Friday, August 10, 2018

হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার সূত্র


আজকে আমরা ব্রেকিং ব্যাডের হাইজেনবার্গকে নিয়ে কথা বলবো না। আমাদের হাইজেনবার্গ এমন ড্রাগডিলার নন, বরং অনেক বেশি দুর্দান্ত একজন বিজ্ঞানী ছিলেন। যিনি তার অনিশ্চয়তার বিখ্যাত সূত্র দিয়ে কোয়ান্টাম ফিজিক্সের মূল ভিত্তি গড়ে দিয়েছিলেন। আজকে আমরা সেই সূত্রটার পাশাপাশি হাইজেনবার্গের কথাও একটু জানবো।

মূল ব্যাপারে ঢোকার আগে আসো হাই স্কুলের জ্ঞানটাকে একটু ঝালাই করে নিই। কোয়ান্টাম ফিজিক্স এর বিষয়বস্তু হচ্ছে অতি ক্ষুদ্রের জগৎ। সেই অতি ক্ষুদ্রের জগৎ নিয়ে আগে অতি সংক্ষেপে একটু কথা সেরে নিই।

ডেমোক্রিটাস প্রায় ২০০০ বছর আগে বলেছিলেন, পরমাণুকে ভাঙ্গা সম্ভব না, এজন্যেই এটার নাম ছিলো a-tom বা বিভাজন অসম্ভব। আমরা অবশ্য পরমাণুকে ভাঙলাম। দেখলাম, নিউক্লিয়াসে প্রোটন আর নিউট্রন আছে। আর তার চারপাশে ঘুরছে ইলেকট্রন। বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড আর নিলস বোর বললেন, ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসকে কেন্দ্র করে ঘুরছে।

নিলস বোরের পরমাণু মডেল নিয়ে কাজ করতে করতে হাইজেনবার্গ একটা অদ্ভুত সমস্যার মুখোমুখি হন। বোর বলেছিলেন, ইলেকট্রনগুলো নিউক্লিয়াসের বাইরে কক্ষপথের মধ্যে শক্তিশেল বানিয়ে সেখানে অবস্থান করে। হাইজেনবার্গ সেই ইলেকট্রনকে লোকেট করতে গিয়ে দেখেন যে পুরোপুরি বের করা যাচ্ছে না। নিউক্লিয়াসের চারপাশে ইলেকট্রনের একটা ‘মেঘ’ টাইপের কিছু আছে। এখানে মেঘ বলতে আসলে ইলেকট্রনকে কোথায় পাওয়া যেতে পারে, সেই সম্ভাব্য এলাকাটাকে বুঝাচ্ছে।

অর্থাৎ নিউক্লিয়াস থেকে একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে একটা গোলক চিন্তা করো। এই গোলকের পৃষ্ঠের কোনো এক জায়গায় ইলেকট্রন আছে। কোথায় আছে কেউ জানে না। ইলেকট্রনকে যত নিখুঁতভাবেই সনাক্ত করো না কেন, এই অবস্থান কখনই ১০০ ভাগ শিওর করা যাবে না। হাইজেনবার্গ দেখলেন, ইলেকট্রনের অবস্থান যত নিশ্চিত হচ্ছি, এর বেগ সম্পর্কে ততই অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছি। আবার বেগ নিশ্চিত করতে গেলে অবস্থান অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে…

তাহলে আমরা দুই ধরনের অনিশ্চয়তা পেলাম – একটা অবস্থানের অনিশ্চয়তা, আরেকটা হলো ভরবেগের অনিশ্চয়তা। অবস্থানের অনিশ্চয়তাকে প্রকাশ করা হয় Δx দিয়ে, ভরবেগের অনিশ্চয়তাকে প্রকাশ করা হয় Δp দিয়ে।

হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা সূত্র বলছে, এই দুটো অনিশ্চয়তার গুণফল কখনই শূন্য হবে না। সহজ বাংলায় বললে, একটি কণার অবস্থান সম্পর্কে তুমি যতই শিওর হবে, তার ভরবেগ বা মোমেন্টাম সম্পর্কে ততই অনিশ্চিত হয়ে যাবে। আবার কণার মোমেন্টাম সম্পর্কে তুমি যতই শিওর হতে থাকবে, তার অবস্থান নিয়ে ততই অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। আরেকভাবে বললে একটা কণার অবস্থান আর ভরবেগ দুটোকে একইসাথে সম্পূর্ণ নিশ্চিত করে আমরা কখনই জানতে পারব না।

তো, আমরা জানলাম, মানটা কখনোই শূন্য হয় না, তাহলে কেমন হয়? গুণফলটা একটা পজিটিভ বা ধনাত্মক সংখ্যা হয়। পজেটিভ সংখ্যাটার ন্যূনতম মান হলো (এইচ/৪*পাই)। খেয়াল করে দেখো, গুণফলের ন্যূনতম মান বললাম এটাকে। তার মানে হলো, গুণফল এর চেয়ে বড়ও হতে পারে। আসো, তাহলে এই কথাগুলোকে সমীকরণের মধ্যে ফেলে দেখি, হাইজেনবার্গ এই সূত্রটিকে বর্ণনা করেছিলেন এভাবে –

Δx.Δp >= h/4pi

চলো, রিভিউ করি তথ্যগুলো —

ডেলটা এক্স হলো অবস্থানের অনিশ্চয়তা। ডেলটা পি হচ্ছে ভরবেগের অনিশ্চয়তা। এই দুই অনিশ্চয়তার গুণফল একটা ধ্রুবক সংখ্যা বা কনস্ট্যান্ট নাম্বার, অর্থাৎ h/4pi। অর্থাৎ, Δx আর Δp এর গুণফলকে 4pi দিয়ে গুণ করলে h পাওয়া যাবে। আর এটাই আমাদের প্ল্যাংক কনস্ট্যান্ট।

তা এই প্ল্যাংক কনস্ট্যান্টটা দিয়ে তাহলে কী বোঝায়? কোনো ফোটন বা ইলেকট্রনের শক্তি বা এনার্জি আর কম্পাঙ্ক বা ফ্রিকোয়েন্সির যে অনুপাত, সেটাই হলো প্ল্যাংক কনস্ট্যান্ট। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের জগতে প্ল্যাংক কনস্ট্যান্ট অনেকটা গণিতের পাই – এর মতন গুরুত্বপূর্ণ। এই সমীকরণ থেকে অনিশ্চয়তার ব্যাপারটা আরো স্পষ্ট হয়।

আচ্ছা, এভাবে দেখো ব্যাপারটা –

Δx আর Δp এর গুণফল যেহেতু সবসময় ধ্রুবক বা অপরিবর্তনীয়, ধরো সেই মানটা ১০০। কল্পনা করো, Δx আর Δp দুটোরই মান ১০।

তো, ১০ x ১০ = ১০০

এবার মনে করো, তুমি যে কোনো একটা অনিশ্চয়তা কমিয়ে আনছো। ধরলাম, Δp অর্থাৎ ভরবেগের অনিশ্চয়তাকে কমিয়ে ৫-এ আনলে। তাহলে, গুণফল ১০০ রাখার জন্য তোমাকে অবস্থানের অনিশ্চয়তাকে বাড়াতেই হচ্ছে, ১০ এর জায়গায় ২০ করে দিতে হচ্ছে।

২০ x ৫ = ১০০

এমন করে ভরবেগের অনিশ্চয়তাকে কমাতে কমাতে,

৫০ x ২ = ১০০

১০০ x ১ = ১০০

১০০০০০০ x .০০০১ = ১০০

একসময় গিয়ে তুমি খুব নিখুঁতভাবে একটা ফোটন বা ইলেকট্রনের ভরবেগ বের করতে পারলে। মানে প্রায় নিশ্চিত আর কি! তাহলে σp এর মান কত হবে? ভরবেগের অনিশ্চয়তা প্রায় নেই বললেই চলে, অর্থাৎ শূন্যের কাছাকাছি।

তাহলে গুণফল ১০০ রাখতে হলে অবস্থানের অনিশ্চয়তাকে কী করতে হবে? Δx হয়ে যাবে প্রকাণ্ড একটা সংখ্যা। তার মানে এই ফোটন বা ইলেকট্রন কোথায় আছে তা তুমি আর শিওর হতেই পারছো না, অনিশ্চয়তাটা অনেক বেশি।

আরেকটা উদাহরণ দেই –

ধরো, এক ঘণ্টাতে কোনো গাড়ি ৬০ কিলোমিটার যায়। কিন্তু নির্দিষ্ট একটি সেকেন্ডে (বা আরো ছোটো এককে) কতদূর যায়, সেটা নির্ধারণ করা মুশকিল। আবার গাড়িটা এখন ছুটছে, বুঝলাম। কিন্তু যখন ঠিক অমুক জায়গাটাতে আছে, তখন ভরবেগ কত? শূন্য তো না নিশ্চয়ই!

ধরা যাক, আমি চলন্ত গাড়িটার একটা ছবি তুললাম। ছবি দেখে তার অবস্থান সম্পর্কে তুমি একশোভাগ নিশ্চিত, কিন্তু ভরবেগ? ভরবেগ সম্পর্কে তুমি তখন ১০০% অনিশ্চিত! তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, সমীকরণ এলো কিভাবে?

আলাদা আলাদা করে দুটোই যে মাপা যায়, এটা তো বোঝা যাচ্ছে। যতবারই একই সাথে দুটোকে মাপা হচ্ছে, ততবারই এদের গুণফল ন্যূনতম h/4pi হচ্ছে। এভাবেই সমীকরণের সূত্রপাত।

এবার একটা থট এক্সপেরিমেন্ট তোমার জন্য। ধরা যাক, ভরবেগ তুমি একদম নিশ্চিত করে বের করতে পারলে। অর্থাৎ Δp = শূন্য। তাহলে সেই মুহূর্তে এই কণার অবস্থানের অনিশ্চয়তা কত? ভেবে উত্তর পেলে কমেন্ট সেকশনে লিখে ফেলো দেখি!

এই সূত্রটাকে অনেক সময় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আরেকটি ঘটনার সাথে গুলিয়ে ফেলা হয়, যার নাম দর্শক প্রভাব বা অবজার্ভার ইফেক্ট। দর্শক প্রভাব বলছে, তুমি যখনই কোন ইলেকট্রনকে ‘দেখবে’ বা সনাক্ত করবে, তখনই তার চেহারাসুরত বা আচরণ বদলে যাবে। বাবা-মা ঘরে ঢুকলে আমরা যেমন ভদ্র ছেলে-মেয়ে হয়ে যাই, অনেকটা সেরকম।

ইলেকট্রনকে যখন আমরা দেখি না, তখন সে তরঙ্গের মত আচরণ করে। ব্যাটাকে ‘দেখা’ মাত্রই তার ওয়েভ ফাংশন চলে গিয়ে পার্টিকেল বা “কণা” অবস্থা চলে আসে – এটাকে বলে অবজার্ভার ইফেক্ট বা দর্শকের প্রভাব। এই ঘটনার সাথে অনিশ্চয়তার সূত্রকে গুলিয়ে ফেললে হবে না।

অনিশ্চয়তার সূত্র যে সমীকরণ মেনে চলে, এটা অতি ক্ষুদ্র কণার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। কেউ দেখুক আর না দেখুক, এই অনিশ্চয়তা সব সময়ই থাকবে, যদি কণাটা ইলেকট্রন এর মত ছোটো কোনো কণা হয়। কোয়ান্টাম ফিজিক্সের চরম মজার কিছু ঘটনার মধ্যে এটা একটা। কিন্তু এটা হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নয়।

ওয়ারনার হাইজেনবার্গ জন্মগ্রহণ করেন ১৯০১ সালের ৫ ডিসেম্বর, জার্মানির উর্জবার্গে। তিনি ১৯২৭ সালে, মাত্র ২৬ বছর বয়সে তার বিখ্যাত অনিশ্চয়তা নীতিটি প্রকাশ করেন! ১৯২৮ সালে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন হাইজেনবার্গকে ফিজিক্সে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত করেন, যদিও সে বছর তিনি নোবেল পাননি। পেয়েছেন ১৯৩২ সালে।

তিনি যে সময়ে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এই গবেষণাগুলো করছিলেন, তখন ইউরোপে তথা জার্মানিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল শুরু হয়েছিল। পুরো জার্মানি জুড়ে নাতজি বাহিনীর প্রতিপত্তি, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আর বিজ্ঞানীরাও অনেকে জার্মান জাতির বিশুদ্ধতার তত্ত্বে বিশ্বাস করতো, আর ইহুদীসহ অন্যান্য জাতিদের ঘৃণা করতো।

হাইজেনবার্গের গবেষণার সাথে আইনস্টাইন আর ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের কাজ জড়িয়ে ছিল। আইনস্টাইন ছিলেন ইহুদি। হাইজেনবার্গ নিজে জার্মান নাতজিবাদে বিশ্বাস করতেন না, অন্য জাতের মানুষদের বিশেষ করে বিজ্ঞানীদের নিজের সমান ভাবতেন। এজন্য নাতজি সংগঠন SS তার পেছনে লাগে।

১৯৩৫ সালে, জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর আর্নল্ড সমারফিল্ড অবসর গ্রহণ করেন। ফলে ওই পদ পূরণ করার জন্য প্রথম পছন্দ হিসেবে হাইজেনবার্গের নাম দিয়ে বিভাগ থেকে তিনজনের একটি তালিকা বানানো হয়। তখন পদার্থবিজ্ঞানের জাতীয়তাবাদী দল “ডয়েশে ফিজিক” হাইজেনবার্গের বিরোধিতা করে। ডয়েশে ফিজিক আইনস্টাইনের সকল কাজ এবং আধুনিক তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের (যেমন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের) উপর “ইহুদি পদার্থবিজ্ঞান” তকমা লাগিয়ে এগুলোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল।

ওরা কিছুতেই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম অগ্রদূত হাইজেনবার্গকে ওই পদে বসাতে রাজি হয়নি। ওদের সমর্থকদের কাছে হাইজেনবার্গকে বারবার আক্রমণের শিকার হতে হয়। তিনি আইনস্টাইনকে এবং তার আপেক্ষিক তত্ত্বকে সমর্থন করেছিলেন বলে ১৯৩৭ সালে SS এর সাপ্তাহিক পত্রিকায় তাকে ফিজিক্সের “হোয়াইট জিউ বা শ্বেতাঙ্গ ইহুদি” বলে গালি দিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখেন নোবেল জয়ী পদার্থবিদ ইয়োহানেস স্টার্ক। সেখানে তাকে “গায়েব” করে দেওয়ার ইচ্ছাও ব্যক্ত করা হয়। এতো ধরনের হুমকি সত্ত্বেও নিজের নীতি থেকে সরে আসেননি হাইজেনবার্গ। উল্টো প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন সম্পাদকীয় লিখে।

মজার ব্যাপার হল, অতিষ্ঠ হয়ে একসময় হাইজেনবার্গের মা ফোন করেন ss এর প্রধান হেনরিখ হিমলারের মাকে এবং অনুরোধ করেন যেন তার ছেলের প্রতি এসব আক্রমণ বন্ধ হয়। ১৯৩৮ সালে, হিমলার নিশ্চিত করেন যেন হাইজেনবার্গের উপর আর কোনো আক্রমণ না আসে। তবে দুঃখের বিষয় হল, সমারফিল্ডের স্থানে হাইজেনবার্গকে আর বসানোই হয়নি। একাডেমিক স্ট্যান্ডার্ডের তোয়াক্কা না করে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে উইলহেম মুলারকে বানানো হয়েছিলো বিভাগের প্রধান। তিনি না ছিলেন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী, না কোনো ফিজিক্স জার্নালে ছিল তার পাব্লিকেশন।

আরেকটা মজা হল, যখন হাইজেনবার্গের উপর তদন্ত করতে SS তিনজন তদন্তকারীকে পাঠায়, তখন তারা হাইজেনবার্গের ভক্ত হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি ডয়েচে ফিজিকের অনর্থক ঘৃণার বিরুদ্ধে হাইজেনবার্গের অবস্থানকেও তারা সমর্থন জানায়।

মহানএই বিজ্ঞানী কিডনি এবং গল ব্লাডারের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৭৬ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি একজন সফল পিয়ানোবাদকও ছিলেন।

অনিশ্চয়তার সূত্রের জনক, ব্যক্তিগত জীবনে নীতিবোধের ব্যাপারে কিন্তু হাইজেনবার্গ অনিশ্চিত ছিলেন না। আমাদের বিজ্ঞানী হাইজেনবার্গ ব্রেকিং ব্যাডের ড্রাগডিলার হাইজেনবার্গের মতো ডেঞ্জারাস কেউ ছিলেন না। কিন্তু তার সাহস নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।

অনিশ্চয়তার বিখ্যাত সূত্রের জনক নিজের নৈতিকতা ও মনুষ্যত্বের নিশ্চয়তায় পুরোপুরি কনস্ট্যান্ট ছিলেন।

 

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/heisenberg_uncertainty_principle/

Thursday, August 2, 2018

E = mc2 কী এবং কেন


[ E = mcআইনস্টাইনের সবচেয়ে বিখ্যাত এবং সর্বাধিক পরিচিত সমীকরণ। সমীকরণটিতে ভর ও শক্তির মধ্যেকার একটি পারস্পরিক সম্পর্ক তুলে ধরা হয়েছে। আজ ১৪ই মার্চ অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের জন্মদিন উপলক্ষে সম্প্রতি প্রকাশিত আমার “আপেক্ষিকতার তত্ত্বকথা” বইটি থেকে “ভর-শক্তি সম্পর্ক” অংশটি ভিন্ন নামে বিজ্ঞানযাত্রার পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে দেয়া হলো ]

বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের একটি উল্লেখযোগ্য ফলাফল হচ্ছে ভর ও শক্তিকে অভিন্নরূপে দেখা। ভরের সাথে যেমন শক্তি জড়িত, তেমনি শক্তির সাথে ভর জড়িত। অর্থাৎ আপেক্ষিকতার তত্ত্বে  ভর ও শক্তিকে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ বলে প্রমাণ করা যায়। আপেক্ষিকতার তত্ত্ব যেহেতু আপেক্ষিক বেগে চলমান বস্তুর মধ্যেকার বৈশিষ্ট্য পর্যালোচনা সাপেক্ষে সকল ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সেহেতু ভর-শক্তি সম্পর্কটিও  আমরা আপেক্ষিক বেগের আলোচনার মধ্য দিয়েই তুলে আনার চেষ্টা করবো। একটি ট্রেন যখন হুইসেল বাজাতে বাজাতে তোমার দিকে অগ্রসর হতে থাকে তখন সেই শব্দের তীব্রতা তোমার নিকট অনেক বেশি মনে হয়। আবার যখন তোমাকে অতিক্রম করে চলে যায় তখন শব্দের তীব্রতাও অনেক কমে আসে। আমরা জানি, শব্দ চলে তরঙ্গের আকারে। ট্রেন যখন হুইসেল বাজাতে বাজাতে তোমার দিকে অগ্রসর হতে থাকে তখন সেই শব্দের তরঙ্গদৈর্ঘ্যগুলো ঘন সন্নিবিষ্ট হয়ে তোমার কানে প্রবেশ করে। আবার যখন তোমাকে অতিক্রম করে দূরে চলে যায় তখন ঠিক বিপরীত ঘটনা ঘটে। ঘটনাটির গাণিতিক ব্যাখ্যা দেন বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান ডপলার। তাই তাঁর নামানুসারে ঘটনাটিকে ডপলার ক্রিয়া বলা হয়। ডপলার ক্রিয়া কেবল শব্দের ক্ষেত্রেই নয়, আলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ইতিমধ্যে আমরা জেনেছি, আলো এক প্রকার তরঙ্গ। দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য একেক রঙের জন্য একেক রকম। লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে বেশি বেগুনী আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য সবচেয়ে কম।



ক্রিশ্চিয়ান ডপলার ও ডপলার ক্রিয়া




একটি আলো যখন আপেক্ষিক গতিতে দূরে সরে যাবে তখন সেই উৎসের আলো তোমার কাছে লাল এবং যখন কাছে আসতে থাকবে তখন নীলাভ মনে হবে। নীল আলোর কম্পাঙ্ক বেশি, তাই নীল আলোর শক্তি, লাল আলোর তুলনায় বেশি। একটি স্পেস শীপে চড়ে যদি একজন নভোচারী খুব বেশি বেগে সূর্য অভিমুখে যেতে থাকে তবে আপেক্ষিকতার নীতি অনুসারে নভোচারীর কাছে মনে হবে যেন সূর্যই তার দিকে সেই বেগে অগ্রসর হচ্ছে। ফলে উপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হবে যেন সূর্য থেকে নির্গত আলোকরশ্মি তড়িৎচৌম্বক বর্ণালীতে নীলের দিকে সরে গেছে। আবার যখন তিনি সূর্যকে অতিক্রম করে যাবেন তখন মনে হবে যেন সূর্য থেকে নির্গত আলোকরশ্মি তড়িৎচৌম্বক বর্ণালীতে লালের দিকে সরে গেছে। এর অর্থ, সূর্যকে অনেক



বেশি শক্তি ব্যয় করতে হচ্ছে। কিন্তু সূর্যের শক্তিতো সীমিত। তাহলে এই অতিরিক্ত শক্তি আসে কোথা থেকে। এর একটা কারণ হতে পারে সূর্যের আপেক্ষিক গতি (নভোচারী সাপেক্ষে)। এখানেও সমস্যা আছে। সূর্য তখনই তার শক্তি ছেঁড়ে দিবে যখন গতি মন্থর হতে থাকবে। নভোচারী তো চলছে সমবেগে, অর্থাৎ গতি মন্থর করার কোনো প্রশ্নই আসে না। সূর্যের গতি যেহেতু নভোচারী সাপেক্ষে সেহেতু সূর্য নিজেও তার গতি কমাতে পারছে না। তাহলে উপায়? হ্যা, একটা উপায় অবশ্য আছে বটে এবং সেটা হচ্ছে- সূর্যের ভর কমিয়ে। সূর্য যেহেতু আপেক্ষিক বেগ কমাতে পারছে না তাই তার অতিরিক্ত শক্তি আসছে সূর্যের ভর থেকে। আমরা জেনেছি, গতিশীল বস্তুর বেগ যতো বাড়ে ভরও ততো বাড়ে। এক্ষেত্রে সূর্য শক্তি ক্ষয় করছে আবার গতিও কমছে না। তাই বলা হচ্ছে, সেই শক্তি আসছে স্বয়ং সূর্যের ভর থেকেই। সেটা কি করে সম্ভব? কারণ পৃথিবী কাঠামো থেকে দেখলে সূর্যকে স্থির বলেই মনে হয়। অথচ আমরা পুরো কাহিনীটা তৈরি করেছি নভোচারী সাপেক্ষে সূর্যকে গতিশীল বিবেচনা করে। আসলে আপেক্ষিকতার নীতি থেকে বলা যায়, যে ঘটনা নভোচারীর জন্য বৈধ, সেটা পৃথিবীতে স্থির সকলের জন্যই বৈধ। সূর্য আলো বা তাপ উৎপন্ন করে নিউক্লিও ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে এবং এতে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় হাইড্রোজেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকেও সূর্য ও অন্যান্য তারার শক্তির উৎস সম্পর্কে জানা যায়নি। তখন মনে করা হতো, সূর্যের শক্তির উৎস হচ্ছে মহাকর্ষ। আইনস্টাইনের ভর-শক্তি সম্পর্কের পথ ধরে জানা সম্ভব হলো যে, আলো ও তাপশক্তি উৎপন্ন হয় ফিউশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এবং এতে সূর্য তার ভর হারায়। সূর্য প্রতিনিয়ত তার ভর হারাচ্ছে শক্তিতে রুপান্তরনের মাধ্যমে এবং গণনা করে দেখা গেছে, সূর্য প্রতি সেকেন্ডে চার মিলিয়ন টন ভর হারাচ্ছে। তাপকে আমরা বরাবর শক্তি বলেই জেনে এসেছি। তবে এখন একথা মানতেই হবে যে, তাপের সাথেও ভর জড়িত।  একটি বৈদ্যুতিক ইস্ত্রিকে গরম করলে কিছুটা হলেও এর ভর বেড়ে যায়। একটি জগে গরম পানি ঢাললে সেই জগের ভরও বৃদ্ধি পায় যদিও সেটা পরিমাপযোগ্য হবে না। আইনস্টাইন চিন্তা করলেন, শক্তির সাথে ভর জড়িত থাকলে ভরের সাথে শক্তি জড়িয়ে থাকবে না কেন। আর এই চিন্তা থেকেই তিনি তাঁর সেই বিখ্যাত সিদ্ধান্তটি দিলেন- ভর আছে এমন সকল সাধারণ বস্তুই আসলে একেকটা জমাটবদ্ধ শক্তি। সেই হিসেবে তুমি নিজেই কিন্তু শক্তির আধার এবং সেই শক্তির পরিমাণ কতো সেটা জানলে অবাক হয়ে যাবে। তোমার ভরকে আলোর বেগের বর্গ দ্বারা গুণ করো। তাহলেই পেয়ে যাবে। ১৯৩২ সালে ককরফট ও আর্নেষ্ট ওয়ালটন নামক দু’জন বিজ্ঞানী তাঁদের তৈরি করা বৈদ্যুতিক ত্বরক যন্ত্রে একটি প্রোটন দ্বারা একটি লিথিয়াম পরমাণুকে আঘাত করান। এর ফলে উক্ত পরমাণু দুটির নিউক্লিয়াস একে অপরের সাথে মিলে গিয়ে হিলিয়ামের দুটি নিউক্লিয়াস গঠন করে। হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস দুটির ভর পরিমাপ করে দেখা গেলো এদের সম্মিলিত ভর, প্রোটন ও লিথিয়াম পরমাণুর ভরের তুলনায় সামান্য কম। তোমরা তো জানো যে, ভর বা শক্তির ধ্বংস বা বিনাশ নেই। তাহলে সেই সামান্য ভরটুকু গেলো কোথায়? বলা হয়, এই হারানো ভর হিলিয়াম নিউক্লিয়াস দুটিকে গতিশক্তি প্রদানে ব্যয় হয়েছে। আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম সূর্যের শক্তি আকারে ভর হারানোর উদাহরণ দিয়ে। এবার সহজ গাণিতিক হিসাব নিকাশের সাহায্যে পুরো বিষয়টি গণনা করে দেখানো যাক। আগেই বলেছি, সূর্যের তাপকেন্দ্রিন বিক্রিয়ার মূল কাঁচামাল হচ্ছে হাইড্রোজেন। এই প্রক্রিয়ায় দুটি নিউট্রন ও দুটি প্রোটন মিলিত হয়ে হিলিয়াম উৎপন্ন হয়। নিউট্রন, প্রোটন ও হিলিয়ামের ভর বিজ্ঞানীরা হিসাব করে বের করেছেন।

২টি প্রোটনের ভর = ২ × ১.০০৮১৫ এ এম ইউ

= ২.০১৬৩০ এ এম ইউ।

[পারমাণবিক কণিকাগুলোর ভর এতোই নগণ্য যে এদেরকে কেজি বা গ্রামে প্রকাশ করা কঠিন। এতে অনেক বড় বড় সংখ্যার আবির্ভাব ঘটে। এ কারণে কণিকার ভর প্রকাশ করা হয় এ এম ইউ ইউনিটে। এ এম ইউ কে বিস্তৃত করলে হয় অ্যাটমিক মাস ইউনিট। ১ এ এম ইউ = ১.৬৬ × ১০-২৪ গ্রাম]

২টি নিউট্রনের ভর = ২ × ১.০০৮৯০৮ এ এম ইউ

= ২.০১৭৯৬ এ এম ইউ।

অতএব, ২টি প্রোটনের ভর + ২টি নিউট্রনের ভর = ৪.০৩৪২৬ এ এম ইউ

হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের ভর =  ৪.০০৩৮৭ এ এম ইউ

দেখা যাচ্ছে, হাইড্রোজেন যখন হিলিয়ামে পরিণত হয় তখন (৪.০৩৪২৬ – ৪.০০৩৮৭) = ০.০৩০৩৯ এ এম ইউ ভর কম থাকে। আবার ০.০৩০৩৯ এ এম ইউ = ২৮.৩ মেগাভোল্ট (১ এ এম ইউ = ৯৩১.১ মেগাভোল্ট)। অর্থাৎ ০.০৩০৩৯ এ এম ইউ পরিমাণ ভর থেকে ২৮.৩ মেগাভোল্ট এর বিপুল পরিমাণ শক্তি আলো ও তাপরূপে বেরিয়ে যায়। সূর্যের ভেতরে যেটা ঘটে সেটাকে বলা হয় নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া। এই বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী পরমাণুর নিউক্লিয়াসগুলো পরস্পরের সাথে জুড়ে গিয়ে নতুন পরমাণু উৎপন্ন করে। এ ধরণের আরো একটি প্রক্রিয়া আছে যেটাকে বলা হয় নিউক্লিয়ার ফিশন বিক্রিয়া। এক্ষেত্রে একটি কণা দ্বারা অপর একটি পরমাণুর (আইসোটোপ) নিউক্লিয়াসকে বিদীর্ণ করা হয়। এখানেও কিছুটা ভর, শক্তি হিসেবে বের হয়ে যায়। কিন্তু সেই কিছুটা ভরকে যদি আলোর বেগের বর্গ দ্বারা গুণ করা হয় তবে সেই শক্তির পরিমাণ হয় ব্যাপক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যে ধ্বংসলীলা সাধিত হয়েছে তার কারণও এই শক্তি। হিরোশিমাতে যে বোমাটি নিক্ষেপ করা হয়েছিলো সেটাতে ব্যবহার করা হয়েছে ইউরেনিয়াম ২৩৫ আইসোটপ এবং নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত বোমায় ছিলো প্লুটোনিয়াম ২৩৯ আইসোটপ। ইউরেনিয়াম ২৩৫ আইসোটপকে আঘাত করা হয় একটি নিউট্রন দ্বারা। এতে দুটি নতুন পরমাণু ও তিনটি নিউট্রন উৎপন্ন হয়। নতুন পরমাণুর মোট ভর ইউরেনিয়ামের থেকে কম থাকে। এ সময় দুটি নিউট্রন অকেজো হয়ে যায় বা ইউরেনিয়াম ২৩৮ আইসোটপ দ্বারা গৃহীত হয়। বাকি যে নিউট্রনটি থাকে সেটা আবার ইউরেনিয়াম ২৩৫ আইসোটপকে আঘাত করে আরো শক্তি উৎপন্ন করতে থাকে। এভাবে রিয়্যাকশন চলতেই থাকে। সেজন্য এই ধরনের বিক্রিয়াকে চেইন রিয়্যাকশনও বলা হয়। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিক্ষিপ্ত পারমাণবিক বোমায় প্রায় ১,২৯,০০০ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।



যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৫ সালের ৬ আগষ্ট হিরোশিমায় (১) ও ৯ আগষ্ট নাগাসাকিতে (২) দুটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়


উৎস ঃ https://bigganjatra.org/e-mc2-%E0%A6%95%E0%A7%80-%E0%A6%8F%E0%A6%AC%E0%A6%82-%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%A8/



Wednesday, August 1, 2018

বাংলার প্রথম পত্রিকা ও পৃথিবীর প্রথম মহামারী ওলাওঠা - কুলদা রায়


প্রথম বাংলা সংবাদপত্র সমাচার দর্পন প্রকাশিত হয় ১৮১৮ সালের ২৩ মে। সম্পাদক ছিলেন জন ক্লার্ক মার্শম্যান। কয়েকজন বাঙালি পণ্ডিত সংবাদপত্রটিতে লিখতেন। শুরুতে সমাচার দর্পন সাপ্রাহিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হলেও পরে সপ্তাহে দুদিন প্রকাশিত হত।

জয়গোপাল তর্কালঙ্কার বাংলা সংবাদ রচনা ও সঙ্কলনে সম্পাদকের সহায়ক ছিলেন বলে তা উন্নতমানের সংবাদপত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সমর্থ হয়েছিল। সংবাদ, ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক বিষয়াদির বিবরণ এই পত্রিকায় স্থান পেত। সে আমলে প্রগতিশীল পত্রিকা হিসেবে এর বিশেষ গুরুত্ব ছিল। ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত পত্রিকাটি অস্তিত্ব রক্ষা করেছিল। তবে পরেও কয়েকবার এই পত্রিকা পুনঃপ্রকাশিত হয়েছিল।


সমাচারদর্পনের মত সাময়িকপত্রের মধ্যে দিয়ে শিক্ষিত বাঙালি প্রথম গদ্যরচনার রস গ্রহণ করতে শেখে। তখনকার বাংলা সাহিত্য বলতে সবই পদ্য রচনা ছিল। সমাচারদর্পনের প্রকাশ হবার ফলে পাঠকের সংখ্যা বাড়তে লাগল এবং আরো সাময়িকপত্রের চাহিদা বৃদ্ধি পেল। এর ফলে বাংলা গদ্য সাহিত্যের ভবিষ্যৎ উন্নতির পথও খুলে গেল।

সমাচারদর্পনের জনপ্রিয়তার ফলে আরো কয়েকটি সাময়িক ও সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। এদের মধ্যে প্রধান ছিল সংবাদকৌমুদী (১৮২১) এবং সমাচারচন্দ্রিকা (১৮২২)। ১৮৪১ সালে সমাচার দর্পন বন্ধ হয়ে গেলেও পরে আরো কিছুদিন অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

এই সমাচার দর্পন পত্রিকা প্রকাশের ৬ মাস পরে পত্রিকাটিতে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদের লেখা প্রকাশিত তথ্য অনুসারে জানা যায় যশোরে ওলাওঠা রোগের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব হয়েছে। শত শত লোক মারা যাচ্ছে। রোগটি সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে। দেড় বৎসর যাবৎ এই রোগটি মহামারি রূপে দেখা দিলেও তার কারণ অজানা। এই ওলাওঠা রোগটিই কলেরা রোগ নামে পরিচিত।

কলেরার ইতিহাস


পৃথিবীতে প্রথম কলেরা রোগটির প্রাদুর্ভাব বঙ্গদেশের ঘটে। সেটা গঙ্গানদী থেকে উৎপত্তি হয়েছে বলে স্বাস্থ্য-ইতিহাসবিদগণ মনে করেন। মহামারীরূপে পৃথিবীতে প্রথম কলেরার প্রাদুর্ভাব ঘটে ১৮১৭ সালে। ১৯২৪ সাল পর্যন্ত এটা এটা লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুর কারণ ঘটায়। ১০ হাজার বৃটিশ সৈন্যো মারা যায়। এর কারণ হিসেবে চরম দরিদ্রতা, দূষিত পানীয় জলকে দায়ী করা হয়।
বঙ্গদেশ থেকে কলেরা রোগটি সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। সেখান থেকে ১৮১৭ সালেই বানিজ্য স্থল ও জলপথে দক্ষিণ এশিয়া, চীন, জাপান, মধ্যপ্রাচ্য ও রাশিয়াতে যায়। ১৮২৭ থেকে ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয়বারের মত কলেরা মহামারী রূপে আক্রমণ করে এই সমস্ত দেশে। এবং ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায়ো এর বিস্তার ঘটে। এই সময়কালে আমেরিকাতে ১০ লক্ষ মানুষ মারা যায় কলেরাতে।
এরপর ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় ভয়াবহভাবে কলেরার বিস্তার ঘটে।১৮৩৯ থেকে ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত কলেরার মহামারীতে আক্রান্ত হয় উত্তর আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা। প্রথমবারের মতো ব্রাজিলে আক্রমণ ঘটে।

১৮৬৩-১৮৭৫ পর্যন্ত সাব-সাহারা অঞ্চলে কলেরা আঘাত হানে।

১৮৮১-১৮৯৬ পর্যন্ত পঞ্চম এবং ১৮৯৯-১৯২৩ সাল পঞ্চম ও ষষ্ঠবারের মত পৃথিবীব্যাপী কলেরা মহামারী হয়ে কোটি কোটি মানুষের জীবন হরণ করে। মিশর, আরব, পারস্য, ভারত ও ফিলিপাইনে কলেরার আক্রমণ হয় অন্যান্য দেশের তুলনায় ভয়ঙ্কর। ১৮৯২ সালে জার্মানী ও ১৯১০-১৯১১ সালে নেপলসে কলেরার আঘাত ছিল বেশি ধ্বংসাত্মক। ১৯৬১ সালে ইন্দোনেশিয়া থেকে যে কলেরা পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে তা ছিল সর্বশেষ প্রাণঘাতী আক্রমণ। ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে মারা যায় ১ লক্ষ মানুষ। ১৯৬৩ সালে পূর্ব পাকিস্থানে কলেরা মারাত্মকভাবে দেখা দেয়। ১৯ শতকে সারা পৃথিবীতে ১০ কোটি মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ১৮৪৭-১৮৫১ সালে রাশিয়াতে মারা যায় ১০ লক্ষ মানুষ।.১৯০০-১৯২০ সালে ভারতে মারা যায় আশি লক্ষ মানুষ।

১৮৮৩ সালে বিজ্ঞানী কক (Koch) Vibrio cholerae জীবাণু আবিষ্কার করেন। এটি একটি কমা (,) আকৃতির ব্যাকটেরিয়া যা কলেরা আক্রান্ত রোগীর মলে দূষিত পানির মাধ্যমে ছড়ায়। শরীরের অভ্যন্তরে প্রবেশের পর এ জীবাণু ক্ষুদ্রান্ত্রের গায়ে লেগে যায় এবং সেখানে দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে। এ সময় জীবাণু বিষ (Toxin) উৎপন্ন করে। এ বিষ রিসেপ্টরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গ্যাংলিওসাইড (ganglioside) নামে ক্ষুদ্রান্ত্রের ভিলাইগুলিতে অবস্থান করে। এর ফলে জীবাণুর বসবাসের স্থানে ব্যাপকভাবে এডেনাইলেট সাইক্লেজ এনজাইমের (adenylate cyclase) কার্যক্রম বৃদ্ধি পায়। এ এনজাইম মূলত সাইক্লিক এএমপি (cAMP) তৈরির জন্য দায়ী যেটি ভয়ঙ্করভাবে অন্ত্রের নাড়াচাড়া বৃদ্ধি করে যার ফলে প্রচুর পাতলা পায়খানা হয়। প্রাথমিকভাবে কলেরা রোগে দেহের প্রচুর তরল পদার্থ ও Eletrolytes হারিয়ে যায়। কলেরা আক্রান্ত রোগী একদিনেই ৩০ লিটারের মতো তরল পদার্থ (মল) ত্যাগ করতে পারে। পানি শূন্যতায় মারা যায়।





বাংলার কলেরার দিনগুলোর 

সামাজিক রাজনৈতিক অবস্থার একটুখানি


সেই কালপর্বে ১৭৫৬ সালে পলাশীর আম বাগানে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ইংরেজরা পরাজিত করে। নয় বছর পরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলা-বিহার-উড়িশ্যার দেওয়ানী লাভ করে। তারা কর আদায়ের সুবিধার্থে বাংলাকে কয়েকটি বিভাগে ভাগ করে। মোগলদের আমলে যারা কর আদায় করতেন তাদের মাধ্যমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী নানা কায়দায় বেশি বেশি কর আদায়ে সর্বশক্তি নিয়োগ করে।

১৭৭০ সালে বাংলায় ভয়াবহ মন্বন্তর বা দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। অনাহারে, অপুষ্টিতে, রোগে, শোকে তখনকার বাংলার এক তৃতীয়াংশ লোক মারা যায়। মৃত লোকদের জমির খাজনা প্রতিবেশীর কাছ থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী আদায় করার নীতি গ্রহণ করে। সে সময়কার এক তৃতীয়াংশ লোক মন্বন্তর ও ইস্ট কোম্পানীর ভয়ে বনে জঙ্গলে পালিয়ে যায়। এদের অধিকাংশ বাঘের পেটে, কুমিরের পেটে মারা যায়। বাংলায় মাত্র এক তৃতীয়াংশ মানুষ মাত্র বেঁচে ছিল। এই দুর্ভিক্ষের ফল বাংলার মানুষকে বয়ে বেড়াতে হয় বহুকাল ধরে।

এই দুর্ভিক্ষের মধ্যেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী পাঁচশালা পরিকল্পনা করে ১৭৭২ সালে। সে বছরই বাংলার গণজাগরণের প্রাণপুরুষ রাজা রামমোহন রায় জন্মগ্রহণ করেন। এবং এই বছর থেকেই কোলকাতায় ইংরেজরা তাদের অনুগত ধনী বাঙালীদেরকে বাবু নামে ডাকতে শুরু করে। ধনী মুসলমানদেরকে বলা হতে থাকে সাহেব।

১৭৯৩ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর মাধ্যমে নব কলেবরে জমিদারী পদ্ধতি চালু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনী। । বাংলাদেশে সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এ সময়কালে দেশজুড়ে ছিল ঘোর বিশঙ্খলা এবং কোম্পানি ও তার ইজারাদার জমিদার প্রভৃতির বিরুদ্ধে অসন্তোষ। এ অসন্তোষ দেবী সিংহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, চোয়াড় বিদ্রোহ, বাঁকুড়ার বিদ্রোহ এবং ফকির সন্যাসীর বিদ্রোহ ঘটে।

১৭৯৩ সালে উইলিয়াম কেরি ভারতে আগমন করেন। ১৮৮০ সালে কোলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপিত হয়। উইলিয়াম কেরি শ্রীরামপুরে খ্রিস্টান মিশনে চলে আসেন। এই সময় থেকেই বাংলা গদ্যের প্রচলন করার চেষ্টা করা হয়।

১৮১৮ সালে বাংলায় যে ওলাওঠা বা কলেরা রোগটি ছোবল মারতে শুরু করে তখন দ্বারকানাথ ঠাকুরের বয়স মাত্র চব্বিশ বছর। তার পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বয়স তখন মাত্র এক বছর। এর দু বছর পরে বাংলা গদ্যের জনক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জন্মেছেন মহামারীর মধ্যে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নামে আধুনিক ঔপন্যাসিকে্র জন্ম হয় ঠিক এর ২০ বছর পর। মহামারীর ৪৭ বছর পরে তিনি দূর্গেশনন্দীনী নামে প্রথম উপন্যাস লেখেন। তার পরের বছরই লেখেন ফকির-সন্নাসীর বিদ্রোহকালের সময় নিয়ে উপন্যাস কপালকুণ্ডলা। এই উপন্যাসে মন্বন্তর-উত্তরকালে বিপর্যস্ত বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার চিত্র পাওয়া যায়।

সমাচার দর্পনের ভাষা সহজ। তখনো যতি চিহ্নের ব্যবহার শুরু হয়নি। শুধু দাঁড়ি (।) চিহ্ন দেখা যায় একটি স্তবকের পরে। তবে পড়তে কষ্ট হয় না।


সমাচার দর্পন পত্রিকায় ১৮১৮ সালে যে কলেরা বা ওলাওঠার খবর পাওয়া যাচ্ছে, এই সংবাদগুলোর ভাষার দিকে খেয়াল করলে বোঝা যায় বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডে কলেরা-পীড়িত মানুষের অবস্থা ছিল অতি ভয়াবহ। মানুষ মরছে চিকিৎসার অভাবে। ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছে। এ এক ভয়ঙ্কর অসহায় পরিস্থিতি।

সে সময়কালের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ ছিল। কোনো টেলিফোন, টেলিগ্রাফ তখনো আসেনি। ফ্যাক্স, ইমেইল চিন্তার অতীত। প্রতিটি এলাকায় সংবাদদাতা নিয়োগের ব্যবস্থা ছিল না। ফলে প্রকৃত অবস্থার সামান্য বিবরণীই সংবাদপত্রে এসেছে। পরিস্থিতি ছিল আরো ভয়াবহ।
১৮৮০ সাল থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত লাতিন আমেরিকায় কলেরার যে মহাদূর্যোগ হয়েছিল, সেটা নিয়ে কলাম্বিয়ার ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ আশির দশকে লাভ ইন দি ডেজ অফ কলেরা উপন্যাস লেখেন। বইটি স্প্যানিশ ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৫ সালে। ১৯৮৮ সালে ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়।
বাংলায় যে কলেরার মহাদূর্যোগ হয়েছিল তা নিয়ে এখনো কোনো উল্লেখযোগ্য উপন্যাস রচিত হয়নি।


সমাচার দর্পনে প্রকাশিত

 সংবাদগুলোর কয়েকটি এখানে দেওয়া হল--


২১ নবেম্বর ১৮১৮। ৭ অগ্রহায়ণ ১২২৫।

যশোহর।-- যশোহরে যে২ লোকের ওলাওঠা হইয়াছিল তাহারা হরিতাল ভস্ম ঔষধি সেবন করিয়া রক্ষা পাইয়াছে এবং যাহারদিগের নাড়ি ত্যাগ ও হিমাঙ্গ প্রভৃতি মৃত্যুচিহ্ন হইয়াছিল তাহারাও ঐ হরিতাল ভস্ম দ্বারা রক্ষা পাইয়াছে হিন্দুস্থানমধ্যে পূর্ব্ব দক্ষিণ উত্তর পশ্চিম যত দেশ প্রদেশ আছে সম্বৎসরের মধ্যে ওলাওঠা রোগ না হইয়াছে এমত দেশ ও প্রদেশ দেখিলাম না ও শুনিলাম না কিন্তু দেড় বৎসর পর্যন্ত এ রোগ হইয়াছে তথাপি ইহার কারণ কেহ কোন স্থানে নিশ্চয় করিতে পারিল না ইহাতে অনুমান এই হয় যিনি মৃত্যু তিনি অন্ধকার হইতে বিষাক্ত বান নিক্ষেপ করিয়া লোক সংহার করিতেছেন।
২৯ এপ্রিল ১৮২০। ১৮ বৈশাখ ১২২৭

ওলাওঠা।--ওলাওঠা রোগে কলিকাতার এই২ ভাগ্যবান লোক মরিয়াছেন। বাবু সূর্য্যকুমার ঠাকুর ও বাবু মোহিনীমোহন ঠাকুর ও কোম্পানির ত্রেজুরির খাজাঞ্চি জগন্নাথ বসু ও কলিকাতার একশ্চেঞ্জ ঘরের কর্ম্মকারী শিবচন্দ্র বসু। এবং ইংগ্লণ্ডীয় সাত জন সাহেব মরিয়াছেন।
৬ মে ১৮২০। ২৫ বৈশাখ।

ওলাওঠা--ওলাওঠা রোগ এতদ্দেশে কতক পরাক্রম সম্বরণ করিয়াছে যেহেতুক যাহারদের২ ঐ রোগ হইতেছে তাহাদের মধ্যে অনেকে রক্ষা পাইতেছে কিন্তু সমাচার পাওয়া গেল যে মোং যশোহর প্রদেশে তাহার পরাক্রম অতিশয়। সেখানে কোন২ গ্রাম ঐ রোগে উচ্ছিন্ন হইয়াছে তাহাতে মুসলমান লোক মরিলে লোকাভাবপ্রযুক্ত তাহারদের গোর হওয়া ভার এবং হিন্দুলোকের প্রায় সৎকার হয় না। একবার নামে একবার উঠে ইহাতেই নাড়ী বসিয়া গিয়া ক্ষণেক কাল পরে মরে।
২৭ এপ্রিল ১৮২২ ।। ১৬ বৈশাখ ১২২৯

সহগমন।।–ওলাওঠা রোগে অনেক বাঙ্গালি মরিয়াছে তাহার মধ্যে ঐ [গয়া] মোকামে এক ব্রাহ্মণ মরিলে তাহার স্ত্রী সহগমনে উদ্যতা হইল তাহাতে গয়ার জজ শ্রীযুত মেং কিরিষ্টফর স্মিথ সাহেব গিয়া তাহাকে অনেক নিষেধ করিলেন তাহাতে সে ব্রাহ্মণী আপন অঙ্গুলী অগ্নিতে দগ্ধ করিয়া পরীক্ষা দেখাইল তাহা দেখিয়া জজ সাহেব আজ্ঞা দিলেন যে তোমার যে ইচ্ছা তাহা করহ। পরে সে স্ত্রী সহগমন করিল।
১ মে ১৮২৪। ২০ বৈশাখ।

ওলাওঠা।-- শুনা গেল যে নব্দ্বীপে রোজ২ ওলাওঠা আপন সৈন্য সন্নিপাত সমভিব্যাহারে গমনানন্তর অবিরোধে রাজ্য শাসন করিয়া অতিশয় প্রবল হইয়া বসিয়াছেন। এবং তাহার সহকারী হইয়া অনাবৃষ্টি ও গ্রীষ্ম সুখে কালক্ষেপণ করিতেছে। ঐ রোগরাজের আজ্ঞানুসারে সন্নিপাত সৈন্য মহোৎপাত করিইয়া বহু লোককে কাতর করিয়াছে এবং করিতেছে। এক দিবস ঐ রোগরাজ নবদ্বীপে বহু জনতা দেখিয়া কোপাবিষ্ট হইয়া সন্নিপাতকে কহিলেন তুমি আমার কর্ম্মে আলিস্য করিতেছ তাহাতে সন্নিপাত আপন ক্ষমতা প্রকাশ করিয়া এক দিবসেই ছত্রিশ জনের প্রাণ নষ্ট করিয়াছে এবং অদ্যাপিও ঐ রাগে প্রতিদিন দশ বারো জনকে নষ্ট করিতেছে তাহাকে নিবারণ করে এমত কাহার ক্ষমতা হয় না। ইহা দেখিয়া ভয়ে ভীত হইয়া বিদেশী যে সকল লোক নবদ্বীপে বাস করিতেছিল তাহারা পলায়নপর হইয়াছে ও প্রতিদিন ক্রন্দন ধ্বনিতে সুস্থ লোকেরো ভয় জন্মিতেছে এবং শোকাবিষ্ট লোকেরো শোকশান্তি হইতেছে এরূপ যদ্যপি আর কিছু কাল নবদ্বীপে ঐ সৈন্য সমভিব্যাহারে ওলাওঠা প্রবল হইয়া বসতি করেন তবে ঐ নবদ্বীপ দ্বীপমাত্র হইবেক।
২৭ আগষ্ট ১৮২৪ ।। ১৩ ভাদ্র ১২৩২

সহগমন।।–সিমল্যানিবাসি ফকিরচন্দ্র বসু ১ ভাদ্র সোমবার ওলাওঠারোগে পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইয়াছেন। ইহার বয়ঃক্রম প্রায় ৩৬ বৎসর হইয়াছিলো তাঁহার সাধ্বী স্ত্রী শ্যামবাজারনিবাসি শ্রীমদনমোহন সেনের কন্যা তাঁহার বয়ঃক্রম ন্যূনাতিরেক ২২ বৎসর হইবেক এবং সন্তান হয় নাই। ঐ পতিব্রতা স্ত্রী রাজাজ্ঞানুরোধে দুই দিবস অপেক্ষা করিয়া বুধবার প্রাতে সুরের বাজারের নিকট সুরধুনী তীরে স্বামিশবসহ জ্বলচ্চিতারোহণপূর্ব্বক ইহলোক পরিত্যাগ পুরঃসর পরলোক গমন করিয়াছে।
১৭ সেপ্টেম্বর ১৮২৫। ৩ আশ্বিন ১২৩২

ঢাকা।--ঢাকার পত্রদ্বারা ওলাওঠা রোগের বিষয় যেরূপ শোনা গেল তাহাতে প্রায় বিশ্বাস হয় না বিশেষতো গত মাসের শেষ সপ্তাহে আট শত লোক পঞ্চত্ব পাইয়াছে এবং বর্ত্তমানে মাসের প্রথম সপ্তাহে সাত শত লোক মারা পড়িয়াছে। পত্রলেখক সাহেব লিখিয়াছেন যে ইহাতে লোকদের মধ্যে অতিশয় ভয় জন্মিয়াছে এবং হাহাকার উঠিয়াছে লোকেরা স্থান ও কাষ্ঠের অভাবহেতু শব দাহ করিতে পারে না। এক্ষণে আদালত ও অন্য২ কার্য্যকর্ম্ম সকল বন্ধ হইয়াছে এবং লোকেরা পলায়ন করিতেছে। এই রোগে সকলেরই ভয় জন্মিতে পারে যেহেতুক কোন ঔষধেতে কিছু উপকার দর্শে না।
৩ সেপ্টেম্বর ১৮২৫। ২০ ভাদ্র ১২৩২

ওলাওঠা।।-- শহর কলিকাতার মধ্যে মধ্যে যেরূপ ওলাওঠা রোগের প্রাবাল্য হইয়াছে তাহার বর্ণনা করিতে লেখনি অসমর্থা যাঁহারা মফস্বলে আছেন তাহারা প্রায় ইহাতে বিশ্বাস করিবেন না কিন্তু তাঁহারা ভাগ্য করিয়া মানুন যে এ সময় তাহারা কলিকাতায় নহে। কলিকাতায় লোক প্রতিদিন মরিতেছে তাহার সংখ্যা করা সুকঠিন কিন্তু আমরা শুনিয়াছি যে এই সপ্তাহে গড়ে প্রতিদিন যদি চারি শত করিয়া ধরা যায় তবে প্রায় সমান হইতে পারিবে এবং কিছু কমও বা হয়। এ সপ্তাহে মুসলমান অধিক মরিতেছে বিশেষত আমরা শুনিয়াছি যে একদিনের মধ্যে ৫৭১ পাঁচশত একাত্তর জন লোক মরিয়াছে কিন্তু ইহাতে প্রায় বিশ্বাস হয় না যে হউক তাহার কারণ সকলেই কহিতেছে যে সম্প্রতি মুসলমানদের মহরমেতে একাদিক্রমে তিন চারি রাত্রি জাগরণ করিয়াছিল ও আর২ অত্যাচার করিয়াছিল এইহেতুক অধিক মুসলমান মরিতেছে। এবং যাহারা কদর্য্য গলির মধ্যে বাস করে তাহাদের মধ্যেও অধিক লোক মরিতেছে যেহেতু কদর্য্য স্থানের দুর্গন্ধেতে ও মন্দ বায়ুতে এ রোগ জন্মে।যাহারা বড় রাস্তার ধারে উচ্চ স্থানে বাস করে তাহাদের মধ্যে এত লোক মরে নাই। মুসলমানেরা এক হস্ত গভীর মৃত্তিকা খনন করিয়া কবর দেয় তাহাতে আরো মন্দ হয় যেহেতুক রাত্রিকালে শৃগালাদি আসিয়া মৃত্তিকার মধ্য হইতে শব বাহির করে পরে সেই সকল শব পচিয়া অতিশত দুর্গন্ধ হয়।

অনেকে ভয়েতে মরে ওলাওঠা রোগে ভয় অপেক্ষা প্রবল উপসর্গ আর নাই এবং অনেকে ঐ ভয়েতে রোগগ্রস্ত হয় পরে হঠাৎ গঙ্গাতীরে লইবার উদ্যোগ হয় তাহাতে রোগির যত সাহস-বৃদ্ধি হয় তাহা প্রায় সকলেই বিবেচনা করিতে পারেন। যখন রোগীকে কহা যায় যে তোমাকে গঙ্গাযাত্রা করিতে হইবে তখন সে ভাবে যে এই আমার অগস্ত্যযাত্রা। আরো আমরা দেখিতেছি যে রোগের প্রথমাবস্থাতে যাহারা সাহেবলোকদের ঔষদ সেবন করে তাহাদের ভেদ বমি তৎক্ষণাৎ বন্দ হয় এবং অনেকে রক্ষা পায় কিন্তু খেদপূর্বক লেখা যাইতেছে যে অনেক লোক রোগের প্রথমাবস্থাতে না আসিয়া শেষাবস্থাতে আইসে তাহাতে ঔষধ কিছু করিতে পারে না কিন্তু রোগ হইবামাত্র যত লোক ঔষধ সেবন করিয়াছে তাহারদের মধ্যে প্রায় অনেকে রক্ষা পাইয়াছে।
সম্প্রতি মোং শালিখাতে এক জন ভাগ্যবান লোক এই রোগে পীড়িত হইয়া গঙ্গাতীরে আসিয়া কফাভিভূত হইলে সকলে তাহার মৃত্যু নিশ্চয় করিয়া চিতা প্রস্তুত করিল ও মৃত ব্যক্তিকে চিতার উপরে তুলিয়া অগ্নি দিল। কিঞ্চিৎকাল পরে অগ্নির উত্তাপে সে উঠিয়া বসিল কিন্তু তাহার আত্মীয় অথবা উত্তরাধিকারী কোন ব্যক্তি তাহার মস্তকে যষ্ঠ্যাঘাত করিয়া তৎক্ষণাৎ খুন করিল এবং অগ্নির মধ্যে পুনর্বার নি:ক্ষেপ করিল। এই সমাচার অমূলক নয় যে সাহেব এই ব্যাপার প্রত্যক্ষ দেখিয়াছেন তাহার প্রমুখাৎ শুনা গিয়াছে।

শহর শ্রীরামপুরেও ওলাওঠা রোগ আগমন করিয়াছে কিন্তু বড় প্রবল হয় নাই চাতরা ও শ্রীরামপুর দুই গ্রামের মধ্যে প্রতিদিন তিন চারি জন করিয়া মরিতেছে।


কিন্তু রোগের প্রথমাবস্তাতে অর্থাৎ একবার কিম্বা দুইবার ভেদ হইলে যাহারদিগকে ঔষধ দেওয়া যায় তাহাদের মধ্যে প্রায় কেহ মরে না। সম্প্রতি চিকিৎসক নিযুক্ত করিয়া ঔষধ দেওয়াতে অনেকের রক্ষা হইতেছে। গত বুধবারে শ্রীরামপুরের যুগল আঢ্যের বান্ধাঘাটেতে ওলাওঠা রোগগ্রস্ত এক জন অনাথ বৈষ্ণবকে ফেলিয়া গিয়াছিল তাহার মুখে জল দিতে কোন লোক ছিল না পরে আমাদের প্রেরিত চিকিৎসক সেখানে গিয়া তাহাকে ওষধ দিতে লাগিল ও তিন দিবসের মধ্যে সে ব্যক্তি সুস্থ হইল। ঐ ঘাটে তৎকালে আর এক বেশ্যা অনেক পরিবারে পরিবৃতা হইয়া আসিয়াছিল এবং সেও ঔষধ খাইয়াছিল কিন্তু সে মৃতা হইয়াছে।
২২ ডিসেম্বর ১৮২৭। ৮ পৌষ।

ওলাওঠা।-- শুনা গেল যে উলাগ্রামে প্রাণনাশক গুণধাম ওলাওঠা সংপ্রতি তথায় অবস্থিতি করিয়া অনেককে কাতর করিয়াছেন তাহাকে কাতর করিবার নিমিত্তে কবিরাজসকলে সন্ধান করিতেছেন কিন্তু সে সন্ধান বলবান না হইবাতে ঐ ওলাওঠা ঐ চিকিৎসকদিগকে ঠাট্টা করিতেছে আর যাহার নিকটে ঐ রোগরাজ বিরাজ করিতেছেন তাহাকে ততক্ষণাৎ সন্নিপাত সঙ্গে দিয়া ধর্ম্মরাজের নিকটে পাঠাইতেছেন।



অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প : কাফের


গাধাগুলোকে সে রাতে আর জল দেখানো গেল না। গোরুগুলো গোয়ালে হাম্বা হাম্বা করে ডাকছিল। এবং বাবুদের ঘোড়াগুলোর চিৎকারে ধরা যাচ্ছে যে, এই হত্যাকান্ড থেকে কেউ বাদ যাচ্চে না। নিশুতি রাত। গ্রামগুলো দাউ দাউ করে জ্বলছে। মাঠে মাঠে মানুষের আর্তনাদ, কখনও পোড়া মাংসের গন্ধ আর এক হাহাকারের ছবি মাঠময় প্রেতের মতো ভেসে বেড়াচ্ছিল। সকলেই প্রায় পালাচ্ছিল। অন্ধকার মাঠের ভিতরে, ঘাসের ভিতরে অথবা বন-বাদাড়ের ভিতর দিয়ে পালাবার জন্য ছুটছিল। যুবতীদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। পরাণ ওর স্ত্রীর নাম ধরে মাঠের ভিতরে দুবার চিৎকার দিয়েছিল-- ঠিক তখন একদল মানুষ ছুটে আসছে, হাতে মশাল, আগুন ওদের হাতে--ওই যায়, চলে যাচ্ছে, এবারে গেঁথে ফেল সুপারির শলাতে-- এমন চিৎকার ছিল ওদের কণ্ঠে। পরাণ তাড়াতাড়ি মোত্রা ঘাসের জঙ্গলে লুকিয়ে পড়ল। ঘাসের জঙ্গলে ফিসফিস করে ডাকল, 'কিরণী, কিরণী আছস'।

কোন উত্তর পেল না। সকলেই ভয়ে কথা বলছে না যেন। কোনও রকমে এই নিশুতি রাতে প্রাণ নিয়ে পালানো, কিন্তু পালানো দায়, শহরে গঞ্জে উঠে যেতে পারলে রক্ষা। পরাণ কিরণীকে খুঁজে পেল না। সে একা, এবং একা বলেই বোধহয় হাসিমের কথা মনে পড়ে গেল। জাবিদার কথা মনে পড়ে গেল। যদি ওই রক্ষা করতে পারে। হাসিম ওর পরাণের জন, দুঃখে-কষ্টে পরাণকে বারবার রক্ষা করে আসছে। সেই হাসেম, যদি হাসিম ওকে রক্ষা না করে তবে আর কোথায় নির্ভর করবে। কোথাও যখন সে যেতে পারছে না, সকলে ওকে ঘিরে ফেলেছে হত্যার জন্য, তখন নদীর জলে ভেসে পড়ল পরাণ। সাঁতার দিল, ডুবে ডুবে হাসিমের বাড়ি উঠে ডাকল, 'একটা তফন দ্যাও আমারে হাসিম। আমি মুসলমানের মতো এক টুপি পইরা চইলা যামু'। অথবা যেন ওর বলার ইচ্ছা ছিল, বনে-জঙ্গলে কিরণীকে খুঁজে পাইনি হাসিম, তোর বাড়িতে কিরণীর খোঁজে উঠে এলাম।

'কে কথা কয়'।

'আমি পরাইন্যা। আমারে বাঁচা তুই। যদি মারতে ইচ্ছা যায় তবে মাইরা ফ্যাল। আর পারি না।'

ভয়ংকর দাঙ্গায় হাসিমের মতো মানুষেরা কেমন একঘরে ছিল। ওরা রক্ষার জন্য, মানুষ, প্রাণ, পাখি রক্ষার জন্য দলে দলে বের হয়ে যেতে পারল না। এই বীভৎস ছবির ভিতর ওরা দরজা বন্ধ করে বসেছিল। ওদের চোখ জ্বলছিল, কপাল ঘামছিল, এবং নৃশংস অত্যাচার অথবা আর্তনাদ পাগল করে দিচ্ছিল।

পরাণ দাঁড়াতে পারছিল না। সে খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। ঘরে একটা লম্প জ্বলছে। মোরগের ডাক শোনা যাচ্ছিল। শীত তীব্র বলে ঘরের ভিতরে জাবিদা আগুন জ্বেলে দিয়েছে এবং ওরা পরস্পর ফিসফিস করে কথা বলছিল। কেউ শুনতে পাবে কথা, সর্বত্র চর ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা লোক অন্ধকার মাঠে চোঙা মুখে চিৎকার করছে, এই হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দিচ্ছে। পরাণ শীতের ভিতর বসে ছিল। সে আতঙ্কে যেন খুব ভুল কথাবার্তা শুনছে, যেন কিরণী কোথাও কোনও ঝোঁপের ভিতর বসে ওকে ডাকছে। সে প্রায় কিছুই বুঝতে পারছিল না। ষে শুধু একবার জাবিদার দিকে চোখ তুলে তাকাল, তারপর কাঁপতে কাঁপতে বলল, 'কী কইতাছ বইন।'

জাবিদা পরাণকে সাহস দিল। বলল, 'আপনে আগুন পোহান। আমি আইতাছি।' বলে সে উঠোনে নেমে অন্য অনেক বাড়িতে সংবাদ সরবরাহের জন্য খোঁজখবর নিচ্ছিল। জাবিদা সব শুনে আতঙ্কিত। ইসমতালির পেটে সুপারির শলা ঢুকে গেছে। ওদের স্কুল বাড়িতে কিছু লোককে আশ্রয় দিয়েছিল ইসমতালি, ওর দলটা ওদের বাঁচাবার জন্য প্রাণপণ লড়ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারেনি। স্কুলে এখন আগুন জ্বলচ্ছে। মাঠের ভিতর ইসমতালি চিৎ হয়ে শুয়ে এখন আসমান তারা নক্ষত্র গুনছে।

হাসিম বলল, 'ইসমতালি-অ গ্যাল'।

পরাণ ঘটনাটা যেন এতক্ষণে ধরতে পেরছে। যেন এতক্ষণ পর বুঝতে পারল ইসমতালি যাদের স্কুলে আশ্রয় দিয়েছিল, তারা সব পড়ে মরেছে। অনেক আহত হয়েছে। চোঙ মুখে লোকটা সবাইকে সেই খবর দিয়ে মাঠের দিকে যে মসজিদ আছে যেখানে চাকের কূপ আছে এবং জলের ভিতর এখনও যেখানে ছায়া সৃষ্টি হয়--সেদিকে চলে যাচ্ছে।

পরাণের ভয় হল সে বুঝি হাসিমেরও বিপদ ডেকে আনবে। সে উঠে বলল, 'বইন আমি যাই। মাঠে নাইমা যাই।' বলে সে ছুটতে চাইলে হাসিম আগলে দাঁড়াল দরজায়। বলল, ' যাইবা কই? মাঠে? আমি তো এখনও মরি নাই।' তারপর বিবির দিকে তাকাল পরামর্শের জন্য। তফন পরে টুপি মাথায় পরাণ নেমে যেতে পারে মাঠে। ছদ্মবেশে সে শহরে উঠে গেলে ভয় নেই। কিন্তু আঞ্চলের মানুষ পরাণ, ধরা পড়ে যাবে। জাহিদা কোন বুদ্ধি দিতে পারল না। মাঠে মাঠে অনেক দূর যেতে হয়, তারপর নদীর পার ধরে। সহসা জাহিদার মুখ উজ্জল হয়ে উঠল। বেশি সময় আর ঘরে রাখা যাচ্ছে না পরাণকে, বাড়ি বাড়ি চর ঘুরে বেড়াচ্ছে, ওর মুখে আশার আলো দেখা গেল। সামান্য বুদ্ধি করে নদী পর্যন্ত হেঁটে যেতে হবে। তারপর নদীর জলে পরাণ, সঙ্গে একটা পাতিল, পাতিলটা জলের উপর ভেসে যাবে, জলের নিচে পরাণের মুখ, পাতিলের নিচে মুখ রেখে শ্বাস নেবে পরাণ। নদীর পারে বসবে হাসিম, কাঁধে বাঁশের লাঠি, ছোট এক পুটুলি ঝুলবে চিড়ার, এক বাটি জলে চিড়া ভিজিয়ে মাঠের কোনও ঝোঁপে অথবা বন-বাদাড়ে খুদা পেলে পরাণকে খেতে দেবে। জাবিদা নদীর পারের মানুষ। নদীর জল সম্পর্কে, কচুরি পানা সম্পর্কে এবং কোন পারে কী আছে সব তার টিয়া পাখির মতো মুখস্থ।

গোয়াল থেকে হাসিম সামান্য দুধ দুয়ে নিল। জাবিদা শীতের রাতে সেই দুধ গরম করে চারিদিকে তাকাল, এই সময়, নয়তো মশালের আলো নিয়ে যারা মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা পর্যন্ত টের পেয়ে যাবে। জাহিদা দুধ দিল খেতে পরাণকে। পুঁটলিতে চিড়া বেঁধে দিল। হাসিম পাহারাদারের মতো অথবা বরকন্দাজের মতো পাহারা দিয়ে নদী পার করে দিয়ে আসবে। আর পরাণ নদীর জলে পাতিলের নীচে মুখ রেখে, শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য সময় সময় পাড়ে হাসিমের লাঠির শব্দ শুনে জলের উপর ভেসে উঠবে, অথবা এই পাতিলের ভিতরও ইচ্ছা করলে পরাণ শ্বাস-প্রশ্বস নিতে পারে। ওর কোন কষ্ট হবার কথা নয়। নদীতে কী যায়, পাতিল ভেসে যায়, পাতিলের নিচে পরাণ আছে, জলের নীচে সাঁতার কাটছে। কেউ টের পাবে না। পরাণ অনেক জলের নীচে মাছের মতো, অথবা পাখা মেলে মাছের মতো জল কেটে শহরে গিয়ে উঠবে।

ঘোড়াগুলো আর চিৎকার শোনা যাচ্ছে না। বাবুদের ঘোড়াগুলো মরে গেছে। মাঝে মাঝে আকাশে বাতাসে ভীষণ এক কল্লোলের মতো ইতর সব ধ্বনি ভেসে বেড়াচ্ছিল। নিরীহ নারী-পুরুষগণ আগুনের ভিতর জ্বলছিল। পোড়া স্যাঁতস্যাঁতে চামসে গন্ধ মাঠে মাঠে, কখনো গোপাটের উপর দিয়ে ভেসে আসছে। মাঠের উপর শুধু অন্ধকার গম্বুজে সাদা পায়রা উড়ছে। বড় বড় মাঠ নদীর পরে--ওরা উড়ে উড়ে সেদিকে চলে যাচ্ছেল। জাহিদা লন্ঠন হাতে উঠোনে নীচে নেমে এসেছিল। পরাণ সকলের পিছনে। হাসিম বলল তখন, খুদা ভরসা। ওরা মাঠে নেমে এলে অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকল। যত অন্ধকারের ভিতর ওরা অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকল। তত মনে হল জাবিদার--আহা কত ঘাস এখানে, কত পাখি এখানে, সবুজ গন্ধ ছিল মাঠময়। পরাণ পিছনে ফেলে চলে যাচ্ছে। ওর কিরণী কোথায় এখন, ওর সংসার। মাটির মতো আর কী প্রিয় জিনিস আছে চাষি মানুষের। জাবিদার চোখের উপর কিছু স্মৃতি ভেসে উঠল, দুঃখের দিনে, সুখের দিনে পরাণ, পরাণে মা মাধুপিসি--সকলের কথা মনে হল, মোত্রা ঘাসের জঙ্গলে একবার পরাণ আবিষ্কার করেছিল--জাবিদা, দশমাসের পোয়াতি, জাবিদা ছাগল নিতে এসে অচৈতন্য হয়ে পড়েছে। কোলে করে সে এই মাঠ পার করে দিয়েছিল, ধরে এনে হাসিমকে গালমন্দ করেছিল, সেই পরাণ ওর প্রিয় মাঠ এবং ফসল ফেলে চলে যাচ্ছে। আর এদেশে ফিরবে না। জাবিদার চোখে জল এসে গেল।

ওরা কখনও আগুনের ভিতর দিয়ে কখনও নির্জন মাঠের অন্ধকার অতিক্রম করে ছুটে চলছিল। পরাণ তফন পরেছে, টুপি মাথায় অন্ধকারে মুখ ঢেকে রেখেছে। হাসিম লাঠিতে চিড়ার পুঁটুলি ঝুলিয়ে নিয়েছে। পুঁটুলির ভিতর জামবাটি। যখন পরাণ চলতে পারবে না, জলের ভিতর ঠাণ্ডা হয়ে যাবে তখন এই সামান্য চিড়াগুড় এবং কিছু উত্তাপ পরাণকে ফের ডুবসাঁতার দিতে অথবা পাতিরে নীচে ভেসে থেকে অনেকদূর এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। পরান আমার কিরনী গেল কই এই সব বলে যেতে যেতে কপাল থাপড়াচ্ছিল। আমার বাঁইচা থাইকা কি হইব হাসিম। এই সব বলে মাঝে মাঝে অন্ধকার মাঠে বসেই হাউ মাউ করে কাঁদছিল। তখন কেমন পাগলের মত পরাণ। পিছনে দাঁড়িয়ে হাসিম । নানা রকম আশার কথা শোনাচ্ছিল ফিসফিস করে, মাঝ মাঝে বেঁচে থাকার জন্য, নদী পার হবার জন্য এবং নদীতে ভেসে অনেক দূর অনেক পথ সাঁতার কাটার জন্য প্রেরণা দিচ্ছিল--যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে, যেভাবে পারছে পালাচ্ছে, গঞ্জে কিরণী হয়তো তাঁবু, সরকারী তাঁবুতে পরাণের জন্য অপেক্ষা করছে, সবই আন্দাজে বলছিল হাসিম। পরাণকে প্রেরণা দেবার জন্য নানারকমের পাঁচমেশালি কথা পরাণের পিছনে দাঁড়িয়ে বলছিল।

পরাণকে প্রেরণা দিয়ে কোনওরকমে সাঁকো পর্যন্ত হাঁটিয়ে এনেছে। এবার সাঁকো পার হতে হবে। মসজিদের অন্ধকারে ক'জন লোক দাঁড়িয়ে ছিল--ওরা কারা হাসিম টের করতে পারছিল না। সে মাঠের দিকে নেমে গেল। তামাক ক্ষেত, পেঁয়াজের ক্ষেত চাধ্বারে। সে মসজিদের পাশ দিয়ে গেল না। তামাকের ক্ষেতের উপর দিয়ে হামাগুড়ি দিতে থাকল। কুয়াশার জল লেগে ওদের শরীর ভিজে গেল। পরাণ মন্ডলের কোনও খেয়াল ছিল না, হাসিম মন্ত্রের মত ওর নাম, বাপের নাম নতুন ভাবে শেখাচ্ছে--নাম, মহম্মদ ইদ্রিস, বাজীর নাম--মহম্মদ ইমানুল্লা। অথবা বোবা বনে থাকবে--যা বলবার হাসিম বলবে, ব্যারামি নাচারি মানুষ, শহরে গঞ্জে ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছে। তবে এই অন্ধকার রাতে কেন? তখন কী বলবে হাসিম? সে ভাবল--না এটা ঠিক হবে না। বোবা পরাণ মণ্ডল বড় বড় চোখে তাকিয়ে ব্যা ব্যা করবে শুধু, কোনও কথা বলেবে না, সে বাছুরের মতো টেনে বিপদের স্থানগুলো পার করে নেবে। যেন গঞ্জের হাটে পরাণ মণ্ডলকে বিক্রি করতে যাচ্ছে হাসিম। 

মাঠ, জমিন, শ্যাওড়া গাছের বন অতিক্রম করে ওরা হিজলের মাঠে এসে নামল। ওরা সোজা পথে গেলনা। বাঁকা পথে গেল। ঘুরে ঘুরে, যেখানে খুনজখম কম হচ্ছে সে পথ ধরে গেল। কিছু মানুষের শব্দ পেল। হই হই করে গ্রামে ফিরছে । সে বুঝল ওরা কোথাও এতক্ষণ খুনজখমে লিপ্ত ছিল--এখন গ্রামে ফিরছে। সে পরাণকে নিয়ে ফের ঝোঁপের ভিতর লুকিয়ে পড়ল। যখন দেখল মানুষগুলো গ্রামের ভিতর ঢুকে গেছে--এখন ছুটতে পারলে আর ধরতে পারেবে না, তখন ওরা বড় মাঠে পড়ে ছুটতে থাকল। 

পরগনাতে পরগনাতে দুঃসহ অরাজকতা। উত্তর দক্ষিণে সোনারগাঁ, পূবে পশ্চিমে মহেশ্বরদি অথবা শীতলক্ষ্যার দুই তীর ধরে ধ্বংসের উল্লাস। মানুষের ভয়ানক দুর্দিন--ধর্মের কথা কেউ শুনছে না, ধর্মবোধ নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, উগ্র বিদ্বেষ ক্রমশ এক ভুজঙ্গের মতো গোট অঞ্চলকে গ্রাস করে ফেলেছে। যেতে যেতে হাসিম সেই আগের মত বিড়বিড় করে বকে যাচ্ছে। ওর প্রায় চার দিকে নজর রাখতে হচ্ছে। কারণ পরাণ , বেহুঁশ পরাণকে না বাঁচাতে পারলে ওর সম্মান থাকে না, মানুষের সম্মান থাকেনা--হাসিম ছুটতে ছুটতে পরাণকে বাঁচার জন্য ফের নানা ভাবে প্রেরণা দিতে থাকল। 

ওরা গরিপরদীর আশ্রমে পৌঁছে প্রথম থামল। অশ্বত্থের জঙ্গল এবং ভাঙ্গা মঠের ভিতর কিছু পাখির কলরব শোনা যাচ্ছে। ভোর হতে বাকি নেই। নদীর জলে কিছু পাখির ছায়া পড়ছিল, কোনও পাখি উত্তর-দক্ষিণে হারিয়ে যাচ্ছে। কাক-শালিখেরা তেমনি ডানা মেলে আকালে উড়ছিল, এত বড় খুনের উল্লাস দিনের বেলাতে আরশির মত পরিচ্ছন্ন, যেন কোথাও কোনও মালিন্য লেগে নেই। কিন্তু হাসিম টের পাচ্ছিল, জলের নীচে তখনও বড় এক অজগর ফোঁশে ফোঁশে উঠছে, সময় পেলেই ছোবল দেবে। এখন সামনে শুধু নদীর জল। দিনের বেলায় যেতে গেলে পরাণ মণ্ডল ধরা পড়ে যাবে। জলে নেমে পাতিল মাথার উপর রেখে জলে জলে এখন থেকে হেঁটে যাওয়া । গঞ্জে উঠে যেতে পারলে তিন ক্রোশের মতো পথ আর। মাত্র এই তিন ক্রোশ টেনে নিতে পারলেই হাসিমের সম্মান বাঁচে। পরাণকে সে জামবাটিতে চিড়া-গুড় দিল খেতে। সারা দিনের জন্য পরাণকে জলে ডুবে থাকতে হবে। পরাণ পাতিল মাথায় জলে ভেসে যাবে, শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্রিয়াটুকু মুখ ভাসিয়ে পাতিলের নীচে সেরে নেবে। কিন্তু হায় পরাণের ভিতর জীবনের কোনও লক্ষণ পাওয়া যাচ্ছে না। ভয়ে শরীর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সে গত সালের মেলার কথা বলে, মেলার লাভ-লোকসানের কথা বলে অন্যমনস্ক করতে চাইল পরাণকে। কিন্তু পরাণ, ভুতের মত বসে আছে, খাচ্ছে না, যেন চিড়ে গুড় ঠেলে দিচ্ছে মুখে--হাসিম বসে নজর রাখছে চারিদিকে, খাওয়া হয়ে গেলে আর দেরি করল না হাসিম। পরাণকে নদীর জলে নামিয়ে নিজে পায়ে পায়ে হেঁটে যেতে থাকল। যেন হাসিম এখন যথার্থই তীর্থযাত্রায় বের হয়ে পড়েছে, মক্কা মদিনা যাচ্ছে, মানুষের ভালবাসার স্থান, যেখানে মানুষে মানুষে কোনও বিভেদ থাকে না, সবই ঈশ্বরপ্রেরিত, জীবন মাত্রেই করুণার যোগ্য--সুতরাং প্রাণধারণের অবহেলা করলে পাপ, হাসিম হাঁটতে হাঁটতে মদিনা, মক্কা যাচ্ছে--নীচে শীতের জল, জলে একটা শুধু এখন পাতিল ভাসছে। পাতিলটা বেগে দক্ষিণ দিকে উঠে যাচ্ছে, দক্ষিণ দিকে জলের উপর ভেসে যাচ্ছে--কোনও টের পাবার কথা নয়, অঞ্চলের একজন মানুষ পাতিল মাথায় নিরুদ্দেশে পাড়ি দিচ্ছে। নদী এখানে অগভীর--জল কম, জলজ ঘাস নেই, জলের নীচে বালি মাটি। পরাণ জলের নীচে গোসাপের মত সাঁতার কাঁটছিল। মনে হবে সব কীটপতঙ্গের মত, মরা বাঁদর অথবা বেড়ালের মতো কচুরিপানার পশে সামান্য এক পাতিল ভেসে যায়, পাতিলের নীচে এক মানুষ আছে, মানুষ জলে ভেসে যায় কেউ বলবে না। পারে লম্বা হয়ে হাসিমের ছায়াটা জলের উপর এসে পড়েছে, আর ঘোড়ার খুরের মত শব্দ ঠক ঠক, বাঁশের লাঠির শব্দ করছিল--এক দুই। ভয় ভয়। শব্দটা জলের নীচে পরাণ শুনছে--সাঁতার ভয় ভয়। সে ডুবে থাকছ। এক দুই তিন, তিনটা শব্দ করছে পাথরে ঠুকে ঠুকে, আর ভয় নেই। সে মুখ তুলে কচুরিপানার ভিতর দিয়ে হাঁটতে থাকল।

নদীর পাড় ক্রমশ পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে যাচ্ছিল। অনেক উঁচুতে হাসিম হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। ওর শরীরটা ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে। অনেক দূর থেকে এখনও সেই শব্দ, ক্রমাগত শব্দ, এক দুই, এক দুই--অদ্ভুত শব্দটা, জলের নীচে মনে হয় কোনও পাতালপুরী আছে, সেখানে রাজপুত্র ঘোড়ায় চড়ে ঠক ঠক করে যাচ্ছে, অথবা কদম দিচ্ছে ঘোড়ায়--এক দুই তিন, কদম তুলে ঘোড়া ছুটলেই আর পরাণের ভয় থাকছে না। সে জলের নীচে কিরণীর স্বপ্ন দেখছে। ছোট মুখ কিরণীর, বড় চোখ কিরণীর, ছাগল গোরু পায়রা কিরণীর সব পুড়ে গেছে। এখন কিরণী কোথায়! হল্লাটা বড় সহসা আরম্ভ হয়েছিল, সে জেগে দেখল আগুন জ্বলছে গোয়ালে, বের হয়ে দেখল মানুষের আর্তনাদ, সে সব ফেলে ছুটতে থাকল।

নদীর দুপারে গ্রাম মাঠ ফসল। ঝোপে জঙ্গলে টুনি ফুলের লতা। সামনে মাঝের চরের শ্মশান। আবার সেই এক দুই--ঠক্ ঠক্ শব্দ। পরাণ জলের নীচে, পাতিলে মুখ ভাসিয়ে ডুবে থাকল, অথবা জলের নীচে যেন পরাণ ঝিনুক খুঁজছে, ঝিনুক নয়, পরাণ কিরণীকে খুঁজছে। কিরণী, আমার কিরণী, জলে মাঠে য়ে কিরণী প্রাণের সঙ্গে লেগে থাকত। পরাণ যেতে যেতে বলল, 'কিরণী, তুই কোনখানে আছস ক। আমি পরাণ তরে ফালাইয়া কই যামু।'

জলের নীচে সে আবার শব্দ পেল--ঠক ঠক ঠক। আর ভয় নেই। সে মুখ ভাসিয়ে রাখল জলের উপর। দুহাতে সে কচুরিপানা কেটে এগুতে থাকল। শক্তি ক্রমশ নিঃশেষ হয়ে আসছে। শীতের সময় বলে জল হিমের মত ঠাণ্ডা। সে ভিতরে ভিতরে মরে যাচ্ছিল, ভয়ে বিস্ময়ে এবং কিরণীর জন্য, এই শীতের জন্য, হিম ঠাণ্ডার জন্য ওর প্রাণশক্তি ক্রমশ উবে যাচ্ছে। হাসিম পাড়ে থেকে ওকে চিৎকার করে সাহস দিচ্ছে--'আর বেশি দেরি নাই পরাইন্যা। ধামগড়ের কলের চিমনি দ্যাখা যাইতেছে। ওখানে তর কিরণীরে পাইবি।' ঠিক সেই জলেডোবা মানুষের মতো। যেন পিতা পুত্রকে বলছে--দেখো, দূরে বাতিঘর দেখা যাচ্ছে, আমরা আর একটু সাঁতার কাটতে পারলেই সেই বাতিঘর পাব। আলো, খাদ্য এবং তাপ পাব। অথবা দেখো জন, আকাশের নক্ষত্র দেখো, তোমার মা বাড়িতে আমাদের দুজনের প্রতীক্ষাতে বসে আছেন, আর একটু সাঁতার কাটতে পারলেই আমরা এই ভয়ংকর সমুদ্র অতিক্রম করে চলে যেতে পারব। জাহাজডুবি মানুষ পুত্রকে যেন উদ্বুদ্ধ করছে। হাসিম পরাণকে প্রেরণা দিচ্ছে--আর একটু যেতে পারলেই সেই বাতিঘর, বাতিঘরে আমাদের পৌঁছোতে হবেই।

হাসিম এখন লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটছে। যত নদী নীচে নেমে যাচ্ছে, যত হাসিম উপরে উঠে যাচ্ছে, তত পাড়ের ফাটল গভীর এবং প্রশস্ত হচ্ছে। ওকে খুব সাবধানে ফাটল পার হতে হচ্ছিল। একটু ঘুরে গেলে পথ, কিন্তু সেখান থেকে নদীর জলে পরাণকে দেখা যায় না, পরাণ অতদূর থেকে লাঠির শব্দও শুনতে পাবে না। বর্ষার জলে যখন প্রচণ্ড স্রোত থাকে, তখন যে সব জমি ভাঙতে ভাঙতে ভাসিয়ে নিতে পারেনি, তারা এখন প্রচণ্ড ফাটল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বর্ষা এলেই ঝুপ ঝুপ শব্দ হবে, জলে ভেসে মোহনায় চলে যাবে। নদী ভাঙতে ভাঙতে পরাণের মতো দূরে সরে যাবে।

পরাণ বোধহয় ওর ডাক জলের ভিতর থেকে শুনতে পায়নি। অনেক উঁচুতে দাঁড়িয়েছিল হাসিম। নদীর খাড়া পাড়, নীচে সামান্য বালুমাটি, যখন ভয় নেই, যখন কোনও মানুষের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না তখন পরাণের আর কিরনীয়। সে বিশ্রামের জন্য ঘাসের ভিতর বসে থেকে ওপারের মাঠে বসন্তের ফসল দেখল। যব গমের গাছ, পাশে বড় গ্রাম নাঙ্গলবন্দ। কামার কুমোর একঘরও নেই। দেবদেবীর মন্দির আছে এখানে। মাটির মূর্তি, ভৈরব ঠাকুরের পূজা হয় এখানে, পাঁঠা বলি হয়, এখন আর কিছুই নেই, দেবদেবীর মূর্তি খড়ের গাদার মতো পড়ে আছে। গরিব চাষি মানুষেরা এসেছিল দেবীর গায়ে সোনার অলঙ্কার থাকলে তুলে নিতে। ঠিক মাথার উপরে অনেক উঁচুতে হাসিম লাঠিতে শব্দ করল ঠক্ ঠক্--ঠিক সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙের মতো লাফ, পরাণ ব্যাঙের মতো জলের ভিতর ডুবে গেল।

হাসিম যেতে যেতে দেখল দুজন যুবক কলা গাছে সুপারির শলা বল্লমের মতো গেঁথে রেখেছে। ওরা বর্শার মতো দূরে সুপারির শলা নিক্ষেপ করছিল--তখন ওরা নদীর এত খাড়া পাড় ধরে এক মানুষ যায় দেখতে পেল। পথ ফেলে, বিপথে যাচ্ছে মানুষটা। ওরা হাতের উপর সুপারির শলা তুলে বলল, 'যায় কোন মাইন্সে। কোনখানে যায়!' বলে ওরা হাসিমকে ধরার জন্য যব খেতের ভিতর দিয়েই ছুটতে থাকল। হাসিম কী করবে ভেবে পেল না। পরাণের পরিবর্তে যেন সেই বোবা বনে গেল, বোকার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকাল তারপর চোখ উল্টে দিল। মানুষের শখ কত রকমের হয়! ওরা খোঁচা দিল একটা হাসিমকে--'মিঞা, কই যাও?'

'নারানগঞ্জে যাই।' সে চোখ উল্টেই রাখল। হাবাগোবা মানুষ হাসিম। বেশি কথা না বলার জন্য নিজেই বিড় বিড় করে বকতে থাকল।

'তোমার নাম, মিঞা?'

'মহম্মদ হাসিমালি। সাং নয়াপাড়া, ইসমতালি সেখ আমার চাচা।'

ওরা বলল, 'পথেঘাটে লোক খুন হইতাছে। তোমার বেজায় সাহস, মিঞা।'

'আমি সেখের বাচ্চা। আমারে খুন করব কোন মাইনসে।' বলে চোখ সোজা করে ফেলল। তারপর যেন দাঁড়াতে নেই, সোজা হেঁটে যেতে হয়, সে থপ থপ করে লাঠিতে ঠক ঠক শব্দ করল আর হাঁটল। কিন্তু হায়, পাশের কলমিলতার ভিতর এক পাতিল ভাইসা যায়, পাতিলের উপর এক কাক বইসা যায়, নীচে এক মানুষ ভাইস্যা যায়। মানুষের শ্বাস পড়ে না, জলের ভিতরে এক মানুষ কিরণীর খোঁজে নারানগঞ্জে উইঠা যায়। হাসিম হাঁটছিল, শব্দ হচ্ছে লাঠিতে ঠক ঠক--কাঁসার জামবাটিতে, অথবা হাতের পাথরে সে শব্দ করে করে যায়, ভয় ভয়! পরাইন্যা ভাইস্যা উঠলে ডুইবা মরবি জলে, পরাইন্যা ভয় ভয়। তখন পিছনের লোক দুটো চিৎকার করে উঠল--'অ মিঞা, দ্যাখছনি পানিতে এক পাতিল ভাইস্যা যায়!'

হাসিমের শরীর অসাড় হয়ে আসছে। সে তেমনি হাঁটছে থপ থপ। থামলেই লোকগুলো টের পাবে। হাসিম এক গেরস্থ মানুষ, হাসিম এক নাচারি ব্যারামি মানুষ, সে পরাণকে নিয়ে শহরে যাচ্ছে। সে কোনওরকমে ব্যারামি নাচারি মানুষ সেজে ওদের গাজীর গীতের গান শোনাল--এক ছিল গাজী ভাই, গাজীর পরাণে সুখ নাই রে নাই। সে ঘুরে ঘুরে লাঠি বাজাল ঠক ঠক। পরাণ ভয় ভয়। চান্দের লাখান মুখখান, গাজীর গীতের বায়ানদার--পরাণ ঘুরে ঘুরে। সে ঘুরে ঘুরে ওদের অন্যমনস্ক করতে চাইল। কিন্তু কে কার কথা শোনে। ওরা শলা হাতে নিয়ে পাতিলের দিকে নেমে যাচ্ছিল।

হাসিম এবার চিৎকার করে উঠল, 'অ মিঞা ভাই, পাতিল তোমার হাওয়ায় ভাইস্যা যায়।'

'হাওয়া কোনখানে দ্যাখতাছ মিঞা!'

হাসিম এবারে আদাব দিল, যেন এবার যথার্থই গাজীর গীত শেষ। সে এবার বিদায় নিয়ে চলে যাবে। গানের শেষে আদাব দেবার মতো ভঙ্গি করে ডাকল--'অ মিঞা ভাই, কন দেখি চান্দে সুর্যে তফাত কী? গমে যবে তফাত কী, মাটিতে ফসল ফলে, অঃ মিঞা, কার লাগি! কোন সে মানুষ আছে তিন ভুবনে ফসলের রস দেয়, পরাণের ভিতর রস দেয়--অঃ মিঞা, দৌড়ান ক্যান, আল্লা বুঝি আপনেগ জ্বালায় সব হাওয়া গিল্যা ফ্যালাইছে।'

ওরা হাসিমের কথা শুনল না। ওরা পাতিলটার পাশে গিয়ে জোরে শলাটা ছুঁড়ে দিল। পাতিলের ভিতর দিয়ে শলাটা পরাণের ব্রহ্মতালুতে ঢুকে পলকের মতো খাড়া হয়ে থাকল। পরাণ জল থেকে উঠে দাঁড়াল সহসা। মুখে পিঠে রক্তের ফোয়ারা নেমেছে। চোখগুলো গোল গোল হয়ে গেল। দুহাত উপরে তুলে পরাণ চিৎকার করে উঠল--কিরণীরে পাইছি। বলে সে পাতিলটা বুকে জড়িয়ে ডুবে গেল ফের। কিছু বুদবুদ দেখা গেল। মানুষ দুজন হা হা করে হাসল তারপর যেদিকে হাসিম পাগলের মতো পালাবার জন্য ছুটছে সেদিকে ওরা ছুটতে থাকল। 'কাফের যায়!' ওরা মাঠের ভিতর, খাড়া পাড়ের ভিতর সেই কাফেরকে ধরার জন্য লাফিয়ে লাফিয়ে ছুটছিল। আর বলছিল, 'ওই দ্যাখ কাফের যাইত্যাছে। দ্যাখ এক কাফের যায়, যব গম খেতের ভিতর দিয়া এক কাফের যায়। সন্ধ্যা হয় হয়, যব গম খেতের ভিতর এক কাফের ছুইটা যায়।' পাখিরা ঘরে ফেরে--যব গম খেতের ভিতর এক কাফের লুকিয়ে রয়। ওরা শলা দিয়ে গাছগুলোর মাথায় বাড়ি মারছে আর সেই গাজীর গীতের বয়ানদারের মতো কাফেরটাকে খুঁজে মরছে। পেলেই শলা দিয়ে পেটে একটা খোঁচা। কাফেরটা হাঁ করে আলিসান এক ভুজঙ্গের মতো পড়ে থাকবে মাঠে।

হাসিম খুব নুয়ে যব খেতের ভিতর দিয়ে ছুটছে। সামনে বড় বড় ফাটল। সে ফাটলগুলো লাফ দিয়ে পার হচ্ছে। মৃত্যুভয় হাসিমকে অস্থির করে তুলছিল, সে একবার গলা তুলতেই দেখল ওরা ঠিক পিছন পিছন আসছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে এতক্ষণে। মরা চাঁদের ফালিটা ধামগড়ের মিলটার চিমনিতে মরা কাকের মতো ঝুলে আছে যেন। সামনের ফাটলটা অতিক্রম করতে গিয়েই মনে হল নীচে এবার পড়ে যাবে। পড়ে গেলে সেই অতল এক গহ্বর। অন্ধকারে গহ্বরটা ভয়াবহ মনে হচ্ছিল। কিন্তু সে উঁকি দিতেই দেখল, ওরা এসে গেছে, ওরা ওকে লক্ষ করে শলা এবার নিক্ষেপ করবে। সে ফের বলল, খুদা ভরসা, বলে লাফ দিয়ে অন্য পারে পড়তেই মনে হল বাঁ পাটা ভেঙে গেছে সে নড়তে পারছিল না, ওরা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে হা হা করে হাসছে। এখন খোঁচা মারলেই হাসিম সারা হয়ে যাবে, সে হাতজোড় করে পড়ে থাকল মাটিতে। সে গোঙাতে থাকল। এমন কাছে যখন পাওয়া গেছে, যখন আর কোনও দিক থেকে পালিয়ে যাবার উপায় নেই, তখন লাফ দিয়ে ওপারে চলে গেলে পিঠের ওপাশ থেকে শলাটা ঢুকিয়ে দিলে সুখের হয়। হাসিম ভয়ে কুকুরের মতো গুটিয়ে ছিল। হাসিম কিছু বলছিল না, কী যেন দেখছিল। শুধু শক্ত করে লাঠিটা ধরে রেখেছে ডান হাতে। সে শেষবারের মতো ওরা লাফ দিলে লাঠি দিয়ে ফাটলের মাঝখানে আটকে দিল পথটা। ওরা হড়কে নীচে পড়ে যেতে থাকল। হাসিম কোন তাড়াতাড়ি করল না। সে নীচে মুখ ঝুলিয়ে দিল--কী মিঞারা আসমান দ্যাখ, নদী দ্যাখ। কীরকম লাগে। কোনখানে আছ মিঞা। দোজখের পথটা চোখে পড়তাছেনি।' হাসিম এবার জোরে হা হা করে হেসে উঠল। পরাইন্যারে আর ভয় নাই। নদীতে সাঁতার দিয়া দ্যাখ পানিতে ঝিনুক আছে, সব ঝিনুকে মুক্তা হয় না রে, পরাইন্যা। বলে কেমন বিলাপ করতে থাকল। তারপর লাঠিটা পাশে রেখে খাদের ভিতর মুখটা ঢুকিয়ে বলল, 'কী গ মিঞারা, আল্লা সব হাওয়া গিল্যা ফ্যালাইছে! আল্লা কী কয়?'

কাতর শব্দ দ্রুত ফাটল থেকে উঠে ছড়িয়ে পড়ছিল মাঠময়। ফাটলের ভিতর মানুষ দুটোর উপর পাড় থেকে মাটি ধ্বসে পড়ছিল। তখন আঁধার মাঠ। তখন লণ্ঠন নেমে আসছে মাঠে। যব গমের খেতে লণ্ঠন হাতে মানুষ নেমে এসেছিল--কাফের যায় এক, চিৎকারে মানুষেরা ছুটে আসছিল। আর হাসিম হা হা করে হাসছিল। যেন বলার ইচ্ছা দ্যাখ দ্যাখ দুই কাফের জীবন্ত কবর যায়। বলে সে তার জামবাটির বাকি চিড়াগুড়টুকু ফাটলের মুখে ঢেলে দিল এবং বাটি দিয়ে বালি মাটি টেনে বড় বড় ধ্বস নামাল। নীচে তখন আর কাতর শব্দ শোনা যাচ্ছে না। সে মানুষ জনদের দেখে বলল, দুই কাফের যাচ্ছিল মিঞা-- দিলাম, গোরে দিয়া দিলাম।

আর অন্ধকারে হাসিমের মাটি ফেলার কাজ শেষ হচ্ছিল না। পরাণের মুখ কেবল মনে পড়ছিল। পরাণের মাথায় শড়কিটা পালকের মত আটকে ছিল। ওর চোখেমুখে কোনও দৃশ্য ঝুলে ছিল না। মৃত দুই চোখ নিয়ে সে অন্ধের মতো জলের উপর কেবল ভালবাসার ধন, ভালবাসার মাটি এবং ভালবাসার কিরণীকে খুঁজছিল। হাসিমকে দেখে মনে হচ্ছে সে ভয়ংকর দৃশ্য ভুলতে পারছে না, পাগলের মতো কেবল মাটি টেনে ফেলছে। জোয়ারের জল ফাটলের মুখে ঢুকে গেছে। মাটি জলের ভিতর পড়ে গুলে গুলে যাচ্ছে। ঘামে ওর শরীর ভিজে গেছে, সে খুঁট দিয়ে মুখ মুছে ফেলতেই দেখল সামনে এক লণ্ঠন জ্বলছে। দুজন লোক লণ্ঠন হাতে দাঁড়িয়ে আছে।

'অ মিঞা, পাগলের মতো মাটি ফ্যালতাছ ক্যান?'

হাসিম জবাব দিল না। সে পাগলের মতো মাটি আঁচড়ে নীচে টেনে টেনে ফেলছে।

ওরা ফের বলল, 'মাটির নীচে কী খোঁজতাছ?'

হাসিম এবার হায় হায় করে বিলাপ করে উঠল, মাটির নীচে সোনা খোঁজতাছি, মিঞা। আমার সোনা কোনখানে হারাইয়া গ্যাছে।'

ওরা হাসিমকে এবার যেন চিনতে পারল, তুমি হাসিম না?

কত দীর্ঘকাল পর যেন মনে হল সে যথার্থই হাসিম। সে সব ভুলে গিয়েছিল। ঘরে ওর বিবি জাবিদা আছে। সে এবার জামবাটিটা বুকের কাছে নিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে দেখল পারছে না, উঠতে পারছে না, সে ফের বসে বলল, 'আপনেরা!'

'পরাণের বউ কিরণীরে তুইল্যা দিয়া আইলাম।'

'আমারে ইবার তুইলা লন, আমি যাই।'



যব গম খেতের ভিতর পরাণের পায়রাগুলি তখন উড়ছিল, বক বকম করছিল। নদীর জলে পরাণ ডুব দিল। পাতিল বগলে পরাণ জলের নীচে শুয়ে ছিল। কোন দুঃখ ছিল না। নিজের দেশ, নিজের এই মাটিতে শুয়ে পরাণ স্বপ্ন দেখছে--কলমিলতায় আবার ফুল ফুটেছে। পাখি উড়ছে আকাশে। যব গম খেতের ভিতর পরাণ কিরণীর সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে।

 

জেমস জয়েসের গল্প : অতিথিশালা


জেমস জয়েসের গল্প : অতিথিশালা






অনুবাদ : মোবারক হোসেন খান

মিসেস মুনি ছিল এক কসাইয়ের মেয়ে। সংসারের কাজকর্মে খুব দক্ষ। আর অত্যন্ত জেদি মহিলা। পিতার দোকানের ফোরম্যানকে বিয়ে করে স্প্রিং গার্ডেনের কাছে নিজেরাই একটা মাংস বিক্রয়ের দোকান খুলল। কিন্তু শ্বশুর মারা যাওয়ার কিছুদিন যেতে না যেতেই মি. মুনি লাগামহীন জীবনযাপনের দিকে ঝোঁকে পড়ল। আকণ্ঠ মদ গিলে ভাঁড় হয়ে থাকত। দোকানের টাকা চুরি করে অপব্যয় করতে লাগল। ঋণে মাথা পর্যন্ত নিমজ্জিত হলো। অনেক চেষ্টা চরিত করেও মিসেস মুনি স্বামীর স্বভাব বদলাতে পারল না। হয়ত দু'চারদিন ঠিক থাকে। তারপর আবার যে কি সেই। খদ্দেরের সামনেই স্ত্রীকে গালিগালাজ করত। দোকানে বিক্রির জন্য খারাপ মাংস কিনে আনত। ফলে, ব্যবসাটা একেবারে অধঃপাতে যেতে বসল। একদিন তো সে মাংস কাটার ছুরি নিয়ে স্ত্রীকে তাড়া করল। বেচারী স্ত্রীকে বাধ্য হয়ে সে রাতটা প্রতিবেশীর বাড়িতে কাটাতে হলো।

তারপরের দিন থেকে তারা আলাদা থাকতে লাগল। মিসেস মুনি ধর্মযাজকের কাছে গিয়ে তালাকের সব ঠিকঠাক করে এলো। সে সঙ্গে ছেলেমেয়েদের নিজের তত্ত্বাবধানে রাখার জন্য সব ব্যবস্থা করতেও ভুললো না। স্বামীকে সে কিছুই দিল না। না টাকা, না খাদ্য সামগ্রী, না আশ্রয়। স্বামী বেচারা তখন শেরীফের শরণাপন্ন হয়ে একটা চাকরির জন্য রোজ রোজ ধরনা দিতে লাগল। মিসেস মুনি মাংস বিক্রয়ের সঞ্চিত টাকা দিয়ে হার্ডউইক স্ট্রিটে একটি বোর্ডিং হাউস খুলল। তার বোর্ডিং হাউসে লিভারপুল আর আইন অব ম্যান থেকে পর্যটকরা ভিড় জমাত। তাছাড়া, কিছু শিল্পীও এখানে থাকত। বোর্ডিং হাউসের অধিকাংশ বাসিন্দাই ছিল শহরের করণিক। মিসেস মুনি বেশ চাতুর্য আর দৃঢ়তার সঙ্গে বোর্ডিং হাউস তত্ত্বাবধান করত। কখন বাকি দিতে হবে আর কখন শক্ত হতে হবে কিংবা কখন চুপ থাকতে হবে সব কিছুই বেশ আয়ত্ব করে ফেলেছিল। বোর্ডিং হাউসের তরুণ বাসিন্দারা তাকে 'মাদাম' বলে ডাকত।

মিসেস মুনির বোর্ডিং হাউসের তরুণ বাসিন্দাদের থাকা-খাওয়ার জন্য সপ্তাহে পনেরো শিলিং দিতে হতো। অবশ্য খাওয়ার সঙ্গে বিয়ার বা দামি ডিনার অন্তর্ভুক্ত ছিল না। অধিবাসীদের সবার রুচি আর পেশা একই ধরনের ছিল বলে তাদের পরস্পরের মধ্যে বেশ বন্ধুত্ব ছিল। তারা নিজেদের মধ্যে তাদের প্রিয় ব্যক্তিদের সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করত। মাদামের পুত্র জ্যাক মুনি ফ্রিট স্ট্রিটে এক কমিশন এজেন্টের ওখানে চাকরি করত। বেশ রুঢ় বলে তার বদনাম ছিল। তার স্বভাব-চরিতও ভালো ছিল না। গভীর রাতে বাড়ি ফিরত। প্রতি রোববার রাতে মিসেস মুনির ড্রয়িং রুমে হামেশাই সবাই আনন্দ হৈ-হুল্লোড় করার জন্য মিলিত হতো। সঙ্গীত শিল্পীরা গান গাইতো। বাদকরা গানের সঙ্গ বাদ্যযন্ত্রে ঝংকার তুলত। মাদামের কন্যা পলি মুনিও গান গাইতঃ

‘আমি এক... বদ ছোকড়ি
সব রকম ভানের খেতা পুড়ি!
ভাল করেই জানো তো আমায়।’

পলির বয়স উনিশ। হালকা-পাতলা গড়ন। মাথার চুলগুলো বেশ কোমল আর ছোট মুখটা বেশ ভরাটে। ধূসর চোখ দুটোর চারদিকে সবুজের ছায়া। কারো সঙ্গে কথা বলার সময় উপরের দিকে তাকানো তার স্বভাব। ফলে, তাকে বেপথু ম্যাডোনা বলে মনে হতো। মিসেস মুনি কন্যাকে প্রথমে কর্ন-ফ্যাক্টরের অফিসে টাইপিস্ট হওয়ার জন্য পাঠাল। কিন্তু শেরীফের অফিস থেকে এক বদমাস লোক একদিন অন্তর সেখানে এসে তার কন্যার সঙ্গে কথা বলতে চাইতো বলে মিসেস মুনি কন্যাকে বাড়িতে এসে ঘরকন্যার কাজে লাগিয়ে দিল। অবশ্য এর পেছনে মিসেস মুনির আরেকটা উদ্দেশ্যও ছিল। পলির বয়স কম বলে বেশ প্রাণচঞ্চল। বোর্ডিং হাউসের বাসিন্দারা স্বাভাবিকভাবেই এজন্য একটা বাড়তি আকর্ষণ বোধ করত। পলি অবশ্য শুধু তরুণীদের সঙ্গেই মেলামেশা করতে ভালোবাসত। মিসেস মুনি এতে বাধা দিত না। কারণ, যুবকের দল যে বেশি দিন একঘাটের জল খেতে পছন্দ করে না সে কথা তার জানা ছিল। এভাবে বেশ কয়েক দিন পার হয়ে গেল। মিসেস মুনি মেয়েকে আবার টাইপ-রাইটিংয়ের কাজে পাঠাবে বলে ঠিক করতে গিয়ে এক তরুণের সঙ্গে পলির মন দেয়ানেয়ার পালা চলছে বুঝতে পারল। মিসেস মুনি দু'জনের ওপর নজর রাখতে লাগল আর মনে মনে নিজের কর্তব্য স্থির করতে লাগল।

পলি অবশ্য বুঝতে পারল তার ওপর নজর রাখা হচ্ছে। মায়ের নীরবতার উদ্দেশ্য বুঝতে তার কষ্ট হলো না। মা ও মেয়ের মধ্যে যেমন খোলাখুলি বিরোধিতা ছিল না তেমনি দু'জনের মধ্যে কোনো অকপট বোঝাপাড়াও ছিল না। কিন্তু তাই বলে মানুষের মুখ তো আর চাপা দিয়ে রাখা যায় না। বোর্ডিং হাউসের বাসিন্দারা দু'জনের হৃদয়ঘটিত ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনামুখর হয়ে উঠল। তাসত্ত্বেও মিসেস মুনি বাধা দিল না। পলি মায়ের আচরণে বিস্ময় বোধ করতে লাগল। আর প্রেমিকপ্রবর মনের ভিতরে অশ্বস্তিতে ভোগতে লাগল। অবশেষে, মিসেস মুনি যখন বুঝল, হস্তক্ষেপ করার সময় উপস্থিত, তখন আর দেরি করল না।

সেদিনটা ছিল রোববার। রৌদ্রকরোজ্জ্বল দিন। তাপ থাকলেও হালকা বাতাসের দরুণ প্রখরতার তীব্রতা অসহ্য ছিল না। বোর্ডিং হাউসের সব জানালা খোলা। বাতাসে জানালার পর্দাগুলো দোলছিল। গির্জা থেকে মৃদ্যু ঘণ্টাধ্বনি ভেসে আসছিল। বোর্ডিং হাউসের বাসিন্দাদের ব্রেকফাস্ট শেষ হয়ে গিয়েছিল, টেবিলের ওপর কাপ-প্লেটগুলো ইতঃস্তত ছাড়ল। প্লেটের গায়ে ডিমের হলুদ কুসুম আর শুকরের চর্বির উচ্ছিষ্ট লেগেছিল। মিসেস মুনির পরিচারিকা মেরী টেবিল থেকে পরিত্যক্ত কাপ-প্লেটগুলো পরিষ্কার করার কাজে ব্যস্ত। মিসেস মুনি একটা হাতাঅলা চেয়ারে বসে মেরীর কাজ দেখছিল। আর মাঝেমধ্যে এটা ওটা নির্দেশ দিচ্ছিল। মিসেস মুনির নির্দেশমতো মেরি পাউরুটির উচ্ছিষ্ট শক্ত কিনারগুলো পুডিং তৈরির জন্য এক জায়গায় জমা করে রেখ দিল। চিনি আর মাখনের ভা- মিটসিবে তুলে রেখে তালা মেরে রাখল। মিসেস মুনি গত রাতে পলির সঙ্গে কথাবার্তাগুলো নতুন করে রোমন্থন করতে লাগল। সে যা সন্দেহ করেছিল ঘটনা তা-ই ঘটেছে। সে যেমন পলিকে খোলাখুলি প্রশ্ন করেছে, পলিও তেমনি খোলাখুলি উত্তর দিয়েছে। অবশ্য দু'জনেই কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করেছি। মিসেস মুনি এভাবে মেয়ের কাছ থেকে কথা শুনবে। কোনোদিন যেমন ভাবেনি, পলিও মায়ের কাছ থেকে এ ধরনের আচরণ প্রত্যাশা করেনি।

মিসেস মুনি হঠাৎ যেন সম্বিৎ ফিরে পেল। গির্জার ঘণ্টাধ্বনি থেমে যেতেই সে দেয়ালে ঝুলানো ঘড়িটার দিকে তাকালো। এগারোটা বেজে সতেরো মিনিট। ডোরানের সঙ্গে দুপুর বারোটার মধ্যেই একটা ফয়সালা করে ফেলতে পারবে বলে ভালো। আর সে যে জিতবে তাতে নিশ্চিত ছিল। কেননা, প্রথমত সামাজিক অভিমত তার পক্ষে এবং দ্বিতীয়ত সে একজন অপমাণিত জননী। সে ডোরানকে একজন ভদ্রলোক ভেবে তার বোর্ডিং হাউসে থাকতে দিয়েছে, আর সে কিনা মিসেস মুনি'র আতিথেয়তার সুযোগ নিয়ে তাকে অপমান করল। তার বয়স তো চৌত্রিশ কিংবা পঁয়ত্রিশ হবে। এ বয়সে নিশ্চয় তার কা-কারখানকে তারুণ্যের উচ্ছলতা বলে ক্ষমা করা যায় না। দুনিয়ার অনেক কিছুই সে দেখেছে। সুতরাং এটা তার অজ্ঞতার ওজরও হতে পারে না। না, না সে পলির তারুণ্য আর অনভিজ্ঞতার সুযোগ নিয়েছে। মিসেস মুনির এতে আর কোনো সন্দেহ নেই। ডোরান এর ক্ষতিপূরণ কি দেবে সেটাই হলো কথা।

এ ধরনের ঘটনার ক্ষতিপূরণ নিশ্চয় থাকতে হবে। মজা লুটবার জন্য পুরুষরা যা খুশি তা করে চলে যাবে আর মেয়েরা তার ঝক্কিঝামেলা পোহাত। তা হতে পারে না। না, কিছুতেই নয়। কোনো কোনো মা হয়ত টাকা-পয়সার এ ধরনের ঘটনা ধামাচাপা দিয়েই সন্তুষ্ট হতো। মিসেস মুনি অনেক দেখেছে। কিন্তু সে কিছুতেই তেমন কাজ করবে না। মেয়ের মর্যাদাহানির উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ তার কাছে একটাই, সেটা হলো বিয়ে।

মিসেস মুনি মনে মনে আবার সব দিক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার বেশ্লেষণ করল। তারপর ডোরানকে খবর দেয়ার জন্য মেরীকে পাঠাল। ডোরানের সঙ্গে মিসেস মুনি ব্যাপারটার ফায়সালা করবে। আর সে যে জিতবে এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। ডোরান খুবই সিরিয়াস মানুষ। অন্যদের মতো লম্পট বা ধূর্ত নয়। শেরিডন বা সিড়ে কিংবা বানটাম হলে মিসেস মুনির পক্ষে কাজটা খুব কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ত। ডোরান নিশ্চয়ই ব্যাপারটা নিয়ে হইচই হোক তা চাইবে না। বোর্ডিং হাউসের সবাই ঘটনা জেনে ফেলেছে, কেউ কেউ বেশ মুখরোচক কাহিনীও উদ্ভাবন করে ফেলেছে। গত তেরো বছর ধরে ডোরান ক্যাথলিক ওয়াইন-মার্চেন্টের ওখানে চাকরি করছে। এ ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে তাকে চাকরিটা খোয়াতে হবে অথচ মিসেস মুনির প্রস্তাব মেনে নিলে সবকিছুরই একটা শান্তিপূর্ণ মীমাংসা হয়ে যাবে।

আধঘণ্টা প্রায় হয়ে গেল। মিসেস মুনি চেয়ার ছেড়ে উঠে আয়নার নিজের চেহারাটা পরীক্ষা করে দেখে নিল। চেহারায় দৃঢ়তার ছাপ দেখে মনে মনে সন্তুষ্ট হলো। অন্য যাদের কথা মনে হলো, নিশ্চয় তারা মিসেস মুনির' মতো ঘটনার নিষ্পত্তি করত না। বরং মেয়ের এ ঘটনা পুঁজি করে বেশ কিছু কামাই করে নিত।

ডোরানকে রোববার সকালে খুবই উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছিল। দু'দুবার চেষ্টা করেও দাড়ি কামাতে পারল না। দু'তিনদিনের না কামানো দাড়ি গালে বারবার খোঁচা দিল। দু'তিন মিনিট পর পর চোখের চশমার কাচগুলোর ঘামে ঝাপসা হয়ে উঠছিল বলে পকেট থেকে রুমাল বের করে বারবার মুছতে হচ্ছিল। গত পরশু রাতের স্বীকারোক্তির কথাগুলো মনে হতেই কেমন যেন সব গুলিয়ে যাচ্ছিল। বুকের ভিতরে একটা দারুণ ব্যথা অনুভব করছিল। ধর্মযাজক ঘটনার প্রতিটি বর্ণনা খুটিয়ে খুটিয়ে বিচার করে পাপের পরিণতি এত বড় করে তার সামনে তুলে ধরছিলেন যে শেষপর্যন্ত এ ব্যাপারে ক্ষতিপূরণের একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তার মনে শান্তি ফিরে এসেছিল। বিয়ে করা অথবা পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কি করতে পারে সে? না, সে নির্লজ্জ হতে পারবে না। ঘটনা লুকিয়ে থাকবে না। মানুষ এ নিয়ে কথা বলবেই আর সে কথা একান্ত সেখান হয়ে তার মনিবের কানে নিশ্চিত পেঁৗছবে। ডাবলিন খুবই ছোট শহর। এখানে সবাই সবাইকে চেনে, জানে। মনিবের গলার স্বর যেন কল্পনায় সে শুনতে পেল। মনিব তাকে ডেকে আনার জন্য নির্দেশ দিচ্ছেন_ ‘যাওতো, ডোরিনকে এখানে আসতে বলো।' সে টের পেল তার হৃৎপিন্ড কণ্ঠার কাছে ধুকধুক করছে।

তার এত বছরের খাটাখাটনি সব বৃথা গেল। বয়সের দোষে একটু ফুর্তিফার্তা করতে গিয়ে গোল্লায় গেল তার এতদিনের সমস্ত পরিশ্রম আর অধ্যবসায়! তারুণ্যের দিনগুলোতে সে বীজ বপন করেছিল, তার মুক্ত চিন্তার জন্য সে গর্ব করত। সব কিছু আজ বিনষ্ট হওয়ার পথে। সে ধর্মের অনুশাসনগুলো ঠিকঠাকমতো পালন করে চলেছে, ধরতে গেলে বছরের পুরো সময়ে সে নিয়মিত জীবনযাপন করে আসছে। তার যে টাকা সঞ্চিত আছে তা দিয়ে সে সুন্দরভাবে ব্যাপারটা মিটিয়ে ফেলতে পারে। কিন্তু কথা সেটা না। কিন্ত মেয়েটির বাড়ির লোক তো মেয়েটিকে ঘেন্না করবে। প্রথমেই তো আছে তার কুখ্যাত বাবা; এমনিতেই তার বাপেরও সুনাম নেই, ওদিকে মায়ের বোর্ডিং হাউসের যা সুনাম হচ্ছিল তাও ভেস্তে যাবে। তার মাথাটা কেমন যেন চক্কর দিয়ে উঠল। গেল সব তাহলে! কল্পনায় সে দেখতে পেল তার দিকে তাকিয়ে সবাই উপহাস করছে; তার আর পলির ব্যাপার নিয়ে ফিসফিস করার চিত্র তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। মেয়েটা অবশ্য কিছুটা অশিষ্ট। হয়তো বলবে, ইস, যদি জানতাম এমন ঘটবে তাহলে কি আর ওপথ মাড়াই। কিন্তু ঘটনা তো ঘটে গেছে, তাহলে মেয়েটিকে ভালোবাসতে তার দোষ কোথায়? পলি যা করেছে তার জন্য সে পলিকে ভালোবাসবে, না ঘৃণা করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। অবশ্য সেও সমানভাবেই দোষী। কারণ, সেও একই কাজে রত হয়েছিল! তার মন বলছিল এড়িয়ে যাও, বিয়ে করো না। বিয়ে একবার করেছ তো জীবনের বারোটা বেজে গেল।

সে খাটের ওপর বসে ভাবছিল। গায়ে জামা আর পরনে পাজামা। পলি দরজায় মৃদু টোকা দিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকল। পলি তার কাছে সব কথা খুলে বলায় পলি তার মায়ের কাছে তাদের দু'জনের ঘনিষ্ঠতার কথা খোলাখুলিভাবে বলেছে। পলির মা ডোরানের সঙ্গে সকালে কথা বলবে। কথা বলতে বলতে পলি কান্নাজড়িত কণ্ঠে ডোরানের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ও, বব! বব! আমি কি করব? উহ, আমি কি যে করব!

না, তার আর বেঁচে থাকার ইচ্ছা নেই, পলি জানাল।
ডোরান পলিকে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করল। কিন্তু তার সে সান্ত্বনায় তত জোর ছিল না। পলিকে সে কাঁদতে বারণ করল। সব ঠিক হয়ে যাবে। ভাবনার কিছু নেই। ডোরান তার জামার ওপর দিয়ে পলির আবেগজড়িত কণ্ঠ উষ্ণ ছোঁয়া অনুভব করছিল।

যা ঘটে গেছে সবটাই অবশ্য ডোরানের দোষ নয়। তাদের প্রথম পরিচয়ের দিনগুলোতে এই ডোরান মেয়েটিকে এক ঝটকায় বিছানায় নিয়ে যাবার চিন্তা কল্পনায় উত্তপ্ত ইমেজ তৈরি করার বাসনা দমিয়ে রাখত কিন্ত তারপরও একটি অবিবাহিত তরুণীর আঙুলের ছোঁয়া, তার শ্বাসপ্রশ্বাস, তার পোশাকের সযত্ন সোহাগ ডোরানকে কেমন আনমনা করে তুলছিল মনে পড়ে গেল। তারপর একদিন সে যখন ঘুমাতে যাওয়ার জন্য পোশাক বদলাছছিল তখন তার দরজায় পলির ভীরু আঙ্গুলের টোকা শুনতে পেল। পলির মোমবাতিটি বাতাসে নিভে গিয়েছিল বলে সে ডোরানের মোমবাতি থেকে আগুন ধরাতে এসেছিল। সেটা ছিল পলির স্নানের রাত। তার পরনে ছিল বুক খোলা ঢিলা পোশাক। সস্নিপারের ফাঁকে তার গায়ের মাংসল গোছা দেখা যাচ্ছিল। পায়ের রক্তিম গোছা থেকে যেন একটা সুগন্ধ ভেসে আসছিল। যে হাতে সে মোমবাতিটা ধরাচ্ছিল সে হাতের কব্জি থেকেও যেন একটা মৃদু সুগন্ধ ভেসে আসছিল।

যেদিন রাতে ডোরান দেরিতে ফিরত সেদিন পলি তাকে ডিনার গরম করে পরিবেশন করত। নিদ্রামগ্ন বাড়িতে গভীর রাতে একাকী পলি তার পাশে বসে থাকত। ডোরান কি না কি খাচ্ছে বুঝতেও পারত না। পলির সেবাযত্নের যেন কোনো তুলনা হয় না। রাতটা যেদিন হিমশীতল বা ঝড়ো থাকতো সেদিন অবশ্যই বাড়তি খাবার হিসেবে তার ভাগ্যে জুটত। হয়ত বিয়ে হলে দু'জনে সুখেই থাকবে...।

তারা দু'জনে পা টিপে টিপে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠত। দু'জনের হাতে থাকত দুটো মোমবাতি। বিদায় নেয়ার আগে পরস্পর পরস্পরকে চুমু খেত। পলির চোখের চাহনি, তার হাতের ছোঁয়া আর তার নিজের প্রবল উত্তেজনার মুহূর্তগুলো এখনো যেন জ্বল জ্বল করে তার চোখের ওপর ভাসছে...।

তবে উত্তেজনারও প্রশমন ঘটে। পলির কথাগুলোই যেন তার নিজের মনেও একই প্রতিধ্বনি তোলে_ আমি কি করব? তার তারুণ্য তাকে পিছে সরে দাঁড়াতে বলে। কিন্তু পাপ, যে পাপ সে করে বসে আছে তার কি হবে। তার শ্রদ্ধাশীল মন বলে_ পাপের ক্ষতিপূরণ তাকে করতেই হবে।

পলিকে পাশে নিয়ে বসে যে যখন চিন্তার সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিল তখন মেরী ঘরে ঢুকে ডোরানকে নিচের ঘরে মিসেস মুনির সঙ্গে দেখা করতে খবর দিল। ডোরান উঠে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে কোটটা তুলে গায়ে দিল। ভীষণ অসহায় বোধ করছিল সে। পলিকে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে গেল। সব ঠিক হয়ে যাবে, কোনো ভয় নেই। ডোরান পলিকে রেখে চলে গেল। পলি বিছানায় আছড়ে পড়ে কান্নার আবেগে বলে উঠল, উহ্, ইশ্বর!

সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার সময় চশমার কাচ আবার ঝাপসা হয়ে গেল। ডোরান চোখ থেকে খুলে রুমাল দিয়ে মুছে নিলো। তার মনে হচ্ছিল, ধরনী দ্বিধা হও, আমি তোমার ভিতরে আশ্রয় নিই।
কিন্তু, ধরনী দ্বিধা হলো না। অগত্যা মন্থর পদে সে নিচে নামতে লাগল। তার মনিবের নির্দয় চাহনি আর তার পরাজিত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা বোর্ডিং হাউসের মাদামের চেহারাটা তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। সিঁড়ির নিচের সোপানে পলির ভাই জ্যাক মুনি তার পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। তার হাতে দু'বোতল মদ। দু'জনে পরস্পরকে অভিবাদন জানাল। কিন্তু দু'জনের কণ্ঠস্বরই কেমন যেন শীতল। সিঁড়ির নিচের সোপান থেকে ডোরান উপরের দিকে তাকালো, দেখল উপরের সিঁড়ি থেকে জ্যাক তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে।

হঠাৎ একদিন রাতের কথা ডোরানের মনে পড়ে গেল। একজন সঙ্গীত শিল্পী, সোনালি চুলের এক খুদে লন্ডনবাসী, পলির দিকে বেশ খোলাখুলি একটা ইঙ্গিত করেছিল। কিন্তু তাদের সে অন্তরঙ্গতা শেষ পর্যন্ত জ্যাকের গুন্ডামিতে ভেঙে গিয়েছিল। সেদিন রাতে জ্যাক জন্তুর মতো আচরণ করেছিল। সবাই তাকে ঠা-ন্ডা করতে চেষ্টা করতে লাগল। সেই সঙ্গীতশিল্পী, একটু ফ্যাকাসে তখন, মুখে অপ্রস্তুতের একটা হাসি টেনে বারবার বলেছিল, তার মনে কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই। কিন্তু জ্যাক বরাবরের মতো চিৎকার করে তার বোনের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করতে চেষ্টা করলে সঙ্গীতশিল্পীর দাঁতের পাটি ভেঙে পেটের ভিতরে ঢুকিয়ে দেবে বলে শাসাতে লাগল। তাই করবে সে।

পলি কিছুক্ষণ ধরে খাটের এক প্রান্তে বসে রইল। তার চোখে অশ্রু। একটু পর চোখের অশ্রু মুছে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। একটা তোয়ালে নিয়ে জগের ভিতর কোণাটা ডুবিয়ে ঠান্ডা জল দিয়ে চোখ দুটো মুছে সতেজ করে নিলো। এক পাশ ফিরে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো। কানের ঠিক উপরে একটা চুলের কাঁটা ঠিক করল। তারপর আবার ফিরে গিয়ে খাটের ওপর বসে পড়ল। সে অনেকক্ষণ ধরে বালিশগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। সেগুলো দেখে তার মনের ভিতর একটা গোপন সুখ-স্মৃতি জেগে উঠল। মাথাটা খাটের রেলিং এলিয়ে দিয়ে এক সুখের স্বপ্ন বিভোর হয়ে পড়ল পলি। তার চেহারায় উদ্বেগের আর কোনো লেশ রইল না।

সে প্রফুল্লচিত্তে ধৈর্যের সঙ্গে অপেক্ষা করতে লাগল। তার হৃদয়ে ভয়ের কোনো আশঙ্কা নেই। তার মনের পটে আশা আর ভবিষ্যৎ জীবনের একটা স্বপ্নময় ছবি ধীরে ধীরে রূপ নিয়ে ভেসে উঠল। তার আশা আর মনের স্বপ্নটা আস্তে আস্তে এমন জটিল হয়ে উঠতে লাগল যে তার চোখের সামনে থেকে সাদা বালিশগুলো অদৃশ্য হয়ে গেল। আর সে কিসের জন্য অপেক্ষা করছে সেকথাও বেমালুম ভুলে গেল।

অনেকক্ষণ কেটে গেল। এমন সময় পলি মায়ের ডাক শুনতে পেল। সে খাট থেকে উঠে দাঁড়াল। তারপর এক ছুটে সিঁড়ির রেলিংয়ের কাছে ছুটে গেল।
পলি! পলি!
আমাকে ডাকছো, মা?
এদিকে এসো তো মা। ডোরান তোমার সঙ্গে কথা বলবে।
আর ঠিক তক্ষণই পলির মনে পড়ে গেল এতক্ষণ ধরে কিসের জন্য সে অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিল।

(লেখক পরিচিতি : জেমস জয়স ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে ডাবলিনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জেস্যুট স্কুলে লেখাপড়া করেন এবং ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে ইউনিভার্সিটি কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি লাভ করেন। তার দু'বছর পর তিনি আয়ারল্যান্ড ছেড়ে চলে যান। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে স্বল্পকালের জন্য আরেকবার আসেন। তিনি ট্রিয়েস্টে শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং বার্লিজ স্কুলে ভাষা-শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবনে ব্রতী হন। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে তার কবিতা সঙ্কলন 'চেম্বার মিউজিক' প্রকাশিত হয়, ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে ছোট গল্পের সঙ্কলন 'ডাবলিনার্স', ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস 'এ পোট্র্রেট অব দ্য আর্টিস্ট এজ এ ইয়ং ম্যান' প্রকাশিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জয়েস জুরিখ চলে যান এবং ইউলিসিস রচনা শুরু করেন। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে 'ইউলিসিস' প্যারিস থেকে প্রকাশিত হয়। তার দু'বছর পর জয়েস গ্যারিস শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে ফিনেগানস ওয়েক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি জুরিখ ফিরে যান এবং সেখানেই এই বিরলপ্রজ সাহিত্যিকের জীবনাবসান ঘটে। তাঁর ইউলিসিস গত শতকের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের মর্যাদা পায়। অতিথিশালা তার লেখা 'বোর্ডিং-হাউস' গল্পের অনুবাদ)

[পাঠকের স্বীকারোক্তি: এই গল্পটার অন্য এক অনুবাদও আছে যাতে মূল লেখা অনুসরণ করা হয়েছে। বাক্যগুলো বেশ লম্বা লম্বা। তাতে মাঝে মাঝে নিরস লাগলেও মূলের একটা স্বাদ পাওয়া যায়। কিন্তু এই অনুবাদটা সহজবোধ্য করতে গিয়ে মূলের লম্বা বাক্য ভেঙ্গে ভেঙ্গে ছোট ছোট বাক্যে পরিণত করা হয়েছে এবং এতে গল্পটা মূলের সুরটা অনেকটা ক্ষুণ্ণ হয়ে গেছে। মাঝে মাঝে দুএক লাইন করে বাদও দেওয়া হয়েছে। তবুও জয়েসের গল্প বলে কথা! তাঁর গল্পের একজাক্ট অনুবাদ বাংলায় সম্ভব না খুব সম্ভব।]



"দেখিব কাঁঠাল পাতা ঝরিতেছে..."-অদিতি ফাল্গুনী


ইস্কান্দার যে! অনেকদিন পর!

শাদা ধবধবে পাজামা-পাঞ্জাবি পরা ইস্কান্দারের চেহারা আজও খুবই সুন্দর। ফর্সাহাল্কা-পাতলা আর মাঝারির চেয়ে কিছুটা বেশি লম্বা। একটা চোখে কালো ঠুলি। নাযুদ্ধ ত’ ওকে অন্ধ বা খঞ্জ করেনি। তবে চোখে ঠুলি কেনহাতে একটা লাঠি। ইস্কান্দারের পাশে সালোয়ার-কামিজ পরা এক ফুটফুটে তরুণী। ইস্কান্দার আমাকে চিনলো। যুদ্ধের সময় ভারতের লক্ষ্ণৌয়ের সেন্ট্রাল মিলিটারি কমান্ড হাসপাতালে আমরা কয়েক মাস পাশাপাশি বেডে ছিলাম।
আমার আঘাত নিরাময়যোগ্য হলো না বলে দেশে ফিরলাম হুইল চেয়ারে। ইস্কান্দার সুস্থ হয়েই ফিরেছে। এই রেস্ট হাউসে মাঝে মাঝে আসত বা আসে ইস্কান্দার। মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টেই চাকরি করে। কিন্তু চোখে কী হয়েছে?

তোমার চোখে ওটা কী পরেছোকী হয়েছে?’

ইস্কান্দার উত্তর করলো না। উত্তর করলো ওর সাথে আসা মেয়েটি,

আঙ্কেলআব্বুর রিসেন্টলি ব্রেইন টিউমার ধরা পড়েছে। একটা চোখ হঠাৎ করেই আই সাইট লস করেছে। গলার স্বরও হঠাৎ করেই প্যারালাইজড্ হয়ে যাওয়ায় কথা বলতে পারছেন না। আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করুন।

ইস্কান্দার আমার দিকে তাকিয়ে পরিচিতের হাসি হাসলো। আমাদের এই বিশ্রামাগারে হাতের বাম দিকের অংশে আমরা থাকি। আর ডান দিকে একটা ছোট অফিস রুম। অফিস রুমের পাশেই একটা টিভি রুম। যেখানে পাশাপাশি কয়েকটা সোফা। অসুস্থ দিন-রাতের বেশ কিছুটা সময় এই টিভি রুমে চলে যায়।

তুমি ইস্কান্দারের মেয়েতোমাকে কি আগে দেখেছি মা?’

আব্বুর সাথে নানা কাজে-কর্মে আমার ছোট ভাইয়াই আসে। ভাইয়ার রিসেন্টলি বগুড়ায় একটা জব হওয়ায় ঢাকায় নেই। তাই আমাকেই আব্বুর সাথে বের হতে হচ্ছে। আমি শায়লা। ইউডায় বিবিএ থার্ড ইয়ারে অনার্স পড়ছি।

বসো।

হাত দেখিয়ে বসতে বলি ওদের অফিস রুমের সোফায়। যুদ্ধে আধাআধি অসুস্থ প্রাক্তন সৈনিকেরা কখনো সরকারের কাছে ওষুধ খরচডিসএ্যাবিলিটির পার্সেন্টেজ অনুযায়ী ভাতার পরিমাণ নিয়ে দর-দস্তুর ইত্যাদি নানা আবেদন নিয়ে তেজগাঁওয়ের মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট’ অফিস থেকে অসংখ্য সিল-ছাপ্পড় যুক্ত নানা চিঠি এনে চলে আসে এই বিশ্রামাগার অফিসের ইন-চার্জের কাছে। আবার ইন-চার্জের কাছ থেকে নতুন সিল-ছাপ্পড় ভরা চিঠি নিয়ে ছোটে কল্যাণ ট্রাস্ট অফিসে। এই বিশ্রামাগারও কল্যাণ ট্রাস্টেরই আওতাধীন। আমার মতো সম্পূর্ণ হুইলচেয়ার বন্দীরা থাকে সম্বৎসরকাল। ঢাকার বাইরের আধা অসুস্থ যোদ্ধারা বছরে এক/দুবার চেক-আপ করতে আর যুদ্ধে পুরোপুরি চলৎশক্তি হারানো পুরনো সাথিদের দেখতে আসে এখানে। চেক-আপের সময়টা বিশ্রামাগারের অফিসেই তারা ডাক্তার পায়। ডাক্তার তাদের প্রেসক্রিপশন দেখে প্রয়োজনে ওষুধের রদ বদল করেন। ঢাকায় অন্য কোন হোটেল বা আত্মীয় বাড়ি থাকার চেয়ে এই বিশ্রামাগারেই কদিন থেকে খেয়ে দিব্যি চলে তাদের। আসলে যুদ্ধে একবার আহত হলেআমাদের মতো সম্পূর্ণ পঙ্গু না হলেওশরীরটা আর কখনোই স্ববশে থাকে না। যত দিন যায় ততই ডিসএ্যাবিলিটির পার্সেন্টেজ বাড়তে থাকে। যার হয়তো দশ বছর আগেও হাতেকোমরে বা পায়ে পাঁচ পার্সেন্ট ডিসএ্যাবিলিটি ছিলদশ বছর পরে সেই ডিসএ্যাবিলিটি হয়তো বেড়ে পনেরো বা কুড়ি পার্সেন্টে দাঁড়ায়। যুদ্ধের পরও লাঠি ছাড়া হাঁটতে পারা কেউ কেউ ১৯৮০-৮১ সাল নাগাদ হুইল চেয়ার বন্দী হয়ে এখানে চলে আসে নি বাকি জীবনের মতোঢাকার ভেতরেও যারা আধা অসুস্থ যোদ্ধাযারা জীবনের স্রোত থেকে আমাদের মতো পুরোপুরি ছিটকে পড়েনি… তারাও কখনো কখনো চেক-আপ বা প্রেসক্রিপশন আপডেট রাখতে কি কখনো আমাদের মতো সম্পূর্ণ অচল হয়ে যাওয়া সাথিদের দেখতে চলে আসে। ইস্কান্দার সুস্থসবল মানুষ। দিব্যি চাকরি করছিল। তার হঠাৎ কী হলোমনে আছে লক্ষ্ণৌয়ের সেন্ট্রাল মিলিটারি কমান্ড হাসপাতালে আমি ওর দিন পনেরো আগেই ভর্তি হয়েছিলাম। আমি আর মধু। ইস্কান্দারভিন্ন সেক্টর আর ভিন্ন এলাকা১১ নম্বর সেক্টর আর টাঙ্গাইল থেকে যুদ্ধে আহত হয়ে এখানে এসেছিল। প্রথমে অবশ্য ওকে পাঠানো হয়েছিল মেঘালয়ের তুরা টেন্টস্ হাসপাতালে।’ ইস্কান্দার আসার আগের দিনই দক্ষিণ ভারতীয় নার্স শ্রীলেখা আমাদের বলেছিল, ‘এ্যানাদার বাংলাদেশী বয় ইজ কামিং টুমরো ইন ইওর ওয়ার্ড।’ তামিল শ্রীলেখা কখনোই আমাদের সাথে হিন্দিতে কথা বলে নি। শ্রীলেখাই জানালো যে এই নতুন ছেলেটি অলরেডি এই হাসপাতালের পোস্ট অপারেটিভ সেকশনে বিশ্রামে আছে। আরো জানা গেল যে তুরা টেন্টস্ হাসপাতালে’ পাঁচ দিন অচেতন থাকার পর সামরিক হেলিকপ্টারে করে লক্ষ্ণৌ হাসপাতালে গত পরশু দুপুর বারটায় পৌঁছানোর পরই কোমর আর মেরুদণ্ডের নিচে যেখানে গুলি লেগেছে সেখানে অপারেশন করে গুলি সরানো হয়েছে। দুদিন ইনটেন্সিভ কেয়ার ইউনিটে থাকার পর আগামীকাল সন্ধ্যায় তাকে আমাদের এই ওয়ার্ডে আনা হবে। আসলে লক্ষ্ণৌয়ের হাসপাতালে বসে আমরা সবসময়ই অপেক্ষা করতাম বাংলাদেশ থেকেমুক্তিবাহিনী থেকে নতুন কেউ আসে কিনা!

আহত হয়ে লক্ষ্ণৌ হাসপাতালে পড়ে থাকার ঐ দিনগুলোয় মুক্তিবাহিনীর কতজনই ত’ আহত হয়ে আসছে গেছে। ইস্কান্দারের আসার কথা এ কারণে মনে আছে যে ওর ঝোলায় ছিল রূপসী বাংলা।’ স্ট্রেচারে করে সন্ধ্যায় যেদিন প্রথম আনা হলো তখন ওর হাতে স্যালাইন। অবশ্য সেন্স আছে। স্যালাইন তার খোলা হলো আর পরদিন সন্ধ্যায়। সেদিন আমাদের ওয়ার্ডের জানালা থেকে সন্ধ্যার রক্তবর্ণ আকাশ দেখে আমি কি ওর পাশের বেডে গুনগুন করে উঠেছিলাম: তুমি সন্ধ্যার মেঘমালাতুমি আমার সাধের সাধনা!?’ সেই অবর্ণণীয় সঙ্কট মূহূর্তেও কি সুর ভেঁজেছিলাম?

ইস্কান্দার তার সদ্য স্যালাইনের সুঁই মুক্ত হাত কিন্তু ব্যান্ডেজ বন্দি কোমর নানা কসরতে নাড়িয়ে বেডের পাশের টেবিল থেকে ওর ব্যাগ হাতড়ে একটা বই বের করলো। আমার দিকে বাড়িয়ে দিল, ‘এটা দ্যাখো!

কি এটাআরে রূপসী বাংলা!ও মিটিমিটি হাসে, ‘আমার মনে হয় আমি সেন্সলেস হবার পর আমাকে তুরায় পাঠানোয় সময় কল্যাণই আমার ব্যাগে জামা-কাপড়ের সাথে এটা দিয়ে দিয়েছে।
কল্যাণ কে?’
টাঙ্গাইলের সাদত কলেজে আমরা একসাথে পড়তাম। একই সাথে যুদ্ধেও নাম লিখিয়েছি। একই ক্যাম্পে থাকতাম।
দারুণ। তুমি কবিতা পড়ো?’
আকাশটা দ্যাখো। কেমন লাল!

ইস্কান্দার বইয়ের পাতা হাতড়ায়:

আকাশে সাতটি তারা যখন উঠেছে ফুটে আমি এই ঘাসে
বসে থাকিকামরাঙা-লাল মেঘ যেন মৃত মনিয়ার মতো
গঙ্গাসাগরের ঢেউয়ে ডুবে গেছে- আসিয়াছে শান্ত অনুগত
বাংলার নীল সন্ধ্যা- কেশবতী কন্যা যেন এসেছে আকাশে:

চমৎকার কবিতা পড়ো ত’ তুমি!
এ আর কিআমাদের সাঈদ ভাইয়ের আবৃত্তি যদি শুনতে?’
সাঈদ ভাই কে?’
আমাদের ক্যাম্পের টুআইসি ছিলেন। ফুলপুর থানা অপারেশনে আমাকে বাঁচাতে গিয়ে…’
কী হলো?’
কী আর হবেআমি তার বন্ধুর ছোট ভাই বলে আমাকে আগলাতে গিয়ে নিজে মরলো। শুধু যদি মরতো! আমার চোখের সামনে মানুষটার নাড়ি-ভুড়ি সব তিন হাত কাছের কাঁঠাল গাছটায় জড়িয়ে গেলপাঞ্জাবিদের শেলিংয়েঅদ্ভুত ব্যপার কী জানোমৃত্যুর আগের রাতে রূপসী বাংলা’ থেকে আমাদের আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেনবিশেষ করে তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও’ কবিতাটি। দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে আবৃত্তি করে মৃত্যুর আগের রাতে যে ঘুমাতে গেল,পরের দিন সকালে একটা কাঁঠাল গাছেরই ডাল-পালা আর পাতায় রক্ত ও নাড়ি-ভুড়ি ছিটকে সে মারা গেল!

দেখিবইটা দাও ত’ আমাকে!’ আমি পাশের বেড থেকে হাত বাড়িয়েছিলাম।

ইস্কান্দার আমাকে বইটা দিলে আমি চোখ বুলাই,

তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও- আমি এই বাংলার পারে
য়ে যাবদেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে;দেখিব খয়েরি ডানা শালিখের সন্ধ্যায় হিম হয়ে আসে
ধবল রোমের নিচে তাহার হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে
নেচে চলে- একবার- দুইবার- তারপর হঠাৎ তাহারে
বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে যায় হৃদয়ের পাশে;’

তোমাদের এই অপারেশনটা ঠিক কোথায় হয়েছিল?’
আসলে দ্যাখোটাংগাইলের ফুলপুর থানাটা যুদ্ধের স্ট্র্যাটেজিক কারণেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই থানার পাশেই ঘাপটি মেরেছিল পাঞ্জাবিবিহারী আর রাজাকাররা। থানার একদম মুখোমুখি মুক্তিবাহিনীরচর বাংলা’ ক্যাম্প। এপ্রিল থেকে টানা যুদ্ধ চলছে। তখন ছিল নভেম্বর মাস। আসলে ১১ নম্বর সেক্টরের ছেলেদের প্রশিক্ষণ মেঘালয়ের তুরা পাহাড়েই হয়েছিল। নভেম্বর থেকেই মিত্র বাহিনী তার আড়াল সরিয়ে সরাসরি মুক্তিবাহিনীর ব্যাক-আপ করছে। কোন কোন জায়গায় সেপ্টেম্বর কি অক্টোবর থেকেই মিত্র বাহিনীর সরাসরি সাপোর্ট শুরু হয়েছে। তার আগে বর্ডার এলাকায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যুদ্ধই বেশি চলেছে। ১১ নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর বেশির ভাগ ছেলেই কলেজের ছাত্র। এর ভেতর করটিয়ার সাদত কলেজের ছাত্ররা সবচেয়ে বেশি হারে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। টাংগাইলের আছিমতলায় ৭১-এর ৪ঠা এপ্রিল ছাত্র-জনতার প্রথম সঙ্ঘবদ্ধ ও সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধেও কলেজের ছেলেরা অনেকেই ছিল।

কী বলতে কী বলানভেম্বর থেকেই মিত্রবাহিনী প্ল্যান করলো যে মুক্তিবাহিনীর সাথে মিলে হালুয়াঘাট থানা থেকে অপারেশন শুরু হবে। তারই অংশ হিসেবে ফুলপুর থানার পাশের ঘাঁটিকে টার্গেট ঠিক করা হয়েছিল। টুআইসি কমাণ্ডার আবু সাঈদ ভাই তার এই অল্পবয়সী সাবোর্ডিনেট যোদ্ধাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের কী ক্ষতিটাই না করলেন।

আমাকে সামনে আগাইতে দ্যান্

‘ না- না- তুমি বাচ্চা ছেলে! আমার বন্ধুর ছোট ভাই- সরো!

জানোআগের রাতে ক্যাম্পে রাতের খাবারের পর রেডিওতে কিছুক্ষণ আকাশবাণীর খবর আরস্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের চরমপত্র শুনবার পর এই আবু সাঈদ ভাই-ই আমাদের জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা থেকে আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন। গলাটা ভালই ছিল তাঁরক্যাম্পে রাতে খাওয়া-দাওয়ার শেষে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেব রে’ কি জয় বাংলা বাংলার জয়’ বা পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’ গাইতে শুরু করলে আমরা ওর দোহার হতাম। সাঈদ ভাইই ছিল মূল গায়েন! বয়সে আমাদের বছর ছয়েকের বড়। আমরা সবে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ছি আর আবু সাঈদ ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়ে তার জন্ম শহর টাঙ্গাইলে ছুটি কাটাতে এসেছে। মাস্টার্সের রেজাল্ট হতে আরো কয়েক মাস বাকি। চাকরি খোঁজা শুরুর আগেই হঠাৎই তো সেই ছোট বেলায় রবীন্দ্রনাথের কবিতায় পড়া ডাকাত দলের মতো হা-রে-রে-রে করে আমাদের সবার ঘাড়ের উপর লাফিয়ে পড়ল এই যুদ্ধ। আমাদেরচর বাংলা’ ক্যাম্পে প্রায় পাঁচ/ছয় জন ছাত্র ছিল। তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও’ পড়ার পর সবাই মিলে তাকে বললাম:

সাঈদ ভাই, ‘যতদিন বেঁচে আছিটা একটু পড়েন!

আরে আমি একাই পড়বো নাকিআসোসবাই মিলে পড়ি!

আমরা সবাই একসাথে আবৃত্তি করেছিলাম,

‘…আমি যে দেখিতে চাই,- আমি যে বসিতে চাই বাংলার ঘাসে;পৃথিবীর পথে ঘুরে বহুদিন অনেক বেদনা প্রাণে সয়ে
ধানসিঁড়িটির সাথে বাংলার শ্মশানের দিকে যাব বয়ে,যেইখানে এলোচুলে রামপ্রসাদের সেই শ্যামা আজো আসে,…’

অপারেশনের দিনের সকালটা ছিল কুয়াশা ঢাকা। ফুলপুর থানা ক্যাম্পাসের চারপাশটা ছিল আম,জামকাঁঠাল আর হিজল গাছে যাওয়া। কেউ যেন রূপসী বাংলার চরণগুলো সাজিয়েই রেখেছে। মাথার উপর ধূ ধূ নীল আকাশ। আকাশ যেখানে অপরাজিতার মতো আরো নীল হয়ে আকাশে হারিয়ে গেছে।আমারও কোমর আর মেরুদণ্ডের নিচে গুলি লেগেছিল। আমি জ্ঞান হারাতে হারাতেই টের পেলাম আবু সাঈদ ভাই স্পট ডেড। অচেতন আমাকে কারা তুরা টেন্টস্ হাসপাতাল’-এ পাঠালো কে জানেসেখান থেকে আবার লক্ষ্ণৌয়ে মিলিটারি সেন্ট্রাল কমান্ড হাসপাতাল! আমার ব্যাগটা গুছিয়ে দেবার সময় আমাদের দলের কল্যাণ রূপসী বাংলাও ব্যাগে দিয়ে দিতে ভোলে নি। তা’ হাসপাতাল মানেই ওষুধইঞ্জেকশনের ভাঙ্গা এ্যাম্পুলডেটল-স্যাভলন-ফিনাইলের মিলিত গন্ধস্টিলের ট্রে-তে সকাল-দুপুর-সন্ধ্যার খাবারশাদা জামা পরা কবুতরের মতো নার্সের দল! সত্যিই এই বাংলা ছেড়ে আমাদের সাঈদ ভাইয়ের আর কোথাও যাওয়া হলো না!

বাতাসের চেয়ে দ্রুতগামী কেমন। নয়তো আজ প্রায় বছর খানেক পর ইস্কান্দারকে বিশ্রামাগারের অফিস রুমে বিকাল পাঁচটার দিকে ঢুকতে দেখেআমি যখন মাত্রই আমার হুইল চেয়ারটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অফিস রুমের পাশের টিভি রুমে ঢুকবার চেষ্টা করছিলামওকে দেখে অফিস রুমেই হুইল চেয়ারটা সামান্য ঘুরিয়ে ঢুকে দুএকটা কথা না হতেই পুরনো এত কথা ধাঁ করে মনে পড়ে গেল?

শায়লাআব্বুর ব্রেন টিউমারডাক্তার কী বলছে?’

আঙ্কেলআব্বুকে ত’ একটা ক্লিনিকে ভর্তি করেছিলাম। গত পনেরো দিনে প্রায় ৬১/৬২ হাজার টাকা নানা মেডিকেল ইনভেস্টিগেশনেই শেষ হয়ে গেছে। ক্লিনিক থেকে ফোর্সড রিলিজ দেওয়ায় আব্বুকে বাসায় নিয়ে এলাম। এখন রিলেটিভদের কাছে যদি টাকা পয়সা কিছু ধার করা যায়,তাহলে আবারআবার ভর্তি করবোআর তেজগাঁর কল্যাণ ট্রাস্ট অফিস থেকেই আমাদের বললো এখানে এসে আব্বুর মোস্ট রিসেন্ট অসুস্থতার কাগজ-পত্র জমা দিতে। যদি চিকিৎসার জন্য কিছু টাকা পাওয়া যায়! কিন্তু তেজগাঁ থেকে চিঠি পেতেই তিনটা বেজে গেল। পথে এত জ্যাম। এখানে আসতে আসতেই ত’ পাঁচটা বেজে গেল।

হ্যাঁতোমাকে কাল সকালে আর একবার আসতে হবে। তোমাদের বাড়ির দখল নিয়ে কিছু ঝামেলা ছিল। ওটা মিটেছে?’

নাআঙ্কেল। সরকার থেকে সেই চুরাশি সালে জাকির হোসেন রোডে বিহারিদের একটা ফেলে যাওয়া বাড়ি আমাদের দিয়েছে ঠিকইকিন্তু আজো ত’ সেটা কাগজ-কলমেই। আমরা ত’ এখনো তার দখল বুঝে পাই নি।

একদিক থেকে তোমার আব্বু অনেক লাকি। ভারতের লক্ষ্ণৌয়ের হাসপাতালে আমরা পাশাপাশি বেডে ছিলাম। দুজনেই তখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। আমি সারা জীবনের মতো পঙ্গুহুইল চেয়ার বন্দি হয়ে ফিরলাম। তোমার আব্বু অবশ্য সুস্থ হয়ে গেলেন। মনের জোরও ছিল। দেশে ফিরে ইন্টারমিডিয়েট- অনার্স-মাস্টার্স করে কল্যাণ ট্রাস্টে চাকরিও নিল। বিয়েও করলো। দিব্যি সুস্থ,স্বাভাবিক জীবন। শেষ জীবনে এমনটা ঘটলো কেন?’

সবই আল্লাহর ইচ্ছাআঙ্কেল। আজ উঠি।

বাবার হাত ধরে তাকে সাবধানে ওঠায় শায়লা। একটা কথাও বলতে না পারাগলার স্বর ও এক চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলা ইস্কান্দারলক্ষ্ণৌ হাসপাতালের বেডে সন্ধ্যা বেলায় কামরাঙা লাল আকাশ দেখে গঙ্গাসাগরে ডুবে যাওয়া মৃত মুনিয়ার কবিতা পড়া ইস্কান্দারআমার দিকে তাকিয়ে অসহায় হেসে হাত নাড়ে।