Tuesday, July 10, 2018

নিকোলা টেসলা- হারিয়ে যাওয়া এক নাম


আজ নিকোলা টেসলার জন্মদিন ,

১৮৫৬ সালের ১০ জুলাই টেসলার জন্ম গ্রহন করেন ।

******************************************************************************************

প্রথমেই কয়েকটা বিজ্ঞানভিত্তিক কুইজ আপনাদের জন্যে। বলুন তো-

১। আমাদের পরিচিত এবং বাসাবাড়িতে বহুল ব্যবহৃত ফ্লুরোসেন্ট বাতির আবিষ্কারক কে?
২। আধুনিক জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের আবিষ্কারক কে?
৩। আমরা এখন যে এক্স-রে ফটো প্রযুক্তি ব্যবহার করি এর নেপথ্য নায়ক কে?
৪। রেডিওতে যে অনবরত আর.জে. দের বকবকানি আর গান শুনছেন সেটার আবিষ্কারক কে?
৫। টিভিতে যে রিমোট কন্ট্রোল চেপে নিউজ চ্যানেল হতে খেলার চ্যানেল, খেলার চ্যানেল হতে ডকুমেন্টারি চ্যানেল, সেখান হতে মুভি চ্যানেল, আর সবশেষে মুভি চ্যানেল হতে মিউজিক চ্যানেলে গিয়ে থেমে সাবেক জনৈক পর্নস্টার এর নাচ দেখছেন- সেই রিমোট কন্ট্রোল এর আবিষ্কারক কে?
৬। আধুনিক রোবটিক্স-এর প্রথম ধারণার সূত্রপাত কার হাত ধরে?
৭। ওয়ারলেস যোগাযোগ ব্যবস্থার সূত্রপাত কার হাতে?

প্রথমেই বলি আপনাদের জবাবগুলো-
১। ‘টমাস আলভা এডিসন’ কিংবা ‘পিটার কুপার হিউইট (Peter Cooper Hewitt)’
২। জর্জ ওয়েস্টিংহাউজ (না, ‘লেস্টার অ্যালান পেল্টন’ নন। তিনি জলবিদ্যুৎ শক্তি সম্পর্কিত ধারণা দেন। কিন্তু বর্তমানে আমরা জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে যেভাবে চিনি সেটার আবিষ্কারক হিসেবে ধরা হয় জর্জ ওয়েস্টিংহাউজকে)
৩। উইলহেলম রন্টজেন
৪। গুইয়েলমো মার্কনি (Guglielmo Marconi)
৫। নিকোলা টেসলা
৬। প্রথম গ্রীক প্রকৌশলী টেসিবিয়াস (Ctesibius)-এর ২৭০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তৈরিকৃত জলঘড়িকে প্রথম রোবটের নমুনা হিসেবে ধরা যায়। কিন্তু আধুনিক রোবট জনসম্মুখে প্রদর্শনের জন্যে উল্লেখ করা হয় ‘ডব্লিউ এইচ রিচার্ডস’ এর নাম, যিনি ১৯২৮ সালে লন্ডনে রিমোট কন্ট্রোলড রোবট সর্বপ্রথম প্রদর্শন করেন।
৭। নিকোলা টেসলা

এবার শুনুন আমাদের বিজ্ঞানযাত্রার জবাব –
১। নিকোলা টেসলা
২। নিকোলা টেসলা
৩। নিকোলা টেসলা
৪। নিকোলা টেসলা
৫। নিকোলা টেসলা
৬। নিকোলা টেসলা
৭। নিকোলা টেসলা

এবার আসি লাখ টাকার প্রশ্নে। সেটা হলো, আপনাদের মধ্যে কেউ কেউ নিশ্চয়ই মনে মনে ভাবছেন- এই নিকোলা টেসলা আবার কে? আসলে যারা এই নাম বাবার জন্মেও শুনেননি তাদের এই নাম না জানার অপরাধ আমরা ক্ষমা-সুন্দর দৃষ্টিতে দেখা ছাড়া কোন উপায় খুঁজে পাচ্ছিনা। যারা বিজ্ঞানকে প্রকৃত ভালোবাসেন, নিকোলা টেসলা তাদের অনেকের কাছে মোটামুটি সুপারহিরো। কারো কারো কাছে তিনি ব্যাটম্যান- বিজ্ঞানের জগতের ‘দ্যা ডার্ক নাইট’।

যদি নোলানের ‘ডার্ক নাইট’ মুভির ‘কমিশনার গর্ডন’ এর ভাষায় বলি, তাহলে বলতে হয়-
“টেসলা হচ্ছে সেই হিরো বিজ্ঞানের যাকে প্রয়োজন, কিন্তু ঠিক এখনই তাকে বরনের জন্যে বিজ্ঞান প্রস্তুত নয়। তাই সঠিক সময়ের আগ পর্যন্ত আমরা তাকে উপেক্ষা করবো, কিন্তু তার এতে কিছুই আসবে যাবে না। কারণ সে শুধু আমাদের হিরো নয়। সে হচ্ছে বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ সাধক, নিঃশব্দ রক্ষাকর্তা। দ্যা ডার্ক নাইট!” (এখানে ‘হ্যান্স জিমার’ এর কম্পোজ করা এপিক মিউজিক বাজা শুরু হবে)

ড্রামা করা বাদ দিয়ে মূল ঘটনায় যাই। বস্তুতপক্ষে, আপনি দৈনন্দিন জীবনে প্রায় সবক্ষেত্রেই টেসলার কোনো না কোনো অবদান ব্যবহার করছেন। এমনকি এই যে ইন্টারনেটে বসে আপনার জীবনের মূল্যবান সময়গুলো ফেইসবুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করছেন, এর পেছনেও আছে টেসলার অবদান। ভাবছেন- কী করে, তাই তো? আসলে আপনি যে আপনার কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল ইত্যাদি চালাতে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছেন সেটা টেসলারই অবদান! আপনার রুমে যে বাতি জ্বলছে সেটা টেসলার অবদান। এফ এম রেডিওতে যে আর.জে. দের বাংলিশ (আর.জে.দের সবাই অবশ্য এমন বাংলিশ ভাষায় কথা বলেন না) কথাবার্তার ফাঁকে ফাঁকে গান শুনছেন- সেটার পেছনেও টেসলা।

এতক্ষণে আপনাদের অনেকেই হয় চোখ কপালে তুলে ফেলেছেন, না হয় মনে মনে ভাবছেন- আমরা গাঁজার কল্কে হাতে নিয়ে এই লেখাটা লিখতে বসেছি। আপনার রাগ আমরা বুঝতে পারছি। কিন্তু একটু সবুর করুন। আগে চলুন মূল লেখাটা পড়ি-

নিকোলা টেসলাঃ ম্যাড সায়েন্টিস্ট


নিকোলা টেসলার জন্ম ১৮৫৬ সালে। তিনি জন্মসূত্রে সার্বিয়ান। কিন্তু পুরো শৈশব ও কৈশোর কাটিয়েছেন ক্রোয়েশিয়ায়। এ কারণে সার্বিয়া এবং ক্রোয়েশিয়া আজও টেসলাকে নিয়ে টানা হেঁচড়া করে, বিতর্ক করে- তিনি আসলে কাদের? বিতর্কের মূল কারণ সেই সময় দুটো এলাকাই অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো। যা পরে ভেঙ্গে সার্বিয়া, ক্রোয়েশিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে পরিণত হয়। তার পিতা ছিলেন একজন যাজক।

১৮৮০ সালে টেসলা পকেটে করে মাত্র চার পেনি (ডলার নয়, পেনি!), একটা কাগজে লেখা কয়েক গুচ্ছ কবিতা, আর একটা বিমান বানানোর ব্লু-প্রিন্ট (যা আর কখনো বানানো হয়ে ওঠেনি) নিয়ে আমেরিকায় পা রাখেন। এর ঠিক ২০ বছরের মধ্যে টেসলা বলতে গেলে প্রায় একাই বৈদ্যুতিক নানাবিধ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটান। তার হাত ধরেই আসে-

*বৈদ্যুতিক জেনারেটর (মূলনীতি মাইকেল ফ্যারাডের হলেও ব্যবহারিক আবিষ্কার টেসলার)
*রেডিও
*রিমোট কন্ট্রোল
*স্পার্ক প্লাগ
*রোবট (জ্বি হ্যাঁ, রোবট!)
*ফ্লুরোসেন্ট বাতি (যেটার ক্রেডিট পরে ‘এডিসন’ নিয়ে নেন)
*টেসলা কয়েল (টিভি, রেডিও দুটোরই অপরিহার্য অংশ) ………এবং আরও অনেক কিছু যা এই বিংশ শতাব্দীতে আপনার জীবনকে পুরোই বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে।

উপরের তালিকার অনেকগুলো হয়তো আপনারা চিনবেন। আর যারা ‘কমান্ড এন্ড কংকার- রেড এলার্ট’ ভিডিও গেইম এর ভক্ত তারা ভালোমতোই জানেন টেসলা কয়েল কী! যদিও এর উৎপত্তির পেছনে অসাধারণ গল্প অনেকেই জানেন না। (জ্বি হ্যাঁ, টিভি-রেডিওর উপাদান ‘টেসলা কয়েল’ দিয়ে বাস্তবিক ভাবেই বিশাল টাওয়ার বানিয়ে সেটা দিয়ে আমেরিকা কিংবা ব্রিটেনের সৈন্যদেরকে ভাজা ভাজা করে আপনার সোভিয়েত মিলিটারি বেইজ রক্ষা করা সম্ভব!)

বিভিন্ন সায়েন্স ফিকশন গল্পে বা মুভিতে ‘ম্যাড সায়েন্টিস্ট’ বলতে যা বোঝায়, ঠিক তাই ছিলেন নিকোলা টেসলা। তিনি ছিলেন চিরকুমার। জ্যামিতিক ভাবে নিখুঁত গোলাকার বস্তুর প্রতি অদ্ভুত এক আতংক ছিলো তার (কে জানে, তিনি হয়তো এ কারণেই চিরকুমার ছিলেন)! তদুপরি কোনো সংখ্যা, বা বস্তু যা সুষমভাবে তিন ভাগ করা যায় না সেগুলোর প্রতিও আজব এক ভীতি ছিলো তার।

তিনি একদা মিডিয়ার সামনে জোর গলায় দাবি করেছিলেন তিনি ‘ভয়ংকর মৃত্যু রশ্মি’ আবিষ্কার করেছেন। কেউ তার কথা বিশ্বাস করেনি। হাসাহাসি করেছিলো।

টেসলা তার সারা জীবনে কোনো আবিষ্কারের জন্যই কৃতিত্ব পাননি। বরং তার মৌলিক আবিষ্কার চুরি করে- ডিজাইন একটু এদিক সেদিক করে কিংবা সামান্য উন্নত সংস্করণ তৈরি করে অনেকেই ইতিহাসের পাতায় নাম কামিয়েছেন। টেসলার বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণার বাইরে বাকি সারা জীবন ব্যয় হয়েছে এইসব চুরি হওয়া আবিষ্কারের পেটেন্ট নিয়ে কোর্টে লড়াই করতে কিংবা তার বেঁচে থাকার খরচ জোগাতে। তার উন্মাদ সব গবেষণা নিয়ে সবাই হাসাহাসি করতো। কিন্তু ১৯৪৩ সালে যখন টেসলা সম্পূর্ণ নিঃস্ব-হত-দরিদ্র অবস্থায় মারা যান, তখন ঠিকই তৎকালীন এফবিআই চীফ ‘জে. এডগার হুভার’ (‘হুভার বাঁধ’ এর জন্য বিখ্যাত; এবং ‘হুভার বাঁধ’ যে আসলে টেসলার আইডিয়া, সেটা শুনে নিশ্চয়ই আশ্চর্য হচ্ছেন না, তাই না?) আরও কিছু এফবিআই সদস্য নিয়ে টেসলার হোটেল রুমে হামলা চালিয়ে তার সুটকেস এবং সমস্ত কাগজ-পত্র লুটপাট করে। সেইসব কাগজ-পত্রের হদিস আজও পাওয়া যায়নি। এগুলো এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আমেরিকা সরকার অত্যন্ত সুরক্ষিত ভল্টে জব্দ করে রেখেছে। ষড়যন্ত্র তত্ত্ববিদেরা অভিযোগ করেন টেসলার অনেক আইডিয়া মানব কল্যাণে না লাগিয়ে তারা গোপন বিধ্বংসী গবেষণায় কাজে লাগাচ্ছে। টেসলার অনেক আবিষ্কার এখন আমাদের কাছে ডাল-ভাত ব্যাপার। তবু কেন এত নিরাপত্তা? তাহলে কি টেসলার বৈজ্ঞানিক গবেষণার সেসব কাগজ-পত্রে আরও কিছু আইডিয়া আছে যা আমরা এই একবিংশ শতাব্দীর মানুষ এখনো পাইনি?

টেসলা যে আসলে ১৫০ বছর আগের মানুষ না, বরং আমাদের এই যুগের মানুষ সেটার প্রমাণ পাবেন যখন আমরা উল্লেখ করবো, তিনি একবার বলেছিলেন, “এমন এক সময় আসবে যখন সংবাদ, প্রেসিডেন্টের ভাষণ, কিংবা মাঠের খেলাগুলো তারবিহীন পদ্ধতিতে ঘরে বসেই দেখা যাবে”। হ্যাঁ, টেসলার স্বপ্ন সত্যি হয়েছে। টিভি এবং ইন্টারনেটের ভুবনে সবাইকে স্বাগতম!

বৈদ্যুতিক যুদ্ধ


১৮৮৪ সালে নিকোলা টেসলা টমাস আলভা এডিসনের কোম্পানিতে চাকুরী নেন। সেইসময় তিনি এডিসনকে বলেন যে এডিসনের ফ্লুরোসেন্ট বাতি নিয়ে বৈদ্যুতিক গবেষণার কাজ অনেক তাড়াতাড়ি এবং আরও কম খরচে তিনি শেষ করতে পারবেন। এডিসন প্রস্তাব দেন যদি টেসলা এটা করতে পারে তবে তাকে ৫০,০০০ ডলার পুরষ্কার দেয়া হবে।

এখানে টমাস আলভা এডিসন সম্পর্কে একটু বলা প্রাসঙ্গিক। এডিসন ছিলেন বিত্তশালী এবং একটা কর্পোরেশনের মালিক। ইতিহাস এডিসনকে কতটা ভুলভাবে উপস্থাপন করেছে তা বুঝবেন যদি জানেন যে এডিসনের মানসিকতা ছিলো বর্তমানে পুঁজিবাদ সমাজের বড় বড় মুনাফা-লোভী কর্পোরেশনের মালিকদের মত। তিনি দরিদ্র-অসহায় কিন্তু মেধাবী বিজ্ঞানীদের দুঃস্থতাকে কাজে লাগিয়ে টুপাইস কামানোর সাথে সাথে বিজ্ঞানের জগতেও নিজেকে একজন কেউকেটা হিসেবে স্থাপন করেছিলেন। এরা সবাই তার হয়ে কাজ করতো। যখন ভালো কোনো আইডিয়া তার নজরে আসতো সেটার স্বত্ব তিনি কিনে নিতেন। তারপর নিজের নামে চালিয়ে দিতেন। যারা বিক্রি করতে চাইতো না, তাদের সাইজ করার জন্য এডিসনের ছিলো নিজস্ব ‘ঠেঙ্গাড়ে’ বাহিনী! আমরা জানি, কারো কারো এসব কথা বিশ্বাস হবে না। তাই আমাদের কথা বিশ্বাস না হলে ইন্টারনেটে একটু খোঁজ করে দেখুন।

আমরা এডিসনকে এক্কেবারে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছি না। বৈদ্যুতিক বাতি সংক্রান্ত কিছু গবেষণা তার আসলেই ছিলো। কিন্তু সেটা কার্যকরী ছিলো না। প্রথম কার্যকরী এবং সাশ্রয়ী ফ্লুরোসেন্ট বাতি ছিলো নিকোলা টেসলার। পেটেন্ট অফিসের তথ্য অনুযায়ী এডিসনের নামে প্রায় ১০০০ আবিষ্কারের তালিকার প্রায় সবকটাই হয় অন্যের কাছ থেকে টাকা দিয়ে কেনা, নাহয় গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে ঠেঙ্গিয়ে কেড়ে নেয়া ‘ব্লু-প্রিন্ট’ এর ফসল।

যাই হোক, টেসলার প্রসঙ্গে আসি। উপরোক্ত প্রতিশ্রুতি প্রদানের পর টেসলা মাস কয়েক ক্রীতদাসের মত খেটে তার প্রজেক্ট শেষ করলেন এবং ফ্লুরোসেন্ট বাতিকে আমরা বর্তমানে যেভাবে চিনি সেভাবে রূপদান করলেন। তারপর যখন এডিসনের কাছে তার প্রাপ্য পুরষ্কার চাইতে গেলেন এডিসন তখন বেশ একচোট হেসে পাক্কা ভিলেনের মত বললেন, “লুলজ! আপনি তো দেখি আমেরিকান রসিকতাও বুঝেন না।”

টেসলা তখন ক্ষেপে গিয়ে এডিসন কোম্পানির চাকুরী ছেড়ে দেন। এই সুযোগে তাকে লুফে নেয় এডিসনের প্রতিদ্বন্দ্বী ‘ওয়েস্টিংহাউজ ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানী‘ (নামটা খেয়াল রাখুন)। কিছুদিনের ভেতরেই শুরু হয়ে যায় বৈদ্যুতিক যুদ্ধ। একদিকে এডিসনের স্থির বিদ্যুৎ (ডিসি কারেন্ট) বনাম অন্যদিকে ওয়েস্টিংহাউজের সাথে মিলে টেসলার চলবিদ্যুৎ (এসি কারেন্ট)। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটা ‘বৈদ্যুতিক যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এই পর্যায়ে আমরা পরামর্শ দিচ্ছি ঐতিহাসিক এই দুর্ধর্ষ যুদ্ধের উত্তেজনা পুরোপুরি আঁচ করার জন্য ব্যাকগ্রাউন্ডে আপনারা ফুল ভলিউমে ‘এসি/ডিসি’ ব্যান্ডের কোন মিউজিক ছেড়ে দিন। আমরাও লেখাটা লিখার সময় তাই করেছি!

যাই হোক, শেষ পর্যন্ত টেসলার তত্ত্বই ঠিক হলো। তার চলবিদ্যুৎ এডিসনের স্থির বিদ্যুতের চেয়ে বেশী কার্যকরী প্রমাণিত হলো। টেসলার চলবিদ্যুৎ আবিষ্কার না হলে আমাদের হয়তো আজকে এডিসনের প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হতো যেখানে প্রত্যেক ঘরে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হলে আলাদা আলাদা জেনারেটর বসানো লাগতো। কিন্তু টেসলার প্রযুক্তি অনুযায়ী এখন বহু মাইল দূরে একটা পাওয়ার স্টেশনে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় এবং সেখান থেকে তার দিয়ে টেনে বাসা-বাড়িতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়।

কিন্তু টেসলা দুর্ধর্ষ বৈজ্ঞানিক হলেও যেহেতু তেমন মেধাবী ব্যবসায়ী ছিলেন না, তাই শেষ পর্যন্ত হারু পার্টির খাতায় নাম লেখালেন টেসলা-ই। তার সমস্ত গবেষণার ফসলই এখন ব্যবহৃত হচ্ছে আপনার পকেটের টাকা দিয়ে এডিসনের উত্তরসূরীদের পকেট বোঝাই করতে।

টেসলাকে অনেকে চেনে একটা কাল্পনিক চরিত্র হিসেবে। ক্রিস্টোফার প্রিস্টের লেখা সায়েন্স ফিকশন The Prestige এর মধ্যে টেসলা আর এডিসনকে নিয়ে আসা হয়েছিলো। বইটিকে কেন্দ্র করে একটা চলচ্চিত্রও (দ্যা প্রেস্টিজ– ২০০৬ এর চলচ্চিত্র) বানিয়েছেন খ্যাতনামা পরিচালক ক্রিস্টোফার নোলান। ওখানে আসলে গল্পের প্রয়োজনেই টেসলাকে নিয়ে আসা হয়েছিলো। কাহিনীর নায়ক রবার্ট এনজিয়ার এমন একটা ক্ষমতা খুঁজছিলো, যা বাস্তবে নেই। আর পৌরাণিক কোনো ক্ষমতাকে বাস্তব করে তোলার ক্ষমতা ইতিহাসে খুব বিজ্ঞানীর কাছে ছিলো না। যাদের ছিলো, তাদের মধ্যে একজন নিকোলা টেসলা। যদিও সিনেমাতে দেখানো সেই আবিষ্কারটা হয়তো টেসলা করেননি; তবুও আমরা ক্রিস্টোফার প্রিস্ট আর ক্রিস্টোফার নোলানের কাছে কৃতজ্ঞ – এডিসন এবং তার ঠেঙ্গাড়ে বাহিনীকে সঠিকভাবে উপস্থাপনের জন্য।

টেসলার যা কিছু অবদান


টেসলার নামে ২৬টা দেশে প্রায় ৩০০ আবিষ্কারের পেটেন্ট রয়েছে। এর মধ্যে কিছুতো উপরেই উল্লেখ করা হয়েছে। আরও কিছু আবিষ্কারের মধ্যে আছে- বৈদ্যুতিক ঝাড়বাতি, এক্স-রে মেশিনের যন্ত্রপাতি, বাইফিলার কয়েল, ব্লেড বিহীন টারবাইন।

বিজ্ঞানের জগতে বৈদ্যুতিক বাতির পাশাপাশি আরেকটা আবিষ্কার হচ্ছে ‘রেডিও’ যেটা নিয়ে তৎকালীন বিজ্ঞানী সমাজে ব্যাপক মাথা ফাটাফাটি এবং ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়েছিলো। জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল, আলেক্সান্ডার পোপভ, স্যার অলিভার লজ, হাইনরিখ হার্জ, জগদীশ চন্দ্র বসু সহ অনেকেই এই রেডিও আবিষ্কার নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রেডিওর আবিষ্কারের পেছনে মার্কনি’র নাম টিকে গেলো। কিভাবে? সেই গল্পেই যাচ্ছি।

মার্কনি প্রথম রেডিও সিগন্যাল সম্পর্কে জানেন যখন তিনি ১৮৯৪ সালে ছুটি কাটানোর সময় বিজ্ঞানী হার্জের লেখা গবেষণাপত্রগুলো পড়েন। অথচ তার আরও ৭-৮ বছর আগে হতেই জগদীশ চন্দ্র বসু এবং নিকোলা টেসলা এই রেডিও সিগন্যাল নিয়ে কাজ করে যাচ্ছিলেন। মার্কনি প্রথম যে রেডিও সিগন্যাল আবিষ্কার করেছিলেন সেটা তার বাড়ির চিলেকোঠা পর্যন্ত পৌঁছেছিলো। পক্ষান্তরে ১৮৯১ সালেই টেসলার আবিষ্কৃত রেডিও সিগন্যাল সেকেন্ডে ১৫,০০০ সাইকেল বা চক্র সম্পন্ন করতে পারতো। কারণ এই কাজে তিনি ব্যবহার করেছিলেন তাঁর নিজেরই আবিষ্কৃত টেসলা কয়েল।

মার্কনি যখন ১৯০০ সালে তার রেডিওর মডেল নিয়ে যান পেটেন্ট অফিসে, তখন তাকে সোজা রাস্তা মাপতে বলা হয়েছিলো। কারণ পেটেন্ট অফিসের অভিযোগ ছিলো মার্কনি মূলত টেসলার রেডিওর মডেল এবং যন্ত্রাংশ ব্যবহার করে সেটাকে নিজের মত সাজিয়ে নিয়ে এসেছেন। এরপরে ১৯০৪ সালে মার্কনি তার মডেল নিয়ে আবার পেটেন্ট অফিসে গেলে তারা কোন এক বিচিত্র কারণে টেসলার নাম কেটে দিয়ে মার্কনির নামে রেডিও পেটেন্ট ইস্যু করেন। তৎকালীন অনেক প্রত্যক্ষদর্শীদের লেখা থেকে জানা যায় মার্কনি এই সময়ে ক্ষমতাধর কিছু মানুষের সাথে উঠাবসার ফলে তাদের সংস্পর্শে চলে এসেছিলেন।

অন্যদিকে ঠিক একই সময়ে আমরা টেসলার দিকে তাকাই। তিনি ওয়েস্টিংহাউজ কোম্পানির সাথে মিলে চল বিদ্যুতের সাশ্রয়ী উৎপাদন কিভাবে সম্ভব সেটা আবিষ্কার করেন। টেসলাই সর্বপ্রথম নায়াগ্রা জলপ্রপাতের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বাসা-বাড়িতে ব্যবহারযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম হন। তার হাত ধরেই বিশ্ব পরিচিত হয় ‘আধুনিক জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র’ এর ধারণার সাথে। কিন্তু আমরাতো জানি ‘জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র’ এর আবিষ্কারক জর্জ ওয়েস্টিংহাউজ। উপরে বলেছিলাম যে মনে আছে, টেসলা এডিসনের কোম্পানি ছেড়ে ওয়েস্টিংহাউজ কোম্পানিতে চলবিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে গবেষণার কাজ নিয়েছিলেন। এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কার মেধা বিক্রি করে ওয়েস্টিংহাউজ এই নাম কামিয়েছেন। ঘটনা এখানেই শেষ হলে ভালো ছিলো। কিন্তু হয়নি।

Tesla_colorado
এডিসন দেখলেন তার ‘ডিসি কারেন্ট’ টেসলার ‘এসি কারেন্টে’র কাছে ভোক্তাবাজারে বড় ধরণের মার খাবে। তাই তিনি প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগলেন যে– টেসলার তৈরি বিদ্যুৎ নিরাপদ নয়। বরং এতে জীবনহানি ঘটা সম্ভব। সেটা প্রমাণে তিনি জনসম্মুখে একটা সার্কাসের হাতিকে এসি কারেন্ট ব্যবহার করে শক দিয়ে মারেন। শুধু তাই নয়, তৎকালীন ‘গ্যারি কমিশন’ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডের বদলে বিকল্প কিছু খুঁজছিলো। এডিসন সুযোগ বুঝে টেসলার এসি কারেন্টকে ব্যবহার করে চেয়ারে বসিয়ে অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড প্রদানের প্রস্তাব করেন। এমনকি মানবজাতির কল্যাণার্থে(!) ফাঁসির মত ভয়ংকর শাস্তির বিকল্প হিসেবে এই মহান বিজ্ঞানী এডিসন নিজ খরচে এবং নিজ উদ্যোগে এমন একটা চেয়ারও প্রস্তুত করে দেন। ১৮৮৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর জোসেফ শ্যাপ্লো (Joseph Chappleau) নামক এক মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীকে এই চেয়ারে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের মাধ্যমে মানবসভ্যতায় এক নবদিগন্তের সূচনা হয়। ফাঁসি দিয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদানের মত মানবতার প্রশ্নের সমাধান করে মানবজাতিকে বিবেক যন্ত্রণা হতে মুক্তি দেন এডিসন। একইসাথে সবার সামনে প্রমাণ করেন টেসলার চলবিদ্যুৎ কতটা ভয়ংকর।

পরে অবশ্য ইতিহাসে উল্লেখ না করার মত অতি ‘অগুরুত্বপূর্ণ’ কিছু ঘটনা ঘটে। যেমন- ওয়েস্টিংহাউজের ব্যবসায় লস খেতে থাকা, টেসলার গবেষণার মাধ্যমে এসি কারেন্টকে আরও উন্নত করে তোলার পেছনে টাকার অভাব দেখা দেয়া, ‘জে পি মরগান’ কর্তৃক ওয়েস্টিংহাউজ কোম্পানির শেয়ার ক্রয় এবং সর্বোপরি জে পি মরগানের মাধ্যমে ‘এডিসন ল্যাম্প কোম্পানি’র ‘ওয়েস্টিংহাউজ ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি’কে কিনে নিয়ে তাদের ডিসি কারেন্ট ব্যবসাকে এসি কারেন্ট ব্যবসাতে রূপান্তর করা।

শেষ পর্যন্ত দেখা গেলো সবাই যে যা চেয়েছে তাই পেয়ে খুশি, কিন্তু সবার কাছে ভিলেন হয়ে গেছেন নিকোলা টেসলা। অভিজাত সমাজে তাঁর নাম কেউ শুনতে পারতেন না। ফলে, ১৯০৪ সালে পেটেন্ট অফিস তাঁর নাম কেটে দিয়ে রেডিওর পেটেন্ট মার্কনির নামে ইস্যু করাটাতে বিচিত্র কিছু খুঁজে পাওয়া অসম্ভব নয়। টেসলাকে এই ব্যাপারে বলা হলে তাঁর জবাব ছিলো, “মার্কনি ছেলেটা ভদ্র। সে যা করছে করতে দাও। সে ইতোমধ্যে আমার ১৭টা পেটেন্ট নিজের বিভিন্ন আবিষ্কারে ব্যবহার করেছে”।

কিন্তু পরে আবার ১৯৪৩ সালেই আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট রেডিওর পেটেন্টে ইতালিয়ান বিজ্ঞানী মার্কনি’র নাম বাতিল করে দিয়ে নিকোলা টেসলার নাম ঘোষণা করেছিলো। কিন্তু ততদিনে নিকোলা টেসলা মৃত।

যাই হোক, এছাড়াও টেসলার ময়লা, ব্যাকটেরিয়া, জীবাণুর বিরুদ্ধে বাতিক ছিলো। এই বাতিক থেকে টেসলা এমনকি একবার মানুষের শরীরের ময়লা-জীবাণু পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে বাথটাবও আবিষ্কার করেছিলেন, যাতে মানুষ গোসল করতে পানির বদলে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে!

তবে সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনা হলো তিনি একবার বিশাল সাইজের টেসলা কয়েল দিয়ে ১৩০ ফুট দৈর্ঘ্যের বৈদ্যুতিক রশ্মি তৈরি করেছিলেন (‘কমান্ড এন্ড কংকার’ এর ভক্তরা পুনরায় স্বাগতম)! এটা এখন পর্যন্ত বিশ্ব রেকর্ড হয়ে আছে। তদুপরি তিনি একবার নিউ ইয়র্কে রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প সৃষ্টির জন্য দায়ী ছিলেন। এই ভূমিকম্পে নিউ ইয়র্কের ফিফথ এভিনিউ পুরোপুরি ধসে গিয়েছিলো!

উইলহেলম রন্টজেন প্রথম এক্স-রে রশ্মি আবিষ্কার করলেও সেটা দিয়ে যে ফটো তোলা সম্ভব সেটা দেখিয়েছেন নিকোলা টেসলা। ১৮৯৪ সালের দিকে তাঁর ল্যাবরেটরিতে বেড়াতে আসেন লেখক ‘মার্ক টোয়েন’। টেসলা তাঁর এই ঘনিষ্ঠ বন্ধুর আগমন উপলক্ষে ভ্যাকুয়াম টিউবে কিছু ফটো তোলেন। কিন্তু পরে দেখা যায় ছবিতে মার্ক টোয়েনের চেহারার বদলে ভ্যাকুয়াম টিউবের লেন্স অ্যাডজাস্ট করার স্ক্রুগুলো দেখা যাচ্ছে। সেখান হতেই তাঁর এক্স-রে ইমেজ নিয়ে গবেষণার শুরু। অন্যান্য সব ক্ষেত্রের বিপরীতে এই ক্ষেত্রে অবশ্য রন্টজেন টেসলাকে কৃতিত্ব দিয়েছিলেন তাঁর আবিষ্কৃত এক্স-রে রশ্মির এমন একটা ভালো উপযোগিতা খুঁজে বের করার জন্যে।

টেসলার আবিষ্কারের মধ্যে আরও আছে ভ্যাকুয়াম টিউব, রোটারি ইঞ্জিন, লাউডস্পিকার, ওয়ারলেস যোগাযোগ ব্যবস্থা, রাডার প্রযুক্তি ইত্যাদি।

চোখ নিশ্চয়ই এতক্ষণে কপালে উঠে গেছে। উঠারই কথা। নিকোলা টেসলা বলতে গেলে একাই বিংশ শতাব্দীর পরিচিত সব প্রযুক্তি আবিষ্কার করে গেছেন। পরবর্তীতে ইতিহাসের পরিচিত বিজ্ঞানীরা এগুলোকে সংস্কার করে আরেকটু উন্নত করেন এই আর কি। কিন্তু নিকোলা টেসলার মত সম্পূর্ণ মৌলিক চিন্তাধারা এবং প্রায় শূন্য হতে ম্যাজিকের মত কোন আইডিয়া নিয়ে আসা কারো পক্ষেই সম্ভব হয়নি।

উপরন্তু তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবদের মতে টেসলা একজন দুরন্ত কবি, আটটি ভাষায় কথা বলতে পারদর্শী এবং একবার কোন বই পড়লে সেই বই পুরোটা মগজে গেঁথে ফেলতে সক্ষম।

টেসলাঃ ভুলে যাওয়া এক প্রতিভা


আমরা যে বলেছিলাম ১৯৪৩ সালে টেসলা মারা যান, মনে আছে? সে ব্যাপারেই এখন আসছি। ১৯৪৩ সালের ৬ই জানুয়ারিতে টেসলা বৃদ্ধ বয়সে, সম্পূর্ণ নিঃস্ব অবস্থায় নিউইয়র্কের এক হোটেল রুমে মারা যান। কেউ কেউ বলেন, জার্মান নাজি গুপ্তচরেরা তাকে খুন করেছিলো। অনেকে দাবি করেন যে তারা গুপ্তচরদের নামও নাকি জানেন – অটো স্করজেনি (হিটলারের সরাসরি বডি গার্ড) এবং রাইনহার্ড। মৃত্যু যেভাবেই হোক না কেন, টেসলার যাবতীয় কাজকর্মের নকশা সব চলে যায় এফবিআইয়ের কাছে।

টেসলা চাইছিলেন মানবসভ্যতার উন্নয়নের জন্যে বিদ্যুৎশক্তিকে বিনামূল্যে ছেড়ে দেয়া হোক। তিনি অনেক প্রভাবশালীদের নিয়ে এ ব্যাপারে আলোচনাও করেছিলেন। কিন্তু কেউই তাঁর এই মতামত গ্রহণ করেননি। সবাই চেয়েছিলেন মানুষ বিদ্যুৎ তাদের থেকে কিনে নিয়ে ব্যবহার করুক। পরে টেসলা একা একাই গবেষণার মাধ্যমে এই লড়াই চালিয়ে যান। এতে কিছু সফলতাও লাভ করেন। তথ্য-প্রমাণ না থাকলেও অনেকে সন্দেহ করেন এই ব্যাপারটা নিয়ে গবেষণা করার কারণেই তিনি পুঁজিবাদীদের রোষানলে পড়ে গিয়েছিলেন। মৃত্যুর পরপরই তাঁর হোটেল রুমে তৎকালীন এফবিআই চীফ এডগার জে হুভার এর নেতৃত্বে কিছু এফবিআই সদস্য হামলা চালায়। তারা টেসলার সব গবেষণাপত্র লুটপাট করে কেটে পড়ে।

আসলে শুধু মৃত্যুর পরে নয়, মৃত্যুর আগেও এই সমস্যাটায় তাকে পড়তে হয়েছিলো। তিনি যেটাই আবিষ্কার করেন সেটাই পরে চুরি হয়ে যায়। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও তার এমন অনেক আবিষ্কার বিভিন্ন দেশে পাচার হয়ে গিয়েছিলো। তার প্রযুক্তি দিয়ে অনেক দেশ সুপার পাওয়ার হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত টেসলা যেই নিঃস্ব-ভবঘুরে-হতচ্ছাড়া ছিলেন, তাই রয়ে গেলেন। মাঝে অনেক টাকা কামালেও সেগুলোকে নতুন গবেষণায় উড়িয়ে দিয়েছিলেন টেসলা।

এইবার একটা লাখ টাকার প্রশ্ন। যদি টেসলা এতই জিনিয়াস হয় তাহলে বিশ্ববাসী তার সম্পর্কে এত কম জানে কেন? কেন স্কুলে এডিসন, মার্কনি, কিংবা আইনস্টাইনের নামের সাথে সাথে তার নাম জানলাম না?

এর কারণ টেসলা সম্পর্কে আমাদের কখনো জানতে দেয়া হয়নি। তার আবিষ্কারগুলো ছিলো বিভিন্ন দেশের সরকারের বেশ আগ্রহের বিষয়। তার সমসাময়িক সকল বিজ্ঞানীরা তার অনন্য মেধাকে হিংসা ও ঘৃণা করতেন। কিন্তু তার কাছ থেকে আইডিয়া চুরি করতে কারো তেমন খারাপ বোধ হতো না। কিন্তু টেসলা প্রশংসা দূরে থাক, বেঁচে থাকার জন্য ভালোমতো খাবারের পয়সাই জোটাতে পারেননি। তিনি এমনকি আক্ষেপ করে বলেছিলেন- কিছু টাকাপয়সার মালিক হলে তিনি আরও নতুন নতুন কিছু আইডিয়া নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারতেন। এবার কল্পনা করুন বিদ্যুৎ, রেডিও, টিভি, ওয়ারলেস ফোন, রাডার, এক্স-রে মেশিন, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ১৩০ ফুট লম্বা বৈদ্যুতিক রশ্মির বাইরেও আর কি আবিষ্কার তিনি আমাদের উপহার দিতে পারতেন? আমরা একটু বেশি কল্পনাবিলাসী বিধায় ধরে নিচ্ছি উত্তরটা হচ্ছে- টাইম মেশিন!

যদি টেসলাকে বিন্দুমাত্র অনুভব করতে চান, তাহলে আপনার রুমে যান। লাইট, ফ্যান সব বন্ধ করে দিন। মোবাইল ফোন বন্ধ করে দিন। ইন্টারনেট থেকে লগআউট করে কম্পিউটার শাট ডাউন করে দিন। রুমে চলতে থাকা টিভি, রেডিও সব বন্ধ করে দিন। এবার খাটে বা চেয়ারে ৫টা মিনিট চুপ করে চোখ বন্ধ করে বসে থাকুন আর ভাবুন কেমন অনুভব করছেন?

নিকোলা টেসলা ছাড়া আমাদের জীবনটাও ঠিক এমনই হতো! নিকোলা টেসলা তাই আমাদের কাছে বিজ্ঞানের জগতের ‘দ্যা ডার্ক নাইট’।

 

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/nikola_tesla_a_forgotten_name/

Saturday, July 7, 2018

আমাদের কালের নায়ক : স্যার স্টিফেন উইলিয়াম হকিং


Stephen Hawkingবস ঘুমোচ্ছেন (Boss asleep)। দরজার ওপর এমন লেখা দেখে একটু ভড়কে গেল কিশোর আলোর দুই প্রতিনিধি- তপতী আর দীপ্ত। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বীয়  মহাকাশবিদ্যা কেন্দ্রের গবেষণা পরিচালকের রুমের আশপাশে কাউকে দেখাও যাচ্ছে না যে জিজ্ঞাষা করা যাবে।

ফিরে যাবো? দীপ্ত-র প্রশ্নভরা চোখের দিকে চেয়ে তপতী বললো – না।

দরজা ঠেলে সাহস করে ভেতরে ঢুকে গেল ওরা দুজন। রুমটা এলোমেলো, ছড়ানো-ছিটানো বই, একটা হোয়াইট বোর্ড! রুমের বাসিন্দাকে দেখা যাচ্ছে না। এদিক ওদিক তাকিয়েও কোন সুবিধা হল না।

প্রথম দর্শনেই তো দেখতে পাওয়ার কথা। হতাশ হয়ে পেছন ফিরে তপতী আর দীপ্ত দুজনই বুজতে পারলো ওরা ভুল ঘরে এসেছে। দরজাজোড়া মেরিলিন মনরোর এক বিরাট ছবি! নিজের ভুল বুঝে ওরা যখন বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো, তখনই শুনতে পেল একটি অদ্ভুত ধাতব কণ্ঠস্বর, স্বাগতম। তোমরা ভুল করোনি!

কণ্ঠস্বর শুনে, ঠিকমতো খুঁজে টেবিলের পেছনে, বোর্ডের সামনে একটি হুইল চেয়ারে বসা বিজ্ঞানীকে দেখতে পেল ওরা। মুখে এক ধরনের হাসি, কী, কেমন চমকে দিলাম।

তপতী আর দীপ্ত দুজনই সামনাসামনি হয়ে পড়েছে এক জীবন্ত কিংবদন্তির!

স্টিফেন উইলিয়াম হকিং!

হকিংকে বলা হয় আইনস্টাইনের পর এই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিভাবান বিজ্ঞানী। কতটা প্রতিভাবান? তার খোঁজ খবর নিয়েই ওরা এসেছে।article-1206107-060AE1C1000005DC-618_468x320-300x205

স্বীকৃতি দিয়েই শুরু করা যাক। কেমব্রিজে ওরা গনভিল ও ফেবুস কলেজের স্টিফেন হকিং ভবন পার হয়েই এসেছে। এবং আসার সময় তাঁর মূর্তিটিও দেখেছে! দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনেও তাঁর একটি মূর্তি আছে। সান সালভাদরের বিজ্ঞান জাদুঘরটির নাম স্টিফেন হকিং বিজ্ঞান জাদুঘর। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রানি তাঁকে ইতোমধ্যে অর্ডার অব দ্যা ব্রিটিশ এম্পায়ার এবং অর্ডার অব দ্যা কম্প্যানিয়ন অনারে ভূষিত করেছেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম পদক।

তপতী আর দীপ্ত হেটে তার কাছে যাওয়ার সময় খেয়াল করলো আর দশজন পদার্থবিদের কামরার মতো হকিঙের কামরায় রয়েছে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কিছু বইপত্র, বইয়ের কয়েকটি রেক, দুতিনটে বাড়তি চেয়ার, একটা বোর্ড, বড়সড়ো একটা টেবিল। পড়ার ডেস্কটা অদ্ভুত। দীপ্ত আগে থেকে জানতো এর বৈশিষ্ট্য হলো একবার সেট করে দেওয়া হলে সুইচ টিপে বইয়ের পাতা ওল্টানো যায়। বোর্ডটিতে গণিতের নানান কিছু ছাড়াও বেশ কিছু  মজাদার সব মন্তব্য। তবে, তাতে হকিঙের কোনো হাতের লেখা নেই। দেয়ালজুড়ে বিচিত্র সব কাগজপত্র। এর মাঝে সাদা চুলের একজন বিজ্ঞান ব্যক্তিত্বকে ওরা খুঁজে নিতে পারলো অনায়াসে। আইনস্টাইন।

সাধারণ  আপেক্ষিকতা তত্ত্বের যে আঙিনায় হকিঙের বিচরণ, তাঁর স্রষ্টা হকিংকে ঘিরে রেখেছেন সার্থকভাবেই। ওরা বুঝলো, হকিং আসলে আইনস্টাইনের জগতের মানুষ – নিউটনের কার্যকারণের বেড়াজাল ডিঙিয়ে সম্ভাবনার জগতে তাঁর চলাচল।

এসময় দরজা খুলে ভিতরে আসলো হকিঙের একজন সহকারি। দীপ্ত আর হকিং ওনাকে চেনে। উনি তাদের জন্য এই সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। ওরা এসে হকিঙের পাশে এমনভাবে বসলো, যাতে হুইল চেয়ারের সঙ্গে লাগানো কম্পিউটার স্ক্রিন পড়তে পারে সহজে। সহকারিটিও এসে পড়লো কাছে।

ওদের ধারণা, আইনস্টাইনের পর সবচেয়ে প্রতিভাবান বিজ্ঞানী ছোটবেলা থেকেই দারুণ প্রতিভাবান। কাজেই শুরুটা তারা হকিঙের ছেলেবেলা দিয়েই করলো।

আর সবারই মতো


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকাল, ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি। অক্সফোর্ড শহরে ওইদিন আলাদা কোনো চমক ছিল না। ১৪ হিলসাইড রোডের ফ্রাঙ্ক হকিং ও তাঁর স্ত্রী ইসাবেলা অবশ্য খুশি ছিলেন অন্য কারণে। ওইদিন ইসাবেলার কোলজুড়ে এসেছে হকিং জুনিয়র। ঝটপট নাম রাখা হয়েছে স্টিফেন-স্টিফেন উইলিয়াম হকিং। সেদিনের আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য ছিল কি?

কেন?

দীপ্ত আর তপতী এর বিশেষ তাত্পর্য জানে। কেননা এর ঠিক ঠিক ৩০০ বছর আগে এই দিনে ইতালিতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনাকারী গালিলিও গ্যালিলি। ওরা তাই হকিংকে সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিল। মুচকি হাসলেন স্টিফেন হকিং – ওইদিন আরো দু‌’শ শিশুর জন্ম হয়েছিল, কমপক্ষে।

michael-church-NO-REUSE-300x225

সেই অ্যালবা শহরে বাল্য ও শৈশব কেটেছে স্টিফেনের। ডাক্তার পিতার খায়েশ ছিল স্টিফেনকেও তিনি ডাক্তার বানাবেন। তাই হকিং যখন ঘোষণা করলেন, তিনি পড়তে চান পদার্থবিদ্যা কিংবা গণিত, তখন পুত্রের ভবিষ্যৎ ভেবে আতঙ্কিত হলেন ফ্রাঙ্ক। তার ধারণা ছিল ওই সব পড়লে স্টিফেনকে আজীবন বেকার থাকতে হবে।

স্বভাবের দিক থেকে ছোটবেলা থেকে হকিং খুব দূরন্ত। ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করাটা রীতিমতো অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। হকিং রেডিও খুলে তার ভেতরটা দেখতেন বোঝার জন্য নয়। হকিং আসলে আর সব বাচ্চার মতোই কাজটি করতেন।

স্কুলের শিক্ষকরা তাকে সাধারণের ওপরে স্থান দিতেন। আর দশজনের সঙ্গে তাঁর একটি পার্থক্য সে সময় ছিল, হকিং কেন জানি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত পছন্দ করতেন!

সেন্ট অ্যালবা থেকে অক্সফোর্ডে পড়তে এসে হকিং মোটামুটি জনপ্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠেন। স্বভাবের কারণে। ছাত্রটি বাচাল ও দুষ্ট। কিন্তু পড়াশোনায় ভালো। কাজেই শিক্ষকরাও তাঁকে পছন্দ করতেন। ইচ্ছে ছিল অনার্স শেষে কেম্ব্রিজে যাবেন।

এ সময় ওরা হকিং সম্পর্কে একটি প্রচলিত গল্পের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে সহকারি তাতে সায়ও দিল। শেষ পরীক্ষায় ভাইবা বোর্ডে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বলতে গিয়ে হকিং বললেন – আমি যদি প্রথম শ্রেণী পাই তাহলে কেম্ব্রিজে চলে যাবো। নতুবা কিন্তু এখানেই থাকবো।

ভাবখানা অক্সফোর্ডে থেকে মাস্টারদের অনেক জ্বালাবো! অতএব একটা প্রথম শ্রেণী ও কেম্ব্রিজ।

হকিঙের সঙ্গে আলাপচারিতায় এটুকু আসতেই ওদের প্রায় সারাদিন লেগে গেল। কারণ, হকিং কথা বলেন, খুব ধীরে। এরই মধ্যে একাধিকবার নার্স এসে হকিঙের যত্ন নিয়েছে। এর মধ্যে এলিনা হকিঙের একটা ফোনও এসেছে। সহকারি বললো পরের দিন আসার জন্য।

মৃত্যুর সঙ্গে বসবাস

হুইল চেয়ারের হকিংকে দেখে যারা জানে না তারা ভাবে তাঁর এই রোগটি বেশি পুরোনো নয়। কাজেই, যখন জানে ১৯৬২ সালে পিএইচডির ছাত্র থাকাকালে তাঁর এই অসুখের কথা হকিং প্রথম জানতে পারেন, তখন নিশ্চয়ই  ভীষণ চমকে উঠে সকলে।

কেম্ব্রিজে পিএইচডি কোর্স করাকালে হকিং মাঝে মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়তেন। ছুটিতে বাড়িতে আসার পর ডাক্তার পিতা তাঁকে নিয়ে ছুটলেন বিভিন্ন ডাক্তারখানায়। ফলাফল – হকিং আক্রান্ত হয়েছেন মটর নিউরন ডিজিজে, আমেরিকায় এই রোগটির নাম লো গ্রেইরিজ ডিজিজ। স্নায়ুতন্ত্রের এই রোগ ক্রমশ হকিঙের প্রাণশক্তি নিংড়ে নেবে। ডাক্তারদের ভাষ্য মতে, হকিং আর মাত্র দু-আড়াই বছর বাঁচবেন।

আলাপচারিতায় হয়রান হয়ে পড়ায় হকিং একটু বিশ্রাম নিলেন। তপতীরা রুমের চারদিক, বিশেষ করে টেবিলটা, ভালোভাবে লক্ষ করে একটি মজার জিনিষ দেখতে পেল। মনে হল প্রায় পাঁচ দশক ধরে মৃত্যুর সঙ্গে হকিঙের লড়াইয়ের প্রেরণার খোঁজ ওরা পেয়েছে। টেবিলে দুটো বাঁধানো ছবি। একটি ছবিতে দুছেলে ও এক মেয়ের সঙ্গে হকিং দম্পতি। অপর ছবিটিও হকিং দম্পতির। তবে, ভালোভাবে খেয়াল করে ওরা বুঝলো দুটো ছবির দুজন স্ত্রী কিন্তু আলাদা। প্রশ্নসূচক ভঙ্গিতে হকিঙের দিকে তাকাতে দেখল তিনি হাসছেন। ভাবখানা – অল্পক্ষণের মধ্যে জেনে যাবে।

 

মধুর সেই স্মৃতি

ATsgP-300x194

১৯৬৫ সালের জুলাই মাসে ওঁদের বিয়েটা হয়। ট্রিনিটি হলের আর দশটা বিয়ের মতো এই বিয়ের অনুষ্ঠান খুব সাধারণ ছিল যে কোনো বিচারে। এই বিয়ের অসাধারণত্ব আসলে অন্যখানে। শ’খানেক আমন্ত্রিত অতিথির অনেকেই জানতেন এই অনুষ্ঠানের উজ্জ্বল হাসিখুশি চেহারার, সোনালি ফ্রেমের চশমা পরিহিত যুবকের আয়ু আর মাত্র দুবছর। শুধু আমন্ত্রিতরা নন, এই নির্মম সত্যটি জানা ছিল ওই দিনের বর স্টিফেন হকিং ও কনে জেন ওয়াইল্ডের।

সহকারির কাছে হকিঙের পারিবারিক অ্যালবামে দেখা গেল লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়ানো স্টিফেনের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লাজনম্র বধুটির মুখে হাসি। হ্যাঁ, বিয়ের আসরে হকিঙের হাতে লাঠিই ছিল। ‘৬২ সালে এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে ভাষাতত্ত্বের ছাত্রী জেনের সঙ্গে লাভ অ্যাট ফাস্ট সাইট হওয়ার আগেই হকিঙের অসুস্থতা ধরা পড়ে। কাজেই উজ্জ্বল স্ফূর্তিবাজ, প্রাণবস্তু হকিংকে জেন দেখেননি কখনো। জেনের ভালোবাসা তাই অসুস্থ হকিংকে ঘিরেই।

কতোটা ভালোবাসা ছিল তাঁদের দুজনের মধ্যে? হকিঙের কাছে জানতে চাইতেই বললেন – বিয়ের কারণে আমি বেঁচে থাকতে, এগিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলাম। জেন আসলেই আমার বেঁচে থাকার প্রথম প্রেরণা।

কাজেই হকিং ফিরলেন তার মূল এরিনায় আপেক্ষিকতা তত্ত্বের আঙ্গিনায়।

ঈশ্বর যখন নরক বানাচ্ছিলেন

১৯১৬ সালে আইনস্টান তাঁর আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব প্রকাশ করেন। ১৯২২ সালে ফ্রিডম্যান আপেক্ষিতার সমীকরণের সমাধান করেন। তাতে দেখা যায় এই দুনিয়া (Universe) ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। নিউটনের স্থির দুনিয়া তত্ত্বের লোকজন  এতে আতকে ওঠেন, খোদ আইনস্টাইনও এই সমাধান নাকচ করেন। কিন্তু ১৯২৯ সালে এডউইন হাবল দুরবিন দিয়ে সত্যটা দেখে ফেলেন – দুনিয়া আসলেই সম্প্রসারিত হচ্ছে! গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর পরস্পর থেকে দ্রুত সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যদি তুমি পেছনে যাও তাহলে এক সময় দেখা যাবে এই দুনিয়ায় সবকিছু এক বিন্দুতে ছিল। কোনো এক সন্ত্রাসী ঘটনায় সবাই দিগ্বিদিক হয়ে ছুটে চলেছে। এ থেকে উদ্ভব বিগ ব্যাং তত্ত্বের, যা আজকের কসমোলজির প্রাণ।

বিগ ব্যাং-এর সমস্যা অন্যত্র। দুনিয়ার সবকিছুকে এক জায়গায় জড়ো করলে যা হয়, তাতে বিজ্ঞান একটু অস্বস্তিতে পড়ে। কারণ এক বিন্দুর দুনিয়ার নাম সিংগুলারিটি যাতে জানা সমীকরণগুলোর ভগ্নদশা। ষাটের দশকে রজার পেনরোজের সঙ্গে হকিং দেখালেন তাঁর প্রথম খেল। বললেন, যতোই আপত্তি থাকুক সিংগুলারিটি থেকেই দুনিয়ার শুরু। শুধু তাই নয়, বিগ ব্যাং থেকেই সময়ের শুরু। অর্থাৎ, বিগ ব্যাং-এর আগে বলে কিছু নেই। ক্ষ্যাপা, লোকজনের অনেকে হকিঙের কাছে জানতে চাইতো বিগ ব্যাঙের আগে ঈশ্বর কী করেছিলেন?

মুচকি হেসে হকিং বলতেন, অবিশ্বাসীদের জন্য নরক বানাচ্ছিলেন!

ঈশ্বর কি পাশা খেলে?

সময়ের শুরুর ধারণা জেনে হকিং এগোলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে। এরই মধ্যে জানা হয়েছে, বস্তুজগতে এমন বস্তু সম্ভব, যার থেকে দুনিয়ায় সবচেয়ে দ্রুতযান আলোও বের হতে পারে না – ব্ল্যাকহোল। ব্ল্যাকহোল কি আসলেই ব্ল্যাক? কিছুই  কি সেখান থেকে বের হতে পারে না?

হুইল চেয়ারের বিজ্ঞানী ভাবেন। ভাবেন কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের অনিশ্চয়তার তত্ত্ব নিয়ে। পরস্পর সম্পর্কযুক্ত দুটো কোয়ান্টাম রাশির যুগপৎ নিশ্চয়তা নেই। শূন্যস্থানে এই তত্ত্বের প্রয়োগ এরই মধ্যে বলে ফেলেছে শূন্যস্থান আসলে শূন্য নয়। সেখানে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে কণা ও প্রতিকণা, আবার তা লয়ও পাচ্ছে। হকিং এই ঘটনাকে প্রয়োগ করলেন ব্ল্যাকহোলের আশপাশে এবং আশ্চর্য হয়ে দেখলেন ব্ল্যাকহোল থেকেও বের হয়ে আসছে অবিরল কণাস্রোত।

১৯৭৩ সালে হকিং প্রকাশ করলেন তাঁর ধারণা এবং অচিরেই তা গৃহীত হলো। বিজ্ঞানজগৎ ওই বিকিরণকে অভিহিত করলো হকিঙেরই নামে হকিং রেডিয়েশন

রাজকীয় বিজ্ঞান সমিতির সভ্য

এই বিশ্বের বিজ্ঞানীদের বড় সম্মানের একটি হলো রয়্যাল সোসাইটির সভ্য হওয়া। নতুন সভ্য হওয়ার কোনো অনুষ্ঠানে তোমাদের আমরা নিতে চাই। দেখবে উপস্থিত সব সভ্যদের সামনে দিয়ে নতুন সভ্যটি এগিয়ে যাবেন মঞ্চের দিকে, সেখানে সভাপতির সামনে রক্ষিত খাতা সই করবেন। টাইম মেশিনে করে এবার আমরা হাজির হবো ১৯৭৪ সালের কোনো একদিন। দেখবে সোসাইটর শত বছরের নিয়ম ভেঙে সভাপতি খাতা হাতে নিয়ে হাজির হয়েছেন এক নতুন সভ্যর সামনে। আর হুইল চেয়ারের সভ্যটি অনেক কষ্টে নিজের নাম স্বাক্ষর করছেন – স্টিফেন উইলিয়াম হকিং।

এরপর থেকে আশির দশকের শুরু পর্যন্ত হকিং পেয়েছেন ছয়টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার, যার মধ্যে রয়েছে তত্ত্বীয় পদার্থবিদদের সর্বোচ্চ সম্মান অ্যালবার্ট আইনস্টাইন পদক। ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে, তাঁর পুরোনো অক্সফোর্ডসহ। রানী এলিজাবেথ তাঁর নাম ঘোষণা করেছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একজন কমান্ডার’ (Commander of the British Empire)  হিসেবে।

আর ১৯৭৯ সালে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হকিংকে বানালো গণিতের লুকাসিয়ান প্রফেসর, এক সময় যে পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। ২০০৯ সালে আবারএ এই পদে আসীন হোন তিনি। সর্বশেষ এখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কেন্দ্রের গবেষণা পরিচালক।

 

সবকিছু এক রকম নয়

1008375_a_451537cজেন আর হকিঙের জীবনে এর মধ্যে এসেছে রবার্ট, লুসি ও টিমোথি। পাঁচজনের যে বাঁধানো ছবিটি ওরা দেখেছে হকিঙের টেবিলে, তার বাকি তিনজন। ভাষাতত্ত্বের ছাত্রী হওয়ায় জেনের বড় খেদ ছিল হকিঙের কাজের সঙ্গে একাত্ম হতে না পারা। তারপরও দীর্ঘদিন তিনিই ছিলেন হকিঙের সার্বক্ষণিক সেবিকা। পরে আর্থিক সচ্ছলতার কারণে সার্বক্ষণিক নার্স নিয়োগের সামর্থ্য হলো হকিং পরিবারের আস্তে আস্তে দূরত্ব বাড়তে শুরু করলো হকিং ও জেনের মধ্যে।

মধ্য-আশিতে এক অপারেশনের ফলে তকিং সম্পূর্ণভাবে বাকশক্তি হারান। আগে থেকেই তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। ছোট ছেলে টিমোথির বন্ধুর বাবা ডেভিড মেসন হকিংকে একটি কম্পিউটার বানিয়ে দেন, যা তাঁর হুইল চেয়ারের হাতলে ফিট করা (এটিরই উন্নত সংস্করণটি দেখছে তপতী ও দীপ্ত)। ক্যালিফোর্নিয়ার এক কম্পিউটারবিদ তৈরি করেছেন একটি বিশেষ সফটওয়্যার। শুধু আঙুল নাড়িয়ে হকিং কম্পিউটারের পর্দায় ফুটে ওঠা শব্দ নির্বাচন করেন। এভাবে তৈরি করেন বাক্য। ভয়েস সিনথেসাইজারের মাধ্যমে ওই বাক্য স্পিকার থেকে বের হয়ে আসে। এভাবে হকিং কথা বলছে তপতীদের সঙ্গে এবং এভাবেই লিখেছেন এযাবত্কাল প্রকাশিত সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বিখ্যাত বিজ্ঞানের বই এ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম।

ব্রিফ হিস্ট্রি অ টাইম

১৯৮৮ সালে স্টিফেন হকিঙের A Brief History of Time- From the Big Bang to Black Holes প্রকাশিত হয়। বিশ্বজুড়ে আজ পর্যন্ত এক কোটি কপিরও বেশি বিক্রি হয়েছে। এখনো প্রতি মাসে সারা বিশ্বে এর প্রায় ৫ হাজার কপি বিক্রি হয়। প্রকাশের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমেরিকায় ৪০ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল। ফলে দুটো উল্টো ছাপানো ছবিসহ ওই মার্কিন সংস্করণ সংশোধনের আগেই বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়! বিজ্ঞানের দুরূহতম বিষয়ের এমন সহজবোধ্য বই এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি বলে ধারণা করা হয়। যদিও জটিল বিষয়বস্তুর কারণে অনেকেই বেশি দূর এগোতে পারেন না। এই বইয়ের শেষে হকিং তিনজন বিজ্ঞানী সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। গ্যালিলিও, নিউটন ও আইনস্টাইন। দুর্জনেরা বলেন আগামী দিনের ব্রিফ হিস্ট্রিতে থাকবে চারটি জীবনী। চতুর্থটি হবে হকিঙের।

 

জেন আর হকিং নয় আর দুজনার

বই লেখা শুরু করার কিছু আগে ডেভিড মেসনের স্ত্রী এলিনা মেসন হকিঙের নার্সিঙের দয়িত্ব নেন। এলিনার ভরসায় হকিঙের সঙ্গে বিদেশ যাওয়া বাদ দেন জেন। এর মধ্যে তিন ছেলেমেয়ের দায়িত্বও তাকে পালন করতে হচ্ছে। সর্বোপরি হকিঙের  ঈশ্বরবিশ্বাসও জেনকে টলিয়ে দিছে। অবশেষে জেন ও হকিং পরস্পরের জীবন থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৯১ সালে হকিং উঠে আসেন এলিনার ফ্ল্যাটে। জেন ও হকিং তাদের বিচ্ছেদ সম্পর্কে কখনোই কিছু বলেন না।

stephen-hawking-quotes-10সেই থেকে হকিং তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী এলিনা হকিঙের সঙ্গেই আছেন। টেবিলের দ্বিতীয় ছবির মহিলাটির সঙ্গে এভাবেই পরিচয় ঘটে দীপ্তদের।

ঈশ্বরের মন

হকিঙের কাছে ওরা জানতে চাইল বিজ্ঞানের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী?  হকিঙ বললেন – ঈশ্বরের মন বুঝতে পারা।

কীভাবে? এই বস্তুজগতের নিয়মাবলীর সাধারণ, সহজ ও সরল সূত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে। এই তত্ত্ব হবে সব পেয়েছির তত্ত্ব। এই যে হকিং আজকাল বেশি মাথা ঘামাচ্ছেন কাল্পনিক সময়, ওয়ার্মহোল প্রভৃতি নিয়ে— এসব কিছুর লক্ষ্যও কিন্তু এক। নিছক কোনো বাগুজে সমীকরণ নয়, এ হচ্ছে সব পেয়েছির চাবি। এর সাহায্যে মানুষ যেমন পারবে বস্তুজগতের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মৌলিক কণার খবর জানতে, তেমনি সক্ষম হবে দূর মহাকাশের বিশালাকার কৃষ্ণবিবরের আচরণ ব্যাখ্যা করতে।

বস্তুজগতে মোট চার ধরনের বল ও তাদের মিথষ্ক্রিয়া আমরা অনুভব করছি প্রতিনিয়ত। মহাকার্ষ, বিদ্যুৎ- চৌম্বক, ক্ষীণ ও সবল পারমাণবিক বল। প্রকৃতি জগতের এই চারটি বলকে একত্রিত করে একটি সমন্বিত তত্ত্ব দাঁড় করানোই হলো এখনকার তত্ত্বীয় পদার্থবিদদের চ্যালেঞ্জ। ইতিমধ্যে সবল, ক্ষীণ ও তড়িৎ- চৌম্বকত্বের এককত্ব প্রমাণিত। বাকি রয়েছে মহাকর্ষ। মহাকর্ষ সম্পর্কে সবেচেয়ে সুন্দর তত্ত্বটি হলো আইনস্টাইনের সাধারণ তত্ত্ব। আর অন্যদিকে মাইক্রোওয়ার্ল্ডের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগতের কণারা মেনে চলে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। কাজেই মেলাতে হবে এই দুই তত্ত্বকে— পেতে হবে কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির সন্ধান।

পরিণয়ের আগে পরিচয়ের পালাটি করিয়ে দিয়েছেন হকিং। ব্ল্যাকহোলের আচরণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মহাকাশে সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন কোয়ান্টাম তত্ত্বের।

বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা এই জোড় মেলানোর কাজে ব্যস্ত। কেম্ব্রিজের অসাধারণ প্রতিভাবান উজ্জ্বল চোখের অধিকারী, তপতীদের পাশে বসা স্টিফেন উইলিয়াম হকিংও এই দলে রয়েছেন। যদিও তাঁর বয়স মাত্র ৭২ বছর। অন্য বিজ্ঞানীদের মতো হকিংও আশাবাদী। কেউ না কেউ এই খোঁজ পেয়ে যাবেন দুই-এক দশকের মধ্যে।

হকিং কি নোবেল পুরস্কার পাবেন

না মনে হয়। স্টিফেন হকিং নোবেল পুরস্কার পাবেন না। কারণ? কারণ আলফ্রেড নোবেল নিজে। দুর্জনেরা বলেন, নোবেল তাঁর উইলে পদার্থ বিজ্ঞানে পুরস্কারের ক্ষেত্রে পরীক্ষাগারে প্রমাণিত হতে হবে- এমন বাক্য যোগ করেছিলেন জ্যোতির্বিজনীদের পুরস্কার থেকে দূরে রাখার জন্যই! কেননা, নোবেল বিশ্বাস করতেন, শেষ বয়সে তাঁর প্রতি তাঁর স্ত্রীর অনীহার কারণ এক যুবক জ্যোতির্বিজ্ঞানী। এ জন্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা। এই খাঁড়াতেই তত্ত্বীয় পদার্থ বিজ্ঞানীদেরও সমস্যা। কখনো কখনো এমন সময় আসে পুরস্কারপ্রাপ্তি ব্যক্তির চেয়ে পুরস্কারকেই মহিমান্বিত করে। হয়তো সে রকম একটা মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছে নোবেল পুরস্কার যেদিন স্টিফেন উইলিয়াম হকিং ভূষিত হবেন নোবেল পুরস্কারে।

আমাদেরই লোক

সহকারির সঙ্গে কথা বলে, পারিবারিক এলবাম দেখে তপতীদের তখন অনেক কিছু জানা হয়েছে। হকিঙ আড্ডা দিতে ভালবাসেন। যখন পারতেন তখণ কনসার্ট গিয়ে হুইর চেযারেই মেতে উঠতেন আনন্দে। ছবি ঘেটে একটি ছবিতে আমাদের বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামকে দেখে উচ্ছসিত হয়ে পড়ল দীপ্ত। হকিঙকে যকন বলা হল ওরা জেএনইসলামের দেশের লোক তখনই চোখদুটো আরোকিত হয়ে উঠলো। জানা গেল আশির দশকে জামাল নজরুল ইসলাম আর হকিং ছিলেন পারিবারিক এবং গবেষণা বন্ধু।

এই ক’দিনে ওদের সঙ্গে খাতির হয়েছে হকিঙের। কাজে সাহস করে জানতে চাইল – নোরমা জিন ওরফে মেরিলিন মনরো কেন হকিঙের দেয়ালে?

হ্যাঁ, এদের মতোই হকিঙের প্রিয় নায়িকা মেরিলিন মনরো। হকিং রীতিমতো তাঁর ফ্যান।

জ্যামিতিক চিত্রের মাধ্যমে তিনি নিজের চিন্তাকে বিকশিত করেন। ছুটে যাচ্ছেন দেশ থেকে দেশে, লোকেদের শোনান বিজ্ঞানের কথা। বলেন, বিজ্ঞান আর গবেষণাকে ভালোবাসতে, যাতে মানবজাতি এগোতে পারে।

কেবল বক্তৃতা নয়, লিখে ফেলেছেন বিজ্ঞানকে সহজ করে বলা বই। এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইমের কথা আগেই শুনেছে ওরা। এর বাইরে ইউনিভার্স ইন এ নাটশেল, ব্রিফার হিস্টরি অব টাইম, ব্ল্যাকহোল অ্যান্ড বেবি ইউনিভার্স, গড ক্রিয়েটেড দ্যা ইন্টিজার, দ্যা গ্র্যান্ড ডিজাইন  প্রভৃতি বই। মেয়ে লুসির সঙ্গেলিখেছেন, জর্জস সিক্রেট কি টু ইউনিভার্স, যেখানে হ্যারি পটারের স্টাইলে বিজ্ঞানের জটিল বিষয় তুলে ধরা হয়েছে।

হকিং অভিনয় করেছেন স্টারট্রেকের ডিসেন্ট এপিসোডে। যারা তোমরা পিঙ্ক ফ্লয়েডের ডিভিশন বেল অ্যালবামের কিপ টকিং গানটা শুনেছে, তারা সবাই কিন্তু হকিংয়ের সিনথেসাইজড শব্দও শুনেছ! সেখানে তাঁর সিনথেসাইজড ভয়েস ব্যবহার করা হয়েছে।

হকিং যদি বিজ্ঞানী নাও হতেন, তাহলেও তিনি বিখ্যাত হতেন। কারণ ৫০ বছর ধরে এএলএস রোগে আক্রান্ত কেউ বেঁচে আছেন, এমন কোনো রেকর্ড নেই!

তবে আমাদের সৌভাগ্য যে রোগ তাঁর বাক ও চলত্শক্তি কেড়ে নিলেও তাঁর মেধা, মনন, দৃষ্টিকে কেড়ে নিতে পারেনি।

কাজে তিনি স্বপ্ন দেখেন এবং স্বপ্ন দেখাতে ভালবাসেন।

 

[তপতী ও দীপ্তর সাক্ষাৎকার নেওয়ার বিষয়টি কাল্পনিক]

উৎস ঃ http://munirhasan.com/hawking/

Tuesday, July 3, 2018

কাফকার জন্মদিনে (কোথাও সুপ্ত - কাফকা' কে নিয়ে মিলান কুন্দেরা)



-কোন কবি কবিতার সৃষ্টি করেন না
কবিতাটা শুরু থেকেই কোথাও সুপ্ত আছে
বহু কাল ধরে সেইখানেই ছিল
কবি শুধু সেটা আবিষ্কার করেন- জ্যান স্ক্যাকেল



আমার বন্ধু জোসেফ স্কভোরেকি তাঁর বইয়ে এই সত্যি ঘটনাটা লিখেছিলেন:
প্রাগের একজন ইঞ্জিনিয়ার আমন্ত্রিত হয়েছিলেন লন্ডনের একটি পেশাদারি আলোচনা সভায়। তিনি সেইখানে গেলেন, অংশগ্রহণ করলেন এবং প্রেগে ফিরে এলেন। ফিরে আসার কয়েক ঘন্টা পরে, তাঁর অফিসে বসে, তিনি তুলে নিয়েছিলেন রুড প্রাভো – পার্টির দৈনিক মুখপত্র – এবং পড়েছিলেন – লন্ডনের একটি আলোচনা সভায় আমন্ত্রিত এক চেক ইঞ্জিনিয়ার, পশ্চিমের সংবাদমাধ্যমের সামনে তাঁর সমাজতান্ত্রিক স্বদেশ সম্পর্কে কুরুচিকর মন্তব্য করে পশ্চিমেই থেকে গেছেন।

অবৈধ অভিবাসন এমন কুরুচিকর মন্তব্যের পর, খুব সহজ বিষয় নয়। কুড়ি বছরের জেল হওয়ার জন্য যথেষ্ট। আমাদের ইঞ্জিনিয়ার নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কিন্তু লেখাটা যে তাঁর সম্পর্কেই, তা নিয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ ছিল না। তাঁর সহায়ক অফিসে এসে তাঁকে দেখে অবাক: হা ভগবান, আপনি ফিরে এসেছেন! আমি বুঝতে পারছি না – দেখেছেন আপনার সম্পর্কে কী লিখেছে?
ইঞ্জিনিয়ার সহায়কের চোখে ভয় দেখতে পাচ্ছিলেন। কিন্তু কিই বা করবেন? ছুটে গেলেন রুডো প্রাভোর অফিসে। খুঁজে বার করলেন লেখাটির দায়িত্বপ্রাপ্ত সম্পাদককে। সম্পাদক ক্ষমা চাইলেন, হ্যাঁ, বিষয়টা সত্যিই অস্বস্তিকর, কিন্তু তাঁর কিছু করার নেই, লেখাটার তিনি পেয়েছিলেন অভ্যন্তরীন মন্ত্রক থেকে।
ইঞ্জিনিয়ার অতঃপর পৌছালেন অভ্যন্তরীন মন্ত্রকে। সেখানে তাঁকে বলা হল যে হ্যাঁ এটা একটা ভুল, কিন্তু তাঁদেরও কিছু করার নেই কারণ প্রকৌশলবিদ সম্পর্কে এইরকমই রিপোর্ট পাঠিয়েছেন লন্ডন দূতাবাসের গোয়েন্দা বিভাগ। ইঞ্জিনিয়ার অনুরোধ করলেন খবরটা প্রত্যাহার করার জন্য। না, তাঁরা জানালেন প্রত্যাহার করার নিয়ম নেই, কিন্তু তাঁরও কোন সমস্যা হবে না, কোন চিন্তা নেই।
কিন্তু আমাদের ইঞ্জিনিয়ারের চিন্তার অনেক কারণ ঘটল। তিনি হঠাৎ বুঝতে পারলেন যে তাঁকে নজরে রাখা হচ্ছে, তাঁর টেলিফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে, এবং তাঁকে রাস্তায় অনুসরণ করা হচ্ছে। তাঁর ঘুম বন্ধ হয়ে গেল, তিনি দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন, অবশেষে আর চাপ না নিতে পেরে, অনেক ঝুঁকি নিয়ে বেআইনি ভাবে দেশত্যাগ করলেন। এবং সত্যি সত্যিই রাজনৈতিক কারণে অভিবাসন নিতে বাধ্য হলেন।



যে গল্পটা আমি এই মাত্র বললাম, সেই ধরণের গল্পকে আমরা প্রায় শোনার সঙ্গে সঙ্গেই বলি কাফকা-সদৃশ। এই যে পরিভাষাটি, একজন শিল্পীর কাজ থেকে নেওয়া, একজন লেখকের তৈরী দৃশ্যের থেকে নির্নয় করা, হল সেই সব পরিস্থিতির (সাহিত্যে কিংবা সত্যি জীবনে) একমাত্র সাধারণ বিভাজক যা অন্য কোন শব্দ বোঝাতে পারে না এবং কোন রাজনৈতিক বা সামাজিক বা মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব কোন উত্তর দিতে পারে না।
কিন্তু কি এই কাফকা-সদৃশ?
এর কিছু বৈশিষ্ট বর্ণনা করার চেষ্টা করা যাক।
এক:
আমাদের ইঞ্জিনিয়ার যে ক্ষমতার মুখোমুখি হয়েছিলেন তার মধ্যে একটা অসীম গোলকধাঁধার বৈশিষ্ট আছে। তিনি কোনোদিনই এই অসমপনীয় করিডোরের উপান্তে পৌঁছাতে পারবেন না, জানতে পারবেন না তাঁর কে এই চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা দিয়েছিলেন। তাঁর পরিস্থিতি যেন আদালতের সামনে জোসেফ কে. এর মত, কিংবা ক্যাসেল এর সামনে জমির সার্ভেয়ার কে. এর মতই। এঁদের তিনজনেই এমনটা একটা জগতের যেখানে আর কিছুই নেই শুধু একটা প্রকাণ্ড গোলকধাঁধার মত প্রতিষ্ঠান আছে, যার থেকে তাঁদের নিস্তার নেই এবং যাকে বোঝার কোন উপায় নেই।
কাফকার আগের ঔপন্যাসিকরা অনেক সময়েই প্রতিষ্ঠানের মুখোস খুলেছেন এমন ভাবে যেন এইগুলো আসলে বিভিন্ন ব্যক্তি এবং সর্বজনীন অভীপ্সার সংঘর্ষের জায়গা। কাফকায় প্রতিষ্ঠান এমন এক প্রক্রিয়া যে স্বতন্ত্র নিয়মে চলে, কেউ জানে না কে এই নিয়মগুলির প্রোগ্রামার বা কবে প্রোগ্রাম করেছিলেন; যার কাছে মানুষের চিন্তার কোন মূল্য নেই এবং তাই বোধাতীত।
দুই:
দ্য ক্যাসেল –এর পঞ্চম অনুচ্ছেদে, গ্রামের মেয়র বিস্তারিত ভাবে কে. কে বোঝাচ্ছেন তাঁর ফাইলের দীর্ঘ ইতিহাস। সংক্ষেপে: বহুদিন আগে, একজন জমির সার্ভেয়ারকে নিয়োগ করার একটা প্রস্তাব ক্যাসেল থেকে এসেছিল। মেয়র এই প্রস্তাবে সায় দেন নি (তিনি লিখেছিলেন যে কোন জমির সার্ভেয়ারকে নিয়োগের দরকার নেই), কিন্তু তাঁর সেই জবাব ভুল দপ্তরে চলে যায়, এবং একটা খুব দুর্বোধ্য, দীর্ঘ বছর ধরে চলা, আমলাতান্ত্রিক ভুল বোঝবুঝির পরম্পরার পর, ভুল করে কে.-কে নিয়োগ করা হয়, ঠিক সেই সময় যখন সব কটা দপ্তর মিলে পুরোনো অচল সেই প্রস্তাবটিকে বাতিল করার কাজ করছে। তাই দীর্ঘ সফরের পর কে. আসলে ভ্রান্তিবসত সেই গ্রামে চলে এসেছে। যদি এটা মেনে নেওয়া হয় যে কে.এর আসলে ক্যাসেল এবং এই গ্রামটি ছাড়া অন্য কোন অস্তিত্ব নেই, তাহলে তাঁর সম্পূর্ণ অস্তিত্বটাই একটা ভুল।
এই কাফকা-সদৃশ জগতে ফাইল আসলে একটা প্লেটোনিক ধারণার ভূমিকা নেয়। তা যেন প্রকৃত বাস্তবের প্রতিনিধি, অন্যদিকে মানুষের শারীরিক অস্তিত্ব যেন একটা অলীকতার পর্দায় একটা ছায়া মাত্র। সত্যি এই জমির সার্ভেয়ার আর প্রেগের ইঞ্জিনিয়ার যেন শুধু তাঁদের ফাইলের ছায়া, বা তার চাইতেও কম, তাঁরা আসলে তাঁদের ফাইলের একটা ভুলের ছায়ামাত্র, ছায়া যাদের ছায়া হিসাবেও বেঁচে থাকার অধিকার নেই।
কিন্তু যদি মানুষের জীবন শুধুই একটা ছায়াই হয় আর প্রকৃত বাস্তব থাকে অন্য কোথাও, যেখানে পৌছানো যায় না, মনুষ্যতর বা মনুষ্যতম কোন অস্তিত্বে, তাহলে আমরা ধর্মতত্ত্বের ক্ষেত্রে প্রবেশ করি। সত্যিই কাফকার প্রথম আলোচকরা তাঁর উপন্যাসের ব্যাখা করেছিলেন ধর্মীয় রূপক হিসাবে।
কিন্তু আমি মনে করি এই ধরণের ব্যাখান ভ্রান্ত (কারণ এই ব্যাখায় আছে রূপক, যেখানে কাফকা আত্মস্থ করেছিলেন মানুষ জীবনের সুনির্দিষ্ট ঘটনা) কিন্তু জানায়: যখনই ক্ষমতা নিজেকে অমান্য করে, তখনই সে সৃষ্টি করে তার নিজস্ব ধর্মতত্ত্ব; যখনই তা ভগবানের মত আচরণ করে, তা নিজের প্রতি জাগিয়ে তোলে এক ধর্মীয় বোধ; এমন জগতের বর্ণনা শুধু ধর্মতত্ত্বের পরিভাষাতেই সম্ভব।
কাফকা ধর্মীয় রূপক লেখেন নি, কিন্তু কাফকা-সদৃশ তার ধর্মতত্ত্ব (বা ছদ্মধর্মতত্ত্ব) – এর থেকে অবিচ্ছেদ্য।
তিন:
রাস্কালনিকোভ তাঁর অনুশোচনার ভার বহন করতে পারছিলেন না, শান্তি পেতে তিনি স্বেচ্ছায় তাঁর শাস্তিতে সম্মতি জানিয়েছিলেন। এটা হল খুব পরিচিত সেই পরিস্থিতি যেখানে অপরাধ শাস্তি চায়।
কাফকায় এই যুক্তি উলটে যায়। শাস্তিপ্রাপ্ত মানুষটি জানেন না কেন তাঁর এই অপরাধ। শাস্তির উদ্ভটতা এতই অসহনীয় যে শান্তি পেতে শাস্তিপ্রাপ্ত মানুষটি তাঁর দণ্ডের একটি ন্যায্যতা খোঁজেন: শাস্তি অপরাধ খোঁজে।
প্রেগের ইঞ্জিনিয়ারের শাস্তি ছিল প্রগাঢ় পুলিশি পাহারা। এই শাস্তি দাবী করে এমন অপরাধ যেটা করাই হয় নি, দেশত্যাগে অভিযুক্ত ইঞ্জিনিয়ার অবশেষে সত্যিই দেশত্যাগ করেন। শাস্তি অবশেষে অপরাধ খুঁজে নেয়।
তাঁর বিরুদ্ধে কি অভিযোগ না জেনে, দ্য ট্রায়ালের সপ্তম অধ্যায়ে কে. তাঁর পুরো অতীতটাকেই “পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে” পরীক্ষা করবে বলে ঠিক করে। “স্বয়ংদণ্ডপ্রদান” যন্ত্র চলতে শুরু করে। দণ্ডিত তার অপরাধ খোঁজে।
একদিন, অ্যামেলিয়া ক্যাসেলের একজন পদাধিকারীর থেকে একটি অশ্লীল চিঠি পান। রেগে গিয়ে তিনি চিঠিটা ছিড়ে ফেলেন। অ্যামেলিয়ার এহেন ব্যবহারের তিরষ্কার পর্যন্ত দরকার পড়ে না ক্যাসেলের। ভয় (সেই ভয় যা আমাদের ইঞ্জিনিয়ার দেখেছিলেন তাঁর সেক্রেটারীর চোখে) নিজেই তার কাজ করে। কোন আদেশ ছাড়া, ক্যাসেল থেকে আসা কোন বোধগম্য নির্দেশ ছাড়াই, সবাই অ্যামেলিয়ার পরিবারকে মহামারীর মত এড়িয়ে চলতে শুরু করে।
অ্যামেলিয়ার বাবা তাঁর পরিবারকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সেইখানেও একটি সমস্যা দেখা দেয়: শুধু এই শাস্তিত সিদ্ধান্তের উৎস খুঁজে পাওয়াই অসম্ভব নয়, এই সিদ্ধান্তেরই আসলে কোন অস্তিত্ব নেই। পুনর্বিচারের জন্য, ক্ষমা চাওয়ার জন্য, আগে দণ্ডপ্রাপ্ত হতে হবে! অ্যামেলিয়ার বাবা তাই ক্যাসেলের কাছে অপরাধ ঘোষণা করবার জন্য ভিক্ষা চান। অতএব শুধু এইটুকু বললেই চলে না যে যে শাস্তি অপরাধ খোঁজে। এই ছদ্মধর্মতত্ত্বের জগতে, দণ্ডিত তার দণ্ডের প্রকৃত কারণ- অপরাধ-এর স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য ভিক্ষা চায়!
আজকাল অনেক সময়ে দেখা যায় যে বদনাম হওয়া কোন মানুষ সামান্যতম কাজটুকুও জোটাতে পারেন না। বারবার নিষ্ফল হয়ে তাঁদের অপরাধ করেছেন এবং সেই কারণে তাঁদের কাজ পাওয়া নিষিদ্ধ এমন সার্টিফিকেট চাইতে হয়। আর শাস্তির কোন সিদ্ধান্ত খুঁজেই পাওয়া যায় না। প্রেগে যেহেতু আইনত কাজ করা বাধ্যতামূলক, এঁরা অবশেষে পরজীবি হিসেবে অভিযুক্ত হন, যার মানে তাঁরা কাজ এড়িয়ে চলার দায়ে অভিযুক্ত হন। শাস্তি অভিযোগ খুঁজে নেয়।
চার:
প্রেগের ইঞ্জিনিয়ারের গল্পটা অনেকটা মজার গল্পের মত, একটা রসিকতা: হাসির উদ্রেক করে।
দু’জন ভদ্রলোক, একেবার সাধারণ ( ফ্রেঞ্চ অনুবাদে যেমন আছে তেমন “ ইন্সপেক্টর” নন), একদিন সকালে জোসেফ কে.-কে হতভম্ব করে তাঁর শোয়ার ঘরে উপস্থিত হন, তাঁকে জানান যে তাঁকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে, এবং তাঁর ব্রেকফাস্ট খেয়ে নেন। কে. একজন খুব নিয়মনিষ্ঠ সরকারী কর্মচারী : তাঁদের ফ্ল্যাট থেকে বার না করে দিয়ে, রাতপোশাক পরিহিত অবস্থায় দাঁড়িয়ে দীর্ঘ আত্মপক্ষ সমর্থন করতে থাকেন। কাফকা যখন তাঁর বন্ধুদের সামনে দ্য ট্রায়ালের প্রথম অধ্যায়টা পড়ে শোনান, তখন সব্বাই হেঁসে উঠেছিলেন, এমনকি লেখক নিজেও।
ফিলিপ রথের দ্য ক্যাসেলের কাল্পনিক ফিল্ম ভারশানে: গ্রাউচো মার্ক্স ল্যাণ্ড সার্ভেয়র কে. –এর ভূমিকায়, আর চিকো আর হার্পো তাঁর দুই সহকারী। হ্যাঁ, রথ খুবই সঠিক: কাফকা-সদৃশ জগতের মূল নির্যাস থেকে কমিককে আলাদা করা যায় না।
কিন্তু তাঁর গল্পটা কমিক এটা ইঞ্জিনিয়ারের কাছে স্বস্তির কারণ নয়। তিনি তাঁর নিজের জীবনের রসিকতায় আবদ্ধ, যেমন পাত্রে মাছ; তাঁর কাছে এটা মজার নয়। সত্যিই রসিকতা ততক্ষণ রসিকতা যতক্ষণ আপনি পাত্রের বাইরে; উলটো দিকে কাফকা আমাদের নিয়ে যান ভিতরে, রসিকতার অভ্যন্তরে, কমিকের বীভৎসতায়।
কাফকা-সদৃশ জগতে কমিক ট্র্যাজিকের উলটো দিক নয় (ট্র্যাজি-কমিক) যেমন শেক্সপীয়ারে; এখানে তা ট্রাজিককে আরো সহনীয় করে তোলার জন্য তার স্বরকে নরম করে না, এটা ট্র্যাজিকের সাথেও যায় না, এটা ট্রাজিককে তার ডিমের মধ্যে ধ্বংস করে এবং তাই তার শিকারকে, তাঁদের সামান্যতম উপসম – ট্রাজিকের (সত্যি অথবা ধরে নেওয়া) মহিমার থেকেও বঞ্চিত করে। ইঞ্জিনিয়ার তার স্বদেশ হারান, আর সব্বাই হেসে ফেলেন।


আধুনিক ইতিহাসে এমন অনেক সময় আছে যখন জীবন কাফকার উপন্যাসের মত হয়ে যায়।
আমি যখন প্রেগে থাকতাম, আমি অনেক সময়েই শুনতে পেতাম লোকে পার্টির সদর দপ্তরকে (একটা কুৎসিত, বলা চলে আধুনিক বাড়ি) “দ্য ক্যাসেল” বলে উল্লেখ করতে। একইভাবে প্রায়শই আমি শুনতে পেতাম পার্টির দ্বিতীয় প্রধানকে ( যাঁর নাম ছিল কমরেড হেন্ড্রিক) “ক্লাম”( চেক ভাষায় যেটা অনেক বেশী সুন্দর কারণ ক্লাম মানে “মরিচিকা” বা “ঠগ”) বলে ডাকা হচ্ছে।
কবি এ., একজন বিরাট কম্যুনিস্ট ব্যক্তিত্ব, পঞ্চাশের দশকের একটা স্তালিনিস্ত বিচারের পর জেলে যান। তাঁর সেলে তিনি এক গুচ্ছ কবিতা লেখেন, যাতে সমস্ত ভীতিজনক অভিজ্ঞতার পরেও তিনি নিজেকে কম্যুনিজমের প্রতি বিশস্ত বলে অবিহিত করেন। কাপুরুষতার জন্য নয়। কবি তাঁর বিশস্ততাকে (তাঁকে শাস্তিপ্রদানকারীদের প্রতি বিশস্ততাকে) তাঁর গুনের পরিচায়ক হিসেবে দেখেছিলেন, তাঁর সততা হিসেবে। প্রেগে যাঁরা এই কবিতাগুচ্ছের কথা জানতে পারেন, বক্রাঘাত করে, তার নাম দেন “ জোসেফ কে.-এর কৃতজ্ঞতা।”
কাফকার উপন্যাসের দৃশ্য, পরিস্থিতি, এমনকি স্বতন্ত্র বাক্যগুলোয় প্রাগের জীবনের অংশ ছিল।
এটা বললে, অবশ্য অনেকে ভেবে বসতে পারেন যে কাফকার দৃশ্যগুলো প্রাগে জীবিত কারণ সেইগুলো স্বৈরতন্ত্রের অনুমান করে।
এই চিন্তাটাকে অবশ্যই ঠিক করতে হবে: কাফকা-সদৃশ জগত কোন সামাজিক বা রাজনৈতিক ধারণা নয়। কাফকার উপন্যাসগুলোক শিল্পায়িত সমাজের, শোষণের, বিচ্ছিন্নতাবোধের – এক কথায় ধনতন্ত্রের বুর্জুয়া মূল্যবোধের সমালোচনা বলে ভাবানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু কাফকার মহাবিশ্বে ধনতন্ত্রের উপাদানগুলো নেই: নেই অর্থ বা তাঁর বল, বানিজ্য, সম্পত্তি বা মালিকানা বা শ্রেণী সংগ্রাম।
কাফকা স্বৈরতন্ত্রের কোন সংজ্ঞার সাথেও যান না। কাফকার উপন্যাসে দল, মতাদর্শ বা তার পরিভাষা বা রাজনীতি, পুলিশ বা সৈন্য কারুরই কোন উল্লেখ নেই।
বরং বলা উচিত কাফকা মানুষ ও তার জগতের একটি মৌলিক সম্ভাবনার পরিচায়ক, এমন একটা সম্ভাবনা যা ঐতিহাসিক ভাবে নির্ণিত নয় এবং যা মানুষের কাছে খানিকটা চিরন্তন।
কিন্তু এই সংশোধন প্রশ্নটা উড়িয়ে দেয় না: কিভাবে প্রাগে কাফকার উপন্যাস জীবনের সাথে অঙ্গীভূত হয় আর প্যারিসে সেই একই উপন্যাসকে দেখা হয় একজন লেখকের সম্পূর্ণ আত্মগত দুর্বোধ্য অভিব্যক্তি হিসাবে? এর কি মানে দাঁড়ায় যে মানুষ ও তার জগতের একটি সম্ভাবনা যাকে আমরা কাফকা-সদৃশ বলে অবিহিত করি তা প্যারিসের থেকে প্রাগে অনেক সুনির্দিষ্টভাবে মানুষের ব্যক্তিগত ভাগ্যে পর্যবসিত হয়।
আধুনিক ইতিহাসে এমন অনেক প্রবণতা পাওয়া যায় যা বৃহত্তর সামাজিক মাত্রায় কাফকা-সদৃশের নির্মাণ করে: ক্ষমতার ক্রমবর্ধমান কেন্দ্রীকরণ, নিজের দেবত্ব-আরোপের প্রবণতা, সামাজিক কর্মকাণ্ডের আমলাতন্ত্রীকরণ যা সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে অসীম গোলকধাঁধায় পর্যবসিত করে; এবং তার ফলে ব্যক্তির সাতন্ত্রতা নষ্ট করে।
স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্র, এই সমস্ত প্রবণতার একটা চরম কেন্দ্র হয়ে, কাফকার উপন্যাস এবং বাস্তবজীবনের নিকট সম্পর্ক দেখিয়ে দেয়। কিন্তু পশ্চিমে যদি মানুষ এই সম্পর্ক দেখতে না পায় তা শুধু এই আমরা যাকে গনতান্ত্রিক সমাজ বলি সেইগুলো আজকে প্রাগের থেকে কম কাফকা-সদৃশ এই কারণেই নয়। এই কারণেও বলে আমি মনে করি, এইখানে, বাস্তব এর বোধটাই নির্মমভাবে হারিয়ে যাচ্ছে।
আসলে, যে সমাজকে আমরা গনতান্ত্রিক বলি তাও আমলাতন্ত্রীকরণ এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ধ্বংসের প্রক্রিয়ার সাথে পরিচিত, এই পুরো গ্রহটাই এই প্রক্রিয়ার একটা মঞ্চ হয়ে উঠেছে। কাফকার উপন্যাস আসলে এরই এক কাল্পনিক, স্বপ্নময় অতিরঞ্জন এবং বস্তুবাদী অতিরঞ্জন।
কিন্তু কাফকাই কেন এই পৃথিবী প্রথম ঔপন্যাসিক যিনি এই প্রবণতাকে ধরতে পেরেছিলেন, যা তাঁর মৃত্যুর অনেক পরের ইতিহাসে খুব পরিস্কার এবং নির্মমভাবে আবির্ভূত হয়েছিল।


কিংবদন্তি এবং রহস্যমণ্ডিত করা ছাড়া, কাফকার রাজনৈতিক আগ্রহ সম্পর্কে কোন উল্লেখযোগ্য সূত্র নেই; সেই অর্থে বলতে গেলে, তিনি তাঁর প্রাগের বন্ধুদের থেকে একটু আলাদা ছিলেন, ম্যাক্স ব্রড, ফ্রানজ ওয়েরফেল, এরগন এরিউন কিশ, আর সব আঁভা-গার্দ, যাঁরা ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি জানতেন বলে দাবী করতেন, যাঁরা ভবিষ্যৎকে জানার ভেলকিবাজীর আশকারা অনুভব করতেন।
তাহলে কি করে তাঁদের সৃষ্টির বদলে তাঁদের একা, মুখচোরা, নিজের জীবন ও শিল্পে ডুবে থাকা সহচর আজ একটি সামাজিক-রাজনৈতিক ভবিষ্যৎবানী হিসাবে স্বীকার করা হচ্ছে, এবং একই কারণে গোটা দুনিয়ার একটা বিরাট অংশে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে?
এই রহস্যের কথা আমার মাথায় এসেছিল একদিন আমার এক পুরোণো বন্ধুর বাড়িতে একটা ছোট্ট দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে। আমার এই বন্ধু মহিলাটি ১৯৫১ সালে, প্রাগে স্তালিনিস্ট বিচার চলার সময়, গ্রেফতার হন এবং এমন সব অপরাধে দোষী সাবস্ত হন যা তিনি করেননি। সেই সময় কয়েকশো কম্যুনিস্টের এই অবস্থা হয়েছিল। সারা জীবন তাঁরা নিজেদের পার্টির থেকে আলাদা করে ভাবতে পারেননি। যখন সেই পার্টিই তাঁদের অভিযুক্ত করল, তখন তাঁরা জোসেফ কে.-এর মতই রাজি হয়ে গেলেন নিজেদের “সমগ্র অতীতটাকেই পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পরীক্ষা করে” লুকিয়ে থাকা অপরাধ খুঁজে বার করতে, এবং অবশেষে, কাল্পনিক অপরাধ স্বীকার করে নিতে। আমার বন্ধুটি নিজের জীবন বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁর অসাধারণ সাহসের জন্য যে কারণে তিনি তাঁর কমরেডদের মত, কবি এ.-এর মত “অপরাধ খুঁজতে” সম্মত হননি। শাস্তিপ্রদানকারীদের সাহায্য করতে অসম্মত হওয়ার জন্য তিনি ছিলেন চুড়ান্ত বিচারের প্রদর্শনীতে অব্যবহার্য। তাই ফাঁসির বদলে তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। চোদ্দ বছর জেল খাটার পর তাঁকে সম্পূর্ণ পুনর্বাসন এবং মুক্তি দেওয়া হয়।
এই ভদ্রমহিলার গ্রেফতারের সময় একটি এক বছরের ছেলে ছিল। তাই জেলখানা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর, তিনি তাঁর পনের বছরের ছেলের সাথে পুনর্মিলিত হন এবং তার সাথে তাঁর নগন্য একাকিত্ব ভাগ করে নেওয়ার আনন্দ পান। তিনি যে তাঁর ছেলের প্রতি তীব্রভাবে আসক্ত হবেন সেটা সম্পূর্ণ বোধগম্য। একদিন আমি তাঁদের সাথে দেখা করতে যাই- ততদিনে তাঁর পুত্রের বয়স পঁচিশ। মা সেই সময় অভিমানে এবং রাগে কাঁদছিলেন। কারণটা খুব তুচ্ছ : ছেলেটি বেশী সময় ধরে ঘুমিয়ে ছিল বা এমন কিছু। আমি তাঁকে জিজ্ঞাসা করি: “এত তুচ্ছ একটা বিষয় নিয়ে তুমি এত ভাবিত কেন? এটা কি কাঁদার মত কিছু? তুমি বেশিবেশি করে ফেলছ না?”
মায়ের হয়ে ছেলেটি আমায় উত্তর দিল: “ না, আমার মা বেশিবেশি করেননি। আমার মা একজন অসাধারণ সাহসী ভদ্রমহিলা। যখন সবাই ভেঙে পড়ছিল তখন তিনি একা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি চান আমি একজন প্রকৃত মানুষ হই। এটা সত্যি, যে আমি বেশি ঘুমিয়েছি, কিন্তু মা আমাকে যে কারণে আমার নিন্দা করছে তার কারণ অনেক গভীরে। সেটা হল আমার মনোভাবের কারণে। আমার স্বার্থপর মনোভাব। আমি আমার মা যা চায় সেইরকম হতে চাই। আপনাকে স্বাক্ষী রেখে আমি প্রতিজ্ঞা করছি আমি সেইরকমই হব।”
যা পার্টি তার মায়ের উপর করতে পারেনি, মা তার ছেলের উপর করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি তাঁকে বাধ্য করেছেন একটা উদ্ভট অভিযোগ খুঁজে বার করতে, “ নিজের অপরাধ খুঁজে নিতে,” সবার সামনে স্বীকারোক্তি করতে। আমি বোকার মত এই ক্ষুদ্র স্তালিনীয় বিচার প্রক্রিয়া দেখে গেলাম, এবং অনুভব করলাম বিরাট ( আপাত অর্থে বিস্ময়কর এবং অমানবিক) ঐতিহাসিক ঘটনায় মনস্তত্ত্বের যে প্রক্রিয়া কাজ করে, সেই একই প্রক্রিয়া ব্যক্তিগত ( খুব সামান্য এবং মানবিক) ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করে।



বাবাকে লেখার এবং কোনদিন না পাঠানো কাফকার সেই বিখ্যাত চিঠি দেখায় যে আসলে পরিবার থেকেই, অবিভাবকদের দেবত্ব আরোপিত ক্ষমতার সাথে শৈশবের সম্পর্কের থেকেই কাফকা তাঁর দণ্ডপ্রদান পদ্ধতির জ্ঞান অর্জন করেছিলেন, যা পরে তার আখ্যানের একটা প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। লেখকের পরিবারিক অভিজ্ঞতার সাথে নিকটভাবে সম্পৃক্ত ছোট গল্প “দ্য জাজমেন্ট”, যেখানে বাবা তাঁর ছেলেকে অভিযুক্ত করছেন এবং তাঁকে আদেশ দিচ্ছেন জলে ডুবে মরবার জন্য। ছেলে সেই কাল্পনিক অভিযোগ মেনে নিচ্ছেন এবং জলে ঝাঁপ দিচ্ছেন ততটাই বাধ্য হয়ে, যতটা বাধ্যভাবে জোসেফ কে. একটা রহস্যাবৃত সংগঠন দ্বারা নির্দেশিত হয়ে, নিজের হত্যার সম্মতি দিচ্ছেন। এই দু’টো অভিযোগের, দু’টো দণ্ডপ্রদানের, দু’টো হত্যার সদৃশ্যতা, কাফকার লেখার, আসল সংযুক্তিটা দেখিয়ে দেয়, পরিবারের ব্যক্তিগত “স্বৈরতন্ত্র”-এর সাথে তাঁর মহান সামাজিক দৃষ্টি ভঙ্গিমার।
স্বৈরতন্ত্রী সমাজ, বিশেষত তার চরম সংস্করণে, সর্বজনীন ও ব্যক্তিগতর ভেদরেখা মুছে দেওয়ার চেষ্টা করে; ক্ষমতা, তা যত অস্বচ্ছ হয়ে ওঠে, তত বেশী করে চায় যে তার নাগরিকদের জীবন স্বচ্ছ হয়ে উঠুক। গোপনীয়তাবিহীন জীবন-এর আদর্শবাদ একটা আদর্শ পরিবারের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ: একজন নাগরিকের কোন অধিকার নেই পার্টি বা রাষ্ট্রের থেকে কোন কিছুকে গোপন রাখার, ঠিক যেমন একটি শিশুর কোন অধিকার নেই তার বাবা বা মায়ের থেকে কোন কিছু গোপন রাখার। এই প্রচারের দ্বারা, স্বৈরতন্ত্রী সমাজগুলো নিজেদের একটা সরল ও মনোরম ছবি প্রক্ষেপিত করে: তারা নিজেদের দেখতে চায় “এক বিরাট পরিবার” হিসাবে।
অনেক সময় এইভাবেও বলা হয় যে কাফকার উপন্যাস আসলে সমষ্টির সাথে মানুষের যোগাযোগের একটা তীব্র বহিঃপ্রকাশ, যে শিকড়বিহীন কে.-এর আসলে একটাই উদ্দেশ্য: একাকিত্বের অভিশাপ থেকে বাঁচা। কিন্তু এটা আসলে একটা ক্লিশে, একটা ক্ষুদ্রায়িত ব্যাখ্যা, একটা ভুল ব্যাখা।
ল্যান্ড-সার্ভেয়র কে. কোনভাবে মানুষ এবং তাঁর উষ্ণতা অন্বেষণ করেননি, সার্ত্র-এর ওরেস্টিসের মত তিনি “মানুষের মধ্যে মানুষ” হয়ে উঠতে চাননি; তিনি মানুষের থেকে স্বীকৃতি চাননি চেয়েছেন প্রতিষ্ঠানের থেকে। সেটা পেতে গেলে, তাঁকে অনেক মূল্য দিতে হবে: তাঁকে তাঁর একাকীত্ব বর্জন করতে হবে। আর এটাই তাঁর জন্য নারকীয়: তিনি কখনোই আর একা নন, ক্যাসেল থেকে পাঠানো তাঁর দুই সহচর সবসময় তাঁকে অনুসরণ করছেন। যখন তিনি প্রথমবার ফ্রিডার সাথে মিলিত হচ্ছেন, এই লোকদুটো উপস্থিত, যার নিচে প্রেমিক-প্রেমিকারা মিলিত হচ্ছেন, সেই কাফের কাউন্টারের উপর বসে রয়েছেন, এবং তার পর থেকে কখনোই তাদের বিছানার থেকে দূরে নন।
নিঃসঙ্গতার অভিশাপ নয়, একাকিত্বের লঙ্ঘন-এ কাফকা আবিষ্ট হয়ে ছিলেন!
কার্ল রসম্যানকে সবাই সবসময় জ্বালাতন করত: তাঁর জামাকাপড় বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল, তাঁর বাবা মায়ের একমাত্র ছবিটা নিয়ে নেওয়া হয়েছিল, ডর্মিটরিতে তার বিছানার পাশে, ছেলেদের বাক্স প্রায়শই তাঁর উপর এসে পড়ত; রুক্ষ-প্রকৃতির দু’জন রবিনসন আর ডেলামার্ক জোর করে তাঁকে তাঁদের সঙ্গী করতেন আর ছিল মোটা ব্রুনেল্ডা, যাঁর বিলাপ ঘুমের মধ্যেও তিনি শুনতে পেতেন।
জোসেফ কে.-এর গল্পটাও আসলে শুরু হয় ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ধর্ষণের মধ্য দিয়ে: দু’জন অপরিচিত মানুষ তাঁর বিছানায় তাঁকে গ্রেফতার করতে আসেন। এরপর থেকে কখনোই তিনি আর একা নন: আদালত সব সময় তাঁকে অনুসরণ করে, তাঁর উপর লক্ষ্য রাখে, কথা বলে, তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়, তাঁর পিছু নেওয়া একটা রহস্যময় সংগঠন তাকে গিলে ফেলে।
আবেগতাড়িত কিছু মানুষ, যাঁরা গোপনীয়তার বিলোপ এবং ব্যক্তিগত জীবনে স্বচ্ছতার প্রচার চালান, তাঁরা বোঝেন না যে এই ভাবে আসলে তাঁরা কোন প্রক্রিয়ার পথ অবারিত করে দিচ্ছেন। স্বৈরতন্ত্রের শুরু অনেকটা দ্য ট্রায়ালের শুরুর মত: আপনার অজান্তে তাঁরা আপনার বিছানার পাশে এসে হাজির হবেন। তাঁরা আসবেন যেমন আসতেন আপনার মা কিংবা বাবা।
অনেক সময় মানুষ ভাবেন যে কাফকার উপন্যাসগুলো তাঁর জীবনের ব্যক্তিগত ও গোপনীয় দ্বন্দ্বের প্রক্ষেপণ, কিংবা “সামাজিক যন্ত্র”-এর একটা বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা।
কাফকা-সদৃশ আসলে ব্যক্তিগত বা সর্বজনীন কোন একটাতে আবদ্ধ নয়, তা এই দু’টোকেই আবৃত করে। সর্বজনীনতা ব্যক্তিগতর আয়না, ব্যক্তিগত সর্বজনীনের প্রচ্ছায়া।



ক্ষুদ্র-সামাজিক প্রয়োগ যা কাফকা-সদৃশ-এর নির্মাণ করে তার কথা বলতে গিয়ে, আমি শুধু পরিবারের কথাই বোঝাতে চায়নি তার সাথে সেই সংগঠন যেখানে কাফকা তাঁর পরিণত জীবন কাটিয়েছেন, সেই অফিসের কথাও বোঝাতে চেয়েছি।
কাফকার নায়কদের অনেক সময় বৌদ্ধিকতার রূপক প্রক্ষেপণ হিসাবে বুঝতে চাওয়া হয়, কিন্ত গ্রেগর সাসমার কোন বৌদ্ধিকতা ছিল না। একটি গুবরে পোকায় রূপান্তরিত হয়ে জেগে ওঠার পর, তাঁর একটাই চিন্তা ছিল: এই নতুন অবস্থায়, তিনি কিভাবে সময়ের মধ্যে অফিসে পৌছাবেন। জীবিকার কারণে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা আনুগত্য আর নিয়মানুবর্তিতা, ছাড়া তাঁর মাথায় আর কিছুই ছিল না: তিনি একজন কর্মচারি, একজন কর্মভারপ্রাপ্ত, যেমন কাফকার সব চরিত্রেরা; একজন কর্মভারপ্রাপ্ত সামাজিক অর্থে (যেমন জোলায়) নয় বরং একটি মানবিক সম্ভাবনা হিসাবে, বেঁচে থাকবার একটা প্রাথমিক প্রক্রিয়া হিসাবে।
দ্বিতীয়ত, একজন কর্মভারপ্রাপ্ত, বিরাট এক প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড, যার মূল উদ্দেশ্য বা ব্যাপ্তির ব্যাপারে কোন ধারণা ছাড়াই , তার ক্ষুদ্রতম অংশ সম্পাদন করেন: এটা সেই জগত যেখানে প্রত্যেকটা ক্রিয়া আসলে যান্ত্রিক হয়ে গেছে আর মানুষ তাঁর কাজের অর্থ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন।
তৃতীয়ত, একজন কর্মভারপ্রাপ্ত শুধু কিছু অচেনা মানুষ আর ফাইলের সাথে সময় অতিবাহিত করেন: এটা হল বিমূর্তের জগত।
এইরকম আনুগত্যপূর্ণ, যান্ত্রিক, বিমূর্ত একটা জগতে, যেখানে মানুষের একমাত্র কর্মকাণ্ড হল এক অফিস থেকে আরেক অফিসে যাওয়া, উপন্যাসের প্রস্তাবনা হল মহাকাব্যের মূল রসের সম্পূর্ণ বিপরীতে। এইটাই প্রশ্ন: এরকম ধূসর, কবিতাবিরোহিত জিনিসকে কাফকা কি করে উপন্যাসে রূপান্তরিত করলেন?
এর উত্তর পাওয়া যায় মিলেনা কে লেখা তাঁর একটা চিঠিতে: “অফিস আসলে একটা বোকা প্রতিষ্ঠান নয়; এর ক্ষেত্র আসলে বোকার চাইতে অনেক বেশী বিচিত্র ও কল্পনাপূর্ণ।” এই বাক্যের মধ্যে কাফকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ রহস্য লুকিয়ে আছে। যা অন্য কেউ দেখতে পাননি তিনি তাই দেখেছিলেন: মানুষের জন্য আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অসীম গুরুত্ব শুধু নয়, তাঁর অবস্থা বা ভবিষ্যতের জন্যও শুধু নয়, বরং (খুব বিস্ময়করভাবে) অফিসের ফ্যান্টাসমিক (এমন কিছু যা আপাতভাবে আছে কিন্তু প্রকৃতভাবে নেই) প্রকৃতির মধ্যে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন কাব্যিক সম্ভাবনা।
কিন্তু যখন বলা হয়ে যে অফিসের ক্ষেত্র আসলে বিচিত্র ও কল্পনাপূর্ণ তখন কি বোঝানো হয়?
প্রাগের ইঞ্জিনিয়ার বুঝবেন: তাঁর ফাইলের একটা ভুল তাঁকে লন্ডনে প্রক্ষেপিত করেছিল; তাই তিনি প্রাগে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন একজন যথার্থ ফ্যান্টমের (ভূত) মত, তাঁর হারিয়ে যাওয়া শরীর খুঁজতে খুঁজতে, আর যে অফিসগুলোতে তিনি যাচ্ছিলেন সেইগুলো যেন কোন এক অজানা পুরাণের অসীম গোলকধাঁধা ।
আমলাতন্ত্রের মধ্যে যে বিচিত্র এবং কাল্পনিক জগত কাফকা পেয়েছিলেন, তার উৎকৃষ্টতাই তাঁকে, এর আগে যা অকল্পনীয় বলে ভাবা হয়েছিল, তাই করতে দিয়েছিল: তিনি প্রবল আমলাতান্ত্রিক সমাজের প্রগাঢ় কাব্যহীনতাকে উপন্যাসের মহান কাব্যিকতায় উত্তীর্ণ করতে পেরেছিলেন; তিনি একজন মানুষের, প্রতিশ্রুত একটা চাকরী না পাওয়ার (যা আসলে ক্যাসেলের গল্প), সাধারণ একটা গল্পকে উত্তীর্ণ করেছিলেন মিথে, মহাকাব্যে, এমন এক সৌন্দর্যে যা কেউ আগে দেখেনি।
আমলাতান্ত্রিক পারিপার্শিকতাকে মহাবিশ্বের বিশাল মাত্রায় উন্নিত করে, কাফকা অনিচ্ছাকৃতভাবে এমন একটা ছবি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন যার সাথে তাঁর না দেখা একটা সমাজের সাযুজ্য, আজকের প্রাগের মত, আমাদের মুগ্ধ করে।
স্বেচ্ছাচারী রাষ্ট্র আসলে এক, বৃহৎ প্রশাসন: যেহেতু সব কাজই আসলে রাষ্ট্রের জন্য, তাই সব পেশার সব মানুষ আসলে একজন কর্মচারী। একজন শ্রমিক আর শ্রমিক নন, একজন বিচারক আর একজন বিচারক নন, একজন দোকানদা আর একজন দোকানদার নন, একজন পুরোহিত আর শুধু একজন পুরোহিত নন; তাঁরা প্রত্যেকেই আসলে রাষ্ট্রের কর্মভারপ্রাপ্ত। “আমি কোর্টের একজন,” ধর্মযাজক জোসেফ কে.-কে বলেছিলেন ক্যাথিড্রালের ভিতর। কাফকায় আইনজীবিরাও কোর্টের জন্য কাজ করে। আজকের প্রাগের একজন নাগরিক এতে অবাক হবেন না। তিনি কে.-এর থেকে বেশী কোন আইনি সহায়তা পাবেন না। তাঁর আইনজ্ঞরা আর বিবাদীর জন্য কাজ করেন না, করেন কোর্টের জন্য।



গুরুগম্ভীর এবং জটিল গভীরতায় পরিপূর্ণ অথচ শিশুসুলভ সারল্যে ভরা একশোটি কোয়ার্টেনের একটি সাইকেলে, মহান চেক কবি লিখেছেন-
কোন কবি কবিতার সৃষ্টি করেন না
কবিতাটা শুরু থেকেই কোথাও সুপ্ত আছে
বহু কাল ধরে সেইখানেই ছিল
কবি শুধু সেটা আবিষ্কার করেন

কবির জন্য, তাহলে, লেখা মানে হল একটা দেওয়াল ভাঙা যার পিছনে একটা অপরিবর্তনীয় কিছু (“কবিতা”) অন্ধকারে লুকোনো আছে। এই কারণেই (এই বিস্ময়কর এবং হঠাৎ প্রকাশের কারণে) “কবিতা” আমাদের প্রথমে চোখ ধাঁধানো কিছু হিসাবে আঘাত করে।
দ্য কাসেল আমি প্রথম পড়ি যখন আমার বয়স চোদ্দ, এই বইটা আর কখনো আমাকে ওইভাবে মুগ্ধ করেনি, যদিও সেই সময় ওর ভিতরের বিস্তৃত বোধ (কাফকা-সদৃশ-এর প্রকৃত উপাদান) সেই সময় আমার বোধগম্য হয়নি: আমার চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল।
পরে যখন আমার চোখ “কবিতা”-র আলোয় অভ্যস্ত হল আর আমি যাতে আমার চোখ ধাঁধিয়ে গিয়েছিল তার মধ্যে আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা দেখতে পেলাম; যদিও আলোটা তখনো ছিল।
“কবিতা” জন স্ক্যাকেলের মতে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিল, অপরিবর্তনীয় ভাবে, “বহু কাল ধরে।” কিন্তু নিয়ত পরিবর্তনশীল এই দুনিয়ায় অপরিবর্তনীয় কি শুধুই বিভ্রম নয়?
না। মানুষের কৃত প্রতিটি অবস্থা শুধু ততটাই ধারণ করতে পারে যতটা মানুষ ধারণ করে, অতএব একজন ভাবতে পারেন যে এই অবস্থা (এবং তার সমস্ত অধিবিদ্যীয় নিহিতার্থ) মানবিক একটা সম্ভাবনা হিসাবে বিদ্যমান ছিল “ বহু কাল ধরে।”
তাহলে ইতিহাস ( যা পরিবর্তনশীল) কবির কাছে কি মানে নিয়ে আসে?
অদ্ভুত লাগতে পারে, কিন্তু একজন কবির চোখে ইতিহাসের অবস্থান কবির নিজের মতই: ইতিহাস সৃষ্টি করে না, ইতিহাস আবিষ্কার করে। নতুন অবস্থার মধ্যে দিয়ে, ইতিহাস দেখায় মানুষ কি, তার মধ্যে কি আছে “বহু কাল ধরে,” কি তার সম্ভাবনা।
যদিও “কবিতা” আগে থেকেই থাকে, তাহলে কবিকে ভবিষ্যৎদর্শি হিসাবে ভাবা অযৌক্তিক, তিনি শুধু একটা মানবিক সম্ভাবনাকে (“কবিতা” যা ছিলই “অনেক অনেক দিন থেকে”) আবিষ্কার করেন যেটা ইতিহাসও একদিন আবিষ্কার করবে।
কাফকা কোন ভবিষ্যৎবানী করেননি। তিনি শুধু দেখেছিলেন যা আগে থেকেই “সুপ্ত” ছিল। তিনি জানতেন না যে তাঁর দেখাও আসলে ভবিষ্যৎকে দেখা। তিনি একটা সামাজিক প্রক্রিয়ার মুখোস খুলে দেখাতে চাননি। তিনি শুধু আলো ফেলেছিলেন সেই সমস্ত যান্ত্রিকতায় যা তিনি তাঁর ব্যক্তিগত এবং ক্ষুদ্র সামাজিক মানবিক প্রয়োগের মাধ্যমে জেনেছিলেন, এটা সন্দেহ না করে যে পরবর্তী পর্যায় এই সমস্ত যান্ত্রিকতাকেই ইতিহাসের বৃহত্তর মঞ্চে অবতীর্ণ করবে।

ক্ষমতার মন্ত্রমুগ্ধকর দৃষ্টি, নিজের অপরাধ খুঁজে বার করার নিদারুণ হতাশা, বিছিন্নতা এবং তার তীব্র যন্ত্রণা, নিন্দিত হয়ে খাপ খাইয়ে নেওয়ার চেষ্টা, বাস্তবের ফ্যান্টামাস্টিকতা এবং ফাইলের জাদুবাস্তবতা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অনন্ত ধর্ষণ, ইত্যাদি- এই সমস্ত পরীক্ষা ইতিহাস মানুষের উপর করে দেখেছে তার অসংখ্য টেস্টটিউবে, কাফকা করেছিলেন (কয়েক বছর আগে) তাঁর উপন্যাসে।
কাফকার “কবিতার” সাথে বাস্তব জীবনে স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্রের সমধর্মীতা সবসময়েই কিছুটা অবাস্তব, এবং সেইটি সব সময়েই সাক্ষ্য দেবে যে কবির কাজ, একদম মূলে,পরিমাপযোগ্য নয়; এবং হেঁয়ালীপূর্ণ: কাফকার উপন্যাসের প্রবল সামাজিক, রাজনৈতিক এবং “ভবিষ্যৎদর্শীতা” বোধ যথাযথভাবে তাদের “অনাবদ্ধতার” মধ্যে পাওয়া যায়, অর্থাৎ যথার্থভাবে বলতে হলে, সেইটি সমস্ত রাজনৈতিক কার্যক্রম, মতাদর্শগত ধারণা এবং ভবিষ্যতের পূর্বাভাষের থেকে স্বতন্ত্র বলে।
যদি কবি “কোথাও সুপ্ত” “কবিতাটিকে” না খুঁজে নিজেকে “ব্যস্ত” রাখেন প্রথম থেকে জানা সত্যের সেবায় (যা নিজে থেকেই সামনে আসে এবং “গোচরে”), তাহলে তিনি কবিতার লক্ষ্য থেকে চ্যূত হয়েছেন। আর এই পূর্বধারণ করা সত্যের নাম বিপ্লব না মতপার্থক্য, ক্রিশ্চান ধর্মবিশ্বাস না নাস্তিকতা, তা বেশী সমর্থনযোগ্য না কম সমর্থনযোগ্য তা দিয়ে কিছুই এসে যায় না; যে কবি আবিষ্কারের অপেক্ষায় (যা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়) থাকা সত্য ছাড়া অন্য কোন সত্যের সেবা করেন তিনি মিথ্যা কবি।
আমি কাফকার উত্তরাধিকারকে উজ্জ্বলভাবে বহন করি, আমি যদি এটাকে আমার ব্যক্তিগত ঐতিহ্য বলে রক্ষা করে থাকি, তা এই কারণে নয় যে আমি মনে করি অন-অনুকরণীয়ের অনুকরণ (এবং কাফকা-সদৃশ-এর পুনরাবিষ্কার) করা উচিত বরং এই কারণে যে তা উপন্যাসে মৌলিক স্বাতন্ত্রের (উপন্যাসের কবিতার) জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। এই স্বাতন্ত্রের কারণে কাফকা আমাদের মানবিক অবস্থার (যা আমাদের শতকে সামনে আসছে) কথা বলতে পেরেছিলেন যা অন্য কোন সামাজিক রাজনৈতিক চিন্তা পারেনি।




Monday, July 2, 2018

প্যাট্রিক ওয়াডিংটনের গল্পঃ দ্যা স্ট্রীট দ্যাট গট মিসলেইড


মার্ক জিরনডিন সিটি হলের প্রকৌশলী বিভাগের নথি সংরক্ষণ সেকশনে এত দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করেছে যে পুরো শহরটা একটা মানচিত্রের মত তাঁর মনের ভিতরে অধিশায়িত ছিলো। শহরের প্রতিটা জায়গা, আনাচ-কানাচ, রাস্তাঘাট, কানা গলি আর চিপা গলি সবই ছিলো তাঁর মুখস্থ।

পুরো মন্ট্রিয়ালে শহর সম্পর্কিত এত জ্ঞান তাঁর মত আর কেউ রাখতো না। ডজন খানেক পুলিশ আর ট্যাক্সি চালক মিলেও এই বিষয়ে প্রতিযোগিতায় তাঁকে হারাতে পারেনি। ব্যপারটা এমন না যে সত্যিই সে শহরের প্রতিটা জায়গা চিনে, যদিও সে মন্ত্র পাঠের মত সেগুলোর নাম গড়গড় করে বলে যেতে থাকে যেন সে সবকটি রাস্তায় নিজে হেঁটে বেড়িয়েছে। আসলে শুধুমাত্র তাঁদের অস্তিত্ব সম্পর্কে সে অবগত —কোথায় কোন জায়গায় কোন রাস্তা আছে, এক জায়গার সাথে আরেক জায়গার সম্পর্ক কী, ইত্যাদি।

কিন্তু এইটুকু জ্ঞান এই বিষয়ে তাঁকে বিশেষজ্ঞ বানানোর জন্যে যথেষ্ট ছিলো। কেবিনেটের নথি সংরক্ষণের ব্যাপারে তাঁর দক্ষতা ছিলো বিতর্কের ঊর্ধ্বে, যেখানে অ্যাবোট থেকে যটিক পর্যন্ত সকল রাস্তার সমস্ত খুঁটিনাটি — রাস্তার সামনে, পিছনে, মাঝামাঝি— সকল তথ্য নথিবদ্ধ ছিলো। সম্ভ্রান্ত ব্যাক্তিরা, প্রকৌশলী, ইন্সপেক্টর, তাঁদের মত আরও অনেকেই তাড়াহুড়োর মধ্যে বিশেষ তথ্য বা খুঁটিনাটি উপাত্তের জন্যে তাঁর কাছে ছুটে আসতো। তাঁরা হয়তো তাঁকে নিম্ন শ্রেণীর একজন কেরানী হিসেবে অবজ্ঞাই করতো। কিন্তু উপায় নেই, অন্য সবার মত তাকেও তাঁদের সমভাবে দরকার।

কাজ-কর্মে উদ্দীপনার একটা বড় ধরনের ঘাটতি থাকলেও মার্ক তাঁর ওভেন স্ট্রীটের বাড়ি থেকে নিজের অফিসটাকেই বেশী পছন্দ করতো। ওভেন স্ট্রীটের ওখানে তাঁর প্রতিবেশীরা বড্ড হৈচৈ করে, মাঝে মাঝে মারামারিও করে আর বাড়িওয়ালীও তো নিরন্তর কোলাহলে মেতেই থাকে। একবার সে সাথের ভাড়াটিয়া লুইসকে তাঁর নিজের অস্তিত্বের অর্থটা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলো, কিন্তু খুব একটা সফল হয়নি। লুইস যখন প্রাচীরের উপর উঠে বসলো, তখন তাঁর চেহারায় একটা তীক্ষ্ণ বিদ্রূপাত্মক ভাব ফুটে উঠলো।

“সুতরাং ক্রেইগ গিয়ে ব্লেউরির খিড়কি খুলে ঢুকে এবং ব্লেউরি পেলো পার্ক-এর চরিত্র, তো এই নিয়ে মাথা ঘামায় কে? এত উত্তেজনার কী আছে?”

“সেটা আমি তোমাকে দেখাবো” বললো মার্ক, “তার আগে বলো, তুমি কোথায় থাকো।”

“পাগল নাকি? কোথায় আবার? ওভেন স্ট্রীট। আর কোথায় হবে?”

“কী করে জানলে?”

“কি করে জানলাম মানে? আমি এখানেই থাকি, নাকি? আমি ভাড়া দেই এখানে, এখানেই আমার চিঠিপত্র আসে, নাকি?”

মার্ক আলতো ভাবে মাথা নাড়লো।

“যা যা বললে, এর কোনোটাই প্রমাণ করে না যে তুমি এখানকার বাসিন্দা,” সে বললো। “তুমি যে এই ওভেন স্ট্রিটে থাকো এর একমাত্র প্রমাণ হলো সিটি হলের নথির কেবিনেটে এই কথাটা উল্লেখ আছে। পোস্ট অফিস তোমার কাছে চিঠি পাঠায় এর কারণ হলো আমার কার্ড ইনডেক্সে তোমার ঠিকানা লেখা আছে। যদি আমার নথিতে এসব লেখা না থাকতো, তাহলে তোমার হয়তো কোনো অস্তিত্বই থাকতো না, এমনকি এই ওভেন সড়কেরও কোনো অস্তিত্ব থাকতো না। বুঝেছ বন্ধু, এটাই হলো আমলা প্রশাসনের বিজয়।”

“এইসব কথা বাড়িওয়ালীকে গিয়ে বলার চেষ্টা করো,” বিরক্তিতে বিড়বিড় করতে করতে লুইস হেঁটে চলে গেলো।

অতএব মার্ক তাঁর অখ্যাত কর্মজীবনে দিনাতিপাত করতে থাকলো। এর মধ্যে তাঁর চল্লিশতম জন্মদিন আসলো এবং চলেও গেল, কেউ লক্ষ্যই করলো না। নিরস আর ঘটনা বিহীন অনেকগুলো দিন পার হতে থাকলো। ওদিকে কোথাও কোনো রাস্তার নাম পাল্টানো হয়েছে, নতুন আরেকটা নির্মিত হয়েছে, তৃতীয় কোনটা প্রশস্ত করা হয়েছে, এইসব তথ্য সতর্কতার সাথেই নথিবদ্ধ হচ্ছিলো।

তারপর এমন কিছু একটা ঘটলো যা তাঁকে হতবিহবল করে দিলো, সে মাত্রাহীন বিস্ময়ে বিস্মিত হয়ে গেলো, কেঁপে উঠলো পুরো কেবিনেটের লৌহ ভিত্তি।

অগাস্টের এক বিকেলে, ড্রয়ার খুলতে গিয়ে সে হাতে কিছু একটা অনুভব করলো। আরেকটু হাতিয়ে দেখতে পেলো ড্রয়ারের উপর-নিচে একটা কার্ড আটকে আছে। টেনে বের করে দেখলো জীর্ণ, মলিন একটা ইনডেক্স কার্ড। পুরনো হলেও কার্ডটা এখনো এমন অবস্থায় আছে যা থেকে অর্থোদ্ধার সম্ভব। কার্ডের গায়ে লেখা ছিলো, “রুয়ে দে লা বউতলে ভারতে” অথবা “গ্রিন বোটল স্ট্রীট”।

মার্ক বিস্ময়ে পলকহীন চোখে চেয়ে রইলো কার্ডটার দিকে। এরকম কোন বেখাপ্পা জায়গার নাম সে জীবনেও কোনোদিন শোনেনি। নিঃসন্দেহে আধুনিক ফ্যাশনের সাথে তাল মিলিয়ে এই জায়গার পুনরায় নামকরণ করা হয়েছে। সে রাস্তার নামের পুরো লিস্ট আর সব মাস্টার ফাইল এলোমেলো করে ঘেঁটে দেখতে লাগলো। কিন্তু এই জায়গার নাম কোথাও দেখতে পেলো না। সে আবারো সবকটি কেবিনেটে খুব সতর্কতার সাথে, আস্তে আস্তে খুঁজে দেখতে লাগলো। সেখানে এই নামের কিছুই ছিলো না। একেবারে কিচ্ছুই না।

আরও একবার সে কার্ডটা পরখ করে দেখলো। কোনো ভুল নেই! সড়কটা সর্বশেষ নিয়মমাফিক পরিদর্শিত হয়েছিলো ঠিক পনেরো বছর পাঁচ মাস চৌদ্দ দিন আগে।

ভয়ংকর সত্যটা এসে ভর করলো তাঁর ওপর, আতংকে হাত থেকে সে কার্ডটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো। ভয়ে ভয়ে কার্ডটাকে আবার ছোঁ মেরে হাতে তুলে নিয়ে চকিত নয়নে তাকিয়ে রইলো। হারিয়ে যাওয়া, বিস্মৃত একটা সড়ক! সিটি হল থেকে মাত্র আধা মাইল দূরে মন্ট্রিয়ালের কেন্দ্রে গত পনেরো বছরেরও বেশি সময় ধরে এই সড়কটা এখানেই ছিলো, সেটা কেউই জানতো না। জলে পতিত একটা পাথরের টুকরোর মতই সড়কটা সবার দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গিয়েছিলো।

হৃদয়ের গভীরে, মার্ক মাঝে মাঝেই এমন একটা সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখতো। শহরে অনেক অজ্ঞাত জায়গা ছিলো— আঁকাবাঁকা গলি আর মিশরীয় গোলকধাঁধার মত এলোমেলো পেঁচানো সব রাস্তাঘাট। কিন্তু এমন কোন জায়গা থাকার কথা না যার নাম তাঁর হাতে থাকা সর্বজ্ঞ নথিতে উল্ল্যেখ নেই। অথচ এই একটা সড়কের নাম সত্যিই এখানে নেই। ঘটনাটা তাকে বোমার মত আঘাত করলো।

হতবুদ্ধিকর অবস্থায় মার্কের অস্পষ্টভাবে মনে পড়লো, এখানে কাজ শুরু করার কিছুদিন পরেই কিভাবে তাঁর পুরো কেবিনেট অন্য তলায় স্থানান্তরিত হয়েছিলো। পুরনো সব নথিগুলো ফেলে দিয়ে নতুন নথি বানানো হয়েছিলো। নিশ্চয়ই ঐ সময়টাতেই “গ্রিন বোটল স্ট্রীট”টা ড্রয়ারের চিপায় আটকা পড়েছিলো।

কার্ডটা পকেটে নিয়ে সে বাড়ি চলে গেলো। সেই রাতে তাঁর ভালো ঘুম হলো না। ভয়ঙ্কর সব দৈত্যাকৃতি তাঁর স্বপ্নে এসে হানা দিলো। সে স্বপ্নে দেখলো তাঁর অফিস প্রধানের বিশাল একটা ছায়ামূর্তি প্রচণ্ড রাগের মাথায় তাঁকে একটা তপ্ত লাল বর্ণের নথির আলমারিতে ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে।

পরের দিন সে মনস্থির করে ফেললো। অসুস্থতার অজুহাতে বিকেলে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে দুরু দুরু বুকে সে জায়গাটা খুঁজতে বেরিয়ে গেলো। যদিও সে এলাকাটা ভালো করেই চিনতো, তবুও সে দুই বার জায়গাটা পার হয়ে গিয়ে আবার ফিরে আসলো। বিমূঢ় হয়ে সে চোখ বন্ধ করলো। তাঁর মনের মধ্যে আঁকা অব্যর্থ মানচিত্রটা অনুসরণ করে সে সরাসরি প্রবেশদ্বারে চলে গেলো। প্রবেশদ্বারটা এতই সরু ছিলো যে মার্ক তাঁর প্রসারিত হাত দিয়ে সংযুক্ত দেয়ালগুলোকে ছুঁতে পারছিলো। ফুটপাত থেকে কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো একটা লম্বা, শক্ত কাঠের কাঠামো যার বেশীর ভাগ অংশই জর্জরিত ছিলো। কাঠামোটার মাঝখানে ছিলো একটা সাদামাটা খিড়কি ওয়ালা দরজা। দরজাটা ঠেলে সে ভিতরে ঢুকে পড়লো। তাঁর সামনে এখন শুয়ে আছে সেই ‘গ্রিন বোটল স্ট্রীট’।

একেবারেই জলজ্যান্ত একটা জায়গা! শান বাঁধানো ফুটপাতের একপাশে তিনটে ছোট বাড়ি, সব মিলিয়ে মোট ছয়টা। প্রতিটা বাড়ির সামনেই একটা করে লোহার বেড়ায় ঘেরা ক্ষুদ্র বাগান। বাড়িগুলোকে মাত্রারিক্ত পরিচ্ছন্ন। তাদের গায়ে যত্নের ছাপ। ফুটপাতের পাথর গুলো দেখে মনে হচ্ছিলো সম্প্রতিই কেউ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রেখেছে। বাড়ি ছয়টাকে ঘিরে রেখেছিলো গুদাম ঘরের পুরনো জানালাহীন ইটের দেয়ালগুলো। আর সেই দেয়ালগুলো মিলিত হয়েছিলো রাস্তার ঠিক শেষ মাথাটায় গিয়ে।

প্রথম ঝলকেই মার্ক বুঝতে পারলো কিভাবে জায়গাটার এমন অস্বাভাবিক নামকরণ করা হয়েছে। গলিটা দেখতে ঠিক বোতলাকৃতিরই ছিলো।

পাথর আর বাগানে প্রতিফলিত সূর্য কিরণ, মাথার উপরের নীল আকাশ, এইসব কিছু নিয়ে গলিটা তাঁকে একটা ক্ষণস্থায়ী ভালো লাগা আর প্রশান্তিতে ডুবিয়ে রাখলো। পঞ্চাশ বছর আগের খোদাইকৃত এই দৃশ্যটা কী যে মোহনীয় ছিলো!

মার্কের হাতের ডান দিকের প্রথম বাড়িটার বাগানের গোলাপ গাছে একটা বয়স্ক মহিলা জলসেচন করছিলো। মহিলাটার বয়স ষাটের কাছাকাছি হবে বলে মার্ক অনুমান করলো। মার্ককে দেখে মহিলাটা তাঁর দিকে নিস্পন্দ পলকহীন চোখে চেয়ে রইলো, আর তাঁর হাতের কৌটা থেকে মাটিতে এলোমেলো ভাবে পানি পড়তে লাগলো। মার্ক তাঁর মাথার হ্যাট খুলে বললো, “আমি শহরের প্রকৌশলী বিভাগ থেকে এসেছি, ম্যাডাম।”

মহিলা নিজেকে সামলে নিয়ে তাঁর জলের কৌটা ঠিক করে নিচের দিকে তাক করলো।

“শেষ পর্যন্ত তাহলে এই জায়গার খোঁজ পেয়েছো”, সে বললো।

মহিলার এই কথা গুলো শুনে মার্কের মনে পুনর্জন্ম নেয়া নির্দোষ, হাস্যকর ভুলের ধারণাটা দ্রুত বেগে পালিয়ে গেলো। সে কোনো ভুল করেনি।

“দয়া করে সব খুলে বলুন,” মার্ক নিরাসক্ত গলায় বললো।

সে এক বিস্ময়কর গল্প! অনেক বছর ধরে, মহিলা বললো, গ্রিন বোটল স্ট্রীটের ভাড়াটিয়ারা বাড়িওয়ালার সাথে মিলেমিশে বসবাস করতো। বাড়িওয়ালা এখানকারই কোনো এক ছোট বাড়িতে থাকতো। ভাড়াটিয়াদের সাথে বাড়িওয়ালার সম্পর্কটা এতটাই গভীর হয়েছিলো যে মৃত্যুকালে সে তাঁদেরকে একটা ছোট অংকের টাকা সহ তাঁর সম্পদ লিখে দিয়ে গিয়েছিলো।

“আমরা নিয়মিত কর পরিশোধ করতাম,” মহিলাটা বললো, “আর ফরমের একটা পুঞ্জিকা বানিয়েছিলাম এবং একটা নির্দিষ্ট সময় পর পর আমাদের সম্পদ সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতাম। অতঃপর, কিছুদিন পর থেকে আমাদের কাছে ট্যাক্সের নোটিশ আসা বন্ধ হয়ে গেলো, আমরাও আর কোনো কর পরিশোধ করলাম না। কেউ আর আমাদেরকে ঘাটালো না। অনেক দিন পর আমরা বুঝতে পারলাম যে কোনো না কোনোভাবে ট্যাক্সের লোকজন আমাদের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেছে।”

মার্ক মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। অবশ্য, গ্রিন বোটল স্ট্রীট যদি সিটি হলের দৃষ্টি সীমার বাইরে হারিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে কোনো পরিদর্শক, আদমশুমারি পরিচালক, কর সংগ্রাহক সেখানে যাওয়ার কথা না। কেবিনেটের অব্যর্থ নথি সবাইকে সানন্দে বরং অন্যদিকে টেনে নিয়ে যাবে।

“তারপর মাইকেল ফ্ল্যানাগান, ঐ যে চার নম্বর বাড়িটায় বাস করতো, সে আর কী,” মহিলা বলে যেতে থাকলো, “লোকটা বড়ই মজার মানুষ, তাঁর সাথে তোমার দেখা করা উচিৎ — সে আমাদেরকে ডেকে বললো, ব্যাপারটা যদি কোন অলৌকিক ঘটনা হয়েই থাকে তাহলে আমাদের উচিত এটাকে সাহায্য করা, উৎসাহ দেয়া। ইনিই সেই লোক যে দরজাটা বানিয়ে প্রবেশ পথে বসিয়েছিলো, যেন কোনো পথচারী অথবা অফিসিয়াল যখন তখন ভেতরে ঢুকতে না পারে। আমরা সবসময় দরজাটা তালা মেরে রাখতাম, কিন্তু অনেক দিন হয়ে গেল কেউ আর এদিকে আসে না। তাই আমরা আর এটা নিয়ে মাথা ঘামাই না, এখন দরজাটা খোলাই থাকে।”

“ওহ, আরও অনেক ছোট ছোট জিনিস ছিলো যা আমাদেরকে করতে হতো, যেমন পোস্ট অফিস থেকে আমাদের চিঠি পত্র নিয়ে আসা। কারণ আমাদের দরজায় কখনই কেউ কিছু দিয়ে যেত না। এখন শুধুমাত্র খাবার আর কাপড় কেনা ছাড়া বাইরের জগতে যাওয়া আর কোনো কারণ আমাদের নেই।”

“আর এতদিনে এখানে আর কোনো প্রকার পরিবর্তন ঘটেনি?” মার্ক জিজ্ঞেস করলো।

“হ্যাঁ, এর মধ্যে আমাদের দু’জন স্বজন মারা গেছে এবং তাঁদের ঘরগুলো কিছুদিনের জন্যে খালি পড়ে ছিলো। তারপর ছয় নম্বর বাড়িতে বাস করা জিন ডেসেলিন মাঝে মাঝে শহরে যায়। একদিন সে মি. প্লন্সকাই নামের একজন শরণার্থীকে সাথে নিয়ে ফিরলো। ভ্রমণ করে মি. প্লন্সকাই ছিলো বড্ড ক্লান্ত আর জরাগ্রস্ত, সে সানন্দেই আমাদের সাথে থেকে গেলো। তিন নম্বর বাড়িতে বাস করা মিস হান্টার একদিন এক দূরবর্তী আত্মীয়কে নিয়ে আসলো। লোকটা বড় ভালো মানুষ, এমনটাই আমার মনে হয়। তাঁরা দুজনেই আমাদের সার্বিক অবস্থাটা পুরোপুরি বুঝতে পারে।”

“আর আপনি, ম্যাডাম?” মার্ক জানতে চাইলো।

“আমার নাম সারা ট্রুসডেল। আমি এখানে বিশ বছর ধরে বাস করে আসছি। জীবনের শেষ দিনগুলি এখানেই কাটাতে চাই।”

মহিলা মার্কের দিকে তাকিয়ে একটা সন্তোষজনক মুচকি হাসি দিলো। আপাতভাবে সে মুহূর্তের জন্য ভুলে গেল যে মার্কের পকেটে এমন একটা গ্রেনেড রয়েছে যা তাঁদের এই সুন্দর ছোট্ট প্রশান্তির জগতটাকে উড়িয়ে টুকরো টুকরো করে দিতে পারে।

এই যে গ্রিন বোটল স্ট্রীট, এই আশ্রয়খানায় নিজেদের খুঁজে পাওয়ার আগে এদের সবার জীবনই জর্জরিত ছিলো সমস্যায়, জটিলতায় আর ব্যর্থতায়। নিজের শোচনীয় অস্তিত্বের কথা চিন্তা করে মার্কের মনেও এখানে এসে বাস করার ইচ্ছাটা জেগে উঠলো। সে আনমনেই পকেটে আঙুল ঢুকিয়ে কার্ডটা নাড়াচাড়া করতে থাকলো। “মি. প্লন্সকাই আর মি. ফ্ল্যানাগান দুজনের ভিতরে খুব ভাব জমেছে।” মিস ট্রুসডেল বললো, “তাঁরা দুজনই ছিলো ভ্রমণকারী, তাই ভ্রমণ কালীন স্মৃতি নিয়ে কথা বলতেই তাঁরা ভালোবাসে। মিস হান্টার পিয়ানো বাজাতে পারে আর মাঝে মাঝেই আমদেরকে নিয়ে কনসার্ট করে। তারপর আছে মি. হ্যাযার্ড আর মি. ডেসেলিন, দাবা খেলা তাঁদের খুব প্রিয়। তাঁরা আমাদের জন্য চোলাই মদ বানায়। আর আমার কথা বলতে গেলে বলা যায়, আমি আছি আমার ফুল গাছ আর বই নিয়ে। মোট কথা এখানে আমরা সবাই মিলে বেশ ভালোই আছি।”

মার্ক আর মিস ট্রুসডেল দীর্ঘক্ষণ নীরবে বসে রইলো। আকাশের নীল রঙটা ধীরে কালো হয়ে আসলো, গোলাঘরের বাঁ দিকের দেয়ালের পেছনে হারিয়ে গেলো সূর্যটা।

“তোমাকে দেখে আমার ভাতিজার কথা মনে পড়ছে,” মিস ত্রুসডেল হঠাৎ কথা বলে উঠলো, “ছেলেটা বড় ভালো ছিলো। যুদ্ধের পরে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীতে ছেলেটা যখন মারা গেল, তখন আমার হৃদয়টা ভেঙ্গে খান খান হয়ে গিয়েছিলো। তুমি জানো, আমিই আমার বংশের শেষ ব্যক্তি।”

মার্ক মনে করতে পারলো না শেষ কবে সে কারো সাথে এমন সুন্দর বন্ধুসুলভ আলাপ করেছে। এই বৃদ্ধ মহিলাটার জন্যে তাঁর হৃদপিণ্ডটা কাতর হয়ে উঠলো। একটা মহৎ নৈতিকতা আবিষ্কারের অস্পষ্ট অনুভূতি এসে ভর করলো তাঁর উপর। পকেট থেকে সে কার্ডটা বের করলো।

“নথির আলমারিতে গতকালকে আমি এই কার্ডটা পেয়েছি,” মার্ক বললো। “এই সম্পর্কে এখনো কেউ কিছু জানে না। জানাজানি হলে বড় ধরনের একটা কেলেঙ্কারি বেঁধে যাবে, আর পাশাপাশি আপানাদের সমস্যারও আর শেষ থাকবে না। পত্রিকার রিপোর্টার, কর সংগ্রাহক………”

মার্কের বাড়িওয়ালীর কথা আবার মনে পড়লো, মনে পড়লো তাঁর ঝগড়াটে প্রতিবেশীদের কথা, তাঁর অনুন্নত ঘরটার কথা। সে আস্তে করে বললো, “আমার মনে হয়, ভাড়াটিয়া হিসেবে আমি খুব একটা মন্দ নই। ভাবছিলাম……”

“ওহ, হ্যাঁ,” মহিলাটা সাগ্রহে সামনের দিকে ঝুঁকে বললো, “আমার বাড়ির উপরের তলাটা খালি পড়ে আছে, তুমি থাকতে পারবে। আমার এখানে এত জায়গা পড়ে আছে যে তা দিয়ে আমি কি করবো আমি নিজেই জানিনা। আমি নিশ্চিত, জায়গাটা তোমার ভালো লাগবে। তুমি এখনি এসে দেখে যাও।”

নথির কেরানী মার্ক জিরনডিন মনস্থির করে ফেললো সে এখানেই থেকে যাবে। পরিত্যাগের ভঙ্গিতে কার্ডটাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে জলের কৌটার মধ্যে ফেলে দিলো। তারপর যতটুকু তাঁর মনে হলো, এই ‘গ্রিন বোটল স্ট্রীট’ এর কথা আর কেউ কক্ষণো জানবে না, এই জায়গাটা বিস্মৃতই থেকে যাবে, অনন্তকাল।

উৎস ঃ http://onubadokderadda.com/the-street-that-got-mislaid/

Sunday, July 1, 2018

"হুজুর কেবলা "- আবুল মনসুর আহমদ


এক

এমদাদ তার সবগুলি বিলাতি ফিনফিনে ধুতি,সিল্কের জামা পোড়াইয়া ফেলিলফ্লেক্সের ব্রাউন রঙের পাম্প সুগুলি বাবুর্চিখানার বঁটি দিয়া কোপাইয়া ইলশা-কাটা করিল। চশমা ও রিস্টওয়াচ মাটিতে আছড়াইয়া ভাঙ্গিয়া ফেলিলক্ষুর স্ট্রপ,শেভিংস্টিক ও ব্রাশ অনেকখানি রাস্তা হাঁটিয়া নদীতে ফেলিয়া দিয়া আসিল;বিলাসিতার মস্তকে কঠোর পদাঘাত করিয়া পাথর-বসানো সোনার আংটিটা এক অন্ধ ভিক্ষুককে দান করিয়া এবং টুথক্রিম ও টুথব্রাস পায়খানার টবের মধ্যে ফেলিয়া দিয়া দাঁত ঘষিতে লাগিল।

অর্থাৎ এমদাদ অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করিল! সে কলেজ ছাড়িয়া দিল।
তারপর সে কোরা খদ্দের কল্লিদার কোর্তা ও সাদা লুঙ্গি পরিয়া মুখে দেড় ইঞ্চি পরিমাণ ঝাঁকড়া দাড়ি লইয়া সামনে-পিছনে সমান-করিয়া চুলকাটা মাথায় গোল নেকড়ার মতো টুপি কান পর্যন্ত পরিয়া চটিজুতা পায়ে দিয়া যেদিন বাড়িমুখে রওনা হইল,সে দিন রাস্তার বহুলোক তাকে সালাম দিল।

সে মনে মনে বুঝিলকলিযুগেও দুনিয়ায় ধর্ম আছে।
কলেজে এমদাদের দর্শনে অনার্স ছিল।
কাজেই সে ধর্ম,খোদা,রসূল কিছুই মানিত না। সে খোদার আরশ,ফেরেশতা,ওহী,হযরতের মেরাজ লইয়া সর্বদা হাসিঠাট্টা করিত।
কলেজ ম্যাগাজিনে সে মিল,হিউম,স্পেন্সার,কোমতের ভাব চুরি করিয়া অনেকবার খোদার অস্তিত্বের অসারতা প্রমাণ করিয়াছিল।

কিন্তু খেলাফৎ আন্দোলনে যোগদান করিয়া এমদাদ একেবারে বদলাইয়া গেল।
সে ভয়ানক নামাজ পড়িতে লাগিল। বিশেষ করিয়া নফল নামাজ সে একেবারে তন্ময় হইয়া পড়িল।
গোল-গাল করিয়া বাঁশের কঞ্চি কাটিয়া সে নিজ হাতে একছড়া তসবিহ তৈরি করিল। সেই তসবির উপর দিয়া অষ্টপ্রহর অঙ্গুলি চালনা করিয়া সে দুইটা আঙ্গুলের মাথা ছিঁড়িয়া ফেলিল।
কিন্তু এমদাদ টলিল না। সে নিজের নধর দেহের দিকে চাহিয়া বলিল : হে দেহ,তুমি আমার আত্মাকে ছোট করিয়া নিজেই বড় হইতে চাহিয়াছিলে! কিন্তু আর নয়।
সে আবার দ্বিগুণ উৎসাহে তসবিহ চালাইতে লাগিল।

দুই

দিন যাইতে লাগিল।
ক্রমে এমদাদ একটা অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিল।
বহু চেষ্টা করিয়াও সে এবাদতে তেমন নিষ্ঠা আনিতে পারিতেছিল না। নিজেকে বহু শাসাইল,বহু প্রক্রিয়া অবলম্বন করিল;কিন্তু তথাপি পোড়া ঘুম তাকে তাহাজ্জতের নামাজ তরক্ করিতে বাধ্য করিতে লাগিল।
অগত্যা সে নামাজে বসিয়া খোদার নিকট হাত তুলিয়া কাঁদিবার বহু চেষ্টা করিল। চোখের পানির অপেক্ষায় আগে হইতে কান্নার মতো মুখ বিকৃত করিয়া রাখিল। কিন্তু পোড়া চোখের পানি কোন মতেই আসিল না।

সে স্থানীয় কংগ্রেস ও খেলাফৎ কমিটির সেক্রেটারি ছিল।
সেখানে প্রত্যহ সকাল-বিকালে চারিপাশের বহু মওলানা মৌলবী সমবেত হইয়া কাবুলের আমিরের ভারত আক্রমণের কতদিন বাকি আছে তার হিসাব করিতেন এবং খেলাফত নোট-বিক্রয় লব্ধ পয়সায় প্রত্যহ পান ও র্জদা এবং সময়-সময় নাশতা খাইতেন।
ইহাদের একজনের সুফী বলিয়া খ্যাতি ছিল। তিনি এক পীর সাহেবের স্থানীয় খলিফা ছিলেন এবং অনেক রাত পর্যন্ত 
এলহু এলহুকরিতেন।
অল্পদিন পূর্বে 
এস্তেখারা করিয়া তিনি দেখিয়াছিলেন যে,চারি বৎসরের মধ্যে কাবুলের আমির হিন্দুস্থান দখল করিবেন।
তাঁহার কথায় সকলেই বিশ্বাস করিয়াছিলো;কারণ মেয়েলোকের উপর জিনের আসর হইলে তিনি জিন ছাড়াইতে পারিতেন।

এই সুফী সাহেবের নিকট এমদাদ তার প্রাণের বেদনা জানাইল।
সুফী সাহেব দাড়িতে হাত বুলাইয়া মৃদু হাসিয়া ইংরাজী-শিক্ষিতদের উদ্দেশ্য করিয়া অনেক বাঁকা বাঁকা কথা বলিয়া উপসংহারে বলিলেন : হকিকতান যদি আপনি রুহের তরক্কী হাসেল করিতে চান,তবে আপনাকে আমার কথা রাখিতে হইবে। আচ্ছা;মাস্টার সাহেব,আপনি কার মুরিদ?
এমদাদ অপ্রতিভভাবে বলিল : আমি ত কারো মুরিদ হই নাই।

সুফী সাহেব যেন রোগ নির্ণয় করিয়া ফেলিয়াছিলেন এইভাবে মাথা নাড়িতে নাড়িতে বলিলেন : হ-ম্,তাই বলুন। গোড়াতেই গলদ। পীর না ধরিয়া কি কেহ রুহানিয়ৎ হাসেল করিতে পারেহাদীস শরীফে আসিয়াছে : [এইখানে সুফী সাহেব বিশুদ্ধরূপে আইন-গাইনের উচ্চারণ করিয়া কিছু আরবী আবৃত্তি করিলেন এবং উর্দুতে তার মানে-মতলব বয়ান করিয়া অবশেষে বাংলায় বলিলেন] : জযবা ও সলুক খতম করিয়া ফানা ও বাকা লাভে সমর্থ হইয়াছেন এরূপ কামেল ও মোকাম্মেল,সালেক ও মজযুব পীরের দামন না ধরিয়া কেহ জমিরের রওশনী ও রুহের তরক্কী হাসেল করিতে পারে না।

হাদীসের এই সুস্পষ্ট নির্দেশের কথা শুনিয়া এমদাদ নিতান্ত ঘাবড়াইয়া গেল।
সে ধরা-গলায় বলিল : কি হইবে আমার তাহা হইলে সুফী সাহেব?
সুফী সাহেব এমদাদের কাঁধে হাত রাখিয়া বলিলেন : ঘাবড়াইবার কোন কারণ নাই। কামেল পীরের কাছে গেলে একদিনে তিনি সব ঠিক করিয়া দিবেন।

স্বস্তিতে এমদাদের মুখ উজ্জ্বল হইয়া উঠিল।
সে আগ্রহাতিশয্যে সুফী সাহেবের হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিল : কোথায় পাইব কামেল পীর?আপনার সন্ধানে আছে?
উত্তরে সুফী সাহেব সুর করিয়া একটি ফরাসী বয়েত আবৃত্তি করিয়া তার অর্থ বলিলেন : জওহরের তালাশে যারা জীবন কাটাইয়াছে,তারা ব্যতীত আর কে জওহরের খবর দিতে পারেহাজার শোকর খোদার দরগায়,বহু তালাশের পর তিনি জওহর মিলাইয়াছেন।

সুফী সাহেবের হাত তখনও এমদাদের মুঠার মধ্যে ছিল। সে তা আরো জোরে চাপিয়া ধরিয়া বলিল : আমাকে লইয়া যাইবেন না সেখানে?
সুফী সাহেব বলিলেন : কেন লইয়া যাইব না?হাদীস শরীফে আসিয়াছে : (আরবী ও উর্দু) যে ব্যক্তি আল্লাহ্র রাস্তায় আসিতে চায়তার সাহায্য কর।
সংসারে একমাত্র বন্ধন এবং অভিভাবক বৃদ্ধা ফুফুকে কাঁদাইয়া একদিন এমদাদ সুফী সাহেবের সঙ্গে পীর-জিয়ারতে বাহির হইয়া পড়িল।

তিন

এমদাদ দেখিল : পীর সাহেবের একতলা পাকা বাড়ি। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। অন্দরবাড়ির সব কখানা ঘর পাকা হইলেও বৈঠকখানাটি অতি পরিপাটি প্রকাণ্ড খড়ের আটচালা।
সে সুফী সাহেবের পিছনে পিছনে বৈঠকখানায় প্রবেশ করিল। দেখিল : ঘরে বহু লোক জানু পাতিয়া বসিয়া আছেন। বৈঠকখানার মাঝখানে দেওয়াল ঘেঁষিয়া অপেক্ষাকৃত উচ্চ আসনে মেহেদি-রঞ্জিত দাড়ি বিশিষ্ট একজন বৃদ্ধ লোক তাকিয়া হেলান দিয়ে আলবোলায় তামাক টানিতেছেন।
এমদাদ বুঝিল : ইনিই পীর সাহেব।

আসসালামু আলাইকুম বলিয়া সুফী সাহেব সোজা পীর সাহেবের নিকট উপস্থিত হইয়া হাঁটু পাতিয়া বসিলেন। পীর সাহেব সম্মুখস্থ তাকিয়ার উপর একটি পা তুলিয়া দিলেন। সুফী সাহেব সেই পায়ে হাত ঘষিয়া নিজের চোখে মুখে ও বুকে লাগাইলেন।
তৎপর পীর সাহেব তাঁর হাত বাড়াইয়া দিলেন। সুফী সাহেব তা চুম্বন করিয়া দাঁড়াইয়া উঠিলেন এবং পিছাইয়া-পিছাইয়া কিছু দূর গিয়া অন্যান্য সকলের ন্যায় জানু পাতিয়া বসিলেন।
পীর সাহেব এতক্ষণে কথা বলিলেন : কিরে বেটা,খবর কিতুই কি এরই মধ্যে দায়েরায়ে হকিকতে মহব্বত ও জযবায়েযাতী-বনাম হোব্বে এশক হাসিল করিয়া ফেললি নাকি?

পীর সাহেবের এই ঠাট্টায় লজ্জা পাইয়া সুফী সাহেব মাথা নিচু করিয়া মাজা ঈষৎ উঁচু করিয়া বলিলেন,হযরত,বান্দাকে লজ্জা দিতেছেন!
পীর সাহেব তেমনি হাসিয়া বলিলেন : তা না হইলে নিজের চিন্তা ছাড়িয়া অপরের রুহের সুপারিশ করিতে আমার নিকট আসিলেন কেনকই তোর সঙ্গী কোথায়আহা! বেচারা বড়ই অশান্তিতে দিনপাত করিতেছে।

এই বলিয়া পীর সাহেব চক্ষু বুজিলেন এবং প্রায় এক মিনিট কাল ধ্যানস্থ থাকিয়া চক্ষু মেলিয়া বলিলেন: সে এই ঘরেই হাজির আছে দেখিতেছি।
উপস্থিত মুরিদগণের সকলে বিস্ময়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিল। এমদাদ ভক্তি ও বিস্ময়ে স্তব্ধ হইয়া একদৃষ্টে পীর সাহেবের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। মেহেদি-রঞ্জিত দাড়ি-গোঁফের ভিতর দিয়া পীর সাহেবের মুখ হইতে এক প্রকার জ্যোতি বিকীর্ণ হইতে লাগিল।

সুফী সাহেব এমদাদকে আগাইয়া আসিতে ইশারা করিলেন। সে ধীরে ধীরে পীর সাহেবের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া সুফী সাহেবের ইঙ্গিতে অনভ্যস্ত হাতে কদম-বুসি করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
পীর সাহেব 
বস বেটা,তোর ভাল হইবে। আহা,বড় গরীব! বলিয়া আলবোলার নলে দম কষিলেন।
সুফী সাহেব আমতা-আমতা করিয়া বলিলেন : হযরত এর অবস্থা তত গরীব নয়। বেশ ভাল তালুক সম্পত্তি-

পীর সাহেব নলে খুব লম্বা টান কষিয়াছিলেন;কিন্তু মধ্যপথে দম ছাড়িয়া দিয়া মুখে ধোঁয়া লইয়াই বলিলেন : বেটা,তোরা আজিও দুনিয়ার ধন-দৌলত দিয়া ধনী-গরিব বিচার করিস। এটা তোদের বুঝিবার ভুল। আমি গরিব কথায় দুনিয়াবী গোরবৎ বুঝাই নাই। মুসলমানদের জন্য দুনিয়ার ধন-দৌলত হারাম। এই ধন-দৌলত এনসানের রুহানিয়ত হাসেলে বাধা জন্মায়,তার মধ্যে নফসানিয়ত পয়দা করে। আল্লাহতালা বলিয়াছেন : (আরবী ও উর্দু) বেশক দুনিয়ার ধন-দৌলত শয়তানের ওয়াস-ওয়াসা,ইহা হইতে দূরে পলায়ন কর। কিন্তু দুনিয়ার মায়া কাটান কি সহজ কথা?তোদের আমি দোষ দিই না। তোদের অনেকেই এখন যেকেরের দরজাতেই পড়িয়া আছিস। যেকরে জলী ও যেকরে খফী- এই দুই দরজার যেকের সারিয়া পরে ফেকেরের দরজায় পৌঁছিতে হয়। ফেকের হইতে যহুর এবং যহুর হইতে মোরাকেবা-মোশাহেদার কাবেলিয়ত হাসেল হয়। খোদার ফজলে আমি আরেফিন,সালেহীন ও সিদ্দিকিনের মোকামাতের বিভিন্ন দায়েরার ভিতর দিয়া যেভাবে এলমে-লাদুন্নির ফয়েজ হাসেল করিয়াছি,তোদের কলব অতটা কুশাদা হইতে অনেক দেরি অনেক-
-বলিয়া তিনি হুক্কার নলটা ছাড়িয়া দিয়া সোজা হইয়া বসিলেন এবং চোখ বুজিয়া ধ্যানস্থ হইলেন।

কিছুক্ষণ চোখ বুজিয়া থাকিয়া হাসিয়া উঠিলেন এবং চিৎকার করিয়া বলিলেন : কুদরতে-ইয্দানী,কুদরতে-ইয্দানী। মুরিদরা সব সে-চিৎকারে সন্ত্রস্ত হইয়া উঠিলেন।
কিন্তু কেহ কোনও কথা জিজ্ঞাসা করিতে সাহস করিলেন না।
পীর সাহেব চিৎকার করিয়াই আবার চোখ বুজিয়াছিলেন। তিনি এবার ঈষৎ হাসিয়া চোখ মেলিয়া বলিলেন : আমরা কত বৎসর হইল এখানে বসিয়া আছি?
জনৈক মুরিদ বলিলেন : হযরত,বৎসর কোথায়এই না কয়েক ঘণ্টা হইল।
পীর সাহেব হাসিলেন। বলিলেন : অনেক দেরি- অনেক দেরি। আহা বেচারারা চোখের বাহির আর কিছুই দেখিতে পায় না।
অপর মুরিদ বলিলেন : হুজুর কেবলা,আপনার কথা মোটেই বুঝিতে পারিলাম না।
পীর সাহেব মৃদু হাসিয়া বলিলেন : অত সহজে কি আর সব কথা বুঝা যায় রে বেটাচেষ্টা কর,চেষ্টা কর।

মুরিদটি ছিলেন একটু আবদেরে রকমের। তিনি বায়না ধরিলেন : না কেবলা,আমাদিগকে বলিতেই হইবে। কেন আপনি বৎসরের কথা জিজ্ঞাসা করিলেন?
পীর সাহেব বলিলেন : ও-কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিস না। তার চেয়ে অন্য কথা শোন। এই যে সাদুল্লাহ (সুফী সাহেবের নাম) একটি ছেলেকে আমার নিকট মুরিদ করিতে লইয়া আসিল,আমি সে-কথা কি করিয়া জানিতে পারিলামআজ তোমরা তাজ্জব হইতেছ। কিন্তু ইনশাআল্লাহযখন তোমরা মোরাকেবায়ে-নেসবতে-বায়নান্নাসে তালিম লইবে,তখন অপরের নেসবত সম্বন্ধে তোমাদের কলব আয়নার মতো রওশন হইয়া যাইবে। আলগরজ ইহাও খোদার এক শানে-আজিম। সাদুল্লাহ যখন আমার দস্ত-বুসি করে,তখন তার মুখের দিকে আমার নজর পড়িল এবং সঙ্গে সঙ্গে আমার রুহ সাদুল্লাহর রুহের দিকে মোতাওয়াজ্জাহ হইয়া গেল। সেখানে আমি দেখিলাম,সাদুল্লার রুহ আর একটা নূতন রুহের সঙ্গে আলাপ করিতেছে। উহাতেই আমি সব বুঝিয়া লইলাম। আল্লাহু আজিমুশশান।
বলিয়া পীর সাহেব একজন মুরিদকে হুক্কার দিকে ইঙ্গিত করিলেন।

মুরিদ হুক্কার মাথা হইতে চিলিম লইয়া তামাক সাজিতে বাহির হইয়া গেল।
পীর সাহেব বলিলেন : তোমরা আমার নিজের নুৎফার ছেলের মতো। তথাপি তোদের নিকট হইতে আমাকে অনেক গায়েবের কথা গোপন রাখিতে হয়। কারণ তোমরা সে-সমস্ত বাতেনি কথা বরদাশত করিতে পারিবে না। যেকের ও ফেকের দ্বারা কলব কুশাদা করিবার আগেই কোনও বড় রকমের নূরে তজল্লী তাতে ঢালিয়া দিলে তাতে কলব অনেক সময় ফাটিয়া যায়। এলমে-লাদুন্নি হাসেল করিবার আগেই আমি একবার লওহে-মাওফুযে উপস্থিত হইয়াছিলাম। তখন আমি মাত্র দায়েরায়ে-হকিকতে-লাতা আইউনে তালিম লইতেছিলাম। সায়েরে-নাযাবীর ফয়েজ তখনও আমার হাসেল হয় নাই। কাজেই আরশে-মওয়াল্লার পরদা আমার চোখের সামনে হইতে উঠিয়া যাইতেই আমি নূরে-ইয্দানী দেখিয়া বেহুশ হইয়া পড়িলাম। তারপর আমার জেসমের মধ্যে আমার রুহের সন্ধান না পাইয়া আমার মুর্শেদ-কেবলা- তোরা তো জানিস আমার ওয়ালেদ সাহেবই আমার মুর্শেদ -লওহে মাহফুজ হইতে আমার রুহ্ আনিয়া আমার জেসমের মধ্যে ভরিয়া দেন,এবং নিজের দায়রার বাহিরে যাওয়ার জন্য আমাকে বহুৎ তম্বিহু করেন। কাজেই দেখিতেছিস,কাবেলিয়ত হাসেল না করিয়া কোনও কাজে হাত দিতে নাই। খানিকক্ষণ আগে আমি জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম : আমরা কত বৎসর যাবত এখানে বসিয়া আছি?শুনিয়া তোরা অবাক হইয়াছিলি। কিন্তু এর মধ্যে যে ঘটনা ঘটিয়াছে,তা শুনিলে তো আরো তাজ্জব হইয়া যাইবি। সে জন্যই সে কথা বলিতে চাই না। কিন্তু কিছু কিছু না বলিলে তোরা শিখবি কোথা হইতেতাই সে কথা বলাই উচিত,মনে করিতেছি। সাদুল্লাহ এখানে আসিবার পর আমি আমার রুহকে ছাড়িয়া দিয়াছিলাম। সে তামাম দুনিয়া ঘুরিয়া সাত হাজার বৎসর কাটাইয়া তারপর আমার জেসমে পুনরায় প্রবেশ করিয়াছে। এই সাত হাজার বৎসরে কত বাদশাহ ওফাত করিয়াছে,কত সুলতানাৎ মেসমার হইয়াছে,কত লড়াই হইয়াছে;সব আমার সাফ-সাফ মনে আছে। সেরেফ এইটুকুই বলিলামইহার বেশি শুনিলে তোদের কলব ফাটিয়া যাইবে।

ইতিমধ্যে তামাক আসিয়াছিল।
পীর সাহেব নল হাতে লইয়া ধীরে ধীরে টানিতে লাগিলেন।
সভা নিস্তব্ধ রহিল। কলব ফাটিয়া যাইবার ভয়ে কেহ কোনও কথা জিজ্ঞাসা করিল না।
এমদাদ পীর সাহেবের কথা কান পাতিয়া শুনিতেছিল। কৌতূহল ও বিস্ময়ে সে অস্থিরতা বোধ করিতে লাগিল।
সে স্থির করিল,ইহার কাছে মুরিদ হইবে।

চার

পীর সাহেব অনেক নিষেধ করিলেন। বলিলেন : বাবা,সংসার ছাড়িয়া থাকিতে পারবে না,তাসউওয়াফ বড় কঠিন জিনিস ইত্যাদি।
কিন্তু এমদাদ তাওয়াজ্জোহ লইল।
পীর সাহেব নিজের লতিফায় যেকের জারি করিয়া সেই যেকের এমদাদের লতিফায় নিক্ষেপ করিলেন।
এমদাদ প্রথম লতিফা যেকরে-জলী আরম্ভ করিল।
সে দিবানিশি দুই চোখ বুজিয়া পীর সাহেবের নির্দেশমত 
এলহু এলহু করিতে লাগিল।

পীর সাহেব বলিয়াছিলেন : খেলওয়াৎ-দর-অঞ্জুমান দ্বারা নিজের কলবকে স্বীয় লতিফার দিকে মুতাওয়াজ্জাহ করিতে পারিলে তার কলবে যাতে আহাদিয়াতের ফয়েজ হাসেল হইবে এবং তার রুহ ঘড়ির কাঁটার ন্যায় কাঁপিতে থাকিবে।
কিন্তু এমদাদ অনেক চেষ্টা করিয়াও তার কলবকে লতিফায় মুতাওয়াজ্জাহ করিতে পারিল না। তৎপরিবর্তে তার চোখের সামনে পীর সাহেবের মেহেদি-রঞ্জিত দাঁড়ি ও তার রূপা-বাঁধানো গড়গড়ার ছবি ভাসিয়া উঠিতে লাগিল।
ফলে তার কলবে যাতে-আহাদিয়তের ফয়েজ হাসেল হইয়া তার রুহকে ঘড়ির কাঁটার মতো কাঁপাইবার পরিবর্তে ফুফু-আম্মার স্মৃতি বাড়ি যাইবার জন্য তার মনকে উচাটন করিয়া তুলিতে লাগিল।

দিন যাইতে লাগিল।
অনাহারে অনিদ্রায় এমদাদের চোখ দুটি মস্তকের মধ্যে প্রবেশ করিল। তার শরীর নিতান্ত দুর্বল ও মন অত্যন্ত অস্থির হইয়া পড়িল।
সে বুঝিল,এইভাবে আরও কিছুদিন গেলে তার রুহু বস্তুতই জেসম হইতে আযাদ হইয়া আলমে-আমরে চলিয়া যাইবে।
সে স্থির করিল : পীর সাহেবের কাছে নিজের অক্ষমতার কথা নিবেদন করিয়া সে একদিন বিদায় হইবে।

কিন্তু বলি বলি করিয়াও কথাটা বলিতে পারিল না।
একটা নূতন ঘটনায় সে বিদায়ের কথাটা আপাতত চাপিয়া গেল! দূরবর্তী একস্থানে মুরিদগণ পীর সাহেবকে দাওয়াত করিল।
প্রকাণ্ড বজরায় একমণ ঘি,আড়াই মণ তেল,দশ মণ সরু চাউল,তিনশত মুরগী,সাত সের অম্বুরি তামাক এবং তেরজন শাগরেদ লইয়া পীর সাহেব 
মুরিদানে রওয়ানা হইলেন।

পীর সাহেবের ভ্রমণ বৃত্তান্ত ইংরেজিতে লিখিয়া কলিকাতার সংবাদপত্রে পাঠাইবার জন্য এমদাদকেও সঙ্গে লওয়া হইল। নদীর সৌন্দর্য,নদীপারের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এমদাদের কাছে বেশ লাগিল।
পীর সাহেব গন্তব্যস্থানে উপস্থিত হইলেন।
তিনি মুরিদগণের নিকট যে অভ্যর্থনা পাইলেন,তাহা দেখিলে অনেক রাজা-বাদশাহ রাজত্ব ছাড়িয়া মোরাকেবা-মোশাহেদায় বসিতেন।
পীর সাহেব গ্রামের মোড়লের বাড়িতে আস্তানা করিলেন।
বিভিন্ন দিন বিভিন্ন মুরিদের বাড়িতে বিরাট ভোজ চলিতে লাগিল।
পীর সাহেবের একটু দূরে বসিয়া গুরুভোজ করিয়া এমদাদ এত দিনের কৃচ্ছ সাধনার প্রতিশোধ লইতে লাগিল। ইহাতে প্রথম প্রথম তার একটু পেটে পীড়া দেখা দিলেও শীঘ্রই সে সামলাইয়া উঠিল এবং তার শরীর হৃষ্টপুষ্ট ও চেহারা বেশ চিকনাই হইয়া উঠিতে লাগিল।

পীর সাহেবের ভাত ভাঙিবার কসরত দেখার সুযোগ ইতিপূর্বে এমদাদের হয় নাই। এইবার সে ভাগ্য লাভ করিয়া এমদাদ বুঝিল : পীর সাহেবের রুহানীশক্তি যত বেশিই থাকুক না কেন,তাঁর হজমশক্তি নিশ্চয়ই তার চেয়ে বেশি।
সন্ধ্যায় পুরুষদের জন্য মজলিশ বসিত।
রাতে এশার নামাজের পর অন্দর মহলে মেয়েদের জন্য ওয়াজ হইত। কারণ অন্য সময় মেয়েদের কাজে ব্যস্ত থাকিতে হয়।
সেখানে পুরুষদের প্রবেশ নিষেধ ছিল।
স্ত্রীলোকদিগকে ধর্মকথা বুঝাইতে একটু দেরি হইত। কারণ মেয়েলোকের বুদ্ধিসুদ্ধি বড় কম- তারা নাকেস-আকেল।
কিন্তু বাড়িওয়ালার ছেলে রজবের সুন্দরী স্ত্রী কলিমন সম্বন্ধে পীর সাহেবের ধারণা ছিল অন্যরকম। মেয়ে-মজলিশে ওয়াজ করিবার সময় তিনি ইহারই দিকে ঘন-ঘন দৃষ্টিপাত করিতেন।
তিনি অনেক সময় বলিতেন : তাসাউওয়াফের বাতেনী কথা বুঝিবার ক্ষমতা এই মেয়েটার মধ্যেই কিছু আছে। ভাল করিয়া তাওয়াজ্জোহ দিলে তাকে আবেদা রাবেয়ার দরজায় পৌঁছাইয়া দেওয়া যাইতে পারে।

এশার নামাজের পর দাঁড়িয়ে চিরুনি ও কাপড়ে আতর লাগান সুন্নত এবং পীর সাহেব সুন্নাতের একজন বড় মোতেকাদ ছিলেন।
ওয়াজ করিবার সময় পীর সাহেবের প্রায়ই জযবা আসিত।
সে জযবাকে মুরিদগণ 
ফানাফিল্লাহ বলিত।
এই ফানাফিল্লাহ্র সময় পীর সাহেব 
জ্বলিয়া গেলাম পুড়িয়া গেলাম বলিয়া চিৎকার করিয়া চিৎ হইয়া শুইয়া পড়িতেন। এই সময় পীর সাহেবের রুহ আলমে-খালক হইতে আলমে-আমরে পৌঁছিয়া রুহে ইযদানির সঙ্গে ফানা হইয়া যাইত এবং নূরে ইয়াদানি তাঁর চোখের উপর আসিয়া পড়িত। কিন্তু সে নূরের জলওয়া পীর সাহেবের চক্ষে সহ্য হইত না বলিয়া তিনি এইরূপ চিৎকার করিতেন।

তাই জযবার সময় একখণ্ড কাল মখমল দিয়া পীর সাহেবের চোখ-মুখ ঢাকিয়া দিয়া তাঁর হাত-পা টিপিয়া দিবার ওসিয়ত ছিল।
এইরূপ জযবা পীর সাহেবের প্রায়ই হইত।
-এবং মেয়েদের সামনে ওয়াজ করিবার সময়েই একটু বেশি হইত।
এই সব ব্যাপারে এমদাদের মনে একটু খট্কার সৃষ্টি হইল।
কিন্তু সে জোর করিয়া মনকে ভক্তিমান রাখিবার চেষ্টা করিতে লাগিল।
সে চেষ্টায় সফল হইবার আগেই কিন্তু ও-পথে বাধা পড়িল। প্রধান খলিফা সুফী বদরুদ্দীন সাহেবের সঙ্গে পীর সাহেবকে প্রায়ই কানাকানি করিতে দেখিয়া এমদাদের মনের খট্কা বাড়িয়া গেল। তার মনে পীর সাহেবের প্রতি একটা দুর্নিবার সন্দেহের ছায়াপাত হইল।

এমন সময় পীর সাহেব অত্যন্ত অকস্মাৎ একদিন ঘোষণা করিলেন : তিনি আর দু-এক দিনের বেশি সে অঞ্চলে তশরিফ রাখিবেন না।
এই গভীর শোক সংবাদে শাগরেদ-মুরিদগণের সকলেই নিতান্ত গমগিন হইয়া পড়িল।

জনৈক শাগরেদ সুফী সাহেবের ইশারায় বলিলেন : হুজুর কেবলা আপনি একদিন বলিয়াছিলেন;এবার এ-অঞ্চলের মুসলমানগণকে কেরামতে-নেসবতে বায়নান্নাস দেখাইবেনতা না দেখাইয়াই কি হুজুর এখান হইতে তশরিফ লইয়া যাইবেনএখানকার মুরিদগণের অনেকেই বলিতেছেন : হুজুর মাঝে মাঝে কেরামত দেখান না বলিয়া উম্মী মুরিদগণের অনেকেই গোমরাহ হইয়া যাইতেছে। মওলানা লকবধারী ঐ ভণ্ডটা ও-পাড়ার অনেক মুরিদকে ভাগাইয়া নিতেছেসে নাকি বৎসর বৎসর একবার আসিয়া কেরামত দেখাইয়া যান।

পীর সাহেব গম্ভীর মুখে বলিলেন : (আরবী ও উর্দু) আল্লাহ্ই কেরামতের একমাত্র মালিক,মানুষের সাধ্য কি কেরামত দেখায়ও-সব শয়তানের চেলাদের কথা আমার সামনে বলিও না। তবে হ্যাঁ,মোরাকেবায়ে-নেসবতে বায়নান্নাস-এর তরকিব দেখাইব বলিয়াছিলাম বটেকিন্তু তার আর সময় কোথায়?
সমস্ত সাগরেদ ও মুরিদগণ সমস্বরে বলিয়া উঠিলেন : না হুজুর,সময় করিতেই হইবে,এবার উহা না দেখিয়া ছাড়িব না।
অগত্যা পীর সাহেব রাজি হইলেন।
স্থির হইল,সেই রাত্রেই মোরাকেবা বসিবে।
সারাদিন আয়োজন চলিল।
রাত্রে মৌলুদের মহফেল বসিল। হযরত পয়গম্বর সাহেবের অনেক অনেক মোওয়াজেযাত বর্ণিত হইল।
মৌলুদ শেষে খাওয়া-দাওয়া হইল এবং তৎপর মোরাকেবার বৈঠক বসিল।

পাঁচ

পীর সাহেব বলিলেন : আজ তোমাদের আমি যে মোরাকেবার তরকিব দেখাইব,ইহা দ্বারা যে-কোনও লোকের রুহের সঙ্গে কথা বলিতে পারি। আমি যদি নিজে মোরাকেবায় বসি,তবে সেই রুহ গোপনে আমার সঙ্গে কথা বলিয়া চলিয়া যাইবে। তোমরা কিছুই দেখিতে পাইবে না। তোমাদের মধ্যে একজন মোরাকেবায় বস,আমি তার রুহের দিকে তোমরা যার কথা বলিবে তার রুহের তাওয়াজ্জোহ দেখাইয়া তারই রুহের ফয়েজ হাসিল করিব। তৎপর তোমরা যে-কেহ তার সঙ্গে কথা বলিতে পারিবে।
সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিল।
কেহই কোন কথা বলিল নামোরাকেবায় বসিতে কেহই অগ্রসর হইল না।
এমদাদ দাঁড়াইয়া বলিল : আমি বসিব।
পীর সাহেব একটু হাসিলেন।
বলিলেন : বাবা,মোরাকেবা অত সোজা নয়,তুই আজিও যেকরে খফী আমল করিস নাই,মোরাকেবায় বসিতে চাস?
বলিয়া তিনি হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিলেন।
দেখাদেখি উপস্থিত সকলেই হাসিয়া উঠিল।
লজ্জায় এমদাদের রাগ হইল। সে বসিয়া পড়িল।

পীর সাহেব আবার বললেন : কি,আমরে মুরিদগণের মধ্যে আজও কারও এতদূর রুহানী তরক্কী হাসেল হয় নাইযে মোরাকেবায় বসিতে পারেআমার খলিফাদের মধ্যেও কেহ নাই?
বলিয়া তিনি শাগরেদদের দিকে দৃষ্টি ফিরাইলেন।
প্রধান খলিফা সুফী সাহেব উঠিয়া বলিলেন : হুজুর কেবলা কি তবে বান্দাকে হুকুম করিতেছেনআমি ত আপনার আদেশে কতবার মোরাকেবায়-নেসবতে-বায়নান্নাসে বসিয়াছি। কোনও নূতন লোককে বসাইলে হইত না?
সুফী সাহেব আরও অনেকবার বসিয়াছেন শুনিয়া মুরিদগণের অন্তরে একটু সাহসের উদ্রেক হইল।
তারা সকলে সমস্বরে বলিল : আপনিই বসুন,আপনিই বসুন।
অগত্যা পীর সাহেবের আদেশে সুফী সাহেব মোরাকেবায় বসিলেন।
পীর সাহেব উপস্থিত দর্শকদের দিকে চাহিয়া বলিলেন : কার রুহের ফয়েজ হাসিল করিব?
মুরিদগণের মুখের কথা যোগাইবার আগেই জনৈক সাগরেদ বলিলেন : এই মাত্র মৌলুদ-শরীফ হইয়াছে;হযরত পয়গম্বর সাহেবের মোয়াজেযা বয়ান হইয়াছে। তাঁরই রুহ আনা হোক।
সকলেই খুশী হইয়া বলিলেন : তাই হউক,তাই হউক।
তাই হইল।

সুফী সাহেব আতর-সিক্ত মুখমলের গালিচায় তাকিয়া হেলান দিয়া বসিলেন। চারিদিকে আগরবাতি জ্বালাইয়া দেওয়া হইল। মেশক্ যাফরান ও আতরের গন্ধে ঘর ভরিয়া গেল।
পীর সাহেব তাঁর প্রধান খলিফার রুহে শেষ পয়গম্বর হযরত মোহাম্মদের রুহ-মোবারক নাযেল করিবার জন্যে ঠিক তাঁর সামনে বসিলেন।
শাগরেদরা চারিদিক ঘিরিয়া বসিয়া মিলিত-কণ্ঠে সুর করিয়া দরুদ পাঠ করিতে লাগলেন। পীর সাহেব কখনও জোরে কখনও বা আস্তে নানা প্রকার দোওয়া কালাম পড়িয়া সুফী সাহেবের চোখে-মুখে ফুঁকিতে লাগিলেন।
কিছুক্ষণ ফুঁকিবার পর শাগরেদগণকে চুপ করিতে ইঙ্গিত করিয়া পীর সাহেব বুকে হাত বাঁধিয়া একদৃষ্টে সুফী সাহেবের বুকের দিকে চাহিয়া রহিলেন।
সুফী সাহেবের বুকের দুইটা বোতাম খুলিয়া তাঁর বুকের খানিকটা অংশ ফাঁক করিয়া দেওয়া হইয়াছিল। পীর সাহেব তাঁর দৃষ্টি সেইখানেই নিবদ্ধ করিলেন।

অল্পক্ষণ মধ্যেই সুফী সাহেবের শরীর কাঁপিতে লাগিল। কম্পন ক্রমেই বাড়িয়া গেল। সুফী সাহেব ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলিতে লাগিলেন এবং হাত পা ছুঁড়িতে ছুঁড়িতে মূর্ছিতের ন্যায় বিছানায় লুটাইয়া পড়িলেন।
পীর সাহেব মুরিদগণের দিকে চাহিয়া বলিলেন : বদর বাবাজীর একটু তকলিফ হইল!
কি করিবপরের রুহের উপর অন্য রুহের ফয়েজ হাসেল আসানির সঙ্গে করে বেলকুল না-মোমকেন। যা হউক,হযরতের রুহ তশরিফ আনিয়াছেন। তোমরা সকলে উঠিয়া কেয়াম কর।
-বলিয়া তিনি স্বয়ং উঠিয়া পড়িলেন। সকলেই দাঁড়াইয়া সমন্বরে পড়িতে লাগিল : ইয়া নবী সালাম আলায় কা ইত্যাদি।
কেয়াম ও দরুদ শেষ হইলে অভ্যাসমত অনেকেই বসিয়া পড়িল।
পীর সাহেব ধমক দিয়া বলিলেন : হযরতের রুহে পাক এখনও এই মজলিশে হাজির আছেন,তোমরা কেহ বসিতে পারিবে না। কার কি সওয়াল করিবার আছে করিতে পার।

এমদাদ একটা বিষয় ধাঁধায় পড়িয়া গেল। সে ইহাকে কিছুতেই সত্য বলিয়া মানিয়া লইতে পারিল না।
-মাথায় এক ফন্দি আঁটিয়া অগ্রসর হইয়া বলিল : কেবলা আমি কোন সওয়াল করিতে পারি?
পীর সাহেব চোখ গরম করিয়া বলিলেন : যাও না,জিজ্ঞাসা কর না গিয়া!
-বলিয়া কণ্ঠস্বর অপেক্ষাকৃত মোলায়েম করিয়া আবার বলিলেন : বাবা সকলের কথাই যদি রুহে পাকের কাছে পৌঁছিত,তবে দুনিয়ার সব মানুষই ওলি-আল্লাহ হইয়া যাইত।
এমদাদ তথাপি সুফী সাহেবের দিকে চাহিয়া বলিল : আপনি যদি হযরত পয়গম্বর সাহেবের রুহ হন,তবে আমার দরুদ-সালাম জানিবেন।
হযরতের রুহ কোন জবাব দিলো না।

পীর সাহেব এমদাদের কাঁধে হাত দিয়ে তাকে একদিকে ঠেলিয়া দিয়া বলিলেন : অধিকক্ষণ রুহে পাককে রাখা বে-আদবি হইবে। তোমাদের যদি কাহারও সিনা সাফ হইয়া থাকেতবে আসিয়া যে কোন সওয়াল করিতে পার।
-বলিতেই পীর সাহেবের অন্যতম খলিফা মওলানা বেলায়েতপুরী সাহেব আসর হইয়া
আসসালামো আলায়কুম ইয়া রসূলুল্লাহবলিয়া সুফী সাহেবের সামনে দাঁড়াইলেন।
সকলে বিস্মিত হইয়া শুনিল সুফী সাহেবের মুখ দিয়া বাহির হইল : ওয়া আলায়কুমস্ সালাম,ইয়া উম্মতী।
মওলানা সাহেব বলিলেন : হে রেসালাত-পনা,সৈয়দুল কাওনায়েন,আমি আপনার খেদমতে একটা আরজ করিতে চাই।
আওয়াজ হইল : শীগগির বল,আমার আর দেরী করিবার উপায় নাই।
মওলানা : আমাদের পীর দস্তগির কেবলা সাহেব নূরে-ইযদানির জলওয়া সহ্য করিতে পারেন না,ইহার কারণ কিতার আমলে কি কোনও গলদ আছে?
কঠোর সুরে উত্তর হইল : হ্যাঁ,আছে।
পীর সাহেব শিহরিয়া উঠিলেন। তিনি কাঁদ-কাঁদ সুরে নিজেই বলিলেন : কি গলদ আছে,
ইয়া রসূলুল্লাহআমার পঞ্চাশ বৎসরের রঞ্জকশি কি তবে সব পণ্ড হইয়াছে?- বলিয়া পীর সাহেব কাঁদিয়া ফেলিলেন।
সুফী সাহেবের অচেতন দেহের মধ্যে হইতে আওয়াজ হইল : হে আমার পিয়ারা উম্মত,ঘাবড়াইও না। তোমার উপর আল্লাহর রহমত হইবে। তুমি মারফত খুঁজিতেছ। কিন্তু শরীয়ত ত্যাগ করিয়া কি মারফত হয়?
পীর সাহেব হাত কচলাইয়া বলিলেন : হুজুর,আমি কবে শরীয়ত অবহেলা করিলাম?
উত্তর হইল : অবহেলা কর নাইকিন্তু পালনও কর নাই। আমি শরিয়তে চার বিবি হালাল করিয়াছি। কিন্তু তোমার মাত্র তিন বিবি। যারা সাধারণ দুনিয়াদার মানুষ তাদের এক বিবি হইলেও চলিতে পারে। কিন্তু যারা রুহানী ফয়েজ হাসিল করিতে চায়,তাদের চার বিবি ছাড়া উপায় নাই! আমি চার বিবির ব্যবস্থা কেন করিয়াছি,তোমরা কিছু বুঝিয়াছচার দিয়াই এ দুনিয়া,চার দিয়াই আখেরাত। চারদিকে যা দেখ সবই খোদা চার চিজ দিয়া পয়দা করিয়াছেন। চার চিজ দিয়া খোদাতা
লা আদম সৃষ্টি করিয়া তার হেদায়েতের জন্য চার কেতাব পাঠাইয়াছেন। সেই হেদায়েত পাইতে হইলে মানুষকে চার এমামের চার তরিকা মানিয়া চলিতে হয়। এইভাবে মানুষকে চারের ফাঁদে ফেলিয়া খোদাতালা চার কুরসির অন্তরালে লুকাইয়া আছেন। এই চারের পরদা ঠেলিয়া আলমে-আমরে নূরে-ইয্দানিতে ফানা হইতে হইবেদুনিয়াতে চার বিবির ভজনা করিতে হইবে।

পীর সাহেব সকলকে শুনাইয়া হযরতের রুহের দিকে চহিয়া বলিলেন : এই বৃদ্ধ বয়সে আবার বিবাহ করিব?
-তুমি বৃদ্ধআমি ষাট বৎসর বয়সে নবম বার বিবাহ করিয়াছিলাম।
পীর সাহেব মিনতি ভরা কণ্ঠে বলিলেন : না রেসালাত-পানা আমি আর বিবাহ করিব না।
-না কর,ভালই। কিন্তু তোমার রুহানী কামালিয়ত হাসেল হইবে নাতুমি নূরে- ইযদানির জলওয়া বরদাশত করিতে পারিবে না। তোমার মুরিদানের কেহই নফসানিয়তের হাত এড়াইতে পারিবে না।
পীর সাহেব হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া বলিলেন : আমি নিজের জন্য ভাবি না ইয়া রসূলুল্লাহ;কিন্তু যখন আমার মুরদিগণের অনিষ্ট হইবে,তখন বিবাহ করিতে রাজি হইলাম। কিন্তু আমি এক বুড়িকে বিবাহ করিব।
-তুমি তওবা আসতাগফার পড়। তুমি খোদার কলম রদ করিতে চাওতোমার বিবাহ ঠিক হইয়া আছে। বেহেশতে আমি তার ছবি দেখিয়া আসিয়াছ।
-সে কে,ইয়া রসূলুল্লাহ?
-এই বাড়ির তোমার মুরিদের ছোট ছেলে রজবের স্ত্রী কলিমন।
-ইয়া রসূলুল্লাহ,আমি মুরিদের স্ত্রীকে বিবাহ করিবসে যে আমার বেটার বউ-এর শামিল।
-ইয়া উম্মতি,আমি আমার পালিত পুত্র যায়েদের স্ত্রীকে নিকাহ্ করিয়াছিলাম,আর তুমি একজন মুরিদের স্ত্রীকে নিকাহ্ করিতে পারিবে না?
ইয়া রসূল্লাহ,সে যে সধবা।
রজবকে বল স্ত্রীকে তালাক দিতে। কলিমন তোমার জন্যই হালাল। এ মারফতি নিকায় ইদ্দত পালনের প্রয়োজন হইবে না। আমি আর থাকিতে পারি না। চলিলাম। অররহহুমাতুল্লাহ আলায়কুম,ইয়া উম্মতি।

মূর্ছিত সুফী সাহেব একটা বিকট চিৎকার করিলেন। পীর সাহেবের অপর অপর শাগরেদরা তাঁকে সজোরে পাখার বাতাস করিতে লাগিলেন।
মুরিদগণের সনির্বন্ধ অনুরোধ সত্ত্বেও পীর সাহেব মাথা নাড়িয়া বলিতে লাগিলেন : চাই না আমি রুহানী কামালিয়ত। আমি মুরিদের বউকে বিবাহ করিতে পারিব না।
গ্রাম্য মুরিদগণ আখেরাতের ভয়ে পীর সাহেবের অনেক হাতে-পায়ে ধরিল। পীর সাহেব অটল।
এই সময় প্রধান খলিফা সুফী সাহেব স্মরণ করাইয়া দিলেন : এই নিকাহ না করিলে কেবল পীর সাহেবের একারই রুহানী লোকসান হইবে নাতাঁর মুরিদগণের সকলের রুহের উপরও বহুত মুসিবত পড়িবে। তখন পীর সাহেব অগত্যা নিজের রেজামন্দী জানাইয়া দাঁড়িতে হাত বুলাইতে বুলাইতে বলিতে লাগিলেনঃ ছোবহান আল্লাহ! এ সবই কুদরতে এলাহী! তাঁরই শানে-আজিম! আল্লাহ্ পাক নিজেই কোরান-মজিদ ফরমাইয়াছেন (আরবী ও উর্দু)

বাপ-চাচা পাড়া-পড়শীর অনুরোধে,আদেশে,তিরস্কারে ও অবশেষে উৎপীড়নে তিষ্ঠিতে না পারিয়া রজব তার এক বছর আগে বিয়া-করা আদরের স্ত্রীকে তালাক দিল এবং কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছিতে মুছিতে বাড়ির বাহির হইয়া গেল।
কলিমনের ঘন-ঘন মূর্ছার মধ্যে অতিশয় ত্রস্ততার সঙ্গে শুভকার্য সমাধান হইয়া গেল।

এমদাদ স্তম্ভিত হইয়া বর বেশে সজ্জিত পীর সাহেবের দিকে চাহিয়া ছিল। তার চোখ হইতে আগুন ঠিকরাইয়া বাহির হইতেছিল।
এইবার তার চেতনা ফিরিয়া আসিল। সে এক লাফে বরাসনে-উপবিষ্ট পীর সাহেবের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া তাঁর মেহেদি-রঞ্জিত দাড়ি ধরিয়া হেচকা টান মারিয়া বলিল : রে ভণ্ড শয়তান! নিজের পাপ-বাসনা পূর্ণ করিবার জন্য দুইটা তরুণ প্রাণ এমন দুঃখময় করিয়া দিতে তোর বুকে বাজিল না?

আর বলিতে পারিল না। শাগরেদ-মুরিদরা সকলে মার মার করিয়া আসিয়া এমদাদকে ধরিয়া ফেলিল এবং চড়-চাপড় মারিতে লাগিল।
এমদাদ গ্রামের মাতব্বর সাহেবের দিকে চাহিয়া বলিল : তোমরা নিতান্ত মূর্খ। এই ভণ্ডের চালাকি বুঝিতে পারিতেছ নানিজে শখ মিটাইবার জন্য যে হযরত পয়গম্বর সাহেবকে লইয়া তামাসা করিয়া তাঁর অপমান করিতেছে। তোমরা এই শয়তানকে পুলিশে দাও।
পীর সাহেবের প্রতি এমদাদের বেয়াদবিতে মুরিদরা ইতিপূর্বে একটু অসন্তুষ্ট হইয়া ছিল। এবার তার মস্তিষ্ক বিকৃতি সম্বন্ধে তারা নিঃসন্দেহ হইল। মাতব্বর সাহেব হুকুম করিলেন : এই পাগলটা আমাদের হুজুর কেবলার অপমান করিতেছে। তোমরা কয়েকজন ইহাকে কান ধরিয়া গ্রামের বাহির করিয়া দিয়া আস।

ভূলুণ্ঠিত পীর সাহেব ইতিমধ্যে উঠিয়াআস্তাগফেরুল্লাহ পড়িতে পড়িতে তাঁর আলুলায়িত দাঁড়িতে আঙ্গুল দিয়া চিরুনি করিতেছিলেন। মাতব্বর সাহেবের হুকুমের পিঠে তিনি হুকুম করিলেন : দেখিস বাবারা,ওকে বেশি মারপিঠ করিস না। ও পাগল। ওর মাথা খারাপ। ওর বাপ ওকে আমার হাতে সঁপিয়া দিয়াছিল। অনেক তাবিজ দিলাম। কিন্তু কোনও ফল হইল না। খোদা যাকে সাফা না দেন,তাকে কে ভালো করিতে পারে? (আরবী ও উর্দু