Tuesday, November 21, 2017

কার্ল সেগানের বিখ্যাত Pale Blue Dot স্পিচের অনুবাদ


১৯৯০ সাল, ১৪ই ফেব্রুয়ারি। ততদিনে কার্ল সেগান একজন জীবন্ত কিংবদন্তী। ভয়েজার-১ যখন আমাদের সৌরজগত ছেড়ে আরো বাইরে চলে যাচ্ছিলো, তখন সেগান নাসাকে অনুরোধ করলেন, যাতে যাওয়ার আগে পৃথিবীর একটা ছবি তোলা হয় ঐ দূরত্ব থেকে। বিশাল সেই দূরত্ব থেকে ভয়েজার-১ এর তোলা পৃথিবীর ঐ ছবি দেখে Carl Sagan এটার নাম দিয়েছিলেন Pale Blue Dot

pale-blue-dot-wallpaper-1900x1200

মলিন নীল বিন্দু

এই সুবিশাল দূরত্ব থেকে, পৃথিবীকে তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু মনে হওয়ার কথা না। কিন্তু আমাদের জন্য ব্যাপারটা একটু ভিন্ন।

বিন্দুটির দিকে আরেকবার তাকান – এটাই পৃথিবী, আমাদের বসত, আমরা এটাই। এখানেই ওরা সবাই, যাদের আমরা ভালোবেসেছি, যতজনকে আমরা চিনি। যাদের যাদের কথা আমরা শুনেছি, তাদের সবাই এখানেই তাদের জীবন কাটিয়েছে। আমাদের সারা জীবনের যত দুঃখ কষ্ট, হাজার হাজার ধর্ম, আদর্শ আর অর্থনৈতিক মতবাদ, যত শিকারী আর লুণ্ঠনকারী, যত সাহসী-ভীরু, সভ্যতার নির্মাতা-ধ্বংসকারী,যত রাজা আর প্রজা, যত প্রেমিক-প্রেমিকা, যত বাবা মা, স্বপ্নে বিভোর শিশু, আবিষ্কারক, পরিব্রাজক, যত নীতিবান শিক্ষক, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, যত সুপারস্টার, যত জাঁহাবাজ নেতা, মানব ইতিহাসের সকল সাধু আর পাপী, সবাই তাদের জীবন কাটিয়েছে আলোয় ভেসে থাকা ধূলোর ঐ ছোট্টো কণাটিতে।

অসীম এই মহাবিশ্বে…… খুব ছোট একটা মঞ্চ…… আমাদের এই পৃথিবীটা।

ভাবুন তো, সেনাপতি আর দিগ্বিজয়ী বীরের দল কত রক্ত ঝরিয়েছে – ক্ষুদ্র এই বিন্দুর ক্ষুদ্র একটা অংশ জয় করে, মহান হবার আশায়। ভাবুন তো, সেই সীমাহীন হিংস্রতার কথা; ছোট্টো এই বিন্দুর আরো ছোটো এক প্রান্তের মানুষ যা ঘটিয়েছে, অন্য প্রান্ত জয় করবে বলে।

কী দ্বন্দ্ব তাদের নিজেদের মাঝে! রক্তের জন্য তাদের কী পিপাসা! কী প্রকট তাদের জিঘাংসা! আমাদের নাক-উঁচু ভাব, আমাদের কাল্পনিক অহমিকা, ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে আমরাই সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছি, সেই বিভ্রম প্রশ্নবিদ্ধ হয় এই ঝাপসা নীল আলো দিয়ে।

আমাদের এই গ্রহ, মহাজাগতিক অন্ধকারের মধ্যে নিতান্তই ক্ষুদ্র একটা বিন্দু। আমাদের অজ্ঞানতায়, এই বিশালতায়, এমন কোনো ইঙ্গিত নেই যে কেউ আসবে, আমাদেরকে নিজেদের হাত থেকে রক্ষা করতে।

আমাদের জানামতে পৃথিবীই একমাত্র বাসযোগ্য গ্রহ। অন্য কোথাও, অন্তত নিকট ভবিষ্যতে, আমাদের প্রজাতি আস্তানা গাড়তে পারবে না।

ভ্রমণ? সম্ভব।

বসতি, এখনো নয়।

ভাল লাগুক আর নাই লাগুক, এই মুহূর্তে পৃথিবীই আমাদের একমাত্র আশ্রয়।

বলা হয়ে থাকে জ্যোতির্বিজ্ঞান আমাদের বিনয়ী করে তোলে, চরিত্র গঠনে সাহায্য করে। মানুষের অহংকারকে ধূলিস্যাৎ করার জন্য দূর থেকে তোলা ছোট্টো পৃথিবীর এই ছবিটার চেয়ে ভালো উদাহরণ আর হয় না। আমার মতে, এটা মনে করিয়ে দেয়, কতটা জরুরি পরস্পরের প্রতি আরেকটু সহানুভুতিশীল হওয়া; এই ছোট্টো নীল বিন্দুটাকে, আমাদের একমাত্র বসতটাকে, সংরক্ষণ করা, উপভোগ করা।

উৎস ঃ http://onubadokderadda.com/pale-blue-dot-speech/

Monday, November 13, 2017

সম্রাট হুমায়ূন – সমরেশ মজুমদার


হুমায়ূনকে আমি প্রথম দেখি একুশের বইমেলায়, সাতাশি সালের এক সন্ধ্যায়।

যিনি আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি বলেছিলেন, ‘‘ইনি হুমায়ূন আহমেদ। ‘এইসব দিনরাত্রি’ নামে একটি জনপ্রিয় টিভি-নাটক লিখেছেন, ‘শঙ্খনীল কারাগার’ নামের উপন্যাস লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান পড়ান।’’ দেখলাম, একটি শীর্ণ যুবককে, যার পরনে পা়ঞ্জাবি, চোঙা পাজামা গোড়ালির ওপরে। কিন্তু চশমার আড়ালে অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখ। হেসে বলেছিল, ‘‘আমি আপনাদের লেখা পড়ে বড় হয়েছি।’’

সে দিন মেলার দর্শক-শ্রোতারা হুমায়ূনকে ঘিরে ভিড় জমায়নি। রথের মেলায় উদাসীন বালকের মতো বইমেলায় ঘুরছিল সে।

বছর পাঁচেক পরে ঢাকার একুশের বইমেলায় ঢুকেই দেখি বিশাল লাইন। বই হাতে মানুষ দাঁড়িয়ে আছেন। প্রশ্ন করে জানলাম ওঁরা হুমায়ূন আহমেদের বই কিনে দাঁড়িয়ে আছেন অটোগ্রাফ করিয়ে নেবেন বলে। অন্তত পাঁচ-ছ’শো মানুষ একই আগ্রহে অপেক্ষায় আছেন দেখে অবাক হলাম।

আমাদের কলকাতা বইমেলায় এমন ঘটনা ঘটেছে কি না মনে পড়ল না। সমরেশ বসু-শংকর-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়রা যখন মেলায় আসতেন, তখন তাঁদের ঘিরে ছোটখাট ভিড় জমলেও এমন লাইন পড়ত না।

সময়টা উনিশশো বিরানব্বই। তখনও কলকাতার পাঠকদের নব্বই ভাগ হুমায়ূন আহমেদের নাম শোনেননি, বই পড়া তো দূরের কথা। লাইনের শুরুতে পৌঁছে দেখলাম একটি স্টলের সামনে চেয়ারে বসে হুমায়ূন মাথা নিচু করে একের পর এক সই দিয়ে যাচ্ছে। যে বই এগিয়ে দিচ্ছে তার মুখের দিকে তাকাচ্ছে না।

আমি একটা ‘গীতবিতান’ এগিয়ে ধরতে সে আমাকে না দেখে বইটি নিল। সই করার ঠিক আগে থেমে গিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘‘সর্বনাশ, আপনি কি আমাকে দোজখে পাঠাতে চান? এই বই-এ সই করার যোগ্যতা তো আমার—!’’ বলতে বলতে মুখ তুলেই সে আমাকে দেখতে পেল। তার চোখ বিস্ফারিত হল। লাফিয়ে উঠে আমাকে প্রণাম করতে এল সে। বলল, ‘‘ছি ছি, আপনি আমায় এ কী লজ্জায় ফেললেন!’’

গত পঞ্চাশ বছরে আমি বিখ্যাত, অতি বিখ্যাত অনেক লেখকের সংস্পর্শে ধন্য হয়েছি। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যাকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু তাঁর সঙ্গ যাঁরা পেয়েছেন, তাঁদের মুখে ওঁর কথা শুনেছি। ওরকম নির্লোভ, সরল লেখকের সঙ্গে হুমায়ূনের মিল পেয়েছি। মনে রাখতে হবে, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ এবং শরৎচন্দ্রকে বাদ দিলে যে বাংলা সাহিত্য নিয়ে আমরা গর্ব করি, তার সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখকের নাম হুমায়ূন আহমেদ।

চুরানব্বই সালের একুশের মেলার শেষে শোনা গেল, ওঁর সমস্ত বই এক মেলায় কত কপি বিক্রি হয়েছে, তার হিসেব নেই, তবে নতুন বইগুলোর বিক্রির সংখ্যা পঁচিশ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। কলকাতা বইমেলায় যদি কারও দেড়-দু’হাজার বই বিক্রি হয়, তা’হলে তাঁকে আমরা জনপ্রিয় লেখক বলি। হুমায়ূনের সঙ্গে তুলনা করার কথা চিন্তাও করা যায় না।

তখনও পশ্চিমবাংলার বেশির ভাগ পাঠক ওঁর কথা জানে না। যখন  ওঁর একটি টিভি নাটকের চরিত্র, যাঁকে নাটকেই ফাঁসি দেওয়া হবে জেনে হাজার হাজার দর্শক রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছিল, সে দিন পশ্চিমবাংলার কাগজে সেটা খবর হয়েছিল। এরকম হয় নাকি? বিস্ময় ছিল অনেকের।

কলকাতার এক নামী প্রকাশক আমার মাধ্যমে যোগাযোগ করে অনুমতি নিয়ে ওর বিখ্যাত কয়েকটি বই ছাপলেন। আশ্চর্য ব্যাপার, কুড়ি বছর আগে পশ্চিমবাংলায় বইগুলো পাঠক পায়নি। অথচ ঢাকায় বিক্রি হয়েছিল রমরমিয়ে।

হুমায়ূন বয়সে আট বছরের ছোট হলেও বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে গেল। ওর স্ত্রী-ছেলেমেয়ের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করেছি অনেকবার। হুমায়ূনের বাসনা ছিল চলচ্চিত্র তৈরি করার। অনেকগুলো ছবি তৈরি করেছিল সে। প্রথম দিকের একটি টেলি প্লে ওর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছিল আমাকে। দেখতে দেখতে আমার ঘুম পাচ্ছিল। সে ওটা বন্ধ করে বলেছিল, ‘‘বুঝতে পারছি কিছুই হয়নি। হলে আপনার ঘুম পেত না।’’

যখনই ঢাকায় গিয়েছি, সন্ধে থেকে মধ্যরাত হুমায়ূনের সঙ্গে কেটেছে। এই রকম এক রাতে সে আমাকে বলল, ‘‘সমরেশদা, আমার বহুকালের ইচ্ছে দেশ পত্রিকায় উপন্যাস লিখব। আপনি দয়া করে যোগাযোগ করিয়ে দেবেন?’’

‘‘কেন এমন ইচ্ছে হল?’’ জিজ্ঞেস করেছিলাম।

‘‘যে কাগজে রবীন্দ্রনাথ থেকে আপনারা লিখেছেন, সেখানে না লিখলে নিজেকে ঠিক—,’’ হুমায়ূন হেসেছিল।

‘‘কিন্তু হুমায়ূন, এখানে একজন প্রকাশক তোমাকে দশ লাখ টাকা অগ্রিম দিয়ে অপেক্ষা করে কখন পাণ্ডুলিপি দেবে, আমাকেই অনেকে দুঃখ করে বলেছে যে তোমার একটা উপন্যাসের আশায় কয়েক বছর ধৈর্য ধরে আছে। কলকাতার কাগজে লিখলে তুমি যা পাবে তা তো তুলনায় আসবে না।’’

‘‘না, সমরেশদা, দেশ পত্রিকার বিকল্প হয় না। দেশ ইজ দেশ।’’

হুমায়ূন কলকাতায় এলে সাগরময় ঘোষ মশাই-এর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম। সে অত্যন্ত বিনীত গলায় বলেছিল, ‘‘আমাকে যদি লেখার সুযোগ দেন।’’

সাগরদাও বলেছিলেন, ‘‘দেখি!’’

তারপর বেশ কয়েক বছর হুমায়ূন দেশ পত্রিকার পুজো সংখ্যায় একের পর এক উপন্যাস লিখে গিয়েছে। পশ্চিমবাংলার পাঠক সেই সব উপন্যাস নিয়ে কোনও হইচই করেননি, কিন্তু ঢাকার প্রকাশকরা দশ-বারো লক্ষ টাকা আগাম দিয়ে সেগুলো একুশের মেলাতেই তিরিশ হাজার কপি বিক্রি করেছে।

এক বন্ধু খবরটা দিয়েছিলেন যে হুমায়ূন চট্টগ্রামের কাছে সমুদ্রে একটি দ্বীপ কিনেছেন। শুনে অবাক হয়েছিলাম। কোনও বাঙালি লেখকের পক্ষে কি দ্বীপ কেনা সম্ভব? সেই দ্বীপ কিনে লেখক করবেই বা কী?

দেখা হতেই হুমায়ূনকে জিজ্ঞাসা করতে সে সলজ্জ হাসল, ‘‘আমি সেন্ট মার্টিন দ্বীপে একটি বাড়ি কিনেছি। এমন কিছু ব্যাপার নয়। আসুন না একবার, সামনের ডিসেম্বরেই আসুন, ঘুরে আসি।’

‘‘বর্ষাকালে যাওয়া যায়?’’

‘‘যায়। কিন্তু গিয়ে লাভ নেই। দ্বীপের অনেকটাই জলের তলায় থাকে। শীতে জল নেমে গেলে বাসযোগ্য হয়,’’ হুমায়ূন বলেছিল।

‘‘বাড়িটা কিনেছিলে কেন?’’

‘‘সমুদ্রের মধ্যে বাড়িতে থাকলে খুব মজা লাগে সমরেশদা।’’

গোটা দ্বীপ অবশ্যই নয়। দ্বীপের মধ্যে একটি বাড়ি কিনে যে মানুষ মজা পায়, সে যে জীবনটাকে উপভোগ করতে চায়, তাতে সন্দেহ নেই।

টাকা যেন হুমায়ূনকে তাড়া করত। বাংলাদেশের অন্যান্য নাট্যকারের কল্পনার বাইরে সম্মানদক্ষিণা হুমায়ূনকে দেওয়া হত। বলা ভাল দিতে বাধ্য হতেন প্রকাশকরা। কারণ সেই সব নাটকের দর্শক সংখ্যা ছিল বিপুল। অথচ হুমায়ূনের চালচলন, কথাবার্তা, পোশাক দেখলে মনে হত, পাশের বাড়ির ছেলে যার কোনও অহঙ্কার নেই।

স্ত্রীর সঙ্গে মতান্তর হচ্ছে ওর, খবর পেয়েছিলাম। ঔৎসুক্য দেখাইনি। খারাপ লাগলেও মনে হয়েছিল, এটা ওদের ব্যক্তিগত ব্যাপার।

সে সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। আনন্দবাজারের পুজো সংখ্যায় ‘এত রক্ত কেন’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলাম ত্রিপুরার উগ্রপন্থীদের নিয়ে যারা বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আশ্রয় নিত, তাদের নিয়ে। সেই পুজো সংখ্যা বাজেয়াপ্ত করেছিল বাংলাদেশ সরকার।

এই সময় হুমায়ূন আহমেদ আমাকে আমন্ত্রণ জানায় ওর এক অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য।

ঢাকা বিমানবন্দরে পুলিশ আমায় আটক করে। এবং শেষ পর্যন্ত শর্তসাপেক্ষে বাইরে যেতে দেয়। সেটা হল আমি ঢাকা শহরে থাকতে পারব না। হুমায়ূন সোজা আমাকে ঢাকা থেকে অনেক দূরে তার নুহাসপল্লিতে নিয়ে যায়। কয়েক একর বাগানঘেরা জমিতে সে তার ফিল্মশ্যুটিং-এর স্টুডিয়ো বানিয়েছিল। গেস্টহাউসে ঘরও অনেকগুলো।

হুমায়ূন এবং তার সর্বক্ষণের সঙ্গীদের সঙ্গে আড্ডা মারার সময় সন্ধের মুখে বৃষ্টি নামল। তুমুল বৃষ্টি। বাইরে ঘন অন্ধকার। গাছগুলো যে ঝড়ে দুলছে তা টের পাচ্ছি। লেখালেখি নিয়ে কথা উঠতে হুমায়ূন হাসল, ‘‘আমার কথা ছাড়ুন। বন গাঁয়ে শেয়াল রাজা। আসলে কী জানেন, পাকিস্তান আমলে কলকাতা থেকে বাংলা বই আসা নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। পাঠক নতুন বই পড়ার সুযোগ পাচ্ছে না। আমাদের এখানে যাঁরা প্রতিভাবান সিরিয়াস লেখক, তাঁদের লেখা সমালোচকদের শ্রদ্ধা পেলেও আমপাঠক খুশি হতে পারছিলেন না। যাঁরা নীহাররঞ্জন, অবধূত, প্রবোধ সান্যাল পড়তে অভ্যস্ত ছিলেন। যাঁরা সমরেশ বসু পড়তেন, তাঁরা আর কত পুরনো বই পড়বেন! হয়তো আমার লেখায় সেই ধরনের রোম্যান্সের স্বাদ পেলেন এঁরা, যা চেয়েছিলেন। আমি কখনই তারাশংকর, বিভূতিভূষণ বা সমরেশ বসুর কাছাকাছি পৌঁছতে পারব না। আমাকে যাঁরা পছন্দ করেন না, তাঁরা বলেন, পনেরো-ষোলোতে যাঁরা হুমায়ূন পড়া শুরু না করে, তারা পাঠক নয়। আবার চব্বিশের পরে যারা হুমায়ূন পড়ে তাদেরও ভাল পাঠক বলা যায় না। আমি এখনও রবীন্দ্রনাথ পড়ি আর প্রতিদিন কিছু না কিছু শিখি।’’

হুমায়ূনের বেশির ভাগ বইয়ের নামকরণ সে করেছে রবীন্দ্রনাথের গানের লাইন থেকে শব্দ নিয়ে। এমনকী নিজের তৈরি ছবির নাম রেখেছিল ‘আগুনের পরশমণি’। নিজের লেখা নিয়ে সে সব সময় বিনীত ছিল।

সেই বৃষ্টির রাত্রে, প্রায় দশটার মধ্যে, এক হাঁটু জল ভেঙে একটা গোরুর গাড়ি এল নুহাসপল্লিতে। সম্পূর্ণ ভিজে এক তরুণী নেমে এল গোরুর গাড়ি থেকে, নেমে হুমায়ূনকে অনুযোগ করল বড় রাস্তার মোড়ে কেউ তার জন্য অপেক্ষা করেনি বলে।

মেয়েটি পোশাক পাল্টাতে বাথরুমে গেলে হুমায়ূন সলজ্জ হাসল, ‘‘ওঃ, খুব ভুল হয়ে গিয়েছে।’’ জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘‘মেয়েটি কে? এ ভাবে কথা বলল?’’

‘‘ওঁর নাম শাওন, অভিনয় করে। ভাল গান গায়।’’ এর বেশি বলেনি সে।

হুমায়ূনের বিবাহবিচ্ছেদ এবং শাওনের সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ে ওর পাঠক-পাঠিকাদের দুঃখিত করেছিল। আমাকে এ কথা অনেকেই বলেছেন। শাওন বয়সে ওর মেয়ের মতো, রক্ষণশীলরা মেনে নিতে পারেননি। সবাই আশঙ্কা করেছিলেন এই ঘটনার ফলে হুমায়ূন জনপ্রিয়তা হারাবে, তার বই বিক্রি দ্রুত কমে যাবে। প্রথম দিকে সে রকম মনে হলেও দেখা গেল হুমায়ূনের পাঠক কমে গেল না। লেখকের ব্যক্তিজীবন আর তাঁর লেখাকে গুলিয়ে ফেললেন না পাঠকরা।

হুমায়ূনের সঙ্গে ঢাকা বা কলকাতা ছাড়া দেখা হয়েছে আমেরিকায়। পৃথিবীর যেখানেই গিয়েছি, দেখেছি, বাংলাদেশের মানুষ আর কোনও বই রাখুক বা না রাখুক, হিমু বা মিসির আলি রেখেছে। এই দুটি চরিত্র লিখে হুমায়ূন জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠেছিল। হিমুর মধ্যে হুমায়ূন আহমেদকে অনেকেই খুঁজে পান। আমার ভাল লেগেছে মিসির আলিকে।

দেশবিদেশের অনেক গোয়েন্দা গল্প আমি পড়েছি। কিন্তু এমন কোনও গোয়েন্দার খবর পাইনি যিনি পেটের গোলমালে ভোগেন। যাঁর কাছে কোনও ক্লায়েন্ট এসে কথা শুরু করার সময় মিসির আলিকে যদি পটি করতে ছুটতে হয় তা’হলে তার পরে আধঘণ্টা না শুয়ে থাকলে কাজ করার উৎসাহ পান না। অপেক্ষা করে করে ক্লায়েন্ট চলে গেলেও মিসির আলি নিয়ম ভাঙেন না। কিন্তু তদন্তে নেমে তিনি যে বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণ করতে সক্ষম, তার তুলনা খুব কম পাওয়া যাবে।

নিউইয়র্কের কুইন্সের এক হোটেলে আমরা ছিলাম। গিয়েছিলাম এক বইমেলায় অংশ নিতে। রাত্রে আড্ডা হচ্ছিল। সে হেসে বলেছিল, ‘‘যাই বলুন সমরেশদা, পশ্চিমবঙ্গের পাঠকদের চেয়ে বাংলাদেশের পাঠক অনেক উদার। পশ্চিমবঙ্গে একমাত্র সৈয়দ মুজতবা আলী আর কিছুটা সিরাজভাই ছাড়া আর কোনও মুসলমান লেখককে সেখানকার হিন্দু পাঠক গ্রহণ করেননি। মুজতবা আলী সাহেব গীতা, চণ্ডী, বাইবেল, কোরান পড়ে নিজের মতো লিখেছেন। তাই তাঁকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারেননি কেউ। তাছাড়া লেখায় যে রস ছিল, তা মোহিত করত সবাইকে। আমাদের লেখায় নামাজ, আপা, ফুপা, দুলাভাই, দোয়া, রোজা ইত্যাদি শব্দ থাকে বলে হিন্দু পাঠকদের বোধহয় অস্বস্তি হয়। কিন্তু আপনাদের লেখায় তুলসী মঞ্চ, শালগ্রাম শিলা, যাগযজ্ঞ থাকলেও মুসলমান পাঠক তা নিয়ে মাথা ঘামান না। তারা গল্পটাই পড়তে ভালবাসেন। আমি আশা করি, পরিস্থিতির বদল হবেই।

বলেছিলাম, ‘‘কথাটা এখনও পর্যন্ত ঠিক। এটা বোধহয় লেখা এবং পড়ার সময় দীর্ঘদিনের অভ্যেস প্রতিবন্ধকতার কাজ করে। পশ্চিমবাংলার বাংলা সাহিত্যের হিন্দু লেখকদের কলমে মুসলমান নায়ক-নায়িকা উপন্যাসে জায়গা পেয়েছে কি না এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। শরৎচন্দ্র গফুর চরিত্র লিখেছিলেন, কিন্তু তাকে মানুষ হিসেবেই সবাই ভেবেছে। গফুরের গোরুর মুসলমান নাম রাখাটাই তো স্বাভাবিক হত। তবে এই অভ্যেস বদলাচ্ছে। কলকাতার অনেক তরুণতরুণী এখন হিমুর কথা পড়তে চায়। মুশকিল হল বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করেও তোমাদের লেখায় উর্দু আরবি শব্দের প্রাধান্য আজকাল দেখা যাচ্ছে যার সঙ্গে পশ্চিমবাংলার পাঠক আদৌ পরিচিত নয়। যেমন, জিম্মা।’’

হুমায়ূন হাসল, ‘‘আসলে ওই সব শব্দ শুনে শুনে আমরা বড় হয়েছি। তাই কলমে এসে যায়। আমি জল বলি, পানিও। কিন্তু লিখতে গিয়ে পানি লিখি। আপনি জল বলেন। কিন্তু জলে যে ফল জন্মায়, তাকে পানিফল বলেন।’’

পরের সকালে ঘটনাটি ঘটল। হুমায়ূন রাত্রে ঘুমোবার আগে তার ডলারভর্তি মানিব্যাগ বালিশের নীচে রেখে দেয়। সকালে উঠে দেখল সেটা নেই। তন্ন তন্ন করে খোঁজা হল। পাওয়া গেল না।

হুমায়ূনের মুখ গম্ভীর। বলল, ‘‘আমি কপর্দকহীন।’’

কে নিতে পারে হাজার চারেক ডলার? বাইরের কেউ নেবে, এমন সম্ভাবনা নেই। ওর সঙ্গে যারা ছিল তাদের একজনই কাজটা করেছে। কিন্তু স্বীকার করছে না।

দুপুরে অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখলাম, সে তার দুজন সঙ্গীকে নিয়ে বাইরের ফুটপাথে বসে আছে। হেসে বলল, ‘‘সমরেশদা, যে নিয়েছে সে যেন বিবেকের কামড় খেয়ে ফেরত দিতে না আসে। তা’হলে তাকে কোনও দিন ক্ষমা করতে পারব না। যে নিয়েছে তাকে আমি সন্দেহ করতে পারি, কিন্তু আমার সন্দেহ তো সঠিক নাও হতে পারে। তাই তাকে অপরাধী ভাবছি না।’’

অদ্ভুত ব্যাপার! পরের দিনই হুমায়ূনের বালিশের নীচে মানিব্যাগটি পাওয়া গেল। একটি ডলারও খোয়া যায়নি। হুমায়ূন বলল, ‘‘যে নিয়েছে এবং ফেরত দিয়েছে তাকে ধন্যবাদ, কারণ ফেরত দেওয়ার নাটকটা করেনি।’’

খ্যাতির শিখরে উঠে লিখে প্রচুর অর্থ পেয়েও হুমায়ূনের ব্যবহার ছিল খুব সাধারণ। ঢাকায় গেলেই জিজ্ঞাসা করত, ‘‘সুনীলদা কেমন আছেন?’’ খুব ভক্ত ছিল সে সুনীলদার লেখার। বলত, ‘‘মানুষটার লেখা পড়তে বসলেই একটা অদৃশ্য হাত এসে ঘাড় ধরে শেষ পর্যন্ত  পড়িয়ে নিয়ে তবে ছাড়ে।’’

বললাম, ‘‘লোকে এ কথা তোমার ক্ষেত্রেও বলে!’’

‘‘দূর!’’ হুমায়ূন বলেছিল, ‘‘আমি তো যা লিখতে চাই, তা লিখতে পারি না বলে এই সব লিখি। আমাদের লেখায় কেন সমকালীন রাজনীতির ছাপ থাকে না বলে আপনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, উত্তরটা হল, লিখতে ভয়
করে।’’

হুমায়ূন তখনও অসুস্থ হননি। ঠিক তার আগে ঢাকায় যেতেই ওর ফোন এল, ‘‘সমরেশদা, আসুন, অনেক কথা আছে।’’

সন্ধের পর গিয়ে দেখলাম অনেক মানুষকে নিয়ে সে আড্ডা মারছে। লেখক, প্রকাশক, গায়ক, নায়ক কে নেই! পিনা এবং খানার সঙ্গে লক্ষ করলাম হুমায়ূন ঘন ঘন সিগারেট খাচ্ছে। রাত বাড়তে উঠতে চাইলে সে হাত ধরল, ‘‘আপনার সঙ্গে কথা আছে। সবাই চলে যাক, তারপর—।’’

শাওন তার শিশুদের নিয়ে শোওয়ার ঘরে চলে গেল। অতিথিরা বিদায় নিলেন রাত সাড়ে বারোটায়। আমি আর হুমায়ূন চুপচাপ বসেছিলাম। বললাম, ‘‘বলো।’’

সে শ্বাস ফেলল শব্দ করে। বলল, ‘‘খুব কষ্ট হয় সমরেশদা। জীবনে যা চেয়েছি, তার অনেকটাই পেয়েছি। এই চাইতে গিয়ে অনেক কিছুই হারাতে হয়েছে। কী করি বলুন তো?’’

‘‘আমৃত্যু এই কাঁটা তোমার আমার সবার মনে বিঁধতে থাকবে। এই নিয়েই তোমাকে বাস করতে হবে। তোমার কাজটা তুমি করে যাও, কষ্টটা কমে যাবে।’’

সত্যি কি কষ্ট কমে? সত্যি কি ভুলতে চাইলে ভোলা যায়? আমার তো মনে হয় না। এর কিছু দিন পরে কর্কটরোগে আক্রান্ত হল হুমায়ূন। তা সত্ত্বেও সিগারেট ত্যাগ করল না। সে কি মৃত্যুকে দেখেছিল বলে মাথা নোয়ালো না? নিজের মতো করে চলে গেল?

মধ্য ষাটের সবচেয়ে জনপ্রিয় একজন মানুষ, যিনি নিজে পাঠক তৈরি করেছেন, সেই পাঠকদের মনে বসত করেছেন, তিনি চলে গেলেও থেকে যাবেন। এটাই তো পরম পাওয়া।

 

উৎস ঃ এখানে ক্লিক করুন ..

Tuesday, November 7, 2017

কানাডায় বেড়ানোর সেরা কয়েকটি স্থান



কানাডা বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ। পূর্বে আটলান্টিক ও পশ্চিমে প্যাসিফিক এই দুটি মহাসাগর থেকে শুরু করে পশ্চিমের বিস্তির্ণ পাহাড়ী এলাকাসহ আরো বহু কিছুই আছে দেশটিতে দেখার। আছে নদী, আছে সুবিশাল বন। অন্টারিওর উত্তরে আছে হাডসন উপসাগর। চার ঋতুতে কানাডার রূপ বদলায় চার রকম। তীব্র শীত থেকে তীব্র গরম সবই অনুভব করা যায় এখানে।
কানাডায় এখন সামার। মাত্র অল্প সময়ের জন্য তার স্থায়িত্ব। সময় ও সুযোগ থাকলে এই অল্প সময়ের মধ্যেই বেড়ানোর কাজটি সেরে নিতে পারেন। ডলারের মান পড়ে যাওয়াতে দেশের বাইরে বিশেষ করে আমেরিকায় বেড়াতে যাওয়ার চেয়ে কানাডার অভ্যন্তরে বেড়ানোই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
পশ্চিমের সুদর্শন শহর ভেঙ্কুভার, মন্ট্রিয়লের ওল্ড সিটি, কুইবেকের রাজধানী কুইবেক সিটিসহ অন্যান্য শহরগুলোর প্রত্যেকটির রয়েছে আলাদা আলাদা বৈচিত্র। কানাডার নাগরিকেরা বন্ধুবৎসল। দেশটিতে রয়েছে নিরাপত্তার গ্যারান্টি। সুতরাং নির্ভয়ে বেড়াতে যেতে পারেন দেশটির যে কোন প্রান্তে। নিচে জনপ্রিয় কয়েকটি পর্যটন স্থানের বর্ণনা দেওয়া হলো।
নায়েগ্রা ফলস
কানাডায় কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা মনে হলে প্রথমেই আসে নায়েগ্রা ফসল এর কথা। কানাডায় এবং পৃথিবীতেও সবচেয়ে বিখ্যাত কয়েকটি প্রাকৃতিক আকর্ষনীয় স্থানের মধ্যে এই নায়েগ্রা ফসল অন্যতম। কেউ কানাডায় বেড়াতে আসলেন আর নায়েগ্রা ফসল দেখতে গেলেন না এটি হতেই পারে না। নায়েগ্রা ফলস না দেখলে কানাডা দেখা হয় না। প্রতি বছর কয়েক মিলিয়ন পর্যটক আসেন কানাডায় শুধু এই ফলসটি দেখার জন্য।
নায়েগ্রা ফসল টরন্টো থেকে বেশী দূরে নয়। মাত্র এক থেকে সোয়া ঘন্টার ড্রাইভ। যারা প্রথমবার নায়েগ্রা ফলস দেখতে যান তাদের কাছে এটি বাকী জীবনের এক অভাবনীয় স্মৃতি হয়ে থাকে। নায়েগ্রা ফলসটি খুব কাছে থেকে দেখারও ব্যবস্থা রয়েছে। শীপে করে অথবা সুরঙ্গ পথে নিচে নেমে খুব কাছে থেকে জলপ্রপাতের দৃশ্য দেখতে পারেন পর্যটকগণ। হেলিকপ্টারে উঠেও দেখা যেতে পারে জলপ্রপাতের দৃশ্য। নায়েগ্রা জলপ্রপাতটি কানাডা ও আমেরিকার বর্ডারে। তবে কানাডার অংশ থেকে জলপ্রপাতটি খুব ভাল করে দেখা যায়।
নায়েগ্রায় যারা রাত কাটাতে চান তাদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন হোটেলে থাকার সুব্যবস্থা।
নায়েগ্রায় আরো আছে মেরিনল্যান্ড। এখানে পর্যটকদের জন্য রয়েছে নানারকম চিত্তাকর্ষক ও মজাদার খেলা ও প্রদর্শণীর আয়োজন। ডলফিনের মনোমুগ্ধকর খেলা, বিভিন্ন রাইডিং এ উঠার সুযোগ
আপনাকে দিবে দিনব্যাপী আনন্দ। বাচ্চাদের জন্য এটি ড্রিমল্যান্ড। দু/চার ঘন্টার ভ্রমণে আপনার পুষাবে না। সেখানে যেতে চাইলে সারাদিনের পরিকল্পনা নিয়ে যেতে হবে। মেরিনল্যান্ডে ফ্যামিলি পিকনিক করার জন্য নির্দিষ্ট জায়গাও রয়েছে।
সামারে নায়েগ্রার বোটানিক্যাল গার্ডেনও দেখার মত। চারিদিকে প্রকৃতি তার অপার সৈন্দর্য অকাতরে বিলিয়ে দিচ্ছে। ১৯৩৬ সালে পার্কটি গড়ে তোলা হয় ৯৯ একর জমির উপর।
নায়েগ্রাতে আরো আছে বাটারফ্লাই কনজারভেটরী পার্ক। এখানে প্রায় ৪৫ প্রজাতির প্রজাপতি উড়ে বেড়ায়। অসাধারণ এক মোহনীয় দৃশ্য এটি। বাগানের ভিতর ঘুরে ঘুরে খুব কাছে থেকে এই দৃশ্য উপভোগ করা যায়।

ব্যানাফ ন্যাশনাল পার্ক
প্রকৃতির কোলে যদি দিন কতকের জন্য নিজেকে সপে দিয়ে অপার শান্তি খুঁজে পেতে চান তবে একবার ঘুরে আসতে পারেন আলবার্টায় অবস্থিত ব্যানাফ পার্কে। পশ্চিমের রাজকীয় রকি মাউন্টেনের মাঝে অবস্থান এই ন্যাশনাল পার্কটি। একবার গেলে আর ফিরে আসতে মন চাইবে না এমনি রূপ এই পার্কের। কানাডার সবচেয়ে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো এই পার্কেই অবস্থিত।
টরকুয়েসী সবুজ হ্রদ, বরফ আচ্ছাদিত সুবিশাল পাহাড়ের চূড়া, তুষার স্রোত সবই পাবেন এই অত্যাশ্চর্য পার্কটিতে যেখানে আপনি সহজেই প্রবেশ করতে পারবেন। এখানকার লুইসি হ্রদটি দর্শনীয় স্থানসমূহের মধ্যে একটি। এর সবুজ পানিতে চারপাশে অবস্থিত পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি ফুটে থাকে স্ফটিক সচ্ছতায়। পর্যটকগণ হ্রদের চারপাশে ঘুড়ে বেড়াতে পারেন। পার্কটির একেবারে দক্ষিনে ক্ষুদ্র ব্যানাফ শহরটি অবস্থিত যেখানে থাকা খাওয়াসহ সবরকমের সুবিধা রয়েছে পর্যটকদের জন্য।



সি এন টাওয়ার
টরন্টো শহরের একটি প্রধান প্রতীক এর দৃষ্টিনন্দন ও চমকপ্রদ স্থাপত্য নিদর্শন সি এন টাওয়ার। গত ২৬ জুন ছিল এই টাওয়ারটির ৪০তম জন্মবার্ষিকী। লেক অন্টারিওর পাড় ঘিরে গড়ে উঠা কানাডার সর্ববৃহৎ শহর টরন্টোর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই টাওয়ারটি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু যে কয়টি টাওয়ার রয়েছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম।  সি এন টাওয়ারের উচ্চতা ৫৫৩ মিটার। এই টাওয়ারে রয়েছে একটি ঘূর্ণ্যমান রেস্টুরেন্ট। এতে বসে অতিথি বা পর্যটকগণ খাবার গ্রহণের পাশাপাশি শহরের নজরকারা দৃশ্য অবলোকন  করতে পারেন। টাওয়ারে আরো আছে একটি গ্লাস ফ্লোর। এই ফ্লোরে দাড়িয়ে কাচের ভিতর দিয়ে সরাসরি নিচের দৃশ্য দেখা যায়। রাতের বেলা টাওয়ারটি বৈদ্যুতিক আলোর মাধ্যমে নানা রঙ্গে রাঙ্গিয়ে তোলা হয় যা দূরদুরান্ত থেকেও দেখা যায়।


কুইবেক সিটি
কুইবেকের রাজধানী কুইবেক সিটি। কানাডার কুইবেক সিটি সম্পর্কে একটি কথা প্রচলিত আছে। কথাটি এরকম যে, আপনি যদি এই শহরটি ঘুরে ঘুরে দেখেন তবে আপনাকে প্যারিস না দেখলেও চলবে। অবশ্য কুইবেক সিটিতে আইফেল টাওয়ার নেই। কিন্তু এর দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাগুলো আপনাকে মুহূর্তের মধ্যেই নিয়ে যাবে ইতিহাসের পাতায় পাতায়। সেন্ট লরেন্স নদীর পার ঘিরে অবস্থিত কুইবেক সিটি কানাডার একটি খুবই জনপ্রিয় পর্যটন এলাকা।
জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক এই শহরটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ এর অংশ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। কানাডার দশম বৃহত্তম শহর এটি এবং উত্তর আমেরিকার সবচেয়ে পুরাতন শহরগুলোর একটি। লা সিটাডেলি (La Citadelle) দুর্গ এই শহরের ল্যান্ডমার্ক স্থাপনা। এখানে দেখার মত আরো রয়েছে কুইবেক পার্লামেন্ট ভবন। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টস অব কুইবেক আরেকটি দর্শনীয় স্থান কুইবেক সিটির।
পর্যটকদের জন্য কুইবেক সিটিতে আরো আকর্ষন হলো এর উইন্টার কার্নিভাল, সামার মিউজিক ফেস্টিভাল  এবং সেন্ট জিয়েন ব্যাপ্টিস্ট ডে, মন্টোমরেন্সি জলপ্রপাত ও মন্ট সেইন্ট এ্যানি স্কি রিজোর্ট।

অটোয়ার পার্লামেন্ট হিল
কানাডার রাজধানী অটোয়াতে পার্লামেন্ট ভবন একটি দর্শনীয় স্থান। নদীর (অটোয়া রিভার) তীরে অবস্থিত এই ভবনটি পার্লামেন্ট হিল নামেই সর্বাধিক পরিচিত। ১৯ শতকের স্থাপত্য কলার একটি অসাধারণ নিদর্শন এই পালামেন্ট হিল। প্রতি বছর বহুসংখ্যক পর্যটক আসেন এই ভবনটি পরিদর্শনে। ওইকিপিডিয়ার হিসাবে দেখা যায় প্রতি বছর এখানে প্রায় তিরিশ লক্ষ পর্যটক আসেন। এখানে প্রতিদিন ফ্রি ট্যুর গাইড পাওয়া যায়। তবে ‘ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভ’ পলিসির ভিত্তিতে এই ফ্রি ট্যুর গাইডের সেবা পাওয়া যায়। পার্লামেন্টে ভবনের পিস টাওয়ারে উঠার সুযোগও পাওয়া যেতে পারে যেখান থেকে অটোয়া সিটির মনোরম দৃশ্যাবলী অবলোকন করা যায়। পার্লামেন্ট ভবনকে কেন্দ্র করে প্রায় সারা বছরই কোন না কোন উৎসব লেগে থাকে। তবে সামারের অনুষ্ঠানগুলো হয় আরো জমকালো। ১লা জুলাই কানাডা ডে উপলক্ষে লক্ষাধিক লোকের সমাগম ঘটে এখানে। ঐ দিন জমকালো ফায়ারওয়ার্কস সহ আরো নানা ধরণের উৎসব পালিত হয়। সামারে প্রতিদিন বিকেলে অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক সাউন্ড এন্ড লাইট শো অনুষ্ঠিত হয় মিউজিক সহ। এগুলো ফ্রি অনুষ্ঠান।

আফ্রিকান লায়ন সাফারী
আফ্রিকান লায়ন সাফারী টরন্টোর নিকটবর্তী হ্যামিলটনে অবস্থিত। টরন্টো থেকে এর দূরত্ব ১০০ কিলোমিটারের মত। এই লায়ন সাফারীতে আছে শতাধিক প্রজাতির প্রায় এক হাজার প্রাণী। পৃথিবীর প্রায় সব প্রান্ত থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছে এই প্রাণীসমূহ। এই সাফারীর বিশেষত্ব হলো, এখানে খোলা আকাশের নিচে প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রাণীগুলো ঘুরে বেড়ায়। আর পর্যটকগণ নির্ধারিত রাস্তা দিয়ে নিজের গাড়ি অথবা সাফারীর ট্যুর বাসে করে ঘুরে বেড়াতে পারেন। এই সময় মনে হবে আপনি বন বাদাড়ে পশু-পক্ষীর সঙ্গেই বাস করছেন। প্রাণীগুলো গাড়ির খুব কাছে চলে আসে। মাঝে মধ্যে গাড়ির ভিতরেও চলে আসতে চায়।
লায়ন সাফারীতে নিজের গাড়ি নিয়ে ঢুকতে হলে গাড়ির কন্ডিশন ভাল হতে হবে। বিশেষ করে গাড়ির জানালার কাঁচ যদি ভাঙ্গা থাকে বা ফাটলও যদি থাকে তবে সেই গাড়ি ভিতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। সাফারীতে ট্যুর বাসে ঘোরাই উত্তম।
সাফারী পার্কটি একটি পারিবারিক ব্যবসা। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৯ সালে। কানাডার সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল গর্ডন ডেবেনহাম প্রথমে উদ্যোগ নিয়ে এই পার্কটি স্থাপন করেন।
-সূত্র : অনলাইন

Sunday, November 5, 2017

মারেফতের বাণী - ডাঃ বাবা জাহাঙ্গীর বা-ঈমান আল সুরেশ্বরী




ডাঃ বাবা জাহাঙ্গীর বা-ঈমান আল সুরেশ্বরী র  " মারেফতের বাণী  বইটি পড়ুন


মারেফতের গোপন কথা - ডাঃ বাবা জাহাঙ্গীর বা-ঈমান আল সুরেশ্বরী



ডাঃ বাবা জাহাঙ্গীর বা-ঈমান আল সুরেশ্বরী র  " মারেফতের গোপন কথা " পড়ুন


Saturday, November 4, 2017

গ্রেট এক্সপেক্টেশানস - চার্লস ডিকেন্স


চার্লস ডিকেন্সের অনবদ্য ক্লাসিক উপন্যাস গ্রেট এক্সপেক্টেশানস পড়ুন 

Friday, November 3, 2017

Thursday, November 2, 2017

আমাদের বসবাস প্রসারণশীল মহাবিশ্বে


রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলে আমাদের কৌতুহলী মনে অনেক প্রশ্ন উঁকি মারে। সব প্রশ্নের উত্তর আমরা পাই না।

খালি চোখে আমরা রাতের আকাশে তাকিয়ে থাকলে হাজার হাজার নক্ষত্র, গ্রহ দেখতে পারব। আমাদের নিজ সৌরজগতের অনেক গ্রহ যেমন শুক্র, মঙ্গল, শনি, বৃহস্পতি এগুলোকে আমরা দেখতে পাই। নক্ষত্রগুলো আমাদের সূর্যেরই মতোন। কোনো কোনো নক্ষত্র অনেক অনেক গুণ বড়, আবার কোনোটা আমাদের সূর্যের চেয়ে ছোট। আমাদের নিকটতম নক্ষত্রের নাম প্রক্সিমা সেন্টোরাই। আলো এক বছরে যতটা দূরত্ব অতিক্রম করে তাকে এক আলোক বর্ষ বলে। প্রক্সিমা সেন্টোরাই থেকে আমাদের পৃথিবীর দূরত্ব প্রায় ৪.৩ আলোকবর্ষ। মানে আমাদের পৃথিবীতে প্রক্সিমা সেন্টোরাই থেকে আলো আসতে ৪.৩ আলোকবর্ষ সময় নেয়। রাতের আকাশে দৃশ্যমান তারকাগুলিকে একটা বন্ধনীতে আবদ্ধ মনে হয়। মনে হয় যেন কোন কালো পর্দার উপরে হীরা ফেলে রাখা হয়েছে যা অনেক দূর থেকে আলোকে প্রতিফলিত করছে।

আমাদের আকাশগঙ্গা ছায়াপথে (Milkyway Galaxy তে) এমন প্রায় ২২০ বিলিয়ন নক্ষত্র রয়েছে। আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডুইন হাবল দেখেয়েছিলেন যে আমাদের ছায়াপথের মতো আরো অনেক ছায়াপথ মহাবিশ্বে আছে। তিনি ছায়াপথগুলির ভিতরে দূরত্ব নির্ধারণ করেন। আসলে ছায়াপথগুলি এত দূরে অবস্থিত যে তাদেরকে দৃশ্যত স্থির বলে মনে হয়। সেই কারণে হাবল দূরত্ব মাপার জন্য পরোক্ষ পদ্ধতির ব্যবহার করেছিলেন। একটা তারকার আপাতদৃষ্ট উজ্জ্বলতা দুটি কারণের উপর নির্ভর করে থাকে , এক হলো কতটা আলো এর থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে আর আমাদের থেকে তারকাটি কতটা দূরে অবস্থিত। কাছের তারকা গুলোর তাদের দৃশ্যমান ঔজ্জ্বল্য আর দূরত্ব মাপতে পারি। আর কোনো ছায়াপথের ঔজ্জ্বল্য জানা থাকলে আমরা সেটা মেপে তাদের দূরত্ব বের করতে পারি। হাবল নয়টি ছায়াপথের দূরত্ব এভাবে মাপেন। তারকাগুলো আমাদের কাছ থেকে এত দূরে যে আমাদের পক্ষে তাদের গঠন আর আকার দেখা সম্ভব নয়। তাহলে আমরা তারকাদের কীভাবে আলাদা করি?

আমরা জানি সূর্যের আলোকে প্রিজমের ভিতর দিয়ে বিশ্লেষণ করলে সাতটি রঙের পট্টি পাওয়া যায়। দূরবীক্ষণকে একটা তারকার অথবা ছায়াপথের দিকে নিশানা করা হয় তাহলে ঐ ভাবেই একটা তারকা অথবা ছায়াপথের আলোক বর্ণালী পর্যবেক্ষণ করা যায়। বিভিন্ন তারকার বর্ণালী বিভিন্ন, কিন্তু একটা বস্তুপিণ্ড উত্তাপে লাল বর্ণ হয়ে যখন দীপ্ত হয় তখন তা থেকে বিচ্ছুরিত আলোক দেখে বলা যায় তা থেকে তাপ বিকিরিত হচ্ছে। অনেক সময় পর্যবেক্ষণ কালে অনেক তারকার পর্যবেক্ষিত সব বর্ণালী উপস্থিত থাকে না। আমরা জানি প্রতিটি মৌলিক পদার্থ কয়েকটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রঙের সেট শোষণ করে নেয়। তারকার বর্ণালীতে যে রং অনুপস্থিত তার সঙ্গে এই রঙগুলি মিলালে আমরা তারকার পরিমণ্ডলে কী কী মৌলিক উপদান আছে সেটা নির্ভুলভাবে বের করতে পারি। আমাদের নিজেদের ছায়া পথের তারকাগুলির ক্ষেত্রে যে রঙের সেট অনুপস্থিত, অন্য ছায়া পথের ক্ষেত্রেও সেই বিশিষ্ট রঙের সেট অনুপস্থিত। তাদের সব কটি ক্ষেত্রেই রঙগুলো বর্ণালীর লাল প্রান্তের দিকে বিচ্যুত এবং সেই বিচ্যুতির পরিমাণ একই। আলোর বিভিন্ন কম্পাঙ্ক বিভিন্ন। সর্বনিম্ন লালের দিকে আর সর্বোচ্চ নীলের দিকে। ধরা যাক স্থির দূরত্ব অবস্থিত তারকার মতো একটা আলোক উৎস এবং সেখান থেকে নির্দিষ্ট তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের আলো বের হচ্ছে। স্পষ্টতই আমরা সাধারণত যে তরঙ্গ পাই তার সাথে সেই উৎস থেকে বের হওয়া তরঙ্গ হবে অভিন্ন। ধরি উৎসটি আমাদের নিকটে আসছে, সুতরাং তরঙ্গ শীর্ষের আমাদের কাছে পৌঁছাতে যে সময় লাগবে, সেটা উৎস যখন স্থির ছিল তখন যে সময় লাগতো তার চেয়ে কম। অর্থাৎ তরঙ্গশীর্ষদ্বয়ের মধ্যবর্তী সময় হবে অল্প। প্রতি সেকেন্ডে আমাদের কাছে যে তরঙ্গ পৌঁছাবে, তার সংখ্যাটা তারকার স্থির অবস্থার তুলনায় বেশি হবে।

অনুরুপভাবে উৎস যদি আমাদের কাছ থকে দূরে চলে যেতো, তাহলে উলটো ঘটনা ঘটতো, মানে আমরা ক্ষুদ্রতম তরঙ্গ পেতাম। সুতরাং, আলোকের ক্ষেত্রে আমাদের কাছ থেকে দূরে অপসারিত তারকাগুলি থেকে নির্গত আলোক বর্ণালীর লাল প্রান্ত অভিমুখে বিচ্যুত হবে এবং আমাদের অভিমুখে যারা চলমান তাদের বর্ণালীতে থাকবে নীল অভিমুখে। কম্পাঙ্ক আর দ্রুতির মধ্যকার এই সম্পর্কটা ডপলার ক্রিয়া নামে পরিচিত। ছায়াপথের অস্তিত্ব প্রমাণের পর হাবল ছায়াপথ গুলির দূরত্ব তালিকা প্রস্তুত করে এবং তাদের বর্ণালী পর্যবেক্ষণ করেছেন। অনেকের ধারণা ছিল সে সময় যে ছায়াপথগুলি এলোমেলোভাবে বিক্ষিপ্ত বা চলমান। তাই অনেকে এটা ভেবে বসেছিলেন যে লাল আর নীল বিচ্যুতির মান সমান হবে। কিন্তু যখন দেখা গেল অধিকাংশ ছায়াপথ লাল বিচ্যুতি রয়েছে অর্থাৎ সবগুলি আমদের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তখন অনেক বিজ্ঞানী বিস্মিত হয়েছিলেন। লাল বিচ্যুতির পরিমাণ বিক্ষিপ্ত নয়, বরং সে বিচ্যুতি আমাদের কাছ থেকে ছায়াপথের দূরত্বের সমানুপাতিক অর্থাৎ মহাবিশ্ব স্থির অবস্থায় নেই, চলমান।

848e2b64-0f50-4b31-83c3-479c9cfb1d49

উৎস ঃ https://bigganjatra.org/expanding-universe/

আইজ্যাক আসিমভ – ‘রেইন, রেইন, গো অ্যাওয়ে’




ওকে আবারও দেখা যাচ্ছে,” জানালার পর্দা আলতোভাবে সরিয়ে লিলিয়ান রাইট বলল, “ঐযে ওখানে ও, জর্জ।”
“ঐখানে কে আছে বলছ?” টেলিভিশনে বেসবল খেলা দেখার জন্য সন্তোষজনক একটা চ্যানেল খুঁজতে খুঁজতে জানতে চাইল লিলিয়ানের স্বামী।
“মিসেস স্যাকারো,” লিলিয়ান বলল, “কে মিসেস স্যাকারো?” ওর স্বামী অনিবার্যভাবেই এ প্রশ্নটা করবে এমন আভাস পেয়েই দ্রুত আরো যোগ করল, “ভালো কথা, আমাদের নতুন প্রতিবেশী।”
“ওহ।”
“সূর্যস্নান করছে। সব সময় সূর্যস্নান করে। আমি অবাক হচ্ছি, কোথায় ওর ছেলেটা। ও সাধারণত এমন চমৎকার একটা দিনে বাইরে বের হয়, ওদের ঐ অদ্ভুত সুন্দর উঠোনে দাঁড়িয়ে ঘরের দেয়ালে বল ছুঁড়ে মারে। তুমি ওকে কখনো দেখেছিলে, জর্জ?”
“আমি ওর কথা শুনেছি। চাইনিজ জল যন্ত্রণার একটা সংস্করণ এটা। দেয়ালে প্রচণ্ড শব্দে আঘাত করা, মাটিতে দাপাদাপি করা, হাততালি দেওয়া। প্রচণ্ড আঘাত, দাপাদাপি, হাততালি, প্রচণ্ড আঘাত, দাপাদাপি…”
“ও ভালো ছেলে, শান্ত, সুন্দর ব্যবহার। আমার ইচ্ছে, টমি ওর সাথে বন্ধুত্ব করুক। ও টমির সমবয়সী হবে, বয়স দশের কাছাকাছি।”

ডমুরুধরের কুমির শিকার( ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়)





শঙ্কর ঘোষ জিজ্ঞাসা করিলেন,- শুনিয়াছি যে, সুন্দরবনে নদী নালায় অনেক কুমির আছে ! তোমাদের আবাদে ঐ জলাজমিতে কুমির কিরূপ?

ডমরুধর বলিলেন, – কুমির ! আমার আবাদের কাছে যে নদী আছে, কুমিরে তাহা পরিপূর্ণ। খেজুর গাছের মত নদীতে তাহারা ভাসিয়া বেড়ায়। অথবা কিনারায় উঠিয়া পালে পালে তাহারা রৌদ্র পোহায়। গরুটা, মানুষটা, ভেড়াটা, ছাগলটা বাগে পাইলেই লইয়া যায়। কিন্তু এসব কুমিরকে আমরা গ্রাহ্য করি না। একবার আমার আবাদের নিকট এক বিষম কুমিরের আবির্ভাব হইয়াছিল। ইহার দেহ বৃহৎ, তাল গাছের ন্যায় বড়, ইহার উদর এই দালানটির মত, অন্যান্য কুমির জীবজন্তুকে ছিড়িয়া ভক্ষণ করে, কিন্তু এ কুমিরটা অস্ত গরু, আস্ত মহিষ গিলিয়া ফেলিত। রাত্রিতে সে লোকের ঘরে ও গোলালে সিঁদ দিয়া মানুষ ও গরু-বাছুর লইয়া যাইত। লাঙ্গুলে জল আনিয়া দেয়াল ভিজাইয়া গর্ত করিত। ইহার জ্বালায় নিকস্থ আবাদের লোক অস্থির হইয়া পড়িল। প্রজাগণ পাছে আবাদ ছাড়িয়া পলায়ন করে, আমাদের সেই ভয় হইল। তাহার পর লাঙ্গুলের আঘাতে নৌকা ডুবাইয়া আরোহীদিগকে ভক্ষণ করিতে লাগিল। সে নিমিত্ত ও পথ দিয়া নৌকায় যাতায়থ অনেক পরিমাণে বন্ধ হইয়া গেল।

Wednesday, November 1, 2017

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প-- নিরুদ্দেশ যাত্রা




এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো। রাত এগারোটা পার হয় হয়, এখনো রাস্তার রিকশা চলছে ছল ছল করে যেনো গোটিয়ার বিলে কেউ নৌকা বইছে, 'তাড়াতাড়ি করো বাহে, ঢাকার গাড়ি বুঝি ছাড়ি যায়।' আমার জানলায় রোদন-রূপসী বৃষ্টির মাতাল মিউজিক, পাতাবাহারেরর ভিজে গন্ধভরা সারি, বিষাদবর্ণ দেওয়াল; অনেকদিন পর আজ আমার ভারি ভালো লাগছে।
ছমছম করা এই রাত্রি, আমারি জন্যে তৈরি এরকম লোনলী-লগ্ন আমি কতোদিন পাইনি, কতোকাল, কোনোদিন নয়। বৃষ্টি-বুনোট এইসব রাতে আমার ঘুম আস না, বৃষ্টিকে ভারি অন্যরকম মনে হয়, বৃষ্টি একজন অচিন দীর্ঘশ্বাস। এইসব রাতে কিছু পড়তে পারি না আমি, সামনে বই খোলা থাকে, অক্ষরগুলো উদাস বয়ে যায়, যেনো অনন্ত-কাল কুমারী থাকবার জন্যে একজন রিক্ত রক্তাক্ত জন্মদান করলো এদের। চায়ের পেয়ালায় তিনটে ভাঙা পাতা ঘড়ির কাঁটা হয়ে সময়কে মন্থর কাঁপায়। ষাট পাওয়ারের বাল্বে জ্বলছে ভিজে আলো, আর চিনচিন করে ওঠে হঠাৎ, কতোদিন আগে ভরা বাদলে আশিকের সঙ্গে আজিমপুর থেকে ফিরলাম সাতটা রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে, 'তুই ফেলে এসেছিস কারে', সেই সোনার শৈশবে ভুল করে দ্যাখা একটি স্বপ্ন, স্বপ্নের মতো টলটল করে। আমার ঘুম আসে না, আলোর মধ্যে একলা জেগে রই। সন্ধেবেলা আম্মার ঘরে যখন যাচ্ছি, আকাশ কালো, রাস্তার মানুষজন নেই, চারটে জানালায় আমাদের পাতাবাহারের ছায়া লুফে নিয়ে পালিয়ে গেলো দুটো ফক্সওয়াগন, কাক আর বাদুড়েরা চিৎকার করে উঠলো; আমার মনে হলো আজ আমি একটুও ঘুমোতে পারবো না। আধ ঘন্টা একা কাটিয়ে আম্মার ঘর থেকে যখন ফিরছি তখন ভরা স্বরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আমার খারাপ লাগলো, আজ আমার একটুও ঘুম হবে না। আম্মার ঘরে কি যেনো ফেলে এসেছি।

পরশুরাম এর গল্প "মাৎস্য ন্যায়"




বাজারের সামনে দিবাকরের সঙ্গে তার এককালের সহপাঠী গণপতির দেখা হল। গণপতি বলল, কি খবর দিবু, আজকাল কি করছ? চেহারাটা খারাপ দেখছি কেন, কোনও অসুখ করেছে নাকি?

দিবাকর বলল, সিকি-পেটা খেলে চেহারা ভাল হতে পারে না। তিনটে ছেলেকে পড়িয়ে পঞ্চান্ন টাকা পাচ্ছি আর চাকরির খোঁজে ফ্যা ফ্যা করে বেড়াচ্ছি। নেহাত একটা বউ আছে, তিন বছরের একটা মেয়েও আছে, নয়তো সোজা পরলোকে গিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচতুম।


দিবাকরের বুকে একটা আঙল ঠেকিয়ে গণপতি বলল, ভাল রোজগার চাও? ভাল ভাল জিনিস খেতে চাও? শৌখিন জামা কাপড় চাও?