Friday, December 7, 2018

এলিস মুনরো'এ গল্প : অ্যামান্ডসেন


মুল গল্পঃ এলিস মুনরো

অনুবাদ : নাসরীন সুলতানা

স্টেশনের বাইরের বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করছিলাম। স্টেশন এখন বন্ধ। শুধুমাত্র ট্রেন এলেই স্টেশন খোলা হয়। বেঞ্চের অন্য প্রান্তে একজন মহিলা তার দুই হাঁটুর মাঝে অয়েল-পেপারে মোড়ানো ছোট-ছোট কিছু পুঁটুলি ভরা একটি খুঁতি নিয়ে বসেছিলেন। মাংস- কাঁচা মাংস। আমি গন্ধ পাচ্ছিলাম।

রেললাইনের উপরে বৈদ্যুতিক রেলগাড়ি, শুন্য, অপেক্ষারত।

 

অন্য আর কোন যাত্রী দেখা গেল না এবং কিছুক্ষন পর স্টেশনমাস্টার তার মাথা স্টেশনের জানালা গলিয়ে হাঁকলেন, ‘স্যান’। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম তিনি স্যাম নামের কোন লোককে ডাকছেন। এবং তারপর কেমন এক ধরনের উর্দি পরা অন্য একজন লোক অট্টালিকার শেষ প্রান্ত থেকে ঠিকই বেরিয়ে এলেন। তিনি রেললাইন পার হয়ে বৈদ্যুত্যিক গাড়িতে চড়লেন। পুঁটুলিওয়ালী মহিলা উঠে তাকে অনুসরন করলেন। তাই আমিও তা-ই করলাম। রাস্তার ওপাশ থেকে হঠাৎ ভীষন একটা শোরগোলের শব্দ শোনা গেল, এবং কালচে টালির অনুভূমিক ছাদের অট্টালিকার দরজা খুলে এক সাথে কয়েকজন লোক মুক্ত হলো। তারা চাপ দিয়ে টেনে-টুনে মাথায় ক্যাপ পরতে পরতে বেরিয়ে এল এবং তাদের হাতের টিফিন বাটিগুলো হাঁটার সময় তাদের উরুর সাথে বাড়ি খেয়ে ঠন-ঠন শব্দ করছিল। সৃষ্ট সেই শব্দে এমনও মনে হতে পারতো যে গাড়িটা যেন যে-কোন মুহুর্তে তাদের ফেলে চলে যাবে। কিন্তু তারা গাড়িতে চড়ে সুস্থির হয়ে বসার পরও কিছুই ঘটলো না। গাড়ি বসেছিল, এবং তখন তারা একে অন্যকে গুনে অনুপস্থিত ব্যাক্তিটি কে তা সনাক্ত করার চেষ্টা করতে করতে চালককে বলল যে তখনো যাওয়া যাবে না। তারপর কোন একজনের মনে পড়লো যে অনুপস্থিত লোকটি সারাদিনই আশেপাশে ছিল না। গাড়ী চলা শুরু করল, যদিও আমি বলতে পারবো না যে চালক আদৌ তাদের এই সব কথা শুনছিল কিম্বা গুরুত্ব দিচ্ছিল কিনা।

লোকগুলো বনের মধ্যে একটা করাত-কলে নামল। হাঁটা পথে কোন ভাবেই দশ মিনিটের বেশী হবে না, এবং তার খানিকটা পরেই বরফাবৃত একটা হ্রদ নজরে এলো। তার সামনে একটা সাদা লম্বা কাঠের অট্টালিকা। মহিলা তার পুঁটুলি গুছিয়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং আমি তাকে অনুসরন করলাম। চালক আবার হাঁকলেন ‘স্যান’ এবং দরজা খুলে গেল। কয়েকজন মহিলা গাড়িতে চড়ার অপেক্ষায় ছিলেন। তারা মাংসওয়ালী মহিলাকে অভ্যর্থনা জানালেন এবং তিনি বললেন যে এটা একটা হাড় কাঁপানো শীতের দিন।

আমি মাংসওয়ালী মহিলার পিছু-পিছু নীচে নামলেও অন্য সবাই ইচ্ছাকৃতভাবেই আমাকে না দেখার ভান করলো।

দরজার পাল্লা দুটো ঘটাং করে বন্ধ হয়ে ট্রেন আবারও চলতে শুরু করলো।

তারপর অপরিমেয় নিরবতা এবং হীম-শীতল বাতাস। শুকনো খড়খড়ে ভঙ্গুর-সদৃশ্য সাদা বাকলে কালো দাগের বার্চ গাছ এবং কিছু অবিন্যাস্ত ছোট ছোট চিরহরিৎ গুল্ম ঘুমন্ত ভাল্লুকের মত পাকানো। হিমায়িত হ্রদ তীরের দিকে ঢিবির মত উঁচু, যেন ঢেউগুলো আছড়ে পড়তে-পড়তে বরফে রুপান্তরিত হয়েছে। এবং সেই  অট্টালিকা, তার সারি-সারি সুপরিকল্পিত জানালা এবং তার দুই পাশে কাঁচ ঘেরা বারান্দা। উঁচু গম্বুজাকৃতির মেঘের নীচে সব কিছুই সাদা-কালো, অনাড়ম্বর, সুমেরীয়। অপার ঐন্দ্রজালিক নীরবতা।

কিন্তু বার্চের বাকল আদৌ সাদা নয়-যত কাছে যাওয়া যায় ততই বোঝা যায়—ধূসর-হলুদ, ধূসর-নীল, ধূসর।

“কোন দিকে যাবেন?”, মাংসওয়ালী মহিলা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন। “সাক্ষাতের সময় তিনটেয় শেষ হয়ে গেছে”।

“আমি দর্শনার্থী নই”, আমি বললাম, “আমি নতুন শিক্ষিকা”।

“তারপরও, তারা এমনিতেই আপনাকে সামনের দরজা দিয়ে যেতে দেবে না”, কিছুটা প্রত্যয়ের সাথেই মহিলা বললেন। “আপনি বরং আমার সাথে আসুন। আপনার কি স্যুটকেস নাই”?

“স্টেশনমাস্টার পরে নিয়ে আসবেন বলেছেন”।

“যেভাবে দাঁড়িয়ে আছেন, মনে হচ্ছে আপনি হারিয়ে গেছেন”।

আমি তাকে বললাম যে, জায়গাটা খুব সুন্দর বলে আমি সেখানে থেমেছিলাম।

“কেউ কেউ অমন ভাবতেই পারে— যদি তারা বেশী ব্যস্ত বা বেশী অসুস্থ না থাকে”।

অট্টালিকার শেষপ্রান্তে রসুইখানায় ঢোকার আগ পর্যন্ত আমার সাথে তার আর কোন কথা হয় নি। রসুইখানায় ঢুকে চারিদিকে কোন কিছু দেখার সুযোগ পেলাম না, কারন তার আগেই তিনি আমার বুটের দিকে দৃষ্টি আকর্ষন করালেন।

“মেঝেতে দাগ পড়ার আগেই বরং আপনি ওগুলো খুলে ফেলুন”।

বুট খুলতে আমার রীতিমত কুস্তি করতে হল-সেখানে বসার জন্য কোন চেয়ার ছিল না, এবং খুলে শতরঞ্জির উপর, যেখানে ঐ মহিলা তার জুতো রেখেছেন তার পাশে রাখলাম।

“ওগুলো তুলে আপনার সাথে করে নিয়ে আসুন। আমি জানি না তারা আপনাকে কোথায় রাখবে। আপনি বরং কোটও পরে থাকুন। ক্লোকরুমে কোন হিটিং নেই”।

হিটিং নেই, আলো নেই- শুধু মাত্র আমার নাগালের বাইরের একটা ছোট্ট জানালা দিয়ে যেটুকু আসছে সেটুকু ছাড়া। যেন স্কুলে শাস্তি ভোগ করছি, কোন কিছু ঘটলেই ক্লোকরুমে পাঠিয়ে দাও। হ্যাঁ, সেই একই রকমের শীতের কাপড়ের গন্ধ যা আদৌ কখনো ঠিকমত শুকোয় না, অথবা জবজবে ভেজা বুট চুইয়ে নোংরা হওয়া মোজা, অপরিস্কার পা।

আমি বেঞ্চের উপরে উঠলাম কিন্ত তাতেও বাইরটা দেখতে পেলাম না। তাকের উপর যেখানে এলোমেলো ভাবে টুপি এবং স্কার্ফ রাখা ছিল সেখানে আমি একটা থলের মধ্যে কিছু ডুমুর আর খেজুর দেখতে পেলাম। নিশ্চয় কেউ একজন চুরি করে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য এখানে লুকিয়ে রেখেছে। হঠাৎ করেই আমার খুব ক্ষুধা পেল। ওন্টারিও’র নর্থল্যান্ডে পনিরের একটা শুকনো স্যান্ডউইচ ছাড়া সকাল থেকে কিছুই পেটে পড়েনি। আমি চোরের কাছ থেকে চুরি করার নৈতিকতা নিয়ে ভাবছিলাম। কিন্তু সেই ডুমুর আমার দাঁতে ধরা দিয়ে আমাকে বিপথে পরিচালিত করলো।

আমি কোন রকম নীচে নেমে এলাম- কেউ একজন ক্লোকরুমে ঢুকছিল।

রান্নাঘরের সাহায্যকারীদের কেউ নয়। গায়ে একটা ভারী শীতের কোট এবং চুলে স্কার্ফ জড়ানো এক স্কুল-পড়ুয়া মেয়ে। সে হুড়মুড় করে ঢুকে এমন ভাবে-বইগুলো বেঞ্চের উপর ফেললো যে, সেগুলো বেঞ্চ থেকে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়লো। মেয়েটি এক-ঝটকায় স্কার্ফ খুলে ফেললো এবং তাতে একসাথে জড়ানো তার সব চুল  ঝপ করে বেড়িয়ে পড়লো। মনে হলো, সেই একই সময় সে হ্যাঁচকা টানে বুট খুলে হালকা একটা লাথি দিয়ে মেঝে পার করলো। তাকে নিবৃত করার মত সেখানে কেউ ছিল না, দৃশ্যত, তাকে দিয়ে সেগুলো রান্নাঘরের দরজায় খুলিয়ে নেয়ার মত কেউই ছিল না।

“হায় হায়! আমি তো আপনাকে আঘাত করতে চাইনি”, মেয়েটি বলল। “বাইরে থেকে ভিতরে এলে এত  অন্ধকার লাগে যে, কি করছি-না-করছি বোঝা যায় না। আপনি কি ঠান্ডায় জমে যাচ্ছেন না? আপনি কি কারো কাজ শেষ হওয়ার অপেক্ষায় আছেন”?

“আমি ডাক্তার ফক্সের জন্য অপেক্ষা করছি”।

“তাই, তা হলে তো, আপনাকে বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হবে না। আমি মাত্র তার গাড়িতে শহর থেকে ফিরেছি। আপনি তো অসুস্থ নন, তাই না? অসুস্থ হলে তো এখানে দেখাতে পারবেন না। তার সাথে আপনার শহরেই দেখা করতে হবে”।

“আমি নতুন শিক্ষিকা”।

“তাই? আপনি টরন্টো থেকে এসেছেন”?

“হ্যাঁ”।

সে খানিকটা থামল, সম্ভবত সন্মান দেখানোর জন্য।

কিন্ত না। আমার কোটের পর্যবেক্ষনের জন্য।

“এটা আসলেই খুব সুন্দর। কলারের ঐ পশম কিসের”?

“পারস্যের ভেড়ার। আসলে এটা কৃত্রিম”।

“আমি তো সত্যি বলেই বিশ্বাস করতাম। আমি বুঝতে পারছি না, আপনাকে এখানে কি জন্য রাখা হয়েছে- ঠান্ডায় তো আপনার পাছা সুদ্ধ জমে যাবে! মাফ করবেন। আপনি ডাক্তার সাহেবের সাথে দেখা করতে চান, আমি আপনাকে নিয়ে যেতে পারি। এ বাড়ির অন্ধি-সন্ধি সব আমার জানা। আমি বলতে গেলে জন্ম থেকেই এখানে আছি। আমার মা রসুইখানা চালান। আমার নাম ম্যারি। আপনার নাম কি”?

“ভিভি, ভিভিয়েন”।

“আপনি যেহেতু শিক্ষিকা, এটা কি ‘মিস’ হওয়া উচিত নয়? মিস কি”?

“মিস হাইড”।

“ট্যান ইওর হাইড”, দুঃখিত, এইমাত্র এটা মনে পড়ল। আপনি যদি আমার শিক্ষক হতেন তা হলে খুব খুশী হতাম। কিন্তু আমাকে শহরের স্কুলে যেতে হচ্ছে। যত্তোসব নিয়ম! কারন আমার তো যক্ষ্মা নেই”।

সে কথা বলতে বলতে আমাকে ক্লোকরুমের অপর প্রান্তের দরজা দিয়ে একটা সাধারন হাসপাতালের বারান্দা ধরে পথ দেখাচ্ছিল—চকচকে নিনোলিয়ামের মেঝে, দেয়ালে ফ্যাকাসে সবুজ রং এবং চারিদিকে জীবানুনাশকের গন্ধ।

“এখন আপনি যখন এখানে এসেছেন, আমি হয়ত রেডিকে বলে স্কুলে বদলে নেবো”।

“রেডি কে”?

“রেডি ফক্স। বই থেকে নামটা নিয়েছি। আমি আর অ্যানাবেল ডাক্তার ফক্সকে এমনি এমনি এই নামে ডাকা শুরু করেছিলাম”।

“অ্যানাবেল কে”?

“এখন আর কেউ না। মারা গেছে”।

“ওহ, আমি তোমার মনে কষ্ট দিয়ে ফেললাম”।

“আপনার কোন ভুল হয়নি না। এখানে এমন হয়। এই বছর আমি হাইস্কুল শুরু করেছি। অ্যানাবেল আসলে কখনোই স্কুলে যেতে পারেনি। আমি যখন সাধারন পাবলিক স্কুলে পড়তাম তখন রেডি শিক্ষককে বলে আমাকে অনেকটা সময় বাসায় থাকার ব্যাবস্থা করেছিল যাতে আমি অ্যানাবেলকে সংগ দিতে পারি”।

ভেজানো একটা দরজায় থেমে ম্যারি শিষ দিল।

“হেই, আমি শিক্ষিকাকে নিয়ে এসেছি”।

একটা পুরুষ কন্ঠ বলল, “ঠিক আছে ম্যারি। আজ একদিনের জন্য তুমি যথেষ্ট করেছো”।

সে ধীর গতিতে সরে গিয়ে আমাকে একজন হালকা-পাতলা সাধারন উচ্চতার পুরুষের মুখোমুখি রেখে গেল যার লালচে সোনালি চুল খুব ছোট করে কাটা যা করিডোরের কৃত্রিম আলোতে চকচক করছিল।

“আপনার তো ম্যারির সাথে দেখা হয়েছে”, তিনি বললেন। “ও নিজের সম্পর্কে অনেক কিছু বলে তবে ও আপনার ক্লাসে পড়বে না। তাই আপনাকে এই বকবকানি প্রতিদিন শুনতে হবে না। যদিও কিছু-কিছু মানুষ তাকে পছন্দ করে আবার কিছু-কিছু মানুষ তাকে অপছন্দও করে”।

তাকে দেখে আমার মনে হল তিনি আমার চেয়ে হয়ত দশ-পনেরো বছরের বড় হবেন এবং প্রথমে তিনি এমনভাবে কথা বললেন যেন তিনি একজন বয়স্ক মানুষ- একজন নিবিষ্ট চিন্তার ভবিষ্যত নিয়োগদাতা। তিনি আমার ভ্রমনের কথা, আমার স্যুটকেসগুলোর কথা জিজ্ঞেস করলেন। তিনি জানতে চাইলেন টরন্টো থেকে এসে এই বনের মধ্যে থাকতে আমার কেমন লাগতে পারে এবং সে সম্পর্কে আমার কোন ধারনা আছে কিনা কিম্বা একঘেয়েমিতে ভুগব কিনা।

“একেবারেই না”, আমি বললাম এবং যোগ করলাম যে জায়গাটা খুব সুন্দর। “এটা অনেকটা—এটা অনেকটা এমন যেন আমি কোন রাশিয়ান উপন্যাসে বর্নিত দৃশ্যাবলীর মধ্যে আছি”।

তিনি প্রথম বারের মত আমার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকালেন।

“আচ্ছা, তাই? রাশিয়ান কোন উপন্যাস”?

তার চোখ উজ্জ্বল ধূসরাভ নীল। একটা ভ্রু উঁচানো- কিছুটা ছোট্ট পাহাড়ের চূড়ার মত।

এমন নয় যে আমি রাশিয়ান উপন্যাস পড়িনি। আমি কতগুলো আগাগোড়াই পড়েছি এবং কতগুলো আংশিক পড়েছি। কিন্তু তার সেই উঁচানো ভ্রু এবং আমোদিত তথাপি তর্কক অভিব্যাক্তিতে আমি “যুদ্ধ এবং শান্তি” ছাড়া অন্য কোন নামই মনে করতে পারছিলাম না। কিন্তু আমি এ নামটা বলতে চাচ্ছিলাম না কারন এটা সেই নাম যেটা যে-কারোই মনে আসতে পারে।

“‘যুদ্ধ এবং শান্তি’”।

“আসলে, আমার মতে আমাদের এখানে শুধুমাত্র শান্তিই আছে। কিন্তু আপনি যদি যুদ্ধে প্রলুব্ধ হতেন তাহলে হয়তবা ঐ সব উর্দী পরা মহিলাদের দলে যোগ দিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিতেন”।

আমার রাগ হচ্ছিল এবং অপমানিত বোধ করছিলাম কারন আমি আসলেই নিজেকে জাহির করছিলাম না। এবং শুধুমাত্র জাহির করতে চাইও না। আমি ব্যাখা করতে চেয়েছিলাম যে, এই- এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী আমার উপর একটা বিস্ময়কর প্রভাব বিস্তার করেছে।

স্পষ্টতই তিনি সেই ধরনের মানুষ যারা ফাঁদে ফেলানোর জন্য প্রশ্ন করেন।

“আমি ধরে নিয়েছিলাম, মানে আমি আসলেই মনে করেছিলাম কোথাকার কোন এক বুড়ো শিক্ষিকা আসবেন”, কিছুটা ক্ষমা চাওয়ার ভংগিতে তিনি বললেন। “আপনি তো শিক্ষক হওয়ার জন্য পড়াশুনা করেননি, তাই না? বি.এ. ডিগ্রী পাওয়ার পর আপনার পরিকল্পনা কি ছিল”?

“এম.এ. করবো”, আমি কাঠখোট্টা ভাবে বললাম।

“তো, আপনার মন কিসে বদলালো”?

“ভাবলাম কিছু উপার্জন করা উচিত”।

“বিচক্ষন চিন্তা, যদিও আমার ভয় হচ্ছে আপনি এখানে যথেষ্ট উপার্জন করতে পারবেন না। আপনার ব্যাক্তিগত বিষয়ে নাক গলানোর জন্য দুঃখিত। আমি শুধুমাত্র নিশ্চিত হতে চাচ্ছিলাম যে আপনি এখানে আমাদের বিপদের মধ্যে ফেলে পালাবেন কিনা। বিয়ে করার কোন পরিকল্পনা তো নেই, তাই না”?

“না”।

“ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপনার কাছে আমার আপাতত আর কিছু জানার নেই। আপনাকে নিরুৎসাহিত করিনি তো, করেছি কি”?

আমি আমার মাথা ঘুরিয়ে নিলাম।

“না”।

“হলঘর ধরে যেতে থাকলে ম্যাট্রনের অফিস পড়বে, এবং তিনিই আপনার যা জানা দরকার সব বলে দেবেন। শুধু ঠান্ডাটা না লাগানোর চেষ্টা করবেন। আমার মনে হয় না… আপনার যক্ষ্মার সম্পর্কে কোন পুর্ব ধারনা আছে”?

“আসলে, আমি পড়েছি—”

বুঝেছি, বুঝেছি”। আপনি ‘দ্যা ম্যাজিক মাউন্টেন’ পড়েছেন”।

সহসাই অন্য আর একটা ফাঁদ পাতা হলো এবং মনে হলো তিনি তার স্বভাব সুলভ অবস্থায় ফিরে এলেন।

“তখনকার অবস্থা থেকে আমরা কিছুটা এগুতে পেরেছি বলে আমি আশা করি। এই যে, এই কাগজে, আমি এখানকার বাচ্চাদের সম্পর্কে কিছু লিখে এনেছি এবং তাদের দিয়ে কী-কী করানো যেতে পারে সে সম্পর্কে আমার কিছু ধারনাও, যা আপনি তাদের সাথে করার চেষ্টা করতে পারেন। কখনো কখনো আমি বরং নিজেকে লিখিত ভাবে প্রকাশ করতেই পছন্দ করি। ম্যাট্রন আপনাকে সবকিছু বিস্তারিত বলবেন”।

প্রচলিত শিক্ষা-বিজ্ঞানের ধারনা এখানে অনুপযুক্ত। এই শিশুদের কিছু আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাবে  এবং কিছু যাবে না। বেশী চাপ না দেয়াই ভাল, তার মানে- পরীক্ষা, মুখস্থ করা, শ্রেনীবিন্যাস এ সব ছাইপাঁশ।

গ্রেডিং প্রথা পুরোপুরি উপেক্ষা করতে হবে। যাদের দরকার হবে তারা পরবর্তীতে এই ঘাটতি পুরন করে নিতে পারবে অথবা এটা ছাড়াই চলতে পারবে। আসলে প্রয়োজনীয় খুব সহজ ছোট-ছোট বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে পারলেই পৃথিবীতে চলা যায়। তথাকথিত বিস্ময়কর শিশু সম্পর্কে কি বলা যায়? বিরক্তিকর শব্দ। পড়শুনায় মেধাবী হলে সহজেই ধরে ফেলতে পারবে।

দক্ষিন আমেরিকার নদী বা ম্যাগনা কার্টা এ সব দরকার নেই।

প্রাধান্য পাবে অংকন, সংগীত এবং গল্প।

খেলাধুলা ঠিক আছে কিন্তু অতিরিক্ত উত্তেজনা বা অতিরিক্ত প্রতিযোগিতার প্রতি লক্ষ্য রাখুন

চাপ এবং একঘেয়েমী মোকাবিলা করে চলাটাই হল আসল চ্যালেঞ্জ। একঘেয়েমী হল হাসপাতালে ভর্তি থাকার অভিশাপ।

যদি আপনার প্রয়োজনীয় জিনিস ম্যাট্রন সরবরাহ না করতে পারে, তাহলে কখনো-কখনো তা জ্যানিটরের কাছে মজুদ থাকতে পারে।

বোঁ ভোয়ায১০ 

এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই প্রথমদিনের সব ঘটনা অনন্য এবং অসম্ভব বলে মনে হল। রসুইখানা, এবং রসুইখানার ক্লোকরুম, যেখানে কর্মীরা তাদের কাপড় রাখতেন এবং চুরি করা জিনিস গোপনে লুকাতেন, এই কক্ষগুলো আমি আর দেখিনি এবং সম্ভবত আর দেখবোও না। একই ভাবে ডাক্তারের কক্ষও অনোনুমোদিত স্থানে পরিনত হলো। সব ধরনের অনুসন্ধান, অভিযোগ এবং সাধারন ব্যাবস্থাপনার জন্য সঠিক জায়গা ম্যাট্রনের কক্ষ। ম্যাট্রন ছিলেন খাটো এবং মোটাসোটা গড়নের, গোলাপী মুখে রিমলেস চশমা পরতেন আর ভারী-ভারী নিশ্বাস নিতেন। তাকে যা-ই জিজ্ঞেস করা হত না কেন, তিনি বিস্মিত হতেন এবং মনে হত যেন তিনি অনেক বিপদে পড়েছেন তবে শেষ পর্যন্ত তিনি তা সরবরাহ করতে পারতেন। কখনো কখনো তিনি সেবিকাদের খাবারঘরে খেতেন- তখন তাকে একটি বিশেষ ধরনের জাংকেট১১ পরিবেশন করা হত, সে সময় চারিদিকে একটা থমথমে পরিবেশ বিরাজ করতে। অধিকাংশ সময় তিনি তার নিজের জায়গাতেই থাকতেন।

ম্যাট্রন ছাড়াও আরো তিনজন নিবন্ধিত সেবিকা ছিলেন। তাদের কারো বয়সই আমার বয়্সের ত্রিশ বছরের মধ্যেও ছিল না। তারা যুদ্ধকালীন দায়িত্ব পালন করার জন্য অবসর ছেড়ে এখানে এসেছেন।আরও, সেখানে সেবিকাদের কিছু সাহায্যকারী ছিল যারা আমার বয়সী বা তারচেয়েও ছোট। তাদের অধিকাংশই বিবাহিতা অথবা বাগদত্তা অথবা বাগদান প্রক্রিয়াধীন, মোটামুটি ভাবে সবাই সৈন্যবাহিনীর পুরুষদের সাথেই। ম্যাট্রন এবং সেবিকারা আশেপাশে না থাকলে তারা সারাক্ষনই কথা বলতো। আমার প্রতি তাদের নুন্যতম কৌতুহল ছিল না। টরন্টো কেমন তা জানার কোন ইচ্ছে তাদের ছিল না- যদিও সেখানে মধুচন্দ্রিমা যাপনের জন্য গিয়েছে এমন কাউকে কাউকে তাদের কেউ কেউ চিনতো। আমার পড়ানো কেমন চলছে অথবা আগে কি করেছি এ ব্যাপারেও তাদের কোন আগ্রহ ছিল না। তারা অভদ্র এমন নয়, তারা আমাকে মাখন এগিয়ে দিত (মাখন বলা হলেও আসলে তা ছিল কমলা দাগ দেওয়া মার্জারিন, রসুইখানাতেই এই রং টা করা হত)। এবং তারা আমাকে শেপার্ডস-পাই১২সম্পর্কে সাবধান করেছিল, বলেছিল সেটাতে ভুমী-বীবরের মাংস আছে। তবে তাদের ব্যাপারটা এমন ছিল যে তারা তদের চেনা গন্ডীর বাইরে যা-ই ঘটুক না কেন তা আমলে নেবে না, নিলে তাদের ঝামেলা হত এবং তারা অস্বস্তি বোধ করত। রেডিওতে খবর শুরু হলেই তারা নব ঘুরিয়ে গানের অনুষ্ঠানে চলে যেতো--ড্যান্স উইথ আ ডলি উইথ আ হোউল ইন হার স্টকিন...

তা সত্বেও তারা ডাক্তার ফক্সকে সমীহ করত, আশিংক কারন, তিনি অনেক বই পড়েছেন। এবং তারা এ-ও বলতো যে রাগ করলে তার মত ভর্তসনা অন্য কেউ করতে পারে না।

আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না যে বেশি বই পড়া এবং ভয়ংকর রাগের মধ্যে কোন যোগসুত্র আছে বলে তারা মনে করে কিনা।

আগত ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যা প্রতিদিন একই রকম থাকত না। কখনো-কখনো তা পনেরো অথবা কমে গিয়ে    আধ ডজনে নেমে আসত। শুধুমাত্র সকাল বেলাটাই পড়াতে হত- ন’টা থেকে দুপুর পর্যন্ত। শিশুদের মধ্যে যাদের শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে যেতো এবং যারা ডাক্তারী পরীক্ষাধীন থাকত তাদের আলাদা করে রাখা হতো। উপস্থিত থাকলে তারা থাকতো শান্ত এবং বাধ্য তবে কোন কিছুতেই তেমন একটা কৌতুহলী নয়। তারা ধরে ফেলেছিল যে এটা একটি মিছেমিছি স্কুল, যেখানে তারা কোন কিছু শেখার আবশ্যিক সব শর্ত থেকে মুক্ত, ঠিক যেমন নামতা পড়া এবং মুখস্থ করা থেকেও মুক্ত। এই স্বাধীনতা তাদেরকে বেয়াড়া অথবা অলস করেনি, শুধুমাত্র নম্র এবং স্বপ্নাবিষ্ট করেছে। তারা মৃদু সুরে গান করতো এবং কাটাকুটি খেলতো। এই নিয়মবহির্ভুত ক্লাসের উপর সব সময়েই পরাজয়ের একটা ছায়া বিরাজ করত।

আমি ডাক্তারের কথা মেনে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। অন্ততপক্ষে কিছুটা হলেও, যেমন তিনি বলেছিলেন, এক ঘেয়েমীটা শত্রুর মত।

জ্যানিটরের কুঠুরীতে একটা ভূ-গোলক দেখেছিলাম। তাকে বলে সেটা বের করে আনালাম। আমি সাধারন ভুগোল দিয়ে শুরু করলাম- সমুদ্র, মহাদেশ, জলবায়ু। তাহলে বাতাস এবং স্রোত নয় কেন? দেশ এবং শহরগুলো? উত্তরায়ন এবং দক্ষিনায়ন? তা হলে এতকিছুর পর দক্ষিন আমেরিকার নদীগুলোই বা নয় কেন?

শিশুদের কেউ-কেউ এ ধরনের বিষয় আগেই শিখেছিল, কিন্তু প্রায় ভুলতে বসেছিল। এই হ্রদ এবং এই বন পেরিয়ে যে পৃথিবী, তা তাদের কাছ থেকে ঝরে গেছিলো। মনে হল এই অনুশীলন তাদের অনুপ্রানিত করছে, যেন তারা আগে জানা বিষয় গুলোর সাথে আবার বন্ধুত্ব করছে। অবশ্যই আমি তাদেরকে এক সাথে সব চাপিয়ে দেইনি। আর যেসব শিশু খুব তাড়াতাড়ি অসুস্থ হয়ে পড়ার কারনে এ সব আগে কখনোই শেখেনি তাদেরকে আমি কোন রকম চাপ প্রয়োগ করতাম না। তাদের সাথে আমি খুব ধীরে ধীরে সহজ ভাবে অগ্রসর হতাম।

কিন্তু এগুলো সব ঠিকই ছিল। এগুলো তো খেলাও হতে পারে। আমি তাদেরকে দলে দলে ভাগ করে এবং একটা নির্দেশক কাঠি দিয়ে ভূ-গোলকের এখনে সেখানে নির্দেশ করে উত্তর দিতে বলতাম। তারা যাতে অতি উত্তেজিত না হয়ে যায় সে দিকে আমার খেয়াল ছিল। কিন্তু একদিন ডাক্তার সকালের অস্ত্রপচার শেষ করার পরপরই চলে এলেন এবং আমি ধরা খেলাম। আমি চট করে সব কিছু থামাতে পারছিলাম না, কিন্তু প্রতিযোগিতা সামলানোর চেষ্টা করছিলাম। তিনি কিছুটা ক্লান্ত এবং নির্লিপ্ত মুখে বসে পরলেন। তিনি কোন অভিযোগ করলেন না। কয়েক মুহুর্ত পর, তিনি খেলায় যোগ দিলেন, উচ্চস্বরে বেশ হাস্যকর উত্তর দিচ্ছিলেন, যে নামগুলো শুধু ভুলই নয় বরং কাল্পনিকও। তারপর ধীরে-ধীরে তিনি গলার স্বর নীচে নামিয়ে আনলেন। নীচে, আরো নীচে এবং প্রথমে বিড়বিড়ে, তারপর ফিসফিসে, এবং তারপর পুরো অশ্রুত। এই ভাবে, অর্থহীন হাস্যরসের মাধ্যমে তিনি কক্ষের নিয়ন্ত্রন নিলেন। তাকে অনুকরন করতে গিয়ে পুরো ক্লাস সমস্বরে তার সাথে সাথে উচ্চারন করছিল। শিশুদের চোখ তার ঠোঁটের দিকে নিবিষ্ট ছিল।

হঠাৎ তিনি নিচু স্বরে গোঁ-গোঁ করে উঠলে সবাই হেসে উঠলো।

“কি অবস্থা! সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে কেন? মিস হাইড কি তোমাদের এইসব শেখাচ্ছেন? একজন গোবেচারা মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকা”?

অধিকাংশই হেসে উঠল কিন্তু কেউ কেউ তা সত্বেও তার থেকে চোখ ফেরাতে পারছিল না। তারা আরো মজা দেখার জন্য ব্যাগ্র হয়েছিল।

“যাও, তোমরা অন্য কোথাও গিয়ে ডেঁপমো কর”।

তিনি অসময়ে ক্লাসটা ভেঙ্গে দেয়ার জন্য আমার কাছে ক্ষমা চাইলেন। আমি কেন এটা কিছুটা আসল স্কুলের মত করে করছি, সেই কৈফিয়ত দেয়া শুরু করলাম।

“যদিও আমি মানসিক চাপের ব্যাপারের আপনার সাথে একমত, আমি আন্তরিকভাবে বললাম। আপনার নির্দেশাবলিতে যা বলেছেন আমি তার সাথেও একমত। আমি শুধুমাত্র চিন্তা করলাম যে...”

“কিসের নির্দেশাবলি? ওহ! ওগুলো ছিল আমার মাথার ভিতর আসা তাৎক্ষণিক টুকরো চিন্তা। আমি কখনোই সেগুলোকে স্বতসিদ্ধ ধরে নেই নি”।

“মানে, যদি খুব বেশী অসুস্থ না হয় তবে...”

“আমি নিশ্চিত আপনি ঠিক। আমি মনে করি না এটা তেমন কোন বিষয়”।

“না হলে ওদের কেমন যেন হতোদ্যাম মনে হয়”।

“এ নিয়ে গান বেঁধে নাচার তো কোন দরকার নেই!” বলে হেঁটে চলে গেলেন।

তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে কোনমতে দায়সারা ভাবে দুঃখ প্রকাশ করলেন।

“আমরা অন্য কোন সময় এ নিয়ে কথা বলবো”।

আমি ভাবলাম ‘অন্য কোন সময়’ কখনোই আসবে না। স্পষ্টতই তিনি আমাকে বিরক্তিকর ও বোকা ভেবেছেন।

দুপুরের খাবার সময় আমি সাহায্যকারী সেবিকাদের কাছ থেকে আবিস্কার করলাম যে কেউ একজন ঐ দিন সকালে অস্ত্রপচারের পর আর টেকেনি। তাই আমার রাগ অযৈক্তিক প্রমান হল এবং এ কারনে আমার নিজেকে আরো বেশী বোকা-বোকা লাগছিল।

বিকেলগুলোতে আমার কোন কাজ থাকতো না। আমার ছাত্র-ছাত্রীরা বিকেলে লম্বা ঘুম দিত, এবং কখনো কখনো আমারও তাই করতে ইচ্ছে করতো। কিন্তু আমার ঘরটা ছিল ঠান্ডা এবং কম্বলটাও ছিল বেশ পাতলা- নিশ্চয়ই যক্ষ্মা রোগীদের আরো বেশী উষ্ণ কিছুর দরকার হয়।

অবশ্যই আমার যক্ষ্মা ছিল না। হতে পারে তারা আমার মত মানুষের জন্য বরাদ্দের ব্যাপারে কৃপন ছিল।

আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন থাকতাম কিন্তু ঘুমাতে পারতাম না। এ সময় বরফ-শীতল বিকেলের ঠান্ডা গায়ে লাগানোর জন্য বারান্দার দিকে বিছানার ট্রলির নিয়ে যাওয়ার গুড়গুড় শব্দ শুনতে পেতাম।

সেই অট্টালিকা, সেই গাছপালা, সেই হ্রদ আর কখনোই আমার কাছে আর সেই প্রথম দিনের মত লাগেনি- যেদিন আমি তাদের ব্যাখ্যাতীত রহস্যময়তা এবং প্রভুতায় ধরা পড়েছিলাম। সেই দিন আমার নিজেকে অতি নগন্য মনে হয়েছিল। এখন আমার কাছে মনে হয় সেই সব যেন কখনোই সত্যি হতে পারে না।

-ঐ যে শিক্ষিকা। করছেটা কি?

-হ্রদের দিকে তাকিয়ে আছে।

-কি জন্য?

-আর কিছু করার নাই বলে।

-কিছু কিছু মানুষের যা ভাগ্য!

কখনো-কখনো আমি দুপুরের খাবার বাদ দিতাম, যদিও সেটা আমার বেতনের অন্তর্ভুক্ত ছিল, এবং অ্যামান্ডসেনে গিয়ে সেখানে কফিশপে খেতাম। তাদের কফিটা ছিল পসটাম১৩ এবং যদি কখনো আদৌ কোন স্যান্ডউইচ পাওয়া যেত তাহলে সবচেয়ে ভালটাই হতো টিনজাত স্যামনের। মুরগীর সালাদ ভালোভাবে পরীক্ষা করতে হতো চামড়া এবং তরুনাস্থি আছে কিনা দেখার জন্য। তারপরও আমি ওখানে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম- যেন আমাকে ওখানে কেউই চিনবে না।

এবং এ ব্যাপারে আমার ধারনাটা ছিল সম্ভবত ভুল।

কফিশপে মহিলাদের জন্য কোন ওয়াশরুম ছিল না, তাই পাশের হোটেলে গিয়ে বিয়ার পার্লারের১৪দরজা পার হতে হতো। সেটা সবসময় অন্ধকার, কোলাহলমুখর, এবং বিয়ার ও হুইস্কির গন্ধে ভরা থাকতো। সিগারেট এবং সিগারের মিলিত ধোঁয়ার মিশ্র গন্ধের ঝাপ্টা একেবারে ধরাশায়ী করে ফেলতো। কিন্তু সেই করাতীরা- করাতকলের সেই মানুষগুলো কখনোই টরন্টোর সৈনিক এবং বিমান সেনাদের মত উচ্চস্বরে নারীদের উত্ত্যক্ত করত না। তারা ছিল পু্রুষালি জগতে গভীরে, নিজেদের জীবনের গল্প নিয়েই ব্যতিব্যস্ত, তারা এখানে মেয়ে মানুষ খুঁজতে আসেনি। তারা সম্ভবত মহিলাদের এড়ানোর জন্যই এখানে এসেছে- এই সাময়িক সময়টুকুর জন্য অথবা একেবারেই সারা জীবনের জন্য।

প্রধান সড়কের উপর ডাক্তারের একটা অফিস ছিল, একটা ছোট একতলা ভবন। অর্থাৎ তিনি অন্য কোথাও বাস করতেন। সেখানে যে কোন মিসেস ফক্স নেই তা আমি সাহায্যকারী সেবিকাদের কাছ থেকে আগেই জেনেছিলাম। জনপদের একমাত্র গলিতে একটা বাড়ি দেখতে পেলাম যেটা সম্ভবত তার। প্লাস্টার করা বাড়ি, সামনের দরজার উপরের দিকে একটা ডরমার১৫ জানালা। সেই জানালার ভিত্তিতে থরে-থরে রাখা বই। বাড়িটায় কেমন একটা বিমর্ষতার ভাব থাকলেও বেশ গোছানো। একজন একা মানুষ- একজন নিয়ন্ত্রিত একাকী মানুষের আরামের জন্য নুন্যতম সব কিছু একেবারে যথাযথ আছে বলেই ইংগিত দিচ্ছিল- একেবারেই সুপরিকল্পিত।

শহরের স্কুলটা আবাসিক এলাকার রাস্তার শেষ মাথায়। একদিন বিকেলে আমি ম্যারিকে স্কুলের মাঠে স্নো-বল ছোড়াছুড়ি খেলার সময় দেখলাম। মনে হচ্ছিল মেয়েরা বনাম ছেলেরা খেলছে। সে যখন আমাকে দেখলো তখন উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলল “হেই টীচ”১৬, এবং দু’হাতের বলগুলোকে লক্ষ্যহীনভাবে ছুঁড়ে ফেলে স্বাচ্ছন্দে রাস্তা পার হতে হতে ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদেরকে মোটামুটি সাবধানের সুরে বললো “আগামীকাল দেখা হবে”, যাতে কেউ আর তাকে অনুসরন না করে।

“আপনি কি বাড়ি যাচ্ছেন”? সে বলল, “আমিও। আমি আগে রেডির গাড়িতে যেতাম। কিন্তু ইদানিং সে যেতে অনেক দেরী করে। আপনি কিভাবে যাবেন? ট্রামে”?

আমি উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ” এবং ম্যারি বলল, “তাই, আমি আপনাকে একটা সংক্ষিপ্ত বিকল্প পথ দেখিয়ে দেব। এতে সময়ও বাঁচবে আর খরচও কম হবে। বনের পথ”।

সে আমাকে শহর থেকে উঁচুতে বনের মধ্য দিয়ে করাত-কল পেরিয়ে একটা সরু পায়ে চলা পথ ধরে নিয়ে চলল।

সে বলল, “এই পথেই রেডি যায়”।

করাত-কলের পর, আমাদের নীচের দিকে বনের কিছুটা অংশ বিচ্ছিরি ভাবে কাটা এবং অল্প কয়েকটা কুটির- স্পষ্টতই জনবসতি। কারন সেখানে স্তুপীকৃত কাঠ, কাপড় শুকানোর দড়ি এবং উর্ধগামী ধোঁয়া ছিল।  কুটিরগুলোর একটা থেকে বড় একটা নেকড়ের মত কুকুর ভয়ংকর ভাবে ঘেউ-ঘেউ এবং খ্যাঁক-খ্যাঁক করতে-করতে দৌড়ে এলো।

ম্যারি চেঁচিয়ে বলল, “এই তুই মুখ বন্ধ কর”। এবং চোখের পলকেইে কিছু তুষার দলা পাকিয়ে কুকুরটার দিকে ছুঁড়ে মারল, যেটা জন্তুটার দুই চোখে মাঝে গিয়ে লাগল। কুকুরটা বেগে ঘুরে গেল এবং ম্যারি ওটার পশ্চাদ্দেশে আঘাত করার জন্যে আর একটা তুষার দলা প্রস্তুত করে ফেলল। এ সময় এপ্রন পরা একজন মহিলা বেড়িয়ে এসে উচ্চস্বরে বলল, “তুই তো ওকে মেরেই ফেলবি দেখছি”!

“মরলে আপদ বিদেয় হয়!”

“দাঁড়া, আমার বাবাকে ডাকছি”।

“তাহলেই হবে! তোর বাপ ল্যাট্রিনের চালেও ঢিল মারতে পারে না”।

কুকুরটা একটু দুরত্ত্বে থেকে কপট হুমকি দেখাতে দেখাতে আমাদের পিছু পিছু আসছিল।

“চিন্তা করবেন না, আমি যে কোন কুকুরকেই সোজা করে ফেলতে পারি”, ম্যারি বলল। “আমি বাজি ধরে বলতে পারি যদি আমরা সে রকম কোন পরিস্থিতিতে পরি তাহলে যে কোন ভাল্লুককেও সোজা করে ফেলতে পারবো”।

“ভাল্লুকরা এ সময় শীত-নিদ্রায় যায় না”?

আমি কুকুরটাকে বেশ ভয় পেলেও না পাওয়ার ভান করলাম।

“হ্যাঁ, তবে কখন যে কী হবে কেউ বলতে পারে ন। একবার, যে সময়টায় সাধারনত ভাল্লুক বের হয় তার আগেই একটা বেরিয়ে এসে স্যানের ময়লা আবর্জনা ঘাটাঘাটি শুরু করেছিল। আমার মা পিছন ঘুরতেই সেখানে ভাল্লুকটা দেখতে পেল। রেডি তার বন্দুক দিয়ে ওটাকে গুলি করলো। আগে প্রায়ই রেডি আমাকে এবং অ্যানাবেলকে স্লেজ১৭ গাড়িতে বেড়াতে নিয়ে যেতো, কোন-কোন সময় অন্য বাচ্চারাও আমাদের সাথে থাকতো এবং রেডি একটা বিশেষ ধরনের হুইসল দিত যার শব্দে ভাল্লুকরা ভয় পেতো। শব্দটার তরংগের মাত্রা মানুষের কানে শোনার মাত্রার বাইরে ছিল”।

“সত্যি! সেটা দেখতে কেমন ছিল”?

“আসলে তেমন কোন হুইসল না। মানে সে তার খালি মুখ দিয়েই বাজাতো।

শ্রেনীকক্ষে ডাক্তার ফক্সের কার্যকলাপ আমার মনে পড়ে গেল।

“আমি ঠিক বলতে পারব না, তবে সম্ভবত রেডি অ্যানাবেলকে ভয় পাওয়া থেকে বিরত রাখতে এটা বলত। অ্যানাবেল স্লেজে চড়তে পারতো না। রেডিকে অ্যানাবেলর টবোগান১৮ টানতে হত। কখনো-কখনো আমিও টবোগানে লাফিয়ে উঠতা্ম, সে তখন বলতো, “ব্যাপার কি? এটা এত ভারী কেন?”তারপর যদি তিনি দ্রুত ঘুরে পিছন ফিরতেন তাহলে আমাকে ধরে ফেলতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা কখনোই করতেন না। বরং তিনি অ্যানাবেলকে জিজ্ঞেস করতেন, ‘এটা এত ভারী কেন? তুমি সকালের নাস্তায় কী খেয়েছো’? কিন্তু অ্যানাবেল কখনোই বলতো না যে সেখানে আমিও ছিলাম। সে ছিল আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধু আর এমন কেউ ভবিষ্যতেও হবে না”।

“স্কুলের মেয়েরা কেমন? তারা কি বন্ধু নয়”?

“আর কেউ না থাকলে শুধুমাত্র তাদের সাথে ঘুরে বেড়াই। তারা তেমন কিছুই না। অ্যানাবেল এবং আমার জন্ম একই মাস- জুনে। আমাদের এগারোতম জন্মদিনে রেডি আমাদের নৌকায় করে হ্রদে নিয়ে গেছিল। সে আমাদের সাঁতার শিখাতো। আসলে শুধু আমাকেই- তাকে সব সময়েই অ্যানাবেলকে ধরে রাখতে হত। অ্যানাবেল আসলে ঠিকমত শিখতে পারতোই না। একদিন সে নিজেই অনেক দূর সাঁতরে গেল আর আমরা তার জুতোর ভিতর বালু ভরে রাখলাম। এবং তারপর আমাদের বারোতম জন্মদিনে, আমরা আর সে-রকম ভাবে বাইরে যাইনি, কিন্তু আমরা রেডির বাড়িতে গিয়ে কেক খেলাম। অ্যানাবেল একটুও খেতে পারেনি। তাই সে আমাদেরকে তার গাড়িতে করে বাইরে বেড়াতে নিয়ে গেল এবং আমরা কেকের টুকরাগুলো জানালা দিয়ে  ছুঁড়ে-ছুঁড়ে গাংচীলদেরকে দিলাম। তারা চিৎকার, চ্যাঁচামেচি আর মারামারি লাগিয়ে দিয়েছিল। তা দেখে আমরা পাগলের মত হাসছিলাম এবং রেডিকে থেমে অ্যানাবেলকে ধরতে হয়েছিল যাতে অ্যানাবেলের রক্তক্ষরন না হয়।

“এবং তারপর”, সে বলল, “তারপর আমাকে আর অ্যানাবেলকে দেখতে দেয়া হল না। আমার মা কখনো কোনভাবেই আমাকে যক্ষ্মাক্রান্ত শিশুদের সাথে মিশতে দিতে চাইতেন না। কিন্তু রেডি সে ব্যাপারে তার সাথে কথা বলতো। সে বলতো প্রয়োজন হলে সে অবশ্যই বন্ধ করে দেবে। এরপর সেঅ্যানাবেলের সাথে আমার মেশা বন্ধ করলো আর তাতে আমার অনেক রাগ হয়েছে। কিন্তু অ্যানাবেল আর কখনো আমাদের সাথে মজা করতে পারতোই না— সে খুব বেশী অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল। আমি আপনাকে তার কবর দেখাতে পারি তবে এখনো তার কবরে কোন ফলক দেয়া হয় নি। রেডি সময় পেলে আমি আর সে গিয়ে একটা কিছু করবো। আমরা যেখান থেকে বাঁক নিয়েছি তা না নিয়ে, যদি সোজা যেতাম তাহলেই আমরা অ্যানাবেলের কবরস্থানে পৌঁছে যেতাম”।

এই সময়ের মধ্যে আমরা স্যান’র কাছাকাছি সমতল ভূমিতে পৌঁছে গেলাম।

“ওহ! আমি তো ভুলেই গেছিলাম” বলে সে এক মুঠো টিকিট বের করলো।

“ভ্যালেন্টাইন্স ডেই তে আমরা পিনাফোর১৯ নামে একটা নাটক স্কুলে মঞ্চস্থ করবো। আমাকে এই সবগুলো টিকেট বিক্রি করতে হবে। আপনাকে দিয়েই তো বউনি করতে পারি। আমি এ নাটকে অভিনয় করবো”।

আগে এমান্ডসেনে যে বাসাটায় ডাক্তার থাকতেন বলে আমি অনুমান করেছিলাম তা আসলে ঠিক ছিল।

তিনি আমাকে সেখানে একদিন রাতের খাবারের জন্য নিয়ে গেলেন। মনে হল হঠাৎ করে একদিন হলঘরে তার সাথে দেখা হয়ে যাওয়ায় খেয়ালি ভাবে হুট করেই এই দাওয়াতটা দিয়ে বসলেন। আমরা কোন এক সময় একসাথে শিক্ষাদানের ভাবনা সম্পর্কে আলাপ করতে পারি- সম্ভবত এ কথা বলার পর তার ভিতর এক ধরনের অস্বস্তিকর স্মৃতি কাজ করছিল।

যে সন্ধ্যাটা তিনি প্রস্তাব করেছিলেন সেটা ছিল সেই সন্ধ্যা যে দিনের জন্য আমি পিনাফোর নাটকের টিকেট কিনেছিলাম। আমি তাকে তা বললাম এবং তিনি বললেন, “বেশ, আমিও কিনেছি। এর মানে এই নয় যে আমাদের যেতেই হবে”।

“আমার মনে হচ্ছে যেন আমি তাকে মোটামুটি যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলেছি”।

“আচ্ছা বেশ, আপনি এখন তার কাছ থেকে মোটামুটি প্রতিশ্রুতি ফিরিয়ে নিতে পারেন। বিশ্বাস করেন, ভয়ংকর বাজে নাটক হবে”।

তার কথামত তা-ই করলাম যদিও বলার জন্য ম্যারির সাথে দেখা করিনি। স্যান’র সামনের দরজার পাশে গাড়ি বারান্দায়, যেখানে তিনি আমাকে অপেক্ষা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, আমি সেখানেই অপেক্ষা করছিলাম। আমি আমার সবচেয়ে সুন্দর পোষাকটা পরলাম- ক্রেপ কাপড়ের গাঢ় সবুজ রংযের, ছোট-ছোট মুক্তার বোতাম এবং আসল লেসের কলার। এবং আমার স্নো-বুটের২০ মধ্যে সুয়েড২১ চামড়ার উঁচুহীলের জুতো পরেছিলাম। তিনি যে সময়ের মধ্যে আসবেন বলেছিলেন তার চেয়ে বেশি সময় আমি অপেক্ষা করলাম। কিছুটা উদবিগ্ন ছিলাম— প্রথমত, ম্যাট্রন তার অফিস থেকে বের হয়ে এলে আমাকে দেখে ফেলতে পারেন এবং দ্বিতীয়ত, তিনি হয়ত সব কিছু ভুলেই বসে আছেন।

কিন্তু তারপর তিনি ওভারকোটের বোতাম লাগাতে লাগাতে এলেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করলেন।

“সবসময় এটা-সেটা লেগেই থাকে”, তিনি বললেন। তারপর অট্টালিক ঘুরিয়ে আমাকে তার গাড়ির কাছে নিয়ে গেলেন।

“আপনি ঠিক আছেন তো”? তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এবং যখন সু্যেড জুতো সত্বেও যখন আমি বললাম হ্যাঁ, তিনি আমার দিকে হাত বাড়ালেন না।

সেকালের অধিকাংশ গাড়ির মতোই তার গাড়িটাও ছিল পুরানো এবং জরাজীর্ন। সেটাতে কোন হিটার ছিল না। যখন তিনি বললেন যে আমরা তার বাড়িতে যাচ্ছি তখন আমি স্বস্তি পেলাম। আমি ভেবে উঠতে পারছিলাম না যে কি ভাবে আমরা হোটেলের ভীড় সামলাব এবং আমি মনে মনে চাইছিলাম যে ক্যাফেতে আমাকে যেন স্যান্ডউইচ খেতে না হয়।

তার বাসায় গিয়ে জায়গাটা কিছুটা গরম না হওয়া পর্যন্ত তিনি আমাকে কোট খুলতে মানা করলেন। এবং এর পরই তিনি ঘর গরম করার জন্য কাঠের ফায়ারপ্লেস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

“আমি আপনার দারওয়ান, বাবুর্চি এবং পরিবেশক”, তিনি বললেন। “ঘর বেশ তাড়াতাড়ি গরম হয়ে আরামদায়ক হবে এবং খাবার প্রস্তুত করতে বেশি সময় লাগবে না। আমাকে সাহায্য করার কথা বলবেন না। আমি একাই কাজ করতে পছন্দ করি। আপনি কোথায় অপেক্ষা করতে চান? আপনি চাইলে আমার সামনের ঘরে বই দেখতে পারেন। ওখানে কোট পরে গেলেও আপনার অসহনীয় লাগবে না। দরজার ঠিক পাশেই লাইটের সুইচ। আমি যদি খবর শুনি আপনি কি কিছু মনে করবেন? এটাতে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি”।

আমি রান্নাঘরের দরজা খোলা রেখে এমনভাবে সামনের রুমে গেলাম যেন আমাকে মোটামুটি এক ধরনের আদেশই দেয়া হয়েছে।

“রান্নাঘরটা একটু গরম হোক” বলতে বলতে দরজা বন্ধ করলেন এবং সিবিসি চ্যানেলের নাটকীয় এবং ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যে যুদ্ধের খবর শুনতে লাগলেন।

সেখানে দেখার মত অসংখ্য বই। শুধুমাত্র বইয়ের তাকেই নয়, টেবিলে, চেয়ারে, জানালার ভিত্তিতে এবং মেঝেতেও গাদা করা। আমি তাদের কতগুলো পরখ করে এই সিদ্ধান্তে এলাম যে তিনি সম্ভবত সেট ধরে বই কেনেন এবং অনেক গ্রন্থ-সংঘের সদস্য। হার্ভাড ক্লাসিক, উইল ডুরান্টের ইতিহাস। ফিকশন এবং কবিতার বইয়ের পরিমান কম মনে হলো যদিও সেখানে বিস্ময়কভাবে অল্প কিছু শিশু ক্লাসিক ছিল। আমেরিকার গৃহযুদ্ধ, দক্ষিন আফ্রিকার যুদ্ধ, নেপোলিয়নীয় যুদ্ধ, পিলোপনেশিয়ান যুদ্ধ, জুলিয়াস সিজারের যুদ্ধাভিযাত্রা। আমাজন এবং আর্কটিক অনুসন্ধান। বরফ-বন্দী শ্যাকেল্টন। জনফ্র্যাংকলিনের শেষ অভিযান, ডোনার পার্টি, হারানো উপজাতিদের কথা। নিউটন, এবং অ্যালকেমি, হিন্দুকুশের গোপন রহস্য। জ্ঞান-পিপাসুদের জন্য জ্ঞানের বিভিন্ন পরিধির বই– কিন্তু যারা একটা সুনির্দৃষ্ট ধরনের বই পছন্দ করে তাদের জন্য নয়।

সুতরাং সম্ভবত তিনি যখন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “রাশিয়ান কোন উপন্যাসটা”? তখন আমি যেমন চিন্তা করেছিলাম, আসলে রাশিয়ান কোনো উপন্যাস সম্পর্কে তার তেমন কোনো স্বচ্ছ ধারনা ছিল না।

তিনি যখন “প্রস্তুত”, বললেন আমি তখন দরজা খুললাম এবং ততক্ষনে আমি নতুন সংশয়বাদ অনেকখানি রপ্ত করে ফেলেছি।

আমি বললাম, “আপনি কাকে পছন্দ করেন, ন্যাফটা নাকি সেটেমব্রিনি২২”?

“মাফ করবেন, ঠিক বুঝলাম না”।

“ম্যাজিক মাউন্টেনে আপনি ন্যাফটাকে বেশি পছন্দ করেন নাকি সেটেমব্রিনিকে”?

“আমার কাছে সব সময়েই তাদেরকে বাচাল, ফালতু এবং অপদার্থ মনে হয়েছে। আপনার কাছে”?

“সেটেমব্রিনি একটু বেশি দয়ালু কিন্তু ন্যাফটা বেশী কৌতুহলোদ্দীপক”।

“এগুলো কি আপনি স্কুল থেকে শিখেছেন”?

আমি শীতল কন্ঠে বললাম, “আমি এটা স্কুলে পড়িনি”।

চকিতে তিনি আমার দিকে তাকালেন, সেই আগের মতোই এক ভ্রু উঁচানো।

“মাফ করবেন, যদি আপনার ভাল লেগে থাকে তাহলে বিনা দ্বিধায় আপনার অবসর সময় এখানে এসে পড়তে পারেন। যেহেতু আমার মনে হচ্ছে আপনি কাঠের চুল্লিতে অভ্যস্থ নন, এখানে একটা বৈদ্যুতিক হিটার আছে সেটা আমি লাগিয়ে দেবো। ভেবে দেখবেন? আমি একটা অতিরিক্ত চাবি বানিয়ে আপনাকে দেবো”।

“ধন্যবাদ”।

খাবার ছিল খুব সাদামাটা-পর্ক চপ, ইনস্ট্যান্ট ম্যাশড পটেটো, আর টিনজাত মটরদানা। ডেজার্ট ছিল বেকারি থেকে কেনা আপেল পাই। তবে তিনি যদি তা গরম করার কথা চিন্তা করতেন তা হলে আরও ভাল হতে পারতো।

তিনি আমাকে আমার টরন্টোর জীবন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস এবং পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন।তিনি বললেন যে, তিনি মনে করেন আমি খুব সৎ এবং দৃঢ় নৈতিকতার মধ্যে বড় হয়েছি।

“আমার দাদা একজন লিবারেল পাদ্রী, পল টিলিক২৩-এর ধাঁচের”।

“এবং আপনি? লিবারেলের ছোট্ট খৃস্টান নাতনী”?

“না”।

“যান, আপনিই জিতলেন, আমাকে কি আপনার রূঢ় মনে হচ্ছে?”

“সেটা নির্ভর করে... আপনি যদি নিয়োগদাতা হিসাবে আমার সাক্ষৎকার নেন, তাহলে না”।

“সুতরাং আমি এগুতে পারি। আপনার বয়ফ্রেন্ড আছে”?

“হ্যাঁ”।

“মনে হচ্ছে সেনাবাহিনীতে”?

আমি বললাম, “নৌবাহিনীতে”। আমার কাছে মনে হল এটা বলাটাই ভালো কারন তাহলে সে কোথায় আছে তা না জানা এবং নিয়মিত চিঠি বিনিময় না করাটাকে বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে।

ডাক্তার উঠে চা নিয়ে এলেন।

“কি ধরনের জাহাজে সে আছে?”

“রণতরী”, এটা আর একটা ভাল বিষয়- এটা বলার যুক্তিটা হল কিছু দিন পরে তাকে আমি টরপেডোর আঘাতে মৃত বানিয়ে ফেলতে পারবো যা, রণতরীতে সচরাচর ঘটে থাকে।

“একটা বাঘের বাচ্চা। চায়ে কি চিনি বা দুধ লাগবে”?

“কোনটাই না। ধন্যবাদ”।

“খুব ভাল, কারন আমার একটাও নেই”।

“আপনি জানেন তো, মিথ্যা কথা বললে আপনাকে দেখে বোঝা যায়- আপনার মুখ লাল হয়ে যায়”।

আগে যদি লাল না-ও হয়ে গিয়ে থাকি তবে এবার হলাম। পা থেকে মাথা পর্যন্ত রক্ত প্রবাহ টের পেলাম এবং আমার বগল থেকে ঘাম চুয়ে পড়ছিল। আমি ভাবছিলাম আমার জামাটা যেন নষ্ট না হয়।

“চা পান করলেই আমার গরম লাগে”।

ওহ তাই”।

পরিস্থিতি এর চেয়ে আর খারাপ হতে পারে না। সুতরাং আমি তাকে জব্দ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। তিনি কি ভাবে মানুষে অস্ত্রপচার করেন এটা জিজ্ঞেস করে আমি বিষয়টা ঘুরিয়ে পরিবর্তন করলাম।“আপনি কি ফুসফুস অপসারন করেন, আমি এমনই শুনেছিলাম”।

আমাকে টেক্কা দিতে তিনি আরো ঠাট্টা করে উত্তর দিতে পারতেন। সম্ভবত এটা ছিল তার প্রেম-কৌতুকের ধরন, এবং আমি মনে করেছিলাম তিনি যদি এটা করেন তাহলে আমাকে কোট গায়ে দিয়ে ঠান্ডার মধ্যেই বেড়িয়ে পড়তে হবে। হয়ত তিনি সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি থোরাকোপ্লাস্টি সম্পর্কে বলা শুরু করলেন। “অবশ্যই, ফুসফুসের উপরিভাগ অপসারন ইদানিং জনপ্রিয়তা পাচ্ছে”।

“কিন্তু এতে আপনি কি কিছু রোগী হারাচ্ছেন না”? আমি বললাম।

তিনি বোধ হয়  চিন্তা করলেন এখন আবার মজা যায়।

বললেন, “তা তো অবশ্যই, কিছু দৌড়ে গিয়ে ঝোপের আড়ালে লুকায়- আমরা বুঝে উঠতে পারিনা তারা কোথায় যায়। কিছু হ্রদেও ঝাঁপ দেয়। নাকি আপনি বুঝাতে চাইছিলেন যে, কিছু মারা যায় কি না? এমন কিছু ঘটনা ঘটে যেখানে অস্ত্রপচার কোন কাজেই আসে না, হ্যাঁ”।

তিনি আরও বললেন যে, বেশ বড় ধরনের একটা পরিবর্তন হতে যাচ্ছে। তিনি নিয়মিত যে অস্ত্রপচারগুলো করে আসছিলেন সেগুলো ছিল রক্তমোক্ষনের২৪ মতোই প্রায় বিলুপ্তির পথে। একটা নতুন ঔষধ বের হচ্ছিল-স্ট্রেপ্টোমাইসিন। পরীক্ষামুলকভাবে ব্যাবহারও হচ্ছিল। কিন্তু তাতে কিছু সমস্যাও ছিল– স্বাভাবিক ভাবেই এ সবে সমস্যা থাকে। স্নায়ুতন্ত্রে বিষক্রিয়া। কিন্তু তা মোকাবিলা করার উপায়ও বের হবে।

“আমার মত হাড়-কাটা করাতীর ভাত মেরে দেয়া আর কি”।

তিনি থালা বাটি পরিস্কার করলেন; আমি শুকোলাম। আমার জামা যাতে নষ্ট না হয় সে জন্য তিনি আমার কোমরের কাছে একটা ডিশ-টাওয়েল জড়িয়ে দিলেন। সেটা ভাল ভাবে বাঁধা হলে তিনি আমার পিঠের উপরের দিকে হাত রাখলেন। পাঁচ আঙ্গুল পৃথক করে যে দৃঢ় চাপ দিলেন, তাতে যেন পেশাদারের মত এক মুহুর্তেই সব কিছু বুঝে নিলেন। সেই রাতে আমি যখন বিছানায় গেলাম, তখনও আমি সেই চাপ অনুভব করছিলাম। আমার মনে হল চাপের তীব্রতা কনে আংগুল থেকে শুরু হয়ে ক্রমশ বুড়ো আংগুলের দিকে বিস্তার লাভ করেছে। আমি উপভোগ করেছিলাম। সেটা পরে গাড়ি থেকে নামার পুর্ব মুহুর্তে কপালে দেয়া চুমু চেয়েও বেশি গুরুত্বপুর্ন ছিল। একটা শুকনো ঠোটের চুমু, ছোট্ট এবং প্রথাগত যা আমার উপর দ্রুত প্রভাব বিস্তার করেছিল।

আমার কক্ষের মেঝেতে তার বাড়ির চাবি দেখা গেল, আমার অনুপস্থিতিতে তিনি সেটা দরজার নিচ গলিয়ে দিয়ে গিয়্যেছেন। কিন্তু আমার পক্ষে তা আদৌ ব্যাবহার করার কোন উপায় ছিল না। অন্য কেউ এই প্রস্তাবটা দিলে আমি তা লুফে নিতাম- বিশেষ করে যদি সেই প্রস্তাবে হিটারও অন্তর্ভুক্ত থাকতো। কিন্তু, এই ক্ষেত্রে, বাড়ীতে তার অতীত এবং ভবিষ্যত উপস্থিতির এই সমস্ত স্বাভাবিক আরাম-আয়েশকে অন্য দিকে নিয়ে যেতে পারতো এবং তার পরিবর্তে বরং আনন্দটুকু স্বস্তিকর না হয়ে স্নায়ুপীড়াদায় হত। আমার সন্দেহ হচ্ছিল যে আমি একটা অক্ষরও পড়তে পারতাম কিনা!

পিনাফোর না দেখতে যাওয়ার জন্য ম্যারি এসে বকা দেবে সেই আশংকা করছিলাম। আমি ভেবে রেখেছিলাম  অসুস্থতার কথা বলবো; বলবো ঠান্ডা লেগেছিল। কিন্তু তারপরই মনে পড়লো যে ঠান্ডা এই জায়গায় খুবই সাংঘাতিক ব্যাপার, যাতে মাস্ক ও জীবানুনাশক ব্যাবহার করা এবং নির্বাসনে যাওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এবং অচিরেই আমি আরও বুঝতে পারলাম যে ডাক্তারের বাড়িতে যাওয়াটাকে লুকানোর কোন সম্ভাবনাই নেই। কারো কাছেই এ কথা গোপন ছিল না, এমনকি নার্সদের কাছেও না, যদিও তারা কিছুই বলেনি, কারন হয়ত তারা খুবই অহংকারী এবং কৌশলী, অথবা এই ধরনের ঘটনাতে তাদের আগ্রহ শেষ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সাহায্যকারী সেবিকারা এ নিয়ে আমার সাথে ঠাট্টা মশকারা করত।

“সে রাতে খাওয়া কেমন হল”?

তাদের কথার ভঙ্গি বন্ধুসুলভ- যেন এতে তাদের সায় আছে। আমার দাম বেড়ে গেল। আগে আমি যা-ই ছিলাম না কেন, এখন অন্ততপক্ষে আমি একজন পুরুষের আরাধ্যা নারী!

পুরো সপ্তাহেই ম্যারির চেহারা দেখা গেল না।

চুমু দেয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে ‘আগামী শনিবার” শব্দ দুটো বলা হয়েছিল। তাই আমি আবারও সামনের রোয়াকে অপেক্ষা করলাম এবং এবার তিনি দেরী করলেন না। আমারা গাড়িতে করে তার বাড়িতে গেলাম এবং আমি যখন সামনের রুমে গেলাম তিনি তখন ফায়ারপ্লেস ধরাতে লেগে গেলেন। সেখানে আমি ধূলিধূসর একটা বৈদ্যুতিক হিটার লক্ষ্য করলাম।

তিনি বললেন, “সেই প্রস্তাব তো গ্রহন করলেন না, আপনি কি ভেবেছিলেন যে আমি এমনিই কথার কথা বলেছি? আমি সবসময় যা করতে পারি বলি তা-ই বলি”।

আমি বললাম যে, ম্যারির সাথে দেখা হওয়ার ভয়ে আমি আর শহরে আসতে চাইনি।

“কারন তার কনসার্ট মিস করলাম যে”।

তিনি বললেন, “ম্যারির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে চাইলে এমনই হতে থাকবে”।

মেনু আগের দিনের মতই। পর্ক চপ, ইন্সটান্ট ম্যাশড পটাটো, মটরের পরিবর্তে ভুট্টার দানা। এই বার তিনি আমাকে রান্নাঘরের কাজে তাকে সাহায্য করতে দিলেন এমনকি টেবিল লাগাতেও বললেন।

“জিনিসপত্র কোথায় কোনটা থাকে জেনে রাখা ভাল, আমি তো মনে করি সব কিছু একেবারে যথাযথ ভাবেই সুবিন্যাস্ত”।

এর মানে আমি রান্নাঘরে তার কাজ করা দেখতে পারবো। কাজের প্রতি তার সহজাত একাগ্রতা এবং তার সুমিত চলনে আমার ভিতর ভাল লাগার রোমাঞ্চকর অনুভূতির শিহরন বৈদুত্যিক তরংগের মত মিছিল শুরু করল।

আমরা কেবলমাত্র খেতে শুরু করেছি এমন সময় দরজায় কে যেন ধাক্কা দিল। তিনি উঠে দরজার খিল ধরে টান দিতেই ম্যারি ঝড়ের বেগে ঢুকে পড়লো।

সে পিচবোর্ডের একটা বাক্স নিয়ে এসেছে, সেটাকে টেবিলের উপর রাখলো। তারপর সে তার কোট এক ঝটকায় খুলে ফেলে একটা লাল আর হলুদ রংযের বিশেষ পোষাকে নিজেকে প্রদর্শন করলো।

“হ্যাপি ভ্যালেন্টাইন্স ডে, সে বলল”। তোমরা তো আমার কনসার্ট দেখতে এলে না- তাই আমিই তোমাদের জন্য কনসার্ট নিয়ে এসেছি”।

সে এক পায়ের উপর দাঁড়িয়ে অন্য পায়ের বুট খুলে ছুড়ে ফেললো এবং তারপর একইভাবে অন্য পায়েরটাও। সেগুলোকে তার পথের উপর থেকে ঠেলা দিয়ে সরিয়ে টেবিলে চারিদিকে তিড়িং-তিড়িং করে নাচতে নাচতে  চনমনে আবেগী কন্ঠে বিলাপ করে গাইতে শুরু করলঃ

“আমার নাম ছোট্ট ঝুমকো লতা

প্রিয় ছোট্ট ঝুমকো লতা

কেন আমি বলতে পারবো না যদিও

কিন্তু আমি ঝুমকো লতা তবুও

অভাগা ছোট্ট ঝুমকো লতা

আমি, মিষ্টি ছোট্ট ঝুমকো লতা...”

এমনকি তার গান শুরুর আগেই ডাক্তার উঠে পড়লেন। তিনি চুলার পাশে দাড়িয়ে চপ ভাজার কড়াই চাঁচছিলেন।

আমি তালি দিয়ে বললাম, “খুব সুন্দর! চমৎকার কস্টিউম”।

আসলেই সেটা খুব সুন্দর ছিল। লাল স্কার্ট, উজ্জ্বল হলুদ পেটিকোট, ফিনফিনে সাদা এপ্রন, সুতার কাজ করা বডিস।

“আমার মা বানিয়েছেন”।

“এমনকি সুতার কাজও”?

“অবশ্যই। তিনি আগের রাতে চারটা পর্যন্ত জেগে থেকে বানিয়েছেন”।

কস্টিউমটা দেখানোর জন্য সেখানে আরো কিছুক্ষন ঘুরে-ঘুরে এবং পা ঠুকে-ঠুকে নাচা হল। তাকের উপর থালা বাটির টুংটাং শব্দ বাজছিল। আমি আরো একটু বেশি তালি দিলাম। আমরা দু’জনেই একই জিনিস চাচ্ছিলাম। আমরা চাচ্ছিলাম ডাক্তার ঘুরে তাকিয়ে আমাদের অগ্রাহ্য করা বন্ধ করুক। ম্যারিকে অন্তত একটা ভদ্রোচিত শব্দ বলুক- এমনকি অনিচ্ছায় হলেও।

“এবং দেখুন আর কী আছে”, ম্যারি বলল, “ভ্যালেন্টাইনের জন্য”। সে বাক্সটা জোরে টান দিয়ে খুলল এবং সেখানে ভ্যালেন্টাইন বিস্কুট ছিল, সবগুলোই হৃৎপিন্ডের আকৃতির এবং লাল রঙের জমাট চিনির আবরন দেয়া।

“কি চমৎকার”, আমি বললাম এবং ম্যারি তার নাচ-গান আবার শুরু করলো।

আমি পিনাফোরের ক্যাপ্টেন

এবং খুবই ভাল ক্যাপ্টেনও একজন

তুমি অনেক অনেক ভাল এবং সেটা বুঝতে হবে

আমি এক ভাল ক্রুকে নির্দেশ দিয়েছি তবে...

শেষ পর্যন্ত ডাক্তার ফিরলেন এবং ম্যারি তাকে স্যালুট দিলো।

“ঠিক আছে”, তিনি বললেন, “যথেষ্ট হয়েছে”।

ম্যারি তাকে উপেক্ষা করলঃ

তারপর তিন চিয়ার্স, এক চিয়ার বেশি

ক্যাপ্টেন পিনাফোর দুঃসাহসী।...

“যথেষ্ট হয়েছে ম্যারি”

“পিনাফোরের ক্যাপ্টেনের জন্য-”

“ম্যারি, আমরা রাতের খাবার খাচ্ছি এবং তুমি আমন্ত্রিত নও। বুঝতে পেরেছো? তোমাকে আমন্ত্রন করা হয় নি”।

শেষ পর্যন্ত ম্যারি শান্ত হল। কিন্তু শুধু এক মুহুর্তের জন্য।

“আচ্ছা এহঃ যাঃ তোমাকে আমি পাত্তা দিলাম না! তুমি খুব পচা”

“আর তুমি ঐ বিস্কুটগুলো না খেলেই ভাল করবে। তুমি একটা ছোট-খাটো শুকরের মত মোটা হয়ে যাচ্ছো”।

ম্যারির মুখটা ফুলে উঠলো যেন সে এক্ষুনি কেঁদে ফেলবে কিন্তু তার পরিবর্তে সে বলল, “কে কাকে বলে! তোমার এক চোখ ট্যারা।“

“যথেষ্ট হয়েছে”।

“হ্যাঁ, ট্যারাই তো”।

ডাক্তার বুট তুলে ম্যারির পায়ের কাছে রাখলেন।

“পায়ে দাও”।

চোখে টলমল এবং নাকে পানি নিয়ে সে তা-ই করল। খুব জোরে নাকও টানলো। তিনি তার কোট তুলে দিলেন কিন্তু ম্যারি যখন সেটার সাথে জোরাজুরি, পারাপারি করে শেষ পর্যন্ত ঠিকভাবে ঢুকে বোতাম লাগানো শুরু করলে তখন তিনি তাকে পরতে সাহায্য করলেন না।

“ঠিক আছে। এখন বলো, এখানে কীভাবে এসেছো?

ম্যারি উত্তর দিতে অস্বীকার করল।

“হেঁটে এসেছো, তাই তো? আমি তোমাকে গাড়ি দিয়ে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি যাতে তুমি দুঃখে কাতর হয়ে তুষার-স্তুপে ঝাপিয়ে পড়ে ঠান্ডায় জমে মরার সুযোগ না পাও”।

আমি একটা কথাও বলিনি। ম্যারি একবারও আমার দিকে তাকালো না। আসলে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে সে মুহূর্তটা এতটাই থমথমে ছিল যে আমাদের কারো পক্ষেই বিদায় বলা সম্ভব হল না।

গাড়ী চলা শুরুর শব্দ শুনে আমি টেবিল পরিস্কার করতে শুরু করলাম। আমরা ডেজার্ট খাওয়ার সময় পাইনি। আবারও আপেল পাই। সম্ভবত তিনি অন্য কোন ধরনের কিছু চিনতেন না অথবা সম্ভবত বেকারীতে শুধু এটাই বানাত।

আমি হৃৎপিন্ডের মত বিস্কুট খেলাম। বাইরের চিনির আবরনটা ছিল ভয়ংকর মিষ্টি। বেরি বা চেরির গন্ধ ছিল না, শুধু চিনি আর লাল খাবার রং। আমি আর একটা এবং আরো একটা খেলাম।

আমি জানতাম যে আমার অন্তত বিদায় বলা উচিত ছিল। আমার তাকে বিস্কুটের জন্যও ধন্যবাদও দেয়া উচিত ছিল। কিন্তু দিলেও তখন কিছুই হত না। আমি নিজেকে স্বান্তনা দিলাম- দিলেও কিছুই হত না। ম্যারির প্রদর্শনীটা আমাকে উদ্দেশ্য করে মঞ্চস্থ হয়নি। অথবা, হয়ত সেটার ক্ষুদ্র একটা অংশ মাত্র আমার উদ্দেশ্যে ছিল।

তিনি খুবই নির্দয় ব্যাবহার করেছিলেন। এক অকিঞ্চনের প্রতি তার এই নির্দয় ব্যাবহারে আমি ভীষন মর্মাহত হয়েছিলাম। একভাবে তিনি এটা আমার জন্যই করেছিলেন। যাতে আমার সাথে তার সময় ম্যারি না নিতে পারে। এই চিন্তা আমাকে পুলকিত করলো, এবং এই পুলকিত হওয়ার জন্যও আমি লজ্জিত হলাম। আমি বুঝতে পারছিলাম না তিনি ফিরে এলে আমার কি বলা উচিত।

তিনি আমারকে কিছুই বলতে দিলেন না। আমাকে সোজা বিছানায় নিয়ে গেলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম না যে, এটা কি তার কাছে খুব মামুলি কোন ব্যাপার ছিল- নাকি তিনিও আমার মতোই বিস্মিত? আমার কুমারীত্ব অন্তত অপ্রত্যাশিত বলে মনে হয়নি- তিনি আমাকে একটা তোয়ালে এবং একটা কন্ডম দিলেন- এবং অনড়ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন, যতটুকু সহজে সম্ভব। আমার প্রচন্ড আবেগ ছিল দু’জনের কাছেই বিস্ময়কর।

“আমি আপনাকে বিয়ে করবো বলে মনস্থির করেছি”, তিনি বললেন।

আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার আগে তিনি সব বিস্কুটগুলো ছুঁড়ে ফেললেন, তুষারের উপর। পাখীর খাবারের জন্য...লাল হৃদপিন্ডের মত বিস্কুট।

সুতরাং তা-ই স্থির হল। আমাদের বাগদান- যদিও তিনি এই নিদৃষ্ট শব্দটার ব্যাপারে খুঁতখুঁতে ছিলেন- তবে সেটা যে ব্যাক্তিগতভাবে আমাদের মধ্যে হয়ে গেছে এ ব্যাপারে তিনি একমত ছিলেন। এক সাথে পর পর কয়েক দিন ছুটি পেলেই আমাদের বিয়েটা হবে। তিনি বললেন বিয়েটা হবে খুব অনাড়ম্বর, একেবাই ন্যাড়া-হাড্ডি বিয়ে। আমি আমার দাদা-দাদীকে একটা অক্ষরও লিখতে পারবো না। আমাকে বুঝতে হবে যে- যাদের বিশ্বাস এবং চিন্তাধারাকে তিনি সন্মান করেন না এবং যারা আচার অনুষ্ঠানের ধরন নিয়ে হাসি তামাশা করবে- এমন মানুষদের উপস্থিতিতে তিনি বিয়ে করতে অপারগ।

তিনি হীরের আংটির পক্ষেও ছিলেন না। আমি তাকে বলেছিলাম যে এমনিতে আমি তা কখনোই চাইনি, আসলেই সত্যিই, কারন, আমি আগে কখনোই এ নিয়ে ভাবিনি। তিনি বললেন যে, সেটাই ভাল। তিনি জানতেন আমি ঐ সব নির্বোধ ও গতানুগতিক মেয়েদের মত নই।

তিনি বলেছিলে যে, একসাথে রাতের খাবার বন্ধ করাটাই শ্রেয়। শুধুমাত্র এজন্য নয় যে মানুষ এ নিয়ে কথা বলবে, বরং এ জন্য যে একটা র‍্যাশন কার্ডে দুজনের পরিমান মাংস পাওয়া ছিল কঠিন। আমার র‍্যাশন কার্ড নেই- স্যানে খাওয়া শুরু করার পরপরই কিচেনের তত্বাবধায়ক, ম্যারির মাকে তা হস্তান্তর করা হয়েছিল।

আমাদের প্রতি অন্য কারো দৃষ্টি আকৃষ্ট না করাটাই মঙ্গল।

অবশ্যই সবাই কিছু একটা সন্দেহ করছিল। বয়স্কা নার্সরা আন্তরিক হলেন, এমনকি ম্যাট্রনও আমার সাথে কষ্ট করে তার স্বভাব বিরুদ্ধ ভাবেই হাসতেন। আমার আত্মতুষ্টির অনিচ্ছাকৃত বাকুম-বাকুম ভাবটা কাউকে বুঝতে না দিয়ে সংযত ভাবে চলতাম। আমি চোখ নামিয়ে নিজেকে মখমলের নিরবতায় গুটিয়ে নিলাম। আমার চিন্তায়ও আসে নি যে বয়স্ক এই মহিলারা আমাদের এ ঘনিষ্টতা কোন দিকে মোড় নেয় তার উপর নজরে রাখছিলেন এবং যদি ডাক্তার আমাকে ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেয় তবে তারা ন্যায়ের পথে যেতেও প্রস্তুত ছিলেন।

একমাত্র সাহায্যকারী সেবিকারাই অকপটে আমার দিকে ছিল, এবং তারা আমার সাথে এই বলে মজা করতো যে তারা আমার চায়ের পাতার মধ্যে বিয়ের ঘন্টা দেখতে পাচ্ছে।

মার্চ মাসে হাসপাতালের ভিতরের পরিস্থিতি ছিল ভয়ানক ব্যাস্ত ও মার্মান্তিক। সাহায্যকারী সেবিকারা বলতো যে বরাবরই এটা বছরের সবচেয়ে খারাপ মাস। কিছু কারনে, শীতের প্রকোপের মধ্য দিয়ে যাওয়ার পর কিছু কিছু মানুষ এই মাসেই মরার সিদ্ধান্ত নেয়২৫। যদি কোন বাচ্চাকে ক্লাসে না দেখা যেত, খুব খারাপ কিছু ঘটে গিয়েছে নাকি সে শুধুমাত্র ঠান্ডায় শয্যাশায়ী তা জানার আমার কোন উপায় ছিল না।

তসত্বেও ডাক্তার কিছু সময় বের করার ব্যাবস্থা করেছিলেন। তিনি আমার কক্ষের দরজার নীচ দিয়ে একটা চিরকুটে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিলেন। যদি না কোন ভীষন সঙ্কট ঘটে তবে তিনি ঐ সময় কয়েকটা দিন বের করতে পারবেন।

আমরা হান্টসভিলে২৬ যাচ্ছি।

হান্টসভিলে যাচ্ছি- এটা ছিল আমাদের বিয়ের সাংকেতিক শব্দ।

আমি আমার সবুজ ক্রেপ ড্রেসটাকে ড্রাইক্লিন করিয়ে সযত্নে ভাজ করে ছোট ব্যাগে তুলে রেখেছি।আমাকে কোন মহিলা টয়লেটে গিয়ে পোষাক পরিবর্তন করতে হবে— এই ভেবে। আমি ব্যাকুল ভাবে রাস্তার ধারে আগাম বন্য ফুল খুঁজছি, তুলে একটা তোড়া বানানোর জন্য। তিনি আমার ফুলের তোড়ার প্রস্তাবে রাজি হবেন তো? কিন্তু আসলে ফুলের জন্য তো সময়টা বেশি আগাম- এমন কি কোন জলাভুমির গাঁদা ফুলের জন্যেও। খটখটে শুকনো কালো স্পুস গাছ, দ্বীপের মত বিচ্ছিন্ন ভাবে ছড়ানো জুনিপার এবং জলাভুমি, আর ভাংগা রাস্তার ফাটলের মধ্যে এলোমেলো ভাবে মিশানো পাথর যেগুলো এতোদিনে আমার কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে, রক্তলাল লৌহ এবং তেরসা ধাপ কাটা গ্রানাইট পাথর ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছিল না।

গাড়িতে রেডিও চালানো এবং সেখানে বিজয় সংগীত বাজছে কারন, মিত্রশক্তি বার্লিনের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে। ডাক্তার বললেন যে, তারা দেরী করছে যাতে রাশিয়ানরা প্রথমে বার্লিনে ঢুকতে পারে। তিনি বললেন যে, মিত্রবাহিনীকে পরে পস্তাতে হবে।

অ্যামান্ডসেন থেকে এই দূরে এসে আমি আবিস্কার করলাম যে এখন তাকে আমি অ্যালিস্টার নামে ডাকতে পারি। এতদিন পর্যন্ত আমাদের একসাথে বেড়ানোর মধ্যে এটাই সবচেয়ে দীর্ঘ পথ। তার স্বচ্ছন্দে গাড়ি চালানোর দক্ষতা এবং আমার প্রতি তার পুরুষালী উদাসীনতায় তার প্রতি আমার তীব্র প্রেম-আকাঙ্ক্ষার উদ্রেক হল, তবে আমি এ-ও জানি যে দ্রুত তা উল্টেও যেতে পারে। সে যে একজন সার্জন এটা ভেবে আমি রোমাঞ্চিত হলাম, যদিও আমি তা কখনোই স্বীকার করবো না। ঠিক এখন, আমার মনে হয় আমি তার জন্য যে কোন জলাভুমি কিম্বা নোংরা গর্তেও শুতে পারবো, এমনকি রাস্তার পাশের পাথরের চাঁইয়ের চাপও মেরুদন্ডে নিতে পারবো যদি তিনি দাঁড়ানো ভাবেও চান। আমি এটাও জানি আমাকে এই অনুভুতিগুলো অবশ্যই নিজের মধ্যে রাখতে হবে।

আমি আমার মনকে ভবিষ্যতের দিকে ফেরালাম। আমি আশা করছিলাম যে হান্টসভিলে আমরা একজন পুরোহিতকে খুঁজে পাবো এবং এমন একটা বসারঘরে আমরা পাশাপাশি দাঁড়াবো-যেটা হবে আমার জীবনভর দেখে আসা বসার-ঘরগুলোর মতোই ছিমছাম এবং মার্জিত।

কিন্তু সেখানে পৌঁছে বিয়ে করার জন্য যে অন্য উপায়ও আছে, এবং আমার বরের যে পুরোহিতদের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা আছে যা আমি আগে ধরতে পারিনি- তা আবিস্কার করলাম। সে পুরোহিতের ধারে-কাছেই যেতে অনিচ্ছুক।

হান্সটভিলের টাউনহলে আমরা আমাদের অবিবাহিত অবস্থা নিশ্চিত করতে একটা হলফনামা পুরন করলাম এবং বিয়ে করার জন্য একজন ন্যায়পালের সাথেও সাক্ষাতের সময় ঠিক করলাম।

দুপুরে খাবারের সময়। অ্যালিস্টার একটা রেস্তোরাঁর সামনে থামে যেটা অ্যামান্ডসেনের কফি শপের চাচাতো ভাই হিসেবে চালিয়ে দেয়া যায়।

“এটাতে চলবে”?

কিন্তু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে সে তার মনোভাব পরিবর্তন করলো।

শেষ পর্যন্ত মুরগীর মাংসের ডিনারের বিজ্ঞাপন দেয়া অভিজাত খাবার ঘরগুলোর একটার ঠান্ডা সামনের কক্ষে লাঞ্চ করলাম। বরফের মত ঠান্ডা প্লেট। সেখানে অন্য কোন ভোজনকারী অথবা গান শোনার জন্য কোন রেডিও-ও ছিল না- শুধুমাত্র আঁশালো মুরগীর মাংসকে আলাদা করতে গিয়ে আমাদের ছুরি-কাটার ঠুং ঠ্যাং শব্দ। আমি নিশ্চিত যে তিনি ভাবছেন প্রথম যে রেস্তোরাটা তিনি প্রস্তাব করেছিলেন সেটাতে খেলেই ভাল হতো।

তাসত্বেও, মহিলাদের ওয়াশরুম কোথায় এটা জিজ্ঞেস করার মত সাহস আমি খুজে পেলাম, এবং সেখানে সামনের রুমের চেয়ে আরো বেশী ঠান্ডা এবং হতাশাব্যাঞ্জক হওয়া স্বত্বেও আমি ঝাড়া দিয়ে আমার সবুজ জামা পরলাম, ঠোঁটে আবার নতুন করে রং মাখলাম এবং চুল ঠিক করলাম।

আমি বের হয়ে এলে, অ্যালিস্টার উঠে দাঁড়িয়ে হেসে আমাকে অভিবাদন করে এবং আমার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলল যে, আমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে।

আমরা হাত ধরাধরি করে সতর্কভাবে পা ফেলে গাড়িতে ফিরে যাই। তিনি আমার জন্য গাড়ির দরজা খুলে ধরেন, তারপর ঘুরে গিয়ে গাড়িতে ঢুকে, ঠিকঠাক ভাবে বসে গাড়িতে চাবি দিয়ে স্টার্ট দেন এবং পরক্ষনেই বন্ধ করেন।

গাড়িটা একটা হার্ডওয়েরের দোকানের সামনে পার্ক করা। সেখানে বরফ-বেলচা মুল্য হ্রাসে অর্ধেক দামে বিক্রি হচ্ছিল। এবং ভিতরে স্কেইট-ব্লেইডে২৭ শান দেয়া যাবে এমন একটা সাইন বোর্ড এখনো তাদের জানালায় ঝুলছিল।

রাস্তার উল্টো পাশে তেলচে হলুদ রং করা একটা কাঠের বাড়ি। সেটার সামনের সিড়ি বিপদজনক হয়ে পড়াতে সেখানে দু’টো বোর্ডকে পেরেক দিয়ে ক্রস করে জুড়ে রাখা।

অ্যালিস্টারের গাড়ির সামনে পার্ক করা ট্রাকটার মডেল প্রাক যুদ্ধ কালীন, সেটা পা-দানি যুক্ত এবং তার বাম্পারের ধারে জং ধরা। হার্ডওয়েরের দোকান থেকে ওভারঅল২৮ পরা একজন মানুষ এসে ট্রাকে চড়ে বসে। ইঞ্জিনের কিছু সমস্যা, একটু ঝাকাঝাকি ও ঝনঝনে শব্দ এবং তারপর জোরে একটা ঝাকুনির পর সেটাকে দূরে চালিয়ে নেয়া হয়। দোকানের নাম লেখা একটা ডেলিভারী ট্রাক খালি হওয়া জায়গায় এখন পার্ক করার চেষ্টা করছে। সেখানে পর্যাপ্ত জায়গা নেই, ড্রাইভার বের হয়ে এসে অ্যালিস্টারের জানালায় টোকা দেয়। অ্যালিস্টার বিস্মিত হয়ে গেল- যদি সে আমার সাথে কথা বলাতে এতটা একাগ্রতায় নিবিষ্ট না থাকতো তাহলে সে সমস্যাটা আগেই খেয়াল করতো। সে হাতল ঘুরিয়ে জানালার কাঁচ নামাল এবং লোকটা জিজ্ঞাস করলো যে আমরা দোকান থেকে কোন কিছু কেনার জন্য সেখানে পার্ক করেছি কিনা। না হলে আমরা কি অনুগ্রহ করে সরে যেতে পারি?

“এক্ষুনি যাচ্ছি”, অ্যালিস্টার বলল- যে মানুষটা আমার পাশে বসে আছে এবং যে আমাকে বিয়ে করতে যাচ্ছিল কিন্তু এখন আর করবে না। “আমরা এক্ষুনি যাচ্ছি”।

‘আমরা’! সে বলল ‘আমরা’। এক মুহুর্তের জন্য আমি সেই শব্দটাকে আঁকড়ে ধরি। তারপর আমার চিন্তায় এল, এটাই শেষ বার। শেষ বার আমি তার ‘আমরা’র মধ্যে গন্য হলাম।

সমস্যার কারণ ‘আমরা’ নয়; আমার কাছে যে ব্যাপারটা সত্যটাকে পরিস্কার করেছে সেটা এটা নয়। সেটা তার পুরুষে-পুরুষে- ড্রাইভারের সাথে কথা বলার সময় কন্ঠ স্বরের উঠা নামা, তার ধীর এবং যুক্তিসংগত ক্ষমা প্রার্থনা। ভ্যান পার্ক করা দেখার আগে তিনি আমার সাথে যখন কথা বলেছিলেন, এখন আমার খুব করে পিছনের সেই সময়ে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। তিনি যা বলেছিল তা ছিল হৃদয়বিদারক কিন্তু অন্তত পক্ষে স্টিয়ারিংয়ের উপর তার শক্ত হাতের মুঠো- তার মুঠো, তার বিমুর্ততা, তার অভিব্যাক্তি এবং তার কন্ঠস্বর সব কিছুতেই ছিল কষ্টের প্রকাশ। তিনি কি বলেছিলেন সেটা তেমন গুরুত্বপুর্ন বিষয় নয়, আমার সাথে বিছানায় তিনি ঠিক যে গভীরতায় কথা বলেন তখন তিনি সেই একই গভীরতা থেকে কথাগুলো বলেছেন। কিন্তু এখন আর তার কন্ঠস্বর সে রকম নয়- অন্য একজন পুরুষের সাথে কথা বলার পর। তিনি হাতল ঘুরিয়ে জানালার কাঁচ বন্ধ করলেন এবং তার সব মনোযোগ এখন গাড়িতে দিলেন, পিছিয়ে সেই আঁটসাঁট জায়গা থেকে বেরিয়ে এলেন যাতে আর ভ্যানের সাথে না লাগে। যেন এর চেয়ে বেশী কিছু বলার বা করার ছিল না।

“আমি পারবো না” সে বলল।

এখন সে আর বিয়ে করতে পারবে না।

সে এটা ব্যাখ্যাও করতে পারবে না।

শুধুমাত্র তার মনে হচ্ছে এটা করা ভুল হবে।

আমার কাছে মনে হল, এরপর থেকে আমি স্কেইট ধার দেয়ার সাইনবোর্ডের সেই ‘এস’র মত পেঁচিয়ে লেখা ‘এস’ অথবা সেই হলুদ বাড়ীর সিড়ির গায়ে এবড়োথেবড়ো তক্তার ‘এক্স’র মত কোন এক্স’র দিকে তাকালেই আমার কানে তার এই কন্ঠস্বর বাজতে থাকবে।

“আমি তোমাকে এখন স্টেশনে পৌঁছে দেবো। তোমার জন্য টরন্টোর টিকিট কিনবো। আমি মোটামুটি নিশ্চিত, শেষ বিকেলে টরন্টোগামী কোন একটা ট্রেন আছে। আমি একটা কিছু বিশ্বাসযোগ্য গল্প বানিয়ে ফেলবো এবং কাউকে দিয়ে তোমার জিনিসপত্র গোছগাছ করিয়ে দেবো। তোমার টরন্টোর ঠিকানাটা আমাকে দেয়া দরকার। মনে হয় না আমি সেটা রেখেছি। আর হ্যাঁ, আমি তোমার জন্য একটা প্রশংসাপত্রও লিখে দেব। তুমি খুব ভাল কাজ করেছো। এমনিতেও তোমার এ টার্ম শেষ করা হয়ে উঠতো না- তোমাকে এখন পর্যন্ত বলা হয়নি, কিন্তু বাচ্চাদের অন্য আর একটা আরোগ্য-নিকেতনে স্থানান্তরিত করা হচ্ছে। নানা রকমের বিশাল আকারের একটা পরিবর্তন হতে যাচ্ছে”।

তার কন্ঠস্বরে নতুন এক সুর— উচ্ছ্বলপ্রায়। স্বস্তির সুর। আমি চলে না যাওয়া পর্যন্ত সে সেটা চেপে রাখার চেষ্টা করছে।

এখন আবার আমি রাস্তার উপর চোখ রাখি। যেন আমাকে ফাঁসির দড়ির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এখনো না... এখনও একটু সময় আছে। এখনও আমি তার কন্ঠস্বর শেষবারের মত শুনছি না। এখনও নয়।

স্টেশনের যাওয়ার রাস্তা তার জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন হলো না। আমার ভেতরের ভবনাটা আমি সশব্দে বলে উঠিলাম- সে আগেও কি আরো কিছু মেয়েকে এভাবেই ট্রেনে তুলে দিয়েছে কিনা।

সে বলল, “অমন করে বলো না”।

রাস্তার প্রতিটা মোড়ের বাঁকই যেন আমার বাকী জীবনটা একটু একটু করে খাবলে তুলে নিচ্ছে।

পাঁচটার সময় টরন্টোগামী একটা ট্রেন আছে। সে যখন স্টেশনে খোঁজে যায় তখন আমি গাড়িতে বসা। সে তার হাতে টিকেট নিয়ে বের হয়ে এলো, আমার মনে হল সে পলকা পায়ে যেন উড়ে উড়ে আসছে। অবশ্যই সেও সেটা অনুধাবন করেতে পারছে কারন যতই সে গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছে ততই সে শান্ত হয়ে যাচ্ছে।

“স্টেশনের ভেতরটা বেশ উষ্ণ। মহিলাদের জন্য একটা আলাদা বিশ্রামাগার আছে”।

সে আমার জন্য গাড়ির দরজা খুল ধরে।

“নাকি তুমি চাও আমি বরং তোমাকে সী-অফ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করি? হয়তবা আশে পাশে মোটামুটি ভাল গোছের কোন পাইয়ের দোকান পেয়েও যেতে পারি। দুপুরের খাবারটা ভয়ংকর বাজে ছিল!”

তার এই কথায় আমার ভিতরটা আলোড়িত হলো। আমি গাড়ি থেকে নেমে তার আগে আগে হেঁটে স্টেশনে ভিতরে গেলাম। সে মহিলা বিশ্রামাগারের দিকে ইঙ্গিত করলো। সে আমার দিকে তার সেই ভ্রু তুলে শেষ বারের মত কৌতুক করার চেষ্টা করলো।

“হয়ত কোন একদিন তুমি এই দিনটাকেই তোমার জীবনের সবচেয়ে পয়মন্ত দিন বলে মনে করবে”।

আমি বিশ্রামাগারে এমন একটা বেঞ্চ বেছে নেই যেখান থেকে স্টেশনের সামনের দরজা দেখা যায়। যাতে করে সে ফিরে এলে আমি তাকে দেখতে পাই। যদি সে এসে বলে এগুলো সবই ছিল কৌতুক।অথবা আমার ভালবাসার একটা পরীক্ষা, যেমনটা মধ্যযুগীয় কিছু-কিছু নাটকে দেখা যায়। কিম্বা হয়ত তার মনের পরিবর্তন হবে। মহা-সড়ক ধরে যেতে-যেতে পাথরের উপরে বসন্তের ম্লান সূর্যালোক দেখে- যা আমরা অতিসম্প্রতি দু’জন এক সাথে দেখেছি। এবং অনুধাবিত বোকামী দিয়ে তাড়িত হয়ে দ্রুত গাড়ি ঘুরিয়ে ফিরে আসবে।

টরন্টোর ট্রেনটা ষ্টেশনে আসতে অন্তত একঘন্টা লেগে যায়, কিন্তু মনে হলো এটা আদৌ তেমন কোন সময়ই নয়। এবং এমনকি এ অবস্থায় এখনও আমার মনে কল্পনা ডানা মেলে। আমি এমন ভাবে ট্রেনে উঠি যেন আমার পায়ে শিকল বাঁধা। প্লাটফর্মে আমাদের ট্রেন ছেড়ে যাওয়ার ভেঁপু বাজলে আমি জানালার সাথে মুখ লাগিয়ে প্লাটফর্মের যতটুকু দেখা যায় দেখার চেষ্টা করি। ভাবি- এখনও ট্রেন থেকে ঝাঁপিয়ে নামার জন্য খুব বেশি দেরী হয়ে যায়নি। ঝাঁপ দিয়ে নেমে স্টেশনের মধ্যে দিয়ে দৌড়ে রাস্তার সেখানে চলে যাই, যেখানে ঠিক এইমুহুর্তে সে তার গাড়িটা পার্ক করে গভীর আত্মমগ্নতায় পা ফেলছে।মোটেও দেরী হয়নি, হে প্রভূ! যেন বেশী দেরী না হয়।

আমি তার দিকে দৌড়ে যাচ্ছি। এখনও বেশী দেরী হয়ে যায়নি।

একজন নয় বরং একঝাঁক বিলম্বে আসা যাত্রীরা এখন বসার জায়গার মাঝখান দিয়ে যাওয়ার সময় ঠেলা-ঠেলি, ধাক্কা-ধাক্কি এবং চেঁচামেচিতে একটা বিশৃংখল অবস্থার সৃষ্টি করেছে। খেলার পোষাকে একদল হাই-স্কুলের ছাত্রীরা নিজেদের করা বিপত্তিতে উল্লাসিত হয়ে কটাক্ষ করে নিজেদের মধ্যে হাসি-তামাশা করছে। তারা বসার জায়গা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঠেলাঠেলি করতেই ট্রেনের তত্বাবধায়ক বিরক্ত হয়ে তাদেরকে তাড়া দিলো।

তাদের মধ্যে একজন, সম্ভবত যে বেশি জোরে কথা বলছে, সে ম্যারি। আমি মাথা ঘুরিয়ে নিয়ে তাদের দিকে আর তাকালাম না।

কিন্তু এখন সে উচ্চস্বরে চিৎকার করে আমার নাম ধরে ডেকে জানতে চাইছে আমি কোথায় গেছিলাম।

একজন বন্ধুর কাছে বেড়াতে, আমি তাকে বললাম।

সে ঝপ করে আমার সীটের পাশে বসে বললো, তারা হান্টসভিলের দলের বিপক্ষে বাস্কেট বল খেলেছে। প্রচন্ড হাস্যকর অবস্থা- ম্যারিরা হেরে গেছে।

“আমরা হেরেছি, তাই না”? সে আপাত উল্লাসে ডাক ছাড়লো এবং তার দলের কেউ কেউ খিল-খিল করে হেসে উঠল এবং বাকিরা খেঁকিয়ে উঠলো।

সে খেলার স্কোর বললো, যা আসলেই বেশ জঘন্য। “আপনি তো খুব সুন্দরভাবে সাজুগুজু করেছেন” সে বললো, কিন্তু আমাকে খুব একটা খেয়াল করলো না।

সে কোন রকম ঔৎসুক্য ছাড়াই আমার উত্তর বিশ্বাস করলো। সে খেয়ালই করেনি যে তাকে আমি বলেছি যে, আমি টরন্টোতে দাদা-দাদীকে দেখতে যাচ্ছি। সে অ্যালিস্টার সম্পর্কে একটা শব্দও উচ্চারণ করলো না। এমনকি কোন আপত্তিকর শব্দও না। সে ভোলেনি। আসলে সে ঘটনাটাকে তার পিছনের জীবনের সাথে গুছিয়ে তুলে রেখেছে- আত্মার কুঠুরীতে। অথবা হয়ত সে আসলেই এমন একজন মানুষ যে বেপরোয়া ভাবে অপমানের সাথে সমঝোতা করতে পারে।

আমি এখনও তার কাছে কৃতজ্ঞ, যদিও আমি সে সময়ে ব্যাপারটা অনুভব করতে পারিনি। সে সময় যদি আমি একা থাকতাম তবে অ্যামান্ডসেনে ট্রেন পৌঁছালে আমি কী না কী-ই যে করে ফেলতাম? হয়ত ট্রেন থেকে পালিয়ে তার বাড়ীতে দৌড়ে গিয়ে জানার দাবী করতাম কেন, কেন? কি লজ্জা! সারা জীবনের জন্য।

এমনিতেই, স্টেশনে বিরতির সময়টা ঐ দলের সবার গুছিয়ে এক সাথে নামার জন্য যথেষ্ট ছিল না এবং তখন তত্বাবধায়কের কাছে থেকে তারা হুশিয়ারী পেল যে এখন তারা চটপট না নামলে ট্রেন তাদেরকে পরবর্তী স্টেশন টরন্টোতে নিয়ে যাবে।

অনেক বছর ধরেই আমি ভাবতাম আমার সাথে তার আবার হয়ত হঠাৎ দেখা হতে পারে। আমি টরন্টোতে ছিলাম এবং এখনও আছি। আমরা মনে হত সবাই কোন না সময় টরন্টোয় আসেই, অল্প সময়ের জন্য হলেও।

তারপর, দশ বছরেরও বেশি সময়ের পর, শেষ পর্যন্ত তা সত্যি হল। একটা জনবহুল রাস্তায়, যেখানে এমন কি হাঁটার গতি স্লথ করাও প্রায় অসম্ভব, আমাদের মুখোমুখি দেখা হলো- দু’জনই পরস্পর বিপরীতমুখী- একই পথে- ঠিক একই সময়ে চোখাচোখি, সময়ের ছাপ পড়া মুখে একটা অপলক ধাক্কা।

সে চিৎকার করে বলল “কেমন আছো”? এবং আমি উত্তর দিলাম “ভালো”। তারপর আরও স্পষ্ট করার জন্য যোগ করলাম “সুখী”।

সে সময় আদতে এটা মোটামুটি ভাবে সত্যি ছিল। তখন আমার স্বামীর অন্যপক্ষের একটা ছেলের ধার  শোধ দেয়া নিয়ে আমাদের মাঝে এক ধরনের টানপোড়ন চলছিল। নিজের মনেকে একটু প্রশান্তি দেয়ার জন্য সেই বিকেলে আমি একটা আর্ট গ্যালারির প্রদর্শনীতে গিয়েছিলাম।

সে আর একবার আমাকে পিছন থেকে ডাক দিয়ে বললো, “তাহলে তো ভালই হয়েছে”।

আমার তখনও মনে হচ্ছিল আমরা যেন সেই ভীড়ের মধ্য থেকে আমাদের পথ খুঁজে ঠিকই বের হয়ে যাবো। যেন এক মুহুর্তের মধ্যেই আমরা আবার এক সাথে মিলবো। কিন্তু এটাও ঠিক নিশ্চিত যে, আমরা যে যেদিকে যাচ্ছিলাম সে সেদিকেই যাবো, এবং আমরা তা-ই করলাম।

যখন আমি ফুটপাথে পৌঁছলাম তখন কোন রুদ্ধশ্বাস কান্না নয় কিম্বা কাঁধে উপর কারো হাতও নয়। শুধু মাত্র সেই একটা দৃশ্যই চোখে ভাসছিল যা আমি দেখেছিলাম... তার এক চোখের চেয়ে অন্য চোখে বিস্ফোরিত দৃষ্টি- সেটা তার বাম চোখ- হ্যাঁ, সব সময়েই বাম চোখ, যতটুকু আমার মনে পড়ে। এবং সেখানে সব সময়েই এতো ঔৎসুক্য, এবং বিস্ময়তা, চঞ্চলতা এমন ভাবে ফুটে থাকতো যেন কোন বিরাট আজগুবী কিছু ঘটছে এবং তিনি খুব মজা পাচ্ছেন।

এটুকুই...

তারপর আমি বাড়ির পথ ধরলাম- ঠিক সেই একই রকমের অনুভুতি নিয়ে যা অ্যামান্ডসান ছেড়ে আসার সময় আমার ভিতরে ছিল। রেলগাড়ি আমাকে টেনে নিয়ে চললো, অবিশ্বাস্য...

স্পষ্টতই ভালবাসার কোন পরিবর্তন হয় না।

_______________________________

টীকাঃ

১। অ্যামান্ডসেনঃ কানাডার ওন্টারিও প্রদেশের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত একটি ক্ষুদ্র জনপদ। এক সময়ে এটা হয়ত বর্ধিষ্ণু ছিল কিন্তু বর্তমানে ক্ষয়িষ্ণু। এলিস মুনরোর এই গল্পটি অ্যামান্ডসেনের একটি আরোগ্য নিকেতন নিয়ে। এই গল্পটা প্রথমে ‘দ্যা নিউইয়ির্কার’-এ ২০১২ সালে প্রকাশিত এবং বহুল আলোচিত।

২। স্যানঃ স্যানাটোরিয়াম/আরোগ্যনিকেতন। কারো-কারো দাবী, এই গল্পের স্যানাটরিয়ামটি ওন্টারিও’র মুস্কোকা’র পরিত্যক্ত স্যানাটোরিয়াম অবলম্বনে কল্পিত।

৩। ক্লোকরুমঃ শীতের দেশের ওভার-কোট, টুপি ইত্যাদি রাখার কক্ষ।

৪। ঠান্ডায় আপনার পাছাও জমে যাবেঃ এটা একটা ইংরেজী প্রচলিত বুলি। অতিরিক্ত ঠান্ডা বোঝাতে ব্যাবহৃত হয়। ঠান্ডায় প্রথমে নাক, কান এবং অন্যান্য উন্মুক্ত স্থান জমে যায়। কিন্তু ঠান্ডায় নিতম্ব জমে যাওয়া মানে অস্বাভাবিক রকমের ঠান্ডা।

৫। ট্যান ইওর হাইডঃ একটা সেকেলে ইংরেজী প্রচলিত বুলি। এক সময় এটা এতটাই প্রচলিত ছিল যে শুধু ট্যানিং বলা হত। এটা বলে মারের ভয় দেখানো হয়।

৬। চকচকে নিনোলিয়ামের মেঝেঃ লিনোলিয়াম হল বিভিন্ন রঞ্জক পদার্থ, তিসি তেল এবং কাঠের গুড়োর মিশ্রন যা দিয়ে ঘরের মেঝে তৈরী করা যায়। স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য এটাকে অ্যাক্রিলিক ফ্লোর পলিশ করা হয় যা মেঝেকে চকচকে করে।

৭। উর্দী পরা মহিলাঃ ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেক নারীরা সেবিকা হিসেবে যুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছিলেন এবং তাদের উর্দী পরতে হত।। এখানে উর্দী পরা মহিলা বলতে সেই সব মহিলা নার্সদের বোঝানো হয়েছে।

৮। ম্যাজিক মাউন্টেনঃ জার্মান লেখক টমাস মান-এর লেখা উপন্যাস যা ১৯২৪ সালে প্রকাশিত হয়। এটা বিংশ শতাব্দীর জার্মান সাহিত্যের বিশেষ উল্লেখ্যযোগ্য সাহিত্য কর্ম বলে বিবেচিত। মান যখন এই উপন্যাস লিখতে শুরু করেন তখন তার স্ত্রী ফুসফুসের জটিলতায় ভুগছিলেন এবং স্যানাটোরিয়ামে ছিলেন। এই উপন্যাসের নায়ক বিশ বছরের এতিম হান্স কাস্টর্প, যে চাচার কাছে বড় হয়েছে, সে জাহাজে চাকরীতে যোগদানের আগে তার চাচাত ভাই, যক্ষ্মাক্রান্ত ইওয়াহীমকে স্যানাটারিয়ামে দেখতে গিয়ে নিজেই যক্ষ্মাক্রান্ত হয়ে পড়ে।

৯। জ্যানিটরঃ অ্যাপার্টমেন্ট বাড়ি, অফিস ভবন, স্কুল, ইত্যাদিতে নিযুক্ত কোন ব্যক্তি যিনি চৌহদ্দি পরিষ্কার, আবর্জনা অপসারণ এবং ছোটখাট মেরামতের কাজ করেন।

১০। বোঁ ভোয়াযঃ এটা একটা ফরাসী বুলি। অর্থ হল- শুভ ভ্রমন।

১১। জাংকেটঃ দুধ দিয়ে তৈরী সুগন্ধযুক্ত এক ধরনের মিষ্টান্ন।

১২। শেপার্ডস পাইঃ মাংশের পুর দেয়া বেক করা এক ধরনের খাবার। এর বৈশিষ্ট হল বাইরের দিকের আবরনটা আলু থাকে, যা বেক করার পর মচমচে হয়।

১৩। পসটামঃ ভাজা গমের তুষের তৈরী এক ধরনের পানীয়, যা কফির পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়।

১৪। বিয়ার-পার্লারঃ হোটেলের যে রুমে বিয়ার সার্ভ করা হয় (কানাডিয়ান)।

১৫। ডরমারঃ এটা হল কোন ভবনের এমন এক ধরনের গাঠনিক উপাদান যা ছাদের ঢালু পৃষ্ঠ থেকে বাইরের দিকে বিভিন্ন আকারে বাড়ানো থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ত্রিকোনাকার হয় এবং এই ফ্রেমের মধ্যে জানালা থাকে।

১৬।টিচঃ টিচাররের সংক্ষিপ্ত।

১৭। স্লেজঃ বরফের উপর দিয়ে চলার জন্য পশু বাহিত একধরনের যান বিশেষ যার তলে চাকার পরিবর্তে ধাতব পাত বা কাঠের ফালা ব্যাবহৃত হয় যা সহজেই বরফের উপর দিয়ে পিছলে যেতে পারে।

১৮। টবোগানঃ লম্বা, সরু, সমতল তলদেশের এক বিশেষ ধরনের স্লেজ যেটা পাতলা বোর্ড দিয়ে তৈরী এবং এর সামনের দিকটা উপরের দিকে উঠে বাঁকা হয়ে আবার পিছনের দিকে আসে। দুইদিকেই নিচু রেলিং থাকে। তুষারের উপরে চলাচলের উপযোগী। এটা স্লেজের চেয়ে নীচু হয়।

১৯। পিনাফোরঃ প্রহাসনিক গীতিনাট্য। এটা ১৮৭৮ সালে মে মাসে প্রথম লন্ডনে মঞ্চস্থ হয়। সংলাপ লিখেছেন ডাব্লু এস গিলবার্ট এবং সংগীত আর্থার সুলিভানের।

২০। স্নো-বুটঃ তুষারের মধ্যে হাঁটার জন্য জলরোধী, উঁচু এবং রাবারের সোলযুক্ত বুট যা সাধারনত গোড়ালি বা তার উপর পর্যন্ত ঢাকে।

২১।সু্যেডঃ এক ধরনের চামড়া যার উপরিতল একটু রোমশ এবং সেগুলো খাড়াভাবে থাকে অনেকটা মখমল কাপড়ের উপরিতলের মত।

২২। ন্যাফটা ও সেটেমব্রিনিঃ দ্যা ম্যাজিক মাউন্টেন উপন্যাসের দুটো চরিত্র। সেটেমব্রিনি একজন আলোকিত মানুষ, মানবতা, গনতন্ত্র, সহনশীল এবং মানবাধিকার সম্পর্কে ধন্যাত্বক ধারনা পোষন করেন। ন্যাফটা সেটেম্ব্রনির প্রতিদ্বন্দী, জন্মগত ভাবে একজন ইহুদী কিন্তু পরে ক্যাথলিক চার্চে খৃষ্টান ধর্মের পুরুষদের ধর্ম-সভায় যোগদান করেন এবং পরে হেজেলিয়ান মার্ক্সবাদী হন।

২৩। পল টিলিকঃ একজন জার্মান-আমেরিকান খৃষ্টান অস্তিত্ববাদী দার্শনিক এবং ধর্মতত্ত্ববিদ।

২৪। রক্তমোক্ষনঃ এটা একটা পুরনো চিকিৎসা পদ্ধতি যেটাতে রোগীর শরীর থেকে অল্প পরিমান রক্ত বের করে নেয়া হত। এর কারণ তারা বিশ্বাস করতো যে মানুষের শরীরে রক্ত সহ চার ধরনের ফ্লুয়িড থাকে এবং এদের অনুপাত কম বেশী হলে মানুষ অসুস্থ হয়। এটা উনবিংশ শতাব্দীর শেষের সময় পর্যন্ত চালু ছিল। এটা প্রায় ২০০০ বৎসর যাবৎ টিকে ছিল।

২৫। শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচার পর মানুষ এই মাসেই মরার সিদ্ধান্ত নেয়ঃ সাধারনত মেরু অঞ্চলের কাছাকাছি দেশগুলোতে শীতের সময়- অর্থাৎ ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারীতে দিনের দৈর্ঘ এবং তাপমাত্রা প্রচন্ড ভাবে কমে যাওয়ার কারনে কিছু কিছু মানুষের মানসিক সমস্যা দেখা দেয় ফলে অনেকেই এ সময় আত্মহত্যা করে।

২৬। হান্টসভিলঃ টরন্টো থেকে ২১৫ কিমি উত্তরে একটা শহর। পর্যটনের জন্য বিখ্যাত।

২৭। স্কেইট-ব্লেডে শান দেয়াঃ বরফের উপর হকি এবং ফিগার স্কেইটিং করার জন্য এক বিশেষ ধরনের জুতো পরা হয় যার নীচে একটা বিশেষ ধরনের ব্লেড লাগানো থাকে। এই ব্লেডকে মাঝে-মাঝেই ধার দিতে হয়।

২৮। ওভারঅলঃ বুকের কাছে বিব আটকানো ঢিলাঢালা প্যান্ট যার অনেক পকেট থাকে। এটা সাধারনত পোষাকের উপরে পরা হয়। সাধারনত ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রী বা কারখানার কর্মীরা পড়ে থাকে।

 

উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ...

লিপ সেকেন্ডঃ পৃথিবীর গতি ধীর হওয়ার খেসারত


লিপ ইয়ারের নাম আমরা শুনেছি। এটা কেন হয়, কবে হয়, সেটাও জানি। কিন্তু লিপ সেকেন্ডের (Leap Second) নাম কি এতোটা শুনেছি? অনেকে হয়ত এইমাত্রই শুনলেন।

তো? শোনাটাই আসল। এরপর আসে জানার পালা। জেনে নিন যে, লিপ ইয়ারের মত এটিও সময় অ্যাডজাস্ট করার একটি প্রক্রিয়া। মজার ব্যাপার হল, এ বছরের (২০১৫) ৩০ জুন ছিল লিপ সেকেন্ডের দিন!

লিপ সেকেন্ড কী?


লিপ সেকেন্ড মানে হল, রাত পার হয়ে নতুন একটা দিন শুরু হবে ২৩ ঘণ্টা ৫৯ মিনিট ৬০ সেকেন্ড পার হয়ে ০০.০০.০০ সেকেন্ডে। এক্ষেত্রে বাড়তি এক সেকেন্ডটিই লিপ সেকেন্ড। আবার, সেকেন্ডের হিসেব থেকে এক সেকেন্ড হাপিশও হয়ে যেতে পারে! মানে, রাত পার হয়ে নতুন একটা দিন শুরু হবে ২৩ ঘণ্টা ৫৯ মিনিট ৫৮ সেকেন্ড পার হয়ে একেবারে ০০.০০.০০ সেকেন্ডে। এক্ষেত্রে যে সেকেন্ডটি কাটা পড়ল, সেটিও লিপ সেকেন্ড।

আরেকটু খোলাসা করে বলি। ধনাত্মক (পজিটিভ) লিপ সেকেন্ড হল, ঊনষাট সেকেন্ডের সাথে বাড়তি এক সেকেন্ড যোগ হয়ে ষাট সেকেন্ড হবে, এবং তারপরই পরবর্তী মাসের প্রথম দিন শুরু হবে। যেমনঃ প্রতিদিন ঘড়িতে ২৩:৫৯:৫৯-এর পরই ০০:০০:০০ অর্থাৎ পরের দিন হয়। কিন্তু ধনাত্মক লিপ সেকেন্ড যেদিন হিসেব করা হবে, সেদিন ২৩:৫৯:৫৯ এর পর হবে ২৩:৫৯:৬০। এবং তার পরে হবে ০০:০০:০০, অর্থাৎ পরের দিনের শুরু। কিন্তু ঋণাত্মক (নেগেটিভ) লিপ সেকেন্ডের ক্ষেত্রে টাইম অ্যাডজাস্টমেন্টের জন্য ২৩ ঘণ্টা ৫৯ মিনিট ৫৮ সেকেন্ডের পরেই ০০.০০.০০ সময় ধরে পরবর্তী দিন শুরু করা হবে। অর্থাৎ ঊনষাট সেকেন্ড পর্যন্তও আপনাকে যেতে দেওয়া হবে না। ফলে আপনি হারাচ্ছেন স্বাভাবিক একটা সেকেন্ড।

সাধারণত এক দিন হয় ২৪ ঘণ্টায়, অর্থাৎ ৮৬,৪০০ সেকেন্ডে। কিন্তু যেদিন ধনাত্মক লিপ সেকেন্ড গণনা করা হবে, সেদিন ২৪ ঘণ্টা হবে ৮৬,৪০১ সেকেন্ডে। অর্থাৎ সেদিনের মেয়াদ ১ সেকেন্ড বেশি হবে। আর যেদিন ঋণাত্মক লিপ সেকেন্ড গণনা করা হবে, সেদিন ২৪ ঘণ্টা হবে ৮৬,৩৯৯ সেকেন্ডে।

উল্লেখ্য যে, আজ পর্যন্ত সবই ধনাত্মক লিপ সেকেন্ডের কাহিনীই ঘটেছে।

লিপ সেকেন্ড কেন গণনা করা হয়?


নিশ্চয় আপনাদের মাথায় প্রশ্ন গিজগিজ করছে লিপ সেকেন্ডের “কারণ” নিয়ে? চলুন, এ ব্যাপারে নাসার ব্যাখ্যা শুনি।

এ বছর যখন আমরা ধনাত্মক লিপ সেকেন্ড উদযাপন করছিলাম, তখন সে বিষয়ে মেরিল্যান্ডের গ্রিনবেল্ট-এর নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের তরফ থেকে ড্যানিয়েল ম্যাকমিলান বিস্তারিত বিবৃতি দিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন, আহ্নিক গতির সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য এই জুন মাসে অতিরিক্ত ১ সেকেন্ড যোগ করা হবে। কাজেই আজ ৩০ জুন রাত ১১ টা ৫৯ মিনিট ৫৯ সেকেন্ডের পর ১ জুলাইয়ের সূচনা হবে না। আরো এক সেকেন্ড অপেক্ষা করতে হবে বিশ্বের সবখানে।

22
তিনি আরো বলেছিলেন, পৃথিবীর গতি ক্রমশ ধীর হচ্ছে। তাই কো-অর্ডিনেটেড ইউনিভার্সাল টাইম, বা ইউটিসি (UTC) এবং অ্যাটমিক টাইম একই রাখতে ইউটিসি-তে ১ সেকেন্ড যোগ করা হবে।


গ্রহের সঙ্গে গ্রহের আকর্ষণ বলের কারণে ১৮২০ সাল থেকে কোনো সৌর দিন পুরোপুরি ৮৬,৪০০ সেকেন্ড স্থায়ী হয় না। মাত্র ২ মিলিসেকেন্ড করে কম হচ্ছে দিনের সময়। এটাকে খুব বেশি সময় বলে মনে হয় না। কিন্তু এই সামান্য ২ মিলিসেকেন্ড যোগ হয়ে বছর শেষে এক সেকেন্ড সময় পূর্ণ করে। সাধারণত আবহাওয়া, জলবায়ু, ঋতুর পরিবর্তন, সমুদ্রের অবস্থা, ভূগর্ভস্থ পানি এবং পৃথিবীতে বরফের মজুদের নানা পরিবর্তনে দিনের সময়সূচির হের-ফের হয়। সেই সামান্য সময় একসময় ১ সেকেন্ড পূর্ণ করে।

কবে লিপ সেকেন্ড হবে, সেটা কে ঠিক করে?


International Earth Rotation and Reference Systems Service (IERS) লিপ সেকেন্ড নির্ধারণ করে থাকে।

কবে থেকে শুরু হয়েছে লিপ সেকেন্ডের গণনা? 


১৯৭২ সাল থেকে লিপ সেকেন্ড গণনা শুরু হয়েছে। ৩০ জুন ২০১৫ তারিখেরটা নিয়ে মোট ২৬ বার হবে লিপ সেকেন্ড পালনের ঘটনা। কিন্তু বিষয়টি যে প্রতি বছরই ঘটবে, তা নয় (যেমন, শেষবার লিপ সেকেন্ড উদযাপিত হয়েছিল ২০১২ সালের ৩০ জুন)। বরং এটি একটি অনিয়মিত ঘটনা এবং আগে থেকে বুঝা যায় না যে, পরবর্তীতে কোন সালে ঘটবে। কোনো একটি নির্দিষ্ট বছরের সাধারণত ছয় মাস পূর্বে IERS সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে উক্ত বছরে সময় অ্যাডজাস্টমেন্টের জন্য সেকেন্ড যোগ করতে হবে, না বিয়োগ!

 

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/leap-second/

Sunday, December 2, 2018

হকিং বিকিরণ এবং তারপর……


জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে স্টিফেন হকিং এর অবদান কী সেটা আমরা সকলেই কম বেশি জানি। তাঁর গবেষণার প্রধান বিষয় ছিল কৃষ্ণ গহ্বর। সেই আবিষ্কার তাঁকে খ্যাতির সর্বোচ্চ শিখরে পৌছে দিয়েছিল। কৃষ্ণ গহ্বরের বিকিরণ সম্পর্কে তিনি যে তত্ত্ব দিয়েছেন তাতে কোন ভুল ছিল না। তবে একটা জায়গায় এসে বেশ কিছু বিজ্ঞানী হকিং এর ধারণায়  মারাত্মক একটি অসঙ্গতি খুঁজে পেলেন। তাঁরা বললেন, হকিং বিকিরণে কোনরূপ সুশৃঙ্খলতা বজায় থাকে না। অর্থাৎ এই বিকিরণ হয় এলোমেলোভাবে। কোয়ান্টাম তত্ত্বমতে, কণার এলোমেলো বিকিরণের কারণে কৃষ্ণ গহ্বর থেকে কোন তথ্যই উদ্ধার করা সম্ভব হয় না।



হকিং বিকিরণ




এর অর্থ- কৃষ্ণ গহ্বরে যা কিছুর পতন হয় সেগুলোর কোন তথ্যই আর পাওয়া যায় না; সব যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। এই ঘটনাটি ছিল কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্য এক বড় ধাক্কা। হকিং তথ্য হারিয়ে যাওয়ার এই বিষয়টিকে “Black Hole Information Paradox” নামে অভিহিত করেন। আইনস্টাইনের বিখ্যাত উক্তি ‘ঈশ্বর পাশা খেলেন না’। এর সূত্র ধরে হকিং আর একটি বিখ্যাত উক্তির জন্ম দিলেন- “ঈশ্বর শুধু পাশা খেলেন তাই নয় বরং মাঝে মাঝে পাশার ঘুটি এমন জায়গায় নিক্ষেপ করেন যে তা আর পাওয়া যায় না”।



হকিং এবং থর্ন




কিপ স্টিফেন থর্ন এবং স্টিফেন হকিং প্রস্তাব করেন, প্রয়োজনে কোয়ান্টাম তত্ত্বে কিছু পরিবর্তন আনা যেতে পারে যার মাধ্যমে তথ্য হারিয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে বোঝা যাবে। ক্যালটেক-এর বিজ্ঞানী জন প্রেসকিল, থর্ন ও হকিং এর মতের বিরোধিতা করেন। প্রেসকিল মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, কৃষ্ণ গহ্বরের তথ্যগুলো কোন অবস্থাতেই হারিয়ে যেতে পারে না। এরই ফলশ্রুতিতে হকিং ও প্রেসকিল এর মধ্যে বাজি ধরাধরির সৃষ্টি হয়। এটা ১৯৯৭ সালের ঘটনা। বাজিতে হকিং এবং থর্ন কৃষ্ণ গহ্বরের তথ্য শূন্য হয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী, আর প্রেসকিল তথ্য টিকে থাকার পক্ষপাতী। বাজির শর্ত অনুযায়ী যে পক্ষের জয় হবে সেই পক্ষকে হেরে যাওয়া পক্ষ থেকে চাহিদা মাফিক এনসাইক্লোপেডিয়া প্রদান করতে হবে।

সমগ্র পৃথিবীর প্রথম সারির সব বিজ্ঞানী অধীর আগ্রহে বাজির এই জয় পরাজয় দেখার জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। পরবর্তীতে হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ মালদাসিনা গণিতের মাধ্যমে (হলোগ্রাম ভিত্তিক গণিত যেখানে ত্রিমাত্রিক স্থানের ঘটনাকে দ্বিমাত্রিক স্থানের আওতায় এনে একটি ঘটনাকে বিশ্লেষণ করা হয়) দেখাতে সক্ষম হন যে,  কৃষ্ণ গহ্বরের তথ্যগুলো অবশ্যই এর ভেতর থেকে বের হয়ে আসবে। এর কয়েক বছর পর কাভলি ইনস্টিটিউট ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স, সান্তা বারবারার পদার্থবিদ ম্যারলফ দেখালেন, কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির সবগুলো প্রতিরূপ মালদাসিনার গবেষণা ফলকে সমর্থন করে। ২০০৪ সালে হকিং পরাজয় স্বীকার করেন এবং বাজির শর্ত অনুসারে প্রেসকিলকে বেসবল এনসাক্লোপেডিয়া প্রদান করেন।



একটি সমস্যার সমাধান নতুন এক সমস্যার উদ্ভব ঘটায়- এ যেন জগতের এক চিরাচরিত নিয়ম। প্রশ্ন উঠলো- কৃষ্ণ গহ্বরের তথ্য যদি হারিয়ে না যায় তবে এই তথ্য কীভাবে বাইরের দুনিয়ার সাথে সম্পর্কিত হয়? নব্বই-এর দশকে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক, কৃষ্ণ গহ্বর ও কোয়ান্টাম তত্ত্বে বিশেষজ্ঞ লেনার্ড সাসকিন্ড হকিং বিকিরণের কোয়ান্টাম অবস্থার জন্য ‘এনট্যাঙ্গেলমেন্ট’ এর ধারণা প্রদান করেন। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব- এর উত্তর খুঁজতে গিয়েই কাভলি ইনস্টিটিউট ফর থিওরিটিক্যাল ফিজিক্স, সান্তা বারবারার তন্তু তত্ত্ববিদ পোলচিনস্কি তাঁর দু’জন ছাত্র আহমদ আলমেইরি ও জেমস সালি এবং ফেলো ডোনাল্ড ম্যারলফ নতুন ধরনের এক সমস্যার সম্মুখীন হলেন। সমস্যাটির নামকরণ করা হয়েছে “অগ্নিপ্রাচীর স্ববিরোধ” (Firewall Paradox)। খুবই সংক্ষিপ্ত একটি উদাহরণের মাধ্যমে “অগ্নিপ্রাচীর স্ববিরোধ” বোঝানো সম্ভব। আমিও সেই পথেই এগোবো। তবে উদাহরণটিতে কিছুটা রোম্যান্টিকতার ছোঁয়া পেতে পারেন। আমরা এখানে কৃষ্ণ গহ্বরে পতিত কণা বা হকিং বিকিরণে বিদ্যমান কণার পরিবর্তে মানুষ এলিস এবং ববকে বিবেচনা করবো। এখানে সাসকিন্ড এর ‘এনট্যাঙ্গেলমেন্ট’ ধারণাটি ব্যবহার করতে হবে কেননা আমরা এখন জানি যে, কৃষ্ণ গহ্বরে পতিত যে কোন কিছুর তথ্য বজায় থাকে এবং সেটা সম্ভব এনট্যাঙ্গেলমেন্ট-এর মাধ্যমে। এক জোড়া কণার একটি, যেটা কৃষ্ণ গহ্বরে পতিত হয় সেটা অপর কণা, যেটা বাইরে বেরিয়ে যায় সেটার সাথে একটি সম্পর্কসূত্র দ্বারা আবদ্ধ থাকবে।

আমাদের উদাহরণে এলিস যদি কৃষ্ণ গহ্বরে অবস্থান করে আর বব বাইরে থাকে তবে তাদের মধ্যেকার আত্মিক টান অবশ্যই একজন অপরজনকে দূর থেকেও প্রভাবিত করবে। তবে এলিস ও বব এর সম্পর্কের মাঝে আরও একজনের আবির্ভাব ঘটবে যাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় নেই। ধরা যাক নতুন চরিত্রটির নাম টেড। টেড-এর অবস্থান ঘটনা দিগন্তের একেবারে গা ঘেঁষে। বব এর মতো টেডও এলিস এর সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি করতে আগ্রহী। মনে রাখতে হবে, এখানে সম্পর্ক তৈরি করার অর্থ- এনট্যাঙ্গেলড হওয়া। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, হঠাৎ করে টেড-এর আগমন কেন? আপেক্ষিকতার তত্ত্ব অনুসারে, স্থান যদি যথেষ্ট মসৃণ হয় এবং কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্ব সঠিক হয় তবে টেডকে আমাদের আলোচনায় আনতেই হবে।



আর কাহিনীতে টেড-এর প্রবেশ মানে- এলিসের সাথে তারও একটি রোম্যান্টিক সম্পর্ক তৈরি হবে। তবে কাহিনীতে টেড-র অনুপ্রবেশই মূলত অগ্নিপ্রাচীর সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট। কেননা মনোগ্যামি অফ এনট্যাঙ্গেলড (Monogamy of Entangled)-এর নিয়ম অনুসারে একটি কোয়ান্টাম সিস্টেম (এখানে কৃষ্ণ গহ্বরের সাথে সম্পৃক্ত সকল এনট্যাঙ্গেলমেন্ট প্রক্রিয়া, যাকে একটি মাত্র কোয়ান্টাম সিস্টেমের সাথে সম্পর্কিত ধরা হচ্ছে) সম্পূর্ণ স্বাধীন দুটো সিস্টেমের (এখানে এলিসের সাথে বব এবং টেড উভয়ের এনট্যাঙ্গেলমেন্ট) সঙ্গে একই সাথে পুরোপুরি এনট্যাঙ্গেলড হতে পারে না। যার ফলে যদি এলিস এবং ববকে পরস্পরের সাথে এনট্যাঙ্গেলড হতে হয় (কৃষ্ণ গহ্বরের তথ্য জীবিত রাখতে হলে এটাই করতে হবে) তবে এলিসকে অবশ্যই টেড-এর সাথে সম্পর্ক ভেঙেই সেটা করতে হবে। বিষয়টা অনেকটা গরুর বেড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়ার মতো অবস্থা যেখানে গরুটিকে অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করতে হবে বেড়া ডিঙানোর জন্য, যে শক্তি কৃষ্ণ গহ্বরের ক্ষেত্রে একটি অগ্নিপ্রাচীররূপে আবির্ভূত হবে এবং সেটা কৃষ্ণ গহ্বরের ঘটনা দিগন্তকে বৃত্তাকারে ঘিরে রাখবে। এই সমস্যার সমাধানকল্পে বাঘা বাঘা সব বিজ্ঞানীরা মিলিত হয়েছিলেন, যার যার মতামত ব্যক্ত করেছেন, হয়েছে তর্ক বিতর্ক। তবে এর ফলে যে অগ্নিপ্রাচীর সমস্যার সমাধান হলো তা কিন্তু নয়। কৃষ্ণ গহ্বরের ঘটনা দিগন্তে গিয়ে যেহেতু ঘটনাটি দেখা সম্ভব নয় সেহেতু এর অস্তিত্ব সম্পর্কেও কোন নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা যাবে না। একটি কথা ঠিক যে, মহাকাশবিজ্ঞান গবেষণার অনেক সিদ্ধান্তই কাগজে কলমে হিসাব নিকাশের উপর নির্ভর করে এবং অগ্নিপ্রাচীর স্ববিরোধ সেরকমই একটা সিদ্ধান্ত। আপেক্ষিকতার তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম তত্ত্বে বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীদের অনেকেই হরেক রকম সমাধান নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। স্টিফেন হকিং সশরীরে উপস্থিত থাকতে না পারলেও ভিডিও বার্তার মাধ্যমে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেছেন। তবে সম্মেলনের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে লেনার্ড সাসকিন্ডের একটি সমাধান সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। সমাধানটির কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ওয়ার্মহোল।



ব্ল্যাক হোল এনটেঙ্গলমেন্ট




সাসকিন্ড ও মালদাসিনা বললেন, কৃষ্ণ গহ্বরের ভেতরের কণা বাইরের কণার সাথে অথবা আরও সঠিকভাবে বললে হকিং কণাগুলোর সমন্বয়ে সৃষ্ট আরেকটি কৃষ্ণ গহ্বরের সাথে এনটেঙ্গলড হয় ওয়ার্মহোল এর মাধ্যমে। সুতরাং এই অনুকল্পে ওয়ার্মহোল এর অস্তিত্ব কোন প্রকার সন্দেহ ব্যতিরেকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। এটাও সর্বজনগ্রাহ্য কোন তত্ত্ব নয়; অনুকল্প মাত্র। সুতরাং বলা চলে অগ্নিপ্রাচীর সমস্যার গ্রহণযোগ্য কোন সমাধান এখনও মেলেনি। বিজ্ঞানীরাও যে এটা নিয়ে খুব বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করছেন তাও নয়। কারণটা আগেই বলেছি- “কৃষ্ণ গহ্বরের ঘটনা দিগন্তে গিয়ে যেহেতু ঘটনাটি দেখা সম্ভব নয় সেহেতু এর অস্তিত্ব সম্পর্কেও কোন নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা যাবে না।“

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/hawking-radiation-and-more/

Saturday, December 1, 2018

পরশুরামের গল্প "যদু ডাক্তারের পেশেন্ট"


ক্যালকাটা ফিজিসার্জিক ক্লাবের সাপ্তাহিক সান্ধ্য বৈঠক বসেছে। আজ বক্তৃতা দিলেন ডাক্তার হরিশ চাকলাদার, এম ডি, এল আর সি পি, এম এম আর সি এস। মৃত্যুর লক্ষণ সম্বন্ধে তিনি অনেকক্ষণ ধরে অনেক কথা বললেন। চার পাঁচ ঘণ্টা শ্বাস রোধের পরেও আবার নিশ্বাস পড়ে, ফাঁসির পরেও কিছুক্ষণ হৃৎস্পন্দন চলতে থাকে, দুই হাত দুই পা কাটা গেলেও এবং দেহের অর্ধেক রক্ত বেরিয়ে গেলেও মানুষ বাঁচতে পারে, ইত্যাদি। অতেব রাইগার মর্টিস না হওয়া পর্যন্ত, অর্থাৎ দ্বিজেন্দ্রলালের ভাষায় কুঁকড়ে আড়ষ্ট হয়ে না গেলে একেবারে নিঃসন্দেহ হওয়া যায় না।


বক্তৃতা শেষ হলে যথারীতি ধন্যবাদ দেওয়া হল, কেউ কেউ নানা রকম মন্তব্যও করলেন। বক্তার সহপাঠী ক্যাপ্টেন বেণী দত্ত বললেন, ওহে হরিশ, তুমি বড্ড হাতে রেখে বলছ। আসল কথা হচ্ছে, ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা না হলে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না। শিবপুরের দশরথ কুণ্ডুর কথা শোন নি বুঝি ? বুড়ো হাড় কঞ্জুস, অগাধ টাকা, মরবার নামটি নেই। ছেলে রামচাঁদ হতাশ হয়ে পড়ল। অবশেষে একদিন বুড়ো মুখ থুবড়ে পড়ে গেল, নিশ্বাস বন্ধ হল, নাড়ী থামল, শরীর হিম হয়ে সিঁটকে গেল। ডাক্তার বললে, আর ভাবনা নেই রামচাঁদ, তোমার বাবা নিতান্তই মরেছেন। রামচাঁদ ঘটা করে বাপকে ঘাটে নিয়ে গেল, বিস্তর চন্দন কাঠ দিয়ে চিতা সাজালে, তার পর যেমন খড়ের নুড়ো জ্বেলে মুখাগ্নি করতে যাবে অমনি বুড়ো উঠে বসল। অ্যাঁ, এসব কি ? বলেই ছেলের গালে এক চড়।

সবাই ভয়ে পালাল। বুড়ো গটগট করে বাড়ি ফিরে এসে ঘটককে ডাকিয়ে এনে বললে, রেমোকে ত্যাজ্যপুত্তুর করলুম, আমার জন্যে একটা পাত্রী দেখ।

সভাপতি ডাক্তার যদুনন্দন গড়গড়ি একটা ইজিচেয়ারে শুয়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছিলেন। এঁর বয়স এখন নব্বই, শরীর ভালই আছে, তবে কানে একটু কম শোনেন আর মাঝে মাঝে খেয়াল দেখে আবোল তাবোল বকেন। ইনি কোথায় ডাক্তারি শিখেছিলেন, কলকাতায় কি বোম্বাইয়ে কি রেঙ্গুনে, তা লোকে জানে না। কেউ বলে, ইনি সেকেলে ভি এল এম এস। কেউ বলে, ওসব কিছু নন, ইনি হচ্ছেন খাঁটি হ্যামার ব্র্যাণ্ড, অর্থাৎ হাতুড়ে। নিন্দুকেরা যাই বলুক, এককালে এঁর অসংখ্য পেশেণ্ট ছিল, সাধারণ লোকে এঁকে খুব বড় সার্জেন মনে করত। প্রায় পঁচিশ বৎসর প্র্যাকটিস ছেড়ে দিয়ে ইনি এখন ধর্মকর্ম সাধুসঙ্গ আর শাস্ত্রচর্চা নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। ক্লাবের বাড়িটি ইনিই করে দিয়েছেন। সেজন্য কৃতজ্ঞ সদস্যগণ এঁকে আজীবন সভাপতি নির্বাচিত করেছেন। সকলেই এঁকে শ্রদ্ধা করেন, আবার আড়ালে ঠাট্টাও করেন।

হাসির শব্দে ডাক্তার যদু গড়গড়ির ঘুম ভেঙে গেল। মিটমিট করে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ব্যাপারটা কি?

হরিশ চাকলাদার বললেন, আজ্ঞে বেণী বলছে, ধড় থেকে মুণ্ডু আলাদা না হলে মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না।

যদু ডাক্তার বললেন, এই বেণীটা চিরকেলে মুখখু, বিলেত থেকে ফিরে এসে মনে করেছে ও সবজান্তা হয়ে গেছে। জীবনমৃত্যুর তুমি কতটুকু জান হে ছোকরা ?

ক্যাপ্টেন বেণী দত্ত ছোকরা নন, বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। হাতজোড় করে বললেন, কিছুই জানি না সার, আমি তামাশা করে বলেছিলুম।

— তামাশা! মরণ বাঁচন নিয়ে তামাশা!

যদু ডাক্তার চিরকালই দুর্মুখ, তাঁর অত পসার হওয়ার এও একটা কারণ। লোকে মনে করত, রোগী আর তার আত্মীয়দের যে ডাক্তার ধমক দেয় সে সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি। বয়স বৃদ্ধির ফলে তাঁর মেজাজ আরও খিটখিটে হয়েছে, কিন্তু তাঁর কটুবাক্যে কেউ রাগ করে না। তাঁকে শান্ত করবার জন্য ডাক্তার অশ্বিনীকুমার সেন এম বি বি এস, কবিরত্ন, বৈদ্যশাস্ত্রী বললেন, সার, আজকের সাবজেক্ট সম্বন্ধে আপনি কিছু বলুন।

যদু ডাক্তার বললেন, আমার কথা তোমরা বিশ্বাস করবে কেন, আমার তো এখন ডোটেজ, যাকে বলে ভীমরতি।

অশ্বিনী সেন বললেন, সে তো মহা ভাগ্যের কথা। সাতাত্তর বৎসরের সপ্তম মাসের সপ্তম রাত্রির নাম ভীমরথী। আপনি তা বহুকাল পার হয়েছেন। আমাদের শাস্ত্রে বলে, এই দুস্তরা রাত্রি অতিক্রম করে যিনি বেঁচে থাকেন তাঁর প্রতিদিনই যজ্ঞ, তাঁর চলা ফেরা বিষ্ণুপ্রদক্ষিণের সমান, তাঁর বাক্যই মন্ত্র, নিদ্রাই ধ্যান, যে অন্ন খান তাই সুধা। আপনার কথা বিশ্বাস করব না — সে কি একটা কথা হল ?

— কিন্তু ঐ বেণী কাপ্তেন ? ও বিশ্বাস করবে ?

বেণী দত্ত আবার হাতজোড় করে বললেন, নিশ্চয় করব সার, যা বলবেন তা বেদবাক্য বলে মেনে নেব।

যদু ডাক্তার প্রসন্ন হয়ে বললেন, নেহাত যদি শুনতে চাও তো শোন। কিন্তু তোমরা হয়তো ভয় পাবে।

বেণী দত্ত বললেন, যদি ভুতুড়ে কাণ্ড না হয় তবে ভয় পাব কেন সার ?

— না না, ভুতুড়ে নয়। কিন্তু যে কেস হিস্টরি বলছি, তা অতি ভীষণ; অথচ এতে শুধু সার্জারির ক্লাইম্যাক্স নয়, প্রেমের পরাকাষ্ঠা পাবে।

— বাঃ, বিভীষিকা সার্জারি আর প্রেম, এর চাইতে ভাল কমবিনেশন হতেই পারে না। আপনি আরম্ভ করুন সার, আমরা শোনবার জন্য ছটফট করছি।

ডাক্তার যদুনন্দন গড়গড়ি বলতে লাগলেন। — প্রায় পঁচিশ বৎসর আগেকার কথা। তখন তোমাদের সালফা পেনিসিলিন আর স্ট্রেপ্টো ক্লোরো না টেরা কি বলে গিয়ে — এ সব রেওয়াজ হয় নি। কারও বাড়িতে অপারেশন হলে আয়োডোফর্মের খোশবায়ে পাড়া সুদ্ধ মাত হয়ে যেত, লোকে বুঝত, হ্যাঁ, চিকিৎসা হচ্ছে বটে। আমি তখন কালীঘাটে বাস করতুম। আমার বাড়ির কাছে এক তান্ত্রিক সিদ্ধপুরুষ থাকতেন, নাম বিঘোরানন্দ, তিনি কামরূপ কামাখ্যায় আর তিব্বতে বহু বৎসর সাধনা করেছিলেন। ভক্তরা তাঁকে বিঘোর বাবা বা শুধু বাবাঠাকুর বলত। বয়স ষাট পঁয়ষট্টি, লম্বা চওড়া চেহারা, ঘোর কাল রং, একমুখ দাড়ি গোঁফ দেখলেই ভক্তিতে মাথা নিচু হয়ে আসে। আমি তাঁর কার্বংকল অপারেশন করেছিলুম। একটু চাঙ্গা হবার পর একগোছা নোট আমার হাতে দেবার চেষ্টা করলেন। হাত টেনে নিয়ে আমি বললুম, করেন কি, আপনার কাছে কি আমি ফী নিতে পারি ? বিঘোর বাবা একটু হেসে বললেন, তুমি না নিলেও ও টাকা তোমার হয়ে গেছে। কথাটার মানে তখন বুঝতে পারি নি, তাঁকে নমস্কার করে বিদায় নিলুম।

বাড়ি ফিরে এসে পকেটে হাত দিয়ে দেখি একটা ভুর্জপত্রের মোড়কে দশটা গিনি রয়েছে। বুঝলুম বিঘোর বাবার দান তাঁর অলৌকিক শক্তিতে আমার পকেটে চলে এসেছে। তার পর থেকে মাঝে মাঝে তাঁর কাছে যেতুম, নানা রকম আশ্চর্য তত্ত্বকথা শুনতুম। বছর খানিক পরে তিনি কালীঘাট থেকে চলে গেলেন, তাঁর একজন বড়লোক ভক্ত ত্রিবেণীর কাছে গঙ্গার ধারে একটি আশ্রম বানিয়ে দিয়েছিলেন, সেখানেই গিয়ে রইলেন। একাই থাকতেন, তবে ভক্তরা মাঝে মাঝে তাঁকে দেখতে যেত।

তার পর দু বৎসর তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয় নি, খবরও কিছু পাই নি। একদিন বেলা বারোটায় বাড়ি ফিরে এসেছি, একটা হার্নিয়া, দুটো অ্যাপেন্ডিক্স, তিনটে টিউমার, চারটে টনসিল, আর গোটা পাঁচেক হাইড্রোসিল অপারেশন করে অত্যন্ত ক্লান্ত বোধ করছি। নাওয়া খাওয়ার পর স্ত্রীকে বললুম, আমি বিকেল চারটে পর্যন্ত ঘুমুব, খবরদার কেউ যেন না ডাকে। কিন্তু ঘুমুবার জো কি! ঘণ্টা খানিক পরেই ঠেলা দিয়ে গিন্নী বললেন, ওগো শুনছ, জরুরী তার এসেছে। বললুম ছিঁড়ে ফেলে দাও। গিন্নী বললেন, এ যে বিঘোর বাবার তার। অগত্যা টেলিগ্রামটা পড়তে হয়, লিখছেন — এখনই চলে এস, মোষ্ট আর্জেণ্ট কেস।

তখনই মোটরে রওনা হলুম। ব্যাগটা সঙ্গে নিলুম, তাতে শুধু মামুলী সরঞ্জাম ছিল, কি রকম কেস কিছুই জানা নেই, সেই জন্য বিশেষ কোনও ওষুধপত্র নিতে পারলুম না। শীতকাল, পৌঁছুতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। বিঘোর বাবার আশ্রমটি ত্রিবেণীর কাছে কাগমারি গ্রামের গঙ্গার ধারে। খুব নির্জন স্থান, কাছাকাছি লোকালয় নেই। গাড়ি থেকে নেমে আশ্রমের আগড় ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই বিঘোর বাবার সাঙ্গে দেখা। পরনে লাল চেলির জোড়, কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা, পায়ে খড়ম, হুঁকো হাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাক খাচ্ছেন। আমাকে দেখে বললেন, এস ডাক্তার। যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল, এঁর কোনও ফ্যাসাদ হয় নি। প্রণাম করে জিজ্ঞাসা করলুম, পেশেণ্ট কে ? কি হয়েছে ? বললেন, ঘরের ভেতর এস, স্বচক্ষে দেখলেই বুঝবে।

ঘড়টি বেশ বড়, কিন্তু আলো অতি কম, এক কোণে পিলসুজের মাথায় পিদিম জ্বলছে, তাতে কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। একটু পরে দৃষ্টি খুললে নজরে পড়ল — ঘরের এক পাশে একটা তক্তপোশ, বোধ হয় বিঘোর বাবা তাতেই শোন। আর এ পাশে মেঝেতে একটা মাদুরের ওপর দুজন পাশাপাশি চিত হয়ে চোখ বুজে শুয়ে আছে, একখানা কম্বল দিয়ে সমস্ত শরীর ঢাকা, শুধু মুখ দুটো বেরিয়ে আছে। একজন পুরুষ, জোয়ান বয়স, বোধ হয় পঁচিশ, মুখে দাড়ি, গোঁফ, মাথায় ঝাঁকড়া চুল। আর একজন মেয়ে, বয়স আন্দাজ কুড়ি, কালো কিন্তু সুশ্রী, ঝুঁটি বাঁধা খোঁপা, সিঁথিতে সিঁদুর। জিজ্ঞাসা করলুম, স্বামী-স্ত্রী ?

বিঘোর বাবা উত্তর দিলেন, উঁহু, প্রেমিক প্রেমিকা।

— কি হয়েছে।

— নিজেই দেখ না।

স্টেথোস্কোপটি গলায় ঝুলিয়ে হেঁট হযে কম্বলখানা আস্তে আস্তে সরিয়ে ফেললুম। তার পরেই এক লাফে পিছনে ছিটকে এলুম। কম্বলের নিচে কিচ্ছু নেই শুধু দুটো মুণ্ডু পাশাপাশি পড়ে আছে।

ভয়ও হল রাগও হল। বিঘোর বাবাকে বললুম, আমাকে এরকম বিভীষিকা দেখাবার মানে কি ? এ তো ক্রিমিন্যাল কেস, যা করতে হয় পুলিশ করবে, আমার কিছু করবার নেই। কিন্তু আপনি যে মহাবিপদে পড়বেন। বাবা শুধু একটু হাসলেন। তারপর দেখলুম, পুরুষ-মুণ্ডুটা পিটপিট করে তাকিয়ে চিঁ চিঁ করে বলছে, মরি নি ডাক্তারবাবু। মেয়ে মুণ্ডুটাও ডাইনে বাঁয়ে একটু নড়ে উঠল।

ডিসেকশন রুমে বিস্তর মড়া ঘেঁটেছি, হরেক রকম বীভৎস লাশ দেখেছি, কিন্তু এমন ভয়ঙ্কর পিলে চমকানো ব্যাপার কখনও দৃষ্টিগোচর হয় নি। আমি আঁতকে উঠে পড়ে যচ্ছিলুম, বিঘোর বাবা আমাকে ধরে ফেলে বললেন, ওহে গড়গড়ি ডাক্তার, ভয় নেই, ভয় নেই, মুণ্ডু কাটা গেছে কিন্তু আমি এদের বাঁচিয়ে রেখেছি। মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা শুনেছ ? তার প্রভাবে এরা এখনও বেঁচে আছে।

সেই শীতে আমার গা দিয়ে ঘাম ঝরছিল। কোনও রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললুম, এদের ধড় কোথায় গেল ?

— ঐ যে, ঐ কোণটায় কম্বলের নিচে পাশাপাশি শুয়ে আছে।

বিঘোর বাবা আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে বললেন, এই ধড় দুটোও বাঁচিয়ে রেখেছি, দেখ না তোমার চোঙা লাগিয়ে।

স্টেথোস্কোপের দরকার হল না। বুকে হাত দিয়ে দেখলুম হার্ট আর লংস ঠিক চলছে, তবে একটু ঢিমে। বিঘোর বাবাকে বললুম, ধন্য আপনার সাধনা, বিলিতী বিজ্ঞানের মুখে আপনি জুতো মেরেছেন। কিন্তু এতই যদি পারেন তবে ধড় আর মুণ্ডু আলাদা রেখেছেন কেন ? জুড়ে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়।

বিঘোর বাবা বললেন, তা আমার কাজ নয়। আমি মৃতসঞ্জীবনী জানি, কিন্তু খণ্ডযোজনী বিদ্যা আমার আয়ত্ত নয়। ও হল মুচী বা ডাক্তারের কাজ। মুচী আবার লাশ ছোঁবে না, তার মোটরও নেই যে এই অবলায় এতদূরে আসবে, তাই তোমাকে ডেকেছি। তুমি ধড়ের সঙ্গে মুণ্ডু সেলাই করে দাও।

আমি নিবেদন করলুম,, বাইরের চামড়া সেলাই করলেই তো গলার হাড় আর নলী জুড়বে না। সার্কুলেশন রেস্পিরেশন এবং স্পাইন্যাল কর্ডের সঙ্গে ব্রেনের যোগ কি করে হবে ? সেরিব্রেশন অর্থাৎ মস্তিষ্কের ক্রিয়া চলবে কি করে ?

— কেন চলবে না ? দুই ভুরুর মধ্যে আজ্ঞাচক্র ঘুরছে, তাতেই পঞ্চেন্দ্রিয় আর মনের ক্রিয়া চলছে। কাটা মুণ্ডু কথা কয়েছে তা তো তুমি স্বকর্ণে শুনেছ। কোনও চিন্তা নেই তুমি সেলাই করে ফেল।

আমি বললুম, সেলাইয়ের উপযুক্ত বাঁকা ছুঁচ আর ক্যাটগট তো আমার সঙ্গে নেই, আর সেপসিস অর্থাৎ পচন বন্ধ করব কি করে ?

— তোমাকে একটা গুনছুঁচ আর সুতলি দড়ি দিচ্ছি। পচবার ভয় নেই, দেখছ না, কাটা জায়গায় গঙ্গামৃত্তিকা লেপন করে দিয়েছি। ঐ কাদা সুদ্ধ সেলাই করে দাও।

বড়ই মুশকিলে পড়া গেল। আয়োজন কিছুই নেই, অ্যাসিস্টান্ট নেই নার্স নেই, অপারেশন টেবল নেই, আলো পর্যন্ত নেই, অথচ বিঘোরানন্দ আমাকে এমন সার্জারি করতে বলছেন, যা কস্মিন কালে কোথাও হয় নি —

ক্যাপ্টেন বেণী দত্ত বললেন, হয়েছিল সার — গজানন গণেশ আর অজানন দক্ষ।

— আরে তারা হলেন দেবতা। আচ্ছা বেণী, আজকাল বড় অপারেশনের আগে তোমরা নাকি হরেক রকম টেস্ট করাও ?

— আজ্ঞে হ্যাঁ। ব্লাড-প্রেশার, ব্লাড-কাউণ্ট, ব্লাড-সুগার, এক্স-রে ফোটো, কার্ডিওগ্রাম, প্রভৃতি মামুলী রুটিন টেস্ট তো আছেই, তা ছাড়া নন প্রোটিন নাইট্রোজেন, টোটাল হেভি হাইড্রোজেন, বডিফ্যাটের আয়োডিন ভ্যালু, হাড়ের ইলাস্টিসিটি, দাঁতের রেডিও অ্যাকটিভিটি, চামড়ার স্পেকট্রোগ্রাম — এসবও দেখা দরকার। অধিকন্তু রোগী আর তার আত্মীয়দের ইনটেলিজেন্স কোশন্ট টেস্ট করালে খুব ভাল হয়। শাঁসালো পেশেন্ট হলে অন্তত বিশজন স্পেশ্যালিষ্টের রিপোর্ট নেওয়া চাই। আর গরীব পেশেণ্টকে বলে দিই, উঁচু দরের চিকিৎসা তোমার সাধ্য নয় বাবু, দাতব্য হোমিওপ্যাথিক খাও গিয়ে, না হয় পাঁচ সিকের মাদুলি ধারণ কর।

যদু ডাক্তার বললেন, আমাদের আমলে অত সব ছিল না, জিব আর নাড়ী, থার্মমিটার আর স্টেথোস্কোপ, এতেই যা করে। আর এই দুই পেশেন্টের তো চূড়ান্ত অপারেশন মুণ্ডচ্ছেদ আগেই হয়ে গেছে, এখন টেষ্ট করা বৃথা। যাক, তার পর যা হয়েছিল শোন। আমাকে দ্বিধাগ্রস্ত দেখে বিঘোরানন্দ আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, অত মাথা ঘামিও না ডাক্তার, শুধু সেলাই করে দাও, বাকীটুকু কুলকুণ্ডলিনী নিজেই করে নেবেন।

আমি বললুম, বাবাঠাকুর, ধড়ের সঙ্গে মুণ্ডু সেলাই করা সার্জনের কাজ নয়, থিয়েটারের বাবা মুস্তাফার কাজ। বেশ, আপনার আজ্ঞা পালন করব, কিন্তু এই দুজনের হিস্টরি তো বললেন না, এদের এমন দশা হল কি করে ?

বিঘোরানন্দ এই ইতিহাস বললেন। — মেয়েটার নাম পঞ্চী, ওর বাপ হরি কামার বাঁশবেড়েতে থাকে। পঞ্চীর বিয়ে হয়েছে এই কাগমারি গ্রামের রমাকান্ত কামারের সঙ্গে। রমাকান্ত লোকটা অতি দুর্দান্ত, দেখতে যমদূতের মতন, বদরাগী আর মাতাল। সে জমিদার বাড়িতে প্রতি বৎসর নবমী পুজোয় এক’শ আটটা পাঁঠা, দশটা ভেড়া, আর গোটা দুই মোষ এনে এক কোপে কাটে। পঞ্চী তাকে বিয়ে করতে চায় নি, তার বাপ টাকার লোভে জোর করে বিয়ে দিয়েছে। রমাকান্ত বজ্জাত হলেও আমাকে খুব ভক্তি করে, আমার অনেক ফরমাশও খাটে। সে পঞ্চীর ওপর অকথ্য অত্যাচার করত, আমি ধমক দিয়েও কিছু করতে পারি নি। এ রকম ক্ষেত্রে যেমন হয়ে থাকে তাই হল। এই যে পুরুষটার মুণ্ডু দেখছ, ওর নাম জটিরাম বৈরাগী — তোর দেশের লোক, নয় রে পঞ্চী ?

পঞ্চীর মাথা ওপর নিচে একটু নড়ে উঠে সায় দিলে।

— এই জটি ছোকরা কীর্তন গায় ভাল, তার জন্য নানা জায়গা থেকে ওর ডাক আসত। জটিরাম মাঝে মাঝে এই গাঁয়ে এলে পঞ্চীর সঙ্গে দেখা করত, শেষটায় দুজনের প্রেম হল।

পঞ্চীর ভুরু আর ঠোঁট একটু কুঁচকে উঠল।

বিঘোরানন্দ বলতে লাগলেন — রমাকান্ত টের পেয়ে একদিন পঞ্চীকে বেদম মারলে, কিন্তু তাতে কোন ফল হল না। তার পর গত কাল রাত একটার সময় আমি ঘুমিয়ে আছি এমন সময় দরজায় ধাক্কা পড়ল। উঠে দরজা খুলে দেখি, রাম দা হাতে রমাকান্ত। আমার পায়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, সর্বনাশ করেছি বাবাঠাকুর, এক কোপে দুটো সাবাড় করেছি, বাঁচান আমাকে।

ব্যাপারটা এই। — আগের দিন রমাকান্ত পঞ্চীকে বলেছিল, আমি ভদ্রেশ্বর যাচ্ছি, চৌধুরী বাবুদের লোহার গেট তৈরি করতে হবে, চার পাঁচ দিন পরে ফিরব, তুই সাবধানে থাকিস। সব মিথ্যে কথা। রাত দুপুরে রমাকান্ত চুপি চুপি তার বাড়িতে এল এবং আস্তে আস্তে ঘরে ঢুকে দেখলে পঞ্চী আর জটিরাম পাশাপাশি শুয়ে ঘুমুচ্ছে। দেখেই রাম দায়ের এক কোপে দুজনের মুণ্ডু কেটে ফেললে। তার পর ভয় পেয়ে আমার কাছে ছুটে এসেছে।

আমি তখনই রমাকান্তর সঙ্গে তার বাড়ি গেলুম। প্রথমেই মৃতসঞ্জীবনী বিদ্যা প্রয়োগ করে পঞ্চী আর জটিরামের সূক্ষ্মশরীর আটকে ফেললুম। তার পর রমাকান্তকে বললুম, তুই ধড় দুটো কাঁধে করে আশ্রমে নিয়ে চল, মুণ্ডু দুটো আমি নিয়ে যচ্ছি। আশ্রমে এসে রমাকান্ত আমার উপদেশ মত ধড় এক জায়গায় আর মুণ্ডু আর এক জায়গায় শুইয়ে দিলে। খণ্ডযোজনের আগে পর্যন্ত এই রকম তফাৎ রাখাই তান্ত্রোক্ত পদ্ধতি।

হরিশ চাকলাদার প্রশ্ন করলেন, সূক্ষ্মশরীরেরও কি দু ভাগ হয়েছিল মুণ্ডু আর ধড় দুটোই আলাদা হয়ে বেঁচে রইল কি করে ?

যদু গড়গড়ি বললেন, তোমরা দেখছি কিছুই জান না। সূক্ষ্মশরীর ভাগ হয় না, নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি। তার অ্যানাটমি অন্য রকম। কতকটা অ্যামিবার মতন, কিন্তু ঢের বেশি ইলাস্টিক। ধড় আর মুণ্ডু তফাতে থাকলেও সূক্ষ্মশরীর চিটে গুড়ের মতন বেড়ে গিয়ে দুটোতেই ভর করতে পারে। তার পর বিঘোর বাবা যা বলছিলেন শোন।

রমাকান্ত আবার আমার পায়ে পড়ে বললে, দোহাই বাবাঠাকুর, ফাঁসি যেতে পারব না, আমাকে বাঁচান। আমি বললুম, তুই এক্ষুণি তোর বাড়ি গিয়ে সব রক্ত ধুয়ে সাফ করে ফেলবি, তোর রাম দা গঙ্গায় ফেলে দিবি, তার পর গায়েব হয়ে থাকবি। এক বৎসর পরে গাঁয়ে ফিরতে পারিস। রমাকান্ত বললে, কিন্তু লাশের গতি কি করবেন ? পুলিশ টের পেলেই তদারক করতে আসবে, আপনাকেই আসামী বলে চালান দেবে। আমি বললুম, তোকে তা ভাবতে হবে না, যা বলছি তাই করবি। রমাকান্ত যে আজ্ঞে বলে চলে গেল। আমার সেই টেলিগ্রাম পেয়ে তুমি এসেছ। এখন আর দেরি নয়, রাত আটটায় অশ্লেষা পড়বে, আত আগেই সেলাই করে ফেল, নইলে জোড়া লাগবে না।

গুন ছুঁচ আর সুতলি নিয়ে আমি সেলাই করতে যাচ্ছি, এমন সময় দেখলুম মুণ্ডু দুটো ফিসফিস করে আপনের মধ্যে কথা বলছে। ক্রমশ পঞ্চীর কণ্ঠস্বর চড়া হয়ে উঠল। বিঘোর বাবা ধমক দিয়ে বললেন, এই পঞ্চী, চেঁচাস নি। আরে গেল যা, এখনও ঘাড়ের ওপর মুণ্ডু বসে নি, এর মধ্যেই গলাবাজি শুরু করেছে।

পঞ্চী ডাকল, অ বাবাঠাকুর, একবারটি শুনুন তো।

বিঘোর বাবা উবু হয়ে অনেকক্ষণ ধরে কান পেতে পঞ্চী আর জটিরামের কথা শুনলেন। তার পর আমাকে বললেন, ওহে ডাক্তার, এরা বলছে যে জটির ধড়ে পঞ্চীর মুণ্ডু আর পঞ্চীর ধড়ে জটির মুণ্ডু লাগাতে হবে। আমিও ভেবে দেখলুম এই ব্যবস্থাই ভাল।

স্তম্ভিত হয়ে আমি বললুম, এ কি রকম কথা বাবাঠাকুর! মুণ্ডু বদল হতেই পারে না, ভিয়েনা কনভেনশানে তার কোনও স্যাংশন নেই। এ রকম অপারেশন মোটেই এথিক্যাল নয়, আমাদের প্রোফেশনাল কোডের একদম বাইরে।

বিঘোর বাবা বললেন, আরে রেখে দাও তোমার কোড। পঞ্চী যদি নিজের ধড় আর মুণ্ডু নিয়ে বেঁচে ওঠে তবে যে আবার রমাকান্তর কবলে পড়বে। মুণ্ডু বদল করলে এদের নব কলেবর হবে, কোনও গোলযোগের ভয় থাকবে না। আর একটা মস্ত লাভ এই হবে যে কখনও এদের ছাড়াছাড়ি হবে না। জটিরাম যদি আগে মরে তবে তার ধড় নিয়ে পঞ্চীর মুণ্ডু বেঁচে থাকবে। পঞ্চী যদি আগে মরে তবে তার ধড়টা জটির মুণ্ডু নিয়ে বেঁচে থাকবে। এই পঞ্চীটা অত্যন্ত চালাক, এর মাথা থেকেই এই বুদ্ধি বেরিয়েছে। জটিরাম হচ্ছে হাঁদারাম। কালই আমি ভৈরব মতে এদের বিয়ে দেব, আমার আশ্রমেই এরা বাস করবে।

আমি প্রশ্ন করলুম, ধড় আর মুণ্ডু বদল হলে কে পঞ্চী কে জটিরাম তার স্থির হবে কি করে ?

বিঘোর বাবা বললেন, মাথা হল উত্তমাঙ্গ। মাথা অনুসারেই লোকের নাম হয় ধড় যারই হোক।

ক্যাপ্টেন বেণী দত্ত জনান্তিকে বললেন, কিন্তু গণেশ আর দক্ষের বেলায় তা হয় নি।

যদু ডাক্তার বলতে লাগলেন, এর পর আর আপত্তি করা চলে না, অগত্যা খণ্ডযোজনের জন্য প্রস্তুত হলুম। অ্যানাস্থেটিক দরকার হল না, বিঘোর বাবা মাথায় আর গলায় হাত বুলিয়ে অসাড় করে দিলেন। কিন্তু ভোঁতা গুণ ছুঁচ আর খসখসে পাটের সুতলি দিয়ে চামড়া ফোঁড়া গেল না। বিঘোর বাবা বললেন, এই পিদিম থেকে রেড়ির তেল নিয়ে ছুঁচ আর সুতোয় বেশ করে মাখিয়ে নাও। তাই নিলুম। লুব্রিকেট করার পর কাজ সহজ হল, আধ ঘণ্টার মধ্যে মুণ্ডুর সঙ্গে ধড় সেলাই করে ফেললুম।

এবার বিঘোর বাবাকে বললুম, এখন এদের শরীরে কিছু তাজা রক্ত পুরে দেওয়া দরকার, অভাবে পাঁচ শ সিসি গ্লুকোজ স্যালাইন। কিন্তু এই পাড়াগাঁয়ে যোগাড় হবে কি করে ? যদি নেহাতই বেঁচে থাকে তবে এর পর কিছুদিন লিভার এক্সট্রাক্ট, ব্লডস পিল আর ভিগারোজেন খাওয়াতে হবে, নইলে গায়ে জোর পাবে না।

বিঘোর বাবা বললেন, ওসব ছাই ভস্ম চলবে না বাপু। এখন এরা সমস্ত রাত ঘুমুবে। কাল সকালে জেগে উঠলে ঝোলা গুড় দিয়ে খানকতক রুটি পথ্য করবে। তার পর বেলা হলে পঞ্চী ভাত চড়িয়ে দেবে আর লঙ্কাবাটা দিয়ে কাঁকড়া চচ্চড়ি রাঁধবে। তাতেই বলবান হবে। জটিরাম আবার গাঁজা খায়। নয় রে জটে ? জটিরাম দাঁত বার করে বললে, হাঁ।

বিঘোর বাবা বললেন, বেশ তো, কাল সকালে আমার প্রসাদী ছিলিমে দু এক টান দিস। এখন খাওয়া চলবে না, গলার জোড় পোক্ত হতে চার পাঁচ ঘণ্টা সময় লাগবে। এখন খেলে সেলাইয়ের ফাঁক দিযে সব ধোঁয়া বেরিয়ে যাবে। দেখ ডাক্তার, তোমাকে ফী কিছু দেব না, আজ তুমি যা দেখলে তারই দাম লাখ টাকা।

আমি উত্তর দিলুম, তাতে কোনও সন্দেহ নেই বাবা। আমার চক্ষু কর্ণ সার্থক হয়েছে, অহংকার চূর্ণ হয়েছে, গা দিয়ে ঘাম ছুটছে, আগাপাস্তলা রোমাঞ্চিত হচ্ছে। আমি ধন্য হয়ে গেছি। এখন অনুমতি দিন, আমি বাড়ি ফিরে যাই, দু ডোজ ব্রোমাইড খেয়ে নার্ভ ঠাণ্ডা করে শুয়ে পড়ি। এই বলে প্রণাম করে সেই রাত্রেই কলকাতায় ফিরে এলুম।

ডাক্তার অশ্বিনী সেন বললেন, কিমাশ্চর্যমতঃপরম।

ডাক্তার হরিশ চাকলাদার বললেন, ফ্ল্যাবারগাস্টীং মিরাকল।

ক্যাপ্টেন বেণী দত্ত বললেন, অতি খাসা। পরকীয়া প্রেমের এমন পারফেক্ট পরিণাম বৈষ্ণব সাহিত্যেও নেই, আর সিমবায়োসিসের এমন চমৎকার দৃষ্টান্ত বায়োলজির কেতাবেও পাওয়া যায় না। আচ্ছা সার, নায়ক নায়িকার তো একটা হিল্লে লাগিয়ে দিলেন, কিন্তু রমাকান্তর কি হল ?

ডাক্তার যদু গড়গড়ি বললেন, শুনেছি এক বছর পর সে চুপি চুপি বিঘোর বাবার আশ্রমে এসেছিল, কিন্তু জটি আর পঞ্চীকে দেখে ভূত পেত্নী মনে করে তখনই ভয়ে পালিয়ে যায়। তারপর থেকে সে নিরুদ্দেশ।

— আহা, তার জন্য দুঃখ হয়, বেচারা খুন করেও বউকে শায়েস্তা করতে পারল না। নামটাই যে অপয়া, ডাইনে বাঁয়ে যে দিক থেকে পড়ুন পাবেন রমাকান্ত কামার। আমাদের সুবল বসুও তার দুমুখো নামের জন্য উন্নতি করতে পারছেন না। আচ্ছা তার পর আর কখনও আপনি পঞ্চী আর জটিরামকে দেখেছিলেন ?

— দেখেছিলুম। দু বছর পরে বিঘোর বাবা চিঠি লিখলেন, মাঘ সংক্রান্তির দিন জটি পঞ্চীর ছেলের অন্নপ্রাশন, তুমি অবশ্যই আসবে। বাবার যখন আদেশ তখন যেতেই হল।

— কি দেখলেন গিয়ে ?

— দেখলুম, বিঘোর বাবা ঠিক আগের মতন লাল চেলির জোড় পরে দাঁড়িয়ে হুঁকো টানছেন, পঞ্চী তার মাস্ক্যুলার মদ্দা হতে একটা মস্ত কুড়ুল নিয়ে কাঠ চেলা করছে, জটিরাম রোয়াকে বসে একটা পিঁড়িতে আলপনা দিচ্ছে আর কোলের ছেলেকে মাই খাওয়াচ্ছে।