কথাটা এত দিনে এ গাঁয়ের সবাই জেনেছে। তার দিন নেই, রাত নেই, গান লেগে আছে, দুপুরে রাত্রে রোজ এসরাজ বাজায়। গান সম্বন্ধে কথা সর্বদা তার মুখে। শান্তির এখনো বিয়ে হয়নি; যদিও সে কমলার বয়সী। সে শ্রীপতির বৌয়ের কাছে আজকাল দিনরাত লেগে থাকে গান শেখবার জন্যে।

একদিন শ্রীপতির বৌ তাকে বলল, ভাই শান্তি, এক কাজ করবি, সত্রাজিৎপুরে তো যাত্রা হবে বলে সবাই নেচেছে। আমাদের পাড়ার মেয়েরা তো আর দেখতে পাবে না? তারা কি আর অপর গাঁয়ে যাবে যাত্রা শুনতে? অথচ এরা কখনো কিছু শোনে না—আহা! এদের জন্যে যদি আমরা আমাদের পাড়াতেই থিয়েটার করি?

শান্তি তো অবাক। থিয়েটার? তাদের এই গাঁয়ে? থিয়েটার জিনিসটার নাম শুনেছে বটে সে, কিন্তু কখনো দেখেনি। বলল, কী করে করবে, বৌদি কী যে তুমি বলো। তুমি একটা পাগল।

শ্রীপতির বৌ হেসে বলল, সেসব বন্দোবস্ত আমি করব এখন। তোকে ভেবে মরতে হবে না—দ্যাখ না কী করি।

সপ্তাহখানেক পর শ্রীপতি যেমন শনিবারের দিন বাড়ি আসে তেমনি এলো। সঙ্গে তিনটি বড় মেয়ে ও দুটি ছোট মেয়ে ও চার-পাঁচটি ছেলে। বড় মেয়ে তিনটির ষোলো-সতেরো এমনি বয়স, সকলেই ভারি সুন্দরী, ছোট মেয়ে দুটির মধ্যে যেটির বয়স তেরো, সেটি তত সুবিধে নয়, কিন্তু যেটির বয়স আন্দাজ দশ—তাকে দেখে রক্তমাংসের জীব বলে মনে হয় না, মনে হয় যেন মোমের পুতুল। ছেলেদের বয়স পনেরোর বেশি নয় কারো। সকলেই সুবেশ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।

শান্তি, শান্তির মা এবং চক্কত্তি-গিন্নি তখন সেখানেই উপস্থিত ছিলেন। শ্রীপতির বৌ ওদের দেখে ছুটে গেল রোয়াক থেকে উঠোনে নেমে। উচ্ছ্বসিত আনন্দের সুরে বলল, এই যে রমা, পিন্টু, তারা, এই যে শিব, আয় আয় সব কেমন আছিস? ওঃ কত দিন দেখিনি তোদের—

রমা বলে ষোলো-সতেরো বছরের সুন্দরী মেয়েটি ওর গলা জড়িয়ে ধরল, সকলেই ওকে প্রণাম করে পায়ের ধুলো নিল।

—দিদি কেমন আছিস, ভাই—

—একটু রোগা হয়ে গেছিস দিদি—

—ওঃ, কত দিন যে তোকে দেখিনি—

—দাদাবাবু যখন বললেন তোর এখানে আসতে হবে, আমরা তো—

—আহিরীটোলাতে মিউজিক কম্পিটিশন ছিল—নাম দিয়েছিলাম—ছেড়ে চলে এলাম—

মেয়েগুলোর মুখ, রং, গড়ন শ্রীপতির বৌয়ের মতো। রমা তো একেবারে হুবহু ওর মতো দেখতে, কেবল যা কিছু বয়সের তফাত। জানা গেল মেয়ে দুটির মধ্যে রমা ও তার ছোট সতী, এবং ছেলেমেয়েদের মধ্যে বারো বছরের ফুটফুটে ছেলে শিবু শ্রীপতির বৌয়ের আপন ভাইবোন, বাকি সবই কেউ খুড়তুতো, কেউ জ্যাঠাতুতো ভাইবোন।

ক্রমে আরো জানা গেল শ্রীপতির বৌ এদের চিঠি লিখিয়ে আনিয়েছে থিয়েটার করানোর জন্যে।

পাড়ার সবাই এদের রূপ দেখে অবাক। এসব পাড়াগাঁয়ে অমন চেহারার ছেলেমেয়ে কেউ কল্পনাই করতে পারে না। দশ বছরের সেই ছেলেটির নাম পিন্টু, সে শান্তির বড় ন্যাওটা হয়ে গেল। সে আবার একটা সাঁতার দেবার নীল রঙের পোশাক এনেছে, সিক্ত নীল পোশাক সুগৌর দেহে যখন সে নদীর ঘাটে স্নান করে উঠে দাঁড়ায়—তখন ঘাটসুদ্ধ মেয়েরা, বোস-গিন্নি, মন্টুর মা, শান্তির মা, মজুমদার-গিন্নি ওর দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকেন। রূপ আছে বটে ছেলেটির! শান্তি দস্তুর মতো গর্ব অনুভব করে, যখন পিন্টু অনুযোগ করে বলে, আঃ শান্তিদি, আসুন না উঠে, ভিজে কাপড়ে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকব? আসুন বাড়ি যাই।

পূজা এসে পড়ল। এ-গাঁয়ে কোনো উৎসব নেই পূজার, গরিবদের গাঁয়ে পূজা কে করবে? দূর থেকে সত্রাজিৎপুরের বাঁড়ুজ্যে-বাড়ির ঢাক শুনেই গাঁয়ের মেয়েরা সন্তুষ্ট হয়। ভিনগাঁয়ে গিয়ে মেয়েদের পূজা দেখবার রীতি না থাকায় অনেকে দশ-পনেরো কি বিশ বছর দুর্গাপ্রতিমা পর্যন্ত দেখেনি। মেয়েদের জীবনে কোনো উৎসব-আমোদ নেই এ গাঁয়ে।

শ্রীপতির বৌ তাই একদিন শান্তিকে বলেছিল, সত্যি কী করে যে তোরা থাকিস ঠাকুরঝি—একটু গান নেই, বাজনা নেই, বই পড়া নেই, মানুষ যে কেমন করে থাকে এমন করে।

বোধ হয় সেই জন্যেই এত উৎসাহের সঙ্গে ও লেগেছিল থিয়েটারের ব্যাপারে।

শ্রীপতিদের বাড়ির লম্বা বারান্দায় একধাপে তক্তপোশ পেতে দড়ি টাঙিয়ে হলদে শাড়ি ঝুলিয়ে স্টেজ করা হয়েছে।

শ্রীপতির বৌ ভাইবোনদের নিয়ে সকাল থেকে খাটছে।

শান্তি বলল, তুমি এত জানলে কী করে, বৌদি।

রমা বলল, তুমি জানো না দিদিকে শান্তিদিদি। দিদি অল বেঙ্গল মিউজিক কম্পিটিশনে—

শ্রীপতির বৌ ধমক দিয়ে বোনকে থামিয়ে দিয়ে বলল, নে, নে—যা, অনেক কাজ বাকি, এখন তোর অত বক্তৃতা করতে হবে না দাঁড়িয়ে—

রমা না থেমে বলল, আর খুব ভালো পার্ট করার জন্যেও সোনার মেডেল পেয়েছে...।

যতবার পয়লা বোশেখের দিন আমাদের বাড়িতে থিয়েটার হয়, দিদিই তো তার পাণ্ডা—জানো আমাদের কি নাম দিয়েছেন জ্যাঠামশায়?

শ্রীপতির বৌ বলল, আবার?

রমা হেসে থেমে গেল।

মহাষ্টমীর দিন আজ। শুধু মেয়েদের আর ছোট ছোট ছেলেদের নিয়ে থিয়েটার দেখবে। শুধু মেয়েরাই—সমস্ত পাড়া কুড়িয়ে সব মেয়ে এসে জুটেছে থিয়েটার দেখতে।

ছোট্ট নাটকটি। শ্রীপতির বৌয়ের জ্যাঠামশায়ের নাকি লেখা। রাজকুমারকে ভালোবেসেছিল তাঁরই প্রাসাদের একজন পরিচারিকার মেয়ে। ছেলেবেলায় দুজনে খেলা করেছে। বড় হয়ে দিগ্বিজয়ে বেরুলেন রাজপুত্র, অন্য দেশের রাজকুমারী ভদ্রাকে বিবাহ করে ফিরলেন। পরিচারিকার মেয়ে অনুরাধা তখন নব-যৌবনা কিশোরী, বিকশিত মলি্লকা-পুষ্পের মতো শুভ্র, পবিত্র। খুব ভালো নাচতে-গাইতে শিখেছিল সে ইতিমধ্যে। রাজধানীর সবাই তাকে চেনে, জানে—নৃত্যের অমন রূপ দিতে কেউ পারে না। এদিকে ভদ্রাকে রাজ্যে এনে রাজকুমার এক উৎসব করলেন। সে সভায় অনুরাধাকে নাচতে-গাইতে হলো রাজপুত্রের সামনে ভাড়া করা নর্তকী হিসেবে। তার বুক ফেটে যাচ্ছে, অথচ সে একটা কথাও বলল না, নৃত্যের মধ্য দিয়ে সংগীতের মধ্য দিয়ে জীবনের ব্যর্থ প্রেমের বেদনা সে নিবেদন করল প্রিয়ের উদ্দেশে। এর পরে কাউকে কিছু না বলে দেশ ছেড়ে পরদিন একা একা কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।

শ্রীপতির বৌ অনুরাধা, রমা ভদ্রা। ওর অন্য সব ভাই-বোনও অভিনয় করল। শ্রীপতির বৌ বেশভূষায়, রূপে, গলে দোদুল্যমান জুঁইফুলের মালায় যেন প্রাচীন যুগের রূপকথার রাজকুমারী, রমাও তাই, গানে গানে অনুরাধা তো স্টেজ ভরিয়ে দিল, আর কী অপূর্ব নৃত্যভঙ্গি! সতী, রমা, পিন্টুও কি চমৎকার অভিনয় করল, আর কী চমৎকার মানিয়েছে ওদের!

তারপর বহুকাল পরে পথের ধারে মুমূর্ষু অনুরাধার সঙ্গে রাজপুত্রের দেখা। সে বড় মর্মস্পর্শী করুণ দৃশ্য! অনুরাধার গানের করুণ সুরপুঞ্জে ঘরের বাতাস ভরে গেল। চারদিকে শুধু শোনা যাচ্ছিল কান্নার শব্দ, শান্তি তো ফুলে ফুলে কেঁদে সারা।

অভিনয় শেষ হলো, তখন রাত প্রায় এগারোটা। গ্রামের মেয়েরা কেউ বাড়ি চলে গেল না। তারা শ্রীপতির বৌকে ও রমাকে অভিনয়ের পর আবার দেখতে চায়। শ্রীপতির বৌ ও তার ভাইবোনদের রান্নাঘরে নিয়ে গিয়ে চক্কত্তি-গিন্নি, শান্তির মা ও মন্টুর মা খেতে বসিয়ে দিলেন আর ওদের চারিধার দিয়ে পাড়ার যত মেয়ে।

ও পাড়ার রাম গাঙ্গুলীর বৌ বললেন, বৌমা যে আমাদের এমন তা তো জানিনে! ওমা এমন জীবন তো কখনো দেখিনি—

মন্টুর মা বললেন, আর ভাইবোনগুলোও কি সব হিরের টুকরো! যেমন সব চেহারা তেমনি গান—

শান্তি তো তার বৌদিদির পিছু পিছু ঘুরছে, তার চোখ থেকে অভিনয়ের ঘোর এখনো কাটেনি, সেই জুঁইফুলের মালাটি বৌদির গলা থেকে সে এখনো খুলতে দেয়নি। ওর দিক থেকে অন্যদিকে সে চোখ ফেরাতে পারছে না যেন।

চক্কত্তি-গিন্নি বললেন, আর কী গলা আমাদের বৌমার আর রমার। পিন্টু অতটুকু ছেলে, কী চমৎকার করল।...

শান্তির মা বললেন, পিন্টু খাচ্ছে না, দেখ সেজ বৌ। আর একটু দুধ দি, কটা মেখে নাও বাবা, চেঁচিয়ে তো খিদে পেয়ে গিয়েছে।...কী চমৎকার মানিয়েছিল পিন্টুকে, না সেজ বৌ?

—একে ফুটফুটে সুন্দর ছেলে...

শ্রীপতির বৌ হাজার হোক ছেলেমানুষ, সকলের প্রশংসায় সে এমন খুশি হয়ে উঠল যে খাওয়াই হলো না তার। সলজ্জ হেসে বলল, জ্যাঠামশায় আমাদের বলেন কিন্নর দল—এখন ঐ নামে আমাদের—

রমা হেসে ঘাড় দুলিয়ে বলল, নিজে যে বললে দিদি, আমি বলতে যাচ্ছিলুম, আমায় তবে ধমক দিলে কেন তখন?

তারা বলল, নামটি বেশ, কিন্নর দল, না? আমাদের শ্যামবাজারের পাড়ায় কিন্নর দল বলতে সবাই চেনে—

রমা বলল, কৃত্রিম গর্বের সঙ্গে—প্রায় এক ডাকে চেনে—হুঁ হুঁ—

তারপর এই রূপবান বালক-বালিকার দল, সকলে একযোগে হঠাৎ খিলখিল করে মিষ্টি হাসি হেসে উঠল।

সতী হাসতে হাসতে বললে—বেশ নামটি, কিন্নর দল, না?

এমন একদল সুশ্রী চেহারার ছেলেমেয়ে, তার ওপর তাদের এমন অভিনয় করার ক্ষমতা, এমন গানের গলা, এমন হাসি-খুশি মিষ্টি স্বভাব, সকলেরই মন হরণ করবে তার আশ্চর্য কী?

মন্টুর মা ভাবলেন, কিন্নর দলই বটে।...

ওদের খেতে খেতে হাসি গল্প করতে মহাষ্টমীর নিশি ভোর হয়ে এলো!

শ্রীপতির বৌ বলল, আসুন, বাকি রাতটুকু আর সব বাড়ি যাবেন কেন? গল্প করে কাটানো যাক।

শ্রীপতি বাড়ি নেই, সে সত্রাজিৎপুরের বাঁড়ুজ্যে-বাড়ির নিমন্ত্রণে গিয়েছে, আজ রাত্রের যাত্রা দেখে সকালে ফিরবে। সেই জন্যে সকলে বলল, তা ভালো, কিন্তু বৌমা তোমাকে গান গাইতে হবে!

শান্তি বলল, বৌদি, অনুরাধার সেই গানটা গেও আরেকবার, আহা, চোখে জল রাখা যায় না শুনলে।

শ্রীপতির বৌ গাইল, রমা এসরাজ বাজাল। তারপর রমা ও তারা একসঙ্গে গাইল। একটিমাত্র তেড়ো-পাখি বাঁশগাছের মগডালে কোথায় ডাক আরম্ভ করেছে। রাত ফরসা হলো।

সে মহাষ্টমীর রাত্রি থেকে গ্রামের সবাই জানল শ্রীপতির বৌ কী ধরনের মেয়ে।

কেবল তারা জানল না যে শ্রীপতির বৌ-প্রতিভাশালিনী গায়িকা, সত্যিকার আর্টিস্ট। সে ভালোবেসে শ্রীপতিকে বিয়ে করে এই পাড়াগাঁয়ের বনবাস মাথায় করে নিয়ে, নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছেড়েছে, যশের আশা, অর্থের আশা, আর্টের চর্চা পর্যন্ত ত্যাগ করেছে। তবু গানের ঝোঁক ওকে ছাড়ে না—ভূতে পাওয়ার মতো পেয়ে বসে—দিনরাত তাই ওর মুখে গান লেগেই আছে, তাই আজ মহাষ্টমীর দিন সেই নেশার টানেই এই অভিনয়ের আয়োজন করেছে।

শান্তি কিছুতেই ছাড়তে চায় না ওকে। বলে, তুমি কোথাও যেও না, বৌদিদি, আমি মরে যাব, এখানে তিষ্ঠুতে পারব না। শান্তি আজকাল শ্রীপতির বৌয়ের কাছে গান শেখে, গলা মন্দ নয় এবং এদিকে খানিকটা গুণ থাকায় সে এরই মধ্যে বেশ শিখে ফেলেছে। কিছু কিছু বাজাতেও শিখেছে। গান-বাজনায় আজকাল তার ভারি উৎসাহ। শ্রীপতির বৌ গান-বাজনা যদি পেয়েছে, আর বড় একটা কিছু চায় না, শান্তির সংগীত শিক্ষা নিয়েই সে সব সময় মহাব্যস্ত।

অগ্রহায়ণ মাসের দিকে বৌয়ের বাড়ি থেকে চিঠি এলো রমা কী অসুখ হয়ে হঠাৎ মারা গিয়েছে। শ্রীপতি কলকাতা থেকে সংবাদটা নিয়ে এলো। শ্রীপতির বৌ খুব কান্নাকাটি করল। পাড়াসুদ্ধ সবাই চোখের জল ফেলল ওকে সান্ত্বনা দিতে এসে।

শান্তি সব সময় বৌদির কাছে কাছে থাকে আজকাল। তাকে একদিন শ্রীপতির বৌ বলল, জানিস শান্তি, আমাদের কিন্নর দল ভাঙতে শুরু করেছে, রমাকে দিয়ে আরম্ভ হয়েছে, আমার মন যেন বলছে...

শান্তির বুকের ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল, ধমক দিয়ে বলল, থাক ওসব কী যে বলো বৌদি!

কিন্তু শ্রীপতির বৌয়ের কথাই খাটল।

সে ঠিকই বলেছিল, শান্তি ঠাকুরঝি, কিন্নর দলে ভাঙন ধরেছে।

রমার পরে ফাল্গুন মাসের দিকে গেল পিন্টু বসন্ত রোগে। তার আগেই শ্রীপতির বৌ মাঘ মাসে বাপের বাড়ি গিয়েছিল, শ্রাবণ মাসের প্রথমে প্রসব করতে গিয়ে সেও গেল।

এ সংবাদ গ্রামে যখন এলো, শান্তি তখন সেখানে ছিল না, সেই বোশেখ মাসে তার বিবাহ হওয়াতে সে তখন ছিল মোটরি বাণপুরে, ওর শ্বশুরবাড়িতে। গ্রামের অন্য সবাই শুনল, অনাত্মীয়ের মৃত্যুতে খাঁটি অকৃত্রিম শোক এ রকম এর আগে কখনো এ গাঁয়ে করতে দেখা যায়নি। রায়-গিন্নি, চক্কতি-গিন্নি, শান্তির মা, মন্টুর মা কেঁদে ভাসিয়ে দিলেন। ঐ মেয়েটি কোথা থেকে দুদিনের জন্যে এসে তার গানের সুরের প্রভাবে সকলের অকরুণ, কুটিলভাবে পরিবর্তন এনে দিয়েছিল, সে পরিবর্তন যে কতখানি, ওই সময়ে গাঁয়ের মেয়েদের দেখলে বোঝা যেত। ওদের চক্কত্তি-বাড়ির দুপুরবেলায় আড্ডায়, স্নানের ঘাটে শ্রীপতির বৌয়ের কথা ছাড়া অন্য কথা ছিল না।

চক্কত্তি-গিন্নি পেয়েছিলেন সকলের চেয়ে বেশি। শ্রীপতির বৌয়ের কথা উঠলেই তিনি চোখের জল সামলাতে পারতেন না। বলতেন, দুদিনের জন্যে এসে মা আমায় কী মায়াই দেখিয়ে গেল! আমার পেটের মেয়ে অমন কক্ষনো করেনি...আহা! আমার পোড়া কপাল, সে কখনো এ কপালে টেকে!

মন্টুর মামা বলতেন, সে কি আর মানুষ! দেবী অংশে ওসব মেয়ে জন্মায়। নিজের মুখেই বলত হেসে হেসে, ‘আমরা কিন্নর দল খুড়িমা’, শাপভ্রষ্ট কিন্নরীই তো ছিল।...যেমন রূপ, তেমনি স্বভাব, তেমনি গান...ও কি আর মানুষ, মা!

কথা বলতে বলতে মন্টুর মায়ের চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ত।

এসবের মধ্যে কেবল কথা বলত না শান্তি। তার বিবাহিত জীবন খুব সুখের হয়নি, ভেবেছিল বাপের বাড়ি এসে বৌদিদির সঙ্গে অনেকখানি জ্বালা জুড়োবে। পূজার পরে কার্তিক মাসের প্রথমে বাপের বাড়ি এসে সব শুনেছিল। বৌদিদি যে তার জীবন থেকে কতখানি হরণ করে নিয়ে গিয়েছে, তা এরা কেউ জানে না। মুখে সেসব পাঁচজনের সামনে ভ্যাজ ভ্যাজ করে বলে লাভ কী? কী বুঝবে লোকে?

বছর দুই পরে একদিনের কথা। গাঁয়ের মধ্যে শ্রীপতির বৌয়ের কথা অনেকটা চাপা পড়ে গিয়েছে। শ্রীপতিও অনেকদিন পরে আবার গ্রামের বাড়িতে যাওয়া-আসা করছে শনিবারে কিংবা ছুটিছাঁটাতে।

শ্রীপতিদের বাড়ি থেকে শান্তিদের বাড়ি বেশি দূর নয়, দুখানা বাড়ির পরেই। শান্তি তখন এখানেই ছিল। অনেক রাত্রে সে শুনল শ্রীপতিদাদাদের বাড়িতে কে গান গাইছে। ঘুমের মধ্যে গানের সুর কানে যেতেই সে ধড়মড় করে বিছানার ওপর উঠে বসল—

বিরহিণী মীরা জাগে তব অনুরাগে, গিরিধর নাগর—

এ কার গলা? ওর গা শিউরে উঠল। ঘুমের ঘোর এক মুহূর্তে ছুটে গেল। কখনো সে ভুলবে জীবনে এ গান, এ গলা? সেই প্রথম পরিচয়ের দিনে ওদের রোয়াকে জ্যোৎস্না রাত্রে বসে এই গানখানা বৌদি প্রথম গেয়েছিল! সেই অপূর্ব করুণ সুর, গানের প্রতি মোচড়ে যেন একটি আকাঙ্ক্ষার প্রাণঢালা আত্মনিবেদন! এ কি আর কারো গলার—ওর কুমারী জীবনের আনন্দভরা দিনগুলোর কত অবসর প্রহর যে এ কণ্ঠের সুরে মধুময়!

ও পাগলের মতো ছুটে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়াল।

রাত অনেক। কৃষ্ণাতৃতীয়ার চাঁদ মাথার ওপর পৌঁছেছে। ফুটফুটে শরতের জ্যোৎস্নায় বাঁশবনের তলা পর্যন্ত আলো হয়ে উঠেছে।

ঠিক যেন তিন বছর আগেকার সেই মহাষ্টমীর রাত্রির মতো।

শান্তির মা ইতিমধ্যে জেগে উঠে বললেন, ও কে গান করছে রে শান্তি? তারপর তিনিও তাড়াতাড়ি বাইরে এলেন। শ্রীপতিদের বাড়ি তো কেউ থাকে না, গান গাইবে কে? ওদিকে মন্টুর মা, মণি, বাদল সবাই জেগেছে দেখা গেল।

প্রথমেই এরা সবাই ভয়ে বিস্ময়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। পরে ব্যাপারটা বোঝা গেল। শ্রীপতি কখন রাতের ট্রেনে বাড়ি এসেছিল, কেউ লক্ষ করেনি। সে কলের গান বাজাচ্ছে। ওদের সাড়া পেয়ে সে বাইরে এসে বলল, আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে আজ চেয়ে আনলুম ওর গানখানা। মরবার কমাস আগে রেকর্ডে গেয়েছিল।

সবাই খানিকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। শান্তি প্রথমে সে নীরবতা ভঙ্গ করে আস্তে আস্তে বলল, ছিরুদা, রেকর্ডখানা আর একবার দেবে?

পরক্ষণেই একটি অতি সুপরিচিত, পরম প্রিয়, সুললিত কণ্ঠের দরদ-ভরা সুরপুঞ্জে পাড়ার আকাশ-বাতাস, স্তব্ধ জ্যোৎস্না রাত্রিটা ছেয়ে গেল। মানুষের মনের কী ভুলই যে হয়! অল্পক্ষণের জন্যে শান্তির মনে হলো তার কুমারী জীবনের সুখের দিনগুলো আবার ফিরে এসেছে, যেন বৌদিদি মরেনি, কিন্নরের দল ভেঙে যায়নি, সব বজায় আছে। এই তো সামনে আসছে পূজা, আবার মহাষ্টমীতে তাদের থিয়েটার হবে, বৌদিদি গান গাইবে। গান থামিয়ে ওর দিকে চেয়ে হাসি হাসি মুখে বলবে, কেমন শান্তি ঠাকুরঝি, কেমন লাগল!