Sunday, January 21, 2018

কার্ল সেগানের “ভুয়া জ্ঞান সনাক্তকরণ প্রক্রিয়া”


কার্ল সেগানের ক্ষেত্রে অনেকগুলো বিশেষণ ব্যবহার করা যায়- তিনি ছিলেন মহাবিশ্বের জ্ঞান সম্পন্ন এক ব্যক্তি- এক ক্ষুধার্ত পাঠক- একজন প্রেমিক- সর্বোপরি একজন দার্শনিক। আমাদের যুগের সম্মানিত জ্ঞানানুরাগীদের মধ্যে সেগান ছিলেন অন্যতম- মুক্তচিন্তার পথপ্রদর্শক- স্বচ্ছচিন্তা আর সন্দেহবাদীতার অগ্রনী পুরুষ।
১৯৯৬ সালে তাঁর মৃত্যুর আগে তিনি আমাদের The Demon Haunted World: Science as a Candle in the Dark এর মাধ্যমে আমাদের জনপ্রিয় ছদ্মজ্ঞান আর অপপ্রচারের বিরুদ্ধে রণ কৌশল শিখিয়ে দেন।

02.-onubadokder-adda10

উক্ত বইয়ের The Fine Art of Baloney Detection অধ্যায়ে আমাদের মাঝে প্রচলিত প্রচারণা- ধর্মীয় অপবিজ্ঞান- বিজ্ঞানের অপব্যাখ্যাসহ বিজ্ঞানীদের ব্যবসায়ী প্রবণতা যাকে সেগান বলতেন- “ক্রেতাদের বুদ্ধিমত্তার সাথে প্রতারণা” আর “বিজ্ঞানের মূল লক্ষ্যের আড়ালে লুকিয়ে রাখা দুর্নীতি”।

তবে তাঁর এই শিক্ষা নৈতিকতা আর স্বচ্ছচিন্তার সর্বোচ্চ অবস্থান থেকে আসেনি- এসেছে তাঁর আবেগী অবস্থান- প্রিয় পিতামাতার প্রয়াণের পর। তিনি আমাদের বলেছেন আবেগের তাড়নায় মৃত্যু পরর্বতী জীবনে বিশ্বাসের বৈজ্ঞানিক ভিত্তিহীনতার কথা- তিনি বলেছেন এতে আমরা বোকা হয়ে যাই না-শুধু আমাদের নিজেকে এসব ভিত্তিহীন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে তৈরি রাখা।

বৈজ্ঞানিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা অপবিজ্ঞান আর মিথ্যাপ্রচারণার বিরুদ্ধে এসব হাতিয়ার ব্যবহার করা শেখেন- সেগান এই হাতিয়ার গুলোকে বলেন- “ছদ্মবিজ্ঞান সনাক্তকরণ প্রক্রিয়া”।
এই হাতিয়ার কাজে লাগে তখনি যখন নতুন কোনো ধারনা আমাদের সামনে আসে। নতুন সেই ধারনা যদি আমাদের ছদ্মবিজ্ঞানরোধী ব্যবচ্ছেদের পরও বেঁচে থাকে তবে আমরা তাকে স্বাগত জানাবো। আপনি যদি কোন ভুল না করতে চান- অথবা বোকা না বনতে চান- তবে-পরিক্ষীত ভোক্তাবান্ধব এই অস্ত্র ব্যবহার আপনার শিখতে হবে।”

তবে এই প্রক্রিয়া, সেগান বলেন, শুধু বিজ্ঞানের জন্যই মোক্ষম হাতিয়ার না। আপনি চাইলেই দৈনন্দিন জীবনেও এর ব্যবহারের সুফল পাবেন। এই প্রক্রিয়া জানা থাকলে আপনি প্রমাণহীন ভুলধারনা কিংবা উদ্দেশ্যপ্রনোদিত মিথ্যাচার থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেন। সেগানের মতে, এর ৯টি মূলনীতি হচ্ছে-
১) সম্ভবপর হলে সকল “ফ্যাক্টের” স্বাধীনসত্ত্বা থাকতে হবে, কোন “ফ্যাক্ট” অন্য কিছুর উপর নির্ভরশীল হতে পারবে না।

২) প্রাপ্ত প্রমাণের উপর ভিন্ন মতাদর্শের বিষয়গত বিতর্ক হওয়া উচিত।

৩) “কর্তৃপক্ষের মত” কোন মূল্য বহন করে না। “কর্তৃপক্ষরা” অতীতে ভুল মত দিয়েছেন, ভবিষ্যৎেও যে ভুল মত দিতে পারেন না এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। বিজ্ঞানে কোন কর্তৃপক্ষ নেই, বিজ্ঞানে বিশেষজ্ঞ আছে।

৪) একের বেশী তত্ত্ব নিয়ে কাজ করুন। ব্যাখ্যাযোগ্য ব্যাপারের একের বেশী ব্যাখ্যা বিবেচনায় রাখুন। কোন কোন পরীক্ষা করে আপনি অন্য ব্যাখ্যাগুলোকে ভুল প্রমাণ করতে পারবেন সেটা ভাবুন। যাই বাঁচে- যে ব্যাখাই এই “ডারউইনিয় নির্বাচনে” টিকে থাকে তার সঠিক হওয়ার সম্ভাব্যনা- পছ্ন্দসই একটা ব্যাখার সঠিক হওয়ার সম্ভাবনার চেয়ে ঢের বেশী।

৫) নিজের তত্ত্ব বলে তার প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন না। জ্ঞানের যাত্রাপথে আপনার তত্ত্ব একটা স্থান মাত্র। নিজেকে জিজ্ঞেস করুন কেনো আপনার তত্ত্ব আপনার পছন্দ, বিকল্পগুলোর সাথে আপনার তত্ত্বের তুলনা করে দেখুন। দেখুন তত্ত্বটিকে ভুল সাব্যস্ত করার কোন পথ খুঁজে পান কি না, আপনি না পেলেও অন্যরা ঠিকই পাবে।

৬) হিসাব যোগ করুন। আপনি যা ব্যাখ্যা করতে চান সেটা ব্যাখ্যা করা সহজ হবে যদি আপনি সেটাকে গানিতিকভাবে মাপতে পারেন। বিকল্পগুলোর মাঝে সবচেয়ে ভালোটার দিকে ইঙ্গিত করতে এটা আপনাকে সাহায্য করবে। অবশ্যই এমন ব্যাপার আসবে যেখানে সংখ্যার চেয়ে গুনগতমান বিবেচনা করতে হতে পারে- কিন্তু সে ব্যাপারগুলো খুঁজে বের করা কঠিন হবে।

 ৭) যদি ধারণা/তত্ত্বটি দুই বা ততোধিক বিবেচ্য নির্ভর হয় তবে প্রত্যেকটি বিবেচ্য ব্যাখ্যাযোগ্য হতে হবে- অধিকাংশ বিবেচ্য ব্যাখ্যাযোগ্য হলেই চলবে না।

 ৮) অকাম’স রেজর। দুইটি  সমান কার্যকরী ব্যাখ্যার মধ্যে সহজতর ব্যাখ্যা যা আরো প্রশ্নের জন্ম দেয় না, সেটাই গ্রহণযোগ্য হবে।

 ৯) নিদেনপক্ষে, তাত্ত্বিকভাবে, আপনার তত্ত্ব বিকৃত করা যায় কি না প্রশ্ন করুন। যে ধারণা ভুল প্রমাণ করা যায় না, বিকৃত করা যায় না, সেই তত্ত্বের মূল্য কম। ধরুন-  দৃশ্যমান মহাবিশ্বের সবকিছু প্রাথমিক কণা- ইলেকট্রনের তৈরী-  যদি বিরাট কসমসের ক্ষেত্রে এ ধারণা ব্যক্ত করা হয়? আমরা যদি দৃশ্যমণ মহাবিশ্বের বাইরেই না যেতে পারি তবে এই ধারণা কি ভুল প্রমাণের অযোগ্য না? সংশয়বাদীরা যেন পরীক্ষা করার সুযোগ পায়- আপনার মত একই ফলাফল পায়- এমন ব্যাখ্যা সৃষ্টি করুন।

এই কৌশলগুলো রপ্ত করার পাশাপাশি পূর্ববর্তী “জ্ঞান”  দিয়ে পরিস্থিতি বিবেচনা করার প্রবণতা বাদ দেয়ার কথাও সেগান বলেছেন। সেগান আমাদের মনে করিয়ে দেন ঠিক কোথায় আমরা এই কান্ডজ্ঞান বহির্ভূত কাজগুলোর প্রতি ঝুকে পড়ি।
“যে কোনো ছদ্মজ্ঞান সনাক্তকারী প্রক্রিয়া আমাদের কি করতে হবে শেখানোর পাশাপাশি কি করা যাবেনা সেটাও শেখায়। এটা আমাদের যুক্তি আর বাগ্মীতার দুই সর্বোচ্চ প্রচলিত ভ্রমের শিক্ষা দেয়- এর ভালো উদাহরণ পাওয়া যায় ধর্মীয় আর রাজনৈতিক পরিমন্ডলে, কারণ এদের পালনকারীরা প্রায়শই দুইটা পরস্পরবিরোধী মতামতকে ন্যায়সঙ্গত করতে চেষ্টা করে।” 

তিনি এরকম ২০টি বহুল প্রচলিত আর বিপজ্জনক মতামত যা আমাদের মাঝে বেঁচে থাকে সেগুলো উদাহরণসহ বর্ণনা করেছেন-
১) ad hominem “ব্যক্তিকে” এর ল্যাটিন প্রতিশব্দ। বক্তৃতাকে না আক্রমণ করে বক্তাকে আক্রমণ করা।

যেমন-রেভারেন্ড ডাঃ স্মিথ একজন বাইবেল বিশেষজ্ঞ, বিবর্তনতত্ত্ব বিষয়ে তাঁর মতামত আমলে নেয়ার কোন কারণ নাই।

২) argument from authority-

যেমন-রিচার্ড নিক্সনকে পুনর্নির্বাচন করা হয়েছে কারণ দক্ষিন পূর্ব এশিয়ায় যুদ্ধ বন্ধ করার ব্যাপারে তাঁর গোপন পরিকল্পনা ছিল। যেহেতু সেটা গোপন পরিকল্পনা, তাই এর উপকারিতা বিচারের কোন পথ নাই।

তাঁর রাষ্ট্রপতি পদের জন্য তাঁকে বিশ্বাস করার সিদ্ধান্তটা পরে ভুল হিসেবে প্রকাশ পায়।

৩) argument from adverse consequences-

যেমন-  শাস্তি এবং পুরস্কার প্রদানকারী ঈশ্বর অবশ্যই আছে- তা না হলে  সমাজে অনৈতিকতা আরো বেড়ে যেত।

অথবা,

বহুল জনপ্রিয় হত্যামামলায় অভিযুক্তরা দোষী হোক বা নির্দোষ হোক, তাদের দোষী সাব্যস্ত করতেই হবে- তা না হলে মানুষ তাদের স্ত্রীদের হত্যা করার উৎসাহ পাবে।

৪) Appeal to ignorance- অসত্য প্রমাণ করা হয় নি, বিধায় কোনোকিছুকে সত্য ধরে নেয়া।

যেমন-  UFO আসে না এর কোন প্রমাণ না থাকা প্রমাণ করে UFO আছে। আর মহাবিশ্বে অন্য বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রাণী আছে।

অথবা,

মহাবিশ্বে যদিও ৭০ “ক্যাজিলিয়ন” গ্রহ আছে, তবুও যেহেতু অন্য কোনো সভ্যতার প্রমাণ নাই সেহেতু আমরাই মহাবিশ্বের কেন্দ্রীয় বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন প্রাণী।

আমাদের অস্থিরতা থেকে আমরা প্রমাণ না থাকাকে না থাকার প্রমাণ ধরে নিয়েছি।

৫) special pleading প্রায়শই একটা গভীর বাগ্মী বিপদ থেকে বাঁচায়।

যেমন-কিভাবে পিতা-পুত্র এবং পবিত্র আত্মা তিনটি জিনিস কিভাবে এক ব্যক্তি হতে পারেন?

Special Pleading- তুমি Trinity এর ঐশ্বরিক রহস্য বোঝো নি।

অথবা

পরম দয়ালু সবজান্তা ঈশ্বর কেন একজন নারীর (ঈভ) অবাধ্যতার শাস্তি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেন?

Special Pleading- তুমি স্বাধীনচিন্তার বিষয়টি বোঝো নি।

৬) begging the question উত্তর অনুমান করে নেয়াও বলা হয় একে।

যেমন-সহিংস অপরাধ কমাতে মৃত্যুদন্ড চালু করতে হবে।

সেটা করলে যে সহিংস অপরাধ কমে যাবে সে উত্তর অনুমান করে নেয়া হয়েছে।

৭) Observational Selection পছন্দসই ফলাফলকে উপস্থাপন করা। দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকনের ভাষায়-  “রাষ্ট্র সবসময় উৎপাদিত রাষ্ট্রপতিতের ব্যাপারে গর্ব করে-  উৎপাদিত খুনিদের ব্যাপারে রাষ্ট্র কথা বলে না।

৮) Statistics of small numbers- Observational Selection এর মত-

যেমন-  প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে গড়ে একজন মানুষ চাইনিজ হয়।  সেটা কিভাবে সম্ভব-  আমি শত শত লোককে চিনি, তাদের কেউই চাইনিজ নন।

৯) Misunderstanding the nature of statistics-

যেমন-  অর্ধেক আমেরিকানদের বুদ্ধিমত্তা স্বাভাবিকের চেয়ে কম- এই পরিসংখ্যানে রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়্যারের বিস্ময় প্রকাশ করা।

১০) Inconsistency

যেমন- মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ কাল অসীম হওয়ার সম্ভাব্যতাকে মেনে নেয়া তবে অসীম অতীত কালের সম্ভাব্যতাকে অযৌক্তিক মনে করা।

১১) Non sequitur- “it doesn’t follow” এর ল্যাটিন পরিভাষা।

যেমন-  আমাদের দেশই উন্নত হবে কারণ মহান ঈশ্বর আমাদের পক্ষে, অথচ সকল দেশই এটা ভাবে। (যারা non sequitur এ পড়েন তারা সাধারণত বিকল্প সম্ভাবনাগুলোর ব্যাপারে অবগত থাকেন না।)

১২) post hoc, ergo propter hoc- ‘ক’  ঘটনা ‘খ’  ঘটনার আগে ঘটেছে সুতরাং ‘খ’  ঘটনার কারণ ‘ক’  ঘটনা।

যেমন-  জ্যামি কার্ডিনাল সিন, ম্যানিলার আর্চ বিশপ বলেন-  “আমার পরিচিত এক ২৬ বছর বয়স্কা আছেন যাকে দেখতে  ৬০ বয়স্কা মনে হয়- কারণ তিনি জন্মনিয়ন্ত্রন বড়ি সেবন করেন।

অথবা,

নারীরা ভোটাধিকার পাওয়ার আগে পারমানবিক অস্ত্র ছিল না।

১৩) meaningless question-

যেমন- যদি অপ্রতিরোধ্য কোন শক্তি অনড় কোন বস্তুকে আঘাত করে তবে কি ঘটবে?

(যদি অপ্রতিরোধ্য কোন শক্তি থেকে থাকে তবে অনড় কোন বস্তু থাকতে পারবে না, এবং উল্টোটাও একইভাবে সম্ভাব্য।)

১৪) Excluded middle or False Dichotomy – আলোচ্য বিষয়কে দুটোমাত্র সম্ভাব্যতায় আবদ্ধ করা।

যেমন- হয় তুমি তোমার দেশকে ভালোবাসো, আর না হয় ঘৃণা করো। *

অথবা,

হয় তুমি সমাধানের অংশ না হয় তুমি সমস্যার অংশ।

১৫) Short term vs Long term- excluded middle এর গুরুত্বপূর্ণ উপপর্যায়-  এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ যে এটাকে আলদাভাবে বিশ্লেষণ করতে হচ্ছে।

যেমন-  অপুষ্টি আর শিক্ষাহীনতায় ভোগা শিশুদের চেয়ে তৃনমূল থেকে অপরাধ মোকাবেলা করা আমাদের বাজেটবান্ধব হবে।

অথবা,

আমাদের বাজেটের ঘাটতি বিবেচনা করে মহাশূন্য গবেষণা আর মৌলিক বিজ্ঞানের চর্চা করাটা মূখ্য মনে হয় না।

১৬) Slippery slope –  excluded middle এর সাথে সম্পর্কিত।

যেমন-  যদি প্রথম সপ্তাহে ভ্রূনের গর্ভপাত করা হয় তবে পূর্ণবয়স্ক অভূমিষ্ঠ শিশুহত্যা রোধ করা যাবে না।

অথবা,

যদি নবম মাসেও আমাদের গর্ভপাত করতে না দেয়া হয় তবে কিছুদিন পর আমাদের অন্তঃস্বত্তা হওয়াকালীন দৈহিক ব্যবহারও সরকার বলে দিবে।

১৭) Confusing correlation and causation-

যেমন-  এক সমীক্ষা বলে সমকামিদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিতদের আধিক্য আছে আর অল্প শিক্ষিতদের মাঝে সমকামিদের সংখ্যা কম- সুতরাং উচ্চশিক্ষা সমকামিতার কারণ।

১৮) Straw man বা বক্তব্যের মনগড়া ব্যাখা দিয়ে আক্রমন সহজ করা।

যেমন- বিজ্ঞানীরা মনে করেন সবকিছু দৈবাৎ সৃষ্টি হয়েছে। যদিও এটা ডারউইনিও নীতি মেনে সম্ভব না, কারণ সেটা বলে  প্রকৃতি কর্মক্ষম সবকিছুকে টিকিয়ে রাখে আর অকর্মণ্য সবকিছুকে বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দেয়।

অথবা,

এটাকে short term vs long term হেত্বাভ্যাসও বলা যায়-  পরিবেশবাদীরা মানুষের চেয়ে পেঁচা আর শামুকের প্রতি বেশী সহানুভূতিশীল।

১৯) Suppressed evidence or half truths

যেমন-  রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রেগানকে হত্যা করার পর টেলিভিশনে এক ব্যক্তির চমকপ্রদ ভবিষ্যৎবানী প্রচারিত হয় যা বলে রেগানকে কিভাবে হত্যা করা হবে।

(তবে চিত্রায়ণের তারিখ ছাড়া সকল তথ্যই সঠিকভাবে বলা হয়েছিল। )

অথবা,

সরকারের শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে হবে-  ডিম না ভেঙ্গে অমলেট বানানো যায় না।

(হ্যাঁ, তবে এই বিদ্রোহ কি সবার জন্য ভাল হবে? এটা কি সরকারী শোষণের তুলনায় কম রক্তক্ষয়ী হবে? অভিজ্ঞতা থেকা পাওয়া জ্ঞান কি তার সায় দেয়?)

২০) Weasel words

যেমন-  আমেরিকার সংবিধানে যুদ্ধ ঘোষণার ক্ষমতা কংগ্রেসের কাছে ন্যস্ত, যাতে রাষ্ট্রপতিরা যুদ্ধ শুরু না করতে পারেন। তবে পররাষ্ট্রনীতি আর যুদ্ধনীতি রাষ্ট্রপতির মর্জি নির্ভর হয়। রাষ্ট্রপতিরা দেশপ্রেমের আড়ালে ভিন্ননামে যুদ্ধ শুরু করতে পারেন- যেমন-  “পুলিশী কর্মকান্ড”, “অস্ত্রসজ্জিত আকস্মিক আক্রমন”, “রক্ষণশীল প্রতিক্রিয়ায় আক্রমন”, “শান্তকরন”, “আমেরিকার স্বার্থরক্ষা”। যুদ্ধের এসব প্রতিশব্দ ব্যবহার করা রাজনৈতিক কারণে ভাষাকে ব্যবহার করার নজীর । Talleyrand বলেন-  “রাজনীতিবিদদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটা কলা হচ্ছে নতুন নামে পুরোনো এবং জনস্বার্থবিরোধী কাজ করার পথ খুঁজে নেয়া।”

সেগান একটা সতর্কবাণী দিয়ে অধ্যায়টি শেষ করেন-
 “সব অস্ত্রের মত এই ছদ্মজ্ঞান সনাক্তকরণ প্রক্রিয়ারও অপব্যবহার আছে- প্রাসঙ্গিকতার বাইরে ব্যবহার করা-  অথবা চিন্তা করার বিকল্প হিসেবেও একে ব্যবহার করা যায়। নিজের মত অন্যকে জানানোর আগে নিজে যাচাই করে নেয়া ছাড়াও বিজ্ঞ ব্যবহারে এই প্রক্রিয়া পৃথিবী বদলে দেয়ার ক্ষমতাও রাখে।” 

The Demon Haunted World বইটি একটি কালজয়ী রচনা। এর বিষয়বস্তু যেন এই ছদ্মবিজ্ঞান আর অপপ্রচারের যুগের জন্যই সেগান লিখে গিয়েছিলেন।

উৎস ঃ http://onubadokderadda.com/baloney_detection/

Wednesday, January 3, 2018

মাদাম কুরিকে আইনস্টাইনের চিঠি


১৯১১ সালের নভেম্বর, মাদামোয়াজেল মেরি কুরি তাঁর দ্বিতীয়বারের নোবেল বিজয়ী (রসায়নে) হওয়া থেকে মাত্র ১ সপ্তাহ দূরে ছিলেন। ১৯০৩ সালে কুরি প্রথমবার পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ী হন, এবং দ্বিতীয়বারের মত নোবেল বিজয় তাকে দুর্লভ সম্মান এনে দিয়ে অতি-অসাধারণ এক এলিট শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করে যে শ্রেণীর সবাই ২বার নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। এখনো পর্যন্ত মাত্র ৪ জন ব্যক্তি ২বার করে নোবেল পুরষ্কার জিতেছেন। মাদাম কুরি তেজস্ক্রিয়তা সন্ধান পাওয়ার জন্য পদার্থ বিজ্ঞানে ১৯০৩ সালে এবং বিশুদ্ধ রেডিয়াম আলাদা করবার জন্য রসায়নে ১৯১১ সালে নোবেল বিজয় করেন। যদিও বিজ্ঞানে তাঁর অসাধারণ অবদানের বিষয়েই সবার মনোযোগ দেওয়া উচিৎ ছিলো, সেটা না করে তখনকার মিডিয়া এবং অনেকেই মাদাম কুরির অতি সাধারণ ব্যক্তিগত জীবনের খবর নিয়েই বেশী ব্যস্ত ছিলো।

মাদাম কুরিকে বিধবা করে তাঁর স্বামী বিজ্ঞানী পিয়েরে কুরি ১৯০৬ সালে মারা যান। এর কয়েক বছর পরই মাদাম কুরি পিয়েরে কুরির পিএইচডি ছাত্র পল ল্যাঞ্জেভিন এর সাথে রোম্যান্টিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। পল যদিও বিবাহিত ছিলো, কিন্তু সে তার স্ত্রীর থেকে আলাদা (সেপারেশন) থাকতো। মাদাম কুরির সাথে সম্পর্ক পলের বৈবাহিক জীবনে অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আসন্ন সমস্যার কাছে অবশ্য এই অশান্তি কিছুই মনে হবে না।

মাদাম কুরি, পল ল্যাঞ্জেভিনসহ আরো ২০ বিজ্ঞানীকে ১৯১১ এর শরতে বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে এক উচ্চ পর্যায়ের সম্মেলনে আমন্ত্রণ করা হয়, সেখানে সকলের প্রবেশের অনুমতি ছিলো না। যখন মাদাম কুরি আর ল্যাঞ্জেভিন ব্রাসেলসে, তখন ল্যাঞ্জেভিনের স্ত্রী, মাদাম কুরী এবং ল্যাঞ্জেভিনের মধ্যকার বেশ কিছু প্রেমপত্র তৎকালীন মিডিয়ার কিছু লোকের হাতে পৌঁছে দেয়, যারা ল্যাঞ্জেভিনের স্ত্রীর প্ররোচনায় মাদাম কুরিকে দুষ্ট সংসার-বিনষ্টকারী নারী  হিসেবে সমগ্র ফ্রান্সের কাছে তুলে ধরে।

মাদাম কুরি যখন ফ্রান্সে তার বাসায় প্রত্যাবর্তন করেন, তখন আচমকাই (হ্যাঁ, আচমকাই! কারণ তখন ফেইসবুক, হোয়াটসেপ বা ভাইবার ছিলো না বা সবার টেলিফোন নাম্বারও সবার কাছে থাকতো না।) সংবর্ধিত হন একদল ক্ষুব্ধ জনতার দ্বারা যারা তাঁর বাড়ি ঘিরে রেখেছিলো। বাড়ির ভেতরের তাঁর ছোট দুই মেয়ে (৭ এবং ১৪) আতংকে কাঁপছিলো।

এই ঘটনার প্রেক্ষিতে, এলবার্ট আইনস্টাইন, যিনি মাদাম কুরির সাথে ব্রাসেলস কনফারেন্সে সম্প্রতি পরিচিত হয়েছে, তিনি ফ্রান্সের নির্বোধ কভারেজখোর মিডিয়ার কর্মকাণ্ডে বিরক্ত হয়ে, তাঁর নতুন বন্ধুকে উৎসাহ ও সাহস প্রদান করে (মাদাম কুরিকে) উষ্ণ একটি চিঠি লিখেন। মাদাম কুরিকে লেখা আলবার্ট আইনস্টাইনের চিঠিটা নিচে তুলে ধরা হলো। চিঠি লেখা দেখে বোঝা যায় আইনস্টাইন শুধুমাত্র সায়েন্সের প্রতি নয়, তাঁর বন্ধু ও কাছের মানুষদের প্রতিও যথেষ্ট সংবেদনশীল ছিলেন। উনার চিঠি লেখার ভাষা দেখে উনার মেরি কুরির প্রতি উনার বন্ধুসুলভ উদ্বেগের প্রমাণ পাওয়া যায়।
প্রাগ, ২৩ নভেম্বর ১৯১১

পরম শ্রদ্ধেয় মিসেস কুরি,

তেমন মূল্যবান কিছু বলার নেই, তবু লিখছি বলে আমার ওপর হাসবেন না। কিন্তু জনগণ আপনার সাথে বর্তমানে যেভাবে আচরণ করবার সাহস করছে, তাতে আমি এতই ক্রোধান্বিত যে আমার অনুভূতি আপনাকে জানাতেই হলো। যাই হোক, আমি বিশ্বাস করি যে আপনি সবসময়ই এইসব ইতর জনতাকে অবজ্ঞা করেন, তা ওরা আপনাকে চাটুকারের মত তোষামোদীই করুক আর আপনাকে রগরগে খবরের বস্তু হিসেবেই দেখুক না কেন।

আমি এটা না বলে পারছি না – আপনার মেধা ও মননে আমি যে কী পরিমাণ মুগ্ধ! এবং আপনার সাথে ব্রাসেলস ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হয়ে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি। ঐ সকল ঘৃণ্য সরীসৃপ প্রাণীগুলো ব্যতীত যেকোনো ব্যক্তিই আনন্দিত হবে আপনার এবং ল্যাঞ্জেভিনের মত ব্যক্তিত্বদের আমাদের মধ্যে পেয়ে। আপনাদের মত খাঁটি মানুষ যাদের সান্নিধ্যই বড় ধরনের প্রাপ্তি বলে আমি মনে করি। যদি নিম্নশ্রেণীর এসব কথায় আপনার মন খারাপ হয়, তাহলে ওসব ছাইপাশ না পড়লেই হয়। বরং যাদের রুচির জন্য মেরুদণ্ডহীনেরা এসব অতিরঞ্জিত এবং মনগড়া কথা ছড়িয়েছে, এগুলো তাদেরকেই পড়তে দিন।

আপনাকে, ল্যাঞ্জেভিনকে, আর পেরিনকে বিনীত শ্রদ্ধাসহ…

আপনাদেরই একান্ত
এ. আইনস্টাইন

বিঃদ্রঃ আমি একটা মজার উপায়ে প্ল্যাংকের বিকিরণ ক্ষেত্রের দ্বি-পারমাণবিক অণুর গতির পরিসংখ্যানগত সূত্র বের করেছি। একটা শর্ত ছিলো যে, গঠনটার গতি স্ট্যান্ডার্ড মেকানিকসের সূত্রগুলো মেনে চলবে। এটা বাস্তবে কাজ করবে কিনা, সেটা নিয়ে আমার আশা প্রায় শূন্য যদিও।

উৎস ঃ http://onubadokderadda.com/einstein-to-marie-curie/

Tuesday, January 2, 2018

মাধ্যাকর্ষণের কোয়ান্টাম জ্যামিতিঃ স্থানকালের বিদায়?


আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা আমাদের সর্বপ্রথম ধারণা দিয়েছিলো যে, “স্থান” ও “সময়” মূলত একই জিনিস তাই দুটোকে একসাথে বলা হয় “স্থান-কাল” এবং প্রতিটি পর্যবেক্ষকের জন্য স্থান-কালের পরিমাপ আলাদা। অন্যদিকে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা বলে, “স্থান-কাল” ও “মাধ্যাকর্ষণ-ক্ষেত্র (Gravitational Field)” একই জিনিস। স্থানকাল বক্রতার মাধ্যমে মাধ্যাকর্ষণ-ক্ষেত্রের স্বরূপ নির্দেশ করে। আমাদের জানা মতে, প্রতিটি ক্ষেত্রই কোনো না কোনো পরিসরে কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে। তাই স্থান-কালেরও কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্য থাকার কথা।

বৈশিষ্ট্যগুলো জানার জন্য আমাদেরকে প্রথমে স্থান ও সময়ের প্রকৃতি সম্পর্কে একটু জানা দরকার। সাধারণ আপেক্ষিকতায় স্থানকালকে মসৃণ রেইম্যানিয়ান সমতলে (Riemannian manifold) মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়, মাধ্যাকর্ষণ হলো এই মসৃণ সমতলের বক্রতা। অর্থাৎ, সাধারণ আপেক্ষিকতায় মাধ্যাকর্ষণ হলো একটা মসৃণ সমতলের জ্যামিতিক বৈশিষ্ট্য। সমস্যা হলো, স্থান-কালের এই বর্ণনা কোয়ান্টাম তত্ত্বের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।

এই  অসংগতি প্রথম উন্মোচিত হয় একটা ভুল থেকে, ভুলটি করেন একজন রাশান পদার্থবিদ নাম লেভ ল্যানদাউ (Lev Landau)। হাইজেনবার্গ তার বিখ্যাত অনিশ্চয়তার নীতি ও তার গাণিতিক সমীকরণের প্রকাশের পরপরই ১৯৩১ সালে ল্যানদাউ এটা প্রমাণের চেষ্টা করেন যে, স্থানকালের নির্দিষ্ট কোনো বিন্দুতে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডের কোনো উপাদানকে নির্ভুলভাবে পরিমাপ করা যায় না। উনার উপলব্ধি এই ছিলো এরকম, হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতির কারণে স্থানকালে কোনো স্পষ্ট অবস্থান নির্ণয় সম্ভব নয় (Sharp location with arbitrary precision)। নীলস বোর ভুলটি ধরতে পারেন এবং ১৯৩৩ সালে তিনি লিও রোসেনফেল্ডের (Léon Rosenfeld) একটা গবেষণাপত্র ব্যবহার করে প্রমাণ করেন যে, কোয়ান্টাম তত্ত্বে স্থানকালের স্পষ্ট বিন্দুতে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডের কোনো একক উপাদানের নির্ভুল পরিমাপে কোনো বাধা নেই।

কিন্তু, ল্যানদাউ এতো সহজে হার মানার পাত্র ছিলেন না। তিনি “স্থানকাল”, “তাড়িৎচৌম্বক ক্ষেত্র”, ও “অনিশ্চয়তার নীতি” সংক্রান্ত এই বিবাদে টেনে আনলেন এক তরুণ বন্ধুকে যার নাম ম্যাটভেই পিত্রোভিচ ব্রনস্টেইনকে (Matvei Petrovich Bronstein)। ব্রনস্টেইন অত্যন্ত প্রতিভাবান ছিলেন, তিনি খুব শীঘ্রই (১৯৩৬ সালে) বুঝতে পারলেন যে, “তাড়িৎচৌম্বক ক্ষেত্র” বাদ দিয়ে যদি “মাধ্যাকর্ষণ-ক্ষেত্র” এবং সাধারণ আপেক্ষিকতাকে হিসেবে আনা হয় তবে ল্যানদাউ ধারণা সঠিক। অর্থাৎ, কোয়ান্টাম তত্ত্ব সত্যি সত্যিই স্থানকালে স্পষ্ট অবস্থান নির্ণয়ে বাধা দেয়। নিচে ব্রনস্টেইনের এই আবিষ্কারের আধুনিক বর্ণনা দেয়া হলো।


Matvei Petrovich Bronstein

এটা ম্যাটভেই পিত্রোভিচ ব্রনস্টেইনের শেষ ছবি। যিনি সর্বপ্রথম আইনস্টাইনের স্থানকালে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতির প্রভাব (কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটি) বুঝতে পেরেছিলেন। স্টালিনের রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী না হওয়ায় অগাস্ট ৬, ১৯৩৭ থাকে গ্রেফতার করা হয় এবং ফেব্রুয়ারী ১৯৩৮ সালে লেনিনগ্রাদ কারাগারে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।




ধরুন, আমরা স্থানকালের একটা নির্দিষ্ট অবস্থান x-এ কোনো কণার (Particle) ভরবেগ p বের করবো। প্রথমে আমাদেরকে x অবস্থানটি খুঁজে বের করতে হবে। আমরা চাই এই অবস্থান নির্ণয়ের নির্ভুলতা (Precision) হবে “L”। হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতি বলছে, কণাটির অবস্থান ও ভরবেগের কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তা হলো যথাক্রমে Δx ও Δp। অবস্থান নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্য, L > Δx। অনিশ্চয়তার সমীকরণ থেকে আমরা পাই, Δp > ħ/Δx বা Δp > ħ/L। গবেষণা অনুসারে p²-এর গড় মান সবসময় (Δp)²-এর চেয়ে বেশি, তাই আগের সমীকরণটি লেখা যায় এভাবে, p² > (ħ/L)²। এই p² > (ħ/L)² হলো হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতির সুপরিচিত পরিণতি, আর এর মানে হলো, “স্পষ্ট অবস্থান নির্ণয়ের জন্য প্রচুর ভরবেগের দরকার”। ঠিক এইজন্যই CERN-এ ক্ষুদ্র পরিসরে (Small Scale) পর্যবেক্ষণের জন্য উচ্চ ভরবেগযুক্ত কণা ব্যবহার করা হয়। খেয়াল করুন, আমরা এখনো কোয়ান্টাম মেকানিক্সেই আছি।

এবার ভরবেগ জিনিসটার দিকে আসা যাক, কণার স্থিরভর (Rest Mass) যদি নগণ্য ধরা হয়, তবে বিশেষ আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে, E ~ cp (এখানে E = শক্তি, c = শূন্যস্থানে আলোর বেগ)। অর্থাৎ, আপেক্ষিক তত্ত্ব অনুসারে, প্রচুর ভরবেগের জন্য প্রচুর শক্তির দরকার। আমরা জানি, শক্তি ও ভর একই জিনিস, শক্তি প্রয়োগে কণার ভর বৃদ্ধি পায়, এই ভরকে আমরা বলি মাধ্যাকর্ষণজনিত ভর (Gravitational Mass), আর মাধ্যাকর্ষণজনিত ভর স্থানকালের বক্রতার সৃষ্টি করে, তাই সংক্ষেপে বলা যায়, শক্তি মাধ্যাকর্ষণ সৃষ্টি করে। এখন, কণার ওপর শক্তি প্রয়োগের ফলে যে মাধ্যাকর্ষণজনিত ভর তৈরি হবে, সেটা খুব সহজেই আইনস্টাইনের বিখ্যাত E=mc² সমীকরণের মাধ্যমে বের যায় করা, এই ভরের মান M ~ E/c²। যেহেতু, ভর ও মাধ্যাকর্ষণ ইত্যাদি চলে আসলো তাই আমাদেরকে এখন সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বকে টেনে আনতে হবে।

সাধারণ আপেক্ষিকতা অনুসারে, শক্তি বাড়ার সাথে সাথে স্থানকালের বক্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকবে, এক পর্যায়ে এই বক্রতা ব্ল্যাকহোলে রূপান্তরিত হবে, যার ঘটনা-দিগন্তের ব্যাসার্ধ, R ~ GM/c², এখানে, G নিউটন  ধ্রুবক আর M মাধ্যাকর্ষণজনিত ভর। এখন, L-কে যদি খুব ছোট একটা অঞ্চল হিসেবে ধরা হয় (L যতো ছোট হবে কণার অবস্হানও ততো স্পষ্ট হবে) তবে এই ক্ষুদ্র অঞ্চলে কণার অবস্হানও নির্ণয়ের জন্য প্রচুর শক্তি প্রয়োগ করতে হবে, ফলে একসময় R > L হয়ে পরবে, এর মানেটা হলো, “L” নামক যেই অঞ্চলে আমরা কণা খোঁজার চেষ্টা করছিলাম সেটা এখন একটা মিনি ব্ল্যাকহোলের ভেতরে। L-এর এই ক্ষুদ্রতম মানটি হলো, L = √(ħG/c³) ~ ১০-³³ সেন্টিমিটার। এই দৈর্ঘ্যকে বলে প্লাংক-দৈর্ঘ্য (Planck Length)। কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও সাধারণ আপেক্ষিকতাকে যখন এক করা হয় তখন প্লাংক-দৈর্ঘ্যের চেয়ে ছোট অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। তাই স্থানকালে প্লাংক-দৈর্ঘ্যের চেয়ে ছোট অঞ্চলকে বলে মিনি ব্ল্যাকহোল।

কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুসারে সাব-প্লাংক-দৈর্ঘ্যে (Sub Plank Length) স্থানকালের শক্তি ওঠানামা করে, যেটাকে বলে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন (Quantum Fluctuation)। কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের কারণ হলো ওই হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার নীতি। অনিশ্চয়তার নীতি বলে, স্থানকালে যে কোনো ক্ষেত্রের শক্তির মান সুনির্দিষ্ট হতে পারে না। তাই স্থানকালের কোনো অঞ্চল যদি একেবারেই বস্তুশূন্য হয় তবুও ওই অঞ্চলের শক্তির পরিমাণ শূন্য হবে না, বরং শক্তির পরিমাণ ক্ষণে ক্ষণে ওঠানামা করবে (Quantum Jitters)। কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের গাণিতিক মান 10¹¹² আর্গ/ঘন সেন্টিমিটার এবং পর্যবেক্ষণকৃত মান ১০^(-৮) আর্গ/ঘন সেন্টিমিটার। কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনকে বলা হয় শূন্যস্থানের শক্তি বা ভ্যাকুয়াম এনার্জি। ভ্যাকুয়াম এনার্জির গাণিতিক ও পর্যবেক্ষণকৃত মানের ব্যবধান ১০^(-১২০), এই সংখ্যাকে বলে মহাজাগতিক ধ্রুবক (Cosmological Constant)।

সাব-প্লাংক-দৈর্ঘ্যে স্থানকালের এই কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের কারণে প্রতিনিয়তই অগণিত ভার্চুয়াল কণা ও প্রতিকণার (Anti Particle) সৃষ্টি হয় এবং মুহূর্তেই বিপরীতধর্মী কণার নিজেদের বিনাশ করে। এই ভার্চুয়াল কণারা অন্য যেকোনো ফার্মিয়ন ও বোসন কণাদের মতোই, শুধু পার্থক্য হলো, এদের সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা যায় না। কিন্তু, পর্যবেক্ষণকৃত কণাদের ওপর এইসব ভার্চুয়াল কণাদের প্রভাব পরিমাপ করা যায়। সাব-প্লাংক-দৈর্ঘ্যে ভার্চুয়াল কণা ও প্রতিকণাদের সৃষ্টি ও বিলীনের ঘটনাকে বলে কোয়ান্টাম ফেনা (Quantum Foam)। অন্যদিকে, সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্ব মতে, সাব-প্লাংক-দৈর্ঘ্যে স্থানকাল অত্যন্ত মসৃণ, অর্থাৎ, মাধ্যাকর্ষণ-ক্ষেত্রের শক্তিমাত্রা স্থির।


quantum foam

শিল্পীর দৃষ্টিতে কোয়ান্টাম ফেনা




কথা হলো, সমস্যাটা কোথায়? কোয়ান্টাম মেকানিক্সে নাকি সাধারণ আপেক্ষিকতায়? এই দুটোই হলো পদার্থবিজ্ঞানের সফলতম দুটি তত্ত্ব। কোয়ান্টাম-গ্র্যাভিটি মতে স্থানকাল সম্পর্কিত আমাদের প্রচলিত ধারণাগুলো ভুল, আমরা মনে করি যে, স্থানকাল হলো বিশাল একটা ধারক বাক্স যার মধ্যে বিভিন্ন কোয়ান্টাম-ক্ষেত্রগুলো অবস্থিত। কিন্তু বাস্তবে, স্থান ও সময় হলো কোয়ান্টাম কনফিগারেশন, অর্থাৎ, স্থান ও সময় যে কোনো কণার স্পিন, চার্জ, ঘূর্ণন-ভরবেগ ইত্যাদির মতোই কোয়ান্টাম অবস্থা নির্দেশ করে। স্থানকালের অবস্থান কোয়ান্টাম-ক্ষেত্রের মধ্যেই, যদি তাই হয়, তবে স্থান ও সময় দুটোরই কোয়ান্টাইজ (Quantized) করা জরুরি। সাধারণ আপেক্ষিকতায় আইনস্টাইন মাধ্যাকর্ষণকে স্থানকালের জ্যামিতিতে পরিণত করেছিলেন। আর কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির কাজ এই জ্যামিতিকে কোয়ান্টাইজ করা। যদি সেটা সম্ভব হয় তবে মাধ্যাকর্ষণকে কোয়ান্টাম-ফিল্ড তত্ত্বের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে, এবং তাহলেই মাধ্যাকর্ষণের জন্য আমাদের আর আইনস্টাইনের স্থান-কালের প্রয়োজন হবে না।


end of space-time

স্থানকালের বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি। সত্যিকারের কোয়ান্টাম গ্রাভিটিতে স্থানকালের প্রয়োজন নেই। বিদায় স্থানকাল।




অবলম্বনে: “Covariant Loop Quantum Gravity: An Elementary Introduction to Quantum Gravity and Spinfoam Theory” by “Carlo Rovelli” and “Francesca Vidotto”

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/quantum-gravity/

জলপরী: মার্ক টোয়েন


 

আমেরিকান  কথা সাহিত্যিক মার্ক টোয়েন কে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই, স্যামুয়েল ল্যাংহর্ন ক্লিমেন্স লিখতেন মার্ক টোয়েন ছদ্মনামে। যারা “এডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন” এবং “এডভেঞ্চার অব টম স্যয়ার” পড়েছেন তাঁদের কাছে একটু অন্যরকম মনে হতে পারে পরিনত বয়সের এই গল্পটি।
এক.

একদিন সকালে একজন জলপরী এসে কড়া নাড়লো দরজায়, তাঁর হাতে একটি ঝুড়ি, বললো- “এই নাও উপহার, যে কোনো একটি পছন্দ করে নিয়ে বাকীগুলো রেখে দাও, বুঝে শুনে বেছে নাও- কোনটি তুমি চাও কারণ এর মধ্যে কেবল একটিই মূল্যবান!”
ঝুড়িতে ছিল ‘সম্মান’, ‘ভালোবাসা’, ‘সম্পদ’, ‘আনন্দ’ আর ‘মৃত্যু’ এই পাঁচটি উপহার। যুবকটি আগ্রহের সাথে বললো- “এখানে বিচার বিবেচনার কিছু নেই” বলে সে আনন্দটি বেছে নিল।
সে বাইরের পৃথিবীতে গেল, যৌবনের আনন্দে মেতে উঠলো। কিন্তু সব আনন্দই তার কাছে ক্ষনস্থায়ী, অপ্রত্যাশিত, এবং সবশেষে অর্থহীন মনে হলো!
যুবকটি মনে মনে ভাবলো, এই বছরগুলো অযথাই নষ্ট হলো, যদি আবার সুযোগ পাওয়া যেত আমি তাহলে খুব বুদ্ধি বিবেচনা করে বেছে নিতাম!

দুই.
একদিন ওই জলপরীটি আবার এলো এবং বললো- “আরো চারটি উপহার বাকী আছে, খুব সাবধানে বেছে নাও আর মনে রেখো কেবল একটিই এখানে খুব মূল্যবান!” মানুষটা এবার খুব দীর্ঘক্ষন ধরে ভাবলো এবং বেছে নিলো- ‘ভালোবাসা’ এবং জলপরীর চোখে জ্বলজ্বল করে ওঠা অশ্রুকনাটুকু তার চোখেই পড়লো না।
অনেক বছর পর, শূন্যঘরে একটি কফিনের পাশে বসে আছে লোকটি, আর নিজেকে বলছে- “একজন একজন করে ওরা সবাই চলে গেছে, এখন সে শুয়ে আছে এখানে, সবচেয়ে প্রিয় এবং সর্বশেষ জন। হাহাকার আর হাহাকার করেই জীবন গেল আমার; ভালোবাসার বিশ্বাসঘাতকতা আমাকে কাঙাল করেছে, আমি অভিশাপ দেই তোকে!”

তিন.
“বেছে নাও।” জলপরিটি বলছে।“এই বছরগুলো তোমাকে ‘জ্ঞান’ দিয়েছে, তাই দেয়া উচিত। তিনটি উপহার বাকী আছে, মনে রেখো শুধু একটিই কাজের সুতরাং ভালোভাবে বেছে নাও!”
দীর্ঘক্ষন তাকিয়ে থেকে লোকটি বেছে নিলো, ‘সম্মান’, জলপরীটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাঁর পথে চলে গেলো।
আরো কিছু বছর কাটলো, জলপরীটি এসে দাঁড়িয়েছে লোকটির পেছনে, যখন ম্লান হয়ে আসা এক দিনের শেষে লোকটি ভাবছে। জলপরীটি জানে সে কি ভাবছে!
“আমার নাম পূর্ণ করেছে এই পৃথিবীকে, সবার মুখে মুখে আমার নাম, এবং কিছু সময়ের জন্য এটা দেখতে ভালোই লেগেছে। কিন্তু কত ক্ষুদ্রতর ছিল সেই সময়টুকু! এর পরপরই আসলো ঈর্ষা, বিভ্রান্তি, ঘৃণা এবং নানা অভিযোগ। এরপর সেই পরিহাস এর পূনরাবৃত্তি।সবশেষে সেই করুণা যা সম্মানকে ধুলিস্বাত করে দিলো!”

চার.
“আবার বেছে নাও” আবার সেই জলপরীর কন্ঠস্বর।
“দুটো উপহার এখনো আছে বাকী, এবং আফসোস করো না, শুরুতে যেমন একটি মাত্র মূল্যবান উপহার ছিল এখনো তা আছে”
“সম্পদ… যার মানে হলো ক্ষমতা! কি অন্ধ ছিলাম আমি!এতদিনে জীবন হবে অর্থপূর্ণ” বলে উঠলো লোকটি।“এই পৃথিবী এখন আমার কথায় উঠবে বসবে, আমি সমস্ত বিত্ত, বৈভব, প্রাচুর্য, এবং আনন্দ সবকিছু, সম্মান, প্রভুত্ব সবকিছু আমি কিনে নেবো। এখন পর্যন্ত আমি ভুল উপহার বেছে নিয়েছি…”
তিনটি ক্ষুদ্র বছর কাটলো, একদিন লোকটি এক সাধারণ চিলেকোঠায় বসে কাঁপছে; সে ছিল অস্থি চর্মসার, চোখে ঢুকে গেছে গর্তে। শুকনো স্বরে সে বিড়বিড় করছে- “অভিশাপ পৃথিবীর সমস্ত উপহারকে, পরিহাসকে এবং সাজানো মিথ্যাকে! ওগুলো কোনো উপহার ছিল না, বড়জোর ‘দায়’ ছিল। আনন্দ, ভালোবাসা, সম্মান, সম্পদ সব কিছুই এত ক্ষনস্থায়ী যে সব শেষ হয় যন্ত্রণা, লজ্জা আর দৈন্যতার মাঝে। জলপরী ঠিকই বলেছিল একটি মাত্র উপহারই মূল্যবান ছিল! আমি ক্লান্ত, শ্রান্ত অনেক, আমি বিশ্রাম চাই…”

পাঁচ.
জলপরীটি আবার আসলো, চারটি উপহার নিয়ে কিন্তু মৃত্যু ছাড়া। সে বললো- “আমি ওটা অন্য একজনকে দিয়ে এসেছি, সে ছিল উপেক্ষিত কিন্তু সে আমাকে বিশ্বাস করেছিল, আমাকে বলেছিল পছন্দ করে দিতে।তুমি তো কখনো আমাকে পছন্দ করে দিতে বলো নি!”
লোকটি বললো, “কি আর বাকী আছে আমার জন্য?”
জলপরীটি উত্তর দিলো, “যার যোগ্যও তুমি নও, বৃদ্ধকালের লাঞ্চনা!”

Monday, January 1, 2018

শিবরাম চক্রবর্তী'র গল্প | স্বামী মানেই আসামি


বীরেনবাবু ধীরে ধীরে বাড়ি ঢুকলেন–চোরের মত পা টিপে টিপে। রাত ১০টা বেজে গেছে–একজন স্বামীর দণ্ডলাভের পক্ষে এই যথেষ্ট প্রমাণ–বীরেনবাবুর তাই এই চোরের দশা।

আসলে চোরের পক্ষে অবশ্যি রাত ১০টা কিছুই নয়, আসলে তারা যখন খুশি আসতে পারে, যাতায়াতের ব্যাপারে তারা অনেকটা স্বাধীন এবং আপ্যায়ালি। একটা চোরের ‘পরগৃহ প্রবেশের’ বেলায় যে স্বাধীনতা আছে, অতটুকুও তার নিজ গৃহে নেই এই কথা ভেবে বীরেনের দীর্ঘনিশ্বাস পড়ল।

বীরেনের বউ সেলাই করছিল, চাইল চোখ তুলে, কিছু বলল না। বীরেন কোটটা খুলে রেখে একটু তেরি হয়েই বসল সোফাটায়। ঝড় যে আসন্ন, মাথার উপর দিয়ে বইবে এক্ষুণি, অবহাওয়া-তত্ত্বে অভ্যস্ত হয়ে সেটা জানার তার বাকি ছিল না।
‘আপিসফেরতা সোজা বাড়ি আসবে ভেবেছিলুম।’ বৌয়ের গলায় গুমোট।
-‘জরুরি কোনও কাজে আটকা পড়ে আসতে দেরি হল বুঝি?’
‘আটকা পড়েছিলাম তা সত্যি, তবে বিশেষ যে কোনও কাজে তা না-’ তানা-নানায় সুর হয় বীরেনের-‘অনেকদিন পরে হরিপদর সঙ্গে দেখা হলো। হরিপদ আমার স্কুলের বন্ধু-তাই তার সঙ্গে গল্প করতে করতে-’
‘বুঝেচি।’ একটা ঝটকা এল নৈঋত কোণ থেকে।-‘তোমার মুখ দেখলেই তা বোঝা যায়। হরিপদ সেখানে জড়িত। আজ হরিপদ, কাল নিরাপদ, পরশু তারাপদ- পদে পদেই ওরা রয়েছে! নাও গেলো এসে, গিলে কৃতার্থ করো।’
বীরেন বোয়ের পিছু পিছু খাবারঘরে যায়। স্ত্রীর কাছে বীর কেউই নয়- বিশেষত খাবারঘরে। বড় বড় বক্তৃতা-বাজও ভাতের গ্রাস মুখে তুলে নীরবে অপর পক্ষের বাক্যবাণ হজম করে-করতে বাধ্য হয়। প্রলয়মূর্তি নটরাজও অন্নপূর্ণার কাছে এসে কিরূপ নম্র হয়ে পড়েন (একেবারে স্পীকটিনট!) তার দৃষ্টান্ত কে না দেখেছে?
থালাবাটির ঝনৎকার তুলে দেয় বীরেনের বৌ, ‘আচ্ছা, ফি দিনই কি এম্নি এক একটা আপদ-হয় ইস্কুলের নয় কলেজের নয়তো আপিসের-তোমার বাড়ি ফেরার পথের সামনে পড়ে হোঁচট খায়? আশ্চর্য!’
বীরেনও বিস্মিত হয়-বৌয়ের বলার ধরনে। তিলমাত্র জিনিসকে কি করে যে ও তালমাত্রায় এনে ফ্যালে যা সামলাতে বীরেন দিশে পায় না-তার কানে তালা লাগে-ভাবলে অবাক হতে হয়।
‘প্রত্যেক দিন নয়।’ প্রতিবাদচ্ছলে সে বলতে যায় : ‘কোনও কোনও দিন। বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে দেখা হলে কি করব? দেখতে পাইনি ভান করে পাশ কাটিয়ে চলে আসব? তুমি তাই বলো?’
বীরেনের বৌ কিছু বলে না, ভাতের থালা ধরে দেয়। বীরেনকে হাতমুখের ব্যাপারে বিব্রত করে। তারপরে বলে-‘মনে করো আমিও যদি প্রত্যেকদিন এমনি বেরিয়ে যেতুম আর ফিরতুম অনেক রাত করে? আমারও কি বন্ধু-বান্ধব নেই? তুমি তাহলে কী বলতে আমায় শুনি?’
বীরেন গ্রাসটা কোঁৎ করে গিলে এক ঢোঁক জল খেয়ে নেয়–কিচ্ছু না। ‘যাওনা কেন বেড়াতে? আমি তো তাই বলি। চুপচাপ বাড়িতে এমনি মনমরা হয়ে বসে না থেকে সই-টইদের বাড়িগেলে কি সিনেমা দেখে এলে–মন্দ কি?’
‘যাবার মত কোনও চুলো আছে নাকি আমার? থাকলে আর একথা তুমি আমায় বলতে না।’ ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টির আমেজ দেখা দেয় এবার।
বীরেন অস্থির হয়ে ওঠে-‘ওই তো! মেয়েদের ধরনই ওই! একটুতেই কান্না!’
বীরেন বৌয়ের বায়না সইতে পারে, রান্না সইতেও রাজি, কিন্তু কান্না ওর অসহ্য। গর্জনে সে কাহিল নয়, কিন্তু বর্ষণে সে কাতর।
বীরেনের বৌ উদ্গত অশ্রু দমন করে অন্য ভূমিকা নেয় : ‘তাছাড়া যাব যে সিনেমায় তার সময় কই আমার? সেই সকাল থেকে এই এতটা রাত অব্দি তো তোমাদের দাস্যবৃত্তিই করছি! আমি সিনেমায় গেলে গুষ্ঠির পিন্ডি কে রাঁধবে শুনি? ছেলেমেয়েদের ইজের ফ্রক-এ সবই বা সেলাই করবে কে? তারপর ঘর-দোর ঝাড়ামোছা-’
‘আমি বলি কি, এর কিছু কিছু বাদ দিলে বোধহয় ভাল হয়। বড্ড যেন বেশি বেশি করা হচ্ছে।’
‘তাই নাকি?’ বীরেন বাধা দিয়ে জানায় : ‘এই যেমন ধরো,ঘর-দোর ঝাড়মোছার কাজ! এটার যেন একটু বাড়াবাড়ি করা হয় আমার ধারণা। এই সেদিন আমি দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম হয়ত তুমি দেখতে পাওনি, তুমি ঝুলঝাড়া ঝাড়নটা দিয়ে মায় দরজা আমার আগাপাশতলা ঝেড়ে দিলে! তাতে আপাদমস্তকে আমার অনেক আবর্জনা সাফ হয়ে গেল তা সত্যি, কিন্তু মানুষ পরিষ্কার করার রীতি বোধহয় ও নয়।’
বৌকে এবার নিরুত্তর হতে হয়-‘বধূ জীবনে বোধহয় এই প্রথম এবং জীবনের এই প্রথম সুযোগে বীরেনও আরও কিছু বলে নেয়-‘তাছাড়া সেলাইয়ের কাজ বলছ, তার জন্য বাজারের দরজি আছে- তাদের অন্ন মারা কেন? আর পিন্ডি রাঁধার কথা যা বললে, কথাটা নেহাত মিথ্যে বলোনি। আমার মনে হয় ঠিকে ঝিকে আরও গোটা কয়েক টাকা বেশি দিলে সে রেঁধে দিয়ে যাবে এবং এর চেয়ে বেশি খারাপ সে রাঁধতে পারবে বলে আমি আশা করি নে।’
‘তা তো বলবেই। তা তো বলবেই তুমি।’ বৌয়ের চোখের বিদ্যুৎ এবার বর্ষা হয়ে নামল। ‘আমি যা করি সব খারাপ, সমস্ত অকাজ! আমার রান্না মুখে তোলা যায় না। আমি কিছু না করলেই তোমার ভালো হয়। ঘরদোর গোল্লায় যাক, কী হবে ঝেড়ে মুছে, বেশ, তবে আর আমি কিচ্ছুটি করব না।’ ঝমাঝম বর্ষা!
বর্শাবিদ্ধ হয়ে বীরেনকে এবার চুপ করতে হয়। রোরুদ্যমানকে কে রুখবে? বৌ বলেই চলে-‘কেন যে তুমি আর সবার স্বামীর মতো নও আমি তাই ভাবি! আর সব স্বামীরা নিজের ঘরদোর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দেখলে খুশি হয়, বাড়িতে থাকতে ভালোবাসে, নিজের বৌছেলেমেয়ের সঙ্গে গল্প করতে চায়, মিশতে চায়-তুমি তাদের মতো নও। পাশের বাড়ির নিবারণবাবু দ্যাখো তো? কেমন চমৎকার লোক! সন্ধ্যের আগেই বাড়ি ফিরবেন, কেবল আপিসটুকুই যা বাইরে, নইলে বাড়িতেই সরাক্ষণ। আর কিরকম বৌয়ের বাধ্য!- সর্বদা কাছে কাছে রয়েছেন। নিবারণবাবুর মত হতে কেন যে তুমি পারো না, কোথায় যে তোমার আটকায়-’
বীরেনের গলায় আটকাচ্ছিল, তাড়াতাড়ি জল খেয়ে বাধাকে তলায় পাঠিয়ে,অন্নগ্রাসমুক্ত হয়ে চট করে সে উঠে পড়ল। নিবারণবাবুর প্রসঙ্গ ওঠার প্রায় সময় হয়েছে সে টের পেয়েছিল, সে-ঢেউ একবার উঠলে শ্রীমতীকে নিবারণ করা অসম্ভব সে জানত। কথার চেয়ে দৃষ্টান্ত তীক্ষè। কথার খোঁচা তবু সওয়া যায়, কিন্তু দৃষ্টান্তের খোঁচা অসহ্য। তার সূচিমুখ থেকে বাঁচতে হলে কান হাতে করে দৃষ্টির বাইরে যেতে হয়। বীরেন হাত-মুখ ধুয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে বারান্দার দিকে পালিয়ে গেল। যতক্ষণ না বৌ ঠাণ্ডা হয়, সে না হয় এই ঠাণ্ডাতেই কাটাবে।
খোলা বারান্দাটার ওধারেই নিবারণদের বাড়ি। একেবারে কোণাঘেঁষা–কানঘেঁষা! বারান্দার গায়ে হেলান দিয়ে যে একটুকরো আকাশের দেখা মেলে সেই দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইল বীরেন। তারাদের পানে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবতে লাগল সে–মেয়েদের মন পাওয়া দায়। তার বৌয়ের কথাই ধরা যাক না! অতি তুচ্ছ কারণে, এমন অকারণে সে উত্তাল হয়ে ওঠে যে ভবতেই পারা যায় না। হয়তো সব দোষটাই বৌয়ের নয়, তার নিজেরও কিছুআছে। বাস্তবিক, ভেবে দেখলে দিনের পর একঘেয়ে খালি ঘরকন্না চালিয়ে কতটা আমোদ পেতে পারে মানুষ? মেয়ে হলেও মানুষ তো! পুরুষের তবু একটা পা বাড়ির বাইরে থাকে, এই একঘেয়েমির অরণ্য থেকে তবু তার বেরুবার পথ আছে, সরাদিনের কোনও না কোনও সময়ে সে মুক্তির স্বাদ পায়। একবারও অন্তত ঘরোয়া বানপ্রস্থ থেকে বেরিয়ে বাইরের জনারণ্যে সে নিজেকে হারাতে পারে। প্রতিদিনই সিনেমা, রেস্তোরাঁ, প্রিয়সঙ্গ–অতটা না হোক তবু রাস্তায় বেরুলে অনেক নতুন মুখ চোখে পড়ে তো। নতুন মুখ আর অচেনা মুখ যত! সব মুখই কিছু অসুন্দর নয়। ফিরে দেখবার মতও কেউ কেউ থাকেই বইকি তার মধ্যে–ফিরে দেখা আর নাও যদি হয়! শুধুই মুখ দেখা–পাকা দেখায় নাই বা পাকলো, তাই কি কম?
তার বৌও তো ইচ্ছে করলে বেরুতে পারে! এধার-ওধার ঘুরেটুরে আসতে পারে একটু-আধটু। তার দিকে তো কোনোই বাধা নেই। লাইব্রেরি থেকে বই আনিয়ে পড়তে পারে, কত নাচগানের জলসা হয়, সিনেমায় কত ভালো ভালো ছবি আসে–গিয়ে দেখতে দেখতে পারে তো! একলাই বা কাউকে সঙ্গে নিয়ে- কে আপত্তি করছে? তা না, কেবল সেলাই আর সেলাই! কে বলেছে তাকে এত এত সেলাই করতে আর দিনরাত কেবল ঘরদোরের ঝুল ঝাড়তে- শুনি?
অবশ্যি, তার বৌ যে আরও অনেক বৌয়ের মত নয় এজন্যে সে মনে মনে খুশিই। তার বৌ যে ঘরকন্না নিয়ে জড়িয়ে থাকে সুখী থাকে সেটা সেটা একপক্ষে ভালই। কোনও কোনও মেয়ে যেমন প্রজাপতির মত খালি উড়ছেই, দিন রাতই কেবল ফুর্তি- স্বামীর দিকেও নজর নেই, গেরস্থালির দিকেও না, কেবল তার কষ্টার্জিত টাকা উড়িয়েই খালাস- তার বৌ তেমন নয়। হ্যাঁ, এর জন্য তার বৌকে ধন্য বলতে হয়- বীরেন নিজের মনে মনে বলে। সে নিজেও কম ধন্য নয় একথাও সে মানতে বাধ্য হয়।
এতদূর ভেবে এতক্ষণে বীরেনের বিবেক টন টন করতে থাকে। দূরের তারকালোকের দিকে তাকিয়ে একটু আগেই নিজের গৃহকে সে তাড়নালোক জ্ঞান করেছে, কিন্তু এখন দেখল, না তা নয়, অতটা নয়। দূরবীন না লাগিয়েও অদূরে যাকে দেখা যায় সে নিছক তাড়কারাক্ষুসী না, বরং ধ্রুবতারার সগোত্রীয়াই তাকে হয়তো বলা চলে।
না, এরপর থেকে সে বৌয়ের কথামতই চলবে। আর তার অবাধ্য হবে না। আপিসের ফেরৎ সোজা বাড়ি এসে তার সান্ধ্যকৃত্য! তারপর
আর বাড়ির বার নয়। বৌয়ের রূপসুধা, কথামৃত, শ্রীহস্তলাঞ্ছিত খাদ্যাখাদ্য ইত্যাদির পানাহারশেষে লক্ষ্মীছেলের মত শুতে যাওয়া, তারপরে ঘুম থেকে উঠে বাজার সেরে নিয়ে খেয়েই ফের আপিস! এবার থেকে এই হল তার নিত্যক্রিয়া। এবং নৃত্যক্রীড়া।
বৌয়ের খাতিরে বন্ধুবান্ধব সব বর্জন করবে। রাস্তায় তাদের কারও সঙ্গে দেখা হলে প্রথমেই পাওনাদারের মত না দেখার ভান দেখাবে, তাতেও যদি তারা না মানে, ঘাড়ে পড়ে জমাতে আসে, সে চোখ তুলে না চেয়ে ব্রীড়াবনত মুখে সরে পড়ার চেষ্টা করবে। যদি তবুকেউ তাড়া করে– তাকে উপদেশ দেবে, যাও নিজের বৌয়ের কাছে যাও। আমাকে বখিয়ো না।…সত্যি, বৌয়ের চেয়ে আপনার তার কে আছে? কার কে আছে?
এইরূপ সমাধানে পৌঁছে, অনুতাপ-বিদগ্ধ বীরনে বৌয়ের কাছে মার্জন-ভিক্ষা করে আরও মার্জিত হবার আশায় যখন বারান্দা ত্যাগ করতে যাচ্ছে সেই সমায়ে অপ্রত্যাশিতরূপে আরেক সমস্যা দেখা দিল! আরেক দাম্পত্য সমস্যা।
পাশের নিবারণবাবুর ঘর থেকে শ্রীমতী নিবারণীর কলকণ্ঠ কানে এল। তিনিও স্বামীকে শায়েস্তা করতে লেগেছেন।
‘বলিহারি যাই তোমায় (বলছিলেন নিবারনের বৌ) কি করে যে দিনের পর দিন এমনি করে বাড়ি কামড়ে পড়ে থাকতে পারো তাই আমি অবাক হয়ে ভাবি! এমন ঘরকুনো মানুষ আমি জন্মে দেখিনি! কেন, সন্ধ্যের পরে একটু বেড়ালে, হাওয়া খেতে বেরুলে কী হয়? বন্ধুবান্ধব পাঁচজনের সঙ্গে মিশলে, আড্ডা দিলে, এখানে-ওখানে গল্পগুজব করলে খানিক-তাও কি তোমার ভালো লাগে না? কেবল আপিস আর ঘড়, ঘড় আর আপিস! আপিস ফিরে নির্জীব হয়ে শুয়ে পড়লে! এমন করলে বাতে ধরবে যে-’
‘কেয়াবাৎ!’ বারান্দার অন্ধকারের মধ্যে বীরেনের মুখ উজ্জল হয়ে উঠল। -‘বেচারা নিবারণেরও দেখছি সেই দশা। তারও স্বস্তি নেই। যদিও তার অপরাধ আমার ঠিক উলটো বলেই যেন বোধ হচ্ছে।’
নিবারণ কী সদুত্তর জানবার জন্য পরের কথায় আড়ি পাতা অন্যায়- এবং আড়ি পাততে গিয়ে অধঃপতন লাভ আরও অন্যায়- তা জেনেও, বারান্দা থেকে অনেকখানি সে ঝুকল। কিন্তু এত ঝুঁকি নিয়েও কোন লাভ হল না। প্রত্যুত্তরে নিবারণ আমতা আমতা করে কী যে বলল কিচ্ছু বোঝা গেল না।
সঙ্গে সঙ্গে ওর বৌয়ের গর্জন তেড়ে এল। -‘বৌয়ের এত আঁচল ধরা হওয়া কি ভালো? এরকম ন্যাওটা মানুষ মোটেই আমি ভালোবাসিনে। আমার দু-চক্ষের বিষ! সারাটা সন্ধ্যে বাড়িতে বসে থেকে আমার প্রত্যেক কাজে বাগড়া না দিয়ে একটু বেড়িয়ে- টেড়িয়ে এলে কি হয় না? তাতে কিছু মহভারত অশুদ্ধ হবে না। একটু পুরুষ মানুষের মত না হয় হলেই! পাশের বাড়ির বীরেনবাবুকে দ্যাখো দিকি। ওরকম কি তুমি হতে পারো না? না কি, ওরকম না হবার জন্যে কেউ তোমাকে মাথার দিব্যি দিয়ে পায়ে ধরে সেধেছে?…’
এই পর্যন্ত শুনেই বীরেনের মাথা ঘুরতে লাগল। বারান্দা থেকে পা টিপে টিপে ঘরের মধ্যে ফিরল সে, কিন্তু বৌয়ের কাছে মার্জনালাভের সঙ্কল্প নিয়ে নয়। সে সাধু ইচ্ছা তার উড়ে গেছে তখন। কী লাভ? মেয়েদের রহস্য তার সামান্য; বুদ্ধির বাইরে। তবে এটুকু সে বুঝেচে যে, মেয়েদের কাছে মার্জনা নেই; কখনই না, কোনও ক্ষেত্রেই নয়। আছে সম্মার্জনা, সর্বদা এবং সর্বত্র; এবং এই বোঝাই তার যথেষ্ট। সেই বোঝা আরও বাড়িয়ে আর কী লাভ হবে তার?

পোপ নির্বাচনের ১০ টি ধাপ


খ্রিস্টান ধর্ম মতে পোপ হচ্ছে সর্বোচ্চ ধর্মগুরু। তিনি একই সাথে ভাটিকানের রাস্ট্রপ্রধান, পৃথিবীর সকল চার্চের প্রধান এবং ধর্মীয় নেতা। পোপকে নির্বচিত হয়ে আসতে হয় এটা সবারই জানা কিন্তু কিভাবে নির্বাচিত হন একজন পোপ সেটা কিন্তু অনেকেরই অজানা। আসুন দেখি কিভাবে নির্বাচিত হন একজন পোপ

১০) The Death of the Previous Pope (প্রাক্তন পোপের মৃত্যু)

প্রথমেতো আগেরজন মরতে হবে। না হলে নতুন পোপের জন্য ভ্যাকেন্সি হবে না। তবে এইটা কোন নিয়ম না যে মরতেই হবে। যে কোন সময় আগের পোপ রিজাইন করলেই পদ শুন্য বলে বিবেচিত হবে। তবে এটা খুব কমই ঘটেছে যেমন সাবেক পোপ এখনও জীবিত আছেন। তিনি তার অধঃস্তন ফাদারদের যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনায় পদত্যাগ করেন। পোপ মারা যাওয়ার পরে প্রথম কাজ হচ্ছে Cardinal Camelengo (যার অবস্থান পোপের পরেই) তার সামনে একজন ডাক্তার পোপের পালস চেক করে তাকে মৃত ঘোষনা করবেন। এরপর Cardinal Camerlengo পোপের নাম ধরে তিন বার উচ্চঃস্বরে ডাক দিয়ে অপেক্ষা করবেন পোপের প্রতিউত্তরের জন্য। আগে এই ভদ্রলোক একটা ছোট হাতুড়ি দিয়ে পোপের কপালে তিনটা আঘাত করতেন মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য।

০৯) Declaration of the Death (পোপকে মৃত ঘোষণা)

আর একটা ইন্টারেস্টিং কাজ। Cardinal Camerlengo যখন নিশ্চিত হবেন যে পোপ মৃত, তিনি সাথে সাথে তার পোপের আঙুল থেকে ফিশারম্যান রিং টা খুলে নেন এবং অন্যান্য কাগজপত্রের সাথে নস্ট করে দেন। ফিশারম্যান রিং টা হচ্ছে একজন পোপের মুল আইডেন্টিটি। প্রত্যেক পোপের জন্য একটা একটা আলদা আলাদা রিং তৈরি হয় এবং তার মৃত্যুর সাথে সাথে তা ধংস করা হয়। মুলত প্রথম পোপ পিটার একজন ফিশারম্যান ছিলেন তাই সেখান থেকেই এই নিয়মটি চালু হয়েছে। এর পরই Cardinal Camerlengo পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে থাকা সকল কার্ডিনালদের কাছে পোপের মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে একটি চিঠি লিখেন। ফলে সকল কার্ডিনালরা যাতে পরবর্তী পোপ নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হতে পারেন। যদিও এই আধুনিক যুগে চিঠি পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে যথেষ্ট তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে।

০৮) Sede Vacante( সিট খালি)

প্রাক্তন পোপের মৃত্যু এবং নতুন পোপ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত সময়কালকে বলা হয় Sede vacante বা সিট খালি। ইতিহাসে এই সময় টা ১৩ দিন থেকে ২ মাস ১০ দিন পর্যন্ত ছিল। তবে সর্বনিম্ন ১৩ দিনের মধ্যেই এই কাজটা শেষ করতে হবে। এই সময়ের মধ্যে তিনজন ব্যাক্তি ছাড়া চার্চের সকল উচ্চপর্যায়ের ব্যাক্তিগন পদত্যাগ করেন। এই তিন জন হলেন the Camerlengo, the Cardinal Vicar of Rome and the head of the Apostolic Penitentiary। মুলতঃ এরা প্রধান নির্বাচকের ভুমিকায় অবতীর্ণ হন এবং তারা কোনভাবেই পোপ নির্বাচনের জন্য প্রতিযোগি হিসাবে বিবেচিত হবেন না। যেহেতু ভ্যাটিক্যান একটি আলাদা দেশ তাই Camerlengo এই সময়ে সর্বময় কর্তা হিসাবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন।

০৭) Burial of the Pope (পোপকে সমাহিতকরন)

এরপর পোপের মৃত শরীরকে সুন্দর ভাবে পরিস্কার করে পাপাল ড্রেস পরিয়ে পিটার এর চার্চ অথবা সেইন্ট জন এর চার্চে রাখা হয় যাতে সবাই শেষ বারের মত তাকে দর্শন করতে পারে। এর পরই শুরু হয় বিভিন্ন ধরনের ধর্মীয় সব আচার-অনুষ্ঠান। যেমন মৃতের চারপাশে ধুপ জ্বালিয়ে চক্কর মারা, পবিত্র জল ছিটানো সহ আরো অনেক কিছু যার। এখানে একটা গান গাওয়া হয় যেটা এরকম ” তার জন্য দোয়া কর”। এর পর মৃত পোপের লাশটা নিয়ে রাখা হয় একটা কাঠের কফিনে। এবং সেই কফিনটি রাখা হয় আর একটি সীসা অথবা জিংক এর এর বিশাল বাক্সের ভিতরে। এর পর সেই বাক্সটির উপরিভাগ সিল করা হয় স্বর্নের তৈরি ক্লিপ দ্বারা।

০৬) Novemdiales (কান্নাকাটি)

পোপের মৃত্যুর পর ঠিক নয় দিন পর্যন্ত চলে এই অনুষ্ঠানটি। মুলতঃ শব্দটির অর্থ হচ্ছে মৃত পোপের জন্য কান্নাকাটি। এই নয়দিনের প্রতিদিন একজন করে কার্ডিনাল মৃত পোপের জন্য প্রার্থনায় নেতৃত্ব দেন এবং সকল কার্ডিনাল এবং পাদ্রিরা সেই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন। এখানে মুলতঃ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কার্ডিনালরা একত্রিত হন এবং একে অন্যের সাথে পরিচিত হন, কারন অনেক কার্ডিনাল আছেন যারা একে অন্যকে একেবারেই চেনেননা। এই নয়দিনে কনক্লেভের জন্য সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়।

০৫) Conclave (নির্বাচন)

নতুন পোপ নির্বাচন একটা বিশাল সময় সাপেক্ষ বিষয়। সব কার্ডিনালরা একমত হতে পারেননা প্রায়ই। কার্ডিনালদের একটা বিশেষ রুমের ভিতরে প্রবেশ করতে হয় যার দরজা বাইরে থেকে তালাবন্ধ থাকে। এই প্রথাটা প্রথমে ছিল না। এটা শুরু হয় ১২৭১ সালে পোপ নির্বাচনের সময়, সেসময় কিছুতেই সকল কার্ডিনালরা একমত হতে পারছিলেন না। ফলে প্রায় ২ বছর ৯ মাস সময় পার হয়ে যায় কিন্তু কোন পোপ নির্বাচিত হয় না। পরে স্থানীয় অধিবাসীরা রুমের দরজা বন্ধ করে খুব অল্প পরিমানে খাবার দিয়ে বাহির থেকে তালা মেরে দেয়। ফলাফল এক দিনের মাথা নতুন পোপ পাওয়া যায়।
মজার বিষয় হচ্ছে ৮০ বছরের উপরে কার্ডিনালরা পোপ নির্বাচনের জন্য অংশগ্রহন করতে পারবেন না।

০৪) Voting( ভোটাভুটি)

পোপ নির্বাচিত হতে হলে উক্ত কার্ডিনালকে সকল ভোটের দুই তৃতীয়াংশ ভোট পেতে হবে। প্রত্যেক কার্ডিনালকে তার হাতে একটা ছোট কাগজের টুকরো দেয়া থাকে যেখানে লেখা থাকে ” আমি পোপ হিসাবে নির্বাচিত করলাম”। প্রত্যেক কার্ডিনাল এর ঠিক নিচেই তার পছন্দের কার্ডিনালের নাম লিখে সবার সামনে রাখা একটি বাক্সে ফেলেন। প্রথমে তিনজন ব্যাক্তির নাম বলেছিলাম যারা প্রধান নির্বাচক হিসাবে কাজ করেন। তারা নির্বাচনে অংশগ্রহন এবং প্রার্থী হতে পারেন না। নির্বাচকরা এর পরে প্রত্যেকটি ভোট সজোরে সবাইকে পাঠ করে শোনান। যদি কেউ সংখাগরিষ্ঠতা না পায় তবে সবগুলো কাগজ একটি নির্দিষ্ট চুল্লির মধ্যে ফেলে পুড়িয়ে ফেলা হয়। চুল্লিটির চিমনি দিয়ে তখন কালো ধোঁয়া বের হয় এবং বাইরে থাকা সবাই বুঝতে পারে কেউ নির্বাচিত হয় নি। ফলে আবার একই প্রক্রিয়া শুরু হয়। পোপ নির্বাচিত হবার সাথে সাথে চিমনি দিয়ে সাদা ধোঁয়া ছাড়া হয় যাতে সবাই বুঝতে পারে কেউ একজন নির্বাচিত হয়েছেন।

০৩) Acceptance (কবুল করা)

নির্বাচিত কার্ডিনালকে এর পরে Dean of the College of Cardinals পোপ হবার জন্য আহ্বান করেন। তিনি যদি কবুল বলেন তবে তিনি পোপ হিসাবে পরিপুর্ন ভাবে নির্বাচিত হয়ে যাবেন। এর পরে নতুন পোপ তার জন্য একটি নতুন নাম নির্বাচন করবেন। এই প্রথাটা শুরু হয়েছিল পোপ জন ২ এর সময়। তার আসল নাম ছিল মার্কারিয়াস যেটি একটি প্যাগান দেবতার নাম। ফলে তিনি বাধ্য হন একটি নতুন নাম গ্রহন করার জন্য। এরপরই সকল কার্ডিনালরা নতুন পোপের সাথে থাকার অঙ্গিকার ব্যাক্ত করেন।

০২) Announcement ( ঘোষনা)

এতক্ষনে সেন্ট পিটার্সবার্গ স্কয়ারের সামনে প্রচুর মানুষ জমতে থাকে নতুন পোপকে দর্শন করার জন্য। পোপ তার জন্য নির্ধারিত কাপর পরিধান করেন। তবে মজার বিষয় হল চার্চ কর্তৃপক্ষ আগেথেকেই সম্ভাব্য সকল কার্ডিনালদের মাপ অনুযায়ী কাপড় বানিয়ে রাখে ফলে সাথে সাথেই নতুন পোপ তার জন্য বানানো কাপড় খুব দ্রুত পরিধান করতে পারেন। এছাড়া এসময় তিনি তার ফিশারম্যান রিং পরিধান করেন। এবং শেষ পর্যন্ত ব্যালকনিতে গিয়ে পোপ হিসাবে প্রথম ভাষন দেন।

০১) Coronation / Inauguration(অভিষেক)

আগে সমগ্র রোম এবং ইতালির অনেকাংশ সরাসরি চার্চের দ্বারা শাসিত হত। এবং পোপ এই পুরো প্রসাশনের প্রধান হিসাবে একরকম রাজার মর্যাদায় শাসন করতেন। ফলে নতুন নির্বাচিত পোপ একজন রাজার মতই একটা অভিষেক অনুষ্ঠান উদযাপন করতেন। তবে বর্তমানে আর সেটা হয়না তবে খুব বড়ধরনের একটা প্রার্থনার আয়োজন হয়।

পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী নারী, আপনার জন্য - আনিসুল হক


আমি অত্যন্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ। আমি অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পাই। এবং আমার পঞ্চ-ইন্দ্রিয় খুবই প্রখর। আমি পেছনে না তাকিয়ে শুধু বাতাসে শ্বাস নিয়ে বলতে পারি, এক শ হাত পেছনে একটি অত্যন্ত রূপবতী তরুণী অবস্থান করছে।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের নতুন প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমি বুঝে ফেললাম, পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী নারীটি পুরোনো প্ল্যাটফর্মে এইমাত্র পা রাখল।
আমি ঘ্রাণ নিলাম। বাতাস আমাকে জানিয়ে দিল। হ্যাঁ, এসেছে একজন।

আমি পেছনে ফিরে তাকালাম। মেয়েটি পরেছে ঘিয়ে রঙের একটা ফতুয়া, গ্যাবাডিনের একটা ট্রাউজার। তার চুল খোলা। মেয়েটির নাকে একটা নাকফুল। মেয়েটি ঈষৎ শ্যাম বর্ণ।
আমার চিত্তচাঞ্চল্য দেখা দিল। মেয়েটিকে দেখতে হবে। কোনো মেয়ের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে হয় না। কিন্তু তার মুখখানা আরেকটু কাছে থেকে না দেখলে আমি মারাই যাব।
আমি নতুন প্ল্যাটফর্ম থেকে পুরোনো প্ল্যাটফর্মের দিকে রওনা হলাম। আমার পিঠে একটা ব্যাকপ্যাক। আমি অফিসের কাজে চট্টগ্রামে এসেছিলাম। কাজ সেরে ঢাকায় ফিরে যাচ্ছি। মাত্র আটাশ বছর বয়সের কোমরেই ব্যথা এসে বাসা বেঁধেছে, ভারী জিনিস টানা আমার বারণ। কিন্তু ব্যাকপ্যাক পিঠে নিতে মানা নেই। আমার সামনের দিকে ঝোঁকা বারণ, পেছনের দিকে নয়।
ঘিয়ে জামার কাছাকাছি গেলাম।
একটু আগে বলছিলাম, কোনো মেয়ের মুখের দিকে হাঁ করে তাকাতে হয় না। কিন্তু আমি তার কাছে গিয়ে হাঁ হয়ে গেলাম। আমার মুখ দিয়ে মাছি ঢুকে যেতে পারে।
আমার জীবনে এত রূপবতী নারী আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি। সে দেখতে নন্দিতা দাসের মতো—সংক্ষেপে শুধু এতটুকুন বলতে পারি। ভারতীয় অল্টারনেটিভ মুভির এই নায়িকার মতোই রংটা চাপা, সুন্দর নাক, খানিকটা খাড়া, খানিকটা গোল, তাতে নাকফুলটা­—ইশ্, একটা নাকফুল নারীকে এই রকম অপরূপা করে তুলতে পারে! তার চোখ টানা–টানা, ভাসা-ভাসা। এবং ফাজিল মেয়েটা ট্রাউজার আর ফতুয়া পরেছে, কিন্তু চোখে পরেছে কাজল। দেখে তো আমি মুগ্ধ হবই, আমি তো পুরুষ।
আমার তার দিকে আরও খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করছে বটে, কিন্তু তাতে আমার ট্রেন মিস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। আমার মন পড়ে রইল পুরোনো প্ল্যাটফর্মে, আর আমার অনিচ্ছুক শরীরটাকে পা দুটো কোনো রকমে টেনেটুনে আনল নতুন প্ল্যাটফর্মে।
টিকিট কাটাই ছিল। ফার্স্ট ক্লাস, এসি চেয়ার।
নম্বর মিলিয়ে আমি সিটে বসলাম।
সিটটাও পেয়েছি, বলার মতো। সামনে একটা টেবিল। চা খাওয়ার জন্য বোধ হয়। উল্টোদিকের সারিটা আমাদের সারির মুখোমুখি।
মেয়েটি কি একই ট্রেনে উঠবে?
একই ট্রেনে আমরা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যাব?
উঠবে পুরোনো প্ল্যাটফরম থেকে?
তাহলে কি সে যাচ্ছে এসি বাথে। শুয়ে যাবে? তার সঙ্গে কি আর কেউ আছে?
আমরা দুজন একটি ট্রেনে যাই
এই আমাদের একটি মাত্র সুখ,
তাহার বগি টানছে যে ইঞ্জিন,
আমার বগিও টানছে সে উজবুক।
ভাবছি। কবিতার ছন্দ মেলাচ্ছি।
একটু পরে ট্রেন ছেড়ে দেবে। একজন-দুজন করে যাত্রী আসছেন। কারও-বা বড় বোঝা, কুলি টেনে আনল। কারও-বা বোঝা কম। নানা বয়সের যাত্রীরা আসছেন, বসছেন। কে সেসবের দিকে তাকায়। আমার সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নিয়ে একজন দাঁড়িয়ে ছিল পুরোনো প্ল্যাটফর্মে। এখন বোধ হয় কোনো একটা কামরায় উঠে পড়েছে।
তবে নিয়তির পরিহাস সব সময় নির্মম হয় না। আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় হঠাৎ সাড়া দিয়ে উঠল, তিনি এই কামরাতেই উঠছেন, ওই যে, ওই দরজা দিয়ে। এবং তিনি এই দিকেই আসছেন। ও খোদা। তিনি আমার সামনের আসনে এসে বসলেন!
আমরা দুজন এখন মুখোমুখি আসনে। মধ্যখানে একটা ইস্পাতের নিষ্ঠুর টেবিল।
এখন কী করা যায়?
আমার আইফোন সিক্সটা বের করলাম। সামনের টেবিলে রাখলাম।
তিনি একটা অর্ধচন্দ্র মার্কা কুশন বের করলেন। কাঁধের পেছনে দিলেন। এবং ঘুমিয়ে পড়লেন।
যাহ্। আমার আইফোন-দুরভিসন্ধি মাঠে মারা গেল।
ট্রেন চলছে। এত কাছে তিনি যে আমি তার দিকে পূর্ণ চোখে তাকাতেও পারছি না।
কিন্তু তাকে দেখে আমার দেখার সাধ মিটছে না। আমি উঠলাম। বাথরুমের দিকে গেলাম। আবার এলাম। দূর থেকে তাকে প্রাণভরে দেখছি। নারী আর ঘুমন্ত নারী এক নয়। বিকেলের হলদেটে আলো জানালার কাচ গলে এসে পড়েছে তার মুখে। আমি জানি আলোরও অভিসন্ধি থাকে। এই রোদটুকুন কেন এসেছে, আমি জানি।
ট্রেন চলছে। ট্রেনের চলার মধ্যে একটা একঘেয়েমি আছে। ট্রেনের টেলিভিশনে চলতে থাকা মিউজিক ভিডিও দেখার জন্য আমি ঐকান্তিকভাবে প্রয়াস পেলাম। বেশ হাস্যকর হয়েছে মিউজিক ভিডিওটা। রাত হয়ে এসেছে। ট্রেনের ভেতরে বাতি জ্বলছে। যাত্রীরা সবাই ক্লান্ত। দূরে দুই ভদ্রলোক বেশ চিৎকার করে গল্পও করছেন। মাঝেমধ্যে ট্রেনের খাবারের কামরা থেকে নানা ধরনের খাবার এনে সামনে ধরে দ্রুত কেটে পড়ছে লোকগুলো। কাটলেট। চা। এরপর চিপস।
দেবীর ঘুম ভাঙল।
তিনি সোজা হয়ে বসলেন।
তার সঙ্গে একটা ট্রলি। সেটা খুললেন। একটা ফার্স্ট এইড বক্স বের করলেন। তারপর নিজের পা বের করলেন কালো রঙের জুতা থেকে। তার দুটো পা থেকে পারিজাত ফুলের শোভা যেন দ্যুতি ছড়াচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ কি এই দুটো পা দেখে লিখেছিলেন, ‘দুটো অতুল পদতল রাতুল শতদল, জানি না কী লাগিয়া পরশে ধরাতল।’
তিনি তার পায়ের পেছনের দিকে, গোড়ালির একটু ওপরে একটা ব্যান্ড এইড বাঁধলেন। মানে আঠাওয়ালা ব্যান্ডেজ। বোধ হয় জুতা লেগে তার পায়ের পেছনটা খানিক জখম হয়েছে। তারপর ফার্স্ট এইড বক্স ট্রলির ভেতরে রেখে ট্রলি সুটকেসটা বন্ধ করে রেখে দিলেন সিটের নিচে।
রাত দশটায় পৌঁছে যাব ঢাকায়, বিমানবন্দর স্টেশনে। আমাকে নেমে যেতে হবে।
বিমানবন্দর স্টেশনে কি সে-ও নামবে?
না। যারা যারা বিমানবন্দর স্টেশনে নামবে, টঙ্গী থেকেই তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমার দেবীর মধ্যে সে রকমের কোনো চাঞ্চল্য নেই। তাহলে আমিও নামব না। আমি তার সঙ্গে কমলাপুর চলে যাব। যেতেই হবে।
বিমানবন্দরে পুরো কামরা ফাঁকা হয়ে গেল প্রায়। পৃথিবীর সব লোক এখন উত্তরা থাকে নাকি?
শুধু ওই দূরে দুজন মুরব্বি গোছের মানুষ বসে আছেন।
আমরা দুজন এইখানে মুখোমুখি আসনে।
ট্রেন আবার চলতে শুরু করেছে।
কমলাপুর পৌঁছাতে লাগবে আরও এক ঘণ্টা।
একটা ঘণ্টা তো আমি তার সামনে বেশি থাকতে পারব।
এইবার বোধ হয় আমার কথা বলা উচিত।
আমি বললাম, ‘আপনি কোথায় নামবেন?’
তিনি জবাব দিলেন না।
মুখটা বিস্বাদে ভরে গেল।
জবাব দিল না কেন মেয়েটা। খুবই নিরীহ প্রশ্ন। জবাব দিলে কী হতো?
আমার খুব খারাপ লাগছে। আমি এভাবে অপমানিত হলাম! এর কি কোনো শোধ নেই?
ফ্যানটা তার দিকে ঘোরানো। তিনি উঠে ফ্যানটা ঘোরানোর চেষ্টা করলেন।
পারলেন না।
আমি ভাবলাম, এবার আমার চেষ্টা করা উচিত। না হয় সে খারাপ ব্যবহার করেইছে। তুমি অধম তাই বলে আমি উত্তম হইব না কেন।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে ফ্যানটা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য হাত বাড়ালাম।
ভুলক্রমেই, আপনাদের এ কথা আমি বেশ জোরের সঙ্গেই বলতে পারব, ইচ্ছা করে কাজটা আমি করিনি, আমার তর্জনী ঢুকে গেল ফ্যানের খাঁচার ভেতরে, আর ঘুরন্ত পাখা লেগে বেশ খানিকটা গেল কেটে। আমি দ্রুতই হাতটা সরিয়ে নিলাম, একটা অব্যয়ধ্বনি বেরিয়ে এল, আহা...
টপ টপ করে রক্ত ঝরছে। এবার দেবীর দয়া হলো। তিনি আমার আঙুল চেপে ধরলেন তার চাপাকলির মতো আঙুল দিয়ে। তারপর নিজের সুটকেসটা খুললেন। ফার্স্ট এইড বক্সটা বের করলেন। তাতে ডেটল ছিল। একটা তুলায় ডেটল মেখে, আহা, তিনি আমার আঙুলের রক্ত মুছে দিলেন। তারপর আরেকটু তুলা চেপে ধরে আমার আঙুলের ডগায় একটা ব্যান্ড এইড বেঁধে দিলেন।
আমার জীবন চিরদিনের জন্য ধন্য হয়ে গেল।
তারপর এসে গেল কমলাপুর।
আমি বললাম, ‘আসি।’
তিনি হাসলেন। কোনো কথাই বললেন না।
আমি বললাম, ‘আপনার সুটকেসটা আমি নামিয়ে দেব?’
তিনি হাসলেন। কথা বললেন না।
কমলাপুর এসে গেল।
আমি নেমে পড়লাম।
তিনিও নামলেন।
তাকে নিতে এসেছে এক যুবক।
আমি পেছন ফিরে তাকালাম। দেখলাম, দুজনে কথা বলছে, সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে, সাংকেতিক ভাষায়, হাত নেড়ে নেড়ে।
একে অন্যকে একবার আলতো করে হাগ করল।
তারপর যুবকটি মেয়েটির ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে মিশে গেল কমলাপুর রেলস্টেশনের ভিড়ে।
আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম।
দীর্ঘশ্বাস গোপন করার চেষ্টা করছি নিজের কাছ থেকেই।
তারপর তাকে হারিয়ে ফেললাম।
এই গল্পটা লিখছি কম্পিউটারে। ডান হাতে এখনো তার দেওয়া ব্যান্ডেজটা আছে।
তর্জনী ব্যবহার করতে পারছি না।
দেবী, যদি তুমি এই লেখাটা পড়ো, তোমার মোবাইল নম্বরটা আমাকে দিয়ো। স্যরি, মোবাইল নম্বর নিয়ে আমি কী করব? তুমি কি বাংলা পড়তে পারো? আমি আশা করি, তুমি পারো এবং এই লেখাটা তুমি পড়ছ। তাহলে আমাকে ই-মেইল কোরো। এই লেখার সঙ্গে আমি আমার ই-মেইল এড্রেস দিয়ে দিচ্ছি। ওটা দিয়ে সার্চ দিলে তুমি আমাকে ফেসবুকেও পেতে পারো।

হুমায়ুন আহমেদের গল্প-- "পাপ"


ভাই আপনাকে একটা ভয়ঙ্কর পাপের গল্প বলি। পাপটা আমি করেছিলাম। নিজের ইচ্ছায় করিনি। স্ত্রীর কারণে করেছিলাম। স্ত্রীর কারণে অনেক পাপ পৃথিবীতে হয়েছে। মানুষের আদি পাপও বিবি হাওয়ার কারণে হয়েছিল। আপনাকে এইসব কথা বলা অর্থহীন। আপনি জ্ঞানী মানুষ, আদি পাপের গল্প আপনি জানবেন না তো কে জানবে। যাই হোক, মূল গল্পটা বলি।


আমি তখন মাধবখালি ইউনিয়নে মাস্টারি করি। গ্রামের নাম ধলা। ধলা গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। নতুন বিবাহ করেছি। স্ত্রী সঙ্গে থাকেন। আমার বয়স তখন পঁচিশের মতো হবে। স্ত্রী নিতান্তই বালিকা। পনের-ষোল মতো বয়স। ধলা গ্রামে আমরা প্রথম সংসার পাতলাম। স্কুলের কাছেই অনেকখানি জায়গা নিয়ে আমার টিনের ঘর। আমরা সুখেই ছিলাম। ফুলির গাছগাছালির খুব শখ। সে গাছপালা দিয়ে বাড়ী ভরে ফেলল। ও আচ্ছা, বলতে ভুলে গেছি। ফুলি আমার স্ত্রীর ডাক নাম। ভালো নাম নাসিমা খাতুন।

বুঝলেন ভাই সাহেব, ধলা বড় সুন্দর গ্রাম। একেবারে নদীর তীরের গ্রাম। নদীর নাম কাঞ্চন। মাছ খুবই সস্তা। জেলেরা নদী থেকে মাছ ধরে বাড়ীতে দিয়ে যায়। তার স্বাদই অন্যরকম। পনের বছর আগের কথা বলছি। এখনও সেখানকার পাবদা মাছের স্বাদ মুখে লেগে আছে। শীতের সময় বোয়াল মাছ থাকতো তেলে ভর্তি।

ধলা গ্রামের মানুষজনও খুব মিশুক। আজকাল গ্রাম বলতেই ভিলেজ পলিটিক্সের কথা মনে আসে। দলাদলি, কাটাকাটি, মারামারি। ধলা গ্রামে এসব কিছুই ছিল না। শিক্ষক হিসেবে আমার অন্যরকম মর্যাদা ছিল। যে-কোন বিয়ে শাদিতে আদর করে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে যেত। গ্রাম্য সালিসিতে আমার বক্তব্য গুরুত্বের সাথে নেয়া হতো। দুই বছর খুব সুখে কটলো। তারপরই সংগ্রাম শুরু হলো। আপনারা বলেন স্বাধীনতা যুদ্ধ। গ্রামের লোকের কছে সংগ্রাম।

ধলা গ্রাম অনেক ভিতরের দিকে। পাক বাহিনী কোন দিন ধলা গ্রামে আসবে আমরা চিন্তাই করি নি। কিন্তু জুন মাসের দিকে পাক বাহিনীর গান বোট কাঞ্চন নদী দিয়ে চলাচল শুরু করলো। মাধবখালি ইউনিয়নে মিলিটারি ঘাঁটি করলো। শুরু করলো অত্যাচার। তIদের অত্যাচারের কথা আপনাকে নতুন করে বলার কিছু নেই। আপনি আমার চেয়ে হাজার গুণে বেশি জানেন। আমি শুধু একটা ঘটনা বলি। কাঞ্চন নদীর একপাড়ে ধলা গ্রাম, অন্য পাড়ে চর হাজরা। জুন মাসের ১৯ তারিখ চর হাজরা গ্রামে মিলিটারির গানবোট ভিড়ল। চর হাজরার বিশিষ্ট মাতবর ইয়াকুব আলী সাহের মিলিটারিদের খুব সমাদর করে নিজের বাড়ীতে নিয়ে গেলেন। ভাই সাহেব, আপনি এর অন্য অর্থ করবেন না। তখন তাদের সমাদর করে নিয়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না। সবারই হাত-পা ছিল বাঁধা। ইয়াকুব আলী সাহেব মিলিটারিদের খুব আদর-যত্ন করলেন। ডাব পেড়ে খাওয়ালেন। দুপুরে খানা-খাওয়ার জন্য খাসি যবেহ করলেন। মিলিটারিরা সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকলো। খানা পিনা করলো। যাবার সময় ইয়াকুব আলী সাহেবের দুই মেয়ে আর ছেলের বউকে তুলে নিয়ে চলে গেল। আর তাদের কোন খোঁজ পাওয়া যায় নাই। এখন গল্পের মতো মনে হয়। কিন্তু এটা বাস্তব সত্য। আমার নিজের দেখা। সেই দিনের খানায় শরীক হওয়ার জন্য ইয়াকুব আলী সাহেব আমাকে দাওয়াত দিয়েছিলেন। নিয়ে যাওয়ার জন্য নৌকা পাঠিয়েছিলেন। আমি গিয়েছিলাম।

চরহাজরার ঘটনার পর আমরা ভয়ে অস্থির হয়ে পড়লাম। গজবের হাত থেকে বাঁচার জন্য মসজিদে কোরআন খতম দেয়া হলো। গ্রাম বন্ধ করা হলো। এক লাখ চব্বিশ হাজার বার সুরা এখলাস পাঠ করা হলো। কী যে অশান্তিতে আমাদের দিন গিয়েছে ভাই সাহেব। আপনাকে কী বলব। রাতে এক ফোঁটা ঘুম হতো না। আমার স্ত্রী তখন সন্তান সম্ভবা। সাত মাস চলছে। হাতে নাই একটা পয়সা। স্কুলের বেতন বন্ধ। গ্রামের বাড়ী থেকে যে টাকা পয়সা পাঠাবে সে উপায়ও নাই। দেশে যোগাযোগ বলতে তখন কিছুই নাই। কেউ কারো খোঁজ জানে না। কী যে বিপদে পড়লাম। সোবহানাল্লাহ।

বিপদের উপর বিপদ-জুলাই মাসের শেষের দিকে মুক্তিবাহিনী দেখা দিল। নৌকায় করে আসে, দুই একটা ফুটফাট করে উধাও হয়ে যায়। বিপদে পড়ি আমরা। মিলিটারি এসে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে যায়। মুক্তিবাহিনীর তখন আর কোন নাড়াচাড়া পাওয়া যায় না। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে অবস্থার পরিবর্তন হলো। মুক্তিবাহিনী তখন আর শুধু ফুটফাট করে না। রীতিমতো যুদ্ধ করে। ভালো যুদ্ধ। বললে বিশ্বাস করবেন না, এরা কাঞ্চন নদীতে মিলিটারির একটা লঞ্চ ডুবিয়ে দিল। লঞ্চ ডুবার ঘটনা ঘটলো সেপ্টেম্বর মাসের ছাব্বিশ তারিখ। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে এই সংবাদ প্রচার করা হয়েছিল। ভাই সাহেব হয়তো শুনেছেন, বলা হয়েছিল শতাধিক মিলিটারির প্রাণ সংহার হয়েছে। এটা অবশ্য ঠিক না। মিলিটারি অল্পই ছিল। বেশির ভাগই ছিল রাজাকার। রাজাকারগুলো সাঁতরে পাড়ে উঠেছে, গ্রামের লোকরাই তাদের পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিস ভাই সাহেব। যুদ্ধ অতো সাধারণ মানুষকেও হিংস্র করে ফেলে। এটা আমার নিজের চোখে দেখা।

এখন মূল গল্পটা আপনাকে বলি। সেপ্টেম্বর মাসের আটাশ তারিখের ঘটনা। মাগরেবের নামাজ পড়ে বারান্দায় বসে আছি। তুমুল বর্ষণ হচ্ছে। ইংরেজিতে যাকে বলে ক্যাটস এন্ড ডগস। একা একা বৃষ্টি দেখছি। আমার স্ত্রী শোবার ঘরে। ঘর অন্ধকার করে শুয়ে আছে। তার শরীর খুব খারাপ। দুদিন ধরে কিছুই খেতে পারছে না। যা খায় তাই বমি করে দেয়। শরীর অত্যন্ত দুর্বল। কোন কিছু না ধরে দাঁড়াতে পর্যন্ত পারে না। ডাক্তার যে দেখাব সে উপায় নাই। ডাক্তার পাবো কই? মাধব খালিতে একজন এমবিবিএস ডাক্তার ছিলেন। বাবু নলিনীকুমার রায়। ভালো ডাক্তার। মিলিটারি মাধবখালিতে এসে প্রথম দিনই তাকে মেরে ফেলেছে।

যে কথা বলছিলাম, আমি বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখছি। মন অত্যন্ত খারাপ।

বৃষ্টির বেগ বাড়তে লাগল। একসময় প্রায় ঝড়ের মতো শুরু হলো। বাড়ী-ঘড় কাঁপতে শুরু করলো। আমি একটু দুঃশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। পুরনো নড়বড়ে বাড়ী। ঝড়ে উড়িয়ে নিয়ে গেলে অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে বিপদে পড়বো। কাছেই মোক্তার সাহেবের পাকা দালান। স্ত্রীকে নিয়ে সেখানে উঠবো কি-না ভাবছি। তখন ফুলি আমাকে ভেতর থেকে ডাকলো। আমি অন্ধকারে ঘরে ঢুকলাম। ফুলি ফিসফিস করে বলল, তোমার সঙ্গে আমার একটা কথা আছে।

আমি বললাম, কী কথা?

ফুলি বলল, আমার কাছে আগে বসো। আমি বসলাম। ফুলি বলল, আমি যদি তোমার কাছে কোন জিনিস চাই তুমি আমাকে দিবে?

আমি বললাম, ক্ষমতার ভিতরে থাকলে অবশ্যই দিবো। আকাশের চাদ চাইলে তো আর দিতে পারবো না। জিনিসটা কী?

তুমি আগে আমার গা ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা কর।

আমি তার কপালে হাত রেখে বললাম, প্রতিজ্ঞা করলাম। এখন বলো ব্যাপার কী?

হ্যারিকেনটা জ্বালাও।

হ্যারিকেনটা জ্বালালাম। দেখি তার বালিশের কাছে একটা কোরআন শরীফ। আমাকে বলল, আল্লাহ পাকের কালাম ছুয়ে প্রতিজ্ঞা কর যে তুমি কথা রাখবে।

আমি ধাঁ ধাঁর মধ্যে পড়ে গেলাম। ব্যাপার কী? পোয়াতি অবস্থায় মেয়েদের মধ্যে অনেক পাগলামী ভর করে। আমি ভাবলাম এরকমই কিছু হবে। দেখা যাবে আসল ব্যাপার কিছু না। আমি কোরআন শরীফে হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করলাম। তারপর বললাম, এখন বলো আমাকে করতে হবে কী?

একটা মানুষের জীবন রক্ষা করতে হবে।

তার মানে?

একটা মানুষ আমার কাছে আশ্রয় নিয়েছে। তার জীবন রক্ষা করতে হবে।

কিছুই বুঝতে পারছি না। কে তোমার কাছে আশ্রয় নিল?

ফুলি থেমে থেমে চাপা গলায় যা বললো তাতে আমার কলিজা শুকিয়ে গেল। দুদিন আগে মিলিটারির লঞ্চডুবি হয়েছে। একটা মিলিটারি নাকি সাঁতরে কুলে উঠেছে। আমাদের বাড়ীর পেছন দিকে কলাগাছের ঝোপের আড়ালে বসে ছিল। ফুলিকে দেখে বহেনজি বলে ডাক দিয়ে কেঁদে উঠেছে। ফুলি তাকে আশ্রয় দিয়েছে।

আমি হতভম্ব গলায় বললাম, দুদিন ধরে একটা মিলিটারি আমাদের বাড়ীতে আছে?

ফুলি বলল, হু!

সত্যি কথা বলছো।

হাঁ সত্যি, এখন তুমি তাকে মাধবখালি নিয়ে যাও। মাধবখালিতে মিলিটারি ক্যাম্প আছে। আজ ঝড়বৃষ্টির রIত আছে। অন্ধকারে অন্ধকারে চলে যাও। কেউ টের পাবে না।

তোমার কী মাথা খারাপ।

আমার মাথা খারাপ হোক আর যাই হোক, তুমি আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছ।

আমি মিলিটারি নিয়ে রওনা হব। পথে আমাকে ধরবে মুক্তিবাহিনী। দুজনকেই গুলি করে মারবে!

এইরকম ঝড়-বৃষ্টির রাতে কেউ বের হবে না। তুমি রওনা হয়ে যাও।

ব্যাটা আছে কোথায়?

আস তোমাকে দেখাই।

সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র কী আছে?

কিছুই নাই। খালি হাতে সাঁতরে পাড়ে উঠেছিল।

আমি মোটেই ভরসা পেলাম না। অস্ত্র থাকুক আর না থাকুক মিলিটারি বলে কথা। জেনেশুনে এরকম বিপজ্জনক শত্রু শুধুমাত্র মেয়েছেলেদের পক্ষেই ঘরে রাখা সম্ভব। আমর মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। আমি ক্ষীণ গলায় বললাম, হারামজাদা কই?

ফুলি আমাকে দেখাতে নিয়ে গেল। এমনিতে সে কোনকিছু না ধরে উঠে দাঁড়াতে পারে না। আজ দেখি হ্যারিকেন হাতে গটগট করে যাচ্ছে।

রান্না ঘরের পাশে ভাড়ার ঘর জাতীয় ছোট একটা ঘর আছে। সেখানে চাল ডাল পিয়া-টিয়াজ থাকে। ফুলি আমাকে সেই ঘরের কাছে নিয়ে গেল। দেখি ঘরটা তালাবদ্ধ। একটা মাস্টারলক তালা ঝুলছে। ফুলি তালা খুলল। হ্যারিকেন উঁচু করে ধরলো। দেখি ঘরের কোনায় কম্বল বিছানো। কম্বলের উপর নিতান্তই অল্প বয়সি একটা ছেলে বসে আছে। তার পরণে আমার লুঙ্গি, আমার পাঞ্জাবি। ঘরের এককোণায় পানির জগ-গ্লাস। পাকিস্তানি মিলিটারির সাহসের কত গল্প শুনেছি। এখন উল্টা জিনিস দেখলাম। ছেলেটা আমাকে দেখে ভয়ে শিউরে উঠল। গুটিশুটি মেরে গেল। ফুলি তাকে ইশারায় বলল, ভয় নাই।

আমি হারামজাদাকে খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছি। এতো কাছে থেকে আগে কখনও মিলিটারি দেখিনি। এই প্রথম দেখছি। লুঙি পাঞ্জাবি পড়া বলেই বোধ হয় একে দেখাচ্ছে খুব সাধারণ বাঙালির মতো। শুধু রঙটা বেশি ফর্সা আর নাকমুখ কাটা কাটা।

আমি ফুলিকে বললাম --এর নাম কী?

ফুলি গড়গড় করে বলল, এর নাম দিলদার। লেফটেন্যান্ট। বাড়ী হলো বালাকোটে। রেশমি নামে ওদের গাঁয়ের একটি মেয়ের সঙ্গে ওর খুব ভাব। যুদ্ধের পর দেশে ফিরে গিয়ে সে মেয়েটাকে বিয়ে করবে। রেশমি যে কতো সুন্দর তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না। অবিকল ডানাকাটা পরী। রেশমির ছবি দেখবে? দিলদারের পকেটে সবসময় রেশমির ছবি। বালিশের নীচে এই ছবি না রাখলে সে ঘুমুতে পরে না।

কারো ছবি দেখারই আমার কোন শখ ছিল না। আমার মাথা তখন ঘুরছে। এক সমস্যায় পড়লাম। ফুলি তারপরও একটা ছবি দেখাল। ঘাগরা পড়া একটা মেয়ে। মুখ হাসি হাসি। ফুলি বলল, মেয়েটা সুন্দর কেমন দেখলে!

আমি বললাম, হু

এখন তুমি ওকে মাধবখালি পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা কর। আজ রাতেই কর।

দেখি।

দেখাদেখির কিছু না। তুমি রওনা হও।

মাধবখালি তো পায়ে হেঁটে যাওয়া যাবে না। নৌকা লাগবে।

নৌকার ব্যবস্থা কর। ওকে পার করার জন্য আজ রাতই সবচেয়ে ভালো। ভয়ে বেচারা অস্থির হয়ে গেছে। পানি ছাড়া কিছু খেতে পারছে না।

আমি শুকনা গলায় বললাম, দেখি কী করা যায়।

ফুলি মিলিটারির দিকে তাকিয়ে আনন্দিত গলায় বল, তোমার আর কোন ভয় নাই। আমার স্বামী তোমাকে নিরাপদে পৌঁছে দিবে। তুমি এখন চারটা ভাত খাও। মিলিটারি বাংলা ভাষার কী বুঝলো কে জানে। সে শুধু বললো, শুকরিয়া বহেনজি। লাখো শুকরিয়া।

ফুলি ভাত বেড়ে নিয়ে এলো। তাকে খাওয়াতে বসল। আমাকে বলল, তুমি দেরি করো না--চলে যাও।

আমি ছাতা হাতে বাড়ী থেকে বের হলাম। তখনও ঝুম বৃষ্টি চলছে। তবে বাতাস কমে গেছে। আমি দ্রুত চিন্তা করার চেষ্টা করছি। কী করা যায় কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। স্ত্রীকে কথা দিয়েছি, আল্লাহ পাকের কালাম ছুয়ে প্রতিঞ্জা করেছি। সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা দরকার। ছেলেটার জন্য মায়াও লাগছে। বাচ্চা ছেলে। এরা হুকুমের চাকর। উপরওয়ালার হুকুমে চলতে হয়। তাছাড়া বেচারা জীবনই শুরু করে নাই। দেশে ফিরে বিয়ে-সাদি করবে। সুন্দর সংসার হবে। আবার অন্যদিকও আছে। একে মাধবখালি পৌঁছে দিলে ঘটনা প্রকাশ হয়ে পড়বে। নৌকIর মাঝিই বলে দিবে। কোনকিছুই চাপা থাকে না। তারপর রাজাকার হিসাবে আমার বিচার হবে। দেশের মানুষ আমার গায়ে থু থু দিবে। পকিস্থানি মিলিটারি শুধু আমাদের পরম শত্রু তা না, এরা সাক্ষাৎ শয়তান। এদের কোন ক্ষমা নাই।

আমি নৌকার খোঁজে গেলাম না। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে গিয়ে খবর দিলাম। রাত দুটার সময় তারা এসে দিলদারকে ধরে নিয়ে গেল। দিলদার আমার স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে একবার শুধু বলল, বহেনজি। তারপই চুপ করে গেল। আমার স্ত্রী অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। দিলদারকে সে রাতেই গুলি করে মারা হলো। মৃত্যুর আগেও সে কয়েকবর আমার স্ত্রীকে ডাকলো, বহেনজি, বহেনজি।

আমার স্ত্রী মারা গেল সন্তান হতে গিয়ে। একদিক দিয়ে ভালই হলো। বেঁচে থাকলে সারা জীবন স্বামীকে ঘৃণা করে বাঁচতো। সে বাঁচা তো মৃত্যুর চেয়ে খারাপ। বুঝলেন ভাই সহেব, যুদ্ধ খুব খারাপ জিনিস। যুদ্ধে শুধু পাপের চাষ হয়। আমার মতো সাধারণ একটা মানুষ কতগুলো পাপ করলো চিন্তা করে দেখেন। রোজ হাশরে আমার বিচার হবে। আল্লাহ পাক পাপ-পূণ্য কিভাবে বিচার করেন, আমাকে কী শাস্তি দেন, এটা আমার খুব দেখার ইচ্ছা।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের প্রবন্ধ-- লেখকের দায়


সাহিত্যে পুরস্কার দেওয়ার সময় লেখককে একটি অলিখিত শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়, তা হল এই যে : তোমার লেখা অব্যাহত রাখতে হবে, এবং লেখার মান বাড়ুক কি নাই বাড়ুক অর্জিত মান যেন পড়ে না-যায় সে দিকে লক্ষ রাখবে। এই শর্ত যে-কোন লেখককে সবসময় তটস্থ রাখার পক্ষে যথেষ্ট। একথা, আমার মনে হয়, উপন্যাস-লেখকের ক্ষেত্রে বেশি প্রযোজ্য।

উপন্যাসের সৃষ্টি ঔপনিবেশিক যুগে, অথচ এর অবস্থান ঔপনিবেশিক মানসিকতার বিপক্ষেই। উপন্যাসে সব স্তরের মানুষের যে বিপুল সমাবেশ ঘটে, শ্রেণী গোষ্ঠী সম্প্রদায় নির্বিশেষে যে-বিচিত্র জীবন্ত মানুষ সুষ্টি হয়, মানুষের সৃজনশীল কল্পনার যে-বাঁধভাঙ্গা প্রকাশ ঘটে তা ঔপনিবেশিক আর্থসামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক ব্যবস্থার প্রতি তো রীতিমত হুমকি। এজন্যই কি দন কিহোতে-র মতে শিল্পকর্মকে দুশো বছর লাতিন আমেরিকার স্পানিশ উপনিবেশগুলোয় নিষিদ্ধ করা হয়? কিন্তু উপন্যাসের খোলামাঠে বিপুল লোকসমাগম ও মানুষের স্ফূর্ত কল্পনার উড়াল ঠেকায় কে? স্পেনের ক্ষয়িষ্ণু আভিজাত্যের কাহিনি তাই মদের পিপেয় চালান হয়ে দিব্যি ঢুকে পড়ে বলিভিয়ায়, পেরুতে, লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশে। প্রায় চারশো বছর আগে সের্ভান্তস সাহেব তাঁর নাইটকে যে রুগ্‌ণ ঘোড়ায় চাপিয়েছিলেন তা এখন দাপিয়ে বেড়ায় দুনিয়া জুড়ে। ওই রুগ্‌ণ ঘোড়ার দাপটে সত্যিই অভিভূত না হয়ে পারা যায় না।

উপন্যাস বড় হয়েছে ব্যক্তির বিকাশ ঘটতে ঘটতে। আবার ব্যক্তির বিকাশ ঘটাতেও উপন্যাসের ভূমিকা কম নয়। ওদিকে পাশ্চাত্যে ব্যক্তিস্বাধীনতার উন্মেষ না-ঘটতেই তা রুপান্তরিত হয়েছে ব্যক্তিসর্বস্বতায়। উপন্যাসে ব্যক্তি আসছে নানান রঙে নানান ঢঙে।

আমাদের এই উপমহাদেশে ব্যক্তির বিকাশ প্রথম থেকেই বাধা পেয়ে এসেছে। এখানে ব্যক্তিপ্রবরটি জন্ম থেকেই পঙ্গু ও দুর্বল। পাশ্চাত্যের সর্বত্রই যেহেতু ব্যক্তিসর্বস্বতার জয়গান, আমাদের এখানেও তাই জন্মরোগা ব্যক্তিটির দিকেই আমাদের লেখকদের অকুণ্ঠ মনোযোগ। বাংলা উপন্যাসে প্রথমে এই রুগ্‌ণ ব্যক্তির শরীরে একটু তেজ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সেই নকল তেজ তাকে শক্তি যোগাতে পারেনি। কেবল তা-ই নয়, বাংলা সাহিত্যের প্রথম সফল উপন্যাসগুলোয় বরং দেশের কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতাকে প্রতিষ্ঠিত মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের মর্যাদাই দেওয়া হয়। অথচ অন্যান্য সাহিত্যের উপন্যাসে তখন প্রচলিত সংস্কার, মূল্যবোধ ও বিশ্বাসকে অবিরাম আঘাত করা হয়েছে।

ঔপনিবেশিক শক্তির উপহার এই খঞ্জ ব্যক্তিটিই হয়ে ওঠে লেখকদের আদরের ধন। তাকে নানাভাবে তোয়াজ করাই হল আমাদের ঔপন্যাসিকদের আসল কাজ। দেশের অসংখ্য শ্রমজীবি মানুষের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ এবং আবার স্বপ্ন দেখার অসীম শক্তি আমাদের চোখে পড়ে না। এজন্য শ্রমজীবি, নিম্নবিত্ত মানুষকে নিয়ে যখন লিখি তখনও পাকেপ্রকারে তার মধ্যে ঢুকিয়ে দেই মধ্যবিত্তকে এবং শক্তসামর্থ্য, জীবন্ত মানুষগুলোকে পানসে ও রক্তশুন্য করে তৈরি করি। বাংলাদেশে এখন চলছে শ্রমজীবি মানুষের সঙ্গে মধ্যবিত্তের বিচ্ছেদ-প্রক্রিয়া। ফলে আমাদের সংস্কৃতির বনিয়াদ চলে যাচ্ছে আমাদের চোখের আড়ালে। আমাদের গান, আমাদের ছবি, আমাদের কবিতার উৎস যে-জীবন ও সংস্কৃতি তাদের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটায়, সংখ্যার দিক দিয়ে বিস্ফোরণ হলেও, আমাদের উপন্যাস দিন দিন রক্তহীন হয়ে পড়ছে। একই কাহিনি নানান বয়ানে শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্ত। তবে ক্লান্তিও লেখকরা লুফে নেন এবং জীবনে একেই একমাত্র সত্য বলে জাহির করার সুযোগ খোঁজেন।

বাংলার মুসলমান মধ্যবিত্তের বিকাশ ঘটেছে আরও দেরিতে। বাঙালি জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সমাজে উপন্যাসের চর্চা শুরু হয়েছে বাংলা ভাষায় প্রথম উপন্যাস রচনার অনেক পরে। বাংলাদেশের প্রধান ঔপন্যাসিক প্রয়াত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ ধর্মীয় কিংবা সামাজিক কুসংস্কারকে গৌরব দেওয়ার কাজে লিপ্ত হননি। বরং এই সমাজের ধর্মান্ধতাকেই তিনি প্রবল শক্তিতে আঘাত করেছেন। নিজ সম্প্রদায়ের শেকড়সন্ধানের প্রয়াস এবং পশ্চাৎপদ সংস্কারকে আঘাত করার চেষ্টা তিনি করেছিলেন একই সঙ্গে। তাঁর শেষ উপন্যাসে তাই তাঁকে একটি স্বকীয় ভাষারীতিও তৈরি করতে হয়েছে। কিন্তু তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ না-করে আমরা বরং পাঠকের মনোরঞ্জনের কাজেই নিয়োজিত হয়েছি। আমরা কৃশকায় মধ্যবিত্ত ব্যক্তির তরল ও পানসে দুঃখবেদনার পাঁচালি গাই, কিন্তু এতে উপন্যাসে কি ব্যক্তির যথাযথ সামাজিক অবস্থানটি কোনভাবেই প্রকাশিত হয়? এতে শেষে যে-ব্যক্তিটিকে উদ্ধার করি সে কিন্তু রেনেসাঁসের সেই শক্তসমর্থ্য, উচ্চাকাঙ্ক্ষী মানুষ নয় বরং দায়িত্ববোধহীন ফাঁপা এক প্রাণীমাত্র।

আমাদের সংস্কৃতির ভিত্তি অনুসন্ধান করলে সেখানে বাঙালি জাতির একটি অভিন্ন পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু সেই পরিচয় খোঁজা তো দুরের কথা, আমরা শিক্ষিত মানুষেরা, আমাদের বহুল প্রচারিত সংবাদপত্রগুলো, আমাদের স্ফীতোদর রাজনৈতিক সংগঠনসমূহ দীর্ঘদিন থেকে সম্প্রদায়গুলোকে নানাভাবে উসকানি দিয়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেই। সমগ্র জাতির বিকাশে এমন আচরণ কখনই সহায়ক হতে পারে না। নিঃসন্দেহে, সমগ্র জাতির সাংস্কৃতিক ভিত্তি অনুসন্ধান করা একটি কঠিন কাজ। কিন্তু 'কঠিনেরে ভালবাসিলাম'-এটুকু জেদ না-থাকলে কারও শিল্পচর্চায় হাত দেওয়ার দরকার কী?

আজ এই পুরস্কার নিতে আনন্দের সঙ্গে আমার একটু সংকোচও হয় বইকী। দেশের কী জাতির সংস্কৃতির গোড়ায় না-গিয়ে যদি নিজের আর বন্ধুদের আর আত্মীয়-স্বজনের স্যাঁতসেঁতে দুঃখবেদনাকেই লালন করি তো তাতে হয়তো মধ্যবিত্ত কী উচ্চবিত্তের সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টি হবে, কিন্তু তা থেকে তারা নিজেদের জীবনযাপনে যেমন কোন অস্বস্তিও বোধ করবে না, তেমনই পাবে না কোন প্রেরণাও। তা হলে আমার যাবতীয় সাহিত্যকর্ম ভবিষ্যতের পাঠকের কাছে মনে হবে নেহাতই তোতলা বাখোয়াজি।

(এই গদ্যটির প্রকাশকাল ২৮ এপ্রিল, ১৯৯৬, কলকাতা, আনন্দবাজার পত্রিকা। তাঁর 'সংস্কৃতির ভাঙা সেতু' প্রবন্ধগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত।)

হারুকি মুরাকামির গল্প : এপ্রিলের এক অপরূপ



হারুকি মুরাকামি
মূল : হারুকি মুরাকামি
অনুবাদ : শিবব্রত বর্মনএপ্রিলের এক অপরূপ সকালে, টোকিওর কেতাদুরস্ত হারাজুকু এলাকার সংকীর্ণ রাস্তায় আমি মুখোমুখি হেঁটে গেলাম আমার জন্য ১০০% নিখুঁত মেয়েটির সামনে দিয়ে।

সত্যি কথা বলতে কী, সে যে দেখতে খুব সুন্দর তা নয়। ভিড়ের মধ্যে তাকে আলাদা করা যাবে না। এমন বিশেষ চমকদার পোশাকও পরেনি সে। ঘুম ভেঙে এইমাত্র উঠে আসার কারণে অপরিপাটি পেছনের চুল। বয়সও খুব কম নয় — তিরিশের কাছাকাছি হবে। সেভাবে বললে, তাকে ‘মেয়ে’ই বলা চলে না। তবু পঞ্চাশ গজ দূর থেকেও আমি টের পেলাম: সে আমার জন্য ১০০% নিখুঁত মেয়ে। তাকে দেখামাত্র আমার বুকের ভেতরটা ধুকপুক করতে থাকলো, মরুভূমির মতো শুকিয়ে গেল জিহ্বা।

আপনাদের হয়তো নিজ নিজ প্রিয় ধাঁচের মেয়ে আছে — কারো বা হয়তো, ধরা যাক, চিকন হাঁটুর মেয়ে পছন্দ, কারো বড় বড় চোখের, কারো বা কোমনীয় আঙুলের, অথবা আপনি হয়তো তেমন কোনো বিশেষ কারণ ছাড়াই কোনো মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন। আমার নিজেরও কিছু বিশেষ পছন্দ-অপছন্দ আছে। মাঝে মাঝে রেস্টুরেন্টে পাশের টেবিলের কোনো মেয়ের দিকে আমার চোখ আটকে যায় শুধু তার নাকটা আমার ভালো লেগে গেছে বলে।
তবে কেউ জোর গলায় বলতে পারবে না, তার জীবনের ১০০% নিখুঁত মেয়েটি আগে থেকে ঠিক করে রাখা কোনো ধাঁচের। এই যে নাকের ব্যাপারে আমার এতো বাছবিচার, কিন্তু সেই ১০০% নিখুঁত মেয়েটির নাকের আকৃতি আমি মনেই করতে পারছি না — এমনকি তার নাক ছিল কিনা সেটাই আমার মনে নেই। শুধু এটুকু আমি নিশ্চিত মনে করতে পারি যে, সে তেমন একটা সুন্দর ছিল না। অদ্ভুত ব্যাপার।

‘গতকাল রাস্তায় যেতে যেতে ১০০% নিখুঁত মেয়ের দেখা পেয়েছি,’ কোনো এক লোককে বললাম আমি।

লোকটা বলল, ‘তাই নাকি? খুব সুন্দর দেখতে?’

‘না তেমন একটা নয়।’

‘তাহলে তোমার পছন্দের ধাঁচের, তাই না?’

‘জানি না। তার কোনো কিছুই মনে নাই — চোখ বা বুকের আকার।’

‘অদ্ভুত।’

‘হ্যাঁ। অদ্ভুত।’

বিরক্ত হয়ে লোকটা বলে, ‘তা, তুমি কী করলা? কথা বললা? পিছন পিছন গেলা?’

‘নাহ। শুধু রাস্তায় পাশ কাটিয়ে গেলাম।’

মেয়েটা পূর্ব থেকে পশ্চিমে হেঁটে যাচ্ছে, আমি যাচ্ছি পশ্চিম থেকে পূবে। এপ্রিলের অপূর্ব এক সকাল।

ইস্‌, যদি কথা বলতে পারি মেয়েটার সাথে। আধা ঘণ্টা কথা বলতে পারলেই হয়ে যায়: মেয়েটাকে শুধু তার নিজের সম্পর্কে বলতে বলবো, আমার সম্পর্কেও অনেক কিছু বলবো তাকে, আর তাকে বলবো — বলতে পারলে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগবে — ১৯৮১ সালের এপ্রিলের এক অপূর্ব সকালে হারাজুকু এলাকার এক সরু রাস্তায় আমাদের এভাবে মুখোমুখি হেঁটে যাওয়ার ঘটনাটি ঘটনোর পেছনে ভাগ্যের কী যে জটিল এক ষড়যন্ত্র কাজ করছে। এর মধ্যে নিশ্চয়ই বহু গোপন ব্যাপার ঠাসা আছে, শান্তির সময়ে বানানো একটা প্রাচীন ঘড়ির মতো।

রাস্তায় কথা বলার পর আমরা হয়তো কোথাও লাঞ্চ করতে বসবো, হয়তো উডি অ্যালানের কোনো সিনেমা দেখবো, ককটেল খেতে কোনো হোটেল বারে গিয়ে বসবো। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে, ব্যাপারটা হয়তো বিছানা পর্যন্ত গড়াবে।

একের পর এক সম্ভাবনা আমার মনের দরজায় কড়া নাড়ছে।

আমাদের দুজনের মধ্যেকার দূরত্ব এবার পঞ্চাশ গজে কমে এসেছে।

কীভাবে শুরু করবো? কী বলবো?

‘গুড মর্নিং, মিস। আপনার সাথে একটু কথা বলতাম, এই আধা ঘণ্টার মতো। সময় হবে কি?’

হাস্যকর। ইন্সুরেন্সের দালালের মতো শোনাবে।

‘মাপ করবেন, এখানে আশপাশে সারারাত খোলা থাকে এমন ধোপার দোকান আছে নাকি, বলতে পারেন?’

না, এটাও সমান হাস্যকর। প্রথম কথা হলো, আমার হাতে ময়লা কাপড়ের গাট্টি নেই। এরকম একটা বাক্য কার বিশ্বাস হবে?

হয়তো সহজ সত্য কথাটা বলে দিলেই কাজ হয়ে যাবে। ‘গুড মর্নিং, আপনি আমার জন্য ১০০% নিখুঁত মেয়ে।’

না, সে এই কথা বিশ্বাস করবে না। কিংবা বিশ্বাস যদি করেও, আমার সাথে হয়তো কথা বলতে চাইবে না। স্যরি, সে হয়তে বলবে, আপনার জন্য ১০০% নিখুঁত মেয়ে আমি হলে হতেও পারি, কিন্তু আপনি আমার জন্য ১০০% নিখুঁত ছেলে নন। এমনটা হতেই পারে। আর যদি এই পরিস্থিতি হয়, আমি সম্ভবত খানখান হয়ে যাবো। এ আঘাত আমার পক্ষে আর কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। আমার বয়স এখন বত্রিশ, আর বয়স বাড়লে এরকম আঘাত সামলানো দায় হয়ে যায়।

একটা ফুলের দোকানের সামনে আমরা একে অপরকে পেরিয়ে গেলাম। একটা মৃদু, উষ্ণ বাতাসের ঝাপটা আমাকে ছুঁয়ে গেল। রাস্তার এসফল্ট স্যাঁতস্যাতে, আর আমার নাকে এসে লাগলো গোলাপের গন্ধ। তার সাথে কথা বলা আমার পক্ষে সম্ভব না। মেয়েটা একটা সাদা সোয়েটার পরেছে, আর তার ডান হাতে একটা ধবধবে সাদা খাম ধরা, খামে একটা ডাকটিকেট লাগানো। সে তাহলে কাউকে চিঠি লিখেছে, হয়তো সারা রাত জেগে চিঠিটা লিখেছে সে, তার ঘুমঘুম চোখ দেখে এমনটা অনুমান করাই যায়। ওই খামের ভিতর হয়তো তার জীবনের সব গোপন কথা লেখা আছে।

আমি আরো কয়েক কদম এগিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম: মেয়েটা ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেছে।

* * *
এখন আমি নিশ্চিত করে জানি, ঠিক কোন কথাটা বলা যেতো মেয়েটাকে। সেটা একটা লম্বা বক্তৃতাই হয়ে যেত, এত লম্বা যে, আমি ঠিকঠাক মতো বলতে পারতাম কিনা, কে জানে। আমার মাথায় যেসব বুদ্ধি আসে, কোনোটাই খুব বাস্তববাদী হয় না।

সে যাই হোক। আমি শুরু করতে পারতাম, ‘এক যে ছিল,’ দিয়ে, আর শেষ করতাম,‘বড় করুণ কাহিনি, তাই না?’ দিয়ে।

* * *

এক যে ছিল ছেলে, আর এক যে ছিল মেয়ে। ছেলেটার বয়স ছিল আঠার আর মেয়েটার ষোল। ছেলেটা দেখতে এমন কোনো রাজপুত্তুর ছিল না, আর মেয়েটাও ছিল না তেমন বলার মতো সুন্দর। আর দশজনের মতো তারা ছিল কেবলই সাধারণ নিঃসঙ্গ এক ছেলে আর সাধারণ নিঃসঙ্গ এক মেয়ে। তবে তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতো যে, পৃথিবীতে কোথাও তার জন্য ১০০% নিখুঁত একটা ছেলে আর ১০০% নিখুঁত একটা মেয়ে আছে। হ্যাঁ, তারা বিশ্বাস করতো একদিন অলৌকিক একটা কিছু ঘটবে। আর সেই অলৌকিক ঘটনাটা সত্যি সত্যি ঘটেছিল।

একদিন একটা রাস্তার কোণায় তাদের একে অপরের দেখা হয়ে গেল।

‘অবিশ্বাস্য ঘটনা,’ ছেলেটা বলল। ‘আমি সারা জীবন ধরে তোমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। হয়তো বিশ্বাস করবে না, কিন্তু তুমি হচ্ছো আমার জন্য ১০০% নিখুঁত মেয়ে।‘

‘আর তুমি,’ মেয়েটি বলল ছেলেটিকে, ‘তুমি হচ্ছো আমার জন্য ১০০% নিখুঁত ছেলে। তোমাকে যে-যে ভাবে কল্পনা করেছিলাম, তুমি ঠিক ঠিক তাই। এ যে একেবারে স্বপ্ন।’

তারা একটা পার্কের বেঞ্চে বসলো, হাতে হাত ধরে। আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা একে অপরকে তাদের নিজ নিজ কাহিনি বললো। এখন তারা আর নিঃসঙ্গ নয়। তারা একে অপরের ১০০% নিখুঁত অপরকে খুঁজে পেয়েছে। ১০০% নিখুঁত অপরকে আবিষ্কার করা এবং নিজে তার দ্বারা আবিষ্কৃত হওয়া কী বিস্ময়করই না এক ব্যাপার। এ এক দৈব ঘটনা, মহাজাগতিক দৈব।

তারা যখন বসে কথা বলছিল, তখন ক্ষীণ এক চিলতে সন্দেহের রেখা তাদের মনে আসন গেড়ে বসলো। এতো সহজে কারো স্বপ্ন সত্যি হয়ে যাওয়া কি ঠিক হচ্ছে?

আর তাই, তাদের দুজনের কথা মধ্যে যখন মুহূর্তের নীরবতা নেমে এসেছে, ছেলেটা মেয়েটাকে বললো, ‘চলো নিজেদের পরীক্ষা করি — শুধু একবারের জন্য। আমরা যদি সত্যি সত্যি একে অন্যের ১০০% নিখুঁত মনের মানুষ হই, তাহলে অন্য কোথাও অন্য কোনোখানে আমাদের আবার দেখা হবে। হবেই। যখন সেটা ঘটবে, আমরা সেবারও জেনে যাবো যে, আমরা একে অপরেরর ১০০% নিখুঁত জুটি, আর তক্ষুণি আমরা বিয়ে করবো। তোমার কী মত?’

‘হ্যাঁ,’ মেয়েটি বললো, ‘ঠিক তাই করা উচিৎ আমাদের।’

আর তারা আলাদা হয়ে গেল। মেয়েটা গেল পুব দিকে, ছেলেটা পশ্চিমে।

নিজেদের ওরকম একটা পরীক্ষার মুখে ঠেলে দেওয়ার তাদের কোনোই প্রয়োজন ছিল না। এরকম একটা পরীক্ষায় নিজেদের দাঁড় করানো তাদের উচিৎই হয়নি, কেননা তারা আসলেই ছিল একে অপরের ১০০% নিখুঁত জুটি, আর তাদের যে দেখা হয়ে গেছে, এটাই ছিল একটা দৈব। কিন্তু এটা জানা তো আর তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না, তাদের যে বয়স কম। ভাগ্যের হিমশীতল, অকরুণ ঢেউ এসে তাদের শূন্যে ছুড়ে দিলো বড় নিষ্ঠুরভাবে।

এক শীতের মৌসুমে ছেলে আর মেয়ে দুজনেরই কঠিন ইনফ্লুয়েঞ্জা রোগে ধরলো, কয়েক সপ্তাহ ধরে জীবন আর মৃত্যুর দোলাচলে দুলতে দুলতে তারা দুজন তাদের দেখা হওয়ার সব স্মৃতি হারিয়ে ফেলল। যখন তারা জাগলো, তখন তাদের মাথা শিশু ডি এএইচ লরেন্সের পয়সা জমানোর মাটির ব্যাংকটার মতো ফাঁকা হয়ে গেছে।

দুজনেই তারা প্রতিভাবান, শক্ত মনের মানুষ। তাই নিজেদের নিরলস চেষ্টায় তারা আবার সেই জ্ঞান আর অনুভূতি অর্জন করে নিতে পারলো, যার গুণে তারা সমাজের পরিপূর্ণ সদস্য হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। আর ঈশ্বরের কী কৃপা, তারা এমন সুযোগ্য নাগরিক হয়ে উঠলো, যারা জানে এক সাবওয়ে লাইন বদলে কীভাবে আরেক সাবওয়ে লাইনে যেতে হয়, জানে কীভাবে পোস্টাপিসে গিয়ে বিশেষ-ডেলিভারি চিঠি পাঠাতে হয়। আর, কথা হলো, পরবর্তীকালে প্রেমের অভিজ্ঞতাও তাদের হয়েছে, কখনও কখনও ৭৫%, এমনকি কখনও ৮৫% পর্যন্ত প্রেম।

এরপর সময় গড়াতে থাকলো ঝড়ের গতিতে। দেখতে না দেখতে ছেলেটা বত্রিশে পা দিলো, আর মেয়েটা ত্রিশে।

এবং এপ্রিলের এক চমৎকার সকালে দিনের প্রথম কফিটার সন্ধানে ছেলেটা পশ্চিম থেকে পুবে হেঁটে যাচ্ছিল, আর একটা বিশেষ-ডেলিভারি চিঠি পোস্ট করার জন্য ঠিক সেই সময় মেয়েটা হেঁটে যাচ্ছিল পুব থেকে পশ্চিমে। দুজনেই হাঁটছিল টোকিওর হারাজুকু এলাকার একই সংকীর্ণ রাস্তা ধরে। রাস্তাটার ঠিক মাঝখানে তারা একে অপরকে পেরিয়ে গেল। আর তখন তাদের হৃদয়ের কোনো এক কোণায় মুহূর্তের তরে দোলা দিয়ে গেল নিজ নিজ হারিয়ে যাওয়া স্মৃতির খুবই আবছা এক উদ্ভাস। দুজনেরই বুকের ভেতরটা একটু ধুকপুক করে উঠলো। আর তারা বুঝতে পারলো:

এই হলো আমার জন্য ১০০% নিখুঁত মেয়ে।

এই হলো আমার জন্য ১০০% নিখুঁত ছেলে।

কিন্তু তাদের স্মৃতির সেই আভা বড়ই আবছা। আর তাদের চিন্তায়ও চৌদ্দ বছর আগের সেই টলটলে ভাব ক্ষয়ে গেছে। তাই কোনো কথা না বলে তারা একে অপরকে পেরিয়ে গেল, মিশে গেল ভিড়ের মধ্যে। চিরকালের জন্যে।

খুব করুণ গল্প, তাই না?

* * *

হ্যাঁ। এটাই। এই কথাটাই মেয়েটাকে বলা উচিৎ ছিল।