Saturday, March 2, 2019

নাসা স্পেস মিশন – যে কারণে এখনো মানবজাতির উপর বিশ্বাস আছে


আমরা পুরো মানবজাতি একে অন্যের উপর হতাশ। ধর্মপ্রাণরা বিধর্মীদের উপর হতাশ, বিধর্মীরা আবার সেই ধর্মপ্রাণ কিন্তু বিধর্মীদের (!) উপর হতাশ। ধর্মী-বিধর্মীরা আবার ধর্মবিহীনদের উপর মিলিতভাবে হতাশ। এইদিকে যারা “যার যার ধর্ম তার তার” নীতিতে বিশ্বাসী, তাদের মাঝেও হতাশা। সরকারি দল হতাশ বিরোধীদলকে নিয়ে, বিরোধীদল হতাশ সরকারি দলকে নিয়ে। অফিসের বস হতাশ তার কর্মচারী নিয়ে, কর্মচারী হতাশ বসকে নিয়ে। পুরুষেরা হতাশ নারীদের নিয়ে, নারীরা হতাশ পুরুষদের নিয়ে। এত কিছু দেখে ঈশ্বর এখন নিজেই পুরো মানবজাতির উপর হতাশ। আর ঈশ্বরের হতাশা দেখে যেসব স্বর্গীয় দূতেরা তাঁকে শুরুতেই মানবজাতি সৃষ্টি না করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন, তারা নিজেরা এখন আড়ালে চোখ টেপাটেপিতে আর কনুই গুঁতোগুঁতিতে ব্যস্ত।

কিন্তু গুটিকয় মানুষ আছে, যারা এখনো হতাশ নয়। এত হিংসা, বিদ্বেষ, কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি, ইট-পাটকেল মারামারি, অন্যের পরনের কাপড় টানাটানির মাঝেও তারা কোত্থেকে কোত্থেকে যেন আশার আলো খুঁজে পান! আমি নিজে হয়তো তাদের মত হয়ে উঠতে পারিনি, কিন্তু তবুও মাঝেমাঝে নিজেকে তাদের মত ভাবতে ভালো লাগে। অন্যেরা কোত্থেকে এসব আশা-ভরসা খুঁজে পায়, জানি না। কিন্তু সুঠাম ব্যক্তিদের শরীরের শক্তির উৎস যেমন ডানো দুধ (কারো কারো ক্ষেত্রে হয়তো কলিকাতা হারবাল), তেমনি আমার মনের সকল আশা-ভরসার উৎস হচ্ছে বিজ্ঞানচর্চা।

আমি সবসময় আমার চারপাশের মানুষজনকে জ্ঞানচর্চা ধরে রাখার ব্যাপারে উৎসাহ দিই। কিন্তু বহুবারই হতভম্ব হয়ে গেছি যখন তাদের অনেকে বলে, “তিরিশ বছরে যেটা শিখতে পারি নাই, সেটা এখন আর কীভাবে শিখবো?” এই কথার অর্থ অনেকটা এমন দাঁড়ায় – যে শিক্ষায় পকেটে দু’পয়সা বেশি আসে না, সেই শিক্ষার কোনো মানে নেই।

শিক্ষিত মানুষের মুখে এই ধরণের কথা শুনে আমার নিজেরও হতাশ হয়ে পড়তে ইচ্ছা করে। সত্যি কথা হলো, যারা জানে যে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমুদ্র কত ব্যাপক, তারাই পড়ার মত কিছু পেলে সেটা গোগ্রাসে গিলতে শুরু করে। আশেপাশের জগতে কী ঘটছে, সেটা নিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া দেখানোর তেমন সময় নেই। ভবলীলা যেকোনো মুহূর্তে সাঙ্গ হয়ে যাবার আগেই যতটুকু সম্ভব এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে জেনে যেতে হবে। আর প্রতিক্রিয়া দেখানোর সময়ও তারা কেমন যেন ইতস্তত করে। কারণ তাদের মনে সবসময়ই বাজে “আমি তো কিছুই জানি না, কিছুই শিখতে পারিনি; কী নিয়ে কথা বলবো?”

যাই হোক, কথা বলছিলাম পুরো মানবজাতির হতাশা আর গুটি কয়েকজনের মত আমার কিছু আশা-ভরসার ব্যাপার নিয়ে। আমি এখন আশা খুঁজে পাই মহাশূন্যে – ছায়াপথ, নীহারিকায়। মহাশূন্যের বিশাল শূন্যতা আমি বড়ই ভালোবাসি। সত্যি কথা হলো, শুধু আমি নই, সবাই-ই মহাশূন্যকে বড়ই ভালোবাসে। সারাদিন অনলাইনে, অফলাইনে, সাইডলাইনে একে অপরের পশ্চাতে বাঁশ ঢুকিয়ে এবং নিজের পশ্চাতে বাঁশ ঢুকানো ঠেকিয়ে, ক্লান্ত-বিধ্বস্ত হয়ে যখন রাতে ঘরে ফিরে অন্ধকার সেই বিশাল জগতের দিকে তাকাই, তখন মনে হয় এই পৃথিবীতে আসলে চাপাচাপিটা একটু বেশি হয়ে গেছে। সেই চাপাচাপিতে সব ভাব-ভালোবাসা দশ টনি ট্রাকের নিচে চাপা পড়ার মত পিষে থেঁতলে গেছে। কিছু মানুষ ঐসব ছায়াপথের কোনো এক গ্রহে পার্সেল করে দিতে পারলে মন্দ হতো না। তাহলে হয়তো সবাই একটু দম ফেলার জায়গা পেত। বিদ্বেষ, মারামারিও একটু কমতো।

সত্যি কথা হলো – আমার চিন্তাভাবনার চেয়ে খুব একটা ব্যতিক্রম নন নাসার বিজ্ঞানীরা। তবে তারা শুধু একটু দম ফেলার ফুরসতের জন্যেই ছায়াপথ হতে ছায়াপথে পৃথিবী সদৃশ গ্রহের খোঁজে ছুটে বেড়াচ্ছেন না। বরং তাদের এইসব স্পেস মিশনে আরো কিছু ব্যাপার আছে, যা আমাকে এখনও পুরো মানবজাতির উপর ভরসা হারিয়ে ফেলা থেকে বিরত রাখছে। যেমন-


বৃহস্পতির চাঁদ ইউরোপায় তরল পানির খোঁজ লাভ


মহাশূন্যে আমাদের পদচারণা শুরু করার পর থেকে আজ অবধি আমরা ইতিউতি তাকিয়ে একটা জিনিসই খুঁজে বেড়াচ্ছি। সেটা হচ্ছে ‘পানি’। প্রথমে চাঁদে খুঁজে দেখলাম, পেলাম না। এরপর দেখলাম মঙ্গলে, কিন্তু সেটাতেও ব্যর্থ। খুঁজতে খুঁজতে আমাদের তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি এখন সৌরজগত ছাড়িয়ে অন্য গ্যালাক্সিতেও গিয়ে পড়েছে, কিন্তু পানির কোনো হদিস নেই। পানির খোঁজে আমাদের যখন ‘হায় হাসান! হায় হোসেন!!’ দশা, ঠিক তখন ১৯৭৯ সালে ভয়েজার-২ বৃহস্পতির চাঁদ ইউরোপার একটা ছবি পাঠালো যেখানে বিশাল এক বরফে আচ্ছাদিত এলাকা দেখা যাচ্ছিলো। কিন্তু যেহেতু বৃহস্পতি সূর্য হতে অনেক বেশি দূরে অবস্থিত, তাই সবাই ধারণা করে নিলো, সেই পানি আর ব্যবহারযোগ্য অবস্থায় নেই, জমাট বেঁধে গেছে।

পরবর্তীতে যখন স্পাই ক্যামেরার দায়িত্ব পাওয়া হাবল টেলিস্কোপ মহাবিশ্বের অলি-গলি, কানাগলি সব জায়গায় ফুচকি মেরে বেড়াচ্ছিলো, তখন ২০১৩ সালে তার ক্যামেরায় ইউরোপা উপগ্রহের একটা আজব জিনিস ধরা পড়লো। সেখানে স্পষ্ট দেখা গেলো, ইউরোপার মেরুতে বরফের মাঝ দিয়ে ঝর্ণা বয়ে চলার মত কিছু একটা দেখা যাচ্ছে! তখন বিজ্ঞানীরা উপলব্ধি করলেন, বরফের সেই এলাকায় শুধু উপরিতলেই বরফের আচ্ছাদন রয়েছে। কিন্তু এর নিচে আসলে রয়েছে তরল পানির এক মহাসমুদ্র! ইউরোপার কেন্দ্র আসলে যতটা শীতল মনে করা হয়েছিলো, ঠিক ততটা নয়। বরং সেই উত্তপ্ত কেন্দ্র মহাসাগরের সেই পানিকে জমে এখনো বরফ হতে দেয়নি, উপরে বরফের হালকা আচ্ছাদন পড়েছে মাত্র।

খুব শীঘ্রই ইউরোপার উদ্দেশ্যে অভিযান চালানো হবে। একটা মহাকাশযান সেখানে গিয়ে পানির কিছু নমুনা সংগ্রহ করবে। যদি কপাল ভালো থাকে, তবে পানির নমুনায় হয়তো নতুন জীবনের খোঁজ পাওয়া যাবে। বেশি কিছু নয় – এককোষী কিছু ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেলেই যথেষ্ট।

এমনটা ঘটবে আমাদের প্রজন্মেই। আর যদি এমনটা ঘটে তবে আমাদের এই প্রজন্ম হবে মহাজাগতিক ইতিহাসের সাক্ষী। ভবিষ্যতে যদি কখনো সম্পূর্ণ একটা এলিয়েন সভ্যতার সাথে আমাদের পরিচয় হয়, তখন এর শুরু হিসেবে বিবেচিত হবে আমাদের প্রজন্মের এই সময়টা। সুতরাং অস্থিরতা, ঝগড়া-ফ্যাসাদ, অশান্তির যুগ বলে আমি এই সময়টাকে কোনভাবেই মানতে রাজি নই। যারা হিংসা-হানাহানি নিয়ে ব্যস্ত, তারা নিজেরা নিজেরা কাটাকাটি করেই মরবে। ওটা সব যুগেই ছিলো। কিন্তু মানবসভ্যতার এই সময়টুকু ভবিষ্যতে বিবেচিত হবে নতুন এক প্রাণের সাথে পরিচিত হবার সময় হিসেবে, মানুষের সাথে মানুষের হানাহানির সময় হিসেবে নয়।

পৃথিবীর জমে যাওয়া বরফের নিচে বিশাল সমুদ্রে যখন আমরা এককোষী হয়ে ভাসছিলাম, তখনও নিশ্চয়ই আমাদের নিয়ে কেউ না কেউ গবেষণা করছিলো। তারাও নিশ্চয়ই এক পর্যায়ে মারামারি-কাটাকাটি করে ধ্বংস হয়ে গেছে! আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হবে। কিন্তু তাই বলে আমাদের বর্তমান সময়টাকে নিয়ে হতাশ হবার কিছু নেই। ইতিহাস অপ্রয়োজনীয় সবকিছু দুইদিন পর নিজে থেকেই ছুঁড়ে ফেলে দিবে। রেখে দিবে শুধু এক প্রাণের সাথে নতুন আর এক প্রাণের মিলনের বার্তাটুকু। বহু বছর পরে সেটা হয়ে যাবে কিংবদন্তী। মিলিয়ন বছর পর এই নতুন সভ্যতা হয়তো আমাদের সাথে তাদের এই সাক্ষাৎকে দেখবে মিথলজি হিসেবে, যেমনটা আমরা আমাদের মিথলজিতে দেখি।

মানব সভ্যতার বার্তা বুকে নিয়ে ভয়েজারের ছুটে চলা


অনেকেই আছেন ছিঁচকাঁদুনে স্বভাবের, তাদের কথা বাদ। এখানে বলছি কঠিন স্বভাবের মানুষদের কথা, যাদের চোখে সহজে পানি আসে না। তারা কোনো কিছুতেই আবেগে আপ্লুত হন না। কিন্তু এই স্বভাবের মানুষদেরও তিনটা সময়ে ছাড় দেয়া যায়, যখন তারা ইচ্ছা করলে হালকা কান্নাকাটি করতে পারেন।

১। যখন তারা জন্ম নেন – এটা করতেই হবে। যতক্ষণ না কাঁদবে, ততক্ষণ ছাড়াছাড়ি নাই। না হয় উল্টো করে ধরে পশ্চাদ্দেশে শক্ত মার দেয়া হবে।
২। যখন তাদের আত্মার সম্পর্কীয় কেউ মারা যান – মা, বাবা, স্ত্রী, সন্তান অনেকেই এই তালিকায় যোগ হতে পারে।
৩। যখন কেউ ভয়েজার সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করেন।

১৯৭০ এর দশকের শেষে ভয়েজার-১ এবং তারপরে ভয়েজার-২ উৎক্ষেপণ করা হয়েছিলো মূলত বৃহস্পতি এবং শনি গ্রহের ছবি তুলে পাঠানোর জন্যে। কিন্তু এর আরেকটা গৌণ উদ্দেশ্য ছিলো। সেটা হলো, মনুষ্য উৎক্ষেপিত এই বস্তু মহাকাশে কতদূর পর্‍যন্ত ছুটে যেতে পারে, তা দেখা। উৎক্ষেপণের ৩০ বছরেরও বেশি সময় পরে ২০১৩ সালের ২৫ আগস্ট এটা আমাদের সৌরজগতের সীমানা ছেড়ে বাইরের ব্রহ্মান্ডে পা রেখে সৌরজগতের বাইরে যাওয়া প্রথম মনুষ্য নির্মিত বস্তু হিসেবে নাম কুড়িয়েছে।

এই ভয়েজারের মূল চমকপ্রদ ব্যাপারটা কিন্তু এই নয় যে – এটা এখন এমন দূরত্বে অবস্থিত, যেখানে সূর্‍যের মাধ্যাকর্ষণ শক্তিরও এটাকে টেনে ভেতরে নিয়ে আসার ক্ষমতা নেই। মূল ব্যাপারটা এটাও নয় যে – বস্তুটা পুরোপুরি মনুষ্যনির্মিত। এটার চমক জাগানিয়া ব্যাপারটা হলো, এর ভেতরে ভরে দেয়া তথ্যাবলী। এটা আসলে বিশাল মহাসমুদ্রে মানবজাতির পক্ষ হতে একটা কাঁচের বোতলে ভরে দেয়া বার্তা। এর ভেতরের বার্তার জন্যে ভয়েজার আমাদের মানব সভ্যতার নিকট অনন্য।

বিশ্বখ্যাত মহাকাশবিজ্ঞানী এবং সায়েন্স ফিকশান লেখক ‘কার্ল সেগান’ এই ভয়েজার প্রজেক্টের দায়িত্বে ছিলেন। তার বিভিন্ন দায়িত্বের মাঝে একটা ছিলো – ভয়েজারে এমনভাবে কিছু বার্তা ভরে দেওয়া, যাতে তা সৌরজগতের সীমানা পেরিয়ে বাইরের গ্যালাক্সির কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর হাতে পড়লে, তারা যেন তা সহজেই পাঠোদ্ধার করতে পারে এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এক কোণায় পড়ে থাকা মানবজাতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পায়। লিখিত কিছু বার্তার সাথে সাথে কার্ল সেগান এবং তার কর্মীরা একটা স্বর্ণালী রেকর্ড ডিস্ক ভরে দিলেন। এই ডিস্কের মেমরির চেয়ে বর্তমানে আপনার হাতের চায়না মোবাইলের মেমরি অনেকগুণ বেশি। কিন্তু তবুও তারা মোটামুটি পৃথিবীর কিছু ডিজিটাল ছবি, শব্দ, গান এবং ৫৫ টি ভাষায় অভিবাদন জুড়ে দিলেন। এর মধ্যে বাংলায় “নমস্কার, বিশ্বে শান্তি হোক”-ও আছে। শব্দের মধ্যে আছে – একজন মানুষ আরেকজনকে চুমু খাবার শব্দ, নবজাত বাচ্চার কান্নার শব্দ, সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ, সদ্য কথা বলতে শেখা বাচ্চার আবোল তাবোল কথামালা, পাখির শব্দ ইত্যাদি। যে করেই হোক, হয়তো তাদের ধারণা হয়ে গিয়েছিলো যে, এই রেকর্ডটা এমন কোনো এলিয়েনদের হাতে গিয়ে পড়বে, যারা সারাদিন হো হো করে হাসে, আর কান্না পেলে শুঁড়ের মত বস্তু দিয়ে চোখ মোছে। হয়তো তারা ভেবেছিলো, এই রেকর্ডটা শুনে এলিয়েনরা পৃথিবী দখলের চিন্তা বাদ দিয়ে অন্য কোনো গ্রহ আক্রমণের চেষ্টা করবে। ডিস্কে হাবিজাবি অনেক কিছু জুড়ে দেয়ার পরেও তাতে কয়েক মিনিটের মত স্পেস খালি রয়ে গেলো। কার্ল সেগান এবং তার টিম চিন্তা করতে লাগলেন, এতে আর কী ভরে দেওয়া যায়। তারা চাইছিলেন এই জায়গাটুকুতে এমন একটা কিছু দিতে, যেটা দিয়ে পুরো মানব সভ্যতাকে এক কথায় সংজ্ঞায়িত করা যাবে। কিন্তু তারা কিছুই ভেবে পাচ্ছিলেন না। শেষে ভেবে ঠিক করলেন – জীবনদর্শন ছাড়া মানুষ বাঁচে কীভাবে? তাই টিমের একজন ভলান্টিয়ার মানব জীবন, তার সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করবেন, আর একই সময়ে তার ইইজি রেকর্ড করা হবে। পরে সেটা ডিস্কে ভরে দেয়া হবে।


এই সেই গোল্ডেন ডিস্ক!

এই সেই গোল্ডেন ডিস্ক!




এইদিকে ঘটছিলো আরেক মজার ঘটনা! সেটা হলো – কার্ল সেগানের টিমে একজন বিজ্ঞানী ছিলেন যার নাম ‘অ্যান ড্র্যুইয়্যান (Ann Druyan)’। তিনি কীভাবে কীভাবে যেন সেগানের প্রেমে পড়ে গেলেন। প্রেম মানে পুরো হাবুডুবু খাওয়ার অবস্থা! কিন্তু সেগান তাকে ‘সহকর্মী’ হিসেবেই দেখেন। আর দিনরাত ভয়েজার প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। আমাদের অ্যানিও তাই মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেন না। একদিন আর না পেরে “কপালে যা আছে লেখা/মনে যদি পাইও ব্যথা/ দেখে নেবো আমি এর শেষ” নীতি নিয়ে মাঠে নামলেন। সেগানকে বলে ফেললেন তার মনের কথা।  সেগান এক ঘন্টা ধরে পুরো বক্তব্য চুপচাপ মন দিয়ে শুনলেন। তারপর গম্ভীর গলায় জানালেন, তিনি অ্যানিকে বিয়ে করতে চান। এই কথা বলেই সেগান বাইরে গিয়ে যথারীতি আবার প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলেন। এরপরে কী ঘটেছিলো, তা অ্যানির বিশেষ মনে নেই। এর কারণ সম্ভবত তিনি পরের ঘণ্টাখানেক নাসা অফিসে তার চেম্বারে একলা অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলেন। তাই সেই সময়কার কোনো স্মৃতি তার মনে নেই।

যাই হোক, এর কিছু পরে আমাদের অ্যানিই প্রস্তাব করলেন তার মস্তিষ্কের ইইজি রেকর্ড করা হোক। কারণ মানুষ সংজ্ঞায়িত হয় ভালোবাসায়। শুধুমাত্র একটা শব্দে যদি মানুষকে ব্যাখ্যা করতে বলা হয় – তাহলে সে শব্দটা হতে পারে শুধু ‘ভালোবাসা’। একজন মানুষ কতটা তীব্র ভালোবাসা নিয়ে বাঁচতে পারে, সেটার প্রমাণ হিসেবে তাই সংগ্রহ করা হলো অ্যান ড্র্যুইয়্যানের মস্তিষ্কের ইইজি।


image_full (1)

অ্যান ড্রুইয়ানের মস্তিষ্কের তরঙ্গের কিছু নমুনা, রেকর্ড করা হয়েছিলো ১৯৭৭ সালের ৩ জুন




পুরো ইইজি রেকর্ড করার সময় সেগান অ্যানির পাশে ছিলেন। সেই অনুভূতির কথা সরাসরি অ্যানির মুখ থেকেই শুনুন, “It was a Eureka! moment for both of us—the idea that we could find the perfect match. It was a discovery that has been reaffirmed in countless ways since…………………………….For me Voyager is a kind of joy so powerful, it robs you of your fear of death.”

পরে সেই ইইজিকে ভয়েজার নামক একটা রকেটে ভরে অসীম অন্ধকার এক সাগরে অজানার উদ্দেশ্যে ভাসিয়ে দেয়া হলো মানব সভ্যতার এক প্রতিনিধি হিসেবে। ১৯৮২ সালে সেগান এবং অ্যানের বিয়ে হয়। ১৯৯৬ সালে সেগান মৃত্যুর আগ পর্‍যন্ত অ্যান ড্র্যুইয়্যানের সাথে সংসার করে যান।


Carl-and-Ann-by-Luxemburg_lg

অ্যান ড্রুইয়ান এবং কার্ল সেগান




বর্তমানে পৃথিবী হতে ১১.৭ বিলিয়ন মাইল দূরত্বে অবস্থিত ভয়েজার এই বার্তা নিয়ে প্রতি ঘন্টায় ৩৮,০০০ মাইল বেগে ছুটে চলছে মহাশূন্যের অন্ধকার বুক চিরে। এই ডিস্ক আদৌ কারো হাতে পড়বে কিনা জানা নেই। কিংবা ভয়েজারই বা আর কতদূর যাবে, তাও কেউ জানে না। কিন্তু আমরা এটা জানি যে, আমরা অন্তত চেষ্টা করেছিলাম আমাদের সেরাটুকু দিতে।

ভয়েজার হচ্ছে আমাদের মানব সভ্যতার একটা হৈ-হুল্লোড় মাখা দিনের ‘ফ্যামিলি ফটো’। এখানে আমরা সবাই হাসি হাসি মুখে ক্যামেরাম্যানের দিকে তাকিয়ে আছি, আর পেছনের ২-৪টা বাঁদর ভেংচি কেটে পুরো ছবির মুডটাকে নষ্ট করে দিচ্ছে। যখন বাকিরা তাদের দেখছে, তারাও পেটফাটা হাসি সামলাতে পারছে না। একদিন আমরা সবাই ধূলোয় মিশে যাবো। কিন্তু যাবার আগে সবাই একসাথে কিছুটা ভালোলাগার যে মুহূর্ত কাটালাম, সেই স্মৃতি নিঃসীম অন্তরীক্ষের এক কোণা হতে আরেক কোণায় ভেসে বেড়াবে আজীবনের জন্যে। সেখানে কোথাও আমাদের এসব ঠুনকো ব্যক্তিস্বার্থ, দ্বেষ, হিংসার স্থান নেই।

তবে সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো – আমরা যেসব গুণের কারণে মানুষ, ভয়েজার সেসব গুণের প্রতিনিধিত্ব করে। সেটা কেমন? ভয়েজার চলে কঠিন যান্ত্রিকতার যুক্তিতে, কিন্তু একই সাথে সেটা ধারণ করে অসম্ভব ভালোবাসাকে পাবার অদম্য যে আকাঙ্ক্ষা – সেই বার্তাটিকে। মানুষ হিসেবে আমাদের মূল সার্থকতা হচ্ছে কঠিন সব যুক্তিতে চলার পরেও তার সেই ভালোবাসাকে চারপাশে ছড়িয়ে দেয়া। এই নশ্বর জীবনে আরাধ্য বস্তুকে স্পর্শ করা গেলো কি গেলো না, তাতে কী আসে যায়? সেই আরাধ্য বস্তুর প্রতি আবেগ বুকে নিয়ে এই বিশ্বজগতের এক কোণা হতে আরেক কোণায় ভালোবাসার বার্তা পৌঁছে দেয়াতেই তো আমাদের মূল উদ্দেশ্য নিহিত!

 

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/nasa_space_mission/

Friday, March 1, 2019

মোস্তাক আহমাদ দীন-এর প্রবন্ধ-- ঔপন্যাসিক ওয়ালীউল্লাহ্ ও তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষা


সমগ্র উপন্যাসকৃতি নিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্'র অবস্থান যেখানেই থাকুক, এখন পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে লালসালুর ঔপন্যাসিক হিসেবেই তাঁর গড় খ্যাতি। বইটি পাঠ্যতালিকাভুক্ত ছিল বলে যারা পড়তে বাধ্য হয়েছেন বা পুরস্কৃত হয়েছে বলে কিংবা খ্যাতি ছড়িয়েছিল বলে যারা পড়ে দেখেছেন, সেই সকল সাধারণ পাঠকের পক্ষে এমন ধারণায় পৌঁছাটাই স্বাভাবিক-তাদের প্রতি বলবারও কিছু নেই আমাদের-কিন্তু এর বাইরেও কিছু পাঠক/সমালোচকও যখন তাঁর অন্য উপন্যাসগুলো বিচার করার ক্ষেত্রে বারবার লালসালুকেই মানদণ্ড হিসেবে দাঁড় করান, তখন আমাদের ধারণা, তাঁকে একপ্রকার অস্বীকারই করা হয়।


অথচ তাঁর প্রত্যেকটি উপন্যাসই তো এক-একটি পৃথক শিল্পকর্ম, তাদের অভিমুখও অভিন্ন নয়, তাই আলোচনার ক্ষেত্রে পরিপ্রেক্ষিত-বিবেচনার সঙ্গে-সঙ্গে লেখকের জীবন-অভিপ্রায় ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রটিকে যেখানে আবিষ্কার করা জরুরি ছিল, বিচ্ছিন্ন কয়েকটি নজির বাদ দিলে, ওয়ালীউল্লাহ্'র ক্ষেত্রে এখনো তা করা হয়নি। এর কারণ, অন্তত আলোচকদের আলোচনায় এ-টুকু স্পষ্ট যে, দীর্ঘ দিনব্যাপী তাঁর প্রবাসযাপন-ফরাসি নারীকে বিয়ে করার প্রসঙ্গও তুলেছেন একজন আলোচক-এবং সেই সব সূত্র ধরে লালসালু-পরবতী উপন্যাসে বিশেষ সময়-যুগ-তত্ত্ব প্রভৃতির প্রভাব খুঁজে বের করার প্রাণান্তকর অনুসন্ধান! এ-কথা থেকে কেউ যেন এমনটি মনে না করেন যে আমরা প্রমাণ করতে চাইছি তাঁর উপন্যাসের সঙ্গে বিদেশি লেখকের ভাব ও তত্ত্বের কোনো যোগ নেই-একটা সময় পরে একাধিক আলোচক, বিশেষত শিবনারায়ণ রায় ও সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তো দেখিয়েছেন যে, তত্ত্বের মর্ম গ্রহণ করেও একজন লেখক কীভাবে কালোত্তরণের দ্ষ্টৃান্ত স্থাপন করতে পারেন-আমরা বলতে চাইছি, লালসালু উপন্যাসটি তাঁর দেখা-অভিজ্ঞতার তাড়নাজাত সফল উদাহরণ, কিন্তু ওয়ালীউল্লাহ্'র উচ্চাকাঙ্ক্ষার নজির লালসালু-পরবর্তী উপন্যাসগুলোতেই প্রতিফলিত। তাঁর প্রথম উপন্যাস লালসালু এবং তৎপরবর্তী চাঁদের অমাবস্যা ও কাঁদো নদী কাঁদোর উচ্চাকাঙ্ক্ষী চিন্তাই এই লেখার বিষয়বস্তু। উল্লেখ্য যে, এই লেখার অভিব্যক্তির সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক বিবেচনায় ইংরেজি ভাষায় লিখিত তাঁর অন্য উপন্যাস দুটিকে এ-আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

দুই
ওয়ালীউল্লাহ্'র লালসালু উপন্যাসের অসংখ্য আলোচক উপন্যাসটি নিয়ে এত-এত আলোচনা করেছেন যে, এখনকার আলোচক সেগুলো না পড়ে আলোচনা করতে গেলে তাতে পূর্ববর্তী আলোচকের পুনরাবৃত্তি করাই স্বাভাবিক। এইসব আলোচনায় সফলতার দিকটিই বেশি আলোচিত, দু-একজন সমালোচক কিছু অসঙ্গতি নিয়েও আলোচনা করেছেন অবশ্য, কিন্তু এদের কেউই এখন পর্যন্ত এ-প্রশ্নটি তোলেননি যে তাঁর মানসগঠনের সঙ্গে এ-উপন্যাসের পাঠবস্তু কতটা যুক্ত এবং তার পাঠবস্তুতে কোনোপ্রকার অভিজ্ঞানজনিত দৈন্য ঘটেছে কি না। প্রশ্নটি কারও লেখায় প্রাসঙ্গিক হলে হয়তো তাঁর অন্য উপন্যাসগুলোর প্রতি আরেকটু বিশেষ নজর পড়ত আমাদের, আর সেটি তাঁর জীবদ্দশায় ঘটলে, অল্পসময়ের মধ্যেই তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষার ডালপালা আরও বিস্তারিত হতে পারত। কিন্তু তা যে হয়নি, সেটি আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে-জীবদ্দশায় লালসালু বাদে মাত্র দুটি উপন্যাস প্রকাশিত হলো তাঁর। প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার নির্দিষ্ট সময়ের পর যে-লেখক বহুভাবে সমাদৃত, মাত্র ক-টি উপন্যাস লেখার মধ্য দিয়ে সেই লেখকের ঔপন্যাসিকজীবন শেষ হওয়ার কারণ-আমাদের মতে-আলোচকেরা প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ উভয়ভাবেই তাঁর অন্য উপন্যাসে লালসালুর ছায়াই খুঁজেছেন; খুঁজে ব্যর্থ হয়ে, এর জন্য তাঁর প্রবাসজীবনকে দায়ী করেছেন, লেখায় অন্য লেখকের/অন্য যুগের প্রভাব বের করার চেষ্টা করেছেন। অথচ তাঁর যে-জীবনযাপন তাতে এই ব্যক্তিই যে একদিন লালসালুর মতো একটি উপন্যাস লিখে উঠবেন, তা-ই ছিল অস্বাভাবিক।

ওয়ালীউল্লাহ্'র জন্ম ও বেড়ে-ওঠা বাংলা সাহিত্যের আর-দশজন লেখকের মতো নয়-তিনি তাঁর বাবা মা দুই তরফ থেকেই পারিবারিক শিক্ষা ও রুচির উত্তরাধিকার নিয়ে বড় হয়েছেন যা তাঁর লেখকমানস-গঠনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ছোটোবেলা থেকে পড়াশোনায় মনোযোগী, মাতৃহারা, নিঃসঙ্গ, সংবেদনশীল ওয়ালীউল্লাহ্ যে-পেশা ও বন্ধুবৃত্তে জড়িয়েছিলেন এবং যা পড়েছেন যা নিয়ে আলোচনা করেছেন তাতে তাঁর পক্ষে চাঁদের অমাবস্যা, কাঁদো নদী কাঁদো এবং দি আগলি এশিয়ান-এর মতো উপন্যাস লেখা যতটা সহজ ছিল, লালসালু লেখা ছিল ততোটাই কঠিন। কথাটির সত্যতা খুঁজে পাব তাঁর মামাতো ভাই জামাল নজরুল ইসলামের স্মৃতিকথায়ও :

ওয়ালীউল্লাহ্ কর্মরত ছিলেন উচ্চপদে। কাজেই সমাজের উচ্চশ্রেণীর জনগণের জীবন-যাপন, তাদের সুখ-দুঃখ, আচার-আচরণকে কেন্দ্র করে সাহিত্যরচনায় মনোনিবেশ করাই ছিল স্বাভাবিক। তিনি যদি তাই করতেন তবে এতে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। কিন্তু তিনি এর পরিবর্তে তার সাহিত্যকর্মে গুরুত্ব দিলেন সমাজের নিম্নবিত্তের অবহেলিত মানুষের জীবনকে। স্বল্পবিত্ত বা হতদরিদ্র মানুষের বঞ্চনার নেপথ্যের রহস্য উন্মোচনে তিনি আত্মনিয়োগ করেন।

এরপরও ওয়ালীউল্লাহ্ গ্রামসমাজের ধর্ম-বাস্তবতা নিয়ে লালসালু লিখেছেন, লিখে খ্যাতিও পেয়েছেন, তাঁর আকাঙ্ক্ষাও অনেকটা এতে পূর্ণ হয়েছে-সমালোচকদের বিচারেও এ-কথাটি অস্পষ্ট নয়। কিন্তু ওয়ালীউল্লাহ্ যে-মাপের প্রতিভা এবং উপন্যাস-রচনার ব্যাপারে তাঁর যে-প্রস্তুতি, লালসালু উপন্যাসটি কি সে-উচ্চতায় পৌঁছাতে পেরেছিল? কথাটি বিষয়ের গুণ-নির্গুণ নিয়ে শুধু নয়, এ-বিচার সার্বিক-চেতনাগত। শুধু বিষয়ব্যাপারের কথা ধরলে, চাঁদের অমাবস্যা ও কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাস দুটির বিষয়ও তো সেই সমাজ, উপন্যাসে যার প্রতিফলন ঘটানোর কথা তিনি একাধিকবার তাঁর লেখায় ব্যক্ত করেছেন। কাজি আফসারউদ্দিনকে-লিখিত একটি চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছিলেন : ‘ I want to write মুসলমান সমাজ নিয়ে- আমার সমগ্র মনের ইচ্ছে সেদিক পানে। এও একরকম passion থেকে সৃষ্ট। মুসলমান সমাজ সম্বন্ধে আমরা কেউ হয়ত অজ্ঞ নই; কিন্তু অধঃপতনের এই যে একটা চূড়ান্ত অবস্থা-এই অবস্থা নিয়ে লিখে আমার লেখা কলঙ্কিত(?) করতে চাই।' তাঁর স্ত্রী অ্যান-মারি ওয়ালীউল্লাহ্ও এমনটি জানিয়েছিলেন যে, ওয়ালীউল্লাহ্ আধুনিক চিন্তায় প্রভাবিত হলেও তাঁর লক্ষ্য ছিল পূর্ববঙ্গের গ্রামের মানুষদের নিয়ে লেখা, নিজের দেশপরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে তিনি সেই কাজটিই করে গেছেন আজীবন। অ্যান-মারির এক প্রশ্নের উত্তরে তাঁকে যে-জবাবি চিঠিটি লিখেছিলেন ওয়ালীউল্লাহ্ এখানে তার উল্লেখ করলে সে-বিষয়ে তাঁর ধারণাটি স্পষ্ট হবে :

আমার বইপত্র আর লেখালেখির ব্যাপারে তুমি খুব প্রাসঙ্গিক একটি প্রশ্ন তুলেছ, তা হলো, আমি যে গ্রাম আর তার মানুষজন নিয়ে লিখি গোর্কি ওদের যতটা কাছ থেকে জানতেন, অতটা জানাশোনা কি তাদের নিয়ে আমার আছে। জানি না তুমি এটা মনে করো কি না যে ওদের নিয়ে লিখতে গেলে ওদের মধ্যে আমাকে বসবাস করতে হবে। আমার পক্ষে সেটা করা সম্ভব নয়। গ্রামের লোকদের নিয়ে লিখতে গেলে আমাকে কেন গ্রামের মানুষ হতেই হবে? এটা অত্যাবশ্যকীয় নয়। অন্যদিকে, গ্রামের অর্থনৈতিক সমস্যাগুলো কী শুধু সেটাই আমি জানি না, সেই সঙ্গে তাদের গঠন, তাদের ইতিহাস, এবং ভবিষ্যৎ বিষয়ে আমি ওয়াকিবহাল। আমি তাদের গোটা জীবন বিশ্লেষণী দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে পারি, আর সেটা পারি আমি গ্রামের মানুষ নই আর গ্রামে বসবাস করি না বলে। ওদের মধ্যে বসবাস করলেও গুটিকয়েক গ্রামবাসীর জীবনের আক্ষরিক এবং ফটোগ্রাফিক বিবরণ তুলে ধরা আমার লক্ষ্য হতো না। বরং আমি যাদের চিনতাম, তারা যে এক বৃহৎ সামাজিক অর্থনৈতিক বুনোটের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ সেটা বোঝানোই আমার লক্ষ্য। (আমার কথা বুঝতে পারছ?)...আমি যখন ধর্মীয় কুসংস্কার, মোল্লাদের হাতে গরীব মানুষের শোষণকে আক্রমণ করি, তখন আমি গোটা ব্যবস্থাটাকেই আক্রমণ করি।

ওয়ালীউল্লাহ্'র কথাগুলি কতটা গ্রহণযোগ্য তা বিবেচনার পাশাপাশি এ-ব্যাপারটিও আলোচনাযোগ্য যে, তাঁর স্ত্রী অ্যান-মারির মনে এই প্রশ্ন জাগবার কারণটা কী? এমনিতে জামাল নজরুল ইসলামের লেখায় তো এটুকুও জানা গেছে যে সময়-সুযোগে তিনি গ্রামের মানুষদের সঙ্গে কথা বলতেন এবং তাদের ‘দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার চেষ্টা করতেন’, এ-তথ্য তো অ্যান-মারিরও অজানা থাকবার কথা নয়; তাহলে? হয়তো লেখাবস্তুর সঙ্গে-অন্তত লালসালুর ক্ষেত্রে- ওয়ালীউল্লাহ্'র অন্তরঙ্গতার দৈন্যই অনুভব করেছিলেন অ্যান-মারি, কারণ এ-বইটি সম্পর্কে তাঁর একটি পরোক্ষ ইঙ্গিত রয়েছে রশীদ করীমের লেখায়ও। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ফ্রান্সের বাড়িতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন রশীদ করীম। আলাপের একপর্যায়ে রশীদ করীমকে জিজ্ঞেস করলেন ওয়ালীউল্লাহ্ : ‘আমার লালসালু কেমন লেগেছে তোমার?’ জবাবে রশীদ করীম বললেন, ‘প্রথম পৃষ্ঠা বিশেক অপ্রয়োজনীয়’, এ-সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন অ্যান-মারি ওয়ালীউল্লাহ্, রশীদ করীম লিখেছেন, ‘যদ্দুর মনে পড়ছে, তিনি আমার মত সমর্থন করেছিলেন।' -এই কথোপকথন থেকেই বোঝা যায় ওয়ালীউল্লাহ্'র লেখাপত্র-বিষয়ে তাঁর স্ত্রী সদাউৎসাহী থাকলেও তিনি ছিলেন স-তর্ক ও স-চেতন। আর রশীদ করীমও যখন লালসালুকে ওয়ালীউল্লাহ্'র শ্রেষ্ঠ কাজ বলে অভিহিত করেছেন, তখনো কিন্তু কাঁদো নদী কাঁদো বের হয়নি, প্রকাশিত হয়েছে কিছু গল্প আর উপন্যাস চাঁদের অমাবস্যা। এ-ছাড়াও লালসালু-সম্পর্কে আরেকটি লেখায় রশীদ করীম লিখেছিলেন, অন্যরা যে-কারণে এই উপন্যাসটিকে মহিমান্বিত করেন তাঁর আগ্রহ সে-জায়গায় নয়, অর্থাৎ ভণ্ড পির মজিদ ধর্মান্ধতাকে অবলম্বন করে যে গ্রামের মানুষদের তারাবাজি দেখিয়ে ‘টেরিয়ে’ দেয়, ঔপন্যাসিকের কৃতিত্ব সেটি নয়, কারণ গ্রামের মানুষ-রশীদ করীমের মতে-এতটা সরল নয় যে বছরের পর বছর তাদেরকে বোকা বানিয়ে রাখা যাবে। এ-কথার পক্ষে উপন্যাস থেকে লেখক-বর্ণিত হাসুনির মার বুড়ো বাপের মনের কথাটি তুলে ধরেন : ‘একটা বিষয়ে গোলমাল নেই তার মনে। অন্তরের শক্তিতে মজিদ ব্যাপারটা জানতে পেরেছে সে কথা সে বিশ্বাস করে না।’ উল্লেখ করেছেন খালেক ব্যাপারীর নিঃসন্তান বউটির কথাও, বলেছেন তাদের কথাও যারা মজিদের অলৌকিকত্বে বিশ্বাসী নয়-তিনি বলেন, ‘মজিদ পীরে তাদের বিশ্বাস অটল থাকলে তারা দলে দলে আওয়ালপুরের নবাগত পীর সাহেবের দরবারে শরিক হওয়ার জন্য মিছিল করে বেরিয়ে পড়ত না’। বরং তিনি মনে করেন, ‘উপন্যাসটির আসল বাহাদুরি অন্য জায়গায়। স্ত্রী-পুরুষের সম্পর্কের রহস্য-উন্মীলনে। এবং সেখানে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ তাঁর সূক্ষ্ম হাতের মিহি কাজ দেখিয়ে দিয়েছেন।’ তাঁর এই মতের পক্ষে পুকুরে গোসল করে উঠে সিক্ত-বসনে-দাঁড়ানো রহীমার চুল-ঝাড়ার দৃশ্য আর খড়ের আগুনের উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত বেগুনি রঙের শাড়ি-পরা হাসুনির মার খোলা গলা-কাঁধ-বাহুর নগ্নতার প্রতি মজিদের তাকিয়ে-থাকার বর্ণনা তুলে ধরেন। অবশ্য এই সব বর্ণনায় অবদমিত কামনাবাসনার সপক্ষ দৃষ্টান্ত উপস্থাপনের পাশাপাশি সচেতনভাবে নিজের চিন্তাও আরোপিত করেছেন রশীদ করীম, কারণ, হয়তো তাঁর মনে হয়েছে এই বিষয়গুলোকে ওয়ালীউল্লাহ্ গৌণ করে দেখেছেন বলেই এই দিকে আর এগোননি। যেহেতু আমরা জানি, লালসালুর মুখ্য বিষয় ধর্মান্ধতা- ধর্মকে অবলম্বন করে মিথ্যাকে সত্যের রূপে প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টার ধারাবাহিক বিবরণ রয়েছে এর পাতায়-পাতায় ।

যে-মিথ্যা/ধর্মান্ধতা-কে পুঁজি করে মজিদ ক্ষমতাশালী, তার প্রতি অনেকের যে-অবিশ্বাস, সেই বিষয়টিকে মুখ্য করেও তো উপন্যাস হতে পারে, কিন্তু অবিশ্বাসীর সংখ্যা যদি অধিক হয় তাহলে চরিত্রের ক্ষমতার প্রশ্নে উপন্যাসের অন্তর্কাঠামোগত ঐক্য নষ্ট হয়-দুর্বলতা প্রকট হয়ে ওঠে। এমন দুর্বলতা আরও রয়েছে এতে, লালসালু যে-ধরনের উপন্যাস, সে-বিচারে এগুলোকে বড় অসঙ্গতিই বলা চলে।

আমরা দেখেছি মজিদের ক্ষমতার উৎস হলো মাজার-বোঝা যায়, পির থাকুন আর নাই থাকুন সে মাজারে বিশ্বাসী, মাজারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, এ-ক্ষেত্রে পূর্ব-অভিজ্ঞতা যা বলে, আমাদের লোকগান যেগুলো এখন গ্রামসমাজের মানুষের অতি আদরের ধন, আরাধ্যও বটে, সেগুলোর রচয়িতা, গ্রাহক ও লালনকারীদের অনেকেই মাজারের সঙ্গে যুক্ত। এই যুক্ততার ইতিহাস খুব প্রাচীন না হলেও আজকালকার নয়, অনেকদিন ধরেই চলে আসছে-দেখা যায় এরা নানা কারণে বহুজায়গায় অবস্থান করলেও এই সকল মাজারই এদের মিলনস্থল; এদের মত-পথ-তরিকা ভিন্ন, তবু এই বিশেষ জায়গাটি কোনো-না-কোনো ভাবে অলিখিত ঐকসূত্রে বেঁধে রাখে তাঁদের। এদের অনেকেই মাজারকে কেন্দ্র/উপলক্ষ্য করে ভক্তিমূলক ও অধ্যাত্মধর্মী গান রচনা করে ও গায়, এবং এরাই আবার তাদের জীবনজীবিকার সূত্রে সমাজের অসঙ্গতি-জোরজুলমি নিয়ে গান বাঁধে। কিন্তু লালসালুর মজিদকে আমরা দেখছি এ-অভিজ্ঞতার সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম-সে এই সব গানকে সহ্যই করতে পারে না : ‘কাতারে কাতারে সারবন্দী হয়ে দ্বিতীয়ার চাঁদের মত কাস্তে নিয়ে মজুররা যখন ধান কাটে আর বুক ফাটিয়ে গীত গায় তখনো মজিদ দূরে দাঁড়িয়ে দেখে আর ভাবে। কিসের এত গান, এত আনন্দ?’ উক্তিটিতে গানের প্রতি মজিদের বিরাগ স্পষ্ট, তার মনে হয়, ‘ঝালরওয়ালা সালু কাপড়ে আবৃত মাজারটিকে তাদের হাসি আর গীত অবজ্ঞা করে যেন।

এছাড়াও ওয়ালীউল্লাহ্ আরও যে-সকল কার্যকারণ মিলিয়ে লালসালুর ঘটনাপরম্পরা তৈরি করেছেন, সাধারণ চোখে দেখলে তা একধরনের বাস্তবই মনে হয়, যাকে বলে বানানো বাস্তব, যার মূল ভিত্তি নিরেট/বাস্তব জীবনে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। অন্তত এমন বাস্তবতায়-তৈরি মজিদের মতো পির আমাদের সমাজে খুঁজে পেতে লবেজান হতে হবে যে-কিনা কৃষকদের ভয় দেখিয়ে দোয়া-কলমা মুখস্থ করায়, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জন্য তাদেরকে তৈরি করে, মসজিদ বানায় আবার মাজারকে কেন্দ্র করে ক্ষমতার সাম্রাজ্যও প্রতিষ্ঠা করে। দোয়া-কলমা, নামাজ-রোজা পালনে কৃষকদেরকে বাধ্য করতে দেখে মজিদকে শরিয়তের একজন পাক্কা পাবন্দ মাওলানার মতোই মনে হয়, অথচ শরিয়তপন্থী মাওলানারা মাজারকে সাধারণত ‘কবর’ বলেই অভ্যস্ত, তার প্রতি তাদের কোনো ভয়-খওফও প্রবল নয়, তারা কবর জিয়ারত করেন, আর কবর-পূজাকে র্শিক জ্ঞান করেন, কিন্তু মজিদ সেরকম নয়। তাহলে কি মজিদ ফকিরি পন্থায় বিশ্বাসী? তাও মনে হয় না-কারণ, এ-পন্থায় পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ জরুরি নয়, তাদের নামাজও আলাদা, তবে এ-পন্থার অনুসারীরা মাজারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, গানও তাদের প্রিয়, কারও-কারও একান্ত অবলম্বনও বটে। মজিদ চরিত্রটি এর কোনোটিই নয়, তাই একথা না বলে উপায় নেই যে, তাকে কেন্দ্র করে যে-কৃত্রিম বাস্তবতাই তৈরি হোক না কেন সেটি পুরো ভিত্তিশূন্য না হলেও, সামঞ্জস্যশূন্য। মজিদের মতো মাজারকেন্দ্রী পির আমাদের সমাজে অসংখ্য, কিন্ত মজিদের যে-বিশ্বাস, তার মতো অবিকল পির এখানে পাওয়া দুরূহ। কথাটিকে অভি/অনু-যোগ হিসেবে ধরে নিয়ে কেউ যদি এর জবাব দিতে গিয়ে বলেন যে পুরো চরিত্রটিই যেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি মিথ্যে ভিত্তির ওপর-যেখানে মোদাচ্ছের পিরেরই কোনো অস্তিত্ব নেই-সেখানে এই অভিযোগ তোলা কেন? তাহলে এর জবাবে বলতেই হবে যে, ঔপন্যাসিকের জগৎ সেটি নির্মিত জগৎ হলেও তার বাস্তবতার মধ্যেও জ্ঞানগত সামঞ্জস্য থাকা জরুরি। এ-ছাড়া ওয়ালীউল্লাহ্ তো তার দেখা-চরিত্রকেই বাস্তবে রূপ দিতে চেয়েছিলেন। এ-বিষয়ে ওয়ালীউল্লাহ্'র সঙ্গে সৈয়দ আলী আহসানের একটি আলাপও সেই স্বাক্ষ্য দেয় : ওয়ালীউল্লাহ্'র প্রথম গল্পগ্রন্থ নয়নচারা আদৃত হওয়ার পর সৈয়দ আলী আহসান তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন আপনি উপন্যাস লিখেন না কেন? জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘একটি উপন্যাসের বিষয় নিয়ে অনেক দিন ধরে ভাবছি। একজন গ্রামের সাধারণ গৃহস্থ-যার সংসার আছে, ছেলেমেয়ে আছে, সে ব্যবসা হিসেবে বেছে নিল কবর-পূজা। এ লোকটি কি রকম আচরণ করে তা আমার জানতে ইচ্ছে হচ্ছে। চট্টগামে আমাদের গ্রামের বাড়ীর কাছে এরকম একটি ঘটনা ঘটেছিল। একজন লোক হঠাৎ উঁচু একটি মাটির ঢিবির উপর চুনকাম করে তার উপর লালসালু বিছিয়ে পথচারীদের কাছ থেকে পয়সা নিতে লাগল। সরল বিশ্বাসী পথচারীরা চিরন্তন বিশ্বাসের ভারে এতই অভিভূত যে তারা নানাবিধ কামনায় সেখানে পয়সা দিতে লাগল'। এই ভাবনার ফলই লালসালু, তাঁর দেখা এই ‘একজন লোক’ই হলো মজিদ, কিন্তু এই চরিত্রকে পিরের মূর্তিতে দাঁড় করাতে গিয়ে তাকে কেন্দ্র করে যে-সকল ধর্মীয় ঘটনা-অনুষঙ্গ হাজির করা হয়েছে সেগুলোর কারণেই মজিদ চরিত্রটি জটিল ও গোলমেলে চরিত্রে পরিণত হয়েছে। এর কারণ, আমাদের মতে, ইসলামের মত-পথ বিষয়ে ঔপন্যাসিকের স্বচ্ছ ধারণার অভাব-মজিদকে কেন্দ্র করে যে-সকল ধর্মীয় বিধিবিধানের উল্লেখ করেছেন ওয়ালীউল্লাহ্, তার বেশির ভাগই কাণ্ডজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে রচিত। যদিও সৈয়দ আলী আহসানকে তিনি বলেছিলেন, ‘ইসলাম এটাকে সমর্থন করে না জানি তবু এ ব্যবসা ক্রমান্বয়ে প্রসারের পথে। এরকম একজন ব্যবসায়ীর চাতুর্যকে আমি আবিষ্কার করতে চাই, মিথ্যাচারকে আবিষ্কার করতে চাই, আবার মমতার মধ্যেও তাকে পেতে চাই। এটা কি করে সম্ভব হবে জানি না কিন্তু আমি চেষ্টা করছি।’-এই চেষ্টা করতে গিয়ে শৈশব-কৈশোরের দু-আনা অভিজ্ঞতার সঙ্গে পড়ে-পাওয়া চোদ্দ আনা মিলিয়ে মজিদের যে-জগৎ তৈরি করেছেন ওয়ালীউল্লাহ্, তা হয়ে উঠেছে এক আরোপিত জটিল জগৎ। এতকিছুর পরও, বিষয়গত অসামঞ্জস্য সত্ত্বেও, মুসলমান সমাজের প্রেক্ষাপটে এমন কিছু অগ্রসর চিন্তা ও কল্যাণমূলক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে লালসালুতে, সে-ক্ষেত্রে পথিকৃতের মর্যাদা ওয়ালীউল্লাহ্'র প্রাপ্য। বিশেষ করে সেই সময়ে, যখন সবেমাত্র দেশভাগ-এর মতো ভুল সিদ্বান্তে ‘বিষাদবৃক্ষ’-এর বীজ রোপিত হওয়ার কারণে অসংখ্য মানুষের জীবনে দুর্দশা নেমে এসেছে তখন এই বইয়ের বিষয় যেন সেই ভবিষ্যতেরই ইশারা দিচ্ছে যেখানে নানা রূপে অসংখ্য মজিদের আবির্ভাব ঘটবে এবং এর সঙ্গে-সঙ্গে নষ্ট হয়ে যাবে মানুষের সম্প্রদায়নিরপেক্ষ স্বাভাবিক সম্পর্ক-লোকায়তের মেলা-পরব, উৎসবাদি গান ও মানুষের ভেদমোচনে ক্রিয়াশীল নানা লোকাচার। যার প্রমাণ তো আমরা পরে পেয়েছিই বাস্তবে হাতে-কলমে, বইপত্রে, তাই যত সময় গেছে আরও প্রাসঙ্গিক হয়েছে লালসালুর ধর্মান্ধতার নানা চিত্র ও অনুষঙ্গ।

তবে এ-উপন্যাসের মাধ্যমে ওয়ালীউল্লাহ্ ধর্মব্যবসায়ীর চাতুর্য ও মিথ্যাচার আবিষ্কার ও উন্মোচন করতে পারলেও-নিজের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী-মজিদের প্রতি পাঠকের মমতা জাগাতে সক্ষম হননি। উপন্যাসে মজিদকে মাঝে-মধ্যে নামাজ ও অন্যান্য আচার পালন করতে দেখা যায়, আচারপালনে অন্যকে হুকুম করতেও দেখা যায়-যে-লোক একটি মিথ্যা তথ্য/তত্ত্বকে পুঁজি করে, ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থের নানা প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গকে স্বার্থোদ্ধারের কাজে ব্যবহার করে মানুষকে প্রতারিত করছে তার ক্ষেত্রে এই আচারনিষ্ঠা স্ববিরোধিতারই উদাহরণ; আমাদের ধারণা, এর মাধ্যমে পাঠককে মজিদের প্রতি ‘মমতা’ময় হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন ওয়ালীউল্লাহ্, কিন্তু উপন্যাসে ভণ্ডামি আর মিথ্যাজগতের বাস্তবতা এতটাই তীব্র হয়েছে যে, এর অন্যস্বরটি আচ্ছন্ন হয়ে গেছে এবং পরবর্তী সময়ের মাজার-ব্যবসার প্রকটতার কারণে স্বরপ্রকাশের সদর্থ ও দ্বান্দ্বিক সম্ভাবনাটুকুও শেষ হয়ে গেছে। এমনিতে কোনো উপন্যাসে দ্বান্দ্বিক ও বহুস্বরগত সম্ভাবনার সুযোগ সৃষ্টি করতে চাইলে তার প্রধান সহায় হয়ে উঠতে পারে তার মনোজাগতিক বাস্তবতা, বাইরের বাস্তবতা নয়। কিন্তু লালসালু বাইরের বাস্তবতার উপন্যাস, অর্থাৎ তার আঙ্গিকটাই এমন যে, যা লক্ষযোগ্য যা নিয়ত প্রত্যক্ষ, তাকে অবলম্বন করেই এর কাহিনি বিস্তারিত হয়েছে-শওকত আলী লিখেছেন-‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ প্রত্যক্ষ, স্থূল, এবং আবয়বিক বাস্তবতার দাবি অস্বীকার করবেন কোন যুক্তিতে? ক্ষুধা লাঞ্ছনা ও দাসত্বের ভারে প্রত্যক্ষত যে-জীবন পিষ্ট এবং ন্যুব্জ, সেই জীবনের আবয়বিক চেহারাটিকে কি পাশ কাটানো যায়? অবশ্যই যায় না। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পাশ কাটাননি-অন্তত তাঁর প্রথম উপন্যাসে তো নয়ই।’...‘একটি চরিত্র যেভাবে তার জগৎ দেখে, লেখকও সেইভাবেই দেখেন এবং দেখিয়ে একটি জীবন সত্যের দিকে ইঙ্গিত করতে চান।' লালসালু উপন্যাসের ক্ষেত্রে তাঁর কথা একদম অক্ষরে-অক্ষরে ঠিক আর এই ধরনের উপন্যাসের বেলায় তার বাস্তবতার চাপে (জীবন-)সত্যের ইঙ্গিতও নির্দিষ্ট হতে বাধ্য এবং দূরে রয়ে যায় বহুস্বর ও বহুঅর্থ-এর সম্ভাবনা। মিখাইল বাখতিন তাঁর ঞযব ঢ়ৎড়নষবসং ড়ভ উড়ংঃড়বাংশু’ং ঢ়ড়বঃরপং গ্রন্থে দস্তয়েভস্কির উপন্যাসের চরিত্রগুলো বিশ্লেষণ করে লিখেছিলেন তাঁর সব প্রধান চরিত্রের ভাবনার উৎস হলো অস্বার্থপরতা, তাদের ব্যক্তিত্বের গভীরতম কেন্দ্র এই প্রবণতার বশবর্তী; তাই খুনী ও লুঠেরা রাসকলনিকভ, বেশ্যা সোনিয়া, নিজের পিতার হন্তারক ইভান-এরা কেউই স্বার্থপর নয়, আর এই সূত্রেই এরা পৃথক পৃথক স্বর-বহুস্বর । উপন্যাসে এ-কথার সপক্ষ উদাহরণ তৈরি হতে পারে মনোজগতের বাস্তবতার ভিত্তিতে, অন্য বাস্তবতায় নয়, আর, তা হলে, সদর্থ নঞর্থ যে-কোনো চরিত্রই পেতে পারে স্বতন্ত্র ‘মমতা’ ও মর্যাদা। লালসালু উপন্যাসের মজিদ যে পাঠকের মমতা পায় না, তা ওই মনোজাগতিক বাস্তবতার অভাবে। কিন্তু সৈয়দ আলী আহসানকে করা উক্তিতে ওয়ালীউল্লাহ্'র যে-মনোভাব প্রকাশ পায় তাতে বোঝা যায় লালসালুর মজিদকে কার্যকারণ-এর কাছে নিরূপায়রূপে হাজির করাই ছিল তার উদ্দেশ্য, কিন্তু উপন্যাসটি যতই সফলতা পাক না কেন তাঁর এ-উদ্দেশ্য সফল হয়নি। তারপরও একথা বলা যায় লালসালু-পরবর্তী উপন্যাসগুলো যে-রীতি ও আবহে রচিত, সেখানে মজিদের মতো চরিত্রও ঠিকই মমতা আদায় করে নিত। কারণ, ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর উপন্যাসে যে- বহুস্বরিক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে চান তার জন্য পরবর্তী উপন্যাসগুলোর বিষয় ও রীতি দুটোই ছিল উপযুক্ত। শেষের উপন্যাসগুলোর জগৎ ‘প্রত্যক্ষ, স্থূল, আবয়বিক বাস্তবতা’ এবং ‘ক্ষুধা লাঞ্ছনা ও দাসত্বের’ জগৎ নয়, এ-জগৎ মনস্তত্ত্বের জগৎ, কাব্যময় ভাষায় তৈরি আলো-আঁধারির জগৎ যার ভিত তৈরিতে কাজ করেছে দর্শনসূক্ষ্ম অনুসন্ধিৎসা। সেজন্য লালসালুর পির মজিদ যেখানে নির্মমতার দায় বহন করছে, সেখানে চাঁদের অমাবস্যার দরবেশ কাদের একটি খুন করা সত্ত্বেও পাঠকের চোখে দোষী সাব্যস্ত হয় ঠিক, তবু তাকে ঘৃণ্য-চরিত্ররূপে যাতে না ভাবা হয় সেরকম সমান্তরিত বর্ণনাও সেখানে কম নয়। এই ভাবে চরিত্রগুলোকে নানা কার্যকারণ-সূত্রে বেঁধে আপেক্ষিকতার মর্মে দাঁড় করিয়ে-দেওয়ার চেষ্টা রয়েছে ওয়ালীউল্লাহ্'র উপন্যাসে, তাঁর আকাঙ্ক্ষার প্রাণভোমরাও সেখানে-লালসালুর গৎ-বাঁধা ছকে এই চিন্তার প্রতিফলন ঘটানো সম্ভব না-হলেও, চাঁদের অমাবস্যায় তাই হয়েছে, আর সেই আকাঙ্ক্ষা রীতিমতো উচ্চাকাঙ্ক্ষার পর্যায়ে পৌঁছেছে যে-উপন্যাসে তার নাম কাঁদো নদী কাঁদো।

চাঁদের অমাবস্যার কাদেরও এক (মিথ্যে) ‘দরবেশ’, তাকে দরবেশ হিসেবে কেউ মানে কি না সেটি বড় কথা নয়, তবু তার দাদা তার চারিত্রিক অদ্ভুতত্ব ও দুর্বোধ্যতার কারণে- হয়তো তার দুষ্কর্ম ঢেকে রাখবার জন্য (অবশ্য সে-বিষয়ে কোনো সবিস্তার বর্ণনা উপন্যাসে নেই)-তাকে সেই রূপে পরিচিত করতে আগ্রহী। চাঁদের অমাবস্যার যুবক শিক্ষক আরেফ এক জ্যোৎস্নাপ্লাবিত শীতের রাতে কাদেরকে দেখে আপন খেয়ালে তাকে অনুসরন করতে শুরু করে এবং একসময় হারিয়েও ফেলে, পরে বাঁশবনের মধ্য থেকে চাপা ভারী কণ্ঠে কথা-বলার আওয়াজ শোনে, কিছুক্ষণ পর আলো-আঁধারে এক যুবতী নারীর অর্ধউলঙ্গ মৃতদেহ দেখতে পায়, আরও পরে, তার সামনে কাদেরকে দেখে এবং বুঝতে বাকি থাকে না মৃত যুবতীর হত্যার কারণ কে। ‘হত্যার কারণ’ কথাটি স্পষ্ট ও জোরের সঙ্গেই বলতে হচ্ছে-‘হত্যার কারণ’, শুরুতে ‘হত্যাকারী’ শব্দটির উল্লেখ থাকলেও চিন্তাগত ক্ষেত্রে ‘হত্যাকারী’ ভাবা হয় না তাকে-কেননা স্কুলশিক্ষক আরেফের মনে এই দুই-এর মধ্যকার দ্বন্দ্ব শুরুতে অস্পষ্ট থাকে বলেই উপন্যাসের পৃষ্ঠা বাড়তে থাকে। একটি যুবক একটি যুবতীকে হত্যা করেছে, এর মধ্যে অন্য কোনো চিন্তার যোগ/জট না থাকলে সেই ঘটনার দ্রষ্টা আরেফ তার জীবনজীবিকার তোয়াক্কা না করে প্রথমেই থানায় গিয়ে হাজির হতো, কিন্তু ঘটনাটি সেরকম নয়, আর সেরকম নয় বলেই এর লেখক আরেফের আত্মগত ভাবনার ‘সুযোগ গ্রহণ করে’, এর মধ্য দিয়ে বহুস্বরের অস্তিত্ব বা ব্যক্তিসাপেক্ষ (পৃথক-পৃথক) স্বর ও সত্যের সন্ধান চলতে থাকে-বলার দরকার পড়ে না যে লেখকের আকাঙ্ক্ষার জায়গাটিও সেখানে। আরেফ কেন বারবার প্রত্যক্ষ বাস্তবের মাধ্যমে হত্যাকারীকে চিহ্নিত-করার সহজ পথে না-গিয়ে তার কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছে, এর কারণ হিসেবে জীবিকার প্রসঙ্গটি এনেছেন একজন আলোচক : ‘সে চেষ্টা করে হত্যাদৃশ্যটি ভুলে যেতে। সে ভাবে, নিহত নারীটিকে সে চেনে না। ঘটনাটিকে নিছক একটি দুর্ঘটনা হিসেবে উড়িয়ে দিতে চায়। সে জানে, হত্যাকাণ্ডটির কথা প্রকাশ করলে কাদেরের শাস্তি অনিবার্য। আর তাতে আরেফও হারাবে বড়বাড়ির নিশ্চিত আশ্রয়’। -কথাটি অঠিক নয়, তবু একথাও ঠিক যে, এ-প্রসঙ্গটি বাধা হিসেবে যেমন উল্লিখিত, তেমনি উপন্যাসের অন্যত্র তা এসেছে সত্যপ্রকাশের অনিবার্যতাকে তীব্র করে তোলার জন্য। লেখকের বয়ানটি উল্লেখ করলে তা আরও স্পষ্ট হবে :

যুবক শিক্ষকের বিরুদ্ধে কেউ কোন অভিযোগ না আনলেও কথাটি প্রকাশ করার পর তাকে বড়বাড়ীর আশ্রয় এবং ইস্কুলের শিক্ষকতার চাকুরীটি ছাড়তে হবে, তারপর এখানে থাকতে তার বিবেকে বাধবে। তখন সে কোথায় যাবে? কোথায়ই-বা এমন লাভজনক চাকুরী বা দাদাসাহেবের মত এমন স্নেহ-দয়াশীল অভিভাবক পাবে?

তবু কথাটা প্রকাশ না করে উপায় নাই। উপায় থাকলে সে বলতো না। বাঁশঝাড়ে একটি নারী অর্থহীনভাবে জীবন দিয়েছে। তার বিশ্বাস, মানুষের জীবন এত মূল্যহীন নয়। না, সত্যই তার উপায় নাই।

যুবক শিক্ষকের শীর্ণ মুখ শুষ্ক কাঠের মত নীরস-কঠিন মনে হয়। সে-মুখ কখনো যেন হাসবে না কাঁদবে না।

বাঁশঝাড়ে একটি নারীর মৃত্যুর ঘটনাকে কাদের একটি ‘দুর্ঘটনা’ বলে উল্লেখ করে আরেফকে নিরস্ত করতে চেয়েছিল, যদি আশ্রয়হারানোর পরিণতি তাঁর কাছে বড় হতো, তাহলে এই ‘সুযোগ’-এ সে আনুষঙ্গিক যুক্তি সাজিয়ে ঘটনা থেকে বেরিয়ে যেতে পারত-চুপ মেরে ঘটনা থেকে পালাতে পারত। ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর ফরাসি প্রকাশককে লিখিত একটি চিঠিতে চাঁদের অমাবস্যা-বিষয়ে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছিলেন : ‘আমি যেটা বলতে চাই তা হলো, সেই অশুভ কর্মটি বা সেই অপকর্মের হোতা, কেউই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং সবচেয়ে জরুরি হলো এরকম একটি অপকর্মের বাইরের মানুষটির আচরণ। এটি এমন এক সমস্যা যা ভয়ঙ্কর মাত্রা পাচ্ছে। যুবক শিক্ষকটি এই অপরাধের কাছ থেকে পালায় না, সে পালায় তার আবশ্যিক সিদ্ধান্তগ্রহণ সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে যুক্ত দায়িত্ব থেকে।' এই কারণে সে ঘটনার আরও গভীরে প্রবেশ করতে চেয়েছে-সে কাদেরকে বলে : ‘একটা দুর্ঘটনার কথাই আপনি শুধু বলেছেন। আর কিছু বলেন নাই।’ এর উত্তরে কাদের জানায় যে, সে জানে না তার আর কী বলবার আছে, তখন আরেফকে আবার বলতে হয় ‘বললাম তো! মেয়েলোকটির জন্যে আপনার মায়ামহব্বত ছিলো সে-কথা একবারও বলেন নাই।’ বাক্যের ধরনে এ-বার্তাটি স্পষ্ট যে, সে ধরেই নিয়েছে মেয়েটিকে কাদের ভালোবাসে, কিন্তু পরে, কাদেরের ভাবান্তরে, ঘৃণা ও বিস্ময়ভরা কণ্ঠ শুনে আরেফ বোঝে ‘কাদেরের পক্ষে দরিদ্র মাঝীর বউয়ের প্রতি ভাবাবেগ বোধ করা সম্ভব নয়’। এতে খুবই মর্মাহত হয় আরেফ-এ-প্রসঙ্গে লেখকের বর্ণনা :

না কাদের যে প্রেমিক নয় সে-কথাই তার দুঃখের কারণ নয়। আসল কারণ এই যে, একটি যুবতী নারী নিতান্ত অর্থহীনভাবেই প্রাণ হারিয়েছে। তার মৃত্যুতে কাদেরের মনে একটু দুঃখবেদনা জাগে নাই। শূন্য হৃদয়ে দুঃখ-বেদনা জাগে না। কাদেরের হৃদয়ের শূন্যতার জন্যেই যুবতী নারীর মৃত্যুটা একটি নির্মম হত্যা ছাড়া আর কিছু নয়।

লেখকের বর্ণনায় এ-কথা স্পষ্ট, যুবতী নারীর মৃত্যু অর্থহীন হয়ে উঠেছে তার জন্য কাদেরের মনে দুঃখবেদনা জাগেনি বলে-এই কারণে এই মৃত্যু একটি নির্মম হত্যা, আর, তা থেকে এই সিদ্ধান্তে সহজেই পৌঁছোনো যায় যে, তার দ্বারা মৃত্যু সংঘটিত হলেও কাদের যদি নারীটির প্রতি প্রেমময় হতো তাহলে হত্যাটি নির্মম হতো না, তখন হয়তো হত্যার দৃশ্যমান যে কারণ/কাদের, তার ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রসঙ্গটি উপন্যাসে আরও বিস্তারিত হতো।

এই চিন্তা সাধারণ চিন্তা নয়, বিশেষ চিন্তা-দর্শনগত চিন্তা। এই চিন্তা যে আরেফ করে তাকে সাধারণের পক্ষে ‘পাগল’ ঠাহরানোই স্বাভাবিক, কাদেরও তো তা-ই করেছে, কিন্তু এই চিন্তা যাকে কেন্দ্র করে তার মধ্যে আরেকটি স্বতস্ত্র স্বর আবিষ্কার করতে চেয়েছে সে, খুঁজে পেতে চেয়েছে আরেকটি সত্যের সম্ভাবনা যেখানে মৃত্যুর চেয়েও প্রেম বড়, মমতা বড়। কিন্তু শেষপর্যন্ত কী হলো? মিলান কুন্ডেরা তাঁর বক্তৃতায় টলস্টয়ের আন্না কারেনিনা বিষয়ে উল্লেখ করেছিলেন ‘লিখতে লিখতে ব্যক্তিগত নৈতিক বিশ্বাসের বদলে অন্য এক কণ্ঠস্বর শ্রবণ করেছিলেন তিনি। তিনি শ্রবণ করেছিলেন, বলতে ইচ্ছে করছে, উপন্যাসেরই প্রজ্ঞাবাণী। সকল প্রকৃত ঔপন্যাসিকই সেই অতিব্যক্তিক প্রজ্ঞাবাণী শুনে থাকেন, মহৎ উপন্যাসমাত্রেই সবসময়েই কেন তাদের স্রষ্টার চেয়েও মহত্তর যা থেকে সেই ব্যাখ্যাই পাওয়া যায়। সৃষ্টির চাইতেও বিজ্ঞতর যে ঔপন্যাসিক, অন্যতর কর্মেই নিজেকে নিজেকে নিয়োজিত করুন তিনি বরং।' কিন্তু এই অন্য কণ্ঠস্বরকে উপেক্ষা করে আন্না কারেনিনার প্রাথমিক খসড়ার অনেক কিছু বর্জন করেন টলস্টয়। ওয়ালীউল্লাহ্ যা করলেন-অন্য স্বরকে অস্তিত্বহীন করে দিয়ে আরেফকে আদালতের দিকে ঠেলে দিলেন; এবার চন্দ্রগ্রস্ত আরেফ দিবালোকে ফিরে আসে, চাঁদের অমাবস্যার কারণে ঘটনার মধ্যে আগে সে যে-জটিলতা দেখেছে এখন আর তা দেখে না :

কয়েক মাস আগে বিবাহিত এবং ভদ্রবংশীয় সে-নিষ্কর্মা মানুষটি তাদের গ্রামেরই একটি দরিদ্র মাঝীর সন্তানহীনা যুবতী স্ত্রীর সঙ্গে কোন প্রকারে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করে।...অবস্থা অনুকূল হলেই কাদের যুবতী নারীর সঙ্গে গোপনে দেখা-সাক্ষাৎ করে।...ধর্মনীতিবিরুদ্ধ অবৈধ মিলনের কারণ কি? যুবতী নারী আজ মৃতা। তার মনে কি ছিলো তা আজ জানা সম্ভব নয়। তবে তার সঙ্গে কাদেরের সম্পর্কের কারণ নিঃসন্দেহে বলা যায়। সে-কারণ ইন্দ্রিয়পরায়ণতা।

বোঝা যায়, কাদের সম্পর্কে ‘অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন’, ‘ধর্মনীতিবিরুদ্ধ অবৈধ মিলন’ এবং ‘ইন্দ্রিয়পরায়ণতা’র অভিযোগ ওঠার কারণ সে নিষ্প্রেম, তার হৃদয় শূন্য-এর পক্ষে অনেক যুক্তি হাজির করা সম্ভব, কিন্তু প্রেম নেই বলে যে উৎকটতা ও উগ্রতার সঙ্গে ‘অবৈধ’ ‘ধর্মনীতিবিরুদ্ধ’ ‘ইন্দ্রিয়পরায়ণতা’ ইত্যাদি শব্দগুলো উচ্চারিত হয়েছে তা এই দর্শনগর্ভ উপন্যাসের জন্যে বেমানান। শিবনারায়ণ রায় চাঁদের অমাবস্যার শৈলীকে সূক্ষ্ম আর তাঁর চরিত্রকে প্রমিতাক্ষরিত বলে অভিহিত করলেও, পরিমিতির দিক থেকে উপন্যাসের বারোতম পরিচ্ছেদকে এ-উপন্যাসের দুর্বলতম পরিচ্ছেদ হিসেবে গণ্য করতে হয়-আরেফকে আদালতের দিকে ঠেলে দেওয়ার জন্য উপন্যাসে পূর্ববর্ণিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি এবং শাস্ত্রীসুলভ চিন্তার আরোপ এ-পরিচ্ছেদকে আরেফের ক্ষোভ-প্রশমনের ক্ষেত্ররূপে পরিচিত করেছে। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এ-উপন্যাস সম্পর্কে ওয়ালীউল্লাহ্'র সঙ্গে রশীদ করীমের যে-আলাপ হয়েছিল এখানে তার উল্লেখ করা যেতে পারে :

‘চাঁদের উপন্যাস’ পড়েছো?

‘হ্যাঁ।’

‘কেমন লেগেছে?’

‘গা ছমছম করানো এক উপন্যাস’ বললাম আমি। সেই সঙ্গে আমার আপত্তির কথা জায়গাগুলোও বললাম।

‘এর মধ্যে কিছুই কি তোমার পছন্দ হয় নি?’

‘হ্যাঁ, অনেক কিছু ভালো লেগেছে। বইটি যখন পড়ি, মনে হয় আপনি যেন হাত ধরে মানুষের মনে অন্ধকার অলিগলিতে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছেন। খুব ভয়ঙ্করভাবে হাত চেপে ধরে আছেন। একটুও আলগা করছেন না।’

এগারোতম পরিচ্ছেদ পর্যন্ত রশীদ করীমের কথাটি ঠিক, কিন্তু বারোতম পরিচ্ছেদে এসে সেই হাতটি ছেড়ে দেন ওয়ালীউল্লাহ্ এবং চাঁদের অমাবস্যাও কেটে যায়। অ্যান-মারি যে বলেছিলেন প্রাণসংশয়ের আশঙ্কা সত্ত্বেও নিজের কাছে বিশ্বস্ত, সাক্ষী হওয়ার দায়িত্বপালনকারী একজন সদাশয় সৎমানুষের কাজের খোঁজ পাওয়া যায় আরেফের চরিত্রে, তার পরিচয় উপন্যাসের এই অংশেই-যেটি নীতিগত ক্ষেত্রে বিয়োগান্তিক বটে, কিন্তু দর্শন ও উপন্যাসগত বিচারে নীতিতাড়িত ও ক্লান্তিকর। তবু সার্বিক বিচারে শিবনারায়ণ যে এই উপন্যাসে ‘সব মহৎ রচনার মতো...একটি সার্বকালিক ও সার্বজনিক গূঢ়ার্থ’ খুঁজে পেয়েছেন তা মেনে না নিলে এই মহৎ ঔপন্যাসিকের প্রতি অশ্রদ্ধা পোষণ করা হয়। শিবনারায়ণের কথাটি চাঁদের উপন্যাস-এর ক্ষেত্রে করা হলেও, সার্বকালিক ও সার্বজনিক গূঢ়ার্থ-এর যথার্থ সমন্বয় ঘটেছে কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসে এবং এ-ক্ষেত্রে একথাটিও যোগ করতে চাই যে, এই উপন্যাসটিই হলো তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষার পরিণত রূপ।

চাঁদের অমাবস্যা প্রকাশের চার বছর পর ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হয় ওয়ালীউল্লাহ্'র তৃতীয় উপন্যাস কাঁদো নদী কাঁদো, তার দুই দশক পরে লিয়াকত আলী তাঁর 'ওয়ালীউল্লাহ্'র উপন্যাস : পাশ্চাত্য প্রভাব' প্রবন্ধে লিখেছিলেন ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর উপন্যাসের বিষয় ও আঙ্গিক উভয় কারণে মুষ্ঠিমেয় সমালোচকদের মধ্যে আলোচিত, এর মধ্যে চাঁদের অমাবস্যা ও কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাসের আলোচনায় নিন্দার দিকটাই ভারী-তাঁর মতে, সৈয়দ আবুল মকসুদের ‘গড়পড়তা প্রশংসা’ আর চাঁদের অমাবস্যার ক্ষেত্রে শিবনারায়ণ রায়ের সদর্থক আলোচনা ছাড়া অধিকাংশ আলোচকই তাঁর রচনারীতি ও সৃষ্ট চরিত্রগুলোকে আচ্ছন্ন, দুর্বোধ্য ও বিজাতীয় বলে উল্লেখ করেছেন; কেউ বলেছেন ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাসে ভাষা ও চরিত্র-চিত্রণের কৌশলগত চমৎকারিত্বেরই প্রাধান্য এবং এদেশের পরিবেশ ও আবহাওয়ার অনুপস্থিতিও সেখানে প্রকট, কেউ কেউ পেয়েছেন রহস্যোপন্যাসের স্বাদ, যে-কারণে উপন্যাস দুটির শিল্পমূল্য হয়েছে উপেক্ষিত। এর পর তিনি আবু রুশদের নিম্নোক্ত মন্তব্যটি উদ্ধৃত করেছেন :

তিনি দেশে বহুদিন ছিলেন না বলে বিদেশী নিসর্গ দেশজ আবহাওয়ার সঙ্গে তাঁর অনেক রচনার অনেক জায়গায় মিলে গিয়ে লেখকের সূক্ষ্ম বৈপরিত্ব সৃষ্টির প্রয়াসকে পুরোপুরি সফল হতে দেয়নি। তাঁর ভাষাকে মন্থর করে তুলেছে। তাঁর প্রতীক সমর্পিত মানসকে কাফকা ও ক্যামুর প্রভাবে বড় বেশি জড়িয়ে তাঁর শৈল্পিক স্বাস্থ্য ও স্বাতন্ত্র্য লক্ষ্যযোগ্যভাবে বিঘ্নিত হয়েছে।

উদ্ধৃত মন্তব্যে বিদেশী প্রভাবের কথাটি স্পষ্ট-এই প্রভাবের কারণে শৈল্পিক স্বাস্থ্য ও স্বাতন্ত্র্য বিঘ্নিত হওয়ার কথা স্পষ্ট করে লিখেছেন আবু রুশদ। অন্যত্র, হাসান আজিজুল হকও উল্লেখ করেছিলেন বিদেশী প্রভাবের কথা :


আমার মনে হয় না যে ‘চাঁদের অমাবস্যা’র অনুসন্ধানগুলি আমাদের দেশ ও সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে অবধারিতভাবে প্রাসঙ্গিক। তখনই স্পষ্ট হয় ওয়ালীউল্লাহ্'র উপর কামুর নাছোড় প্রভাব। নাছোড় এজন্যে যে পরের উপন্যাস ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ আমাদের পক্ষে আরো দূর এবং ‘দি প্লেগ’-এর সঙ্গে এর গভীর সাদৃশ্য প্রায় সন্দেহাতীত। এই উপন্যাস দুটি লিখে ওয়ালীউল্লাহ্ নিঃসন্দেহে আমাদের কথাসাহিত্যের ঐশ্বর্য বৃদ্ধি করেছেন, ভাষায় এসেছেন অকল্পনীয় ধার, তাঁর নিরাসক্তি প্রায় ঈশ্বরের মতোই অর্থাৎ শূন্যতার জয়গান। কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি আর বাংলাদেশ ও বাঙালির ঔপন্যাসিক থাকেন না। মনোভাবেই নয় শুধু, উপন্যাসের স্থূল শরীরেও প্রবিষ্ট হয়ে ঘটায় বিদেশী উপস্থিতি।হাসান অবশ্য সরাসরি সে-কথা বলেননি, তবু ভাষা-বিষয়ে সপ্রশংস উল্লেখ সত্ত্বেও তাঁর বাক্যের লক্ষ্যও তাই। তবে তিনি যে উল্লেখ করেছেন ‘শেষপর্যন্ত তিনি আর বাংলাদেশ ও বাঙালির ঔপন্যাসিক থাকেন না’, তা বলার অনেক কারণ ওয়ালীউল্লাহ্'র উপন্যাসে আছে, বিশেষত যে-সমাজবাস্তবকে অন্তরঙ্গ ও শিল্পময় করে তোলার জন্য হাসান আজিজুল হক আজ আমাদের শ্রদ্ধেয়, ওয়ালীউল্লাহ্'র লালসালু-পরবর্তী লেখায় সে-‘সমাজবাস্তব’-এর পরিচয় প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু কথা অন্য জায়গায়-এই বাস্তবতার অভাবে ওয়ালীউল্লাহ্'র লেখকসত্তা ক্ষুণ্ণ হয় কি না, বা ‘অবধারিতভাবে’ তিনি বাংলাদেশি বা বাঙালি ওপন্যাসিক হতে চেয়েছিলেন কি না, সেটিই আসল প্রশ্ন। চাঁদের অমাবস্যা প্রকাশিত হওয়ার পরই তো ফ্রান্সে ওয়ালীউল্লাহ্'র সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন রশীদ করীম এবং কথায়-কথায় বলেছিলেন, ‘বইটি পড়ে কিছুটা কাফকা আর কিছুটা কামুর কথা মনে আসে’, এ-কথার পিঠে কোনো কথা না বলে, একটু হেসে অন্যকথায় চলে গিয়েছিলেন ওয়ালীউল্লাহ্। আন্দাজ করতে পারি, এমন মন্তব্য আরও অনেকেই করে থাকবেন, তিনি নিজেও এই বিষয়ে অ-চেতন, এমন মনে করারও কোনো কারণ নেই, কেননা এই সময়েই তো লিখছিলেন তাঁর তৃতীয় উপন্যাস কাঁদো নদী কাঁদো, এবং সেটি পড়েও যে পাঠকেরা এমন কথা বলবে তাও হয়তো তিনি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন; কিন্তু তারপরও তিনি তাঁর কাজে ছিলেন অবিচল ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী। এমনিতে পাঠক-প্রতিক্রিয়ার প্রতি আর-দশজন লেখকের মতো তিনিও ছিলেন কৌতূহলী, রশীদ করীমের সঙ্গে আলোচনা তো তারই পরিচয়বহ, কিন্তু এরপরও একজন মহৎ লেখকের যে-স্থৈর্য্য ও ঔদাসীন্য থাকা দরকার তা শতভাগই ছিল তাঁর, না হলে সেদিনের সাক্ষাৎকারে রশীদ করীমের এত-এত নঞর্থক মন্তব্যে অন্তত একবার হলেও অস্থির বা নিজের কাজের পক্ষে ঊনলেখকসুলভ পাল্টা যুক্তি খাড়া করতেন ওয়ালীউল্লাহ্, কিন্তু তিনি তা না করে অনুজ লেখককে অবাধে কথা বলতে দিয়েছিলেন-দেখা গেল কাঁদো নদী কাঁদোর টাইপ-করা কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে রশীদ করীম বললেন, ‘যা পড়লাম তা খুব একটা ভালো লাগলো না’ বললেন, ‘ভাষা ঝাঁকি খেতে খেতে এগোয়, ঠিক যেন কাদায় আটকে পড়া কোনো গাড়ির ঘুরন্ত চাকা, হঠাৎ হঠাৎ সামনে ছুটে। ভাষার গতি মোটেও মসৃণ নয়। আর এ ভাষা খামোকাই ভারাক্রান্ত। ন্যারেটিভেও কিছুটা অগোছালো ভাব রয়েছে।’ যে-কোনো লেখা ভালো না-লাগার প্রতিক্রিয়া জানানোর অধিকার সকল পাঠকেরই থাকে, রশীদ করীমেরও আছে, কিন্তু একটি উপন্যাসের পূর্ণ-অভিব্যক্তি উপলব্ধি করার আগেই তার কয়েকটি পৃষ্ঠা পড়ে ভাষা ‘খামোকাই ভারাক্রান্ত’, ‘ন্যারেটিভেও কিছুটা অগোছালো ভাব’ ইত্যাদি বলার অধিকার অবশ্যই তাঁর ছিল না, কিন্তু তিনি তাই করেছিলেন, ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর জবাবে স্বাভাবিকভাবে উপন্যাসগত অভিপ্রায়ের কথা বলতে পারতেন, তুলতে পারতেন চেতনাপ্রবাহ-রীতির কথাও যা তাঁর ঔপন্যাসিক-অভিপ্রায়েরই অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু (রশীদ করীমের কথায়) ‘ওয়ালীউল্লাহ্‌ কোনো মন্তব্য করলেন না।’ হয়তো, ধারণা করি, কুন্ডেরা-বণিত ঈশ্বরের হাসি শুনেছিলেন ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা ওয়ালীউল্লাহ্ও, কারণ, তাঁর উচ্চাকাঙ্ক্ষার আড়ালে রয়েছে যে-আত্মবিশ্বাস তাতেই তাঁর সেই ভবিষ্যৎ দেখতে পারছিলেন-যেখানে বাঙালি পাঠককে ঝাঁকি খেতে-খেতে তাঁর উপন্যাসকে বুঝতে হচ্ছে। এ-কথার পক্ষে শওকত আলীর ওয়ালীউল্লাহ্-বিবেচনা আমাদের প্রাসঙ্গিক হতে পারে-২০০৩ সালে প্রকাশিত শওকত আলীর প্রবন্ধ বইয়ের ভূমিকায় তিনি লিখেছিলেন :

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্'র প্রথম বই বের হয় ১৯৪৮-এ, কলকাতা থেকে। কিন্তু তাঁর লেখা গল্প-উপন্যাস বা নাটক নিয়ে তেমন আলোচনা হতে দেখা যায়নি। ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে তাঁর চাঁদের অমাবস্যা এবং তারপরে কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাস দু’খানি প্রকাশিত হলে আমরা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে পড়ি। মাটি আর মানুষের উপাদান নিয়ে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুনতর আঙ্গিক প্রয়োগ করে আমাদের উপন্যাস সাহিত্যকে যে আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে তা আমরা সবাই বুঝতাম না। বিষয়টি নিয়ে আমাদের ভাবতে হয়েছে এবং সে কারণে আমাদের লেখালেখিও করতে হয়েছে এবং হচ্ছে। তাই সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্'র উপন্যাস নিয়ে লেখা প্রবন্ধটি এ বইয়ের অনেকখানি জায়গা দখল করে রেখেছে।

শওকত আলীর এই উপলব্ধি একজন একাপাঠকের উপলব্ধি নয়, ওয়ালীউল্লাহ্ জানা-অজানা অসংখ্য পাঠকের মনের কথাটি এই কয়েকটি বাক্যে ফুটে উঠেছে। তাঁর চাঁদের অমাবস্যা ও কাঁদো নদী কাঁদো উপন্যাস ও কিছু গল্পের ভাষা-বিষয়ের যে-যুগলরূপ, তার গড়নটাই এমন যে, তাঁর লেখা পড়ামাত্র পাঠককে-তিনি তাঁর লেখা পছন্দ করুন আর নাই করুন-বিহ্বল আর অভিভূত হয়ে পড়তে হয়, পরে সেই অভিভূতি থেকে বের হয়ে পাঠককে তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করতে হয়, সিদ্ধান্তে যেতে হয়, সিদ্ধান্ত পাল্টাতে হয়, কারণ পড়া শেষ হয় না, বা আপাত শেষ হয়ে গেলেও, মনের মধ্যে পাঠের ক্রিয়া চলতে থাকে নিরন্তর-সত্য কথা বলতে গেলে, লেখকের আকাঙ্ক্ষা বা উচ্চাকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রটিও সেখানে। এ-প্রসঙ্গে কারও কারও মনে পড়ে যেতে পারে ফ্রানজ কাফকার লেখা সম্পর্কে আলবেয়ার কামুর সেই মন্তব্যটি যেখানে তিনি বলেছিলেন, কাফকার সমগ্র শিল্প এমনভাবে গঠিত যে, তা পাঠককে বারবার পড়তে বাধ্য করে : ‘তাঁর সমাপ্তি বা সমাপ্তিতে তাঁর অনুপস্থিতি’র ব্যাখ্যা দিতে বলা হলে স্পষ্ট ভাষায় সেই ব্যাখ্যা প্রকাশ পায় না, তবু যুক্তিযুক্ত মনে হয়; গল্পে এমন কিছু থাকে যার জন্য পুনর্পাঠ করতে হয় এবং একাধিক অর্থের সম্ভাবনা দেখা দেয়। শওকত আলীর ‘সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্'র উপন্যাস’ শীর্ষক সবিস্তার প্রবন্ধটিও এরকম একাধিক/বারবার পাঠ-প্রতিক্রিয়ার ফল। তাঁর প্রবন্ধে ওয়ালীউল্লাহ্'র তিনটি উপন্যাসের মধ্যে লালসালুর খুব কম দৃশ্যই আছে যেখানে তিনি চোখ ফেলেননি; একই কাজ করতে চেয়েছেন বাকি দুটি উপন্যাসের ক্ষেত্রেও, কিন্তু এগুলোর বহুস্বরিক গুণের কারণেই আরও বহু কিছু অনালোচিত রয়ে যায় এবং সেটাই স্বাভাবিক। এই বই দুটির যে-দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন শওকত আলী, তার মাধ্যমে তিনি এমন কিছু সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যা ওয়ালীউল্লাহ্'র জন্য সম্মানজনক কি না সহজে বোঝা যায় না-তিনি লিখেছেন, উনিশ শতক থেকে রবীন্দ্র-পরবর্তী সাহিত্যের ধারার সঙ্গে ওয়ালীউল্লাহ্‌-কে মেলানো সম্ভব নয়, বাংলা সাহিত্যে তিনি একক, তাঁর পথে তিনি একাকী এবং এ-প্রশ্ন তোলা অনুচিত জ্ঞান করেও উল্লেখ করেছেন, ‘আদৌ কি তিনি বাংলা সাহিত্যের পরিমণ্ডলের লেখক?' অবশ্য এই লেখায় তিনি যে-ভাবে ওয়ালীউল্লাহ্'র বই দুটি নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং এর অনেক সদ্গুণ-বিশেষত চাঁদের অমাবস্যার-খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন তাতে উক্ত মন্তব্যকে সদর্থক বিবেচনা করাই সঙ্গত। এরপরও দুটি উপন্যাসের আলোচনা শেষে তিনি পাঠকদের তরফ থেকে কিছু প্রশ্ন তুলতেও ভোলেননি। চাঁদের অমাবস্যার আলোচনা শেষে যুবক শিক্ষক আরেফের সত্তা-আবিষ্কারের প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, ব্যক্তির এই আবিষ্কার সর্বজনীন নয়-আরেফ একজন না হয়ে দু-জনও হতে পারে, আর তা যদি হয়, তো, বিচ্ছ্ন্নি ব্যক্তির মনোলোকে নিমজ্জিত হওয়ার মধ্যে জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করার ইঙ্গিত থাকে কি না; আর কাঁদো নদী কাঁদো নিয়ে আলোচনার শেষের দিকে লিখেছিলেন, ‘ওয়ালীউল্লাহ কোনো জীবনের শিল্পী? প্রত্যক্ষ জীবনের, না পরোক্ষ জীবনের, মৃত্যুমুখী জীবনের, না জীবনমুখী জীবনের? কারণ জীবনশিল্পী উপন্যাস-লেখকের শিল্পরচনার চূড়ান্ত বিশ্লেষণে এ প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই’-এই প্রশ্ন জাগবার কারণ ভাঙা, দোমড়ানো-মুচড়ানো, আচ্ছন্ন, ভীত ও আক্রান্ত মানুষই হলো ওয়ালীউল্লাহ্'র উপন্যাসের চরিত্র, এদেরকে কখনোই সম্পূর্ণ মানুষরূপে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায় না। কিন্তু এই সব প্রশ্ন-অনুযোগ-অভিযোগ যাই বলি না কেন, তা কি ওয়ালীউল্লাহ্'র উপন্যাসের দুর্বল কোনো দিক? ওয়ালীউল্লাহ্ কি এই সব বিষয়ে সচেতন ছিলেন না? এ-সূত্রে আবার সেই কথায় চলে যাওয়া যেতে পারে যে ওয়ালীউল্লাহ্ ‘অবধারিতভাবে’ এবং আক্ষরিক অর্থে, বাংলাদেশি বা বাঙালি ঔপন্যাসিক হতে চেয়েছিলেন কি না, আবার ফিরে আসা যেতে পারে সেই প্রসঙ্গেও, তিনি ‘জীবনমুখী জীবনের’ শিল্পী হতে চেয়েছিলেন কি না-এই সব। এ-বিষয়ে স্বাক্ষ্য নেওয়া যেতে পারে তাঁর স্ত্রী অ্যান-মারি ওয়ালীউল্লাহ্ :

সফোক্লিসের মতো প্রাচীন গ্রিক লেখকই হোক আর ফরাসি ভলতের বা বাঙালি হিন্দু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই হোক, বিশ্বনাগরিক হিসেবে পৃথিবীর সব সাহিত্যকে ও নিজের সাহিত্য বলে গণ্য করত। তাদের চিন্তা, তাদের পদ্ধতি বা তাদের কাছ থেকে যা কিছু সে আদায় করতে পেরেছে, তার সবই সে নিজের সংস্কৃতি ও মানুষ-পূর্ববাংলার মুসলমান কৃষকদের ওপর প্রয়োগ করত।...পশ্চিমা আর অপশ্চিমা সাহিত্যের মধ্যে ও কোনো তফাৎ করত না। জাপানিই হোক আর ইতালীয়ই হোক, হোক তা প্রাচীন বা আধুনিক, বিশ্বের সব সাহিত্যকে ও মানুষের অভিন্ন উত্তরাধিকার বলে গণ্য করত।

অ্যান-মারির মন্তব্যে এ-কথাটি স্পষ্ট যে ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর সাহিত্য-রচনার ক্ষেত্রে বিদেশি সাহিত্যের তত্ত্ব ও সদ্গুণের মর্ম গ্রহণে ঠিক কী মনোভাব পোষণ করতেন, সেই সঙ্গে এই আন্দাজও করা যায় একই বিষয়ে রশীদ করীমের মন্তব্যের বিরোধিতা তিনি কেন করেননি। কিন্তু এ-ক্ষেত্রে যে-কথাটি মনে না রাখলে তাঁর প্রতি অবিচার করা হয় তা হলো : যে-অন্তর্দৃষ্টির আলোকে তিনি বিদেশি সাহিত্যের মর্ম গ্রহণ করেছিলেন তার সঙ্গে গভীরভাবে মিশেছিল স্বদেশকেন্দ্রী দূরদৃষ্টির প্রজ্ঞা ও প্রতিভা। তাঁর সৃষ্টিকর্মে এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছিল দীর্ঘদিনব্যাপী বিদেশে থেকে ‘দেশ’কে আরও গভীরভাবে আরও তাৎপর্যের সঙ্গে উপলব্ধি করেছিলেন বলে। এ-ছাড়া কোনো জায়গা নিয়ে কিছু লিখতে গেলে সেই জায়গা থেকে দূরত্বে থাকাটাকে জরুরি মনে করতেন তিনি-আমাদের প্রচল্-বার্তায়-অভ্যস্ত কানে উক্তিটি যে-রকমই শোনাক, ফ্রান্সকে নিয়ে কেন লিখছেন না এ-প্রশ্নের জবাবে এমন কথাটিই বলেছিলেন ওয়ালীউল্লাহ্। এই দূরত্ব ভৌগোলিক দূরত্ব, মনের দূরত্ব নয়, তিনি যেখানেই থাকুন বা যা-ই গ্রহণ করুন না কেন, তাঁর মনে সবসময় জীবন্ত গ্রাম-সমাজ-প্রকৃতি নদীনালা সুপারি-নারকেল গাছ ধানক্ষেতের অক্ষয় ছবি, ফলে তিনি যে-রূপেই লিখুন না কেন তাঁর লেখা সেই স্মৃতি-অভিজ্ঞতাকে ছাড়িয়ে-যাওয়ার কথা নয়, যায়ওনি। এই সব বলার অর্থ এই নয় যে দেশ-বিদেশের এমন যুগল রূপ আলাদা-আলাদাভাবে কোনো দেশ বা অঞ্চলের প্রতিনিধিত্ব করবে, বরং এই দুই-এর মধ্যকার ভেদ মোচন করে সর্বদেশের ও সর্বকালের সাহিত্য হয়ে-ওঠার উচ্চাকাঙ্ক্ষা ধারণ করেছিল ওয়ালীউল্লাহ্'র উপন্যাস এবং সফলও হয়েছিল। বিশ্বসাহিত্যের একনিষ্ঠ ও সতর্ক পাঠক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কাঁদো নদী কাঁদো পড়ে চিরকালীন রূপ আবিষ্কার করে লিখেছিলেন :

ভবিষ্যতের পাঠক ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ পড়বেন, যেমন এসময়ের পাঠকেরা পড়েছেন এবং পড়ে চমৎকৃত হচ্ছেন এর আধুনিকতার জন্য। একথা সত্য যে বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের অভাব নেই, কিন্তু প্রকৃত আধুনিক উপন্যাস হাতের আঙুল গুণে বলা যাবে। ওয়ালীউল্লার আধুনিকতা কী? সে কি শুধু অতি আধুনিক একটি পদ্ধতির ব্যবহার, তার মাধ্যমে একটি আধুনিক-জীবন-দর্শন উপহার? আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং চরিত্রচিত্রণ? ওয়ালীউল্লাহ্'র আধুনিকতায় এসব থাকলেও এদের বাইরে গিয়ে একটি ব্যক্তি ও একটি সময়কে চিরতরে সমসাময়িক করে রেখেছে তাঁর শিল্প।

তিনি আরও লিখেছেন এতে বিবৃত হয়েছে আদিম পৌরাণিকতার উপাদান, উপন্যাসের মুহাম্মদ মুস্তফা ও তবারক ভূইঞা যে-পৃথিবীতে বাস করে সেখানে ভালভাবে সভ্যতার আলো পড়েনি, শেষবিচারে কুমুরডাঙ্গা কোনো শহর নয়, সেটি ‘মানুষের প্রবৃত্তির একটি অন্ধকার লীলাক্ষেত্র’। এ-প্রসঙ্গে নিয়ে এসেছেন কাফকার দি ক্যাসল-এর দুর্গ-সংলগ্ন শহরটির প্রসঙ্গ যাকে কেন্দ্র করে উপন্যাসের গল্প তৈরি হয় এবং একসময় তা ‘পাঠকের অজান্তে তার অন্ধকার বোধ অনুভূতিগুলোকেই রূপায়িত করে, স্থান হয়ে দাঁড়ায় মানুষের গভীর ও অন্তর্গত জীবনের প্রতীক’; এরপরও তিনি ওয়ালীউল্লাহ্'র নিজস্ব ‘দেশ’-বোধ এবং আধুনিক উচ্চাকাঙ্ক্ষী দূরদৃষ্টি লক্ষ করেছেন বলেই তাঁর সম্পর্কে লিখতে পেরেছেন উপস্থাপনার জাদুস্পর্শে কুমুরডাঙ্গার মানুষজনকে সর্বজনীন করে তুলেছেন ওয়ালীউল্লাহ্।

ওয়ালীউল্লাহ্ তাঁর উপন্যাসে যে-বাস্তবকে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন তার জন্য চেতনাপ্রবাহ-রীতি ও অস্তিত্ববাদের আবহ গ্রহণ করা অনিবার্য ছিল কি না সে-প্রশ্ন আলাদা, কিন্তু এখানে তা যে-রূপে গৃহীত সেটি নানা তাৎপর্যে হয়ে উঠেছে প্রাসঙ্গিক ও ব্যঞ্জনাময়। চেতনাপ্রবাহ-রীতির যুক্ততার বিষয়টি মনে আসে উপন্যাসের উত্তম পুরুষের কথক আর তবারক ভূইঞার গল্প বর্ণনার সূত্রে, কারণ তাদের মাধ্যমেই উপন্যাসের বিষয় ও চরিত্রের সঙ্গে পাঠকের পরিচয়। উপন্যাসের জট খোলা বা তাকে জটিল-করে-তোলা-দুটোর দায়িত্ব উত্তম পুরুষের কথকের উপরে থাকলেও হতো, কিন্তু এখানে তবারক ভূইঞাও গল্পের আরেক কথক; উত্তম পুরুষের কথক তবারক ভূইঞার কাছ থেকে কারও/মুহাম্মদ মুস্তফা-বিষয়ে কথা শোনার অপেক্ষা করে; আবার কথকের মনে এই সন্দেহও জাগে যে, তবারক ভূইঞা ঠিক তবারক ভুইঞাই কি না-সব মিলিয়ে পাঠককে ধাঁধায় ফেলে যে-আকাঙ্ক্ষিত বাস্তবকে রূপ দিতে চেয়েছিলেন লেখক, তার জন্য যে-রীতি দরকারি হয়ে পড়েছিল, নিজের মাটির উপর দাঁড়িয়ে ওয়ালীউল্লাহ্'র গ্রহিষ্ণু মন সেই রীতিটিই গ্রহণ করেছিল। আধুনিক বাংলা কবিতায় জীবনানন্দের কাব্যচেষ্টা ও নজিরবিহীন সাফল্যের ইতিহাস আজ সকল মনোযোগী পাঠকেরই জানা, কিন্তু এ-কথাও তো কারও অজানা নয় যে তাঁর কবিতার রীতিটি তিনি কোথা থেকে গ্রহণ করেছিলেন-শুধু রীতিই বা বলছি কেন, তাঁর কবিতার ওপর পাশ্চাত্য-কবিদের বিষয়ানুষঙ্গের প্রভাব নিয়েও তো একসময় পাতার পর পাতা লিখিত হয়েছে। জীবনানন্দ আজ বাঙালির একান্ত গর্বের ধন, নানা তর্ক-বিতর্কের পর এতদিনে তাঁর মৌলিকত্বও প্রশ্নাতীত; কিন্তু ক্ষেত্র আলাদা হলেও, ওয়ালীউল্লাহ্'র উপন্যাস-চেষ্টা কি তাঁর চেয়ে ভিন্নতর কিছু? আধুনিক বাংলা কবিতার তিরিশের পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে সুধীন্দ্রনাথ, বিষ্ণু দে ও বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে তো সাক্ষাৎপরিচয় ছিলই তাঁর, স্টেট্সম্যান সম্পাদনার সূত্রে জীবনানন্দের সঙ্গেও পত্রযোগাযোগ ঘটেছিল-এই সূত্রে, পাশ্চাত্য রীতি গ্রহণ করা সত্ত্বেও, বাংলা কবিতা যখন পাঠক ও সমালোকদের কাছ থেকে তার প্রাপ্য সমর্থন আদায় করে নিচ্ছিল, তখন, যাটের দশকে পৌঁছে, উপন্যাসের ক্ষেত্রে, সেই দৃষ্টান্ত থেকে প্রেরণা তো নিতেই পারেন ওয়ালীউল্লাহ্; কিন্তু দুঃখজনক ঘটনা হলো, আধুনিক বাংলা কবিতার আলোচনায় আমরা যে-বিশ্ববোধের পরিচয় দিয়েছি, আধুনিক উপন্যাসের আলোচনায় তার সিকি ভাগও দিতে পারিনি। সেটুকু দিতে পারলে ওয়ালীউল্লাহ্'র উপন্যাসের আরও বহু সদ্গুণ আমাদের নজরে পড়ত। আর তা হলে-এবং কাঁদো নদী কাঁদো লেখার মাত্র তিন বছরের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু না ঘটলে-বাংলা উপন্যাসের ইতিহাসে আরও প্রভাবশীল কোনো বাঁক/ধারা সৃষ্টি করে যেতে পারতেন ওয়ালীউল্লাহ্। এরপরও যতটা হয়েছে, বিশেষ করে বাঙালি মুসলমান সমাজে ধর্মের যে-নাছোড় প্রভাব এবং তাঁকে কেন্দ্র করে শোষণ ও দুষ্কর্মের পথ যে তৈরি হয়, বহুস্বরের নিরিখে তার বিশ্লেষণে যে-দুঃসাহস দেখিয়েছেন ওয়ালীউল্লাহ্ সেটি কোনো সাধারণ ঘটনা নয়।

ওয়ালীউল্লাহ্'র আলোচকেরা তাঁর সাহিত্য বিবেচনার ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলমানের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতের ওপর গুরুত্ব প্রদানের কারণও সেখানে। ওয়ালীউল্লাহ্'র স্ত্রী অ্যান-মারিও বেড়ে ওঠার সূত্রে, ধর্মীয়ভাবে না হলেও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাঁকে বাঙালি হিন্দুর বিপরীতে 'বাঙালি মুসলমান' বলতেন-বিশেষত ভাষা ও বিষয়/বিষয়ানুষঙ্গ ব্যবহারের ক্ষেত্রে তিনি যে স্বাতন্ত্র্য দেখিয়েছেন তার নেপথ্যে কাজ করেছে তাঁর ওই বিশেষ পরিচয়টি। এমনিতে প্রচলিত ধর্মকর্মে আস্থা ছিল না তাঁর, কিন্তু যে-সমাজে বড় হয়েছেন তাদের নানাবিধ দুরবস্থা তাঁকে পীড়িত করেছিল বলেই সাহিত্যের বিষয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি সেই সমাজকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন :

আমরা মুসলমান। হয়তো-বা মাত্র কয়েক ঘর আমরা শহরে বাস করি এবং আমাদের বাড়ি শহরে। তাছাড়া আমরা যে-বিরাট সমাজসভ্যতার জঞ্জাল, সে-সমাজের পক্ষে অতি আধুনিকতম সাহিত্যের তেমন প্রয়োজন রয়েচে কী? এবং সে সাহিত্য যদি ব্যর্থ হয় তবে সে ব্যর্থতা হবে সেই রকম-ভারতীয় প্রাচীন শিল্পকলা ছেড়ে কিছুরও মধ্যস্থতা না নিয়ে একলাফে সুররিয়ালিজম শুরু করার যে-ব্যর্থতা।

কাজি আফসারউদ্দিন আহমদকে লিখিত ওয়ালীউল্লাহ্'র এ-মন্তব্যে বিষয়নির্বাচনের ক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি একদম স্পষ্ট। অ্যান-মারিও জানিয়েছিলেন ধর্মের লেবাসে সমাজে যে-প্রতারণা চলে, যে-কোনো ধর্মের ক্ষেত্রেই, তার প্রতিবাদ করেছেন ওয়ালীউল্লাহ্, তবে যে-ধর্ম সম্পর্কে তিনি বেশি পরিচিত, যেটিকে তিনি তার দেশের মানুষের দারিদ্র্য ও পশ্চাদ্পদতার জন্য দায়ী মনে করতেন তার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন আরও বেশি প্রতিবাদী-অ্যান-মারির মতে-ওয়ালীউল্লাহ্ ঠিক ধর্মের বিরুদ্ধে ছিলেন না, ছিলেন গ্রামের মোল্লাদের হাতে ক্ষমতার অস্ত্র হিসেবে ধর্মের ব্যবহার বা মানুষের স্বাধীনতার পথের বাধা যে-কোনো কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে। এ-কথা থেকে আমাদের সহজেই মনে পড়বে লালসালু ও চাঁদের অমাবস্যার কথা, কিন্তু কাঁদো নদী কাঁদোর বিষয় ও পরিপ্রেক্ষিত ভিন্ন-এ-উপন্যাসটি তাঁর বহুস্বরিক গুণের কারণে লেখকের আকাঙ্ক্ষিত বক্তব্য নানা রূপে, নানা স্বরে উপস্থাপিত হয়।

উপন্যাসে এখানে এমন চরিত্রও রয়েছে, যে খুন করা সত্ত্বেও মসজিদে গিয়ে প্রকাশ্যে ঘোষণা দিতে পারে সে নির্দোষ আর সে-খবরটি গ্রামে পৌঁছার পর যে-প্রতিক্রিয়া হয় তাতে ধর্ম-প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ওই অঞ্চলের মানুষদের মনোভাব বোঝা যায় :

খবরটি বাড়ীর সবাইকে স্তম্ভিত করে। বস্তুত কিছু সময়ের জন্যে সকলে কেমন বাকশূন্য হয়ে পড়ে। তাদের মনে হয়, মসজিদঘরে কথাটি বলে ধূর্ত কালুমিঞা আমাদের সঙ্গে বড়ই শয়তানি করেছে, যেন যাকে আমরা প্রায় ধরে ফেলেছিলাম সে হাত থেকে ফস্কে গিয়ে একটি দুর্গের মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে। দুর্গটি সাধারণ দুর্গও নয়, সেটি আকায়িদ-ঈমানে তৈরী দুর্গ।

এই দুর্গ কঠিন দুর্গ, এই ধর্মদুর্গে আশ্রয় নিলেই যে সবাই তার কথা বিশ্বাস করবে তা ঠিক নয়, সাধারণত ভীত মানুষের মুখে এমন স্বর তো এমনি-এমননি চলে আসতে পারে যে ‘মসজিদে কেউ মিথ্যা কথা বলে না’, আবার এমন স্বরও রয়েছে উপন্যাসে-‘যে-মানুষ খোদার বান্দাকে খুন করতে ভয় পায় না সে-মানুষ খোদার ঘরে মিথ্যা বলতে ভয় পাবে কেন?’ অন্যত্র, কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীদের সম্বন্ধে একজন দারোগার স্বরে কথকের উক্তি : ‘সে যদি কুমুরডাঙ্গার নিন্দা করে থাকে তার কারণ সে-শহরের ধর্মাভাব, যে-ধর্মাভাব শুধু জনসাধারণের মধ্যে নয়, শহরের নেতৃস্থানীয় শিক্ষিত এলেমদার লোকেদের মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়। বাইরে তারা ধার্মিক কিন্তু সে-ধার্মিকতা একটি মুখোশ মাত্র।’ দারোগার মতে, কুমুরডাঙ্গার লোকেরা হিংসুটে, নিচুমনা, নিজের নাক কেটে পরের ক্ষতি করে, আর সেখানকার অর্থনৈতিক অবস্থাটা খারাপ হওয়ার কারণ তাদের অধার্মিকতা। এবার দারোগা সম্পর্কে কথকের বর্ণনা : ‘এরপর খাকি রঙের পুলিশি পোষাকের আড়াল থেকে দারোগার ধর্মপ্রাণ উঁকি মারতে সময় লাগেনি এবং এ-সময় তার গোঁফ-কামানো মাথা-মুড়ানো কিন্তু দীর্ঘ দাড়ি শোভিত মুখাবয়বটিও মুহাম্মদ মুস্তফা প্রথম লক্ষ্য করে’-এই দারোগার প্রতি, উপন্যাসে যা দেখতে পাই, মুহাম্মদ মুস্তফার মনে শ্রদ্ধার ভাব জেগেছিল, কিন্তু কথকের বলার ধরনে কোনও শ্রদ্ধা নেই, আছে নিরুপায় করুণা। মুহাম্মদ মুস্তফার মনে শ্রদ্ধা জাগাটাই স্বাভাবিক, কারণ সে ধার্মিক কি না জানি না কিন্তু সে ধর্মভাবে আক্রান্ত এবং ভীরু : তার ভাবনা থেকেই বেরিয়ে এসেছিল ‘মসজিদে কেউ মিথ্যা কথা বলে না’, সেটি সেই ভীরুতার জন্যই। এতকিছুর পরও মুহাম্মদ মুস্তফা চরিত্রটি নানা কারণে আমাদেরকে কৌতূহলী করে তোলে : তার বিয়ের সংবাদ জেনে খোদেজা যখন আত্মহত্যা করে তখন চাঁদের অমাবস্যার স্কুলশিক্ষক আরেফের মতো-যদিও বিপরীতভাবে-ভাবতে চেষ্টা করে যে, এর জন্য সে দায়ী নয়; কিন্তু একসময় সেও আত্মহত্যা করে। কিন্তু কেন? এর কারণ কি ভীরুতা? আরেফ যেমন ঘটনা থেকে পালাতে পারত, সেও তো পালাতে পারত, তবু তারা কেউই পালায়নি। আরেফ আদালতে হাজির হয়েছিল, সেখানে জয় হয়েছিল নীতির, কিন্তু মুহাম্মদ মুস্তফার বিষয়টি তো সেরকম নয় শুধু? আলবেয়ার কামু ‘ঈশ্বরহীন, যুক্তিহীন, ন্যায়হীন, অর্থহীন অস্তিত্বের থেকে পরিত্রাণের উপায়' হিসেবে আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেছিলেন, কিন্তু মুহাম্মদ মুস্তফার ক্ষেত্রে কী হয়েছিল-খোদেজার আত্মহত্যার জন্য অপরাধবোধ তো আছেই, সে-প্রসঙ্গ বিস্তারিত রয়েছে উপন্যাসে, এ-ছাড়াও আত্মহত্যার পেছনে পিতার মৃত্যুপরবর্তী তার মানসিক অবস্থাও কাজ করেছে। তার পিতার মৃত্যুর পর সে শুনেছিল ‘বদলোকের নছিবে অপঘাতে মৃত্যুই বরাদ্দ থাকে’, সে জানতে পারে তার বাবা ছিল ‘অতিশয় দুর্বৃত্ত’, অনেক মানুষকে ধ্বংসের পথে বসিয়েছিল, নিরপরাধ শিশুদের দণ্ডিত করেছিল, এরপরও ‘নির্দয়ভাবে দেয়া বৃত্তান্তসমৃদ্ধ বিবরণে, কখনো তীব্র ঘৃণাভরা কণ্ঠে নিক্ষিপ্ত অভিযোগে, কখনো আবার স্পষ্টতই পরস্পরবিরোধী বিবৃতিতে-এ-সবে মিলে মুহাম্মদ মুস্তফার মনে ক্রমশ যে-মানুষের চিত্র স্পষ্টাকার রূপ ধারণ কবে সে-মানুষকে সে যে চিনতে পারে তা নয়, তবু তাকে প্রত্যাখ্যান করতেও সাহস হয় না তার। কখনো কখনো তার মনে হয়, সে যেন এমন একটি মানুষের কথা শুনছে, জীবনে যার কোনো উদ্দেশ্য ছিলো না।’ মনে হয় সে যেন তার বাবার অপরাধ লঘু করতে চাইছে, কিন্তু আসলে তা নয়, সে ভাবে-‘একটি বিশেষ স্তর পেরিয়ে যাবার পর মানুষের পাপ-দুষ্কর্ম আইনের দাঁড়িপাল্লায় হয়তো ওজন করা যায় কিন্তু অন্তরের দাঁড়িপাল্লায় ওজন করা যায় না।’ বোঝা যায়, জগতের বাস্তবতাই যেন মেনে নিচ্ছে মুহাম্মদ মুস্তফা; কিন্তু এই সব ভেবে কি নির্ভার হতে পারে সে? দেখা যায় মানসিক যন্ত্রণায় আস্তে আস্তে অসামাজিক হতে থাকে সে-নিয়মিতভাবে সামাজিক ‘মাজহাবী জমাতে-বৈঠকে’ হাজির হয়, এ-সামাজিকতার উদ্দেশ্যও হলো সমাজের কৌতূহল এড়ানো; ধীরে ধীরে সে নিজেকে এমনভাবে নিশ্চিহ্ন করে ফেলে যে সামনে থাকলেও অনেকে বলে উঠত ‘কোথায় গেলো মুহাম্মদ মুস্তফা ?’ এ যেন নিজেকে একদম অস্তিত্বহীন করে-ফেলা-এই অবস্থায় কথক তবারকের ভাষ্য : ‘জীবন সম্বন্ধে কী একটা নিদারুণ ভীতিই তাকে ক্রমশ আচ্ছন্ন করে ফেলেছিলো’। কিন্তু এ-ভাষ্য মেনে-নেওয়া মুশকিল-কথকের ভাষ্য তো লেখকের কোনো-না-কোনো স্বরেরও ভাষ্য, সে-হিসেবে এমন মনে করার কারণ আছে যে, চরিত্রসম্বন্ধে তাঁর সিদ্ধান্তবাক্যকে-ছাপিয়ে অপরাপর সত্তার সংস্পর্শে এসে তাঁরই চরিত্র অন্য বেদনায় পৌঁছে গেছে-এই বেদনা অর্থকীর্তিসচ্ছলতা-হীন আরও এক ‘বিপন্ন বিস্ময়’-এর বেদনা, এই বেদনা আরেফের আদালতমুখী সাহসের(?) বিপরীত ভীতিজাত মৃত্যুমুখী বেদনা নয়; তাহলে ‘বিপন্ন বিস্ময়’ আর তার বেদনাটাই বা কী? কামু যে বলেছিলেন মানুষ এক অনিবার্য সত্যের শিকার, একবার মেনে নেওয়ার পর আর তা থেকে মুক্ত হতে পারে না, মুহাম্মদ মুস্তফাও কি সেরকম কোনো-খেদমত উল্লাহ কি খোদেজার সঙ্গে-অলিখিত ও বিমূর্ত বন্ধন/প্রেম/সত্য-এর শিকার, বিপরীত যুক্তি থাকা সত্ত্বেও যা সে মেনে নিতে বাধ্য? হয়তো,-কারণ, এমন অবস্থায় পৌঁছলেই একজন নিরাশ ও সচেতন মানুষ নিজের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আর ভাবে না-আত্মহত্যা করে বসে। হয়তোবা এই সব কিছুই নয়-উপন্যাসের চরিত্র ও তার পাঠক সম্পর্কে ঔপন্যাসিকের আরও কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা হয়তো রয়ে গেছে কোথাও যা এই লেখায় অনাবিষ্কৃত : যেমন নবি মুহাম্মদ ও তাঁর স্ত্রী খাদিজার নামে উপন্যাসের দুটি চরিত্রের নাম কেন? কারবালার সেই সকিনার নামে আরেকটি চরিত্রের নাম কেন যে-কিনা নদীর কান্না শোনে; আর নদীটাই বা কেন কাঁদে? কথক বলে, নদী কাঁদে কুমুরডাঙ্গার অধিবাসীদের জন্য, বিশেষত মুহাম্মদ মুস্তফার জন্যে, তাহলে লেখকের/কথকের কেন মনে হয় ‘নিষ্ফল ক্রোধ’-এ কাঁদছে নদী? কেনইবা লেখককে বলতে হচ্ছে ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, এর সঙ্গে পৌরাণিক চরিত্রগুলোর নানা সম্পর্ক আবিষ্কার করা হয়তো সম্ভব, কিন্তু তার কোনো সন্ধানই তো করা গেল না এই উপন্যাসে-এই সব কারণেই উপন্যাসের কাছে ঔপন্যাসিকের উচ্চাকাঙ্ক্ষার কাছে বারবার ফিরে-যাওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই আমাদের।


উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ..

সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের গল্প শ্বেতপাথরের টেবিল


শ্বেতপাথরের টেবিলটা ছিল দোতলায়, দক্ষিণে রাস্তার ধারের জানালার পাশে। ঠিক চৌকোও নয়, গোলও নয়। চারপাশে বেশ ঢেউ-খেলানো। অনেকটা আলপনার মতো। বেশ বাহারি একটা ফ্রেমের ওপর আলগা বসানো। নিজের ভারেই বেশ চেপে বসে থাকত। পাথরটা প্রায় মণ দুয়েক ভারী। ফ্রেমের চারদিকে জাফরির কাজ করা কাঠের ঝালর লাগানো ছিল। সারা ফ্রেম ঘিরে ছিল অসংখ্য কাঠের গুলি। গোল গোল ডাম্বলের মতো। দুদিক সরু। অনেকটা পালিশ করা পটলের মতো। ঘোরালে সেগুলো বনবন করে ঘুরত। পায়া চারটে ছিল কারুকার্য করা থামের মতো। তলায় ছিল ভরাট পাদানি।

যে বয়সে আমার বাবার যৌবন ছিল, মাথায় একরাশ কোঁকড়ানো কালো চুল ছিল, সামনে চেরা সিঁথি ছিল, ঠোঁটের ওপর বাটারফ্লাই গোঁফ ছিল, যে বয়সে তিনি বিকেলে পায়ে বার্নিশ করা জুতো পরে, ইয়ংসাহেবের উপহার দেওয়া গ্রেহাউন্ড চেনে বেঁধে নদীর ধারে বেড়াতে যেতেন। সেই সময় টেবিলটারও যৌবন ছিল। বাবাই কিনেছিলেন নিলাম থেকে। টেবিল আর কড়িকাঠ থেকে ঝোলানো যায় এমন একটা দোলনা একই সময় বাড়িতে এসেছিল।
বড় হতে হতে আমার চিবুকটা যখন শীতল পাথরে রাখার মতো অবস্থায় এলো তখন দেখতাম রোজ সকালে চেয়ারে উবু হয়ে সামনে একটা ডিমের মতো আয়না রেখে বিচিত্র-মুখভঙ্গি করে বাবা দাড়ি কামাচ্ছেন। দাড়ি কামাবার সময় পাশে দাঁড়ালে বাবা খুব রেগে যেতেন। এমনিই বাবার খুব দাপট ছিল। সে যুগটাই ছিল বাঙালির দাপটের যুগ। রাগী ছিলেন তেমনি। রোজ সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে, বাড়িতে দু’জন যুবক কাজের লোক ছিল, পালা করে এক একদিন এক একজনকে জুতাপেটা করে একটা লুঙ্গি পরে এই টেবিলে বসেই রাগ-রাগ মুখ করে চা খেতেন। আর ঠিক সেই সময় আমার শান্তশিষ্ট মজলিশী মেজ জ্যাঠামশাই বাঁ পাশের হাতলহীন খালি চেয়ারে এসে বসতেন। গায়ে একটা খড়খড়ে তোয়ালে। চুলে কলপ লাগাতেন। খানিকটা অংশ কালো খানিকটা লাল, জায়গায় জায়গায় সাদার ছিট।
জ্যাঠামশাই বোঝাতেন রাগ জিনিসটা ভাল নয়। বিশেষ করে দিনের শেষে অফিস থেকে ফিরেই এই ধরনের জুতোজুতি শরীরের বাড়তি এনার্জি টেনে নেয়। চাকরবাকরেরা একটু অ্যাডামেন্ট হয়েই থাকে। জ্যাঠামশাইয়ের মৃদু স্বভাবের জন্যে বাবা খুব একটা পাত্তা দিতেন না। কে বড়, কে ছোট বোঝাই যেত না। চায়ের কাপটা খটাং করে টেবিলে রেখে বাবা বলতেন, ‘তুমি আর এর মধ্যে নাক গলাতে এসো না। ফার্স্ট অ্যান্ড ফোরমোস্ত থিং ডিসিপ্লিন। ছেলেটার দিকে তাকাতে হবে। ওরা দুপুর বেলা নিজেদের মধ্যে খেস্তাখিস্তি করেছে। অশ্বতর বলেছে।’ বাবা খুব পিউরিটান ছিলেন, খচ্চর শব্দটা উচ্চারণ করলেন না। অফিস থেকে এসে দাঁড়ানো মাত্রই রিপোর্টটা আমারই পেশ করা। আর সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকশন। লম্বা বারান্দার এধার থেকে ওধার, বাবা আর নিরঞ্জনের ছুটোছুটি। পুবদিকের প্রান্ত থেকে পেটাতে পেটাতে পশ্চিমের সিঁড়ির বাঁক পর্যন্ত এসে জুতো ফেলে দিলেন।
জ্যাঠামশাই নিরঞ্জনকে ভালবাসতেন, কারণ নিরঞ্জন রবিবার সকালে পচা পাউরুটি কুঁড়ো পনির আর পিঁপড়ের ডিম দিয়ে তরিবত করে জ্যাঠামশাইকে মাছের চার মেখে দিত। সে কারণেই বোধ হয় নিরঞ্জনের হয়ে সালিশি করতে এসেছিলেন। কিছু আর বলার রইল না। আস্তে আস্তে উঠে বাথরুমে চলে গেলেন। অশালীন কথা বাবা কোনো সময়েই বরদাস্ত করতে পারতেন না। একদিন ছুটির সকালে এই পাথরের টেবিলে দাদু আর বাবা মুখোমুখি বসে মুড়ি তেলে-ভাজা খাচ্ছিলেন। শ্বশুর আর জামাইয়ের গল্প বেশ জমে উঠেছে। দাদু বার কয়েক ‘শালা’ বলেছেন। শালা পর্যন্ত অ্যালাউড। হঠাৎ দাদু বলে উঠলেন কী একটা কথা প্রসঙ্গে—’পাছার কাপড়।’ বাবা নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালেন। ঘর থেকে একট ঠোঙা নিয়ে এলেন। দাদুর মুড়ি আর তেলে-ভাজার বাটিটা টেনে নিয়ে ঠোঙায় ঢেলে ফেললেন। ঠোঙাটা দাদুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘বাড়িতে গিয়ে কিংবা রকে বসে খান। টেবিলে বসে খাবার মতো সিভিলাইজড আপনি নন। আপনার স্ফিয়ার আলাদা।’ বৃদ্ধ মানুষ। টকটকে গায়ের রঙ। লম্বা চওড়া পালোয়ানের মতো চেহারা। বাবার কথায় মুখটা আরো টকটকে হয়ে উঠল। ছেলেমানুষের মতো হয়ে বললেন, ‘কেন বলো তো? হঠাৎ কী হলো তোমার।’ দাদু তখনো অপরাধটা বুঝতে পারেননি। বাবা বললেন, ‘আপনি ভীষণ স্ল্যাং।’ দাদু অপরাধীর মতো মুখ করে বললেন, ‘ওহো, ওই পা—’
বাবা হাত তুলে বললেন, ‘ডোন্ট রিপিট।’ দাদু এবার ভয় পেয়ে গেলেন, ‘কী বলব তাহলে?’ বাবা বললেন, ‘কেন, পেছনের কাপড়, কি পরনের কাপড় বলা যায় না!’ দাদু তখনও হাল ছাড়লেন না। নিজের সপক্ষে একটু ক্ষীণ ওকালতি করতে গেলেন। বললেন, ‘সেকেলে মানুষ তো! আমাদের সময়, বুঝলে পরমেশ্বর, ওই সব কথারই চল ছিল।’ বাবা দাদুকে কোনো রকম ডিফেনসের সুযোগ না দিয়েই শ্বেতপাথরের টেবিল ছেড়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। দাদু সেই মুড়ির ঠোঙাটা হাতে ধরে উদাস হয়ে বসে রইলেন। কী করবেন বুঝতে পারলেন না। একসময় করুণ হেসে বললেন, ‘নাঃ, পরমেশ্বর দেখছি খুব রেগে গেছে।’
বাবার দাপটে সংসারে মা ভীষণ আড়ষ্ট হয়ে থাকতেন। ছুটির দিনে মাকে জীবিত কোনো প্রাণী বলে মনে হতো না। অনেকটা ছায়ার মতো নিজের কাজে ঘুরে বেড়াতেন। সারা দিনে বাবাকে বার চবি্বশ চা করে দিতেন। বাবাকে চা দেবারও একটা কঠিন কায়দা ছিল। কাপ থেকে ছলকে ডিশে এক ফোঁটা চা পড়লেই চা খাওয়া মাটি। কাপের কানায় চা ভরে ডিশের ওপর ব্যালেনস করে আনতে হবে।
আমার মার একটা পা আর একটার চেয়ে বোধ হয় একটু ছোটো ছিল। সাবেক আমলের বাড়িতে ঘরে ঘরেই উঁচু চৌকাঠ, ফলে মার খুব অসুবিধে হতো। চা হাতে যখন আসতেন মনে হতো তরল বোমা নিয়ে আসছেন, একটু কেঁপে গেলেই বিস্ফোরণ।
মা যখন চা নিয়ে এলেন, দাদু তখনও ঠোঙাটি হাতে ধরে বসে আছেন। বাইরে তেলে-ভাজার তেল ফুটে উঠেছে। দাদু বললেন, ‘চা আর খাবো না তুলসী, জামাই খুব রেগে গেছে।’ মা ব্যাপারটা জানতেন, রান্নাঘরে গিয়ে আগেই আমি রিপোর্ট করে এসেছিলুম। মা ফিসফিস করে বললেন, ‘চা খেয়ে আপনি চলে যান।’ দাদু বললেন, ‘আমি তো চলেই যেতুম রে, কিন্তু আটকে গেছি।’ মা একটু অবাক হলেন, ‘কিসে আটকে গেছেন?’ দাদু বললেন, ‘সে এক বিচ্ছিরি ব্যাপার!’ মা একটু ভয় পেলেন। দাদু খাওয়াদাওয়ার ব্যাপারে একটু বেহিসেবি ছিলেন, পাঁচপো দুধের সঙ্গে পুরো একটা কাঁঠালের রস, ডালের সঙ্গে আধ শিশি কাঁচা ঘি, এই সব ছিল তাঁর সাংঘাতিক খাওয়া। মা ভাবলেন দাদু হয়তো কাপড়ে করে ফেলেছেন। আগে একবার দু’বার এই ধরনের ঘটনা ঘটে গেছে। মা বললেন, ‘করে ফেলেছেন!’ দাদু খুব বুক ঠুকে উত্তর দিলেন, ‘না না, সে রকম বিচ্ছিরি নয়।’ সেই কাজটি করে ফেলেননি বলে যেন বেশ গর্বিত। ‘তবে কী করেছেন?’ মা যেন বেশ ধাঁধায় পড়লেন। দাদুর মুখটা যেন দুষ্টু ছেলের মতো হয়ে উঠল। চেয়ারে নড়েচড়ে বসে বললেন, ‘ডান হাতের আঙুলটা টেবিলে আটকে গেছে।’ মা নিচু হয়ে বললেন, ‘কই দেখি?’ টেবিলের পাশে যে কাঠে হরতন, চিঁড়েতন, ইস্কাবন কাটা ডিজাইন ছিল তারই একটায় দাদুর ডান হাতের তর্জনীটা আটকে গেছে। মা বললেন, ‘টেনে বের করে নিন না।’ দাদু অসহায়ের মতো বললেন, ‘বেরোচ্ছে না।’ ‘ঢুকলো কী করে?’ দাদু তখন ঢোকার বিবরণ দিলেন, ‘পরমেশ্বর রাগ করে উঠে গেল তো, আমি একলা বসে আছি। অন্যমনস্ক আঙুলটাকে এই গর্ত সেই গর্ত এমনি করতে করতে হঠাৎ একটায় ফস করে ঢুকে গেল। হাতে তেল ছিল। ওমা, তারপর আর বেরোচ্ছে না কিছুতেই। জামাই মুড়ি আর তেলে-ভাজা যত্ন করে ঠোঙায় ঢেলে দিয়ে গেল। এখনো দুটো চপ খাওয়া হয়নি। ডান হাতটা আটকে গেছে।’
ভয়ে মার মুখ শুকিয়ে গেল। ‘কী হবে এখন!’
দাদু ছেলেমানুষের মতো বললেন, ‘কাঠটা ভেঙে আঙুলটা বের করে নিতে পারি, কিন্তু পরমেশ্বর যদি রেগে যায়।’ মা বললেন, ‘না না, কাঠ ভাঙা চলবে না। কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে। আপনি বরং আর একবার চেষ্টা করুন।’ ‘হচ্ছে না রে তুলসী। তখন থেকে ঘোরাতে ঘোরাতে ছাল উঠে গেল।’ মা চায়ের কাপটা শ্বেতপাথরের টেবিলের ওপর রেখে উত্তরের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। ওই দিকে এক ফালি জমিতে বাবার কিচেন গার্ডেন। ভাল রোদ পড়ে না। তবু বাবার সাধনার শেষ নেই। এক টুকরো জমিতে খুঁজলে সব গাছ পাওয়া যাবে। রোদের অভাবে সমস্ত গাছই উচ্চতায় বিশাল। গোটা কতক পেঁপে গাছ তিন তলার ছাদের কার্নিস ছুঁতে চলেছে। বাবা তখন বাগানে। সঙ্গে সহকারী নিরঞ্জন। সকালে নিরঞ্জনের মতো লোক হয় না। সন্ধেবেলা সেই নিরঞ্জনকেই জুতোপেটা। গাছের গোড়ায় গোড়ায় পচা খোলের জল দেওয়া চলেছে। একটু বেসামাল হলেই নিরঞ্জন চারাগাছ মাড়িয়ে ফেলবে। বাবা মাঝে মাঝেই হাঁ হাঁ করে উঠছেন, ‘যাঃ সর্বনাশ করে ফেললি, ড্যাফোডিলটা গেল।’ নিরঞ্জনের দৃকপাত নেই, ‘না না ছোটবাবু।’ বাবা দাঁতে দাঁত চেপে বলছেন, ‘ব্লাডি বাগার, পা দিয়ে চেপে দাঁড়িয়ে আছিস, ক্রিস্ট্যালাইজড ইডিয়েট। ওই জন্যে বলে মিনিমাম এডুকেশন দরকার।’ নিরঞ্জন বলছে, ‘সব জায়গাতেই তো গাছ। না মাড়িয়ে যাবো কী করে?’ ‘কেন, তোর বুড়ো আঙুলে কি পক্ষাঘাত হয়েছে, এইভাবে যাবি, টিপ টো কাকে বলে জানিস, এই দেখ!’ বাবা দেখাতে গেলেন, ‘যাঃ গেল, নিজেই শেষে মাড়িয়ে ফেললুম, ফ্রুসটা গেল, দূর ছাই।’ নিরঞ্জন ভরসা দিল, ‘ও একটু দুটো যাবেই বাবু। পেটের সব কটা ছেলেই কি আর বাঁচে! একটা দুটো মরেই।’ বাবা বললেন, ‘ঠিক বলেছিস। লাগা, তুই দিয়ে যা। গোড়া থেকে ছ’ইঞ্চি দূরত্ব থাকবে মনে থাকে যেন।’ মা জানতেন এই ব্যাপার চলবে বেলা বারোটা অবধি। ওইখানে দাঁড়িয়েই মশার কামড় ও বার কয়েক চা খাওয়া চলবে। তারপর গাছের বাড়তি ডাল কাটতে গিয়ে হাত কেটে, ওপরে উঠে আসবেন—গেল গেল করতে করতে। আয়োডিন আর ব্যান্ডেজ তৈরিই রাখা আছে।
মা উত্তরের বারান্দা থেকে দক্ষিণে টেবিলের সঙ্গে আটকে থাকা দাদুর কাছে চলে এলেন। সামনেই রাস্তার ওপরে সনাতনের ছোট্ট ছবি-বাঁধাইয়ের দোকান। সারা দিন ছোট্ট হাতুড়ি নিয়ে ঠুকঠুক করে কাজ করে। লম্বা, কালো পাকানো চেহারা। মাঝে মাঝে কাজের ফাঁকে ছোট্ট অ্যালুমিনিয়ামের ডিবে খুলে বিড়ি মুখে দিয়ে যখন এ বাড়ির জানালার দিকে তাকায় তখন দেখেছি ছোট দুটো ঘোলাটে হলুদ। মা বললেন, ‘সনাতনকে একবার চুপি চুপি ডেকে আনতে পারিস।’ সনাতন এসে হাজির, ‘কী বলছেন মা?’ রোগা হলে কী হয়, বাজখাঁই গলা। মা ফিসফিস করে বললেন, ‘আস্তে আস্তে।’ সনাতন গলাটাকে যথাসম্ভব খাটো করে বলল, ‘কী হয়েছে মা?’ মা তখন সনাতনকে ব্যাপারটা দেখালেন। হাঁটু মুড়ে দাদুর চেয়ারের পাশে বসে সনাতন টেবিলটা ভাল করে দেখে নিয়ে বললেন, ‘দুটো স্ক্রু দিয়ে কাঠটা লাগানো আছে। স্ক্রু দুটো খুলে নিলেই কাঠটা আঙুলের সঙ্গে টেবিল ছেড়ে চলে আসবে লম্বা আংটির মতো।’ মা বললেন, ‘তাহলে খুলে ফেলুন। খুব তাড়াতাড়ি। একটুও শব্দ করবেন না।’ সনাতন খড়ম পায়ে সিঁড়ি দিয়ে খটাং খটাং করে নামছিলেন। মার কাঁচুমাচু অনুরোধে শুধু পায়ে হাতে খড়ম নিয়ে দোকানে চললেন যন্ত্র আনতে।
স্ক্রু দুটো অনেক দিনের। মরচে পড়ে মাথার ঘাট বোধ হয় বুজে এসেছিল। সনাতনকে বেশ কসরত করতে হলো। টেবিলটাকে ঠেলে সরাবারও উপায় নেই। দাদু আঙুল আটকে বসে আছেন। ঘুপচিমতো জায়গায় কোনো রকমে সনাতন অসাধ্য সাধনে ব্যস্ত। দাদুর মুখ দেখে মনে হচ্ছে যেন বেশ মজা হয়েছে এমনি ভাব। মার মুখে চাপা উৎকণ্ঠা। একটা কান বাগানের দিকে পড়ে আছে। বাবার গলা শুনতে না পেলেই পা টিপে টিপে গিয়ে দেখে আসছেন।
হঠাৎ ঝরঝর করে এক গাদা পটলের মতো গোল গোল কাঠ মেঝেতে পড়ে গড়িয়ে গেল। ‘এই রে, কী হলো’ বলে মা এগিয়ে গেলেন। সনাতন টেবিলের পাশ থেকে হাসি হাসি মুখ তুলে বললেন, একটা পাশ খুলে ফেলেছি।’ ‘এগুলো খুললেন কেন?’ মার প্রশ্ন। ‘কাঠটা খুললেই তো এগুলোও খুলবে মা। ওপরের কাঠের চাপে এই কেয়ারিগুলো ঠাস হয়ে ছিল।’ সনাতন অন্য দিকটা খোলার কাজে মন দিলেন। দাদু দেখলেন চুপ করে থাকা ঠিক নয়। সনাতনকে তারিফ করে বললেন, ‘বেশ কাজের লোক হে তুমি। ঠিক খুলেছো তো দেখছি।’ মা তখন গোল কাঠগুলো কুড়িয়ে নিয়ে আঁচলে ঢাকছেন বামাল ধরা পড়ে যাবার ভয়ে।
কাঠের টুকরোটা অবশেষে টেবিলের মায়া ছেড়ে দাদুর পুরুষ্টু তর্জনীর সঙ্গে খুলে এল। দাদুর সেকি মুক্তির আনন্দ! মনে হলো যেন জেলখানা থেকে মুক্তি পেয়েছেন। কাঠটা আঙুলসমেত দুবার ঘুরিয়ে দেখে বললেন, ‘বেশ ফিট করেছে রে তুলসী!’ দাদুর উল্লাসে মা ঠিক যোগ দিতে পারলেন না জানি মার মনে তখন কী খেলা করছে। একটু পরেই ওই রুমাল আকৃতির এক টুকরো বাগান থেকে বাবা ঘর্মাক্ত চেহারা নিয়ে ওপরে উঠে আসবেন। মুখে নানা রকমের অদ্ভুত শব্দ। খুব পরিশ্রম হলে বাবা জোরে জোরে মুখ দিয়ে হাওয়া ছাড়তেন। ফুস…স। ফুস…স। অনেকটা এখনকার প্রেশার কুকাকের মতো।
রবিবার দ্বিতীয় বিশাল কাজ ছিল, টেবিলের শ্বেতপাথর পুটি দিয়ে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করা। আগের রবিবার ইচ্ছে করেই পরিষ্কার করেননি। সেও এক ঘটনা। আমার বন্ধু বিপুল, কপিং পেনসিল দিয়ে পাথরের ওপর নাম লিখেছিল—বিপুল রায়। গোটা গোটা হাতের লেখা। যেদিন লিখে গেল তার পরের দিন বাবার চোখে পড়ল। বাবা পাশে ‘অ্যারো’ দিয়ে আরো বড় বড় করে লিখলেন ব্লাডি বাগার। দরজায় খড়ি দিয়ে লেখা কী ছবি আঁকা, বইয়ের পাতায় নাম সই, শ্বেতপাথরের টেবিলে নিজের নাম জাহির করা, খাতায় ঘিচু ঘিচু কিছু আঁকা দেখলেই বাবা উত্তেজিত হয়ে উঠতেন। সঙ্গে সঙ্গে লেখকের জন্যে শুরু হতো মনস্তাত্তি্বক চিকিৎসা। আমাদের বাইরের সদর দরজায় এইরকম লেখার লড়াই কার বিরুদ্ধে জানি না বেশ কিছুদিন চলছে। ঢোকার মুখে কোনো অতিথি একটু লক্ষ করলেই অবাক হবেন। প্রথম লেখা বাঘের বাসা। লেখক বোধ হয় আমাদের বাড়িকে ‘বাঘের বাসা’ নাম দেবার সদিচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। বাবা লিখলেন—’স্কাউন্ড্রেল’। অদৃশ্য লেখক লিখলেন—’পাগলের আখড়া’। বাবা উত্তরে লিখলেন—’সোয়াইন’। উত্তর এলো—’বাটারফ্লাই’। লেখক বোধ হয় বাবার গোঁফ সম্পর্কে মন্তব্য করলেন। বাবা লিখলেন—’স্টুপিড’। বিশাল সদর দরজায় লেখার জায়গার অভাব নেই। সপ্তাহে সপ্তাহে উতোর-চাপানোর খেলা বেশ জমে উঠেছে।
শ্বেতপাথরের টেবিলে বিপুলের লেখা আর এগোবে না। কারণ বিপুল যে ব্লাডি বাগার নিজে এসে দেখে গেছে এবং মনে হয় এ বাড়ির ত্রিসীমানা সে আর মাড়াবে না। আমাকে জিজ্ঞেস করল, ব্লাডি বাগার মানে কী রে। মানেটা আমি ঠিক জানতুম না। বিপুল মুখ চুন করে চলে গিয়েছিল।
মা দাদুকে তাড়াতাড়ি টেবিল ছাড়া করলেন। ঠিক হলো দাদু সনাতনের দোকানে গিয়ে বসবেন। সনাতন একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবে, কাঠটা অক্ষত আঙুল থেকে খোলা যায় কি না। ‘দাঁড়া তুলসী, চপ দুটো বাঁ হাতে চট করে খেয়ে নি।’ মা আঁতকে উঠলেন, ‘না না, ওপরে আসার সময় হয়ে গেছে, আপনি এখুনি পালান।’ এক হাতে ঠোঙা, অন্য হাতে আঙুলে গলান কাঠের টুকরো, পায়ে কালো ক্যাম্বিসের জুতো, দাদু সিঁড়ি দিয়ে নামছেন, পেছনে সনাতন, হাতে যন্ত্রপাতি। অন্যদিকে বাড়ির পেছনের সিঁড়ি বেয়ে বাবা উঠে আসছেন। মুখে প্রেশার কুকারের শব্দ। পেছনে নিরঞ্জন, হাতে খুরপি, সারের কলসি।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলে বোঝার উপায় নেই, পাথরের তলার এক পাশের কেরামতি ঝরে গেছে। মা আশা করেছিলেন, দুর্ঘটনাটা তক্ষুনি ধরা পড়বে না। কিছু দিন হয়তো চাপা থাকবে। বলা যায় না, সনাতনের অদ্ভুত কেরামতিতে কাঠের টুকরোটা দাদুর চাঁপাকলার মতো আঙুল থেকে হয়তো খুস করে খুলে আসবে। তারপর অফিস-বারে বাবার অনুপস্থিতিতে আবার যথাস্থানে বহাল হয়ে যাবে। বাবা ওপরে এসেই এক গেলাস জল চাইলেন। বেশ মোটা কাচের একটা বড় গেলাস ছিল। প্রায় সেরখানেক জল ধরত। জলের গেলাসটা হাতে নিয়ে টেবিল থেকে কিছু দূরে মেঝেতে উবু হয়ে বসলেন। জল খাবার এইটাই ছিল তাঁর ধরন। একটু একটু করে জল খাচ্ছেন আর সামনের জানালা দিয়ে রোদ-ঝলসানো দ্বিপ্রহরের সুনীল আকাশের দিকে তাকাচ্ছেন। জল খেতে খেতে মাঝে মাঝে আঃ আঃ করে অদ্ভুত শব্দ করছেন। কিছু দূরে মা উৎকণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। জানালার সামনে টেবিল। শ্বেতপাথর সমাধি-ফলকের মতো শুভ্র। রবিবারের সমস্ত শান্তি যেন সেই মুহূর্তে ওই পাথরের তলায় সমাহিত। শেষ চুমুকে জলটা সমস্তই খেয়ে ফেলে বাবা একটা ফাইনাল শব্দ করলেন। ভেল্টিলেটার থেকে একটা চড়ুই পাখি উড়ে গেল। ঘুলঘুলিটার দিকে একবার তাকালেন। গত কয়েক রবিবার ধরে শুনছি ওই গর্তটা টিন মেরে বন্ধ করা হবে। গেলাসের তলানি শেষ বিন্দু জলটা ঝেড়ে ফেলে বাবা উঠে দাঁড়ালেন। যাক, দেখতে পাননি, দেখে ফেলতেও পারতেন। যে জায়গায় বসেছিলেন সেখান থেকে টেবিলের তলা ও পাশ সহজেই নজরে পড়ে।
গোড়ালির ওপর ভর দিয়ে দুম দুম করে হেঁটে বাবা বাথরুমে ঢুকে গেলেন। সব কিছুতেই স্পিড এই ছিল তাঁর বৈশিষ্ট্য। কেবল একটা জিনিসে স্পিড ছিল না, সেটা হলো ইভ্যাকুয়েশান। কনস্টিপেশানের ব্যাপার। মাঝে মাঝে রেগে গিয়ে বলতেন, এমন একটা উপায় থাকত ব্লাডারটা খুলে ফেলে ঝেড়ে ফেলা যেত! নিরঞ্জন সময় সময় আদেশমতো পেটটা প্যাঁক প্যাঁক করে দিত। একমাত্র বেলের সিজনে খুঁতখুঁতুনিটা একটু কম থাকত।
আধঘণ্টা কি পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মতো সময় পাওয়া গেল। তার আগে বাথরুম থেকে বাবার বেরোবার সম্ভাবনা নেই। মা আর আমি দৌড়ে রাস্তার দিকে জানালার ধারে গেলুম। সনাতনের দোকানে দাদুর আঙুল থেকে কাঠ খোলার কসরত চলেছে। সনাতন একা দোকানে বসে আছে, দাদু নেই। অন্য সময় সনাতন হামেশাই জানালার দিকে মিটমিট করে তাকায়। সেই মুহূর্তে সনাতন তন্ময়। কী যে করছে! অনেকক্ষণ দাঁড়াবার পর সনাতন হলদেটে চোখ তুলে তাকাল। মা হাতের ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন—কী হলো? সনাতন ফিক্ করে হেসে দু খণ্ড কাঠ তুলে দেখালে। দাদু আঙুল ঢুকিয়েছিলেন একটা চিড়িতনে। সেই জায়গা থেকেই কাঠটা দু টুকরো হয়ে গেছে। মার মুখের মৃদু হাসি মিলিয়ে গিয়ে একটা থমথমে ভাব ফুটে উঠল।
বাথরুম থেকে বেরিয়েই বাবা সেদিনের বুলেটিন ঘোষণা করলেন—অ্যাবসোলিউটলি নো ইভ্যাকুয়েশান। নিরঞ্জন সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। মানে না বুঝলেও ইংরেজিটা তার চেনা। সঙ্গে সঙ্গে বললে—’একটু প্যাঁক প্যাঁক!’ বাবা বললেন—’এখন না। দাঁড়া একটু চা খেয়ে দেখি।’ মা খুব দরদ দিয়ে চা করে দিলেন। একে কোষ্ঠ সাফ হয়নি, তার ওপর টেবিল ভেঙেছে। ভেঙেছেন আবার মার বাবা। ভাল চায়ে মেজাজটা যদি একটু নরম হয়।
বেলা দেড়টার সময় শুরু হলো পুটি দিয়ে টেবিলের পাথর পরিষ্কার করার কাজ। মা আশ্রয় নিলেন মেজ জ্যাঠামশায়ের ঘরে। জ্যাঠামশায় একটা পুরনো টুথব্রাশ দিয়ে ঘাড়ের কাছের চুলে কলপ লাগাচ্ছিলেন। গায়ে একটা খড়খড়ে তোয়ালে। এই বাড়ির সমস্ত অপরাধীর আশ্রয়দাতা মেজ জ্যাঠামশায়। উদারপন্থী, সদা হাস্যময়। মর্যাল-ফর্যালের ধার ধারেন না; আবেগের নির্দেশে কাজ করেন।
আমি বহুবার জ্যাঠামশায়ের শরণাপন্ন হয়ে বিশেষ সুবিধে করতে পারিনি। মার বরাতে কী হবে বলা শক্ত। সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফিরেই ওই শ্বেতপাথরের টেবিলে বাবা যখন আমাকে পড়াতে বসতেন, বাড়ির সকলেরই অবস্থা তখন ছিলে-টান ধনুকের মতো। কখন কী হয়। প্রথমেই হোমটাস্ক। টাস্কের চৌকাঠেই প্রথম হোঁচট। একটা ভুল, দুটো ভুল। মেজাজের পারা চড়ছে ব্যারোমিটারের মতো। আবহাওয়ার পূর্বাভাস। ঝড় এলো বলে। মেঘ ডেকে উঠলো—সারা দিন কী করা হয়েছে? গুলি, ঘুড়ি গল্পের বই?’ অপরাধ চাপা থাকে না। বাবা উঠে পড়লেন। জয়েন্ট ফ্যামিলির মুখ ফাঁদালো উনুনে প্রথম আহুতি, ছাত্রবন্ধু লাইব্রেরি থেকে আনা ‘আবার যকের ধন’। শ্বেতপাথরের টেবিলের তলার পাদানিতে লুকোনো ছিল। যে কোনো গুপ্ত জিনিস গুপ্ত চিন্তা টেনে বের করার অপরিসীম ক্ষমতা ছিল বাবার। তার পরই উনুনে পড়ল সিন্দুকের পাশে লুকোনো সুতোভর্তি লাটাই। সবে চ্যাঁভোঁ মাঞ্জা দিয়ে রাখা। তার পরই ঘুড়ির কাঁপকাঠি, বুককাঠি ভাঙার পটাপট আওয়াজ। মনে হচ্ছে বুকের এক-একটা পাঁজর ভাঙছে। সেই সঙ্গে বাবার সিংহবিক্রমে দাপাদাপি আর চিৎকার—শয়তান শয়তান, সেটান, সেটান। মা কিছুটা দূর থেকে গরাদের ওপাশে থাকা ফাঁসির আসামির সঙ্গে যেভাবে কথা বলে সেইভাবে করুণ কণ্ঠে আমাকে বলতেন—’কেন বাবা ঠিক করে অঙ্কগুলো কষলি না!’ সব শেষ করে, সব শ্মশান করে দিয়ে বাবা আবার টেবিলে এসে বসতেন। বুকভর্তি কাঁচাপাকা চুল। ফোঁটা ফোঁটা ঘাম গড়াচ্ছে। এদিকে এত কাণ্ডের পরও ঘুমে আমার চোখ ঢুলে আসছে। মাথা ঝুঁকে আসছে টেবিলের পাথরের দিকে। বাবা তাক করে থাকতেন। মাথাটা প্রায় কাছাকাছি এলেই পিছনে এক ভুঁই থাপ্পড়। ঠাঁই করে কপালটা পাথরে ঠুকে ঘুম ছুটে যেত আপনি। চোখের সামনে সাদা শ্বেতপাথর, কপালে, ঠিকরে আলুর যন্ত্রণা, পাথরে কোঁদা চুলওলা বাবা, খোলা বইয়ের পাতায় নৃত্যশীল কালো কালো অক্ষর। জীবনের অন্ধকারতম দিনে আলোর বীভৎস সাধনা। জ্যাঠামশায়ের কাতর প্রার্থনা—’ছেলেটাকে এবার ছেড়ে দে।’ যেন বাঘে ধরেছে। বাঘের সংক্ষিপ্ত গর্জন—’ডোন্ট পোক ইওর ফাইন নোজ। কর্তা সিঙ্গুলার হলে ভার্ব সিঙ্গুলার হবে, ক-তো বা-আর বলতে হবে, কনডেনসড ইডিয়েট। লেখো। বড়ো বড়ো করে।’
সামনের রাস্তায় গভীর রাতের এক-আধটা পথিক, অজস্র কুকুরে লুটোপুটি ঝগড়া। সেই মেজ জ্যাঠামশায়ের কাছে শেল্টার নিয়েছেন মা। কত দূর কী হবে বলা শক্ত। চুলে কলপ লাগানো বন্ধ। দরজার পাশ থেকে গুপ্তচরের মতো একটা মাত্র চোখ বের করে আমি ওয়াচ করছি। মেজ জ্যাঠামশায় আশা দিচ্ছেন মাকে—’কোনো ভয় নেই বউমা, আমি ফেস করব। আজ আমি তোমার জন্যে জান দিয়ে দেবো।’ পাথরে পুটি চড়ল। চারপাশে ঘুরে ঘুরে কাপড় দিয়ে পাথর ঘষছেন। জানালার দিকের অংশে গিয়ে বাবা হঠাৎ উঃ করে লাফিয়ে উঠলেন। নিচু হয়ে মেঝে থেকে কী একটা তুলে নিলেন। স্ক্রু। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করলেন, ‘এ কী হলো? কোত্থেকে এলো? কোন্ শয়তানের কাজ!’ মার মুখ বিবর্ণ। মেজ জ্যাঠামশায় প্রস্তুত। মুখ দেখে মনে হলো—তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলেছে, ‘চিত্রে সমর’ বলে একটা বই বেরোত, সেই বইয়ের পাতায় দেখা যুদ্ধবন্দীদের মুখের মতো করুণ।
স্ক্রুটা দু আঙুলে ধরে বাবা নিচু হয়ে টেবিলের পাশটা দেখতে লাগলেন কোথা থেকে খুলে পড়েছে ব্যস ধরে ফেলেছেন। একবার দেখলেন। দুবার দেখলেন। সোজা উঠে দাঁড়ালেন। স্বগতোক্তি—’এ কী হলো?’ ‘নিরঞ্জন!’ দুবার ডাকলেন। ভেগেছে। হাওয়া হয়ে গেছে। জানালার দিক থেকে সরে এসে দরজার দিকে মুখ করে চিৎকার করে বললেন, ‘নিরঞ্জন কি মরে গেছে?’
জ্যাঠামশায় বেরিয়ে এলেন। ঘাড়ের কাছে কিছু চুল কালো, কিছু তামাটে। জ্যাঠামশায় বাবার কাঁধে হাত রেখে আস্তে আস্তে মোলায়েম করে বললেন, ‘চল একটু বসি, উত্তেজিত হসনি। বাবা খুব অবাক হয়ে জ্যাঠামশায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ‘চল না একটু বসি। একটু বসি। একটু বসাটাকেই ঠুংরী গানের মতো জ্যাঠামশায় বার কতক বললেন। কোয়েলিয়া গান থামা এবার, গান থামা এবার, গান থামা এবার। কিন্তু আমার তো বসার সময় নেই। মুখ বিকৃত করে ভেঙে ভেঙে উচ্চারণ করে বাবা তাঁর সময়ের অভাবটা জ্যাঠামশায়কে জানিয়ে দিলেন। এই জানানোর মধ্যে একটা অশ্রদ্ধার ভাব ছিল। কারণ জ্যাঠামশায় চুল রঙ করছিলেন আর বাবা টেবিল সাফ করছিলেন। একটা অকাজ। অন্যটা কাজ। কাঁচুমাচু মুখে জ্যাঠামশায় বললেন, কথা আছে। পাঁচ মিনিটের বেশি সময় তোর নেবো না।’
দু’জনে দুটো চেয়ারে বসলেন। বাবা কোনো রকমে পেছনটা চেয়ারের ডগায় ঠেকিয়ে রাখলেন। শরীরের পুরো ভাবটা রইল পায়ের ওপর। হাত দুটো হাঁটুর ওপর টানটান। দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল শক্ত। চোখ দুটো খোলা আকাশে লটকানো। এই রকম একটা ভঙ্গি, এই রকম একটা মুখের সামনে বসার শক্তি চাই। জ্যাঠামশায় ঘটনাটা বলে চলেছেন। মুখটাকে ঈষৎ বাঁকিয়ে বাবা শুনছেন। কোনো সময় জ্যাঠামশায়ের দিকে তাকাচ্ছেন না। মাঝে মাঝে নাকের ওপর কপালের কিছুটা অংশ কুঁচকে যাচ্ছে। ঘটনার বর্ণনা শেষ করে জ্যাঠামশায় বাবার হাত দুটো স্পর্শ করে বললেন, ‘তুই আর এই নিয়ে রাগারাগি করিসনি। বউমা ভীষণ ভয়ে ভয়ে আছে।’
কয়েক সেকেন্ড নীরবতা। তার পরই অ্যাকশন। হাঁটুতে চটাস করে চারটে চাপড় মেরে বাবা বললেন, ‘হোয়াই সনাতন, হোয়াই সনাতন! আমি কি মরে গিয়েছিলুম?’
‘না না, মরে যাবার কথা আসছে কী করে? তুই ব্যাপারটা অন্যভাবে নিচ্ছিস। মুকুজ্জেমশায়ের আঙুল তুই খুলবি, সেটা ভাল দেখায় না বলেই—’
‘ভাল দেখায় না বলেই একটা উটকো বাইরের লোককে ডেকে টেবিলটার সর্বনাশ করতে হবে! আমি হয়তো কাঠটা ইনট্যাক্ট রেখেই খুলতে পারতুম। আমাকে একবার চান্সই দেওয়া হল না। কেন হলো না? বলতে পারো কেন হলো না! এক্সপ্লেন।’
‘একটা সামান্য ব্যাপার, তোকে বিরক্ত না করে যদি হয়ে যায় তাই আর কি। সনাতন পুরোনো লোক। যন্ত্রপাতি রয়েছে। টুক করে খুলে দিলে।’
‘সেই কাঠ আর কেয়ারিগুলো কোথায়?’
জ্যাঠামশায় ঘটনার সেকেন্ড পার্টটা জানতেন না। অসহায়ের মতো মুখ করে দরজার দিকে তাকালেন—’বউমা।’
‘ও তুমিও জানো না। সনাতনকে তুমি ডেকেছিলে?’
‘আমি, আমি পাশের ঘরেই ছিলুম। সনাতন তো চোখের সামনেই থাকে। ওই তো কাজ করছে। চোখাচোখি হতেই চলে এলো আর কি! ডাকতেও হয় না। ইশারাতেই কাজ হয়।
‘কার ইশারা?’
জ্যাঠামশায় খুব বিপদে পড়লেন। বাবা ঠেলতে ঠেলতে তাকে কোণঠাসা করে ফেলেছেন। দেখেছো বাড়ির ডিসিপ্লিন কোথায় নেমে গেছে। বাড়ির বউ কাউকে কিছু না বলে জানালা দিয়ে ইশারা করে একটা লোফার মিস্ত্রিকে হুট করে ডেকে নিয়ে এলো। টেবিলটা বড় কথা নয়, মেজদা, বড় কথা হলো ডিসিপ্লিন। তুমি পাশে রয়েছো জানলে না, আমি নিচে রয়েছি জানলুম না। এ হাইড অ্যান্ড সিক গেম। নিপ ইন দি বাড।’
বাবা উঠে দাঁড়ালেন। জ্যাঠামশায়ের শেষ চেষ্টা—’শোন্, আমার অনুরোধ, আমি তোর চেয়ে বয়সে বড় তো, একটা রিকোয়েস্ট, এই নিয়ে তুই আর গোলমাল করিসনি। ব্যাপারটা বড্ড ডেলিকেট, বুঝলি। আমি তোর পয়েন্টটা বুঝেছি।’
হাতের একটা বিচিত্র ভঙ্গি করে বাবা বললেন—’নো কমপ্রোমাইজ।’
জ্যাঠামশায়ের মুখটা একটু কাঁদো-কাঁদো হয়ে গেল। বউমাকে আশা দিয়েছিলেন শেলটার দেবেন কিন্তু দাবার চালে বাবা কিস্তি মাত করে উঠে দাঁড়িয়েছেন। জ্যাঠামশায়ও উঠে দাঁড়ালেন। বাবার চেয়ে লম্বা, এটু কৃশ, অল্প কোলকুঁজো।
বাবার চেতানো বুকের সামনে বড় বেশি দুর্বল।
আমরা সকলে ভেবেছিলাম বাবা ঘরের দিকে যাবেন। তিনি ঘুরে রাস্তার দিকে জানালার দিকে এগিয়ে গেলেন। গরাদহীন ফরাসি জানালা দিয়ে বুকের আধখানা রাস্তার দিকে ঝুলিয়ে দিলেন। কী করতে চাইলেন বোঝা গেল না। জ্যাঠামশায় কিছু দূরে বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে। আমার মনে হলো, মাথায় ঠাণ্ডা হাওয়া লাগাচ্ছেন বোধ হয়। কিংবা সনাতনকে ডাকলেন। হঠাৎ জানালার বাইরে হাত বের করে ফটফট করে বারকতক তালি বাজালেন। কাকে ডাকছেন? চিৎকার করে ডাকাটা, ‘আউট অব ইংলিশ, এটিকেট’। তালিতে কাজ হলো না। যত দূর সম্ভব চাপা গলায় ডাকলেন—’শরৎ শরৎ এ… এই শরৎ।’ শরৎ কী করবে। শরৎ বোধ হয় সামনের রাস্তা দিয়ে সেই সময় যাচ্ছিল। বাবার ডাকে মুখ তুলে তাকাল মনে হয়।
‘তোমার গাড়িটা নিয়ে এখুনি একবার এসো।’ রাস্তা থেকে শরতের গলা শোনা গেল, ‘আমি এইমাত্র গ্যারেজ বন্ধ করে খেতে যাচ্ছি।’
‘আধঘণ্টা পরে খেতে গেলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না।’
‘আমি খেয়ে আসি না ছোটবাবু!’
‘দশ টাকা দেব, কুড়ি টাকা দেব, এখুনি গাড়ি বের করো।’
তেরপলের হুক লাগানো শরতের একটা প্রাচীন গাড়ি ছিল। চারদিক খোলা। আধকাটা দরজা। দরজার সব ক’টা লক ভাঙা। আরোহীরা উঠে বসলে নারকেল দড়ি দিয়ে দরজা বেঁধে দেওয়া হতো। পেছনের সিটে গদির বদলে কয়েকটা মাথার বালিশ পাতা। এই গাড়িটাই আমাদের পারিবারিক ভ্রমণে, উৎসবে নানা সময়ে ভাড়া খাটত। শরতের গাড়ি দুঃখের দিনে, আনন্দের দিনে।
বাবা জানালা থেকে সরে এলেন। বোঝা গেল শরৎ আবার বাধ্য হয়েই গ্যারেজের দিকে ফিরে গেল। সেই গোড়ালির ওপর ভর দিয়ে যেমন দুমদুম করে হাঁটেন, সেভাবেই হেঁটে বাবা ঘরে ঢুকলেন। জ্যাঠামশায় বাবাকে অনুসরণ করছিলেন। জানলার কাছে দাঁড়িয়ে বাবাকে কাপড় নিতে দেখে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘গাড়ি কি হবে রে? এই এত বেলায়।’ বাবা কোনো উত্তর দিলেন না। প্রায় ছিটকে আর একদিকে চলে গেলেন। আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম, বাবা মালকোঁচা মেরে কাপড় পরলেন, তার ওপর চাপালেন সাদা টেনিস শার্ট। ছুটির দিন দাড়ি কামাননি, একমুখ কাঁচাপাকা দাড়ি। ‘চললি কোথায়?’ জ্যাঠামশায় এ প্রশ্নেরও কোনো জবাব পেলেন না। সব কিছুই ঘটে চলেছে ‘স্পেকটাকুলার স্পিডে’।
গাড়ি থামার আওয়াজ পাওয়া গেল। বাবা হাঁকলেন—নিরঞ্জন। নিমেষে নিরঞ্জন সামনে এসে দাঁড়াল। ঘরের কোণের দিকে মার চকোলেট রঙের ট্রাঙ্কটা দেখিয়ে বললেন—’তুলে দে গাড়িতে।’ এমনভাবে বললেন যেন ওই ট্রাঙ্কটার মধ্যে মার অনেক দিনের গলিত মৃতদেহ রয়েছে। বাবা এগিয়ে গেলেন জ্যাঠামশায়ের ঘরের দিকে। মা তখন খাটের এক পাশে পা ঝুলিয়ে বিষণ্ন মুখে বসে আছেন। অসম্ভব ফর্সা রঙ। রক্তশূন্যতার জন্যে আরো সাদা দেখাচ্ছে। আমার আবির্ভাবের পর থেকেই মার শরীর ভীষণ ভেঙে গেছে।
আমার নাকি ভূমিষ্ঠ হবার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না। জঠরের ঈশান কোণে ঘাপটি মেরে বসে ছিলাম, বোধ হয় বাবার ভয়ে। তারপর একসময়ে উপায় না দেখে হেলানো পাটাতন বেয়ে লোকে যেমন হড়কে নামে সেইভাবে সড়াৎ করে নেমে এলুম। আসার সময় মার একটা ভাইটাল নাড়ি উপবীতের মতো গলায় জড়িয়ে এনেছিলুম। বাপকো বেটারা বোধ হয় এই কায়দায় জন্মায় আগে মাথাটা বের করে হালচাল দেখে নেবার প্রয়োজন বোধ করে না। তাতেও মার কী আনন্দ। অসংখ্য সন্তানের জননী হবার ইচ্ছে ছিল মায়ের। গিনিপিগের মতো ঘরময় ঘুরে বেড়াবে। বাবার ঠিক উলটো। ওয়ান ইজ এনাফ। সেকেন্ড ইজ অ্যাকসেপটেবল উইথ এ স্ট্রিকচার।
বিছানার ওপর হাতের চেটোটাকে উলটো করে রেখে মা আপন মনে আঙুল গুনছিলেন। লম্বা লম্বা আঙুল। একটা সাদা পোখরাজের আংটি জ্বলজ্বল করছে অনামিকায়। বাবা একেবারে মার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন—’উঠো।’ মা ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ‘চলো।’ বাবা চলতে শুরু করলেন। জানেন এ আদেশ অমান্য করার ক্ষমতা কারোর নেই। মার পরনে একটা নীল বুটিদার শাড়ি। জ্যাঠামশায়ের এইটা লাস্ট চান্স। নিজের কোর্টে প্রতিপক্ষকে পেয়েছেন। দরজা আগলে দাঁড়ালেন। ‘এই দুপুর বেলা বউমাকে নিয়ে কোথায় যাবি।’
‘তুমি পঞ্চতন্ত্র পড়েছ?’ দরজা থেকে একটু দূরে থমকে দাঁড়িয়ে বাবা প্রশ্ন করলেন। জ্যাঠামশায় একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। ‘বুঝেছি পড়নি। পড়বে কখন? জীবনে দুটি জিনিস।’ দুটো আঙুল তুলে হাতের একটা ভঙ্গি করলেন, ‘চুল আর মাছ। শুনে রাখ, শরীরের জন্যে প্রয়োজন হলে একটা অঙ্গ ত্যাগ করবে। গ্রামের জন্যে একটি পাড়া, শহরের জন্য গ্রাম, দেশের জন্য শহর। ফর দি স্যাংটিটি অব দি ফ্যামিলি লেট দেম বি রিমুউভড্।’ মুউ শব্দটার সঙ্গে সঙ্গে বাবা দরজাবূ্যহ ভেদ করার জন্যে এগিয়ে এলেন। জ্যাঠামশায় কিন্তু প্রকৃত বীরের মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। তখন স্বদেশি আমলে একটা কথা প্রায়ই আমাদের কানে আসত—ডু অর ডাই। জ্যাঠামশায়ের সাহস দেখে মনে হলো এই সংকটপূর্ণ দিনে তার ব্রত হলো—ডু অর ডাই। ‘তোর স্বেচ্ছাচারিতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। হিটলারের মতো একটা ডিকটেটর হয়ে উঠছিস। বউমাকে তুই কোথাও নিয়ে যেতে পারবি না। আই ওন্ট অ্যালাও।’ জ্যাঠামশায়ের মুখে ইংরেজি মানে তিনি খুব রেগে গেছেন। শুকনো তোয়ালেটা হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছিল, দু হাতে তাড়াতাড়ি চেপে ধরলেন আর ‘গাদি’ খেলার খেলোয়াড়ের মতো বাবা সট্ করে দরজা গলে বেরিয়ে গেলেন। মা দাঁড়িয়ে রইলেন, কী করবেন ভেবে পেলেন না। শেষে বললেন, ‘আমি তবে আসি।’
‘কোথায় আসবে তুমি মা? তুমি এইখানে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকবে। হু ইজ হি? এ টাইরান্ট! আই উইল সি হিম।’
জ্যাঠামশায় হাঁকলেন—’নিরঞ্জন।’
রাস্তা থেকে উত্তর এলো—’যাই মেজবাবু।’
‘নামিয়ে নিয়ে আয়।’
‘বাক্সটা?’
‘হ্যাঁ, বাক্স’।
নিরঞ্জন চলে গেল বাক্স আনতে।
বাবা পাল্টা নির্দেশ দিলেন, ‘খবরদার নামাবি না।’ নিরঞ্জন সিঁড়ির বাঁকে থেবড়ে বসে পড়ল। জ্যাঠামশায় টেবিলের পাশে চেয়ারে বসে ঘোষণা করলেন, ‘এই বাড়ি থেকে কারোর এক পা বেরোনো চলবে না। এটা জয়েন্ট ফ্যামিলি। কারোর একার মতে সংসার চলবে না।’
বাবা ঘুরে দাঁড়ালেন, ‘অবিশ্বাসী, ষড়যন্ত্রকারী স্ত্রী নিয়ে সংসার করা চলে?’
‘বউমা এর কোনোটাই নয়। তোমার চিরকালের স্বভাব তিলকে তাল করা। আই ডোন্ট অ্যাগ্রি উইথ ইউ।’
‘আমার ফ্যামিলি আমার মতে চলবে। এসব ব্যাপারে নো লিনিয়েনসি।’
শরৎ রাস্তা থেকে চিৎকার করে উঠল, ‘কী হলো রে বাবা!’
জ্যাঠামশায় চিৎকার করলেন, ‘নিরঞ্জন রাসকেল, বাক্স নামিয়ে আন আর শরৎকে দশটা টাকা দিয়ে বিদেয় কর।’
‘আমাকে ছোট বাবু জুতোপেটা করবেন।’
‘আমি তোকে ডাণ্ডাপেটা করব রাসকেল। তোমার ফ্যামিলি কী? আমরা তোমার বিয়ে দিয়েছিলুম। বউমা তোমার একার নয়। এই বাড়ির বউ।’
নিরঞ্জন বাক্সটা ঘাড়ে করে ওপরে উঠে এলো। শরতের গাড়ি স্টার্ট নিয়ে চলে গেল।
‘তুমি জামাকাপড় খুলবে কি না?’
‘মেজদা, তোমার প্রশ্রয়ে সংসার উচ্ছন্নে যাবে।’
‘যায় যাবে। ডোন্ট ফরগেট, সংসারটা তোমার অফিস নয়। কথায় কথায় ডিসচার্জ আর চার্জশিট করবে।’
‘স্বীকার করুক অন্যায় হয়েছে। আই উইল পার্ডন হার।’
‘বউমা।’
মা পায়ে পায়ে এগিয়ে এলেন, দরজার পাশেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। মুখ একেবারে বিবর্ণ।
‘বলো অন্যায় হয়ে গেছে।’
বাবা বুক চিতিয়ে চিবুক উঁচু করে দাঁড়ালেন। মা গলায় আঁচল দিয়ে খুব মৃদু সুরে বললেন, ‘আমার অন্যায় হয়ে গেছে।’
বাবা মুখ উঁচু রেখেই বললেন, ‘আর কখনো এ রকম কোরো না। দিস ইজ ভেরি ব্যাড। পানিশেবল অফেন্স। কক্ষনো নিজে কোনো ডিসিশান নেবে না। মেয়েছেলে, মেয়েছেলের মতো থাকবে।’
মা পিছন ফিরে ধীরে ধীরে চলে যেতে যেতে নারীর অধিকারসংক্রান্ত শেষ উপদেশ শুনে নিলেন।
সেই শ্বেতপাথর। সেই শ্বেতপাথর দাঁড় করানো রয়েছে দেয়ালে ঠেস দিয়ে। সেই নকশা ফ্রেম চলে গেছে উইয়ের পেটে। আর শ্বেত বলা চলে না, অব্যবহারে ধূসর। জীবন থেকে চল্লিশটা উত্তপ্ত বছর বাষ্পের মতো বের করে দিয়ে বরং বাবার চুল এখন প্রকৃত দুগ্ধশুভ্র। মা এখন অয়েল পেন্টিংয়ে অস্পষ্ট স্মৃতি। জ্যাঠামশায় একটি ধূসর ছবি। শুকনো মালায় মাকড়সার লালা। দাদুর লাউফাটা তানপুরা গলায় দড়ি দিয়ে হুক্ থেকে ঝুলছে। চিবুক উঁচু করে বাবা এখনো দাঁড়াতে পারেন; কিন্তু পায়ের কাছে হাঁটু মুড়ে বসার মতো কেউ এ পরিবারে আর অবশিষ্ট নেই।

লেখকের নোটবুক : গারসিয়া লোরকা


আমি গারসিয়া লোরকা, কবি
ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা

অনুবাদ >>> এমদাদ রহমান

[হিস্পানি ভাষার কবি ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা’র এই লেখাটি বিষয় মূলত, স্মৃতি-- কবির নিজের আত্মার দিকে ফিরে তাকানোর কথা আছে এখানে। লেখাটি হিস্পানি’তে লা ভিদা দে গারাসিয়া লোরকা, পোইয়েতা শিরোনামে হোশে লুনা’র একটি প্রবন্ধের অংশবিশেষ, যাকে ক্রিস্তোফার মোরের ইংরেজিতে দ্য লাইফ অভ গারসিয়া লোরকা, পোয়েট এই শিরনামে গভীর গান ও অন্যান্য প্রবন্ধ গ্রন্থে একটি সম্পূর্ণ স্মৃতিকথামূলক গদ্য হিসেবে স্থান দিয়েছেন, আবার মোরের এই কথাটিও জানাচ্ছেন যে এই লেখাটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি সাক্ষাৎকারেরও গদ্যরূপ।
১৯৩৩ সালের ১৬ই অক্টোবর বুয়েন্স আইরেসে কীভাবে একটি নগরী গান গাইতে থাকে, নভেম্বর থেকে নভেম্বরে শীর্ষক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন— আজ আমি সেই ছেলেটির মতো, কোন উৎসবের জন্য নিজের মাকে রঙিন সাজে সাজতে দেখে যে পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকে, ঠিক তেমনিভাবে আমি আপনাদেরকে একটি নগরীর কথা বলব, যেখানে আমি জন্ম নিয়েছিলাম। তার নাম গ্রানাদা। আর গ্রানাদা’র কথা বলতে গিয়ে আমি এই নগরীর সঙ্গীতের বিভিন্ন উদাহরণ দিব। আমি গানগুলো গাইবও। ... গারসিয়া লোরকা’র জন্ম স্পেনের গ্রানাদায়, ৫ জুন ১৮৯৮ সালে। কবির গ্রামের নাম ফুয়েন্তে ভাকুইরোস। ১৯ আগস্ট ১৯৩৬-এ মর্মান্তিক মৃত্যু হয় কবি ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা’র। সালভাদর দালি, লুই বুনুয়েল, পাবলো নেরুদা, রাফায়েল আলবেরতি, হুয়ান রামোন হিমেনেথ— এইসব দুনিয়াখ্যাত মানুষ ছিলেন তাঁর বন্ধু। জিপসি-গীতিকা, গভীর গানের কবিতা, গীতিমালা, নিউইয়র্কে কবি ইত্যাদি তাঁর কবিতার বই। আর রয়েছে বেশ কিছু নাটক, যেমন— রক্তবাসর, ইয়ারমা, বারনারদা আলমা’র বাড়ি।]

আমার জীবন? জীবন বলতে যা বোঝায়, তা কি আমার ছিল? আমার নিজেকে এখনও একটি শিশু ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। ছেলেবেলার আবেগ অনুভূতিগুলি এখনও আমার ভিতর প্রবলভাবেই বর্তমান, আমি তাদের কোনোভাবেই ত্যাগ করতে পারিনি। নিজের জীবনের কথা বলতে গেলে, বলতে হবে; আমি আসলে কে? যে-কারোরই জীবন হল বেঁচে-থাকবার-কালে, কী কী ঘটেছে; তার-ই বৃত্তান্ত বা উপাখ্যান। আমার সঞ্চয়ের সমস্ত স্মৃতিই, এমনকি আমার শৈশবের সূচনা থেকেই, যা যা ঘটেছে, এখনও তীব্রভাবে জেগেই আছে।

আমি আমার শৈশবের স্মৃতি সম্পর্কেই এখানে বলছি। এই স্মৃতিগুলো একান্তই আমার একার, এত প্রগাঢ় আর গোপনীয় যে, আমি এই স্মৃতিগুলোকে নিয়ে কখনই কিছু বলতে চাইনি। আলাপ করতে চাইনি। কখনই চাইনি এগুলোকে নিয়ে কোনও বিশ্লেষণে যেতে।

আমি বেড়ে উঠেছিলাম প্রকৃতির সঙ্গে, অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়ে। দুনিয়ার সমস্ত শিশুর মত, প্রত্যেকটি জিনিস, আসবাবপত্র, লতাগুল্মবৃক্ষ আর পাথরগুলো, অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ ছিল আমার কাছে। তাদের পৃথক সত্তাগুলোকে শ্রদ্ধা করতাম। অবিরাম কথা বলতাম তাদের সঙ্গে। জীবনের সূচনাকাল থেকে তাদের সঙ্গে আমার কতই-না কথা হল আর তাদের কী তীব্র ভালোই না বাসতাম। আমাদের বাড়ির উঠানে বেশ কয়েকটি পপলার গাছ ছিল, এক ঘোরগ্রস্ত বিকালে আমার মনে হল, কাল কাল এই পপলারগুলো গান গাইছে! বাতাস প্রবল বেগে যখনই গাছগুলোকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে, মনে হচ্ছে পপলারদের গান পালটাচ্ছে সুর, পালটাচ্ছে তাল, লয় আর হতবিহবল আমি, ভাবছি; এই তো সঙ্গীত, হৃদয়ের অন্তঃস্থ সঙ্গীত। পপলার বৃক্ষদের গান শোনার সহগামী হয়ে পড়েছিলাম, দিনের বড় একটি অংশ চলে যেত তাদের গান শুনায়। আসলে নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ একদিন, আমি বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে পড়েছিলাম, যখন শুনতে পেলাম কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে – ‘ ফে... দে... রি... কো’... তাকাচ্ছি চারপাশে। না, কেউ নাই, কাউকে দেখছি না। কে এমন শব্দ করে ডাকল? অনেকক্ষণ পর আবার সেই ডাক... আমার উপলব্ধি হল এই প্রাচীন পপলারদের শাখাপ্রশাখাগুলো বিপুল বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে, পরস্পরকে আলঙ্গন করছে বিষণ্ণভাবে।

আমি এই মাটিকে ভালবাসি। আমার অনুভূতিগুলো এই মাটির সঙ্গেই আমাকে কড়িকাঠের মত বন্ধনে জড়িয়েছে, আটকে রেখেছে।

প্রায় বিস্মৃত শৈশবস্মৃতিগুলোর সবই হল মাটি-পৃথিবীর মৃন্ময় স্বাদ উপলব্ধির। এই পৃথিবী আর এই পৃথিবীর গ্রামগুলোই, আমার জীবনকে বারবার মহৎ সব অনুভূতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। কীটপতঙ্গ আর প্রানিগুলো আর পাড়াগাঁর লোকজন ছিল আমার কাছে সব সময়ের এক অতি ব্যঞ্জনাময় বিষয়। হয়ত, গ্রামের লোকজনের ব্যঞ্জনাময় অভিব্যক্তিগুলোই যেন আমার জীবন-চেতনাকে আত্মিকৃত করে নিয়েছিল সুদূর শৈশবে। আর, যদি তা না-ই হতো রক্তবাসর বইটি আমার পক্ষে তাহলে কোনকালেই লিখে ওঠা সম্ভব ছিল না। মৃন্ময়কে ভালবাসা, পৃথিবীকে ভালবাসা আমার ভেতরের শিল্পিক অভিজ্ঞতা লাভের মূল বীজটি রোপণ করেছিল।

এটা হল বাস্তবতা সম্পর্কে সংক্ষিপ্তরূপে এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে কোনকিছুর অকপট বয়ান। সময়টা ছিল সম্ভবত ১৯০০ সাল। আমার স্বদেশ--যে-দেশটি ছিল কৃষকদের—কৃষিজমিগুলোর মাটি চষা হত এমন এক ধরণের লাঙল দিয়ে, যে-লাঙল কায়ক্লেশে মাটির খোলসটাকে খুঁড়তে পারত আসলে নামমাত্রই। সেই বছর কয়েকজন চাষি তইরি করল একেবারে আনকোরা বাবানতি লাঙলের ফলা-- এই নামটি আমার স্মৃতিতে উজ্জল—এই তেজস্বী বলবান লাঙলের ফলা ১৯০০ সালের প্যারিস এক্সিবিশনে পদক লাভ করেছিল। ছোট্ট বালক হিসাবে আমার ছিল প্রচণ্ড কৌতূহল। বালকের উৎসুক্য নিয়ে আমি দেখতাম জমির পর জমির মাটি কী প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতায় খুঁড়ে চলেছে নতুন লাঙলের চতুর ফলা!

আমার দেখতে ভাল লাগত কীভাবে অগুন্তি ইস্পাতের ফলা খুঁড়ে চলেছে পৃথিবীর বুক আর তার গভীর থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনছে নানান শিকড়বাকড়, মনে হত, না, শিকড় নয়, যেন মাটির আত্মা থেকে বের হচ্ছে রক্ত আর মাঝেমাঝে শক্ত কিছুর সঙ্গে লেগে পেরে না উঠে আটকে যাচ্ছে ফলার দুর্বার গতি। ঘর্ষণে উজ্জ্বলিত ইস্পাতের ফলা মাটি খুঁড়ে বের করে এনেছে বহুবর্ণ-পাথর-শোভিত রোমান মোজাইকের একটি খণ্ড, তাতে খোদাই করা দুইজন মানুষের নাম... আজ আমি এই ব্যপারে আর কিছুই মনে করতে পারছি না, তবে, আবছা মনে পড়ছে; নাম দুটি ছিল মেষপালক দাফনিস আর কোলী’র। বিষয়টার গুরুত্ব এইখানেই যে এখান থেকেই আমার জীবনের প্রথম শিল্প-উপলব্ধি হল বিস্ময়কর। বুঝতে পারলাম শিল্প আর সুন্দর সম্পর্কিত মাটির সঙ্গে। খোদাইকৃত এই নাম দুটি—দাফনিস আর কোলী—ছিলেন ভূমিপুত্র, পৃথিবীর স্বাদকে তারা আস্বাদন করেছেন আর জীবনের সঙ্গে জড়িয়েছেন; প্রেমময় সম্পর্কের বন্ধনে। আসলে, এইসব উপলব্ধি হল আমার ভিতর জেগে ওঠা প্রথম অনুভূতি, যা খুব দৃঢ়ভাবেই ভূমির সঙ্গে বন্ধনে আবদ্ধ, মাঠঘাটে দিনমান কাজ করার সঙ্গে সম্পর্কিত। আমার নিজের সঙ্গে এই কথাটাই বলতে চাই যে আমি হলাম কৃষক আর জমিজমা বিষয়ক জটিলতায় আক্রান্ত এক মানুষ, যেমনটা মনঃসমীক্ষণবিদরা, বলে থাকেন। মাটির প্রতি এই ভালবাসা ছাড়া আমার পক্ষে কোনভাবেই দ্বিতীয় কাজটি, ইয়ারমা, শুরু করতেই পারতাম না। আমার কাছে মাটি হল দীনতা, দারিদ্রতার এক প্রগাঢ় ইঙ্গিত, আমি দারিদ্রতা ভালবাসি, সবকিছুর উর্ধে বসিয়ে রাখি; কিন্তু এই দারিদ্রতা শোচনীয় বুভুক্ষা নয়; মহিমান্বিত, বিনীত, বিবর্ণ পাউরুটির মত সরল...

বৃদ্ধ জরাজীর্ণ লোকদের সামনে আমি দাঁড়াতে পারতাম না। আমি তাদের ঘৃণা করছি বা ভয় পাচ্ছি, বিষয়টা আসলে তেমন কিছুই নয়। কারণ তারা আমাকে খুব দ্রুত অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিতেন। চুপসে দিতেন। আমি কখনই তাদের সঙ্গে কথা কইতে চাইতাম না। আসলে আমি জানতামই না বৃদ্ধদের সঙ্গে ঠিক কী নিয়ে আর কীভাবে কথা বলা সম্ভব! মোটকথা এই— আমার এই কথাটাই বারবার মনে হতো-- জীবনের সমস্ত গুঢ়তা সম্পর্কে কেবলমাত্র বৃদ্ধরাই জানেন। তারা শুধু এরকমই চিন্তা করেন, যাকে বলে অভিজ্ঞতা। দীর্ঘজীবনে কত সঞ্চিত অভিজ্ঞতা তাদের! তারা এমন সব বিষয়আশয় নিয়ে কথা বলতেন, যা ছিল আমার ধারণা-কল্পনা’রও বাইরের। বৃদ্ধরা কোথাও একত্রে জড়ো হলে আমার এমন এক অবস্থা হয় যে মনে হয় এখানে আমার পক্ষে একটিও শব্দ উচ্চারণ করার সামর্থ্য নাই। তাদের তির্যক ভ্রূকুটি, মুখের জটিল আয়ুরেখা, জল ছলছল ধূসর চোখ, তাদের কম্পিত ঠোঁট, তাদের পিতামহসুলভ হাস্য আমাকে আতঙ্কিত করে ফেলত। তাদের মহত্ত্বকে মনে হত সবকিছুকে যেন অতল অন্ধকারের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এই হল জরাগ্রস্থ লোকদের বিশিষ্টতা-- একটা সুদৃঢ় বন্ধন যেন যৌবন আর অন্ধকারে-আচ্ছন্ন-মৃত্যু’র সঙ্গে!

মৃত্যু! ধীরে, সুচতুরভাবে মৃত্যু সবকিছুর ভিতর ঢুকে পড়ে। বিশ্রাম, শব্দহীনতা, মৌনতা, স্তব্ধতা, প্রশান্তি— এইসব হল মৃত্যুর প্রবেশদুয়ার। মৃত্যু চতুর্দিকে। সর্বত্র। মৃত্যু হল মহান বিজেতা। আমাদের মৃত্যু শুরু হয় অবসরে, যখন পরিশ্রান্ত আমরা বিশ্রামে যাই, পরবর্তী কোনওএক দিনে, কোনও অনুষ্ঠানে, খুব প্রশান্তভাবে কথা বলার ফাঁকে, লোকেদের জুতার দিকে তাকাও। দেখবে, পরিশ্রান্ত জুতাগুলি বিশ্রাম করছে; কী ভয়ানকভাবেই না তারা বিশ্রাম করছে। তুমি দেখতে পাবে বা তোমার মনে হবে জুতাগুলি নির্বাক, বিষণ্ণ, অভিব্যক্তিহীন জিনিস ছাড়া আর কিছুই না। সমগ্র সত্ত্বা তাদের অর্থহীন, নিষ্ফল এবং ইতোমধ্যেই তারা মরতে শুরু করেছে। জুতা আর পা— তারা যখনই বিশ্রামে যায় তখন তাদের নিরাধারা মৃত্যু আমার মনকে ভয়ানকরকম পীড়িত করে ফেলে। আমি একজোড়া অবসর-নিতে-থাকা-পা’র দিকে তাকাই— দেখি যে পা-জোড়া অবসরের সেই শোকাবহ বিয়োগান্তক পদ্ধতিটি আয়ত্ত করে ফেলেছে আর আমি তখন ভাবতে থাকি,- দশ, বিশ, চল্লিশ কিংবা তার চেয়ে আরও বেশি কিছু বছর... এবং হ-ঠা-ৎ একদিন তাদের পরম এবং অন্তিম বিশ্রাম, কিংবা; হয়ত কয়েকটি মিনিট, হয়ত মাত্র একটি ঘণ্টা। মৃত্যু ইতোমধ্যেই তাদের ভিতর ঢুকে পড়েছে। পায়ে জুতাসমেত আমি কখনই ঘুমাতে যাই না, বোধবুদ্ধিহীন লোকেরা দিনের বেলার ঘুমে যেমনটা করে থাকে। আমি পা’র দিকে তাকাই এবং মৃত্যুর অনুভূতিতে ভয়ে আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। কারো কারো পা’র দিকে-- যে-পা গোড়ালির ওপর ভর দিয়ে বিশ্রাম করছে-- তাকালে, ছেলেবেলায় দেখা মরা মানুষের দেহের কথা মনে পড়ে যেত। মরা মানুষের পা’গুলি সবসময়ই এরকম- পরস্পরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ আর বিশ্রাম করছে তাদের নতুন জুতার ভিতর... মৃত্যুর কারণে, সবকিছুই মৃত্যুর কারণে।

যদি হঠাৎ একদিন, আমি একেবারে বন্ধুহীন হয়ে যাই, আমার বন্ধুদের হারিয়ে ফেলি, যদি আমি ঘৃণা বিদ্রুপ আর ঈর্ষা দ্বারা পরিবৃত্ত হয়ে যাই, তাহলে কোনভাবেই আমি আর কিছুতে জয়ী হতে পারব না। এমনকি আমি লড়াই করার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলব। এটা খুবই সামান্য একটা বিষয় অথবা বলা যায়, আমার জন্য এটা আদৌ কোন বিষয় নয়, বিষয়টি আসলে আমার বন্ধুদের সঙ্গে সম্পর্কিত, যাদের আমি মাদ্রিদে ফেলে এসেছি এবং যাদেরকে আমি বুয়েন্স আইরেসে পেয়েছি। আমি দৃঢ়ভাবেই জানি, যদি কখনও আমার কোন কাজ নিয়ে হাসিঠাট্টা করা হয়, তাহলে আমার বন্ধুরা খুব দুঃখ পাবে। আমি আমার কোনও কাজের জন্য ভুক্তভোগী হতে চাই না, ভুক্তভোগী হতে চাই আমার বন্ধুদের কারণে। তারা অনেকটাই এরকম, যারা আমাদেরকে বিজয়ী হতে বাধ্য করে ফেলে। আর তাদের শক্তিতে আমিও বারবার জয়ী হতে চাই, কারণ আমি তাদেরকে জীবনে প্রবলভাবে কামনা করি, তাদের ভালবাসা আর বিশ্বাসকে আমি হারাতে চাই না, যা তারা আমাকে উপুর করে ঢেলে দিয়েছে। শিল্পীজনোচিত একটা কথা হল, আমি কখনোই তাদের নিয়ে অস্বস্তিতে ভুগি না, যারা আমাকে ভালবাসে না কিংবা আদৌ যারা আমাকে চিনে না।

আমার জীবনের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতা কোনটি? হ্যাঁ, বলছি, এইতো গতকালই অভিজ্ঞতাটা পেলাম। এইতো এই বুয়েন্স আইরেসে, জনৈক নারী নাটকের মঞ্চে আসেন আসেন আমার সঙ্গে দেখা করতে। বিনম্র, দরিদ্র আর মহিমান্বিত চেহারার এই নারী বাস করেন স্প্যানিশ-বলা এখানকার এই লোকদের কোন এক ঘরে। সংবাদপত্রমারফত তিনি এখানে আমার আগমন বিষয়ে জানতে পেরেছেন। আমি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিলাম না তিনি সত্যিই কী চান। সুতরাং তার সঙ্গে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তিনি আমার সামনে বেশকিছু কাগজ বের করলেন, আর খুব সাবধানে কিছু একটা মুড়িয়ে-রাখা জিনিস খুলতে লাগলেন। তিনি তাকিয়ে থাকলেন আমার চোখের দিকে আর মৃদু হাসি ছড়িয়ে পড়ল তার সরল মুখখানিতে, যেন তিনি এই হাসির মধ্য দিয়ে কোনকিছু মনে করবার চেষ্টা করছেন। ‘ফেদেরিকো... কে বুঝতে পেরেছিল... ফেদেরিকো...’ কথা বলতে বলতে তিনি তার হাতের কাগজপত্রের তোড়া থেকে বের করলেন পুরোনো হলদে হয়ে যাওয়া একখানি ফটোগ্রাফ—ছোট্ট একটি শিশুর প্রতিকৃতি। এবং এই প্রতিকৃতিটাই হলো আমার জীবনের সবচেয়ে মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতা!

‘তুমি তাকে চিনতে পারছ, ফেদেরিকো?’

‘না।’

‘এ হলে তুমি’, যখন এক বছরেরটি ছিলে।’

তোমার জন্মের সময় আমিও ছিলাম। আমি তোমাদের বাড়ির পাশেই থাকতাম। তোমার জন্মের সেই দিনটিতে, আমরা স্বামী-স্ত্রী একটা অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য তইরী হচ্ছিলাম। তোমার মা হঠাৎ অসুস্থ আমরা অবশ্য আর সেই অনুষ্ঠানে যাই নি। তোমার মায়ের পাশে ছিলাম এবং তুমি জন্ম নিলে! তোমার এক বছর বয়সে এই ছবিটি তুলা হয়। এই যে দেখো, ছবির শক্ত কাগজ ছিঁড়ে গেছে। কীভাবে? তোমার ছোট্ট হাতই কাজটা করেছে, যখন ছবিটি একেবারে নতুন ছিল। এটা তুমিই ছিঁড়েছ... ছবির ছেঁড়া অংশটুকু হলো আমার কাছে এক বিস্ময়কর স্মৃতিচিহ্ন।’

এইসব কথাই নারীটি বলেলেন আর আমাকে স্থম্ভিত করে রেখে চলেও গেলেন! আমি চিৎকার করে কাঁদতে চাইলাম— তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে, ছবিটিতে চুম্বন করে আর আমি এই সবকিছুই করতে চাইলাম শক্ত কাগজের ছেঁড়া অংশটির দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে। এইতো আমার প্রথম কাজ। আমি জানতাম না কোনটা ভাল আর কোনটা খারাপ, কিন্তু এটা আমার করা প্রথম কাজ...

এটা দেখেছো? (একটা পোস্টারের দিকে তাকিয়ে),-- তুমি কল্পনাও করতে পারবে না-- এই যে বিপুল পরিমাণ মুদ্রিত অক্ষরে আমার নামটি লিখিত হয়েছে আর জনসমক্ষে এই যে প্রচার প্রদর্শন, এটা কী পরিমাণ লজ্জার। আমি অনুভব করি, আমার নিজেকে কেবল মনে হয়, আমি যেন উলঙ্গ হয়ে গেছি; কৌতূহলী জনতার ভীরের সামনে! আমি কোনভাবেই আমার নামের প্রদর্শনীর সামনে দাঁড়াতে পারি না লজ্জায়। থিয়েটার আসলে কী চায়, আমি তার কথাও ভুলে যেতে পারি না। তাই যেন দেখতে পাই, প্রথমবারের মতো, আমি দেখতে পেলাম আমার নাম ব্যবহৃত হচ্ছে, মাদ্রিদে। আমার বন্ধুরা উল্লাশ করছে, তারা ঘোষণা করছে এই কথা যে আমি খুব রাতারাতি বিখ্যাত হওয়ার পথে। কিন্তু এইটা আমার আকাঙ্ক্ষিত ছিল না। আমার নাম নগরীর রাস্তার মোড়ে মোড়ে, যাকে ঘিরে রয়েছে কিছু মানুষের নিঃস্পৃহতা আর কিছু মানুষের প্রচণ্ড ঔৎসুক্য। এই হলো আমার নাম এবং এইখানে তার যথেচ্ছ ব্যবহার; পুর বিশ্ব যে-নামটিকে আঠা দিয়ে সবখানে সেঁটে রেখেছে আর যেই মুহূর্তে নামটি অন্যদের অবশ্যই সুখি করছে, আনন্দিত করছে, আমাকে দিচ্ছে মর্মভেদী যন্ত্রণা। এটা যেন এমন, আমি যেন আমার নিজেকেই ধ্বংস করে ফেলেছি; যেন দ্বিতীয় কেউ একজন আমার ভিতর থেকে উন্মোচিত হয়ে গেছে! এক শত্রু যেন, প্রাচিরপত্রগুলো থেকে আমারি দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আর আমার ভীরুতা দেখে পরিহাস করছে। কিন্তু, হে বন্ধুগণ, আমি যে নিরুপায়।

 

উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ..