Friday, November 30, 2018

স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু : মুক্ত দর্শনের বিজ্ঞানী


bose87reমে ১০, ১৯০১। লন্ডনের রাজকীয় বিজ্ঞান সমিতির কেন্দ্রীয় মিলনায়তন। দীর্ঘদিন এখানে এত লোকের ভিড়ে কোনো বিজ্ঞানী বক্তব্য দেননি। এই বিজ্ঞানী আবার এসেছেন সাত সাগরের ওপার অর্থাত্ ভারত থেকে। দর্শকদের মধ্যে রয়েছেন লর্ড রেইলির মতো বিজ্ঞানকুল শিরোমণি। দর্শকেরা অবশ্য খুব বেশি চমত্কৃত হলেন না পরীক্ষার বন্দোবস্ত দেখে। একটি গাছের মূল একটি বোতলের পানির মধ্যে দেওয়ার ব্যবস্থা, গাছ থেকে কী সব তারটার টেনে এটা কিম্ভূতদর্শন যন্ত্রের সঙ্গে লাগানো।

দর্শকদের জ্ঞাতার্থে বিজ্ঞানী জানালেন, বোতলের ভেতরের তরল পদার্থটি পানি নয়, এটি ব্রোমাইড সলিউশন। উপস্থিত বিজ্ঞানের লোকেরা বুঝলেন অচিরেই গাছটি মরবে। কারণ, হাইড্রোব্রোমিক অ্যাসিডের এই লবণের দ্রবণ সহ্য করার ক্ষমতা গাছের নেই। তাতে অবশ্য তাঁদের ভ্রুক্ষেপ নেই। তাঁদের লক্ষ্য কিম্ভূত যন্ত্রটি।

বিজ্ঞানী গাছের মূলকে সলিউশনে দিয়ে দিলেন আর চালু করে দিলেন তাঁর যন্ত্র। চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেটি কাগজের ওপর মানুষের হূদ্যন্ত্রের ওঠা-নামার মতো গ্রাফ আঁকতে শুরু করল। তবে সেটিতে তেমন কোনো চাঞ্চল্য নেই। পেন্ডুলামের মতো একই নিয়মের ওঠা-নামা। কিন্তু একটু পরই যন্ত্রের গ্রাফে ব্যাপক চাঞ্চল্য দেখা দিল। গ্রাফ বেশ দ্রুত ওঠা-নামা শুরু করল। মনে হচ্ছে কার সঙ্গে যেন লড়ছে গাছটি। তবে একসময় সব চাঞ্চল্য থেমে গেল।

উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা দেখলেন, গাছটি মরে গেছে!

উপস্থিত বিজ্ঞানী ও দর্শকেরা সবাই চমত্কৃত হলেন ভারতীয় বাঙালি বিজ্ঞানীর এই যন্ত্রে। লর্ড রেইলি উঠে গিয়ে দর্শক সারিতে বসা বিজ্ঞানীর স্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে এলেন।

উদ্ভিদেরও প্রাণীদের মতো প্রাণ আছে, এই ধারণা কিন্তু নতুন নয়। কারণ, সবাই দেখেছে বীজ থেকে চারা হয়, সেটি মহিরুহ হয় এবং একসময় মরে যায়। কিন্তু উদ্দীপনায় উদ্ভিদও প্রাণীর মতো প্রতিক্রিয়া করে, জোর করে মেরে ফেলা হলে আর্তচিত্কার করে—এমনটা কেউ এর আগে ভাবেননি। ভেবেছেন ওই বাঙালি বিজ্ঞানী।

মুন্সিগঞ্জের রাঢ়িখালের সন্তান জগদীশ চন্দ্র বসু। ব্রিটিশ সরকারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ভগবান চন্দ্র বসু ও বনসুন্দরী দেবীর প্রথম সন্তান। জগদীশের জন্মের সময় তাঁর বাবা ফরিদপুরের ম্যাজিস্ট্রেট। তবে জগদীশ চন্দ্রের জন্ম ময়মনসিংহে, নানার বাড়িতে ১৮৫৮ সালের ৩০ নভেম্বর। সে সময় ইংরেজদের স্কুলে ছেলেমেয়েকে পড়ানো ছিল আভিজাত্যের ব্যাপার। কিন্তু ভগবান চন্দ্র বসু তাঁর সন্তানকে এমনকি ফরিদপুরেও রাখলেন না, পাঠিয়ে দিলেন নিজ গ্রামে। সেখানে বাবার চালু করা পাঠশালায় জগদীশের পড়ালেখার হাতেখড়ি। প্রাথমিক পড়ালেখার পর ফরিদপুর হাইস্কুলে পড়ে অবশেষে ১৮৬৯ সালে জগদীশ চলে গেলেন কলকাতায়। ভর্তি হলেন সেন্ট জেভিয়ার স্কুল ও কলেজে। সেখানে তখন বিজ্ঞান নিয়ে ভারতবাসীকে জাগানোর চেষ্টা করছেন ফাদার ইউজিন ল্যাকো। বিজ্ঞানেই মুক্তি, এ ছিল তাঁর যুক্তি। জগদীশ হয়ে উঠলেন তাঁর ভক্ত।

১৮৭৯ সালে ফিজিক্যাল সায়েন্সে জগদীশ চন্দ্র বিএ পাস করলেন। বিজ্ঞান নিয়ে পড়ালেখা করার জন্য তিনি বিলাত (ইংল্যান্ড) যাওয়ার মনস্থির করলেন। কিন্তু বাদ সাধলেন তাঁর মা। কারণ, তার কিছুদিন আগে মাত্র ১০ বছর বয়সে জগদীশের ছোট ভাই মারা যায়। মায়ের মন অবশিষ্ট সন্তান সাত সমুদ্র পাড়ি দিয়ে লন্ডন যাক, এটি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। অন্যদিকে, ভগবান চন্দ্র বসু অসুস্থ হয়ে পড়ায় বলতে গেলে ঘরবসা। আধা মাইনেতে চলেন। যেসব উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন গ্রামের মানুষদের জন্য তার বেশির ভাগই ব্যর্থ হওয়ায় তিনি অনেক ঋণে জর্জরিত। মন খারাপ করে জগদীশ দেশেই থাকবেন বলে যখন সিদ্ধান্ত নেন তখন আবার মায়ের মন পরিবর্তন হয়। বনসুন্দরী দেবী নিজের গয়না বিক্রি করে ও তাঁর সঞ্চিত অর্থ দিয়ে ছেলেকে ডাক্তারি পড়ার জন্য বিলেতে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু সেখানে গিয়ে জগদীশ আক্রান্ত হলেন জ্বরে, শরীর হয়ে গেল দুর্বল। বোঝা গেল ডাক্তারি পড়াটা কঠিন হয়ে যাবে।

এই সময় জগদীশের স্ত্রীর ভাই বাংলার প্রথম রেংলার, আনন্দ মোহন বসু জগদীশকে কেমব্রিজে ভর্তি হতে সহায়তা করেন। আনন্দ মোহন বসু ১৮৭৪ সালে প্রথম ভারতীয় হিসেবে গণিতে ট্রাইপস পান। কেমব্রিজে আর লন্ডনে জগদীশের শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন লর্ড রেইলি, মাইকেল ফস্টার, সিডনি ভাইন, ফ্রান্সিস ডারউইনের মতো বিজ্ঞানীরা। ১৮৮৪ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৃতি বিজ্ঞানে বিএ এবং লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করে জগদীশ চন্দ্র বসু ভারত ফিরে আসেন। দেশে ফিরে একই বছরে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক হিসেবে চাকরিতে যোগদানের চেষ্টা করেন। ‘ভারতীয়রা পড়াতে পারে না’ অজুহাতে কলেজের সেই সময়কার অধ্যক্ষ চার্লস টাউনি এবং বাংলার পাবলিক ইনস্টিটিউটের পরিচালক স্যার আলফ্রেড ক্রফট প্রবল বিরোধিতা করলে জগদীশ চন্দ্র বসু ভারতের ভাইসরয় লর্ড রিপনের শরণাপন্ন হন। শেষমেশ, ভাইসরয়ের হস্তক্ষেপে তিনি শিক্ষক হলেও চার্লস টাউনি এবং স্যার আলফ্রেড ক্রফট তাঁকে ‘অস্থায়ীভাবে’ নিয়োগ দেন। এমনকি তাঁর বেতন নির্ধারণ করা হয় একই পদে আসীন ব্রিটিশ অধ্যাপকদের অর্ধেক। এমনকি তাঁকে গবেষণাগারে একটা কাজ করারও সুযোগ দেওয়া হতো না। সাহসী জগদীশ অর্ধেক বেতনের নিয়োগপত্র অগ্রাহ্য করে কলেজে যোগ দেন এবং একনাগাড়ে তিন বছর বেতন নিতে অস্বীকার করেন। এই সময়কালে নিজের মেধা ও পাণ্ডিত্য দিয়ে তিনি প্রায় সবার মন জয় করেন। অন্যদিকে নিজের বাড়িতেও একটি গবেষণাগার গড়ে তোলেন। তিন বছর পরে কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে সসম্মানে, পূর্ণবেতনে অধ্যাপক হিসেবে নিয়োগ দেয়। আর এই নিয়োগ দেওয়া হয় ভূতাপেক্ষা, অর্থাত্ তিন বছর আগে থেকে। তাঁর তিন বছরের বকেয়া বেতনও পরিশোধ করা হয়। সেই টাকা দিয়ে জগদীশ চন্দ্র বসু তাঁর বাবার ঋণ শোধ করেন। সেই সময়ে জগদীশ চন্দ্র বসুর গবেষণার আগ্রহের বিষয়বস্তু ছিল ক্ষুদ্র দৈর্ঘ্যের তরঙ্গ, যা মাইক্রোওয়েভ নামে পরিচিত। সে সময় তিনি ‘কোহেরার’ নামে একটি ধারণাকে আরেকটু এগিয়ে নিয়ে দেখেন সেটিকে মাইক্রোতরঙ্গের গ্রাহক যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়।micro

১৮৯৪ সালে তিনি কলকাতায় প্রথম বিনা তারে বার্তা প্রেরণ এবং তা গ্রহণ করার একটি কৌশল দেখিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। বড় লাটের হস্তক্ষেপে তাঁর এই আবিষ্কার ইংল্যান্ডে দেখানোর জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে সহায়তা করলে তিনি লন্ডনে গিয়ে সেটি প্রদর্শন করেন। ১৮৯৬ সালের ২৪ জুলাই লন্ডনে রাজকীয় বিজ্ঞান সমিতিতে তিনি তাঁর আবিষ্কার সব বিজ্ঞানীর সামনে তুলে ধরেন। এমনকি তিনি তাঁর পরীক্ষার খুঁটিনাটি এত বিশদভাবে তুলে ধরেন যে তা থেকে যে কেউ পরীক্ষাটি পুনরাবৃত্তি করতে পারবেন।

মানবসভ্যতার ইতিহাসে কলকাতার সেই বিনা তারে বার্তা প্রেরণের ঘটনাটিই প্রথম। পরে লন্ডনেও তিনি একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেন। কিন্তু বিজ্ঞানীদের অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি তাঁর উদ্ভাবনের কোনো ‘পেটেন্ট’ বা ‘স্বত্ব’ করেননি। কারণ, কর্ণ ছিল তাঁর আদর্শ। তাঁর সব কাজকর্ম হবে মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য, পিছিয়ে দেওয়ার জন্য নয়। বলা যায়, জগদীশ চন্দ্র বসু হচ্ছেন পৃথিবীর প্রথম মুক্ত দর্শনের অধিকারী বিজ্ঞানী।

লন্ডন থেকে দেশে ফেরার পর পদার্থবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক মাইক্রোতরঙ্গ নিয়ে কাজ করা থেকে নিজেকে বিরত রাখেন। এর অন্যতম কারণ হলো, তিনি তখন ‘ধাতব বস্তুর’ প্রাণ আছে কি না তা ভাবতে থাকেন। তবে তাঁর এই ভাবনাটা ক্রমেই উদ্ভিদের দিকেই চলে যায়।

ফলে মাইক্রোতরঙ্গ নিয়ে বিনা তারে বার্তা প্রেরণের জগদীশের সাফল্য অনেকে ভুলে যান। অন্যদিকে উদ্ভিদের জীবনের বহিঃপ্রকাশের কারণে তিনি সেই দিকে বেশি কার্যকরী হন।

বর্তমানে, বিশ্বের তাবত বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুকেই বিনা তারে বার্তা প্রেরণের জনক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তবে জগদীশ চন্দ্র বসু কাজ করেছেন মাইক্রোতরঙ্গ নিয়ে এবং রেডিও যন্ত্রের উদ্ভাবক মার্কনি কাজ করেছেন বেতারতরঙ্গ নিয়ে।

অনেকেরই ধারণা, জগদীশ চন্দ্র যদি মাইক্রোতরঙ্গ নিয়ে তাঁর কোহেরারকে আরও এগিয়ে নিতেন, তাহলে ১৯০১ সালের প্রথম নোবেল পুরস্কারটি একজন বাঙালি পেলেও পেতে পারতেন। যে কলেজ তাঁকে নিয়োগ দিতে চায়নি, সে কলেজই তাঁকে অবসরের পরও অতিরিক্ত দুই বছর জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক হিসেবে বেতন দিয়েছে। ১৯১৫ সালে অবসরের পর তাঁকে প্রফেসর ইমেরিটাস মর্যাদা দিয়েছে। ব্রিটিশ সরকার ১৯০৩ সালে তাঁকে কমান্ডার অব ইন্ডিয়ান এমপায়ার উপাধি দেয়। ১৯২৮ সালে তিনি রাজকীয় বিজ্ঞান সমিতির ফেলো নির্বাচিত হন।

১৯২৭ সালে তিনি কলকাতায় একটি বিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র স্থাপন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এটিকে তিনি একটি ‘মন্দির’ হিসেবে উল্লেখ করেন। বর্তমানে এটি বসু বিজ্ঞান মন্দির নামেই বেশি পরিচিত।

আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন বন্ধু। রবীন্দ্রনাথ জগদীশ চন্দ্র বসুর তিন বছরের ছোট হলেও তাঁদের বন্ধুত্ব ছিল আমৃত্যু। একজনের হাতে বিকশিত হয়েছে বাংলায় সাহিত্য আর একজন করেছেন বাংলায় বিজ্ঞান রেনেসাঁর সূচনা।

স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু একটি চমত্কার কথা বলতেন। তিনি বলতেন, সে-ই প্রকৃত বিজ্ঞানী যে তার ল্যাবরেটরির সঙ্গে ঝগড়া করে না। অর্থাৎ প্রকৃতিবিজ্ঞানী সব সময় নিজের ল্যাবরেটরি তৈরি করে নেন, অন্যকে দোষারোপ করেন না।

আজ থেকে প্রায় সোয়া শ বছর আগে একটি পিছিয়ে পড়া দেশ থেকে জগদীশ চন্দ্র বসু মানবসভ্যতাকে একটি বড় ঝাঁকুনি দিয়েছেন। সেই মাত্রায় না হলেও যদি আমরা তাঁর মতো বিজ্ঞানকে ভালোবেসে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারি, তাহলেই কেবল এই বিজ্ঞানীর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে পারব।

 

Wednesday, November 7, 2018

ইন্টারস্টেলার মুভি রিভিউ এবং প্রয়োজনীয় বিজ্ঞান


আমরা সবসময়ই নিজেদেরকে সংজ্ঞায়িত করেছি, অসম্ভবকে সম্ভব করার সামর্থ্য দিয়ে। সেই মুহূর্তগুলোকে আমরা শ্রদ্ধা করি, যখন আমরা দুঃসাহস দেখিয়েছিলাম, আরো উঁচুতে উঠতে চেয়ে; সকল বাধা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে, নক্ষত্রের পানে, অজানাকে জানার উদ্দেশ্যে। আমরা এগুলোকে স্মরণ করি, আমাদের সবচেয়ে গর্বের মুহূর্ত হিসেবে। কিন্তু সেগুলো অতীতের গল্প। হয়তো আমরা ভুলে গেছি, যে আমরা শুধুই পথপ্রদর্শক। যাত্রা শুরু করেছি মাত্র। আর আমাদের সর্বোচ্চ সাফল্য অতীতের গুলো নয়। কারণ, আমাদের নিয়তি অপেক্ষা করছে সুদূর উচ্চতায়, নক্ষত্রের মাঝে।

এই কথাগুলো বলা হয়েছিলো ইন্টারস্টেলার মুভির প্রথম ট্রেলারে। এরপরে আমি আর কোনো ট্রেলার দেখিনি। চেয়েছিলাম, একেবারে ভার্জিন অবস্থায় মুভিটা দেখতে।

আমি মুভির কাহিনী নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করিনা। তাই, শুরুর দিকে সামান্য একটু বলে অফ যাবো। ভবিষ্যত পৃথিবী খুব ক্রিটিক্যাল একটা অবস্থার মধ্যে আছে। খাদ্য সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এই অবস্থায় স্পেস রিসার্চ করার মত কোনো পরিস্থিতি নেই। প্রাক্তন ইঞ্জিনিয়ারদেরকেও কৃষিকাজ করতে হচ্ছে। এমন সময় একটা সিগন্যাল আসে, from the unknown. একটা ওয়ার্মহোল পাওয়া যায় শনি গ্রহের কাছাকাছি কোথাও।

ওয়ার্ম হোল, টাইম-স্পেস কন্টিনিউয়ামের মধ্যে একটা বাইপাস, একটা শর্টকাট, নিয়ে যাবে অজানা কোথাও, এমনকি অজানা কোনো ছায়াপথে। এই ওয়ার্মহোল একটা সম্ভাবনা, যা হয়তো মানবসভ্যতাকে রক্ষা করবে পুরোপুরি বিলুপ্ত হওয়া থেকে।

Wormhole, in Interstellarin_wWormhole, in Interstellar




এটুকু আপনারা ট্রেলারেই দেখেছেন।


এই মুভিটা এমন কিছু টপিক নিয়ে ডীল করে, যেগুলো আমরা খুব সহজে বুঝে উঠতে পারিনা। এজন্য অনেকেই বলে, এই মুভি বোঝা যাবেনা সহজে। কিন্তু, মুভি বুঝতে হলে আপনাকে astrophysicist হতে হবে, এমন মুভি নিশ্চয়ই বানাবেনা কেউ। অবশ্যই কিছু কিছু ব্যাপার হয়তো আছে, যেগুলো বুঝতে হলে আপনাকে কিছুটা পড়াশোনা থাকতে হবে। তো, একটা মুভির খাতিরে হলেও যদি কিছুটা জানার আগ্রহ জাগে, খারাপ কী?


বিজ্ঞানের যে কয়েকটা জিনিস আমাদের অনেকের মাথার ওপর দিয়ে যায়, তার মধ্যে দুটো হচ্ছে টাইম আর স্পেস। এই দুটোই আসলে একসূত্রে গাঁথা। একটা পর্যায়ে গিয়ে সময়ও একটা বস্তুর মত আচরণ করে। জিনিসটা বুঝতে হলে আমাদেরকে ডাইমেনশন বা মাত্রা জিনিসটা বুঝতে হবে।


বিজ্ঞানের অন্যতম ইন্টেরেস্টিং একটা টপিক হচ্ছে ডাইমেনশন বা মাত্রা। আমরা আছি থ্রি ডাইমেনশনে, এবং আমাদের দৃষ্টি চলে টু-ডাইমেনশনে। আমরা যততম ডাইমেনশনে থাকবো, আমাদের দৃষ্টি চলবে তার চেয়ে এক ডাইমেনশন কমে। আমরা যখন ফোর্থ ডাইমেনশনে চলে যাবো, যেখানে সময় একটা মাত্রা। আরো হায়ার ডাইমেনশনে গেলে আমরা বস্তুর মধ্যে দিয়ে দেখতে পাবো। ফিফথ ডাইমেনশনে গেলে আমরা চতুর্থ মাত্রা অর্থাৎ সময়ের মধ্যেও দৃষ্টিপাত করতে পারবো। এটা নিয়ে আমাদের সাইটে সহজ ভাষায় বস্তুর মাত্রাসমূহ নামে একটা নোট আছে, পড়ে নিতে পারেন


রিলেটিভিটি (আপেক্ষিকতা) আরেকটা চরম ব্যাপার। সময়ের একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, অন্য সবকিছুর মত এটাও আপেক্ষিক। সবার জন্য, স্পেসের সব জায়গায় টাইম একভাবে চলে না। ঐ যে বললাম, সময়ও বস্তুর মত আচরণ করে! আপনাকে যদি হাওয়ার বিপরীতে দৌড়াতে বলা হয়, অথবা স্রোতের বিপরীতে দাঁড় বাইতে বলা হয়, তাহলে আপনি যেমন স্লো চলবেন। গ্র্যাভিটি বা মহাকর্ষের বিপরীতে চলতে হলে সময়কেও ধীরে চলতে হয়।


তাই, যারা মহাকাশে দূর পাল্লার যাত্রাতে যাবেন, তারা ফিরে এসে দেখবেন, তাদের পরিচিত মানুষেরা অনেক বেশি বুড়িয়ে গেছে। কারণ, তারা মহাকর্ষকে ছিন্ন করে দ্রুতগতির যাত্রার মধ্যে ছিলেন। সময়কে চলতে হয়েছে মহাকর্ষের বিপরীতে। কিন্তু পৃথিবীর মানুষদের জন্য সময় চলেছে স্বাভাবিকভাবেই (মানে, আমাদের জন্য সবসময় যেভাবে চলে এসেছে, সেভাবে)……


ইন্টারস্টেলারে নায়ক কুপার (ম্যাথিউ ম্যাককোনাহেই) তার ছেলেমেয়েকে রেখে যাত্রা করেছে সেই ওয়ার্মহোলের দিকে। কোথায় যাবে সে, কোন গ্যালাক্সিতে গিয়ে পৌঁছাবে, বস্তুর কোন মাত্রার মুখোমুখি হবে সে – এই জিনিসগুলো নিয়ে ইন্টারস্টেলারের কাহিনী এগিয়ে যাবে। মুভির প্লটের জন্য জোনাথন নোলান ক্যালটেকে রিলেটিভিটি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। স্ক্রিপ্ট রাইটিং এর সময় সাথে রাখা হয়েছিলো তাত্ত্বিক পদার্থবিদ কিপ থর্নকে। থর্ন হচ্ছে একদম প্রথম দিকের বিজ্ঞানীদের একজন যিনি থিওরেটিক্যাল সায়েন্টিফিক রিসার্চ করেছিলেন, যে বিজ্ঞান কি আসলেই আমাদেরকে টাইম ট্র্যাভেল এর সূত্র দিতে পারবে কিনা; ব্ল্যাক হোল কসমোলজি নিয়ে তার নিজস্ব রিসার্চ আছে।


ম্যাথিউ ম্যাককোনাহেইকে এতো স্বাভাবিক লেগেছে স্ক্রীনে, যেন সে স্ক্রীনেরই একটা অংশ। অ্যান হ্যাথাওয়ে, স্যার মাইকেল কেইন, এরা তো আমার খুবই প্রিয় অভিনেতা। মার্ফ এর চরিত্রে পিচ্চি ম্যাকেঞ্জি ফয়কেও এতো ফাটাফাটি লেগেছে, যে বলার মত না। প্রথম ট্রেলার বাদে, আমি আর অন্য কোনো ট্রেলার দেখিনি বলে জানিও না, আর কে কে ছিলো। আমার মত যদি কেউ থেকে থাকেন, তাহলে ওদের কথা চিন্তা করে জেসিকা চ্যাস্টেইন আর ম্যাট ডেমন কী কী চরিত্র করেছে, সেগুলো আর বললাম না।


স্ক্রীন রাইটিং এর জন্য জোনাথন নোলান তার ভাইয়ের চেয়ে ভালো বলেই আমার মতামত। সে থাকলে বেশি ভালো হয়, আমার মতে। এটাতেও ব্যতিক্রম হয়নি। হ্যান্স জিমার এর মিউজিক নিয়ে আর কী বলার আছে। উত্তেজনায় গায়ের লোম খাড়া হবে, ব্রেইনের ওপর চাপ পড়বে, ইমোশনাল হয়ে যাবেন, I mean, the usual.  ফটোগ্রাফি was excellent, basic Christopher Nolan stuff. ব্যাটা ৩-ডি তে বিশ্বাস করে না, for good reasons. So, IMAX is the way to go, for best experience. কিছু কিছু সীন এতো বেশি ইলাবোরেট, এগুলো বিগ স্ক্রীনে দেখলে হারায়ে যেতে ইচ্ছে করে।


প্লটহোল নিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে না। শুধু একটা জিনিস যেটা একটু বেশি চোখে বেজেছে, সেটা হচ্ছে, আমার মতে এখানে ব্ল্যাকহোলের শক্তিকে কিছুটা আন্ডার-এস্টিমেট করা হয়েছে। আর ব্ল্যাকহোলের ভেতরে কী আছে, সেটা নিয়ে ওদের আন্দাজের সাথেও মতভেদ আছে। কার্ল স্যাগান বা নীল টাইসন, দুজনেই তাদের দুই কসমসের মধ্যে বলেছেন, if you want to know what’s inside a black hole, look around. অর্থাৎ, there will be another universe, galaxies and planets, compacted within it. In a sense, it’s no different than a worm hole. দুইটা দিয়েই অন্য কোথাও যাওয়া যায়। পার্থক্যটা হচ্ছে, worm hole দিয়ে আপনি এই ইউনিভার্সেরই অন্য জায়গায় পৌঁছাবেন, আর ব্ল্যাক হোল দিয়ে অন্য আরেক ইউনিভার্সে চলে যাবেন।


সিনেমা শেষ করে হল থেকে বের হলাম, যেন কিছুটা মাতাল অবস্থায় অন্য এক গ্যালাক্সী থেকে আবার পৃথিবীতে ফিরে এলাম। সাথে করে একটা…… ফ্রি পোস্টার নিয়ে এলাম। Overall experience, এক শব্দে বলতে গেলে, ম্যাজিক্যাল।


 

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/interstellar_movie_review_and_science/

টাইম ট্রাভেল – প্যারাডক্স


টাইম ট্রাভেল সম্ভব কি না সেটা না হয় আলোচনা করলাম না। ধরে নেই, মানুষ একসময় টাইম মেশিন, কৃষ্ণগহবরের মহাকর্ষ, বা ওয়ার্ম হোল ব্যবহার করে বা আলোর গতিতে ভ্রমণ করে টাইম ট্রাভেল করতে শিখলো। কিন্তু টাইম ট্রাভেল করা সম্ভব হলেও কি অতীতে যাওয়া সম্ভব? এখানে শুধু অতীতে গমন নিয়েই বলা হবে।

প্রযুক্তিগত বাধাগুলো বাদ দিলেও টাইম ট্রাভেলের সময় অনেক প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে। যেমন, শারীরিক বাধা- মানুষের শরীর হয়তো টাইম ট্রাভেলের ঝক্কি সামলাতে পারবে না, টাইম ট্রাভেল করে হয়তো নিজের জগতে ফিরে আসতে পারবে না বা ডাবল অক্যুপেন্সি সমস্যা।  এসব ছাড়িয়ে সবচেয়ে বড় যে বাধা, সেটা হলো গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স।

গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স


“Paradox” শব্দটার বাংলা হলো “আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী”। মানে যা কোনো কিছুর সম্ভাবনা নাকচ করে দেয়। এই গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্সকে এভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে – বর্তমানের কোনো ব্যক্তি যদি টাইম ট্রাভেল করে অতীতে ফিরে গিয়ে দাদা-দাদীর পরিচয় প্রতিহত করে দেয়, তাহলে ভ্রমণকারী ব্যক্তিটির বাবার জন্ম হবার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়। তার ফলে টাইম ট্রাভেলার ব্যক্তিরও জন্ম হবার সুযোগ থাকে না। বড় হয়ে টাইম টাইম ট্রাভেল করে অতীতে ফিরে দাদাকে হত্যা করার সুযোগও থাকে না। কারণ তার তো জন্মই হয়নি। তাহলে প্রশ্ন হলো – তার দাদাকে কে হত্যা করলো? তার তো জন্মই হয়নি। বা দাদাকে হত্যা করার পর তার অস্তিত্বের কী হবে? তার কি আদৌ কি কোনো অস্তিত্ব থাকবে? দাদাকে হত্যা করার পর পর কি সে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে? টাইম ট্রাভেলের এই যে স্ববিরোধী ঘটনা, এটাকে বলা হয় গ্র্যান্ডফাদার প্যারাডক্স।

টাইম ট্রাভেলের প্যারাডক্সের বিষয়ে ২টা প্রচলিত থিওরি আছে।

১) নভিকভের আত্মরক্ষার থিওরি (Novikovs self-consistency theory) : এই থিওরি অনুযায়ী টাইম ট্রাভেল করে অতীতে ফিরে গেলেও কেউ এমন কোনো কাজের সাথে সংযুক্ত হতে পারবে না (মানে জগতের নিয়ম অনুযায়ী জগত সেটা হতে দেবে না) যেটা তার প্রকৃত বর্তমানকে প্রাভাবিত করবে। ধরা যাক কেউ একজন ব্যক্তি, “X” যদি অতীতে গিয়ে তার ছোটবেলার শিশু অবস্থার X কে হত্যা করার চেষ্টা করে, সে সেটা পারবে না। কারণ নিয়ম অনুযায়ী সে তার শিশু অবস্থাকে হত্যা করলে তার অস্তিত্বই অসম্ভব হয়ে যায়। হয়তো সে ছোটবেলায় যেখানে থাকতো সেখানে গিয়ে শৈশবের নিজেকে খোঁজার চেষ্টা করে তাহলে দেখবে যে সেখানে তারা থাকে না। অন্য কোনো পরিবার সেখানে বসবাস করছে। জগতই তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে দিয়েছে। এই থিওরি অনুযায়ী কেউ যতই চেষ্টা করুক না কেনো, এমন কোনো কাজ করতে পারবে না যা প্রকৃত বর্তমানকে পরিবর্তন করবে।

ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি এর সেথ লয়েড (Seth Lloyed) ও তার গবেষক দল নভিকভের থিওরির একটু বিস্তৃত বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, “প্যারাডক্স থেকে রক্ষা পেতে “সম্ভাবনা” সবসময়ই প্রয়োজন অনুযায়ী বেঁকে (পরিবর্তন) যাবে।


main-qimg-15a183d888450b38d8ce5409e9cb0ad0

হয়তো ইউনিভার্সের বাবলের মধ্যে এমন কোন ইউনিভার্স আছে যেখানে আপ্নি…………ব্যাট্ম্যান




যদি কেউ প্যারাডক্স তৈরি করার মত কাজ করে তবে তার ফলাফল যথেষ্ট অদ্ভুত হবে (Outcomes would become stranger as one approaches a forbidden act)। কারণ যা ঘটার, তা যাতে ঘটে সেজন্য জগত যতটুকু পরিবর্তন বা যত অসম্ভব প্রয়োজন, সবই সম্ভব করবে।

২) প্যারালাল ইউনিভার্স থিওরিঃ এই তত্ত্ব অনুযায়ী কেউ যদি টাইম ট্রাভেল করে, সে কখনই তার নিজের টাইমলাইনের ইউনিভার্সের অতীতে যেতে পারবে না। টাইম ট্রাভেল করে শুধু মাত্র প্যারালাল ইউনিভার্সে গমন সম্ভব। যদি কেউ অতীতে গিয়ে তার দাদাকে হত্যা করে, সে আসলে তার ইউনিভার্সের প্যারালাল ইউনিভার্সে যাবে যেখানে আদৌ তার কোনো অস্তিত্ব ছিলো না। অর্থাৎ টাইম ট্রাভেলার যে টাইম লাইন থেকে এসেছে সেখানে তার বর্তমান অপরিবর্তিতই থাকবে। কারণ সে ট্রাভেল করছে অন্য আরেক ইউনিভার্সের টাইমলাইনে যেখানে তার অস্তিত্ব কখনই ছিলো না।  ফলে তার দাদাকে হত্যা করায় আরেকটা সম্ভাবনার ইউনিভার্সে সে চলে যাচ্ছে।

এই থিওরির সাথে আরেকটি বিষয় চলে আসে। প্রতিটি সম্ভাবনার সাথে এক একটি ইউনিভার্সের থিওরি। ব্যাপারটা এইরকম যে আপনি আপনার এই জগতে হয়তো ছোটবেলায় জিলা স্কুলে চান্স পেয়েছেন। কিন্তু হয়তো এমন কোনো প্যারালাল ইউনিভার্স আছে যেখানে আপনি জিলা স্কুলের বদলে জোসেফ’স স্কুলে চান্স পেয়েছেন। আরেক ইউনিভার্সে আপনি হয়তো পড়াশুনাই করছেন না। আরেক ইউনিভার্সে আপনি ছোটবেলায় টাইফয়েডেই মারা গেছেন। এই ইউনিভার্সে আমি বাংলাদেশে আছি। হয়তো আরেক ইউনিভার্সে আমি আমেরিকায় থাকি যেখানে স্কারলেট জোহানসন আমার গার্লফ্রেন্ড (আহা, ভাবলেই দিল খুশ হয়ে যায়) ।

প্যারালাল ইউনিভার্সের থিওরি অনুযায়ী প্রতিটা সম্ভাবনার জন্য একটা করে ইউনিভার্স আছে। অনেকটা গাছের একটি কাণ্ড থেকে যেভাবে অনেকগুলো শাখা বের হয় তেমনি একটি ঘটনাকে গাছের কাণ্ড হিসেবে ধরলে প্রতিটা সম্ভাব্য ফলাফলের জন্য গাছের শাখার মত  সম্ভাবনা সংখ্যক প্যারালাল ইউনিভার্স থাকবে। প্রতিটা কর্মের জন্য আলাদা ইউনিভার্স আছে – সুফল ভোগ বা দুষ্কর্ম ভোগের জন্য। এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড গল্পে এলিস খরগোশের গর্ত (Rabbit Hole) এর ভেতর পরে আরেক টাইমলাইনে চলে যায় যেখানে সব কিছু ভিন্ন, তেমনি ওয়ার্ম হোলগুলোও যেন   এক একটা র‍্যাবিট হোল। একেক ওয়ার্ম হোলের ভিতর একেক কাহিনী পাওয়া যাবে।


diagram2

প্রতিটি সিদ্ধান্তই এক একটি ইউনিভার্সের দিকে ধাবিত করে




*প্যারালাল ইউনিভার্সের মতবাদের মাধ্যমে ফিজিক্সের কোয়ান্টাম মেকানিক্সের থিওরি এবং মেম্ব্রেনাস থিওরি (M-Theory), টাইম ট্রাভেলের প্যারাডক্সের সমাধান দেবার চেষ্টা করেছে ।

কোয়ান্টাম মেকানিক্সের বহু জগত (Many world interpretation)  থিওরি তে বলা হয় যে – যে ঘটনার “সম্ভাবনা শূন্য নয়” ( random quantum event with a non-zero probability), তার প্রতিটা সম্ভাবনা এক একটা আলাদা জগতে ঘটবে।

ওদিকে মেম্ব্রেনের থিওরিতে বলা হচ্ছে অনেকগুলো ইউনিভার্স (Multi-verse/ Multiple Universe) ত্রিমাত্রিক গঠনে পাশাপাশি (Side by side) অবস্থান করে এক বিশাল চতুর্মাত্রিক স্থানাংক ব্যবস্থার ভেতর। এবং এই মাল্টিভার্সের ইউনিভার্স গুলোই আমাদের বিভিন্ন সম্ভাবনার ক্ষেত্র বা বলা যায় কর্মফলের ক্ষেত্র।

এখন প্রশ্ন হলো –
১: টাইম ট্রাভেল কি সম্ভব?
উত্তর: থিওরিটিক্যালি সম্ভব। যেহেতু প্রাক্টিক্যালি পরীক্ষা করার মত প্রযুক্তি এখনো আবিষ্কৃত হয়নি, তাই শুধু মাত্র থিওরিটিক্যাল সম্ভাবনা নিয়ে সন্তষ্ট থাকতে হচ্ছে।

২: বর্তমান প্রযুক্তি দিয়ে সম্ভব?
উত্তর: না। বর্তমান প্রযুক্তি দিয়ে সম্ভব না।

Recommended movies:
১. Back to the future Trilogy
২. Looper  (2012)
৩. X-men Days of the future past (2014)
৪. Predestination (2014)
৫. Primer (2004)
৬. Justice League: Flashpoint Paradox (2013)
৭. Butterfly Effect (2004)
8. Interstellar (2014)

 

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/time_travel_paradox/

Thursday, November 1, 2018

ভার্জিনিয়া উল্ফের গল্প : বেহালার সঙ্গীত


ঠিক আছে, আমরা এখানেই আছি, এবং তুমি যদি প্রখর দৃষ্টিতে বাইরে তাকাও, তাহলে দেখতে পাবে ট্রেন, ট্রাম আর বাসগুলো, বেশকিছু ঘোড়ায় টানা চার চাকার গাড়ি; এমনকি, আমি খুব সাহস করে বিশ্বাস করছি যে, সবকিছুই সমস্ত জায়গাকে দখল করে বসে আছে, ব্যস্তসমস্ত হয়ে আছে, মনে হচ্ছে যেন চরকিতে সুতো বোনা হচ্ছে লন্ডন শহরের এক প্রান্ত থেকে শুরু করে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত, অথবা তারা সবাই সার বেঁধে বসে আছে কোনো এক বেলাভূমিতে। এসব সত্ত্বেও, যাই হোক, আমি কিন্তু এখনও সংশয়েই আছি... আমার ভেতরে এখনও নিরবিচ্ছিন্ন সন্দেহ আর অবিশ্বাস...

যদি আসলেই তা সত্যি হয়, তারা ঠিক যেমনটি বলেছিল যে রিগান্ট স্ট্রিট হচ্ছে উঁচু আর চুক্তিটিও ইতোমধ্যে স্বাক্ষরিত হয়ে গেছে; আর আবহাওয়াও বছরের এই সময়ে ঠিক যেমন কোমল আর ঠাণ্ডা থাকার কথা, আসলে ঠিক তেমন ছিল না, এমনকি নিজেদের থাকার জন্য কোনো ফ্ল্যাটও ভাড়া করা হয়নি, ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্তদের অবস্থা আশঙ্কাজনক,যদি আমি স্মরণ করি আমাকেই যে আমি একেবারেই লিখতে ভুলে গেছি শূন্য ভাঁড়ারঘরের কথা আর আমার হাতের দস্তানাও ফেলে এসেছি ট্রেনে, যদি এগিয়ে যাওয়ার ঝোঁকে এখনই আমার দরকার হয়ে পরে রক্তসম্পর্কের বন্ধন,উষ্ণভাবে গ্রহণ করবো সেই হাত যা আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল দ্বিধার সঙ্গে...

‘সাত বছর হলো আমাদের প্রথম সাক্ষাতের’

‘শেষবার ভেনিসে’

‘এখন তুমি কোথায় থাকো?’

‘ঠিক আছে, বিকেলের শেষ সময়টা আমার সঙ্গে বেশ মানানসই, যদি এমন হয় যে, তখন কেউ কিছু জানতে চাইবো না...

‘আমি তোমাকে রক্তেমাংসে চিনি’

‘চুপ করো, চুপ! ময়দানে এখন সাময়িক যুদ্ধবিরতি...

যদি মনের ভেতর অভিপ্রায়ের তীরগুলো তীক্ষèভাবে গেঁথে যায়, আর তখনই মানুষের সমাজ কাউকে দিয়ে করতে বাধ্য করায়, তাহলে দেরি না করেই কেউ একজন দ্রুততার সঙ্গে দেগে দেবে তার অস্ত্রটি, আর যদি এই অবস্থাটা উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং বাড়তে বাড়তে তা রূপান্তরিত হয়ে যায় বৈদ্যুতিক আলোর দশায়, অনেক ঘটনার মধ্যে যদি বলা হয় একটা কিছু ঘটবেই, তবে সবকিছু ছেড়ে উৎকর্ষ সাধন এবং সংশোধনের প্রয়োজনে জাগিয়ে দিতে পারে মনস্তাপ,দুঃখবোধ, সুখ, দম্ভ এবং আকাক্সক্ষা-যদি আমি এই সবগুলো অবস্থাকেই বুঝিয়ে থাকি, আর টুপিগুলো আর চামড়ার গলাবন্ধ আর ভদ্রলোকদের দীর্ঘপুচ্ছ কোট, এবং মুক্তোর তৈরি টাইয়ের কাঁটা, যেগুলো বাইরের খোলসটাকে ঢেকে রাখে-তাহলে তুমি কোনগুলোকে যুক্তিগ্রাহ্য মনে করবে?

কী হবে? প্রতি মিনিটেই এর কারণ সম্পর্কে কিছু বলা কঠিনতর হয়ে পড়বে, সবকিছু সত্ত্বেও, আমি এখানেই বসে রয়েছি এই বিশ্বাসে যে আমি কোনোভাবেই বলবো না কেন,

অথবা মনে করাবার চেষ্টা করবো শেষবার যখন এটা ঘটেছিল-

‘তুমি কি মিছিলটি দেখেছো?’

‘রাজাকে কী শীতল আর নিস্প্রাণটাই না দেখাচ্ছিল।’

‘না, না, কিন্তু আসলেই কেন এটা হয়েছিল?’

‘মালমাসবারিতে সে একটা বাড়ি কিনেছিল।’

‘কোনো একজনকে খুঁজে পাওয়া যে কী ভাগ্যের?’

এর সম্পূর্ণ বিপরীত দিকটা খেয়াল করলে আমার কাছে এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে যে   সে-ই সর্বাপেক্ষা সুন্দর, হোক না সে সৌন্দর্যময়ী; এটাই জঘন্য ব্যাপার, আসলে পুরো ব্যাপারটি হলো ফ্ল্যাটগুলি, টুপিগুলি আর গাঙচিলগুলি, অথবা ব্যাপারটাকে অন্যভাবেও বলা যায় যে এখানে পরিপাটি পোশাক পরে একশ জন লোক বসে আছে, যেন তৈরি করা হয়েছে মানব-প্রাচীর, এমনই পরিপূর্ণ বুনন। বিষয়টা এমন নয় যে আমি খুব অহঙ্কার করছি, আমিও আনুগত্য মেনে নিয়ে বসে আছি এক গিল্টিকরা চেয়ারে, কেবলমাত্র পৃথিবীটাই ঘুরছে কিছু সমাধিস্থ স্মৃতির ওপর, যেভাবে আমরাও অবিরত ঘুরে মরি, যেগুলো কিছু চিহ্ন হয়ে টিকে থাকে সবসময়, যদি না আমি কোনো ভুল করে থাকি, আমরা প্রত্যেকেই সবসময় কোনোকিছু পুনর্বার ফিরে পেতে চাই, পুনর্বার স্মরণ করতে থাকি। অগোচরে খুঁজে ফিরি কিছু একটা, যা হারিয়ে ফেলেছি, আমাদের এই স্নায়বিক অস্থিরতার মূল কারণটা কী হতে পারে? কেন আমরা সবসময় আমাদের আলখাল্লা, দস্তানা ইত্যাদি নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকি? বোতামগুলো খোলা বা লাগানো যে অবস্থাতেই থাকুক, এখন তাকানো যাক ক্যানভাসের বিপরীতে অন্ধকারে ডুবে থাকা প্রৌঢ় মুখটির দিকে, যা এক মুহূর্ত আগেও সুন্দর ছিল এবং রঙিন হয়ে উঠেছিল, এখন সে বাক্শক্তিহীন এবং বিষাদে আক্রান্ত, যেন ছায়ার ধাঁধায় হারিয়ে গেছে। পাশের সম্মেলন কক্ষে তাহলে কি দ্বিতীয় বেহালাটি বেজে উঠেছে? এখানেই তারা আসছে, চারজন কালো লোক বাদ্যযন্ত্রগুলো বয়ে নিয়ে আসছে, একে একে তারা বসে গেছে আলোকসম্পাতের নিচে হোয়াইট স্কোয়ারের দিকে মুখ ফিরিয়ে। বাদ্য বাজানোর ছড়গুলো পড়ে আছে স্বরলিপি রাখবার জায়গায় এবং এগুলো একসঙ্গে উঠছে একসঙ্গে নামছে। ছড়গুলোর যুগপৎ সম্মেলন আর বাদকদের দেহভঙ্গি একই কোরাসে মিলে মিলে ভারসাম্য তৈরি করছে। একইসঙ্গে তারা চোখ তুলে দেখছে বিপরীতে বসা অন্য বাদকদের মুখ, প্রথম বেহালাটি বাজছে এক, দুই, তিন...

দীপ্তিময়, উন্মত্ত, পল্লবিত, বিস্ফারিত! নাশপাতি গাছটি একেবারে পর্বতের চূড়ায়। ঝরনা

গড়িয়ে নামছে ঝিরঝিরিয়ে, কিন্তু রাউনি’র জলস্রোত কী দ্রুতই না বয়ে যাচ্ছে, জল  অগাধ, খরস্রোতা, ধনুকের মতো বাঁকা তীব্র স্রোত, সমস্ত প্রতিবন্ধক চুরমার করে বয়ে যায়

স্রোতরেখা মুছে দিয়ে, ধাবমান জলরাশি ধুয়ে ফেলে ছোট্ট পতঙ্গদের ছায়া, ডোরাকাটা চিত্রল মাছগুলো হুমড়ি খেয়ে ছুটে চলে স্রোতের টানে, তীব্র বেগে আর সৃষ্টি হয় বৃত্তাকার জলাবর্ত,-এই জটিল ঘূর্ণিতে ঘুরপাক খাওয়া মাছগুলো চলে যায় খাড়ির দিকে, জল যেখানে গভীর আর প্রশান্ত। তবুও তারা টিকে থাকতে পারে না। তারা লাফ দেয়, দিক্বিদিক ছড়িয়ে পড়ে, মারামারি করে তাদের সাঁতারকাটার ক্ষিপ্র ডানাগুলো দিয়ে আর জলস্রোতের তীব্র মন্থনে হলুদ শিলাখ-গুলো অবিরাম আবর্তিত হয়, তারপর জলঘূর্ণির হাত থেকে মুক্তি...বেপরোয়া ধাবিত হয় গভীরের দিকে, এমনকি কোনো না কোনোভাবে সর্পিল ছন্দে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে নিখুঁতভাবে তারা শূন্যে উড়তে শুরু করে, বিমানের মতো, বাঁক খেয়ে, ওপরে আরো ওপরে...কী আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য তাদের, যাদের পদক্ষেপগুলো মৃদু আর পৃথিবী ভেদ করে চলে যায়! এমনকি ধীবরবধূরাও, জীবনের ভারে যেন অবনমিত, উফ্ বার্ধক্যপীড়িত বয়স্কা স্ত্রীলোকেরা, কী প্রগাঢ় তোমাদের হাসি আর শরীরের প্রতিটি আন্দোলন আর কৌতুকহাস্য, ফুর্তিবাজদের মতো চলাফেরা-তোমরা যখন হাঁটো, চারপাশ থেকে গুঞ্জরিত হয় সঙ্গীত। আহা!

‘এটা অবশ্যই মোৎসার্টের প্রথম দিককার রচনা...

‘কিন্তু এই সুরটি, তাঁর অন্যান্য সুরগুলোর মতোই জন্ম দেয় গভীর নৈরাশ্য-আমি বলতে চাচ্ছি এর অর্থ হচ্ছে ‘আশা’,আসলে আমি ঠিক কী বোঝাতে চাইছি? এটাই সঙ্গীতের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম বিষয়। আমি নাচতে চাই, হাসতে চাই,খেতে চাই গোলাপরঙা কেক, পান করতে চাই হালকা কিন্তু খুব কড়া আঙুরের মদ অথবা পড়তে চাই খুব অশ্লীল একটি গল্প, আমি যেটাকে উপভোগ করতে পারবো। আমি এসব বেশ

উপভোগ করতে পারি। বয়স্করা বেড়ে ওঠে অনেকের চেয়ে বেশি অশ্লীলভাবে। হাঃ হাঃ হাঃ! আমি হাসছি, তাতে কী হবে? তুমি কিছুই বলবে না। কিছুই বলবে না বিপরীতে থাকা সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোকটি...শুধু অনুমান করবে আর অনুমান করবে-চুপ করো, স্তব্ধ হও। ইশ্!’

বিষণ্ন নদীটি আমাদের কেবল বয়ে নিয়ে যায়, যখন চাঁদ ভেসে আসে উইলোর ডালপাতার ফাঁক দিয়ে, আমি তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, আমি শুনি তোমার কণ্ঠস্বর আর আমরা যখন পাতাভর্তি ঝুড়িগুলোর পাশ দিয়ে যাই,পাখিগুলো ঠিক তখনই গান গেয়ে ওঠে। তুমি ফিসফিস করছ কেন? বিষাদ, বিষাদ, আনন্দ, আনন্দ একসঙ্গে জড়িয়ে থাকে, মালার মতো গেঁথে থাকে পরস্পর, চাঁদের আলোর নৈঃশব্দ্যের মতো, তাদের আর ছাড়ানো যায় না, আরো বেশি জড়িয়ে যায়, কষ্টের ভেতর ঘুমিয়ে থাকে, দুঃখের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে-ভাঙনের কী ভয়ানক শব্দ! ভেঙে পড়ে, সবকিছু মড়মড়িয়ে

ভেঙে পড়ে!

নৌকোটি ডুবতে ডুবতে আবার ভেসে উঠছে, কিন্তু এখন সেটা পাতার মতোই পলকা, মৃত মানুষদের ছায়ামূর্তিগুলো ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, তাদের কাছেই আছে আগুনের কু-লী, এগুলো আমার আত্মায় দ্বিগুণ অনুভূতির জন্ম দেয়, এসবই আমার জন্য চড়া সুরে গান গায়, আমার কষ্টগুলোকে মথিত করে উন্মুক্ত করে ফেলে, বরফজমাট যন্ত্রণাগুলোকে সমবেদনার তাপে গলিয়ে দেয়, ভালোবাসাময় জলপ্লাবনে ভেসে যায় সূর্যহীন পৃথিবী; এটাই সবকিছু নয়, ভঙ্গুর অবস্থা থেকে টেনে তোলে, কিন্তু দক্ষ আর সূক্ষ্মভাবে এফোঁড়-ওফোঁড় সেলাই করে বাহির আর ভেতর যতক্ষণ না নকশাগুলো পূর্ণতা পায়, তাতে বিচ্ছিন্ন আর একা অংশগুলো জুড়ে যায় একত্রে, তারপর আকাশের অনেক উঁচুতে পাখা না নাড়িয়ে ভেসে থাকা আর যন্ত্রণায় ফোঁপানো কান্নার শব্দ, বিশ্রাম, বিষণ্নতা আর আনন্দের জন্য নিমজ্জিত হয়ে যাওয়া।

তাহলে কীসের জন্য এই শোক আর বিলাপ? জানতে পারি কেন? অতৃপ্তি? আমি বলব যে প্রত্যেকেরই টিকে থাকবার কোনো একটা বন্দোবস্ত হয়ে গেছে, হ্যাঁ, বিশ্রামের জন্য শুয়ে আছি গোলাপ-পাপড়ির তৈরি চাদরের নিচে, যেন আমাদের পতন হয়েছে। উফ্, কিন্তু তারা হার মেনে নিয়েছে। গোলাপের একটা পাপড়ি খসে পড়েছিল অনেক উঁচু থেকে ঠিক যেমনটি একটা ছোট্ট প্যারাসুট একটা অদৃশ্য বেলুন থেকে ঘুরপাক খেতে খেতে পড়তে থাকে, যেটা কোনোদিন আমাদের কাছে পৌঁছাবে না-

‘না, না, আমি আসলে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছুই বলছি না, এই অসংলগ্ন স্বপ্নগুলোই হচ্ছে সঙ্গীতের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম দিক। দ্বিতীয় বেহালাটি দেরিতে বেজেছিল, তুমি বলছ?’

‘এইখানে, পিচ্ছিল মেঝেয় পরে আছেন বৃদ্ধ মনরো, সেকেলে আর বাতিকগ্রস্ত, মদ খেয়ে পড়ে আছেন হতভাগ্য মহিলা।’

দৃষ্টিহীন, বার্ধ্যক্যপীড়িত স্ফিংক্স, এই তো পথের ধারে দাঁড়িয়ে আছে, পাথরের মতো স্থির, ডাকছে ইশারায়, লাল লাল মিনিবাসগুলো...

অপূর্ব! কী আশ্চর্য সুরই না তারা বাজাতে পারে! কীভাবে...কীভাবে... কীভাবে!

জিহ্বা যেন সময় মাপনের দোলক। কতো সহজ এই নিরূপণ! আমার পাশে টুপির পালকগুলো উজ্জ্বল আর ভীষণ আরামদায়ক, ঠিক যেন শিশুদের হাতের ঝুমঝুমি। জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে চিনারগাছটাকে দেখা যাচ্ছে, পাতাগুলি তার গাঢ় সবুজ রঙে ঝলকাচ্ছে । কী অদ্ভুত, কী উত্তেজক ব্যাপার!

কীভাবে...কী করে...কেমন করে...চুপ! সেইসব প্রণয়ীরা শুয়ে আছে ঘাসের ওপর!

‘যদি, ম্যাডাম আমার হাতটা একবার ধরতে...’

‘স্যার, আপনার ওপর আমার হৃদয়ের অবিচল আস্থা আর তাছাড়া আমরা তো আমাদের শরীরকে ফেলে এসেছি সেই ভোজ উৎসবের ঘরের ভেতর আর এসব হচ্ছে ঘাসের চাপড়ার ওপর পতিত আমাদেরই আত্মার ছায়া।’

‘তবে এই সবই হলো আমাদের আত্মার যুগল সম্মিলন।’ প্রতারকরা ঠিক এইভাবেই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়। মরালটি তটরেখা থেকেই তাকে প্ররোচিত করে আর স্বপ্নের ডানায় ভর করে ঢেউ খেলিয়ে ভেসে ভেসে চলে যায় অগাধ জলের দিকে।

‘আবারো ফিরে আসে।’ সে আমাকে অনুসরণ করতে থাকে আর যেই না আমি ঘুরে দাঁড়িয়েছি বারান্দার বাঁকে,আচমকা সে আমার পেটিকোটের ফিতা ধরে টান মারে। নিঃশব্দে কান্না ছাড়া আমার আর কী করার ছিল? তাকে থামিয়ে দেয়া ছাড়া? তার কজ্বা থেকে রেহাই পাওয়া ছাড়া? আর যখনই সে তার তরবারিটি খাপ থেকে বের করে আনে, আক্রমণের পর্যায়টি রচিত হয় এমনভাবে যেন মৃত্যুর দিকে যাত্রা শুরু হয়েছে, আর আমি ‘উন্মাদ! উন্মাদ! উন্মাদ!’ বলে চিৎকার করি আর সেই রাজপুত্র, ভেড়ার চামড়ায় লিখছিল তার গ্রন্থটি ওপরতলার জানলার খুপরিতে বসে, বেরিয়ে আসে কার্ডিনালদের মতো মখমলের টুপি আর নরম লোমে আবৃত চটিজুতো পায়ে, এক ঝটকায় দেয়াল থেকে খুলে ফেলে দ্বন্দ্বযুদ্ধের হালকা কিন্তু দীর্ঘ তরবারিটি, যা ছিল এস্পানিয়লের রাজার

উপঢৌকন আর আমি পালিয়ে যাওয়ার সময় বলাৎকারের চিহ্নগুলোকে গোপন করতে স্কার্টটি ছুঁড়ে মারি তার আলখাল্লার ওপর...কিন্তু শোনো, ওই যে তীব্র নাদে তূরী বাজছে!

ভদ্রলোকটি দ্রুত তার জিজ্ঞাসার জবাব দিলেন এবং সে চরম মানসিক ক্ষিপ্রতায় সুতীব্র অনুভূতির শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছানোর জন্য আরোহণীর ধাপগুলো বেয়ে উঠতে লাগল। শব্দগুলোর মর্মার্থ অপরিস্ফুট, যদিও তাদের সাধারণ অর্থ যথেষ্টই আটপৌরে-ভালোবাসা, হাসি, পলায়ন, অনুসরণ, পরম সুখ, সবকিছু ভেসে যায় উল্লাসের কোমল তরঙ্গের ওপর, যতক্ষণ না রূপার বাঁশির শব্দ প্রথমেই নিকট দূরত্ব থেকে, একটু একটু করে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে, যেন কোনো রাজকর্মচারী কপালে হাত তুলে সেলাম করছে ভোরবেলাকে, অথবা অমাঙ্গলিক ইস্তাহারে ঘোষিত হচ্ছে প্রেমিকের নিরুদ্দেশ হওয়ার সংবাদ...সবুজ উদ্যান, জ্যোৎস্না, জল, লেবু, প্রণয়ী আর মাছ গলে গলে একাকার হয়ে যাচ্ছে বর্ণময় আকাশের ভেতর, সঙ্গম ঘটছে তখনই, যখন শিঙাগুলো ট্রাম্পেটের সঙ্গে সঙ্গত করছে আর তাদের সঙ্গে তাল দিচ্ছে ক্ল্যারিয়নগুলো আর সেখানে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে শুভ্র খিলানগুলো, দৃঢ়ভাবে পোতা মর্মর পাথরের থামগুলোর ওপর...তূরীগুলো অবিরাম দ্রিম দ্রিম শব্দে বাজছে। দ্রিম দ্রিম ঢং ঢং...শব্দের সুদৃঢ় বন্ধন। সুরক্ষিত কাঠামো। অগুন্তি শৃঙ্খলিত পদক্ষেপ। বিশৃঙ্খলা আর নৈরাজ্য পৃথিবীকে যেন ঘৃৃণায় পদদলিত করছে, কিন্তু সেই মহানগরী-আমরা যেখানকার পর্যটক-তার কোথাও পাথরও নেই, নেই কঠিন মর্মর। শুধু ঝুলে আছে অটল অনড় স্থির; না কোনো মুখ,না কোনো পতাকা আমাদের সম্ভাষণ জানাবে; চলে যাও তোমরা তোমাদের আশাকে ধ্বংস করতে, মরুভূমিতে আমার আনন্দ-মাথা হেট করে আছে; প্রগতি এখানে বিবস্ত্র হয়ে গেছে। দালানের থামগুলো নগ্ন; মাঙ্গলিক কোনোকিছুই আর অবশিষ্ট নেই। কঠোর আর রুক্ষ অভিজ্ঞতাগুলো কোথাও কোনো আকারের জন্ম দিতে পারেনি। আমরাই পতন; আর কোনো অধীরতা নেই, কোথাও চলে যাবার দুর্নিবার আকাক্সক্ষাই শুধু, কাক্সিক্ষত রাস্তাটিকে খুঁজে পাওয়া, দালানটিকে চিনে রাখা কোনো চিহ্ন দিয়ে, সম্ভাষণ জানানো আপেল-নারীটিকে, আর যে পরিচারিকা মেয়েটি দরোজা খুলে দেবে,তাকে এই কথাটাই শুধু বলা : আজ নক্ষত্রের রাত।

‘শুভরাত্রি, শুভরাত্রি। তুমি কি এ পথেই যাবে?’

 

‘হায়! এটাই আমার চলে যাবার পথ।’

 

---------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------

বৃটিশ কথাসাহিত্যিক এবং ফেমিনিস্ট ভার্জিনিয়া উল্ফের জন্ম ১৮৮২ সালে। তাঁকে বিবেচনা করা হয় বিশ শতকের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য আধুনিকতাবাদী সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব হিসেবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে লন্ডনের সাহিত্য সমাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখক হিসেবে পরিগণিত হন তিনি। তৎকালীন ব্লুমসবারি গোষ্ঠীরও একজন সম্মানিত সদস্য ছিলেন তিনি। উল্ফ-রচিত সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। লিখেছেন গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথা, প্রবন্ধ।

মিসেস ডলওয়ে, টু দ্য লাইটহাউস, জেকবস্ রুম, ওরলানডো, দ্য ওয়েভস্ তাঁর প্রখ্যাত উপন্যাস। চরিত্রের অবিরাম বিবৃতি আর উন্মোচনে উপন্যাসগুলো পেয়ে যায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মাত্রা। উল্ফকে বলা হয় অক্লান্ত পরীক্ষক, পর্যবেক্ষক এবং বহুদর্শী এক রচয়িতা। স্ট্রিম অব কনসাসনেস বা চেতনাপ্রবাহ রীতিতে তিনি রচনা করেন ‘নিজের একটি ঘর’ নামক প্রখ্যাত গ্রন্থটি। এই রীতির শ্রেষ্ঠ ফসল জেমস জয়েসের ইউলিসিস। এই রীতিটিকে বলা হয় কোনো ব্যক্তির চেতনাপ্রসূত অভিজ্ঞতার বিরামহীন বর্ণনা। দীর্ঘদিন বিষণ্নতায় ভোগার ফলে বেঁচে থাকবার তীব্রতা কমে যায় তাঁর। নিজের হাতে তুলে নেন নিজেকে ধ্বংসের দায়িত্ব! ৫৯ বছর বয়সে কোটের পকেটে পাথর ভরে বৃটেনের ওউশি নদীতে ডুবে যান তিনি। জীবনে আর ফেরা হয় না তাঁর। জলের সঙ্গে মিশে যায় বিষণ্ন লেখিকার আত্মা। দিনটি ছিল ১৯৪১ সালের ২৮ মার্চ। , বেহালার সঙ্গীত গল্পটির মূল শিরোনাম The String Quartet, গল্পটির রচনাকাল ১৯২১ সাল।

উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ...

"ঘোর" - আবদুশ শাকুর


বেরুনোর মুখে মায়ের চোখের স্থিরদৃষ্টির মুখোমুখি এক যুগ তাকিয়ে থাকল ইশরাত,অতঃপর মুখ খুলল :
আমি তোমাদের সৃষ্টি ঠিকইতবে ঘটনাচক্রে। সুতরাং আমার ওপর কর্তৃত্ব করতে চেও না।
তার মানে?’
মানে তোমাদের চান্স-মিটিংয়ের ফসল আমি - 
তার মানে?’
মানেটা গভীরনিগূঢ় -
তবু আমার জানতে হবে - এত বড় একটা আদেশ দিয়ে ফেললি যখন।
প্যানপ্যানে মা পেছনে লেগেই পড়েছেন যখন মেয়ের শেষ কথাটা আজ তাঁকে শুনতেই হবে। কুপিতা কন্যার শেষ কথাটি ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত :
মানেটা হচ্ছে - তোমাদের দুজনেরই যার যার সঙ্গে প্রেম ছিল তাদের সঙ্গে বিয়ে হলে সে-মিলনের সন্তান আমি হতাম না। সে অর্থে আমি তোমাদের পালিতা কন্যামাত্র। ভালোভাবে পালিতাও নই। তোমার হা পুত্র! হা পুত্র!’-ব্যারামের ঘোরে আমি এক উপেক্ষিতা কন্যামাত্র। অতএব আমার ওপর মালিকানা ফলাতে যেও না।
মালিকানা ফলাতে চাইলে তোকে ওই ঘরটিতে তালাবন্ধ করে রেখে দিতামসিনেমার মতো। কিন্তু এখন এটুকু তো অন্তত জানতে হবে - আমরা কখনো জন্মনিয়ন্ত্রণ করিনিতাহলে তৃতীয় সন্তান তুই আমাদের আকস্মিক মিলনের ফসল হলি কীভাবে?’
আকস্মিকমানে ঘটনাক্রমিক’ আরকি। তোমাদের এই তৃতীয় সন্তানটি কি আমি হতাম?তোমার মিলনটা খালেদ আংকেলের সঙ্গে হলে?কিংবা বোরহান আংকেলের সঙ্গে হলেযাদের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলবিয়ের সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়েছিল বলে বান্ধবীদের সঙ্গে গল্প করেছিলে?’
অন্যদের সঙ্গে বিয়ের সম্ভাবনা কি শুধু আমার জীবনেই সৃষ্টি হয়েছিলতোর বাবার জীবনে হয়নি?’
হয়েছিল। সেও আমি তোমাদের গল্পগাছা থেকেই জেনেছি - সালমা অ্যান্টির সঙ্গেরেশমা খালার সঙ্গে।
তবে?’
তবেই তো বলছি - সালমা ী বাবার বা রেশমা ী বাবার তৃতীয় সন্তানটি আমি’ ইশরাত হতাম না। অর্ধেক হতাম আমি আর বাকি অর্ধেক হতো সালমা অ্যান্টির তৃতীয় সান এলিজা বা রেশমা খালার তৃতীয় সন্তান ফারিহা। তেমনি হাজেরা ী খালেদ আংকেলের বা হাজেরা ী বোরহান আংকেলের তৃতীয় সন্তান আমি হতাম না। অর্ধেক হতাম আমি আর বাকি অর্ধেক হতো খালেদ আংকেলের তৃতীয় সন্তান রেহানা বা বোরহান আংকেলের তৃতীয় সন্তান বারখা - 
এসব কথার তাৎপর্যটা কী রেঠিক কী বলতে চাচ্ছিস তুই ইশরাত?’
হুবহু লেবাননের বিশ্ববিখ্যাত চিত্রকর ও কবি খলিল জিবরান বা কাহলিল জিবরান যা বলেছেন তা-ই। বিষয়টির ওপর চমৎকার একটা পরোক্ষ আলোকপাত আছে তাঁর অন চিলড্রেননামক কবিতাটিতে :Your children are not your children.They are the sons and daughters of Life’slonging for itself.



আমি কি ইংরেজি পড়িনা পড়াই। আমি পড়াই বাংলা এবং পড়িও বাংলা -
তাহলে বাংলাতেই বলি। জগজ্জীবনে মনুষ্যের পারস্পরিক সম্পর্কের ওপর এমন আশ্চর্য আলোকপাত আমার পড়াশোনায় আমি আর কোথাও পাইনি। তাই এ মহৎ কবিতাটি আমি নিজেই অনুবাদ করছিকোথাও ছাপানোর জন্য - যাতে আমাদের জীবনের এই পরম সত্যটি এ-সমাজের যথাসম্ভব বেশি পাঠকের বোধে গিয়ে হানা দেয়। তুমি শুনবে তো মা আমার অনভ্যস্ত অনুবাদ?’
না শুনলে তোর ওই কঠিন কথাগুলো আমি বুঝবো কী করে -
তবে শোন :
তোমাদের সন্তানগণ তোমাদের নন।
পুত্র-কন্যা তাঁরা জীবনের নিজেরই ব্যাকুলতার।
তাঁরা আসেন তোমাদের থেকে নয়তোমাদের তৎপরতাতে,
তোমাদের অন্তর্ভুক্ত নন তাঁরাযদিও তোমাদের পরিবারভুক্ত।
তোমরা তোমাদের ভালোবাসা দিতে পার তাঁদের,ভাবনা নয়,
কারণতাঁদের আছে নিজস্ব চিন্তা।
তোমরা তাঁদের দেহের নিবাস দিতে পারঅন্তরের নয়,
কারণ তাঁদের অন্তর বসত করে আগামীর ঘরে,
যে-ঘরে অভ্যাগমন তোমরা তোমাদের স্বপ্নেও করতে পার না।
তোমরা আপ্রাণ চেষ্টা করতে পার তাঁদের মতো হতে,
কিন্তু কখনো তোমাদের মতো করতে চেয়ো না তাঁদের।
কারণ জীবন পেছনে চলে নাঅধিষ্ঠান করে না গতকালে।
বাকিটা অনুবাদ এখনো হয়নি। কী বুঝলে মা?’
কী আর বুঝবো। আমি করি ঘর-সংসার। বুঝিও সংসার আর  পরিবার --’
না মাপরিবারও বোঝ না তোমরা। বুঝলে সন্তানদের তোমাদের ভাবতে না।
তোরা আমাদের না?’
না।
কবি বলেছেন বলে?’
হাঁ। কবি-সাহিত্যিকগণ মৌল সত্যটি সম্যক উপলব্ধি করতে পারেন। তাই তাঁরা জানেন --সন্তানেরা তোমাদের দ্বারা এ-সংসারে আসে বটে। তবে তারা তোমাদের কেউ নাতারা কেবল নিজেদেরই। এই সহজ সত্যটাই উপলব্ধি করতে পার না বলেই তোমরা ভাইয়াদের ওপর এত রাগ করতাদের এত ভুল বোঝ। অবশ্য ভুল বোঝার খুব জোর কারণও আছে তোমাদের। জন্ম থেকে কুড়ি-পঁচিশ বছর পর্যন্ত সন্তানদের বুকের ভেতর আগলে রেখে একটা ঘোরের মধ্যে থাক তোমরা। জানতেও পার না কবে থেকে তাদের নিজেদের মুক্ত পরিবারের নেশা ডেকে চলেছেতোমাদের যুক্ত পরিবারের ঘোরটা কাটিয়ে।
বাহ্! আমাদের ঘোর কাটিয়ে তবেই তোদের নেশার ডাকে সাড়া দেওয়া!
নেশাটা একেবারে অকাজের জিনিস নয় মাবেশ কাজের জিনিসও হতে পারে। যেমন প্রেমের নেশা,বিত্তের নেশামদের নেশাব্যবসার নেশা - এমনকি ধর্মের নেশাও। জীবনটা তার প্রতিটি পর্বেই একটা নেশার ঘোরে চলে। আসলে বাঁচাটা আগাগোড়া একরাশ নেশারই যোগফল। সে-অর্থে নেশা নিজেতে তেমন খারাপ কিছু নয় মা। যেমন সন্তান ধারণ এবং লালনপালন জীবনের পর্ববিশেষের একটা স্বাস্থ্যকর নেশা। কিন্তু সে-নেশার ঘোরটা একটা রোগবিশেষ - যেটা থেকে নিরাময় প্রয়োজন। তোমাদের এই রোগ-নিরাময়ের অপরিহার্য প্রয়োজনের কথাটাই আজ আমি তোমাকে আমার ভাষায় এবং আমার অভিব্যক্তিতে বলতে বাধ্য হলাম। তোমাকে বলা এজন্যে যেতুমিই আমাকে গর্ভে ধারণ এবং লালন করেছ।
এ ব্যাপারে এই বয়েসেই এত বিদ্যা তুই পেলি কোথায় রে মেয়ে?’
বিদ্যালয়ে মা। ভুলে যাও কেনআমি সামাজিক নৃবিজ্ঞানের ছাত্রী। আমাকে সামাজিক এবং পারিবারিক বন্ধনগুলি নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা আর গবেষণা করতে হয়।
তোর বাবাও আমার মতো জয়েন্ট ফ্যামিলির ঘোরের মধ্যে আছে। কবির ওই নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির মূলতত্ত্বটা সংক্ষেপে আবার বল তো শুনি - তাঁর চিকিৎসাটা আমিই করতে পারি কি নাআমারটা যেমন তুই করলি?’
সন্তানেরা তোমাদের দ্বারা এ সংসারে আসে বটে। তবে তোমাদের থেকে আসে না। তারা ভ্রƒণ থেকেই নিজেদের মতো করে বেড়ে ওঠে। ফলে তারা কেবল নিজেদেরইতোমাদের কেউ না।
বিব্রতবিচলিত মাতা মুদ্রাদোষের মতো বেখেয়ালে আবারও বলে বসলেন :
তার মানে?’
মানেটা প্রায় অজ্ঞেয় বলেই দীর্ঘ ব্যাখ্যার ব্যাপার। আপাতত শুধু এ-কথাটি মনে রেখো যে,মানবসভ্যতার বিকাশে দুটি শক্তির সংঘর্ষের চেয়ে দুটি ব্যক্তির সঙ্গমের ফলাফলই অধিক স্থায়ী অবদান রেখেছে। কবি তাই মানবসভ্যতার মৌল সত্যরূপে দম্পতি-কেন্দ্রিকতার প্রতিই ইঙ্গিত করেছেন।
মাতার ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা দৃষ্টি উপেক্ষা করে ইশরাত আকরাম হনহন করে বেরিয়ে গেল,যেন মানবসভ্যতার বিকাশে নিজের ওই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাটিরই কোনো কাজে। অধিকারিণী’-নামের নারী-অধিকার প্রতিষ্ঠাকামী বিদেশি সাহায্যে পরিচালিত এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার আধিকারিক তাঁর এই একরত্তি মেয়েটির এই সব কিসের উদ্গারহাজেরা আকরাম তা পুরোপুরিই জানেন। তার নিত্যনতুন ছেলেবন্ধু নিয়ে ফেরা এবং ঘরে ঢুকে রুম বন্ধ করা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রচলিত মাতৃ-অধিকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার নিত্যনতুন অধ্যায়ের সম্ভবত অন্তিম কিস্তি এটি।
বস্তুত পরিণত বয়সের মেয়েটির এত উৎকট-উদ্ভট কথা এতক্ষণ ধরে ধৈর্য সহকারে শোনার কারণ হলো প্রশ্নসংকুল মেয়েটি মায়ের প্রশ্নহীন মনটিকে অবশেষে বিচলিত করে তুলতে পেরেছে। এমনকি এরপরে হাজেরার শান্ত-সুখী জীবনটি যে চেনামহলে কখনো কখনো খুবই অস্বস্তিকরই হয়ে উঠতে পারে -- এও তিনি এ মুহূর্তেই উপলব্ধি করছেন।
সোশ্যাল অ্যানথ্রোপলজির ছাত্রীটির মাতাও তো আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েরই ছাত্রী ও শিক্ষয়িত্রী - সাহিত্যের। তিনিও তো অধ্যয়ন এবং অধ্যাপন সূত্রে নর-নারীর শারীরিক-মানসিক সম্পর্কের জটাজাল-বেড়াজাল নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করে থাকেন এবং সে সূত্রেই বুঝতে পারেন যেবদ্ধঘরে যুবক-যুবতীর নামাজে রত হওয়ার সম্ভাবনা কম। কিন্তু অন্য কোনো কাজে রত হওয়ার অব্যক্ত সন্দেহ সম্পর্কেও জাগ্রত চেতনা-ধন্যা কন্যার ভাষণ শুনতে হয়েছিল মাতাকে আরেকদিন।
সেটার তাপমাত্রা ছিল আরো উচ্চ - এক শব্দেবিপজ্জনক’ ভল্টেজের। কন্যার বিপজ্জনক জীবনযাপন দিন দিন আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে চলেছে দেখে সেদিন একটা ভাষণদানের খেয়ালে হাজেরা সবে উচ্চারণ করেছিলেনমহাপুরুষগণ বলেছেন - যৌবনের উদগ্র কামনা আর ব্যগ্র বাসনার যাবতীয় জ্বালা-যন্ত্রণা থেকে নির্বাণলাভের পথ যথাসময়ে অবলম্বন করাটাই শ্রেয়। অমনি শুরু হয়ে গিয়েছিল কন্যার প্রশ্নের বন্যা আর তর্কের ঘূর্ণাবর্ত :
কিন্তু কোন পথটি অবলম্বনে বিশ্বাসী তুমি?নির্বাণলাভের পথ তো বিভিন্ন মহাপুরুষের মতে বিভিন্ন। অস্তিত্বকে আনন্দ-বেদনার ওপারে নিয়ে যাবার উপায় নাকি একাধিক - বোধগুলিকে এড়িয়ে অথবা বোধগুলিকে ছেদিয়ে। অর্থাৎ সভয়ে সংবেদনগুলির পাশ কাটিয়ে গিয়ে কিংবা নির্ভয়ে বেদনগুলির মধ্য দিয়েই পেরিয়ে গিয়ে। কোন পথটি ধরবে তুমি?’
আমি তো দেখতে পাই যে প্রথম পন্থাটি অবলম্বন করে স্বস্তি পায় প্রাচ্য আর দ্বিতীয় পথটি গ্রহণ করে তড়পায় প্রতীচ্য -
প্রথমত প্রাচ্যের পথটি মানবিকই নয়যেহেতু ওটা স্রেফ ইন্দ্রিয়-ভয়। দ্বিতীয়ত প্রতীচ্যের পথটি সত্যিকারের ইন্দ্রিয়-জয় বলে সঠিক অর্থেই মানবিক। কারণ ইন্দ্রিয়ের আকর্ষণে সাড়া দেওয়া যেমন মানবিকতেমনি তাকে গ্রহণ-চর্বণ ও আস্বাদনশেষে চূড়ান্ত বিকর্ষণে পর্যবসিত করা - অর্থাৎ আক্রমণকারী শিঙেল মোষটির শিঙ ধরে লড়ে শেষ পর্যন্ত তাকে ভূলুণ্ঠিত করে ফেলাটাও মানবের প্রজাতীয় বৈশিষ্ট্য। তাই আমার মতে,সকল অর্থে ওটাই মানবিক।
আমার কোনো কোনো বান্ধবী কিংবা তাদের কোনো কোনো বান্ধবীর ইন্দ্রিয়জয়ের সরজমিন দৃষ্টান্তগুলি দেখে এবং শুনে এ যাবৎ আমি নিজের মনে অন্তত প্রাচ্য পথটিকেই শ্রেয় জ্ঞান করে এসেছি। ভেবেছি যেঅন্তিম উদ্দেশ্যটি যখন আনন্দ-বেদনার অপর পারে পৌঁছে গিয়ে মানবিক দুর্বলতাগুলিকে কোনোমতে পেছনে ফেলে দেওয়াতখন মেঠোপথের দীর্ঘযাত্রায় নিজেকে ক্লেদাক্ত না-করে নভোপথে উড়ে গিয়ে পরিচ্ছন্ন শরীরে গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়াটাই তো শ্রেয়।
তাহলে কামনাগুলির কী হবে?’
সীমাবদ্ধ থাকবে।
হোয়াইজীবন তো একটাই।
জীবনের পাত্রটা যখন সসীমতখন প্রাপ্যটাকেও সসীমই থাকতে হবে।
ডিজগাস্টিং!’ বলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে ঘড়ি দেখে বেরিয়ে গিয়েছিল মেয়ে। হয়তো বাইরে অপেক্ষমাণ তার কাম্য কোনো ছেলেবন্ধু বিরক্ত হচ্ছিল।


 


সেদিনটি থেকেও অশান্ত হয়ে গেল এদিনটি। নষ্ট হয়ে যাওয়া ধৃষ্ট দুটি ভাইয়ের পিতা-মাতার প্রতি অমানবিক আচরণের সমর্থনে মেয়েটির পণ্ডিতি ফলিয়ে জোর ওকালতি করা হা পুত্র! হা পুত্র!’-করা এই মাতাটিকে এতটাই বিচলিত করেছে যে,স্বামী ঘরে ফিরতেই তাঁকে মেয়ের আজকের সকল সীমা লঙ্ঘন করা তাবৎ বয়ান হুবহু শুনিয়ে তবেই আত্মস্থ হতে পেরেছিলেন তিনি।
স্বস্থ হতে পেরেছিলেন বটেকিন্তু থাকতে পারলেন কোথায়এদিনটি যে আবার শনিবার! প্রতি শনি-রোববার আকরাম-দম্পতির একজোড়া সাপ্তাহিক ঝগড়াকে বিশেষত্বের মর্যাদা দিতেই হয়। জোড়া বলা এজন্য যেকলহের বিষয়বস্তু অভিন্ন। আর সাপ্তাহিক তো বটেই যেহেতু খিটিমিটি-দুটি প্রায় প্রতি সপ্তাহেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে নির্দিষ্ট দুটি দিনের নির্ধারিত দুটি ক্ষণে -  মৃদুতর্জনে,মন্দগর্জনেতবে সাড়ম্বরে নয় কখনো। প্রতি শনিবার রাত আটটা আর প্রতি রবিবার রাত দশটার দিকে নাজুক সংলাপটি শুরু করেন বেগম ওয়াসিফযদিও প্রায়শই শেষ হয় তাঁরই নিঃশব্দ বিলাপেআর বিপক্ষের অনুচ্চ বিক্ষোভে।
সমাজগণ্য এই সচ্ছল দম্পতি স্ব-স্ব নামে হাজেরা আর ওয়াসিফ। সরকারের কুলীন চাকরি থেকে,সময় হতেইস্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে সংরক্ষিত কর্মশক্তি ব্যবসায় বিনিয়োগ করে পড়তি যৌবনের উঠতি ধনের যোগে জীবনের বিকেলটি অনবসর কাটিয়ে জনাব ওয়াসিফ স্বনামধন্য না হলেও সমাজগণ্য হয়েছেন। ফলে বেগম ওয়াসিফও তাঁর শখের শিক্ষকতায় ইস্তফা দিয়ে সমাজসেবিকার ভূমিকা গ্রহণ করেছেন। অতঃপর নর-নারীর এই সুসংসারী জুটিটি তাঁদের গুলশানের আলিশানআশিয়ান’ ভাড়া দিয়ে বনানীর কোজি কর্নারেবিরামহীন বিশ্রাম আর অনুক্ষণ বিনোদনেই দিনযাপন করতে পারছেন।
উত্তরপঞ্চাশের হলেও জীবন তাঁদের সম্পূর্ণ সপ্রেম এবং সময়ও সম্পূর্ণ ভরপুর - বাহুল্য-বাতুল সামাজিক অনুষ্ঠানের বর্ধিষ্ণু জৌলুসে। সর্ব অর্থের এই-যে জমাট জীবনএর একমাত্র ফাঁকটি হচ্ছে আকরাম-দম্পতির দুটি পুত্রের দুটিই প্রবাসী - যাদের প্রত্যাবাসনও আর প্রত্যাশিত নয়। বড় ছেলে ইউনুস গিয়েছে নিজের উদ্যমেইতবে পিতার পকেট থেকে পথভাড়া আর মাতার আঁচল থেকে হাতখরচা নিয়ে। ছোট ছেলে ইউসুফও বিভুঁই পাড়ি দিয়েছে যথাসময়েইঅগ্রজের স্পন্সরশিপ আর মেয়াদি ধারের হাতখরচায় - অর্থাৎ জনক-জননীকে এক্ষেত্রে কেবল রাহাখরচই মেটাতে হয়েছে।
এরা গিয়েছে বস্তুত ইদানীংকালের নিত্যশ্রত ফ্যালাসির ঠ্যালাতেই। কীএদেশে লাইফে শাইনকরার সুযোগই নেইথাকলেও নিতান্তই সীমিত,অতিমাত্রায় নিয়মশাসিত ইত্যাদি। ওদেশে লাইফ এনজয়’ করার সীমা সিম্পলি ঊর্ধ্বে আকাশ আর নিম্নে পাতাল। আর সর্বোপরিওখানে সবকিছুই লাগামছাড়া -- যা খুশিযেমন খুশিযত খুশি,যখন খুশি প্রভৃতি। তবে বহুল পরিচিত এই শ্রেণীটির দেশত্যাগের গূঢ়তর হেতুটি খুলে তুলে ধরলে বলতে হয় যেএদেশে সুখী শূকর’ হওয়া প্রায়শই অসৎ তরিকাসাপেক্ষ আর ওদেশে অবস্থাটা ঠিক অতটা পতিত নয় -- যদিও পন্থাটার ব্যবহার ওখানেও সমানই উদার। বিকল্পেশুচিশুভ্র মনুষ্য’ হবার উপকরণ এবং উপায় দুয়েরই উপস্থিতি এদেশে যথেষ্ট থাকলেও - লক্ষ্যটি যেমনি নিরামিষওটির অর্জনও তেমনি কৃচ্ছ্রসাধনাসাপেক্ষ।
যাহোকআকরাম-পুত্রদ্বয় গিয়েছে যথাস্থানেই,মানে বিপুল বিজ্ঞাপিত মার্কিনধামে। প্রায় বছরদশেক হচ্ছে মন্টু আছে ইস্টকোস্টে,নেওয়ার্কের কাছেএমবিএ-কিসিমের কিছু একটা পড়েছে বা পড়ছেগোমস্তা-মার্কা কিছু একটা করেছে বা করছে। সে সাদা মার্কিন বিয়ে করেছে অনেকদিনতবে তার মাতা বীথির ব্যথার দিকটি হচ্ছে তাঁর অপছন্দ কীর্তিটি টিকেও রয়েছে এতদিন। ঝন্টু গিয়েছে প্রায় সাত বছর আগে,আছে মিড্ওয়েস্টে উইস্কন্সিনের ম্যাডিসনে। বিয়েটি এখনো নিষ্পন্ন না হলেও জনৈকা ফরাসিনীর সঙ্গে ডেটিং স্টেডি’ যাচ্ছে দীর্ঘদিন। এ-বৎসটির শিক্ষা এবং জীবিকানির্বাহও ওই অগ্রজের ধরনেরই। তবে বিবাহোত্তর জীবনের জন্যে অপরিহার্য অধিক আয়ের পেশা হিসেবে নাকি লিমুজিন-ড্রাইভিংয়ের পাবলিক সার্ভিসে জব সুইচ’ করেছে সম্প্রতি।
স্পষ্টতই এসব অকালবিদেশযাত্রীদের অভিযাত্রা সাধারণত বডিড্রেন’ মাত্র - কদাচিৎই ব্রেন্ড্রেন্। বিশেষ কোনো শিক্ষা কিংবা ক্রিয়ায় কৃতবিদ্য হওয়ার বদলে এই শরণার্থীদলের অনতিসচেতন লক্ষ্য : কঠোর মূল্যবোধ কর্ষণ থেকে মুক্তি এবং ভৌত সুখসমৃদ্ধির প্রয়োজনাতীত প্রাপ্তি। এই প্রাপ্তিযোগপুষ্ট আকরাম-পুত্রগণ তাদের সুসময়ে,অনর্থক হলেওপিতামাতাকে কিছু অর্থও প্রেরণ করে থাকে। প্রয়োজন না থাকলেও পিতা মানা করেন না এজন্যে যেএতে মাতার একরকমের সান্ত্বনা আছেএমনকি গর্বও। তা প্রকাশ করার জন্যেই গরিব আত্মীয়স্বজনকে দান-খয়রাতও তিনি ওই ফান্ড থেকেই করে থাকেন।
এসবেতে আকরাম সাহেবের তেমন কিছু আসে-যায় না বটেতবে হাজেরা বেগমের অনেক কিছুই আসেও এবং যায়ও। আসার খাতে আছে : তাঁর দু-দুটি পুত্রই পবিত্র পশ্চিমভূমে বাড়ি বাগিয়েছে,প্রচুর অধ্যয়ন’ করছেউপার্জন করছে প্রচুরতর প্রভৃতি। আর যাবার খাতে থাকে : দুটি ছেলেই বহুকাল যাবৎ চোখের আড়ালেমনে হচ্ছে আসবেও না কোনো কালেপৌত্রপৌত্রীসহ বউমায়েদের সম্মিলনে চাঁদের হাটটি তাঁর এ জীবনে আর মিলল নাঅর্থাৎ পরিণত বয়সের শেষ শখটাই অপূর্ণ রয়ে গেল -- ইত্যাকার বঞ্চনাযাতনা।
বয়েসে সবার নিচে এবং মেধায় সবার ওপরে ইশরাত-নামের একমাত্র কন্যাটির ওপরই বা আর ভরসা কিসের - মাস্টার্স পাশের পর থেকে কথায় তো সারাক্ষণই উড়ু-ড়ুকাজেও যে-কোনো মুহূর্তেই ফুড়ুৎ হওয়ার অপেক্ষায় আছে। সে গিয়ে ওয়েস্টকোস্টে অবতরণ করলে আকরাম-সন্তানেরা তাদের স্বর্গরাজ্যের এপার-ওপারময় হয়ে যায়। গর্বের কথাই বটে - অন্তত তাদের মাতার কষ্টকল্পিত সান্ত্বনাসূচক বিবেচনায়।
যোগ-বিয়োগের এ-জাতীয় অনুকূল জরিপের জের হিসেবে মিসেস আকরামের পুত্রগর্বের দ্রুততানটি থিতিয়ে গিয়ে সেখানে ইদানীং শুধু পুত্রশোকের গভীর মীড়ই মোচড় দিয়ে ওঠেথেকে থেকে। বোধের এ-বদলটা ঘটেছে দ্বিতীয় ছেলেটিরও বিদেশিনী বিয়ে করে বিভুঁইয়ে থিতু হয়ে যাবার পরিচিত প্রক্রিয়াটি গোচরীভূত হবার পর থেকে। সচ্ছলতা বাড়ামাত্রই উভয় পুত্রের ক্ষেত্রেই নিয়মিত লিখিত পূর্ণপৃষ্ঠা পত্রের বদলে চালু হয়ে গিয়েছিল অনিয়মিতকৃত ক্ষণকালীন টেলিফোন। তাও দিনদিন ক্ষীণ হতে হতে একদিন কেবল এ-পক্ষের ওপর এসেই বর্তে গিয়েছে অনুষ্ঠানটি সংঘটনের একতরফা প্রয়োজন। কেননাপ্রয়োজনটি পরিহার্য বিবেচিত হওয়ায় এমন ভাবপ্রবণ অপচয় তো সুহিসাবী পশ্চিমবাসীদের প্রান্ত থেকে আশা করা যায় না।
এই পটভূমিতেই বেগম আকরাম তাঁর অনাগ্রহী স্বামীকে ফোনের প্রয়োজনটি নিয়মিত স্মরণ করিয়ে থাকেন - বারো ঘণ্টা পেছনের ছোট ছেলেটির বেলায় প্রতি শনিবার রাত আটটায়এই অভিজ্ঞতায় যে অবিবাহিত পুত্রটির কেনাকাটার বহর কম থাকায় তাকে সপ্তাহান্তের শপিংয়ের দিনেও ঘরেই পাওয়া যায়বিশেষত ভোরবেলায়। আর এগারো ঘণ্টা পেছনের বড়ো ছেলেটির ক্ষেত্রে দুপুর বারোটা পর্যন্ত ওয়ার্কিং উইকের বকেয়া ঘুম উশুলের সময় দিয়ে রোববার রাত এগারোটায় - এই অনুমানে যে বিবাহিত ছেলেটি শনিবারে সাপ্তাহিক বাজার সেরে সারাটা রোববার ঘরেই কাটায়। বিশেষত বাড়িটি নিজের হওয়াতে ঘরের কিছু না-কিছু কাজ এই দিনটির জন্যে সারা সপ্তাহ ধরে জমতেই থাকে - যা ওই বেনিয়াদের দেশে পরকে দিয়ে করাতে হলে নিজের গলাটাই কাটা পড়ে বেঘোরে।
আকরাম সাহেবের এই দূরালাপন অনুষ্ঠানে অনাগ্রহ ততটা বিত্তঘটিত নয়যতটা চিত্তজনিত। তবু সন্তানশোকে কাতরা মাতার যাতনার বহর মেপে ডিরেক্ট ডায়েলিংয়ে সহৃদয় পিতা লং কল উভয়পুত্রকেই করে থাকেন মাঝেমধ্যে। বিধুরা মাতাকে পুত্রদের অমূল্য এই শারীরসান্নিধ্যটুকু উপহার দিতে গিয়ে টেলিফোনের প্রাণরাসায়নিক এই উপঢৌকনের ক্ষমতাটি - সাম্প্রতিক উদ্ভাবিত প্রযুক্তির সুদীর্ঘ তালিকায় কেন-যে এখনো একক বলে বিজ্ঞানী মহলেই স্বীকৃত তা -  আকরাম তাঁর মৃতবৎ অনুভবেও বোধ করে থাকেন। বোধটিকে যদিও ক্ষণিকেই বধ করে ফেলে অপরপ্রান্তে সহানুভবের অগোপন অভাব। সেই অভাবের প্রকাশটা যে এবারে একেবারে শনির দশাতেই গড়াবেসেটা স্নেহান্ধ মাতার পূর্বাহ্নে জানা থাকলেও হয়তো তিনি তাঁর চিরায়ত ভূমিকাটি থেকে বিরত না-হয়ে আলোচ্য শনিবারের রাত আটটায় স্বামীর সঙ্গে নিয়মিত এই সংলাপটি ঠিকই ফেঁদে বসতেন :
ঈদটা যত ঘনাচ্ছেছেলেদুটির জন্যে বুকটাও যেন ততই তড়পাচ্ছে। ঈদে-চাঁদেও কি ওদের ফোন-টোন একটু করবে না তুমি?’
বুকটা যখন তোমারই তড়পাচ্ছেটেলিফোনটাও তখন তুমিই করতে পারো।
ওসব কান্ট্রিকোড-এরিয়াকোড-লোকাল নম্বরের লটবহর ভয়ংকর ভজকট লাগে আমার। তাছাড়া তোমার মনটা কি মোটেই জ্বলছে না?’
না। এতকাল ধরে মনটা কেবল জ্বলতেই থাকলে মানুষের জীবনটাই কি অচল হয়ে যেতো না?’
আচ্ছাতুমি কি একটা পিতা নও?’
আমি তো অনেক দিন ধরে শুধুই-পিতাওরাই বরং আর শুধুই-পুত্র নেই বহুদিন থেকে।
তোমাকে বোঝার ক্ষমতা বিধাতা অন্তত কোনো সন্তানের মাতাকে দেননি। কী-যে তুমি বলতে চাও -
বলতে চাই - পুত্র হয়ে জন্মেছিলাম আমিও,স্বভাবতই থাকতে পারিনিপিতাতে পরিণত হতে হয়েছে। প্রক্রিয়াটি অপরিবর্তনীয়। ফলে এ ধরাধাম থেকে আমাকে চলে যেতে হবে কেবল পিতা হিসেবেই। তেমনি আমার পুত্রদ্বয়েরও পুত্রত্বের পুনরাবৃত্তি আর আদৌ সম্ভব নয়। বরং পিতৃত্বের ভূমিকাটি প্রাপ্তিই ওদের এখন একমাত্র সম্ভাব্য বাস্তব -
সম্ভাব্য তো রইল দূরেউপস্থিত-বাস্তব থেকেই বিদায় নিয়ে বীথি তাঁর স্বপ্নের-বাস্তবে চলে গেছেন চলতি সংলাপের কোন ফাঁকে কে জানে। তবে সেটা মাতার নয়নের দর্পণে দর্শনমাত্রই কর্ডলেস ফোনের বেস সেট থেকে হ্যান্ডসেটটি পিতার হাতে উঠে এলো সন্তর্পণেকানে বেজে উঠল ডায়েল-টোন এবং ডজনখানেক ডিজিট ঘুরে গেলে পরে তাঁর ছোট ছেলে ইউসুফের স্পষ্ট কণ্ঠও ভেসে এলো পিতার পেতে-রাখা সটেনশন কর্ণে :
হ্যালো! কেবাবা?’
হাঁ। ঝন্টু তোরা কেমন আছিস?’
ভালো। তোমরাও ভালো তো?’
ভালোই - 
ফোন করলে কী জন্যে?’
তোর মায়ের জন্যে। ঈদের মৌসুম বলে তোদের খুব বেশি করে মনে পড়ছে তাঁর -
কেনআমাদের গ্রিটিং কার্ড পাওনিতোমাদের কার্ড তো পেয়ে গিয়েছি আমরা।
পেয়েছি বটেতবে সে-মুদ্রিত কার্ড তো মৃত হরফের। এই কণ্ঠস্বর তো আস্ত জ্যান্ত এবং একমাত্র তোরই অংশ -
কত-কী-যে ভাবতে পারো তোমরা বাবা! শুধু এটুকুর জন্যই কি এত খরচ করে টেলিফোনটা করলেআমি ভাবলাম কোনো দরকারি খবরটবরই বুঝি -
এটুকু দরকারি না হলেতোর ওই বারোয়ারি গ্রিটিং তো নয়ই - মহার্ঘ্য ডলার পাঠানোও দরকারি নয়। তাই ওসব আর পাঠালে অবশ্যই ফেরত যাবে। তোর মাকে দিলাম।
কি রে টাকার কথা আবার কী হলোবুঝলাম না তো!
রাখো মাবাবার কথার আমি অনেক কিছুই বুঝি না। বুঝতে চাইও না বেশি। কোথা থেকে কোথা চলে যায়। তাতোমার কথা কী বলো।
আমার আবার কথা কী রেআমি যে তোর মা,আমার তো শুধু ব্যথা -
তবে কি অযথাই এই কস্টলি টেলিফোনটা করলে?’
অযথা কেনতোরা কেমন আছিস?’
ভালোমা ভালো। এদেশে মানুষ সাধারণত ভালোই থাকে। একমাত্র অ্যাকসিডেন্ট ছাড়া -
খুব তাড়া আছে মনে হচ্ছে তোর কথার ধরনে?’
হাঁমা। দূরের একটা ওপেন মার্কেটে’ যাচ্ছি। ইজাবেলের কিছু স্পেশাল শপিং আছে। বাইরে দাঁড়িয়ে বেচারী ভারি বিরক্ত হচ্ছে -
বিরক্ত হচ্ছে! দুনিয়ার আরেক প্রান্ত থেকে ফোন করে মা-বাবা তাদের সন্তানের সঙ্গে দুদণ্ড কথা -
কথা তো হয়েই গেল। তবু যদি আরো বাকি থাকে,সে আরেক দিন বলা যাবে। এখন রাখি মাচলি।
ছেলে ফোনের কথা ছেঁটে মাঝপথে রেখে দেওয়াতে মায়ের নিরুদ্ধ নিঃশ্বাসের বাষ্প হঠাৎ হিমেল প্রবাহে গলে গিয়ে টলটল করতে থাকল ছলছল চোখের ক্লান্ত দুটি পাতায়। অশ্রর উৎস চক্ষুকর্ণের পুরোপুরি অগোচর ছিল না পিতারও। তাই পত্নীকে     সান্ত্বনা দান কর্তব্যজ্ঞান করলেন দায়িত্বশীল পতি :
বীথিতুমি অযথা এত ব্যথা পাও কেন বলো তো?এরা আমাদের সোনালি অতীত। আমাদের ভবিষ্যৎ আর রূপালীও নয় বলেই আমরা বারে বারে এদেরই দিকে ফিরে ফিরে যাই। তাই বলে,ভবিষ্যতের পিতৃত্বের জন্যে যুধ্যমান বর্তমান নিয়ে ব্যতিব্যস্ত এসব সন্তানেরা আমাদের মতো অস্পষ্ট অতীতের দিকে ফিরতেই বা চাইবে কেন -- সময় অপচয়ের কথা বাদ দিলেও।
চোখ দুটি বারবার মুছলেন বটেতবে নিজের মনটাকে একবারও চোখ ঠারতে না পেরে বীথি আজ আচমকা এক অভূতপূর্ব অনুরোধ করে বসলেন তার ঘরেতে পরবাসী’ স্বামীকে :
আচ্ছাতোমার ওই প্রিয় গানটা একবার গাও দেখি আজ - সন্তানে কুকর্ম করে/ ভোলে তারে পিতামাতা/ -
আরেওসব তো  হলো ভক্ত রামপ্রসাদের ভিন্নমাত্রার কথাজগৎমাতার কথা - 
তবু গাও না একটু শুনিসকল মাতার কথাও তো হতে পারে।
গানটি ওয়াসিফ গাইলেনতবে যেখান থেকে কণ্ঠে আপনা-আপনি এসে পড়লো : দশমাস দশ দিন/ যাতনা পেয়েছেন মাতা/ -।’ চিরনবিশ ওয়াসিফ গান কিছুক্ষণ প্রতি রাতেই করে থাকেন প্রাণ ভরে,তবে শুধু নিজেরই তরে - যার মারফত অতুলপ্রসাদী আর্তিও ঝরে : দগ্ধ যবে চিত্ত হবে এ মরুসংসারে/ স্নিগ্ধ করো মধুর সুরধারে
কিন্তু স্নিগ্ধ হয়েছিল না বলেই সম্ভবত পরদিন রোববার রাত দশটায় বীথির নিত্যকার মিনতি বিনেই জ্যেষ্ঠ পুত্রটিকে ফোন করতে বসে গেলেন ওয়াসিফ। বীথিও কেন জানি গুটিগুটি এসে পাশে বসে গেলেনহয়তো প্রেরণা আজ দুজনারই একই বেদনাপ্রসূত। হঠাৎ অপর প্রান্তে রিং হতে শুনেই ওয়াসিফ কেন যেন আঁতকে উঠে ফোনটি স্ত্রীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে সরে গিয়ে বসে গেলেন তাঁর হারমোনিয়ামের পাশে। এ-শার্পের সুরটি টেনে দিয়ে বেদনাবিধুর একটি বিখ্যাত তালছাড়া গান গুনগুন স্বরে ভাঁজতেও শুরু করে দিলেন -পাগলা মনটারে তুই বাঁধ
বস্তুত চাইছিলেনও তিনি মনটাকে বাঁধতেইবিগত রাতের জীবন্মৃত মনটাকে। বাঁধতে কিন্তু পারছিলেন নাযেহেতু মাতা-পুত্রের দূরালাপনের ক্রমবর্ধমান সুরচ্যুতি মর্মগোচর হয়ে যাচ্ছিল --বিশেষত হ্যান্ডসেট হাতে বিব্রত বীথির ত্বরিতে দূরে সরে যাওয়ার কসরত দেখে। গানের ভান ছেড়ে ওয়াসিফকে তাই ফোনের প্যারালাল সেটটাই বরং কানে তুলে নিতে হলো। কিন্তু পরক্ষণেই বুঝলেন যে ভুল করলেন - মহাভুল। কেননা না-তুললে তো তাঁকে এসব শুনতে হতো না :
কী রে মন্টুতোদের কি এখনো কোনো খবরটবর নেই?’
সন্তানের কথা বলছ তোনামা। তবে আইরিন এ ব্যাপারে কথা বলার সিদ্ধান্ত শিগগিরই নিতে পারে বলে জানিয়েছে।
সে কী রেএত বছর পরেও আবার কথা বলার কী আছে! এটা তো একটা চিরন্তন বিষয় -
চিরন্তন হলেওবিষয় তো। আর বিষয়মাত্রেই এসব দেশে আগে আলোচনামধ্যে বিবেচনা,অন্তে সম্পাদনা। তুমি অতসব বুঝবে না মা। মূলত রীতিনীতিপদ্ধতির প্রতি এই বিশ্বস্ত আনুগত্যই এদের এতখানি উন্নত করেছে।
তাহলে নাতি-নাতনির মুখ আমাদের আর দেখা হলো না।
নাতি-নাতনি হলেও তো দেখা হতো নাহতো বড়জোর শোনা। দেখার সম্ভাবনার কথা তো আপাতত ভাবাও যায় না মা - যা খর্চা!
খর্চাটা আমরা জোগালেযাবারটার মতো আসারটাও না-হয় তোর বাবাই - 
তোমরা তো করবে শুধু টাকা খরচকিন্তু সময়টা খরচ করবে কেজানো না তো এখানে সময়ের দামটা কত বেশি -
তার মানে আমরা দুনিয়া থেকে চলে যাবার আগে একবার দেখা দিয়ে যাবার বাসনাও তোদের নেই!
ব্যসঅমনি অভিমান করে বসলে। কোনো সাবস্ট্যানশ্যাল কথা নাএসব সেন্টিমেন্টাল কথার জন্যে উইকেন্ডের ঘুমটা-যে ইতিমধ্যেই ছেঁটে দিয়েছ সেও তো বলিনি শুধু অযথা রাগ করবে বলেই। এসব কাজের সমাজে সপ্তাহটা যে কি কঠিন শ্রমে কাটেসে তোমাদের বোঝারই কথা নয় মা। তবে আজকে ঘুম কমিয়ে দিয়ে কিন্তু ভালোই করেছো -- আইরিনের ওয়ালপেপার বদলানোর শখটা এ-রোববারে একেবারে মিটিয়েই দেওয়া যাবে।
‘(
ব্যাকুল কণ্ঠে) আমি তোর স্বল্প শিক্ষিতা মা,অতশত বুঝি না। একা হলেও একটিবার অন্তত দেখা দিয়ে যা না বাবা। আজকাল খালি ভয় হয় : তোদের বুঝি আর এক নজরও দেখে যেতে পারব না। তুই-যে আমার প্রথম সন্তান রে মন্টু!
মাএইটুকু শুধু বোঝার চেষ্টা করো যেএত বড় একটা অপচয় বাঁচাতে পারলে ওটা দিয়েই তো চট করে ইশরাতকে নিয়ে আসা যাবে এদেশে -
অতঃপর নিজেকে আর সামলাতে না-পেরে মাতার পক্ষে অগত্যা পিতাই কথা বলে উঠলেন --শীতল কণ্ঠে এবং নির্মম শব্দে :
তোদের টাকা ছাড়াই ওই মূঢ়ের স্বর্গে মেধাবিনী ইশরাত সসম্মানেই পৌঁছে যাবেস্কলারশিপ নিয়ে। ভাইদের মতো ডাল্ সে নয়। বরং বাপের চেয়েও শার্প্। তাই মা-বাপের কাছেও হাত পাততে হবে না ওরতোদের মতো -
পিতার অপমানকর কথাবার্তা আর বাড়তে না দিয়ে স্বভাবতই টেলিফোন রেখে দিলো পুত্র। পিতা ওয়াসিফ যেন পুঞ্জীভূত গ্লানির দুঃসহ বোঝাটা নামাতে পেরে এবারে পূর্ণপ্রাণে গানে বসতে পারলেন। দীর্ঘক্ষণ নিভৃতে রোদনের পরে স্খলিতপদে এসে পতির পাশে আসন টেনে বসে ব্যথাতুর বীথি কালকের মতো অভিনব অনুরোধটি আজও করে বসলেন :
আজো না-হয় রামপ্রসাদীই গাও। ওই-যে আরেকটা আছে না - কুপুত্র অনেক তো হয় মা/ কুমাতা নয় কখনো তো।
না বীথিওই গানের মেজাজ আজ পাওয়াই যাবে না।
তাহলে একটু আগে-যে গুনগুনাচ্ছিলেসেই অতুলপ্রসাদীটাই একটু প্রাণ খুলে গাও -- ‘এবার তুই একলা ঘরে নয়ন ভরে কাঁদ।/ পাগলা মনটারে তুই বাঁধ ॥
তাই গাইলেন ওয়াসিফ এবং পূর্ণ প্রাণেই গাইলেন। হাজেরাও মগ্ন হয়েই শুনলেন কিছুক্ষণ। পরে বোধহয় শ্রবণের চেয়ে নয়ন ভরে ক্রন্দনেরই প্রয়োজন বেশি বোধ করলেন এবং যেন কাকে খুঁজতে খুঁজতে উঠে চলে গেলেন ধীরে ধীরে,আরেক অতুলপ্রসাদী ক্রন্দসী পথচারিণীর মতোই -- ‘তুমি কোথা যাওতুমি কারে চাও?’অতঃপর নিজেকে নিয়ে একাকী হতে পেরে পীড়িত ওয়াসিফ তাঁর সংগীতসরোবরে এবারে পুরোপুরিই নিমজ্জিত হতে পারলেন। সে-নিমজ্জন এমনি সংজ্ঞাহরণ যেকালজ্ঞান তাঁর একদম রহিত হয়ে গিয়েছিল। তাই ঠিক কতক্ষণ পর ধিকৃত পুত্রটি জ্বালা জুড়ানো কিংবা ক্ষোভ মেটানোর জন্য টেলিফোনটা করল -- ওয়াসিফ ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না। বুঝতে অবশ্য চাইলেনও না তেমন করে।
কিন্তু বীথি যেন আহত পুত্রের জরুরি শুশ্রুষার সুযোগটির অপেক্ষাতেই রাতের দুটো পর্যন্ত নিদ্রাহীন প্রহর গুনছিলেন ফোনের জন্যে উৎকর্ণ হয়ে। তাই রিং একবার বাজতেই শয্যা থেকে ছুটে এসে ফোন ধরলেন তিনি। ছেলে কিন্তু মায়ের সঙ্গে একটি কথাও বললো নাবলতে থাকলো শুধু বাবাকে দিতে। এদিকে স্ত্রীর অধীর তাগিদও স্বামীর সুধীর সংগীত থামাতে পারলো না। শুধু মাঝে মাঝে শুনলেন - আগে তোমাদের কথা শেষ হোক। অবশেষে বিব্রত মাতাকে বলতেই হলো ফোনের মুখ চেপে ধরে - মায়ের কথা শেষ হবে কীছেলে তো কথা শুরুই করলো না। কেবল পীড়াপীড়ি করতে থাকলো - বাবাকে দাও,বাবাকে দাও। ফোনটা হাতে নিতে বাধ্য হলেন নির্যাতিত পিতা। ফোনের কাছে মুখ নিয়ে শুধু একটা ফরমানই জারি করলেন অবসন্ন ওয়াসিফ :
ওকে বলে দাও বীথি : ওই জড়জগতের একটি জড়পিণ্ডের সঙ্গে কথা বলে অপচয় করার মতো সময় আমার এক মুহূর্তও নেই। কারণ আমি এখন মনোজগতের আনন্দমার্গে বিচরণ করছি।
ক্ষুব্ধ জনকের এই কঠোর উত্তর অবাধ আকাশপথে রুষ্ট পুত্রের কর্ণগোচর হতেই টেলিফোনটা সে রেখে দিলো সশব্দে। আহত মাতাও সশব্দেই জুড়ে দিলেন ক্রন্দন। থেমে গেল ওয়াসিফের শান্তরসমণ্ডিত সংগীতের সপ্রাণ সেবনও। কিছুক্ষণ সমস্তটা ঘর যেন শ্মশানই হয়ে রইল। অবশেষে বীথির ক্রন্দনমথিত নিন্দাবাদেই নীরবতাটা ভাঙলো :
তুমি কি একটা পিতানা এক টুকরা পাথর?স্বভাবগত পুত্রস্নেহও কি পিতার মনে অবশিষ্ট নেই যৎসামান্য?’
যৎসামান্য কেনঅসামান্যই আছে -- তবে আছে কেবল পুত্রেরই জন্য। আমার পুত্রদ্বয় এত কাল আগে গত হয়েছে যে ওদের প্রতি স্নেহবোধও কালে কালে সম্পূর্ণই লোপ পেয়ে গিয়েছে বলতে পারো। আর তুমিও যা! যারা চলে গিয়েছে তাদের জন্য অযথা অশ্রপাত না করেযে আছে তাকে দিয়ে তোমার মাতৃমনের চাহিদা মিটিয়ে যাও না কেনআমার মেধাবিনী ইশরাতকে দিয়ে?’
তার মানে মন্টু-ঝন্টুকে তুমি কাল ঈদের দিনেও আর ফোন করবে নাঅন্তত ঈদ মোবারক জানাবার জন্যেও নাএমন একটা খুশির ঈদের মুখে অমন সব দুখের কথায় সন্তানদের দোষী সাব্যস্ত করে কি সুখে থাকতে পারবো আমি?’
তা না পারোতবু ফোন আমি তোমার জন্যও আর করবো না - যার জন্য এতদিন করে এসেছি। আমার জন্য কোনোদিনই করিনি।
জঙ্গম পশুও নওতুমি একটা স্থাবর পাষাণ - সন্তানের টান থেকে পশুও বঞ্চিত নয় তোমার মতো।
শ্বেত ঘৃণায় পাষাণের মতোই জমাট বেঁধে-যাওয়া স্বামী আর একটা কথাও বাড়ালেন না দেখে স্ত্রীও ইতি টানলেন -  তাঁর অতি-উগ্র ওই উপসংহারেই। কিন্তু বিন্দুমাত্র স্বস্তি নেই যে-মায়ের মনেতার পক্ষে ইতি টানা কি সম্ভবদ্রুতপদেই চলতে থাকলেন বীথি - যাকে বলেডাউন দ্য মেমারি লেন। পৌঁছে গেলেন প্রথম বিপর্যস্ত ঈদের সেই চারচোখে বান-ডাকা চাঁদরাতটিতে - যে রাতে হৃদয়হীন বড় ছেলেটির যান্ত্রিক আচরণের প্রথম আঘাতটি পেয়েছিলেন তার হার্দিক পিতা এবং মাতা দুজনেই।
বিনিদ্র রজনীশেষে ঈদের ময়দান থেকে ফিরে এসে স্বামী নিজের ঘরের কোণে বসে আছেন শুনে সেবারের অতি সুন্দর ঈদী শাড়িখানি পরে আনুষ্ঠানিক দাম্পত্য কর্তব্য পালন করতে গিয়ে এক অদৃষ্টপূর্ব দৃশ্য দেখে চমকে উঠেছিলেন স্ত্রী। ওয়াসিফ তাঁর ঈদের লেবাসেই হেলান চেয়ারটায় যেন জীবনের হালটাই ছেড়ে দিয়ে আত্মসমর্পিত হয়ে পড়ে রয়েছেন। অবিশ্রান্ত অশ্রধারে ফুরফুরে পাঞ্জাবিটির সমস্ত বক্ষটাই ভিজে জবজবে হয়ে গিয়েছে। তবু বুকের অগ্নি-যে নেভেনিতার প্রমাণ - চোখের পানি থামেনি। ঘাবড়ে গিয়ে জরুরি কণ্ঠে জানতে চাইলেন বীথি :
কাউকে কাছে না ডেকে একা-একা এখানে হচ্ছেটা কীকী হয়েছে তোমার?’
চিরনির্বিকার পুরুষটি নিরুত্তর। চোখের জলের জোয়ারেই কেবল তরঙ্গভঙ্গ বেড়ে গেল।
শুধু এটুকু তো বলতে পারো যে আমার সর্বনাশের কি আরো কিছু বাকি ছিল?’
হাঁকাল পর্যন্তও হয়তো ছিল। আজ আর কিছুই বাকি নেইসবই শেষ। তবে এটুকু ভেবে সান্ত্বনাও পেতে পারো যেহারাবার মতো কিছুই আমাদের আর বাকি রইলো না -- বাকি পুত্রটিও আজ হারিয়ে গেলো চিরতরে।
কে হারিয়ে গেলোসব খুলে বলে ফেলছো না কেন তুমিকালরাতের পর সইতে না পারার মতো কোনো কষ্টই আর থাকতে পারে না আমার -
তাহলে দুঃসংবাদটি দুঃসহতম হলেও সহজেই নিতে চেষ্টা করো। সবে ধন যে-নীলমণিটি কাল পর্যন্ত আমাদের পূর্ণ করে রেখেছিলসেই শেষ পুত্রটিও তার পিতামাতাকে সম্পূর্ণ শূন্য করে দিয়ে চিরতরে বিদায় হয়ে গেল -
কী বললেতোমার সঙ্গেই তো ঈদের জামাতে গিয়েছিল ঝন্টু -
গিয়েছিল এবং ফিরেওছিল। ওকে নিয়ে বরাবরের মতো প্রথমেই বড় ভাইকে ঈদের সালাম করে আসার জন্যে ওর ঘরেও গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু গিয়ে দেখলামপ্রাণের টুকরো ঝন্টু আমার তার আগেই কখন যেন আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে চিরতরেই হারিয়ে গিয়েছে -
পাশের শয্যায় ঢলে পড়ে সংজ্ঞা হারাবার আগে কাজের ছেলেটিকে ডেকে ডুকরে উঠলেন বীথি,অস্বাভাবিক চিৎকারে :
হাফিজ রে! আমাকে খুলে বল --  কীভাবে চলে গেলো আমার ঝন্টুকোথায় গেলো?’
সাহেবের কথাবার্তা শুনে ঘাবড়ে গিয়ে দরজার বাইরে কর্মরত হাফিজ থতমত খেয়ে ছুটে এসে দুচোখ মুছতে মুছতে কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বললো :
ভাইয়া তো আমারে বইলা গেলেন যে সাদেক ভাইয়ার বাসায় যাইতাছেন।
ঝন্টুর নিকটতম এ-বন্ধুটির ফোন নম্বর হাফিজ জানতো। সুতরাং উদ্ভ্রান্ত হয়ে কারো অনুমতি ব্যতিরেকেই সে-নম্বরে ফোন করলো সে এবং ভাইয়াকে পেয়ে গিয়ে বাসার কান্নাকাটির উল্লেখটুকু করেই লাইনে থাকেন’ বলে ফিরে এসে খবর দিলো :
ভাইয়া তো যেইখানে গেছেন সেইখানেই আছেন,বন্ধুদের সঙ্গে ঈদের নাস্তা খাইতাছেন -
হাফিজের শেষের কথাকটি বীথির কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হলোঠিক যেন স্বপ্নে :
নাস্তা খাচ্ছে! আমার ঝন্টু ঈদের নাশতা খাচ্ছে?’
হাঁ খালাম্মাঈদের নাস্তা। বইলা যাওয়ার পরেও ডিস্টার্ব করাতে একটু রাগও করছেনতবু কান্নাকাটির কথা শুইনা ফোন ধইরা আছেন। এই যে ফোন নেনকথা বলেন!
হাফিজ হ্যান্ডসেটটি বীথির কানে ধরিয়ে দিতেই অধৈর্য ঝন্টু বিরক্ত স্বরে বলে উঠলো :
আমাকে নিয়ে হঠাৎ কান্নাকাটির কী হয়ে গেল মা?’
আগে বল বাবা তুই কেমন আছিস -
ভালো আছি। কিন্তু এবার তুমি বলো এইসব হচ্ছেটা কী?’
ওয়াসিফ সবকিছু জেনেশুনেও নির্বিকার বসে আছেন। তাঁর মুখে কোনো কথাই সরছে না,চোখের পানিও থামছে না। ঝন্টুর সকারণ বিরক্তির মুখে বলার মতো তেমন কথা আর না-পেয়েচিরতরে হারিয়ে যাওয়া পুত্রটিকে মুহূর্তে ফিরে-পাওয়া মাতা তাঁর হর্ষোজ্জ্বল কণ্ঠে কেবল বাড়তি কিছু আদর ছড়িয়ে অবশেষে বললেন :
কিন্তু তোর বাবা-যে ঈদের লেবাসে বসে আছেন প্রতিবারের মতো তোকে নিয়েই ঈদ-বেড়াতে যাবেন বলে। প্রত্যেক বছর  সেই-যে তোর বড় চাচার বাসা থেকে শুরু করে -
মায়ের বক্তব্য পূর্ণ শুনতে না চেয়ে ঝন্টু আজ নিজের মন্তব্যই পূর্ণ শোনাতে শুরু করলো :
সব সময় আমি কি খালি বাবার সঙ্গেই বেরুবো?কোনোদিনই কি আমি নিজে-নিজে বেরুবো না?নিজের বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াবো না?’
প্রশ্নের বহরেকণ্ঠের স্বরে ঝন্টুকে আজ অতিসচেতন বোধ হওয়াতে আরো নরম সুরে,আরো আদরভরে - বরং আদরের সঙ্গে অনেকখানি আবদার মিশিয়েবীথি এবার মিনতি করেই বললেন :
হলো তো বাবাসবই তো হয়ে গেল। নিজে-নিজে বেড়ালিবন্ধুর বাড়ি গেলিসকলে মিলে খেলি। এবার চলে আয়! বাবারও তো একটু পাওয়া চাই আমাদের কলজের টুকরো ঝন্টু মিয়াকে --’
না মাএখন আসা যাবে না। মেলা দেরি হবে। আমাদের আরো অনেক প্রোগ্রাম আছে। বাবাকে বলো এবার একা-একা বেরুতে,  না-হয় তোমাকে সঙ্গে নিয়ে বেরুতে।
সে কি করে হয় রেআমিও না থাকলে বাসায় ঈদের গেস্ট রিসিভ করবে কে?’
উত্তর না দিয়ে টেলিফোনই রেখে দিলো ঝন্টু। এতক্ষণে মুখ খুললেন ওয়াসিফতবে কণ্ঠে তাঁর বিদ্রƒপের রেশ বেশ অপ্রচ্ছন্নই শ্রত হলো :
কী বললো তোমার পুত্র?’
সদ্যমাত্র শঙ্কামুক্ত মাতার জবাবে বরং ক্ষাণিকটা প্রগলভতারই ছটা :
বললোবাবাকে এবারে মাকে নিয়ে বেরুতে বলো -
মাকে তাঁর কথা আর শেষ করতে হলো না,বাকিটুকু বাবাই বলে গেলেন :
শুধু এবারেই নয়এখন থেকে প্রতিবারেই - তাই না?’
সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে হেলান-চেয়ার থেকে উঠে পড়ে সাদরে বীথির হাতখানি ধরে উঠে দাঁড়িয়ে চলতে চলতে বলতে লাগলেন ওয়াসিফ :
চলোতোমাকে আজ দেখিয়েই দিই : আমাদের পুত্রগণ জনক-জননী থেকে কীভাবে বিচ্ছিন্ন হন,কখন বিগত হনযার পরে তাঁরা আর পুত্ররূপে থাকতেই পারেন না - রূপান্তরিত হতে থাকেন পিতৃরূপে।
বিভ্রান্ত বীথিকে ঝন্টুর কক্ষে নিয়ে গিয়ে তার পড়ার টেবিলের দেরাজটা দেখিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন ওয়াসিফকিছুটা যেন রহস্য করেই :
ঝন্টুর দেরাজটা খোলো তো দেখি।
বীথি টেনে দেখলেন যে ওটা তালা-মারা। ওটার খুলে না যাওয়াটাই যেন মাতার গোটা মাথাটাই খুলে-যাওয়া। সুতরাং এই স্বতঃসিদ্ধটিরই শুধু স্বীকৃতি চাইলেন ঝন্টুর পিতা :
এবার বুঝলে তো?’
এতে আবার বোঝার কী হলো?’
কাল পর্যন্তও যা ছিল মুক্ত-দেরাজ -- তার পিতামাতারসহ সকলেরই কমন ভুবন। আজ থেকে বন্ধ-দেরাজটি শুধু ঝন্টুরই আপন ভুবন হয়ে গেলো।
সে তো বটেই। কালই তো মনুমিস্ত্রিকে ডাকিয়ে নিয়ে ঝন্টু তার দেরাজটিতে তালা লাগিয়ে নিয়েছে।
আমিও তো তাই বলছি : ঠিক তখন হতেই আমাদের শিশুপুত্র ঝন্টু মিয়া তার মাতা-পিতা থেকে চিরবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে কেবল নিজের জন্যে জনাব ইউসুফ আকরাম হয়ে গিয়েছে। গোটা পরিবারের এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি আমি তো মাত্র কিছুক্ষণ আগেই আবিষ্কার করলাম : সামান্য একটা দরকারে ওর ড্রয়ার থেকে একটা হাইলাইটার নেবার জন্য ওর ঘরে গিয়েছিলাম বলে। ওটা নিতে             না-পারাটাই যে এমন অসামান্য একটা ব্যাপারের হাইলাইটার হয়ে যাবে,সেটা যে আগে ভাবাই যায়নি।
তা ভাবা না-ই বা গেল। কিন্তু হাইলাইট হলো কোন পয়েন্টটা?’
পয়েন্টটা এই যেঅবশেষে আমাদের শেষ পুত্রটিও তার মনের কুঠুরিতে নিজস্ব তালাটি লাগিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎপিতামাতার সঙ্গে কমন জীবনের মেয়াদ তার এ-জন্মের মতো ফুরিয়ে গিয়েছে : তার বদলে জন্ম নিয়েছে আরেকজনসে’, আরেকজন পিতা - পুত্র আর নেই আমাদের ঝন্টু।
বীথি কিন্তু আরো একজন সাবালক পুত্রের মাতা হয়ে যাবার সুসংবাদে হৃষ্টস্বরে সুখের লহর তুলেই যেমন সংবাদটির সমর্থনে প্রমাণ জোগান দিলো :
তাই তো মনে হয় আমি’-শব্দটির ব্যবহারও ঝন্টু যেমন আজ একটু বেশি-বেশিই করছিল -- আমি,আমিআমি।
তবেই বোঝোপ্রবাসী মন্টুর ক্ষেত্রে পুত্রশোক আমাদের কতখানি বাসি।
মন্টু-নামটি মনে মনে উচ্চারিত হতেই স্মৃতিপথটির ঠিক এইখানটায় হোঁচট খেয়ে বারান্দার সোফা-দুটির একটিতে হাজেরা যেনঠিক বসে নয় - একেবারে উলটেই পড়ে গেলেন                        বাস্তবজগতের এবারের ঈদের সকালটিতে। ঘোর-লাগা স্ত্রীকে এভাবে বসে পড়তে দেখে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ওয়াসিফও পাশের সোফাটিতে বসে পড়লেন। বিষণ্ন তার অভিব্যক্তিতে এখন আর কোনোই ভিন্নতা নেই - প্রায় বিপরীত প্রকৃতির এই দুটি ব্যক্তিতে। নব-আবিষ্কৃত এই হৃতসর্বস্বতা একটা একমুখীনতা এনে দিয়েছে বিষম দৃষ্টিভঙ্গির দুটি নরনারীর মধ্যে। এ মুহূর্তে দুজনের দৃষ্টিও প্রসারিত একই দিকেসম্মুখেনাসিকাপ্রান্ত থেকে সুদূর দিগন্তের  যে-দূরত্বেই হোক : তা যেন স্থাপিতও আজ একই স্থানে।
ঠিক এমনি একটি নতুন মৈত্রীবন্ধনে একসময় সুস্থির বোধ করলে জননীর কাছে জানতে চাইলেন জনক :
কার জন্য কাঁদছোবড় আর ছোট ছেলের জন্য?’
হ্যাঁ। আমার কাছে তাদের অন্তত একটিবার এনে দাও টেলিফোনের লাইনে।
ওরা তো হাজার-হাজার মাইল দূরে। সরাসরি শ্রবণ-দূরত্বের তোমার পাশের কামরার ইশরাতকেও তো আর কখনোই আমাদের কাছেআনা যাবে না বীথি। এ দুঃসহ শোকই তো জগজ্জীবনে মনুষ্যলোকের জন্য বরাদ্দকৃত গুরুতম দণ্ডটি।
তবে দণ্ড গুরুতম হলেও - তরতাজা শরতের এই ঝকঝকে সকালের সন্তানশোক আকরাম-দম্পতিকে এমন এক নিবিড় বন্ধনে একাত্ম করে তুলছিলযেমন একাত্ম বন্ধনে এককালে তাঁরা এই          সন্তানদের জন্ম দিয়েছিলেন।