Wednesday, March 21, 2018

“আমার পিতা কার্ল সেগান থেকে পাওয়া মৃত্যুর ধারণা” – Sasha Sagan


আমরা থাকতাম একটা বেলে রঙের পাথরের ঘরে যার দরজার উপর একটা পাখা-ওয়ালা সাপ আর একটা সৌরবলয় ছিল। ঘরটাকে দেখে মনে হতো এটা প্রাচীন সুমেরিয়া অথবা ইন্ডিয়ানা জোন্সের কোনো ঘর। ঘরটা অবশ্য দুটোর কোনোটাই ছিলো না। কিন্তু নিউইর্য়কের উত্তর অংশে যেমনটা মানুষ আশা করে, এটা সেরকম কিছুও ছিলো না। আমাদের বাসার সামনে একটা গভীর খাঁড়ি ছিলো, আর তার ওপারে ইথাকা শহর। গত শতকের শুরুর দিকে ঘরটা কর্নেলের একটা সিক্রেট সোসাইটি “Sphinx head Tomb” এর প্রধান কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। অবশ্য গত শতকের মাঝামাঝি সময়ের পর কয়েকটা শোবার ঘর আর একটা রান্নাঘর যোগ করা হয়। ১৯৮০ সালের দিকে এটাকে পরিপূর্ণ ঘরে রূপান্তরিত করা হয়। আমি আমার অসাধারণ বাবা-মায়ের সাথে থাকতাম এখানেই।

আমার বাবা, জ্যোতির্বিদ কার্ল সেগান, কর্নেলে মহাকাশবিজ্ঞান আর critical thinking শেখাতেন। ১৯৮০ সালের দিকে তিনি জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ঘন ঘন টেলিভিশনের পর্দায় হাজির হয়ে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে মহাবিশ্বের সংক্রামক কৌতুহল ছড়িয়ে দিতে থাকেন। কিন্তু Sphinx Head Tomb-এর ভেতর তিনি আর আমার মা অ্যান ড্রুয়ান বই-প্রবন্ধ- চলচ্চিত্রের কাহিনী লিখতেন। যে  কুসংস্কার, আধ্যাত্মবাদ, আর অন্ধ বিশ্বাস সমাজকে কুক্ষিগত করার চেষ্টা করছিলো, সেগুলোকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির দর্শন দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার জন্য কাজ করছিলেন। ওরা একে অন্যকে অনেক ভালবাসতেন, আমি এখন বুঝতে পারছি তাঁদের পেশাদারী সাহায্য তাঁদের ভালবাসারই অন্য এক রূপে প্রকাশ ছিল। এরকমই একটা প্রজেক্ট ছিল ১৯৮০ সালের ১৩ পর্বের পিবিএস সিরিজ কসমস যা ওরা যৌথভাবে লিখেছিলেন, আর বাবা উপস্থাপনা করেছিলেন। অনুষ্ঠানটার পুনর্জন্ম ঘটিয়েছেন আমার মা (নীল ডিগ্রাস টাইসনের কসমস, ২০১৪ সালে)।

Sasha-Sagan-Cosmos-SpaceTime-Odyssey-Premieres-QOM7SAAC2KXl-220x300

 

প্রাথমিক স্কুল শেষ করার পর আমার বাসায় প্রতিরাতে খাবার টেবিলে সংশয়বাদী চিন্তা আর মহাবিশ্বের ধর্ম নিরপেক্ষ ইতিহাসের পরিপূর্ণ শিক্ষা দেয়া হতো। তাঁরা খুব ধৈর্যের সাথে আমার অসীম সংখ্যক “কেন”-র উত্তর দিতেন। কখনো বলেন নি “আমি বলেছি, তাই!” অথবা “এটা এই রকমই”। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর সুচিন্তিত আর সৎ জবাব দিয়ে দিতেন তাঁরা; এমনকি সেসব প্রশ্নেরও, যেগুলোর কোনো উত্তর হয় না।

খুব ছোটবেলায় একদিন আমি বাবাকে তাঁর বাবা-মায়ের কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম। আমি নানা-নানীকে দেখেছি, কিন্তু দাদা-দাদীকে কেনো দেখিনি – তা জানতে চেয়েছিলাম।

“কারণ তাঁরা মারা গেছেন” তিনি বলেন।

“তুমি আবার তাঁদের দেখতে পারবে?” আমি জানতে চাইলাম।

তিনি খুব ভেবেচিন্তে উত্তর প্রস্তুত করছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি বললেন,  বাবা-মায়ের সাথে দেখা করতে পারলে তিনি আর কিছু চাইতেন না। কিন্তু তাঁর কাছে এমন কোনো কারণ বা প্রমাণ নাই যা মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে সমর্থন করে, তাই তিনি আবেগের লোভে পড়তে পারেন না।

“কেনো?” আমি আবার জানতে চাইলাম।

তিনি খুব কোমল সুরে বললেন যে কোনো কিছুতে বিশ্বাস করার জন্য তাকে সত্য বলে বিবেচনা করা খুব বিপদজনক। নিজেকে এবং অন্যকে, বিশেষ করে যারা কর্তৃত্বপূর্ণ অবস্থানে আছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করার মনোভাব যদি না থাকে তবে একজন মানুষকে খুব সহজেই বোকা বানানো যায়। তিনি আমাকে বলেন – “কোনো কিছুর যদি সত্যতা থাকে, তাহলে নিঃসন্দেহে সেটা সূক্ষ্ম যাচাই সহ্য করার ক্ষমতা রাখে”।

আমার যতদূর মনে পড়ে, সেবারই প্রথম আমি মৃত্যুর চিরস্থায়ী রুপের কথা জানতে পেরেছিলাম। আমি গভীরভাবে নিজের অস্তিত্বের সংকটে পড়ে গিয়েছিলাম। তাঁরা আমাকে স্বান্তনা দিয়েছিলেন, কিন্তু অবশ্যই তাদের বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারা থেকে বিচ্যুত না হয়েই।

“ঠিক এই মুহূর্তে তুমি কিন্তু জীবিত! এটা কিন্তু মোটেও সাধারণ কিছু নয়” তাঁরা আমাকে বললেন, “একটা মানুষ জন্ম নেয়ার রাস্তায় যে কতগুলো বাঁক আছে, সেই অসীম সম্ভাবনার কথা যখন চিন্তা করবে, তখন এই জীবনের জন্যে আপনাআপনিই কৃতজ্ঞতা অনুভব করবে। ভাবো, অসীম সংখ্যক সেই বিকল্প মহাবিশ্বগুলোর কথা, যেখানে হয়তো তোমার প্র-প্র-পিতামাতার কখনো দেখাই হয়নি। আর সে কারণে হয়তো তোমার অস্তিত্বই নেই! তারপর ভাবো, তুমি এমন একটা গ্রহে বিবর্তিত হয়েছো যেখানে তুমি শ্বাস নিতে পারছো, যার পানি পান করতে পারছো, আর এর সবচেয়ে কাছের নক্ষত্র থেকে উষ্ণতা পাচ্ছো! ডিএনএ জিনিসটার মাধ্যমে কিন্তু তুমি অনেক অনেক প্রজন্মের সাথে সংযুক্ত। আরো বড় ব্যাপার হচ্ছে, তোমার শরীরের প্রতিটি কোষ একটা নক্ষত্রের অন্তরে তৈরি হয়েছিলো। “আমরা নক্ষত্রের টুকরো দিয়েই তৈরি” বাবার এই কথাটা খুব বিখ্যাত হয়েছিলো। এবং তিনি আমাকে এই কথাটার সত্যতা অনুভব করিয়েছিলেন।

13-sasha-sagan-1.w529.h793.2x

 

 

আমার বাবা-মা আমাকে শিখিয়েছেন – জীবন যদিও চিরস্থায়ী নয় এবং এজন্যেই বেঁচে থাকাটা এতো সুন্দর একটা জিনিস; যার জন্য আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। জীবন যদি চিরস্থায়ী হতো, তবে এটা এতো সুন্দর হতো না।

আমার বয়স যখন ৭ তখন আমরা আরো বড় একটা বাসায় উঠি, মূলত আমার ভাই স্যামের জন্মের প্রস্তুতি নিতে। বাবা-মা Sphinx Head Tomb উন্নয়ন কাজে হাত দিয়েছিলেন বলে সেটা কিছু দিন খালি ছিলো। তাঁদের পড়া-লেখা আর কাজ করার জন্য একটা আলাদা জায়গা দরকার ছিলো। বাড়ি পুনর্নির্মাণ ব্যাপারটা বেশ একটা লম্বা কাজ, এবং সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পুনর্জন্ম লাভ করা সেই বাসায় খুব একটা কাজ করা হয়নি বাবার। তাঁকে দুর্বল, ম্লান, এবং ফ্যাকাশে দেখাতো। রক্ত পরীক্ষার পর জানা গেলো, তাঁর রক্তে খুব দুর্লভ একটা রোগ হয়েছে।

আমরা সিয়াটলে চলে গেলাম যাতে করে বাবা ভালো ডাক্তার দেখাতে পারে। উপশম, অবনতি, অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন; অবনতি, দ্বিতীয় অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন, উপশম; অবনতি, তৃতীয় অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন…… তারপর ১৯৯৬ সালের দক্ষিণায়নের (winter solstice) মৌসুমে তিনি মারা যান, আমার বয়স তখন ১৪।

 

13-sasha-sagan-2.w750.h560.2x

 

আমাদের Sphinx Head Tomb এর বাসা অব্যবহৃত পড়ে ছিল, ধীরে ধীরে সেটা বাবার লেখা পেপার, নোট, ছবি, কার্যতালিকা, জন্মদিনের কার্ড, ছোটবেলার আঁকা ছবি, আর রিপোর্ট কার্ডে ভরে ওঠে। ১৮ ফুট উঁচু ফাইল ক্যাবিনেটে হাজারো কাগজপত্র জমা হতে থাকে। মা বাবার এসব নথিপত্র রাখার জন্য জায়গা খুঁজতে থাকেন যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানতে পারে আমার বাবার মহান কর্মজীবনের কথা, কিন্তু কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অথবা সংস্থা এই নথিপত্রের সংরক্ষণ আর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিতে রাজি হয়নি।

মায়ের বয়স বাড়ার পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন – বাবার ঐতিহ্য ধরে রাখবেন; তাঁদের যৌথ প্রযোজনায় করা কাজগুলো তাঁর মৃত্যুর পরও চালিয়ে যাবেন। যখন তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না, ঠিক কিভাবে কসমসের কাজ শুরু করবেন, তখন তিনি চার বছর ধরে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। শেষ পর্যন্ত সেথ ম্যাকফারলেন (ফ্যামিলী গাইয়ের স্রষ্টা, যিনি বাবার কাজের অনেক বড় ভক্ত ছিলেন)-এর সাথে মায়ের দেখা হয়। আর তারপর, নতুন কসমসের কাজ শুরু হয়, সেথের অসামান্য সাহায্যে। আমার মায়ের ধরা হাল আর নীল ডিগ্রাস টাইসনের মনোমুগ্ধকর উপস্থাপনায় কসমস কয়েক মিলিয়ন মানুষকে বিজ্ঞানের রাজকীয়তা আর বাবার আনন্দঘন সংশয়বাদ শেখায়।

কিন্তু সেথ আমাদের জন্য শুধু এটুকুই করেননি! তিনি বাবার কাজগুলো রক্ষার জন্য আরও বড় একটা কাজ করেছেন, যেটা সম্পর্কে টুইটারে ঝড় ওঠেনি। তিনি Sphinx Head Tomb-এ রাখা সকল নথিপত্র- পারমাণবিক শীতকাল সম্পর্কে লেখা সকল প্রবন্ধ, শুক্র গ্রহের (ভেনাস-এর) আবহাওয়ার উপর লেখা প্রবন্ধগুলো, বাবার চিন্তাভাবনার সমষ্টি, আর ছেলেবেলায় আঁকা একটা আন্তঃনাক্ষত্রিক মিশনের ছবি- সবকিছু লাইব্রেরি অফ কংগ্রেসে রাখার ব্যবস্থা করে দেন।

এই অসাধারণ সম্মান আমাকে ভাবিয়ে তোলে। বাবা মারা যাওয়ার পর একপ্রকার অমরত্ব লাভ করেছেন – হোক সেটা ছোটো, মানবিক, এবং জাগতিক অমরত্ব। কিন্তু এটাই একমাত্র প্রকার অমরত্ব যা একজন মানুষ পেতে পারে। একদিন হয়তো আমাদের সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে। লাইব্রেরী অফ কংগ্রেস অন্য কারো কাছে আলেক্সান্দ্রিয়ার লাইব্রেরির মত হয়ে যাবে। আমাদের প্রজাতি একটা সময় মারা যাবে, অথবা অন্যকিছুতে বিবর্তিত হবে; আমরা যা শ্রদ্ধা করি, তারা হয়তো সেটাকে শ্রদ্ধা করবে না। আর তারপর কয়েক বিলিয়ন বছর পর সূর্য মারা যাবে, আর সাথে চলে যাবে পৃথিবীতে থাকা সকল প্রাণ।

বড় হওয়ার সময় বাবা আমাকে বুঝিয়েছিলেন কেন অমরত্ব লাভ অসম্ভব। কিন্তু আমি এখন ভাবি, ২৩ অথবা ২৪ শতকের কোনো কিশোর আমার বাবার লেখনীর দিকে তাকিয়ে কী ভাববে না যে, কোনো না কোনোভাবে তিনি এখনো আছেন?

এই নভেম্বরের চঞ্চল আর ধূসর দিনগুলিতে, বাবার ৭৯তম জন্মবার্ষিকীর সপ্তাহে আমার পরিবার, আমাদের বন্ধুরা, আর বাবার ছাত্র ও সহকর্মীরা ওয়াশিংটন ডিসিতে সমবেত হন  The Seth MacFarlane Collection of Carl Sagan and Ann Druyan Archive এর উদ্বোধনে। কিন্তু যখন আমি আমেরিকার ইতিহাসের সেই গির্জায় ঢুকলাম, বেশ অবাক হলাম – অমরত্ব দেখে নয়, বরং এর বৈপরীত্য দেখে। আমার সামনেই ছিল গুটেনবার্গ বাইবেলের আসল কপি আর গেটিসবার্গ এড্রেস! তখনই আমার মাথায় বজ্রপাতের মত আপতিত হলো – এটা চিরস্থায়ী জীবনের স্মৃতিস্তম্ভ নয়, এটা একটা কবরস্থান!

মাঝে মাঝে দম্পতিরা যেভাবে বিয়ের শপথ নবায়ন করেন, আমরাও সেদিন আমাদের দুঃখ নবায়ন করলাম। আর ঠিক সেই মূহুর্তে, বাবা সেই মানুষগুলোর অন্তরে অত্যন্ত তীব্রভাবে জীবিত ছিলেন, যারা তাকে ভালোবাসতো; আবার তার অনুপস্থিতিটাও ছিলো অত্যন্ত দুঃখজনক। সেদিন লাইব্রেরী অফ কংগ্রেসে, নশ্বরতা আর অবিনশ্বরতার এই প্রহেলিকা আমার জন্য খুব কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। কিন্তু এটাও সেই বিশাল মহাবিশ্বে আমাদের ছোট্ট অবস্থানের ধাঁধাটার মতোই, যেটা বাবা-মা আমাকে Sphinx Head Tomb-এ বলেছিলেন।

মূল প্রবন্ধ –
Lessons of Immortality and Mortality From My Father, Carl Sagan – Sasha Sagan.

উৎস ঃ http://onubadokderadda.com/mortality_and_immortality_sasha_sagan/

Wednesday, March 14, 2018

শুভ জন্মদিন মহামতি আইনস্টাইন


স্টিফেন হকিং-এর ধারণা আজ থেকে কয়েকশত বছর পরে মানুষ যখন বিজ্ঞানের ইতিহাস লিখবে তখন সেখানে মাত্র চারজন বিজ্ঞানীর কথা থাকবে। গ্যালিলিও, নিউটন, আইনস্টাইন আর হকিং নিজে!

এদের মধ্যে আইনস্টাইনের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। আপনার ল্যাবরেটরি আর যন্ত্রপাতি কোথায়?

এই প্রশ্নের উত্তরে আইনস্টাইন মাথা দেখিয়ে বলতেন ঐটাই তাঁর ল্যাবরেটরি আর কাগজ-কলম হলো তাঁর গবেষণার যন্ত্রপাতি।

অন্য অনেক বিজ্ঞানীর মতো আইনস্টাইন কিন্তু ছোটবেলায় ক্লাসে ফার্স্ট হতেন না। এমনকী কখনো কখনো স্যারদের বকাও খেতেন। কিন্তু চিন্তার স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে আইনস্টাইন ছিলেন ব্যতিক্রম। গ্যালিলিও ছিলেন এক্সপেরিমিন্টাল বিজ্ঞানী। হাতে-কলমে করার লোক। যেমন উনি একটা লোহার বলকে একটা কাঠের পাটাতনে গড়িয়ে দিতেন। তারপর ঐ পাঠাতনকে ক্রমাগত স্মুথ করতে থাকলেন। দেখলেন সেটি যত স্মুখ হয় ততই বলটি বেশি দূর যায়। আর এ থেকে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, বাধা না থাকলে চলন্ত বস্তু চলতেই থাকবে। আইনস্টাইন ছিলেন হাতে-কলমে কাজের ব্যাপারে অলস। তিনি কেবল থট এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালবাসতেন। আর সেগুলো করেই তিনি আপেক্ষিকতা তত্ত্বের বিশেষ এবং সাধারণ রূপটি খুঁজে পান। আমার নিজের ধারণা ১৯০৫ সালের দিকে তিনি যে তিনটি একেবারে নতুন ধারণা নিয়ে আসতে পেরেছেন তার কারণ হলো তাঁর কোন সুপারভাইজর ছিল না! থাকলে তার খবর  ছিল।

আইনস্টাইনের বেহালা বাজাতেন আর এ কারণে স্পিনোজার ঈশ্বরে বিশ্বাস করতেন। সুরের ঐকতানের কারণে দুনিয়াজুড়ে একটা ঐকতানের পক্ষে ছিলেন। কাজে বোর আর হাইজেনবার্গের নেতৃত্বে যখন কোয়ান্টাম বিশ্ব বিকশিত হচ্ছে তখন তিনি তার বিরোধিতা করেন। প্রথম ও দ্বিতীয় সলভে কনভেনশনে বোরদের সঙ্গে তাঁর যে ঝগড়া তা অবশ্য শেষপর্যন্ত বিজ্ঞানকেই এগিয়ে নিয়েছে। বেহালার সুরই এটার একমাত্র কারণ ছিল না। আর একটা কারণ ছিল ততোদিনে আইনস্টাইন বুড়ো হয়েছেন। কাজে কোয়ান্টাম জগতে আইনস্টাইনকে মনে হয় বেচারা আইনস্টাইন!

তবে, তিনি তরুনদের দেখতে পারতেন। এ কারনে আমাদের সত্যেন বসুর কাজটিকে সবার সামনে তুলে ধরেছিলেন।

গ্যালিলিওর মৃত্যুর বছরে জন্ম হয়েছিল নিউটনের। আর আইনস্টাইনের মৃত্যুর বছরে বিল গেটস আর স্টিভ জবসের। এ যেন ইতিহাসের ব্যাটন রেস। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সত্য ও সুন্দরের পতাকা বহন করে চলা।

প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বাড়িতে আইনস্টাইন থাকতেন তার কাছেই এখন থাকেন আমাদের জাহিদ হাসান। হয়তো একদিন তিনি বিজ্ঞানের মহীরুহতে পরিণত হবেন।

আজ মহামতি আইনস্টাইনের জন্মদিন। কোন একদিন পৃথিবীর ইতিহাস লেখা হবে চার পৃষ্ঠায় আর তার তিন পৃষ্ঠাজুড়ে থাকবে আইনস্টাইনে্র কথা।

শুভ জন্মদিন আইনস্টাইন!

Friday, March 2, 2018

সংরক্ষণকারী যন্ত্র (ফিলিপ কে. ডিকের গল্প)


লেখক পরিচিতি:  [মূল অনুবাদ গল্পে যাবার আগে লেখক ফিলিপ কে. ডিক সম্পর্কে দুটো কথা বলা প্রয়োজন। তাঁর পরিচয় হচ্ছে, তিনি একজন আমেরিকান সাহিত্যিক। তাঁর প্রায় সব গল্পই বিজ্ঞানভিত্তিক কল্প-কাহিনী ক্যাটাগরিতে পড়ে। এটা আশ্চর্যের বিষয় হবে না যদি এই অসাধারণ সাহিত্যিকের নাম আপনি কস্মিনকালেও শুনে না থাকেন। কিন্তু এটা বাজি ধরে বলা যায়, এই প্রতিভাবান ব্যক্তির কোনো না কোনো কর্মের সাথে আপনি পরিচিত। হলিউড মুভি ইন্ডাস্ট্রি যে কী পরিমাণ ঋণী এই ব্যক্তির নিকট, সেটা যারা সায়েন্স-ফিকশন ঘরানার শিল্প-কর্মের নিয়মিত খোঁজ রাখেন তারাই জানেন। আপনার দেখা প্রতি ৭ টা হলিউডি সাই-ফাই মুভির একটা এই ব্যক্তির লেখা। কয়েকটার নাম বলি?

যেমন ধরুন- ১৯৮২ সালে রিডলী স্কট পরিচালিত এবং হ্যারিসন ফোর্ড অভিনীত ‘Blade Runner’, যেটা এখনো ক্লাসিক সাই-ফাই মুভির আওতায় পড়ে। সেটা নির্মিত হয়েছিলো ডিকের লেখা উপন্যাস ‘ডু অ্যান্ড্রয়েড ড্রিমস অব ইলেক্ট্রিক শীপ’ অবলম্বনে। জীবনে একবার হলেও মুভিটা দেখার চেষ্টা করুন। আর সবচেয়ে ভালো হয় বইটা পড়তে পারলে। এর পরে আসে ১৯৯০ সালে নির্মিত ‘Total Recall’ মুভি, যেটাতে অভিনয় করেছিলেন আর্নল্ড শোয়ার্জেনেগার। এর পরের মুভিটাকেও অনেকেই চিনবেন। সেটা হচ্ছে ২০০২ সালে স্টিফেন স্পিলবার্গ নির্মিত ‘Minority Report’, যেটায় অভিনয় করেছিলেন টম ক্রুজ। তারপরে আসে ‘Pay check’ মুভিটার কথা। ২০০৩ সালে নির্মিত এই মুভিতে অভিনয় করেছিলেন বেন অ্যাফ্লেক। এরপরে বলা যায় ২০০৭ সালে নির্মিত ‘Next’ মুভিটার নাম, যেটায় অভিনয় করেছিলেন নিকোলাস কেইজ। এছাড়াও আরো গাদা-গাদা মুভি আছে যেগুলো সব তার লেখা গল্প বা উপন্যাসকে একটু এদিক-সেদিক করে সাজিয়ে নির্মাণ করা।

কথা হচ্ছে- অসম্ভব প্রতিভাবান এই লেখক মারা গিয়েছিলেন ১৯৮২ সালে সম্পূর্ণ নিঃস্ব অবস্থায়, বিনা চিকিৎসায়; হ্যারিসন ফোর্ড অভিনীত ‘ব্লেড রানার’ মুভিটা মুক্তির মাত্র মাস কয়েক আগে। এখন তারই রেখে যাওয়া স্ক্রিপ্ট ব্যবহার করে হলিউড মাল্টি বিলিওন ডলারের ব্যবসা করছে। কিন্তু তার নাম কেউ মনে রাখেনি। একজন সায়েন্স-ফিকশন ভক্ত হিসেবে এই ক্ষুদ্র অনুবাদটা উপস্থাপন করে অসাধারণ সব দর্শন, আধ্যাত্মবাদ এবং সামাজিক মূল্যবোধ ধারণকারী এই প্রতিভাবান সাহিত্যিককে সবার সামনে পরিচয় করিয়ে দিতে পারলেই হয়তো তার প্রতি আমাদের অবহেলার সামান্য কিছুটা হলেও দায়মুক্তি হবে। তাহলে চলুন মূল গল্পে………

ফিলিপ কে. ডিক সম্পর্কে আরো জানতে হলে তার উইকিপিডিয়া পেইজে যেতে পারেন।

———————————————————————————–

মূল গল্প: The Preserving Machine

লেখক: ফিলিপ কে ডিক

———————————————————————————–

ডক ল্যাবরিন্থ লন চেয়ারে তার চোখ আধবোজা অবস্থায় হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। কম্বলটা টানা ছিলো তার হাঁটু পর্যন্ত।

“তো?” আমি শুধালাম। আমি বারবিকিউ এর অগ্নিকুণ্ডলীর সামনে দাঁড়িয়ে হাতগুলোকে উষ্ণ করে নিচ্ছিলাম। দিনটা ছিলো বেশ পরিষ্কার ও ঠাণ্ডা। লস এঞ্জেলস এর রৌদ্রজ্জ্বল আকাশটা ছিলো প্রায় মেঘ-মুক্ত। ল্যাবরিন্থের নিরহংকারী বাড়িটার পেছনে সবুজের এক শান্ত ঢেউ খেলানো বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্রসারিত হয়ে পড়েছিলো দূর পাহাড় পর্যন্ত – ছোট্ট একটা বন যা শহরের সীমার ভিতরে এক ধু ধু প্রান্তরের মত বিভ্রম সৃষ্টি করেছিলো। “তো?” আমি বললাম, “যন্ত্রটা আপনার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কাজ করেছে তাহলে?”

ল্যাবরিন্থ জবাব দিলেন না। আমি ফিরে তাকালাম। বৃদ্ধ মানুষটা গভীর ভাব নিয়ে সামনে তাকিয়ে ছিলেন, দেখছিলেন মেটে-বর্ণের এক ধাড়ি গুবরে পোকাকে তার চাদরের কিনার বেয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠতে। গুবরে পোকাটা বেশ নিয়মতান্ত্রিকভাবেই উঠছিলো, তার শূন্য মুখটায় আত্ম-গৌরব ধরে রেখে। সেটা শীর্ষ অঞ্চল অতিক্রম করলো এবং দূর প্রান্তে একসময় হারিয়ে গেলো। আমরা আবার একা হয়ে পড়লাম।

ল্যাবরিন্থ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমার দিকে তাকালেন। “ওহ, এটা খুব ভালোভাবেই কাজ করেছে”।

আমি গুবরে পোকাটাকে খুঁজে বেড়ালাম, কিন্তু সেটাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলো না। বিকেলের পড়ন্ত সূর্যালোকে মৃদু একটা বাতাস আমার চারপাশে পাক খেয়ে উঠলো, ঠাণ্ডা এবং পাতলা। আমি বারবিকিউয়ের অগ্নিকুণ্ডলীটার আরো কাছ ঘেঁষে বসলাম।

“আমাকে সেটার ব্যাপারে একটু বলুন”, আমি বললাম।

ডক্টর ল্যাবরিন্থ, যারা বেশ পড়াশোনা করে এবং হাতে যাদের বেশ সময় আছে তাদের অনেকের মতো, বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন যে আমাদের সভ্যতার পরিণতি ঠিক রোমের মত হতে যাচ্ছে। আমার মনে হয়, তিনি ঠিক একই ধরণের একটা ফাটল তৈরি হতে দেখতে পেয়েছিলেন, যেটা গ্রীস এবং রোমের মত প্রাচীন দুনিয়াকে খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলেছিলো। তার দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে গিয়েছিলো যে আমাদের বর্তমান পৃথিবী, আমাদের সমাজও তাদেরটার মতই বিলীন হয়ে যাবে আর অন্ধকার এক সময় এসে উপস্থিত হবে।

এই চিন্তা আসার পরপরই ল্যাবরিন্থ সমাজের এই ওলট-পালটের মাধ্যমে পুনর্বিন্যাসের ফলে যে সমস্ত সুন্দর ও উপভোগ্য বস্তু হারিয়ে যাবার আশংকা আছে, সেগুলো সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করে দিলেন। তিনি ভেবেছিলেন শিল্প, সাহিত্য, রীতিনীতি, সঙ্গীত এবং বাকী সবকিছুর কথা যেগুলো হারিয়ে যাবে। এবং তার কাছে মনে হয়েছিলো এতসব মহান এবং রুচিশীল বস্তুর মাঝে সঙ্গীতটাই মনে হয় সবচেয়ে বেশী হারিয়ে যাবে এবং বিস্মৃতও হয়ে পড়বে খুব দ্রুত।

সঙ্গীত হচ্ছে সব জিনিসের মাঝে সর্বাপেক্ষা বেশী বিলুপ্ত-ক্ষম বস্তু। কোমল এবং ভঙ্গুর, সহজেই ধ্বংস-ক্ষম।

ল্যাবরিন্থ এটা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন ছিলেন, কারণ তিনি সঙ্গীত ভালোবাসতেন। কারণ তিনি এই ব্যাপারটা ঘৃণা করতেন যে একদিন আর কোনো ব্রামস এবং মোজার্ট থাকবে না। থাকবে না কোনো শয়নকক্ষে বাজতে থাকা মৃদু সঙ্গীতের মূর্ছনা, যেটাকে তিনি পাউডারবিশিষ্ট পরচুলা আর বাঁকানো সব বো-টাইয়ে ভরপুর স্বপ্নের সাথে যোগ করতে পারবেন না, যেখানে লম্বা-সরু মোমবাতিরা অস্পষ্ট আলো-আঁধারিতে ক্রমাগত গলে যাচ্ছে।

সঙ্গীত ব্যতীত কী এক শুষ্ক ও দুর্দশাময় জগত হবে সেটা! কী ধূসর এবং অসহনীয়।

ঠিক এভাবেই তার মাথায় এসেছিলো সংরক্ষণকারী যন্ত্রের কথা। এক সন্ধ্যায় যখন তিনি বসার ঘরের আরামকেদারাটায় নিচু স্বরে গ্রামোফোন ছেড়ে দিয়ে বসে ছিলেন, একটা কল্পনা ভেসে উঠলো তার মনে। তার মনে ভেসে উঠলো এক অদ্ভুত দৃশ্য। শুবার্ট ত্রয়ীর শেষ স্কোরটা, একদম শেষ একটা কপি, নষ্ট-ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় পড়ে আছে এক নোংরা স্থানের মেঝেতে, হয়তো সেটা একটা মিউজিয়াম।

একটা বোমারু বিমান মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেলো। বোমা পড়লো, মিউজিয়ামটি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেলো, দেয়ালের চুন-সুরকিরা আর্তনাদ করতে করতে ধ্বসে পড়লো। সেই ধ্বংসস্তূপের মাঝে অদৃশ্য হয়ে গেলো শেষ স্কোরটা, হারিয়ে গেলো আবর্জনার তলে পঁচতে এবং বিলুপ্ত হতে।

আর তখনই, ডক ল্যাবরিন্থের কল্পনায়, তিনি দেখতে পেলেন সেই স্কোরটা মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আসছে, ঠিক মাটিচাপা পড়া ছুঁচোর মত। সত্যি বলতে গেলে, ছুঁচোর মতই ত্বরিৎ গতির, নখর ও ধারালো দন্তবিশিষ্ট এবং ভয়ানক শক্তিসম্পন্ন ছিলো সেটা।

বেঁচে থাকার তাগিদের মতো সাধারণ, দৈনন্দিন জীবনের সহজপ্রবৃত্তি যা সকল পোকামাকড় এবং ছুঁচোর মত প্রাণীদের আছে, সঙ্গীতেরও যদি সেই ক্ষমতা থাকতো, তবে বাস্তবতাটা কী ভিন্নই না হতো! যদি সঙ্গীতকে জীবন্ত প্রাণীতে রূপান্তরিত করা যায়, সেইসব প্রাণী যাদের নখর এবং দাঁত আছে, তাহলে হয়তো এটা টিকেও যেতে পারে। যদি কোনোভাবে একটা যন্ত্র তৈরি করা যেতো, এমন এক যন্ত্র যা সঙ্গীতের স্কোরগুলোকে জীবন্ত প্রাণীতে রূপান্তরিত করবে।

কিন্তু ডক ল্যাবরিন্থ কোনো মেকানিক ছিলেন না। তিনি পরীক্ষামূলক ভাবে কয়েকটি স্কেচ তৈরি করলেন আর সেগুলো অনেক আশা নিয়ে পাঠিয়ে দিলেন আশেপাশের গবেষণাগারগুলোতে। এগুলোর বেশীরভাগই যথারীতি তখন যুদ্ধসংক্রান্ত গবেষণার চুক্তি নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। কিন্তু অবশেষে তিনি খুঁজে পেলেন তার পছন্দসই ব্যক্তিদের। মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলের এক বিশ্ববিদ্যালয় তার পরিকল্পনা দেখে খুশী হয়েছিলো এবং তারা যন্ত্রটা নির্মাণ শুরুর ব্যাপারে সেই মুহূর্তেই কাজে নামতে রাজী ছিলো।

কয়েক সপ্তাহ পেরিয়ে গেলো। অবশেষে ল্যাবরিন্থ বিশ্ববিদ্যালয় হতে একটা পোস্টকার্ড পেলেন। যন্ত্রটার নির্মাণ বেশ ভালোমতোই এগিয়ে চলছে; প্রকৃতপক্ষে, এর কাজ প্রায় শেষের দিকে। তারা যন্ত্রটাকে পরীক্ষামূলক ভাবে চালিয়ে দেখেছেন এতে জনপ্রিয় কিছু সঙ্গীত ভরে দিয়ে। ফলাফল? দুটো ইঁদুর-সদৃশ প্রাণী বেরিয়ে এসে ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছিলো পুরো ল্যাবরেটরিতে, যতক্ষণ পর্যন্ত না একটা বেড়াল এসে সেগুলোকে ধরে খেয়ে ফেলেছিলো। কিন্তু যন্ত্রটা ছিলো তার কাজে সফল।

এই ঘটনার কিছুদিন বাদেই যন্ত্রটা তার কাছে এসে পৌঁছুলো, কাঠের বাক্সে সযত্নে বন্দী করা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভালোভাবে দড়ি দিয়ে বাঁধা অবস্থায়। তিনি বেশ উৎসাহী হয়ে কাঠের পাটাতনগুলো খুলতে নেমে পড়লেন। অনেক ভাসাভাসা দৃশ্যপট নিশ্চয়ই তার কল্পনায় উড়ে আসছিলো যখন তিনি এর নিয়ন্ত্রণকারী অংশগুলোকে জোড়া লাগাতে ব্যস্ত ছিলেন আর প্রথম রূপান্তর কার্যের জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি যাত্রার শুরুতেই এক মহামূল্যবান স্বরলিপিকে বাছাই করলেন, মোজার্টের জি মাইনর।

পঞ্চস্বর। তিনি কিছুটা সময় খাতার পাতা ওলটাতে লাগলেন, ভাবনার অতল গভীরে হারিয়ে গিয়ে, মন উড়ে গিয়ে বহুদূর। অবশেষে তিনি খাতাটা নিয়ে গেলেন মেশিনের কাছে আর ভেতরে ফেলে দিলেন সেটা।

সময় গড়িয়ে গেলো। যখন তিনি কম্পার্টমেন্টটা খুলবেন তখন আসলে কী তাকে অভিবাদন জানাবে সেটা ভেবে একটু উদ্বিগ্ন, শঙ্কিত এবং অনিশ্চিতভাবেই ল্যাবরিন্থ দাঁড়িয়ে রইলেন যন্ত্রটার পাশে। তার মনে হলো, তিনি একইসাথে একটা চমকপ্রদ এবং করুণ কাজ করছেন। মহান সুরকারদের সুরগুলোকে চিরদিনের জন্যে তিনি সংরক্ষণ করতে চলেছেন। তার প্রাপ্য প্রশংসাটুকু তাহলে কী হবে? তিনি আসলে কোন সত্যের মুখোমুখি হবেন? কাজটা শেষ হবার আগে কী রূপ ধারণ করবে ব্যাপারটা?

অনেক প্রশ্ন, যাদের কোনো সদুত্তর নেই। যখন তিনি গভীর ধ্যানে আচ্ছন্ন ছিলেন তখনো যন্ত্রের লাল বাতিটা জ্বলজ্বল করে যাচ্ছিলো। এক সময়ে প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন হলো, চূড়ান্ত রূপান্তর ঘটে গেলো যন্ত্রের ভেতরে। তিনি দরজাটা খুললেন।

“হায় ঈশ্বর?” তিনি বলে উঠলেন। “এ তো দেখি ভীষণ সাংঘাতিক”।

কোনো জন্তু নয়, বরং একটা পাখি বেরিয়ে এলো। মোজার্ট পাখিটা ছিলো ভীষণ সুন্দর, ছোট্ট আর হালকা। সারা শরীর-জুড়ে ছিলো ময়ূরের মতো পালক। এটা ঘরের এমাথা-ওমাথা কিছুটা দৌড়ালো, তারপর তার দিকে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এলো, উৎসুক এবং বন্ধু-ভাবাপন্ন হয়ে। শিহরিত হয়ে ডক ল্যাবরিন্থ হাত বাড়িয়ে শরীর মাটির দিকে ঝুঁকিয়ে বসলেন। মোজার্ট পাখিটা আরো কাছে এলো। তারপরই হঠাৎ করে ক্ষিপ্র গতিতে ওটা বাতাসে ডানা ঝাপটাতে লাগলো।

“অসাধারণ”, তিনি বিড়বিড় করে বললেন। তিনি অতি কোমল ও শান্তভাবে পাখিটাকে প্রলুব্ধ করতে লাগলেন তার দিকে, এবং অবশেষে এটা ডানা ঝাপটে তার কাছে চলে এলো। ল্যাবরিন্থ অনেকক্ষণ ধরে সেটাকে আঙ্গুল দিয়ে আদর করলেন, আর গভীরভাবে ভাবতে লাগলেন। বাকীরা তাহলে দেখতে কেমন হবে? তিনি কোনো ধারণাই করতে পারলেন না। অতি সযত্নে মোজার্ট পাখিটাকে তুলে নিলেন এবং একটা বাক্সে রেখে দিলেন সেটাকে।

তিনি পরের দিন আরো হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন যখন বিটোফেন গুবরে-পোকাটা বেরিয়ে এসেছিলো, দৃঢ়তা এবং আত্ম-গৌরবের সাথে। এটাই ছিলো সেই গুবরে-পোকা যেটাকে একটু আগে আমি দেখেছিলাম তার শরীরের লাল চাদর বেয়ে বেয়ে উঠতে, একাগ্রচিত্তে এবং পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে উদাসীন হয়ে। হয়তো তার নিজের কোনো কাজেই যাচ্ছিলো সেটা।

এরপরে বের হয়ে এসেছিলো শুবার্ট জন্তু। শুবার্ট জন্তুটা ছিলো একটু বোকা-বোকা, সদ্য শৈশব পেরুনো ভেড়া-সদৃশ প্রাণী যেটা এদিক-সেদিক বোকার মত লাফিয়ে বেড়াচ্ছিলো আর খেলতে চাইছিলো। ল্যাবরিন্থ তখন সেখানেই বসে কিছু গভীর ভাবনা ভাবতে শুরু করেছিলেন।

এদের টিকে থাকার বৈশিষ্ট্যগুলো কী হওয়া দরকার? রঙিন পালক কি নখর এবং ধারালো দাঁতের চেয়ে উত্তম? ল্যাবরিন্থ বিমূঢ় হয়ে রইলেন। তিনি আশা করেছিলেন এক ঝাঁক নির্ভীক গর্ত-বাসী প্রাণীকে, যাদের আছে নখর এবং শল্কযুক্ত চামড়া। তারা মাটি খুঁড়ছে, লড়াই করছে, আঁচড়ে-কামড়ে দিতে এবং কষে লাথি বসাতে প্রস্তুত থাকছে। তিনি কী আসলেই সঠিক জিনিসটা পাচ্ছেন? তথাপি, কেইবা বলতে পারে টিকে থাকার জন্যে আসলে কী প্রয়োজন? – ডাইনোসরেরাও ছিলো এমন সব অস্ত্রে সুসজ্জিত, কিন্তু তাদের কেউই আর এখন বেঁচে নেই। কিন্তু যাই হোক, যন্ত্রটা তো এখন প্রস্তুত; আর নতুন করে শুরু করার জন্যেও বড্ড দেরি হয়ে গেছে।

ল্যাবরিন্থ তাই এগিয়ে চললেন। সংরক্ষণকারী যন্ত্রটাকে একের পর এক অসংখ্য সুরকারের সুর গেলাতে লাগলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না তার বাড়ির পেছনের জঙ্গলটা হামাগুড়ি দিয়ে চলা, ভ্যাঁ-ভ্যাঁ ডাক ছাড়া সব প্রাণীতে ভর্তি হয়ে গেলো যারা রাতভর চেঁচামেচি আর ধুপ-ধাপ আওয়াজ করতো। এদের মাঝে অনেক সাংঘাতিক বস্তুও বেরিয়ে এসেছিলো, এমন সব সৃষ্টি যেগুলো তাকে আঁতকে উঠতে এবং বিস্মিত হতে বাধ্য করেছিলো। বিস্তৃত এবং থালা-সদৃশ এক শতপদী ব্রামস পোকাটার ছিলো অনেকগুলো পা, যেগুলো ছিলো চারদিকে ছড়ানো। এটা ছিলো খুবই নিচু এবং চ্যাপ্টা, আর আবৃত ছিলো সুষম দৈর্ঘ্যের লোমে। ব্রামস পোকাটা নিজের মতো করে থাকতে চেয়েছিলো, এবং তাই চটজলদি করে বিশাল যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে এড়িয়ে গেলো ওয়েগনার জানোয়ারটাকে, যেটা তার একটু আগেই বেরিয়ে এসেছিলো।

ওয়েগনার জানোয়ারটা ছিলো বেশ বড় এবং গাড় রঙ ছড়ানো-ছিটানো ছিলো তার গায়ে। এর মেজাজটা বেশ ভারীই মনে হয়েছিলো এবং ডক ল্যাবরিন্থ এ কারণে বেশ চিন্তিতও ছিলেন। ঠিক ঐ এক-দঙ্গল ব্যাশ কীটসমূহের মতো, যারা ছিলো গোল গোল বল আকৃতির প্রাণী, কিছু বড়, কিছু ছোট। যাদেরকে পাওয়া গিয়েছিলো ‘ফোরটি-এইট প্রিল্যুডস অ্যান্ড ফিউগস’ সুরটা হতে। আর অন্যান্য আরো বহু সংখ্যকদের পাশাপাশি সেখানে ছিলো স্ট্রাভিনস্কি পাখি, কৌতূহল উদ্দীপক অনেক খণ্ড খণ্ড অংশের সমন্বয়ে গঠিত।

তাই তিনি তাদেরকে চলে যেতে দিলেন বনের দিকে এবং তারা গেলোও বটে। কেউ টিং-টিং করে ঝাঁপিয়ে, কেউ গড়িয়ে, কেউ লাফিয়ে- যে যেভাবে পারলো। কিন্তু ইতোমধ্যেই ব্যর্থতার এক অনুভূতি তার উপর ভর করেছিলো। যতবারই একটা করে প্রাণী বেরিয়ে এসেছিলো ততবারই তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন; মনে হচ্ছিলো ফলাফলের উপরে তার কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই। ব্যাপারটা তার ক্ষমতার বাইরে গিয়ে কোনো এক শক্তিশালী ও অদৃশ্য সূত্রের হাতে পড়েছিলো, যে অতি সূক্ষ্মভাবে পুরো জিনিসটা কব্জায় নিয়ে ফেলেছিলো এবং এই ব্যাপারটা তাকে বেশ উদ্বিগ্ন করে তুলেছিলো। প্রাণীগুলো এক সুগভীর, নৈর্ব্যক্তিক শক্তির সামনে বিকৃত হয়ে বদলে যাচ্ছিলো। এমন এক শক্তি যেটাকে ল্যাবরিন্থ দেখতেও পারছিলেন না, বুঝতেও পারছিলেন না। এবং এটা তাকে ভীত করে তুলেছিলো।

ল্যাবরিন্থ কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আমি কিছুটা সময় অপেক্ষা করলাম, কিন্তু তাকে দেখে মনে হলো – তিনি আর আগে বাড়তে রাজী নন। বৃদ্ধ মানুষটি বরং আমার দিকে অদ্ভুত ও সরল চোখে চেয়ে রইলেন।

“আমি সত্যিই আর কিছু জানি না”, তিনি বললেন। “আমি বনটায় আর ফিরে যাইনি অনেক সময় হয়ে গেলো। আমি ওখানে যেতে ভয় পাচ্ছি। আমি জানি কিছু একটা ঘটছে সেখানে, কিন্তু –”

“দুজনে একসাথে গিয়েই দেখি না হয়?”

তিনি একটা স্বস্তির হাসি হাসলেন। “সত্যিই? আমি মনে মনে আশা করছিলাম যাতে তোমার কাছ থেকেই প্রস্তাবটা আসে। এই ব্যাপারটা আমাকে ভেতরে ভেতরে কুরে খাচ্ছিলো”। তিনি তার গা ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে চাদরটা খুলে একপাশে রাখলেন। “চলো যাই তবে”।

আমরা বাড়ির কিনার ধরে হেঁটে একটা সরু পথ ধরে বনটায় ঢুকলাম। সবকিছুই ছিলো বুনো এবং বিশৃঙ্খল, মাত্রা-ছাড়াভাবে গজিয়ে ওঠা এবং জট পাকানো, উস্কো-খুস্কো, যত্ন হীনভাবে বেড়ে ওঠা সবুজের বিশাল এক সমুদ্র। ডক ল্যাবরিন্থ পথের উপরে ছড়িয়ে থাকা ডাল-পালাগুলোকে একপাশে ঠেলে প্রথমে ভিতরে ঢুকলেন, সম্মুখে ঝুঁকে এবং দেহটাকে মুচড়িয়ে যাতে সহজেই পার হয়ে যাওয়া যায়।

“বেশ তো জায়গাটা” আমি লক্ষ্য করে বললাম। আমরা কিছুটা সময় ভেতরে ঢুকতে ব্যয় করলাম। বনটা বেশ অন্ধকার এবং স্যাঁতস্যাঁতে। সূর্যাস্ত প্রায় ঘনিয়ে এসেছিলো, আর হালকা এক কুয়াশা মাথার উপরের পাতাগুলোকে পাশ কাটিয়ে আমাদের উপরে নেমে আসতে শুরু করেছিলো।

“এখানে কেউ আসে না”। হঠাৎ ডক থেমে গেলেন, তাকালেন চারপাশে। “সবচেয়ে ভালো হয় আমরা ফিরে গিয়ে আমার বন্দুকটা নিয়ে আসলে। আমি চাই না এখানে কোনো কিছু ঘটুক”।

“আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে যে আপনি নিশ্চিত ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে”। আমি হেঁটে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। “আপনি যতটা খারাপ ধারণা করছেন ব্যাপারটা তত খারাপ নাও হতে পারে”।

ল্যাবরিন্থ চারপাশে তাকালেন। তিনি পা দিয়ে কিছু লতা-গুল্ম একপাশে ঠেলে দিলেন। “তারা সবাই আমাদের আশে-পাশেই আছে, সবদিকে। আমাদের দেখছে। তুমি টের পাচ্ছো না কিছু?”

আমি অন্যমনস্ক হয়ে মাথা নাড়লাম। “এটা কী?” আমি একটা ভারী, ছাতা-ধরা ডাল তুলে ধরলাম, যেটা হতে ছত্রাকের কণারা ঝরে ঝরে পড়ছে। আমি সেটাকে পথ থেকে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। একটা প্রসারিত, বিশেষ আকার এবং পরিচয় বিহীন কীসের স্তূপ নরম মাটিতে অর্ধ-নিমগ্ন অবস্থায় পড়ে আছে।

“এটা কী জিনিস?” আমি আবার বললাম। ল্যাবরিন্থ নীচে তাকালেন, তার চেহারা একইসাথে শক্ত এবং অসহায় হয়ে পড়লো। তিনি স্তূপটাকে উদ্দেশ্যহীনভাবে লাথি মারতে শুরু করলেন। আমি একটু অস্বস্তি অনুভব করতে লাগলাম। “ঈশ্বরের দোহাই, বলুন এটা কী জিনিস?” আমি বললাম। “”আপনি কি জানেন?”

ল্যাবরিন্থ ধীরে ধীরে ঘাড় তুলে আমার দিকে তাকালেন। “এটা হচ্ছে সেই শুবার্ট জন্তুটা”, তিনি বিড়বিড় করলেন। “কিংবা বলা যায় ‘ছিলো’, কোনো একসময়। এখন আর এটার বিশেষ কিছুই অবশিষ্ট নেই”।

সেই শুবার্ট জন্তু- যেটা দৌড়েছিলো এবং লাফ-ঝাঁপ করেছিলো একটা কুকুরছানার মতো, বোকাটে স্বভাবের, আর সবসময় খেলতে চাইতো। আমি হাঁটু মুড়ে বসে তাকালাম স্তূপটার পানে, কয়েকটা পাতা আর প্রশাখা ওটার গা হতে সরিয়ে দিলাম। এটা যে মৃত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মুখটা ছিলো হাঁ করা, শরীরটা ছিঁড়ে দু’ফালি করা। পিঁপড়ে এবং কীটেরা ইতোমধ্যেই কাজ করতে শুরু করে দিয়েছিলো, সীমাহীন পরিশ্রম করে যাচ্ছিলো এটাকে নিয়ে। এটা গন্ধও ছড়াতে শুরু করেছিলো।

“কিন্তু হয়েছিলো কী?” ল্যাবরিন্থ বললেন। তিনি মাথা ঝাঁকালেন। “কিসে এমন কাজ করতে পারে?”

একটা শব্দ হলো। আমরা ঝটকে ফিরে তাকালাম।

এক মুহূর্তের জন্যে আমরা কিছুই দেখতে পেলাম না। তারপরই ঝোপটা নড়ে উঠলো, আর প্রথমবারের মতো আমরা সেটার আকৃতি উপলব্ধি করতে পারলাম। ওটা নিশ্চয়ই ওখানে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখে যাচ্ছিলো পুরোটা সময়। প্রাণীটা ছিলো অতিকায়, সরু এবং লম্বা, সেই সাথে উজ্জ্বল, তীক্ষ্ম চোখ বিশিষ্ট। আমার কাছে ওটাকে মনে হলো নেকড়ের মত দেখতে, কিন্তু আরো ভারী। এর চামড়া ছিলো ভারী এবং পুরু, মুখটা ঈষৎ ফাঁক করে চেয়ে ছিলো নিঃশব্দে আমাদের দিকে। আমাদের পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিলো, মনে হচ্ছিলো আমাদের এখানে দেখে বিস্মিত।

“সেই ওয়েগনার জন্তুটা”, ল্যাবরিন্থ ভরাট গলায় বললেন। “কিন্তু এটা বদলে গেছে। পুরোই বদলে গেছে। আমি এটাকে চিনতেই পারছি না”।

প্রাণীটা চটে গিয়ে বাতাসে নাক শুঁকতে লাগলো। তারপর আচমকা পেছন ফিরে ছায়াতে সরে গেলো, আর এক মুহূর্ত বাদেই হারিয়ে গেলো সেটা।

আমরা কিছুটা সময় নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলাম। অবশেষে ল্যাবরিন্থ নড়ে উঠলেন। “তাহলে এটাই ছিলো সে”, তিনি বললেন। “আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না। কিন্তু কেন? কী –”

“অভিযোজন”, আমি বললাম। “যখন আপনি সাধারণ একটা গৃহপালিত বেড়ালকে বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেন, সেটা বুনো হয়ে উঠে। অথবা কুকুরের ক্ষেত্রেও”।

“হ্যাঁ”। তিনি মাথা নাড়লেন। “একটা কুকুর আবারও নেকড়ের মতো হয়ে উঠে, বেঁচে থাকার তাগিদে। জঙ্গলের আইন। আমারও এটাই আশা করা উচিৎ ছিলো। এমনটা সবকিছুর ক্ষেত্রেই ঘটে”।

আমি মাটিতে পড়ে থাকা লাশটার দিকে তাকালাম, তারপর আবার ফিরে তাকালাম নিশ্চুপ সেই ঝোপটার দিকে। অভিযোজন –- কিংবা তার থেকেও খারাপ কিছু। একটা ধারণা আমার মাথায় গজিয়ে উঠতে শুরু করেছিলো, কিন্তু আমি কিছুই বললাম না। অন্তত তখনই না।

“আমি এদের আরো কয়টাকে দেখতে চাই”, বললাম আমি। “বাকীদের মধ্যে কয়েকটাকে। চলুন ঘুরেফিরে দেখি আরো কিছু”।

তিনি রাজী হলেন। আমরা সামনের শাখা-প্রশাখা এবং লতা-গুল্মকে পথ থেকে সরিয়ে দিয়ে ঘাস এবং আগাছার ভেতর দিয়ে পা ফেলে হাঁটতে শুরু করলাম। আমি একটা লাঠি খুঁজে নিলাম, কিন্তু ল্যাবরিন্থ হাত এবং হাঁটুর উপর ভর দিয়ে ঝুঁকে পড়লেন, মাটির কাছাকাছি চোখ এনে দেখতে লাগলেন। মাটির কাছে পৌঁছার এবং কিছু অনুভব করার চেষ্টা করতে লাগলেন।

“এমনকি শিশুরাও পশুতে পরিণত হতে পারে”, আমি বললাম। “আপনার মনে আছে ভারতের সেই নেকড়ে শিশুদের কথা? কেউ বিশ্বাসই করতে পারেনি তারা সাধারণ শিশু ছিলো”।

ল্যাবরিন্থ মাথা নাড়লেন। তার মনটা বিষণ্ণ ছিলো, এবং কারণটা বুঝাও কঠিন কিছু ছিলো না। তিনি ভুল ছিলেন, তার মূল ধারণাটা ভুল ছিলো। এবং এর ফলাফল সবেমাত্র তার কাছে স্পষ্টভাবে ফুটে উঠতে শুরু করেছে। সুর জীবন্ত প্রাণী হিসেবে টিকে থাকতে পারতো, কিন্তু তিনি ভুলে গিয়েছিলেন স্বর্গের বাগানের সেই শিক্ষা: একবার একটা জিনিস তৈরি করা হয়ে গেলে সেটা নিজেই তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে শুরু করে, এবং এর স্রষ্টার সম্পদ হিসেবে গণ্য হওয়া ক্ষান্ত দিয়ে নিজের ইচ্ছানুযায়ী নিজেকে গড়ে তুলতে এবং নির্দেশনা দিতে থাকে। ঈশ্বর মানুষদের বেড়ে ওঠা দেখে নিশ্চয়ই একই ধরণের বিষণ্ণতা অনুভব করেছিলেন। ল্যাবরিন্থের মতো ঈশ্বরও একই ধরণের লজ্জা অনুভব করেছিলেন, যখন তাঁর সৃষ্টিদেরকে বেঁচে থাকার তাগিদে পাল্লা দিয়ে রূপান্তরিত হতে এবং বদলে যেতে দেখে দেখেছিলেন।

তার সুরময় প্রাণীদের টিকে থাকার আর কোনো মানে নেই তার কাছে। সৌন্দর্যের হিংস্রতায় পর্যবসিত হওয়া – ঠিক এটা ঠেকাতেই তিনি তাদের সৃষ্টি করেছিলেন, আর সেটাই ঘটছে এখন ওদের মধ্যে, পুরোপুরি তার চোখের সামনে। ডক ল্যাবরিন্থ হঠাৎ আমার মুখপানে চাইলেন, তার মুখ ভারাক্রান্ত। তিনি তাদের টিকে থাকাটা নিশ্চিত করেছিলেন, তা সত্যি, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে তিনি পুরো মর্মার্থটাকেই মুছে দিয়েছেন, এর অন্তর্নিহিত সব মূল্যকেই ধূলিস্যাৎ করেছেন। আমি তার দিকে মৃদু হাসি ছোড়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু তিনি চকিতে আবার ঘাড় ঘুরিয়ে নিলেন।

“এ নিয়ে এতো ভাববেন না”, আমি বললাম। “ওয়েগনার জন্তুটার জন্যে পরিবর্তনটা তেমন বিশাল কিছু ছিলো না। ওটা কি এমনিতেই কর্কশ এবং মেজাজী ছিলো না? ওটার কি হিংস্রতার প্রতি স্বাভাবিক প্রবণতা — ”

আমি থেমে গেলাম। ডক ল্যাবরিন্থ ঘাস হতে হাত ঝেড়ে সরিয়ে নিয়ে পিছনপানে ঝাঁপ দিলেন। তার কবজি শক্ত করে আঁকড়ে ধরলেন ব্যথায় কোঁকাতে কোঁকাতে।

“কী হয়েছে?” আমি ছুটে গেলাম। কাঁপতে কাঁপতে তিনি তার বয়সে জরাজীর্ণ হাতটাকে বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে। “কী হলো? ঘটলোটা কী?”

আমি হাতটা উলটে নিলাম। হাতের পুরো পেছনটা জুড়ে ছিলো লাল কাটা দাগ, যেটা আমি তাকিয়ে থাকার সময়েও আরো ফুলে উঠছিলো। কিছু একটা হুল ফুটিয়েছে, অথবা কিছু একটা কামড়ে দিয়েছে তাকে ঘাসের ভেতর থেকে। আমি নীচে তাকিয়ে ঘাসগুলোকে লাথি মেরে সরাতে লাগলাম।

সেখানে কিছু একটা নড়ছিলো। একটা ছোট্ট সোনালি বল দ্রুতগতিতে গড়িয়ে গড়িয়ে ঝোপের দিকে ফিরে চলছিলো। এটা বিছুটি পোকার মত কাঁটা দিয়ে ঢাকা ছিলো।

“ধরো ওটা!” ল্যাবরিন্থ চেঁচিয়ে উঠলেন। “জলদি!”

আমি আমার রুমালটা বের করে ধরে ওটার পেছনে ধাওয়া করে গেলাম, কাঁটা এড়ানোর চেষ্টায়। গোলকটা উন্মত্তের মতো পালিয়ে যেতে চেষ্টা করছিলো, কিন্তু আমি সেটাকে অবশেষে রুমালে ধরে ফেলেছিলাম।

আমি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে ল্যাবরিন্থ হাতের ভিতরে সংগ্রাম করতে থাকা রুমালটার পানে চেয়ে রইলেন। “আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না”, তিনি বললেন। “আমাদের মনে হয় ঘরে ফেরাটাই ভালো”।

“এটা কী জিনিস?”

“বাখ (সিবাশ্চিয়ান বাখ) পোকাগুলোর একটা। কিন্তু এটা বদলে গেছে……”

আমরা আঁধারে পথ হাতড়ে হাতড়ে ফিরতি পথ ধরে ঘরে ফিরে যেতে লাগলাম। আমি চললাম আগে আগে, ডাল-পালা সব সরিয়ে দিতে দিতে। আর ল্যাবরিন্থ চললেন পিছু পিছু, ভারী মেজাজে এবং অন্যমনস্কভাবে, তার হাত ডলতে ডলতে।

আমরা উঠোনে প্রবেশ করলাম আর বাড়ির পেছনের সিঁড়ি বেয়ে বারান্দায় গিয়ে উঠলাম। ল্যাবরিন্থ দরজাটা খুলে দিলেন আর আমরা রান্নাঘরে ঢুকলাম। তিনি বাতি জ্বালালেন আর তারপর ছুটলেন সিংকের দিকে তার হাত ভালোমতো ধুতে।

আমি কাবার্ড থেকে একটা খালি বয়াম নিয়ে সযত্নে বাখ পোকাটাকে এর ভিতরে ভরে রাখলাম। আমি ঢাকনিটা লাগাতে লাগাতে সোনালি বলটা রগচটা ভাবে এটার ভিতরে গড়াগড়ি খেতে লাগলো। আমি টেবিলের পাশে বসে পড়লাম। আমরা কেউই কোনো কথা বললাম না। ল্যাবরিন্থ সিংকের কাছে, তার হুল ফুটে যাওয়া হাতে ঠাণ্ডা পানি গড়াচ্ছে। আর আমি টেবিলে, অস্বস্তির সাথে চেয়ে আছি বয়ামের ভিতরে থাকা সোনালী বলটার দিকে। ওটা রাস্তা খুঁজছে কোনো না কোনোভাবে পালানোর জন্যে।

“তাহলে?” আমি অবশেষে বললাম।

“কোনো সন্দেহ নেই”। ল্যাবরিন্থ ফিরে এলেন আর আমার উল্টো পাশে বসে পড়লেন। “এটা অনেক রূপান্তরের মাঝ দিয়ে গেছে। শুরুতে এর কোনো বিষাক্ত কাঁটা ছিলো না। তুমি জানো, এটা খুব ভালো ব্যাপার ছিলো যে আমি আমার নূহের চরিত্রে বেশ ভালোভাবেই অভিনয় করেছিলাম”।

“কী বলতে চাইছেন?”

“আমি তাদের নপুংসক করে তৈরি করেছিলাম। তারা প্রজননে সক্ষম নয়। তাদের কোনো দ্বিতীয় প্রজন্ম নেই। তারা যখন মারা যাবে, সেটাই হবে এই ঘটনার চূড়ান্ত পরিণতি”।

“মানতেই হচ্ছে, আমি আনন্দিত যে আপনি এই ব্যাপারে ভেবেছিলেন”।

“আমি ভাবছি”, ল্যাবরিন্থ বিড়বিড় করলেন, “আমি ভাবছি এটার সুর কেমন হবে, এখন, ঠিক এভাবে”।

“কোনটা?”

“ঐ গোলক, বাখ পোকাটা। এটাই তো আসল পরীক্ষা, তাই নয় কি? আমি এটাকে যন্ত্রের ভিতরে ফেলে আবার আগের অবস্থায় নিয়ে যেতে পারি। আমরা মনে হয় দেখতে পারি। তুমি কি দেখতে চাও নাকি?”

“আপনিই যা বলেন, ডক”, আমি বললাম। “এটা আপনার উপরে। তবে খুব বেশী উচ্চাশা করবেন না”।

তিনি বয়ামটা তুলে নিলেন সযত্নে আর আমরা চললাম নীচের তলায়, খাড়া সিঁড়ি বেয়ে সেলারের দিকে। আমি এক কোণায়, কাপড় ধোয়ার টাবের পাশে, অনুজ্জ্বল ধাতুর তৈরি কলামকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। একটা অদ্ভুত অনুভূতি বয়ে গেলো আমার ভেতর দিয়ে। এটাই ছিলো সেই সংরক্ষণকারী যন্ত্র।

“তাহলে এটাই সেই বস্তু”, বললাম আমি।

“হ্যাঁ, এটাই সেটা”। ল্যাবরিন্থ যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণগুলো চালু করলেন আর কিছুটা সময় সেগুলোকে নিয়ে কাজ করলেন। অবশেষে তিনি ফিরলেন বয়ামটার দিকে আর সেটাকে ধরলেন চোঙ্গার উপরে। তিনি সাবধানে ঢাকনাটা খুললেন, আর বাখ পোকাটা অনীহার সাথে পড়ে গেলো বয়াম হতে, যন্ত্রের ভিতরে। ল্যাবরিন্থ এরপরে চোঙ্গাটা বন্ধ করে দিলেন।

“এই শুরু হলো”, তিনি বললেন। তিনি কন্ট্রোলে ধাক্কা দিলেন আর মেশিনটা চলতে শুরু করলো। ল্যাবরিন্থ হাত হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। বাইরে রাত নেমে এসেছিলো, আলোকে তাড়িয়ে, সেটাকে চাপতে চাপতে অস্তিত্ব হতে বিলীন করে দিয়ে। অবশেষে যন্ত্রের গায়ে একটা নির্দেশক বাতিতে লাল রঙ জ্বলে উঠলো। ডক কন্ট্রোল বন্ধ করে দিলেন আর আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম নৈঃশব্দ্যে। কেউই নিজেকে যন্ত্র উন্মোচনকারী ব্যক্তি হিসেবে দেখতে চাচ্ছিলাম না।

“তাহলে?” আমি বললাম অবশেষে। “আমাদের মাঝে কে এটায় চোখ রাখবে?”

ল্যাবরিন্থ নড়ে উঠলেন। তিনি স্লট-পিসটাকে ঠেলে একপাশে সরিয়ে যন্ত্রের ভিতরে হাত পৌঁছালেন। তার হাত বেরিয়ে এলো একটা পাতলা শিট ধরা অবস্থায়, সঙ্গীতের একটা স্বরলিপি। তিনি ওটা আমাকে দিলেন। “এই হচ্ছে ফলাফল”, বললেন তিনি। “আমরা উপরে গিয়ে এটা বাজাতে পারি”।

আমরা উপরে ফিরে ঢুকলাম সংগীত কক্ষে। ল্যাবরিন্থ গ্র্যান্ড পিয়ানোর সামনে বসলেন আর আমি তাকে স্বরলিপিটা ধরিয়ে দিলাম। তিনি সেটা খুললেন আর এক মুহূর্ত শূন্য মুখে পর্যালোচনা করলেন, কোনো অভিব্যক্তি প্রকাশ ছাড়াই। তারপর তিনি সেটা বাজাতে শুরু করলেন।

আমি শুনলাম সুরটা। বীভৎস! আমি এর আগে কখনো এরকম কিছু শুনিনি। বিকৃত, নারকীয়, অর্থহীন! সম্ভবত একটা অযাচিত ও অপ্রতিভ রকমের অর্থ ছিলো, কিন্তু যেটার এখানে থাকারই কথা ছিলো না। এটা এককালে বাখের ঐকতান ছিলো, এক সুবিন্যস্ত এবং সু-সম্মানিত কর্ম ছিলো – সেটা বিশ্বাস করতে আমাকে খুব কষ্ট হচ্ছিলো।

“এতেই প্রমাণিত হয়ে গেলো”, ল্যাবরিন্থ বললেন। তিনি উঠে দাঁড়ালেন, স্বরলিপিটা তুলে নিলেন তার হাতে, আর তারপর ছিঁড়ে কুটিকুটি করলেন সেটা।

যখন আমার গাড়ির পানে আমরা ফিরতি পথে নীচে নামছিলাম, আমি বললাম, “আমার ধারণা টিকে থাকার সংগ্রামের পেছনের শক্তিটা হয়তো মানুষের যেকোনো মূল্যবোধের চেয়েও বেশী শক্তিশালী। এটা আমাদের মূল্যবান সব নীতি এবং আচার-ব্যবহারকে বেশ ঠুনকো ভাবে উপস্থাপন করে”।

ল্যাবরিন্থ একমত হলেন। “তাহলে সম্ভবত রীতি-নীতি এবং মূল্যবোধদের বাঁচাতে কিছুই করা যাবে না”।

“সেটা একমাত্র সময়ই বলে দেবে”, বললাম আমি। “যদিও এই পদ্ধতি ব্যর্থ হয়েছে, কিন্তু অন্য কোনোটা হয়তো কাজ করবে; এমন কিছু একটা যা আমরা এখন কেন, আরো কিছু দিন বাদেও হয়তো কল্পনা বা ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারবো না”।

শুভ রাত্রি জানিয়ে আমি গাড়িতে উঠলাম। বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার; রাত পুরোপুরি নেমে গেছে। আমি হেডলাইট জ্বালিয়ে রাস্তা বরাবর এগিয়ে চলতে লাগলাম, নিকষ আঁধারের মাঝ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে। দৃশ্যপটে আর কোনো গাড়ি চোখে পড়লো না। আমি সম্পূর্ণ একা, এবং অত্যন্ত শীতার্ত।

গিয়ার বদলে, গাড়ি ধীর করে আমি একটা মোড়ে এসে থামলাম। আঁধারে আচমকা কিছু একটা নড়ে উঠলো, বিশাল সিকামোর গাছের গোড়ায়। আমি বাইরে ঘাড় বের করলাম, জিনিসটা কী সেটা দেখার আশায়।

সিকামোর গাছের গোড়ায় একটা বিশাল মেটে বর্ণের গুবরে পোকা কিছু একটা বানাচ্ছে। এঁটেল মাটি এনে রাখছে একটা অদ্ভুত, উৎকট কাঠামোর ভিতরে। আমি গুবরে পোকাটাকে একটা সময় পর্যন্ত দেখতে লাগলাম হতবুদ্ধি হয়ে, কৌতূহল নিয়ে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সেটা আমাকে লক্ষ্য করলো এবং থেমে গেলো। গুবরে পোকাটা তখন আকস্মিকভাবে ঘুরে তার সেই দালানের ভিতরে ঢুকে গেলো, দরজাটা চোয়াল দিয়ে কামড়ে ধরে শক্তভাবে পেছন হতে আটকিয়ে দিয়ে।

আমি গাড়ি চালিয়ে সরে এলাম।

উৎস ঃ http://onubadokderadda.com/the_preserving_machine/

মহাকর্ষ : নিউটন থেকে আইনস্টাইন


গ্রাভিটি বা মহাকর্ষের সংজ্ঞা আলাদাভাবে দেয়ার তেমন একটা প্রয়োজনীতা দেখছি না। পদার্থবিদ্যায় চারটি মৌলিক বলের মধ্যে মহাকর্ষ সবচেয়ে দুর্বল বল হওয়া সত্ত্বেও এটাই গোটা বিশ্বব্রহ্মান্ডের গঠনশৈলী বা তাদের মধ্যের সম্পর্ক সবচেয়ে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করে। আমরা নিউটনকে (১৬৪২-১৭২৭) মহাকর্ষের জনক বলি। গ্রাভিটি বা মহাকর্ষ ধারণাটি তারই দেওয়া। কিন্তু তার জন্মের প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে অভিকর্ষ বা সূক্ষ্মভাবে বললে মহাকর্ষ নিয়ে প্রথম পরীক্ষাগুলো (১৬৯০-৯২) করেছিলেন গ্যালিলিও। এই পরীক্ষাগুলোর ফলাফল থেকে তিনি তার বিখ্যাত পড়ন্ত বস্তুর সূত্রগুলো দিয়েছিলেন।

কিন্তু সেই সময় কেন বস্তুগুলো নিচের দিকে পড়ছে সেটা নিয়ে তিনি আর খুব বেশী এগোননি বিভিন্ন কারণে। এছাড়াও সেসময় তিনি তার বিখ্যাত আবিষ্কারগুলোর একটি টেলিস্কোপের দিকেই বেশী মনযোগী ছিলেন। কেপলার দিয়েছিলেন গ্রহসমূহের আবর্তনকাল, কক্ষপথ  সংক্রান্ত তিনটি সূত্র (১৬০০)। তিনিও তাদের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে খুব একটা এগোননি। কেপলার মূলত পুরো মহাবিশ্বের জ্যামিতিক গঠন নির্ণয়ের মত অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার নিয়ে পড়ে থাকতেন, যেটা তাকে খুব বেশী ফলও দেয়নি। কারণ, তার কল্পনার ডিজাইনটার অস্তিত্ব ছিলো শুধু কল্পনাতেই। তারপরেও সেখান থেকে চিন্তা করতে করতে তিনি গ্রহের গতির তিনটি সঠিক সূত্র বের করতে পেরেছিলেন।

গ্যালিলিওর পরীক্ষার প্রায় ৭০ বছর পার হলো। কাহিনী অনুযায়ী ১৬৬৫ সালের কোন এক দিনে যুবক নিউটনের সামনে আপেল পড়ার মত সেই সামান্য ঘটনাটি ঘটলো। সেই সাধারণ ঘটনাটিই ওই অসাধারণ মস্তিষ্কের যুবকের মাথায় নতুন চিন্তার জন্ম দিল। সেই চিন্তার ফলাফল ছিল সূদুরপ্রসারী এবং সেটা আমাদের প্রথমবারের মত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে একটি সুতোয় গাঁথার মত সুযোগ এনে দিলো। নিউটন বললেন এই মহাজগতের সবকিছুই একে অপরকে একটা অদৃশ্য বল দিয়ে নিজের দিকে টানছে। তিনি এই বলের নাম দিলেন মহাকর্ষ। যাই হোক, আসল কাহিনী নাকি এমন- নিউটন চিন্তার মেজাজেই ছিলেন, ভাবছিলেন বস্তুগুলো একে অপরকে আকর্ষণ করে কিনা। তখন আপেলের পতনের ব্যাপারটা তার মাথায় চিন্তাগুলোকে বিন্যস্ত করতে সহযোগিতা করেছিলো।

আমরা বর্তমানে যে যুগে বাস করছি তার মাঝে থেকে আমরা আসলে নিউটনের মহাকর্ষ আবিষ্কারকে সেভাবে অনুভব করতে পারবো না, কারণ এখন আমাদের হাতে বেশ কিছু অত্যাধুনিক টেলিস্কোপ আছে যা দিয়ে আমাদের দৃষ্টিসীমানা এতদূরে চলে গেছে যেটা নিউটনের আমলে কেউ স্বপ্নেও হয়ত ভাবেনি। কিন্তু পৃথিবীতে বসে নিজের সামান্য প্রতিফলক টেলিস্কোপ আর গণিত দিয়ে পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে তিনি যেভাবে মহাকর্ষের একটা অদৃশ্য সুতোয় বেধেঁ দিয়েছিলেন(ইউনিফিকেশন) সেটা অসাধারণ একটা ব্যাপার ছিলো। তার মহাকর্ষ সূত্র দিয়ে আমরা মুক্তিবেগ, অভিকর্ষজ ত্বরণ ও গ্রহান্তরে এর তারতম্য, ওজন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি বের করতে পেরেছি। যেহেতু তার সূত্রে দূরত্ব বাড়লে বল বর্গের ব্যাস্তানুপাতে হ্রাস পায়, তার এই সূত্র এটাও ব্যাখ্যা করতে পেরেছে কেন গ্রহগুলোর কক্ষপথগুলো উপবৃত্তাকার আর কেনই বা অধিকাংশ গ্রহ নক্ষত্র গোলাকার।

কিন্তু নিউটন মহাকর্ষ বলের কেবলমাত্র নামকরণই করতে পেরেছিলেন, কিন্তু এটা ব্যাখ্যা করতে পারেননি মহাকর্ষ আসলে কিভাবে কাজ করে? অতঃপর, তিনি এটাতে একটা ঐশ্বরিক যোগসূত্র সামনে এনেছিলেন। তিনি বলতেন…

“This most beautiful system of the sun, planets, and comets, could only proceed from the counsel and dominion of an intelligent Being. … This Being governs all things, not as the soul of the world, but as Lord over all; and on account of his dominion he is wont to be called ‘Lord God’ [pantokrator], or ‘Universal Ruler’. … The Supreme God is a Being eternal, infinite, absolutely perfect.”

নিউটনের অপূর্ণ সেই গবেষণা আবার জেগে উঠে বিংশ শতকের শুরুতে আরেক মহান বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের হাত ধরে (অবশ্য কিভাবে স্পর্শ না করেও মহাকর্ষ কাজ করে – মাইকেল ফ্যারাডে সেই ব্যাখ্যা দিয়ে ফেলেছিলেন)। আইনস্টাইন পেটেন্ট অফিসের কর্মচারী হিসেবে কাজ করার সময় এটা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে আলোই এই মহাজগতে সবচেয়ে দ্রততম। মাত্র ২৬ বছর বয়সে ১৯০৫ সালে তিনি তিনি প্রকাশ করেন তার বিখ্যাত তত্ত্বগুলোর একটি। যার নাম বিশেষ আপেক্ষিকতা বা স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি। নিউটন ভাবতেন স্থান বা স্পেস আপেক্ষিক কিন্তু সময় ধ্রুব বা কন্সট্যান্ট। যা তিনি দেখিয়েছেন তার গতির সূত্রগুলিতে আইনস্টাইন বললেন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আসলে ধ্রুব বলে কোনো কিছু নেই; স্থান-কাল উভয়েই আপেক্ষিক বা রিলেটিভ; শুধুমাত্র আলোর গতিই ধ্রুব। কেউ আলোর গতিকে অতিক্রম করতে পারবে না। অর্থাৎ আইন্সটাইন আসলে আলোর গতিকে একটা মহাজাগতিক মানদণ্ড বা কসমিক স্পিড লিমিট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। কিন্তু তার এই ধারণা কিন্তু নিউটনের মহাকর্ষের ধারণার সাথে পুরোপুরিই সাংঘর্ষিক।

এটা বোঝার জন্য আমরা একটা ব্যাপার চিন্তা করতে পারি। ধরুন কোনো নোটিশ ছাড়াই সূর্য হঠাৎ ধ্বংস হয়ে গেলো বা গায়েব হয়ে গেলো। তো এক্ষেত্রে নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র বলে, যে মূহুর্তে সূর্য ধ্বংস হয়ে গেলো, ঠিক সেই মূহুর্তেই পুরো সৌরজগতে ওলট পালট ঘটে যাবে, পৃথিবী তার কক্ষপথ থেকে ছিটকে যাবে। অর্থাৎ তাৎক্ষণিকভাবেই মহাকর্ষ বলের পরিবর্তন হয়ে যাবে, অন্যভাবে বলা যায় মহাকর্ষ পরিবর্তিত হতে কোনো সময়ই লাগবে না। অর্থাৎ সূর্য ধ্বংসের সাথে সাথেই আমরা মহাকর্ষের পরিবর্তনের ফলটা বুঝতে পারবো।

কিন্তু আইনস্টাইন জানতেন আলো সূর্য থেকে ৯৩ মিলিয়ন মাইল দূরে পৃথিবী পর্যন্ত পৌঁছাতেই সময় নেয় সোয়া আট মিনিট। তিনি ভাবলেন যেখানে আমরা সূর্যের আলো নিভে যাওয়ার খবর পাবো সোয়া আট মিনিট বাদে, সেখানে আমরা তার আগেই মহাকর্ষের পরিবর্তনের প্রভাব কিভাবে পাওয়া সম্ভব? তাই তিনি বললেন, মহাকর্ষ আলোর বেগের চেয়ে বেশি বেগে চলাটা অসম্ভব, এবং সম্ভবত মহাকর্ষের যে ধারণা প্রচলিত তার কিছুটা পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা আছে।

মহাকর্ষকে তিনি নতুনভাবে চেনালেন তার আপেক্ষিকতার আরেকটি তত্ত্বে, যার নাম সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব বা জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি। এই তত্ত্বে তিনি একটি চতুর্মাত্রিক কাঠামোকে দাঁড় করালেন যার নাম স্থান-কাল বা স্পেস টাইম। ত্রিমাত্রিক স্থানের সাথে আরো এক মাত্রা সময় – এই দুইয়ে মিলে স্থান-কাল। তিনি বললেন যে, এই স্থান-কাল অনেকটা জালের মত, যেসব বস্তুর ভর বেশি তারা স্থান-কালের এই জালকে তত বেশি বাঁকাতে পারবে; এমনকি ভরের কারণে স্থান-কালের পরিবর্তনে আলোও বেঁকে যেতে পারে।

একদম সহজ ভাষায় আসি – ধরে নিন, স্থান-কাল হলো একটি চাদর। এই চাদরের উপরই তাই সব কিছুর অবস্থান। এবার চাদরটি চার কোণায় শক্ত করে বাঁধুন যেন টানটান হয়ে থাকে। এরপর একটি ভারী গোলাকার পাথর চাদরের উপর রাখলে পাথরটি চাদরের মাঝখানে গিয়ে স্থির হয়ে থাকবে। পাথরের ভরের কারণে চাদরটি কুঁচকে যাবে এবং চাদরের মাঝখানের অঞ্চলটা নিচের দিকে ঝুলে পড়বে। এবার অপেক্ষাকৃত কম ভরের আরেকটি পাথর চাদরের উপর রাখলে কী হবে? নিঃসন্দেহে যেখানেই রাখি না কেন, সেটির মাঝে বেশি ভরের পাথরটির কাছাকাছি চলে আসার প্রবণতা সৃষ্টি হবে। কারণ, বড় পাথর চাদরে যে বক্রতার সৃষ্টি করেছিলো, তার কারণে মাঝের অঞ্চলটা ঢালু হয়ে গেছে। এই যে কম ভরের পাথরটা বড় ভরের পাথরের দিকে আসতে চাইছে, এই প্রবণতার নামই মহাকর্ষ। স্থান-কালের বক্রতা নামক অদ্ভুত সুন্দর এই তত্ত্বের মাধ্যমে মহাকর্ষ বলকে সংজ্ঞায়িত করলেন আইনস্টাইন।

এইবার মহাবিশ্বের জটিল চাদরে মাঝখানের বড় পাথরটিকে যদি সূর্য ধরেন, তাহলে ছোট পাথরটিকে বলা যায় পৃথিবী। স্থান-কালের চাদরের বক্রতা থেকে সৃষ্ট মহাকর্ষের মাধ্যমেই সূর্য বেঁধে রাখছে সৌর জগতের সবকিছুকে। এ থেকেই বলা হলো, বিশাল ভরের যে কোনো বস্তু স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দিতে পারে। ভর যত বেশি হবে সে বাঁকাতেও পারবে তত বেশি। চাদরের উদাহরণটি প্রকৃত অর্থেই স্থূল। তাই এটি বুঝতে একটু কল্পনা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে পুরো বিষয়টিকে ত্রিমাতৃকক্ষেত্র রূপে ভেবে নিতে হবে। আর এই বক্রতার কারণেই গ্রহগুলো যেভাবে ঘুরছে তার প্রকৃতিটা উপবৃত্তাকার।

এবার যদি সূর্যের হঠাৎ ধ্বংস হবার বিষয়টা চিন্তা করেন তাহলে দেখবেন, যখনই সূর্য চলে যাবে তখন স্থান-কালে বক্রতা আর থাকবে না, সমান হয়ে যাবে , কিন্তু সূর্যের ধ্বংসের ব্যাপারটা আমরা তাৎক্ষণিকভাবে টের পাবো না। অনেকটা শাপলা ভর্তি পুকুরে ঢিল ছুঁড়লে যে ঢেউ হবে তার মত। অর্থাৎ ঢেউ শাপলাকে আঘাত করবে ঠিকই কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে না, ঠিক তেমনি সূর্য ধ্বংস হলে স্থান-কালের বাঁকানো  অংশ বা বক্রতা হঠাৎ পরিবর্তনে সোজা হওয়ার চেষ্টা করবে এবং এর ফলে স্থান-কালের চাদরে ঢেউয়ের মত পরিবর্তন ঘটবে এবং চারপাশে এর ফলাফলটাকে ছড়িয়ে দেবে। কিন্তু অবশ্যই এটা আলোর গতিকে অতিক্রম করবে না। আসলে লিখে ভালোভাবে বোঝানো বা কল্পনার মানসপটে এটার চিত্র আঁকা বেশ কষ্টসাধ্য একটা ব্যাপার।

এই অসাধারণ তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে আইনস্টাইনকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছে। দুইবারের চেষ্টায় তিনি দেখিয়েছিলেন সূর্যগ্রহণের সময় সূর্যের সৃষ্ট স্থান-কাল-বক্রতার দরুণ আলো দূরবর্তী অন্য নক্ষত্র থেকে আসার সময় বেঁকে যায়। এই তত্ত্ব আইনস্টাইনকে বিজ্ঞানমহলে রীতিমতো সুপারস্টার করে তোলে। প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকে আজ পর্যন্ত এটা সবচেয়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত তত্ত্বগুলোর মধ্যে একটি। এই তত্ত্বের কারণে কৃষ্ণগহ্বর (Black hole), কীট-গহ্বর (Worm hole), সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্ব, গ্রাভিটেশনাল লেন্সিংয়ের মত ধারণাগুলো জন্মলাভ করেছে। মহাবিশ্বের সম্প্রসারণশীলতা প্রমাণিত হয়েছে বেশ আগেই লালমুখিতার (রেড শিফট এর) মাধ্যমে। গ্রাভিটেশনাল লেন্সিং মাত্র কদিন আগেই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। আইনস্টাইন আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছেন। কে জানে? তার এই তত্ত্বই হয়তো আমাদের এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আরো চমকপ্রদ কোনো কিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে।

 

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/gravity_newton_to_einstein/

Thursday, March 1, 2018

শ্যামল গঙ্গ্যোপাধ্যায়ের গল্প " রস"




ভাদ্র শেষ হয়ে আশ্বিন শুরু। এখন বেলা চারটে সাড়ে চারটে। গত দু’তিন মাস বৃষ্টি দিয়ে দিয়ে আকাশটা একদম ফ্যাকাশে। এখনও সূর্য ডোবেনি। তবে আলো নরম হয়ে আসছে। হাবুল পাল আলে আলে ঘুরে জমিতে ভিজে ভাবটা আছে কিনা দেখছেন। একদম খটখটে শুকনো হয়ে গেলে যাও বা দুটি ধান ফলার কথা—তাও ফলবে না। একটু পরেই তো রোদ মুছে গিয়ে আকাশটাকে অন্ধকার করে তুলবে। বছরের এই সময়টায় আকাশে একখানাও মেঘ আসে না।

সাহেবপুর, রায়পুর, দ্বারিকপোতা, মৌভোগ—পরপর সব মৌজা। আসলে এগুলো হল গিয়ে এক একটা মাঠের নাম। মৌজা ম্যাপে আর লোকের মুখে মুখে এইসব নাম ঘোরে বলে হাবুল পাল প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে জন্মে তক এই নামগুলো শুনে আসছেন।

আলে দাঁড়িয়েই শেয়ালদা যাবার লোকালের হুড়দুড় করে এসে পড়া টের পেলেন তিনি। ওখান থেকে ট্রেন দেখা যায় না। মাঝখানে কোম্পানি আমলের বাঁধ পিঠ উপুড় করে পড়ে আছে। তারপরে খাল। খাল পেরোলে ইটখোলার কেটে নেওয়া মাটির গর্তে এই বর্ষার জল গলায় গলায়। শেষে হোগলাবন। তারপরেই ট্রেন লাইন। স্টেশন। প্ল্যাটফর্মের মাথায় করোগেটের ঢেউ। ইলেকট্রিক ট্রেনের গম্ভীর ভোঁ।

বিকেল আর সূর্য ডুবে যাওয়ার মাঝখানে খানিকটা সময় সূর্য থেকে নরম আলো আসে। সেই আলোয় হাবুল পাল ধানের গোছা হাতে নিয়ে থর থর করে কেঁপে উঠলেন। পায়ের নীচে বর্ষকালের নরম আল এখন শুকিয়ে পাথর। নইলে এখন বেঢপ ফুলো ফুলো লম্বা মানুষটা কেঁপে উঠেই পা সমেত নরম আলে খানিক গেথে যেতেন।

ধানগাছের গোছ তো ভালো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে পোকা লেগে ধানের গর্ভথোড় প্রায় সবটাই খেয়ে ফেলেছে। তাই ধানের ছড়া পড়লেও ভেতরে দুধ নেই। দুধ থাকলে এবার সেসব শক্ত হয়ে চাল হয়ে যেত। হাবুল পাল তার আট বিঘের দাগটায় তাকিয়ে বুঝতে পারছেন—শুধু গোছই সার—নয়তো ধান প্রায় সবটাই চিটে। এই মাঠের ধান হলুদ হয়ে পেকে উঠলে তা কাটবার মজুরি পোষাবে না। শুধু হয়রানি। আল ছেড়ে হাবুল পাল কোম্পানি বাঁধে উঠে বসে পড়লেন। কম মেহনত যায়নি এই আটবিঘেয়। সেই সঙ্গে পয়সা। সার, ওষুধ—সব নগদে কেনা। তারপর লোক করে দেবারা নিড়েনিতেও গেছে অনেক। এখন ফল বলতে কিছু খড়। বেশি ফলনের ধানের খড় আবার গরুর মুখে রোচে না। -

কলকাতা থেকে ডাউন লোকালখানা এসে প্রায় পাখির মতো উড়ে পালাল। আরেকটু এগিয়ে আমতলা-বারুইপুর-ঘটকপুকুর বাসরাস্তার ওপর হাবুল পালের বাড়ি। উঠোনে গাই-গরুর জাবনা দেওয়ার চাড়ি বসানো। পেছনে পুকুরের গায়ে হালের বলদের ছাউনি, গোয়াল। বিচি রাখার লাউটি চালের ওপর এখনও তত হলুদ হয়নি।

চাষের শুরুতে এসব মাঠ সারাদিন লোকে লোকে জ্যাস্ত থাকে। আবার ধান পাকলে মাঠ লোকে ভরে যায়। এই সময়টাই সারা তল্লাট শুধু খাঁ খাঁ করে। পরেপ্পর মৌজা ধানচারায় ভরাট হয়ে আছে। বহুদূরে মৌভোগ মৌজার শেষে মৌভোগ গায়ের গাছগাছালির ওপর আকাশ গিয়ে শেষ। আকাশের কিনারায় গাছপালার ভেতর কুড়েঘর, ধানের গোলা।

মাঝে মাঝে তাল গাছ। নিকাশি ভেতর-খালের পাড় ধরে খেজুর গাছ। আর রেলের নামি জায়গা—পঞ্চায়েতের খাসরাস্তার গা ধরে এলোপাথাড়ি নানান গাছ। পাখিদের কাণ্ড । কোথায় কোন ফল খেয়েছে—তার দেনা কোথায় ফলে গেছে—তার কোনও ঠিকঠিকানা নেই। সেই থেকে গাছ। সেই গাছ থেকে আবার ফল। বেশিরভাগই খেজুর গাছ। অনেক গাছের আবার নাম জানে না কেউ।

রোজ ভোর রাতে উঠে হাবুল পালের মনে হয়—সাহেবপুর, রায়পুর, দ্বারিকপোতা, মৌভোগ—এসব জায়গা ফের বুঝি নতুন করে জন্মাল। রোদ ওঠার আগেকার ফিকে হয়ে আসা অন্ধকারে। এই মাত্র। যে অন্ধকারও গেল—মৌজা মাঠগুলোও জন্মাল। অথচ তিনি তো জানেন—এরা কতকালের মাঠ। কতকালের মৌজা! সেই সমুদ্র সরে গিয়ে ডাঙা জেগে ওঠার সময় থেকে।

খালের ওপারে ইটখোলার গর্তে জলভর্তি বুকের সামনে একেবারে গা ঘেঁষে বসে থাকা আস্ত একখানা গাছ যেন এইমাত্র উঠে দাঁড়াল। বাবা—?

খালের ওপার থেকে হাবুল পাল বললেন, কিরে খোকা ? এখনও ওখানে বসে ? উঠে আয়—

মন বলে বাবা—গলদার মিনগুলো এই দেড়মাসেই ডাগরটিই হয়ে উঠল—

আত জলে টের পেলি কী করে? অ্যা? ইটখোলার গর্ত সে তো মহা গভীর—

জানা থাকলি টের পাওয়া যায় বাবা ? জলের ধারে ধারে ডাড়া তুলে রোদ খাচ্ছিল কটা গলদা। এমন বোকা—বলে তার খোকা ওরফে শ্যাম পাল হো-হো করে হেসে উঠল। ভারি গলার সে-হাসি গড়াতে গড়াতে একদম ডিসস্ট্যান্ট সিগনালে। ডাড়া ধরে টানতেই একদম চ্যাংদোলা হয়ে উঠে এল বাবা—একটা গলদা একখানা পঞ্চাশ টাকার নোট বাবা!

বলিস কিরে? ছেড়ে দিসনি?

হ্যাঁ বাবা। ছেড়েই দিলাম। এক একটা দু’শো শ'দুশো গ্রাম হয়ে এল বোধহয়—চাই কি চারশো সাড়ে চারশো গ্রামে মুটিয়ে যাবে।

আমার ইদিকে ধানের দশা শেষ।

ছাড়ো তো বাবা। ধান ধান করে মরলে। ধান আবার একটা কারোবার নাকি। ভাগ্যিস ইটখোলার গর্তগুলো লিজ নে ছিলাম। এবার বাবা গলদায় গলদায় ভর্তি হয়ে যাবে সব গর্ত-

সব ধান চিটে হয়ে গেল খোকা। মাঠসুদ্ধ শুধুই খড়।

ধান দিয়ে কী হবে বাবা। মা নেই। দুটো মোটে পেট আমাদের। তাও আমি এবেলা ওবেলা দু’বেলাই রুটি খাই। দেখো বাবা যদি সব কটা ছানা বড় হয়ে ওঠে—তুমি আবার এসব কথা রেলবাজারে গিয়ে গাবিয়ে বেড়িও না।

নারে খোকা! আমি আর রেলবাজারে যাই কোথায়! এখন তো ডাগরটি হয়ে তুই-ই রেলবাজারে জুতোর দোকানে, পালানের সারের দোকানে বসে গল্প মারিস। কথা বলতে বলতে হাবুল পাল দেখলেন—তিনি তার জোয়ান ছেলে শ্যাম পালকে আর দেখতে পাচ্ছেন না। বাপ বেটা দু’জনেই লম্বা চওড়া। কয়েক বছর আগেও হাবুল পাল চুটিয়ে পঞ্চায়েত করতেন। তখন পঞ্চায়েতে এখনকার মতো অ্যাতো পয়সা ছিল না। সালিশীতে বসতেন। সবাই তার বিচার মেনে নিত। খুব ট্যারা বলে বাদী-বিবাদী কেউই মুখ দেখে বুঝতে পারত না—হাবুলদা কার দিকে।

রেলস্টেশন দ্বারিকপোতা। ডাকঘর দ্বারিকপোতা। মৌজা দ্বারিকপোতা। লোকজনের বসবাস গ্রাম দ্বারিকপোতায়। ইলেকট্রিকের দুটি তার লেভেল ক্রসিং পার হয়ে এপারে আর আসেনি। অনেক কাল আগে শ্যামের মা বেঁচে থাকতে এদিকে নতুন ধানের পয়লা চলন হয়েছিল হাবুল পালের হাত দিয়ে। বি ডি ও অফিসের গ্রাম সেবকের মারফত। গ্রাম সেবকই প্রথম ও তল্লাটে হাবুল পালকে বোরো ধানের চাষে নামাতে পারেন। অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে। তাতেই হাবুল পাল কলা গাছ হতে থাকেন।

তিনি ঠিক হেলে চাষা নন। নামে সই করতে পারেন। পটাশ, ফসফেট, ল্যাদাপোকার জ্ঞান আছে। কখনও কয়লার দোকান করেছেন হাবুল পাল। কখনও বা শ্যামকে বসিয়ে রেলবাজারে হাবুল পাল কিশলয়ও বেচেছেন। এখন সন্ধের পর খবর শোনেন। একটা কালো ট্রানজিস্টরে। টিভি কেনেননি। বিড়ি টানেন। বুঝে উঠতে পারে না—ঠিক কতদিন বাঁচতে হবে। বুঝতে পারলে তিনি সেইমত ঘরের চাল সারাতেন—আট বিঘের দাগটায় পরিমাণ মতো সই সই ধান দিতেন। এখন সব হিসেব তার কেমন গোলমাল হয়ে যায়। জীবনটা যে কতদূর?—কতখানি ? তা ঠিক বোঝা যায় না।

ও বাবা শ্যাম ? কোথায় গেলি ? আর যে দেখা যাচ্ছে না—

হাবুল পালের এসব কথা খাল পেরিয়ে ওপারে পৌছাল না। দূরে ঘটকপুকুরের বাস যায়। ভ্যান রিকশায় আশ্বিনের পয়লা বিয়ের পর পা ঝুলিয়ে বসে। এখন বেলা বড়। তবু ইটখোলার জলভর্তি গর্ত, হোগলা বন, পাটিঘাসের বন ঝোপের আড়ালে পচিশ ছাব্বিশ বছরের শ্যাম পাল হারিয়ে গেল। ছেলেটার কোনও ভয়ডর নেই। বাতিল ইটখোলা আসলে গোখরোর আড়ত। মানুষ যায় না। ওরা ওখানটায় নিজের জায়গা ভেবে চলাফেরা করে। তার ভেতর মানুষ পা দিলে খুব রেগে যায়। নিজের বুদ্ধিতেই শ্যাম কয়লার কারবার করতে করতেই জলে ভরাট গর্তগুলো একটার পর একটা জমা নিল। গলদার মিন ছাড়ল। ...

পড়ন্ত রোদে খালপাড়ে মোটা পাটির ঘাসের ফাঁকে মাটি দেখা যায়। এখানে মাটির গা একদম কালো। খালে নেমে গিয়ে হাবুল পাল দেখেছেন, জলের সঙ্গে গা লাগানো মাটিও কালো। তার ভেতর দিয়ে ওপরকার নানা বনঝোপের শেকড় দাড়ি হয়ে বেরিয়ে।

হাবুল পালের নীচে হেটো ধুতি। ওপরে ফতুয়া। কিন্তু শ্যাম পালের গায়ে ধুতির ওপর ফুলশার্ট। কবজিতে হাতঘড়ি। হাবুল পাল স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন, খোক গলদার বাড় দেখতে উবু হয়ে জলের ধারে বসে। চাওড়া কাঁধ। মাথাটা ঘন কালো। পায়ের পাম্প সু ভারি লম্বা চওড়া। শরীর উবু হয়ে বসায় তার ওজনে ঘাস মাটিতে ডেবে বসে যাচ্ছে। জলভরাট ইটখোলার গর্তে নীলচে পিঠ নিয়ে এই বুঝি বড় একটা গলদা ভেসে উঠল। চোখের পলক নড়ছে না শ্যাম পালের।

হাবুল পাল বুঝতে পারে না—তিনবিঘের ভদ্রাসন, দুখানা পুকুর, রেলবাজারে কয়লার দোকান, ধান—তারপর আবার জুটিল গলদা চিংড়ি—এসব কি খোকা সামলাতে পারবে ?

 তিনি বুঝতে পারছেন—যে মাটির ওপর তিনি দাঁড়িয়ে আছেন—তাতে ধান ফেললে চাল হয়—তার জলভর্তি পুকুরে পোনা ছাড়লে রুই কাতলা—ইটখোলার জমা নেওয়া জলে গলদার মিন ফেললে সবুরে চাই-কি তিন চারশো গ্রামের বড় চিংড়ি হয়। এই মাটির গায়ে আপনা আপনি ফলে থাকা ঘাস খেয়ে গরু দুধ দেয়। আবার ল্যাদা পোকা গর্ভ থেকে থোড় খেয়ে ফেললে ধানে দুধ আসে না। চাল হয় না। পুকুরের জলে শ্যাওলা না জন্মালে পোনা বাড়ে না। মাথা মোটা ডিগডিগে কাতলারা ঘুরে বেড়ায়। ইটখোলার জলভরাট গর্তে অঢেল পোকামাকড়—তাই খেয়ে গলদার মিন তিন-চার মাসে গায়ে গতরে মুটিয়ে যায়। আন্দাজে অতখানি জলার জমা নিয়ে শ্যাম বুদ্ধির কাজ করেছে। আমার চেয়েও অনেক তাড়াতাড়ি এই পৃথিবীটা চিনতে শিখেছে। তাই তো মনে হচ্ছে হাবুল পালের। মাথার মাঝখানে পুরনো সিথির জায়গায় ক’গাছা মোটে চুল। বাকিটা ফাকা। ট্যারা চোখ দুটি দূরের দিগন্তে ফিট হয়ে আছে। এই পৃথিরীর ভেতরটা যে শাসে-জলে—যে জানে—সে-ই শাঁস খায়—জল খায়। শ্যাম ঠিক ধরতে পেরেছে।

আমরা মাহীনগরের পাল। মাহীনগর এখান থেকে আরও তিন ক্রোশ ভেতরে। ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে যেতে হয়। আজও কোনও রাস্তা হয়নি। আমার বাবা সেখান থেকে দ্বারিকপোতায় উঠে আসেন। বডড কষ্টে জন খাটতেন। কোনদিন কোনও আমোদ করতে পারেননি বাবা। দ্বারিকপোতা স্টেশনে মাল বয়ে দিতেন ব্যাপারীদের। আমিও বয়েছি ছোটবেলায়।

এইসব ভাবনা মাথার ভেতর দিয়ে যাতায়াত করছে যখন তখন হাবুল পাল বিড়বিড় করে বলে উঠলেন, পৃথিবীর ভেতরটা যে শাসে-জলে—ভেতরে মানুষের জন্যে এত রস তা আমি তখনই টের পাই—চাষ-আবাদ, গাইগরু, বৃষ্টি দেখে দেখে —বলতে বলতে হাবুল পাল সাহেবপুর, রায়পুর, দ্বারিকপোতা, মৌভোগের ধোপেমাঠের দিকে তাকিয়ে খিক খিক করে হেসে ফেললেন। খুব তৃপ্তিতে। কোনও সাক্ষী না রেখে। যদিও তার এবার ধান হয়নি। তবুও । খালের ওপারেই গলদারা বাড়ছে। সব সময়।

হাসি গিলে ফেললেন হাবুল পাল। যতদূর চোখ যায়—ততদূর ধান চারার গোছ। বিকেল প্রায় শেষ। এর ভেতর সাহেব ?

মাথায় হালকা টুপি, কোট প্যান্টালুন—একজন সাহেব মৌজাগুলোর নিকাশী ভেতর খালের উচু পাড়ে ভেসে উঠল। রীতিমতো চমকে গেলেন হাবুল পাল। তিনি কিছুতেই মেলাতে পারছেন না। এখানে সাহেব আসবে কোথেকে? আকাশ থেকে পড়ল নাকি? আর সাহেব এগিয়ে আসছে কেমন? যেন এ তল্লাটের সব জায়গা তার চেনা জানা। নয়তো আমন করে আল ধরে ধরে কেউ এগিয়ে আসতে পারে?

হাবুল পাল নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাড়িয়ে। ধানক্ষেতের ওপর এতক্ষণ সাহেবের কোমর অব্দি দেখা যাচ্ছিল। এবার সাহেব ক্ষেত ডিঙিয়ে নাবাল জায়গায় পড়লেন। এবার তার পুরোটা দেখা গেল। মাঝারি লম্বা। বয়স কিছু হয়েছে বোধহয়। একটু ঝুঁকে হাঁটছেন। মৌভোগের দিককার মাঠের ভেতর দিয়ে সাহেব কোথেকে আসছেন? এদেশে তো কানও সাহেব নেই। কোনও কুলকিনারা করতে পারলেন না হাবুল পাল।

সাহেব তখন একটা খেজুর গাছের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। খুব মন দিয়ে তিনি গাছটাকে দেখছেন। হাবুল পালের মনে হল—সাহেব গাছটাকে ঘাড় কাত করে যেন চোখ দিয়ে মাপছে। এদিকে সাহেব আসে না সে কতকাল। ইংরেজ চলে যাওয়ার পরেও দু’একজন এসেছে। তবে তারা রেলের, না, অন্য কোনও ব্যবসার তা জানে না হাবুল পাল। একটা গির্জে আছে রেলবাজার ছাড়িয়ে দক্ষিণ পাড়ায়। কঘর বাঙালি খ্রিস্টান থাকেন সেখানে। তা সে বড়দিনের সময় ওখানে বিলিতি পাদ্রি আসতেন আগে। এখন যারা আসেন তারা সবাই এদেশি। আশ্বিন মাসের বিকেলে দ্বারিকপোতায় জলজ্যান্ত সাহেব। তাজ্জব ব্যাপার! দূর থেকে হব যে তারই দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে এগিয়ে আসছে।

হাবুল পাল একবার তার পেছনে তাকালেন। নাঃ ? তার পেছনে তো ফাঁকা খালপাড়। হাত দশেকের ভেতর এসে পড়ল সাহেব। মাথার ওপর দিয়ে একঝাক পাখি তাদের বাসার দিকে সাঁ সাঁ করে উড়ে গেল।

নোমোস্কার হাবুলবাবু—

হাবুল পাল পাল্টা হাত তুলে নমস্কার করতে ভুলে গেলেন। বুঝতে পারছেন—একেবারে লালমুখো গোরা সাহেব নয়। তবে রংটা ফর্সা। ছাইরঙের কোট প্যান্টালুন। জুতো-প্যান্টালুনের পা মাঠের শুকনো ধুলোয় সাদা।

অনেক কষ্টে হাবুল পালের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, নমস্কার। আপনি আমায় চেনেন?

আপনি তো হাবুল পাল। বাসরাস্তায় ওই তো আপনার বাড়ি—

পেছন ফিরে আঙুল দিয়ে ঠিক ভদ্রাসনই দেখাল সাহেব। নারকেল গাছ। বাড়ি। পুকুর। হাবুল পাল তো হতভম্ব। তার মুখে কোনও কথা সরছে না। দেখে বোঝা যায় লোকটা বাঙালি নয়। আবার গোরাও নয়। দিব্যি বাংলা বলছে। আর তার নামও জানে। চেনেও । পুলিসের লোক না তো? যদি কোন ক্ষতিও করে দেয়!

অবাক হবার কিছু নেই। আমার বেঙ্গলে আছি দুশো বছর। আমরা পারসি। এসব মাঠ-ঘাট আমার সব চেনা। এদিকে আসেন নাকি মাঝেমাঝে ?

আমি দু’বছর তিন বছর পর পর একবার করে আসি। সব জায়গায় তো সারা জীবনেও পৌছানো যাবে না। একবার এসে আপনার বাড়িটা চিনেছিলাম। আপনাকে দেখিয়ে কে একজন বলেছিল—ওই তো হাবুল পাল। ওটা ওনারই বাড়ি।

দু’বছর তিন বছর অন্তর একবার আসে। আমাকে দূর থেকে চিনিয়ে দিয়েছিল কে? একবার দেখেই, নাম চেহারা ভোলেনি। নিৰ্ঘাৎ পুলিসের কোনও বড় টিকটিকি।

আপনার নামটা জানতে পারি কি ?

নিশ্চয়। নিশ্চয়। এতক্ষণে একবার আমার নিজেরাই বলা উচিত ছিল। আমরা পারসি। আমি হলাম গিয়ে—হিড়জিভাই প্রেস্টনজি মরিশাসওয়ালা—আমার ঠাকুর্দার বাবা মরিশাস গিয়েছিলেন। ভাগ্য ফেরাতে।

কী ?

অতবড় নাম মনে রাখতে পারবেন না হাবুলবাবু। আমাকে প্রেস্টনজি বলেই মনে রাখবেন। আমরা দুশো বছর কলকাতায় আছি। লালবাজারের পেছনে রাধাবাজারে আমার ঠাকুর্দার ঠাকুর্দার বাবা বাড়ি করেন। মরিশাস থেকে ফিরে—সেই থেকে আমরা মরিশাসওয়ালা।

তবু একটা সন্দেহের খোঁচ লেগে থাকে হাবুল পালের মনে। সন্ধে হয়ে আসছে। রেল প্ল্যাটফর্মের মাথায় আকাশ লালে লাল। কলকাতায় আরেকখানা ট্রেন গেল। হাবুল পাল জানতে চাইলেন, তা ঘুরে ঘিরে এদিকে আপনাকে আসতে হয় কেন? মরিশাসটা কোন দিকে ?

মরিশাস অনেক দূরে একটা দ্বীপ। এখন একটা দেশ হাবুলবাবু। ঘুবে-ফিরেই আসি আমি হাবুলবাবু। দুপুরবেলা তো এই রোদে ঘোরা যায় না। বিশেষ করে এই সময়ে। শীতকাল হলে আলাদা কথা। তখন দুপুরে ঘুরতেই মজা।

এসব কথায় আরও ঘাবড়ে গেলেন হাবুল পাল। এই মাঠেঘাটে বনবাদাড়ে ঘুরতে কোনও মজা আছে নাকি! আশ শ্যাওড়ার জঙ্গল। উলু ঘাসের বন। তিনি প্রেস্টনজির মুখে তাকিয়ে থাকলেন। কথাটি না বলে।

হিড়জিভাই প্রেস্টনজি মরিশাসওয়ালা হাবুল পালকে কিছুটা আশ্বস্ত করতে চাইলেন। - তিনি বুঝতে পারছেন—হাবুলবাবু সন্ধের মুখে কোনও থই পাচ্ছেন না। অবিশ্যি এখনও আলো আছে। একটা বাতাস দিল।

 প্রেস্টনজি বললেন, এই তো আজ দুপুরে কলকাতা থেকে মোটরে বেরলাম। সিধে বারুইপুর থেকে ঘটকপুকুরের রাস্তা ধরে আড়ংঘাটায় এসে নেমেছি এই ঘণ্টা দুই আগে।

তারপর?—বেশ অবাকই হয়েছেন হাবুল পাল। কলকাতা থেকে মোটরে এলে তো দ্বারিকপোতায় সিধে আসা যায়। তা না করে দ্বারিকপোতা পেরিয়ে আড়ংঘাটা গিয়ে নামা কেন ? বিশেষ করে দ্বারিকপোতা যখন আসতেই হবে? তিনি কিছু বুঝতে পারছেন না। প্রেস্টনজির সবটাই যেন ধাধা। মাথার টুপিটা খুলে তিনি বা হাতে নিয়েছেন। কাচাপাকা চুল। তার চেয়ে প্রেস্টনজি বছর পাঁচ দশের বড়ই হবেন। এই বয়সে এমন আবোল-তাবোল ঘোরা কেন ? পাগল নয়তো ?

প্রেস্টনজি বললেন, আড়ংঘাটায় গাড়িটা রেখে ড্রাইভারকে বললাম, দ্বারিকপোতায় গিয়ে অপেক্ষা করো স্টেশনের কাছে। তারপর এই ঘণ্টা দুইয়ে মাঠঘাটের ভেতর দিয়ে সাত আট মাইল তো হেঁটেছি। -

হাবুল পাল প্রেস্টনজিকে একদম বুঝতে পারলেন না। দ্বারিকপোতার খালপাড়ে এই বিকেলবেলায় একজন পারসি সাহেব। কোট প্যান্টালুন গায়ে। হাতে টুপি। বয়স হয়েছে। পরিষ্কার বাংলায় কথা বলছেন। তারপর পড়তি দুপুর থেকে সন্ধে অব্দি বনবাদাড় ভেঙে হাঁটাই বা কেন? লোকটা এখানে কেন? এখানেই বা দু’তিন বছর হাবুল পালের ঘাবড়ে যাওয়া মুখ অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। সন্ধের আবছা আলো থেকে তা ডাঙায় তোলার মতো করে প্রেস্টনজি বললেন, বড়সড় ঝড় হলেও আমি ঝড়ের পরদিন ভোর ভোর এসব জায়গায় ঘুরে যাই।

দুপুরবেলা মাঠ ভেঙে হাঁটা? তারপর আবার বড়সড় ঝড় হলে প্রেস্টনজির এদিকে ঘুরে যাওয়া ? ঝড়ের সঙ্গে কিসের সম্বন্ধ ? ওঃ! আর পারা যাচ্ছে না। এখন যদি শ্যাম পাশে থাকত। সে আর আবার কোথায় সেঁধোল? হাবুল পাল শান্ত গলায় বললে, বাংলাটা ভাল শিখেছেন— বাঃ! আমরা তো বাঙালিই। বলতে পারেন পারসি বাঙালি। দুশো বছরে বিলকুল

বাঙালি হয়ে গেছি। আমার পড়াশুনো পোলক স্ট্রিটে এক বাঙালি স্কুলে। আমার ঠাকুর্দার ফিজিসিয়ান ছিলেন ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়—

কোন বিধান রায়?

বাঃ! চিফ মিনিস্টার—মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। জানেন তো।

জানি। আপনারা তাহলে বড়লোক খুব!—ভয়ে ভয়েই বলে ফেলেন হাবুল পাল।

না না। বিধানবাবু সবাইকেই তো দেখতেন। আমরা সাধারণ লোক হাবুলবাবু।

ঠাকুর্দার বাবা কলকাতায় ছটা তাড়িখানা খোলেন। সেই সুবাদেই এখানে ঘুরে যাওয়া আমাদের। আমার বাবাও আমারই মতো ঘুরে যেতেন। ছোটবেলায় কয়লার ইঞ্জিনে কাঠের ট্রেনে তা পঞ্চাশ বছর আগে বাবার হাত ধরে আমি প্রথম এদেশে আসি। সেই থেকে এদিকে ঘুরে ঘুরে আসছি। আসছিই—

দেখুন প্রেস্টনজি সাহেব। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। চলুন। আমার বাড়ির বারান্দার বসে আপনি এক পেয়ালা চা খাবেন। অনেক পথ হেটেছেন।

তা হেঁটেছি। চলুন—

ঘটকপুকুর-দ্বারিকপোতার রাস্তায় কেরোসিন কুপি বুলিয়ে সাইকেল ভ্যান। যেসব হেলে বলদ গোহাটায় বিক্রি হয়নি—তারা সার দিয়ে ঘরে ফিরছে এখন। এদের চাপা গলা—ঠেলাঠেলি করে দল বেঁধে হাঁটার শব্দই আলাদা। হাবুল পাল চেনেন। ঘরে ফিরলে এদের বড় হেনস্থা।

প্রেস্টনজি মাটির দাওয়ায় কাঠের জলচৌকিতে বসলেন। হাবুল পাল কেরোসিন পড়ে আছে। আকাশ থেকে জ্যোৎস্নাগোলা আলো। হাবুল পাল জানতে চাইলেন, ছ ছটা তাড়িখানা? বলেন কি? দেখাশুনো করাও তো কঠিন ছিল আপনার ঠাকুর্দার বাবার পক্ষে—অত লোক তাড়ি খেয়ে মাতলামি জুড়ে দিলে—

নাঃ ! বলছেন কি? লোকজনই চালায়। মাস মাইনে পায় তারা। একসময় কলকাতায় আশিটা তাড়িখানা গজিয়ে ওঠে। তার ভেতর আরও তিনখানা ছিল আমার ঠাকুর্দারই—বেনামায়।

চায়ের জল ভুগ ভুগ করে ফুটছে। তার ভেতরেই হিড়জিভাই প্রেস্টনজি মরিশাসওয়ালা ফের কথা বলে উঠলেন, আগে নাকি আমাদের নামের শেষে লেখা হোত নওরোজি। ঠাকুর্দার ঠাকুর্দার বাবা মরিশাসে যান নতুন ব্যবসা করতে। ফিরে এলেন কলকাতায়। একদম দেনদার হয়ে। তখনই খুব সম্ভব পাওনাদারদের হাত থেকে বাঁচতে নওরোজি থেকে মরিশাসওয়ালা হয়ে যান তিনি রাতারাতি—

হাবুল পাল চা ছাকছেন আর মনে মনে ছবি একে নিচ্ছেন। কলকাতায় লালবাজারের পেছনে দুশো বছরের বাস। বিধান ডাক্তার দেখতেন ওনার ঠাকুর্দাকে। ছ’ ছ’খানা তাড়িখানা চালান। তাছাড়া তিনখানা বেনামায় —ভাবতে ভাবতে চায়ের পেয়ালা এগিয়ে দিয়ে হাবুল পাল জানতে চান, এত তাড়ি?

আগে তো আরও বেশি লাগত। এখন সবটাই দ্বারিকপোতা থেকে যায়।

ভোরবেলার ট্রেনে কামরা বোঝাই দিয়ে পিপে পিপে তাড়ি—

ওসবই কি আপনাদের যায় ? না না হাবুলবাবু। কলকাতায় তো আরও অনেক তাড়িখানা আছে। তাদের পিপের।

সঙ্গে আমাদের পিপেগুলোও যায়। এই তো এবার শীত পড়লে কিছু গাছ কাটা হবে। খেজুর তাড়ি শুরু হয়ে যাবে। গরম ভোর চলবে তালের তাড়ি— -

হাবুল পালের চা খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। এত তাড়ি ? কত গাছ তাহলে ?

সে-ই সব গাছই তো ঘুরে ঘুরে দেখতে বেরই। মানুষের বসানো গাছ আর কটা হাবুলবাবু? পাখিরা খেজুর খেয়ে খেয়ে ইচ্ছেমতো দানা ফেলেছে—তাতে যেখানে সেখানে গাছ জন্মেছে। সেইসব গাছ আমাদের জমা নেওয়া।

জমা নেওয়া ? বলেন কি।

- হ্যাঁ। ঠিকই বলছি। ঠাকুর্দার বাবার স্কুলের বন্ধু ছিলেন কেলভিন সাহেব। পরে তিনি গোটা চব্বিশ পরগনার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিষ্ট্রেট হন। কেলভিনই ঠাকুর্দার বাবাকে শ’তিনেক খেজুর গাছ—আশিটা তালগাছ পাইয়ে দেন—সদর আলিপুরে নিয়ে গিয়ে।

তিনশো ? বলেন কি? .

হ্যাঁ। আরও আশিটা তালগাছ। সবই বনে বাদাড়ে। ঠাকুর্দার বাবা ঘুরে ঘুরে গাছগুলো সনাক্ত করান।

অ্যাতো গাছ সনাক্ত করা ?

হ্যাঁ। মাঠে মাঠে ঘুরতে হয়েছে অনেক। সে-আমলে নাকি সব গাছে তিনি দাগ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।

কী বলছেন প্রেস্টনজি!

ঠিকই বলছি হাবুলবাবু। মৌজার পর মৌজা পায়ে হেঁটে হেঁটে সনাক্ত করা খুবই কঠিন কাজ। পাখিদের তো মাথার ঠিক নেই কোনও। ফল খেয়ে যেখানে সেখানে দানা ফেলাই ওদের স্বভাব। ইউনিয়ন বোর্ডের খাতায় গাছের পাশে নাম উঠে গেল—হুরমুশজি প্রেস্টনজি মরিশাসওয়ালা—

হ্যারিকেন ধরাতে ধরাতে হাবুল পাল জানতে চাইলেন, তিনি কে? বাঃ! এই তো বললাম—আমার ঠাকুর্দার বাবা—। ওকি—হ্যারিকেন ধরাচ্ছেন কেন ? ধরাব না ? -

না। এই তো বেশ আছি। হাওয়া দিচ্ছে। চাদের আলো এ দেশের কত কত মৌজায় যে ঘুরলাম সারাটা জীবন। খেজুর গাছের সুবাদে। তালগাছের সুবাদে।

- বলুন প্রেস্টনজি—পাখিদের সুবাদে।

হ্যাঁ হ্যাঁ। ঠিকই বলেছেন হাবুলবাবু। দ্বারিকপোতা তো রেল স্টেশনের গায়ে। ভাবুন তো কোথায় সেই চন্দনেশ্বর। পশ্চিম কণিকা। খয়রামারি। নীলগঞ্জ।

ওরে বাবা! এসব নাম তো আমি কোনওদিনই শুনিনি। সে সব জায়গা কোন দেশে?

হাবুল পালের একথায় কিছু গৰ্বই হল হিড়জিভাই প্রেস্টনজি মরিশাসওয়ালার। তিনি একগাল হেসে বললেন, তবে? সবই এই চব্বিশ পরগনায়। কত মজা সারা দুনিয়ায়। কত রস। কত মানুষ। কত গাছ। ঠাকুর্দার বাবার আমলের গাছগুলোর বয়স হয়ে গেছে। তারা একে একে ছুটি নিল।

ছুটি নিল?

হ্যাঁ। সবাইকে আমি দেখিনি। মাটির ভেতরে শেকড় চালান করে দিয়ে ওপরে রস দিতে দিতে তারা তো একদিন বুড়ো হবেই হাবুলবাবু।

তা তো নিশ্চয়। খুবই ন্যায্য কথা।

ঠাকুর্দার বাবার ডাইরিতে যেসব মৌজায় যেসব গাছের কথা পেয়েছি—সরেজমিনে তাদের অনেককেই খুঁজে পাইনি।

কেন ?

বুড়ো হয়ে ক্ষয়ে গিয়ে ভেতরে মরে গিয়ে—ঘুণ ধরে কবেই তারা একে একে সাফ হয়ে গেছে। একদম গোড়া থেকে। জুলানির জন্য বুড়ো গাছ কেটে নিয়ে গেছে লোকে। রস দেয় না। ফল দেয় না। কী কাজে লাগবে আর, বলুন ? খেজুর গাছ—তাল গাছ তো আর মেহগনি গাছ নয়। যে শুধু দাড়িয়ে থাকলেই—বিউটি—শোভা!

 তা তো বটেই।-কথাটা বলে নিজেই হাবুল পাল নিজের ভিতরে একটুংখানি কাঁপে উঠলেন।

প্রেস্টনজি খোলা বারান্দায় জলচৌকির পাশে খালি পেয়ালাটি রেখে আবছা চাদের আলোয় হো-হো শব্দ করে বিটকেলের মতো একটা পারসি হাসি হাসলেন। অবিশ্যি আমাদের বাবার আমলে জমা নেওয়া সব কটা গাছের সঙ্গেই আমার দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে। তারা কেউ কেউ এখন ছুটি নিচ্ছে। আমি নতুন গাছ বেশি জমা নিতে পারিনি। আর গাছগুলো দেখাশুনো করতে গিয়ে কত লোকের সঙ্গে আলাপ পরিচয় হল। নীলগঞ্জের গোহাটার হাটবাবু ভরত সর্দারের সঙ্গে আপনার কখনও আলাপ হয়েছে?

নীলগঞ্জে আমি যাই-নি কোনওদিন। কোথায় নীলগঞ্জ তা-ই জানি না। তা কোথেকে ভরত সর্দারের সঙ্গে আলাপ হবে!

মানুষ ছিলেন বটে একজন ভরত সর্দার। নীলগঞ্জে বিরাট গোহাটা। দুপুরবেলা তেঁতুলগাছের মাঝের ছায়ায় হাট বাসে। গোরু মোষ তো আসতই। দুধের। হালের। তাছাড়াও আশ্চর্যের ব্যাপার—আমি নিজের চোখে দেখেছি—আশিটা পর্যন্ত রামছাগল বিক্রি হয়ে যেতে এসেছে। ভরত সর্দারের থেলো হুঁকোর নারকেলটি এই অ্যাতো বড় ছিল।

প্রেস্টনজি দুহাতের থাবা বড় করে উঁচুতে ধরে আছেন। থেলো হুঁকোর নারকেল চালের বাতায় কখন এই আধো-অন্ধকারে গুজে রেখে দিয়েছেন। গলায় শক্ত করে বাধা লাল কাপড়ের টুকুরোটাও খোলা সারা।

অনেকক্ষণ তো বেরিয়েছেন। দুটো ভাত রাধি?

ভাত ? তা অনেকদিন খাওয়া হয় না। এবেলা পাউরুটি। ওবেলাও পাউরুটি।

বেশ তো প্রেস্টনজি—বিরহী চাল তুলে রাখা আছে। লালচে মতো। ভাত খুব মিষ্টি হয়। গত সনের চাষের গোটা মসুর ডাল রয়েছে। সেদ্ধ বসাই? দুটি ডাল-ভাত খেয়ে যান। বাড়ির কাগজি নেবু আর র্কাচালঙ্কা ছিড়ে আনছি—

অনেকদিন পরে হয়ে যাক ভাত ! তা আপনার ওয়াইফ—স্ত্রী—তিনি এই গরমে আবার—

ও বস্তুটি অনেকদিন হল নেই। তিনি মরে গেছেন।

এবার প্রেস্টনজি মরিশাসওয়ালা জলচৌকিতে না বসে মাটিতেই বসলেন। দাওয়ার বাইরে পা ঝুলিয়ে। আমার ওয়াইফও অনেকদিন হল নেই। জানেন—বড় ঝড়ের পরদিন সকালে কতবার খয়রামারির ওদিকটায় ছুটে গেছি হাবুলবাবু। জানি তো এলোপাথাড়ি ঝোড়ো হাওয়া খয়রামারি, গলতামারি পিপুলপাতির ওপর দিয়ে সমুদ্রের দিকে ছুটে যায়। -

ঝড়ের আবার পথ আছে নাকি প্রেস্টনজি?

আছে না? ঠাকুর্দার ডাইরিতে ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যায় যেসব জায়গার ওপর দিয়ে—যে যে রাস্তা দিয়ে–অনেকদিন ধরে দেখা-জানা খবর তিনি একটু একটু করে লিখে রেখে গেছেন তার ছেলের জন্যে—মানে আমার ঠাকুর্দার জন্যে। ঠাকুর্দার বাবা তো তার তাজা বয়সে চব্বিশ পরগনার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট কেলভিনের সঙ্গে ওঠাবসা করতেন—একসঙ্গে লঞ্চে ঘুরেছেন সুন্দরবনের নদীতে নদীতে—শুনেছি শিকারেও যেতেন ক্লাসফ্রেন্ড কেলভিনের সঙ্গে।

কালবৈশাখী তো বটেই—এই তো দুগ্গাপুজোর কিছু আগে আরেকটা ঝড় আমাদের ইদিকে ঝাপিয়ে পড়ে। ফি বছর—এই তো সময় হয়ে এল।

তা পড়ে। খয়রামারির ওদিককার গেরস্থ চাষীরা খুব ভাল নারকেল চাষী। সবাই দিঘির পাড় ধরে নারকেল সুপারি বসায়। আর ঝড়ে মাথাভারি নারকেল গাছ আধখানা হয়ে দু’চারটে ভেঙে পড়বেই। পড়লে আমি গিয়ে মাথাগুলো কিনে ফেলি।

দিয়ে হাবুল পাল জানতে চান, কেন? কেন?

চুলোর ভেতর শুকনো চালা দাউ দাউ করে জুলে উঠল। সে আগুনের আলোয় ট্যারাচোখো হাবুল পালের মুখখানি আবার স্পষ্ট দেখতে পেল মরিশাসওয়ালা। হাবুল পালও প্রেস্টনজির মুখখানি পরিষ্কার দেখতে পেলেন। দুখান মুখই জায়গায় জায়গায় ভাঙা। মুখ দুখানির সেইসব ভাঙা ভাঙা জায়গার ওপর দিয়ে পয়সা কামানোর মেহনতের ঝক্কি আর তার চাকার দাগ ফেলে গেছে। সংসারের ঝড় ঝাপটার দাগদাগালি দুখানি মুখেই চেপে বসেছে।

প্রেস্টনজি বলল, নারকেল গাছের মাথাই তো আসল হাবুলবাবু। মাটির ভেতর শেকড় চালান করে সব রস মাথায় টেনে তোলে গাছগুলো। পাতালের জল শরীর দিয়ে ওপরে উঠে কী করে যে ডাব বানায় !

আমরা ওকে বলি মাথি। সবুজ খোল দিয়ে গাছ তার মাথি ঢেকে রাখে। ভেতরটা সাদা। কচকচি। বেশি খেলে মাথা ঘুরে উঠবেই— -

ঠিক ধরেছেন। ওখান থেকেই ডাব বেরোয়। চারপাশ দিয়ে ডেগো ছাড়ে নারকেল গাছ।

ডেগো কথাটা জানেন দেখছি। -

জানবো না? বাঃ! গাছ, গাছের রস নিয়ে ক পুরুষের কারবার আমাদের। তা ঝড়ে পড়া নারকেল গাছের ওই মাথিটা আমি স্পটে নগদ টাকায় কিনে ফেলি। খুবই দামী জিনিস তো।

মাথি কেনেন ?

হ্যাঁ। মাথি থেকে একরকমের মদ হয়। খুব দামী মদ। আমাদের পারসিদের নওরোজ পরবে সবাইকে ওটা থেকে দিতে পারা—সে এক মস্ত গর্বের ব্যাপার হাবুলবাবু।

আপনার কটি ছেলেমেয়ে ?

একটি ছেলে। সে এদেশে থাকে না।

কোথায়? বিলেতে ?

- না হাবুলবাবু। সে ফ্যামিলির তাড়িখানার কারবারে আসেনি। সে ফিরে গেছে যেখান থেকে আমরা আটশো বছর আগে ইন্ডিয়ায় এসেছিলাম—সেখানে।

মানে ? এ কি কথা বলছেন প্রেস্টনজি? আপনার পরে এসব দেখবে কে? কোন দেশে গিয়ে সে বসে আছে?

ওই যে বললাম, যেখান থেকে আমরা আটশো বছর আগে তাড়া খেয়ে ইন্ডিয়ায় এসেছিলাম—সেই ইস্পাহানে।

ওসব দেশ কোথায় আমি জানি না প্রেস্টনজি। আটশো বছর আগের কথা জানব কী করে?

একটু হাসলেন প্রেস্টনজি। এখন যাকে বলে ইরান—সে দেশের গায়ে কৃষ্ণসাগর নামে একটা খুব বড় জলকর আছে। ইংরাজিতে বলে ব্ল্যাক সি।

হবে।

সেই কৃষ্ণসাগরের একরকমের মাছের ডিমের কারবার করে আমার ছেলে।

অত দূরদেশে গিয়ে মাছের ডিমের কারবার ? সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়!

কি বললেন?

নাঃ! কিছু না বলে চুলোর ভেতর কখানা চালা গুজে দিলেন হাবুল পাল। অনেক পয়সার কারবার। কৃষ্ণসাগরে বিদেশিরা বেড়াতে গিয়ে ওই ডিম খুব আদরআহ্লাদ করে খায়। তাতেই পয়সা। ইউরোপ আমেরিকার সাহেবমেমেরা ওই ডিমের জন্য একেবারে ছুটোছুটি করে। আমার ছেলেটা দুনিয়ার এত জায়গা থাকতে ব্ল্যাক সি-র মাছের ডিমেই রস পেল।

সে তো বিদেশিরা চিংড়ির জন্যেও ছুটোছুটি করে প্রেস্টনজি। তা তো করেই। সারা দুনিয়াই করে। জাপানীদের বড্ড টান হাবুলবাবু এই চিংড়িতে।

সেই চিংড়িতেই ঝুঁকেছে আমার ছেলে। নয়তো দেখুন না, রেলবাজারে পোজিশন মতো জায়গায় আমার কয়লার ডিপো। এই খালের গায়ে চাষের জমি। তবু—

দু'জনের মুখেই কথা ফুরিয়ে আসে। বিরহী চাল এবার মিষ্টি একটা সুগন্ধ ছড়িয়ে ভুগ ভুগ করে ফুটতে লাগল। আলোগোলা অন্ধকারে গা জুড়োনো বাতাস। হাবুল পাল ছাড়ো তো বাবা! দুটো মোটে তো পেট আমাদের।

আমার ছেলেও চিঠি লিখেছে হাবুলবাবু।

কী লিখেছে ?

মাঠে ঘাটে গাছ দেখে দেখে বনবাদাড় ভেঙে ঘুরে ঘুরে কী লাভ বাবা! আমার কাছে ব্ল্যাক সি-এর পাড়ে এসে থাকো। সুন্দর জায়গা। আমার বাড়ির সামনে ফলের বাগান—কত ভালো ভালো কথা। আমি ভাবি আমাদের বংশের প্রথম মরিশাসওয়ালা মরিশাসে কী রস পেয়েছিলেন তার প্রথম যৌবনে।

এক হাতা ভাত তুলে দেখলেন হাবুল পাল। দেখতে দেখতে বললেন, চিংড়ির তো মড়ক লাগে। বড় সুখী মাছ—

সে তো আপনার ধানেও পোকা লাগে। কোনও কোনও বছর জিরেন কাটের পর কোনও কোনও গাছ যে শুকিয়ে যায় হাবুলবাবু। একবার তো ব্ল্যাক সি-তে আমার ছেলের সেই মাছ এলই না।

এবারই আমার ধানে পোকা লেগেছে প্রেস্টনজি। সব ধান বরবাদ।

দেখবেন আবার সামনের বছর ধানে মাঠ ভরে যাবে হাবুলবাবু।

চিন্তা হয় ছেলের জন্য। দামী মাছ। চুরি যেতে পারে। কেউ বিষ দিয়ে দিতে পারে। তাহলেই তো গেল সব।

চুরি কার না যায়! আমার জমা নেওয়া জোয়ান বয়সী তাজা খেজুর গাছে গজাল মেরে হিং ঢুকিয়ে গাছ মেরে দেয় না?

গাছ মেরে দেয় ?

তবে কী? ফাঁকা মাঠে অত গাছ—কে পাহারা দেবে বলুন ? না, পাহারা দেওয়া যায়! ওঃ ! বডড খিদে পেয়ে যাচ্ছে। আপনার এই বিরহী না কী এক চাল বললেন—এর ভাত আমি কোনওদিন খাইনি।

খেয়ে দেখুন। গতবার দেড় বিঘেয় বিরহী ধান দিয়েছিলাম। তারই চাল।

ভাত বসানো থেকে ডালসেদ্ধ হওয়া অবধি এই সময়টুকুর ভেতর আরও দুখানি ট্রেন শেয়ালদায় গেল। দুখানি ট্রেন শেয়ালদা থেকে এল। এই সময়টায় কলকাতার ডেলি প্যাসেঞ্জারবাবুরা ঘরে ফেরেন। শেয়ালদায় কোলে মার্কেটে গন্ত করতে যায় একই লাইনের আনাজ ব্যাপারীরা। ফেরে সেই লাস্ট ট্রেনে।

নিন, এবার গায়ের জামাটা খুলুন। প্যান্টালুন পরে খেতে বসতে পারবেন তো?

খুব পারব।

ভাতের গরাস মুখে তুলে হিড়জিভাই প্রেস্টনজি মরিশাসওয়ালা বললেন, আহা! কী মিষ্টি। এমন তো খাইনি কখনও। -

হাবুল পাল বললেন, আর দু’হাত ভাত—একটু ডাল দিই বরং। নেবু-নঙ্কা পাশেই আছে। দেখেছেন তো। আঃ। হেরিকেনটা বড্ড জ্বালাচ্ছে। যদি আরেকটু আলো দিত।

(শারদীয় বর্তমান ১৪০৪)





সিসিফাসের কল্পকথা আলবেয়া ক্যাম্যু


অনুবাদ: রওশন জামিল

দেবতারা চরম দণ্ড দিয়েছিলেন সিসিফাসকে, একটি বিশাল প্রস্তরখণ্ড নিরন্তর ঠেলে তুলতে হবে পর্বতের মাথায়, যেখান থেকে আপন ভারেই পাথরটি গড়িয়ে পড়বে নিচে। খানিক চিন্তাভাবনা করেই তাঁদের মনে হয়েছিল নিষ্ফল ও সম্ভাবনারহিত শ্রমের চেয়ে ভয়ঙ্কর শাস্তি আর কিছুই হয় না।


হোমারকে বিশ্বাস করলে, মরণশীলদের মধ্যে সিসিফাস ছিলেন সবচেয়ে জ্ঞানী ও বিচক্ষণ। অবশ্য, এও বলা হয়ে থাকে, তাঁকে মর্ত্যলোকে পাঠানো হয়েছিল তস্করবৃত্তি অনুশীলনে। কোন বিরোধ দেখি না আমি এতে। কেন তিনি যমপুরীর তুচ্ছ শ্রমিকে পরিণত হয়েছিলেন তা নিয়ে মতভেদ আছে। তাঁর বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ, দেবতাদের সাথে বেয়াড়া রসিকতা করেছিলেন। তাঁদের গূঢ় তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিলেন তিনি। ইসোপাসের কন্যা, ইজিনাকে অপহরণ করেন জুপিটার। কন্যার অন্তর্ধানে মুষড়ে পড়েন পিতা, এবং সিসিফাসের কাছে অনুযোগ করেন। সিসিফাস, যিনি অপহরণের বিষয়টি জানতেন, এই শর্তে সত্যপ্রকাশে সম্মত হন যে ইসোপাস করিন্থের পুরদুর্গে জলের ব্যবস্থা করবেন। স্বর্গলোকের বজ্রনিনাদের পরিবর্তে জলের মঙ্গলধ্বনিই পরম মনে হয়েছিল তাঁর কাছে। যমপুরীতে এজন্য শাস্তি বরাদ্দ হয় তাঁর। হোমার থেকেই জানতে পারি, যমকে শেকলে বেঁধে ছিলেন সিসিফাস। নিজের বিরান, স্তব্ধ সাম্রাজ্যের চেহারা সইতে পারেননি প্লুটো। তাই, যুদ্ধের দেবতাকে পাঠিয়েছিলেন, যিনি যমকে মুক্ত করেন তাঁর বিজেতার কবল থেকে।

এমনও কথিত আছে যে, মরণ যখন শিয়রে এক অদ্ভুত খেয়াল চেপেছিল সিসিফাসের, স্ত্রীর ভালবাসা যাচাই করবেন। তাঁর নশ্বর দেহ সমাহিত করবার পরিবর্তে চৌরাস্তার মোড়ে ফেলে রাখতে তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। যমপুরীতে ঘুম ভাঙে সিসিফাসের; এবং সেখানে, মানবীয় ভালবাসার একেবারেই স্ববিরোধী এই আনুগত্যে বিরক্ত হয়ে, মর্ত্যলোকে ফিরে গিয়ে স্ত্রীকে ভর্ৎসনা করে আসার অনুমতি আদায় করে নেন প্লুটোর কাছ থেকে। কিন্তু এই পৃথিবীর মুখ যখন আবার দেখলেন তিনি, এর জল আর সূর্য, উষ্ণ নুড়ি আর সাগরকে উপভোগ করলেন, আর ফিরতে চাইলেন না সেই নারকীয় আঁধারে। প্রত্যাবর্তনের আদেশ, রক্তচক্ষু, সতর্কবার্তা, কোনকিছুতেই ফল হচ্ছিল না। উপসাগরের বাঁক, সফেন সমুদ্র আর বসুন্ধরার হাসি দেখে আরও অনেক বছর বেঁচে ছিলেন তিনি। আবশ্যক হয়ে পড়েছিল দেবতাদের বিধান । বুধ এলেন, এবং দুর্বিনীত মানুষটিকে ঘাড়ে ধরে, তাঁর সকল আনদন্দযজ্ঞ থেকে একটানে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন যমপুরীতে, যেখানে পাথরটি অপেক্ষা করছিল তাঁর জন্য।

ইতিমধ্যে বুঝে গেছেন আপনি, সিসিফাস হচ্ছেন অ্যাবসার্ড নায়ক। তিনি আসলেই তা-ই, যতখানি তাঁর উদ্দীপনায়, ততখানিই তাঁর লাঞ্ছনাভোগে। দেবতাদের প্রতি তাঁর অবজ্ঞা, মৃত্যুর প্রতি তাঁর ঘৃণা, আর জীবনের প্রতি তাঁর অদম্য ভালবাসা তাঁর জন্য সেই অমোঘ শাস্তি-ই নির্দিষ্ট করেছিল যেখানে সমগ্র সত্তাটিই নিক্ষিপ্ত হয় এক নিষ্ফল অর্জনে। এই মাশুল, মর্ত্যরে প্রতি ভালবাসার অনিবার্য ক্ষতিপূরণ। যমপুরীর সিসিফাস সম্পর্কে আমাদের কিছুই বলা হয়নি। কল্পকথা তৈরি করা হয় কল্পনা দিয়ে তার মধ্যে প্রাণসঞ্চারের জন্য। এই কল্পকথাটির ক্ষেত্রে, একজন শুধু দেখতে পায় চড়াই ভেঙে একটি মানুষের বিশাল একটি প্রস্তরখণ্ড শত-সহস্রবার ঠেলে তুলবার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাটুক; দেখতে পায় কুঞ্চিত একটি মুখ, পাথরে সেঁটে-থাকা শক্ত চোয়াল, কাঁধে কর্দমাক্ত পিণ্ডের ভার, ঠেস-দেয়া পা, প্রসারিত দুবাহুর নতুন উদ্যম, কাদামাখা দুটি হাতের পূর্ণ মানবীয় সুরক্ষা। অবশেষে, নিঃসীম শূন্যতা আর অতলান্তিক সময়ের পরিমাপে নির্ণীত তাঁর দীর্ঘ প্রচেষ্টার অন্তিমক্ষণে, অর্জিত হয় উদ্দেশ্যটি। কিন্তু মুহূর্তমাঝে পাথরটিকে সিসিফাস ছিটকে পড়তে দেখেন পাতালপুরীতে, যেখান থেকে আবার তাঁকে সেটা ঠেলে তুলতে হবে চূড়ায়। তিনি ফিরে যান সমতলে।

ঠিক সেই প্রত্যাবর্তন-মুহূর্তের, সেই দ্বিধাচকিত বিরামের সিসিফাস আকৃষ্ট করেন আমাকে। একটি মুখ, প্রস্তর-ঘনিষ্ঠ পরিশ্রমে নিজেই পাথর হয়ে গেছে! আমি সেই মানুষটিকে শ্রান্ত অথচ সুমিত পদক্ষেপে ফিরে যেতে দেখি এক উৎপীড়নের কাছে যার অবসান তিনি কোনদিনই জানবেন না। মুহূর্ত অবসরের সেই ক্ষণ যা ফিরে ফিরে আসে তাঁর যন্ত্রণার মতই অবধারিতভাবে, তা-ই হচ্ছে চৈতন্যোদয়ের মুহূর্ত। ওই মুহূর্তগুলোর প্রতিটিতে, যখন তিনি শীর্ষদেশ ত্যাগ করে ধীরে ধীরে তলিয়ে যেতে থাকেন দেবতাদের স্তরে, তিনি তাঁর নিয়তির চেয়ে গরীয়ান; তাঁর প্রস্তরের চেয়েও শক্তিমান।

এই কল্পকথাটি যদি ট্র্যাজিক হয়ে থাকে, তা এর নায়ক সচেতন বলে। বস্তুত, কোথায় থাকত তাঁর নিগ্রহ যদি সাফল্যের আশা প্রতি পদক্ষেপে উজ্জীবিত রাখত তাঁকে? আজকের শ্রমজীবী তার জীবনের প্রতিটি দিন পুনরাবৃত্তি করে যান একই কাজের -- এ নিয়তিটিও কম অ্যবাসার্ড নয়। কিন্তু এটি ট্র্যাজিক শুধু সেই বিরল মূহূর্তে যখন তা ফুটে ওঠে নিজের নিবিড় অনুভবে। সিসিফাস, যিনি দেবতাদের মধ্যে সর্বহারা, ক্ষমতাহীন এবং বিদ্রোহী, জানেন নিজের দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থার সমগ্র চিত্রটি: তাঁর অবতরণের সময়ে ঠিক একথাটিই ভাবেন তিনি। তাঁর লাঞ্ছনার কারণ হয়েছিল যে-সারল্য, তা-ই বিজয়ের মুকুট পরিয়ে দিয়েছে তাঁকে। এমন কোন নিয়তি নেই যা মানুষের অনতিক্রম্য।

এই অবতরণ যদি তাই কখনও করা হয়ে থাকে সন্তাপে, তবে আনন্দচিত্তেও তা ঘটতে পারে বৈকি। এমন কিছু বেশি কথা নয় এটি। আবার কল্পনা করি আমি, সিসিফাস ফিরে যাচ্ছেন তাঁর পাথরটির দিকে, দুঃখের সূচনায়। পৃথিবীর ছবিগুলো যখন খুব শক্ত করে আঁকড়ে ধরে স্মৃতি, যখন জেদি হয়ে ওঠে সুখের আহ্বান, মানুষের হৃদয়ে জেগে ওঠে বিষণ্নতা এটি হচ্ছে সেই পাথরের জয়, বস্তুত এটি ওই পাথরটি নিজেই। ভীষণ দুর্ভর, সীমাহীন এই শোক। এগুলো সেই গেথসেমান এর রজনী। কিন্তু রূঢ় সত্য স্বীকৃত হওয়ার পরিবর্তে লয়প্রাপ্ত হয়ে থাকে। তাই, সত্য জানবার পরিবর্তে শুরুতেই নিয়তির আজ্ঞাবাহী হন ইডিপাস। কিন্তু ঠিক যে-মুহূর্তে তা জানলেন তিনি, তাঁর ট্র্যাজিডি শুরু হয়ে গেল। আবার একই সময়ে, অন্ধ ও বেপরোয়া, উপলব্ধি করেন তিনি, পৃথিবীর সাথে যে-একটিমাত্র বন্ধন যুক্ত রেখেছে তাঁকে তা একটি মেয়ের কোমল হাত। সেইক্ষণে প্রতিধ্বনিত হয় এক অবিস্মরণীয় উক্তি: “এত সব অগ্নিপরীক্ষা সত্বেও, আমার প্রবীণ বয়স আর আমার আত্মার উৎকর্ষ আমাকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে দিয়েছে যে সবকিছুই সুন্দর।” সফোক্লিসের ইডিপাস, দস্তয়েফ্স্কির কিরিলভের মতই, এইভাবে উপহার দেন অ্যাবসার্ড বিজয়লাভের কৌশল। পুরাকালের প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিত করে আধুনিক শৌর্যের।

সুখের একটি নির্দেশিকা রচনায় প্রলুব্ধ হওয়া ভিন্ন অ্যাবসার্ডকে আবিষ্কার করে না কেউ। “কী! অমন এক সঙ্কীর্ণ পথে----?” একটিমাত্র দুনিয়াই আছে, শত হলেও। সুখ আর অ্যাবসার্ড একই মর্ত্যলোকের দুই পুত্র। তারা অবিচ্ছেদ্য। এটি বলা ভুল হবে যে অ্যাবসার্ড আবিষ্কার থেকেই অবধারিতভাবে অঙ্কুরোদ্গম হয় আনন্দের। এমনটিও ঘটে, আনন্দ থেকে জাগ্রত হয় অ্যাবসার্ডের বোধ । ইডিপাসের মহান, পবিত্র সেই উক্তি “আমি সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে সবকিছুই সুন্দর।” মানুষের আদিম এবং সীমিত জগতে প্রতিধ্বনিত হয় সেটি, এবং তা এ-শিক্ষাই দেয় যে সবকিছু শেষ হয়নি, শেষ হয়ে যায়নি। এটি এই মর্ত্যলোক থেকে একজন দেবতাকে বিতাড়িত করে যিনি এখানে এসেছিলেন অতৃপ্তি আর নিষ্ফল যন্ত্রণাভোগের ইচ্ছা নিয়ে। নিয়তিকে এক মানবীয় বিষয়ে পরিণত করে এই এষণা , যার সমাধান মানুষের মাঝেই করতে হবে।

এর মধ্যেই সংগুপ্ত রয়েছে সিসিফাসের সমস্ত নির্বাক আনন্দ। তিনিই তাঁর নিয়তির প্রভু। তাঁর প্রস্তর তাঁরই গুরুভার। একইভাবে, অ্যাবসার্ড মানুষ, যখন নিজের অপার ক্লেশ নিয়ে ভাবেন, তাঁর সকল উপাস্যকে স্তব্ধ করেন তিনি। আপন স্তব্ধতায় অকস্মাৎ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত ব্রহ্মাণ্ডে জেগে ওঠে মর্ত্যলোকের বিস্ময়াভিভূত অযুত মৃদ কণ্ঠস্বর । অচেতন, গোপন আহ্বান, সকল কণ্ঠের আমন্ত্রণ, ওরা হচ্ছে বিজয়ের অপরিহার্য প্রতিরূপ এবং তার শর্তপূরণ। ছায়াহীন কোন সূর্য নেই, এবং রাতকে জানবার জন্যই এটা জরুরি। অ্যাবসার্ড মানব বলে, ঠিককথা, এবং তারপর থেকে তার প্রচেষ্টা হয় বিরামহীন। আপন ভাগ্য বলে যদি কিছু থাকে, উচ্চতর অদৃষ্ট বলে কছু নেই, অথবা শুধু একটিই রয়েছে যাকে সে অবশ্যম্ভাবী ও জঘন্য বলেই রায় দেয়। অন্য সবকিছুর জন্য, নিজেকে সে তার জীবনের প্রভু জানে। ঠিক সেই মাহেন্দ্রক্ষণে মানুষ যখন তার জীবনের দিকে ফিরে তাকায়, যেমন সিসিফাস তাঁর পাথর অভিমুখে ফিরে আসছিলেন, ঘুরে দাঁড়াবার ওই লহমায় অসম্বন্ধিত সেইসব কর্মের কথা ভাবছিলেন তিনি, যা তাঁর ভাগ্যে পরিণত হয়েছে, নিজেই সৃষ্টি করেছেন, সম্মিলিত হয়েছে তার স্মৃতিসত্তার গভীরে, এবং অচিরেই যার অবসান ঘটবে তাঁর মৃত্যুতে। এইভাবে, মানবীয় সবকিছু মানবেরই সৃষ্টি এমত প্রত্যয়ে, দেখবার আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল একজন অন্ধ মানুষ যিনি জানেন রাত্রির কোন শেষ নেই, তাঁকে আরও পথ চলতে হবে। পাথরটি এখনও গড়াচ্ছে।


সিসিফাসকে ছেড়ে আসি আমি পর্বতের সানুদেশে! প্রত্যেকেই সর্বদা নিজের দুর্বহ ভার ফিরে পান পুনর্বার। কিন্তু সিসিফাস সেই সমুন্নত পৌরুষের শিক্ষা দেন যা দেবতাদের অগ্রাহ্য করে এবং পাথর ঠেলে তোলে। তিনিও মীমাংসায় পৌঁছেন যে সবকিছুই ঠিক আছে। নিরীশ্বর এই ব্রহ্মা- অতঃপর তাঁর কাছে আর নির্বীজ বা নিষ্ফল কিছুই মনে হয় না। ওই পাথরের প্রতিটি অণু, অমানিশায়-ঘেরা সেই পর্বতের প্রতিটি ক্ষুদ্রকণা, নিজেদের মধ্যেই নির্মাণ করে নেয় একেকটি ভুবন। শীর্ষদেশে পৌঁছুবার সংগ্রামই একজন মানুষের হৃদয়কে পরিপূর্ণ করবার জন্য যথেষ্ট। সিসিফাস সুখী, একথা ভাবতেই হবে।



গ্যুইন্টার গ্রাস এবং আমাদের গ্যাস্ট্রিক আলসার -আখতারুজ্জামান ইলিয়াস


গুন্টার গ্রাসের টিন ড্রাম পড়ি ১৯৭১ সালে।

পূর্ব বাংলায় তখন ঘোরতর পাকিস্তান এবং রাষ্ট্রটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য সেনাবাহিনী একনাগাড়ে মানুষ খুন করে চলেছে। ঢাকার রাত্রিগুলি তখন কারফ্যু-চাপা, ব্ল্যাক-আউটের বাধ্যতামূলক অমাবস্যায় নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। গলির মাথায় বড় রাস্তায় আর্মির ট্রাক চলে যায়, গ্লাস ফ্যাক্টরির শ্রমিক কলোনিতে ব্রাশফায়ার চলছে শুনে বুঝতে পারি আরও কয়েকটা মানুষ লাশে পরিণত হল। গলির ভেতর জিপ থামলে নিজের হার্টবিট সারা ঘর জুড়ে গুলিবর্ষণের ধ্বনি হয়ে ওঠে। মিলিটারি বুটের সদম্ভ পদক্ষেপে আবার এই শব্দ চাপা পড়ে। এই বুট ঘা মারতে পারে আমার দরজায়, আবার থামতে পারে প্রতিবেশীর ঘরের ভেতর ঢুকে। পরদিন পাড়ার কয়েকজন মানুষকে দেখা যায় না।
আর্মির জিপ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের কোথায় নিয়ে গেছে, তারা আর কোনোদিন ফেরে না। সকালবেলায় রাস্তায় বেরুলেও খালি মিলিটারি। তাদের কাজের বিরতি নেই। মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের খোঁজে গিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয় বস্তিতে, বাজারে। আগুনের গ্রাস থেকে পালাতে গিয়ে বাজারের লোকজন মারা পড়ে ব্রাশফায়ারের সামনে। বিকালবেলা হতে-না-হতেই রাস্তাঘাট শুনশান, সন্ধ্যা হতে-না-হতে গভীর রাত। আবার কারফ্যু, আবার ব্ল্যাক-আউট, বুটের সদম্ভ পদচারণা, ব্রাশফায়ার নরহত্যার যজ্ঞ। এই আতঙ্কে নিশ্বাসপ্রশ্বাসের কাজটা করতেই হাঁপিয়ে উঠি।

ঐ সময় পড়ি টিন ড্রাম। অসকার ড্রাম পেটায় আর তার আকাশ ফাটানো আওয়াজ কানে ঢোকে বজ্রপাতের মতো। এবং কানের পর্দা ছিঁড়ে চলে যায় মগজে, মগজ থেকে এ-শিরা ও-শিরা হয়ে পড়ে রক্তধারার ভেতর। অসকারের ঐটুকু হাতের বাড়ি এতটাই প্রচণ্ড যে তা ছাপিয়ে ওঠে মেশিনগান স্টেনগানের ব্রাশফায়ারকে। আমরা কয়েকজন বন্ধু একে একে বইটা পড়ি আর হাড়ের মধ্যে মজ্জার কাঁপন শুনিঃ ঘোরতর বিপর্যয়েও মানুষ বাঁচে। প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর সম্ভাবনা থাকলেও বাঁচা যায়। বাঁচার ইচ্ছা যদি তীব্র হয় তা হলে তা-ই পরিণত হয় সংকল্পে। তখন মৃত্যুর আতঙ্ক মাথা নত করে।

টিন ড্রাম কিন্তু আমাদের বিজয়ের ডঙ্কা শোনায়নি। বিজয় সম্পর্কে আমাদের প্রধান প্রেরণা ও একমাত্র ভরসা ছিল আমাদের প্রতিরোধের অদম্য স্পৃহা। সেনাবাহিনীর নৃশংস নির্যাতনে এই স্পৃহা নতুন নতুন শিখায় জ্বলে উঠেছিল। কিন্তু কবুল করতে দ্বিধা নেই, ১৯৭১ সালের শেষ কয়েকটা মাস অসকারের ড্রামের ডম্বরু আমাদের ভয় ও আতঙ্ককে শ্লেষ, কৌতুক, বিদ্রুপ ও ধিক্কার দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে দেখতে আমাদের প্ররোচিত করে। নিজেদের আতঙ্কের এই ময়না-তদন্তের ফলে আতঙ্ককে বাগে আনা সহজ হয়েছিল।

ঐ বছরের শেষে আমাদের দেশ থেকে পাকিস্তান লুপ্ত হয়, ঐ ভয়াবহ আতঙ্ক ও উত্তেজনা থেকে আমরা রেহাই পাই।

দিন যায়। আরও অনেক বইয়ের সঙ্গে গুন্টার গ্রাসের আরও বই জোগাড় করে পড়ি। তাঁর কবিতা পড়ি। এখানে-ওখানে আঁকা তাঁর স্কেচও দেখি। বেশির ভাগই আত্মপ্রতিকৃতি। অদ্ভুত, ভয়াবহ ও বীভৎস সব ছবি। ১৯৮৫ সালে এক সন্ধ্যায় টিন ড্রাম চলচ্চিত্রটা দেখে ফেলি।

চলচ্চিত্র তো দেখা ও শোনার মাধ্যম। কিন্তু, ১৯৭১ সালে বই পড়ার সময় ড্রামের যে-পিটুনি কানে তালা লাগিয়ে দিয়েছিল, বরং বলা যায় কানের তালা খুলে দিয়েছিল, ১৯৮৫ সালে ফিল্মে তা অনেকটা ফাঁপা মনে হল। কিন্তু ফিল্ম হিসাবে তো টিন ড্রাম বেশ ভালো। তবে? হয়তো ফিল্মের দোষ নয়, কয়েক বছরে আমার কানও বোধহয় ভোঁতা হয়ে গেছে।

গুন্টার গ্রাস কিন্তু ভোঁতা হননি। এই দেড় দশকে তাঁর ধার অনেক বেড়েছে। তিনি এখন খুব বড় ব্যক্তিত্ব, কেবল জার্মানিতে নয়, তাঁর তৎপরতা ও প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে গোটা পশ্চিম ইউরোপ জুড়ে। বড় শিল্পীর মতো কেবল নিভৃত শিল্পচর্চায় তিনি মগ্ন থাকেন না, কিংবা ব্যাপক ও প্রশস্ত কর্মকাণ্ডকে তিনি মনে করেন শিল্পচর্চার অংশ। পরাশক্তির আণবিক ষড়যন্ত্রকে ধিক্কার দেওয়ার জন্য ইউরোপের যুবকদের সঙ্গে তিনি মিছিলে নামেন, বড় সমাবেশের আয়োজন করেন। স্ফীতোদর পুঁজিবাদের সর্বগ্রাসী চোয়াল বন্ধ করার তাগিদে উদার গণতন্ত্রী নেতা উইল ব্রান্টের নির্বাচনী প্রচারণায় শামিল হন। স্ফীতোদর পুঁজিবাদের মেদ চেঁছে ফেলার জন্য ইউরোপে যেসব তৎপরতা চলছে তাতে কেবল সমর্থন দিয়েই ক্ষান্ত হন না, এর সমস্ত উদ্যোগেই তিনি তৎপর। শেষ পর্যন্ত ইউরোপেও সীমাবদ্ধ থাকতে পারেন না। পুঁজিবাদের শোষণে ক্লিন্ন ও ক্লিষ্ট তৃতীয় বিশ্বের চেহারা দেখতে ছুটে আসেন এই উপমহাদেশের জনাকীর্ণ শহরে। মুমূর্ষু কলকাতা, অবক্ষয়ী কলকাতা, রুগণ ও নোংরা কলকাতা তাঁকে ক্ষিপ্ত করে তোলে। একটি উপন্যাসের কয়েক পাতা জুড়ে এই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটে, এই শহরকে তিনি মনে করেন নরকের বিষ্ঠা।

এবার তাঁর পদার্পণ ঘটছে ঢাকায়। শুনলাম, আমাদের এই পুরনো শহরটির নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনযাপন দেখার জন্য তিনি উদগ্রীব। কলকাতা সম্বন্ধে প্রতিক্রিয়া দেখে ভয় হয়, আবার আশাও হয়, এখানকার কাণ্ডকারখানা দেখে অসকারের ড্রামের কাঠি এবার হয়তো তিনি নিজের হাতে তুলে নেবেন।

১৫ বছর আগে এলে রাষ্ট্রের নির্যাতন ও মানুষের প্রতিরোধের আগুনে হয়তো উষ্ণ হতে পারতেন। সেই উত্তাপ এখন কোথায়? এক রাষ্ট্রের পতন ঘটেছে, অভ্যুত্থান ঘটেছে আরেক রাষ্ট্রের। কিন্তু দেশের বদল হয়নি। আগেকার রাষ্ট্রের শোষণ বর্তমান রাষ্ট্রেও অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু নির্যাতনের সরাসরি পদ্ধতিটা বাতিল হয়ে গেছে, এখন নতুন নতুন পথ খোলা হচ্ছে। পুরনো রাষ্ট্রের নৃশংস নির্যাতনের বিরুদ্ধে যে-প্রতিরোধ স্পৃহা মানুষকে দারুণভাবে জ্যান্ত করে রেখেছিল সেই স্পৃহা এখন স্তিমিত। রুখে দাঁড়াবার বদলে মানুষ এখন ভোঁতা হতাশায় নিস্তেজ। উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের এখানকার কর্ণধার কারা? গুন্টার গ্রাস তরুণদের উদ্দেশে যে-বয়স্ক লোকদের পঙ্গু ও নপুংসক বলে রায় দিয়েছেন, আমাদের রাষ্ট্রীয়-রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব সেইসব চির-অপরিণত পঙ্গু ও নপুংসক লুম্পেনদের হাতে। এদের সকলের ওপর চেপে বসে রয়েছে বিদেশি পরাশক্তি। ঘাড় থেকে তাদের সরাবার কোনো ইচ্ছা বরদাস্ত করা হবে না। আর সেরকম ইচ্ছা হবেই-বা কেন? নিজেদের স্বার্থ যাতে ঠিক থাকে তার জন্য এখানকার নেটিভ নেতাদের আসন অটল রাখার উদ্দেশ্যে প্রভুরা সবসময় সতর্ক। পুঁজিবাদের গতর আরও মোটাসোটা করতে হলে এই ভাড়াটে ঠ্যাঙাড়েদের টিকিয়ে রাখাটা খুব দরকার। এজন্য কত ফন্দিফিকিরই-না বার করা হয়।

কোথাও ব্যবস্থা দেওয়া হয়, পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের চওড়া সিঁড়ি ধরে ধাপে ধাপে ওঠো। উঠতে উঠতে একদিন সমস্ত দেশবাসীর সামগ্রিক মুক্তির সোনার কাঠিটি পাওয়া যাবে। মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী মহা উৎসাহে বাণী ছাড়েন, পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের শিকড় গভীরে প্রোথিত হয়ে গেছে, এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। যারা এসব কথা বলেন তাঁরা কোথাকার লোক? এঁদের বাড়ি সেই দেশে যেখানে প্রধানমন্ত্রী নিহত হলে তাঁর রাজনীতিবিমুখ পেশাদার পাইলট পুত্রসন্তানকে ককপিট থেকে ধরে এনে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসাতে না-পারলে সংসদীয় দল তো দল, রাষ্ট্র পর্যন্ত ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। যেসব দেশে দলনেতার মৃত্যুর পর নেতার বিধবা স্ত্রী বা কন্যাকে নেতৃত্বে বসাতে না-পারলে দলের লোকজন একসঙ্গে বসতে চায় না, সেসব জায়গায় ওয়েস্টমিনস্টার গণতন্ত্র প্রয়োগ করার জন্য এত উৎসাহ কেন? শোষণের বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিরোধ-স্পৃহাকে নিভিয়ে দেওয়া ছাড়া এই উৎসাহের আর কি কারণ থাকতে পারে? এর অন্তর্নিহিত বাণী একটিই, তা হল এইঃ বেশি জ্বলে ওঠা ভালো নয়। মানুষ জ্বলে উঠলে এইসব পঙ্গু ও চির-অপরিণত সাবালকদের হাতে নেতৃত্ব থাকে না।

যেখানে দেখা যায় এসব ব্যবস্থায় ঠিক জুত হচ্ছে না সেখানকার ব্যবস্থাপত্র একটু আলাদা। বাইরে থেকে সেখানে প্রভুরা লেলিয়ে দেয় সেনাবাহিনী। কোন সেনাবাহিনী? না, না, বাইরের লোক নয়। দেশের মানুষ দিয়ে গঠিত সেনাবাহিনী। কিন্তু সেনাপতিদের মুণ্ডু থেকে ল্যাজ পর্যন্ত বাঁধা পুঁজিবাদের স্ফীতোদর শক্তির হাতের শক্ত দড়িতে। প্রভুরা ঝাঁকে ঝাঁকে অস্ত্র পাঠায়। পঙ্গুর হাতে, নপংসকের হাতে অস্ত্র পড়লে নিরন্ন ও নিরস্ত্র দেশবাসীর ওপর ছাড়া আর কোথায় তার প্রয়োগ হতে পারে?

এদের ওপর গুন্টার গ্রাসের ক্রোধ নানাভাবে বিস্ফোরিত হয়েছে তাঁর বিভিন্ন লেখায়, তবে সরাসরি পাই তরুণদের উদ্দেশে তাঁর ভাষণে। পুঁজিবাদের ক্রমপ্রসারমাণ মেদ চেঁছে ফেলার আন্দোলনের তিনি একজন সক্রিয় সদস্য। আর আমাদের এই উপমহাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী বা ঠ্যাঙারে সেনাবাহিনী--দুইই হল আত্মসম্প্রসারণে তৎপর পুঁজিবাদের নপুংসক ও পঙ্গু সেবাদাস। স্ফীতোদর পুঁজিবাদের মেদ চেঁছে ফেললে কি তার সাঁড়াশি থেকে বেরুনো সম্ভব? পুঁজিবাদের মেদ কমলে তার শক্তি কমবে না, বরং মেদহীন ছিপছিপে চেহারা দেখিয়ে উপমহাদেশে আরও বেশি মানুষকে দলে টানা তার পক্ষে সহজ হবে। তারপর সুযোগ পেলেই তার আসল মূর্তি ফের প্রকট হয়ে উঠবে। তখন তার সম্প্রসারণ ঘটবে নতুন বেগে।

আজ থেকে সোয়াশো বছর আগে গুন্টার গ্রাসের আরেকজন দেশবাসী পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের এই উপমহাদেশের শোষিত মানুষের সুখদুঃখের শরিক হতে চেয়েছিলেন। নাম তাঁর কার্ল মার্কস। সমসাময়িক ঘটনা থেকে তিনি বুঝতে পারেন তখনকার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এই দেশে রাজ্যগ্রাসী তৎপরতা চালিয়ে কী করে তাদের নির্মম শোষণের প্রসার ঘটাচ্ছে। ১৮৫৭ সালে ভারতীয় সিপাইদের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হলে নতুন পাশ্চাত্য শিক্ষায় আলোকিত ভারতীয় বুদ্ধিজীবীদের কেউ-কেউ এটাকে উৎপাত বলে গণ্য করেন। আর হাজার হাজার মাইল দূরে বসেও সিপাহিদের ওপর হামলে-পড়া-ইংরেজদের মার্কস অভিহিত করেন কুত্তা বলে এবং ইংরেজকুত্তাদের সেবায় লিপ্ত ভারতীয় দালালদের ধিক্কার দিতে তাঁর কিন্তু এতটুকু দেরি হয়নি।

মার্কস জানতেন শান্তিপূর্ণ উপায়ে, বিনা রক্তপাতে, পুঁজিবাদী শক্তিকে পরাভূত করা যায় না। একটি রুগণ ও শোষিত সমাজের জন্য 'শান্তি' হল বিলাসিতা। তরুণ নাগরিকদের উদেশে গুন্টার গ্রাসও বলেন, 'দীর্ঘস্থায়ী শান্তি বড় ভালো জিনিস'। কিন্তু এটা অস্বস্তিকর, বিরক্তিকর। শান্তি দিয়ে আমরা করবটা কী? এতে দম বন্ধ হয়ে আসে। ফলে গ্যাস্ট্রিক আলসার দেখা দিতে পারে।

গুন্টার গ্রাসকে আমরা আশ্বাস দিতে পারি যে, পরাশক্তির প্রভুত্ব নিশ্চিত করার উদেশ্যে ওয়েস্টমিনস্টার-মার্কা গণতন্ত্রের ভেলকি দেখিয়ে কিংবা তোপের মুখে তাদের এদেশি দালালরা শান্তিপূর্ণ অবস্থার মায়াসৃষ্টির যত আয়োজনই করুক-না, ওরকম শান্তি আমাদের দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। পেটে যাদের খাবার নেই, আর কিছু না-হোক পেটটা তাদের জ্বলবেই। আমাদের গ্যাস্ট্রিক আলসারের উৎস আমাদের দমবন্ধ-করা-শান্তি নয়--দীর্ঘদিনের অনাহার-অর্ধাহার। হ্যাঁ, অনাহার ও অর্ধাহারই হল আমাদের আলসারের প্রধান কারণ। বহুকাল থেকে আমরা ঠিকমতো খেতে পাই না। এক হাজার বছর আগে লেখা সবচেয়ে পুরনো বাংলা কবিতা শুরু হয়েছে অন্নহীন হাঁড়ির খবর দিয়ে। অনাহারে-অর্ধাহারে পেটের অসুখের ঐতিহ্যও আমাদের বহুকালের। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের বহু লোকালয়, বহু জনপদ উজাড় হয়ে গেছে কলেরায়। কার্ল মার্কস, এমনকী, ১৮১৭ সালের একটি মহামারির কথা উল্লেখ করেছেন। এই কলেরা প্রথম দেখা দেয় আমাদের যশোরে, সেখান থেকে এশিয়া হয়ে তা চলে যায় ইউরোপে, সেখানে প্রচণ্ড লোকক্ষয় করে যায় ইংল্যান্ডে এবং সেখান থেকে আমেরিকায়। আজ আণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য পরাশক্তিগুলো কোটি কোটি টাকা খরচ করে, আর আমাদের দেশের মানুষের অনাহারজনিত পেটের রোগ উপশমের কোনো লক্ষণই চোখে পড়ে না।

আমাদের আলসারের ব্যথা দিনদিন অসহ্য হয়ে উঠছে। স্ফীতোদর সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদকে শ্লেষ আর বিদ্রুপে বিদ্ধ করে এই ব্যথাকে চিরে চিরে দেখার মতো সময় শেষ হয়ে এসেছে, সেই বিলাসিতা আমাদের পোষায় না। পুঁজিবাদের গতর রোজই একটু একটু করে মোটা হচ্ছে, উপমহাদেশের বিভিন্ন পয়েন্টে মোতায়েন তাদের নপুংসক ও পঙ্গু কুকুরগুলোর দাঁতের ধারও বাড়ছে। অবস্থা এমন যে এদের কামড়ে আলসার-ভোগা মানুষের জলাতঙ্ক হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। তাদের হাত থেকে অস্ত্র নিয়ে তাদের দিকে তাক করতে না-পারলে আমাদের আলসার ও সম্ভাব্য জলাতঙ্ক থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো উপায় নেই।

গুন্টার গ্রাস আমাদের এইসব রোগের কারণ নিশ্চয়ই শনাক্ত করতে পারেন। অসকারের বয়স এখন ৬০ বছর। তবু আমাদের কাছে সে চিরকালের তরুণ। পঙ্গু ও নপুংসক সাবালকদের লিস্টে সে নাম লেখায়নি। তার হাতে এবার আরও শক্ত, আরও কর্কশ একটি ড্রাম তুলে দেওয়ার কথা গুন্টার গ্রাস কি বিবেচনা করে দেখবেন?