Sunday, June 10, 2018

সময় (এবং আপেক্ষিকতা)


“Time, you old gipsy man,
Will you not stay,
Put up your caravan
Just for one day?”

শহরের বাইরে গিয়েছিলাম। ফিরতি পথে এক বিমানবন্দরে লম্বা বিরতি। লাঞ্চ সারলাম, অনেক সময় ধরে বাথরুম সারলাম, দুই-একটা কাজের ফোন সারলাম, বাচ্চাদের সাথে ডু-ইউ-সি-হোয়াট-আই-সি খেললাম, এরপরও দেখি স্টপওভারের সময়টা শেষ হচ্ছে না। এর মধ্যে ফ্লাইট আরো পিছিয়েছে। শেষমেষ একটা ম্যাগাজিন স্টলে হানা দিলাম। হালকা কিছু কিনে বাকি সময়টা কাটিয়ে দেবো ঠিক করলাম।

হঠাৎই চোখে পড়লো সায়েন্টিফিক আমেরিকান পত্রিকার সেপ্টেম্বর সংখ্যাটি। প্রচ্ছদের এই লোকটাকে আমরা প্রায় সবাই চিনি। বলা যায় এই ভদ্রলোকের নামটা আর বিশেষ্য নয়; বরং, কাউকে ভীষণ রকম জ্ঞানী বোঝাতে হলে আমরা এই লোকের নামকে বিশেষণ হিসেবেই ব্যবহার করি।

SA_cover

এটা ২০১৫ সাল। ঠিক একশ বছর আগে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন তাঁর জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি প্রকাশ করেন। বিনা দ্বিধায় পত্রিকাটা কিনে পড়া শুরু করলাম। পড়তে গিয়ে মনে হল স্টপওভারটা আরেকটু বেশি হলেই ভালো হতো। প্লেনটা আরেকটু দেরিতে ছাড়তে পারে?

সময়টাকে একটু প্রসারিত করা যায় না?

এই সংখ্যাতে থিওরি অফ রিলেটিভিটির বিভিন্ন দিক আছে, মহাবিশ্ব ও কসমোলজিতে রিলেটিভিটির প্রয়োগ আছে, বলা যায় গত শতাব্দীর সবচেয়ে যুগান্তকারী আবিষ্কারের প্রতিটি দিক তুলে ধরা হয়েছে এতে। একই সঙ্গে আইনস্টাইনের ব্যক্তিগত জীবন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল, তাঁর ভুলগুলো – কোনো কিছুই বাদ যায় নি।

জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি প্রকাশিত হওয়ার বছর দশেক আগে আইনস্টাইন স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি প্রকাশ করেন। আইনস্টাইন তখন কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি নন। তিনি তখন কাজ করতেন সুইস পেটেন্ট অফিসে। বর্তমানে এই কাজকে “পেটেন্ট এক্সামিনার” বা পেটেন্ট পরীক্ষক বললেও সেই সময় একে “পেটেন্ট ক্লার্ক” বলা হতো। নতুন কোনো আবিষ্কারের জন্য কেউ পেটেন্টের আবেদন করলে পরীক্ষক সেই আবেদন যাচাই-বাছাই ও পরীক্ষণ করে দেখেন যে আবিষ্কারটা সত্যিকার অর্থেই নতুন। আইনস্টাইন এই কাজের ফাঁকে ফাঁকেই তাঁর গবেষণা পত্রগুলো তৈরি করেন।

স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটিটা আসলে কি? উইকিপিডিয়া বলছে…

In physics, special relativity (SR, also known as the special theory of relativity or STR) is the generally accepted physical theory regarding the relationship between space and time. It is based on two postulates: (1) that the laws of physics are invariant (i.e. identical) in all inertial systems (non-accelerating frames of reference); and (2) that the speed of light in a vacuum is the same for all observers, regardless of the motion of the light source. It was originally proposed in 1905 by Albert Einstein in the paper “On the Electrodynamics of Moving Bodies”

অর্থাৎ, সহজ ভাষাতে বললে – স্থান আর কাল – যেই দুটো শব্দ আমরা প্রায় পাশাপাশিই ব্যবহার করি, সেইগুলো জিনিস আসলে সম্পর্কিত। দুটো মূল ধারণার উপরে এটা দাঁড়িয়ে আছে। সেই দুটো ধারণার একটা হচ্ছে, পদার্থবিদ্যার সূত্র সকল জড় কাঠামোর জন্য একইভাবে সত্য এবং শূন্যস্থানে আলোর বেগের ধ্রুবক।

আলোর বেগ ধ্রুব, এবং কোন অবস্থান থেকে মাপা হচ্ছে সেটার উপর নির্ভর করে না। এটা শুনতে খুব সাধারণ ঘটনা মনে হলেও আসলে এটা অসাধারণ একটা ব্যাপার। আইনস্টাইন স্পেশাল রিলেটিভিটি থিওরি প্রকাশের প্রায় ২৫ বছর আগে মাইকেলসন এবং মর্লি পরীক্ষা করে দেখান যে আলোর প্রবাহের জন্য কোনো মাধ্যমের (ইথার) দরকার হয় না এবং মাধ্যমভেদে আলো বেগের তারতম্য হয় না। স্পেশাল রিলেটিভিটির মূল ভিত্তিটা এইখানে।

ধরা যাক – দুটো গাড়ি পাশাপাশি ৫০ মাইল/ঘণ্টা এবং ৩০ মাইল/ঘণ্টা বেগে চলছে। প্রথম গাড়িটা থেকে দ্বিতীয় গাড়ির বেগ মাপলে, আপেক্ষিক বেগ হবে ২০ মাইল/ঘণ্টা। এইবার একটা গাড়িকে অত্যন্ত দ্রুতগামী রকেট হিসাবে চিন্তা করি। ধরা যাক, রকেটটি আলোর বেগের ২৫% বেগে যাচ্ছে (বাস্তবে যা এখনও অসম্ভব)। রকেটের পাশে এখন আর কোনো গাড়ি নেই, বরং একটা আলোর রশ্মি যাচ্ছে। এই বার যদি রকেট থেকে পাশের আলোক রশ্মির বেগ মাপা হয়, তাহলে সেইটা দুই গাড়ির উদাহরণের মতো আপেক্ষিক বেগ হবে না। আলোর বেগ স্থির অবস্থান থেকে মাপলেও যা, গতিশীল অবস্থান থেকে মাপলেও সেই একই। এটা যদি না হতো, তাহলে আলোর বেগ একেক গতিশীল অবস্থাতে একেক রকম হতো।

এটা সম্ভব হয় তখনই যখন গতিশীল বস্তু থেকে মাপা সময় এবং দৈর্ঘ্য স্থির অবস্থানের তুলনাতে কম হবে। মানে হচ্ছে আলোর বেগকে ধ্রুব রাখতে গিয়েই ব্যাপারগুলো ঘটছে। সুতরাং, এই তত্ত্বের সাথে সাথে আরও কিছু মৌলিক অজানা বিষয় বের হয়ে আসে। একটা হচ্ছে যে কোনো বস্তুর জন্য সর্বোচ্চ বেগ হচ্ছে আলোর বেগ। অর্থাৎ, আইনস্টাইন এসে মহাজাগতিক গতিসীমা ঠিক করে দিলেন। এর পাশাপাশি বস্তু এবং শক্তির রূপান্তরের ব্যাপারটাও প্রমাণিত হয়। বস্তু থেকে শক্তি আর শক্তি থেকে যে বস্তু পাওয়া যায়, সেই সংক্রান্ত E = mc^2 সূত্রটা আমরা স্কুলেই পড়েছি।

সময় প্রসারণ বা টাইম ডাইলেশন, দৈর্ঘ্য সংকোচন, আপেক্ষিক ভর – এই ব্যাপারগুলোও স্পেশাল রিলেটিভিটি প্রথমবারের মতো প্রমাণ করেছে। খুব সাধারণ ভাষায় বলতে গেলে – দুই জন পর্যবেক্ষকের একজন যদি গতিশীল থাকেন এবং অন্যজন যদি স্থির থাকেন, তাহলে তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে মাপা সময়, দৈর্ঘ্য, ভর অপরের তুলনায় ভিন্ন হবে। ঠিক কতখানি ভিন্ন হবে, সেটা খুব নির্দিষ্ট করে বলে দেয় স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি।

আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক মনে হয় টাইম ডাইলেশনের ব্যাপারটা। আমার এই লেখাটা টাইম ডাইলেশনেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই। লেখাটার নাম তাই দিয়েছি সময় (এবং আপেক্ষিকতা); জিনিসটা আইসক্রিমের মতো, ধরে রাখা যায় না, গলে বেরিয়ে যায়। আমাদের হাতে সময় থাকে না (সম্ভবত ঘড়ি হাতে পরা হয় দেখে হাতে সময়ের ব্যাপারটা এসেছে, এখন অনেকেই ঘড়ি পরেন না, পকেট থেকে সেলফোন বের করে সময় দেখে নেন – এখন সময় আমাদের পকেটে থাকে), পড়ার সময় থাকে না, বন্ধুদের সাথে আড্ডার সময় থাকে না। অঞ্জনের গানের কথায় বললে…

“সেই মন-প্রাণ খুলে গল্প করার দিন শেষ,
শুধু তাড়াহুড়ো করে যদি কিছু কথা বলে ফেলা যায়..
সময় যা ছিলো হাতে সবটাই নিঃশেষ,
পড়ে আছে শুধু অজস্র অসময়..”

সময় নিয়ে কিছু বলতে গেলেই কিছুটা হাহাকার চলে আসে। কেননা সময় এসে তারুণ্যকে কেড়ে নেয়, স্মৃতিকে ফিকে করে দেয়, মাথার চুলের রঙ পালটে দেয়, শৈশবকে টেনে নিয়ে ফেলে দেয় মধ্যবয়েসে। সময়ের আঁচড় থেকে আমরা কেউই মুক্ত নই। ভদ্রলোক এমনই খতরনাক!

টাইম ট্র্যাভেল করে ভবিষ্যতে ভ্রমণ করা কি সম্ভব? উত্তর হচ্ছে – অবশ্যই সম্ভব। আমরা প্রতি মিনিটেই ভবিষ্যতে যাচ্ছি, প্রতি মিনিটে আমরা ঠিক এক মিনিট পথ পাড়ি দিচ্ছি সময়ে। এই গতিতেই আমরা সবাই টাইম ট্র্যাভেল করি। আজকে যেটা অনাগত ভবিষ্যত, সেটা এক সময়ে আর অনাগত থাকে না, বরং এক সময়ে দূর অতীত হয়ে যায়। প্রশ্নটা হচ্ছে আমরা কি আমাদের ভবিষ্যত যাত্রার গতি বাড়াতে পারি? স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি বলছে সেটা সম্ভব।

সময় প্রসারণ বা টাইম ডাইলেশনের এই সূত্রটা দেখুন –

Time Dilation Equation__1444763553_68.105.159.231

এই সূত্র বলছে অর্থাৎ সাঁই সাঁই করে কোথাও যেতে থাকলে আমরা যে শুধু স্থানে অগ্রগামী হই তা নয়, কালেও অগ্রগামী হই। যেটা একটু আগেই বলেছি সময় জিনিসটা আপেক্ষিক, এটা নির্ভর করে পর্যবেক্ষকের উপর। দুজন পর্যবেক্ষকের একজন স্থির এবং অপরজন গতিশীল হলে, গতিশীল পর্যবেক্ষকের সময় স্থির পর্যবেক্ষকের তুলনাতে ধীরে চলবে। অর্থাৎ গতিশীল পর্যবেক্ষক স্থির পর্যবেক্ষকের তুলনায় তাড়াতাড়ি ভবিষ্যতের দিকে রওনা দিচ্ছেন।

একটা উদাহরণ দেখি।

ধরা যাক, দুই যমজ ভাই – হাসান ও হোসেন। দু’জনের বয়েসই ২৫। ঠিক হলো যে হাসান স্পেসশিপে করে দূরের এক গ্রহে যাবে, গ্রহটা ১২ আলোক বর্ষ দূরে। স্পেসশিপের গতি 0.6c তে স্থির হলো। অর্থাৎ আলোর বেগের ষাট শতাংশ। এই বেগে ১২ আলোক বর্ষ যেতে হাসানের ২০ বছর লাগবে। ফিরতে আরও ২০ বছর। অর্থাৎ ৪০ বছর এই দুই ভাইয়ের দেখা হবে না।

হাসান একটু মন খারাপ করলেও বিজ্ঞানের স্বার্থে হোসেনকে “গুড বাই” বলে স্পেসশিপে উঠে গেলো। আরেকটা ব্যাপার দুই ভাই মিলে ঠিক করলো যে তারা একে অপরকে প্রতি বছর একটা করে মেসেজ পাঠাবে। এই অবস্থায় ওপরের টাইম ডাইলেশনের সূত্রটা কেমন দাঁড়াবে?

01. Science

হাসানের স্পেসশিপের বেগ আলোর বেগের ৬০ ভাগ। অর্থা ১২ আলোক বর্ষ পাড়ি দিতে তার লাগবে ১২/০.৬ = ২০ বছর। ফিরতে লাগবে আরও ২০ বছর। সুতরাং ২০ + ২০ = ৪০ বছর পরে সে যখন ফিরবে তার বয়েস তখন ৬৫। এই চল্লিশ বছরে সে হোসেনকে ৪০ টি মেসেজ পাঠাবে।

এই উপরের সূত্রটা প্রয়োগ করে হোসেনের ঘড়ির সময় বের করি।

01. Science

হোসেনের ঘড়ির সময় = হাসানের ঘড়ির সময় / বর্গমূল( (১ – (হাসানের বেগ/আলোর বেগ) ** ২ ) )

হাসানের সময় ৪০ বছর।
হাসানের বেগ/আলোর বেগ = ০.৬, তার বর্গ হচ্ছে ০.৩৬
সুতরাং হরের অংশটা হচ্ছে ১ – ০.৩৬ = ০.৬৪ এর বর্গমূল = ০.৮

তাহলে হোসেনের ঘড়ির সময় = ৪০ /০.৮ = ৫০ বছর

যেই সময়টা হাসান স্পেসশিপে ছিল, সেই সময়ে হোসেন ৫০ টা মেসেজ পাঠাবে হাসানকে। হাসান যখন ফিরে আসবে হোসেনের বয়েস তখন হবে = ২৫ + ৫০ = ৭৫

হাসান ৬৫ বছর বয়েসে ফিরে এসেছে এমন এক জায়গাতে, যেখানে স্থির থাকলে তার বয়েস হতো ৭৫। অর্থাৎ হাসান চল্লিশ বছর গতিশীল থেকে ১০ বছর ভবিষ্যতে পাড়ি দিয়ে ফেলেছে।

আমাদের সাধারণ বেগের জন্য টাইম ডাইলেশনের পরিমাণ তুচ্ছ। আপনারা যদি এই সূত্রে জেট প্লেনের গতিও বসানো তবুও খুবই নগণ্য পার্থক্য পাবেন সময়ের।

আরও একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, এটা অবশ্য কাল্পনিক উদাহরণ নয়, বরং বেশ বাস্তব।

পৃথিবীর মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাইম ট্রাভেল করার রেকর্ডটা সার্গেই ক্রিকলায়েভের (Sergei Krikalev)। উনি ৮০৩ দিনের কিছু বেশি সময় মহাশূন্যে পরিভ্রমণ করেছেন – এই সময়ে বেগের কারণে আমাদের পৃথিবীর মানুষদের থেকে তাঁর ঘড়ি ০.০২ সেকেন্ড কম চলেছে। অর্থাৎ এতোদিন বাইরে থাকার কারণে তাঁর তারুণ্য তিনি ধরে রেখেছেন – আমাদের চেয়ে পুরো ০.০২ সেকেন্ড বেশি তরুণ তিনি।

তবে ব্যাপারটা সর্বত্রই তুচ্ছ করা যায় না। আমাদের গাড়িতে আমরা যেই জিপিএস ব্যবহার করি সেইগুলো স্যাটেলাইটের সাথে যোগাযোগ স্থাপনা করে ভূমিতে আমাদের নির্দিষ্ট অবস্থান জানিয়ে দেয়। কিন্তু আমাদের গাড়ির তুলনায় স্যাটেলাইটের গতি অনেক। জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইটের বেগ ঘণ্টাতে প্রায় ২২,২৩৬ মাইল, বা সেকেন্ডে ৩ কিলোমিটারের সামান্য বেশি। এটা যদিও আলোর বেগের তুলনাতে তুচ্ছ তবুও জিপিএসের ঘড়ি স্যাটেলাইটের সাথে মিলানোর জন্য সূক্ষ্ম টাইম ডাইলেশনের হিসাবটাও নেওয়া হয়, কেননা জিপিএসকে খুব নির্ভুলভাবে অবস্থান জানাতে হয়।

সুতরাং বন্ধুগণ, তারুণ্য ধরে রাখতে হলে দৌড়ের উপর থাকতে হবে। আলোর বেগের কাছাকাছি বেগে দৌড়াতে পারলে চিরতারুণ্য ধরে রাখতে পারবেন। সেটা যদি নাও পারেন, একটু হাঁটাহাঁটি করলেও সময়ের আঁচড় রুখতে পারবেন, নাহ স্পেশাল রিলেটিভিটির কথা বলছি না, আপনার দেহ ঘড়িটা ঠিক ঠিক টিকটিক করে যাবে।

 

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/time_and_relativity/

Saturday, June 2, 2018

হোয়াট ইউ পন, আই উইল রিডীম – শেরম্যান অ্যালেক্সি


দুপুর – ১২টা


জীবনে কখনো এমন সময় আসে যখন আপনার মাথার উপর ছাদ থাকবে। আবার কখনো সেই ছাদ সরে যাবে। ঠিক কী কারণে আমি ঘরছাড়া হলাম তা বলবো না কারণ এটা একটা গোপন ব্যাপার আমার কাছে আর ইন্ডিয়ানদেরকে (এখানে ইন্ডিয়ান মানে উত্তর আমেরিকার আদিবাসী, ভারতীয় নয়) পাগলা সাদা চামড়াগুলোর কাছ থেকে নিজেদের  গোপনীয়তা লুকিয়ে রাখতে যথেষ্টই ঝামেলা পোহাতে হয়।

আমি স্পোকেইন (Spokane) ইন্ডিয়ান, স্যালিশ ভাষার লোক। আমার পূর্বপুরুষ এখানে, এই ওয়াশিংটনের স্পোকেইনের ১০০ মাইল ব্যাসার্ধের মধ্যে বাস করে করে আসছে ১০ হাজার বছর ধরে। আমি স্পোকেইনেই বড় হয়েছি। পরে কলেজে পড়তে সিয়াটলে গেছি প্রায় তেইশ বছর আগে। দুই সেমিস্টার পরই কলেজ ছেড়েছি। তারপর থেকে ভাল-খারাপ মিলিয়ে অনেক রকমের কাজ করেছি, বিয়ে করেছি বার দুই-তিনেক, দু-তিনটে বাচ্চা হয়েছে। আর তারপর-ই মাথাটা খারাপ হয়ে গেলো।

সত্যি বলতে কি, মাথা খারাপ বলতে যা বোঝায়, আমার সমস্যাটা তেমন কিছু না। ভাবতে পারেন, আমি বুঝি সিরিয়াল কিলার টাইপ কিছু। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি ওরকম কিছুই না। আমি জীবনে কাউকে ব্যথা দেইনি-অন্তত শারীরিক ভাবে তো নয়। কারো কারো হৃদয়ে ব্যথা দিয়েছি অবশ্য, তা কে না দেয়! এ ক্ষেত্রে আমার বিশেষত্ব বলতে কিছু নেই। কারো হৃদয়ে আমি হুট করে আঘাত দেইনি। ধীরে-সুস্থে সময় নিয়েছি। এবং হুট-হাট  বাসা ছেড়ে পালাইনি আমি। যখন পালিয়েছি , আর ফিরে যাইনি।

ছয় বছর হয়ে গেল আমি বাড়িছাড়া। এর ভাল দিকটাও বোধহয় আমি ছাড়া আর কেউ এত ভাল ধরতে পারেনি। এই একটা দিক-ই আছে আমার অন্তত যেদিকটায় আমি সুবিধা করতে পেরেছি। আমি জানি সবচেয়ে ভাল খাবারটা কোথায় পাওয়া যায়। আমি কিছু রেস্টুরেন্ট এবং স্টোর ম্যানেজারদের সাথে বন্ধুত্ব পাতিয়ে নিয়েছি। ফলস্বরূপ তারা আমাকে এমনকি তাদের বাথরুম পর্যন্ত ব্যবহার করতে দেয়। এই বাথরুম কিন্তু পাবলিক বাথরুম না। তাদের নিজস্ব ব্যবহারের জন্য বানানো পরিষ্কার বাথরুম, যেটা বেশিরভাগ সময়ে কিচেন কিংবা প্যান্ট্রি অথবা কুলারের পিছনে আড়াল করা থাকে। জানি হাস্যকর শোনায়, তবু অন্যের ব্যক্তিগত পরিষ্কার বাথরুমে প্রস্রাব করার মতো বিশ্বাস অর্জন করতে পারাটা আমার কাছে মনে হয় বিশাল কিছু। আপনারা হয়তো পরিষ্কার বাথরুমের মর্ম বুঝবেন না, কিন্তু আমি বুঝি।

জানি এসব শুনে আপনি মজা পাবেন না। সিয়াটলের সব জায়গায় আপনি উদ্বাস্তু ইন্ডিয়ানদের দেখা পাবেন। আমরা সবাই প্রায় একইরকম। একইরকম বোরিং। আপনি আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যাবেন। কখনো রাগ, কখনো বিরক্তি কিংবা কখনো করুণা নিয়ে তাকাবেন আমাদের দিকে। তবে আমাদেরও পরিবার আছে, আছে স্বপ্ন। আমার এক ইন্ডিয়ান বন্ধু আছে । সেও উদ্বাস্তু। দাবি করে তার ছেলে পশ্চিমের কোনো এক বড় পত্রিকার সম্পাদক। গাঁজাখুরিও হতে পারে কেননা আমরা, প্রায় সব ইন্ডিয়ানরাই, মিথ্যা বলতে আর গল্প ফাঁদতে ওস্তাদ। কে জানে, ওই ব্যাটা আর দশজন ইন্ডিয়ানের মতই সাধারণ একজন প্লেইন্স ইন্ডিয়ান (কানাডার প্রেইরী ও সমভূমিতে বাস করে এরা) এখানে-ওখানে কাজ খুঁজে বেড়ায় কিনা। তাকে নিয়ে আমার সন্দেহ হয় কারণ নিজের পরিচয় বলতে সে বলে সে একজন প্লেইন্স ইন্ডিয়ান, কিন্তু নির্দিষ্ট কোন গোত্রের কথা বলে না। জিজ্ঞেস করলে বড়জোর বলবে, “আমরা কেউ কি জানি যে আমাদের আসল পরিচয় কী?” বড় দার্শনিক আমার! আমি বলি, “তোমার বাড়িঘর তো কিছু একটা থাকতে হবে, তাই না? ” সে কিছু না বলে হেসে আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়।

রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ানোর সময়ে আমার সাথে কয়েকজন থাকে; এরা আমার দলের সদস্য, আমার প্রতিরক্ষা বাহিনী, আমার বডিগার্ড। এই দলে আছে শ্যারন (মূল গল্পে Rose of Sharon লেখা হয়েছিলো, আমি শুধু শ্যারন লিখছি), জুনিয়র, এবং আমি। আর কারো সাথে বনিবনা না হলেও আমরা একসাথে থাকি। শ্যারন এক বিশাল মহিলা। সামগ্রিক প্রভাব বিবেচনায় তার উচ্চতা ৭ ফিট। আর শারীরিক উচ্চতা ৫ ফিট। তার পরিচয় – সে উইস্রাম ভ্যারাইটির ইয়ামাকা ইন্ডিয়ান। জুনিয়র কোলভিলের। তবে কোলভিলের ১৯৯টা গোত্র আছে। সে যে কোনোটা একটার  হতে পারে। জুনিয়র দেখতে-শুনতে ভালই। দেখলে মনে হবে ‘পরিবেশ পরিচ্ছন্নতা কর্মসূচী’-র বিজ্ঞাপন করে  বের হয়ে এসেছে। তার গালের হাড় দেখলে মনে হয় গ্রহ-নক্ষত্রের চিত্র আঁকা। ওকে দেখে আমার হিংসা হয়, হিংসা আর হিংসা। আমার পাশে জুনিয়রকে দাঁড় করালে মনে হবে ও কলম্বাস পূর্ব যুগের ইন্ডিয়ান আর আমি কলম্বাস পরবর্তী যুগের। সাম্রাজ্যবাদ আমাদের কী ক্ষতি করেছে আমি তার জ্বলন্ত প্রমাণ। এইসব ইতিহাস মনে পড়লে আমার মাথার ভিতর ভয় জেঁকে বসে। আমি একজন শক্ত-সামর্থ্য মানুষ। আমি জানি সাদা চামড়ার মানুষদের সাথে মিলে-মিশে থাকতে এইসব বিষয়ে কথা না বলাই ভাল।

আমার গল্পের শুরুটা দুপুরবেলায়। আমি আর শ্যারন পাইক প্লেস মার্কেটের সামনে একটা হ্যান্ডেল ঘুরাচ্ছিলাম। দুই ঘণ্টা বাদানুবাদের পর শেষ পর্যন্ত আমাদের কপালে জুটল পাঁচ ডলার। সেভেন-ইলেভেন থেকে এক বোতল ফর্টিফাইড কারেজ কেনা যায় তাতে। আমরা সেদিকেই রওনা দিলাম। চলতে চলতে একটা সুদ কারবারির দোকানকে পাশ কাটিয়ে আসলাম। এই দোকানটা আগে কখনো চোখে পড়েনি। অদ্ভুত-ই বলতে হবে কারণ আমাদের সব ইন্ডিয়ানদের মধ্যেই সুদ কারবারির দোকান চিনতে পারার এক আশ্চর্য ক্ষমতা থাকে। সবচেয়ে বিস্ময়কর যে জিনিসটা চোখে পড়ল সেটা হলো: একটা পুরনো আদিবাসী পাও-ওয়াও নৃত্যের রেগালিয়া (আদিবাসী নৃত্যের বিশেষ পোশাক)। জানালাতে সেটা ঝুলানো ছিলো।

“এটা আমার দাদীর রেগালিয়া,” শ্যারন আর জুনিয়রকে বললাম।

“তুমি নিশ্চিত?” জুনিয়র জানতে চাইলো।

আমি আসলে পুরোপুরি নিশ্চিত ছিলাম না। তার কারণ- এই জিনিসটা সরাসরি চোখে দেখিনি কখনো। শুধু ছবিতে দেখেছি এটা নিয়ে দাদীকে নৃত্যরত অবস্থায়। একদিন সেটা চুরি হয়ে যায়। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের ঘটনা! কিন্তু আমার স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে, তবে এটাই সেই রেগালিয়া। সেলাই করা রঙিন পালক আর গুটি গুলো দেখতে একইরকম।

“একটাই উপায় আছে জানার” আমি বললাম।

অতঃপর আমি, শ্যারন, আর জুনিয়র দোকানে ঢুকে পড়লাম। কাউন্টারে পিছনে বসে থাকা বৃদ্ধ শ্বেতাঙ্গ লোকটি আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন।

“কিভাবে সাহায্য করতে পারি?” তিনি জিজ্ঞেস করলেন।

“আপনার জানালায় ঝুলানো ওই রেগালিয়াটা আমার দাদীর। ” বললাম আমি। “পঞ্চাশ বছর আগে এটা চুরি হয়ে যায়। আমার পরিবার তখন থেকে এটা খুঁজে বেড়াচ্ছে।”

লোকটা আমার দিকে এমনভাবে তাকাল যেন আমি একটা মিথ্যুক। স্বাভাবিক। এখানে যারা আসে সবাই এই ধরনেরই হয়।

“আমি মিথ্যা বলছি না।“ বললাম আমি। “আমার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করুন। তারা বলবে।“

“ও আমার দেখা সবচাইতে সৎ ইন্ডিয়ান”, শ্যারন বলল।

“ঠিক আছে, সৎ ইন্ডিয়ান”, লোকটা বলল, “তোমাকে প্রমাণের একটা সুযোগ দেওয়াই যায়। তুমি কি প্রমাণ করতে পারবে এইটা তোমার দাদীর?”

একমাত্র স্রষ্টা ছাড়া আর কিছুই নিখুঁত নয়। তাই ইন্ডিয়ানরা রেগালিয়া বানানোর সময়ে তাতে খুঁত রেখে দেয়। আমার পরিবার যেমন রেগালিয়ার উপর কোনো এক জায়গায় একটা হলুদ গুটি সেলাই করে রাখতো। কিন্তু এমন জায়গায় আর এমন ভাবে এটা করা হতো যাতে খুঁজে বের করাটা খুব সহজ না হয়।

“এটা আমার দাদীর হয়ে থাকলে অবশ্যই এতে একটা হলুদ গুটি লুকানো আছে”, বললাম আমি।

“ঠিক আছে” বলল লোকটা, “তাহলে পরীক্ষা করে দেখা যাক”।

সে রেগালিয়াটাকে নামিয়ে আনলো। গ্লাস কাউন্টারের উপর বিছিয়ে রাখল। আমরা খুঁজতে লাগলাম হলুদ গুটি। এবং বগলের কাছাকাছি জায়গাটায় পেয়ে গেলাম।

“এইতো তাহলে।” দোকান মালিককে বিস্মিত মনে হলো না। “তোমার কথাই ঠিক। এটা তোমার দাদীর রেগালিয়া।”

“পঞ্চাশ বছর ধরে এটা নিখোঁজ ছিলো”, জুনিয়র বলল।

“জুনিয়র” আমি ধমক লাগালাম,”আমার ফ্যামিলির গল্প আমাকেই বলতে দে।”

“ভুল হয়ে গেছে”, বললো সে, “কিছু মনে করো না, বলো।”

“এটা পঞ্চাশ বছর ধরে নিখোঁজ ছিলো”, বললাম আমি।

“এটা তার ফ্যামিলির জন্য এক দুঃখজনক ইতিহাস”, শ্যারন বললো, “আপনি এটা ওকে ফিরিয়ে দেবেন না?”

“তেমন করতে পারলে তো ভালই হতো”, লোকটা বললো, “কিন্তু উপায় নেই। এই জিনিসের পিছনে আমার এক হাজার ডলার খরচ হয়েছে। আমি কীভাবে এক হাজার ডলার পানিতে ফেলে দেই বলো?”

“আমরা পুলিশের কাছে গিয়ে সব বলবো”, শ্যারন বলল।

“হেই” আমি বললাম ওকে,”অমন হুমকি দিও না তো।”

লোকটা ভাবছিলো কী করা যায়।

“আমার মনে হয় তোমরা পুলিশের কাছে যেতে পারো”, সে বললো, “কিন্তু তারা তোমাদের কথার এক বর্ণও বিশ্বাস করবে বলে মনে হয় না।”

তার কথা শুনে মনে হলো সেও দুঃখিত। আমাদের এই অবস্থার সুযোগ নিতে তারও খারাপ লাগছে।

“তোমার নাম কী?” জানতে চাইল সে।

“জ্যাকসন”, বললাম আমি।

“আগে পরে কিছু নাই?”

“আগেও যা পরেও তা।”

“মশকরা করছ  নাকি?”

“সত্যি বলছি। বাবা-মা নাম রেখেছিলেন জ্যাকসন জ্যাকসন। আমার ফ্যামিলি নিকনেম জ্যাকসন স্কয়ার্ড। আমার ফ্যামিলি আসলে একটু রসিক।”

“ঠিক আছে জ্যাকসন জ্যাকসন”, বলল সে, “তোমার নিশ্চয়ই ১০০০ ডলার নেই, নাকি আছে?”

“আমাদের সব মিলিয়ে আছে পাঁচ ডলার,” বললাম আমি।

“আহারে!”, সে চিন্তা করছে সম্ভাবনাগুলো নিয়ে। “একটা চুক্তিতে আসা যাক তাহলে। তোমার হাতে চব্বিশ ঘণ্টা সময়। এর মাঝে তুমি ৯৯৯ ডলার নিয়ে এসে আমাকে দেবে। কাল দুপুরের মধ্যে যদি টাকা নিয়ে আসতে পারো তবে তোমার দাদীমার রেগালিয়া ফেরত পাবে। ঠিক আছে?”

“আমি রাজি”, বললাম আমি।

“ঠিক আছে তাহলে,” বলে চলল লোকটা, “সেটাই কথা রইলো। এবং শুরুটাও আমিই করে দিচ্ছি। এই নাও ২০ ডলার।”

সে তার ওয়ালেট ঘেঁটে একটা চকচকে ২০ ডলারের নোট বের করে আমাকে দিল।

আমি, শ্যারন আর জুনিয়র বেরিয়ে পড়লাম  ৯৭৪ ডলারের সন্ধানে।

দুপুর ১ টা

আমরা তিনজন ২০ ডলারের নোট আর বাকি ৫ ডলার দিয়ে সেভেন-ইলেভেনে তিন বোতল ইমাজিনেশন কিনলাম। এক দিনে বাকি টাকাটা কীভাবে ম্যানেজ করা যায় চিন্তা করা দরকার। চিন্তা করতে করতেই আলাস্কা ওয়ের পেছনে এক অ্যালিতে তিনজনে মিলে তিন বোতল সাবাড় করলাম এক, দুই, তিন।

দুপুর ২ টা

যখন জেগে উঠলাম দেখি শ্যারন নেই। পরে জেনেছিলাম, সে হাঁটতে হাঁটতে টপেনিসের দিকে চলে গিয়েছিল। সেখানে তার এক বোন থাকে। নিজের বমিতে মাখামাখি হয়ে পাশেই জুনিয়র শুয়ে আছে। কিংবা বমিটা অন্য কারোরও হতে পারে। কাজেই তাকে রেখেই আমি সমুদ্রে নামলাম। সমুদ্রের নোনা জলের গন্ধ আমার ভাল লাগে। লবণের গন্ধ পুরনো স্মৃতির মত মনে হয়।

জাহাজ নোঙ্গর করার জায়গাটায় তিন অ্যালিউট কাজিনদের সাথে দেখা হল। ওরা কাঠের বেঞ্চে বসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে কথা বলছিলো। সিয়াটলের বেশিরভাগ উদ্বাস্তু ইন্ডিয়ানরা এসেছে আলাস্কা থেকে। সুখের স্বপ্ন নিয়ে অ্যাঙ্করেজ, ব্যারো, কিংবা জুনোর কোন নৌকায় চড়ে বসেছিল ওরা। পকেটভর্তি করে নিয়ে আসা টাকা উড়িয়েছে ফূর্তি করতে গিয়ে। তারপর থেকে অপেক্ষায় আছে আবার কোনো নৌকায় উঠে হিমশীতল উত্তরে চম্পট দেবার।

 

dd8db558e245dd5099f6470adde40abd-243x300

 

অ্যালিউটদের গা থেকে স্যালমন মাছের গন্ধ ছড়াচ্ছিলো। ওরা বললো যে ওদের নৌকা তীরে না ফেরা পর্যন্ত ওরা এখানেই থাকবে।

“কতদিন হলো তোমাদের নৌকা ফেরেনি?” জানতে চাইলাম।

“এগারো বছর।” ওদের মধ্যে বড়জন বলল।

খানিকক্ষণ ওদের সাথে গল্প করলাম।

“আমাকে কিছু টাকা ধার দিতে পারো?” জিজ্ঞেস করলাম।

ওরা জানালো, পারবে না ।

দুপুর ৩টা

জুনিয়রের কাছে ফিরে এলাম। বেচারা তখনো ঘুমাচ্ছে। আমি তার মুখের কাছে মাথা ঝুঁকিয়ে নিয়ে এসে পরীক্ষা করে দেখলাম সে শ্বাস নিচ্ছে কিনা। বেঁচে  আছে বটে। ওর নীল জিনসের পকেট হাতড়ে একটা আধ খাওয়া সিগারেট পেলাম। সিগারেট টানতে টানতে আমার দাদীর কথা ভাবতে লাগলাম।

ওনার নাম ছিল অ্যাগনেস। আমার যখন চৌদ্দ বছর বয়স, তখন তিনি স্তন ক্যান্সারে মারা যান। আমার বাবার ধারণা, ইউরেনিয়াম খনিতে কাজ করতে গিয়েই ক্যান্সার দানা বেঁধেছিলো তার শরীরে। আমার মা অবশ্য বলতেন, এই রোগের সূচনা সেদিন থেকে, যেদিন রাতের বেলা নাচের অনুষ্ঠান থেকে ফেরার সময়ে তিনি মোটরসাইকেল চাপা পড়ে আহত হন এবং তার পাঁজরের তিনটি হাড় ভেঙ্গে যায়। মা বলতেন, ভাঙ্গা হাড়গুলো ঠিকমত সারেনি। আর কোন ক্ষত ঠিকমতো না সারলেই শরীরে ক্যান্সারের টিউমার দানা বাঁধে।

জুনিয়রের পাশে বসে ধোঁয়া, বমি, আর লবণের গন্ধ নাকে আসতে ভাবতে লাগলাম, কে জানে রেগালিয়াটা চুরি হওয়াটাই ক্যান্সারের কারণ  ছিলো কিনা। হয়তো ক্যান্সারটা বাসা বেঁধেছিল তার ভাঙ্গা হৃদয়ে, আর সেখান থেকে স্তনে।  জানি অদ্ভুত শোনায়, যদি কখনো তিনি ফিরে আসতেন, আমি যে কোনো মূল্যে তার হারানো রেগালিয়াটা তাকে ফিরিয়ে দিতাম।

আমার টাকা দরকার, অনেক টাকা। জুনিয়রকে ফেলে রেখে আমি আবার হাঁটতে লাগলাম। এবার গন্তব্য রিয়েল চেঞ্জ অফিস।

দুপুর ৪টা

রিয়েল চেঞ্জ একটা বহুমুখী সংস্থা। এদের সংবাদ প্রকাশনাও রয়েছে। গরিব এবং উদ্বাস্তুদের এরা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রজেক্টের মাধ্যমে সাহায্য করে এবং দারিদ্রের বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলে। এদের উদ্দেশ্য গরিব ও উদ্বাস্তুদের জন্য শিক্ষা, কাজের সুযোগের ব্যবস্থা করা, এবং এদেরকে সংগঠিত করা। আমাদের মতো সমাজের নিম্নস্তরের মানুষদের পক্ষে এরা কথা বলে।

এদের উদ্দেশ্য  আর কর্মকাণ্ড আমার মুখস্থ, কারণ আমি প্রায়ই রাস্তায় এদের পেপার বেচি। তবে বেচার সময়ে আপনাকে মাতাল হলে চলবে না। আর এই শর্তটা সবসময়ে মানা আমার জন্য বেশ কঠিন। যে কেউ পেপার বেচতে পারে। আপনি ত্রিশ সেন্ট দিয়ে প্রতি কপি কিনে এক ডলারে বেচবেন। লাভটা আপনার পকেটে যাবে।

“আমার চৌদ্দশ তিরিশখানা পেপার দরকার।” বড় কর্তাকে বললাম।

“পেপারের সংখ্যাটা বেশ অদ্ভুত তো। এবং অনেক বড়।” তিনি বললেন।

“আমার দরকার আছে।”

বড় কর্তা একটা ক্যালকুলেটর বাগিয়ে হিসেব করলেন।

“এতগুলো পেপারের জন্য তোমাকে দিতে হবে চারশো ঊনত্রিশ ডলার।”

“আমার যদি অত টাকা থাকতই, তাহলে তো ছাতার পেপার বেচতে আসতাম না।”

“কাহিনীটা কী জ্যাকসন টু দ্য পাওয়ার টু? ” মজা করে বললেন তিনি। তিনিই একমাত্র আমাকে এই নামে ডাকেন। মানুষটা বেশ মজার।

আমি তাকে আমার দাদীর হারানো রেগালিয়ার কাহিনীটা শোনালাম। বললাম এটার জন্যই আমার টাকাটা দরকার।

“আমার মনে হয় বিষয়টা পুলিশকে জানানো উচিত।” তিনি বললেন।

“আমি ওসব ঝামেলায় যেতে চাই না,” বললাম, “এটা আমার জন্য একটা প্রতিযোগিতা। আমি যেভাবেই হোক এটায় জিততে চাই।”

“বুঝলাম,” বড় কর্তা বললেন, “কিন্তু সত্যি বলতে আমি তোমাকে অতগুলো পেপার দিতাম যদি কাজ হতো। কিন্তু আমাদের কারো পক্ষে একদিন সর্বোচ্চ পেপার বিক্রির রেকর্ড হল মাত্র তিনশ দুটো। ”

“তাতে আমার লাভ হবে প্রায় দুশো ডলার,” বললাম আমি।

“দুশো এগারো ডলার চল্লিশ সেন্ট”, কর্তা ক্যালকুলেটরে হিসাব করে বললেন।

“যথেষ্ট না,” আমি বললাম।

“তাছাড়া একদিন সর্বোচ্চ ইনকামের রেকর্ড পাঁচশো পঁচিশ। তার কারণ- কেউ একজন হতভাগা বুড়ো ব্লুকে পাঁচশো ডলার ফাও ধরিয়ে দিয়েছিল। গড়ে প্রতিদিন লাভ আসলে মাত্র ত্রিশ ডলার।”

“এভাবে কাজ হবে না।”

“জানি।”

“আমাকে কিছু টাকা ধার দিন না।”

“সেটা আমার পক্ষে সম্ভব না। তোমাকে যদি ধার দিই, তাহলে সবাইকেই ধার দিতে হবে।”

“তাহলে আপনি কী করতে পারেন?”

“আমি তোমাকে বড়জোর পঞ্চাশটা পেপার মাগনা দিতে পারি। কিন্তু খবরদার কাউকে বলো না।”

“ওকে।”

নিউজপেপার গুলো জড়ো করে সে আমার হাতে তুলে দিলো। সেগুলো আমি বুকের কাছে ধরে রাখলাম। সে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। এরপর আমি বেরিয়ে এলাম।

বিকেল ৫ টা

জাহাজের নোঙ্গর ফেলার জায়গাটায় ফিরে এসে আমি ব্যানব্রিজ আইল্যান্ড টার্মিনালের কাছে দাঁড়ালাম এবং ফেরিতে আসা ব্যবসায়ীদের কাছে পেপারগুলো বিক্রির চেষ্টা করতে লাগলাম।

এক ঘণ্টায় মোটে পাঁচটা বেচতে পারলাম। বাকিগুলো ময়লা ফেলার বাক্সে ফেলে দিয়ে চলে আসলাম ম্যাকডোনাল্ডসে। চারটা চীজবার্গার অর্ডার দিলাম, এক ডলার করে এগুলো। ধীরেসুস্থে সেগুলো শেষ করলাম।

খাওয়া শেষে বাইরে বেরিয়েই বমি করে ফেললাম। খাওয়ার সাথে সাথে বমি হয়ে গেলে মেজাজটা যা লাগে তা বলার মতো না। এলকোহলের কারণে পেটের বারোটা বেজেছে আমার। তারপরও সবসময়ে চেষ্টা করি বেঁচে  থাকার মতো যথেষ্ট খাবার যেন অন্তত পেটে থাকে।

বিকেল ৬টা

পকেটে মাত্র এক ডলার নিয়ে জুনিয়রের কাছে ফিরে এলাম। বেচারা এখনো বেহুঁশ। আমি ওর বুকে কান লাগিয়ে শুনলাম হার্ট বীট পাওয়া যায় কিনা। ছোকরাটা বেঁচে  আছে। কাজেই আমি ওর মোজা খুলে ফেললাম। ওর বাম পায়ের মোজায় পেলাম এক ডলার আর ডান পায়ের মোজায় পেলাম পঞ্চাশ সেন্ট।

যখন আমার বয়স তের, তখন দাদী আমাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার গল্প শোনাতেন। তিনি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে একটা মিলিটারি হসপিটালের নার্স ছিলেন। দুবছর ধরে তিনি অস্ট্রেলিয়ান আর আমেরিকান সৈন্যদের সেবা-শুশ্রূষা করেছেন। একদিন তার কাছে এক আহত মাওরি সৈন্য এলো। যুদ্ধে তার পা উড়ে গিয়েছিলো। সে দেখতে একেবারে ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ। তার ছিল কোঁকড়ানো কালো চুল। তার চোখদুটোও ছিল কালো এবং উষ্ণ। তার মুখ ভর্তি ছিল উল্কি দিয়ে।

“তুমি কি মাওরি?” সে জিজ্ঞেস করেছিল দাদীকে।

“না। আমি স্পোকেইন ইন্ডিয়ান। আমেরিকা থেকে এসেছি।”

“ওহ হো। আমি তোমার গোত্রের গল্প শুনেছি। কিন্তু এই প্রথম কোনো আমেরিকান ইন্ডিয়ানের দেখা পেলাম আমি। ”

“অনেক ইন্ডিয়ান সৈন্য আছে যারা আমেরিকার হয়ে যুদ্ধ করছে,” দাদী বলেছিলেন, ”আমার এক ভাই জার্মানিতে যুদ্ধে আছে। আরেক ভাইকে হারিয়েছি ওকিনাওয়াতে।”

“শুনে খারাপ লাগলো। ওকিনাওয়াতে আমিও ছিলাম। ভয়াবহ অবস্থা।”

“তোমার পায়ের এই অবস্থা দেখে বেশ খারাপ লাগছে”, দাদী বলেছিলেন।

“ব্যাপারটা কেমন মজার না?”

“কোন ব্যাপারটা মজার?”

“এই যে আমরা কালো মানুষেরা একজন আরেকজনকে মারছি যাতে সাদারা বাঁচতে পারে।”

“আমি আসলে এভাবে চিন্তা করে দেখিনি।”

“মাঝে মাঝে আমি এভাবে ভাবি। আর অন্যসময়ে ওরা আমাদের যেভাবে ভাবতে বলে সেভাবেই ভাবার চেষ্টা করি। আমি বিভ্রান্ত হয়ে যাই।”

দাদী তাকে মরফিন দিয়েছিলেন।

“তুমি কি স্বর্গে বিশ্বাস কর?” সে জিজ্ঞেস করলো।

“কোন স্বর্গের কথ বলছো?”

“যেই স্বর্গে আমার পা দুটো আমার জন্য অপেক্ষা করছে।”

তারা হাসলো।

“যখন আমি স্বর্গে যাবো” সে বলছিল, “আমার পা দুটো আমার কাছ থেকে ছুটে পালাবে। ওদেরকে কীভাবে ধরবো বল তো?”

“তোমার হাত দুটোকে অনেক মজবুত করতে হবে,” দাদী বলেছিলেন, ”যাতে তুমি হাত ব্যবহার করেই দৌড়াতে পার।”

তারা আবার হাসতে লাগলো।

জুনিয়রের পাশে বসে দাদীর গল্পগুলো মনে করে আমিও হাসলাম। জুনিয়রের মুখের কাছে হাত দিয়ে দেখলাম সে এখনো শ্বাস নিচ্ছে। কাজেই আমি সর্বসাকুল্যে দুই দলার পঞ্চাশ সেন্ট নিয়ে রওয়ানা দিলাম। এবার গন্তব্য পাইওনিয়ার স্কয়ারের কোরিয়ান মুদির দোকান।

সন্ধ্যা ৭ টা

কোরিয়ান মুদির দোকান থেকে পঞ্চাশ সেন্ট দিয়ে একটা সিগার আর দুই ডলারে দুইটা স্ক্র্যাচ করার লটারি কিনলাম। সর্বোচ্চ পুরস্কার ৫০০ ডলার। যদি দুটো টিকেট-ই জিতি, তাহলে রেগালিয়াটা কেনার মতো পয়সা জোগাড় হয়ে যাবে।

রেজিস্টারে যে মেয়েটা কাজ করে, মেরি, তাকে আমি পছন্দ করি। সে দোকান মালিকের মেয়ে। সারাদিন গান গায় মেয়েটা।

“আমি তোমাকে ভালোবাসি।” তাকে টাকাটা দিতে দিতে বললাম।

“তুমি সবসময়ে এই কথাটাই বলো,” সে জবাব দিলো।

“কারণ আমি সবসময়-ই তোমাকে ভালবাসবো।”

“তুমি আচ্ছা রকমের পাগল।”

“আমি বুড়ো তো কী হয়েছে? এখনো অনেক রোমান্টিক।”

“কিন্তু তুমি মানুষটা আমার জন্য একটু বেশি-ই বুড়ো।”

“আমি জানি। কিন্তু তারপরও স্বপ্ন দেখতে তো কোনো মানা নেই।”

“ঠিক আছে। তোমার স্বপ্নের অংশ হতে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু আমি তোমার হাত ধরবো যদি তুমি কথা দাও যে তুমি আমাকে চুমু খাবে না। কিংবা সেক্স করবে না। স্বপ্নেও না।”

“ঠিক আছে যাও। কথা দিলাম। সেক্স হবে না। শুধু রোমান্স।”

“বিদায় জ্যাকসন জ্যাকসন, আমার সোনাপাখি। আবার দেখা হবে।”

দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম। অক্সিডেন্টাল পার্কের দিকে এগোলাম। একটা বেঞ্চে বসে সিগারটা টানতে লাগলাম।

দশ মিনিট লাগলো ওটা শেষ করতে। তারপর প্রথম লটারিটা ঘষলাম। নাহ, কিছু পেলাম না। বলা যায় না, এখনো পাঁচশ ডলার জেতার চান্স আছে, কিন্তু তাতে আমার চলবে না।

দশ মিনিট পর আর পারলাম না। অন্য লটারিটাও ঘষলাম এবং পুরস্কার হিসেবে পেলাম একটা ফ্রি টিকেট। মন্দের ভাল যাকে বলে।

মেরির সাথে দেখা করার জন্য ফিরে চললাম।

“জ্যাকসন জ্যাকসন ,” সে বলল আমাকে দেখে,” তুমি কি এবার আমার হৃদয় চাইতে এসেছো?”

“আমি একটা ফ্রি টিকেট জিতেছি।” বললাম।

“পুরুষ মানুষ এমন-ই হয়,” সে বলল,” তুমি আমার চাইতে বেশি ভালবাসো টাকা আর ক্ষমতা।”

“সত্যিটাই বলেছো,” আমি বললাম,” দুঃখিত কারণ এটা আসলেই সত্য।”

সে আমাকে আরেকটা টিকেট দিল। টিকেট নিয়ে বাইরে চলে এলাম। মানুষজনের সামনে টিকেট দেখতে আমার ভাল লাগে না।

টিকেটটা ঘষলাম, অনেক আশা আর ভয় নিয়ে। আর এইবার সত্যি সত্যি টাকা পেলাম।

মেরির কাছে ফিরে গেলাম।

“একশ ডলার জিতেছি।”

সে টিকেটটা নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলো। তারপর হাসলো।

“ভাগ্য বটে তোমার।” বিশ ডলারে পাঁচটা নোট গুণতে গুণতে বলল সে। টাকাটা দেওয়ার সময়ে তার হাতে আমার হাতের স্পর্শ লাগলো। এক মুহূর্তে আমার শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো।

“ধন্যবাদ,” বলে তাকে একটা নোট ধরিয়ে দিলাম।

“আমি এটা নিতে পারবো না,” সে বলল,” এটা তোমার টাকা।”

“উঁহু। এটা আমাদের গোত্রের রীতি। তুমি কোনো কিছু জিতলে তা তোমার পরিবারের সাথে শেয়ার করবে।”

“আমি তোমার পরিবারের কেউ নই।”

“তুমি আমার পরিবার।”

সে হাসলো। টাকটা নিলো। পকেটে আশি ডলার নিয়ে, প্রিয়তমা মেরিকে বিদায় জানিয়ে শীতল রাত্রিতে বেরিয়ে পড়লাম।

রাত ৮ টা

খবরটা জুনিয়রের সাথে শেয়ার করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ওকে পেলাম না। পরে জেনেছিলাম, সে গিয়েছিল অরিগনের পোর্টল্যান্ডে এবং ঠাণ্ডায় হিল্টন হোটেলের পেছনে এক গলিতে মারা যায়।

রাত ৯টা

পকেটে আশি ডলার নিয়ে চলে এলাম সাউথ ডাউনটাউনের বিগ হার্টে। এটা একটা অল-ইন্ডিয়ান বার। কেউ ঠিক জানে না, কেন এবং কীভাবে ইন্ডিয়ানরা একটা বারকে অল-ইন্ডিয়ান বার বানিয়ে ফেলে। বিগ হার্ট তেইশ বছর ধরেই এরকম। আগে এটা ছিল অরোরা অ্যাভিনিউতে। কিন্তু এক উন্মাদ লুম্মি ইন্ডিয়ান সেটা পুড়িয়ে ফেলার পর বারটা এখানে নিয়ে আসা হয়েছে।

বিগ হার্ট-এ ঢুকে জনা পনেরো ইন্ডিয়ানের দেখা পেলাম। তাদের মধ্যে সাতজন মহিলা আর বাকিরা পুরুষ। এদের কাউকেই আমি চিনি না। কিন্তু ইন্ডিয়ানরা একে অন্যের নিকটজনের মতো। তাই আমরা ভান করি আমরা সবাই একে অন্যের কাজিন।

“হুইস্কির জন্য কত লাগবে?” বারটেন্ডারের কাছে জানতে চাইলাম।

“কোনটা চাও তুমি? জঘন্য নাকি জঘন্যের চেয়েও জঘন্যটা?”

“যতখানি জঘন্যটা তোমার আছে।”

“এক ডলার এক শটের জন্য।”

বারের উপরে আশি ডলার রাখলাম।

“হুম,” বললাম আমি,”আমি আর আমার কাজিনরা সবাই মিলে আশি শট গিলবো। একেকজনের ভাগে কয়টা পড়ে তাহলে?”

“তোমাকে ধরে প্রত্যেকের জন্য পাঁচটা,” আমার পিছন থেকে এক মহিলা বলল।

তার দিকে ঘুরে তাকালাম। গোলগাল ফ্যাকাসে ইন্ডিয়ান মহিলা। শুকনোমত লম্বা আরেক ইন্ডিয়ানের সাথে বসে আছে।

“অল রাইট ম্যাথ জিনিয়াস,” তার উদ্দেশ্যে বললাম। এরপর চিৎকার করে বারের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম,”প্রত্যেকের জন্য পাঁচটা ড্রিঙ্কস আমার পক্ষ থেকে।”

সব ইন্ডিয়ানরা বারের দিকে ছুটে গেলো। কিন্তু আমি ম্যাথমেটিশিয়ান আর তার শুকনোমতো বন্ধুর পাশে এসে বসলাম। ধীরে সুস্থে হুইস্কি গিলতে লাগলাম।

“তুমি কোন গোত্রের?” জানতে চাইলাম।

“আমি ডুওয়ামিশ,” জবাব দিল সে, “আর সে ক্রো।”

“মন্টানা থেকে অনেক দূরে চলে এসেছো দেখছি,” অন্যজনকে বললাম।

“আমি একজন ক্রো(কাক)। আমি উড়ে উড়ে এখানে চলে এসেছি।”

“তোমার নাম কী?”, জিজ্ঞেস করলাম।

“আমি আইরিন মুজ,”মহিলা উত্তর দিল,”আর ও হানি বয়।”

মহিলা আমার সাথে বেশ জোরের সাথে হ্যান্ডশেক করলো। কিন্তু পুরুষ মানুষটি এমনভাবে তার হাত বাড়িয়ে দিলো যেন আমি চুমু খেতে চাচ্ছি তাতে। অবশ্য তাই করলাম আমি। সে খিলখিল করে হাসতে লাগল এবং চোখ পিটপিট করে উঠলো।

“তাহলে তুমি দুই-দিকেই…?” আমি জানতে চাইলাম।

“মেয়েদের আমি পছন্দ করি। আবার ছেলেদেরকেও।”

“কখনো একই সাথে দুইজনকেই,” আইরিন বলল।

আমরা হাসাহাসি করতে লাগলাম।

“সোনাপাখি,” হানি বয় বলল,”তুমি ঠিক যেভাবে চাও আমাকে সেভাবেই পেতে পারো।”

“হে হে। হানি বয় প্রেমে পড়েছে,” আইরিন বলে উঠলো।

“এর মধ্যে প্রেমে পড়ার কিছু নেই,” সে বললো।

আমরা হাসতে থাকলাম।

“ওয়াও! তুমি আমাকে মুগ্ধ করেছো, হানি বয়। কিন্তু বাপু আমি তোমার সাথে খেলবো না।” বললাম আমি।

“অমনভাবে না বোলো না তো”, হানি বয় বলল।

“তোমাকে সাবধান করে দিই,” আইরিন বলল,”হানি বয় কিন্তু জাদু জানে। তোমাকেও বশ করে ফেলবে।”

“হানি বয়,” বললাম, ”চেষ্টা করতে পারো, কিন্তু আমার হৃদয় যে মেরি নামের এক মেয়েকে দিয়ে দিয়েছি আমি।”

“তোমার মেরি কি এখনো ভার্জিন?” জানতে চাইল হানি বয়।

হাসাহাসি চলতে থাকলো।

হুইস্কি শেষ না হওয়া পর্যন্ত চলতে লাগলো। অন্য ইন্ডিয়ানরা অবশ্য পরে আরও ড্রিঙ্কস অফার করলো আমাকে। এমনকি হানি বয় তার ক্রেডিট কার্ড বের করল আর আমি ড্রিঙ্ক করে গেলাম।

এক ডজন পুরো হবার পর আইরিনকে নাচতে বললাম। সে রাজি হলো না। কিন্তু হানি বয় লাফ দিয়ে জিউকবক্সের দিকে চলে গেলো। একটা কোয়ার্টার ফেলে নতুন একটা গান বাজালো। উইলি নেলসনের “হেল্প মি মেইক ইট থ্রু দ্য নাইট”। আইরিন আর আমি টেবিলে বসে রইলাম। হাসাহাসি আর পাশাপাশি ড্রিংকিং চলতে লাগলো। হানি বয় ধীরে ধীরে ঘুরে নাচতে লাগল আর উইলি নেলসনের সাথে গলা মেলাতে লাগলো।

“তুমি নিশ্চয়ই আমাকে উদ্দেশ্য করে গান গাইছো, তাই না?” ওকে জিজ্ঞেস করলাম।

সে নাচতে নাচতে গাইতে থাকলো।

“আমাকে উদ্দেশ্য করেই গান গাইছো, তাই না?”, আবারো জিজ্ঞেস করলাম।

“সে তোমাকে জাদু করতে যাচ্ছে,” আইরিন বলল।

আমি টেবিলের উপর শুয়ে পড়লাম। মুখ থেকে খানিকটা ড্রিঙ্ক ছিটকে পড়লো।

তারপর আইরিনকে চুমু খেলাম। সেও পালটা চুমু খেল আমাকে।

রাত ১০টা

আইরিন আমাকে লেডিস বাথরুমে ঠেলে নিয়ে গেলো এবং দরজা আটকিয়ে দিল। এবং তার হাত প্রবেশ করল আমার প্যান্টের ভেতরে। সে আমার চাইতে খাটো। তাই তাকে চুমু খাওয়ার জন্য আমার নিচু হতে হল। তাকে ধরে আমি পাগলের মত পিষতে চাইলাম, শরীরের সব জায়গায়। কিন্তু সে অদ্ভুত রকমের মোটা এবং আমার হাত তার শরীরের যেখানেই পৌঁছল, সব জায়গাই মনে হল নরম, উষ্ণ স্তনের মতো।

মাঝরাত

নেশায় চুর হয়ে বারের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি। কসম খেয়ে বলতে পারি একটু আগেও আইরিনের সাথে বাথরুমে দাঁড়িয়ে ছিলাম।

“আর এক গ্লাস দাও,” বারটেন্ডারকে বললাম।

“তোমার কাছে আর টাকা নাই,” সে পালটা জবাব দিল।

“কেউ আমাকে এক গ্লাস কিনে দাও,” আমি চিৎকার করে বললাম।

“ওদের কারো কাছে টাকা নেই।”

“আইরিন আর হানি বয় কোথায়?”

“অনেক আগেই চলে গেছে।”

রাত ২ টা

“এখন বার বন্ধ হয়ে যাবে,” বসে থাকা তিন-চারজন ইন্ডিয়ানের উদ্দেশ্যে বলল বারটেন্ডার।

“আইরিন আর হানি বয় কোথায়?” জানতে চাইলাম।

“তারা অনেক আগেই চলে গেছে।”

“কোথায় গেছে?”

“একশবার বলেছি। আমি জানি না।”

“এখন আমার কী করা উচিত?”

“এখন বন্ধ করার সময় হয়ে গেছে। তুমি কী করবে তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নাই। আপাতত এখান থেকে বের হয়ে গেলেই আমি খুশি হবো।”

“অকৃতজ্ঞ বেজন্মা কোথাকার। তোর সাথে তো আমি খারাপ ব্যবহার করিনি।”

“তুই যদি না বের হোস, তোর পাছায় লাথি মেরে বের করে দিব আমি।”

“সাহস থাকলে আয়। বাপের নাম ভুলিয়ে দেব আজকে তোর।”

সে আমার দিকে এগিয়ে এলো। তারপর কী হলো আমার আর মনে নেই।

রাত ৪টা

নিজেকে হাঁটতে থাকা অবস্থায় আবিষ্কার করলাম একটা বিশাল ওয়্যারহাউজের পিছনে। আমি জানি না আমি কোথায়। সারা মুখে ব্যথা। সম্ভবত নাক ভেঙ্গেছে। বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। শেষমেশ একটা ট্রাকের ভেতরে বিছানা থেকে প্ল্যাস্টিকের চাদর বের করে সেটা গায়ে পেঁচিয়ে মাটিতেই শুয়ে পড়লাম।

ভোর ৬টা 

কেউ একজন আমার পাঁজরে গুঁতা মারলো। চোখ খুললাম এবং একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশকে দেখতে পেলাম।

“জ্যাকসন না?” সে বললো।

“অফিসার উইলিয়ামস,” আমি বললাম। সে একজন ভাল পুলিশ অফিসার। তার আচার-ব্যবহার ভালো। কত ক্যান্ডিবার যে সে আমাকে খাইয়েছে তার হিসেব নেই। সে বোধহয় জানেও না যে আমি ডায়াবেটিসের রোগী।

“তুমি এখানে কী করছো?” সে জিজ্ঞেস করলো।

“আমার শীত করছিলো আর ঘুম পাচ্ছিলো।তাই এখানে শুয়ে পড়লাম।”

“বোকার হদ্দ কোথাকার। তুমি রেললাইনের উপর শুয়ে আছো।”

আমি উঠে বসে চারদিকে তাকালাম। আসলেই আমি রেল লাইনের উপর শুয়ে ছিলাম। ডকে যারা কাজ করছিল তারা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু এদিক-সেদিক  হলেই রেলরোড ট্র্যাক পিজা হয়ে যেতাম।

অসুস্থ লাগছিলো নিজেকে। হেলান দিয়ে বসে হুইস্কিটুকু বমি করে ফেললাম।

“তোমার সমস্যা কী?” অফিসার জিজ্ঞেস করলো,”তুমি তো এমন আহাম্মকি করোনি আগে কখনো।”

“আমার দাদী মারা গেছেন,” বললাম তাকে।

“শুনে খারাপ লাগল। কখন মারা গেছেন?”

“উনিশশো বাহাত্তর সালে।”

“আর সেই দুঃখে তুমি এখন মরতে এসেছো?”

“তার মৃত্যুর পর থেকেই আমি প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছি।”

সে মাথা ঝাঁকালো। আমাকে দেখে তার খারাপ লাগছে। আগেই বলেছিলাম, লোকটা ভাল মানুষ।

“তোমাকে কেউ একজন বেদম পিটিয়েছে,” সে বলল, ”কে এই কাজ করেছে বলো তো?”

“মিঃ গ্রিফের সাথে লেগে গিয়েছিলো আমার।”

“মিঃ গ্রিফ তোমাকে মেরে আস্ত রাখে নাই। ”

“মিঃ গ্রিফ সবসময়ে জেতে আমার সাথে।”

“হুম। চলো আমার সাথে।”

সে আমাকে তার গাড়ীতে উঠতে সাহায্য করলো। আমাকে গাড়ির পেছনে বসালো। “বমি-টমি করলে কিন্তু তোমাকে পরিষ্কার করতে হবে,” সাবধান করে দিলো আমাকে।

“ঠিক আছে।”

সে হেঁটে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসলো। “আমি তোমাকে ডেটক্সে নিয়ে যাচ্ছি,” সে বললো।

“প্লিজ। ওই জায়গাটা একটুও ভাল না। যতসব মাতাল ইন্ডিয়ান দিয়ে ভরা।”

আমরা দুজনেই হাসলাম। সে ডকের দিকে গাড়ি চালিয়ে যেতে লাগলো।

“আমি বুঝি না তোমরা কীভাবে পারো,” বলল সে।

“কী পারি?”

“এই যে তোমরা ইন্ডিয়ানরা। এতো হাসতে পারো তোমরা! আমি এইমাত্র তোমাকে রেল লাইনের উপর থেকে উঠিয়ে নিয়ে এলাম আর এখন তুমি কৌতুক করছো। কীভাবে পারো? ”

“দুনিয়ায় সবচেয়ে মজার মানুষ হল ইহুদী আর ইন্ডিয়ানরা। আমাদের এত হিউমার আসে কোথা থেকে এখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো।”

আবার হাসলাম আমরা।

“জ্যাকসন, তোমার কথা শুনেই বোঝা যায় তুমি অনেক স্মার্ট। তোমার মতো মানুষ রাস্তায় থাকে কেন?”

“আমাকে এক হাজার ডলার দাও। আমি উত্তর দিচ্ছি।”

“তুমি যদি টাকাটা ঠিক রাস্তায় ব্যবহার করবে জানতাম তাহলে সত্যি সত্যি-ই দিতাম।”

সে মন থেকেই বলল কথাটা। মানুষটা আমার দেখা দ্বিতীয় সেরা পুলিশ অফিসার।

“তুমি মানুষটা অনেক ভাল,” বললাম তাকে।

“হয়েছে। আমার আমাকে ফুলাতে হবে না।”

“না সত্যি বলছি। তোমাকে দেখলে আমার দাদার কথা মনে পড়ে।”

“এমন কথা সব ইন্ডিয়ানরাই বলে আমাকে।”

“সেটা নয়। আমার দাদা তার গোত্রের আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে ছিলেন। তিনিও তোমার মতো ছিলেন। তিনি কখনো কাউকে এরেস্ট করেননি।তিনি সবাইকে দেখে-শুনে রাখতেন। ঠিক তোমার মতো।”

“আমি কিন্তু শ’খানেক বদমাশকে এরেস্ট করেছি। কয়েকজনকে গুলিও করেছি।”

“তাতে কিছু আসে যায় না। তুমি আর যাই হোক খুনী নও।”

“আমি ওদের মারি না। শুধু পাকড়াও করি।”

আমরা ডাউনটাউনে চলে এসেছি। ঘুমঘুম চোখে উদ্বাস্তু লোকজন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ধূসর আকাশটা দেখছে। জীবন্মৃত মানুষগুলোর আরেকটা দিন শুরু হলো।

“তোমার ভয় করে না কখনো?” আমি বললাম।

“বুঝলাম না।”

“মানে এই যে পুলিশের দায়িত্ব পালন করাটা। তোমার ভয় হয় না কখনো?”

সে একমূহুর্ত চিন্তা করলো। একদৃষ্টে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। এই ব্যাপারটা বেশ ভাল লাগে আমার।

“আমি আসলে ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামাই না। যত চিন্তা করবে, ভয় ততই তোমাকে জেঁকে ধরবে। আমার কাজটা বেশিরভাগ সময়ে অনেক ক্লান্তিকর। শুধু গাড়ি চালানো আর নজর রাখা সবদিকে এবং কিছুই ঘটতে না দেয়া। কিন্তু মাঝে মাঝে বিষয়টা অন্যরকম। তুমি কাউকে ধাওয়া করছো বা মারামারি করছো অথবা কোনো অন্ধকার বাড়ির চারপাশে ঘুরঘুর করছো, জানো এখানে কেউ ঘাপটি মেরে বসে আছে। এভাবে চিন্তা করলে আসলে ভয় লাগে।”

“আমার দাদা দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই মারা পড়েছিলেন,” আমি বললাম।

“শুনে খারাপ লাগলো। কিভাবে?”

আমি জানি সে আমার গল্প মনোযোগ দিয়ে শুনবে।

“তিনি রিজার্ভেশনে কাজ করতেন। সেখানে সবাই সবাইকে চিনতো। এটা নিরাপদ ছিলো। আমরা তো আর সাইওক্স বা এপাচিদের মতো যোদ্ধা ছিলাম না। গত একশ বছরে আমাদের গোত্রে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ছিল মাত্র তিনটা।”

“তার মানে তোমরা অনেক নিরাপদে ছিলে।”

“হুম। আমরা স্পোকেইনরা কথা দিয়ে কথা রাখি। আমাদের মাঝে বড়জোর খোঁচাখুঁচি হতে পারে। কিন্তু আমরা কাউকে আঘাত করি না। কখনোই না। ”

“তো তোমার দাদার কী হয়েছিলো?”

“লিটল ফলসের কাছে এক লোক তার বান্ধবীর সাথে ঝগড়া করছিলো।”

“হুম, ঘরোয়া ঝামেলা, খুব বাজে জিনিস।”

“হুম। লোকটা ছিল আমার দাদার ভাই, আমার ছোটো দাদা।”

“ওহ-হো।”

“হুম। দাদা ধীরেসুস্থে ঘরে ঢুকেছিলেন। তিনি সেখানে অনেকবার গেছেন। আমার চাচা আর তার বান্ধবী মাতাল হয়ে রীতিমতো মারামারি করছিলো। তিনি তাদেরকে থামানোর চেষ্টা করলেন, যেমনটা আগেও করেছেন। তখন চাচার বান্ধবী কোনো কারণে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন বা ওইরকম কিছু। তার মাথায় ব্যথা লাগলো আর তিনি কাঁদতে লাগলেন। দাদা বসে তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন আর দেখলেন তার কোনো আঘাত লেগেছে কিনা। আর তখন-ই ছোটো দাদা কী এক কারণে খেপে গিয়ে দাদার হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করে সোজা গুলি করলেন তার মাথায়।“

“ভয়াবহ ব্যাপার! শুনে খারাপ লাগলো।”

“হুম। আমার চাচা নিজেও বলতে পারেন না কেন তিনি অমনটা করেছিলেন। তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিলো। তিনি জেল থেকে বিশাল বিশাল চিঠি লিখতেন। একেকটা চিঠি পঞ্চাশ-ষাট পৃষ্ঠার মতো হতো। তিনি লিখতে চাইতেন কেন তিনি অমনটা করলেন। এভাবে লিখেই গেছেন উনি। কিন্তু নিজে কখনোই জানাতে পারেননি গুলি করার কারণটা কী ছিলো। এ এক বিরাট রহস্য।”

“তোমার কি দাদার কথা মনে আছে?”

“অল্প-বিস্তর। তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানের কথা মনে পড়ে। আমার দাদী কিছুতেই তাকে কবর দিতে দিবেন না। শেষমেশ আমার বাবা তাকে জোর করে সরিয়ে নেন।”

“বুঝতে পারছি না কি বলবো।”

“আমিও না।”

আমরা ডেটক্স সেন্টারে এসে থামলাম।

“চলে এসেছি,” অফিসার উইলিয়ামস বললো।

“আমার যেতে ইচ্ছা করে না ভেতরে।”

“তোমাকে যেতেই হবে।”

“প্লিজ। ওরা আমাকে চব্বিশ ঘণ্টা আটকে রাখবে। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যাবে।”

“কীসের দেরি হবে?”

আমি তাকে আমার দাদীর রেগালিয়া আর কেনার সময়সীমার ব্যাপারটা বললাম।

“এটা যদি চুরি হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে তোমাকে রিপোর্ট করতে হবে,” সে বলল,” আমি নিজে তদন্ত করবো। যদি এটা সত্যি-ই তোমার দাদীর হয়ে থাকে, তাহলে আমি এটা আইনসঙ্গতভাবেই তোমাকে ফিরিয়ে দিতে পারবো।”

“না,” আমি বললাম,” সেটা তো ঠিক হবে না। ঐ দোকানমালিক তো আর জানতো না যে ওটা চুরি করা জিনিস। তাছাড়া এটা আমার জন্য একটা চ্যালেঞ্জ। জিতলে আমি হিরো হতে পারবো। আমি এটা যেভাবেই হোক, জিততে চাই।”

“আহ কি রোমান্টিক অথচ উদ্ভট কথাবার্তা!”

“হতে পারে। কিন্তু আমার কাছে বিষয়টার মূল্য আছে। অনেকদিন এমনটা ঘটেনি আমার সাথে।”

অফিসার উইলিয়াম তার গাড়ির সিটে গিয়ে বসল এবং আমার দিকে তাকালো। সে আমাকে পরীক্ষা করে দেখলো।

“আমি তোমাকে কিছু টাকা দেই,” সে বলল,” আমার কাছে বেশি নেই। মাত্র ত্রিশ ডলারের মতো আছে। বেতন না পাওয়া পর্যন্ত আমার হাতে টাকা থাকবে না। জানি রেগালিয়াটা ফেরত পাবার জন্য এটা মোটেও যথেষ্ট না। কিন্তু এই সামান্য কটা টাকা বিশেষ কিছু।”

“ঠিক আছে। আমি নিচ্ছি তোমার টাকা,” বললাম আমি।

“তোমাকে টাকাটা দিচ্ছি কারণ তোমার বিশ্বাসে আমার আস্থা আছে। জানি না আমি কেন আশা করছি, তারপরও আশা করি তুমি কোনোভাবে এই ত্রিশ ডলারকেই এক হাজার ডলারে পরিণত করতে পারবে।”

“আমি জাদুতে বিশ্বাস করি।”

“আর আমি জানি যে তুমি এই টাকাটা মদের পেছনে উড়িয়ে দিবে।”

“তাহলে আমাকে টাকা দিচ্ছো কেন?”

“কারণ আমি বিশ্বাসী। পুলিশ কখনো অবিশ্বাসী বা নাস্তিক হতে পারে না।”

“অবশ্যই পারে।”

“ঠিক আছে। অন্তত আমি তাদের মধ্যে নই।”

সে আমাকে গাড়ি থেকে নামালো। দুটো পাঁচ ডলার আর একটা বিশ ডলারের নোট হাতে তুলে দিলো। তারপর আমার হাত ধরলো।

“নিজের প্রতি খেয়াল রেখো, জ্যাকসন। আর রেললাইন থেকে দূরে থেকো।”

“চেষ্টা করবো।”

সে চলে গেলো। টাকটা নিয়ে, আমি সমুদ্রের দিকে পা বাড়ালাম।

সকাল ৮টা

জাহাজ নোঙ্গর করার জায়গাটাতে এখনো অ্যালিউট ভাইয়েরা বসে আছে।

“তোমাদের জাহাজ কি দেখা গেছে?” ওদের জিজ্ঞেস করলাম।

“অনেক জাহাজ দেখা গেছে,” বড়জন বলল,” কিন্তু কোনোটাই আমাদের নয়।”

আমি তাদের পাশে বসলাম। অনেকক্ষণ আমরা নীরবে বসে রইলাম। বসে থাকতে থাকতে মনে হলো, এভাবে একদিন ফসিল হয়ে যাব।

দাদীর কথা মনে পড়লো। আমি কখনো তাকে রেগালিয়া গায়ে নাচতে দেখিনি। বড় ইচ্ছা ছিল, তাকে পোউওউ এর অনুষ্ঠানে নাচতে দেখার।

“তোমরা কোনো গান জানো?” ওদের জিজ্ঞেস করলাম।

“হ্যাঙ্ক উইলিয়ামসের সব গান আমার মুখস্থ,” বড়জন বলল।

“কোনো ইন্ডিয়ান গান জানো?”

“হ্যাঙ্ক উইলিয়ামস ইন্ডিয়ান।”

“কোনো উপাসনামূলক গান?”

“হ্যাঙ্ক উইলিয়ামসের চেয়ে বড় উপাসক আর নেই।”

“আমি বলতে চাচ্ছি অনুষ্ঠানে গাওয়ার মতো গান। ধর্মীয় টাইপের কিছু। যখন তোমার নিজের বাড়িঘর ছিলো, ছিলো আশা আর ইচ্ছা।”

“তোমার আশা আর ইচ্ছাটাই বা কী?”

“আমি ভাবি যদি আমার দাদী আজ বেঁচে থাকতেন!”

“আমি যত গান জানি তার সবগুলোই এই সব নিয়ে।”

“ঠিক আছে। তাহলে যত গান জানো গাইতে থাকো।”

অ্যালিউট ভাইয়েরা তাদের বিচিত্র গান অদ্ভুত সুন্দর সুরে গাইতে লাগলো। আমি শুনতে লাগলাম। তারা গাইল আমার দাদীকে নিয়ে। তাদের দাদীকে নিয়ে। ফেলে আসা শীত আর তুষারপাতের জন্য তাদের হাহাকার নিয়ে।

আর আমার হাহাকার সবকিছুকে নিয়ে।

সকাল ১০ টা

অ্যালিউটদের শেষ গান শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও আমরা দীর্ঘসময় নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। এই একটা দিকে ইন্ডিয়ানরা ভাল।

“ওটাই কি শেষ গান ছিলো?” জানতে চাইলাম।

“যত গান জানি আমরা, সব-ই গেয়েছি। আর যে কটা বাকি আছে তা শুধু আমাদের জন্য।”

বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা। আমরা ইন্ডিয়ানরা নিজেদের গোপনীয়তা বজায় রাখতে পছন্দ করি। অ্যালিউটরা নিজেদের গোপনীয়তা বজায় রাখতে এত উদগ্রীব যে তারা নিজেদের ইন্ডিয়ান পরিচয়টুকু পর্যন্ত গোপন রাখে।

“তোমাদের কি ক্ষুধা লেগেছে?” জিজ্ঞেস করলাম।

তারা নিজেদের মধ্যে নীরব ভাব বিনিময় করলো।

“খেতে আপত্তি নেই।” বড়জন বলল।

সকাল ১১টা

অ্যালিউটদের সাথে খেতে গেলাম ইন্টারন্যাশনাল ডিসট্রিক্টের বিগ কিচেন-এ। আমি জানতাম, ওরা টাকা-পয়সা সাধলে উদ্বাস্তু ইন্ডিয়ানদের খাওয়াতে আপত্তি করবে না।

“চারজনের জন্য সকালের নাস্তা দেবো?” আমরা ভেতরে ঢুকতেই ওয়েইট্রেস জানতে চাইলো।

“হুম। আমাদের অনেক ক্ষিধে পেয়েছে।”

সে আমাদের রান্নাঘরের কাছাকাছি একটা বুথে নিয়ে এলো। রান্নার খাবারে গন্ধ নাকে এলো। আমার পেটের ভেতর গুড়গুড় করে উঠলো।

“চারজনের বিল কি আলাদা?” ওয়েট্রেস জিজ্ঞেস করলো।

“উঁহু। আমি বিল দিচ্ছি,” আমি বললাম।

“তুমি-ই কি আমার দেখা সবচাইতে উদার মনের মানুষ?” ওয়েট্রেস প্রশ্ন ছুঁড়লো।

“এমন কোরো না,” আমি বললাম।

“কেমন করবো না?”

“এই যে এমন প্রশ্ন কোরো না যার উত্তর নেই। আমি এই ধরণের প্রশ্নগুলোকে ভয় পাই।”

দেখে মনে হলো সে অবাক হয়েছে। তারপর-ই সে হাসতে শুরু করলো।

“ঠিক আছে প্রফেসর। এর পর থেকে আমি তোমাকে সত্যিকারের প্রশ্নই করবো।”

“ধন্যবাদ।”

“তো তোমরা কী খেতে চাও?”

“আহ, এর চেয়ে ভাল প্রশ্ন আর হয় না,” আমি বললাম,”তোমাদের এখানে কী কী আছে?”

“তোমাদের মোট কত টাকা আছে?”

“আরেকটা সুন্দর প্রশ্ন,” আমি বললাম, “আমার কাছে পঁচিশ ডলার আছে ব্যয় করার মতো। এই টাকায় যতখানি নাস্তা সম্ভব নিয়ে আসো। তাছাড়া তোমার বখশিশের টাকাও এর মধ্যে।”

মেয়েটা হিসেব করে ফেলল।

“ঠিক আছে। তাহলে চারটা স্পেশাল আর চারটা কফি। আর আমার বখশিশ পনেরো পার্সেন্ট।”

আমরা চারজন নীরবে অপেক্ষা করলাম। খানিক বাদেই ওয়েট্রেস ফিরে এলো চারটা কফি নিয়ে। সেটা শেষ করার পরপর-ই সে আবার ফিরে এলো চার প্লেট নাস্তা নিয়ে। ডিম, বেকন, টোস্ট, আলু ভাজি। এতো অল্প টাকায় এতো খাবার হতে পারে এটা অবাক করা ব্যাপার।

অনেক তৃপ্তি করে খেলাম আমরা।

দুপুরবেলা

অ্যালিউটদের বিদায় জানিয়ে সুদের কারবারের দোকানে চলে এলাম। পরে জেনেছিলাম, অ্যালিউটরা ৪৭ নাম্বার ডকের কাছাকাছি কোথাও নোনাপানিতে নেমে গিয়েছিলো। আর কখনো ফিরে আসেনি। কিছু ইন্ডিয়ান অবশ্য বলে তারা তাদের পানির উপর দিয়ে উত্তরের দিকে হেঁটে যেতে দেখেছে। অন্যরা বলে ওরা ডুবে গেছে। আমি জানি না আসলে কী ঘটেছে ওদের ভাগ্যে।

আমি দোকানটা খোঁজার চেষ্টা করলাম কিন্তু পেলাম না। আমি নিশ্চিত এটা আগের জায়গায় নেই। দোকানটার খোঁজে আমি বিশ-ত্রিশ ব্লক হাঁটলাম । প্রত্যেকটা কর্নারে খুঁজে দেখলাম। এমনকি ফোন বুকেও নাম্বার খুঁজে দেখলাম। মানুষকে জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু দোকানটা মনে হয় কর্পূরের মতো উবে গেছে। মনে হল চিৎকার করে কাঁদি। ঠিক যখন আমি হাল ছেড়ে দিলাম, ঠিক তখন-ই ওটা চোখে পড়ল। এমন একটা জায়গায়, আমি কসম খেয়ে বলতে পারি মিনিটখানেক আগেও ওটা ওখানে ছিল না।

আমি দোকানের  ভিতরে ঢুকলাম আর মালিকের সাথে দেখা হলো। মালিককে আগের চেয়ে খানিকটা অল্পবয়স্ক মনে হল।

“ফিরে এসেছো তাহলে,” সে বলল।

“হুম, ফিরে এলাম।”

“জ্যাকসন জ্যাকসন। ”

“নাম মনে আছে দেখছি।”

“তোমার বন্ধুরা কোথায়?”

“তারা আমাকে রেখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ব্যাপার না। ইন্ডিয়ানরা সব জায়গাতেই আছে।”

“টাকাটা জোগাড় হয়েছে?”

“তোমার জানি কত টাকা লাগবে?” জিজ্ঞেস করলাম এই আশায় যে সে বোধ হয় এবার দামটা একটু কমিয়ে বলবে।

“নয়শো নিরানব্বই ডলার।”

দাম বদলায়নি। স্বাভাবিক। বদলাবেই বা কেন?

“আমার অত টাকা নেই,” বললাম।

“তোমার কত টাকা আছে?”

“পাঁচ ডলার।”

দুমড়ানো পাঁচ ডলারের নোটটা কাউন্টারের উপর রাখলাম। সে মনোযোগ দিয়ে দেখল এটা।

“এটা কি সেই কালকের পাঁচ ডলারের নোটটাই?”

“না। এটা আলাদা।”

সে কি একটা ভাবল।

“তুমি কি এই টাকাটা উপার্জন করতে পরিশ্রম করেছ?”

“হ্যাঁ,” উত্তর দিলাম।

সে চোখ বন্ধ করে অনেক কিছু চিন্তা করলো। তারপর সে পিছনের রুমে গেলো এবং দাদীর রেগালিয়াটা নিয়ে ফেরত এলো।

“নাও এটা।” আমার দিকে বাড়িয়ে দিল ওটা।

“আমার তো টাকা নেই।”

“তোমার টাকা দিতে হবে না।”

“কিন্তু আমি তো এটা টাকা দিয়েই জিতে নিতে চেয়েছিলাম।”

“তুমি এটা জিতেই নিয়েছো। এখন আমার মত পাল্টানোর আগেই এটা নিয়ে ভাগো।”

পৃথিবীতে ভাল মানুষ আছে কতজন? নিশ্চয়ই গুণে শেষ করা যাবে না!

আমি দাদীর রেগালিয়াটা নিয়ে বাইরে হাঁটতে লাগলাম। আমি জানি, ঐ সোনালি গুটিটা আসলে আমার ভিতরেও আছে। কিংবা সেই খুঁতওয়ালা সোনালি গুটিটাই আসলে আমি। রেগালিয়াটা শরীরে জড়িয়ে আমার দাদীকে অনুভব করলাম। সেই অবস্থায় রাস্তায় হাঁটতে লাগলাম।

পথচারীরা আমাকে দেখে থমকে দাঁড়ালো।

গাড়িগুলো আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো।

শহরটা আমাকে দেখে স্থবির হয়ে গেলো।

তারা সবাই দেখলো আমাকে। আমি আমার দাদীর সাথে নাচছি।

আমি-ই ছিলাম আমার দাদী। তিনি-ই নেচে যাচ্ছেন।

উৎস ঃ http://onubadokderadda.com/what-you-pawn-i-will-redeem/

বিজ্ঞানের হওয়া বদলের এক মহানায়ক আমাদের আইনস্টাইন


বিশ শতকের একেবারে শুরুতে দুটি নতুন তত্ত্ব দুনিয়া (Universe) সম্পর্কে আমাদের জানাশোনাকে একেবারেই পরিবর্তিত করে ফেলে। তত্ত্বের ঠেলায় এমনকি বদলে যায় বাস্তবতার সংজ্ঞাও। সে থেকে প্রায় এক শতাব্দী পরেও আমরা সেই দুই তত্ত্বের ভেতরের খবর আরো বিশদভাবে যেমন জানতে চাই, তেমনি চাই ওই দুই তত্ত্বকে এক সুতোয় বাঁধতে। ছাদনাতলায় নিয়ে গিয়ে তাদের গাঁটছড়া বেঁধে দিতে। এ দুই তত্ত্ব হলো আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব (জেনারেল থিউরি অব রিলেটিভিট) আর কোয়ান্টাম বলবিদ্যা (কোয়ান্টাম মেকানিক্স)।

বস্তুজগতের বড় স্কেলের কারবারে সাধারণ আপেক্ষিকতার বাহাদুরি। স্থান ও সময়ের আচরণ এবং বস্তুর কারণে স্থানকালের বেঁকে যাওয়া এ তত্ত্বের আসল কথা। অপরদিকে বস্তুর ভেতরের যে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগৎ, তার রাজাধিরাজ হলো কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। এ কোয়ান্টাম বলবিদ্যায় রয়েছে অনিশ্চয়তার নীতি (আনসার্টেনিটি প্রিন্সিপল)। এ নীতি বলছে একটি বস্তুকণার অবস্থান ও ভরবেগ যুগপৎ সঠিকভাবে মাপা যায় না; একটিকে যত নিখুঁতভাবে মাপবেন, অন্যটির সঠিকত্ব ততই কমে যাবে! ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু জগতে সবসময় অনিশ্চয়তা বা সম্ভাবনা থেকেই যাবে। অনিশ্চয়তার এ মৌলিক প্রভাব থেকে বস্তুজগতের কোনো মুক্তি নেই।
আইনস্টাইন বলতে গেলে একাই সাধারণ আপেক্ষিকতা সংজ্ঞায়িত ও তাকে তত্ত্বে পরিণত করেছেন। আবার আইনস্টাইন অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ অবদান রেখেছেন কোয়ান্টাম বলবিদ্যার উন্নয়নে। কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যা সম্পর্কে তার ধারণাকে একবাক্যে প্রকাশ করা যায় এভাবে— ‘ঈশ্বর পাশা খেলেন না’। কিন্তু সব তথ্যপ্রমাণ বলছে ঈশ্বর একজন সেটি ভালই খেলেন এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি পাশা ছুড়ে থাকেন!

ঈশ্বরের পাশা খেলার বিষয়ে আইনস্টাইনের আপত্তি তাঁর জীবনধারা থেকে আঁচ করা যায়। আইনস্টাইন বেহালা বাজাতেন, সুরের জগতের মানুষ। ভাবতেন সবকিছু হবে নিয়মমাফিক। এতাল বেতালের জায়গা নয় এই দুনিয়া। সাধারণ তত্বের আগে, আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বের সময় আইনস্টাইনের চিন্তার জগৎ ছিল সে সময়ের সবার চেয়ে আলাদা, বলা ভাল – একজন থাকে সবার চেয়ে এগিয়ে। আইনস্টাইন ছিলেন সেরকম। আর একটি বড় কারণ হয়তো ঐ সময় আইনস্টাইনের কোন সুপারভাইজার ছিলেন না। ফলে কেহ থাকে বলেনি যে, তোমার চিন্তাটা ঠিক না। ফলে তিনি একা একা নতুন চিন্তা করতে পেরেছেন। আর সবচেয়ে বড় কথা সেসময় আইনস্টাইন বিশের ঘরের যুবক। পরে যখন তিনি সাধারণ তত্ত্ব নিয়ে কাজ করেন, তখনো তার আত্মবিশ্বাস অটুট ছিল। মনে আছে? ১৯১৯ সালে এডিংটন ব্রাজিল থেকে সূর্যগ্রহণ দেখে নিশ্চিত হোন সাধারণ তত্বের ব্যাপারে। তখন এক সাংবাদিক আইনস্টাইনের কাছে জানতে চান যদি পরীক্ষার ফলাফল তাঁর অনুকুলে না আসতো তাহলে তিনি কী করতেন?
জবাবে আইনস্টাইন বলেছিলেন তিনি ঈশ্বরের জন্য দু:খবোধ করতেন!

এই আইনস্টাইনই কিন্তু কোয়ান্টাম তত্ত্বের সঙ্গে যখন আপেক্ষিকতার মেলবন্ধন করতে গেলেন তখন কিন্তু এই সাহসটা আর রাখতে পারলেন না। একটা বড় কারণ, তিনি ততদিনে পরিণত হয়েছেন, বৃদ্ধ হয়েছেন, নতুন কোন কিছু মেনে নেওযার সাহস হারিয়েছেন। তবে এটিই একমাত্র কারণ নয়।

hqdefault-300x225

যখন কেউ এ দুই তত্ত্বকে মেলাতে যান তখন একটা কেমন যেন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। একদিকে দেখা যায়, দেড় হাজার কোটি বছর আগে সময়ের নিজের সূচনা। আবার কোনো কোনো গবেষণায় মনে হয় এ দুনিয়ার কোনো শুরু বা শেষ নেই!

আপেক্ষিকতা দিয়ে শুরু করা যাক। বাংলাদেশের আইনকানুন (এবং বেআইন) কেবল বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মনীতি সব জায়গার জন্যই প্রযোজ্য। এমনকি সূর্য ও অ্যান্ডোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জে এর ব্যতিক্রম হয় না। শুধু তাই নয়, নিয়মগুলো আমার আপনার গতির সঙ্গে সম্পর্কহীন। অর্থাৎ জেট প্লেনে যা, মাটিতেও তাই।
গতির এ প্রভাবহীনতা প্রথম আবিষ্কার করেন গ্যালিলিও। গ্যালিলিও প্রথমে খুঁজে পান কামানের গোলা কিংবা গ্রহগুলোর গতির সূত্র। কিন্তু মুশকিল দেখা গেল যখন মানুষ গতির এ প্রভাবহীনতা আলোর গতির বেলায় প্রয়োগ করতে গেল। আঠারো শতকেই জানা হয়েছে যে, আলো এক লহমায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যায় না, এরও নির্দিষ্ট গতি রয়েছে— সেকেন্ডে ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল। তাহলে এ গতি কার সাপেক্ষে? কাজেই, ধারণা করা হলো দুনিয়াজুড়ে রয়েছে একটি বিশেষ মাধ্যম— ইথার। মানে হলো, ইথারে আলোর গতি ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল। কেউ যদি ইথারের সাপেক্ষে স্থির থাকে তাহলে সে আলোর এই গতি দেখবে। কিন্তু ইথারের সাপেক্ষে চলমান কেউ আলোর ভিন্ন গতি দেখবে। কিন্তু ১৮৮৭ সালে মাইকেলসন-মর্লি অত্যন্ত সূক্ষ্ম এক পরীক্ষা করে দেখালেন আলোর গতি দর্শকের গতির ওপর মোটেই নির্ভরশীল নয়। এটি ধ্রুবক। নিশ্চিতভাবে ধ্রুবক!!!
এটা কীভাবে সম্ভব? কীভাবে বিভিন্ন গতিতে চলমান দর্শকের কাছে আলোর একই গতি হবে? উত্তর হচ্ছে— না এটি সম্ভব নয়, যদি আমরা স্থান ও কালের প্রচলিত ধারণায় থাকি। ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন তার একটি লেখায় দেখালেন এ বিষয় সত্য হতে পারে, কেবল যদি আমরা সময়ের চিরন্তন ও সনাতনী ধারণাকে ত্যাগ করি। তার বদলে প্রত্যেক দর্শকের নিজের আলাদা সময় থাকবে, নিজ নিজ ঘড়ি অনুযায়ী। তবে তাদের ঘড়ি প্রায় একই সময় দেখাবে যদি পরস্পরের সাপেক্ষে তাদের গতি হয় শ্লথ, ধীর। কিন্তু দুই ঘড়ির সময় তাত্পর্যপূর্ণভাবে পার্থক্য দেখাবে যদি তাদের গতির মধ্যে বিস্তর ফারাক থাকে। বাণিজ্যিক বিমানে করে যদি আপনি পৃথিবীর চারপাশে ৪০ কোটিবার ঘুরে আসতে পারেন তাহলে আপনি ১ সেকেন্ড আয়ু বাড়াতে পারবেন। অবশ্য, ততদিন বিমানের খাওয়ায় আপনার আয়ু অনেক বেশি কমে যাবে!
১৯০৫ সালে আপেক্ষিকতার প্রথম নিবন্ধ, যাকে আমরা এখন আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব বলছি, প্রকাশ পায়। তাতে তিনি বিভিন্ন গতির বস্তুর জন্য জগতের নিয়মকানুন ব্যাখ্যা করেন। বললেন, সময় স্থান নিরপেক্ষ কোনো ব্যাপার নয়। বরং ভবিষ্যৎ আর অতীত হলো বাম-ডান, সামনে-পেছন বা ওপর-নিচের মতো দিকের ব্যাপার, যা বিদ্যমান স্থান-কালের মধ্যে। তবে, আপনি কেবল ভবিষ্যতের দিকে যেতে পারবেন, অতীতে নয়।

এভাবে আপেক্ষিকতায় বিশেষ তত্ত্ব স্থান ও কালকে একীভূত করল। কিন্তু তারপরও স্থান-কাল রয়ে গেল ঘটনার স্থির প্রেক্ষাপট হিসেবে। আপনি স্থান-কালের মধ্যে বিভিন্ন পথ বেছে নিতে পারেন, কিন্তু খোদ স্থান-কালকে পরিবর্তন করতে পারেন না। কিন্তু ১৯১৫ সালে আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বে আইনস্টাইন এসবই পাল্টে দিলেন। বললেন, স্থান-কালের মধ্যে কাজ করে মহাকর্ষ আসলে কোনো বল নয়, বরং এ হলো স্থান-কালের বক্রতা, ভর ও শক্তির কারণে এটি হয়। গ্রহ কিংবা কামানের গোলা আসলে সোজা-সরল পথে চলতে চায়, কিন্তু পারে না। কারণ তাদের যাত্রাপথটাই বাঁকা। পৃথিবী সোজাই চলত কিন্তু সূর্যের কারণে স্থান-কাল বেঁকে যাওয়ায় বেচারা সূর্যের প্রেমে পড়ে গেছে। একইভাবে সূর্যের পাশ দিয়ে আসার সময় আলোকরশ্মিও বেঁকে যাবে, ওই বক্রতার কারণেই। ১৯১৯ সালে পূর্ণ সূর্যগ্রহণের সময় এ বিষয়টি নিশ্চিতভাবেই প্রমাণিত হয়ে যায়।

এটি ছিল আইনস্টাইনের এক মহান বিজয়!
তার আবিষ্কার স্থান ও কাল সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে একেবারেই পাল্টে দিল। ঘটনার নিষ্ক্রিয় প্রেক্ষাপট হিসেবে স্থান-কাল কি না একেবারেই অক্কা পেল; বরং তারাও হয়ে উঠল সক্রিয় অংশগ্রহণকারী— ঘটনা ঘটাতে কিংবা ঘটনার প্রভাবে পরিবর্তিত হতে!
ভর ও শক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো দুটিই ধনাত্মক। এ জন্যই মহাকর্ষ কেবল আকর্ষণ করে, বিকর্ষণ করে না। [পাদটীকা— অর্থাৎ মহাকর্ষ আসলে ছোট প্রেম, বড় প্রেম নয়!] সাধারণ আপেক্ষিকতায় এর একটি প্রভাব আমাদের একেবারে হতচকিত করে দিতে পারে। ভর যদি সব সময় ধনাত্মক হয় তাহলে স্থান-কাল নিজের দিকে বেঁকে যেতে পারে, পৃথিবীর উপরি ভাগের মতো। যদি তা ঋণাত্মক হতো তাহলে তা ঘোড়ার লাগামের মতো ছড়িয়ে যেত।
সে সময় ধারণা করা হতো, দুনিয়া স্থির। ফলে নিজের তত্ত্ব নিয়ে আইনস্টাইন নিজেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যান। আইনস্টাইনের তত্ত্বে বোঝা যাচ্ছিল যে, দুনিয়া হয় সম্প্রসারিত হচ্ছে নতুবা সঙ্কুচিত হচ্ছে! তা কী করে হবে? কাজেই আইনস্টাইন সমীকরণে মহাকর্ষবিরোধী একটা কসমোলজিক্যাল ধ্রুবক বসিয়ে দিলেন, যেন বা এতে দুনিয়া স্থির হয়ে যাবে! (এই সময় আইনস্টানের বয়স কতো?)
তা, এই ধ্রুবক নিয়ে দুনিয়ার বাড়া-কমার কোনো সমস্যা হতো না। তবে সবাই ওই ধ্রুবককে মেনে নিয়েছিলেন সেই ১৯২৯ সাল পর্যন্ত। ১৯২৯ সালে এডউইন হাবল জেনে ফেললেন, সমীকরণে আইনস্টাইন যা খুশি তাই করুক, দুনিয়া আসলেই প্রসারিত হচ্ছে। পরবর্তী সময়ে আইনস্টাইন কসমোলজিক্যাল ধ্রুবককে তার জীবনের ‘মহা ভুল’ বলেছিলেন।
কিন্তু কসমোলজিক্যাল ধ্রুবক থাক বা না থাকুক স্থান-কালের বক্রতা কিন্তু একটা অসস্তি বজায় রাখল। কারণ, এমনভাবে স্থান-কাল বেঁকে যেতে পারে যে, স্থান-কালের কোনো অংশ ওই অংশের থেকে নিজেকে পৃথক করে ফেলতে পারে। সৃষ্টি হতে পারে কৃষ্ণবিবর— ব্ল্যাকহোল। ব্ল্যাকহোল থেকে কোনো বস্তুকে বের হতে হলে তাকে আলোর চেয়ে দ্রুতগতিতে ছুটতে হবে। কাজেই, ব্ল্যাকহোলের ভেতরে বস্তুর আরো ভাঙন হবে, যা আমরা জানতে পারব না।

albert-einstein-planck-1-300x218

আইনস্টাইন বস্তুর এই সঙ্কোচন মেনে নিতে পারেননি। মনে করতেন এটা সম্ভব নয়। কিন্তু ১৯৩৯ সালে ওপেন হাইমার প্রমাণ করে ফেললেন যে, এটা সম্ভব। তবে ওই সময়ে বাইরের দুনিয়ার চেয়ে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বিষয়-আশয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ১৯৬০ সালের দিকে আবার মহাকাশে আমরা ফিরলাম আর আশ্চর্য হয়ে দেখতে থাকলাম আইনস্টাইনের তত্ত্বের মহিমা। সে সময় স্টিফেন হকিং আর রজার পেনরোজ মিলে দেখালেন সিংগুলারিটি থেকে স্থান-কালের শুরু অথবা শেষ। বিগব্যাং থেকে সূচনা আর ব্ল্যাকহোলে গিয়ে সমাপ্তি। কিন্তু সিংগুলারিটিতে গেলেই সাধারণ আপেক্ষিকতা হার মেনে যায়। অর্থাৎ তখন বোঝা যায়, এটি পূর্ণাঙ্গ তত্ত্ব নয়, ওর বাড়তি কিছু দরকার।

এই বাড়তিটাই হলো, অনেকে বলেন, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। ১৯০০ সালে ম্যাক্স প্ল্যাঙ্কের হাতে যার সূচনা। আর ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন আলোর তড়িৎক্রয়া ব্যাখ্যা করে কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে একটি সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দেন। এই কাজের জন্যই তিনি নোবেল পুরস্কার পান ১৯২২ সালে। (আপেক্ষিকতা ল্যাবরেটরীতে প্রমাণ করা যায় না। গণিতাবিদরা যাতে নোবেল পেতে না পারে সেজন্য ‘ল্যাবরেটরী’ তত্ত্ব নোবেল পুরস্কারের অংশ!) অনিশ্চয়তা তত্ত্বের বেলায় কোয়ান্টাম তত্ত্বের যে ধারণাটি প্রকাশ সেটি আইনস্টাইনের ওই কাজেরই ফসল। অনিশ্চয়তার নীতির বেলায় আইনস্টাইন বেঁকে বসলেন। বললেন, কোয়ান্টাম তত্ত্ব অসম্পূর্ণ। কিন্তু যত দিন গেল দেখা গেল কোয়ান্টাম বলবিদ্যাই ঠিক। আইনস্টাইন নন।১৯৭৩ সালে ব্ল্যাকহোলের আশপাশে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা প্রয়োগ করে হকিং বললেন ব্ল্যাকহোল আসলে ব্ল্যাক নয়। এ থেকে বের হয়ে আসে কণাস্রোত।

heisenberg_uncertainty_principleআইনস্টাইনের সঙ্গে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বা অনিশ্চয়তার তত্ত্বের বিরোধের মূল কারণ, ততদিনে আইনস্টাইন বুড়ো হয়েছেন। তিনি প্রচলিত ধারণা, যেকোনো ঘটনার একটিমাত্র ইতিহাস থাকে, এটি মেনে নিতে চাচ্ছিলেন। এ জন্য ফাইনম্যানের দেখানো সামওভার হিস্ট্রির ব্যাপারটা তার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না।

এখন আমরা বুঝি, আইনস্টাইনের যত আপত্তি থাকুক কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এবং অনশ্চিয়তা নীতিকে বাদ দিয়ে কোনো একীভূত তত্ত্ব পাওয়া যাবে না। নানা দেশের বিজ্ঞানীরা নানাভাবে ওই একীভূত তত্ত্বের তালাশ করছেন। একদিন পেয়েও যাবেন।

তবে শেষ পর্যন্ত আইনস্টাইন তাদের সঙ্গেই থাকবেন। কারণ, বিশ শতকের সেরা দুই তত্ত্বে আইনস্টাইনের অবদান তাবৎ মানবকুলের চেয়ে বেশি।

 

Friday, June 1, 2018

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়'এর গল্প : "গন্ধরাজ"





রেলাইন ছাড়িয়ে কতদূরে ময়ূরাক্ষী ? আরও কত দূরে ?

কাঁকর-ছড়ানো মাটি। অসুর-মুণ্ডের মতো ছোট-বড় টিবি ছড়িয়ে আছে আচক্রবাল। যেন প্রাগৈতিহাসিক কোনও এক রণক্ষেত্রের স্মরণ-চিহ্ন এই মাঠ। কোনও কোনও টিবির ওপরে লক্ষ্মীছাড়া চেহারার এক আধটা খেজুর গাছ দাঁড়িয়ে আছে ত্ৰিভঙ্গ ভঙ্গিতে। হাঁপানি রোগীর গলায় অতিকায় মাদুলির মতো এক একটা হাঁড়ি ঝুলছে কোনও-কোনটাতে। রুক্ষ মাটির যা শ্রী--এক ফোঁটাও রস গড়ায় বলে মনে হয় না।


ক্যানভাসার শ্রীসুধাংশু চক্রবর্তী, হাল সাকিন বারোর সাত ছকু খানসামা লেন, জিলা--কলিকাতা--একবার থমকে দাঁড়াল। এ জেলায় এই তার প্রথম আবির্ভাব। শুনেছিল ময়ূরাক্ষী পার হয়ে--একটা শাল-পলাশের বন ছাড়ালেই ব্রজপুর গ্রাম। ময়ূরাক্ষী নদী, শাল-পলাশের বন, গ্রামের নাম ব্রজপুর। তিনটে একসঙ্গে মিলে মনের মধ্যে একটা কল্পলোক গড়ে উঠেছিল দস্তুর মতো। সুধাংশু চক্রবর্তী কল্পনাতে আরও খানিক জুড়ে নিয়েছিল এদের সঙ্গে সঙ্গে। হোক শীতকাল, থাকুক চারদিকে শস্যহীন মৃত্যুপাণ্ডুতা--তবু ব্রজপুর এদের চাইতে অনেকখানি আলাদাই হবে নিশ্চয়। তার গাছে গাছ কোকিল ডাকতে থাকবে, ফুলের গন্ধ বয়ে বেড়াবে বাতাস, তার মাঠে মাঠে শ্যামলী ইত্যাদি ধেনুরা চরে বেড়াবে। বেণু বাজবে এবং সন্ধে হলেই শ্বেতচন্দন ঘষা একখানি পাটার মতো পূর্ণচাঁদ উঠে আসবে আকাশে।

কিন্তু কোথায় কী!

আপাতত মাঠ আর মাঠ। দেড় বছরের পুরনো জুতোটা নতুন জুতোর মতো মচ্‌ মচ্‌ আওয়াজ করছে তলার কঠিন কাঁকরে। এদিকে কি ডালভাঙ্গা ক্রোশ ? তিন মাইল পথ যে আর ফুরোয় না।

সামনেই ছোট খাল একটা। রাস্তাটা তার মধ্যে গিয়ে নেমে পড়েছে অনেকখানি ঢালুতে। হোক মরা খাল--তবু তো এতক্ষণে জলের দেখা পাওয়া গেল। মনে হচ্ছিল, সে বুঝি বোখারা-সমরখন্দের কোনও মরুভূমির ভেতর দিয়ে পথ হাঁটছে।

একটা গরুর গাড়ি ছপ্‌ছপিয়ে উঠে এল খাল পেরিয়ে। চাকা থেকে তরল কাদা গলে গলে পড়ছে তার। গাড়োয়ান সাঁওতাল। খোলা ছাঁইয়ের ভেতরে রুপোর হাঁসুলিপরা একটি কালো মেয়ে বসে আছে--নিবিড় চোখের স্নিগ্ধ দৃষ্টি মেলে সে তাকাল সুধাংশুর দিকে। এক ফালি জলের সঙ্গে একটি তরল দৃষ্টি যেন সুধাংশুর সারা শরীরটাকে জুড়িয়ে দিলে।

-ভাই, ময়ূরাক্ষী কতদূর ?

গাড়ির ভেতরে মেয়েটি হেসে উঠল। গাড়োয়ান আপাদ-মস্তক লক্ষ করে দেখল সুধাংশুর। বিদেশী।

বললে, এটাই তো ময়ূরাক্ষী নদী।

--অ্যাঁ! এই নদী ।

কয়েক বছর আগে যে সুধাংশু চক্রবর্তী বাস করত মেঘনা নদীর ধারে এবং অধুনা বাস্তুহারা হয়ে সে বারোর সাত ছকু খানসামা লেনে বাসা বেঁধেছে, তার পক্ষে এটা শোনবার মতো খবর বটে! নদী এর নাম! এবং কাব্য করে একেই বলা হয় ময়ূরাক্ষী ।

কিন্তু বিস্ময়টা ঘোষণা করে শোনাবার মতো কাছাকাছি কেউ ছিল না। গরুর গাড়িটা ততক্ষণে বাঁধের মতো উচু রাস্তাটার ওপরে উঠে গেছে--শুধু খোলা ছইয়ের মধ্য থেকে দেখা যাচ্ছে সাঁওতাল মেয়েটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে এখনও।

আপাতত নদী পার হতে হচ্ছে তা হলে।

খেয়া পাড়ি দেবার সমস্যা নেই--সীতারও দিতে হবেনা। এক হাতে জুতো, আর এক হাতে হাঁটু পর্যন্ত কাপড় তুলে ধরলেই চলবে। সুধাংশুও তাই করল। পায়ের তলায় কিছু দলিত শ্যাওলা, ভাঙা ঝিনুকের টুকরো আর এঁটেল কাদা অতিক্রম করে সে ওপারে পৌঁছল। জুতোটা একরকম করে পরা গেল বটে, তবে পায়ের গোড়ালিতে আঠার মতো চটচট করতে লাগল।

নদী তো মিটল। এবারে শাল-পলাশের বন ?

সেও কাছাকাছিই ছিল, কিন্তু এর নাম বন? গোটা কয়েক মাঝারি ধরনের গাছ দাঁড়িয়ে আছে জড়াজড়ি করে। সুসঙ্গের পাহাড়ে-দেখা নিবিড় মেঘবর্ণ অরণ্য স্বপ্নের মতো ভেসে গেল চোখের সামনে দিয়ে। এটা পার হলেই ব্রজপুর। সুধাংশুর কল্পনা ফিকে হতে শুরু করেছে।

ব্রজধামই বটে, তবে শ্রীকৃষ্ণ মথুরায় চলে যাওয়ার পরে।

লালমাটির দেওয়াল--কিংবা টিনের চাল। খান দুই নোনা ধরা দালান। একটা প্রকাণ্ড বটগাছের চারিদিকে অজস্র পোড়ামাটির ছোট ছোট ঘোড়া। ও জিনিসটা সুধাংশু আগেই চিনেছে--ধর্মঠাকুরের ঘোড়া এগুলো |

কিন্তু ঘোড়া জ্যান্তই হোক আর মাটিরই হোক সে কখনও কথা কয় না এবং যুগের মাহাত্ম্যে ধর্মঠাকুর সম্প্রতি নির্বাক। পতিতপাবনী এম ই স্কুলের হেড়মাস্টার নিশাকর সামন্তের হদিশটা পাওয়া যাবে কার কাছ থেকে? কাছাকাছি কাউকেই তো দেখা যাচ্ছে না। দুপুরের রোদে গ্রামটা ঘুমিয়ে আছে যেন ।

আরও দু পা এগোতেই একটি ছোট দোকান।

তোলা উনুনে খোলা চাপিয়ে একটি লোক খাই ভাঁজছে। বাঁশের খুন্তি দিয়ে নাড়ছে। গরম বালি। পট্‌-পট্ করে ধান ফুটছে--মল্লিকা ফুলের মতো শুভ্র খইয়ের দল খোলা থেকে ছিটকে ছিটকে পড়ছে চারপাশে।

সুধাংশু তাকেই নিবেদন করল প্রশ্নটা।

—স্কুল ?—দু তিনটে বিদ্রোহী খইয়ের আঘাতে মুখখানাকে বিকৃত করে লোকটা বললে, এগিয়ে যান সামনে। লাল রঙের বাড়ি। ওপরে টিনের চাল। বাঁক ঘুরলেই দেখতে পাবেন।

এ বাঁকটা আর ডালভাঙা ক্রোশ নয়। --কাছাকাছিই ছিল এবং টিনের চালওয়ালা লাল রঙের বাড়িটাও আর বিশ্বাসঘাতকতা করল না। আশায়-আনন্দে উৎসুক পা চালিয়ে দিলে সুধাংশু। “দি গ্রেট ইণ্ডিয়ান পাবলিশিং কোম্পানির” মালিক অক্ষয়বাবু আগেই চিঠি দিয়েছেন নিশাকর সামন্তকে। দু'জনে কীরকম একটা বন্ধুত্ব আছে। নিশাকর সামন্ত তার ওখানে সুধাংশুকে আশ্রয় দেবেন এবং তারই বাড়িতে দিন চারেক থেকে আশেপাশের স্কুলগুলোতে বইয়ের ক্যানভাস করবে সুধাংশু। স্কুলের দর্শন পেয়ে তাই স্বভাবতই প্রসন্ন হযে উঠল মনটা। অর্থাৎ থাকবার জায়গা পাওযা যাবে, কিছু খাদ্য জুটবে এবং হাত-পা ছড়িয়ে আরামে ঘুমিয়ে নেওয়া যাবে ঘ্ণ্টা কয়েক!

স্কুলে টিফিন পিরিয়ড চলছে খুব সম্ভব। বাইরে দাপাদাপি করছে একদল ছোট ছোট ছেলে। একটা টিনের সাইনবোর্ডে কাত হয়ে ঝুলছে স্কুলের নাম। ‘প’টা মুছে গেছে--মনে হচ্ছে অতীতপাবনী।

জায়গায় জায়গায় গর্ত হয়ে যাওয়া বারান্দাটা পার হয়ে সুধাংশু এসে ঢুকল টিচার্স রুমে। খান কয়েক কাঠের চেয়ার--মাঝখানে একটা লম্বা টেবিল। কাচভাঙা আলমারিতে ছেড়া- খোঁড়া খান ত্রিশেক বই, র‍্যাকে সাজানো গোটা কয়েক ম্যাপ। আলমারির মাথা থেকে তিন-চারখানা বেতের ডগা উঁকি মারছে। আর এই দীনতার ভেতরে সম্পূর্ণ বেমানানভাবে শোভা পাচ্ছে দেওয়ালে একটি সুহাসিনী সুন্দরী মহিলার মস্ত একখানা অয়েলপেইন্টিং। খুব সম্ভব উনিই পতিতপাবনী।

ঘরে পা দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সুধাংশু। কলাইকরা বড় একখানা থালায় একটি লোক তেল আর চীনে বাদাম দিয়ে মুড়ি মাখছে প্ৰাণপণে। খুব সম্ভব দপ্তরী। ছ'জোড়া চোখ লোলুপভাবে তাকিয়ে আছে তার হাতের দিকে। টিফিনের ব্যবস্থা।

সুধাংশু একবার গলা খাঁকারি দিলে।

ছ’জন মানুষ একসঙ্গে ফিরে তাকালেন। শীর্ণকান্তি জীর্ণদেহ ছ’টি খাঁটি স্কুল--মাস্টার। আসন্ন টিফিনের ব্যাপারে ব্যাঘাত পড়ায় স্পষ্ট অপ্রীতি ফুটে উঠেছে তাদের চোখে।

সমবেত ছ'জনের উদ্দেশ্যেই কপালে হাতটা ঠেকাল সুধাংশু। তারপর বললে, নমস্কার। আমি কলকাতা থেকে আসছি।

ততক্ষণে তার কাঁধে কলেজ-স্কোয়ারের শীতোদর ছিটের ঝোলাটি চোখে পড়েছে সকলের।

একজন চশমাটা নাকের নীচের দিকে ঠেলে নামালেন খানিকটা। বিরসমূখে বললেন, বইয়ের এজেন্ট তো?

--আজ্ঞে হ্যাঁ।


-বসুন। একটু।একটা খালি টিনের চেয়ার ছিল একটেরোয়। সুধাংশু বসতেই ঠক-ঠক করে দুলে উঠল বারকয়েক। একটা পায়া একটু ছোট আছে খুব সম্ভব।

--আমি নিশাকার বাবুর কাছে এসেছিলাম—কলাই করা থালায় মুড়ি মাখবার শব্দটা সুধাংশুর অস্বস্তিকর মনে হতে লাগল।


--হেড়মাস্টারমশাই?- -প্রথম সম্ভাষণ যিনি করেছিলেন, তিনিই বললেন, তিনি তিন মাসের ছুটিতে দেশে আছেন। তার খুড়িমা মারা গেছেন। শ্রাদ্ধ-শান্তি সেরে তারপর বিষয়-সম্পত্তির কী সব ঝামেলা মিটিয়ে তবে ফিরে আসবেন।চমকে উঠল সুধাংশু। ঢোক গিলিল একটা।

- -দিন চারেক আগে আমাদের পাবলিশার অক্ষয়বাবুকে একটা চিঠি দিয়েছিলেন--

একটা প্লেটে করে খানিক মুড়ি নিজের দিকে টেনে নিয়ে আর একজন বললেন, সেটা নিশ্চয় রি-ডাইরেক্টেড হয়ে সাঁইথিয়ায় চলে গেছে--আপনি ভাববেন না।

না, ভাবনার আর কী আছে! মুড়ি চিবোনোর শব্দে সুধাংশু আবার ঢোক গিলল। মধ্যদুপুরের তীব্র ক্ষুধা এতক্ষণে পেটের মধ্যে পাক দিয়ে উঠেছে তার। নিশাকরবাবুর বাড়িতে থাকার এবং খাওয়ার কথা লিখেছিলেন অক্ষয়বাবু--এই দুপুরেও অন্তত দুটি ভাতের একটা নিশ্চিত আশা মনের মধ্যে জেগেছিল তার। সুধাংশু এতক্ষণে বাস্তবভাবে অনুভব করল --ব্রজপুর সত্যিই অন্ধকার। তার কানু মথুরায় নয়--সাঁইথিয়ায় বিদায় নিয়েছেন।

কিছু ভাবতে না পারার আচ্ছন্নতায় সুধাংশু ঝিম ধরে বসে রইল কতক্ষণ। কী অদ্ভুত লোলুপভাবে যে মুড়ি খাচ্ছে লোকগুলো! একজন আবার টুকটুকে একটা পাকা লঙ্কায় কামড় দিচ্ছে--সুধাংশুর শুকনো জিভের আগায় খানিকটা লালা ঘনিয়ে এল। রিফ্লেক্স অ্যাকশন ! আঃ-অত শব্দ করে অমনভাবে চিবোচ্ছে কেন ওরা ? ওদের খাওয়া কি শেষ হবে না কখনও ?

আর থাকা যায় না। ওই একটানা শব্দটা অসহ্য।

- -বই দেখবেন না ?

-হাঁ-হাঁ নিশ্চয়।-- তিন চারজন ঘাড় ফেরালেন। মুড়ির পাত্রগুলো শূন্য হয়ে যাচ্ছে দ্রুতবেগে। দুজন উঠে গেলেন হাত ধুতে।

- -এই দেখুন--মুড়ি ছড়ানো টেবিলটার ওপরেই একরাশ বই ছড়িয়ে দিলে সুধাংশু ।

--ওঃ ! গ্রেট ইণ্ডিয়ান পাবলিশিং ? আপনাদের অনেকগুলো বই তো আমাদের রয়েইছে মশাই ৷

-- ধুতির কোঁচায় হাত মুছে একজন একটা বই তুলে নিলেন : ‘জ্ঞানের আলো’, ‘স্বাস্থ্য সমাচার', “ভূগোলের গল্প'-- সবই তো আছে আমাদের।

--এবারেও যাতে থাকে, সেইজন্যেই আসা--অনুগত বিনয়ে সুধাংশু হাত কচলাল : তাছাড়া আমাদের নতুন ট্রানশ্লেসনের বইটা দেখেননি বোধ হয় ? বাই কে-পি পাঁজা, এম-এ, বি-টি, হেডমাস্টার, বামুনপুকুর এইচ-ই স্কুল- -

--হুঁ!

--বাড়িয়ে বলছি না স্যার, বাজারের যে কোনও চল্‌তি বইয়ের সঙ্গে একবার মিলিয়ে দেখুন। সিমপ্লেস্ট প্রোসেস্‌, নতুন নতুন আইটেম, একটা ওয়ার্ডবুকও আছে সঙ্গে--

ঠং ঠং করে ঘণ্টা বাজল। অবশিষ্ট টিচারেরা গোগ্রাসে মুড়ি শেষ করলেন।

প্রথম লোকটি হাই তুললেনঃ আপনি আপাতত এই এরিয়ায়ই তো আছেন ? কাল তা হলে একবার দশটার দিকে আসুন। তখনই কথাবার্তা হবে। আমি অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার--এবার আমার ওপরেই ভার। আচ্ছা--নমস্কার--নমস্কার। --

অগত্যা থলের মধ্যে বইগুলো পুরে সুধাংশু উঠে পড়ল।

আসুন। অর্থাৎ আবাহন নয়--বিসর্জন। আপনি যান, কিন্তু যাওয়া যায় কোথায় ?

গ্রামটা যখন মাঝারি, তখন জেলা বোর্ডের একটা ডাকবাংলো কোথাও থাকলেও থাকতে পারে,

কিন্তু এই জীর্ণ চেহারার দীন ক্যানভাসার--চৌকিদার কি আমল দেবে ? আর যদি বা থাকতেও দেয়--খাওয়া ছাড়াও দৈনিক দুটো টাকা চার্জ তো নির্ঘাত। স্কুল বইয়ের ক্যানভাসারের পক্ষে দৈনিক দু টাকা দিয়ে ডাকবাংলোয় থাকা আর বারোর সাত ছকু খানসামা লেন থেকে চৌরঙ্গির ফ্ল্যাটে গিয়ে ওঠা--এ দুইয়ের মধ্যে প্রভেদ নেই কিছু।

অতএব ব্রজধাম ছেড়ে আবার স্টেশনের দিকে যাত্রা ? উহু, সেও অসম্ভব। এ এরিয়াতে আশেপাশে পাঁচ-ছটা স্কুল রয়েছে। তাদের বাদ দিয়ে চলে গেলে নিস্তার নেই। অক্ষয়বাবু ঠিক টের পেয়ে যাবেন, এবং অক্ষয়বাবু কড়া লোক।

ক্ষিদেয় পেটের নড়িগুলো দাপাদাপি করছে। সেই খইয়ের দোকানটাকে মনে পড়ল। কয়েকটা কালো ছিটধরা চাঁপা কলাও ঝুলতে দেখেছিল সেখানে। কিঞ্চিৎ ফলারের ব্যবস্থা হবে নিশ্চয়।

শুধু চাঁপা কলা নয়, মোষের দুধও ছিল এবং একটু মোদো-গন্ধধরা ভেলিগুড়। পনেরো পয়সায় খাওয়াটা নেহাত মন্দ হল না। আচমকা সুধাংশুব মনে হল, এমন খই-কলার ফলার কাছাকাছি থাকতে দুপুরবেলা খানিক শুকনো মুড়ি কেন চিবিয়ে মরে মাস্টারেরা ?

শীতের নরম রোদ। পেটে খাবার পড়ে গা এলিয়ে আসছে। একটু শুতে পারলে হত।

কাছেই ধর্মঠাকুরের বটগাছ। ছিমছাম জায়গাটি। দেবতার স্থান, অতএব সর্বজনীন সম্পত্তি। এখানে হত্যে দেবার নাম করে খানিকক্ষণ গড়িয়ে নিলে কেউ আপত্তি করবে না নিশ্চয়। যা ভাবা--তাই কাজ। ব্যাগের ভেতর থেকে সন্তর্পণে ভাজ করা র‍্যাপারটা সে বের করে আনল। পথে বিছানাটা এক জায়গায় রেখে এসে ভারী ভুল করেছে সে। নিশাকারবাবুর ওখানে বিছানা নিয়ে যাওয়ার দরকার নেই--বন্ধু লোক।--অক্ষয়বাবু বুঝিয়েছেন।

ফিরেই যেতে হবে। থানা গাড়তে হবে তিন মাইল দুরের স্টেশনেই । ওখান থেকে যতটা "এরিয়া’ কভার করা যায়। ব্যাগটা মাথায় দিয়ে বটগাছের তলায় শুয়ে পড়ল সুধাংশু। ধর্মঠাকুরের মাটির ঘোড়াগুলো কেমন পিটি-পিট করে তাকিয়ে রইল তার দিকে।

কতক্ষণ ?

--ও মশাই--কত ঘুমুবেন ? উঠুন--উঠুন--

ঘোড়াগুলো ডাকছে নকি ? সুধাংশু ধড়মড়িয়ে উঠে বসল।

--আপনি এখানে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছেন, আর আমি আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। নিন--চলুন এবার--

ঘোড়া নয়। একটি মানুষ এবং স্কুলের একজন মাস্টার।

-কেন বলুন তো ?

সুধাংশুর মনে পড়ল, এই লোকটিকেই টিচার্স রুমে বসে মুড়ির সঙ্গে কঁচা লঙ্কা চিবুতে দেখেছিল সে।

মাস্টার মিটি-মিটি হাসলেন : আছে মশাই, ব্যাপার আছে। সাধে কী আর এসেছি--ওপরওলার হুকুমে।

-ওপরওলার হুকুম --সুধাংশু বিস্থিত হয়ে বললে, অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার ?

--ছেঃ !--মাস্টার উত্তেজিত হয়ে উঠলেনঃ ওকে কে পরোয়া করে মশাই ? সেক্রেটারির কুটুম বলে অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার হয়েছে--নইলে ওর বিদ্যে তো ম্যাট্রিক অবধি। গুণের মধ্যে খালি সেক্রেটারির কান ভারী করতে পারে। আমিও শশধর বাড়ুয্যে মশাই--আই-এ পাশ করেছি, হেডমাস্টারের লেখাতে ভুল ধরেছি। দু-দুবার। গজেন বিশ্বাসকে আমি গ্রাহ্যও করি না।

--তবে কার তলব ? থানার দারোগার নয় তো --এবার ভয়ে সুধাংশুর গলা বুজে এল।

—দারোগা আবার কেন ?

—শশধর বাডুয্যে হা-হা করে হেসে উঠলেন : আপনি কি চোর ডাকাত ? দারোগা নয়--ম্যাজিস্ট্রেট ডেকেছে। চলুন।

ম্যাজিস্ট্রেট! রহস্য অতল!

মন্ত্রমুগ্ধের মতো সুধাংশু উঠে পড়ল।

এবং কী আশ্চর্য--যেতে হল ম্যাজিষ্ট্রেটের কোর্টে নয়, শশধর বাড়ুয্যের বাড়িতে।

বাড়ি রাস্তার ধারেই। সামনে একটি ফুলের বাগান। লাল মাটির দেওয়াল আর টিনের চাল। একটি ছোট ধানের মরাই আর এক পাশে।

বাইরের ঘরে ঢুকেই সুধাংশু থমকে গেল। শশধর বাড়ুয্যের বাড়িতে এতখানি আশা তার ছিল না।

একখানি তক্তপোষের ওপরে পরিষ্কার একটি সুজনী পাতা। শাদা কাপড়ে ঢাকা একটি টেবিল এবং পাশে একটি চেয়ার। আর সবচেয়ে আশ্চর্য--টেবিলের ওপরে কোনাভাঙা সস্তা একটি কাচের ফুলদানিতে সপত্র একগুচ্ছ গন্ধরাজ। এই শীতকালে গন্ধরাজ!

কিন্তু গন্ধরাজের চাইতেও বিস্ময়কর অভ্যর্থনার এই আয়োজনটা। মনে হচ্ছে--সুধাংশুর সম্মানেই ঘরখানাকে এমন করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। যেন কনে দেখতে এসেছে সে। শশধর বললেন, বসুন, আমি ম্যাজিস্ট্রেটকে ডাকছি।--বলেই আবার হেসে উঠলেন হা-হা করে। তারপর পা বাড়ালেন ভেতরের দিকে।

সুধাংশু থ হয়ে রইল। এ আবার কোন পরিস্থিতি ! একটা দুর্বোধ্য নাটকের মতো ঠেকাছে সব। অসময়ের গন্ধরাজের একটা মৃদু সৌরভ রহস্যলোক সৃষ্টি করতে লাগল তার চারদিকে।

—মন্টুদা--চিনতে পারছি না ?--কপালের ওপর ঘোমটাটা একটুখানি সরিয়ে শ্যামবর্ণ একটি তরুণী মেয়ে ঢুকল ঘরে। হাসিতে মুখখানা উজ্জ্বল।

তটস্থ হয়ে সুধাংশু উঠে দাঁড়াল। মন্টুদা--কে মন্টুদা ?

- -দেখুন, আমি তো আপনাকে- -

--চিনতে পারোনি--না ? কিন্তু আমি তোমাকে দূর থেকে দেখেই চিনেছি। সকলের চোখকে ফাঁকি দিতে পারো--কিন্তু আমাকে নয়। কেমন ধরে আনলাম--দেখো।

একটা ভুল হচ্ছে--মারাত্মক ভুল। বলবার চেষ্টায় বার দুতিন হাঁ করল সুধাংশু ।

—আহা-হা, আর চালাকি করতে হবে না। তোমাকে আমি জব্দ করতে জানি। বেশি দুষ্টুমি করো তো সব ফাঁস করে দেব--মেয়েটি মৃদু হাসল : দাঁড়াও--তার আগে তোমার চা করে আনি। দিনে এখনও সে পনেরোবার চা খাওয়ার অভ্যাসটি আছে তো ? না--রত্নার শাসনে এখন কমেছে একটু?

রত্না ? এবার আর হাঁ-টা সুধাংশু বন্ধ করতে পারল না।

--ঐ দেখো, সাপের মুখে চুন পড়ল!--মেয়েটিসকৌতুকে হেসে উঠল।

গায়ে একটা জামা চড়িয়ে শশধর ফিরে এলেন। মেয়েটি একটুখানি নামিয়ে আনল মাথার ঘোমটা।

শশধর বললেন, তুমি তা হলে চায়ের ব্যবস্থা করো ওঁর জন্যে। আমি একবার ঘুরে আসি বাগ্‌দিপাড়া থেকে। দেখি বিল থেকে দু চারটি কই মাছ ওরা ধরে এনেছে কিনা।

--দেখুন শশধর বাবু--

---পরে দেখব মশাই। এখন সময় নেই--

শশধর বেরিয়ে গেলেন।

মেয়েটি হাসলঃ পালাবার ফন্দি ? ও হবে না। অনেকদিন পরে ধরেছি তোমাকে। এখন চুপ করে বসে। আমি চা আনছি --

অতঃপর আবার সেই বিব্রত প্রহর যাপনের পালা সুধাংশুর। এ কী হচ্ছে--এ কোথায় এল সে। মন্টুদা বলে তার কোনও নাম আছে একথা সে এই প্রথম শুনল । এবং রত্না । সেইই বা কে ? বারোর সাত ছিকু খানসামা লেনে যে তার ঘর আলো করে রয়েছে, তাকেও তো সে এতকাল নিভাননী ওরফে বুলু বলেই জানত । একটা ভুল হচ্ছে--ভয়ঙ্কর ভুল।

ভুলটা ভেঙে দিয়ে এই মুহুর্তে তার ভদ্রলোকের মতো সরে পড়া উচিত।

কিন্তু -

কিন্তু চা আসছে এবং এ-সময় এক কাপ চায়ের নিমন্ত্রণ তুচ্ছ করবার মতো মূঢ়তাকে সে প্রশ্রয় দিতে রাজি নয়। চা-টা খাওয়া শেষ হলেই এক ফাঁকে ঝোলাটা কাঁধে করে সে উঠে পড়বে। তারপর এক দৌঁড়ে শালবন ছাড়িয়ে ময়ূরাক্ষী পার হতে আর কতক্ষণ।

সামনে ফুলদানি থেকে গন্ধরাজের মৃদু সৌরভ ছড়াচ্ছে। শীতের ফুল । সমস্ত ঘরে একটা রহস্যময় আমেজ ছড়িয়ে রেখেছে। পড়ন্ত বেলায় ঘরময় শীতল ছায়া ঘনাচ্ছে। মশার গুঞ্জন উঠেছে। র‍্যাপারটা গায়ে জড়িয়ে সুধাংশু অভিভূতের মতো বসে রইল।

ভেতর থেকে গরম ঘিয়ের গন্ধ আসছে। খাবার তৈরি হচ্ছে- -এবং নিশ্চয় তারই সম্মানে। সুধাংশুর মুখে আবার লালাজমে উঠল। রিফ্লেক্স অ্যাকশন! খই জিনিসটা লঘুপাক, কিন্তু চাপাকলা আর মোষের দুধও যে এমন অবলীলাক্রমে হজম হয়ে যায়--সে রহস্যই বা কার জানা ছিল। চায়ের প্রলোভনটা আরও শক্ত পাকে জড়িয়ে ধরল ঘিয়ের গন্ধ। রাত্রে স্টেশনের হোটেলে তো জুটবে ঢ্যাড়শ-চচ্চড়ি আর কড়াইয়ের ডাল--এক টুকরো মাছ যদি পাওয়া যায়, তার স্বাদ মনে হবে পিস্‌বোর্ডের মতো। তার চাইতে এখান থেকে যথাসাধ্য রেশন নিয়ে নেওয়া যাক। হোক ভ্রান্তিবিলাস, তবু ধরে নেওয়া যাবে এটা বাংলা দেশের পুরনো আতিথেয়তার নমুনা মাত্র।

গন্ধরাজের সৌরভ ছাপিয়ে লুচির গন্ধ আসছে। সুধাংশু প্রতীক্ষা করে বসে রইল। একটু পরেই এক হাতে সধুম লুচির থালা, আর একহাতে লণ্ঠন নিয়ে ঢুকল মেয়েটি।

--এত কেন?

--খাওয়ার জন্য।--মেয়েটি হাসল : নাও--আর ভদ্রতা কোরো না। সামনেই গাড়ু-গামছা রয়েছে--ধুয়ে নাও হাতমুখ।

যা হওয়ার হোক। এস্‌পার কি ওস্‌পার । মেঘনার ধারের সুধাংশু চক্রবর্তী আর বিস্মিত হবে না ঠিক করল। দেশ ছেড়ে উর্ধ্বশ্বাসে পালানোর চরম বিস্ময়টাকেই যখন রপ্ত করতে হয়েছে--তখন শিশিরে আর ভয় নেই তার।

-- বেপরোয়া হয়ে লুচি-বেগুন ভাজায় মনোনিবেশ করল সে।

মেয়েটি পাশে দাঁড়িয়েছিল, আস্তে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

- -কত রোগা হয়ে গেছ আজকাল!

শুনে রোমাঞ্চ হয় যে সুধাংশুও একদিন মোটা ছিল!

মেয়েটি বললে, সেই দশ বছর আগে যখন রত্নাকে নিয়ে পালিয়েছিলে, সেদিন কত কথাই উঠেছিল গ্রামে, কিন্তু আমি তো জানতাম--যা করেছ, ভালই করেছ!

রত্নাকে নিয়ে পালানো। হে ভগবান, রক্ষা করো! সুধাংশুর গলায় লুচি আটকে আসতে লাগল। তাদের হেড্‌মাস্টার থাকলে এখন সাক্ষী দিয়ে বলতেন, স্কুলে বরাবর গুড কণ্ডাক্টের প্রাইজ পেয়েছে সে!

--কাকিমা তো অগ্নিমূর্তি!- -মেয়েটির চোখে স্মৃতির দূরত্ব ঘনিয়ে আসতে লাগল : আমাকে এসে বললেন, কণা, তুই দুঃখ পাসনি। ওর কপালে অনেক শাস্তি আছে--দেখে নিস্‌। সত্যি বলছি মন্টুদা--বিশ্বাস করো আমাকে। আমি খুশি হয়েছিলাম। জাত বড় নয়--রত্না সত্যিকারের ভাল মেয়ে। আর তোমাকেও তো জানি। প্রাণে ধরে রত্নাকে তুমি কখনও দুঃখ দেবে না।

আহা, এই কথাগুলো যদি বুলু শুনত! তার ধারণা, স্বামী হিসেবে যে বস্তুটি তার কপালে জুটেছে, পুরুষের অপদার্থতম নমুনা হচ্ছে সেইটিই।

--সত্যি, রত্নার কষ্ট চোখে দেখা যেত না। সৎমা কী অত্যাচারই করত ওর ওপরে। কতদিন খেতে পর্যন্ত দেয়নি। তবু মেয়েটা মুখ ফুটে একটা কথা পর্যন্ত বলেনি কখনও। এমন ঠাণ্ডা লক্ষ্মী মেয়ে আর হয় না। জাতটা কিছু নয় মন্টুদা--জীবনে সত্যিই তুমি জিতেছ।

অজানা-অদেখা রত্নার জন্যে এবারে সুধাংশুরও দীর্ঘশ্বাস পড়ল। মনে পড়ে গেল, ঝগড়া করবার আগে কোমরে হাত দিয়ে বুলুর সেই দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা। লুচির থালা শেষ হতে সয় লাগল না।

—আর দুখানা এনে দিই মন্টুদা ?

--না-না-সর্বনাশ !

কণা বলে চলল, তোমার চেহারা বদলেছে মন্টুদা--কত ভারী হয়েছে গলার আওয়াজ। তবু আমি কি ভুল করতে পারি ? সেই চোখ, সেই কেঁকড়া চুল, সেই মুখের আদল, সেই হাঁটাবার ভঙ্গি। বাড়ির সামনে দিয়ে যখন ধর্মখোলার দিকে চলে যাচ্ছিলে, তখনই আমি চিনে ফেললাম । তারপর উনি যখন স্কুল থেকে ফিরে এসে বললেন যে, কলকাতা থেকে বইয়ের এজেন্ট এসেছে, তখনই আর বুঝতে কিছু বাকি রইল না। এখনও তো সেই বইয়ের কাজই করছ ?

- -হু!--সংক্ষিপ্ততম উত্তরই সব চেয়ে নিরাপদ ব্যবস্থা।

- -শোনো--কণার গলার স্বর নিচু হয়ে এল ; আমি ওকে বলেছি, তুমি সম্পর্কে আমার মামাতো ভাই। --কণা অর্থগভীর হাসি হাসলত : তুমি কিন্তু আসল ব্যাপারটা ফাঁস করে দিয়ো না--কেমন ?

—না-না। --সুধাংশু আন্তরিকভাবে মাথা নাড়ল : তা কখনও বলতে পারি। তাহলে আজ বরং উঠি আমি। রাত হয়ে যাচ্ছে--আমাকে আবার স্টেশনে যেতে হবে।

—বা রে, ভেবেছ কী তুমি ? এমনি ছেড়ে দেব ? ওঁকে মাছ আনতে পাঠালাম--দেখলে না ?

আমার রান্না খেতে তুমি কত ভালবাসতে—এরই মধ্যে ভুলে গেলে? ও সব হবে না। যাও দেখি--কেমন যেতে পারো।

- -কিন্তু বিছানপত্র কিছু সঙ্গে নেই--

কণা গরিব হতে পারে, কিন্তু তোমাকে শুতে দেবার মতো একখানা লেপ আর একটা বালিশ তার জুটবে। বেশি ভদ্রতা কোরো না আমার সঙ্গে-- বুঝেছ?

বুঝেছে বৈকি সুধাংশু। ইচ্ছার বিরুদ্ধেই প্রতারকের একটা চমৎকার ভূমিকায় নেমে পড়েছে সে। এখন আর সহজে পালাবার উপায় নেই। শশধর তাকে কখনওই দেখেনি এবং কণা তাকে মিন্টুদা বলে প্রমাণ করার জন্যে দৃঢ়-প্রতিজ্ঞ। অতএব জালিয়াতিটা অন্তত আজ রাতে ধরা পড়বে না। কাল ভোরেই তাকে পালাতে হবে- -এবং এ এরিয়া ছেড়ে। তারপরে অক্ষয়বাবু রইলেন আর সে রইল।

বাগানে টিনের গেট খুলে কে ভেতরে ঢুকল। পাওয়া গেল চটির আওয়াজ।

শশধর ফিরে এলেন। হাতের বাঁধা ন্যাকড়াটার মধ্যে উত্তেজিত দাপাদাপি চলছে। উল্লসিত হয়ে শশধর বললেন, অতিথি-সেবার পুণ্যে আজ ভাল মাছ পাওয়া গেল। কণা! দশটা বড় বড় কই।

কণার মুখ হাসিতে ভরে উঠল।

--মন্টুদার ভারী প্রিয় মাছ। মনে আছে মন্টুদা--রেলের বাঁধের তলা থেকে একবার তুমি আর আমি ছিপ দিয়ে এক কুড়ি কই ধরেছিলাম ? তারপর বাড়িতে ফিরে মার হাতে সে কী পিট্টি ।

শশধর সস্নেহ হাঁসি হাসলেন। ধপ করে বসে পড়লেন চেয়ারটায় : ভাই বোনে মিলে খুব দুষ্টুমি হত বুঝি? তা বেশ, কিন্তু শিবেনবাবুকে এখনও চা দাওনি ?

শিবেনবাবু ! সুধাংশু আর একবার ঢোক গিলল। নিজের নামটা প্রায় অষ্টোত্তর শতনামের গণ্ডিতে গিয়ে পৌঁছুচ্ছে।

--তুমি আসবে বলেই দেরি করছিলাম।

--দাও--দাও।--শশধর ব্যস্ত হয়ে উঠলেন : বিকেলের চা-তো এখনও জোটেনি ওঁর। কুটম মানুষ--বদনাম গাইবেন।

--মণ্টুদা খুব ভাল ছেলে--কারও বদনাম করে না--কণা ভেতরে চলে গেল।

খাওয়ার দিক থেকে কিছুমাত্র ত্রুটি হল না। বারোর সাত ছকু খানসামা লেনের সুধাংশু চক্রবর্তী এমন টাট্‌কা কই মাছ চোখে দেখেনি দেশ ছাড়বার পরে। এ অঞ্চল নাকি কাঁকরের জন্যে বিখ্যাত, কই চালে তো একটি দানা কাঁকরেরও সন্ধান পাওয়া গেল না!

শশধর গল্প করলেন অজস্র। দেশের কথা, স্কুলের কথা। যোগ্যতায় বি-এ ফেল হেড়মাস্টার নিশাকর সামন্তের পরেই তার স্থান--এ কথাও ঘোষণা করলেন বার বার। শুধু সেক্রেটারির কুটুম ওই গজেন বিশ্বাস! মামার জোরেই অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার--নইলে একটা ইংরেজি সেনটেন্সও কারেক্ট করে লিখতে জানে নাকি ?

--আপনাকে ভাবতে হবে না মশাই। আপনি আমার কুটুম--গ্রেট ইণ্ডিয়ানের সব বই আমি ধরিয়ে দেব স্কুলে। ও দায়িত্বটা এখন আমার ওপরেই ছেড়ে দিন।

বাইরে কনকনে শীতের রাত। ভারী হাওয়ায় অসময়ের গন্ধরাজের গন্ধ। মাটির দেওয়ালে কেরোসিনের আলোর কাঁপনলাগা ছায়া। বিমিশ্র অনুভূতি বিজড়িত একটা স্তব্ধ মন নিয়ে সুধাংশু আধশোয়া হয়ে রইল লেপের মধ্যে। আশ্চর্য । জীবনটা এত আশ্চর্য--কে জানত ।

মন্টুদা ?

কণা ঘরে ঢুকল।

--জেগেই আছি। শশধর বাবু কী করছেন ?

--ওঁর তো এখন মাঝ-রাত। পড়া আর মড়া। শুনছ না-- নাক ডাকছে ?--কণা খিল্‌-খিল্‌ করে হেসে উঠল : ওই নাকের ডাকের ভয়ে পাড়ায় চোর আসতে পারে না।

সুধাংশু অপ্রতিভের মতো হাসল। টেবিলের পাশ থেকে চেয়ারটা নিয়ে বসল কণা। কিছুক্ষণ ধরে নাড়াচাড়া করতে লাগল লণ্ঠনের বাড়ানো কমানো চাবিটা। কিছু একটা বলতে চায়--বলতে পারে না।

সুধাংশু সংকুচিত হয়ে আসতে লাগল মনের ভেতরে। আড় চোখে একবার তাকিয়ে দেখল কণার দিকে। এক কালে সুশ্রীই ছিল মুখখানা। এখন পরিশ্রম আর চিন্তার একটা ম্লান আবরণ ছড়িয়ে পড়েছে তার ওপরে।

তারপর :
একটা কথা বলব ভাবছি মন্টুদা। বলব কিনা বুঝতে পারছি না।

--বলো। অতি সংকোচের কী আছে ?

--না, তোমার কাছে সংকোচের আমার কিছুই নেই। --কণা ভেতরের দিকে মাথা ফিরিয়ে একবার কী দেখল,যেন কান পেতে শুনল শশধরের নাকের ডাকটা। তারপর মুখ ফিরিয়ে মৃদু হাসল : রত্না অমন করে মাঝখানে এসে না দাঁড়ালে তোমার ঘরে হাঁড়ি ঠেলার ব্যবস্থাই যে আমার পাকা হয়ে গিয়েছিল সে কথা কি তুমি ভুলে গেলে ?

সুধাংশু শিউরে উঠল। লণ্ঠনের আলোয় আশ্চর্য দেখাচ্ছে কণার চোখ। ঘন বর্ষার মেঘের মতো কী যেন টলমল করছে সেখানে। কণা বললে, ভয় নেই। তুমি ভেবো না--আমি রাগ করেছি। আমি তো জানি রত্না কত ভাল মেয়ে- -কণার চোখ থেকে টপ করে এক ফোঁটা জল ঝরে পড়ল বুকের ওপর : আমি সুখে আছি, খুব সুখে আছি মন্টুদা!--

-- আঁচল দিয়ে চোখ মুছে ফেলে কণা আবার হেসে উঠল। শ্রাবণের মেঘ-রৌদ্রের লীলার মতো তার হাসি-কান্না দেখতে লাগল সুধাংশু । কণা বলে চলল, দশ বছর পরে দেখা, ভেবেছিলাম, কথাটা বলা ঠিক হবে না। তারপব ভেবে দেখলাম, পৃথিবীতে তোমাকে ছাড়া আর কাকেই বা বলতে পারি।--গলার স্বর নামিয়ে কণা বললে, মন্টুদা, কুড়িটা টাকা দেবে আমাকে ?

কুড়ি টাকা! ক্যানভাসার সুধাংশু চক্রবতী সভয়ে নড়ে উঠল। আঁচলের গিট থেকে একটা চিঠি বের করলে কণা। বললে, এইটে পড়ো।

সুধাংশু বিমূঢ়ের মতো হাত বাড়িয়ে নিল চিঠিখানা। বোলপুর থেকে কোন এক বিনু চিঠি দিযেছে দিদিকে। তার ম্যাট্রিকের ফি এ মাসেই দিতে হবে।--দিদি যেন একটা ব্যবস্থা করে দেয়।

হতবাক হয়ে চিঠিটার দিকে সে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ ।

- -অবাক হয়ে গেলে তো ? দশ বছর আগে যে ছোট বিনুকে দেখেছিলে, সে আর ছোটটি নেই। ম্যাট্রিক দেবে এবার। ভাল ছেলে--ভাল করেই পাশ করবে। অথচ ফিয়ের টাকা নিয়ে মুশকিল। বাবার অবস্থা তো সবই জানো--কোনমতে আধাপেটা খেয়ে আছেন। অথচ এদের কাছেও চাইতে পারিনা। নিজেরই সংসার চলেনা, তবু বাবাকে যখন পারেন দু পাঁচটাকা পাঠান। এই কুড়িটা টাকার জন্যে ওঁকে আর কী ভাবে চাপ দিই বলো ?

সুধাংশু তেমনি নির্বাক হয়ে রইল। কোমল গভীর গলায় কণা বললে, একদিন তোমার কাছে সবই আমার চাইবার দাবি ছিল মন্টুদা। আজ সেই সাহসেই কথাটা বলতে পারলাম। রত্নাকে আমি সবই তো দিয়েছি--কণার চোখে জল চকচক করতে লাগলঃ মোট কুড়িটা টাকাও কি আমি চাইতে পারব না?

অভিনেতা সুধাংশুর কাছে অভিনয়টা কখন সত্যি হয়ে উঠল সে নিজেই জানে না। তেমনি গভীর গলায় সেও বললে, নিশ্চয় কণা--নিশ্চয়। বালিশের তলায় রাখা মানিব্যাগটার দিকে হাত বাড়াল।

--এখুনি- -কণা বললে, ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। তুমি কলকাতা গিয়েও বিনুকে পাঠিয়ে দিতে পারো। ঠিকানাটা নিয়ে যাও বরং।

ব্যাগটা বের করে এনে সুধাংশু বললে, না--না। অঢেল কাজ নিয়ে থাকি, কলকাতায় গিয়ে ভুলে যেতে কতক্ষণ ? টাকাটা তুমিই রাখো কণা।

শীতের হাওয়ায় ঘরে গন্ধরাজের মৃদু সুরভি। দেওয়ালে ছায়া কাঁপছে। আশ্চর্য তরল কণার চোখ। জল গড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু এবার আর সে তা মুছতে পারল না।
***

শাল-পলাশের বনে ভোরের কুয়াশা। পায়ের তলায় শিশিরভেজা ধুলো। ময়ূরাক্ষী আর

কতদূরে ?

ঠাণ্ডা নরম রোদে--শালের পাতায় সোনালি ঝিকিমিকি দেখতে দেখতে আর মন্থর পা ফেলে চলতে চলতে হঠাৎ ক্যানভাসার সুধাংশু চক্রবতীর মনে হল--অভিনয়টা সত্যি সত্যি করেছে কে --সে--না কণা? কে বলতে পারে, এই পরিচয়ের ছদ্মবেশটা কুড়িটা টাকা আদায় করার এক চক্রান্ত কিনা?

কিন্তু তা হলে কি এত মিষ্টি লাগত গন্ধরাজের গন্ধটা? এই সকালে কি এত সুন্দর দেখাত এ শাল-পলাশের বন? আর সামনে--সামনে ওই তো ময়ূরাক্ষী। ময়ূরের চোখের মতোই সোনা আলো-ছড়ানো কী অপরূপ নীল ওর জল।

এই কুড়িটা টাকার হিসেব সহজে বোঝানো যাবে না ব্যবসায়ী অক্ষয়বাবুকে। এ এরিয়ার কাজ সবই তো পড়ে রইল। আর অক্ষয়বাবু কড়া লোক।

এর ঋণ শোধ করতে হবে এক মাস রেশন না এনে,কণার চোখের জলের দাম শোধ করে দিতে হবে বুলুকে। পিঠের বোঝাটার কথাটা হঠাৎ মনে পড়ে গেল সুধাংশুর। এত বই--রাশি রাশি বই শুধু চিনির বলদের মতো বয়েই বেড়ায় সে--তার নিজের ছেলের কর্পোরেশনের স্কুলে পড়ার খরচ জোটে না। তবু একজন তো ম্যাট্রিকের ফি দিতে পারবে--একজন তো কৃতী হতে পারবে জীবনে।

কুড়িটা টাকার চেয়ে ঢের বেশি সত্য বুকের পকেটে এই গন্ধরাজ দুটো। অসময়ের ফুল। কাচের ফুলদানিটা থেকে চুরি করে এনেছে সুধাংশু--পালিয়ে এসেছে ভোরের অন্ধকারে। যে অন্ধকারে ব্রজপুর একটা স্বপ্নমাধুরী নিয়ে পেছনে পড়ে রইল ।

সামনে ময়ূরাক্ষী। কী আশ্চর্য নীল সোনালি ওর জল ।






ঝুম্পা লাহিড়ির গল্প : মি.পিরজাদা


১৯৭১ সালের হেমন্তে এক ভদ্রলোক আমাদের বাড়িতে আসতেন। তাঁর পকেটে থাকত লজেঞ্জ-চকোলেট আর বুকে তাঁর পরিবারের জীবন-মৃত্যুর নিশ্চিত খবর পাওয়ার আশা। তাঁর নাম ছিল মি. পিরজাদা। তিনি ঢাকা থেকে এসেছিলেন। ঢাকা এখন বাংলাদেশের রাজধানী, কিন্তু তখন পাকিস্তানের অংশ ছিল।
সে বছর পাকিস্তান গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। সেই পূর্ব সীমান্ত যেখানে ঢাকা অবস্থিত, পশ্চিমের কাছ থেকে স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা করছিল। মার্চ মাসে পাকিস্তানি সেনা ঢাকায় হানা দিয়ে, আগুন লাগিয়ে, গুলিগোলা চালিয়েছিল। শিক্ষকদের রাস্তায় টেনে এনে গুলি করে মারা হয়েছিল। মেয়েদের ব্যারাকে টেনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছিল। শোনা যাচ্ছিল যে, গ্রীষ্মকালের মধ্যে ৩,০০,০০০ মানুষ মারা গিয়েছিল। ঢাকায় মি. পিরজাদার একটা তিনতলা বাড়ি ছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যার অধ্যাপনা ছিল, কুড়ি বছরের বিবাহিতা স্ত্রী ছিলেন এবং ছ’ থেকে ষোলোর সাতটি মেয়ে ছিল, যাদের সকলের নাম শুরু হয়েছিল ‘এ’ অক্ষর দিয়ে। ‘ওদের মায়ের ইচ্ছে,’ তিনি একদিন আমাদের, তাঁর মানি ব্যাগ থেকে একটা সাদা-কালো ছবি বের করে দেখিয়ে বুঝিয়েছিলেন। সাতটি মেয়ে একটি পিকনিকে সারি দিয়ে বাবু হয়ে বসে কলাপাতায় মুরগির মাংসের ঝোল খাচ্ছে। সকলের বিনুনি ফিতে দিয়ে বাঁধা। ‘কী করে চিনব আমি? আয়েষা, আমিরা, আমিনা, আজিজা, বুঝতে পারছ তো, কত কঠিন?

প্রতি সপ্তাহে মি. পিরজাদা স্ত্রীকে চিঠি লিখতেন এবং প্রত্যেকটি মেয়েকে কমিক্‌স বই পাঠাতেন। কিন্তু ঢাকায় আর সবকিছুর মতোই ডাকব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছিল। ছ’মাসের ওপর তিনি তাদের কোনও খবর পাননি। সেই সময় মি. পিরজাদা এক বছরের জন্য আমেরিকা এসেছিলেন। কারণ পাকিস্তানি সরকার তাঁকে নিউ ইংল্যান্ডের গাছের পত্রালি নিয়ে পড়াশুনা করার জন্য জলপানি দিয়েছিল। বসন্ত এবং গ্রীষ্মকালে তিনি ভার্মান্ট এবং দেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। হেমন্তকালে তিনি বোস্টনের উত্তরে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন তাঁর আবিষ্কার নিয়ে একটি ছোট বই লিখতে। আমরা সেখানেই থাকতাম। জলপানিটা খুবই সম্মানের ছিল, যদিও ডলারে তার মূল্য নির্ধারণ করতে গেলে সেটা পর্যাপ্ত মনে হত না। তাই মি. পিরজাদা একটি গ্রাজুয়েট ডর্মেটরিতে থাকতেন। তাঁর কোনও নিজস্ব টিভি বা স্টোভও ছিল না, সেজন্য তিনি আমাদের বাড়িতে আসতেন টিভিতে সন্ধেবেলার খবর দেখতে এবং রাতের খাবার খেতে।

প্রথমদিকে আমি তাঁর আসার কারণ কিছুই বুঝতাম না। আমার তখন মাত্র দশ বছর বয়স। আমার মা-বাবা ছিলেন ভারতীয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁদের সঙ্গে পরিচিত অনেক ভারতীয় ছিল। তাই মি. পিরজাদাকে তাঁরা আমাদের সঙ্গে খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানানোয় আমি অবাক হইনি। ছোট ক্যাম্পাসটায় ইটের সরু ফুটপাথ এবং সাদা রংওয়ালা বিল্ডিং ছিল। যে শহরের প্রান্তে ক্যাম্পাসটা অবস্থিত, সেটা যেন আরও ছোট। সুপারমার্কেটে সরষের তেল পাওয়া যেত না, ডাক্তাররা বাড়িতে রুগী দেখতে যেতেন না, বিনা নিমন্ত্রণে কেউ পড়শিদের বাড়ি যেত না, এইসব নিয়ে আমার মা-বাবা খুব অভিযোগ করতেন। স্বদেশবাসীর খোঁজে প্রতি সেমিস্টারের শুরুতে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিরেক্টরিতে আঙুল দিয়ে নাম খুঁজতেন। তাঁদের দেশের পরিচিত পদবির কোনও নাম পেলে সেটা গোল দাগ দিয়ে রাখতেন। এইভাবেই তাঁরা মিঃ পিরজাদাকে খুঁজে পেয়ে ফোন করেছিলেন এবং বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন।

তাঁর প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার আসার কথাও আমার মনে নেই। কিন্তু সেপ্টেম্বরের মধ্যেই আমি আমাদের বসার ঘরে মি. পিরজাদার উপস্থিতির সঙ্গে এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম যে, একদিন জলের জগে বরফ ঢালার সময় আমি মাকে চতুর্থ গেলাসটা আমার নাগালের বাইরের একটা তাক থেকে পেড়ে দিতে বলেছিলাম। মা স্টোভের সামনে এক কড়াই ভরতি ভাজা পালং শাক মুলো নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। একজস্ট ফ্যান আর জোরে জোরে হাতা নাড়ানোর শব্দে আমার কথা শুনতে পাননি। বাবা ফ্রিজে হেলান দিয়ে মুঠো থেকে তুলে মশলা মাখানো কাজুবাদাম খাচ্ছিলেন। আমি তাঁর দিকে ফিরলাম।

‘’কী হয়েছে লিলিয়া?”

“ভারতীয় ভদ্রলোকটির জন্য একটা গেলাস চাই।”

“মি. পিরজাদা আজ আসবেন না। তার চেয়েও বড় কথা মি. পিরজাদাকে আর ভারতীয় মনে করা হয় না,” বাবা ঘোষণা করলেন। তাঁর পরিপাটি করে ছাঁটা কালো দাড়ি থেকে কাজুর নুন ঝাড়তে ঝাড়তে বললেন, “পার্টিশনের পর থেকে আর না। ১৯৪৭-এ আমাদের দেশ ভাগ হয়ে গিয়েছিল।”

আমি যখন বললাম যে, আমার ধারণা ছিল সেটা ব্রিটেনের শাসন থেকে ভারতের স্বাধীনতার তারিখ, তখন বাবা বললেন, “ সেটাও ঠিক। এক মুহূর্তে আমাদের ভাগ করে দেওয়া হল।” কাউন্টার-টপের ওপর আঙুল দিয়ে একটা ক্রস চিহ্ন এঁকে তিনি বোঝালেন, “ঠিক একটা পিঠের মতো ভাগ করা হল। হিন্দুরা এখানে, মুসলমানরা ওখানে। ঢাকা আর আমাদের নেই।” তিনি বললেন, পার্টিশনের সময় হিন্দু-মুসলমানরা পরস্পরের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। এখনও অনেকের কাছেই, অন্য ধর্মের কারও উপস্থিতিতে খাওয়া অভাবনীয়।

আমি এর কিছুই বুঝতে পারলাম না। মি. পিরজাদা এবং আমার মা-বাবা একই ভাষায় কথা বলতেন, একই কথায় হাসতেন, অনেকটা একইরকম দেখতেও ছিল ওঁদের। তাঁরা খাবারের সংগে আমের চাটনি খেতেন, প্রতি রাতে হাত দিয়ে ভাত খেতেন, হজমের জন্য মৌরি চিবোতেন, মদ খেতেন না, খাওয়ার পর মিষ্টির বদলে একের পর এক চায়ের কাপে কোনও সাধারণ বিস্কুট ডুবিয়ে খেতেন। এসব সত্ত্বেও, বাবা চাইছিলেন যেমন আমি তঁদের মধ্যে তফাতটা বুঝতে পারি। তিনি ডেস্কের ওপরের দেওয়ালে সাঁটা সারা পৃথিবীর একটা মানচিত্র দেখাতে নিয়ে গেলেন। মনে হল, বাবা যেন এই ভেবে চিন্তিত যে, ভুল করে মি. পিরজাদাকে ভারতীয় বলে ফেললে তিনি অপমানিত বোধ করতে পারেন। আমি অবশ্য কল্পনাই করতে পারছিলাম না, মি. পিরজাদা কোনও কথাতেই অপমানিত বোধ করবেন। ‘মি. পিরজাদা বাঙালি, কিন্তু তিনি মুসলমান,” বাবা আমাকে বোঝালেন। “তাই তিনি পূর্ব পাকিস্তানে থাকেন, ভারতে নয়।” তাঁর আঙুল অতলান্তিকের ওপর দিয়ে এগিয়ে গেল। ইউরোপ , মেডিটেরিয়ান, মিডল ইস্ট এবং অবশেষে সেই ছড়িয়ে থাকা কমলা রঙের হিরেটা। মা বলেছিলেন সেটা দেখে যেন মনে হয় যেন কোনও শাড়ি পরা মহিলা বাঁ হাতটা বাড়িয়ে আছে। আমার মা বাবার সফর বোঝানোর জন্য অনেকগুলো শহরের চারপাশে গোল করে দাগ দেওয়া ছিল। সেই শহরগুলো একটা লাইন দিয়ে জোড়া। এবং তাঁদের জন্মস্থান কলকাতা একটা ছোট তারা দিয়ে চিহ্নিত ছিল। আমি সেখানে শুধু একবারই গিয়েছিলাম। সেই যাত্রার কোনও স্মৃতি ছিল না আমার। “দেখেছিস লিলিয়া, ওটা একটা আলাদা দেশ, আলাদা রঙ,” বাবা বললেন। পাকিস্তানের রঙ কমলা নয়--হলুদ। আমি লক্ষ করলাম যে, দেশটার দুটো আলাদা অংশ আছে। একটা অন্যটার চেয়ে অনেক বড়। ভারতের এক বিস্তৃত অংশ দিয়ে দুটো ভাগ করা। আমেরিকা থেকে আলাদা হয়ে, ক্যালিফোর্নিয়া আর কানেকটিকাট দিয়ে একটা দেশ তৈরি হলে যেমন হয়, তেমন।

বাবা তাঁর আঙুলের ডগা দিয়ে আমার মাথায় টোকা মারলেন। “তুই নিশ্চয়ই বর্তমান পরিস্থিতি জানিস। জানিস তো যে পূর্ব পাকিস্তান সার্বভৌম ক্ষমতার জন্য লড়াই করছে?”

আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম যদিও আমি কিছুই জানতাম না।

আমরা রান্নাঘরে ফিরে এলাম। মা একটা ঝাঁঝরি দিয়ে এক হাঁড়ি সেদ্ধ ভাত থেকে জল ঝরাচ্ছিলেন। বাবা কাউন্টারের ওপরের ক্যানটা খুলে আরও কাজু বাদাম খেতে খেতে চশমার ফ্রেমের ওপর দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। “তোকে স্কুলে ঠিক কী পড়ায় বল তো। ইতিহাস পড়িস? ভূগোল?”

“লিলিয়ার স্কুলে অনেক কিছুই পড়ায়,” মা বললেন। “আমরা এখন এখানেই থাকি। ও তো এখানেই জন্মেছে।” মা’র কথা শুনে মনে হল তিনি এই ব্যাপারটা নিয়ে খুব গর্বিত, যেন সেটা আমার কোনও ব্যক্তিগত গুণ। আমি জানতাম যে, তাঁর ধারণা অনুযায়ী, মার জন্য এক নিরাপদ সহজ জীবন, ভাল শিক্ষাদীক্ষা এবং সব রকমের সুযোগ নিশ্চিত ছিল। আমাকে কখনও রেশনের খাবার খেতে হবে না, কারফিউ মানতে হবে না, ছাদে দাঁড়িয়ে কোনও দাঙ্গার সাক্ষী হতে হবে না বা কোনও পড়শিকে গুলি খেয়ে মরা থেকে বাঁচানোর জন্য জলের ট্যাঙ্কে লুকিয়ে রাখতে হবে না, যেমন তাঁদের করতে হয়েছিল। “ একবার ভাবো, ওদের একটা ভদ্রসভ্য স্কুলে ভরতি করা, লোডশেডিং হলে কেরোসিনের লণ্ঠনের আলোয় পড়তে বসানো। পড়ার চাপ, টিউটর, একের পর এক পরীক্ষা,” মা তাঁর ব্যাঙ্ক টেলারের কাজের উপযোগী ছাঁটা চুলের মধ্যে দিয়ে হাত চালালেন। “তুমি কী করে আশা করো যে ও পার্টিশন সম্পর্কে জানবে। বাদামগুলো রাখো এবার।”

“কিন্তু ও পৃথিবীর সম্পর্কে কী শিখছে?” বাবা কাজুর কৌটাটা হাতে ঝাঁকিয়ে বললেন। “কী শিখছে ও?”

বলাবাহুল্য, আমরা আমেরিকার ইতিহাস শিখতাম এবং আমেরিকার ভূগোল। সে বছর এবং মনে হত যেন প্রতি বছরই, আমরা রেভলিউশনারি ওয়ার দিয়ে পড়াশোনা করতাম। স্কুলবাসে চেপে আমাদের প্লাইউমাউথ রক দেখতে, ফ্রিডম ট্রেল-এর ওপর হাঁটতে এবং বাঙ্কার হিল মনুমেন্ট-এর ওপর চড়তে নিয়ে যাওয়া হত। রঙিন কাগজ দিয়ে মডেল তৈরি করতাম, জর্জ ওয়াশিংটন ডেলাওয়্যার নদীর উত্তাল জল পার হচ্ছেন। সাদা রঙের টাইট্‌স এবং কালো রঙের বো পরা কিং জর্জের পুতুল তৈরি করতাম। পরীক্ষার সময় আমাদের তেরোটি কলোনির ফাঁকা ম্যাপ দিয়ে নাম, তারিখ এবং রাজধানী লিখতে বলা হত। আমি চোখ বুজে ওই কাজগুলো করতে পারতাম।
পরের দিন সন্ধেবেলা, মি. পিরজাদা নিয়মমতো ছ’টার সময় আমাদের বাড়ি এলেন। অনেকদিনের পরিচিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি এবং আমার বাবা দেখা হওয়ার সময় হাত মেলানোর অভ্যাসটা ছাড়তে পারেননি।

“আসুন, লিলিয়া, মি. পিরজাদার কোটটা নাও।”

নিখুঁত স্যুট, স্কার্ফ এবং কলারে সিল্কের টাই পরিহিত মি. পিরজাদা সামনের ঘরে এসে দাঁড়ালেন। প্রতিদিন তিনি প্লাম, অলিভ এবং চকোলেট ব্রাউন রঙের সাজে উপস্থিত হতেন। পিরজাদা ছিলেন একজন পরিপাটি মানুষ। যদিও তার পা দুটো বাইরের দিকে ছড়িয়ে থাকত এবং একটু ভুঁড়ি ছিল, তাও তিনি বেশ একটা কর্মদক্ষ ভঙ্গি বজায় রাখতেন, যেন দু’হাতে দুটো সমান ওজনের সুটকেস ধরে আছেন। তাঁর কানে কয়েকটি চুলের গোছা পেকে গিয়েছিল। দেখে মনে হত, সেগুলো জীবনের অপ্রীতিকর শব্দ থেকে তাঁর কান ঢেকে রেখেছে। তাঁর ঘন পলকওয়ালা চোখে ছিল ধূসরের ছোঁয়া। হৃষ্টপুষ্ট গোঁফটি যেন মজা করে দু’পাশে উঠে আছে আর, বাঁ গালের ঠিক মধ্যিখানে একটা চ্যাপটা কিশমিশের মতো জড়ুল। মাথায় পারসি ভেড়াদের লোম থেকে বানানো একটি কালো রঙের ফেজটুপি পরতেন। ববি পিন দিয়ে আটকানো এই টুপিটি ছাড়া আমি তাঁকে কখনো দেখিনি। আমার বাবা সসময়ই তাঁকে আমাদের গাড়ি করে নিয়ে আসার প্রস্তাব দিতেন, কিন্তু তিনি ডরমিটরি থেকে আমাদের পাড়ার গাছপালা, ঝোপঝাড় দেখতে দেখতে হেঁটে যখন এসে পৌঁছতেন, তখন হেমন্তের তাজা হাওয়ায় তাঁর আঙুলের গাঁটগুলো গোলাপি হয়ে যেত।

“ভারতে আরও এক উদ্বাস্তু।”

“শেষ যা গোনা হয়েছে, তাতে আন্দাজ ন’মিলিয়ন দাঁড়িয়েছে,” আমার বাবা বললেন।

মি. পিরজাদা আমার তাঁর কোটটা দিলেন । আমার কাজ ছিল সিঁড়ির নীচের র‍্যাকে সেটা ঝুলিয়ে রাখা। ধূসর আর নীল রঙের উল দিয়ে ছোট ছোট চেক কাটা, কোটটায় ডোরাকাটা লাইনিং এবং শিং-এর বোতাম লাগানো। বুনটের মধ্যে লেবুর হালকা গন্ধ থাকত। ভিতরে চেনার মতো কোনও লেবেল লাগানো ছিল না। শুধু হাতে সেলাই করা একটা লেবেলে টানা টানা হাতের লেখায় চকচকে কালো সুতো দিয়ে এমব্রয়ডারি করা ছিল ‘জেড সৈয়দ, সুটর্স’। কোনও কোনও দিন বার্চ বা মেপল গাছের একটা পাতা পকেটে ঢোকানো থাকত। তিনি জুতোর ফিতে খুলে জুতোজোড়া বেসবোর্ডের গায়ে হেলান দিয়ে রাখলেন। আমাদের ভিজে, পাতাঝরা লনের ওপর দিয়ে হাঁটায় তাঁর জুতোর ডগায় এবং গোঁড়ায় এক ধরনের সোনালি কাদাটে মিশ্রণ লেগে ছিল। এইসব পোশাকআশাক থেকে মুক্ত হওয়ার পর তিনি তাঁর বেটে, অস্থির আঙ্গুলগুলো আমার গলায় চাপড় দিলেন, ঠিক যেমনভাবে কেউ দেওয়ালে পেরেক গাঁথার আগে সেই জায়গাটা চাপড়ে দেখে নেয় সেটা নিরেট কি না। তারপর তিনি বাবার পিছন পিছন বসবার ঘরে ঢুকলেন। সেখানে টিভিতে স্থানীয় খবর চালানো ছিল। তাঁরা বসবার সঙ্গে সঙ্গে মা রান্নাঘর থেকে এক প্লেট কাবাব আর ধনেপাতার চাটনি নিয়ে আসলেন। মি. পিরজাদা একটা নিয়ে মুখে পুরলেন।

“আমরা শুধুমাত্র আশা করতে পারি যে,” আর-একটা কাবাবের দিকে হাত বাড়িয়ে তিনি বললেন, “ঢাকার রিফিউজিরাও এত ভাল খেতে পায়। এই কথা থেকে মনে পড়ে গেল।” তিনি সুটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দারচিনির হার্ট ভরতি একটা ছোট্ট প্লাস্টিকের ডিম বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, “ বাড়ির ‘লেডি’র জন্য।” তার সঙ্গে ওই ছড়ানো পায়ে প্রায় বোঝাই যায় না এমনভাবে সামান্য ঝুঁকে আমাকে ‘বাও’ করলেন।

“সত্যি মি. পিরজাদা,” মা আপত্তি জানালেন। “রাতের পর রাত। আপনি ওকে বিগড়ে দিচ্ছেন একেবারে।”

“আমি শুধু সেই বাচ্চাদেরই বিগড়ে দেই, যারা বিগড়ে যেতে পারে না।”

আমার কাছে সেটা ছিল একটা অস্বস্তিকর মুহূর্ত। কিছুটা ভয়ে, কিছুটা উৎফুল্ল হয়ে আমি এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করতাম। মি. পিরজাদার হৃষ্টপুষ্ট, দরাজ আভিজাত্য আমাকে মুগ্ধ করত, আমার প্রতি তাঁর মনোযোগে যে আধো-নাটকীয়তা ছিল, তাতে আমি তৃপ্ত বোধ করতাম, কিন্তু তাঁর ভাবভঙ্গিতে যে চূড়ান্ত স্বাচ্ছন্দ্য ছিল, তা আমাকে অস্বস্তিতে ফেলত। মুহূর্তের জন্য মনে হত যেন, আমি নিজের বাড়িতেই আগন্তুক। আমাকে কিছু দেওয়াটা তাঁর একটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অনেক সপ্তাহ ধরে, পরস্পরের সঙ্গে আরও সহজ হওয়ার আগে ওটাই একমাত্র উপলক্ষ ছিল, যখন তিনি আমার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতেন। আমার কোনও উত্তর ছিল না, যখন তিনি আমার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতেন। কোনও মন্তব্য করতাম না আমি ভাবলেশহীন মুখে আমি তাঁর কাছ থেকে মধুভরা লজেঞ্জ, র‍্যাস্পবেরি ট্রাফল, টক প্যাস্টিলের সরু সরু রোল গ্রহণ করে যেতাম। আমি তাঁকে ধন্যবাদও জানাতে পারতাম না। কারণ, একবার বেগুনি সেলোফেনে মোড়া বিশেষভাবে লোভনীয় পিপারমেন্ট ললিপপ পাওয়ার জন্য আমি যখন তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলাম, তখন তিনি বলেছিলেন, “ধন্যবাদ আবার কীসের? ব্যাঙ্কের ভদ্রমহিলা আমাকে ধন্যবাদ জানান, দোকানের ক্যাশিয়ার আমাকে ধন্যবাদ জানান, নির্ধারিত তারিখের পর বই ফেরত দিলে লাইব্রেরিয়ান আমাকে ধন্যবাদ জানান, ঢাকায় আমার ফোনটা লাগানোর চেষ্টা করা হলে ওভারসিস অপারেটর আমাকে ধন্যবাদ জানান। আমাকে যদি এইদেশে সমাধিস্থ করা হয়, তা হলে নিঃসন্দেহে আমার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময়ও আমাকে ধন্যবাদ জানানো হবে।”

মি. পিরজাদার দেওয়া মিষ্টিটা যেমন তেমন ভাবে খাওয়া আমার অশোভন মনে হত। প্রতিটি সন্ধের উপহারের মূল্য আমার কাছে ধনরত্ন বা গুপ্তধনের একটি রত্ন বা মুদ্রার মতোই ছিল। আমি সেটি আমার খাটের পাশে একটি কারুকার্য করা ছোট চন্দনকাঠের বাক্সে রাখতাম। বহু বছর আগে আমার ঠাকুরমা ওই বাক্সে চানের পর খাওয়ার জন্য সুপারি রাখতেন। যে ঠাকুরমাকে আমি কোনোদিন দেখিনি, আমার কাছে সেই ঠাকুরমার একমাত্র চিহ্ন ছিল সেই বাক্সটি। মি. পিরজাদা আমাদের জীবনে আসার আগে পর্যন্ত আমি ওই বাক্সে রাখার মতো কিছুই খুঁজে পেতাম না। মাঝে মাঝেই দাঁত মাজার এবং পরের দিনের জন্য স্কুলের জামাকাপড় বের করে রাখার আগে আমি বাক্সের ঢাকনা খুলে তাঁর দেওয়া মিষ্টিগুলোর মধ্যে খেতাম।

রোজ রাতের মতো সেই রাতেও আমরা ডাইনিং টেবিলে বসে খেলাম না। কারণ টেবিলে বসে ভাল করে টিভি দেখা যেত না। তাই আমরা বাক্যালাপ ছাড়াই, কফি টেবিলের চারপাশে, হাঁটুর ওপর খাবার প্লেট রেখে জড়ো হয়ে বসলাম। মা রান্নাঘর থেকে একের পর এক খাবার আনলেন। ভাঁজা পেয়াজ দেওয়া মুসুরডাল, নারকেল দেওয়া সবুজ বিন, দই-কিশমিশ দেওয়া মাছ। জলের গেলাস, প্লেটভরতি লেবুর টুকরো এবং লঙ্কা নিয়ে আমি তাঁর পিছন পিছন এলাম। শেষের বস্তুটি প্রতি মাসে চায়নাটাউনে গিয়ে পাউন্ডদরে কেনা হত এবং ফ্রিজে জমিয়ে রাখা হত। বড়রা সেগুলো ছিঁড়ে, খাবারে ঘষে খেতে ভালবাসতেন।

খাওয়ার আগে মি. পিরজাদা সবসময় এক অদ্ভুত কাজ করতেন। বুকপকেট থেকে একটা ব্যান্ডহীন, সাদাসিধে রুপোর ঘড়ি বের করতেন, কয়েক মুহূর্তের জন্য সেটি কানের কাছে ধরতেন এবং তর্জনী এবং বুড়ো আঙুলের তিনটে দ্রুত টোকায় ঘড়িটায় দম দিতেন। তিনি আমাকে বুঝিয়েছিলেন যে, তাঁর পকেট ঘড়িটা তাঁর রিস্টওয়াচের মতো নয়। সেটা ঢাকার স্থানীয় সময় অনুযায়ী ঠিক করা আছে। আমাদের সময়ের চেয়ে ১১ ঘণ্টা এগিয়ে। খাওয়ার সময় ঘড়িটা কফি টেবিলে, তাঁর মুড়ে রাখা কাগজের ন্যাপকিনের ওপর রাখা থাকত। তিনি কখনও ঘড়িটা দেখতেন বলে মনে হয় না।

মি. পিরজাদা ভারতীয় নন, এটা জানতে পারার পর আমি তাঁকে ভালভাবে লক্ষ করতাম। কোন দিক দিয়ে তিনি আমাদের চেয়ে আলাদা, তা বোঝবার চেষ্টা করতাম। মনে হল যে, পকেটঘড়িটা তেমনই একটা জিনিস। সে রাতে, তাঁকে সেটি দম দিয়ে কফিটেবিলের ওপর রাখতে দেখে আমার কেমন অস্বস্তি হল। উপলব্ধি করলাম যে, জীবনটা আগে ঢাকায় প্রবাহিত হচ্ছে। কল্পনা করলাম, মি. পিরজাদার মেয়েরা ঘুম থেকে উঠেছে, চুলের ফিতে বাঁধছে, প্রাতরাশের তোড়জোড় করছে, স্কুলের জন্য তৈরি হচ্ছে। আমাদের খাওয়া-দাওয়া, আমাদের কাজকর্ম সবই সেখানে আগেই যাওয়া কাজকর্মের ছায়ামাত্র। মি. পিরজাদা আদতে যেখানকার মানুষ, সেই জায়গাটির এক পিছিয়ে পড়া ছায়া।

সাড়ে ছ’টা জাতীয় খবরের সময়। বাবা ভলিউম বাড়িয়ে এন্টেনাগুলো ঠিক করে দিতেন। আমি সাধারণত কোনও বই নিয়ে বসতাম, কিন্তু সে রাতে বাবা বললেন আমার মন দিয়ে শোনা উচিত। দেখলাম ধুলোয় ঢাকা রাস্তার ওপরে ট্যাঙ্ক গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে, কত বিল্ডিং ধসে পরেছে, অচেনা গাছের জঙ্গলে পূর্ব পাকিস্তানের রিফিউজিরা পালিয়ে ভারতের সীমান্তে আশ্রয় খুঁজছে। পাখার মতো পালতোলা নৌকা প্রশস্ত কফি রঙের নদীতে ভেসে যাচ্ছে, কোনও এক বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা পড়েছে ব্যারিকেডের পিছনে, খবরের কাগজের অফিস পুড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি মি. পিরজাদার দিকে তাকালাম। ছবিগুলো ছোট্ট হয়ে একের পর এক তাঁর চোখের ওপরেও ভেসে উঠছিল। দেখার সময় তাঁর মুখে এক অচঞ্চল ভাব ছিল। অবিচলিত, কিন্তু সজাগ। যেন কেউ তাঁকে অচেনা কোনও জায়গায় পৌঁছানোর নির্দেশ দিচ্ছে।

বিজ্ঞাপনের বিরতির সময় আমারও ভাত আনতে রান্নাঘরে গেলেন মা। বাবা এবং মি. পিরজাদা ইয়াহিয়া খান নামে কোনও জেনারেলের নীতির নিন্দে শুরু করলেন। তাঁরা যেসব চক্রান্তের আলোচনা করছিলেন, আমি সে-সম্বন্ধে কিছুই জানতাম না। আমি সেই বিপর্যয়ের কিছুই বুঝছিলাম না। আমাকে আর-এক টুকরো মাছ দিতে দিতে বাবা বললেন, “ দেখ, তোর বয়সী সব ছেলেমেয়ে, বেঁচে থাকার জন্য কী করতে হচ্ছে তাদের।” কিন্তু আমি আর খেতে পারছিলাম না। আমি শুধু আড়চোখে মি. পিরজাদার দিকে তাকাচ্ছিলাম। তিনি জলপাই-সবুজ জ্যাকেট গায়ে আমার পাশে বসে শান্তভাবে তাঁর ভাতের স্তূপে দ্বিতীয় হাতা ডালের জন্য কুয়ো তৈরি করছিলেন। ওই ধরনের গুরুগম্ভীর ব্যাপারে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মানুষকে যেমন লাগে বলে আমার ধারণা ছিল, তার সঙ্গে মি. পিরজাদার মিল ছিল না। আমি ভাবতাম, উনি কি সবসময় অত পরিপাটিভাবে জামাকাপড় পরে থাকেন যাতে আকস্মিক কোনও দুঃসংবাদ পেলে যথোচিত গাম্ভীর্য এবং সম্মানের সঙ্গে তা সহ্য করতে পারবেন? এমন-কী দরকার পড়লে মুহূর্তের মধ্যে কারও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত হতে পারবেন? আরও ভাবতাম, কেমন হবে, যদি হঠাৎ তাঁর সাত মেয়েকে টিভিতে দেখা যায়? যদি তারা কোনও বারান্দা থেকে মি. পিরজাদার দিকে হেসে, হাত নাড়িয়ে চুমু ছুড়ে দেয়? কল্পনা করতাম, তা হলে তিনি কত আশ্বস্ত হবেন। কিন্তু সেরকম কখনও হত না।

সে রাতে যখন আমি দারচিনির হার্টওয়ালা প্লাস্টিকের ডিমটা আমার খাটের পাশে বাক্সে রাখলাম, তখন অন্য দিনের মতো প্রাপ্তির আনন্দ হল না। আমি লেবুর গন্ধওলা ওভারকোট পরা মি. পিরজাদার কথা মনে না করার চেষ্টা করছিলাম। কয়েক ঘণ্টা আগে, আমাদের উজ্জ্বল, কার্পেট-বিছানো বসবার ঘরে যে বিশৃঙ্খল, গরমে ঝলসানো জগতের ছবি দেখছিলাম, তার সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আছে। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে আমি ওই কথা ছাড়া আর কিছু ভাবতেই পারলাম না। টিভির পরদায় মাঝে মাঝেই যে তাড়িত, অশান্ত মানুষের দল দেখা যাচ্ছিল, মি. পিরজাদার স্ত্রী এবং সাত মেয়ে তেমন কোনও দলের সদস্য, এই দুর্ভাবনায় আমার পেটের ভিতর কীরকম করছিল। ছবিটা মন থেকে তাড়ানোর জন্য আমি ঘরের চারপাশে তাকালাম, হলুদ চাদর দেওয়া আমার বিছানা, তার সঙ্গে রঙ মিলিয়ে জালি দেওয়া পরদা, সাদা-বেগুনি কাগজ লাগানো দেওয়ালে টাঙানো ফ্রেমে সাঁটা ক্লাসের ছবি, দেওয়াল-আলমারির দরজার ওপর পেনসিলের লেখা, সেখানে বাবা প্রতি জন্মদিনে আমার উচ্চতা মাপেন। কিন্তু যতই আমি নিজের মনটাকে অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করলাম, ততই আমি নিজেকে বোঝাতে থাকলাম যে, মি. পিরজাদার স্ত্রী-কন্যারা হয়তো মারাই গিয়েছেন। শেষে আমি বাক্স থেকে এক টুকরো চৌকো সাদা চকোলেট বের করে, মোড়ক খুললাম। তারপর আমি এমন একটা কাজ করলাম, যা আগে কখনও করিনি। চকোলেটটা মুখে পুরে, সেটা মুখে রেখে যথাসম্ভব গলে যেতে দিলাম। তারপর আস্তে আস্তে সেটা চিবানোর সঙ্গে সঙ্গে প্রার্থনা করলাম যে, মি. পিরজাদার পরিবার যেন নিরাপদে সুস্থ থাকে। আমি এর আগে কখনও কিছুর জন্য প্রার্থনা করিনি। আমাকে কখনো প্রার্থনা করতে বলা বা শেখানোও হয়নি। কিন্তু আমি ঠিক করলাম যে, সেই পরিস্থিতিতে আমার প্রার্থনা করা উচিত। কারণ, আমার ভয় হচ্ছিল, সত্যি সত্যি দাঁত মাজে হয়ত তার সঙ্গে প্রার্থনাও ধুয়ে যাবে। আমি ব্রাশটা ভিজিয়ে, টুথপেস্টের টিউবটা একটু সরিয়ে রাখলাম যাতে আমার মা বাবা কোনও প্রশ্ন না করেন। তারপর জিভে চিনি লেগে থাকা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পরলাম।

যে যুদ্ধের বৃত্তান্ত আমাদের বসবার ঘরে এত বিশ্বস্তভাবে শোনা হত, সেই যুদ্ধ নিয়ে আমাদের স্কুলে কোনও হত হত না। আমরা আমেরিকার বিদ্রোহ নিয়ে পড়াশুনা চালিয়ে গেলাম। প্রতিনিধিত্ব ছাড়া কর মকুব করা কত অন্যায় তা শিখলাম এবং ডিক্লারেশন অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স-এর কয়েকটি অংশ মুখস্থ করলাম। টিফিন টাইমে ছেলেরা দু’দলে ভাগ হয়ে দোলনা, ঢেঁকির চারদিকে পরস্পরকে তাড়া করে বেড়াত। একপক্ষে লালকোট, বিপক্ষে কলোনি। ক্লাসরুমে আমাদের শিক্ষিকা মিসেস কেনিয়ন মাঝে মাঝে ই আমাদের একটা ম্যাপ দেখাতেন । সিনেমার পরদার মতো মানচিত্রটা চকবোর্ডের ওপর থেকে বেরিয়ে আসত, মিসেস কেনিয়ন আমাদের ‘মে-ফ্লাওয়ারের’র যাত্রাপথ বা লিবার্টি বেল কোথায় অবস্থিত দেখাতেন। প্রতি সপ্তাহে ক্লাসের দু’জন সদস্য রেভলিউশন-এর কোনও একটি বিশেষত্বের ওপর রিপোর্ট পেশ করত। তাই একদিন, ইয়র্কটাউনে আত্মসমর্পণের অধ্যায় সম্পর্কে শেখার জন্য আমার বন্ধু ডোরার সঙ্গে স্কুলের লাইব্রেরিতে পাঠানো হল। মিসেস কেনিয়ন আমাদের একটা কাগজে তিনটে বইয়ের নাম লিখে দিলেন যেগুলো কার্ড ক্যাটালগে খুঁজে বের করতে হবে। আমরা বইগুলো একবারেই খুঁজে পেলাম; পড়ে নোটস নেওয়ার জন্য একটা নিচু গোল টেবিলে বসলাম। কিন্তু আমি পড়ায় মন দিতে পারছিলাম না। ব্লন্ডুডের তাকগুলোর যে অংশে আমি ‘এশিয়া’ লেখা লেবেল দেখেছিলাম সেখানে ফিরে গেলাম। চিন, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া সম্পর্কে বই রয়েছে সেখানে। শেষ ‘পাকিস্তান : আ ল্যান্ড অ্যান্ড ইটস পিপল’ নামে একটা বই দেখে একটা টুলে বসে বইটা খুললাম। বইয়ের মলাটটা আমার আঙুলের ভিতর খসখস করে উঠল। নদী, ধানক্ষেত, সৈন্যের পোশাক-পরা লোকদের ছবিওয়ালা পাতাগুলো ওলটাতে শুরু করলাম। একটা অধ্যায় ঢাকা নিয়ে লেখা। আমি ঢাকার বৃষ্টিপাত আর চটের উৎপাদন সম্পর্কে পরতে শুরু করলাম। জনসংখ্যার ওপর একটা চার্ট পড়ছিলাম, এমন সময় ডোরা এসে দাঁড়াল।

“এখানে কী করছিস? মিসেস কেনিয়ন লাইব্রেরিতে এসেছেন। আমরা ঠিক করে পরছি কি না দেখতে এসেছেন।”

আমি চটাস করে বইটা বন্ধ করলাম। শব্দটা একটু বেশি জিরেই হয়ে গেল। মিসেস কেনিয়ন এলেন। তাকের মাঝখানের সরু চলাচল-পথটার পুট (স্পাইন) ধরে এমনভাবে তুললেন যেন আমার সোয়েটারে লেগে থাকা কোনও চুল তুলছেন। মলাটটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে তারপর আমার দিকে তাকালেন।

“এই বইটা কি তোমার রিপোর্টে কাজে লাগবে, লিলিয়া?”

‘না, মিসেস কেনিয়ান।”

“তা হলে বইটা পরার কোনও কারণ দেখছি না,” তিনি বইটা তাকের সরু ফাঁকে রেখে দিয়ে বললেন। “তুমি কি দেখছ?”

যত সপ্তাহ যেতে লাগল, খবরে ঢাকার কোনও ছবি দেখতে পাওয়া কঠিন হয়ে পরল। প্রথম বা কখনও দ্বিতীয় বিরতির পর রিপোর্ট পাওয়া যেত। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব করে, সাংবাদিকদের সরিয়ে, আটকে, অন্য পথে চালিত করা হচ্ছিল। কোনও কোনও দিন, প্রায়দিনই, শুধু মৃতের সংখ্যা জানানো হত। আর তার আগের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি। আরও কয়েকজন কবিকে মেরে ফেলা হয়েছিল, আরও কয়েকটি গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এতসব হওয়া সত্ত্বেও, মা বাবা এবং মি. পিরজাদা রাতের পর রাত সময় নিয়ে, ধীরে সুস্থে রাতের খাবার খেতেন। টিভি বন্ধ করার পর, থালাবাসন ধুয়ে শোকানো হয়ে গেলে, তাঁরা মজা করতেন, গল্প করতেন এবং চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খেতেন। রাজনীতি নিয়ে আলোচনা একঘেয়ে হয়ে গেলে আলোচনার বিষয় ছিল, নিউ ইংল্যান্ডের পত্রমোচী বৃক্ষ সম্পর্কে মি। পিরজাদার বই কদ্দুর এগোল, আমার বাবার কার্যকালের মেয়াদের মনোনয়ন বা মায়ের ব্যাংকের আমেরিকান সহকর্মীদের খাওয়া-সংক্রান্ত অদ্ভুত অভ্যেস ইত্যাদি। কিছুক্ষণ পর আমাকে হোমওয়ার্ক করার জন্য ওপরে পাঠিয়ে দেওয়া হত, কিন্তু কার্পেটের মধ্যে দিয়ে আমি শুনতে পেতাম যে, তারা আরও চা খাচ্ছেন, ক্যাসেটে কিশোরকুমারের গান শুনছেন, কফি টেবিলের ওপর স্ক্র্যাবল খেলছেন, গভীর রাত পর্যন্ত ইংরেজি বানা নিয়ে তর্কাতর্কি, হাসাহাসি করছেন। আমি ওদের সঙ্গে যোগ দিতে চাইতাম। সবচেয়ে বেশি ইচ্ছে করত মি. পিরজাদাকে সান্ত্বনা জানাতে। কিন্তু তাঁর পরিবারের কথা ভেবে এক টুকরো চকোলেট খাওয়া এবং নিরাপত্তার জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না। তাঁরা এগারোটার খবর শুরু হওয়ার আগে পর্যন্ত স্ক্র্যাবল খেলতেন। তারপর মাঝরাত নাগাদ মি. পিরজাদা হেঁটে তাঁর ডর্মিটরিতে ফিরে যেতেন। সেইজন্য আমি কখনও তাঁকে চলে যেতে দেখিনি, কিন্তু রোজ রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমি তিনজনের কথাবার্তা শুনতে পেতাম। পৃথিবীর অপর প্রান্তে এক নতুন দেশের জন্মের সম্ভাবনার কথা।

অক্টোবর মাসে একদিন মি. পিরজাদা এসে জিজ্ঞেস করলেন, “ সব বাড়ির দরজায় ওই বড় বড় কমলা রঙের সবজিগুলো কী? কোনও ধরনের লাউ নাকি?”

“ওটা কুমড়ো,” মা বললেন। “লিলিয়া, মনে করিয়ে দিস তো সুপারমার্কেট থেকে একটা কিনতে হবে।”

“ওটা দিয়ে কী করে? এটা কীসের চিহ্ন?”

“এটা দিয়ে জ্যাক-ও-ল্যান্টার্ন বানায়,” আমি জানালাম। বোঝানোর জন্য দাঁত খিঁচিয়ে একটা হিংস্র হাসি হাসলাম। “এভাবে ভয় পাওয়ানোর জন্য।”

“বুঝলাম,” মি. পিরজাদা প্রত্যুত্তরে হাসলেন। “খুবই উপকারী মনে হচ্ছে।”

পরের দিন মা একটা দশ পাউন্ডের মোটাসোটা, গোলগাল কুমড়ো কিনলেন। সেটা ডাইনিং টেবিলের ওপর রাখা হল। খাওয়ার আগে, যখন বাবা এবং মি. পিরজাদা স্থানীয় খবর দেখছিলেন, তখন মা আমাকে বললেন পেন দিয়ে ফলটা সাজাতে। কিন্তু আমি পাড়ায় যেমন দেখেছিলাম, সেভাবে ওটাকে কেটে সাজাতে চাইছিলাম।

“হ্যাঁ, চলো, ওটাকে কেটে সাজানো যাক,” মি. পিরজাদা সোফা থেকে উঠলেন। “আজ খবর চুলোয় যাক।” কিছু জিজ্ঞেস না করে রান্নাঘরে গেলেন।, একটা ড্রয়ার খুললেন, তারপর একটা লম্বা খাঁজকাটা ছুরি নিয়ে ফিরে এলেন। সম্মতির জন্য তিনি আমার দিকে তাকালেন। “আমি করি?”

আমি সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়লাম। সেই প্রথমবার আমরা সকলে ডাইনিং টেবিলের চারপাশে জড়ো হলাম। মা, বাবা, মি. পিরজাদা এবং আমি। টিভি চলা সত্ত্বেও কেউ আর ওদিকে মন দিল না। আমরা খবরের কাগজ দিয়ে টেবিলটা ঢাকলাম। মি. পিরজাদা তাঁর জ্যাকেটটা খুলে একটা চেয়ারের পিঠে ঝুলিয়ে উপল পাথরের একজোড়া কাফলিঙ্ক খুলে রেখে তাঁর মাড় দেওয়া শার্টের হাতাগুলো গুটিয়ে নিলেন।

“প্রথমে ওপরদিকটা কাটুন। এভাবে,” আমি তর্জনী ঘুরিয়ে কায়দাটা দেখিয়ে নির্দেশ দিলাম।

মি. পিরজাদা প্রথমে ছুরির ফলার গায়ে ঢুকিয়ে সেটাকে চারপাশে ঘোরালেন। একটা গোটা বৃত্ত কাটা হয়ে যাওয়ার পর তিনি ওপরের ঢাকার মতো অংশটার বোঁটা তুলে ধরলেন। সেটা খুব সহজেই আলগা হয়ে উঠে আসল। এক মুহূর্তের জন্য মি. পিরজাদা ফলটার ওপর ঝুঁকে পড়ে ভিতরটা দেখলেন এবং শ্বাস ভরে গন্ধটা নিলেন। তারপর মা তাঁকে একটা লম্বা ধাতব চামচ দেওয়াতে সেটা দিয়ে ভিতরের অংশটা পরিষ্কার করে চেঁছে বের করলেন যতক্ষণ না শেষ সুতো, শেষ বীজটাও বেরিয়ে গেল। ইতিমধ্যে বাবা শাঁস থেকে বীজ বাদ দিয়ে একটা বিস্কুট করার শীট-এর ওপর শুকোতে দিয়েছিলেন, যাতে পরে আমরা সেগুলো ঝলসে খেতে পারি। ফলটার দাগকাটা গায়ে আমি দুটো ত্রিভুজ আঁকলাম। মি. পিরজাদা সে দুটো কেটে দিলেন। তারপর আমি ভুরুর জন্য দুটো অর্ধচন্দ্রাকার এবং নাকের জন্য আর একটা ত্রিভুজ আঁকলাম। ধুধু মুখটাই বাকি ছিল। মনে হল দাঁত তৈরি করাটা একটু কঠিন হবে, আমি ইতস্তত করছিলাম।

“হাসবে, নাকি মুখ বেঁকিয়ে থাকবে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“তুমিই বলো,” মি. পিরজাদা বললেন।
সমঝোতা করার জন্য একটা সোজাসাপটা গম্ভীর মতো মুখ আঁকলাম, বিষণ্ণ নয়, হাসি-হাসিও নয়। মি. পিরজাদা একটুও না দমে গিয়ে কাটতে শুরু করলেন, যেন সারা জীবন জ্যাক_ও ল্যান্টার্ন কেটে এসেছেন। তাঁর কাজ প্রায় শেষ হয়েই গিয়েছিল যখন জাতীয় খবর শুরু হল। সাংবাদিক ঢাকার নাম উল্লেখ করলেন এবং আমরা সকলেই শোনার জন্য টিভির দিকে ফিরলাম। একজন ভারতীয় কর্মকর্তা ঘোষণা করলেন যে, বাকি পৃথিবী যদি পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তুদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে না দেয়, তা হলে ভারতকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। খবরটা শোনানোর সময় সাংবাদিকটির মুখ থেকে ঘাম ঝরে পরছিল। কোনও টাই বা জ্যাকেট ছাড়াই এমন জামাকাপড় পরেছিলেন যেন, তিনি নিজেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছেন। ক্যামেরাম্যানকে চিৎকার করে কথাগুলো বলার সময় তিনি তাঁর রোদে পোড়া মুখটা সূর্যের তাপ থেকে বাঁচানোর জন্য হাত দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন। মি. পিরজাদার হাত থেকে ছুরিটা ফসকে পরে গিয়ে কুমড়োটার নীচের দিকটা কেটে গেল।

“প্লিজ আমাকে ক্ষমা করবেন,” মি. পিরজাদা তাঁর তাঁর মুখের একপাশে একটা হাত তুললেন, যেন কেউ তাঁকে সেই গালে থাপ্পড় মেরেছে। “আমি --এ তো ভয়ংকর ব্যাপার। আমি আর-একটা কিনে দেব। আমরা আবার চেষ্টা করব।”

“আরে না, না, “ বাবা বললেন। তিনি মি. পিরজাদার হাত থেকে ছুরিটা নিয়ে ফলটা এমনভাবে কাটলেন যাতে ভুলটা ঢাকা পড়ে যায়। আমার আঁকা দাঁতগুলো অদৃশ্য হয়ে গেল। তার জায়গায় একটা বেখাপ্পা রকমের বড় পাতিলেবুর মাপের ফুটো তৈরি হল এবং তার ফলে আমাদের জ্যাক-ও-ল্যান্টার্নের মুখে এক শান্ত স্তম্ভিত ভাব এসে গেল। ভুরুগুলো আর রাগী রাগী দেখতে রইল না। বরং এক শূন্য, জ্যামিতিক দৃষ্টির ওপর বিস্ময়ে স্থির হয়ে ভাসতে থাকল।

হ্যালোউইনে আমি ডাইনি সেজেছিলাম। আমরা ট্রিক-অর ট্রিট-এর সঙ্গী ডোরাও ডাইনি হয়েছিল। বালিশের ওয়াড় রঙ করে আমরা কালো কেপ (হাতকাটা ক্লক) বানিয়েছিলাম, সেই সঙ্গে কার্ডবোর্ডের চওড়া কানাওয়ালা আইসক্রিম কোনের মত টুপি। ডোরার মায়ের একটা ভাঙ্গা আইশ্যাডো দিয়ে আমরা আমাদের মুখে সবুজ রঙ লাগালাম। আমার মা লজেঞ্জ রাখার জন্য আমাদের দুটো মোটা ক্যানভাসের বস্তা দিলেন, যার মধ্যে একসময় বাস্মতী চাল ছিল। সে বছর আমাদের মা-বাবাদের মনে হয়েছিল যে, আমরা একা একা পাড়ায় ঘুরে বেড়ানোর জন্য যথেষ্ট বড় হয়ে গিয়েছি। কথা ছিল আমি আমাদের বাড়ি থেকে ডোরার বাড়ি হেঁটে যাব, সেখান থেকে ফোন করে জানাব যে আমি নিরাপদে পৌঁছেছি এবং তারপর ডোরার মা আমাকে গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দেবেন। বাবা আমাদের টর্চ দিলেন। আমাকে ঘড়ি পরতে হল এবং তাঁর ঘড়ির সঙ্গে সময় মিলিয়ে নিতে হল। আমাদের ন’টার চেয়ে বেশি দেরি করার অনুমতি ছিল না।

সেই সন্ধেয় মি. পিরজাদা এসে আমাকে এক বাক্স মিন্ট ভরতি চকোলেট দিলেন।

“এর মধ্যে,” আমি বস্তাটা খুলে ধরে বললাম, “ট্রিক অর ট্রিট।”

“বুঝতে পেরেছি যে, আজ তোমার আমার উপহারের দরকার নেই,” বাক্সটা জমা দিয়ে তিনি বললেন। মি. পিরজাদা আমার সবুজ মুখ এবং টুপির দিকে তাকালেন। টুপিটা একটা সুতো দিয়ে আমার চিবুকের তলায় বাঁধা ছিল। খুব সাবধানে তিনি আমার টুপিটার প্রান্ত একটু তুলে ধরলেন। আমি টুপির নীচে একটা একটা সোয়েটার এবং ভেড়ার লোমের চিন দেওয়া জ্যাকেট পরেছিলাম। “তোমার শীত করবে না তো?”

আমি ঘাড় নাড়লাম, টুপিটা একদিকে হেলে গেল।

মি. পিরজাদা টুপিটা সোজা করে দিলেন। “স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকাই বোধ হয় ভাল।”

আমাদের সিঁড়ির নীচটা ছোট ছোট লজেঞ্জের বাক্সে ভরতি হয়ে ছিল। মি. পিরজাদা জুতো খুলে অন্যদিনে মতো সেখানে না রেখে দেওয়াল আলমারির ভিতর রেখে কোটের বোতাম খুলতে শুরু করলেন। আমি তাঁর কোটটা নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলাম, কিন্তু ডোরা বাথরুম থেকে আমাকে ডেকে বলল যে, চিবুকে একটা জড়ুল আঁকার জন্য আমার সাহায্য চাই। আমরা প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার পর মা ফায়ারপ্লেসের সামনে দাঁড় করিয়ে আমাদের একটা ফোটো তুললেন। তারপর আমি বেরোব বলে সদর দরজা খুললাম। মি. পিরজাদা এবং আমার বাবা তখনও বসার ঘরে যাননি, সামনের ঘরেই ঘোরাঘুরি করছিলেন। বাইরে আঁধার নেমে এসেছিল। হাওয়ায় ভিজে পাতার গন্ধ। দরজার পাশে ঝোপের সামনে আমাদের জ্যাক-ও ল্যান্টার্নটা মিটমিট করে কিন্তু সদর্পে জ্বলছিল। দূর থেকে দ্রুতপায়ে দৌড়ানোর শব্দ, যে ছেলেরা শুধুই একটি করে রাবারের মুখোশ পরে বেরিয়েছিল, তাদের চিৎকার এবং ছোট ছোট বাচ্চাদের জামাকাপড়ের খসখসানি ভেসে এলো। কেউ কেউ এত ছোট ছিল যে, মা-বাবারা কোলে করে তাদের দরজায় দরজায় নিয়ে যাচ্ছিলেন।

“যে বাড়িটা চেনো না, সেখানে যেয়ো না যেন,” মা সাবধান করলেন।

মি. পিরজাদা ভুরু কোঁচকালেন। “কোনও বিপদের সম্ভাবনা আছে নাকি?”

“না না,” মা তাঁকে আশ্বস্ত করলেন। “সব ছেলেমেয়েই বেরোবে আজকে। এটা তো একটা ঐতিহ্য।’’

“আমার বোধ হয় ওদের সংগে যাওয়া উচিত?” মি. পিরজাদা প্রস্তাব দিলেন। মোজা পরা ছড়ানো পায়ে দাঁড়ানো দেখে হঠাৎ কেমন ক্লান্ত, ছোটখাটো মনে হল তাঁকে। তাঁর চোখে একটা আতঙ্কের ছাপ দেখলাম, যে আগে কখনও দেখিনি। যথেষ্ট ঠাণ্ডা সত্ত্বেও আমি আমার বালিশের ওয়াড়ের মধ্যে ঘামতে শুরু করলাম।

“না না মি. পিরজাদা,” মা বললেন। “লিলিয়া ওর বন্ধুর সঙ্গে একদম নিরাপদ থাকবে।”

“কিন্তু যদি বৃষ্টি পড়ে? যদি ওরা হারিয়ে যায়?”

“চিন্তা করবেন না,” আমি বললাম। সেই প্রথমবার আমি ওই কথাগুলো মি. পিরজাদাকে বললাম। খুব সামান্য কয়েকটি কথা, কিন্তু যেগুলো সপ্তাহের পর সপ্তাহ তাঁকে বলার চেষ্টা করেও পারিনি। শুধু আমার প্রার্থনাতেই বলতে পেরেছিলাম। এবার আমার লজ্জা লাগল ভেবে যে, আমি শুধু নিজের জন্যই কথাগুলো বললাম।

মি. পিরজাদা তাঁর একটা মোটাসোটা আঙুল আমার গালে রাখলেন। তারপর আঙুলটা নিজের হাতের পিছনে চেপে ধরলেন। একটা হালকা সবুজ ছাপ পড়ল। “যদি ‘লেডি’ তাই চান,” তিনি মেনে নিলেন। তারপর ছোট্ট করে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালেন।

আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের কালো ছুঁচোলো সস্তা জুতা পায়ে অল্প হোঁচট খেতে খেতে এগোলাম। ড্রাইভ-ওয়ের শেষে হাত নাড়ার জন্য ফিরে ফিরে তাকিয়ে দেখলাম দরজার ফ্রেমের মধ্যে, আমার মা আর বাবার মাঝখানে বেঁটেখাটো মানুষটি দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন।

“ওই লোকটি আমাদের সঙ্গে আসতে চাইছিল কেন?” ডোরা জিজ্ঞেস করল।
“ওর মেয়েদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।” বলার সঙ্গে সঙ্গেই আমার আফসোস হল। মনে হল যেন আমার বলার জন্য কথাটা সত্যি হয়ে গেল, যেন মি. পিরজাদার মেয়েদের সত্যিই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এবং তিনি আর কখনও তাদের দেখতে পাবেন না।
“মানে তাদের কি ছেলেধরায় নিয়ে গিয়েছে? ডোরা প্রশ্ন করল।

“পার্ক বা কোনও জায়গা থেকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছে।”

“ঠিক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তা নয়। আমি বলতে চাইছিলাম যে, মেয়েদের কথা ওঁর খুব মনে পড়ে। তারা একটা অন্য দেশে থাকে আর তিনি অনেকদিন তাদের দেখেননি তো, তাই।”

আমরা ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে কলিং বেল বাজালাম। কেউ কেউ ভৌতিক পরিবেশ তৈরি করার জন্য সব আলো নিভিয়ে রেখেছিলেন। কেউ জানালায় রাবারের বাদুড় ঝুলিয়েছিলেন। ম্যাকেন্টয়ারদের দরজার সামনে একটা কফিন রাখা ছিল। মি. ম্যাকেন্টয়ার চকের গুঁড়ো মেখে নিঃশব্দে কফিন থেকে উঠে আমাদের বস্তার ভিতর মুঠোভরতি ক্যান্ডি কর্ন ঢেলে দিলেন। অনেকেই আমাকে বললেন যে, তাঁরা আগে কখনও ভারতীয় ডাইনি দেখেননি। অন্যরা কোনও মন্তব্য না করে যা দেওয়ার দিয়ে দিলেন। টর্চের সমান্তরাল আলোর রেখা ফেলে এগোতে এগোতে আমরা দেখলাম রাস্তার মাঝখানে ফাটা ডিম, শেভিং ক্রিম মাখানো দাড়ি, গাছের মরা ডালে মালার মতো করে ঝোলান টয়লেট পেপার। যতক্ষণে আমরা ডোরার বাড়ি পৌঁছলাম, ততক্ষণে ভারি বস্তাগুলো বয়ে আমাদের হাতে দাগ হয়ে গিয়েছে। পা ফুলে ব্যথা করছে। ডোরার মা আমাদের কালশিটের জন্য ব্যান্ডেজ দিলেন, উষ্ণ সিডার এবং ক্যারামেল্ পপকর্ন খেতে দিলেন। তিনি আমাকে মনে করালেন যে, মা-বাবাকে ফোন করে জানাতে যে আমি নিরাপদে পৌঁছে গিয়েছি। আমি যখন ফোন করলাম তখন পিছনে টিভির আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমার গলা শুনে মা যে খুব আশ্বস্ত হলেন তা মনে হল না। ফোনটা রাখার পর খেয়াল হল যে, ডোরার বাড়িতে টিভি চলছিল না। ডোরার বাবা সোফায় শুয়ে একটা পত্রিকা পড়ছিলেন। কফি-টেবিলের ওপর এক গেলাস ওয়াইন রাখা ছিল, স্টিরিয়োতে স্যাক্সোফোন সংগীত বাজছিল।

ডোরা আর আমি আমাদের লুট পরীক্ষা করলাম। গোনাগুনি, নমুনা চেখে দেখা, লেনদেন ইত্যাদি করার পর আমরা সন্তুষ্ট হলে ডোরার মা তাঁদের গাড়িতে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিলেন। আমি তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে দরজা অবধি পৌঁছানো পর্যন্ত তিনি ড্রাইভওয়েতে অপেক্ষা করলেন। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় দেখতে পেলাম যে, আমাদের কুমড়োটা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গিয়েছে। মোটা খোসাটা টুকরো টুকরো হয়ে ঘাসের ওপর ছড়িয়ে ছিল। আমার চোখ জ্বালা করে উঠল, গলার কাছে একটা ব্যথা অনুভব করলাম। যেন আমার অবসাদগ্রস্ত পায়ের তলায় প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে যে ছোট্ট ধারালো নুড়িপাথরগুলো আওয়াজ তুলছিল, সেগুলো কেউ আমার গলায় ঠেসে দিয়েছে। আমি দরজা খুললাম। ভেবেছিলাম যে ওঁরা তিনজন সামনের ঘরে দাঁড়িয়ে আমাকে স্বাগত জানানোর অপেক্ষা করবেন। আমাদের নষ্ট হয়ে যাওয়া কুমড়োটার জন্য দুঃখ প্রকাশ করবেন। কিন্তু সেখানে কেউ ছিল না। বসার ঘরে মি. পিরজাদা, বাবা এবং মা সোফার ওপর পাশাপাশি বসে ছিলেন। টিভিটা বন্ধ। মি. পিরজাদা মাথায় হাত দিয়ে বসে।
সেই সন্ধে এবং তার পরবর্তী অনেক সন্ধেবেলায় তাঁরা যা শুনেছিলেন, তা এই যে, ভারত এবং পাকিস্তান ক্রমশই যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে। দু’পক্ষের সৈন্যরাই সীমান্তে উপস্থিত। স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুতেই ঢাকা সন্তুষ্ট হতে চাইছিল না। শোনা গেল যে, যুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানের মাটিতেই হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পশ্চিম পাকিস্তানকে সমর্থন করছিল। ভারত এবং শীঘ্রই যা বাংলাদেশ বলে পরিচিত হবে, তাদের পক্ষে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। ৪ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধ ঘোষিত হল। বারো দিন পর তাদের রসদের থেকে ৩,০০০ মা ইল দূরে যুদ্ধ করতে করতে দুর্বল হয়ে পর পাকিস্তানি সৈন্য ঢাকায় আত্মসমর্পন করল। এসব কথা আমি এখন জানতে পেরেছি। কারণ, এখন যে-কোনও ইতিহাস, যে-কোনও গ্রন্থাগারে এসব তথ্য পাওয়া যায়। কিন্তু সেই সময়, কয়েকটি এলোমেলো যোগসূত্র ছাড়া ব্যাপারটা বেশিরভাগই আমার কাছে এক রহস্য ছিল। সেই বারো দিনের যুদ্ধের যেটুকু স্মৃতি আমার আছে, তা হল, বাবা আমাকে আর তাঁদের সঙ্গে খবর শুনতে বলতেন না। মি. পিরজাদা আমার জন্য লজেঞ্জ আনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মা রাতের খাবারের জন্য ভাত আর সেদ্ধ ডিম ছাড়া কিছুই রাঁধতেন না। মনে আছে কোনও কোনও রাতে আমি মাকে সোফার ওপর চাদর-কম্বল পাততে সাহায্য করতাম যাতে মি. পিরজাদা সেখানে শুতে পারেন। মাঝরাতে যখন মা-বাবা কলকাতায় আমাদের আত্মীয়স্বজনদের ফোন করে পরিস্থিতির খুঁটিনাটি খবরাখবর জানতে চাইতেন, তখন আমি তাঁদের তীক্ষ্ণ কণ্ঠের উচ্চস্বরে কথোপকথন শুনতে পেতাম। সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে, সেই সময় তিনজন যেন একজন মানুষের মতোই ব্যবহার করছিলেন যেন একটাই শরীর, একই খাবার, একই নৈঃশব্দ এবং ভয়।

জানুয়ারি মাসে মি. পিরজাদা ঢাকায় তাঁর তিনতলা বাড়িতে ফিরে গেলেন বাড়িটার কতটা অবশিষ্ট আছে দেখার জন্য। বছরের সেই সপ্তাহগুলোয় আমরা তাঁর বেশি দেখা পেতাম না। তিনি তাঁর লেখা শেষ করতে ব্যস্ত ছিলেন। আমরাও ফিলাডেলফিয়া গিয়েছিলাম মা-বাবার বন্ধুর সঙ্গে বড়দিনের ছুটি কাটাতে। ঠিক যেমন আমাদের বাড়িতে তাঁর প্রথমবার আসার কথা মনে নেই, তেমনই তাঁর শেষবার আসার কথাও মনে নেই। এক দুপুরে, আমি যখন স্কুলে ছিলাম, তখন বাবা মি. পিরজাদাকে গাড়ি করে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিলেন। তারপর অনেকদিন আমরা তাঁর কোনও খবর পাইনি। টিভিতে খবরের সামনে খাবার খেতে খেতে আমাদের সন্ধেগুলো আগের মতোই কাটতে লাগল। একমাত্র তফাত ছিল যে, মি. পিরজাদা এবং তাঁর বাড়তি ঘড়িটি আমাদের সঙ্গে আর থাকত না। খবর অনুযায়ী, ঢাকা একটি নতুন সংসদীয় সরকার গঠন করে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল। নতুন নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সদ্য জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন। যুদ্ধে যে দশ লক্ষেরও বেশি বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল, তার জায়গায় নতুন নির্মাণের জন্য তিনি অনেক দেশের কাছ থেকে নির্মাণ-সামগ্রী চাইলেন। ভারত থেকে অসংখ্য উদ্বাস্তু ফিরে আসল। আমরা জানলাম, বেকারত্ব এবং দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা তাদের স্বাগত জানানোর জন্য অপেক্ষা করছে। মাঝে মাঝেই আমি বাবার ডেস্কের ওপর টাঙানোর মানচিত্রটা খুঁটিয়ে দেখতাম এবং সেই ছোট হলুদ অংশটায় গলদঘর্ম মি. পিরজাদাকে কল্পনা করার চেষ্টা করাতাম। কল্পনা করতাম যে, একটা স্যুট পরিহিত অবস্থায় তিনি তাঁর পরিবারকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন। ততদিনে অবশ্য সেই ম্যাপটা অকেজো হয়ে গিয়েছিল।

অবশেষে কয়েকমাস পর ইসলামী নববর্ষের স্মরণে মি. পিরজাদা আমাদের একটি কার্ড এবং একটি ছোট চিঠি পাঠালেন। তিনি লিখেছিলেন যে, তিনি তাঁর স্ত্রী এবং সন্তানদের সঙ্গে পুনর্মিলিত হয়েছেন। সকলেই ভাল আছেন। আগের বছরের ঘটনাগুলোর সময় তাঁর স্ত্রী-কন্যারা শিলং-এর পাহাড়ে, তাঁর স্ত্রীর দাদু-দিদিমার এস্টেটে থেকে নিজেদের রক্ষা করেছেন। তাঁর সাত মেয়ে আগের চেয়ে বেশি লম্বা হওয়া ছাড়া একইরকম আছে। তিনি এখনও তাদের নাম মনে রাখতে পারেন না। চিঠির শেষে তিনি আমাদের আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে লিখলেন যে, যদিও তিনি এখন ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ কথাটির অর্থ জানেন, তবুও কথাগুলো তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য যথেষ্ট নয়। সুসংবাদ পাওয়ার খুশিতে মা সে রাতে ভাল ভাল রান্না করলেন। কফিটেবিলে খেতে বসে আমরা নিজেদের জলের গেলাস তুলে শুভকামনা করলাম। কিন্তু আমার শুভ সংবাদ পালন করতে ইচ্ছে করছিল না। যদিও আমি তাঁকে কয়েক মাস দেখিনি, মি. পিরজাদার অনুপস্থিতি আমি যেন তখনই উপলব্ধি করলাম। সেই মুহূর্তেই, তাঁর নামের র জলের গেলাসটা উঠিয়ে, আমি যেন বুঝতে পারলাম যে, বহু মেইল এবং অনেক সময়ের দূরত্বে থাকা কারও কথা মনে পড়লে কীরকম মনখারাপ লাগে। যেমন অতদিন ধরে মি. পিরজাদার তাঁর স্ত্রী-কন্যার কথা মনে পড়ত। তাঁর আমাদের কাছে ফিরে আসার কোনও কারণ ছিল না। বা-বাবাই ঠিক বলেছিলেন যে, তাঁর সঙ্গে আমাদের আর কখনও দেখা হবে না। জানুয়ারি মাস থেকে, মি. পিরজাদার পরিবারের কথা মনে করে প্রতি রাতে শুতে যাওয়ার আগে আমি হ্যালোউইন থেকে বাঁচিয়ে রাখা একটা করে লজেঞ্জ খেতাম। সে রাতে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত একদিন আমি পড়ে-থাকা উপহারগুলো ফেলে দিলাম।

 

উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ...