Saturday, April 21, 2018

ফিফটি টু – পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম এক তিমির গল্প


সমুদ্রের অতল জলরাশির জগতটাকে আমাদের মতো স্থলচারী প্রাণীদের কাছে মনে হয় নিঃশব্দ, ভুতুড়ে। কিন্তু সত্যি কথা হলো, অতল জলরাশির এই জগতটাতে আসলে আলোর চেয়ে শব্দেরই প্রাধান্য বেশি। আমাদের হয়তো শোনার মতো কান নেই, কিন্তু এই জগতে বেশিরভাগ সময়ে চারপাশে নানা রকমের শব্দরাই শুধু খেলে বেড়ায়। শব্দময় এই জগতটায় সবচেয়ে বিখ্যাত সম্ভবত তিমি মাছদের মুখ নিঃসৃত শব্দ। জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল সেগানের এতই পছন্দ ছিলো তিমিদের এই শব্দময় জগতটাকে যে, ১৯৭০-এর দশকের শেষে যখন ‘ভয়েজার’ প্রজেক্টের জন্যে গোল্ডেন ডিস্ক তৈরির দায়িত্ব দেয়া হয় তাঁকে, তখন সেই ডিস্কে ‘সাউন্ড অব আর্থ’ ক্যাটাগরিতে পিঠকুঁজো তিমির গান জুড়ে দিয়েছিলেন তিনি।

কথা হলো, কী ঘটবে, কোনো একদিন যদি দেখেন আপনি কারো সাথে কথা বলে আর মনের ভাব প্রকাশ করতে পারছেন না?  আপনি কথা বলতে পারছেন ঠিকই, কিন্তু আপনার ভাষা কেউ বুঝতে পারছে না এবং আপনার হাতে অন্য কোনো উপায়ও নেই ভাব বিনিময় করার। কী অবস্থা হবে আপনার?

পরিস্থিতিটা উপলব্ধি করতে হলে আসুন জানি এক রহস্যময় শব্দের কথা। সেই সাথে জেনে নিই দুনিয়ার নিঃসঙ্গতম তিমি সম্পর্কে, যার নাম দেয়া হয়েছে ‘ফিফটি টু (52)’। আমাদের আজকের আর্টিকেলের আরেক নাম দেয়া যেতে পারে, ‘দ্যা লিজেন্ড অব ফিফটি টু’।

ফিফটি টু – প্রথম আবির্ভাব
কাহিনীর শুরু ১৯৮৯ সালে। আমেরিকা বনাম সোভিয়েত ইউনিয়নের স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে আমেরিকান নেভি কিছু স্থাপনা বানিয়েছিলো যেখান থেকে সোভিয়েত সাবমেরিনের গতিবিধি লক্ষ্য করা যায়। সোভিয়েত সাবমেরিনগুলো যাতে কারো অগোচরে আমেরিকার সীমানার ভিতরে ঢুকে পড়তে না পারে, সেজন্যে এই সব স্থাপনায় এমন সব যন্ত্রপাতি বসানো হয়েছিলো যা দিয়ে সমুদ্রের অত্যন্ত গভীরের মৃদু হতে মৃদুতম শব্দও রাডারে ধরা পড়ে। সোভিয়েতের সাবমেরিনগুলো সাধারণত ২০-৫০ হার্জের মধ্যে শব্দ উৎপাদন করে চলাচল করতো গভীর সমুদ্রে। যন্ত্রপাতিগুলোও তাই বসানো হয়েছিলো সেভাবেই। আমেরিকার উপকূলে হঠাৎ এই রেঞ্জের মধ্যে শব্দ রাডারে ধরা পড়লে শব্দের উৎসটাকে ট্র্যাক করা হতো। সেটা কোন পথ দিয়ে কোথায় যাচ্ছে, তা মনিটরিং করা হতো। চলাচলের প্যাটার্নে সন্দেহজনক কিছু পেলেই কেল্লা ফতে। রিপোর্ট চলে যেতো উপর মহলে।

এই কাজ করতে গিয়ে আরেকটা বোনাস দিক খুঁজে পেলো আমেরিকান নেভি। তারা আমেরিকার উপকূলীয় অঞ্চলের তিমি মাছদের ট্র্যাক করতে সক্ষম হলো তাদের রাডারে। তিমি মাছেরা প্রজাতি ভেদে ১০ হার্জ থেকে ৪০ হার্জের মধ্যে শব্দ উৎপাদন করে। সোভিয়েতদের সাবমেরিনও এই রেঞ্জেই কাজ করে। ফলে, সেই সব শব্দ দিয়ে তিমি মাছদের উপরে গবেষণার এক নতুন দুয়ার খুলে গেলো তাদের সামনে। ১৯৮০-এর দশকের শেষে সোভিয়েত বনাম আমেরিকা ইট-পাটকেল ছোঁড়াছুঁড়ির ইতি ঘটলে নেভির তৈরি এই সব লিসেনিং পোস্টকে দিয়ে দেয়া হয় মেরিন লাইফের গবেষণার জন্যে।

এমনই এক মেরিন লাইফ নিয়ে গবেষণাকারী স্থাপনা হচ্ছে ম্যাসাচুসেটসে। এটার বর্তমান নাম ‘Woods Hole Oceanographic Institution’। এখানে ১৯৯২ সালের ৭ ডিসেম্বর ‘বিল ওয়াটকিনস’ নামের এক গবেষক অদ্ভুত এক সিগন্যাল ধরে ফেলেন রাডারে। তরঙ্গটার কম্পাংক ছিলো ৫২ হার্জ। ততদিনে সোভিয়েতের সাবমেরিন ট্র্যাক করার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। তার মানে এটা ঐ অঞ্চলের জলচর কোনো প্রাণীরই তৈরি করা শব্দ। বিল দেখলেন, শব্দের উৎসটার চলাচলের পথের সাথে তিমি মাছের চলাচলের পথের মিল আছে। ঐ অঞ্চলে নীল তিমি (Blue Whale) এবং ফিন তিমি (Fin Whale) যে প্যাটার্নে চলাফেরা করে, ঠিক সেই প্যাটার্নেই ঘুরেফিরে চলছে এই শব্দের উৎসটা। কিন্তু সমস্যা বাঁধছে একটা জায়গায়। ৫২ হার্জ মানুষের কানে শুনার জন্যে যথেষ্ট পরিমাণে শক্তিশালী শব্দতরঙ্গ না। কিন্তু তিমি মাছেদের জন্যে এটা অনেক বেশিই বলা চলে। ঐ অঞ্চলের নীল কিংবা ফিন তিমিরা সাধারণত ৪০ হার্জের উপরে শব্দ উৎপাদন করতে পারে না। নীল তিমির শব্দের রেঞ্জ ১০ হার্জ থেকে ৪০ হার্জ। আর ফিন তিমির শব্দের রেঞ্জ মোটামুটি ২০ হার্জ।

52-loneliest-whale2-600x459

 

বিল ওয়াটকিনসকে নেশায় পেয়ে বসলো। তিনি দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এই ৫২ হার্জের শব্দটাকে ট্র্যাক করে চললেন। ট্র্যাক করে দেখলেন, ৫২ হার্জের এই শব্দটা শুধু অদ্ভুতই নয়, বরং বেশ ইউনিক। এটা শুধু একটা মাত্র উৎস হতেই আসছে। আর সেই শব্দ উৎসের মালিকটার সাথে মিলছে নীল এবং ফিন তিমির চলাচলের প্যাটার্ন। তার মানে এই শব্দ উৎসের মালিক একটা তিমি মাছ। এমন এক তিমি মাছ, যেটা ৫২ হার্জের শব্দ উৎপাদন করতে পারে। এই শব্দ তৈরি করে সে যোগাযোগ করতে চাইছে তার প্রজাতির অন্য কোনো সদস্যের সাথে। কিন্তু প্রত্যুত্তরে আর কোনো ৫২ হার্জের শব্দ ভেসে আসছে না। ফলে ৫২ হার্জের শব্দের মালিক নিঃসঙ্গ ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রশান্ত মহাসাগরের অতলে। তবে সে টের পাচ্ছে না, সে আসলে একা নয়। মাইল কয়েক দূরের উপকূলে এক রিসার্চ সেন্টারে বসে জীবন সায়াহ্নে উপনীত হওয়া এক ব্যক্তি গভীর মুগ্ধতায় সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে তাকে। শুনে যাচ্ছে তার আরেকজন সঙ্গী খুঁজে পাবার আকুতি।

বিল ওয়াটকিনসের পুরো নেশা ধরে গিয়েছিলো ব্যাপারটায়। রাতের পর রাত তিনি একটা পাকা দালানের ভিতরে ল্যাবরেটরিতে বসে গভীর মনোযোগে শুনে চলতেন আর রেকর্ড করতেন ৫২ হার্জের শব্দটাকে। প্রায় এক যুগ ধরে তিনি মুগ্ধ বিস্ময়ে যতটুকু সম্ভব ডেটা রেকর্ড করেছিলেন এই শব্দ উৎসটার। ২০০৪ সালে এই শব্দটার প্রতি এক বিশাল মুগ্ধতা নিয়েই তিনি ৭৮ বছর বয়সে বিদায় নেন পৃথিবী হতে। রেখে যান এই শব্দ উৎসের ব্যাপারে করে যাওয়া তাঁর সকল গবেষণাপত্র। তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন পরেই সেগুলো প্রকাশিত হয় জার্নালে। হৈচৈ পড়ে যায় মিডিয়ায়। পত্রপত্রিকায় চলে আসে এক নিঃসঙ্গ তিমি মাছের কথা, যে ৫২ হার্জের শব্দ উৎপাদন করে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার মতো আরেকজন সঙ্গীকে। কিন্তু তার কথা তার প্রজাতির আর কেউ বুঝতে পারে না। ফলে আসে না কোনো প্রত্যুত্তর। আর সেই তিমিটা নিঃসঙ্গ ঘুরে বেড়ায় প্রশান্ত মহাসাগরের সুবিশাল জলরাশির এমাথা-ওমাথায়। শব্দের উৎসটার নাম হয়ে যায় ‘ফিফটি টু – দ্যা লোনলিয়েস্ট হোয়েল অন আর্থ’।

লিজেন্ড অব ফিফটি টু
সব পত্রপত্রিকা ফলাও করে প্রচার করে এটা একটা নিঃসঙ্গ তিমি মাছের গান। তার ভাষা কেউ বুঝতে পারছে না, ফলে তার সঙ্গী খুঁজে পাবার আহবানে কেউ সাড়া দিতে পারছে না। ইংল্যান্ডের ‘দি এক্সপ্রেস’ তো ছাপিয়েই দিয়েছিলো, “পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম তিমি মাছের অনন্য সুরটাই তাকে তার ভালোবাসা খুঁজে পেতে বাধা দিচ্ছে”। (নিচের পত্রপত্রিকার লিংকে সর্বশেষ এড্রেসটা দ্রষ্টব্য)

কিন্তু সত্যিটা আসলে কী? ফিফটি টু কি আসলেই কোনো তিমি মাছ?

বিল ওয়াটকিনস এবং তার আরেক সহ-গবেষক তাদের জার্নালে উল্লেখ করেছিলেন, “এটা আসলেই যদি একটা তিমি মাছের গান হয়, তবে মেনে নেয়া খুবই কঠিন হবে যে, এই বিশাল মহাসাগরীয় অঞ্চলে এই ধরণের প্রাণী শুধুমাত্র এমন একটাই আছে। তা সত্ত্বেও বছরকে বছর সতর্কতার সাথে পর্যবেক্ষণ করে পুরো এলাকা জুড়ে এই বৈশিষ্ট্যের ডাক এমন একটাই পাওয়া গেছে। প্রতি মৌসুমে একটা উৎস হতেই এমন ডাক ভেসে আসে”। (২ নং লিংক দ্রষ্টব্য)

ঘটনা আসলেই তাই। বিল এবং তার সহ-গবেষকদের প্রকাশিত জার্নাল অনুযায়ী প্রতি বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বর নাগাদ ৫২ হার্জের এই সুরটা ভেসে আসতো তাদের রাডারে। এটা চলতো জানুয়ারির শেষ হতে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। এরপরে শব্দ উৎসটা আবার উপকূলের সীমানার বাইরে চলে যেতো। ঠিক প্রশান্ত মহাসাগরের ঐ অঞ্চলে তিমির ঝাঁকেরা যেভাবে ঘুরে বেড়ায়, সেই প্যাটার্নের সাথে মিল রেখে। পুরো ১২ বছর এই ধাঁচেই সুরটা রেকর্ড করেছিলেন বিল ও তার সহযোগীরা। কিন্তু ট্যুইস্ট একটা জায়গাতেই। প্রত্যেকবার ৫২ হার্জের শব্দ একটা উৎস থেকেই পেয়েছিলেন বিল।

ট্যুইস্টের উপরে ওভার ট্যুইস্ট দিতে সাম্প্রতিক কালের আরো কিছু কথা যোগ করা যায়। বিল ২০০৪ সালে মারা যাবার পরে ফিফটি টু-কে ট্র্যাক করা এক প্রকার বন্ধই হয়ে গিয়েছিলো। বিল ওয়াটকিনসের মতো মুগ্ধতা নিয়ে আর কেউ দিনের পর দিন এই কাজ চালিয়ে যাননি। খুবই ছাড়া ছাড়া ভাবে এই গবেষণাটা চালিয়ে যাওয়া হয়েছিলো। সেটুকুতেই ধরা পড়ে আরেক চমকপ্রদ ব্যাপার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ৫২ হার্জের সুর উৎপাদনকারী উৎসটা মোটামুটি ৪৭-৪৯ হার্জের সুর তৈরি করে যাচ্ছে। ক্যালিফোর্নিয়ার ‘স্ক্রিপস ইন্সটিটিউশন অব ওশেনোগ্রাফি’-র গবেষক জন হিলডাব্র্যান্ড বলছেন, এই ব্যাপারটা তিমি মাছদের শিশু হতে প্রাপ্তবয়স্ক হবার সময়ে গলার টোন পালটে যাবার সাথে মিলে যায়। অর্থাৎ, ধারণা করা হচ্ছে, আমাদের সেই শিশু তিমিটা এখন আর শিশু নেই। অনেক বড় হয়ে গেছে! তবে হিলডাব্র্যান্ড তার এক গবেষণাপত্রের ফলাফল উল্লেখ করে আরো জুড়ে দিয়ে বলেন, “তিমি মাছেরা, বিশেষত নীল তিমিরা ১৯৬০ সালের পর থেকেই গভীর হতে গভীরতর পিচে গলার সুর ছেড়ে চলছে। হয়তো সেটাও ফিফটি টু-এর গলার সুর পালটে যাবার আরেকটা ব্যাখ্যা হতে পারে”। এভাবেও হয়তো তিমি মাছের সাথে রহস্যময় শব্দ উৎসটার আরেকটা যোগসূত্র দাঁড় করানো যায়। কিন্তু চাক্ষুষ প্রমাণ এখনো কারো হাতে নেই।

কথা হলো, আমাদের ফিফটি টু যদি একটা তিমি মাছই হয়, তবে তার এমন অনন্য সুর উৎপাদনের কার্যকারণটা কী?

এখন পর্যন্ত, কয়েকটা হাইপোথিসিস দাঁড় করানো হয়েছে। একটা ধারণায় বলা হচ্ছে, এটা সম্ভবত নীল এবং ফিন তিমির সংকর। এমন সংকর তিমির শরীরের গঠন হবে পুরোই অন্যরকম। ফলস্বরূপ, তার গলার সুর পালটে ৫২ হার্জের সুর তৈরি হতে থাকাও বিচিত্র কিছু নয়। এই ধরণের সংকর তিমিদের শারীরিক গঠন হয় অনেকটা ফিন তিমির মতো, কিন্তু গলার সুর এবং অন্যান্য আচার-আচরণ হয় নীল তিমির মতো। সিয়াটলের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের প্রফেসর ‘কেইট স্টাফোর্ড’ এর মতে, “ফিফটি-টু এর আচরণও পুরোই নীল তিমির মতো। এর বিভিন্ন মৌসুমে এক এলাকা হতে অন্য এলাকায় মাইগ্রেশন করার প্যাটার্নটা নীল তিমির সাথে মিলে যায়। সুতরাং আমার ধারণা, এই প্রাণীটার কিছু অংশ অবশ্যই নীল তিমির মতো”।

আরেক হাইপোথিসিসে বলা হচ্ছে, এই তিমিটা সম্ভবত কোনো ভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে থাকতে পারে। সেই প্রতিবন্ধকতার দরুন এমন অনন্য কম্পাংকের এক সুর বের হয় তার গলা দিয়ে।

এদিকে নিউইয়র্কের ইথাকা কর্নেল ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ‘ক্রিস্টোফার উইলস ক্লার্ক’ বলেন, “মানুষ ফিফটি টুর ডাককে যতটা অনন্য মনে করছে, ততটা অনন্য হয়তো নয় ব্যাপারটা। এখন পর্যন্ত বহু অঞ্চলের তিমির ডাক রেকর্ড করা হয়েছে। সেখান থেকে দেখা গেছে, একেক অঞ্চলের তিমির একেক রকমের ডায়ালেক্ট আছে। একেক অঞ্চলের মানুষ যেমন একেক ভাষায় কথা বলে, তেমন”। কিন্তু তাতেও এই রহস্যের সমাধান হয় না তেমন একটা। কারণ বিলের রেখে যাওয়া গবেষণা অনুযায়ী, এই শব্দের উৎস কেবল একটাই।

তবে এক্ষেত্রে ২০১০ সালের একটা ঘটনা উল্লেখ করা যায়। বিলের মৃত্যুর পরে আর কেউ তেমন উৎসাহ নিয়ে ফিফটি টুর সুর ট্র্যাক করে যায়নি নিরলস ভাবে। উপরে উল্লিখিত গবেষক হিলডাব্র্যান্ড ২০১০ সালে এই ব্যাপারে পুনরায় কৌতূহল প্রকাশ করলে তার এক সহকারী আবার ট্র্যাক করা শুরু করেন শব্দটাকে। শব্দের উৎসটা বিলের গবেষণা অনুযায়ীই চলাচলের প্যাটার্ন দেখাতে শুরু করে সেন্সরে। হিলডাব্র্যান্ডের অফিস থেকে মাত্র ৫-৬ মাইল গভীর সমুদ্রে অবস্থান দেখাতে থাকে ৫২ হার্জ সুরটা। তবে এবারে একটু ভিন্ন ফলাফল পাওয়া যায়, যা কিছুটা হলেও আশার সঞ্চার করে সবার মনে। দেখা যায়, সমুদ্রে পরস্পর হতে বহুদূরে অবস্থিত আলাদা এলাকার দু’টো সেন্সর থেকে এই তরঙ্গ ভেসে আসছে। তার মানে, হয়তো আমাদের ফিফটি টু আর আমাদের ধারণা অনুযায়ী নিঃসঙ্গ কোনো প্রাণী নয়। তাছাড়া অনেক বিজ্ঞানী “তার কাছাকাছি প্রজাতির অন্য কেউ ৫২ হার্জ কম্পাংকের সুর বুঝতে পারে না” এমন ধারণাও উড়িয়ে দিয়েছেন। তাদের মতে, নীল তিমি হয়তো ৪০ হার্জের বেশি সুর উৎপাদন করতে পারে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ৫২ হার্জের একটা সুর তারা শুনতে পারবে না এবং শুনলেও সেটা বুঝতে পারবে না”।

ফিফটি টু – পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম তিমি মাছ?!
ফিফটি টু কি আদৌ কোনো তিমি মাছ, নাকি সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত রকমের কোনো শব্দের উৎস? তিমি মাছ হলে সে পুরুষ না স্ত্রী? কী ধরণের তিমি সে? নীল তিমি, ফিন তিমি, নাকি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের নতুন কোনো প্রজাতির তিমি? নাকি শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো এক নীল তিমি সে, যার কথা কেউ বুঝতে পারছে না? শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে দলের বাইরে সঙ্গীহীন অবস্থায় প্রশান্ত মহাসাগরের জলরাশিতে সে ঘুরে বেড়াচ্ছে নিঃসঙ্গ, একাকী! বয়স বাড়ছে, সেই সাথে বাড়ছে তার গলার সুরের গভীরতা!

এখন পর্যন্ত এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। তবে ২০১৬ সালে এক গবেষক দল অবশেষে অভিযানে নেমেছেন এই ব্যাপারটার সুরাহা করতে। তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন আমেরিকান ফিল্মমেকার ‘জশ যেমান’ এবং অভিনেতা ‘আদ্রিয়ান গ্রেনিয়ের’। এই অভিযানে যা কিছুই ঘটবে, সবকিছুই পরবর্তীতে একটা ডকুমেন্টারি হিসেবে রিলিজ দেয়া হবে। এই অভিযানের পেছনে খরচের জন্য ২০১৫ সালে ‘কিকস্টার্টার’ এর মতো সাইটে জনগণের সাহায্য চাওয়া হয়েছিলো। জনগণ বিপুল সাড়া দিয়েছিলো সেখানে। তারপরেও কিছুটা ঘাটতি রয়ে গিয়েছিলো ফান্ড তোলাতে। তখন এগিয়ে এসেছিলেন হলিউড অভিনেতা ‘লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও’। নিরলস ভাবে সুস্থ পৃথিবী ও পরিবেশের জন্যে কাজ করে যাওয়া এই ব্যক্তি ৫০,০০০ ডলার দান করে দিয়েছিলেন তার ফান্ড হতে। ২০১৭ সালের কোনো এক সময়ে ডকুমেন্টারিটা রিলিজ পাওয়ার কথা রয়েছে।

 

52-loneliest-whale3-600x337

ফিফটি টুকে নিয়ে বিশ্বব্যাপী এখন পর্যন্ত অনেক কবিতা, গান এবং গল্প তৈরি হয়েছে। সবখানেই তাকে নিঃসঙ্গ এক তিমি মাছ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আজকে জুল ভার্ন বেঁচে থাকলে তিনিও হয়তো দুর্ধর্ষ এক কল্পবিজ্ঞান কাহিনী ফেঁদে বসতেন। সেই কাহিনীতে থাকতো বিল ওয়াটকিনসের ফিফটি টুর ব্যাপারে অসামান্য মুগ্ধতার কথা। ফিফটি টুর পেছন পেছন ধাওয়া করে চলা কোনো এক চরিত্রের রোমাঞ্চকর সমুদ্রাভিযানের কথা। সবশেষে হয়তো তিনি সমাপ্তি টানতেন কোনো এক জোছনা ভরা রাতে। আমাদের চরিত্রটা হয়তো ভেদ করতে পারেনি ফিফটি টুর রহস্য। খুবই কাছাকাছি চলে গিয়েছিলো সে। কিংবা ভেদ করলেও হয়তো সেটা মনুষ্য সমাজ হতে আড়াল করে রাখার সিদ্ধান্ত নেয় সে। কারণ তাতে “নিঃসঙ্গ, শারীরিক প্রতিবন্ধী কিন্তু অনন্য” এই তিমিটার ক্ষতি হতে পারে। সে আর ডক্টর বিল ওয়াটকিনসের অশরীরী ছায়ামূর্তি জাহাজের ডেকে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রহস্য ঘেরা পরিবেশে উপভোগ করতে থাকে সমুদ্রের রূপালী জোছনা। তাদের সামনেই সেই জোছনায় প্রশান্ত মহাসাগরের জলের উপরে খানিক ঝিকমিকিয়ে উঠে আবার ডুবে যায় ‘ফিফটি টু’। মানব সভ্যতা তাকে ছুঁতে চায়, কিন্তু সে মানুষের আড়ালে থেকে ৫২ হার্জে গেয়ে চলে তার গান – হয়তো নিজ প্রজাতির কোনো সঙ্গী খুঁজে পাবার আশায়।

Monday, April 2, 2018

কেইট শোপেনের গল্পঃ এক জোড়া রেশমি মোজা


ক্ষুদ্রাকায় মিসেস সমারস একদিন হঠাৎ করেই নিজেকে পনেরো ডলারের মালিক হিসেবে আবিষ্কার করলো। তাঁর কাছে এই পনেরো ডলারই একটা বেশ মোটা অঙ্কের টাকা মনে হলো। আর টাকাটা তাঁর পুরনো জীর্ণ পার্সটাকে যেভাবে ঠেসে স্ফীত করে তুলেছিলো, সেটা দেখে সে এক ধরনের গৌরব অনুভব করলো, যে অনুভূতি সে বহু বছর উপভোগ করেনি।

বিনিয়োগের চিন্তাটা তাঁর মনকে প্রবলভাবে পরিব্যাপ্ত করে রেখেছিলো। গোটা দিন দুয়েক সে আপাতদৃষ্টিতে একটা স্বপ্নের জগতে হাঁটাচলা করেছিলো, সে সম্পূর্ণ ডুবে গিয়েছিলো জল্পনায় আর হিসাব- নিকাশে। তাড়াহুড়ো করে হঠাৎ কোন কিছু করে ফেলার ইচ্ছা তাঁর ছিলো না, সে এমন কিছু করতে চায়নি যার জন্যে পরে তাঁকে অনুশোচনায় ভুগতে হবে। কিন্তু মধ্যরাতের স্তব্ধ সময়গুলোতে সে শুয়ে জেগে থাকতো। জেগে জেগে মনের মধ্যে আবর্তিত অভিসন্ধি আঁটতো আর তাঁর মনে হতো এই সব পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে সে টাকাটার সঠিক এবং সুদূরদর্শী ব্যবহারের একটা পরিষ্কার পথ দেখতে পেয়েছিলো।

সাধারণত যে দামে জেনির জন্যে জুতো কেনা হয় তাঁর সাথে দু-এক ডলার যোগ করলে আরও স্থায়ী টেকসই এক জোড়া জুতো পাওয়া যাবে। সে অবশ্যই কিনবে এবং সে তাঁর ছেলে, জেনি আর ম্যাগের জামার জন্যে বেশ কয়েক গজ কাপড়ও কিনবে। সে মনস্থ করলো পুরনো জামা গুলোকে দক্ষ হাতে তালি দিয়ে দিবে। ম্যাগের জন্যে আরেকটা গাউন কেনা দরকার। সে দোকানের জানালায় কিছু সুলভ মূল্যের সুন্দর কাপড়ের নকশা দেখেছে। ছেলে মেয়েদের জামা বানানোর পরেও নতুন মোজার জন্যে যথেষ্ট পরিমাণ কাপড় রয়ে যাবে — আলাদা দুই জোড়া — আর কত গুলো রিফুকর্ম যে বেঁচে যাবে! সে ছেলেদের জন্যে কয়েকটা মাথার ক্যাপ কিনবে আর মেয়েদের জন্যে কিনবে সেইলর-হ্যাট। তাঁর ছোট্ট এই পরিবারটাকে জীবনে একবারের জন্যে অভিনব, পরিচ্ছন্ন আর নতুন জকজকা অবস্থায় দেখার কল্পিত দৃশ্যটা তাঁকে উত্তেজিত আর অস্থির করে তুললো, তাঁকে জাগিয়ে তুললো প্রত্যাশায়।

প্রতিবেশীরা মাঝে মাঝেই নির্দিষ্ট একটা “ভালো সময়” এর কথা বলতো, যা মিসেস সমারস মি. সমারসকে বিয়ে করার চিন্তাটা মাথায় আসার আগে থেকেই জানতো। সে এমন ধরনের কোনো অসুস্থ অতীত চিন্তায় নিজেকে প্রশ্রয় দিলো না। অতীতের চিন্তায় নষ্ট করার মত কোন সময় তাঁর ছিলো না, তাঁর হাতে একটা সেকেন্ডও ছিলো না। বর্তমানের প্রয়োজন গুলো তাঁর মস্তিষ্কের প্রতিটা অনুষদকে আত্মিভুত করে রেখেছিলো। কল্পিত ভবিষ্যৎ দৃশ্যের একটা ক্ষীণ, আবছা দৈত্যমানব মাঝে মাঝে তাঁকে আতংকিত করে তুলতো, কিন্তু ভাগ্যক্রমে সেই পরের দিনের সকালটা আর কখনই আসতো না।

দর কষাকষির যে কি মূল্য তা মিসেস সমারসের চেয়ে ভালো আর কেউ জানতো না। সে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে ইঞ্চি ইঞ্চি করে তাঁর আকাঙ্ক্ষিত জিনিসটাকে সর্বনিম্ন দরে কেনার পথে এগিয়ে যেতে পারতো। সে প্রয়োজনে কনুই দিয়ে ঠেলে তাঁর নিজের রাস্তা বের করে নিতো; সে শিখেছিলো কিভাবে একটা পণ্যকে আঁকড়ে ধরে থাকতে হয়। সে অধ্যবসায় আর দৃঢ় সংকল্পের সাথে পণ্যটার পিছনে লেগে থাকতো যতক্ষণ না দোকানী ঘুরে আবার তাঁর কাছে ফিরে আসতো। এতে ঠিক কত সময় লাগতো সে ব্যাপারে তাঁর কোনো মাথাব্যথা ছিলো না।

কিন্তু সেদিন সে একটু দুর্বল আর ক্লান্ত অনুভব করছিলো। মধ্যাহ্নভোজনে সে খুবই হালকা খাবার খেয়েছে— না! মধ্যাহ্নভোজের কথা ভাবতে গিয়ে তাঁর মনে পড়লো, বাচ্চাদের খাওয়ানো আর সবকিছু ঠিকঠাক করা আর নিজেকে কেনাকাটার যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত করতে গিয়ে সে দুপুরে খাওয়ার কথা সে বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলো!

সে তুলনামূলক জনশূন্য একটা কাউন্টারের সামনের একটা ঘূর্ণায়মান টুলের উপর বসে পড়লো। সেখানে বসে সে কাপড়ের দোকানের ভিড়টাকে ঠেলে নিজে অবস্থান নেওয়ার শক্তি ও সাহস সঞ্চয়ের চেষ্টা করলো। হঠাৎ একটা নিস্তেজ শিথিল অনুভূতি তাঁর পুরো শরীরে বয়ে গেলো এবং সে উদ্দেশ্যহীন ভাবে তাঁর হাত দুটো ফেলে রাখলো কাউনটারের উপর। তাঁর হাতে কোনো দস্তানা ছিলো না। ধীরে কিছুক্ষণ পর একটা নির্দিষ্ট মাত্রার অনুভূতিতে সে টের পেল তাঁর হাত দুটো খুব শীতল এবং ছুঁতে খুব আরাম এমন কিছু একটাকে স্পর্শ করলো। সে হাতের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল হাত দুটো রেশমি মোজার একটা স্তূপের উপর শায়িত। পাশেই একটা প্ল্যাকার্ড দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে মোজা গুলো বিশেষ ছাড়ে বিক্রি হচ্ছে — দাম কমে দুই ডলার পঞ্চাশ সেন্ট থেকে এক ডলার আটানব্বই সেন্টে নেমে এসেছে; এবং কাউন্টারের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা একজন যুবতী তাঁর কাছে জানতে চাইলো সে তাদের রেশমি হোসিয়ারির সারিটা যাচাই করে দেখতে চায় কিনা। সে মুচকি হাসলো, এমন ভাবে হাসলো যেন তাঁকে কেউ একটা হীরার মুকুট শেষবারের জন্যে পরিদর্শন করতে বলছে যেহেতু এটা কেনার জন্য সে ইতিমধ্যেই বদ্ধ পরিকর। কিন্তু সে কোনো দিকে না গিয়ে দুই হাত দিয়ে উজ্জ্বল বিলাসবহুল পণ্য গুলোর নরম অনুভূতিটা উপভোগ করতে লাগলো, চোখের কাছে তুলে ধরে দেখতে লাগলো তাঁদের চিকচিকে রঙটা, উপভোগ করতে লাগলো তাঁর আঙ্গুলের চিপা দিয়ে সাপের মত তাঁদের পিছলে পড়ার অনুভূতিটা।

তাঁর বিবর্ণ গাল দুটো হঠাৎ করেই একটা অস্বাভাবিক লাল বর্ণ ধারণ করলো। সে মেয়েটার দিকে তাকালো।

“এগুলোর মধ্যে সাড়ে আট সাইজের কোন মোজা হবে?”

সাড়ে আট সাইজের অনেকগুলোই ছিলো। আসলে, অন্য যে কোন সাইজের চেয়ে সাড়ে আট সাইজটাই বরং বেশী ছিলো। এখানে ছিলো হালকা নীল রঙের একটা জোড়া; ওখানে ছিলো কিছু ল্যাভেন্ডার রঙের, কিছু ছিলো পুরোপুরি কালো আর কিছু ছিলো তামাটে আর ধূসর রঙের মাত্রা ওয়ালা। মিসেস সমারস একটা কালো জোড়া বেছে নিলো এবং জোড়াটার দিকে সে দীর্ঘক্ষণ মনযোগের সহিত তাকিয়ে রইলো। সে মোজার বুননটা পরখ করে দেখার ভান করছিলো, আর দোকানের কর্মচারী নিশ্চিত করলো যে তাঁর হাতেরটা উন্নতমানের।

“এক ডলার আটানব্বই সেন্ট।“ সে ঘোরের মধ্যে উচ্চস্বরে বলে উঠলো। “আচ্ছা, আমি এই জোড়াটা নিব।“ সে মেয়েটাকে পাঁচ ডলারের একটা বিল ধরিয়ে দিয়ে অবশিষ্ট খুচরা টাকা আর পার্সেলের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। পার্সেলটা কত ছোট ছিল! মনে হল এটা তাঁর পুরনো জীর্ণ শপিং ব্যাগের গভীরতায় একবারে হারিয়ে গেলো।

এরপর মিসেস সমারস বিক্রয় কাউন্টারের দিকে আর গেলো না। সে একটা এলিভেটরে উঠে পড়লো। এলিভেটরটা তাঁকে উপরে তলায় মহিলাদের ওয়েটিং রুম এলাকায় নিয়ে গেলো। এখানে, একটা নির্জন কোণায়, সে কটনের মোজাগুলো খুলে সদ্য কেনা নতুন রেশমি মোজা জোড়া পড়ে নিলো। তাঁর মানসিক কার্যধারায় কোন সূক্ষ্ম বোধশক্তি কাজ করছিলো না, অথবা সে নিজের উপর কোন প্রকার যুক্তিও প্রয়োগ করছিলো না, নিজের সন্তুষ্টির জন্যে সে যা করছে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যাখ্যাও সে দাঁড় করানোর চেষ্টা করলো না। সে একবারেই কিছু ভাবছিলো না। মনে হলো সে কিছু সময়ের জন্যে তাঁর শ্রমশীল, অবসাদময় সকল কাজকর্ম থেকে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলো, আর একটা যান্ত্রিক ঝোঁকের তাড়নায় সে তাঁর সকল দায়দায়িত্ব থেকে একটু ছুটি নিয়েছিলো।

তাঁর শরীরের চামড়ায় কাঁচা রেশমের স্পর্শের অনুভূতিটা কত ভালো লেগেছিলো! মনে হচ্ছিলো সে একটা নরম গদিতে শুয়ে আছে এবং কিছু সময়ের জন্যে এই বিলাসিতাটা সে উপভোগ করলো। বেশিক্ষণ নয় আবার! তারপর সে তাঁর জুতো পরিবর্তন করলো এবং কটনের মোজা গুলো পেঁচিয়ে তাঁর ব্যাগের ভিতরে ছুঁড়ে মারলো। তারপর সোজা চলে গেলো জুতোর ডিপার্টমেন্টে, একটা সিটে বসে পড়লো পা মেপে জুতা কেনার জন্যে।

সে ছিলো খুব খুঁতখুঁতে। দোকানের কর্মচারী কিছুতেই তাঁর মোজার সাথে মিলিয়ে জুতা বের করে দিতে পারলো না, সে খুব সহজে সন্তুষ্ট হওয়ার মত মহিলা নয়। সে তাঁর স্কার্ট তুলে ধরেই রাখলো এবং একদিকে তাঁর পা ঘুরিয়ে আর অন্যদিকে তাঁর মাথা ঘুরিয়ে রাখলো। তাঁর নজর গেলো পালিশ করা, সরু মাথা ওয়ালা বুট গুলোর দিকে। তাঁর পা আর গোড়ালিটাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিলো। সে বুঝতেই পারছিলো না যে এই পা দুটো তাঁর নিজের এবং তাঁরা তাঁর শরীরের একটা অংশ। সে উন্নতমানের জাঁকালো ফিটিং এর এক জোড়া জুতা চায়, যে যুবক তাঁকে জুতা দেখাচ্ছিলো তাঁকে সে বললো এবং সে এও বললো যে দুই এক ডলার বেশী লাগলেও জুতো জোড়া কিনতে তাঁর আপত্তি নেই, যদি সে গুলো তাঁর মনের মত হয়।

মিসেস সমারস শেষবার কোনো জুতসই দস্তানা পড়ার পর কেটে গেছে অনেকদিন! দুর্লভ কোনো উপলক্ষে যখনই সে কোনো দস্তানা কিনেছে, তার সবগুলোই প্রবল দর কষাকষিতে কেনা, আর এতই সস্তা দরের ছিলো যে তাঁরা হাতে ফিট হবে এমন চিন্তা করাটা ছিলো পুরোপুরি নির্বুদ্ধিতার লক্ষণ।

এখন সে দস্তানার কাউনটারে একটা গদির উপর তাঁর কনুই দুটোকে বিশ্রাম দিচ্ছিলো, আর একটা সুন্দর, মনোরম ছোট্ট প্রাণী, কমনীয় আর স্পর্শকাতর, একটা লম্বা হাতের “বাচ্চা”কে টেনে মিসেস সমারসের উপর নিয়ে আসলো। সে কব্জির উপরে হাত বুলিয়ে দিলো এবং পরিচ্ছন্ন ভাবে তাঁর বোতাম লাগিয়ে দিলো। দুজনেই এক অথবা দুই সেকেন্ডের জন্যে ছোট্ট সুসঙ্গত দস্তানা পরিহিত হাতের প্রশংসার গভীর ধ্যানে হারিয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু টাকা খরচ করার তো আরও অনেক জায়গা ছিলো।

রাস্তা থেকে কয়েক কদম নিচে একটা দোকানের জানালায় বেশ কিছু বই আর ম্যাগাজিন স্তূপ করে রাখা ছিলো। মিসেস সমারস সেখান থেকে চড়া মূল্যের দুটো ম্যাগাজিন কিনে ফেললো, যেন সে তাঁর অবসর দিন গুলিতে অন্যান্য আনন্দদায়ক জিনিসের পাশাপাশি ম্যাগাজিন পড়তেও অভ্যস্ত। কোনো মোড়ক ছাড়াই সে ম্যাগাজিন দুটো বহন করছিলো। পাশাপাশি সে রাস্তার ক্রসিং এ নিজের স্কার্ট তুলে ধরে রাখছিলো। তাঁর সদ্য কেনা মোজা, বুট জুতা আর হাতের সুসঙ্গত দস্তানা যেন তাঁর মনে হাজার বার দেখার মত একটা অনুভূতি তৈরি করলো — তাঁর মধ্যে এক ধরনের নিশ্চয়তার অনুভূতি জাগ্রত করলো, সে নিজেকে সুবেশী মানুষের ভিড়ের অন্তর্ভুক্ত একজন মনে করলো।

সে খুব ক্ষুধার্ত ছিলো। অন্য সময় হলে বাড়ি পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত ক্ষুধাটা সে চেপে ধরে রাখতো। বাড়ি পৌঁছে নিজের জন্যে এক কাপ চা বানাতো আর খাবার যা কিছু আছে তাই দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতো। কিন্তু এখন যে ঝোঁক তাঁকে চালিত করছিলো তা তাঁর মাথায় এ ধরনের কোন চিন্তাই প্রশ্রয় দিলো না।

পাশেই একটা রেস্টুরেন্ট ছিলো। সে কখনোই দরজা দিয়ে এর ভিতরে প্রবেশ করেনি; বাইরে থেকে মাঝে মাঝে সে আবছা ভাবে দেখতো কিছু দাগহীন রেশমি কারুকাজ, উজ্জ্বল কাচের ঝলকানি আর মৃদু পায়ে ওয়েটাররা খাবার পরিবেশন করছে কেতাদুরস্থ মানুষদের।

যখন সে ভিতরে প্রবেশ করলো, তাঁর উপস্থিতি কোন চমক সৃষ্টি করলো না, কেউই তাঁর দিকে কোনো মনযোগও দিল না, সে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো। সে একটা ছোট্ট টেবিলে একা বসে পড়লো এবং একজন ভদ্র ওয়েটার এসে অর্ডার নিতে চাইলো। সে অতি প্রাচুর্যের কিছু চাইলো না; ব্যাকুলভাবে শুধু একটা সুন্দর ও মজাদার খাবার চাইলো — এক ডজন ব্লু-পয়েন্ট, শাকের সাথে একটা প্লাম চপ, মিষ্টি কিছু একটা — আইসক্রিম জাতীয় কিছু, যেমন, এক গ্লাস রাইন ওয়াইন, এবং সর্বোপরি এক গ্লাস ছোট ব্ল্যাক কফি।

যখন খাবার পরিবেশনের জন্যে অপেক্ষা করছিলো, তখন সে হাতের দস্তানাগুলো অলস ভাবে খুলে পাশে রেখে দিলো। সে একটা ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে পাতা গুলোতে চোখ বুলাতে লাগলো, তাঁর ছুরির ভোতা প্রান্ত দিয়ে ম্যগাজিনের পাতা গুলো কাটতে লাগলো। জায়গাটা ছিলো খুব মনোরম। রেশমের কারুকাজ গুলো একটু বেশীই পরিষ্কার ছিলো যতটা না জানালা দিয়ে দেখা যেতো, আর কাঁচগুলো ছিলো আরও ঝলমলে। সেখানে বেশ কয়েকজন নম্র ভদ্র পুরুষ ও মহিলা ছিলো, যারা তাঁকে খেয়াল করেনি, সে নিজের মত করে একটা ছোট্ট টেবিলে বসে লাঞ্চ করছিলো। একটা মৃদু, মনোমুগ্ধকর মিউজিকের সুর কানে আসছিলো, আর জানালা দিয়ে একটা মৃদু মন্দ বাতাস বইছিলো। সে খাবারে একটা কামড় বসালো, ম্যাগাজিনের একটা অথবা দুটো শব্দ পড়লো, ওয়াইনের গ্লাসে একটা চুমুক দিলো এবং তাঁর নতুন রেশমি মোজার ভিতরে পায়ের আঙ্গুল গুলো নাড়লো। খাবারের দামটা কোনো পার্থক্য তৈরি করলো না। সে টাকাটা গুণে ওয়েটারের হাতে দিলো, একটা অতিরিক্ত কয়েন ট্রেতে রেখে দিলো, ফলস্বরূপ ওয়েটার তাঁর সামনে এমন ভাবে মাথা নোয়ালো যেন সে রাজবংশীয় কোন  রাজকুমারী।

তাঁর পার্সে তখনো কিছু টাকা অবশিষ্ট রয়ে গেলো এবং তাঁর পরবর্তী প্রলোভনটা একটা ম্যাটিনি-শো এর পোস্টারের রূপে তাঁর মনে উদিত হলো।

যখন সে থিয়েটারে প্রবেশ করলো তখন একটু দেরি হয়ে গিয়েছিলো, নাটক ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছিলো আর পুরো ঘরটা তাঁর কাছে বস্তাবন্দী মনে হলো। কিন্তু এখানে সেখানে খালি সিট পড়েছিলো, তাঁদের মধ্য থেকে একটায় সে বসে পড়লো, তাঁর দু’পাশে অতি সুন্দর পোশাক পরিহিত মহিলারা, যারা সেখানে গিয়েছিলো সময় কাটাতে, ক্যান্ডি খেতে, আর তাঁদের জাঁকালো রুচিহীন বেশভূষা দেখাতে। আরও অনেকে ছিলো যারা শুধুই নাটক আর অভিনয় উপভোগ করতে গিয়েছিলো। এটা নিরাপদে বলা যায় সেখানে এমন কেউ উপস্থিত ছিলো না যে মিসেস সমারসের অঙ্গভঙ্গিকে পুরোপুরি সহ্য করতে পেরেছিলো। সে পুরো জায়গাটা — অভিনেতা, মঞ্চ, আর মানুষজন সবাইকে একটা গভীর আবেগে জড়িয়ে ফেললো, ডুবে গেলো এবং উপভোগ করলো। সে হাসির দৃশ্যে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো এবং কাঁদলো— সে আর রুচিহীন মহিলাটা দুঃখের দৃশ্যে কেঁদে উঠেছিলো। বিষয়টা নিয়ে তাঁরা একটু আধটু কথাও বলেছিলো। রুচিহীন মহিলাটা তাঁর চোখ মুছলো এবং একটা চারকোণা লেসে নাকের সর্দি মুছলো, ক্ষুদ্রাকায় মিসেস সমারসকে তাঁর ক্যান্ডি বক্সটা এগিয়ে দিলো।

নাটক শেষ হয়ে গেলো, মিউজিক থেমে গেলো, মানুষজন সব বেরিয়ে গেলো। যেন একটা স্বপ্নের সমাপ্তি হলো। সবাই এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়লো। মিসেস সমারস এক কোণায় গিয়ে দাঁড়ালো এবং গাড়ির জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলো।

গাড়িতে তাঁর বিপরীতে একটা তীক্ষ্ণ চোখের অধিকারী লোক বসেছিলো। মনে হলো লোকটার কাছে তাঁর ছোট্ট, বিবর্ণ মুখটা ভালো লেগেছে। লোকটা তাঁর মুখে কী দেখেছিলো সে অর্থ উদ্ধার করতে গিয়ে বেচারা বিমূঢ় হয়ে পড়লো। সত্যিকার অর্থে, সে আসলে কিছুই দেখেনি — যতক্ষণ না সে মায়াবী ইন্দ্রজালটা কাটিয়ে নিজের ভিতরের একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা উদ্ঘাটিত করলো। লোকটা তীব্র ভাবে চাইলো, এই গাড়িটা যেন আর কক্ষণো কোথাও না থামে, যেন চলতেই থাকে, তাঁকে নিয়ে অনন্তকাল।

উৎস ঃ http://onubadokderadda.com/a-pair-of-silk-stalkings/

মহাকর্ষীয় তরঙ্গ (gravitational wave) – সহজ ভাষায় প্রাথমিক জ্ঞান


০১৬ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি একটা গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হলো, যাতে বলা হলো – বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মত দুটো কৃষ্ণগহ্বরকে ঝগড়া (সংঘর্ষ) করতে দেখেছেন, এরপর আবার মিলেমিশে (একীভূত হয়ে) যেতে দেখেছেন; এবং এই ঘটনা থেকে পেয়েছেন মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সন্ধান, যে তরঙ্গকে বরাবর ১০০ বছর ধরে খুঁজছিলেন পদার্থবিদেরা। আমাদের মহাবিশ্বকে বোঝার ক্ষেত্রে এটা একটা বিশাল মাইলফলক। কেন এই আবিষ্কার গুরুত্বপূর্ণ, সেই ব্যাপারে যথাসময়ে আসছি। তবে এই প্রবন্ধের শিরোনাম যেহেতু সহজ ভাষায় প্রাথমিক জ্ঞান, তাই আগেই প্রাথমিক জ্ঞানগুলো সহজ ভাষায় বলে নেয়া দরকার – আমাদেরকে শুরুতেই জানতে হবে মহাকর্ষ কী। এটা নিয়ে ভালো করে না জানলে ঐ তরঙ্গের মা-বাপের খবর পাওয়া যাবে না। সেটা জেনে নিয়ে দেখবো তরঙ্গটা কী; এরপর দেখবো কেমনে মানুষ মহাজাগতিক গোয়েন্দার মত “হ্যান্ডস আপ” বলে ওকে সনাক্ত করে ফেললো। আসুন, শুরু করি…

মহাকর্ষ কী?


অত্যন্ত সংক্ষেপে – নিউটন বলেছিলেন, সবকিছু একে অপরকে আকর্ষণ করছে, এবং এই আকর্ষণ বলই হচ্ছে মহাকর্ষ। এই মহাকর্ষ বলের মাধ্যমেই সূর্য পৃথিবী এবং অন্যান্য গ্রহগুলোকে বলছে, “আমার চারপাশে ঘুর, ব্যাটা।” কিন্তু কিভাবে, সেটা তিনি জানতেন না। আইনস্টাইন এসে বললেন, আসলে আকর্ষণের জন্য নয়, মহাকর্ষ কাজ করে আরেকটু ভিন্নভাবে। কিভাবে? সংক্ষেপে, মহাকর্ষ হচ্ছে “স্থান-কাল চাদরের মধ্যে একটা বক্রতার প্রভাব”। এই ৭টা শব্দ প্রত্যেকটা আলাদা করে বুঝলেও একত্র করলে অনেকেরই বুঝতে বেশ ঘাপলা হয়। তাই আসুন, জিনিসটাকে আরেকটু ভালো করে দেখি।

স্থান বলতে আমরা (ত্রিমাত্রিক প্রাণীরা) যা বুঝি, তা হলো দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, ও উচ্চতার সমন্বয়। এই তিনটা জিনিস আমরা উপলব্ধি করতে পারি, এবং এগুলোতে আমাদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণও করতে পারি। মানে, আমরা সামনে-পিছে (দৈর্ঘ্য), ডানে-বামে (প্রস্থ), আর উপরে-নিচে (উচ্চতা) নড়াচড়া করতে পারি। আইনস্টাইনের মতে, সময়ও এখানে আরেকটা মাত্রা হিসেবে কাজ করে। তিনটি মাত্রার স্থান আর আরেক মাত্রা সময়, দুটো মিলিয়ে চতুর্মাত্রিক পর্দা তৈরি হয়, যার নাম Space-Time Continuum বা স্থান-কালের চাদর। আমরা ত্রিমাত্রিক প্রাণী, আমাদের জন্য চারটা বস্তুগত মাত্রা কল্পনা করা অত্যাধিক কঠিন। তাই, আসুন আমরা ত্রিমাত্রিকভাবেই চিন্তা করি।

মনে করুন, একটা বিশাল এবং মোটা কাপড়ের পর্দাকে টানটান করে ঘরের চারকোণার খুঁটিতে বেঁধে রাখা হয়েছে। ধরুন, এই চাদরটাই হচ্ছে স্থান-কালের চাদর। এখানে আপনি যত ভারী বস্তু রাখবেন, তত বেশি বক্রতা তৈরি হবে। আর এই বাঁকের মধ্যে যারা আসে, তারা সেই বাঁকে আটকে যাবে। অর্থাৎ, বক্রতার কারণে এখন যা যা ঘটবে, সেটাকেই আমরা মহাকর্ষ বলি। এখন, কম ভরের বস্তুগুলো বেশি ভরের বস্তুর চারপাশে উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘোরা শুরু করবে। আর এভাবেই মহাকর্ষ কাজ করে, কোনো আকর্ষণের বালাই নেই। আইনস্টাইন তার সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে এই ব্যাখ্যাটা দিয়েছিলেন।



স্থান-কালের চাদরকে বাঁকিয়ে দেয়ার মাধ্যমে কাজ করে মহাকর্ষ




 

মহাকর্ষীয় তরঙ্গ কী?


সপ্তম বা অষ্টম শ্রেণীতে থাকতে যে জিনিস পড়েছিলাম, সেখান থেকে ঘুরে আসি। তরঙ্গের ব্যাপারে দেখেছিলাম, সেটা নাকি দুই প্রকার –

১) অনুদৈর্ঘ্য তরঙ্গ বা longitudinal wave – যেটা এগিয়ে যায় সংকোচন আর প্রসারণের মাধ্যমে। যেমন – শব্দ।

longitudinal wave 2

২) অনুপ্রস্থ তরঙ্গ বা transverse wave – যেটা এগিয়ে যায় শীর্ষ এবং খাদের মাধ্যমে। যেমন, আলোর তরঙ্গ রুপ, তাড়িৎ-চৌম্বক তরঙ্গ, পানির তরঙ্গ, ইত্যাদি।

transverse wave 2

এই অনুপ্রস্থে শুধু একটি মাত্রায় (উচ্চতায়) নড়াচড়া ফলে তরঙ্গটা আরেকটি মাত্রায় (দৈর্ঘ্যে) এগিয়ে যাচ্ছে। এই দুটো তরঙ্গ দ্বিমাত্রিক তলে দেখানো গেলেও মহাকর্ষীয় তরঙ্গের জন্য নিচের ত্রিমাত্রিক চিত্রটা প্রয়োজন হবে। এর মধ্যেও সংকোচন-প্রসারণ হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু দুটো মাত্রায়, একই সাথে প্রস্থে এবং উচ্চতায়। যখন এই তরঙ্গ কোনোকিছুর মধ্য দিয়ে যাবে, তখন সেই জিনিসটাও এভাবে মুচড়ে যাবে। মোচড়ানোর পরিমাণ অত্যাধিক সামান্য। এতো সামান্য যে সেটা সনাক্ত করার জন্য আমাদেরকে প্রায় ১০০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। এতোদিন আমাদের সেই যান্ত্রিক সক্ষমতাই ছিলো না।

quadruple wave

এবং এভাবেই এই তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ছে স্থান-কালের চাদরে, আলোর গতিতে। আমরা জানলাম যে, যে কোনো বস্তুই স্থান-কালের চাদরে বক্রতা তৈরি করে। আর এভাবেই মহাকর্ষ তৈরি হয়। যখন ভরযুক্ত বস্তু স্থান-কালের চাদরে ভেসে বেড়ায়, তখন এই বক্রতার প্রভাবও কিন্তু সেই বস্তুর সাথে সাথে চলতে থাকে – তুমি যেখানে, আমি সেখানে স্টাইলে। কিন্তু কখনো কখনো, কোনো বস্তুর ত্বরণ বা গতিবৃদ্ধির হার বেড়ে যায়। কিভাবে বেড়ে যায়? যখন একটা বিশাল ভরের বস্তু আরেকটা বিশাল ভরের কাছাকাছি আসে। যেমন – দুটো কৃষ্ণগহ্বর, একটা কৃষ্ণগহ্বর এবং একটা বিশালাকার নক্ষত্র, ইত্যাদি। একটা আরেকটার বক্রতার মধ্যে আটকা পড়ে যায়। পাইরেটস অফ ক্যারিবিয়ানের শেষ দিকে যে দুটো জাহাজের যুদ্ধ হয়, মনে আছে? তেমন করে একজন আরেকজনকে চক্কর খেতে থাকে, ত্বরণও বাড়তে থাকে।

Calypsosmaelstrom

যাই হোক, ত্বরণ বেড়ে গেলে স্থান-কালের ঐ চাদরে একটা ঘূর্ণির সৃষ্টি হয়, যা ঢেউ আকারে আলোর গতিতে সবদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই ঢেউকেই বলে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। প্রথমবারের মত দুটো কৃষ্ণগহবরকে এই কাহিনী করতে দেখেছি আমরা।


waves3

শিল্পীর কল্পনায় কৃষ্ণগহ্বরের একীভূত হওয়ার চিত্র




 

কিভাবে এটা সনাক্ত করা হলো?


LIGO – Laser Interferometer Gravitational-wave Observatory এই জিনিসটা শেষ পর্যন্ত সনাক্ত/আবিষ্কার করতে পেরেছে। কিভাবে? গল্পটা কোনো খুনের রহস্য সমাধানের চেয়ে কম রোমাঞ্চকর না।

১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে, অর্থাৎ ১২৩০ ট্রিলিয়ন মাইলের মত বিশাল এক দূরত্বে দুটো কৃষ্ণগহ্বর একটা আরেকটার সাথে সংঘর্ষ করে একীভূত হয়ে গেলো। দুই কালা মিয়ার একটার ভর ছিলো আমাদের সূর্যের ২৯ গুণ, অন্যটা ৩৬ গুণ। সূর্যের ভর চিন্তা করলেই খাবি খেতে হয়। সূর্য আয়তনে অনেক বড় একটা জিনিস, এটাতে অনেক ভর ধরে। সেটার ভরকে ২৯ আর ৩৬ দিয়ে মনে মনে গুণ দিন। এবার চিন্তা করুন, সেই ভরের দুটো জিনিস (যদিও আয়তনে অনেক ছোটো, কম জায়গায় বেশি বস্তু নিয়ে চলে কৃষ্ণগহবর) সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে।


এখানে পৃথিবী হচ্ছে ঐ যে, ছোট্টো বলগুলোর একটা।

এখানে পৃথিবী হচ্ছে ঐ যে, ছোট্টো বলগুলোর একটা।




সংঘর্ষে দুটো মিলে একটি কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হলো, যার ভর দাঁড়ালো আমাদের সূর্যের ৬২ গুণ; বাকি ৩ গুণ ভর শক্তিতে পরিণত হলো। এই সংঘর্ষের ঘটনাটা স্থান-কালের চাদরে বইয়ে দিলো মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। সেই তরঙ্গ আলোর গতিতে, অর্থাৎ ১৩০ কোটি বছর সময় অতিক্রম করে এসে পৌঁছালো পৃথিবীতে। এ ধরনের ঘটনাগুলো থেকে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বের হয়, তা আইনস্টাইনই প্রস্তাব করেছিলেন ১৯১৬ সালে। এরপর থেকে চলছিলো সনাক্ত করার চেষ্টা। আমরা জানি, এই তরঙ্গ স্থান-কালকে মুচড়ে দেবে। অর্থাৎ, পৃথিবীতেও আমরা স্থান দেখি, সেই স্থানের সংকোচন-প্রসারণ ঘটবে। আমরা সেই সংকোচন-প্রসারণ বুঝবো না, কারণ সেটা খুবই সামান্য।

আর মাপার জটিলতাতে কাহিনী আরো একটা আছে। মনে করুন, আপনার কাছে একটা স্কেল আছে যেটা দিয়ে আপনি বারো ইঞ্চি মাপতে পারেন। এখন বারো ইঞ্চির দুদিকে দুটো খুঁটি পুঁতলেন। এই দুই খুঁটির মধ্যে দূরত্বটা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আসার পর বাড়লো নাকি কমলো, সেটা ঐ স্কেল দিয়ে বোঝা যাবে না। কারণ, তরঙ্গের কারণে ঐ দূরত্বটা যদি বাড়ে, তাহলে স্কেলেরও ততটুকু প্রসারণ ঘটবে। আপনার কাছে তখনও সেটাকে ১২ ইঞ্চিই মনে হবে। মহাবিশ্বে শুধু একটা মানদণ্ডই আছে, যা এই তরঙ্গে পরিবর্তিত হবে না। শুধু সেই মানদণ্ড দিয়েই আপনি সংকোচন বা প্রসারণ মাপতে পারবেন। সেই মানদণ্ড হচ্ছে – আলো। আলোর গতি একই থাকবে, এবং আলোর যাওয়া-আসার সময় দিয়ে আপনি বুঝতে পারবেন দূরত্ব কতটুকু। ধরুন, আগে স্থান-১ থেকে স্থান-২ পর্যন্ত যেতে যদি আলোর ০.০০১ সেকেন্ড সময় লাগতো, দূরত্বটা প্রসারিত হলে ০.০০১ সেকেন্ডের চেয়ে একটু বেশি লাগবে।

দৃশ্যপটে এলো LIGO. চার কিলোমিটার লম্বা ইংরেজি L আকৃতির সুড়ঙ্গ বানালো ওরা। সুড়ঙ্গের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় ওরা আলো (লেজার) ছুঁড়ে মারে। এরপর অন্য মাথায় গিয়ে সেটা ফিরে আসতে কতক্ষণ লাগে, সেটা বিচার করে দেখে যে আসলেই দূরত্বটা এখনো ৪ কিলোমিটারই আছে কিনা। যদি সময় কমবেশি লাগে, তাহলেই বোঝা যাবে যে স্থান মুচড়ে গেছে, সংকোচন-প্রসারণ হয়েছে। এক মাত্রায় (ধরুন ডানে-বামে) যদি প্রসারিত হয়,  তাহলে অন্য মাত্রায় (সামনে-পিছনে) সংকুচিত হবে। অর্থাৎ, L এর এক বাহুতে আলো যেতে বেশি সময় নেবে, আরেক বাহুতে আলো যেতে কম সময় নেবে। দুটোই মিলতে হবে।


10232107

LIGO পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের দুই বাহু, প্রত্যেক বাহু ৪ কিলোমিটার লম্বা




কতটুকু সংকোচন/প্রসারণ হয়েছিলো? একটা প্রোটনকে ১০ হাজার ভাগে ভাগ করলে যে দৈর্ঘ্য পাওয়া যায়, ততটুকু পরিমাণ দৈর্ঘ্যের পার্থক্য যদি আপনি মাপতে পারেন, তাহলে আপনি এই সংকোচন আর প্রসারণ মাপতে পারবেন। বোঝা গেলো না মনে হয়? আরেকটা উদাহরণ দেই – ধরুন, আপনার কাছে ১ বিলিয়ন ট্রিলিয়ন কিলোমিটার লম্বা একটা ট্রেন আছে। সেটার মধ্যে যদি মাত্র ৫ মিটার লম্বা আরেকটা বগি লাগাতে হয়, তাহলে দৈর্ঘ্যের যেমন পার্থক্য হবে, সেটা আপনাকে মাপতে পারতে হবে। অত্যন্ত সংবেদনশীল যন্ত্র ছাড়া এই পার্থক্য মাপা সম্ভব না।

মাপার মধ্যে আরেকটা সমস্যা তো ছিলোই, সেটা হলো হৈচৈ। যে কোনো জিনিস, যার আয়তন আছে, অথবা যার তাপমাত্রা পরম শূন্য তাপমাত্রার ওপরে, সেটাই কাঁপে, সর্বদাই কাঁপছে। এগুলোকে যন্ত্রের হিসেব থেকে বাদ দিতে হবে। তারপর অন্যান্য তরঙ্গ আছে, সেগুলোকেও বাদ দিতে হবে। তার ওপর যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এইরকম কাকতালীয় ঘটনা ঘটলো কিনা, তাও দেখতে হবে। তাই, এই ধরনের পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র বানানো হলো দুটো। একটা যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানাতে, আরেকটা চার হাজার কিলোমিটার দূরে ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যে। নিশ্চিত হবার জন্য দুটো পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রেই একই পরিমাপ পেতে হবে।

২০০২ থেকে ২০১০ পর্যন্ত LIGO এর তথ্য সংগ্রহের প্রথম অধিবেশন চললো। কিন্তু ওরা কোনো ফলাফল পায়নি। আগেই বলেছি, কাজটা কঠিন। এরপর ২০১০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ওরা অনেক যান্ত্রিক ত্রুটি সারালো। এই ত্রুটি সারাতে, সংবেদনশীলতা বাড়াতে, ৫ বছরে খরচ হয়েছিলো ২০০ মিলিয়ন ডলারের ওপরে। ২০১৫ তে যখন তথ্য সংগ্রহের দ্বিতীয় অধিবেশন শুরু হলো, তখন ওরা প্রায় সাথে সাথেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সন্ধান পেয়েছিলো। কিন্তু সেটা আসলেই মহাকর্ষীয় তরঙ্গ কিনা, সেটা নিয়ে বারবার পরীক্ষা চলতে লাগলো। অবশেষে ২০১৫ এর সেপ্টেম্বর মাসে ওরা নিশ্চিতভাবেই এই কৃষ্ণগহ্বর সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট তরঙ্গের ব্যাপারে নিশ্চিত হলো। শুরু হলো গবেষণা প্রবন্ধ লেখার কাজ। গবেষকদের বিশাল একটা দল Physical Review নামক গবেষণা পত্রিকায় একটা প্রবন্ধ জমা দিলো ২০১৬ সালের জানুয়ারির ২১ তারিখে। সেই প্রবন্ধ প্রকাশনার জন্য নির্বাচিত হলো ফেব্রুয়ারির ১১ তারিখ। সেই প্রবন্ধে একটা রেখাচিত্র (গ্রাফ) আছে, যেখানে দুই পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রতেই একই ফলাফল পাওয়ার ব্যাপারটা দেখানো হয়েছে।

LIGO results

এই তরঙ্গ আবিষ্কার হওয়াটা কেন গুরুত্বপূর্ণ?


প্রত্যেকটা তরঙ্গ আমাদেরকে নতুন কিছু শেখায়। প্রথমে আমরা শুধুমাত্র চোখের দেখাতে যা যা দেখা যায়, তাই দেখতাম। অর্থাৎ, আমাদের দৃষ্টিশক্তিতে যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যগুলো ধরা পড়ে, সেই দৃশ্যমান আলোক তরঙ্গেই দেখতাম। এরপর যখন অবলোহিত (infrared), অতিবেগুনী (ultraviolet), বেতার (radio) এমন তরঙ্গগুলো আবিষ্কৃত হলো, আমাদের দেখার দৃষ্টিভঙ্গিই পাল্টে গেলো। আর সেগুলোর প্রভাব নিশ্চয়ই নতুন করে বলতে হবে না। আর মহাকর্ষীয় তরঙ্গ তো একেবারে আলাদা এক ধরনের তরঙ্গ। এই তরঙ্গ ব্যবহার করে যে সামনে আমরা কী কী দেখবো, তা এখন অনুমানও হয়তো করা যাচ্ছে না। একদম কম করে বললেও, আমরা বুঝতে পারবো – আমাদের এই মহাবিশ্ব কিভাবে কাজ করে, মহাকর্ষ কিভাবে কাজ করে। সায়েন্স ম্যাগাজিনের ভিডিও-তে বলা হয়েছে, এটা জন্ম দিয়েছে জ্যোতির্বিদ্যার একদম নতুন একটা শাখা।

হয়তো একদিন এটার মাধ্যমেই আমরা মহাকর্ষকে কাজে লাগাতে শিখবো। মহাকর্ষকে যদি কাজে লাগানো যায়, কোনোভাবে যদি স্থান-কাল চাদরের নিয়ন্ত্রণ নেয়া যায়, তাহলে কী হবে, আন্দাজ করতে পারছেন? হয়তো আমরা ওয়ার্মহোল বা কীটগহ্বর তৈরি করতে পারবো, আলোকবর্ষ ভ্রমণ করতে পারবো মুহূর্তের হিসেবে।

সমাপনী বক্তব্য


স্টিফেন হকিং একটা মন্তব্য করেছেন এই আবিষ্কারটা প্রকাশিত হবার পর। তিনি বলেছেন,
LIGO দলকে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ আবিষ্কারের জন্য ধন্যবাদ। এটা হিগস বোসন কণা আবিষ্কারের মতই গুরুত্বপূর্ণ। ওরা প্রথমবারের মত মহাকর্ষীয় তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ করেছে, দুটো কৃষ্ণগহ্বরের সংঘর্ষ এবং মিশে এক হয়ে যাওয়া পর্যবেক্ষণ করেছে। LIGO এর বর্ধিত সংবেদনশীল যন্ত্র দিয়ে আমরা হয়তো সামনে এমন আরো ঘটনা সনাক্ত করতে পারবো, হয়তো এই ব্রহ্মাণ্ড নিয়ে আমাদের জ্ঞান আরো বাড়াতে পারবো।
এই নিরীক্ষাধর্মী পর্যবেক্ষণগুলো, ১৯৭০ সালে কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে আমার করা কাজগুলোর সাথে সংগতিপূর্ণ। একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিদ হিসেবে, আমি নিজের সারাজীবন ব্যয় করেছি এই ব্রহ্মাণ্ডটাকে বোঝার জন্য যাতে কিছুটা অবদান রাখতে পারি। ব্যাপারটা ভাবতেই রোমাঞ্চ হয় যে, আমি কৃষ্ণগহ্বরের ক্ষেত্রফল আর অনন্যতা তত্ত্ব নিয়ে যে ভবিষ্যদ্বাণীগুলো ৪০ বছর আগে করেছিলাম, সেগুলো আমার জীবদ্দশাতেই পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।

বিজ্ঞান আমাদের জীবনযাত্রাকে পাল্টে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। এই ধরনের বিশাল আবিষ্কার আমাদের জীবদ্দশায় আবার হবে কিনা, তা বলা বেশ মুশকিল। এটাই হয়তো আপনার আর আমার জীবনের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানভিত্তিক মুহূর্ত – এতোটাই বিশাল এই আবিষ্কার। অবশ্য আমি বেশ আশাবাদী। আমার ভবিষ্যদ্বাণী হচ্ছে – ঠিক এই মাত্রার পরবর্তী বিশাল আবিষ্কার হচ্ছে পৃথিবীর বাইরে প্রাণের সন্ধান খুঁজে পাওয়া, আর সেটা হয়তো ঘটবে আমার জীবদ্দশাতেই।

বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টাকে ধন্যবাদ, আইনস্টাইনকে ধন্যবাদ, LIGO গবেষকদেরকে ধন্যবাদ – এরকম গা শিরশির করা একটা আবিষ্কার আমাদেরকে উপহার দেয়ার জন্য।

 

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/gravitational_wave/

Sunday, April 1, 2018

শওকত আলীর গল্প "শুন হে লখিন্দর"


লণ্ঠনের আলোর নিচে লোকটা সোজা হয়ে দাঁড়ায়। হাতে তখনো রক্তাক্ত ছুরিখানা। ওই অবস্থাতেই সে দুহাতে সদ্য-ছাড়ানো গোসাপের চামড়াখানা মেলে ধরে। বলে, তুই সদাগরের ব্যাটা সদাগর লখিন্দর বাবু, বহুত জান-বুঝ তোর, কহ রক্তই তো জানোয়ারের জান, নাকি ?



লক্ষ্মীকান্ত স্বীকার করেন—হ্যাঁ, রক্তই জন্তু-জানোয়ারের বেঁচে থাকবার প্রধান অবলম্বন। বলেন, হ্যাঁ বাবা গুপীনাথ, রক্ত ছাড়া কি প্রাণ বাঁচে ?


হ্যাঁ—গুপীনাথ যেন খুশি হয় কথাটা শুনে। বলে, তুই খুব ভালো মাহাজন-হামার কথাটা তুই বুঝিস, কিন্তুক রক্ত দেখে তুই ঘিন করিস ক্যানে কহ ?


লক্ষ্মীকান্ত বিব্রত হন গুপীনাথের কথা শুনে। বলেন, না ঘেন্না করব কেন, ঘেন্না করি নি–কিন্তু অন্যের ঘর, এই ঘরের ভেতরে তুই সাপখোপ কাটা-ছেড়া করবি—এটা কি ঠিক ?


নাহ, ঠিক নহে–হামি জানি ঠিক নহে, কিন্তুক যেখুন কসিমুদ্দিন মাহাজন হামার জান লিয়ে এই ঘরের ভিতর কাটাকাটি করে, তেখুন ? তেখুন কামটা ঠিক হয়, না সদাগরের ব্যাটা ?


লক্ষ্মীকান্ত বিব্রত বোধ করেন। হারামজাদা কোন কথা থেকে কোন কথায় চলে যাচ্ছে। ছাল-ছাড়ানো গোসাপটা তখনো মেঝেময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর মেঝেতে থিকথিকে কাদার এত রক্ত জমছে জায়গায় জায়গায়। জানোয়ারটা হেঁটে বেড়াচ্ছে আর তার চামড়াটা গুপীনাথের হাতে-কী বীভৎস ব্যাপার! লক্ষ্মীকান্তের গা বিজ বিজ করতে লাগল। বললেন, ওটাকে বাপু বাইরে ফেলে আয়।


লষ্ঠনের আলোয় ল্যাজে-মুড়োয় বাঁধা গোসাপের স্পপটার দিকে নজর ফেলে গুপীনাথ বেশ একচোখ হেসে নেয়। তারপর বলে, এই আড়তের ঘরত বসে কসিমুদিন মহাজন কুন কাম করে তুই কহ ? হামার জানটা কাটা-ছিড়া করে না ? চাউলটা কী ? গহমটা কী ? মকইটা কী ? উগিলা তো মানুষের রক্তই, ঠিক কি না কহ ?


লক্ষ্মীকান্ত নজর করে দেখেন গুপীনাথের মুখের দিকে। দাড়িগোফ আর ঝাঁকড়া এলো চুলে গোটা মুখ এমনভাবে ঢাকা, যে সে মুখের কোনো ভাবই আন্দাজ করা যায় না। -


যেখুন আকাল হয় তেখুন সদাগরের ব্যাটা কী করে ? হামার জান লিয়ে কাটা-ছিড়া করে না এইঠে বসে? সিটা খুব ঠিক কাম, হয় না মাহাজন?


লক্ষ্মীকান্ত জবাব দেন না। এই বদ্ধ পাগলের সঙ্গে কথা বলা অর্থহীন। তিনি চুপ করে থাকেন।


গুপীনাথ গোটা মেঝেটা পায়চারি করে আসে একবার। তারপর সদ্য-ছাড়ানো লৎপতে চামড়াখানা, একেবারে মুখের সামনে এসো দোলায়ই মাল তোর পছন্দ হয় না, কহ ?


আহা কেন বাপু দিকদারি শুরু করেছিস ? লক্ষ্মীকান্ত বিরক্ত হন। বলেন, বললাম তো, চামড়ার ব্যবসা আমি ছেড়ে দিয়েছি—ওকাজ আর আমি করি না, লক্ষ্মীকান্ত প্রায় মিনতি করতে থাকেন।


গুপীনাথ চামড়াখানা তখন মেঝেতে নামিয়ে রাখে। তারপর আরেকটা গোসাপ নিচ থেকে টেনে তোলে। গলার বাধন আলগা হয়ে যাওয়াতে সাপটা ভয়ানক ফোঁসে, শরীর মোচড়ামুচড়ি করে, ল্যাজ দিয়ে বাড়ি মারার চেষ্টা করে। গুপীনাথ নিপুণ হাতে সামাল দেয় সব এবং সামাল দেওয়ার সময় সাপটার সঙ্গে সে আলাপ করে। শেষে একহাতে মাথা আর অন্যহাতে ল্যাজ টানটান লম্বা করে সাপটার দৈর্ঘ্য দেখায় লক্ষ্মীকান্তকে। বলে, এইটা পসন্দ হয় তোর ? কহ, হয় না ?


লক্ষ্মীকান্ত স্থির করেছেন হারামজাদার সঙ্গে কোনো কথাই বলবেন না। তিনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন।


অ্যাই চোপ্। হঠাৎ ধমক দিয়ে উঠল লোকটা। ধমক যে কাকে দিল, বোঝা গেল না। বলতে লাগল, হামার লখিন্দরের পসন্দ হয় না— হামা’র কাহাকো পসন্দ্ হয় না। -


ওই কথা বলতে বলতেই সে একপায়ে গোসাপটার লেজ এবং একহাতে মাথা ধরে ধারালো ছুরি দিয়ে গলার কাছে আঁচড় দেয় দুবার। তারপরই দেখতে-না-দেখতে চড় চড় করে ছাল ছাড়িয়ে নেয়। তারপরই দেয় সাপটকে ছেড়ে। ছালহীন গোসাপটা মেঝেতে মোচড়ামুচড়ি করে, ফোঁসে এবং মেঝেময় রক্ত ছিটিয়ে ছুটে বেড়াতে আরম্ভ করে। আর এদিকে তখন গুপীনাথ হাসে–এই দ্বিতীয় চামড়াখানও দুহাতে সে মেলে ধরে লক্ষ্মীকান্তের মুখের সামনে। বলে, এইখান দেখ লখিন্দর বাবু, পসন্দ্ হয় এইখান, কহ ? ই সাপ সাপ নহে, সাপের বাপ-ইয়ার নাম সনা গুই, কহ পসন্দ্ হয় ?


লক্ষ্মীকান্তের অসহ্য বোধ হয়। ঘড়ির দিকে তাকান, মোটে ৯টা, কিন্তু মনে হচ্ছে, যেন নিশুতি রাত। শেষে বললেন, হয়েছে বাপ, আর জ্বালাস নে, গত বছরের পাওনার টাকাটা চাস তো, পাবি। এখন তোর এই কাটাকাটির কাজটা বন্ধ কর—ভগবানের জীব তো—


হ্যাঁ ভগমানের জীব, গুপীনাথ মাথা দোলায়, কিন্তুক কুন্ ভগমানের জীব সিটা কহ ? হামার ভগমান মা বিষহরি—হামরা সান্তাল, কালিনাথ হামার ভাই, হাঁ। বুঝে দেখিস, এই বলে সে মেঝেতে রাখা মুখবাধা থলের গায়ে একটা খোঁচা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে ফোঁস করে শব্দ হয়। থলের ভেতরকার জীবটা নড়াচড়া আরম্ভ করে দেয়। গুপীনাথ ধমকে ওঠে, চোপ সালা, তুই কুছু কহিস না, হামার সঙ্গে সদাগরের ব্যাটা লখিন্দরের হিসাব-নিকাশ—তোর কী ?


লক্ষ্মীকান্ত লক্ষ করে দেখলেন, থলের মধ্যেও সাপ নিয়ে এসেছে হারামজাদা। তিনি জানতে চান, ওটাকে আবার থলের মধ্যে কেন গুপীনাথ ?


গুপীনাথ হাসে। বলে, উটি হামার লতুন কইনা বাবু মসয়, ভারী রূপসী—কালি গহমা দেখিছিস ? দেখিস নাই ? কালা দেওয়ার এতন বন্নখানি, বুকখান ফকফকা ধলা আর লয়ন দুটি দীঘির পানির মতন টলটল টলটল করে—দেখিস নাই, দেখে লে তা হইলে—


গুপীনাথ ঝুকে পড়ে থলের মুখের বাঁধন খুলতে যায়।


না না, আরে পাগল নাকি-লক্ষ্মীকান্ত ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। কাতরস্বরে বলতে থাকেন, তুই ওই সাপ-টাপ বার করিস না বাপ—তোর সব হিসেব আমি মিটিয়ে দেব।


হাঁ, হিসাব ত মিটাবি–তুই বড়া সদাগর, তোর বহুত পাইসা, সি হামি জানি, চান্দো সদাগরের গুষ্টি না তুই? হিসাব মিটাবা পারিস তুই— কিন্তুক হিসাবটা তো বাবু মসয় বহুত লাম্বা। কতকালের হিসাব, কেহ জানে না—তুইও জানিস না।


এ কেমন কথা বলছে পাগল ? লক্ষ্মীকান্ত ঠিক বুঝতে পারেন না। বলেন, ও বাবা গুপীনাথ—হিসেবে তো গোলমাল কিছু নেই, মাত্র এক বছরেরই তো হিসেব-মাত্র গতবছরই তো মোট দুই দফা মাল দিয়েছিলি। ওইসময় বাপু ভারি ঝামেলা যাচ্ছিল আমার। আমি কোনোদিকে খেয়াল রাখতে পারি নি। পরে শুনেছি, শালা দাজুটা নাকি তোকে ঘাড় ধরে বার করে দিয়েছিল—আমি ও-বিষয়ে কিছু জানি না বাপ, দাজুটাকে আমি আগে কিছু বলি নি–বিশ্বাস কর।


উসব হামার ফম নাই। গুপীনাথ ভারি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। বলে, উপার তোর বহুত লোক, বহুত বড়া সদাগর তুই—সি হামি জানি—নাই হে সদাগরের ব্যাটা—উসব হামি মনত রাখি না—হামার বিষহরি মায়ীর কথা বুঝে দেখ। চান্দো সদাগরের মাহাতটা কুন কাম করিল ফম ভাঙ্গে দিলে—আহা কী কষ্ট, সন্তানের কষ্ট দেখে মায়ী কান্দে, কিন্তুক কিছু করে না—কিছু করিবা পারে না। কারণ উ যে মা জননী। যদি মায়ের রাগ হয়, তা হইলে যে দংশাবে মা—মা কিছু করে না সেই তানে—খালি সইয্য করে যায়। হামিও সইয্য করিছি, হামার রাগ সইয্য করার কুনো ক্ষমতা যে কাহারো নাই, সেই তানে হামি কিছু করি নাই—বুঝে দেখ মহাজন।


গুপীনাথ ওইসময় কেমন বিচিত্র ভঙ্গিতে ডাইনে-বায়ে দোল খায়। একবার এ পায়ে ভর রাখে, একবার ও-পায়ে। হাতে তখন গোসাপের চামড়াখানা ধরা। লোকটাকে ক্লান্ত মনে হয়। লক্ষ্মীকান্ত সিগ্রেট বার করে ধরান। তারপর আরেকটা সিগ্রেট বার করে গুপীনাথের দিকে এগিয়ে ধরেন, লে বাপু, সিগ্রেট খা।


মাথা ঝাকুনি দেয় গুপীনাথ। তারপর মুখখানা উপরে তোলে, চোখের পাতা টানটান করে তাকায়। তারপর মাথা ডাইনে বায়ে দুলিয়ে—থু করে থুতু ফেলে মেঝেতে। তারপর বলে, উ বান্দরের চ্যাট হামি খাই না, তুই খা।


কথাটা বলে সে মেঝেতে উবু হয়ে বসে। এবং চুপচাপ মাথা নিচু করে কোমরে গোঁজা একটি ছোট থলে বার করে। থলেটা উপুড় করে ঢালে মেঝেতে। থলের ভেতর থেকে বার হয় ভাঙা বেঁটে একটা ছিলিম আর দলা-পাকানো শুকনো ভাঙপাতা। বোঝা যায়, গুপীনাথ এখন ভাঙের আসর বসাবে ।-


লক্ষ্মীকান্ত একবার ভাবেন, পালিয়ে যাবেন এই ফাঁকে। কিন্তু সাহস হয় না তার শেষপর্যন্ত। কারণ ঘরের ভেতর থেকেও দিব্যি শুনতে পাচ্ছেন দূরে মোটরগাড়ি চলাচলের আওয়াজ। একেকবার আসছে, আবার চলে যাচ্ছে। পালিয়ে যাওয়ার চিন্তাটা তাকে মগজ থেকে ঠেলে রিয়ে দিতে হয়। কোনো উপায় নেই, লম্বা নিশ্বাস বার হয় তার। কোনো উপায় নেই, এই উন্মাদ সাওতাল সাপুড়ের সঙ্গেই তাকে রাতটা কাটাতে হবে।


এই গুপীনাথকে দেখেছিলেন দুপুরবেলা—তখন যদু রায়ের বাড়ি থেকে এই বটতলির হাটে আসছিলেন। লোকটা বাবা রোদে কান্দরের ওপর দিয়ে লম্বা একখানা লাঠি হাতে নিয়ে ছুটে যাচ্ছিল তীরবেগে। তারপর হঠাৎ দেখা গেল, লোকটা দাড়িয়ে পড়েছে—পায়ের নিচে লাঠিচাপা এবং লাঠির নিচে গুইসাপ। এবং দেখতে—না-দেখতে, সাপটকে ল্যাজে, মুড়োয় গিট দিয়ে পাকানো বিড়ার এত করে বেঁধে ফেলল। গুইসাপ ধরার ওইটিই কৌশল। কিন্তু লোকটার দ্রুততা দেখে তার সন্দেহ হয়েছিল, এ নিশ্চয়ই গুপীনাথ। সঙ্গে ছিল দাইমুদ্দিন, সে হারামজাদা হল স্মাগলারদের আড়কাঠি। সে বলল, সাহা মশাই—ও গুপীনাথ নয়, আপনার ভুল হচ্ছে—গুপীনাথ তো সেই কবে থেকে লাপাত্তা। ও কোথেকে আসবে এখানে ?


ওই সময় যদি পকেট থেকে চশমাখানা বার করে পরে নিতেন তাহলে এই হেনস্থা হয় তার ? তিনি দাইমুদিনের কথা বিশ্বাস করলেন আর তারপর ওই বটতলির হাটখোলায় অহেতুক শুয়ে-বসে কাটিয়ে দিলেন দুপুরটা। ভাবলেন, এই তো মাইল পাচেক রাস্তা, একটা ছুট লাগাবেন, তারপরই ওপার। ঘণ্টাদুয়েকের মামলা। ও নিয়ে কখনো দুশ্চিন্তা করেন নি, আজ কেন করতে যাবেন ? তখন কি জানতেন, বর্ডারের হাঙ্গামাটা ঠিক সন্ধেবেলাতেই লেগে যাবে। ছিছি, একেই বলে বেকুবি। ১১ নং ১২ নং ১৩ নং–একসঙ্গে তিন বি-ও-পি জুড়ে গোলমাল। দাইমুদ্দিন খবর জানাল, বর্ডারের দিকে মানুষ যেতে দেখলেই দড়াম্ দড়াম করে গুলি চালিয়ে দিচ্ছে। আর ওই হাঙ্গামা আরম্ভ হতে-না-হতেই আড়তদার কসিমুদ্দিন, তার সাগরেদ বসির মুনশি, আর তাদের যত চাকর নফর, সব হাওয়া হয়ে গেল। তিনি কোথায় যান তখন ? ভয়ানক দুশ্চিন্তা হয়েছিল তার। কিন্তু ভাগ্য বলতে হবে, যে দাইমুদ্দিনস পালায় নি। দাইমুদিনই রাতের খাবার জোগাড় করে দিয়েছে, লণ্ঠন জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে, শোবার ব্যবস্থাটিও তারই হাতে করা। কিন্তু শেষ আহাম্মুকিটা করলেন তিনি নিজেই। দাইমুদ্দিন বারবার করে বলে দিয়েছিল, সাহামশাই, খবরদার দরজা খুলবেন না। যে-ই আসুক, বলবেন, সকাল হোক, তারপর দরজা খোলা হবে। তিনি বেশ ভালো করে শুনে রেখেছিলেন দাইমুদিনের কথাটা। কিন্তু কী-যে হল, দরজায় দিলেন। এমন আহাম্মুকির কাজ কেউ করে ? কপালে দুঃখ থাকলে খন্ডাবে কে ?


গুপীনাথের তখন কয়েক দম ভাঙ্টানা হয়ে গেছে। ঘরের ভেতরটা ধোঁয়ায় ধোঁয়াকার। পোড়া ভাঙের উৎকট বুনো গন্ধ বাতাসে ভাসছে। বুঝলেন, এবার নেশা হবে পাগলাটার এবং তা হলেই সে শান্ত হয়ে যাবে। একবার ঘুমিয়ে গেলে তিনি নিশ্চিন্ত। সকাল হওয়ার পর কি আর তিনি বসে থাকবেন ? বয়ে গেছে তার। এখন নেশাগ্রস্ত লোকটা ঘুমিয়ে পড়লেই হয়।


কিন্তু ঠিক ওইসময়ই গুপীনাথ ফের উঠে দাঁড়াল। মেঝে থেকে গুইসাপের ছাল দুখানা হাতে তুলে নিয়ে জানতে চাইল, হাঁ বাবু মসয়— মাল গিলা তাইলে পসন্দ্ হইছে তোর—ঠিক না ?


সে একটা কিছু হবে গুপীনাথ,—সকাল হোক, এবার তুই ঘুমো, আর আমাকেও একটু জিরোতে দে।


গুপীনাথ হো হো করে হেসে উঠল। যেন হাস্যকর একটা প্রস্তাব দিয়েছেন লক্ষ্মীকান্ত। বলল, নিন্দ হামার আসে না লখিন্দর—সদাগর নিন্দায়, তার বহু সনকা নিন্দায়, ব্যাটা লখিন্দর নিন্দায়, পুতোহু বেহুলা নিন্দায়—জগৎসংসার নিন্দায়—কিন্তুক জাগে কে ? না মা বিষহরি । মা বিষহরি নিন্দায় না, তার সন্তানেরা নিন্দায় না। আসমানের দেওয়া নামে—গাছ বিরিক্ষ উলটপালট করে—ডরে কেহ বাহার থাকে না–কিন্তুক ওইসময় কে থাকে বাহার ? কহ লখিন্দর–কে থাকে বাহার ? বাহার থাকে বিষহরি মায়ী আর তার সন্তানেরা। হামি বিষহরির সন্তান, বিষহার মায়ী যেমন দুনিয়ার পাপ-তাপ জ্বালা-যাতনার বিষ নিজের ভিতর ধরে রাখে আর নিজে নিজে জ্বলে, হামারও আমন। হামিও বিষ ধরে রাখি আর জ্বলি। বুঝে দেখ, সওদাগরের বেটা লখিন্দর-গহমা হামার ভাই, আলাদ হামার ভাই, বোরাও হামার ভাই—হামরা সবাই বিষ ধরে রাখি—তাতে দুনিয়াটা শান্তিতে থাকে। কিন্তুক যুদিন হামার শান্তি না থাকে, হামাক যদি মারে ফালাবা চাহেন—তেখুন ? মাহাজন বুঝে দেখ, তেখুন হামার আর উপায় নাই—হামরা তেখুন দংশাই।


লক্ষ্মীকান্ত দেখছিলেন লোকটাকে। ভারি স্নিগ্ধ আর কোমল একটি ভাব ধরা পড়েছে এখন তার ভঙ্গিটিতে। মনে হচ্ছিল, একহাত ওপরে তুলে কোনো গায়েন যেন পালাগান গাইছে। লক্ষ্মীকান্তের মনে হতে লাগল—এ একরকমের পালাগানই—যে পালাগানে ভদ্রমানুষ চাঁদ সওদাগরের দাম নাই, লখিন্দরের দাম নাই, বেহুলার দাম নাই শুধু মনসার গুণগান। বললেন, গুপীনাথ আমিও তো মা-মনসার পূজা করি, কিন্তু কই, আমি তো মনে করি না সাপখোপেরা আমার ভাই বন্ধু।


মনে করিস না, না ? গুপীনাথ হাসে আর মাথা দোলায়। বলে, না বাবু মসয়, উট মিছা কথা—ওই পূজাটা তোর মিছা। মনসার পূজা তোরা করিস না। চান্দো সদাগর যেমন বাঁও হাতের আঙ্গুল দে’ পূজা দিছিল, তোর পূজা ওইরকম। কহ দেখি, দেবীপূজা যেমন করে করিস, অমন করে কি বিষহরি মায়ীর পূজা করিস ?


আহা তা কেন করব, লক্ষ্মীকান্ত বোঝাতে চেষ্টা করেন। বলেন, বড় ছোট থাকবে না ? মা আর মেয়ে এক হল ? মানীর মান বেশি হবে না ?


গুপীনাথ মাথা দোলায়, না হে লখিন্দর, সি নহে, মাও বিটির কথা নহে। দেওতা হইল দেওতা। কিন্তুক বিষহরি মায়ীক দেওতা মানিবা চাহে নাই কেহ। বুঝে দেখ বাবু মসয়। জনমের পর হামার বিষহরি মায়ীক বাড়িত নিয়ে গেল মাহাদেব শিবোনাথ। কিন্তুক দেবীমায়ী উমহাক মারিল ক্যানে, কহ ? দেবী মায়ী জগতের খবর রাখে আর ওই খবরটা রাখিবা পারে নাই যে বিষহরির জনমটা ক্যামনে হইল, কুষ্ঠে হইল, ক্যানে হইল ? আর মায়াদয়া নাই কনে, অ্যা ? মারতে মারতে মায়ের হামার চোখটা কানা করে দিলে ? ই কুনদেশি বিচার কহ ? ইটা কি দেওতা ভগমানের কাম ? অমন মার দিলে, কিন্তুক কুনো দেওতা আগাইল নাই। ক্যানে আগাইল নাই বিচার কর ইবার ? উ যে মাটির সন্তান, সেই তানে, না ? সব দেওতার পূজা আছে, কিন্তুক মা বিষহরি পাবে নাই—কহ ই কেমন বিচার ? বিষহরি মায়ীক ঘরের বাহার করে দিলে। মায়ের তেখুন কী কষ্ট—আহা রে, কেহ নাই, মায়ের সোয়ামি নাই, সন্তান নাই, মা-বাবা নাই। সঙ্গী হইল ধূপীর বেটি নেতা। মা বিষহরি এখুন কুনুঠে যায় ? কারঠে যায় ? চিন্তা করে দেখ মহাজন। মাটির সন্তান বিষহরি মায়ী গেল মাটির সন্তানের বগলত। ছোট জাতের মানুষ হইল বিষহরি মায়ীর সন্তান। এই কথাটা হিসাব করে বুঝিস লখিন্দর, চান্দো সদাগর কে—আর বিষহরি মায়ী কে ? ই তোর মানুষ আর দেওতার নাঢ়াই নহে বাবু মসয়ই হইল গরিব আর ধনীর নাঢ়াই। জিরাত নাই—আর তুই হইলো ধনী চান্দো সদাগরের সন্তান। তোর সব আছে। হিসাব করে দেখ বাবু মসয়, কথাটা হামার ঠিক কি না।


লক্ষ্মীকান্ত শুনছিলেন। লোকটা একই ভাবে অনেকক্ষণ ধরে দাড়িয়ে আছে আর ভারী ভাঙা ভাঙা জংলি স্বরে কথাগুলো বলে যাচ্ছে। তার মনে হয়েছিল বোধহয় অসংলগ্ন প্রলাপ | কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, তা নয়। তার অসংলগ্নতার ভেতরে ভেতরে ভারি সূক্ষ্ম এবং শক্ত একটি যোগসূত্র রয়েছে। কোথাকার জিনিশ কোথায় এনে ফেলল। কিন্তু যোগাযোগটা ঠিক বোঝা যায়। গোটা প্রসঙ্গটা হালকা করার জন্য হাসতে হাসতে বললেন, এ কিন্তু ভালো পালাগান হবে গুপীনাথ। তুই বাপু গায়েন হয়ে এবার বিষহরির পালা বাঁধ্।


চোপ, গুপীনাথ হঠাৎ ধমক দিয়ে উঠল। এবারও বোঝা গেল না কাকে সে ধমক দিল । লক্ষ্মীকান্ত আন্দাজ করলেন গুপীনাথকে লোকে যে পাগল বলে, তা বোধহয় এই কারণেই—যখন-তখন এই বেমক্কা চিৎকার করে দেওয়া ধমকটাই ওর পাগলামি। হাসতে হাসতে বললেন, তাহলে গুপীনাথ-গুনিন এবার গুপীনাথ-গায়েন হবে, কী বলিস ?


না হে সওদাগরের বেটা, হামি গাওনা করি না, হামি মন্তর পঢ়ি । যে মন্তরে সাপের রাগ ঠান্ডা হয়, সেই মন্তর হামার। বিষটা তো আর কিছু নহে, বিষ হইল রাগ। রাগ হইলেই সাপ দংশায়। হামার মন্তর রাগ থামায়, ফির রাগ জাগায়।


আচ্ছা গুপীনাথ, বহুত হয়েছে বাপ–এবার একটু ঘুমোতে দে, লক্ষ্মীকান্ত হাই তুললেন এবার। বললেন, তুই ঘুমো, আমিও ঘুমোই।


গুপীনাথ জোরে হাসে হো হো করে। বলে, এক কথা ঘুরে ঘুরে কহিবা ভালো লাগে না মাহাজন, নিন্দ হামার আসে না, রাইতে হামার নিন্দ হয় না কুনোদিন। কহ ইবার, আসল কথাটা—এই মাল গিলা তুই লিবো কি না ?


এ তো মহাজ্বালা, লক্ষ্মীকান্ত দেখলেন, ভবি কিছুতেই ভুলছে না। বললেন, ঠিক আছে বাপ, নেব তোর মাল, কাল সকালেই নিয়ে নেব, কথা দিলাম ।


গুপীনাথ হাসে, তোর কথার কুনো ঠিক নাই বাবু মসয়, সদাগরের কথা আর ব্যাঙের মাথা–তুই টাকা দে।


লক্ষ্মীকান্ত দুখানা দশ টাকার নোট এগিয়ে ধরলেন—এই নে, এবার গিয়ে বসে থাক চুপচাপ, আর দিক করিস না।


গুপীনাথ নোট দুখানা হাত বাড়িয়ে নেয়। বলে, লখিন্দর হে। তু বড়া ভালো সদাগর। মায়ী বিষহরি তোর ভালো করবে।


টাকাটা কোমরে গুজে সে আবার হাসে। বলে, হামার পুরানা হিসাবটা কর ইবার।


লক্ষ্মীকান্ত আর পারলেন না। এবার ধমকে উঠলেন। কিসের হিসেব ? আমার কাছে টাকা চাইলেই পাবে, অ্যা ? এইমাত্র টাকা দিলাম, এখনই ফের হিসেব ?


চোপ, গুপীনাথও ধমকে ওঠে।


লক্ষ্মীকান্ত এতক্ষণ উপেক্ষা করছিলেন এবার আর পারলেন না। বললেন, কাকে ধমকাস তুই গুপীনাথ? তুই আমাকে ধমক দিতে চাস ? আমাকে—


না না সদাগরের বেটা। তোক কি হামরা ধমক দিবা পারি ? তুই কেমনু লোহার ঘরত বাস করিস, বাহার দিক লোকের পহরা, কত গুনিন, কত মাহাত জড়িবুটি লিয়ে ঘুরে বেড়াছে। তোক হামরা ধমক দিমো, এমন ক্ষমতা হামার—ছি!


গুপীনাথের গলার স্বর বদলে যেতে থাকে। বলে, হিসাবটা যে বহুত দিনের লখিন্দর। কতদিন আর ঘুরে ঘুরে যামো হামরা সান্তালী পাহাড়ত হামার দাদা, পরদাদার বাস ছিল। কালিনাগের রক্ত হামার শরীলে বহে যাছে। কতকালের পুরানা হিসাব, ফম করে দেখ তুই। কত আকাল গেল, ব্যারাম গেল, বানবরিষা গেল—কিন্তুক হামরা খোরাকি পাই নাই। সদাগরের বেটা, সেই হিসাবটা ইবার দিবা হবে।


রাগে না লোকটা—রক্তাক্ত মেঝেতে ছায়া ফেলে ভারি ধীর স্বরে কথা বলে যেতে থাকে। ছায়াটা একেবার ডাইনে-বায়ে দোলে। মনে হয়, যেন প্রকাণ্ড একটা ফণা-তোলা সাপ ছোবল দেওয়ার আগের মুহুর্তে ডাইনে-বায়ে দুলছে। হিসেবের কথা শুনে লক্ষ্মীকান্ত প্রায় কাতরে ওঠেন। বলেন, বাপ, তোর হিসেব তো আমি বুঝতে পারছি না।


চিন্তা করে দেখ। চিন্তা করলেই হিসাবটা বুঝিবো। গুপীনাথ বলতে বলতে ফের যেন দোল খায়। বলে, আকালের সময় কত চাউল তুই হিসাবটা, তারপর ফের গহমের হিসাবটা। এইরকম করে করতে থাক হিসাবটা।


বাপ, আমি তো ওপারের লোক, এদিকের আকাল হলে আমি কেন দায়ী হব ?


গুপীনাথ এবার হাসে, ইপার উপার হামি বুঝি না—এইপার হামরা দুই ভাই তো ওইপার হামরা চার ভাই! আর ইপারের কসিমুদিনটা কে ? তোরই সাগরিদ নয় ? কহ, লখিন্দর বাবু হামার, কহ কসিমুদ্দিন তোর সাগরিদ কিনা ? যদু রায় কার সাগরিদ ?


গুপীনাথ ঝুঁকে পড়ে ওইসময় কিছুটা। বুকে বোধহয় লক্ষ্মীকান্তকে ভালো করে দেখে নিতে চায়—ওইসময় সে আবার ডাইনে বায়ে একটু একটু দোলে! লক্ষ্মীকান্ত কী দেখেন, তিনিই জানেন—ভয়ানক জোরে চিৎকার করে ওঠেন হঠাৎ ৷ বলেন, আসবি না, কাছে আসবি না, খবরদার!


গুপীনাথ পিছিয়ে আসে। বলে, ডরাইস না লখিন্দর। হামি তো মানুষ। সাপ নহওঁ। দংশামো ক্যামনে হামি—তুই হিসাবটা মিটা এইবার। পরথমে মোর দুইশ' খালের টাকা বাহার ক্।


লক্ষ্মীকান্ত গুপীনাথের চোখমুখের দিকে আর তাকাতে পারেন না। অজানা একটা ভয় মনের খুব ভেতরে কোথায় যেন শিরশির করে ওঠে। বলেন,—বাপ তোর পায়ে পড়ি—আমার কাছে টাকা নেই এখন, ওপারে চল্, আমার গদিতে। পাই পয়সাটা পর্যন্ত বুঝিয়ে দেব।


গুপীনাথ হাসে। বলে, লখিন্দর তোর হিসাব তোরঠে আর হামার হিসাব হামারঠে। তুই কী করবো সে হামি জানি। ইবার দুইজন নেপালী দাজু হামাক ঘাড় ধাক্কা দে খেদাবে—হা, সি হামি বুঝি। হিসাবটা তুই এইঠে মিটায় দে।


বাবা, বুঝতে চেষ্টা কর, আমি কেমন করে পয়সা দেব এখান থেকে ? এখানে তো আমার টাকাপয়সা নেই।


ওদিকে লণ্ঠনের আলো স্নান হয়ে এসেছে। সম্ভবত তেল নেই। লক্ষ্মীকান্ত কাতর আর্তনাদ করে ওঠেন। বাবা গুপীনাথ, বাতিটাকে তেল দে বাপ—অন্ধকারে থাকলে আমার ভয় করে।


লখিন্দর, হামরা কিন্তু অন্ধকারে থাকি। আন্ধারে জনম, আন্ধারে বাঁচন, আন্ধারে মরণ গুপীনাথ হাসতে হাসতে এবার বসে পড়ে।


লষ্ঠনের শিখা ওদিকে ছোট হয়ে আসে আর গুপীনাথ বলতে থাকে, লখিন্দর শুনে রাখ। ইবার হামি নিন্দামো, এক চোখ হামার নিন্দাবে, অন্য চোখ থাকবে সজাগ। বিষহরি মায়ীর এক চোখ, সেই চোখটা হামি আর যে চোখ কানা, সিটা হইল হামার ভাই কালি গহমা। কালি গহমার বস্তার মুখ হামি খুলে দিনো। হামার হিসাবটা মিটায় দে তুই।



দেখতে দেখতে অন্ধকার গাঢ় হয়ে উঠল চারদিকে। ঝুলন্ত বাতিটার নিশানা পর্যন্ত চোখের সামনে থেকে মুছে গেল। গুপীনাথ শুয়ে, না বসে—ঘুমিয়ে, না জেগে–কিছুই বোঝা যায় না। খানিক পর লক্ষ্মীকান্ত একবার সরে বসতে চেষ্টা করলেন। আর তাতেই ভয়ানক শব্দে ফুসে উঠল একটা সাপ। সেটা নির্বিষ গোসাপ—না বস্তা থেকে সদ্য ছেড়ে দেওয়া গুপীনাথের সেই কালিগহমা—লক্ষ্মীকান্ত বুঝতে পারলেন না। তার চারদিকে অন্ধকার এবং ওই অন্ধকারের ভেতরে হিংস্র কালিগহমা নড়েচড়ে বেড়াতে লাগল।

 

ওয়াল্ট হুইটম্যানের দু’টি গদ্য


অনুবাদ :  এমদাদ রহমান

[গদ্য দু’টি অনুবাদের পর হুইটম্যানের জন্ম আর মৃত্যু ছাড়া আরও বেশি কিছু জানার ইচ্ছা হল। খুঁজতে খুঁজতে দূরে আর কিছু গভীরে গিয়ে পেয়ে গেলাম হেনরি মিলার! আলম খোরশেদের ভাষান্তরে হেনরি মিলারের ভাবনাগুচ্ছ। মিলার বলছেনঃ ‘আমার বন্ধু অ্যাবে রাটনার আর আমি যখন আমাদের আমেরিকাব্যাপী এয়ারকন্ডিশন্ড নাইটমেয়ার যাত্রা শুরু করি তখন আমরা ছিলাম লং আইল্যান্ড-এ, ওয়াল্ট হুইটম্যান যে খামারে জন্মেছিলেন সেটা থেকে খুব একটা দূরে নয়। আমরা ঠিক করি যাত্রা শুরু করার আগে তাঁর জন্মস্থানের পাশ দিয়ে গিয়ে আমাদের শ্রদ্ধা জানাবো।
কথামত তাঁর বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আমরা গাড়ির গতি কমিয়ে মাথার টুপি খুলে নিই, তারপর দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে, মৃদু হেসে আমাদের অভিযান শুরু করি।’ মিলারকে তখন মুগ্ধ হয়ে পড়ছি, ‘আমি হুইটম্যানকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম লেখক বলে মনে করি, এমনকি ইউরোপের যে-কোন শ্রেষ্ঠতমর চেয়েও শ্রেষ্ঠ । লীভ্স্ অভ গ্রাস একটি সত্যিকারের মাস্টারপীস, আত্মার সংগীতবিশেষ। তাঁর কবিতা সং অভ মাইসেল্ফ-এ স্বাধীনতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল।’ এখন এই শেষরাতে, নিজের সংগ্রহের পেপারব্যাক লীভ্স্ অভ গ্রাস বের করে পড়তে পড়তে অন্ধকার-ফিকে-হয়ে-আসা হ্যাম্পশায়ারের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা যায়!

হুইটম্যানের জন্ম হয় ১৮১৯ সালের ৩১ মে, আমেরিকায়; জীবন শেষ হয় ২৬ মার্চ ১৮৯২। তাঁর ‘সেইসব দিন’ বইটি প্রকাশ পায় ১৮৮২ সালে। বিচিত্র-বিষয়ে-ঠাসা এই বইটিকে হুইটম্যানের ডাইরিও বলা যায়। অনূদিত গদ্য দু’টি এই বই থেকেই নেয়া।]

পাখি আর পাখি আর পাখি

একটু পর—ঝলমলে আলোয়—এক অদ্ভুত সঙ্গীত, এই সব দিনরাত্রি মুখর করে দেয় (এপ্রিলের শেষে, মে’র প্রথমে) কালোপাখির গান; অবশ্য সবজাতের পাখিই, অকস্মাৎ ছুটে চলে, শিস-ধ্বনি দেয়, লাফায়, স্থির হয়ে বসে, গাছেদের ডালেপাতায়। আমি আগে আর কখনোই এমনটা দেখি নাই, শুনি নাই, কিংবা বলা যায় এই দেখা আর শোনার মাঝামাঝিও কিছু ঘটে নাই, পাখিদের অবিরাম ছুটে চলা, বসা, গান গাইতে থাকা জনিত এই যে ব্যস্ততা; এই যে গানপ্লাবন এই যে একাকার উন্মাদনা; আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, বছরের ঠিক এই সময়টায় আর কখনোই এমন হয় নাই। মহাসমুদ্রের মতো, পাখিদের এই পরম্পরা। এইখানে আমি আজ যে পাখিদের গান শুনলাম, তাদের নামের একটা তালিকা দিচ্ছি—

কালোপাখি (অগুন্তি),
চড়ুই (অগুন্তি),
চিত্রা ঘুঘু,
ক্যাটবার্ড,
পেঁচা,
কোকিল,
কাঠঠোকরা,
পানকৌড়ি,
রাজপাখি,
কথক,
কাক (অগুন্তি),
কোয়াক,
রেন,
মাটিখোর,
মাছরাঙ্গা,
দাঁড়কাক,
কোয়েল,
ধূসরমুখা,
টার্কিশ-বাজ,
ঈগল,
মোরগ-বাজ,
নাছোড়বান্দা,
হলুদিয়া,
সারস,
শরালি,
চুচুক,
কীচকী,
বন পায়রা।

পরে আরও যারা আসে, তাদের নামের তালিকা—
ব্লু বার্ড,
টুনটুনি,
কিলডার,
শাদাপেট-সোয়ালো,
টিট্টিভ,
গাঙশালিক,
রবিন পাখি,
উইলসন থ্রাস,
বনমোরগ,
ফ্লিকার।

পাখিদের গান

কতখানি সঙ্গীত (বুনো, সরল, আদিম, নিশ্চিত কিন্তু এত মিষ্টি আর এত টক) যে এখানে বাঁশির মত বাজছে! তার পাঁচ ভাগের চার ভাগই পাখিদের গলার। দুনিয়ার সমস্ত পাখি আর তাদের গলার ভঙ্গি! গত আধঘণ্টা থেকে, এখনও, আমি যখন থেকে এখানে বসে থেকেছি, দেখতে পেয়েছি, কয়েকগোছা ঝরাপালক একসঙ্গে এসে পড়ছিল ঝোপঝাড়ের ওপর, পড়তেছিল তারা উড়ে উড়ে, অবিরাম, আমার ইচ্ছা হল ব্যাপারটাকে বলি স্পন্দময় শিস-ধ্বনি। আর এখন, ঠিক যেন একটি খুব ছোট্ট একটা পাখি চকিতে দেখা গেল, পুরোটাই মালবেরিরাঙা, ঝোপের চারপাশে- মাথা, ডানাগুলি, শরীর গাঢ় লাল, খুব উজ্জ্বলও নয়- গানও গাইছে না, যা এতক্ষণ আমি শুনছিলাম। ৪টার সময়ঃ সত্যিকারের এক জমকালো কনসার্ট আমাকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। এক ডজন নানাপ্রকারের পাখি যেন এক ইচ্ছাশক্তির বলে একসঙ্গে জড়ো হয়ে গেছে! হঠাৎ, বৃষ্টি এসে তাদের কোরাস বন্ধ করে দেয় তবু পাখিদের উদ্দাম গান আর থামে না, তারা যেন যূথবদ্ধ এই জীবনে, কেউ কাউকে ছেড়ে চলে যেতে চায় না। এই দৃশ্যদেখা শেষ করে আমি ডোবার কাছের গাছের গুড়িতে বসে পড়ি। বহুলস্বরের কিচিরমিচির আর তার পূর্ণান্তর হতে থাকে আমার থেকে একটু দূরত্বে আর তখন আমি দেখতে থাকি একটি পালক, সমস্ত সঙ্গীত থেকে বিছিন্ন, নিঃসঙ্গ, জঙ্গলের ভিতর কোথায় জানি উড়ে যাচ্ছে- যেন গান গাইছে একাকীত্বের, যেন তার উড়ে যাওয়ার সঙ্গে মিশে গেছে মানুষের জন্য পৃথিবীতে নিয়ে আসা ভালবাসার গান- যে-গান অনন্তজীবনকালের, যে-সময় চিরপ্রণম্য, শুধুই তার।

 

উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ...

বেফাস হৃদয় - এডগার অ্যালান পো


সত্যি! অনেক বেশি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম; খুব ভয়ঙ্করভাবে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু কেন, তোমার কি ধারণা আমার মাথা ঠিক নেই। রোগটি আমার ইন্দ্রিয়গুলোকে আরো তীক্ষè করেছে; ধ্বংস করেনি-- ভোঁতাও করেনি। মোটের ওপর আমার শ্রবণ শক্তি ছিল অসাধারণ। আমি স্বর্গ এবং পৃথিবীর সব কিছুই শুনতে পেতাম। নরকের অনেক কিছুই শুনেছি আমি। কিভাবে, তাহলে, আমি কি উন্মাদ?


মনোযোগ সহকারে শোন এবং দেখ কত গুছিয়ে, কত শান্তভাবে আমি তোমাকে সমস্ত ঘটনাবলীর বিবরণ দিই।

আসলে এটা বলা কঠিন কত তাড়াতাড়ি উদ্দেশ্যটা আমার মাথায় বাসা বেঁধেছিল; তবে এটুকু বলতে পারি আসা মাত্রই আমার মধ্যে সেঁটে গিয়েছিল এবং সেই থেকে দিন--রাত আমাকে তাড়া করে বেড়াতো। বলবার মত কোনো বিষয় সেখানে ছিল না, ছিল না কোনো আবেগ।

আমি বৃদ্ধ লোকটিকে ভালোবাসতাম। সে কখনোই আমার ওপর কোনো অবিচার করেনি, অপমানও করেনি। তার সহায়-সম্পত্তির ওপর আমার যে কোনো লোভ ছিল তাও নয়। আমার মনে হয় তার চোখটিই সমস্ত কিছুর জন্য দায়ী ছিল! হ্যাঁ, আমি হলফ্ করে বলতে পারি এ কথা! তার এক চোখ ছিল শকুনের মতন তীক্ষè, পর্দাটি ছিল ফ্যাকাশে নীলাভ। যখনই চোখে চোখ পড়ত, আমার গা ঘিন ঘিন করতো, রক্ত যেত জমে; ফলে আস্তে আস্তে-- অনেক ভেবে চিন্তে-- আমি ঠিক করেছিলাম বৃদ্ধ লোকটিকে মেরে এই বিভৎস চোখটির হাত

থেকে নিজেকে রক্ষা করবো।

এখন তোমরা আমাকে পাগল বললে বলতে পারো। উন্মাদগ্রস্থ ব্যাক্তিরা কিছুই জানে না। কিন্তু তোমরা দেখে থাকবে আমাকে, তোমরা দেখে থাকবে কত গুছিয়ে আমি কাজটি করেছিলাম-- কত সতর্কতার সাথে-- কতটা দূরদৃষ্টি নিয়ে-- কতটা ছলনার সাহায্যে! আমি বৃদ্ধ লোকটির ওপর এতটা দয়া কখনো প্রদর্শন করিনি যতটা আমি তার ওপর করেছি যে সপ্তাহে তাকে আমি মারার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। প্রতিদিন রাতে-- ঠিক মধ্যরাতে, আমি ছিটকিনি টেনে তার দরজা খুলতাম, তুমি ভাবতেই পারবে না কতটা সাবধানে! এবং যখন আমার মাথা ঢুকানোর মত যথেষ্ট ফাঁক হয়ে যেত আমি অন্ধকার কক্ষে লণ্ঠন প্রবেশ করাতাম। সব বন্ধ-- একেবারে বন্ধ, যাতে করে

বাইরে থেকে কোনো আলো দেখা না যায়। এবং তারপর চট করে আমি আমার মাথাটা ভেতর ঢুকিয়ে দিতাম। তুমি শুনে হাসবে কতটা চতুরতার সাথে আমি ভিতরে ঢুকতাম! খুব সাবধানে পা ফেলতাম-- খুবই সাবধানে যাতে করে বৃদ্ধ লোকটির ঘুমের ব্যঘাত না ঘটে। আমার এক ঘণ্টা লেগে যেত সব কিছু স্বাভাবিক করতে, ব্যস! একটা পাগল কি এই মুহূর্তে এতটা বিচক্ষণ হতে পারে, হুম? এবং তারপর যখন আমি পুরো স্বাভাবিক হয়ে উঠতাম, খুব সতর্কতার সাথে লণ্ঠনটা বন্ধনমুক্ত করে ফেলতাম-- খুবই সতর্কতার সাথে-- যাতে করে একটা হালকা আলোকচ্ছটা শকুনরূপী চোখটির ওপর গিয়ে পড়ে। সাতরাত ধরে আমি একই কাজ করেছিলাম-- প্রতি মধ্যরাতে। কিন্তু সবসময় চোখটিকে বন্ধ অবস্থায় দেখতে পেতাম; ফলে আমার পক্ষে তাকে খুন করা সম্ভব হত না, কারণ বৃদ্ধ লোকটি আমাকে বিক্ষুব্ধ করত না, বিক্ষুব্ধ করত তার ঐ জ্বালাতনময়ী চোখ। প্রতিদিন সকালে, সবকিছু স্বাভাবিক হলে, আমি বেশ সাহস সঞ্চার করে বেহায়ার মত তার চেম্বারে যেতাম, আন্তরিকতার সাথে তার নাম ধরে তার সাথে কথা বলতাম, এবং বুঝতে চেষ্টা করতাম গত রাতটি সে কেমন কাটিয়েছে। এখন তোমরা বুঝতে পারছো, সে খুবই বয়স্ক একজন মানুষ। আমি যে প্রতি রাতে ঠিক ১২টার সময় তার রুমে যাই এ

ব্যাপারে তার সন্দেহ করার কোন কারণ ছিল না।

অষ্টম রাতে আমি দরজা খোলার ব্যাপারে অন্যান্য রাতের থেকে অনেক বেশি সতর্ক ছিলাম। ঘড়ির কাটাও আমার থেকে বেশি জোরে নড়াচড়া করছিল। ঐ রাতের পূর্বে কখনো আমার নিজের শক্তি এবং বিচক্ষণতাকে এতটা তীব্রভাবে অনুভব করিনি। আমি খুব কমই আমার বিজয়োল্লাসকে চেপে রাখতে পারতাম। আমি যে কুমতলব এঁটে রাতের অন্ধকারে চুপিসারে দরজা খুলে তার কাছে গিয়েছিলাম, তা সে স্বপেড়বও কল্পনা করেনি; -- এসব ভেবেই আমি মুরগীর ছানার মতন ডেকে উঠেছিলাম, এবং খুব সম্ভবত সে তা শুনতে পেয়েছিল; যার জন্য সে বিছানা থেকে ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়েছিল, যেন সে চমকে গেছে। এখন তুমি ভেবে থাকবে, আমি পিছিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু না। তার কক্ষটি ছিল পিচের মতন কালো, নিবিড় অন্ধকারে ঢাকা (কারণ ডাকাতের ভয়ে স্যাটারগুলো টানা ছিল)। আমি জানতাম সে দরজা খোলা দেখতে পাবে না। তাছাড়া আমি দরজার পাল্লাটা ভিড়িয়ে দিয়েছিলাম। আমার মাথা ভেতরেই ছিল, লণ্ঠন জ্বালাতে যাবো এমন সময় লণ্ঠনের গায়ে আঙুল পিছলিয়ে যাবার শব্দে বুড়ো বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে

বলে উঠল-- “কে ওখানে?”

এতকিছুর পরেও আমি নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলাম। এক ঘণ্টার মত আমি এক চুলও নড়িনি এবং বৃদ্ধের ঘুমানোর শব্দ শুনতে পাইনি। সে তখনো বিছানায় কান পেতে বসে দেয়ালে গুবরে-পোকার কাঠ কাটার শব্দ শুনছিল;-- যেমনটি আমি করেছি রাতের পর রাত। কিছুক্ষণ পরে আমি হালকা গোঙানোর শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম, বুঝতে পারলাম এটা তার মরণ ভয়ের আতঙ্ক। এটা কোনো অসুখের গোঙানি নয়, নয় কোনো কষ্টের; এটা ছিল অধিক ভয় পাওয়ার ফলে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসার শব্দ। এ শব্দটি আমার বেশ ভালো করেই চেনা। বহুরাতে-- ঠিক মধ্যরাতে, যখন পৃথিবী ঘুমিয়ে পড়ে তখন এটা আমার বুক চিরে বেরিয়ে আসে। বুঝতে পারছিলাম বৃদ্ধ মানুষটি

কেমন অনুভব করছিল। আমার তার জন্য করুণা হচ্ছিল, যদিও ভেতরে ভেতরে বেশ তৃপ্তি অনুভব করছিলাম। আমি জানতাম সে প্রথম থেকেই ঘুমানোর ভান করে জেগে ছিল। তার ভয়গুলো ক্রইমেই তার ওপর চড়াও হচ্ছিল। সে যারপরনায় চেষ্টা করছিল সবকিছু স্বভাবিক করতে, কিন্তু কিছুতেই পারছিল না। সে নিজেকেই নিজে বলল--“চিমনি দিয়ে বাতাস ঢুকছে, এছাড়া আর এটা তেমন কিছু না; এটা একটা ইঁদুরের মেঝের এপাশ থেকে ওপাশ যাওয়ার শব্দ,”-- কিম্বা “এটা শুধুমাত্র একটা ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ।” এগুলো বলে সে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছিল মাত্র কিন্তু কোনটাই কাজে আসছিল না। কেননা মৃত্যু অন্ধকারকে ভর করে তার সনিড়বকটে এসে তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছিল। কিছু একটার উপস্থিতি তার ভেতরকে বিষিয়ে দিচ্ছিল যদিও সে ঘরের ভেতর আমার অবস্থানকে টের পাওয়ার মতন তেমন কিছু দেখেওনি--শোনেওনি।

তারপর আমি অনেক্ষণ ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করি। সে তখনো ঘুমায়নি। সিদ্ধান্ত নিলাম লণ্ঠনের আলোটা হালকাভাবে বের করার--

খুবই হালকাভাবে। তাই করলাম যতক্ষণ না মাকড়সার সুতার মত হালকা আলোকরশ্মি তার শকুনের মতন চোখটিতে গিয়ে পড়ল—তুমি ভাবতেই পারবে না কতটা চুপিসারে আমি কাজটি সেরেছিলাম। সে তাকিয়ে ছিল-- প্রসন্থভাবে। তার চোখের দিকে তাকাতেই ক্রোধোন্মত্ত হয়ে পড়লাম। আমি পরিষ্কারভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম, বিরক্তিকর নীলাভ চোখের ওপর খুব জঘন্য একটি পর্দা যা দেখে আমার হাড়ের মজ্জাগুলো ঠান্ডায় কাঁপতে শুরু করেছিল। আমি কিন্তু বৃদ্ধ লোকটির চোখ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। তার ঐ জঘন্য জায়গাটি যেন আমার সমস্ত চেতনাকে গুম করে রেখেছিল। এখনো কি আমি তোমাদের বলিনি যে, পাগলামীর জন্য যে ভুলগুলো হয় তা হলো ইন্দ্রিয়গুলো খুব বেশি তীব্র হওয়া? এখন আমি একটি চাপা-বিরক্তিকর শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম, এ ধরনের শব্দ সাধারণত ঘড়ি সোলার প্যাকেটে থাকলে শোনা যায়। এ শব্দটিকেও আমার বেশ ভালো করেই চেনা। এটা ছিল বৃদ্ধ লোকটির হার্টবিটের শব্দ। এটা আামার ক্রোধকে বাড়িয়ে দিচ্ছিল বহুগুণে, ড্রামের শব্দ যেমন করে সৈনিকদের সাহসকে বাড়িয়ে দেয়। এত কিছুর পরেও আমি সংযত ছিলাম এবং যতটা সম্ভব চুপচাপ থাকার চেষ্টা করছিলাম। আমার শ্বাস-প্রশ্বাস যেন থেমে আসছিল। আমি লণ্ঠনটি খুব শক্ত করে ধরে রেখেছিলাম এবং

চেষ্টা করছিলাম আলোকরশ্মিটাকে যতটা সম্ভব তার চোখের ওপরে রাখার। ইতোমধ্যে হার্টবিটের নরকতুল্য শব্দটা অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। এটার শব্দ এবং গতি বেড়েই চলেছিল। বুৃদ্ধ লোকটির ভয় হয়ত চূড়ান্ত পর্যায়ে উঠে পড়েছিল! আমি তোমাকে বলেছি যে আমি নার্ভাস, আসলেই আমি নার্ভাস। এই নিশুতি রাতে, পোড়ো বাড়ির ভয়ঙ্কর নীরবতাকে ভেদ করে আসা এই শব্দটি আমার ক্রোধকে করে তুলেছিল নিয়ন্ত্রণহীন। কিছুক্ষণ পূর্বেও আমি যথেষ্ট সংযত ছিলাম। কিন্তু এখন হার্টবিটটা যে গতিতে বেড়ে চলেছে তাতে আমার মনে হচ্ছে খুব শ্রীঘ্রই তার বিস্ফোরণ ঘটবে। এখন আরো একটা উদ্বেগ কাজ করছে-- আশপাশের কেউ যেন শব্দটি শুনে না ফেলে! আমি

তীব্র চিৎকার দিয়ে লণ্ঠনটা উন্মুক্ত করে ঘরের ভেতর প্রবেশ করলাম। সে একবার চেঁচিয়ে উঠল-- শুধুমাত্র একবার। নিমিষে আমি তাকে মেঝেতে টেনে হিঁচড়ে নামালাম এবং ভারী চৌকিটা তার শরীরের ওপর ফেলে দিলাম। আমার কাজের নিষ্পত্তি ঘটার আনন্দ আমার চোখে মুখে ফুটে উঠল। তারপর অনেক সময় ধরে আমি আমার হার্টবিটের চাপা শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। এটা আমাকে বিন্দুমাত্র ভাবিয়ে তোলেনি; জানতাম দেয়ালের বাইরের কেউ এটা শুনতে পাবে না। অবশেষে শব্দটা কমে আসলো। বৃদ্ধ মরে পড়ে ছিল। আমি চৌকিটা তার ওপর থেকে সরালাম এবং বৃদ্ধের মৃত দেহটি পরীক্ষা করলাম। সে পাথরের মতন জমে গিয়েছিল আমি আমার হাতটা তার বুকের ওপর রেখে তার হার্টবিটকে অনুধাবন করার ব্যর্থ চেষ্টা করছিলাম। সে ততক্ষণে মরে ভূত বনে গিয়েছিল। তার চোখটি আর আমাকে জ্বালাতে পারবে না। এখনো যদি তুমি আমাকে পাগল মনে করো তবে আমার মৃত দেহ সরানোর বুদ্ধি ও কৌশলের বর্ণনা শুনে নিজের ভুল বুঝতে পারবে।

রাত প্রায় শেষ হয়ে আসছিল বিধায় আমি নীরবে কিন্তু বেশ দ্রুততার সাথে কাজ সারছিলাম। প্রথমে আমি মৃত দেহের প্রতিটা অঙ্গকে পৃথক করলাম। মাথা কাটলাম, হাত কাটলাম, পা দুটো কাটলাম। তারপর মেঝে থেকে তিনটা তক্তা ছাড়ালাম এবং দেহের প্রতিটি অঙ্গকে তক্তাগুলোর ওপরে সাজালাম। অতঃপর তক্তাগুলোকে তাদের পূর্বের স্থানে এমন নিখুঁতভাবে সেঁটে দিলাম যে কারও সন্দেহ করার বিন্দুমাত্র অবকাশ রইল না। মেঝেতে ধুয়ে ফেলার মত রক্ত, নোংরা কিংবা এ জাতীয় কিছুই লেগে ছিল না। আমি এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন ছিলাম। একটা টবেই সব এঁটে গিয়েছিল-- হা! হা! ভোর চারটার দিকে আমার সকল পরিশ্রমের সমাপ্তি ঘটল। তখনো মধ্যরাতের

মত গাঢ় অন্ধকারে ঢাকা ছিল চারপাশ। ঘণ্টা বাজার সাথে সাথে সম্মুখ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শোনা গেল। আমি বেশ হালকা মেজাজে দরজা খুলবার জন্য এগিয়ে গেলাম-- এখন আর আমার ভয় পাবার কি আছে? তিনজন লোক প্রবেশ করল যারা বেশ ভদ্রভাবে নিজেদেরকে পুলিশের অফিসার হিসাবে পরিচয় দিল। রাতের বেলায় প্রতিবেশিদের কয়েকজন একটা চিৎকারের শব্দ শুনতে পেয়ে তাদের খবর পাঠিয়েছে এবং সেই চিৎকারের তদন্ত করার জন্যই তাদের এখানে আসা। আমি হাসলাম; আমার ভয় পাবার কি আছে? আমি ভদ্রলোকদের ওয়েলকাম জানালাম। আমিই রাতে স্বপেড়বর মধ্যে চিৎকারটি করেছিলাম, তাদেরকে বললাম। আরো বললাম যে, বৃদ্ধ লোকটি দেশের বাইরে গেছে। আমি তাদেরকে ঘরের ভেতরে নিয়ে গিয়ে সার্চ করার আমন্ত্রণ জানিয়ে বললাম, ভালো করে খুঁজে দেখুন। আমি শেষ পর্যন্ত তাদেরকে ঐ কক্ষেও নিয়ে গেলাম। তার ধন-সম্পত্তি দেখালাম। আমার অধীক আত্মবিশ্বাস দেখাতে তাদের অবসাদ ঘুঁচানোর জন্য কক্ষের ভেতর চেয়ার এনে দিলাম; এবং আমি নিজের চেয়ারটা বেশ সাহস নিয়ে যেখানে মৃতের দেহ শুইয়ে রাখা হয়েছে তার ওপর পেতে বসলাম। অফিসাররা আমার ব্যবহারে বেশ মুগ্ধ হলো। আমি ভীষণ উৎসাহ সহকারে তাদের প্রতিটা প্রশেড়বর উত্তর দিচ্ছিলাম এবং মাঝে মধ্যে তারা চলতি সময়ে ঘটে যাওয়া বিভিনড়ব বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলছিল। কিন্তু অনতিবিলম্বে, সবকিছু আমার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল এবং তাদের চলে যাবার জন্য আমি মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম। আমার মাথা ব্যথা করছিল এবং অদ্ভুত একটা শব্দ এসে আমার কানে বাড়ি মারছিল। তাদের ওঠার কোনো লক্ষণ দেখছিলাম না। এদিকে সেই অদ্ভুত শব্দটা বেড়েই চলেছিল

এবং এটা ক্রমেই আরো অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। আমি এটা থেকে মুক্তি পাবার জন্য আরো সহজভাবে কথা বলছিলাম কিন্তু এটা বেড়েই চলেছিল এবং ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। একসময় অনুভব করলাম, শব্দটির উৎস আমার কান না। কোনো সন্দেহ নেই আমি আরো বেশি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, এবং উঁচু গলায় ঝড়ের বেগে কথা বলছিলাম। শব্দটির গতি আরো বেড়ে গিয়েছিল, মনে হচ্ছিল কানের ভেতর কে যেন ঢোল পেটাচ্ছে। আমি কি করবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি হাঁপাতে শুরু করেছিলাম। এতকিছুর পরেও অফিসাররা কিছুই টের পাচ্ছিল না। আরো দ্রুত, আরো আগ্রহ নিয়ে কথা বলছিলাম; কিন্তু শব্দটা বেড়েই চলেছিল। উঠে দাঁড়ালাম, এবং খুবই তুচ্ছ বিষয়ে বিশ্রি অঙ্গভঙ্গি করে তর্কাতর্কি শুরু করে দিলাম, শব্দটা কিন্তু বেড়েই চলেছিল। তারা যে কেন চলে যাচ্ছে না! আমি লম্বা লম্বা পা ফেলে মেঝের এদিক ওদিক পায়চারি করছিলাম; বোঝাতে চাচ্ছিলাম তাদের পর্যবেক্ষণ যথেষ্ট হয়েছে। শব্দটা বেড়েই চলেছে। হায় খোদা! আমি এখন কি করবো? আমি এতটাই খেপে গিয়েছিলাম যে মুখ দিয়ে ফেনা উঠছিল এবং বার বার দিব্যি কাটছিলাম। আমি যে চেয়ারটিতে বসে ছিলাম সেটা মেঝের সাথে টানা হিঁচড়া করে একধরনের বিরক্তিকর শব্দ করছিলাম কিন্ত সেই শব্দটা এই শব্দটাকে ছাড়িয়ে আমার কানে এসে গুঁতা মারছিল। শব্দটা বেড়েই চলেছিল। এতকিছুর পরেও তারা বেশ আয়েশ করে গল্প করছিল। তারা কি তবে কিছুই শুনতে পাচ্ছে না? এটা কি করে সম্ভব? হায় খোদা! তারা বোধহয় শুনতে পাচ্ছে, বুঝতে পেরেছে সবই, তারা আমার ভয়টাকে নিয়ে উপহাস করছে!-- এসব সাত পাঁচ ভাবনা আমার মাথায় ভর করছিল। আমি যেকোনো ভাবে এই নিদারুণ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি কামনা করছিলাম। তাদের উপহাস এবং ভ-ামি মার্কা হাসি আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। ইচ্ছে করছিল মরে যেতে অথবা চিৎকার দিয়ে সব বলে দিতে। ওহ্, আর পারছিলাম না, শব্দটা আমার কান ভেদ করে যেন মাথার ভেতর ঢুকে পড়েছিল!

“শয়তানেরা,” আমি চেঁচিয়ে বললাম, “আমার সাথে আর ছলচাতুরি করিস না! আমি খুনের কথা স্বীকার করছি!-- এইখানটা খোড়, ঠিক এইখানে! এটাই তার ভয়ঙ্কর হৃদয়ের ধুক ধুক শব্দ!”


গল্পপাঠ : বেফাস হৃদয়

আলোচক : মোজাফফর হোসেন

এডগার অ্যালান পোর সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্পগুলোর একটি ‘অ্যা টেল টেল হার্ট’ বা যা যার বাংলা আমি করেছি, বেফাস হৃদয়। গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৪৩ সালে। জনপ্রিয় এই গল্পকার তাঁর জীবদ্দশায় গল্পকার হিসেবে সমালোকদের দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হননি। ১৮৪৫ সালে প্রকাশিত হয় পোর দিখ্যাত কবিতা ‘দ্য র‌্যাভেন’। ফলে সমসাময়িক সমালোচকরা কবি হিসেবেই পোকে গ্রহণ করতে চেয়েছেন।  বর্তমানে পোকে মনে করা হয় সাইন্সফিকশন, গোয়েন্দা ও গোথিক গল্পের জনক। একটা সময় রূপালি পর্দায় তাঁর গল্পের চিত্রায়নে হিড়িক  পড়ে যায়।

আলোচ্য গল্পে একজন পাগল চরিত্রের, যে আপাত কোনো কারণ ছাড়ায় একজনকে হত্যা করে, তার মনস্তাত্ত্বিক প্রতিকৃতি তৈরি করা  হয়েছে। এটি একই সাথে হরর-সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার স্টোরি।  বেনামি গল্পকথক পাঠকদের সরাসরি তুমি বলে সম্বোধন করে গল্পটি বলা শুরু করে। তার উদ্দেশ্য নিজেকে সৎ এবং সুস্থ্য বলে প্রমাণ  করা। কারণ, খানিক আগে সে একজনকে খুন করেছে। সে বলছে যে সে কিছুটা ভড়কে গেছে তবে সে পাগল না। তার খুন করার কারণ  কোনো অর্থসম্পদের লোভ বা প্রতিহিংসা নয়। সে খুন করেছে বৃদ্ধ লোকটির ধূসর-নীল চোখটির কারণে। তারপরও সে দাবি করছে যে,  সে পাগল নয়। কারণ সে অনেক সময় নিয়ে, অনেক পরিকল্পনা করে খুনটি করেছে। তার দাবি, পাগলরা এত ঠাণ্ডা মাথার খুনি হতে পারে  না। সে ক্রিমিনালও নয়, কারণ তার খুনের পেছনে কোনো লোভ বা গোপন অভিসন্ধি জড়িয়ে নেয়। এরপর সে সমস্ত ঘটনা তুলে  ধরেছে। তাকে কিভাবে পুলিশরা খুনি হিসেবে সনাক্ত করেছে তারও বর্ণনা সে দিয়েছে।  পো খুব কৌশলে একজন সাইকোকে উপস্থাপন করেছেন তাঁর এই গল্পে। সে যে পাগল নয় এটি প্রতিষ্ঠিত করার ভেতর দিয়ে গল্পটি  এগিয়ে গেছে। কিন্তু আইরনিক্যালি তার নিজেকে পাগল হিসেবে দাবি না করার আর্গুমেন্ট যত এগিয়েছে ততই সে পাগল বলে প্রমাণিত  হয়েছে।

ড্রামাট্রিক মনোলোগ
বেফাস হৃদয় গল্পটি শুরুই হয়েছে ড্রামাটিক মনোলগের ভেতর দিয়ে। গল্পকথক গল্পের প্র ম লাইনে পাঠককে তুমি বলে সম্বোধন করে  তার খুনী হওয়ার কারণ ব্যাখা করা শুরু করে। পাঠকদের গল্পে সরাসরি যুক্ত করে নেওয়ার জন্যে থেকে থেকে ‘তুমি’ সম্বোধন করে  পাঠকদের কাছে ফিরে গেছে। এখানে পো গল্প লেখার নয় বরং বলার শিল্পটা অ্যাপ্লাই করেছেন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার এই  স্টাইলটা চালু থাকে। অর্থাৎ সম্পূর্ণ গল্পটা ড্রামাটিক মনোলগের ছলে লেখা।

রূপক বা এলিগরি
গল্পটিতে মোরাল এবং সাইকোলজিক্যাল এলিগরি বা নৈতিক-মনস্তাত্ত্বিক রূপক গল্প হিসেবে দেখা যেতে পারে। এলিগরি হল কোনও আর্টফর্মের ইনার মিনিং বা অন্তর্নিহিত অর্থ। আপাত বিষয়বস্তুর ভেতরে লুকানো অর্থকে এলিগরি বলা যেতে পারে। কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে একটি উপন্যাস বা গল্পের প্রতিটা চরিত্র এবং ঘটনা একটি সামাজিক, রাজনৈতিক, ঐতিহাসিক অথবা নৈতিক কোনো পরিস্থিতির প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত হওয়াকে এলিগরি বলে।

এই গল্পে প্রতিটা ঘটনা এবং চরিত্র একটা নৈতিক ভিত্তি থেকে দেখা যেতে পারে। নীতিগতভাবে গল্পকথক অবশ্যই ঠিক কাজ করেননি। তিনি খুনী। খুন করেছেন একজন অসহায় নিরাপরাধী বৃদ্ধকে। বলা চলে কোনো কারণ ছাড়ায়। এই ধরনের খুন একটি সমাজকে অপরাধপ্রবণ করে তোলে। উচ্চারিত বা ভার্বাল আয়রনি গল্পকথক খুনী খুনের কথা স্বীকার করে গল্পটি শুরু করেছেন, কিন্তু তার বলার স্বর স্বীকারোক্তিমূলক নয়। তিনি স্বীকার করছেন বৃদ্ধ ভাল

লোক, তার কোনো ক্ষতি তিনি করেননি। আবার বলছেন বৃদ্ধকে তিনি পছন্দও করতেন। অথচ তাকে তিনি খুন করেছেন। খুনের কোনো উপযুক্ত কারণ তিনি দেখাতে পারছেন না। অথচ এই খুনের ঘটনায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে চলেছেন।
ন্যারেটর বলছেন, ‘আমি স্বর্গ মর্ত্যরে সবকিছুই শুনতে পেতাম। তবে কি আমি পাগল?’ অথচ আমরা জানি, কোনো পাগল ছাড়া স্বর্গের কোনোকিছু শুনতে পাওয়ার দাবি তুলতে পারে না।

মুখে নিজেকে তিনি শান্ত, ধীরবুদ্ধির বলে দাবী করছেন কিন্তু কথায় বোঝা যায় তিনি যথেষ্ট বদমেজাজী মানুষ। ধৈর্যশক্তি নেই বললেই চলে। বলছেন সুস্থ মস্তিস্কে কাজ করেছেন। কিন্তু তার কাজটা অসুস্থ।

অবস্থানগত বা সিসুয়েশনাল আয়রনি
গল্পে ন্যারেটর বলছে যে, বৃদ্ধ ডাকাতের ভয়ে দরজাটা শক্ত করে লাগিয়ে রাখতো। এখানে সিসুয়েশনাল আইরনি হল, বৃদ্ধ ডাকাতের বড়

ডাকার অর্থাৎ নিজের খুনির সঙ্গে এক বাসাতেই থাকতো-- এটা তার সম্পূর্ন অজানা ছিল।

ড্রামাটিক আয়রনি
ন্যারেটর গল্পের শুরু থেকে বলে যাচ্ছেন তিনি সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কিন্তু তার ভাষ্যেই প্রমাণিত হয় যে তিনি পাগল।

অপ্রত্যাশিত সমাপ্তি বা টুইস্ট
টুইস্ট হল অপ্রত্যাশিত সমাপ্তি। পো এই গল্পের সমাপ্তিতে এসে খানিকটা মোচড় দিয়েছেন। গল্পের শেষদৃশ্যে গল্পকথক নিজেই নিজেকে

পুলিশের হাতে সপে দিয়েছে। নিজের হৃদযন্ত্রের শব্দকে সে মৃত বৃদ্ধের হার্টবিটের শব্দ ভেবে, এবং এই শব্দের আঘাত থেকে নিজেকে  মুক্তি দিতে সে পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছে যে খুনটা সে নিজেই করেছে। এই ধরনের নির্বুদ্ধিতার পরিচয় যে গল্পকথক দেবে সেটা আগে

বোঝা যায়নি।

লেখক পরিচিতি
এডগার এডগার এলান পো
জন্ম : ১৮০৯ সালের ১৯শে জানুয়ারী। তিনি একজন স্বার্থক আমেরিকান লেখক, কবি, সম্পাদক, সাহিত্য সমালোচক এবং তাকে বলা হয় আমেরিকান রোমান্টিক মোভমেন্টের অংশীদার।
তিনি দ্য পেন নামে তার একটি নিজস্ব পত্রিকাও ছিল যার পরবর্তীতে নতুন নাম করণ হয়েছিল দ্য স্টাইলাস নামে। ১৮৪৯ সালের ৭ই অক্টোবর মাত্র চলি্লশ বছর বয়সে এই মহান লেখকের মৃত্যু ঘটে।

অবশ্য এলান পো'র খ্যাতি সবচেয়ে বেশি তার রহস্য ও রোমাঞ্চ গল্পের জন্য। তিনি নিজস্ব লেখনীর বৈচিত্রের জন্য অতি অল্প সময়েই পাঠক হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন। গবেষণামূলকভাবেই তিনিই প্রথম রচনা করেছিলেন বহু ডিটেকটিভ ফিকশন যা পরবর্তী সায়েন্স ফিকশনের প্রচলনকে নতুন মাত্রা দিয়েছিল।
এলান পো-ই প্রথম আমেরিকান লেখন যিনি লেখালেখিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছিল। যদিও এর কারণে তাকে প্রথম দিকে কিছুটা আর্থিক অনটনে দিন কাটাতে হয়েছিল। তথাপি তিনি লেখনীকেই তার মূল লক্ষ্য হিসেবেই বেছে নিয়েছিলেন।
প্রথম দিকে অবশ্য তিনি কবি হিসেবেই আত্ম প্রকাশ করেছিলেন। ১৮২৭ সালে রচনা করেছিলেন তার কবিতার বই _ আ বোস্টনিয়ান।
১৮৩৫ সালে তিনি তার কাজিন ভার্জিনিয়া ক্লেমকে বিয়ে করেন। ১৮৪৫ সালে বের হয় তার কবিতার বই_ 'দ্য র‌্যভন' যা অল্প সময়েই বেশ সাড়া ফেলে। বইটি প্রকাশিত হওয়ার দুই বছর পরই তার স্ত্রী টিউবার কোলোসিস এ মারা যান।
টেল টেল অব হার্টস, হাউজ অব উশার, পেন্ডুলাম এসব গল্পগুলো তার রচিত ভীষণ পাঠক নন্দিত গল্প। এর মধ্যে টেল টেল অব হার্টস গল্পটি বিশ্ব সাহিত্যের সেরা ক্লাসিক গল্প হিসেবে নিজ স্থান দখল করে আছে।
এলান পো'র জন্মের সময় পিতাকে হারিয়েছিলেন। কিছুদিন পর মাকেও। অনাথ অবস্খয় তাকে দত্তক নিয়েছিলেন এলান দম্পতি। তারপর থেকেই তার নাম হলো-- এডগার এলান পো।

 

উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন...