Wednesday, January 2, 2019

সহজ ভাষায় বস্তুর মাত্রাসমূহ


নিচে যে ব্যাপারগুলো বর্ণিত হবে সেগুলো বোঝার জন্য কোনো বিষয়ে কোনো জ্ঞান না থাকলেও চলবে। শুধু দুটো জিনিস থাকতে হবে – কল্পনা এবং গ্রহণ করার ক্ষমতা। আগে কল্পনা বা ইমাজিনেশনের ছবি এঁকে পরে সেটাকে লজিক দিয়ে ফিল্টার করতে হবে। আগেই লজিকের ফ্রেমে আটকে দিলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে না। এ বিষয়ে আইনস্টাইনের একটা বিখ্যাত উক্তি দেয়া যায় – “The true sign of intelligence is not knowledge but imagination”।

ডাইমেনশনের ব্যাপারটা আমাদের কাছে সবসময়ই একটু অস্পষ্ট। আমরা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না কোন ডাইমেনশনে কী হয়। এখানে সহজ ভাষায় সেটা বোঝানোর চেষ্টা করবো।

1

শুধুমাত্র একটা ডট, যার কোনো দৈর্ঘ্য নেই, প্রস্থ নেই।

2

সেই অসংখ্য ডট পাশাপাশি রেখে একটি লাইন নেয়া হলে সেটিই আমাদের ফার্স্ট ডাইমেনশন। অর্থাৎ একটা একক, আলাদা লাইন হবে ফার্স্ট ডাইমেনশন।

3

এখন যদি একাধিক লাইনকে পাশাপাশি রেখে একটা স্ট্রাকচার নেয়া হয়, তাহলে সেটা হবে তল (plane)। মানুষের চোখ এই ‘তল’ই দেখতে পারে এবং তলের উপর দিয়ে ট্রাভেল করে।

4

যদি একাধিক তলকে একটার ওপর একটা রেখে কোনো স্ট্রাকচার বানানো হয়, আমরা পাবো স্পেস। এটা হলো থার্ড ডাইমেনশন। উল্লেখ্য যে মানুষ অবস্থান করে এই থার্ড ডাইমেনশনে। কিন্তু থার্ড ডাইমেনশনে অবস্থান করলেও আমাদের চোখ দেখতে পারে শুধু মাত্র সেকেন্ড ডাইমেনশনের স্ট্রাকচার। থার্ড ডাইমেনশনের মধ্য দিয়ে দেখা সম্ভব হলে মানুষ দেয়ালের মধ্য দিয়ে দেখতে পেতো এবং দেয়াল ভেদ করে চলে যেতে পারতো।

[ফ্যাক্টসঃ কেউ যদি N-th ডাইমেনশনে থাকে, তার সব কার্যকলাপের পরিধি থাকবে (N-1)th ডাইমেনশনে। কিন্তু তার কার্যকলাপের প্রভাব পড়বে N-th ডাইমেনশনেই। যেমন, আমরা থাকি থার্ড ডাইমেনশনে কিন্তু দেখি সেকেন্ড ডাইমেনশন। আবার তলের উপর দিয়ে গমন করি। কিন্তু আমরা চাইলেও বস্তুর মধ্যে দিয়ে গমন করতে পারবো না]

ফোর্থ ডাইমেনশনের ফ্যাক্টস ভালো করে পড়ার জন্য অনুরোধ করা হলো।

5

ফোর্থ ডাইমেনশনের ক্ষেত্রে নতুন করে স্ট্রাকচার যোগ করলে ব্যাপারটার কোনো মানে থাকে না। সেক্ষেত্রে স্ট্রাকচারের বদলে যোগ করা হবে সময় (মহাবিশ্বের অতি ক্ষুদ্র কোন মুহুর্ত)। অর্থাৎ যে ফোর্থ ডাইমেনশনের মধ্যে অবস্থান করবে, সে যেকোনো বস্তুর ভেতর দিয়ে চলাচল করতে পারবে এবং যেকোনো বস্তুর মধ্য দিয়ে দেখতে পারবে। ফোর্থ ডাইমেনশন হলো মহাবিশ্বের এই মুহূর্তের বর্তমান অবস্থা। সোজা কথায় “বর্তমান” বা “present state” হল ফোর্থ ডাইমেনশন। কারণ, আমাদের অনুভূত মহাবিশ্ব স্পেস এন্ড টাইমের এক সম্মিলিত অবস্থা। তাই আমাদের ইউনিভার্স ফোর্থ ডাইমেনশনাল। এখানে ফোর্থ ডাইমেনশন দেখার প্রশ্নটা আমাদের জন্য অপ্রাসঙ্গিক। কেউ যদি কখনো সবুজ রঙ দেখে না থাকে তাহলে সে কিভাবে আইডিয়া করবে যে সবুজ রঙ কেমন? তারপরো যদি কেউ প্রশ্ন করে, “ফোর্থ ডাইমেনশনে কী দেখা যায়?”, সেক্ষেত্রে বেসিক আইডিয়া হলো, অসংখ্য তল পাশাপাশি ও ওপর-নীচে যোগ করার পরও ফোর্থ ডাইমেনশনে সবগুলো object এর ভিতরের গঠনও আমরা দেখতে পাবো।

[ফ্যাক্টসঃ যে যেই ডাইমেনশনে অবস্থান করে সে তার চেয়ে এক ডাইমেনশন নীচে চলাচল করতে পারবে এবং দেখতে পারবে। সেক্ষেত্রে যে ফোর্থ ডাইমেনশনে থাকবে সে সরাসরি বস্তুর মধ্য দিয়ে চলতে পারবে অর্থাৎ সে হবে স্থান জয়ী। যেকোন স্থানে যেকোন মুহুর্তে সে যেতে পারবে। সুতরাং ইন্টারস্টেলার তো বটেই, ইন্টারগ্যালাক্টিক ট্রাভেল এর জন্যও আপাতভাবে ফোর্থ ডাইমেনশনের বিকল্প নেই। কারণ স্পেসের উপর জয় না করে আলোর গতিতেও এই ট্রাভেলগুলোতে এক মানব জীবন অতিবাহিত হয়ে যাবে]

6

এখন আসি ফিফথ ডাইমেনশনে। এই ব্যাপারটা আসলে মানুষের সীমা বা সেন্সের বাইরে। এই ডাইমেনশন হলো ফোর্থ ডাইমেনশন এবং এই মহাবিশ্বের যত সময় – তার সমন্বিত অবস্থা। এটা সবচেয়ে ট্রিকি। কারণ, এটাই একমাত্র অবস্থা, যেখান থেকে কেউ যেকোনো টাইমলাইনে ভ্রমণ করতে পারবে। অর্থাৎ বর্তমান থেকে অতীত কিংবা ভবিষ্যতে ভ্রমণ বা টাইম ট্রাভেল একমাত্র ফিফথ ডাইমেনশনেই সম্ভব। এখানে সময়ের মধ্য দিয়েই দেখা সম্ভব। কারণ ফোর্থ ডাইমেনশন হল সময় আর ফিফথ ডাইমেনশন হল মহাবিশ্বের সকল সময়, সব ইতিহাস, এখনো পর্যন্ত যত সময় হয়েছে বা হবে তার সমষ্টি। অর্থাৎ অসংখ্য ফোর্থ ডাইমেনশন।

যেহেতু ফিফথ ডাইমেনশনে থাকলেও সব কার্যকলাপের পরিধি থাকবে ফোর্থ ডাইমেনশনে, আবার যেহেতু ফোর্থ ডাইমেনশন হল সময়, তাই ফিফথ ডাইমেনশনে থাকাকালীন ফোর্থ ডাইমেনশন বা সময়ের উপর অবাধ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। এখান থেকে যেকোনো outcome সম্ভব। প্যারালাল ইউনিভার্স অর্থাৎ এক একটা সম্ভাবনার জন্য এক একটা এক্সিস্টেন্স এই ডাইমেনশনে থেকেই প্রত্যক্ষ করা সম্ভব। অর্থাৎ কী হতো যদি ছোটোবেলায় এই স্কুলে না গিয়ে ঐ স্কুলে যেতেন, অমুক তারিখে এই জিনিসটা না খেয়ে ঐ জিনিসটা খেতেন, যদি আপনার ভাইটা মারা না যেতো – ইত্যাদি দেখা সম্ভব। তার মানে অসীম সম্ভাবনার জগত (Parallel universe of infinite possibilities)। আমরাও এই প্যারালাল ইউনিভার্সের একটা পার্ট।

সিক্সথ ডাইমেনশন ব্যাপারটি আরো জটিল এবং বিস্তৃত। এখান থেকে যেকোনো সম্ভাব্য ইউনিভার্সে গমন সম্ভব। আমদের দৃশ্যমান ইউনিভার্স মাত্র ১৩.৮ বিলিয়ন বছরের পুরনো। তার মানে এই নয় যে, ১৩.৮ বিলিয়ন বছরের ওপারে কিছু ছিলো না। আমাদের এই ইউনিভার্স বাদেও আর যত সম্ভাব্য জগত আছে, এই ডাইমেনশনে থেকে সেগুলোতেও গমন সম্ভব। অন্য ইউনিভার্সের কথা অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটা বেশ যৌক্তিক। এটার নাম মাল্টিভার্স (ইন্টারনেট/বই ঘেঁটে আরেকটু স্পষ্ট হতে পারেন)। অর্থাৎ ইউনিভার্সের ভেতরে ও বাইরে আরো অনেক ইউনিভার্স। সিক্সথ ডাইমেনশনে থেকে এই মাল্টিভার্স ট্রাভেল সম্ভব। শুধু মাল্টিভার্স না, পাওয়া যাবে প্রত্যেক মহাবিশ্বের সকল ফিজিকাল বস্তু ও বস্তুর ধারণা, সব লজিক এবং ফিজিক্সের সূত্রের কনসেপ্ট ও তার অল্টারেশন এবং চূড়ান্তভাবে পুরো সৃষ্টির অস্তিত্বের ধারণা। এখান থেকে দেখলে সমগ্র সৃষ্টির কনসেপ্ট পাওয়া যাবে। এখান থেকে সৃষ্টি থাকা আর না থাকার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

 

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/dimension_of_matter/

Tuesday, January 1, 2019

ফ্রানৎস কাফকা.র গল্প এক গ্রাম্য ডাক্তার


ভাষান্তর: মাসরুর আরেফিন

বিরাট দ্বিধার মধ্যে আছি আমি; জরুরি একটা ডাকে বেরুতে হবে আমাকে; খুবই অসুস্থ এক রোগী আমার জন্য অপেক্ষা করছে দশ মাইল দূরের এক গ্রামে; তার আর আমার মধ্যের বিশাল পথ ভরে আছে ঘন ঝড়ো তুষারে; চার চাকার একটা ঘোড়াগাড়ি আছে আমার, বড় চাকাওয়ালা হালকা একটা গাড়ি, আমাদের গাঁয়ের রাস্তার জন্য একদম ঠিক জিনিস; আমার পশুর লোমে বানানো কোটটাতে শরীর মুড়িয়ে নিয়ে, ডাক্তারির জিনিসপত্তরের ব্যাগ হাতে ধরে, রওনা দেবার জন্য পুরো তৈরি হয়ে আমি উঠোনে দাঁড়ালাম; কিন্তু ঘোড়াটা কোথাও নেই, ঘোড়াটা।
আমার নিজের ঘোড়াটা কাল রাতে এই বরফ-ঢাকা শীতকালের বেশি খাটাখাটনিতে ক্লান্ত হয়ে মারা গেছে; এখন রোজ নামে আমার কাজের মেয়েটা গ্রাম জুড়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে একটা ঘোড়া ধার করবে বলে; কিন্তু আমি জানি, ওতে কোনো কাজ হবে না; নিরর্থক আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি এখানে, তুষারে ঢাকা পড়ছি আরও আরও বেশি করে, আর ততই বেশি নড়বার ক্ষমতা হারিয়ে বসছি। রোজকে দেখা গেল গেটে দাঁড়িয়ে আছে, একা, হাতের লণ্ঠন দোলাচ্ছে; ঠিকই তো, কে এই এত রাতে এরকম একটা সফরের জন্য তার ঘোড়া ধার দেবে? আবার একবার উঠানে পায়চারি করলাম আমি; কোনো বুদ্ধি মাথায় এলো না; না বুঝেই, এ রকম এক হতাশ অবস্থায় হাবুডুবু খেয়ে, একটা লাথি মেরে বসলাম শুয়োরের খোঁয়াড়টার পচে যাওয়া দরজায়, খোঁয়াড়টা ব্যবহার করা হয়নি অনেক বছর। দরজা খুলে গেল, কবজার ওপর দাঁড়িয়ে বাড়ি খেতে লাগলো এদিক-ওদিক। ভেতর থেকে একটা ভাপ বেরোলো, আর ঘোড়ার মতো একটা গন্ধ। ভেতরে একটা দড়িতে ঝুলছে টিমটিমে আস্তাবলের লণ্ঠন। একজন মানুষ পাছায় ভর দিয়ে গুটিসুটি বসে আছে ওই নিচু ছাউনির খোঁয়াড়টার মধ্যে, সে তার নীল চোখের অমায়িক মুখটা তুলে তাকালো। ‘আমি কি ঘোড়াগুলো জুড়বো গাড়িতে?’ চার হাত-পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে জিজ্ঞাসা করল সে। কী বলবো তা বুঝে পেলাম না, কেবল মাথা নোয়ালাম ওই খোঁয়াড়ে আর কী আছে তা দেখার জন্য। কাজের মেয়ে আমার পাশে দাঁড়ানো, সে বললো, ‘নিজের ঘরের মধ্যে কী লুকানো থাকে তা নিজেরাই জানি না’, আর হেসে ফেললাম আমরা দু’জনে।

‘ও ভাই গো, ও বোন গো!’ ডাক দিলো সহিস আর দুটো ঘোড়া, পুরু-মোটা পাছার দুই প্রকাণ্ড জীব, একটার পেছনে অন্যটা, স্রেফ ওদের মোচড়ানো শরীরের শক্তি দিয়েই ঘুরে বেরিয়ে এলো সামনের দিকে, ওদের পাগুলো শরীরের ভাঁজে টানটান হয়ে আছে, সুঠাম মাথা দুটো নুয়ে আছে উটের মতো, দরজার ফুটোটা গলে [ওটা ভরে গেছে তাদের শরীরের আয়তনে] বেরিয়ে এলো ওরা। পরমুহূর্তে লম্বা পায়ের উপরে উঁচু হয়ে উঠে দাঁড়ালো, ওদের লোম থেকে বেরুচ্ছে একটা ঘন বাষ্পের মেঘ। ‘ওকে একটু সাহায্য করো’, আমি বললাম, কাজের মেয়েটা নিজের থেকেই জলদি এগিয়ে এলো সহিসকে ঘোড়া জুতবার জিনিসগুলো দিতে। কিন্তু মেয়েটা ঠিকমতো তার কাছে যেতেও পারেনি, সহিস তাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো, নিজের মুখ চেপে ধরলো মেয়েটার মুখে। মেয়েটা চিৎকার করে ছুটে এলো আমার কাছে; তার গালে দুই সারি দাঁতের লাল চিহ্ন পড়ে গেছে। ‘অই জানোয়ার’, আমি রাগে চিৎকার দিলাম, ‘চাবকানো লাগবে নাকি তোকে?’ কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়লো, এ একটা অচেনা লোক; আমি জানিও না কোত্থেকে সে এসেছে, আর সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় সে এগিয়ে এসেছে আমাকে সাহায্য করতে, যখন কিনা বাকি সবাই আমাকে হতাশই করেছে শুধু। যেন সে জানে যে, আমি কী ভাবছি, তাই আমার ধমকে সে মনোক্ষুণ্ন হলো না, কেবল ঘোড়াগুলো নিয়ে ব্যস্ত অবস্থায়— একবার ঘুরে দেখলো আমাকে। ‘উঠুন’, বললো সে, আর আসলেই সবকিছু তৈরি। আমি খেয়াল করলাম, এর আগে কোনোদিন এত সুন্দর ঘোড়ার গাড়িতে উঠিনি, তাই খুশি মনে চড়ে বসলাম। ‘গাড়ি আমি চালাবো, তুমি পথ চেনো না’, বললাম আমি। ‘অবশ্যই’, সে বললো, ‘আমি তো আর আপনার সঙ্গে আসছি না, আমি রোজের সঙ্গে থাকছি।’ ‘না’, তীক্ষষ্ট চিৎকার দিলো রোজ, আর নিজের অবধারিত নিয়তিকে ঠিক অনুমান করতে পেরেই দৌড়ে পালালো ঘরের মধ্যে; আমার কানে এলো দরজায় সে শিকল বাঁধছে ঝনঝন শব্দ করে; শুনলাম তালা লাগানোর শব্দও; এমনকি আমি দেখতে পাচ্ছি কীভাবে সে নিভিয়ে দিচ্ছে বসার ঘরের বাতি, তারপর সবগুলো ঘরে দৌড়ে দৌড়ে ওগুলো অন্ধকার করে দিচ্ছে, যেন তাকে খুঁজে বের করা না যায়। ‘তুমি আমার সঙ্গে আসছো, সহিসকে বললাম আমি, তা না হলে যত জরুরিই হোক না কেন, আমি যাওয়া বাতিল করছি। তোমার ঘোড়ায় চড়ার দাম হিসেবে আমি তো মেয়েটাকে তোমার হাতে তুলে দিতে পারি না।’ ‘হেঁট, হেঁট’! চিৎকার করলো সে; হাত দিয়ে তালি বাজালো; ঘোড়ার গাড়িটা ঘূর্ণি খেয়ে উড়ে গেল স্রোতের মধ্যে কোনো কাঠের টুকরার মতো; আমি কেবল ওটুকুই শুনতে পেলাম যে, সহিসের ধাক্কার মুখে আমার বাড়ির দরজা দড়াম করে খুলে ভেঙে পড়েছে, এরপর একটা প্রবল ঝড়ো হাওয়ায় আমার চোখ, কান আর বাকি সব ইন্দ্রিয় অসাড় হয়ে এলো। কিন্তু সেটাও কেবল এক মুহূর্তের জন্য, কারণ মনে হলো আমার নিজের বাসার গেট যেন সোজা খুলে গেছে সেই রোগীর বাসার উঠানে, আমি হাজির; ঘোড়াগুলো দাঁড়িয়ে আছে শান্ত হয়ে; বরফ পড়া থেমেছে, চারপাশে চাঁদের আলো; আমার রোগীর বাবা-মা ছুটে এলেন বাড়ির ভেতর থেকে; রোগীর বোন ওদের পেছনে; গাড়ি থেকে আমাকে বলতে গেলে কোলে তুলে নেওয়া হলো; এদের হিজিবিজি কথাবার্তার কিছুই ধরতে পারছি না আমি; রোগীর বদ্ধ ঘরের হাওয়ায় প্রায় দম বন্ধ হয়ে আসবে এমন অবস্থা; ফেলে রাখা স্টোভটা থেকে ধোঁয়া উঠছে; আমাকে ধাক্কা দিয়ে জানালা খুলতে হলো; কিন্তু সবার আগে আমি চাচ্ছি রোগীকে দেখতে। দুবলা-পাতলা, গায়ে কোনো জ্বর নেই, গা না ঠাণ্ডা না গরম, চোখে শূন্য দৃষ্টি, গা খালি, কিশোর বয়সী ছেলেটা বিছানার চাদর থেকে শরীর তুললো, আমার গলা জড়িয়ে ধরলো আর কানে ফিসফিস করে বললো : ‘ডাক্তার, আমাকে মরতে দিন।’ আমি তাকালাম চারপাশে; কেউ শোনেনি; ছেলের বাবা-মা কোনো শব্দ না করে সামনে ঝুঁকে আছেন আর আমার রায়ের অপেক্ষা করছেন; ওর বোন আমার ব্যাগ রাখার জন্য একটা চেয়ার নিয়ে এসেছে। আমি ব্যাগ খুলে ডাক্তারির জিনিসপত্তরের মধ্যে ঘাঁটতে লাগলাম; ছেলেটা বারবার তার অনুরোধ মনে করিয়ে দেবার জন্য বিছানা থেকে আমার কাছে আসতে চেষ্টা করছে; ছোট সাঁড়াশিটা হাতে তুললাম আমি, মোমের আলোয় ওটা পরখ করলাম, তারপর আবার রেখে দিলাম ব্যাগের মধ্যে। ‘হ্যাঁ’, অধার্মিকের মতো ভাবলাম আমি, ‘এ রকম অবস্থায় পেঁৗছানোর পরে খোদা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। হারানো ঘোড়া ফেরত পাঠান, তাড়া বুঝতে পেরে আরও একটা ঘোড়া যোগ করে দেন, আর ষোলআনা পূরণ করতেই একটা সহিসও পাঠান—’ এ পর্যন্ত এসে হঠাৎ আমার মনে গেল রোজ মেয়েটার কথা; আমার করার আছেইবা কী, কী করে আমি বাঁচাবো ওকে, কী করে ওকে ওই সহিসের নিচ থেকে টেনে বের করবো, ওর থেকে এই দশ মাইল দূরে, আর আমার গাড়িতে-জোড়া বেপরোয়া ঘোড়াগুলো নিয়ে? এই ঘোড়াগুলো, ওদের লাগাম যেন ওরা কী করে খুলে ফেলেছে; বাইরে থেকে গুঁতো দিয়ে কী করে যেন জানালাও খুলেছে, কী করে আমি জানি না; ওরা দুটো দুই আলাদা জানালা দিয়ে ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছে, আর এ বাসার লোকজনের চিৎকারে কোনো ভ্রূক্ষেপ না করে গভীর মন দিয়ে দেখছে রোগীকে। ‘খুব শিগগিরই রওনা হয়ে বাড়ি ফিরছি আমি, মনে মনে বললাম’, যেন বা ঘোড়াগুলো আমাকে যাত্রা শুরু করার জন্য ডাকছে, তারপরও বাধা দিলাম না যখন রোগীর বোন [সে ভাবছে আমার খুব গরম লাগছে] আমার কোট খুলে দিতে লাগলো। আমার সামনে রাখা হলো এক গ্গ্নাস রাম, বুড়ো লোকটা আমার কাঁধে চাপড় দিলেন, তার এ মহামূল্যবান সম্পদ আমাকে খেতে দিয়ে তিনি আমার আপন হবার অধিকার পেয়ে গেছেন। আমি মাথা ঝাঁকালাম; বুড়ো মানুষটার চিন্তার সংকীর্ণতা দেখে আমার নিজেকে অসুস্থ লাগছে; স্রেফ এ কারণেই আমি ফিরিয়ে দিলাম তার রামের গ্লাস।

ছেলের মা বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে ডাকছে ওখানে; আমি তাই করলাম, আর যখন একটা ঘোড়া জোরে চিঁ-হি-হি করে ছাদের দিকে মাথা তুলে ডেকে উঠলো, আমি ছেলেটার বুকে মাথা রাখলাম, আমার ভেজা দাড়ির ছোঁয়ায় কাঁপতে লাগলো সে। যা আমি এরই মধ্যে আন্দাজ করে ফেলেছি, তাই নিশ্চিত হলো : এ ছেলের কিছুই হয়নি, তার মা দুশ্চিন্তার তোড়ে তাকে এত বেশি কফি খাইয়েছেন যে, তার রক্ত চলাচল খানিক ক্ষীণ হয়ে গেছে; কিন্তু ওটুকুই, তার স্বাস্থ্য একদম ভালো, আরও ভালো হয় এখুনি ওকে লাথি মেরে বিছানা থেকে উঠিয়ে দিলে। কিন্তু পুরো দুনিয়া ঠিক করার দায়িত্ব আমি নিয়ে আসিনি, তাই তাকে শুয়ে থাকতেই দিলাম। আমি চাকরি করি জেলা প্রশাসনের আওতায়, আমার কাজ আমি করি একটা মানুষের পক্ষে যতটা করা সম্ভব তার চেয়েও বেশি নিবেদিত প্রাণে। যদিও মাইনে পাই খুব সামান্য, তারপরও মানুষের জন্য আমার দয়ামায়ার কমতি নেই, গরিব মানুষের জন্য সব সময় খাটতে রাজি। রোজ-এর দেখভালের বিষয়টাই আমাকে যা ভাবায়; তারপর এই ছেলে শুধু না, আমি নিজে মরে গেলেও আমার আর দুঃখ থাকবে না। এই বিরামহীন শীতকালে আমি করছিইটা কী এখানে! আমার নিজের ঘোড়া হাওয়া হয়ে গেছে, আর গ্রামে একটা লোকও নেই যে তারটা আমাকে ধার দেবে। শুয়োরের খোঁয়াড় থেকে আমাকে একজোড়া বার করতে হলো; ওরা যদি ঘোড়া না হতো, তাহলে আমাকে মাদী শুয়োরের পিঠে চেপে আসতে হতো এখানে। ব্যাপারটা এমনই। আমি মাথা নাড়লাম পরিবারের লোকজনের উদ্দেশে। এরা এসবের কিছুই জানে না, আর যদি জানতোও, তবু বিশ্বাস করতো না। প্রেসক্রিপশন লেখা সোজা, কিন্তু গাঁয়ের লোকের সঙ্গে মানিয়ে চলা অনেক কঠিন। হুঁ, আমার আজকের ভিজিট তাহলে মনে হচ্ছে এখানেই শেষ; আরও একবার আমাকে জ্বালানো হলো বিনা কারণে; আমার অভ্যাস হয়ে গেছে এসবে, আমার বাড়ির কলিংবেল বাজিয়ে বাজিয়ে পুরো জেলার লোকজন আমাকে উত্ত্যক্ত করে; কিন্তু তাই বলে এবার যা হলো, রোজকে ফেলে রেখে আসতে হলো, আহারে ফর্সা বাচ্চা মেয়েটা কত বছর ধরে আমার বাড়িতে, কখনোই বলতে গেলে ওর খেয়াল নেওয়াই হয়নি আমার — এই কোরবানি অনেক বেশি হয়ে গেছে, যে কোনোভাবে হোক এখন আমাকে এটা মাথার মধ্যে হালকা করে আনতে হবে, না হলে আমার সব রাগ গিয়ে পড়বে এই পরিবারটার ওপর, হায়রে ওরা সারা দুনিয়ার সদিচ্ছা নিয়েও তো আর রোজকে আমার কাছে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে দিতে পারবে না। কিন্তু তারপরও, আমি যখন আমার ব্যাগ বন্ধ করছি, কোটটা আমাকে দিতে ইশারা করছি, যখন পুরো পরিবার একসঙ্গে ওখানে দাঁড়িয়ে, ছেলের বাবা রামের গ্গ্নাস নাকে নিয়ে শুঁকছেন, ছেলের মা খুব সম্ভব আমার ব্যাপারে হতাশ হয়ে — আচ্ছা, মানুষ আশা করেটা কী? — চোখ ছলছল করে তার ঠোঁট কামড়াচ্ছেন, আর যখন ছেলের বোন একটা রক্তে ভেজা রুমাল হাতে তুলে নাড়াচ্ছে, এই পরিস্থিতিতে তখন শেষমেশ আমি মোটামুটি মানতে রাজি হলাম যে, ছেলেটা হয়তো আসলেই অসুস্থ। আমি ওর কাছে গেলাম, সে আমার উদ্দেশে হালকা একটু হাসলো যেন আমি ওর জন্য সবচাইতে পুষ্টিকর কোনো স্যুপ নিয়ে এসেছি — আহ্, এখন দুটো ঘোড়াই ডাক ছাড়ছে; কোনো সন্দেহ নেই ওকে আমার পরীক্ষা করে দেখার কাজ সহজ করার জন্যই আসমান থেকে আদেশ এসেছে এই ডাক দেবার — আর এবার আমি দেখলাম : হ্যাঁ, ছেলেটা অসুস্থ। তার ডান পাশে, পাছা ও কোমরের দিকে, আমার হাতের তালুর মতো বড় আকারের একটা ক্ষত খুলে বেরিয়ে আছে। গোলাপের মতো লাল আভা নিয়ে, গভীর অংশে কালো আর কিনারের দিকে রঙটা হালকা হয়ে — সূক্ষ্ম দানা দানা মতো, বিভিন্ন জায়গা থেকে রক্ত চুইয়ে বেরুচ্ছে — ক্ষতটা হাঁ করে আছে মাটিতে পোঁতা বোমার মতো। দূর থেকে দেখতে এমনই লাগছে। কাছ থেকে দেখলে বিষয়টা আরও জটিল। কার সাধ্য তা দেখবে মুখে হালকা শিস না বাজিয়ে? অনেক পোকা, আমার কড়ে আঙুলের মতো মোটা আর লম্বা, এগুলোরও রক্ত-গোলাপ রঙ আর তার সঙ্গে রক্তের ছোপে ভরা, আঁকড়ে আছে ক্ষতের গভীরে, ওদের সাদা সাদা মাথা আর অসংখ্য ছোট পা নিয়ে কিলবিল করে মুচড়িয়ে উঠে আসতে চাইছে আলোর দিকে। হতভাগা কিশোর, তোমাকে সারিয়ে তোলার আর কারও সাধ্য নেই। তোমার বিশাল ক্ষতটা আমি খুঁজে পেয়েছি, তোমার শরীরের পাশের এই ফুল তোমাকে খতম করে দিচ্ছে। পরিবারটা এখন খুশি, তারা দেখছে আমি মন দিয়ে কাজ করছি; বোনটা বলছে মা-কে, মা বলছেন বাবাকে, আর বাবা বলছেন দেখতে আসা কিছু লোককে, যারা পা টিপে টিপে খোলা দরজার চাঁদের আলোর মধ্য দিয়ে, তাদের দুই হাত দু’পাশে ভারসাম্য রাখার জন্য বাড়িয়ে, এই ঘরে ঢুকেছে। ‘আপনি বাঁচাবেন আমাকে?’ ফোঁপানি দিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো ছেলেটা, তার এই জীবন্ত ক্ষত তাকে একদম হতবিহ্বল করে দিয়েছে।

এই হচ্ছে আমার জেলার লোকজন। সব সময় ডাক্তার সাহেবকে অসম্ভব সব আবদার জানানো তাদের স্বভাব। তাদের আগের সেই ধর্মবিশ্বাস আর নেই; পুরোহিত মশাই ঘরে বসে আছেন, তার বেদিতে পরার কাপড়গুলো এক এক করে ছিঁড়ে-কেটে ফেলছেন; কিন্তু ওদিকে ডাক্তারের কাছ থেকে মানুষের আশা যে তিনি তার শল্য চিকিৎসকের নাজুক হাত দিয়ে অলৌকিক জিনিস ঘটিয়ে দেবেন। তাহলে তাই হোক : আমি তো আর স্বেচ্ছায় রাজি হইনি, তোমরা যদি আমাকে পুজো-অর্চনার কাজেও ভুলভাবে লাগিয়ে দাও, আমি তাতেও বাধা দেবো না কোনো; এর চেয়ে ভালো আর কীইবা আমি আশা করবো, আমি, বুড়ো এক গ্রাম্য ডাক্তার, যার কাছ থেকে কাজের মেয়েটাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে!

তারপর এগিয়ে এলো তারা, পুরো পরিবার এবং গ্রামের সব প্রবীণ লোকজন, তারা সবাই মিলে আমাকে ন্যাংটো করলো; স্কুলে-পড়া-বাচ্চাদের একটা ধর্মগীতি গাইয়ের দল, দলের নেতৃত্বে তাদের শিক্ষক, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে খুব সাদামাটা সুরে গাওয়া শুরু করলো :

কাপড় খোলো ওর, তবেই তিনি অসুখ সারাবেন

যদি না সারান তো মেরে ফেলো তাকে!

এক ডাক্তারই তো সে, স্রেফ ডাক্তারই তো শুধু।

ওখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি, উলঙ্গ, মাথা নিচু করে আর দাড়িতে আঙুল বুলিয়ে শান্তভাবে দেখছি উপস্থিত সবাইকে। পুরো শান্ত-স্থির আমি, এদের সবার চাইতে উঁচুতে আমার মর্যাদা, আর আমি সেটাই থাকবো, যদিও তাতে আমার কোনো লাভ হচ্ছে না কারণ তারা এবার আমার মাথা ও পা দুটো ধরে তুলে ফেলেছে উপরে আর নিয়ে গেছে বিছানায়। এরা আমাকে শুইয়েছে দেয়ালের পাশে, ক্ষতের দিকটাতে। তারপর সবাই এরা চলে গেল ঘর ছেড়ে; দরজা বন্ধ করা হলো; গান থামলো; মেঘ ঢেকে দিল চাঁদকে; আমার চারপাশে পড়ে আছে গরম কাঁথা-কম্বল; খোলা জানালাগুলোয় ঘোড়ার মাথা দুটো সামনে-পেছনে দুলছে ছায়ার মতো। ‘আপনি জানেন কি’, শুনলাম একটা গলা আমার কানের মধ্যে বলছে, ‘আপনার ওপরে আমার তেমন কোনো বিশ্বাস নেই। অন্যদের মতোই আপনাকেও যেন কোত্থেকে ভাসিয়ে আনা হয়েছে, এমনও না যে, নিজের পায়ে ভর দিয়ে আপনি নিজেই এসেছেন। উপকার করার বদলে আপনি বেশ আমার মরবার বিছানায় আমার নিজের জায়গাটুকুও দখল করে নিয়েছেন। খুব চাচ্ছি যে, আপনার চোখ দুটো খুঁচে তুলে ফেলি।’ ‘তুমি ঠিকই বলেছ, কী লজ্জা! কিন্তু কী আর করার, আমি তো ডাক্তার। কী করার আছে আমার? বিশ্বাস করো, আমার জন্যও ব্যাপারটা সহজ না।’

‘আপনার এই অজুহাতে আমি সন্তুষ্ট থাকবো চাইছেন? ওহ, মনে হয় তা-ই থাকতে হবে। সব সময় আমাকে সন্তুষ্ট থাকতে হবে। এই দুনিয়াতে আমি এসেছি সুন্দর একটা ঘা নিয়ে; আমার সৌন্দর্য বলতে স্রেফ ওটুকুই।’ ‘বাচ্চা ছেলে বন্ধু আমার’, আমি তাকে বলি, ‘তোমার সমস্যা হচ্ছে : তোমার দেখার চোখ খুব সংকীর্ণ। আশপাশে যত রোগীর ঘর আছে, সব দেখা হয়ে গেছে আমার, তোমাকে শুধু এটাই বলতে পারি : তোমার ঘায়ের অবস্থা অন্যদের মতো অতো খারাপ না। কুড়ালের দুটো নিখুঁত বাঁকা আঘাতে এর জন্ম। অনেক লোক আছে যারা তাদের শরীরের পাশটা সামনে বাড়িয়ে দেয়, তারপরও বনে কুড়ালের আওয়াজ তাদের প্রায় কানেই আসে না, আর ওটা যে ওদের কাছে এগিয়ে আসছে তা বোঝার কথা তো বাদই দাও।’ ‘আসলেই তাই? নাকি আপনি আমার জ্বরের সুযোগ নিয়ে আমাকে যা খুশি মিথ্যা বলছেন?’ ‘সত্যিই তাই, একজন সরকারি ডাক্তার হিসেবে জবান দিচ্ছি তোমাকে।’ সে কথাটা বিশ্বাস করলো, স্থির হলো। কিন্তু এবার আমি নিজে এখান থেকে কী করে বেরুবো, তা ভাববার পালা। ঘোড়াগুলো এখন বিশ্বস্ত দাঁড়িয়ে আছে ওদের জায়গায়। কাপড়চোপড়, কোট আর ব্যাগ জড়ো করলাম তাড়াতাড়ি; ঠিকমতো সেজেগুজে বের হবার জন্য নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে নেই; ঘোড়া দুটো যে গতিতে এসেছে যদি সেই একই গতিতে ফেরত যায়, তাহলে তো এটা স্রেফ আমার এই বিছানা থেকে নিজের বিছানায় লাফ দেবার ব্যাপার। একটা ঘোড়া বাধ্যগত সেবকের মতো জানালা থেকে সরলো; আমি আমার সব জিনিসের পুঁটলিটা ছুঁড়ে মারলাম ঘোড়ার গাড়িতে; কোটটা উড়ে যাচ্ছিল একটু বেশিই দূরে, এটার একটা হাতা কোনোমতে একটা হুকে গিয়ে আটকে গেল। তাতেই চলবে। আমি লাফ দিয়ে উঠলাম ঘোড়ার পিঠে। লাগামগুলো ঢিলে হয়ে হেঁচড়ে চলেছে পেছন পেছন, দুই ঘোড়া বলতে গেলে একসঙ্গে জোড়াই নেই, গাড়িটা পেছনে কোথায় কোনোমতে সঙ্গে চলেছে, শেষমেশ কোটটা আসছে মাটিতে তুষারে ঘষটে। ‘এবার চলো বিদ্যুতের বেগে!’ আমি চিৎকার দিয়ে উঠলাম, কিন্তু কোনো কাজ হলো না তাতে; বুড়ো মানুষদের মতো ধীরে আমরা হামা দিয়ে চলেছি তুষারের তেপান্তরে; অনেকক্ষণ ধরে আমরা পেছন দিকে শুনতে পেলাম বাচ্চাদের নতুন কিন্তু ভুল এক গান :

ও রোগীরা সব, ফুর্তি মনে থাকো

ডাক্তার শুয়ে আছে বিছানায় তোমাদের পাশে !

এভাবে কোনোদিনও আমি বাড়ি পৌঁছতে পারবো না; আমার ফুলেফেঁপে উঠতে থাকা ডাক্তারি চর্চার এই শেষ; এর পরের জন এসে আমার যা আছে সব কেড়ে নেবে, কিন্তু লাভ কী — আমার জায়গাটা নিতে কোনোদিনও পারবে না সে; আমার বাড়িতে ওই জঘন্য সহিস সব কিছু তোড়ফোঁড় করছে; রোজ মেয়েটা তার শিকার; ওসব নিয়ে ভাবতে রাজি নই আমি। উলঙ্গ, সবচেয়ে দুর্ভাগা এই সময়ের তুষারের কাছে অসহায় উন্মুক্ত হয়ে, পার্থিব এক চার চাকার ঘোড়ার গাড়ি আর অপার্থিব ঘোড়াগুলো নিয়ে, এই বুড়ো লোক আমি উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমার পশুর লোমে তৈরি কোট গাড়িটার পেছন থেকে ঝুলছে, কিন্তু ওটার কাছে পৌঁছাতে পারছি না আমি, আর আমার ব্যস্ত রোগীদের দলের কেউ আমাকে সাহায্য করতে একটা আঙুলও তুলছে না। জোচ্চুরি হলো আমার সাথে! জোচ্চুরি হলো! রাতের-ঘণ্টার ভুল আওয়াজে একবার সাড়া দিয়েছো কী — সেই ভুলের মাশুল দেওয়া শেষ হবে না, কোনোদিন।

উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ..

হুমায়ূন আহমদের গল্প : চোখ


ভোর ছটায় কেউ কলিং বেল টিপতে থাকলে মেজাজ বিগড়ে যাবার কথা। মিসির আলির মেজাজ তেমন বিগড়াল না। সকাল দশটা পর্যন্ত কেন জানি তাঁর মেজাজ বেশ ভালো থাকে। দশটা থেকে খারাপ হতে থাকে, চূড়ান্ত রকমের খারাপ হয় দুটার দিকে। তারপর আবার ভালো হতে থাকে। সন্ধ্যার দিকে অসম্ভব ভালো থাকে। তারপর আবার খারাপ হতে শুরু করে। ব্যাপারটা শুধু তাঁর বেলায় ঘটে না সবার বেলায়ই ঘটে তা তিনি জানেন না। প্রায়ই ভাবেন একে ওকে জিজ্ঞেস করবেন—শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠে না। তাঁর চরিত্রের বড় রকমের দুর্বল দিক হচ্ছে পরিচিত কারো সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে না। অপরিচিত মানুষদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কথা বলতে পারেন, কথা বলতে ভালোও লাগে। সেদিন রিকশা করে আসতে রিকশাওয়ালার সঙ্গে অতি উচ্চ শ্রেণীর কিছু কথাবার্তা চালিয়ে গেলেন। রিকশাওয়ালার বক্তব্য হচ্ছে—পৃথিবীতে যত অশান্তি সবের মূলে আছে মেয়েছেলে।

মিসির আলি বললেন, এই রকম মনে হওয়ার কারণ কী?
রিকশাওয়ালা অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বলল, চাচামিয়া, এই দেহেন আমারে। আইজ আমি রিকশা চালাই। এর কারণ কী? এর কারণ বিবি হাওয়া। বিবি হাওয়া যদি কুবুদ্ধি দিয়া বাবা আদমরে গন্ধম ফল না খাওয়াইতো, তা হইলে আইজ আমি থাকতাম বেহেশতে। বেহেশত তো আর রিকশা চালানির কোনো বিষয় নাই, কী কন চাচামিয়া? গন্ধম ফল খাওয়ানির কারণেই তো আইজ আমি দুনিয়ায় আইসা পড়লাম।
মিসির আলি রিকশাওয়ালার কথাবার্তায় চমৎকৃত হলেন। পরবর্তী দশ মিনিট তিনি রিকশাওয়ালাকে যা বললেন, তার মূল কথা হলো—নারীর কারণে আমরা যদি স্বর্গ থেকে বিতাড়িত হয়ে থাকি তাহলে নারীই পারে আবার আমাদের স্বর্গে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।
রিকশাওয়ালা কী বুঝল কে জানে। তার শেষ বক্তব্য ছিল—যা-ই কন চাচামিয়া, মেয়ে মানুষ আসলে সুবিধার জিনিস না।
কলিং বেল আবার বাজছে।
মিসির আলি বেল টেপার ধরন থেকে অনুমান করতে চেষ্টা করলেন—কে হতে পারে।
ভিখিরি হবে না। ভিখিরিরা এত ভোরে বের হয় না। ভিক্ষাবৃত্তি যাদের পেশা তারা পরিশ্রান্ত হয়ে গভীর রাতে ঘুমুতে যায়, ঘুম ভাঙতে সেই কারণেই দেরি হয়। পরিচিত কেউ হবে না। পরিচিতরা এত ভোরে আসবে না। তাঁকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে পারে এমন ঘনিষ্ঠতা তাঁর কারো সঙ্গেই নেই।
যে এসেছে, সে অপরিচিত। অবশ্যই মহিলা। পুরুষরা কলিং বেলের বোতাম অনেকক্ষণ চেপে ধরে থাকে। মেয়েরা তা পারে না। মেয়েটির বয়স অল্প তাও অনুমান করা যাচ্ছে। অল্পবয়স্ক মেয়েদের মধ্যে একধরনের ছটফটে ভাব থাকে। তারা অল্প সময়ের মধ্যে বেশ কয়েকবার বেল টিপবে। নিজেদের অস্থিরতা ছড়িয়ে দেবে কলিং বেলে।
মিসির আলি, পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে দরজা খুললেন। বিস্মিত হয়ে দেখলেন, তাঁর অনুমান সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে—মাঝবয়েসী এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। বেঁটেখাটো একজন মানুষ। গায়ে সাফারি। চোখে সানগ্লাস। এত ভোরে কেউ সানগ্লাস পরে না। এই লোকটি কেন পরেছে কে জানে।
‘স্যার স্লামালিকুম।’
‘ওয়ালাইকুম সালাম।’
‘আপনার নাম কি মিসির আলি?’
‘জি।’
‘আমি কি আপনার সঙ্গে খানিকক্ষণ কথা বলতে পারি?’
মিসির আলি কী বলবেন মনস্থির করতে পারলেন না। লোকটিকে তিনি পছন্দ করছেন না, তবে তার মধ্যে একধরনের আত্মবিশ্বাস লক্ষ করছেন, যা তাঁর ভালো লাগছে। আত্মবিশ্বাসের ব্যাপারটা আজকাল আর দেখাই যায় না।
লোকটি শান্ত গলায় বলল, আমি আপনার কিছুটা সময় নষ্ট করব ঠিকই, তবে তার জন্যে আমি পে করব।
‘পে করবেন?’
‘জি। প্রতি ঘণ্টায় আমি আপনাকে এক হাজার করে টাকা দেব। আশা করি আপনি আপত্তি করবেন না। আমি কি ভেতরে আসতে পারি?’
‘আসুন।’
লোকটি ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, মনে হচ্ছে আপনার এখনো হাত-মুখ ধোয়া হয়নি। আপনি হাত-মুখ ধুয়ে আসুন, আমি অপেক্ষা করছি।
মিসির আলি বললেন, ঘণ্টা হিসাবে আপনি যে আমাকে টাকা দেবেন—সেই হিসাব কি এখন থেকে শুরু হবে? নাকি হাত-মুখ ধুয়ে আপনার সামনে বসার পর থেকে শুরু হবে?
লোকটি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল, টাকার কথায় আপনি কি রাগ করেছেন?
‘রাগ করিনি। মজা পেয়েছি। চা খাবেন?’
‘খেতে পারি। দুধ ছাড়া।’
মিসির আলি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বললেন, এক কাজ করুন—রান্নাঘরে চলে যান। কেতলি বসিয়ে দিন। দুকাপ বানান। আমাকেও এক কাপ দেবেন।
ভদ্রলোক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন।
মিসির আলি হাসিমুখে বললেন, আমাকে ঘণ্টা হিসেবে পে করবেন বলে যেভাবে হকচকিয়ে দিয়েছিলেন, আমিও ঠিক একইভাবে আপনাকে হকচকিয়ে দিলাম। বসুন, চা বানাতে হবে না। সাতটার সময় রাস্তার ওপাশের রেস্টুরেন্ট থেকে আমার জন্যে চা-নাশতা আসে। তখন আপনার জন্যেও চা আনিয়ে দেব।
‘থ্যাংক ইউ স্যার।’
‘আপনি কথা বলার সময় বারবার বাঁ দিকে ঘুরছেন, আমার মনে হচ্ছে আপনার বাঁ চোখটা নষ্ট। এই জন্যেই কি কালো চশমা পরে আছেন?’
ভদ্রলোক সহজ গলায় বললেন, জি। আমার বাঁ চোখটা পাথরের।
ভদ্রলোক সোফার এক কোণে বসলেন। মিসির আলি লক্ষ করলেন, লোকটি শিরদাঁড়া সোজা করে বসে আছে। চাকরির ইন্ট্যারভ্যু দিতে এলে ক্যানডিডেটরা যে ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে অবিকল সেই ভঙ্গি। মিসির আলি বললেন, আজকের খবরের কাগজ এখনো আসেনি। গত দিনের কাগজ দিতে পারি। যদি আপনি চোখ বুলাতে চান।
‘আমি খবরের কাগজ পড়ি না। একা একা বসে থেকে আমার অভ্যাস আছে। আমার জন্যে আপনাকে ব্যস্ত হতে হবে না। শুরুতে টাকা দেয়ার কথা বলে যদি আপনাকে আহত করে থাকি তার জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।’
মিসির আলি টুথব্রাশ হাতে বাথরুমে ঢুকে গেলেন। লোকটিকে তার বেশ ইন্টারেস্টিং বলে মনে হচ্ছে। তবে কোন গুরুতর সমস্যা নিয়ে এসেছে বলে মনে হয় না। আজকাল অকারণেই কিছু লোকজন এসে তাঁকে বিরক্ত করা শুরু করেছে। মাসখানিক আগে একজন এসেছিল ভূতবিশারদ। সে নাকি গবেষণাধর্মী একটি বই লিখছে, যার নাম ‘বাংলার ভূত’। এ দেশে যত ধরনের ভূত-পেত্নী আছে সবার নাম, আচার-ব্যবহার বই-এ লেখা। মেছো ভূত, গেছো ভূত, জলা ভূত, শাকচুন্নি, কন্ধকাটা, কুনী ভূত, আঁধি ভূত…। সর্বমোট এক শ ছয় রকমের ভূত।
মিসির আলি বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ভাই আমার কাছে কেন? আমি সারা জীবন ভূত নেই এইটা প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছি…।
সেই লোক মহা উৎসাহী হয়ে বলল, কোন্ কোন্ ভূত নেই বলে প্রমাণ করেছেন—এইটা কাইন্ডলি বলুন। আমার কাছে ক্যাসেট প্লেয়ার আছে। আমি টেপ করে নেব।
সানগ্লাস পরা বেঁটে ভদ্রলোক সেই পদের কেউ কিনা কে বলবে?
তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে মিসির আলি বললেন, ভাই, বলুন কী ব্যাপার?
‘প্রথমেই আমার নাম বলি—এখনো আমি আপনাকে আমার নাম বলিনি। আমার নাম রাশেদুল করিম। আমেরিকার টেঙ্াস এমঅ্যান্ডএন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের আমি একজন অধ্যাপক। বর্তমানে এক বছরের স্যাবোটিক্যাল লিভে দেশে এসেছি। আপনার খোঁজ কিভাবে এবং কার কাছে পেয়েছি তা কি বলব?’
‘তার দরকার নেই। কি জন্যে আমার খোঁজ করছেন সেটা বলুন।’
‘আমি কি ধূমপান করতে পারি? সিগারেট খেতে খেতে কথা বললে আমার জন্যে সুবিধা হবে। সিগারেটের ধোঁয়া একধরনের আড়াল সৃষ্টি করে।’
‘আপনি সিগারেট খেতে পারেন, কোন অসুবিধা নেই।’
‘ছাই কোথায় ফেলব? আমি কোন এসট্রে দেখতে পাচ্ছি না।’
‘মেঝেতে ফেলুন। আমার গোটা বাড়িটাই একটা এসট্রে।’
রাশেদুল করিম সিগারেট ধরিয়েই কথা বলা শুরু করলেন। তাঁর গলার স্বর ভারী এবং স্পষ্ট কথাবার্তা খুব গোছানো। কথা শুনে মনে হয় তিনি কী বললেন তা আগেভাগেই জানেন। কোন্ বাক্যটির পর কোন্ বাক্য বলবেন তাও ঠিক করা। যেন ক্লাসের বক্তৃতা। আগে থেকে ঠিকঠাক করা। প্রবাসী বাঙালিরা একনাগাড়ে বাংলায় কথা বলতে পারেন না—ইনি তা পারছেন।
‘আমার বয়স এই নভেম্বরে পঞ্চাশ হবে। সম্ভবত আমাকে দেখে তা বুঝতে পারছেন না। আমার মাথার চুল সব সাদা। কলপ ব্যবহার করছি গত চার বছর থেকে। আমার স্বাস্থ্য ভালো। নিয়মিত ব্যায়াম করি। মুখের চামড়ায় এখনো ভাঁজ পড়েনি। বয়সজনিত অসুখ-বিসুখ কোনটাই আমার নেই। আমার ধারণা শারীরিক এবং মানসিক দিক দিয়ে আমার কর্মক্ষমতা এখনো একজন পঁয়ত্রিশ বছরের যুবকের মতো। এই কথাটা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। আজ আমার গায়েহলুদ। মেয়ে পক্ষীয়রা সকাল নয়টায় আসবে। আমি ঠিক আটটায় এখান থেকে যাব। আটটা পর্যন্ত সময় কি আমাকে দেবেন?’
‘দেব। ভালো কথা, এটা নিশ্চয়ই আপনার প্রথম বিবাহ না। এর আগেও আপনি বিয়ে করেছেন?’
‘জি। এর আগে একবার বিয়ে করেছি। এটি আমার দ্বিতীয় বিবাহ। আমি আগেও বিয়ে করেছি তা কী করে বললেন?’
‘আজ আপনার গায়েহলুদ তা খুব সহজভাবে বললেন দেখে অনুমান করলাম। বিয়ের তীব্র উত্তেজনা আপনার মধ্যে দেখতে পাইনি।’
‘সব মানুষ তো একরকম নয়। একেকজন একেক রকম। উত্তেজনার ব্যাপারটি আমার মধ্যে একেবারেই নেই। প্রথমবার যখন বিয়ে করি তখনো আমার মধ্যে বিন্দুমাত্র উত্তেজনা ছিল না। সেদিনও আমি যথারীতি ক্লাসে গিয়েছি। গ্রুপ থিওরির ওপর এক ঘণ্টার লেকচার দিয়েছি।’
‘ঠিক আছে, আপনি বলে যান।’
রাশেদুল করিম শান্ত গলায় বললেন, আপনার ভেতর একটা প্রবণতা লক্ষ করছি—আমাকে আর দশটা মানুষের দলে ফেলে বিচার করার চেষ্টা করছেন। দয়া করে তা করবেন না। আমি আর দশজনের মতো নই।
‘আপনি শুরু করুন।’
‘অঙ্কশাস্ত্রে এমএ ডিগ্রি নিয়ে আমি আমেরিকা যাই পিএইচডি করতে। এমএ-তে আমার রেজাল্ট ভালো ছিল না। টেনেটুনে সেকেন্ড ক্লাস। প্রাইভেট কলেজে কলেজে চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছি, তখন বন্ধুদের দেখাদেখি জি-আর-ই পরীক্ষা দিয়ে ফেললাম। জি-আর-ই পরীক্ষা কী তা কি আপনি জনেন? গ্রাজুয়েট রেকর্ড একজামিনেশন। আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে গ্রাজুয়েট ক্লাসে ভর্তি হতে হলে এই পরীক্ষা দিতে হয়।’
‘আমি জানি।’
‘এই পরীক্ষায় আমি আশাতীত ভালো করে ফেললাম। আমেরিকান তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার কাছে আমন্ত্রণ চলে এল। চলে গেলাম। পিএইচডি করলাম প্রফেসর হোবলের সঙ্গে। আমার পিএইচডি ছিল গ্রুপ থিওরির একটি শাখায়—নন অ্যাবেলিয়ান ফাংশানের ওপর। পিএইচডির কাজ এতই ভালো হলো যে আমি রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলাম। অঙ্ক নিয়ে বর্তমান কালে যাঁরা নাড়াচাড়া করেন তাঁরা সবাই আমার নাম জানেন। অঙ্কশাস্ত্রের একটি ফাংশান আছে যা আমার নামে পরিচিত। আর কে এঙ্পোনেনশিয়াল। আর কে হচ্ছে রাশেদুল করিম।
পিএইচডির পরপরই আমি মন্টানা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনার কাজ পেয়ে গেলাম। সেই বছরই বিয়ে করলাম। মেয়েটি মন্টানা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন আর্টসের ছাত্রী—স্প্যানিশ আমেরিকান। নাম জুডি বারনার।
‘প্রেমের বিয়ে?’
‘প্রেমের বিয়ে বলাটা বোধ হয় ঠিক হবে না। বাছাবাছির বিয়ে বলতে পারেন। জুডি অনেক বাছাবাছির পর আমাকে পছন্দ করল।’
‘আপনাকে পছন্দ করার কারণ কী?’
‘আমি ঠিক অপছন্দ করার মতো মানুষ সেই সময় ছিলাম না। আমার একটি চোখ পাথরের ছিল না। চেহারা তেমন ভালো না হলেও দুটি সুন্দর চোখ ছিল। আমার মা বলতেন, রাশেদের চোখে জন্ম-কাজল পরানো। সুন্দর চোখের ব্যাপারটা অবশ্য ধর্তব্য নয়। আমেরিকান তরুণীরা প্রেমিকদের সুন্দর চোখ নিয়ে মাথা ঘামায় না—তারা দেখে প্রেমিক কী পরিমাণ টাকা করেছে এবং ভবিষ্যতে কী পরিমাণ টাকা সে করতে পারবে। সেই দিক দিয়ে আমি মোটামুটি আদর্শ স্থানীয় বলা চলে। ত্রিশ বছর বয়সে একটি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাকাল্টি পজিশন পেয়ে গেছি। ট্যানিউর পেতেও কোনো সমস্যা হবে না। জুডি স্বামী হিসেবে আমাকে নির্বাচন করল। আমার দিক থেকে আপত্তির কোনো কারণ ছিল না। জুডি চমৎকার একটি মেয়ে। শত বৎসর সাধনার ধন হয়তো নয়, তবে বিনা সাধনায় পাওয়ার মতো মেয়েও নয়।
বিয়ের সাত দিনের মাথায় আমরা হানিমুন করতে চলে গেলাম সানফ্রান্সিসকো। উঠলাম হোটেল বেডফোর্ডে। দ্বিতীয় রাত্রির ঘটনা। ঘুমুচ্ছিলাম। কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখি জুডি পাশে নেই। ঘড়িতে রাত তিনটা দশ বাজছে। বাথরুমের দরজা বন্ধ। সেখান থেকে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ আসছে। আমি বিস্মিত হয়ে উঠে গেলাম। দরজা ধাক্কা দিয়ে বললাম, কী হয়েছে? জুডি কী হয়েছে? কান্না থেমে গেল। তবে জুডি কোনো জবাব দিল না।
অনেক ধাক্কাধাক্কির পর সে দরজা খুলে হতভম্ব হয়ে আমাকে দেখতে লাগল। আমি বললাম, কী হয়েছে?
সে ক্ষীণ স্বরে বলল, ভয় পেয়েছি।
‘কিসের ভয়?’
‘জানি না কিসের ভয়।’
‘ভয় পেয়েছ তো আমাকে ডেকে তোলনি কেন? বাথরুমের দরজা বন্ধ করেছিলে কেন?’
জুডি জবাব দিল না। এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, ব্যাপারটা কী আমাকে খুলে বলো তো?
‘সকালে বলব।’
‘না, এখনি বলো। কী দেখে ভয় পেয়েছ?’
জুডি অস্পষ্ট স্বরে বলল, তোমাকে দেখে।
‘আমাকে দেখে ভয় পেয়েছ মানে? আমি কী করেছি?’
জুডি যা বলল তা হচ্ছে—রাতে তার ঘুম ভেঙে যায়। হোটেলের ঘরে নাইট লাইট জ্বলছিল, এই আলোয় সে দেখে তার পাশে যে শুয়ে আছে সে কোনো জীবন্ত মানুষ নয়। মৃত মানুষ। যে মৃত মানুষের গা থেকে শবদেহের গন্ধ বেরোচ্ছে। সে ভয়ে কাঁপতে থাকে তবু সাহসে হাত বাড়িয়ে মানুষটাকে স্পর্শ করে। স্পর্শ করেই চমকে উঠে, কারণ মানুষটার শরীর বরফের মতোই শীতল। সে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে যায় যে আমি মারা গেছি। তার জন্যে এটা বড় ধরনের শক হলেও সে যথেষ্ট সাহস দেখায়—টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে দেয় এবং হোটেল ম্যানেজারকে টেলিফোন করবার জন্যে টেলিফোন সেট হাতে তুলে নেয়। ঠিক তখন সে লক্ষ করে মৃতদেহের দুটি বন্ধ চোখের একটি ধীরে ধীরে খুলছে। সেই একটিমাত্র খোলা চোখ তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। জুডি টেলিফোন ফেলে দিয়ে ছুটে বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। এই হলো ঘটনা।
রাশেদুল করিম কথা শেষ করে সিগারেট ধরালেন। হাতের ঘড়ি দেখলেন। আমি বললাম, থামলেন কেন?
‘সাতটা বেজেছে। আপনি বলেছেন সাতটার সময় আপনার জন্যে চা আসে। আমি চায়ের জন্যে অপেক্ষা করছি। চা খেয়ে শুরু করব। আমার গল্প শুনতে আপনার কেমন লাগছে?’
‘ইন্টারেস্টিং। এই গল্প কি আপনি অনেকের সঙ্গে করেছেন? আপনার গল্প বলার ধরন থেকে মনে হচ্ছে, অনেকের সঙ্গেই এই গল্প করেছেন।’
‘আপনার অনুমান সঠিক। ছয় থেকে সাতজনকে আমি বলেছি। এর মধ্যে সাইকিয়াট্রিস্ট আছেন। পুলিশের লোক আছে।’
‘পুলিশের লোক কেন?’
‘গল্প শেষ করলেই বুঝতে পারবেন পুলিশের লোক কী জন্যে।’
চা চলে এল। চায়ের সঙ্গে পরোটা-ভাজি। মিসির আলি নাশতা করলেন। রাশেদুল করিম সাহেব পরপর দুকাপ চা খেলেন।
‘আমি কি শুরু করব?’
‘জি, শুরু করুন।’
‘আমাদের হানিমুন মাত্র তিন দিন স্থায়ী হলো। জুডিকে নিয়ে পুরনো জায়গায় চলে এলাম। মনটা খুবই খারাপ। জুডির কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছি না। রোজ রাতে সে ভয়ংকর চিৎকার করে ওঠে। ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। আমি যখন জেগে উঠে তাকে সান্ত্বনা দিতে যাই, তখন সে এমনভাবে তাকায় যেন আমি একটা পিশাচ কিংবা মূর্তিমান শয়তান। আমার দুঃখের কোনো সীমা রইল না। সেই সময় নন এবিলিয়ান গ্রুপের ওপর একটা জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছিলাম। আমার দরকার ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার মতো পরিবেশ। মানসিক শান্তি। সব দূর হয়ে গেল। অবশ্যি দিনের বেলায় জুডি স্বাভাবিক। সে বদলাতে শুরু করে সূর্য ডোবার পর থেকে। আমি তাকে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে গেলাম।
সাইকিয়াট্রিস্ট প্রথমে সন্দেহ করলেন সমস্যা ড্রাগঘটিত। হয়তো জুডি ড্রাগে অভ্যস্ত। সেই সময় বাজারে হেলুসিনেটিং ড্রাগ এলএসডি প্রথম এসেছে। শিল্প সাহিত্যের লোকজন শখ করে এই ড্রাগ খাচ্ছেন। বড় গলায় বলছেন—মাইন্ড অলটারিং ট্রিপ নিয়ে এসেছি। জুডি ফাইন আর্টসের ছাত্রী। ট্রিপ নেয়া তার পক্ষে খুব অস্বাভাবিক না।
দেখা গেল ড্রাগঘটিত কোনো সমস্যা তার নেই। সে কখনো ড্রাগ নেয়নি। সাইকিয়াট্রিস্টরা তার শৈশবের জীবনে কোনো সমস্যা ছিল কিনা তাও বের করতে চেষ্টা করলেন। লাভ হলো না। জুডি এসেছে গ্রামের কৃষক পরিবার থেকে। এ ধরনের পরিবারে তেমন কোনো সমস্যা থাকে না। তাদের জীবনযাত্রা সহজ এবং স্বাভাবিক।
সাইকিয়াট্রিস্ট জুডিকে ঘুমের ওষুধ দিলেন। কড়া ডোজের ফেনোবারবিটন। আমাকে বললেন, আপনি সম্ভবত লেখাপড়া নিয়ে থাকেন। স্ত্রীর প্রতি বিশেষ করে নববিবাহিত স্ত্রীর প্রতি যতটা সময় দেয়া দরকার, তা দিচ্ছেন না। আপনার প্রতি আপনার স্ত্রীর একধরনের ক্ষোভ জন্মগ্রহণ করেছে। সে যা বলছে তা ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ।
জুডির কথা একটাই—আমি ঘুমুবার পর আমার দেহে প্রাণ থাকে না। একজন মৃত মানুষের শরীর যেমন অসাড় পড়ে থাকে, আমার শরীরও সে রকম পড়ে থাকে। ঘুমের মধ্যে মানুষ হাত নাড়ে, পা নাড়ে—আমি তার কিছুই করি না। নিঃশ্বাস পর্যন্ত ফেলি না। গা হয়ে যায় বরফের মতো শীতল। একসময় গা থেকে মৃত মানুষের শরীরের পচা গন্ধ বেরোতে থাকে এবং তখন আচমকা আমার বাঁ চোখ খুলে যায়, সেই চোখে আমি এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। সেই চোখের দৃষ্টি সাপের মতো কুটিল।
জুডির কথা শুনে আমার ধারণা হলো, হতেও তো পারে। জগতে কত রহস্যময় ব্যাপারই তো ঘটে। হয়তো আমার নিজেরই কোনো সমস্যা আছে। আমিও ডাক্তারের কাছে গেলাম। স্লিপ অ্যানালিস্ট। জানার উদ্দেশ্য একটিই—ঘুমের মধ্যে আমার কোনো শারীরিক পরিবর্তন হয় কি না। ডাক্তাররা পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করলেন। একবার না, বারবার করলেন। দেখা গেল আমার ঘুম আর দশটা মানুষের ঘুমের চেয়ে আলাদা নয়। ঘুমের মধ্যে আমিও হাত-পা নাড়ি। অন্য মানুষদের যেমন ঘুমের তিনটি স্তর পার হতে হয়, আমারও হয়। ঘুমের সময় আর দশটা মানুষের মতো আমার শরীরের উত্তাপও আধ ডিগ্রি হ্রাস পায়। আমিও অন্য সবার মতো স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন দেখি।
জুডি সব দেখেশুনে বলল, ডাক্তাররা জানে না। ডাক্তাররা কিছুই জানে না। আমি জানি। তুমি আসলে মানুষ না। দিনের বেলা তুমি মানুষ থাক—সূর্য ডোবার পর থাক না।
আমি কী হই?
তুমি পিশাচ বা এই জাতীয় কিছু হয়ে যাও।
আমি বললাম, এইভাবে তো বাস করা সম্ভব না। তুমি বরং আলাদা থাক।
খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, জুডি তাতে রাজি হলো না। অতি তুচ্ছ কারণে আমেরিকানদের বিয়ে ভাঙে। স্বামীর পছন্দ হলুদ রঙের বিছানার চাদর, স্ত্রীর পছন্দ নীল রঙ। ভেঙে গেল বিয়ে। আমাদের এত বড় সমস্যা কিন্তু বিয়ে ভাঙল না। আমি বেশ কয়েকবার তাকে বললাম, জুডি, তুমি আলাদা হয়ে যাও। ভালো দেখে একটা ছেলেকে বিয়ে করো। সারা জীবন তোমার সামনে পড়ে আছে। তুমি এইভাবে জীবনটা নষ্ট করতে পার না।
জুডি প্রতিবারই বলে, যা-ই হোক, যত সমস্যাই হোক আমি তোমাকে ছেড়ে যাব না, I love you, I love you.
আমি গল্পের প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। শেষ অংশটি বলার আগে আমি আপনাকে আমার চোখের দিকে তাকাতে অনুরোধ করব। দয়া করে আমার চোখের দিকে তাকান।
রাশেদুল করিম সানগ্লাস খুলে ফেললেন। মিসির আলি তৎক্ষণাৎ বললেন, আপনার চোখ সুন্দর। সত্যি সুন্দর। আপনার মা যে বলতেন—চোখে জন্ম-কাজল, ঠিকই বলতেন।
রাশেদুল করিম বললেন, পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর চোখ কার ছিল জানেন?
‘ক্লিওপেট্রার’।
‘অধিকাংশ মানুষের তাই ধারণা। এ ধারণা সত্যি নয়। পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর চোখ ছিল বুদ্ধদেবের পুত্র কুনালের। ইংরেজ কবি শেলীর চোখও খুব সুন্দর ছিল। আমার স্ত্রীর ধারণা, এই পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর চোখ আমার। জুডি বলত এই চোখের কারণেই সে কোনোদিন আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না।
রাশেদুল করিম সানগ্লাস চোখে দিয়ে বললেন, গল্পের শেষ অংশ বলার আগে আপনাকে ক্ষুদ্র ধন্যবাদ দিতে চাচ্ছি।
মিসির আলি বিস্মিত হয়ে বললেন, কী জন্যে বলুন তো?
‘কাউকে যখন আমি আমার চোখের দিকে তাকাতে বলি, সে আমার পাথরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আপনি প্রথম ব্যক্তি যিনি একবারও আমার পাথরের চোখের দিকে তাকাননি। আমার আসল চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ঝড় হরপব ড়ভ ুড়ঁ, ঝরৎ.’
রাশেদুল করিমের গলা মুহূর্তের জন্যে হলেও ভারী হয়ে গেল। তিনি অবশ্যি চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, আটটা প্রায় বাজতে চলল, গল্পের শেষটা বলি—
‘জুডির অবস্থা ক্রমেই খারাপ হতে লাগল। কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমুতে যায়, দু-এক ঘণ্টা ঘুম হয়, বাকি রাত জেগে বসে থাকে। মাঝে মাঝে চিৎকার করে ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।
এমনি এক রাতের ঘটনা। জুলাই মাস। রাত সাড়ে তিনটার মতো হবে। জুড়ির মাথা পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেল—সে আমার বাঁ চোখটা গেলে দিল।
আমি ঘুমুচ্ছিলাম, নারকীয় যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলাম। সেই ভয়াবহ কষ্টের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।’
রাশেদুল করিম চুপ করলেন। তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে লাগল।
মিসির আলি বললেন, কী দিয়ে চোখ গেলে দিলেন?
‘সুঁচালো পেনসিল দিয়ে। আমার মাথার বালিশের নিচে প্যাড এবং পেনসিল থাকে। তখন গ্রুপ থিওরি নিয়ে গভীর চিন্তায় ছিলাম। মাথায় যদি হঠাৎ কিছু আসে, তা লিখে ফেলার জন্যে বালিশের নিচে প্যাড এবং পেনসিল রাখতাম।’
‘আপনার স্ত্রী এ ঘটনা প্রসঙ্গে কী বক্তব্য দিয়েছেন।’
‘তার মাথা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সে কিছুই বলেনি, শুধু চিৎকার করেছে। তার একটিই বক্তব্য—এই লোকটা পিশাচ। আমি প্রমাণ পেয়েছি। কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমার কাছে প্রমাণ আছে।’
‘কী প্রমাণ আছে তা কি কখনো জিজ্ঞেস করা হয়েছে?’
‘না। একজন উন্মাদকে প্রশ্ন করে বিপর্যস্ত করার কোনো মানে হয় না। তা ছাড়া আমি তখন ছিলাম হাসপাতালে। আমি হাসপাতালে থাকতে থাকতেই জুডির মৃত্যু হয়।’
‘স্বাভাবিক মৃত্যু?’
‘না। স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। সে মারা যায় ঘুমের ওষুধ খেয়ে। এইটুকুই আমার গল্প। আমি আপনার কাছে একটাই অনুরোধ নিয়ে এসেছি, আপনি সমস্যাটা কি বের করবেন। আমাকে সাহায্য করবেন। আমি যদি পিশাচ হই তাও আমাকে বলবেন। এই ফাইলের ভেতর জুডির একটা স্কেচ বুক আছে। স্কেচ বুকে নানান ধরনের কমেন্টস লেখা আছে। এই কমেন্টসগুলি পড়লে জুডির মানসিক অবস্থা আঁচ করতে আপনার সুবিধা হতে পারে। আটটা বাজে, আমি তাহলে উঠি?’
‘আবার কবে আসবেন?’
‘আগামীকাল ভোর ছয়টায়। ভালো কথা, আমার এই গল্পে কোথাও কি প্রকাশ পেয়েছে জুডিকে আমি কতটা ভালোবাসতাম?’
‘না, প্রকাশ পায়নি।’
‘জুডির প্রতি আমার ভালোবাসা ছিল সীমাহীন। আমি এখন উঠছি।’
‘ছিল বলছেন কেন? এখন কি নেই?’
ভদ্রলোক জবাব দিলেন না।
রাশেদুল করিম চলে যাবার পর মিসির আলি ফাইল খুললেন। ফাইলের শুরুতেই একটা খাম। খামের ওপর মিসির আলির নাম লেখা।
মিসির আলি খাম খুললেন। খামের ভেতর ইংরেজিতে একটা চিঠি লেখা। সঙ্গে চারটি এক শ ডলারের নোট। চিঠি খুবই সংক্ষিপ্ত।
প্রিয় মহোদয়,
আপনার সার্ভিসের জন্য সম্মানী বাবদ সামান্য কিছু দেয়া হলো। গ্রহণ করলে খুশি হব।
বিনীত
আর করিম।


মিসির আলি স্কেচ বুকের প্রতিটি পাতা সাবধানে ওল্টালেন। চারকোল এবং পেনসিলে স্কেচ আঁকা। প্রতিটি স্কেচের নিচে আঁকার তারিখ। স্কেচের বিষয়বস্তু অতি তুচ্ছ, সবই ঘরোয়া জিনিস—এক জোড়া জুতা, মলাট ছেঁড়া বই, টিভি, বুক শেলফ। স্কেচ বুকের শেষের দিকে শুধুই চোখের ছবি। বিড়ালের চোখ, কুকুরের চোখ, মাছের চোখ এবং মানুষের চোখ। মানুষের চোখের মডেল যে রাশেদুল করিম তা বলার অপেক্ষা রাখে না। না বললেও ছবির নিচের মন্তব্য থেকে বোঝা যাচ্ছে। মন্তব্যগুলি বেশ দীর্ঘ। যেমন একটি মন্তব্য—
আমি খুব মন দিয়ে আমার স্বামীর চোখ লক্ষ্য করছি। মানুষের চোখ একেক সময় একেক রকম থাকে। ভোরবেলার চোখ এবং দুপুরের চোখ এক নয়। আরো একটি জিনিস লক্ষ্য করলাম চোখের আইরিশের ট্রান্সপারেন্সি মুডের ওপর বদলায়। বিষাদগ্রস্ত মানুষের চোখের আইরিশ থাকে অস্বচ্ছ। মানুষ যতই আনন্দিত হতে থাকে তার চোখের আইরিশ ততই স্বচ্ছ হতে থাকে। আমার এই অবজারভেশন কতটুকু সত্য তা বুঝতে পারছি না।
মেয়েটি মাঝে মাঝে তার মনের অবস্থাও লিখেছে—অনেকটা ডায়েরি লেখার ভঙ্গিতে। মনে হয় হাতের কাছে ডায়েরি না থাকায় স্কেচ বুকে লিখে রেখেছে। সব লেখাই পেনসিলে। প্রচুর কাটাকুটি আছে। কিছু লাইন রাবার ঘষে তুলেও ফেলা হয়েছে।
আমি ভয়ে অস্থির হয়ে আছি। নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছি—এই ভয় অমুলক। বোঝাতে পারছি না। আমি আমার স্বামীকে ভয় পাচ্ছি এই তথ্য স্বভাবতই স্বামী বেচারার জন্যে সুখকর না। সে নানাভাবে আমাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছে। কিছু কিছু চেষ্টা বেশ হাস্যকর। আজ আমাকে বলল, জুডি আমি ঠিক করেছি, এখন থেকে রাতে ঘুমুব না। আমার অঙ্কের সমস্যা নিয়ে ভাবব। লেখালেখি করব। তুমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাও। আমি দিনের বেলায় ঘুমুব। একজন মানুষের জন্যে চার ঘণ্টা ঘুমই যথেষ্ট। নেপোলিয়ান মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমুতেন।
আমি এই গম্ভীর, স্বল্পভাষী লোকটিকে ভালোবাসি। ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি। আমি চাই না, আমার কোনো কারণে সে কষ্ট পাক। কিন্তু সে কষ্ট পাচ্ছে। খুব কষ্ট পাচ্ছে। হে ঈশ্বর, তুমি আমার মন শান্ত কর। আমার ভয় দূর করে দাও।
যে জিনিস খুব সুন্দর তা কত দ্রুত অসুন্দর হতে পারে—বিস্মিত হয়ে আমি তাই দেখছি। রাশেদের ধারণা আমি অসুস্থ। সত্যি কি অসুস্থ? আমার মনে হয় না। কারণ এখনো ছবি আঁকতে পারছি। একজন অসুস্থ মানুষ আর যাই পারুক—ছবি আঁকতে পারে না। গত দুদিন ধরে ওয়াটার কালারে বাসার সামনের চেরী গাছের ফুল ধরতে চেষ্টা করছিলাম। আজ সেই ফুল কাগজে বন্দি করেছি। অনেকক্ষণ ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভালো হয়েছে। রাশেদ ছবি তেমন বুঝে বলে মনে হয় না—সেও মুগ্ধ হয়ে অনেকক্ষণ দেখল। তারপর বলল, আমি যখন বুড়ো হয়ে যাব, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেব, তখন তুমি আমাকে ছবি আঁকা শিখিয়ে দেবে। এই কথাটি সে আজ প্রথম বলেনি। আগেও বলেছে। আন্তরিক ভঙ্গিতে বলেছে। কেউ যখন আন্তরিকভাবে কিছু বলে তখন তা টের পাওয়া যায়। আমার মনে হয় না সে কোনোদিন ছবি আঁকবে। তার মাথায় অঙ্ক ছাড়া কিছুই নেই।
আমি ছবি আঁকতে পারছি না। যেখানে নীল রঙ চড়ানো দরকার সেখানে গাঢ় হলুদ রঙ বসাচ্ছি। ডাক্তার সিডেটিভের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। সারাক্ষণ মাথা ঝিম ধরে থাকে। কেন জানি খুব বমি হচ্ছে।
আজ দুপুরে অনেকক্ষণ ঘুমুলাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সুন্দর একটা স্বপ্নও দেখে ফেললাম। সুন্দর স্বপ্ন আমি অনেকদিন দেখি না। অনেকদিন দেখি না। অনেকদিন দেখি না। অনেকদিন দেখি না। আচ্ছা, আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি? শুনেছি পাগলরাই একই কথা বারবার লেখে। কারণ তাদের মাথায় একটি বাক্যই বারবার ঘুরপাক খায়।
বৃহস্পতিবার কিংবা বুধবার—
আজ কত তারিখ আমি জানি না। বেশ কয়েকদিন ধরেই দিন-তারিখে গণ্ডগোল হচ্ছে। আজ কত তারিখ তা জানার কোনো রকম আগ্রহ বোধ করছি না। তবে মনের অবস্থা লেখার চেষ্টা করছি যাতে পরবর্তী সময়ে কেউ আমার লেখা পড়ে বুঝবে যে মাথা খারাপ হবার সময় একজন মানুষ কী ভাবে। কী চিন্তা করে।
মাথা খারাপের প্রথম লক্ষণ হচ্ছে, আলো অসহ্য হওয়া। আমি এখন আলো সহ্য করতে পারি না। দিনের বেলায় দরজা-জানালা বন্ধ করে রাখি। ঘর অন্ধকার বলেই প্রায় অনুমানের ওপর নির্ভর করে আজকের এই লেখা লিখছি। দ্বিতীয় লক্ষণ হচ্ছে, সারাক্ষণ শরীরে একধরনের জ্বালা অনুভব করা। মনে হয় সব কাপড় খুলে বাথটাবে শুয়ে থাকতে পারলে ভালো লাগত। আমার আগে যারা পাগল হয়েছে তাদেরও কি এমন হয়েছে? জানার জন্যে পাবলিক লাইব্রেরিতে টেলিফোন করেছিলাম। আমি খুব সহজভাবে বললাম, আচ্ছা আপনাদের এখানে পাগলের লেখা কোনো বই আছে?
যে মেয়েটি টেলিফোন ধরেছিল সে বিস্মিত হয়ে বলল, পাগলের লেখা বই বলতে কী বোঝাচ্ছেন?
‘মানসিক রোগীদের লেখা বই।’
‘মানসিক রোগীরা বই লিখবে কেন?’
‘কেন লিখবে না। আমি তো লিখছি, বই অবশ্যি নয়—ডায়েরির আকারে লেখা।’
‘ও আচ্ছা। ঠিক আছে আপনার বই ছাপা হোক। ছাপা হবার পর অবশ্যই আমরা আপনার বই-এর কপি সংগ্রহ করব।’
আমি মনে মনে হাসলাম। মেয়েটি আমাকে উন্মাদ ভাবছে। ভাবুক উন্মাদকে উন্মাদ ভাববে না তো কী ভাববে?
রাত দুটা দশ—
আমার মা, এই কিছুক্ষণ আগে টেলিফোন করলেন। দুপুর রাতে তাঁর টেলিফোন করার বদঅভ্যাস আছে। আমার মার অনিদ্রা রোগ আছে। কাজেই তিনি মনে করেন পৃথিবীর সবাই অনিদ্রা রোগী। যা-ই হোক, আমি জেগে ছিলাম। মা বললেন, জুডি তুই আমার কাছে চলে আয়। আমি বললাম, না রাশেদকে ফেলে আমি যাব না।
মা বললেন, আমি তো শুনলাম ওকে নিয়েই তোর সমস্যা।
‘ওকে নিয়ে আমার কোনো সমস্যা নেই মা। ও ষড়াব যরস, ও ষড়াব যরস, ও ষড়াব যরস.
‘চিৎকার করছিস কেন?’
‘চিৎকার করছি না। মা, টেলিফোন রাখি। কথা বলতে ভালো লাগছে না।’
আমি টেলিফোন নামিয়ে রাখলাম। রাশেদকে ফেলে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। আমার ধারণা রাশেদ নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সেও এখন রাতে ঘুমায় না। গ্রুপ থিওরির যে সমস্যাটি নিয়ে সে ভাবছিল, সেই সমস্যার সমাধান অন্য কে নাকি বের করে ফেলেছে। জার্নালে ছাপা হয়েছে। সে গত পরশু ঐ জার্নাল পেয়ে কুচি কুচি করে ছিঁড়েছে। শুধু তা-ই না—বারান্দার এক কোণায় বসে ছেলেমানুষের মতো কাঁদতে শুরু করেছে। আমি সান্ত্বনা দেবার জন্যে তার কাছে গিয়ে চমকে উঠলাম। সে কাঁদছে ঠিকই কিন্তু তার বাঁ চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। ডান চোখ শুকনো।
আমি তাকে কিছু বললাম না। কিন্তু সে আমার চাউনি থেকেই ব্যাপারটা বুঝে ফেলল। নিচু গলায় বলল, জুডি ইদানীং এই ব্যাপারটা হচ্ছে—মাঝে মাঝেই দেখছি বাঁ চোখ দিয়ে পানি পড়ে।
কথাগুলি বলার সময় তাকে এত অসহায় লাগছিল যে আমার ইচ্ছা করছিল তাকে জড়িয়ে ধরে বলি—I love you, I love you, I love you.
হে ঈশ্বর! হে পরম করুণাময় ঈশ্বর! এই ভয়াবহ সমস্যা থেকে তুমি আমাদের দুজনকে উদ্ধার করো।
স্কেচ বুকের প্রতিটি লেখা বারবার পড়ে মিসির আলি খুব বেশি তথ্য বের করতে পারলেন না, তবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যা জানা গেল তা হচ্ছে—মেয়েটি তার স্বামীকে ভালোবাসে। যে ভালোবাসায় একধরনের সারল্য আছে।
স্কেচ বুকে কিছু স্প্যানিশ ভাষায় লেখা কথাবার্তাও আছে। স্প্যানিশ ভাষা না জানার কারণে তার অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হলো না। তবে এই লেখাগুলি যেভাবে সাজানো তাতে মনে হচ্ছে—কবিতা কিংবা গান হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মডার্ন ল্যাংগুয়েজ ইনস্টিটিউটে স্কেচ বুক নিয়ে গেলেই ওরা পাঠোদ্ধারের ব্যবস্থা করে দেবে—তবে মিসির আলির মনে হলো তার প্রয়োজন নেই, যা জানার তিনি জেনেছেন। এর বেশি কিছু জানার নেই।


রাশেদুল করিম ঠিক ছয়টায় এসেছেন। মনে হচ্ছে বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। ঠিক ছয়টা বাজার পর কলিং বেলে হাত রেখেছেন। মিসির আলি দরজা খুলে বললেন, আসুন।
রাশেদুল করিমের জন্যে সামান্য বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। তার জন্যে টেবিলে দুধ ছাড়া চা। মিসির আলি বললেন, আপনি কাঁটায় কাঁটায় ছয়টায় আসবেন বলে ধারণা করেই চা বানিয়ে রেখেছি। লিকার কড়া হয়ে গেছে বলে আমার ধারণা। খেয়ে দেখুন তো।
রাশেদুল করিম চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন, ধন্যবাদ।
মিসির আলি নিজের কাপ হাতে নিতে নিতে বললেন, আপনাকে একটা কথা শুরুতেই বলে নেয়া দরকার। আমি মাঝে মাঝে নিজের শখের কারণে—সমস্যা নিয়ে চিন্তা করি। তার জন্যে কখনো অর্থ গ্রহণ করি না। আমি যা করি তা আমার পেশা না—নেশা বলতে পারেন। আপনার ডলার আমি নিতে পারছি না। তা ছাড়া অধিকাংশ সময়ই আমি সমস্যার কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারি না। আমার কাছে পাঁচ শ পৃষ্ঠার একটা নোট বই আছে। ঐ নোট বই ভর্তি এমন সব সমস্যা—যার সমাধান আমি বের করতে পারিনি।
‘আপনি কি আমার সমস্যাটার কিছু করেছেন?’
‘সমস্যার পুরো সমাধান বের করতে পারিনি—আংশিক সমাধান আমার কাছে আছে। আমি মোটামুটিভাবে একটা হাইপোথিসিস দাঁড় করিয়েছি। সেই সম্পর্কে আপনাকে আমি বলব, আপনি নিজে ঠিক করবেন—আমার হাইপোথিসিসে কী কী ত্রুটি আছে। তখন আমরা দুজন মিলে ত্রুটিগুলি ঠিক করব।’
‘শুনি আপনার হাইপোথিসিস।’
‘আপনার স্ত্রী বলেছেন, ঘুমুবার পর আপনি মৃত মানুষের মতো হয়ে যান। আপনার হাত-পা নড়ে না। পাথরের মূর্তির মতো বিছানায় পড়ে থাকেন। তাই না?’
‘হ্যাঁ—তাই।’
‘স্লিপ অ্যানালিস্টরা আপনাকে পরীক্ষা করে বলেছেন—আপনার ঘুম সাধারণ মানুষের ঘুমের মতোই। ঘুমের মধ্যে আপনি স্বাভাবিকভাবেই নড়াচড়া করেন।’
‘জি—কয়েকবারই পরীক্ষা করা হয়েছে।’
‘আমি আমার হাইপোথিসিসে দুজনের বক্তব্যই সত্য ধরে নিচ্ছি। সেটা কিভাবে সম্ভব? একটিমাত্র উপায়ে সম্ভব—আপনি যখন বিছানায় শুয়েছিলেন তখন ঘুমুচ্ছিলেন না। জেগে ছিলেন।’
রাশেদুল করিম বিস্মিত হয়ে বললেন, কী বলছেন আপনি?
মিসির আলি বললেন, আমি গতকালও লক্ষ্য করেছি—আজও লক্ষ্য করছি আপনার বসে থাকার মধ্যেও একধরনের কাঠিন্য আছে। আপনি আরাম করে বসে নেই—শিরদাঁড়া সোজা করে বসে আছেন। আপনার দুটা হাত হাঁটুর ওপর রাখা। দীর্ঘ সময় চলে গেছে আপনি একবারও হাত বা পা নাড়াননি। অথচ স্বাভাবিকভাবেই আমরা হাত-পা নাড়ি। কেউ কেউ পা নাচান।
রাশেদুল করিম চুপ করে রইলেন। মিসির আলি বললেন, ঐ রাতে আপনি বিছানায় শুয়েছেন—মূর্তির মতো শুয়েছেন। চোখ বন্ধ করে ভাবছেন আপনার অঙ্কের সমস্যা নিয়ে। গভীরভাবে ভাবছেন। মানুষ যখন গভীরভাবে কিছু ভাবে তখন একধরনের ট্রেন্স স্টেটে ভাবজগতে চলে যায়। গভীরভাবে কিছু ভাবা হচ্ছে একধরনের মেডিটেশন। রাশেদুল করিম সাহেব।
‘জি।’
‘অঙ্ক নিয়ে ঐ ধরনের গভীর চিন্তা কি আপনি প্রায়ই করেন না?’
‘জি, করি।’
‘আপনি কি লক্ষ্য করেছেন এই সময় আশেপাশে কী ঘটছে তা আপনার খেয়াল থাকে না।’
‘লক্ষ্য করেছি।’
‘আপনি নিশ্চয়ই আরো লক্ষ্য করেছেন যে এই অবস্থায় আপনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিচ্ছেন। লক্ষ্য করেননি?’
‘করেছি।’
‘তাহলে আমি আমার হাইপোথিসিসে ফিরে আসি। আপনি বিছানায় শুয়ে আছেন। আপনার মাথায় অঙ্কের জটিল সমস্যা। আপনি ভাবছেন, আর ভাবছেন। আপনার হাত-পা নড়ছে না। নিঃশ্বাস এত ধীরে পড়ছে যে মনে হচ্ছে আপনি মৃত।’
রাশেদুল করিম সাহেব সানগ্লাস খুলে—এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মিসির আলি বললেন, ভালো কথা আপনি কি লেফ্ট হ্যানডেড পারসন? ন্যাটা?
ভদ্রলোক বিস্মিত হয়ে বললেন, হ্যাঁ, কেন বলুন তো?
‘আমার হাইপোথিসিসের জন্যে আপনার লেফ্ট হ্যানডেড পারসন হওয়া খুবই প্রয়োজন।’
‘কেন?’
‘বলছি। তার আগে—শুরুতে যা বলছিলাম সেখানে ফিরে যাই। দৃশ্যটি আপনি দয়া করে কল্পনা করুন। আপনি একধরনের ট্রেন্স অবস্থায় আছেন। আপনার স্ত্রী জেগে আছেন—ভীত চোখে আপনাকে দেখছেন। আপনার এই অবস্থার সঙ্গে তাঁর পরিচয় নেই। তিনি ভয়ে অস্থির হয়ে গেলেন। তাঁর ধারণা হলো আপনি মারা গেছেন। তিনি আপনার গায়ে হাত দিয়ে আরো ভয় পেলেন। কারণ আপনার গা হিমশীতল।’
‘গা হিমশীতল হবে কেন?’
‘মানুষ যখন গভীর ট্রেন্স স্টেটে চলে যায় তখন তার হার্টবিট কমে যায়। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ধীরে বয়। শরীরের টেম্পারেচার দুই থেকে তিন ডিগ্রি পর্যন্ত নেমে যায়। এইটুকু নেমে যাওয়া মানে অনেকখানি নেমে যাওয়া। যা-ই হোক আপনার স্ত্রী আপনার গায়ে হাত দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনি তাকালেন—তাকালেন, কিন্তু এক চোখ মেলে। বাঁ চোখে। ডান চোখটি তখনো বন্ধ।’
‘কেন?’
‘ব্যাখ্যা করছি। রাইট হ্যানডেড পারসন যারা আছে তাদের এক চোখ বন্ধ করে অন্য চোখে তাকাতে বললে তারা বাঁ চোখ বন্ধ করে ডান চোখে তাকাবে। ডান চোখ বন্ধ করে বাঁ চোখে তাকানো তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এটা সম্ভব শুধু যারা ন্যাটা তাদের জন্যেই। আপনি লেফট্ হ্যানডেড পারসন—আপনি একধরনের গভীর ট্রেন্স স্টেটে আছেন। আপনার স্ত্রী আপনার গায়ে হাত রেখেছেন। আপনি কী হচ্ছে জানতে চাচ্ছেন। চোখ মেলছেন। দুটি চোখ মেলতে চাচ্ছেন না। গভীর আলস্যে একটা চোখ কোনোমতে মেললেন—অবশ্যই সেই চোখ হবে বাঁ চোখ। আমার যুক্তি কি গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে?’
রাশেদুল করিম হ্যাঁ-না কিছু বললেন না।
মিসির আলি বললেন, ‘আপনার স্ত্রী আরো ভয় পেলেন। সেই ভয় তার রক্তে মিশে গেল। কারণ শুধুমাত্র একবার এই ব্যাপার ঘটেনি, অনেকবার ঘটেছে। আপনার কথা থেকেই আমি জেনেছি সেই সময় অঙ্কের একটি জটিল সমাধান নিয়ে আপনি ব্যস্ত। আপনার সমগ্র চিন্তা-চেতনায় আছে—অঙ্কের সমাধান—নতুন কোনো থিওরি। নয়-কি?
‘হ্যাঁ’।
‘এখন আমি আমার হাইপোথিসিসের সবচেয়ে জটিল অংশে আসছি। আমার হাইপোথিসিস বলে আপনার স্ত্রী আপনার চোখ গেলে দেননি। তাঁর পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। তিনি আপনার চোখের প্রেমে পড়েছিলেন। একজন শিল্পী মানুষ কখনো সুন্দর কোনো সৃষ্টি নষ্ট করতে পারেন না। তবু যদি ধরে নিই তাঁর মাথায় হঠাৎ রক্ত উঠে গিয়েছিল এবং তিনি এই ভয়াবহ কাণ্ড করেছেন—তাহলে তাঁকে এটা করতে হবে ঝোঁকের মাথায়—আচমকা। আপনার চোখ গেলে দেয়া হয়েছে পেনসিলে, যে পেনসিলটি আপনার মাথার বালিশের নিচে রাখা। যিনি ঝোঁকের মাথায় একটা কাজ করবেন তিনি এত যন্ত্রণা করে বালিশের নিচ থেকে পেনসিল নেবেন না। হয়তোবা তিনি জানতেনও না বালিশের নিচে পেনসিল ও নোট বই নিয়ে আপনি ঘুমান।’
রাশেদুল করিম বললেন, কাজটি তাহলে কে করেছে?
‘সেই প্রসঙ্গে আসছি, আপনি কি আরেক কাপ চা খাবেন? বানিয়ে দেব?’
‘না।’
‘এ্যাকসিডেন্ট কিভাবে ঘটল তা বলার আগে আপনার স্ত্রীর লেখা ডায়েরির প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, আপনার বাঁ চোখ দিয়ে পানি পড়ত। কথাটা কি সত্যি?’
‘হ্যাঁ, সত্যি।’
‘কেন পানি পড়ত? একটি চোখ কেন কাঁদত? আপনার কী ধারণা?’
রাশেদুল করিম বললেন, ‘আমার কোনো ধারণা নেই। আপনার ধারণাটা বলুন। আমি অবশ্যি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। ডাক্তার বলেছেন, ‘এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। যে গ্ল্যান্ড চোখের জল নিয়ন্ত্রণ করে সেই গ্ল্যান্ড বাঁ চোখে বেশি কর্মক্ষম ছিল।’
মিসির আলি বললেন, এটা ‘একটা মজার ব্যাপার। হঠাৎ কেন বাঁ চোখের গ্ল্যান্ড কর্মক্ষম হয়ে পড়ল। আপনি মনে মনে এই চোখকে আপনার সব রকম অশান্তির মূল বলে চিহ্নিত করার জন্যেই কি এটা হলো? আমি ডাক্তার নই। শরীরবিদ্যা জানি না। তবে আমি দুজন বড় ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা বলেছেন, এটা হতে পারে। মোটেই অস্বাভাবিক নয়। গ্ল্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক। একটি চোখকে অপছন্দও করছে মস্তিষ্ক।
‘তাতে কী প্রমাণ হচ্ছে?’
মিসির আলি কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, তাতে একটি জিনিসই প্রমাণিত হচ্ছে—আপনার বাঁ চোখ আপনি নিজেই নষ্ট করেছেন।
অনেকক্ষণ চুপচাপ থেকে রাশেদুল করিম ভাঙা গলায় বললেন, কী বলছেন আপনি?
‘কনসাস অবস্থায় আপনি এই ভয়ংকর কাজ করেননি। করেছেন সাব কনসাস অবস্থায়। কেন করেছেন তাও বলি, আপনি আপনার স্ত্রীকে অসম্ভব ভালোবাসেন। সেই স্ত্রী আপনার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন। কেন দূরে সরে যাচ্ছেন? কারণ তিনি ভয় পাচ্ছেন আপনার বাঁ চোখকে। আপনি আপনার স্ত্রীকে হারাচ্ছেন বাঁ চোখের জন্যে। আপনার ভেতর রাগ, অভিমান জমতে শুরু করেছে। সেই রাগ আপনার নিজের একটি প্রত্যঙ্গের ওপর। চোখের ওপর। এই রাগের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রচণ্ড হতাশা। আপনি যে বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন সেই গবেষণা অন্য একজন করে ফেলেছেন। জার্নালে তা প্রকাশিত হয়ে গেছে। আপনার চোখ সমস্যা তৈরি না করলে এমনটা ঘটত না। নিজেই গবেষণাটা শেষ করতে পারতেন। সব কিছুর জন্যে দায়ী হলো চোখ।’
মিসির আলি আরেকটি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, আমার এই হাইপোথিসিসের পেছনে আরেকটি শক্ত যুক্তি আছে। যুক্তিটি বলেই আমি কথা শেষ করব।
‘বলুন।’
‘আপনার স্ত্রী পুরোপুরি মস্তিষ্কবিকৃত হবার পরে যে কথাটা বলতেন, তা হলো—এই লোকটা পিশাচ। আমার কাছে প্রমাণ আছে। কেউ আমার কথা বিশ্বাস করবে না। কিন্তু প্রমাণ আছে। তিনি এই কথা বলতেন কারণ পেনসিল দিয়ে নিজের চোখ নিজের গেলে দেয়ার দৃশ্য তিনি দেখেছেন। আমার হাইপোথিসিস আমি আপনাকে বললাম। এর বেশি আমার কিছু বলার নেই।’
রাশেদুল করিম দীর্ঘ সময় চুপ করে রইলেন।
মিসির আলি আরেকবার বললেন, ভাই, চা করব? চা খাবেন?
তিনি এই প্রশ্নেরও জবাব দিলেন না। উঠে দাঁড়ালেন। চোখে সানগ্লাস পরলেন। শুকনো গলায় বললেন, যাই?
মিসির আলি বললেন, মনে হচ্ছে আমি আপনাকে আহত করেছি—কষ্ট দিয়েছি। আপনি কিছু মনে করবেন না। নিজের ওপরেও রাগ করবেন না। আপনি যা করেছেন প্রচণ্ড ভালোাবাসা থেকেই করেছেন।
রাশেদুল করিম হাত বাড়িয়ে মিসির আলির হাত ধরে ফেলে বললেন, আমার স্ত্রী বেঁচে থাকলে তার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিতাম—আপনি দেখতেন সে কী চমৎকার একটি মেয়ে ছিল। এবং সেও দেখত—আপনি কত অসাধারণ একজন মানুষ। ঐ দুর্ঘটনার পর জুডির প্রতি তীব্র ঘৃণা নিয়ে আমি বেঁচে ছিলাম। আপনি এই অন্যায় ঘৃণা থেকে তাকে মুক্তি দিয়েছেন। জুডির হয়ে আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ভদ্রলোকের গলা ধরে এল। তিনি চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলে বললেন, মিসির আলি সাহেব। ভাই দেখুন—আমার দুটি চোখ থেকেই এখন পানি পড়ছে। চোখ পাথরের হলেও চোখের অশ্রুগ্রন্থি এখনো কার্যক্ষম। কুড়ি বছর পর এই ঘটনা ঘটল। আচ্ছা ভাই, যাই।
দুমাস পর আমেরিকা থেকে বিমান ডাকে মিসির আলি বড় একটা প্যাকেট পেলেন। সেই প্যাকেটে জল রঙে আঁকা একটা চেরী গাছের ছবি। অপূর্ব ছবি।
ছবির সঙ্গে একটি নোট। রাশেদুল করিম সাহেব লিখেছেন, আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি আপনাকে দিতে চাচ্ছিলাম। এই ছবিটির চেয়ে প্রিয় কিছু এই মুহূর্তে আমার কাছে নেই। কোনোদিন হবে বলেও মনে হয় না।

লেখকের বন্ধু লেখক


এক টেবিলের দু’ধারে দুজন বসে লিখছেন। প্রেমে, ডিভোর্সেও, এগিয়ে দিচ্ছেন আশ্রয়ের কাঁধ। প্রকাশক খুঁজে দিচ্ছেন, আমৃত্যু আগলে রাখছেন বন্ধুর লেখা। কলমের বন্ধুতা চারিয়ে যাচ্ছে জীবনে।


লিখেছেন শিশির রায়--



 61-Otto-Brod-und-Kafka-Quellennachweis

কাফকা ও তাঁর বন্ধু ম্যাক্স ব্রড

বড় বড় লেখকদের নিয়ে প্রচুর জনশ্রুতি জমা থাকে ইতিহাসে। বেশির ভাগই অনিবার্য রোম্যান্টিক। যেমন ছিল ইংরেজি সাহিত্যের দুই কবি— উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ আর স্যামুয়েল টেলর কোলরিজকে ঘিরে। ১৭৯৭-এর ইংলিশ সামারের এক দিন কোলরিজ নাকি চল্লিশ মাইল পথ উজিয়ে হাজির হয়েছিলেন এক বাগানবাড়িতে, যেখানে দুই ভাইবোন— উইলিয়াম আর ডরোথি— থাকছিলেন, লিখছিলেন। উইলিয়াম তখন সাতাশ বছরের তরুণ, ডরোথি ছাব্বিশ, কোলরিজ পঁচিশ। কোলরিজের দিন তিনেকের ‘দেখা করতে আসা’ সে যাত্রা গড়িয়েছিল তিন হপ্তায়। দিনে ছবির মতো সুন্দর ইংল্যান্ডের কান্ট্রিসাইডে ঘুরে বেড়ানো, আর রাত জেগে দুই বন্ধুর কথা। কী দেখলাম, কবিতা লেখা হবে তাই নিয়ে। ভাবনার বিনিময়: কেমন হবে কবিতার ভাব, ভাষা। খুব জ্বরে পড়লে যেমন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে মানুষ, তেমনই আচ্ছন্ন হয়ে কবিতা লিখতেন একই টেবিলের দু’ধারে দুজন। এ জুগিয়ে দিচ্ছেন এক-একটা ইমেজ, ও বলে দিচ্ছেন: আরে, সেই ভেবে-রাখা দুর্দান্ত স্তবকটা বাদ দিয়ে দিলে দেখছি, ঢোকাও ওটা! এমনই কবিতাতুতো বন্ধুতা, সে বার ফিরে এসে কোলরিজের সমারসেটের বাড়ির খুব কাছেই ডেরা বেঁধেছিলেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ। কাছাকাছি না থাকলে, পাশাপাশি না লিখলে, কী করে তৈরি হবে রোম্যান্টিক মুভমেন্টের কাব্যভাষা, লেখা হবে যুগান্তকারী কবিতার বই ‘লিরিকাল ব্যালাড্‌স’! কী করে হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটবে ‘টিনটার্ন অ্যাবি’ আর ‘দ্য রাইম অব দি এনশেন্ট মেরিনার’!

১৮৫০-এ ওয়ার্ডসওয়ার্থ মারা যাচ্ছেন, আর তার ঠিক বছরখানেকের মাথায় চার্লস ডিকেন্সের সঙ্গে দেখা হচ্ছে উইল্কি কলিন্স-এর। চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই ডিকেন্স তখন ইংল্যান্ডে সেনসেশন, খোদ মহারানি ভিক্টোরিয়া তাঁর নভেল ‘অলিভার টুইস্ট’ আর ‘দ্য পিকউইক পেপার্স’ পড়ে দরাজ সার্টিফিকেট দিয়েছেন। সেলেব্রিটি লেখকের দিকে যেমন তাকিয়ে থাকে স্বপ্নালু উঠতি-লিখিয়েরা, এক আড্ডায় ডিকেন্সকেও সে ভাবেই দেখছিলেন বছর সাতাশের কলিন্স। তিনি তখন স্রেফ খানকয়েক গল্প, একটা উপন্যাস লিখে প্রকাশকের দুয়ো-কুড়োনো যুবক। কিন্তু, বন্ধুতার ঈশ্বর যে কার জন্য কোথায় কুটোবাঁধা করে রাখেন কাউকে! সে দিনের সেই বন্ধুত্ব চলল সারা জীবন। চার্লস ডিকেন্স আর উইল্কি কলিন্স— দুজনে একসঙ্গে নাটকে অভিনয় করেছেন। কলিন্সের ছোটগল্প ডিকেন্স বের করেছেন তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা ‘হাউসহোল্ড ওয়ার্ডস’-এ, পরে সেখানেই দুজনে একসঙ্গে কলাম লিখেছেন। একসঙ্গে ডিনার, মদ খাওয়া, নাটক দেখা। দাড়ি রাখবেন তো দুজনেই রাখবেন। লন্ডন বা প্যারিসের রাস্তায় একসঙ্গে হাঁটবেন। আর এ সবেরই মধ্য দিয়ে কবে যেন ডিকেন্সের চিঠির সম্বোধন বদলে গেল ‘মাই ডিয়ার কলিন্স’ থেকে ‘মাই ডিয়ার উইল্কি’তে, চিঠি-শেষের পোশাকি ‘এভার ফেথফুলি’ হল ‘এভার অ্যাফেকশনেটলি’। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি-শাসিত ভারতে যখন সিপাহি বিদ্রোহের মেঘ, তখন লন্ডনে কলিন্সের লেখা নাটক স্টেজে নামাচ্ছেন ডিকেন্স। সেই নাটকের সুবাদেই ডিকেন্সের সঙ্গে পরিচয় অষ্টাদশী সুন্দরী তরুণী এলেন টার্নান-এর, যাঁর প্রেমে মজে ক’মাস পরেই নিজের বৈঠকখানা আর শোবার ঘরের মধ্যে পার্টিশন বসাবেন ডিকেন্স, অচিরে বিয়েও ভাঙবে মধ্যবয়সি লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখকের। টালমাটাল দাম্পত্যের ঘায়ে ক্লান্ত, ধ্বস্ত ডিকেন্সের কাছে আশ্রয়ের কাঁধ তখন বন্ধু কলিন্সই। কলিন্সকে ডিকেন্স লিখছেন: ‘আমরা দুজনে চলো কোথাও যাই, ঘুরে-দেখে আসি কিছু, যা নিয়ে দুজনে লিখতেও পারি। কোনও জায়গা জানা আছে তোমার? আমাদের পত্রিকার জন্য লেখা দরকার, আর আমার আরও বেশি দরকার নিজের কাছ থেকে পালানো।’ অগ্রজপ্রতিম বন্ধুর বিয়ে ভাঙার ঘটনায় কলিন্স ডিকেন্সের পাশেই ছিলেন সব সময়, আবার ওঁদের ডিভোর্সের পরেও বরাবর সহৃদয় যোগাযোগ রেখেছেন বন্ধুপত্নী ক্যাথরিনের সঙ্গে, নিজের উপন্যাস-আধারিত নাটক ‘দি উওম্যান ইন হোয়াইট’-এর বক্স-টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছেন নেমন্তন্ন-চিঠি সহ। কত কাজই যে করতে হয় বন্ধুদের!

‘প্রিয়তম ম্যাক্স, আমার শেষ ইচ্ছা: যা কিছু আমি রেখে যাচ্ছি— ডায়েরি, পাণ্ডুলিপি, নিজের আর অন্যের চিঠিপত্র, আঁকিবুঁকি (আমার বইয়ের তাকে, আলমারিতে, বাড়ি বা অফিসের লেখার টেবিলে, বা তুমি খুঁজে পাও এমন অন্য যে কোনও জায়গাতেই)— না-পড়া অবস্থাতেই সব একেবারে পুড়িয়ে ফেলা হোক। তোমার কাছে আমার লেখা বা আঁকা যা কিছু আছে, সেগুলোও। অন্যের কাছে আমার যা কিছু আছে (আমার হয়ে ওদের বোলো), তাও। চিঠিগুলো কেউ যদি তোমাকে ফেরত দিতে না চায়, অন্তত ওদের দিয়ে শপথ করিয়ে নিও, যেন ওরা নিজেরাই সেগুলো পুড়িয়ে ফেলে।’ বিশ শতকের সাহিত্য যাঁর কাঁধে ভর করে দাঁড়িয়ে, সেই ফ্রান্‌ৎজ কাফকা মৃত্যুর আগে লিখে গিয়েছিলেন এই শব্দগুলো, বন্ধু ম্যাক্স ব্রড-কে। ১৯২৪-এ কাফকা যখন মারা যাচ্ছেন দুরারোগ্য যক্ষ্মায়, বার্লিন বা প্রাগের সাহিত্যবৃত্তে তখন তিনি আদৌ পরিচিত কোনও লেখক নন। সেই তাঁকেই অমর করে তুললেন বন্ধু সাংবাদিক-লেখক ম্যাক্স, মৃত্যুর পর কাফকার সব লেখা, গল্প-উপন্যাস প্রকাশ করে। প্রিয় বন্ধুর উইলকেও আমল দেননি। সেই যেমন জেলে চল্লিশ দিন অনশনরত কাজী নজরুল ইসলামকে লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ: অনশন ভাঙো, our literature claims you, তেমনই যেন জেনে গিয়েছিলেন বন্ধু ম্যাক্স ব্রডও— বিশ্বসাহিত্য দাবি করে কাফকাকে। ম্যাক্সেরই একক প্রচেষ্টায় ১৯২৫-এ কাফকার ‘দ্য ট্রায়াল’, তার পরের বছর ‘দ্য কাস্‌ল’ প্রকাশের পর যখন আবিশ্ব তোলপাড়, ম্যাক্স বলেছিলেন, আমি তো ফ্রান্‌ৎজকে অনেক আগেই বলেছিলাম, তুমি এই সময়ের সবচেয়ে বড় ‘কবি’! ১৯৩৯-এ নাৎসি সেনারা প্রাগে ঢুকে পড়েছে, ইহুদি ম্যাক্স পালিয়ে এলেন ইজরায়েলে। প্রাণ হাতে করে ট্রেনে চড়েছেন, কিন্তু সঙ্গের সুটকেসে বন্ধুর যাবতীয় লেখা ভরে আনতে ভোলেননি! আরও যে তিরিশ বছর বেঁচে ছিলেন, বেঁচে ছিলেন প্রিয় বন্ধুর লেখা সমস্ত অক্ষরকে মায়ের ভালবাসায় আগলে। ম্যাক্স ব্রডদের জন্যই পৃথিবী পেয়েছে ফ্রান্‌ৎজ কাফকাদের।

খুব কাছের মানুষকে চিনতে পারা কঠিন— একমাত্র বন্ধুরাই বোধহয় এ কথা মানবে না। নিজের পরিবারের সামনেও যে মানুষটা ডালাবন্ধ সিন্দুক, বন্ধুর সামনে সে-ই খোলা বইয়ের পাতা। আমার হাত একদম খালি, আমার ঘরে খাবার নেই, আমার একটা গোপন রোগ হয়েছে, আমার কিস্যু লেখা আসছে না— বন্ধুকে সব বলা চলে। আর সেই সব আক্রান্ত সময়ে, বন্ধু নামের মানুষটারও যেন একটা মেটামরফোসিস ঘটে চোখের সামনে। সে হয়ে ওঠে ছায়া-দেওয়া একটা মহাগাছ, বিরাট ডানা মেলা পাখি, চওড়া বুক-কাঁধওয়ালা মহামানুষ। ফ্রিডরিখ এঙ্গেল্‌স ম্যাঞ্চেস্টারে ফার্ম দেখাশোনার কাজ ছেড়ে চলে এলেন, কার্ল মার্ক্স নামের এক বন্ধুর তাঁকে ‘খুব দরকার’ বলে। জানতেন বন্ধুটির সামনে জরুরি খুব জরুরি একটা বই লেখার কাজ পড়ে, সাংগঠনিক আর আন্দোলনের হাতভর্তি কাজও, আর সে দিন কাটাচ্ছে কপর্দকহীন অবস্থায়। এঙ্গেল্‌স এমন বন্দোবস্ত করে এলেন, যাতে ফার্ম থেকে নিয়মিত টাকা আসার একটা হিল্লে হয়, সেই দিয়ে বন্ধু আর তার পরিবারের খাবার জুটবে। এসে দেখলেন, নানান দেশের কমিউনিস্ট বন্ধু-নেতারা রোজ আসছেন, মার্ক্সের সময় নেই, শারীরিক শক্তিও নেই সব সামলানোর। নিজের কাঁধে তুলে নিলেন সেই মহাগুরুত্বপূর্ণ কাজ। ১৮৭০-এর পর, ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসে মার্ক্সের শরীর যখন ভেঙে পড়েছে, এঙ্গেল্‌সই তখন দু’হাতে সব সামলাচ্ছেন। ১৮৮৩-তে মার্ক্সের মৃত্যুর পর, এগারো বছর ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়েছেন, সম্পাদনা করেছেন বন্ধুর লেখা। হিজিবিজি দুর্বোধ্য ছিল মার্ক্সের হাতের লেখা, জায়গায় জায়গায় স্বরচিত স্টেনোগ্রাফিক সিম্বলে ভরা। সব সামলে, প্রকাশ করেছেন ‘দাস কাপিটাল’-এর দ্বিতীয়, তৃতীয় খণ্ড। এঙ্গেল্‌স খান বারো ভাষা জানতেন, দু’হাত ভরে লিখেছেন জার্মানি, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্সের বন্ধুদের জন্য, পোলিশ ভাষায় কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর ভূমিকা। কিন্তু বিপুল কীর্তির কণামাত্র নিজে নেননি, এগিয়ে দিতেন কার্ল মার্ক্সকে: ‘What I contributed, Marx could have easily filled in without my aid, ... But what Marx did, I could have never done.’ ‘Marx was a genius, we were at most talents.’

সাচ্চা বন্ধু খুঁজতে বিলেত যেতে হবে না। সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ ছবি তৈরির নেপথ্য-স্ট্রাগ্‌ল সর্বজনবিদিত, কিন্তু ক’জন জানেন, ‘পথের পাঁচালী’ ছাপতে বিভূতিভূষণের কী হাল হয়েছিল! ১৯২৯-এ বিভূতিভূষণ ভাগলপুর এস্টেটের কাজ ছেড়ে কলকাতায় মাটি কামড়ে পড়ে আছেন, পাণ্ডুলিপি নিয়ে প্রকাশকদের দরজায় দরজায় ঘুরছেন। আর ধেয়ে আসছে উপেক্ষা— ও তো ‘বটানির বই’! নর-নারীর প্রেমকাহিনি নেই, গা-শিউরোনো খুন-কেচ্ছা না, ও আবার প্লট! বিখ্যাত এক প্রকাশক বলেছিলেন, পঞ্চাশ টাকা দিতে পারি, কপিরাইট দেবেন? আর এক জন: বই ছাপার পর আদৌ বিক্রিবাটা হলে, খানিকটা রয়্যালটি দেওয়ার কথা ভাবতে পারি। বিভূতিভূষণ যখন ভাবছেন আর কিছু হল না, ফের ভাগলপুরেই ফিরে যাবেন, তখনই আবির্ভাব বন্ধু নীরদের। নীরদ সি চৌধুরী, রিপন কলেজে তাঁর সহপাঠী, মির্জাপুর স্ট্রিটের মেস-মেট। ‘বিচিত্রা’য় পথের পাঁচালী ধারাবাহিক ভাবে বেরনো ইস্তক নীরদবাবু বলে আসছেন, এ উপন্যাস অসামান্য, যুগান্তকারী, এ বইয়ের ‘ভদ্র প্রকাশক’ না জুটলে তা নিতান্তই দুর্ভাগ্যের। ভেঙে-পড়া বিভূতিভূষণকে টেনে তুলে নীরদ সি চৌধুরী যদি সে দিন ‘প্রবাসী’র আড্ডায় সজনীকান্ত দাসের কাছে নিয়ে না ফেলতেন, বাংলা সাহিত্য বিভূতিভূষণকে (আর এই পৃথিবী সত্যজিৎ রায়কে) পেত কি না সন্দেহ। সজনীকান্তও তখন প্রকাশনার কারবারে নিতান্ত অনভিজ্ঞ। এ বই বার করতে গিয়ে লোন করতে হয়েছিল তাঁকেও। তবু, নীরদ সি চৌধুরীর কথা শুনে, ‘পথের পাঁচালী’ পুরোটা পড়ে, আর সুলেখককে রক্ষা করার প্রেরণায় প্রকাশক হওয়ার তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে বিন্দুমাত্র ভাবেননি!

ভক্ত-গুণমুগ্ধ-স্তাবক পরিবৃত রবীন্দ্রনাথের কি কোনও বন্ধু ছিল? যার কাছে মন খুলতেন, এমন কথা বলতেন যা কেউ শোনেনি? বনফুল, ডা. বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ওঁর যে ক’টা সাক্ষাৎ, পড়ে মনে হয় যেন দুই বন্ধুর মোলাকাত। শুরুটা হয়েছিল দ্বন্দ্ব দিয়ে, রবীন্দ্রনাথের কিছু কথা আর কাজ ভাল না লাগায় ব্যঙ্গ শানিয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় একখানা কবিতা-চিঠি লিখেছিলেন বনফুল। কিন্তু, ‘দ্বন্দ্ব’ মানে তো মিলনও! এর পরেই রবীন্দ্রনাথের চিঠি বনফুলকে, শান্তিনিকেতনে আমন্ত্রণ জানিয়ে। ১৯৩৭-’৩৮ সালের ওই বারকয়েকের দেখায়, অন্য এক রবীন্দ্রনাথকে চিনেছিলেন বনফুল। যে রবীন্দ্রনাথ বলাইয়ের জন্য ঘুগনি রাঁধতে বলেন— ‘বড় বড় কাবলে মটরের ঘুগনি, মাঝখানে একটা লাল লঙ্কা গোঁজা থাকবে’! এই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বন্ধুর মতো তর্ক জোড়া যায়: ‘আপনার বিরাট অস্তিত্ব এখানে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করেছে যে তার কাছাকাছি থেকে পরীক্ষা-পাশের জন্য পড়া মুখস্থ করা শক্ত’, ‘... এটা মেয়েদের ইউনিভার্সিটি হলে ভাল হয়।’ রবীন্দ্রনাথও ঠিক বন্ধুর মতোই চ্যালেঞ্জ ছোড়েন: ‘তুমি যা বলছ তা হাতেকলমে করে দেখিয়ে দাও।... যদি করতে পার তাহলে আমিও এখান থেকে চলে যাব, আমাকে যেখানে যেতে বলবে সেইখানে যাব।’ প্রিয় বন্ধু দুর্দান্ত ভাল কিছু করলে যেমন তাকে সর্বস্ব দিয়ে দিতে ইচ্ছে হয়, ঠিক তেমনই, বনফুলের একটা গল্প খুব ভাল লেগেছে বলে তাঁকে বলছেন, অনেকগুলো কলম রয়েছে, যদি কোনওটা পছন্দ হয় নাও। নয়তো ওই রেডিয়োটা নাও। এই রবীন্দ্রনাথই চিঠিতে গল্পের প্লট পাঠাচ্ছেন বনফুলকে: ‘তুমিই ঠিক পারবে’; বনফুলের নাটকের স্বপ্নদৃশ্য পালটানোর সাজেশন দিয়ে বলছেন, নিবেদিতার অনুরোধে কেমন তিনি নিজেও ‘গোরা’র শেষটা পালটে দিয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনে পড়ুয়াদের সাহিত্যসভায় বনফুলকে প্রধান অতিথি করে পাঠিয়ে পরে লোক পাঠাচ্ছেন এ কথা বলে দিতে যে, ওদের লেখা পছন্দ না হলেও, বনফুল ‘ছেলেমেয়েদের যেন বেশি না বকে’! রাতে শুয়ে পড়ার পরও লোক দিয়ে বনফুলকে নিজের ঘরে ডেকে পাঠিয়ে বলছেন ‘গান শুনবে?’, তার পরেই গেয়ে উঠছেন ‘সার্থক জনম আমার’। সভায় ‘বসন্ত’ কবিতা পড়ছেন বেমালুম দুটো স্তবক বাদ দিয়ে, পরে বনফুল সে কথা তুলতে বলছেন, ‘এখানে কেউ ধরতে পারে না। প্রায়ই আমি বাদ দি’।’ আবার সুবন্ধুর মতো বাতলে দিচ্ছেন পরামর্শ— রোজ নিয়ম করে নির্দিষ্ট একটা সময়ে লিখতে বসতে হবে, লেখালিখির পাশাপাশি বেশি পড়তে হবে ইতিহাস-দর্শন-বিজ্ঞান (‘উপন্যাস না পড়লেও চলবে’), লেখার সময় কী কী মনে রাখতে হবে, সব। এই বন্ধুতা পেয়েই বনফুল লেখেন: ‘...সঙ্কোচের কোন অবসরই ছিল না, যেন অকপটে তাঁর সঙ্গে আলাপ না করলেই অশোভন হবে এই রকম একটা আবহাওয়া গড়ে উঠেছিল...’

এ ভাবেই দুটো কলমের একসঙ্গে বা খানিক আগে-পরে লিখে চলা, নাড়িয়ে ঝাঁকিয়ে দেয় চরাচরকে। একটা কলমের কালি শেষ হয়ে এলে অন্যটা নিজের থেকেই ধার দেয় কিছুটা জীবনীশক্তি। আবার একটা কলম একেবারে ফুরিয়ে গেলে, অন্যটা চলতে থাকে। তাই কিট্‌স-এর মৃত্যুতে পৃথিবী পায় শেলির লেখা কবিতা ‘অ্যাডোনিস’। নজরুলের স্মৃতিতে বাল্যবন্ধু, সাহিত্যিক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় লেখেন ‘আমার বন্ধু নজরুল’, নিজের বইয়ের নাম দেন বন্ধুর লেখা গানের লাইন থেকেই, ‘কেউ ভোলে না কেউ ভোলে’। জেমস বল্ডউইনের মৃত্যুতে টোনি মরিসন লেখেন: ‘Like many of us left here I thought I knew you. Now I discover that in your company it is myself I know.’ শুধু লেখাতুতো বন্ধুতাই না, জীবনতুতো ইয়ারানা। প্যারিসের রাস্তায় মদে চুর জেমস জয়েস অন্য মদাড়ুর সঙ্গে হাতাহাতি বাঁধিয়ে দৌড়ে এসে লুকিয়ে পড়ছেন বিশালদেহী আর্নেস্ট ‘পাপা’ হেমিংওয়ের পেছনে, বন্ধুকে তাতাতে বলছেন, ‘ডিল উইথ হিম, হেমিংওয়ে, ডিল উইথ হিম!’ ১৮৬৬-’৭৬, দশ বছর ধরে একে অন্যকে চিঠি লিখে গেছেন পারফেকশনিস্ট গুস্তাভ ফ্লব্যের আর জীবনোচ্ছল জর্জ সাঁদ। সাহিত্য, রাজনীতি, সমাজ, মানবতা নিয়ে দুজন বেশির ভাগ সময়েই দুই অবস্থানে, তা বলে সংলাপ থামেনি, সখ্যও না। ১৯৩৬-এর মাদ্রিদে পাবলো নেরুদা দাঁড়িয়ে আছেন ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকার অপেক্ষায়, বক্সিং ম্যাচ দেখতে যাবেন দুজনে। লোরকাকে হত্যা করতে তখন বধ্যভূমিতে নিয়ে যাচ্ছে জেনারেল ফ্র্যাঙ্কোর সেনারা। সেই লোরকাকে নিয়ে কবিতা লিখছেন কলকাতার সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বন্ধু-কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় যাঁকে আখ্যা দিচ্ছেন ‘দশকের আততায়ী কবি’! জাঁ পল সার্ত্রের নাটকের অভিনয় শেষ হতে যেচে এসে আলাপ করছেন আলব্যের কামু নামের এক তরুণ, ক’দিন পরেই প্যারিসের বিখ্যাত ‘কাফে দ্য ফ্লোর’-এ সঙ্গে চুটিয়ে লেখালিখি শুরু সার্ত্র, সিমোন দা বুভোয়া আর কামু, তিন জনের! গ্যোয়টে-র ‘দ্য সাফারিংস অব ইয়াং ওয়্যারথার’ পড়ে ‘সুখদুঃখের সঙ্গী’ সুব্রত, কবি সুব্রত চক্রবর্তীর উদ্দেশে গোটা একটা বই লিখে ফেলছেন ভাস্কর চক্রবর্তী, আর সেই বইয়ের প্রচ্ছদলিপি আদরে এঁকে-লিখে দিচ্ছেন কমলকুমার মজুমদার। ‘সঙ্গে থাকো। সঙ্গে থাকো। সারাক্ষণ/ সঙ্গে সঙ্গে থাকো।’

"লিপি" - ব্রাত্য রাইসু


লিপির সঙ্গে দেখা হওয়ার ১০/১২ বছর পরে উনি মারা গেছিলেন। অন্য কারণে। মানে দেখা হওয়ার কারণে না। গলায় ক্যান্সার হইছিল। তার চিকিৎসা করাইতে উনি ভারত গেছিলেন। কয়েকবার আসা যাওয়া করছেন। কেমো নিছেন। তারপর মারা গেছেন।


একবার রনির (গল্পকার ও আর্টিস্ট) আম্মারে ধানমণ্ডির কোন একটা হাসপাতালে দেখতে গেছিলাম। ফিরা আসনের সময় নিচ তলায় লিফটের জন্যে যারা খাড়াইয়া ছিলেন তার মধ্যে দেখি লিপি। চুল ছোট কইরা ছাটা। হাতে খাবারের সসপ্যান। আমি জিগ্যেশ করলাম এইখানে কী মনে কইরা। লিপি হাসলেনআপনে বাসায় আসেন না কেন?টিটুর বউয়ের ডেঙ্গু হইছে। আমি বললাম যামু নে। জিগ্যেশ করলাম আপনের অবস্থা কীবললেন আবার মাদ্রাজ যাইতে হইব। তারপরে লিফটে উঠতে উঠতে বললেনআপনে আইসেন কিন্তু। আমি বললামযামু নে। তো লিপিরে আর দেখতে যাইতে হয় নাই।


আজকে ভোরবেলা লিপিরে দেখলাম স্বপ্নে। স্বপ্ন থিকা উইঠা লেখাটা লিখতে বসছি। লিপি সুন্দর শাড়ি পরতেনসুতি শাড়ি। সেই রকম শাড়ি পরা দেখলাম একটা পুকুর পাড়ে। একটা শহরের মাঝখানের পুকুর। বা মফস্বল রাজধানীর পুকুর। শহরতলীর ধরনে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল এরিয়া মতো। তো আমি দেইখা তার দিকে আগাইয়া গেলাম। গিয়া দেখলাম ওইখানেই তার বাড়ি। মানে আগে যে জানতাম না তা না। স্বপ্ন তোমারা যে গেছেন স্বপ্নে(ও) ভাবি নাই। দেখলাম স্বপ্নে না ভাবাই স্বাভাবিক। তবু মানুষ কেমন স্বপ্নের লগে একটা অহেতুক  লাগায়।


আগাইয়া যাইয়া ওনার সঙ্গে ওনার ভাই দুয়েকজনরে দেখলাম। বা ভাই না। যেমন ওনার বাসায় প্রতিবেশী কমবয়সী ছেলেরা যাইতলিপি আপা লিপি আপা করতোসেই রকম কিছু ছেলে দেখলাম। স্বপ্নে ভাই না প্রতিবেশী এইটা অপ্রকট থাকল। মানে বাস্তবে যেমন মানুষ দেখলেই কার লগে কী সম্পর্ক পট পট মিলা যায় আর আমরা ঠিক করি,এ হইল এর এইস্বপ্নে তা তো সব সময় হয় না।


সেই ছেলেদের একজন বললোআপনে একটু কৃপণ,নাআমি বুঝলাম না ব্যাপারটা। পরে আরেক ভাই কিংবা প্রতিবেশী বললোআপনে স্কলারশিপ পাইছেনখাওয়ান নাই! পরে দেখি লিপি। আমি ওনাদের বাসায় ঢোকার চেষ্টা করলাম। উনি বললেনআম্মা আপনেরে বাসায় নিতে মানা করছে। আপনে স্কলারশিপ পাইয়া খাওয়ান নাই। আর একটা ব্যাপার আছে। সেইটা এখন কমু না। পরে একটু গলা নামাইয়া বললেনপরে আপনেরে কমু। অথবা এমন হইতে পারে স্বপ্নে আমি ভাবছিলাম (এইখানে স্বপ্নেও ভাবি নাই সম্ভব দেখা যাইতেছে) বা উনি কী ভাবছিলেন আমি স্বপ্নে সেইটা বুঝতে পারতে ছিলাম। স্বপ্নে তো এ-ই নিয়ম। পরে কেমন মনে হইল পিছন দিক থিকা ওরা আমারে ঠেলতেছে। আমি আমার বাসার কাছে আইসা পড়লাম।


আমাদের বাসা স্বপ্নে অনেক বড় হইছিল। রাস্তার পাশে অনেকগুলা ঘর। তখন আর ঘরও মনে হইতেছিল নাহাটের মধ্যে যেমন থাকে খোলা রেস্টুরেন্টসেই রেস্টুরেন্টের ভিতর দিয়াই বাইর হওয়া যায় বাঁশের আড়তে বা চাউলের দোকানে সেই রকম খোলা বাসা আমাদের। আমি দেখলাম লিপি রাস্তার পাশের একটা ছোট চা দোকানে আমার অপেক্ষায় বইসা আছে। আমি তারে একটু পরে দেখা করমু ভাব দেখাইয়া সামনে দিয়া কে একজন সিগনেচার নিতে আসছেন তার লগে দেখা করতে আগাইলাম। আমি ভদ্রলোকরে বললামমেয়েদের কারোমানে আমার বোনদের সিগনেচার নেন তাইলেই তো হয়। বললেনমেয়েদের সিগনেচারে হবে না। আমি সিগনেচার দিলাম। পরে আরেকটু আগাইতেই কেমনে কেমনে অন্য ঘটনায় একজন রিকশাঅলা দেখলাম একটা ভাওয়াইয়া গাইতেছেন। আবার আমিও একই গান গাইতেছি। আমি যে ঘটনাক্রমে একই গান একই স্পটে আলাদাভাবে গুনগুনাইলাম তাতে রিকশাঅলার দিকে তাকাইয়া (সঙ্গে আরেক রিকশাঅলা) তার রুচির একটু তারিফ প্রকাশ করলাম। দেখলাম সেইটা বাউন্স হইল। আমার পিঠ চাপড়ানি ধরতে পাইরা একজন গাইতে গাইতে অন্যজন নিঃশব্দে যাইতে লাগলেন। আমি আগের জায়গায় আইসা দেখলাম লিপি নাইচইলা গেছেন।

বাসায় আইসা দেখি আব্বা আমার ছোট বোনরে বলতেছেন তার বাচ্চা নিয়া অন্য কোথাও গিয়া থাকতে। এখন সে কেমনে থাকবে একলা একটা বাচ্চা নিয়া অন্যত্রআমি আব্বার সঙ্গে কথাটা তুলতে চাইলাম। আব্বা উত্তর দিলেন না কোনো। আরেক বোনের সঙ্গে দেখা হইল। সে কী জানি বললো মনে নাই।


আমি বাইরে আসতে লিপি মোবাইলে ফোন করলেন। বললেনআপনে ফোন বন্ধ কইরা রাখছিলেনআমি অনেকক্ষণ যাবৎ চেষ্টা করতেছিলাম। আমার যে একটা মোবাইল ফোন আছেতা দিয়া যে লিপির সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় এইটা এতক্ষণ মাথায় আসে নাই।

লিপি বললেনরাইসু ভাইআমি যেইখানে কাজ করি ওইখানে একটা সমস্যা হইছে। উনি যখন এইসব বলতেছেন আমি তখন হাঁটতে হাঁটতে ওনার ক্যান্সার হাসপাতালের কাছাকাছি আসছি। কিন্তু এই হাঁটা অনেকটা বাতাসে ভাসার মতোই। নিচু নিচু গভীর খাদ। এর মাঝখান দিয়াই কাঁচা মাটির লাল রাস্তা। সরু। ভিজা। আমি হসপিটালের দিকে আগায় আসলাম। লিপি বললেনহাসপাতালের যিনি ডাক্তার তার ওইখানে কোনো এক বিদেশী রোগিণী আসছিল। ডাক্তার মহিলা বলছেন যে তার রোগ নাই। পরে নাকি দেখা গেছে আছে। তা নিয়া নাকি অনেক সমস্যা হইতেছে। আমি লিপিরে বললাম আমি এখন আপনের হাসপাতালের কম্পাউন্ডে। এইখানে অদ্ভুত দেখতে চাইরটা কী জানি কাদা পানির মইধ্যে ঘুরতেছে। লিপি আরও কী কী জানি বলতেছিলেন। আমারে যে ওনার বাসায় নিষেধ করা হইছে এইটা নিয়া কিছু বলতেছিলেন না। ওনার স্বামী কেনাডায় আছেনদুইটা বাচ্চা আছে ওনার সেই সবও দেখলাম স্বপ্নে মনে আসে নাই।


প্রাণী চাইরটা অদ্ভুত। স্বপ্নেও অদ্ভুত মনে হইল। পাতলা চ্যাপটা খয়েরি বড় পোকার মতো। অনেকটা ঘুড্ডির মত দেখতে। বাদামী রঙের। দুই জোড়া কাছাকাছি ছিল। এক জোড়া ভিন্ন লিঙ্গের বোঝা গেল। ওরা দুইটা করতেছিল। পাশেই আরেক সেট। বাপ আর ছেলে। একবার পানিরঘোলা পানিরনিচে ডোবে আবার ভাইসা ওঠে। একবার যেইটা ডোবে পরেরবার আরেকটা ডোবে। আমি হাসপাতাল থিকা আরেক রাস্তায় বাইর হইয়া আসলাম। কিছুক্ষণ হাঁটতেই উত্তর-পশ্চিম কোনায় দেখলাম ফরহাদ দাঁড়াইয়া আছে। ফরহাদ আমার ১৫ বছর আগের বন্ধু। আমরা এক সঙ্গে এক লোকের বাড়ি ভাঙতে গেছিলাম একবার। আমার হাতে রাম দা ধরায় দিছিল তখন কে জানি। আমি দেয়ালের উপরে দাঁড়ায় ছিলাম। ওরা ওই বাড়ির দরজা জানালায় কোপাকুপি করতে ছিল। ফরহাদ একটা লালবাদামি চৌকোনা ডিজাইন অলা টিশার্ট পরা। আমি তার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলাম। তারপরে কোলাকুলি করতে চাইলাম। সে বললোযাও গা,ঝড় আসতেছে।


দেখলাম আকাশে একটা গোলাপি-লালে মিশানো মেঘ। মোটা গরাদের মতো ফাঁক ফাঁক। কিন্তু আবার চারজন মানুষ যেন হাত ধরাধরি কইরা কোথাও যাইতেছে। অনেকটা মার্ক শাগালের ছবির নাচের ভঙ্গিতে বা কার জানি একটা সিনেমাতে যেইভাবে শয়তানরা যাইতেছিল ওইরকম। ওইখানে কামরুজ ভাইয়ের ভাই টুটুল মেবিতার সঙ্গে দেখা হইল। সে দেখলাম ঝড়ের হাত থিকা বাঁচনের জন্য দৌড় দিছে। আমিও দৌড় দিলাম। বাসায় পৌঁছতে পারব কিনা চিন্তা। বৃষ্টির ভারি ফোঁটা পড়া শুরু হইল।


এর মধ্যে আবার ফোন আসলো লিপির। লিপি যে ফোনে কথা কইতেছিলতা কীভাবে জানি অফ হইছিলবা অফ হওয়া ছাড়াই লিপি ফোন না রাখলেও আর ছিল না এতক্ষণ। স্বপ্নে এগুলি হয়। লিপি বলল আপনেরে একটা কথা বলি। আপনে তো জানেন আমার আগে একটা বিয়া হইছিল। ওই সময়ের আমার একটা ছবি আছে। আপনে এইটা একটু দেইখেন। কাকরাইলের ন্যাশনাল না কী যেন একটা হোটেলের নাম বইলা বলল ওইখানে ঢুকলে দেখবেন কাঠের তিনটা তাক আছেছবি সাজাইয়া রাখছে। আপনে মাঝখানেরটায় দেখবেন আমার ছবি আছে। ছবিতে এসিতারপরে কার্পেটের ছবি আছেআপনেগো কার্পেটটাও কিন্তু সুন্দরআমি মাঝখানে বইসা আছি।


আমি দেখলাম একটা ছবির ঠিক মাথার উপরে এসি আর হোটেল ঘরের বেগুনি কার্পেটের মধ্যে লিপি বইসা আছেন। আমি ভাবছিলাম ছবিতে তার আগের স্বামীরে দেখতে পাবোকিন্তু সেইটা নাই। লিপি বইসা যারা যারা ছবি দেখতেছে তাগো দিকে তাকাইয়া আছেন।


কিন্তু এইটা আমি ছবি নিয়া ভাবতেছিলাম। আসল ছবিটা দেখার জন্য আমি দেশে ফিরা কাকরাইলে হোটেলগুলাতে খোঁজ করমু। আসলে লিপি যে হোটেলের নামটা কী কইছিল ঠিক কইরা আমার মনে নাই। সবগুলা হোটেলেই খোঁজ করতে হইব