Saturday, February 2, 2019

বহির্জাগতিক প্রাণ ও আমরা


মহাকাশে আমরা কি একা?

প্রশ্নটা সম্ভবত গত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশিবার জিজ্ঞাসিত প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটি। আবার এমনভাবেও বলতে পারেন এটি এমন প্রশ্নগুলোর একটি যার উওর আজো নিশ্চিতভাবে দেয়া সম্ভব হয়নি। এই অজানা রহস্যটির ব্যাপারে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম জবাব মেলে তবে। যেমন মহাকাশে প্রাণের খোজ আর অস্তিত্ব নিয়ে গবেষণাকারী প্রতিষ্ঠান সেটির (S.E.T.I. : Search For Extra-Terrestrial Intelligence) মহাপরিচালক ও জ্যোতির্বিদ জিল টার্টার বলেনঃ

“মহাকাশে প্রাণীর অস্তিত্ব আছে কি না সেটা সরাসরি বলার সময় এখনো আসেনি। আপনি যদি এই বিশ্বব্রম্মাণ্ডের বিশালত্ব আর এর গঠন সম্পর্কে সামান্য কিছুও জেনে থাকেন তাহলে এতটুকু বোঝার কথা যে মহাকাশে প্রাণ আছে এটা প্রমাণের চেয়ে মহাকাশে প্রাণ নেই এটা প্রমাণ করাও কতবড় কঠিন একটা কাজ।”

আবার কিংবদন্তী সায়েন্স ফিকশন লেখক আর্থার সি ক্লার্কের এ বিষয়ে বলেন:

“দুটো ব্যাপার হওয়া সম্ভব, হয় আমরা একা,নয়ত আমরা একা নই।দুটো ব্যাপারই সমানভাবে আনন্দের আবার ভয়েরও।”

ঊওর যথাযথভাবে না পাওয়া গেলেও এ নিয়ে মাতামাতি আসলে কখনোই থেমে থাকেনি। মানবজাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে আসলে আমরা কখনোই একা থাকতে চাইনি। আমরা সবসময়ই চেয়েছি আমাদের সমকক্ষ বা আমাদের চেয়েও শ্রেষ্ঠতর কেউ থাকুক। এজন্য ভূত,প্রেতাত্মা,দানব,পরী ইত্যাদি নানা রকমের সত্বাকে হরহামেশা তৈরি করে এসেছি। যাদেরকে কখনো আমাদের বন্ধু বলে পাশে টেনেছি কিংবা প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখেছি।তবে বিজ্ঞানের জয়জয়কারের দিনে আমরা আগের সবাইকে বাদ দিয়ে ধীরে ধীরে অন্য আরেক সত্বাকে নিজেদের মানসপটে আনছি।আর তারা হল “এলিয়েন”বা ভীনগ্রহের প্রাণি। বিজ্ঞানের ভাষায় আমরা যাদেরকে এক্সট্রাটেরিস্ট্রীয়াল লাইফ বা বহির্জাগতিক প্রাণ বলি।

এখন এলিয়েন বা ভীনগ্রহের প্রাণি বললেই আমাদের চোখে হলিউডের তৈরি কিছু বিচিত্র প্রাণির ছবিই ভাসতে থাকে।বিজ্ঞানের ভাষায় এলিয়েন বা বহিঃজাগতিক প্রানী বলতে ওই ধরনের প্রাণকেই বুঝানো হয় যাদের জন্ম অবশ্যই পৃথিবীতে হয়নি,এবং যাদের শারীরীবৃত্তিক কার্যকলাপ পৃথিবীর সাথে সম্পর্কিত নয়। এই হিসেবে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের বাইরের একটা ব্যাকটেরিয়াও একটি এলিয়েন। যদিও আজ পর্যন্ত পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে একটা ব্যাকটেরিয়ার অস্তিত্বও প্রমাণ করা সম্ভবপর হয়ে উঠেনি । কিন্তু তার মানে এই নয় যে কখনোই তা মিলবে না।

আমরা মহাবিশ্বে প্রাণের ব্যাপারে এত আশাবাদী কেন?

এটার জবাবটা লুকিয়ে আছে বিশ্বব্রম্মাণ্ডের বিশালতার মাঝে। ইউনিভার্স বা বিশ্বব্রম্মান্ড এতটাই বড় যে আমাদের সৌরজগতও তার কাছে এক ক্ষুদ্র বালুকণার মত।

336287873_150_150

নক্ষত্রদের সম্মিলন ক্ষেত্র যে গ্যালাক্সি,তাদের সংখ্যাও পৃথিবীর মানুষের সংখ্যার চেয়েও বেশী। আমরা যে সুর্যের বিশালতার কথা ভাবি সেটাও কিন্তু একটা গড়পড়তা আকারের নক্ষত্রের চেয়েও ছোট। পৃথিবীর কথা নাই বা বললাম। আর এতসব গ্যালাক্সির অভ্যন্তরীন গ্রহ নক্ষত্রের মাঝে রয়েছে অসংখ্য বিন্যাস।আর সেই বিন্যাসের মাঝে আমাদের সৌরজগতের মত নক্ষত্রকেন্দ্রীক বিন্যাস থাকা খুবই সম্ভব ।এটাও সম্ভব অগণিত সৌরজাগতিক বিন্যাসের মাঝে আমাদের পৃথিবীর মত কোন এক গ্রহের উপস্থিতি । যার অভ্যন্তরে হয়ত বিকাশ ঘটেছে প্রাণের।গত দুই দশকে এই যুক্তির পালে অনেকহাওয়া এসেও লেগেছে। হাবল বা কেপলারের মত অত্যাধুনিক টেলিস্কোপ দিয়ে এটা বের করা সম্ভব হয়েছে যে হুবহু পৃথিবীর মত না হোক অন্তত এর কাছাকাছি বৈশিষ্টের গ্রহের অস্তিত্ব আছে।এদেরকে বলা হয় এক্সোপ্লানেট । যেমন কেপলার ৩৩৮এফ, গ্লিসে ১৩২সি, কেপলার ৩২বি ইত্যাদি। তবে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত এক্সোপ্লানেটগুলোর মধ্যে কেপলার টুটু বি, কেপলার ১৮৬এফই পৃথিবীর সবচেয়ে কাছাকাছি বৈশিষ্টের গ্রহ বলেই বিবেচিত।চিত্রে কেপলার টুটুবির সাথে পৃথিবীর আকৃতিগত মিল দেখানো হয়েছে।

12কিছু কিছু গবেষণা অনুযায়ী বলা হয়ে থাকে পৃথিবীতে প্রাণের বিকাশ আসলে একটা চরমতম অলৌকিকত্ব ছাড়া আর কিছু নয়..

      “Life on earth is either very common or an extremely rare phenomena of the universe”

আমাদের কেন্দ্রীয় নক্ষত্র সুর্যের সাথে পৃথিবীর বিন্যাসটাই বিচিত্র রকমের । পৃথিবী তার নিজ অক্ষের সাথে ৬৬দশমিক পাঁচ ডিগ্রী কোনে অবস্থান করে।এই কৌনিক অবস্থান আর সুর্য থেকে আমাদের মডারেট ডিস্টেন্স বা পরিমিত দুরত্ব পৃথিবীতে ‘নয় গরম নয় ঠান্ডা’ এরকম একটা পরিবেশ সৃষ্টি করেছে এবং বার্ষিক গতির সাহায্যে ঋতু পরিবর্তন নিশ্চিত করেছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রকম পরিবেশ।প্রাণের বিকাশের জন্য যেসব উপাদানগুলোর প্রয়োজন তা কেবলমাত্র পৃথিবীতেই পর্যাপ্ত পরিমানে রয়েছে।কার্বণ, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন আর হাইড্রোজেনের মত উপাদানগুলোর পরিমানমত সহাবস্থান নিশ্চিত করেছে প্রান সৃষ্টির প্রথম উপাদান এমাইনো এসিডের উত্থানের। আর ঘন বায়ুমন্ডল সুর্যের বিভিন্ন ক্ষতিকারক রশ্মিগুলোকে আটকে দিয়ে প্রয়োজনীয় তাপকে দিনের বেলা প্রবেশের সুযোগ দিয়েছে আবার এই বায়ুমণ্ডলই রাতে প্রয়োজনীয় তাপকে আটকে রেখে পৃথিবীকে হিমশীতল বরফখন্ডে পরিণত হওয়া থেকে রক্ষা করছে, যেটা প্রানধারণের জন্য একান্ত জরুরী ছিল। এই ধরনের অভাবনিয় বৈশিষ্ট কেবল আমাদের পৃথিবীরই আছে, অন্য কোন গ্রহে আজ অবধি এমন বৈশিষ্টের কথা শোনা যায়নি।

তার মানে কি কেবল অনুকূল পরিবেশেই কেবলমাত্র প্রাণের বিকাশ বা প্রজনন সম্ভব? অন্য কোন পদ্ধতি নেই?

ব্যাপারটা আসলে পুরোপুরি এমনটা নয়। অভিযোজন ক্ষমতা আর বিবর্তনজনীত কারণেও ভিন্ন পরিবেশে প্রানের অস্তিত্ব সম্ভব।আর এর উদাহরণ ছড়িয়ে আছে পৃথিবীজুড়ে…..

আর্জেন্টিনার উওর পশ্চিমাঞ্চলে সাগরপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪ হাজার ৭০০ মিটার উপরে লেক ডায়ামান্ট নামের হ্রদে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে।এই লেকের পাশেই আছে মাইপো আগ্নেয়গিরি ।আগ্নেয়গিরির উত্তপ্ত লাভা আর প্রায় অক্সিজেনের শুন্যতা নিয়েও ব্যাকটেরিয়াগুলো দিব্যি টিকে থাকে, বংশবিস্তারও করে।

চিলির এটাকেমা মরুভুমিতে কিছু কিছু মাইক্রো অর্গানিজম যেমন Dunaliella algae জন্ম নেয় মাকড়শার জালের এক কোণায় এসব অর্গানিজমের পানির কোন প্রয়োজন পড়ে না। এরা পানির বদলে মাকড়শার জালের উপর সকালে যে ঘনীভূত অতিক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শিশিরের আস্তরণ পড়ে সেটাকেই গ্রহণ করে টিকে থাকে। Halobacterium halobium নামের ব্যাকটেরিয়া সচরাচর যে লবণাক্ততা দেখা যায় তার চেয়েও প্রায় দশ গুন বেশি লবনাক্ততা সইতে পারে। এক্সট্রিমোফিল ও পলিএক্সট্রিমোফিল গোত্রের বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া অনেক বেশী তাপ ও চাপ সহ্য করতে পারে।

এছাড়াও waterbear বা Tardigrades এর কথা আমরা অনেকেই জানি। এই অদ্ভুত প্রাণিটি অবিশ্বাস্যভাবে পরম শুন্য তাপমাত্রায়, পানির স্ফুটনাঙ্কে,সমুদ্রের তলদেশ এমনকি ভ্যাকুয়ামের মত প্রতিকূল পরিবেশেও বেচে থাকে। মানুষের চেয়ে প্রায় দশ গুন বেশী মাত্রার তেজস্ক্রীয়তা সহ্য করতে পারে প্রাণীটি। আর এ সব উদাহারণ চরম প্রতিকুল পরিবেশেও প্রাণের অস্তিত্বের স্বপক্ষে রায় দেয়

indexu

যদিও এখনো পর্যন্ত আমরা পৃথিবীর বাইরের প্রানের অস্তিত্বকে প্রমাণ করতে পারিনি তবে এই সম্পর্কিত বেশ কিছু ধারণা প্রতিষ্ঠা করা গেছে । যেমন ফার্মির প্যারাডক্স বা ফার্মির হেঁয়ালি । এটি আসলে একধরণের অসামঞ্জস্যতাকে নির্দেশ করে। এর পূর্ণতর সংজ্ঞা এভাবে দেওয়া যেতে পারে:

“মহাবিশ্বের আকার এবং বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করে বহু সংখ্যক উন্নত বহির্জাগতিক প্রাণের সম্ভাব্য উপস্থিতি।কিন্তু এই ধারণা অযুক্তিযুক্ত প্রতীয়মান হয়, কারণ পর্যবেক্ষণগত ফলাফল তা সমর্থন করে না।’

এর পরেই বলা যেতে পারে বিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক ড্রেকের কথা। তিনি একটি সমীকরণ দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছিলেন ফার্মির প্যারাডক্সের বিপরীতে। তিনি তার সমীকরণে তারকা সৃষ্টির হার, গ্রহ সংবলিত তারকা সৃষ্টির হার, বাসযোগ্য গ্রহ সৃষ্টির হারের মত বিভিন্ন জটিল গাণিতিক হিসাবকে একত্রিভূত করার চেষ্টা করেছিলেন। তবে তার সমীকরণটি যতটা না গাণিতিক তার চেয়ে অনেকটাই অনুমান আর সম্ভাব্যতাকেন্দ্রিক। ড্রেক ,কার্ল সেগানদের মত বিজ্ঞানিদের হাত ধরেই গড়ে উঠে মহাকাশে বুদ্ধিমান প্রাণী খোজার সংস্থা সার্চ ফর এক্সট্রাটেরিস্ট্রিয়েল ইন্টেলিজেন্স বা সেটি’র।এই সংস্থা নিরন্তরভাবে মহাকাশ পর্যালোচনা করে যাচ্ছে,খুজে চলেছে উন্নত কোন সভ্যতার।336088753_150_150

SETI PROJECT জোরেশোরে খবরে এসেছিল ১৯৭৫ সালে ।ওই বছরের ১৫ই আগস্ট তারা মহাকাশ থেকে আগত একটা সরু বেতার সংকেত চিহ্নিত করতে সমর্থ হয়।এটি শনাক্ত করেন Jerry R. Ehman নামের এক মহাকাশবিজ্ঞানী৭২ সেকেন্ড স্থায়ী এই সংকেত আলোড়ন তোলে গোটা বিশ্বজুড়ে, কেননা এই বেতার সংকেত আপাতদৃষ্টিতে কোন বুদ্ধিমান সভ্যতার থেকে আগত বলেই বিবেচনা করা হয়েছিল। এটার নাম দেয়া হয়ছিল ওয়াও সিগন্যাল।পরবর্তীতে এই সংকেতের অর্থ বা মহাকাশের যে অংশ থেকে সংকেতটি এসেছিল ওই অংশে গবেষণা চালিয়েও কিছু বের করা সম্ভব হয়নি।

মহাকাশ থেকে আগত সংকেত পাওয়ার জন্য আমরা যে অন্য বুদ্ধিমান প্রজাতির টার্গেটে আছি কি না সেটাও একটা ব্যাপার। তারা যদি আকাশগঙ্গার এই অংশকে টার্গেট না করে থাকে তাহলে আমাদের তাদের থেকে বার্তা পাবার সম্ভাবনা অত্যন্ত ক্ষীণ। আবার তারা ঠিক যে পদ্ধতিতে তাদের বার্তা পাঠাবে সেটা ঠিক আমাদের প্রযুক্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে তাও কিন্তু জোরালোভাবে বলা যায় না। এমনও হতে পারে যে আমরা তাদের পাঠানো বার্তা ধরতে পারছি না কিংবা তারাও পারছে না। তারা হয়ত আমাদের চেয়েও শক্তিশালী কোন পদ্ধতি বের করে ফেলেছে যেটা হয়ত আমাদের পক্ষে এখনো সম্ভবপর হয়ে উঠেনি।

তবে এগুলো আসলে নিছকই আশার বাণী। যতটা না দৃশ্যমান তারচেয়ে অনেক বেশী সম্ভাব্যতাকেন্দ্রীক,অন্তত আমাদের কাছে।

মহাকাশে প্রাণের অনুসন্ধান আর যোগাযোগের ক্ষেত্রে জ্যোতির্বিদ কার্ল সেগানের নামটা একটু আলাদাভাবেই নিতে হয়।

segan

অসামান্য প্রতিভাধর এই বিজ্ঞানী তার জীবনের একটা বড় অংশ ব্যয় করেছেন মহাকাশে উন্নত সভ্যতার সন্ধানের গবেষণায়। কর্ণেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপকের হাত ধরেই নির্মিত হয়েছিল ভয়েজার গোল্ডেন রেকর্ড । এটি ছিল সোনার তৈরি একপ্রকারের ডিস্ক,এতে ছিল ১১৬ টি স্থিরচিত্র যাতে পৃথিবীর মানুষের অবয়ব, পৃথিবীর পরিবেশগত আচরণ, পৃথিবী বা সৌরজগতের মহাজাগতিক অবস্থান,মানুষের দৈনন্দিন জীবন, পশু,পাখী,পোকামাকড়, ডিএনএ সম্পর্কিত ধারণা ইত্যাদি দেয়া হয়েছে ।দেয়া হয়েছিল বাতাস-ঢেউ-বৃষ্টির শব্দ, পাখির কূজন,মেঘের বজ্রধ্বনি ইত্যাদি । এছাড়াও প্রাচীণ গ্রিক আর আ্ধুনিক মিলিয়ে মোট ৫৫টি ভাষায় একটি শুভেচ্ছা বার্তা রেকর্ড করা হয়েছিল। এতে বাংলা ভাষাও ছিল।১৯৭৭ সালে নাসার ভয়েজার-১ নামের মহাকাশযান এই গোল্ডেন ডিস্ক নিয়ে যাত্রা শুরু করে। বর্তমানে ভয়েজার-১ প্রথম মনুষ্যসৃষ্ট নভোযান হিসেবে ইন্টারস্টেলার স্পেস বা সৌরজগতের প্রভাব বহির্ভূত স্থানে পৌছেছে। আশা করা হচ্ছে ভয়েজার-২ ও ২০১৬ সালে ইন্টারস্টেলার স্পেসে পৌছবে। এই গোল্ডেন রেকর্ডের উদ্দেশ্য ছিল একটাই।যদি এটা কোন এক সময় গিয়ে কোন এক উন্নত সভ্যতার হাতে গিয়ে পড়ে এবং তারা যেন আমাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা চালায় । আদৌ সে অবধি পৌছবে কি না বা তারা আমাদের তথ্যগুলোর মর্মোদ্ধার করতে পারবে কি না সেটাও কিন্তু একটা বড় প্রশ্ন। সেই গোল্ডেন রেকর্ডের একটা ছবি

31

মহাকাশে উন্নত প্রাণি সন্ধানের বড় সমস্যা অবশ্যই  দূরত্বএবং প্রযুক্তির অপ্রতুলতা। আমরা এখনো মহাকাশীয় দূরত্বকে সফলভাবে জয় করতে পারিনি। আমাদের পা কেবল চাঁদেই পড়েছে আর মঙ্গলে পড়ার অপেক্ষায় আছে। গতিও বড় একটা বাধা। এছাড়াও আমাদের জানা নেই যে ঠিক কোন দিকে বা পথে গেলে আমরা অন্যকোন সভ্যতার দেখা পাব ।এজন্য আমাদের সব দিকেই নজর দিতে হচ্ছে।আর আমরা মূলত কার্বন নির্ভর সভ্যতা। বিশাল বিশ্বব্রম্মান্ডের কোন এক কোনে যদি অন্য কোন উপাদান যেমন নাইট্রোজেন বা সিলিকন নির্ভর সভ্যতা গড়ে ওঠে তাহলে তাদের কিভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হবে বা তাদের সাথে যোগাযোগই বা কিভাবে হবে তা নিয়েও বিস্তর প্রশ্ন আছে। স্টিফেন হকিংস এ ব্যাপারে বলেন

“ মহাকাশে যোগাযোগ একটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, ধরুন আমরা ধরেই নিলাম আমরা একটা উন্নত সভ্যতার কাছে একটা তথ্য পাঠালাম, তথ্যটা তারা পেল এবং সে অনু্যায়ী জবাবও পাঠালো। জবাবটা আমাদের কাছে পৌছবে বহুকাল পরে, এটাও ধরে নিলাম যে ওই জবাবটাও আমরা পেলাম এবং আরেকটা তথ্য পাঠালাম। তথ্যটা তাদের কাছে পৌছাতে পৌছাতে তারা হয়ত ব্যাপারটা ভুলে যেতে পারে কিংবা দীর্ঘসুত্রীতার কারণে আগ্রহও হারিয়ে ফেলতে পারে।”

আধারের বিপরীতে আলোও থাকে।অতি সম্প্রতি কিছু উল্কাপিন্ডের গায়ে পোকামাকড়সদৃশ প্রাণীর ছাপ পাওয়া গেছে।মঙ্গলগ্রহে দিনের আলোয় মিলেছে লবনাক্ত পানির ধারা । Who knows something very interesting yet to be discovered…

15-195_perspective_2

নাসার নিউ হরাইজন আমাদের দেখিয়েছে প্লুটোর মাঝে পাহাড়ী আর সমতল ভূমির  ছবি।

150718150335-new-horizons-pluto-flyby-nasa-orig-00000616-large-169

এছাড়াও শনির উপগ্রহ টাইটানেও রয়েছে প্রাণসঞ্চারের জন্য কিছু উপাদান। নাসার পাঠানো যান ক্যাসিনি থেকে প্রাপ্ত তথ্যানু্যায়ী টাইটানের আবহমন্ডলে হাইড্রোজেন গ্যাস প্রবাহিত হচ্ছে এবং তা ভুপৃষ্ঠের কাছাকাছি এসে মিলিয়ে যাচ্ছে। এটা থেকে আন্দাজ করা হচ্ছে যে হয়ত টাইটানে হাইড্রোজেন শোষনকারী কোন জীবের উত্থান ঘটেছে ।কারণ একই ধরণের ঘটনা ঘটে পৃথিবীতে অক্সিজেনের বেলায়।গত ১৬ই মার্চ নাসা আরো তিনটি নতুন এক্সোপ্ল্যানেট বা পৃথিবীসদৃশ গ্রহের আবিষ্কারের কথা বলেছে।

অল্পকিছুদিন আগেই একটা নক্ষত্রকে ঘিরে বহির্জাগতিক প্রাণীদের তৈরি দানবাকার কোন সোলার এনার্জি কালেক্টর যন্ত্র বা সহজভাষায় এলিয়েন মেগাস্ট্রাকচারের অস্তিত্ব থাকার ব্যাপারে জোরালো দাবী তোলা হয়েছে।এই জিনিসটার উপর জোরেসোরে গবেষণা শুরু হয়েছে।

p3a143dc1omjfziwxpaw

নাসা দাবি করেছে যে তারা আগামী ২০ বছরের মধ্যে খুজে বের করবে মহাকাশে আমরা ছাড়া আর কোন প্রাণী আছে কি না। এছাড়াও ফিউশন ইঞ্জিন রকেট আর ওয়ার্মহোলের মত ব্যাপারগুলোতে যদি সাফল্য আসে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে যদি মহাকাশের কোথাও কোন সভ্যতা বিকশিত হয়ে থাকে আমরা তাদেরকে খুজে পাবই।

ততদিন পর্যন্ত মহাকাশে আমরা একা কি না সেটা নিয়ে জল্পনা কল্পনা চলুক না! কিছু কথা না’হয় তোলাই থাকল সময়ের কাছে।

 

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/et_lives_and_us/

Friday, February 1, 2019

গায়ে হলুদ - বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর গল্প


শ্রাবণ মাসের দিন, বর্ষার বিরাম নেই, এই বৃষ্টি আসছে, এই আকাশ পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে। ক্ষেতে আউশ ধানের গোছা কালো হয়ে উঠেছে, ধানের শীষ দেখা দিয়েছে অধিকাংশ ক্ষেতে।

পুঁটি সকালে উঠে একবার চারিদিকে চেয়ে দেখল—চারিদিকে মেঘে মেঘাচ্ছন্ন। হয়তো বা একটু পরে টিপ-টিপ বৃষ্টি পড়তে শুরু করে দেবে। আজ তার মনে একটা অদ্ভুত ধরনের অনুভূতি, সেটাকে আনন্দও বলা যেতে পারে, ছদ্মবেশি বিষাদও বলা যায়। কি যে ঠিক করে না যায় বোঝা, না যায় বোঝানো। আজ তার বিয়ের গায়ে-হলুদের দিন। এমন একটা দিন তার বারো বছরের ক্ষুদ্র জীবনে এইবার প্রথম এলো। সকালে উঠতেই জ্যেঠিমা বলেছে—ও পুঁটি, জলে ভিজে ভিজে কোথাও যেন যাস নি; আর তিনটে দিন কোনো রকমে ভালোয় ভালোয় কেটে গেলি বাঁচি।


আজ কি বার?—মঙ্গলবার! শনিবার বুঝি বিয়ের দিন। পুঁটির মনে সত্যিই কেমন হয়, আনন্দের একটা ঢেউ যেন গলা পর্যন্ত উঠে আটকে গেল। বিয়ে বেশি দূরে কোথাও নয়, এই গ্রামেই, এমন কি এই পাড়াতেই। এক ঘর ব্রাহ্মণ আজ বছরখানেক হলো অন্য জায়গা থেকে উঠে এসেছেন এখানে, দুখানা বড় বড় মেটে ঘর বেঁধেছেন—একখানা রান্নাঘর। এতদিন ধরে সে সঙ্গিনীদের সঙ্গে সেই বাড়িতে কুল পাড়তে গিয়েছে, সত্যনারায়ণের সিন্নি আনতে গিয়েছে, যখন পাড়ার প্রান্তের ঘন জঙ্গল কেটে সে ভদ্রলোক বাড়ি তৈরী করেন ঘাটে যাবার পথে একেবারে ডান ধারে, তখন সে কতবার ভেবেছে এই ঘন বনের মধ্যে বাড়ি করে বাস করবার কার না জানি মাথাব্যাথা পড়ল।

কে জানত, সেই বাড়িটাই—আজ এক বছর এখনও পোরেনি—তবে শ্বশুরবাড়ি হবে!

কতদূর আশ্চর্যের কথা, কতদূর বিস্ময়ের কথা, ভাবলে অবাক হয়ে যেতে হয়। অথচ তারই ক্ষুদ্র জীবনে এমন একটা মহাশ্চর্য ব্যাপার সম্ভব হলো। যখনই সে একথাটা ভাবে তখনই সে সুদ্ধ তার মন সুদ্ধ যেন কতদূরে কোথায় চলে যায়।
ওই ভদ্রলোকের একটি মাত্র ছেলে, নাম সুবোধ, তারই সঙ্গে ওর বিয়ের সম্বন্ধ হয়েছে। সুবোধকে এই সন্ধের আগে তাদের বাড়িতে কয়েকবার যাতায়াত করতে দেখেছে—বেশ ফর্সা, লম্বামতো মুখ, এবার ম্যাট্রিক দিয়েছে, এখনও পরীক্ষার ফল বার হয় নি। আগে আগে, সত্যি কথা বলতে গেলে, সুবোধের মুখ পুঁটি তত পছন্দ করত না। তার দাদার সঙ্গে যতবার এসেছে তাদের বাড়িতে—পুঁটি ভাবত—দেখো না ঘোড়ার মতো মুখখানা। কিন্তু আজকাল আর সুবোধের মুখ ঘোড়ার মতো তো মনে হয়ই না, মনে হয় বেশ চমৎকার মুখ। গ্রামের ছেলেদের মধ্যে অমন চোখ, অমন রঙ, অমন মুখের গড়ন কার আছে?

রায়েদের পুঁটি সেদিন বলেছিল তাকে—হ্যাঁরে, তুই যে বড় ঘোড়ামুখো বলতিস, তোর অদেষ্টে শেষকালে কিনা সেই ঘোড়ামুখোই জুটল!

পুঁটি মারতে ছুটে গিয়েছিল তার পিছু পিছু।

পুঁটির বাবা গোলার দোরে দাঁড়িয়ে ধান পাড়বার ব্যবস্থা করছে। তার বাবা বেশ চাষীবাসী গেরস্ত। পুঁটিদের বাড়িতে চারটে বড় বড় ধানের আউড়ি আছে, গোলা আছে একটা। আউড়ি জিনিসটা গোলার চেয়ে অনেক ছোটো, তিন চার বিশ ধান ধরে—আর একটা গোলায় ধরে এক পৌটি অর্থাৎ ষোলো বিশ ধান।
তাদেরও ধান আছে গোলা ভর্তি, সব কটা আউড়ি ভর্তি। কলকাতায় চাকরি করে এ পাড়ার হরিকাকা, তিনি মাঝে মাঝে গাঁয়ে এসে পুঁটির বাবাকে বলেন—আর কি রায় মশায়, এ বাজারে তো আপনিই রাজা। গোলা ভর্তি ধান রেখেছেন ঘরে, আপনার মহড়া নেয় কে? কলকাতায় ‘কিউতে দাঁড়িয়ে এক সের চাল নিতে হচ্ছে—আর আপনি—

পুঁটি জিজ্ঞেস করেছিল—কিসে দাঁড়িয়ে চাল নিতে হয় বাবা, বলছিল হরিকাকা?

--কে জানে কিসে দাঁড়িয়ে, তুই নিজের কাজ কর, আমি নিজের করি—মিটে গেল।

--তুমি জান না বুঝি ও কথাটার মানে? না বাবা?

--না জেনে তো পায়ের উপর পা দিয়ে এ বাজারে চালিয়ে দিলাম মা। কলিকাতার মুখ না দেখেও তো বেশ চলে যাচ্ছে।

কলকাতায় নাকি মানুষের এক সের চালের জন্য চার ঘণ্টা কোথায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়—কিন্তু যে বাড়িতে তার বিয়ে হচ্ছে, তাদের অবস্থা এত ভালো নয়। সুবোধ যদি পাস করে, তবে হরিকাকা ভরসা দিয়েছেন কলকাতায় নিয়ে গিয়ে তাকে ওঁর অফিসে চাকরি করে দেবেন। তা হলে তাকেও কি কলকাতায় গিয়ে বাসায় থাকবে হবে আর সেই কিসে দাঁড়িয়ে রোজ এক সের চাল নিয়ে এসে রাঁধতে হবে? সে বড় কষ্ট—তবে, মানে সুবোধ যদি সঙ্গে থাকে, সে বোধহয় সব রকমই কষ্টই করতে প্রস্তুত আছে।

তাদের ধানের গোলা থেকে ধান পাড়া হচ্ছে, খাবরাপোতা থেকে সীতানাথ কলু আড়তদার এসেছে—ধান কিনে নিয়ে যাবে। বিয়ের খরচপত্র ধান বেচে করতে হবে কিনা।

ওর জ্যেঠিমা বললেন, ও পুঁটি আজ কোথাও বেরিও না। নাপিত ও বাড়ি থেকে হলুদ নিয়ে আসবে, সেই হলুদ গায়ে দিয়ে তোমায় নাইতে হবে।
এমন সময় সাধন জেলে এসে ভিজতে ভিজতে উঠোনে দাঁড়াল। হাত জোড় করে মাথা নিচু করে প্রণাম করে বলল, পাতপেন্নাম।

তার বাবা বললে—ও সাধন, বাবা তোমায় ডেকেছি যে একবার। আমার যে কিছু মাছের দরকার এই শনিবারে।
কি জানি কেন পুঁটির বুকটা দুলে উঠল। এই শনিবার—এই শনিবারে তা হলে সত্যিই তার—

সাধন বলল—আজ্ঞে, মাছের যে বড্ড গোলমাল যাচ্ছে। গাঙে কি মাছ আছে? ডুমোর বাঁওড়ের মাছ সব যাচ্ছে কলকাতায়। বিরাশি টাকা দর। এমন দর বাপের জম্মে কোনো কালে শুনি নি রায় মশায়। এক সের পোনা ইস্তক পড়তে পাচ্ছে না। মরগাঙে বাঁধল দিয়েলাম—একদিন কেবল এক সাড়ে এগার সের গজাড় মাছ—

পুঁটির বাবা বিস্ময়ের সুরে বললে—সাড়ে এগার সের গজাড়! এমন কথা তো কখনও শুনি নি—

--অরিবত গজাড় রায় মশায়। মাছের এমন দর, গজাড় মাছই বিক্রি হলো দশ আনা সের।

পুঁটি আর দাঁড়াল না। মাকে এমন আজগুবি খবরটা দিতে ছুটল বাড়ির মধ্যে। বৃষ্টি একটু থেমেছে, একটু বেরুতে পারলে ভালো হতো। তার জীবনে যে একটা আশ্চর্য ব্যাপার হতে চলেছে এ কথাটা কারও সঙ্গে আনন্দ করে বলাও চলে না। বেহায়া বলবে, নিন্দে করবে। কেবল বলা চলে তার সমবয়সী পাঁচি, আর ক্ষেন্তি জেলেনির মেয়ে টুনির কাছে। আর একটা আশ্চর্য ব্যাপার—তার চেয়ে অন্তত সাত বছরের বড় লতিদিদির এখনও বিয়ে হয় নি—অথচ লতিদিকে সবাই বলে সুন্দরী, লতিদির বাপের অবস্থা ভালো। লতিদি লেখাপড়া জানে ভালো। গান করে, ওর বাবা যখন কলকাতা চাকরি করত, তখন লতিদি স্কুলে পড়ত সেখানে। কত বই পড়ে বসে বসে দুপুর বেলা। পুঁটি ভালো লেখাপড়া জানে না, লতিদি একটু ঠ্যাকারে, সে লেখাপড়া জানে না বলে বুঝি আর মানুষ না?

তাকে বলে—তুই বই-টই নাড়িস নে পুঁটি। কি বুঝিস তুই এর আস্বাদ?

পুঁটি হয়তো বলে—এ কি বই বল না লতিদি?

--যা যাঃ, আর বইয়ের খবরে দরকার নেই। শরৎ চাটুজ্জ্যের নাম শুনেছিস? কোথা থেকে শুনবি? তোরা তো শুধু জানিস ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে কি করে চিঁড়ে কুটতে হয়। তাই করগে যা—এদিকে কেন আবার?

আচ্ছা, আজ তার লতিদিকে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে—কই লতিদি, তুমি এত বই পড়ে টড়ে বসে আছ, এতসব নাম জান—কই তোমার তো আজও বিয়ে হলো না। আমার জীবনে এত বড় একটা আশ্চর্যি কাণ্ড তো টুক করে ঘটে গেল। ধানের নিন্দে কর, বাবার গোলায় ধান ছিল বলেই তো আজ—কই তোমাদের তো—তারপর ম্যাট্রিক পাস বর। এ গাঁয়ে পাস করা ছেলে একমাত্র আছে মুখুজ্জেদের জীবনদা। সে নাকি দুটো পাস—কোথায় চাকরি করছে যেন—যেন ঐ দিকে কোথায়। যার সঙ্গে বিয়ের কথা হচ্ছে, সে মুখ্যু নয়। পাসের খবর বেরুবার দেরি নেই—বাবা বলেন, সুবোধ নিশ্চয়ই পাস করবে। হে ভগবান, তাই যেন করো, পাস যেন সে করে, সত্যনারায়ণের সিন্নি দেবে সে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে।

নাপিত এসে বললে—মা ঠাকুরুন, ও বাড়ি থেকে দেখে এলাম। গায়ে হলুদের লগ্ন বেলা দশটার পর। আপনাদের যা দিতে হবে তার আগে দিয়ে দেবেন।
গায়ে হলুদের তত্ত্ব আসবে ও বাড়ি থেকে। কি রকম জিনিসপত্র না জানি আসে। পুঁটির মনটা চঞ্চল হয়ে উঠল। একখানা লাল কাপড় নিশ্চয়ই দেবে। পুঁটির মোটে তিনখানা শাড়ি আর একখানা ডুরে শাড়ি আছে মায়ের বাক্সে তোলা। এবার তার অনেক কাপড় হবে, গহনাও হবে। পাঁচ ভরি সোনা দেবার কথাবার্তা হয়েছে। এতদিন দুটি দুল ছাড়া অন্য কোনো গহনা তার অঙ্গে ওঠেনি—অথচ ও কুমারী মেয়ে লতিদিরই হাতে ছ’গাছা করে চুড়ি, গলায় লকেট ঝোলানো হার, কানে পাশা, হাতে আংটিও আছে। ও থাকত শহরে, সেখানে মেয়েদের চালচলন আলাদা। এ সব পাড়াগেঁয়ে মেয়েরা কাঁচের চুড়ি ছাড়া আবার কি গহনা পরে? অত পয়সাও নেই তার বাপের। গোলায় দুটো ধান আছে মাত্র, নগদ পয়সা কোথায়। যা কিছু করতে হয়, সে ঐ ধান বেচে।

ভীষণ বৃষ্টি এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে সামান্য ঝড়। রান্নাঘরের ছাঁচতলায় দাঁড়িয়ে বকনা বাছুরটা ভিজছে। কচুপাতায় জল জমে আবার গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। তাদের কৃষাণ বীরু মুচি বলছে—ও দিদি ঠাকরোণ, তা একটু তামাক দ্যাও মোরে, বিয়েবাড়ি যে মনেই হচ্ছে না। দুই-দশ ছিলিম তামাক পোড়বে তবে তো বুঝব যে নগনশা লেগেছে।
পুঁটি বিরুকে ধমক দিয়ে বলল—যাঃ, তোর আর বক্তৃতা দিতে হবে না। তামাক আমি কোথায় পাব? কাকিমার কাছে গিয়ে চাইগে যা—

একটু বেলা হয়েছে। বাড়িতে অনেক লোক এসেছে বিয়ের জন্য। বিয়েবাড়ির মতো দেখাচ্ছে বটে—কুমোরপুরের কাকিমা, পাঁচঘর মাসিমা তাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসেছেন—আজ বেলা এগারোটার সময়ে আরও একদল আসবে, ইস্টিশানে গাড়ি গিয়েছে। মেয়েরা সবাই দল বেঁধে নদীতে নাইতে গেল। কুমোরপুরের কাকিমা যাবার সময়ে তাকে বলে গেল—বাঁড়ুজ্জে বাড়ি পিঁড়ি চিত্তির করতে দিয়ে আসা হয়েছে, দেখে আসিস পুঁটি সে-দুখানা পিঁড়ি হয়েছে কি-না।
কাকিমার এটা অন্যায় কথা। তার লজ্জা করে না? নিজের বিয়ের পিঁড়ি নিজে বুঝি সে চাইতে যাবে? এত বেহায়া সে এখনও হয় নি।
তার বাবা চন্ডিমণ্ডপ থেকে হেঁকে বললেন—ও পুঁটি হাতায় করে একটু আগুন নিয়ে এসো মা—

চণ্ডিমণ্ডপের দোর পর্যন্ত গিয়ে শুনল ওর বাবা আর এখন অজ্ঞাত লোকের মধ্যে নিন্মোক্ত কথাবার্তা:

--তাহলে পালকির বন্দোবস্ত দেখতে হয়—

--আজ্ঞে পালকি কোথায় মিলবে? ষোলডুবুরির কাহারপাড়া নির্বংশ। পালকি বইবার মানুষ নেই এ দিগের।

--তবে ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে এসো বনগাঁ থেকে।

--এ কাদা-জলে দশ টাকা দিলেও আসবে না। আসবার রাস্তা কই?

--ওরা বিদেশী লোক। বর আসবার ব্যবস্থা আমাদেরই করে দিতে হবে। বুঝলে না? আমরাই পারছি নে, ওরা কোথায় কি পাবে? হিম হয়ে বসে থেকো না। যা হয় হিললে লাগিয়ে দ্যাও একটা।

--আচ্ছা বাবু, বলদের গাড়িতে বর আনলি কেমন হয়?

--আরে না না। --সে বড় দেখতে খারাপ হবে। সে কি—না না। শুনছি ওরা ইংরিজি বাজনা আনছে। বলদের গাড়ির পেছনে ইংরিজি বাজিয়ে বর আসবে, তাতে লোক হাসবে।

--কেন বাবু তাতে কি? বলদের গাড়িতে কি বর যায় না? একেবারে আপনাদের বাড়ির পেছনে এসে থামবে—সেই তো ভালো।

--বলদের গাড়িতে বর যাবে কেন? সে কি আর ভদ্দরলোকের বর যায়? তা ছাড়া পেছনের ও পথ আইবুড়ো পথ। ওখান দিয়ে বর আসবে না, সামনের তেঁতুল তলার রাস্তা দিয়ে বরকে আনতে হবে। তুমি আজকেই যাও দিকি ষষ্ঠীতলা। সেখানে ক’ঘর কাহার আছে শুনিছি। সেখান থেকেই পালকি আনতে—

--সে যে এখান থেকে তিনকোশ সাড়ে তিনকোশ রাস্তা বাবু।
পুঁটি আর সেখানে দাঁড়াল না। সুবোধ বর সেজে আসবে বলদের গাড়িতে? হি –হি—সে বড় মজা হবে এখন। ধুতরো ফুলের মালা গলায় দিয়ে?

দৃশ্যটা মনে কল্পনা করে নিয়েই হাসতে হাসতে পুঁটির দম বন্ধ।
--ও তিনু—তিনু রে—শোন শোন একটা মজার কথা—

তিনু চার বছরের খুড়তুতো ভাই। উঠোনের নিচে দিয়েই যাচ্ছে। সে মুখ উঁচু করে ওর দিকে চেয়ে বললে—কি লে ডিডি?

--জানিস? এই আমাদের বাড়ি বর আসবে—

--বল?

--হ্যাঁ-রে। ধুতরো ফুলের মালা পরে বলদের গাড়ি চেপে ইংরিজি বাজনা বাজিয়ে—হি—হি—

তিনু না বুঝে হাসলে—হি—হি—

এই সময়ে ওদের জ্যাঠাইমা বাড়ির ছেলেমেয়েকে ডাক দিলেন—ওরে, সবাই এসে কাঁঠাল খেয়ে যা—ও হিমু, পান্তা ভাত কে কে খাবে ডাক দিয়ে নিয়ে আয়। এক হাঁড়ি পান্তা রয়েছে। সেগুলো কাঁঠাল দিয়ে ওঠাতে হবে। এই যুদ্ধের বাজারে—

পান্তা ভাত ও কাঁঠাল পুঁটির অতি প্রিয় খাদ্য। কিন্তু আজ এখন তার খাবার নাম করার জো নেই—খিদেও পেয়েছিল, ইচ্ছে করলে সে কলসি থেকে কাঁঠাল-বীচি ভাজা আর মুড়ি লুকিয়ে পেড়ে নিয়ে খেতে পারত—কিন্তু সে ইচ্ছে তার নেই। তাতে ভগবান রাগ করবেন। আজকের দিনে সে ভগবানকে রাগাবে না। বেলা বাড়ল। ও বাড়িতে শাঁক ও হুলুর শব্দ শোনা গেল। অবিশ্যি খুব কাছে নয় পুঁটির ভাবী শ্বশুরবাড়ি। তা হলেও শাঁকের শব্দ না আসবার মতো দূরও নয়।
ওর খুড়তুতো বোন শ্যামা বললে—ওই শোন দিদি, দাদাবাবুর গায়ে হলুদ হচ্ছে—পুঁটি ধমক দিয়ে বললে—চুপ। মেরে ফেলে দেব। দাদাবাবু কে?
-বা-রে, হয়েছেই তো—আর তো দুদিন দেরি—

--না। তা হোক। আগে বলতে নেই।
জ্যাঠাইমা তো বলছে?

--কি বলছে?

--বলেছে, আমাদের জামাইয়ের গায়ে হলুদ হচ্ছে—সেখান থেকে তত্ত্ব নিয়ে নাপিত এবার এসে পৌঁছে যাবে—

--না। তা হোক। আগে বলতে নেই।

--আচ্ছা দিদি-দাদাবাবু—ইয়ে সুবোধবাবু পাস করেছে?

--খবর এখনও বের হয়নি।

-আমি ও পাড়ার রাধীদের বাড়ি গিয়েছিলাম এই এট্টু আগে। রাধীর দাদা পাস করেছে, কাল বিকেলে কলকাতা থেকে ওর কাকা খবর দিয়েছে।

--তোর দাদাবাবুর—ইয়ে মানে ওর—দূর, এই কেশববাবুর ছেলের খবর কে পাঠাবে কলকাতা থেকে? ওদের তো কেউ নেই কলকাতায়।

একটু পরে ওদের বাড়িতে শাঁক বেজে উঠল, হুলু পড়ল। নাপিত তত্ত্ব নিয়ে আসছে তেঁতুলতলার পথে, বাড়ি থেকে দেখা গিয়েছে।

পুঁটির বুক আনন্দে দুলে উঠল—জ্যাঠাইমা বলছিলেন, আশীর্বাদ হয়ে গেলেও বিয়ে না হতে পারে, কিন্তু গায়ে হলুদ হয়ে গেলে বিয়ে নাকি আর ফেরে না।
এবার তাহলে সেই আশ্চর্য ব্যাপারটা তার জীবনে ঘটে গেল।

কেউ আর বাধা দিতে পারবে না। পাড়াগাঁয়ে কত রকমে ভাঙচি দেয় লোকে। তার বিয়েতেও ভাঙচি দিয়েছিল। বলেছিল, মেয়ের রঙ কালো, মুখ-চোখ ভালো না--লেখাপড়া জানে না—আরও কত কি। কিন্তু সুবোধ—না। ছিঃ, ওর নাম করতে নেই, নাম হিসেবে মনে ভাবতে নেই।

তারপর বাকি অনেকগুলো কি ব্যাপার স্বপ্নের মতো তার চোখের সামনে দিয়ে ঘটে গেল। শাঁকের ডাক, হুলুধ্বনি, মা, কাকিমা, জ্যাঠাইমা তাকে তেল-হলুদ মাখিয়ে দিলেন। গায়ে হলুদের তত্ত্ব এলো লালপেড়ে শাড়ি, তেল-হলুদ, একটা বড় মাছ, এক হাঁড়ি দই। তার সমবয়সী বন্ধু তিনজন খেতে এলো তাদের বাড়ি। তাকে কাছে বসিয়ে কত যত্ন করে মাছ দিয়ে, দই দিয়ে, মা জ্যাঠাইমা কত আদর করে খাওয়ালেন, কত মিষ্টি কথা বললেন। সোনার পিঁড়িতে সিঁদুর দেওয়া হলো, প্রদীপ দেখানো হলো, --যাতে শুন্য ধানের গোলা সামনের ভাদ্র মাসে আউস ধানে অন্তত অর্ধেকটা পুরে যায়। বাবা বলেন, গোলার ধান খালি হয়ে যেত না। মধ্যে কি একটা গভর্নমেন্টের হাঙ্গামা এলো—কেউ গোলায় ধান জমিয়ে রাখতে পারবে না, তাতেই অনেক ধান কর্জ দিতে হলো গ্রামের লোকজনকে।

গায়ে হলুদের তত্ত্বে আরও অনেক জিনিস এসেছিল, খাওয়া-দাওয়ার পরে গাঁয়ের মেয়েরা কেউ কেউ দেখতে এলো—তখন সে নিজেও দেখল। আগে লজ্জায় ওদিকেও সে যায় নি। একটা শাড়ি, একটা ব্লাউজ, সায়া একটা—আলতা, সাবান, আয়না আর গন্ধতেল। এ সব জিনিস তার নিজস্ব। কারও ভাগ নেই এতে। সে ইচ্ছে করে যদি কাউকে দেয় তবেই সে পাবে, নইলে নিজের বাক্সে রেখে দিতে পারে, কারও কিছু বলবার নেই।

সব কাজ মিটতে বেলা দুটো পার হয়ে গেল।

পুঁটির মন ছটফট করছিল, ওপাড়ার লতিদি, হিমি, অন্ন, রাধী—এরা কেউ আসে নি—এদের গিয়ে একবার দেখা দেওয়া দরকার--যাতে তারা বুঝতে পারে যে, তার গায়ে হলুদের মত আশ্চর্য ব্যাপারটা আজ সত্যিই ঘটে গিয়েছে। আচ্ছা, যখন ইংরিজি বাজনা বাজিয়ে বর আসবে তাদের বাড়ির দোরে তেঁতুলতলার ওই পথটা দিয়ে, বোধনতলার কাছে পালকি নামিয়ে প্রণাম করে—বাজি পু্ড়বে, লোকজনের হৈ হৈ হবে—ওঃ সে সময়ের কথা ভাবাও যায় না। দ্যাখে যেন পাড়ার সব মেয়েরা এসে।
সে বেড়াতে বেড়াতে গেল মুখুজ্জেদের বাড়ি। মুখুজ্জেগিন্নি ওকে দেখে বললেন---কি রে পুঁটি, আয় মা আয়। গায়ে হলুদ হয়ে গেল? আহা, এখন ভালোয় ভালোয় দু-হাত এক হয়ে গেলে—বোসো মা, বোসো।

একটু পরে লতিকাও হাজির হলো। পুঁটিকে দেখে বললে, ও পুঁটি, তোর আজ গায়ে হলুদ ছিল না: হয়ে গেল? কি তত্ত্ব এলো শ্বশুরবাড়ি থেকে?

মুখুজ্জেগিন্নি বললেন—বোস মা তোরা। লতি, পুঁটির সঙ্গে গল্প কর। একটু চা করে আনি। যাক, ভালোই হলো, আজকাল মেয়ের বিয়ে দেওয়া যে কী কষ্ট, যে দেয় সে-ই জানে!

পাশের বাড়ির জানালা দিয়ে গাঙ্গুলীদের ছোট বৌ ডেকে বললে—ও কে, পুঁটি নাকি? গায়ে হলুদ হয়ে গেল? তা কই আমাদের একবার বলতেও তো হয়? এই তো বাড়ির পেছনে বাড়ি—

পুঁটি বললে—গেলেন না কেন বৌদি? আমরা তো বারণ করিনে যেতে। শাঁক যখন বাজল, তখনও যদি যেতেন—

লতিকা ভাবলে, পুঁটি ছেলে মানুষ, এ উত্তরটা দেওয়া উচিত হলো না। এখানে ও কথা বলা ঠিক হয় নি। কিন্তু এর পরবর্তী ব্যাপারের জন্য সে বা পুঁটি কেউ প্রস্তুত ছিল না। গাঙ্গুলীদের ছোট বৌ মুখ লাল করে উত্তর দিলে—কি বললি? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা? আমরা কখনও গায়ে হলুদ দেখি নি, শাঁকে ফুঁ পড়লে অমনি কুকুরের মতো ছুটে যাব তোমাদের বাড়ি পাতা পাততে। অত অংখার ভালো নারে পুঁটি। তোমার বাপের বড্ড ধানের গোলা হয়েছে না? অমন বিয়ে আমরা কখনও কি দেখিছি জীবনে? ছেলের না আছে চাল, না চুলো—সংসারে মানুষ নেই বলে হাড়ি ঠেলতে নিয়ে যাচ্ছে। ছেলের বিদ্যে কত, তা জানতে বাকি নেই—এবার তো ম্যাট্রিক ফেল করেছে—

এখানে লতিকা আর না থাকতে পেরে বললে—কে বললে ছোট বৌদি? সুবোধবাবুর পাসের খবর তো পাওয়া যায় নি?

--কেন পাওয়া যাবে না? চিঠি এসেছে ফেল করেছে বলে—ওরা সে চিঠি লুকিয়ে ফেলেছে। বিয়ের আগে ও খবর জানাজানি হতে দেবে না। উনিই হাট থেকে চিঠি আনেন। পোস্টকার্ডে চিঠি। উনি সন্ধের পর সুবোধদের বাড়ি দিয়ে এলেন। আমাদের চোখে ধুলো দেওয়া—

পুঁটির সামনে সব অন্ধকার হয়ে বিশ্বসংসার লেপে পুছে গিয়েছে। মুখরা দর্পিত ছোট বৌয়ের মুখের কাছে সে কি করে দাঁড়াবে। চেঁচামেচি শুনে মুখুজ্জেগিন্নি হাঁ হাঁ করে ছুটে এলেন, লতিকা ওর হাত ধরে নিয়ে ঘরের মধ্যে গেল।
মুখুজ্জেগিন্নি ঘরের মধ্যে এসে চাপা গলায় বললেন—আহা, ছেলেমানুষ—ওর সাধ-আহ্লাদের দিনটাতে অমন করে বিষ ছড়াতে আছে—ছিঃ ছিঃ—দ্যাখ তো মা লতি কাণ্ডটা—

কাঠের পুতুলের মতো আড়ষ্ট পুঁটির হাত ধরে ততক্ষণ লতিকা বলছে—চল চল পুঁটি তোকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি—ছিঃ, বৌদির কাণ্ড! ও সব কথা মনে করিস নে, মিথ্যে কথা। চল পুঁটি—ভাই—

লতিকার গলার সুরে ও কথার ভাবে কিন্তু পুঁটির মনে হলো লতিদিও এ খবরটা জানে—কি জানি হয়তও গাঁয়ের সবাই জানে—সে-ই কেবল জানত না এতোক্ষণ। পথে পা দিয়েই লজ্জায় অপমানে সে ছেলেমানুষের মতো কেঁদে ফেলে বললে—লতিদি, আমি কী বলেছিলাম ছোট বৌদিকে?—খারাপ কিছু?

ভি এস নাইপলের গল্প : বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ


অনুবাদ : মোজাফ্ফর হোসেন

ভারতীয় বংশদ্ভূত কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক ভি এস নাইপল (১৯৩২-)-এর জন্ম ও বেড়ে উঠা ত্রিনিদাদে। তিনি বেড়ে উঠেছেন হিন্দু সংস্কৃতির মধ্যে এবং পড়াশুনা করেছেন ব্রিটিশ স্কুলে। পরবর্তী সময়ে ইংল্যান্ডে বসবাস করেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ান। তাঁর এই মাল্টি-ব্যাকগ্রাউন্ডের কারণে তাঁকে ইন্দো-ত্রিনিদাদ-বিট্রিশ লেখক বলা হয়। ব্যাক্তি জীবনে তিনি প্রথমে ইংরেজ প্যাট্রিকা হেলকে বিয়ে করেন, তার মৃত্যুর পর বিয়ে করেন পাকিস্তানী সাংবাদিক নাদিরা খানম আলভীকে। এছাড়াও তিনি নারীঘটিত ব্যাপারে সবসময় আলোচিত হয়ে এসেছেন। মুসলিম বিশ্বে সমালোচিত হয়েছেন  Among the Believers: An Islamic Journey (1981) ও Beyond Belief: Islamic Excursions among the Converted Peoples (1998)বই দু’টি লিখে। তাঁর ভ্রমণ সাহিত্যে তৃতীয় বিশ্বকে যে ভাবে উঠিয়ে আনা হয়েছে সেটা নিয়েও সমালোচনা করেছেন কেউ কেউ। সম্প্রতি আলোচিত হয়েছেন এই বলে যে নারী সাহিত্যিকরা পুরুষদের থেকে অনেক বেশি পিছিয়ে। এবং তিনি তাঁর সমকক্ষ কোনও নারী সাহিত্যিক আছে কিংবা ছিল বলে মনে করেন না।


উপনিবেশ ও নির্বাসন তাঁর সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য বিষয়বস্তু। অধুনা পৃথিবীতে মানুষের যে অস্তিত্ব-সংকট বা identity crisis তা তাঁর লেখা গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধে ফুটে উঠেছে। তিনি বুকার পুরস্কার (১৯৭১) ও সাহিত্যে নোবেল (২০০১) সহ বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হন। ‘এ হাউস ফর মি. বিশ্বাস’ (১৯৬১), ‘ইন এ ফ্রি স্ট্রেট’ (১৯৭১), ‘হাফ এ লাইফ’ (২০০১) তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস।

বর্তমান গল্পটির কাল ও স্থান ১৯৪২ সালের দিককার ত্রিনিদাদ। ১৮০২ সালে ত্রিনিদাদ ব্রিটিশ উপনিবেশের আওতায় আসে এবং ১৯৬২ সালে স্বাধীনতা অর্জন করে। ১৮৪৫ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত ভারত থেকে প্রচুর চুক্তিভিত্তিক কর্মী এখানে আসে। নাইপলের দাদা তাদের মধ্যেই একজন। বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ মানে ব্লাক ওয়ার্ডসওয়ার্থ উপনিবেশিক শাষন ব্যবস্থার কারণে হোয়াইট ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর মতো খ্যাতিমান কবি হতে পারেন না। তাঁর অস্তিত্বই একসময় নেই হয়ে যায়।

প্রায় তিনজন করে ফকির প্রতিদিনই নিয়ম করে আমাদের মিগুয়েল স্ট্রিটের বাড়িটায় আসতো। দশটার দিকে ধুতি ও সাদা জ্যাকেট পরিহিত একজন ভারতীয় আসলো, আমরা তাকে এক মগ চাল দিয়ে বিদায় করলাম। বারটার দিকে একজন বয়স্ক মহিলা আসলো এবং এক টাকা নিয়ে চলে গেল। দু’টার দিকে এক অন্ধ ভিখারী একটা ছোট বালককে লাঠি বানিয়ে হাজির হল, তাকেও এক টাকা দিয়ে বিদায় করলাম। মাঝে মধ্যে কিছু ধূর্ত প্রকৃতির ভিক্ষুক আসতো। একদিন এক ভিখারি দরজায় বাড়ি দিয়ে বলল যে সে খুব ক্ষুধার্ত। আমরা তাকে খেতে দিলাম। তারপর সে একটা সিগারেট চাইলো, এবং ততক্ষণ নড়লো না যতক্ষণ না আমি তার সিগারেটে আগুন লাগিয়ে দিলাম। তাকে আর কোনদিন দেখা যায়নি। একদিন বিকেল চারটার দিকে আজব প্রকৃতির একজন মানুষ দরজায় এসে দাঁড়াল। আমি সবে স্কুল থেকে ফিরেছি।

‘শোনো বাবা, আমি কি একটু ভিতরে আসতে পারি?’ সে আমাকে বলল। লোকটি বেশ খাট, পরনে ছিল সাদা শার্ট ও কালো ট্রাওজার। মাথায় ছিল টুপি।

আমি জিজ্ঞেস করলাম-- আপনি কি চান?

‘আমি তোমাদের মৌমাছিগুলো একবার দেখতে চাচ্ছিলাম।’ সে বলল।

আমাদের উঠোনে চারটি পাম গাছ ছিল, সেখানে বেশ কয়েকটি মৌমাছির চাক ছিল। আমি ঘরের দিকে কয়েক পা এগিয়ে চেঁচিয়ে বললাম-- মা, গেটে একজন লোক আছে, সে বলছে যে সে আমাদের মৌমাছিগুলো একবার দেখতে চায়!

মা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে লোকটিকে একবার দেখে নিয়ে কর্কষ গলায় বললেন-- ‘কি চাওয়া হয়?’

‘আমি আপনাদের মৌমাছিগুলো একবার দেখতে চাচ্ছিলাম।’ লোকটি বলল।

তার ইংরেজি ছিল খুব গোছান। বোঝায় যাচ্ছিল এটা তার মাতৃভাষা না। মাকে বেশ চিন্তিত মনে হল। মা আমাকে বললেন-- ‘যতক্ষণ উনি থাকেন, তুমি এখান থেকে একপাও নড়বে না।’

‘ধন্যবাদ ম্যাডাম! আপনার অশেষ মেহেরবানী।’ সে খুব ধীরে ধীরে গুছিয়ে কথাটা বলল, যেন প্রতিটা শব্দ তার টাকা দিয়ে কেনা! আমরা পাম গাছের নিচে হাঁটুর উপর ভর দিয়ে বসে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে মৌমাছিগুলো দেখলাম।

‘মৌমাছি দেখতে আমার বেশ ভালো লাগে। তা, তোমার কেমন লাগে?’ লোকটি বলল।

আমার অত সময় নেই। আমি বললাম।

সে গম্ভীরভাবে মাথা ঝাঁকালো। ‘আমি এই কাজটিই করি। এটা-ওটা দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। শুধু পিঁপড়ে দেখতে দেখতেই আমি দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতে পারি। তুমি কি কখনও পিঁপড়েদের লক্ষ্য করে দেখেছ? কিংবা মাকড়সা, কেল্লুই-- এদেরকে ভালো করে দেখছ?’

আমি মাথা নাড়ালাম। আপনি আসলে কি করেন, বলুন তো?

তিনি উঠে দাঁড়ালেন-- ‘আমি কবি’।

‘খুব ভালো কবি?’ আমি কোন রকম ভনিতা না করেই জানতে চাইলাম।

‘পৃথিবীর সব চেয়ে বড় কবি।’ সে অকপটে বলল।

আপনার নামটা কি একবার বলবেন?

‘বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ।’

‘বি মানে কি বিল?’

‘ব্লাক। ব্লাক ওয়ার্ডসওয়ার্থ। সাদা ওয়ার্ডসওয়ার্থ ছিলেন আমার ভাই। আমাদের হৃদয় ছিল একটাই। আমি খুব খুদে একটা ফুলকেও সকালের মতোই শুভ্র ও মহৎ মনে করি, এবং সেটা দেখে আমার কান্না পায়।’

কেন? এতে কান্না পাওয়ার কি আছে? আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘বুঝলে না বালক! তুমি যখন বড় হবে তখন বুঝবে। তুমিও যে একজন কবি, তুমি কি জানো সেটা? এবং একজন কবি যখন তখন যে কোনও কারণে কাঁদতে পারে!’

আমি না হেসে আর পারলাম না!

‘তুমি তোমার মাকে পছন্দ কর?’ সে জানতে চায়লো।

হুম, তবে যখন সে আমাকে না মারে।

সে তখন তার পেছনের পকেট থেকে একটা প্রিন্টেড কাগজ বের করে বলল-- ‘এই কাগজে মাকে নিয়ে লেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতাটি আছে। আমি এটা বিক্রি করবো। কোনও দরদস্তুর চলবে না, একদাম-- চার টাকা।’

আমি ভেতরে গিয়ে মাকে বললাম-- মা, তুমি কি চার টাকা দিয়ে একটি কবিতা কিনবে?

মা রেগে গিয়ে গলার লাগাম ছেড়ে বলল-- ‘ওই ফালতু লোকটাকে গিয়ে বল, ও যদি এখনই আমার সীমানা থেকে বেরিয়ে না যায়, আমি তার লেজ টেনে ছিড়ে ফেলব; কি, কানে যায় আমার কথা?’

আমি বাইরে এসে বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থকে বললাম-- মার কাছে এখন চার টাকা নেই।

বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলল-- ‘এখানেই তো কবির ঐতিহাসিক পরাজয়!’

তারপর সে তার কাগজটি পূর্বের স্থানে রেখে দিল। সে মার কথায় কিছু মনে করেছে বলে মনে হল না।

আমি বললাম-- এভাবে কবিতা বিক্রি করে বেড়ানোটা কি ভালো দেখায়? শুধুমাত্র ক্যালিপসনিয়ানরা এই কাজ করে বেড়ায়। খুব বেশি কি বিক্রি হয়?

‘এখন পর্যন্ত এক কপিও হয়নি।’

তাহলে আপনি এই ভাবে ঘুরে ঘুরে কবিতা বেচে বেড়াচ্ছেন কেন?

‘এর ফলে আমি অনেককিছু দেখার সুযোগ পাই। এবং আমি সবসময় কবিদের সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই।’

আপনি কি সত্যি সত্যিই আমাকে কবি মনে করেন?

‘তুমি আমার চেয়ে কোনও অংশে কম না।’ তিনি উত্তরে বললেন।

যখন বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ চলে গেলেন, আমি মনে মনে প্রার্থনা করলাম যেন তার সাথে আবার আমার সাক্ষাৎ ঘটে।

এক সপ্তাহ পরে, আমি যখন স্কুল থেকে ফিরছিলাম তখন মিগুয়েল স্ট্রিটের এক বাঁকে তার সাথে দেখা হয়ে গেল।

‘আমি অনেকক্ষণ থেকে তোমার জন্যে এখানে অপেক্ষা করছি।’

এ কয়দিনে একটা কবিতাও কি বিক্রি করতে পারলেন? আমি জানতে চাইলাম।

সে মাথা নাড়াল। বলল-- ‘আমার আঙিনায় এই অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ আম গাছটি রয়েছে। এখন গাছটিতে আম পেকে টসটস করছে। আমি তোমাকে আম খাওয়ার দাওয়াত দিতে এসেছি।’

সে আলবার্তো স্ট্রিটের এক মোড়ে এক কক্ষ বিশিষ্ট একটি বাসায় বসবাস করত। বাড়ির সামনেটা সবুজে ভরা। সেখানে বিশাল একটি আম গাছ আছে, আর আছে নারিকেল ও তাল গাছ। জায়গাটি জঙ্গল হয়ে আছে, দেখে মনে হচ্ছে, শহরের বাইরে কোথাও এসেছি। এখান থেকে রাস্তার ওপারের বিশাল বিশাল দালানকোঠাগুলো দেখা দুষ্কর ব্যাপার।

সে একটুও বাড়িয়ে বলেনি, আমগুলো সত্যিই চমৎকার। আমি প্রায় আটটা সাবাড় করে ফেললাম। আমের হলুদ রস আমার কনুই চুইয়ে জামায় লেগে গেল। আমি যখন বাড়ি ফিরলাম, মা বললেন-- ‘এতক্ষণ কোথায় ছিলে, হতচ্ছাড়া? মনে করেছ খুব বড় হয়ে গেছ, যেখানে খুশি যেতে পারবে, তাই না? যাও, আমার জন্যে একটি কঞ্চি কেটে আনো।’

তিনি আমার কাটা কঞ্চি দিয়ে আমাকেই পেটালেন-- আচ্ছা পিটুনি পেটালেন! আমি কাঁদতে কাঁদতে রেগেমেগে বাড়ি থেকে বের হয়ে আসলাম। প্রতিজ্ঞা করলাম-- আর কিছুতেই বাড়ি ফিরব না। বি ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর বাড়িতে গেলাম। আমার নাক রাগে লাল হয়ে গিয়েছিল।

বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলল-- ‘কান্না এবার থামাও। চল কোথাও ঘুরে আসি।’

আমি কান্না থামিয়ে দিলাম। তখনও বেশ জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম। আমরা হাঁটতে বের হলাম। এস.টি. এভিনিউ এর ভেতর দিয়ে সাভান্নাহ হয়ে রেস কোর্স-এ চলে গেলাম।

বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলল-- ‘আসো, দু’জনে ঘাসের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশ দেখি। আর আমি চাই যে তুমি এখন চিন্তা করে দেখবে ঐ তারাগুলো আমাদের থেকে কত দূরে অবস্থান করছে।’

তার কথা মতো আমি কাজ শুরু করলাম। তার উদ্দেশ্যটা একটু পরেই পরিস্কার হল। নিজেকে খুব হালকা মনে হচ্ছিল। এবং একই সাথে খুব মহান আর বিশাল মনে হচ্ছিল, ঠিক ঐ আকাশটার মতন; জীবনে আর কখনো কোনদিন এই অনুভূতি হয়নি। আমি আমার সমস্ত ক্রোধ, অশ্রু ও আঘাতকে ভুলে গেলাম। যখন আমি বললাম যে আমি খুব ভালো অনুভব করছি, সে তখন এক এক করে তারাদের নাম বলতে লাগল। সহসা একটা টর্চের আলো এসে আমাদের মুখের উপর পড়ল। দেখলাম-- পুলিশের লোক, ঘাস থেকে উঠে দাঁড়ালাম।

‘তোমরা এখানে কি করছ?’ পুলিশটি জিজ্ঞেস করল।

বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ উত্তরে বলল-- ‘নিজেকে আমি চল্লিশ বছর ধরে এই একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে ফিরছি।’

আমরা খুব দ্রুত বন্ধু হয়ে গেলাম। সে আমাকে বলল-- ‘তুমি কাউকে কখনও আমার সম্পর্কে বলবে না। আমার ঐ গাছগুলো সম্পর্কেও না। সমস্ত বিষয়টা গোপন রাখবে। কাউকে বললেই আমি কিন্তু ধরে ফেলব, কারণ আমি কবি।’

আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম, এবং আজ অবধি আমি আমার কথা রেখেছিলাম। তার ছোট্ট কক্ষটি আমার ভালো লাগতো। এত সুন্দর, গোছান ও পরিস্কার! তবে বেশ নিঃসঙ্গ দেখাত। একদিন আমি জিজ্ঞেস করলাম-- আপনি উঠানের আবর্জনাগুলো কেটে ফেলেন না কেন? এটা তো জায়গাটাকে আরও স্যাঁতসে্যঁতে করে তুলছে, তাই না?

‘শোনো, তোমাকে তাহলে ঘটনাটা বলেই ফেলি-- একদা একটা মেয়ে আর একটা ছেলের সাক্ষাৎ ঘটলো এবং তারা পরস্পরের প্রেমে পড়ে গেল। কাজেই তারা বিয়ে করে ফেলল। ছেলেটি শব্দ বুনতে ভালো বাসতো, আর মেয়েটি ভালোবাসতো ঘাস, ফুল এবং গাছপালা। তারা একটি কক্ষে বেশ সুখেই দিন যাপন করছিল। তারপর একদিন মেয়ে কবিটি ছেলে কবিকে বলল-- আমরা পরিবারে আর একজন কবিকে পেতে চলেছি। কিন্তু সেই কবির আর জন্ম হয়নি কারণ মেয়েটি মারা গেল। এবং শিশু কবিটি মায়ের সাথে, মায়ের ভেতরে সমাধিস্থ হল। ছেলেটি খুব কষ্ট পেল। সে প্রতিজ্ঞা করল যে বাগানের একটি জিনিসও সে আর কোনদিন স্পর্শ করবে না। কাজেই, বাগানটি রয়ে গেল, বেড়ে উঠল, তারপর একসময় জঙ্গলে পরিণত হল।’ বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ গল্পটি এখানেই শেষ করলো।

আমি মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকালাম। তাকে আরও বয়স্ক দেখাচ্ছিল। আমি তার গল্পটি বুঝতে পারলাম। আমরা সেদিন দীর্ঘ পথ হেঁটেছিলাম। বোটানিক্যাল গার্ডেনে গেলাম, তারপর গেলাম রক গার্ডেনে। সন্ধ্যের আগ দিয়ে চ্যান্সেলর হিলে উঠলাম, দেখলাম-- সমস্ত জায়গাটাকে অন্ধকার কেমন করে গিলে ফেলল। তারপর আবার শহরের বাতিগুলো শহরটাকে অন্ধকারের হাত থেকে উদ্ধার করল। সে প্রত্যেকটি কাজ এমন মনোযোগ দিয়ে করত, মনে হত যেন জীবনে প্রথম সেই কাজটি করছে। আর মনে হত, যেন ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে সবকিছু করছে। সে আমাকে বলত-- ‘এখন এককাপ আইসক্রিম খেলে কেমন হয়?’ এবং আমি যখন বলতাম-- মন্দ হয় না। সে খুব গম্ভীর হয়ে বলত-- ‘এখন আমরা কোন দোকানের সেবা গ্রহণ করব?’ যেন এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। সে এটা নিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলত-- ‘আমার মনে হয়, ওই দোকানের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনায় বসা যেতে পারে!’ তখন পৃথিবীকে আমার খুব উপভোগ্য বলে মনে হত।

একদিন, যখন আমি তার উঠানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, আমাকে বলল-- ‘আমার খুব গোপন একটা বিষয় আজ তোমাকে বলব।’

খুব কি গোপন কিছু?-- আমি জানতে চাইলাম।

‘এই মুহূর্তে তা তো বটেই।’

আমি তার দিকে তাকালাম। এবং সেও আমার দিকে তাকাল। আমি ভেতরে ভেতরে বেশ শিহরিত হলাম। সে বলল-- ‘মনে রেখো, এটা শুধু তোমার আর আমার ভিতরে। একটি কবিতা লিখছি।’

ওহ, সেই কথা! বেশ হতাশ হলাম শুনে। আমি আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু শোনার অপেক্ষায় ছিলাম।

‘কিন্তু এটা ভিন্ন ধাঁচের একটি কবিতা।’ সে বলল। ‘এটা পৃথিবীর সব থেকে মহৎ একটি কবিতা।’

আমি শিষ দিলাম।

সে বলে চলে-- ‘এটা নিয়ে আমি পাঁচ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছি। আজ থেকে বাইশ বছর পরে কবিতাটি শেষ করব। তবে সেটা সম্ভব হবে আমি যে গতিতে এখন লিখছি সেটা ধরে রাখতে পারলে।’

তুমি তাহলে প্রচুর লেখ? আমি বললাম।

‘এখন আর না। এখন আমি প্রতি মাসে একটা করে লাইন লিখি। তবে নিশ্চিত করি যেন ওটাই শ্রেষ্ঠ লাইন হয়।’

গত মাসের শ্রেষ্ঠ লাইনটা কি? আমি জানতে চাইলাম।

সে আকাশের দিকে তাকাল, তারপর বলল-- ‘অতীত বড় গভীর, বিষণ্নময়।’

বেশ ভালো লাইন। আমি বললাম।

‘আমি আমার একটি মাসের সমস্ত অভিজ্ঞতাকে জ্বালিয়ে কবিতার একটি লাইনে ঘনীভূত করতে চাই। কাজেই, বাইশ বছর পরে আমি যে কবিতাটি লিখব সেটা বিশ্ব-মানবতার সঙ্গীত হয়ে উঠবে।’

আমি বেশ বিস্মিত হলাম।

আমাদের হাঁটা চলতেই থাকল। একদিন ডকসাইটে সি-ওয়ালের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় আমি বললাম-- ওয়ার্ডসওয়ার্থ, যদি আমি এই পিনটি পানিতে ফেলে দিই, তোমার কি ধারণা এটি ভেসে থাকবে?

‘পৃথিবীটা বড় আজব। ওটা ফেলে দাও, দেখি কি ঘটে!’

পিনটি ঢুবে গেল।

আমি বললাম-- এ মাসের লাইনটি কতদূর?

সে আর কোনও লাইন শোনায়নি। শুধু বলত-- ‘এই তো চলে এসেছে...হয়ে যাবে...।’

আমরা তখন সি-ওয়ালের উপরে বসে যাত্রীবাহী জাহাজগুলোকে বন্দরে ভিড়তে দেখতাম। পৃথিবীর সেই শ্রেষ্ঠ কবিতাটি আমার আর শোনা হয়নি।

আমার মনে হত, সে একটু জলদিই বুড়িয়ে যাচ্ছে।

তুমি কিভাবে বেঁচে আছ?-- একদিন জানতে চাইলাম।

‘মানে, তুমি বলতে চাইছ আমি কিভাবে আয় রোজগার করি, তাই তো?’

আমাকে তোত্লাতে দেখে সে মুচকি হেসে বলল--

‘আমি ক্যালিপসোর সময়ে ক্যালিপসো গেয়ে বেড়ায়।’

তাতেই তোমার হয়ে যায়?

‘খুব ভালো মতোই।’

কিন্তু তুমি যখন পৃথিবীর বিখ্যাত কবিতাটি লেখা শেষ করবে তখন তো তুমি বেশ ধনী হয়ে যাবে?

সে কোনও উত্তর দিলো না।

একদিন তাকে আমি তার সেই ছোট্ট ঘরটিতে দেখতে গেলাম। সে শুয়ে ছিল। তাকে খুব বয়স্ক আর ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। তার এই অবস্থা দেখে আমার কাঁদতে ইচ্ছে করছিল।

‘কবিতাটি আসতে আসতে কোথায় যেন থমকে গেছে।’ সে বলল।

সে তখন জানালা দিয়ে বাইরের নারিকেল গাছটির দিকে তাকিয়ে ছিল। এমন ভাবে কথা বলছিল যেন আমার উপস্থিতি টের পায়নি। ‘যখন আমার বয়স বিশের কাছাকাছি ছিল, নিজের ভিতরে একটা শক্তি অনুভব করতাম।’ তারপর আমার চোখের সামনেই তাকে আরও বুড়িয়ে ও ক্ষয়ে যেতে দেখলাম। ‘কিন্তু, সেটা ছিল অনেক অনেক দিন আগে।’

তার কথা শুনে, সবকিছু এতটাই তীব্রভাবে আমার চেতনায় এসে ধরা দিল যে মনে হল, মা আমার গালে কষে একটা থাপ্পড় মারল। মৃত্যু তার সঙ্কুচিত হয়ে আসা মৃতপ্রায় মুখম-লে জীবন্ত হয়ে উঠলো-- এটা যেন সবার জন্যেই উপস্থিত হয়েছিল।

সে আমার দিকে তাকালো, আমার চোখের অশ্রু দেখে উঠে বসল।

‘এ দিকে এসো।’ সে বলল। আমি তার পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসলাম।

সে আমার চোখের দিকে তাকাল, এবং বলল-- ‘তুমিও তাহলে এটাকে দেখতে পাচ্ছ? আমি জানতাম, তোমার চোখদুটো কবির চোখ।’

তাকে একটুও চিন্তিত দেখাচ্ছিল না। তার বোকার মতো শান্ত চেহারা দেখে আমি চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলাম।

সে তার শুকনো বুকে আমাকে টেনে নিল। ‘তুমি কি চাও যে আমি তোমাকে এখন একটা মজার গল্প বলি?’ তারপর আমার ভেতরে উৎসাহ যোগাতে হেসে উঠল। কিন্তু আমি কোনও উত্তর দিলাম না।

সে বলল-- ‘যখন আমি গল্পটি বলা শেষ করব, আমি চাই যে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে এবং আর কোনদিন ফিরে আসবে না। তুমি এখন আমাকে প্রতিশ্রুতি দিবে।’

আমার কণ্ঠস্বর যেন রুদ্ধ হয়ে আসছিল!

সে বলল-- ‘বেশ, তবে শোনো। আমি তোমাকে ঐ ছেলে কবি ও মেয়ে কবিকে নিয়ে যে গল্পটা বলেছিলাম, তোমার মনে পড়ে? ওটা সত্য ছিল না। গল্পটা আমি তোমাকে বানিয়ে বলেছিলাম। তোমাকে কবিতা এবং আমার বিখ্যাত কবিতাটি নিয়ে যে সমস্ত কথা বলেছি তাও সত্য ছিল না। এটা কি তোমার জীবনের শোনা সব থেবে মজার বিষয় হল না?’

কিন্তু তার কণ্ঠস্বর আস্তে আস্তে ক্ষয়ে যেতে লাগল।

আমি ঘর থেকে বেরিয়ে আসলাম। এবং একজন কবির মতো যা কিছু দেখলাম তাই দেখে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ছুটে আসলাম।

এক বছর পরে এলবার্তো স্ট্রিট ধরে একাকী হেঁটে যাচ্ছিলাম। ঐ কবির বাড়ির কোনও চিহ্ন খুঁজে পেলাম না। এটা ঠিক উবেও যায়নি, মনে হচ্ছে কে বা কারা যেন এটাকে গুড়িয়ে ফেলেছে, এবং বেশ বড় দু’তলা একটি ভবন জায়গাটি দখল করে নিয়েছে। সেই বিশাল আম গাছটিসহ, নারিকেল ও তাল গাছটিও কেটে ফেলা হয়েছে। এখন সেখানে শুধু ইট, পাথর আর লোহা দেখা যাচ্ছে, যেন বি. ওয়ার্ডসওয়ার্থ কোনদিনই ছিল না।

 

উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ..

আমরা তিনজন বুদ্ধদেব বসু


আমরা তিনজন একসঙ্গে তার প্রেমে পড়েছিলাম : আমি, অসিত আর হিতাংশু; ঢাকায় পুরানা পল্টনে, উনিশ-শো সাতাশে। সেই ঢাকা, সেই পুরানা পল্টন, সেই মেঘে-ঢাকা সকাল!

এক পাড়ায় থাকতাম তিনজন। পুরানা পল্টনে প্রথম বাড়ি উঠেছিল তারা-কুটির, সেইটে হিতাংশুদের। বাপ তার পেনশন পাওয়া সাব-জজ, অনেক পয়সা জমিয়েছিলেন এবং মস্ত বাড়ি তুলেছিলেন একেবারে বড় রাস্তার মোড়ে। পাড়ার পয়লা নম্বর বাড়ি তারা-কুটির, দু-অর্থেই তাই, সবচেয়ে আগেকার এবং সবচেয়ে ভালো। ক্রমে ক্রমে আরো অনেক বাড়ি উঠে ঘাস আর লম্বা-লম্বা চোর-কাঁটা ছাওয়া মাঠ ভরে গেল, কিন্তু তারা-কুটিরের জুড়ি আর হলো না।

আমরা এসেছিলাম কিছু পরে, অসিতদের বাড়ির তখন ছাদ পিটোচ্ছে। একটা সময় ছিল, যখন ঐ তিনখানাই বাড়ি ছিল পুরানা পল্টনে; বাকিটা ছিল এবড়োখেবড়ো জমি, ধুলো আর কাদা, বর্ষায় গোড়ালি-জলে গা-ডোবানো হলদে-হলদে-সবুজ রঙের ব্যাঙ আর নধর সবুজ ভিজে-ভিজে ঘাস। সেই বর্ষা, সেই পুরানা পল্টন, সেই মেঘ-ঢাকা দুপুর!

আমরা তিনজন একসঙ্গে থাকতাম সব সময়—যতটা এবং যতক্ষণ থাকা সম্ভব। রোজ ভোরবেলায় আমার শিয়রের জানালার বাইরে দাঁড়িয়ে অসিত ডাকত, ‘বিকাশ! বিকাশ!’ আর আমি তাড়াতাড়ি উঠে বাইরে আসতাম, দেখতাম অসিত সাইকেলে বসে আছে এক-পা মাটিতে ঠেকিয়ে—এমন লম্বা ও, কাঁধে হাত রাখতে কনুই ধরে যেত আমার। হিতাংশুকে ডাকতে হতো না, দাঁড়িয়ে থাকত তাদের বাগানের ছোট ফটকের ধারে, কি বসে থাকত বাগানের নিচু দেয়ালে পা ঝুলিয়ে, তারপর অসিত সাইকেলে চেপে চলে যেত পাকা সড়ক ধরে স্কুলে, ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুলে; আমি আর হিতাংশু ঘুরে ঘুরে বেড়াতাম হাতে হাত ধরে, হাওয়ায় গন্ধ, যেন কিসের, যেন কার, সে-গন্ধ আজও যেন পাই, কী মনে পড়ে, কাকে মনে পড়ে!

বিকেলে দুটি সাইকেলে তিনজনে চড়ে প্রায়ই আমরা শহরে যেতাম, কোনো দিন বিখ্যাত ঘোষবাবুর দোকানে চপ-কটলেট খেতে, কোনো দিন শহরে একটিমাত্র সিনেমায়, কোনো দিন চিনেবাদাম পকেটে নিয়ে নদীর ধারে। সাইকেল চালানোটা আমার জীবনে হলো না—চেষ্টা করেও শিখতে পারিনি ওটা, কিন্তু ঐ দু-চাকার গাড়িতে চড়েছি অনেক; কখনো অসিতের, কখনো হিতাংশুর গলগ্রহ হয়ে লম্বা-লম্বা পাড়ি দিয়েছি তাদের পিছনে দাঁড়িয়েই। আবার কত সন্ধ্যা কেটেছে পুরানা পল্টনেরই মাঠে, ঘাসের সোফায় শুয়ে-বসে ছোট ছোট তারা ফুটছে আকাশে, চোর-কাঁটা ফুটছে কাপড়ে, হিতাংশুদের সামনের বারান্দার লণ্ঠনটা মিটমিট করছে দূর থেকে। এ-সময়টা হিতাংশ বেশিক্ষণ আমাদের সঙ্গে থাকত না—আটটার মধ্যে তাকে ফিরতেই হতো বাড়িতে। অত কড়া শাসন আমার ওপর ছিল না, অসিতের ওপরেও না, দুজনে বসে থাকতাম অন্ধকারে, ফেরবার সময় আস্তে আস্তে একবার ডাকতাম হিতাংশুকে, পড়া ফেলে উঠে এসে চুপি চুপি দু-একটা কথা বলেই সে চলে যেত।

আমরা তিনজন তিনজনের প্রেমে পড়েছিলাম, আবার তিনজন একসঙ্গে অন্য একজনের প্রেমে পড়লাম, সেই ঢাকায়, পুরানা পল্টনে উনিশ-শো সাতাশ সনে।

নাম তার অন্তরা। তখনকার ঢাকার পক্ষে নামটি অত্যন্তই শৌখিন, কিন্তু ঢাকার মতো কিছুই তো তাঁদের নয়, মেয়ের নামই বা হবে কেন। ভদ্রলোক বাড়িতেও প্যান্ট পরে থাকেন, আর ভদ্রমহিলা এমন সাজেন যে পিছন থেকে হঠাৎ তাঁকে তাঁর মেয়ে বলে ভুল হয়—আর তাঁর মেয়ে, তাঁদের মেয়ে, তার কথা আর কী বলব! সে সকালে বাগানে বেড়ায়, দুপুরে বারান্দায় বসে থাকে বই কোলে নিয়ে, বিকেলে রাস্তায় হাঁটে প্রায় আমাদের গা ঘেঁষেই, সব সময় দেখা যায় তাকে, মাঝে মাঝে শোনা যায় গলার আওয়াজ—সেই ঢাকায়, সুদূর সাতাশ সনে, কোনো একটা মেয়েকে চোখে দেখা যখন সহজ ছিল না, যখন বন্ধ-গাড়ির দরজার ফাঁকে একটুখানি শাড়ির পাড় ছিল আমাদের স্বর্গের আভাস, তখন—এই যে মেয়ে, যাকে আমরা দেখতে পাই একেক দিন একেক রঙের শাড়িতে, আর তার ওপর নাম যার অন্তরা, তার প্রেমে পড়ব না এমন সাধ্য কি আমাদের!

নামটা কিন্তু বের করেছিলাম আমি। রোজ সই করে পাউরুটি রাখতে হয় আমাকে, একদিন রুটিওয়ালার খাতায় নতুন একটা নাম দেখলাম নীল কালিতে বাংলা হরফে পরিষ্কার করে লেখা : ‘অন্তরা দে’। একটু তাকিয়ে থাকলাম লেখাটুকুর দিকে, খাতা ফিরিয়ে দিতে একটু দেরি করলাম, তারপর বিকেলে হিতাংশুকে বললাম, ‘নাম কি অন্তরা?’

‘কার’—কিন্তু তক্ষুনি কথাটা বুঝে নিয়ে হিতাংশু বলল, ‘বোধ হয়।’ অসিত বলল, ‘সুন্দর নাম!’

‘ডাকে তরু বলে।’

তরু! এই ঢাকা শহরেই দু-তিনশো অন্তত তরু আছে, কিন্তু সে-মুহূর্তে আমার মনে হলো এবং আমি বুঝলাম অসিতেরও মনে হলো যে সমস্ত বাংলা ভাষায় তরুর মতো এমন একটি মধুর শব্দ আর নেই। তা হোক, হিতাংশুর একটু বাজে কথা বলা চাই। কেননা যাকে নিয়ে বা যাদের নিয়ে কথা হচ্ছে, তাদেরই বাড়ির এক তলায় তারা ভাড়াটে, আমাদের চাইতে বেশি না-জানলে ওর মান থাকে না। তাই ও নাকের বাঁশিটা একটু কুঁচকে বলল, ‘অন্তরা থেকে তরু—এটা কিন্তু আমার ভালো লাগে না।’

‘ভালো না কেন, খুব ভালো!’ গলা চড়িয়ে দিলাম, কিন্তু ভেতরটা কেমন দমে গেল। ‘আমি হলে অন্তরাই ডাকতাম।’

কী সাহস! কী দুঃসাহস! তুমি ডাকতে, তাও আবার নাম ধরে। ইস! প্রতিবাদের তাপে আমার মুখ গরম হয়ে উঠল, বেশ চোখা চোখা কয়েকটা কথা মনে-মনে গোছাচ্ছি, ফস করে অসিত বলে উঠল, ‘আমিও তা-ই।’

বিশ্বাসঘাতক!

এ-রকম ছোট ছোট ঝগড়া প্রায়ই হতো আমাদের। এমন দিন যায় না যেদিন ওকে নিয়ে কোনো কথা না হয়, আর এমন কোনো কথা হয় না যাতে তিনজনেই একমত হতে পারি। সেদিন যে নীল শাড়ি পরেছিল তাতেই বেশি মানিয়েছিল, না কালকের বেগুনি রঙেরটায়; সকালে যখন বাগানে দাঁড়িয়ে ছিল তখন পিঠের ওপর বেণি দুলছিল, না চুল খোলা ছিল, বিকেলে বারান্দায় বসে কোলের ওপর কাগজ রেখে কী চিঠি লিখছিল, না আঁক কষছিল—এমনই সব বিষয় নিয়ে চেঁচামেচি করে আমরা গলা ফাটাতুম। সবচেয়ে বেশি তর্ক হতো যে-কথা নিয়ে সেটা একটু অদ্ভুত : ওর মুখের সঙ্গে মোনালিসার মিল কি খুব বেশি, না অল্প একটু, না কিছুই না। আমি তখন প্রথম মোনালিসার ছাপা ছবি দেখেছি এবং বন্ধুদের দেখিয়েছি। হঠাৎ একদিন আমারই মুখ দিয়ে বেরোল কথাটা—‘ওর মুখ অনেকটা মোনালিসার মতো।’ তারপর এ নিয়ে অসংখ্য কথা খরচ করেছি আমরা, কোনো মীমাংসা হয়নি; তবে একটা সুবিধা এই হলো যে আমাদের মুখে-মুখে ওর নাম হয়ে গেল মোনালিসা। অন্তরাতে যতই সুর ঝরুক, তরুতে যতই তরুণতা, যে-নামে ওকে সবাই ডাকে সে-নামে তো আমরা ওকে ভাবতে পারি না—অন্য একটি নাম, যা শুধু আমরা জানি, আর কেউ জানে না, এমন একটি নাম পেয়ে আমরা যেন ওকেই পেলাম।

হিতাংশুকে প্রায়ই বলতাম, ‘তোমার সঙ্গে একদিন আলাপ হবেই—একই তো বাড়ি’, আর হিতাংশুও একটু লাল হয়ে বলত, ‘যাঃ!’ যার মানে হচ্ছে যে সেটা হলেও হতে পারে—আর তা নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনাই চলত আমাদের, কিন্তু মনে-মনে আমরা ধরেই নিয়েছিলাম যে এ-সব কিছু না, শুধুই কথার কথা।

একদিন সন্ধ্যার একটু পরে তিনজনে ফিরছি সাইকেলে রমনা বেড়িয়ে, আমি হিতাংশুর পিছনে, নির্জন পথে নিশ্চিন্তে গল্প চালিয়েছি, হঠাৎ হিতাংশু কথা বন্ধ করে সাইকেলের ওপর কী রকম কেঁপে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম সাইকেল থেকে, টাল সামলাতে গিয়ে টেনে ধরলাম হিতাংশুর জামার গলা; ‘উঃ’ বলে সে নেমে পড়ল, আমি পায়ের তলায় মাটি পেলাম। সঙ্গে-সঙ্গে মোটা গলায় কে একজন বলে উঠলেন, ‘Take care young man!’ তাকিয়ে দেখি, ঠিক আমাদের সামনে দে-সাহেব দাঁড়িয়ে, আর তাঁর স্ত্রী—আর কন্যা। অসিত সাইকেলটা একটু ঘুরিয়ে এক পা মাটিতে ঠেকিয়ে চুপ করে আছে, তার মুখের ভাবটা বেশ বীরের মতো।

‘Really you must—’ বলতে বলতে দে-সাহেব হিতাংশুর মুখের ওপর চোখ রাখলেন।— ‘Oh it's you! কেশব বাবুর ছেলে!’

‘আমি স্পষ্ট দেখলাম, হিতাংশুটা বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।’

‘আর এরা—তিনজনকে একসঙ্গেই তো দেখতে পাই সব সময়। বন্ধু বুঝি! বেশ, বেশ। I like young men. এসো একদিন আমাদের ওখানে তোমরা।’

ওঁরা চলে গেলেন। আমরা রাস্তা ছেড়ে মাঠে নেমে ঘাসের ওপর পাশাপাশি শুয়ে পড়লাম লম্বা হয়ে। একটু পরে অসিত বলল, ‘কী কাণ্ড! হিতাংশু ঘাবড়ে গিয়েছিলে না?’

‘না তো! ঘাবড়াব কেন? ব্রেকটা হঠাৎ—’

‘কোনো দিন তো এ-রকম হয় না। আর আজ কিনা ওঁদের সামনে—’

‘বেশ তো! হয়েছে কী? কারো গায়েও পড়েনি, পড়েও যাইনি, হঠাৎ ব্রেক কষতে গিয়ে—’

‘না, না, তুমি তো ঠিকই নেমেছিলে, তবে তোমার মুখটা যেন কেমন হয়ে গিয়েছিল। আর বিকাশ তো—’

আমার নাম করতেই আমি খেঁকিয়ে উঠলাম, ‘চুপ করো, ভালো লাগে না!’

‘ও বোধ হয় একটু হেসেছিল’, অসিত তবু ছাড়ল না (‘ও’ বলতে কাকে বোঝায় তা বোধ হয় না বললেও চলে)।

‘হেসেছিল তো বয়ে গেল!’ চিৎকার করল হিতাংশু, কিন্তু সে চিৎকার যেন কান্না।

‘তুমি দেখেছিলে বিকাশ? ঠিক মোনালিসার হাসির মতো কি?’

‘যা বোঝো না তা নিয়ে ঠাট্টা কোরো না!’ বলতে গিয়ে আমার গলা ভেঙে গেল। সে-রাত্রে ভালো ঘুমোতে পারলাম না, দুদিন আধমরা হয়ে রইলাম, সাত দিন মন-মরা।

রাগ করি আর যা-ই করি, আমাদের মধ্যে অসিতটাই তুখোড়। সে কেবলই বলতে লাগল, ‘চল না একদিন যাই আমরা ওঁদের ওখানে।’

‘পাগল।’

‘পাগল কেন? দে-সাহেব বললেন তো যেতে! বললেন না?’

ক্রমে-ক্রমে হিতাংশুর আর আমারও ধারণা জন্মাল যে দে-সাহেব সত্যিই আমাদের যেতে বলেছেন, আমরা গেলে রীতিমতো সুখী হবেন তিনি, না-গেলে দুঃখিত হবেন—এমনকি তাঁকে অসম্মানই করা হবে তাতে। তাঁর সম্মান রক্ষার জন্য ক্রমশই আমরা বেশি রকম ব্যস্ত হতে লাগলাম। রোজ সকালে স্থির করি ‘আজ’, রোজ বিকেলে মনে করি, ‘আজ থাক’। কোনো দিন দেখি ওঁরা বাগানে বসেছেন বেতের চেয়ারে; কোনো দিন বাড়ির সামনে মোটরগাড়ি দাঁড়ানো, তার মানে শহরের একমাত্র ব্যারিস্টার দাস-সাহেব বেড়াতে এসেছেন। আর কোনো দিন বা চুপচাপ দেখে ধরে নিই ওঁরা বাড়ি নেই। দৈবাৎ একদিন হয়তো চোখে পড়ে দে-সাহেব একা বসে খবরের কাগজ পড়ছেন, মনে হয় এইটে ভারি সুসময়, কিন্তু বাগানের গেটের সামনে পা থমকে যায় আমাদের, অসিতের যতটা নয় ততটা হিতাংশুর, হিতাংশুর ততটা নয় যতটা আমার, একটু ঠেলাঠেলি ফিসফিসানি হয়, আর শেষ পর্যন্ত তারা-কুটির ছাড়িয়ে মোড় ঘুরে আমরা অন্যদিকে চলে যাই। কেবলই মনে হয় এখন গেলে বিরক্ত হবেন, আবার তখনই ভাবি—বিরক্ত কেন, আর এ নিয়ে এত ভাববারই বা কী আছে, মানুষ কি মানুষের সঙ্গে দেখা করে না? আমরা চোরও নই, ডাকাতও নই, যাব, বসব, আলাপ করব, চলে আসব—ব্যস!

সেদিন আকাশে মেঘ টিপটিপ বৃষ্টি। বাইরে থেকে মনে হলো ওঁরা বাড়িতেই আছেন। ছোট্ট গেট ঠেলে সকলের আগে ঢুকল অসিত, লম্বা ফরসা, সুশ্রী; তারপর হিতাংশু, গম্ভীর, চশমা পরা, ভদ্রলোক মাফিক; আর সকলের শেষে পুঁচকে আমি। বাগান পার হয়ে বারান্দায় উঠে দাঁড়ালাম আমরা, কাউকে ডাকব কি না, কাকে ডাকব, কী বলে ডাকব—এসব আমরা যতক্ষণ ধরে ভাবছি, ততক্ষণ পরদা ঠেলে দে-সাহেব নিজেই বেরিয়ে এলেন। দাঁতের ফাঁকে পাইপ চেপে ধরে বললেন, ‘Yes?’

এই বিজাতীয় সম্ভাষণে সপ্রতিভ অসিতও একটু বিচলিত হলো। ‘আমি—আমরা—মানে আমরা এসেছিলাম—আপনি বলেছিলেন—’ আবছা আলোয় তখন দে-সাহেব আমাদের চিনলেন। ‘ও, তোমরা! তা...’

অসিত আবার বলল, ‘আপনি বলেছিলেন আমাদের একদিন আসতে।’

‘ও, হ্যাঁ, হ্যাঁ...’ একটু কেশে—‘এসো, এসো তোমরা’, পর্দা তুলে দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালেন দে-সাহেব, আমরাও দাঁড়িয়ে থাকলাম।

‘যাও, ভেতরে যাও।’

ঢুকতে গিয়ে হিতাংশু তার নিজেরই বাড়ির চৌকাঠে হোঁচট খেয়ে আমার পা মাড়িয়ে দিল, খুব লাগল আমার, কিন্তু চুপ করে থাকা ছাড়া তখন আর উপায় কী। আমাদের কাদামাখা স্যান্ডেলে ঝকঝকে মেঝে নোংরা করে এলাম আমরা। কী সুন্দর সাজানো ঘর, এমন কখনো দেখিনি। পেট্রোম্যাক্স জ্বলছে। সামনের দিকে সোফায় বসে মিসেস দে উল বুনছেন, আর দেয়ালের সঙ্গে ঠেকানো কোণের চেয়ারটিতে বসে আছে আমাদের মোনালিসা, কোলের ওপর মস্ত মোটা নীল মলাটের বইয়ের পাতায় চোখ নামিয়ে।

দে-সাহেব বললেন, ‘সুমি, এই আমাদের পুরানা পল্টনের থ্রি মস্কেটিঅর্স। এটি কেশব বাবুর ছেলে, আর এরা...’

হিতাংশু পরিচয় করিয়ে দিল, ‘এর নাম অসিত আর এই হচ্ছে বিকাশ।’

মিসেস দে মৃদু হেসে মৃদুস্বরে বললেন, ‘তিন বন্ধু বুঝি তোমরা? বেশ, রোজই তো দেখি তোমাদের। বসো।’

একটা লম্বা সোফায় ঝুপঝুপ বসে পড়লাম তিনজনে। মিসেস দে ডাক দিলেন—’তরু’!

মোনালিসা চোখ তুলল।

‘এঁরা আমাদের প্রতিবেশী—আর এই আমার মেয়ে।’

মোনালিসা বই রেখে উঠল, ছিপছিপে সবুজ একটি গাছের মতো দাঁড়াল, অল্প হাওয়ায় গাছ যেমন নড়ে, তেমনি করে মাথা নোয়াল একটু, তারপর আবার চেয়ারে বসে বই খুলে চোখ নিচু করল।

আমার মনে হলো আমি স্বপ্ন দেখছি।

অসিত কলকাতার ছেলে, আমাদের সকলের চাইতে খবর রাখে বেশি, চটপট কথা বলতেও পারে; আর হিতাংশু—সেও তার বাবার সঙ্গে নানা দেশ ঘুরেছে, উচ্চারণ পরিষ্কার, আর তা ছাড়া এই তারা-কুটির তো তাদেরই বাড়ি। কথাবার্তা যা একটু তা ওরা দুজনেই বলল, আমি মেঝের দিকে তাকিয়ে চুপ, কী বলব ভেবেও পেলাম না, বলতেও ভরসা হলো না, পাছে আমার বাঙাল টান বেরিয়ে পড়ে। মোনালিসাকে দেখবার ইচ্ছা ভেতরে-ভেতরে পাগল করে দিচ্ছিল আমাকে, কিন্তু কিছুতেই কি একবারও চোখ তুলতে পারলাম!

ইলেকট্রিসিটি না থাকলে জীবন কী রকম দুর্বহ, ঢাকার মশা কী সাংঘাতিক, রমনার দৃশ্য কত সুন্দর, এসব কথা শেষ হবার পর মিসেস দে বললেন, ‘তোমরা কি কলেজে পড়ো?’

অসিত যথাযথ জবাব দিয়ে সগর্বে বলল, ‘হিতাংশু পনেরো টাকা স্কলারশিপ পেয়েছে ম্যাট্রিকে।’

‘বাঃ বেশ, বেশ। আমার মেয়ে তো অঙ্কের ভয়ে পরীক্ষাই দিতে চায় না।’

হঠাৎ ঘরের কোণ থেকে তারের মতো একটি আওয়াজ বেজে উঠল, ‘বাবা, কীটস কত বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন?’

দে-সাহেব আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘তোমরা কেউ বলতে পারো?’

অসিত ফস করে বলল, ‘বিকাশ নিশ্চয়ই বলতে পারবে—বিকাশ কবিতা লেখে।’

‘সত্যি?’ মুখে একটি ছেলেমানুষি হাসি ফোটালেন মিসেস দে, আর মুহূর্তের জন্য—আমি অনুভব করলাম—মোনালিসার চোখও আমার ওপর পড়ল। হাত ঘেমে উঠল আমার, কানের ভেতর যেন পিঁ-পিঁ আওয়াজ দিচ্ছে।

সবসুদ্ধু কতটুকু সময়? পনেরো মিনিট? কুড়ি মিনিট? কিন্তু বেরিয়ে এলাম যখন এত ক্লান্ত লাগল, কলেজে চারটা-পাঁচটা লেকচার শুনেও তত লাগে না।

মিসেস দে জোর করেই দুটা ছাতা দিয়েছিলেন আমাদের, কিন্তু ছাতা আমরা খুললাম না, টিপটিপ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মাঠের অন্ধকারে মিলিয়ে গেলাম। হঠাৎ অসিত—বকবক না করে ও থাকতেও পারে না—বলে উঠল, কী চমৎকার ওঁরা!’

‘সত্যি! চমৎকার!’ হিতাংশু সায় দিল সঙ্গে সঙ্গে।

আমি কথা বললাম না, কোনো কথাই ভালো লাগছিল না আমার।

একটু পরে অসিত আবার বলে, ‘কিন্তু জুতোগুলো বাইরে ছেড়ে গেলেই পারতাম আমরা! আর হিতাংশু, তুমি আবার আজ হোঁচট খেলে!’

‘কখন?’

‘ঘরে ঢুকতে গিয়ে।’

‘যাঃ!’

‘যাঃ আবার কী। আর ঘুরে ঢুকে নমস্কার করেছিলে তো মিসেস দে-কে?’

‘নিশ্চয়ই!’ একটু চুপ করে থাকল হিতাংশু, তারপর হঠাৎ বলল, কিন্তু যখন মোনালিসা উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করল...’

অন্ধকারে আমরা তিন বন্ধু একবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম এবং অন্ধকারেই বোঝা গেল যে তিনজনেরই মুখ ফ্যাকাসে হয়েছে। একটি মেয়ে, একজন ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করলেন, আর আমরা কিনা জরদ্গবের মতো বসেই থাকলাম—উঠে দাঁড়ালাম না, কিছু বললাম না, কিচ্ছু না, ওঁরা আমাদের বাঙাল ভাবলেন, কাঠ-বাঙাল, জংলি, বর্বর, খাস কলকাতার ছেলে অসিত মিত্তিরও আমাদের মুখ-রক্ষা করতে পারল না।

কী যে মন-খারাপ হলো, কী আর বলব।

পরের দিন তিনজনে আবার গেলাম ছাতা ফেরত দিতে। চাকর আমাদের ঘরে নিয়ে বসাল, তারপর—তারপর মোনালিসাই এলো ঘরে, তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে নমস্কার করলাম, একটু হেসে বললাম, ‘এই ছাতাটা...’! ‘ও মা! এর জন্য আবার...বসুন...।’ মনে-মনে এই রকম ভেবে গিয়েছিলাম ঘটনাটা, কিন্তু হলো একটু অন্য রকম। চাকর এসে ছাতাটি নিয়ে ভেতরে চলে গেল, আর ফিরে এলো না, কেউই এলো না। আমরা একটু দাঁড়িয়ে থেকে মাথা নিচু করে নিঃশব্দে ফিরে এলাম—কেউ কারো মুখের দিকে তাকাতে পারলাম না। না, না। ঐ সুন্দর করে সাজানো ঘর, যেখানে সাদা ধবধবে আলোয় দেয়ালের প্রতিটি কোণ ঝকঝক করে, আর কোণের চেয়ারে বসে পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্য মেয়েটি কোনো এক নীল মলাটের আশ্চর্য বইয়ের পাতা ওল্টায়—সেখানে জায়গা নেই আমাদের। কিন্তু তাতে কী। মোনালিসা—মোনালিসাই। ঝমঝম করে বর্ষা নামল পুরানা পল্টনে, মেঘে-ঢাকা সকাল, মেঘ-ডাকা দুরু দুরু দুপুর, নীল জ্যোৎস্নায় ভিজে-ভিজে রাত্রি। পনেরো দিন ধরে প্রায় অবিরাম বৃষ্টির পর প্রথম যেদিন রোদ উঠল, সেদিন বাইরে এসে দেখি শহরের সবচেয়ে বড় ডাক্তারের মোটরগাড়ি তারা-কুটিরের সামনে দাঁড়িয়ে।

হিতাংশুকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমাদের বাড়িতে কারো অসুখ নাকি?’

‘না তো!’

তবে কি ওদের বাড়িতে—প্রশ্নটা উচ্চারিত না হয়েও ব্যক্ত হলো। পরের দিন হিতাংশু গম্ভীর মুখে বলল, ‘ওদের বাড়িতেই অসুখ।’

‘কার?’

‘ওরই অসুখ।’

‘ওর অসুখ!’

‘ওর!’

সেদিনও বড় ডাক্তারের গাড়ি দেখলাম, তার পরদিন দুবেলাই। আমরা কি একবার যেতে পারি না, কিছু করতে পারি না? ঘুরঘুর করতে লাগলাম রাস্তায়, ডাক্তারের গাড়ির আড়ালে। ডাক্তার বেরিয়ে এলেন, দে-সাহেব সঙ্গে সঙ্গে গেট পর্যন্ত। আমাদের চোখেই দেখলেন না তিনি, তারপর হঠাৎ দেখতে পেয়ে বললেন, ‘তোমরা একবার যাও তো ভেতরে, উনি একটু কথা বলবেন।’

সিঁড়ির ওপরের ধাপে দাঁড়িয়েছিলেন মিসেস দে, এক সিঁড়ি নিচে দাঁড়িয়ে অসিত বলল, ‘আমাদের ডেকেছেন, মাসিমা?’ কলকাতার ছেলে, ডাক-টাকগুলো দিব্যি আসে, আমি মরে গেলেও ওসব পারি না।

মিসেস দে বললেন, ‘তরুর অসুখ।’ তার কণ্ঠস্বর আমার বুকে ছুরি বিঁধিয়ে দিল।

‘কী অসুখ?’

‘টাইফয়েড!’ ঐ ভয়ংকর শব্দটা আস্তে উচ্চারণ করে তিনি বললেন, ‘আমার কিছু ভালো লাগছে না।’

অসিত বলে উঠল, ‘কিছু ভাববেন না। আমরা সব করে দেব।’

‘পারবে, পারবে তোমরা? দ্যাখো বাবা, এই একটাই সন্তান আমার...’ বলতে বলতে চোখে তাঁর জল এলো।

মোনালিসা, কোনোদিন জানলে না তুমি, কোনোদিন জানবে না, কী ভালো আমাদের লেগেছিলো, কী সুখী আমরা হয়েছিলাম, সেই সাতাশ সনের বর্ষায়, পুরানা পল্টনে, দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, সেই জ্বরে ঝড়ে, বৃষ্টিতে থমথমে অন্ধকারে, ছমছমে ছায়ায়। দেড় মাস তুমি শুয়ে ছিলে, দেড় মাস তুমি আমাদের ছিলে। দেড় মাস ধ’রে সুখের স্পন্দন দিনে-রাত্রে কখনো থামল না আমাদের হৃৎপিণ্ডে। তোমার বাবা আপিস যান, ফিরে এসে রোগীর ঘরে উঁকি দিয়েই হাত-পা এলিয়ে শুয়ে পড়েন ইজি-চেয়ারে; তোমার মা-র সারাদিন পায়ের পাতা দাঁড়ায় না, কিন্তু রাত্তিরে আর পারেন না তিনি, রোগীর ঘরেই ক্যাম্পখাটে ঘুমোন, আর সারারাত পালা ক’রে ক’রে জেগে থাকি আমরা—কখনো একসঙ্গে দুজনে, ক্বচিৎ তিনজনেই, বেশির ভাগ একলা একজন। আর তোমাকে নিয়ে এই একলা রাত-জাগায় সুখ আমিই পেয়েছি বেশি—অসিত সারাদিন ছুটোছুটি করেছে সাইকেলে, হিতাংশুও বারবার। সবচেয়ে কাছের বরফের দোকান এক মাইল দূরে, ওষুধের দোকান দুই মাইল, ডাক্তারের বাড়ি সাড়ে তিন মাইল—কোনোদিন অসিত দশবার যাচ্ছে, দশবার আসছে, কতবার ভিজে কাপড় শুকোল তার গায়ে, কোনোদিন রাত বারোটায় হিতাংশু ছুটল বরফ আনতে, সব দোকান বন্ধ, রেলের স্টেশন নিঃসাড়, নদীর ধারে বরফের ডিপোতে গিয়ে লোকজনের ঘুম ভাঙিয়ে বরফ নিয়ে আসতে-আসতে দুটো বেজে গেলো তার, এদিকে আমি আইসব্যাগে জলের পরিমাণ অনুভব করছি বারবার, আর অসিত বাথরুমে বরফের ছোট ছোট ছড়ানো টুকরো দু-হাতে কুড়োচ্ছে। সাইকেলে আমার দখল নেই ব’লে বাইরের কাজ আমি কিছুই প্রায় পারি না, সারাদিন ঘুর-ঘুর করি তোমার মা-র কাছে কাছে, হাতের কাছে এগিয়ে দিই সব, ওষুধ ঢালি, টেম্পারেচার লিখি, ডাক্তার এলে তাঁর ব্যাগ হাতে ক’রে নিয়ে আসি, নিয়ে যাই। তারপর সন্ধ্যা হয়, রাত বাড়ে, বাইরে অন্ধকারের সমুদ্র, সে-সমুদ্রে ক্ষীণ আলো-জ্বলা একটি নৌকোয় তুমি আর আমি চলেছি ভেসে, তুমি তা জানলে না মোনালিসা, কোনোদিন জানবে না। সারাদিন, সারারাত মোনালিসা মূর্ছিতের মতো প’ড়ে থাকে, ভুল বকে মাঝে মাঝে—এত ক্ষীণ-স্বর যে কী বলছে বোঝা যায় না—তবু যে ক’টি কথা আমরা কানে শুনেছি তা-ই যত্ন ক’রে তুলে রেখেছি মনে, একের শোনা কথা অন্য দুজনকে বলাই চাই; কখনো হঠাৎ একটু অবসর হলে তিনজন ব’সে সেই কথা ক’টি নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি, যেন তিনজন কৃপণ সারা পৃথিবীকে লুকিয়ে তাদের মণি-মুক্তো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে, বন্ধ ঘরে, অন্ধকার রাত্রে। যদি বলেছে ‘উঃ’, সে যেন বাঁশির ফুঁয়ের মতো আমাদের হৃদয়কে দুলিয়ে গেছে; যদি বলেছে ‘জল’, তাতে যেন জলের সমস্ত তরলতা ছলছল ক’রে উঠেছে আমাদের মনে।

এক রাত্রে হিতাংশু বাড়ি গেছে আর অসিত বারান্দায় বিছানায় ঘুমুচ্ছে, আমি জেগে আছি একা। টেবিলের উপর জ্বলছে মোমবাতি, দেওয়ালের গায়ে ছায়া কাঁপছে বড়-বড়, অন্ধকারের সঙ্গে যুদ্ধ ক’রে ঐ আলোটুকু যেন আর পারছে না; আমিও আর পারছি না ঘুমের সঙ্গে যুদ্ধ করতে, ডাকাতের মতো ঘুম আমার হাত-পা কেটে-কেটে টুকরো ক’রে দিলো, মোমের মতোই গলে যাচ্ছে আমার শরীর। যতবার চাবুক মেরে নিজেকে সোজা করছি; লাফিয়ে উঠছে অতল থেকে বিশাল ঢেউ। ডুবতে ডুবতে মনে হ’লো মোনালিসা তুমিও কি এমন করেই যুদ্ধ করছ মৃত্যুর সঙ্গে, মৃত্যু কি এই ঘুমের মতোই টানছে তোমাকে, তবু তুমি আছো—কেমন ক’রে আছো! মনে হ’তেই ঘুম ছুটল। সোজা হ’য়ে বসলাম, তাকিয়ে রইলাম তোমার মুখের দিকে সেই ক্ষীণ আলোয় কাঁপা-কাঁপা ছায়ায় রাত চারটের স্তব্ধ মহান মুহূর্তে। তুমি কি মরবে? তুমি কি বেঁচে উঠবে? কোনো উত্তর নেই। তোমার কি ঘুম পেয়েছে? উত্তর নেই। তুমি ঘুমিয়েছ না জেগে আছো? উত্তর নেই। তবুও আমি তাকিয়ে থাকলাম, মনে হ’লো এর উত্তর আমি পাবই, পাব তোমারই মুখে, তোমার মুখের কোনো একটি ভঙ্গিতে হয়তো—কে জানে—তোমার কণ্ঠেরই কোনো একটি কথায়। আর, আমি অবাক হ’য়ে দেখলাম, আস্তে আস্তে চোখ তোমার খুলে গেলো, মস্ত বড় হ’লো, উন্মাদের মতো ঘুরে ঘুরে স্থির হ’লো আমার মুখের উপর। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল—‘কে?’

আমি তাড়াতাড়ি আইসব্যাগ চেপে ধরলাম।

‘কে তুমি?’

‘আমি।’

‘তুমি কে?’

‘আমি বিকাশ।’

‘ও, বিকাশ। বিকাশ, এখন দিন, না রাত্রি?’

‘রাত্রি।’

‘ভোর হবে না?’

‘হবে, আর দেরি নেই।’

‘দেরি নেই? আমার ঘুম পাচ্ছে, বিকাশ।’

আমি তার কপালে আমার বরফে-ঠাণ্ডা হাত রাখলাম।

‘আহ্, খুব ভালো লাগছে আমার।’

‘আমি বললাম, ‘ঘুমোও।’

‘তুমি চলে যাবে না তো?’

‘না।’

‘যাবে না তো?’

‘না।’

‘আমি তাহলে ঘুমুই, কেমন?’

নিশ্বাস উঠলো আমার ভিতর থেকে, নিশ্বাসের স্বরে বললাম,—‘ঘুমোও, ঘুমোও, আমি জেগে আছি, কোনো ভয় নেই।’

তুমি ঘুমিয়ে পড়লে আর বাইরে, দু-একটা পাখি ডাকল। ভোর হ’লো।

প্রলাপ, জ্বরের প্রলাপ, তবু এটা আমারই থাক। একলা আমার। এই একটা কথা ওদের দুজনেক বলি নি, হয়তো ওদেরও এমন কিছু আছে যা আমি জানি না, আর-কেউ জানে না। তুমি, মোনালিসা, তুমিও জানলে না, জানবে না কোনোদিন।

তারপর একদিন তুমি ভালো হলে। সে তো খুব সুখের কথা, কিন্তু আমরা যেন বেকার হ’য়ে পড়লাম। আর তুমি ভাতটাত খাবার দিন-পনের পরে যে-রবিবারে তোমার মা আমাদের তিনজনকে নিমন্ত্রণ ক’রে খাওয়ালেন, সেদিন আমার অন্তত মনে হ’লো যে এই খাওয়াটা আমাদের ফেয়ারওএল পার্টি।

কিন্তু তা-ই বা কেন? এখনো আমরা যেতে পারি, বসতে পারি কাছে, গ্রামোফোন বাজিয়ে শোনাতে পারি, সে ক্লান্ত হলে পিঠের বালিশটা দিতে পারি ঠিক ক’রে। এদিকে আকাশে কালো মেঘের সঙ্গে সাদা মেঘের খেলা, আর ফাঁকে-ফাঁকে নীলের মেলা, এই ক’রে-ক’রে আশ্বিন যেই এলো, ওঁরা চলে গেলেন মেয়ের শরীর সারাতে রাঁচি।

বাঁধাছাঁদা থেকে আরম্ভ ক’রে নারায়ণগঞ্জে স্টিমারে তুলে দেয়া পর্যন্ত সঙ্গে-সঙ্গে থাকলাম আমরা তিনজন।

ফার্স্ট ক্লাসের ডেকে রেলিং ধরে দাঁড়ানো মোনালিসার ছবিটি যখন চোখের সামনে ঝাপসা হ’লো তখন আমাদের মনে পড়লো যে ওঁদের রাঁচির ঠিকানাটা জেনে রাখা হয়নি আমার ইচ্ছে করছিলো বাড়ি ফিরেই একটা চিঠি লিখে ডাকে দিই, তা আর হ’লো না।

অসিত বললো, ‘ওরই তো আগে লেখা উচিত।’

‘তা কি আর লিখবে?’ একটু হতাশভাবেই বললো হিতাংশু।

‘কেন লিখবে না, না-লেখার কী আছে।’

কী আছে কে জানে, কিন্তু কুড়ি দিনের মধ্যেও কোনো চিঠি এলো না। এলো হিতাংশুর বাবার নামে মনি-অর্ডার, বাড়ি-ভাড়ার টাকা। তাই থেকে ঠিকানা সংগ্রহ করে আমরা চিঠি লিখব স্থির করলাম। ও লেখে নি বলে আমরাও না-লিখে রাগ দেখাব, এটা কোনোরকম যুক্তি বলেই মনে হলো না আমাদের। অসুখ থেকে উঠে গেছে, হয়তো এখনো ভালো ক’রে শরীর সারেনি—কেমন আছে সে খবরটা আমাদেরই তো নেয়া উচিত। কিন্তু চিঠিতে পাঠে কী লিখব? আপনি লিখব, না তুমি? মুখে ও অবশ্য আমাদের তুমিই বলেছে, আমরাও তা-ই, কিন্তু কতটুকু কথাই বা এ পর্যন্ত বলেছি আমরা—এতখানি কথা নিশ্চয়ই বলি নি যার জোরে কালির আঁচড়ে জ্বলজ্বলে একটা তুমি লিখে ফেলা যায়। তাছাড়া, কী লিখবই বা চিঠিতে? কেমন ভালো তো? এতেই তো সব কথা ফুরিয়ে গেলো। আমরা কেমন আছি, কী করছি, সে-সব লিখলে তো কতই লেখা যায়—কিন্তু মোনালিসা কি আমাদের খবর জানতে ব্যস্ত?

অনেকক্ষণ ধ’রে জটলা ক’রেও কোনো মীমাংসা যখন হ’লো না, তখন ওরা আমাকেই বললো চিঠিখানা রচনা ক’রে দিতে। আমি কবিতা-টবিতা লিখি, তাই।

সে-রাত্রেই লণ্ঠনের সামনে ঘামতে ঘামতে আমি লিখে ফেললাম :

সুচরিতাষু,

ভেবেছিলাম একখানা চিটি আসবে, চিঠি এলো না। ভাবতে-ভাবতে একুশ দিন কেটে গেলো। খুবই ভালো লাগছে বুঝি রাঁচিতে? অবশ্য ভালো লাগলেই ভালো, আমরা তাতেই খুশী। তারা-কুটিরের একতলা বন্ধ, পুরানা পল্টন তাই অন্ধকার। ওখানে পেট্রোম্যাক্স জ্বলত কিনা রোজ সন্ধ্যায়।

বসে বসে রাঁচির ছবি দেখছি আমরা। পাহাড়, জঙ্গল, লাল কাঁকরের, কালো-কালো-সাঁওতাল। হাসি, আনন্দ, স্বাস্থ্য। সত্যি, কী বিশ্রী অসুখ গেলো—আর যেন কখনো অসুখ না ক’রে।

কারো কোনো অসুখ না ক’রেও এমন কি হয় না যে আমাদের খুব খাটতে হয়? সত্যি, শুয়ে-ব’সে আর সময় কাটে না। চিঠি পেলে আবার আমাদের চিঠি লিখতে হবে, কিছু কাজ তবু জুটবে আমাদের।

মাসিমা মেসোমশায়কে প্রণাম।

আপনি তুমি দুটোই বাঁচিয়ে এর বেশি পারলাম না। এটুকুতেই রাত তিনটে বাজল। তাকিয়ে দেখি, কাটাকুটির ফাঁকে-ফাঁকে এই ক’টি কথা যেন কালো জঙ্গলে ঝিকিমিকি রোদ্দুর। বার-বার পড়লাম; মনে হ’লো বেশ হয়েছে, আবার মনে হ’লো ছি-ছি, ছিঁড়ে ফেলি এক্ষুনি। ছিঁড়ে ফেললামও, কিন্তু তার আগ ভালো একটি কাগজে নকল ক’রে নিলাম, আর পরদিন তিনজন বসিয়ে দিলাম যে যার নাম সই, চোখ বুজে ছেড়ে দিলাম ডাকে।

ঢাকা থেকে রাঁচি, রাঁচি থেকে ঢাকা। চারদিন, পাঁচদিন—আচ্ছা ছ-দিন। না, চিঠি নেই। সন্ধ্যায় কুয়াশা, একটু একটু শীত; চিঠি নেই। শিউলি ফুরিয়ে স্থলপদ্ম ফুটল; চিঠি নেই।

চিঠি এলো শেষ পর্যন্ত, হিতাংশুর নামে শীর্ণ একটা পোস্টকার্ড, লিখেছেন ওর মা। অনেকটা এই রকম :

কল্যাণীয়েষু,

হিতাংশু, অসিত, বিকাশ, তোমরা তিনজনে আমাদের বিজয়ার আশীর্বাদ জেনো। আমাদের রাঁচির মেয়াদ শেষ হ’লো, শিগগিরই ফিরব। ইতিমধ্যে, হিতাংশু তুমি যদি আমাদের ঘরগুলি খুলিয়ে তোমাদের চাকর দিয়ে ঝাঁটপাট করিয়ে রাখো, তাহলে বড় ভালো হয়। চাবি তোমার বাবার কাছে।

আশা করি ভালো আছো সকলে। তরুর শরীর এখন বেশ ভালো হয়েছে, মাঝে মাঝে সে তোমাদের কথা ব’লে। ইতি—তোমাদর মাসিমা।

মাঝে মাঝে আমাদের কথা ব’লে! আর আমাদের চিঠি? পোস্টকার্ডটি তন্ন তন্ন ক’রে খুঁজেও কোনো প্রমাণ পাওয়া গেলো না যে চিঠিটা পৌঁছেছিলো। কি হ’লো চিঠির? কিন্তু সে কথা বেশিক্ষণ ভাববার সময় কই আমাদের, তক্ষুনি লেগে গেলাম কাজে। একদিনের মধ্যেই তারা-কুটিরের একতলাকে আমরা এমন ক’রে ফেললাম যে মেঝেতে মুখ দেখা যায়। কয়েকদিন পরে আর-একটি পোস্টকার্ড : ‘রবিবার ফিরছি, স্টেশনে এসো।’ শুধু স্টেশনে। আমরা ছুটলাম নারায়ণগঞ্জে।

আ, কী সুন্দর দেখলাম মোনালিসাকে, কচিপাতার রঙের শাড়ি পরনে, লাল পাড়, লালচে মুখের রং, একটু মোটা হয়েছে, একটু যেন লম্বাও। পাছে কাছে দাঁড়ালে ধরা প’ড়ে যে সে আমাকে মাথায় ছাড়িয়ে গেছে, আমি একটু দূরে দূরে থাকলাম, হিতাংশু ছুটোছুটি ক’রে বরফ লেমনেড কিনতে লাগল, আর অসিত কুলিকে ঠেলে দিয়ে বড়-বড় বাক্স-বিছানা হাই-হাই ক’রে তুলতে লাগল গাড়িতে।

মাসিমা বললেন, ‘তোমরা এ-গাড়িতেই এসো।’

‘না, না, সে কী কথা, আমরা-আমরা এই পাশের গাড়িতেই—’

‘আরে এসো না’—ব’লে দে-সাহেব অসিতের পিঠের উপর হাত রাখলেন।

নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা : মনে হ’লো আমাদের জীবনের সবচেয়ে সুখের সময়টি এতকাল এই পঁয়তাল্লিশটি মিনিটের জন্যই অপেক্ষা ক’রে ছিলো। ফার্স্ট ক্লাসের গদিকে অবজ্ঞা ক’রে আমরা বসলাম বাঙ্-বিছানার উপর; তাতে একটা সুবিধে এই হ’লো যে একসঙ্গে সকলকেই দেখতে পেলাম—দেখলাম মোনালিসা খুশী, ওর মা খুশী। বাবা খুশী, দেখতে-দেখতে আমরাও খুশীতে ভ’রে গেলাম; এতদিন যা বাধো-বাধো ছিলো তা সহজ হ’লো, এতদিন যা ইচ্ছে ছিলো তা মূর্ত হ’লো—রীতিমতো কলরব করতে-করতে চললাম আমরা; এতবড় রেলগাড়িটা যেন আমাদের খুশীর বেগেই চলেছে। মোনালিসা নাম ধ’রে-ধ’রে ডাকতে লাগল আমাদের—কত তার কথা, কত গল্প—আর গাড়ি যখন ঢাকা স্টেশনের কাছাকাছি, কোনো-এক ঝর্নার বর্ণনা দিচ্ছে সে, হঠাৎ আমি ব’লে উঠলাম, ‘আমাদের চিঠি পেয়েছিলে?’

‘তোমাদের চিঠি, না তোমার চিঠি?’

আমি একটু লাল হ’য়ে বললাম, ‘জবাব দাও নি যে?’

‘এতক্ষণ ধ’রে তো সেই জবাবই দিচ্ছি। বাড়ি গিয়ে আরও দেবো।’

মিথ্যো বলে নি মোনালিসা। স্বর্গের দরজা হঠাৎ খুলে গেলো আমাদের, আমরা তিনজন আমরা চারজন হ’য়ে উঠলাম।

তারপর একদিন মাসিমা আমাদের ডেকে বললেন, ‘একবার তোমরা তরুর জন্য খেটেছ, আর একবার খাটতে হবে। ঊনতিরিশে অঘ্রাণ ওর বিয়ে।’

ঊনতিরিশে! আর দশ দিন পরে!

ছুটে গেলাম ওর কাছে, বললাম, ‘মোনালিসা, এ কী শুনছি!’

ভুরু কুঁচকে বললো, ‘কী? কী বললে?’

গোপন নামটা হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ায় আমি একটু থমকে গেলাম, কিন্তু একবার যখন বেরিয়েই গেছে তখন আর ভয় কী! মরিয়া হলে মানুষের যে সাহস হয়, সেই সাহসের বশে আমি সোজা তাকালাম ওর চোখের দিকে, চোখের ভিতরে—যা যা আগে আমি কখনো করি নি—বেগুনি-বেগুনি কালো রঙের ওর চোখ, একফোঁটা হীরের মতো চোখের মণি—তাকিয়ে থেকে আবার বললাম, ‘মোনালিসা।’

‘মোনালিসা’ সে আবার কে?’

‘মোনালিসা তোমারই নাম’, বললো অসিত, ‘জানো না?’

‘সে কী?’

হিতাংশু বললো, ‘আর কোনো নামে আমরা ভাবতেই পারি না তোমাকে।’

‘মজা-তো—’ কৌতুকের রং লাগল ওর মুখে, মিলিয়ে গেলো, পলকের জন্য ছায়া পড়লো সেখানে, যেন একটি ক্ষণিক বিষাদের মেঘ আস্তে ভেসে গেল মুখের উপর দিয়ে। একটু তাকিয়ে রইল, চোখের পাতা দুটি চোখের উপর নামল একবার।

হঠাৎ, মুহূর্তের জন্য—কী কারণে বুঝলাম না—আমাদের একটু যেন মন-খারাপ হ’লো, কিন্তু তখনই তা উড়িয়ে দিল হাসির হাওয়া, আমাদের কথায় লাগল ঠাট্টার বুড়বুড়ি।

‘কী শুনছি? মোনালিসা, কী শুনছি?’

‘কী শুনছ বলো তো?’ ব’লে আঁচলে মুখ চেপে খিলখিল ক’রে হেসে পালিয়ে গেলো।

বর এলো বিয়ের দু’দিন আগে কলকাতা থেকে। ধবধবে ফর্সা, ফিনফিনে ধুতি পাঞ্জাবি পরনে, কাছে দাঁড়ালে সূক্ষ্ম একটি সুগন্ধে মন যেন পাখি হ’য়ে উড়ে যায়। দেখে আমরা মুগ্ধ। হিতাংশু বারবার বলতে লাগল—’হীরেন বাবু কী সুন্দর দেখতে।’

অসিত জুড়ল—‘ধুতির পাড়টা!’

‘পা দুটো!’ বলে উঠলো হিতাংশু। ‘অমন ফর্সা পা না-হলে কি আর ও-রকম ধুতি মানায়!’

আমি ফস্ করে বললাম, ‘যা-ই বলো, ঠোঁটের কাছটা একটু বোকা-বোকা।’

‘কী! বোকা-বোকা!’ অসিত চেঁচিয়ে উঠলো, কিন্তু চিৎকার বেরোল না, কারণ লোকজন নিয়ে চ্যাঁচামেচি ক’রে-ক’রে বিয়ের অনেক আগেই সে-গলা ভেঙে ব’সে আছে। রেগে যাওয়া বেড়ালের মতো ফ্যাঁশ ফ্যাঁশ ক’রে বললো, ‘এমন সুন্দর দেখেছ কখনো!’

‘মোনালিসার মতো তো নয়!’ আমি আমার গোঁ ছাড়লাম না।

‘একজন কি আর-একজনের মতো হয় কখনো! খুব মানিয়েছে দু’জনে। চমৎকার!’ ব’লে অসিত লাফিয়ে সাইকেলে উঠে বোঁ ক’রে কোথায় যেন চলে গেলো। বিয়ের সমস্ত ভারই তার উপর, তর্ক করার সময় কোথায়।

বিয়ের দিন শানাইয়ের শব্দে রাত থাকতেই আমার ঘুম ভাঙল। চোখ মেলেই মনে পড়লো সেই আর-একটি শেষ-রাত্রি, যখন মৃত্যুর হাত থেকে—তা-ই মনে হয়েছিলো তখন—মোনালিসাকে আমি ফিরিয়ে এনেছিলাম। সেদিন অন্ধকারের ভিতর থেকে একটু একটু ক’রে আলো বেরিয়ে আসা দেখতে-দেখতে যে আনন্দে আমি ভেসে গিয়েছিলাম, সেই আনন্দ ফিরে এলো আমার বুকে, গা কাঁটা দিয়ে উঠলো, শানাইয়ের সুরে চোখ ভ’রে উঠলো জলে। আর শুয়ে থাকতে পারলাম না, তারা-ভরা আকাশের তলায় দাঁড়ালাম এসে। শুনতে পেলাম বিয়েবাড়ির সাড়াশব্দ, শাঁখের ফুঁ—কাছে গেলাম। মনে হ’লো আর একবার যদি দেখতে পাই, এই ভোর হবার আগের মুহূর্তে, যখন আকাশ ঘোষণা করছে মধ্যরাত্রি আর হাওয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে ভোর—এই আশ্চর্য অপার্থিব সময়ে একটু দেখতে পাই যদি। কিন্তু না—গায়ে-হলুদ হচ্ছে, কত-কত অচেনা মেয়ে ঘিরে আছে তাকে, কত কাজ, কত সাজ—এর মধ্যে আমি তো তাকে দেখতে পাব না। বাইরে দাঁড়িয়ে ভেতরকার চলাফেরা, কথাবার্তা শুনতে লাগলাম, আর সব ছাপিয়ে, সব ছাড়িয়ে শানাইয়ের সুর ঝরল, আমার চোখের সামনে কাঁপতে-কাঁপতে তারার ঝাঁক মিলিয়ে গেলো, ফুটে উঠলো মাঠে মাঠে গাছপালার চেহারা, মাটির অবয়ব, পৃথিবীতে আর একবার ভোর হলো।

সেদিনে অসিতের গলা একেবারেই ভেঙে গিয়ে নববধূর মতো ফিসফিসে হ’লো। এত ব্যস্ত সে, আমাকে যেন চেনেই না। হিতাংশুও ব্যস্ত, ব্যস্ত এবং একটু গর্বিত, কেননা বর সদলে বাসা নিয়েছেন তাদেরই বাড়ির দুটো ঘরে, একতলা দোতলায় দূতের কাজ করতে-করতে সে স্যান্ডেল ক্ষইয়ে ফেলল। আমি একবার হিতাংশুকে, একবার অসিতকে সাহায্য করার চেষ্টা করলাম সারাদিন ভ’রে, কিন্তু আমার নিজের মনে হ’লো না বিশেষ-কোনো কাজে লাগছি, আর শেষ পর্যন্ত যখন বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে কনেকে সাতপাক ঘোরাবার সময় এলো, তখনও আমি এগিয়ে গেলাম, কিন্তু আমাকে ঠেলে দিয়ে অসিত আর হিতাংশুই পিঁড়ি তুলল, দু’হাতে দু’জনের গলা জড়িয়ে ধ’রে ও সাত পাক ঘুরল, আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম।

বিয়ের পরদিন থেকেই আমরা তিনজন হীরেন বাবুর চাকর বনে গেলাম। তাঁর মতো সুন্দর কেউ না, তাঁর মতো বিদ্যেবুদ্ধি কারো নেই, তাঁর মতো ঠাট্টা কেউ করতে পারে না। অন্য পুরুষদের বাঁদর মনে হ’লো তুলনায়—আমারও আর মনে হ’লো না যে তাঁর ঠোঁটের কাছটা একটু বোকা-বোকা। এমনকি, আমি চেষ্টা করতে লাগলাম তাঁর মতো ক’রে বসতে, দাঁড়াতে, হাঁটতে, হাসতে, কথা বলতে; ওরা দু’জনও তা-ই করলো, আবার তা দেখে হাসি পেলো আমার, হয়তো প্রত্যেকেই আমরা অন্য দু’জনের চেষ্টা দেখে হেসেছি মনে-মনে, যদিও মুখে কেউ কিছু বলি নি।

একদিন দুপুরবেলা হীরেনবাবুর কাছে খুব একটা মজার গল্প শুনছি, তিনি একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে হঠাৎ বললেন, ‘দ্যাখো তো ভাই, তরু গেলো কোথায়।’

‘ডেকে আনব?’ ব’লে আমি ছুটে বেরিয়ে গেলাম।

দক্ষিণের বারান্দায় রোদে পিঠ দিয়ে ব’সে মোনালিসা চুল আঁচড়াচ্ছে। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, দাঁড়িয়ে কথা বলতে ভুলে গেলাম। হঠাৎ যেমন নতুন লাগল তাকে, একটু অন্যরকম সিঁথিতে জ্বলজ্বলে সিঁদুর, পরনে কড়কড়ে শাড়ি, কানে হাতে গলায় চিকচিকে গয়না, আর কেমন একটা গন্ধ দিচ্ছে গা থেকে—হীরেনবাবুর সেন্টের গন্ধ না, নতুন ফার্নিচারের মদ-মদ গন্ধ না, চুলের তেল কি মুখের পাউডারেরও না—আমার মনে হ’লো এই সমস্ত মিলিত গন্ধের যেটা নির্যাস, সেটাই ভর করেছে মোনালিসার শরীরে। জোরে নিশ্বাস নিলাম কয়েকবার, মাথা যেন ঝিমঝিম ক’রে উঠলো।

চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কী?’

‘কিছু না’—সঙ্গে সঙ্গে কাজের কথাটা মনে পড়লো, ‘হীরেনবাবু ডাকছেন তোমাকে।’

আমার কথাটা যেন শুনতেই পেলো না মোনালিসা, নিশ্চিন্তে চুলই আঁচড়াতে লাগল।

‘শুনছ না কথা! হীরেনবাবু ডাকছেন তোমাকে।’

‘ডাকছেন তো হয়েছে কী। উনি ডাকলেই যেতে হবে?’

‘বাঃ—!’

চিরুনি থামিয়ে আমার মুখের দিকে তাকালো—‘আর কী—চলেই তো যাব শিগগির।’

আমি বললাম, ‘কত ভালো লাগবে তোমার কলকাতায় গিয়ে—ঢাকা কি একটা জায়গা!’

‘ঢাকা খুব ভালো।’ ঘাড় বেঁকিয়ে বাইরের দিকে তাকালো, একটু, শীতের দুপুরের সবুজ-সোনালি মাঠের দিকে। সেদিকে তাকিয়েই আবার বললো, ‘তোমরা আমাকে মনে রাখবে, বিকাশ?’

আমি ব্যস্ত হ’য়ে বললাম, ‘আর কথা না। চলো এখন।’

‘দেখছো না চুল আঁচড়াচ্ছি। বলো গিয়ে এখন যেতে পারবো না।’

কথা শুনে প্রায় ভড়কে গিয়েছিলাম, কিন্তু একটু পরেই মোনালিসা উঠলো, তার সঙ্গে সঙ্গে আমিও এলাম ঘরে। এসেই বললাম, ‘তারপর? সেই লোকটার কী হ’লো, হীরেনবাবু?’

কিন্তু হীরেনবাবুর গল্প বলার উৎসাহ দেখি মিইয়ে গেছে। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলেন তিনি, আর মোনালিসা চেয়ারে ব’সে টেবিলের কাপড় খুঁটতে লাগল।

আমি পীড়াপীড়ি করলাম, ‘বলুন না কী হ’লো!’

‘এখন থাক।’

আমি খাটে ব’সে একটি ইংরেজি বইয়ের পাতা উল্টিয়ে বললাম, ‘এটা পড়েছি, ভারি মজার বই।’

হীরেনবাবু হঠাৎ হাত বাড়িয়ে আর-একটি বই টেনে নিয়ে বললেন, ‘এ-বইটাও ভারি মজার। এক কাজ করো তুমি—এটা বাড়ি নিয়ে গিয়ে প’ড়ে ফ্যালো, আমি চট ক’রে একটু ঘুমিয়ে নিই। কেমন?’ বলতে-বলতে তিনি একেবারে উঠে দাঁড়ালেন।

আর কথা না-ব’লে আস্তে বেরিয়ে এলাম আমি, পিঠ দিয়ে অনুভব করলাম ও-ঘরের দরজা বন্ধ হ’য়ে গেলো। বাড়ি গেলাম না; বারান্দায় যেখানে ও ব’সেছিলো ঠিক সেখানটায় ব’সে পড়লাম। ওর চুলের গন্ধমাখা চিরুনিটা সেখানেই প’ড়ে ছিলো, হাতে তুলে নিয়ে দাঁতগুলির উপর আস্তে আস্তে আঙুল চালাতে লাগলাম, বার-বার, বার-বার।

আরো একদিন, আরো একদিন। যাবার দিন এলো, পেছোল, আর-একটা একটা দিন শুধু; তারপর চলে গেলো।

চিঠি এলো এবার, তিনজনের কাছে একখানা, চিঠি, মোটা নীল খামে, আমার নামে! তিনজনের হ’য়ে জবাব লিখলাম, আমি, একটু লম্বাই হ’লো, সেই সঙ্গে একটা কবিতাও লিখে ফেললাম, সেটা অবশ্য পাঠালাম না। চিঠি বন্ধ হ’য়ে গেলো শিগগিরই, তারপর শুধুই কবিতা লিখতে লাগলাম, দেখতে দেখতে খাতা ভ’রে উঠলো!

মাসিমার কাছে খবর পাই সবই। ভালো আছে ওরা, খুব ভালো আছে। হীরেন গাড়ি কিনেছেন, সেদিন ওরা আসানসোল বেড়িয়ে এলো। কলকাতায় কথা-বলা সিনেমা দেখাচ্ছেন, টোম্যাটোর সের এক পয়সা, তবে শীত কমে গেছে, হঠাৎ অসুখ-বিসুখ দেখা না দেয়। আর-একটু গরম পড়লেই ওরা চলে যাবে দারজিলিং।

না-দেখা দারজিলিং-এর ছবি দেখতে লাগলাম, মনে-মনে, কিন্তু সে-ছবি মুছে দিয়ে মাসিমা একদিন বললেন, ‘ওরা তো আসছে।’

আসছে! এখানে! ঢাকায়। দারজিলিং-এর কী হ’লো? আমাদের নীরব প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘শরীরটা খারাপ হয়েছে ওর, আমার কাছেই থাকবে এখন।’

‘কী? অসুখ করেছে আবার?’ চমকে উঠলাম তিনজনে।

‘না, অসুখ ঠিক না, শরীরটা ভালো নেই আর কি’, মাসিমা মৃদু হাসলেন।

খুব খারাপ লাগল। খারাপ লাগল মাসিমার কথা শুনে, হাসি দেখে। শরীর ভালো না, অথচ অসুখও না—এ আবার কী-রকম কথা? আর মাসিমা কেমন নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ,—যেন খুশীই হয়েছেন খবর শুনে। রীতিমতো রাগ হ’লো মনে মনে।

ওরা পৌঁছোবার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা তিন মূর্তি গিয়ে হাজির হলাম। মোনালিসা সোফায় ব’সে আছে একটু এলিয়ে, হাতে সিগারেটের টিন। চকিতে আমরা তিনজন মুখ-চাওয়াচাওয়ি করলাম—হীরেনবাবু কি সিগারেট ধরিয়েছেন ওকে?

আমাদের দেখে ফিকে একটু হাসলো। কথা বললো না।

‘কেমন আছো মোনালিসা?’ আমরা চেষ্টা করলাম স্ফূর্তির সুর লাগাতে।

সিগারেটের টিনটা মুখের কাছে এনে তার সঙ্গে একবার মুখ ঠেকিয়ে ডালা বন্ধ ক’রে বললো, ‘এই—’

‘তোমার নাকি অসুখ?’

সে-কথার কোনো জবাব না-দিয়ে বললো, ‘তোমাদের কী খবর?’ তারপর আস্তে আস্তে এটা-ওটা গল্প করতে লাগল, আর সিগারেটের টিনটা মুখে তুলতে লাগল ঘন ঘন।

হীরেনবাবু ঘরে এসে ব্যস্তভাবে বললেন, ‘তরু এখন কেমন আছো?’

ক্লান্ত চোখ তুলে বললো, ‘ভালো।’

‘তুমি বরং একটু শোও।’

‘না, এই বেশ আছি।’

‘এই যে তোমরা এসেছো দেখছি। তরু তো এদিকে—’ হঠাৎ থেমে গেলেন হীরেনবাবু।

‘হয়েছে কী ওর?’

‘হয় নি কিছু, তবে...’

তবে কী? ওর কী এমন সাংঘাতিক কোনো অসুখ করেছে যা কারো কাছে বলাও যায় না? আর ও যেন কেমন হ’য়ে গেছে, যেন আধ-মরা, আস্তে কথা ব’লে, একভাবে স্থির হ’য়ে ব’সে থাকে, হাসি পেলে ভালো ক’রে হাসেও না। মায়েদের মুখে শুনেছি যে বিয়ের পরে মেয়েদের শরীর আরো ভালো হয়, কিন্তু আমাদের মোনালিসার নাকি এই হ’লো?

ছোট একটা প্লেট হাতে ক’রে মাসিমা এসে বললেন, ‘এটা একটু মুখে দিয়ে দ্যাখ তো?’

‘কী, মা?’

‘দ্যাখ না—’ ব’লে তিনিই আঙুল দিয়ে মুখে গুঁজে দিলেন।

‘না, না, আর না—’, মোনালিসার মুখে কষ্টের রেখা ফুটে উঠলো, গলার কাছটায় হাত রেখে মুখ নিচু করলো সে।

বেরিয়ে এসে খানিকক্ষণ নিঃশব্দ হাঁটলাম আমরা, মন বিষণ্ন খুবই। হঠাৎ অসিত বললো, ‘ও বার-বার থুতু ফেলছিলো সিগারেটের টিনে।’

‘যাঃ!’ আমি আঁতকে উঠলাম।

‘সত্যি! আমি দেখলাম!’

হিতাংশু বললো, ‘তা হলে এটাই বোধহয় ওর অসুখ।’

‘অসুখ না’, অসিত গম্ভীরভাবে বললো, ‘ওর ছেলে হবে।’

শুনে হিতাংশুটা খুকখুক ক’রে হেসে উঠলো।

‘হাসছো কেন?’—আমি রেগে গেলাম—‘হাসবার কী আছে এতে?’

অসিত বললো, ‘ঐ জন্যেই তো টক এনে দিলেন মাসিমা। এ-রকম হলে টক খেতে ভালো লাগে।’

‘তুমি সবই জানো!’ রাগে গর্জে উঠলাম আমি।

‘হ’লো কী তোমার?’ অসিত যেন সকৌতুকে আমার দিকে তাকালো।

‘যাও! কিছু ভালো লাগছে না আমার, আমি বাড়ি যাই।’ ওদের ত্যাগ ক’রে একা ফিরে এলাম বাড়িতে, বেলা শেষের আলোয় একটা বই খুলে পড়তে ব’সে গেলাম।

হীরেনবাবু ফিরে গেলেন দু’দিন পরেই। দুপুরবেলা গাড়ি। ঘোড়ার গাড়িতে মাল তোলা হ’লো : হীরনেবাবু উঠতে গিয়ে থমকালেন। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ‘কিছু ফেলে এসেছেন, নিয়ে আসবো?’

‘না, না, আমি যাচ্ছি।’

তাড়াতাড়ি বাড়ির ভেতরে গেলেন তিনি, ফিরে এসে কোনোদিকে না তাকিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন। চাবুকের শব্দ হ’লো। অসিত সাইকেলে উঠলো—স্টেশনে যাবে সে। হিতাংশু গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কবে আসবেন আবার?’

‘আসবো—তোমরা দেখো ওকে’, ব’লে হীরেনবাবু মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আমার মনটা হু হু ক’রে উঠলো।

কী স্তব্ধ সেই দুপুরবেলা, কী-রকম ছবির মতো সুন্দর, সেই উনিশ-শো-আটাশ সনে, পুরানা পল্টনের ফাল্গুন মাসে! ঘোড়ার গাড়ি আর অসিতের সাইকেল, ছোট হ’তে-হ’তে রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হ’লো; আমি আর হিতাংশু ভেতরে এলাম। বালিশে মুখ গুঁজে মোনালিসা ফুলে ফুলে কাঁদছে।

‘মোনালিসা!’

‘শোনো, কথা শোনো।’

‘হীরেনবাবু আবার তো আসবেন—’

‘এরপর ওঁকে আর যেতেই দেব না আমরা!’

‘আর না—আর কেঁদো না, মোনালিসা, তোমার পায় পড়ি।’ থামল না কান্না। আমি মেঝেতে ওর কাছে হাঁটু ভেঙে ব’সে পড়লাম, ওর মাথায় হাত রেখে গুনগুন ক’রে বলতে গেলাম, ‘আর না, আর কাঁদে না, একটু থামো, একটু চুপ ক’রো মোনালিসা!’ হঠাৎ গলা ভেঙে গিয়ে আমিও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম।

একটু পরে মোনালিসা আমাকে ঠেলা দিয়ে বললো, ‘এই—কাঁদছ কেন? বোকা!’ আমি দু’হাতে মুখ ঢেকে থাকলাম, আমাকে চুলে ধ’রে ঝাঁকানি দিয়ে আবার বললো, ‘পুরুষমানুষ—কাঁদতে লজ্জা ক’রে না। থামো এক্ষুনি!’

আমি হাত সরিয়ে ভেজা চোখে তাকালাম। ওর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সুখে আমার বুক কেঁপে উঠলো, তারপর সারাদিন ধ’রে একটু একটু কাঁপল, রাত্রে ঘুমের মধ্যেও ভুলতে পারলাম না।

আমরা তিনজন ওকে ঘিরে রইলাম। ও যাতে ভালো থাকে, কখনো মন খারাপ না ক’রে। হঠাৎ এক-একটা অদ্ভুত জিনিষ ওর খেতে ইচ্ছা ক’রে, অসিত শহর ঢুঁড়ে তা জোগাড় ক’রে আনে। দেখেই ওর ইচ্ছে চলে যাবে, জানা কথা; কবে আবার নতুন ইচ্ছে হবে সেই আশায় থাকি আমরা। আর যদি কখনো একটু খায়, খেয়ে ভালো ব’লে, তাহলে তো কথাই নেই—আহ্লাদে আমরা হাবুডুবু।

হীরেনবাবুর চিঠি আসতে দেরি হলেই আমরা বলি, উনি হঠাৎ এসে অবাক ক’রে দেবেন ব’লেই চিঠি লিখছেন না। কথাটা ঠিক নয় জেনেও প্রতিবারেই মোনালিসার মুখ উজ্জ্বল হ’য়ে ওঠে। আমরা চুপ ক’রে উপভোগ করি।

হীরেনবাবু এলেন তিন মাস পরে। ততদিন ওর শরীরটা অনেকটা সেরেছে, খায়, বেড়ায়, ফেরিওলা ডেকে কাপড় কেনে, চেহারাও ভারী হয়েছে একটু। এবারে দিন দশেক থাকলেন তিনি, তারপর পুজোর সময় এসে এক মাস কাটালেন।

ততদিন ওর শরীর আবার খারাপ হচ্ছে। ডাক্তার আসছেন ঘন-ঘন, ওষুধ দিচ্ছেন, কিন্তু যা শুনি তাতে মনে হয় কিছুই উপকার হচ্ছে না। কী কষ্ট জানি না, বুঝি না, শুধু চোখে দেখতে পাই;—চোখে কালি পড়েছে, দু’টো কথা বললেই হাঁপিয়ে প’ড়ে, মুখটা এক-এক সময় নীল হ’য়ে যায়। আমরা কাছে কাছে ঘুরঘুর করি, শুয়ে থাকলে হাওয়া করি হাতপাখায়, কখনো একটু ভালো দেখলে হাসি-ঠাট্টায় ভোলাতে চাই—কিছুই পারি না।

একদিন আমি বললাম, ‘বাবর নিয়েছিলেন হুমায়ুনের অসুখ, ও-রকম পারলে বেশ হ’তো।’

অসিত হো হো ক’রে হেসে উঠলো—’আর যাই পারো, ওর এ-অসুখটা তুমি নিতে পারবে না!’

লাল হ’য়ে বললাম, ‘অসুখ না, অসুখের কষ্ট।’

হিতাংশু বললো, ‘কী কষ্ট, সত্যি! সারারাত নাকি পায়চারি ক’রে—ঘুমোতে পারে না, শুতেও নাকি কষ্ট হয়।’

অসিত বললো, ‘হবে না, দেখতে কীরকম হয়েছে দেখেছ!’

আমি ঝাঁঝিয়ে উঠে বললাম, ‘কীরকম আবার হবে! সুন্দর হয়েছে, খুব সুন্দর।’

‘যত সুন্দরই হোক, এই শেষের সময়টা...’

আর-এক পরদা গলা চড়িয়ে বললাম, ‘এই সময়টাই তো সবচেয়ে সুন্দর!’

সত্যিই তাই, আমার চোখে সত্যিই তা-ই দেখলাম। দিন যত কাটল, তত ওকে আরো বেশি সুন্দর দেখলাম আমি, ওর সমস্ত শরীর এক অসহ্য সৌন্দর্যে ভরপুর হ’য়ে উঠলো আমার চোখে। একদিন ওকে না-ব’লে পারলাম না সে-কথা। আগের বছর যেদিনে ওরা রাঁচি থেকে ফিরেছিলো, যেদিন রেলগাড়ির একটা ছোট কামরায় সমস্ত স্বর্গ ধ’রে গিয়েছিলো, ঠিক সেইরকম একটি শীতের আমেজ-লাগা দিনে হঠাৎ ও বললো, ‘বিকাশ তোমার হয়েছে কী বলো তো? বড্ড আজকাল তাকিয়ে থাকো আমার দিকে!’

আমি একটুও লজ্জিত না হ’য়ে জবাব দিলাম, ‘তুমি আজকাল খুব সুন্দর হয়েছ কি না, তাই।’

‘আগে বুঝি সুন্দর ছিলাম না?’

‘এখনকার মতো না!’

‘তাই বুঝি?’ মোনালিসা ভুরু কুঁচকে বাইরে মাঠের দিকে তাকালো। একটু চুপ ক’রে থেকে বললো, ‘সত্যি আমাকে ভালোবাসো তোমরা। কিন্তু ও-রকম ক’রে আর তাকিয়ো না, ভারি অসুবিধে লাগে আমার।—ইস্, কী রোদ!’

আমি উঠে সামনের জানালাটা ভেজিয়ে দিলাম।

‘একটু ঘুমিয়ে নিই কেমন?’

পায়ের কাছে একখানা চাদর ছিলো, ভাঁজ-করা, খুলে গায়ের উপর ছড়িয়ে দিতে-দিতে বললাম, ‘আজকাল তুমি বেশ ভালো আছো, না?’

‘আমি তো ভালোই আছি।’

ওর মুখে দেখলাম সাহসের সঙ্গে আশা, আশার সঙ্গে ভয়, ভয়ের সঙ্গে ধৈর্য। পায়ের পাতা দুটির উপর থেকে চাদর সরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘হীরেনবাবু চলে গেলেন কেন?’

‘বা রে! ওর বুঝি কাজকর্ম নেই?’

‘কবে আসবেন আবার?’

‘আসবেন সময়মতো।’

‘কী দরকার ছিলো যাবার—আমার মোটেও ভালো লাগে না!’

‘হয়েছে হয়েছে, আর সর্দারি করতে হবে না’—বলে পাশ ফিরে চোখ বুজল। বোজা চোখেই ব’লে নিলো, ‘আমি কিন্তু ঘুমোলাম’, এবং বলবার সঙ্গে-সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লো। আহা, রাত্তিরে ঘুমোতে পারে না, কত ক্লান্তি ওর শরীরে! মনে-মনে বললাম—কার কাছে বললাম জানি না—ওর ভালো হোক, ওর ভালো হোক।

রাত্রে বিছানায় শুয়ে মনে হ’লো ও হয়তো এতক্ষণ ছটফট করছে কষ্টে, উঠে পায়চারি করছে ঘরের মধ্যে, আর বাইরে শেয়াল-ডাকা অন্ধকার, আর আকাশে এখনো সাত-আট ঘণ্টা রাত্রি। কেন আমি কিছু করতে পারি না, কেন এক্ষুনি যেতে পারি না ওর কাছে, কোনো অলৌকিক উপায়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারি না ওকে? চোখের উপর কষ্ট দেখতে হবে, কিছু করা যাবে না, এই কি মানুষের ভাগ্য? সত্যি কি আমাদের হাত-পা বাঁধা, কোনো উপায় নেই? ভাবতে ভাবতে ঘুম ছুটল চোখের, কবিতার লাইন মনে এলো, উঠে বসতেই চোখে পড়লো ছায়া-ছায়া জ্যোৎস্না ফুটেছে বাইরে, আমার জানালা দিয়ে আবছা দেখা যাচ্ছে তারা-কুটির স্বপ্নের মতো। বেশিক্ষণ তাকালাম না, লণ্ঠন জ্বেলে কেরোসিনের গন্ধে আর মশার কামড়ে ব’সে ব’সে কবিতা বানাতে লাগলাম।

রোজ হ’তে লাগল এ-রকম, আমার রাত্রি থেকে ঘুম প্রায় চলে গেলো। আমিও জেগে আছি ওর সঙ্গে-সঙ্গে, আমি ওর প্রহরী, সকল দুঃখ থেকে আমি বাঁচাব ওকে—এ কথা ভাবতে-ভাবতে দেবতা মনে হ’লো নিজেকে, কবিতায় এমন সুন্দর সুন্দর কথা এলো যে নিজেই অবাক হলাম।

এমনি এক রাত্রে—রাত তখন দুটো প্রায়—লিখতে লিখতে হঠাৎ আমার হাত কেঁপে একটা অক্ষর বেঁকে গেলো। শুনলাম বাইরে কে ডাকছে আমাকে, ‘বিকাশ বিকা—শ!’ একটু অপেক্ষা করলাম, আবার শুনলাম চাপা গলার ডাক। আস্তে দরজা খুলে বেরিয়ে এসে দেখি, ওরা দু’জন ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে।

সে রাত্রে তখনও চাঁদ ওঠেনি, সারা রাত্রেও বোধহয় ওঠেনি, অমাবস্যার কাছাকাছি রাত সেটা। আকাশ ছিলো তারায় ঝকঝকে, তারই ধুলোর মতো আলোয় আমরা তিনজন দাঁড়ালাম—শীতের রাত্রি, মাঠের মধ্যে, ঢিপঢিপ বুকে।

‘কী, অসিত? হিতাংশু কী খবর?’

‘আরম্ভ হয়েছে বোধহয়’, কথা বললো হিতাংশু।

‘আরম্ভ হয়েছে?’

‘একতলায় শুনলাম চলাফেরা, কথাবার্তা, আর চাপা একটা গোঙানি। ঘুমের মধ্যেই যেন শুনলাম, তারপর আর বিছানায় থাকতে পারলাম না। অসিতকে ডেকে তুলে তোমার কাছে এলাম। তুমি কি জেগেই ছিলে?’

আমি কথা বললাম না, তারার আলোয় দেখলাম হিতাংশুর মুখ শাদা হ’য়ে গেছে, আর অসিত মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে আছে দূরের দিকে। এ-কদিনে আমরাও যেন বদলে গিয়েছিলাম; হাসি, ঠাট্টা, ঘোরাঘুরি কমে গিয়েছিলো আমাদের, বেশি কথা বলতাম না, আর এতদিন ধ’রে যে-মানুষকে নিয়ে লক্ষ কথা আমরা বলেছি, তার সম্বন্ধে একেবারে নীরব হ’য়ে গিয়েছিলাম। রুদ্ধশ্বাস আমরা, প্রতীক্ষায় রুদ্ধশ্বাস।

আমরা বুঝলাম না যে আমরা কাঁপছি, জানলাম না যে আমরা হাঁটছি, কখন বাগানের ছোট গেট খুলে এসে সিঁড়ির তলায় দাঁড়ালাম। নিশ্চয়ই আমরা কোনো শব্দ করি নি, কোনো কথাও বলি নি, কিন্তু প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই দে-সাহেব টর্চ হাতে বেরিয়ে এলেন, যেন আমাদেরই অপেক্ষা করছিলেন এতক্ষণ। নিচুগলায় বললেন, ‘অসিত, একবার যাও তো সাইকেলটা নিয়ে ডক্টর মুখার্জির কাছে—একেবারে সঙ্গে ক’রে নিয়ে আসবে তাঁকে।’

অন্ধকারে হাওয়ার মতো মিলিয়ে গেলো অসিত। আমি আর হিতাংশু সিঁড়ির উপরেই ব’সে পড়লাম। একটা কান্না, চাপা একটানা, আমাদের পিঠ ফুঁড়ে বুকের মধ্যে ঢুকলো, তার যেন আওয়াজ নেই, শুধু কষ্ট আছে, যেন পৃথিবীর প্রাণে আঘাত দিয়েছে কেউ, পৃথিবীর বুক থেকে এই কান্না উঠছে, তাই কোনোদিন থামবে না।

ওকে চোখে দেখতে পারি না আমরা, দূর থেকেও না; ও-ঘরে যেতে পারি না আমরা, ঘরের কাছেও না। শুধু বাইরে ব’সে থাকতে পারি, শীতে, অন্ধকারে, না-জেগে, না-ঘুমিয়ে, আকাশের সামনে, অদৃষ্টের মুখোমুখি।

ডাক্তারের আনাগোনা শুরু হ’লো, চললো বাকি রাত ভ’রে, চললো তার পরের দিন। ভোর হ’তেই চড়া মাশুলের টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দিলাম হীরেনবাবুকে—মনে মনে ভাবলাম, টেলিগ্রাম যত দ্রুতই ছুটে যাক, তার চেয়েও দ্রুতবেগে ছুটে আসুক হীরেনবাবুর মন, কাল বিকেলের আগে তিনি পৌঁছতে পারবেন না কিছুতেই—কী অসহায় মানুষ, কী নিরুপায়! ডাক্তার, নার্স, ওষুধ, ইনজেকশন, পরিশ্রম, প্রার্থনা;—তবু অসহায়, তবু মানুষ অসহায়—কী হচ্ছে, কী হ’লো, কী হবে, এসব প্রশ্নের উত্তর নেই কারো চোখে, ডাক্তারের মুখ পাথরের মতো, ওর মা-বাবার মুখে সংক্ষিপ্ত ফরমাশ ছাড়া আর-কোনো কথা নেই, মাসিমা আমাদের সঙ্গে চোখাচোখি পর্যন্ত ক’রেন না, আর দে-সাহেবের পরিপাটি চেহারাটির তলায় একজন কোঁকড়ানো বুড়োমানুষ যে লুকিয়ে ছিলো তা কে জানতো! কে জানতো আকাশের নীল নরম ঘোমটার তলায় এই কান্না লুকিয়ে আছে! আর আমাদের কি আর কিছু নেই, আর কিছু করবার নেই, শুধু কান পেতে এই কান্না শোনা ছাড়া?

দুপুরের আগেই বিকেল হ’য়ে গেলো সেদিন, বিকেলের আগেই অন্ধকার। তারপর, রাত যখন একটু ভারি হয়েছে, হঠাৎ যেন পৃথিবীর বুক চিরে চিৎকার উঠলো একটা; উঠলো, পড়লো, আবার উঠলো আকাশের দিকে; আকাশ চুপ, তারাদের নড়চড় হ’লো না; আবার উঠলো চিৎকার, যেন প্রতিমার সামনে ছাগশিশুর আর্তরব, ঘণ্টার পর ঘণ্টা, বিরামহীন। আমরা ছুটে চলে গেলাম বাইরে, মাঠের মধ্যে, কিন্তু যতদূর সে-শব্দ চলে আমাদের, মাতা পৃথিবীর আদিম কান্না এটা, এ থেকে নিস্তার কোথায়?

ফিরে এলাম। ভিতরে আলো, ব্যস্ততার ঢেউয়ের পর ঢেউ, ফাঁকে ফাঁকে ডাক্তারের মোটা গলা, আর বাইরে অফুরন্ত তারা, অসীম অন্ধকার, অপরূপ রাত্রি, কিন্তু পৃথিবীর কান্না তো থামে না।

যে-তারা ছিলো মাথার উপরে নেমে এলো পশ্চিমে, যে-তারা ছিলো চোখের বাইরে উঠে এলো দিগন্তের উপরে, পুবের কালো ফিকে হ’লো, ছোট ছোট অনেক তারা মুছে গিয়ে মস্ত সবুজ একলা একটি তারা জ্বলজ্বল করতে লাগল সেখানে। এই সেই অপার্থিব মুহূর্ত, সেই অলৌকিক লগ্ন, যখন আমি জেগে উঠে বাইরে এসেছিলাম ওর বিয়ের দিন, যখন আমি ওকে পেয়েছিলাম মৃত্যুর হাত থেকে, অন্ধকারের সমুদ্রের মধ্যে একটিমাত্র ভেসে চলা আলো-জ্বলা নৌকায়। অন্তত একমুহূর্তের জন্য সেদিন সে আমার হয়েছিলো, আজ কি আবার এলো সেই মুহূর্ত?

অসিত ফিসফিস ক’রে বললো, ‘কী হ’লো?’

হিতাংশু বললো, ‘কই, না!’

‘সব যেন চুপ?’

‘তাই তো।’

‘যাব একবার ভেতরে?’ অসিত উঠে দাঁড়াল, কিন্তু গেলো না। অনেক, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম আমরা, কিন্তু আর কোনো শব্দ নেই, সব স্তব্ধ, তারপর হঠাৎ দেখি দে-সাহেব আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। ভোরের প্রথম ছাইরঙা আলোয় দেখলাম তাঁর ঠোঁট নড়ে উঠলো, এমন স্থির হ’য়ে আমরা তাকিয়েছিলাম আর এমন স্তব্ধ চারদিক যে তাঁর কথাটা আমরা কানে না-শুনে যেন চোখ দিয়ে দেখলাম :

‘এসো তোমরা, ওকে দেখবে।’

অসিত আর হিতাংশুই সব করলো, রাশি রাশি ফুল নিয়ে এলো কোথা থেকে, আরো কত কিছু বেলা দু’টো পর্যন্ত শুধু সাজাল শুধু সাজাল, তারপর নিয়ে যাবার সময় সকলের আগে রইল ওরা দু’জন। আরো অনেকে এলো কাঁধ দিতে, শুধু আমি বেঁটে ব’লে বাদ পড়লাম, পিছনে পিছনে হেঁটে চললাম একা-একা। ঠিক একা-একাও নয়, কারণ ততক্ষণ হীরেনবাবু এসে পৌঁছেছেন, গাড়ির কাপড়ে জুতো-ছাড়া পায়ে তিনিও চললেন আমার পাশে পাশে।

হীরেনবাবু পরের বছর আবার বিয়ে করলেন, দে-সাহেব চলে গেলেন বদলি হ’য়ে। কিছুদিন পর্যন্ত লোকেরা বলাবলি করলো ওঁদের কথা, তারপর তারা-কুটিরের একতলায় অন্য ভাড়াটে এলো, পুরানা পল্টনে আরও অনেক বাড়ি উঠলো, ইলেকট্রিক আলো জ্বললো। অসিত স্কুল থেকে বেরিয়ে চাকরি নিলো তিনসুকিয়ায়, ছ-মাসের মধ্যে কী একটা অসুখ ক’রে হঠাৎ মরে গেলো। হিতাংশু এম.এস.সি. পাস ক’রে জার্মানিতে গেলো পড়তে আর ফিরল না, সেখানকারই একটা মেয়েকে বিয়ে ক’রে সংসার পাতল, এখন এই যুদ্ধের পরে কেমন আছে, কোথায় আছে কে জানে। আর আমি—আমি এখনো আছি, ঢাকায় নয়, পুরানা পল্টনে নয়, উনিশ-শো সাতাশে কি আটাশে নয়, সে-সব আজ মনে হয় স্বপ্নের মতো, কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু স্বপ্ন, ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে একটু হাওয়া—সেই মেঘে-ঢাকা সকাল, মেঘ-ডাকা দুপুর, সেই বৃষ্টি, সেই রাত্রি, সেই—তুমি! মোনালিসা, আমি ছাড়া আর কে তোমাকে মনে রেখেছে!