Sunday, October 7, 2018

মাইকেল ফ্যারাডে – যে বিজ্ঞানীর কাছে পুরো মানবজাতি কৃতজ্ঞ!


এলবার্ট আইনস্টাইন তার পড়ার ঘরের দেয়ালে কেবল তিনজনের ছবি ঝুলিয়ে রেখেছিলেন – আইজ্যাক নিউটন, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল, আর তৃতীয় জন – যাকে নিয়ে আজ আমাদের গল্প – মাইকেল ফ্যারাডে। মহান বিজ্ঞানী রাদারফোর্ডকে চেনেন তো? তিনি মাইকেল ফ্যারাডেকে নিয়ে বলেছিলেন, “তার আবিষ্কারগুলোর মাত্রা আর ব্যাপকতা, বিজ্ঞান আর শিল্পকারখানার জগতে সেগুলোর গুরুত্ব বিবেচনা করলেই বোঝা যায় – এই লোকটাকে যত বড় সম্মানই দেয়া হোক না কেন, সেটা যথেষ্ট নয়।”

michael-faraday-1241x763

ব্রিটিশ পদার্থবিজ্ঞানী, রসায়নবিজ্ঞানী, আবিষ্কারক মাইকেল ফ্যারাডের জীবনীতে সবাইকে স্বাগতম। শুরুতেই এক নজরে দেখে নিই সাধারণ কিছু তথ্য –

জন্ম – ২২শে সেপ্টেম্বর, ১৭৯১, জন্মস্থান – লন্ডন, ইংল্যান্ড
শৈশব – কী অদ্ভুত কষ্টে আর সমস্যায় যে কেটেছে এই লোকটার শৈশব!
স্ত্রী – সারাহ বার্নার্ড
সন্তান – নেই
ঝোঁক – পদার্থ (বিশেষ করে তাড়িৎ-চৌম্বক), রসায়ন
আবিষ্কার – ওরে বাবা! এখানে লিখে শেষ করা যাবে না। পাবেন নিচের দিকে, গল্পে গল্পে আসবে। শুধু একটা জিনিস বলে রাখি, তার কাজের মাহাত্ম্য বোঝানোর জন্য – আধানের একক ফ্যারাডে (অবশ্য এখন কুলম্ব ব্যবহার করা হয়), আধান সংরক্ষণ ক্ষমতার একক ফ্যারাড (Farad, ফ্যারাডে নয়), এক মোল ইলেকট্রনে আধানের পরিমাণকে বলে ফ্যারাডে ধ্রুবক বা Faraday Constant.
পুরষ্কার – Royal Medal (দুইবার), Copley Medal (দুইবার), Rumford Medal, Albert Medal
মৃত্যু – ২৫শে আগস্ট, ১৮৬৭, মৃত্যুস্থল – ইংল্যান্ড

এই লোকটার আবিষ্কারগুলোর গুরুত্ব এতো বেশি যে, বিজ্ঞানভিত্তিক অনুষ্ঠান “কসমস”-এর (২০১৪ সালের) সিকুয়েলে গোটা একটা পর্ব উৎসর্গ করা হয়েছিলো তার জন্য। এই পোস্টে সেই পর্বটি থেকে অনেক গল্পই থাকবে।

শৈশবের তিক্ত অভিজ্ঞতা


ফ্যারাডের উচ্চারণে সমস্যা ছিলো। তিনি “র” উচ্চারণ করতে পারতেন না। এটা নিয়ে সবখানে হাসাহাসি হতো, স্কুলেও। তিনি বেশিদূর পড়াশোনা করেননি, সামান্য যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ শেখা পর্যন্তই ছিলো তার গণিতবিদ্যার দৌড়! তার পরিবারও ছিলো দরিদ্র। চার সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। স্কুলেও আর গেলেন না, পড়াশোনাও করলেন না। তাকে লেগে পড়তে হলো জীবিকার কাজে, মাত্র ১৩ কি ১৪ বছর বয়সে! স্থানীয় একটা বই বাঁধাই করার প্রতিষ্ঠানে কিশোর ফ্যারাডে যোগ দিলেন। বস্তুত, এখানেই তিনি নিজেকে স্বশিক্ষিত করেছিলেন। দিনের বেলায় বই বাঁধাই করতেন, রাতের বেলায় বই পড়তেন বসে বসে।

বই বাঁধাইয়ের কারখানা থেকে রয়েল ইন্সটিটিউট


লন্ডনের বিখ্যাত রয়্যাল ইন্সটিটিউশনে তিনি একবার আবিষ্কারক হামফ্রে ডেভি’র বিজ্ঞান প্রদর্শনীর অনুষ্ঠান দেখতে গেলেন। সবাই যখন অনুষ্ঠান উপভোগে মত্ত, ফ্যারাডে তখন নোট নিতে ব্যস্ত। পুরো অনুষ্ঠানের কথাগুলোই লিখে ফেললেন তিনি! নিজে থেকে এতো এতো নোট যুক্ত করলেন যে শেষ পর্যন্ত বইটার পৃষ্ঠা সংখ্যা দাঁড়ালো ৩০০! বই বাঁধাইয়ের অভিজ্ঞতা তো ছিলোই! সেটাকে কাজে লাগিয়ে, নোটগুলোকে একটা বইয়ের মত বানিয়ে সেটা পাঠিয়ে দিলেন স্যার ডেভি’কে। হামফ্রে ডেভি মুগ্ধ হলেন ফ্যারাডের স্মৃতিশক্তি দেখে। এমন সময় তার গবেষণাগারের একটা দুর্ঘটনায় তিনি সাময়িকভাবে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে গবেষণায় অক্ষম হয়ে গেলেন। লেখালেখি করা তার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছিলো না। তখন, তিনি ফ্যারাডেকে ডেকে পাঠালেন, নিজের এসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করার জন্য। দিনের বেলায়, রয়েল ইন্সটিটিউটে স্যার ডেভির গবেষণাগারে সাহায্য করতেন ফ্যারাডে। সাহায্য বলতে বিশেষ করে গবেষণার নোট নেয়া, এটা সেটা এগিয়ে দেয়া, পরিষ্কার করা, আগে থেকে দেখিয়ে দেয়া নিরীক্ষাগুলোর প্রস্তুতি করা ইত্যাদি।

ডেভির স্ত্রী ফ্যারাডেকে অবজ্ঞা-অবহেলা করতেন। তখনকার সমাজটাই এমন ছিলো যে অর্থনৈতিকভাবে নিচু স্তরের মানুষকে হেয় করা হতো। ডেভি যখন ফ্যারাডেকে নিয়ে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক ভ্রমণে দূর-দূরান্তে (এমনকি অন্য দেশে) যেতেন, তখন ডেভির স্ত্রী তাকে ঘোড়ার গাড়ির ভেতরে বসতে দিতেন না। তিনি ফ্যারাডেকে অন্যান্য চাকরদের সাথে খাওয়াদাওয়া করাতেন। এতো অপমান করতেন যে মাঝে মাঝে ফ্যারাডের ইচ্ছে হতো, একা একা আবার ইংল্যান্ডে চলে যেতে।

কর্মচারী থেকে আবিষ্কারক


অবশ্য স্যার হামফ্রে ডেভি নিজে খারাপ ব্যবহার করতেন না ফ্যারাডের সাথে। এমনকি নিজের লেখালেখির মধ্যে তিনি ফ্যারাডের অবদানের কৃতজ্ঞতাও স্বীকার করতেন।

কোনো ধাতব বস্তুতে বিদ্যুৎ চালনা করলে সেটা একটা অস্থায়ী চুম্বকে পরিণত হয়। এটা তখনকার বিজ্ঞানীদের জানা ছিলো না। হামফ্রে ডেভি এবং তার সহ-গবেষক বিদ্যুতায়িত বস্তুর এই চৌম্বকক্ষেত্র ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে খাবি খাচ্ছিলেন। এই ধর্মটাকে কাজে লাগিয়ে কোনো ধাতব দণ্ডকে ক্রমাগত ঘোরানো যায় কিনা, সেই চিন্তা করছিলেন। তখন মাইকেল ফ্যারাডে, গবেষণাগারের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কর্মী, সারা দিন রাত এটা নিয়ে ভাবতে লাগলেন। তিনি এটা সেটা নিয়ে টুকটাক প্রচেষ্টা চালাতে লাগলেন। এবং একদিন, সত্যি সত্যি তিনি বিদ্যুৎকে কাজে লাগিয়ে একটা ধাতব বস্তুকে ঘোরাতে সক্ষম হলেন। এই প্রথমবারের মত কেউ বিদ্যুৎকে যান্ত্রিক শক্তিতে পরিণত করলো। আবিষ্কৃত হলো ইলেকট্রিক মোটরের মূলনীতি।

আজ আমরা আশেপাশে যত যন্ত্রকে বিদ্যুৎ দিয়ে চলতে দেখছি, সেটার সূত্রপাত হয়েছিলো মাইকেল ফ্যারাডের এই গবেষণার হাত ধরে। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আবিষ্কারগুলোর কথা বলতে গেলে এটা একদম ওপরের দিকে থাকবে। তখনই মানুষ এটার আশু গুরুত্বের কথা বুঝতে পেরেছিলো। মাইকেল ফ্যারাডে প্রায় রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন। ১৮২৪ সালে, মাত্র ৩২ বছর বয়সে, তাকে রয়েল সোসাইটির সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করা হলো। এটা একটা স্বীকৃতি ছিলো যে, ফ্যারাডে নিজ যোগ্যতায় একজন বিজ্ঞানী হয়ে উঠেছেন। পরের বছর তাকে রয়েল ইন্সটিটিউটের গবেষণাগারের পরিচালক বানিয়ে দেয়া হলো।

একটি কাঁচের বিস্কিট


নিজের অধীনের এই খ্যাতি হামফ্রে ডেভি হয়তো খুব একটা ভালো চোখে দেখেননি। তিনি ফ্যারাডেকে ধরিয়ে দিলেন একটা কাজ, যেটা ফ্যারাডে কখনোই পেরে ওঠেননি। কাঁচ জিনিসটা তখন অনেক মূল্যবান ছিলো। অপটিকস (optics) এর জগতে তোলপাড় হচ্ছিলো, শুধুমাত্র উন্নতমানের কাঁচের কারণে। আর এই কাঁচ যারা আবিষ্কার করেছিলো, তারা সেই আবিষ্কারের সূত্র লুকিয়ে রেখেছিলো সবার কাছ থেকে। তাদের বানানো কাঁচ গবেষণা করে সেই সূত্র আবিষ্কারের চেষ্টা করলেন ফ্যারাডে। এবং চার বছর ধরে চেষ্টা করার পর রণে ভঙ্গ দিলেন, যখন হামফ্রে ডেভি মারা গেলেন। নিজের ব্যর্থতার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে, ঘরের তাকে একটি কাঁচের বিস্কিট রেখে দিলেন তিনি। চার বছরের ব্যর্থতার এই স্মৃতিচিহ্ন একদিন চরম একটা আবিষ্কারের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। কিন্তু সেই কাহিনী আরো পরে!

বার্ষিক সায়েন্স লেকচারের আয়োজন


স্যার হামফ্রে ডেভি মারা যাওয়ার পর গবেষণাগারের পরিচালকের পদে আসীন হলেন মাইকেল ফ্যারাডে। জীবন তাকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে এলো! নতুন এই ক্ষমতা পেয়ে তিনি অত্যন্ত চমৎকার একটা কাজ করলেন। তরুণদের জন্য বার্ষিক সায়েন্স লেকচারের আয়োজন করলেন রয়েল ইন্সটিটিউটে।

Faraday_Michael_Christmas_lecture_detail

প্রথম সেই আয়োজন হয়েছিলো ১৮২৫ সালে, এবং আজও সেটা চলছে। এই আয়োজনে বাচ্চাদের সামনে গল্পের ছলে বক্তৃতা দিয়েছেন ইতিহাসের বিখ্যাত সব ব্যক্তিরা। সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে ১৯৭৩ সালে এসেছিলেন ডেভিড এটেনবরো, ১৯৭৭ সালে এসেছিলেন কার্ল সেগান, আর ১৯৯১ সালে এসেছিলেন রিচার্ড ডকিন্স।

জেনারেটর আবিষ্কার


জেনারেটরের মূলনীতি (গতিশক্তি থেকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রুপান্তর) আবিষ্কার করলেন মাইকেল ফ্যারাডে।

early

একটা তারের কুণ্ডলীর মধ্য দিয়ে চুম্বককে আনা-নেওয়া করার মাধ্যমেই অসম্পূর্ণ বর্তনীকে সম্পূর্ণ করলেন। সোজা বাংলায় (!), “he invented the switch”. অর্থাৎ, বিদ্যুতের শক্তিকে সাধারণের ব্যবহারের উপযোগী করে তোলার কাজে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিলেন তিনি।

স্মরণশক্তি আর বিষণ্ণতা সংক্রান্ত সমস্যা


৪৯ বছর বয়সে ফ্যারাডে স্মৃতিশক্তিজনিত অসুস্থতার মুখোমুখি হলেন। তার স্মরণশক্তি দুর্বল হয়ে পড়লো। অনেক সময় অনেক কিছু তিনি মনে করতে পারতেন না। এজন্য তার মধ্যে প্রচণ্ড বিষণ্নতা তৈরি হলো। হবারই কথা! তিনি একজন বিজ্ঞানী, মস্তিষ্ক তার হাতিয়ার। আর সেই হাতিয়ারই কিনা তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছিলো। ফ্যারাডে কি এখানেই দমে যাবেন?

তিনি সম্পূর্ণ সেরে ওঠেননি কখনোই। কিন্তু তার সবচেয়ে মহান আবিষ্কারগুলো, যেগুলো আমরা এখনো পড়ি, সেগুলো কিন্তু আরো পরের কথা!

তিন শক্তির বন্ধন


ইতোপূর্বে আমরা জানলাম যে, ফ্যারাডে বিদ্যুৎ আর চৌম্বক বলের মধ্যে সম্পর্ক আবিষ্কার করেছিলেন। এই দুটো বল (force) মিলে হচ্ছে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক বা তাড়িত-চৌম্বক বল। কিন্তু এই দুই বল কি অন্য কোনোকিছুর সাথে সম্পর্কিত? তিনি তিন ধরনের শক্তির (energy) মধ্যে সম্পর্ক আছে কিনা পরীক্ষা করে দেখতে চাইলেন। তৃতীয় শক্তিটার নাম ছিলো আলো। তিনি দেখতে চাইলেন ইলেকট্রোম্যাগনেটিক বল প্রয়োগ করে পোলারাইজড আলোকরশ্মিকে বাঁকিয়ে দেয়া যায় কিনা। তিনি একের পর এক পরীক্ষা করলেন। তিনি দেখলেন, সাধারণ বায়ু বা শূন্য মাধ্যমে চলা আলোকে বাঁকানো যাচ্ছে না। তাই তিনি আর অনেক অনেক মাধ্যম ব্যবহার করলেন। আলোকে সেগুলোর মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত করে চৌম্বকক্ষেত্র দিয়ে বাঁকাতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না। বিভিন্ন গ্যাস নিয়ে চেষ্টা করলেন, তরল (এমনকি অ্যাসিড) নিয়ে চেষ্টা করলেন; পারলেন না। অনেকটা বেপরোয়া হয়ে, মাধ্যমের জায়গায় বসিয়ে দিলেন নিজের ব্যর্থতার স্মৃতিচিহ্নটিকে, সেই কাঁচের বিস্কিটটিকে। মনে আছে তো সেটার কথা? যাই হোক, সেটার মধ্যে দিয়ে গমন করে আলো তার গতিপথ পালটে নিলো! এই পরীক্ষার ফলাফল কেন মানবজাতির জন্য মহা গুরুত্বপূর্ণ?

এই কারণে যে, এর মাধ্যমেই আমরা প্রকৃতির উপাদানগুলো যে আসলে একে অপরের সাথে কতটা গভীরভাবে সংযুক্ত, সেটা বুঝতে পারলাম। ব্রহ্মাণ্ডের আদি শক্তিগুলোর মধ্যে যে কী লীলাখেলা চলে, তা তিনি দেখিয়ে দিলেন। এই আবিষ্কারটাই আইনস্টাইন, হাবল, লেমিত্রের আবিষ্কারগুলোর পথ সুগম করে দিয়েছিলো।

চৌম্বকক্ষেত্র এবং চৌম্বক বলরেখার আবিষ্কার


কেন চুম্বক জিনিসটা সবসময় উত্তর-দক্ষিণ হয়ে থাকে – এটা নিয়ে মানুষ ভেবেছে সবসময়ই। লোহার গুঁড়াকে চুম্বকের ওপর ছড়িয়ে দিলে যে এমন একটা আকৃতি ধারণ করে, এটাও জানা ছিলো।

magneticfields

কিন্তু কেন এমন হয়, কেউ জানতো না। ফ্যারাডে জানতেন, ইলেকট্রিসিটি প্রবাহিত করলে তারও চুম্বকে পরিণত হয়। তিনি সেটাকে দিয়ে একই পরীক্ষা করলেন। ফলাফল আসলো এরকম।

faraday

এবার তিনি বুঝতে পারলেন, চুম্বক জিনিসটা সবসময়েই নিজের চারপাশে একটা ক্ষেত্র তৈরি করে। প্রথমে তিনি এটাকে চৌম্বক বলরেখা (magnetic lines of force), পরবর্তীতে শুধু বলরেখা (lines of force), এবং আরো পরে চৌম্বকক্ষেত্র (magnetic field) বলা শুরু করলেন।

তিনি এমন এক প্রশ্নের সমাধান দিলেন যা আইজ্যাক নিউটনকেও হতবাক করে দিয়েছিলো। নিউটন মহাকর্ষের সূত্র দিয়েছিলেন; কিন্তু তিনি জানতেন না, এতো দূর থেকেও স্পর্শ না করেই মহাকর্ষ কিভাবে কাজ করে? ফ্যারাডে বললেন, ওদের মহাকর্ষের ক্ষেত্র কিন্তু ঠিকই একে অপরকে স্পর্শ করে। এজন্যেই চুম্বক, পৃথিবী নামক দানবীয় চুম্বকের বলরেখা দ্বারা প্রভাবিত হয়, এজন্যেই সে উত্তর-দক্ষিণে মুখ করে থাকে।

জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল, পুরনো অতীতের ভূত


নিজের আবিষ্কারটাকে তিনি সবার কাছে প্রচার করলেন। কিন্তু সেটার পেছনে কোনো গাণিতিক ব্যাখ্যা দিতে পারলেন না। কারণ, সেই যে ছোটোবেলায় তিনি দারিদ্র্যে ভুগেছিলেন, ঐ যে তিনি স্কুল ছেড়ে দিয়েছিলেন। গণিতের জটিলতা তিনি কখনোই বুঝে উঠতে পারেননি। তাই প্রায় সবাই ফ্যারাডের কথাগুলোকে প্রমাণ হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানালো। কেউ কেউ খোঁচা মারতেও ছাড়লো না। এমন সময় তার সাহায্যে এগিয়ে এলেন মোটামুটি সুপরিচিত একজন তরুণ গণিতবিদ, জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল।

maxwell

তিনি মনে করলেন, ফ্যারাডের এই আবিষ্কার নিঃসন্দেহে চোখ ধাঁধানো। তিনি বসে গেলেন, এই চৌম্বকক্ষেত্রের বিস্তারটাকে একটা গাণিতিক রুপ দেয়ার জন্য। লিখে ফেললেন, On Physical Lines of Force.

Untitled

সেটার পাণ্ডুলিপি পাঠিয়ে দিলেন মাইকেল ফ্যারাডের কাছে। ঠিক যেভাবে, সূদূর অতীতে স্যার হামফ্রে ডেভির কাছে তারই কাজ নিয়ে একটা বই পাঠিয়েছিলেন ফ্যারাডে। ম্যাক্সওয়েল যে ফ্যারাডের অতীত, ফ্যারাডের ভূত!

আমি মাঝে মাঝে চিন্তা করি, কী ভয়াবহ আবেগময় একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিলো তখন ফ্যারাডের মনে। কী চিন্তা করছিলেন তখন তিনি? তিনি কি কেঁদে ফেলেছিলেন? তিনি কি তার ভুলোমনের বিষণ্ণতা কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গিয়ে প্রশান্তি পেয়েছিলেন?

এই আবিষ্কারটার আরো ব্যাপকতার কথা শুনবেন? খুব শীঘ্রই ম্যাক্সওয়েল দেখলেন যে এই ক্ষেত্রটা স্থির নয়, বরং সবসময়েই ছড়িয়ে পড়ছে প্রতিটি মুহূর্তে। সেই ছড়িয়ে পড়া প্রবাহটাকে কাজে লাগিয়েই আজ আমরা যেকোনো কিছু সরাসরি সম্প্রচার করি, তথ্য বিনিময় করি ইন্টারনেট দিয়ে। আপনি যে আমার লেখা পড়ছেন, সেটাও ঐ প্রবাহটাকে কাজে লাগিয়েই আপনার কাছে পৌঁছাচ্ছে। একটু চিন্তা করুন তো, মাইকেল ফ্যারাডে নামের এই লোকটা না জন্মালে কী হতো? বিদ্যুৎ, মোটর, অন্যান্য মেশিন হয়তো আবিষ্কার হতো একসময় না একসময়, কিন্তু আপনি বা আমি হয়তো পেতাম না।

মৃত্যু


জীবিত থাকা অবস্থায় মাইকেল ফ্যারাডেকে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো যে ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবি (Westminster Abbey)-তে তার কবর দেয়া হবে। সেখানে ব্রিটেনের রাজা-রাণীদের কবর দেয়া হয়। সেখানে আইজ্যাক নিউটনের মত বিজ্ঞানীর মৃতদেহ রাখা আছে। তিনি সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। ৭৫ বছর বয়সে, ১৮৬৭ সালের আগস্টের ২৫ তারিখে, মারা যাওয়ার পর তাকে লন্ডনের হাইগেইট সেমেটারিতে কবর দেয়া হয়। সেখানে স্ত্রী সারাহ এবং তার কবর পাশাপাশি।

মাইকেল ফ্যারাডে, আপনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।

 

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/michael_faraday/

Tuesday, October 2, 2018

সিংগুলারিটি কি?


“Singularity” শব্দটি এসেছে ‘Singular’ শব্দ থেকে। ইংরেজী ব্যাকারণে সিংগুলার শব্দটি দ্বারা একটি ক্রিয়াশীল কর্তা-কে বুঝায় (‘one subject acting’)। ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহবর এর ব্যাখ্যায় সিংগুলারিটি বলতে বুঝায় এমন একটি অবস্থা বা পয়েন্ট যেখানে সবকিছুই হয়ে যায় ‘এক’, একটি সংখ্যা; ‘একীভুতকরণ ও ফিউশান এর একটি অবস্থা’।স্পেস, টাইম এবং ম্যাটার (Unification of space, time and matter) অর্থাৎ স্থান, কাল ও বস্তুর একীভুতকরণের একটি অবস্থা; মহাবিশ্বের মৌলিক চারটি বল (Fundamental forces)গ্র্যাভেটি, ইলেকট্রো ম্যাগনেটিং ফোর্স ও শক্তিশালী এবং দূর্বল নিউক্লিয়ার ফোর্স একীভুত হয়ে তৈরী হয়ে রূপান্তরিত হয় একটি চুড়ান্ত বল-এ, যাকে বলা যায় ‘ইউনিভার্সাল প্রাইম এ্যানার্জী’ (Universal Prime Energy)। আমরা বলতে পারি, সিংগুলারিটি দ্বারা তথ্যের একটি সংখ্যাকে বুঝায়।


wormhole

 

আমরা জানি, ব্ল্যাকহোল হলো একটি নক্ষত্রের মৃত্যু বা ধ্বংসের ফলাফল। আমাদেরকে যদি সেই মৃত নক্ষত্রের বৈশিষ্ট্য বা তার প্রপারটিজ খুঁজে বের করতে হয় তাহলে আমরা নিশ্চই তার ধ্বংসাবশেষ খুজঁবো। এটা বলা হয় যে ব্ল্যাকহোলের একেবারে নীচের দিকের সিংগুলারীটি হলো সেই মৃত নক্ষত্রের ধ্বংসাবশেষ। এই সিংগুলারীটির অনেক ভর! কারণ এটি সেই নক্ষত্রের অদৃশ্য শক্তিকে ধারন করে। বস্তুত, ব্ল্যাকহোলের আকৃতি নির্ভর করে তার এই সিংগুলারীটির ভরের উপর। কাজেই সিংগুলারীটির ভর যতো বেশী হবে ব্ল্যাকহোলের আকৃতি ততো বড় হবে। ধরা যাক, প্রকৃতিতে একটি বিড়ালের মৃত্যু ঘটেছে; আমরা এটির দেহাবশেষ ঘাটাঘাটি করব বা ডিএনএ (সিংগুলারীটি) নমুনা সংগ্রহ করব সেই বিড়ালের (নক্ষত্র) ইউনিক বৈশিষ্ট্য বা প্রপারটিজ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। আরো সহজ ভাবে বলা যায়, সিংগুলারীটি হলো একটি বাক্স যেখানে একটি ব্ল্যাকহোল বা কিষ্ণগহবর তার গহবরে কি কি বস্তু গিলেছে সে সম্পর্কিত তথ্য একটি সংখ্যা (ONE NUMBER only) হিসাবে সংরক্ষিত থাকে।

কাজেই, সিংগুলারীটি হলো একটি সংখ্যা যা একটি বস্তু সম্পর্কে তথ্য ধারন করে।

কিভাবে একটি সিংগুলারীটি থেকে তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে? কিভাবে হলোগ্রাফিক নীতি বা সূত্র বা নিয়ম পূর্ণভাবে কাজ করে থাকে? (একটি সিংগুলারীটি থেকে তথ্য নিয়ে একটি দ্বিমাত্রীক তলে একমাত্রিক স্ট্রিং এ বিন্যস্ত করে একটি ত্রিমাত্রীক বস্তু তৈরী করা হয়!)

এবিষয়ে ভবিষ্যতে আরও সহজ ভাষায় মজার করে লিখবার আশা রাখি……..।।।

মূল গবেষণা ও ইংরেজী ভাষায় প্রবন্ধটির স্বত্বাধিকারীঃ Jacques Lutia

Jacques Lutia দ্বারা প্রদত্ত অনুমতিতে, সহজ বাংলা ভাষায় প্রত্যয়গত অনুবাদের সর্বসত্ব সংরক্ষণেঃএ.এম. আহাদ (লিও)

black-hole-signalএখানে ব্ল্যাকহোল এর একটি ছবি দেওয়া হলো যা গুগল থেকে সংগৃহীত। ব্ল্যাকহোল সম্পর্কে আরও মজার তথ্য হলো একটি ব্ল্যাকহোল এর কেন্দ্রে গ্র্যাভেটি এতো থকে যে মহাবিশ্বের কোনোকিছুই কেন্দ্রের এই গ্র্যাভেটিকে এড়িয়ে যেতে পারে না; এমনকি আলোও এই প্রবল গ্র্যাভেটি এড়িয়ে যেতে পারে না! একারণেই ব্ল্যাকহোল এর কেন্দ্র সবসময় অন্ধকার!

উৎস ঃ https://www.aparajito.com/barta/%E0%A6%B8%E0%A6%BF%E0%A6%82%E0%A6%97%E0%A7%81%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%95%E0%A6%BF-what-is-a-singularity/

Monday, October 1, 2018

আনিসুল হকের গল্প : পোস্টমাস্টার ২০১০



৬২ বছর বয়সে ডাক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল হোসেন সাহেব আবিষ্কার করলেন, বালিকা রতন আর বালিকা নেই, রমণী হয়ে গেছে। এটা আবিষ্কার করবার জন্য তাকে সেই অপরাহ্ণের জন্য অপেক্ষা করতে হলো, যখন তিনি দোরঘণ্টি বাজিয়ে নিজবাড়ির দরজা খোলার অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলেন, আর রতন স্নানঘরে ঝরনার নিচে দাঁড়িয়ে ভিজছিল, হঠাৎ কলবেল বেজে ওঠায় তড়িঘড়ি করে একটা জামা গায়ে চাপিয়ে সে ছুটে এসেছিল, ভেজা গায়ে পাতলা জামা ভেদ করে তার কিশোরী শরীর দুধে ভেজা পাউরুটির মতো ফুলে উঠেছিল এবং পোস্টমাস্টার জেনারেল আবুল হোসেনের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল।
কে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তার গৃহপরিচারিকা রতন, নাকি কোনো অপ্সরী, আবুল হোসেন সাহেবের ধন্দ লেগেছিল। আজ থেকে আট বছর আগে আট বছর বয়সী রতন এ-বাড়িতে এসেছিল, তখন শামীমাও এ-বাড়িতেই থাকতেন। ৫৪ বছরের ডাক-কর্মকর্তা আবুল হোসেন এই নবাগতা গৃহকর্মী রতনকে নিতান্ত শিশু ছাড়া আর কিছুই ভাবেননি। তিনি শামীমাকে বলেছিলেন, ‘এই বাচ্চা মেয়েটাকে দিয়ে ঘরের কাজ করানো কি ঠিক হবে? এটা কি শিশুশ্রম হয়ে যায় না?’ শামীমা বলেছিলেন, ‘শোনো, ময়লার ঝুড়িটা নিয়ে বের হবে, রাস্তার ডাস্টবিনে তুমি ফেলবে, আমি রতনকে দিয়ে এ-কাজ করাব না। শিশুশ্রম একটু কম কম হোক।’ ওই একদিনই বিবেকের তাড়না বোধ করেছিলেন আবুল হোসেন সাহেব, এরপরে আট বছরের শিশুটি যে তাদের বাসায় রয়ে গেল, মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে ঘুমায়, এটা-ওটা কাজ করে, মেঝেতে পিঁড়ি পেতে বসে ভাত খায়, সেটা তার কাছে হয়ে গেল একটা স্বাভাবিক দৃশ্য। একটা ছুটা বুয়াও ছিল, সকালে এসে ঘরদোর ঝাড়মোছ করত, কাপড়চোপড় ধুয়ে দিয়ে যেত।বছরছয়েক আগে, আবুল হোসেনের বয়স তখন ৫৬, আর হিসাব করলেই বেরিয়ে আসে যে, রতনের বয়স তখন ১০, শামীমা আমেরিকা চলে যান। আমেরিকায় তার একমাত্র ছেলে মিল্টন আছে, লস অ্যাঞ্জেলেসে, মিল্টনের বউয়ের বাচ্চা হয়েছে, তাকে দেখভাল করার কেউ নেই। কাজেই ‘মা আসো মা আসো’ বলে মিল্টন, আর ‘মা আসেন মা আসেন’ বলে মিল্টনের বউ সাবরিনা শামীমার কান ঝালাপালা করে ফেলতে থাকলে শামীমা ভিসার জন্য লাইনে দাঁড়ান এবং একদিন ভিসা পেয়ে গেলে শামীমা স্বামীকে বলেন, ‘আমি ভেবেছিলাম ভিসা পাব না, কতজনই তো ভিসা পায় না, তাই ভেবেছিলাম আমারটাও হবে না, আমার আমেরিকা যাওয়াও লাগবে না; এখন ভিসা হয়ে গেছে, এখন আমি কী করি?’ কী আর করবেন শামীমা, আমেরিকা চলে যান নাতির মুখ-দর্শনের জন্য। বলে যান, ‘চিন্তা করো না, বুয়া আসবে সকাল-বিকাল, আমি বুয়াকে বলে যাচ্ছি, আর রতন তো রইলই। ও এখন অনেক কাজ পারে, তোমাকে চা করে দিতে পারবে, লাগলে ভাতও রাঁধতে পারবে, খুব সুন্দর ডাল রাঁধে জানো!’সেই থেকে শ্যাওড়াপাড়ার এই দোতলার বাসার দোতলায় আবুল হোসেন সাহেব একাই থাকেন। আর সঙ্গে থাকে বালিকা রতন। এক মাসের জন্য গিয়েছিলেন শামীমা, আজ ছয় বছর, তিনি আর ফিরে আসেননি। রতনটাও যে বড় হয়ে গেছে, সেটাও আবুল হোসেন সাহেব বুঝতে পারেননি।

কিন্তু একদিন, খুবই হঠাৎ করেই, পেনশনের টাকা তুলে বেলা ৩টার দিকে বাসায় ফিরে সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে দোরঘণ্টি বাজিয়ে সামনে একটা অপ্সরা, তার সাদা ভেজা জামা, আর জামার আড়ালে স্তনাভাস, কালো ঘের, বৃন্ত-উন্নতি ইত্যাদি তাকে এক নতুন উপলব্ধির জগতে নিয়ে যায়।

তিনি বুঝতে পারেন, তার শরীর শিরশির করছে।

কিন্তু বালিকা রতন রমণীর স্থান অধিকার করলেও জননীর স্থান অধিকার করে না। কারণ আবুল হোসেন সাহেবের জ্বর আসে না। তার ললাট তপ্ত হয় না, কাজেই শাঁখাপরা হাতের স্পর্শ পাওয়ার প্রয়োজন হয় না। ঘটনা ঘটে উলটো। রতনেরই একদিন জ্বরজ্বর লাগে, প্রথমে হাঁচি আর পরে সে কাশি দিতে থাকে, তখন সে দুপুরবেলায় মেঝেতে মাদুর বিছিয়ে শুয়ে পড়ে, আর অনেকক্ষণ পড়ে থাকে, রোদ মরে আসে পশ্চিমের জানালায়, তবু সে ওঠে না। তখন আবুল হোসেন সাহেবই রতনের কাছে যান, রতনের শয্যাপাশে মেঝেতে বসেন, হাত দিয়ে রতনের কপালের জ্বর অনুভব করার চেষ্টা করেন, রতন চোখ মেলে না, অস্ফুট স্বরে বলে, নানা...

আবুল হোসেন সাহেব প্রথমে কপালে হাত দিয়ে জ্বর মাপেন, তারপর রতনের গলায় হাত দেন, এখানে তাপ আরেকটু বেশি, তারপর জামার ভেতরে হাত দিয়ে দেখেন, সেখানটা একেবারে গরম ভাতের হাঁড়ির মতো গরম, তিনি হাতটা রতনের একটা স্তনের ওপরে রেখে দেন, তার মনে হয়, তার হাতের মধ্যে একটা কবুতরের বুক কাঁপছে। তারপর হুঁশ হলে তিনি ছুটে যান প্যারাসিটামল কেনার জন্য।

আবুল হোসেন খুব যতœ করেন রতনের। রতনকে এমনকি ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে স্পঞ্জ পর্যন্ত করে দেন। তারপর তাকে বলেন, এই জ্বর নিয়ে তোকে আর মেঝেতে শুতে হবে না, তুই আমার সঙ্গে আমার ঘরে শো, না হলে কারেন্ট চলে গেলে জেনারেটরের লাইন এইখানে থাকবে না, জ্বরের মধ্যে তোর কষ্ট হবে।

রতন আবুল হোসেন সাহেবের শোবার ঘরের মেঝেতে নিজের জায়গা করে নেয়। জ্বর সেরে গেলে প্রায় প্রতিদিনই আধঘণ্টার জন্য আবুল হোসেন সাহেবের বিছানাতেও তার জায়গা হতে থাকে। আবুল হোসেন সাহেবকে এই সময় জীবনের সবচেয়ে কঠিন কাজটা করতে হয়। স্ত্রী বিদেশে থাকা অবস্থাতেও একটা পুরো বাক্স কনডম কিনে আনতে হয়। ওষুধের দোকানের ছেলেটা অবশ্য কোনো প্রশ্ন করে না। প্রশ্ন যাতে সে না করতে পারে সেজন্যেই তিনি তার বাসা থেকে দূরবর্তী একটা অপরিচিত দোকানেই গমন করেন।

রতন তার নতুন মর্যাদা ভীষণ উপভোগ করে। কাজের বুয়াটা বদলে গেছে, নতুন বুয়াটা আরো বৃদ্ধা, তাই তার কোনো বিশেষ মর্যাদা নেই এ-বাড়িতে, যেটা কিনা রতনের আছে। নানা তাকে কানের দুল কিনে দিয়েছেন, তাকে শাড়ি কিনে দেন, তার জন্য ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি কিনে আনেন, এমনকি তার পিঠে ব্যথার কথা জানতে পেরে পিঠও টিপে দেন।

আবুল হোসেন সাহেবও ৬২ বছর বয়সে ১৬ বছরের কিশোরীর প্রেমে পড়ে আকাশে উড়তে থাকেন। তার দিনরাত্রিগুলো রতনময় হয়ে ওঠে।

শামীমা যে ফিরতে পারেন না, সেটা তার নিজের ইচ্ছায় নয়। মিল্টন তার পাসপোর্ট আটকে রাখে, এবং বারবার করে তার ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করে এবং সফল হয়। শামীমা প্রতি রোববার রাতে ঢাকায় ফোন করেন এবং খোঁজখবর নেন। স্বামীকে কতদিন দেখেন না তিনি, তার খুব কান্না পায় এবং ফোনে তিনি কান্নাকাটিও করেন। তিনি বলেন, মিল্টন বলেছে, তার মেয়েটাকে স্কুলে দিলেই আমার ঢাকা যাওয়ার টিকিট করে দেবে। আর তিন মাস।

আবুল হোসেন মনে মনে বলেন, সাবরিনার আরেকটা বাচ্চা হোক, শামীমা আরো অনেকদিন থাকুক আমেরিকাতেই, রতনকে নিয়ে রিটায়ার্ড পোস্টমাস্টার জেনারেল মহাসুখে আছেন। এমনকি তিনি একদিন ভায়াগ্রা কিনে এনে তার সিকিভাগ খেয়েও দেখেছেন। জীবনটা বড়ই সুখেই যাচ্ছে।

সুখ চিরস্থায়ী হয় না। শামীমা ফিরে আসেন। রতন আবার ডাইনিং রুমের মেঝের দিনগুলোয় ফিরে যেতে বাধ্য হয়। আর আবুল হোসেন রাতের বেলা ঘুম ভাঙলে দেখেন একজন মোটা বৃদ্ধা চিৎ হয়ে মৃত তেলাপোকার মতো তার পাশে শুয়ে আছে। তিনি অস্থির বোধ করেন।

প্রেম এমন একটা জিনিস, যা গোপন করে রাখা যায় না। রতনের সঙ্গে আবুল হোসেনের পরিণয়টা শামীমা অচিরেই আবিষ্কার করে ফেলেন এবং কান্নাকাটি করতে থাকেন। আবুল হোসেন বাথরুমে গিয়ে রতনের জন্য অশ্র“ বিসর্জন করেন। সেটা শামীমা টের পান না। কিন্তু রতনের ট্রাংক খুলে শাড়ি-গয়নার বাহার দেখে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। মোটা মানুষ! পড়ে যাওয়ার শব্দটা এত জোরে হয় যে, নিচতলার ভাড়াটের বউ পর্যন্ত দৌড়ে আসে দোতলায় কী ঘটল তা জানার জন্য।

এ পর্যন্তও হয়তো সহ্য হতো। একদিন রাত ৩টায় ঘুম ভেঙে গেলে শামীমা দেখেন তার পাশে তার স্বামীধন নেই, তিনি বিছানা ছাড়েন, রান্নাঘরের দিকে যান, এবং দেখতে পান, ডাইনিং স্পেসের মেঝেতে অর্ধনগ্ন আবুল হোসেন ও রতন বিভোর হয়ে গলা জড়াজড়ি করে ঘুমুচ্ছে।

তিনি রতনকে পরের দিন সকালবেলা পত্রপাঠ বিদায় করেন।

আবুল হোসেন প্রতিবাদ করতে সাহস পান না। তিনি চুপচাপ বসে থাকেন। এবং খাওয়া-দাওয়া ত্যাগ করেন। তার মনে হয়, যাই, জগতের ক্রোড়বিচ্যুত সেই অনাথিনীকে নিয়ে আসি। তখন ফ্যানের বাতাসে তার মনে একটা চিরপুরাতন তত্ত্ব উদিত হয়। তিনি নিজেকে বলেন, গিয়া ফল কী? জগতে কে কাহার?

কিন্তু রতন এত সহজেই দমিত হয় না। সে তার নানাকে ভীষণ ভালোবাসে। নানাকে কতদিন দেখি না, তিনদিনের দিনই তার মনে এ-হাহাকার তীব্রভাবে দেখা দেয়। সে নানাকে ফোন করে। নানা তখন রতনের নানির সামনে। তিনি ফোন কেটে দেন। পরে তিনি আবারো বাথরুমে গমন করেন এবং কমোডের ওপরে বসে সর্বশেষ আসা নম্বরটায় কল করেন।

‘হ্যালো নানা!’

‘হ্যাঁ।’

‘আপনি কেমন আছেন?’

‘খুব খারাপ! তোর জন্য মনটা পোড়ে। তুই কেমন আছিস?’

‘নানা, আপনারে ছাড়া আমি বাঁচুম না।’ মোবাইল ফোনে রতনের কান্না শোনা যায়।

‘তুই এখন রাখ। তোর নানি আছে।’

আবুল হোসেন সাহেব ঘেমে-নেয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসেন।

তারা গোপনে গোপনে কথা বলা ও এসএমএস চালাচালি করতে থাকেন। রতন অশিক্ষিত হলেও কীভাবে টেক্সট মেসেজ পাঠাতে সক্ষম হয়, তা সে জানে।

কিন্তু এইখানে, প্রিয় পাঠক, আমরা একবার শামীমার কথাটাও ভাবিব। শামীমা বড় আশা করিয়া ফিরিয়া আসিয়াছিল স্বামীর নিকট। আমেরিকার দিবস-রজনীগুলি তাহার নিকট বিষবৎ বোধ হইত। সারাদিন ওই অচেনা-অজানা পরিবেশে একা একা থাকা তাহার অসহ্য বোধ হইত। মিল্টনের ছেলে আসওয়াদ ও মেয়ে আবরিনা একটু বড় হইলে পরে তবু তাহাদের লইয়াই ব্যতিব্যস্ত থাকা যাইত। তাহা সত্ত্বেও শামীমার নিকট নিজেকে কাজের মেয়ে ছাড়া আর বেশি কিছু মনে হয় নাই। বহুদিন মনে হইয়াছে, তিনি নাইন ওয়ান ওয়ানে ফোন করিবেন, পুলিশ আসিলে তিনি বলিবেন, তিনি বন্দিনী, তাহার মুক্তির একটা ব্যবস্থা পুলিশ করিয়া দিক। আমেরিকায় বহু বছর থাকিয়া তিনি নাইন ওয়ান ওয়ানে ফোন করিবার মতো কেতাও কিছু শিখিয়া ফেলিয়াছিলেন। তিনি সর্বদা স্বপ্ন দেখিতেন, দেশে ফিরিয়া যাইবেন, নিজের সংসারের হাল ধরিবেন। এইখানে পুত্রবধূর সংসার তাহার কাছে কারাগারের মতো মনে হইত।

আমেরিকায় পুত্রের বাটিতে নিজেকে তাহার মনে হইত ক্রীতদাসী, আর এখন এইখানে নিজের সংসারে ফিরিয়া আসিয়া তাহার মনে হইল, তাহার জীবন দাসীরও অধম। একজন দাসীর যাহা আছে, তাহা তাহার নাই। যৌবনই কি তাহা হইলে নারীর একমাত্র সহায়। যৌবন নাই তো নারীর কিছুই নাই?

অতঃপর শামীমা ও তাহার স্বামী পোস্টমাস্টার জেনারেল (রিটায়ার্ড) আবুল হোসেন দুজনেই জায়নামাজে বসিয়া একই প্রার্থনা করিতেন, হে পরওয়ারদিগার, উহাকে তুলিয়া লহো। কতজনেই তো মরে। আমার স্বামী/স্ত্রী কেন মরে না?

আবুল হোসেন মারা গেলে বিষয়-সম্পত্তি যা আছে, তা দিয়ে শামীমার দিন ভালোই চলে যাবে, শামীমা হিসাব কষেন। শামীমা মারা গেলে রতনকে নিয়ে এসে আমি স্বর্গখেলনা রচনা করতে পারব, আবুল হোসেন আকাশকুসুম চয়ন করেন।

রতনের ফোন আসে। আবুল হোসেন সকালবেলা হাঁটতে গিয়ে কলটা রিসিভ করেন। রতন বলে, নানা, আমারে বিয়া করেন।

আবুল হোসেন জবাব দেন, সে কী করে হবে?

ব্যাপারটা যে কী কী কারণে অসম্ভব কিশোরীকে বোঝানোর প্রয়োজন তিনি বোধ করেন না। কিন্তু নিজের বিবেকের কাছে তিনি পরিষ্কার, বাংলাদেশের আইনে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিবাহ করা অসম্ভব। একটা উপায় আছে, শামীমাকে ডিভোর্স দেওয়া। কিন্তু এ-বয়সে এসে মানী লোকের মান তো আর বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া চলে না।

কাজেই আবুল মোনাজাত করেন, হে আল্লাহ, শামীমারে তুলে নাও।

কাজেই শামীমা জায়নামাজে বসে কান্নাকাটি করেন, হে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন, বুড়াটা মরে না কেন?

এই দুই প্রার্থনার মধ্যে আল্লাহতালা শামীমার প্রার্থনাটাই পূরণ করেন। কেন করেন, তা আমরা জানি না। আর আবুল হোসেনের মোনাজাত কেন তিনি পূর্ণ করেন না, তিনিই জানেন। বিধাতার লীলা আমাদের পক্ষে অনুধাবন করা সত্যিই কষ্টকর। তবে, আমাদের মনে হয়, আল্লাহ যা করেন ভালোই করেন। শামীমা আগে মারা গেলে আবুল হোসেন রতনকে ঘরে আনতেন। ঘরে আনলে রতন বিয়ের জন্য চাপ দিতে পারত। বলা যায় না, কনডম ফুটো করে পেটে বাচ্চা বাঁধিয়ে ফেলে শেষমেশ বিয়ের পিঁড়িতে বসতে আবুল হোসেনকে বাধ্য করেও ছাড়তে পারত।

আমরা রতনকে এ-কথা জিগ্যেস করি নাই, রতন হয়তো তার প্রিয় নানাকে ব্ল্যাকমেইল নাও করতে পারত। তবে প্রেমে ও যুদ্ধে নৈতিকতা বলতেও তো কিছু নাই।

আবুল হোসেন সকালবেলা হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। শ্যাওড়াপাড়ার আকাশে ছিল কালো মেঘ, দোতলা বাড়ির পেছনের নিমগাছগুলো বাদল-বাতাসে মাথা দোলাচ্ছিল। সামনের বড় রাস্তায় পানি জমে গিয়েছিল।

রতন টেলিভিশনে একটা বাংলা সিনেমা দেখছিল তার বস্তিঘরে বসে। সিনেমার নাম বাবা কেন চাকর। ছবির নিচে স্ক্রলে হঠাৎ খবর ওঠে, সাবেক পোস্টমাস্টার জেনারেল আবুল হোসেন আজ সকালে হৃদরোগের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন (ইন্নালিল্লাহি ... রাজিউন)।

রতনের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তখন সত্যি সত্যি ভীষণ জোরে দেওয়া ডেকেও ওঠে। একহাঁটু পানি মাড়িয়ে রতন শ্যাওড়াপাড়ার ওই দোতলা বাড়ির দিকে রওনা হয়।

লাশ তখন বাড়ির নিচতলার গ্যারাজে রাখা হয়েছে। পাড়ার মসজিদ থেকে আনা খাটিয়ায় যে-চাদরটার নিচে আবুল হোসেন শুয়ে আছে, সে-চাদরটা রতনের খুব চেনা। আগরবাতি জ্বলছে। দু-একজন আত্মীয়স্বজন ও পাড়ার লোকজন ভিড় করতে শুরু করেছে। একটা আরএফএল প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে একটা অল্পবয়সী হুজুর দুলে দুলে কোরান শরিফ পাঠ করছে।

রতন চাদরটা সরিয়ে তার নানার শরীরের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে, সে বলতে থাকে, নানা, নানা, আপনি চইলা গেলেন, নানির জন্য বাড়ি রাইখা গেলেন, আমার লাইগা কী থুয়া গেলেন। আপনি যান, আমার দুঃখ নাই, খালি আমারে আপনার সাথে নিয়া যান। আমি আপনার সাথে কবরে যাইতে চাই।

নিচতলার ভাড়াটে কাশেম সাহেব রতনের ডানা ধরে তাকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। রতন বাধা মানতে চায় না। ‘আমি আমার নানার লগে যামু। আমি আমার নানার লগে যামু।’ রতন ডুকরে কেঁদে ওঠে।

কাশেম সাহেব চোখ মোছেন। আহারে, পোস্টমাস্টার সাব তার এই নাতনিটারে একেরে নিজের নাতনির মতোই আদর করত।

রতন ফিরে আসে। বৃষ্টি আরো বেড়ে গেছে। শ্যাওড়াপাড়ার রাস্তা জলে থইথই করছে। একটা রিকশা একটা ড্রেনে পড়ে কাত হয়ে গেছে, তার সিট সমান পানি।

কোমরপানি মাড়িয়ে রতন ফিরে আসে, তার মনে কোনো তত্ত্বের উদয় হয় কি-না, আমরা জানি না। আকাশে তখন বিজলি চমকায়। ইলেকট্রিক তারে কাক কা-কা করে ডেকে ওঠে।




জেরোম কে জেরোমের গল্প : ঘড়ি


অনুবাদ // এমদাদ রহমান

 

দুই জাতের ঘড়ি আছে। তাদের মধ্যে এক জাত, সব সময়ই ভুল সময় নির্দেশ করে, এবং এই ভুল সম্পর্কে তাদের থাকে নির্ভুল ধারণা। সময়কে ভুল করে দেখাবার মধ্যেই যেন তাদের সমস্ত মহিমা। অন্য জাতের ঘড়িগুলো, যখনই তাদের ওপর নির্ভরশীলতা তৈরি হয়, তখনই তারা ভুল করতে থাকে। ঘড়িগুলি আরও বেশি ভুল করবে যখন কেউ এই কথা ভাববে—সভ্য দেশগুলির ঘড়ি সব সময়ই নির্ভুল।


ঠিক এরকমই একটা ঘড়ির কথা আমি মনে করতে পারি। যখন আমি নিতান্তই এক বালক। এক প্রচণ্ড শীতের রাতে ভোর তিনটের দিকে ঘড়িটা চিৎকার করে আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছিল। আমরা সকালের জলখাবার শেষ করেছিলাম দশ মিনিটের জায়গায় মাত্র চার মিনিটে, পাঁচ মিনিটের একটু পর পৌঁছে গিয়েছিলাম আমার ইশকুলে, বসে পড়েছিলাম সিঁড়ির ধাপে আর ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার করছিলাম। মনে হয়েছিল পৃথিবী তার অন্তিমে পৌঁছে মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে; চারপাশের সবকিছু ছিল মৃতদেহের মতো নিশ্চুপ, দণ্ডায়মান।

আমাদের পরিচিত একজনের ঠিক এরকম একটি ঘড়ি ছিল। স্বর্গ-বিষয়ে তার মারাত্মক ধরনের বিপন্নতা ছিল, যে-বিপন্নতা তাকে মাসের পর মাস আচ্ছন্ন করে রাখত। যখন সে তার স্বপ্নগুলোর বর্ণনা দিত, শুনে মনে হত বাস্তব পৃথিবীটা তার কাছে এক ঘোরলাগা আচ্ছন্নতা ছাড়া আর কিছু নয়। তার কাছে জীবনের পথে এগিয়ে যাওয়ার অর্থ ছিল— শুধুমাত্র একটা ঘড়ির কারণে— চলন্ত রেলগাড়িকে ধরার জন্য বিধ্বস্ত হতে হতেও ধরবার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে লোকটির স্বপ্ন দেখার নির্দিষ্ট সময় বজায় থাকল। সূর্য যেভাবে সকাল-সন্ধ্যা-বিকেল-রাত্রি নির্দেশ করে, ঠিক সেভাবে তার অদ্ভুত ঘড়িটি তার স্বপ্ন দেখবার সময় নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল।

বিষয়টি শিশুদের পবিত্র হাসির কথা মনে করিয়ে দিত, যার মাঝে আত্মার শুদ্ধতা আছে। যেমন, কোন একদিন সকালে, বাড়ির প্যাসেজে তোমার চারপাশে পরিবারের সবাইকে জড়ো করলে, চুম্বন করলে তোমার সন্তানদের কপালে, হাতের আঙুল ছোঁয়ালে তাদের চোখে, তারপর প্রতিজ্ঞা করলে যে আর কোনদিনই রান্না করবার কয়লা আনতে ভুলে যাবে না। অবশেষে হাত নেড়ে, মমতাময় দৃষ্টিতে তাদের বিদায় জানালে আর ছাতামাথায় স্টেশনের উদ্দ্যেশে চলে গেলে।

অথচ আমি কখনই এই বিষয়টা ভাবতে পারি না,-- আমার পক্ষে এই গোঁ ধরা, যা অস্বস্তিকর— তোমার গতির চেয়ে দুই মাইলের বেশি এগিয়ে গিয়ে এটা আবিষ্কার করাঃ এক ঘণ্টার চারভাগের তিনভাগ সময়ের আগেই তুমি স্টেশনে পৌঁছে গেছ (প্রত্যাশার চেয়ে কতই-না দ্রুত!), অথবা ধীরে সুস্থ্যে ব্যস্ততাহীন পদচারণা করেছ পুরটা পথ, এবং স্টেশনের বুকিং অফিসের বাইরে ইতস্তত কালক্ষেপন করছ, নয়তো আশেপাশে ঘুরতে-থাকা স্থানীয় কিছু নির্বোধ লোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলছ, অসতর্ক হামবড়া ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছ প্ল্যাটফরমে আর কেবল তখনই তুমি দেখতে পেলে— ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে! অন্য জাতের ঘড়িগুলি— খুবই সাধারণ কিংবা সব সময়েই ভুল করে যারা— যথেষ্টই শান্তশিষ্ট। তারা তোমার ক্ষতি করবে না। তুমি তাদের দম দিয়ে, —যখন ঘড়িগুলি যাপন করছে জীবনের প্রকৃত অবসর— সপ্তায় এক বা দুইবার ঠিকঠাক করে চলতে পারার মত ‘জীবন্ত’ করে রাখো (এবং তুমি যেভাবে লন্ডন টম-ক্যাটটাকেও ‘নিয়মিত’ চলার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাও।) কিন্তু তুমি যে এসব করছ, তা কোনও আত্মপরায়ণ অভিপ্রায় থেকে জেগে উঠে না, এটা তৈরি হয় ঘড়িগুলির নিজস্ব দায়িত্ববোধ থেকে, তুমি এটা শুধু অনুভবই করতে পার, যে-কোনকিছুই ঘটতে পারে, তুমি এর দ্বারা যথোপযুক্ত কাজটিই করেছ, তাতে তোমার ভিতর কোনও অপরাধবোধ জেগে উঠবে না বা অপরাধী হিসাবে শাস্তিও ভোগ করতে হবে না।

যতদূর বোঝা যায়, কোন কিছু সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য— যা তুমি কখনই কল্পনা কর না এবং তাতে তুমি বিন্দুমাত্র দুঃখিত বা হতাশও নও— তুমি মেয়েটির কাছে জানতে চাইলেঃ এখন কয়টা বাজে?

মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে জানাল— হ্যা, খাবারঘরের ঘড়িতে দেখতে পাচ্ছি দুটো বেজে পনের মিনিট।

এরকম উত্তরে তুমি কিন্তু কোনভাবেই বিভ্রান্ত হবে না। খুবই মামুলি একটা বিষয় হিসাবে এটাকে বিবেচনা করবে। হয়তো কোন এক জায়গায় তখন সবেমাত্র বিকাল হয়েছে। শুধু এটা মনে করবে যে তুমি কৌতূহলোদ্দীপক পারিপার্শ্বিক অবস্থার সবকিছু সম্পর্কেই যথেষ্ট সতর্ক আছ আর ঘড়িটি চারটা থেকে মাত্র চল্লিশ মিনিট এগিয়েছে। তুমি খুব শান্তভাবে তার শক্তি ও ক্ষমতাকে শ্রদ্ধা জানাবে এবং অবাক হবে এই সবকিছু কীভাবে সম্পন্ন হচ্ছে সেই কথা ভেবে।

স্বয়ং আমি এমন একটি ঘড়ির অধিকারী হয়েছিলাম, যা ছিল জতিলতায় পূর্ণ, দুর্বোধ্য, গতানুগতিকতা মুক্ত এবং আনন্দচ্ছ্বল। আমি ভেবেছিলাম ঘড়িটা দ্রাঘিমারেখার যেকোনো অবস্থানকেই নির্দেশ করতে পারে। উপকূল থেকে জলপথে যাত্রার উপযুক্ত মুহূর্ত-নির্ণায়ক ঘড়ি হিসাবে তার কাছে আমার যতটুকু প্রত্যাশা, তা না মিটিয়ে সে কাজে বিরত থাকত, তবে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হল, সে তার কাজকে কেবল এক স্বয়ংক্রিয় ধাঁধা হিসাবেই বিবেচনা করত। ধাঁধাগুলি বিচিত্র কৌতূহল ও আকর্ষণে ভরপুর।

একবার আমি এক লোকের কাছে শুনেছিলাম যে তার এমন একটি ঘড়ি ছিল, শুধু সে ছাড়া আর কারো জন্যই সেটা উপকারী যন্ত্র ছিল না। সে-ই ছিল সবচে ব্যতিক্রমী মানুষ, যে ঘড়িটার মতিগতি সম্পর্কে ধারণা করতে পেরেছিল। লোকটা আমায় বলেছিল— এটা এমন এক চমৎকার যন্ত্র, যার ওপর তুমি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে নির্ভর করতে পারবে, তবে তোমাকে এর চারিত্রিক কায়দা সম্পর্কে অর্জন করতে হবে পর্যাপ্ত জ্ঞান। কোনও আগন্তুক ঘড়িটির দ্বারা খুব সহজেই বিভ্রান্ত হতে পারে, যেমন ধরেন, সে বলে চলল, ঘড়িটা যখন পনের বার অ্যালার্ম দেয় কিন্তু তার কাঁটাগুলি নির্দেশ করে এগারটা বেজে বিশ, আমি বুঝতে পারি, সে আসলে নির্দেশ করছে আটটা বাজতে আর মিনিট পনের বাকি। ঘড়ি সম্পর্কিত অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান দায়সারা গোছের যেকোনো পর্যবেক্ষকের চেয়ে অনেক বেশি সুবিধা দিতে পেরেছিল লোকটিকে।

কিন্তু আমার ঘড়িটি নিয়ে সবচেয়ে মনোমুগ্ধকর বিষয় হল এর বিশ্বাসযোগ্য অনিশ্চয়তা। সুশৃঙ্খল কোন নিয়মেই সে কাজ চালাতে পারত না, তাতে এই জগৎসংসারে যত উলটপালটই ঘটুক না কেন। তাকে মনে হত বিশুদ্ধ আবেগে আক্রান্ত একটা ঘড়ি! একদিন আমার অদ্ভুত ঘড়িটা লীলাচঞ্চল হয়ে পড়েছিল। পৃথিবীতে স্বাভাবিক নিয়মে ভোর হবার তিনঘণ্টা আগেই রাতটাকে সে ভোর করে দিয়েছিল!

সে ছিল ভোর থেকে তিন ঘণ্টা এগিয়ে আর এটা নিয়ে তার মনে কোনও বিকার ছিল না। পরের দিন সে ইচ্ছা করল নিজেকে আর বাঁচতে দিবে না। পরিকল্পনামত কাজও শুরু করে দিল সে। প্রতি চার ঘণ্টার ভিতর থেকে দুই ঘণ্টা সময় সে হারিয়ে ফেলল, যা ছিল অপ্রত্যাশিতরকম শোচনীয় একটা ব্যাপার। বিকালের দিকে তার যাবতীয় কাজকর্ম বন্ধ হল। তারপর, সন্ধ্যা যখন ঘনিয়ে আসছিল, ঘড়িটি হঠাৎ আনন্দে অস্থির—স্বতঃপ্রণোদিত যন্ত্রটি পুনরায় কালের চক্রে আবর্তিত হতে শুরু করল।

ঘড়ি সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে আমি কোনোকিছুকেই গ্রাহ্য করব না, কারণ যখনই এই ব্যাপারে আমি আমার সাদামাটা উপলব্ধি প্রকাশ করতে যাব, আমি নিশ্চিত যে লোকে বলবে আমি অতিরঞ্জন করছি।

কোনোকিছুকে খুঁড়ে খুঁড়ে বের করার পক্ষে এটা খুবই হতাশাজনক, কারণ সত্যকে প্রকাশ করবার জন্য তোমার স্নায়ুগুলি এমনভাবে উন্মুখ হয়ে থাকে যে লোকে তোমাকে বিশ্বাসই করবে না। তোমার শুধু মনে হবে অতিরঞ্জন করছ।

এটা আমি প্রায় সময়ই অনুভব করি— ভিতরে প্রলোভন জাগছে। স্বয়ং নিজের জন্যই এই জেগে-ওঠা। এ হল নিজেকে বাঁচাবার একটা কৌশল, যা জন্মের পরেই মানুষ আত্মস্থ করে নেয় আর সারাজীবন বয়ে বেড়ায়।

আমরা সব সময় অত্যন্ত সতর্ক থাকি যেন কোনভাবেই অতিকথন বা অতরঞ্জনের পথ উন্মুক্ত না হয়। এটা এমন এক আচরণ, যা যেকোনো মুহূর্তে নিজেদের ভিতর থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে জেগে উঠতে পারে। এটা অবশ্যই কুরুচিপূর্ণ আচরণগুলিরও একটি। পুরনো দিনগুলোয় কবি আর ব্যবসায়ীরা অতিকথন করত। তাতে লুকানো থাকত কিছুটা চাতুরী এবং অতিকথনের শিল্পটাকে প্রকাশ করবার খ্যাতি। আরও যথাযথভাবে বলতে গেলে, স্রেফ বাস্তবতার নগ্নতাকে অগ্রাহ্য করা। আজ কিন্তু সকলেই অতিকথনে ব্যস্ত।

অতিকথনের সৌন্দর্য প্রকাশের বিষয়টি শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যসূচিতে দীর্ঘদিন টিকে থাকার মত কোনও বিষয় নয়, বরং জীবনের পক্ষে জরুরি একটা উপাদান, যা কি-না জীবনে টিকে থাকার যুদ্ধে আবশ্যকীয় বিষয় হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে।

পুরা দুনিয়াটাই অতিরঞ্জত। সব কিছুকেই অতিরঞ্জিত করা হয়েছে— সাইকেল বিক্রির পরিমাণ থেকে বাৎসরিক ধর্মান্তরিতকরণ— সবকিছুকেই, এমনকি পাপের অনিবার্য পরিণাম থেকে উদ্ধার পাওয়া এবং হুইস্কির মত কড়া মদকেও।

অতিকথনই আমাদের যাবতীয় ব্যবসায়-বাণিজ্যের বুনিয়াদ। আমাদের শিল্পসাহিত্যের পতিতজমি। সামাজিক জীবন-সূচনার মূল অংশ। আমাদের রাজনৈতিক অস্তিত্বের ভিত্তি। বিদ্যালয়পড়ুয়া বালক হিসাবে আমরা অতিরঞ্জিত করি আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীকে, আমাদের ফলাফলকে, আমাদের ঋণ-জর্জরিত পিতাদের। মানুষ হয়ে জন্মানোর পরও আমরা অতিরঞ্জিত করি আমাদের উৎপাদিত পণ্যগুলিকে। অতিরঞ্জিত করি আমাদের অনুভবগুলিকে, এমনকি অর্থের উৎসকেও। শুধু কর আদায়কারীর বিষয়টা ব্যতিক্রম। তার কাছে অতিরঞ্জিত করি আমাদের যাবতীয় ব্যয়কে। আমরা অতিরঞ্জিত করি আমাদের গুণগুলিকে, এমনকি আমাদের যাবতীয় ব্যভিচারকেও।

অতিকথনের অভিনয় করতে করতে আমরা পঙ্খিলতার অতলে তলিয়ে গেছি, জীবন ভরে ফেলেছি ঝুরি ঝুরি মিথ্যা দিয়ে, পরম আনন্দের সঙ্গে। আমরা এর নাম দিয়েছি ‘যা ইচ্ছা করো এবং তা বজায় রাখো’।

যদি আমরা বছরে একশো পাউন্ডের মালিক বনে যাই, তাহলে কি দুইশ পাউন্ড বলব? ধরা যাক, আমাদের ভাঁড়ারঘর খালি হয়ে গেছে আর উনুনও জ্বলছে না, তবু আমরা সুখি হব ‘পৃথিবী’ (মানুষের অভিজ্ঞতা এবং অন্যের প্রতি প্রচণ্ড কৌতূহলী এক প্রতিবেশী) আমাদের দেড়শ পাউন্ড ধার দেবে। যেদিন এর পরিমাণ হবে পাঁচশো, আমরা লোকের কাছে গল্প করব এক হাজারের, আর অতিগুরুত্বপূর্ণ ও ভালোবাসার ‘পৃথিবী’ (ছয় বন্ধু, যাদের দুজন এখন রয়েছে ঘোড়ায়টানা গাড়িতে) সম্মত হল যে আমরা এখনি সাতশো পাউন্ড খরচ করে ফেলব, তাতে বিশ্বসংসারে যে-ঘটনাই ঘটুক না কেন, এটা বিবেচিত হবে চলতি ঋণ হিসাবে। পরিচিত কসাই আর রুটির কারিগররা খবরটি জানতে পারবে আমাদের গৃহপরিচারিকার মাধ্যমে।

কিছুক্ষণ পর, — যখন আমরা চাতুরী সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞানের অধিকারী —আমরা উচ্চাভিলাষী কাজটা করতে শুরু করলাম। আমরা ভারতীয় রাজকুমারদের মত খরচ করতে লাগলাম, অথবা, আরও যথার্থভাবে বলতে গেলে —কীভাবে টাকাকড়ি খরচ করতে হয় তার ধারণা লাভ করলাম। কারণ আমরা জানতাম সময়ের ভিতর দৃশ্যের বিদ্যমানতা —কীভাবে নিজেদের বিত্তশালী হিসাবে প্রদর্শন করা যায় আর দেখানো যায় কাড়ি কাড়ি মুদ্রা ঝকমক করছে। হে সুপ্রিয় প্রাচীন পৃথিবী, বালজিবাব তোমাকে আশীর্বাদ করুন। এই আশীর্বাদ দরকার তার পুত্রকন্যাদের জন্য।

এ হল গতি লাভ করার রঙ্গচিত্রের নমুনা। অভিনন্দন জানানো এবং হাসিমুখে তাকিয়ে থাকা মিথ্যের দিকে, লোকের সঙ্গে আলাপ করা যা প্রতারণায় পূর্ণ, বেদমভাবে মার খাওয়ার চিন্তার দিকে সংকীর্ণ চোখে তাকিয়ে থাকা, যা এটাই জানায় যে দেরিতে ঘটুক বা দ্রুতই ঘটুক না কেন, আমাদেরকে আঘাত করা হবে প্রচণ্ড হাতুড়ি দিয়ে, এবং এটা শীঘ্রই রূপান্তরিত হবে কুহকবিদ্যার এক প্রাণবন্ত খেলায়, যতক্ষণ না ধূসর ঊষালোকের আলো ফুটে উঠেছে।

‘সত্য’ ও ‘প্রকৃত’ হচ্ছে পুরনোদিনের কেতা। অসৎ উপায়ে কড়ি কামানোর জন্য ‘সত্য’ ও ‘প্রকৃত’ এখন স্থূল ও কুরুচিপূর্ণ পদ্ধতির সঙ্গে মানানসই। আসলে প্রথম দেখায় কোনোকিছুকে যা মনে হয়, আসলে তা ‘প্রকৃত’ নয়, তা হচ্ছে চতুর কুকুরটি সেইসব চতুর দিনগুলিতে যা আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করেছিল। আমরা নীরস পিচ্ছিল কঠিন মাটি থেকে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি, আমরা ঘরবাড়ি গড়েছি রামধনুশোভিত মাটিতে এবং অলীক কল্পনায়। আমরা ঘুমিয়েছি এবং হেঁটে বেড়িয়েছি রামধনুর নিচে। আমাদের ঘরগুলির ভিতর সৌন্দর্য ছিল না, কেননা, তারা ছিল কনকনে ঠাণ্ডা আর কুয়াশায় স্যাঁতস্যাঁতে। যখন সোনালি মেঘদল গলে একাকার হয়, রুক্ষ পৃথিবীর অধোদেশে নামতে থাকে প্রবল বৃষ্টিধারা, তখন ঘুরে ফিরে আমাদের মনে জেগে উঠত কেবল ভয়।

কিন্তু সেখানে আমাদের এত দুর্ভোগ আর আতঙ্কের কারণ কী ছিল? যেকোনো আগন্তুকের কাছে আমাদের ঘরবাড়িগুলিকে মনে হত মনোরম আর উজ্জ্বল। যেসব চাষি নিচের মাঠে কাজ করছে, তারা চোখ তুলে দেখছে এবং ঈর্ষা করছে আমাদের —এই ঈর্ষা আমাদের জাঁকজমকপূর্ণ বসতভিটা আর গৌরবের প্রতি। যদি তারা ভাবে যে সত্যিই এগুলি মনোমুগ্ধকর, তাহলে নিশ্চিতভাবেই আমরা পরিতৃপ্ত হব।

বেঁচেবর্তে থাকবার জন্য আমরা অন্য কাউকেই কিছু শিখাইনি, এমনকি নিজেদের জন্যও কোন দৃষ্টান্তের জন্ম দিইনি। বিজয়ীর শক্তিমত্তা নিয়ে দুর্বিষহ আচরণ দ্বারা শিক্ষকের মত আমরা কি বলেছি —এটাই হল বেঁচে থাকবার সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক পদ্ধতি? আমরা যথেষ্ট পরিমাণে আত্মবিসর্জনকারী!

আহা! অবশ্যই আমরা ঈশ্বরের প্রতি যথেষ্ট পরিমাণ বিশ্বস্ত, আর আমরা আনুগত্য প্রকাশ করছি আমাদের নতুন অভিষিক্ত রাজার নিকট। আনুগত্য প্রকাশ করছি ছদ্মবেশী রাজপুত্রের কাছে, চতুর রাজকুমারীর কাছে।

মানুষকে —যদি সে টিকে থাকতে চায় —তাকে অবশ্যই স্তুতি করতে হবে। চারপাশের জীবনকে দেখতে দেখতে অবশেষে জীবনের অন্তর্দৃষ্টির মধ্যে কী আছে মানুষ তা উপলব্ধি করে। সে খুঁজে পায় শ্রেষ্ঠ ও সর্বোত্তমকে। তবু মানুষ পতিত হয়, বিস্ময় ও ভয়ের যুগপৎ অনুভব দ্বারা তাড়িত হয় তার প্রতি, যার চোখ উনিশ শতকের ওপর খোলা রয়েছে।

কোনও মহান প্রতিমার জন্ম কি এই ব্রহ্মাণ্ড দিতে পেরেছিল, যা চুরিকরা পদমর্যাদার মত মিথ্যের খোদাইকৃত মূর্তি নয়?

এইসব হল কর্কশ, নির্লজ্জ, উদ্ধত আর কপট, অন্তঃসারশূন্য হৃদয়ের উপলব্ধি। মানুষ এটা উপলব্ধি করতে পারে যে তার আত্মা আর পবিত্র নয় আর সঙ্গে সঙ্গেই সে পতিত হয় আর পদচুম্বন করে; এবং শক্ত হয়ে এঁটে থাকে —চিরকালের জন্য নিজের কাছে নিজেই প্রভুর পদ-লেহনের শপথ করে।

প্রভু, হায়! সে এক পরাক্রমশালী অধিরাজ, সম্রাট। রাবারের তৈরি কিং হামবুর্গ। চলো, আমরা গড়তে বসি হিউনের মন্দির, যে-মন্দিরের ছায়ায় রাজাকে আমরা পূজা করতে পারব, তাকে বাঁচাতে পারব আলোর আক্রমণ থেকে। চলো, রাজাকে আমরা রক্ষাকবজের আড়ালে ঢেকে ফেলি। দীর্ঘজীবী হোক আমাদের কূপমণ্ডূক মেকি শাসক।

আমাদের মত সোলজারদের জন্য উপযুক্ত নেতা ঠিক করতে হবে। অভিষেক-গ্রহণকারী মহামান্য মিথ্যা-রাজাদের জয় হোক! বেচারা রাজা অ্যাপারেন্স দীর্ঘজীবী হোক। তার জন্য আমাদের নতমস্তক বশ্যতা। আমরা কিন্তু রাজাকে উপরে তুলে শক্ত করে ধরে রাখব।

রাষ্ট্রের সৈনিকেরা শুনুন, রাজার বেঁচে থাকবার জন্য এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ হল তাকে যথেষ্ট উঁচুতে তুলে রাখা। নিজের কাজ নিজে করার পক্ষে প্রয়োজনীয় হাড় ও পেশি তার নেই, সে এমনই এক বেচারা সম্রাট!

তার পদতল থেকে আমরা যদি হাত সরিয়ে নিই, তাহলে এক গাঁদা জীর্ণ ন্যাকড়ার ওপর তার পতন হবে আর ক্রোধান্ধ বাতাস টেনে হিঁচড়ে ঘুরপাক খাওয়াতে খাওয়াতে তাকে বহুদূর উড়িয়ে নিয়ে যাবে। রাজা পরিত্যক্ত হবে। হায়! তার চিরস্থায়ী আসনটির জন্য চলো জীবন উৎসর্গ করি। তার খাবার পরিবেশনে হাত লাগাই। চিরকালীন অস্তিত্বহীনতার বাতাস, মুখ থেকে ছেড়ে দেবার মত চলো তাকে মস্ত আকৃতিতে গড়ে তুলি। বলতে থাকি, বিস্ফোরিত হওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা তার সঙ্গেই আছি!

একদিন না একদিন সে সশব্দ ফেটে যাবেই। যেমন যেকোনো বিস্ফোরণের আগেই আমরা বুদ্বুদ দেখতে পাই, তেমনি তাকেও একদিন দেখা যাবে পরিণত হয়েছে এক বিশালাকৃতি দানবে।

ইতোমধ্যেই সে আমাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে, এখন পর্যন্ত সেই প্রভাব আমরা কাটাতে পারিনি। পৃথিবীর বয়স বাড়ছে অধিক থেকে আরও অধিক কপট ও ছলনাময় পৃথিবী হিসাবে, অতিকথন এবং মিথ্যাচার হিসাবে; এবং সে, যে-ছদ্মবেশ ধারণ করছে, অতিরঞ্জন করছে, মিথ্যা বলছে অবিরাম, সে-ই আমাদের সকলের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম!

পৃথিবী হল আদা দিয়ে তৈরি রুটি কেনাবেচার এক প্রচণ্ড কোলাহল। আমরা প্রতিটি বুথ আর পয়েন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখছি জমকালোরঙে-আঁকা চিত্রগুলি। বাজাচ্ছি বিশাল বিশাল ড্রাম আর মেতে উঠছি দম্ভের খেলায়।

কিনুন আমাদের তৈরি সাবান। শুনুন হে জনগণ, আপনাদেরকে কখনোই বুড়ো হাবড়াদের মত দেখাবে না। আপনাদের টেকো মাথা পুনরায় ঢেকে যাবে নতুন গজানো চুলে।

আপনারা আর কোনোদিনও গরিব হবেন না, আগের মত অসুখিও হবেন না আর। আমরাই আপনাদের একমাত্র সত্যিকার সাবান। উফ! মিথ্যা ইমিটেশন থেকে সতর্ক থাকবেন। কিনুন আমাদের তৈরি লোশন। আপনাদের মধ্যে যারা প্রায়ই প্রচণ্ড মাথাব্যথায় ভোগেন, যাদের পাকস্থলী নষ্ট হয়ে গেছে, পা টনটন করে, কিংবা যাদের দুটো হাতই ভেঙে গেছে, অথবা যাদের কোমল হৃদয় ভেঙে গেছে মুহূর্তের এক ঝড়ে আর সেইসব দজ্জাল শাশুড়িরা, আপনাদের কাছে বিনীত প্রার্থনা এই যে, পান করুন আমাদের সালসা। দেখবেন, এই সালসা জীবনের সমস্ত ঝঞ্ঝাট ঝেটিয়ে বিদায় করে দিয়েছে।

যারা যেতে চান স্বর্গে, তারা আসুন আমাদের গির্জায়। কিনে নিন পয়সা বানানোর গাইড বই। মিটিয়ে দিন গির্জার বেঞ্চের ভাড়া আর শুধু প্রার্থনাই করুন। আপনাদের সেই বিভ্রান্ত ভাইদের কথা স্মরণ করুন, যারা ভুল পথে চলে গেছে। এখন তাদের জন্য আপনাদের আর করবার কিছুই নেই —এ-কথা মগজে নিয়েই চলুন প্রার্থনায় রত হই। এটাই একমাত্র নিরাপদ উপায়।

বুদ্ধিমান নির্বাচকগণ —ভোট দিন আমাদের মার্কায়, যাতে আমাদের দল ক্ষমতায় যেতে পারে। দেখুন, আমরা ক্ষমতায় গেলে পৃথিবী সম্পূর্ণ নতুন হয়ে জন্ম নেবে, যার কোথাও আগের তিল পরিমাণ পাপ কিংবা দুঃখ থাকবে না। প্রত্যেক স্বাধীন ও প্রভাবমুক্ত ভোটারের জন্য থাকবে আনকোরা ইউটোপিয়া, যা তৈরি হবে প্রত্যেকের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে এবং প্রত্যেকের নিজস্ব আইডিয়া অনুসারে। এটা সকলের হাতেই থাকবে, বিশুদ্ধ আকার এবং আত্মার প্রায়শ্চিত্ত বিষয়টি যার সঙ্গে সম্পৃক্ত।

আহা! সুবর্ণ সুযোগটি হেলায় হারাবেন না।

আহা! আমার ফিলোসফিটা লক্ষ্য করুন, কেননা এটাই শ্রেষ্ঠ এবং গভীরতর। আহা! আমার সঙ্গীত শ্রবণ করুন, কেননা এই সঙ্গীতই সবচেয়ে শ্রুতিমধুর। আহা! আমার আঁকা ছবিগুলোই শুধু কিনুন, কেননা শুধু এগুলোই সত্যিকারের শিল্প হতে পেরেছে। আহা! কেবল আমার লেখা বইগুলোই পড়ুন, কেননা শুধু এই বইগুলোতেই মানুষের সূক্ষ্মতম অনুভূতিগুলোকে ধরা হয়েছে।

আমিই একমাত্র শ্রেষ্ঠ পনির ব্যবসায়ী। আমিই সবচেয়ে চৌকশ আর্মি। আমিই শ্রেষ্ঠতম রাষ্ট্রনায়ক। আমিই শ্রেষ্ঠতম কবি। আমিই শ্রেষ্ঠতম সার্কাসের সঙ। চটকদার কথা-বলা শ্রেষ্ঠ ধাপ্পাবাজ। আমিই শ্রেষ্ঠতম সম্পাদক। শ্রেষ্ঠতম দেশপ্রেমিক আমিই।

আমরাই শ্রেষ্ঠতম জাতি। একমাত্র আমরাই দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম মানুষের দঙ্গল। আমাদের ধর্মই চিরকালীন ধর্ম।

বাহ! আমরা সকলে কী নারকীয় চিৎকারটাই না করছি!

ঠিক কীরকমভাবে আমরা প্রত্যেকে প্রবল উত্তেজনা অনুভব করছি, প্রচণ্ড শব্দে ড্রাম পেটাচ্ছি, উচ্চস্বরে চেঁচাচ্ছি —আমরা তার একটি বর্ণও অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে বিশ্বাস করছি না!

লোকে নিজেদের মধ্যে বিনিময় করছে তাদের ভাবনা। তারা বলছেঃ এটা আমরা কীভাবে তীক্ষ্ণস্বরে চেঁচিয়ে আবিষ্কার করতে পারি যে কে এই চিৎকার-করতে-থাকা লোকদের ভিতর শ্রেষ্ঠতম? কোন জন সেই দক্ষতম ব্যক্তি?

উত্তরে তারাই বলছেঃ এখানে কেউই শ্রেষ্ঠতম নয়। কেউই দক্ষতম নয়। সর্বোত্তম দক্ষ লোকটি এখানে নেই। এইসব হৈ চৈ কোলাহল ও বিশৃঙ্খলা যারা তৈরি করেছে, তারা সবাই জ্ঞান-দক্ষতা আর সক্ষমতার ভানকারী হাতুড়ে লোক মাত্র। আমাদের মধ্যে তার কোন আসন নেই। স্থান নেই। যেখানে মোরগ ডেকে ওঠে তাকে সেখানে দেখতে পাবে। আমরা বুঝতে পেরেছি শ্রেষ্ঠতম ও সর্বোত্তম হল তারা, যারা উচ্চস্বরে এবং দীর্ঘসময় ধরে ডাকতে পারে। এটাই আমাদের কাছে উৎকর্ষ নির্ণয়ের শ্রেষ্ঠতম পরীক্ষা। সুতরাং, মোরগের ডাক দেয়া ছাড়া আমাদের করার আর কী বাকি রইল? আমাদের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট তারাই যারা মোরগের উল্লাসময় স্বরে চিৎকার করছে আর দীর্ঘকাল ধরে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট এক গোবরের ঢিবিতে, আমরা যার নাম দিয়েছি পৃথিবী!

আমি এখন আমাদের ঘড়ি সম্পর্কে কিছু কথা বলতে যাচ্ছি।

আইডিয়াটা ছিল আমার স্ত্রীর। ঘড়িটাকে আপন করে পাওয়ার জন্য, হ্যাঁ, প্রথম দর্শনেই তাকে একেবারে নিজের করে পাওয়ার জন্য সে পাগল হয়ে গিয়েছিল।

আমি ও আমার স্ত্রী আমাদের বন্ধু বোগেলের বাড়িতে দুপুরের খাবারে যোগ দিয়েছিলাম। বোগেল এইমাত্র একটা ঘড়ি কিনেছে। একটা পড়ে-পাওয়া পুরাতন ঘড়ি, এসেছে এসেক্স থেকে। এইসব পড়ে-পাওয়া জিনিস কেনায় সে পাকা লোক। সে বসেছিল বিচিত্র নকশা-খোদাই বিশাল পালঙ্কের মত দেখতে একটা ঘড়ির ওপর, যার ওজন প্রায় তিন টন। সে বলল, খুব সুন্দর ছিমছাম এই জিনিশটা সংগ্রহ করা হয়েছে হল্যান্ড থেকে। কথাটা সে এমনভাবে বলল যে মনে হল এটা তার মালিকের ছাতার ভিতর থেকে খসে পড়েছে আর বেচারা বোগেল লোকের নজর এড়িয়ে সেটাকে খুঁজে পেয়েছে রাস্তার পাশে। ব্যাপারটা আর কেউ বুঝতেই পারেনি!

সদ্য-কেনা ঘড়ি নিয়ে সে দারুণ উত্তেজিত ছিল। ঘড়িটা ছিল আগের আমলের পুরনো উঁচু কাঠের বাক্সে রক্ষিত ওজনচালিত ঘড়ির একটি মডেল। খোদাই-করা ওক কাঠের বাক্সের ভিতর তার উচ্চতা ছিল আট ফুট। তার ছিল ধ্বনিময়, গভীর ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলির মত ছন্দময় টিকটিক শব্দ, যেন রাতের খাবারের পর সঠিক তাল-লয়-ছন্দে পরিবেশিত হচ্ছে সঙ্গীত আর ঘরময় তৈরি হয়েছে অনাড়ম্বর সহজতা।

ঘড়িটাকে কেন্দ্র করেই আমাদের আলাপ জমে উঠল। কীভাবে ঘড়িটার প্রলম্বিত ও গুরুগম্ভীর টিকটিক শব্দকে সে ভালবাসতে পেরেছে বোগেল আমাদের তা বলল। রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে কাদা, তখন সে আর তার ঘড়িটা যমজ বন্ধুর মত সময় কাটায়। মনে হয় পুরনো বন্ধুরা তার সঙ্গে কথা বলছে। বলছে পুরনো দিনগুলি কেমন ছিল। কেমন ছিল পুরনো দিনের চিন্তাধারা, কেমন ছিল মানুষের বেঁচে থাকবার পদ্ধতি, এবং কেমন ছিল সেইসব পুরনো আমলের মানুষ, যারা এই দুনিয়া থেকে হারিয়ে গেছে!

ঘড়িটা আমার স্ত্রীরত্নের মনে গভীর প্রভাব ফেলল। ঘরে-ফেরার পুরটা সময় সে ছিল গভীর ভাব নায় মগ্ন। যখন আমরা বরাবরের মত সিঁড়ি ভেঙে ঢুকে পড়েছি আমাদের ঘুমাবার গুহায়, সে বলল, আমরা কেন ঠিক এরকমই একটি ঘড়ি কিনছি না? তার বিশ্বাস ঘড়িটা হবে ঠিক একজন মানুষের মত যে আমাদের দেখেশুনে রাখবে। সে এটাও কল্পনা করে নিল যে ঘড়িটা আমাদের অনাগত সন্তানদেরও বিপদাপদ থেকে রক্ষা করবে।

নর্থহ্যাম্পশায়ারের সেই লোকটিকে —যার কাছ থেকে আমরা মাঝেমধ্যে আসবাবপত্র কিনে থাকি— ব্যাপারটা বললাম। সে জানালো আমি ঠিক যেমনটা চাইছি সে ঠিক তেমন একটা জিনিশ আমার জন্য জোগাড় করবে। সুনিশ্চিতভাবে ভাগ্যবান ছিলাম বলেই নর্থহ্যাম্পশায়ারের আসবাবপত্রবিক্রেতা বেশ সময় নিয়ে খুঁজে পেতে অদ্ভুত কিন্তু আকর্ষণীয় এবং বেশ পুরনো কেতার একটা ঘড়ি জোগাড় করল। ঘড়িটার একটা ছবি এবং খুঁটিনাটি সম্পর্কে ধারণা দিয়ে জানতে চাইল আমাদের ফ্ল্যাটে এটাকে পাঠিয়ে দেবে কিনা। ছবি দেখে, আনুষঙ্গিক বিষয় সম্পর্কে জেনে নিয়ে বললাম, হ্যাঁ, দেরি না করে পারলে আজই পাঠিয়ে দাও।

দিন তিনেক পর কারা যেন দরজার কড়া নাড়ল। নিশ্চয় এর আগেও কয়েকবার নাড়া হয়েছিল কিন্তু আমি ঘড়িটির ইতিহাস নিয়ে মগ্ন হয়ে থাকায় শুনতে পাই নি। মেয়েটি জানাল বাইরে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খুলতেই পিকফোর্ডের মালামালবহনকারী লোকগুলিকে দেখলাম। তাদের হাতে ঠিকানা-নির্দেশসহ মালপত্রের তালিকা। বুঝতে পারলাম তারা আমাদের কাঙ্ক্ষিত ঘড়িটি নিয়ে এসেছে। বায়বীয় কণ্ঠে তাদের বললাম— হ্যাঁ, ঠিক আছে। এটাকে ওপরে তুলে আনো।

তারা অপারগতা প্রকাশ করল। নিচ থেকে একটা ঘড়িকে ওপরে তোলা নাকি তাদের পক্ষে সম্ভব নয়!

নিচে নেমে দেখি সিঁড়ির ধাপে কিলক দিয়ে আটকানো একটা বাক্স, ঠিক যেন লন্ডনের ক্লিয়পেত্রা ওবেলিস্ক, যা ওপরের দিকে ক্রমশ সরু, চতুষ্কোণ দীর্ঘ শিলানির্মিত স্তম্ভ বিশেষ; যার শীর্ষদেশে রয়েছে ছোট্ট একটা পিরামিড।

তারা বলল, এটাই আপনার ঘড়ি।

আমি কাটারি আর লোহার দণ্ড জোগাড় করে, রাফিয়ান মার্কা দুজন লোক ডেকে প্রায় আধঘণ্টা ধাক্কাধাক্কি করার পর ঘড়িটাকে ওপরে উঠাতে পারলাম। এতক্ষণ সিঁড়ি দিয়ে লোকচলাচল বন্ধ ছিল, ওপরে তুলে নেয়ায় ভাড়াটেদের মনে আগের স্বস্তি ফিরে এল। ঘড়িটা রাখলাম দোতলার খাবার ঘরের কোণায়। গোরায় সে এমন ভাব করল যেন সে খুব নড়বড়ে, যেকোনো মুহূর্তে লোকের মাথায় ভেঙে পড়বে। এ অবস্থা ঠেকালাম প্রচুর পেরেক, স্ক্রু আর জ্বালানী কাঠ ব্যবহার করে। ঘড়িটার জীবনের সব ঝুঁকি হ্রাস করে অবসাদ আর ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

মধ্যরাতে, হঠাৎ ভীতিকর আওয়াজে স্ত্রীর ঘুম ভেঙে গেল। সে বলল —ঘড়িটা এইমাত্র তেরোবার অ্যালার্ম দিয়েছে! আমি কি এটা ভাবতে পারছি যে কেউ একজন মারা যাচ্ছে? তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম —এসবের কিছুই আমি জানি না। বললাম, হতে পারে পাশের বাড়ির কুকুরটা মরতে বসেছে। আমার স্ত্রী বলল, কিছু একটা ঘটার ইঙ্গিত পাচ্ছে সে। সম্ভবত আমাদের সন্তানটি জন্ম নিতে শুরু করেছে। তার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছিল। প্রাণ আকুল করা কান্নায় ভেঙে যেতে যেতে সে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল।

অবশ্যই কোথাও তোমার ভুল হচ্ছে —কথাগুলি বলে সকালে তাকে প্রবোধ দিলাম। তাতে সে স্বাভাবিক মানুষের মত খানিকটা হাসতে পারল। বিকালে ঘড়িতে আবার তেরোবার অ্যালার্ম বাজল। তাতে আতঙ্ক আরও তীব্র আকার ধারণ করল। সে আমাকে বিশ্বস্তভাবে বোঝাতে চাইল, আমাদের অনাগত সন্তান এবং আমি উভয়েই মারা যাচ্ছি আর সে স্বামীসন্তানহীন বিধবায় পরিণত হতে যাচ্ছে। বিষয়টিকে আমি স্রেফ একটা কৌতুক হিসাবে বিবেচনা করলাম। এটা তাকে আতঙ্কিত করে তুলল। বলল, সে বিষয়টাকে ঠিক যেরকম অনুভব করছে দয়া করে আমিও যেন সেরকম অনুভব করি। তার ধারণা হল আমি তাকে সান্ত্বনা দেবার খাতিরে নিরুদ্বেগ থাকবার ভান করছি। সে বলল, এখন যা কিছু ঘটবে সবকিছুকেই সে সত্যিকার সাহসের সঙ্গেই মোকাবেলা করবে। আমার স্ত্রী যে-লোকটিকে এই দুরবস্থার জন্য দায়ী করল, সে হচ্ছে বেচারা বোগেল।

রাতে ঘড়িটি আবারো অ্যালার্ম বাজিয়ে আমাদের সতর্ক করে দিল। আমার স্ত্রী ধরেই নিল যে এই সংকেত তার অ্যান্ট মারিয়ার মৃত্যু-সম্পর্কিত। এই সংকেতকে সে বিনা প্রতিবাদে মেনে নিল।

পরদিন ঘড়িটা চারবার তেরোটি করে অ্যালার্ম বাজাল। হঠাৎ আমার স্ত্রীকে খুব উৎফুল্ল মনে হল। সে বলল- মনে হয় আমরা সবাই মারা যাচ্ছি! সম্ভবত কালাজ্বর বা প্লেগ এগিয়ে আসছে। আমাদের কারোরই আর নিস্তার নেই। আমরা সবাই প্লেগে আক্রান্ত হব।

‘সবাই একসঙ্গে মারা যাচ্ছি’ এটা ভেবে আমার স্ত্রী-রত্ন প্রফুল্ল হয়ে উঠল আর ঘড়িটাও তার দায়িত্ব এমনভাবে পালন করতে লাগল যে তার অ্যালার্মের কারণে আমাদের যত বন্ধু আর আত্মীয়স্বজন ছিল তাদেরকে —স্ত্রীর বর্ণনা অনুযায়ী— হত্যা করতে লাগল। বন্ধুবান্ধবের মৃত্যুর পর ঘনিয়ে এল প্রতিবেশীদের জন্য মৃত্যুসংকেত।

ঘড়িটা মাসের তিরিশ দিনই একসঙ্গে তেরোবার অ্যালার্ম বাজাল, যতক্ষণ না ব্যাপক গণহত্যায় আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ি। মাইলের পর মাইল জীবিত মানুষের কোনও অস্তিত্বই ছিল না!

তারপর ঘড়িটা চরম যুক্তিবোধের পরিচয় দিল। বন্ধ হল অবিরাম হত্যাযজ্ঞ। ক্ষতিকর চরিত্র পাল্টে স্রেফ ঊনচল্লিশ আর একচল্লিশের ঘরেই বারবার বাজতে থাকল। ঘড়িটার প্রিয় নির্দেশকবিন্দু ছিল বত্রিশ, কিন্তু হঠাৎ একদিন সে ঊনপঞ্চাশের কাছে এসে বাজতে লাগল। ঊনপঞ্চাশের ঘর সে কিছুতেই পেরুতে পারল না। কোনভাবেই বুঝতে পারলাম না সে এমন আচরণ কেন করছে! ঊনপঞ্চাশের ঘর কিছুতেই পেরুল না ঘড়িটা। তার বেজে-উঠার মধ্যে বিরতি খুব কমই ছিল। প্রতি ঘণ্টায় সে তিন থেকে চারবার পর্যন্ত অ্যালার্ম দিত। আবার কখনও দিনের অর্ধেকটাই কাটিয়ে দিত শব্দ না করে।

প্রকৃত অর্থেই ঘড়িটা ছিল এক আশ্চর্য বস্তু!

মাঝে মধ্যে ভাবতাম তার প্রতি সমস্ত ‘মনোযোগ নিবিষ্ট করব’, যাতে প্রতিটি ঘণ্টাকেই সে নিয়মিত আবর্তন করতে পারে। তাকে নিয়ে আমার এই ধারণার জন্ম হল যে, সময়কে উপহাসের ব্যাপারে সে যথেষ্ট সাহসী। সুতরাং, তার প্রতি আমার বিশেষ অনুরাগ জন্ম নিল।

ঘড়িটা সময়ের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল নয়। সে যখন তার কালচক্রপথ আবর্তন করে, তখন সময়কে প্রায় খোলাখুলিই অবমাননা করতে পারে। এই প্রবণতা তার ভিতর প্রবল। সে জানান দেয় দুটো বেজে আটত্রিশ মিনিট, এবং তার ঠিক বিশ মিনিটের মধ্যেই বলে বসে —এখন বাজে মাত্র একটা!

বিষয়টা কি এমন, ঘড়িটা তার মালিকের প্রতি অনুভব করছে সত্যিকার ঘৃণা আর মনে করছে এই ঘৃণাকেই সে সবার সামনে প্রকাশ করবে? তার ঘৃণার অনুভব এটাই বোঝাচ্ছে যে, মালিকের পোশাক-পরিচ্ছদের যত্ন নেবার কাজে নিয়োজিত ভৃত্যের কাছে কোনও মানুষই প্রকৃত নায়ক হতে পারে না। এটা এজন্যই হতে পারে —সময় যেন এক পাথরের মূর্তি, কিন্তু তার স্থায়িত্ব ক্ষণকালের। মুহূর্তেই মরে যায় অন্য মরণশীলদের মত। হয়তো এটাই ‘সময়’-এর সবকিছু, হয়তো পুরাতন ভৃত্যের ছানিপড়া ঝাপসা চোখে তাকিয়ে থাকার মত কোনও ব্যাপার। তার শুধু একটাই কাজ —টিকটিক, টিকটিক শব্দে বেজে চলা সারাটা জীবন ধরে। সবশেষে সময়ের সামান্যতা আবির্ভূত হয় আবছাভাবে, ছাপ ফেলে যায় মানুষের আতঙ্কিত চোখে।

ঘড়িটা যেমনভাবে ভয়ানক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে আর বারবার আঘাত করে পঁয়ত্রিশ এবং চল্লিশের ওপর, তাহলে কি সে প্রবাদকথার মতই বলে —বাহ, সময়! তোমাকে আমি চিনতে পেরেছি, তুমি ঈশ্বরতুল্য আর কী ভয়ঙ্করই না তোমাকে দেখায়! একটা কিমাকার ভূত ছাড়া আর কী তুমি? একটা স্বপ্ন —এখনও আমরা যারা বেঁচে আছি, ঠিক তাদের মতই বেঁচে থাকবার একটা স্বপ্ন। এছাড়া তুমি আর কী? হ্যাঁ, তুমি ধীরে ধীরে বয়ে যাও। ফেরা আর হয় না তোমার। শাশ্বত মানুষ, সময়কে ভয় নেই।

সময় হল চিরন্তনতার পটভূমির ওপর পতিত পৃথিবীর এক ছায়া।

 

 

 

[জেরোম কে জেরোম, পুরো নাম জেরোম ক্লাপকা জেরোম, জন্ম ১৮৫৯ সালে; ইংল্যান্ডে। ছেলেবেলা কেটেছে প্রচণ্ড কষ্টে। পার্লামেন্টের সদস্য হবার ইচ্ছা ছিল তার, কিন্তু চরম দারিদ্র্য আর মায়ের মৃত্যু তাকে ভীষণ একা করে ফেলে। কাজ করতে শুরু করেন লন্ডন এবং নর্থওয়েস্টার্ন রেলওয়েতে। একসময় বেছে নেন বিচিত্র পেশা। কখনও সাংবাদিকতা, কখনও শিক্ষকতা... আর সবসময়ই প্রচণ্ড হতাশা। তাঁর গল্প আর বিদ্রূপাত্মক রচনাগুলির রয়েছে বিতর্কিত আর বিখ্যাত হবার খ্যাতি। মার্ক টোয়ান, কিপলিং এবং আরথার কোনান ডোয়েলের সঙ্গে ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। ভিক্টোরিয়ান মূল্যবোধকে নিয়ে লেখা আর কার্টুনের মাধ্যমে বিদ্রুপ আর আঘাত করাই ছিল তার লেখার মূল লক্ষ্য। হাস্যরস সৃষ্টির মাধ্যমে জেরোম কে জেরোম আসলে মানুষের বিষণ্ণতাকেই তুলে ধরেছেন। লিখেছেন বিদ্রূপাত্মক নাটক, উপন্যাস, গল্প আর বিচিত্র বিষয়ে গদ্য। ১৯২৭ সালে এই লেখকের মৃত্যু হয়।]

 

উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ...

রম্য গল্পের রাজা | শিব্রাম চক্কোত্তিমশাই


সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়

 

শিবরাম চক্রবর্তী, তিনি বলতেন বা লিখতেন শিব্রাম চক্কোত্তি। নিজের নাম নিয়েই খেলা করতেন।

যখন আমি স্কুলে পড়ি তখন শিবরাম চক্রবর্তীর লেখা পড়ার জন্য আমরা সকলেই খুব উতলা হতুম।

পরশুরাম বালকদের তেমন বোধগম্য হতেন না। কারণ তাঁর ব্যঙ্গাত্মক লেখা, স্যাটায়ার ছিল বড়দের জন্য। আর ত্রৈলোক্যবাবুর কোনও কোনও লেখা ছোটদের হাত ধরতে চাইলেও তেমন জোরে ধরতে পারতেন না।


শিবরাম চক্রবর্তীর লেখা যেমন ছোটদের জন্য, সেই রকম বড়দের জন্যও। এমনটা অনেকের ভাগ্যে ঘটে না।

তিনি তো কবিতা দিয়ে শুরু করেছিলেন। গম্ভীর বিষয়ে প্রবন্ধও লিখেছেন। কিন্তু ব্যক্তি শিবরামের অবস্থান ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুতে। একেবারে অন্য রকমের মানুষ, অন্য রকমের লেখা। কারও সঙ্গে মিলবে না। যদি কেউ প্রশ্ন করেন, তাঁর লেখার আকর্ষণটা কোথায়? তাহলে একটিই উত্তর বলতে পারব না। ভাল রাঁধুনি যেমন বলতে পারবেন না, ঠিক কীসের সঙ্গে কীসের সংযোগে এমন সুস্বাদু একটি পদ তৈরি হল।

তাঁর লেখার মধ্যে একজন মানুষকে দেখতে পাওয়া যেত। না সাধু, না গৃহী সম্পূর্ণ মুক্তমনের একজন। পরবর্তী কালে যখন তাঁর ঘনিষ্ঠ হয়ে পত্রিকায় লেখার সূত্রে একটা অন্য রকম সম্পর্ক হল, তখন দেখলুম মানুষটি যেন রাজাধিরাজ। একেবারে বন্ধনমুক্ত। নিজের জীবন নিয়েই কত রসিকতা।

গদ্যে তাঁর অভাবনীয় দখল ছিল। যার ফলে বাক্যকে এমন মোচড় দিতেন যা বিস্ময়কর। তাঁর প্রতিভার এটা একটা মস্ত দিক। সাফল্যের নব্বই ভাগ এরই উপর দাঁড়িয়ে আছে। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘পানিং’। তিনি বলতেন, মুক্তারামবাবুর মুক্ত আরামে আছি। জমিদারের ছেলে। পরিবার-পরিজনের কী হল তা কখনও বলতেন না। একটি প্রাচীন মেসবাড়ির একটি ঘরেই তাঁর সাম্রাজ্যের বিস্তার।

ছেলেবেলার আকর্ষণ দিয়ে লেখার শুরু। হঠাত্‌ একদিন তাঁর সঙ্গে সারাটা দিন কাটাবার সুযোগ হল। নানা রকম খেতে ভালবাসতেন। বন্ধুত্ব করেছিলেন কিশোরদের সঙ্গে।

আমার এক বন্ধুর মা অসাধারণ ভাল রান্না করতে পারতেন। একদিন খবর এল আমার এই বন্ধুর বাড়িতে তিনি দুপুরবেলা আসবেন, আহারাদি করবেন, থাকবেন অনেক ক্ষণ।

জমিদারের ছেলে। সংস্কারে সেই বীজটি রয়েছে। সিল্কের পাঞ্জাবি, সাদা ধবধবে ধুতি। উজ্জ্বল মূর্তি, মাথার চুল বিচিত্র কায়দায় আঁচড়ানো। ফর্সা টকটকে কপালের উপর ঝুলে আছে এক গুচ্ছ চুল। তিনি এলেন। বৈঠকখানায় বসলেন আমাদের নিয়ে। বড়দের খুব একটা পাত্তা দিলেন না।

একটি তাকিয়ায় ঠেসান দিয়ে আধশোয়া হয়ে মজলিসি ঢঙে শুরু হল নানা গল্প। শ্রোতা আমরা কয়েক জন অল্পবয়সি। মাঝে মাঝে বলতে লাগলেন, তোমাদের খুশি করতে পারলে খাওয়াটা জমবে। গন্ধ নাকে আসছে, প্রাণ বড় উতলা। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। ফর্সা মুখে বুদ্ধির আভা। একজন একশোভাগ ইন্টেলেকচুয়াল মানুষ।

সময় সময় কিছু কথা বুঝতে অসুবিধা হলেও বেশির ভাগই বেপরোয়া মজা। অশালীন নয়, ভাঁড়ামি মুক্ত। এই দেখার স্মৃতিটি রয়ে গেল। এর পর জীবনপথে ঘুরতে ঘুরতে দেশ পত্রিকার দফতরে তাঁকে পেলুম একেবারে অন্য ভাবে। এর আগে তিনি অনেক লিখেছেন। সে সব লেখা সোশ্যাল স্যাটায়ার। যার সঙ্গে অনেক তাবড় তাবড় ইংরেজ লেখকের তুলনা করা যায়। সেই সব লেখায় মজার কোনও গল্প থাকত না, থাকত আঘাত। কায়দাটি খুব সুন্দর। এক একটি কথাকে ধরে ধুনুরির কায়দায় তুলোধোনা করা। দেশ পত্রিকায় তখন তিনি লিখছেন, ‘ঈশ্বর পৃথিবী ভালবাসা’। কী সুন্দর নাম। এটিকে বলা যেতে পারে তাঁর আত্মজীবনী।

একটি কথা এখানে বলা উচিত, তিনি ছিলেন অতি অভিজ্ঞ, অতি সুদক্ষ এক সারথি। নিজের রথ কী ভাবে কোন কায়দায় চালাতে হবে তা তিনি জানতেন। এটা সম্ভব হয়েছিল তাঁর কোনও উচ্চ অ্যাম্বিশন ছিল না বলে। জীবনদর্শন ছিল এই রকম কয়েক দিনের জন্য এসেছি, আনন্দ করতে করতে চলে যাব। এই আনন্দটাও ছিল রিবাউন্স করা। তোমাদের আনন্দ আমার আনন্দ। তোমাদের সঙ্গে খানিক মজা করব। জীবন নিংড়ে এমন কোনও লেখা বের করতে চাই না যার মধ্যে কোনও ইজম আছে।

অথচ একসময়, জীবনের প্রথম দিকে তিনি রাজনীতি ঘেঁষা অবশ্যই ছিলেন। ঈশ্বর-পৃথিবীর ভালবাসা-র শুরুটাই করেছেন এইভাবে “প্রায় লেখককেই নিজের কবর খুঁড়তে হয় নিজের কলম দিয়ে। গায়কের মতো লেখকেরও ঠিক সময়ে থামতে জানা চাই। সমে এসে যথাসময়ে না থামলেই বিষম, সবটাই বিষময় হয়ে দাঁড়ায়। এমনকী কালজয়ী লেখকও যদি যথাকালে না থামেন তো জীবদ্দশাতে জীবন্মৃতের অন্তর্দশা তাঁর বিধিলিপি।

অবশ্য মহাকাল কারও কারও প্রতি একটু সদয়। সময় থাকতে থাকতেই তাঁদের নিরস্ত করেন, নিজের পুনরাবৃত্তির পথে আত্মহননের ভোগান্তি তাঁদের আর পোহাতে হয় না। যেমন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ, শরত্‌চন্দ্র। বিস্ময় থাকতে থাকতেই, রাখতে রাখতেই তাঁরা অস্ত গেছেন।”

এই দুটি প্যারা পড়লে বোঝা যায় গদ্যের ওপর তাঁর বাঁধুনিটা কত মজবুত ছিল। এই আত্মজীবনীতেই দেখতে পাওয়া যাবে সব লেখকই যে যে দুস্তর বাঁধা অতিক্রম করেন তাঁকেও তা করতে হয়েছে। যেমন, জীবনের প্রথম দিকে প্রবাসীতে একটি কবিতা পাঠিয়েছিলেন। এবার নিজেই লিখছেন, দিন কতক বাদে লেখাটা ফেরত এল। সঙ্গে চারুদার এক চিরকুট। এই হলেন শিবরাম। চারুদার চিরকুট। শব্দ যেন তাঁর সঙ্গে খেলা করত।

চিঠির বক্তব্য, কবিতাটি মন্দ হয়নি কিন্তু এটি প্রবাসীতে ছাপিয়ে তোমাকে উত্‌সাহ দিতে চাই না। সম্পাদক উপদেশ দিয়েছিলেন, এই বয়সে লেখাপড়া করে মানুষ হও আগে। তারপর না হয় লিখো। সঙ্গীত, কবিত্ব আর ল্যাজ কারও ভিতরে থাকলে তা আটকানো যায় না। তোমার মধ্যে যদি তা থাকেই তা প্রকাশ পাবেই। যথাকালে দেখা দেবে অযথা জোর করে অসময়ে তাকে টানাটানি করে বার করার কোনও দরকার নেই। শিবরাম লিখছেন, কথাগুলো আমার মর্মে মর্মে গাঁথা হয়েছিল অনেক দিন।

এই সময় একদিন দেশ পত্রিকার অফিসে একজন লেখক এসে জানালেন, সেন্ট্রাল এভিনিউ-এর ফুটপাথে শিবরামবাবু চিত হয়ে শুয়ে আছেন।

সম্পাদক শ্রদ্ধেয় সাগরদা আমাকে ডেকে বললেন, ওর তো আজ লেখা দিতে আসার কথা। ফুটপাথে শুয়ে আছে কেন! দেখে এসো তো।

আমি গিয়ে দেখি, ‘চাংওয়া’র সামনে তিনি আরামে শুয়ে আছেন। একটা হাত কপালে, আর একটা হাত সিল্কের পাঞ্জাবির পকেটে। একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছি। ডান হাতটা পাঞ্জাবির পকেটে। পকেট থেকে তেলেভাজা বের করে মাঝে মাঝে মুখে দিচ্ছেন।

এই বার আমি গিয়ে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞেস করলুম, এইখানে এইভাবে শুয়ে আছেন কেন! আমাকে নিচু হতে ইশারা করলেন।

ফিসফিস করে বললেন, চলন্ত বাস থেকে নামতে গিয়ে কোঁচা জড়িয়ে পড়ে গেছি। একটা ধেড়ে মানুষের পড়ে যাওয়াটা লজ্জার, না শুয়ে থাকাটা লজ্জার! আমি বললুম, এর উত্তর দেবেন সাগরদা। আপনি এখন উঠুন। সিল্কের পাঞ্জাবির পিছনে ধুলো। মাথার পেছনে ধুলো। আমি ঝাড়ার চেষ্টা করতেই বললেন, তুমি কিছুই জান না। এক সময় কলকাতার বাবুরা ভোরবেলায় খানা থেকে উঠে প্রাসাদে প্রবেশ করত। পাঞ্জাবির পেছনে ধুলো এটা একটা অ্যারিস্টোক্রেসি।

একদিন মুক্তারামবাবুতে গেছি। একটা সভায় যাওয়ার কথা। আমাকে বললেন, আমার এই তক্তাপোশে পা তুলে বসো। কারণ এর তলায় কী কী জন্তু জানোয়ার আছে তা আমি জানি না। ঘাঁটাইনি কোনও দিন। সাপও থাকতে পারে। আমি আমার ড্রেসিং রুম থেকে আসছি। জিজ্ঞেস করলুম সেটা কোথায়? বললেন, ওই যে রাস্তার ওপারে যে লন্ড্রিটা রয়েছে ওইটা। আমি ওখানে গিয়ে আমার এই ধুতি আর পাঞ্জাবিটা ছেড়ে দেব। আর যেটা কেচে এসেছে সেটা পরে চলে আসব। দুটো সেট। কোনও ঝামেলা নেই। বাক্সপ্যাঁটরা নেই। বুঝলে, একেই বলে আপনি আর কোপনি। জীবনটাকে হালকা করো। রেল কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখেছ? ট্রাভেল লাইট।

হাসির লেখার একটা অ্যানাটমি আছে। প্রথম কথা, ‘হাসির লেখা’ এই চিহ্নিত কথাটা আমার ভাল লাগে না। শ্রদ্ধেয় বিমলদা আমাকে বলেছিলেন, শোন! লেখা হাসিরও নয়, কান্নারও নয়। লেখা হল লেখা। তবে মজার লেখা উপভোগ্য লেখার একটা গঠন আছে। চরিত্রকেন্দ্রিক।

শিবরামবাবুর লেখায় আমরা সেই সব চরিত্রদের পাই। যেমন হর্ষবর্ধন, গোবর্ধন, পিসিলা, জহর ইত্যাদি। এই চরিত্রদের তিনি খেলিয়েছেন। গল্প অনেক ক্ষেত্রেই সামান্য। রস তৈরি হয়েছে কথার পিঠে কথা আর সিচ্যুয়েশনের মাধ্যমে। কত নাম করব। গন্ধচুরির মামলা, খোলাখুলি ইত্যাদি ইত্যাদি। কোনও দিন তাঁকে দেখিনি নিজের লেখা, বই আর প্রাপ্যের হিসাব রাখতে। সংস্কারটা যে ছিল জমিদারের আর ত্যাগীর। সেই জন্যই বইটির নাম প্রথমে ঈশ্বর, তারপর পৃথিবী এবং সব শেষে ভালবাসা। এই মানুুষটিকে আমরা চিরকাল ভালবাসতে বাধ্য।